৩৪. সুরিনামে মাফিয়া

চ্যাপ্টার

বিছানায় উঠে বসল লিন্ডা লোরেন। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে।
সে তো মরে গেছেই। ক্রিস্টিনাকেও সে বাঁচাতে পারবে না। তাই ডকুমেন্ট সে কিছুতেই জোয়াওদের হাতে তুলে দেবে না। এই ডকুমেন্ট তার বংশীয় আমানত। তাছাড়া এখানে এসে সে জানতে পেরেছে, এই ডকুমেন্টে যে ডায়াগ্রাম রয়েছে, সেটা অনুসরণ করে যাওয়া যাবে টেরেক স্টেটের এক স্বর্ণ ভান্ডারে। যে স্বর্ণ তার পূর্ব পুরুষ কলম্বাসের ক্যাপ্টেন সঞ্চিত করে রেখেছেন, সেটা উদ্ধার করা যাবে। এই পবিত্র সম্পদ সে কিছুতেই সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেবে না। এই সম্পদ ওদেরকে দিলেও ওরা ক্রিস্টিনাকে মানুষের মত বাঁচতে দেবে না, যেমন সে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। পিতৃপুরুষের এই সম্পদ রক্ষার জন্যে তার জীবন দিতে হলেও দেবে। তার আগে চেষ্টা করবে আহমদ মুসার মত ভালো মানুষকে উদ্ধার করতে। আহমদ মুসার মত বিশ্ব ব্যক্তিত্ব নিজের জীবন বিপন্ন করে একজন অখ্যাত বালিকাকে বাঁচিয়েছেন। তাঁকে বাঁচাতে যদি তাদের দুই মা-বেটির জীবন কোরবানি হয়, তাতে পৃথিবীই উপকৃত হবে।
হাত ঘড়ির দিকে তাকাল লিন্ডা। রাত ১২ টা বাজে।
উঠে দাঁড়াল লিন্ডা।
ঘরের গুমোট বাতাসে হাঁপিয়ে উঠেছে সে।
ছাদের উন্মুক্ত বাতাসের জন্যে মন আকুলি-বিকুলি করে উঠল।
লিন্ডার কক্ষটি চারতলায়। সিঁড়ির পাশেই। এখানে আসার পর থেকে সুযোগ পেলেই সময়টা সে ছাদে গিয়ে কাটিয়েছে।
লিন্ডা উঠে গেল ছাদে।
ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল লিন্ডা। মুক্ত পরিবেশ, মুক্ত আকাশ তার ভালো লাগে। এ খোলা প্রকৃতি তার বিশালত্ব ও উদারতা দিয়ে তার বুক ভরা বেদনায় শান্তির পরশ বুলায়।
ছাদের বেঞ্চিটার উপর বসল লিন্ডা।
তার চোখটা ঘুরে এল একবার চারদিক।
সমুদ্রে ভাসমান একটা টিলার উপর এই বাড়িটা। চারদিকেই পানি। অবশ্য পশ্চিম দিকে অল্প দূরেই উপকূল। সুরিনাম নদীর মোহনাতেই বলতে গেলে এই টিলাটা। সুরিনাম নদীর পলি দিয়েই গড়ে উঠেছে এটা। নদী মুখে পারামারিবো বন্দরের আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে, কোলাহলও শোনা যাচ্ছে কিছু কিছু।
লিন্ডা শুনেছে, টিলার এই বাড়িটা তৈরি করেছিল সুরিনামের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী দ্বীপটা কিনে নিয়ে। কিন্তু চোরাচালান আর সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে সে টিকতে পারেনি। বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। এখন এটা মাফিয়া চক্রের রাজধানী। কিনিক কোবরা কয়েকদিনের জন্যে এটা নিয়েছে।
চারদিকের পরিবেশসহ বাড়িটা লিন্ডার ভাল লেগেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাড়িটা একটা বন্দীখানা। এখান থেকে আহমদ মুসাকে কেমন করে সে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবে?
লিন্ডা লোরেন আবার তার ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত সোয়া ১২টা।
উঠল বেঞ্চি থেকে। নেমে এল তার ঘরে আবার।
দ্রুত পড়ে নিল ক্যাবারে ড্যান্সারের মত সেক্সী পোশাক। তাকে নির্লজ্জ মাতাল ক্যাবারে ড্যান্সারের ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে, তা না হলে আহমদ মুসার কাছে পৌঁছানো যাবে না।
কাপড় পড়ে তার সেতারের পকেট থেকে বের করল ছোট্ট একটা রিভলবার এবং তা গুজে রাখল ঘাড়ের সাথে লেগে থাকা আস্তিনের একটা পকেটে।
প্রস্তুত হয়ে পার্টিশন ডোর দিয়ে প্রবেশ করল পাশের কক্ষে। সে ঘরে একটা বেডে অঘোরে ঘুমুচ্ছে ক্রিস্টিনা।
বেডের উপর ঝুঁকে পড়ে একটা চুমু খেল ক্রিস্টিনাকে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এল লিন্ডা।
দাঁড়াল করিডোরে।
কি করতে হবে তা আরেক বার তাকে ঠিক করে নিতে হবে।
আহমদ মুসাকে রাখা হয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের একটা রুমে।
দোতলার সিঁড়ির পাশের একটি কক্ষে রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ডে নামার সিঁড়ি। জোয়াও লেগার্ট স্বয়ং থাকে ঐ কক্ষটিতে।
দোতলা থেকে একতলা পর্যন্ত রয়েছে টাইট নিরাপত্তার ব্যবস্থা। দোতলার সিঁড়ির মুখে এবং জোয়াও লেগার্টের কক্ষের দরজায় দুজন করে চারজনের সার্বক্ষণিক পাহারা সে দেখেছে। এক তলায় নিরাপত্তার কি ব্যবস্থা রয়েছে তা সে জানে না। তবে জোয়াও লেগার্টের কাছে সে শুনেছে, এখান থেকে যেই পালাতে চেষ্টা করুক মারা পড়বে। কেন মারা পড়বে তা সে জানতে পারেনি।
এসব চিন্তা করতে করতে তার মাথাটা ভারী হয়ে উঠল।
কিন্তু পরক্ষণেই সে মাথা সোজা করে দাঁড়াল। সব চিন্তা সে ছুড়ে ফেলল মাথা থেকে। সে ভাবল, এসব তার ভাবনা নয়। তার লক্ষ্য আহমদ মুসাকে মুক্ত করা। তারপর যা ঘটার ঘটবে।
চারতলা থেকে নামার সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল লিন্ডা লোরেন।
অভিনয় শুরু করল। টলতে টলতে নামছে সে। মুখে তার অসংলগ্ন কথা।
দেখলেই মনে হবে মদ খেয়ে মাতাল হয়েছে লিন্ডা লোরেন।
দোতলার ল্যান্ডিং-এ নামল সে টলতে টলতে।
নেমেই সে দেখতে পেল এক তলায় নামার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে দুজন প্রহরী।
মাথাটা একদিকে ঝুঁকিয়ে টলায়মান অবস্থায় থমকে দাঁড়াল লিন্ডা লোরেন। তারপর বলল ওদেরকে লক্ষ্য করে মাতালের মত জড়িত ভাষায়, ‘এই তোরা কি করছিস এখানে! জোয়াও কোথায়? কোথায় আমার ডারলিং?’
বলে ওদের দিকে এগুলো।
প্রহরী দুজন দু’ধাপ পিছিয়ে সিঁড়ির একেবারে মুখে গিয়ে দাঁড়াল। তাদের চোখে বিস্ময় ও সম্ভ্রমের দৃষ্টি। তারা জানে, লিন্ডা তাদের বস এর খাস লোক। বস তাকে মানিয়ে চলে।
তার কোন অসুবিধা বস হতে দেয় না।
একজন প্রহরী সংকুচিতভাবে সম্ভ্রম জড়িত কণ্ঠে বলল, ‘ম্যাডাম, বস বাইরে গেছেন।’
‘তোরা সব মিথ্যাবাদী। এইতো জোয়াও আমাকে আসতে বলল।’ বলে লিন্ডা প্রহরীদের থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জোয়াও-এর ঘরের দিকে চলল।
জোয়াও-এর ঘরের সামনেও ছিল দুজন প্রহরী।
লিন্ডা টলতে টলতে বলল, ‘তোরা এখানে কি করছিস? তোদের ষড়যন্ত্র সব বলে দেব জোয়াওকে। যা দুর হ।’
বলে সাতার কাটার মত কষ্ট করে এগুতে লাগল দরজার দিকে।
দরজার দুজন প্রহরী স্তম্ভিত ও ভীত। একজন কিছুটা এগিয়ে লিন্ডাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘ম্যাডাম, দরজা বন্ধ। বস দরজা লক করে বাইরে গেছেন। আপনি……।’
লিন্ডা চলা অব্যাহত রেখে মুখ ঘুরিয়ে জড়িত কণ্ঠে বলল, ‘চুপ, একটা কথাও নয়। জোয়াও তোদের আস্ত রাখবে না।’
দরজায় পৌঁছে গেছে লিন্ডা।
ধাক্কা দিল দরজায়। বন্ধ দরজা।
মাতাল কণ্ঠে লিন্ডা বলে উঠল, ‘জোয়াও ডার্লিং, দরজা খোল। আমি তোমার কাছে এসেছি।’
কথা শেষ করে পরক্ষণেই বলে উঠল, ‘কি জোয়াও দরজা খুলবে না। ঘুমিয়ে গেছ? আমার সাথে রসিকতা?’
বলে লিন্ডা পকেট থেকে তার দ্বিতীয় রিভলবার বের করে নিয়ে মাতাল –কম্পিত হাতে রিভলবারের নল অতিকষ্টে দরজার কিহোলে লাগিয়ে গুলী করল।
দরজার লক গুড়ো হয়ে গেল।
দরজা ফাঁক করল লিন্ডা। বলে উঠল, ‘তুমি কোথায়? আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।’
বলে দু’ধাপ ভেতরে এগিয়ে পেছনে না ঘুরেই দরজা বন্ধ করে দিল এবং বলে উঠল। ‘কোথায় তুমি, আমি ঘুমাব, আমি ঘু..মা….ব।’
কথা শেষে লিন্ডা সোজা হয়ে দাঁড়াল। ঘুরে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে দরজার উপর ও নিচের দুটি ছিটকিনিই লাগিয়ে দিল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে রিভলবারটা পকেটে রেখে এগুল ঘরের একমাত্র আলমারিটার দিকে। সে জোয়াও-এর কাছ থেকেই শুনেছে এই ঘর থেকেই আন্ডারগ্রাউন্ডে নামবার সিঁড়ি আছে। ঘরের মেঝেতে এমন কোন সিঁড়ি সে দেখেনি। নিশ্চয় তাহলে সিঁড়িটা আলমারির ভিতর থেকে নিচে নেমে গেছে।
আলামারির সামনে গিয়ে দাঁড়াল লিন্ডা। হাত ঘুরিয়ে আলমারি খোলার চেষ্টা করল।
আলমারি বন্ধ।
আবার রিভলবার বের করল।
আলমারির কিহোলে রিভলবারের নল লাগিয়ে গুলী করল।
খুলে গেল আলমারি।
আলমারি খুলে ভেতরে তাকিয়ে একেবারে চুপসে গেল লিন্ডা। আলমারি থেকে সিঁড়ি জাতীয় কিছু নেই। ফাঁকা আলমারি। আলামারিতে কোন তাকও নেই। দেখতে ঠিক ওয়ানম্যান মিনি লিফট রুমের মত। আলমারির তলায় শুধু একটা মিনি মেশিনগান ‘উজি’ ও তার সাথে কয়েকটা ম্যাগাজিন পড়ে আছে মাত্র।
উদ্বিগ্ন হলো লিন্ডা। তার হাতে সময় বেশি নেই। সাধারণত সে শেষ রাতে ফিরলেও কোন সময় যে সে এসে পড়বে তার ঠিক নেই।
লিন্ডা আলমারির পাল্লা লাগিয়ে সরে এল। নজর বুলাল গোটা মেঝের উপর। খাটের তলাসহ সবটা মেঝে সে পরীক্ষা করল। মিনি মেশিনগান ‘উজি’র বাঁট দিয়ে টোকা দিয়ে দেখল দেয়ালও। না সন্দেহ করার মত কিছুই সে পেল না।
দাঁড়াল সে মেঝের মাঝখানে।
ঘড়ির দিকে তাকাল লিন্ডা। রাত পৌনে একটা বাজে।
আতংক, ক্লান্তি এসে তাকে ঘিরে ধরল। ঘাম ঝরে পড়তে লাগল কপাল থেকে।
আকুলি-বিকুলি করে উঠল তার মন। তাহলে কি সে ব্যর্থ হয়ে যাবে? এ ব্যর্থতার অর্থ আহমদ মুসা, সে এবং ক্রিস্টিনা সবারই জীবন যাবে। আর সফল হলে অন্তত আহমদ মুসার মত একজন ভালো লোক বেঁচে যাবে।
মনটাকে আবার শক্ত করল লিন্ডা।
সিঁড়ি খোঁজার জন্যে আবার মরিয়া হয়ে উঠল সে।
আলমারির পাশের দেয়াল পরীক্ষা করতে গিয়ে হঠাত্ তার নজরে পড়ল, আলমারিটা দেয়ালের ভেতর সেঁটে যাওয়া। এমন কেন? পরক্ষণেই তার মনে হলো, আলমারির পিছনটা সিঁড়ি মুখের দরজা হতে পারে।
ভাবনাটা মাথায় আসতেই ছুটল লিন্ডা আলমারির দিকে। পাল্লা খুলে ফেলল আলমারির। ডান হাত বাড়িয়ে চাপ দিল আলমারির পেছনটায়। না, নড়ার কথা নেই, বেশ শক্ত। মনে মনে কথাগুলো আওড়াল লিন্ডা। আলমারির পেছনটায় চাপ দিতে গিয়ে লিন্ডা একটা জিনিস খেয়াল করল, আলমারির পেছনের পাল্লাটার তিন দিকে্ ওয়েল্ডিং করে আলমারির সাথে আটকে দেয়া নেই। তার উপর সে দেখল পেছন পাল্লার ডানদিকের উপর-নিচ লম্বা-লম্বি প্রান্তটা কব্জা দিয়ে আলমারির সাথে আটকানো। অর্থাত্ এটা সিড়িঁর মুখের দরজা নি:সন্দেহে বুঝল লিন্ডা।
কিন্তু দরজাটা খুলবে কিভাবে?
ছিটকিনি, হাতল অথবা বৈদ্যুতিক বোতামের সন্ধানে প্রতিটি ইঞ্চি স্থানে নজর বুলাল লিন্ডা। কিন্তু কিছুই পেলনা। হাত দিয়ে আবার ধাক্কা-ধাক্কি করল। কিন্তু অনড় দরজা।
আবার হতাশা এসে ঘিরে ধরল লিন্ডাকে। দরজা খুলতে না পারলে তো সব চেষ্টাই তার বৃথা যাবে। তার ও ক্রিস্টিনার জীবন যাবে, কিন্তু এ জীবন দান কোন কাজে আসবে না।
অস্থির হয়ে পড়ল লিন্ডা।
এ সময় ঘরের দরজার বাইরে থেকে জোয়াও-এর গলা শোনা গেল। লিন্ডাকে ডাকছে সে।
কয়েকটা ডাকের পর লিন্ডার সাড়া না পেয়ে দরজায় করাঘাত করতে লাগল।
জোয়াও-এর কণ্ঠ শুনেই লিন্ডার গোটা শরীর উদ্বেগ-আতংকে অসাড় হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সাজানো দুনিয়া তার কাছে উলট-পালট হয়ে গেল। জোয়াও-এর কণ্ঠকে তার আজরাঈলের কণ্ঠ বলে মনে হচ্ছে।
দরজার ধাক্কা বেড়ে গেল।
এবার লাথি পড়ছে দরজায়।
লিন্ডার বুঝতে বাকি রইলনা এখনি দরজা ওরা ভেঙে ফেলবে। কি করবে লিন্ডা এখন?
লিন্ডা আতংকের সাথে দেখল দরজার নিচের ছিটকিনি ভেঙে খসে পড়েছে। উপরেরটাও এখনি ভেঙে পড়বে। লিন্ডা তখনও দাঁড়িয়ে আলমারির ভেতর। সে আর কোন দিশা না পেয়ে আলমারির দরজা লাগিয়ে দিল। দেখল, আলমারির দরজার ভেতর দিকে উপরে ও নিচে দুটি ছিটকিনি আছে।
লিন্ডার মনে হল স্বয়ং ঈশ্বর যেন ছিটকিনি তার জন্যেই এইমাত্র তৈরী করে দিলেন।
লিন্ডা ত্বরিত হাত চালিয়ে আলমারির দরজার দুটি ছিটকিনিই লাগিয়ে দিল।
ছিটকিনি বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে গেল অভাবনীয় ঘটনাটা। আলমারির পেছনের স্টিলের পাল্লাটা খুলে গেল।
লিন্ডা পিছনের ক্লিক শব্দে পেছন ফিরে দেখল। স্তম্ভিত হয়ে গেল সে। তার সামনে আলোকজ্জ্বল সিঁড়ি।
তার বিস্ময় পরক্ষণেই আনন্দে রুপান্তরিত হলো।
পেছনে ঘরের ভেতর ভীষণ শব্দে কি যেন ভেঙে পড়ল। নিশ্চয় ঘরের দরজা ভেঙে পড়েছে, ভাবল লিন্ডা। আতংকিত হয়ে উঠল সে। এক হাতে ‘উজি’ কারবাইন, অন্য হাতে রিভলবার নিয়ে দৌড় দিল সিঁড়ি পথে।
সিঁড়ি গিয়ে শেষ হয়েছে লাউঞ্জ ধরনের একটা হলঘরে। প্রায় চারদিক ঘিরেই ঘর।
চারদিকে তাকিয়ে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে বসল লিন্ডা, কোথায় বন্দী আহমদ মুসা? সময় তো বেশি নেই। এখনি জোয়াও আলমারির দরজা ভেঙে ফেলবে। তারপর যা ঘটবে, তা কল্পনাও করতে পারে না সে। সবাই তারা বেঘোরে মারা পড়বে। বাঁচতে হলে আহমদ মুসাকে বাঁচাতে হবে, জোয়াও আসার আগে আহমদ মুসাকে মুক্ত করতে হবে।
কিন্তু কিভাবে তাকে মুক্ত করব? সব ঘর খোঁজা তার পক্ষে সম্ভব?
প্রচন্ড শব্দ এল উপর থেকে।
ওরা আলমারির দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে।
বিমূঢ় হয়ে পড়ল লিন্ডা। সে ব্যাকুল কণ্ঠে চিত্কার করতে লাগল, ‘মি আহমদ মুসা আপনি কোথায়?’
এ সময় সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়ানো লিন্ডার ঠিক নাক বরাবর সামনে লাউঞ্জের ওপারের একটি কক্ষের দরজা থেকে শব্দ এল। লিন্ডা ছুটল সে দরজার দিকে নিশ্চয় আহমদ মুসাই তার ডাকে সাড়া দিয়েছে।
দাঁড়াল দরজার সামনে।
দরজাটি মজবুত কাঠের। তাতে ইস্পাতের শীট বসানো।
লিন্ডা দরজার কিহোলে রিভলবারের নল লাগিয়ে গুলী করল। একবার নয়, দুবার। আতংকিত লিন্ডার বুদ্ধি-জ্ঞান হারিয়ে যাবার দশা।
আলমারিতে ধাক্কানো বন্ধ হয়ে গেছে। সিঁড়ির মাথার দিক থেকে শব্দ আসছে। ঢুকে পড়েছে জোয়াওরা।
লিন্ডার গুলীর তোড়েই দরজার লক ভেঙে দরজা খুলে গেছে। লিন্ডার চোখে পড়ল দরজার বাঁ দিকের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আহমদ মুসা তার হাতে পায়ে লোহার কড়া পরানো।
লিন্ডা দ্রুত কিছু বলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসাকে। কিন্তু মুখ খুললেও তা থেকে শব্দ বেরুল না। পেছন থেকে গর্জে উঠেছে জোয়াও-এর কণ্ঠ, ‘লিন্ডা আর এক ইঞ্চিও এগিয়ো না। হাত থেকে অস্ত্র-ফেলে দাও। হাত উপরে তোল।’
লিন্ডার বাম হাতে ‘উজি’ এবং ডান হাতে ছিল রিভলবার।
লিন্ডা জোয়াও-এর নির্দেশের সাথে সাথেই দুহাত থেকে অস্ত্র ছেড়ে দিল। কিন্তু ‘উজি’ মিনি মেশিনগানটাকে সে আর একটু বাঁ দিকে ছুঁড়ে দিল। যাতে অস্ত্রটা দরজার একটু আড়াল হয় এবং সেটা আহমদ মুসা পায়।
অস্ত্র ফেলে দিয়ে দুহাত উপরে তুলেছে লিন্ডা।
পেছন থেকে জোয়াও-এর কণ্ঠ আবার দ্রুত ধ্বনিত হলো, ‘ডোমান তাড়াতাড়ি যাও অস্ত্রগুলো কুড়িয়ে নাও।’
ডোমান আসা শুরু করল।
লিন্ডা দুহাত উপরে রেখেই ঘুরে দাঁড়াল। তার ভেতরে তখন ঝড় বইছে। সবই তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন শেষ চেষ্টা করেই সে মরবে।
লিন্ডার মাথার উপরে তোলা দু হাত কান বরাবর নেমে এসেছে। তার হাত থেকে ঘাড়ের আস্তিনে গুঁজে রাখা রিভলবারের বাটের দূরত্ব তিন ইঞ্চির বেশি হবে না।
ওদিকে আহমদ মুসা গুটি গুটি এগিয়ে এসে বসে পড়েছে মেঝেয়। হ্যান্ডকাফে বাধা দু হাত এগিয়ে নিচ্ছে সে ‘উজি’ কারবাইনটার দিকে। সে বুঝেছে লিন্ডা তার জন্যেই অস্ত্রটাকে তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে। মনে মনে লিন্ডার বুদ্ধির প্রশংসা করল আহমদ মুসা এবং ঠিক করল যা করবার ডোমান লোকটা আসার আগেই করতে হবে।
লিন্ডা ঘুরতেই জোয়াও বলে উঠল, ‘লিন্ডা পেছন ফিরেই থাকো, মুখটা দেখাতে লজ্জা…।’ কথা শেষ করতে পারল না জোয়াও। লিন্ডার ডান হাতে উঠে এসেছে আস্তিনে গুজে রাখা রিভলবার এবং চোখের পলকে তা থেকে ছুটে যাওয়া গুলী গিয়ে বিদ্ধ করল জোয়াও-এর ডান কাঁধের প্রান্তের ডান বাহুর সন্ধিস্থলকে।
আহমদ মুসার দুহাতে উঠে এসেছিল ‘উজি’টা।
লিন্ডার গুলীর প্রায় সাথে সাথেই আহমদ মুসার উজিটাও গর্জন করে উঠল এবং এক ঝাঁক গুলী গিয়ে ডোমান, জোয়াও এবং সিড়ির গোড়ায় দাড়ানো তিনজনকে ঘিরে ধরল।
পাঁচটি দেহই ভুলুণ্ঠিত হলো।
ঘুরে দাঁড়াল লিন্ডা। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। একবার মেয়েকে রক্ষা করেছিলেন, এবার আমাকে রক্ষা করলেন।’
‘ধন্যবাদ আমিই তো আপনাকে দেব। আপনিই …।’
কথা শেষ করতে পারলো না আহমদ মুসা। লিন্ডা তার কথায় বাধা দিয়ে বলল, ‘আপনার হাত-পায়ের লোহার কড়া এখন কিভাবে খুলব বলুন। নিচের লোকরা উপরে এসে পড়তে পারে।’
‘আপনার রিভলবার দিযে কড়া দুটোর লক-এ গুলী করুন।’ বলল আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গে লিন্ডা হাতের রিভলবার তুলে গুলী করল লকের কিহোল দুটোর উপর।
খুলে গেল আহমদ মুসার হাত-পায়ের কড়া।
আহমদ মুসার হাতেই ছিল ‘উজি’টা, উঠে দাঁড়াল সে।
লিন্ডা চলতে শুরু করে বলল, ‘আসুন মি. আহমদ মুসা।’
লিন্ডা জোয়াও-এর পাশে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।
জোয়াও-এর কাধে একটা গুলী লেগেছে। এছাড়া আরও দুটি গুলী লেগেছে। একটা পাঁজরে, অন্যটি বাম বাহুতে।
বলল লিন্ডা তাকে লক্ষ্য করে, ‘তোমাকে মারতে চাইনি এবং মারব না জোয়াও। তোমার হাতে গুলী করেছিলাম লেগেছে কাঁধে। তুমি এভাবে গুরুতর আহত হবার জন্যে আমি দু:খিত। তোমার লোকদের বলছি তোমাকে হাসপাতালে নিতে।’
বলে হাঁটতে শুরু করেই আবার থমকে দাঁড়াল লিন্ডা। বলল, ‘তুমি আমাকে এবং আমার ক্রিস্টিনাকে হত্যা করতে চাইবে। আমি আর মৃত্যুকে ভয় করি না। বিদেশী একজন ভালো মানুষ আহমদ মুসাকে মুক্ত করতে পেরে আমি খুশি এবং এইভাবে আমার পিতৃপুরুষের পবিত্র সম্পদ তোমার হাত থেকে রক্ষা করতে পারলে আমি খুশি হবো।’
কথা শেষ করেই আবার হাঁটতে শুরু করল লিন্ডা।
তার পেছনে পেছনে চলল আহমদ মুসা। উঠে এল তারা দু’তলার বারান্দায়।
বলল লিন্ডা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘নিচে এদের আরও কিছু লোক আছে। তাদের সাফ করতে পারলেই আপনি ঘাটে পৌঁছবেন। সেখানে একাধিক বোট আছে। আমি কি …।’
লিন্ডার কথার মাঝখানে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘না আরও কিছু আছে নিচে। এদের একদল শিকারী কুকুর আছে, যারা বন্দুকধারী লোকদের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক। এছাড়া পাতা আছে বিদ্যুতের ফাঁদ।
লিন্ডা আহমদ মুসার খালি পায়ের দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, ‘আহমদ মুসা অবশ্যই সব কিছু জানবেন, সেটাই স্বাভাবিক। আমি আপনাকে রাবার সোলের এক জোড়া জুতা দিচ্ছি। সেটা পায়ে থাকলে বিদ্যুতের ফাঁদ কোন কাজে আসবে না। ওরা বন্দীদের খালি পায়ে এ জন্যেই রাখে যাতে বন্দী পালালে খালি পায়ে পালাতে বাধ্য হয়।’
কথাটুকু শেষ করে একটু দম নিয়েই আবার বলে উঠল, ‘কুকুরগুলো আমাকে চেনে। ওদের ভয় নেই। ওদের পার করে দিয়ে আসব আমি আপনাকে।’
‘আসব মানে, আপনি যাবেন না আমার সাথে?’
‘কোথায় যাব?’
‘আপাতত আমার সাথে বের হবেন। জোয়াও তো এখনি আপনাকে ও আপনার মেয়েকে মেরে ফেলবে।’ আহমদ মুসা বলল। ‘কোথাও গিয়েই আমি জোয়াও এর হাত থেকে বাঁচতে পারব না। ওদের ‌কিনিক কোবরা’র হাত থেকে কারও নিস্তার নাই। সুতরাং আমি পালিয়ে কারও আশ্রয়ে গিয়ে আরো অনেককে বিপদগ্রস্ত করতে চাই না।’ থামল একটু।
কিন্তু আহমদ মুসা কথা শুরু করার আগেই আবার বলে উঠল, ‘একটু দাঁড়ান, আমি আপনাকে জুতা এনে দেই।’
বলেই ছুটল জোয়াও-এর পাশের ঘরে। সেখান থেকে একটা কেটস এনে আহমদ মুসাকে দিল। বলল, ‘পরে নিন।’
আহমদ মুসার জুতা পরা হলে বলল, ‘চলুন আপনাকে কুকুর বাহিনীর রাজত্ব পার করে দিয়ে আসি।’
‘না আপনি আসবেন না, আমার সাথে যেতে হবে আপনাকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি কি বলেছি বুঝেছেন তো?’ বলল লিন্ডা।
‘বুঝেই বলছি। আপনাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে আমি যাবনা। এই আমি বসলাম।’ বলেই সত্যিই বসে পড়ল আহমদ মুসা।
একটু বিব্রত হলো লিন্ডা। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘আপনি নিজে বিদেশী। আপনি দয়া করে বিপদ বাড়াবেন না। আমার ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দিন।’
‘ঠিক আছে, তাহলে আমি সাথেই থাকছি। কি হয় সেটা দেখেই আমি যাব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্লিজ দয়া করে আমার সাথে আপনাকে জড়াবেন না। আমি জানি আপনার জীবন অনেক মূল্যবান। দুনিয়ার অনেক কাজ হবে আপনাকে দিয়ে।’ বলল লিন্ডা।
‘আমার এই মুহূর্তের কাজ হলো, আপনাকে এবং ক্রিস্টিনাকে রক্ষা করা। সুতরাং আমাকে আপনাদের সাথেই থাকতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
লিন্ডা চোখ তুলে আহমদ মুসার দিকে একবার তাকাল। বুঝল, আহমদ মুসা যা বলছে তাই করবে। বলল, ‘ঠিক আছে। আপনি একটু দাঁড়ান আমি ক্রিস্টিনাকে নিয়ে আসি।’
বলেই সে দৌড়ে উপরে উঠতে লাগল।
আহমদ মুসা দাঁড়াল দোতলার সিঁড়ির মুখে। আহমদ মুসার মাথায় নানা চিন্তা ঘুর পাক খাচ্ছে। লিন্ডা জোয়াওকে মারতে চায় না, আবার জোয়াও-এর হাতে সে ও ক্রিস্টিনা মরবে, কোথাও গিয়ে বাঁচবেনা, এ ব্যাপারে লিন্ডা নিশ্চিত। তাহলে সে জোয়াওকে মারতে চায়না কেন? জোয়াও-এর সাথে লিন্ডার কি সম্পর্ক?
তারা অবশ্যই স্বামী-স্ত্রী নয়। তাহলে ক্রিস্টিনা কি জোয়াও-এর মেয়ে? তারা কি বন্ধু ছিল? বা এখনও আছে? লিন্ডার পিতৃপুরুষের সম্পদের বিষয়টা কি? কেন লিন্ডা জীবন দিয়েও সে সম্পদ জোয়াও-এর হাত থেকে বাঁচাতে চায়? সব সম্পদ দিয়ে হলেও সবাই নিজেকে বাঁচাতে চাইবে, এটাই তো সাধারণ প্রবণতা?
আহমদ মুসা একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল। সিঁড়িতে পায়ের শব্দে সম্বিত ফিরে পেল সে। তাকাল সিঁড়ির দিকে। চারজন উঠে আসছে সিঁড়ি দিয়ে। তাদের চারজনের হাতে মিনি মেশিনগান ‘উজি’। একজেনর ‘উজি’ আহমদ মুসার দিকে তাক করা।
আহমদ মুসার ‘উজি’টা ঝুলছে তার হাতে।
কি করণীয় দ্রুত ভাবছে আহমদ মুসা।
এ সময় আহমদ মুসার পেছনে তিন তলার সিড়ির দিক থেকে একটা গুলীর শব্দ এল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা চারজনের যে লোকটির ‘উজি’ আহমদ মুসার দিকে তাক করা ছিল তার হাত থেকে ‘উজি’টা ছিটকে পড়ে গেল। আর লোকটি আর্তনাদ করে উঠে তার গুলীবিদ্ধ ডান হাতটি বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরে বসে পড়ল।
আহমদ মুসা শব্দ শুনেই বুঝতে পেরেছিল লিন্ডা তিন তলার সিঁড়ি দিয়ে নামছে। সেই গুলী করেছে। আহমদ মুসাও এক মুহূর্ত নষ্ট করেনি। লোকটির হাত থেকে ‌‌‌‌‌‌‌‍‍‍‍‍‍‍‘উজিটি’ ছিটকে পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসার ‘উজি’ উঠে এসেছিল সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা অবশিষ্ট তিনজনের লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা ‘উজি’র ট্রিগার চেপে ধরেছিল বেশ কয়েক সেকেন্ড। গুলি বৃষ্টি গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা চারজনকেও ঝাঁঝরা করে দিল।
ক্রিস্টিনাকে নিয়ে নেমে এসেছে লিন্ডা।
এসে দাঁড়াল সে আহমদ মুসার পাশে।
আহমদ মুসা তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ লিন্ডা দ্বিতীয়বার আপনি গুলীর মুখ থেকে আমাকে বাঁচালেন। ’
‘লজ্জা দেবেন না। আপনার চোখ তো সিঁড়ির দিকে ছিল। কিন্তু ওরা উঠে আসছে তা টের পেলেন না কেন?’ বলল লিন্ডা।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘স্যরি, একটা ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলাম।’
‘এমন জরুরী ভাবনাটা কি?’ বলল লিন্ডা।
‘বলব এক সময়, এখন আসুন, চলি।’ আহমদ মুসা বলল।
চলতে শুরু করে ক্রিস্টিনাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এস মা ক্রিস্টিনা।
আমাকে এবং ক্রিস্টিনাকে আগে যেতে হবে মি. আহমদ মুসা। দরজা পেরোলেই কিন্তু ছুটে আসবে কুকুর বাহিনী।’ বলে লিন্ডা ক্রিস্টিনার হাত ধরে আহমদ মুসাকে ডিঙিয়ে আগে চলতে শুরু করল।
‘নিচে কি এদের আরও লোক আছে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘মনে হয় নেই। এত গুলী গোলার শব্দ শোনার পর কেউ বাইরে থাকার কথা নয়। ‘কিনিক কোবরা’র যারা সুরিনামে এসেছে, তাদের বেশির ভাগই থাকে মূল শহরে। জোয়াও-এর কয়জন খাস লোকই শুধু এখানে থাকে, এখানকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে।’
তারা এক তলায় নেমে এল।
এক তলায়ও কাউকে দেখা গেল না।
বাইরে বেরুবার গেটে এসে পৌঁছল তারা। গেটের বাইরে একটা ফাঁকা চত্বর। এ চত্বরটা বাড়িটাকে চারদিক থেকে ঘিরে আছে। এ চত্বরটাকেই পাহারা দেয় কুকুর বাহিনী।
চত্বরটার পর পানির ধার ঘেঁষে চারদিক জুড়ে ঘিরে আছে কাঁটাতারের বেড়া।
গেট খুলে প্রথম বেরুল লিন্ডা। তার সাথে ক্রিস্টিনা। সবশেষে আহমদ মুসা।
গেট থেকে পাথর বিছানো একটা পথ চলে গেছে ঘাট পর্যন্ত। ঘাট পাওয়ার আগে কাঠের তৈরি আরেকটা গেট পার হতে হয়। দুই দিক থেকে কাঁটাতারের বেড়া এসে রাস্তাটার দু’প্রান্তে শেষ হয়েছে। দু’প্রান্তের বেড়াকে সংযোগ করে দাঁড়িয়ে আছে গেটটা। গেটের নিচের রাস্তায় বসানো হয়েছে একটা ইস্পাতের বড় শীট। গেটের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত জুড়েই রয়েছে শীটটা। গেট পার হতে হলে এই লোহার শিটে সবাইকে পা রাখতে হবে।
আহমদ মুসারা বাড়ি থেকে বের হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই দুদিক থেকে ছুটে এল পাঁচ ছয়টা কুকুরের একটা দল। তাদের মুখে হিংস্র হুংকার। কুকুর গুলোর জ্বলন্ত চোখগুলো যেন আহমদ মুসাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চায়।
আহমদ মুসা দাড়িয়েছে লিন্ডা ও ক্রিস্টিনার মাঝখানে।
লিন্ডা ও ক্রিস্টিনা দুজনেই হাত তুলে মুখে এক প্রকার শব্দ করে কুকুরগুলোকে শান্ত করার চেষ্টা করল।
লিন্ডা ও ক্রিস্টিনার কথায় কুকুরগুলো শান্ত হলো ও লেজ নাড়তে শুরু করল। নিশ্চয় কুকুরগুলো বুঝেছে আহমদ মুসা অপরিচিত হলেও অনাত্মীয় নয়।
ধীরে ধীরে ফিরে গেল কুকুরগুলো।
তিনজন এগিয়ে চলল ঘাটের দিকে।
সবার সামনে ছিল লিন্ডা।
লিন্ডা কাঠের গেটটা খুলতে খুলতে বলল, ‘গেটের নিচে রাস্তার উপর এই যে আইরন শীটটা দেখছেন, তা সম্পূর্ণটাই বিদ্যুতায়িত এবং বাড়ির চারদিক ঘিরে এই যে কাঁটাতারের বেড়া দেখছেন এটাও বিদ্যুত্ বহন করছে। এই বাড়িতে আটক কোন বন্দী পালাতে গেলে ভেতরের প্রহরী ও বাইরের কুকুরের হাত থেকে কোনভাবে বাঁচলেও কাটাতারের বেড়া অথবা গেটের এই বৈদ্যুতিক ফাঁদ থেকে বাঁচতে পারবেনা।’
‘কিন্তু আমি বেঁচে গেলাম। যাদের বাঁচার কথা, তারা এভাবেই বেঁচে যায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তা ঠিক।’ বলল লিন্ডা।
ঘাটে পৌঁছল তারা।
ঘাটে একটা বোট বাঁধা আছে।
বোটটি আটলান্টিকের অব্যাহত তরঙ্গ দোলায় অবিরাম দুলছে। লিন্ডা গিয়ে বোটে উঠল এবং ক্রিস্টিনাকে হাত ধরে বোটে তুলল।
আহমদ মুসা বোটে উঠতে উঠতে বলল, ‘একটিই তো বোট দেখছি। আমরা নিয়ে গেলে এরা তো আটকা পড়ে যাবে।’
‘না আশে-পাশে কিংবা বন্দর এলাকায় এদের আরও বোট আছে। ওগুলো কালোবাজারিতে লিপ্ত। মোবাইলে সংকেত পেলে সংগে সংগেই চলে আসবে।’ বলল লিন্ডা।
‘তাহলে এখনও আমরা বিপদমুক্ত নই! ওরা মোবাইল করলে বোটগুলো আমাদের ধাওয়া করতে পরে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তা পারে, যদি জোয়াও তাদের মোবাইল করতে পারে। কিন্তু জোয়াও এর কাছে মোবাইল নেই। জ্যাকেটসহ তার মোবাইলটা ছিল সিঁড়ি ঘরের বাইরের রেলিং-এ। আমি মোবাইলটা নিয়ে এসেছি।’ বলল লিন্ডা।
‘ধন্যবাদ আপনাকে । এ পর্যন্ত আপনার প্রত্যেকটা কাজই একজন ঝাঁনু গোয়েন্দার মত ।’
আমহদ মুসা বলল।
হাসল লিন্ডা। ম্লান হাসি। বলল, ‘আমি কিনিক কোবরা’র সদস্য ছিলাম না । কিন্তু অনেক বছর থেকে তাদের দেখছি । সুতরাং কিছু তো শেখার কথা।’
‘আপনি কিনিক কোবরা’র সদস্য নন, কিন্তু তারা আপনাকে তাদের কাজ দেখতে দিচ্ছে কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
ম্লান হয়ে গেল লিন্ডার মুখ।
কিছু বলতে যাচ্ছিল লিন্ডা, কিন্তু তার আগেই ক্রিস্টিনা বলল, ‘ঘুম পাচ্ছে আম্মা আমার ।’
ব্যস্ত হয়ে উঠল লিন্ডা। বলল, ‘মি. আহমদ মুসা আমি আসছি ওকে শুইয়ে দিয়ে।’
বলে ক্রিস্টিনাকে নিয়ে দোতলার কেবিনে উঠার জন্যে অগ্রসর হলো লিন্ডা।
‘ঠিক আছে আপনি আসুন। আমি ততক্ষণে বোট স্টার্ট দিয়ে দেই।’
বলে আহমদ মুসাও এগুলো বোটের ইঞ্জিনের দিকে।
মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এল লিন্ডা । বসল সে আহমদ মুসার ড্রাইভিং চেয়ারের পাশের চেয়ারটায়।
লিন্ডা বসতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আপনি ক্রিস্টিনাকে আনতে গেলে দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আমি আপনার কথাই ভাবছিলাম।’
‘কি ভাবছিলেন?’ ম্লান কণ্ঠ লিন্ডার।
‘আমি ভাবছিলাম, আপনি সুযোগ পেয়েও জোয়াও কে মারলেন না, অথচ জোয়াও আপনাকে ও ক্রিস্টিনাকে মেরে ফেলবে, এটা আপনি নিশ্চিতভাবে জানেন। আপনাকে আমি বলতে শুনেছি আপনার পিতৃপুরুষের পবিত্র সম্পদ তার হাত থেকে রক্ষা করতে চান। আপনার সাথে জোয়াও-এর সম্পর্কটা কি? আপনার পিতৃপুরুষের সম্পদ পবিত্রই বা হলো কি করে? এসব প্রশ্নই আমার মাথায় তখন কিলবিল করছিল।’
প্রায় এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামলেও কথা বলল না লিন্ডা। তার মুখ নিচু এবং ম্লান। ভাবছিল সে। একটু পর মুখ তুলল লিন্ডা। বলল, ‘প্রশ্নগুলোর উত্তর অনেক কাহিনীর সাথে জড়িত। এক অখ্যাত-অজ্ঞাত ভাগ্যাহত মহিলার সে কাহিনী আপনার শুনে কি লাভ!’
‘কি লাভ হবে আমি জানি না। কিন্তু জোয়াও-এর কারাগার থেকে আপনার দ্বারা মুক্তি লাভের মাধ্যমে যে লাভ আমি পেয়েছি, তাতে এ জিজ্ঞাসার জবাব আমার জানা দরকার।’
আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি আমাকে দয়া করতে চান, তাই না?’ বলল লিন্ডা।
‘হ্যাঁ। কারণ আপনি আমাকে দয়া করেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
উত্তরে কিছু বলল না লিন্ডা।
মুখ নিচু করে চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। একটু পর মুখ তুলল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। লজ্জামিশ্রিত এক টুকরো ম্লান হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। বলতে শুরু করল, ‘আমার পুরো নাম লিন্ডা লোরেন। আমরা ও জোয়াও লেগার্টরা গুয়েতেমালার রাজধানী গুয়েতেমালা শহরের এক অভিজাত এলাকায় প্রতিবেশী ছিলাম। আমার আব্বা ছিলেন জাতি-সংঘের একটা এজেন্সীর কর্মকর্তা, আর জোয়াও লেগার্টের আব্বা ছিলেন একজন ধনী রাজনীতিক। আমরা একই স্কুলে পড়তাম। আমরা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। পরে আমি উচ্চতর লেখাপড়ার জন্যে চলে যাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় এবং অবশেষে পেশা হিসবে বিমান বালার চাকুরী গ্রহণ করি সেন্ট্রাল আমেরিকান এয়ার লাইন্সে। আমি বিমানবালা হিসেবে খুব সফল হই দীর্ঘদেহী ও একটু ভিন্নতর চেহারা হওয়ার কারণেই। একজন পাইলটকে বিয়ে করি। কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্রিস্ট্রিনা হওয়ার কিছুদিন পর আমার স্বামী বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। আমি ফিরে আসি গুয়েতেমালায় বাবার কছে। তখন তিনি জাতিসংঘের চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে গুয়েতেমালার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েয়েছন। আমি গুয়েতেমালায় আসার পর জোয়াও লেগার্টের সাথে ঘনঘন দেখা হওয়া শুরু হয়। আগের সেই সম্পর্ক আবার ফিরে আসে। অনেক দিন পর বুঝতে পারি এই জোয়াও লেগার্ট আগের জোয়াও লেগার্ট নয়। তার পিতার রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পর তার স্নেহময় সৎ রাজনীতিক পিতার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে সে যোগ দেয় এক সন্ত্রাসী দলে। যখন আমি এ বিষয়টা জানতে পারি, তখন সে সন্ত্রাসী দল ‘কিনিক কোবরা’র এক নম্বর নেতা।’ তখন আমার আব্বা মারা গেছেন। অসহায় আমি তখন । সব জেনেও আমি জোয়াও লেগার্টের কাছ থেকে সরে যেতে পারিনি। জোয়াও তা হতে দেয়নি। ক্রিস্টিনার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এবং তার বড় হবার অপেক্ষায় আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে কোরবানী দেই। সবশেষে আমাদের পবিত্র সম্পদ হস্তগত করার সে চেষ্টা করে, তাতে রাজী না হলে আমাদের দুই মা-বেটিকে হত্যা করার সে সিদ্ধান্ত নেয় এবং এজন্যে সে আমাকে ও আমার মেয়েকে গুয়েতেমালা থেকে সুরিনামে নিয়ে এসেছে। আর….।’
‘সুরিনামে কেন?’ লিন্ডার কথার মাঝখানে বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘তাদের কথায় ‘অমূল্য সেই সম্পদ’ সুরিনামে আমার পিতৃপুরুষের ভিটার তলায় লুকায়িত আছে।’ বলল লিন্ডা।
‘পিতৃপুরুষের ভিটা কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমি ঠিক জানিনা, দলিলেই নাকি সব লেখা আছে। দলিলটা আমি ঠিক বুঝিনা। কৌতূহল বশে জোয়াও ওটা আমার কাছে থেকে নিয়ে অন্য কারো কাছ থেকে পড়িয়ে নেয়। তখন কিন্তু জোয়াও দলিলগুলোকে গুরুত্ব দেয়নি।’ কিন্তু রঙ্গলালদের এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে সুরিনাম আসার পর কি ঘটল আমি জানি না। হঠাৎ করে গুয়েতেমালায় ফিরে যায় এবং দলিলগুলো আমার কাছ থেকে নিতে চায়। তার উদ্দেশ্য নিয়ে আমার সন্দেহ হয়। তাছাড়া দলিলগুলো পিতার পবিত্র আমানত আমার কাছে। সেই আমানত আমি একজন সন্ত্রাসী নেতার হাতে দেব কেন? অথচ দেব না বলে রক্ষা পাওয়াও মুশকিল। অবশেষে আমি মিথ্যা বলি। তাকে জানাই যে, আমি যখন কিছু দিন আগে সুরিনাম গিয়েছিলাম ইউনেস্কোর এক সম্মেলনে তখন দলিলগুলো নিয়ে গিয়েছিলাম একজন পুরাতত্ববিদকে দেখাবার জন্যে। ওখানেই এক বিশ্বস্ত স্থানে রেখে এসেছি। সে আমার কথায় সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে এবং ভীষণ রেগে যায়। সে ভাবে, আমি দলিলগুলো নিয়ে কোন মতলব আঁটছি। সঙ্গে সঙ্গেই সে আমাকে ও ক্রিস্টিনাকে সুরিনাম নিয়ে আসে জোর করে এবং তখন থেকেই দলিলগুলো হাত করার জন্যে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আগে আমি বুঝিনি দলিলগুলো সে কেন চায়। কিন্তু সুরিনাম এসে ধীরে ধীরে জানতে পারলাম, দলিলগুলোর মধ্যে ডায়াগ্রাম ও দিকনির্দেশনা আছে যা অনুসরণ করে আমার পিতৃপুরুষের রাখা বিশাল সম্পদ মাটির তলা থেকে তুলে আনা যাবে। এটা জানার পর আমি আরও শক্ত হয়ে যাই এবং জীবন গেলেও পবিত্র ঐ পৈত্রিক সম্পদ তার মত সন্ত্রাসীর হাতে যেতে দেবনা, এই সিদ্ধান্ত নেই।’
‘আপনার পৈত্রিক সম্পত্তি সুরিনামে কেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘এর সবটুকু উত্তর আমার জানা নেই। তবু এটুকু বলতে পারি, আমি শুনেছি আমার গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদার ছাত্র জীবনে সুরিনাম থেকে সান্টো ডোমিংগোতে চলে আসেন এবং সেখানেই স্থায়ী নিবাস গড়েন। দাদাও সান্টো ডোমিংগোতে বাস করেন। আব্বা লেখা-পড়া করেন ফ্লোরিডায়। সেখান থেকেই জাতিসংঘ সংস্থায় চাকুরী নিয়ে আসেন গুয়েতেমালায়। দাদার মৃত্যুর পর আব্বা গুয়েতেমালাতেই স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। আব্বা দলিলগুলো পেয়েছিলেন দাদার কাছ থেকে। আব্বা এগুলো আমাকে দিয়ে যান। তিনি সুরিনামে আমাদের পুর্বপুরুষ ও আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে তেমন কিছু জানতেন না। শুধু বলতেন দাদার কাছে তিনি শুনেছেন সুরিনামে ছিল তাদের বিরাট ও প্রাচীন পরিবার। রাজধানী পারামারিবো নাকি তাদেরই গড়া। যখন তাদের সুদিন ছিল, তখন তাদের বাড়িই প্রায় একটা শহর ছিল। দাদা কোনদিন যান নি। তবে আব্বা সুরিনামে তার পরিবারের জন্য গর্ব করতেন। এই গর্ব আমাদের মধ্যেও আছে। সুরিনামে এলে মন আকুলি-বিকুলি করে পরিবারের সন্ধান করার জন্যে। কিন্তু কিছুই তো জানি না এখানকার পরিবার সম্পর্কে।
‘দলিলে কিছু নেই এ সম্পর্কে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘দলিল আমি পড়িনি। দলিলটা ইংরেজি ভাষায় নয়।’
‘তাহলে কি সুরিনামের ভাষায়?’
‘তাও নয়।’
‘তাহলে কি ভাষায়?’
‘আব্বাও পড়তে পারতেন না বলে আমিও কোনদিন ভাল করে দেখার চেষ্টা করিনি।’ বলল লিন্ডা।
‘দলিলটা কোথায়? আমাকে কি দেখানো যাবে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনাকে দেখাতে না পারলে দুনিয়ার কাউকে আর দেখানো যাবে না।’ বলল লিন্ডা।
‘এই বিশ্বাসের কারণ?’
‘কারণ অনেকগুলো। একটি হল, জীবনের প্রতি আপনার কোন লোভ নেই। দুনিয়ার প্রতি যার কোন লোভ থাকে না, দুনিয়ার সম্পদের প্রতিও সে কোন লোভ রাখে না। আরেকটি কারণ হল, আপনি মুসলমান।’ বলল লিন্ডা।
‘মুসলমানদের প্রতি আপনার এই পক্ষপাতিত্ব কেন?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘জানি না। তবে আমি এয়ার হোস্টেস থাকা কালে অনেক জাতির মানুষের সংস্পর্শে এসেছি। তাদের মধ্যে মুসলমানদেরকেই আমি মদ ও নারীর ব্যাপারে সবচেয়ে সংযত দেখেছি। আর তারা ধর্ম পালন করা জাতিও। প্লেনের মধ্যেও তারা প্রার্থনা করতে ভোলে না। আর সবচেয়ে বড় হল, দাদুর কাছে একটা শোনা কথা। তিনি বলতেন, আমাদের পরিবারের সাথে মুসলমানদের একটা যোগসূত্র রয়েছে। তাছাড়া আপনি মুসলমান জেনে সত্যিই আমার খুব খুশি লেগেছে।’
‘মিস লিন্ডা, আপনার কথা শুনে আমারও খুশি ও কৌতূহল দুই-ই সৃষ্টি হয়েছে। আপনার সেই দলিলগুলো কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল।
হাসল লিন্ডা। বলল, ‘দলিলগুলো আমার এই হ্যান্ডব্যাগের তলায় চামড়ার দুই লেয়ারের মাঝখানে রয়েছে।’
‘আপনার নাইস বুদ্ধিতো!’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
ততক্ষণে লিন্ডা লোরেন ব্যাগ থেকে ছোট করে একটা কাঁচি বের করে ব্যাগের তলা কাটতে শুরু করেছে। ব্যাগের একটা প্রান্ত কেটে ভেতরে দুই আঙ্গুল ঢুকিয়ে বের করে আনল কয়েকখণ্ড কাগজ। কাগজের ভাঁজ খুলতে লাগল লিন্ডা।
আহমদ মুসা কাগজের দিকে চেয়ে বলল, ‘মিস লিন্ডা, কাগজগুলো খুব প্রাচীন মনে হচ্ছে না।’
‘ঠিকই বলেছেন। এগুলো আসলে মূল দলিলের ফটোকপি। দেখেই বোঝা যায়। সম্ভবত আমার গ্রেট গ্রান্ডফাদার যখন ফাইনালি সুরিনাম থেকে চলে আসেন তখন দলিলগুলো ফটোকপি করে নিয়ে আসেন। মূল দলিল নিশ্চয় পরিবারের মূল অংশের সাথেই রয়েছে।’
এতক্ষণে কাগজগুলোর ভাঁজ খোলা হয়ে গেছে।
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলল, ‘দলিলগুলোর মধ্যে একটা পাল তোলা জাহাজের স্কেচ আছে, অর্ধ ডুবন্ত। পাশেই উপকূল। উপকূলের নাম ও জাহাজের নাম স্প্যানিশ ভাষাতেই লেখা আছে। জাহাজের নাম দেখছি সান্তামারিয়া এবং উপকূলের নাম দেখছি সুরিনাম কোস্ট।’ থামল লিন্ডা লোরেন।
‘কলম্বাসের প্রথম সমুদ্র যাত্রায় যে জাহাজগুলো ছিল, তার একটির নাম সান্তামারিয়া। কিন্তু কলম্বাসের প্রথম অভিযানতো সুরিনাম কোস্ট পর্যন্ত আসেনি। তাহলে এখানে সান্তামারিয়া ডুববে কেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘মি. আহমদ মুসা, বোটের হুইলটা আমি ধরেছি। আপনি এ কাগজগুলো একটু দেখুন। আপনি বুঝতে পারেন কি না। দলিলগুলোর মধ্যে সান্তামারিয়াকে সুরিনাম কোস্টে যখন ডুবতে দেখেছি তখন দলিলগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকতে পারে।’
বলে লিন্ডা উঠে বোটের হুইলটা ধরল এবং আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিট থেকে পাশের সিটে সরে এল।
আহমদ মুসা চেয়ারে বসে ডেক টেবিল থেকে তুলে নিল দলিলগুলো। দলিলগুলোর উপর নজর পড়তেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল আহমদ মুসা। দলিলগুলো সবই আরবীতে লেখা। দ্রুত চোখ বুলাল সে। প্রথম দলিলটির শিরোনাম ‘আমার কথা’। দ্রুত পাতা উল্টিয়ে শেষ পাতায় দেখল নাম স্বাক্ষর ‘আব্দুর রহমান আত-তারিক’। পরিচয় লেখা আছে ‘ক্যাপ্টেন, শিপ সান্তামারিয়া।’ দ্বিতীয় দলিলটির শিরোনাম ‘আল্লাহর দান আল্লাহর জন্যে’। এ দলিলেরও শেষ পাতায় সেই একই স্বাক্ষর ও একই পরিচয়। তৃতীয় দলিলটা হল ‘সান্তামারিয়া জাহাজের স্কেচ’। এর শিরোনাম আগামী দিনের সুরিনামিদের জন্যে সুভেনীর। এখানেও ঐ একই স্বাক্ষর এবং পরিচয়।
বিস্ময়-আনন্দে বোবা হয়ে গেল আহমদ মুসা। তার মনে এখন আর কিছুমাত্র সন্দেহ নেই, টেরেক দুর্গেরই এসব দলিল পত্র। টেরেক, মানে আল-তারিক দুর্গের প্রতিষ্ঠাতা সান্তামারিয়া জাহাজের ক্যাপ্টেন আব্দুর রহমান আল-তারিক! এটা মুসলিম দুর্গ! সম্ভবত সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকার এটাই প্রথম এবং হয়তো একমাত্র মুসলিম নির্মিত দুর্গ। আর ওভানডোরা এবং লিন্ডা লোরেনরা একই পরিবার।
আরও কতক্ষণ আহমদ মুসা বিস্ময় ও আনন্দের সমুদ্রে সম্বিতহারা হয়ে থাকতো কে জানে। কিন্তু লিন্ডা লোরেনের কথায় সম্বিত ফিরে পেল আহমদ মুসা। লিন্ডা লোরেন বলছিল, ‘কি ব্যাপার মি. আহমদ মুসা, আপনি এরকম হয়ে গেলেন কেন? ভূত দেখলেন নাকি?’
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে মুখ তুলল। বলল, ‘না মিস লিন্ডা, ভূতের চেয়ে বড় কিছু।’
‘কি ব্যাপার?’ বলল লিন্ডা। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
‘জানেন, দলিলগুলো আরবীতে লেখা।’
‘আঁকা-বাঁকা হাতের লেখা দেখে আমি বুঝতে পারি নি। তবে শুনেছি বিদেশী ভাষায় লেখা। কিন্তু এর কারণ কি? আরবী ভাষায় কেন?’ বলল লিন্ডা।
‘শুধু আরবী ভাষার কথা নয়। যার দলিল তিনি একজন মুসলমান!’ আহমদ মুসা বলল।
‘মুসলমান?’ চোখ কপালে তুলে বলল লিন্ডা লোরেন।
‘হ্যাঁ। নাম আব্দুর রহমান আল-তারিক।’
‘তার মানে আমাদের পূর্বপুরুষ মুসলমান এবং তার নাম আব্দুর রহমান আল-তারিক?’ প্রায় চিৎকার করে বলল লিন্ডা লোরেন। তার চোখে-মুখে আবার বিস্ময়।
‘আমিও বিস্মিত মিস লিন্ডা। কিন্তু বিস্মিত এই কারণে যে, আমার অপূর্ণ জিজ্ঞাসার জবাব এই দলিলে মিলবে তা ভাবিনি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝলাম না মি. আহমদ মুসা।’
‘আপনার অপূর্ণ জিজ্ঞাসাটা কি ছিল?’ লিন্ডা বলল।
মুখে হাসি টেনে আহমদ মুসা বলল, ‘আমার দ্বিতীয় জিজ্ঞাসা ছিল, আপনার পরিচয় সম্পর্কে আপনার পিতৃপুরুষের বিশাল স্টেট ধ্বংস প্রাপ্ত দুর্গে মুসলমানদের প্রার্থনা গৃহ মসজিদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। আপনার আত্মীয়-স্বজনরা এখনও সেখানে বসবাস করেন।’
লিন্ডা লোরেনের চোখে বিস্ময়। বলল, ‘আমার পূর্ব পুরুষের স্টেট আছে, তাদের ভাঙ্গা দুর্গ আছে, আমি জানি না। আপনি জানলেন কি করে?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনার পূর্ব পুরুষের স্টেটেই তো আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।’
‘সেটা আমার জন্য মহা আনন্দের কথা। কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব তো দিলেন না, আমার পিতৃ পুরুষের পরিবার, তাদের স্টেট আপনি চিনলেন কি করে?’ বলল লিন্ডা।
‘আমি সেখানে থাকি। আপনার পিতৃপুরুষের পরিবারের আমি অতিথি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আপনি বিদেশী। পরিচয় হল কি করে তাদের সাথে?’ জিজ্ঞেস করল লিন্ডা।
আহমদ মুসা ওভানডোকে কিভাবে উদ্ধার করে, তারপর কি সব ঘটে এবং কিভাবে সে তাদের স্থায়ী অতিথি হয়ে গেল, বলল সব সংক্ষেপে।
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। অশেষ ধন্যবাদ ঈশ্বরকে। আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন আজ। সৌভাগ্য যে আপনার সাথে দেখা হয়েছিল। এখনও আমার কাছে সবকিছু স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। ঈশ্বর এ সৌভাগ্যস্বপ্ন যেন ভেঙ্গে না দেন।’ বলল লিন্ডা।
‘আপনার চেয়ে আমার আনন্দ কম নয় মিস লিন্ডা। সুদূর সুরিনামে এসে যদি দেখি যে আধুনিক সুরিনামের প্রতিষ্ঠাতা একজন মুসলমান, আমার ভাই, তাহলে আনন্দ রাখার জায়গা কি থাকে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার পূর্ব পুরুষ আব্দুর রহমান আল-তারিককে যদি আপনি ভাই বলেন, তাহলে আমি তো আপনার বোন হয়ে গেলাম।’
‘বোন হয়ে গেলেন নয়, বোন হয়ে গেছেন। কিন্তু একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেই, আব্দুর রহমান আল-তারিক মুসলমান ছিলেন। কিন্তু বোন লিন্ডা লোরেন কিন্তু আব্দুর রহমান আল-তারিকের ধর্মে নেই।’
‘দেখুন ভাইজান, আমি তো আগেই বলেছি মুসলমানদের আমার ভাল লাগে। আহমদ মুসার বোন হওয়ার আগে মুসলমানদের ভাল লেগে থাকলে, আহমদ মুসার বোন হবার পর এবং পিতৃপুরুষের মুসলিম পরিচয় পাবার পর মুসলমান হবার বাকি থাকে কি!’ বলল লিন্ডা।
‘ধন্যবাদ বোন। এটা আমার জন্য আরেকটা খুশির খবর।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝা গেল আমি মুসলমান না হলে আপনার এই খুশিটা পেতাম না। আপনি তো সাম্প্রদায়িক খুব!’ হাসতে হাসতে বলল লিন্ডা লোরেন।
‘কল্যাণ গ্রহণ ও তার প্রতিষ্ঠায় একনিষ্ঠ হওয়া যদি সাম্প্রদায়িকতা হয়, তাহলে অবশ্যই আমি সাম্প্রদায়িক এবং সব মানুষেরই সাম্প্রদায়িক হওয়া উচিত।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মুসলমানিত্ব ও কল্যাণকে তাহলে তো আপনি এক করে ফেলেছেন।’ বলল লিন্ডা।
‘আমি এক করে ফেলছি না। মুসলমানিত্ব ও কল্যাণ আসলেই এক। ইসলাম হল মানুষের জন্য স্রষ্টার মনোনীত জীবন-যাপন পদ্ধতি। মানুষের ইহকালীন সব কল্যাণ, পরকালীন মুক্তি এই জীবন-যাপন পদ্ধতির মধ্যেই নিহিত রয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি যা বললেন এই বিশ্বাসের প্রতি যদি একনিষ্ঠ হতে হয়, তাহলে তো মানুষকে এই পথে নিয়ে আসার জন্য শক্তি প্রয়োগও বৈধ, যেমন ঔষধ খাওয়ার জন্যে রোগীর উপর প্রয়োজন হলে ডাক্তার শক্তি প্রয়োগ করেন।’ বলল লিন্ডা লোরেন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ইসলাম ঔষধ নয়। রোগীর ঔষধ খাওয়া-না খাওয়ার পিছনে তার বেঁচে থাকা, না থাকার প্রশ্ন জড়িত। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করা- না করার সাথে এই প্রশ্ন জড়িত নয়। কল্যাণের পথ যদি মানুষ গ্রহণ না করে, তাহলে তার অকল্যাণ হবে। তখন সে অকল্যাণ থেকে সতর্ক হবে ও কল্যাণের পথে ফিরে আসতে চাইবে। তাকে এই পথে সাহায্য করতে হবে মাত্র। এজন্যই ইসলাম বা কল্যাণের পতাকাবাহীকে নিরন্তর কল্যাণের পথ মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। মানুষ চাইলে তা গ্রহণ করবে, না চাইলে তা গ্রহণ করবে না। মানুষের মাথায় বাড়ি মেরে বা বাধ্য করে মানুষকে ইসলামের পথে আনা ইসলামের পথ নয়।’
‘তাহলে তো ইসলাম অর্থাৎ কল্যাণের প্রতিষ্ঠা হবে না।’ বলল লিন্ডা লোরেন।
‘কল্যাণের প্রতিষ্ঠা না হলে অকল্যাণের প্রতিষ্ঠা হবে। অকল্যাণের প্রতিষ্ঠা হলে মানুষ অকল্যাণ সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন হবে এবং কল্যাণের দিকে ফিরে আসবে। কল্যাণের পথ অব্যাহতভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরে মানুষের এই পরিবর্তনকেই উৎসাহিত করতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘যদি মানুষের পরিবর্তন না হয়? অধিকাংশ মানুষ যদি কল্যাণের পথে না আসে?’ জিজ্ঞেস করল লিন্ডা।
‘যে আসবে না, তার পরিণতি সেই ভোগ করবে। দুনিয়াতে সে অকল্যাণের মধ্যে নিমিজ্জিত হবে এবং পরকালে তাকে জাহান্নামের শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। স্রষ্টা তো এজন্য পুরষ্কার ও শাস্তির জায়গা বেহেশত ও দোজখ দুই-ই সৃষ্টি করে রেখেছেন’।
‘তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, ইসলাম আইনের পথ, গণতন্ত্রের পথ এবং মানুষের স্বাধীন চিন্তাকে স্বীকার করে নেয়ার পথ।’ বলল লিন্ডা।
‘ঠিক স্বীকার করে নেয়া নয়। ইসলাম মানুষের অকল্যাণের পথে চলার স্বাধীন চিন্তাকে পরিবর্তন করার অবিরাম প্রচেষ্টা, কিন্তু সেটা গায়ের জোরে নয়, ঘৃণা ছড়িয়ে নয় কিংবা অসহযোগ করে নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে তো এটা আইন ও গণতন্ত্রের পথ হল।’ বলল লিন্ডা।
‘হ্যাঁ অবশ্যই।’
‘ঠিক আছে। তাহলে আপনি সাম্প্রদায়িক নন, চরমপন্থীও নন। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর দিন, অমঙ্গলের স্বাধীন চিন্তাকে আপনি গায়ের জোরে বাঁধা দিচ্ছেন না, আইনানুগ ও গণতন্ত্রের পথে তার পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন, কিন্তু অমঙ্গলের পথচারীরা যদি গায়ের জোরে আপনার অর্থাৎ ইসলামের এই চেষ্টায় বাঁধ সাধে, তাহলে কি হবে?’
‘তাহলে এই বেআইনি ও অগণতান্ত্রিক বাঁধা ডিঙানোর সব বৈধ উপায়ই গ্রহণ করতে হবে। অমঙ্গল যে শক্তি নিয়ে আসবে, মঙ্গলের শক্তিকে তার চেয়ে বেশী শক্তি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তাতে যুদ্ধ লড়াই সবই হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি অমঙ্গলের বেআইনি ও অগণতান্ত্রিক বাঁধা ডিঙানোর সব বৈধ পথ গ্রহণের কথা বলেছেন। এখানে ‘বৈধ পথ’ বলতে কি বোঝাতে চেয়েছেন?’ বলল লিন্ডা।
‘যারা বাঁধা দিতে আসছে, যারা লড়াই করতে আসছে, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করুন। কিন্তু প্রত্যক্ষ লড়াই-এ নেই এমন অসামরিক, নিরপরাধ মানুষ, নারী, শিশুকে হত্যা করা, নির্যাতন করা বৈধ পথ নয়। প্রত্যক্ষ যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট না হলে শত্রুপক্ষের হলেও ধর্মস্থান, ফসলের ক্ষেত, বাগান ইত্যাদি ধ্বংস করাও বৈধ কাজ নয়। ইসলাম এগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।’
আহমদ মুসা বলল।
থামল আহমদ মুসা। প্রশান্ত মুখ লিন্ডার। আহমদ মুসা থামার পর একটু ভেবে নিয়ে সে বলল, ‘আইন ও গণতন্ত্রের পথে চলেও এবং মানুষের মঙ্গল কামনা করে কল্যাণের পথে চলার পরেও কিন্তু ইসলাম যুদ্ধ বন্ধ করতে পারল না ভাইজান।’
‘পৃথিবী যতদিন থাকবে, আদম ও ইবলিসও ততদিন থাকবে এবং ইবলিস- আদমের শান্তির সংসারে হানা দেবেই। তাই আদম অর্থাৎ মঙ্গলের শক্তি চাইলেও যুদ্ধ-লড়াই বন্ধ হচ্ছে না।’ থামল আহমদ মুসা।
কথা বলল না লিন্ডাও। ভাবছিল সে। একটু পর বলল, ‘এসব ভারী কথা এখন থাক ভাইজান। দলিলগুলোতে কি আছে তা দেখতে অনুরোধ করেছিলাম আমি।’
আহমদ মুসা প্রথম দলিলটা তার চোখের সামনে তুলে ধরল। ডেক টেবিলের আলোটা এডজাস্ট করে নিয়ে বলল, ‘বোন আমি অনুবাদটাই শুধু আপনাকে শোনাচ্ছি। শুনুন।’ বলে আরবীটা আস্তে আস্তে পড়ে অনুবাদটা জোরে বলতে লাগলঃ
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আমি আমার ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য কিছু কথা লিখে যাচ্ছি। আমার মাতৃভাষা আরবীতেই লিখছি। স্বর্ণভাণ্ডারের নির্দেশিকা দলিলটাও আরবীতে লিখলাম। কারণ, আমি চাই আরবী পাঠোদ্ধারের মত এক উপযুক্ত সময়ে আল-তারিক দুর্গের ইতিহাস ও দুর্গের তলার স্বর্ণভাণ্ডার আমার বংশধরদের হাতে পড়ুক। আমি চাই, আল্লাহর দন এই স্বর্ণ ভাণ্ডারের বৃহত্তর অংশ আল্লাহর কাজে ব্যয় হোক।
আমি আব্দুর রহমান আল-তারিক। ১৫০১ সালের দিকে স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্ড ও রানী ইসাবেলা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের হিসপানিওয়ালা এলাকার গভর্নর হিসেবে ওভানডোকে প্রেরণ করেন ৩০ টি জাহাজসহ। আমাকে জোর করে জাহাজ বহরের চীফ নেভীগেটর ও অগ্রবর্তী জাহাজটির ক্যাপ্টেন করে গভর্নর ওভানডোর সাথে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে পাঠানো হয়। কিন্তু আমি এ জীবন চাইনি।
আমি আমার ছাত্র জীবনের শুরু থেকেই ভূগোল ও সমুদ্রবিজ্ঞানের প্রতি অনুরক্ত। আমার ছাত্রজীবনের সকল পর্যায়ে আমি এই দুই বিষয়ে ভাল রেজাল্ট করেছি। আমি এই দুই বিষয়ে কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করি। আমার আবাল্য স্বপ্ন ছিল কর্ডোভার মত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব। আমি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করি এবং এর মাধ্যমে আমার সে স্বপ্ন সফল হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেয়া শুরু করার আগেই কর্ডোভা এলাকা মুসলমানদের হাত ছাড়া হয়ে যায় এবং ফার্ডিনান্ড ও ইসাবেলার বাহিনী কর্ডোভা দখল করে নেয়। অন্যান্য অনেকের সাথে আমিও পালিয়ে যাই কর্ডোভা থেকে। কিন্তু শীঘ্রই আমার কপাল ভাঙে। আমার এক খৃস্টান সহপাঠী আমার ব্যাপারে ফার্ডিনান্ডকে বলে দেয়। আমাকে ভূগোল সমুদ্র বিজ্ঞানী হিসেবে ফার্ডিনান্ডের কাছে তুলে ধরা হয়। ফার্ডিনান্ড সরকার আমার সন্ধান করতে থাকে। আমি তখন গ্রানাডা থেকে তিরিশ-চল্লিশ মাইল দূরে এক সুন্দর পার্বত্য উপত্যকায় আমার নিজের গ্রাম ‘ওয়াদিউল গানী’তে বাস করছি। আমি তখনও বিয়ে করিনি। এক বৃদ্ধা মা ছাড়া আমার কেউ ছিল না। দুজনের অত্যন্ত সুখী ও স্বচ্ছল সংসার আমাদের। এক রাতে সেখানেই হাজির হল ফার্ডিনান্ডের লোকরা। রাস্তা চিনিয়েছিল আমার সেই খৃস্টান সহপাঠী। জোর করে আমাকে তুলে নিয়ে আসে আমার শয্যা থেকে। পাশের ঘরে ঘুমিয়ে থাকা মা’র কাছ থেকেও বিদায় নিতে দেয় নি। এভাবেই আমাকে শামিল করা হয় ওভানডোর জাহাজ বহরে। আমার নতুন নাম হয় ‘কটিজ পিজারো’।
এক মাসের সমুদ্র যাত্রা শেষে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমরা সান্টো ডোমিংগোতে পৌঁছলাম।
ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের হিস্পানিওয়ালা অঞ্চলের রাজধানী তখন এই সান্টো ডোমিংগো। ’ সান্টো ডোমিংগোর সমুদ্র তীরে এক ছোট বাড়িতে হল আমার নিবাস। কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যে একে আমার নিবাস বলে মেনে নিতে পারিনি। প্রতিদিনের অবসর সময়টা জানালায় বসে ক্যারিবিয়ান সাগরের দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছিল আমার অভ্যাস। ক্যারিবিয়ান সাগর পেরিয়ে আটলান্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে আমার মন ছুটে যেত স্পেনের পাহাড় ঘেরা ‘ওয়াদিউল গানী’তে। চোখে ফুটে উঠতো মায়ের মমতাময়ী চেহারা। পরক্ষণেই আবার চোখের সামনে ফুটে উঠতো পাগল পারা হয়ে আমাকে খুঁজে ফেরা মায়ের দৃশ্য। ভাবতাম মা আমার নিশ্চয় বেঁচে নেই। সন্তানের খোঁজে ছুটে বেড়ানো নাওয়া-খাওয়াহীন মা কোথায় পড়ে একদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে! এসব ভাবতে গিয়ে চোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রু গড়াত।
এমনি অবস্থায় যখন আমার কাল কাটছে, তখন একদিন গভর্নর ওভানডো আমাকে ডেকে পাঠাল। আমি হাজির হলে বলল, ‘দেশে যাবার জন্যে তুমি পাগল হয়ে আছ। কিছুদিনের জন্যে তোমাকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। জিনিসপত্রসহ ২৪টি জাহাজের একটা বহর পাঠাচ্ছি স্পেনে। তুমি একটা জাহাজের ক্যাপ্টেন থাকবে।’
সম্ভবত তারিখটা ১৫০২ সালের জুনের ১৫ তারিখ। আমরা ২৪টি জাহাজ নিয়ে সান্টো ডোমিংগো বন্দর ত্যাগ করে আটলান্টিকে পাড়ি জমালাম। নোঙর তোলার মুহূর্তে গভর্নর এসে আমাকে বলল, ‘বহরের দুটি জাহাজে স্বর্ণ বোঝাই আছে। দুটি জাহাজের মধ্যে তোমারটা একটা। সাবধানে যেও।’ কিন্তু সাবধানতা কাজে এল না। যাত্রা করার দ্বিতীয় দিন শেষে ভয়াবহ হারিকেন ঝড়ে আক্রান্ত হল আমাদের জাহাজ বহর। চোখের সামনেই একের পর এক জাহাজ ডুবে যেতে লাগল। আমার জাহাজ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হল। অর্ধেকের বেশী নাবিক মারা গেল। সামনে এগুবার চিন্তা বাদ দিয়ে জাহাজকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে ঝড়ের হাতে সপে দিলাম জাহাজের ভাগ্য। দিনের কোন হিসেব ছিল না। সম্ভবত দিন সাতেক পর আমার জাহাজ একটা কূলে ভিড়ল। কূলে ভেড়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জাহাজ ডুবে গেল। অস্ত্র-শস্ত্র, খাবার ও অতি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসসহ আমরা তীরে নেমে এলাম। এই দেশটি হল সুরিনাম। আর জায়গাটা ছিল সুরিনাম নদীর পারামারিবো মোহনা।
আমরা জাহাজ থেকে নেমেছিলাম ১৭ জন। এই ১৭ জনের মধ্যে ১০ জন নাবিকই ছিল মুসলমান। অবশিষ্টরা ছিল ক্যাথলিক। আমরা ১৭ জন একটা পরিবারে পরিণত হলাম। গড়ে তুললাম সুরিনামে ইউরোপের প্রথম কলোনি। কলোনি গড়লেও কলোনিয়ালিস্টদের মত আচরণ আমরা করিনি। সুখে-দুখে সব কাজে সব সময় স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ানরা ও আমরা একসাথে থেকেছি। ধীরে ধীরে অতি গোপনে আমরা সোনা খালাশ করছিলাম জাহাজ থেকে। রেড ইন্ডিয়ান ও স্থানীয় উপজাতিদের আমরা বিষয়টা না জানালেও একটা ভাগ হিসেব করে প্রচুর অর্থ আমরা ওদের দিয়েছি।
সকলের সহযোগিতা নিয়ে প্রচুর অর্থ খরচ করে সুরিনাম নদীর মোহনার পাশে আমরা আল-তারিক দুর্গ গড়ে তুললাম। দুর্গটার ডিজাইন করলাম স্পেনের প্রথম মুসলিম দুর্গ ‘আত-তারিক’ এর অনুকরণে। দুর্গের কেন্দ্রে তৈরী করলাম বিশাল মসজিদ। নিজের বাড়িটা তৈরী করলাম মসজিদের পাশে। আমাদের ১৭ জনের পরিবারের ক্যাথলিক কয়জনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। দুর্গের মধ্যেই অবশিষ্ট সতের জনের বাড়ি তৈরি হল। আমরা সকলেই তখন বিয়ে করেছি রেড ইন্ডিয়ান পরিবারে। এই বিবাহ-সূত্রে রেড ইন্ডিয়ানরা আর আমরা এক হয়ে গেলাম। তাদেরও আধুনিক বাড়িঘর তৈরি করে দেয়া হল পারামারিবো মোহনায়। এভাবে ভিত্তি স্থাপিত হল পারামারিবো শহরের।
দুর্গ তৈরির পর ষোল জনকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী স্বর্ণ দিয়ে অবশিষ্ট স্বর্ণের বিশাল ভাণ্ডার আমি সঞ্চিত করে রাখলাম মাটির তলায়। আল্লাহর দান এ স্বর্ণ আমি আল্লাহর জন্যেই রাখলাম মাটির তলায়। আল্লাহ আমার ইচ্ছাকে কবুল করুন। পরিবার পরিজন নিয়ে আমি সুখী। সুরিনামকে নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছি। মা’র জন্য কাঁদা আমার অনেক কমে গেছে। ধরে নিয়েছি এবং সত্যও যে মা এতদিনে মারা গেছেন। অতএব তাঁকে দেখার, তিনি কেমন আছেন তা জানার জন্যে মন আকুলি-বিকুলি করে ওঠে না। কিন্তু এর পরও স্পেনের আমার দুঃখী স্বজন-স্বজাতির জন্যে মন কাঁদে। আমার প্রিয় ‘ওয়াদিউল গানী’ কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্ডোভা-গ্রানাডার কথা মনে হলে আমি আবার পাগল হয়ে যাই। অশ্রু নেমে আসে দু’গাল বেয়ে। ঘুমের মধ্যে ‘ওয়াদিউল গানী’ ছাড়া কোন স্বপ্নই আমি দেখি না। দিনের সজাগ মুহূর্তে আমি থাকি এই সুরিনামের আল-তারিক দুর্গে। কিন্তু রাতের স্বপ্নে আমি ফিরে যাই আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের স্বপ্নভূমি ওয়াদিউল গানীতে। কোনদিন আর কি যেতে পারব সেখানে? আমি না পারলেও আমার বংশধররা কেউ সেখানে যাবে। আমার মায়ের কবর কি তারা খুঁজে পাবে সেখানে? এ প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। কিন্তু তবু লিখে গেলাম আমার হৃদয়ের আকুতি। আল্লাহ একে কবুল করুন।’
দলিলটা পড়া যখন আহমদ মুসা শেষ করল, তখন তার চোখের ফোটা ফোটা অশ্রুতে দলিলের অনেকখানি ভিজে গেছে।
পড়া শেষ করে আহমদ মুসা চোখ তুলল লিন্ডা লোরেনের দিকে। দেখল তার অপলক চোখ দুটি সামনের দিকে নিবদ্ধ। দুচোখ থেকে নেমে আসা অশ্রুর ঢলে তার দুই গণ্ড ধুয়ে যাচ্ছে। তার দাঁত কামড়ে ধরেছে তার নিচের ঠোঁটটাকে।
পড়া শেষ হলেও অনেকক্ষণ কেউ কথা বলল না।
প্রথম নিরবতা ভাঙল লিন্ডা লোরেন। বলল, ‘আমি গর্বিত ভাইজান এমন একজন পূর্বপুরুষের উত্তর সূরী আমি।’ তার কণ্ঠ ভেঙে পড়ল কান্নায়।
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আবার বলে উঠল, ‘মনে হচ্ছে কি জানেন! তার ‘ওয়াদিউল গানী’টা যেন আমার ওয়াদিউল গানী। মন আমার ছুটে যেতে চাচ্ছে সেখানে।’ থামল লিন্ডা লোরেন।
আহমদ মুসাও কথা বলল না। তার শূন্য দৃষ্টিটা হারিয়ে গেছে সাগরের অন্ধকারে।
এক সময় ধীর কণ্ঠে আহমদ মুসা বলল, ‘আজ টেরেক স্টেটে অর্থাৎ আল তারিক স্টেটে কিভাবে ঢুকব তাই ভাবছি। আব্দুর রহমান আল-তারিকের গড়া স্টেটের ধুলি কণায় পা পড়লে, তার বিশাল দুর্গের দিকে চাইলে, মসজিদের ধ্বংসাবশেষের পাশে তার বাড়িটা দেখতে না পেলে মনটা হুহু করে কেঁদে উঠবে।’
‘আর আমার হবে আরেক অভিজ্ঞতা। মনে হবে আমি প্রবেশ করছি স্বপ্নের দেশ অর্থাৎ চাঁদের দেশে।’ বলল লিন্ডা লোরেন উদাস কণ্ঠে।
আহমদ মুসা আবার তার চোখ ফিরিয়ে আনল দলিলের পাতায়। পাতা উল্টিয়ে দ্বিতীয় দলিল সে বের করল। বলল, ‘এবার তাহলে মিস লিন্ডা স্বর্ণ ভান্ডারের নির্দেশিকাটা পড়ি?’
লিন্ডা সংগে সংগেই জবাব দিল না। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘না ভাইজান। ওটা বরং আপনি ওভানডো ভাইজানকে পড়ে শোনাবেন। ঐ স্বর্ণের সাথে যে দায়িত্ব জড়িয়ে আছে তার ভার বহন করার ক্ষমতা আপনার আছে, ওভানডো ভাইয়ারও হতে পারে। আমি অনুরোধ করব, আমাকে স্বর্ণ ভান্ডরের নির্দেশিকা নয়, আমাকে দয়া করে আপনি ‘ওয়াদিউল গানী’র দিক নির্দেশিকা শোনান। আর কিছু না হোক, আমার মহান দাদুর শেষ ইচ্ছাটুকু যদি পূরণ করতে পারি, তবে জীবন জনম সব আমার সার্থক হবে।’ কান্নায় জড়িয়ে গেল তার শেষ কথাগুলো।
লিন্ডা লোরেনের হৃদয় ভাঙা আহমদ মুসাকেও স্পর্শ করেছে। তার দু’চোখের কোনায়ও জমে উঠেছে অশ্রু।
আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। তার দু’চোখ আবার ফিরে গেছে সাগরের অন্ধকারে। লিন্ডা লোরেনেরও দুই চোখ সামনে নিবদ্ধ।
জমাট নিরবতা।
এই নিরবতার মাঝে বোট তার ইঞ্জিনের বেসুরো শব্দ চারদিকে ছড়িয়ে তীব্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে পারামারিবো বন্দর ছাড়িয়ে টেরেক স্টেটের নিজস্ব ঘাটের দিকে।

Top