৩২. অক্টোপাশের বিদায়

চ্যাপ্টার

বেলা ১২টার মধ্যেই আহমদ মুসারা নিও নিকারীতে পৌছে গেল।
ওমর বোংগো ও ওয়ে এমবা তাদেরকে নিও নিকারীতে পৌছে দিল।
ওমর বোংগো ও ওয়ে এমবাসহ সেদিন রাতে উদ্ধার করা ২৫ জনকে আহমদ মুসা পরামর্শ দিয়েছে গ্রামে না থেকে নিও নিকারীতে থাকার জন্যে। কারণ আহমদ মুসা আশংকা করেছে এদিন রাতের এই বিপর্যয়ের খবর শত্রুর কানে পৌছবে। সেক্ষেত্রে রক্ষা পাওয়া লোকদের তারা সন্ধান করবে এবং গোটা ঘটনা জানার তারা চেষ্টা করবে। সুতরাং গ্রামে থাকলে তারা বিপদে পড়বে। আহমদ মুসা পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া বা অন্যকোন ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত তারা ওখানেই থাকবে। ওমর বোংগোদের মত বুদ্ধিমান ছেলেদের প্রয়োজন বলে ওদেরকেও আহমদ মুসা নিও নিকারীতে থাকতে বলেছে। এদের যাবতীয় খরচ বহনের দায়িত্ব নিয়েছে হাত্তা নাসুমন। তার জমিদারী এলাকা টটনস নিও নিকারী থেকে ৮০ মাইলের মধ্যে।
খাওয়া দাওয়া সেরে হোটেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে আহমদ মুসা বেরিয়েছিল ট্যুরিষ্ট অফিসে একটা গাড়ি বন্দোবস্তের জন্যে। কিন্তু সেখানে গিয়ে যা শুনল তাতে তার মাথায় রক্ত উঠে এল। ট্যুরিষ্ট ম্যানেজমেন্ট অফিস থেকে তাকে জানানো হলো, সুরিনামের নাগরিক নয় এবং সুরিনামে কোন চাকুরী বা ব্যবসায় কিংবা বৈধভাবে কর্মরত কোন এনজিওর সাথে যুক্ত নয় এমন সকলকে অবিলম্বে সুরিনাম ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী পারামারিবোতে এমন কাউকে ঢুকতেই দেয়া হবে না। এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিত করার লক্ষে পারামারিবো পর্যন্ত রাস্তায় অনেকগুলো চেকপোষ্ট বসানো হয়েছে। ট্যুরিষ্ট অফিস থেকে হোটেলে ফেরার পথে এই বিষয় নিয়েই আকাশ পাতাল ভাবছিল আহমদ মুসা। শেষে ভাবল, ট্যাক্সি ক্যাব বা রেন্ট-এ-কার এর একটা গাড়ি যদি হাতে পাওয়া যেত, তাহলে তার ড্রাইভার সেজে হাত্তা নাসুমনকে আরোহী বানিয়ে পারামারিবো যাওয়া যেত। কিন্তু এমন গাড়ি পাওয়া যাবে কোথায়? হঠাৎ তার খেয়াল হলো ঘণ্টা দেড়েক ধরে এই যে ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে সে ঘুরছে, এর ড্রাইভারকে একটু বাজিয়ে দেখা যায়। কোন সাহায্য সে করতে পারে কিনা। ট্যাক্সি ক্যাবটির ড্রাইভার বুদ্ধিদীপ্ত এক তরুণ যুবক। চেহারা মিশ্র বর্ণের। এ্যাংলো-আফ্রিকান হতে পারে, আবার ইন্দো-আফ্রিকানও। চুল ও মুখের কাঠামো আফ্রিকান, কিন্তু রং ফর্সা এবং চোখ অনেকটা এশিয়ানদের মতো কালো ও টানা।
‘তোমার নাম কি ইয়ংম্যান?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল ড্রাইভারকে।
‘জোয়াও বারনারডো।’ বলল ড্রাইভার।
‘তোমার গাড়িটা তোমার নিজের, না কোম্পানীর?’
‘আমার নিজের।’
‘কত দাম গাড়িটার।’
‘সেকেন্ড হ্যান্ড, বিশ হাজার গিল্ডার দিয়ে কিনেছি।’
বলেই সে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। প্রশ্ন করল, ‘দাম জিজ্ঞেস করছেন কেন স্যার?’
জিজ্ঞাসার জবাব না দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘এই গাড়িটা যদি আমি এখনি কিনতে চাই তাহলে কত দাম নেবে?’
জোয়াও বারনারডো হাসল। বলল, ‘আমার সাথে রসিকতা করছেন।’
আহমদ মুসা গম্ভীর হলো। বলল, ‘রসিকতা নয়। আমি বিপদে পড়েছি। আমাকে আজ সন্ধ্যার মধ্যে পারামারিবো পৌছতে হবে। কিন্তু আমি বিদেশী ট্যুরিষ্ট বলে সেখানে যাওয়া আমার জন্যে নিষিদ্ধ। এ রকম একটা ট্যাক্সি ক্যাব পেলে আমি পারামারিবো যেতে পারি ট্যাক্সি-ক্যাবের ড্রাইভার সেজে।’
গম্ভীর হলো বারনারডো। বলল, ‘বুঝতে পেরেছি স্যার। নতুন গাড়ি নয়, একটা রেজিষ্টার্ড ট্যাক্সি-ক্যাবের ড্রাইভার হওয়া আপনার প্রয়োজন।’
‘ঠিক ধরেছো। এখন বল তোমার কথা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ড্রাইভারের কাগজপত্র তো চেক হতে পারে।’
‘তোমার গাড়ির সাথে তোমার কাগজপত্রও নিয়ে নেব। তোমাকে উপযুক্ত পয়সা দেব, দরকার হলে নতুন কাগজপত্র করে নেবে। অথবা কয়েকদিন পর সব কাগজপত্র তোমাকে ফেরত দিয়ে দেব।’
‘আমার লাইসেন্সে তো আমার ফটো আছে। যদি ধরা পড়ে যান।’
‘এতটা চেক হবে আশা করি না। আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি বারনারডো, তোমার কোন ক্ষতি আমার দ্বারা হবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার পারামারিবো যাওয়া এতটা কেন জরুরী বলুন তো?’ জিজ্ঞেস করল বারনারডো।
‘আগামীকাল সকালের প্লেনে আমার একজন আত্মীয়া আসবেন পারামারিবোতে। আমি তাকে যদি রিসিভ করতে না পারি, সে মহা বিপদে পড়বে। আমি যখন এই এ্যারেঞ্জমেন্টটা করি তখন এখানকার নতুন আইন-কানুন আমার জানা ছিল না। আমি নিউ আমষ্টারডাম হয়ে নিও নিকারীতে এসেছি।’
‘আপনি আপনার আত্মীয়াকে রিসিভ করার পর মানে পারামারিবোতে পৌছার পর তো আপনার গাড়ির কোন প্রয়োজন নেই। তাই তো?’
‘ঠিক তাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে এই সামান্য সময়ের জন্যে আপনি এত টাকা খরচ করবেন কেন? এক কাজ করুন। আপনি গাড়ি নিয়ে যান। গাড়ি ফেরত পেলে আপনার টাকা আমি ফেরত দেব। ইতিমধ্যে যে সময় যাবে, তার উপযুক্ত ভাড়া আপনি দিয়ে দেবেন।’ বলল বারনারডো।
খুশি হলো আহমদ মুসা। বলল, ‘ধন্যবাদ বারনারডো। হোটেলে পৌছে তুমি আমাকে গাড়ির চাবি দিয়ে দেবে, আমি তোমাকে দিয়ে দেব ২০ হাজার গিল্ডার।’
‘ঠিক আছে স্যার। আপনি গাড়ি নিয়ে চলে যান। আমি কাল সকালেই পারামারিবো পৌছব। আপনি ইচ্ছা করলে তখন আমাকে গাড়ি দিয়ে দিতে পারবেন, অথবা পরেও দিতে পারবেন।’
‘ধন্যবাদ বারনারডো। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো।’
‘কোথায় আমি দেখা করবো, সেটা আমাকে বলে দিন।’
‘কোথায় কোন হোটেলে উঠব, কোন হোটেলে জায়গা পাব এখনও জানি না। তুমি কাল সকাল ৯ টায় এয়ারপোর্টের কারপার্কে আমার সাথে দেখা করবে।’
‘ঠিক আছে।’
‘ধন্যবাদ বারনারডো।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
বারনারডোর গাড়ি ছুটে চলল হোটেলের দিকে।

আহমদ মুসা আহমদ হাত্তা নাসুমনকে সরকারের নতুন আইনের কথা বলতেই উদ্বেগে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। বলল, ‘মি. আহমদ মুসা আমার মেয়ের কি হবে। আপনি যদি পারামারিবো পৌছতে না পারেন, তাহলে আমার ফাতিমা এয়ারপোর্টে পৌছেই নির্ঘাত ওদের হাতে পড়ে যাবে। ওয়াং আলীও শেষ হবে। ফাতিমারও সর্বনাশ হবে।’
হতাশা, উদ্বেগে ভেঙে পড়ল হাত্তা নাসুমন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘মি. হাত্তা আপনি অর্ধেক কথা শুনেছেন। পুরোটা শুনুন।’
বলে আহমদ মুসা ট্যাক্সি ক্যাবের মালিক জোয়াও বারনারডো’র সাথে তার চুক্তির কথা সব বলল এবং জানাল যে, ‘টাকা তাকে দিয়ে দিয়েছি, চাবি আমার হাতে, গাড়ি হোটেলের কারপার্কে দাঁড়িয়ে আছে।’
‘আল হামদুলিল্লাহ। মি. আহমদ মুসা কি আর বলব। আমি শুধু বলব, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন।’
একটু থামল হাত্তা নাসুমন। চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘ধরে নিলাম ড্রাইভার হিসেবে আপনার কাগজপত্র পুলিশ দেখবে না, কিন্তু আমার পরিচয় কি হবে?’
‘আপনার শিখের পোশাক থাকবে না, কিন্তু দাড়ি থাকবে, মাথায় আলগা চুলও থাকবে। একান্তই প্রয়োজন পড়লে আপনার সঠিক পরিচয় দেয়া হবে।’
‘কিন্তু এতে বিপদ ঘটতে পারে।’
‘হ্যাঁ তা পারে। ড্রাইভার হিসেবে আমার ভূঁয়া পরিচয়ও ধরা পড়ে যেতে পারে। তাতেও বিপদ ঘটতে পারে। কিন্তু ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই। রাতের মধ্যে আমাদেরকে অবশ্যই পারামারিবো পৌছতে হবে।’
‘কিন্তু রাস্তায় যদি বিপদ ঘটে?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ হাত্তা নাসুমনের।
‘শত বিপদ মাথায় নিয়েই আমাদেরকে পারামারিবো পৌছতে হবে। ফাতিমা নাসুমনকে বিপদে ফেলা যাবে না।’
‘সত্যিই তাই মি. আহমদ মুসা। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।’ অসহায় কণ্ঠস্বর হাত্তা নাসুমনের।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালো। বলল, ‘গোছ-গাছ করে নেয়া যাক। মিনিট পনেরোর মধ্যেই আমরা বেরুব।’

বেলা তখন ৪টা।
আহমদ মুসা ট্যাক্সি ক্যাবের ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। পাশে তার ব্যাগটি।
পেছনের সিটে উঠল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘গাড়ি ছাড়ব স্যার?’ বলল আহমদ মুসা হাত্তা নাসুমনকে লক্ষ করে। মুখে তার মিষ্টি হাসি।
‘মি. আহমদ মুসা আমাকে আর লজ্জা দেবেন না। আসুন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আপনার পরিকল্পনাকে সফল করেন।’ বলল হাত্তা নাসুমন বিব্রত কণ্ঠে।
‘আমিন।’ বলল আহমদ মুসা। গাড়ি ষ্টার্ট নিল।
বেরিয়ে এল হোটেলের কার পার্ক থেকে।
ছুটতে শুরু করল গাড়ি।

পরবর্তী বই
সুরিনামের সংকটে

Top