২৫. আটলান্টিকের ওপারে

চ্যাপ্টার

নিকোলাস বুখারিন বুঝল সে বেঁচে আছে। ব্রাশ ফায়ারের গুলী তার লাগেনি।
চোখ খুলল নিকোলাস বুখারিন।
চোখ খুলেই দেখল তার সামনে দাঁড়ানো আইভানের সৈনিক প্রহরীটি ব্রাশ ফায়ারের শব্দ লক্ষ্যে পেছনে তাকিয়েছে।
নিকোলাস বুখারিন একে ঈশ্বরের দেয়া সুযোগ মনে করল। ঝাঁপিয়ে পড়ল সে প্রহরীটির উপর।
কিন্তু ততক্ষণে নিকোলাস বুখারিন মিঃ প্লাতিনির কক্ষের সামনে দ্বিতীয় প্রহরীটির নজরে পড়ে গেছে।
দ্বিতীয় প্রহরীটির তার হ্যান্ড মেশিনগান তুলে গুলি করল নিকোলাস বুখারিনকে লক্ষ্য করে।
একটি গুলি গিয়ে নিকোলাস বুখারিনের পাঁজরকে বিদ্ব করল।
কিন্তু তার দেহ গিয়ে পড়ল প্রথম প্রহরীটির উপর।
গুলি বিদ্ধ হয়েও নিকোলাস বুখারিন প্রহরীটিকে জড়িয়ে ধরল।
কিন্তু তার আগেই প্রথম প্রহরীটির হ্যান্ড মেশিনগান ছিটকে পড়েছিল তার হাত থেকে।
ওদিকে আহমদ মুসা কালো কাপড়ে আবৃত আগন্তুকের ব্রাশ ফায়ার থেমে যাবার সাথে সাথেই উঠে দাঁড়িয়েছে।
পেছন ফিরে উঠে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা। কালো কাপড়াবৃত আগন্তুকের দিকে এগুতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে হ্যান্ড মেশিনগান গর্জে উঠার শব্দ পেল। চমকে উঠে পেছনে ফিরল সে।
দেখল, করিডোরের একেবারে পুব মাথায় মাটিতে পড়ে দুজন একে অপরকে কাবু করার চেষ্টা করছে।
একজন সৈনিকের পোশাক। আরেকজনের দিকে চাইতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। নিকোলাস বুখারিনের সাথে তার সৈনিকের লড়াই হচ্ছে কেন?
আহমদ মুসার নজরে পড়ল, নিকোলাস বুকারিন তার বাম হাত দিয়ে নিজের পাঁজর চাপে ধরে আছে এবং ডান হাত দিয়ে গলা চেপে ধরেছে সৈনিকটির। আর সৈনিকটিও দু’হাতে গলা চেপে ধরেছে নিকোলাস বুখারিনের।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে নিকোলাস বুখারিনের বাম পাঁজর। আহমদ মুসা বুঝল, ব্রাশ ফায়ারটি নিকোলাসকে লক্ষ্য করেই হয়েছে।
আহমদ মুসা ছুটে গেল সেদিকে। আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েছে নিকোলাস বুখারিন। বলল সে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে, ‘পারলাম না আমি, পাশের ঘরে ক্যাথারিন ও প্লাতিনি বন্দী। উদ্ধার কর তাদের।’
বলে নিকোলাস বুখারিন সৈনিকটির গলা ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে নিজের পাঁজর চেপে ধরল। আহমদ মুসা সৈনিকটির হাত থেকে ছিটকে পড়া করিডোরের এদিকে চলে আসা হ্যান্ড মেশিনগান তুলে নিয়েছে।
সৈনিকটি নিকোলাস বুখারিনকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। পকেটে হাত দিয়ে সে বের করল রিভলবার।
ঠিক এই সময় মিঃ প্লাতিনির কক্ষের সামনে দাঁড়ানো সেই দ্বিতীয় সৈনিকটি ছুটে এল আহত বুখারিনের পাশে দাঁড়ানো প্রথম সৈনিকের কাছে।
আহমদ মুসা প্রথম সৈনিককে রিভলবার বের করতে দেখেই হাতের হ্যান্ড মেশিনগানের ট্রিগারে আঙুল চাপে তৈরি হয়েছিল। দ্বিতীয় সৈনিকটি ছুটে আসতে দেখেই ট্রিগারে আঙুল চাপল সে।
হ্যান্ড মেশিনগানের ব্যারেল সে ঘুরিয়ে নিল প্রথম ও দ্বিতীয় সৈনিকের উপর দিয়ে।
আহমদ মুসা তার হ্যান্ড মেশিনগান বাগিয়ে প্রবেশ করল ক্যাথারিনদের কক্ষের সামনে দিয়ে যাওয়া করিডোরে।
প্রবেশ করার সময় সে করিডোরের পুব পাশ দিয়ে দাঁড়ানো পাঁচটি কক্ষের দক্ষিণ দিক থেকে দ্বিতীয়টির দরজা বন্ধ হতে দেখল।
‘আহমদ মুসা, গ্রেট বিয়ারের প্রধান শয়তান আইভান ঐখানে লুকিয়েছে। ঐখানে প্রিন্সেস ক্যাথারিন এবং মিঃ প্লাতিনি রয়েছেন। তুমি দেখ, শয়তান ওদের যেন ক্ষতি না করে।’ ক্লান্ত কণ্ঠে বলল নিকোলাস বুখারিন।
আহমদ মুসা এগিয়ে গেল নিকোলাস বুখারিনের কাছে। ঝুঁকে পড়ল তার পাঁজরের আহত স্থানটা পরীক্ষার জন্যে।
নিকোলাস বুখারিন তার একটা হাত দিয়ে ঠেলে আহমদ মুসাকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে বলল, ‘সময় বেশি পাবে না। তাড়াতাড়ি ওদেরকে শয়তানের হাত থেকে উদ্ধার কর। আমাদের রাশিয়াকে তুমি সাহায্য কর।’
‘কিন্তু আপনি গুরুতর আহত।’
‘আমার কথা বাদ দাও। আমি একজন সৈনিক। লাখো সৈনিক আছে রাশিয়ায়। তুমি যাও।’
আহমদ মুসা এগুলো দরজার দিকে।
পেছন থেকে নিকোলাস বুখারিন বলল, ‘দরজায় ডিজিটাল লক। তুমি এই ম্যাগনেটিক রেডিয়েশনটা নিয়ে যাও।’
আহমদ মুসা ফিরে এল।
নিকোলাস বুখারিন রক্তাক্ত হাতে তার কলমাকৃতির ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন গানটা আহমদ মুসার হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘অন করাই আছে, তুমি শুধু লকের উপর এটাকে সেট কর।’
আহমদ মুসা ছুটল দরজার দিকে।
দরজার ডিজিটাল কম্পুটারাইজড লকের উপর সেট করল ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন গানটা।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড, খুলে গেল দরজার লক।
আহমুদ মুসা হ্যান্ড মেশিনগানটা কাঁধে ঝুলিয়ে রেখে রিভলবার ডান হাতে নিয়ে তর্জনিটা ট্রিগারে রেখে বাম হাতে এক ঝটকায় খুলে ফেলল দরজা।
আইভান তখন প্লাতিনি এবং প্রিন্সেস ক্যাথারিনের ওপাশে বসে অয়্যারলেস সংযোগের চেষ্টা করছিল। তার রিভলবারটা পড়েছিল তার সামনে।
দরজা খুলে যাওয়ার শব্দে আইভান চমকে উঠে অয়্যারলেস ফেলে দিয়ে প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে সামনে ধরে উঠে দাঁড়াল।
তার রিভলবারটা তুলে নিতে সময় পায়নি আইভান।
আহমদ মুসা গুলী করল তার রিভলবারের উপর। তা ছিটকে পড়ল ঘরের শেষ প্রান্তে, খাটের পাশ দিয়ে নিচে।
‘আহমদ মুসা তোমার রিভলবার ফেলে দাও। আমার হাতে কথা বলার মত সময় বেশি নেই।’ একটা ভয়ংকর ধরনের চকচকে ছুরি ক্যাথারিনের গলায় চেপে ধরে কথাগুলো বলল আইভান।
আইভানের ছুরির তীক্ষ্ণ ফলা ক্যাথারিনের গলার চামড়া ঠেলে নিয়ে অনেকখানি ডিপ হয়েছে।
প্রিন্সেস ক্যাথারিনের মুখ থেকে তার অজান্তেই যেন একটা ‘আহ!’শব্দ বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা আইভানের চোখ দেখতে না পেলেও বুঝল আইভান দি টেরিবলের ভঙ্গিতে অভিনয়ের কোন চিহ্ন নেই অতএব এর অসাধ্য কিছু নেই। মরার আগে মেরেই মরবে।
আহমদ মুসা ছুড়ে দিল তার রিভলবার বাইরে। কাঁধে ঝুলানো হ্যান্ড মেশিনগানকেও তাই করল।
আহমদ মুসা হাত তুলে বাইরে বেরিয়ে যাও। প্লাতিনি যাও।
আহমদ মুসা ও প্লাতিনি বাইরে বেরুল।
আইভানও প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে সামনে ধরে রেখে প্রায় সাথে সাথেই বাইরে বেরুল।
আইভান আহমদ মুসা ও প্লাতিনিকে দক্ষিণ দিকে সরে যেতে বলে প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে সামনে নিয়ে পিছু হটে পশ্চিম মুখী করিডোরে গিয়ে প্রবেশ করল।
পাঁজর চেপে ধরে মাটিতে পড়ে থাকা নিকলাস বুখারিন বলল, ‘পারলে না তুমি আহমদ মুসা, আইভান শয়তানটাকে খতম করতে। তার মৃত মুখটা দেখে যাবার খুব ইচ্ছা ছিল আমার।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তা অবশ্যই দেখবে তুমি বুখারিন।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই ওদিক থেকে একটা রিভলবার গর্জন করে উঠল।
গুলীটা মাথা গুড়িয়ে দিয়েছে আইভানের।
গুলী করেই আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কালো কাপড়ে আবৃত সেই ছায়ামূর্তি। মাথা থেকে কালো কাপড়টা সরিয়ে সে বাউ করল প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে।
ঠিক এ সময়েই আহমদ মুসা এসে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমমুখী করিডোরটির মুখে।
উন্মুক্ত মাথা সেই মূর্তির দিকে চোখ পড়তেই আহমদ মুসা অবাক বিস্ময়ে বলল, ‘কেলা এলভা তুমি?’
বেদনাময় এক হাসি মাখা মুখে কেলা এলভা বলল, ‘হ্যাঁ, আমি।’
মুহূর্ত কয়েক বিস্ময়ভরা চোখে কেলা এলভার দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘তুমি তোমার কথা রেখেছো মিসেস কেলা এলভা। কিন্তু আমি তোমার জন্যে কিছু করতে পারিনি।’
‘সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ভাবি কোথায়? তাঁর খোঁজ পেয়েছেন?’
‘না পাইনি’ বলেই আহমদ মুসা প্রিন্সেস ক্যাথারিনের দিকে চেয়ে কেলা এলভার পরিচয় তাকে দিয়ে বলল, ‘সম্মানিতা প্রিন্সেস একটু দাঁড়ান।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা ফিরল নিকোলাস বুখারিনের দিকে। দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘মিঃ বুখারিন দ্রুত আমাদের চলে যেতে হবে। আপনাকে হাসপাতালে নেয়া দরকার। তার আগে দয়া করে বলুন, ‘আপনার এ দশা কেন? আর আমার স্ত্রী ডোনা জোসেফাইনকে এরা কোথায় রেখেছে? এখানে তো নেই।’
চোখ বুজে পড়েছিল নিকোলাস বুখারিন। ধীরে ধীরে চোখ খুলল সে। বলল, ‘হাসপাতালের নেবার দরকার হবে না। শয়তানটার মুখোশ খুলে আমাকে দেখাও। তাহলে আমি শান্তিতে মরতে পারব। আর আপনার স্ত্রী এদের হাতে ধরা পড়েনি।’
থামল বুখারিন। একটু দম নিল। ক্লান্তিতে ধুকছিল সে। কথা শুরু করল একটু পরেই, ‘হ্যা, আর একজন বন্দী ওদিকে আছে। খাঁটি একজন দেশপ্রমিক সে। শত নির্যাতন করেও তার কাছ থেকে একটা কথাও আদায় করতে পারেনি। তাকে আপনাদের সাহায্য করা দরকার।’
কথাটা শুনেই চমকে উঠল কেলা এলভা। যে ঘরের দিকে বুখারিন ইংগিত করেছে, সেদিকে চলল কেলা এলভা।
পেছনে পেছনে গেল আহমদ মুসাও।
ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন গান দিয়ে দরজা খুলল আহমদ মুসাই।
দরজা খুলে আহমদ মুসা দেখল তৃতীয় শ্রেণীর একটা কয়েদখানা। মাটিতে রাখা একখন্ড তক্তার উপর শুয়ে আছে একজন বন্দী।
দরজা ফাঁক করে এক পাশে সরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। কেলা এলভা ঘরে ঢুকে বন্দীর দিকে একবার তাকিয়েই চিৎকার করে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। আহমদ মুসার মুখে আনন্দের হাসি।
ডোনা জোসেফাইন তাহলে বন্দী হয়নি। তার বুক থেকে একটা পর্বতের ভার যেন নেমে গেল। অন্যদিকে কেলা এলভার স্বামী’ লেনার্ট লা’রকেও পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, গ্রেট বিয়ার প্রধান আইভান নিহত হয়েছে এবং প্রিন্সেস ক্যাথারিন ও মিঃ প্লাতিনিকে পাওয়া গেছে। তাদেরকে এখন নিরাপদে বের করে নিয়ে যেতে পারলেই হলো।
আহমদ মুসার মনে পড়ল নিকোলাস বুখারিনের কথা। আহমদ মুসা দ্রুত গিয়ে আইভানের মুখোশ টান দিয়ে খুলে ফেলল।
নিকোলাস বুখারিন কষ্ট করে তাকিয়েছিল এদিকেই। আইভানের মুখের উপর চোখ পড়তেই চিৎকার করে বলে উঠল, ‘লেনিনের নাতি শয়তান বুলগানিন তুমি আইভান!’ সব শক্তি একত্রিত করেই যেন চিৎকার করে উঠেছিল নিকোলাস বুখারিন।
লেনিনের নাতি বুলগানিন মানে রুশ পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় নেতা? কথাটা জিজ্ঞেস করার জন্যে আহমদ মুসা ছুটে গেল নিকোলাসের কাছে। কিন্তু গিয়ে দেখল নিকোলাস বুখারিন আর নেই। চিৎকারটাই তার জীবনের শেষ প্রকাশ ছিল।
স্বামীকে হাত ধরে বের করে নিয়ে এল কেলা এলভা। তার চোখে অশ্রু।
আহমদ মুসা, প্রিন্সেস ক্যাথারিন এবং মিঃ প্লাতিনির পরিচয় স্বামীকে দিয়ে কেলা এলভা বললেন, ‘মিঃ আহমদ মুসার জন্যেই আজ তুমি, প্রিন্সেস ক্যাথারিন ও মিঃ প্লাতিনি মুক্ত হতে যাচ্ছ।
আহমদ মুসা কেলা এলভার স্বামী লেনার্ট লার’-এর সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আর কেলা এলভার সাহায্য না পেলে আপনাদের মুক্ত করার সুযোগই পেতাম না।’
লেনার্ট লার কিছু বলতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল। ‘আপনাদের কাছ থেকে অনেক কথা শুনতে হবে। চলুন, আমরা বের হই। আপনারা খেয়াল করেছেন কিনা জানিনা, বিল্ডিংটা কয়েকবার কেঁপেছে। কিছু একটা ঘটছে বা ঘটতে যাচ্ছে।
সকলের মুখে একটা ভয়ের চিহ্ন দেখা দিল। কেউ কিছু বলল না।
আহমদ মুসা কেলা এলভাকে বলল, ‘তুমি সামনে এগোও। আমি পেছনে চলছি।’
‘কিন্তু গত কয়েকদিনে আমি পেছনে পেছনে চলতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি।’ কেলা এলভা বলল।
‘সেটা আমার অজান্তে এবং সে অবস্থা এখন নেই।’ সেই সুড়ঙ্গ পথে চলতে শুরু করল কেলা এলভা। চলতে শুরু করল সবাই। সকলের পেছনে আহমদ মুসা।
হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সামনের ওয়াটার প্ল্যান্ট-এর একটু পশ্চিমে মাইক্রো’তে চড়ে আহমদ মুসারা যখন হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সামনে দিয়ে চলছিল, তখনও হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ভেতরে গোলা-গুলী চলছিল। পুলিশ চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে বিল্ডিংটাকে।
আহমদ মুসা তাকাল কেলা এলভার দিকে। বলল, ‘পুলিশ এখানে কেন এল, কি করে এল জান তুমি কিছু?’
‘না আমি জানি না। আমি পুলিশকে কিছু জানাইনি।’
মনে পড়ল আহমদ মুসার পাভলভ ও রোসার কথা। তারা কি পুলিশকে খবর দিয়েছে? আহমদ মুসার কোন সন্দেহ নেই যে, তারা মিঃ বরিসভের নিজস্ব লোক। মিঃ বরিসভ অবশ্যই সরকারী লোক।
আহমদ মুসা কমসোমল রোডের ব্রীজটি পার হয়ে বামে মোড় নিয়ে গাড়ি পাভলভের গাড়ির পাশে দাঁড় করাল। পাভলভ আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়ে গাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে এল। প্রবল উৎসাহে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘পুলিশকে তুমি কিভাবে খবর দিয়েছিলে পাভলভ?’
পাভলভ অবাক বিস্ময়ে আহমদ মুসার দিকে একবার চাইল। বুঝল, আহমদ মুসার কাছে কিছুই গোপন নেই। তারা যেমন আহমদ মুসাকে জানে। তেমনি আহমদ মুসাও পাভলভদের জেনেই সাথে করে রেখেছে। তারপর আহমদ মুসার প্রশ্ন সম্পর্কে ভাবল এবং একটু দ্বিধা করে বলল, ‘অয়্যারলেসের মাধ্যমে।’
‘অ্য়্যারলেস তোমার কাছে আছে?’
‘আছে।’
‘আমাকে দিতে পার?’
‘আপনি চাইলে অবশ্যই দেব।’
‘দাও।’
পাভলভ সঙ্গে সঙ্গে জামার ভেতর হাত দিয়ে ভেতরের একটা পকেট থেকে ক্ষুদ্র অয়্যারলেসটি বের করে আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল। আহমদ মুসা তা হাতে নিতে নিতে বলল, ‘তোমার চাকুরীর ভয় করো না।’
একটু থেমেই আবার বলল, ‘প্রেসিডেন্টের অয়্যারলেস কোড তোমার কাছে আছে?’
‘আছে স্যার।’
‘দাও।’
আহমদ মুসা লিখে নিচ্ছিল কোড নাম্বারটি। এমন সময় রোসা ছুটে এসে বলল, ‘স্যার ম্যাডাম অপেক্ষা করছেন।’
‘কোন ম্যাডাম?’ চমকে উঠে বলল আহমদ মুসা।
‘পাভলভ কিছু বলেনি?’
‘না।’
পাভলভ কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই রোসা বলল, ‘ডোনা জোসেফাইন ম্যাডাম ঐ গাড়িতে।’
নামটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসার গোটা স্নায়ু তন্ত্রীতে শিহরণের একটা উচ্ছাস খেলে গেল।
‘তোমরা দাঁড়াও রোসা। ‘বলে আহমদ মুসা গাড়ি নিয়ে দাঁড় করাল ডোনাদের গাড়ির পাশে।
ডোনা বেরিয়ে আসছিল।
আহমদ মুসা নিষেধ করল ইশারায়।
নামল আহমদ মুসা মাইক্রো থেকে।
ডোনা নামতে গিয়ে দরজা খুলে ছিল, সে দরজা খোলাই ছিল।
আহমদ মুসা ভেতরে উঁকি দিতেই এক সাথে সালাম দিল ডোনা এবং ওলগা। আহমদ মুসা তাকাল ওলগার দিকে।
ডোনা বলল, ‘ও ওলগা।’
‘কোন ওলগা? ডঃ নাতালোভার মেয়ে?’
‘হ্যা।’
‘তুমি কেমন আছো? তোমার মা কেমন আছেন। ‘ওলগাকে লক্ষ্য করে বলল আহমদ মুসা
‘আলহামদুলিল্লাহ। ভাল।’
‘পরে কথা হবে।’ বলে আহমদ মুসা ডোনা জোসেফাইনের দিকে চেয়ে বলল, ‘আল্লার অশেষ শুকরিয়া, তুমি ওদের ওখানে আছ।’
তারপর বলল, ‘আমার মাইক্রোতে প্রিন্সেস ক্যাথারিন ও তোমার আব্বা ছাড়াও কেলা এলভা ও তার স্বামী লেনার্ট লার রয়েছে। ওলগার আপত্তি না থাকলে ক্যাথারিন ছাড়া অন্যদের এ গাড়িতে দিতে চাই। আমি ক্যাথারিনকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট হাউজে যাব।’
‘কেলা এলভার স্বামীকে পাওয়া গেছে? আলহামদুলিল্লাহ। অবশ্যই ওঁরা আসবেন।’
বলে একটু থেমে বলল ডোনা জোসেফাইন, ‘ তোমার প্রেসিডেন্ট হাউজে যাওয়া কি নিরাপদ হবে?’
‘জানিনা। তবু যেতে হবে।’
‘আমরা?’
‘তোমাদের বাসায় ফেরা উচিৎ।’
‘ওলগা ওদের নিয়ে যাবে, আমি মাইক্রোতে উঠব। ‘বলল দৃঢ় কণ্ঠে ডোনা জোসেফাইন। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে ওলগার গাড়ি প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ চত্বরের বাইরে দাঁড়াতে পারে।’
মিঃ প্লাতিনি, কেলা এলভা, তার স্বামী লেনার্ট লার এসে ওলগার গাড়িতে উঠল।
পিতাকে স্বাগত জানানো ও কুশল বিনিময়ের পর ডোনা কেলা এলভাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আহমদ মুসাকে বার বার যে বাঁচিয়েছেন, সেই আড়ালের তরুণী তাহলে তুমি?’
আহমদ মুসা অপেক্ষমান পাভলভ ও রোসাকে তাদের অনুসরণ করতে বলে মাইক্রোতে উঠে স্টার্ট দিল গাড়ি।
গাড়ি চলতে শুরু করলে আহমদ মুসা ক্যাথারিনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘সম্মানিতা প্রিন্সেস, কয়েকটা কথা বলতে চাই।’
‘অবশ্যই।’
‘প্রেসিডেন্টের কাছে আপনাকে পৌছে দিতে চাই। আপনার কোন কথা আছে?’
‘যে পরিস্থিতি তাতে এ প্রোগ্রাম ঠিক আছে।’
‘আপনার দু’টি আমানত আমার কাছে আছে, তা কখন আপনি নিতে চান?’
‘প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলার পর।’
‘ব্যাপারটা দেরী হয়ে যাবে। পরে জিনিস দু’টি নেয়া আপনার জন্যে জটিল হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
‘যদি এমন পরিস্থিতি হয়, তাহলে জিনিস দু’টি আপনার কাছে থাকাই নিরাপদ বেশি।’
‘সম্মানিতা প্রিন্সেস, জিনিস দু’টি আপনার কাছে পৌছানো আমার দায়িত্ব, এ সবের নিরাপত্তা বিধান নয়।’
‘আপনি জিনিস দু’টির বাহক মাত্র নন। প্রিন্সেস তাতিয়ানার মৃত্যুকালীন ভিডিও ফিল্ম আমি দেখেছি। তাতিয়ানার প্রতি যদি আপনার দায়িত্ব থাকে, তাহলে তার আমানাতের প্রতিও আপনার দায়িত্ব থাকবে।
তাতিয়ানা নেই বটে, কিন্তু তার প্রিয়তম ব্যক্তি আমাদের পর নন।’
‘গ্রেট বিয়ারের সাথে একবার ঝগড়া হলো, রুশ সরকারের সাথে আবার ঝগড়ায় নামতে হয় তাহলে।’
‘ঐ রকম ঝগড়ায় নামতে আমি দেব না।’
‘আপনাকে তারা জানাবে না। রাশিয়ায় প্রবেশের শুরু থেকেই রুশ গোয়েন্দারা আমার প্রতি পদক্ষেপ অনুসরণ করছে, আজ থেকে তা আরও বাড়বে এবং জিনিস দু’টি তারা যে কোন উপায়ে হাত করতে চেষ্টা করবে।’
‘সে সুযোগ সম্ভবত রুশ সরকার পাবে না। আমি তাদের সাথে ঝগড়া করতে চাই না। রাজতন্ত্র সম্পর্কে তাদের পরিকল্পনার সাথে আমি একমত শুধু আমার কিছু শর্ত আছে, সে শর্ত তাদের মেনে নিতে হবে।’
‘সে শর্ত যদি মেনে নেবার মত না হয়?’
‘না মানলে নতুন সরকার ব্যাবস্থা সংক্রান্ত তাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে। এই ঝুঁকি তারা নিশ্চয় নেবে না। যদি নেয় তাহলে আমাকে তারা তাদের সাথে পাবে না এবং রাজকীয় রিং ও ডায়েরী তাদের পাবার প্রশ্নই উঠে না।’
‘আপনার এ ভুমিকা আমি সমর্থন করছি। কিন্তু আপনার সাথে আমি একটা পক্ষ হয়ে পড়া ঠিক হবে না। এতে আপনার অবস্থানও দুর্বল হতে পারে।’
থামল আহমদ মুসা। থেমেই আবার শুরু করল, ‘সম্মানিতা প্রিন্সেস, আমি আমার দায়িত্ব শেষ করে রোখসত পেতে চাই।’
‘মিঃ আহমদ মুসা রাশিয়ার সিংহাসনের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র লোভ নেই। যদি সিংহাসনে আমাকে দেশের স্বার্থে বসতেই হয়, তাহলে আমার শর্তের সাথে তাদেরকে অবশ্যই একমত হতে হবে। আর এ শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে মস্কো থাকতে হবে। আপনি এবং আপনার স্ত্রী মারিয়া জোসেফাইন হবেন আমার ব্যক্তিগত মেহমান।’
ক্যাথারিন একটু থামল এবং পরক্ষণেই আবার শুরু করল, ‘রাজকীয় ডায়েরীটা সাময়িকভাবে আমাকে দেবেন। আমার শর্তের ব্যাপারে ডায়েরী আমাকে সাহায্য করতে পারে। আমি কাজ শেষ করেই আপনাকে ডায়েরী ফেরত দেব।’
‘ঠিক আছে প্রিন্সেস, গাড়ি থেকে নামার আগেই আপনি ডায়েরী পেয়ে যাবেন।’
গাড়ি তখন চলে এসেছে ‘পুশকিন মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস’-এর পাশের রাস্তায়। সামনেই ‘কিরনস্কি স্টেট লাইব্রেরী’ (সাবেক লেনিন স্টেট লাইব্রেরী)।
‘কিরনস্কি স্টেট লাইব্রেরী’ থেকে একটা রাস্তা সোজা পুব দিকে এগিয়ে ক্রেমলিনের আউটার রিং রোডে গিয়ে পড়েছে।
আহমদ মুসা এই রিং রোড ধরে এগিয়ে ক্রেমলিনের গেটে গিয়ে পৌছল।
গাড়ি দাঁড় করাল আহমদ মুসা।
তার পেছনের গাড়িটা ছিল ডোনা জোসেফাইনের এবং শেষের গাড়িটা পাভলভের।
এ গাড়ি দুটোও দাঁড়াল।
আহমদ মুসা পকেট থেকে পাভলভের অয়্যারলেস বের করল। সংযোগ করল প্রেসিডেন্টের সাথে।
‘কোথায় অয়্যারলেস করছেন? ‘বলল প্রিন্সেস ক্যাথারিন।
‘প্রেসিডেন্টের কাছে।’
‘ঠিক আছে।’
আহমদ মুসা অয়্যারলেস তুলে নিল মুখের কাছে।

প্রেসিডেন্ট কিরনস্কী জুনিয়ার তার ক্রেমলিন অফিসে বিশাল টেবিলের সামনে বসে। উদ্বিগ্ন সে।
হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে পুলিশ অপারেশনের প্রতি মুহুর্তের খবর তাকে অবহিত করা হচ্ছে।
এই অপারেশনের রেজাল্ট কি হবে?
প্রিন্সেস ক্যাথারিন সেখানে বন্দী আছে, এটা নিশ্চিত না হয়ে নিশ্চয় আহমদ মুসা সেখানে প্রবেশ করেনি। তাদের পুলিশের সর্বাত্বক বেষ্টনি এবং আক্রমণ থেকে আহমদ মুসা ও গ্রেট বিয়ার কেউ-ই রেহাই পাবে না। এক ঢিলে দুই পাখি তারা মারতে পারবে।
প্রেসিডেন্ট মনে মনে ধন্যবাদ দিল তাদের ব্রিলিয়ান্ট গোয়েন্দা অফিসার বরিসভকে। তার নিয়োজিত দু’জন গোয়েন্দা এজেন্ট পাভলভ ও রোসা ড্রাইভারের ছদ্মবেশে সর্বক্ষণ সাথে থেকেছে আহমদ মুসার। তারাই জানিয়েছে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে আহমদ মুসার প্রবেশের কথা।
প্রেসিডেন্ট কিরনস্কী জুনিয়রের মনে পড়ল বরিসভের অনুরোধের কথা। আহমদ মুসার কোন ক্ষতি না হয়, এটা নিশ্চিত করতে আবেদন করেছে বরিসভ। অনেকে চাইলেও প্রেসিডেন্ট কিরনস্কী চান না আহমদ মুসার কোন প্রকার ক্ষতি হোক। তিনি শুধু চান প্রিন্সেস ক্যাথারিনের উপর আহমদ মুসার কোন প্রভাব পড়ুক।
এই মাত্র আসা একটা খবর প্রেসিডেন্ট কিরনস্কীর টেনশন বাড়িয়ে দিয়েছে। তার পুলিশ বাহিনী গোটা হেরিটেজ সার্চ করার পরও আহমদ মুসা, প্রিন্সেস ক্যাথারিন, ফরাসী প্রিন্স প্লাতিনি কারোরই কোন সন্ধান পায়নি। পুলিশ প্রধান আলেকজান্ডার খুব হতাশ কণ্ঠে এ খবর জানিয়েছে প্রেসিডেন্টকে। তবে একটা ভাল খবর দিয়েছে, গ্রেট বিয়ারের প্রধান আইভান ধরা না পড়লেও তার প্রধান দুই সহযোগী, মাজুরভ ও ভাদিমির খিরভ ধরা পড়েছে।
প্রেসিডেন্ট কিরনস্কী কিছুতেই উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না আহমদ মুসা ও ক্যাথারিনরা কোথায় হাওয়া হলো? সকাল থেকে একটা প্রাণীও তো বের হয়নি হেরিটেজ ফাউন্ডেশন থেকে।
অয়্যারলেসে আবার মেসেজ এল। এ্যাম্পলিফায়ার সেট করা অয়্যারলেস প্রেসিডেন্টের সামনে রাখা। অয়্যারলেস কথা বলে উঠল।
পুলিশ প্রধান আলেকজান্ডার জানাচ্ছেন, মাজুরভের কাছ থেকে জানা গেল
প্রিন্সেস ক্যাথারিনদেরকে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ভূগর্ভস্থ বন্দীখানায় রাখা হয়েছে। গ্রেট বিয়ারের প্রধানকেও ওখানে পাওয়া যাবে। কিন্তু নিচে নামার পথ বন্ধ। লিফট ভূগর্ভে নিয়ে লক করে রাখা হয়েছে। এখন লিফট ধ্বংস করে রাস্তা পরিস্কার করার পর সেখানে নামার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এই মেসেজ পেয়ে প্রেসিডেন্ট কিরনস্কীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। নিশ্চয় আহমদ মুসাও আইভানের হাতে ধরা পড়ার পর সেই ভূগর্ভেই রয়েছে।
মাত্র পাঁচ মিনিট। এরপর যে দু’টি খবর এল তা ভয়াবহ। ভুগর্ভস্থ বন্দীখানায় পুলিশ প্রধান আলেকজান্ডার সহ পুলিশরা প্রবেশ করেছে।
গ্রেট বিয়ারের প্রধান আইভানকে তার ছয়জন প্রহরীর সাথে মৃত অবস্থায় সেখানে পাওয়া গেছে। প্রিন্সেস ক্যাথারিনের বন্দী কক্ষে তার কাপড় চোপড় পাওয়া গেছে, কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। ফরাসী প্রিন্স প্লাতিনের বন্দী কক্ষেও এই একই বিষয় দেখা গেছে।
দ্বিতীয় ভয়াবহ খবর হলো, বন্দীখানায় মৃত অবস্থায় আইভান হিসেবে যাকে পাওয়া গেছে, তিনি পার্লামেন্টের বিরোধী দলের নেতা লেনিনের নাতি বুলগানিন।
এই দুই খবরে উদ্বেগ-উত্তেজনায় প্রেসিডেন্ট কিরনস্কী জুনিয়রের মধ্যে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি হলো।
আর দু’দিন বাদে ৫ই মার্চ জার সম্রাটের পদত্যাগ দিবসে (১৯১৭) ক্রাউন প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে রাশিয়ার নিয়মতান্ত্রিক সম্রাট ঘোষণা করা হবে। তাকে না পেলে এর কি উপায় হবে। জনগণকে তারা কি বলবে। অবশ্য কানাঘুষার মাধ্যমে দেশের সব লোকই আজ জানে, ক্রাউন প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে গ্রেট বিয়ার কিডন্যাপ করেছে রুশ পার্লামেন্টের নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র চালুর উদ্যোগ বানচাল করে দেবার জন্যে। তবে যেহেতু সরকার কিছু বলেনি, তাই জনগণ ধরে নিয়েছে ৫ই মার্চ তাদের
আকাঙ্খিত নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র চালু হতে যাচ্ছে রাশিয়ায়। এই অবস্থায় মানুষকে আশাহত করলে এমনকি তার সরকারের পতনও ঘটতে পারে।
এরপর রুশ পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় নেতা বুলগানিন আইভান হওয়া এবং হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ভূগর্ভস্থ কক্ষে তার নিহত হওয়ার ঘটনা। জনগণ কি এটা বিশ্বাস করবে? একে যদি মানুষ তার সরকারের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে তাহলে তার সরকারের দশা কি হবে!
একমাত্র উপায় ছিল ক্রাউন প্রিন্সেস ক্যাথারিন উদ্ধার হওয়া। সে যদি জনগণকে সব ঘটনা জানাত, তাহলে মানুষ সেটা বিশ্বাস করতো এবং সরকার ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বেঁচে যেত।
বিমূঢ় প্রেসিডেন্ট কিরনস্কী ইন্টারকমে পি.এসকে নির্দেশ দিল প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তাড়াতাড়ি আসার জন্যে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা এসে আসন নিল প্রেসিডেন্টের সামনের চেয়ারে। তাদেরও মুখ ম্লান ও চিন্তাক্লিষ্ট।
‘সব খবর আপনারা শুনেছেন। বলুন আপনারা কি ভাবছেন?’
‘স্যার, আমরা পরিস্থিতিকে বিপদজনক মনে করছি। গ্রেট বিয়ারের কারাগারে বন্দী এবং প্রত্যক্ষদর্শী প্রিন্সেস ক্যাথারিনের সাক্ষ্যই শুধু পারে সরকারকে রক্ষা করতে।’ বলল তারা।
‘আপনাদের সাথে আমি একমত। কিন্তু প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে পাওয়া যাবে কোথায়?’
‘আমাদের মনে হচ্ছে, আহমদ মুসাই তাকে বন্দীখানা থেকে উদ্ধার
করেছে।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।
‘তোমার পুলিশ তা পারল না কেন?’ তীব্র ক্ষোভের সাথে বলল প্রেসিডেন্ট কিরনস্কী।
‘স্যার, আমাদের পুলিশ ভূগর্ভস্থ সুরঙ্গের কথা চিন্তাই করেনি।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘বিদেশী আহমদ মুসা তা চিন্তা করল কি করে? খুঁজে পেল কি করে?’ তীব্র কণ্ঠে বলল প্রেসিডেন্ট।
কথা বলল না প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্রেসিডেন্ট কিছু বলতে যাচ্ছিল।
কিন্তু তার আগেই প্রেসিডেন্টের অয়্যারলেস কথা বলে উঠল। তাতে অপরিচিত এক কন্ঠ শোনা গেল, ‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, আমি আহমদ মুসা। গাড়ি নিয়ে ক্রেমলিনের গেটে। আমার সাথে রয়েছেন ক্রাউন প্রিন্সেস ক্যাথারিন। আমি প্রেসিডেন্টের সাক্ষাত প্রার্থী।’
প্রেসিডেন্ট তার কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যিই আহমদ মুসা ক্রাউন প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে নিয়ে ক্রেমলিনের গেটে এসেছে। সে কথাগুলো স্বপ্ন শুনছে না তো?
আনমনা হয়ে পড়েছিল প্রেসিডেন্ট।
‘স্যার, জবাব দেয়ার প্রয়োজন।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।
সম্বিত ফিরে পেল প্রেসিডেন্ট। না সে স্বপ্ন দেখছে না। বলল, ‘আপনার সাথে আর কে আছে আহমদ মুসা?’
‘প্রথম গাড়ি ড্রাইভ করছি আমি। এ গাড়িতে আছেন ক্রাউন প্রিন্সেস। দুই নম্বর গাড়িতে রয়েছেন আমার স্ত্রী, স্ত্রীর দু’জন বান্ধবী এবং গ্রেট বিয়ারের বন্দীখানা থেকে উদ্ধার পাওয়া প্রিন্স প্লাতিনি এবং লেনার্ট লার। আর শেষ গাড়িতে রয়েছেন আপনাদের দু’জন গোয়েন্দা এবং আমার সাথী পাভলভ ও রোসা।’
‘হুকুম দিচ্ছি তিন গাড়িই ভেতরে ঢুকবে। কিন্তু আমার কাছে আসবেন আপনি এবং ক্রাউন প্রিন্সেস।’
‘ধন্যবাদ।’ ওপার থেকে বলল আহমদ মুসা।
তিন গাড়িই ভেতরে ঢুকল।
প্রেসিডেন্টের গাড়ি বারান্দায় স্বয়ং প্রেসিডেন্ট নেমে এসেছেন ক্রাউন প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে স্বাগত জানানোর জন্যে।
প্রেসিডেন্ট কিরনস্কীর অফিসের আলোচনা কক্ষ।
টেবিলের এক পাশে বসেছে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অন্যপাশে ক্রাউন প্রিন্সেস ক্যাথারিন ও আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা বসতে চায়নি প্রিন্সেসের পাশে। প্রেসিডেন্টও আহমদ মুসাকে সমর্থন করেছে।
কিন্তু ক্রাউন প্রিন্সেস যুক্তি দেখিয়েছে, বর্তমান সংকটকালে আহমদ মুসা স্বাভাবিকভাবে তার পক্ষে শামিল হয়ে গেছে।
কথা শুরু হলো।
প্রেসিডেন্ট দুঃখ প্রকাশ করলেন। ক্রাউন প্রিন্সেসের দীর্ঘ বন্দী জীবনের জন্যে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট মোবারকবাদ জানালেন আহমদ মুসাকে প্রিন্সেসকে উদ্ধারে তার অবিস্মরণীয় অবদানের জন্যে।
‘ধন্যবাদ মিঃ প্রেসিডেন্ট। আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য সম্মানিতা প্রিন্সেসকে আপনার কাছে পৌছে দেয়া। আমার সে দায়িত্ব পালন শেষ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। কিন্তু…….মানে আমি বলতে চাচ্ছি, রাজকীয় রিং এবং…।’
আহমদ মুসা প্রেসিডেন্টকে বাধা দিয়ে বলল, ‘ও দু’টি জিনিসের মালিকানা ক্রাউন প্রিন্সেসের। এ ব্যাপারে উনিই বলতে পারেন।’
‘না, মানে এসব কথা আমি প্রিন্সেসকে জিজ্ঞেস করছি না। থাক এসব এখন। বর্তমান সংকটের কথায় আসি। সম্মানিতা ক্রাউন প্রিন্সেসের আমরা সহযোগিতা চাই।’
‘কি সহযোগিতা?’ বলল ক্যাথারিন।
‘আমার সরকার ভীষণ সংকটে পড়েছে। বিরোধী দলীয় নেতা বুলগানিন হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে নিহত হয়েছে, একথা এখনি ঘোষণা করা দরকার। কিন্তু আইভান নামের আড়ালে সেই যে গ্রেট বিয়ারের প্রধান ছিল, একথা মানুষকে বিশ্বাস করানো যাবে না। একমাত্র ক্রাউন প্রিন্সেস ক্যাথারিনের সাক্ষ্যই পারে রুশ জনগণকে এ কথা বিশ্বাস করাতে। সুতরাং ক্রাউন প্রিন্সেসকে অবিলম্বে রেডিও টেলিভিশনে কথা বলতে হবে।’
‘ব্যাপারটা আমি বুঝেছি। কিন্তু রেডিও টিভিতে শুধু আমিই কথা বললে চলবে না। ফ্রান্সের বুরবন প্রিন্স প্লাতিনি লুই গ্রেট বিয়ারের বন্দীখানায় বন্দী ছিলেন, এস্টোনিয়ার কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স প্রধান লেমার্ট লারও গ্রেট বিয়ারের বন্দীখানায় বন্দী ছিলেন। এদের সবাইকেই রেডিও টিভিতে কথা বলতে দিতে হবে।’
থামল ক্যাথারিন। প্রেসিডেন্ট কিরনস্কী জুনিয়র একবার প্রধানমন্ত্রীর দিকে চাইল এবং তারপর বলল, ‘যদিও এর খুব বেশি প্রয়োজন ছিল না, তবু ক্রাউন প্রিন্সেসের এ প্রস্তাবকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি।’
‘দ্বিতীয়ত, আমার কথা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করাতে হলে আমার বন্দী জীবন, আমার উদ্ধারের সব সত্য কথাই আমাকে বলতে হবে। তাতে আহমদ মুসার কথাও বার বার আসবে।’
প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সকলের মুখ ম্লান দেখা গেল।
একটু সময় নিয়ে প্রেসিডেন্ট অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল, ‘আমাদের যাতে উপকার হবে, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। আপনি যা ভাল মনে করবেন, সবই বলতে পারবেন।’
‘তৃতীয়ত, রাশিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত আপনাদের রাজনৈতিক প্রোগ্রামের সাথে আমি একমত। তবে জার পরিবারের সদস্য হিসেবে জার সম্রাটদের অতীত অনেক ভুলের আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই, এ ব্যাপারে আমার পূর্ণ স্বাধীনতা আপনাদের স্বীকার করতে হবে।’
‘প্রায়শ্চিত্তগুলো কি?’ বলল প্রেসিডেন্ট কিরনস্কী জুনিয়র।
‘সেগুলো আমি পরে বলব। তবে সে সবের সবটাই রাশিয়ার জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যত স্বার্থকে সামনে রেখেই করব।’
‘সম্মানিতা ক্রাউন প্রিন্সেসের তৃতীয় শর্তকেও আমরা মেনে নিচ্ছি।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘চতুর্থত, আহমদ মুসা এবং তার সাথের লোকজন আমার ব্যক্তিগত অতিথি হিসেবে থাকবেন যে কয়দিন ওরা রাশিয়ায় আছেন। তবে ওরা কোথায় থাকবেন, সেটা শুধু ওরাই জানবেন। তবে ক্রেমলিনে এবং আমার বাসস্থান পর্যন্ত পৌছার তাদের অবাধ অধিকার থাকবে। ক্রেমলিনে তাদের কারও কোন ক্ষতি হলে রাষ্ট্র দায়ী থাকবে।’
‘রাশিয়ানরা অবশ্যই অতিথি পরায়ণ। আপনার প্রস্তাব আমরা সানন্দে গ্রহণ করছি।’ বলল প্রেসিডেন্ট কিরনস্কী জুনিয়র।
কথা শেষ করেই প্রেসিডেন্ট একটু থামল। পরক্ষণেই আবার বলল, ‘সম্মানিতা ক্রাউন প্রিন্সেস, ক্রেমলিনে জার সম্রাটদের খাস মহল নতুন করে সাজানো হয়েছে। সেখানেই আপনি থাকবেন।’
বলে প্রধানমন্ত্রীর দিকে চেয়ে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘আপনি একটু ওদিকে দেখবেন, কোন অসুবিধা না হয়। উনি একটু রেষ্ট নেবার পর রেডিও টিভি’তে আসবেন। আর ক্রাউন প্রিন্সেসের মেহমানরা এখনকার মত ক্রেমলিনের মেহমান খানায় থাকবেন।’
‘ধন্যবাদ প্রেসিডেন্ট।’ বলে উঠে দাঁড়াল প্রিন্সেস ক্যাথারিন।
প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও উঠে দাঁড়িয়েছে। আহমদ মুসাও।

Top