৩৭. গুলাগ থেকে টুইনটাওয়ার

চ্যাপ্টার

কাঁদছে মিসেস জোনস।
অঝোর ধারায় ঝরছে তার চোখ থেকে অশ্রু।
ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপার চেষ্টা করছে পলা জোনস।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের বিব্রত চেহারায় বেদনার একটা মলিন আস্তরণ নেমে এল।
‘স্যরি, এই মর্মান্তিক ঘটনা রোধ করার কোন উপায় আমাদের ছিল না।’ বলল সে নরম ও বেদনা জড়িত কণ্ঠে।
ধীরে ধীরে চোখ খুলে মিসেস জোনস বলল, ‘বাছা তোমাদের কোন দোষ নেই। তোমরা আত্মরক্ষার জন্যে যা করার তাই করেছ। তা না করলে হয়তো তোমাদেরই মরতে হতো। এরা যে কতবড় খুনি বর্বর, তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। আমার দু:খ……………..।‘
কথা শেষ করতে পারলো না মিসেস জোনস। কান্নায় ভেঙে পড়ল সে আবার।
সান্তনার কোন ভাষা খুঁজে পেল না আহমদ মুসা। বুক ভাঙা কান্না যাকে বলে সেই কান্না শুনে যাওয়া ছাড়া তাদের কোন উপায় ছিল না।
অস্বস্তিকর একটা অবস্থা।
চরম বিব্রতকর অবস্থা আহমদ মুসাদের।
অসহনীয় নিরবতাটা এবার ভাঙল পলা জোনস। মুখ থেকে রুমাল সরিয়ে নিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘আপনারা না বললে ভাইয়া খুন হয়েছে বা মরে গেছে সেটাও আমরা জানতে পারতাম না। ওরা আমাদের জানাত না। বেশি পীড়াপীড়ি করলে আমাদেরই ওরা খুন করতো।
আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে পলা জোনসের দিকে তাকাল। বলল, ‘স্যরি, আমি বুঝতে পারছি না, আপনি আজোরস-এর মানে পর্তুগালের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মী হয়েও ওদের ভয় করেন কেন? আপনি গোয়েন্দা বিভাগকে বলে তো এদের শায়েস্তা করতে পারেন।
ম্লান হাসর পলা জোনস। হাসিটা কান্নার চেয়েও করুণ। বলল, ‘বলে কোন লাভ হতো না। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এরা WFA এর ভাড়া করা লোক। আর আমাদের দেশের গোয়েন্দা প্রধান WFA এর চীফ আজর ওয়াইজম্যানের অন্ধ বন্ধু। আর আমি মাত্র কয়েকদিন আগে কাজে যোগদান করা একজন সামান্য গোয়েন্দা অফিসার।’
‘অন্ধ বন্ধু বলছেন কেন?’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘আমাদের গোয়েন্দা প্রধান সকল নীতি-নিয়ম ভংক করে আজোরস-এর পানি সীমায় WFA-এর মিনি সাব ও অন্যান্য জলযানের অবাধ বিচরণের অনুমতি পাইয়ে দিয়েছেন এবং দূরের বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ ওদের নামে লীজ করিয়ে দিয়েছেন।’ বলল পলা জোনস।
‘নাম কি দ্বীপটার?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘দ্বীপের একটা নাম আছে, আমি শুনেছি। কিন্তু ভুলে গেছি নামটা।’ বলল পলা জোনস।
‘ম্যাপে নাম পাওয়া যাবে না?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ফরমালি দ্বীপটার আলাদা নামকরণ হয়নি। মানচিত্রে পার্শ্ববর্তী দ্বীপের নামেই তাকে হয়তো ডাকা হয়। তবে লোক মুখে দ্বীপটার আলাদা একটা নাম আছে, তা আমি ভুলে গেছি।’ বলল পলা জোনস।
‘সাও তোরাহ কি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
হাসল পলা জোনস। বলল, ‘এ নামটা কি করে জানলেন? বেন্টো সসাদের কাছে শুনেছেন?’
‘এ নাম আমরা আগে থেকেই জানি। এ দ্বীপেই আমাদের লোকেরা বন্দী আছে বলে মনে হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এ নাম আমি বেন্টো-সসাদের কথা থেকে জানি। কিন্তু দ্বীপটা চিনি না। এ নামের কোন দ্বীপ আজোরস দ্বীপপুঞ্জে নেই। হতে পারে এটা কোন দ্বীপের নতুন নাম।’ পলা জোনস বলল।
কথা শেষ করে একটা দম নিয়েই আবার বলে উঠল পলা জোনস, ‘ও দ্বীপে শুধু আপনাদের লোকরাই নেই। অন্য লোকরাও আছে আমাদের এ দ্বীপের রুটেও তো অনেক বন্দী সেখানে যায়।’
‘আপনাদের গোয়েন্দা বিভাগ এ বিষয়টা জানে না? কিছু করে না কেন?’ চট করে প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘আজোরস দ্বীপপুঞ্জ অনেকটা মুক্ত দেশ। পর্তুগাল কিংবা ইউরোপীয় কোন দেশের ভিসা থাকলে সে আজোরাসে প্রবেশ করতে পারে। তাছাড়া ওরা বন্দীদের নিয়ে আসে কোনও বিশেষ ব্যবস্থায় জলপথে। এ বিস্তীর্ণ জলপথ পাহারা দেবার কোন ব্যবস্থা আজোরস-এর নেই। এরপরও গোয়েন্দা বিভাগ এবং কোন পর্যায়ে পুলিশরাও এ বিষয়টা জানে বলে আমার মনে হয়েছে। আমি একদিন কথায় কথায় আমার উর্ধতন অফিসারকে এ বিষয়ে বললে তিনি মন্তব্য করছিলেন, WFA এর লোকরা এ দ্বীপপুঞ্জের ভিআইপি। এদের নিয়ে মাথা ঘামিও না। একদিন হারতার পুলিশ ইনচার্জের গাড়িতে আমি বেন্টো-সসাদের দেখেছি।’ বলল পলা জোনস।
‘যে দ্বীপ ওদের লীজ দেয়া হয়েছে, সে দ্বীপে তাহলে আজোরস সরকারের কোনই উপস্থিতি নেই?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘সেটাই স্বাভাবিক।’ পলা জোনস বলল।
‘আপনি গোয়েন্দা বিভাগের লোক এ কথা কি বেন্টো-সসারা জানে?‘ প্রশ্ন আহমদ মুসা।
‘জানে না। জানলে আমার উপর ওদের আরও অধিকার বর্তাবে বলে আমি ভয় করি।’ বলল পলা জোনস।
‘আজোরস-এর একজন গোয়েন্দা এতটা অসহায়? তার সামান্য আত্মরক্ষার অধিকারও সে আদায় করতে পারবে না ডিপার্টমেন্ট থেকে?’ আহমদ মুসা হাসল। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
ম্লান হাসল পলা জোনস। বলল, ‘মেয়ে হওয়ার অনেক অসুবিধা আছে। আমার দূর্বলতা টের পেলে অফিসের যাদের কাছে আশ্রয় চাইব, তারাও এই সুযোগ ব্যবহার করতে পারে। তাছাড়া ভিআইপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে চাকুরীর অসুবিধা হওয়ার ভয়তো আমার আছেই।’
আহমদ মুসা একটু হাসল। তার পরেই গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘মুক্ত সোসাইটিতে’ মেয়েরা সমানাধিকার পাওয়ার পরেও মেয়েদের এই অসহায়ত্ব গেল না?’
‘আরও বেড়েছে। আগে মেয়েরা পারিবারিক প্রটেকশনে থাকত। কিন্তু এখন পথে-ঘাটে, অফিসে-রেস্তোরায় পুরুষদের মত নিজেদের প্রটেকশন তাদের নিজেদেরই করতে হয়। কিন্তু সমানাধিকার পেলেও প্রাকৃতিকভাবে অসম নারীরা সে প্রটেকশন দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। ফলে পথে-ঘাটে, অফিস-আদালতে অবাধ বিচরণের আজাদী তাদেরকে চারপাশের যথেচ্ছাচারের জিঞ্জীরে বেঁধে ফেলেছে। সমানাধিকারের ব্যাপারটা একটা গাঁজাখুরি, তা এখন আর বুঝার বাকি নেই। সমানাধিকার পেয়েও নারীরা লাঞ্জিত হবার অভিযোগ অবিরাম তুলছে, কিন্তু একজন পুরুষ কখনও এই অভিযোগ তোলে না। উভয়ের মধ্যেকার প্রাকৃতিক অসমতাই এর কারণ।’ বলল পলা জোনস।
সে থামতেই মিসেস জোনস বলল, ‘তোমরা কথা বল বাছা। আমি একটু ওপর থেকে আসি।’
বলে মিসেস জোনস কাপড় দিয়ে ভালো করে চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল।
‘ধন্যবাদ মিস পলা জোনস। আজকের ঘটনাকে আপনার অফিস কিভাবে দেখবে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি এতে ইনভলভ আছি, এ কথা আমি কিছুতেই প্রকাশ করব না। প্রমাণ হয়েছে বেন্টো, সসা, ‘এক বিশ্ব-এক দেশে-এক জাতি’ এনজিও এর এমানুয়েলরা সবাই WFA-এর লোক। এই ঘটনার জন্যে গোয়েন্দা বিভাগ উল্টো আমাকে দায়ী করতে পারে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, একথা প্রকাশ হলে আমি WFA-এর টার্গেটে পরিণত হবো। ভাইয়াকে ওরা মেরেছে, আমাকেও মারবে।’ বলল শুষ্ক কণ্ঠে পলা জোনস, তার চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন।
‘কিন্তু আমার বিশ্বাস, আপনাদের গোয়েন্দা বিভাগ এবং WFA সম্মিলিতভাবেই বের করতে চেষ্টা করবে কারা এ ঘটনার সাথে জড়িত। বেন্টো ও সসারা এ বাড়িতে থাকতো এ খবর তাদের জানা থাকতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে……….?‘ কথা শেষ না করেই থেমে গেল পলা জোনস। তার কণ্ঠে উদ্বেগ ঝরে পড়ল।
‘উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই মিস পলা জোনস। ওদের কাজ ওরা শুরু করুক। আমাদেরও কিছু করতেহবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘WFA আপনাদের লোকদের কেন বন্দী করে রেখেছে, তা কিন্তু বলেননি।’ বলল পলা জোনস।
‘আপনি কিছু কি আন্দাজ করেন?’ মুখে একটু হাসি টেনে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আপনাদের যারা বন্দী আছে, তারা কি মুসলমান?’ প্রশ্ন পলা জোনসের।
‘হ্যাঁ মুসলমান।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে বন্দীটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রসূত। কারণ, আমি জানি WFA-এর চীফই শুধু ইহুদী তা নয়, গোটা WFA টাই ইহুদী। গত রাতের ঘটনায় ‘এক বিশ্ব এক জাতি’ এনজিওর যে ইমানুয়েল মারা গেল সেও ইহুদী। সুতরাং ইহুদীরা কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই আপনাদের লোকদের আটক করেছে। এটা আরও বেশি পরিষ্কার হবে, যদি জানা যায় ওরা কি করতেন।’ বলল পলা জোনস।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনি…………….।’
আহমদ মুসাকে থামিয়ে দিয়ে কথা বলে উঠল পলা জোনস, ‘আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধনের কি প্রয়োজন আছে? গত রাতে আমাকে উদ্ধারের কঠিন মুহূর্তে আপনি আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করেছিলেন, আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমি আপনাদের ছোট বোনের মত হতে পারি না!’
থামল পলা জোনস।
‘ধন্যবাদ পলা। তুমি আমাদের ছোট বোনের মত নও, ছোট বোনই তুমি আমাদের।’ বলে আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘তাই কিনা হাসান তারিক?’
‘অবশ্যই ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক আনন্দে মুখ উজ্জ্বল করে।
বলেই হাসান তারিক পলা জোনসের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আজোরস-এর হারতায় এসে আমরা আরেকটা বোন পেয়েছি, এ কথা শুনলে তোমার ভাবীরা খুব খুশি হবে।’
‘আমার কি তাহলে এখন দুই ভাবী?’ হেসে বলল পলা জোনস।
‘অবশ্যই।’ হাসান তারিক বলল।
‘ও! গুড গড! যেখানে একটিও ছিল না, সেখানে দুই ভাবী পেলাম, ওরা থাকেন কোথায়?’ বলল পলা জোনস।
‘আমার স্ত্রী থাকেন ফিলিস্তিনে আর ভাইয়ার মোহতারামা থাকেন সৌদি আরবের মদিনা শরীফে।’ হাসান তারিক বলল।
‘আপনারা আরব? তাহলে তো WFA-এর সাথে লড়াই লাগার কথাই। যাঁরা আজর ওয়াইজম্যানের হাতে আটক আছেন, ওঁরা কোন দেশের?’ জিজ্ঞেস করল পলা জোনস।
‘ওরা ৭ জন ছয় দেশের। দুজন তুরষ্কের, ইরান মিসর লিবিয়া ইন্দোনেশিয়া ও স্পেনের একজন করে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বোধ হয় একই সাথে ধরেছে, কিন্তু এক সাথে পেল কি করে?’ পলা জোনস বলল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘ওরা ৭ জন ফ্রান্সের ষ্টার্সবার্গে একটা গোয়েন্দা ফার্ম খুলেছিল। সে গোয়েন্দা ফার্মটিকেও ধ্বংস করেছে, তাদেরকেও কিডন্যাপ করেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওরা কি ইহুদীদের বিরুদ্ধে কিংবা WFA-এর বিরুদ্ধে কোন কেস নিয়ে কাজ করছিল?‘ প্রশ্ন করল পলা জোনস।
‘তোমার এ কথা মনে হলো কি করে?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘গোয়েন্দা ফার্মটাও যখন ধ্বংস করেছে, তখন বলতে হবে ফার্মটি খুব বড় ব্যাপার নিয়ে সামনে এগুচ্ছিল।’ বলল পলা জোনস।
‘ধন্যবাদ পলা। ঠিক বলেছ তুমি। গোয়েন্দা ফার্মটি ধ্বংস করার পর সেই কাজ সম্পর্কে তথ্য নেয়ার জন্যেই ওদের কিডন্যাপ করেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া আপনারা কে?’ প্রশ্ন পলা জোনসের।
‘কেন এ প্রশ্ন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘কারণ বন্দী গোয়েন্দাদের যারা উদ্ধার করতে আসেন, তারা আরও বড় কেউ। আর এর প্রমাণও গত রাতে আমি পেয়েছি। দেখে মনে হয়েছিল, পৃথিবীর বেষ্ট কমান্ডোদের আমি দেখছি। আবার মানুষ হিসাবেও আপনারা অসাধারণ। সুতরাং আপনারা অসাধারণ কেউ হবেন নিশ্চয়।’ পলা জোনস বলল।
আহমদ মুসা হেসে কিছু বলতে যাচ্ছিল, এ সময় বাইরের গেটে নক হলো।
আহমদ মুসা থেমে গেল।
পলা জোনস একবার দরজার দিকে তাকিয়ে বলল। ‘আপনারা বসুন, আমি দেখি কে?’
বলে পলা জোনস তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজার লুকিং হোল দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেই দ্রুত ফিরে এসে বলল, ‘একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং আরও একজন লোক।’ পলা জোনসের চোখে-মুখে একটা ভীত ভাব।
‘আমরা ভেতরে যাচ্ছি। ওদের এনে বসাও। আমরা পরে প্রয়োজনে আসব। তোমার কোন ভয় নেই।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
বলেই আহমদ মুসা উঠে ছুটল তার ঘরের দিকে। হাসান তারিকও।
পলা জোনস ফিরে গিয়ে গেট খুলে দিল এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং স্যার। আপনি কষ্ট করে আমাদের বাসাায়! আমাকে খবর দিলেই তো হতো।’
গোয়েন্দা কর্মকর্তার নাম ভিক্টর রাইয়া। হারতার গোয়েন্দা প্রধান সে।
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলে উঠল পলা জোনস, ‘স্যার, আসুন স্যার, ভেতরে আসুন।’
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘ব্যাপারটা খুব জরুরী তো। তাড়াতাড়ি তোমার এখানে আসতেই হতো। তাই চলে এলাম।
ভেতরে ঢুকে একটু থমকে দাঁড়াল। পেছন ফিরে তার পেছনে আসা সাথের লোকটির দিকে ইংগিত করে গোয়েন্দা প্রধান ভিক্টর রাইয়া বলল, ‘ইনি ‘এক বিশ্ব’ এনজিও‘র ভাইস চেয়ারম্যান। নাম কেলভিন কেনেইরো। এই সকালে তিনি হারতা এসে পৌছেছেন। ওঁদের একটা কাজ আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে।’
বলে আবার হাঁটতে লাগল ভিক্টর সোফা লক্ষ্য করে।
পলা জোনস ও কেলভিন কেনেইরো সম্ভাষণ বিনিময়ের পর তারাও হাঁটতে লাগল সোফার দিকে।
পলা জোনসের মুখটা মলিন। ওদের দেখেই বুঝতে পেরেছে পলা জোনস যে, এরা গতকালের ঘটনা তদন্ত করার জন্যে এখানে এসেছে। সে যে জড়িত এই বিশাল হত্যাকান্ডের সাথে, এরা কি তা জানতে পেরেছে?’
আশংকা ও অস্বস্তিতে ভরে গেল তার মন।
ওদেরকে বসিয়ে তাদের সামনের এক সোফায় গিয়ে বসল পলা জোনস।
পলা জোনস বসতেই গোয়েন্দা কর্মকর্তা ভিক্টর রাইয়া বলে উঠল, ‘বেন্টো ও সসা নামের দুজন লোক এবারও তো তোমার এখানেই উঠেছে?’
ভেতরে ভেতরে আৎকে উঠল পলা জোনস। কিন্তু স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘জি স্যার।’
’রাতে তো ওরা বাড়ি আসেনি। খোঁজ নিয়ে কিছু জেনেছ?’ বলল ভিক্টর রাইয়া।
‘হ্যাঁ, ওরা বাড়ি আসেনি। কিন্তু আপনি জানলেন কি করে স্যার?’ পলা জোনস বলল।
‘বলছি। আমার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশের উত্তর দাও।’ বলল ভিক্টর।
এক টুকরো বিব্রত হওয়ার মত হাসি। বলল, খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন হয় না। ওরা এ রকম প্রায়ই করেন। এমন কি একবার বাড়ি থেকে কোন কাজে বেরুবার পর চলে গিয়েছিলেন। তিন মাস পর ফিরেছিলেন।’
‘ওরা খুন হয়েছে।’ ঠান্ডা গলায় বলল ভিক্টর।
‘খুন? কখন, কোথায়?’ চোখে মুখে উদ্বেগ ও বেদনার চিহ্ন মেখে বলল পলা জোনস।
‘শুধু তারা নয়, আরও কয়েকজন খুন হয়েছে তাদের সাথে।’ ভিক্টর বলল।
‘কোথায়?’ বলল পলা জোনস।
‘এক বিশ্ব এক দেশ‘ এনজিও‘র মি. এমানুয়েলের বাড়ি চেন?’ ভিক্টর বলল।
‘চিনি না, তবে লোকেশনটা জানি।’ বলল পলা জোনস।
‘ঐ বাড়িতেই তারাসহ এমানুয়েল ও অন্যান্যরা খুন হয়েছে।’ ভিক্টর বলল।
রাজ্যের উদ্বেগ আতংক টেনে আনল পলা জোনস তার চোখে-মুখে। তার মুখ হ্যাঁ হয়ে গেছে। কথা সরছেনা যেন মুখে।
‘মিস পলা জোনস গতকাল ওরা কখন বেরিয়েছিলেন?’ জিজ্ঞাসা কেলভিন কেনেইরার। তার চোখেও সন্ধানী দৃষ্টি।
‘গতকাল সন্ধ্যার পর ওঁরা বেরিয়ে যান।’ বলল পলা জোনস।
‘তাদের সাথে কি আর কেউ ছিল?’ কেলভিন কেনেইরা বলল।
বুকটা কেঁপে উঠল পলা জোনসের। ওরা কি জানতে পেরেছে যে, পলা ওদের সাথে ছিল! পলা স্মরণ করে খুশি হলো যে, সে যখন ওদের সাথে গাড়িতে উঠেছিল, তখন আশে-পাশে কেউ ছিল না। সন্ধ্যার আলো-ছায়ায় দূর থেকে সব দেখা ও বুঝাও কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। জিজ্ঞাসার উত্তরে পলা জোনস বলল, ‘স্যরি। ওদের যাওয়াটা আমি দেখিনি।’
‘পাড়ার বা শহরের কোন মেয়ে বা মেয়েদের সাথে ওদের উঠাবসা ছিল?’ বলল কেলভিন কেনেইরা।
‘ওদের সাথে কোন মেয়ে কখনও আমাদের বাড়িতে আসেনি, বাইরে কিছু ঘটে থাকলে আমি কিছু বলতে পারবো না।’ পলা জোনস বলল। তার কথা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু উদ্বেগটাতার চোখে-মুখে ঠিকরে পড়ছে।
কেলভিন কেনেইরা কথা বলল, ‘দেখুন গত রাতে এমানুয়েলের বাড়িতে যে গণহত্যার ঘটনা ঘটৈছে, সেখানে একজন মেয়ের উপস্থিতি ছিল। সেখানকার পুরো ঘটনাটা অন্তত সেই মেয়েকে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়েছে। তার সার্ট ও ব্লাউজের ছেড়া অংশ পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে চেন-ছেঁড়া একটি লেডিজ হাত ঘড়ি। হাত ঘড়ির ছেঁড়া চেনে রক্তের দাগ আছে। এর অর্থ একজন মেয়ে সেখানে নির্যাতিত হয়েছে। অবস্থা বলছে নির্যাতন করেছে এমানুয়েলরা। তারা সকলেই মরেছে। কিন্তু মেয়েটির লাশ কোথাও নেই। তার মানে মেয়েটাকে উদ্ধার কর হয়েছে। যারা উদ্ধার করেছে তারাই হত্যা করেছে এমানুয়েলদেরকে। মেয়েটাকে খুঁজে পেলে হত্যাকারীদেরকেও পাওয়া যাবে। আমাদের বিশ্বাস যাদের মাধ্যমে সেখানে মেয়ে নেয়া হতে পারে, তাদের মধ্যে বেন্টোদের কথাই প্রথম আসে। এজন্যেই প্রথমে এসেছি। বেন্টোদের কথা জানতে।’
ভেতরটা কাঁপছিল পলা জোনসের। কেলভিন কেনেইরার প্রত্যেকটা কথাই সত্য। ওরা কি আরও কিছু জানে? মনের দিক দিয়ে মুষড়ে পড়ল পলা জোনস। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবল, পরিস্থিতির মোকাবিলা তাকে করতে হবে। কেলভিন কেনেইরার দিকে মুখ তুলল পলা জোনস। বলল, ‘আর কি জানতে চান? ওরা মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকতেন। এর বাইরে কোন প্রকার সম্পর্ক তাদের সাথে আমাদের ছিল না।’
কেলভিনের হঠাৎ নজর পড়ল পলা জোনসের ডান হাতের কব্জির উপর। কব্জির একটু উপরে চামড়া ছিড়ে যাওয়া। তাছাড়া হাতের ছোট্ট ব্যান্ডেজের পাশেও আঁচড়ের চিহ্ন। ভ্রু কুঁচকে উঠল কেলভিনের। বলে উঠল, ‘আপনার হাতে কি হয়েছে মিস জোনস? এ্যাকসিডেন্ট করেছিলেন বলে মনে হচ্ছে। কবে?’
‘চমকে উঠেছিল পলা জোনস। নিজের ভেতরটাকে আড়াল করার জন্যে পলা জোনস তার মুখ নামিয়ে নিল এবং হাতটাকে নিজের কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, একটু ছিড়ে গেছে।’
‘আপনি ঘড়ি নিশ্চয় ডান হাতে পরেন?‘ বলল কেলভিন কেনেইরা। তার চোখে-মুখে প্রবল চাঞ্চল্য ঠিকরে পড়ছে।
চকিতে মুখ তুলে একবার চেয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, কেন বলছেন এ কথা?’ কণ্ঠের কম্পন পলা জোনস আড়াল করতে পারলো না।
‘মাফ করবেন মিস জোনস।’ বলে কেলভিন কেনেইরা ভিক্টর রাইয়ার সাথে একটুক্ষণ কানে কানে কথা বলল এবং পকেট থেকে একটা লেডিজ ঘড়ি বের করে ভিক্টর রাইয়া‘র হাতে দিল।
ভিক্টর রাইয়া ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়েই বলে উঠল, ‘মিস পলা, আমার যতটা মনে পড়ে তোমার ঘড়িটাও এই রকমই। নিয়ে এসতো তোমার ঘড়িটা।’
ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল পলা জোনসের মুখ। কেঁপে উঠল তার বুক। বুঝল সব ওরা জেনে ফেলেছে। তার মুখ থেকে কোন কথা বের হলো না।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো গোয়েন্দা কর্মকর্তা ভিক্টর রাইয়ার। একরাশ প্রশ্ন জেগে উঠেছে তার চোখে। সে বলে উঠল, ‘মিস পলা, তাহলে তোমাকেই ধরে নিয়ে গিয়েছিল ওরা?’
দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল মিস পলা।
কেলভিন কেনেইরা আবার ভিক্টর রাইয়ার কানে কানে কথা বলল। ভিক্টর কেনেইরা বলল, ‘মিস পলা আমরা দু:খিত, তোমার উপর জুলুম হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেছ। তোমাকে কে বা কারা উদ্ধঅর করল মিস পলা?’
‘আমি জানি না। আমাকে উদ্ধার করে এনে পার্কের সামনে নামিয়ে দিয়েছে।’ কান্না জড়িত কণ্ঠ পলা জোনসের।
‘তারা কয়জন ছিল?’ জিজ্ঞেস করল কেলভিন কেনেইরা।
‘তারা কয়েকজন ছিল। খেয়াল করে দেখিনি কয়জন।’ ভয় ও দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলল পলা জোনস।
কেলভিন তাকাল ভিক্টর রাইয়ার দিকে। কেলভিনের চোখে সন্দেহ। পরক্ষণেই সে মুখ ঘুরাল পলা জোন্সের দিকে। বলল, ‘উদ্ধারকারীদের তো আপনি দেখেছেন।’
‘হ্যাঁ।’ বলল পলা জোনস।
‘দেখলে তো নিশ্চয় চিনতে পারবেন।’ কেলভিন বলল।
‘আলো আঁধারীর মধ্যে দেখেছি তো!’ বলল পলা জোনস। আবার দ্বিধাজড়িত কণ্ঠ তার।
কেলভিন কেনেইরা তাকাল ভিক্টর রাইয়ার দিকে। তার চোখে বিরক্তির ভাব সুস্পষ্ট। বলল, ‘মি. রাইয়া চলুন একে আমাদের অফিসে নিয়ে যাই। ফাইলে আমাদের প্রচুর ফটো আছে। ক্রিমিনাল থেকে অস্ত্রবাজ কেউ বাদ নেই। ফাইল দেখে পলা জোনস আমাদের মূল্যবান সহযোগিতা করতে পারবেন।’
‘সেটাই ভাল। তাই চলুন।’ বলল ভিক্টর রাইয়া।
মুখ শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেল পলা জোনসের। ভয় ও উদ্বেগে আচ্ছন্ন হয়ে গেল তার চোখ-মুখ। মুখ থেকে কোন কথা সরল না তার।
ভিক্টর রাইয়াই কথা বলে উঠল আবার, ‘তৈরী হয়ে নিন মিস পলা।’
ভিক্টর রাইয়ার কথা শেষ হবার আগেই ড্রইং রুমে প্রবেশ করল মিসেস জোনস।
‘পলা, কোথাও যাচ্ছিস নাকি?’ বলে মিসেস জোনস ভিক্টর রাইয়া ও কেলভিন কেনেইরার দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকাল।
পলা জোনস কম্পিত গলায় ভিক্টর রাইয়াকে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি হারতার গোয়েন্দা বিভাগের ডিজি।’ আর কেলভিন কেনেইরাকে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি গত রাতে যিনি মারা গেছেন সেই এমানুয়েলের দলের একজন বড় কর্মকর্তা। এঁরা গতরাতের ঘটনার তদন্তে এসেছেন।’
‘ওয়েলকাম আপনাদেরকে। কিন্তু পলা কোথাও যাবে যেন বলছিলেন।’ বলল মিসেস জোনস ভিক্টর রাইয়াকে লক্ষ্য করে।
‘মি. কেলভিনের অফিসে। মিস পলাকে উদ্ধার করতে গিয়ে কারা হত্যাকান্ড ঘটায়, নানা কারণে এটা আমাদের জানা দরকার। তাদেরকে চিহ্নিত করার ব্যাপারে আমরা মিস পলার সাহায্য চাই। কিছু জানতে চাই তাঁর কাছ থেকে।’ ভিক্টর রাইয়া বলল।
শুনে উদ্বেগ ফুটে উঠল মিসেস জোনসের চোখে-মুখে। একটু ভেবে বলল, ‘পলার যাওয়ার দরকার কেন? এখানেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করুন। আমার মনে হয় সে তেমন কিছু বলতে পারবে না। সে তো মহাআতংকগ্রস্ত হয়ে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কোন দিকে নজর দেয়ার তার সুযোগ ছিল কোথায়?’
‘তবু একমাত্র উনিই সেই লোকদেরকে দেখেছেন। ওদের খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে একমাত্র উনিই সাহায্য করতে পারেন।’ বলল কেলভিন কেনেইরা দৃঢ় কণ্ঠে।
‘কিন্তু কালকের ঘটনার পর তাকে আমি এভাবে ছাড়তে পারি না। গতকালের বুকের কাঁপুনি আমার আজও শেষ হয়নি।’ মিসেস জোনস বলল।
‘কিন্তু ম্যাডাম জোনস, তাকে তো যেতেই হবে। গতকালকের ঘটনা ছোট কিছু নয়। বলতে গেলে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। যারা এটা ঘটিয়েছে তারা মিস পলাকে উদ্ধার করেছে বটে, কিন্তু উদ্ধার করতেই শুধু তারা গিয়েছিল বলে আমাদের মনে হয় না। মিস পলার উদ্ধার একটা আনুসঙ্গিক ঘটনা, আসল লক্ষ্য তাদের কি তা আমাদের জানা দরকার। সুতরাং মিস পলাকে আমাদের সাথে যেতেই হবে।’ বলল কেলভিন কেনেইরা। তার কণ্ঠ কঠোর শুনাল।
‘মিসেস জোনস, মি. কেলভিন যা……………..।’ বলতে শুরু করেছিল ভিক্টর রাইয়া।
এ সময় আকস্মিক বাজ পড়ার মত প্রচন্ড শব্দে ড্রইংরুমের বাইরের দরজা খুলে গেল।
দরজা দিয়ে ঝড়ের বেগে প্রবেশ করল দুইজন মুখোশধারী। দুজনেরই শরীর ঢাকা বিশেষ এক ইউনিফরমে। দুজনের হাতেই উদ্যত রিভলবার।
‘কে আপনারা?’ বলে চিৎকার করে উঠে দাঁড়াচ্ছিল মিসেস জোনস। মুখোশধারীদের একজন অস্বাভাবিক ভারী কণ্ঠে পর্তুগীজ ভাষায় চিৎকার করে উঠল, ‘যে যেভাবে আছেন, সেভাবে থাকুন। এক ইঞ্চি নড়লেই মাথার খুলি উড়ে…………।’
মুখোশধারীর কথা শেষ হওয়ার আগেই চোখের পলকে কেলভিন কেনেইরা পকেট থেকে রিভলবার বের করে মুখোশধারীদের লক্ষ্যে তুলছিল। কিন্তু তার আগেই মুখোশধারীর কথা থেমে গেল এবং সংগে সংগেই তার রিভলবার অগ্নিবৃষ্টি করল। গুলী গিয়ে কেলভিনের হাতের কব্জীতে লাগতেই রিভলবার পড়ে গেল তার হাত থেকে।
গুলী করেই মুখোশধারীটি পাশের সাথীর উদ্দেশ্যে বলল, ‘কেলভিনকে ঘুম পাড়িয়ে গাড়িতে তুলে নাও।’
সংগে সংগেই দ্বিতীয় মুখোশধারীটি দ্রুত এগোল কেলভিনের দিকে এবং পকেট থেকে ক্ষুদ্র স্প্রেয়ার বের করে কেলভিনের নাকে স্প্রে করল। মুহূর্তেই তার দেহ সোফায় ঢলে পড়ল।
দ্বিতীয় মুখোশধারীটি কেলভিনের সংজ্ঞাহীন দেহ পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে পেছন ফিরে দরজার দিকে হাঁটতে লাগল। তার আগেই প্রথম মুখোশধারী দ্বিতীয় মুখোশধারীর হাত থেকে স্প্রেয়ার নিয়ে নিয়েছে।
কেলভিনকে নিয়ে দ্বিতীয় মুখোশধারী বেরিয়ে গেলে প্রথম মুখোশধারী বাম হাতে স্প্রেটা রেখে ডান হাতে রিভলবার তাক করল ভিক্টর রাইয়া, মিসেস জোনস ও পলা জোনসের দিকে।
বিমূঢ় ভিক্টর রাইয়া অনেকটা মরিয়া হয়েই বলল, ‘আপনারা কে? এসব কিন্তু ভাল হচ্ছে না। আমরা সরকারী লোক।’
প্রথম মুখোশধারীর অস্বাভাবিক ভারী কণ্ঠটা সিংহের মত গর্জন করে উঠল, ‘হ্যাঁ, আপনি ও পলা জোনস সরকারী লোক। কিন্তু নির্লজ্জের মত বিদেশী ষড়যন্ত্রকারী কেলভিনদের ভাড়া খাটছেন। তাদের হাতে আজোরস দ্বীপপুঞ্জকে ইজারা দিয়ে বসে আছেন। আজোরসবাসী আপনাদেরও বিচার করবে।’ বলে মুখোশধারীটি তার হাতের স্প্রেটার বোতাম টিপে ভিক্টর রাইয়া, পলা জোনস ও মিসেস জোনসের উপর ঘুরিয়ে নিল।’
মুহূর্তের মধ্যে তারা সংজ্ঞাহীন হয়ে ঢলে পড়ল সোফার উপরে।
প্রথম মুখোশধারী গিয়ে গাড়িতে উঠতেই গাড়িটা ছেড়ে দিল।
দ্বিতীয় মুখোশধারী আগেই গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসেছিল। আর প্রথম মুখোশধারী পেছনের সিটে গিয়ে বসেছে। তার সামনে গাড়ির মেঝের উপর কেলভিনের সংজ্ঞাহীন দেহ।
গাড়িটা ছুটছে।
প্রথম মুখোশধারী দ্বিতীয় মুখোশধারীকে লক্ষ্য করে বলল, ‘হাসান তারিক, গাড়ির নাম্বার প্লেট বদলেছ তো?’
‘জি ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
ওদিকে প্রথম ঘুম ভাঙল ভিক্টর রাইয়ার। সে লাফ দিয়ে উঠে বসেই ছুটল বাইরে। দেখল তার গাড়ি নেই। দ্রুত পকেট থেকে বের করল তার মোবাইল। প্রথমেই টেলিফোন করল হেড কোয়ার্টারে। তার গাড়ির নাম্বার জানিয়ে দিয়ে বলল, ‘যেখানে পাও গাড়িটাকে আটকাও এবং গাড়ির সবাইকে গ্রেফতার করো। আহত কেলভিনকে তাড়াতাড়ি ক্লিনিকে নেবে।’ এরপর ভিক্টর রাইয়া দ্বিতীয় টেলিফোনটি করল আজর ওয়াইজম্যানকে। তাকে জানাল সব কথা।
টেলিফোনের ওপ্রান্ত থেকে উত্তেজিত আজর ওয়াইজম্যান বলল, ‘ওরা কি গনজালোদের লোক, না ভেতরের অন্যকোন জাতীয়তাবাদী গ্রুপ? কোন সন্দেহ নেই, এরাই গতরাতে এমানুয়েলের বাড়িতে গণহত্যা সংঘটিত করেছে। যাই হোক যে কোনভাবে ওদের পাকড়াও করা চাই। আমি দ্বিতীয় কলের অপেক্ষা করছি।’
ভিক্টর রাইয়া মোবাইল বন্ধ করে পলা জোনসদের ড্রইংরুমে প্রবেশ করল। তখনও পলা জোনস ও মিসেস জোনসের জ্ঞান ফেরেনি।
ভিক্টর রাইয়া ঠান্ডা পানি এনে ওদের চোখে-মুখে ছিটিয়ে ওদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনল।
মিসেস জোনস উঠে বসেই পলা জোনসকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এসব কি সর্বনেশে কান্ড ঘটছে।’ বলেই মিসেস জোনস ভিক্টর রাইয়ার দিকে ফিরে বলল, ‘দোহাই আমার মেয়ের কোন দোষ নেই। তাকে ওরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। প্রাণে বেঁচে এসেছে। তাকে আর কোথাও নেবেন না দয়া করে।’
‘না, মিসেস জোনস মিস পলাকে এখন কোথাও নিচ্ছি না। মি. কেলভিন ফিরে এলে দেখা যাবে কি করা যায়। আমার মনে হচ্ছে, মিস পলা ওদের নিশ্চয় চেনে না এবং তাদের সাথে কোনও সম্পর্কও নেই। এখন যারা হামলা করেছিল, তারাই সম্ভবত গতরাতে এমানুয়েলের বাড়িতে ঘটনা ঘটিয়েছিল। এরা আমাদের সবার জন্যেই বিপজ্জনক।’ বলল ভিক্টর রাইয়া।
বিস্ময় ফুটে উঠল মিসেস জোনসের চোখে-মুখে। কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ভিক্টর রাইয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি চলি। মিস পলা, ম্যাডাম জোনস আপনারা একটু সাবধানে থাকবেন।’
বলে বাইরে বেরুবার জন্যে দরজার দিকে এগুলো ভিক্টর রাইয়া।
সংজ্ঞা ফেরার পর একটি কথাও বলেনি পলা জোনস। আগেই সেই উদ্বেগ, আতংক চোখে-মুখে নেই, বরং চোখে-মুখে স্বস্তি ও আনন্দ।
মিসেস জোনস উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘যাই বাছাদের ডাকি, ঝামেলা তো গেছে। ওদের দেখতে পেলে ঝামেলা আরও বাড়ত। বুদ্ধিমানের কাজ করেছে না বেরিয়ে।’
মিসেস জোনস হাঁটা শুরু করেছিল আহমদ মুসাদের ঘরের দিকে। পলা জোনস হাসল। বলল, ‘আম্মা ওরা ঘরে নেই। আমরা সংজ্ঞাহীন থাকার সময় ওরা কোথাও গেছে।’
‘কিন্তু তুমি দেখলে কি করে? আর তারা আমাদের ওভাবে ফেলে যেতে পারে না।’ বলে মিসেস জোনস আবার হাঁটা শুরু করল।
‘ওরা নেই আম্মা।’ হেসে আবার বলল পলা জোনস।
কিন্তু মিসেস জোনস পলার কথা এবার গ্রাহ্য না করে গেল আহমদ মুসাদের ঘরে। পরক্ষণেই আবার ফিরে এল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল, ‘বাছারা এভাবে তো বাইরে যেতে পারে না। কিন্তু ঘটনা কি? কোথায় ওরা?’
‘ভেব না আম্মা। ওরা ফিরে আসবেন।’ বলল পলা এবার গম্ভীর কণ্ঠে।
‘তুমি তাহলে জান, বলছ না কেন?’ বলল মিসেস জোনস অধৈর্য্যরে সাথে।
‘দুজন মুখোশধারী ওরাই আম্মা। মহাবিপদ থেকে ওঁরা আবার আমাকে বাঁচিয়েছেন।’ বলল পলা জোনস। তার কণ্ঠ ভারী।
বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেছে মিসেস জোনসের চোখ। তার স্বগত কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ‘ওরা বাছারা ছিল?কিন্তু এভাবে একাজ ওরা করল কেন? তাদের বিপদ তো আরও বাড়ল?’
বলে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল মিসেস জোনস। তার চোখে রাজ্যের বিস্ময় আর দুর্ভাবনা।

ধীরে ধীরে চোখ খুলল কেলভিন কেনেইরা। তাকাল সে সোনালী দাড়ি চুলওয়ালা পর্যটকবেশী আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের দিকে। তারপর চারদিকে তাকাল সে। তার চোখের ভয় ও উৎকণ্ঠাটা আরও গভীর হলো। বলল, ‘তোমরা আমাকে কোথায় এনেছ। কে তোমরা? কি চাও?’
কেলভিন ঘাসের উপর শোয়া অবস্থায় ছিল। আহমদ মুসা কোন কথা না বলে তাকে তুলে বসাল। উঠতে গিয়ে গুলীবিদ্ধ ডান হাতে একটু চাপ লাগায় কঁকিয়ে উঠল সে। তাকাল কেলভিন তার গুলীবিদ্ধ ডান হাতের দিকে।
‘চিন্তা নেই মি. কেলভিন। গুলী ভেতরে নেই। ভালো করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি। আপনি বেঁচে থাকলে ঘা শুকাতে বেশি সময় নেবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
আবার চারদিকে তাকাল কেলভিন।
জায়গাটা তিন দিক থেকে পাহাড় ঘেরা। সামনে শুধু সাগরের দিকটাই উন্মুখ। জায়গাটা একটা বিশাল সমতল উপত্যকা। পাথুরে ভুমির উপর ঘাসের আস্তরণ। দেখলে মনে হবে বিশাল এক ঘোড় দৌড়ের মাঠ। সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক হলো, মাঠটার উত্তর প্রান্ত হঠাৎ খাড়াভাবে নিচে নেমে গেছে ২০ গজের মত। তারপর তা নেমে গেছে সাগরে। এর ফলে পাহাড়ের প্রাচীর ঘেরা মাঠটা যেন এক বিরাট মঞ্চে পরিণত হয়েছে। মঞ্চের পরের নিচের অঞ্চলটা গাছপালায় ঠাসা যেন এক সবুজ কার্পেট। মাঠে দাঁড়িয়ে এই সবুজের উপর দিয়ে দেখা যায় প্রশান্ত এক নীল সাগর। সত্যিই অপরূপ এখানকার দৃশ্য।
কেলভিনকে আবার চারদিকে তাকাতে দেখে আহমদ মুসা বলল, ‘কি দেখছেন মি. কেলভিন? চেনার চেষ্টা করছেন জায়গাটা, হারতা থেকে খুব বেশি দূরে নয় জায়গাটা। মাত্র………..।‘
আহমদ মুসাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল কেলভিন, ‘আমাকে আর জায়গা চিনিও না। এটা পিকনিক স্পট ‘সান্তাসিমা’। এটা আমাদেরই জায়গা। ‘এক বিশ্ব এক দেশ এক জাতি’ এনজিও এই ‘সান্তাসিমা’ লীজ নিয়েছে ৫০ বছরের জন্যে।’
থামল কেলভিন।
বিস্ময় ফুটে উঠল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। ‘এক বিশ্ব এক দেশ এক জাতি’ এনজিও মানে তো WFA (ওয়ার্ল্ড ফ্রিডোম আর্মি)। আজর ওয়াইজম্যানের ওয়ার্ল্ড ফ্রিডোম আর্মি এটা লীজহ নিয়েছে! কেন? এই প্রশ্নটাই আহমদ মুসা করল কেলভিনকে। বলল, ‘এই জায়গাটা আপনারা লীজ নিয়েছেন কেন?’
‘এর সাথে তোমাদের কোন সম্পর্ক নেই। এখন বল তোমরা কে? কেন আমাকে ধরে এনেছ? তোমরাই কি গতরাতে পলা জোনসকে উদ্ধার করতে গিয়ে খুন করেছ অতগুলো লোককে? কিন্তু মনে রেখ………।’
‘থাক থাক, আপনার প্রশ্নের জবাব দেবার জন্যে আপনাকে নিয়ে আসিনি। আমাদের প্রশ্নের জবাব দেবেন আপনি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তোমরা কে জানি না। তবে তোমরা আমাদের চেন না বলেই মনে হচ্ছে। তুমি যে স্বরে কথা বলছ, সেই স্বরে ইউরোপের কোন সরকারও আমাদের সাথে কথা বলতে পারে না। যাক। আমি একটা সিগারেট খেতে পারি?’ কেলভিন বলল।
‘না, এখন নয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর খাবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘জিজ্ঞাসাবাদ! কি জিজ্ঞাসাবাদ?’ কেলভিন বলল।
‘আজোরস দ্বীপপুঞ্জ দখলের আপনাদের ষড়যন্ত্রে সাহায্য করছে কে বা কারা?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমরা আজোরস দখল করেছি! না, একথা ঠিক নয়।’ বলল কেলভিন।
‘আপনারা ইতিমধ্যেই একটা দ্বীপ দখল করে নিয়েছেন। প্রত্যেক দ্বীপেই আপনারা ঘাঁটি গড়েছেন এবং আপনাদের লোক সংখ্যা বাড়াচ্ছেন। এই যে ৫০ বছরের জন্যে লীজ নিয়েছেন। এটাই ঔপনিবেশিকদের দেশ দখল করার প্রধান কৌশল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কোন দ্বীপ আমরা দখল করেছি? সাও তোরাহ? ওটা তো আমরা লীজ নিয়েছি। এ ধরনের লীজ দেয়া-নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন দেশ ও দ্বীপপুঞ্জে। কেউ একে দেশ দখল বলে না।’ বলল কেলভিন।
‘অন্যরা যাই করুক, আপনারা দেশ দখল করছেন? আপনারা সরকারের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গোপন কম্যুনিকেশন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। এমনকি তার মধ্যে ‘মিনি সাবমেরিন’ ব্যবস্থাও চালু করেছেন।’
বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল কেলভিনের। তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘কে তোমরা? বিদ্রোহী গনজালো গ্রুপের লোক? যদি তাই হয়ে থাক শোন, আজোরস দ্বীপপুঞ্জ স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ কারো সাথেই আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।’
থামলো কেলভিন।
‘কারণ আপনরা তৃতীয়পক্ষ। আপনারাই দ্বীপপুঞ্জকে গ্রাস করতে চান। আপনারা ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপে কাউকে যেতে দেন না। কারণ ওখানে সামরিক ঘাঁটি গড়েছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এ অভিযোগ সত্য নয়। এমন অভিযোগ সরকারের কাছেও সম্ভবত গেছে। পরশু সরকারী একটা সার্ভে বিমান দ্বীপটার উপর দিয়ে ফ্লাই করেছে। আমরা শুনেছি পাহাড়, ঘাস ও জংগলের উপত্যকা ছাড়া আর কিছুই দেখেনি। ঘাঁটি বলছ, ওখানে একটা বাড়িরও সন্ধান পাবে না। আসল কথা হলো, আমরা দ্বীপটাকে পৃথিবীর সকল বৃক্ষ-প্রজাতির অভয়ারণ্য বানাচ্ছি।’
‘একটা বাড়িও যদি না থাকে, তাহলে যারা অভয়ারণ্য বানাচ্ছে তারা থাকে কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
থতমত খেয়ে গেল কেলভিন কেনেইরা। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে দ্রুত বলল, ‘কেন প্ল্যান্টেশন কর্মীদের জন্যে অস্থায়ী তাঁবুই কি যথেষ্ট নয়?’
আহমদ মুসা হাসল। ভাবছিল সে। সংগে সংগে কোন কথা বলল না। কিন্তু কথা বলে উঠল হাসান তারিক। বলল, ‘কিন্তু এই যে বললেন সরকারী বিমান সেখানে পাহাড়, ঘাস ও জংগলের উপত্যকা ছাড়া কিছুই দেখেনি!’
‘বিমান থেকে জংগলের মধ্যে ছোট ছোট তাঁবু দেখবে কি করে?’ বলল কেলভিন।
‘আজোরসের বিরুদ্ধে তোমার বদমতলব না থাকলে মিনি সাব দিয়ে তোমরা কি কর?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘মিনি সাব’ এর কথা শুনে কেলভিন চমকে উঠে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। চোর ধরা পড়ার মত মুখের চেহারা হলো তার। বলল, ‘মিনি সাব? মিনি সাব আমরা কি করব?’
আহমদ মুসার মুখ কঠোর হয়ে উঠল। হাতের রিভলবারটা কেলভিনের দিকে তাক করে বলল, ‘সত্য কথা বলতে যদি আর একটুও দেরী হয়, তাহলে এখনি তোমার ডান কানটা উড়ে যাবে।’
ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল কেলভিনের চোখে-মুখে। মরিয়া হয়ে বলার চেষ্টা করল, ‘না আমি ………….।’
সংগে সংগেই আহমদ মুসার রিভলবারের নল সরে এসে স্থির হলো কেলভিনের ডান কান লক্ষ্যে। তার তর্জ্জনি চেপে বসতে যাচ্ছিল রিভলবারের ট্রিগারে।
ভয়ে বিস্ফোরিত হয়ে হয়ে উঠল কেলভিনের চোখ। কঁকিয়ে উঠল, ‘বলছি আমি।’
বলে একটু থেমেই শুরু করল, ‘নাম ‘মিনি সাব’ হলেও এটা সামরিক যান নয়। নিছক পরিবহন যান আমাদের মিনি সাব।’
‘মিথ্যা কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স, রাশিয়ার মত দেশও পরিবহন যান হিসাবে সাবমেরিন বা মিনি সাবকে ব্যবহার করে না। আপনাদের মত একটা এনজিও’র জন্যে এর কোনই প্রয়োজন হতে পারে না।’ বলল আহমদ মুসা।
দ্বিধায় পড়ল কেলভিন। মনে হয় জবাব খুঁজছিল। অবশেষে বলল, ‘এই পরিবহন সবচেয়ে নিরাপদ ও নিরিবিলি বলে আমরা ব্যবহার করছি।’
‘আজোরস দ্বীপপুঞ্জের নৌপথকে কোন দিক দিয়েই কি অনিরাপদ ও অনিরিবিলি মনে হয়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
আবার দ্বিধায় পড়ে গেল কেলভিন। উত্তর ঠিক করে নিয়ে বলল, ‘নিরাপদ না হবার ও নিরিবিলি না হবার অবস্থা নেই।’
‘তাহলে মিনি সাব পরিবহনের বিলাসিতা কেন? আসল কথা হলো, মিনি সাব সামরিক-যান। এই মিনি সাব ও সাও তোরাহ দ্বীপকে আজোরসের বিরুদ্ধে কোন সামরিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং নিশ্চয় এই ষড়যন্ত্রের পিছনে বাইরের কোন শক্তি কাজ করছে।’
বলে আহমদ মুসা একটু থেমেই আবার তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল, ‘বলুন আপনারা কার এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন?’
কথা শেষ হবার আগেই আহমদ মুসার রিভলবার কেলভিনের বুক বরাবরে এসে স্থির হলো।
ফ্যাকাশে হয়ে উঠল কেলভিনের মুখ। কম্পিত কণ্ঠে কেলভিন বলল, ‘না না আমরা আজোরসের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করছি না। এমন বিষয় আমাদের কল্পনাতেও নেই।’
‘তাহলে কি করছেন আপনারা আজোরস?‘ কণ্ঠের স্বর কঠোর হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার।
কেলভিন কোন উত্তর দিল না। তার চোখ-মুখ ভয় ও উদ্বেগে আরও চুপসে গেল।
আহমদ মুসা ভাবল, আসল কথা কেলভিন বলবে না, মরলেও না। সুতরাং এ পথে না গিয়ে বরং প্রয়োজনীয় তথ্য যা পাওয়া যায় এর কাছ থেকে উদ্ধার করা উচিত। বলল আহমদ মুসা, ‘তোমাদের মিনি সাব দ্বীপপুঞ্জের কোথায় কোথায় ল্যান্ড করে? নিজস্ব জেটিতে, না কোন প্রাইভেট জেটিতে?’
‘কোন জেটিতেই ল্যান্ড করে না। কোন দ্বীপে এলে মিনি সাব উপরে ভেসে ওঠে এবং এরপর বোটের মাধ্যমে তীরে যাতায়াত চলে।’ বলল কেলভিন।
‘মিনি সাব দ্বীপপুঞ্জের নৌপথের সব রুটেই চলে, না এর নিজস্ব রুট আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘নিজস্ব রুট আছে।’
‘এই রুটে কোন কোন দ্বীপ পড়ে?’
‘রাজধানী পঁতা দেলগা বন্দর ও হারতা পড়ে। একটা মিনি সাব পঁতা দেলগা থেকে হারতা আসে এবং আবার পঁতা দেলগাতে ফিরে যায়। আরেকটা মিনি সাব সাও তোরাহ ও হারতা পর্যন্ত যাতায়াত করে।’
‘সাও তোরার তো নিজস্ব জেটি আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘না সাও তোরার কোন জেটি নেই কোন বন্দরও নেই।’ কেলভিন বলল।
‘তাহলে সাও তোরার বোট, জাহাজ ইত্যাদি কোথায় থাকে? মিনি সাবই বা কোথায় ভেড়ে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। তার ভ্রু কুঞ্চিত।
আহমদ মুসার কঠোর মুখভাবের দিকে একবার তাকিয়ে কেলভিন আমতা আমতা করে বলল, ‘সাও তোরাহ’র সাথে শুধু মিনি সাবের মাধ্যমেই যোগাযোগ হয়। বোট বা লঞ্চে সাও তোরাহ গেলেও উপকূলে গিয়ে মিনি সাবেই উঠতে হয়।
‘কেন?’ আহমদ মুসার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়।
নতুন ভয় ও উদ্বেগসহ একটা অসহায়ভাব ফুটে উঠল কেলভিনের চোখে-মুখে। বলল, ‘একটা সিগারেট খেতে পারি।’
‘খান।’ আহমদ মুসা অনুমতি দিল।
কেলভিন কেনেইরা পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট নয় সিগারেট বের করল।
সে সিগারেট বের করার সময় হঠাৎ আহমদ মুসার চোখে পড়ল সিগারেটের গোড়ার দিকে সিগারেটের গায়ে ফিল্টার রং ঠিকই আছে, কিন্তু ফিল্টার নেই, ফাঁকা। তার উপর সিগারেটটা মনে হলো স্বাভাবিকের চেয়ে একটু লম্বা।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। আহমদ মুসার রিভলবার কেলভিনের দিকে তাক করাই ছিল। তর্জ্জনিটাও তার চলে এল আবার ট্রিগারে। ভাবনাও তার সম্পূর্ণ হয়েছে। বলল আহমদ মুসা, ‘আপনার সিগারেটটাতো খুবই সুন্দর। দেখি কি ব্রান্ডের ওটা।’
কিন্তু ততক্ষণে কেলভিন সিগারেরটা তার ঠোঁটে তুলে নিয়েছে দ্রুত।
‘হাসান তারিক শুয়ে পড়’ বলেই আহমদ মুসার তর্জনি রিভলবারের ট্রিগারে চেপে ধরে নিজেকে মাটির উপর ছুড়ে দিয়েছে।
পরপর দুটি গুলী ছুড়েছে আহমদ মুসা। একটি গুলী বিদ্ধ করেছে কেলভিনের বুক, অন্য গুলীটি বিদ্ধ করেছে তার বাম পাঁজরকে।
বসে থাকা কেলভিনের দেহটা পেছন দিকে ছিটকে পড়ে গেছে। সিগারেটটা তার মুখ থেকে খসে পড়েছে মাটিতে ঘাসের উপর।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই উঠে বসেছে।
‘কি ঘটেছে ভাইয়া ওকে যে গুলী করলেন? সিগারেটটাকে আপনি সন্দেহ করেছেন?’ বলল হাসান তারিক।
‘হ্যাঁ হাসান তারিক। আমার চোখ যদি ঠিক দেখে থাকে, তাহলে ওটা একটা ভয়ংকর বন্দুক।’
বলে আহমদ মুসা উঠে গিয়ে সিগারেটটা হাতে তুলে নিল। সিগারেট টিউবের দুপ্রান্তে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘সন্দেহটা ঠিক হাসান তারিক। রীতিমত এটা একটা মেশিনগান। এর ফিল্টার টপের উপর ঠোঁটের চাপ পড়লেই টিগ্রার সক্রিয় হয়ে উঠে এবং সুচের অগ্রভাগের মত সূক্ষè ও তীক্ষè এক ঝাঁক বুলেট বেরিয়ে গিয়ে চারদিক ছড়িয়ে পড়ে আঘাত করে। সামনে দশ বারজন লোক থাকলেও তাদের সকলকে কভার করার জন্যে একবার ট্রিগারে চাপ দেয়াই যথেষ্ট।’
‘নিশ্চয় কোন ভয়ংকর বিষ মেশানো আছে ঐ বুলেটগুলোতে। না হলে সুচাগ্র বুলেট কতটুকু আর ক্ষতি করবে?’ বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসা বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ হাসান তারিক। চলত পরীক্ষা করি।’
বলে আহমদ মুসা একটু পিছিয়ে গিয়ে এক ধরনের গাছের বড় পুরু পাতায় একটা ফায়ার করল। কয়েকটা সুচাগ্র বুলেট গিয়ে বিদ্ধ করল পাতাটিকে।
মিনিটখানেক অপেক্ষা করতে হলো। এর মধ্যেই বড় পাতাটি নেতিয়ে গিয়ে তার কান্ডের উপর ঝুলে পড়ল।
বিস্ময় আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনের চোখে-মুখেই। হাসান তারিক বলল, ‘আহমদ মুসা ভাই এটা ভয়ংকর ধরনের এক পয়জন যা জীবিত সবকিছুকেই মুহূর্তে ধ্বংস করতে পারে।’
‘আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেছেন হাসান তারিক।’ বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করে বলল, ‘চল হাসান তারিক, এলাকাটা একটু ঘুরে দেখা যাক।’
তারা এদিক ওদিক ঘুরে পাহাড় ঘেরা উপত্যকা করিডোরটির একদম উত্তর প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালো। এখান থেকে উপত্যকা প্রায় খাড়াভাবে বিশ গজ নেমে গেছে। তারপর ঘন গাছ-পালায় ঢাকা উপত্যকাটি আধা মাইলের মত এগিয়ে সাগরে মিশেছে।
হঠাৎ হাসান তারিক ভ্রু কুঞ্চিত করে সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘এখানে এক ধরনের তেলের গন্ধ পাচ্ছি আহমদ মুসা ভাই।’
শুনে আহমদ মুসাও সেটা অনুভবের চেষ্টা করল। মুহূর্ত কয়েক পরে আহমদ মুসাও বলে উঠল, ‘সত্যি বলেছ, এক ধরনের তেলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।’
‘গন্ধটা বেশ ভারী আহমদ মুসা ভাই। এর উৎস খুব দূরে হবে না।’ বলল হাসান তারিক।
‘সাগরের পানিতে তেল পড়তে পারে। সাগর তো খুব দুরে নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
ভাবছিল হাসান তারিক। বলল, ‘ভাইয়া সাগরের পানিতে তেল মেশার পর তার গন্ধ এতটা ভারী হবার কথা নয়।’
‘তাহলে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার মনে হয় ভিন্ন কোন উৎস থেকে তেলের এই গন্ধ আসছে।’ হাসান তারিক বলল।
‘সে ভিন্ন উৎসটা কি হতে পারে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমি বুঝতে পারছি না আহমদ মুসা ভাই।’ বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসারা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল। তারা এসে পড়েছে ঘাসে ঢাকা উন্মুক্ত উপত্যকাটার উত্তর-পূর্ব কোণের একদম প্রান্তে। সামনেই পাহাড়ের প্রাচীর।
হঠাৎ পাহাড়ের প্রাচীরের এক টুকরো নীল রংয়ের উপর চোখ আটকে গেল আহমদ মুসার।
এগিয়ে গেল আহমদ মুসা প্রাচীরের কাছে। দেখল, নীর রং দিয়ে একটা উর্ধমূখী তীর আঁকা। তীরের দন্ডটি জিগজ্যাগ। তীরের চারদিক ঘিরে বহুকৌণিক একটা সীমান্ত আঁকা সীমান্তের উপর চোখ বুলাতে গিয়ে চমকে উঠল আহমদ মুসা। বহুকৌণিক সীমান্তটিকে মনে হলো একটি হিব্রু অক্ষর যার উচ্চারণ ইংরেজী ‘প্রসিড’ এর সমার্থক।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই এক প্রশ্ন এসে এই ঔজ্জ্বল্যকে আচ্ছন্ন করে দিল।
আহমদ মুসা পাহাড়ের দেয়ালের অংকনটির দিকে ইংগিত করে বলল, ‘হাসান তারিক দেখ তো কিছু বুঝতে পারো।’
আহমদ মুসার সাথে হাসান তারিকও অংকনটিকে দেখছিল। বলল, ‘তীরটি উপরের দিকে অর্থাৎ সামনের দিকে একটা পথের ইংগিত করছে।’
‘আর চারদিকের কৌণিক বৃত্তটি?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমি বুঝতে পারছি না ভাইয়া।’
‘দেখ ওটা একটা হিব্রু অক্ষর।’
ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠল হাসান তারিকের। বলল, ‘ঠিক ভাইয়া।’
তারপরেই হাসান তারিক আবার উচ্ছসিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কেউ যেন সামনে ‘প্রসিড’ মানে অগ্রসর হবার জন্যে নির্দেশ দিচ্ছে।’
‘নির্দেশ দাতা কে?’ প্রসন্ন মুখে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘হিব্রু অক্ষরের উপস্থিতি প্রমাণ করছে সে নিদের্শদাতা ইহুদী কেউ।’ বলল হাসান তারিক।
‘ধন্যবাদ হাসান তারিক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু কোথায় অগ্রসর হতে নির্দেশ দিচ্ছে?’ জিজ্ঞাসা হাসান তারিকের।
‘সেটাই এখন প্রশ্ন।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার বলে উঠল, ‘কেলভিনের কাছ থেকে আমরা জানলাম এই উপত্যকাটা ইহুদীরা মানে WFA (ওয়ার্ল্ড ফ্রিডোম আর্মি) লীজ নিয়েছে। লিজ নিয়েছে নিশ্চয় কোন কাজে লাগাবার জন্যে। সেই কাজটা কি? আমার মনে হয় এই ‘তীরটি’র সাথে এই জিজ্ঞাসার সম্পর্ক আছে।’
‘তার মানে তীরের নির্দেশ অনুসারে সামনে অগ্রসর হলে জিজ্ঞাসাটির জবাব পাওয়া যাবে।’ বলল হাসান তারিক।
‘তাই মনে হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু অগ্রসর হবো কিভাবে?’ চারদিকে চোখ বুলাবার সাথে সাথে জিজ্ঞেস করল হাসান তারিক।
‘চারদিকে নয় হাসান তারিক। তীরের দিক-নির্দেশনার দিকে তাকাও। দেখ আমরা পাহাড়ের প্রাচীর বেয়ে যদি উপরে উঠি, তাহলে কিছুটা উপরে গিয়েই আমরা একটা ‘ষ্টেপ’ পাচ্ছি। ষ্টেপটা দুই পাহাড়ের টিলার মধ্য দিয়ে সামনে এগিয়ে গেছে সামনের আরেক পাহাড়ের দেয়ালের দিকে। ঐ দেয়ালে পৌছে কি করতে হবে, তার নির্দেশ বোধ হয় ওখানে গেলেই পাওয়া যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
হাসান তারিকের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘চলুন ভাইয়া তাহলে অগ্রসর হই। জিজ্ঞাসাটির জবাব না নিয়ে আমরা ফিরছি না।’
‘আমারও তাই মত। চল হাসান তারিক।’ বলে আহমদ মুসা পাহাড়ের দেয়ালে ওঠার জন্যে সামনে অগ্রসর হলো।
দুজনেই পাহাড়ের ধাপে উঠে এল।
ধাপ বা ষ্টেপের মুখটা সরু। কিন্তু তারা দেখল, মুখের কয়েক গজ পরেই ধাপটা প্রশস্ত হয়েছে এবং তা এগিয়ে গেছে সামনের পাহাড়টার দেয়াল পর্যন্ত। তারপর তা সংকীর্ণ এক গিরিপথ আকারে এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে উত্তর দিকে।
‘চল আমরা এগোই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কোথা?’ জিজ্ঞাসা হাসান তারিকের।
‘জানি না। তবে পথে এগুলে এই উপত্যকা কেন WFA লীজ নিয়েছে তার রহস্য জানা যাবে। এই পথে গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ের গায়ে তীর চিহ্ন তা প্রমাণ করে।’ বলল আহমদ মুসা।
গিরিপথ ধরে এগুলো তারা।
হঠাৎ এক সময় মাটি থেকে একটা জিনিস তুলে নিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘এই যে আহমদ মুসা ভাই একটা সিগারেটের গোড়া পাওয়া গেছে। তার মানে গিরিপথ দিয়ে লোকজন যাতায়াত করেছে।’
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়িয়ে ফিরল। হাত বাড়িয়ে বলল, ‘দাও দেখি সিগারেটের গোড়াটা।’
সিগারেটের গোড়াটা হাতে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে বলল, ‘গোড়াটা টাটকা নয় দেখছি। দুএকদিনের মধ্যে নয়, তবে এই পথে লোক যাতায়াত করেছে।’
আবার হাঁটা শুরু করল তারা।
পথে সিগারেটের টুকরো, ভাঙা চারাগাছ, চকলেটের মোড়ক, প্রভৃতি মানুষ চলাচলের আরও কিছু চিহ্ন তারা পেল। কিন্তু সবই বেশ পুরানো। এক জায়গায় পেল একখন্ড দলা পাকানো কাগজ।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি তুলে নিল কাগজের দলাটি। কাগজের দলাটি তাড়াতাড়ি খুলল।
কাগজটা আয়তাকৃতির একটা স্লিপ পেপার। কাগজের এক পৃষ্ঠা সাদা। অন্য পৃষ্ঠায় একটা মোবাইল টেলিফোন নাম্বার লেখা। তার সাথে কয়েকটি তারিখ। এলোপাথাড়ী লেখা তারিখগুলো সবই সামনের।
মোবাইল নাম্বারটি চিনতে পারল আহমদ মুসা। কেলভিনের কাছ থেকে একটাই মোবাইল টেলিফোন নাম্বার পাওয়া গেছে। আর সেটা এই নাম্বার।
হাসান তারিকও কাগজটি দেখল। সেও টেলিফোন নাম্বারটি চিনতে পারল। কিন্তু তারিখ সম্পর্কে বলল, ‘এগুলোর বোধ হয় কোন অর্থ নেই। কেউ এমনিই এলোপাথাড়ি লিখে থাকতে পারে।’
‘হতে পারে, কিন্তু দেখ তারিখগুলোর একটা তারিখ কেটে দিয়ে সেটা আবার লেখা হয়েছে। অর্থহীন আঁচড় হলে একটা তারিখ কেটে দিয়ে তা আবার সংশোধন করার দরকার ছিল না।’ বলে আহমদ মুসা কাগজের খন্ডটি পকেটে রেখে দিল।
গিরিপথ ধরে তারা একেবারে উপকূলে পৌছে গেল।
উপকূল দেখে তারা বিস্মিত হলো।
পাহাড় ঘেরা মাঠ থেকে যে উপত্যকা নেমে এসেছে তার শেষ প্রান্তটা, মানে উপকূল অংশটা পাহাড় ঘেরা ঘাসে ঢাকা মাঠটা যেমন খাড়া বিশ ফুট নেমে গিয়ে একটা সবুজ সমতল উপত্যকার সৃষ্টি করেছে, তেমনি নগ্ন পাথুরে উপকূলটি খাড়া সমুদ্রে নেমে গেছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো সাগর এখানে শান্ত।
বিস্মিত হাসান তারিক বলে উঠল, ‘ভাইয়া এটা একটা ন্যাচারাল পোর্ট। পাথুরে উপকূলটা একটা ন্যাচারাল জেটিও এবং সাগর এখানে অত্যন্ত গভীর। সাবমেরিনসহ যে কোন জাহাজ এই পাথুরে জেটিতে ল্যান্ড করতে পারে। এমন ন্যাচারাল পোর্ট পৃথিবীতে আর আছে কি না সন্দেহ।’
আহমদ মুসা অপার বিস্ময় নিয়ে তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘সাগর এখানে অত্যন্ত গভীর কি করে বুঝলে?’
মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হাসান তারিক জবাব দিল, উপকূল হওয়া সত্ত্বেও সাগর এখানে এতটা শান্ত হওয়াই তার প্রমাণ।’
‘ও আল্লাহ! পাহাড় ঘেরা দুর্গম এই উপত্যকা ন্যাচারাল পোর্ট বলেই WFA এটা লীজ নিয়েছে।’ বলেই আহমদ মুসা প্রবল উচ্ছাসে চিৎকার করে উঠল, ‘এটাই তাহলে ওদের দুই মিনি-সাব লাইনের সংযোগ বন্দর। ‘পঁতা দেলগা’ থেকে আসা মিনি-সাব এখানে নোঙর করে, আবার এখান থেকেই মিনি-সাব সাও তোরাহ যায়।’
হাসান তারিকও উচ্ছসিত হয়ে উঠল। বলল, ‘ঠিক বলেছেন ভাইয়া, এটাই ওদের সংযোগ বন্দর।’
একটু থেমেই হাসান তারিক আবার বলে উঠল, ‘ভাইয়া তেলের যে গন্ধ পেয়েছিলাম সেটা এখান থেকেই। দেখুন এখানকার মাটি থেকেই এই গন্ধ আসছে। এটা সাবমেরিন ওয়েলের গন্ধ।’
আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ তেলের গন্ধ এখান থেকেই উঠেছে। এ থেকে আরও নিশ্চিত প্রমাণ হচ্ছে যে, ওদের মিনি সাবমেরিন এখানে নোঙর করে।’
‘কিন্তু আশ্চর্য ভাইয়া, ওরা এখানে কোন স্থাপনা গড়ে তোলেনি।’ বলল হাসান তারিক।
‘চল একটু ঘুরে দেখা যাক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘চলুন।’ বলল হাসান তারিক।

Top