৩৮. ধ্বংস টাওয়ার

চ্যাপ্টার

‘ধন্যবাদ মি.জন ফ্রাংক, লিসাকে ঠিক শাস্তি দিয়েছেন। কিন্তু বালকটির কি খবর?’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
দানিয়েল ডেভিড আজর ওয়াইজম্যানের অন্যতম দক্ষিণ হস্ত। আজর ওয়াইজম্যান ওয়াশিংটন যাবার পর নিউইয়র্কে ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি’র দায়িত্ব সে পালন করছে।
আর জন ফ্রাংক মার্কিন হাজতে বন্দী জেনারেল শ্যারনের লোক। আন্ডার গ্রাউন্ডে থেকে সেই এখন গোটা পূর্ব আমেরিকার ইহুদী গোয়েন্দা কার্যকম পরিচালনা করছে।
আজর ওয়াইজম্যানের ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি এবং জেনারেল শ্যারনের ‘গোয়েন্দা আর্মী’ এক লক্ষ্যে এক হয়ে গেছে। লক্ষ্য হলো আমেরিকায় তথা দুনিয়ায় ইহুদীবাদীদের দ্বিতীয় এবং চুড়ান্ত বিপর্যয় ঠেকানো। তারা এক হয়েছে, নিউইয়র্কের লিবার্টি টাওয়ার ও ডেমোক্রেসি টাওয়ার ধ্বংসের প্রকৃত রহস্য যদি দুনিয়াবাসী জানতে পারে, তাহলে শ্যারন ও আজর ওয়াইজম্যানদের পা রাখার জায়গা থাকবে না দুনিয়ার কোথাও।
‘দুঃখিত, আমি নিশ্চিত ছিলাম বালক জুনিয়ার প্যাকার মরে গেছে। কিন্তু খবর পেলাম, সেই শয়তানের বাচ্চা আহত অবস্থায় তাকে কোন হাসপাতালে নিয়ে গেছে।’ বলল জন ফ্রাংক।
‘এই শয়তানের বাচ্চাটা কোত্থেকে উদয় হলো? ড. জ্যাকবকে সেই বাঁচিয়েছে। লিসাকে সন্ধান করে হাত করেছিল আমাদেরকে খুঁজে বের করার জন্য। আজ বালককেও সেই বাঁচাল। নিশ্চিত যে, সে বালকের মাধ্যমে আমাদের সন্ধান লাভের চেষ্টা করবে।’ দানিয়েল ডেভিড বলল।
‘সে আশার গুড়ে বালি। বালকটি আমাদের কিছুই জানে না। একটা হোম সার্ভিসে সে কাজ করত। সেখান থেকেই তাকে রিক্রুট করেছি। তার কাজের ফাঁকে আমাদের কাজ করে দিত।’ বলল জন ফ্রাংক।
‘তার বাড়ি কোথায়? তাকে পাওয়া প্রয়োজন।’ দানিয়েল ডেভিড বলল।
‘দরকার হয়নি তার ঠিকানার আর তাই সেটা আমরা জোগাড়ও করিনি।’ বলল জন ফ্রাংক।
‘আজ কিন্তু ভীষণ দরকার হয়ে পড়েছে। আপাতত সেই হাসপাতাল খোঁজার নির্দেশ দিন। তারপর কান টানলে মাথা এসে যাবে। আমাদের কিছু কাজের সে সাক্ষী। লিসার মতই তাকে মরতে হবে।’ দানিয়েল ডেভিড বলল।
‘আমাদের লোকেরা ইতিমধ্য সে কাজে লেগে গেছে।’ বলল জন ফ্রাংক।
একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘আমি মনে করি ঐ বালক এখন বিষয় নয়। আমাদেরকে ঐ লোকটিকে খুঁজে পাবে, এ ভয়ও আমাদের এখনকার বিষয় নয়। এখন তাকে আমাদের খোঁজা দরকার। কোত্থেকে কেন সে ড. হাইম হাইকেলের খোঁজে এসেছে। স্পুটনিকের লোকেরা মুক্ত হবার পর এই প্রশ্ন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার হলো এ বিষয়টির সাথে আহমদ মুসা জড়িত হয়ে পড়েছে।’
নড়ে-চড়ে সোজা হয়ে বসল দানিয়েল ডেভিড। বলল, ‘ঠিক বলেছেন মি. ফ্রাংক। টুইনটাওয়ার সংক্রান্ত দলিল স্পুটনিকের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর তারা ড. হাইম হাইকেলের সন্ধানে সবচেয়ে বেশি হন্য হয়ে উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক। নতুন দলিলের জন্য ড. হাইম হাইকেলকে তাদের চাই-ই। আপনি ঠিকই বলেছেন এই লোকটিকে অবশ্যই আমাদের খুঁজে পেতে হবে। শুধু ড. হাইম হাইকেলকে আড়ালে রাখলে চলবে না, তাদেরকে ড. হাইম হাইকেল পর্যন্ত পৌঁছার সব পথই বন্ধ করতে হবে, সেদিকে যাবার সব উদ্যোগকেই বানচাল করে দিতে হবে।’
‘কিন্তু তাকে পাওয়া যাবে কোথায়। নিশ্চয় কোন হোটেলেই উঠেছে সে।’ বলল, জন ফ্রাংক।
কথা শেষ করেই হঠাৎ পরম কিছু পেয়ে যাবার মত আনন্দে ‘ইউরেকা, ইউরেকা’ বলে চিৎকার করে উঠল, ‘লিসার মোবাইলে নিশ্চয় লোকটার টেলিফোন নাম্বার পাওয়া যাবে। লিসা অবশ্যই তার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করত।’
তার কথা শেষ হবার আগেই সে পকেট থেকে লিসার মোবাইলটা বের আনল। মোবাইল থেকে লিসার কল সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই তার চোখে-মুখে হতাশার অন্ধকার নেমে এল। মোবাইলের কল লগের ‘ডায়ালড’ ও রিসিভড’ সেকশনে কোন নাম্বারই এন্ট্রি নেই। তার মানে কল আসা বা কল করার পরপরই ইরেজ করে ফেলা হতো। আর মোবাইলের ফোন বুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ বারোজনের নাম্বার ছাড়া আর কোন নাম্বার নেই।
‘মেয়েটি সাংঘাতিক ধড়িবাজ ছিল।’ বিরক্তির সাথে বলল জন ফ্রাংক।
‘থাক মরা মানুষের পিন্ডিপাত করে কোন লাভ হবে না। এখন বলুন, আমরা এগুবো কোন পথে। লোকটিকে পেতেই হবে।’
মোবাইল বেজে উঠল দানিয়েল ডেভিডের।
মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রীনে কল নাম্বারের দিকে চোখ পড়তেই তার চোখে-মুখে একটা আড়ষ্ঠতা ও সমীহের ভাব ফুটে ঊঠল। ত্বরিত সে জন ফ্রাংকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এক্সলেন্সি আজর ওয়াইজম্যানের টেলিফোন।’
কথা শেষ করেই কল ওপেন করে বলে উঠল, ‘ইয়েস এক্সিলেন্সি।’
‘শোন, নিউইয়র্কের গোটা বিষয় ভেবে দেখলাম। যা ঘটেছে খুব বড় ঘটনা। মনে হচ্ছে ঘটনা আরও বড় কিছুর দিকে এগুচ্ছে। ডবল এইচ (হাইম হাইকেল) আমাদের জন্যে দোজখের এক দরজার মত হয়ে উঠেছে। তাকে কেউ খোঁজ করা মানে আমাদের ভাগ্যে আগুন লাগাবার চেষ্টা। সুতারাং এই চেষ্টাকে যে কোন মূল্যে বানচাল করতে হবে।’ ওপার থেকে বলল আজর ওয়াজম্যান।
‘এক্সিলেন্সি আমরাও এখন এ বিষয়টা নিয়েই আলোচনা করছিলাম। লোকটাকে খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে আমরা এখন সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি।’ দানিয়েল ডেভিড বলল।
‘ধন্যবাদ। কিন্তু লোকটাকে তোমরা কেউ দেখেছ? ওপ্রান্ত থেকে বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘আমি আজ এক ঝলক দেখেছি গাড়ি থেকে। আমেরিকান নয়।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘এই খবরটাই তো ভয়ের। বড় শয়তানটা মানে আহমদ মুসা সাও তোরাহ থেকে এত তাড়াতাড়ি নিউইয়র্কে চলে আসবে তা স্বাভাবিক নয়। কিন্তু এক বা একাধিক লোক এসেছে তাতো দেখাই যাচ্ছে এবং এ পর্যন্ত সে কার্যকরভাবেই সামনেই এগিয়েছে। এখনিই তাদের গতিরোধ করতেই হবে।
‘এক্সিলেন্সি সে আমাদের জালের বাইরে কিছুই করতে পারেনি। সে প্রতিপদেই বাধা পেয়েছে। ডবল এইচ সম্পর্কে কোন তথ্যই সে কারো কাছ থেকে পায়নি। যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে তার ফলেই কারও কাছ থেকে সে সহযোগিতা পাচ্ছে না।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘আরেকটা কথা আমি ভাবছি, এই লোকটা ডবল এইচ সম্পর্কে তার প্রয়োজনীয় খবরাদি না পেলে তার বাড়ি পর্যন্ত ছুটতে পারে। লোকটা ডবল এইচের বাড়ি যাওয়া আমাদের জন্য বিপজ্জনক হবে। আমরা পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে তার নিরুদ্দেশ হওয়া, পুলিশ তার সন্ধানের চেষ্টা করছে, ইত্যাদি বলে তাদের থামিয়ে রেখেছি। তারাও এখানে-সেখানে কিছু দৌড়া-দৌড়ি করে এখন চুপ হয়ে গেছে। ডবল এইচ-এর ছেলে লেখাপড়ার জন্য বাইরে থাকায় কিছুটা সুবিধা হয়েছে। এই অবস্থায় লোকটা যদি ডবল এইচের বাড়ি যায়, তাহলে ব্যাপারটা ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে। এজন্য লোকটা কিংবা বাইরের কেউই যাতে ডবল এইচের বাড়ি যেতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’
থামল আজর ওয়াইজম্যান।
সে থামতেই দানিয়েল ডেভিড বলে উঠল, ‘এক্সিলেন্সি। আপনি জানেন, আমরা ফিলাডেলাফিয়ার আমাদের স্টেশনে এ ব্যাপারে আগেই বলেছি। ডবল এইচের বাড়িতে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থা হিসাবে ডবল এইচের ফ্যামিলির সাথে ঘনিষ্ট একটি মেয়ে, যে আমাদের লোক, বাড়ির ভেতরের সবকিছু উপর চোখ রাখছে। সুতরাং আমাদের চোখ এড়িয়ে বাইরের কেউ সেখানে গিয়ে কিছু করতে পারবে না।’
‘ধন্যবাদ। এ সম্পর্কে দ্বিতীয় বিষয় হলো, আমরা বাইরের লোককে আটকাতে সফল নাও হতে পারি। সেক্ষেত্রে পরিবারটি যাতে আমাদের মুঠোর বাইরে না যায় সেজন্য ডবল এইচের সাথে তার পরিবারের কৌশলগত একটা সাক্ষাতকারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যপারে কি করতে হবে, পরিবারকে কি বলতে হবে, এ ব্যপারে ডিটেল নোট আমি ‘ই-মেইল-এ’ পাঠাচ্ছি।’
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আমরা আপনার ‘ই-মেইল’-এর অপেক্ষা করছি।’
কথা শেষে মোবাইল অফ করে দিয়ে দানিয়েল ডেভিড তাকাল জন ফ্রাংকের দিকে। বলল, ‘মি. ফ্রাংক মনে হচ্ছে আমাদের কাউকে ফিলাডেলফিয়ায় যেতে হতে পারে। আমরা শিঘ্রই এক্সিলেন্সির কাছ থেকেই ই-মেইল পাব, তারপর এ ব্যপারে বিস্তারিত জানতে পারব। আর এ দিকে লোকটাকে পাকড়ও করার কাজকে নাম্বার ওয়ান গুরুত্ব দিতে হবে।’
কথা বলতে যাচ্ছিল দানিয়েল ডেভিড।
বেজে উঠল কলিং বেল।
থেমে গেল দানিয়েল ডেভিড।
জন ফ্রাংক এগুলো রিসিভিং বক্সের দিকে। বাইরের কলিং বেল ‘টিভি ক্যামেরা সজ্জিত ইন্টারকম সিস্টেম। এর মাধ্যমে ভেতর থেকে কলারের ছবিও দেখা যায়, জবাবও দেয়া যায়।
রিসিভারের সুইচ অন করতেই স্ক্রীনে একটা ছবি ভেসে উঠল। অপরিচিত। আমেরিকানও নয়। ভ্রুকুঁচকালো সে। হঠাৎ তার মনে হলো, ক’ঘন্টা আগে বালক জুনিয়ার প্যাকারের সাথে এই লোকটিকেই সে দেখেছিল কি! এক ঝলক দেখা চেহারা তার মনে নেই। কিন্তু এই নীল ব্লেজার ও কালো প্যান্টই সে দেখেছিল। এটা একটা ‘রিয়ার কম্বিনেশন’ বলে তার মনে আছে এই রংয়ের কথা। পরিচয়ের ব্যাপারে কিছুটা নিশ্চিত হতেই বিস্ময় ও আনন্দ দুই-ই তাকে ঘিরে ধরল। আনন্দ এই কারণে যে, আকাঙ্ক্ষিত লোকটা একদম নাকের ডগার সামনে। আর বিস্ময়ের কারণ হলো, লোকটা এখানে কেন? তাদের উপস্থিতির কথা জেনে কি এসেছে! কিন্তু কি করে হয়, এটা তো একটা বিখ্যাত ডাক্তারের বাড়ি। মাত্র আজই যে এই ডাক্তারকে এখান থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে তারা এ বাড়িতে এসেছে, একথা অন্য কারো জানার কথা নয়। তাহলে কি সে ডাক্তারের কাছে এসেছে? এটা স্বাভাবিক।
এসব ভাবতে ভাবতেই জন ফ্রাংক সরে এল দানিয়েল ডেভিডের কাছে।
দানিয়েল ডেভিড বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ছিল জন ফ্রাংকের দিকে। জন ফ্রাংকের ভাবনা ও বিস্ময় জড়িত চেহারা দানিয়েলের নজর এড়ায়নি।
জন ফ্রাংক ফিরে এসে সব কথা খুলে বলল দানিয়েলকে। দানিয়েলের মুখও বিস্ময় ও আনন্দে ছেয়ে গেল। সে আনন্দ-উৎসাহে বলে উঠল, ঈশ্বর আমাদের সহায় হয়েছেন। শিকারকে দোর গোড়ায় এনে দিয়েছেন।
বলেই সে ছুটল কল-রিসিভারের দিকে। এক ঝলক দেখেই সে এসে জড়িয়ে ধরল জন ফ্রাংককে। বলল, আমার চোখ যদি ভুল না দেখে তাহলে বলছি, ইনিই আহমদ মুসা।’
কথা শেষ করে একটা দম নিয়ে জন ফ্রাংকের কথা বলার চেষ্টাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘একে এখানে আটকাতে হবে।’
বলে সে ত্বরিত গুছিয়ে নেয়া একটা প্লান সম্পর্কে জন ফ্রাংকে কানে কানে বলল।
প্ল্যান শুনে জন ফ্রাংকের মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল,‘ধন্যবাদ আপনাকে। একেবারে ধন্বন্তরী প্লান। কিন্তু যা শুনেছি, তাতে আহমদ মুসার মত লোককে কি এভাবে আটকানো যাবে?’
কথা শেষ করেই জনফ্রাংক ছুটল কল রিসিভারের দিকে। এ সময় কলিং বেল আবার বেজে উঠল।
রিসিভার অন করাই ছিল। জনফ্রাংক বলে উঠল, ‘স্যরি আমি টয়লেটে ছিলাম। ডাক্তার সাহেবও ওদিকের বারান্দায়। বলুন আপনি কে, কি চাই?’
জন ফ্রাংকের সন্দেহ ঠিক। ও প্রান্তের লোকটিকেই জন ফ্রাংক বালক জুনিয়র প্যাকারের সাথে দেখেছিল। কিছুটা ছদ্মবেশ থাকলেও আহমদ মুসা হিসাবে তাকে চেনা অসম্ভব ছিল না।
আহমদ মুসার ঠোঁটে রহস্যময় এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেছিল। বলল সে জন ফ্রাংকের প্রশ্নের উত্তরে, ‘আমি ডা. নিউম্যানের সাথে দেখা করতে এসেছি।’
জন ফ্রাংকের ঠোঁটেও ফুটে উঠল রহস্যময় হাসি। বলল, ‘ওয়েলকাম। আমি ডা. নিউম্যানের একজন এ্যাসিটেন্ট। আমি গেটলক খুলে দিচ্ছি ঢুকেই ডান পাশের কক্ষটায় বসুন। স্যারকে বলে আসছি।
খট করে অফ হয়ে গেল কল বক্সের কানেকশান। আর সাথে সাথেই ক্লিক করে খুলে গেল দরজার লক।
দরজা খুলতেই একটা প্রশস্ত করিডোর। শুরুতেই বাম পাশে একটা দরজা এবং ডান পাশে একটা দরজা।
আহমদ মুসা ডান দিকের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। ঘরটির ভেতরে নজর পড়তেই বুঝল, ডাক্তারের রোগী দেখার ঘর।
আহমদ মুসা ঘরে ঢুকে চারদিকটা দেখতে লাগল। আহমদ মুসা পশ্চিম দরজা দিয়ে ঢুকেছে। ঘরে আর একটি দরজা আছে উত্তর দিকে।
ডাক্তারের টেবিলটা উত্তর দরজা দিয়ে ঢুকেই পুব পাশে। ডাক্তারের বড় টেবিলটার সামনে তিনটা চেয়ার। ডাক্তার বসেন দক্ষিণমুখী, আর তার দর্শনার্থী বা রোগীরা তার সামনে উত্তরমুখী হয়ে বসেন।
আহমদ মুসা ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখছিল।
উত্তর দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল একজন লোক।
ব্যায়াম-পুষ্ট সুঠাম দেহের লোক। সে ঘরে ঢুকে কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে হাসিমুখে আহমদ মুসার দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়াল।
লোকটির মুখে হাসি ফুটে উঠল বটে, কিন্তু হাসির নিচে হিংসার কালো রেখাটা দেখা যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা হ্যান্ডশেক করল।
‘স্যার আমি জন ফ্রাংক। ডাক্তারের এ্যাটেনডেন্ট।’ তারপর চেয়ার দেখিয়ে আহমদ মুসাকে বসতে বলল।
আহমদ মুসা বসতে যাচ্ছিল ডাক্তারের টেবিলের সামনের চেয়ারে।
আহমদ মুসা যখন চেয়ারে বসছিল, তখন জন ফ্রাংক ঘরের পশ্চিম প্রান্তের দিকে এগিয়ে পশ্চিমের দরজাটা, যে দরজা দিয়ে আহমদ মুসা প্রবেশ করেছিল, সেটা খুলে পাল্লার হুক লাগিয়ে দিল। দরজাটা উন্মুক্ত হয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে দেখল।
আহমদ মুসাকে ফিরে তাকাতে দেখে জন ফ্রাংক বলল, ‘ঘরটা অনেক্ষণ বন্ধ আছে, একটু ফ্রেস বাতাস আসুক স্যার।’
আহমদ মুসার চোখে নতুন সিদ্ধান্তের আলো জ্বল জ্বল করছিল। সেটা আরও উজ্জ্বলতর হয়ে উঠল।
জন ফ্রাংক আহমদ মুসার বাম পাশের টেবিলের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।
তার ডান হাতটা তার কোটের পকেটে।
জন ফ্রাংক দাঁড়িয়েই বলে উঠল, ‘এখনি ডাক্তার স্যার এসে পড়বেন।’
আহমদ মুসা জন ফ্রাংককে ধন্যবাদ দিয়ে সামনের দিকে মনোযেগী হলো। টেবিল-জোড়া কাঁচটা বিশেষভাবে তৈরি সাদা কার্পেটের উপর রাখা।
হঠাৎ টেবিলের কাঁচের মধ্যে সরু পাতলা সাপের মত একটা ছায়াকে লাফিয়ে উঠতে দেখল আহমদ মুসা।
দৃশ্যটি আহমদ মুসার চোখে পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসার মাথাটা নিচু হয়ে ডান দিকে তীব্র গতিতে ছুটে গেল। ডান পাশের চেয়ার এবং নিজের বসা থাকা চেয়ার নিয়ে সে পড়ে গেল মেঝেতে।
তার সাথে নাইলনের একটা ফাঁস টেবিলের উপর পড়ে গড়িয়ে গেল নিচে। নাইলনের ফাঁসের গোড়ার প্রান্তটি ধরে দাঁড়িয়েছে দানিয়েল ডেভিড পশ্চিম প্রান্তের খোলা দরজায়।
আহমদ মুসা পড়ে যাবার সাথে সাথেই উল্টে নিয়েছে শরীরটা। তার ফলে দেহের পায়ের দিকটা পড়ল দক্ষিণ দিকে এবং মাথা উত্তর দিকে। এবার ফাঁস হাতে নিয়ে পশ্চিম দরজায় দাঁড়ানো দানিয়েল ডেভিডকে দেখতে পেল আহমদ মুসা। দেখল দ্রুত সে পকেটের দিকে হাত নিচ্ছে।
আহমদ মুসা দেহটাকে ঘুরিয়ে নিয়েই পকেট থেকে রিভলবার বের করে এনেছিল। আহমদ মুসা কোন সুযোগ দিতে চাইল না ফাঁস ওয়ালাকে। শুয়ে থেকেই তার রিভলবার ঘুরিয়ে নিয়ে দ্রুত গুলী ছুড়ল এবং সেই সাথেই রিভলবার ঘুরিয়ে নিল জন ফ্রাংকের দিকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল জন ফ্রাংক। কিন্তু দানিয়েল ডেভিডকে গুলী করা দেখে সে সম্বিত ফিরে পেল এবং দ্রুত পকেট থেকে রিভলবার বের করল। কিন্তু ততক্ষণে রিভলবার ঘুরিয়ে নেয়া হয়ে গেছে আহমদ মুসার।
রিভলবার ঘুরিয়ে নিয়েই গুলী করেছে আহমদ মুসা। গুলী গিয়ে বিদ্ধ হলো জন ফ্রাংকের রিভলবার ধরে রাখা হাতের মুঠোয়।
রিভলবার ছিটকে পড়ে গেল জন ফ্রাংকের হাত থেকে। জন ফ্রাংক আর্তনাদ করে উঠে বাম হাত দিয়ে ডান হাতের মুঠোটা চেপে ধরল।
আর ওদিকে বুকে গুলী বিদ্ধ দানিয়েল ডেভিডের দেহটা আছড়ে পড়েছিল দক্ষিণের দেয়ালের উপর। তার দেহের পেছন দিকটা মেঝেয় আর মাথার দিকটা দরজার পাশে দুদেয়ালের কোণে ঠেস দেয়ার মত আটকে গেছে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল এবং কুড়িয়ে নিল জন ফ্রাংকের রিভলবারটা। তারপর গিয়েই দাড়াল জন ফ্রাংকের মখের দিকে। বলল, ‘ফাঁসে আটকে ফেলে বন্দী করতে চেয়েছিলে না? আজোরসের হারতা দ্বীপেও তোমাদেরকে ফাঁস ব্যবহার করতে দেখেছি। সাগর- মহাসাগর জুড়ে লুট-তরাজ ও দস্যুতার রেকর্ড সৃষ্টিকারী পূর্ব পুরুষদের সনাতন যুদ্ধ-মানসিকতায় ফিরে যাচ্ছ নাকি তোমরা?’
বলে আহমদ মুসা রিভলবারের নল দিয়ে জন ফ্রাংকের নিচু করে রাখা মুখটাকে উঁচু করে তুলল। বলল, অপরাধীরা অপরাধ করলে তার একটা চিহ্ন রেখেই যায়। তোমরা কলিং ইন্টারকমের রিসিভার অন করে রেখেই শলা-পরামর্শ করেছিলে। শুনতে একটু কষ্ট হয়েছে, কিন্তু শুনতে পেয়েছি সব।’
আহমদ মুসা একটু থামল।
কঠোর হয়ে উঠল তার চেহারা। বলল, ‘ডা. নিউম্যান কোথায়?’
‘এখান থেকে চলে গেছে।’ বলল জন ফ্রাংক।
‘সেটা আগেই বুঝতে পেরেছি। আমি জিজ্ঞাসা করছি কোথায় গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপাতত ওয়াশিংটন গেছে, তারপর কোথায় যাবেন জানি না।’ বলল জন ফ্রাংক।
‘তাহলে তোমাদের নেতা আজর ওয়াইজম্যান ওয়াশিংটনেই আছে?’
জন ফ্রাংক আহমদ মুসার এ প্রশ্নের কোন জবাব দিল না।
‘যাক। এ প্রশ্নের জবাব আমার প্রয়োজন নেই। এখন বল, ড. হাইম হাইকেলকে তোমরা কোথায় রেখেছ?’ ধীর শান্ত শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
চমকে উঠে জন ফ্রাংক তাকাল আহমদ মুসার দিকে। চোখের দৃষ্টিতে টই-টুম্বর হিংস্রতা। কোন জবাব দিল না সে।
‘এই প্রশ্নের জবাব আমার প্রয়োজন মি. ফ্রাংক।’ বলে আহমদ মুসা তার রিভলবার তাক করল ফ্রাংকের চোখ বরাবর। বলল, ‘এখুনি জবাব না পেলে গুলী করব।’
কিন্তু লোকটি পাথরের মত নিরব রইল।
আহমদ মুসা তার রিভলবারের নল লোকটির বাম কানের বরাবর সরিয়ে আনল।
ঠিক এই সময়ই রিভলবারের সেফটি ক্যাচ তোলার শব্দ এল পেছন থেকে।
শব্দটি তার কান স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা জন ফ্রাকের সামনে চোখের পলকে এক ধাপ সরে গেল।
সঙ্গে সঙ্গেই একটা গুলী এসে জন ফ্রাংকের বুক বিদ্ধ করল।
দানিয়েল ডেভিড বুকে গুলী খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু গুলীটা তার হৃদপিন্ডকে মাঝামাঝি বিদ্ধ না করে একটু পাশ দিয়ে যাওয়ায় সে মরেনি তখনও। মরিয়া দানিয়েল ডেভিড একটা মহাসুযোগের সদ্ব্যব্যবহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেফটি কাচের শব্দ ও আহমদ মুসার বিপদ আঁচের অদ্ভুত শক্তি ও ক্ষীপ্রতা তাকে সফল হতে দিল না।
কিন্তু যখন সে দেখল তার গুলী বুমেরাং হয়েছে, হত্যা করেছে জন ফ্রাংকেই, তখন সে শিথিল, কম্পিত দুহাতে তার রিভলবার আবার তুলছিল সর্বশক্তি ব্যয় করে।
এ যাত্রায়ও সে সফল হলো না। আহমদ মুসা তার আগেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এবং তার রিভলবারও উঠে এসেছিল তাকে তাক করে। গুলী করতে আহমদ মুসার কষ্ট হচ্ছিল। ওদের অন্ততঃ একজনকে সে জীবন্ত চেয়েছিল কথা বের করার জন্য। কিন্তু গুলী না করে তার আর উপায় ছিল না। এক গুলী দিয়ে দুহাতকে নিস্ক্রিয় করার চেষ্টার মধ্যে ঝুঁকি আছে। সে ঝুঁকি আহমদ মুসা নিতে চায়নি।
আহমদ মুসার গুলী এবার দানিয়েল ডেভিডের মাথাকেই গুঁড়িয়ে দিল।
দুলাশের দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে আহমদ মুসা পাশের চেয়ারটায় একটু বসল। ওদের কাউকে এখন পর্যন্ত জীবন্ত পাওয়া গেল না। আসল লক্ষ্য হল ড হাইম হাইকেলের সন্ধান লাভ, সেটারই কোন অগ্রগতি এখনও হলো না।
একটু রেস্ট নিয়ে উঠে আহমদ মুসা মৃত দুজনকেই সার্চ করল, তারপর সার্চ করল গোটা বাড়িটা। কিন্তু প্রয়োজনীয় এমন কিছু পেল না। একটা বিষয়ে আহমদ মুসার বিস্ময় লাগল, ওরা ডা. নিউম্যানকে সরিয়ে দিল কেন? এটা কি ওদের সতর্কতা না ওরা জানতে পেরেছে যে, ডা. নিউম্যানের ব্যাপারটা প্রকাশ হয়ে পড়েছে!
বাড়িটা থেকে শূন্য হাতে বের হতে হতে আহমদ মুসা ভাবল ড. হাইম হাইকেল সম্পর্কে জানার জন্যে সামনে একটা অবলম্বই দেখা যাচ্ছে। সেটা হলো ড. হাইম হাইকেলের পরিবার তার সাহায্য করতে পারে। আবার তাদের দিয়ে পথও বের করা যেতে পারে। কারণ তাদের সহযোগিতা করতে পুলিশ, সরকার, সবাই বাধ্য।
সুতারাং আহমদ মুসার নেক্সট ইনভেস্টিগেশন ফিলাডেলফিয়া, ড. হাইম হাইকেলের বাড়ি।

ফিলাডেলফিয়া এয়ারপোর্ট থেকে তীরবেগে ছুটে আসছে একটা কার। দিলাওয়ার এভেনিউতে প্রবেশ করে গাড়ি দিলাওয়ার নদী তীর ধরে ছুটে চলছে। দিলাওয়ার এভেনিউ থেকে গাড়িটি লম্বার্ড স্ট্রিটে প্রবেশ করে পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলল। সেন্ট পিটার্স চার্চ বরাবর এসে গাড়িটি প্রবেশ করল থার্ড স্ট্রিটে। চার্চ পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে গাড়িটা স্ট্রিট থেকে নেমে লাল পাথরে বাধা প্রাইভেট রাস্তা একশ গজের মত চলার পর গাড়িটা বিশাল এক বাড়ির গেটে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
পুরানো মডেলের নতুন বাড়ি। বাড়িটি ষোড়শ শতকের তৈরি। ফিলাডেলফিয়ার এই এলাকা একটি ইউরোপীয় বসতি। বৃটিশ সম্রাট দ্বিতীয় চার্লস কর্তৃক নিয়োজিত প্রথম বৃটিশ গভর্নর উইলিয়াম পেম এই দিলাওয়ার উপকূলে ল্যান্ড করার পরই এই বসতি স্থাপিত হয়। এই এলাকার শত শত বাড়ি এখনও সেই আগের মডেলেই বিদ্যামান। চারশ’ বছরের পুরানো বাড়িগুলো সংস্কার করা হয়েছে, কিন্তু আকার-আঙ্গিকে হাত দেয়া হয়নি। ঐতিহাসিক স্মৃতি রক্ষার জন্য মডেল, স্টাইল হুবহু রক্ষা করা হয়েছে।
যে বাড়িটার সামনে গাড়িটা গিয়ে দাঁড়াল, সে বাড়িটাও এই শত শত বাড়ির একটি। কিন্তু বাড়িটার আরেকটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, আমেরিকার বিখ্যাত ইহুদী ব্যক্তিত্ত্ব হাইম সলমনের বাড়ি এটা। অতুল বিত্তের অধিকারী এই হাইম সলমন আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সমুদয় অর্থ তুলে দিয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের তহবিলে। স্বাধীনতা উত্তর আমেরিকার সরকার গঠন ও পরিচালনা এবং শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে হাইম সলমন। সুতারাং এই বাড়িটা ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান এবং পরিবারটাও পরম শ্রদ্ধাস্পদ।
গাড়িটা গেটের সামনে দাঁড়াতেই গেট বক্স থেকে সিকিউরিটি ছুটে এসে গেটের দরজা খুলে দিল।
গাড়ি লাল পাথরের রাস্তা ধরে সুন্দর ফুল-বাগানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে প্রশস্ত গাড়ি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
গাড়ি থেকে নামল সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত এক তরুন। হাতে ছোট্ট একটা হ্যান্ড ব্যাগ। এক দৌড়ে সে সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেল বারান্দায়। বাড়িতে প্রবেশের দরজার মুখোমুখি হতে দরজা খুলে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে হাসি মুখে এক তরুণী। দরজা খুলেই তরুণীটি তরুণকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, ‘হাই বেঞ্জামিন।’
‘হাই ব্রাউন। তুমি! এখন, এখানে তোমাকে দেখব ভাবতেই পারছি না।’ বলল বেঞ্জামিন।’
বেঞ্জামিনের পুরো নাম হাইম বেঞ্জামিন। হাইম হাইকেলের ছেলে এবং হাইম সলমনের উত্তম পুরুষ। পড়ে রোমের ‘ইউনিভার্সিটি অব থিয়োলজী’তে। সে ‘কম্পারেটিভ রিলিজিওন’-এর ছাত্র। তার পরীক্ষা ছিল বলে পিতার খবর তাকে জানানো হয়নি। পরীক্ষা শেষে জানতে পেরেই ছুটে এসেছে বাড়িতে।
আর ব্রাউনের পুরো নাম বারবারা ব্রাউন। বেঞ্জামিনদের প্রতিবেশী এক ইহুদী পরিবারের মেয়ে সে। পরিবারটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মাইগ্রেট করে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউন ছোটবেলা থেকে সহপাঠি ও বন্ধু। বারবানা ব্রাউন এখন ফিলাডেলফিয়া বিশাববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্রী।
বেঞ্জামিন কথা শেষ করতেই ব্রাউন বলে উঠল, ‘আমি এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। দাদীর সাথে দেখা করতে এলাম। তুমি আসছ শুনলাম। তাই তোমাকে ওয়েলকাম করার জন্য দাঁড়িয়ে আছি।’
হাসিমুখে কথাগুলো বলল বারবানা ব্রাউন। কিন্তু হাসির মধ্যেও একটা অস্বস্তির প্রকাশ দেখা গেল তার মধ্যে। চোখের কোণায় যেন অপরাধের একটা কালো দাগ।
বারবানা ব্রাউন বেঞ্জামিনের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, দাদীর শরীর খুবই ভেঙে পড়েছে। তিনি উঠতে যাচ্ছিলেন তোমাকে রিসিভ করার জন্যে। আমি তাকে জোর করে শুইয়ে রেখেছি।’
বেঞ্জামিনের কথা শুনতে পেয়েছিল বেঞ্জামিনের দাদী গ্লোরিয়া হাইম।
বেঞ্জামিনের মা মারা গেছে। অনেক বছর হলো। দাদীই বেঞ্জামিনকে মানুষ করেছে। বেঞ্জামিনের পিতা হাইম হাইকেল চাকুরীর কারণে বেশির ভাগ সময় নিউইয়র্কেই থাকত। আর বেঞ্জামিন পড়ত ফিলাডেলাফিয়াতেই। সুতারাং পিতা-মাতা দুজনেরই স্নেহ দাদী বেঞ্জামিনকে দিয়েছে।
বেঞ্জামিন ইটালীর রোমে পড়তে গেলে দাদী গ্লোরিয়া মানসিকভাবে খুবই ভেঙে পড়ে। হাইম হাইকেল মাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য নিউইয়র্ক থেকে প্রতি সপ্তাহেই ফিলাডেলফিয়াতে আসত। একদিকে বেঞ্জামিন বিদেশে অন্যদিকে একমাত্র ছেলে হাইম হাইকেল নিরুদ্দেশ। শারীরিকভাবই দারুন ভেঙে পড়েছে গ্লোরিয়া।
বেঞ্জামিন গিয়ে জড়িয়ে ধরল দাদীকে।
বেঞ্জামিন দাদীকে সাত্ত্বনা দিল। বলল, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে দাদী। আব্বার কোন শত্রু থাকতে পারে আমি বিশ্বাস করি না। তাঁর ক্ষতি কে করবে, কেন করবে দাদী?’
‘আমিও তাই ভাবি। কিন্তু কোথায় গেল হাইকেল! তুই রোম যাবার পর কোন উইক এন্ডেই সে ফিলাডেলাফিয়ায় আসা বন্ধ করেনি।’ বলল দাদী।
‘এটা অবশ্যই চিন্তার বিষয় দাদী। কিন্তু এ থেকেই কোন খারাপ চিন্তা আমরা না করলেও পারি। সাধারণ ফর্মালিটির বাইরে তিনি কোথাও থাকতে পারেন। একথা সত্যি দাদী, আব্বার মধ্যে বিস্ময়কর মানসিক পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্বাসের দিক থেকে তিনি ইহুদী ধর্মের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে এসেছেন। দুর্বোধ্য এই পরিবর্তন। পারিবারিক উত্তরাধিকার রাব্বানিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের পদ পরিত্যাগ করে তিনি একাডেমিক একটা ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বে নেমে এলেন। সবচেয়ে বড় কথা দাদী, সবকিছু থেকে নিজেকে বিছিন্ন করার একটা প্রবল আত্মমুখী প্রবণতা তার মধ্যে আমি দেখেছি। সুতারাং কোথাও গিয়ে কিছু সময়ের জন্য তিনি আত্মগোপন করতে পারেন।’ বলল হাইম বেঞ্জামিন।
‘বেঞ্জামিন, বয়সের পরিবর্তনের সাথে চিন্তাধারায় যে কোন পরিবর্তন আসতে পারে, তা বিস্ময়কর হতেও পারে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই কারণে হাইকেল তার মায়ের প্রতি, তার পরিবারের প্রতি এতটা অবিচার করবে, তা আমি মেনে নিতে পারছি না।’ বলল দাদী গ্লোরিয়া।
‘এটা ঠিক বলেছ দাদী। আব্বার ইদানিংকালের মানবতাবাদী চিন্তার সাথেও এটা মিলে না। আচ্ছা পুলিশ কি বলছে দাদী?’ জিজ্ঞাসা বেঞ্জামিনের।
‘ফিলাডেলাফিয়ার পুলিশ প্রধান ঘটনার পর আমার কাছে এসেছিল। সমবেদনা প্রকাশ করেছিল। বলেছিল, ‘সকলের সম্মানিত হাইম হাইকেলকে উদ্ধারের সব রকম চেষ্টা তারা করবে। কিন্তু তদন্তের কাজটা চলবে নিউইয়র্ক ভিত্তিক। সব ব্যাপার জানে বিশ্বাবদ্যালয় এবং সেখানকার পুলিশ।’ বলল দাদী।
‘ঠিক আছে দাদী, আমি দুএকদিনের মধ্যেই নিউইয়র্ক যাব।’ হাইম বেঞ্জামিন বলল।
‘ঠিক আছে ভাই। এখন আর কথা নয়। যাও কাপড় ছাড়, ফ্রেশ হও।’ বলল গ্লোরিয়া হাইম।
‘আচ্ছা দাদী, একটু পরে আসছি। তোমার সাথে বসেই চা খাব।’ হাইম বেঞ্জামিন বলল।
উঠে দাঁড়াল সে।
উঠে দাঁড়াল বারবারা ব্রাউনও।
‘তুমি এখন চলে যাবে? একটু পরে যাও। এস কথা বলি।’ বারবানা ব্রাউনকে লক্ষ্য করে বলল হাইম বেঞ্জামিন।
‘তোমার এখন রেস্ট প্রয়োজন।’ বলল বারবারা ব্রাউন।
‘কথাকে রেস্টের বিকল্প বলছি না। চল।’ হাইম বেঞ্জামিন বলল।
হাইম বেঞ্জামিন কাপড় ছেড়ে ফ্রেস হয়ে এসে সোফায় বারবারা ব্রাউনের মুখোমুখি বসল। বলল, ‘আচ্ছা ব্রাউন বলত তুমি কি ভাবছ? আমি বিষয়টাকে সহজভাবে নিতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম,আব্বা নিভৃত জীবনের জন্য কিছু সময়ের জন্য কোথাও হয়তো গেছেন। ধর্ম চিন্তায় যারা গভীরভাবে ডুবে যান, তাদের ক্ষেত্রেই কখনও কখনও এমন ঘটে। কিন্তু এখন দাদীর কথায় মনে হচ্ছে, সত্যি আব্বা এমন দায়িত্বহীন হতে পারেন না। দাদী ও পরিবারের চিন্তাকে বাদ দিয়ে তিনি কোন চিন্তাই গ্রহণ করতে পারেন না।’
বেদনা মিশ্রিত একটা বিব্রতভাব ফুটে উঠেছিল বারবারা ব্রাউনের মুখেও। এই ভাবটা চাপতে চেষ্টা করে বলল বারবারা ব্রাউন, আমি দাদীর সাথে একমত। বড় কিছু ঘটেছে। ভেবে-চিন্তে তোমার সামনে এগুনো দরকার।
‘বড় কিছু একটা কি হতে পারে?’ জিজ্ঞেস করল হাইম বেঞ্জামিন।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না বারবারা ব্রাউন। কি উত্তর দেবে সে! সে নিজেও সবকিছু জানে না। কিন্তু এটুকু জানে যে, আংকেল ড. হাইম হাইকেল বিপদে আছেন। হাইম পরিবারকে তা জানতে দেয়া হবে না। ইহুদীদের স্বার্থেই নাকি এটা প্রয়োজন। আংকেল ড. হাইম হাইকেলের স্বার্থেই নাকি কোন বিদেশীকে, এমনকি অপরিচিত কোন স্বদেশীকেও হাইম পরিবারের সাথে দেখা করতে দেয়া যাবে না কিছুতেই। এই পাহারা দেবার দায়িত্ব তার উপরেও পড়েছে। পরিবারের অজান্তে এটা করতে তার খারাপ লাগছে। সে বুঝতে পারছে না এর মধ্যে ইহুদী স্বার্থের কি আছে, হাইম পরিবারের স্বার্থেরই বা কি আছে! তবু অর্পিত দায়িত্ব তাকে পালন করতে হচ্ছে। হাইম বেঞ্জামিন শুধু তার বন্ধু নয়, তার সব কিছুই সে। কিন্তু তার সাথেও লুকোচুরি খেলতে হচ্ছে তাকে। সত্য কথাটা বলা যাচ্ছে না। এই চিন্তা তাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে।
চিন্তার টানাপোড়নে বিব্রত বারবারা ব্রাউন উঠে হাইম বেঞ্জামিনের পাশে গিয়ে বসল। তুলে নিল হাইম বেঞ্জামিনের একটা হাত। বলল, ‘বেঞ্জামিন ‘বড় কিছু একটা’ কি আমি জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে আংকেল বড় বিপদে পড়েছেন।’
থামল বারবানা ব্রাউন। একটা দম নিয়ে ভয়ার্ত ফিসফিসে কন্ঠে বলল, ‘আমার মনে হয় তোমাদের পরিবারের উপরও চোখ রাখা হচ্ছে।’
ভ্রুকুঞ্চিত হলো বেঞ্জামিনের। সোজা হয়ে বসল। বারবারা ব্রাউনের দুহাতই সে তার হাতের মুঠোর মধ্যে নিল। বলল, ‘ব্রাউন, সত্যি এটা? কি করে বুঝলে তুমি?’
কথা গুছিয়ে রেখেছিল বারবারা ব্রাউন। বলল, আমাদের কম্যুনিটির বিভিন্ন সূত্র থেকে এটা বলা হচ্ছে। আর গতকাল নিজেও আমি তোমাদের বাসায় একটা টেলিফোন ধরেছি দাদীর নির্দেশে। টেলিফোন যিনি করেছিলেন, কথার উচ্চারণ থেকে বুঝলাম তিনি একজন বিদেশী। তিনি বললেন, মি. হাইম বেঞ্জামিন আগামীকাল ক’টায় পৌঁছাচ্ছেন?’ আমি উত্তরে জিজ্ঞাসা করলাম, কে আপনি? তিনি বললেন, আমি ড. হাইম হাইকেলের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। আমি মি. হাইম বেঞ্জামিন ও তার দাদীর সাথে দেখা করতে চাই।’ আমার বিস্ময় লেগেছে তুমি আজ আসছ এ বিষয়টা একজন বিদেশী নিউইয়র্ক থেকে জানল কি করে? ‘দাদী অসুস্থ, পরে যোগাযোগ করবেন’ বলে আমি তাঁকে এড়িয়ে গেছি।’
ওদিকে হাইম বেঞ্জামিন কিছু বলার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। বারবারা ব্রাউন থামতেই বেঞ্জামিন বলে উঠল, ‘আশ্চর্য, আমি এই দুমিনিট আগে টয়লেট থেকে বেরিয়ে একটা টেলিফোন ধরলাম। টেলিফোনটা তোমার সেই লোকের। ঠিক সেই বিদেশী উচ্চারণ। তোমাকে যা বলেছে আমাকেও তাই বলল। আব্বার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী সে, আমার সাথে দেখা করতে চায়।’
‘অবাক ব্যাপার! তুমি এসেছ এক ঘন্টাও হয়নি, সে জানল কি করে?’ বলল বারবারা ব্রাউন। বিস্ময়ভরা তার কন্ঠে।
হাইম বেঞ্জামিন চিন্তা করছিল। বলল,‘আধুনিক ব্যবস্থায় বিমান বন্দরকে জিজ্ঞাসা করে বা ইন্টারনেট-ই-মেইলের মাধ্যমেও এটা জানা সম্ভব।’
‘আবার বাড়ির উপর চোখ রেখেও জানা সম্ভব।’ বারবারা ব্রাউন বলল।
‘হ্যাঁ, তাও সম্ভব।’ বলল, হাইম বেঞ্জামিন।
‘তুমি কি বলেছ লোকটাকে?’ জিজ্ঞাসা করল বারবারা ব্রাউন।
‘আমি তাকে সময় দিয়েছি। আমি নিউইয়র্ক যাবার আগে তার সাথে আলোচনা করলে ভালোই হবে।’ বলল বেঞ্জামিন।
‘অপরিচিত একজন মানুষ। তার উপর বিদেশী। একজন অপরিচিত বিদেশী কি করে আংকেলের শুভাঙ্ক্ষী হতে পারেন?
হঠাৎ তার সাথে দেখা করা কি ঠিক হবে? তার কোন বদ মতলবও থাকতে পারে।’ বারবারা ব্রাউন বলল।
‘হঠাৎ করে তো দেখা করছি না। আসছেন আগামীকাল। আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় থাকছে।’ বলল বেঞ্জামিন।
কলিংবেল বেজে উঠল।
বারবারা ব্রাউন দৌড়ে গিয়ে কলটা রিসিভ করল। কথা বলল। তারপর ছুটে এল হাইম বেঞ্জামিনের কাছে। বলল, ‘একজন পুলিশ অফিসার এবং নিউইয়র্ক রাব্বানিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইরেক্টর এসেছেন। তোমার সাথে দেখা করবেন।’
হাইম বেঞ্জামিনের মুখটা উজ্জল হয়ে উঠল। ওরা কি আব্বার সম্পর্কে কোন সুসংবাদ এনেছেন? মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকল হাইম বেঞ্জামিন যেন কোন সুখবর সে পায়।
উঠে দাঁড়াল হাইম বেঞ্জামিন। বলল,‘চল ব্রাউন, ওদের নিয়ে আসি।’
মেহমান দুজনকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে এসে ওরা চারজন ড্রইংরুমে বসল। বেঞ্জামিন ও বারবারা পাশাপাশি এক সোফায় বসল। আর অন্য দুটি সোফায় বসল পুলিশ আফিসার এবং নিউইয়র্ক রাব্বানিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইরেক্টর মি. ফ্রান্সিস।’
হাইম বেঞ্জামিন বসেই মি. ফ্রান্সিসকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার, আপনি আসায় খুব খুশি হয়েছি। আমি নিজেই নিউইয়র্ক যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। আমরা খুব উদ্বিগ্ন।’
‘আমরাও নিদারুন দুঃখিত ও উদ্বিগ্ন। আসলেই এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে কিছু বলার জন্যে আমরা এসেছি।’ বলে একটু থামল ফ্রান্সিস। তারপর পুলিশ অফিসারের দিকে চেয়ে বলল, ‘এসপি সাহবে আপনিই কথাটা শুরু করুন।’
পুলিশ অফিসারের চোখে-মুখে একটা বিব্রতভাব ফুটে উঠল। তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হবার চেষ্টায় নড়ে-চড়ে বসল। বলল, ‘আমি এ্যালেন শেফার। নিউইয়র্কের ইয়র্কভিল ডিস্ট্রিক্ট-এর একজন তদন্তকারী অফিসার। দুঃখের সাথে বলছি, আমরা ড. হাইম হাইকেলকে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় খুঁজে পেয়েছি। যা বুঝা গেছে তাতে মনে হয়েছে ভীষণ এক ভয়ে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁর জীবন প্রচন্ড ঝুঁকির মুখে। এর একটা সত্যতা পাওয়া গেছে, গত কয়েকদিনে রাব্বানিক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একজন খুন হয়েছে, দুজনকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছে। ড. হাইকেলের সন্ধানে তাদের হত্যা ও জখম করা হয়। এই আশংকাকে সামনে রেখেই ড. হাইকেলকে খুঁজে পাওয়ার খবরটা প্রকাশ করা হয়নি। আর……………..।’
পুলিশ অফিসার এ্যালেন শেফারের কথার মাঝখানেই হাইম বেঞ্জামিন বলে উঠল, ‘আব্বা এখন কোথায়?’
‘একটা মানসিক হাসপাতালে রাখা হয়েছে।’ বলল এ্যালেন শেফার।
‘কোন হাসপাতালে?’ জিজ্ঞাসা বারবারা ব্রাউনের।
‘সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্তৃপক্ষ ছাড়া কাউকে বলার অনুমতি নেই। আমিও জানি না ম্যাডাম।’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘পরিবারের সদস্যরাও তা জানতে পারবে না?’ জিজ্ঞেস করল হাইম বেঞ্জামিন।
‘পরিবারের সদস্যরা জানতে পারবে না?’ কিন্তু যেতে পারবে। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য আমরা এসেছি।’ পুলিশ অফিসারটি বলল।
‘বলুন ঘটনা কি?’ বলল হাইম বেঞ্জামিন।
সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল না পুলিশ অফিসারটি। একটু ভাবল। বোধ হয় কথা গুছিয়ে নিল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘ড. হাইম হাইকেল একদিকে অপ্রকৃতিস্থ, অন্যদিকে অদৃশ্য এক প্রবল শত্রু তাকে তাড়া করে ফিরছে। এই অবস্থায় তার যেমন চিকিৎসা দরকার, তেমনি দরকার নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার। এজন্য তাকে চিকিৎসার জন্য এমন এক জায়গায় রাখা হয়েছে, যা পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ছাড়া কেউ জানে না। আপনাদেরও জানানো যাবে না এই কারণে যে, আপনাদের যাতায়াত বা অন্য কোনভাবে বিষয়টা শত্রুরা জেনে ফেলতে পারে। শত্রুরা ড. হাইম হাইকেলের সন্ধানে আপনাদের উপরও চোখ রেখেছে। তবে সিন্ধান্ত হয়েছে, সংশ্লিষ্ট পুলিশের তত্ত্ববধানে ড. হাইম হাইকেলকে দেখানো হবে তার পরিবারের লোকদের।’
একটা ঢোক গিলল পুলিশ অফিসার এ্যালেন শেফার। থামতে হলো তাকে।
পুলিশ অফিসার থামতেই হাইম বেঞ্জামিন বলে উঠল, আমার দুটি কথা। এক, আপনি বলেছেন হাসপাতালের নাম, ঠিকানা আমাদের জানাবেন না। কিন্তু ওখানে যখন যাব, তখন তা তো জানা হয়েই যাবে। তাহলে নাম, ঠিকানা জানাতে আপত্তি কেন? দুই. আব্বাকে আমাদের দেখানো হবে বলেছেন। দেখানোর অর্থ সাক্ষাত ও কথা বলা নয়। ‘দেখানো হবে’ বলতে আপনি কি অর্থ করেছেন?’
পুলিশ অফিসারটির মুখে একটা অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠল। বিব্রতও মনে হলো কিছুটা। কিন্তু এরপরও হাসার চেষ্টা করে সে বলল, ‘ড. হাইম হাইকেলের পরিবারকে তার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হবে, দেখানো হবে, কিন্তু সাক্ষাত করানো হবে না। ডাক্তারের নিষেধ। যথেষ্ট সুস্থ না হওয়ায় আত্নীয়-স্বজনের সাথে তাকে সাক্ষাত করানো যাবে না। যে কোন আবেগ উত্তেজনা তার জন্য ক্ষতিকর। এই একই কারণে তাঁকে তাঁর কোন পরিচিতজনের সাথেও সাক্ষাত করানো হচ্ছে না। যেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেখানকার নাম- ঠিকানা না জানানোর অর্থ হলো, ড. হাইম হাইকেলের পরিবার সেখানে যাবেন বটে, কিন্তু যাওয়ার রাস্তা এবং যাওয়ার স্থান তাদের দেখতে দেয়া হবে না। শেডে ঢাকা বন্ধ গাড়িতে করে যে ঘরে বসে তারা হাইকেলকে দেখবেন, সেই ঘরে নিয়ে নামিয়ে দেয়া হবে। দেখার পর ঐ ঘর থেকে ঐভাবেই আবার ফিরিয়ে আনা হবে।’
বিরক্তি ফুটে উঠল হাইম বেঞ্জামিনের মুখে। বলল, এত কিছুর আমি কারণ বুঝছি না। ড. হাইম হাইকেলের পরিবারকেও বিশ্বাস করা হবে না কেন? আব্বার শত্রু কে বা কারা, কেন তা আমরা জানতে পারব না?’
পুলিশ অফিসারের মুখে সেই আগের অস্বস্তিভাব আবারও ফুটে উঠল। ম্রিয়মান কন্ঠে বলল, ‘যা করা হচ্ছে সবই ড. হাইম হাইকেলের স্বার্থে।’ বলে একটু থামল পুলিশ অফিসার। তারপর পুনরায় বলা শুরু করল, ‘মুসলিম একটি মৌলবাদী চক্র বিরাট এক ষড়যন্ত্র এঁটেছে ড. হাইকেলকে ঘিরে। ড. হাইম হাইকেল একটি ঐতিহাসিক পরিবারের অত্যন্ত সুপরিচিত ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর কাছ থেকে ঐ চক্র একটা কনফেশন আদায় করতে চায় যে কোন মূল্যে। তারপর তাকে হত্যা করতে চায়, যাতে সে কনফেশনের কোন প্রতিবাদ জানানোর কোন সুযোগ না পান।’
পুলিশ অফিসার থামতেই বারবারা ব্রাউন বলে উঠল, ‘কনফেশনটা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? কিসের কনফেশন এটা?’
‘এ প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না। তবে এইটুকু জানি যে, জাতীয় মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনার সাথে এই কনফেশন জড়িত। এই কনফেশন শত্রুর হাতে এমন এক মহাঅস্ত্র তুলে দেবে যা ইতিহাসই পাল্টে দিতে পারে।’ বলল পুলিশ অফিসারটি।
বিস্ময় ও ভীতির ছায়া নেমে এসেছে হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউনের চোখে-মুখে। পুলিশ অফিসারটি থামলেও তারা কোন কথা বলতে পারল না। ভাবছিল হাইম বেঞ্জামিন, তার আব্বা কি এমন জানেন বা চাপে পড়ে ভিত্তিহীন কি এমন কনফেশন করতে পারেন যা ইতিহাস পাল্টে দিতে পারে! তার পিতার মানসিক পরিবর্তনের সাথে এই কনফেশন ব্যাপারটার কি কোন সর্ম্পক আছে?
পুলিশ অফিসারই আবার কথা বলে উঠল। বলল, ‘সব কথা আমরা জানি না। কিন্তু ষড়যন্ত্রটা অত্যন্ত ভয়াবহ। জাতির স্বার্থে, ড. হাইম হাইকেলের স্বার্থে আপনারা আমাদের সহযোগিতা করবেন বলে আমরা সবাই আশা করি।’
ভাবছিল হাইম বেঞ্জামিন। একটু পর বলল, ‘ঠিক আছে মি. এ্যালেন শেফার। আমরা কবে দেখা করতে পারি?’
‘সুবিধা অনুসারে আমাদের পক্ষ থেকেই তা আপনাদের জানানো হবে।’ বলল পুলিশ অফিসার।
হাইম বেঞ্জামিন পাশের ডেস্ক থেকে স্লিপ প্যাডের একটা পাতা নিয়ে এসে পকেট থেকে কলম বের করে পুলিশ অফিসারকে বলল, ‘আপনার অফিস ও বাসার টেলিফোন নাম্বার দিন, যাতে আমরাও যোগাযোগ করতে পারি আপনার সাথে।’
পুলিশ অফিসার কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়ে বাধো বাধো কন্ঠে বলল, ‘আমি অফিসে কখন থাকি, বাসায় কখন থাকি তার কোন স্থিরতা নেই। সুতরাং আমাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে লাভ হবে না। আপনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইরেক্টরের সাথে যোগাযোগ রাখবেন, তাহলেই হবে।’
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে হাইম বেঞ্জামিন তার কাগজ ও কলম রেখে দিতে দিতে বলল, ‘ধন্যবাদ ওঁদের সকলের টেলিফোন আমাদের কাছে আছে।’
হাইম বেঞ্জামিনের কথা শেষ হতেই পুলিশ অফিসার উঠে দাঁড়াল। তার সাথে উঠল নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইরেক্টর মি. ফ্রান্সিস। বলল পুলিশ অফিসার, ‘আমরা দুঃখিত। একেবারে অসময়ে আপনাদের বিরক্ত করেছি। আপনি বাড়িতে ফিরে বোধ হয় একটু রেস্টও নিতে পারেননি।’
‘আমাদের খুশি হবার কথা। আমরা খুশি হয়েছি। আমাদের জন্যেই কষ্ট করে আপনারা এসেছেন। কষ্ট করে আসার জন্য ধন্যবাদ।’ বলল হাইম বেঞ্জামিন।
পুলিশ অফিসার এ্যালেন শেফার এবং নিউইয়র্ক রাব্বানিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইরেক্টর মি. ফ্রান্সিসকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসে হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউন আবার বসল।
কপাল কুঞ্চিত, চোখ আধ-বোজা। ভাবছিল হাইম বেঞ্জামিন।
তার চিন্তায় বাধ সেধে বারবারা ব্রাউন বলে উঠল, ‘বলেছিলাম না বেঞ্জামিন আংকেল বড় কোন বিপদে পড়েছেন এবং বলেছিলাম যে, তোমাদের বাড়ি ও তোমাদের উপর চোখ রাখা হচ্ছে। দেখলে সবই সত্য প্রমাণ হলো। ওরাও বলে গেল এবং আমিও নিশ্চিত যে, শত্রু পক্ষ তোমাদের বাড়িতে আসবে, তোমাদের সাথে দেখা করারও চেষ্টা করবে।’
‘কেন আসবে আমরা তো কিছুই জানি না।’ বলল হাইম বেঞ্জামিন।
‘এখন তো অনেক কিছুই জানলে’। বারবারা ব্রাউন বলল।
‘আব্বা যখন বিপদগ্রস্থ, তখন সে বিপদ আমাদের স্পর্শ করবেই।’ বলল হাইম বেঞ্জামিন।
‘ভেব না বেঞ্জামিন। শত্রুরা তোমাদের পর্যন্ত পৌঁছতেই পারবে না।’ বারবারা ব্রাউন বলল।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো হাইম বেঞ্জামিনের। বলল, ‘তুমি এতটা নিশ্চিত কেমন করে?’
একটু সংকুচিত ভাব দেখা দিল বারবারা ব্রাউনের চোখে-মুখে। একটু হেসে স্বাভাবিক হয়ে বলল, কেন যারা আংকেলের নিরাপত্তা দিচ্ছেন, তাদের কি দায়িত্ব নয় তোমাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া?’
‘এটা যুক্তির কথা, কিন্তু বলেছ নিশ্চিত কথা। যাক। আব্বার অপ্রকৃতিস্থ হবার বিষয়টি আমার মন মেনে নিতে পারছে না। একমাস আগেও আব্বার যে চিঠি পেয়েছি, তাতে তাঁকে সুস্থ শুধু নয়, আরও গভীর ও স্বচ্ছ চিন্তার মনে হয়েছে।’ বলল বেঞ্জামিন।
‘তুমি বলছ এক মাস আগের কথা। কিন্তু বর্তমানকে তো মানতে হবে বেঞ্জামিন।’ বারবারা ব্রাউন বলল।
‘মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। কি করব বুঝতে পারছি না। আব্বার সাথে সাক্ষাত করতে পারবো না, এ কেমন কথা!’ বলল হাইম বেঞ্জামিন।
‘ডাক্তারের কথা তো মানতেই হবে। ডাক্তারের উপর ভরসা করা ছাড়া করার কি আছে!’ বারবারা ব্রাউন বলল।
সেই সাথে বারবারা ব্রাউন সরে বেঞ্জামিনের ঘনিষ্ট হলো। বেঞ্জামিনের কাঁধের উপর হাত রেখে বলল, ‘আবেগ নয়, তোমাকে বাস্তববাদী হতে হবে বেঞ্জামিন। আমার মনে হচ্ছে, বিপর্যয়টাকে যতটা আমরা দেখছি, তার চেয়ে বড়। তোমাকে সবদিক দেখে চলতে হবে।’
‘পরিবারের সবকিছু আব্বাই দেখেছেন, এখন তিনিই বিপদে। খুবই অসহায় বোধ করছি আমি।’ বলল বেঞ্জামিন।
বারবারা ব্রাউন হাত দিয়ে বেঞ্জামিনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি তোমার পাশে থাকব বেঞ্জামিন।’
বেঞ্জামিন কোন কথা বলল না।
মাথাটা সে এলিয়ে দিল বারবারা ব্রাউনের কাঁধে।

দিলাওয়ার নদীর তীরে দিলাওয়ার এভেনিউর ঠিক উপরেই একটা হোটেলে উঠেছে আহমদ মুসা। ইউরোপীয় ট্যুরিস্টের ছদ্মবেশে। সামান্য ছদ্মবেশেই সে একেবারে বদলে গেছে। সুবেশী একজন এ্যাংলো-এশিয়ান ট্যুরিস্ট মনে হচ্ছে তাকে।
দুপুরে সে হোটেলে উঠেছে। গোসল করে খাওয়ার পর একটু রেস্ট নিয়েই আহমদ মুসা বেরিয়েছিল এলাকাটা দেখার জন্যে। সেই সাথে সাথে হাইম বেঞ্জামিনের বাড়িটাও সে দেখে এসেছে।
হোটেলে উঠেই আহমদ মুসা যোগাযোগ করেছে হাইম বেঞ্জামিনের সাথে। বলেছে, ‘আমি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি, আপনার আব্বার ব্যাপারে আপনার সাথে কিছু আলোচনার জন্যে।’ সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর আসেনি বেঞ্জামিনের কাছ থেকে। একটু পর বলে, ‘আমরা সিন্ধান্ত নিয়েছি, আমি কিংবা আমাদের পরিবারের কেউ আমার আব্বার ব্যাপার নিয়ে কারও সাথে কথা বলব না।’ আহমদ মুসা উত্তরে এই সিদ্ধান্তের কারণ জিজ্ঞাসা করেছিল। বেঞ্জামিন বলেছিল, ‘এ ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই বলে। কারও কিছু জানার থাকলে পুলিশের কাছ থেকেই জানা উচিত।’ আহমদ মুসা বলল, ‘ধন্যবাদ আমি গত সাতদিনে নিউইয়র্কে সে রকম পুলিশ তালাশ করেছি, যিনি ড. হাইম হাইকেলের সর্ম্পকে কিছু জানেন। কিন্তু এ রকম পুলিশ পাইনি, যে অন্তত; এটুকু বলতে পারে, ড. হাইকেলের লা-পাত্তা হবার তদন্ত শুরু হয়েছে। এ ধরনের তদন্ত শুরু হয়, সংশ্লিষ্ট লোকের ঘর থেকে। কিন্তু আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে শুনেছি, ঘরটি পুলিশের কেউ এখনও দেখেইনি। তাঁকে যদি অসুস্থ বা অপ্রকৃতিস্থ বলা হয়, তাহলেও এর পটভূমির জন্যে তার ঘরের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসের তার ব্যাক্তিগত জিনিসপত্র ও কাগজপত্রের পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ দরকার হয়। পুলিশ তার কিছুই করেনি। তদন্তের জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন পুলিশ অফিসারই পাইনি। সুতরাং যা জানতে চাই, কাকে জিজ্ঞাসা করব?’ আহমদ মুসার এ দীর্ঘ কথার পর সঙ্গে সঙ্গেই বেঞ্জামিন কিছু বলেনি। বোধ হয় ভাবছিল। একটু পরে বলে ওঠে, ‘আপনি নিউইয়র্কের নিউইয়র্কভীল ডিস্ট্রিক্ট পুলিশ অফিসার এ্যালেন শেফারের কাছে গেছেন? তিনি আপনাকে সাহায্য করতে পারেন।’ শুনেই আহমদ মুসা বলে উঠেছিল, ‘কি নাম বললেন পুলিশ অফিসারের?’ বেঞ্জামিন উত্তরে বলে, ‘এ্যালেন শেফার।’ আহমদ মুসা একটু ভেবে বলেছিল, ‘আমি নিউইয়র্কের নিউইয়র্কভিল ডিস্টিক্টেই রয়েছি। ওখানকার পুলিশ অফিসে আমি খোঁজ-খবর নিয়েছি। ওখানে ১১ জন তদন্তকারী অফিসার আছেন। তার মধ্যে এ্যালেন শেফার নামে কাউকে পাইনি!’ উত্তরে বলেছিল বেঞ্জামিন ‘পাননি! কয়েকদিন আগেই তো আমার সাথে কথা বলে গেল!’ ভ্রুকুঞ্চিত হয়েছিল আহমদ মুসার। একটু ভেবে নিয়ে সে, বলেছিল, ‘নিউইয়র্কের পুলিশ আপনার এখানে এসেছিল? তার নাম এ্যালেন শেফারই ছিল? ঠিক মনে আছে আপনার?’ হাইম বেঞ্জামিন বলল, ‘হ্যাঁ ঠিক আছে।’ একটু ভেবে আহমদ মুসা বলেছিল, ‘আমার অনুরোধ, আপনি সময় করে নিউইয়র্ক পুলিশের ওয়েব সাইটে নিউইয়র্কভিল ডিস্ট্রিক্টের পুলিশের লিস্টটা একটু পরীক্ষা করুন। ওখান থেকে টেলিফোন নাম্বার নিয়ে আপনি টেলিফোনও করতে পারেন।’ আহমদ মুসা থামতেই বেঞ্জামিন বলে উঠল, ‘আমি এখনি দেখছি। মিনিট দশেক পরে আপনার সাথে কথা বলব। স্যরি, এখন রাখছি।’ বলেই সে টেলিফোন রেখে দিয়েছিল।
ঠিক দশ মিনিট পর আহমদ মুসা টেলিফোন করার আগে হাইম বেঞ্জামিনই আহমদ মুসাকে টেলিফোন করে। আহমদ মুসা টেলিফোন ধরে হ্যালো বলতেই হাইম বেঞ্জামিন বলতে শুরু করে, ‘স্ট্রেঞ্জ মি. ………….।’
‘আইজ্যাক দানিয়েল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ মি. দানিয়েল, আমি কম্পিউটারের ওয়েব সাইটে চেক করেছি। নিউইয়র্কভিল ডিস্ট্রিক্ট-এ এ্যালেন শেফার নামে কোন পুলিশ নেই। আমি টেলিফোনও করেছিলাম। ওখানকার পুলিশ অফিস জানাল, ঐ নামের কোন পুলিশ অফিসার এখানে নেই। গত তিন বছরের মধ্যে ছিল না। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম কোন পুলিশ অফিসার তারা আমাদের বাড়িতে পাঠিয়েছিল কিনা। তারা পাঠায়নি বলেছে। আপনার কথাই ঠিক। তারা আমার আব্বার অন্তর্দ্ধানের তদন্ত বিষয়ে কোন তদন্ত অফিসারই নিয়োগ করেনি এখনও।’ হাইম বেঞ্জামিন থামলেই আহমদ মুসা বলেছিল, ‘মি.হাইম বেঞ্জামিন আপনার সাথে আমার কথা আছে। আসতে পারি?’ একটু চুপ করে থেকে হাইম বেঞ্জামিন বলেছিল, ‘কি বলব মি. দানিয়েল, বুঝতে পারছি না।’ আহমদ মুসা বলল, ‘মি. হাইম বেঞ্জামিন আমাকে বিশ্বাস করার দরকার নেই। আমার কথা আপনি শুনবেন। আমি একাই এসেছি। একাই আপনার সাথে কথা বলব। আমাকে সার্চ করে ঢুকাবে আপনার সিকিউরিটি। আপনি যে কোন কাউকে সঙ্গে রাখতে পারেন।’ অবশেষে সাক্ষাতের সময় দেয় বেঞ্জামিন।
কাপড়-চোপড় পরেই আহমদ মুসা বসেছিল। বেঞ্জামিনের বাড়িতে যাবার জন্যে ঠিক সন্ধ্যা ৭ টায় উঠে দাঁড়াল।
দরজা খুলল।
দরজা খুলে বাইরে মুখ বাড়াতেই একজন লোকের মুখোমুখি হয়ে গেল। লোকটি যুবক বয়সের এবং লাল শ্বেতাংগ। আহমদ মুসার দরজার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসার মুখোমুখি হতেই লোকটি চমকে উঠল এবং পেছনে ফিরে করিডোর বরাবর হনহন করে চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে লোকটির পেছনে হাঁটতে শুরু করল। আহমদ মুসা নিশ্চিত, লোকটি তার ঘরের সন্ধানেই এসেছিল।
সামনেই করিডোরের একটা বাঁক।
লোকটি বাঁক ঘুরে গেল।
আহমদ মুসা দরজা বন্ধ করতে যেয়ে একটু পিছিয়ে পড়েছিল।
আহমদ মুসাও বাঁক ঘুরল। কিন্তু বাঁক ঘুরে লোকটিকে আর দেখতে পেল না। লিফট রুম সামনে, কিন্তু বেশ একটু দূরে। এত তাড়াতাড়ি সে লিফটে নেমে যেতে অবশ্যই পারেনি। কিন্তু গেল কোথায়? লোকটি তার মতই কি হেটেলের বাসিন্দা? আহমদ মুসার দরজায় তার ঐভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা কি একটা বোকামি? কিন্তু লোকটির চোখ-মুখ দেখে তা মনে হয়নি।
মাথায় এসব ভাবনা নিয়েই আহমদ মুসা লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
এসে গেল লিফটটা।
আহমদ মুসা চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলে লিফটে প্রবেশ করল। মনে মনে বলল, এখন ড. হাইম হাইকেলের পরিবারের সদস্যের সাথে কথা বলাই তার জন্য সবচেয়ে বড় কাজ। অন্যদিকে সে নজর দেবে না। সে নিশ্চিত যে, তার ফিলাডেলাফিয়ায় আসা শত্রুর কাছে ধরা পড়ে গেছে। লোকটি তাদের হওয়াটাই ঘটনার সবচেয়ে সংগত ব্যাখ্যা।
আহমদ মুসা হোটেলের সামনে কয়েক ঘন্টার চুক্তিতে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে যাত্রা করল।
আহমদ মুসার গাড়ি দেলোয়ার এভেনিউ থেকে ক্যাথেরিন স্ট্রিটে প্রবেশ করে পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলল। তারপর পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে প্রবেশ করল থার্ড স্ট্রিটে।
আহমদ মুসার গাড়ি এগিয়ে চলল ঐতিহাসিক ‘সাউথওয়াক’ আবাসিক এলাকার মধ্যে দিয়ে। ষোড়শ শব্দাতীর এ আবাসিক এলাকা। এলাকার বাড়ি ঘরগুলো কাঠামো, ডিজাইন সবই ষোড়শ শতাব্দীর। আধুনিক সংস্কার বাড়িগুলোকে আধুনিক করে তুলেছে। এই আবাসিক এলাকারই একেবারে উত্তর-প্রান্তে ড. হাইম হাইকেলের বাড়ি।
আবাসিক এলাকার রাস্তাগুলো প্রশস্ত। বাড়িগুলো অনেক দূরে দূরে। সব বাড়িই চারদিক থেকে বাগানে সুসজ্জিত। এতে এলাকার শোভা বেড়েছে, কিন্তু চারদিকে একটা শুন-সান নির্জনতা নেমে এসেছে। সন্ধ্যা সাতটাতেই মধ্যরাতের নিরবতা-নির্জনতা এসে জুড়ে বসেছে। কচিৎ দুএকটা গাড়ির দেখা পাওয়া যাচ্ছে।
আহমদ মুসা একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল, অতীতে ফিরে গিয়েছিল তার মন। ভাবছিল, ষোড়শ শতাব্দীর আগে এই ফিলাডেলফিয়ার কোন অস্তিত্ব ছিল না। অস্তিত্ব ছিল না ইউরোপীয় কোন মানুষের। আমেরিকার আদিবাসী ইন্ডিনয়ানদের ‘দিলওয়ার’ জাতি গোষ্ঠি বাস করত এই ফিলাডেলফিয়া অঞ্চলে। ষোড়শ শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে ইউরোপের ডাচরা প্রথমবারের মত এ অঞ্চলে এল। তারপর ১৬৪০ সালের দিকে ইউরোপের সুইডিশরা দিলওয়ার ইন্ডিয়ানদের এই অঞ্চলে এসে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলল। ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের উপর ইউরোপের সাম্রাজবাদী লোভাতুর দৃষ্টি তীব্র হয়ে উঠল। শুরু হলো এ এলাকার দখল নিয়ে ডাচ, সুইডিশ ও ইংরেজদের মধ্যে ঘোরতর লড়াই। এলাকার আসল মালিক সহজ, সরল দিলওয়ার ইন্ডিয়ানদের ঘরছাড়া করে আগেই হটিয়ে দেয়া হয়েছিল। দখলের লড়াই-এ অবশেষে জিতে যায় বৃটেন। আমেরিকা হয়ে দাঁড়ায় বৃটেনের উপনিবেশ। তারপর……।’
আহমদ মুসার চিন্তা আর এগুতে পারল না। ড্রাইভারের কথায় আহমদ মুসার চিন্তায় ছেদ নেমে এল। ড্রাইভার বলেছিল, ‘স্যার আপনার সাথে আর কেউ আসছে?’
‘না তো! কেন বলছ এ কথা?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘স্যার, ক্যাথেরিন স্ট্রিট থেকে একটা গাড়ি আমাদের পিছে পিছে আসছে। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত আমাদের সমান স্পীডে এসেছে। এখন স্পিড বাড়িয়ে নিকটবর্তী হচ্ছে।’ বলল ড্রাইভার।
আহমদ মুসা পেছনে তাকাল। দেখতে পেল একটা গাড়ির হেডলাইড। আহমদ মুসা খুশি হলো ড্রাইভারের উপরে। বলল, ‘ধন্যবাদ ড্রাইভার তোমার সর্তক দৃষ্টির জন্যে। তুমি যে গতিতে গাড়ি চালাচ্ছ, সেই গতি অব্যাহত রাখ! সত্যিই অনুসরণ করে থাকলে দেখা যাক ওরা কারা! পুলিশ তো নয় দেখাই যাচ্ছে।’
‘জি স্যার, পুলিশ নয়।’ বলল ড্রাইভার।
আহমদ মুসা পেছন থেকে দৃষ্টিটা ফিরিয়ে আনল ড্রাইভারের দিকে। বলল, ‘ড্রাইভার, তোমার ইংলিশ উচ্চারণ শুনে মনে হচ্ছে, ‘আরবের কোন দেশে তোমার বাড়ি।
‘জি স্যার আমি জর্দানী।’ বলল ড্রাইভার।
‘কতদিন তোমরা আছ?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘স্যার, বহুদিন। মাঝখানে টুইন টাওয়ারের ঘটনার পর আমার আব্বা আমাদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেশে ফিরে গিয়েছিলন। দেশে গিয়ে আব্বা মারা যান। এখন অবস্থা আগের চেয়ে ভালো বলে এক বছর আগে আমি ফিলাডেলফিয়ায় ফেরত এসেছি।’ বলল ড্রাইভার।
অবস্থা এখন ভালো মনে করছ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘জি স্যার। এই সরকারের আগের সরকারের আমল থেকেই অবস্থা ভাল হযেছে। তবে গত এক বছর হলো পরিস্থিতি একেবারে পাল্টে গেছে। স্যার, এজন্য আমরা আমেরিকার মুসলমানসহ দুনিয়ার সব মুসলমান আহমদ মুসার প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি মার্কিন সরকার ও মার্কিন জনগণের চোখ খুলে দিয়েছেন। মার্কিনীদের কাছে আমাদের সম্মান রাতারাতি একেবারে যেন আকাশচুম্বি হয়ে উঠেছে। তারা এখন মুসলমাদেরকেই প্রকৃত বন্ধু মনে করে।’ উৎসাহের সাথে আবেগ-ঘন কন্ঠে বলল ড্রাইভার।
‘ভাল খবর শুনালে ড্রাইভার। কিন্তু মার্কিনীরা শুধু তোমাদেরকেই ভালবাসে, না তোমাদের ধর্মকেও ভালবাসে, তোমাদের সংস্কার-সংস্কৃতিকেও ভালোবাসে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাল কথা মনে করে দিয়েছেন স্যার। এমন প্রশ্ন কেউ কখনও জিজ্ঞাসাই করে না। অথচ অকল্পনীয় সব ঘটনা ঘটেছে এ ক্ষেত্রেই। আপনি ফিলাডেলফিয়ার মুসলিম ‘সানডে’ স্কুলগুলিতে গিয়ে দেখুন স্কুলের দুই তৃতীয়াংশ ছেলেমেয়েই আমেরিকান খৃষ্টান পরিবারের। মুসলিম স্কুলগুলোতে নৈতিক শিক্ষা ভাল হয়, ভাল অভ্যাস গড়ে ওঠে বলে খৃষ্টান পরিবারও এখানে তাদের ছেলেমেয়ে পাঠায়।’ ড্রাইভার বলল।
‘কতগুলো ‘সানডে স্কুল’ আছে তোমাদের?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘শহরে দশটি মসজিদ আছে। দশটি মসজিদেই ‘সানডে স্কুল’ আছে। এছাড়া আরও দশ বারটা মুসলিম ‘সানডে স্কুল’ গড়ে উঠেছে শহরের বিভিন্ন জায়গায়।’ বলল ড্রাইভার।
‘আমেরিকানরা কি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে?’ আহমদ মুসা বলল।
বহু স্যার। প্রতি সপ্তাহে ফিলাডেলফিয়ার প্রত্যেক মসজিদে জুমুআর নামাজের পর চার পাঁচজন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ঘটনা ঘটেছে। স্যার, এই সপ্তাহে আমাদের মসজিদে ছয়জন ইসলাম গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে স্থানীয় খৃষ্টান চার্চের ফাদার ও একজন প্রফেসর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। খৃষ্টান চার্চটা ছয় মাস আগে বন্ধ হয়ে যায় কোন প্রার্থনাকারী যায় না বলে।’
থামল ড্রাইভার। একটা দম নিল। তারপর আবার বলে উঠল, ‘স্যার কি মুসলমান? এশিয়ান তো বুঝতেই পেরেছি।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগে ড্রাইভার আঁৎকে উঠার মত শব্দ করে চাপা কন্ঠে বলে উঠল, ‘স্যার রং সাইড নিয়ে সামনে থেকে একটা গাড়ি আমাদের দিকে ছুটে আসছে।’
আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়েছিল। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকাল সামনে। দেখল, ড্রাইভারের কথা ঠিক। আহমদ মুসাদের গাড়ির পথ রোধ করে গজ পাঁচেক সামনে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে।
আহমদ মুসাদের গাড়িকেও ড্রাইভার থামিয়ে দিয়েছিল। পেছনের গাড়িটাও পেছনে এসে দাঁড়িয়ে গেছে।
‘স্যার কি করব? আমরা পাশ কাটাতে চাইলে ওরা নির্ঘাত গুলী করবে।’ গাড়ি থামিয়েই বলে উঠল ড্রাইভার।
‘তুমি ঠিক সিন্ধান্ত নিয়েছ ড্রাইভার। দেখা যাক ওরা কে, কি চায়।’ বলল আহমদ মুসা।
থামার পরেই আগে পিছের দুগাড়ি থেকে চারজন দ্রুত নেমে এল। ছুটল তারা আহমদ মুসার গাড়ির দিকে।
‘ড্রাইভার গাড়ির জানালার কাঁচগুলো নামিয়ে ফেল। বন্ধ থাকলে ওরা ভেঙে ফেলতে পারে।’ বলল দ্রুতকন্ঠে আহমদ মুসা।
‘কিন্তু স্যার………………।’ কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল ড্রাইভার। বোধ হয় আহমদ মুসার নির্দেশের প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল। কিন্তু কি মনে করে থেমে গিয়ে সুইচ টিপে সব জানালার কাঁচ খুলে দিল।
ছুটে আসা ওরা চারজন দুজন করে আহমদ মুসার দুপাশের জানালায় এসে দাঁড়াল। তাদের প্রত্যেকের হাতে রিভলবার।
দু’পাশের জানালা থেকে দুজন আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ‘বেরিয়ে আসুন। এক মুহূর্ত দেরি করলে গুলী করব’।
‘দুদিক থেকেই বলছ, তোমরাই বল কোন দরজা দিয়ে বের হবো।’ শান্ত স্বাভাবিক কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
গাড়ি দাঁড়িয়েছিল রাস্তার অনেকটা বাম প্রান্ত ঘেঁষে। ডানেই প্রশস্ত মূল রাস্তাটা।
ডান দিকের দুজনের মধ্যে একজন রিভলবার নাচিয়ে বলল, ‘এদিক দিয়ে নাম।’ বলেই সে দক্ষিণ দিকের দুজনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমরা এদিক এস।’
সঙ্গে সঙ্গেই বাম পাশের দুজন দৌড় দিয়ে ডান পাশে চলে এল।
‘ড্রাইভার দরজার কী আনলক করেছ?’ ধীরে সুস্থে বলল আহমদ মুসা।
ওদের চারজনের মধ্যে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে দুজন এবং দরজার পিছন দিকে দাঁড়িয়েছে দুজন। দরজার পাল্লা খুলে সামনের দিকে যাবে বলে ওদিকে কেউ নেই।
আহমদ মুসা ড্রাইভারকে দরজা খোলার কথা বলার সাথে সাথে ক্লিক শব্দ করে দরজা খুলে গেল।
আহমদ মুসা দরজার দিকে ঘুরে বসে এগুলো দরজার দিকে।
হঠাৎ ওদের একজন চিৎকার করে উঠল, ‘দাঁড়াও।’
আহমদ মুসা থেমে গেল।
রিভলবার বাগিয়ে রেখেই সামনে থেকে একজন ছুটে এসে বলল, ‘তোমার কাছে রিভলবার আছে, ওটা দিয়ে দাও।’
‘তোমাদের চারজনের কাছে চার রিভলবার, এরপরও আমার এক রিভলবারের ভয় করছ।’ বিদ্রূপাত্মক হাসির সাথে একথাগুলো বলতে বলতে আহমদ মুসা পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে ওদের দিয়ে দিল।
রিভলবার হাতে নিয়ে লোকটা একটু পেছনে হটে আগের জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল।
সে যখন পেছনে হটছিল, তখন আহমদ মুসা দরজার দিকে এগুলো। দরজায় পৌঁছে পা দুটো দরজার প্রান্তে নিয়ে বাম হাত দিয়ে দরজা খুলে জোরে সামনের দিকে ঠেলে দিল। তার পরেই সে দুপায়ের উপর ভর দিয়ে দুহাত সামনে নিয়ে মাথাকে কিছুটা নিম্নমুখী করে বাইরে ড্রাইভ দিল। দুহাত তার মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে পা দুটি তার বিদ্যুত বেগে অর্দ্ধচন্দ্রাকারে ঘুরে গিয়ে সামনে পাশাপাশি দাঁড়ানো দুজনের বুকে আঘাত করল। ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল ওরা।
আহমদ মুসার পা দুটো ঘুরে গিয়ে মাটি স্পর্শ করতেই দুপায়ের দুমোজায় আটকানো রিভলবার বের করে নিয়ে ডান হাতের রিভলবার দিয়ে তাক করল গাড়ির দরজার পাশে দাঁড়ানো দুজনকে। তাদের একজনের কানের পাশ দিয়ে একটা ফাঁকা গুলী করে বলল, রিভলবার ফেলে দাও, না হলে পরের দুই গুলী দুজনের মাথায় ভরে দেব।’
আকস্মিক এই ঘটনায় তারা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। রিভলবার সমেত হাত তাদের নিচে ঝুলে পড়েছিল। কানের পাশ দিয়ে ফাঁকা গুলীটাও ম্যাজিকের মত কাজ করল। তারা তাদের হাতের রিভলবার একটু সামনে ছুড়ে ফেলে দিল।
ওদিকে মাটিতে ছিটকে পড়া দুজন উঠে তাদের হাত থেকে ছিটকে পড়া রিভলবার হাত করার জন্য এগুচ্ছিল।
আহমদ মুসার বাম হাতের রিভলবার তাদের দিকে তাক করা ছিল। আহমদ মুসা ওদের নির্দেশ দিল, আর এক ইঞ্চি এগুবে না। দুজনকেই লাশ বানিয়ে দেব।
ওরা দুজনেই থমকে গেল।
আহমদ মুসা এবার দুদিকে রিভলবার তাক করে রেখে পা দিয়ে রিভলবার চারটিকে এক জায়গায় নিল। তারপর ওদের চারজনকেই নির্দেশ দিল ওদের পেছনের গাড়িটার পাশে এসে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে।
যন্ত্রের মতই ওরা নির্দেশ পালন করল।
আহমদ মুসা পকেট থেকে ক্ষুদ্র একটা ক্লোরোফরম স্প্রেয়ার বের করে ওদের নাকে স্প্রে করল। তারপর কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষার পর ওদের সংজ্ঞাহীন দেহ ওদের গাড়িতে তুলে স্টাটার থেকে চাবিটি খুলে নিয়ে গাড়ির সব জানালা-দরজা বন্ধ করে লক করে দিল। তারপর গাড়িটাকে একটা গাছের অন্ধকারে ঠেলে দিল।
আহমদ মুসার ড্রাইভার বেরিয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল। তার চোখে বোবা বিস্ময়।
আহমদ মুসা তার দিকে চেয়ে বলল, ‘ড্রাইভার ঐ গাড়িটাকেও রাস্তার বাইরে ঠেলে দাও। পারবে।’
‘ইয়েস স্যার। বলে ড্রাইভার তখনি গাড়িটা রাস্তার বাইরে ঠেলে দিল।’
আহমদ মুসা ওদের গাড়ি লক করার আগে ওদের চারটি রিভলবারও ওদের গাড়িতে রেখে দিয়েছিল। কিন্তু গুলী বের করে নিয়েছিল।
আহমদ মুসা এসে গাড়িতে উঠে বসল।
ড্রাইভার এসে তার সিটে বসতেই আহমদ মুসা বলল, ‘একটু দেরি হয়ে গেল ড্রাইভার, ওখানে ঠিক সময় পৌঁছাতে পারলাম না। দেখ জোরে চালিয়ে পুশিয়ে নিতে পার কিনা!’
ড্রাইভারের মুখ হা হয়ে গেছে বিস্ময়ে। বলল, ‘স্যার আপনি দেরি হওযার জন্যে চিন্তা করছেন, কিন্তু এদিকে তো আপনি প্রাণে বেঁচে গেলেন। এই অবস্থায় আপনি প্রোগ্রাম বাতিলও করতে পারেন।’
‘আমি যদি প্রোগ্রাম বাতিল করি, তাহলে যারা আমাকে বাধা দিতে এসেছিল তারা জিতে যায়, উদ্দেশ্য তাদের সফল হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝেছি স্যার। কিন্তু গোয়েন্দারা আপনাকে বাধা দিতে এসেছিল কেন?’ বলল ড্রাইভার।
‘কাদের গোয়েন্দা বলছ? ওদের? কেমন করে বুঝলে ওরা গোয়েন্দা?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমাদের গোয়েন্দারা সাধারণত সাদা সার্টের সাথে কালো জুতা, কালো মোজা, কালো প্যান্ট এবং কালো হ্যাট পরে থাকে। আর কোন অফিসিয়াল অপারেশনে গেলে চার জনের টীম গিয়ে থাকে।’ বলল ড্রাইভার।
‘কিন্তু ড্রাইভার, ওরা গোয়েন্দা নয়। ওরা গোয়েন্দাদের ছদ্মবেশ পরেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেমন করে আপনি এতটা নিশ্চিত কথা বলছেন?’ ড্রাইভার বলল।
‘মার্কিন গোয়েন্দা ও পুলিশরা যে রিভলবার ও অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে তাতে একটা বিশেষ মার্কিং থাকে, এদের চারজনের রিভলবারে তা ছিল না। তবে বুট কালো বটে, কিন্তু বুটের কন্ডিশন পুলিশের মত নয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আল-হামদুলিল্লাহ, আপনি মারামারির মধ্যে এত কিছু খেয়াল করেছেন। আমি এই বৈশিষ্টের বিষয়ে জানিই না।’ বলে ড্রাইভার তাকাল আহমদ মুসার দিকে পেছনে ফিরে। বলল, ‘স্যার, সিনেমার আমি একজন আগ্রহী দর্শক। ফাইটিং যেভাবে শুরু হলো এবং শেষ হলো, তেমন দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি।’ বলেই একটু থেমেই সে আবার শুরু করল, ‘স্যার আপনার পরিচয় জিজ্ঞাসা করার অধিকার আমার নেই। আমার মাত্র একটি জিজ্ঞাসা। আমি বুঝতে পারছি, এশিয়া বা উত্তর আফ্রিকার কোন দেশে আপনার বাড়ি। আপনি মুসলিম কিনা?’
‘এটা জানার আগ্রহ কেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমার জীবনে এটা একটা অবিস্মরণীয় ঘটনাতো! ঘটনার নায়ক মুসলিম হলে গর্বের সাথে মানুষের কাছে গল্প করতে পারব। এ রকম সাহস ও বীরত্ব তো আমরা বহুদিন আগে হারিয়ে ফেলেছি!’ শেষ দিকে তার আবেগে কন্ঠ ভেঙে পড়ল।
ড্রাইভারের নিখাদ আবেগ আহমদ মুসাকেও স্পর্শ করল। আনমনা হয়ে পড়ল সেও। হঠাৎ করে তার সামনে যেন দুঃখ-বেদনা, লাঞ্ছনা-আপমানের কালো মেঘে ঢাকা এক দিগন্ত ভেসে উঠল। সে এক দীর্ঘ কালো রাত। রাজনৈতিক পরাধীনতা, সাংস্কৃতিক আধিপত্য, জ্ঞানের দেউলিয়াপানা মুসলমানদের চারদিক থেকে নিষ্পিষ্ট করেছে। তাদের অসহায় আর্তনাদ আকাশকে ভারী করেছে। সৃষ্টি হয়েছে কান্নার সমুদ্র। বহু বছরের দাসত্বে ভীরুতা-কাপুরুষতা হয়ে পড়েছিল তাদের চরিত্র-বৈশিষ্ঠ্য। ড্রাইভারের আবেগ রুদ্ধ কন্ঠ এই দুর্ভাগ্যের দিকেই ইংগিত করেছে। আহমদ মুসারও দুচোখের কোণ ভারী হয়ে উঠেছিল।
একটা নিরবতা নেমে এসেছিল। নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসা। বলল, ‘ড্রাইভার, আহমদ মুসা এই আমেরিকাতেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তুমিই তো বললে। তোমাদের অবস্থাও তিনি পাল্টে দিয়েছেন। তাকে নিয়ে তো গর্ব করতে পার।’
‘স্যার, তিনি তো জাতির গর্বের ধন। তার স্থান সবার মাথার উপরে, আকাশে। তাকে দেখার সৌভাগ্যও কোনদিন আমার হবে না। তাকে নিয়ে গর্ব করার মত কোন গল্প নেই। আজ যে গল্প সৃষ্টি হয়েছে, তা আমার জন্যে এক গর্বের কাহিনী।’ বলল ড্রাইভার।
‘হ্যাঁ ড্রাইভার, আমি তোমার এক ভাই।’
আল-হামদুলিল্লাহ, আল-হামদুলিল্লাহ। তাহলে অনেক আহমদ মুসা তৈরি হয়েছে। তার সাথে এসেছে এক উর্বর পরিবেশও আমাদের আমেরিকায়। আল-হামদুলিল্লাহ।’ আবেগ জড়িত কন্ঠে বলল ড্রাইভার।
গাড়ি হাইম হাইকেলের বাড়ি ক্রস করে চলে যাচ্ছিল।
‘ড্রাইভার গাড়ি থামাও। আমরা এসে গেছি।’ বলে আহমদ মুসা হাইম হাইকেলের বাড়ি দেখিয়ে দিল।
‘স্যরি’ বলে ড্রাইভার গাড়ি পিছিয়ে নিল। তারপর থার্ড স্ট্রিট থেকে নেমে প্রবেশ করল লাল পাথরে বাঁধানো প্রাইভেট রোডে।
এগিয়ে চলল গাড়ি হাইম হাইকেলের গেটের দিকে।

Top