২৯. আমেরিকায় আরেক যুদ্ধ

চ্যাপ্টার

চ্যাপ্টার

ওয়াশিংটন।
প্রধান রাস্তা থেকে এফ.বি.আই হেডকোয়ার্টার বেশ ভেতরে।
প্রধান রাস্তা থেকে লাল পাথরের একটা প্রশস্ত পথ, গিয়ে পৌঁছেছে বিশাল বিল্ডিং-এর গাড়ি বারান্দায়। প্রধান রাস্তাটিও গাড়ি বিরল।
পটোম্যাক নদীর এ এলাকাটা এমনিতেই জনবিরল। তার উপর আজ শনিবার। হঠাৎ দুএকটা দ্রুত গতির গাড়ি চোখে পড়ার পরই আবার হারিয়ে যাচ্ছে।
আহমদ মুসার গাড়ি সবে এই রাস্তায় গিয়ে পড়েছে।
রাস্তার দুই পাশে গাছের সারি। রাস্তার এক পাশ ধরে আহমদ মুসার গাড়ি দ্রুত এগিয়ে চলছে।
আহমদ মুসার চোখের দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। হঠাৎ আহমদ মুসার চোখে পড়ল কিছু দূর সামনে একটা গাড়ি রাস্তার বাইরে নিয়ে পার্ক করা।
দুজন লোক গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। একজনের হাতে একটা ওয়াকিটকি।
আহমদ মুসার গাড়ি ঐ সমান্তরালে যেতেই দুজনের একজন হাত তুলে আহমদ মুসার গাড়ি থামাতে বলল। ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করাল। গাড়ি দাঁড়াতেই দুজন এগিয়ে এল। ওয়াকিটকিধারী ওয়াকিটকিতে কথা বলছিল। তার শেষ কথাটা আহমদ মুসা শুনতে পেল, ‘বুঝলাম, তাকে যেতে দেব না। ওকে কমপক্ষে এক ঘন্টা আটকে…… ঠিক আছে।’
ওয়াকিটকিধারী আহমদ মুসাকে বলল, ‘তুমি কি শেখ আবদুল্লাহ আলী?’
‘জি, হ্যাঁ।’ শেখ আবদুল্লাহ আলী রূপী আহমদ মুসা উত্তর দিল।
‘এদিকে কোথায় যাচ্ছ? এ রাস্তা বন্ধ, এদিকে এখন যাওয়া যাবে না।’
বলে ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে নির্দেশ দিল, ‘গাড়িটা রাস্তার বাইরে ওদিকে নিয়ে যাও।’
‘আমি যাচ্ছি এফ.বি.আই প্রধান জর্জ আব্রাহামের সাথে দেখা করতে ৫টায় তার সাথে আমার এ্যাপয়েন্টমেন্ট’ বলল শেখ আবদুল্লাহ রূপী আহমদ মুসা।
লোকটি মুখ বাঁকা করে বলল, ‘জর্জ আব্রাহামের সাথে মৌলবাদীর কি দরকার! সন্ত্রাসী আহমদ মুসার পক্ষে তদবীর করতে? সৌদি সরকার পাঠিয়েছে? তা যাবে, ঘন্টা খানেক পরে।’
কথা শেষ করে আবার নির্দেশ দিল ড্রাইভারকে, ‘গাড়ি ঘুরাও। নিয়ে চল ওদিকে।’
আহমদ মুসা বিস্মিত হলো, এরা যদি শেখ আবদুল্লাহ আলীর জন্য এই ব্যবস্থা করে থাকে, তাহলে আহমদ মুসার জন্য এরা কি আয়োজন করে রেখেছে আল্লাহই জানে।
ড্রাইভার নির্দেশের জন্য আহমদ মুসার দিকে তাকাল।
আহমদ মুসা ড্রাইভারকে কিছু না বলে ওয়াকিটকিধারীর দিকে চেয়ে বলল, ‘একবার বলছেন রাস্তা বন্ধ। আবার বলছেন এক ঘন্টা যাওয়া যাবে না। রাস্তাটা কি এক ঘন্টা বন্ধ থাকবে?’
‘ওসব কথা নয়। তোমার যাওয়া হবে না। জর্জ আব্রাহামের কাছে আহমদ মুসার পক্ষে দালালী করতে তোমাকে আমরা যেতে দেব না।’ বলল ওয়াকিটকিধারী।
‘বারবার আহমদ মুসার সাথে আমাকে যুক্ত করছেন কেন? তার সাথে আমার এই যাওয়ার কি সর্ম্পক?’ হাসল শেখ আবদুল্লাহ আলী রূপী আহমদ মুসা।
‘ইস ন্যাকা সাজা হচ্ছে! ও নিয়েছে ৬টায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট, আর তুমি নিয়েছ ৫টায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট! বিনা যোগাযোগে? তুমি গিয়ে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে আহমদ মুসার জন্য তদবির করে আসবে, এরপর আহমদ মুসা যাবে ফায়দা নেবার উদ্দেশ্যে, এ সহজ কথাটা আমরা বুঝিনা, না?’ আহমদ মুসা মনে মনে হাসল। মনে মনেই বলল, বুঝবে না কেন, তোমরা তো একটা বুদ্ধির ঢেকি! প্রকাশ্যে বলল, ‘ঠিক আছে তাহলে ফিরে যাই।’
‘না ফিরে যেতে পারবে না।’
‘কেন?’
‘ফিরে গিয়ে আহমদ মুসাকে সাবধান করবে তা কি হতে দিতে পারি আমরা? সে আসুক এটাই তো আমরা চাচ্ছি। কত আয়োজন তার জন্য!’
‘আয়োজনটা আবার কি?’
‘তুমি আশেপাশে থাকলে, দেখতে পাবে। আধ ঘন্টার মধ্যেই সবাই এসে পড়বে।’
‘না, আমি থাকছি না।’
উত্তরে ওরা কিছু বলল না। হঠাৎ তাদের মুখের ভাব কঠোর হয়ে উঠল। দুজনের হাতেই রিভলবার উঠে এল। ওয়াকিটকিধারী তার রিভলবার ড্রাইভারের দিকে তাক করে বলল, ‘যা বলেছি সে আদেশ পালন কর।’
ড্রাইভার তাকাল আহমদ মুসার দিকে নির্দেশের জন্য।
‘ও আমার আদেশ……’
কথা শেষ করতে পারল না লোকটি।
পেছন থেকে পরপর তিনবার দুপ দুপ শব্দ হলো। সংগে সংগেই দেখা গেল, গাড়ির পাশে দাঁড়ানো ওদের হাত থেকে দুটি রিভলবার ও ওয়াকিটকি ছিটকে পড়ে গেল। আর্তনাদ করে উঠলো ওরা দুজনই। ওয়াকিটকিধারীর দুই হাত এবং অন্যজনের ডান হাত রক্তাক্ত।
আহমদ মুসা পেছনে তাকাল। দেখল, বেঞ্জামিন বেকনের গাড়ি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার হাতে নেমে এসেছে গাড়ি থেকে বেঞ্জামিন বেকন।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামছিল।
বেঞ্জামিন বেকন ‘না, না’ বলে নিষেধ করল। বলল, ‘ইয়া শেখ, আপনার নামার দরকার নেই। আপনি চলে যান। আমি এদের ব্যবস্থা করছি।’ বলে বেঞ্জামিন বেকন তার রিভলবারের বাট দিয়ে দুজনের মাথায় দুটি ঘা লাগিয়ে বলল, ‘চল, আমার গাড়িতে উঠ। একটু দেরী করলে রিভলবারের গুলি এবার মাথা গুড়িয়ে দেবে।’
লোক দুটি চলল বেঞ্জামিনের গাড়ি লক্ষ্যে।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করেছে।
একটু পর আহমদ মুসা পেছনে ফিরে দেখল, লোক দুটি বেঞ্জামিনের গাড়িতে উঠছে। আর বেঞ্জামিন কিছু দড়ি নিয়ে এগুচ্ছে তাদের দিকে।
‘বেঞ্জামিন তাহলে ওদের বেঁধে গাড়িতে রাখবে’ ভাবল আহমদ মুসা। বেঞ্জামিনের সতর্কতাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিল সে। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাল বেঞ্জামিন কে। সে এসে তাকে এই অপ্রীতিকর কাজে জড়িয়ে পড়া থেকে উদ্ধার করেছে। তার যে পরিচয় এবং পোশাক তা নিয়ে এই কাজে জড়িয়ে পড়া তার জন্য নিরাপদ ও শোভন হতো না। আল্লাহ তাকে বাঁচিয়েছেন।
আবার চোখ ফেরাল আহমদ মুসা পেছনে। দেখল, বেঞ্জামিনের গাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
আহমদ মুসা পৌছে গেল এফ.বি.আই ভবনগামী সেই লাল পাথুরে রাস্তার মুখে।
সেই রাস্তার মুখে সাদা পোশাকে দুজন লোক দাড়িয়ে। তাদের হাতে ওয়াকিটকি, ওরা এফ,বি, আই-এর লোক, দেখেই আহমদ মুসা চিনল।
গাড়ি ওদের সামনে এসে দাঁড়াতেই ঐ দুজনের একজন গাড়ির ভেতরে উকি দিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে সসম্মানে বলল, ‘আপনি কি মিঃ শেখ আবদুল্লাহ আলী?’
‘হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়েলকাম স্যার।’ বলে রাস্তার একপাশে সরে দাঁড়াল ওরা দুজন।
আহমদ মুসার গাড়ি লাল পাথরের সড়ক ধরে এগিয়ে গেল এফ.বি.আই ভবনের দিকে, গাড়ি বারান্দায় গিয়ে প্রবেশ করল। গাড়ি বারান্দার পরেই প্রশস্ত করিডোর, তার পরেই বিল্ডিং-এ প্রবেশের বিশাল দরজা। দরজায় দুজন সেন্ট্রি।
আহমদ মুসার গাড়ি থামতেই একজন সেন্ট্রি ছুটে এল। আহমদ মুসার গাড়ির গেট খুলে ধরল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে বেরুল।
স্যালুট দিল সেন্ট্রি।
সেন্ট্রি আহমদ মুসাকে নিয়ে উঠে গেল বারান্দায়।
বড় দরজার পাশেই আরেকটা ছোট দরজা। সেন্ট্রি আহমদ মুসাকে নিয়ে গিয়ে সেই ছোট দরজার সামনে দাঁড়াতেই দরজা খুলে গেল।
বিরাট একটি কক্ষ। সোফায় সাজানো।
অভ্যর্থনা কক্ষ এটা।
দরজার ডানপাশে একটি কাউন্টার। তৎপর একটি মহিলা সে কাউন্টারে বসে।
আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকতেই ‘গুড ইভনিং!’ বলে স্বাগত জানাল আহমদ মুসাকে। এরপর টেলিফোন তুলে কার সাথে কি কথা বলে মেয়েটি উঠে এল। আহমদ মুসাকে নিয়ে একটা সোফায় বসার অনুরোধ করে বলল, ‘একটু বসুন স্যার, ভেতরে নিয়ে যাবার জন্য লোক আসছে।’
আহমদ মুসা বসল।
মেয়েটি ফিরে এল তার কাউন্টারে।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে কক্ষটির ভেতরের দরজা দিয়ে একজন লোক এসে প্রবেশ করল। সোজা এসে ‘গুড ইভনিং স্যার’ বলে আহমদ মুসার সামনে দাড়াল। তার হাতে একটি কাগজ। একবার কাগজ ও একবার আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসুন স্যার, আমার সাথে।’
বলে সে ঘুরে দাড়াল।
আহমদ মুসাও উঠে তার পিছু নিল।
এফ.বি.আই হেড কোয়ার্টার ১১ তলা একটা বিশাল বিল্ডিং।
একেবারে পটোম্যাক নদীর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।
হেডকোয়ার্টারের দুটি ফ্রন্ট সাইড। একটা আহমদ মুসা যে দিক দিয়ে এল সেদিকে, আরেকটা পটোম্যাক নদীর সাথে। পটোম্যাক নদীতে ভাসছে এফ.বি.আই-এর উভচর হেলিকাপ্টার ও ছোট ছোট প্লেনগুলো।
আর শত গাড়ির গ্যারেজ রয়েছে আন্ডার গ্রাউন্ড টপ ফ্লোরে।
আহমদ মুসাকে নিয়ে লোকটি এল সাত তলায়। এই সাত তলার মাঝামাঝি পটোম্যাক প্রান্তের একটা বিশাল কক্ষে বসে এফ.বি.আই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জন আব্রাহাম জনসনের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তার পি,এস। আহমদ মুসাকে নিয়ে লোকটি সেখানে পৌছতেই জর্জ আব্রাহামের পি,এস লোকটিকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে আহমদ মুসাকে নিয়ে দরজা ঠেলে প্রবেশ করল একটা ঘরে।
ঘরটা বেশ বড়। সোফায় সাজানো। দেখে ওয়েটিং রুমের মত মনে হয়। সে ঘরের পর একটা করিডোর। তারপর প্রবেশ করল আরেকটা বিশাল কক্ষে। দেখেই বুঝল আহমদ মুসা কক্ষটি কনফারেন্স রুম।
কনফারেন্স রুমের পর আবার করিডোর। তারপর প্রবেশ করল আরেকটি কক্ষে, এ ঘরও সোফায় সাজানো।
ঘরে ঢুকে একটা সোফা দেখিয়ে আহমদ মুসাকে বলল, ‘বসুন স্যার, চীফ স্যার এখনি এসে পড়বেন।’
বলে পি, এস বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
বসতে বসতে আহমদ মুসা ভাবল পি, এস সাহেব তাকে সাধারণের চলাচলের পথ দিয়ে নিয়ে আসেনি, ডানদিকের সংক্ষিপ্ত পথে নিয়ে এসেছে। কক্ষটি দেখে আহমদ মুসা ভাবল এটা সাক্ষাতকার রুম। এমন সাক্ষাতদানের রুম হয়তো আরও আছে।
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল এক প্রৌঢ় ব্যক্তি, মাথার চুলে মিলিটারি ছাঁট। মাথায় সাদা-পাকা চুলে বয়সের ছাপ আছে, কিন্তু দেহে তা নেই। দেখলেই বুঝা যায় মেদহীন পেটা শরীর।
আহমদ মুসা প্রথম নজরেই চিনতে পারল ওহাই নদীর মটর বোটে দেখা জর্জ আব্রাহাম জনসনকে। ছদ্মবেশে থাকায় আহমদ মুসাকে তার চেনার কথা নয়।
সে সময় জর্জ আব্রাহামের চোখের দিকে আহমদ মুসা তাকিয়েছিল কিনা মনে পড়ছে না, কিন্তু আজ দেখল বাজের মত শিকারী চোখ দুটি তার।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল।
জর্জ আব্রাহাম জনসনই প্রথম হাত বাড়াল হ্যান্ডশেকের জন্য।
আহমদ মুসাও হাত বাড়াল।
‘আমি জর্জ আব্রাহাম জনসন।’ হ্যান্ডশেক করতে করতেই বলল সে।
‘আমি আহমদ মুসা।’ হ্যান্ডশেক অবস্থাতেই বলল আহমদ মুসা।
মুখে যখন নিজের নাম উচ্চারণ করছিল আহমদ মুসা, তখন বাম হাত দিয়ে মুখের দাঁড়ি সে খুলে ফেলছিল।
প্রথমেই বিস্ময় ও বিব্রতকর অবস্থা ফুটে উঠল জর্জ আব্রাহামের মুখে। কিন্তু পরক্ষণেই তার চোখ দুটি জ্বলে উঠল বাঘের মত। চোখের পলকে তার বাম হাত পকেট থেকে রিভলবার বের করে এনে আহমদ মুসার কপাল বরাবর তাক করল। বলে উঠল তীব্র কন্ঠে ‘এই প্রতারণার অর্থ কি আহমদ মুসা?’
জর্জ আব্রাহাম জনসন ও আহমদ মুসারে ডান হাত তখনও হ্যান্ডশেকে আবদ্ধ।
হাসল আহমদ মুসা। শিশুর মত নিদোর্ষ হাসি। বলল, ‘আপনার সাথে দেখা করাটা নিশ্চিত করার জন্য।’
‘কেন সাক্ষাতের জন্যে সময় তো নির্দিষ্ট আছে বিকেল ছটায়।’
‘তখন আসতে পারতাম না। আসতে দেয়া হতো না। পথেই আটক করা হতো।’
‘একটা অসম্ভব কথা বলছেন আহমদ মুসা।’
‘অসম্ভব নয়, এটাই বাস্তবতা। আমি মানে শেখ আবদুল্লাহ আলীকেও বাধা দেয়া হয়েছিল। বাধাদান কারী দুজনকে আমার সাহায্যকারী কাবু করে নিয়ে যায় তার ফলে আমি আসতে পেরেছি।’
‘কারা কেন শেখ আবদুল্লাহ আলীকে বাধা দিয়েছিল?’
‘শেখ আবদুল্লাহ আলীকে নাকি সৌদি সরকারের তরফ থেকে আহমদ মুসার পক্ষে তদ্বীর করার জন্য আপনার কাছে পাঠানো হয়েছে। এই তদ্বীর যাতে শেখ আবদুল্লাহ করতে না পারে এজন্য তাকে এক ঘন্টা আটকে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।’
একটু ভাবল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
তার রিভলবার ধরা বাম হাত নিচে নেমে গেল এবং রিভলবারও গিয়ে পকেটে ঢুকল।
‘এখানে কথা বলা নিরাপদ নয় বলে মনে হচ্ছে, আপনি আমার অফিসে আসুন।’
বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসাও চলল তার পেছনে পেছনে।
বিরাট অফিস কক্ষ জর্জ আব্রাহাম জনসনের।
বড় টেবিল। তার বা পাশে দীর্ঘ প্রশস্ত ডেস্ক। ডেস্কটা ইন্টারনেট, ইন্টারকম, ফ্যাক্স ও নানা রকম টেলিফোনে ঠাসা।
পেছনে একটা বিগ সাইজ কম্পিউটার।
জর্জ আব্রাহাম টেবিলের সামনে একটা চেয়ার দেখিয়ে আহমদ মুসাকে বসতে বলে নিজে গিয়ে টেবিলের ওপাশে বসল নিজের চেয়ারে।
‘কিন্তু আমি বিস্মিত হচ্ছি আপনার সাথে এ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যাপারটা জানাজানি হলো কি করে? ব্যাপারটা আমি কাউকে জানাইনি। ঠিক করেছিলাম, আমি গিয়ে গেট থেকে আপনাকে নিয়ে আসব।’
‘আপনার টেলিফোন মনিটর হতে পারে না?’
‘এফ. বি. আই-এর সেন্ট্রাল সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ সব কিছুই রেকর্ড করে থাকে।’
‘সেখান থেকে তো এ তথ্য পাচার হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হতে পারে। কিন্তু বিস্মিত হচ্ছি, কারা এ নিয়ে মাথা ঘামাল এবং কেন?’
‘আমি বোধ হয় আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
‘কি সেটা?’ ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘আপনার একজন ডিউটি অফিসার বিষয়টা জানে। সে জড়িতও থাকতে পারে। তার এখন ডিউটি নেই, তবু সে অফিসে কিংবা আসে-পাশে আছে বলে জানি।’
চমকে উঠার মতই চোখটা চঞ্চল হয়ে উঠল জর্জ আব্রাহাম জনসনের। বলল, ‘ডিউটি অফিসারের নাম বলতে পারবেন?’
‘মিঃ ম্যাগগিল।’
‘ম্যাগগিল?’ চমকে উঠার মত নাম উচ্চারণ করেই হঠাৎ যেন কোন ভাবনায় ডুবে গেল জর্জ আব্রাহাম। সে চেয়ার হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে সামনে। কিন্তু তার দৃষ্টিতে শুন্যতা।
হঠাৎ সোজা হয়ে বসল জর্জ আব্রাহাম। ইন্টারকমের সামনে ঝুঁকে পড়ল। চাপ দিল একটা কীতে।
ওপার থেকে একটা কন্ঠ ভেসে এল, ‘সিকিউরিটি চীফ হারমান হেইঞ্জ বলছি।’
‘জর্জ আব্রাহাম, গুড ইভনিং।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘স্যার, গুড ইভনিং। কিছু নির্দেশ স্যার?’
‘হ্যাঁ। শোন, বিকেল ৬টায় আমার পার্সোনাল একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট। এটা ফাঁস হয়েছে। কারা করল, কেন করল, আমি জানতে চাই।’
‘স্যার, এ্যাপয়েন্টমেন্ট কিভাবে হয়েছিল?’
‘আমার সরাসরি টেলিফোনে।’
‘ধন্যবাদ। আরও কোন ইনফরমেশন আছে স্যার আমাকে সাহায্য করার মত?’
‘ফাঁস করার মাধ্যমে যারা জানে তাদের একজন ম্যাগগিল।’
‘ধন্যবাদ স্যার। কবে কয়টায় এ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছিল স্যার?’
‘আজ সকালে।’
‘অনেক ধন্যবাদ স্যার। আমি এখনি বিষয়টা দেখছি স্যার। আমি খবর পেয়েছি, ডিউটি শেষ হয়ে যাবার পরও ম্যাগগিল চলে যায়নি। ক্লাবে বসে আড্ডা দিচ্ছে।’
‘কতক্ষণে আমাকে জানাবে?’
‘৬টা বাজার আগেই, স্যার।’
‘ধন্যবাদ হেইঞ্জ।’
‘ওয়েলকাম স্যার।’
ইন্টারকম অফ করে দিয়ে আহমদ মুসার দিকে ফিরে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘খবরটা পাওয়ার আগে আপনার সাথে কোন কথা বলব না এই ব্যাপারে। আসুন চা খাই।’
আহমদ মুসা তার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাড়ে পাঁচটা বাজে।
চা খেতে খেতে প্রথম নিরবতা ভাঙল জর্জ আব্রাহামই। বলল, ‘আমার সেই নাতিটা কেমন আছে, আপনি কিন্তু একবারও জিজ্ঞেস করেননি।’ জর্জ আব্রাহাম অস্পষ্ট একটা হাসি হাসল।
‘আপনার পারিবারিক কোন বিষয়কে আপনার অফিসে টেনে আনা ঠিক মনে করিনি। দ্বিতীয়ত আমি ব্যক্তি আহমদ মুসা হিসেবে আসিনি, এসেছি আপনাদের সাংঘাতিক এক অভিযোগের আসামী হিসেবে।’ বলল গম্ভীর কন্ঠে আহমদ মুসা।
‘ঠিক বলেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম। তারও গম্ভীর কন্ঠ।
আরও কিছুক্ষণ পর, এবারও নিরবতা ভাঙল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘ন্যাসভিলের রিপোর্ট আমি পেয়েছি। রিপোর্ট পেন্টাগন, সি.আই.এ এবং প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা অফিসেও গেছে। সবাই আমরা বিস্মিত যে, সুযোগ পেয়েও আপনি পালানোর পরিবর্তে আহত মূমুর্ষু শত্রুদের উদ্ধার ও বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। তার ফলে আমাদের তিনটা মূল্যবান প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। বলুন তো এ রকম মানবতাবোধ যার, তিনি কেন খুনোখুনির জগতে?’
‘ঐ মূমুর্ষদের মত যারা মজলুম অসহায় তাদের সেবা করার জন্যে।’ গম্ভীর কন্ঠ আহমদ মুসার।
জবাবে তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলল না জর্জ আব্রাহাম। ভাবছিল সে। অনেকক্ষণ পরে বলল, ‘ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আইন এবং শত্রুরা একথা মানবে না। লস-আলামোস ল্যাবরেটরী অব স্ট্রাটেজিক রিসার্চে আপনি ঢুকে ছিলেন, এটা প্রমাণিত হলে আইন অত্যন্ত কঠোরভাবে তা দেখবে।’
‘তাই দেখা উচিত জনাব।’ আহমদ মুসার ঠোটে মিষ্টি এক টুকরো হাসি।
সেদিকে তাকিয়ে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘আপনার মত শক্ত নার্ভের মানুষ আমি দেখিনি। আপনার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনি আত্মসমর্পণ করতে এলেন কেন?’
‘কারণ, আপনারা আমাকে ধরে রাখতে পারবেন না।’
‘এফ.বি.আই অফিসে বসে একথা বলা কি সাজে?’
‘না সাজলে বলতাম না।’
‘তা ঠিক। কিন্তু এটা অমূলক একটা অহংকার আপনার।’
‘প্রকৃত মুসলমান যে সে অহংকার করে না, করতে পারে না।’
‘আবার মুসলমানিত্বকে টেনে আনছেন কেন, আমরা মানুষ হিসাবে কথা বলছি।’
‘কিন্তু আমি মানুষ হিসাবে কথা বলছি না, মুসলমান হিসাবে কথা বলছি।’
‘তার কোন দরকার কি আছে? মানুষ হওয়াটাই কি যথেষ্ট নয়?’
‘আচ্ছা বলুন তো, রাস্তার ভীড় থেকে একজনকে ধরে এনে আপনার চেয়ারে বসালেই সে কি এফ.বি.আই প্রধানের দায়িত্ব পালন করতে পারবে?’
‘পারবে না।’
‘কেন পারবে না।’
‘এফ.বি.আই-এর ট্রেনিং তার নেই এবং এফ.বি.আই প্রধানের দায়িত্ব-কর্তব্যও জানা থাকবে না তার।’
‘এই বিশ্ব সংসারে প্রতিটি মানুষ একজন করে শাসক। সে নিজেকে, পরিবারকে, কিছু মানুষকে এবং তার চারপাশের সৃষ্ট জগতকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করে। এই শাসন ও নিয়ন্ত্রণ শেখার জন্যে এফ.বি.আই-এর মত আর ট্রেনিং ও দায়িত্ব-কর্তব্যের শিক্ষা থাকা দরকার কিনা?’
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না জর্জ আব্রাহাম। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘এ শিক্ষা তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং সরকার দেয়।’
‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং সরকার প্রফেশনাল বা পেশাজীবী তৈরী করে, ঐ ‘শাসক মানুষ’ তৈরী করে না। সরকারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ট্রেনিং কর্মসূচীতে মানুষের ‘মৌলিক শিক্ষা’টা কি? -এই পৃথিবীতে মানুষের সৃষ্টি কেন? তার পরিণতি কি? ইত্যাদি। দেখুন আপনি আপনার চারদিকে সৃষ্ট জগতের দিকে চেয়ে, সবকিছুই সৃষ্টি হয়েছে মানুষের জন্য, মানুষের উপকারের জন্যে, মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত হবার জন্যে। গাছ-পালা ও পশু-পাখি থেকে শুরু করে চাঁদের আলো, সূর্যের কিরণ, নদ-নদী-সমুদ্র-বৃষ্টি, সৌর-জাগতিক সম্বন্ধ, তারকাপুঞ্জের (গ্যালাক্সি) ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান সবই মানুষকে ঘিরে। কিন্তু সৃষ্ট জগতের উপর একচ্ছত্র শাসক মানুষের সৃষ্টি কোন উদ্দেশ্যে, কি তার কাজ? তার একটাই কাজ খঁজে পাওয়া যায়, আর সেটা হলো ঐ শাসন নিয়ন্ত্রণ যা সে নিজের উপর, পরিবারের উপর, অধিনস্ত কিছু মানুষের উপর এবং আয়ত্বাধীন সৃষ্ট জগতের উপর চালায়। এটাই তার মূল কাজ, মূল দায়িত্ব। এই কাজ সম্পাদন ও দায়িত্ব পালনের জন্যে কি শিক্ষার দরকার নেই? এই শিক্ষাই মানুষে মৌলিক শিক্ষা।’
‘এটাতো দর্শণ শিক্ষা।’
‘দর্শণ শিক্ষা বটেই, কিন্তু ‘মানুষ প্লেটো’, ‘মানুষ হেগেল’ প্রমুখের দর্শন নয়। তাঁদেরও যিনি স্রষ্টা সেই আল্লাহর দর্শন বা জীবন বিধানই হলো মূল শিক্ষা।’
‘আপনি ধর্ম শিক্ষার কথা বলছেন?’
‘ধর্ম শিক্ষা মানে তো মানুষ কি করবে, কি করবে না অর্থাৎ মানুষের জীবন পরিচালনার শিক্ষা।’
‘এ নির্দেশ তো আমাদের সংবিধানেই আছে।’
‘ও তো মানুষের তৈরী।’
‘তাতে দোষ কি? জনমতের ভিত্তিতে জনগণের জন্যেই তৈরী এ সংবিধান।’
‘মানুষ যখন কিছু করে তার সংকীর্ণ স্বার্থে করে। মানুষের তৈরী আইন ও সংবিধান তাই সংকীর্ণ স্বার্থ-দুষ্ট হয়ে থাকে। আর আল্লাহর সংবিধান পৃথিবীর সকল মানুষের সার্বিক মঙ্গলের জন্যে। যেমন মদ খাওয়া খারাপ, কিন্তু আমেরিকান আইন জনমতের ভিত্তিতে এই খারাপ জিনিসকে বৈধ করেছে। কিন্তু আল্লাহর আইনে মদ পানের মত ক্ষতিকর কাজ বৈধ হবে না সব মানুষ চাইলেও। অনুরূপভাবে আমেরিকান আইনে অবৈধ ব্যভিচার যদি সম্মতিমূলক হয়, তাহলে শাস্তিযোগ্য হবে না, কিন্তু আল্লাহর সংবিধানে ব্যভিচার সম্মতিমূলক হোক বা অসম্মতিমূলক হোক উভয়ক্ষেত্রেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমন হাজারো দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখানো যাবে যে, মানুষ নিজের ভালো নিজেই বোঝে না, নিজের হাতেই সে নিজের ধ্বংসের আইন রচনা করে (যেমন মৃত্যদন্ড রহিত করা আইন)। এর অর্থ, মানুষ তার জীবন পরিচালনার আইন তৈরী বা সংবিধান রচনার উপযুক্ত নয়। প্রকৃত পক্ষে এই অধিকারই মানুষ রাখে না। মানুষের জন্য সংবিধান আসবে আল্লাহর কাছ থেকে।’
‘তাহলে কি মানুষ আইন প্রনয়ন করবে না?’
‘করবে আল্লাহর দেয়া সংবিধানের ভিত্তিতে।’
‘থাক, মিঃ আহমদ মুসা। আর নয়। দেখছি, আর একটু এগুলে হয় তো আমি মৌলবাদীই হয়ে পড়বো। স্বীকার করছি, যা বলেছেন তার কোনটাই অযৌক্তিক নয়। এ ভারি বিষয়গুলো নিয়ে পরে আরও ভাববো। এখন আসল কথায় ফিরে আসি।’
বলে একটা দম নিয়ে জর্জ আব্রাহাম ব্লল, ‘তাহলে দাঁড়াল, আমরা আপনাকে আটকাতে পারব না, এটা আপনার কোন অমূলক অহংকারের কথা নয়।’
‘হ্যাঁ, তাই জনাব।’
‘আমি খুশি হবো যদি তাই হয় যে, আমরা আপনাকে আটকাচ্ছি না। কিন্তু জেনে রাখবেন আমাদের সকল আইন ভাল বা মন্দ হোক, এ আইনের হাত থেকে রেহাই আপনি পাবেন না। যদিও তাতে কষ্ট…………।’
কথা শেষ করতে পারলো না জর্জ আব্রাহাম। তার ইন্টারকম কথা বলে উঠল। সিকিউরিটি চীফ হারমান হেইঞ্জের কন্ঠ। বলল, ‘গুড ইভনিং স্যার। আমি হারমান হেইঞ্জ।’
‘গুড ইভনিং। বল।’
‘ম্যাগগীল সহজেই কথা বলেছে। প্রাথমিক কাজ হয়ে গেছে স্যার। রিপোর্ট পাঠালাম। আর সামনে এগুতে হলে আপনার জরুরী নির্দেশ দরকার।’
‘অপেক্ষা কর, রিপোর্ট পড়ে নেই। ধন্যবাদ।’
বলে ইন্টারকম অফ করে দিল জর্জ আব্রাহাম।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কম্পিউটার থেকে একটা প্রিন্টেড শিট বেরিয়ে এল।
জর্জ আব্রাহাম দ্রুত চোখ বুলাতে লাগল প্রিন্টেড শিটটিতে।
পড়া তাঁর যতই এগুতে লাগল, তার মুখের ভাব ততই পরিবর্তিত হতে লাগল।
পড়া যখন শেষ হলো, তখন সাদা চেহারা তার লাল হয়ে উঠেছে। সেই সাথে শক্ত হয়ে উঠেছে তার মুখমন্ডল। বলল সে, ‘মিঃ আহমদ মুসা আপনার অনুমান সত্য। আপনি ৬টায় সত্যিই আসতে পারতেন না। আমাদের সামনের ‘পটোম্যাক ১১’ রোডের মুখে দুই গাড়ি বোঝাই লোক ওৎ পেতে ছিল। আপনি ঐ রোডে প্রবেশ করলেই সামনে ও পেছন থেকে আপনার গাড়ি ঘিরে ফেলা হতো।’
‘এ রকম ঘটবে আমি আগেই অনুমান করেছিলাম। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আপনার টেলিফোনের কথা ফাঁস হলো কাদের দ্বারা?’
‘জানতে চাইলেন না, ওৎ পেতে ছিল ওরা কারা?’
‘জানি আমি। ওরা জেনারেল শ্যারণ ও মিঃ গোল্ড ওয়াটারের লোক।’
‘না আহমদ মুসা। জেনারেল অত্যন্ত চালাক লোক। তার লোক এখানে পাঠিয়ে ধরা পড়ার ঝুঁকি নেবে না।’
‘তাহলে?’
‘আমাদের এফ.বি.আই-এর আটজন লোক ধরা পড়েছে।’
‘জেনারেল শ্যারণের ভাড়া করা?’
‘বলতে পারেন’
‘আর টেলিফোনের কথা ফাঁসের ব্যাপারটা?’
‘ডিউটি অফিসার ম্যাগগিল স্বীকার করেছে ফাঁস করার দায়িত্ব। কিন্তু সিকিউরিটি অফিসার হারমান হেইঞ্জের ধারণা আমাদের মনিটরিং ও কম্যুনিকেশন সেলেও ভূত থাকতে পারে।’
‘আমি আশ্চর্য হচ্ছি মিঃ জর্জ আব্রাহাম ইহুদী স্বার্থের কাছে এফ.বি.আই-এর মত প্রতিষ্ঠানও এত ভঙ্গুর!’
‘আপনার অভিযোগ সত্য, ওরা বিরাট দোষণীয় কাজ করেছে এটাও সত্য, কিন্তু নিশ্চয় দেশপ্রেম থেকেই ওটা করেছে বলে মনে করছে। এ রকমই তাদের বুঝানো হয়েছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘দেশপ্রেমের কাজ হলো কেমন করে?’
‘এ তথ্যটা আপনিও দিলেন। ব্যাপারটা এই রকম, সৌদি সরকারের চাপ পড়েছে মার্কিন সরকারের উপর আহমদ মুসাকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেবার জন্যে। এই চাপে আমি এফ.বি. আই চীফ বুঝাপড়ার মাধ্যমে ব্যাপারটা সেটেল করার জন্য আহমদ মুসাকে ডেকেছি আজ সন্ধ্যা ৬টায়। এই আলোচনার পর আহমদ মুসা অভিযোগ থেকে মুক্ত হয়ে যাবেন। সুতরাং দেশপ্রেমিকরা আগেই আপনাকে কিডন্যাপ করে আপোষ রফা বানচাল করতে চেয়েছে। কিডন্যাপ করার পর তারা আহমদ মুসাকে তুলে দেবে ইহুদী গোয়েন্দা বিভাগের হাতে। প্রচার করা হবে যে, ইহুদী গোয়েন্দারা মার্কিন সরকারের অজান্তে আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করে আমেরিকার বাইরে নিয়ে গেছে। অতএব এতে মার্কিন সরকারকে দোষ দেয়া যাবে না। এতে দুই লাভ দেশপ্রেমিকরা দেখেছে। এক, আহমদ মুসাকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়া বন্ধ করা গেল, দুই, মার্কিনীদের বিশেষ বন্ধু ইহুদীদের একটা বড় উপকার হলো। এ রকম বুঝ যদি কেউ পায়, তাহলে কোন আমেরিকান এতে সম্মত হবে না বলুন?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘যেভাবে যুক্তি দিলেন, তাতে মনে হচ্ছে আপনিও ঐ দেশপ্রেমিকদের একজন।’
‘অবশ্যই, তবে আমি আপনাকে গ্রেফতার করে ইহুদীদের হাতে তুলে দেব না, সোপর্দ্দ করব আপনাকে মার্কিন আইনের হাতে। নির্দোষ হলে ছাড়া পেয়ে যাবেন।’
বলে জর্জ আব্রাহাম আবার ইন্টারকম অন করল। ওপার থেকে কথা বলে উঠল হারমান হেইঞ্জ।
জর্জ আব্রাহাম তাকে নির্দেশ দিল, ‘টেলিফোনের কথা ফাঁস করার সাথে আর কে জড়িত, তার তদন্ত তুমি চালিয়ে যাও। আর যে আটজনকে গ্রেফতার করেছ, তাদের বিরুদ্ধে বাইরের সাথে অবৈধ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিরুদ্ধ যোগাযোগ, অবাধ্যতা এবং অফিস-শৃংখলা ভংগের অভিযোগ রেকর্ড কর এবং ডিপার্টমেন্টাল প্রসিকিউশন বিভাগে পাঠিয়ে দাও। আর ওদের ডিপার্টমেন্টাল সেলে বন্দী রাখ। ধন্যবাদ।’
ইন্টারকম অফ করে জর্জ আব্রাহাম ঘুরে বসল আহমদ মুসার দিকে, হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘ঠিক ৬টা, আপনার সাথে সাক্ষাতের সময় এটা। এখন বলুন, আমি আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি?’
‘জনাব আমি কিছু বলার আগে আপনাদের কলিনস কোথায় জানতে চাচ্ছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের এফ.বি.আই এজেন্ট কলিনস?’
‘জি, হ্যাঁ।’
‘সে হেড কোয়ার্টারেই আছে। কেন বলুন তো?’
‘ওয়াশিংটনের গ্রীন ভ্যালিতে তিনি জেনারেল শ্যারন ও গোল্ড ওয়াটারের সাথে ছিলেন না?’
‘ছিল। অফিসের নির্দেশেই সে ওদের সাথে ছিল।’
‘তিনি কি ওদের সাথে নিউ মেক্সিকোতে গিয়েছিলেন না?’
‘গিয়েছিলেন। সেটাও অফিসের নির্দেশেই।’
‘তিনি নিউ মেক্সিকোর কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন, কি করেছিলেন, ইত্যাদি রিপোর্ট নিশ্চয় দিয়েছেন?’
‘দিয়েছে। সে নিউ মেক্সিকোতে গিয়ে সব সময় ওদের সাথে ছিল না। সবুজ পাহাড়ে যাওয়ার পরদিন সে ওয়াশিংটন ফিরে এসেছে।’
‘দু’এক মিনিটের জন্য তাঁকে ডাকতে পারেন?’
‘অবশ্যই। কিন্তু তাকে কি দরকার?’
‘আমার অনুরোধ স্যার।’
‘আচ্ছা ডাকছি।’
বলে জর্জ আব্রাহাম ইন্টারকমে নির্দেশ পাঠাল কলিনসকে এখনি তার কাছে পাঠাবার জন্যে।
দু’মিনিটের মধ্যে কলিনস এসে হাজির হলো। সে আহমদ মুসাকে দেখে বিস্মিত হলো না। অর্থাৎ আহমদ মুসা আসবে, এসেছে সে জানে।
‘জনাব, আমি মিঃ কলিনসকে দু’একটা প্রশ্ন করব। জর্জ আব্রাহামকে লক্ষ্য করে বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
আহমদ মুসা কলিনসের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘মিঃ কলিনস কোন তারিখ কতটার সময় আমাকে বন্দী ও আহত অবস্থায় সবুজ পাহাড়ে আপনাদের সামনে হাজির করা হয়েছিল?’
‘গত ২১ তারিখ সকাল ১০টায়।’ বলল কলিনস।
‘সবুজ পাহাড়ের ঐ সিনাগগ কমপ্লেক্সের অন্ধকুপে নিয়ে আমাকে বন্দী করা হয়েছিল কয়টায়?’
‘সোয়া দশটা হবে তখন।’ একটু চিন্তা করে বলল কলিনস।
‘২১তারিখ গোটা দিন তো আপনিও সবুজ পাহাড়ে ছিলেন তাই না?’
‘ছিলাম।’
‘সবুজ পাহাড়ের বন্দীখানার অন্ধকূপ থেকে আমি পালিয়েছি এমন কথা সবুজ পাহাড়ের কারও কাছে আপনি শুনেছিলেন?’
‘না শুনিনি।’
কলিনসের কথা শেষ হলে, আহমদ মুসা জর্জ আব্রাহামকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘জনাব কলিনসকে জিজ্ঞেস করা আমার শেষ।’
কলিনস চলে গেলে আহমদ মুসা জর্জ আব্রাহামকে বলল, ‘লস আলামোস স্ট্রাটেজিক রিসার্চ ল্যাবরেটরীতে কোন তারিখে কতটার সময় আমাকে দেখা যায় বলে রিপোর্ট এসেছে জনাব?’
‘গত মাসের ২১ তারিখ বেলা ৩টার দিকে।’
‘জনাব আমি সবুজ পাহাড়ে বন্দী হলাম সোয়া দশটায়, আর বেলা ৩টার দিকে আমাকে দেখা গেল লস আলামোস গবেষণাগারে, এটা কেমন করে হয়? এ নিয়ে আপনারা ভেবেছেন?’
‘বিষয়টা নিয়ে আমরা ভেবে দেখিনি। আর এ সময়ের হিসাব দিয়ে কিন্তু প্রমাণ করা যাবে না যে, আপনি লস আলামোসে আসেননি। এসেছেন এটা বাস্তবতা।’
‘এ বাস্তবতা আমি অস্বীকার করছি না, আমি তো টেলিফোনেই আপনাকে জানিয়েছি, ঘটনা সত্য কিন্তু অভিযোগ সত্য নয়।’
‘ঘটনা সত্য হলে অভিযোগও সত্য হবে এটাই ঠিক, আর যদি আপনার কথা সত্য হয় তাহলে আর সময় নষ্ট না করার জন্য অনুরোধ করছি।’ জর্জ আব্রাহামের কন্ঠ নিরস ও কঠোর শুনাল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমার কথা শুরুই হয়নি জনাব।’
জর্জ আব্রাহামের চোখ যেন একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘আমিও তাই আশা করি। বলুন।’
‘ঘটনা সত্য হলে অভিযোগও সব সময় সত্য হবে এটা ঠিক নয় আমি সে কথা বলার জন্যেই আপনার কাছে এসেছি।’
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। পরে আবার শুরু করল, ‘আপনি কি জন জ্যাকবকে চেনেন?’
‘বিজ্ঞানী জন জ্যাকব?’
‘জি, ইহুদী বিজ্ঞানী জন জ্যাকব।’
‘হ্যাঁ, খুব ভাল করে চিনি। তিনি দেশের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতীয় পুরস্কার ‘সান অব দি নেশন’ তাঁকে দেয়া হয়েছে।’
‘তিনি কি লস আলামোসের বিজ্ঞানী ছিলেন?’
‘না। আমেরিকার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। ব্যক্তিগত গবেষণা ছিল তার সবচেয়ে বড় কাজ।’
‘লস আলামোসের সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল কি?’
‘ছিল না।’
‘এখন সবুজ পাহাড়ের কারো সাথে লস আলামোসের কোন সম্পর্ক আছে বা সেখানকার কেউ কি লস আলামোসে আসা যাওয়া করে?’
‘না। এদিনও লস আলামোসে গিয়ে বিষয়টা সম্পর্ক জেনে এসেছি। লস আলামোসে আসা যাওয়ার সম্পর্ক বাইরের কারো নেই। সেখানকার বিজ্ঞানী ও কলাকুশলী এবং মুষ্টিমেয় সাধারণ কর্মচারী সবাই লস আলামোসের বাসিন্দা। তারা সবাই বাহির থেকে বিচ্ছিন্ন। শুধুমাত্র ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে তাঁদের সাক্ষাতের অনুমতি আছে। তাও লস আলামোসের বাইরে গিয়ে।’
‘আচ্ছা, লস আলামোসের বৈজ্ঞানিক তথ্য কখনও চুরি গেছে বা বৈজ্ঞানিক তথ্য কোনভাবে খোয়া যাবার ঘটনা ঘটেছে কিনা?’
‘না। চুরি বা খোয়া যাবার ঘটনা কখনও ঘটেনি। তবে বৈজ্ঞানিক ডাটা ব্যাংকের ইউজ রেজিস্টার এবং কম্পিউটারের নিজস্ব মেমোরি রেজিস্টার-এ দুয়ের মধ্যে একটা অসংগতি দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। একে রেকর্ড এরর হিসাবে দেখা হচ্ছে।’
বলে একটু থেমেই জর্জ আব্রাহাম জিজ্ঞেস করল অবাক হয়ে, ‘এসব দিয়ে আপনার কি কাজ আহমদ মুসা। আপনি নিজের কথা বলুন।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আচ্ছা জনাব আপনি কলিনসের কাছে শুনলেন, সবুজ পাহাড়ের বন্দীখানার অন্ধকূপ থেকে সেই ২১ তারিখের গোটা দিন আমার পালানোর কথা আপনি শুনেননি, তাহলে বেলা ৩টায় আমাকে লস আলামোসে দেখা গেল কি করে, এটা কি আপনার মনে বড় প্রশ্নের সৃষ্টি করছে না? কলিনসসহ সবুজ পাহাড়ের সবাই জানে আমি সবুজ পাহাড় থেকে পালাইনি, তাহলে ৩টার দিকে লস আলামোসে গেলাম কি করে?’
জর্জ আব্রাহামের কপাল কুঞ্চিত হলো, তীক্ষ হলো তার চোখ। বলল, ‘বুঝতে পারছি আহমদ মুসা, এ বিষয়টার প্রতি আপনি খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এখানে নিশ্চয় বড় ঘটনা আছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, সেটা কি হতে পারে।’
আহমদ মুসা আবারও হাসল। বলল, ‘আচ্ছা জনাব, আমি যদি বলি বৈজ্ঞানিক জন জ্যাবক প্রতিদিন লস আলামোসে সবার অলক্ষ্যে আসতেন, আপনি তা বিশ্বাস করবেন?’
স্প্রিংয়ের মত লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল জর্জ আব্রাহাম জনসন। চোখে মুখে তার উত্তেজনা, দৃষ্টি বিস্ফোরিত। বলল, ‘তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন, সবুজ পাহাড় থেকে লস আলামোস পর্যন্ত সুড়ংগ পথ আছে?’ কথা তার অনেকটা আর্তচিৎকারের মত শুনাল।
‘বলতে চাচ্ছি নয়, বলছি, সবুজ পাহাড়ের অন্ধকূপ থেকে একটি সুড়ঙ্গ পথ লস আলামোসের কম্পিউটার রুমে গিয়ে উঠেছে। আমি অন্ধকূপ থেকে বের হতে গিয়ে ঐ সুড়ঙ্গ পথে নিজের অজান্তেই গিয়ে উঠেছিলাম লস আলামোসে।’
ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘তাহলে বিজ্ঞানী জন জ্যাবক ঐ সুড়ঙ্গ পথে লস আলামোসে যেতেন, পাচার করে নিয়ে যেতেন সব বৈজ্ঞানিক তথ্য।’ কান্নার মত শুনাল তার কন্ঠ। উদ্বেগ আতঙ্কে মুখ চুপসে গেছে।
‘আমি তাই মনে করি জনাব।’
‘এখনও তো পাচার চলছে।’
‘আমার মনে হয় জন জ্যাবক এই পথের সন্ধান কাউকে দিয়ে যাননি, অথবা দিয়ে যাবার সময় পাননি।’
‘কিন্তু আগের এক প্রশ্নে সবুজ পাহাড় ও লস আলামোসের মধ্যে কারও যাতায়াত আছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন? এখন বুঝছি এ প্রশ্নের অর্থ হলো সবুজ পাহাড় ও লস আলামোসে এখনও যাতায়াত আছে বলে মনে করেন? তার মানে পাচার এখনও চলছে কোন পথে, ঐ সুড়ঙ্গ পথ ছাড়া?’
‘আমার মনে হয় অন্ধকূপের সুড়ঙ্গ পথের খবর সবুজ পাহাড়ের এখনকার লোকেরা জানে না। জানলে ঐ অন্ধকূপে ওরা আমাকে বন্দী করতে সাহস পেত না। তবে অন্য পথে তথ্য পাচার হয়ে যাচ্ছে ঐ সবুজ পাহাড়ে , তা শুধু আমার অনুমান নয়। কিছু প্রমাণও আমার হাতে আছে।’
নতুন করে চমকে উঠল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘আমাকে দয়া করে দেখাতে পারেন।’ বিনীত কন্ঠ জর্জ আব্রাহামের।
আহমদ মুসা পকেট থেকে বের করে হিব্রুতে ‘used, destroy’ লেখা সেই ছোট কার্টনটি তুলে দিল জর্জ আব্রাহামের হাতে।
জর্জ আব্রাহাম জনসন কার্টুনটির হিব্রু লেখা পড়ে, উলটে পালটে দেখে খুলল কার্টনটি। ভেতরে একই মাপের চিরকুটগুলোর উপর চোখ বুলাল সে গম্ভীর অভিনিবেশ সহকারে।
জর্জ আব্রামের মুখ উদ্বেগে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। ঠোঁট দুটি তার দারুণ শুকনো।
এক সময় চিরকুটগুলো থেকে চোখ তুলল এবং পাশের র‍্যাক থেকে বিশেষ সাইজের একটা মোবাইল তুলে দ্রুত কোথায় যেন টেলিফোন করল।
সঙ্গে সঙ্গে ওপার থেকে সাড়াও পেয়ে গেল। বলল, ‘ডঃ হাওয়ার্ড বলছি।’
ডঃ হাওয়ার্ড ‘লস আলামোস ল্যাবরেটরী অব স্ট্রাটেজিক রিসার্চ’- এর প্রধান।
জর্জ আব্রাহাম জনসন নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘ডঃ হাওয়ার্ড আমি কম্পিউটার চিরকুটের কিছু ডাটা পড়ছি, আপনি নোট করুন এবং আমাকে বলুন যে, এগুলো কোন ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট বা ইনফরমেশন কিনা।’
বলে জর্জ জনসন কার্টন থেকে পাওয়া চিরকুটের ডাটাগুলো গড়গড় করে পড়ে গেল।
অর্ধেক পড়া হতেই ওপার থেকে ডঃ হাওয়ার্ডের আর্তকন্ঠ শোনা গেল। বলল, ‘থামুন স্যার। বলুন এগুলো কোথায় পেলেন? এগুলো আমাদের ফিফথ জেনারেশন এস.ডি.আই (স্ট্রাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ) ক্ষেপনাস্ত্রের সদ্য আবিষ্কৃত অত্যন্ত টপসিক্রেট ডাটা। কোথায় পেলেন আপনি এগুলো? এগুলোর একটা বর্ণও এখনও আমাদের গবেষণাগারের বাইরে যায়নি।’
‘গেছে মিঃ হাওয়ার্ড। না হলে আমি জানলাম কি করে?’ বলল জর্জ আব্রাহাম। তার কন্ঠ শুকনো ও কম্পিত।
‘স্যার, ডাটাগুলো যদি কম্পিউটার পেপার চিপসে থাকে, তাহলে সে চিপস জলছাপে তারিখ থাকবে। আপনি দয়া করে একটা চিপস আলোর সামনে ধরে তারিখটা দেখুন।’ ওপার থেকে বিনীত কন্ঠে বল ডঃ হাওয়ার্ড।
সঙ্গে সঙ্গে জর্জ আব্রাহাম টেলিফোন এক হাতে রেখে অন্য হাতে একটা চিরকুট আলোর সামনে ধরে একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বলল, ‘হ্যাঁ ডঃ হাওয়ার্ড। তারিখটা হলো গত মাসের ১১ তারিখ।’
‘তার অর্থ হলো, ঐ ১১ তারিখে আমাদের সিক্রেট কম্পিউটার কেবিন থেকে ঐ ডাটাগুলো পাচার হয়েছে। আমি এদিকে দেখছি স্যার। কোন নির্দেশ আমার প্রতি?’ বলল ডঃ হাওয়ার্ড। ভীত তার কন্ঠস্বর।
‘না ডঃ হাওয়ার্ড, এখন কাউকে কিছু বলা বা জিজ্ঞাসাবাদ করার দরকার নেই। শুধু একতলার কম্পিউটার কক্ষে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করুন।’
‘ইয়েস স্যার।’
‘ধন্যবাদ ডঃ।’
বলে টেলিফোন রেখে দিল জর্জ আব্রাহাম জনসন। সে ফিরল আহমদ মুসার দিকে।
উদ্বেগ উত্তেজনায় আচ্ছন্ন তার মুখ। বলল সে, ‘মিঃ আহমদ মুসা, বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের মৃত্যুর পরও তথ্য পাচার অব্যাহত আছে। আপনি কি মনে করেন, সেটা সুড়ঙ্গ পথে নয়?’
‘আমি তাই মনে করি। আমার বিশ্বাস লস আলামোসে এমন কেউ আছে,সে মাঝে মাঝে সবুজ পাহাড়ে যায়। সে-ই এ তথ্য পাচার করছে।’
‘আপনার এ বিশ্বাসের কারণ?’ জিজ্ঞেস করল জর্জ আব্রাহাম।
‘আমি যার গাড়িতে সবুজ পাহাড়ে গিয়েছিলাম তার কাছেই একটা গল্প শুনেছি। সে এক বিজ্ঞানীকে লিফট দিয়েছিল এস্পানোলা থেকে লস আলামোসে। সে ফেরার পথে লস আলামোসের বাইরে একটা ঝোপের আড়াল থেকে লস আলামোসের ইউনিফরম পরে একজন লোক উঠেছিল তার গাড়িতে। উঠেই সে ইউনিফরম খুলে ফেলেছিল। তাকে ড্রাইভার নামিয়ে দিয়েছিল সবুজ পাহাড়ে।’
ভয়, উদ্বেগ, উত্তেজনায় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে জর্জ আব্রাহাম জনসনের মুখ। টেবিলে রাখা তার হাতটি যেন কাঁপছে।
আহমদ মুসা কথা শেষ করলেও জর্জ আব্রাহাম কোন কথা বলল না। মূর্তির মত স্থির বসে। ভাবছিল সে।
হঠাৎ সে সচল হয়ে উঠল। হাতে নিল ছোট একটা সাদা টেলিফোনের রিসিভার।
সাথে সাথেই রিসিভারে কন্ঠ শোনা গেল, ‘আমি কমান্ডার জন লিংকন।’
‘শোন, তোমার কজন লোককে নির্দেশ দাও তারা যেন ইহুদী গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শ্যারনের উপরে তার অলক্ষ্যে সর্বক্ষণ নজর রাখে। আর নিউ মেক্সিকোয় তোমার লোকদের বলে দাও তারা যেন গোপনে সবুজ পাহাড়ের উপর নজর রাখে। কেউ সেখানে ঢুকলে আপত্তি নেই, কিন্তু কেউ বের হয়ে গেলে তাকে গোপনে ধরে রাখবে। এখন এ পর্যন্তই।’
রেখে দিল টেলিফোন জর্জ আব্রাহাম। দ্রুত টেনে নিল আরেকটি টেলিফোন। ক্রাডল থেকে রিসিভার তুলে নিতেই ওপার থেকে কন্ঠ শোনা গেল। ‘এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।’
এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার সি.আই.এ প্রধান।
‘আমি জর্জ আব্রাহাম জনসন। নিরাপত্তা বিষয়ক খুবই জরুরী ব্যাপার। পরামর্শের জন্যে আপনার একটু সময় চাই। ঘন্টা খানেকের জন্যে কি আসতে পারেন, এখনি?’
‘আপনি যখন জরুরী বলছেন, তখন তো আর দেরী করা যায় না মিঃ জর্জ। আসছি।’
‘ধন্যবাদ, এ্যাডমিরাল।’
বলে হাতের রিসিভারটা ক্র্যাডেলে রেখে দিয়ে পাশের অন্য একটা টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল জর্জ আব্রাহাম।
সাথে সাথেই রিসিভারে ভেসে এল ওপারের কন্ঠ। বলল, ‘শেরউড বলছি।’
জেনারেল শেরউড পেন্টাগনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক চীফ।
জর্জ আব্রাহাম যে কথা এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারকে বলেছিল সে কথাই বলল জেনারেল শেরউডকে। জেনারেল শেরউডও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের মত রাজী হয়ে গেল।
বিশ মিনিটের মধ্যেই ওরা পৌছে গেল। এফ.বি.আই হেড কোয়ার্টারে।
ওদের মিটিং বসল জর্জ আব্রাহাম জনসনের মিটিং রুমে।
জর্জ আব্রাহাম আহমদ মুসাকে নিজের বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে গিয়ে রেস্ট নিতে বলে চলল মিটিং-এ যোগ দেবার জন্য। কক্ষ থেকে বের হবার আগে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা মিটিং-এ আপনাকেও প্রয়োজন হতে পারে।’
চলে গেল জর্জ আব্রাহাম।
আহমদ মুসা ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। আলস্য এসে দেহটাকে তার ঘিরে ধরল। কিন্তু মাথা রইল সক্রিয়।
ভাবল সে, জর্জ আব্রাহামের এ মিটিংটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আহমদ মুসা জানে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয় সম্মিলিতভাবে দেখার জন্যে আমলা পর্যায়ের একটা শীর্ষ কমিটি আছে। সে কমিটির নাম ইন্টারন্যাল সিচুয়েশন টিম (আই.এস.টি)। সে কমিটির ৩জন সদস্য এফ.বি.আই চীফ, সি.আই.এ চীফ এবং পেন্টাগনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চীফ। এই টিমেরই বৈঠক বসেছে এখন। টিমের চেয়ারম্যান এফ.বি.আই চীফ জর্জ আব্রাহাম।
আহমদ মুসা মনে মনে খুশি হলো। লস আলামোসের বিষয়টাকে নিশ্চয় জর্জ আব্রাহাম টপ প্রায়োরিটি দিয়ে দেখেছে। না হলে এত দ্রুত আই.এস.টির মিটিং তিনি ডাকতো না।
টীম এ সমস্যাকে কিভাবে নেবে? জানাজানি তো হবেই। ইহুদী লবী একে কিভাবে গ্রহণ করবে? ইত্যাদি হাজারো চিন্তায় যখন আহমদ মুসা ডুবে গেছে, তখন দরজায় এসে দাড়াল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘এক্সকিউজ মি, আহমদ মুসা।’
আহমদ মুসা চমকে উঠে মুখ তুলে তাকাল জর্জ আব্রাহামের দিকে। ‘মিঃ আহমদ মুসা, আমাদের মিটিং-এ যোগ দেবার জন্যে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি আপনাকে।’
‘ধন্যবাদ।’
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
জর্জ আব্রাহাম হাঁটতে শুরু করল। সাথে সাথে আহমদ মুসাও।
আহমদ মুসা মিটিং রুমে প্রবেশ করতেই ঘরের অন্য দুজন, জেনারেল শেরউড ও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল।
আহমদ মুসা বসলে সবাই বসল।
‘মিঃ আহমদ মুসা, আমাদের ইন্টারন্যাল সিচুয়েশন টীমের পক্ষ থেকে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অত্যন্ত মূল্যবান একটি তথ্য আপনি আমাদের দিয়েছেন। আমাদের টীম সদস্যরাও আপনার সাথে কথা বলতে চান। আপনার সহযোগিতা আমরা চাই।’ এই ভাবে প্রথমে কথা শুরু করল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
কথা শেষ করেই জর্জ আব্রাহাম আহমদ মুসাকে সি.আই.এ চীফ ও পেন্টাগনের অভ্যন্তরীণ চীফের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
জর্জ আব্রাহাম থামতেই সি.আই.এ চীফ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার বলে উঠল, ‘ওয়েলকাম আহমদ মুসা। ঘটনাচক্রে যে অকল্পনীয় কিছু ঘটতে পারে, আপনার সাথে আমাদের এই সাক্ষাত তার একটা প্রমাণ। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই আনন্দবোধ করছি।’
একটু থামল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার। সোফায় সোজা হয়ে বসল। তারপর বলল, ‘হিব্রু লেখা ক্যাপসুল আপনি কোথায় পেয়েছিলেন আহমদ মুসা?’
‘যে ঘরে অন্ধকূপে নামার লিফট রুম, সেই ঘরে। সে ঘরের প্রায় চারদিকে র‍্যাক সাজানো। সে র‍্যাকগুলো ছোট বড় কার্টনে প্রায় ভর্তি। হাত পা বাঁধা অবস্থায় আমাকে ওরা সেই ঘরের মেঝেতে ছুড়ে ফেলেছিল। একটা র‍্যাকের সাথে আমি ধাক্কা খেয়েছিলাম। সে ধাক্কাতেই একটা কার্টুন পড়ে গিয়েছিল। কার্টুনের গায়ে হিব্রু লেখাটি পড়ে আমি আগ্রহী হয়ে ওটা তুলে নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আপনার হাত পা বাঁধা ছিল।’ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
‘আমি কার্টুনটির উপর শুয়ে পড়েছিলাম এবং পিছন থেকে হাতে তুলে নিয়েছিলাম কার্টুনটি। পরে তা পকেটে পুরেছিলাম।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অন্ধকূপের তলায় সুড়ঙ্গ পথ আছে, যা আপনার চোখে পড়ল তার সন্ধান সবুজ পাহাড়ের কেউ বর্তমানে জানে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য?’ বলল জেনারেল শেরউড।
‘এ প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। তবে আমি মনে করি, সুড়ঙ্গ পথের সন্ধান তারা জানলে আমাকে ওখানে বন্দী করে রাখতো না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এমনও তো হতে পারে, তারা জেনেশুনেই আপনাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল মার্কিন সরকারের ট্র্যাপে আটকাবার জন্যে।’ বলল সি.আই.এ চীফ।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমাকে তারা হাতের মুঠোয় পাবার পর মার্কিনীদের হাতে তুলে দেবার ব্যাপারটা একেবারেই অযৌক্তিক। দ্বিতীয়ত আমাকে ট্র্যাপে ফেলে তাদের সর্বনাশ তারা ডেকে আনতে পারে না।’
জর্জ আব্রাহাম, জেনারেল শেরউড ও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার তিনজনই হাসল। বলল সি.আই.এ চীফ, ‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আমরাও এভাবেই ভাবছি। কিন্তু বলুন তো, লস আলামোসের ঘটনায় ইহুদীরা জড়িত হবার ঘটনা প্রকাশ পেলে ইহুদীদের সর্বনাশ হবে কেন?’
আবারও হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এটা আমার দৃষ্টিকোণ, মার্কিন দৃষ্টিকোণ থেকে আলাদাও হতে পারে। মার্কিন রাজনীতি ইহুদীদের অনেক কিছুই হজম করছে, এটাও হজম হয়ে যেতে পারে।’
হাসল সি.আই.এ চীফ।
কিন্তু পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘রাজনীতির কথা বাদ দিন। আমরা রাজনীতিক নই। আমরা আপনার সাহায্য চাই আহমদ মুসা।’
‘বলুন, কি সাহায্য?’
এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার জর্জ আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলুন মিঃ জর্জ।’
‘আমরা সবুজ পাহাড়ে যেতে চাই। আমরা সুড়ঙ্গ দেখতে চাই। যতটা পারা যায় গোয়েন্দাগিরীর আলামত হাত করতে চাই। আমরা চাই, আপনি আমাদের সাথে থাকুন। আমরা বুঝতে পেরেছি, সুড়ঙ্গটা গোপন রাখা হয়েছে। আপনার সাহায্য দরকার হবে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘আমি সুড়ঙ্গ দিয়ে পালিয়েছি, এটা তারা জেনে গেলে গোয়েন্দাগিরীর আলামত সব তারা ধ্বংস করে ফেলবে। তারা এটা জানতে পেরেছে বলে আপনারা মনে করেন?’
জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার ও জেনারেল শেরউড পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। কথা বলল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘জেনারেল শ্যারনের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তারা এটা জানে না। আপনি তাদের কাছে এখনও বিস্ময়।’
‘এরপরও সবুজ পাহাড় থেকে বন্দী পালানোর পর ওখানকার ব্যপারে তারা সাবধান হতে পারে। তবু সম্ভাবনা আছে। তবে অভিযানটা দ্রুত ও আকস্মিক হতে হবে।’
‘আপনার কিছু পরামর্শ আছে আহমদ মুসা?’ বলল সি.আই.এচীফ।
‘এ পর্যন্ত কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সবুজ পাহাড় থেকে কোন মানুষ বা কিছু বাইরে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কেউ বাইরে বেরুলে তাকে গোপনে আটকাতে বলা হয়েছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘কিভাবে আপনারা সবুজ পাহাড়ে ঢুকবেন মনে করছেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘যতটুকু খবর এসেছে, ওখানে প্রতিরোধের জোরদার কোন ব্যবস্থা নেই। আমাদের গোয়েন্দা ও পুলিশরা যদি যায়, ওরা আপনাতেই আত্মসর্ম্পণ করবে। আমরা একে কঠিন কোন ব্যাপার মনে করছি না।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘আমিও তাই মনে করি। কিন্তু সবুজ পাহাড়ে পুলিশ ঢুকেছে, এটা জানতে পারার পর পাঁচ মিনিট সময়ও যদি পায় তাহলে ওরা প্রয়োজনীয় কম্পিউটার ডকুমেন্টসহ অন্যান্য প্রমাণাদি ধ্বংস করতে পারে।’
‘ঠিক বলেছেন আহমদ মুসা। এতটুকু সময়ও তাদের দেয়া যাবে না।’
বলে একটু থেমে একটু চিন্তা করে আবার সে বলল, ‘আকস্মিক হামলায় কমান্ডোরা যদি সবুজ পাহাড় কমপ্লেক্স দখল করে নেয়?’
‘এতেও ঝুকি কিছুটা থেকে যায়। আমার মনে হয়, ট্যুরিস্ট বা ইহুদী প্রতিনিধি হিসাবে ছদ্মবেশে সবুজ পাহাড়ে ঢুকে একই সাথে ওদের কাবু করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মিঃ আহমদ মুসা। খুব ভাল একটা প্রস্তাব। আমরা ভেবে দেখব।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
‘তবে আমার মনে হয় মিঃ এ্যাডমিরাল, সবুজ পাহাড়টা হলো ওদের গ্রহণ ও প্রেরণ কেন্দ্র। এমন জায়গায় কখনই বেশি কিছু পাওয়া যায় না। খুব বেশী হলে যে ক্যাপসুল আমি দিয়েছি, ঐ ধরনের আলামত এখনও বিনষ্ট করা হয়নি। এখনও ঐ ধরনের ক্যাপসুল পাওয়া যেতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে আপনি অংগুলি সংকেত করেছেন আহমদ মুসা। এদিকটা আমরা এখনও ভাবিইনি।’ কথা শেষ করে দেহটা সোফায় হেলান দিল। তারপর জর্জের দিকে চাইল। বলল, ‘জর্জ, এদের তথ্য পাচারের গন্তব্য সম্পর্কে কি কোন চিন্তা করেছেন?’
‘অবশ্যই সেটা করতে হবে। আমরা এ বিষয়টা পরে দেখব। আমার মনে হয়, নিউ মেক্সিকোর সবুজ পাহাড় যেমন উৎস কেন্দ্র তেমনি ওদের নিশ্চয় একটা প্রধান ট্রানজিট কেন্দ্র আছে। সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘ডিউটি অফিসার ম্যাগগিলের কাছে কিছু জানা গেল?’ জিজ্ঞেস করল জেনারেল শেরউড।
‘আগে যেটা বলেছি, সেটাই। ষড়যন্ত্রের কথা জানা গেছে, লিংকম্যানের পরিচয় পাওয়া গেছে এবং আমাদের এখানকার তার আরও কিছু সহযোগীর বিষয়ে জানা গেছে।’ জর্জ আব্রাহাম।
‘আমার মনে হয় সবুজ পাহাড় আগে আপনারা দেখুন। লস আলামোসেও আপনাদের যেতে হবে। তারপর করণীয় ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
‘আহমদ মুসা আপনাকে আমরা অবিশ্বাস করছি না। দেখতে যাচ্ছি, সেটা অপরিহার্য একটা রুটিন ডিউটি।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
‘এখনি আমরা সবুজ পাহাড়ে যাত্রা করতে চাই, দয়া করে আপনাদের পরামর্শ বলুন।’ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার ও জেনারেল শেরউডের দিকে চেয়ে বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক। আপনি সব ব্যবস্থা করুন। ততক্ষণে আমরা আর একটু তৈরী হয়ে আসি বাসা থেকে।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
‘ঠিক আছে। আমারও একটু বাসায় যেতে হবে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
উঠে দাঁড়াল জর্জ আব্রাহাম। উঠে দাঁড়াল ওরা দুজনও। আহমদ মুসাও।
জর্জ আব্রাহাম এ্যাডমিরাল ও জেনারেলের সাথে হ্যান্ডশেক করে ওদের বিদায় দিল।
পরে আহমদ মুসাকে বলল, ‘আপনি আমার সাথে আমার বাসায় যাবেন, নিশ্চয় কোন অসুবিধা নেই?’
‘না নেই।’ বলল আহমদ মুসা
ঠোঁটে হাসি আহমদ মুসার। দুজনেই বেরোল ঘর থেকে।

‘ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারছেন মিঃ গোল্ড ওয়াটার? জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার ও জেনারেল শেরউড অস্বাভাবিক ধরনের তাড়াহুড়া করে নিউ মেক্সিকো গেলেন কেন?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠ জেনারেল শ্যারনের।
‘কিছু বুঝছি না। কালকের সন্ধ্যার ঘটনার সাথে এর কি কোন সম্পর্ক আছে?’ চিন্তান্বিত কন্ঠে বলল গোল্ডওয়াটার।
‘গতকালকের ঘটনা তো পরিষ্কার। এফ.বি.আই হেড কোয়াটারের ডিউটি অফিসার ম্যাগগিল শেখ আবদুল্লাহ আলী ও আহমদ মুসার সাথে জর্জ আব্রাহামের এ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যাপার আমাদের কাছে ফাঁস করে দেয়ার অপরাধে গ্রেফতার হয়েছে। এ নিয়ে জর্জ আব্রাহামের সাথে কথা বলেছি। তাকে বলেছি এ ধরনের ফাঁস করে দেয়ার ঘটনা অফিস শৃঙ্খলার বিরোধী, কিন্তু নতুন নয়। এ ধরনের ঘটনা অতীতেও ঘটেছে, কিন্তু এভাবে গুরুতর অপরাধ হিসাবে কোন সময়ই দেখা হয়নি। তিনি একথার কোন স্পষ্ট জবাব দেননি। আমিও তাকে আর কিছু বলিনি। বললে আরও পরে বলব, একজন আমলাকে তেল মাখানোর কোন প্রয়োজন নেই।’
‘আহমদ মুসা কি ওদের কান ভারি করেছে?’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘কি আর ভারি করবে। তার কি বলার আছে। মার্কিন সরকার, মার্কিন প্রশাসন কি ইহুদীদের কাজ সম্পর্কে তার চেয়ে বেশী জানে না।’
‘কিন্তু আমি বিস্মিত হচ্ছি আহমদ মুসার বুদ্ধি দেখে। জর্জ আব্রাহামের সাথে এ গোপন এ্যাপয়েন্টমেন্ট করার পরও বাড়তি সতকর্তা হিসাবে শেখ আবদুল্লাহ আলীর নামে আরেকটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়ার চিন্তা করেছিল কেন?’
‘এটা আহমদ মুসার একটা বৈশিষ্ট্য। পরিস্থিতির পেটে যতকথা থাকে সবই সে বুঝতে পারে। বাতাস থেকেই সে বিপদের গন্ধ পায়।’
‘আহমদ মুসার জন্য ওৎ পেতে থাকা আপনাদের দু’জন লোক গায়েব হলো কোথায়?’
‘সেটাও একটা বিস্ময়। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এফ.বি.আই গ্রেফতার করেনি। শেখ আবদুল্লাহ আলী রূপি আহমদ মুসাও ঠিক সময়ে সাক্ষাতের জন্যে এফ.বি.আই অফিসে পৌছেছে। সুতরাং সেও গায়েব করার কাজে জড়িত বুঝা যায় না।’
‘কেন আহমদ মুসার সাথে কেউ থাকতে পারে, তারা তাদের ধরে নিয়ে যেতে পারে।’
‘হ্যাঁ তা পারে। সেটা খোঁজ নেবার জন্যে বলেছি। আহমদ মুসার সাথে ওয়াশিংটনে আসা বেঞ্জামিন বেকনেরও খোঁজ নিচ্ছি আমরা।’
টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোন ধরল জেনারেল শ্যারন।
টেলিফোনে কথা শুনতে শুনতে গোল্ড ওয়াটারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু বুঝতে পারছি না গোল্ড ওয়াটার। আহমদ মুসাও নাকি গেছে জর্জ আব্রাহামদের সাথে।’
‘আহমদ মুসা গেছে ?কেন?’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘সেটাই তো কথা। তবে আমার মনে হচ্ছে, লস আলামোসের ঘটনার ব্যাপারটাই তাকে নিয়ে গেছে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘তাহলে কি বলা যায় যে, আহমদ মুসা এখন সরকারের হাতে বন্দী?’
‘এটাই স্বাভাবিক মিঃ গোল্ড ওয়াটার।’
‘তাহলে তো বলতে হয়, আহমদ মুসা গায়ে পড়ে এসে ধরা দিয়েছে। কিন্তু আহমদ মুসার জন্য এটা কি স্বাভাবিক?’
‘স্বাভাবিক নয়। কিন্তু এটাই তো ঘটেছে।’
বলল জেনারেল শ্যারন। তার কপাল কুঞ্চিত। ভাবছে সে।
কথা শেষ করেই জেনারেল শ্যারন আবার বলে উঠল, ‘অংক মিলছে না মিঃ গোল্ড ওয়াটার। আহমদ মুসা একটা গোলক ধাঁধা সৃষ্টি করেছে। মতলব কি তার?’ স্বগতোক্তির মত করেই কথা শেষ শ্যারনের।
আবারও টেলিফোন বেজে উঠল জেনারেল শ্যারনের। টেলিফোন তুলে নিল শ্যারন।
ওপারের কথা শুনেই শ্যারন বলে উঠল, ‘গুড মর্নিং, কি খবর বেন?’
ওপারের কথা শুনল জেনারেল শ্যারন। মুহূর্তেই মুখ চুপসে গেল তার। উদ্বেগ আতংকের এক অন্ধকার নেমে এল তার চোখেমুখে। বলে উঠল, ‘কিছুই তোমরা টের পাওনি? কম্পিউটার মেমরী মুছে দিতে ক’সেকেন্ড লাগে? ওরা অন্ধকূপে নেমেছে কেন?’
ওপারে দীর্ঘ কথা শুনল জেনারেল শ্যারন। শুনতে শুনতে তার মুখ মরার মত পাংশু হয়ে উঠল। টেলিফোন ধরা তার হাত কাঁপছে।
টেলিফোনে কথা শেষ হওয়ার পরও কয়েক মুহূর্ত পাথরের মত নিশ্চল হয়ে বসে থাকল জেনারেল শ্যারন।
উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে হোয়াইট ঈগল প্রধান গোল্ড ওয়াটার। বলল, ‘কি ব্যাপার জেনারেল? খারাপ কিছু ঘটেছে?’
গোল্ড ওয়াটারের কথায় প্রায় চমকে উঠার মত তাকাল জেনারেল শ্যারন।
বিমূঢ় তার চেহারা। গোল্ড ওয়াটারের প্রশ্ন সে শুনতে পেয়েছে। কি জবাব দেবে সে? প্রকৃত ঘটনা বলা যাবে না গোল্ড ওয়াটারকে। বর্ণবাদী আন্দোলন করলেও সে নিরেট আমেরিকান। এই ঘটনায় তার মত আমেরিকানরা শ্যারনদের বিরুদ্ধে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
একটু ভেবে জেনারেল বলল, ‘আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার মিঃ গোল্ড ওয়াটার।’ শুষ্ক কন্ঠ শ্যারনের।
‘কি রকম?’
‘জর্জ আব্রাহামরা আহমদ মুসাকে নিয়ে আমাদের সবুজ পাহাড় সিনাগগে অভিযান চালিয়েছে ও দখল করে নিয়েছে।’
‘কেন, সবুজ পাহাড় কেন? ওখানে কি আছে?’ বিস্মিত কন্ঠ গোল্ড ওয়াটারের।
‘অভিযানের প্রধান টার্গেট সিনাগগের কাগজপত্র ও কম্পিউটার। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আহমদ মুসার খপ্পরে পড়ে ওরা কোন ষড়যন্ত্র সাজাচ্ছে আমাদের মানে ইহুদীদের বিরুদ্ধে। গোয়েন্দাবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত আহমদ মুসা মনে হচ্ছে তার দোষ আমাদের ঘাড়ে চাপাবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে।’
‘একটা অসম্ভব কথা শুনালেন জেনারেল শ্যারন।’
‘অর্থনীতিতে সবই সম্ভব মিঃ গোল্ড ওয়াটার। মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলার অনেক মার্কিন আমলারই মাথা কিনে নিচ্ছে। আহমদ মুসা জর্জ আব্রাহামের সাথে দেখা করার কারণ নিশ্চয় বড় কিছু। নিশ্চয় বড় কোন লেন-দেনের ব্যাপার ঘটেছে।’
‘কিন্তু জর্জ আব্রাহামের সাথে সি.আই.এ চীফ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার ও পেন্টাগনের প্রধান জেনারেল শেরউড তো আছেন?’
‘তাদের হাত করা কি সিনিয়র আমলা জর্জ আব্রাহামের জন্যে কঠিন?’ বলে একটু দম নিল। বলল আবার, ‘শুনলাম ওরা অন্ধকূপেও নেমেছে।’
‘অন্ধকূপে? কেন?’
‘আমাদের লোক কিছু বলতে পারল না। আমাদের এ লোকটি কোনভাবে সরে পড়তে পেরেছে বলে টেলিফোনে খবরটা জানাতে পারল। অন্যদের সবাইকে আটক করা হয়েছে।’
‘সাংঘাতিক কথা শুনালেন জেনারেল। কিছু একটা তো করতে হয়।’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘মিঃ গোল্ড ওয়াটার আপনাদেরও আমি সাহায্য চাই। বিকালে আমি আপনার সাথে দেখা করব। এখনি আমাকে বেরুতে হবে।’ বলল কম্পিত কন্ঠে জেনারেল শ্যারন।
উঠে দাঁড়াল গোল্ড ওয়াটার যাবার জন্যে। বলল, ‘দুঃখিত জেনারেল এই অঘটনের জন্যে। আমাদের পূর্ণ সাহায্য আপনি পাবেন।’
গোল্ড ওয়াটার বেরিয়ে গেল ড্রইং রুম থেকে।
গোল্ড ওয়াটার বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সংগেই জেনারেল শ্যারন তার মোবাইল টেলিফোন হাতে নিল। প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা আলেকজান্ডার হ্যামিলনের কাছে টেলিফোন করল সে।
তার চোখ মুখ থেকে উত্তেজনা ঠিকরে পড়ছে। তার দু’চোখে ক্রুর প্রতিহিংসার আগুন।
জেনারেল শ্যারন টেলিফোনে গোটা বিষয় ব্রিফ করল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিলটনকে। সব কথা শুনে আলেকজান্ডার হ্যামিলটন বলল, ‘আমি আপনাকে আর সময় দিতে পারছি না। আমি প্রেসিডেন্টের কাছে যাচ্ছি, ডেকেছেন তিনি। আপনি নিশ্চিত থাকুন। যা করার আমি করব। যা বলার আমি বলে দেব জর্জ আব্রাহাম ও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারকে।’
প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা আলেকজান্ডারের সাথে কথা শেষ করে জেনারেল শ্যারন আরেকটা নাম্বার ডায়াল করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার তর্জনি মোবাইলের ডায়াল বাটন স্পর্শ করার আগেই টেলিফোন বেজে উঠল।
টেলিফোন ধরে ওপারের কথা শুনেই দ্রুত বলে উঠল, ‘বেনইয়ামিন তুমি? কি খবর?’ জেনারেল শ্যারনের কন্ঠে উদ্বেগ।
‘খবর খুব খারাপ স্যার। সবুজ পাহাড়ের অন্ধকূপ থেকে লস আলামোসের কম্পিউটার কক্ষ পর্যন্ত একটা সুড়ঙ্গ খুঁজে পেয়েছে ওরা। ওরা একে গোয়েন্দাগিরীর পথ বলে অভিহিত করছে।’
কথাগুলো জেনারেল শ্যারনের কানে পৌছার সঙ্গে সঙ্গেই মরার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার মুখ। কেঁপে উঠল তার শরীর। হাত থেকে খসে পড়ল টেলিফোন। শিথিল হাতেই আবার টেলিফোন তুলে নিল সে।
মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজে নিজেকে সংবরণ করল জেনারেল শ্যারন।
শক্ত হাতে চেপে ধরল সে টেলিফোন। ঠোঁট দু’টি তার শক্ত হয়ে উঠল। তীব্র হয়ে উঠল তার চোখের দৃষ্টি। বলল সে টেলিফোনে, ‘বেনইয়ামিন তুমি লস আলামোসের আউটার গেটের সামনে গিয়ে লুকিয়ে অপেক্ষা কর। ডি.এস.কিউ (ডেথ স্কোয়াড) সেখানে মানে লস আলামোসে যাচ্ছে। তাদের কি করণীয় আমি তাদের বলে দেব। তোমার করণীয় হলো যা ঘটে তার খবর পাঠানো।’
বলে টেলিফোন রেখে দিল জেনারেল শ্যারন। তার চোখ দু’টো বাঘের মত জ্বলছে। মনে তার ঝড়। সে ঝড়ের একটাই মূল কথা, ‘এখন জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার ও জেনারেল শেরউড এবং তাদের সাথে আহমদ মুসার বেঁচে থাকার অর্থ আমেরিকায় ইহুদীদের বেঁচে না থাকা।’
ড্রইং রুমে প্রবেশ করতে গিয়ে ‘বেনইয়ামিন ও লস আলামোস’ শব্দ জেনারেল শ্যারনের কন্ঠে উচ্চারিত হতে শুনে হোঁচট খাওয়ার মত থমকে দাঁড়াল সারা বেনগুরিয়ান। এক বেনইয়ামিনের নাম সে জানে। যাকে ইহুদীদের পক্ষে গোয়েন্দাবৃত্তির দায়ে কিছুদিন আগে চীন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। চীন থেকে সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে। আর লস আলামোসে একটা বড় ঘটনা ঘটেছে সেটাও সে জানে। ইহুদী গোয়েন্দা প্রধানের মুখে এই দুই নাম শোনাই তার হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়াবার কারন তার এটাই। তার মনে হয়েছে এই কথা বলা অবস্থায় ড্রইং রুমে প্রবেশ করা জেনারেল শ্যারনের জন্যে হয়ত বিব্রতকর হতে পারে। তাছাড়া সাবা বেনগুরিয়ানের মনে কৌতূহলের সৃষ্টি হলো জেনারেল শ্যারনের কথা সম্পুর্ণটা শোনার জন্যে।
সাবা বেনগুরিয়ান ইসরাইলের প্রথম প্রধান মন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ান পরিবারের সন্তান। সে ওয়াশিংটনের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আন্তর্জাতিক রাজনীতি’ বিষয়ের ছাত্রী। তার পিতা আইজাক বেনগুরিয়ান একটা ব্যাংকের মালিক। তারা সকলেই খুবই সম্মানিত। তারা মার্কিন নাগরিক হলেও নিজ জাতি ইহুদীদের প্রতি তাদের দায়িত্ব ভোলেনি। তারা ‘আমেরিকান জুইস পিপলস কমিটি’র সদস্য। এই কমিটি শুধু আন্তর্জাতিক ইহুদীবাদকে সাহায্য করা নয়, মার্কিন পলিসীকে ইহুদীমুখী রাখার জন্যেও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। মার্কিন নির্বাচনের সময় এই কমিটিই চাঁদা উঠায় এবং সুপরিকল্পিতভাবে পছন্দনীয় নির্বাচন প্রার্থীদের সহায়তা করে। জেনারেল শ্যারন সাবা বেনগুরিয়ানের আব্বা আইজ্যাক বেনগুরিয়ানের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শ্যারন ওয়াশিংটন এলে সাবাদের বাড়িতি ওঠে।
সাবা বেনগুরিয়ান জেনারেল শ্যারন টেলিফোনের বেনইয়ামিনকে যে নির্দেশ দিল তার সবটাই শুনল। শুনতে গিয়ে সে চমকে উঠল ‘জি.এস.কিউ’-কে লস আলামোসে পাঠানোর কথা শুনে। এই ‘জি.এস.কিউ’র অর্থ ইহুদী ডেথ স্কোয়াড তা বুঝতে তার দেরী হলো না। এই ডেথ স্কোয়াড লস আলামোসে কেন? আর গোয়েন্দা বেনইয়ামিন লুকিয়ে কি দেখবে, কোন খবর পাঠাবে? আহমদ মুসা লস আলামোসে ঢুকেছিল। কিন্তু তার এখন ফেরার কোন সমস্যা নেই লস আলামোসে।
ডেথ স্কোয়াড যাচ্ছে সেখানে, যাচ্ছে কার বিরুদ্ধে? ইহুদী ডেথ স্কোয়াডকে মার্কিন প্রশাসন কি হায়ার করছে? তাই যদি হবে, তাহলে বেনইয়ামিন লুকিয়ে থেকে কি রিপোর্ট করবে জেনারেল শ্যারনকে?’
কোন প্রশ্নের উত্তরই সাবা বেনগুরিয়ান বের করতে পারলো না।
ওদিকে জেনারেল শ্যারন টেলিফোনে কথা শেষ করেছে। নিরব ড্রইং রুম।
সাবা বেনগুরিয়ান প্রবেশ করল ড্রইং রুমে।
ড্রইং রুমে প্রবেশ করে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল, ‘আঙ্কেল, আব্বা টেলিফোন করেছিলেন আপনাকে আমাদের সাথে আজ লাঞ্চ খেতে হবে। প্রায়ই বাইরে খান, আজ নয়।’
জেনারেল শ্যারন হাসতে চেষ্টা করে বলল, ‘কেন আজ কি কোন অকেশন আছে নাকি?’
শ্যারন হাসার চেষ্টা করলেও হাসিটা হলো তার কান্নার মত।
‘কোন অকেশন নেই, জর্জ জন আব্রাহাম জুনিয়রও আজ এখানে লাঞ্চ করবে।’ বলল সাবা বেনগুরিয়ান।
‘জর্জ আব্রাহামের ছেলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘সে কম্পিউটার বিজ্ঞানী না?’
‘এই তো কয়দিন আগে সে সফটঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুল। কয়েকটা আবিষ্কারের জন্যে তাকে বিজ্ঞানী বলা হচ্ছে বটে।’
‘পেন্টাগনের টপসিক্রেট কম্পিউটার উইং এর কনসালট্যান্টও তো সে?’
‘বিস্তারিত জানি না। শুনেছি পেন্টাগনে কিছু সময় সে দেয়।’
‘হ্যাঁ সাবা সে পেন্টাগনের একজন গুরুত্বপূর্ণ কম্পিউটার বিজ্ঞানী। খুব ভাল ছেলে।’
‘হ্যাঁ আঙ্কেল খুব ভাল ছেলে। প্রেসিডেন্ট তাকে দু’বার ডেকেছেন।’
‘তোমার বন্ধু না?’
‘জি, আঙ্কেল।’ সাবা বেনগুরিয়ানের মুখ লাল হয়ে উঠল।
‘তোমরা বিয়েও করছ, তাই না?’
‘জানি না আঙ্কেল, ও খুব কনজারভেটিভ আমেরিকান।’ বলতে গিয়ে সাবার মাথা লজ্জায় নুয়ে পড়ল।
‘তাতে কি? জান না, জর্জ আব্রাহামের মা ইহুদী কন্যা ছিলেন?’
‘তাই? আমি জানতাম না।’
‘তুমি কি জর্জদের বাড়িতে গেছ?’
‘হ্যাঁ গেছি।’
‘আজ যাও না ওদের বাড়িতে, এটা অনুরোধ।’
‘কেন এ অনুরোধ?’ চোখে মুখে বিস্ময় সাবা বেনগুরিয়ানের।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদী স্বার্থ আজ মহাসংকটে পড়েছে। তোমার সাহায্য দরকার।’
‘জর্জের বাড়িতে যাওয়ার সাথে এ সাহায্যের সম্পর্ক কি?’
‘জর্জের বাড়িতে গিয়ে জর্জ জনের আব্বা জর্জ আব্রাহামের নিজস্ব স্টাডিতে তাঁর পারসোনাল কম্পিউটার তোমাকে ব্যবহার করতে হবে।’
‘কেন? সেখানে কি করব?’
‘তুমি জান না, জর্জ আব্রাহাম জনসন এফ.বি.আই-এর চীফ। তার বিশেষ অভ্যাস হলো, প্রতিদিন তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ দলিল ও ডাটা পান, যেখানেই থাকুন সঙ্গে সঙ্গেই তা মোবাইলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অফিসের মাস্টার কম্পিউটারে পাঠান। বাড়তি সর্তকতা হিসেবে সঙ্গে সঙ্গেই তা আবার তিনি তার পারসোনাল কম্পিউটারে পাঠান। তোমাকে গত দু’দিন ও সর্বশেষ সময় পর্যন্ত আসা লস আলামোস ও সবুজ পাহাড় সংক্রান্ত সকল ডকুমেন্ট মুছে ফেলতে হবে।’
লস আলামোসের নাম শুনে চমকে উঠল সাবা বেনগুরিয়ান। কিছুক্ষন আগে জেনারেল শ্যারনের মুখেই সে লস আলামোসে ডেথ স্কোয়াড পাঠানোর কথা শুনেছে। তার সাথে কম্পিউটার থেকে ডকুমেন্ট মুছার কি সম্পর্ক আছে? ভেতরে ভেতরে শংকিত হয়ে উঠল সাবা বেনগুরিয়ান। তাকে দিয়ে গোয়েন্দাগিরী করাতে চান জেনারেল শ্যারন? অস্বস্তিতে ভরে উঠল সাবা বেনগুরিয়ানের মন। বলল সে, ‘জর্জ জন জুনিয়রের অজ্ঞাতে এই কাজ করা যাবে না এবং আমি তা পারবও না। কিন্তু কেন করতে হবে ? কি ঘটেছে এমন?’
‘সব কথা তোমাকে বলতে পারবো না মা। তবে এটুকু জেনে রাখ অবিলম্বে যদি আমরা জর্জ আব্রাহামদের গতিরোধ করতে না পারি, তারা যদি লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, তাহলে জার্মানীতে আমাদের অবস্থা যা দাঁড়িয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ঘটতে পারে।’
শিউরে উঠল সাবা বেনগুরিয়ান। জার্মানীর ভয়াবহ দৃশ্যগুলো ফুটে উঠল তার চোখে। আমেরিকায় তার পুনরাবৃত্তি তারা কল্পনাও করতে পারে না। ভীত হয়ে পড়ল সাবা বেনগুরিয়ান। কথা বলার শক্তিও যেন সে হারিয়ে ফেলল। কথা বলল আবার জেনারেল শ্যারনই, ‘কাজটা তুমি কিভাবে করবে জানি না। কিন্তু এখন আমার বিশ্বাস এটা একমাত্র তুমিই করতে পারবে।’
কথা বলতে পারল না সাবা বেনগুরিয়ান। কিন্তু তার মনে হলো বেনগুরিয়ান কন্যার উপর একটা দায়িত্ব এসে চেপে বসেছে, যা প্রত্যাখ্যানের কোন শক্তি তার নেই। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, জর্জ জন জুনিয়রের সাথে কোন বিশ্বাসঘাতকতা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
জেনারেল শ্যারন উঠে দাঁড়াল। নির্বাক সাবা বেনগুরিয়ানকে বলল, ‘আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। লাঞ্চের সময় ঠিক এসে যাব।’
বলে বেরিয়ে গেল জেনারেল শ্যারন।
সাবা বেনগুরিয়ান ধপ করে বসে পড়ল সোফায়। দেহের ওজন যেন তার হঠাৎ করেই অনেক কমে গেছে।
গাড়ি থেকে নেমে সাবা বেনগুরিয়ানের হাত ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির ভেতরে নিজের ব্যক্তিগত ড্রইংরুমে প্রবেশ করে সোফায় বসে সাবাকে টেনে নিতে নিতে বলল জর্জ জুনিয়র, ‘আজ কি যে সৌভাগ্য আমার। বেনগুরিয়ান রাজকন্যাকে সেধেও বাড়িতে আনা যায় না, সে কিনা আজ স্বেচ্ছায় ধরা দিল।’
‘সেধে ধরা দিলেই বুঝি দাম কমে যায়?’
বাহুর বাধনটা আরও দৃঢ় করে জর্জ জন জুনিয়র বলল, ‘না দাম আরও বাড়ে।’
‘আব্বা আম্মা কাউকে যে দেখছি না?’
‘আব্বা গেছেন লস আলামোসে সরকারী কাজে। আর আম্মা গেছেন আজ সকালে ভাইয়ার বাড়িতে। আমিই আজ বাড়ির রাজা।’
সাবা বেনগুরিয়ান তার চুলে ঢাকা মুখটা জর্জ জন জুনিয়রের বুকে রেখে বলল, ‘রাজা মশায়, আমি কেন এসেছি জান? তোমার কৃতিত্বকে সেলিব্রেট করার জন্যে।’
‘কোন কৃতিত্ব?’
‘তুমি দুনিয়ার সব কম্পিউটারে গোপন কুঠুরিতে ঢোকার পথ আবিষ্কার করেছ।’
‘হ্যাঁ সাবা, এই আবিষ্কার আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার অনেক পরিশ্রম কমিয়ে দেবে। কম্পিউটারের সিক্রেট কেবিনও আমাদের গোয়েন্দা বিভাগগুলোর মাথা ব্যথার কারণ ঘটাবে না।’
‘সব কম্পিউটারই আনলক করতে পারে? এফ.বি.আই, সি.আই.এ’র গুলোও?’
‘অবশ্যই। জান, এফ.বি.আই, সি.আই.এ’র কম্পিউটারগুলোর মধ্যে আব্বার পারসোনাল কম্পিউটারের সিক্রেট কেবিন সবচেয়ে প্রটেকটেড। আমি ওটাও খুলতে পারি চোখের পলকে।’
সাবা বেনগুরিয়ান জর্জ জন জুনিয়রের বুক থেকে মুখ তুলে বলল, ‘সত্যি পার?’
‘বিশ্বাস হচ্ছে না, চল দেখাচ্ছি।’
সাবা বেনগুরিয়ানকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল জর্জ জন জুনিয়র।
কম্পিউটার টেবিলে সাবা বেনগুরিয়ানকে নিজের পাশে বসিয়ে জর্জ জন জুনিয়র বলল, ‘নাও তুমিই হাত লাগাও সাবা। আমি বলে দিচ্ছি কি করতে হবে।’
অন্তরটা কেঁপে উঠল সাবার। সে প্রতারণা করছে জর্জ জন জুনিয়রকে। বিশ্বাসঘাতকতা করছে তার সাথে। জর্জ জুনিয়র সরল বিশ্বাসে তার হাতে তুলে দিচ্ছে জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ একটি কম্পিউটারের গোপনীয়তা। আর সাবা গোয়েন্দাগিরীর কূটিল মনোভাব নিয়ে তা গ্রহণ করছে।
বিব্রত বোধ করল সাবা বেনগুরিয়ান। কিন্তু পরক্ষণেই জেনারেল শ্যারনের চেহারা ভেসে উঠল তার সামনে। ইহুদী গোয়েন্দা চীফের এক অলংঘনীয় হুকুম আবার তার উপর যেন চেপে বসল। তার সেই কথাও মনে পড়ল, জার্মানিতে যা হয়েছিল তার চেয়েও খারাপ অবস্থার মুখোমুখি হতে পারে ইহুদীরা আমেরিকায়। আবারও শিউরে উঠলো সাবা বেনগুরিয়ান। তার মনে হলো, সেই বিপর্যয় থেকে ইহুদীদের রক্ষার একটা মিশন জেনারেল শ্যারন তুলে দিয়েছে তার হাতে। সে দায়িত্ব সে কি পালন করবে না? করতেই যে হবে তাকে।
কম্পিউটারের কী বোর্ডে হাত রাখল সাবা বেনগুরিয়ান। কম্পিউটার বিজ্ঞানে সাবা বেনগুরিয়ানও দক্ষ কম নয়।
‘সাবা, সব রোগের পাশে যেমন ঔষধ থাকে, তেমনি যে কোন কম্পিউটার সমস্যার সমাধানও তার পাশে মানে কী বোর্ডেই থাকে। রোগের যেমন ঔষধ আবিষ্কার করতে হয়, তেমনি কম্পিউটার সমস্যার সমাধানও কম্পিউটার কী বোর্ড থেকেই আসে।’ বলে জর্জ জুনিয়র জগতের সবচেয়ে দুরুহ কম্পিউটারের লক আনলক করার জটিল কোড ব্রিফ করল সাবা বেনগুরিয়ানকে।
সে কম্পিউটার কোডটি সাবা বেনগুরিয়ান কম্পিউটার কী বোর্ডে কাজে লাগাল। কোডটি সম্পর্ণ হবার সঙ্গে সঙ্গেই কম্পিউটার স্ক্রীনে ‘পাসওয়ার্ড ও,কে’ সিগন্যাল ভেসে উঠল। তার পরেই পরবর্তী কমান্ড চাইল কম্পিউটার।
বুক কেঁপে উঠল সাবা বেনগুরিয়ানের। এবার ওপেন কী চাপলেই কম্পিউটারের গোপনগ্রন্থের পাতা তার সামনে খুলে যাবে। তারপর কী চেপে একের পর এক পাতা উল্টালেই শেষের পাতাগুলো সে পেয়ে যাবে।
কম্পিত তর্জনির শীর্ষ দিয়ে ওপেন কীতে চাপ দিল সাবা বেনগুরিয়ান।
কম্পিউটারের গোপনগ্রন্থের প্রথম পাতা ওপেন হলো সাবা বেনগুরিয়ানের সামনে।
হৃদয়ের কাঁপুনি বেড়ে গেল সাবা বেনগুরিয়ানের। সে অনেক কষ্টে হাসার চেষ্টা করে ধন্যবাদ দিল জর্জ জুনিয়রকে। বলল, ‘সবচেয়ে গোপন দরজা খোলার মন্ত্র তুমি সত্যই আবিষ্কার করেছ জর্জ জুনিয়র।’
একদিকে এই কথাগুলো বলছিল, অন্যদিকে তার ব্যস্ত তর্জনি বোতাম টিপে একের পর এক পাতা উল্টে যাচ্ছিল। সাবা বেনগুরিয়ান কোন পাতায় কি আছে তা দেখার জন্যে বিন্দুমাত্র ওয়েট করছিল না। তার লক্ষ্য সর্বশেষ এন্ট্রিগুলো।
জর্জ জুনিয়র সাবা বেনগুরিয়ানের পাশে বসে সাবার আঙ্গুলের খেলা দেখে যাচ্ছিল। সে মনে করছিল মজা বশতই সাবা কম্পিউটারের একের পর এক পাতা উল্টে যাচ্ছে।
সর্বশেষ এন্ট্রির সামনে আসতেই থমকে দাঁড়াল সাবা বেনগুরিয়ানের চোখ। সেই সাথে গোটাদেহে বয়ে গেলো প্রবল অস্বস্তির একটা শীতল স্রোত।
সাবা বেনগুরিয়ানের দু’টি চোখ নিবদ্ধ কম্পিউটারের সেই লেটেস্ট এন্ট্রি চার্টের উপর। আর তার তর্জনিটা ছুটে গেল ফাংশন কীর দিকে। পরপর তিনটি নির্দিষ্ট বাটন চাপলেই মুছে যাবে লেটেস্ট এন্ট্রিগুলো।
কিন্তু সাবা বেনগুরিয়ানের চোখ দু’টি লেটেস্ট এন্ট্রিগুলো পড়তে গিয়ে আঠার মত লেগে গেল। চোখ ফেরাতে পারল না সে। তার তর্জনি নেমে গেছে, ফাংশন বাটনে চাপ দিতে ভুলে গেল যেন।
পড়ছে সে এন্ট্রিগুলো। ইহুদী সিনাগগ কমপ্লেক্স সবুজ পাহাড়ে আহমদ মুসার বন্দী হওয়া এবং তার মুক্ত হওয়ার গোটা কাহিনী পড়ল সাবা বেনগুরিয়ান। তারপর আহমদ মুসার সাথে জর্জ আব্রাহামের সাক্ষাতের বিবরণও পড়ে ফেলল সে।
সাবা বেনগুরিয়ার অনুভব করল তার দেহ মনের উপর দিয়ে বুদ্ধি বিবেচনা ভোতাকারী এক শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
পড়ে চলল সে। জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার ও জেনারেল শেরউডের তিন সদস্য বিশিষ্ট টিম তদন্তের গেছে আহমদ মুসার দেয়া তথ্যের সত্যতা প্রমাণের জন্যে। টিম সরেজমিনে দেখবে, ইহুদী বিজ্ঞানী জন জ্যাকব সবুজ পাহাড় থেকে লস আলামোস পর্যন্ত তৈরী করা গোয়েন্দা সড়ঙ্গের কথা সত্য কিনা, সত্য হলে এ গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ পথে কতদিন ধরে গোয়েন্দাবৃত্তি চলছে, আহমদ মুসা লস আলামোসে সাম্প্রতিক ইহুদী গোয়েন্দাবৃত্তির যে তথ্য দিয়েছে সে রকম গোয়েন্দাবৃত্তি ইহুদীরা কিভাবে, কার মাধ্যমে করছে। আহমদ মুসা কর্তৃক উদ্ধার করা সাম্প্রতিক গোয়েন্দাবৃত্তি সংক্রান্ত দলিল গোটাটাই কম্পিউটারে সে দেখল। কম্পিউটারের লেটেস্ট এন্ট্রির এখানেই শেষ।
পড়ার পর সাবা বেনগুরিয়ানের গোটা দেহ যেন কাঁপছে। মনে পড়ল জেনারেল শ্যারনের সেই কথা যে, যদি জর্জ আব্রাহামদের রোখা না যায় তাহলে জার্মানীতে ইহুদীদের যে অবস্থা হয়েছিল, সেই অবস্থা হবে আমেরিকার ইহুদীদের। হৃদয়টা থরথর করে কেঁপে উঠল সাবা বেনগুরিয়ানের। এই গোয়েন্দাগিরীর কথা যদি প্রচার হয়, যদি প্রমাণ হয় বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের মত সর্বজন শ্রদ্ধেয় লোকও যদি ইহুদীদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরী, লস আলামোস পর্যন্ত সুড়ঙ্গ তৈরী ও গোয়েন্দাবৃত্তি করে থাকে, তাহলে কোন ইহুদীই বিশ্বাসযোগ্য নয়, এটাই স্বতঃসিদ্ধ হয়ে উঠবে। আর তখন জার্মানীতে যা হয়েছিল সেই অবস্থা এখানেও সৃষ্টি হতে পারে।
কম্পিত হৃদয়ে আরও ভাবল সাবা বেনগুরিয়ান, কিন্তু এ এন্ট্রিগুলো মুছে ফেললেই কি সব প্রমাণ মুছে যাবে? হঠাৎ তার মনে পড়ল লস আলামোসে জেনারেল শ্যারন ‘ডেথ স্কোয়াড’ পাঠানোর কথা। তার মানে তদন্ত টিমের সদস্যসহ আহমদ মুসাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে জীবন্ত প্রমাণ নষ্ট করার পরিকল্পনা করেছে জেনারেল শ্যারনরা?
গাটা কেঁপে উঠল আরেকদফা সাবা বেনগুরিয়ানের। সে বুঝতে পারল পরিকল্পনা। জীবন্ত প্রমাণ সরিয়ে দিতে ও কম্পিউটারের রেকর্ডগুলো মুছে ফেলতে পারলেই কেটে যেতে পারে সংকট।
কিন্তু এই পরিকল্পনা সাবা বেনগুরিয়ানকে আশ্বস্ত করার বদলে আরও আতংকিত করে তুলল। সে ইহুদী বটে, কিন্তু তাই বলে জর্জ জুনিয়রের এতবড় ক্ষতি চোখের সামনে দেখতে পারবে না, জর্জ জুনিয়রের পিতাকে যারা হত্যা করতে চায়, তাদের কোন সহযোগিতা করা তার পাপ হবে। জর্জ জুনিয়র তার সব।
প্রবল একটা আবেগ উথলে উঠল তার হৃদয় থেকে। চোখ দু’টি তার অশ্রুতে ভারি হয়ে উঠল।
কিন্তু পরক্ষণেই জেনারেল শ্যারনের কথা , স্বজাতির কথা, তার পিতার কথা মনে হলো। তার পিতার, তার স্বজাতির কোন বিপর্যয় কি সে সহ্য করতে পারবে? পারবে না। তাহলে সে কি করবে এখন? ফাংশন বাটনের উপর তার তর্জ্জনি তখন। চাপ দেবে কি বাটনে? জর্জ জুনিয়র তার পাশেই । তার দেহের মধুর উত্তাপ সে অনুভব করতে পারছে। সে জানে না কি সর্বনাশ করতে যাচ্ছে সে।
ফাংশন বাটনের উপর রাখা তার তর্জ্জনি ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সাবা বেনগুরিয়ান দু’হাতে মুখ ঢেকে। সে এলিয়ে পড়ল চেয়ারের উপর।
জর্জ জুনিয়র সাবা বেনগুরিয়ানের মতই কম্পিউটারের এন্ট্রিগুলো পড়ছিল। অকল্পনীয় একটা সত্যের মুখোমুখি হয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েছিল সেও।
সাবা বেনগুরিয়ানকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে দেখে জর্জ জুনিয়র বুঝল সাবা অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
জর্জ জন সাবা বেনগুরিয়ানের পিঠে হাত রেখে বলল, ‘এ তুমি কি করছ সাবা। এগুলো ইনফরমেশন মাত্র, রুটিন এন্ট্রি। এসব নিয়ে তুমি এত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লে কেন?’
সাবার কান্না আরও বেড়ে গেল।
জর্জ জন জুনিয়র কম্পিউটার অফ করে দিয়ে সাবা বেনগুরিয়ানকে টেনে নিয়ে এসে বসল সোফায়। বলল, ‘তুমি এত নরম, ভাবনারও বাইরে ছিল আমার।’ সাবা বেনগুরিয়ানের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নরম কন্ঠে বলল জর্জ জুনিয়র।
‘জর্জ তুমি জান না, তোমার সাথে আমি কি বিশ্বাসঘাতকতা করতে যাচ্ছিলাম।’ দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল সাবা বেনগুরিয়ান।
‘তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে যাবে কেন? কি যা তা বলছ তুমি?’ সাবা বেনগুরিয়ানের কথার কোন আমল দিল না জর্জ জুনিয়র।
মুখ তুলল সাবা বেনগুরিয়ান। অশ্রু ধোয়া তার মুখ।
তার চোখে মুখে একটা সিদ্ধান্তের ছাপ। বলল সে, ‘বিশ্বাস করবে যদি বলি ইহুদী গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শ্যারন আমাকে এখানে পাঠিয়েছিল সাংঘাতিক একটা উদ্দেশ্যে?’
বিস্ময়ের একটা ঢেউ খেলে গেল জর্জ জুনিয়রের চোখে মুখে। কিছুক্ষণ সে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সাবা বেনগুরিয়ানের দিকে। বলল ধীরে ধীরে, ‘তুমি মিথ্যা বলবে না। তোমাকে অবিশ্বাসের প্রশ্ন নেই। কিন্তু জেনারেল শ্যারনের সাথে তোমার কোথায় দেখা হলো? সাংঘাতিক সে উদ্দেশ্যটা কি?’
‘জেনারেল শ্যারন আব্বার বন্ধু। ওয়াশিংটন এলে আমাদের বাসাতেই ওঠেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, কম্পিউটারের লেটেস্ট এন্ট্রিগুলো মুছে ফেলা।’
বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার মত চমকে উঠল জর্জ জুনিয়র। তার বিস্ফোরিত চোখ সাবা বেনগুরিয়ানের উপর নিবদ্ধ। বলল, ‘তাহলে এন্ট্রিগুলোর সব তথ্য সত্য সাবা?’
‘আমার তাই বিশ্বাস। না হলে জেনারেল শ্যারন ইহুদী জাতি বিপন্ন হওয়ার দোহাই দিয়ে এই কাজ করায় আমাকে রাজী হতে বাধ্য করতে আসবেন কেন?’ চোখ মুছে ভারি গলায় বলল সাবা বেনগুরিয়ান
‘কিন্তু এই এন্ট্রি মুছে ফেললেই কি সব প্রমাণ মুছে যাবে? তারা……………।’
জর্জ জুনিয়রকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠল সাবা বেনগুরিয়ান, ‘জর্জ তারা শুধু এই একটি কাজ নয়, আমার আশংকা তারা আরও ভয়াবহ কিছু ঘটাতে যাচ্ছে।
জর্জ জুনিয়রের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠল। বলল, ‘ভয়াবহ? সেটা কি?।’
সাবা বেনগুরিয়ান কম্পিত গলায় বলল, ‘আজ সকালে আব্বার একটা মেসেজ জেনারেল শ্যারন আংকেলকে দেবার জন্যে আমাদের ড্রইং রুমে ঢুকছিলাম। ঠিক সে সময় আমি তাঁকে টেলিফোনে জনৈক বেনইয়ামিনকে বলতে শুনলাম যে, সে যেন লস আলামোসের প্রধান গেটের পাশে কোথাও আত্মগোপন করে থাকে এবং যে ডেথ স্কোয়াড তিনি লস আলামোসে পাঠাচ্ছেন তাদের খবরাখবর যেন সে পাঠায়।’
চমকে উঠে সোফায় সোজা হয়ে বসল জর্জ জুনিয়র। বলল, ‘ লস আলামোসে ইহুদী ডেথ স্কোয়াড? কি জন্যে? ওখানে আব্বারা আজ যাচ্ছেন, কিংবা তারা আজ ওখানেই আছেন? তাহলে কি……?’
কথা শেষ করতে পারল না জর্জ জুনিয়র।
‘আমি তোমার সাথে একমত জর্জ। তোমার আব্বার কম্পিউটার টার্গেট হবার সাথে সাথে তোমার আব্বাও টার্গেট হতে পারেন।’
কম্পিত কন্ঠে বলল সাবা বেনগুরিয়ান। তার চোখে মুখে আতঙ্ক।
ঝট করে উঠে দাঁড়াল জর্জ জুনিয়র। তারপর সাবার হাত ধরে টেনে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বলল, ‘এস আব্বার কম্যুনিকেশন টেবিলে এস।’
কম্যুনিকেশন টেবিলে জর্জ জুনিয়র অয়্যারলেস কী বোর্ডের সবুজ বোতামে চাপ দিল।
‘ইয়েস স্যার।’ ওপার থেকে কথা বলে উঠল জন লিংকন।
জন লিংকন এফ.বি.আই-এর অপারেশন কমান্ডার।
‘আমি জর্জ জুনিয়র। আমি আব্বার সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।’
‘কোন খবর আপনাদের কাছে আছে? আমরা তাঁর সাথে কনট্যাকটের চেষ্টা করছি।’
‘চেষ্টা করছি মানে, অয়্যারলেস, মোবাইলে তাকে কনট্যাকট করা যায়নি?’
‘কয়েকবার চেষ্টা করেছি, ব্যর্থ হয়েছি আমরা। আমরা ‘সান্তাফে’ ও ‘লস আলামোসে’ আমাদের ইউনিটকে বিষয়টা জানিয়ে দিয়েছি। যে কোন সময় ওদের উত্তর আশা করছি। এদিকে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। তাঁকে আমাদের জরুরী প্রয়োজন।’
‘সাংঘাতিক? কি ঘটেছে?’ বলল জর্জ জুনিয়র।
‘একটা বিস্ফোরণ ঘটে আমাদের মাস্টার কম্পিউটার ধ্বংস হয়ে গেছে।’
কেঁপে উঠল জর্জ জুনিয়র। সাবার দেয়া তথ্য তাহলে একশ ভাগ সত্য। ইহুদী গোয়েন্দাগিরী ও বিশ্বাসঘাতকতার সব প্রমাণ ধ্বংসের তারা একই সাথে উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের বাসার প্রমাণ রক্ষা পেয়েছ। কিন্তু এফ.বি.আই অফিসের প্রমাণ ধ্বংস হয়েছে। লস আলামোসে তাদের ডেথ স্কোয়াড পাঠানো কি সফল হয়েছে? তার আব্বার মোবাইল ও অয়্যারলেস নিরব কেন? তার গোটা দেহে আতংকের একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল।
নিজেকে সামলে জর্জ জুনিয়র বলল, ‘এমন নাশকতামূলক ঘটনা কিভাবে ঘটল অমন সংরক্ষিত জায়গায়?’
‘নাশকতামূলক ঘটনা বলছেন? কিন্তু প্রাথমিক তদন্তে বলা হয়েছে বৈদ্যুতিক ত্রুটি জনিত অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণ হতে পারে।’ বলল এফ.বি.আই অপারেশন প্রধান জন লিংকন।
‘না মিঃ লিংকন আমি এর প্রতিবাদ করছি। একটা শত্রু পক্ষ কম্পিউটারে সংরক্ষিত কিছু অতি সাম্প্রতিক দলিল ধ্বংস করার জন্যেই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। ওরা লস আলামোসে আব্বাদের টিমের উপরও হামলা করতে পারে আমার আশঙ্কা।’
কমান্ডার জন লিংকন দ্রুত কন্ঠে বলল, ‘মাফ করবেন, এটা আপনার অনুমান, না আপনার কোন নিশ্চিত তথ্য?’
‘মিঃ লিংকন, অনেক গুরুতর ঘটনা ঘটে গেছে তারই প্রতিক্রিয়ায় শত্রু পক্ষ প্রমাণ ধ্বংস কৌশল হিসাবে এফ.বি.আই কম্পিউটারের রেকর্ড ধ্বংসের উদ্যোগ নেয়ার মত করেই ওরা লস আলামোসে আজ ডেথ স্কোয়াড পাঠিয়েছে।’
‘সর্বনাশ! ধন্যবাদ মিঃ জর্জ জন। আমি বুঝতে পারছি। আমি এদিকের এবং লস আলামোসের বিষয়টা দেখার ব্যবস্থা করছি।’
অয়্যারলেস অফ করে দিয়ে জর্জ জন জুনিয়র ফিরল সাবা বেনগুরিয়ানের দিকে।
সাবা বেনগুরিয়ার সীমাহীন উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়েছিল জর্জ জন জুনিয়রের দিকে। বলল, ‘কি ব্যাপার জর্জ?’
‘তোমার তথ্য সত্য সাবা। ওরা প্রমাণ মুছে ফেলার জন্যে সব ব্যবস্থাই করেছে। এফ.বি.আই-এর মাস্টার কম্পিউটার ওরা ধ্বংস করেছে।’ শুকনো কন্ঠে বলল জর্জ জুনিয়র।
‘ও গড! আর তোমার আব্বার কথা?’ সাবা বেনগুরিয়ানের কন্ঠে উদ্বেগ।
জর্জ জুনিয়রের মুখ মলিন হয়ে উঠল। বলল, ‘কম্পিউটার বিস্ফোরণের পর এফ.বি.আই আব্বার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। কিন্তু আব্বার মোবাইল ও ওয়্যারলেস দু’টিই কোন রেসপন্স করেনি।’
সাবা বেনগুরিয়ানের মুখ সাদা হয়ে গেল শোনার সাথে সাথেই। শুকনো ঠোঁট দু’টি তার কাঁপল, বলল, ‘স্যরি জর্জ, তোমাকে আরও আগে আমার জানানো উচিত ছিল। বিশ্বাস কর যখন আমি প্রথম ডেথ স্কোয়াডের কথা শুনি তখন কিছুই বুঝিনি। এমনকি জেনারেল শ্যারন যখন এই এ্যাসাইনমেন্টটি আমার উপর চাপিয়ে দেন, তখনও বুঝতে পারিনি। বুঝলাম এখানে এসে কম্পিউটারের লেটেস্ট এন্ট্রিগুলো পড়ার পর।’
জর্জ জুনিয়র সাবা বেনগুরিয়ানের একটা হাত হাতে নিয়ে বলল, ‘তোমার কোন ত্রুটি হয়নি সাবা, তুমি যথা সময়েই বলেছ।’
বলে একটু থামল জর্জ। একটু ভাবল। তারপর অনেকটা স্বগোতোক্তির মতই বলল, ‘ভাবছি লস আলামোসে যাব কিনা।’
‘তুমি গেলে আমিও যাব জর্জ।’ বলল সাবা বেনগুরিয়ান।
‘ঠিক আছে, আমি আরও একটু ভাবি। তোমাকে আমি টেলিফোন করব।’
‘ধন্যবাদ জর্জ।’
‘এখন উঠি তাহলে।’
বলে উঠে দাঁড়াল সাবা বেনগুরিয়ান। জর্জ জন জুনিয়রও উঠে দাঁড়াল। হাঁটছিল দু’জন।
জর্জের একটা হাত সাবা বেনগুরিয়ানের গলায় পেঁচানো। হাঁটতে হাঁটতে জর্জ সাবা বেনগুরিয়ানকে নিজের দিকে টেনে বলল, ‘তুমি না বললে কিছুই জানতাম না। তোমার জাতির স্বার্থে জেনারেল শ্যারনের অনুরোধ রক্ষা করলে না কেন? শুধুই কি আমার কারণে?’
সাবা বেনগুরিয়ান জর্জে দিকে চাইল। ম্লান হাসল। তারপর মুখ নিচু করল। বলল, ‘শুধুই তোমার কারণে নয়। শুধু তোমার কারনে হলে ওর দেয়া এই দায়িত্বই নিতাম না। ভাবতাম তোমাকে না জানিয়ে এ ধরনের কোন কিছুই করা ঠিক নয়। কিন্তু তা না ভেবে ভেবেছিলাম জাতির পক্ষে ঐ অনুরোধ রক্ষা করলে তা একটা অন্যায় হবে আমার জন্যে, তোমার অমর্যাদা তাতে হবে না।’
‘তাহলে জেনারেল শ্যারনের অনুরোধ শেষ পর্যন্ত রাখলে না কেন?’ জর্জ বলল।
‘এন্ট্রিগুলোর বিষয়বস্তু দেখে আমি তা মুছে ফেলতে পারিনি।’ বলল সাবা।
‘কেন? এন্ট্রিগুলো মুছে ফেলার জন্যে তোমার আগ্রহী হওয়া উচিত ছিলে। কারণ তোমার জাতির বিপদের কথা তখন তোমার কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল।’
‘দুই কারনে পারিনি। জাতির কিছু লোকের একাজকে আমার চরম বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে হয়েছে। দ্বিতীয়ত আমি আমেরিকান, আমেরিকার নাগরিক, এই চিন্তা তখন আমার কাছে বড় হয়েছিল।’
হাসল জর্জ জন জুনিয়র। আরও কাছে টেনে নিল সাবা বেনগুরিয়ানকে। বলল, ‘তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সাবা। আমাকে আশ্বস্ত করলে।’
‘কিভাবে আশ্বস্ত করলাম, কোন বিষয়ে?’ ব্যস্ত কন্ঠে বলল সাবা।
‘আশ্বস্ত হলাম যে, আমাকে কোন সময় তুমি ভালবাসতে না পারলেও দেশের প্রতি তুমি বিশ্বস্ত থাকবে। আর দেশের প্রতি এমন দায়িত্বশীল যে, সে তার সাথীর প্রতিও দায়িত্বশীল হতে বাধ্য।’
‘তোমাকে ধন্যবাদ জর্জ। তুমি আমাকে বুঝতে পেরেছ? বিশ্বাস করেছ। তুমি ভুল বুঝলে, অবিশ্বাস করলে আমার বাচাঁ কঠিন হয়ে উঠতো।’ কান্না ভেজা ভারি কন্ঠ সাবা বেনগুরিয়ানের।
‘কিন্তু সাবা, তোমাকে অবিশ্বাস করার যন্ত্রণা তার চেয়েও বেশি কষ্ট আমাকে দিত।’
‘ধন্যবাদ। আমি অতি ভাগ্যবান জর্জ।’
‘আমিও।’
গাড়ি বারান্দায় তারা পৌছে গেছে।
জর্জ জন জুনিয়র এগিয়ে গিয়ে সাবা বেনগুরিয়ানের গাড়ির দরজা খুলে ধরল।
সাবা ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলে জর্জ গাড়ির দরজা বন্ধ করে বলল, ‘গুড নাইট সাবা, বাই।’
‘বাই। আমি তোমার টেলিফোনের অপেক্ষা করব জর্জ।’
বলে গাড়িতে স্টার্ট দিল সাবা বেনগুরিয়ান।

লস আলামোসের কম্পিউটার কক্ষ।
কক্ষটির পশ্চিম প্রান্তের তিনটি কম্পিউটার সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সরিয়ে ফেলা হয়েছে এ পশ্চিম প্রান্তের কার্পেটও।
লস আলামোসে স্ট্রাটেজিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রধান পরিচালক ডঃ হাওয়ার্ড বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে সুড়ঙ্গ মুখের দিকে।
সুড়ঙ্গ মুখে মেঝের সমান্তরালে যে স্ল্যাব ছিল তা তুলে ফেলা হয়েছে। সুড়ঙ্গ মুখ এখন উন্মুক্ত। নিচে অনেক খানি দেখা যাচ্ছে। সে দিকে তাকিয়েই পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে ডঃ হাওয়ার্ড।
ডঃ হাওয়ার্ডের পাশে নিউ মেক্সিকোর এফ.বি.আই ইনচার্জ এডমন্ড বার্ক। সীমাহীন শংকা ও উদ্বেগ নিয়ে তারও চোখ দু’টি নিবদ্ধ রয়েছে সুড়ঙ্গ মুখে উপর।
মিঃ এডমন্ড বার্কের হাতে মোবাইল টেলিফোন। তার টেলিফোনটি ‘বিপ’ দিয়ে উঠল।
টেলিফোনটি কানের কাছে তুলে ধরে নিচু স্বরে কথা বলল এডমন্ড বার্ক।
অল্প কয়েকটি কথা বলার পর কথা শেষ করে মিঃ এডমন্ড ডাকলো ডঃ হাওয়ার্ডকে। বলল, মিঃ হাওয়ার্ড ওরা সুড়ঙ্গের এ প্রান্তে চলে এসেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা এসে পড়বেন।
‘ওরা কয়জন?’
‘ওরা সেই তিনজন এবং তার সাথে আহমদ মুসা।’
‘আমার বুক কাঁপছে এডমন্ড বার্ক।’
‘এই সুড়ঙ্গ পথে কি যে ঘটেছে ! তবে আমি আনন্দিত যে আহমদ মুসা ঐ সবুজ পাহাড়ের অন্ধকুপে বন্দী হয়েছিল। তা না হলে আরও কতদিন যে এই সুড়ঙ্গ অনুদঘাটিত থাকতো কে জানে।’ বলল ডঃ হাওয়ার্ড।
‘আজ এই সুড়ঙ্গ আবিষ্কার হওয়ায় আহমদ মুসাও বড় বিপদ থেকে বেঁচে যাবে। লস আলামোসে গোয়েন্দাগিরীর দায় তার ঘাড়ে আর বর্তাবে না।’ এডমন্ড বার্ক বলল।
‘তা বটে, দুঃখের মধ্যেও আমার আরও একটা ব্যাপারে আনন্দ লাগছে। সে দিন আহমদ মুসাকে দেখা হয়নি, আজ দেখা যাবে।’
‘অবাক কান্ড। আমিও এটাই ভাবছি ডঃ হাওয়ার্ড।’
এ সময় সুড়ঙ্গ থেকে কথা শোনা গেল।
‘ওরা এসে গেছেন।’ বলে এডমন্ড বার্ক সুড়ঙ্গের একেবারে পাশে এসে দাঁড়াল। তার সাথে সাথে ডঃ হাওয়ার্ডও।
সুড়ঙ্গে প্রথম দেখা গেল জর্জ আব্রাহাম জনসনকে।
‘গুড মর্নিং স্যার।’ বলে উঠল এডমন্ড বার্ক জর্জ আব্রাহামকে লক্ষ্য করে।
‘গুড মর্নিং এডমন্ড।’ বলল জর্জ আব্রাহাম। তার ঠোটে হাসি কিন্তু চোখ দু’টিতে বিষণ্ণতা। কপাল কুঞ্চিত।
সুড়ঙ্গ থেকে সবাই এক এক করে উঠে এল। আহমদ মুসাও।
সবাই ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত।
জর্জ আব্রাহাম আহমদ মুসাকে এডমন্ড বার্ক ও ডঃ হাওয়ার্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
এডমন্ড বার্ক আহমদ মুসার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘ওয়েলকাম, আহমদ মুসা। আমরা কৃতজ্ঞ।’
‘কৃতজ্ঞ কেন?’ হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল আহমদ মুসা
‘গোয়েন্দাগিরীর ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা আপনি উদঘাটন করেছেন।’
‘এটা কৃতিত্ব না হয়ে নতুন এক অপরাধও তো হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝলাম না জনাব।’ বলল এডমন্ড বার্ক।
‘আপনাদের সরকার আহমদ মুসাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে।’
‘সে তো আগের কথা।’
‘না দেড় ঘন্টা আগের কথা।’
চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল এডমন্ড বার্কের। তাকাল সে এফ.বি.আই চীফ জর্জ আব্রাহামের দিকে। দেখল এফ.বি.আই চীফের চোখে সেই বিষণ্ণ দৃষ্টি এবং তার কুঞ্চিত কপাল।
এডমন্ড বার্কে বিমুঢ় ভাব দেখে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘চল বসি, সব বলব।’
বলে একটা দম নিয়েই জর্জ আব্রাহাম এডমন্ড বার্ককে লক্ষ্য করে আবার বলে উঠল, ‘সুড়ঙ্গ ঢোকার সময় তোমাকে টেলিফোনে বলেছিলাম সব চেয়ে দ্রুতগামী একটা বিমান সান্তাফে বিমান বন্দরে রেডি রাখার জন্যে। তার কি করেছো?’
‘ব্যবস্থা হয়ে গেছে স্যার।’ বলল এডমন্ড বার্ক।
এডমন্ড থামতেই ডঃ হাওয়ার্ড বলে উঠল, ‘জনাব, চলুন বসবেন।’
ডঃ হাওয়ার্ড সবাইকে নিয়ে কম্পিউটার কক্ষ থেকে বেরুল।
কক্ষ থেকে বেরুবার সময় জর্জ আব্রাহাম এডমন্ডকে বলল, ‘এ ঘরটা চব্বিশ ঘন্টা সশস্ত্র পাহারায় থাকবে। ব্যবস্থা করেছো?’
‘জি স্যার।’
সবাই এসে বসল ডঃ হাওয়ার্ডের ড্রইং রুমে।

টয়লেট থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বসেছে সবাই।
গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘এডমন্ড, সবুজ পাহাড় এবং সুড়ঙ্গ পথের উপর একটা প্রাথমিক স্টেটমেন্ট আমি এবং এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার ও জেনারেল শেরউড যুক্ত হস্তখতে তৈরী করেছি। ওটার একটা কপি প্রেসিডেন্টের পার্সোনাল সেক্রেটারী এবং আরেকটা কপি এফ.বি.আই হেড অফিসে পাঠাবার ব্যবস্থা কর।’
স্টেটমেন্টটা নিয়ে উঠে গেল এডমন্ড। ফিরে এল মিনিট দুয়েক পর। বলল, ‘আমাদের সিকিউরিটি অফিসারকে দিয়ে এলাম। পাঠাবার ব্যবস্থা হচ্ছে।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলল, ‘স্যার কি যেন বলেছিলেন।’
‘ও আচ্ছা।’ বলে জর্জ আব্রাহাম আবার শুরু করল, ‘আহমদ মুসা ঠিকই বলেছেন। এই কৃতিত্ব যার তাঁকে কাস্টোডিতে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, সবুজ পাহাড়ে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের সবাইকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। সবুজ পাহাড়ের দখলটাও আমাদের ছাড়তে হয়েছে। শুধু আমাদের পাহারাটাই ওখানে বজায় আছে মাত্র।’
বিস্ময়ে থ হয়ে গেছে এডমন্ড বার্কের চোখ-মুখ।
‘কিভাবে এটা ঘটল।’ বলল সে।
‘প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টার নির্দেশে আমরা এটা করেছি। সবাই তো আমরা জানি প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল আলেকজান্ডারের সাথে ইহুদী গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শ্যারনের সম্পর্ক খুবই গভীর।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে সব কথা বোঝাননি?’ বলল এডমন্ড।
‘সব শুনেছেন, জেনেছেন, কিন্তু তার পরও বলেছেন, নিশ্চিত প্রমাণ হাতে না নিয়ে, প্রেসিডেন্টের অনুমতি না নিয়ে ওদের এ ধরনের গ্রেফতার ও কেন্দ্র দখল করা যাবে না। প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক কনসিকুয়েন্স বিচার না করে এ বিষয়ে অবশ্যই কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘প্রেসিডেন্টের কথাও এটাই?’
‘হয়তো তাই। প্রেসিডেন্টের সাথে তিনি কথা বলেছেন।’
‘ডকুমেন্ট ধরা পড়া, গোয়েন্দাগিরীর সুড়ঙ্গ আবিষ্কার হওয়ার মত সাংঘাতিক ঘটনার পরও এ ধরনের নির্দেশ ওরা দিলেন?’ বিস্মিত কন্ঠে বলল ডঃ হাওয়ার্ড।
‘সুড়ঙ্গ তখনও আমরা আবিষ্কার করিনি, তখন ওটা ছিল আমাদের শোনা কথা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘নিরাপত্তা উপদেষ্টার এই নির্দেশ অযৌক্তিক হয়েছে, আমাদের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে। পেন্টাগনও এটাই মনে করে। ওরাও প্রেসিডেন্টের সাথে যোগাযোগ করবেন।’ বলল জেনারেল শেরউড।
আহমদ মুসা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ওদের কথা শুনছিল। সোজা হয়ে বসল সে। বলল, ‘এসব আপনাদের নিজেদের ব্যাপার। আমি বাইরের লোক। তবু একটা কথা আমি বলব, বহুমুখী একটা বিষাক্ত সাপের অস্তিত্বে আপনারা হাত দিয়েছেন। একটামাত্র ছোবল দিয়েছে। ছোবল আরো আসছে।’
‘আপনার কথা ঠিক আহমদ মুসা। নিউ মেক্সিকো এয়ারপোর্টে প্লেন রেডি। আমরা সোজা যাব প্রেসিডেন্টের কাছে। সব কিছু তাঁর হাতে তুলে দেব। তারপর সব দায়িত্ব তাঁর।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
হাতের কফির কাপটা টিপয়ের উপর রেখে সবার দিকে চেয়ে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘এখন আমরা উঠতে পারি।’
তারপর এফ.বি.আই-এর নিউ মেক্সিকো চীফ এডমন্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার গাড়ি প্রস্তুত তো?’
‘অবশ্যই স্যার, দু’টি গাড়িই স্টার্টিং পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছে।’ বলল এডমন্ড বার্ক।
উঠে দাঁড়াল জর্জ আব্রাহাম। সবাই উঠে দাঁড়াল।
‘মিঃ আহমদ মুসা কি সত্যই আপনাদের সাথে যাচ্ছেন?’ জিজ্ঞেস করল এডমন্ড বার্ক।
হাসল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘যাচ্ছেন, কিন্তু বন্দী হিসাবে নয়, সহযাত্রী হিসেবে।’
সবাই বেরিয়ে আসছিল লস আলামোস ল্যাবরেটরী থেকে।
গ্রাউন্ড ফ্লোরের সর্বশেষ করিডোর অতিক্রম করছিল তারা।
অতিক্রম করছিল মিস সারা জেফারসনের অফিস।
অফিসের দিকে তাকিয়ে জর্জ আব্রাহাম থমকে দাঁড়াল। মনে পড়ল তার, মিস জেফারসনকে সে কথা দিয়েছিল আহমদ মুসাকে তার সাথে সাক্ষাত করিয়ে দেবে।
‘আপনারা একটু দাঁড়ান। আহমদ মুসাকে মিস জেফারসনের সাথে সাক্ষাত করিয়ে দেই। আমি মিস জেফারসনকে কথা দিয়েছিলাম।’
সবার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে জর্জ আব্রাহাম আহমদ মুসাকে নিয়ে ঢুকল মিস জেফারসনের অফিস কক্ষে।
মিস সারা জেফারসন যেন তাদেরই অপেক্ষা করছিল।
জর্জ আব্রহামরা কক্ষে ঢুকতেই মিস সারা জেফারসন উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল জর্জ আব্রাহাম ও আহমদ মুসাকে। ওদের বসার অনুরোধ করে জর্জ আব্রাহামকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ যে, ছোট একটা প্রতিশ্রুতি আপনি মনে রেখেছেন।’
‘ওয়েলকাম মিস জেফারসন। আমি বসছি না।’
তারপর আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনি ওর সাথে কথা বলে আসুন আহমদ মুসা। আমরা গেটে অপেক্ষা করছি।’
বেরিয়ে গেল জর্জ আব্রাহাম।
আহমদ মুসা তখনও দাঁড়িয়েই ছিল।
জর্জ আব্রাহাম বেরিয়ে যেতেই মিস জেফারসন হাসি মুখে বলল, ‘বসুন মিঃ আহমদ মুসা।’
আহমদ মুসা বসল। বসল মিস জেফারসনও।
বিস্ময় তখনও আহমদ মুসার কাটেনি। তার সাথে সাক্ষাত করিয়ে দেয়ার জন্যে মিস জেফারসন জর্জ আব্রাহামকে অনুরোধ করেছিল কেন?।
আহমদ মুসার ভাবনাটা ভেঙ্গে গেল মিস জেফারসনের কথায়। বলল, ‘মনে করবেন না যে, সেদিন সবাইকে আহত করেছেন, আমাকে
আহত করেননি, সেই কৃতজ্ঞতায় আমি আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছি।’
‘কেন?’ বলল আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে তার দু’চোখ মিস জেফারসনের উপর নিবদ্ধ রেখে।
‘দুই কারণে। এক, আপনি আহমদ মুসা। দুই, ইহুদী অপকীর্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আপনি একজন সফল নায়ক।’ বলল সারা জেফারসন ঠোঁটে একটুকরো মিষ্টি হাসি টেনে।
‘শেষের কারণটা বুঝলাম না মিস জেফারসন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ব্যাখ্যাটা আপনাকে বলতে পারি। আমি ফ্রি আমেরিকা ফোরামের একজন সদস্য এবং ফ্রি আমেরিকা কি আপনি জানেন।’
কথা শেষ করেই আবার বলে উঠল মিস জেফারসন, ‘বলুন তো এরপর আমি কি বলব? শুনেছি আপনি ভাল থট রিডার।’
আহমদ মুসা হাসল। মিস জেফারসনের দিকে না তাকিয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘আপনি বেঞ্জামিন বেকনের কোন মেসেজ আমাকে দেবেন।’
প্রচন্ড বিস্ময় নেমে এল মিস জেফারসনের চোখে। স্তদ্ধ হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ সে। তার বিস্ময় বিমূঢ় স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার মুখের উপর নিবদ্ধ।
‘আপনি জানলেন কি করে?’ মিস জেফারসনের চোখে বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টি।
‘কেন, আপনিই তো বললেন, আমি থট রিডার।’ বলল আহমদ মুসা ঠোঁটের কোণে একটু হাসি টেনে।
‘কথার কথা আমি বলেছি। কোন থট রিডারই অতদূর যেতে পারে না।’ মিস জেফারসন বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘থট রিডিং সম্পর্কে আমার জানা নেই। সুতরাং আমি বলতে পারবো না এ বিষয়ে।’
একটু থেমে কন্ঠে একটু গাম্ভীর্য টেনে বলল, ‘অন্য কিছু নয় আপনার কথা থেকেই বুঝছি, বেঞ্জামিন বেকনের কোন মেসেজ থাকতে পারে।’
‘কোন কথা?’
‘ফ্রি আমেরিকা’র সদস্য হিসেবে আপনার পরিচয় দেয়া।’
‘এ থেকে কি বুঝা গেছে?’
‘আপনি ফ্রি আমেরিকা’র সদস্য। ফ্রি আমেরিকা’র আরেকজন সদস্য বেঞ্জামিন বেকন। এখন নিউ মেক্সিকোতে এবং তিনি লস আলামোসের পরিস্থিতির উপর নজর রাখছেন। সুতরাং তার সাথে আপনার অবশ্যই যোগাযোগ হয়েছে। এবং যেহেতু বেঞ্জামিন আমার ব্যাপারে আগ্রহী। সুতরাং তার মেসেজ আপনার মাধ্যমে আসা স্বাভাবিক।’
‘মিঃ আহমদ মুসা আপনার যুক্তিগুলো থেকে ঠিকই ধরতে পারেন, বেঞ্জামিন বেকনের কোন মেসেজ আমার কাছে আছে। কিন্তু সে মেসেজটি আপনাকে দেয়ার জন্যে অপেক্ষা করছি, এটা প্রমাণ হলো কিসে?’
আবারও হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমার ভুলও হতে পারে, আপনার চোখে মুখে কিছু একটা বলার উদগ্রীব অপেক্ষার দৃশ্য আমি লক্ষ্য করেছি।’
সারা জেফারসনের বিস্ময় বিমুঢ় চোখে মুখে একটা উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠল। পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে পড়ল। বলল, ‘ঠিক বলেছেন মিঃ আহমদ মুসা, আপনার সাথে দেখা হওয়া ও কথা বলার জন্যে উদগ্রীব ছিলাম। বেঞ্জামিন একটা জরুরী মেসেজ দিয়েছে।’
‘জরুরী? কি সেটা?’
দু’মিনিট আগে বেঞ্জামিন বেকন আমাকে জানিয়েছে, ফ্রি আমেরিকার নিউ মেক্সিকো মনিটরিং রিপোর্ট থেকে তিনি জানতে পেরেছেন ইহুদী চেহারার আরোহীদের নিয়ে ইহুদী চালিত তিনটি গাড়ি লস আলামোসের দিকে গেছে।’
বলে একটু থামল সারা জেফারসন। আবার শুরু করল তারপর, ফ্রি আমেরিকা’র এটা একটা রুটিন ইনফরমেশন। কিন্তু বেঞ্জামিন কোনভাবে এই খবরটি আপনাকে দিতে বলেছেন। সে জন্যে আমি উদগ্রীব ছিলাম আপনার সাথে কথা বলার জন্যে।’
‘ধন্যবাদ মিস জেফারসন। এই মুহূর্তের জন্য খবরটি খুবই মুল্যবান, যদিও আমি এর কোন তাৎপর্য বুঝতে পারছি না।’
হাসল মিস জেফারসন। বলল, ‘তবে মিঃ আহমদ মুসা এই খবর দেবার লক্ষ্যে আপনার জন্যে উদগ্রীব থাকাটা লেটেস্ট এ্যাডিশন। কিন্তু আপনার সাথে সেই সাক্ষাতের পর যখন জানতে পারলাম আপনি আহমদ মুসা, সেই থেকে আমি উদগ্রীব আপনার দেখা পাবার জন্যে।’
‘কিন্তু তখন তো আমাকে আপনার দেশের শত্রু ঠাওরানো হয়েছিল। সেটা জানার পরও?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
‘আপনাকে আমার বাসায় এক ডিনারের দাওয়াত দিতে চাই।’
বিস্ময় ফুটে উঠল আহমদ মুসার চোখে। বলল, ‘তখন যে অবস্থা ছিল তাতে মার্কিন জেলে আমার স্থান হবার কথা। সম্ভাবনা অবশ্য এখনও আছে। এটা জানার পরও দাওয়াতের ইচ্ছা আপনার মাথায় এলো কি করে?’
‘আপনাকে আমি জানি এবং সেদিন আপনাকে দেখেও আমার স্থির বিশ্বাস হয়েছিল আপনি এ ধরনের ষড়যন্ত্রের মধ্যে থাকতে পারেন না।’
‘আমাকে জানেন কি করে?’
‘বিশ্বের অনেকেই আপনাকে যেমন জানে। বিশেষ করে ফ্রি আমেরিকা’র একজন সদস্য হিসেবে আপনাকে বেশিই জানার কথা।’
‘কেন?’
‘আপনি একটা জাতির মুক্তির জন্যে যেমন কাজ করছেন, তেমনি ফ্রি আমেরিকাও কাজ করছে তার জাতিকে মুক্তির জন্যে। ইহুদীবাদ আপনারও শত্রু, আমাদেরও শত্রু।’
‘বুঝলাম। কিন্তু ডিনারের দাওয়াতের অর্থ কি?’
ম্লান হাসি ফুটে উঠল সারা জেফারসনের মুখে। কিছুটা বিব্রত ভাবও। কিছুটা দ্বিধা করে বলল, ‘আপনি বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু ঘটনাটা সত্য। খুবই সাম্প্রতিক ঘটনা। ক্যারিবিয়ান টার্কস দ্বীপপুঞ্জে হোয়াইট ঈগলের কেলেংকারী নিয়ে (ফ্রি ওয়ার্ল্ড টেলিভিশন) যে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছিল, তার উপর তৈরী ফ্রি আমেরিকা’র একটি রিপোর্ট পড়ছিলাম সে দিন রাতে শোবার আগে। ঐ রিপোর্টেই জানলাম টার্কস দ্বীপপুঞ্জে গোটা কাজের কৃতিত্ব এককভাবেই আপনার।’
সত্যি ভাবছিলাম সেদিন আপনাকে নিয়ে গভীরভাবে। বিস্ময়ে হতবাক হচ্ছিলাম, একজন মানুষ কি করে পারে যেখানে প্রয়োজন সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়তে জাতির সেভিয়ার হয়ে! ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে দেখলাম একজনকে। তিনি আহমদ মুসা। তাকে নিয়ে বসলাম গিয়ে ভার্জিনিয়ার মন্টিসেলোতে গ্র্যান্ড গ্র্যান্ড গ্র্যান্ড দাদু টমাস জেফারসন স্টাডিতে।
সেই স্টাডিতে সেফ ভল্টে দাদুর নিজের হাতের লেখা ‘Declaration of Independence’ এর সে খসড়া রয়েছে, সেই খসড়া তুলে দিলাম আপনার হাতে। বললাম, আমার দাদুরা যে মুক্ত, স্বাধীন, সহজ, সুন্দর এক সহমর্মী আমেরিকার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আপনি আমাদের সাহায্য করুন। আপনি………,
কথা আটকে গেল সারা জেফারসনের। আবেগে তার চোখ মুখ ভারি হয়ে উঠেছে। শেষের কথাগুলো তার কাঁপছিল। মুখ তার নিচু হয়ে গিয়েছিল আগেই। থেমেই দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে রুমাল দিয়ে চোখের সিক্ত কোণ মুছে ফেলল।
মুহূর্তকাল চুপ করে থেকে ‘স্যরি’ বলে হাসার চেষ্টা করে আবার শুরু করল, ‘আপনি আমার বাড়ানো হাতে হাত রাখলেন। তারপর আমরা দুজন বেরিয়ে গেলাম স্টাডি থেকে পাশা পাশি হেঁটে।’ থামল সারা জেফারসন।
আবেগে রক্তিম ও ভারি তার মুখ তখনও।
আহমদ মুসা প্রথমে সারা জেফারসনের কথায় কৌতুক বোধ করছিল। পরে এই কৌতুক তার জন্যে বিব্রতকর বিস্ময়ে রুপান্তরিত হলো।
সারা জেফারসন থামলেও আহমদ মুসা কোন কথা বলতে পারছিল না।
কথা বলল সারা জেফারসনই আবার। সেই ম্লান হাসি তার ঠোঁটে। বলল, ‘যেদিন এখানে দেখলাম আপনাকে এবং জানলাম আপনিই আহমদ মুসা, তখনই আমার মনে হলো, ঐ স্বপ্ন আমার স্বপ্ন ছিল না। ওটা ছিল আমার জন্যে ঈশ্বরের বিধি লেখা। তাই আমি আপনাকে আমার দাদুর মন্টিসেলোর বাড়িতে দাওয়াত দিতে চাই। আমার স্বপ্নকে আমি বাস্তবে রূপ দিতে চাই। আমি দেখছি। আমার স্বপ্নের আহমদ মুসার চাইতে আমার বাস্তবের আহমদ মুসা আরও সুন্দর, আরও মহৎ।’
আবেগে সারা জেফারসনের গলা কাঁপছিল।
প্রবল অস্বস্তি আহমদ মুসার মনে।
মিস জেফারসনের এই আবেগের জবাবে সে কি বলবে?
শান্ত কন্ঠে আহমদ মুসা বলল, ‘মিস জেফারসন, আমি ও বেঞ্জামিন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি আপনাদের কোন কাজে লাগলে সেটা আমার খুশিরই ব্যাপার হবে।’
‘ধন্যবাদ। মন্টিসেলোতে আমার দাওয়াতের ব্যাপারে বলুন।’
‘আমেরিকানদের অন্যতম গৌরবদীপ্ত ফাউন্ডার ফাদার টমাস জেফারসনের স্মৃতি বিজড়িত মন্টিসেলো আমার কাছে অবশ্যই আকর্ষণের। আমি সেখান যেতে পারলে খুশি হবো।’
‘ধন্যবাদ মিঃ আহমদ মুসা। এটুকুই আমার জন্যে যথেষ্ট। আমি নিশ্চিত। ঈশ্বরের যে বিধি লেখা আপনার সাথে আমার সাক্ষাত ঘটিয়েছে, সেই বিধি লেখার জোরেই আপনাকে আমি নিয়ে যেতে পারব গ্র্যান্ড দাদুর মন্টিসেলোতে।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনার বোধ হয় ঈশ্বরের প্রতি খুব আস্থা?’
‘আপনার মত নয়।’
‘কেন নয়?’
‘আমাদের ধর্ম আপনার ধর্মের মত অত সুন্দর না হওয়াও বোধ হয় একটা কারণ।’
‘আমাদের ধর্ম সুন্দর কি করে বুঝলেন?’
‘জানি। আমার গ্রান্ড দাদুর স্টাডিতে ‘এভরি ডে লাইফ ইন ইসলাম’ নামে একটি বই পড়েছি। পড়ে বুঝেছি, ইসলাম বাস্তব জীবনের ধর্ম, খৃস্টান ধর্ম তা নয়। মানুষের জাগতিক জীবন পরিচালনার সাথে খৃস্ট ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই।’
‘ধন্যবাদ, মিস জেফারসন। নিজ ধর্মের প্রশংসা খুবই ভালে লাগে।’
‘এরপর কি প্রশ্ন করবেন?’
‘বলুন তো কি প্রশ্ন করবো?’
‘ভালোকে ভাল বলাই যথেষ্ট নয়। ভালোকে গ্রহণও করতে হয়। তাকি করেছেন?’ বলল সারা জেফারসন। তার মুখে মিষ্টি হাসি।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ধরুন প্রশ্নটা যদি করি?’
‘আমি উত্তর দেব না।’
‘কেন?’
‘তাও বলব না। মন্টিসেলোতে গেলে বলব।’
বলে একটু থেমেই সারা জেফারসন দ্রুত বলে উঠল, ‘ওদিকে বোধ হয় জর্জ আংকেল আমার প্রতি বিরক্ত হচ্ছেন। আর আটকাবো না আপনাকে।’
উঠে দাঁড়াল সারা জেফারসন। আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল।
সারা জেফারসন উঠে দাঁড়িয়ে আবার নিচু হলো। ড্রয়ার খুলে বের করল একটা শোল্ডার হোলস্টার। শোল্ডার হোলস্টারটি আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘সেদিন আমাকে গুলী করেননি বলে এটা আপনার জন্যে সকৃতজ্ঞ উপহার।’ বলে হেসে উঠল সারা জেফারসন।
আহমদ মুসাও হাসল। বলল, ‘ওটাও নিশ্চয় বিধি লেখা ছিল।’
‘কৃতিত্বটা ঈশ্বরকে দেয়ায় আমার আপত্তি নেই।’
‘শোল্ডার হোলস্টারে কি আছে?’
‘সর্বাধুনিক মেশিন রিভলবার।’
‘ধন্যবাদ।’
‘ওয়েলকাম। ওটা কোটের ভেতরে ঘাড়ে পরে নিন। জর্জ আংকেলের চোখে পড়লে আতংক বোধ করতে পারেন। জানেন তো, এফ.বি.আই-এর লোকদের কাছে স্ত্রী থেকে শুরু করে কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।’
‘আবারও ধন্যবাদ মিস জেফারসন।’
‘মিস জেফারসন নয়, শুধু ‘সারা’ বলে ডাকলে খুশি হবো।’
চকিতে আহমদ মুসা সারা জেফারসনের মুখের দিকে একবার তাকাল। আহমদ মুসার চোখে কিছুটা বিব্রত দৃষ্টি।
তারপর আহমদ মুসা শোল্ডার হোলস্টার কোটের ভেতরে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে বেরুবার জন্যে পা বাড়াল।
মিস জেফারসন আগেই এসে দরজা খুলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
‘গুড ডে, সারা।’ বলে আহমদ মুসা বাইরে বেরিয়ে এল।
‘গুড ডে। আস-সালাম।’ উত্তরে বলল সারা জেফারসন। তার ঠোঁটে হাসি।
‘আস-সালাম’ শুনে আহমদ মুসা পেছনে ফিরে তাকাল সারা জেফারসনের দিকে।
সারা জেফারসন বলল, ‘আমি ঐ টুকুর বেশি জানি না।’ ঠোঁটে হাসি সারা জেফারসনের।
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা দ্রুত হাঁটতে শুরু করল।
সারা জেফারসনের মুগ্ধ দৃষ্টি অনুসরণ করল আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা সিড়ির বাঁকে হারিয়ে গেলেও দৃষ্টি তার ফিরে এল না।

লস আলামোস থেকে দু’টি গাড়ি আগে পিছে সারিবদ্ধ হয়ে এগিয়ে চলছিল সান্তাফে রোড ধরে সান্তাফে’র দিকে।
লস আলামোস থেকে সান্তাফে পর্যন্ত ৪০কিলোমিটার রাস্তার প্রায় অর্ধেক গেছে বনের মধ্যে দিয়ে। লস আলামোস থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটারের মত পথ গেছে সান্তা ফে ন্যাশনাল ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে। রাস্তায় যাওয়া আসার লেন প্রায় পাশা-পাশি। মাঝখানে ৫ ফুটের ব্যবধান। ব্যবধানের এই পাঁচ ফুট জায়গায় স্বাভাবিক ভূমি উঁচু-নিচু, এবড়ো থেবড়ো।
বিশ কিলোমিটারের এই বনজ অংশে এপার-ওপার করার মাত্র তিনটি ক্রস পয়েন্ট রয়েছে।
আহমদ মুসা ও জর্জ আব্রাহামদের বহনকারী গাড়ি দু’টি তখন রাস্তায় বনজ অংশের মাঝামাঝি পৌছেছে।
সামনেই রাস্তার একটা ক্রসিং। ক্রসিংয়ের ওপাশটায় লস আলামোস মুখী রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটা গাড়ি।
একজন আরোহী গাড়ির ইঞ্জিন অংশের ঢাকনা তুলে ইঞ্জিনের উপর ঝুঁকে আছে। বিপরীত লেন দিয়ে আহমদ মুসাদের গাড়ি ঐ গাড়িটাকে ক্রস করল।
ক্রস করার সময় এক ঝলকের জন্যে আহমদ মুসার নজরে পড়ল একটা দুরবীণ তাদের দিকে তাক করা। একজন লোক দূরবীণে চোখ লাগিয়ে। তার পাশে আরও দু’জন লোক। মোট আরোহী পাঁচজন, বাইরের লোকটিসহ। ছুটে চলছিল আহমদ মুসাদের গাড়ি। বনজ এলাকার প্রান্তে প্রায় এসে গেছে তারা। সামনে আরেকটা ক্রসিং।
সেদিকে আহমদ মুসার চোখ পড়তেই দেখল ক্রসিংয়ের ওপারের মাথায় ওপারের রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা গাড়ি। তবে এ গাড়ির বাইরে কেউ নেই।
গাড়ির উপর নজর পড়তেই আহমদ মুসার চেতনার সমস্ত স্নায়ুমন্ডলীতে সতর্কতার এক সংকেত ধ্বনিত হলো। হঠাৎ তার মনে হলো পেছনের গাড়ি এবং এই গাড়ি একই উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারে। পেছনের গাড়ির দূরবীণের কথা মনে পড়লো তার। ওরা দূরবীণ দিয়ে তাদের দেখছিল কেন? বিশেষ কোন লোক বা লোকদের তার প্রতীক্ষা করছিল। দূরবীণ দিয়ে গাড়িগুলোতে সেই লোকদেরই কি তারা দেখছিল। তার মনে ঝড়ের মত প্রবেশ করল সারা জেফারসনের কাছে শোনা বেঞ্জামিন বেকনের মেসেজের কথা, ইহুদীদের তিনটি গাড়ি লস আলামোসের দিকে আসার কথা। সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে হলো তারা সামনে ও পিছন থেকে ঘেরাও হয়ে গেছে।
‘গাড়ী থামাও ড্রাইভার।’ অগ্নিগিরির লাভার মতই বিস্ফোরিত হয়ে কথাগুলো বেরিয়ে এল আহমদ মুসার কন্ঠ থেকে।
কঠোর এই নির্দেশের প্রভাবে গাড়িটা একদম ডেডস্টপ হয়ে গেল। পর মুহূর্তেই দু’টি বিস্ফোরণের শব্দ হলো একই সাথে। তারা দেখল, একটি তাদের সামনের রাস্তার উপর বিস্ফোরিত হলো, আরেকটি আরও সামনে তাদের সিকিউরিটিদের বহনকারী গাড়িতে।
সবার চোখের সামনেই তাদের সামনের গাড়িটা প্রবল বিস্ফোরণে খেলনার মত শুন্যে উৎক্ষিপ্ত হলো এবং পরিণত হলো অগ্নি গোলকে।
‘ও গড! আমাদের গাড়ি ডেডস্টপ না হলে যেখানে গিয়ে পৌছাত, সেখানেই রাস্তার উপর দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি হয়েছে। আমাদের আগের গাড়ির মতই এতক্ষণে অগ্নি গোলকে পরিণত হতো এ গাড়ি। ও গড!’ প্রায় একই সাথে চিৎকার করে উঠল জর্জ আব্রাহাম ও জেনারেল শেরউড।
কিন্তু এসব কথার দিকে আহমদ মুসার ভ্রুক্ষেপ নেই। গাড়ি থামতেই আহমদ মুসা তাকিয়েছিল পেছনের দিকে। তার অনুমান ঠিক।
পেছন দিক থেকে সেই গাড়িটি ছুটে আসছে।
আহমদ মুসা দ্রুত পেছন থেকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল বিস্ফোরণের দিকে, তারপর সামনে ক্রসিং এ দাঁড়ানো গাড়িটার দিকে।
জর্জ আব্রাহাম ও জেনারেল শেরউডের কন্ঠের আর্তনাদ থামতেই আহমদ মুসা দ্রুত কন্ঠে বলল, ‘গাড়ি থেকে নেমে পড়ুন, ডান দিকের ঝোপের দিকে দৌড় দিন। ওদের আঘাত আবার নিশ্চয় আসবে।’
গাড়ির আড়াল নিয়ে সবাই দৌড় দিল ঝোপের দিকে। তারা গাড়ি থেকে নামার পর মুহূর্তও পার হলো না। আহমদ মুসারা রাস্তাটা তখনও পার হয়নি, সামনের ক্রসিং এ দাঁড়ানো গাড়ির গ্রেনেড লাঞ্চার থেকে উৎক্ষিপ্ত একটি বিস্ফোরণ এসে আঘাত করলো তাদের দিকে। সিকিউরিটিদের গাড়ির মতই এ গাড়িও তীব্র বিস্ফোরণের মাধ্যমে সওয়ার হয়ে শূন্যে উৎক্ষিপ্ত হলো।
আগুন ও ধোঁয়ার দেয়াল সৃষ্টি হলো রাস্তার উপর। এরই আড়ালে আহমদ মুসারা দ্রুত গিয়ে ঝোপে প্রবেশ করল।
পেছন থেকে ছুটে আসা গাড়িটা তখন অনেকখানি সামনে চলে এসেছে।
বনাঞ্চলের এটা প্রান্ত হলেও ঝোপ ঝাড় এবং বড় বড় গাছ পালা প্রচুর।
রাস্তার পাশেই ঝোপটায় গিয়ে তারা আশ্রয় নিল।
একটা বড় গাছের গোড়ায় ঠেস দিতে দিতে জ্বলন্ত গাড়ি দু’টির দিকে তাকাল সি.আই.এ প্রধান এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার। বলল, ‘বিপদ কিন্তু কাটেনি। সামনের গাড়িটা আমাদের দেখতে পায়নি এবং ওরা মনে করতে পারে সামনের গাড়ির আরোহীদের মতই আমাদের হাল হয়েছে। কিন্তু পেছনের গাড়িটা আমাদের দেখতে পেয়েছে আমরা জংগলে ঢুকেছি। দেখুন ওদের দৃষ্টি এদিকে। ওদের একজন দেখুন দূরবীণ দিয়ে আমাদের অবস্থান বের করার চেষ্টা করছে। আসুন সবাই আমরা গাছে আড়াল নেই।’
সবাই দ্রুত গাছের আড়াল নিল।
আহমদ মুসার দু’পাশের দু’গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়েছে জর্জ আব্রাহাম এবং সি.আই.এ প্রধান এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
জর্জ আব্রাহাম আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এতবড় একটা কান্ড ঘটাল এরা কারা? আপনার অনুমান কি আহমদ মুসা?’
‘অনুমান নয় জনাব, নিশ্চিত বলছি, যাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবার জন্যে আপনারা প্রেসিডেন্টের কাছে যাচ্ছেন, তারাই সাক্ষীদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার মানে আপনি বলছেন, জেনারেল শ্যারন মানে ইহুদীরা এই আক্রমণ চালিয়েছে।’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘জি, হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এত তাড়াতাড়ি এই সিদ্ধান্তে আসার পক্ষে আপনার যুক্তি কি?’ বলল সি.আই.এ প্রধান। তারও চোখে মুখে বিস্ময়।
‘তথ্য প্রমাণের প্রশ্ন না তুলে অবস্থার সাধারণ অঙ্ক কষেই এটা বলা যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
কিছু বলতে যাচ্ছিল জেনারেল শেরউড । কিন্তু আহমদ মুসাই আবার কথা শুরু করায় থেমে গেল জেনারেল শেরউড। আহমদ মুসা বলছিল, রাস্তার দিকে উঁকি দিয়ে, ‘ওদিকে দেখুন।’
সবাই গাছে আড়াল থেকে ঝোপের মধ্যে দিয়ে উঁকি দিল রাস্তার দিকে।
পেছন থেকে ছুটে আসা গাড়িটা ঝোপের প্রায় বরাবর এসে রাস্তার উপর থেমে গেছে। রোড ক্রসিংয়ের ওপারে দাঁড়ানো আক্রমনকারী সেই গাড়িটিও এ রাস্তায় এসে আগের গাড়িটার পাশে দাঁড়াল।
গাড়ি থেকে নেমে এল প্রায় দশ জনের মত লোক। দু’জনের হাতে গ্রেনেড লাঞ্চার, অন্য সবার হাতে স্টেনগান।
‘ওরা এদিকে এগুবার জন্যে তৈরী।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘দ্রুত এগুবার কথা, এগুচ্ছে না তো।’ বলল সি.আই.এ প্রধান এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
‘ওরা আরও একটা গাড়ির মনে হয় অপেক্ষা করছে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার কয়েক মুহূর্ত পরেই আরেকটা গাড়ি রাস্তার ঐ লেন ধরে ঝড়ের বেগে এসে আগের দু’টি গাড়ির পাশে হার্ড ব্রেক কষে দাঁড়াল।
আগের দু’টি গাড়ি থেকে নেমে আসা দশজনই শিথিলভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের অস্ত্রগুলোর ব্যারেল নিচে নামানো। তাদের আনন্দিত চোখ ছুটে আসা গাড়িটার দিকে। আগন্তুক গাড়িটা একটা জীপ। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, ড্রাইভিং সিটে একজন এবং তার পাশে একজন বসে। হাতে তাদেরও স্টেনগান, ট্রিগারে আঙ্গুল।
গাড়ি দেখে খুশি হওয়া দশ জনের চোখ যখন পড়ল গাড়িটার আরোহীর দিকে, তখন আনন্দ তাদের মিলিয়ে গেল। প্রায় এক সংগেই ওদের স্টেনগান উপরে উঠতে শুরু করল।
কিন্তু ততক্ষণে জীপের আরোহীর আঙ্গুল তার স্টেনগানের ট্রিগার চেপে ধরেছে। গুলীর বৃষ্টি ছুটল ওদের দশজনের দিকে।
ওদের দশজনের স্টেনগান জীপ লক্ষ্য করে উঠে আসার আগেই গুলী বৃষ্টি এসে ওদের ঘিরে ধরল। ভূমিশয্যা নিল সকলেই।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করল ভূমিশয্যা নেয়া একজনের দেহ গড়িয়ে দক্ষিণের গাড়িটির দক্ষিণ পাশে চলে গেল। গড়িয়ে যাবার সময় তার হাতের গ্রেনেড লাঞ্চার সে ছাড়েনি।
আহমদ মুসা বুঝল বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকায় সে গুলী বৃষ্টি থেকে বেঁচে গেছে।
সে গাড়ির আড়ালে গিয়ে তার গ্রেনেড লাঞ্চার তাক করছে জীপটিকে লক্ষ্য করে।
জীপের আরোহী এটা দেখতে পায়নি। সে জীপ থেকে নেমে জীপের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
জীপের এ আরোহীকে চিনতে পেরেছে আহমদ মুসা। বেঞ্জামিন বেকন সে । আঁতকে উঠল আহমদ মুসা।
‘বেঞ্জামিন সরে দাঁড়াও’ বলে বুক ফাটা চিৎকার দিয়ে উঠে এক লাফে আহমদ মুসা গাছে আড়াল থেকে বেরিয়ে উন্মুক্ত একটা জায়গায় গিয়ে পড়ল। তার হাত ছিল তার মেশিন রিভলবারের ট্রিগারে। লাফ দিয়ে পড়েই আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলবারের ট্রিগার চেপে ধরল।
মেশিন রিভলবারের এক ঝাঁক গুলী গিয়ে ছেঁকে ধরল গাড়ির দক্ষিণ পাশে গিয়ে লুকানো লোকটিকে।
কিন্তু তার আগেই তার গ্রেনেড লাঞ্চারের ট্রিগার টিপেছিল লোকটি।
গ্রেনেড গিয়ে আঘাত করল জীপটিকে।
আহমদ মুসার চিৎকার শুনতে পেয়েছিল বেঞ্জামিন বেকন। শুনার সাথে সাথেই বেঞ্জামিন বেকন এ্যাক্রোবেটিক কায়দায় তার হাত দু’টি বাম পাশে নিচের দিকে চালিয়ে দিয়ে দু’পা ছেড়ে দিল ওপর দিকে। চোখের পলকে বেঞ্জামিন বেকনের দেহ দু’তিনটি পাক খেয়ে প্রায় পনের ফুট দূরে গিয়ে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়িয়ে দেখল তার জীপটি তার সাথীসহ প্রচন্ড বিস্ফোরণে আকাশে উঠে গেছে।
প্রিয় সাথী এবং ‘ফ্রি আমেরিকা’র একনিষ্ঠ এক সহকর্মীর মর্মান্তিক মৃত্যুর দৃশ্য দেখল সে। আহমদ মুসা সাবধান না করলে তার দেহও ঐ জীপের সাথে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেত।
তাকাল বেঞ্জামিন বেকন আহমদ মুসার দিকে। দেখল সে তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
তাকাল সে গাড়ির আড়ালের সেই গ্রেনেড লাঞ্চারধারীর দিকে। তার দেহ রক্তে ডুবে থাকা দেখতে পেল। বুঝতে পারল আহমদ মুসার গুলীতেই সে প্রাণ হারিয়েছে। তাকে সাবধান করেই আহমদ মুসা তাহলে তাকে গুলী করেছিল।
আবার চোখ ফিরাল বেঞ্জামিন বেকন আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুস কাছাকাছি এসে গেছে।
ঝোপের আড়াল থেকে অন্যেরাও বেরিয়ে এগিয়ে আসছে।
বেঞ্জামিন বেকনও এগুলো আহমদ মুসার দিকে।
দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরল।
জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার ও জেনারেল শেরউডও তখন এসে গেছে।
‘আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন আহমদ মুসা।’ আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে থেকেই বলল বেঞ্জামিন বেকন।
কথা শেষ করেই সামনে দাঁড়ান দেখল এফ.বি.আই প্রধান জর্জ আব্রাহামকে।
আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে বেঞ্জামিন বেকন এ্যাটেনশন হয়ে পা ঠুকে স্যালুট দিল। বলল, ‘স্যার আমি অন ডিউটিতে নই, ছুটিতে আছি।’
হাসল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘এফ.বি.আই-এর সবাই ছুটিতেও অন ডিউটি অবস্থায় থাকে।’
‘ডিউটি সে পালন করেছে জনাব। ও বলেছে, আমি তার প্রাণ বাঁচিয়েছি। কিন্তু সে আমাদের সকলের প্রাণ বাঁচিয়েছে। এই ইহুদী সন্ত্রাসীদের আজকের মূল ষড়যন্ত্র তার সাহায্যেই বানচাল করা গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
একটু ভাবল জর্জ আব্রাহাম। বলল একটু সময় নিয়ে, ‘বুঝতে পারছি, বেঞ্জামিন কোনভাবে আপনাকে খবর পাঠায় যে, এরা আমাদের আক্রমণ করবে। তারপরও সে আক্রমণকারীদের অনুসরণ করে এই তো?’
‘ওরা আক্রমণ করবে, এ নিশ্চিত খবর সেও জানতো না। ও খবর পাঠিয়েছিল ইহুদী চেহারার লোকদের তিনটি গাড়ি লস আলামোসের দিকে যাচ্ছে। প্রথম ক্রসিং-এ একটা গাড়ি দাঁড়ানো দেখি, দ্বিতীয় ক্রসিং-এ আরেকটা গাড়ি ঐভাবে দাঁড়ানো দেখে আমার সন্দেহ হয়। প্রথম গাড়ির একজনকে দূরবীণ দিয়ে আমাদের গাড়ির দিকে তাকাতে দেখেছিলাম। আমার কোন সন্দেহ হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় গাড়ির জানালায় বন্দুকের ব্যারেল দেখলাম, তখন আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি তাড়াতাড়ি গাড়ি থামাতে বলি ও আপনাদের নিয়ে নেমে আসি। সাবধান করতে না পারায় আমাদের রক্ষীদের গাড়ি ওদের আক্রমণের শিকার হয়।’
জর্জ আব্রাহাম মনোযোগ দিয়ে শুনছিল আহমদ মুসার কথা। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলছিল জর্জ আব্রাহাম। কিন্তু তার আগেই সি.আই.এ চীফ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার বলে উঠল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘আপনি তো সর্বক্ষণ আমাদের সাথে ছিলেন। কখন কিভাবে আপনি খবর পেলেন, আমরা জানতে পারলাম না।’
‘একটা সময় আমাদের সাথে ছিলেন না। সারা জেফারসনের সাথে সাক্ষাতের সময়। সারা জেফারসনই বেঞ্জামিন বেকনের মেসেজটা আহমদ মুসাকে দিয়েছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘সারা জেফারসন?’ বিস্ময় ফুটে উঠল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের কন্ঠে।
হাসল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘বিস্ময়ের কিছু নেই এ্যাডমিরাল। সারা জেফারসন ফ্রি আমেরিকা’র একজন অতিগুরুত্বপূর্ণ সদস্য।’
‘ও গড।’ বলে একটু থামল। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘কিন্তু বেঞ্জামিন বেকন এফ.বি.আই চ্যানেলে আপনার কাছে খবর পাঠালো না কেন?’
জর্জ আব্রাহাম মুখ খোলার আগেই বেঞ্জামিন বেকন দ্রুত কন্ঠ বলে উঠল, ‘ছুটিতে থাকলেও এটাই আমার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু আমি জানাইনি কারণ, এফ.বি.আই-এর কোন সূত্রে এ কথাটা এখানকার ইহুদীবাদীদের কাছে পৌছে যেতে পারে।’
জেনারেল শেরউড বিস্মিত চোখে তাকাল জর্জ আব্রাহামের দিকে। বলল, ‘বেঞ্জামিন যা বলল তার কতখানি ঠিক মিঃ জর্জ?’
‘আমি দুঃখিত। বেঞ্জামিনের অভিযোগ সাধারণভাবে সত্য। আমাদের এফ.বি.আই’তেও ইহুদীবাদীদের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন লোক প্রচুর আছে। তাদের অনেকে এফ.বি.আই-এর দায়িত্ব পালনের চেয়ে ইহুদীবাদীদের কথা শোনাকে বেশী গুরুত্ব দেয়।’ বলল বিব্রত কন্ঠে জর্জ আব্রাহাম।
জর্জ আব্রাহাম থামলেও অন্য কেউ কোন কথা বলল না। সি.আই.এ প্রধানের মাথা নিচু।
কিছুক্ষণ পরে কথা বলল জেনারেল শেরউডই আবার। বলল সে, ‘ইহুদীবাদীরা এবং ইহুদী গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল আইজ্যাক শ্যারনের যে অনুসারীরা আমাদের সবাইকে হত্যার ফাঁদ পেতেছিল এবং এক গাড়ি বোঝাই আমাদের সিকিউরিটি পারসোনালদের খুন করেছে, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জঘন্য গোয়েন্দাবৃত্তিতে লিপ্ত, তাদেরই কথা শুনে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হাতে নাতে ধরা পড়া ইহুদী ক্রিমিনালদের ছেড়ে দিতে বলেছেন এবং আমরা ছেড়েও দিয়েছি। আমার নিজেকে অপরাধী বোধ হচ্ছে মিঃ জর্জ আব্রাহাম, মিঃ ম্যাক আর্থার। এ মুহূর্তেই আমি পেন্টাগনকে গোটা বিষয়টা রিপোর্ট করতে চাই।’
‘সবুজ পাহাড় থেকে আপনি তো একটা রিপোর্ট পাঠিয়েছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘পাঠিয়েছি। কিন্তু জানিয়েছি শুধু এইটুকু যে, গোয়েন্দাবৃত্তির সন্দেহে আটক সবুজ পাহাড়ের কিছু লোককে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা প্রধানের আদেশে ছেড়ে দিতে হলো।’ জেনারেল শেরউড বলল।
‘রিপোর্ট আপনি পাঠান, কিন্তু এখন আমাদের প্রধান কাজ হলো ওয়াশিংটনে যত দ্রুত সম্ভব পৌছা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জেনারেল শেরউডকে লক্ষ্য করে।
জর্জ আব্রাহাম থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আজকের এই সন্ত্রাসী ঘটনাও যে ইহুদীরা ঘটিয়েছে, তা প্রমাণ করবেন কিভাবে? আমার মনে হয় তাদের কাছে এমন কিছু পাবেন না যা দিয়ে প্রমাণ হবে যে তারা কোণ ইহুদী ষড়যন্তের সাথে যুক্ত।’
‘স্যরি, এদেরকে এবং এদের গাড়িগুলো তো সার্চ করা হয়নি। আসুন সার্চ করি। আহমদ মুসার অনুমান মিথ্যা হোক।’ বলে জর্জ আব্রাহাম এগুলো লাশগুলোর দিকে।
সবাই মিলে লাশগুলো এবং গাড়ি সার্চ করল। কিন্তু এমন কোন কিছু পেল না, যা দ্বারা প্রমাণ হতে পারে।
‘কিন্তু রেসিয়াল টেস্টে প্রমাণিত হবে এরা ইহুদী।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘টিকানোর মত কোন প্রমাণ এটা হবে না। ইহুদীদের ব্যক্তি পর্যায়ের ক্রাইম তাদের জাতির ঘাড়ে চাপানো যাবে না।’
‘ঠিক বলেছেন আহমদ মুসা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম। তার কন্ঠে হতাশা ফুটে উঠল।
‘প্রমাণ করতে হবে কি না, এটা পরের প্রশ্ন। দেখা যাক। এখন আমাদের প্রধান কাজ ওয়াশিংটনে পৌঁছা, মিঃ জর্জ এয়ারপোর্টে আপনাদের লোকদের বলে দিন, আমাদের দেরী হলো বটে, আমরা আসছি।’
‘ঠিক বলেছেন এ্যাডমিরাল।’ বলে সঙ্গে সঙ্গেই জর্জ আব্রাহাম পকেট থেকে ক্ষুদ্র মোবাইলটা বের করল। স্পীকার অন করে সান্তাফে এয়ারপোর্টে সিংগল স্ট্রোক ডায়াল করেই ভ্রু তার কুঞ্চিত হয়ে উঠল। লাইন জাম।
চোখে তার বিস্ময় চিহ্ন ফুটে উঠল। বলল দ্রুত কন্ঠে, ‘মিঃ ম্যাক আর্থার, মিঃ শেরউড দেখুন তো আপনাদের মোবাইল টেলিফোন কাজ করছে কি না?’
ম্যাক আর্থার ও শেরউড দ্রুত তাদের টেলিফোন পরীক্ষা করল এবং বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল জর্জ আব্রাহামের দিকে। বলল, ‘কম্যুনিকেশন জ্যাম।’
‘এর কি অর্থ দাঁড়ায়?’ বলল জর্জ আব্রাহাম। কন্ঠে তার উদ্বেগ।
উৎকণ্ঠা এবার সি.আই.এ চীফ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের চোখে মুখেও। বলল, ‘অর্থ দাঁড়ায় আমাদের টেলিফোন লাইন জ্যাম করে আমাদের কম্যুনিকেশনের পথ বন্ধ করেছে কেউ।’
‘কিন্তু এই ‘কেউরা’ এই টেকনোলজি পেল কোথায়? সদ্য আবিষ্কৃত এই টপসিক্রেট টেকনোলজি শুধু মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগগুলোই ব্যবহার করছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম বিস্ময় বিস্ফোরিত চোখে।
বিস্ময় আহমদ মুসার চোখে মুখেও। তার মনে এখন সন্দেহ নেই ইহুদী সন্ত্রাসীরাই এই টেলিফোন জ্যামের কাজ করছে। যেন বিপদ আচঁ করলেও তা কাউকে জানাতে না পারে এবং সাহায্য যাতে না পায়। তার অবাক লাগছে, ইহুদীরা এত আট ঘাট বেঁধে অগ্রসর হয়েছে।
আহমদ মুসার চিন্তায় ছেদ পড়ল জর্জ আব্রাহামের প্রশ্নে। বলছে জর্জ আব্রাহাম, ‘টেলিফোন জ্যাম ঘটনাকে আপনি কিভাবে দেখছেন মিঃ আহমদ মুসা?’
‘আমার মনে হয়, লস আলামোস থেকে বেরুবার পরেই টেলিফোন জ্যাম শুরু হয়েছে। সম্ভবত এর উদ্দেশ্য একটাই ছিল। সেটা হলো, ওদের হামলার ব্যাপারটা কিছুটা আপনাদের কাছে ধরা পড়লেও যাতে বাইরে কাউকে জানাতে না পারেন।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা, আমারও তাই মনে হয়।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘সান্তাফে পর্যন্ত রাস্তায় আর কি হামলা আসতে পারে না?’ বলল জেনারেল শেরউড।
‘বেঞ্জামিন বেকনের দেয়া খবর যেহেতু সত্য প্রমাণিত হয়েছে, তাই সে সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।’ আহমদ মুসা বলল।
জর্জ আব্রাহাম নড়ে উঠল। সন্ত্রাসীদের পরিত্যক্ত সামনের গাড়িটার দিকে এগুতে এগুতে সে বলে উঠল, ‘আসুন। বেশ দেরী হয়ে গেছে আমাদের।’
সবাই গাড়িতে উঠল। আগে বেঞ্জামিন বেকনের গাড়ি। তার পেছনে আহমদ মুসাদের গাড়ি।
চলতে শুরু করল তীব্র বেগে দু’টি গাড়ি সান্তাফের দিকে।
সবাই চুপচাপ। অনেকক্ষণ পর নিরবতা ভাঙল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না, জটিল এই জ্যামিং সিস্টেম ওরা কেমন করে পেল এবং এত তাড়াতাড়ি তা এখানে প্রয়োগ করতে পারল কেমন করে!’
কেউ কোন কথা বলল না। এবার নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসা। বলল, ‘ওদের হাত যদি লস আলামোসে পৌছে থাকে, তাহলে এই জ্যামিং টেকনলজি পর্যন্ত পৌছবে না কেন?’ বলল আহমদ মুসা।
নেমে এল আবার নিরবতা।
আবারও নিরবতা ভাঙল জর্জ আব্রাহাম।
বলল, ‘জ্যামিং-এর আরেকটা টার্গেট ওদের আছে আহমদ মুসা। আমরা যাতে কোন খবরই উপরে পৌছাতে না পারি সেটা ওরা চায়।’
‘আপনাদের ঘিরে ওদের সমস্ত তৎপরতারই কেন্দ্র বিন্দু এখন ওটা।’ বলল আহমদ মুসা।
আবার নিরবতা।
ভাবছিল আহমদ মুসা, নিজের কথাটা নিয়েই। ওদের আত্মরক্ষার এখন বড় উপায়ই হলো ওদের তিনজনসহ আহমদ মুসাকে হত্যা করা। কিন্তু সবুজ পাহাড় থেকে লস আলামোস পর্যন্ত গোয়েন্দা সুড়ঙ্গকে ওরা ঢাকবে কি করে? হয়তো তারও ব্যাখ্যা তারা বের করে ফেলবে।
সবারই চোখে মুখে উদ্বেগ ও দুর্ভাবনার চিহ্ন। সবাই নিরব।
ছুটে চলছে দুই গাড়ি।

সান্তাফে বিমার বন্দর।
বোর্ডিং লাউঞ্জে বসে চা খাচ্ছে আহমদ মুসা, জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার এবং জেনারেল শেরউড।
আহমদ মুসার পাশেই বসেছিল জর্জ আব্রাহাম। জর্জ আব্রাহামের পায়ের কাছে কার্পেটের উপর পড়েছিল একটা সিগারেটের প্যাকেট। বার বার তার পা ঠেকছিল সিগারেটের সেই খালি বাক্সটায়।
এক সময় সে ঝুঁকে পড়ে সিগারেটের খালি বাক্সটি তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিল ওয়েস্ট পেপার বক্সে ফেলে দেবার জন্যে।
আহমদ মুসারও দৃষ্টি পড়েছিল প্যাকেটটির উপর। প্রথমেই তার চোখটা আটকে গিয়েছিল প্যাকেটের গায়ে লেখা কয়েকটা হিব্রু অক্ষরের উপর।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে প্যাকেটটির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘মাফ করবে, ওটা আমাকে একটু দেবেন?’
‘না আমিই ফেলে দিয়ে আসছি।’ হেসে বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘না । ওটা একটু দেখব আমি।’ বলল আহমদ মুসা।
জর্জ আব্রাহামের হাত থেকে প্যাকেটটি নিয়ে বসে পড়ল আহমদ মুসা। পড়ল হিব্রু লেখা। কয়েকটি হিব্রু অক্ষর এবং কয়েকটি হিব্রু সংখ্যা। অক্ষর ও সংখ্যাগুলোর ইংরেজী অনুবাদ দাঁড়ায় ‘এফ.বি.আই.ভি ০০২১।’ বুঝল আহমদ মুসা এটা এয়ার লাইন্সের নাম্বার। আবার পড়ল নাম্বারটি। এটি কি এফ.বি.আই-এর নিজস্ব বিমান পরিবহন? কিন্তু হিব্রুতে কে লিখল এই এয়ার লাইন্সের নাম্বার? নাম্বারটি কোন বিমানের? তারা যে বিমানে যাচ্ছে, সে বিমানের নাম্বার কি?
প্রশ্নগুলো এক সঙ্গে জট পাকিয়ে তার মনে প্রবল উতসুক্য সৃষ্টি করল।
‘কি ভাবছেন আহমদ মুসা। বাক্সটিতে কি দেখছেন অমন করে?’ প্রশ্ন করল জর্জ আব্রাহাম।
‘আমরা কি এফ.বি.আই-এর নিজস্ব বিমানে যাচ্ছি?’ প্রশ্নের দিকে কান না দিয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ। কেন?’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘নাম্বার কত?’
জর্জ আব্রাহাম তাকাল পাশেই আরেক সোফায় বসা এফ.বি.আই-এর স্থানীয় এক অফিসারের দিকে। বলল, ‘বল নাম্বারটা।’
নাম্বারটা বলল অফিসারটি।
সিগারেটের বাক্সে লেখা নাম্বারটিই বিমানের নাম্বার।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। তাদের বিমানের নাম হিব্রুতে কে লিখল-এ কার্টুনে? কেন লিখল?
কেন লিখল তার জবাব নিজের কাছেই পেল আহমদ মুসা। লেখার আলগোছে ও বিশৃংখলা স্টাইল দেখে বুঝল, লেখক সচেতনভাবে এবং কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এটা লেখেনি। নিশ্চয় কারও সাথে খোশগল্প করা অবস্থায় বা কাজহীন বসা অবস্থায় আনমনে কলম চালিয়ে লেখাগুলো লিখেছে। তবে যেই লিখুক, হিব্রুই তার প্রধান ভাষা। লেখার আঁচড়গুলো পাঁকা।
কিন্তু কে সেই লোক? তার হাতে এ নাম্বার এলো কেন? বিমানটির সাথে তার কোন সম্পর্ক আছে?
এই চিন্তা করতে গিয়ে আঁৎকে উঠল আহমদ মুসা। ইহুদী ছাড়া খুব কম লোকই হিব্রু জানে। ইহুদী ছাড়া কারও প্রধান ভাষা তো হিব্রু নয়ই। সুতরাং ধরে নিতে হবে একজন ইহুদী তাদের বিমানের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে বা এ বিমান নিয়ে ভেবেছে।
আবারও ভীষণভাবে চমকে উঠল আহমদ মুসা। বলল জর্জ আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে, ‘আমরা এখানে আসার আগে কে বা কারা এখানে বসেছিল, সেটা কি দয়া করে খোঁজ নিতে পারেন?’
আহমদ মুসার চিন্তান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হলো জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘সেটা নিচ্ছি। কিছু ঘটেছে? অন্যকিছু ভাবছেন আপনি?’
‘বলার মত এখনও কিছু হয়নি। আপনি দয়া করে একটু খোঁজ নিন।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
জর্জ আব্রাহাম পাশের এফ.বি.আই অফিসারের কানে কিছু বলল।
উঠে গেল অফিসারটি।
মিনিট খানেকের মধ্যেই সে ফিরে এল ইউনিফরম পরা একজন লোককে নিয়ে। বলল, ‘ইনি বোর্ডিং লাউঞ্জের সিকিউরিটি অফিসার মিঃ মার্টিন। ইনি বলছেন, আমরা আসার আগে এখানে পাইলট ও ক্রুরা বসেছিল।’
পরিচয় শুনে ভেতরের সন্দেহটা আরও ঘনিভূত হলো আহমদ মুসার মধ্যে। বলল সে মার্টিনকে লক্ষ্য করে, ‘কোন বিমানের ওরা?’
‘স্যাররা এফ.বি.আই-এর যে বিমানে যাচ্ছেন, সেই বিমানের?’
‘সবাই বিমানে । শুধু একজন ফিরে গেছে তার বাসায়।’
‘ফিরে গেছেন কেন? কে তিনি?’
‘সে একজন পাইলট । আমি আর কিছু জানি না স্যার।’ বলল সিকিউরিটির লোকটি।
‘আমি জানি।’ বলে উঠল এফ.বি.আই-এর স্থানীয় অফিসারটি।
এতক্ষণে এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার ও জেনারেল শেরউডও আগ্রহী হয়ে উঠেহে বিষয়টার প্রতি। সবার দৃষ্টি এফ.বি.আই-এর অফিসারটির দিকে।
এফ.বি.আই অফিসার বলতে শুরু করল, ‘ফিরে গেছেন পাইলট জন আলফ্রেড। তারই এই ফ্লাইট চালাবার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিমানেই একবার বমি করেন। পরে তিনি ককপিট থেকে নেমে আসেন। বিকল্প হিসাবে জনসন আসেন। তারা সবাই এখানে একত্রে বসে আলাপ করছিলেন ও চা খাচ্ছিলেন।’
এফ.বি.আই অফিসারের দেয়া এই তথ্যে ভ্রু কুঞ্চি হয়ে উঠল আহমদ মুসার। সন্দেহটা শংকার রূপ নিল। বলল আহমদ মুসা সিকিউরিটি অফিসার মার্টিনকে লক্ষ্য করে, ‘আচ্ছা মিঃ মার্টিন, আপনি কি বলতে পারেন, মিঃ জর্জ আব্রাহাম যেখানে বসে আছেন, সেখানটায় তাদের কে বসেছিলেন?’
লোকটি তৎক্ষনাতই উত্তর দিল, ‘যিনি ফিরে গেছেন মানে পাইলট জন আলফ্রেড এখানে বসেছিলেন।’
‘তার আশে-পাশে আর কারা বসা ছিল?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা
‘কেউ ছিল না। তাঁর সামনের এদিকের সোফায় বসা ছিলেন অন্য ক্যাপটেন যিনি বিমানে উঠেছেন। অন্যান্য ক্রুরা অন্যান্য জায়গায় বসা ছিল।’ বলল মার্টিন।
‘ধন্যবাদ মিঃ মার্টিন।’ বলে আহমদ মুসা জর্জ আব্রাহামের দিকে চেয়ে বলল, ‘ওর সাথে কথা শেষ মিঃ জর্জ আব্রাহাম।’
মার্টিন চলে গেল।
মার্টিন চলে যেতেই জর্জ আব্রাহাম আহমদ মুসাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা কথা বলে উঠল। বলল এফ.বি.আই-এর সেই স্থানীয় অফিসারকে লক্ষ্য করে, ‘জন আলফ্রেড কি আপনার পরিচিত?’
‘জি, হ্যাঁ। তিনি এফ.বি.আই-এর অনেক দিনের পাইলট।’
‘বলতে পারেন, তিনি কয়টি ভাষা জানেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘শুধু ইংরেজী। দেশের বাইরেও কখনও উনি যাননি।’
সন্দেহের মধ্যে পড়ে গেল আহমদ মুসা। তাহলে এ হিব্রু লেখা কি ফিরে যাওয়া পাইলটের নয়। তার আগে আর কেউ এখানে বসেছিল? তিনিই লেখা লিখেছেন? কিন্তু এফ.বি.আই-এর নিজস্ব এ ফ্লাইটের নাম্বার সে পাবে কি করে? সেও কি তাহলে এফ.বি.আই-এর কেউ ছিল?
গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে গেল আহমদ মুসা। কিন্তু তার মন নিশ্চিত করে বলছে, হিব্রু ভাষায় তাদের এ গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইটের নাম্বার লেখা সময়ের বিচারে একেবারেই নিরর্থক নয়। ইহুদীদের হাত এ ফ্লাইট পর্যন্ত পৌছেছে। সে হাতের উদ্দেশ্যে কি? লোককে চিহ্নিত করতে পারলে উদ্দেশ্যটা বের হয়ে যেতো।
‘কি ব্যাপার আহমদ মুসা? ঘটনা কি বলুন তো?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠ জর্জ আব্রাহামের । ভাবছে সে, আহমদ মুসা কোন ছোট ব্যাপার নিয়ে এতটা মাথা ঘামানোর কথা নয়।
‘আমি এখনও কোন কিনারায় পৌছুতে পারিনি জনাব।’
বলে একটু দম নিয়ে বলল, ‘আপনাদের বিমানের ক্যাপটেন ও ক্রুদের মধ্যে কেউ হিব্রু জানে?’
জর্জ আব্রাহামের চোখে মুখে ভাবনার চিহ্ন ফুটে উঠল। তাকাল সে এফ.বি.আই-এর স্থানীয় অফিসারের দিকে। তারপর বলল, এ রকম কেউ আছে বলে আমার জানা নেই। সি.আই.এ’র হিব্রু উইং আছে। আমাদের দরকার হলে সি.আই.এ’র সাহায্য নেই। এফ.বি.আই’তে হিব্রু শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই।’
জর্জ আব্রাহামে থামলে এফ.বি.আই-এর স্থানীয় অফিসারটিও বলে উঠল, আমাদের এ ধরনের কোন লোক সান্তাফে বা নিউ মেক্সিকোতে ফ্লাইট ক্রুদের মধ্যে নেই।
‘হ্যাঁ তাই। হিব্রু ইহুদীদের জাতীয় ভাষা, ধর্মীয় ভাষা। সাধারণভাবে তারা এ ভাষা শেখে।’
‘আহমদ মুসাকে আমি সমর্থন করছি। কিন্তু আহমদ মুসা, হিব্রু এবং বিমার ক্রুরা আপনার এ আলোচনায় আসছে কেন? খুলে বলুন সব।’ বলল সি.আই.এ চীফ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
আহমদ মুসা তার হাতের সিগারেট কার্টনটি তুলে ধরে বলল, ‘এই কার্টনে হিব্রু ভাষায় আমরা যে ফ্লাইটে এখন যাব সেই ফ্লাইটের নাম ও নাম্বার লেখা। আমার বিশ্বাস এফ.বি.আই-এর ক্যাপটেন ও ক্রুদের কেউ এটা লিখেছে। কিন্তু আপনারা বলছেন তাদের মধ্যে হিব্রু জানা কোন লোক নেই।’
আহমদ মুসার কথা শোনার সাথে সাথে জর্জ আব্রাহাম ও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের চোখে মুখে চাঞ্চল্য ফুটে উঠল। তারা কথা বলল না। ভাবছিল তারা।
কথা বলে উঠল জেনারেল শেরউড, ‘ব্যক্তিগতভাবে কেউ জানতেও পারে হিব্রু। কিন্তু আহমদ মুসা এর দ্বারা আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন?’
‘মারাত্মক কিছু বুঝাতে চাচ্ছেন জেনারেল। তিনি বলতে চাচ্ছেন, লস আলামোস থেকে আসার পথে আমরা ইহুদী সন্ত্রাসীদের দ্বারা ঘেরাও হয়েছিলাম, আবারও আমরা হতে যাচ্ছি।’ বলল সি.আই. এ চীফ।
জর্জ আব্রাহাম তখনও গম্ভীর। ভাবছেন তিনি, সে আহমদ মুসার হাত থেকে সিগারেট কার্টুনটি নিয়ে লেখার উপরও চোখ বুলিয়েছে। এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের কথা শেষ হলে সে বলল গম্ভীর কন্ঠে, ‘এ হস্তাক্ষর পরীক্ষা করলেই লোক পাওয়া যাবে। আপনার কাউকে সন্দেহ হচ্ছে?’
‘আমার অনুমান ভুল না হলে ফিরে যাওয়া ক্যাপটেন জন আলফ্রেড এটা লিখেছেন।’
জর্জ আব্রাহাম একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে লেখাটা পরীক্ষা করা ও তার সাথে মেলাবার নির্দেশ দিচ্ছি।’
‘সেটা পরের কথা, কিন্তু এখন কি করতে চান?’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন, এখন তো আমাদের রওয়ানা হতে হবে।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘না, এই বিমানে এই ফ্লাইটে যাওয়া যাবেনা।’
‘কি বলছেন আপনি?’ বিস্মিত কন্ঠে বলল জর্জ আব্রাহাম।
একটু থেমেই আবার বলল, ‘আপনার সন্দেহ যদি সত্যও হয় তাহলে সে চলে যাওয়ায় কোন ভয় তো এখন আমাদের নেই। সে তো বিমান চালাচ্ছে না।’
‘আমার যুক্তি দু’টি। এক, আমাদের সন্দেহ যাকে সেই ছদ্মবেশী ইহুদী যে জন আলফ্রেড তা এখনও প্রমাণ হয়নি। বিমানটিতে এখন যিনি ক্যাপটেন, তিনি অথবা অন্যকোন ক্রুও তো আমাদের সন্দেহের তালিকায় আসতে পারেন। দ্বিতীয়ত, আমার বিশ্বাস জন আলফ্রেডের অসুখ হওয়ার ব্যাপারটা একটা ভান। তার বিমান থেকে নেমে যাওয়াটা উদ্দেশ্যমূলক।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আসন থেকে লাফিয়ে উঠল জর্জ আব্রাহাম এবং এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার। দুই জনে প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠল, ‘তার মানে বলতে চাচ্ছেন বিমানে কিছু সে পেতে রেখে গেছে?’
‘আমার সেটাই সন্দেহ।’ বলল আহমদ মুসা।
দু’জনেই ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। দু’জনেরই মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। একটু দেরীতে বুঝেছেন জেনারেল শেরউড। বুঝতে পেরেই সে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘মিঃ আব্রাহাম এখনই গ্রেফতার করার নির্দেশ দিন জন আলফ্রেডকে।’
এফ.বি.আই-এর স্থানীয় অফিসারটি জর্জ আব্রাহামের সাথে সাথে দাঁড়িয়েছিল। আর বসেনি। সে কাঁপছে।
আহমদ মুসা তাকাল অফিসারটির দিকে। বলল, ‘বিমানটি কমপ্লিট চেক করার ব্যবস্থা করুন, বিস্ফোরক ডিটেক্টর দিয়ে। বিমান থেকে কেউ যেন না নামে। দ্বিতীয়ত, হস্তাক্ষর পরীক্ষা ও জন আলফ্রেডের উপর চোখ রাখার ব্যবস্থা করুন, অবিলম্বে।’
অফিসারটি চলে গেল।
‘আমি হেড কোয়ার্টারের সাথে কথা বলে আসি। আমার ই-মেইল ওরা পেলেন কি না।’ বলে উঠে গেল জেনারেল।
জর্জ আব্রাহামও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘জেনারেল আমরা বিশ্রাম কক্ষে আছি। আপনি ওখানে আসুন।’
বলে হাঁটার জন্যে পা বাড়িয়ে আহমদ মুসা ও এ্যাডমিরালের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনারা আসুন।’

‘বলুন আহমদ মুসা এখন কি করনীয়। বিমানে কোন অস্ত্র কিংবা কোন ধরনের কোন বিস্ফোরকের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
সার্চ টীমটিকেও সাথে নিয়ে এসেছিল এফ.বি.আই-এর অফিসারটি। টীমটির যিনি অধিনায়ক জিজ্ঞাসার জবাবে তিনিও বললেন, ‘ইঞ্জিন রুম থেকে শুরু করে স্টোর রুম, টয়লেট প্রতিটি সিট মোটকথা বিমানের প্রতি ইঞ্চি জায়গা আলট্রা সেনসেটিভ ডিটেক্টর দিয়ে সার্চ করা হয়েছে। কিছুই পাওয়া যায়নি।’
আহমদ মুসা কিছু বলল না। তাকাল এফ.বি.আই-এর সেই অফিসারের দিকে। বলল, ‘জন আলফ্রেডের খবর কি?’
অফিসারটি জবাব দেবার আগেই তার মোবাইল বেজে উঠল। টেলিফোন কল এসেছে।
মোবাইলে কথা বলল অফিসারটি। কথা বলতে গিয়ে তার মুখ অন্ধকার হয়ে উঠল। কথা বলা শেষ করে সে প্রায় আর্ত কন্ঠে বলল, ‘স্যার, জন আলফ্রেডকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ি,হাসপাতাল, ক্লিনিক, ক্লাব , আত্মীয় বাড়ি সব জায়গায় খোঁজ নেয়া হয়েছে।’
‘সর্বশেষ তাকে কে কোথায় দেখেছ।’ উৎকণ্ঠিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল জর্জ আব্রাহাম।
‘সে এয়ারপোর্ট থেকে ফ্ল্যাটে ফেরেনি।’
বোবা এক নিরবতা নেমে এল সবার মধ্যে। প্রবল এক অস্বস্তি, উৎকণ্ঠা সকলের মধ্যে।
নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসা। বলল সে বিমান সার্চকারী বিস্ফোরক এক্সপার্টদের লক্ষ্য করে, কত প্রকার বিস্ফোরক পাতা যায় বলুনতো?’
সার্চ টীমের নেতা অনেক প্রকারের বিবরণ দিল।
‘সব বলেছেন, কিন্তু একটা বাদ থেকে গেছে।’ বলেই একটু থেমে আবার বলল, ‘বলুন তো এ বিমানের ইঞ্জিনে রিমোট স্টার্টিং-এর ব্যবস্থা আছে?’
‘আছে।’ বলল সার্চ টীমের চীফ।
‘তাহলে বিমান থেকে সবাইকে নামিয়ে বিমান ইঞ্জিন রিমোট স্টার্টের ব্যবস্থা করুন।’
টীমের চীফ জর্জ আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে তার সম্মতি পেয়ে বেরিয়ে গেল তার টীমের লোকদের নিয়ে। টীমের লোকদের সাথে জর্জ আব্রাহামরাও বিশ্রাম কক্ষ থেকে বেরিয়ে আগের সেই বোর্ডিং লাউঞ্জে ফিরে এল।
ওখানে বসেই কাঁচের দেয়ালের মধ্যে দিয়ে দেখল সার্চ টীমকে বিমান থেকে বিমানের ক্যাপটেন ও ক্রু সবাইকে নামিয়ে আনতে। তার আগেই বিমানকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গ্যাংওয়ে থেকে বেশ দূরে।
ক্যাপ্টেনের হাতেই দেখা গেল রিমোর্ট কন্ট্রোলার।
বিমান থেকে একটু দূরে এসে সবাই দাঁড়াল। ডান হাতের রিমোর্ট কন্ট্রোলার একটু উপরে তুলতে দেখা গেল ক্যাপ্টেনকে। রিমোর্ট স্টার্টের বোতামে চাপ দিয়েছে বোধ হয় ক্যাপ্টেন।
সঙ্গে সঙ্গেই ঘটল ভয়াবহ এক বিস্ফোরণ। প্রথমে বিমানের মধ্য থেকে সামনের অংশ উড়ে গেল। তারপর গোটা বিমানই অগ্নিগোলকের আকারে আকাশে উঠে গেল।
সকলের চোখ সেদিকে নিবদ্ধ। জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার ও জেনারেল শেরউডের চেহারা মরার মত পান্ডুর। পাথরের মত তারা স্থির ও নিস্তদ্ধ। চোখে তাদের পলক নেই।
নিরবতা ভাঙল জেনারেল শেরউড। আসন থেকে উঠে সে ছুটে আহমদ মুসার পাশে এসে বসল। বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা গত কয়েক ঘন্টায় আপনি দু’বার আমাদেরকে একেবারে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনলেন। আমি আপনার অনেক গুনের কথাও শুনেছি, কিন্তু আজ দেখলাম আপনি সর্বদর্শীও।’
‘আল্লাহ মাফ করুন। আল্লাহই একমাত্র সর্বদশী। আমি একটা ক্লু পেয়ে সন্দেহ করেছি মাত্র, এটা এমন কিছু নয়।’
মুখ খুলল এবার জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা কোন সন্দেহে আপনি রিমোট স্টার্টের এই ব্যবস্থা করলেন?’
‘আমি তো বলেছিলাম, সার্চ টীমের নেতা বিস্ফোরনের সবগুলো প্রকারের কথা বলছেন, একটাই শুধু বলেননি। সেটা হলো, একটা বিস্ফোরক প্রযুক্তি অতিসম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে যা ডিটেক্টর-নিউট্রাল একটা আবরণে মোড়া থাকে। কোন প্রকার ডিটেক্টর দিয়েই তার সন্ধান মেলে না। এই বিস্ফোরক পাতা থাকে ইঞ্জিন অথবা ঘর্ষণসৃষ্টিকারী কোন বস্তুর সাথে। ইঞ্জিন বা ঘর্ষণসৃষ্টিকারী বস্তুটি চালু হলেই বিস্ফোরণ ঘটে যায়। আমার সন্দেহ হয়েছিল, ইহুদীরা যদি কিছু করেই থাকে, তাহলে এই সর্বাধূনিক প্রযুক্তিরই আশ্রয় নিয়েছে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা, আপনি বলার পর ঐ বিস্ফোরক প্রযুক্তির কথা আমার মনে পড়েছে। কিন্তু এই বিস্ফোরক তো এখনও মার্কেটে যায়নি, ওরা পেল কি করে?’
‘যেভাবে রেডিও কম্যুনিকেশন জ্যাম করার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ওরা পেয়েছে, সেভাবে এটাও ওরা পেয়েছে।’ বলল জেনারেল শেরউড।
বলে একটা দম নিয়েই ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল, ‘ইহুদীবাদীদের কাছে মনে হচ্ছে আমাদের গোপন কিছুই আর গোপন নেই। ওদের গোয়েন্দাগিরী মনে হয় আমাদের আপাদ-মস্তক ছেয়ে ফেলেছে। দেখছি ঘরের শত্রু মহাবিভীষণ ওরা।’
‘উদার গণতন্ত্রমনাদের সংসারে যদি কোন কূট কুশলীর অনুপ্রবেশ ঘটে ,তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা কিছুটা হালকা সুরে।
‘দুঃখের মধ্যেও হাসালেন আহমদ মুসা। তাহলে আপনি মানে আপনারা স্বীকার করছেন মার্কিন জনগণ উদার ও গনতন্ত্রমনা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম। মুখে তার ম্লান হাসি।
‘আমরা মানে মুসলমানরা তো এ কথা কখনও অস্বীকার করিনি যে আজ আমি স্বীকার করছি।’
‘আপনাদের গালির ভাষা কিন্তু তাই বলে, মিঃ আহমদ মুসা।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
‘মার্কিন সরকারের পলিসি এবং মার্কিন জনগণ কিন্তু এক নয়। মার্কিন সরকার বদল হয়,তার পলিসিও বদল হয়, কিন্তু মার্কিন জনগণ বদল হয় না। মার্কিন সরকার যে পলিসি নেয় তার সবটা মার্কিন জনগণ মেনে নেয় না। মার্কিন সরকার ভিয়েতনামে সৈন্য পাঠিয়েছিল, মার্কিন জনগণই তা ফেরত এনেছিল।’
‘যা হোক আহমদ মুসা। আপনি যে কথাটা বলেছেন, সেটা কিন্তু খুবই সত্য। ওরা আমাদের বিশ্বাসের ঘরে চুরি করেছে। আমাদের অস্ত্র হাত করে আমাদের উপরই প্রয়োগ করেছে।’ বলল জেনারেল শেরউড।
বলেই উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘যাই ব্যাপারটা হেড কোয়ার্টারে আমি রিপোর্ট করে আসি।’
এফ.বি.আই-এর স্থানীয় সিকিউরিটি যে অফিসার বাইরে গিয়েছিল, সে দ্রুত ফিরে এসে লাউঞ্জে ঢুকল এবং জর্জ আব্রাহামকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার, ওয়াশিংটনের আমাদের হেড কোয়ার্টার থেকে লোক আসছে প্লেন নিয়ে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ল্যান্ড করবে।’
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমি এমনটাই আশা করেছিলাম। যাক ঘটনা তুমি হেড কোয়ার্টারে রিপোর্ট করেছ?’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘জি স্যার।’ বলল অফিসারটি।
‘আমি আসছি মিঃ আব্রাহাম। আমার ডকুমেন্টগুলো ওরা হেড কোয়ার্টারে পাঠাল কি না’ বলে লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে গেল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
‘ওদিকে দেখে আমি আসছি স্যার।’ বলে বেরিয়ে গেল এফ.বি.আই-এর স্থানীয় অফিসারটিও।
এফ.বি.আই-এর বিমান বিস্ফোরণ নিয়ে তখন বাইরে এয়ারপোর্ট ও পুলিশের মধ্যে হুলুস্থুল চলছে। জন আলফ্রেডের সন্ধানে ছুটাছুটি শুরু করেছে তখন বাঘা বাঘা পুলিশ আর গোয়েন্দার দল।
হাতে কোন কাজ নেই। সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে আহমদ মুসা ও জর্জ আব্রাহাম।
কাঁচের দেয়ালের ভেতর দিয়ে তাদের দু’জনের চোখ নিবদ্ধ ছিল নীল আকাশের দিকে।
এক সময় সেই নীল আকাশের বুকে তাদের চোখে ছোট একটা সাদা বিমান ধরা পড়ল।
ওয়াশিংটন এফ.বি.আই হেড কোয়ার্টার থেকে আসা প্লেন।
ল্যান্ড করছে প্লেনটি।

এবার নিয়ে দশবার টেলিফোন করল জর্জ জুনিয়র সাবা বেনগুরিয়ানের বাড়িতে। কোন উত্তর নেই সেখান থেকে।
বিস্মিত হলো জর্জ জুনিয়র। সাবার তো টেলিফোনের জন্যে অপেক্ষা করার কথা। তার এ সময় কোথাও যাবার প্রশ্ন আসে না। গেলেও তার মোবাইল তো সে রেখে যাবার কথা নয়।
জর্জ জুনিয়র অবশেষে টেলিফোন করল সাবাদের হাউজ-সেট টেলিফোনে। একবার, দু’বার, তিনবার, কোন সাড়া নেই ওপার থেকে। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ টেলিফোন ধরছে না।
বিস্মিত হলো জর্জ জুনিয়র। এমন হওয়াটা অসম্ভব। বাড়ি শুদ্ধ কোথাও গেলেও রিপ্লাই ব্যবস্থা অবশ্যই চালু রেখে যাবে।
ঘড়ির দিকে তাকাল জর্জ জুনিয়র। প্লেনের আর আধ ঘন্টা দেরী। আর দেরী করা যায় না। সাবাদের বাড়িতেই যেতে হবে। দরকার হলে প্লেনের সময় পাল্টিয়ে অন্য সময় ফ্লাইট ধরবে।
উঠল জর্জ জুনিয়র। তৈরী হয়ে বাড়ি থেকে বেরুল সে। তার গাড়ি ছুটল সাবা বেনগুরিয়ানের বাড়ির দিকে।
সাবা বেনগুরিয়ানের বাড়ির গেটে এসে থামল জর্জ জুনিয়রের গাড়ি।
গাড়ি থেকেই সে দেখল গেট বন্ধ। কিন্তু গার্ড বক্স থেকে কেউ বেরিয়ে এল না। অথচ গেটের সামনে গাড়ি থামার সাথে সাথেই গেটম্যান বেরিয়ে আসার কথা। কিন্তু কেউ আজ বেরিয়ে এল না।
জর্জ জুনিয়র কয়েকবার হর্ন বাজাল।
গেটের ভেতরে একটা শব্দ হলো। মনে হলো কেউ গেট খুলছে। খুলে গেল গেট। গেটে দাঁড়ান গেটম্যান।
গাড়ি নিয়ে এগুতে চাইল জর্জ জুনিয়র।
সরল না গেটম্যান গেট থেকে। হাত তুলে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল। জর্জ জুনিয়র একেবারে তার গা ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করাল। জর্জ জুনিয়র বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে।
গেটম্যান একজন এক্স মিলিটারি ম্যান। পুরোপুরি শ্বেতাংগ বলতে যা বুঝায় তা সে না। চেহারায় একটা মিশ্রণ আছে। সুতরাং ইহুদী ধরে নেয়া যায়।
জর্জ জুনিয়রকে একটি স্যালুট দিয়ে গেটম্যান বলল, ‘কেউ বাড়িতে নেই স্যার। তবে ছোট মেম সাহেবের একটা মেসেজ আছে আপনার জন্যে।’
তার শেষের কথাটা জর্জ জুনিয়রের কানে সবটা পৌছার আগেই সে বলে উঠল, ‘কোথায় গেছে ওরা?’
‘আমি জানি না স্যার। একটা মাইক্রো এল। তা থেকে দু’জন লোক নেমে এল। তারা বাড়িতে ঢুকে বড় সাহেব ও ছোট মেম সাহেবকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে ঐ মাইক্রোতে উঠে গেলেন।’
‘তোমাকে কিছু বলে যাননি ওরা?’
‘বড় সাহেব কিছুই বলেননি। তাঁর মুখ দেখে আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাইনি।’
‘তার মানে? ওর মুখ কি রকম ছিল?’
‘খুব বিষন্ন, বিরক্ত।’
‘ওরা কি কোন দুঃসংবাদ পেয়েছিলেন?’
‘বলতে পারবো না স্যার। তবে মাইক্রোটি আসার ১০ মিনিট আগে বড় সাহেবের বন্ধু মিঃ শ্যারন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। তাঁকেও বিষন্ন ও উদ্বিগ্ন দেখি।’
‘মিঃ শ্যারন বেরিয়ে গিয়েছিলেন? দশ মিনিট আগে?’
‘জি হ্যাঁ।’
‘এখন বাড়িতে কেউ নেই?’
‘আছেন। হাউজ-স্টাফ। ওরা নিচের তলায়।’
‘ওদের কাউকে কিছু বলে যাননি?’
‘না, স্যার। ওরাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে।’
‘ওদের সাথে লাগেজ ছিল?’
‘বড় সাহেব ও ছোট মেম সাহেব দু’জনের হাতে দু’টো সুটকেস ছাড়া আর কিছুই ছিল না।’
‘ধন্যবাদ, আসি।’ বলে জর্জ জুনিয়র চলে আসছিল।
‘স্যার, ছোট মেম সাহেবের একটা চিঠি আছে আপনার জন্যে। নিন।’
গেটম্যান একটা মোটা ইনভেলাপ জর্জ জুনিয়রের দিকে বাড়িয়ে ধরল।
‘সাবার চিঠি?’ বলে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত গেটম্যানের হাত থেকে চিঠিটি লুফে নিল জর্জ জুনিয়র। ইনভেলাপটি হাতে দ্রুত জর্জ এসে গাড়িতে চড়ল।
ওদিকে গেট তখন বন্ধ হয়ে গেছে।
ইনভেলাপটি হাতে নিয়েই জর্জ জুনিয়র বুঝেছিল, একটা শক্ত কিছু ইনভেলাপের মধ্যে রয়েছে।
তর সইল না জর্জ জুনিয়রের। সাবা কি লিখেছে তা পড়ার জন্যে অস্থির হয়েছে সে।
ইনভেলাপটি খুলল সে। বেরিয়ে এল ভিডিও ক্যামেরার একটা ডিস্ক। কোন চিঠি ইনভেলাপে নেই।
প্রথমেই হতাশার একটা চোট লাগল তার মনে যে, সাবার কোন চিঠি ইনভেলাপে নাই। পরক্ষনেই ভিডিও ডিস্ক তার মনকে ভিন্ন দিকে নিয়ে গেল। কি আছে এতে? সাবা কেন তাকে দিয়েছে এ ডিস্ক দারোয়ানের মাধ্যমে?
হঠাৎ জর্জের মনটা খুশি হয়ে উঠল। ভাবল, এই ডিস্কে নিশ্চয় এমন কিছু ডকুমেন্ট আছে যা থেকে তার প্রশ্নের জবাব মিলবে। না হলে সাবা কেন ডিস্কটা তাকে এভাবে দিয়ে গেছে। ডিস্কটা তার কাছে এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো।
জর্জ জুনিয়র ডিক্সটা রাখতে যাচ্ছিল তার জ্যাকেটের পকেটে, কিন্তু তা না রেখে চালান দিল তার মোজার ভেতরে, একজন পাকা গোয়েন্দার মত। ভাবল, জ্যাকেটে রাখলে তা ভুলেও যেতে পারে। কিন্তু মোজা খুলতে গেলে চোখে পড়বেই।
গাড়ি স্টার্ট দিল জর্জ জুনিয়র। চলল বাড়ির দিকে।
নিউ মেক্সিকো যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়েই সে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু সে পাল্টেছে তার সিদ্ধান্ত। সাবার ভিডিও টেপ না দেখে সে কোথাও পা বাড়াবে না।
সাবা বেনগুরিয়ানের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এ্যাপ্রোস রোড থেকে মূল রোডে পড়ার মুখেই জর্জ জুনিয়র দেখল একটা মাইক্রো দাঁড়িয়ে আছে। বোধ হয় হঠাৎ স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। একজন লোক নেমে গাড়ির ইঞ্জিন পরীক্ষা করছে।
জর্জ জুনিয়রের গাড়ি দেখে ইঞ্জিনের উপর ঝুঁকে পড়া মাথা তুলে ইশারা করল জর্জ জুনিয়রের গাড়িকে অপেক্ষা করার জন্য।
জর্জ জুনিয়র গাড়ি রাস্তায় আড়াআড়ি দাঁড়ানো মাইক্রোর প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
জর্জ জুনিয়র গাড়ি থেকে বেরিয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হ্যালো, সমস্যা……’
জর্জ জুনিয়র কথা শেষ করতে পারল না।
মাইক্রো থেকে ছুটে এসে তিনজন লোক জর্জ জুনিয়রকে ঘিরে ফেলল।
জর্জ জুনিয়র কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন ডান হাত দিয়ে তার গলা পেঁচিয়ে বাম হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। অন্য দু’জন পা ধরে চ্যাংদোলা করে চোখের পলকে তাকে নিয়ে গাড়িতে তুলল।
মুখ চেপে ধরা লোকটি হাতে ক্লোরোফরম ভেজা রুমাল ছিল। ওরা জর্জ জুনিয়রকে যখন মাইক্রোর মেঝেতে নিয়ে রাখল, তখন সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে।
যখন তার জ্ঞান ফিরল সে দেখল একটা টেবিলের উপর শুয়ে আছে। সে চোখ মেলেই উঠার চেষ্টা করল।
টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়েছিল কয়েকজন।
একজন জর্জ জুনিয়রের গালে বিরাশী কেজি ওজনের একটা থাপ্পড় কষে বলল, ‘হারামজাদা। তো জ্ঞান ফিরতে বড্ড দেরী হয়েছে।’
জর্জ জুনিয়র ছিটকে পড়ল টেবিল থেকে মেঝের উপর।
সঙ্গে সংগেই আরেকজন তাকে তুলে বসাল। এই লোকটিই সবার মধ্যে উচ্চতায় বড়। একদম ইহুদী চেহারা। বলল সে হেঁড়ে গলায়, ‘তোদের বাসার সিকিউরিটি বক্সের টেলিফোন নাম্বার কত?’
‘কেন?’ ক্লান্ত কন্ঠে বলল জর্জ জুনিয়র লোকটির দিকে তাকিয়ে।
লোকটির ডান হাতে একটা মোবাইল।
লোকটি গর্জে উঠল, ‘দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলে থাপ্পড়ে সব দাঁত খুলে ফেলব। যা জিজ্ঞেস করেছি তার জবাব দে।’
‘দেব না।’ বলল জর্জ জুনিয়র। জর্জ জুনিয়রের কথার রেষ বাতাসে মিলাবার আগেই লোকটির প্রচন্ড একটা ঘুষি গিয়ে পড়ল জর্জ জুনিয়রের মুখে। তার নাক ফেটে গল গল করে রক্ত বেরিয়ে এল।
ঘুষি মেরেই লোকটি বলে উঠল, ‘বলবি না কথা। চেয়ে দেখ তোর প্রেমিকার দিকে।’
বলে লোকটি ইংগিত করল জর্জ জুনিয়রের মাথার পেছনের দিকে।
জর্জ জুনিয়র চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাল। দেখল, জেলখানার মত গ্রীল দেয়া দরজার ওপারে ছোট্ট একটা কক্ষে বসে আছে সাবা বেনগুরিয়ান। তার চুল উষ্ক-খুষ্ক। দু’চোখের কোণ ফোলা। তার নাক ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে।
ক্রোধে গা জ্বলে উঠল জর্জ জুনিয়রের। বলল, ‘মনে করেছিস নির্যাতন করেই সবার কাছ থেকে কথা আদায় করতে পারবি?’
লোকটি হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘পারব। কয়েকটা ঘুষি থাপ্পড় খাওয়ার পরও মিস সাবা এ ধরনের কথা বলছিল। কিন্তু একজন মানুষ হায়েনা যখন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তার কাপড় খুলতে শুরু করল, তখন গলে গেল একদম মোমের মত। গড় গড় করে বলে গেল সব কথা। কম্পিউটারে কি দেখেছে, কি হয়েছে সব কিছু। তুইও বলবি।’
কথা শেষ করে লোকটি একটা তালি বাজাল। গরিলা মার্কা একজন লোক ঘরে প্রবেশ করল।
‘বিংগ যা সেল থেকে ম্যাডামকে নিয়ে আয়। তখন তোর হাত থেকে শিকার কেড়ে নিয়েছিলাম, এবার বোধ হয় তা তোর ভাগ্য জুটবে।’
শুনেই বিংগ ছুটল সেলের দিকে। দরজা খুলে পাঁজাকোলা করে সাবাকে নিয়ে এসে শুইয়ে দিল জর্জ জুনিয়রের সামনে, মেঝেতে।
‘শেষবারের মত বলছি, আমাদের কথা শোন। তাহলে তোমার চোখের সামনে হায়েনারা তোমার প্রেমিকার দেহ লুটে-পুটে খাবে না।’
‘তোমরা টেলিফোন নাম্বার কি করবে?’ বলল জর্জ জুনিয়র। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ। সে জানে, ওরা যা বলছে তার ষোল আলাই তারা করবে। সাবাকে সে কিছুতেই এই জঘন্য পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে না।
‘টেলিফোন নাম্বার কি করবো সেটাও দেখতে পাবে।’ বলল সেই লোকটি।
লোকটি থামতেই সাবা বেনগুরিয়ান বলে উঠল, ‘জর্জ তুমি আমার কথা ভেবে ওদের সহযোগিতা করো না। ওরা আমেরিকার শত্রু।’
লোকটি দু’টি চোখ জ্বলে উঠল। সে ফুটবলের গোল কিকের মত একটা প্রচন্ড লাথি কষল সাবা বেনগুরিয়ানকে।
একবার ‘কঁক’ করে উঠার পর কুঁকড়ে গেল সে অসহ্য বেদনায়।
‘আমি বলছি, তোমরা সাবা বেনগুরিয়ানের গায়ে হাত তুলবে না।’
বলে একটা দম নিয়েই তাদের বাড়ির সিকিউরিটি টেলিফোন নাম্বার সে বলল।
‘ধন্যবাদ জর্জ জুনিয়র। তুমি আদর্শ প্রেমিকের কাজ করেছ। এবার এ কাগজটায় যা লেখা আছে তা তোমাদের সিকিউরিটি অফিসারকে জানিয়ে দাও।’
বলে লোকটি কাগজের একটা স্লিপ জর্জ জুনিয়রের হাতে তুলে দিল।
জর্জ জুনিয়র পড়ল কাগজটি। কাগজে লেখা আছে, ‘পত্রবাহকের হাতে আব্বার কমুনিকেশন টেবিলের মাস্টার কম্পিউটারটি দিয়ে দেবে। বাসায় ওটা এখন নিরাপদ নয়। আব্বার পরামর্শেই এই চিঠি লিখলাম।’
লোকটি তার মোবাইলে জর্জ জুনিয়রের দেয়া টেলিফোন নাম্বার নক করে টেলিফোনটি তুলে দিল জর্জ জুনিয়রের হাতে।
জর্জ জুনিয়র টেলিফোনটি হাতে নিল। ওপার থেকে সিকিউরিটি অফিসারের কন্ঠ পাবার পর কাগজে যা লেখা ছিল, তা বলল খুব স্বাভাবিক কন্ঠেই।
‘ধন্যবাদ জর্জ জুনিয়র। তোমার টকিং পারফরমেন্স খুব ভাল হয়েছে। পুরষ্কার হিসেবে তোমার প্রেমিকার সাথে হানিমুনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
জর্জ জুনিয়র ওদিকে কান না দিয়ে বলল, ‘তোমরা ঐ কম্পিউটার দিয়ে কি করবে? মনে করেছ কম্পিউটারের রেকর্ডগুলো মুছে গেলেই রক্ষা পেয়ে যাবে?’
‘শুধু ঐ রেকর্ড নয়, সব রেকর্ডই আমরা মুছে ফেলব।’
‘কিন্তু সব কিছুর পরেও সবুজ পাহাড়ে থেকে লস আলামোসে পর্যন্ত তোমাদের তৈরী সুড়ঙ্গ গোয়েন্দাগিরীর প্রমাণ হিসেবে থেকেই যাবে।’
হো হো করে হেসে উঠল লোকটি। বলল, ‘তোমরা আমেরিকানরা বিচার-বুদ্ধিদীন গনতন্ত্র করে মাথাটা একেবারে ফাঁকা করে ফেলেছ।’
বলে একটু থামল। বলল তারপর একটু গম্ভীর কন্ঠে, ‘প্রমাণ হবে সুড়ংগটি তৈরী হয় লস আলামোস থেকে এমারজেন্সী এক্সিটের একমাত্র পথ হিসেবে। যাতে লস আলামোসে কোন সোভিয়েট হামলার সময় অতিগুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক গবেষণা রক্ষা করা যায়। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে ইহুদী বিজ্ঞানী জন জ্যাকব সহায়তা করেছে মাত্র।
লোকটির কথা শুনে স্তম্ভিত হলো জর্জ জুনিয়র। তারও এখন মনে হচ্ছে তথ্যটা খুবই যৌক্তিক । একটা মিথ্যাকে তারা এভাবে সত্য হিসেবে দাঁড় করাতে পারবে? কোন কথা সরল না জর্জ জুনিয়রের মুখ থেকে।
লোকটি বলে উঠল, ‘এদের দু’জনকে ঐ হানিমুন কক্ষে ঢুকিয়ে দাও। আমাদের ঐ কম্পিউটার উদ্ধারে এখনি ছুটতে হবে।’ বলে সে বেরিয়ে গেল।
জর্জ ও সাবাকে গ্রীলের দরজার ওপারের সেলটাতে ঠেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে ওরা সবাই বেরিয়ে গেল।

ডার্ক কাঁচের একটা মার্সিডিস গাড়ি জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের গেটের সামনে এসে দাঁড়াল।
সিকিউরিটি বক্সের একজন সৈনিক গাড়ির নাম্বারের দিকে একবার তাকিয়েই সুইচ টিপে দরজা খুলে দিল। গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করে গাড়ি বারান্দার দিকে গেল না। গাড়ি বারান্দার পাশ দিয়ে গিয়ে একটা ওয়ালের কাছে দাঁড়াল। দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই স্টিলের ওয়াল উপরে উঠে গেল।
গাড়ি ঢুকে গেল ভেতরে। ভেতরে আরেকটা গাড়ি বারান্দা রয়েছে। সেখানে গিয়ে গাড়িটা থামল।
গাড়ি থামতেই এক পাশে দাঁড়ানো একজন এসে গাড়ির দরজা খুলে জেনারেল শ্যারনকে স্বাগত জানাল।
‘কেমন আছ রবিন?’ গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল জেনারেল শ্যারন।
রবিন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের প্রাইভেট সেক্রেটারি।
‘ভালো আছি স্যার। আপনি?’
‘ভালো নেই।’
‘জানি স্যার। আমাদের সাহেবকে প্রেসিডেন্ট জরুরী তলব করেছেন?’
‘তাই?’
‘জি হ্যাঁ।’
‘কখন যাচ্ছেন উনি?’
‘সম্ভবত ঘন্টা খানেক পরেই।’
‘বিশেষ কারণ কিছু আছে?’
‘আপনাদের সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের কাছে আরও কিছু রিপোর্ট এসেছে।’
‘আসারই কথা।’
এ রকম ছোটখাট দু’একটা কথা বলতে বলতে তারা দু’তলার একটা কক্ষের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
‘স্যার একটু দাঁড়ান, আমি আসছি।’ বলে রবিন দরজা খুলে ঘরে ঢুকে গেল।
কয়েক মুহূর্ত পরে বেরিয়ে এসে বলল, ‘সাহেব আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আসুন স্যার।’
জেনারেল আলেকজান্ডারের স্টাডি রুমে তার টেবিলে মুখোমুখি বসেছে জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন এবং জেনারেল শ্যারন।
কক্ষের সবগুলো দরজা বন্ধ।
আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন নিজে গিয়ে কক্ষের প্রধান দরজা বন্ধ করে এসেছে।
দু’জনের মুখই গম্ভীর, চিন্তাক্লিষ্ট।
‘জেনারেল বলুন, কি করতে পারি আমি।’ বলল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন।
‘প্রেসিডেন্টের সাথে জর্জ আব্রাহাম ও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের দেখা করার পথ বন্ধ করতে হবে। ওরা এখন প্লেনে। আসছেন ওয়াশিংটনে।’ শুকনো কন্ঠে বলল জেনারেল শ্যারন।
‘কিন্তু কিভাবে? বরং যেসব রিপোর্ট প্রেসিডেন্টের কাছে এসেছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ। সবুজ পাহাড় থেকে লস আলামোস পর্যন্ত গোয়েন্দাগিরীর সুড়ঙ্গ, জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার ও জেনারেল শেরউডকে সান্তাফে আসার পথে হত্যার চেষ্টা এবং ডজন খানিক মার্কিন সৈনিক নিহত হওয়া, সান্তাফে বিমান বন্দর থেকে এফ.বি.আই-এর যে বিমানে ওদের নিয়ে আসার কথা সে বিমানে বোমা পাতা, ইত্যাদি সব ভয়াবহ অভিযোগ এসেছে প্রেসিডেন্টের কাছে আপনাদের বিরুদ্ধে। এই অবস্থায় ওদের কোন কথা বলাই তো অসম্ভব।’ বলল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন চিন্তান্বিত কন্ঠে।
জেনারেল শ্যারনের কথায় মুহূর্তের জন্যে জেনারেল শ্যারনের মুখ অন্ধকার হয়ে উঠেছিল, ঠিক চোর হাতে-নাতে ধরা পড়লে যেমনটা হয়। কিন্তু পরক্ষণেই হেসে উঠল। বলল, ‘বলা যাবে। জর্জ আব্রাহামরা তাদের মৃত্যুবান নিজেরাই বয়ে বেড়াচ্ছে।’
‘কি সেটা?’ বলল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন। তার কন্ঠে উৎসুক্যের সুর।
‘আহমদ মুসা তাদের সাথে আছে। এ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে, তার পেছনে রয়েছে আহমদ মুসার হাত। আহমদ মুসার মত বুদ্ধিমান ও ধড়িবাজ লোক দুনিয়াতে খুব কমই আছে। সে মার্কিন সরকার ও জনগনের সাথে ইহুদীদের লড়াই বাধাবার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে। লস আলামোস থেকে সান্তাফে আসার পথে যে ঘটনা ঘটেছে এবং সান্তাফে বিমান বন্দরে এফ.বি.আই বিমানে বোমা পেতে রাখার যে ঘটনা ঘটল তা পরিষ্কারভাবে আহমদ মুসার সাজানো একটা নাটক। দেখুন দুই জায়গাতেই আহমদ মুসা বিষয়টাকে ডিটেক্ট করেছে। যেভাবে, যে পরিস্থিতিতে সে তা ডিটেক্ট করেছে তার বিবরণ নিয়ে দেখুন, আগে থেকে বিষয়টা তার জানা না থাকলে এটা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হতো না।’ অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস ও সাবলীলতার সাথে কথাগুলো বলল জেনারেল শ্যারন।
জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জেনারেল শ্যারনের কথাগুলো তার পছন্দ হয়েছে, এটারই প্রকাশ চেহারা ঐ ঔজ্জ্বল্য। বলল সে, ‘কিন্তু একথা আরও যুক্তিগ্রাহ্য করা চাই। দেখুন, আহমদ মুসা একা মানুষ। যে দলবল নিয়ে আমেরিকা এসেছে এটার কোন প্রমাণ নেই। যে ঘটনাগুলোর কথা বললেন, তা করার জন্যে তার বেশ কিছু দক্ষ লোকের প্রয়োজন। এতবড় কাজ এক দু’জনের দ্বারা সম্ভব নয়।’
‘আহমদ মুসা আমেরিকায় একা নয়। তার লোক আমেরিকায় আসেনি, একথা ঠিক। কিন্তু সে বুদ্ধিমান ও দক্ষ লোক পেয়েছে। ইহুদী বিদ্বেষী ‘ফ্রি আমেরিকা’ আন্দোলনের সব লোকই তাদের সাথে রয়েছে। এ লোকদের মাধ্যমে এফ.বি.আই ও সি.আই.এ’র মধ্যেও কিছু লোক সে পেয়ে গেছে। আপনি জানেন, বেঞ্জামিন বেকন আহমদ মুসাকে ন্যাশভিল থেকে ওয়াশিংটন নিয়ে আসে পুলিশ ও এফ.বি.আই সকলের চোখে ধলো দিয়ে। অথচ বেঞ্জামিন বেকনে মত বহু অফিসার ও কর্মী এফ.বি.আই ও সি.আই.এ-তে রয়েছে। তারাই এখন আহমদ মুসার শক্তি। এদের দ্বারাই আহমদ মুসা হত্যা চেষ্টা ও বোমা পাতার ঘটনা ঘটিয়েছে। আর জর্জ আব্রাহাম এবং এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার কান কথা শুনে আহমদ মুসার বশংবদে পরিণত হয়েছে। এদের দু’জনকে দায়িত্ব থেকে না সরালে, এফ.বি.আই ও সি.আই.এ আহমদ মুসার খপ্পর থেকে উদ্ধার পাবে না।’
সম্মোহিতের মত কথাগুলো গিলছিল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন, তার চোখ-মুখের খুশিই প্রমাণ করছে, জেনারেল শ্যারনের প্রতিটি কথাকে সে গ্রহণ করেছে। জেনারেল শ্যারন থামতেই সে বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ জেনারেল, প্রকৃত রহস্য আপনি উদ্ধার করেছেন। বিষয়টা আমি এভাবে চিন্তা করিনি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আহমদ মুসার সাথে এখন মূল নাটেরগুরু হলো ‘ফ্রি আমেরিকা’ আন্দোলন। দেখতে হবে এখন এদেরকেও।’
‘ঠিক বলেছেন। প্রেসিডেন্টকে এ ব্যাপারে কনভিনস করতে হবে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘সেটা পারা যাবে। এক বেঞ্জামিন বেকনের দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। এখন…।’ কথা শেষ করতে পারল না জেনারেল হ্যামিল্টন।
তাকে থামিয়ে জেনারেল শ্যারন বলে উঠল, ‘খুব জরুরী কথা, লস আলামোস থেকে আসার পথে যে হত্যাকান্ড ঘটে, সেখানে বেঞ্জামিন বেকনকে দেখা গেছে। আর গোটা ওই সময়টা সে সান্তাফেতে ছিল। সুতরাং বোমা পাতার কাজ এফ.বি.আই-এর লোক দিয়ে সেই করিয়েছে।’
‘অসংখ্য ধন্যবাদ জেনারেল শ্যারন। আর প্রমাণের দরকার নেই। এখন বলুন, সবুজ পাহাড় থেকে লস আলামোস ল্যাবরেটরী পর্যন্ত সুড়ঙ্গকে আমরা প্রেসিডেন্টের কাছে কিভাবে তুলে ধরব?’
এই সুড়ঙ্গটা হলো দুর্যোগ ও জরুরী অবস্থাকালে লস আলামোস থেকে তার গবেষণা কর্ম সরিয়ে ফেলার ও সকলে বেড়িয়ে যাবার গোপন পথ হিসেবে তৈরী হয়। এটা তৈরী হয় ঠান্ডা-যুদ্ধের শুরুতেই। বিষয়টা এত গোপন ছিল যে প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইজেন হাওয়ার এবং লস-আলামোসের তদানিন্তন প্রধান পরিচালক জেনারেল জ্যাকসন শুধু মৌখিকভাবেই জানতেন। ঠান্ডা যুদ্ধ আমলের প্রেসিডেন্টরাও লস আলামোসের সেই সময়ের প্রধান পরিচালকরাও মৌখিকভাবেই জেনেছেন। ঠান্ডা যুদ্ধের পর কোনোভাবে এই মৌখিক জানাজানির ব্যাপারে ছেদ পড়ে যায়। এই গোপন বিষয়টাই কোনোভাবে এফ.বি.আই ও সি.আই.এ’র নজরে এসে গেছে। ধূর্ত আহমদ মুসা ‘ফ্রি আমেরিকা’ আন্দোলনের সহযোগিতায় এর সন্ধান পেয়ে একে ইহুদীদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডার একটা হাতিয়ার বানিয়েছে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
মুখ ভরা হাসি ঝলসে উঠল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের মুখে। আনন্দের আতিশয্যে আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন উঠে হ্যান্ডশেক করল জেনারেল শ্যারনের সাথে। বলল, ‘আমি দুশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছিলাম। বাঁচালেন আপনি আমাকে। মনে হচ্ছিল আহমদ মুসা আমেরিকাতেও হিরো হতে যাচ্ছে। ধন্যবাদ এবার তাকে জিরো শুধু নয়, জেলেও ঢুকানো যাবে।’
বলে একটু থেমেই আবার দ্রুত কন্ঠে বল, ‘দেখুন জেনারেল, জর্জ আব্রাহাম ও আহমদ মুসার মত লোকেরা বসে থাকবে না। তারাও সব কথা প্রমাণের চেষ্টা করবে। সে রকম কোন দুর্বলতা আপনাদের দিক থেকে আছে কিনা বলুন।’
‘সে রকম দুর্বলতা নেই। আপনাকে বলতে অসুবিধা নেই। আমাদের কম্যুনিটির একজন সদস্যার বিশ্বাসঘাতকতায় একটা অসুবিধা হতে যাচ্ছিল। আমরা সেটা ম্যানেজ করেছি। সে ও তার প্রেমিক এখন আমাদের হাতে। আর কোনদিন তারা কিছু করার বা বলার সুযোগ পাবে না।’
‘কি করেছিল তারা?’ উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন।
‘আমাদের সে মেয়েটির সাথে প্রেম ছিল জর্জ আব্রাহামের ছেলে জর্জ জন জুনিয়রের। মেয়েটিকে আমি একটা দায়িত্ব দিয়েছিলাম। দায়িত্ব সে পালন করেনি, উপরন্তু সে আমার সব কথা বলে দিয়েছে জর্জ জন জুনিয়রকে।’ একটু দ্বিধান্বিত কন্ঠে কথাগুলো বলল জেনারেল শ্যারন।
কথা শেষ করেই জেনারেল শ্যারন আবার বলল, ‘স্যার এবার কিছু আশার কথা শোনান। আমরা খুবই সংকটে। এ রকম চরম অস্তিত্বের সংকটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদীরা কখনও পড়েনি।’
‘আমি মনে করি প্রেসিডেন্ট বুঝবেন। কিন্তু সমস্যা এফ.বি.আই-কে নিয়ে। ওরা আবার কি ফ্যাসাদ বাধায়। ওদের চোখ সবখানে।’ বলল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন।
‘আপনি জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারকে বের করে দেয়ার ব্যবস্থা করুন। এফ.বি.আই ও সি.আই.এ দুটোই ঠিক হয়ে যাবে। বেঞ্জামিন বেকনের মত ‘ফ্রি আমেরিকা’ আন্দোলনের ঘাপটি মারা লোকদের বের করে দিলেই সব সমস্যা দূর হবে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘কাজটা কঠিন জেনারেল শ্যারন। তবু আমি চেষ্টা করব। কিন্তু জেনারেল আমার ব্যাপারে আপনারা কি চিন্তা করেছেন?’ বলল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন।
‘সে সিদ্ধান্ত আমাদের হয়ে গেছে। আগামী নির্বাচনে আপনি হবেন রানিংমেট, মানে ভাইস প্রেসিডেন্ট। পরবর্তী টার্মেই প্রেসিডেন্ট।’
‘ধন্যবাদ জেনারেল। আমি সারাজীবন আমেরিকার খেদমত করেছি। মার্কিন সর্বাধিনায়ক হিসেবে মার্কিন বাহিনীকে আমি সারা পৃথিবীর অভিভাবকত্বের মর্যাদায় উন্নীত করেছি। আমি চাই মার্কিন জাতিও সারা পৃথিবীর অভিভাবক হয়ে দাঁড়াক।’ বলল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন। তার কন্ঠে আবেগ।
‘আপনি জানেন, এই নতুন বিশ্বায়নের ব্লুপ্রিন্ট নতুনভাবে তৈরী করেছিলেন বিজ্ঞানী জন জ্যাকব। দুর্ভাগ্যের বিষয় আহমদ মুসা এবং তার নতুন সাথী জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার সেই বিজ্ঞানী জন জ্যাকবকেই গোয়েন্দাগিরীর অভিযোগে শেষ করে দিতে চাচ্ছেন। আসল লক্ষ্য এই বিশ্বায়ন পরিকল্পনা বানচাল করা।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘ঠিকই বলেছেন জেনারেল। আমি যখন ব্রিগেডিয়ার তখন আমার আম্মার কাছে দেখি এই ব্লুপ্রিন্ট। আমার আব্বা একজন গোঁড়া ক্যাথলিক রাজনীতিক, কিন্তু আম্মা ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ইহুদী। তিনি ছিলেন সিনাগগ-এর নিয়মিত সদস্য। আব্বা তখন নিউ ইয়র্কের সিনেটর, সে সময় আম্মা একদিন এই ব্লুপ্রিন্ট আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, আমাদের সিনাগগ-এর এই দলিল তোকে দিলাম। এই আমানত রক্ষা করবি। আমি তাকে বলেছিলাম, রাজনীতিক হিসেবে আব্বাই তো এর আমানতদার হতে পারেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি আমাকে ভালবাসেন সিনাগগকে নয়, সিনাগগ-এর দলিলকেও নয়। তোকে রাজনীতিক হতে হবে। যতটুকু পারিস এই বিশ্বায়নের পক্ষে কাজ করতে হবে। এই বিশ্বায়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বিশ্ব নেতৃত্ব তো আমেরিকারই থাকবে। আম্মার এসব কথা আমি ভুলিনি। ভুলিনি বলেই রাজনীতি করতে চাই।’
আবেগে-উত্তেজনায় জেনারেল শ্যারনের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে।

পাশেই আরেকটা কক্ষে জেনারেল আলেকজান্ডারের প্রাইভেট সেক্রেটারি রবিন, মানে রবিন নিক্সন, টেবিলে রাখা একটা ছোট্ট যন্ত্রের উপর ঝুঁকে পড়ে কথা শুনছে।
যন্ত্রটি একটা মাইক্রো রেকর্ডার। আধুনিকতম অয়্যারলেস মাইক্রো রিসিভার এটা। আধা বর্গ মাইলের মধ্যে কোথাও রাখা আলপিনের আগার মত মাইক্রো ট্রান্সমিটার চীপস যে তথ্য প্রেরণ করে, এই রিসিভার তা রিসিভ করে সংগে সংগেই ভাষায় রূপ দিয়ে রেকর্ড এবং রিলে বা ট্রান্সমিটও করতে পারে।
রবিন নিক্সন রেকর্ড রিলেটাই এখানে শুনছে।
জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের সাথে জেনারেল শ্যারনের যে কথোপকথন হলো সবই রবিন নিক্সন রেকর্ড করেছে।
জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের সামনে তার কলমদানির তলায় মেকার কোম্পানির সোনালী যে ষ্টিকার লাগানো আছে তার উপরেই পেষ্ট করা রয়েছে সোনালী ডট আকারে একটা মাইক্রো ট্রান্সমিটার চীপ। সেই ট্রান্সমিটারই ট্রান্সমিট করেছে দুই জেনারেলের আলোচনার গোটা বিবরণ।
শুনতে শুনতে বিস্ময় ও বেদনায় পাথরের মত হয়ে গেছে রবিন নিক্সন। রিলে কখন বন্ধ হয়ে গেছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। যন্ত্র কানের কাছে স্থির রেখে বসে আছে সে।
তার ইন্টারকম কথা বলে উঠল।
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তড়িঘড়ি সোজা হয়ে বসল সে। তাড়াতাড়ি মাইক্রো অয়ারলেস রিসিভারটি হাতে তুলে নিয়ে ইন্টারকমে কথা বলতে বলতে যন্ত্রটাকে তার চশমার খাপে ঢুকিয়ে ফেলল। তারপর দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে এল।
তার ডাক পড়েছে। মেহমানকে বিদায় দিতে হবে।
দ্রুত গিয়ে সে হাজির হল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের স্টাডি রুমের সামনে।
জেনারেল হ্যামিল্টন ও জেনারেল শ্যারন দুজনে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি আলাপ করছে।
রবিনকে দেখেই বলে উঠল জেনারেল হ্যামিল্টন, ‘রবিন তোমারও যাবার সময় হয়েছে। এক কাজ কর আমাদের গাড়িতে একে পৌছে দিয়ে তুমি বাসায় চলে যাবে। উনার ড্রাইভারকে গাড়ী নিয়ে অন্য এক জরুরী কাজে যেতে হবে।’
‘ইয়েস স্যার।’ মাথা নেড়ে বল রবিন নিক্সন।
হাঁটতে শুরু করেছে তখন জেনারেল শ্যারন।
রবিন নিক্সন ড্রাইভারের পাশের সিটে বসতে যাচ্ছিল। কিন্তু জেনারেল শ্যারন পেছনে তার পাশে বসতে বল।
বসল রবিন নিক্সন।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। রবিন নিক্সন বল, ‘স্যার ড্রাইভারকে আপনার বাড়ির লোকেশন তো বলা হয়নি। আপনি কি আইজ্যাক বেনগুরিয়ানের বাড়িতেই আছেন?’
‘ও, তুমি তো জানোই। হ্যা, ওরা সম্ভবত ওয়াশিংটনের বাইরে এখন। আমি চলে এসেছি। মনে হচ্ছে থাকতে হবে আরও বেশ কিছুদিন, তাই একটা বাসা নিয়েছি।’
রবিন নিক্সন কোন কথা বলল না।
কথা বলল জেনারেল শ্যারনই আবার। বলল, ‘বলতো রবিন, তোমাদের আমেরিকার বড় শত্রু কে?’
‘এটা রাজনৈতিক প্রশ্ন, রাজনীতিকরাই ভাল বলতে পারেন স্যার।’ বলল রবিন নিক্সন।
‘কিন্তু রবিন, দেশের শত্রু-মিত্রের ব্যাপারটা রাজনীতির বিষয় নয়, নাগরিকদের চেতনার বিষয়।’
‘নাগরিক চিন্তার দিক দিয়ে দেখলে আমেরিকার কোন শত্রু নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ বিশ্বের বৃহত্তম শক্তি। তাকে চ্যালেঞ্জ করার মত কোন শত্রু আমি দেখি না।’ বলল রবিন নিক্সন।
‘আচ্ছা বলত, ইহুদীরা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হতে পারে?’
‘বললাম তো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ এত বড় যে, কেউ গায়ে পড়ে তার সাথে শত্রুতা করতে আসবে না। ইহুদীরা আসবে কেন?’
‘ছোটরা কি বড়দের সাথে শত্রুতা করতে যায় না?’
‘অবশ্যই যেতে পারে। কিন্তু সেটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে। কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্কিনীরা কারও শত্রু হতে পারে, আবার অন্য কেও মার্কিনীদের শত্রু হতে পারে। আমি বলেছি জাতিগত বা দেশগত শত্রু না থাকার কথা।’
‘তুমি খুব বুদ্ধিমান ও ভালো ছেলে। আচ্ছা তুমি আহমদ মুসাকে জান? তার সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?’
ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠল রবিনের। বলল, ‘তার সম্পর্কে কোন প্রত্যক্ষ ধারণা আমার নেই। কিন্তু যতটুকু শুনেছি তাতে বুঝেছি সব সময় তিনি মজলুমের পক্ষেই থাকেন।’
‘এই তো ভুল করলে রবিন। যার সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা নেই তার সম্পর্কে এই রায় দেয়া তো ঠিক নয়।’
‘ঠিক বলেছেন।’
‘ধন্যবাদ রবিন।’
‘ওয়েলকাম, স্যার।’
‘ড্রাইভার, এসে গেছি। বাম দিকের গেটে দাঁড়াও।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
গাড়ি দাঁড়াল।
জেনারেল শ্যারন গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ‘রবিন নামবে নাকি?’
রবিন হাসল। বলল, ‘স্যারের সাথে তো ফ্যামিলি নেই। নেমে কি হবে স্যার?’
‘কি হবে না বল? বিরাট বাড়ি। সবই এখানে আছে। উদ্যান থেকে জিন্দানখানা সবই এখানে থাকতে পারে।’
‘জিন্দানখানা?’
হেসে উঠল জেনারেল। বলল, ‘বাড়িটা ছিল এক সময় পুলিশ অফিস। পরে এটা হয় একটা প্রাইভেট গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের দপ্তর। সুতরাং বুঝতেই পারছ।’
‘আর বলতে হবে না স্যার’ বলে গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখে নিল সে বাড়িটা। গেটের আলোতে বাড়ির নাম্বারটাও সে দেখতে পেল স্পষ্টভাবে।
রবিনদের গাড়ি বিদায় না হওয়া পর্যন্ত জেনারেল শ্যারন গেটে দাঁড়িয়ে থাকল।

প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের সাথে তার আলোচনার গোটা বিবরণ পেশ করল জেনারেল শ্যারন। বিশাল হলঘর ভর্তি মানুষ। একটা বিশাল গোল টেবিল ঘিরে দুই সারি হয়ে বসেছে তারা।
‘কাউন্সিল অব আমেরিকান জুইস অ্যাসোসিয়েশনে’র সদস্য সবাই। বিশ্ব ইহুদী গোয়েন্দাচক্রের প্রধান জেনারেল শ্যারনের জরুরী তলবে তারা হাজির হয়েছে।
জেনারেল শ্যারন থামতেই ডেভিড বেগিন বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ জেনারেল। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। অদ্ভুত দক্ষতার সাথে যুক্তিগুলো আপনি সাজিয়েছেন। আমি আশা করছি প্রেসিডেন্টকে পক্ষে আনার জন্যে তা যথেষ্ট হবে।’
ডেভিড বেগিন ‘কাউন্সিল অব আমেরিকান জুইস অ্যাসোসিয়েশনে’র সভাপতি এবং আমেরিকার শ্রেষ্ঠ ধনীদের একজন।
ডেভিড বেগিন থামলে সামনের সারি থেকে আরেকজন সদস্য বলে উঠল, ‘মিঃ বেগিন, আপনিও প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন গতকাল। সে সম্পর্কে আমরা কিছু জানতে পারিনি।’
‘ধন্যবাদ সম্মানিত সদস্য। আমরা প্রথমে জেনারেলের রিপোর্ট শুনলাম। সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার সাক্ষাত ছিল সৌজন্যমূলক। প্রসংগক্রমে আমি সব কথা বলারই সুযোগ নিয়েছি।’
একটা দম নিল ডেভিড বেগিন।
সামনের গ্লাস থেকে এক গ্লাস পানি পান করল। কথা শুরু করল আবার, ‘সৌভাগ্যের বিষয় হলো, প্রেসিডেন্টই প্রসংগটা তুলেছিলেন। বলেছিলেন তিনি, সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে জানেন তো? আমি বলেছিলাম, জানি মহামান্য প্রেসিডেন্ট। আপনি বিষয়টি তোলার জন্যে ধন্যবাদ। বিষয়টা নিয়ে আমিও কিছু বলতে চেয়েছিলাম। প্রেসিডেন্ট বলার অনুমতি দিলে আমি বললাম, মহামান্য প্রেসিডেন্ট, মনে হচ্ছে আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার। যেদিনই শুনেছি, আহমদ মুসা আমেরিকা এসেছে সেদিনই ভয় পেয়েছিলাম সে কিছু না করে আমেরিকা থেকে যাবে না। তার দেহের প্রতিটি রক্ত কণিকায় রয়েছে ইহুদী বিদ্বেষ। আমেরিকান গণতন্ত্রের মহান শাসনে ইহুদীরা ভালো আছে, এটা তার সহ্য হবার কথা নয়। তাই হয়েছে। আসার পরেই ষড়যন্ত্র শুরু করেছে আমাদের বিরুদ্ধে। দেখুন, যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, তার সাথে আহমদ মুসা কোন না কোনভাবে যুক্ত আছে। আমাদের সন্দেহ, সেই সবকিছুর নাটেরগুরু। আমাদের সন্দেহটাই মহামান্য প্রেসিডেন্টের কাছে তুলে ধরতে চাই। কোন প্রমাণ আমরা দিতে পারবো না। আমরা প্রেসিডেন্টের সাহায্য চাই, তিনি অমূলক অভিযোগ থেকে আমাদের রক্ষা করবেন। আমার মনে হয়েছে প্রেসিডেন্ট আমার কথায় খুশি হয়েছেন। তিনি বললেন, আমারও এই রকমই ধারণা মিঃ ডেভিড বেগিন। আমাদের গণতন্ত্রের যে সংগ্রাম, সেই সংগ্রামে ইহুদীরা আমাদের সহযোগী। তাদের কাছে থেকে বৈরী কোন আচরণ কোন সময় আমরা পাইনি, আশাও করিনা। তাই হঠাৎ করে সংঘটিত এ ঘটনাগুলো আমাকে খুবই কষ্ট দিয়েছে। আমি বিষয়টা ব্যক্তিগতভাবে দেখছি। প্রেসিডেন্টের কথা শেষ হলে আমি অনুনয়ে বললাম, মহামান্য প্রেসিডেন্ট, এফ.বি.আই প্রধান জর্জ আব্রাহাম ও সি.আই.এ চীফ অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার খুবই ভাল ও দক্ষ লোক, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ইহুদীদের প্রতি তারা সহৃদয় নন। ছোট-খাট বিভিন্ন ঘটনায় এটা দেখা গেছে। তার উপর, মহামান্য প্রেসিডেন্ট আমরা জানতে পেরেছি, আহমদ মুসা জর্জ আব্রাহামের নাতিকে ওহাইও নদীতে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করায় তিনি তার প্রতি খুবই দুর্বল। আমার এ কথায় খুব কাজ হয়। প্রেসিডেন্টের চোখ-মুখ রাগে লাল হয়ে ওঠে। তিনি কঠোর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন, এ কথা কি সত্য? আমি বললাম, জি মহামান্য প্রেসিডেন্ট, জর্জ আব্রাহামের বোটের যিনি ড্রাইভার ছিলেন, তার কাছ থেকেই ঘটনাটা শোনা। ঐ ড্রাইভার এখন ওয়াশিংটনের পটোম্যাক নদীর একটি আর্মি সার্ভিসে কাজ করেন। তথ্যটি দেয়ার পর প্রেসিডেন্ট আমাকে ধন্যবাদ দেন এবং বলেন, রাষ্ট্রীয় কাজে যুক্তিগত প্রবণতার কোন স্থান নেই। কথা শেষ করেই তিনি আবার আমাকে জিজ্ঞেস করেন, জর্জ আব্রাহামের কোন ঘরের নাতি ওটা? আমি বলি, তাঁর বড় ছেলের ঘরের নাতি। এই একটি মাত্রই নাতি তাঁর। তাঁর বড় ছেলে জর্জ মুর আব্রাহাম প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্ণেল। পোস্টিং এ আছেন এখন আলাস্কায়। পরে বুঝলাম এই শেষ কথাগুলো না বলাই ভাল ছিল। আমি প্রেসিডেন্টের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠতে দেখেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আপনারা তো দেখছি অনেক খবর রাখেন। আমার ভুলটা বুঝতে পেরে আমি তাড়াতাড়ি বলেছিলাম, বিষয়টা আমি বাই দি বাই জেনেছি মহামান্য প্রেসিডেন্ট। আমি বিব্রতকর অবস্থা থেকে রক্ষা পেয়ে যাই কফি নিয়ে বেয়ারা এসে পড়ায়। কফি পানের পর আমি বিদায় হই। তিনি খুব আন্তরিকতার সাথে আমাকে বিদায় দেন এবং বলেন, আপনাদের সহযোগিতাকে খুবই মুল্য দেই মিঃ ডেভিড বেগিন। উদ্বিগ্ন হবেন না, দেখব আমি সব।’ থামল ডেভিড বেগিন।
ডেভিড বেগিনের কথাগুলো গোগ্রাসে গিলছিল কক্ষে উপস্থিত সবাই। সবারই চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল। সামনের সারি থেকে একজন বলে উঠল, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আপনার বলে আসা কথার পরে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা যদি জেনারেল শ্যারনের ব্রীফ করা কথাগুলো প্রেসিডেন্টকে বলেন, তাহলে তা মোক্ষম কাজে দেবে। আমি খুবই আশাবাদী। জেনারেল শ্যারন এবং মিঃ ডেভিড বেগিন দুজনকেই ধন্যবাদ।’
এবার কথা বলে উঠল ডেভিড বেগিনের পাশ থেকে পাকা চুল, পাকা গোঁফের সৌম্যদর্শন একজন বৃদ্ধ। বলল, ‘আমরা তো ঘটনার আমাদের দিকটা দেখছি বলে খুশি হচ্ছি। ঘটনার আরেকটি দিক আছে। সেখানে আমাদের কোন দুর্বলতা আছে কি না, সেটাও চিন্তা করা দরকার। তাহলে বিহিত-ব্যবস্থার বিষয়টাও আমরা ভাবতে পারব।’
‘ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আমাদের দুর্বল দিকগুলোর কথা আপনারা সবাই জানেন। আমরা চেষ্টা করছি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে আহমদ মুসার উপর দোষ চাপিয়ে সেসবের রিমেডি করতে। একটা বড় দুর্বল দিক হলো একটা জীবন্ত সাক্ষী, যে আমাদের বৈরী। সে সাক্ষী হলো আইজ্যাক বেনগুরিয়ানের মেয়ে জর্জ আব্রাহামের ছোট ছেলের প্রেমিকা সাবা বেনগুরিয়ান। সে আমাদের সব জানে এবং সবকিছু সে জানিয়েছে তার প্রেমিক জর্জ জন জুনিয়রকে। ঈশ্বরের দয়া। দুজনকেই আমরা পাকড়াও করেছি। তারা এখন আমাদের হাতে। এরা হাতছাড়া হলে আমাদের বিপদ হবে। এ দিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’ বলল জেনারেল আইজ্যাক শ্যারন।
‘তাদের দুজনকে হত্যা করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।’ একজন বলে উঠল পেছন থেকে।
‘আমাদের কম্যুনিটির একজন বিশিষ্ট সদস্য আইজ্যাক বেনগুরিয়ানের একমাত্র মেয়ে সাবা। তাকে কিংবা তার প্রেমিককে এ সময় হত্যা করা ঠিক হবে না। এ নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যে এখন কোন সংকট সৃষ্টি হোক তা চাই না। আসল সংকট কেটে যাক। পরে দেখা যাবে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘জেনারেল ঠিকই বলেছেন। এ সময় আমাদের ঐক্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’ বলল ডেভিড বেগিন।
‘আমাদের এখন আর কি করণীয়?’ বলে উঠল একজন যুবক সদস্য পেছন থেকে।
‘আমরা প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপের অপেক্ষা করছি। কি পদক্ষেপ নেন তার ভিত্তিতেই আমাদের করণীয় ঠিক করতে হবে। সিদ্ধান্ত যদি আমাদের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে রাজনৈতিক কৌশলের দিকে আমাদের যেতে হবে এবং প্রেসিডেন্টকে অসহায় ও বিচ্ছিন্ন করে কাজ আদায় করতে হবে। আর যদি সিদ্ধান্ত পক্ষে আসে, তাহলে আমাদের বৈরী পক্ষের মানে জর্জ আব্রাহাম ও ম্যাক আর্থারের সামনে এগুবার সব পথ বন্ধ করতে হবে। আর আহমদ মুসাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া আমাদের সব সময়ের প্রধান কাজ। আমাদের অস্তিত্ব যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, এবিষয়টাও ততখানিই গুরুত্বপূর্ণ।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আহমদ মুসার ব্যাপারে মার্কিন সরকার কি সিদ্ধান্ত পাল্টেছে?’ একজন জিজ্ঞেস করল।
‘না, পাল্টায়নি। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারের আদেশ এখনও বহাল আছে। তবে জর্জ আব্রাহামের কারণে আদেশটা কার্যকরী হচ্ছে না।’
‘এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্টকে বলা দরকার ছিল না?’ বলল আরেকজন সদস্য।
‘খোদ নিরাপত্তা প্রধান এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দিয়েছেন বিষয়টি সেটেল্ড হওয়ার আগে আহমদ মুসাকে যেন ছাড়া না হয়।’ জেনারেল শ্যারন উত্তর দিল।
‘কিন্তু তবু আহমদ মুসা মুক্ত কিভাবে?’ প্রশ্ন অন্য একজন সদস্যের তরফ থেকে।
‘এটাও জর্জ আব্রাহামদের কারণে। আর এটা আমাদের জন্যে ভালই হয়েছে। জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের বিরুদ্ধে নতুন পয়েন্ট যোগ হয়েছে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা জেনারেল আলেকজান্ডারের হাতে।’ বলল জেনারেল শ্যারন হাস্যোজ্জ্বল মুখে।
জেনারেল শ্যারনের কথা শেষ হতেই তার টেলিফোন বেজে উঠল।
মোবাইল তুলে কথা বলল শ্যারন। মুহূর্তেই তার মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
কথা শষ করে বলল সে সদস্যদের উদ্দেশ্যে, ‘জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন টেলিফোন করেছিলেন, তাঁর মিশন সাকসেসফুল। প্রেসিডেন্ট তাঁর মতামতের প্রতি সায় দিয়েছেন।’
সকলে একযোগে বলে উঠল, ‘আমেন।’

এফ.বি.আই-এর বিমানটি ল্যান্ড করেছে ওয়াশিংটন এয়ারপোর্টের ননকমার্শিয়াল বিশেষ টারমাকটিতে।
বিমান থেকে নেমে এল চারজন, জর্জ আব্রাহাম, অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, জেনারেল শেরউড এবং আহমদ মুসা।
সবশেষে নেমেছে আহমদ মুসা।
প্লেনের সিঁড়ির প্রায় মুখেই দাঁড়িয়েছিল পাশাপাশি তিনটি গাড়ি। একটি সেনাবাহিনীর গাড়ি। নিতে এসেছে জেনারেল শেরউডকে। আর দুটি গাড়ির একটি এফ.বি.আই-এর, অন্যটি সি.আই.এ’র। এফ.বি.আই ও সি.আই.এ’র গাড়ির সামনে দুই সংস্থার দুজন উর্ধ্বতন অফিসার দাঁড়িয়েছিল আগে থেকেই।
প্লেনের সিঁড়ি থেকে টারমাকে নামতেই এফ.বি.আই-এর অফিসার এগিয়ে এল জর্জ আব্রাহামের দিকে এবং সি.আই.এ’র অফিসার অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের কাছে। সামরিক কায়দায় স্যালুট করে তারা দুজন দুজনের হাতে দুটি চিঠি তুলে দিল।
জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার দুজনেই চিঠির উপর চোখ বুলাল। সংগে সংগে তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠল বিস্ময়। পরক্ষণেই বিমর্ষতা এসে গ্রাস করল তাদের মুখ।
জেনারেল শেরউড ও আহমদ মুসা তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। তারা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিল। জেনারেল কিছু বলতে যাচ্ছিল। সে সময় সেনাবাহিনীর গাড়িটা এসে তার সামনে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে একজন অফিসার নেমে স্যালুট করে বলল, ‘আমরা প্রস্তুত স্যার।’
জেনারেল শেরউড আরেকবার জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার ইচ্ছা চেপে গিয়ে গাড়িতে উঠল।
সংগে সংগে গাড়িটা স্টার্ট দিল।
গাড়িটা শ’দেড়েক গজ এগুতেই আরেকটা গাড়ি তীর বেগে এসে একেবারে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের হাতে চিঠি দেয়া ও তাদের চেহারা দেখে বড় একটা কিছু ঘটা সম্পর্কে আশংকিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কিছু বলার ব্যাপারে দ্বিধা করছিল।
এ সময় তীব্র গতির গাড়ি একেবারে পাশে এসে হার্ড ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ায় চমকে উঠে সেদিকে তাকাল। দেখল ড্রাইভিং সিটে বেঞ্জামিন বেকনকে। চোখে-মুখে উত্তেজনা বেঞ্জামিনের।
‘কুইক।’ মাত্র এই শব্দটাই উচ্চারণ করল বেঞ্জামিন বেকন।
গাড়ির স্টার্ট সে বন্ধ করেনি।
এতেই আহমদ মুসা অনেক কিছু বুঝে ফেলল। সে দ্রুত উঠে বসল বেঞ্জামিনের ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে।
ততক্ষণে চঞ্চল হয়ে উঠেছে এফ.বি.আই ও সি.আই.’’র অফিসার দুজন। তারা চিৎকার করে উঠল, ‘আহমদ মুসা তুমি মুভ করতে পার না। তুমি আন্ডার এ্যারেস্ট।’
কিন্তু গাড়ি তখন তীব্র গতিতে ব্যাকগিয়ার করে মুখ ঘুরিয়ে তীর বেগে ছুটতে আরম্ভ করেছে।
এফ.বি.আই ও সি.আই.এ’র অফিসার পকেট থেকে রিভলভার বের করে গাড়ি লক্ষ্যে গুলী করতে শুরু করেছে।
গাড়ি দুটি থেকে আরও চারজন লাফ দিয়ে নেমেছে। তারাও যোগ দিল গুলী বর্ষণে।
কিন্তু গাড়ি তখন তাদের নাগালের বাইরে।
বেঞ্জামিন বেকনের মাথায় ফেল্ট হ্যাট। কপালের শেষটা পর্যন্ত নামানো। আহমদ মুসার সাথে কথা বলার সময় মাত্র মুহূর্তের জন্যে হ্যাটটা একটু উপরে তুলেছিল।
‘আপনি ঢুকলেন কি করে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন, ছুটিতে থাকলেও আইডেনটিটি কার্ড আমাদের কাছে থাকে।’
‘কি ঘটনা বলুন তো, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘বলব। দেখুন সামনে। বের হওয়া নিশ্চয় সহজ হচ্ছে না।’ সামনের দিকে চিন্তিত দৃষ্টি মেলে বলল বেঞ্জামিন বেকন।
আহমদ মুসা সামনে টারমাকের প্রান্তে একটু দূরে দুটি লাল আলো জ্বলতে দেখলো।
‘লাল আলো জ্বলছে ওটা কি গেট?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যা। একটা বেরুবার গেট, আরেকটা প্রবেশের।’
‘গেট কিসের তৈরী?’
‘অসুবিধা হবে না। দুটিই দুভাগে বিভক্ত গ্রীল গেট। এখন নতুন কোন ব্যারিয়ার না দিলেই হয়। তবে আমি বেরুব প্রবেশের গেট দিয়ে, নিশ্চয় ওদিকে ওদের নজর থাকবে কম।’
‘ঠিক বেঞ্জামিন। আমার বিশ্বাস সে সময় ওরা পাবে না। বিশেষ করে প্রবেশের গেটের কথা ওরা নাও ভাবতে পারে।’
আহমদ মুসার কথাই সত্য হলো।
গ্রীলের গেট বন্ধ। দেখা গেল, গেটের বাইরে ডান দিক থেকে একটা ২০ টনি বাঘা ট্রাক সবে এগিয়ে আসছে গেটের দিকে। ওটা দিয়ে গেট ব্লক করা ওদের টার্গেট। কিন্তু তার আগেই বেঞ্জামিন বেকনের গাড়ি প্রায় ১০০ মাইল বেগে আঘাত করল গ্রীলের গেটটিতে।
মুহূর্তে তালা ভেঙে গেটের দুই পাল্লা দুদিকে ছিটকে পড়ে গেল।
গাড়িটাও ছিটকে পড়ল বাইরে।
বেঞ্জামিন বেকন গাড়ি সামলে নিয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ল।
পেছনে একবার তাকিয়ে বেঞ্জামিন বেকন বলল, ‘দুটো গাড়িই পিছু নিয়েছে।’
‘এরপর আপনার পরিকল্পনা কি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওরা পিছু নেবে আমার পরিকল্পনায় সেটা আছে। ওদের কাঁচকলা দেখাবার ব্যবস্থাও রেখেছি।’
বলে গাড়ির স্পীড আরও বাড়িয়ে দিল বেঞ্জামিন বেকন।
বিশেষ এ ল্যান্ডিং টারমাকে প্রবেশ ও বের হওয়ার গেট সম্পূর্ণ আলাদা। রাস্তাও আলাদা। দুই রাস্তার মাঝখানে সমান্তরাল দুফুটের মত উঁচু দেয়ালের মধ্যে দিয়ে প্রলম্বিত গাছ-পালার সারি।
ছুটছিল বেঞ্জামিন বেকনের গাড়ি।
তার পেছনে ছুটে আসছে পেছনের দুটি গাড়ি।
এক জায়গায় রাস্তার প্রান্তের দেয়াল ঘেঁষে গাড়ির হার্ড ব্রেক কষল বেঞ্জামিন বেকন। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা আসুন, কুইক।’
বেঞ্জামিন বেকন লাফ দিয়ে দেয়াল পার হয়ে গাছ-পালা ঠেলে লাফ দিয়ে ওপারের রাস্তায় গিয়ে পড়ল। তার পেছনে আহমদ মুসাও। ওখানে রাস্তার ধার ঘেঁষে একটা সাদা টয়েটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। লাফ দিয়ে ড্রাইভিং সীটে উঠে বসল বেঞ্জামিন বেকন।
আহমদ মুসাও উঠে বসল তার পাশে।
সংগে সংগেই গাড়ি ছুটতে আরম্ভ করল।
আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়েছিল। দেখল, ওরা চার পাঁচজন এসে দাঁড়িয়েছে তাদের পেছনে ফেলে আসা জায়গায়। তাকিয়ে আছে তাদের গাড়ির দিকে। কোন গাড়ি নেই তাদেরকে অনুসরণ করার।
তাদের অসহায় অবস্থার কথা চিন্তা করে হাসি পেল আহমদ মুসার। দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল সামনে। বলল, ‘মিঃ বেঞ্জামিন বেকন সত্যিই আপনে ওদের কাঁচকলা দেখিয়েছেন। ওরা গাড়ি পায়নি। মনে হলো, আমাদের গাড়ির নাম্বারটাও ওরা নিতে পারেনি।’
‘কেমন করে বুঝলেন?’
‘বুঝলাম, কারণ ওরা মোবাইল বের করেনি। ওদের প্রথম কাজ ছিল আমাদের অনুসরণ করা। আর দ্বিতীয় কাজ ছিল, আমাদের গাড়ির নাম্বার পুলিশদের জানিয়ে দেয়া।’
‘ধন্যবাদ। ঠিক বলেছেন। ওরা গাড়ির নাম্বার দেখতে না পাওয়ার একটা কারণ পেছনের লাইট আমি নিভিয়ে দিয়েছিলাম।’
‘কিন্তু এরপরেও ওরা বসে থাকবে না। গাড়ির রঙ ও ধরন তারা দেখেছে। এটুকুও পুলিশের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দেখবেন, আবারও কাঁচকলা দেখাব।’
গাড়ি বেরিয়ে এসেছে এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে।
সামনেই একটা রোড জংশন।
এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে বিভিন্ন দিকে এগুবার এটাই একমাত্র নিস্ক্রমন দরজা।
রোড জংশনে পৌঁছার আগেই একটা ফিলিং স্টেশন। তার পাশেই একটা পার্কিং হাউজ। অনেকে ভীর এড়াবার জন্যে এখানে গাড়ি রেখে এয়ারপোর্টে যায়।
বেঞ্জামিন বেকনের গাড়ি শা করে সে পার্কিং হাউজে প্রবেশ করে একটা আমেরিকান কালো ৬ সিটের ফোর্ড জীপের পাশে পার্ক করল এবং দ্রুত আহমদ মুসাকে নামতে বলে নিজে নেমে পড়ল।
দুজনেই দ্রুত গিয়ে উঠল সে কালো ফোর্ড জীপটায়। ড্রাইভিং সিটে বেঞ্জামিন বেকন।
গাড়ি পার্কিং হাউজ থেকে বেরিয়ে এসে ছুটতে শুরু করল রোড জংশনের দিকে।
‘দেখুন, এয়ারপোর্ট রোড থেকে জংশন রোডে প্রবেশকারী সব সাদা গাড়িকেই থামাচ্ছে পুলিশ।’ বলল বেঞ্জামিন সামনের দিকে স্থির চোখ রেখে।
‘আপনাদের এফ.বি.আই ও পুলিশের প্রশংসা করতে হয়। সত্যিই সময়ের সাথে ওরা পাল্লা দিয়ে চলে। এখানে সামান্য সুযোগকেও ওরা কাজে লাগাতে চেয়েছে।’
‘এটা ওদের প্যাট্রিওটিজম। কিন্তু ইহুদীবাদীরা আজ এই প্যাট্রিওটিজমকে ডিক্টেট করছে।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।
রোড জংশনে প্রবেশ করল গাড়ি।
পুলিশের নাকের ডগার উপর দিয়ে চলল বেঞ্জামিন বেকনের গাড়ি। তারা চোখ তুলেও দেখলো না।
গাড়ি এসে পরলো এক্সপ্রেস এভেনিউতে। সোয়াশ’ কিলোমিটার বেগে ছুটতে লাগলো গাড়ি।
‘ধন্যবাদ বেঞ্জামিন বেকন, সবগুলো বিপদ আপনি ডিঙিয়ে এসেছেন সুন্দরভাবে।’ আহমদ মুসা গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিতে দিতে বলল।
‘বিপদ ডিঙাতে পারলাম কই? বিপদ তো আরও গভীর হয়েছে।’ বেঞ্জামিন বেকনের গলায় উদ্বেগ।
আহমদ মুসা আবার সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘কি ব্যাপার বলুন। ঘটনা কিন্তু আমি কিছুই বুঝিনি। আমাকে এভাবে ছোঁ মেরে নিয়ে এলেন। মিঃ জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারকে কি যেন চিঠি পড়ে মুষরে পড়তে দেখলাম। কি ঘটেছে?’ আহমদ মুসার কন্ঠেও উদ্বেগ।
‘জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের কি চিঠি পেয়েছেন আমি জানি না। তবে তাঁরা সাময়িক বরখাস্ত পত্র পাবার কথা।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘বরখাস্ত পত্র?’ আহমদ মুসার কন্ঠ আর্তনাদের মত শোনাল। সে যেন আকাশ থেকে পড়ল।
‘জি জনাব, বরখাস্ত পত্র। সেই সাথে গাড়ির সামনে দাঁড়ানো এফ.বি.আই অফিসারের কাছে ছিল আপনাকে গ্রেফতারের আদেশ পত্র।’
‘আমাকে গ্রেফতারের আদেশ পত্রের অর্থ বুঝলাম। কিন্তু ওদের বরখাস্তের কথাটা কি ঠিক?’
‘বললাম তো চিঠিতে কি আছে জানি না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ওদের সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছেন, সেটা জানি।’
‘কেন এই নির্দেশ? অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে আমার কাছে।’
‘অবিশ্বাস্য হবে কেন? ইহুদীবাদীদের অসাধ্য কিছুই নেই। তাদের লম্বা হাত প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত সহজেই পৌঁছেছে এবং মুহূর্তেই বাদী আসামী হয়ে পড়েছে, আসামী হয়েছে বাদী।’
‘আর একটু বিস্তারিত বলুন। এমন অসম্ভব কিভাবে সম্ভব হতে পারে? ইহুদীবাদীদের জঘন্য ষড়যন্ত্র হাতে-নাতে ধরা পড়েছে। যারা এটা ধরল তাদের জন্যে পুরস্কারের বদলে কারাগার বরাদ্দ হলো কি করে?’
‘বিস্তারিত সব আমিও জানি না। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের পি,এস রবিন নিক্সন আমাদের ‘ফ্রি আমেরিকা’র সদস্য। এক ঘন্টা আগে আমাকে সে টেলিফোনে জানিয়েছে এই খবর যে, আহমদ মুসাকে গ্রেফতার এবং জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারকে সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ প্রেসিডেন্ট দিয়েছেন। সে আমাকে আরও জানিয়েছে, সব ঘটনার এমন উল্টো ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যাতে আহমদ মুসা প্রধান ষড়যন্ত্রকারী এবং জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার তার সহযোগী হয়ে দাঁড়িয়েছেন। রবিন নিক্সন বলেছে নাটের গুরু হলো প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তিনি জেনারেল শ্যারনের সাথে যোগসাজশ করেছেন এবং পরে প্রেসিডেন্টকে বুঝিয়ে স্বমতে আনতে পেরেছেন। রবিন আমার কাছে একটা ভিডিও টেপ পাঠিয়েছেন এবং বলেছেন ভিডিও টেপ দেখলেই সব কথা পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
‘কিন্তু বেঞ্জামিন বেকন, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, একটা জলজ্যান্ত সত্যকে কিভাবে মিথ্যায় পরিণত করা সম্ভব?’ আহমদ মুসার কন্ঠে তখনও অপার বিস্ময়।
‘চলুন, ভিডিও টেপ দেখবেন।’
‘আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?’
‘সারা জেফারসনের বাড়িতে ভার্জিনিয়ায়। ওখানেই আপনি আপাতত লুকাবেন।’
মুখটা আনন্দিত হয়ে উঠল আহমদ মুসার। বলল, ‘সারা জেফারসন কি ভার্জিনিয়ায়?’
‘না। উনি লস আলামোসে। তবে তিনি উইকএন্ডে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসবেন।’
‘উনি নেই, ওখানে যাব কেন? এটা কি ঠিক হবে?’
‘আমাকে উনি এই নির্দেশই দিয়েছেন। আপনি তার ওখানে থাকবেন তিনি না আসা পর্যন্ত।’
‘নির্দেশ দিয়েছেন? আপনার চেয়ে বয়সে ছোট হবেন তিনি, নির্দেশ দেবেন কেন?’
একটু চমকে উঠল বেঞ্জামিন বেকন। বলল হেসে উঠে, ‘ও কিছু না, কথার কথা বলেছি। একই ‘ফ্রি আমেরিকা’র সদস্য তো আমরা।’ বেঞ্জামিনের ঠোঁটে হাসি এলেও তার চোখে মুখে অপ্রস্তুত ভাব।
আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। বলল গম্ভীর কন্ঠেই, ‘তাহলে কি সারা জেফারসন ‘ফ্রি আমেরিকা’র নেত্রী?’
চমকে উঠল বেঞ্জামিন বেকন। স্টেয়ারিং হুইলে রাখা তার হাত দুটিও কেঁপে উঠেছিল। সেই সাথে মুখটাও তার মলিন হয়ে উঠেছিল।
আহমদ মুসা সেদিকে তাকিয়ে একটা হাত বেঞ্জামিন বেকনের কাঁধে রেখে বলল, ‘আমি জানি মিঃ বেঞ্জামিন বেকন, এ তথ্যটা অত্যন্ত গোপনীয়। আমার কাছেও গোপন থাকবে। ওকেও জানতে দেব না যে আমি জানি। আর এতে কোন দোষ ও নেই। কারণ আপনি আমাকে এ তথ্য জানান নি।’
‘ধন্যবাদ মিঃ আহমদ মুসা। উনি হয়তো তার পরিচয় জানাতেও পারেন। আপনার মত ব্যক্তির কাছে তিনি নিজেকে গোপন রাখবেন বলেও মনে হয় না। সে যাক, আপনি এত দ্রুত কোন বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন, এটা সত্যিই বিস্ময়কর।’
‘বিস্ময়ের এতে কিছুই নেই। আমার বর্তমান অবস্থার বিষয়টা এত তাড়াতাড়ি উনার জানা এবং আপনার ‘নির্দেশ’ লাভের কথা থেকেই বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। আর তাকে না দেখলে, কথা না বললে নিশ্চয় বিষয়টা আমার নজর এড়িয়ে যেত। তাকে দেখেই বুঝেছি টমাস জেফারসনের নেতৃত্ব ও মৌলিকত্ব দুই গুণই যেনি তার মধ্যে আছে। আর আমাকে তার ভার্জিনিয়ার বাড়িতে দাওয়াত দেয়া থেকে তখনই আমার মনে হয়েছিল কোন চিন্তা-ভাবনা বা কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি রয়েছেন।’
গাড়ি তখন পটোম্যাক ব্রীজ পার হয়ে ভার্জিনিয়ার পথ ধরে চলছিল। ডান দিকে অল্প দূরে পেন্টাগন। আর সামনে অরলিংটন সিমেট্রি। নিরব রাস্তার দুপাশে গাছ-পালা, ঝোপ-ঝাড়ের সারি।
বেঞ্জামিনের গাড়ি ফ্রি ওয়ে ধরে ছুটে চলেছে জেফারসনের বাড়ি মন্টিসেলোর দিকে।
অরলিংটন সিমেট্রি এলাকায় তখনও পৌঁছেনি গাড়ি।
হঠাৎ বেঞ্জামিনের খেয়াল হলো অরলিংটন না ঘুরে নতুন ডাইভারশন রোড হয়ে গেলে অনেক সময় বাঁচবে। চিন্তা করেই বেঞ্জামিন ডানদিকে অর্থাৎ পেন্টাগনের দিকে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে নিল।
ডাইভারশন রোডটা পেন্টাগনের প্রায় পাশ দিয়েই চলে গেছে। মাঝখানে শুধু ঘন গাছ আচ্ছাদিত উঁচু ও দীর্ঘ টিলা।
গাড়ি চলছিল সে টিলার পাশ দিয়েই। আহমদ মুসা সে টিলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পেন্টাগনের এত কাছে জংগল কেন?’
‘খুব পাশে নয় মিঃ আহমদ মুসা, দূরত্ব দেড় মাইলের কম হবে না। একে পেন্টাগনের ফাঁদ বলতে পারেন। এ জংগলের মাটি ও গাছের কান্ড, শাখা, পাতা কোন কিছুই শত্রুর জন্যে নিরাপদ নয়। এর বাইরে রয়েছে অদৃশ্য পাহারার একটা ব্যুহ।’ বেঞ্জামিন বলল।
‘সেটাই স্বাভাবিক।’ বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই উৎকর্ণ হয়ে উঠল আহমদ মুসা। বলল, ‘শুনেছেন গুলীর শব্দ?’
‘ঠিক, আমারও কানে এসেছে। একাধিক শব্দ।’ বলল বেঞ্জামিন।
‘একটু আগেও এ ধরনের শব্দ কানে এসেছে। সেগুলোও তাহলে গুলীর শব্দ ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সামনে কিছু ঘটছে নিশ্চয়।’ বলে বেঞ্জামিন বেকন তার গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিল।

জর্জ জুনিয়রের বুকে মাথা রেখে অস্থিরভাবে কাঁদছিল সাবা বেনগুরিয়ান। বলছিল, ‘কেন তুমি ওই চিঠি লিখে দিলে? এ শয়তানদের হাতে ঐ মাস্টার কম্পিউটার পড়লে কি হবে তুমি জান?’
জর্জ জুনিয়র সাবার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘ঐ কম্পিউটারের চেয়ে তোমার সম্মান আমার কাছে অনেক বড়।’
‘ঐ কম্পিউটার তো শুধু কম্পিউটার নয়। ওটা তো দেশ।’
‘তুমি ভেব না সাবা, ওদের ষড়যন্ত্র সফল হবে না। কিছু রেকর্ড ধংস করলেই দেশ শেষ হয়ে যাবে না।’
‘তোমার আব্বাদের কোন ভাল খবর না পাওয়া পর্যন্ত রেকর্ডের মূল্য তুমি অস্বীকার করতে পারবে না।’
আব্বার কথা মনে হতেই অসহনীয় এক খোঁচা লাগল তার বুকে। এক যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল দেহের সকল স্নায়ুতন্ত্রীতে। সে নিউ মেক্সিকো যাবার জন্যে বেরিয়েছিল। যাওয়া তো হলোই না, উপরন্তু সে নিজেই বন্দী হয়ে পড়ল। ওদিকের অবস্থা কে জানে! ওদিকের সব প্রমাণ শেষ করেই কি এরা এদিকের সব প্রমাণ নির্মূল করার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে! বুকটা কেঁপে উঠল তার আতংকে। বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ সাবা। কিন্তু তোমার ক্ষতি সহ্য করার শক্তি কি আমার আছে!’
জর্জ জুনিয়রের বুকে মুখ গুঁজে সাবা বলল, ‘তা জানি। কিন্তু যে ক্ষতি হলো তার পরিমাপ নেই।’
‘ভেবো না সাবা। ঈশ্বর আছেন। অন্ধকারে আলো জ্বলবেই।’
‘কিন্তু আমি সবকিছুর উপরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। আমার স্বজাতির যে বেঈমানী আমি দেখেছি, তাতে দুনিয়ায় কোন নীতিবোধ আছে বলে আমি মনে করতে পারছি না।’ বলল সাবা বেনগুরিয়ান।
‘নীতিবোধ তাদের নেই বলে কারও নেই, তা ভাবতে যাবে কেন?’
কিছু বলতে যাচ্ছিল সাবা বেনগুরিয়ান। হঠাৎ সামনের দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেল সে। একজন লোক এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বিড়ালের মত নিঃশ্বব্দ পায়ে এগিয়ে আসছে তাদের সেলের দিকে।
জর্জ জুনিয়রেরও চোখে পড়েছে লোকটা।
জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ান দুজনেই সোজা হয়ে বসেছে। তাদের স্থির দৃষ্টি লোকটির দিকে।
লোকটি সেলের দরজার সামনে এসে ঠোঁটে তর্জনি চেপে চুপ থাকার ইংগিত করল।
পকেট থেকে একটা চাবি বের করে লোকটি তালা খুলে সেলের দরজা খুলে ফেলল। বলল দ্রুত ফিসফিস কন্ঠে, ‘আসুন, পালাবার এই সুযোগ। দুজন ছাড়া সবাই চলে গেছে কম্পিউটার আনতে।’
‘আপনি কে?’ বলল জর্জ জুনিয়র বিস্মিত কন্ঠে।
‘আমাকে চিনবেন না। আমি মিস সাবার আব্বা মিঃ আইজ্যাক বেনগুরিয়ানের একজন ভক্ত। জীবন বাঁচানো থেকে শুরু করে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ সব তাঁরই দয়ায় হয়েছে। সুযোগ পেয়েছি তাঁর জন্যে কিছু করার। আসুন, তাড়াতাড়ি।’
জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ান দ্রুত উঠল এবং লোকটির পেছনে পেছনে বেরিয়ে এল সেল থেকে। চলতে চলতে ফিসফিস করে লোকটি বলল, ‘মিঃ আইজ্যাক বেনগুরিয়ানকেও ওরা মেরে ফেলবে।’
‘উনি কোথায়?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল জর্জ জন জুনিয়র।
‘ইনস্টিটিউট এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজ’ অফিসের রেসিডেন্সিয়াল
ব্লকে তাকে রাখা হয়েছে। তাকে বুঝানো হয়েছে এফ.বি.আই-এর জ্বালাতন থেকে দূরে রাখার জন্যেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। আসলে তিনি এখন নজরবন্দী। মিস সাবাকে শেষ করার পর তাকেও হত্যা করা হবে।’
কেঁপে উঠল জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ান দুজনেই। বলল সাবা বেনগুরিয়ান, ‘এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজ অফিসে কেন? আব্বাকে ওরা চিনবে না?’
‘চিনলে কি হবে? অফিসের টপ টু বটম ইহুদীবাদীতে ভরা। শুধু এই ইনস্টিটিউট নয়, এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজের দুনিয়াব্যাপী গোটা নেটওয়ার্কই তো এরা নিয়ন্ত্রণ করে।’ বলল লোকটি।
খুব সামনেই দ্রুত পায়ের শব্দ শোনা গেল। থমকে দাঁড়াল লোকটি।
তার পেছনে থমকে দাঁড়াল জর্জ জুনিয়র এবং সাবা বেনগুরিয়ানও।
সামনেই একটা দরজা। দরজার ওপার থেকে পায়ের শব্দ আসছিল।
থমকে দাঁড়ানোর পর মুহূর্তেই দরজায় এসে উদয় হলো দুজন লোক। তাদের হাতে স্টেনগান। তাদের চোখেও আগুন। তাদের নাক বরাবর সামনেই ধরা পড়া চোরের মত দাঁড়িয়েছিল জর্জদেরকে উদ্ধারকারী লোকটি। তাদের একজন তার স্টেনগানটা ডান হাত থেকে বাম হাতে নিয়ে ডান হাতের এক প্রচন্ড ঘুষি চালাল লোকটিকে।
উদ্ধারকারী লোকটি ঘুষি খেয়ে দড়াম করে পড়ে গেল মেঝের উপর।
লোকটি ঘুষি মেরেই স্টেনগান তাক করল জর্জ জুনিয়র এবং সাবা বেনগুরিয়ানের দিকে। চিৎকার করে বলল, ‘ভেবেছিলে পালাবে? যারা একবার এই সেলে ঢোকে তারা আর জীবিত বের হয়ে যেতে পারে না।’
বলে পেছনের লোকটিকে নির্দেশ করল, ‘এদের বেঁধে ফেল, তারপর সেলে ঢোকাও।’
জর্জদের উদ্ধারকারী লোকটি মেঝেয় পড়ে গিয়েই ওদের অলক্ষ্যে পকেট থেকে রিভলভার বের করে নিয়েছিল। জর্জদের বেঁধে ফেলার নির্দেশ বাতাসে মেলাবার আগেই তার রিভলভার থেকে দুটি গুলী বের হয়ে এল।
স্টেনগানধারী দুজনই গুলীবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।
জর্জদেরকে উদ্ধারকারী লোকটি উঠে দাঁড়িয়েই জর্জদের লক্ষ্য করে বলল, ‘আসুন।’
বলে সে ছুটল দরজা পেরিয়ে।
জর্জরাও তার পিছে পিছে ছুটল।
কিন্তু বাড়ি থেকে বেরুতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল লোকটি। ফিস ফিস কন্ঠে বলে উঠল, ‘পুরো যে দলটি গিয়েছিল কম্পিউটার উদ্ধার করতে, তারা ফিরে এসেছে।’ তার কন্ঠ তখন কাঁপছে।
প্রায় পাগলের মত সে এদিক ওদিক তাকিয়ে জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ানকে টেনে নিয়ে পাশেই ছোট্ট একটা কক্ষে প্রবেশ করল। কক্ষটি জেনারেটর রুম। কক্ষটি বাড়িতে ঢোকার প্রবেশ পথ এবং সিঁড়ি দিয়ে দুতলায় উঠার মুখেই। সবই দেখা যায় কক্ষটি থেকে।
জর্জরা দেখল প্রায় দশ বার জন লোক ভেতরে প্রবেশ করল।
‘ওরা সবাই উপরে উঠে গেছে, আসুন এই সুযোগ।’ বলে লোকটিই দ্রুত বেরোল ঘর থেকে।
জর্জ জুনিয়র এবং সাবা বেনগুরিয়ানও তার পেছনে পেছনে ছুটে বেরিয়ে এল।
কিন্তু বেরিয়ে বাইরের করিডোরটায় পা দিয়েই তারা মুখোমুখি পড়ে গেল একজনের। লোকটি ঐ দলেরই একজন। সম্ভবত সেই গাড়ি ড্রাইভ করেছে। গাড়ি পার্ক করে আসাতে পেছনে পড়ে গেছে।
মুখোমুখি হয়ে দুপক্ষই প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েছিল। উদ্ধারকারী লোকটি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছিল। আর ড্রাইভার লোকটি তার নিজেদের লোকের সাথে জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ানকে দেখে ব্যাপারটা বুঝে উঠতে দেরি করে ফেলেছিল। যখন বুঝে উঠে রিভলভার বের করতে যাবে, তখন তার বুক বরাবর তাক হয়ে উঠেছে জর্জদের উদ্ধারকারী লোকটির রিভলবার।
উপায়ন্তর না দেখে লোকটি চিৎকার করে উঠেছিল। আর সেই সাথেই বুকে গুলীবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ল লোকটি।
‘আসুন ঐ গাড়ির দিকে।’ বলে ছুটতে শুরু করেছে লোকটি।
গ্যারেজের দিকে পার্ক করা ছিল একটা মাইক্রোসহ দুটি জীপ। লোকটি ছুটছিল একদম সামনের জীপটার দিকে। শুধু ওটাই পার্ক করা ছিল গেটের দিকে মুখ করে। জীপটি জেনারেল মটরস-এর ৬ সিটের একটা বড় জীপ।
লোকটি ছুটে গিয়ে প্রথমেই ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে ফেলল।
জর্জরাও এসে পড়েছে।
‘গাদ্দার, তোরা পালাবি, তা হবে না।’ উপর থেকে একটা চিৎকার ভেসে এল। সম্ভবত নিচে গুলীর শব্দ পেয়ে কেউ নিচে তাকিয়ে ওদের দেখে ফেলেছে।
চিৎকারের সাথে সাথে স্টেনগানের গুলী ভেসে এল।
তখন গাড়ির দরজা দিয়ে প্রবেশ করছে জর্জরা। প্রথমে প্রবেশ করে জর্জ গিয়ে বসেছে ড্রাইভিং সিটে।
সাবা বেনগুরিয়ান উঠতে যাচ্ছে সেই সময়ই গুলী বৃষ্টি এবং সেটা গাড়ির দরজা লক্ষ্যেই।
জর্জদের উদ্ধারকারী লোকটি নিজের গা দিয়ে ঢেকে সাবা বেনগুরিয়ানকে গাড়িতে উঠিয়ে দিল। দরজাটাও সে বন্ধ করল। তার পরেই উদ্ধারকারী লোকটি তার ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহটা নিয়ে গাড়ির দরজার নিচেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সাবা বেনগুরিয়ান গাড়ির দরজা খুলে দেখতে যাচ্ছিল।
জর্জ জুনিয়র ঝুঁকে এসে চিৎকার করে উঠল, ‘সাবা দরজা খুল না, মাথা নিচু কর। কি দেখবে, বেচারার দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।’
বলে জর্জ গাড়িতে স্টার্ট দিল। গুলী বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গাড়িটি তীব্র গতিতে ছুটল গেটের দিকে।
গ্রীলের গেট ভেঙে জীপটি বেরিয়ে এল বাইরের রাস্তায়।
জীপটি যখন বাড়িটির এরিয়া ছাড়াচ্ছে, তখন ছেড়ে আসা গেটের সম্ভবত পেছনেই দুটি ইঞ্জিন গর্জন করে উঠার শব্দ পেল জর্জ জুনিয়র।
গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল জর্জ জুনিয়র।
একটা ট্রাফিক পয়েন্ট এড়াতে গিয়ে জর্জের গাড়ি পটোম্যাক রোডে গিয়ে পড়ল। পটোম্যাক রোড থেকে অরলিংটন হাইওয়ের রিং-এ গিয়ে পৌঁছল। রিংটা জর্জের গাড়িকে তার তাড়াতাড়িজনিত একটা ভুলের কারণে অরলিংটনমুখী হাইওয়ে চ্যানেলে নিয়ে ফেলল।
ঘাড়ের উপর বিপদ নিয়ে আর কিছু করার ছিল না।
জর্জের গাড়ি ছুটে চলল অরলিংটন হাইওয়ে ধরে। ওদের দুটি গাড়িও আঠার মত লেগে আছে পেছনে। বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছে। দূরত্ব ক্রমশই কমে আসছে।
জর্জ জুনিয়র শেষ পর্যন্ত পেন্টাগনের রাস্তায় যেতে চেয়েছিল, পেছনের তাড়া খেয়ে সেদিকেও ঘুরতে পারল না। গাড়ি তাতে স্লো করতে হয়। এমনিতেই ওদের গুলীর রেঞ্জে তার গাড়ি এসে গেছে।
আরো সামনে এগিয়ে পেন্টাগন এলাকায় প্রবেশের জন্যেই জর্জ জুনিয়র তার গাড়ি পেন্টাগন এলাকা ঘেঁষে চলে যাওয়া ডাইভারশন রোডটির দিকে ঘুরিয়ে নিল।
রাস্তার এক জায়গায় এসে জর্জ জুনিয়র সাবা বেনগুরিয়ানকে বলল, ‘আমি গাড়ি দাঁড় করাব। দাঁড় করানোর সাথে সাথেই তুমি নেমে পড়বে, আমিও। তারপর জংগলের মধ্যে দিয়ে পেন্টাগনের দিকে ছুটতে হবে। এটাই বাঁচার একমাত্র পথ।’
হার্ড ব্রেক কষে এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করাল জর্জ জুনিয়র। দুজনেই দুই দরজা খুলে পা বাড়াল নামার জন্যে।
পেছনের গাড়ি দুটি সম্ভবত এটাই আঁচ করেছিল। পেছন থেকে শুরু হলো গুলী বৃষ্টি।
বের হতে পারল না ওরা গাড়ি থেকে।
গুলী ছুড়তে ছুড়তে পেছনের দুটি গাড়ি এগিয়ে আসছে জর্জদের গাড়ির দিকে।
জর্জদের গাড়ি ততক্ষণে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।
জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ান গাড়ির মেঝেতে শুয়ে আত্মরক্ষা করছে।

অল্প এগিয়ে ছোট্ট একটা বাঁক পার হতেই আহমদ মুসা ও বেঞ্জামিন দুজনেই গাড়ি তিনটি দেখতে পেল।
‘টার্গেট সামনের ঐ জীপটা। জীপটাকে তো এরা ভর্তা করে ফেলল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ও জীপটা থেকে কিন্তু উত্তর আসছে না। মুনে হয় যুদ্ধটা এক তরফা। ও জীপটা মজলুম আর পেছনের মাইক্রো ও জীপটি জালেমের ভূমিকায় দেখছি অবতীর্ণ হয়েছে।’ বেঞ্জামিন বলল।
‘আপাতত তাই মনে হচ্ছে।’
বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘জোরে চালাও, ওদের থামাতে হবে।’
কাছাকাছি পৌঁছে আহমদ মুসাই প্রথমে গুলী করল। গুলী করে দুটি গাড়ির পেছনের মাইক্রোটার পেছনের উইন্ড স্ক্রীন ভেঙে দিল। দ্বিতীয় গুলী পেছনের উইন্ড স্ক্রীনের ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করে মাইক্রোর সামনের উইন্ড স্ক্রীনও ভেঙে দিল।
সামনের জীপ ও মাইক্রো দুটিই তখন দাঁড়িয়ে পড়েছে।
জীপ ও মাইক্রো থেকে গুলী করতে করতে কয়েকজন নেমে পড়ল।
আহমদ মুসা পিস্তল পকেটে রেখে স্টেনগান হাতে তুলে নিল। বেঞ্জামিনও।
ভয় দেখানোর জন্যেই তারা ফাঁকা গুলী করল লোকগুলীর পাশ দিয়ে, ওপর দিয়ে।
ভয় তারা পেল। দ্রুত তারা গাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল এবং গাড়ির জানালা দিয়ে গুলী চালাতে লাগল।
ঠিক এই সময় রাস্তার ডান পাশের জংগলের ভেতর থেকে একটা
হ্যান্ড লাউড স্পীকারের শব্দ ভেসে এল, ‘আপনারা সবাই গুলী বন্ধ করুন। অস্ত্রগুলো রেখে সবাই গাড়ির ডানপাশে এসে দাঁড়ান। যে গাড়ি দেরী করবে সে গাড়িই উড়িয়ে দেয়া হবে।’
আহমদ মুসা ও বেঞ্জামিন মুহূর্ত দেরী না করে স্টেনগান গাড়ির ভেতরে রেখে বেরিয়ে এসে গাড়ির ডান পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।
অন্যদিকে একদম সামনের জীপ থেকে জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ান ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া গাড়ির মেঝে থেকে গড়িয়ে গাড়ির ডানপাশের রাস্তায় নেমে এল।
কিন্তু মাঝের গাড়ি দুটি থেকে তখনও কেউ নামেনি।
জবাব সংগে সংগেই এল।
জংগলের ভেতর থেকে একটা গোলা এসে নিঁখুত অপারেশনের মত মাইক্রোর ছাদটি উড়িয়ে নিয়ে গেল।
কাজ হলো এতে।
মাঝের জীপ ও মাইক্রো থেকে প্রায় দশ জন লোক খালি হাতে গাড়ির ডান পাশে এসে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা ওদের দেখছিল কিছুটা বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে। ওরা দশজন যারা নেমেছে তাদের কেউই পুরো শ্বেতাংগ নয়। গায়ের রং, দেহের গড়ন সবই বলে দেয় সেমেটিক বা এশিয়ান কোন মিশ্রণ ওদের দেহে আছে। হঠাৎ আহমদ মুসার মাথায় ঝড়ের মত একটা চিন্তা প্রবেশ করল। ওরা কি ইহুদী? জেনারেল শ্যারনের লোক হতে পারে?
আহমদ মুসা মুহুর্তের জন্য ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা শেষ মুহূর্তে আহমদ মুসার চোখে পড়েছে।
দেখল ওদের দশজনের একজনের হাত শূন্যে উঠে গেছে। হাতে একটা গোলাকার বস্তু। তার হাতের টার্গেট সামনের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া জীপ থেকে বেরিয়ে আসা সেই দুজন ছেলে মেয়ে।
কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে আহমদ মুসার বিলম্ব হয়নি।
বিদ্যুৎ বেগে আহমদ মুসার একটা হাত পকেটের ভেতরে ঢুকে বেরিয়ে এল এবং তা উপরে উঠল বিদ্যুৎ ঝলকের মত।
হাতের জিনিসটি ছোঁড়ার জন্যে লোকটির হাত একবার পেছনে এসে জোরে ছুটে যাচ্ছিল সামনে। সে মুহূর্তে আহমদ মুসার রিভলভারের গুলী গিয়ে আঘাত করল ঠিক লোকটির হাতে।
সামনের জীপ থেকে বের হওয়া ছেলে ও মেয়েটি শেষ মুহূর্তে বুঝতে পেরেছিল যে তারা বোমার শিকার হতে যাচ্ছে। তারা কুকড়ে গিয়েছিল ভয়ে।
গুলী লোকটির হাতে লাগার সাথে সাথে ভয়াবহ কান্ড ঘটে গেল।
হাতের জিনিসটা ছিল একটা গ্রেনেড। গ্রেনেডটির বিস্ফোরন ঘটল ঠিক ওদের মাঝখানে। মুহূর্তেই বিপর্যয় ঘটে গেল।
প্রচন্ড বিস্ফোরণে জনাদশেক মানুষের দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল চারদিকে।
ধোঁয়া একটু হালকা হলে দেখা গেলো ওরা দশজনের সবাই আহত নিহতের তালিকায়।
জংগলের বুক ফেঁড়ে ঝড়ের বেগে বেড়িয়ে এল ৫জন সৈনিক।
পাঁচ জনের মধ্যে একজন কর্ণেল র‍্যাংকের অফিসার। অবশিষ্ট ৪ জনও বিভিন্ন র‍্যাংকের অধঃস্তন অফিসার। এসেই কর্ণেল র‍্যাংকের অফিসারটি অধঃস্তন অফিসারদের নির্দেশ দিল, আহত নিহতের সবাইকে একটা গাড়িতে তুলে আমাদের মিলিটারী হাসপাতালে নিয়ে যাও। আহত প্রত্যেককে পাহারায় রাখবে।
সৈনিকরা, আহমদ মুসা ও বেঞ্জামিন সবাই ধরাধরি করে আহত নিহতদের গাড়িতে তুলল।
সাবা বেনগুরিয়ান ও জর্জদের ভয় ও আতংকে কাঠ হয়ে যাওয়া অবস্থা তখনও কাটেনি।
দুজন অফিসার আহত নিহতদের গাড়ি নিয়ে চলে গেল। আর দুজন রয়ে গেল কর্ণেলের সাথে।
গাড়িটাকে বিদায় করে কর্ণেল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে যে ওদের শেষ হামলা থেকেও এদের দুজনকে আপনি বাঁচিয়েছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না, কেউ কেউ তো আহত নিহত হলোই।’
বলে একটু থেমে সেই ছেলে মেয়ে দুজনের দিকে ইংগিত করে বলল, ‘ওরা ও আপনারা কি এক সাথের?’
‘না, গোলাগুলী হতে দেখে আমরা এর সাথে জড়িয়ে পড়েছি।’ বলল আহমদ মুসা।
জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ান এগিয়ে এল তাদের দিকে। বলল জর্জ জুনিয়র সৈনিক ও আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ। ওদের বন্দীখানা থেকে আমরা পালিয়েছি। ওরা আমাদের মেরে ফেলার জন্যেই ধাওয়া করেছিল। আপনারা বাঁচিয়েছেন।’
‘আপনার নাম পরিচয় কি বলুন তো?’ যেন চিনতে পারছে, জর্জ জুনিয়রের দিকে এমন দৃষ্টিতে চেয়ে কপাল কুঞ্চিত করে বলল কর্ণেল লোকটি।
‘আমি জর্জ জন আব্রাহাম জুনিয়র। আমার পিতা জর্জ আব্রাহাম জনসন।’ বলল জর্জ জুনিয়র।
‘তার মানে তুমি আমাদের জর্জ মুর আব্রাহামের ছোট ভাই?’ বলল কর্ণেল।
‘হ্যাঁ।’
আহমদ মুসা ও বেঞ্জামিন দুজনেরই চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেছে। জর্জ জুনিয়র ইহুদীদের হাতে বন্দী হয়েছিল? কেন? জর্জ জুনিয়রকে ওরা হত্যা করবে কেন? এসব প্রশ্ন ঝড়ের মত এসে আহমদ মুসার মনে ভিড় জমাল।
‘তোমার আব্বার খবর জান? তুমি বন্দী হয়েছিলে কেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
জর্জ জুনিয়র চমকে উঠে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, ‘আপনি জানেন কিছু? কোন খবর আমি জানি না।’
‘আমরা এক সাথেই নিউ মেক্সিকো থেকে এসেছি ওয়াশিংটনে, এই কিছুক্ষণ আগে।’
‘তিনি ভাল আছেন?’ জর্জ জুনিয়র জিজ্ঞেস করল।
‘ভালো আছেন। কিন্তু তিনি এবং এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার সাসপেন্ড হয়েছেন তাদের পদ থেকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অসম্ভব। কেন?’
‘অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। কারণ বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে।’
‘দয়া করে দুএকটা বলুন। নাহলে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।’ জর্জ জুনিয়র বলল।
‘তাঁর বিরুদ্ধে নির্দোষ ইহুদীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি এবং অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার আহমদ মুসার পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মিথ্যা এ অভিযোগ। আমি তার জীবন্ত সাক্ষী। এজন্যেই ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। আমার আব্বাকে ওরা নজরবন্দী করে রেখেছে।’ বলল তীব্র কন্ঠে মেয়েটি।
‘তুমি কে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
কথা বলে উঠল জর্জ জুনিয়র। বলল, ‘এঁর নাম সাবা বেনগুরিয়ান। আইজ্যাক বেনগুরিয়ানের মেয়ে।’
‘অর্থাৎ ইহুদী ধনকুবের আইজ্যাক বেনগুরিয়ানের মেয়ে?’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘তুমি জীবন্ত সাক্ষী কি করে হলে?’ বলল আহমদ মুসা সাবা বেনগুরিয়ানকে।
‘ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল শ্যারন আব্বার বন্ধু। সেই সুযোগ নিয়ে তিনি আমাকে জর্জ আব্রাহামের মাস্টার কম্পিউটারের লস আলামোসের ইহুদী গোয়েন্দা সংক্রান্ত সব রেকর্ড মুছে ফেলার জন্যে কাজ করতে বাধ্য করেন। সেখানে গিয়েও আমি শেষ পর্যন্ত দেশের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারিনি। আমি আরও কিছু বিষয় জানতে পারি। এ সব কারণেই আমাকে ও আব্বাকে বন্দী করা হয়েছে। আমার কাছ থেকে জেনারেল শ্যারনের বিষয়ে জর্জ জুনিয়র সব কিছু জেনেছে বলে তাকেও বন্দী করা হয়।’
সাবা বেনগুরিয়ান থামতেই কর্ণেল বলে উঠল, ‘আপনারা যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন, সবই দেশের নিরাপত্তার সাথে জড়িত।
আর এখানে যা ঘটল তারও সম্পর্ক আছে দেশের নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়ের সাথে। সুতরাং আপনাদের সবাইকে পেন্টাগনের অভ্যন্তরীণ সিকিউরিটি দফতরে যেতে হবে।’
কর্ণেল থামতেই জর্জ জুনিয়র বলে উঠল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘আপনার পরিচয় তো জানলাম না। আব্বাদের সাথে আপনি এলেন কেমন করে? সব বিষয়ই বা আপনি কি করে জানেন?’
‘আমি গ্রেফতার এড়িয়ে পালিয়ে এসেছি। চলুন পেন্টাগনের অভ্যন্তরীণ সিকিউরিটি দফতরে গিয়েই সব আলোচনা করা যাবে।’
‘চলুন যাওয়া যাক। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দফতরের চীফ জেনারেল শেরউড আজই পৌঁছার কথা। তিনি নিশ্চয়ই পৌঁছেছেন।’ বল কর্ণেলটি।
সবাই এগুলো গাড়ির দিকে।

পেন্টাগনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল শেরউড টেবিলে বসতেই তার টেলিফোন বেজে উঠল।
একটু বিরক্ত লাগলেও টেলিফোন তুলে নিল জেনারেল শেরউড।
জেনারেল শেরউড ক্লান্ত। তিনি নিউ মেক্সিকো থেকে অনেক ধকল আর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তার দফতরে এসে সবেমাত্র বসেছে। বাড়িতেও যায়নি সে।
টেলিফোন করেছে জেনারেল শেরউডের সহকারী ব্রিগেডিয়ার স্টিভ স্টিফেনসন।
তার কাছ থেকেই খবর পেল যে, জর্জ আব্রাহাম জনসনকে এফ.বি.আই চীফ-এর পদ থেকে এবং অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারকে সি.আই.এ চীফ-এর পদ থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। অন্যদিকে বিমান বন্দর থেকেই আহমদ মুসা পালিয়েছে। আরও জানল, জর্জ আব্রাহামের ছোট ছেলে জর্জ জন জুনিয়র নিখোঁজ। রহস্যের ব্যাপার হলো, তার চিঠি নিয়ে এসে জর্জ আব্রাহামের পার্সোনাল কম্পিউটার কারা যেন নিয়ে গেছে। তার কয়েক ঘন্টা আগে এফ.বি.আই হেড কোয়ার্টারের কম্পিউটার কক্ষ বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়েছে। খবরগুলো দিয়ে ব্রিগেডিয়ার স্টিভ স্টিফেনসন বলল, ‘পরিস্থিতি খুব জটিল হয়ে উঠেছে স্যার। আপনার রিপোর্টে যা বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা অফিস তার উল্টো কথা বলছে। আমি পুরোটা আপনার কাছে পাঠাচ্ছি স্যার।’
‘পাঠাও স্টিভ। আমি যে রিপোর্ট পাঠিয়েছি, তার প্রতিটা বর্ণ সত্য। আমরা বড় কোন ষড়যন্ত্রের মুখে স্টিভ।’
বলে টেলিফোন রেখে দিল জেনারেল শেরউড।
টেলিফোন রাখার পর হতভম্বের মত কিছুক্ষণ বসে থাকল জেনারেল শেরউড। ভাবছিল সে, জর্জ আব্রাহাম জনসনের মত প্রবীণ ও সুখ্যাত এবং অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের মত ব্রিলিয়ান্ট অফিসার কখনও সাসপেন্ড হতে পারে! এতদূর এগিয়েছে ইহুদীবাদীরা। আহমদ মুসা গ্রেফতার এড়িয়ে পালিয়েছে, ভালই হয়েছে। তার বাইরে থাকা দরকার সত্য উদঘাটনের জন্যেই। এখন এই মুহূর্তে তার নিজের কি করণীয়?
হঠাৎ তার মনে হলো জর্জ আব্রাহামকে একবার তার টেলিফোন করা দরকার।
টেলিফোন করল। কিন্তু টেলিফোন কেউ ধরল না।
অনুসন্ধান করে জানতে পারল, তার টেলিফোন লাইন নষ্ট কোন কারণে।
মোবাইল টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করল জেনারেল শেরউড। কিন্তু জানা গেল এ লাইনটাও তার খারাপ।
বিস্মিত জেনারেল শেরউড। সে টেলিফোন করল অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারকে। তারও সব টেলিফোনের এই একই অবস্থা।
উদ্বেগ চরমে উঠল জেনারেল শেরউডের। তাদের টেলিফোন লাইনও নষ্ট, একথা তার বিশ্বাস হলো না। তার মনে হলো, তাদেরকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখা হয়েছে। তারা কি নজরবন্দীও?
লাল টেলিফোন তুলে নিল জেনারেল শেরউড। টেলিফোন করল সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনকে।
জেনারেল শেরউডের গলা পেয়াই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন বলে উঠল, ‘কখন তুমি ফিরলে শেরউড?’
‘পাঁচ মিনিট আগে স্যার।’
‘তিনজনের টীম গিয়েছিল লস আলামোসে। দুজন সাসপেন্ড, তুমি একজন বাকি।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন কতকটা রসিকতার সুরে।
‘প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের হাত সম্ভবত আমার পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। স্যার, সবই আপনার জানার কথা। কিছু একটা করুন স্যার।’ জেনারেল শেরউডের কন্ঠে উদ্বেগ।
‘আহমদ মুসা সম্পর্কে রিপোর্টে যা লিখেছ, তা তোমার ইমপ্রেশন থেকে, না বিশ্বাস থেকে?’
‘নিখাদ বিশ্বাস থেকে লিখেছি স্যার।’
‘আহমদ মুসাকে আমিও কোনদিন পছন্দ করিনি। কিন্তু তার বিষয়ে একটা কথা আমি জানি, সে মিথ্যা কথা বলে না।’
‘ধন্যবাদ স্যার। তার সাথে বেশ কিছু সময় থেকে আমার বিশ্বাস হয়েছে, উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাবার মত লোক সে নয়। তাছাড়া ঘটনার মধ্যে থেকে আমরা দেখেছি, প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা যা বলেছেন তা সত্য নয়।’
‘কিন্তু শেরউড, আহমদ মুসা মিরাকলগুলো ঘটাতে পারল কেমন করে?’
‘ওগুলো মিরাকল নয় স্যার, আহমদ মুসার অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও বিশ্লেষণী শক্তির ফল। আমি সে সবের মধ্যে কোন অস্বাভাবিকতা দেখিনি স্যার।’
‘গ্রেফতার এড়িয়ে বিমান বন্দর থেকে তার পালানোর ব্যাখ্যা তুমি কিভাবে করবে? বলা হচ্ছে, ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিল বলেই এ পালাবার ব্যবস্থাও সে করে রেখেছিল।’
‘স্যার, আমার ধারণা ‘ফ্রি আমেরিকা’ আন্দোলনের দুঃসাহসী কেউ আহমদ মুসাকে সাহায্য করেছে। ইহুদীরা আহমদ মুসার পেছনে লাগায় ‘ফ্রি আমেরিকা’ আহমদ মুসাকে সাহায্য করছে।’ বলল জেনারেল শেরউড।
‘ফ্রি আমেরিকা’ আহমদ মুসাকে সাহায্য করায় ওরা কিন্তু সুযোগ পেয়েছে ঘটনাগুলো আহমদ মুসার সাজানো ষড়যন্ত্র বলার।’
‘ঠিক স্যার। কিন্তু কি করণীয়? ইহুদীরা তাদের এ ষড়যন্ত্র চাপা দিতে পারলে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। ইহুদী ষড়যন্ত্র সত্যিই আমাদের গিলে ফেলবে।’
‘কিন্তু প্রমাণ নেই শেরউড। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা অফিস এবং প্রেসিডেন্টকে ওরা বুঝাতে পেরেছে। এখন কিছু করতে গেলে কাগজে-কলমে প্রমাণ করতে হবে।’
‘এ ধরনের ষড়যন্ত্র খুব কমই হাতে-কলমে প্রমাণ করা যায়। ইহুদী ঘাটি সবুজ পাহাড় থেকে লস আলামোস পর্যন্ত যে সুড়ঙ্গ আহমদ মুসা আবিষ্কার করেছেন, তার চেয়ে বড় প্রমাণ কি আর প্রয়োজন আছে স্যার?’
‘সে সুরঙ্গের একটা ব্যাখ্যা তারা দাঁড় করিয়েছে। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা অফিস ও প্রেসিডেন্ট সে ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট।’
‘তাহলে ইহুদী কৌশলেরই কি জয় হবে স্যার?’
‘আমি তোমাকে একটা কথা বলি শেরউড। ইহুদীদের পাপের ভার বোধ হয় পূর্ণ হয়েছে। আহমদ মুসার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগমন সম্ভবত তারই আলামত। এখন দরকার প্রমাণের। আহমদ মুসার গ্রেফতার এড়ানোর অর্থ একটা অবশ্যই আছে।’
‘ধন্যবাদ স্যার। মাফ করবেন স্যার, এফ.বি.আই এবং সি.আই.এ-কে নিষ্ক্রীয় করার পর আমার মতে সেনাবাহিনীই এখন জাতির ভরসা। সুতরাং আপনার উপর অনেক দায়িত্ব বর্তেছে স্যার।’
‘ধন্যবাদ শেরউড। বাই।’
জেনারেল শেরউড টেলিফোন রেখে সোজা হয়ে বসতেই আবার টেলিফোন বেজে উঠল।
ব্রিগেডিয়ার স্টিভ স্টিফেনসনের টেলিফোন। সে বলল, ‘স্যার আমাদের পেন্টাগন এলাকার সীমানায় একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে।’
‘কি ঘটেছে?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠ জেনারেল শেরউডের।
‘দুটি গাড়ি একটা জীপকে তাড়া করে আমাদের দক্ষিণ প্রান্তের ডাইভারশন রোডে আসে। জীপটির আরোহী দুই ছেলে মেয়ে জীপ থামিয়ে পেন্টাগন এরিয়ায় পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু পেছনের দুটি গাড়ির গুলী বৃষ্টির মুখে তারা গাড়ি থেকে বের হতে পারে না। জীপের দুজন ছেলেমেয়েকে ওরা মেরেই ফেলতো। কিন্তু পেছন থেকে আরেকটি গাড়ি এ সময় এসে পড়ে। তারা সেই আক্রমণকারী গাড়ি দুটির উপর গুলী বর্ষণ করে ওদের থামিয়ে দেয়।
ঐ এলাকায় আমাদের প্রহরারত কর্ণেল তার পাঁচজন সাথী নিয়ে এ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করে। সবাই নেমে আসে জীপ থেকে, দুই তরুণ তরুণী, মাঝের দুই গাড়ি থেকে দশজন এবং শেষে আসা গাড়ির দুজন। বিস্ময়ের ব্যাপার গাড়ি থেকে আমাদের লোকদের চোখের সামনে সেই দশজনের একজন গ্রেনেড ছুঁড়ে ঐ দুই তরুণ তরুণীকে হত্যার চেষ্টা করে। পেছনের গাড়ির দুজনের একজন ঠিক সময়ে গ্রেনেড নিক্ষেপকারী লোকটির হাত লক্ষ্যে গুলী করে। তরুণ তরুণী বেঁচে যায়, কিন্তু গ্রেনেডের ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে ঐ দশ জনের মাঝখানে। ওদের ৬ জন নিহত, ৪ জন মারাত্মক আহত। সবাইকে পেন্টাগনে নিয়ে আসা হয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো তাদের পরিচয়। তরুণটি জর্জ আব্রাহাম জনসনের ছেলে আর মেয়েটি ইহুদী ধন কুবের আইজ্যাক বেনগুরিয়ানের মেয়ে। দুজনেই জেনারেল শ্যারনের বন্দীখানা থেকে পালিয়েছে। পেছনে ধাওয়া করা শ্যারনদের লোকরাই………’
‘আর শোনার দরকার নেই, এই মুহূর্তে ওদের এখানে নিয়ে এস। আমিই শুনব ওদের কাছে। কোন গুরুতর ব্যাপার মনে হচ্ছে ব্রিগেডিয়ার।’ বলল জেনারেল শেরউড।
‘ঠিক আছে স্যার, আমি আসছি।’
টেলিফোন রেখে দিল জেনারেল শেরউড।
তার ভ্রু দুটি কুঞ্চিত হলো। চোখে মুখে একটা উত্তেজনা। এফ.বি.আই প্রধানের নিখোঁজ ছেলে জেনারেল শ্যারনদের হাতে বন্দী ছিল? তাহলে তার হাতে চিঠি লিখিয়ে নিয়ে শ্যারনদের লোকরাই জর্জ আব্রাহামের মাস্টার কম্পিউটার নিয়ে গেছে? এর অর্থ কি দাঁড়াচ্ছে, এফ.বি.আই হেড কোয়ার্টারের কম্পিউটার কক্ষটি জেনারেল শ্যারনের লোকরাই ধ্বংস করেছে?
দুচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল জেনারেল শেরউডের। তার মনে হলো, সামনে এগুবার একটা দরজা যেন তার সামনে খুলে গেল।
মিনিট খানেকের মধ্যেই জেনারেল শেরউডের পি.এস টেলিকমে বলে উঠল, ‘স্যার ব্রিগেডিয়ার সাহেবরা এসেছেন।’
‘নিয়ে এস ওদের।’ জেনারেল শেরউড বলল।
ব্রিগেডিয়ার স্টিভ সবাইকে নিয়ে প্রবেশ করল জেনারেল শেরউডের অফিস কক্ষে।
সবাইকে স্বাগত জানানোর জন্যে জেনারেল শেরউড দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
সবার দিকে নজর বুলাতে গিয়ে আহমদ মুসার উপর নজর পড়তেই আনন্দ, বিস্ময় ও আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়ল জেনারেল শেরউড। কিন্তু সেটা কয়েক মুহূর্তের জন্যে।
পরক্ষণেই সে ছুটল আহমদ মুসার দিকে। সে যে একজন জেনারেল তা যেন ভুলে গেল। ভুলে গেল তাদের সামরিক ফর্মালিটির কথা। জেনারেল শেরউড ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘এই মুহূর্তে আমি সবচেয়ে বেশি আশা করছিলাম আপনাকে। ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ।’
তারপর জেনারেল শেরউড আহমদ মুসাকে হাত ধরে টেনে এনে চেয়ারে বসাল। তারপর সবাইকে বসার অনুরোধ করল।
ব্রিগেডিয়ার স্টিভ স্টিফেনসনের দুই চোখ তখন বিস্ময়ে ছানাবড়া। জেনারেল শেরউডের মত কঠোর, রাশভারি ও সার্বক্ষণিক ফরমাল লোক এই লোকটিকে দেখে তার সব বৈশিষ্ট্য ভুলে গেলেন কি করে! কোন মানুষের বেলায়ই জেনারেল যা কোনদিন করেননি, এই লোকটির ক্ষেত্রে তা তিনি করলেন কেন? তার মত লোক তার অফিস কক্ষে সবার চোখের সামনে সিট থেকে উঠে এসে একজনকে জড়িয়ে ধরবেন, এটা একটা অকল্পনীয় ব্যাপার। অসীম ভাগ্যবান এই লোকটি কে?
কতকটা এই ধরনেরই প্রশ্ন জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ানের মনেও। কে এই লোক? পেন্টাগনের একটি শীর্ষ পদের একজন ডাকসাইটে জেনারেল সিট থেকে উঠে এসে যাকে জড়িয়ে ধরেন এবং হাত ধরে নিয়ে গিয়ে সম্মানের সাথে চেয়ারে বসান, তাঁর পরিচয় কি হতে পারে? জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ান দুজনেরই মনে পড়ল, এই লোকটি ঠিক সময়ে গুলী করে গ্রেনেড নিক্ষেপ না ঠেকালে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। কি তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কি অদ্ভূত তাঁর ক্ষীপ্রতা। আব্বাদের সাথে নিউ মেক্সিকো থেকে এসে গ্রেফতার এড়িয়ে পালিয়েছেন। তাহলে তো উনি আব্বাদের সাথেরই লোক। কে তাহলে এই লোক? যাহোক ঈশ্বর তাঁকে পাঠিয়েছেন তাদের দুজনকে বাঁচাতে।
সকলকে বসতে বলে জেনারেল শেরউড গিয়ে তার চেয়ারে বসল।
বসেই ব্রিগেডিয়ার স্টিভকে বলল আহমদ মুসাকে দেখিয়ে, ‘তুমি নিশ্চয় এঁকে চিনতে পারনি?’
‘না স্যার।’
‘তুমি তাকে জান, দেখনি। কিন্তু ফটো তো দেখেছ।’ বলল জেনারেল শেরউড।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো ব্রিগেডিয়ার স্টিভের। তীক্ষ্ণ হলো তার দৃষ্টি।
হঠাৎ লাফিয়ে উঠল চেয়ার থেকে। বলল, ‘ইনি আহমদ মুসা! স্যার, ইনি আহমদ মুসা?’ তার কন্ঠে একটা উচ্ছ্বাস, চোখে তার বিস্ময়-বিমুগ্ধ দৃষ্টি।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল ব্রিগেডিয়ার স্টিভের সাথে। বলল, ‘হ্যাঁ, আমি আহমদ মুসা।’
‘খুশি হলাম, স্যার।’ বলল ব্রিগেডিয়ার স্টিভ।
বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টি তখন জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ানেরও। সাবা বেনগুরিয়ানও অনেক শুনেছে আহমদ মুসা সম্পর্কে পিতার কাছে এবং জেনারেল শ্যারনের কাছে। তার কাছে ছিল আহমদ মুসার একটা ভয়ংকর রূপ। কিন্তু আহমদ মুসাকে এখন খুবই আকর্ষণীয় ও নিষ্পাপ এক ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। তাদেরকে বাঁচিয়েছেন বলেই কি! কিন্তু জেনারেল শেরউডের মত লোকদেরও সম্মান ও শ্রদ্ধা তিনি অর্জন করেছেন দেখা যাচ্ছে।
জর্জ জুনিয়র তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। সে অনেকটা দ্বিধাগ্রস্ত হাত বাড়াল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আব্বা-আম্মার কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। জর্জ এডওয়ার্ড মুর সম্পর্কে আলোচনা উঠলে আপনার কথা ওঠেই।’
জর্জ আব্রাহাম জনসনের নাতি এবং সেনা গোয়েন্দা অফিসার জর্জ মুর আব্রাহামের ছেলে জর্জ এডওয়ার্ড মুরকেই আহমদ মুসা ওহাইও নদীতে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল।
আহমদ মুসা হাসি মুখে তার সাথে হ্যান্ডশেক করল। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তোমার সাথে দেখা হলো।’
‘কিন্তু মিঃ আহমদ মুসা, আপনার জর্জ আব্রাহামের নাতিকে বাঁচানো এখন জর্জ আব্রাহামের বিরুদ্ধে আপনার সাথে যোগসাজসের একটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘উপযুক্ত কারণ বটে।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই জেনারেল শেরউড জর্জ জুনিয়রের দিকে চেয়ে বলল, ‘জর্জ, আমরা একটা কঠিন সময় অতিক্রম করছি। লস আলামোসের তদন্তে তোমার আব্বার সাথে আমিও ছিলাম। যা আমাদের কাছে সত্য, তা মিথ্যায় পরিণত হয়েছে। যে এফ.বি.আই চীফ বাদি হয়ে কেস দায়ের করবেন, তিনিই এখন আসামী। এই অবস্থায় কি সহযোগিতা করতে পার তোমরা? আমরা কিভাবে হাতে-কলমে প্রমাণ করব যে, তোমাদের ও অন্যসব ঘটনার সাথে জেনারেল শ্যারন জড়িত আছেন?’
জর্জ জুনিয়র কথা বলার আগেই সাবা বেনগুরিয়ান কথা বলে উঠল। বলল, ‘স্যার আমি নিজের কানে শুনেছি, জেনারেল শ্যারন টেলিফোনে ইহুদী গোয়েন্দা বেনইয়ামিনকে বলছেন যে, লস আলামোসে ডেথ স্কোয়াড পাঠানো হয়েছে এবং বেনইয়ামিনও যেন সেদিকে যায় ঘটনার বিবরণ সংগে সংগে দেবার জন্যে। তারপর তিনিই আমাকে নিয়োগ করেন জর্জ আব্রাহামের লস আলামোস সংক্রান্ত কম্পিউটার রেকর্ড নষ্ট করার জন্যে।’
‘তুমি জর্জ জুনিয়রের বন্ধু হিসেবে এই কথাগুলো সাজিয়েছ। তোমার বলার কি আছে? বল?’ বল জেনারেল শেরউড।
সাবা বেনগুরিয়ান কানে কানে জর্জ জুনিয়রের সাথে কথা বলল। জর্জ জুনিয়র সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। দুজনের মুখই আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সাবা বেনগুরিয়ানই কথা বলল, ‘স্যার একটা ডকুমেন্ট বোধ হয় আমি আনতে পেরেছি। আমাদের বাড়ির চারদিকসহ গেট, গেটের পরের লন ও করিডোর এবং ড্রয়িং রুমে সার্বক্ষণিক ভিডিও ক্যামেরা পাতা আছে। আমার সাথে জেনারেল শ্যারন যেসব কথা বলেন এবং আমাকে ও আব্বাকে যখন জেনারেল শ্যারন অন্যত্র সরিয়ে নেবার প্রস্তাব করেন, তখন আব্বা ও জেনারেল শ্যারনের যে আলাপ হয়, তাতে জেনারেল শ্যারন বর্তমান বিপদ ও ভবিষ্যত নিয়ে অনেক কথা বলেন। আমি আড়াল থেকে শুনেছি। আমাকে ও আব্বাকে যখন তার লোকজন গিয়ে নিয়ে আসে তার আগেই আমি ভিডিও ক্যামেরার রীল বের করে নিয়ে নেই এবং আসার সময় গেটের দারোয়ানকে দিয়ে আসি জর্জ জুনিয়রকে দেবার জন্যে। ওটা জর্জের কাছে আছে।’
জেনারেল শেরউড ও আহমদ মুসা দুজনের মুখই আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘শ্যারনের বন্দীখানায় ওরা সার্চ করে ওটা নিয়ে নেয়নি?’ বলল ব্রিগেডিয়ার স্টিভ অনেকটা দ্রুত কন্ঠে। তার চোখে মুখে যেন কিছুটা অস্বস্তি।
‘খুব সাধারণ জায়গায় রেখেছিলাম। শুধু ওখানটায় ওদের সার্চ বাকি ছিল।’ বলল জর্জ জুনিয়র।
‘ধন্যবাদ জর্জ ও সাবা। একটা অতি ভাল খবর পাওয়া গেল। কিন্তু ভিডিওতো পরীক্ষা করা হয়নি?’ বলল জেনারেল শেরউড।
‘এখন পরীক্ষা করা যায় স্যার।’ বলল ব্রিগেডিয়ার স্টিভ। তার কন্ঠে উৎকণ্ঠিত আগ্রহ।
‘না থাক।’ এ কথা বলে জেনারেল শেরউড একটু থামল। তারপর আবার বলল আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে, ‘মিঃ আহমদ মুসা, প্রমাণ সংগ্রহ সম্পর্কে আপনি কিছু ভাবছেন?’
‘মিস সাবার আব্বাকে যেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছে, সে ঠিকানা মিস সাবা জানে। তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করা গেলে সেটা একটা প্রমাণ হতে পারে।’
‘ঠিক। এ মিশন এই মুহূর্তেই আমরা হাতে নিতে পারি।’
এ সময় বেঞ্জামিন বেকন আহমদ মুসার কানে কানে কিছু বলল। আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল জেনারেল শেরউডকে লক্ষ্য করে, ‘মিঃ জেনারেল, আরও একটা ডকুমেন্ট আমাদের হাতে আছে।’
‘কি সেটা?’ উদগ্রীব কন্ঠে বলল জেনারেল শেরউড।
‘সে টেপটা এখনও পরীক্ষা করা হয়নি। টেপটা জেনারেল শ্যারন ও জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার একটা রেকর্ড।’
ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠল জেনারেল শেরউডের। ‘সত্যি সে রেকর্ড আপনাদের কাছে আছে? কিন্তু কোথায় পেলেন সেটা? আপনি তো আমাদের সাথেই এলেন।’
আহমদ মুসা বেঞ্জামিন বেকনের দিকে ইংগিত করে বলল, ‘ইনিই আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে গ্রেফতার বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছেন। টেপটা এরই সংগ্রহ।’
‘ও, হো! ওর সাথে পরিচয় তো হয়নি।’
বলে বেঞ্জামিন বেকনের দিকে জেনারেল শেরউড হাত বাড়িয়ে বলল, ‘হ্যাল্লো।’
আহমদ মুসা কথা বলে উঠল বেঞ্জামিন বেকনের আগে। বলল, ‘ওর পরিচয়টা একটু বিদ্ঘুটে। ওর পরিচয়টা পরে হবে মিঃ জেনারেল।’
হাসল জেনারেল শেরউড। বলল, ‘একবার কথাটা উঠার পর পরিচয়টা হয়ে যাওয়াই সব দিক থেকে শোভন নয় কি আহমদ মুসা?’
‘ঠিক বলেছেন জেনারেল।’
বলে আহমদ মুসা বেঞ্জামিন বেকনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, তারপর বলল, ‘ইনি এফ.বি.এই-এর অফিসার বেঞ্জামিন বেকন। ছুটিতে আছেন। তার আরেকটা পরিচয় তিনি ‘ফ্রি আমেরিকা’ সংগঠনের সদস্য।’
জেনারেল শেরউড উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল বেঞ্জামিন বেকনের সাথে।
ব্রিগেডিয়ার স্টিভ বেঞ্জামিনের দিকে তাকিয়ে শুধু মাথা নাড়ল। উঠল না। তার চোখে মুখে একটা ভাবান্তর।
জেনারেল শেরউড তার ডান দিকের লাল টেলিফোনে হাত রেখে বলল, ‘মাফ করুন আপনারা, আমি একটু চীফ জেনারেল স্যারের সাথে কথা বলে নেই। আমার মনে হয় কোন কাজেই এখন আর এক মুহূর্ত দেরী করা ঠিক নয়। তাঁর সাথে এখনি সাক্ষাৎ হওয়া দরকার।’
ব্রিগেডিয়ার স্টিভ বলে উঠল, ‘স্যার, আমি কি একটু উঠতে পারী? পাঁচ মিনিট পর আসব।’
‘এস। চীফ স্যার তোমাকে উপস্থিত চাইতে পারেন।’
‘আসছি স্যার।’ বলে উঠে দাঁড়াল ব্রিগেডিয়ার স্টিভ।
ব্রিগেডিয়ার স্টিভ বেরিয়ে যেতেই আহমদ মুসা দ্রুত জেনারেল শেরউডকে বলল, ‘মাফ করুন জেনারেল, আপনাদের টেলিফোন মনিটরিং ব্যবস্থা নিশ্চয় আছে?’
‘আছে। কেন?’ উৎসুক কন্ঠ জেনারেল শেরউডের।
‘এই মুহূর্ত থেকে পাঁচ মিনিট পর্যন্ত আপনার এ বিভাগ থেকে যতগুলো টেলিফোন বাইরে যাবে, তা মনিটর করুন।’
‘কেন?’
‘আমার মনে হচ্ছে, কতকগুলো সিক্রেট কথা এ সময় বাইরে পাচার হবে।’
ভ্রু কুঁচকে উঠল জেনারেল শেরউডের। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দ্রুত কন্ঠে বলল, ‘আমি আপনার ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছি মিঃ আহমদ মুসা।’ তার কন্ঠে উত্তেজনা।
জেনারেল শেরউড দ্রুত উঠে পেছনের দরজা দিয়ে পাশের কক্ষে প্রবেশ করল।
বেঞ্জামিন বেকন, জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ান সবার দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। তারা সবাই অবাক হয়েছে। কিন্তু সবাই নিরব।
আহমদ মুসাই কথা বলল, ‘জর্জ জুনিয়র, আমি জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তিত।’
‘আব্বা নিশ্চয় বাসায় ফিরেছেন। বাসাতেও নিরাপদ নন?’ বলল জর্জ জুনিয়র।
‘বাসাতে পাহারা এখনো থাকবে নিশ্চয়।’
‘তা থাকার কথা। সাসপেন্ড তো চাকরীচ্যুতি নয়।’
তাদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। কিছু সময় পর ঘরে প্রবেশ করল জেনারেল শেরউড। তার মুখ গম্ভীর। ভীষণ এক নিম্নচাপের লক্ষণ। চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা।’
ঘরে প্রবেশ করল ব্রিগেডিয়ার স্টিভ।
জেনারেল শেরউডের মুখটা যেন আরও কঠোর হয়ে উঠল। ব্রিগেডিয়ার স্টিভের দিকে না তাকিয়েই জেনারেল শেরউড বলল, ‘তোমার টেলিফোন ঠিক পাঁচ মিনিটেই শেষ করেছ স্টিভ।’ ব্রিগেডিয়ার স্টিভ ভূত দেখার মত চমকে উঠল। হঠাৎ তার মুখে যেন এক পোঁচ কালি কেউ ঢেলে দিল।
ঘরে প্রবেশ করল দুজন মিলিটারী পুলিশ।
সবাই তাকাল দুজন মিলিটারী পুলিশের দিকে। ব্রিগেডিয়ার স্টিভও। তার চোখে মুখে তখন চাঞ্চল্য।
দুজন মিলিটারী পুলিশ পা ঠুকে স্যালুট করল জেনারেল শেরউডকে।
‘ব্রিগেডিয়ার স্টিভকে গ্রেফতার কর।’ পুলিশ দুজনের দিকে একবার মাথা তুলে তাকিয়েই নির্দেশ দিল জেনারেল শেরউড। বজ্রপাতের মতই তার কন্ঠ স্থির, তীব্র।
উঠে দাঁড়িয়েছিল ব্রিগেডিয়ার স্টিভ। তার মুখ ফ্যাঁকাশে হয়ে গিয়েছিল। কাঁপছিল যেন সে। নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমার অপরাধ কি স্যার?’
‘যথা সময়ে মিলিটারী ট্রাইবুন্যালই তোমাকে জানাবে ব্রিগেডিয়ার স্টিভ।’ কঠোর কন্ঠ জেনারেল শেরউডের।
মিলিটারী পুলিশ দুজন ব্রিগেডিয়ার স্টিভের দুহাতে হাতকড়া লাগিয়ে তাকে নিয়ে বের হয়ে গেল ঘর থেকে।
ঘরে তখন পিনপতন নিরবতা। একমাত্র আহমদ মুসা ছাড়া অন্য সকলেই বিস্ময়-বিমূঢ়।
নিরবতা ভাঙল জেনারেল শেরউড। বলল, ‘আবার আপনাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি আহমদ মুসা। এক বিশ্বাসঘাতককে আপনি ধরিয়ে দিয়েছেন।’
বলে একটু থামল। চেয়ারটা একটু টেনে নিয়ে নড়ে-চড়ে বসল। বলল, ‘বলুন তো ব্রিগেডিয়ার স্টিভকে কখন কিভাবে সন্দেহ হলো? তাকে কি আগে থেকে চিনতেন?’
‘না, চিনতাম না। কিছুক্ষণ আগে আজই প্রথম দেখা তার সাথে।’
বলে থামল আহমদ মুসা। একটু হাসল। বলল, ‘ঘটনা হয়তো বড় তেমন কিছু নয়। কিন্তু যা ঘটেছে তাতেই আমার নিশ্চিত বিশ্বাস হয়েছে, ব্রিগেডিয়ারের আরেকটা পরিচয় আছে।’
‘কি সে ঘটনা?’
‘প্রথমে তার হাতের সোনার আংটি আমার চোখে পড়ে। আংটিতে একটি হিব্রু অক্ষর খোদাই করা। সেটা জেনারেল শ্যারনের আদ্যাক্ষর। প্রথম সন্দেহ আমার সৃষ্টি হয় এখান থেকেই। ইহুদী ছাড়া অথবা ইহুদীদের প্রতি বড় রকমের ভালবাসা ছাড়া কারও মধ্যে এই হিব্রু প্রীতি থাকা সম্ভব নয়। আর ………’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে জেনারেল শেরউড বলে উঠল, ‘মিঃ আহমদ মুসা, তার হাতের আংটি আমারও চোখে পড়েছে। চারদিকে হীরক খচিত তার আংটির প্রশংসা পর্যন্ত আমি করেছি। কিন্তু হিব্রু অক্ষর তো আমি খেয়াল করিনি।’
‘হিব্রু অক্ষর আরবী ক্যালিওগ্রাফিক ঢংয়ে লেখা। খুব ভালো করে খেয়াল না করলে বোঝা খুব কঠিন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। তারপর বলুন।’ জেনারেল শেরউড বলল।
‘দ্বিতীয় সন্দেহ হয় তার একটা টেলিফোন থেকে। আমাদের ঘটনা শোনার পর তিনি আপনার কাছে টেলিফোন করেন। কিন্তু তার আগে আরও এক জায়গায় টেলিফোন করেন তিনি। সে টেলিফোন নাম্বার আমাকে বিস্মিত করে। সন্দেহটাকে দৃঢ় করে। টেলিফোন নাম্বারটা পেন্টাগনের নয়, কিংবা নয় প্রেসিডেন্ট ভবনেরও। টেলিফোনে তিনি নিজের নাম বলেননি। যার কাছে করেছিলেন তাকে নাম ধরে সম্বোধনও করেননি। আমাদের ঘটনা এবং জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ানের বিষয়ে যে সব তথ্য টেলিফোনে জানালেন, তা অনেকটা সাংকেতিক ধরণের। যা খুবই অস্বাভাবিক।’
‘মিঃ আহমদ মুসা, টেলিফোন নাম্বারটা কি এই?’ বলে একটা টেলিফোন নাম্বার বলল জেনারেল শেরউড।
আহমদ মুসা মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ এটাই সেই নাম্বার।’
‘জানেন, কার নাম্বার এটা?’
‘না।’
‘নাম্বারটা ‘আমেরিকান জুইস পিপললস লীগ’ (AJPL)-এর সভাপতির নাম্বার। মাঝে মাঝে জেনারেল শ্যারনও এ টেলিফোনে কথা বলেন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ, তাহলে তো আমাদের হাতে আরেকটা বড় প্রমাণ জুটল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আপনার আহমদ মুসা। আপনার অদ্ভূত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। একজন বিশ্বাসঘাতককে ধরিয়ে দিয়েছেন এবং শত্রুর হাতে অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য পাচার বন্ধ করতেও সাহায্য করেছেন।’
‘কেন, টেলিফোন উনি করতে পারেননি?’
‘উনি জানেন টেলিফোন তিনি করেছেন, কিন্তু তার কথার একটা শব্দও বাইরে যায়নি। আমাদের সুপার সেনসেটিভ গ্রাহক যন্ত্র ও ব্লকড সিস্টেম তার মোবাইলের প্রতিটি বর্ণ রেডিও ওয়েভ থেকে শুষে নিয়েছে।’
‘ধন্যবাদ মিঃ জেনারেল। তথ্যগুলো ইহুদীদের হাতে পড়লে তারা আত্মরক্ষার সুযোগ পেত। সে সুযোগ আপনি তাদের দেননি।’
‘আমি কি করলাম। আপনি যা বললেন আমি তো শুধু সেটুকুই করেছি। আচ্ছা বলুন তো, পাঁচ মিনিটের জন্য ব্রিগেডিয়ার স্টিভ বাইরে যাচ্ছেন টেলিফোন করার জন্যে এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত হলেন কি করে?’ জেনারেল শেরউড বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘বিশ্বাসঘাতকদের সাইকোলজী হলো, বিশ্বাসঘাতকতার কাজ তারা প্রথম সুযোগেই করে থাকে।’
‘ধন্যবাদ মিঃ আহমদ মুসা।’
বলে একটু থামল জেনারেল শেরউড। একটু ভাবল। বলল, ‘আমি চীফ স্যারের সাথে এখনই এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই। তার আগে আসুন আমরা মিস সাবার বাসার ভিডিও এবং জেনারেল হ্যামিল্টন ও জেনারেল শ্যারনের কথোপকথনের ভিডিও দেখি। ব্রিগেডিয়ার স্টিভের টেলিফোন রেকর্ডও আপনারা শুনবেন।’
কথা শেষ করেই জেনারেল শেরউড উঠে দাঁড়াল এবং পাশের কক্ষে চলে গেল। একটু পরেই সবাইকে ডেকে নিল জেনারেল শেরউড। প্রবেশ করল পাশের ঘরে।
ঘরটি বেশ বড়। নানা যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। বিভিন্ন টেবিলে অনেকগুলো চেয়ার।
চেয়ারগুলোকে ঘরের মাঝখানে সাজানো হয়েছে। সামনে একটা বড় কম্পিউটার স্ক্রীন। সাজানো-গোছানো একটা ড্রয়িং রুমের দৃশ্য ফুটে উঠেছে।
আহমদ মুসারা সবাই বসল।
‘প্রথমে সাবা বেনগুরিয়ানের ভিডিও ফিল্ম দেখানো হচ্ছে।’
শুরু হলো ভিডিও ফিল্মের প্রদর্শন।

মার্কিন সশস্ত্রবাহিনী প্রধান জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের বিশাল কনফারেন্স কক্ষ।
একটা গোল টেবিলের একপাশে একপাশে বসেছেন মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান রোনাল্ড ওয়াশিংটন। তার ডান পাশে বসেছে এ্যালাইড কমান্ড কমিটির দুজন সদস্য বিমান ও নৌ বাহিনী প্রধান। আর তার বাম পাশে বসেছে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ও আভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদ্বয়।
গোল টেবিলের অন্যপাশে বসেছে আহমদ মুসা, বেঞ্জামিন বেকন, জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ান।
সভার শুরুতেই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন বলেন, ‘কতিপয় ঘটনা আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে একটা সংকটের সৃষ্টি করেছে। সবুজ পাহাড় থেকে লস আলামোসের সুপার সেনসেটিভ কম্পিউটার কক্ষ পর্যন্ত একটা সুড়ঙ্গ আবিষ্কৃত হয়েছে। এটা যদি ইহুদীদের গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ হয়, তাহলে এটা আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের এক মহাদূর্ঘটনা। আবার এটা কোন আপতকালীন গোপন বহিরাগমন পথ কিনা? তারপর আমাদের নিরাপত্তা গোয়েন্দা কমিটির সদস্যরা ফেরার সময় লস আলামোস থেকে সান্তাফে বিমান বন্দর পর্যন্ত হামলা, হত্যাকান্ড ও বিমান ধংসের যে দুটি ঘটনা ঘটেছে, তা কারা কোন উদ্যেশ্যে ঘটিয়েছে? এ সবের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা সরকারের কাছে এসেছে, তার কোনটি সত্য? তাছাড়া সাবা বেনগুরিয়ান ও জর্জ জুনিয়রকে কারা কেন কিডন্যাপ করেছিল? সাবা বেনগুরিয়ানের পিতাকে কারা কিডন্যাপ করেছে এবং কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের প্রয়োজন। সাবা বেনগুরিয়ান ও তার পিতার ঘটনাটি ছাড়া অন্য সব বিষয়ের বিবরণ সরকার ও আমাদের কাছে রয়েছে। প্রশ্নগুলোর একটা ব্যাখ্যা সরকারের কাছে রয়েছে। যার ফলে এফ.বি.আই ও সি.আই.এ চীফ বরখাস্ত হওয়ার মত ঘটনা ঘটেছে। সত্য তিক্ত হলেও সত্য সত্যই। কিন্তু মিঃ আহমদ মুসা ও মিঃ জর্জদের কাছ থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য ও দলিল এসেছে। যা সরকারের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ পাল্টে দিতে পারে। সব চেয়ে বড় কথা এই সত্য উদ্ঘাটনে আমাদের রাষ্ট্র উপকৃত হবে সবচেয়ে বেশি। এই চিন্তা করেই আমি আপনাদেরকে আমার এ্যালাইড কমান্ড কমিটির সামনে হাজির করেছি। সত্য উদ্ঘাটনে আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাই। তাতে আমরা লাভবান হবো এবং আহমদ মুসা আপনিও লাভবান হবেন। অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবেন।’ কথাগুলো বললেন জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে শান্ত ও গম্ভীর কন্ঠে।
উত্তরে আহমদ মুসা বলল, ‘ধন্যবাদ জেনারেল ওয়াশিংটন। আমি নিজেকে অভিযোগ থেকে বাঁচানোর চাইতে মার্কিন জনগণের চোখের উপর থেকে অন্ধত্বের কালোপর্দা ছিঁড়ে ফেলতে চাই। আমাদেরকে এ সুযোগ দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ।’
জেনারেল ওয়াশিংটন ও তার টিমের অন্যান্য সদস্যদের চোখে মুখে অস্বস্তির একটা ছায়া নেমে এল। জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন বলে উঠলেন, ‘মন্তব্য একটু কঠোর হলো না মিঃ আহমদ মুসা? মার্কিন জনগণ স্বাধীন ও স্বনির্ভর, তারা অন্ধ নয়। আর তারা তাদের রক্ষা করতে সমর্থও।’ জেনারেল ওয়াশিংটনের কন্ঠে কিছুটা সামরিক রুক্ষতা।
কিন্তু আহমদ মুসার চোখে মুখে কোনই ভাবান্তর এল না। বলল, ‘আমি দুঃখিত জেনারেল। গণতান্ত্রিক দেশে সরকার যদি জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্যে হয়, তাহলে সরকারের অন্ধত্ব জনগণের অন্ধত্ব হয়ে দাঁড়ায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তাই হয়েছে। বাইরে কোন স্থান থেকে লস আলামোস পর্যন্ত সুড়ঙ্গ আবিষ্কার হওয়ার মত মারাত্মক ঘটনা ঘটার পর সেখানে গিয়ে এফ.বি.আই, সি.আই.এ ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি যে প্রাথমিক রিপোর্ট পাঠাল তা শুধু উপেক্ষা নয়, সেই শীর্ষ ব্যক্তিদের দুজনকে বরখাস্ত করা হলো তারা ফেরার আগে এবং তাদের কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই। কোন গণতান্ত্রিক সরকার অন্ধ না হলে, জনগনকে অন্ধ মনে না করলে এই ধরণের পদক্ষেপ নিতে পারে না।’
‘আমি এ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করবো না।’
বলে একটু হাসল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন। তারপর বলল, ‘সময় নষ্ট না করে আসুন আমরা কাজের কথায় আসি। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন আপনি?’
‘পুরো ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আপনাদের কাছে আছে। আপনারা জানেন সবকিছু। এখন আপনাদের প্রয়োজন প্রশ্নগুলোর জবাব। আমি মনে করি অধিকাংশ প্রশ্নের জবাব আপনারা পেয়ে যাবেন সাবা বেনগুরিয়ানের বাসার এবং জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন ও জেনারেল শ্যারনের কথোপকথোনের টেপ থেকে। যদি কিছু বাকি থাকে, আমরা সাহায্য করব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ মিঃ আহমদ মুসা।’
বলে জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন জেনারেল শেরউডের দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘শুরু কর তাহলে শেরউড।’ তাদের গোল টেবিলের পাশেই একটা ট্রলিতে বড় একটা কম্পিউটার।
জেনারেল শেরউড রিমোট প্লেয়ার হাতে নিয়ে তার কীতে চাপ দিল। বিশাল কম্পিউটারের স্ক্রীনে একটা ড্রয়িং রুমের দৃশ্য ফুটে উঠল।
‘আমরা সাবা বেনগুরিয়ানদের ভিডিও থেকে শুরু করছি। আমরা দেখছি সাবা বেনগুরিয়ানদের বৈঠক খানার দৃশ্য।’ বলল জেনারেল শেরউড।
শুরু হল ভিডিও শো।
জেনারেলদের দৃষ্টি ধীরে ধীরে আঠার মত লেগে গেল কম্পিউটার স্ক্রীনে।
তাদের চোখে কখনও বিস্ময়, কখনও উদ্বেগ। পাথরের মত নিশ্চল বসে তারা। দুটি ভিডিও টেপেরই প্রদর্শন শেষ হলো। কিন্তু জেনারেলদের চোখ কম্পিউটার স্ক্রীন থেকে সরেনি। গভীর বিস্ময় ও উদ্বেগ তাদের চোখে মুখে।
ধীরে ধীরে জেনারেলরা চেয়ারে হেলান দিল। নিচু হলো তাদের মুখ।
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন সামনের গ্লাসের ঢাকনা সরিয়ে পানি পান করল, নড়ে চড়ে বসল সে।
তারপর তার দুপাশের জেনারেলদের সাথে ফিস ফিসে কন্ঠে কিছু পরামর্শ করল এবং তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আপনাকে আমাদের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে, আমার জাতির পক্ষ থেকেও।’ আবেগপূর্ণ গম্ভীর কন্ঠ জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের।
বলে মুহূর্তকালের জন্যে একটু থেমে আবার বলল, ‘আমার কোন জিজ্ঞাসা নেই আহমদ মুসা। ঘটনার যে বিবরণ আমাদের কাছে আছে, যেসব তথ্য আমরা পেয়েছি এবং যে জীবন্ত ডকুমেন্ট আমরা দেখলাম, তাতে আর কোন প্রমাণের প্রয়োজন আপাতত নেই। আমরা প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করছি। আমাদের অনুরোধ প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করা ও এর রেজাল্ট পর্যন্ত আপনারা আমাদের সাথে থাকুন। পেন্টাগনের অতিথি ভবনে আপনারা আমাদের মেহমান।’
‘ধন্যবাদ জেনারেল। আমি তিনটি বষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করব। লস আলামোসে গোয়েন্দাগিরীর তদন্ত তো হবেই। কিন্তু তার সাথে ‘খন্ড জ্যামিং টেকনোলজি’ এবং ‘ডিটেক্টর-নিউট্রাল জ্যাকেট মোড়া বোমা’ তারা কিভাবে সংগ্রহ করল বা তৈরী করল তার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এবং অবিলম্বে সাবা বেনগুরিয়ানের আব্বা আইজ্যাক বেনগুরিয়ান-কে উদ্ধার করা দরকার। তিনি একটা বড় প্রমাণ হতে পারেন। আরও একটা বড় বিষয় আছে মিঃ জেনারেল। কথা উঠতে পারে লস আলামোসের সবুজ পাহাড় সুড়ঙ্গটি গোপন সুড়ঙ্গ নয়, ওটা লস আলামোসের গোপন একটা ইমারজেন্সী এক্সিট সুড়ঙ্গ। কিন্তু আমরা প্রমাণ করব লস আলামোস প্রতিষ্ঠার অনেক পরে ইহুদী বৈজ্ঞানিক জন জ্যাকবের আমলে তার তৈরী গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ এটা। এজন্যে সুড়ঙ্গের পাথর ও মাটির কার্বন টেষ্টের একটা দলিল আপনার হাতে থাকতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা এসব বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে। এ তিনটি বিষয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অবিলম্বে কাজ শুরু করছি।’
একটু থেমে সবার দিকে চেয়ে বলল, ‘তাহলে আমরা এবার উঠতে পারি।’
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল অন্য সবাই।
‘জেনারেল শেরউড তুমি মেহমানদের নিয়ে যাও। তাঁদের সব ব্যবস্থা কর।’
বলে জেনারেল ওয়াশিংটন হাত বাড়াল আহমদ মুসার দিকে। একে একে সে হ্যান্ডশেক করল জর্জ জুনিয়র, সাবা বেনগুরিয়ান এবং বেঞ্জামিন বেকনের সাথে। বেঞ্জামিনের সাথে হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে বলল, ‘ইয়ংম্যান তোমার সাথে হ্যান্ডশেক করছি ‘ফ্রি আমেরিকা’র একজন হিরো হিসেবে, তোমাকে এফ.বি.আই-এর সদস্য এই মুহূর্তে মনে করছি না।’
‘ধন্যবাদ স্যার। ‘ফ্রি আমেরিকা’ সবার সহযোগিতা চায়। বিশেষ করে আপনাদের।’
‘এই তো সহযোগিতা করছি।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

‘মিঃ জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন, আপনার রিপোর্ট পড়লাম। তার সাথে সাথে এফ.বি.আই ও সি.আই.এ’র জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের পাঠানো রিপোর্ট আবার দেখলাম। তাদের রিপোর্ট থেকে আপনার রিপোর্টে কিছু ঘটনা বেশি আছে। এফ.বি.আই হেড অফিসে কম্পিউটার ধ্বংসের ঘটনা, সাবা বেনগুরিয়ান ও আইজ্যাক বেনগুরিয়ানের কাহিনী, জর্জ আব্রাহামের বাড়ি থেকে কম্পিউটার চুরির ঘটনা এবং সর্বশেষে পেন্টাগনের পাশের একটা ঘটনায় জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ান উদ্ধার হওয়া ও আহমদ মুসার সাক্ষাৎ পাওয়ার এই ঘটনাগুলো জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের রিপোর্টে নেই। কিন্তু তাদের রিপোর্টের সাথে আপনার রিপোর্টের অন্য কোন পার্থক্য নেই। তাদের মত আপনিও সব দায় চাপিয়েছেন জেনারেল শ্যারন অর্থাৎ ইহুদীদের উপরে। এ বিষয়টা আমাকে বিস্মিত করেছে। সেই সাথে আমাদের এফ.বি.আই চীফ, সি.আই.এ চীফ, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা ব্যবস্থা ও সশস্ত্র বাহিনী প্রধান সকলেই আহমদ মুসার ফাঁদে পড়েছেন, এটাও আমি মনে করতে পারছি না। বিষয়টা আমাকে খুব ভাবিত করেছে বলেই যে সময়ে আপনি সাক্ষাৎ চেয়েছিলেন, তার আগেই আমাদের এ সাক্ষাৎ হচ্ছে। আমি উদ্বিগ্ন। আমি সত্যে পৌঁছাতে চাই জেনারেল।’
দীর্ঘ কথা শেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট অ্যাডামস হ্যারিসন থামলেন। তার কপাল কুঞ্চিত। চোখে মুখে গভীর জিজ্ঞাসার ছাপ।
‘ধন্যবাদ স্যার দ্রুত সাক্ষাতের সুযোগ দেয়ার জন্যে। স্যার আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, সত্য দুই রকম হয় না বলেই আমি মনে করি ওদের রিপোর্টের সাথে আমাদের রিপোর্ট মিলে গেছে।’ বিনীত কন্ঠ জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের।
‘কিন্তু আপনার জেনারেল শেরউড তো জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারদেরই সাথী ছিলেন।’ বলল প্রেসিডেন্ট অ্যাডামস হ্যারিসন জেনারেল ওয়াশিংটনের মুখের উপর সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে।
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট আমি টেলিফোনে আপনাকে জানিয়েছি, কেউকে ডিফেন্ড বা ডিফেম করা আমার লক্ষ্য নয়। ভয়াবহ যে সত্য আমার সামনে এসেছে, তা মহামান্য প্রেসিডেন্টের অবগতিতে আনা আমি প্রয়োজন মনে করেছি।’
‘ধন্যবাদ জেনারেল।’ বলে একটু থামল প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন। কপাল তার নতুন করে আবার কুঞ্চিত হলো। ফুটে উঠল চোখে মুখে জিজ্ঞাসা। বলল, ‘আহমদ মুসা সম্পর্কে আপনার অভিমত বলুন তো?’
মুখটা একটু ম্লান হলো জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের। আহমদ মুসার ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের প্রবল বিরক্তির কথা সে জানে। কি জবাব দেবে সে প্রেসিডেন্টের প্রশ্নের। কোন পক্ষে ঢলে পড়ার মত কথা বলা কি এই সময় ঠিক হবে।
উত্তর দিতে একটু দেরী হয়েছিল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের।
আপনাকে খুবই স্পষ্টবাদী বলে জানি জেনারেল। না হলে এ প্রশ্ন আপনাকে করতাম না।’
‘ধন্যবাদ মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলে একটু থামল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন। একটু ভাবল। মনে হয় গুছিয়ে নিল কথা। তারপর বলল, ‘একজন পারফেক্ট জেন্টলম্যান মনে হয়েছে তাকে আমার কাছে। বিপ্লবীর কোন কঠোরতা তার চেহারা ও কথার মধ্যে সামান্যও নেই। লস আলামোসের ঘটনা তদন্তসহ গোটা মিশনে তিনি আমাদেরকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন বলে মনে হয়েছে।’
‘সেটা তো নিজে বাঁচার জন্যে। দায়টা যাতে ইহুদীদের ঘাড়ে চাপানো যায়।’ বলল প্রেসিডেন্ট এ্যাডমস হ্যারিসন।
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট ঠিকই বলেছেন। আর দোষ স্খলন, আমাদেরকে সহযোগিতা এবং সত্য উদ্ধার পরস্পর পরিপূরক হয়েছে।’
‘আপনার কথায় মনে হচ্ছে তাকে গ্রেফতার করা ঠিক নয়। জানেন তো, সে আইনের হাত থেকে পালিয়েছে?’
‘অবশ্যই আইন সবার উপরে মহামান্য প্রেসিডেন্ট। তিনি এখন আমাদের হাতেই পেন্টাগনে আছেন। তবে মাননীয় প্রেসিডেন্ট, সেদিন আইনের হাত থেকে পালিয়ে আসায় আমাদের অমূল্য লাভ হয়েছে। বলতে গেলে তার জন্যেই জর্জ জুনিয়র, সাবা বেনগুরিয়ানসহ ঘটনার অব্যর্থ দুটি প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে।’
‘তবু জেনারেল, আইন ভাঙাকে আইন ভাঙা হিসেবেই দেখতে হবে।’ হাসি মুখে বলল প্রেসিডেন্ট।
‘মাফ করবেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট, আমি যা শুনেছি তাতে বুঝেছি তার সহযোগিতা নিতে গিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। সেদিন বিমান বন্দরে তাকে জানানো হয়নি যে, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে গেছে। সে চলে যাবার পর পুলিশ তাকে ঢালাওভাবে দোষ দেবার চেষ্টা করেছে।’
প্রেসিডেন্ট আবার হাসল। বলল, ‘তাঁর পক্ষে আপনার উপস্থাপনা সুন্দর হয়েছে। কিন্তু জেনে রাখুন জেনারেল, সে চরমপন্থী উৎকট এক মৌলবাদী। ছোবল দেওয়াই তার কাজ। তাকে ভদ্রলোক বলছেন। কোন ভদ্রলোক কি অবৈধভাবে কোন দেশে প্রবেশ করে। সে অবৈধভাবে আমেরিকায় প্রবেশ করেছে।’
‘আমি যতদূর জানি মহামান্য প্রেসিডেন্ট, হোয়াইট ঈগলরা তাকে কিডন্যাপ করে আমেরিকায় এনেছে। তারপর ঘটনাচক্র তাকে কোথাও স্থিরভাবে দাঁড়াতেই দেয়নি।’ বলল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন খুব নরম কন্ঠে।
‘সে ইতিহাস আমি এফ.বি.আই ও সি.আই.এ দুই তরফ থেকেই পেয়েছি। জানি সে কাহিনী। কিন্তু সে সুযোগ পেলে ছোবল মারবে, এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ নিশ্চয় করবেন না।’
‘আমি যতদূর জানি, তার জাতির স্বার্থের ব্যাপারে সে আপোষহীন। তবে সবগুলো অপারেশনই তার আত্মরক্ষামূলক। মহামান্য প্রেসিডেন্ট, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জেনারেল শ্যারনরা তাকে হত্যা বা কিডন্যাপ করার জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন আহমদ মুসা সান ওয়াকার, কারসেন ঘানেম, ডাঃ মার্গারেট ও লায়লা জেনিফারকে উদ্ধারের জন্যে নিজেকে বিপন্ন করেও কাজ করে যাচ্ছে।’ বলল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন নরম কন্ঠে।
‘তার মানে আপনি বলছেন, সমবেদনা তার প্রাপ্য?’ গম্ভীর কন্ঠ প্রেসিডেন্টের।
‘স্যরি মহামান্য প্রেসিডেন্ট, তা আমি বলতে পারি না। আমি শুধু ঘটনার কথাই বলেছি। তবে আহমদ মুসা ডেঞ্জারাস, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এত শার্প? এত সুক্ষ্মদর্শী কাউকে আমি দেখিনি মহামান্য প্রেসিডেন্ট। লস আলামোস থেকে আসার পথে তার সুক্ষ্মদর্শিতা যেভাবে আমাদের দলকে দুবার সাক্ষাত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে, যেভাবে পেন্টাগনে ব্রিগেডিয়ার স্টিভকে ধরিয়ে দিয়েছে তা অবিশ্বাস্য।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘সত্যিই অবিশ্বাস্য জেনারেল। এজন্যেই তার ব্যাপারে সাবধান হতে হবে। সে এক মৌলবাদী এবং কুশলী সেভিয়ার সেই সাথে নিষ্ঠুর হত্যাকারীও।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘তবে একটা সুবিচার তার প্রতি করতে হবে মহামান্য প্রেসিডেন্ট। আত্মরক্ষা ছাড়া হত্যার দৃষ্টান্ত তার খুব কমই আছে। আক্রমণকারী শত্রুকেও সে প্রয়োজনে সাহায্য করে। ন্যাসভিলের ঘটনা তো তার একটা দৃষ্টান্ত। এফ.বি.আই-এর একটি টিম তাকে তাড়া করেছিল গ্রেফতারের জন্যে। তাদের গাড়ি মারাত্মক এ্যাকসিডেন্ট করে। সংগে সংগেই দুজন মারা যায়। অবশিষ্টরাও ছিল মুমূর্ষ। আহমদ মুসা ওদেরকে নিজে গাড়ি ডেকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। আহমদ মুসার এ মানবিক রূপ অস্বীকার করলে তার প্রতি অবিচার করা হবে।’ বলল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন।
প্রেসিডেন্টের মুখে প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠল। তারপর গম্ভীর হয়ে উঠল সে। বলল, ‘আসল কথা কি জানেন। ওরা সমস্যা নয়, ওদের মৌলবাদটাকেই সমস্যা বলে মনে করা হয়। মুসলিম মৌলবাদীদের চরিত্র সম্পর্কে কোন অভিযোগ নেই। সকল অভিযোগের লক্ষ্যই তাদের মৌলবাদ।’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট আইনের প্রতি একান্ত অনুগত কিংবা শেকড় সন্ধানী হওয়ায় সকলেই তো আমরা মৌলবাদী।’
‘আপনার মৌলবাদ ভয়ের নয়, ওদেরটা ভয়ের। দারুণ শক্তিশালী ওদের মৌলবাদ। দেখছেন না, আমরা গীর্জা বিক্রি করার পর্যায়ে গেছি, আর ওরা গীর্জা কিনে নিয়ে মসজিদ বানানোর পর্যায়ে এসেছে।’
‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা ভয়ের বিষয় তো নয় মহামান্য প্রেসিডেন্ট। স্বাভাবিক যা , মানুষ যা চায় আমরা তো তারই পক্ষে।’
‘এটা আমার আপনার কথা হতে পারে, কিন্তু সবার নয়।’
হাসল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন। বলল, ‘আপনার সহযোগিতা পেলে তার আর কিছুর দরকার হয় না।’
‘কিন্তু জানেন তো, গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটাররা স্বাধীন , আর প্রেসিডেন্ট ভোটারদের অধীন। সুতরাং আমার ক্ষমতা খুবই সীমাবদ্ধ।’
বলেই প্রেসিডেন্ট তার এ্যাপয়েন্টমেন্ট ওয়াচের দিকে তাকাল। বলল, ‘সময় হয়ে গেছে। প্রসঙ্গ থেকে আমরা দূরে সরে গেছি। এবার কাজের কথায় আসি। বলুন।’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট আপনি বলেছেন, সত্য যা, আপনি সেখানে পৌছাতে চান। এটাই আমাদের সকলের কথা।’
একটু থামল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন। পরক্ষণেই আবার শুরু করল, ‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের নিরাপত্তা অফিস থেকে আমাদের কাছে ঘটনার উপর যে ব্রীফ পৌঁছেছে, তার সাথে দেখা সত্যের কোন সম্পর্ক নেই। এ পর্যন্ত যে ডকুমেন্ট সংগৃহীত হয়েছে, তাতে প্রত্যক্ষ ভাবে প্রমাণিত হচ্ছে ইহুদী গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শ্যারন সব ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং আমাদের সকল সিক্রেট গবেষণা ও স্থান তাদের অব্যাহত গোয়েন্দাগিরীর শিকার।’
থামল জেনারেল ওয়াশিংটন।
প্রেসিডেন্ট গভীর মনোযোগের সাথে জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের কথা শুনছিল। তার চোখে মুখে বিস্ময় এবং কিছুটা অস্বস্তিও।
জেনারেল ওয়াশিংটন থামতেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘আপনার প্রাথমিক রিপোর্টে যে কথা এসেছে, তার পক্ষে যে ডকুমেন্টগুলো রয়েছে তা সামনে নিয়ে আসুন।’
প্রেসিডেন্টের বাম পাশে একটা টেবিলটপ কম্পিউটার আগেই রেডি করে রাখা হয়েছিল।
জেনারেল ওয়াশিংটন তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে তিনটি কম্পিউটার ডিস্ক বের করে টেবিলে রাখল। তারপর এ থেকে একটি ডিস্ক নিয়ে সে টেবিলটপ কম্পিউটারে সেট করেল।
এসে বসল জেনারেল ওয়াশিংটন তার চেয়ারে।
কম্পিউটার স্ক্রীনে ভেসে উঠল একটা বাড়ি তার পর একটা বৈঠকখানার দৃশ্য।
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট কম্পিউটার স্ক্রীনে ওটা সাবা বেনগুরিয়ানদের বৈঠকখানার দৃশ্য। এই ভিডিও ফিল্মের দৃশ্যে আছে ইহুদী গোয়েন্দা এজেন্ট বেনইয়ামিনের সাথে জেনারেল শ্যারনের কথোপকথন, সাবা বেনগুরিয়ানের সাথে জেনারেল শ্যারনের কথোপকথন এবং আইজ্যাক বেনগুরিয়ানের সাথে জেনারেল শ্যারনের কথোপকথন।’
চলতে লাগল ভিডিও ফিল্মটি।
প্রেসিডেন্টের দুই চোখ কম্পিউটার স্ক্রীনে নিবদ্ধ।
এক সময় হঠাৎ চেয়ারে সোজা হয়ে বসল প্রেসিডেন্ট। বলল, ‘জেনারেল ডি.এস.কিউ মানে ডেথ স্কোয়াড পাঠাচ্ছেন জেনারেল শ্যারন লস আলামোসে?’
‘ঠিক বলেছেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘তারিখটা?’
‘স্ক্রীনের নিচে বামে কোণায় দেখুন তারিখ ও সময়।’ জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘সর্বনাশ এই তারিখে এই সময়ের দুঘন্টা পরেই তো লস আলামোস থেকে সান্তাফে পথে আমাদের তদন্ত টীমে আক্রান্ত হয়েছিল এবং আমাদের সিকিউরিটির আধ ডজন লোক নিহত হয়েছিল।’ প্রেসিডেন্টের কথায় বিস্ময় ও বেদনার সুর।
‘জি , মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’
আবার নিরবতা। চলছে ভিডিও ফিল্ম।
প্রেসিডেন্টের দুই চোখ আঠার মত লেগে আছে কম্পিউটার স্ক্রীনে।
জেনারেল শ্যারন যখন ইহুদী জাতির চরম দুঃসময়ের কথা বলে জার্মানীর ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশংকা করে জর্জ আব্রাহামের পার্সোনাল কম্পিউটারের লস আলামোস বিষয়ক এন্ট্রিগুলো মুছে ফেলার দায়িত্ব নিতে সাবা বেনগুরিয়ানকে বাধ্য করছিল, তখন বিস্মিত কন্ঠে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘জেনারেল ওয়াশিংটন এন্ট্রিগুলো তাহলে সত্য। না হলে জেনারেল শ্যারন এত মরিয়া হয়ে উঠেছেন কেন এগুলো জর্জ আব্রাহামের কম্পিউটার থেকে মুছে ফেলার জন্যে!’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট উনি একদিকে ডেথ স্কোয়াড পাঠিয়েছেন জর্জ আব্রাহামদেরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্যে, অন্যদিকে সাবা বেনগুরিয়ানকে পাঠাচ্ছেন কম্পিউটারের দলিল মুছে ফেলার লক্ষ্যে।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘কি সাংঘাতিক! তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে এফ.বি.আই হেড কোয়ার্টারের মাস্টার কম্পিউটারগুলো শ্যারনের লোকরাই ধ্বংস করেছে।’ বিস্ময়ে দুচোখ কপালে তুলে বলল প্রেসিডেন্ট।
‘অবশ্যই মহামান্য প্রেসিডেন্ট। জর্জ আব্রাহাম দায়িত্ব থেকে চলে যাবার পর তদন্ত ঠিকমত চলছে না। না হলে জড়িত লোকগুলোও ধরা পড়ে যেত।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
কিছু বলল না প্রেসিডেন্ট। চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। তার চোখে মুখে একটা হতাশা।
আবার নিরবতা। চলছে ভিডিও ফিল্ম।
প্রেসিডেন্টের সমস্ত মনোযোগ সেদিকে।
ভিডিও ফিল্মে তখন চলছে দায়িত্বপালনে ব্যর্থতার জন্যে জেনারেল শ্যারন কর্তৃক সাবা বেনগুরিয়ানকে ধমকানোর দৃশ্য। তার পর এল সাবা বেনগুরিয়ান ও তার আব্বা আইজ্যাক বেনগুরিয়ানকে বাড়ি ছেড়ে জেনারেল শ্যারনদের তত্ত্বাবধানে চলে যেতে বাধ্য করা সংক্রান্ত কথোকপকথনের দৃশ্য। যখন জেনারেল শ্যারন বলছিল, ‘সাবা বেনগুরিয়ান জাতির পক্ষে দায়িত্বপালনে অস্বীকার করেছে, তখন সে জাতির বিশ্বাসঘাতকতাও করতে পারে, আমি তাকে যা বলেছিলাম এবং যা সে জানে সব বলে দিতে পারে পুলিশকে, সুতরাং তাকে আমাদের কাস্টডিতে থাকতে হবে, যাতে সে কথা বলতে না পারে, আপনাকেও আমাদের সাথে যেতে হবে, যাতে আপনিও কিছু বলতে না পারেন’, তখন প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘তাহলে আপনাদের রিপোর্টে সাবা বেনগুরিয়ান ঘটনার যে বিবরণ দিয়েছে এবং জর্জ জুনিয়র ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছে তার সবই তাহলে সত্য। দেখছি, জেনারেল শ্যারনরা উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল সেদিন।’
‘সত্য যা উদ্ঘাটিত হয়েছে তা ওদেরকে উন্মাদ করার মতই মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন।
প্রেসিডেন্ট কোন কথা বলল না। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছে আবার।
আবার সেই নিরবতা।
এবার কম্পিউটারে নতুন ডিস্ক ভরেছে জেনারেল ওয়াশিংটন। এ ভিডিও ফিল্মে রয়েছে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন ও জেনারেল শ্যারনের মধ্যকার কথোপকথনের দৃশ্য।
চলছে ভিডিও ফিল্ম।
জেনারেল শ্যারন যখন জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে বলছিল, ‘প্রেসিডেন্টের সাথে জর্জ আব্রাহাম ও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের সাক্ষাতের পথ বন্ধ করতে হবে, ওরা আসছে প্লেনে ওয়াশিংটনে..’, তখন প্রেসিডেন্ট সোজা হয়ে বসল চেয়ারে। তার চোখ ছানাবড়া। তারপর প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাত করতে গিয়ে প্রেসিডেন্টকে কি বুঝাতে হবে, ঘটনার কি ব্যাখ্যা তাকে দিতে হবে, সে বিষয়ে জেনারেল শ্যারন যে ব্রিফিং দিচ্ছিল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে, তা গোগ্রাসে গিলছিল প্রেসিডেন্ট। তার চোখ দুটি বিস্ময় বিস্ফোরিত। শেষে বলল প্রেসিডেন্ট, ‘জেনারেল ওয়াশিংটন ধন্যবাদ দিতে হয় জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে। যেভাবে জেনারেল শ্যারন তাকে ব্রিফ করতে বলেছিল, ঠিক সেভাবেই যে আমাকে ব্রিফ করতে পেরেছে। মিথ্যাকে সত্যের মত এত সুন্দর করে বলা যায় তাহলে!’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট কাহিনী তৈরীতে ইহুদীদের চেয়ে দক্ষ আর কেউ নেই দুনিয়ায়। জার্মানীর ঘটনা নিয়ে যে হাজারো কাহিনী তারা সৃষ্টি করেছে, তা অভিভূত করেছে পশ্চিমের লোকদের। যার সুফল তারা ভোগ করছে অর্ধ শতাব্দী ধরে।’ বলল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন।
‘লস আলামোসের সবুজ পাহাড়ের সুড়ঙ্গ সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দিল সে সম্পর্কে আপনার মত কি?’ প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞাসা করল জেনারেল ওয়াশিংটনকে।

‘ওটা একটা গাঁজাখুরি কথা মহামান্য প্রেসিডেন্ট। আপনি জানেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট, আপনার কাছে একটা ‘সেফ ভল্ট’ আছে। ওটা খোলা যায় না, ভাঙা যায়। বিদেশী আগ্রাসনের সময় জরুরী মুহূর্তে ওটা আপনাকে ভাঙতে হবে এবং শেষ মুহূর্তের নির্ধারিত করণীয় ওতে পাবেন। অনুরূপভাবে লস আলামোসের মত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কাছেও ঐ ধরনের একটি করে ‘সেফ ভল্ট’ আছে। বিদেশী আগ্রাসনের জাতীয় জরুরী মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে কি করতে হবে সেজন্যে তো ঐ ‘সেফ ভল্ট’ রয়েছে। মৌখিকভাবে থাকার বিষয়টা একেবারেই গাঁজাখুরি।’ জেনারেল ওয়াশিংটন বলল।
‘যাই হোক, সেফ ভল্টে যদি ঐ সুড়ঙ্গের কথা থেকে থাকে জেনারেল?’ প্রশ্ন তুলল প্রেসিডেন্ট।
‘সুড়ঙ্গটাই প্রমাণ যে ওটা অফিসিয়াল সুড়ঙ্গ নয়।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘কেমন করে?’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘অফিসিয়াল হলে সুড়ঙ্গ হলে সুড়ঙ্গ মুখ আরও গোপন , নিরাপদ ও আরও স্থায়ী ধরনের জায়গায় হত। কম্পিউটার সরালেই , কার্পেট তুললেই ধরা পড়ে যাবে, এমন জায়গায় অফিসিয়াল সুড়ঙ্গ মুখ অবশ্যই হবার নয়। আর সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্ত স্বাধীন জায়গায় না হয়ে ইহুদী অধিকারভুক্ত একটা জায়গায় হতে পারে না। তৃতীয়ত, ইহুদী বিজ্ঞানী জন জ্যাকব লস আলামোস ও সরকারের কেউ না হয়েও অফিসিয়াল সুড়ঙ্গের বিষয়টা জানবেন কোন সূত্রে? তাকে বিশ্বাসই বা করা হবে কেন? আপনার ভালোভাবেই জানার কথা মহামান্য প্রেসিডেন্ট, ইহুদীরা আমাদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে ,কিন্তু আমাদের দায়িত্বশীল অগ্রজদের অখন্ড বিশ্বাস তারা কোন সময়ই পায়নি।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘ধন্যবাদ জেনারেল। আমি বুঝেছি।’
নিরবতা নামল আবার।
ভিডিও ফিল্ম এগিয়ে চলছে একের পর এক দৃশ্য। যখন জেনারেল শ্যারন বলছিল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে যে ‘এইবার সে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আগামীবারেই প্রেসিডেন্ট’, তখন প্রেসিডেন্ট চেয়ারে হেলান দেয়া অবস্থাতেই হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘জেনারেল এতক্ষনে খুলল রহস্যের জট। আমার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ইহুদীদের সাথে রাজনৈতিক ব্যবসায় নেমেছেন। ওর এত আগ্রহের কারণ এখানেই।’
‘ইহুদীরা তাদের এই রাজনৈতিক অস্ত্র সব রাজনীতিকের উপরই প্রয়োগ করেন, মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’
‘কিন্তু সবাই তাদের শিকার হন না।’
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ প্রেসিডেন্ট কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে মনযোগী হওয়ায় সে থেমে গেল।
ভিডিও ফিল্মে তখন জেনারেল শ্যারন ইহুদীদের বিশ্বায়ন পরিকল্পনার কথা বলছিল।
শ্যারনের কথা শেষ হলে জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন যখন তার ইহুদী মায়ের হাত থেকে ইহুদীদের বিশ্বায়ন পরিকল্পনা পাওয়া ও তার আব্বা সম্পর্কে মায়ের কথা বলছিল, তখন প্রেসিডেন্ট তার চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘জেনারেল হ্যামিল্টনদের আব্বা সিনেটর বব হ্যামিল্টন ছিলেন একজন খাঁটি আমেরিকান। সেই কারণেই তার মত স্বামীকে বিশ্বাস করেননি, আর ছেলেকে জানিয়েছেন নিজের মত দ্বৈত আনুগত্যের কথা।’
‘ঠিক বলেছেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘ওদের ঐ বিশ্বায়নটা কি জানেন জেনারেল?’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘ওই দলিল দেখিনি স্যার। জানা উচিত আমাদের।’
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল জেনারেল ওয়াশিংটন কম্পিউটার ডিক্স পরিবর্তনের জন্যে।
‘এখন কম্পিউটারে কি তুলবেন?’ জিজ্ঞেস করল প্রেসিডেন্ট।
‘আমাদের ব্রিগেডিয়ার যে তথ্য পাচার করেছিল জেনারেল শ্যারনের কাছে, তারই ভিডিও ফিল্ম।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘ওটা আপনার রিপোর্ট আমি পড়েছি আর দেখার দরকার নেই।’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, ঐ ভিডিও ফিল্মে পরিষ্কার দেখা যায় আমাদের ব্রিগেডিয়ার পদের দায়িত্বশীল অফিসাররাও জেনারেল শ্যারনের মত বাইরের লোকদের স্বার্থের কাছে কতখানি নতজানু।’
‘বাগানে আগাছা কিছু জমতেই পারে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘কিন্তু মহামান্য প্রেসিডেন্ট, ওরা ওদের কালোহাত আমাদের জাতীয় জীবন ও জাতীয় স্বার্থের অনেক গভীরে প্রবেশ করাতে সমর্থ হয়েছে।’
‘ঠিক বলেছেন, এটা স্বীকার করতেই হবে, ওদের কথা প্রেসিডেন্টের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে ওরা সাফল্যের সাথে সমর্থ হয়েছে। এ বিষয়টার দিকে অবশ্যই আমাদের নজর দিতে হবে। কিন্তু সেটা কৌশলের সাথে জেনারেল।’ প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন বলল।
‘অবশ্যই মহামান্য প্রেসিডেন্ট।‘ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
প্রেসিডেন্ট নড়ে চড়ে বসল। বলল, ‘জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ধন্যবাদ, আপনাদের সংগৃহিত অমূল্য ডকুমেন্ট জাতির অশেষ উপকারে আসবে।’
‘ওয়েলকাম মহামান্য প্রেসিডেন্ট। এ কৃতিত্বের অধিকাংশ ‘ফ্রি আমেরিকা’, আহমদ মুসা ও সাবা বেনগুরিয়ানদের প্রাপ্য।’
‘সে কৃতজ্ঞতা আপনারা ওদের জানাবেন।’
বলে একটু থেমেই প্রেসিডেন্ট আবার বলল, ‘আচ্ছা, ফ্রি আমেরিকা আন্দোলন সম্পর্কে আপনারা কি ভাবেন?’
‘ফ্রি আমেরিকা দেশপ্রেমিক সংগঠন। আমরা মনে করি, এ ধরনের প্রেসার গ্রুপ দেশে থাকা প্রয়োজন।’
‘কেন?’
‘ফ্রি আমেরিকা বা সকল অপপ্রভাবমুক্ত আমেরিকা’র শ্লোগান দেশকে জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী ও ক্ষতিকর বাইরের ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।’
‘এমন প্রভাব কি আমাদের জাতীয় জীবনে আছে?’
‘অনেকেই মনে করেন, আমাদের জাতীয় জীবনে ইহুদীদের প্রভাব কোন কোন ক্ষেত্রে অপপ্রভাবের পর্যায়ে পৌঁছেছে। তারা মনে করেন, জাতির ফাউন্ডার ফাদারসরা ইহুদীদের সম্পর্কে যা ভাবতেন সেখান থেকে আমরা সরে গেছি।’
‘হ্যাঁ, এরকম কথা আছে।’
থামল এবং একটু ভাবল প্রেসিডেন্ট। তারপর বলল, ‘আচ্ছা, ফ্রি আমেরিকা আন্দোলনের স্ট্রেনথ কেমন? ওদের প্রধান কে?’
‘ওদের শক্তির বিষয়টা বলা মুস্কিল। বিশেষ করে তরুণ ও যুবকদের মধ্যে খুব পপুলার। সরকারী ও বেসরকারী সব ক্ষেত্রেই ওদের সমর্থক ছড়িয়ে আছে। ওদের প্রধান কে আমি জানি না।’
‘জনমতের ক্ষেত্রে ওরা একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াচ্ছে, কি বলেন?’ প্রেসিডেন্টের কন্ঠে উতসুক্য।
‘ওদের প্রভাব বিবেচনা করলে তাই মনে হয়।’
‘আমি রিপোর্ট পেয়েছি, আমাদের দলেও ওদের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিপক্ষ দলেও নিশ্চয় ওরা কিছু আছে। ভাবছি, ওরা ভোট দেয় কাকে?’
‘শুনেছি ওদের ভোট ব্যক্তিকেন্দ্রিক। প্রার্থীর দৃষ্টিভংগী ও মতামতকেই তারা বেশি গুরুত্ব দেয়।’
‘বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।’ বলে প্রেসিডেন্ট তার সামনে ফেলে রাখা একটা শিটের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘জেনারেল ওয়াশিংটন,আপনি কি জানেন জর্জ আব্রাহামের নাতিকে ওহাইও নদীতে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করায় আহমদ মুসার প্রতি জর্জ আব্রাহাম দুর্বল?’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, এই অভিযোগ আর যাদের ক্ষেত্রেই সত্য হোক, জর্জ আব্রাহামের ক্ষেত্রে নয়। তার কাছে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন এবং প্রফেশন সম্পূর্ণ আলাদা। তার গোটা সার্ভিস লাইফে আত্মীয়-স্বজন ও আপনজনদের সামান্য প্রশ্রয় দেয়ারও কোন নজীর নেই।’ থামল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন।
প্রেসিডেন্ট কথা বলল না। ভাবছিল।
একটু পর বলল, ‘আরো একটা বিষয় জেনারেল, আহমদ মুসার মত ব্যক্তি এধরনের একটি কাজের বিনিময়ের মুখোমুখি হবে, এটাও স্বাভাবিক নয়। আর জর্জ আব্রাহামরা যে আহমদ মুসাকে সাথে করে লস আলামোসে নিয়ে গেলেন,এটা আহমদ মুসার স্বার্থে নয়, আমাদের স্বার্থে। বরং আহমদ মুসাই আমাদের উপকারে এসেছেন। সুতরাং জর্জ আব্রাহাম তাকে কোথায় কোন অন্যায় সুবিধা দিলেন?’
‘আমিও এ ধরনেরই ভেবেছি মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’
‘জেনারেল আলোচনার আরও কোন বিষয় আছে?’ বলল প্রেসিডেন্ট।
জেনারেল ওয়াশিংটন সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘অশেষ ধন্যবাদ মহামান্য প্রেসিডেন্ট আমাকে সময় দেয়ার জন্যে। আমার আর কোন বিষয় নেই আলোচনার।’
‘ধন্যবাদ তো আমি আপনাকে দেব। বলা যায় সাজানো তথ্যের ভিত্তিতে মারাত্মক একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, অকাট্য প্রমাণ এনে আপনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে রাষ্ট্রকে সাহায্য করলেন সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার। আমি আপনাদের জন্যে গর্বিত।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘আমাদের প্রতি আপনার এটা বিশেষ ভালোবাসা মহামান্য প্রেসিডেন্ট। আমরা কৃতজ্ঞ।’
বলে একটু থেমে বিনীত কন্ঠে আবার বলল, ‘আমাকে উঠার অনুমতি দিন মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’
প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল। জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনও উঠে দাঁড়াল।
প্রেসিডেন্ট হাত বাড়িয়ে জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল, ‘আমি নিশ্চিত জাতির পক্ষে আপনাদের এ প্রশংসনীয় তৎপরতা আপনারা আরও জোরদার করবেন। আশ্বাস দিচ্ছি, আমার কাছে জাতি যা চায়, আপনারা যা চান, আইন যা চায়, তা আমি করব। তা করতে গিয়ে কোন সিদ্ধান্তকেই বড় বলে মনে করব না।’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, এই কাজে আমরা আপনার সাথী।’
বলে জেনারেল ওয়াশিংটন চলে যাবার জন্যে পা বাড়াচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট বলল, ‘জেনারেল, আহমদ মুসাকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাবেন। অহেতুক তাঁর উপর অনেক ধকল গেছে। আমরা দুঃখিত।’
‘ধন্যবাদ মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলে জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

এফ.বি.আই-এর দুটি গাড়ি তীর বেগে এগিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটনের একদম পূর্বপ্রান্তের বে রোড ধরে। দুই গাড়িতে মিলে এফ.বি.আই-এর নিরাপত্তা কর্মী মোট ষোলজন। এফ.বি.আই-এর চৌকশ অপারেশন কমান্ডার, জর্জ আব্রাহামের একটি বিশ্বস্ত হাত কমান্ডার বব কার্টার বসে আছেন সামনের গাড়ির সামনের সিটে। বাজপাখির মত তার শ্যেন দৃষ্টি সামনে নিবদ্ধ।
ভোর হবার খুব বেশী নেই। নির্জন পথ। কমান্ডার বব কার্টারের চোখ সামনে প্রসারিত। কিন্তু চোখের পেছনে মাথাটায় অনেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এফ.বি.আই খবর পেয়েছে রাত ১২টায় জেনারেল শ্যারনকে বে-ভিউ রেসিডেন্সিয়াল ব্লকের একটা বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখা গেছে, সে বাড়িটা পাহারা দিচ্ছে এফ.বি.আই-এর একজন লোক। খবর পাওয়ার পরই জর্জ আব্রাহাম সরাসরি নির্দেশ দিয়েছে জেনারেল শ্যারনকে গ্রেফতারের জন্যে।
বিরাট দায়িত্ব পেয়েছে সে তার চীফ বসের কাছ থেকে। তার স্বল্পভাষী চীফ বস দায়িত্ব দেবার সময় বলেছে, ‘এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিকার লক্ষ্যে তুমি জাম্প দিচ্ছ, মূল্যবান সুযোগটা খুব কষ্টে কিন্তু আমরা পেয়েছি।’ চীফের এই কথার অর্থ, বড় এই শিকার হাতছাড়া করা যাবে না। কারনটা সেও জানে। মাঝখানে জেনারেল শ্যারন এফ.বি.আই-এর চোখের বাইরে ছিল। জর্জ আব্রাহাম দায়িত্বে ফিরে আসার পর জেনারেল শ্যারনকে পুনরায় দৃষ্টিসীমায় আনার অনেক চেষ্টার পর আজ তাকে নজরবন্দী করা গেছে। নজর থেকে এখন তাকে হাতে পেতে হবে।
কমান্ডার বব কার্টারের বাহিনী বে-ভিউ রেসিডেন্সিয়াল ব্লকের কিছুটা সামনে চৌমাথায় গিয়ে পৌছল। এ চৌমাথা থেকে পুবমুখী রাস্তা দিয়ে বে-ভিউ রেসিডেন্সিয়াল ব্লকে যাওয়া যায়। চৌমাথা থেকে বের হওয়া আরও দুটি রাস্তার একটি উত্তরে, আরেকটি পশ্চিমে চলে গেছে। বব কার্টারের বাহিনী আসছিল দক্ষিণ দিকে থেকে আসা রাস্তা দিয়ে। চৌমাথার মাঝখানে একটা বিরাট সার্কেল। পুবদিক থেকে আসা গাড়ি সার্কেলটির দক্ষিণ পাশ ঘুরে যেকোন দিকে যেতে পারে। অনুরূপ দক্ষিণ থেকে আসা গাড়ি দক্ষিণ হয়ে পশ্চিমে ঘুরে যেকোন দিকে যেতে পারে।
বব কার্টারদের গাড়ি সার্কেলটির দক্ষিণ হয়ে পশ্চিম উত্তর ঘুরে পুবমুখী রাস্তায় যাওয়ার জন্যে বাঁক নিতে যাবে, এমন সময় পুর্বদিকে একটা গাড়িকে পাগলের মত ছুটে আসতে দেখা দেখল। গাড়িটি বব কার্টারদের গাড়ির প্রায় পাশ ঘেঁষে সার্কেলটির দক্ষিণ দিক ঘুরে পশ্চিমমুখী রাস্তায় তীর বেগে ঢুকে গেল।
বব কার্টারদের থমকে যাওয়া গাড়ি সবে টার্ন নিয়ে পশ্চিম দিকে বাঁক নিতে যাচ্ছে। এমন সময় আরেকটি গাড়িকে আগের মতই উন্মত্ত স্পিডে ছুটে আসতে দেখল। বব কার্টারদের গাড়ি এটা দেখে আবারও ডেড স্লো হয়ে গেল।
কিন্তু উন্মত্ত স্পিডের গাড়িটি বব কার্টারদের গাড়ি পেরিয়ে কয়েকগজ যাবার পর হঠাৎ ডেড স্টপ হয়ে গেল।
সংগে সংগেই গাড়ি থেকে নামল একজন লোক লাফ দিয়ে। লোকটি গাড়ি থেকে নেমেই বব কার্টারদের গাড়ির দিকে মুখ করে ডাকতে লাগল।
বব কার্টার তার দিকে চোখ ফেলেই চিৎকার করে উঠল, ‘এতো আমাদের এফ.বি.আই-এর কলিন্স। গাড়ি ওদিকে আগাও, কুইক।’
গাড়ি কলিন্সের কাছাকাছি হতেই সে চিৎকার করে বলল, ‘জেনারেল শ্যারন পালাচ্ছে। তোমরা এস আমার সাথে।’
বলেই লাফ দিয়ে কলিন্স তার গাড়িতে উঠল। সংগে সংগেই ছুটতে শুরু করল তার গাড়ি।
বব কার্টারের বুঝতে বাকি রইল না আগের পাগলের মত ছুটে চলে যাওয়া গাড়িটাই তাহলে ছিল জেনারেল শ্যারনের।
বুঝে উঠার সাথে সাথেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল বব কার্টারের। নজরবন্দী শিকার তাহলে পালাল?
বসের কথা ও কঠিন মুখটা ভেসে উঠল বব কার্টারের চোখের সামনে, গাড়ি আগেই স্টার্ট নিয়েছিল বব কার্টারের। বব কার্টার বলল ড্রাইভারের দিকে চেয়ে, ‘কলিন্সের গাড়ির আগে ছুটছিল যে গাড়িটা, সেটা আমাদের ধরতে হবে।’
ঝড়ের বেগে ছুটতে লাগল বব কার্টারদের গাড়িও। তখন সকাল হয়ে গেছে। রাস্তা-ঘাট তখনও প্রায় গাড়ি শুন্য। তিনটি গাড়িই চলছে ঝড়ের গতিতে। কলিন্সের গাড়ি এবং বব কার্টারের দুটি গাড়ি পর পর চলছে। জেনারেল শ্যারনের গাড়ি কিছুক্ষণের জন্যে দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছিল, এখন শ্যারনের গাড়ি শুধু দেখা যাওয়া নয়, তার সাথে ব্যবধানও অনেক কমেছে।
হঠাৎ একটা অঘটন ঘটে গেল, একটা চৌমাথা ক্রস করতে যাচ্ছিল কলিন্সের গাড়ি। শ্যারনের গাড়ি চৌমাথা ক্রস করে চলে গেছে।
ঠিক সেই সময় রোড কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর একটা ভারি রোলার গাড়ি রাস্তার ক্রসিং-এ এসে পৌঁছল, একেবারে মুখের উপর।
দুঘর্টনা এড়াতে হার্ড ব্রেক কষতে গিয়ে কলিন্সের গাড়ি উলটে গেল। কতকটা একই দশা হলো পেছনে বব কার্টারদের দুটি গাড়িরও।
বব কার্টারের গাড়ি একটা শার্প বাঁক নিয়ে ব্রেক কষতে গিয়ে রাস্তার পাশের গার্ডারের সাথে ধাক্কা খেল। আর কমান্ডার বব কার্টারের পেছনের গাড়ি ভারি রোলারটার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়ে কোন মতে নিজেকে রক্ষা করল, কিন্তু কাত হয়ে পড়ে গেল।
ধাক্কা খেয়ে গাড়ি থামতেই লাফ দিয়ে নেমেছে বব কার্টার গাড়ি থেকে।
তার চোখের সামনে দিয়েই কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর রোলার গাড়িটি চলে গেল। তাড়া করবারও কোন সুযোগ পেল না। কারণ রাস্তার ঐ লাইনে তখনও জ্বলছিল গ্রীন সিগন্যাল, বব কার্টারদের জন্যে রেড সিগন্যাল।
বব কার্টার হতাশ হয়ে তাকাল জেনারেল শ্যারনের গাড়ির দিকে। ওটা দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল।
বব কার্টার এবার নজর দিল দুঘর্টনায় পড়া সহকর্মীদের দিকে।
এ সময় রোলার গাড়িটির চ্যানেল অর্থাৎ দক্ষিণ দিক থেকে আরেকটা গাড়ি রোড ক্রসিং এ এসে পৌছল।
তিনটি গাড়ির লন্ড-ভন্ড দশা দেখেই সম্ভবত গাড়িটা রাস্তার এক প্রান্তে দাঁড়াল।
গাড়ি থেকে নামল তিনজন মানুষ। নেমেই তারা প্রথমে ছুটে গেল উল্টে যাওয়া কলিন্সের গাড়ির দিকে।
কলিন্স তখন তার উল্টে যাওয়া গাড়ি থেকে বের হচ্ছিল। ছুটে আসা তিনজন লোক তাকে ধরাধরি করে বের করল।
কলিন্স উঠে দাঁড়িয়ে যে তাকে তুলে দাঁড় করাল তার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল মুহূর্তের জন্যে। পরক্ষণেই আনন্দিত কন্ঠে বলে উঠল, ‘স্যার আপনি?’
তার পর পাশের দাঁড়ানো লোকটির দিকে নজর পড়তেই কলিন্স চিৎকার করে উঠল, ‘বেঞ্জামিন বেকন তুমি?’
বলে কলিন্স জড়িয়ে ধরল বেঞ্জামিন বেকনকে।
এদিকে বব কার্টারের দুটি গাড়ি থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে। কাত হয়ে যাওয়া গাড়িও দাঁড় করানো হয়েছে।
বব কার্টার ও অন্যান্যরা এসে দাঁড়াল কলিন্স ও বেঞ্জামিন বেকনদের কাছে।
বব কার্টার বেঞ্জামিন বেকনকে চিনতে পারছে, কিন্তু অন্য দুজনকে চিনতে পারেনি।
বব কার্টার এসে দাঁড়াতেই কলিন্স সোৎসাহে যে লোককে সে স্যার বলেছিল তাকে দেখিয়ে বলে উঠল, ‘বব ইনিই আহমদ মুসা।’
নামটা শুনে বব কার্টার চমকে উঠল। অভাবিত একটা বিস্ময় আকস্মিকভাবে সামনে এসে দাঁড়ালে যেমন মানুষ বিমূঢ় হয়, কতকটা তেমনি দশা হলো বব কার্টারের। অজ্ঞাতসারেই যেন বব কার্টার স্যালুট দিয়ে বসল আহমদ মুসাকে। তার সাথে সাথে দুই গাড়ি থেকে নেমে আসা অন্যান্য এফ.বি.আই কর্মীরাও স্যালুট করল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়াল বব কার্টারের দিকে।
‘ইনি, এই অপারেশনের কমান্ডার বব কার্টার।’ বব কার্টারকে দেখিয়ে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল কলিন্স।
কলিন্স থামতেই বেঞ্জামিন বেকন তাদের তৃতীয় সাথীকে দেখিয়ে বব কার্টারদের লক্ষ্য করে বলল, ‘ইনি প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টার পার্সোনাল সেক্রেটারি রবিন নিক্সন।’
বব কার্টার আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করার পর রবিন নিক্সনের সাথেও হ্যান্ডশেক করল। কলিন্সও হ্যান্ডশেক করল রবিন নিক্সনদের সাথে।
কলিন্স রবিন নিক্সনের সাথে হ্যান্ডশেক শেষ করলে আহমদ মুসা বব কার্টারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মিঃ বব কার্টার মিঃ কলিন্স যে অপারেশনের কথা বলল সেটা কি? আপনাদের এ অবস্থা কেন?’
বব কার্টার বে-ভিউ রেসিডেন্সিয়াল ব্লকের একটা বাড়ি থেকে জেনারেল শ্যারনকে ধরতে আসার বিবরণ দিয়ে বলল, ‘কিন্তু স্যার, আমরা আসার আগেই জেনারেল শ্যারন পালায়। তাকে পাহারায় থাকা মিঃ কলিন্স তার পিছু নেয়। পথে দেখা হলে আমরাও পিছু নিই। এ পর্যন্ত পৌছার পর কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর একটা রোলার গাড়ি আমাদের সব কিছু ভন্ডুল করে দেয়।’ কিভাবে কি ঘটল তারও বিবরণ দিয়ে থামল বব কার্টার।
‘সারারাত পালাল না, ভোরে পালাল কেন জেনারেল শ্যারন? এমন ভোরে তো জেনারেল শ্যারন জেগে থাকে না। আর আপনাকে দেখতে পাওয়ার মত জায়গায় অবশ্যই আপনি ছিলেন না?’ বলল আহমদ মুসা কলিন্সকে লক্ষ্য করে। আহমদ মুসার ভ্রু কুঞ্চিত হলো।
‘তার কিছুতেই আমাকে দেখতে পাওয়ার কথা নয়।’
‘জেনারেল শ্যারন যখন পালায় তখন আপনার মনে হয়েছিল কি যে আপনি পাহারায় আছেন জেনারেল শ্যারন সেটা জানে?’
‘জি, আমার তাই মনে হয়েছে। সে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গাড়িতে উঠেছিল। গাড়িতে উঠেই পাগলের মত ছুটতে শুরু করে।’ বলল কলিন্স।
‘আমার মনে হচ্ছে একটা টেলিফোন পেয়ে জেনারেল শ্যারন ঘুম থেকে জাগে। টেলিফোনে তাকে বলে হয় মিঃ কলিন্স তার বাড়ির বাইরে পাহারা দিচ্ছে । আর বব কার্টারের বাহিনী তাকে ধরতে আসছে। নিশ্চয় কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বব কার্টারের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনার এ অপারেশনের বিষয় নিশ্চয় গোপন রাখা হয়েছিল?’
‘জি স্যার, তার সাড়ে তিনটায় আমাদের চীফ জর্জ আব্রাহাম নিজে তাঁর মোবাইল টেলিফোনে আমাকে অপারেশনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার আগে আমিও কিছু জানতাম না।’
‘আপনি অপারেশনে বেরুনোর আগে বা পরে কাউকে কিছু বলেছিলেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার সাথে আসা লোকজনদেরও বলিনি। তবে গোপন অপারেশন রেজিস্টারে আমি লিখে এসেছি।’ বলল বব কার্টার।
‘আমার বিশ্বাস জর্জ আব্রাহামের টেলিফোন এবং আপনাদের গোপন রেজিস্টার দুটোই শত্রু পক্ষ মনিটর করেছে।’
ভ্রু কুঞ্চিত হলো কমান্ডার বব কার্টার ও কলিন্স দুজনেরই।
ওরা কিছু বলার আগে আহমদ মুসাই কথা বলে উঠল, ‘এখন কি করবেন বলে ভাবছেন আপনারা?’
বব কার্টার ও কলিন্সরা কিছু বলার আগেই কথা বলে উঠল রবিন নিক্সন। বলল, ‘ওদের খুব নতুন একটা গোপন ঘাটির খবর আমি জানি। প্রেসিডেন্টের সাবেক নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল হ্যামিল্টনের নির্দেশে আমাদের গাড়িতে করে জেনারেল শ্যারনকে ঐ ঘাটিতে আমি নামিয়ে দিয়েছিলাম।’
আহমদ মুসা তাকাল বব কার্টারের দিকে।
বব কার্টার বুঝল আহমদ মুসার এ তাকানোর অর্থ। সংগে সঙ্গেই সে বলল, ‘আমরা যেতে চাই সেখানে।’
‘সে ঘাটিটা কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল রবিন নিক্সনের দিকে তাকিয়ে।
রবিন নিক্সন ঠিকানা বললে আহমদ মুসা বব কার্টারকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, ‘মিঃ বব কার্টার, জেনারেল শ্যারনের গাড়ি যদি পশ্চিম দিকেই গিয়ে থাকে, তাহলে সে ঐ ঘাটির দিকেই গেছে বলে মনে হচ্ছে।’
‘আমারও তাই মনে হচ্ছে স্যার।’ বলল বব কার্টার।
‘তাহলে আমরা যাত্রা করতে পারি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি যাবেন স্যার?’ বলল বব কার্টার। আনন্দে তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
‘অবশ্যই।’ বলল আহমদ মুসা।
চারটি গাড়ি আবার যাত্রা শুরু করল।
আহমদ মুসা ও বব কার্টারদের গাড়ি যখন জেনারেল শ্যারনদের নতুন ঘাটির গেটে গিয়ে পৌছল, তখন সকালের নির্জনতা কেটে গেছে।
রাস্তায় তখন সচল গাড়ির মিছিল সরব হয়ে উঠেছে।
ঘাটির গেটে প্রথম গিয়ে থামল আহমদ মুসা ও বেঞ্জামিন বেকনের গাড়ি। পরক্ষণেই তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল বব কার্টারের গাড়ি এবং তার সাথেই কলিন্সের গাড়ি।
আহমদ মুসা গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বব কার্টারকে বলল , ‘মিঃ বব কার্টার, আপনার চিড়িয়া উড়ে গেছে।’
‘কি করে বুঝলেন স্যার?’
‘দেখুন প্রধান গেটের দরজা খোলা। এর প্রথম অর্থ হলো জেনারেল শ্যারন আমাদের চ্যালেঞ্জ করছে। বলছে দরজা খোলা রেখেছি, প্রবেশ কর সাহস থাকলে। দ্বিতীয় অর্থ হলো, জেনারেল শ্যারন আমাদের কাঁচকলা দেখাচ্ছে। বলছে, সব ফাঁকা করে গেছি, এস হাওয়া খেয়ে যাও।’
‘তাহলে কি দ্বিতীয়টাই ঠিক?’ বলল বব কার্টার।
‘অবশ্যই। কারণ, রাস্তার ধারে দিনের বেলায় সে এফ.বি.আই-এর সাথে বন্দুক যুদ্ধে আসবে না।’
‘এখন কি করব স্যার?’ বলল বব কার্টার হতাশ কন্ঠ।
‘চলুন নামি। তার ঘাটিটা দেখে যাই।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল। সকলেই নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। রবিন নিক্সনও। আহমদ মুসা রবিন নিক্সনকে লক্ষ্য করে দ্রুত কন্ঠ বলল, ‘না মিঃ রবিন নিক্সন আপনি নামবেন না। আপনি নিরাপত্তা উপদেষ্টার পিএস। জেনারেল শ্যারনের জানা ঠিক হবে না যে, আপনি অপারেশনে নেমেছেন। আপনার নিরপেক্ষ পরিচয় থাকা ভাল।’
‘বুঝেছি, অনেক ধন্যবাদ স্যার।’ বলে আবার সে গাড়িতে প্রবেশ করল।
বব কার্টার বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার, এতদূর আপনি দেখেন। কিন্তু একটা কথা স্যার, শ্যারনরা তো কেউ নেই। উনি নামলেও তো ওরা দেখতো না।’
‘মিঃ বব কার্টার, আপনারা সত্যিই ঘাটিতে এলেন কিনা, পেলেন কিনা, সেটা দেখার জন্যে জেনারেল শ্যারন অবশ্যই কাউকে কোথাও রাখবে বা পাঠাবে।’
‘বুঝলাম স্যার।’ হাসি মুখে বলল বব কার্টার।
সবাই ঢুকল ভেতরে। আহমদ মুসার কথাই সত্য হলো। একদম শূন্য ঘাটি। সব দরজা-জানালা খোলা। চেয়ার, টেবিল, খাট, শূন্য ফাইল কেবিনেট ছাড়া ঘরে আর কিছুই নেই।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
জেনারেল পালিয়ে ঘাটিতে পৌছার পর যেটুকু সময় পেয়েছে তাতে ফাইলপত্র, কম্পিউটার, নানা ব্যবহার্য দ্রব্য ইত্যাদি নেয়া, গোছানো, সরানো এবং নিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? সবচেয়ে বড় কথা হলো, এত সব জিনিস গেট দিয়ে বের করে নিয়ে গেলে যে আবর্জনা পড়ে থাকার কথা। তার কোন চিহ্ন গেট এলাকায় নেই। এ সব ভাবতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা।
হঠাৎ আহমদ মুসাকে এভাবে ভাবনায় পড়তে দেখে বেঞ্জামিন বেকন, বব কার্টার ও কলিন্স এসে তার পাশে দাঁড়াল। বলল বব কার্টার, ‘কিছু ভাবছেন স্যার?’
‘ভাবছি বব কার্টার। ভাবছি, যেসব জিনিস ওরা এ বাড়ি থেকে সরিয়েছে, তা অধিকাংশই বাইরে নিয়ে যায়নি। সেগুলো তাহলে রাখল কোথায়?’
‘একথা কেন বলছেন স্যার?’ বলল কলিন্স।
‘প্রথম হলো, জেনারেল শ্যারন যে সময়টুকু পেয়েছিল, সে সময়ের মধ্যে জিনিসগুলো বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়, এতসব জিনিস বাড়ি থেকে বের করলে বাড়ি থেকে বের হবার পথে যেসব চিহ্ন থাকার কথা তা নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক।’ বেঞ্জামিন বেকন ও কলিন্স এক সাথে বলে উঠল।
‘তাহলে আসুন সকলে খুঁজি এত জিনিস লুকিয়ে রাখা যায়, সেই জায়গাটা কোথায়।’ বলল আহমদ মুসা।
গোটা বাড়ি খোঁজার পর বিভিন্ন দিক থেকে সকলে গিয়ে হাজির হলো নিচের ড্রইং রুমে। এ ড্রইং রুম থেকেই সিঁড়ি উঠেছে উপরে।
সবাই বলল, বাড়ির এক ইঞ্চি জায়গাও বাকি রাখা হয়নি। সব খোঁজা হয়েছে। দেয়ালগুলো বাজিয়ে দেখা হয়েছে, কিন্তু কোথাও কিছু নেই।
আহমদ মুসা সিঁড়ির দিকে মুখ করে একটা সোফায় বসে ছিল। ভাবছিল সে। ভাবছিল সে সামনের দিকে তার অলস দৃষ্টি মেলে। তার চোখে ভাসছিল সিঁড়িটার কারুকাজ।
সিঁড়িটা বাইরে থেকে ড্রইং রুমে প্রবেশ করার পর হাতের ডান পাশে পড়ে।
সিঁড়ি ও বাইরে বেরুবার দরজার মাঝখানে আরেকটি দরজা। দরজাটা সিঁড়ির শেষ ধাপের সমান্তরালে। সিঁড়ির ধাপ ও দরজাটির মাঝখানে দশ ইঞ্চির মত ব্যবধান। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সিঁড়ির প্রস্থ ও দরজার প্রস্থ সমান। কেন? আর সিঁড়ি আর পাশের দরজার ব্যবধান মাত্র দশ ইঞ্চি কেন? প্রশ্ন জাগল আহমদ মুসার মনে। ব্যবধান দশ ইঞ্চি এই কারণে কি যে সিঁড়ির প্রান্ত ঘেঁষে যে দেয়াল উঠে গেছে তা দশ ইঞ্চি পুরু? যদি তাই হয় তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় দরজাটি দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির প্রান্ত ঘেঁষে তৈরী হওয়া প্রটেকশন দেয়ালের পরেই। আর যেহেতু সিঁড়ির প্রস্থ ও দরজার প্রস্থ সমান , তাই ধরে নেয়া যায়, যে ল্যান্ডিং-এ সিঁড়িটি শেষ হয়েছে, সে ল্যান্ডিং-এরই আরেকটা অংশে দরজাটা দাঁড়িয়ে আছে।
চিন্তাটা এ পর্যন্ত আসতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। ল্যান্ডিং-এর এ অংশটা কেন তৈরী হলো? তাহলে দরজা ল্যান্ডিং-এর যে অংশের উপর দাঁড়িয়ে আছে, তার সাথে কোন সিঁড়ির যোগ আছে? কোন সিঁড়ি নিচে নেমেছে সেখান থেকে?
আহমদ মুসার মনটা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। তার মনে পড়ল ওয়াশিংটনের প্রায় সব ভাল বাড়িরই বেসমেন্টে ঘর থাকে। সে ঘর অনেক ক্ষেত্রেই দুতলা তিন তলা পর্যন্ত নিচে গিয়ে থাকে।
আহমদ মুসা সোফায় সোজা হয়ে বসল। বলল বব কার্টারর দিকে তাকিয়ে, ‘সিঁড়ির পাশে ঐ দরজা খুলে দেখেছেন?’
‘জি স্যার। ওটা সুইচ রুম।’ বলল বব কার্টার।
‘দরজা খোলার পর মেইন সুইচগুলো দু’পাশের দেয়ালে, না শেষ প্রান্তের দেয়ালে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা উৎসুক কন্ঠে।
‘দু’পাশের দেয়ালে, শেষ প্রান্তের দেয়ালে কোন সুইচ নেই।’ বব কার্টার বলল।
‘দু’পাশের দেয়ালে সুইচগুলো সামনের দিকে, না ভেতরের প্রান্তের দিকে?’
‘সবগুলো মেইন সুইচই দুপাশের দেয়ালে সামনের দিকে গাদাগাদি করে বসানো। ভেতরদিকে দুপাশের দেয়ালই এক দম ফাঁকা’ বলল বব কার্টার। তার চোখে মুখে তখন বিস্ময়।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমি নিশ্চিত এ দরজাটা একটা সিঁড়ির টপ ল্যান্ডিং-এর উপর দাঁড়িয়ে আছে।’
কথাটা শেষ করে আহমদ মুসা সোফায় হেলান দিয়ে বলল, ‘মিঃ বেঞ্জামিন বেকন, মিঃ কলিন্স, মিঃ বব কার্টার আপনারা একটু খুঁজে দেখুন তো।’
সকলেরই চোখে মুখে বিস্ময় , সেই সাথে আনন্দও।
তিনজনই ছুটল সে দরজার দিকে। অন্যেরাও গিয়ে দাঁড়াল দরজার সামনে।
মিনিট পনের পর বেঞ্জামিন বেকন, কলিন্স এবং বব কার্টার তিনজনেই দরজার বাইরে বেরিয়ে এল। বলল বেঞ্জামিন বেকন, ‘মিঃ আহমদ মুসা কোন ক্লু-ই খুঁজে পাওয়া গেল না। মেঝের কার্পেট উঠিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। দেয়ালের প্রতি ইঞ্চি জায়গা পরখ করা হয়েছে। দরজার চৌকাঠের সবটা গা তিল তিল করে দেখা হয়েছে, কোথাও কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমাদের মনে হয়, সিঁড়ি এখানে থাকলেও তার কন্ট্রোল বাইরে কোথাও।’
আহমদ মুসা কোন কথা না বলে চোখ বুজল। মুহূর্ত কয় পরে চোখ খুলে বব কার্টারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখে আসুন তো মিঃ বব কার্টার সবগুলো মেইন সুইচ অন কি না।’
‘ইয়েস স্যার।’ বলে ছুটল বব কার্টার দরজার দিকে। দরজা দিয়ে ঢুকল ঘরে।
মুহূর্ত কয়েক পর ফিরে এসে বলল, ‘স্যার সবগুলো মেইন সুইচ অন, মাত্র একটা মেইন সুইচ অফ করা।’
‘মিঃ বব কার্টার কাউকে বলুন ঐ মেইন সুইচ অন করতে। দেখবেন সিঁড়ির মুখ খুলে গেছে।’
সকলেই আহমদ মুসার কথা শুনছিল। সকলেরই বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টি তার প্রতি নিবদ্ধ।
কয়েকজন এফ.বি.আই কর্মী দাঁড়িয়েছিল দরজার সামনেই। তাদের দিকে তাকিয়ে বব কার্টার একজনকে নির্দেশ দিল, ‘টমাস অফ করা সুইচটা অন করে দাও তো।’
টমাস নামের লোকটি ছুটল। ঢুকলো ঘরে।
পরক্ষণেই সুইচ অন করার খট করে একটা শব্দ হলো। বাইরে থেকেও সবাই শুনল।
খট করে শব্দ উঠার পরেই চিৎকার শোনা গেল টমাস নামের লোকটির, ‘পাওয়া গেছে স্যা……’
তার চিৎকার শেষ হলো না। স্টেনগানের আওয়াজ তার কন্ঠ ডুবিয়ে দিল। হারিয়ে গেল তার কন্ঠ।
দরজার সামনেই এফ.বি.আই-এর যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা শুয়ে পড়ে তাদের স্টেনগান বাগিয়ে ধরল সেই দরজার দিকে।
ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে আহমদ মুসা। বব কার্টার, বেঞ্জামিন বেকন ও কলিন্সও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বব কার্টারের হাতে স্টেনগান। বেঞ্জামিন বেকন ও কলিন্সের হাতে উঠে এসেছে রিভলবার।
আহমদ মুসা এগুচ্ছে দরজার দিকে। তার হাত খালি।
‘স্যার, নিচে শত্রু আছে। সিঁড়ি পথে ওরা গুলী চালিয়েছে।’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল বব কার্টার আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘ওরা উঠে আসার সাহস পাবে না এত তাড়াতাড়ি। চিৎকার করায় ভীত শত্রুর নির্বিচার গুলীর শিকার হলো বেচারা টমাস।’
বলতে বলতে এগুলো আহমদ মুসা দরজার দিকে।
আহমদ মুসার পেছনে বেঞ্জামিন বেকন, বব কার্টার ও কলিন্স।
দরজার চৌকাঠের আড়ালে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিল আহমদ মুসা। দেখল, টমাসের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহটা পড়ে আছে ল্যান্ডিং-এর উপর। সেই সাথে আহমদ মুসা দেখল কনক্রিটের একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। সিঁড়িতে কোন রেলিং নেই। সিঁড়ির নিচে আলো। এক ঝলক দৃষ্টিতে কাউকেই দেখতে পায়নি আহমদ মুসা।
তার মানে, ভাবল আহমদ মুসা, শত্রুরা প্রথম দৃষ্টিতে চোখে পড়ার মত জায়গায় নেই।
আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়াল বেঞ্জামিনদের দিকে। বলল, ‘টমাস মারা গেছে।’
মুহূর্তের জন্যে থামল আহমদ মুসা। তার পরেই বলে উঠল, ‘এ বাড়ির মাস্টার সুইচ কোথায়?’
‘কেন এখানেই সব সুইচ নয়?’ বলল বব কার্টার।
‘এটা সুইচ ঘর নয়। মেইন সুইচগুলো এখানে রাখা হয়েছে গোপন সিঁড়ির কনট্রোলকে ক্যামোফ্লেজ করার জন্যে। নিশ্চয় রিডিং মিটার সহ বাড়ির মাস্টার সুইচ অন্য কোথাও আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
এফ.বি.আই কর্মীদের একজন বলে উঠল, ‘স্যার বাড়ির মূল প্রবেশ দরজায় পাশেই একটা ঘর আছে। ওখানেই একটা বড় মাস্টার সুইচ ও মিটারগুলো দেখেছি।’
সে কথা শেষ করতেই আহমদ মুসা তাকে বলল, ‘দেখে আসুন সেটা অন না অফ আছে।’
দৌড়ে চলে গেল লোকটি, ফিরে এলো মিনিট খানেকের মধ্যেই। বলল, ‘স্যার অন আছে সুইচটি।’
আহমদ মুসা লোকটিকে ধন্যবাদ দিয়ে সবাইকে কাছে ডাকল এবং তার পরিকল্পনা সবাইকে বুঝিয়ে বলল। এই পরিকল্পনায় কার কি দায়িত্ব তা বুঝিয়ে দিল।
শেষে কলিন্সের দিকে চেয়ে বলল, ‘মিঃ কলিন্স, আপনি যান মাস্টার সুইচের কাছে। বব কার্টার সংকেতটি বাজাবার পর সুইচ অফ করবেন এবং দ্বিতীয় সংকেতটি বাজাবার পর সুইচটি আবার অন করবেন।’
‘মিঃ আহমদ মুসা আপনি একা নামছেন নিচে, এটা ঠিক নয়। আমিও নামতে চাই।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এটা যুদ্ধের প্রথম পর্যায়, এ পর্যায়ে যদি আমি ব্যর্থ হই। তাহলে দ্বিতীয় পর্যায়ে আপনি নামবেন।’
বেঞ্জামিন বেকন মুখ ভার করল। কিছু বলল না।
নির্দেশ পাওয়ার সংগে সংগেই কলিন্স বাইরে মাস্টার সুইচ বোর্ডের দিকে ছুটল।
বেঞ্জামিন বেকন এফ.বি.আই-এর একজন সৈনিক কর্মীকে সাথে করে স্টেনগান নিয়ে বসল দরজার ঠিক মাঝখানে। তাদের স্টেনগানের ব্যারেল রাখা হলো দরজার দুই প্রান্তের দুই কোণায়। ব্যারেলের মাথা সিঁড়ি এড়িয়ে নিচের দিকে কোণাকুণি তাক করা হলো। যাতে গুলী বৃষ্টি শুরু করলে সিঁড়ি সোজা মেঝে এলাকায় আঘাত না করে।
আহমদ মুসা মাথায় পাগড়ির মত করে একটা লম্বা কালো কাপড় পেঁচিয়ে নিয়েছে। সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ার সময় মাথায় আঘাত না লাগে তার জন্যেই এই ব্যবস্থা। কাপড়টা যোগাড় হয়েছে বাড়িটিরই এক আলমারি থেকে। সম্ভবত কিছু তৈরীর জন্যে কেনা হয়েছিল, কিন্তু তা আর তৈরী হয়নি।
আহমদ মুসার শোল্ডার হোলস্টারে ছিল সারা জেফারসনের দেয়া মেশিন রিভলবার। সেটা বের করে হাতে নিল। তারপর আহমদ মুসা দরজার মাঝ বরাবর বসা স্টেনগানধারী দুজনের মাঝে মাথাটা নিচু করে দরজার চৌকাঠের বরাবরে নিয়ে এল।
কিছুটা পেছনে দাঁড়িয়েছিল বব কার্টার।
আহমদ মুসা তার মাথা নিচু করে চৌকাঠ বরাবর নেয়ার সাথে সাথেই বব কার্টার একটা তীক্ষ্ণ শীষ দিয়ে উঠল।
সংগে সঙ্গেই নিভে গেল সব আলো, নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়ি এবং সিঁড়ির নিচের ঘরেরও।
আলো নিভে যাওয়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসা মাথা চৌকাঠে ঠেকিয়ে দেহের পেছনটা শূন্যে ছুঁড়ে দিল ল্যান্ডিং-এর উপর দিয়ে নিচের সিঁড়ির দিকে।
আহমদ মুসার দেহ সিঁড়িতে পড়ার শব্দ পাওয়ার পঁচিশ সেকেন্ড, যে সময়ের মধ্যে আহমদ মুসার দেহ সিঁড়ি দিয়ে নিচে গড়ানো শুরু করেছে, তখন গর্জে উঠল বেঞ্জামিন বেকন ও এফ.বি.আই-এর সৈনিক কর্মীটির স্টেনগান। বেঞ্জামিন বেকনের স্টেনগান কভার করল সিঁড়ির বাম পাশের এবং এফ.বি.আই-এর কর্মীর স্টেনগান কভার করল সিঁড়ির ডান পাশের এলাকা। লক্ষ্য হলো নিচে বেজমেন্টের ঘরে যে শত্রুরা আছে তারা যেন সিঁড়ির দিকে ছুটে আসতে না পারে এবং আহমদ মুসা যাতে নিরাপদে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নিচে মেঝেতে গিয়ে সিঁড়ি বরাবর সামনে এগিয়ে কোথাও আশ্রয় নিতে পারে। আহমদ মুসার পরিকল্পনার বক্তব্য হলো, শত্রুরা যখন দেখবে আলো নিভে যাওয়ার সংগে সংগে গুলী শুরু হয়েছে দরজা থেকে, তখন তাদেরও প্রাথমিক লক্ষ্য হবে দরজা। শত্রুর স্টেনগানকে দরজার দিকে আটকে রেখে সেই সুযোগ আহমদ মুসা সিঁড়ি বরাবর সামনে এগিয়ে কোথাও আশ্রয় নেবে। এরপরের লক্ষ্য হলো পেছন থেকে শত্রুর উপর আকস্মিক আক্রমণের সুযোগ নেয়া।
আলো নিভে যাবার পচিশ সেকেন্ড পর জ্বলে উঠল আবার আলো।
তখনও দরজার উপর চলছে মুষলধারে গুলী বর্ষণ।
আলো জ্বলার সংগে সংগে আহমদ মুসার পরিকল্পনা অনুসারেই গুলী বন্ধ করে দিয়েছিল বেঞ্জামিন বেকন ও এফ.বি.আই-এর সৈনিক কর্মী।
ওদিকে আহমদ মুসা অন্ধকারের সেই পচিশ সেকেন্ডে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গড়িয়েই দ্রুত এগোলো মেঝের উপর দিয়ে সিঁড়ি বরাবর সামনের দিকে। তার মাথার উপর দিয়ে তখন চলছে গুলী বৃষ্টি। আহমদ মুসা বুঝল, সে গড়িয়ে যেদিকে যাচ্ছে সেদিক থেকেও গুলী সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে। তার অর্থ এ দিকেও শত্রুপক্ষের লোক আছে।
আহমদ মুসা একটা দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেল।
আহমদ মুসা দেয়াল ধরে উঠে বসে ডানে-বামে হাতড়াতে গিয়ে দেখল বাম দিকে হাত দুয়েক পরেই দেয়াল শেষ হয়ে গেছে। তবে সেটা দরজা নয়। দরজা হলে চৌকাঠ বা চৌকাঠ ধরনের কিছু থাকত। কিন্তু তা নেই। তাহলে এটা করিডোর? তাই হবে ভাবল, আহমদ মুসা। অনুমানে আরও বুঝল এ করিডোরটি সিঁড়ির ঠিক বরাবর। আহমদ মুসা গড়াবার সময় একটু ডান দিকে সরে গিয়েছিল সিঁড়ি বরাবর আসা গুলী এড়াবার জন্যে।
তখনও দু’পক্ষের মধ্যে চলছে তুমুল গুলী বৃষ্টি।
আহমদ মুসা বাম পাশে খুঁজে পাওয়া করিডোরে মুখ বাড়াতে গিয়ে বুঝল, এ করিডোর থেকেও স্টেনগানের শব্দ আসছে। অখন্ড শব্দের মাঝে এই শব্দকে এতক্ষণ আহমদ মুসা আলাদা করতে পারেনি। সাবধান হলো আহমদ মুসা।
মেশিন রিভালবারের মুখ করিডোরে তাক করে করিডোর থেকে উত্থিত স্টেনগানের শব্দের উৎসকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করল আহমদ মুসা। বুঝল স্টেনগানের শব্দ করিডোরের মাঝ বরাবর একই উৎস থেকে আসছে। শব্দ একাধিক স্টেনগানের।
আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলবারের নল সে শব্দ লক্ষ্যে তাক করে ট্রিগার চেপে ধরল তর্জনি দিয়ে।
ট্রিগারে তর্জনি চেপেই আহমদ মুসা মেশিন রিভালবারের নল বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে নিল করিডোরের প্রস্থ আনুমানিকভাবে আন্দাজ করে নিয়ে। আর সেই মুহূর্তেই আলো জ্বলে উঠেছিল।
আলোর বন্যায় ভেসে গেল চারদিক।
আহমদ মুসা তার সামনের করিডোরের দিকে একবার চেয়েই দেহটাকে বাঁকিয়ে নিয়ে ছুড়ে দিল করিডোরের ভেতর।
করিডোরর পড়েই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
আগেই চোখে পড়েছিল করিডোরের মাঝ বরাবর তিনটি লাশ পরে আছে। আর একবার ভালো করে দেখল, তার মেশিন রিভলবারের প্রথম তিন শিকারকে।
আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলবার পকেটে রেখে লাশের কাছে পড়ে থাকা তিনটি স্টেনগানের দুটি তুলে নিল। একটা ঘাড়ে ফেলে অন্যটি হাতে রাখল।
গুলী বৃষ্টির তীব্রতা তখন কমে গেছে। উপর থেকে গুলী পরিকল্পনা অনুসারেই থামিয়ে দেয়া হয়েছে অল্পক্ষণের জন্যে, যাতে আলো জ্বলে উঠার পর আহমদ মুসা প্রয়োজনে যে কোন দিকে মুভ করার সুবিধা পায়। কিন্তু এদিক থেকে গুলী বৃষ্টি বন্ধ হয়নি।
সিঁড়ির উপর দিয়ে গুলী গুলো হচ্ছে ঘরের ডান ও বাম দুই প্রান্ত থেকে। মাঝ বরাবার এলাকা থেকে কোন গুলী হচ্ছে না। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, ঘরের মাঝ এলাকায় ঘাপটি মেরে নিশ্চয় কেউ বসে নেই।
ঘরের ডান ও বাম এলাকা থেকে যারা গুলী করছে সিঁড়ি লক্ষ্যে, তারা কি দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে? প্রশ্ন জাগল আহমদ মুসার মনে।
এক ঝলক দেখে আহমদ মুসা যতটুকু বুঝেছে, সিঁড়ির নিচে ফাঁকা একটা প্রশস্থ চত্তর। চত্তরটির সামনের দিকে চত্তর থেকে একটি করিডোর বেরিয়ে এগিয়ে গেছে। সেই করিডোরটিতেই আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে। অনুরূপভাবে চত্বরটি ডান ও বাম দিকে বেশ কিছুটা এগুবার পর চত্বর থেকে দুদিকেই করিডোর বেরিয়ে গেছে। আহমদ মুসার বিশ্বাস, ঐ দুই করিডোরের মুখ থেকে দেয়ালের আড়াল নিয়ে সিঁড়ির দিকে গুলী করা হচ্ছে।
ওরা আহমদ মুসাকে দেখতে পায়নি বলে মনে হচ্ছে আহমদ মুসার। আলো জ্বলার সময় স্বাভাবিকভাবেই ওদের চমকিত দৃষ্টি সিঁড়ি মুখের দিকে নিবদ্ধ হবার কথা। তাছাড়া এক ঝলক দেখতে পেলেও তাকে এ করিডোর থেকে বেরিয়ে যাওয়া নিজেদের লোক মনে করাটাই স্বাভাবিক। শত্রু মনে করলে অবশ্যই তাদের স্টেনগানের গুলী এদিকেও ছুটে আসত। চারদিকে স্টেনগানের আওয়াজের মধ্যে আহমদ মুসার মেশিন রিভলবারের অপেক্ষাকৃত মিঠা আওয়াজ নিশ্চয় তারা শুনতে পায়নি।
আহমদ মুসা খুশি হয়েছে, তবে করিডোরটির পেছন দিকে বেশি এগোয়নি।
পেছনের দিকে নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে আহমদ মুসা ধীরে ধীরে এগোলো করিডোরের মুখের দিকে।
উপর থেকে আবার একটি দুটি করে গুলী বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে ঘরের ডান ও বাম প্রান্তের দিকে পরিকল্পনা অনুসারেই। এ গুলী বর্ষণের লক্ষ্য শত্রুদেরকে গুলী বর্ষণে ব্যস্ত রাখা যাতে তারা অন্যদিকে মনোযোগ দিতে না পারে এবং তাদের অবস্থান চিহ্নিত করাও সহজ হয়।
আহমদ মুসা বিড়ালের মত অতিসন্তর্পণে এগিয়ে দেয়ালের আড়াল থেকে প্রথম উঁকি দিল বাম দিকে। দেখল চত্বরের প্রান্তে করিডোরের মুখে ওরা চারজন বসে। ওরা দেয়ালের আড়ালে, কিন্তু তাদের স্টেনগানের ব্যারেল অর্ধেক দেয়ালের বাইরে।
এরপর আহমদ মুসা একটু সময় নিয়ে উকি দিল ডান চত্ত্বরের দিকে। ওখানে দেখল দুজনকে। ওরাও ঐ একই পজিশনে স্টেনগান বাগিয়ে গুলী করছে। আহমদ মুসা সরে এল। হাতের স্টেনগানের গুলীর চেম্বার পরীক্ষা করল।
তারপর আহমদ মুসা স্টেনগানের ট্রিগার হাত রেখে এগোলো প্রথমে বাঁদিকে।
দেয়ালের গা ঘেঁষে হাঁটু গেড়ে বসে স্টেনগানের ব্যারেল চোখের পলকে বাইরে নিয়ে ট্রিগার চাপল আহমদ মুসা বাঁদিকের চারজনকে লক্ষ্য করে। এক পশলা গুলী করেই আহমদ মুসা বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে স্টেনগান তাক করল ডান করিডোরের দুজনের দিকে।
ওরা দুজন গুলীর শব্দে চমকে উঠে তাকিয়ে আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েই স্টেনগান ঘুরিয়ে নিচ্ছিল।
আহমদ মুসার হাত স্টেনগানের ট্রিগারেই ছিল। সূতরাং স্টেনগানের নল তাদের দুজনের দিকে ঘুরার সাথে সাথেই এক ঝাঁক গুলী গিয়ে ঘিরে ধরল তাদেরকে।
বিশ সেকেন্ডও গেল না। খেলা সাঙ্গ হয়ে গেল। ছয়জনই মুহূর্তে লাশ হয়ে রক্তে ভাসতে লাগল।
সিঁড়ির মাথায় দেখা গেল বেঞ্জামিন বেকন, বব কার্টার ও কলিন্সকে।
আহমদ মুসাকে স্টেনগান হাতে চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওরা ছুটে নেমে এল নিচে সিঁড়ি দিয়ে। তাদের পেছনে এফ.বি.আই-এর অন্যান্য সৈনিকরাও।
তারা পড়ে থাকতে দেখল নয়টি লাশকে।
বেঞ্জামিন বেকন জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বব কার্টার, কলিন্স আহমদ মুসাকে স্যালুট দিয়ে তাদের হৃদয়ের আবেগ প্রকাশ করল।
আর সৈনিকদের চোখে বিস্ময় ও আনন্দ।
‘জেনারেল শ্যারন তো তাহলে এখানে নেই।’ বলল বব কার্টার।
‘অবশ্যই। তিনি এখানে থাকার কথা নয় মিঃ বব কার্টার। তিনি এমন খোপে আশ্রয় নেবার মত লোক নন।’
‘ঠিক স্যার।’ বলল বব কার্টার। কথাটা শেষ করেই বব কার্টার আবার বলে উঠল , ‘স্যার আমরা এখন সার্চ করতে পারি?’
‘অবশ্যই সার্চ করে আপনারা উপরে আসুন। লাশগুলো নেয়ার ব্যবস্থা করুন। আমি ওদিকে দেখি রবিন নিক্সন কি করছে।’
বলে আহমদ মুসা উপরে উঠে এল। উপরে উঠে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
আহমদ মুসাকে গেটে দেখেই রবিন নিক্সন গাড়ির জানালা নামিয়ে হাত নেড়ে ডাকল আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা গিয়ে উঠল রবিন নিক্সনের গাড়িতে।
‘স্যার অনেকক্ষণ ধরে গুলীর শব্দ শুনলাম। খারাপ কিছু ঘটেনি তো? ওরা সবাই কোথায়?’ বলল উদ্বিগ্ন রবিন নিক্সন।
‘বড় ধরনের খারাপ কিছু ঘটেনি, আমাদের একজন সৈনিক মারা গেছে। ওদের কয়েকজন মারা গেছে। সার্চ শেষ করে আসছে সবাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার এদিকে আরেক ঘটনা। যাকে খুঁজতে গেছেন তিনিই তো বাইরে।’
‘কেমন?’
‘স্যার, এর মধ্যে জেনারেল শ্যারন এ রাস্তা দিয়ে দু’বার পাস করেছে।’
‘জেনারেল শ্যারন?’
‘জি স্যার।’
‘দুবার?’
‘জি স্যার।’
‘তাহলে তো এ ঘাটিতে মূল্যবান কিছু আছে, যার জন্যে সে খুবই উদ্বিগ্ন।’
‘তাই হবে স্যার।’
‘তার গাড়ির নাম্বার নিয়েছ?’
‘জি স্যার।’ বলে গাড়ির নাম্বারটা আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল রবিন।
‘আরো একবার জেনারেল শ্যারন আসবে নাকি?’
‘আসতেও পারে স্যার।’
‘কিংবা নাও আসতে পারে। কোথাও দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত কি ঘটে তা দেখতে পারে।’
‘জি স্যার, সেটাও স্বাভাবিক।’
এসব বিষয় নিয়ে কথা চলছিল আহমদ মুসা ও রবিন নিক্সনের মধ্যে।
অবশেষে বব কার্টাররা এল। বব কার্টার গাড়ির জানালা দিয়ে আহমদ মুসাকে বলল, ‘স্যার, কম্পিউটার ছাড়া নেবার মত ডকুমেন্ট কিছু পেলাম না।’
‘আমার বিশ্বাস কম্পিউটারগুলোর মধ্যে মূল্যবান দলিল থাকতে পারে মিঃ বব কার্টার। আপনার শিকার জেনারেল শ্যারন কিন্তু এ রাস্তায় ঘুর ঘুর করছে।’
‘তাই স্যার? তাহলে তো………’
‘এখন নেই। দুবার এ রাস্তা দিয়ে গেছে। অবশ্য যদি তৃতীয়বার আসে ,তাহলে আপনার একটা সুযোগ হতে পারে।’
‘ঈশ্বরের করুণা হোক স্যার।’
‘আমি স্যারকে টেলিফোন করেছিলাম। সব জানিয়েছি। তিনি পুলিশকে খবর দিতে বলেছেন। আমি পুলিশকে খবর দিয়েছি। ওরা আসছে। স্যার আপনাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।’
‘কোন স্যার? জর্জ আব্রাহাম?’
‘জি স্যার।’
‘আপনি সব কথা তাকে বলেছেন?’
‘উনিই খুঁটে খুঁটে জিজ্ঞেস করে জেনেছেন। আপনার মত উনি বলেছেন, কম্পিউটারগুলো খুব মূল্যবান হবে।’
‘মুল্যবান না হলে সরাতো না এবং এভাবে পাহারায় লোকও বসাতো না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ডকুমেন্টগুলো ডেস্ট্রয়ও তো করতে পারে।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘করতে পারত , কিন্তু করেনি। কারণ জেনারেল শ্যারনরা মনে করেছিল যে, তাদের গোপন আশ্রয়ে পৌঁছার পথ এফ.বি.আই খুঁজে পাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জেনারেল শ্যারনের মনে করা ঠিক হয়েছিল। পথটা তো এফ.বি.আই খুঁজে পায়নি। পেয়েছে আহমদ মুসা।’ বলল কলিন্স।
‘এভাবে কথা বলা ঠিক নয়। আহমদ মুসা হাজির না থাকলে আপনারা ঠিকই খুঁজে পেতেন। সে ছিল বলে আপনারা যথাযথ দায়িত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেননি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার। অন্যকে মর্যাদা দেবার, অন্যকে বড় করে দেখবার আপনার এই দুর্লভ গুনের কারণে শত্রুরাও আপনাকে মর্যাদা দেয় স্যার। আমি জেনারেল শ্যারন ও গোল্ড ওয়াটারের সাথে বেশ কয়েকদিন থেকে দেখলাম, তারা আপনাকে যতটা ঘৃনা করে, তার চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদা তারা আপনাকে দেয়। আপনাকে তারা যমের মত ভয় করে, কিন্তু সেই সাথে তারা মনে করে আপনার দ্বারা কোন অন্যায় তাদের হতে পারে না। আজকের দুনিয়ায় এমন শত্রু দুর্লভ।’ বলল কলিন্স।
‘না কলিন্স। মানুষ যদি আল্লাহকে ভালোবাসে, আল্লাহর হুকুম মেনে চলে, তাহলে মানুষ প্রকৃত ‘মানুষ’ হয়ে যায়। আর মানুষ ‘মানুষ’ হলে সে মানুষকে নিজের মত করেই ভালোবাসবে।’
‘স্যার, আপনি খুব ঈশ্বর বিশ্বাসী, না?’ বলল কমান্ডার বব কার্টার।
‘অবশ্যই। কারণ আমি চাই এই জীবনে আমি যেমন আছি, তার চেয়ে অনেক ভাল থাকি পরকালে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মিঃ আহমদ মুসা, আমার খৃস্টান ধর্ম যদি আপনার ধর্মের মত কাজের ধর্ম হতো, সক্রিয় ধর্ম হতো, তাহলে আমিও ঈশ্বরে বিশ্বাসী বা ধর্ম পালনকারী হতে পারতাম। খৃস্টান ধর্মে আমি করার কিছু পাই না।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘স্যারের ধর্মই তাহলে গ্রহণ করে ফেল।’ বলল বব কার্টার।
‘বলতে হবে না, আমি অর্ধেক মুসলমান হয়ে গেছি। দেখে দেখে আমি নামাজ প্রায় শিখে ফেলেছি। মিঃ আহমদ মুসার মত দিনে পাঁচবার নামাজ পড়ে দেখেছি শরীর ও মন দুটোই ভাল লাগছে।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
হেসে উঠল কলিন্স। বলল, ‘শুনেছি নামাজে অনেক কিছু পড়তে হয়। শিখেছেন সেগুলো?’
‘শিখব কোত্থেকে, মিঃ আহমদ মুসা হাসবেন বলে আমি কিছু বলিনি।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘হাসব কেন? ভালো কাজে অবশ্যই সহযোগিতা করব।’
‘মুসলমান হওয়ার কোন নিয়ম আছে খৃস্টানদের ব্যাপটাইজের মত?’ বলল বব কার্টার আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘ও রকম কোন নিয়ম নেই। শুধু একটা ঘোষনা দিতে হয়, তারপর আল্লাহর আদেশ-নিষেধ জীবনের সবক্ষেত্রে মেনে চলতে হয়।’
‘ঘোষনাটা কি?’ আগ্রহের সাথে বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘ঘোষনাটা হলোঃ কোনই উপাস্য নেই আল্লাহ ছাড়া। মুহাম্মদ (সা) তাঁর বার্তাবাহক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এ ঘোষনা দেয়ার অর্থ কি?’ বলল কলিন্স।
‘ঘোষনার অর্থ হলো, আল্লাহ ছাড়া দুনিয়ার আর কাউকেই, শাসক বা সমাজপতি যেই হোন, উপাস্য, মুনিব, মালিক, বিধান দাতা, রিজিক দাতা ইত্যাদি হিসাবে মানা যাবে না। আর আল্লাহ জগতের শেষ নবী মুহাম্মদ (সা) এর মাধ্যমে যে জীবন-বিধান পাঠিয়েছেন তা মেনে চলতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এ ঘোষনা যদি আমি এখনই দেই?’ বলল বেঞ্জামিন বেকন, কলিন্স, বব কার্টার প্রায় একই সাথে।
আহমদ মুসা হাসি মুখে কিছু বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় পুলিশের দুটি গাড়ি এসে দাঁড়াল তাদের গাড়ির পাশে।
আহমদ মুসা থেমে গেল এবং প্রসংগ পাল্টে দ্রুত কন্ঠে বব কার্টারকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি ও লাশ ওদের বুঝিয়ে দিন।’
‘জি স্যার, দিচ্ছি। কম্পিউটার ও অন্যান্য ডকুমেন্ট সবই গাড়িতে তোলা হয়েছে। ওদেরকে বাড়ির দায়িত্বটা বুঝিয়ে দিয়েই আমরা চলে যাব।’ বলল বব কার্টার।
‘আমরা তো এখন চলে যেতে পারি মিঃ বব কার্টার।’
বব কার্টার আহমদ মুসার দিকে আবার পরিপূর্ণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে শশব্যস্তে বলে উঠল, ‘না স্যার। আমি বলতে ভুলে গেছি। স্যার আপনাকে অনুরোধ করেছেন আমাদের সাথে হেড কোয়ার্টারে যেতে। জর্জ এডওয়ার্ড মুরকে নিয়ে তার স্ত্রী বাড়ি এসেছেন। স্যার বলেছেন এডওয়ার্ড মুরের সাথেও দেখা করার কথা।’
হাসল আহমদ মুসা। মনে মনে বলল, লোভ দেখিয়েছেন এডওয়ার্ড মুরের সাথে সাক্ষাতের। আসল মতলব, নিশ্চয় কোন আলোচনার বিষয় আছে। প্রকাশ্যে বলল আহমদ মুসা, ‘ঠিক আছে বব কার্টার। আপনার স্যারের হুকুম তো আর আমি ফেলতে পারি না। যাব।’
‘হুকুম নয় স্যার। অনুরোধ করেছেন আপনাকে।’
‘ঠিক আছে। আপনি কাজ সেরে নিন।’ আহমদ মুসা বলল।
বব কার্টার চলল গাড়ি থেকে নেমে আসা এক পুলিশ অফিসারের দিকে।
আহমদ মুসা মুখ ফিরিয়ে নিল গাড়ির ভেতরে।
রবিন নিক্সনের সাথে আবার গল্প শুরু হলো তার।

‘প্রসিডেন্ট বলতে গেলে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছেন।’ বলল জেনারেল শ্যারন। কান্নার মত ভেজা কন্ঠস্বর তার। ক্ষোভে-দুঃখে বিধ্বস্ত তার মুখ মন্ডল।
জেনারেল শ্যারন যাদের লক্ষ্য করে কথাগুলো বলল, তাদের সবার মুখ নিচু। ভাবনার দুর্বহ ভারে ঝুলে পড়েছে যেন সবার মাথা।
ওয়াশিংটনের বাইরে নির্জন এলাকার একটা বিশাল বাড়ির সাউন্ড প্রুফ ঘরে কাউন্সিল অব আমেরিকান জুইস এ্যাসোসিয়েশনস এবং আমেরিকান জুইস পিপলস লীগের নির্বাহী কমিটির যৌথ অধিবেশন বসেছে। আমেরিকান ইহুদীদের সব মাথাই এখানে হাজির। যাদের মধ্যে রাজনীতিক, শিল্পপতি, সাংবাদিক, কূটনীতিক, আমলা, আইনজীবী সব ধরনের লোক রয়েছে।
জেনারেল শ্যারন থামতেই একজন বলে উঠল, ‘যুদ্ধটা কি, দয়া করে সবাইকে বলুন।’
‘পূর্ব তথ্য সবই আপনারা জানেন। নতুন মারাত্মক যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো আমাদের চেষ্টায় আমাদের চরম বৈরী হয়ে ওঠা এফ.বি.আই চীফ ও সি.আই.এ চীফকে বরখাস্ত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট, কিন্তু এই দুজনকে আবার পুনরবহাল করা হয়েছে। সেই সাথে প্রেসিডেন্টের কাছে পৌছার আমাদের প্রধান অবলম্বন প্রসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল হ্যামিল্টনকে পদচ্যুত করা হয়েছে। এরপরই এফ.বি.আই ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদের উপর। আমাদের একটা অফিস তারা ধ্বংস করেছে। আমাদের নয়জন লোককে তারা হত্যা করেছে, জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। গ্রেফতারের জন্যে আমাকে তাড়া করে ফিরছে। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, আমেরিকান ইহুদী কম্যুনিটির বিরুদ্ধে একটা বিরাট ষড়যন্ত্র মামলা দাঁড় করাচ্ছে। যে মামলার আসামী হবেন বিজ্ঞানী জন জ্যাকব থেকে শুরু করে উল্লেখযোগ্য ইহুদী নেতৃবৃন্দ। এই ষড়যন্ত্র মামলার কাহিনী প্রচার হওয়ার সাথে সাথে আমেরিকানদের ক্ষোভ, ক্রোধ গিয়ে আছড়ে পড়বে ইহুদীদের উপর।’ থামল জেনারেল শ্যারন।
সংগে সংগেই একজন যুবক উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘এমন ষড়যন্ত্র মামলায় সুযোগ আমরা কেন দিলাম। এই গোয়েন্দাবৃত্তি কি অপরিহার্য ছিল?’
তার কথা শেষ হতেই প্রধান গোছের কয়েকজন উঠে দাঁড়াল। সমস্বরে বলে উঠল, ‘আমাদের এই যুবক বন্ধু জাতির ইতিহাস জানেন না। যাকে গোয়েন্দাবৃত্তি বলছেন, তারও ইতিহাস জানেন না।’
কাউন্সিল অব জুইস এ্যাসোসিয়েশনসের সভাপতি এবং অনুষ্ঠানের সভাপতি ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলে উঠল, ‘আপনারা একজন কথা বলুন।’
সবাই বসল। কথা বলার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকল তাদের মধ্যে প্রবীণতম একজন। নিউইয়র্ক অঞ্চলের সভাপতি সে। বলল, ‘আমাদের যুবক বন্ধু যাকে ষড়যন্ত্র বলেছেন, তা ষড়যন্ত্র নয় আমাদের বাঁচার মূলমন্ত্র। এই মূলমন্ত্রই আমাদেরকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ শক্তি মার্কিন-জীবনের কেন্দ্র বিন্দুতে নিয়ে এসেছে। একে ষড়যন্ত্র বললে বিজ্ঞানী জন জ্যাকবকে ষড়যন্ত্রকারী বলতে হয়। কিন্তু জন জ্যাকব তো আমাদের জাতীয় বীর। তিনি তাঁর গোটা জীবনকে তিল তিল করে জাতির জন্যে বিলিয়ে গেছেন।’ থামল বৃদ্ধ।
যুবকটি উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি দুঃখিত।’ গম্ভীর কন্ঠে কথাটি বলেই সে বসে পড়ল।
আবার কথা শুরু হলো। এবার কথা বললো সভা সভাপতি ডেভিড উইলিয়াম জোনস। বলল, ‘অপ্রয়োজনীয় কথা বলার সুযোগ এখন নেই। আজ যে পরিস্থিতির আমরা মুখোমুখি সবার কাছে তা পরিষ্কার। অন্য কোন কথা নয়, সবাই বলুন এখন কি করণীয়। এটাই আজকের একমাত্র এজেন্ডা।’
ডেভিড উইলিয়াম জোনস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুবই সম্মানিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি ব্যাংকার, শিল্পপতি এবং মিডিয়া জায়ান্ট।
তার কথা শেষ হতেই আমেরিকান জুইস পিপলস লীগের সভাপতি কথা বলে উঠল। বলল, ‘করণীয় নিয়েও বড় আলোচনার দরকার নেই। করনীয় আমাদের একটাই। সেটা হলো, মার্কিন সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে আমাদের যারা আছেন এবং যারা আমাদের হতে পারেন, তাদের সকলকেই সক্রিয় ও সোচ্চার করে তুলতে হবে। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের নেতা যারা আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল সেইসব নেতাদের পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হবে। চারদিক থেকে শ্লোগান তুলতে হবে, প্রেসিডেন্ট মৌলবাদীদের পেট্রোডলারে বিক্রি হয়ে গেছেন। প্রেসিডেন্টের যে গোপন ফাইল আমরা সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধ করছি, তার ভিত্তিতে তিনি অনৈতিক কাজের সাথেও জড়িত তা প্রমাণ করতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এইভাবে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে তাকে ‘ইমপীস’ করা যায়। আর এই সব কাজে আমাদের অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং মানষকে বশিভূত করার যত অস্ত্র আছে সব কাজে লাগাতে হবে। আর আমাদের এই কাজের একটা প্রধান ও প্রথম কাজ হবে যেকোন মূল্যে আহমদ মুসাকে শেষ করে দেয়া। সেই আজ আমাদের সকল দুর্গতির মূল। তাকে শেষ করা গেলে আমেরিকায় আমাদের অন্য কাজগুলো আরও সহজ হয়ে যাবে।’
আমেরিকান জুইস পিপলস লীগের সভাপতি থামতেই সভার সভাপতি ডেভিড জোনস তাকে ধন্যবাদ দিল এবং সবাইকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনারা সকলে তাঁর কথার সাথে একমত?’
সংগে সংগে সবাই দুই হাত তুলে তাদের সমর্থন ও শপথের কথা জানাল।
হাসি ফুটে উঠল ডেভিড জোনসের মুখে এবং জেনারেল শ্যারনের মুখেও।
‘তাহলে সিদ্ধান্ত আমাদের হয়ে গেল। আমরা এখনকার মত উঠছি।’ বলল ডেভিড জোনস।
কথাটা শেষ করেই ডেভিড জোনস জেনারেল শ্যারনের দিকে ফিরে বলল, ‘মিঃ জেনারেল, বিভিন্ন মার্কিন গ্রুপের এ সময় আমাদের সমর্থন দরকার। হোয়াইট ঈগলের প্রধান গোল্ড ওয়াটার তো আপনার বন্ধু। তার মাধ্যমে হোয়াইট ঈগলকে কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করুন।’
মুখটা ম্লান হয়ে গেল জেনারেল শ্যারনের। বলল, ‘তিনি আমার বন্ধু ছিলেন, কিন্তু এখন মনে হয় আর নেই। লস আলামোসের ঘটনা জানার পর তিনি বেঁকে বসেছেন। আমি তার সাহায্য চেয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, দেখুন আমি আমেরিকান বলেই হোয়াইট ঈগল করি। আমেরিকান হিসাবে দায়িত্বই আমার কাছে এক নম্বর।’ থামল জেনারেল শ্যারন।
‘কেন সে তো টাকার পাগল। তাকে দিন না কয়েক মিলিয়ন ডলার। দেখবেন কাত হয়ে গেছে।’
‘পরোক্ষ ভাবে তাকে আমি পরখ করেছি। তিনি বলেছেন, টাকা তার দরকার হোয়াইট ঈগলের জন্যে। আর হোয়াইট ঈগল আমেরিকার জন্যে। অতএব তার টাকা দরকার আমেরিকার জন্যে। আমেরিকার ক্ষতি করে কোন টাকা তার চাই না।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডেভিড জোনস। বলল, ‘এই নীতিবাগিশতা আমাদের জন্যে একটা বড় বিপদ। বস্তুবাদকে এত উপরে তোলার পরেও এই নীতিবোধ অধিকাংশ আমেরিকানদের মধ্যে থেকে দূর করা যায়নি।’ থামল ডেভিড জোনস।
জেনারেল শ্যারনও কোন কথা বলল না। ভাবছিল সেও। দুজনের চোখেই তখন একটা ছবি ভাসছে। ভবিষ্যতের একটা ছবি। আমেরিকান এই নীতিবোধ ও প্যাট্রিওটিজমের বিরুদ্ধে তাদের বাঁচার এই যে লড়াই তার ভবিষ্যত কি?
প্রশ্নটি ভীতিকর আকারে জ্বল জ্বল করে উঠল তাদের চোখের সামনে। কিন্তু তার কোন উত্তর স্পষ্ট হয়ে উঠলো না।
একটা ভাবনা তাদের সামনে এখন প্রকট , কলম্বাসরা একদিন যাকে ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’ বলেছিল, সেটা কি ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’ই হয়ে দাঁড়াবে, না একে তারা তাদের আরেক ‘প্রমিজড ল্যান্ড’-এ পরিণত করতে পারবে?

পরবর্তী বই
এক নিউ ওয়ার্ল্ড

Top