৩১. ফ্রি আমেরিকা

চ্যাপ্টার

ওয়াশিংটনের ভোর।
সকালের কুয়াশা তখন গভীর।
এরই মধ্যে ফেডারেল পুলিশ প্রধান বিল বেকারের মনে হল কুয়াশায় জড়িয়ে একজন মানুষ যেন পড়ে আছে রাস্তার পাশে।
‘ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করাও।’ সংগে সংগেই ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল বেকার।
গাড়ি দাঁড়াল।
ফেডারেল পুলিশ প্রধান বিল বেকার পাশের লোকটির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘স্যার রাস্তার পাশে একটা মানুষ পড়ে আছে বলে মনে হচ্ছে।’
পাশে বসা লোকটি এফবিআই-এর প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জর্জ আব্রাহাম জনসন ও বিল বেকার ফিরছিল ভার্জিনিয়ার অরলিংটন থেকে। জরুরী প্রয়োজনে ভোর রাতে গিয়েছিল সেখানে। এখন ফিরছে।
বিল বেকারের কথা শুনে ভ্রুকুঞ্চিত হল জর্জ আব্রাহাম জনসনের। বলল, ‘চলুন তো, নেমে দেখি।’
কাছাকাছি হয়ে তারা নিশ্চিত হল, ঠিক একজন মানুষ রাস্তার পাশে পড়ে আছে।
আরও কাছাকাছি হয়ে তারা আঁৎকে উঠল, একজন মানুষের রক্তাক্ত লাশ এটা। আরও কাছাকাছি গেল তারা।
লাশটি চিৎ হয়ে পড়ে আছে। পরনে কমপ্লিট স্যুট।
লাশের মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকার দুজনেই।
লাশটি জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের।
উদ্বেগ উৎকন্ঠা নিয়ে লাশের উপর একটু ঝুঁকে পড়ল তারা।
বুকে গুলীবিদ্ধ হওয়ার কেন্দ্র দুটি। আর এই দুটি গুলীতেই সে নিহত হয়েছে।
দেহে যা রক্ত লেগে আছে তা জমাট বাধা। মাটিতে রক্তের তেমন কোন চিহ্ন নেই। তার মানে অন্য জায়গায় হত্যা করে এখানে এনে ফেলে রাখা হয়েছে।
আরেকবার ভ্রুকুঞ্চিত হল জর্জ আব্রাহাম জনসনের। হত্যা করে সদর রাস্তার পাশে এনে লাশ ফেলে রাখবে কেন?
এই প্রশ্নটা দেখা দিয়েছে ফেডারেল পুলিশ প্রধান বিল বেকারের মনেও।
হঠাৎ তাদের নজর পড়ল লাশের বুকে রক্তের সাথে লেপটে থাকা একটা চিরকুটের দিকে।
তারা আরও ঝুঁকে পড়ল চিরকুটটা কি ও কেন তা দেখার জন্য।
চিরকুটে একটা মাত্র লাইন টাইপ করে লেখা। চিরকুটটা স্পর্শ না করে রক্তের ফাঁক দিয়ে যতটা পড়া গেল তাতে এই লেখাঃ ‘দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইহুদীদের সহযোগিতার এটাই পরিণাম।’
লেখা পড়ে চমকে উঠল জর্জ আব্রাহাম ও পুলিশ প্রধান বিল বেকার দুজনেই।
উঠে দাঁড়াল দুজনেই।
বিল বেকার তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না স্যার। ওরা কি এধরনের কান্ড ঘটাতে পারে? ‘ফ্রি আমেরিকা মুভমেন্ট’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’ এতটা পাগল হতে পারে যে, এই কান্ড ঘটিয়ে তা আবার সদর রাস্তার ধারে এনে তাতে এই সাইনবোর্ড দিয়ে রাখবে!’
এই প্রশ্নগুলো ভীষণভাবে পীড়া দিচ্ছিল জর্জ আব্রাহাম জনসনকেও। কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছিল না। বিশেষ করে আহমদ; মুসা যেখানে সারা জেফারসন ও গোল্ডওয়াটারের পাশে আছে, সেখানে এই ধরনের কান্ড ঘটতে পারে কি করে? তাহলে কি তাদের অজান্তে অতি উৎসাহী কেউ এই কান্ড ঘটিয়েছে? এটাও জর্জ আব্রাহামের মন মেনে নিতে পারছে না।
জর্জ আব্রাহাম জনসন বিল বেকারের প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘আমাকেও ব্যাপারটা অবাক করেছে। কিছু বুঝতে পারছি না বেকার।’
‘ঝামেলার এই চিরকুটটি তাহলে সরিয়ে ফেলব কি স্যার?’ বলল বিল বেকার আগ্রহী কন্ঠে।
জর্জ আব্রাহাম তাকাল বিল বেকারের দিকে। বলল, ‘না বেকার, চিরকুট না নিয়ে যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। অপরাধীকে আড়াল করা নয়, তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করাই আমাদের দায়িত্ব।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি চিরকুটটাকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না তাই কথাটা বলেছি।’ বলল বেকার।
‘ধন্যবাদ বেকার। তুমি ওদের ডেকে পুলিশ কন্ট্রোলে টেলিফোন করতে বল। ওরা আসুক।’
জর্জ আব্রাহাম জনসনের গাড়ির পেছনেই ছিল তাদের টীম-পুলিশের গাড়ি।
বিল বেকার ডাকল তাদের।
গাড়ি থেকে ছয়জন পুলিশ নেমে দ্রুত এগিয়ে এল।
বিল বেকার ওদের মধ্যে যে অফিসার তাকে বলল, ‘ডিউটি পুলিশকে টেলিফোন কর, ওরা আসুক।’
সংগে সংগেই পুলিশ অফিসার তার অয়্যারলেস নিয়ে একটু দুরে সরে দাঁড়াল কথা বলার জন্যে।
এ সময় জর্জ আব্রাহাম জনসন চারদিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত বলে উঠল, ‘বিল বেকার, এইতো সামনে আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের বাড়ি। এতক্ষনে লাশের দিকে সব মনোযোগ থাকায় কোন দিকে তাকাবার ফুরসৎ হয়নি।’
‘ঠিক স্যার। তাহলে কি পুলিশ পাঠাব ওদের খবর দেয়ার জন্যে?’ বলল বিল বেকার।
‘পুলিশ নয়, তুমি নিজে যাও বেকার। মিসেস হ্যামিল্টনকে তুমি নিজে এ খবরটা দাও।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
‘অলরাইট স্যার।’
বলে বিল বেকার একজন পুলিশকে সাথে নিয়ে পা বাড়াল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের বাড়ির দিকে।
অল্পক্ষন পরে মিসেস আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে সাথে নিয়ে ফিরে এল বিল বেকার। মিসেস হ্যামিল্টন কাঁদছিলেন। তার সাথে তার এক মেয়ে, সেও কাঁদছিল।
মিসেস হ্যামিল্টন লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে আছড়ে পড়তে যাচ্ছিলেন মিঃ হ্যামিল্টনের লাশের উপর।
জর্জ আব্রাহাম তাকে ধরে ফেলে বলল, ‘ম্যাডাম ধৈর্য্য ধরুন, তদন্তের স্বার্থে লাশটা এমনই রাখতে চাই। দয়া করে একটু ধৈর্য্য ধরুন, আমাদের সাহায্য করুন।’
মিসেস হ্যামিল্টন বুঝল। সে লাশ আর স্পর্শ করতে গেল না। কিন্তু বাঁধভাঙা কান্নায় তার দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর।
জর্জ আব্রাহাম সদ্য আসা অপেক্ষমান সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারকে সুরত হাল রিপোর্ট তৈরী করতে নির্দেশ দিল।
কাজে লেগে গেল পুলিশ অফিসার।
প্রথমেই চিরকুটটি জব্দ করল পুলিশ।
মিসেস হ্যামিল্টনও পড়ল চিরকুটটি। পড়ে কেঁদে উঠল। বলল, ‘ও গড, তাহলে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’রাই হত্যা করল আমার স্বামীকে আহমদ মুসার কুমন্ত্রনায়! ও গড, আমি কত নিষেধ করেছি তাকে এই সব রাজনীতিতে না জড়ানোর জন্য।’
মিসেস হ্যামিল্টনের চোখের সামনে নিহত মিঃ হ্যামিল্টনের পকেটের মানি ব্যাগ, কলম, চিরুনীসহ ছোট খাট সব জিনিসকেই জব্দ তালিকায় নিয়ে আসা হলো।
মিঃ হ্যামিল্টনের নীচের পকেট ঘড়ি জব্দ করতে গিয়ে পুলিশ অফিসারের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। ভালো করে পরীক্ষা করতে গিয়ে অকস্মাৎ তার ভ্রুকুঞ্চিত হলো। সে ঘড়িটি পুলিশ প্রধান বিল বেকারের হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘স্যার ঘড়ির ছদ্মবেশে এটা একটা টেপ রেকর্ডার।’
বিল বেকার ঘড়িটির উপর একটু নজর বুলিয়ে পুলিশ অফিসারের কথায় সায় দিয়ে তা জর্জ আব্রাহাম জনসনের হাতে দিয়ে বলল, ‘আপনি দেখুন স্যার।’
রেকর্ডারটি পরীক্ষা করতে গিয়ে নতুন করে ভ্রুকুঞ্চিত হলো জর্জ আব্রাহাম জনসনের। বলল বিল বেকারকে লক্ষ্য করে, ‘থ্যাংকস গড! বেকার টেপটা অন করা আছে। তার মানে যা ঘটেছে, তার সবই অডিও রেকর্ডার এই টেপে আছে।’
বলতে বলতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল জর্জ আব্রাহামের।
‘এটা এই ঘটনার সবচেয়ে মূল্যবান দলিল স্যার।’ বলল বিল বেকার।
‘থ্যাংকস গড! আমি চাই ঐ দুর্বৃত্তদের শাস্তি হোক।’ বলল মিসেস হ্যামিল্টন।
‘অবশ্যই হবে ম্যাডাম।’ মুখে এই কথা বলল বটে জর্জ আব্রাহাম জনসন ও বিল বেকার দুজনেই, কিন্তু জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকার দুজনেরই মনের কোথায় যেন খচ করে উঠল। এতবড় ভুল ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট ও ‘হোয়াইট ঈগলে’র লোকরা করতে পারল, তা ভাবতে তাদের কষ্ট লাগছে।
সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী শেষে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘এরা লাশ নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যাক এবং লাশের ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করুক। চল আমরা মিসেস হ্যামিল্টনকে পৌছে দিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যাব। টেপটা শুনে তার কপি নিয়ে তবেই আমি ফিরব অফিসে।’
জর্জ আব্রাহাম জনসন ও বিল বেকার যখন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পৌছল তখন সকাল ৭টা।
পুলিশ প্রধান বিল বেকারের টেবিলে বসে রেকর্ডপ্লেয়ার বাজিয়ে টেপ শুনল তারা দুজন।
টেপ শুনে তারা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তারপর ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে উঠল তারা দুজন।
‘স্যার, ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং জেনারেল শ্যারন খুন করেছে আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে। এখনি, আমি মনে করি, ওদের গ্রেফতার করা প্রয়োজন।’ বলল পুলিশ প্রধান বিল বেকার জর্জ আব্রাহাম জনসনকে লক্ষ্য করে।
‘আমি তোমার সাথে একমত বেকার। কিন্তু জানত ডেভিড উইলিয়াম জোনস কে? তিনি কাউন্সিল অব আমেরিকান জুইস এ্যাসোসিয়েশনসে’র সভাপতি। সেদিক থেকে সে রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আর জেনারেল শ্যারন আন্তর্জাতিক ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান।তার গায়ে হাত দেয়ার মধ্যে বাইরের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ভয় আছে। সুতরাং তাদেরকে গ্রেফতারের জন্যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।’
‘তাহলে?’
‘প্রেসিডেন্টের অনুমতি নিতে হবে। দেখি প্রেসিডেন্টকে পাই কিনা।’
বলে জর্জ আব্রাহাম পকেট থেকে তার এফবিআই-এর মোবাইলটা বের করল।
প্রেসিডেন্টের বেড টেলিফোনে রিং করল।
এ টেলিফোন সরাসরি প্রেসিডেন্ট ধরেন।
ওপ্রান্তে প্রেসিডেন্টের গলা পেল জর্জ আব্রাহাম। বলল জর্জ আব্রাহাম দ্রুত নরম কন্ঠে, ‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, স্যরি। এসময় টেলিফোন করলাম খুব জরুরী প্রয়োজনে।’
‘ধন্যবাদ মিঃ জর্জ। আমারও জরুরী প্রয়োজন। এই মুহুর্তে আপনাকে আশা করছিলাম। বলুন, আপনার প্রয়োজনটা কি?’
‘আমি এবং মিঃ বিল বেকার আপনার সাথে দেখা করতে চাই।’
‘এখন?’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘আমরা খুব উপকৃত হব মিঃ প্রেসিডেন্ট। বলল জর্জ আব্রাহাম
‘ভালই হলো। উইলিয়াম রুজভেল্ট, রোনাল্ড ওয়াশিংটন, ম্যাক আর্থারকে ডেকেছি। আপনাকে খুঁজছিলাম। শুনলাম অরলিংটন গেছেন। আপনি বিলকে নিয়ে এখনি চলে আসুন।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
টেলিফোন রেখে দিয়ে জর্জ আব্রাহাম বিল বেকারকে প্রেসিডেন্টের কথা ব্রিফ করল এবং টেপটা পকেটে নিয়ে বলল, ‘চলুন উঠি।’
তারা বেরিয়ে এল অফিস থেকে।
তাদের গাড়ি ছুটল হোয়াইট হাউজের উদ্দেশ্যে।

হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্টের ওভাল অফিস। ওভাল টেবিলে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন আসীন।
তার সামনে ওভাল টেবিলের ওপাশে বসেছে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা উইলিয়াম রুজভেল্ট, জর্জ আব্রাহাম জনসন, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, বিল বেকার এবং জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন।
বৈঠকে প্রেসিডেন্টই কথা শুরু করেছে। বলছিল সে, ‘দেশ ও জনগনের স্বার্থের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত একটা বিষয়ে পরামর্শের জন্যে আমরা এখানে বসেছি। ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল শ্যারনরা যে নিউজ সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় প্রচার করেছিল তার জবাবে আহমদ মুসা, সারা জেফারসন ও গোল্ড ওয়াটাররা যে বক্তব্য সংবাদপত্র ও টিভি নেটওয়ার্কে পাঠিয়েছেন তার কপি এবং এ্যাডওয়ার্ড হ্যারি ময়নিহানের উদ্ধার সম্পর্কিত যে রিপোর্ট মিঃ জর্জ আব্রাহাম পাঠিয়েছেন তারও কপি রাতেই আপনারা সকলে পেয়েছেন। সব মিলিয়ে বিষয়টা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। এ সম্পর্কে এখন আমাদের করনীয় কি? আপনাদের কাছে সে পরামর্শই জানতে চাই।’
প্রেসিডেন্ট থামতেই জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, ‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। যে বিষয়ে কথা বলার জন্যে আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। তা হচ্ছে, জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন গতরাতে খুন হয়েছেন। খুন……।’
জর্জ আব্রাহাম জনসনের কথার মাঝখানেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন খুন হয়েছে!’
অন্য সবার চোখেও বিস্ময়। সবাই সোজা হয়ে বসেছে।
‘ইয়েস, মিঃ হ্যামিল্টন খুন হয়েছেন। খুন করেছে জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনস। আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন যখন ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারে, তখন আমেরিকার স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে সে অস্বীকার করে। আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন সব ফাঁস করে দেবে এই ভয়েই জেনারেল শ্যারনরা তাকে খুন করে।’
বলে জর্জ আব্রাহাম পকেট থেকে একটা টেপ বের করে টেবিলে রাখল। বলল, ‘এই টেপে জেনারেল আলেকজান্ডারের হত্যা ও হত্যাকালীন সকলের কথঅ বার্তার রেকর্ড আছে।’
‘রেকর্ডটা বাজিয়ে শুনান মিঃ জর্জ।’ বলে প্রেসিডেন্ট তার বাঁ হাত দিয়ে টেবিলের নিচের তলায় গোপন একটা সুইচ প্যানেলের একটিতে চাপ দিল।
সংগে সংগে জর্জ আব্রাহামের সামনে টেবিল ফুঁড়ে বেরিয়ে এল একটা ক্ষুদ্র ক্যাসেট প্লেয়ার।
জর্জ আব্রাহাম টেবিল থেকে মাইক্রো ক্যাসেটটা নিয়ে প্লেয়ারে বসিয়ে দিল।
প্লেয়ারটি কথা বলে উঠল। সাথে সাথে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘জেনারেল শ্যারনের কথার মাঝখানে থেকে কথা শুরু হলো কেন মিঃ জর্জ?’
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, মনে হয়, জেনারেল হ্যামিল্টন ক্যাসেট অন করতে ভুলে গিয়েছিলেন, অথবা হতে পারে তিনি ওদের সন্দেহ করার পর ক্যাসেটটি অন করেন দলিল হিসেবে ওদের কথা রেকর্ডের জন্যে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘ধন্যবাদ মিঃ জর্জ। ওইরকমই একটা কিছু ঘটে থাকতে পারে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
ক্যাসেট কথা বলে চলল।
সবার মনোযোগ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ক্যাসেট থেকে বেরিয়ে আসা শব্দগুলোর ওপর।
জেনারেল শ্যারন, ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং জেনারের হ্যামিল্টনের বাক বিনিময় তারা শুনল। শুনল জেনারেল হ্যামিল্টনের ভয়ার্ত কন্ঠ। তার জবাব শুনল জেনারেল শ্যারনের কন্ঠে। পরপরই তাদের কানের এল দুবার গুলীর শব্দ এবং জেনারেল হ্যামিল্টনের আর্তনাদ। জেনারেল হ্যামিল্টনের শেষ স্বগোতক্তি। সবশেষে ডেভিড উইলিয়াম জোনস জেনারেল হ্যামিল্টনের লাশ একটি চিরকুটসহ তার বাড়ির সামনে রেখে আসার যে নির্দেশ দিল সেটাও সকলে শুনল।
এরপর প্রেসিডেন্ট নিজেই ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ করে দিল। বলল স্বগতকন্ঠে, ‘ঈশ্বর তার আত্মার মঙ্গল করুন। বেচারা বিভ্রান্ত হয়েছিল জেনারেল শ্যারনদের দ্বারা। কিন্তু জীবন দিয়ে সে প্রমাণ করে গেল সে একজন দেশ প্রেমিক আমেরিকান।’
‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা(New World Order) প্রশ্নে ওদের মিষ্টি কথা অনেক আমেরিকানকেই বিভ্রান্ত করেছে। আমেরিকানদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘শুধু ‘অনেক আমেরিকানে’র কথা বলছেন কেন? সেদিন সারা জেফারসনের সাথে কথা বলার পর বিষয়টা নিয়ে আমি নতুন করে গভীরভাবে ভাবছি। জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন জীবন দিয়ে ঈশ্বরের কাছে তার যে প্রার্থনা রেখে গেলেন তা আমার হৃদয়কে আজ তীরের মত বিদ্ধ করছে মিঃ জর্জ।’ বলল প্রেসিডেন্ট। তার কন্ঠে গভীর আবেগ।
বলেই প্রেসিডেন্ট সোজা হয়ে বসল। বলল উইলিয়াম রুজভেল্টের দিকে তাকিয়ে, ‘বলুন মিঃ রুজভেল্ট আপনি কি ভাবছেন?’
উইলিয়াম রুজভেল্ট নড়ে-চড়ে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়ার আমি পক্ষে। তবে মিঃ প্রেসিডেন্ট আপনি এই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে রাজনৈতিক ফ্রন্টের শীর্ষ ইহুদী নেতাদের ব্রীফ করতে পারেন।’
তারপর প্রেসিডেন্ট তাকালেন জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। এইভাবে একে একে সবার মত নিলেন প্রেসিডেন্ট। সবাই সমর্থন করল উইলিয়াম রুজভেল্টকে।
সবার মত শোনার পর প্রেসিডেন্ট বলল, ‘আইনের গতিকে যদি শর্ত সাপেক্ষ করা হয় তাহলে তার নিজস্ব গতি থাকে না। সুতরাং শর্তের প্রয়োজন নেই।’
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট আমি আলোচনার প্রস্তাব এজন্যে করেছিলাম যে, রাজনৈতিক ফ্রন্টে আমরা যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হই।’ বলল উইলিয়াম রুজভেল্ট।
‘মিঃ উইলিয়াম রুজভেল্ট ওদেরকে সব ব্যাপারে সম্মত করতে গেলে ওদের কিছু ব্যাপারে আমাদেরকে সম্মত হতে হবে। এই ভাবে সমঝোতা করলে আইনের নিজস্ব গতি বাধাগ্রস্থ হয়। রাজনৈতিক স্বার্থে এই সমঝোতা ঠিক নয়। ‘ফ্রি আমেরিকা’ ঠিকই বলছে যে, আমাদের রাজনীতি, আমাদের গনতন্ত্র, অর্থনীতি এর অনেক কিছু স্বার্থবাদী গ্রুপের হাতে পণবন্দী হয়ে পড়েছে। এই পণবন্দী অবস্থা শুধু আমাদের নয়, আমাদের জাতির স্বাধীন গতিকেও বাধাগ্রস্থ করেছে। আমাদের রাজনীতিকে এখন এখান থেকে সরিয়ে আনা দরকার।’
বলে প্রেসিডেন্ট একটু থামল। তাকাল জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকারের দিকে। বলল, ‘আপনারা বোধ হয় আমার সাক্ষাত চেয়েছিলেন তাদের গ্রেফতার করার অনুমতির জন্যে। আমি আদেশ দিচ্ছি, আপনারা আপাতত জেনারেল হ্যামিল্টনকে হত্যার অপরাধে ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং জেনারেল শ্যারনকে গ্রেফতার করতে পারেন। তবে হ্যারিকে কিডন্যাপ ও লস আলামোসের ঘটনা তদন্ত শেষ হওয়ার পর নতুন গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।’
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, ব্যাঙ্কার আইজ্যাক বেন গুরিয়ান ও সাবা বেন গুরিয়ানকে কিডন্যাপের ব্যাপারও আমরা সামনে আনতে পারি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘অবশ্যই। ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’রা যে প্রতিবাদ পত্রিকায় পাঠিয়েছে তাতেও এ প্রসঙ্গ এসেছে। সুতরাং অবশ্যই এরও তদন্ত শেষ করতে হবে এবং অপরাধীদের পাকড়াও করতে হবে। তার সাথে জর্জ জুনিয়রকে কিডন্যাপ করার ব্যাপারটাও আমরা সামনে আনতে পারি। মোট কথা হলো, সংশ্লিষ্ট কোন কিছুই বাদ দেয়া যাবে না।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, শুরুতেই গ্রেফতারে না গিয়েও আমরা আইনকে এগিয়ে নিতে পারি।’ বলল প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা উইলিয়াম রুজভেল্ট।
‘শুরু কোথায়? লস আলামোস নিয়ে যে ঘটনা তার তো এটা মাঝপথ! আর শুরু হলেই বা ক্ষতি কি? খুনি এবং জঘন্য গোয়েন্দা বৃত্তিতে লিপ্ত কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না, মার্কিন বিবেক এতটা অন্ধ, মার্কিন আইন এতটা দুর্বল হয়ে যায়নি।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট আজ সকাল আটটায় সিনেট ও হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ নেতৃবৃন্দের একটা গোপন বৈঠক আছে জেনারেল শ্যারনদের সাথে। প্রেসিডেন্টের আদেশ আমরা গ্রহন করলাম। কিন্তু আদেশটির বাস্তবায়ন হবে বৈঠকটির পর।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
‘তার মানে সিদ্ধান্তকে আপনি ঐ বৈঠকের ফল সাপেক্ষ করতে চান মিঃ জর্জ?’ বলল প্রেসিডেন্ট। তার কন্ঠে বিরক্তির সুর।
‘ঠিক বৈঠকের ফল সাপেক্ষ নয়। তবে আদেশ বাস্তবায়নের পন্থার মধ্যে নতুন কোন চিন্তা আসতে পারে মিঃ প্রেসিডেন্ট।’
প্রেসিডেন্টের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘একটা নতুন চিন্তা আমি যোগ করছি মিঃ জর্জ। ঐ গোপন বৈঠক থেকে ফেরার পথে জেনারেল শ্যারন ও মিঃ ডেভিডকে গ্রেফতার করুন।’
প্রেসিডেন্ট থামল। কিন্তু থেমেই আবার হঠাৎ বলে উঠল, ‘ঠিক আছে মিঃ জর্জ বেলা ১২ টা পর্যন্ত এই আলোচনা আমরা মূলতবী করলাম। ঠিক ১২ টায় আমি আপনাদের এখানে চাই।’
‘ধন্যবাদ মিঃ প্রেসিডেন্ট।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘ধন্যবাদ সকলকে।’ প্রেসিডেন্ট বলল। তারপর উঠে দাঁড়াল।
সকলে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিল।

‘বৈঠক বসেছে ইন্টেলিজেন্স বিষয়ক হাউজ সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান এ্যান্ড্রু জ্যাকবস এর বাসায়।
| | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top