৩৩. সুরিনামের সংকটে

চ্যাপ্টার

প্রেসিডেন্ট ভবনের পারিবারিক অংশ দক্ষিণ অলিন্দের পারিবারিক ড্রইংরুম।
প্রেসিডেন্ট জুলেস মেনডেল বসে আছেন এক সোফায়। মুখটা তার ঈষৎ নিচু। বিমর্ষ চেহারা।
তার সামনের সোফায় পাশাপাশি বসে আছে রাজনৈতিক দল সুরিনাম পিপলস কংগ্রেস (এসপিসি) এর চেয়ারম্যান রোনাল্ড রঙ্গলাল এবং মাসুস (মায়ের সূর্য সন্তান) সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শিবরাম শিবাজী। তাদের দুজনকেই দেখাচ্ছিল উত্তেজিত।
‘মাসুস’ সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন তিলক লাজপত পাল। গত রাতে টেরেক স্টেটের গেটে অন্যদের সাথে সে নিহত হওয়ায় শিবরাম শিবাজী ‘মাসুস’এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।
কথা বলছিল শিবরাম শিবাজী। বলছিল সে, ‘মাত্র দুরাত দুদিনে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল আমাদের। প্রথম ঘটনা ঘটেছে উত্তর সুরিনামে কোরাজ নদী সংলগ্ন আমাদের ঘাঁটিতে। সেখানে আমাদের ৮ জন লোক নিহত হয়েছে, ঘাঁটি হাত ছাড়া হয়েছে এবং প্রথমবারের মত আমাদের হাত থেকে দু’ডজনের মত বন্দী পলিয়ে গেছে। এরপর গত দুরাত একদিনে আমাদের ৬০ জনের মত লোক নিহত হয়েছে, আমাদের শীর্ষ নেতা তিলকসহ। ওভানডো মুক্ত হয়েছে এবং ওয়াং মুক্ত হয়েছে। ফাতিমা ও আহমদ হাত্তাকে ধরেও আমরা রাখতে পারিনি। ভূমিকম্পের মত এ ঘটনাগুলো কিভাবে ঘটল, কে ঘটাল আমরা বুঝতে পারছি না’।
থামল শিবরাম শিবাজী। তার কন্ঠ ভীষণ উত্তেজিত। চোখ-মূখ তার লাল।
‘আমাদের কাছে এটা চরম বিষ্ময় যে, এ ঘটনাগুলো কে ঘটাল, কিভাবে ঘটল। আমরা আহমদ হাত্তাদের রিপাবলিকান পার্টির সবাইকে জানি। তাদের সাধ্য নেই এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর’। বলল রোনাল্ড রঙ্গলাল। তার কন্ঠে উদ্বেগ।
‘তাহলে আহমদ হাত্তারা কি বাইরে থেকে লোক হায়ার করেছে?’
বলল প্রেসিডেন্ট জুলেস মেনডেল।
‘কিন্তু যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তাতে বেশী লোকের ভূমিকা দেখছিনা। মন্দিরের বন্দীখানা থেকে ওভানডোকে উদ্ধার করেছে একজন লোক। টেরেক স্টেটের গেটে গতরাতে যে ঘটনা ঘটেছে, পুলিশের বক্তব্য অনুসারে তা ঘটিয়েছে একজন লোক। ফাতিমাকে উদ্ধার করতে গিয়েছিল মাত্র দুজন লোক। শুধু আহমদ হাত্তা ও ওয়াংকে উদ্ধারের জন্যে পুলিশের পোশাকে পাঁচজন গিয়েছিল। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশের ধারণা হলো সেখানে সব ঘটনা একজনই ঘটিয়েছে। বাইরে থেকে এমন একজন দুজন লোক এসে এসব ঘটাতে পারে?’ বলল রোনাল্ড রঙ্গলাল।
‘তাহলে কি এসব এ দেশের কোন টপ টেররিস্ট কিংবা সাবেক কোন পুলিশ বা গোয়েন্দা অফিসারের কাজ? তারাতো ‘মাসুস’ ও সুরিনাম পিপলস পার্টির দুর্বলতা সম্পর্কে জানে’। বলল পেসিডেন্ট।
‘আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দাদের আমরা চিনি মি. প্রেসিডেন্ট। তাদের কারো মধ্যেই এই সাহস ও ক্ষিপ্রতা নেই’। বলল রোনাল্ড রঙ্গলাল।
‘তাহলে শত্রুকেই আমরা যখন চিনছি না, তখন আমরা তাদের মোকাবিলা করব কি করে? পারামারিবোতে আমাদের যে ফাইটিং ফোর্স ছিল, যে ফোর্স বছরের পর বছর ধরে গড়ে তুলেছিলাম, সে ফোর্স প্রায় নিঃশেষ। আমি এ বিপর্যয়কে কিছুতেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারছিনা’। বলল শিবরাম শিবাজী।
‘অস্বাভাবিক কি আপনি চিন্তা করছেন?’ বলল রোনাল্ড রঙ্গলাল।
‘আমার মনে হচ্ছে দেশের পরিস্থিতিতে বড় রকমের একটা পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা দেশের মুসলিম রাজনৈতিক শক্তিকে উৎখাত করতে চেয়েছিলাম। এ লক্ষ্যে কয়েক হাজার মুসলিম রাজনীতি সচেতন যুবককে শেষ করেছি। তাদের নেতাকে কিডন্যাপ করে দেশের বাইরে বন্দী করে রেখেছিলাম। আমার মনে হচ্ছে গত দুরাতেই এ পরিবর্তন হয়, তাহলে আমি মনে করি খুব বড় একটা শক্তি আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। যারা আমাদের প্রতি একটা মারাত্মক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে’। বলল শিবরাম শিবাজী।
‘আমি আপনার সাথে একমত মি. শিবরাম। নিশ্চয় ঐ রকম একটা কিছু ঘটেছে’। বলল রোনাল্ড রঙ্গলাল।
‘কিন্তু গত এক মাসে দেশের বিমান বন্দর ও সমুদ্র বন্দর দিয়ে যারা দেশে প্রবেশ করেছে এবং গত এক মাসে হোটেলগুলোয় যারা এসেছে, তাদের পূর্ণ তালিকা আমার কাছে আছে। অপরিচিত ও উল্লেখ করার মত কোন বিদেশী তাদের মধ্যে নেই’। বলল প্রেসিডেন্ট।
‘আসলে তারা ওভাবে জানান দিয়ে আসবে না’। শিবরাম শিবাজী বলল।
‘ঠিক আছে ধরে নেয়া হলো একটা গ্রুপ দেশে প্রবেশ করেছে। এখন কি করণীয়?’ বলল রোনাল্ড রঙ্গলাল।
‘যদি এ রকম কোন গ্রুপ দেশে এসে থাকে রিপাবলিকান পার্টিকে সহযোগিতা করার জন্যে, তাহলে অবশ্যই তারা আহমদ হাত্তাসহ রিপাবলিকান নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রাখবে। সুতরাং আহমদ হাত্তাসহ রিপাবলিকান নেতৃবৃন্দের উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে’। বলল শিবরাম শিবাজী।
‘আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ তাদের উপর নজর রাখছে। ঠিক আছে এটা আরও জোরদার করা যাবে’। প্রেসিডেন্ট বলল।
‘ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট। শুধু পুলিশের রুটিন পাহারা দিয়ে ওদের ধরা যাবে না। আমি মনে করি, দলের সাহসী ও চৌকশ ছেলে-মেয়েদেরকেও পুলিশের পাশাপাশি কাজে লাগাতে হবে’। বলল শিবরাম শিবাজী।
‘আমিও একমত। এখন আপনারা আসুন আজকের বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। আজ নমিনেশন পেপার ফাইলের শেষ দিন। আহমদ হাত্তাকে কিছুতেই নমিনেশন পেপার দাখিল করতে দেয়া যাবে না। এখন কি করা উচিত বলুন’। রোনাল্ড রঙ্গলাল বলল।
‘আপনারা কি চিন্তা করেছেন বলুন। পুলিশের পক্ষে কিংবা সরকারীভাবে সরাসরি কিছু করা সম্ভব হবে না’। বলল প্রেসিডেন্ট।
‘অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের পর এ পর্যন্ত আমরা যে সব পদক্ষেপ নিয়েছি তার লক্ষ্যই হলো আহমদ হাত্তার রাজনীতি বন্ধ করে দেয়া, তাকে নির্বাচনে দাঁড়াতে না দেয়া। আজ যদি আমরা তাকে নমিনেশন পেপার দাখিলে বাধা দিতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের এতদিনকার সব কাজ ব্যর্থ হয়ে যাবে। সুতরাং যে কোন মূল্যে তাকে আজ বাধা দিতে হবে। আমরা এ পর্যন্ত যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি তা হলো নির্বাচন অফিসমূখী সব রাস্তায় আমাদের পাহারা থাকবে। প্রত্যেকটা গাড়ি সার্চ করা হবে।আহমদ হাত্তাকে যে কোন মূল্যে আটকানো হবে’। বলল রোনাল্ড রঙ্গলাল।
রোনাল্ড রঙ্গলাল থামতেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘গত দুদিনের ঘটনা সামনে রাখার পর আপনারা কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন যে আহমদ হাত্তাকে আপনারা আটকাতে পারবেন?’
‘তারা রাস্তায় মারামারি করে হত্যাকান্ড ঘটিয়ে নমিনেশন পেপার জমা দিতে আসবে এবং জমা দিয়ে চলে যাবে আমরা এটা মনে করি না। আমাদের লোক যারা আহমদ হাত্তাদের বাধা দেবে, তাদেরকে যদি ওরা খুন করে, তাহলে সংগে সংগে অন্য চারটি স্থানে পাহারায় বসা লোকরা মোবাইলে খবর পেয়ে যাবে এবং তারা সংগে সংগেই চলে আসবে নির্বাচন অফিসের সামনে। তারা একযোগে আহমদ হাত্তাকে আটক করবে খুনি হিসেবে এবং নমিনেশন পেপার দাখিলের সময় পার হয়ে গেলে তাকে থানায় সোপর্দ করবে অথবা অন্য কোন ব্যবস্থা করবে’। বলল রোনাল্ড রঙ্গলাল।
‘অন্য কি ব্যবস্থা করবেন?’ জিজ্ঞেস করল প্রেসিডেন্ট।
‘যেমন ধরুন আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করার পর পুলিশ ডেকে তাদের হাতে তুলে দিলাম। থানায় নিয়ে যাবার পথে আহমদ হাত্তা পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলীতে মারা যাবে, ইত্যাদি’। বলল রোনাল্ড রঙ্গলাল।
‘না, না এরকম কিছু করা যাবে না। এতে আমাদের সরকারের বদনাম হবে। তার চেয়ে ভালো হবে যদি এ রকম হয় যে, আপনাদের গ্রুপগুলো নির্বাচন অফিসের সামনে থেকে তাকে ধরে নিয়ে গেল, কিন্তু কে ধরে নিয়ে গেল তা কেউ স্বীকার করল না। গায়েব হয়ে গেল আহমদ হাত্তা। এতে সরকারের উপর দায়টা কম বর্তাবে’। বলল প্রেসিডেন্ট।
‘প্রেসিডেন্ট, আপনি মোক্ষম ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন তাতে সাপও নিশ্চিত মারা পড়বে কিন্তু লাঠির কিছুই হবে না’। বলল শিবরাম শিবাজী উচ্ছসিত কন্ঠে।
রোনাল্ড রঙ্গলালও প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমারও ধন্যবাদ গ্রহণ করুন মি. প্রেসিডেন্ট। আপনি যে রকম বলেছেন, সে রকম ঘটা মানুষের কাছেও যুক্তিযুক্ত হবে। মানুষ মনে করবে, নির্বাচন নিয়ে রাস্তায় হানাহানিরই ফল এটা এবং আহমদ হাত্তাকে কেউ ধরে নিয়ে যেতে পারে, আবার পালিয়ে আত্মগোপনও করতে পারে খুনের দায় থেকে বাঁচার জন্যে’।
হেসে উঠল প্রেসিডেন্ট ও শিবরাম শিবাজী দুজনেই। বলল প্রেসিডেন্ট, ‘আর এ বিষয়টা মানুষকে বিশ্বাস করাবার মত প্রপাগান্ডা মেশিন আমাদের হাতে রয়েছে’।
কথাটা শেষ করে প্রেসিডেন্ট জুলেস মেনডেল গম্ভীর হয়ে উঠল। ভাবনার একটা চিহ্ন তার চোখে-মুখে ফুটে উঠল। বলল, ‘আহমদ হাত্তাকে না হয় এভাবে সরানো গেলো, কিন্তু ঐ অদৃশ্য শক্তির কি হবে যা মাত্র দুরাত এক দিনে আমাদের ষাট-সত্তর জন লোককে খুন করে আমাদের সব পরিকল্পনাকে লন্ড-ভন্ড করে দিল? আহমদ হাত্তার যদি এ রকম কিছু ঘটে তাহলে ঐ শক্তি নিশ্চয় প্রতিশোধ নিতে পাগল হয়ে উঠবে’।
রোনাল্ড রঙ্গলাল বলে উঠল, ‘প্রতিশোধ নিতে ছুটে আসতে পারে, আবার আহমদ হাত্তা নেই দেখে পালাতেও পারে। ভাড়াকারী বা হায়ারকারী না থাকলে, ভাড়ায় আসা লোকেরাও থাকে না’।
‘আপনার যুক্তি ঠিক মি. রোনাল্ড। কিছুই ঘটবে না, ওরা পালিয়ে যাবে। কিন্তু এ ভালো চিন্তার পাশে খারাপ দিকটাও আমাদের বিবেচনা করা দরকার’। বলল প্রেসিডেন্ট গম্ভীর কন্ঠে।
‘আপনি ঠিক বলেছেন মি. প্রেসিডেন্ট। খারাপ দিকটা নিয়েও আমাদের ভাবা দরকার। ঐ অদৃশ্য শক্তির মোকাবিলায় আমরা ব্যর্থ হয়েছি। নতুন সংঘাত বাধলে এ ব্যর্থতা আরও প্রকট হতে পারে। আমাদের স্বীকার করতেই হবে, আমাদের ট্রেইন্ড ও কার্যকরী জনশক্তি গত দুদিনে প্রায় শেষ হয়ে গেছে। আজ আহমদ হাত্তাকে ঠেকাবার জন্যে বিভিন্ন রাস্তায় যাদের আমরা পাহারায় বসাচ্ছি, তাদের অধিকাংশই সাদা পোশাকের পুলিশ। সিভিল ড্রেসে তারা আমাদের সহায়তা করছে। কিন্তু এভাবে পুলিশ দিয়ে আর কতদিন ওদের মোকাবিলা করা যাবে? এই অবস্থায় আমাদের নতুন কিছু চিন্তা করা দরকার’। শিবরাম শিবাজী বলল গম্ভীর কন্ঠে।
‘নতুন চিন্তাটা কি হতে পারে বলুন?’ বলল রোনাল্ড রঙ্গলাল।
‘বলছি। তার আগে আরেকটা কথা বলি, পারলে গোটা টেরেক স্টেট, না পারলে অন্তত টেরেক দুর্গ কব্জা করা ও তার মাটির তলা থেকে এক জাহাজ পরিমাণ লুকিয়ে রাখা সোনা উদ্ধার করা আমাদের বড় টার্গেট। এ জন্যেও আমাদের শক্তি প্রয়োজন। সব মিলিয়ে আমি মনে করি, কোন মাফিয়া গ্রুপের সাহায্য নেয়া আমাদের প্রয়োজন। তারা অত্যন্ত কূশলী ও পেশাদার যোদ্ধা। তারাই পারবে এখানকার অদৃশ্য শক্তির মোকাবিলা করে আমাদের কার্যোদ্ধার করে দিতে।
আমার মনে হয় হাত্তারাও কোন মাফিয়া গ্রুপকেই হায়ার করেছে। না হলে এত অল্প সময়ে এতবড় বিপর্যয় আমাদের ঘটতে পারে না’। শিবরাম শিবাজী বলল।
শিবরাম শিবাজী থামলেও সংগে সংগে কথা বলল না প্রেসিডেন্ট কিংবা রোনাল্ড রঙ্গলাল। তারা গম্ভীর হয়ে উঠেছে।ভাবছে তারা। মুখ খুলল প্রথমে প্রেসিডেন্ট। বলল, ‘তারা এ জন্যে বিরাট বিনিময় চাইবে। তাছাড়া রয়েছে অতগুলো সোনা উদ্ধারের ব্যাপার’।
‘আমার মনে হয় সোনার একটা ভাগ দিতে চাইলে আর কিছুই তারা চাইবে না’। শিবরাম শিবাজী বলল।
‘সোনার ভাগ কি তাদের দেয়া ঠিক হবে? আর সোনা যদি অবশেষে না পাওয়া যায়?’ বলল রোনাল্ড রঙ্গলাল।
হাসল শিবরাম শিবাজী। বলল, ‘সোনা না থাকার প্রশ্নই উঠে না। তিলক লাজপত পাল লক্ষ ডলার খরচ করে সান্টো ডোমিঙ্গোর তদানিন্তন গভর্নর ওভানডোর উত্তরাধিকারী পাওলো রোসীর কাছ থেকে যে পুরনো ডুকমেন্টগুলো কিনেছিলো, তার একটিতে ওভানডো নিজের হাতে লিখেছে, ‘১৫০২ সালের ১লা জুন কলম্বাসের পরামর্শ উপেক্ষা করে দুটি সোনা বোঝাই জাহাজসহ ২৭টি জাহাজ স্পেনের উদ্দেশ্যে সমুদ্রে পাঠালাম। সবাই জানে এর মধ্যে ২০টি জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ে ক্যারিবিয়ান সাগরে ডুবে গিয়েছিল। আর ছয়টি ফিরে এসেছিল সান্টো ডেমিোঙ্গোর উপকূলে। আর একটি সোনা বোঝাই জাহাজ পৌছেঁছিল স্পেনে। কিন্তু আসল ঘটনা হলো জাহাজ ডুবেছিল ১৯টি। একটি জাহাজ ঝড়ের ভিন্ন একটা ঘূর্নাবর্তে পড়ে দক্ষিণে ভেসে গিয়েছিল। এই জাহাজটি ছিল সোনা বোঝাই দ্বিতীয় জাহাজ। জাহাজের সৎ ও সত্যবাদী ক্যাপ্টেন সর্বশেষ বার্তায় আমাকে জানিয়েছিল, তার ক্ষতিগ্রস্ত ও নিমজ্জমান জাহাজটি সুরিনাম উপকূলে ল্যান্ড করেছে। তারপর সব যোগাযোগ তার সাথে আমার বন্ধ হয়ে যায়। এ জাহাজের তথ্যটি সবার থেকে আমি গোপন করি দুই কারণে। প্রথমতঃ স্পেন সরকারের অধিকতর শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে, দ্বিতীয়তঃ সবাইকে বিশ্বাস করাতে পারব যে জাহাজটি ডুবে গেছে। আমার ইচ্ছা ছিল সুরিনাম থেকে সোনাগুলো নিজে উদ্ধার করার। কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে সে সুযোগ দেয়নি। পরে এক সময় ভাবতে শুরু করি, যাক জাহাজটির ক্যাপ্টেন অত্যন্ত ভালো মানুষ সোনাগুলো ক্যাপ্টেন আব্দুর রহমান আল তারিকের কাজে লাগুক। সে আটলান্টিকের সমুদ্র অভিযান গুলোতে অমূল্য অবদান রেখেছে। সেই তূলনায় সে বঞ্চিত হয়েছে। নির্লোভ ও ভাল মানুষ বলে তাকে ঠকানো হয়েছে। সোনাগুলো বিধাতাই তাকে পুরুস্কার হিসেবে দিয়েছে’। ডকুমেন্টের এই কথাগুলোর পর কি কোন সন্দেহ থাকে যে, টেরেক দুর্গের মাটির তলায় সোনা নেই?’
‘আমি সন্দেহ করিনি। একটা আশংকা প্রকাশ করেছি মাত্র’। বলল রোনাল্ড রঙ্গলাল।
‘আশংকার কোন কারণ নেই। তিলক লাজপত পাল টেরেক দূর্গ সম্পর্কে অনেক অনুসন্ধান করেছেন এবং তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে, সোনা বোঝাই জাহাজ পারামারিবোতেই নোংগর করেছিল এবং সেই জাহাজের লোকরাই এই টেরেক দূর্গের নির্মাতা। তাছাড়া তিলক লাজপত পাল হাজার হাজার ডলার খরচ করে দক্ষিণ আমেরিকার এই অঞ্চলের ভূ-সম্পদ ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপগ্রহ মনিটরিং রিপোর্ট যোগাড় করেছিলেন, তাতেও পারামারিবো এলাকায় সলিড গোল্ডের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে’। শিবরাম শিবাজী বলল।
প্রেসিডেন্ট ও রোনাল্ড রঙ্গলালের চোখগুলো লোভে চকচক করে উঠল। বলল রোনাল্ড রঙ্গলাল, ‘উপগ্রহ মনিটরিং রিপোর্ট ও পাওলো রোসীর কাছ থেকে কেনা ওভানডোর ডকুমেন্টগুলো কোথায়?’
‘এগুলো ছিল তিলকের পার্সোনাল গোপন ডকুমেন্ট। কোথায় রেখেছেন বলা মুষ্কিল। আপনারা সবাই উদ্যোগ নিয়ে তার পরিবারকে বলে খোঁজাখুঁজি করলে নিশ্চয় পাওয়া যাবে’। বলল শিবরাম শিবাজী।
‘ঠিক আছে ওটা দেখা হবে। এখন আসুন আমরা ঠিক করি, কোন মাফিয়া গ্রুপের আমরা সাহায্য নিতে পারি’। বলল রোনাল্ড রঙ্গপাল।
‘এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে আপনার সহকারী সাগর আগরওয়াল। মধ্য ও ল্যাটিন আমেরিকায় তার ব্যবসা চালাতে গিয়ে অনেক মাফিয়ার সংস্পর্শে তাকে আসতে হয়েছে। মধ্য আমেরিকা ও আমাদের ল্যাটিন আমেরিকার মাফিয়ারাই এখন পৃথিবীকে ডমিনেট করছে’। বলল শিবরাম শিবাজী।
খুশি হয়ে রোনাল্ড রঙ্গলাল বলল, ‘তাহলে তো কাজটা অনেক সহজেই হয়ে গেল’।
এ কথার পর রোনাল্ড রঙ্গলাল প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওদের তো অর্থ দিলেই চলে, ওদের সাথে সোনা ভাগাভাগির দরকার আছে?’
‘সোনা ও অর্থ একই একই কথা। সোনার কথা যখন ওরা জানতেই পারবে, উদ্ধারও করবে তারা সোনা, তখন সোনার একটা অংশ তাদের দেয়াই সুবিধাজনক হবে। কারণ সোনা উদ্ধারকে তখন ওরা তাদের প্রাপ্তির সাথে সম্পর্ক যুক্ত হিসেবে দেখবে। ভাল কাজ পাওয়া যাবে তাদের কাছ থেকে’। বলল প্রেসিডেন্ট।
‘তাহলে তাই হবে। মি. প্রেসিডেন্ট আমরা এখন উঠি’।
বলে উঠে দাঁড়াল রোনাল্ড রংলাল। উঠতে উঠতে বলল, ‘মি. প্রেসিডেন্ট আপনিও একটু আইজিকে বলবেন নির্বাচন অফিসে পুলিশ যেন নিষ্ক্রিয় থাকে। যা করার আমাদের লোকরাই করবে। তারা যেন ঠিক সময়ে একটু সরে থাকে’।
প্রেসিডেন্টও উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলল, ‘ঠিক আছে বলব আমি তাকে’।
বলার পরেই প্রেসিডেন্টের মুখমন্ডলে ভাবনার ছায়া প্রকাশ পেল। হঠাৎ মাথা নিচু করে একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘মি. রোনাল্ড, পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে, হাঙ্গামার সময় একটু সরেও থাকতে পারে, কিন্তু নির্বাচন অফিসের ভেতর থেকে বাড়তি কোন সুযোগ আপনারা পাবেন না। দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরা সেখানে থাকবে। ইচ্ছা থাকলেও কোন অবৈধ সহযোগিতা তারা দিতে পারবে না’।
‘ইয়েস মি. প্রেসিডেন্ট, এটা আমরা জানি। পুলিশের ঐটুকু সহযোগিতা হলেই আমাদের চলবে’। বলল রোনাল্ড রঙ্গলাল।
বলেই হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশ্যাক করে তারা বিদায় নিল’।

সেন্ট্রাল রোড ধরে এগুচ্ছে আহমদ মুসাদের গাড়ি। দুটি গাড়ি এক লাইনে সামনে এগুচ্ছে।
আগের গাড়িটি পাজেরো শ্রেণীর আমেরিকান জীপ। আহমদ মুসা ড্রাইভ করছে। পাশের সিটে বার্নারডো। পেছনের সিটের মাঝখানে আহমদ হাত্তা। তার এক পাশে তার দলের নির্বাচন পরিচালক, অন্য পাশে আহমদ হাত্তার সেক্রেটারী।
পেছনের গাড়িটা একটা মিনি মাইক্রো। তাতে পাঁচজন লোক।
আহমদ মুসার জীপটির ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডে রিপাবলিকান পার্টির পতাকা।
গাড়িতে আহমদ হাত্তা এভাবে পতাকা তুলতে চায়নি। কিন্তু আহমদ মুসার ইচ্ছাতেই গাড়িতে পতাকা লাগাতে হয়েছে। এর স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে আহমদ মুসা বলেছে, ‘আপনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং রিপাবলিকান পার্টির প্রধান। আপনি গাড়িতে পার্টির পতাকা তুলে সবাইকে জানিয়ে নির্বাচন অফিসে যাচ্ছেন নমিনেশন পেপার দাখিল করতে। এরপর যদি আপনাকে বাধা দেয়ার মত কিছু ঘটে সেটা হবে পরিকল্পিত সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে গোটা দুনিয়া’।
আহমদ মুসার এ যুক্তি হাসি মুখে মেনে নিয়েছিল আহমদ হাত্তা।
ঠিক ১২টা দশ মিনিটে গাড়ি সেন্ট্রাল সার্কেল পার হয়ে সেন্ট্রাল রোড ওয়ান-এ প্রবেশ করল।
সেন্ট্রাল সার্কেল নগরীর সবচেয়ে অভিজাত ও জনবহুল বাজার এলাকা। সার্কেলের মাঝখানে পার্কিং-এর বিশাল জায়গা।
সেন্ট্রাল সার্কেল থেকে সেন্ট্রাল রোড দু’ শাখায় বিভক্ত হয়ে পশ্চিমে এগিয়ে নির্বাচন অফিসের সামনে সুরিনাম এভিনিউতে গিয়ে পড়েছে। সেন্ট্রাল রোড ওয়ান হলো যাবার এবং সেন্ট্রাল রোড টু হলো ফেরার।
সেন্ট্রাল রোড ওয়ানে প্রবেশ করেই একটু সামনে দুটি মাইক্রোকে রাস্তার দু পাশে বেআইনিভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। এই অসংগতি দেখে রাস্তার দুপাশে মনোযোগ দিল আহমদ মুসা। দেখতে পেল, রাস্তার দুপাশেই ফোল্ডিং চেয়ার পেতে বসে আছে বারো চৌদ্দজন লোক। প্রায় একই বয়সের। দেখেই মনে হচ্ছে রাস্তা পাহারা দিচ্ছে ওরা।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
ওদেরও দৃষ্টিতে পড়ে গেছে আহমদ মুসাদের গাড়ি। ওদের সবার দৃষ্টি আহমদ মুসাদের গাড়ির দিকে।
ওদের মধ্যে থেকে একটা চিৎকার ভেসে এল, ‘রিপাবলিকান পার্টির পতাকা গাড়িতে। শালা আহমদ হাত্তা এ গাড়িতেই যাচ্ছে নির্বাচন অফিসে। উঠে দাঁড়াও সকলে, আটকাও গাড়িকে’।
ওদের মধ্যে ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেল। ওদের সবার হাতে উঠে এসেছে স্টেনগান।
কয়েকজন স্টেনগান উঁচিয়ে আহমদ মুসাদের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। কয়েকজন ছুটে আসছে গাড়ির দিকে।
মুহূর্তেই ঘটে গেল এ ঘটনাগুলো।
আহমদ মুসার কাছে বিষয়টা তখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। ওরা তাদেরই আপেক্ষায় বসে ছিল। যে কোন মূল্যে গাড়ি আটকাবে।
আহমদ মুসা রিভলবার তুলে নিল হাতে। বলে উঠল একটু উচ্চ কন্ঠে, ‘সবাই সিটের উপর শুয়ে পড়ুন। বার্নারডো তুমি বাম দিকের মাইক্রোর টায়ার ফুটো করে দাও’।
বলেই আহমদ মুসা গুলী ছুঁড়লো ডানদিকের মাইক্রোর পেছনের চাকার উদ্দেশ্যে।
প্রায় একই সাথে দুটি টায়ার ফাটার শব্দ উঠল।
গুলী করেই আহমদ মুসা সামনের রাস্তার উপর চোখ বুলিয়ে মাথা নিচু করে গাড়ি চালিয়ে দিল তীব্র গতিতে। ওদের স্টেনগান থেকে গুলী বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। প্রখম সেই গুলীর ঝাঁক আসতে লাগল সামনের দিক থেকে। পরক্ষণে পাশ থেকেও।
কিন্তু পাশ থেকে যখন গুলী বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তখন আহমদ মুসাদের গাড়ি পাশের অস্ত্রধারীদের প্রায় পাশ কাটিয়ে চলে এসেছে সামনে। মাত্র কয়েকটা গুলী দুপাশ থেকে গাড়ির পাশটাকে আঘাত করল।
সামনের গুলী গাড়ির সামনের উইন্ড শিল্ডকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। ভাঙা কাঁচের বৃষ্টি এসে পড়ছে আহমদ মুসা ও বার্নারডোর গায়ে।
কিন্তু যে পাঁচ ছয়জন অস্ত্রধারী গাড়ি আটকাবার জন্যে গাড়ির সামনে অবস্থান নিয়েছিল ও গুলী বৃষ্টি করছিল প্রাণপনে, তারা সকলেই আহমদ মুসার গাড়ির চাকায় পিশে গেছে।
পাঁচ সাত সেকেন্ড পরে আহমদ মুসা মাথা তুলল। দেখল, সামনের রাস্তা পরিষ্কার। রিয়ার ভিউতে তাকিয়ে দেখল, কতগুলো লাশ পড়ে আছে রাস্তায়, আর অন্যেরা ছুটাছুটি করছে।
পাশ থেকে বার্নারডো বলে উঠল, ‘স্যার ওরা আমাদের পিছু নেবার জন্যে মাইক্রোতে উঠছে। এতটাই বেদিশা হয়ে গেছে যে, গাড়ি দুটোর চাকা যে ফেটে গেছে, সে কথা কারো মনে নেই। কিংবা খেয়ালও করেনি। মোবারকবাদ স্যার, গাড়ি দুটোর চাকা নষ্ট করার আপনার সিদ্ধান্তকে’।
‘আল্লাহ এভাবেই ষড়যন্ত্রকারীদের সাজানো স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দেন’।
বলে আহমদ মুসা একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘আর পাঁচ মিনিটে কি আমরা পৌঁছব নির্বাচন অফিসে?’
‘হ্যাঁ আমরা পৌঁছতে পারব’। বলল বার্নারডো।
আহমদ মুসা পেছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলল, ‘মি. হাত্তা, আপনি আপনার লোকদের নির্দেশ দিন, নির্বাচন অফিসমূখী সব রাস্তা যেন তারা বন্ধ করে দেয়। কোন রাস্তা দিয়ে কোন গাড়ি যাতে নির্বাচন অফিসে পৌঁছতে না পারে। আমার মনে হচ্ছে, নির্বাচন অফিসমূখী সব রাস্তায় ওরা এভাবে পাহারা বসিয়েছে। মোবাইলে নিশ্চয় তারা জানতে পারবে যে, তাদের বাধা ভেঙে আমরা নির্বাচন অফিসে পৌঁছতে যাচ্ছি। জানতে পারার পর তারা সকলেই নির্বাচন অফিসের দিকে ছুটবে। এরা যাতে নির্বাচন অফিসে পৌঁছতে না পারে’।
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা আপনাকে। আমাদের বিষ্ময়ের ঘোর এখনো কাটেনি। এক সময় মনে হচ্ছিল চারদিকের ছুটে আসা বুলেট আমাদের ভর্তা করে ফেলবে। কিন্তু পর মুহূর্তেই সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমাদের নির্বাচন পরিচালক ও আমার সেক্রেটারী তো এখনও কাঁপছে’।
বলে আহমদ হাত্তা মোবাইল তুলে নিল হাতে। একে একে পাঁচটি টেলিফোন করল। কথা বলল ও তাদের নির্দেশ জানিয়ে দিল। টেলিফোন শেষ করে আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, আমরা যা চেয়েছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি লোকের সমাগম হয়েছে। ওরা বলছে, নির্বাচন অফিস সংলগ্ন পাঁচটি রাস্তা এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেছে। পাঁয়ে হাঁটা লোক ছাড়া কেউ এদিক ওদিক যেতে পারছে না। আমাদের সেন্ট্রাল রোডও বন্ধ। এখন আমাদের গাড়ি যাওয়ার প্যাসেজ ওরা তৈরী করছে’।
‘পুলিশ নেই? পুলিশ কিছু করছে না রোড ব্লক দূর করার জন্যে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না পুলিশ কিছু করছেনা। ওরা জানাল, পুলিশ একেবারে নিষ্ক্রিয়’। আহমদ হাত্তা বলল।
সত্যি গাড়িটা আর কিছু দূর এগুতেই রাস্তায় লোকের ভীড় দেখা যেতে লাগল। যতই গাড়ি সামনে এগুচ্ছে ভীড় ততই বাড়ছে। এক সময় রুদ্ধ হয়ে গেল গাড়ির গতি।
যখন মানুষ জানতে পারল গাড়িটা আহমদ হাত্তা নাসুমনের, তখন শ্লোগান উঠতে লাগল চারদিক থেকে, ‘আহমদ হাত্তা নাসুমন জিন্দাবাদ, রিপাবলিকান পার্টি জিন্দাবাদ’।
জনতা ও দলের কর্মীরা সকলে মিলেই গাড়ির জন্যে প্যাসেজ সৃষ্টি করতে লাগল। সেই প্যাসেজ ধরে গাড়ি এগুলো।
গাড়ি যখন নির্বাচন অফিসের সামনে পৌঁছল, তখন চারদিকে জনসমূদ্র। সকলে মুহূর্তে জেনেও গেল তাদের প্রিয় নেতা আহমদ হাত্তা নাসুমন নির্বাচন অফিসে পৌঁছে গেছে। চারদিক থেকে গগন বিদারী ঐ একই শ্লোগান উঠল, ‘আহমদ হাত্তা নাসুমন জিন্দাবাদ, রিপাবলিকান পার্টি জিন্দাবাদ’।
উৎসাহী সমর্থকদের ভীড় ঠেলে আহমদ হাত্তার গাড়ি নির্বাচন অফিসের গাড়ি বারান্দায় পৌঁছল। একদল দেশী-বিদেশী সাংবাদিক এসে ঘিরে ধরল আহমদ হাত্তাকে।
গাড়ির নিশ্চিহ্ন উইন্ড শিল্ড ও বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া গাড়ির সামনের দিকটা সকল সাংবাদিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আহমদ হাত্তাকে প্রথমেই প্রশ্ন করল একদল বিদেশী সাংবাদিক, ‘গাড়ির এ অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে গাড়ি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এল!
আহমদ হাত্তা বলল, ‘যুদ্ধক্ষেত্র নয়, আক্রমণ ক্ষেত্র বলতে পারেন। সেখানে যুদ্ধ হয়নি। ওরা আক্রমণ করেছে, আমরা আক্রমণের শিকার হয়েছি। গাড়ি চালিয়ে কোন মতে আমরা বেঁচে আসতে পেরেছি।
‘কারা, কেন আক্রমণ করেছিল?’ প্রশ্ন করল আরেকজন সাংবাদিক।
‘রোনাল্ড রঙ্গলালের নেতৃত্বাধীন সুরিনাম পিপলস কংগ্রেসের লোকরা আক্রমণ করেছিল। ওদের লক্ষ্য ছিল আমাকে নির্বাচন অফিসে আসতে না দেয়া। সুযোগ পেলে হত্যা করা। তারা ভরাডুবির ভয়ে আমাকে এবং রিপাবলিকান পার্টির জনপ্রিয় নেতা কর্মীদের নির্বাচন করতে দিতে চায় না। এই উদ্দেশ্যে তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমাদের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। তাদের হত্যা ও গুমের শিকার হয়েছে অসংখ্য মানুষ’।
আহমদ হাত্তা থামতেই অন্য একজন সাংবাদিক বলে উঠল, ‘এ ধরনের কোন খবর তো পত্র-পত্রিকায় আসেনি। বিষয়টা আপনি বিস্তারিত বলুন’।
‘মাফ করুন নমিনেশন পেপার জমা দিতে আমি এসেছি। আমি এখন এতটা সময় দিতে পারবো না। দু এক দিনের মধ্যেই সাংবাদিক সম্মেলন করে সব ঘটনা আমি আমার দেশের জনগন ও দুনিয়াবাসীকে জানাব’।
বলে আহমদ হাত্তা, তার সেক্রেটারী ও দলের নির্বাচন পরিচালক সাংবাদিকদের ভীড় ঠেলে নির্বাচন অফিসে উঠে গেল।
আহমদ মুসা ও বার্নারডো গাড়িতে বসে রইল।
আহমদ মুসার পরনে শিখ ড্রাইভারের পোশাক।
নমিনেশন পেপার দাখিল শেষে প্রায় এক ঘন্টা পর বেরিয়ে এল আহমদ হাত্তা। ডেকে নিল আহমদ মুসা ও বার্নারডোকে ওয়েটিং রুমে। বলল আহমদ মুসাকে, ‘আপনি যেভাবে বলেছিলেন, সেভাবে আমি প্রেসিডেন্টকে টেলিফোনে সব ঘটনা জানিয়েছি। উনি আইজিকে বলে দুগাড়ি পুলিশ পাঠাচ্ছেন। ওরা আমাদের পৌঁছে দেবে। প্রেসিডেন্ট আরও বলেছে, আমার বাড়িতে যাতে উপযুক্ত পুলিশ পাহারা থাকে, এ জন্যে তিনি আইজিকে বলে দেবেন’।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তাদের মনে যাই থাক, এই বাহ্যিক পাহারাতেও অনেক কাজ হবে’।
‘ঠিক আছে, পুলিশ আসা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করি’। বলল আহমদ হাত্তা।
‘ঠিক আছে। তবে পুলিশের দুটি গাড়িই সামনে থাকবে, একটি সামনে একটি পেছনে এভাবে নয়’। আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু এভাবে নয় কেন? এভাবেই নিরাপদ বেশি’। বলল আহমদ হাত্তা।
কেন নয় একথা বুঝিয়ে বলা মুশকিল। তবে পুলিশ সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে তাদের আগে পিছে রেখে এগুবার পিছুবার পথ বন্ধ করা ঠিক নয়’। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ হাত্তা কিছু বলল না।
স্থির, স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আহমদ হাত্তা আহমদ মুসার দিকে। আকষ্মিকভাবে সে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘আল্লাহ আপনাকে এত দূরদর্শী করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ’।
এই সময় একটি টেলিফোন এল বার্নারডোর মোবাইলে। টেলিফোন ধরল সে। নিচু স্বরে কথা বলল। কথা বলতে গিয়ে তার চেহারায় উদ্বেগ ফুটে উঠল।
বার্নারডো টেলিফোন শেষ করতেই আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল, ‘কার টেলিফোন বার্নারডো?’
‘সহকারী পুলিশ কমিশনারের’। বলল বার্নারডো।
‘কোন খারাপ খবর?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘সহকারী পুলিশ কমিশনার সাহেব বললেন, দেশের গোপন হত্যা-সন্ত্রাস পরিস্থিতির যে বিবরণ সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষণা করবেন বলেছেন, তা ভেতরের পরিস্থিতিকে অগ্নিগর্ভ করে তুলেছে। যে কোন সময় যে কোন ঘটনা ঘটতে পারে। ওরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। খুব উদ্বিগ্ন মনে হলো সহকারী পুলিশ কমিশনারকেও’। বলল বার্নারডো।
‘আর কিছু বলেছে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘বলেছেন পুলিশের উপর নির্ভর করে বসে থাকা যাবে না’। বলল বার্নারডো।
আহমদ হাত্তা এক ধাপ এগিয়ে এসে অনুচ্চকন্ঠে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, সহকারী পুলিশ কমিশনার আপনার কথাই কনফারম করলেন। কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানে ওরা সব পুলিশকে পাল্টে ফেলেছে?’
‘সব পুলিশকে পাল্টাবার দরকার নেই। সব পুলিশকে ওরা সব কাজে ব্যবহার করে না’। বলল আহমদ মুসা।
এ সময় আহমদ হাত্তার সেক্রেটারী ওয়েটিং রুমে প্রবেশ করল। বলল আহমদ হাত্তাকে, ‘স্যার, পুলিশের গাড়ি দুটি এসেছে।
আহমদ হাত্তা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা বলল, ‘চলুন’।
আহমদ হাত্তা চলতে শুরু করে আবার ফিরে দাঁড়াল সেক্রেটারীর দিকে। বলল, ‘তুমি পুলিশ অফিসারক বলে দাও পুলিশের গাড়ি দুটি আমাদের গাড়ির সামনে থাকবে’।
‘ঠিক আছে স্যার, এখনি বলে দিচ্ছি’। বলে সেক্রেটারী তখনই বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসারাও বেরিয়ে এল ওয়েটিং রুম থেকে।
নামল গাড়ি বারান্দায়।
আহমদ মুসা গাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই তাদের দ্বিতীয় গাড়ির একজন আরোহী আহমদ মুসার কাছে এসে দাঁড়াল।
তাকে দেখেই আহমদ মুসা একটু সচকিত হল। বলল, ‘সর্বক্ষণ নজর রেখেছিলে এদিকে?’
‘জি স্যার। অন্য কোন মানুষ গাড়ির কাছে আসেনি। মাত্র একজন ফটো-সাংবাদিক গাড়ির ভেতর ও বাইরের ফটো নিয়েছে’।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। বলল, ‘ভেতরের ফটো কিভাবে নিল?’
‘স্যার, গাড়ির সামনের টপের উপর উঠে উইন্ড শিল্ডের ভাঙা জায়গা দিয়ে ভিতরে মুখ বাড়িয়ে ফটো তুলেছে’। বলল লোকটি।
‘কতগুলো স্ন্যাপ নিয়েছে?’ আহমদ মুসা প্রশ্ন করল।
‘চার পাঁচটা’।
‘তুমি স্ন্যাপ নেয়া দেখেছ, না ‘ক্লিক শুনে বুঝেছ? এ গাড়ির বন্ধ কাচেঁর মধ্যে দিয়ে পেছন থেকে তোমার কিছু শুনতে পাওয়ার কথা নয়’। বলল আহমদ মুসা।
‘ফ্লাসের আলো দেখেছি’। লোকটি বলল।
‘ফ্লাসগুলো পরপর হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘প্রথম ফ্লাসের কিছুপর অবশিষ্ট ফ্লাসগুলো হয়েছে’। লোকটি বলল।
‘ঠিক আছে। যাও। ধন্যবাদ’। বলল আহমদ মুসা।
লোকটির সাথে কথা শেষ করে ফিরে তাকিয়ে দেখল, বাইরের শ্লোগনারত হাজার হাজার লোকের প্রতি হাত নাড়া শেষ করে আহমদ হাত্তা উঠে যাচ্ছে গাড়িতে। পাশে দলের নির্বাচন পারিচালক লানসানা কনটে গাড়িতে উঠার জন্য অপেক্ষা করছে। আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘মি হাত্তা, গাড়িতে উঠবেন না’।
থমকে দাঁড়াল আহমদ হাত্তা। ফিরে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ভাবান্তর লক্ষ্য করল আহমদ মুসার চোখে মুখে।
আহমদ হাত্তা দ্রুত এসে দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে। বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, আপনি কিছু ভাবছেন মনে হচ্ছে?’
এ সময় আহমদ হাত্তার সেক্রেটারী এসে দাঁড়াল তাদের সামনে। বলল, ‘স্যার, ডিএসপি সাহেবকে বলেছি, তাদের দুটি গাড়ি আমাদের গাড়ির সামনে থাকবে। ডিএসপি সাহেব জানালেন, সবদিক বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ যাবার পথ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক করে দিয়েছেন। পুলিশের দুগাড়িই থাকবে পেছনে যাতে সামনের দিকে চোখ রেখে পেছনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি। পেছনে পুলিশ থাকলে সামনে আক্রমনের সুযোগ পাবেনা। কিন্তু পুলিশ সামনে থাকলে পেছনটা একেবারেই অরক্ষিত হয়ে পড়বে’। ডিএসপি সাহেবের একথার জবাবে আমি বলে দিয়েছি, পুলিশের দুগাড়ি সামনে থাকবে আমার প্রতি স্যারের এটাই নির্দেশ’। আমার এ কথার পর তিনি বলেছেন, স্যার যেটা বলেছেন সেটাই হবে’।
‘যাবার পথ কোনটা হবে বলেছেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমরা আসার পথে যেহেতু একবার এ্যাকসিডেন্ট ঘটেছে, সেজন্যে ঐ পথে ওরা যাচ্ছে না। উত্তরের রিং রোড ধরে ওসেয়ান হাইওয়ে হয়ে স্যারের বাড়িতে পৌঁছা যাবে’। বলল আহমদ হাত্তার সেক্রেটারী।
‘মন্দ নয়। রাস্তা ফ্রি, গাড়ি-ঘোড়া খুবই কম। তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে’। আহমদ হাত্তা বলল।
আহমদ হাত্তার কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘ঠিক আছে’।
বলেই আহমদ মুসা আহমদ হাত্তার সেক্রেটারীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি ডিএসপি সাহেবকে বল, আমাদের এ গাড়িটা এক্সপ্লোসিভ ডিটেক্টর দিয়ে চেক করতে হবে’।
শুনেই আহমদ হাত্তা, লানসানা ও আহমদ হাত্তার সেক্রেটারীর চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। বলল আহমদ হাত্তা, ‘আপনি এজন্যেই আমাকে গাড়িতে উঠতে নিষেধ করেছেন?’ তার কন্ঠে উদ্বেগ ঝরে পড়ল।
‘হ্যাঁ, আমি সন্দেহ করছি মি. হাত্তা’। বলল আহমদ মুসা।
‘কিছু ঘটেছে ইতোমধ্যে?’ আহমদ হাত্তা জিজ্ঞেস করল।
‘আমি ওয়েটিং রুমে যাবার সময় আপনার একজন লোককে আমাদের এ গাড়ির দিকে চোখ রাখতে বলে গিয়েছিলাম। তার কাছ থেকে শুনলাম একজন ফটো সাংবাদিক এ গাড়ির ফটো নিতে সামনের টপে উঠে উইন্ড শিল্ডের ভাঙা অংশ দিয়ে মুখ ভেতরে নিয়ে ভেতরের ছবি তুলেছে। কোন ফটো সাংবাদিক এভাবে ভেতরের ছবি তোলার কথা নয়। আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে গাড়ির মধ্যে কিছু একটা ঘটানো হয়েছে’। বলল আহমদ মুসা।
মুখ শুকিয়ে গেল আহমদ হাত্তার।
‘স্যার, আমি ডিএসপি সাহেবকে বলি’। বলে দৌড় দিল আহমদ হাত্তার সে্ক্রেটারী।
মিনিট খানেকের মধ্যেই ডিএসপি ছুটে এল। বলল আহমদ হাত্তাকে, ‘স্যার সন্দেহ যখন হয়েছে, তখন এ গাড়িতে চড়া যাবে না। কিন্তু আমাদের কাছে তো বিস্ফোরক ডিটেক্টর নেই’।
‘তাহলে?’ বলে উঠল অহমদ হাত্তা।
‘স্যার, ভিন্ন একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে’। ডিএসপি বলল।
‘ডিএসপি সাহেব, সে ব্যবস্থা করা যাবে। তার আগে আপনি আমাদের গাড়িটার সামনে একটা দড়ি বেঁধে টেনে বাইরে নেবার চেষ্টা করুন। আমার মনে হয় বোমা যদি গাড়ির ভেতরে পাতা হয়ে থাকে, তাহলে সে বোমা সাউন্ড অথবা স্পীড সেনসিটিভ হবে। স্পীড সেনসিটিভ হলে গাড়ি গতি পাওয়ার সাথে সাথেই বোমার বিষ্ফোরণ ঘটে যাবে’। বলল আহমদ মুসা।
ডিএসপি বিষ্মিত দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল আহমদ হাত্তাকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার আপনার এই লোক অনেক কিছু জানেন দেখছি এবং খুব বুদ্ধিমান। আমার মাথায় এ চিন্তা আসতোই না। ঠিক আছে স্যার, এ পরীক্ষা আমি করছি’।
বলে ডিএসপি ছুটে গেল তার গাড়ির কাছে। কয়েকজন পুলিশ ও দড়ি নিয়ে ফিরে এল। ইতোমধ্যে আহমদ মুসার নির্দেশে আহমদ মুসাদের দ্বিতীয় গাড়ি বাইরে পুলিশের গাড়ির পেছনে নেয়া হলো।
ইতোমধ্যে বাইরে অপেক্ষমান লোকদের মধ্যে খবর রটে গেছে যে, আহমদ হাত্তার গাড়িতে বোমা রাখা আছে। এই খবরে মানুষ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। নানারকম শ্লোগান উঠতে শুরু করেছে বাইরে।
ডিএসপিসহ আহমদ মুসারা গাড়ি বারান্দা থেকে অফিসের ভেতরে চলে গেল।
আহমদ মুসাদের গাড়ির সামনে লম্বা দড়ি বেঁধে চারজন পুলিশ তার শেষ প্রান্ত ধরে টানা শুরু করল। প্রথমে আস্তে, তারপর গাড়ির গতি বাড়তে লাগল। গাড়ি রানিং কন্ডিশনে উঠতেই ঘটল গাড়িতে প্রচন্ড বিষ্ফোরণ।
তখন গাড়িবারান্দা পার হয়ে গাড়িটি শূন্য চত্বরে গিয়ে পৌছেঁছিল। প্রচন্ড বিষ্ফোরণে গাড়ি টুকরো টুকরো হয়ে বিশ পচিঁশ গজ উর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হলো। বিষ্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল গোটা বিল্ডিং, কেঁপে উঠল চারদিকের মাটি ভূমিকম্পের মত। ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। ধোঁয়া প্রবেশ করেছে নির্বাচন অফিসেও।
ডিএসপিসহ আহমদ মুসারা ওয়েটিং রুমের মেঝেয় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। বোমা বিষ্ফোরণের প্রচন্ড শব্দ ও কম্পনে সবাই তাদের অলক্ষ্যেই সে মেঝেয় বসে পড়েছিল, শুধু দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা।
বোমা বিষ্ফোরণের প্রচন্ড শব্দের রেশ তখনও মিলিয়ে যায়নি, আতংকের ঘোর তখনও কাটেনি।
আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘ডিএসপি সাহেব আসুন দেখি পুলিশ চারজনের কি হলো?’
বলে আহমদ মুসা বাইরে ছুটলো। বিষ্ফোরণের জায়গাটাকে পাশ কাটিয়ে আহমদ মুসা সামনে এগিয়ে দেখল, চারজন পুলিশই মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। প্রথম দৃষ্টিতে বুঝল, সবাই কিছু কিছু আহত হয়েছে, তবে মনে হয় মারাত্মক কিছু নয়। কিন্তু আতংক অবস্থা ওদের এখনো কাটেনি।
আহমদ মুসা ওদেরকে একে একে গেটের কাছে নিয়ে রাখল। শেষ জনকে যখন নিয়ে গেল, তখন ডিএসপি সাহেব এসে পৌঁছল, পুলিশরাও গাড়ি থেকে নেমে এল।
আহত পুলিশের রক্তে আহমদ মুসার জামাও রক্তাক্ত হয়ে গেছে। ডিএসপি সাহেব আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ধন্যবাদ ইয়াংম্যান। আপনি শুধু বুদ্ধিমান নন, সাহসীও’।
নির্বাচন অফিস এলাকায় যে পুলিশ অফিসার দায়িত্ব পালন করছে, সেও এ সময় এসে পৌঁছল।
‘আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? আমি আসার পর আপনাকে দেখিনি’। পুলিশ অফিসারটিকে লক্ষ্য করে বলল ডিএসপি।
‘স্যার, বাইরে বিরাট উচ্ছৃঙ্খল জনতা, আমি ওদিকটা দেখছিলাম’। বলল পুলিশ অফিসারটি অপরাধীর কন্ঠে।
‘ঠিক আছে, এখন এদিকের সবকিছু বুঝে নিন’। বলে ডিএসপি সাহেব আহমদ হাত্তার গাড়িতে একজন ফটো সাংবাদিকের বেশধারী লোক কর্তৃক বোমা রাখার ঘটনা থেকে শুরু করে যা ঘটেছে তার একটা ব্রীফ দিল পুলিশ অফিসারকে।
আহমদ হাত্তা নেমে আসছিল গাড়ি বারান্দায়, তখন তাকে দেখতে পেল ডিএসপি সাহেব। সংগে সংগে চিৎকার করে বলে উঠল ‘স্যার, আপনি বারান্দা থেকে নামবেন না। গাড়ি ঠিক করে আপনাকে ডেকে আনব’।
‘অফিসার গাড়ি পাওয়া গেছে। আমাদের একজন লোকের গাড়ি পার্কিং-এ আছে, নিয়ে আসছে’। বলল আহমদ হাত্তা অফিসের বারান্দায় যেতে যেতে।
ডিএসপি সাহেব তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘স্যার যে গাড়ির কথা বললেন, সেটা নেয়া যায় কিনা আপনি দেখুন’।
‘ঠিক আছে অফিসার’। আহমদ মুসা বলল।
পুলিশকে এ্যাম্বুলেন্সে উঠানো হচ্ছে। মারাত্মক আহত নয় তারা। কিন্তু প্রত্যেকেরই শরীরে দু চারটা করে স্প্রিন্টার ঢুকেছে।
নির্বাচন অফিসের পার্কিং থেকে একটা গাড়ি এল গাড়ি বারান্দায়।
আহমদ মুসা এল গাড়ির কাছে। গাড়িটি রিপাবলিকান পার্টির একজন কর্মকর্তার। জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা যে গাড়িতে সব সময় মানুষ ছিল। বাইরের কেউ গাড়ি স্পর্শ করেনি।
এ সময় বাইরে প্রবল হৈ চৈ শুরু হলো। বোমা বিষ্ফোরণের পর মানুষ আতংকগ্রস্ত হয়ে এদিক ওদিক সরে গিয়েছিল। তারা ফিরে এসেছে আবার। নতুন উদ্যোগে সংগঠিত হয়ে উঠেছে হাজার হাজার লোক। প্রবল শ্লোগান উঠছে সুরিনাম কংগ্রেস পার্টির বিরুদ্ধে, কংগ্রেস পার্টির নেতা রোনাল্ড রঙ্গলালের বিরুদ্ধে। বোমা পেতে আহমদ হাত্তাকে হত্যা প্রচেষ্টার বিচার ও উল্লেখিত নেতাদের তারা ফাঁসি দাবী করছে।
বাইরে কিছু উচ্ছৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হলে ডিএসপি সাহেব আহমদ হাত্তাকে অনুরোধ করে বললেন জনতাকে শান্ত করার জন্যে কিছু করতে। আহমদ হাত্তা পার্টির নির্বাচন পরিচালক ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লানসানা কনটেকে নির্দেশ দিল বাইরে গিয়ে জনতাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলতে যে, আমরা এখনি চলে যাচ্ছি, তারাও সবাই যেন চলে যায়।
লানসানা কনটে বাইরে বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসাদের গাড়ি প্রস্তুত। পুলিশের গাড়িও প্রস্তুত।
আহমদ হাত্তা বারান্দা থেকে গাড়ি বারান্দায় নামতে যাচ্ছিল।
নির্বাচন কমিশনার বেরিয়ে এল তার অফিস থেকে। আহমদ হাত্তার সামনে এসে বলল, ‘জনাব, আমি ও আমার অফিসের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করছি নির্বাচন অফিসে এসব ঘটনার জন্যে। ঈশ্বর আপনাকে বাঁচিয়েছেন, এজন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমি এই নিরাপত্তাহীনতার কথা প্রেসিডেন্টকে বলব’।
আহমদ হাত্তা নির্বাচন কমিশনারকে ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে এল গাড়ি বারান্দায়।
লানসানা কনটেও এসে পৌঁছল।
আহমদ হাত্তারা গাড়িতে উঠে বসল। পুলিশরাও।
প্রবল শ্লোগানরত জনতার ভীড় ঠেলে যাত্রা শুরু হলো।
প্রথমে পুলিশের দুটি গাড়ি।
আহমদ মুসাদের দুটি গাড়ি তার পেছনে।

Top