৩৪. সুরিনামে মাফিয়া

চ্যাপ্টার

‘না মা, আজও আহমদ মুসার কোন খোঁজ মেলেনি।’ নীচু কণ্ঠে বিষণ্ন মুখে বলল সুরিনামের নতুন প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তা।
পাশেই আরেক সোফায় মাথা নিচু করে দু’হাতের তালুতে মুখ রেখে বসেছিল ফাতিমা নাসুমন। ছল ছল করছে তার দুই চোখ। বলল, ‘আমার খুব খারাপ লাগছে আব্বা। তুমি কিডন্যাপ হবার পর তোমাকে খুঁজে পেতে আহমদ মুসার সময় লাগেনি। কিন্তু আজ কয়েক দিনেও তোমার গোটা পুলিশ বাহিনী মিলেও আহমদ মুসার সন্ধান করতে পারলো না।’
‘আহমদ মুসার পাশে আমাদের গোটা পুলিশ বাহিনীকেও দাঁড় করানো চলে না মা। তুমি তো জান, গোটা মার্কিন গোয়েন্দা ও পুলিশ বিভাগ বছরের পর বছর ধরে যা পারেনি, আহমদ মুসা তাই পেরেছি। তবু মা, আমাদের পুলিশ বাহিনী চেষ্টার কোন ত্রুটি করছে না। পারামারিবোর সন্দেহজনক প্রতিটি বাড়ি-ঘর তারা তন্নতন্ন করে খুঁজছে। মনে হচ্ছে আহমদ মুসা পারামারিবোতেই নেই।’ বলল আহমদ হাত্তা।
‘আমার মনে হয় রঙ্গলালরা জানে আব্বা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে?’ বলল ফাতিমা নাসুমন।
‘পুলিশ তাকে নজরে রেখেছে। কথাও বলেছে তার সাথে। আমিও তাকে ডেকেছিলাম। কথা বলেছি। সব দোষ সে স্বীকার করেছে, তবে আমাকে কিডন্যাপ করা ও আমার ড্রাইভার (আহমদ মুসা) উধাও হবার ব্যাপারে সে কিছুই জানে না বলে জানিয়েছে। তাদের অজান্তেই মাফিয়ারা কিছু করে থাকতে পারে তাদের লোক হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্যে। আমি বন্দী অবস্থায় তাদের যে কথা শুনেছি, তাতে রঙ্গলালের কথা সত্য। মাফিয়াদের সব রাগ আহমদ মুসার উপর। তারা নিশ্চিত যে, আহমদ মুসার হাতেই তাদের লোক মরেছে।’
ভয়ে-উদ্বেগে আরও ফ্যাকাসে হয়ে উঠল ফাতিমা নাসুমনের মুখ। বুক তার থরথর করে কেঁপে উঠল, আহমদ মুসা তো ওদের হাতেই পড়েছে! আর চিন্তা করতে পারল না ফাতিমা। তার পিতা থামলেও কোন কথা সে বলতে পারল না।
তার পিতা প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তাই আবার কথা বলল। বলল, ‘আমার খুব খারাপ লাগছে মা। সারা রাত ধরে এই আনন্দ প্রোগামটা আমি করতে চাইনি। কিন্তু দেশের রেওয়াজ হিসেবে আমাকে রাজী হতে হয়েছে। তোমার মতই আমারও অনুষ্ঠান ভালো লাগছে না বলে এখানে এসে বসেছি।’
‘স্যরি আব্বা। রাষ্ট্রের যে নিয়মনীতি তা তো মেনে চলাই উচিত। বুক থেকে উদ্বেগের পাথরটা সরাতে পারছি না বলেই হৈ হুল্লোড় থেকে একটু সরে এসেছি।’ বলল ফাতিমা।
‘তার জন্যে আমাদের এই উদ্বেগ স্বাভাবিক মা। তার সাহায্য না পেলে প্রধানমন্ত্রী হওয়া দূরের কথা ওদের হাতে আটক অবস্থাতেই হয়তো আমার জীবন শেষ হয়ে যেত। তোমারও দেখা পেতাম না।’ বলতে বলতে আহমদ হাত্তার কণ্ঠ কান্নায় ভারী হয়ে উঠল। তার দুই চোখ অশ্রুতে ভরে উঠেছে।
ফাতিমা নাসুমন উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে উঠে এল তার আব্বার কাছে। আস্তে পিতার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আব্বা তুমি দুর্বল হয়ে পড়বে না। তুমি ভেঙে পড়লে আমরা আশ্রয় পাব কোথায়। এতক্ষণ তোমার অনুষ্ঠানের বাইরে থাকা ভাল দেখাচ্ছে না। চল আব্বা, আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে।’
ফাতিমার কথা শেষ হতেই দরজায় প্রধানমন্ত্রীর পিএস-এর কণ্ঠ শোনা গেল। সে ভেতরে আসার অনুমতি চাচ্ছিল।
আহমদ হাত্তা তাড়াতাড়ি রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘এস।’
পিএস ঘরে ঢুকে বলল, ‘স্যার পুলিশ প্রধান ও গোয়েন্দা প্রধান আপনার সাথে কথা বলতে চান।’
‘যাও আসতে বলো।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।
চলে গেল পিএস।
আহমদ হাত্তা ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল ফাতিমাকে লক্ষ্য করে, ‘মা রাত তিনটা বাজে। তুমি পাশের ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও। আমি তোমাকে ডাকব।’
‘ধন্যবাদ আব্বা।’ বলে ফাতিমা চলে গেল পাশের ঘরে।
ঘরে ঢুকল পুলিশ প্রধান আলী সিলভু ও গোয়েন্দা প্রধান আহমাদু সিফু।
প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তা উঠে ওদের স্বাগত জানিয়ে বলল, ‘মি. আলী এবং মি. আহমাদু কোন খবর পেলেন?’
পুলিশ প্রধান আলী সিলভু ও গোয়েন্দা প্রধান আহমাদু সিফূ বসল। তাদের চোখে–মুখে বিষণ্নতা। বলল আলী সিলভু, ‘স্যার গতকাল পর্যন্ত আমরা প্রধানত বিদেশী ও মি. রঙ্গলালদের দলে ও অবস্থানে আমাদের অনুসন্ধান সীমাবদ্ধ রেখেছিলাম। আমরা আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দা শক্তির গোটাটাই এই কাজে নিয়োজিত করেছিলাম। কিন্তু তার কোন খোঁজ আমরা পাইনি। আজ আমরা ভিন্ন আরেকটা চ্যানেল ওপেন করেছি।’
‘কি সেটা?’ উদগ্রীব কণ্ঠে বলল প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তা।
পুলিশ প্রধান আলী সিলভু গোয়েন্দা প্রধান আহমাদু সিফুকে লক্ষ্য করে বলল, ‘বলুন মি. আহমাদু। আপনিই তো বিষয়টা প্রত্যক্ষভাবে ড্রীল করছেন।’
নড়ে-চড়ে বসল গোয়েন্দা প্রধান আহমাদু সিফু। বলল সে প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার আমাদের বিশ্বাস এবং রঙ্গলালের সাথে আলোচনা করে যা বুঝেছি, আটক করার ঘটনাটা একটা মাফিয়া গ্রুপের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে এবং আমরা নিশ্চিত রঙ্গলাল সাহেবরা যে মাফিয়া গ্রুপকে হায়ার করে এনেছিল ঘটনাটা তারাই ঘটিয়েছে। আমরা……।’
গোয়েন্দা প্রধান আহমাদু সিফের কথা শেষ হলো না, তার আগেই কথা বলে উঠল প্রধানমন্ত্রী, ‘তারা কোন গ্রুপ, কোথাকার, তাদের নেতা কে, এটা কি রঙ্গলালরা বলেছে?’
‘স্যার, রঙ্গলালরা তা বলতে পারেনি। আর মাফিয়ারা কখনই তা জানতে দেয় না স্যার।’ বলল আহমাদু সিফু।
‘ইয়েস, আপনার কথা শেষ করুন মি. আহমাদু।’ প্রধানমন্ত্রী বলল।
‘ইয়েস স্যার।’ বলে আহমাদু সিফু আবার কথা শুরু করল, ‘স্যার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের এক বিদেশী গ্রুপের সাথে আজ যোগাযোগ করেছি। ব্রুকোপনডোর ঘটনায় যারা নিহত হয়েছে এবং আপনাকে উদ্ধারের ঘটনায় যারা নিহত হয়েছে, সেই বিদেশী মাফিয়াদের লাশের ছবি আমরা তাদের দেখিয়েছি। তারা দেখেই বলেছে নিহত লোকরা ‘কিনিক কোবরা’র মাফিয়া দলের সদস্য। ওরা শুনেছে ‘কিনিক কোবরা’র নেতাও নাকি এখন পারামারিবোতে।’
‘কিনিক কোবরা’ কারা?’ জিজ্ঞেস করল প্রধানমন্ত্রী।
‘কিনিক কোবরা’ মধ্য আমেরিকার একটা দুর্ধর্ষ মাফিয়া চক্র। গুয়েতেমালায় ওদের হেড কোয়ার্টার হলেও গোটা আমেরিকা জুড়েই ওরা ঘুরে বেড়ায়। কখন কোথায় থাকে তার ঠিক নেই।’ বলল গোয়েন্দা প্রধান আহমাদু সিফু।
‘রঙ্গলালরা তাহলে এদেরকেই হায়ার করেছিল?’ জিজ্ঞেস করল প্রধানমন্ত্রী।
‘তাইতো প্রমাণ হচ্ছে স্যার।’ বলল গোয়েন্দা প্রধানই।
‘আসল কথা কি হয়েছে, তাদের কাছে কোন সহযোগিতা চেয়েছ?’ জিজ্ঞেস করল প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তা। তার কণ্ঠে অধৈর্য্য ভাব।
‘ঠিক ফরমাল সাহায্য আমরা চাইনি। তবে কোন সাহায্য তাদের করার আছে কিনা, এমন প্রশ্ন আমরা তুলেছিলাম। তারা যে জবাব দিয়েছে, তাকে আমাদের ইতিবাচক বলে মনে হয়নি। তারা বলেছে, ‘কিনিক কোবরা’ তাদের সিনিয়র দল। তাদের সাথে সংঘাতে নামা ওদের জন্যে অসৌজন্যমূলক হবে, বিশেষ করে ‘কিনিক কোবরা’ যখন তাদের কোন ক্ষতি করেনি। তারা আরও বলেছে, ‘কিনিক কোবরা’র মত দুর্ধর্ষ গ্রুপ আর আমেরিকায় নেই। কোন অপারেশনে তাদের লোক মারা যাবার কোন নজীর নেই। অথচ সুরিনামে এ পর্যন্ত তারা প্রায় পৌনে একডজনের মত লোক হারিয়েছে। এর ভয়াবহ রকমের প্রতিশোধ না নিয়ে ওরা ছাড়বে না।’ থামল গোয়েন্দা প্রধান।
‘কিনিক কোবরা’র কোন লোকেশন বা ঠিকানা পেয়েছে কি না তারা?’ প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তার আবার জিজ্ঞেসা।
‘কেন কিনিক কোবরা’র সুরিনামে’- এই কৌতুহল থেকে তারা নিজেরাই কিনিক কোরবা’র সন্ধান শুরু করেছে। কিন্তু এখনো পায়নি তাদের ঠিকানা।’
‘তাহলে এখন এগুবেন কোন পথে?’ জিজ্ঞেস করল প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তা।
‘স্যার, গুয়েতেমালা সরকারকে অনুরোধ করেছি ‘কিনিক কোবরা’ মাফিয়া গ্রুপের প্রধানসহ তার লোকদের ফটো সরবরাহ করতে। আশা করছি সত্তরই আমরা পেয়ে যাব। ফটোগুলো পেলেই আমরা চিরুনী তল্লাশিতে নেমে যাব।’ বলল গোয়েন্দা প্রধান আহমাদু সিফু।
প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। এ সময় বেজে উঠল তার পাশের মোবাইলটা।
আহমদ হাত্তা মোবাইলটা হাতে তুলে নিল।
সালাম বিনিময়ের পর ওপারের কথা শুনে ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ হাত্তার। বলল, ‘ঠিক আছে। তোমরা দরজা খুল না আর যতটা পার বাধা দাও। আমাদের পুলিশ যাচ্ছে।’
বলে টেলিফোন রেখে দিল আহমদ হাত্তা। উত্তেজিত সে। পুলিশ প্রধান আলী সিলভু ও গোয়েন্দা প্রধান আহমাদুর চোখে-মুখেও উদ্বেগ ফুটে উঠেছে। তারা উদগ্রীবভাবে অপেক্ষা করছে প্রধানমন্ত্রীর কথার।
টেলিফোন রেখে দিয়েই আহমদ হাত্তা বলে উঠল, ‘মি. আলী সিলভু আপনি তাড়াতাড়ি টেরেক স্টেটে ওভানডোদের বাড়িতে পুলিশ পাঠান। নতুন পুলিশ কমিশনার সাহেব যেন নিজে একটা বড় পুলিশ দল নিয়ে সেখানে যান।’
‘কি ঘটনা স্যার?’ বলল পুলিশ প্রধান আলী সিলভু।
‘ওভানডোর বাড়িতে কে বা কারা হামলা করেছে। হামলাকারীরা তাদের ঘরের দরজা ভাঙতে চাচ্ছে।’ বলল প্রধানমন্ত্রী এক নিশ্বাসে।
‘ও আল্লাহ।’ বলে উঠল পুলিশ প্রধান এবং ঘুড়ে দাঁড়াল। বলল, ‘স্যার, পুলিশ কমিশনার সাহেব এখানেই আছেন। আমি তাকে এখনি পাঠিয়ে দিচ্ছি স্যার।’ বলে সালাম দিয়ে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল পুলিশ প্রধান।
গোয়েন্দা প্রধান বলল, ‘আমিও উঠতে চাচ্ছি স্যার, অনুমতি দিন। আমিও একটু খোঁজ-খবর নেই।’ বলে উঠে দাঁড়াল গোযেন্দা প্রধানও।
‘আপনারা আসুন। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।’ বলে প্রধানমন্ত্রী তার মোবাইলটা আবার তুলে নিল হাতে।

‘ইয়েস বস, আমরা এখন টেরেক স্টেটে। ওভানডোদের বাড়ি আমরা ঘিরে ফেলেছি। গেটের তিনজন পুলিশ আমাদের ঠেকিয়েছিল। কিন্তু তাদের দিকে স্টেনগান তাক করে তিনটি একশ ডলারের নোট তাদেরকে দেখিয়ে বলেছিলাম, তোমরা জান দেবে, না টাকা নেবে। তারা টাকাই পছন্দ করেছে। তবে তাদের অনুরোধে তাদেরকে ক্লোরেফরম দিয়ে ঘুম পাড়াতে হয়েছে।’ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো লিউনার্দো।
টেলিফোনের ওপ্রান্ত থেকে জবাব এল, ‘ধন্যবাদ লিউনার্দো। কিন্তু আসল কাজটা ঠিকমত হওয়া চাই। যে কোন মূল্যে ওদের বাড়িতে ঢুকতে হবে। বাড়ির সবাইকে বেঁধে ফেলে বাড়ি দখল করে বসে থাকতে হবে। আজ রাতে আহমদ মুসা অবশ্যই সেখানে যাবে। গেলে দরজা খুলে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে আহমদ মুসা ও লিন্ডার উপর। তাদের দু’জনকেই আমি জীবন্ত চাই লিউনার্দো। আমার দেহের যত ফোটা রক্ত ওরা ঝরিয়েছে, প্রতি ফোঁটা রক্তের মূল্য আমি ওদের গা থেকে তুলব। ঠিক আছে?’ ওপ্রান্তের কণ্ঠ থেমে গেল।
লিউনার্দো বলে উঠল, ‘ইয়েস বস, আমরা সব বুঝেছি। আমরা আপনার নির্দেশ পালন করব।’ থামল লিউনার্দো।
ওপ্রান্ত থেকে কথা ভেসে এল আবার, ‘চেষ্টা করবে দরজা না ভেঙে এবং দরজায় কোন গুলী-গোলার দাগ না রেখে প্রবেশ করতে। আহমদ মুসার চেয়ে ধড়িবাজ আর কেউ নেই। সে এসব দেখলে সন্দেহ করবে এবং সরে পড়তে পারে। সে সুযোগ তাকে দেয়া যাবে না লিউনার্দো।’ থামল ওপারের কণ্ঠ।
লিউনার্দো বলল, ‘ইয়েস বস, আমরা এই চেষ্টাই করব। আরেকটা কথা বস, আমরা যদি কয়েকজন বারে অবস্থান করি এবং কয়েকজন ভেতরে ঢুকে অপেক্ষা করি, তাহলে কেমন হয়? তাতে তার পালানো আটকানো যাবে এবং সামনে-পিছনে দুদিক থেকেই তাকে আক্রমণ করা যাবে।’ থামল লিউনার্দো।
ওপ্রান্ত থেকে আবার কথা বলে উঠল, ‘তোমরা যা ভাল বোঝ তাই কর। আমি চাই তারা তোমাদের হাতে ধরা পড়ুক, তা যেভাবেই হোক। আমি আর ভাবতে পারছি না।’
‘জানি আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে বস। অপারেশনের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। অপারেশনের সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যায়নি ইতিমধ্যে?’ থামল লিউনার্দো।
ওপার থেকে বলল, ‘হ্যাঁ, লিউনার্দো। ডাক্তার প্রস্তুত, অপারেশেনের সব কিছু প্রস্তুত। অপারেশনের টেবিলে শোবার আগে তোমাকে এই টেলিফোন করেছি।’ থামলো ওপারের কন্ঠ।
লিউনার্দো বলল, ‘ঈশ্বর সাহায্য করুন।’
‘ধন্যবাদ, গুডবাই লিউনার্দো।’ বলল ওপারের কণ্ঠ।
ওপার থেকে লাইন কেটে গেছে। লিউনার্দো মোবাইল অফ করে পকেটে রাখল। টেলিফোনের ওপ্রান্ত থেকে লিউনার্দোর সাথে কথা বলল ভীষণভাবে আহত জোয়াও লেগার্ট।
আহমদ মুসা ও লিন্ডা জোয়াও কে আহত অবস্থায় রেখে চলে আসার পর সে বহুকষ্টে শরীরের সব শক্তি ব্যবহার করে উঠে আসে আন্ডার গ্রাউন্ড কক্ষ থেকে উপরে তার যোগাযোগ কক্ষে। টেলিফোন করে পারামারিবো শহরে অবস্থানকারী তার প্রধান সহকারী লিউনার্দোকে। সব কথা তাকে জানিয়ে নির্দেশ দেয় তখনি টেরেক স্টেটে ওভানডোদের বাড়িতে অভিযান চালাতে সবটা জনশক্তি নিয়ে। নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথেই লিউনার্দো তার এগারজন কমান্ডো নিয়ে যাত্রা করে টেরেক স্টেটে ওভানডোদের বাড়িতে। রাত পৌনে তিনটার মধ্যেই তারা টেরেক স্টেটের বাইরের গেটে পৌছে যায়।
জোয়াও লেগার্টের সাথে কথা বলে টেলিফোন পকেটে রেখে দিয়েই মুখ তুলল তার সহকারীর দিকে। বলল, ‘ওদিকের কি খবর?’
‘ধাক্কিয়ে, ডাকাডাকি করে দরজা খোলানো যাবে না। প্রথমে দু’একটা কথা বলেছে। এখন একেবারে নিরব।’ বলল লিউনার্দোর সহকারী রবার্তো।
‘বস বলেছেন, বাইরের দিকের দরজা ভাঙা যাবে না কিংবা গুলী করে তালা আনলক করা ও ছিটকিনি নষ্ট করাও যাবে না। কারণ বাইরে থেকেই বাড়িতে কিছু ঘটেছে এটা আঁচ করতে পারলে আহমদ মুসা পালিয়ে যাবে।’ বলল লিউনার্দো।
‘তা হবে কেন? আমরা তাকে পালাতে দেব কেন। আমরা যদি চারদিকে ওঁৎ পেতে থাকি, পালাতে পারবে কেমন করে সে?’ বলল রবার্তো।
‘আমার যুক্তিও তোমার মতই অনেকটা। কিন্তু বস অতি সাবধানী। তিনি আহমদ মুসা ও ম্যাডাম লিন্ডাকে চার দেয়ালের মধ্যে ঢুকাতে চান, তারপর তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা বলেছেন। তার কথায় বাস্তবতা আছে। আহমদ মুসাকে তিনি আমাদের চেয়ে বেশি চেনেন। জানো কিছুক্ষণ আগে দুর্ভেদ্য বন্দীখানা থেকে আমাদের কিনিক কোবরা’র ৮ জনকে হত্যা করে এবং বসকে মারাত্মক আহত করে লিন্ডা ও তার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। কল্পনা করতে পার কতবড় ধড়িবাজ কুশলী সে!
বন্দী অবস্থায় আটজনকে হত্যা করে যে পালিয়ে আসতে পারে, আমরা ১১জন বাইরে লড়াই করে তাকে হারাতে পারব, এ নিশ্চিত দাবি আমরা কি করতে পারি? এই কারণেই বস চান নিঃসন্দেহ মনে অপ্রস্তুত অবস্থায় যেন সে আমাদের ফাঁদে পা দেয়, তার ব্যবস্থা করতে। থামল লিউনার্দো।
অপ্রস্তুত তিনি নাও তো থাকতে পারেন। আমরা এসেছি দরজা ধাক্কিয়েছি, ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছি, এ সব বিষয় ভেতরের সবার জানা হয়ে গেছে এবং আমরা যে তাদের শত্রু পক্ষ সে সম্বন্ধে তাদের মনে সন্দেহ নেই। যদি তাই হয় তাহলে এতক্ষণে বিষয়টা তারা পুলিশে জানিয়ে দিয়েছে। বলল, রবার্তো।
কিন্তু টেলিফোনের সব লাইন তো আমরা কেটে দিয়েছি। বলল লিউনার্দো।
মোবাইল যদি ওদের থাকে। বলল, রবার্তো।
ওহ গড এ কথা তো মনে আসে নি। আছে কি ওদের কারো মোবাইল? বলল লিউনার্দো।
জানি না। কিন্তু আছে ধরে নিতে হবে। বলল রবার্তো।
ঠিক বলেছ রবার্তো।
কথাটার পর একটু থেমেই আবার বলে উঠল লিউনার্দো, রবার্তো তুমি দু’জনকে নিয়ে চলে যাও গেটে। সংজ্ঞাহীন তিনজন পুলিশের পোশাক খুলে নিয়ে তা তোমরা তিনজন পরে নিয়ে গেটে অপেক্ষা কর। পুলিশ যদি আসে তাহলে তারা যেন এ বাড়ি পর্যন্ত পৌছতে না পারে তার ব্যবস্থা করবে। কি ভাবে করবে তা তোমরাই ঠিক করবে। তোমাদেরকে ওরা সন্দেহ করবে না, এটাই হবে তোমাদের জন্যে বড় প্লাস পয়েন্ট। আর এদিকে ফাঁদ পাতার কাজটা আমরা করছি। থামল লিউনার্দো।
লিউনার্দো থামতেই রবার্তো বলে উঠল, যাচ্ছি বস। একটা কথা বলে যাই। আমি বাড়িটার চার দিক ঘুরে দেখেছি। দূর্গের নিয়মে তৈরী বাড়িটা। কোন প্রাচীর নেই যে টপকে ভেতরে যাওয়া যাবে। চার দিক দিয়েই ঘরের সারি। দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে না চাইলে ছাদে উঠতে হবে। আমার বিশ্বাস ভেতরে বাড়ির মাঝখানে একটা চত্বর আছে। ছাদ দিয়ে সেখানে নামতে পারলে বাড়ির লোকদের সহজে কব্জায় আনা যাবে।
বলা শেষ করে ধন্যবাদের অপেক্ষা না করে রবার্তো দু’জনকে নিয়ে ছুটল গেটের দিকে।
গেটের কাছাকাছি চলে এসেছে রবার্তোরা। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে তারা গেট। কিন্তু গেট খোলা দেখে রবার্তোরা বিস্মিত হলো। সংজ্ঞাহীন পুলিশ তিনজনকে গেটের এপাশে রেখে গেটতো তারা ভেতর থেকে বন্ধ করে গিয়েছিল। কে গেট খুলল। যেই খুলুক তাকে প্রাচীর ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়েছে। আর যদি কেউ ভেতরে ঢুকে থাকে, গেট খুলে থাকে তাহলে তো তারা গেটের পাশের সংজ্ঞাহীন পুলিশদেরকেও দেখতে পেয়েছে, আহমদ মুসা কি এসেছে লিন্ডাকে নিয়ে? না আহমদ মুসা গেট বন্ধ দেখলে প্রাচীর ডিঙিয়ে ঢুকবে না। তাছাড়া টেরেক স্টেটে ঢুকবার একটা গোনী পথ নাকি আছে। সেটা আহমদ মুসা অবশ্যই জানে। সে লিন্ডাকে নিয়ে টেরেক স্টেটে ঢুকবার জন্যে সামনের গেট অবশ্যই ব্যবহার করবে না। তাহলে কি পুলিশ এসেছে? হতে পারে।
রবার্তোরা রাস্তা ছেড়ে দিয়ে পাশেই একটা টিলার পাশে গুঁটি মেরে বসল।
এক মিনিটও গেল না।
গেট দিয়ে পুলিশের দু’টি জীপ এবং দু’টি বড় ক্যরিয়ার প্রবেশ করল।
পুলিশের গাড়িবহর এগুচ্ছে ওভোনডোদের বাড়ির দিকে।
তার ওপর নির্দেশ পুলিশকে বাঁধা দিতে হবে ওভানডোদের বাড়ি যাওয়া থেকে। কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব? পুলিশের সংখ্যা ত্রিশের বেশী হবে। পুলিশরা যেহেতু গাড়ির প্রোটেকশনে এবং আড়াল অবস্থায় আছে তাই তাদের স্টেনগানের প্রথম আক্রমণে ক’জনকেই বা তারা নিষ্ক্রিয় করতে পারবে? কিন্তু তারপরেই তারা এ্যাকশনে আসবে। তাদের হাতে গাড়ি থাকায় তারা সুবিধা বেশী পাবে। তার ফলে পুলিশদেরকে ওভানডোদের বাড়ি যাওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে না। এই অবস্থায় পুলিশকে দু’দিক থেকে আক্রমণ করে কাবু করতে পারলে আহমদ মুসার জন্যে নিরাপদে অপেক্ষা করার একটা সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
এই চিন্তা করে রবার্তো তার মোবাইলে ফোন করল লিউনার্দোকে। তাকে বলল তার চিন্তার কথা। লিউনার্দো সব শুনে তাকে বলল রবার্তো যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটাই এখন বেষ্ট বিকল্প। কিন্তু পুলিশের লড়াইয়ে নামলে আহমদ মুসাকে ফাঁদে আটকাবার আমাদের পরিকল্পনা মাঠে মারা যেতে পারে। একটাই শুধু আশা, আমরা যদি পুলিশের ঝামেলাটা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলতে পারি, তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হতে পারে। উত্তরে রবার্তো তাকে বলল, আসুন আমরা এ চেষ্টাই করি। ওপ্রান্ত থেকে লিউনার্দো সম্মতি জানালো, ঠিক আছে আসছি।
টেরেক স্টেটে ঢোকার পর পুলিশের গাড়ি ধীর গতিতে এগুচ্ছে। রবার্তো তার দু’ই সাথীদের নিয়ে যতটা সম্ভব দেহ গুটিয়ে মাথা নিচু করে দ্রুত এগিয়ে চলল গাড়ির পেছনে। গাড়ির সাথে একটা অনূকুল এ্যাংগেলে আসার পর তার দুই সাথীকে লক্ষ্য করে বলল, তোমরা গাড়ীগুলোর উপরের অংশে ফায়ার কর আর আমি গাড়িগুলোর টায়ার কতটা নষ্ট করা যায় দেখি।
রবার্তোদের ফায়ার শুরু হলো।
গাড়িগুলো তখন ওভানডোদের বাড়ির পথে অর্ধেকেরও বেশি এগিয়েছে?
রবার্তোদের ফায়ার শুরু হবার সাথে সাথে চারটি গাড়িই থেমে গেল।
দু’টি টায়ার ফাটার শব্দ হলো, তাও পেছনের দু’টি ক্যারিয়ারের।
গাড়ির ওপর গুলীবর্ষণ চলতে থাকল অবিরামভাবে যাতে ওরা গাড়ি থেকে নেমে পজিশন নেওয়ার সু্যোগ না পায়। আর যদি গাড়ির ওপাশে ওরা নামার চেষ্টা করে তাহলে লিউনার্দো ওদের টার্গেট করবে।
রবার্তোর এই চিন্তার সাথে সাথেই ওপার থেকে অনেকগুলো স্টেনগান গর্জন করে উঠল। গাড়ীর আরও কয়েকটি টায়ার ফাটার শব্দ হলো।
গাড়ি থেকে কোন গুলী হচ্ছে না। এদিক থেকে রবার্তো ওদিক থেকে লিউনার্দো গুলী বর্ষণ অব্যাহত রেখে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের টার্গেট গাড়িগুলোকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে লড়াইটাকে মুখোমুখি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। কারণ তাদের দরকার তাড়াতাড়ি লড়াই সমাপ্ত হওয়া।
কিন্তু রবার্তো ও লিউনার্দো গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই চারটি গাড়ি থেকে একসাথে গুলী বর্ষণ শুরু হলো।
রবার্তো ভাবল পুলিশ তাদের কাছে আসারই অপেক্ষা করছে যাতে তারা টার্গেট সুনির্দিষ্ট করতে পারে।
কিন্তু তাদের টার্গেট সুনির্দিষ্ট হচ্ছে না। পুলিশকে এলোপাতাড়ি গুলী ছুড়তে হচ্ছে।
গাড়ি চারটি ঝাঁঝরা হয়ে গেল। কিন্তু পুলিশ কয়জন আহত-নিহত হয়েছে বুঝতে পারল না রবার্তোরা। তবে পুলিশ অবরুদ্ধ হয়ে বেকায়দায় পড়েছে নিঃসন্দেহ।
আবারও হঠাৎ পুলিশের গুলী বর্ষণ একসাথে বন্ধ হয়ে গেল। লিউনার্দো রবার্তোকে টেলিফোনে জানাল পুলিশ আমাদের আরও ক্লোজ করতে চাচ্ছে তাদের কাছে। এর অর্থ তাদের আরও সুনির্দিষ্ট হওয়ার সুযোগ দেয়া অথবা লড়াই লংগার করার জন্যে তাদের গুলী তারা সাশ্রয় করতে চাচ্ছে।
রবার্তো উত্তরে বলল, এ সুযোগ তাদের দেয়া যাবে না বস। সময় পেলে টেলিফোন করে আরও পুলিশ তারা আনবে। আমরা তাতে বিপদে পড়ব। আমার প্রস্তাব হলো আমরা চারদিক থেকে গুলী অব্যাহত রাখি, আর কয়েকজন ক্রলিং করে গিয়ে গাড়ি দখল করুক। এই অন্ধকারে ওদের চোখকে ফাঁকি দেয়া যাবে। তাছাড়া ওদের নজর থাকবে গুলীর উৎসের দিকে।
লিউনার্দো বলল টেলিফোনে, ঠিক আছে। আমি পাঁচজনকে পাঠাচ্ছি, তুমি একজনকে পা………………। হঠাৎ কন্ঠ থেমে গেল লিউনার্দোর।

ওভানডোদের বাড়িতে প্রায় এসে গেছে আহমদ মুসা। দু’শ গজ দূরেও নয় আর বাড়িটা। হঠাৎ প্রচন্ড গোলা-গুলীর শব্দে থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা এবং লিন্ডা ও ক্রিস্টিনাও।
আগে হাঁটছিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার পেছনে ক্রিস্টিনা। সবার শেষে লিন্ডা।
রবার্তোর ধারণাই ঠিক। আহমদ মুসা টেরেক স্টেটে প্রবেশ করেছে গোণী দরজা দিয়ে। দরজাটা ধ্বংস প্রাপ্ত দুর্গ থেকে সোজা পূর্বদিকের প্রাচীরে।
গোণী দরজার জায়গাটায় সমুদ্র-তীরের কোষ্টাল হাইওয়ে এবং টেরেক স্টেটের মাঝখানে রয়েছে ভাঙা মিনারের মত উঁচু স্থাপনা। এক সময় এটা বাতিঘর ছিল বলে মনে করা হয়। ভাঙা মিনারটি টেরেক স্টেটেরই অংশ। টেরেক স্টেটের প্রাচীর এবং ভাঙা মিনারের পশ্চিম দেয়াল একই। এই দেয়ালের মাঝ বরাবর প্রায় ছয় ফুট উঁচুতে দেখা যাবে একটা মরিচা ধরা পেরেকের মাথা। আর ঠিক তার নিচে মেঝে থেকে দুই ফুট উপরে আড়াই বর্গফুট আয়তনের একটা জানালা। জানালাটা ভারী ইস্পাতের প্লেট দিয়ে ঢাকা। এটাই টেরেক স্টেটে ঢোকার গোনী দরজা। স্প্রিং লকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পেরেকের মাথাটা টানলে দরজা উপরে উঠে যায়। দরজা পার হয়ে ওপারে গিয়ে দরজাটা টেনে নিচে নামিয়ে আনলে পেরেকটা আবার ভেতরে ঢুকে গিয়ে দরজা বন্ধ রাখে। ভেতরের পাশেও অনুরুপ পেরেকের সুইচ আছে।
গুলী গোলার শব্দে থমকে দাঁড়িয়েই আহমদ মুসা শব্দ লক্ষ্যে ফিরে তাকাল। বলল, ‘লিন্ডা সংঘর্ষটা চলছে টেরেক স্টেটের ভেতরে দুই গ্রুপের মধ্যে। আমি মনে করছি, এই সংঘর্ষের সাথে ওভানডোদের সর্ম্পক আছে। তোমরা এস, আমার সাথে দৌড়াও।’
বলে আহমদ মুসা ছুটল ওভানডোদের বাড়ির দিকে।
দাঁড়াল গিয়ে ওভানডোদের গেটে। দরজা বন্ধ। বাইরে কেউ নেই, ভেতরেও কোন সাড়া শব্দ নেই। তাহলে ঘুমুচ্ছে কি সবাই? সংঘর্ষটা তাহলে কাদের মধ্যে? গেটে কয়েকবার করাঘাত করল। কেউ সাড়া দিল না।
ইতিমধ্যে লিন্ডা ও ক্রিস্টিনা এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসা তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘লিন্ডা এটাই ওভানডোদের বাড়ি। দুর্গ থেকে সরে আসার পর এখানেই একটা বাড়ি বানানো হয়। সেটাও ভেঙে গেলে পরে এই বাড়ি বানানো হয়েছে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘লিন্ডা ও ক্রিস্টিনা তোমরা এখানে দাঁড়াও বা আসতে পার। ‍ওদিকে গিয়ে ডেকে দেখি। এখান থেকে ওদের জাগানো যাবে না।
‘আমাদের ভয় করছে, আপনার সাথে যাব।’
বলে লিন্ডা ও ক্রিস্টিনা হাঁটা শুরু করল আহমদ মুসার পেছনে পেছনে।
ওভানডোর ঘরটা বাড়ির দক্ষিণ দিকের একেবারে মাঝামাঝি জায়গায়।
আহমদ মুসা গিয়ে দাঁড়াল ওভানডোর জানালা বরাবর নিচে।
ওভানডো থাকে দোতলায়। লোহার গরাদে ঢাকা। আহমদ মুসা সেখানে দাঁড়িয়ে উপর দিকে চোখ তুলতে গিয়ে একতলার গরাদের ফাঁক দিয়ে আলো দেখতে পেল। কথার অস্পষ্ট শব্দও তার কানে এল।
যে ফাঁক দিয়ে আলো আসছে সে ফাঁকে চোখ লাগাল আহমদ মুসা। ফ্যামিলি গ্যাদারিং-এর সবচেয়ে বড় লাউঞ্জ এখানে। এবং এখানেই বাড়ির আন্ডার গ্রাউন্ড সেন্টারে নামার গোনী সিঁড়িপথ রয়েছে।
আহমদ মুসা চোখ লাগিয়ে পরিষ্কার কিছু দেখতে পেল না। তবে বুঝল, লোকজন রয়েছে ভেতরে।
আহমদ মুসা হাত দিয়ে নক করল লোহার গরাদে। কোন ফল হলো না।
অবশেষে জানালার গরাদে ধাক্কালো এবং গরাদের ফাঁকে মুখ নিয়ে ‘ওভানডো, ওভানডো, বলে ডাকা শুরু করল।
মিনিট খানেক পরে লোহার গরাদটা দু’ইঞ্চি খুলে গেল। বাইরে অন্ধকার, কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কণ্ঠ ভেসে এল, ‘কে আহমদ মুসা ভাই?’ ভয়ার্ত কণ্ঠ ওভানডোর।
‘হ্যাঁ, আমি আহমদ মুসা ওভানডো।’ বলল আহমদ মুসা গরাদের ফাঁকে মুখ নিয়ে।
সংগেই সংগেই গোটা জানালাটা খুলে গেল। দেখা গেল ভেতের পরিবারের সবাই। ভয়ে কুকঁড়ে আছে সকলে।
জানালা খুলতেই আহমদ মুসা দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘ওভানডো তাড়াতাড়ি গেট খুলে দাও। কথা পরে বলছি।’
‘ভাইয়া, আপনি গেটে যান। আমি যাচ্ছি গেটে।’ বলেই ওভানডো ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটল।
আহমদ মুসারাও ছুটল গেটের দিকে। গেট খুলল ওভানডো। তার সাথে পরিবারের সবাই হাজির। ওভানডো জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। শিশুর মত কেঁদে উঠল ওভানডো। বলল, ‘আপনি ফেরেশতা ভাইজান। আল্লাহ আপনাকে ঠিক সময়েই পাঠান।’
ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া ওভানডোর বোন লিসা, মুখে ওড়না দিয়ে কান্না চাপার চেষ্টা করছে। ওভানডোর মা, দাদী, স্ত্রী সবার চোখেই পানি।
আর এদিকে লিন্ডা ও ক্রিস্টিনা বিস্ময়ভরা চোখে দেখছে পরিবারের সবাইকে।
আহমদ মুসা ওভানডোর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘ওভানডো এখন ভয় বা আবেগ প্রকাশের সময় নয়, তুমি বল কি ঘটেছে?’
ওভানডো চোখ মুছে বলল, ‘স্যরি।’
তারপর সে কোন অজ্ঞাত শত্রু কর্তৃক তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলার কথা, দরজা ধাক্কানীর কথা এবং ওদের দরজা খোলার নানা চেষ্টার বিবরণ দিয়ে বলল, ‘হঠাৎ করেই এই সংঘর্ষ ওখানে শুরু হয়ে গেছে। আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে এইটুকু বুঝতে পারছি, এই সংঘর্ষ শুরু না হলে ওরা এতক্ষণে আমাদের দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে যেত।’
‘তোমরা কি পুলিশে টেলিফোন করেছিলে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ, লিসা টেলিফোন করেছিল।’ বলল ওভানডো।
আহমদ মুসা তাকাল লিসার দিকে। লিসা চোখ মুছছিল। বলল, ‘ভাইয়া আমি টেলিফোন করেছিলাম প্রধানমন্ত্রীকে, ফাতিমার আব্বাকে। উনি সংগে সংগেই পুলিশ পাঠাচ্ছেন বলেছিলেন।’
‘ধন্যবাদ লিসা, তুমি ঠিক জায়গায় টেলিফোন করেছিলে। পুলিশের কাছে টেলিফোন করলে পুলিশ অতটা গুরুত্ব নাও দিতে পারতো।’
একটু থেমে ওভানডোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সন্দেহ নেই ওভানডো, পুলিশের সাথে সেই অজ্ঞাত শত্রুদের সংঘর্ষ হচ্ছে। তবে আমি মনে করি, শত্রু অজ্ঞাত নয়। মাফিয়া অর্থাৎ ‘কিনিক কোবরা’র সদস্যরাই এখানে অভিযানে এসেছে।’
‘কিনিক কোবরা?’ বিস্মিত ওভানডোর মুখে প্রশ্ন ফুটে উঠল।
‘তোমার প্রশ্নের উত্তর পরে হবে।’ বলে সকলকে উদ্দেশ্য করে লিন্ডা ও ক্রিস্টিনাকে দেখিয়ে বলল, ‘এদের আপনারা ভেতরে নিয়ে যান। এদের পরিচয় এদের কাছ থেকেই আপনারা জেনে নেবেন। আমি ওদিকে যাই। কি ঘটছে দেখি। পুলিশকে ওরা কাবু করতে পারলে ওরা হামলা করবে এখানে।’
আহমদ মুসা তার মিনি মেশিনগান ‘উজি’ হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে চলতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। বলল ওভানডোকে, ‘তুমি ঘর থেকে আমার এম-১০ টা এনে দাও। ম্যাগজিন ঠিক আছে কিনা দেখো।’
ওভানডো ছুটল ভেতরে। ওভানডোর মা লিন্ডাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মা তুমি ভেতরে এস।’ বলে নিজের এবং পরিবারের সবার পরিচয় দিল লিন্ডাকে।
‘মা, আমার পরিচয়টা? আমি দেখছি পরিবারের বাইরের হয়ে গেলাম!’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
মিস্টি হাসল ওভানডোর মা। বলল, ‘তুমি আমার বড় ছেলে, আমার এই নতুন মা তা ভালো করেই জানে। পরিচয় দিতে হবে কেন?’
‘আমি কিন্তু মা আপনার সবচেয়ে বড় সন্তান। মি. আহমদ মুসা ভাইয়া নিশ্চয় বয়সে আমার ছোট হবেন।’ বলল লিন্ডা ওভানডোর মাকে লক্ষ্য করে।
‘নিশ্চয় মা, ওয়েলকাম।’ বলে ওভানডোর মা দুই হাত বাড়ালো লিন্ডার দিকে। লিন্ডা গিয়ে জড়িয়ে ধরল ওভানডোর মাকে।
লিন্ডা একে একে দাদী, ওভানডোর স্ত্রী জ্যাকি, লিসা সবাইকে জড়িয়ে ধরল।
লিসা লিন্ডাকে ছেড়ে দিয়েই কাছে টেনে নিল ক্রিস্টিনাকে। বলল, ‘মামনি, আমি তোমার আন্টি।’
‘দাদী, এই মুহুর্তে লিন্ডা ও ক্রিস্টিনা যে আদর পেল এক মাসেও তা আমি পাইনি। তাই তো মানুষ বলে, ‘রক্তের টান সবচেয়ে বড় টান।’ কৃত্রিম অভিমানের স্বরে বলল আহমদ মুসা।
‘যে সব সময় মারামারি আর গোলাগুলী নিয়ে থাকে, সে মানুষের আদর-মমতা বুঝবে কি করে! যাক সে কথা ভাই, রক্তের টানের কথা বলছ কেন? লিন্ডা কে?’
এ সময় এম-১০ নিয়ে হাজির হলো ওভানডো।
আহমদ মুসা তার হাত থেকে এম-১০ নিয়ে নিল। বলল দাদীর কথার উত্তরে, ‘দাদী এ প্রশ্নের জবাব আমার চেয়ে লিন্ডাই ভাল দিতে পারবে।’
বলে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা। ওভানডো বলল, ‘ভাইয়া আমি আপনার সাথে যাব। আমার জন্যে স্টেনগান নিয়ে এসেছি একটা।’
আহমদ মুসা থেমে গিয়ে শক্ত দৃষ্টিতে ওভানডোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এত বড় বাড়িতে এই পরিস্থিতিতে এতগুলো জীবনের পাহারায় একজন পুরুষ কি থাকা উচিৎ নয় ওভানডো?’
ওভানডো মুখ নিচু করল। কিছু বলতে পারলো না।
আহমদ মুসা আবার ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। ওভানডোর দাদী বলে উঠল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘ভাই তুমি তো কারও মমতা, ভালবাসার দিকে এক বিন্দুও তাকাও না। এইতো ওভানডোর মমতাকে তুমি কর্তব্যের হাতুড়ি দিয়ে কিভাবে গুড়িয়ে দিলে!’
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়িয়েছিল। বলল, ‘মমতা-ভালবাসার সুশীতল অংগন সবার জন্যে নয় দাদী!’
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত হাটতে শুরু করল।
সবার অপলক দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। ওভানডোর দাদী বলে উঠল, ‘আমার কর্তব্য-পাগল এ ভাইটিকে দেখলে মনে হয় সে অন্য কোন কিছুরই তোয়াক্কা করে না। কিন্তু তার ভেতরে রয়েছে কান্নার এক সাগর। কান্নার এ বুভুক্ষা মমতার পিয়াসী।’ ধীর স্বগতোক্তির মত কণ্ঠস্বর ওভানডোর দাদীর।
দক্ষিণ দিক থেকে ভেসে আসা অবিরাম গুলী বর্ষণের উত্তপ্ত তরঙ্গে বেসুরো লাগল ওভানডোর দাদীর মমতার সুর।
ওভানডো ধীরে ধীরে এগিয়ে দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, ‘ভাইয়াকে জীবন-মৃত্যুর খেলায় ঠেলে দিয়ে এভাবে তার পেছন থেকে দরজা বন্ধ করতে খুব খারাপ লাগছে।’
‘আহমদ মুসা সবার জন্যে ভালোটাই চিন্তা করে ওভানডো।’ বলল ওভানডোর মা।
‘শুধু নিজের ভালোটা ছাড়া, আম্মা।’ বলল ওভানডো দরজা বন্ধ করে ফিরতে ফিরতে।
‘আমি পারবো না, কিন্তু তোর কথার জবাব আমার ঐ ছেলের কাছে আছে।’ বলে ওভানডোর মা লিন্ডার এক হাত ধরে বলল, ‘চল মা।’
ওভানডোর মা লিন্ডাকে নিয়ে হাঁটা শুরু করল। তার সাথে চলল ক্রিস্টিনাও।
ওদিকে আহমদ মুসা ওভানডোদের বাড়ির এলাকা পার হবার পর সংঘর্ষের স্থানটাকে মোটামুটি চিহ্নিত করে নিয়ে দ্রুত পৌঁছাবার জন্যে মাঠের মধ্যে দিয়ে ছুটল। রাস্তা দিয়ে গেলে দেড়গুণ রাস্তা বেশি অতিক্রম করতে হয়।
আহমদ মুসা গোলাগুলীর রেঞ্জে আসার পর মাটিতে শুয়ে পড়ে ক্রলিং করে এগুতে লাগল। প্রায় ১০০ গজের মধ্যে এসে গেছে আহমদ মুসা। এখন সামনের সবটাই তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। রাস্তার উপর চারটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। দুটি জীপ এবং দুটি ক্যারিয়ার। আহমদ মুসা নিশ্চিত ৪টি গাড়িই পুলিশের। বোঝা যাচ্ছে পুলিশের গাড়ি আক্রান্ত হয়েছে ‘কিনিক কোবরা’দের দ্বারা। ভাল করে খেয়াল করে সে বুঝল, এই মুহুর্তে গাড়ি থেকে গুলী আসছে না। উত্তর দিক থেকে বেশির ভাগ গুলী যাচ্ছে। দক্ষিণ দিক থেকেও গুলী আসছে, তবে কম। খুশি হলো আহমদ মুসা। কারণ সে এগুচ্ছে দক্ষিণ দিকে। দক্ষিণ দিক থেকে গুলী এলে এগুনো কঠিন হতো।
যেখানে গাড়ি চারটি দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে রাস্তা উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোনাকুনি। আর আহমদ মুসা সোজা দক্ষিণে এগুচ্ছে। অতএব গাড়িগুলো তার মুখোমুখি। যতটা সে বুঝতে পারলো গাড়িগুলোর টায়ার নষ্ট করে দেয়া হয়েছে, যাতে গাড়িগুলো চলতে না পারে। গাড়ি না চলুক পুলিশের তরফ থেকে গুলী আসছে না কেন? সব পুলিশ মারা গেছে, এটা অসম্ভব। তাহলে এটা তাদের কোন কৌশল?
পুলিশের গাড়ির দিকে গুলী যাচ্ছে যেহেতু উত্তর দিক থেকে বেশি, সেহেতু আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো ‘কিনিক কোবরা’দের মূল শক্তি উত্তর দিকে।
আহমদ মুসা তার গতি পরিবর্তন করে পশ্চিম দিকে এগুলো। ‘কিনিক কোবরা’দের ঠিক পেছনে গিয়ে ওদের দিকে অগ্রসর হবার জন্যে।
আহমদ মুসা এগুলো নিঃশব্দে, সাপের মত। ‘উজি’ কারবাইনটা কাঁধে ঝুলানো, আর হাতে রয়েছে তার প্রিয় এম-১০।
আহমদ মুসা পশ্চিম দিকে এগিয়ে ওদের পেছনে পৌছার পর এগুতে লাগল কিনিক কোবরা’র দিকে।
অনেকটা এগিয়েছে আহমদ মুসা, মাঝখানে দশগজও দুরত্ব নেই। ছায়ামূর্তির মত ওদের প্রত্যেককেই দেখতে পাচ্ছে আহমদ মুসা। ওরা ছয়-সাতজন হবে।
আহমদ মুসার এম-১০ রেডি। এম-১০ এর ট্রিগারে রয়েছে তার তর্জনি।
আহমদ মুসা স্পষ্ট করে তাদের দেখতে চায়।
আরও সামনে এগুতে লাগল সে।
হঠাৎ একটা ধাড়ি ইঁদুর তার সামনে দিয়ে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে চলে গেল। যাবার সময় ইদুরটা কয়েকটা শুকনো পাতা সজোরে উল্টিয়ে দিয়ে গেল। ঠিক সেই সময় গুলী বর্ষণে একটা ছেদ নেমেছিল। নিরবতার মধ্যে শুকনো পাতার শব্দ যেন বুলেটের মতই শব্দ করে উঠল।
শংকিত ও সর্তক আহমদ মুসা দেখল মোবাইল কানে ধরে রাখা একজন লোক এদিকে ফিরে তাকিযেছে এবং আহমদ মুসাকে দেখতেও পেয়েছে। দেখতে পাওয়ার সাথে সাথে তার হাতের মোবাইলটা পড়ে গেল এবং ডান হাতের দিকে ছুটে গেল তার বাম হাত।
কি ঘটতে যাচ্ছে আহমদ মুসা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু লোকটার স্টেনগান গর্জে উঠার আগেই আহমদ মুসার এম-১০ গর্জে উঠল। শুধু ঐ লোকটিই নয়, ওদের সবার উপর দিয়ে একবার ঘুরে এল তার এম-১০।
গুলী করার পর কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল আহমদ মুসা। ‘কিনিক কোবরা’র এ লোকদের তরফ থেকে আর কোন সাড়া এল না।
আহমদ মুসা এগুলো ওদের দিকে। দেখল, গুলী খেয়ে পড়ে যাওয়া লাশগুলোর উঠে দাঁড়াবার কোন লক্ষণ নেই। মোবাইলে যে লোকটি কথা বলছিল তার লাশের পাশে মোবাইলটা পাওয়া গেল। মোবাইলটা তুলে নিল আহমদ মুসা। মোবাইলটা অন ছিল তখনও। মোবাইলটা আহমদ মুসা কানে ধরল। ওপার থেকে একটা কণ্ঠ চিৎকার করছে, ‘লিউনার্দো, কি ব্যাপার? কি ঘটেছে? কথা বলছ না কেন?’
‘লিউনার্দোসহ এখানে সাতজন মারা গেছে। তোমরা অস্ত্র ফেলে দিয়ে সারেন্ডার কর।’ উচ্চ কণ্ঠে নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কণ্ঠ গাড়ির পুলিশরাও শুনতে পেয়েছিল। দৃশ্যপটে তৃতীয় পক্ষ হাজির হয়েছে এবং এই তৃতীয় পক্ষই যে উত্তর পাশের শত্রু গ্রুপের উপর গুলী বর্ষণ করেছে তাও তারা দেখেছে।
আহমদ মুসার কণ্ঠ থামার সাথে সাথে সামনের জীপের মেঝেতে আশ্রয় নেয়া পুলিশ কমিশনার জীপের মেঝেতেই উঠে বসে বলল, ‘আপনি কে জানি না। আপনাকে ধন্যবাদ। শত্রু এখন শুধু এক দি….।’
তার কথা শেষ হলো না, গুলী বর্ষণ শুরু হলো দক্ষিণ দিক থেকে।
পুলিশের সেই কণ্ঠ কথা অসমাপ্ত রেখেই পুলিশের উদ্দেশ্যে নির্দেশ দিল, ‘ফায়ার’।
পুলিশ গুলী ছুড়ছে তাদের গাড়ি থেকে সুনির্দিষ্ট টার্গেট না করে। অন্যদিকে দক্ষিণ দিক থেকে কিনিক কোবরা’র লোকরা যে গুলী ছুড়ছে তার সুনির্দিষ্ট কোন কিছুকে টার্গেট নিয়ে নয়, গাড়ির দিকে।
আহমদ মুসার মনে হলো, পুলিশের টার্গেট শত্রুদের পরিশ্রান্ত করা, তাদের অধৈর্য করে তোলে শেল্টারের বাইরে নিয়ে আসা এবং ওদের গুলী শেষ করা।
পুলিশের এ প্রচেষ্ট সময় সাপেক্ষ। তাছাড়া শত্রু গুলী শেষ হবার আগে আশ্রয় থেকে বেরিয়ে না এসে পালিয়েও যেতে পারে।
আহমদ মুসা পুলিশের সনাতন ও দায়সারা কৌশলের উপর নির্ভর না করে ক্রলিং করে আরও পশ্চিম দিকে এগিয়ে অনেক দূর দিয়ে পুলিশের গাড়ি অতিক্রম করে দক্ষিণ দিকে এগুলো। ‘কিনিক কোবরা’র লোকেরা যে অবস্থানে থেকে পুলিশের গাড়ির দিকে গুলী ছুড়ছে, তার পেছনে না পৌঁছা পর্যন্ত আহমদ মুসা তার দক্ষিণ মুখে যাওয়া অব্যাহত রাখল। কিনিক কোবরা’দের পেছন বরাবর পৌঁছার পর আহমদ মুসা তার এগুনোর দিক পরিবর্তন করে কিছুটা পূব দিকে এগিয়ে তারপর উত্তর দিকে এগুতে লাগল।
অল্পক্ষণের মধ্যে আহমদ মুসা ওদের পেছনে চলে এল। প্রায় দশ গজের মধ্যে। একদিকে গুলীর শব্দ, অন্যদিকে মনোযোগ সামনের দিকে নিবদ্ধ থাকায় কিনিক কোবরা’র লোকেরা কিছুই টের পেল না।
আহমদ মুসা দেখল, কিনিক কোবরা’র লোকরা মাত্র তিনজন। ওরা একটা ঢিবির আড়ালে পাশাপাশি হাঁটু গেড়ে বসে গুলী করছে।
আহমদ মুসা তার এম-১০ তুলে ধরল। তারপর এম-১০ এর নল তাক করল ওদের দিকে। আহমদ মুসা তার তর্জনি রাখল এম-১০ এর ট্রিগারে। তারপর সে মুখে একটা শীষ দিয়ে উঠল ওদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে।
আহমদ মুসা শীষ দেবার সাথে সাথেই ওরা তিনজন একসাথে বিদ্যূত্ বেগে মুখ ফিরাল এবং ঘুরে এল তাদের স্টেনগানসহ অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে গুলী বর্ষণ অব্যাহত রেখেই।
আহমদ মুসা ওদের অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সেকেন্ডের জন্যে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। স্থির হয়ে পড়েছিল ট্রিগারে রাখা তার তর্জনি। পরক্ষণেই আহমদ মুসা সামলে নিয়েছিল নিজেকে। তার তর্জনি চেপে ধরেছিল এম-১০ এর ট্রিগারে। ওরা স্টেনগান ঘুরিয়ে নিয়েছিল এবং গুলীর বৃষ্টিও বেরিয়ে এসেছিল তাদের তিনজনের স্টেনগান থেকে কিন্তু তাদের স্টেনগানের নল ভূমি এ্যাংগেলে নেমে আসার সময় পায়নি, ফলে শুয়ে থাকা আহমদ মুসাকে নাগাল পায়নি সেই গুলীগুলো। আহমদ মুসার আড়াই ফিট তিন ফিট উপর দিয়ে চলে যায় গুলীর ঝাঁক। সেই সুযোগে আহমদ মুসার এম-১০ এর গুলীর বৃষ্টি ঝাঁঝরা করে দিয়েছে ওদের তিনজনকে।
মৃত্যুরুপী বুলেটের ঝাঁক থেকে তাকে রক্ষা করায় সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।
এখনও গুলী বৃষ্টি হচ্ছে পুলিশের গাড়ি থেকে।
আহমদ মুসা শুয়ে থেকেই চিত্কার করে উঠল, পুলিশদের উদ্দেশ্যে, ‘আপনারা গুলী বন্ধ করুন। এরা সবাই মারা গেছে। আমি প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তার লোক বলছি।’
এর কয়েক সেকেন্ড পর গুলী থেমে গেল এবং তার সংগে সংগে গাড়ি থেকে নেমে ছুটে এল পুলিশ। তাদের সবার হাতেই টর্চ।
আহমদ মুসা ভূমিশয্যা থেকে উঠে বসল।
আহমদ মুসার উপর চোখ পড়তেই একজন পুলিশ আনন্দে চিত্কার করে উঠল, ‘স্যার, এ যে দেখছি প্রধানমন্ত্রীর ড্রাইভার-কাম-সিকিউরিটি, যিনি কিডন্যাপ হয়েছিলেন।’
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল পুলিশ কমিশনার। আহমদ মুসা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার একহাতে ‘উজি’ কারবাইন, অন্যহাতে এম- ১০।
আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে পুলিশ কমিশনার বলল, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, শত কোটি ধন্যবাদ যে, আপনাকে পাওয়া গেছে। মহা খুশি হবেন এ খবর পেলে প্রধানমন্ত্রী মহোদয়।’
বলেই পকেট থেকে মোবাইল বের করল পুলিশ কমিশনার। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘দাঁড়ান মিস্টার, আপনার সাথে পরে কথা বলছি। প্রধানমন্ত্রী মহোদয়কে খবরটা জানিয়ে দেই।’
পুলিশ কমিশনারের কথা শেষ হলো, তার সাথে সাথে মোবাইলে সে প্রধানমন্ত্রীকে পেয়েও গেল। বিগলিত কন্ঠে সম্ভাষণ জানিয়ে সে বলতে শুরু করল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্যার, সুখবর। কিডন্যাপ হওয়া আপনার ‘ড্রাইভার-কাম-সিকিউরিটি’ সাহেবকে পাওয়া গেছে।’
‘হ্যাঁ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, উনি ভাল আছেন। এই তো আমার সামনে। ওর এক হাতে এখনও এম ১০ এবং অন্যহাতে ‘উজি’ কারবাইন।’
‘এখানকার গন্ডগোল এখন শেষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সংঘর্ষে আমরাই জিতেছি। অবশ্য উনি এসে না পড়লে লড়াই ভোর পর্যন্ত চলত। চারদিকের গুলী বৃষ্টির মাঝখানে আমরা চারটা গাড়িতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। উনি একা ওদের সবাইকে হত্যা করেছেন। তারপর আমরা গাড়ি থেকে নেমে এলাম।’
‘স্যার, উনি কিভাবে কোত্থেকে এসে পৌঁছলেন আমি এখনও শুনিনি স্যার। আর আমরা মি. ওভানডোদের বাড়িতে পৌঁছতেই পারিনি। টেরেক স্টেটের মাঝ বরাবর যখন গাড়ি বহর, তখন আমরা মাফিয়াদের দ্বারা আক্রান্ত হই।’
‘হ্যাঁ প্রধানমন্ত্রী মহোদয় স্যার। আমরা যাব মি. ওভানডোদের বাড়িতে এবং কয়েকজন পুলিশ রেখে আসব তাদের বাড়িতে।’
‘হ্যাঁ স্যার, ইয়েস স্যার। টেলিফোন দেব ওঁকে? দিচ্ছি। স্যার বিদায়, ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।’
কথা শেষ করে পুলিশ কমিশনার মোবাইলটা আহমদ মুসার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘নিন, তাড়াতাড়ি ধরুন। প্রধানমন্ত্রী মহোদয় কথা বলবেন।’
আহমদ মুসা টেলিফোন ধরল। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর বলল, ‘না আপনি ব্যস্ত হবেন না, উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। আমি একদম ভাল আছি। আমি এসে সব বলব।’
‘বলছি, আজ রাত ১ টায় ওদের বন্দীখানা থেকে মুক্ত হতে সমর্থ হই। সমুদ্র উপকুলে টিলার মত একটা ছোট্ট দ্বীপের এক বাড়িতে আমাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। মুক্ত হবার পরই আমি ওভানডোদের এখানে ছুটে আসি। এসে দেখি সংঘর্ষ চলছে।’
‘সে অনেক কথা। এসে বলব।’
‘হ্যাঁ, ওভানডোরা সবাই ভাল আছে। আমার মনে হয় পুলিশ এসে না পড়লে ওদের ক্ষতি হতে পারতো।’
‘না মি. হাত্তা। যে কাজটাকে আমার বলছেন, সেটা করার আমি একটা নিমিত্ত মাত্র। আল্লাহ সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং আমাকে সামর্থ্যও দিয়েছেন। অতএব প্রশংসার যদি কিছু থাকে, সেটা মহান আল্লাহরই প্রাপ্য।’
‘ঠিক আছে। আজকেই দেখা হবে।’
‘না না। আমার পুলিশ প্রটেকশন দরকার নেই। ওভানডোদের বাড়িতে কয়েকজন পুলিশ থাকলেই চলবে।’
‘ঠিক আছে। এখনকার মত এটুকুই। পরে দেখা হবে।’
সালাম দিয়ে মোবাইলটা আহমদ মুসা পুলিশ কমিশনারের দিকে তুলে ধরে বলল, ‘পুলিশের লোকজনকে এদের লাশ নিয়ে যেতে বলুন। চলুন আমরা ওভানডোদের ওখানে যাই।’ পুলিশ কমিশনারকে লক্ষ্য করে বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ কমিশনার কয়েকজন পুলিশকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে অন্য পুলিশদের সাথে নিয়ে ওভানডোদের বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করল।
আহমদ মুসার সাথে হাঁটছে তারা।

Top