৩৬. গুলাগ অভিযান

চ্যাপ্টার

বেদিতে উঠতে উঠতে ভ্যানিসা গনজালো বলল, ‘ভাইয়া, গত মাসে আমরা আসতে পারিনি। তাতেই দেখো মনে হচ্ছে বেদিটা জংগলে ভরে গেছে। এ রকম তো হওয়ার কথা ছিল না।’
সার্গিও গনজালোও বেদিতে উঠছিল ভেনিসার সাথে। বলল, ‘ভিয়েনীরা এসেছিল তো। মনে হয় ওরা বেদিটা পরিষ্কার করে যায়নি।’
‘তাই হবে। আজ আমাদের সংগ্রামের শক্তিরা দুধ খেয়ে যাবার পর আমরা বেদিটা পরিষ্কার করব ভাইয়া’। বলল ভ্যানিসা গনজালো।
‘আমিও তাই ভাবছি।’ বলল সার্গিও গনজালো।
দুজনেই উঠল বেদিতে।
দুজনের হাতেই দুটা কারবাইন শ্রেণীর ক্ষুদ্র সাবমেশিনগান। দুজনেই হাতের সাবমেশিনগান কাঁধে ঝুলিয়ে কাঁধের থলে থেকে বের করল প্লাষ্টিকের একটা পট। পটের মুখ খুলতে খুলতে ওরা দুজনে গেল বেদির মাঝখানে রাখা দুটো পাথরের বড় বাটির দিকে। পটের মুখ খুলে ওরা দুজন পাথরের দুই বাটিতে পটের সবটুকু দুধ ঢেলে দিল।
পটের মুখ বন্ধ করে কাঁধের ঝুলানো ব্যাগে রেখে দুজনেই কাঁধ থেকে সাবমেশিনগান হাতে নিল এবং দুজনেই সাবমেশিনগানের ব্যারেল বাটির দুধে ডোবাল। তারপর আবার সাবমেশিনগান কাঁধে ঝুলিয়ে দ্রুত নেমে এল বেদি থেকে।
দুজনেরই পরনে ফুল সামরিক পোশাক। কাঁধের সাবমেশিনগান ছাড়াও ওদের কোমরে একদিকে ঝুলানো রিভলবার, অন্যদিকে খাপবদ্ধ ছুরি।
দুজনের মাথায় সামরিক টুপি।
দুজনে ওরা ভাই বোন। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা। এ কারণেই পতুর্গীজ আইনে গনজালো বংশ বিদ্রোহী পরিবার। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের পর্তুগীজ আইন ও পুলিশ এই পরিবারের সন্ধানে সর্বক্ষণ পই পই করে ঘুরছে।
বেদি থেকে নেমে সার্গিও এগোচ্ছিল দক্ষিণ দিকে।
ভ্যানিসা গনজালো বলল, ‘ভাইয়া, বেদিটা গাছ-গাছড়ায় ছেয়ে গেছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে বেদিতে আমাদের অতিথিদের আসা-যাওয়া দেখি, সেখান থেকে আজ বেদির কিছুই দেখা যাবে না।’
‘তাহলে।’ থমকে দাঁড়িয়ে বলল সার্গিও গনজালো।
‘চল এই গাছটায় উঠে যাই। ওখান থেকে ভালো করে দেখতে পাব।’ বলল ভ্যানিসা গনজালো।
‘ঠিক, ভ্যানিসা গাছে ওঠা যায়। সব ভালো করে দেখা যাবে। কিন্তু তুমি গাছে উঠতে পারবে তো?’ সার্গিও গনজালো বলল।
‘কি বলছ ভাইয়া। তুমি কি নতুন হলে নাকি?’ বলল ভ্যানিসা গনজালো।
‘ঠিক আছে। চলো।’ বলে সার্গিও গনজালো গাছের দিকে এগোলো।
বেদির পুবপাশে একটা উঁচু গাছে তারা উঠে বসল। ওখান থেকে উচ্চভূমির বিরাট এলাকাসহ উত্তর দিকে নেমে যাওয়া ঢালকেও পরিষ্কার দেখা যায়।
ওরা বেদিকে সামনে রেখে পশ্চিমমুখী হয়ে বসল।
তারা গাছে উঠে বসার পর দশ মিনিটও গেল না। পূব দিক থেকে এক জোড়া দীর্ঘ সাপ এক সাথে এসে বেদিতে উঠল। এগুলো তারা দুধ ভর্তি পাথরের বাটির দিকে। সাপ দুটি দুবাটি থেকে দুধ খাওয়া শুরু করল।
গাছে বসে দুভাইবোন সার্গিও ও ভ্যানিসা আনন্দের সাথে দেখছিল এই দৃশ্য। দৃশ্যটা দেখতে দেখতে সার্গিও গনজালো বলে উঠল, ‘আমাদের চার পুরুষ সাপেরও চার পুরুষ ধরে এই দৃশ্য এভাবেই দেখে হয়ে আসছে। এই সাপরা আমাদের শক্তি ছাড়া, সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের প্রতীক।’
‘কিন্তু ভাইয়া, সাপের অব্যর্থ ছোবলের মত আমরা শত্রুর উপর অব্যর্থ আঘাত হানতে পারছি কই? আমরা এগুতে পারছি না কেন?’ বলল ভ্যানিসা।
সার্গিও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু ভ্যানিসার চোখ ঢালের উপর পড়তেই ভূত দেখার মত চমকে উঠে সার্গিওর মুখ চেপে ধরে বলল, ‘ঢালের দিকে দেখ ভাইয়া।’
সংগে সংগেই সার্গিও চোখ ফেরালো ঢালের দিকে।
দেখলো দুজন লোক পাশাপাশি ঢাল বেয়ে দ্রুত উঠে আসছে।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো সার্গিও গনজালোর। ফিস ফিস করে বলল ভ্যানিসাকে, ‘দুজনের কেউ এদেশের নয়, ইউরোপেরও নয়।’
‘তাহলে কোথাকার?’
‘এশিয়ান মনে হচ্ছে ভ্যানিসা আমার কাছে।’
‘তাহলে ওরা আমাদের শত্রু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ভাইয়া দুজনের হাতেই তো মেশিন রিভলবার?’
‘আসলেই এশিয়ানরা আমাদের শত্রু হবার কথা নয়। কিন্তু ওরা যেহেতু অস্ত্রধারী সেহেতু শত্রু হতেও পারে। আর ওদের চলার ভংগি দেখে মনে হচ্ছে অস্ত্র তারা কারো না কারো বিরুদ্ধেই বহন করছে। তাদের সেই শত্রু কে? আমরাও হতে পারি। আর আমাদেরই রাজ্যের মধ্যে এখন ওরা।’ বলল সার্গিও।
লোক দু’জন তখন উচ্চভূমির প্রান্তে উঠে এসেছে। বসল তারা। কিন্তু উন্মুক্ত জায়গায় না বসে ছোট গাছ-গাছড়ার মধ্যে বসল।
নিচু কণ্ঠে তারা কথা বলছিল। মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছিল ঢালের দিকে। হঠাৎ এক সময় তারা নিচের উপত্যকার দিকে তাকিয়ে দ্রুত গড়িয়ে উচ্চভূমির প্রান্ত থেকে কিছুটা ভেতরে গাছ-গাছড়ার আরও আড়ালে সরে এল।
উৎকর্ণ হয়ে উঠল সার্গিও। বলল ফিসফিস করে, ‘নিচে উপত্যকায় মনে হয় কুকুরের চিৎকার শুনলাম। মনে হয় ওরা দুজনও শুনতে পেয়েছে কুকুরের চিৎকার। এ জন্যেই গড়িয়ে ওরা আরও আড়ালে সরে এল। নিশ্চয় ওরা কারো তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসছে এবং তাড়াকারীরা নিচের উপত্যকায় পৌছে গেছে।’
‘কিন্তু ভাইয়া এদের চোখে-মুখে তো পলাতকদের মত ভয় ও উদ্বেগ নেই!’ বলল ভ্যানিসা।
‘তা ঠিক। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তারা পলাতক নয়।’ সার্গিও বলল।
ওরা এ সময় দেখল, লোক দু’জন বেদির দিকে এগুচ্ছে।
আঁৎকে উঠল ভ্যানিসা। ফিসফিস করে বলল, ‘ভাইয়া, আমাদের মেহমান সর্পরাজরা তো এখনও বেদিতে!’
‘আমরা দর্শক, যা ঘটবে তা ঘটতে দাও। পাপ করলে পাপের সাজা ওদের পেতে হবে।’ বলল সার্গিও।
লোক দুজন তখন বেদিতে উঠছিল।
সার্গিও ও ভ্যানিসা বিস্ময়ের সাথে দেখল, সাপ দুটি বেদির দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে সারি বেধে নেমে চলে গেল।
তাদের বিস্ময়ের বড় কারণ হলো, প্রতিদিন সাপ দুটো দুধ খাওয়ার জন্য যেমন বেদিতে উঠে আসে পূর্ব প্রান্ত দিয়ে দুধ খাওয়ার পর নেমেও যায় তেমনি পূর্ব প্রান্ত দিয়ে। কিন্তু আজ প্রথমবার ওরা নামল দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে।
তার মানে তাদের মেহমান সাপ দুটো আপোশ করল লোক দুজনের সাথে, ভাবল সার্গিও। লোক দুজন বেদিতে উঠার আগেই যেমন সাপ দুটো চলে গেল, তেমনি ভিন্ন রাস্তা দিয়ে গেল একই রাস্তা ব্যবহারের সংঘাত এড়িয়ে।
‘ভাইয়া, কি বুঝলে?’ বলল ভ্যানিসা।
‘বুঝলাম, এ দুজন আমাদের শত্রু নয়, বা আমাদের জন্যে ক্ষতিকর নয়।’ বলল সার্গিও।
‘আমারও তাই মত। আর ওদের দুজনের চেহারা কোনও ভাবেই ক্রিমিনালের মত নয়। নিরীহ, নিষ্পাপ ভদ্রলোক বলেই ওদের মনে হয়।’ বলল ভ্যানিসা।
কথা শেষ করেই ভ্যানিসা আবার চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘ভাইয়া দেখ, ওরা দুজন ওদের মেশিন রিভলবার বাগিয়ে যুদ্ধের পজিশন নিয়ে বসে আছে।’
সাপ দুটো ঠিক পথে গেল কিনা দেখছিল সার্গিও। ভ্যানিসার কথায় সে মুখ ফিরাল, দেখল, লোক দুজন বেদির উত্তর প্রান্তে গাছ-গাছড়ার আড়াল নিয়ে ঢালের দিকে তাদের রিভলবার তাক করে বসে আছে।
এক মিনিটও পার হলো না।
নিচের উপত্যকার জংগল থেকে দুটি কুকুর নিয়ে ষ্টেনগানধারী দুজন লোক বেরিয়ে এল। তারা উঠতে শুরু করল ঢাল বেয়ে।
তাদের পেছনে পেছনে বেরিয়ে এল চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ জনের বিশাল বাহিনী। প্রত্যেকের হাতেই উদ্যত ষ্টেনগান। মনে হচ্ছে একদল যোদ্ধা এগুচ্ছে যুদ্ধের জন্যে।
‘তাহলে ওরাই তাড়া করে নিয়ে আসছে এ দুজনকে?’ বলল ভ্যানিসা ফিসফিস করে সার্গিওর উদ্দেশ্যে।
‘ভাবছি, এ দুজন বিদেশী। কিন্তু ওরা কারা? কি নিয়ে এই লড়াই?’ ধীরে ধীরে চাপা কণ্ঠে বলল ভ্যানিসা।
‘দূর থেকে দেখে যতটা বুঝা যাচ্ছে, তাতে সবাইকেই তো এদেশী বলে মনে হচ্ছে।’ বলল সার্গিও।
লোক দুজন রিভলবার বাগিয়ে বসে আছে। আর ওরা ঢাল বেয়ে উঠে আসছে।
‘দুই রিভলবার দিয়ে ওদের সাথে কিভাবে এরা লড়াই করবে, এরা এতদূর পালিয়ে এল, কিন্তু এখন আবার রুখে দাঁড়াল কেন?’ ভ্যানিসা বলল।
‘এদের ষ্ট্রাটেজিক জ্ঞান খুব টনটনে ভ্যানিসা। এরা খুবই সুবিধাজনক অবস্থান বেছে নিয়েছে। এ রকম জায়গা এদের সামনেও ছিল না, পেছনেও নেই।’ বলল সার্গিও।
‘কিন্তু এরা এভাবে বসে কেন? ওদের এগুতে দিচ্ছে কেন?’ চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল ভ্যানিসা।
ওরা তখন ঢালের মাঝামাঝি জায়গায় বসে আছে।
ওদের দিকে তাক করে বসা এদের একজন এ সময় ওদের দিকে একটা ফাঁকা গুলী করল সাধারণ রিভলবার থেকে। উত্তরে ওরা সংগে সংগে একসাথে গুলী বৃষ্টি শুরু করল বেদি লক্ষ্যে। এরাও বেদির উপর শুয়ে পড়ে তাদের দুই মেশিন রিভলবারের ট্রিগার টিপে ওদের উপর ঘুরিয়ে নিতে লাগল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। ওদিক থেকে গুলী ছোড়া বন্ধ হয়ে গেল। ঢালে আর কাউকেই দাঁড়ানো দেখা গেল না।
ওদিকের গুলী বন্ধ হলে এরাও গুলী ছোড়া বন্ধ করে দিল এবং উঠে বসল বেদির উপর।
‘কি আশ্চর্য, ওরা কি সবাই মরে গেল?’ প্রশ্ন তুলল ভ্যানিসা।
‘বলেছিলাম না ভ্যানিসা। এরা খুব কুশলী। উপযুক্ত জায়গা বেছে নিয়েছে। আবার ওদের নিয়েও এসেছে ঢালের মাঝখানে, তারপর আক্রমণ করেছে। যাতে পালাতে না পারে।’ সার্গিও বলল।
‘না ভাইয়া, এরা প্রথম আক্রমণ করেনি। ঢাল থেকে ওরাই প্রথম আক্রমণ করেছিল। কিন্তু ভাইয়া, এরা ঐ একটা ফাঁকা গুলী কেন করেছিল?’
‘ঠিক জানি না। হতে পারে ওদেরকে প্রথমে আক্রমণে আনা অথবা হটিয়ে দেয়ার জন্যে।’
‘ওদেরকে এরা আক্রমণে আনতে চাইবে কেন?’ আবার জিজ্ঞাসা ভ্যানিসার।
‘আমিও ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না ভ্যানিসা।’ বলল সার্গিও।
‘কিন্তু এরা এখন কিসের অপেক্ষা করছে। ঢালে তো এখন নেমে যেতে পারে। যুদ্ধ জয় তো হয়েই গেছে।’ বলল ভ্যানিসা।
‘বোধ হয় এরা আশংকা করছে, উপত্যকায় ওদের শত্রু পক্ষের লোক আরও আছে।’ সার্গিও বলল।
কিছু বলতে গিয়েও তার মুখ দিয়ে আর কথা বেরুল না। সে দেখল, পশ্চিম দিক থেকে দুজন ষ্টেনগানধারী বেদির পেছন পর্যন্ত এসে পৌছেছে।
ভ্যানিসা চাপা কণ্ঠে দ্রুত বলল, ‘ভাইয়া, বেদির পেছনে।’
সার্গিও তাকিয়েছিল ঢালের দিকে। সে তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরাল বেদির পেছনে। দেখতে পেল দুজন ষ্টেনগানধারীকে। তাদের ষ্টেনগানের ব্যারেল তখন লোক দুটিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে।
দেখেই চাপা কণ্ঠে ‘ভ্যানিসা……..’ বলতে বলতেই সার্গিও তার কারবাইনের ট্রিগার চেপে ধরল ঐ দুজন ষ্টেনগাধারীর লক্ষ্যে।
ভ্যানিসাও আগেই তার কারবাইন ঘুরিয়ে নিয়েছিল। সার্গিওর সাথে তারও কারবাইন গর্জন করে উঠেছিল।
দুজন ষ্টেনগানধারীর ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ ঝরে পড়ল মাটিতে।
সার্গিও ও ভ্যানিসা দেখল সেই লোক দুজন প্রথমেই গাছে চড়ে থাকা তাদের দিকেই ফিরে তাকিয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে তাদের দৃষ্টি ঘুরে গেল বেদির পেছনে পড়ে থাকা লাশ দুটির দিকে। তারা বেদির দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত এগিয়ে লাশ দুটিকে দেখল। আবার তাদের চোখ উঠে এসে নিবদ্ধ হলো সার্গিওদের উপর।
লোক দুজনের একজন আহমদ মুসা, সার্গিওদের উদ্দেশ্যে পর্তুগীজ ভাষায় বলল, ‘ধন্যবাদ। আপনারা দুজনকে হত্যা করে আমাদের দুজনের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। অথচ আপনারা ওদের কিংবা আমাদের কাউকেই চেনেন না।’
সার্গিওরা নেমে এল। সার্গিও বলল আহমদ মুসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, ‘আমরা ওদেরকে বা আপনাদেরকে চিনি না বটে। কিন্তু আক্রমণকারী কে আর আক্রান্ত কে তা আমরা দেখেছি। আমরা আক্রান্তকে সাহায্য করেছি।’
‘অপরাধী আক্রমণকারীরা হয়, কিন্তু আক্রান্তরাও হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তা হতে পারে। তবে আমাদের সে ভুল হয়নি, আপনার কথায় নিশ্চিত হলাম।’ বলল সার্গিও।
‘ধন্যবাদ। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল আপনারা যেন স্বর্গের দূত। আমাদের রক্ষার জন্যে দয়া করে ঈশ্বর আপনাদের পাঠিয়েছেন। আমার বিস্ময় এখনও যায়নি। এখানে আপনারা এলেন কি করে? দয়া করে আপনাদের পরিচয় দেবেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি সার্গিও গনজালো।’ বলল সার্গিও। তারপর ভ্যানিসাকে দেখিয়ে বলল, ‘এ আমার সহোদরা ছোট বোন ভ্যানিসা গনজালো। আমরা এ এলাকার। এর বেশি কিছু বলার আগে আপনারা কে তা আমাদের জানা প্রয়োজন।’
‘আমরা বিদেশী। লিজে বিমান বন্দরে নামার পর যাচ্ছিলাম ‘গঞ্জালেস ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে’ থাকার জন্যে।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর হোটেলের পথে তাদের কিডন্যাপ এবং হত্যা প্রচেষ্টাসহ গাড়ির জানালা ভেঙে তাদের পলায়নের সব কথা খুলে বলল।
‘আপনারা বিদেশী। আপনাদের সাথে ওদের শত্রুতা কেন? ওরা কারা?’ বলল ভ্যানিসা।
‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি’ (WFA) এর সাথে আপনাদের পরিচয় আছে?’ আহমদ মুসা সার্গিও ও ভ্যানিসা দুজনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
উত্তরে সার্গিও বলল, ‘পরিচয় নেই, তবে জানি আমরা ঐ সংগঠনকে। সংগঠনটা চরম ইহুদীবাদী। গোটা দুনিয়া দখলের দুঃস্বপ্ন ওদের। আজর ওয়াইজম্যান ওদের নেতা।’
‘ধন্যবাদ মি. সার্গিও। আপনারাতো দেখছি ওদের অনেক কিছুই জানেন। ওদের…….।’ আহমদ মুসার কথা সমাপ্ত হতে পারলো না।
আহমদ মুসাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সার্গিও আবার বলে উঠল, ‘আজোরসের পর্তুগীজ গভর্নর ‘পেড্রো’র স্ত্রী ‘ক্রিষ্টিন করণিকা’ ইহুদী। এই সুবাদে WFA এখানে ব্যাপক সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু আপনাদের সাথে WFA এর শত্রুতা কিসের? আপনাদের পরিচয় কিন্তু বলেননি।’
আহমদ মুসা একটু ভাবল। তারপর মুখ তুলল সার্গিওর দিকে। গভীর দৃষ্টিতে একবার সে দেখল সার্গিওকে।
উত্তর দিতে কিছু দেরি হলো আহমদ মুসার।
হাসল সার্গিও। বলল, ‘বুঝেছি, বিশ্বাস করতে পারছেন না আমাদের।’
আহমদ মুসা সলজ্জ হাসল। বলল, ‘স্যরি, এটা অবিশ্বাস নয়, সতর্কতা। বিশেষ পরিস্থিতিতে এটা সবাইকেই করতে হয়। যেমন আপনারাও আপনাদের সবটা পরিচয় আমাদের কাছে দিতে পারেননি।’
আবার হাসল সার্গিও। বলল, ‘কিছু পরিচয় আমরা গোপন রেখেছি বলে কি আপনি মনে করেন?’
ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার। বলল, ‘আপনারা ব্যক্তি পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু দলীয় বা সাংগঠনিক একটা পরিচয় আপনাদের আছে সেটা দেননি।’
‘কি করে বুঝলেন আমাদের একটা সাংগঠনিক পরিচয়ও আছে?’ গম্ভীর কণ্ঠস্বর সার্গিওর।
‘আপনাদের ইউনিফরম ব্যক্তিগত নয়, নিশ্চয় কোন দল বা সংগঠনের। বিশেষ করে আপনাদের ইউনিফরমের বুকে উদীয়মান সূর্যের আলোকস্নাত আজোরস দ্বীপপুঞ্জের যে ইনসিগনিয়া সেটা ব্যক্তিগত নয় অবশ্যই। আপনাদের কারবাইনেও ঐ একই ইনসিগনিয়া আমি দেখতে পেয়েছি। এর অর্থ এই অস্ত্রগুলোও আপনাদের ব্যক্তিগত নয়।’
সার্গিও ও ভ্যানিসার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। তাদের দুজনেরই গভীর বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। বলে উঠল সার্গিও গম্ভীর কণ্ঠে, ‘আপনাদের পরিচয়ের ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু এখন আপনার পরিচয় জানার কৌতূহল দমন করা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। এ রকম সুক্ষ ও সার্বিক দৃষ্টিওয়ালা লোককে আমি শার্লক হোমস-এর বইতে দেখেছি, আর আজ আপনাকে জীবন্ত দেখলাম। অতএব এখন আপনার পরিচয় জানতেই হবে। তার আগে আমাদের ছোট্ট পরিচয়টা বলছি।’
বলে একটু থামল সার্গিও। একটু মাথা নিচু করল। মাথা তুলল পরক্ষণেই এবং বলা শুরু করল, ‘ইনসিগনিয়ার উদীয়মান সূর্যটা স্বাধীনতার সূর্য। আমরা চাই আমাদের গোটা আজোরস স্বাধীনতা সূর্যের সোনালী আলোক ধারায় সণাত হোক। আমাদের সংগঠেনর নাম……….’
সার্গিও’র মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আজোরস ইনডিপেনডেন্ট পিপল’ (AIP)।
হাসল সার্গিও। বলল, ‘আমি বিস্মিত হলাম না। কারণ আপনি নতুন এক শার্লক হোমস। অতএব আজোরস দ্বীপপুঞ্জের স্বাধীনতা সংগ্রামের নাম জানা আপনার জন্যে বড় কথা নয়।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘আজোরসের স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘আজোরস ইনডিপেনডেন্ট পিপল (AIP) -কে নেতৃত্ব দিচ্ছে আজোরস দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কারক এবং এখানে প্রথম বসতিস্থাপনকারী গনজালো পরিবার। আমরা সেই ‘গনজালো’ পরিবারের সদস্য। আমার বড়ভাই রিকার্ডো এখানকার পর্তুগীজ সরকারের হাতে বন্দী হবার পর আমি আন্দোলনকে দেখাশূনা করার দায়িত্ব পালন করছি।’ থামল সার্গিও।
থেমেই আবার বলে উঠল, ‘আমাদের সব কথা বলেছি। এবার আপনাদের কথা বলুন।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমাদের কথা খুব বেশি নয়। WFA কিছু লোককে এই দ্বীপপুঞ্জের কোন এক দ্বীপে বন্দী করে রেখেছে। আমরা এসেছি তাদের উদ্ধার করতে।’
‘বন্দী করেছে তারা কারা?’ জিজ্ঞাসা ভ্যানিসার।
‘ওরা কয়েকজন একটি গোয়েন্দা ফার্মের কর্মকর্তা। ওদের গোয়েন্দা ফার্ম WFA ধ্বংস করে দিয়েছে এবং তার ৭ জন কর্মকর্তাকে কিডন্যাপ করেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সেই ফার্ম কি ফ্রান্সের ষ্ট্রাসবার্গের স্পুটনিক?’ বলল ত্বরিত কণ্ঠে ভ্যানিসা।
‘হ্যাঁ, তুমি জানলে কেমন করে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমি ঐ সময় ফ্রান্সে ছিলাম। লা-মন্ডেতে ঐ নিউজ আমি পড়েছি। স্পুটনিকের গোয়েন্দারা দেড় যুগ আগের নিউইয়র্কের টুইন-টাওয়ার ধ্বংসের কার্যকরণ অনুসন্ধান করছিল।’ বলল ভ্যানিসা।
‘কিন্তু WFA এই গোয়েন্দাদের প্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও গোয়েন্দাদের কিডন্যাপ করল কেন?’ ভ্যানিসা থামতেই বলে উঠল সার্গিও।
‘আপনার প্রশ্নের উত্তর হিসেবে, ‘ঠাকুর ঘরে কেরে, আমি কলা খাইনি’ এই প্রবাদ প্রযোজ্য।’
বিস্ময় ফুটে উঠল সার্গিওর চোখে-মুখে। বলল, ‘তার মানে WFA টুইন টাওয়ার ধ্বংসের তদন্ত বানচাল করার জন্যে স্পুটনিক ধ্বংস করেছে এবং তার ৭ গোয়েন্দাকে কিডন্যাপ করেছে?’
‘ওদের ভূমিকা তো তাই প্রমাণ করছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আরও একটা মজার খবর আছে, যেদিন স্পুটনিক ধ্বংস হয়, তার একদিন পর ইসরাইল রেডিওর দেশরক্ষা বিভাগের একটা সমীক্ষায় মন্তব্য করা হয় যে, ‘স্পুটনিকের সব কাজের মধ্যে একটা সাম্প্রদায়িক লক্ষ্য আছে। দেড় যুগেরও বেশি পর তারা টুইন টাওয়ার ধ্বংস নিয়ে যে কাজ করছে, তাও সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের ভীষণ একগুয়েমি এবং বর্তমান মার্কিন সরকারের প্রশ্রয়েই টুইন টাওয়ার ধ্বংসের মত ডেড ইস্যু নিয়ে স্পুটনিক কাজ করার সুযোগ পেয়েছে।’ মার্কিন সরকারও স্পুটনিকের যোগসাজসে পরিচালিত এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেককে রুখে দাঁড়াবার জন্যে আহবান জানায়।’ বলল হাসান তারিক।
‘হ্যাঁ, ইসরাইল সরকারের এই প্রতিক্রিয়াও প্রমাণ করছে, টুইন টাওয়ার ধ্বংসের বিষয়ে কোন কার্যকর তদন্ত হোক তা তারা চায় না। এই না চাওয়ার অর্থ এই ধরা যায় যে, টুইন টাওয়ার ধ্বংসের সাথে সংশিস্নষ্ট কোন সত্য তারা গোপন করতে চায়।’ সার্গিও বলল।
‘হ্যাঁ, স্পুটনিক ধ্বংস হওয়া এবং তার গোয়েন্দারা কিডন্যাপ হওয়ার এটাই কারণ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনারা কি স্পুটনিকের লোক?’ জিজ্ঞাসা সার্গিওর।
‘না, আমরা স্পুটনিকের লোক নই। আমরা স্পুটনিকের শুভাকাংখী। এতবড় অন্যায়ের প্রতিবিধান হওয়া উচিত বলেই আমরা কাজে নেমেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার তাহলে কে?’ জিজ্ঞেস করল ভ্যানিসা।
আহমদ মুসা একটু হাসল। হাসান তারিককে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি ফিলিস্তিন বিপ্লবের একজন নেতা। এখন ফিলিস্তিন সরকারের একজন উপদেষ্টা। নাম হাসান তারিক।’
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। থেমেই আবার বলল, ‘আর আমার নাম আহমদ মুসা। হাসান তারিকের মত আমার বিশেষ কোন পরিচয় নেই।’
‘আহমদ মুসা’ নাম শুনে সার্গিও ও ভ্যানিসা দুজনেরই কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠল। চোখে-মুখে ফুটে উঠল প্রবল জিজ্ঞাসা। ভ্যানিসাই প্রথম কথা বলে উঠল, ‘কোন আহমদ মুসা? এই ক’দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সুরিনামে যাকে নিয়ে মহা হৈ চৈ হয়ে গেল সেই আহমদ মুসা?’ ভ্যানিসার কণ্ঠস্বর দ্রুত। যেন এক মুহূর্তেই সব কথা বলে ফেলতে চায়।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই কথা বলে উঠল হাসান তারিক। বলল, ‘হ্যাঁ, উনি সেই আহমদ মুসা। তবে হৈ চৈ শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও সুরিনামে নয়, চীন, রাশিয়া, ককেশাস, ফ্রান্স, ফিলিস্তিন সব জায়গাতেই একটা করে ভূমিকম্প ঘটিয়েছেন তিনি।’
হাসান তারিক থামতেই সার্গিও ও ভ্যানিসা দুজনেই কোমর বাঁকিয়ে সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে আহমদ মুসাকে বাউ করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় একটা চালু ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল।
থেমে গেল সার্গিও ও ভ্যানিসা। উৎকর্ণ হয়ে উঠল তারা।
আহমদ মুসাও উৎকর্ণ হয়ে উঠেছিল। মুহূর্ত কয়েক কান পেতেই সে বলে উঠল, ‘দুটি হেলিকপ্টার আসছে এদিকে। আমার ধারণা মিথ্যা না হলে ওরা এখানেই ল্যান্ড করবে।’
বিস্ময় ফুটে উঠেছে সার্গিও ও ভ্যানিসার চোখে-মুখে। বলল সার্গিও, ‘কেন আসবে হেলিকপ্টার, কার হেলিকপ্টার? আমি তো জানি WFA-এর কোন হেলিকপ্টার নেই।’
‘ঠিক করে বলা মুষ্কিল। তবে আমি আন্দাজ করছি, WFA হেলিকপ্টার ভাড়া করেছে তার প্রেরিত বাহিনীর খোঁজ নেবার জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হেলিকপ্টারগুলো পুলিশের বলে মনে করছেন না কেন? WFA পুলিশকে বলে পুলিশের সাহায্য নিতে পারে। আমার মনে হয়, যে দু’জন লোক পেছন থেকে আক্রমণ করার জন্যে উপরে উঠে এসেছিল, তারাই মোবাইলে জানিয়ে দিয়েছিল তাদের বাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবার কথা।’ বলল সার্গিও।
‘আমি WFA-কে যতটা জানি তাতে বলতে পারি, তারা এক্ষেত্রে পুলিশের সাহায্য নেবে না। এমনকি এতবড় ম্যাসাকারের কথা তারা পুলিশের কাছ থেকে গোপন করবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন?’ বলল সার্গিও।
‘প্রথম কারণ, WFA তার এতবড় বিপর্যয় ও দুর্বলতার কথা পুলিশকে জানাতে চাইবে না। দ্বিতীয় কারণ, এ ধরনের বড় খুন-খারাবির কথা জানতে পারলে আইন-শৃঙ্খলার কারণেই পুলিশ WFA-এর কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে বা তাদের উপর চোখ রাখতে পারে, এমন আশংকা করতে পারে WFA’রা।’ আহমদ মুসা বলল।
সার্গিও ও ভ্যানিসা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। ধীরে ধীরে তাদের চোখে ফুটে উঠল মুগ্ধ দৃষ্টি। বলল সার্গিও, ‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আপনার চিন্তাই ঠিক।’
বাক্যটা শেষ করেই মুহূর্তের জন্যে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘এখন করণীয় কি, ঠিক করা দরকার। আমি মনে করি, হেলিকপ্টারগুলো যদি WFA-এরই হয়ে থাকে, তাহলে ওগুলো ল্যান্ড করার আগেই ধ্বংস করে দিতে পারি।’
‘না মি. সার্গিও, আমরা যা বলছি সবই অনুমান। নিশ্চিত না হয়ে এতবড় পদক্ষেপে যাওয়া ঠিক হবে না। এমনও তো হতে পারে, পুলিশে ইনফরমেশন দিয়ে তাদের জ্ঞাতসারে এই হেলিকপ্টার দুটি পাঠাচ্ছে WFA, অথবা এই হেলিকপ্টারে দুএকজন পুলিশকেও তারা পাঠাচ্ছে। আমরা যদি হেলিকপ্টার ধ্বংস করি, আর যে দুটি বিকল্পের কথা আমি বললাম, তার যে কোন একটি যদি সত্য হয়, তাহলে পুলিশের সাথে সংঘাত আমাদের অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। আমরা এই সংঘাত এখন এড়াতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
হাসল সার্গিও। বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। আহমদ মুসার কথার পর আর কোন কথা চলে না। এখন বলুন আমাদের কি করণীয়। হেলিকপ্টারগুলো এসে পড়ল বলে।’
‘এই উচ্চভূমির পাশে এমন কোথাও আমাদের আত্মগোপন করে অপেক্ষা করতে হবে, যেখান থেকে এই উচ্চ ভূমিটা দেখা যায়। ওদের এ ধারণা দিতে হবে যে, সংঘাতের পরেই এ স্থান ছেড়ে আমরা অন্য কোথাও চলে গেছি।’
‘এর দ্বারা আমরা কি অর্জন করতে চাচ্ছি?’ জিজ্ঞাসা সার্গিওর।
‘নিরর্থক এই সংঘাত এড়ানোর চেষ্টা করা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘নিরর্থক কেন?’ ভ্যানিসা জিজ্ঞেস করল।
‘এ সংঘাতে আমাদের জড়ানোর মধ্যে ওদের লক্ষ্য হলো আমাদের ক্ষতি করা, ধ্বংস করা। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ওদের ধ্বংস করা নয়, আমাদের বন্দী লোকদের উদ্ধার করা। আমরা এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে আমাদের লক্ষ্য অর্জন জটিলতর হবে। দ্বিতীয়ত, আমি চাই না এ সংঘাতে আপনারা আমাদের সাথে আছেন এটা কোনওভাবে তাদের জানার সুযোগ হোক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন চান না?’ ভ্যানিসাই আবার জিজ্ঞেস করল।
‘নতুন শত্রু সৃষ্টি করা আপনাদের ঠিক হবে না। আপনাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য WFA এখন কোন প্রত্যক্ষ শত্রু নয়, কিন্তু আমাদের হয়ে ওদের সাথে সংঘাতে নামলে আপনারাও শত্রু হয়ে যাবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময় ফুটে উঠেছে সার্গিও ও ভ্যানিসার চোখে-মুখে। বলল সার্গিও, ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে আপনি এর মধ্যেই এতটা ভাবছেন! যে লাভ-ক্ষতির কথা আমাদের মাথায় আসেনি, সেটাও আপনার ভাবনার বিষয়!’
বলে একটু হাসল সার্গিও। হাসিটার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠল তার হৃদয়ের একরাশ বিমুগ্ধতা। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ভ্যানিসা বলে উঠল, ‘পরকে আপনি এত আপন করে ভাবতে পারেন বলেই আপনি এত বড়, আপনার এত সাফল্য আহমদ মুসা। এমন মানুষের কাছেই মানুষ তার সবকিছু হারিয়ে বসতে পারে।’ আবেগ-কম্পিত কণ্ঠ ভ্যানিসার।
ভ্যানিসা থামতেই আহমদ মুসা উৎকর্ণ হয়ে বলে উঠল, ‘ওরা আরও কাছে এসে গেছে, আমাদের এখনি সরতে হবে।’
কিন্তু সার্গিও আহমদ মুসার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে ধীরে ধীরে বলে উঠল, ‘এতদিন আমরা ভেবে এসেছি, যত পার শত্রুকে মার, তাতেই লাভ। কিন্তু আজ আপনার কাছে শিখলাম, লক্ষ্যকেই বড় করে দেখতে হবে। লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয় না বা লক্ষ্য অর্জনকে জটিল করে তোলে এমন সংঘাত, হত্যাকান্ড অনর্থক, তাকে অবশ্যই এড়াতে হবে। এটা যে কত বড় শিক্ষা! ধন্যবাদ আপনাকে মি. আহমদ মুসা।’
‘লক্ষ্যকে বড় করে দেখার অর্থ কিন্তু আবার এই নয় যে, লক্ষ্য অর্জনের জন্যে যা ইচ্ছা তাই করা যাবে। লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক নয় এমন অনর্থক কিংবা ক্ষতিকর সংঘাত সংঘর্ষ যেমন পরিত্যাজ্য, তেমনি নিছক লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে হলেও অযৌক্তিক ও অন্যায় হয় এমন কোন কাজ বা ঘটনাও ঘটানো যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আপনাদের WFA এবং আমাদের ক্ষেত্রে পর্তুগীজ সরকার কি এই নীতিবোধ মানছে?’ জিজ্ঞেস করল সার্গিও।
‘তাদের লক্ষ্যই যেখানে অবৈধ, সেখানে তাদের পন্থার বৈধতা নিয়ে আলোচনা চলে না। কিন্তু আমার আপনার লক্ষ্য মহৎ, কোন অবৈধ পথ ও পন্থার ক্লেদ দিয়ে একে কলুষিত করা যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা নড়ে উঠল। বলল, ‘চলুন মি. সার্গিও, কোন দিকে যেতে হবে।’
সম্বিত ফিরে পাওয়ার মত নড়ে উঠল সার্গিও। চলতে শুরু করে বলল, ‘আসুন, আপনি যেমন বলেছেন, তেমন ভালো শেল্টার আছে। ওখান থেকে সরে পড়ারও ভালো পথ আছে।’
সবার সাথে ভ্যানিসাও চলতে শুরু করেছে। হাঁটছে সে আহমদ মুসার পাশাপাশি। তার মুখ গম্ভীর। চলতে চলতে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল সে, ‘লক্ষ্য অর্জনে যে পন্থার দিকে সবশেষে আপনি ইংগিত করেছেন, সেটা গ্রহণ করলে তো আমাদের সবাইকে ‘সেন্ট’ অন্য কথায় সাধু-সন্ত হতে হবে। অস্ত্র ধরা যাবে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের তাহলে কি হবে?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার লক্ষ্য স্বাধীনতা অর্জন, বন্দুক ধরা তোমার লক্ষ্য নয়। লক্ষ্যকে রক্ষার জন্যেই যখন বন্দুক ধরা প্রয়োজন তখন অবশ্যই বন্দুক ধরতে হবে। সাধু-সন্ত হলেও ধরতে হবে।’
হাসল ভ্যানিসা। বলল, ‘বুঝেছি। লক্ষ্য অর্জনে আপোশহীন হতে হবে, লক্ষ্য রক্ষার জন্যেই লড়াই করতে হবে।’
থামল ভ্যানিসা। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘ইতিহাস সাক্ষী, আপনি মাঠের একজন বিপ্লবী। কিন্তু আবার মনে হচ্ছে আপনি নীতিবাগিশ দার্শনিক একজন সেইন্ট। এটা কি বৈপরিত্য নয়?’
‘আমরা মুসলমান। একজন মুসলিম একই সাথে গৃহী, পুলিশ এবং সৈনিক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি মুসলিম! ও, তাইতো আহমদ মুসা তো মুসলমানই।’ বলল ভ্যানিসা।
‘মন খারাপ হলো তোমার?’ বলল আহমদ মুসা ভ্যানিসাকে লক্ষ্য করে।
‘মন খারাপ হবে কেন? বরং একটু ভালই লাগছে। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের পর্তুগীজ সরকার আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভেদ সৃষ্টি ও এই সংগ্রামে গনজালেস পরিবারের নেতৃত্ব নষ্ট করে একে দুর্বল করার জন্যে অপপ্রচার করে বেড়ায় যে, গনজালো পরিবার নাকি আদিতে মুসলিম ছিল। অপপ্রচার হলেও মুসলমানদের প্রতি কিছুটা আকর্ষণ তো আমাদের থাকবেই।’ ভ্যানিসা বলল।
‘অবাক খবর দিলে তুমি। আসল সত্যটা কি সার্গিও?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। অপপ্রচার নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন বোধ করিনি আমরা কোন সময়।’ সার্গিও বলল।
হেলিকপ্টার দুটো এসে পড়েছে। দুএক মিনিটের মধ্যেই ওরা এই উচ্চভূমির আকাশে এসে পৌছবে।
উচ্চভূমির পূর্ব-দক্ষিণ পাশে পাহাড়ের গোড়ায় এসে গেছে আহমদ মুসারা।
একটা সংকীর্ণ গিরিপথে ঢুকতে ঢুকতে সার্গিও বলল, ‘এসে গেছি আমরা। সাত আট ফিট উপরে উঠলেই একটা দীর্ঘ গিরিপথের মুখে শেল্টারটা। তার উপর পাহাড়ের ছাদ। সামনে উচ্চভূমির দিকটা উন্মুক্ত, কিন্তু গাছ-গাছড়ায় ঢাকা।’
সবাই সংকীর্ণ গিরিপথ বেয়ে উঠতে লাগল শেল্টারের দিকে।

হেলিকপ্টার দুটি ল্যান্ড করল আহমদ মুসাদের গুহা মুখের ঠিক নিচেই।
উচ্চভূমির গোটা এলাকা গাছ-পালায় ঢাকা। উচ্চভূমির উত্তর দিকে ঢালু স্লোপ, পশ্চিম দিকেও তাই। এই দুই ঢালে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করা সম্ভব নয়।
উচ্চভূমির দক্ষিণ দিকটা দুর্গম। দিকটা অসংখ্য পাহাড় টিলা, সংকীর্ণ উপত্যকা ও গাছপালায় আচ্ছাদিত। ওদিকে হেলিকপ্টার ল্যান্ডের কোন সুযোগ নেই। উচ্চভূমির মাঝখানে সমতল পাথুরে একটা চত্বর আছে। এই চত্বরেই ল্যান্ড করেছে হেলিকপ্টার দুটি।
হেলিকপ্টার দুটি পূবমুখী হয়ে পাশাপাশি ল্যান্ড করেছে। এদের বিশাল পাখার ব্লেডগুলো আহমদ মুসাদের গুহামুখের মাত্র সাত আট ফুট দূর দিয়ে ঘুরছে।
হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং এর জন্যে এই স্থানটি বেছে নেয়ায় আহমদ মুসা দারুন খুশি। ওদের ওঠানামা এবং কথাবার্তারও অনেক কিছুই তারা শুনতে পাবে।
ল্যান্ড করার মিনিট পাঁচেক পর হেলিকপ্টার দুটির দরজা একই সাথে খুলে গেল। দরজা খোলার সাথে সাথেই দুটি হেলিকপ্টার থেকে ৩জন করে ছয়জন লোক লাফ দিয়ে নামল। তাদের সকলের হাতেই উদ্যত ষ্টেনগান।
নেমেই তারা হেলিকপ্টারকে পেছনে রেখে সামনে ছুটে গিয়ে পজিশন নিল। পরক্ষণেই ছয়টি ষ্টেনগান থেকে গুলী শুরু হলো। উচ্চভূমির সব দিক লক্ষ্য করেই তারা গুলী ছুড়ছে।
মিনিট পাঁচেক একটানা গুলীর পর তাদের ছয়টি ষ্টেনগানই থেমে গেল।
আহমদ মুসা বুঝল, শত্রুকে আতংকিত করা কিংবা শত্রুর উপস্থিতি ও প্রতিক্রিয়া যাচাই করার জন্যে ফাঁকাগুলীর এ মহড়া চলছে।
আরও মিনিট পাঁচেক পার হলো।
হেলিকপ্টার থেকে আরও দুজন নেমে এল। তাদের কাঁধেও ষ্টেনগান ঝুলানো এবং দুজনের হাতেই একটি করে ফোল্ডিং চেয়ার।
হেলিকপ্টার দুটির মাঝখানে তারা চেয়ার দুটি সামনা সামনি করে পাতল।
কাঁচা পাকা চুলের দুজন রাশভারী লোক নেমে এল হেলিকপ্টার থেকে। বসল তারা চেয়ার দুটিতে।
দুজনের কাউকেই চিনতে পারল না আহমদ মুসা। দুজন নিশ্চয় বড় নেতা গোছের কেউ হবে। তবে সে নিশ্চিত যে এদের মধ্যে WFA-এর প্রধান আজর ওয়াইজম্যান নেই।
বসেই দুজনের একজন মুখ তুলে পজিশন নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা ছয়জনের একজনকে লক্ষ্য করে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, ‘রিকার্ডো’ দুজনকে পাহারায় রেখে তোমরা চারজন ওদিকে যাও। কেউ বেঁচে আছে কিনা দেখ। চল্লিশটি লাশই গুণে আসবে। দেখলাম অস্ত্রগুলো পড়ে আছে। ওগুলো নিয়ে আসবে। সবার কাছেই মোবাইল থাকার কথা। ভালো করে সার্চ করে দেখে ওগুলো অবশ্যই নিয়ে আসবে। মনে রেখ, মোবাইলগুলো অস্ত্রের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।’
কথাগুলো আহমদ মুসারাও শুনতে পেল। শুনে মনটা খচখচ করে উঠল আহমদ মুসার। মোবাইল ওদের কাছে আছে, এ কথা মনেই করেনি আহমদ মুসারা। মোবাইলগুলো শুধু টেলিফোন ইনডেক্সই নয়, কার সাথে কখন যোগাযোগ হয়েছে তারও একটা বর্তমান নির্ঘণ্ট। আর আপসোস করে লাভ নেই, ওগুলো এখন ওদের হাতেই পড়ে গেল, ভাবল আহমদ মুসা।
ওদিকে রিকার্ডো নামক লোকটি তিনজনকে সাথে করে নিয়ে চলে গেল উচ্চভূমির উত্তর ঢালের দিকে।
ওরা চলে গেলে চেয়ারে বসা নেতা গোছের সেই রাশভারী লোকটি সামনের চেয়ারে বসা দ্বিতীয় লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মি. ডেভিড ডায়ার, খবর পাওয়ার পনের মিনিটের মধ্যে আমরা পৌছে গেছি। ওরা সরে পড়ার জন্যে খুব বেশি হলেও সাত আট মিনিট সময় পেয়েছে। এই সময় ওরা এক মাইল পথও যেতে পারেনি। সুতরাং ওদের আশে পাশেই পেয়ে যাব।’
‘মি. এডাম এরিয়েল, আমারও তাই মত। কিন্তু ওদের আশে-পাশে পেতে হলে এখনই আমাদের কাজ শুরু করা দরকার।’
‘হ্যাঁ সেটাই হবে মি. ডায়ার।’ বলে এডাম এরিয়েল পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। মেলে ধরল কাগজটি সামনে।
কাগজটি টেরসিয়েরা দ্বীপের একটা মানচিত্র।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনের চোখেই দূরবীন। এডাম এরিয়েলরা আট নয় ফিট নিচে ৪০ ডিগ্রী কোণে আছে বলে দূরবীনের ফোকাস সহজেই মানচিত্রের উপরও ফেলা যাচ্ছে।
মানচিত্র দেখতে গিয়ে ওরা নিচু স্বরে কথা বলা শুরু করেছে।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি পিঠের ব্যাগ থেকে সাউন্ড সেন্সর রেডিও বের করে নিল।
যন্ত্রটি একটা পকেট রেডিওর মত। তাতে দুফিট লম্বা একটা এন্টেনা। এই এন্টেনাটা দুশ বর্গগজের মধ্যেকার সব শব্দ মনিটর করে আলাদা আলাদা করে ক্লাসিফাইড রেকর্ডের পর তা প্রচার করতে পারে।
আহমদ মুসা এন্টেনা তুলে ‘হিউম্যান ভয়েস’ ‘কি’তে চাপ দিয়ে যন্ত্রটিকে সবার মধ্যখানে রেখে দিল।
আহমদ মুসা দূরবীন দিয়ে মানচিত্রের যতটা পারা যায় দেখতে লাগল এবং শুনতে লাগল ওদের কথা রেডিও রিলে থেকে।
যে কণ্ঠ তখন রিলে হচ্ছিল, সেটা এডাম এরিয়েলের কণ্ঠ। শুনেই তা বুঝতে পারল আহমদ মুসা।
বলছিল এডাম এরিয়েল, ‘উচ্চভূমির চারদিকের অবস্থা বুঝলেন তো! এখন দেখুন, আহমদ মুসার যাবার এলাকা একমাত্র দক্ষিণ দিকটাই। উত্তর দিক থেকে সে পালিয়ে এসেছে, অতএব ওদিকে সে এই মুহূর্তে যাবে না। পশ্চিম দিকে ছোটভূমির পরেই বিশাল জলাভূমি। ওদিকে আহমদ মুসার কোন আশ্রয় নেই এবং সামনে এগুবার তার কোন পথ নেই। আর পূব দিকে পাহাড়। এই পাহাড়ের পথে কোন গন্তব্যে পৌছা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অবশ্য আত্মগোপনের জায়গা এ পাহাড়ে থাকতে পারে। কিন্তু আহমদ মুসা আত্মগোপনের কথা ভাবছে না। তার লক্ষ্য কোন শহর বন্দরে পৌছা। সুতরাং দক্ষিণই তার যাবার একমাত্র পথ। দক্ষিণের পাহাড়-উপত্যকার পথ কষ্টকর হলেও এ পথে কিছুদূর সামনে এগুলে সে পাবে একটা ট্রাইবাল এরিয়া। এস্কিমো, রেড ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভুত কিছু লোক এবং পলাতক এক শ্রেণীর অপরাধীদের উত্তর পুরুষ এই এলাকায় বাস করে। এখান থেকে দক্ষিণ ও পূর্ব উপকূলের কয়েকটি বন্দরে ও দক্ষিণের হেরোইমা শহরে যাবার পাহাড়ী পথ আছে। সুতরাং আহমদ মুসা এই আশ্রয়ের সন্ধানেই এগোবে।’
হাসল ডেভিড ডায়ার। বলল, ‘আহমদ মুসা উচ্চভূমির চারদিকের এত কিছু জানলেই না আশ্রয়ের সন্ধানে দক্ষিণে অগ্রসর হবে। তার এতসব জানার কথা নয়। সে আজ রাতে দ্বীপের বিমান বন্দরে ল্যান্ড করেছে এবং সংগে সংগেই তাড়া খেয়ে সে পালিয়ে এসেছে। আমার ধারণা এত কিছু ভেবে সে এগুতে পারবে না।’
এডাম এরিয়েলও হাসল। বলল, ‘আসলে আপনি আহমদ মুসাকে চেনেন না। সে যে দেশে বা যেখানে পা দেয় তার সবকিছুই সে আগে জেনে নেয়। আমার বিশ্বাস এই দ্বীপের কোন কিছুই তার অজানা নয়।’
‘কিন্তু আপনি কি করে ধরে নিচ্ছেন যে, সে-ই আহমদ মুসা। আমি তো শুনলাম আজর ওয়াইজম্যানও এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পারেননি।’ বলল ডেভিড ডায়ার।
‘আগে তিনি নিশ্চিত না হলেও এখন তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। এখানকার বিপর্যয়ের খবর যে মোবাইলে দিয়েছিল, সে জানায়, তারা আগে আক্রান্ত হয়নি। একটা ফাঁকা গুলী তার মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। এই ফাঁকা গুলীর পর তারা আক্রমণ করলে পাল্টা গুলী বর্ষণ শুরু হয় আহমদ মুসার দিক থেকে। এটাই আহমদ মুসার যুদ্ধের সাধারণ কৌশল। সে শত্রুকে কোনওভাবে এলার্ট না করে আক্রমণ সাধারণত করে না। এই ঘটনা যেহেতু এখানে ঘটেছে তাই এখন নিসন্দেহে বলা যায়, এই ম্যাসাকার আহমদ মুসার দ্বারাই হয়েছে।’
‘শত্রুকে আক্রমণের আগে এলার্ট করার আহমদ মুসার এই কৌশল কেন? কেন করে সে এটা?’ বলল ডেভিড ডায়ার।
‘সম্ভবত যুদ্ধ শুরুর দায় আহমদ মুসা তার ঘাড়ে নিতে চায় না, চাপাতে চায় শত্রুর কাঁধে। শত্রুকে এলার্ট করে সে শত্রুকে আক্রমণে নিয়ে আসে, তারপর সে তার জবাব দেয়।’ বলল এডাম এরিয়েল।
‘যুদ্ধে নেমে যুদ্ধের দায় সে নিতে চায় না কেন?’ ডেভিড ডায়ার বলল।
‘সে নিজেকে শান্তিবাদী হিসেবে দেখাতে চায়। সে দেখাতে চায় যে, সে জুলুমের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার লড়াই করে।’ বলল এডাম এরিয়েল।
হাসল ডেভিড ডায়ার। বলল, ‘ভূতের মুখে রাম-নাম।’
হাসল এডাম এরিয়েলও। বলল, ‘থাক, এখন যা করার দ্রুত করতে হবে। আমাদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত আহমদ মুসাকে আর বাঁচতে দেয়া যাবে না।’
‘বলুন, কি করতে চান? শেষ একটা অস্ত্র তো আমরা সাথে এনে……….।’
ডেভিড ডায়ারের কথা শেষ হলো না। হন্তদন্ত হয়ে একজন নেমে এল হেলিকপ্টার থেকে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সে এডাম এরিয়েলকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার, আমরা আমাদের সাউন্ড রেকর্ড থেকে রিলে গ্রহণ করতে গিয়ে দেখছি, আপনাদের কথা ডাবল রিলে হচ্ছে। তার মানে আপনাদের কথা আরও কোন জায়গা থেকে রেকর্ড ও রিলে হচ্ছে।’
শুনেই এডাম এরিয়েল ও ডেভিড ডায়ার বিদ্যুতপৃষ্টের মত চমকে উঠে সোজা হয়ে বসল। এডাম এরিয়েল চিৎকার করে উঠল, ‘ডাইরেকশন আইডেনটিফাই করেছ?’
হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসা লোকটি বলল, ‘জি স্যার। পাহাড়ের দিক মানে পূব দিক থেকে আসছে।’
‘তার মানে আহমদ মুসা পাহাড়েরই কোথাও লুকিয়ে আছে।’ বলল আবার চিৎকার করে এডাম এরিয়েল।
‘স্যার, আপনার একথাগুলোও ওরা শুনতে পাচ্ছে।’ কিছুটা নিচু স্বরে বলল লোকটি।
কিছুটা বিব্রত কণ্ঠে এডাম এরিয়েল বলল, ‘স্যরি। ধন্যবাদ তোমাকে।’
কথাটা বলেই এডাম এরিয়েল উঠে দ্রুত ডেভিড ডায়ারের কাছে গেল। তাকে কানে কানে কি যেন বলল।
ডেভিড ডায়ার সায় দিল এডাম এরিয়েলের কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে।
এরপর এডাম এরিয়েল কানে কানে কিছু বলল হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসা লোকটিকে।
শুনেই মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে লোকটি দ্রুত হেলিকপ্টারে উঠল।
ওদিকে ডেভিড ডায়ারও হেলিকপ্টারে উঠে গেল।
এডাম এরিয়েল হাত ইশারা করে ডাকল পাহারায় দাঁড়ানো লোক দুজনকে।
ওরা এলে ওদের দুজনকেই কানে কানে কিছু বলল এডাম এরিয়েল। ওরাও সায় দিল এডাম এরিয়েলের কথায় মাথা নেড়ে।
ওদের সাথে কথা শেষ করেই এডাম এরিয়েল উঠে গেল হেলিকপ্টারে।
হেলিকপ্টারের পাখা ঘুরতে শুরু করল।
গর্জন শুরু করেছে হেলিকপ্টার দুটির ইঞ্জিন।
হেলিকপ্টার থেকে নামল আরও দুজন ষ্টেনগানধারী। তাদের দুজনেরই কাঁধে ঝুলানো ষ্টেনগান এবং কোমরে রিভলবার। শুধু একজনের হাতে বাড়তি বড় একটি ব্যাগ।
আগের দুজনসহ চারজন ষ্টেনগানধারী দৌড়ে হেলিকপ্টারের নিচ থেকে একটু দূরে সরে গেল।
হেলিকপ্টার উঠে গেল আকাশে।
রুদ্ধশ্বাসে দেখছিল আহমদ মুসারা এই দৃশ্য। আহমদ মুসারা জেনেছে, তাদের মনিটরিং ধরে ফেলার সাথে সাথে আহমদ মুসাদের অবস্থানের এলাকাও তারা চিহ্নিত করেছে। এখন কি ওরা আক্রমণে আসবে? কিন্তু ষ্টেনগানধারীদের রেখে হেলিকপ্টার দুটো আকাশে উড়ল কেন? ষ্টেনগানধারীদের পাহারায় রেখে ওরা বিশেষ কোন প্রস্তুতির জন্যে উপরে উঠেছে। তাহলে কি হেলিকপ্টার নিয়ে ওরা আহমদ মুসাদের অবস্থান চিহ্নিত করার জন্যে বেরুল?
এসব চিন্তা আহমদ মুসার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
হেলিকপ্টার দুটো তখন আকাশে উঠে গেছে এবং পূবমুখী হয়ে উড়তে শুরু করেছে।
নিচের চারজন ষ্টেনগানধারীদের একজন হেলিকপ্টার থেকে নামানো বড় ব্যাগটা খুলে ফেলল। তার ভেতর থেকে এক এক করে বের করে আনল অনেকগুলো গ্যাসমাস্ক।
গ্যাসমাস্কগুলোর দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। পাশের সাউন্ড সেন্সরটা গুটিয়ে ব্যাগের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘হাসান তারিক, ওরা হেলিকপ্টার থেকে গ্যাস ফেলবে এখনি। তোমরা আমার সাথে এস।’
বলে আহমদ মুসা যে পথ দিয়ে উঠেছিল সেই পথে নামা শুরু করল। বলল, ‘ভয় নেই এস, ওদের গ্যাসমাস্ক আমাদের দখল করতে হবে।’
‘ভাইয়া, আমাদের কাছে তো দু’টো গ্যাসমাস্ক আছে। ও দুটো মি. সার্গিও ও মিস ভ্যানিসাকে পরিয়ে দেই?’ চলতে চলতেই বলল হাসান তারিক।
হাসান তারিক, সার্গিও ও ভ্যানিসা আহমদ মুসার পেছনে পেছনে তখন দৌড়াতে শুরু করেছে।
হাসান তারিকের কথার জবাবে আহমদ মুসা দৌড়রত অবস্থায় বলল, ‘ও গ্যাসমাস্কগুলো কার্যকরী থাকে মাত্র দু’এক মিনিট মাত্র। তবুও দিতে পার।’
আহমদ মুসারা সবাই ছুটছে। কিন্তু এগুবার জন্যে যতটা কসরত হচ্ছে, ততটা এগুনো যাচ্ছে না। খাড়া পাহাড়ে ওঠা যতটা কঠিন, নামা তার চেয়েও কঠিন। তার উপর অনেকটা পথ ঘুরে তাদের আসতে হবে হেলিকপ্টার যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই চত্বরটায়।
সার্গিও ও ভ্যানিসার মুখ উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আচ্ছন্ন।
আহমদ মুসা এক ঝলক পেছনে তাকিয়ে ওদের লক্ষ্য করে বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই। হেলিকপ্টারগুলো পাহাড়ের পুব অঞ্চলে গ্যাস স্প্রে করতে করতে আসছে, যাতে এর মধ্যে তাদের সব লোকরা গ্যাসমাস্ক পরে নিতে পারে।’
‘ওরা এতবড় অমানুষ! এ গ্যাস প্রয়োগে তো অন্যান্য নিরপরাধসহ পশু-পাখিও মারা পরবে।’ বলে উঠল সার্গিও।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘মানুষ যখন অমানুষ হয়, তখন সে পশুর চেয়েও খারাপ হয়ে যায়।’
‘ভাইয়া, আপনি এই সময়েও এমন নির্মল হাসতে পারলেন? আপনার মুখে তো কোন উদ্বেগ দেখছি না।’ আহমদ মুসাক লক্ষ্য করে বলল ভ্যানিসা।
‘আল্লাহ যা ঘটাবেন তাই ঘটবে, চিন্তা করে লাভ কি বোন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে তো আমাদের চেষ্টা করে কোন লাভ নেই।’ ভ্যানিসা বলল।
‘আমরা যে চেষ্টা করছি, সর্বশক্তি দিয়েই করছি, সেটাও আল্লাহই ঘটাচ্ছেন। কিন্তু উদ্বেগ-আতংক আল্লাহ ঘটান না, কারণ ওটা কোন কাজ নয়।’
হাসল ভ্যানিসা। বলল, ‘অবিস্মরণীয় এক শিক্ষার কথা বলেছেন ভাইয়া।’
পূর্ব দিক থেকে হেলিকপ্টারের গর্জন ভেসে আসছে। দ্রুত ছুটে আসছে ওরা।
আহমদ মুসা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার মনে পড়ল, তাদের একথাগুলো তো হেলিকপ্টার থেকে ওরা মনিটর করছে এবং এর মাধ্যমে সহজেই ওরা আহমদ মুসাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারবে। অলরেডি ওরা তা হয়তো করেছেও।
ভ্যানিসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘নো মোর টক। ওরা আমাদের অবস্থান ধরে ফেলবে।’
আরেক ঝলক উদ্বেগ নেমে এল সার্গিও এবং ভ্যানিসার চোখে-মুখে।
চত্বরের কাছাকাছি পৌছে গেছে আহমদ মুসারা। চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। ওরা পূব দিক থেকে যে গ্যাস স্প্রে করতে করতে আসছে, তার প্রভাব এখানকার বাতাসেও ছড়িয়ে পড়েছে।
আরও দ্রুত পা চালালো আহমদ মুসা। সে আরও একটা বিষয় ভেবে উদ্বিগ্ন হলো। গ্যাসমাস্ক ওয়ালারা চারজনই যদি গ্যাসমাস্কগুলো উচ্চভূমির ঢালে তাদের সহকর্মীদের কাছে নিয়ে গিয়ে থাকে! সে ক্ষেত্রে মুস্কিলে পড়বে তারা। গ্যাসমাস্ক সংগ্রহ তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।
আশা-নিরাশার দোলায় দুলে আহমদ মুসা ষ্টেনগান সামনের দিকে তাক করে গিরিপথের আড়াল থেকে মুখ বাড়াল। দেখল তিনজন ষ্টেনগানধারী রয়েছে। চতুর্থজন সঙ্গীদের গ্যাসমাস্ক সরবরাহ করতে গেছে ঢালে, বুঝল আহমদ মুসা। গ্যাসমাস্কের ব্যাগটাও পড়ে আছে চত্বরে।
‘পশ্চিমমুখী হয়ে পজিশন নিয়ে বসে থাকা গ্যাসমাস্ক পরা ষ্টেনগানধারীদের অলক্ষ্যে তাদের পেছন থেকে গ্যাসমাস্কের ব্যাগ নিয়ে আসবে কিনা, ইত্যাদি নিয়ে আহমদ মুসা কোন সিদ্ধান্তে পৌছার আগেই পেছন থেকে প্রচন্ড হাঁচি দিয়ে উঠল ভ্যানিসা।
বাতাস কিছুটা দুষিত হয়ে পড়ার কারণেই এটার কোন এলার্জিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
হাঁচির সাথে সাথেই তিনজন ষ্টেনগানধারী চোখের পলকে ঘুরে দাঁড়াল। তাদের ষ্টেনগানও উঠে আসছিল।
আহমদ মুসা সংঘর্ষে যাওয়া ছাড়া গ্যাসমাস্ক দখলের আর কোন উপায় দেখল না।
আহমদ মুসার ষ্টেনগান তাক করাই ছিল। শুধু ট্রিগার চেপে ধরল সে।
ওরা আর গুলী করার সুযোগ পেল না। গুলী খেয়ে পড়ে গেল তিনটি দেহই।
আহমদ মুসা ষ্টেনগান বাগিয়ে ধরে ছুটল ব্যাগের দিকে। তার পেছনে পেছনে ছুটল হাসান তারিক ও ভ্যানিসারাও।
ব্যাগেই গ্যাসমাস্ক পাওয়া গেল।
দ্রুত গ্যাসমাস্ক পরে নিল সবাই।
হেলিকপ্টার এসে গেছে। নিশ্চয় হেলিকপ্টারে ওরা ষ্টেনগানের শব্দ শুনেছে। ওদের দূরবীনে আহমদ মুসারা ধরাও পড়ে যেতে পারে।
‘সবাই এস, জংগলের আড়ালে যেতে হবে।’ খুব নিচু স্বরে কথাগুলো বলে আহমদ মুসা ছুটল জংগলের দিকে। তার সাথে সবাই।
হেলিকপ্টার আসছিল গ্যাস স্প্রে করতে করতে। হেলিকপ্টার থেকে মেশিনগান দাগাও শুরু হলো।
‘হেলিকপ্টার নিশ্চয় ষ্টেনগানের শব্দ শুনেছে, এখন দেখতে পেয়েছে তাদের লোকদের লাশও। আমরা উচ্চভূমির জংগলে আশ্রয় নিয়েছি, এটাও নিশ্চয় ওরা দেখতে পেয়েছে। এস, আমরা উত্তর দিকের ঢালের দিকে আগাই। ওদিকে তাদের লোক আছে। ওদিকে মেশিনগানের ফায়ার কম হতে পারে।’
নিচু চাপা কণ্ঠে কথাগুলো বলার সাথে সাথে আহমদ মুসা উত্তর দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে। তার ষ্টেনগানের নল সামনে উদ্যত। আঙুল ষ্টেনগানের ট্রিগারে। তার পেছনে অন্য সবাই।
পথের মাঝামাঝি জায়গায় একটা ঘন ঝোপের পাশ কাটিয়ে সামনে এগুতেই আহমদ মুসা ৫জন ষ্টেনগানধারীর একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেল। ওরাও দৌড়ে আসছিল, সম্ভবত এদিকে ষ্টেনগানের আওয়াজ শুনেই।
ঘটনার আকস্মিকতা উভয় পক্ষকেই বিমূঢ় করে দিয়েছিল। কিন্তু আহমদ মুসা এ ধরণের অবস্থার জন্যে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। তার ষ্টেনগানও হাতে বাগিয়ে ধরা ছিল, হাতের আঙুলও ছিল ট্রিগারে। সুতরাং জিতে গেল আহমদ মুসাই। সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে ট্রিগারে চেপে ধরল আঙুল।
ওরাও বিমূঢ়তার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। নড়ে উঠেছিল তাদের ষ্টেনগানও।
কিন্তু তারা এ্যাকশনে যাবার আগেই সে সুযোগ তাদের শেষ হয়ে গেল। পাঁচজনই ষ্টেনগানের গুলীতে ঝাঁঝরা হয়ে ভূমি শয্যা নিল।
আহমদ মুসা একবার পেছনে তাকিয়ে ‘এস তোমরা’ বলে আবার দৌড়াতে শুরু করল।
সবাই এসে পৌছল উত্তর ঢালের মুখে। আহমদ মুসা সবাইকে বড় গাছের গোড়ায় আশ্রয় নিতে বলল।
কিন্তু হেলিকপ্টারের গুলী জংগলের মাঝামাঝি অতিক্রম করার পর বন্ধ হয়ে গেল।
হেলিকপ্টার চলে এল ঢালের ওপর।
‘ওরা ঢালে পাঠানো ওদের লোকদের খুঁজছে।’ বলে একটু হাসল আহমদ মুসা। বলল নিচু স্বরে আবার, ‘ঢালে ওদের লোকদের পাচ্ছে না। সুতরাং এখন নিশ্চয় ওরা ভাবছে, তাদের লোকরা ঢালের কাজ সেরে উচ্চভূমির জংগলে উঠে এসেছে। এই ষ্টেনগানের ফায়ারও তাদের কানে গেছে। অতএব এখন তারা ভাবতে বাধ্য হবে, জংগলে তাদের লোকদের সাথে আমাদের লোকদের সংঘর্ষ চলছে। ফলে এখন তাদের মেশিনগান ও গ্যাস আক্রমণ দুটোই অকেজো।’
‘কি করে?’ বলল ভ্যানিসা খুব আসেত্ম। তার বিস্ময়-বিমুগ্ধ চোখে সপ্রশংস দৃষ্টি।
‘গ্যাসমাস্ক আমরা দখল করেছি, এ বিষয়ে তারা নিশ্চিত। সুতরাং গ্যাস আক্রমণ কোন কাজ দেবে না। আর যেহেতু ওরা ধরে নিতে বাধ্য হয়েছে, ওদের লোকরাও এখন উচ্চভূমিতে, তাই হেলিকপ্টার থেকে মেশিনগান আক্রমণও তারা চালাতে পারছে না।’ আহমদ মুসা বলল প্রায় ফিসফিস করে।
কথাটা বলেই আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। দ্রুত চাপা কণ্ঠে নির্দেশ দিল, ‘হাসান তারিক, তুমি যাও এখনি যে লাশগুলো পড়ল ওদের কাছে। ওরা ওদের সহকর্মীদের মোবাইলগুলো সংগ্রহের কথা বলেছিল। সবাইকে সার্চ করে মোবাইলগুলো নিয়ে এস।’
‘আমি যেতে পারি মি. তারিকের সাথে। তাকে সহযোগিতা করব।’ বলল সার্গিও যথাসাধ্য তার দরাজ কণ্ঠকে নিচু রেখে।
‘না মি. সার্গিও, আপনি ভ্যানিসার কাছে থাকুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি তো আছেনই।’ বলল সার্গিও।
‘না আমি থাকছি না। এখনি গাছে উঠব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘গাছে কেন?’
‘ওখান থেকে হেলিকপ্টারকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। ওদের কিছু একটা ব্যবস্থা করা দরকার।’ বলেই আহমদ মুসা এগুলো সামনের সবচেয়ে বড় গাছটার দিকে।
গাছে উঠল আহমদ মুসা।
গাছের এমন এক জায়গায় উঠে সে বসল যাতে চারদিকের আকাশটাকে ভালোভাবে দেখা যায়। মাথার উপরটাতেই গাছের ডাল-পালার আড়াল। হেলিকপ্টার সরাসরি উপর থেকে তাকে দেখতে পাবে না। কিন্তু সে হেলিকপ্টারকে টার্গেট করতে পারবে। কিন্তু অসুবিধা যেটা হবে সেটা হলো, একমাত্র উপর ছাড়া চারপাশ থেকে হেলিকপ্টার তাকে দেখতে পাবে, যদি তারা বিশেষভাবে এদিকটার দিকে তাকায়।
উচ্চভূমির গোটা আকাশটাই চক্কর দিচ্ছে হেলিকপ্টার দুটি। তবে এক সাথে নয়, আলাদাভাবে এবং বেশ দূরত্ব রেখে।
আহমদ মুসা গাছের ডালে যুতসইভাবে বসে তখনও তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি। এই সময় দেখতে পেল, একটি হেলিকপ্টার পূবদিকে কিছু দূরে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। আহমদ মুসার মনে হলো, হেলিকপ্টারটি তাকে দেখতে পেয়েছে। হেলিকপ্টারের খোলা দরজা এদিকে হা করে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয় দূরবীনের দুটি চোখ এ দিকে স্থিরভাবে নিবদ্ধ, ভাবল আহমদ মুসা।
দক্ষিণ দিকের দ্বিতীয় হেলিকপ্টারটি উড়ে আসছিল পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে। সে হেলিকপ্টারটিও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল, দেখল আহমদ মুসা। সেই সাথে দেখতে পেল, হেলিকপ্টারটির মাথা বোঁ করে উত্তরমুখী হয়ে ঘুরে গেল। দ্রুত আহমদ মুসা তাকাল পূবের হেলিকপ্টারটির দিকে। দেখল, পূবের হেলিকপ্টারটির মাথাও পশ্চিম দিকে ঘুরে গেছে। আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইল না দক্ষিণ দিকের হেলিকপ্টারটি, পূবের হেলিকপ্টারকে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে। এখন দুটি হেলিকপ্টারই তাকে আক্রমণ করার জন্যে প্রস্তুত।
আহমদ মুসার এই চিন্তা শেষ হবার আগেই দেখল, হেলিকপ্টার দুটি তার দিকে দৌড় শুরু করেছে।
আহমদ মুসা দ্রুত ভাবল, সে ঝুলানো দড়ি বেয়ে নিচে নেমে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু তার ফলে হেলিকপ্টার দুটি বেপরোয়া আক্রমণের সুযোগ পেয়ে যাবে উচ্চভূমির উপরে। কারণ তারা এখন নিশ্চিত মনে করবে, তাদের লোকেরা উচ্চভূমিতে জীবিত থাকলে তাদের শত্রুরা এভাবে গাছে উঠতে পারতো না। সুতরাং হেলিকপ্টার দুটোকে সে সুযোগ দেয়া যাবে না।
এ চিন্তার সাথে সাথে আহমদ মুসা চারদিকে তাকাল। তার চার দিকেই গাছ আছে তবে বেশ দূরে দূরে। কোন কোনটির দূরত্ব পনের-বিশফুট হবে।
দক্ষিণ পূর্ব কোণের দিকে একটা গাছকে টার্গেট করল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে এসে আশে-পাশের কয়েকটা ছোট ডাল ভেঙে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুঁজে দিয়ে বাদুড়ের মত খুব সহজভাবে এগুলো দক্ষিণ পূবমুখী একটা মোটা ডাল বেয়ে।
ডালের প্রান্তের দিকে রশির মাথা শক্ত করে বেঁধে আহমদ মুসা ফিরে এল তার আগের জায়গায় রশির শেষ প্রান্তটা হাতে ধরে। তার পর দ্রুত কিছুটা নেমে এসে দুহাতে রশির দুপ্রান্ত জড়িয়ে দুপায়ে গাছটিকে প্রচন্ড শক্তিতে পেছনে ঠেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসা। মুহূর্তেই লম্বা রশির ঝুলন্ত গতিবেগ ক্ষেপণাস্ত্রের মত আহমদ মুসাকে পৌছে দিল দক্ষিণ-পুবের সেই গাছটির একটা ডালের সান্নিধ্যে। আহমদ মুসা এক হাতে ডালটি ধরে ফেলে রশি ছেড়ে দিয়ে দুহাতে ডালটি আঁকড়ে উঠে গেল গাছে।
দুটি হেলিকপ্টারের শব্দও অনেক কাছে এসে গেছে।
আহমদ মুসা দ্রুত গাছের উপর দিকে উঠে যাচ্ছে। পাতায় জড়ানো অনেকগুলো ডালের এক গ্রন্থিতে আশ্রয় নিল আহমদ মুসা।
হেলিকপ্টার দুটি এসে গেছে। তাদের টার্গেট সবচেয়ে লম্বা ঐ গাছটি।
প্রবল এক পশলা গুলী বর্ষণ করল গাছটির উপর।
গাছের উপর আকাশে ইতস্তত ঘুরতে লাগল হেলিকপ্টার দুটি।
গাছটিতে কোন লোক নেই এবং সে যে নিচে নেমে গেছে তা তারা বুঝে ফেলেছে।
এ সময় একটা বোমা বিস্ফোরিত হলো গাছের নিচে।
ওরা বোমা ফেলেছে, বুঝল আহমদ মুসা। গ্যাস বোমা নয়, আগুনে বোমা। তবু আহমদ মুসা তার গ্যাস মুখোশটাকে ভালো করে টেনে-টুনে ঠিক করে নিল।
ধুঁয়া ধেয়ে আসছে নিচ থেকে উপর দিকে।
আহমদ মুসা খুশি হলো এই ভেবে যে, ধুঁয়া তাকে ঢেকে ফেলবে এবং হেলিকপ্টার থেকে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। কিন্তু এই সাথে ভাবল ধুঁয়ায় আচ্ছন্ন হলে হেলিকপ্টার দুটোকে টার্গেট করা তার জন্যে কঠিন হয়ে পড়বে। তার উপর হেলিকপ্টার দুটি যদি এই অবস্থায় অন্যদিকে সরে যায়, তাহলে তার গাছে উঠাই বেকার যাবে।
এই চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা দুহাতে তার দুটি ষ্টেনগানকে তৈরি করে নিয়েছে।
তখন ধোঁয়া উঠে আসেনি এবং তখনও হেলিকপ্টার দুটো গাছটির আকাশে চক্কর দিচ্ছে। গতি তাদের খুব স্লো।
ডালের গ্রন্থিতে পা রেখে আহমদ মুসা গাছের কান্ডে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ষ্টেনগান দুটির ব্যারেল অধীরভাবে অপেক্ষা করছে হেলিকপ্টার দুটি তার নাগালের মধ্যে আসার।
আহমদ মুসা জানে, তার প্রথম আক্রমণই শেষ আক্রমণ হবে। প্রথম আক্রমণ থেকে যদি ওরা বেঁচে যায়, তাহলে ওদের পাল্টা আক্রমণের মুখে আহমদ মুসা দ্বিতীয় আক্রমণের সুযোগ পাবে না।
এজন্যেই আহমদ মুসার ষ্টেনগান দুটি খুব সতর্ক।
এক সময় উত্তর ও দক্ষিণ গামী হেলিকপ্টার দুটি আহমদ মুসার মাথার উপরে প্রায় ২০ ডিগ্রী কোণে পাশাপাশি চলে এল। দক্ষিণমুখি হেলিকপ্টারটি পুবপাশে, আর উত্তরমুখিটি পশ্চিম পাশে। দুটি ফুয়েল ট্যাংকার ষ্টেনগানের নাগালের মধ্যে এসেছে।
গর্জে উঠল আহমদ মুসার দুহাতের দুটি ষ্টেনগান। অবিরাম গুলীর ঝাঁক ছুটে চলল হেলিকপ্টার দুটিকে লক্ষ্য করে।
আক্রান্ত হয়েই হেলিকপ্টার দুটি দ্রুত সরে যেতে লাগল এবং অবিরাম গুলীবৃষ্টি তারাও শুরু করল ভূমির দিকে।
আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। হেলিকপ্টার দুটি সরে গিয়ে গুলীবৃষ্টি শুরু না করলে আহমদ মুসা পূব পাশের হেলিকপ্টারের গুলীতে এতক্ষণ ঝাঁঝরা হয়ে গোশতের স্তুপে পরিণত হয়ে যেত।
হেলিকপ্টার দুটি দুদিকে চলে গেল, আর ফিরে এল না।
আহমদ মুসার এ গাছটা অপেক্ষাকৃত ছোট এবং সেও গাছের শীর্ষ থেকে অনেকখানি নিচে, তাই আকাশটা আর তার চোখে পড়ছে না।
আহমদ মুসা একটু অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিল।
একটু পরেই নিচ থেকে সার্গিও চিৎকার করে উঠল, ‘মি. আহমদ মুসা, একটি হেলিকপ্টারে আগুন ধরে গেছে, অন্যটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দ্রুত ফিরে যাচ্ছে।’
সার্গিও’র কথা শেষ না হতেই প্রচন্ড বিস্ফোরনের শব্দ শোনা গেল পুব দিক থেকে।
‘হেলিকপ্টারটি ধ্বংস হয়ে গেছে মি. আহমদ মুসা।’ নিচ থেকে আনন্দে চিৎকার করে উঠল সার্গিও’র কণ্ঠ।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলে আহমদ মুসা গাছ থেকে নামা শুরু করল।
গাছের নিচে দাঁড়িয়েছিল হাসান তারিক, সার্গিও এবং ভ্যানিসা।
আহমদ মুসা গাছ থেকে নামতেই সার্গিও হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘অভিনন্দন মি. আহমদ মুসা। আমাদের টেরসিয়েরা দ্বীপ অবিস্মরণীয় এক যুদ্ধ দেখল। সেই সাথে দেখল আহমদ ………।’
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘আর দেরি নয় মি. সার্গিও, এখনি এখান থেকে সরতে হবে। আমাদেরকে অহেতুক যুদ্ধ এড়াতে হবে।’
‘অহেতুক কেন? এ যুদ্ধে শত্রুরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দূর্বল হয়েছে।’
‘এটুকুই লাভ মি. সার্গিও। কিন্তু এই লাভ করতে গিয়ে শত্রুদের যে পরিমাণ উস্কে দিয়েছি তাতে উদ্দেশ্য হাসিলের পথে এগুবার বদলে আত্মরক্ষার লড়াই-এ ব্যস্ত থাকতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
সার্গিও ও ভ্যানিসা স্থির দৃষ্টি তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়। আহমদ মুসা থামার একটু পরে সার্গিও বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আপনি যেভাবে ভেবেছেন, ওটা আমাদের মাথাতেই আসেনি। আপনি ঠিকই বলেছেন।’
সার্গিও একটু থেমেই পরক্ষণে আবার বলল, ‘ওদের নতুন আক্রমণের আশংকা করছেন আপনি?’
‘এই পরিস্থিতিতে ওরা বড় ধরনের আক্রমণে না এসেই পারে না। আমি হলে তো সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ করতাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে চলুন আমরা এখন থেকে তাড়াতাড়ি সরে পড়ি।’ বলল সার্গিও।
‘অস্ত্রগুলো কাজে লাগবে, কিন্তু এতগুলো অস্ত্র নেয়া হবে কি করে মি. সার্গিও?’
‘অসুবিধা হবে না, আমরা সবাই ভাগ করে নেব। একটু এগুলেই আমরা দুটি ঘোড়া পেয়ে যাব।’ বলল সার্গিও।
‘আপনারা ঘোড়ায় এসেছিলেন? সামনে তাহলে ঘোড়া চলার মত ভালো রাস্তা আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘দক্ষিণের পাহাড়-উপত্যকার খাড়া চড়াই-উৎরাইটা খুব বেশি নয়। তারপরেই ঘোড়া চলতে পারে।’ বলল সার্গিও।
তৈরি হয়ে চলতে শুরু করল তারা।
যে গিরিপথ দিয়ে তারা পাহাড়ে উঠেছিল লুকাবার জন্যে, সে গিরিপথ দিয়েই তাদের চলা শুরু হলো।
‘আমাদের এ যাত্রা কোথায়? আপনাদের বাড়িতে? কোথায় আপনাদের বাড়ি?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা সার্গিওকে।
‘এই উচ্চ ভূমিটাই ছিল আমাদের আদি বাড়ি। ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেলে আরও দক্ষিণে সরে একটা বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। যখন নিরিবিলি সময় কাটাতে চাই, তখন এ বাড়িতেই আমরা আসি।’ বলল সার্গিও।
‘এই উচ্চভূমিটা কি করে বাড়ি হয়? না সমুদ্রের তীর, না নদীর ধার এটা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এটাই ছিল তখন সমুদ্র তীর। এই উচ্চভূমিটা একটা দূর্গ। দূর্গটা তৈরি হয়েছিল সমুদ্র তীরে। এর উত্তরের অঞ্চলটা ভূমিকম্পের ফলে জেগে উঠেছে।’
‘এই দুর্গটা আপনাদের পরিবারের বাড়ি হলে ধরে নিতে হবে যে আপনারাই এ দ্বীপের আদি শাসক পরিবার?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘এ দ্বীপের নয় এ দ্বীপপুঞ্জের। আমাদের গনজালো পরিবারই এ দ্বীপের আদি শাসক।’ বলল সার্গিও।
পূর্বমুখী গিরিপথ কিছুটা গিয়ে একেবারে এবাউট টার্ণ করে পশ্চিমমুখী হয়ে একটা সমতল উপত্যকায় প্রবেশ করল। চারদিকের পাহাড়ের দেয়াল ঘেরা উপত্যকাটা বেশ বড়। সারি সারি কবর সে উপত্যকায়। প্রতিটি কবরের শিয়রে ক্রুস শোভা পাচ্ছে।
‘এটা আমাদের আদি পারিবারিক কবরস্থান। ভূমিকম্প আমাদের দূর্গ ধ্বংস করেছে। কিন্তু এ কবরস্থানটা অক্ষত আছে।’ বলল সার্গিও।
উপত্যকার মাঝ বরাবর দিয়ে তারা পশ্চিমে এগিয়ে চলল। দুধারে কবরের সারি।
সামনে চলছিল হাসান তারিক। তারপর ভ্যানিসা। ভ্যানিসার পরে সার্গিও। সবশেষে আহমদ মুসা।
উপত্যকার পশ্চিম প্রান্তে তারা এসে গেছে।
হঠাৎ হাসান তারিক থমকে দাঁড়িয়েছে।
‘একি দেখছি আহমদ মুসা ভাই?’ বলল হাসান তারিক।
‘কি হল? কি দেখছেন?’ বলল সার্গিও ও ভ্যানিসা এক সাথে। তাদের কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা।
দ্রুত আহমদ মুসা সামনে চলতে চলতে বলল, ‘কি হয়েছে, কি দেখছ?’
হাসান তারিক মুখে কিছু না বলে আঙুল দিয়ে ইংগিত করল সামনের কবরের দিকে।
তাকাল আহমদ মুসা। কবরগুলো চোখে পড়ল তার। তাঁর ভ্রুও কুঞ্চিত হয়ে উঠল। উপত্যকার পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে বেশ কিছু দূর পর্যন্ত অনেকগুলো কবরের শিয়রে ক্রস রাখা নেই। এই কবরগুলোর সবগুলোর উপরের কাঠামো ভেঙে লন্ড-ভন্ড করা। কিন্তু তারপরও কবরের বুনিয়াদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। এই কবরগুলো দক্ষিণ উত্তরমুখী করে তৈরী। অথচ এর পরের সবগুলো কবরই পূব-পশ্চিম মুখী এবং এদের প্রত্যেকটির শিয়রে ক্রস স্থাপিত আছে।
আহমদ মুসাও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল।
পেছন থেকে সার্গিও সামনে এসে আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের মাঝখানে দাঁড়াল। সামনে তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে বলে উঠল, ‘ও এই কবরগুলো ভাঙা কেন! অবাক হয়েছেন আপনারা?’ বলে একটু থামল সার্গিও।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক কিছু বলল না।
সার্গিওই আবার কথা বলে উঠল। বলল, ‘সব কথা জানি না। তবে শুনেছি, প্রায় একশ বছর আগে আমাদের এক পূর্ব পুরুষ আমাদের আজোরস দ্বীপপুঞ্জের আজকের আধুনিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গোমেজ গনজালো এই কবরগুলো ভেঙে ফেলেন। সেই সময় ইউরোপের এক সংবাদপত্রে আমাদের পরিবারের দুর্নাম রটাবার জন্যে কি যেন লেখা হয়, তারপরেই তিনি এই কবরগুলো ভেঙে ফেলেন। শুধু তাই নয়, ভেংগে প্রথম কবরটার পাশে পারিবারিক একটা বাক্সও সমাধিস্থ করেন এবং কবরস্থানকে বিদেশীদের জন্যে নিষিদ্ধ করে দেন। একশ বছরের মধ্যে আপনারাই প্রথম বিদেশী এই কবরস্থানে প্রবেশ করেছেন।’
‘বাক্সটা কেন সমাধিস্থ হলো, কিছু জানেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমি জানি না। তবে অনুমান করি, কবরগুলো যে কারণে ভাঙা হয়েছে, সেই একই কারণে বাক্সটাকেও সমাধিস্থ করা হয়েছে।’ বলল সার্গিও।
‘কিন্তু ঐ কবরের কাছে কেন? যে কোন জায়গায় করলেই তো হতো!’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমারও সেই প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর জানি না।’ সার্গিও বলল।
সার্গিও থামতেই ভ্যানিসা বলে উঠল, ‘মনে হয় পরিত্যাজ্য গোপন কিছু সমাধিস্থ করা হয়েছে।’
‘ধন্যবাদ ভ্যানিসা। আমারও তাই মনে হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কবরগুলো ভাঙা হলো কেন, এই ব্যাপারে আপনার কি মনে হয় ভাইয়া?’
‘তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি জানি। কিন্তু বলবো না। তোমাদের একশ বছর আগের পূর্ব পুরুষ যেমন তা সহ্য করতে পারেনি, তেমনি হয়তো তোমরাও পারবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘পারবো ভাইয়া।’ বলল ভ্যানিসা।
‘ঠিক আছে বলব। আজ নয়। ঐ বাক্সটা যেদিন উদ্ধার করব, সেদিন বলব। এমনও হতে পারে আমাকে কিছুই বলতে হবে না। বাক্সটাই বলে দেবে সব।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময় ফুটে উঠল সার্গিও ও ভ্যানিসা দুজনেরই চোখে-মুখে। বলে উঠল সার্গিও, ‘বাক্সে কি আছে কেমন করে অনুমান করতে পারছেন? আর ঐ বাক্স আপনি পাবেনই বা কি করে?’
‘অনুমান কিভাবে তার উত্তর ভ্যানিসাই দিয়েছে। যে কারণে কবরগুলো ভাঙা সেই একই কারণে বাক্সটিকেও সমাধিস্থ করা হয়েছে। এদিক থেকে বাক্সে কি থাকতে পারে অনুমান করছি। আর বাক্স পাব কি করে? মাটি খুঁড়ে বের করতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বাক্সটাকে আপনি এত জরুরী মনে করেন?’ সার্গিও বলল।
‘হ্যাঁ মি. সার্গিও। আপনারা রাজী হলে এখনি খুঁড়ে ওটা বের করতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না মি. আহমদ মুসা। আজ নয়। আর একদিন আসব আমরা এদিকে। আর এ ব্যাপারে আম্মাকেও আমার রাজি করতে হবে। কারণ ওটা ছিল পারিবারিক এক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।’ সার্গিও বলল।
‘আমার আপত্তি নেই মি. সার্গিও।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আবার যাত্রা শুরু হোক।’ সার্গিও বলল।
যাত্রা আবার শুরু হলো আগের মতই।
হাঁটা শুরু করে ভ্যানিসা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘কবর ভাঙার রহস্য জানার ব্যাপারটা তো দেখছি অনির্দিষ্ট সময় চেপে রাখতে হবে, কিন্তু আমি তো এক মুহূর্তও তা পারছি না।’
‘বেশি প্রত্যাশার জিনিস হলে বেশি ভালো লাগবে ভ্যানিসা।’ বলল আহমদ মুসা একটু রসিকতার সুরে।
‘কিন্তু মি. আহমদ মুসা, প্রত্যাশা ও না পাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে চলছে ভ্যানিসা। তার উপর আরও লোড চাপানো আরও দুঃখজনক হবে।’ সার্গিও বলল।
‘কি সে তিক্ত অভিজ্ঞতা?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
সার্গিও মুখ খুলতে যাচ্ছিল।
ভ্যানিসা চিৎকার করে তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, আমি কিন্তু এখানে বসে পড়ব।’ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠেছে তার মুখ।
‘ঠিক আছে বলব না।’ বলল সার্গিও।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘বলার দরকার নেই। আমার বুঝা হয়ে গেছে। আমার জিজ্ঞাসা মি. সার্গিও, উনি কি এখন রাজবন্দী, না বিদেশে?’
বিস্ময় ফুটে উঠল ভ্যানিসা ও সার্গিও দুজনের চোখে মুখে। পরক্ষণেই বিস্ময়ের স্থান দখল করে নিল বেদনা। বলল সার্গিও ধীরে ধীরে, ‘রাজবন্দী নয়, তবে নজরবন্দী।’
‘ঘটনা কি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘ঘটনাটা বেদনার। ভ্যানিসা বিদ্রোহী গনজালো পরিবারের মেয়ে, আর সে আজোরসের পর্তুগীজ গভর্ণর পেড্রো পাওলেটা’র ছেলে। দুজনেই লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠি ছিল। পাশ করে এসেছে। এখন লুই জুগো রাজধানী পন্ট ডেলগাডারের বাইরে বেরুতে পারে না। আর ভ্যানিসার জন্যে রাজধানীতে ঢোকা কঠিন।’ বলল সার্গিও।
আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘এসব কোন ব্যাপারই নয়। আমি আগের কথাই একটু ঘুরিয়ে বলব, ভালো লাগার বস্তু পাওয়া একটু কঠিন হওয়া বাজার অর্থনীতির জন্যেও স্বাভাবিক।’
সার্গিও মুখ টিপে হাসল।
আরও রক্তিম হয়ে উঠল ভ্যানিসার মুখ।
কিছু বলল না কেউ।

Top