৩৬. গুলাগ অভিযান

চ্যাপ্টার

লিসবনের হোটেল ভাস্কোদাগামা।
পাশাপাশি দুটি কক্ষ।
৭১১ নং কক্ষে থাকে রবীন সিং রাফায়েল ওরফে আহমদ মুসা এবং ৭১২ নং কক্ষে থাকে লছমন লিওনার্দো ওরফে হাসান তারিক।
দুজন দুকক্ষে থাকলেও দুজনেই এখন আহমদ মুসার কক্ষে দুচেয়ারে বসে।
তাদের সামনে টেবিলে উচ্ছিষ্ট খাবার, কয়েক মিনিট আগে তারা খাবার শেষ করেছে।
দশটায় তাদের এয়ারপোর্টে পৌছতে হবে বলে খাবার খাওয়া তারা আগেই সেরে নিয়েছে। বেয়ারা এসে এখনো উচ্ছিষ্টগুলো নিয়ে যায়নি।
বেয়ারা এসে গেল।
উচ্ছিষ্ট খাবার আর বাসনপত্র গোছাতে গোছাতে বলল, ‘স্যার, আপনাদের পরিচিত কে একজন এসেছিল। আপনারা কক্ষে আছেন কিনা জিজ্ঞেস করল। কিন্তু আমি ‘আছেন’ বলার পর তারা ঘরে প্রবেশ না করে তাড়াতাড়ি চলে গেল।’
‘এটা তুমি কখনকার ঘটনা বলছ?’ জিজ্ঞেস করল রবীন সিং রাফায়েল ওরফে আহমদ মুসা।
‘এই তো স্যার ৫ মিনিটও হয়নি।’ বলল বেয়ারা।
‘কি রকম চেহারা বলত?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘বলা যায় পর্তুগীজ চেহারাই। তবে মুখ অপেক্ষাকৃত লাল। মোটামুটি লম্বা-চওড়া।’ বলল বেয়ারা।
আহমদ মুসা বেয়ারাকে বখশিশ দিয়ে বলল, ‘একটু দেখবে, তাকে দেখা যায় কিনা। পেলে নিয়ে আসবে।’
বেয়ারা চলে গেল।
বেয়ারা চলে যেতেই হাসান তারিক বলে উঠল, ‘আমি নিশ্চিত ভাইয়া, শত্রুরা আমাদের খোঁজ পেয়ে গেছে।’
‘তাইতো মনে হচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে?’
ভাবছিল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমার মনে হয় ওরা লবীতে অপেক্ষা করছে। এমনও হতে পারে ওরা হোটেলের চারদিকেই পাহারায় আছে।’
‘দুজন মুসলমান আমরা, একথা তারা নিশ্চিত জানেন। তাই আমার মনে হয় মাত্র দুজন মুসলমানকে ধরার জন্যে ওদের এতকিছু করা স্বাভাবিক নয়।’ বলল হাসান তারিক।
‘তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে খারাপটার কথা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এখন তাহলে আমাদের কি করণীয়?’ বলল হাসান তারিক।
‘আমাদের করণীয় হলো আজোরস দ্বীপপুঞ্জে পৌছে যাওয়া। তার আগে কোন সংঘাতে জড়িয়ে না পড়া, যা আমাদের আজোরস যাত্রায় কোন বিঘ্ন ঘটাতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু সংঘাত আসন্ন মনে হচ্ছে ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
‘দেখা যাক। তুমি রেডি তো এয়ারপোর্ট যাত্রার জন্যে?’
‘হ্যাঁ ভাইয়া। ব্যাগটা রেডি করে রেখেছি।’
‘ধন্যবাদ, তবে শুধু এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্যে রেডি নয়, লড়াইয়ের জন্যেও রেডি হবে। যাও, ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এস। হোটেলের বিল পরিশোধ করে এসেছি। চেক আউটও হয়ে গেছে। আমি বেরুচ্ছি।’
হাসান তারিক উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আসুন, আমিও বের হচ্ছি।’
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই করিডোরে বেরিয়ে এল। দুজনের হাতে দুটি ব্যাগ।
‘আমরা কি সোজা লবি হয়ে বের হবো ভাইয়া?’ হাসান তারিক বলল।
‘হ্যাঁ অবশ্যই।’ বলে লিফট রুমের দিকে হাঁটা শুরু করল আহমদ মুসা।
হাসান তারিকও তার পেছনে হাঁটা শুরু করল।
তারা দুজন যখন লিফটের সামনে এসে দাঁড়াল, ঠিক তখনি লিফট থেকে বেরিয়ে এল বেয়ারা সেই দুজন লোককে সাথে নিয়ে।
আহমদ মুসা অপরিচিত দুজনের দিকে একবার তাকিয়েই বুঝতে পারল, বেয়ারা ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মির দুজন লোককে তাদেরই ঘরে নিয়ে আসছে।
বেয়ারার সাথে ছফুটের মত লম্বা ও জিমন্যাষ্টের মত স্বাস্থ্যের অধিকারী যে লোকটি আহমদ মুসার সন্ধানে হোটেলে ছুটে এসেছে তার নাম মারিও জোসেফ। আর তার সাথের লোকটি হলো, তার দক্ষিণ হস্ত, সেই সিলভা।
যাদেরকে আহমদ মুসা এড়াতে চাচ্ছে, তাদের একদম মুখোমুখি হয়েও আহমদ মুসার চোখে-মুখে চাঞ্চল্যের সামান্য ছায়াও পড়ল না।
হাসিমুখে সে বলল, ‘বেয়ারা, আমাদের খোঁজ করছিলেন যারা তাদেরকে কি পেলে?’
‘স্যার, এরাই তো তাঁরা, আপনাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলাম।’ বলল বেয়ারা খুশি হয়ে দ্রুত কণ্ঠে।
বেয়ারার কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা হ্যান্ডশেকের জন্যে নেতা গোছের লম্বা-চওড়াজন অর্থাৎ মারিও জোসেফের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘ওয়েলকাম, আমি রবীন সিং রাফায়েল এবং আমার সাথি লছমন লিওনার্দো। আপনারা নাকি আমাদের খোঁজ করছিলেন?’
‘আপনারা কি আজ রাত ১২টার প্লেনে আজোরাস যাচ্ছেন?’ জিজ্ঞেস করল মারিও জোসেফ।
আহমদ মুসা একটুও ভ্রু কুচকালো না, মুখে সামান্য ভাঁজও পড়ল না। প্রশ্নের সংগে সংগেই সহজ ও সরল কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ যাচ্ছি তো?’
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মারিও জোসেফের। বলল, ‘আপনাদের দুজনকে আমাদের সাথে একটু যেতে হবে।’
‘কোথায়?’ আহমদ মুসার কণ্ঠে কৃত্রিম বিস্ময়ের সুর।
‘আমাদের অফিসে।’ বলল মারিও জোসেফ।
‘আপনাদের পরিচয় কিন্তু দেননি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি এ্যান্টেনিও। লিসবনের এই অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত অফিসার আমি।’ বলল মারিও জোসেফ।
এক কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার মুখে। বলল, ‘এমন ক্ষেত্রে আপনার আইডেনটিটি কার্ড দেখিয়ে এ ধরনের কথা বলা উচিত। তা আপনি দেখাননি।’
‘মাফ করবেন। আপনি সে ধরনের কেউকেটা নন বলেই দেখানো হয়নি। চলুন আপনারা।’ বলল মারিও জোসেফ।
‘যদি বলি যাব না আমরা। এক ঘন্টার মধ্যে আমাদের এয়ারপোর্টে পৌছতে হবে। আপনারা চাচ্ছেন প্লেনটা আমাদের ফেল হোক।’ আহমদ মুসা বলল।
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মারিও জোসেফের মুখ। বলল, ‘ধন্যবাদ। আমাদের সন্দেহকে আপনারা সত্য প্রমাণ করেছেন। আপনারা যাবেন না আমরা জানতাম। এজন্যে নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থাই করে এসেছি। হোটেল কর্তৃপক্ষও আমাদের সহযোগিতা করবেন। সুতরাং না গিয়ে আপনাদের উপায় নেই।’ বলল কঠোর কণ্ঠে মারিও জোসেফ।
‘সব বুঝলাম। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না আমাদের কেন যেতে হবে? আমরা কি কোন অপরাধ করেছি?’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে কৃত্রিম ক্ষুদ্ধতার সুর।
‘এটা হোটেল। এখানে আমরা সব কথার আসর বসাতে পারি না। অফিসে চলুন, সবই জানতে পারবেন।’ বলল এ্যান্টেনিও ছদ্মনামের মারিও জোসেফ।
আহমদ মুসা ভাবছিল। লোকটি যা বলেছে সব সত্যি। ওরা আট-ঘাট বেঁধেই এসেছে। আর এই হোটেলে ওদের সাথে লড়াইয়ে নামার মধ্যে কোন মংগল নেই। তাতে পর্তুগাল হয়ে আজোরাস যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পর্তুগালের পাসপোর্টে পর্তুগাল হয়ে আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার অনেক সুবিধা। এ সুবিধা আহমদ মুসা হাতছাড়া করতে চায় না। সুতরাং এই আজোরস যাওয়ার পথ যতটা নিরুপদ্রব হয় সে ধরনের ব্যবস্থাই করতে হবে। আহমদ মুসা এটাও ভাবল যে, আজোরস যাওয়ার পথে শুরুতেই ওদের হাতে বন্দী হবার মধ্যেও ঝুঁকি আছে। আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যাওয়াই যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে তো আসল কাজই পন্ড হয়ে যাবে। অবশেষে আহমদ মুসা ভাবল, ওদের হাতে বন্দীও হওয়া যাবে না, কিন্তু এই মুহূর্তে কোন ঘটনাও ঘটানো যাবে না, এই উভয় সংকটে আহমদ মুসা ধৈর্য্য ও অপেক্ষারই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।
মারিও জোসেফ থামলে আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। মুখে একটু হাসি টেনে বলল, ‘লছমন কি বল, এদের সাথে যাওয়ার জন্যে রেডি?’
হাসান তারিকের ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘রেডি, তবে ঠিক সময়ে প্লেন আমাদের ধরতে হবে।’
‘শুনেছেন তো মি. এ্যান্টেনিও? আমাদের প্লেন ছাড়ার আর মাত্র ৪০ মিনিট বাকি। চলুন।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক আগে আগে চলল। তাদের পেছনে মারিও জোসেফরা।
হোটেল থেকে বেরিয়ে এল তারা।
গাড়ি বারান্দায় একটা পাজেরো জীপ এবং একটা মাইক্রো দাঁড়িয়েছিল।
দুগাড়ি ঘিরে লোকরা দাঁড়িয়েছিল।
মারিও জোসেফ সেখানে পৌছেই লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘দুজনকে দুগাড়িতে তুলে তোমরা ওঠ গাড়িতে।’ বলে মারিও জোসেফ নিজে গিয়ে জীপের ড্রাইভিং সিটে উঠল।
লোকরা আহমদ মুসাকে জীপে এবং হাসান তারিককে মাইক্রোতে তুলতে গেল।
আহমদ মুসার হাতে ছিল একটা হ্যান্ড ব্যাগ, হাসান তারিকের হাতেও একটা।
আহমদ মুসা জীপে ওঠার আগে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। বলল হাসান তারিককে লক্ষ্য করে, ‘লছমন, আমার ব্যাগটাও তোমার কাছে থাক।’
বলে আহমদ মুসা কয়েক ধাপ এগিয়ে তার হাতের ব্যাগ হাসান তারিকের হাতে তুলে দিল। তারপর পেছন ফিরে জীপের দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে আবার থমকে দাঁড়িয়ে মুখ পেছন দিকে ঘুরিয়ে হাসান তারিককে লক্ষ্য করে বলল, ‘লছমন, ব্যাগটা বন্ধ করতে ভুলে গেছি। তুমি বন্ধ করো।’
‘ঠিক আছে। বুঝেছি।’ ওদিক থেকে বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল।
গাড়িতে উঠে বসেছে আহমদ মুসা।
দুটি গাড়ি ছুটে চলেছে শহরতলীর দিকে।
গাড়ি ষ্টার্ট দিতেই ওরা সব সিগারেট ধরিয়েছে। দুদিকের দুটি জানালা খুলে দেয়ার পরও গাড়ি ভরে গেছে সিগারেটের ধোঁয়ায়।
আহমদ মুসা প্রতিবাদ করল। বলল, ‘আপনারা গাড়িকে গ্যাস চেম্বার বানিয়ে ফেললেন, এটা কোন ভদ্রতা?’
আহমদ মুসার এ কথা নিয়ে ওদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা শুরু হলো। প্রথমেই মারিও জোসেফ বলল, ‘তাহলে বুঝুন হিটলার কতটা ভদ্র ছিল এবং তার গ্যাস চেম্বারগুলো কেমন ছিল!’
‘বস, সিগারেটের ধোঁয়াকে যে গ্যাস বলে তার পক্ষে হিটলারী গ্যাস সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব নয়।’ একজন বলে উঠল।
সে থামতেই আরেকজন বলল, ‘সিগারেটের ধোঁয়া যার কাছে গ্যাসের মত অসহ্য সে মুসলমান না হয়ে পারে না। আপনি ঠিকই সন্দেহ করেছেন বস।’
এই কণ্ঠ থামতেই আরেকজন বলে উঠল, ‘বস, একে আসল গ্যাস চেম্বারের স্বাদ পাইয়ে দিতে হবে।’
‘মনে হচ্ছে ঈশ্বর তোমাদের আশা পূরণ করবেন।’ বলল মারিও জোসেফ।
এইভাবে তাদের আলোচনা চলতেই থাকল।
আহমদ মুসার ঠোঁটে ফুটে উঠল আগের সেই হাসি। হাসিটা ধীরে ধীরে কঠিন এক সিদ্ধান্তে পরিণত হলো।
ঘড়ি দেখল আহমদ মুসা। দশ মিনিট গাড়ি চলেছে। তার মানে বিমান বন্দরে রিপোর্ট করার আর মাত্র ৩০ মিনিট বাকি।
আহমদ মুসা পকেট থেকে ‘মাউথ-নোজ গ্যাস কভার’ বের করল। এটা ক্ষুদ্রাকারের এক ধরনের গ্যাসমাস্ক। এর কার্যকারিতা পাঁচ দশ মিনিটের বেশি থাকে না।
রাস্তা-ঘাট, কল-কারখানা এবং বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে আকস্মিক কোন গন্ধময় পরিবেশের সৃষ্টি হলে এটা ব্যবহার করা হয়।
আহমদ মুসা গ্যাসমাস্কটি পরে নিল।
হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল গাড়িতে।
মারিও জোসেফ বলে উঠল, ‘হেসো না, ফাঁসির আসামীও মুক্তির স্বপ্ন দেখে।’
গ্যাসমাস্কের সাথেই মার্বেলের মত কালো রংয়ের গ্যাসের ডিনামাইট বের করেছিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার গ্যাসমাস্ক নিয়ে হাসি ঠাট্টারত কেউই এটা খেয়াল করেনি।
গ্যাস-ডিনামাইটের কালো শরীরের এক জায়গায় জ্বল জ্বল করে জ্বলছিল একটা লাল বিন্দু। এটাই গ্যাস-ডিনামাইটের ট্রিগার পিন। পিনটি খুলে নিলেই গ্যাস-ডিনামাইটের বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণ ঘটে মানে গ্যাস-ডিনামাইটটি তার ভয়ংকর গ্যাস নিঃসরণ শুরু করে। এ গ্যাস-ডিনামাইট আলফ্রেড নোবেলের ডিনামাইটের মত সবকিছু ধ্বংস করে না, কিন্তু ছয় বর্গগজের মধ্যে কোন জীবনের অস্তিত্ব রাখে না। এ কারণেই জীবন ধ্বংসের এ নিরব-অস্ত্রকে ডিনামাইট নাম দেয়া হয়েছে।
হাতের মুঠোর মধ্যে লুকানো জীবন ধ্বংসী এ মারণাস্ত্রের ট্রিগার পিন খুলতে গিয়ে কেঁপে উঠল আহমদ মুসা। হৈ হুল্লোড়, হাসি ঠাট্টায় ব্যস্ত এ জীবন্ত মানুষগুলোর জীবন কি এতই সস্তা যে, আগামী কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তারা ধ্বংস হয়ে যেতে পারবে! ওদের সুন্দর পৃথিবী, মমতায় গড়া ওদের পরিবার থেকে ওরা চিরতরে একেবারে বিনা নোটিশে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে কেন! পরক্ষণেই আহমদ মুসার মন থেকে কে যেন বলে উঠল, পৃথিবীর মানব বাগান যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই ‘মহা তিনি’ই সৃষ্টির সাথে ধ্বংসকে একই সাথে জুড়ে দিয়েছেন। ভূমিকম্প, বন্যা, জলোচ্ছাস, ঝড়-সাইক্লোন-হ্যারিকেন, মহামারি এই ধ্বংসেরই এক একটি মহা অস্ত্র। আগাম নোটিশ দিয়ে দিনক্ষণ ঠিক করে এরা আসে না। আবার মন থেকেই আরেকজন বলে উঠল, হত্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধ্বংস তো এক জিনিস নয়। মন থেকে এরও উত্তর এল সংগে সংগেই। বলা হলো, গাছকে রক্ষার জন্যে আগাছা তো মানুষই ধ্বংস করে। না করলে আগাছাই গাছকে শেষ করে দেয়। মানব সমাজেও রয়েছে এ ধরনের অসংখ্য আগাছা। যারা আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এরা ষড়যন্ত্রকারী এবং সন্ত্রাসী নামের আগাছা, এদের হত্যা করতে না পারলে এরাই হত্যা করবে আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে। ওরা আহমদ মুসাকে আসল গ্যাস চেম্বারের স্বাদ পাইয়ে দিতে চায়। ওদের সুযোগ দিলে ওরা এটাই করবে। আর এ জালেমরা জুলুমের জিন্দানখানা সাও তোরাহ দ্বীপে যাবার পথে বাধা। এই আগাছাদের বিনাশ না হলে এক ইঞ্চিও আহমদ মুসা এগুতে পারবে না। শুধু তাই নয়, জীবন দিয়ে মাশুল দিতে হবে অন্যায় দুর্বলতার।
আহমদ মুসা জেগে উঠল মুহূর্তের ভাবাবেগ থেকে। কঠোর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ।
ঠিক এই সময়েই মারিও জোসেফ বলে উঠল, ‘ডন সিলভাকে বলে দাও, আমরা অফিসে যাচ্ছি না। এসব ঝামেলা অফিসে নিয়ে লাভ নেই। সামনে পাইনের পার্কটায় যেতে বল। আর বলে দাও কথাবার্তায় সময় খরচ করার প্রয়োজন নেই। কাপড় খুলে দেখবে খাতনা আছে কিনা। যদি থাকে তাহলে সোজা বুকে কয়েকটা গুলী ঢুকিয়ে দেবে। ব্যস।’ থামল মারিও জোসেফ।
তার থামার সাথে সাথেই জীপটা হঠাৎ বাঁক নিয়ে আরেকটা রাস্তায় প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা বুঝল তাদেরকে পাইনের পার্কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
কঠিন একটা হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। গ্যাস- ডিনামাইট দুহাতের মুঠোতে নিয়ে খুলে ফেলল লাল পিনটা। তারপর সামনের সিটের নিচ দিয়ে কাল বলটা গড়িয়ে দিল সামনে।
এক সেকেন্ড, দুসেকেন্ড করে গড়িয়ে চলল সময়, ঠিক দশ সেকেন্ডের মাথায় গাড়ির ষ্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। ড্রাইভিং সিট থেকে মারিও জোসেফ দূর্বল তন্দ্রালূ কণ্ঠে বলল, ‘ডন, তুমি ড্রাইভিং সিটে এস, হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেল শরীর।’
‘হঠাৎ এ রকম হলো কেন? মনে হচ্ছে আমার শরীর তোমার চেয়েও খারাপ। উঠে দাঁড়াবার শক্তি আমার নেই।’ টেনে টেনে দুর্বল কণ্ঠে বলল ডন।
‘কি বললে?’ তড়াক করে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে চিৎকার করে বলে উঠল মারিও জোসেফ, ‘গুলী কর, খুন কর এই লোককে।’
বলে মারিও জোসেফ নিজেই পকেট থেকে রিভলবার বের করার চেষ্টা করল।
কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা পাশের ঝিমুনি আক্রান্ত লোকটির হাত থেকে ষ্টেনগান কেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘যে যেখানে যেভাবে আছ বসে থাক। একটু বেয়াদবী করলে মরবে গুলী খেয়ে।’
বলে আহমদ মুসা পিছু হটে গাড়ি থেকে নেমে এল। বন্ধ করে দিল গাড়ির দরজা।
পেছনের গাড়িটা প্রায় এসে পড়েছে। আহমদ মুসা তার ষ্টেনগান তুলল গাড়িটাকে লক্ষ্য করে।
সংগে সংগে গাড়ি থেকে চিৎকার শোনা গেল, ‘ভাইয়া, গুলী করবেন না। আমি গাড়ি চালাচ্ছি।’
আহমদ মুসা ষ্টেনগানের ব্যারেল নিচে নামিয়ে ট্রিগার থেকে তর্জনি সরিয়ে নিল। বলল সেই সাথে চিৎকার করে, ‘ভেতরের খবর কি?’
‘সবাই ঘুমিয়েছে কিংবা…………।’ হাসান তারিক কথা শেষ না করেই থেমে গেল।
গাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি নেমে ছুটে এল হাসান তারিক। ফিসফিস করে বলল, ‘ভাইয়া, খোলা ব্যাগের মাধ্যমে আপনি যে মেসেজ দিয়েছিলেন, তা সংগে সংগেই আমি বাস্তবায়ন করেছি।’
‘ধন্যবাদ হাসান তারিক। আমি দুশ্চিন্তায় ছিলাম যে, তুমি বিষয়টা তাড়াতাড়ি ধরে ফেলতে পারবে কিনা। আলহামদুলিল্লাহ।’
বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত জীপের কাছে এল। নিজের মুখের গ্যাসমাস্ক ভালোভাবে মুখে-নাকে সেট হয়ে আছে কিনা দেখে জীপের দরজা খুলে ফেলল। এগুলো লাশের দিকে। পাশে এসে দাঁড়াল হাসান তারিক। দুজনে লাশগুলো রাস্তায় নামিয়ে ফেলল।
‘হাসান তারিক, ব্যাগগুলো নিয়ে এস তোমার মাইক্রো থেকে।’ বলে আহমদ মুসা এগুলো জীপের ড্রাইভিং সিটের দিকে।
হাসান তারিক মাইক্রো থেকে দুটি হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে এসে আহমদ মুসার পাশের সিটে উঠে বসল।
আহমদ মুসা গাড়ি ষ্টার্ট দিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করার আর মাত্র ২৫ মিনিট বাকি হাসান তারিক।’
‘ইনশাআল্লাহ আমরা ঠিক পৌছে যাব ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
‘কিন্তু সামনে গিয়ে এ গাড়িটা ছেড়ে দিয়ে কোন ট্যাক্সি-ম্যাক্সি নিতে হবে হাসান তারিক। এ গাড়িটা পুলিশের পরিচিত হবে নিশ্চয়। সুতরাং এ গাড়ি এয়ারপোর্টে নেয়া যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছেন ভাইয়া। এয়ারপোর্টে কি কোন ঝামেলা হতে পারে? কি ভাবছেন আপনি?’ বলল হাসান তারিক।
‘মুসলমানদের আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যাওয়া বন্ধ। কোনভাবে ওরা সন্দেহ করেছে আমরা মুসলমান, ওরা নিশ্চিত হবার জন্যেই আমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা আহমদ মুসা ও হাসান তারিক এটা ওরা জানে না। সুতরাং এয়ারপোর্টে নতুন কোন ঝামেলা হবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া যে নাম আমরা এ্যান্টোনিওদের বলেছি, সে নামে আমাদের টিকেট নয়। টিকেটে আমাদের পর্তুগীজ-স্পেনীয় নাম রয়েছে। আর পর্তুগীজ পড়তে না পারলেও পর্তুগীজ ভাল বলতে পারি আমরা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার কথা সত্য হোক ভাইয়া। আমাদের যাত্রার অবশিষ্ট সময় আল্লাহ নিরুপদ্রব করুন।’ বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসার গাড়ি সেই রোডে উঠে আসার পর কিছু দূর এগিয়ে একটি ট্যাক্সি ষ্ট্যান্ড দেখে জীপটি রাস্তার পাশে ছেড়ে দিয়ে আহমদ মুসারা নেমে পড়ল।
তারপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছুটল লিসবন এয়ারপোর্টে।

আজোরস দ্বীপপুঞ্জের টেরসিয়েরা দ্বীপের ‘লিজে’ এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন কাউন্টার।
কাউন্টারে আহমদ মুসা এবং তার পেছনে হাসান তারিক দাঁড়িয়ে।
ইমিগ্রেশন অফিসার আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের পাসপোর্ট নাড়াচাড়া করে বলল, ‘আপনাদের টিকেট দেখি।’
আহমদ মুসা তার হাতে দুটি টিকেট তুলে দিল।
লোকটি টিকেটের পাতা উল্টিয়ে দেখল। তারপর বলল, আপনাদের কার নাম রুইজর্জ এবং কার নাম পেড্রো পোর্টিট?
‘আমি রুইজর্জ, আর ও পেড্রো পোর্টিট।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনাদের নাম পর্তুগীজ, কিন্তু আপনারা তো এশিয়ান?’ অফিসার লোকটি বলল।
‘পর্তুগালে আফ্রিকান, রাশিয়ানসহ বিভিন্ন দেশের লোক বাস করে। তাদের সাথে অনেক এশিয়ানও।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘তা ঠিক।’ অনেকটা বিব্রত কণ্ঠেই বলল অফিসার লোকটি।
একটা দম নেবার পরই সে আবার বলে উঠল, ‘আচ্ছা আপনারা রবিন সিং রাফায়েল ও লছমন লিওনার্দো নামের দুএশিয়ানকে চেনেন?’
আহমদ মুসা মনে মনে আঁৎকে উঠল এই ভেবে যে, ‘লিসবনের তাদের সব খবরই তাহলে আজোরস-এ পৌছে গেছে।’
কিন্তু আহমদ মুসার এই আঁৎকে উঠা ভাব মুখের চেহারায় সামান্যও প্রকাশ পেল না। অফিসার লোকটি থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘না, এমন নামের কাউকে আমরা চিনি না। ওরা এই বিমানে যাবে কিনা সেটা যাত্রীদের তালিকা দেখলেই তো জানা যায়।’
‘ওরা খুব সাংঘাতিক লোক এবং মুসলমান। যাত্রী তালিকায় ঐ দুজনের নামে কোন যাত্রী নেই। নিশ্চয় ওরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে ছদ্মনাম ব্যবহার করছে। কোন ছদ্মনাম নিয়েই ওরা প্লেনে উঠেছে।’ বলল অফিসার লোকটি।
থেমেই আবার বলে উঠল লোকটি আহমদ মুসাদের পাসপোর্ট ও টিকিট ফেরত দিতে দিতে, ‘যাই হোক। সন্দেহ করে তো আমরা সব লোককে হেনস্তা করতে পারি না। আপনারা যান। ধন্যবাদ।’
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পাসপোর্ট ও টিকিট নিয়ে ইমিগ্রেশন থেকে বেরিয়ে লাগেজ লাউঞ্জে প্রবেশ করল।
হাসান তারিক আহমদ মুসাকে ফিসফিস করে বলল, ‘ইমিগ্রেশন অফিসারটি নেহায়েত ভদ্রলোক। আমি তো ভাবছিলাম, উনি বলে বসবেন যে, আপনাদের নাম পরিচয় যে ঠিক তা প্রমাণের জন্যে আসুন আপনাদের ফিজিক্যাল টেষ্ট দিতে হবে। প্রমাণ করতে হবে আপনারা মুসলমান নন।’
‘দেখলে না লোকটার চেহারা? সে খাঁটি পর্তুগীজ নয়। ‘আজোরী’ সে। মানে আজোরসের মানুষ সে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আজোরী’রাও পর্তুগীজ?’ বলল হাসান তারিক।
‘পর্তুগীজ নয়, মিক্সড পর্তুগীজ। পর্তুগীজরা যখন এই বিজন দ্বীপপুঞ্জ দখল ও বসতি গড়ে, তখন তারা প্রচুর স্প্যানিশকে এখানে নিয়ে আসে। পরবর্তীকালে নর্থ আমেরিকান আদিবাসি এবং এস্কিমোরাও বেশ সংখ্যায় নানাভাবে এখানে এসে ছিটকে পড়ে। সব মিলিয়ে ‘আজোরী’রা একটি মিশ্র জাতি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাই হবে। কিন্তু ভাইয়া, এই যে ফাঁড়াটা কাটল, এটাই শেষ ফাঁড়া নয় বলে মনে হচ্ছে।’ বলল হাসান তারিক।
‘কোন সন্দেহ নেই এ ব্যাপারে হাসান তারিক। ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি (WFA) নিশ্চিত যে, হোটেলে আমাদের ধরতে যাওয়া দুগাড়ির লোকদের হত্যা করে আমরা বিমানে উঠেছি লিসবন থেকে আজোরসের ‘লিজে’ আসার জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে তো প্রকৃত বিপদ আমাদের জন্যে বাইরে অপেক্ষা করছে!’ বলল হাসান তারিক।
‘ঠিক অনুমান করেছ হাসান তারিক!’ আহমদ মুসা বলল।
হাসান তারিক থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘বেরুবার আগে তো কিছু তাহলে ভাবতে হয়। আসুন একটু দাঁড়ানো যাক।’
আহমদ মুসাও দাঁড়িয়ে পড়ল।
মুখোমুখি হলো দু’জন।
‘ঠিক বলেছ হাসান তারিক। একটু ভাবা প্রয়োজন। তবে বিকল্প কিছু করার সুযোগ খুব একটা আছে বলে মনে হয় না।’
‘কেন?’ বলল হাসান তারিক।
‘বিমান বন্দর থেকে বেরুবার একটাই পথ এবং সে পথটাই যদি ওরা আগলে থাকে!’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে শুরুতেই তো সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হবে!’ বলল হাসান তারিক।
‘কিন্তু আমরা সহজেই চিহ্নিত হয়ে যাব, এমন সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে আমাদের মিশনের ক্ষতি হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমিও তাই ভাবছি ভাইয়া। কিন্তু বিকল্প নেই আপনিই তো বললেন।’ বলল হাসান তারিক।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘হয়তো আমরা বেশি বেশিই ভাবছি। হয়তো কেউ আমাদের পথ আগলে নেই।’
‘যদি থাকে তাহলে কি হবে, সেটাই তো আলোচনার বিষয়।’ হাসান তারিক বলল।
‘যে বিষয়ের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, এসব বিষয় নিয়ে আর ভেবে কি হবে। রণাঙ্গনই বলে দিবে সৈনিকের ভূমিকা কি হবে। এস, অন্য বিষয়ে একটু ভাবি।’ বলে আহমদ মুসা লাউঞ্জের একটা চেয়ারে গিয়ে বসল।
হাসান তারিক গিয়ে বসল তার পাশে।
আহমদ মুসা ব্যাগের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। কাগজটা একটা মানচিত্র। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের একটা মানচিত্র।
মানচিত্রটি আহমদ মুসা সামনে মেলে ধরল। হাসান তারিকও তার উপর চোখ রাখল।
মানচিত্রের উপরের অংশে একটা দ্বীপের উপর আঙুল রেখে বলল, ফ্লোরেস দ্বীপের উত্তরে এটা করভো দ্বীপ। প্রফেসর জ্যাক সাইমনের বক্তব্য অনুসারে এই দ্বীপের কয়েক মাইল দূরে সাও তোরাহ দ্বীপ। করভোর উত্তরে যে সাদা বিন্দুটা দেখা যাচ্ছে, এটা সাও তোরাহ হতে পারে। এই দ্বীপের সবচেয়ে কাছের শহর হলো ফ্লোরেস দ্বীপের ‘সান্তাক্রুজ’। আমার মনে হয় সাও তোরাহ দ্বীপের সবচেয়ে কাছের শহর হিসেবে এর উপর WFA এর খুব বেশি দৃষ্টি থাকবে এখন। সুতরাং এখানে সাও তোরাহ দ্বীপ নিয়ে আলোচনা করা নিরাপদ হবে না। এই কারণে আমি মনে করি, সাও তোরাহ দ্বীপের পরবর্তী নিকটতম শহর হলো সান্তাক্রুজ। সান্তাক্রুজের সোয়াশ’ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে পিকো দ্বীপের ‘হারতা’ শহর। এই হারতা শহরকেই আমরা আপাতত বেজ করতে পারি। এখান থেকে সব খবরাখবর নিয়ে প্রস্তুত হয়ে পরবর্তী বেজ হিসাবে আমরা সান্তাক্রুজে যেতে পারি।’ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই হাসান তারিক বলে উঠল, ‘হারতা এবং সান্তাক্রুজ সম্পর্কেও তো আমাদের কিছু জানা প্রয়োজন।’
‘হ্যাঁ, হাসান তারিক। সেটা করতে হবে। পর্তুগীজ ইয়ারবুক থেকে কিছু জানা গেছে। ওটা তুমি একটু দেখে নিও। ‘লিজে’ থেকে আমরা কিছু ট্যুরিষ্ট লিটারেচার যোগাড় করতে পারব। সেখান থেকেও কিছু জানা যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আবার সে বলে উঠল, ‘আমরা আপাতত একটা টাইম সিডিউল এ ধরনের করতে পারি যে, খোঁজ-খবরের জন্যে ‘লিজে’তে তিন দিন কাটিয়ে ৪র্থ দিনে আমরা ‘হারতা’তে পৌছব এবং হারতা গিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা করব।’
‘হারতা গিয়ে কোথায় উঠব, এ সম্পর্কে আমরা কোন চিন্তা করব কিনা। ছোট শহরের হোটেলগুলো আমার মতে নিরাপদ নয়।’ বলল হাসান তারিক।
‘তুমি ঠিকই বলেছ হাসান তারিক। ফাইনালী কি হবে আমি জানি না। তবে আপাতত চিন্তা করেছি, হারতার ক্যাথলিক গীর্জার অতিথিশালায় উঠব। আমি ইয়ারবুকে দেখেছি, ‘হারতা সেন্টপল’ গীর্জার বিশাল অতিথিশালা সবার জন্যেই উন্মুক্ত।’ আহমদ মুসা বলল।
খুশি হলো হাসান তারিক। বলল, ‘ক্যামোফ্লেজটা ভালোই হবে ভাইয়া।’
‘এস এবার উঠি।’ বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
হাসান তারিকও উঠল।
চলল তারা ডিপারচার লাউঞ্জের দিকে।
লাউঞ্জ থেকে বের হবার দরজার পাশে একটা সুদৃশ্য কাউন্টার। কাউন্টারের এক প্রান্তে বিলবোর্ডে একটি বিজ্ঞপ্তি। বলা হয়েছে, এখান থেকে গাড়ি ভাড়া করতে পারেন। যৌক্তিক ভাড়া ও বিশ্বস্ততার প্রতীক আজোরস ন্যাশনাল কোম্পানী।’
বিলবোর্ডটি পড়ে আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। বর্তমান অবস্থায় বিশ্বস্ত গাড়ি পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আহমদ মুসা হাসান তারিককে কানে কানে বলল, ‘কাউন্টারে যাও। এদের থেকেই গাড়ি ভাড়া কর। বাইরে গিয়ে গাড়ি ভাড়া করার ঝুঁকি নেয়া যাবে না।’
হাসান তারিক কাউন্টারে গেল। গাড়ি ভাড়া হয়ে গেল। তাদের নিজস্ব কমিউনিকেশন নেট ওয়ার্কের মাধ্যমে বলে দেয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ইউনিফর্ম পরা ড্রাইভার লাউঞ্জে ঢুকল এবং আহমদ মুসাদের ‘ওয়েলকাম’ করে গাড়িতে নিয়ে গেল।
প্লেন থেকে নামার পর থেকেই আহমদ মুসার দুচোখ সতর্ক ছিল। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেই গাড়িতে উঠে বসল।
‘স্যার কোথায়?’ ড্রাইভিং সিটে বসে ষ্টিয়ারিং-এ হাত রেখে বলল ড্রাইভার।
আহমদ মুসার চিন্তা করাই ছিল। বলল, ‘গঞ্জালেস ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে চল।’
‘লিজে’ এয়ারপোর্টের বিপরীত দিকে শহরের সাগর প্রান্তে একটা ছোট পাহাড়ের উপর এই হোটেলটি। লিজে এয়ারপোর্ট থেকে দীর্ঘ সরল এক পথ পেরিয়ে ‘লিজে’ শহরে প্রবেশ করতে হয়। তারপর শহর পেরিয়ে ছোট একটা পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড় শীর্ষের ‘গঞ্জালেস ইন্টারন্যাশনাল’ হোটেলে পৌছতে হয়। বেশ দীর্ঘ পথ। খুশিই হলো ড্রাইভার। তার মুখ দেখা গেল প্রসন্ন।
গাড়ি ষ্টার্ট নিয়েছে। চলছে গাড়ি।
গাড়ি তখন বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
হাসান তারিক আহমদ মুসার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘যাত্রার শুরুটা বোধ হয় ভালোই হলো ভাইয়া।’
‘তোমার কথা সত্য হলে ভালো। কিন্তু আমার অন্য রকম মনে হচ্ছে। ডিপারচার লাউঞ্জে একজন ক্রিমিনাল চেহারার লোক সর্বক্ষণ আমাদের উপর চোখ রেখেছে। আমরা বের হয়ে এলে সেও বেরিয়ে একটা সাদা গাড়িতে চড়েছে। এছাড়া কার-পার্কেও আরেকটা সাদা গাড়ির আরেকজন লোকের দুচোখ আঠার মত গেঁথে ছিল আমাদের উপর। আমাদের গাড়ি ষ্টার্ট নিলে সেই গাড়িকেও ষ্টার্ট হতে দেখেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
হাসান তারিকের মুখ ম্লান হয়ে গেল। তাকাল সে পেছন দিকে। বোধ হয় সেই দুটি সাদা গাড়ি পিছু নিয়েছে কিনা তা দেখার জন্যে। কিন্তু পেছনে গাড়ির সারি। অধিকাংশই সাদা গাড়ি। হতাশ হয়ে চোখ দুটি ফিরে এল হাসান তারিকের।
কিন্তু শহর পেরিয়ে পার্বত্য পথে প্রবেশের পর সন্দেহ আর থাকলো না। দুটো সাদা গাড়িকে দেখা গেল আহমদ মুসার গাড়ির সমান গতিতে ছুটে আসছে। আহমদ মুসা ড্রাইভারকে বলে গাড়ির গতি বাড়িয়ে কমিয়ে নিশ্চিত হলো যে, গাড়ি দুটো তাদেরকেই অনুসরণ করছে।
আহমদ মুসা পরিস্থিতিটা ড্রাইভারকে জানানো ও তার মনোভাব জেনে নেয়ার জন্যে বলল, ‘ড্রাইভার, দুটো গাড়ি দেখছি আমাদের ফলো করছে।’
‘স্যার, আপনাদের কোন শত্রু আছে?’ বলল ড্রাইভার। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘এদেশে আমরা বেড়াতে এসেছি। থাকতে পারে। কিন্তু ওরা সরকারের কেউ কিংবা ডাকাত-টাকাত নয়তো?’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, সরকারী নয়। সরকারের কোন ব্যাপার হলে সেটা বিমান বন্দরেই ঘটত। আর এ ধরনের ডাকাতও আমাদের আজোরসে নেই। স্যার, হতে পারে আপনাদের কোন শত্রু পর্তুগাল থেকেই আপনাদের অনুসরণ করছে।’ বলল ড্রাইভার।
‘তাহলে এখন কি করা যায় ড্রাইভার?’ আহমদ মুসা বলল।
‘চিন্তা নেই স্যার। গঞ্জালেস ইন্টারন্যাশনাল হোটেল। ওখানে শক্তিশালী পুলিশ ষ্টেশন আছে। আমরা ঠিক হোটেলে পৌছে যাব, ওরা আমাদের ধরতেই পারবে না।’ বলল ড্রাইভার।
পার্বত্য পথে আরও কিছুটা এগুলো আহমদ মুসাদের গাড়ি।
ঝোপে ঢাকা টিলার একটা বাঁক ঘুরতেই আহমদ মুসা দেখতে পেল দুশ গজের মত দূরে একটা মাইক্রো ও একটা জীপ তাদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে তাকাল সে। দেখল পেছনে ছুটে আসা দুটি গাড়ির সাথে আরেকটি গাড়ি যোগ হয়েছে।
ড্রাইভার বিষয়টা খেয়াল করেছে। গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে সে। তার চোখে ভয়ের ছাপ। বলল সে, ‘সর্বনাশ স্যার! ওরা দুদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।’
আহমদ মুসাদের গাড়ির সামনেই রাস্তার একটা ত্রিমোহনী। হোটেলগামী রোড থেকে আরেকটা রাস্তা বেরিয়ে পার্বত্য এলাকার মধ্যে দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে।
রাস্তাটির দিকে একবার তাকিয়ে আহমদ মুসা ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘পশ্চিম এ রাস্তাটা কোথায় গেছে ড্রাইভার?’
‘স্যার, পার্বত্য এলাকা ছাড়িয়ে রাস্তাটা আমাদের এ দ্বীপের একমাত্র বীচ পর্যন্ত গেছে। সেখানে মনোরম একটা ট্যুরিষ্ট স্পট আছে।’
‘ড্রাইভার গাড়িটা পশ্চিমের ঐ রাস্তায় নাও।’ নির্দেশের স্বরে বলল আহমদ মুসা।
‘ওদিকে তো কোন আশ্রয় নেই স্যার। মাত্র ট্যুরিষ্ট স্পটে একটা পুলিশ ষ্টেশন আছে। সে তো অনেক দূরে?’
‘ভয় করো না ড্রাইভার, তোমার এবং তোমার কোম্পানীর কোন ক্ষতি হবে না। তুমি গাড়ি ঘুরিয়ে নাও।’ এবার দৃঢ় কণ্ঠে নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে পশ্চিমের রাস্তায় চলতে শুরু করল।
একটু হাসল আহমদ মুসা। বলল ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে, ‘শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করার চাইতে শত্রুর হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করাই উচিত নয় কি ড্রাইভার?’
‘অবশ্যই স্যার। কিন্তু শত্রুদেরকে খুব প্রবল দেখছি। স্যার, ওরা কারা আন্দাজ করতে পারেন?’ ড্রাইভার বলল।
‘বন্দী কিছু লোককে আমরা উদ্ধার করতে চাই। হতে পারে আটককারী দলের ওরা কেউ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বন্দীরা কে স্যার?’ বলল ড্রাইভার।
‘নিরপরাধ লোক। ওদের মুখ বন্ধ করার জন্যে ওদের অপহরণ করা হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বন্দীরা কি আপনাদের আত্মীয়?’ ড্রাইভার বলল।
‘না। অন্যায়ের প্রতিবিধান করতেই আমরা ওদের সাহায্য করতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
ড্রাইভারের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। কপাল তার কুঞ্চিত।
আর কোন কথা বলল না সে।
আহমদ মুসা তখন অন্য কাজে মনোযোগ দিয়েছে। হ্যান্ড ব্যাগ থেকে চাবি বের করে লাগেজে করে আনা ব্যাগটা টেনে নিয়ে খুলে ফেলল। বের করল প্লাষ্টিক কনটেইনার থেকে তার এম-১০ মেশিন রিভলবার।
প্লাষ্টিক কনটেইনারটি বিশেষভাবে তৈরি। ‘এক্সরে’ বা কোন ‘রে’ ফেললে এর ভেতরকার কিছু দেখা যায় না। ‘রে’ ফেললেই কনটেইনারটি আয়নার মত স্বচ্ছ একটা ছবি উপহার দেয়। এই কনটেইনারে করেই আহমদ মুসা ও হাসান তারিক তাদের অস্ত্র নিয়ে এসেছে।
হাসান তারিকও তার অস্ত্র বের করে নিয়েছে।
এক জায়গায় এসে হঠাৎ ড্রাইভার হার্ড ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করাল।
‘কি হলো ড্রাইভার?’ বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘স্যার, ইঞ্জিন ট্রাবল দিচ্ছে। দেখছি আমি।’ বলে ড্রাইভার দ্রুত ষ্টার্টার থেকে চাবির রিং খুলে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজা বন্ধ করে ইঞ্জিনের দিকে এগুলো। তারপর ইঞ্জিনের টপটা খুলে ফেলে দাঁড় করিয়ে দিল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক তখন ব্যস্ত পেছনটা দেখতে।
পেছনে ছুটে আসা গাড়ি ৫টি কত দূরে আছে সেটা আন্দাজ করতে চেষ্টা করছিল।
বেশ সময় পার হয়ে গেল।
ইঞ্জিনের দিক থেকে কোন শব্দ না পেয়ে আহমদ মুসা সামনে তাকাল। কিন্তু ইঞ্জিন নিয়ে কাজ করার কোন শব্দ সে শুনতে পেল না। তাছাড়া ড্রাইভারকেও দেখতে পেল না।
গাড়ির জানালা খুলে দেখার চেষ্টা করল আহমদ মুসা। কিন্তু গাড়ির জানালা খোলা গেল না। লক করা। দরজা খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু দেখল দরজাও লক করা।
চমকে উঠল আহমদ মুসা।
দ্রুত সে এগিয়ে ড্রাইভারের দরজায় নব ঘুরাতে চেষ্টা করল। ঘুরল না।
‘হাসান তারিক, ড্রাইভার পালিয়েছে এবং সেই সাথে সে আমাদেরকে বন্দী করে রেখে গেছে।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
বিদ্যুতস্পৃষ্টের মত ঘুরল হাসান তারিক। বলল, ‘এ জন্যেই সে চাবি নিয়ে নেমে গেছে।’
আহমদ মুসা পেছনটা দেখে জানালার কোণা দিয়ে সামনের দিকটা দেখার চেষ্টা করে বলল, ‘হাসান তারিক, সামনে থেকেও দুটি গাড়ি আসছে। দুতিনশ গজের বেশি দূরে নয় ওরা। পেছনের পাঁচটা গাড়িও দুএকমিনিটের মধ্যে এসে পড়বে।’
‘তার মানে লক করা গাড়িতে আমরা বন্দী হয়ে পড়েছি।’ বলেই হাসান তারিক তার মেশিন রিভলবারটা তাক করল জানালা গুড়ো করে দেবার জন্যে।
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে দ্রুত বলল, ‘গুলী নয়, বাট দিয়ে ভেঙে ফেল। গুলীর শব্দ করে আমাদের অবস্থা ওদের জানাতে চাই না।’
হাসান তারিক মেশিন রিভলবারের বাঁট দিয়ে ভেঙে ফেলল জানালা।
ভাঙা জানালা দিয়ে ব্যাগগুলো আগে বাইরে ফেলে দিয়ে হাসান তারিক ও আহমদ মুসা বাইরে বেরিয়ে এল।
বের হয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘যতদূর ধারণা করি উত্তর দিকে কিছু দূরেই সাগর আর দক্ষিণে পার্বত্য এলাকা পার হলে পাওয়া যাবে বনাঞ্চল, তারপর লোকালয়। কোন দিকটা আমরা বেছে নেব হাসান তারিক?’
‘আমার মতে দক্ষিণ দিক ভাইয়া।’ হাসান তারিক বলল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক গাড়ি ঘুরে গাড়ির দক্ষিন পাশে এসে দ্রুত রাস্তা থেকে নেমে একটা টিলার আড়াল নিয়ে দক্ষিন দিকে এগুলো।
দুদিক থেকে গাড়িগুলো তখন এসে পড়েছে।
আহমদ মুসাদের গাড়ির সামনে ও পিছনে দাঁড়াল ৭টি গাড়ির একটি বহর।
৭টি গাড়ি থেকে নামল ৪০ জনের একটি বিরাট দল। তাদের সাথে দুটি শিকারী কুকুর।
জীপ থেকে নেমে আসা দীর্ঘদেহী ঋজু শরীরের এবং উত্তেজিত চেহারার একজন লোক আহমদ মুসাদের গাড়ির ভেতরটায় একবার চোখ বুলিয়ে ভাঙা জানালা দেখে সবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, ‘কোন দিকে গেছে দেখ। শয়তানদের কিছুতেই পালাতে দেয়া যাবে না।’
দুটি কুকুর ধরে রাখা দুজন লোক তাদের হাতের ইনভেলাপ থেকে দুখন্ড কাপড় বের করে কুকুর দুটিকে দিয়ে তা শুকিয়ে নিল এবং কুকুর দুটিকে বেঁধে রাখা দড়ির শেষ প্রান্ত ধরে রেখে পুরো দড়ি ছেড়ে দিল।
সংগে সংগেই কুকুর দুটি গাড়ি ঘুরে উত্তর পাশ থেকে দক্ষিণ পাশে গিয়ে ছুটতে শুরু করল দক্ষিণ দিকে। কুকুরের দড়ি ধরে রাখা লোক দু’জনও ছুটল তার সাথে। অবশিষ্ট আটত্রিশজনও তাদের পিছনে চলতে লাগল।
সেই লম্বা লোকটির নেতৃত্বে ওরা চলছে অস্ত্র বাগিয়ে জংগল যুদ্ধের ফরমেশন নিয়ে।
পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে পথহীন পার্বত্য ভূমির উপর দিয়ে আহমদ মুসারাও চলছিল।
পার্বত্য ভূমি চড়াই-উৎরাই, পাহাড়ের টিলা, খাড়া ও গভীর উপত্যকা এবং গাছ ও ঝোপ-জংগলে ভরা। পথ চলা খুব কঠিন। কিন্তু খুশি হলো আহমদ মুসা। এই পরিবেশে WFA-এর লোকরা তাদের খুঁজে পাবে না। আহমদ মুসা চিন্তা করল, তারা জংগলের দিকে না গিয়ে পুবে ‘লিজে’ শহরের দিকে হাঁটা শুরু করতে পারে। কিন্তু আবার ভাবল, শত্রুদের গতিবিধি সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে শহরমূখী হওয়া তাদের ঠিক হবে না।
প্রায় ১ ঘন্টা চলার পর একটা উচ্চভূমির উপর বসল আহমদ মুসা ও হাসান তারিক।
উচ্চ ভূমিটা সমতল। ঝোপ ও বড় বড় গাছ-গাছড়ায় ভরা। বিশাল উচ্চ ভূমিটা পুরাকীর্তির কোন গড়ের মত। এই গড়টারই উত্তর প্রান্তে এসে বসেছে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক। এখানে বসে পেছনে ফেলে আসা পার্বত্য অঞ্চলটার উপর চোখ রাখা যাচ্ছে। ওরা ফলো করছে না ফিরে গেছে এটা খুব জানা দরকার।
আহমদ মুসার এ চিন্তায় ছেদ পড়ল হাসান তারিকের কথায়। সে বলছিল, ‘ভাইয়া, আমরা কাক ডাকা ভোরে খালি পেটে বেরিয়েছি। খাবার বিষয়টাও আমাদের ভাবনায় রাখা যায়।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ হাসান তারিক। আমিও পেটকে বুঝাতে পারছি না। কিন্তু কি খাবে? ব্যাগের পকেটে আছে বিমান থেকে পাওয়া মাত্র কয়েকটা চকলেট।’
বলে আহমদ মুসা চকলেটগুলো বের করে হাসান তারিককে দিল, নিজেও নিল।
চকলেট মুখে দিয়ে হাসান তারিক বলল, ‘ভাইয়া বুঝতে পারছি না, সাত গাড়ি লোক গেল কোথায়! আমাদের ফলো না করে ওরা ফিরে যাবে এটা কি স্বাভাবিক?’
‘না, স্বাভাবিক নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ হতেই আহমদ মুসার কানে এল একটা অপ্রত্যাশিত শব্দ। একটা কুকুরের কণ্ঠ শব্দ তুলতে গিয়েও আকস্মিকভাবে রুদ্ধ হয়ে গেল।
চমকে উঠল আহমদ মুসা।
হঠাৎ একটা চিন্তা তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। ওরা কি কুকুর নিয়ে এগুচ্ছে? ওরা কি আহমদ মুসাদের দেখতে পেয়েছে? উৎসাহী কুকুরকে সামলাবার জন্যেই কি ঐভাবে তার মুখ চেপে ধরতে হয়েছে?
এই চিন্তা তার মাথায় আসার সাথে সাথেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘হাসান তারিক, তাড়াতাড়ি আড়াল নাও। সম্ভবত আমরা শত্রুর চোখে পড়ে গেছি।’
বলে আহমদ মুসা নিজেও দ্রুত গড়িয়ে উচ্চভূমির প্রান্ত থেকে একটু ভেতরে সরে এল।
হাসান তারিকও গড়িয়ে একটা ঝোপের আড়ালে চলে এসেছে।
আড়ালে এসেই হাসান তারিক ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে। বলল, ‘কি ব্যাপার ভাইয়া?’
‘আমি একটা কুকুরের অসমাপ্ত চিৎকার কানে শুনেছি। কেউ কুকুরের চিৎকারকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস, আমাদের শত্রুরা কুকুরের দিক-নির্দেশনায় নিঃশব্দে আমাদের খুব কাছে এসে পৌছেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দুঃখিত, কুকুরের চিৎকারটা আমি খেয়াল করিনি। শব্দ কোন দিক থেকে এসেছে ভাইয়া?’ হাসান তারিক বলল।
‘উত্তর দিক। একদম এই সামনে থেকে। আমার মনে হয়, এই উচ্চভূমি যেখান থেকে উঠে এসেছে সে পর্যন্ত ওরা পৌছে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার মানে ওরা এখন এই হাইল্যান্ডে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ হাসান তারিক বলল।
‘আমার মনে হয় কুকুরকে অনুসরণ করে আমাদের হাতের মুঠোয় পাওয়া পর্যন্ত ওরা নিরবে এগুবে এবং তারপর আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা কি করব এখন? আমরা কি আরও সামনে সরে যাব?’ হাসান তারিক বলল।
‘ওরা চায় আমাদেরকে ওদের টার্গেটের মধ্যে নিতে। আর আমরা চাইব ওদেরকে আমাদের টার্গেটের মধ্যে আনতে। এদিক থেকে আমরা যেখানে রয়েছি, সেটা আমাদের জন্যে ভালো জায়গা। আমাদের এ উচ্চভূমি থেকে যে ঢাল ওদের দিকে নেমে গেছে তা খুব ফ্ল্যাট এবং উন্মুক্ত। ছোট দুচারটা গাছ-গাছড়া ও ঘাস ছাড়া আর কিছু নেই। এই ঢালে তারা আত্মগোপনের কোন সুযোগ পাবে না এবং এই ঢাল দিয়েই তাদের উঠে আসতে হবে। পূর্ব দিকে উচ্চভূমির সাথে পাহাড় যুক্ত হয়েছে। ওদিক দিয়ে আসতে পারছে না। ঢাল ঘুরে পশ্চিম দিক হয়ে তাদের আসার কোন যুক্তি নেই। কারণ আমরা তাদের সম্বন্ধে জানতে পেরেছি এটা তারা জানে না এবং স্বাভাবিকভাবে কুকুর তাদের এই পথেই নিয়ে আসবে।’ বলল আহমদ মুসা।
হাসান তারিক হাসল। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাদের উপযুক্ত জায়গায় এনে ওদের মুখোমুখি করেছেন।’
আহমদ মুসা ঢালের প্রান্ত বরাবর এলাকা পর্যবেক্ষণ করে মাঝামাঝি জায়গায় একটা উঁচু স্থান দেখতে পেল। উঁচু জায়গাটা ঢালের একদম প্রান্তে বেদীর মত দেখতে এবং ওটা পরিকল্পিতভাবে তৈরি মনে হলো তার কাছে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক ক্রলিং করে গিয়ে উঠল সেই বেদিতে। আহমদ মুসারা বেদিতে উঠতেই বিরাট আকারের দুটি বড় সাপ বেদি থেকে নেমে গেল।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা, বেদির মেঝেটা পাথরের। পাথরের জোড়াগুলো দিয়ে গাছ-গাছড়া উঠে পাথরগুলো ঢেকে দিয়েছে। বেদির উপর দুটি পাথরের বাটি। বাটিগুলো ভেজা দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। চারদিকে চাইল।
বেদির উত্তর প্রান্তে অবস্থান নিল আহমদ মুসারা। তারা খুশি হলো যে, গোটা ঢালটাই তাদের নজরে আসছে। অবশ্য ঢালের পশ্চিম প্রান্ত দক্ষিণ দিকে বেঁকে গেছে বলে শেষটা দেখা যাচ্ছে না।
বেশিক্ষণ বসতে হলো না আহমদ মুসাদের। দেখা গেল, ঠিক তাদের সোজাসুজি জংগলের ভেতর থেকে ঢালের গোড়ায় উঠে এল দুজন লোক। তাদের সামনে দুটি কুকুর। কুকুর দুটির দড়ি তাদের হাতে। কুকুর দুটি ডবলমার্চের ভংগিতে দৌড়াচ্ছে।
কুকুর স্কোয়াডের পরই বেরিয়ে এল মূল বাহিনী। হাতে ষ্টেনগান, কোমরে পিস্তল সজ্জিত বিরাট একটা দল। সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০এর মধ্যে হবে বলে অনুমান করল আহমদ মুসা। রীতিমত যুদ্ধের আয়োজন। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের মেশিন রিভলবার প্রস্তুত।
আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘ওরা ঢালের মাঝ বরাবর আসার আগে আমরা গুলী করব না।’
ওরা ঢালের মাঝ বরাবর এসে গেছে।
আহমদ মুসা তার এম-১০ মেশিন রিভলবার ডান হাতে রেখে বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে আরও একটা রিভলবার বের করে ওদের মাথার উপর দিয়ে গুলী করল। সংগে সংগেই ওদের কয়েক ডজন ষ্টেনগান ও রিভলবার এক সাথে গর্জন করে উঠল আহমদ মুসার রিভলবারের শব্দ লক্ষ্যে। কিন্তু তাদের গুলীগুলো প্রায় ৪০ ডিগ্রী কোণে মাথার উপর দিয়ে চলে গেল।
ওদের গুলীর প্রথম ধাপ আহমদ মুসাদের অতিক্রম করার সাথে সাথেই আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের মেশিন রিভলবার গর্জন করে উঠল এবং ঘুরতে লাগল দলটির উপর দিয়ে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড। দলটির সবাই ভূমি শয্যা নিল।
কয়েকটি দেহ ঢাল বেয়ে গড়িয়ে জংগলে ঢুকে গেল।
অন্যগুলো নির্জীব পড়ে থাকল ঢালের উপর।
ঢাল থেকে দেহগুলো জংগলে গড়িয়ে যাবার পর পরই ওদিক থেকে আহমদ মুসাদের উচ্চভূমি লক্ষ্যে অনিয়মিত ব্যবধানে গুলী আসতে লাগল।
আহমদ মুসারা গুলী খরচ না করে অপেক্ষা করার নীতি অনুসরণ করল। ওখানে বসে গুলী করে ওদের লাভ নেই। সামনে এগুতেই হবে ওদের। সেই সময়ের অপেক্ষা করতে লাগল ওরা।
পল পল করে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। ওপার থেকে সেই অনিয়মিত গুলী একটানা চলছেই।
বিরক্তি ও বিস্ময় কিছুটা আচ্ছন্ন করেছে আহমদ মুসাকে। অর্থহীন ও অব্যাহত এই গুলীর অর্থ কি? এমন কি নিহত-আহতদের নিয়ে যাবারও ওরা চেষ্টা করছে না!
এ সময় আহমদ মুসাদের ঠিক পেছনে অনেকখানি উপরে শূন্য থেকে দুটি কারবাইন হ্যান্ড মেশিনগান গর্জন করে উঠল।
আকাশ থেকে পড়ার মত প্রবল শক খেয়ে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই পেছন ফিরে তাকাল।

Top