৪. পামিরের আর্তনাদ

চ্যাপ্টার

জমাট অন্ধকার। এই জমাট অন্ধকারে সোলো সাগরের কাল বুক চিরে তীব্র বেগে এগিয়ে চলেছে একটি বোট। উপরে তারার দিকে চেয়ে দিক নির্ণয় করছে ড্রাইভার। শেডে ঢাকা একটি ম্লান আলোর সামনে রাখা মানচিত্র দেখে ড্রাইভারকে মাঝে মাঝে পথের নির্দেশ দিচ্ছেন আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার চোখে ইনফ্রারেড গগলস। এক সময় আহমদ মুসা মানচিত্র থেকে মুখ তুলল। দু’টি হাত উপরে তুলে আড়ামোড়া ভেঙে আহমদ মুসা চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। চেয়ারে মাথাটা ঠেকাতেই যন্ত্রণায় আহমদ মুসার মুখ থেকে একটা ‘উঃ’ শব্দ বেরিয়ে এল। আহত মাথাটার কথা ভুলেই গিয়েছিলেন আহমদ মুসা। আহত মাথাটার কথা মনে পড়ার সাথে সাথে কাগায়ানের চিত্র ভেসে উঠল আহমদ মুসার চোখে। প্রশান্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল বুক থেকে। সমস্ত মুসলমানদের সবচেয়ে বিপদপূর্ণ উত্তর মিন্দানাও অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ কাগায়ান দখলে আসায় অনেক সুবিধা হয়েছে। প্রায় দেড় লাখের মত মুসলমান তাদের হারানো বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে পারবে। একটি খোঁচা এসে লাগল আহমদ মুসার মনে। দেশের বাইরে থেকে আসা খৃষ্টানরা যারা মুসলমানদের সহায়-সম্পদ দখল করে বসে আছে, তারা তাহলে যাবে কোথায়? কুঞ্চিত হয়ে উঠল আহমদ মুসার
ভ্রুযুগল। ভাবলেন আহমদ মুসা, ওদরে ওপর কোন অবিচার করা যাবে না। তবে যারা ভূমি দখলের রাজনীতি নিয়ে মিন্দানাওয়ে এসেছে, তাদেরকে অবশ্যই মিন্দানাও ছাড়তে হবে। আর যারা দেশের অনুগত নাগরিক হিসাবে বাস করতে চায়, তাদের যোগ্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ওরা আমাদের ভাই না হোক, আল্লাহর বান্দা তো বটে! ওরা চিরদিনই পথ ভুলে থাকবে, একথা কে বলতে পারে? ওদের হৃদয় জয় করার, ওদের সামনে সত্য তুলে ধরার এই তো সময়! বিজিতের ওপর প্রতিশোধ না নিয়ে ওদের চিরতরে ভাই করে নেয়াই তো আমাদের কাজ -আমাদের ধর্ম।
সামনের আকাশ থেকে এক বিরাট নক্ষত্রের পতন হলো। আলোর এক বিরাট গুচ্ছ নিয়ে তা নেমে এসে সোলো সাগরের অন্ধকার বুকে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আহমদ মুসা চোখ থেকে ইনফ্রারেড গগলসটি খূলে বাঁ হাতে রেখে ডান হাতে চোখ দু’টি একটু রগড়ে তারকা খচিত আকাশের দিকে চোখ তুললেন। আদম সুরত গড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। দীর্ঘ ছায়াপথটি সোলো সাগর পার হয়ে যেন মালয়েশিয়ার মাথার ওপর গিয়ে ঝুলে আছে। আকাশ থেকে চোখ নামাতে পারলেন না আহমদ মুসা। অদ্ভূত প্রশান্তি আছে স্নিগ্ধ তারার আলোর সজ্জিত ঐ নিরব আকাশে। পৃথিবীর কোন দুঃখ-বেদনা আর সীমার পীড়ন সেখানে নেই। আহমদ মুসার অশরীরি চোখ ছুটে চলল এক তারার জগত পেরিয়ে আর এক তারার জগতে। সেখান থেকে আরও ওপরে আর এক তারার জগতে। কিন্তু শেষ নেই এ যাত্রার- শেষ নেই ভয়াবহ নিরবতা ঢাকা ঐ মহাশূণ্যের। কোথায় সেই ‘সিদরাতুল মুন্তাহা- আর কতদূরে? মহানবীর ‘বুরাক’ নেই, পথপ্রদর্শক জিবরাইলও তো নেই। এ মর-জগতে এ জিজ্ঞাসার জবাবও তাই আর নেই। অপরিসীম ক্লান্তি নিয়ে আহমদ মুসার চোখ দু’টি ফিরে এল মর্তের কঠিন মাটিতে।
আহমদ মুসা বাঁ হাতে রাখা ভাঙ্গা গগলসটি ডান হাতে নিয়ে পরতে যাবেন এমন সময় বোটের ড্রাইভার নূর আবদুল্লাহ বলল, ‘জনাব, মনে হচ্ছে একটা জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে’। নূর আবদুল্লাহর দৃষ্টি সামনে নিবদ্ধ। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
নূর আবদুল্লাহ মোটর বোটের গতি ডেড স্লো করে দিয়েছে। সামনের জমাট অন্ধকারটি একদম সামনে এসে গেছে। আহমদ মুসা সেটা ভালো করে নিরীক্ষণ করে বললেন, বোটের মুখ উপকূলের দিকে ঘুরিয়ে নাও আবদুল্লাহ্। কামানের পাশে দাঁড়ানো আবু ও সেলিমকে বললেন, দু’টো কামানের মুখই দক্ষিণ দিকে ঘুরিয়ে রাখ এবং তৈরী থাক।
নূর আবদুল্লাহ নিমেষে বোটের মুখ উপকুলের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। কিন্তু সংগে সংগেই সামনের সেই জমাট অন্ধকারের বুক থেকে আলোর বন্যা ছুটে এল। তীব্র সার্চ লাইটের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল চারিদিক। আহমদ মুসা আলোর উৎসের দিকে একবার চেয়েই নিদের্শ দিলেন-‘ফায়ার’।
আবু ও সেলিমের কামান দু’টো গর্জন করে উঠল। প্রবল এক ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল বোট। নির্ভুল নিশানা। অন্ধকারের সেই কাল জীবটির রক্তচক্ষু উড়ে গেল। আবার আঁধারে ঢেকে গেল চারদিক। কিন্তু সংগে সংগে পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর এই তিন দিক থেকে জ্বলে উঠল আরও তিনটি সার্চ লাইট। সেই সাথে ডেক মাইকে এক বিরাট গলা শোনা গেল, ‘পালাবার পথ নেই মিঃ মুসা, চারদিক থেকে চারটা জাহাজ ঘিরে ফেলেছে। আত্মসমর্পণ করলে খুশী হব।’
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে একবার চারটি জাহাজেরই অবস্থান দেখে নিলেন। দক্ষিণ এবং পূর্বে দাঁড়ানো জাহাজ দু’টির ফাঁক দিয়ে কাল জমাট অন্ধকার দেখা যাচ্ছে। ওটা উপকূল। আহমদ মুসার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক টুকরো হাসি। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে স্টিয়ারিং হুইলের দিকে এগুতে এগুতে বললেন, নূর আবদুল্লাহ, তুমি একটু সরে বসো।
নূর আবদুল্লাহ পাশের সিটে সরে গেল। আহমদ মুসা স্টিয়ারিং হুইল ধরে বসলেন সিটে। সিটে জুতসইভাবে বসতে গিয়ে মাথাটা আবার ঠোকা লাগল চেয়ারের সাথে। যন্ত্রণায় মাথাটা টনটন করে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাটা হজম করলেন তিনি। তারপর পকেট থেকে ডিম্বাকৃতি একটি জিনিস বের করে হাতে নিলেন। বাঁ হাতে ধরা স্টিয়ারিং হুইল। বোটের ইঞ্জিন বন্ধ ছিল। চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিলেন। দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বোটের মাথা ঘুরিয়ে নিলেন। দূরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে মনে মনে হিসেব করলেন, উপকূল দু’মাইলের বেশী হবে না। আহমদ মুসা একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, প্রিয় সাথীরা, চোখ বন্ধ করে দৌড় দেয়ার মত করে আমাদের সামনে এগুতে হবে। অতত্রব, সাবধান থাকবে।
কথা শেষ করার সাথে সাথে আহমদ মুসার ডান হাত বিদ্যুৎ গতিতে ওপরে উঠল। একটি ডিম্বাকৃতি বস্তু তীব্র গতিতে ছুটে গিয়ে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে বিস্ফোরিত হলো। ধোঁয়ার এক পাহাড় সৃষ্টি হলো। বোটাটি তীব্র এক ঝাঁকুনি দিয়ে তীর বেগে ছুটে চলল সামনে। জমাট ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে বোট এগিয়ে চলেছে। চারদিকে ধোঁয়ার দেয়াল। কিছুই দেখা যায় না। মেশিনগান আর কামানের গর্জন শোনা গেল। বোটের মাথা দক্ষিণ পূর্ব কোণে ঘুরিয়ে নেবার পর আহমদ মুসা স্টিয়ারিং হুইল যেভাবে ধরেছিল সেভাবেই কঠিন হাতে ধরে রেখেছেন। একটি কামানের গোলা এসে বোটের গা ছুঁয়ে পেছনে পড়ল। বোটটি লাফিয়ে উঠে ছিটকে পড়ল সামনে। আহমদ মুসা স্টিয়ারিং হুইলের ওপর ঝুঁকে পড়ে বসেছিলেন। হাত তাঁর বিন্দুমাত্র কাঁপল না। স্থির হয়ে আবার ছুটে চলল বোট। স্পিডোমিটারের কাঁটা নব্বই-এ দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছে। মেশিনগান ও কামান দাগার শব্দ এবার পেছন থেকে আসছে। আহমদ মুসা অনুভব করলেন জাহাজের বেষ্টনি তিনি পার হয়েছেন। উপকূলে ধাক্কা এড়াবার জন্য বোটের মুখ ডান দিকে ঘুরাতে গেলেই চার পাঁচ গজ দূরে সামনে আর একটি গোলা এসে বিস্ফোরিত হলো। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি বোটের মাথা আবার বাম দিকে ঘুরালেন। পুনরায় বোটের মাথা ডান দিকে ঘুরাতে যাবেন এমন সময় বোটটি প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে কিসের ওপর যেন উঠে গেল। আহমদ মুসা স্টিয়ারিং হুইলের ওপর মুখ থুবড়ে পড়লেন। জ্ঞান হারালেন। নূর আবদুল্লাহ সহ অন্য ছয়জন ক্রু বোটের পাটাতনের ওপর শুয়েছিল। তারা গড়াগড়ি খেল। ছোট-খাট আঘাত পেলেও মারাত্মক কোন ক্ষতি হলো না তাদের।
আল্লাহর অসীম রহমত, খাড়া উপকূলে ধাক্কা না খেয়ে বোটটি সমতল উপকূলের একটি চরে উঠে এসেছে।
পেছনে দেখা গেল, বিশাল তিনটি রক্তচক্ষু উপকূলের দিকে ছুটে আসছে । দূর থেকে ছুটে আসা আলোর রেখা ইতিমধ্যেই সাদা বালুর ওপর আলোর আল্পনা সৃষ্টি করেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওরা উপকূলে এসে পৌঁছবে।
নূর আবদুল্লাহ ইতিমধ্যেই সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসাকে পাটাতনের ওপর শুইয়ে দিয়েছে। কপালের এক জায়গা কেটে গেছে। সারাটা মুখ তাঁর রক্তে ভেজা। মাথার পুরনো ব্যান্ডেজটিও রক্তে ভিজে উঠেছে। সে আহত জায়গা থেকেও আবার নতুন করে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে।
নূর আবদুল্লাহ পেছনে তাকিয়ে দেখল ছুটে আসা হেড লাইট তিনটি উপকূল থেকে বেশী দূরে নয়। চর আলোকিত হয়ে উঠেছে। বোটের ওপর নিজের ছায়াও দেখতে পেল নূর আবদুল্লাহ। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা চলে না, নূর আবদুল্লাহ সিদ্ধান্ত নিল।
সামনে তাকিয়ে দেখল চরের পরেই বনের কাল রেখা। নূর আবদুল্লাহ সাথীদের দিকে চেয়ে দ্রুত বলল, গুলীর বাক্স,বন্দুক আর খাবার নিয়ে তোমরা সামনে জংগলের দিকে ছুটে যাও। মুসা ভাইয়ের ব্যাগ একজন নাও। বলে সে নিজে আহমদ মুসার সংজ্ঞাহীন দেহ ঘাড়ে তুলে নিল।
নূর আবদুল্লাহ দেখল সাথীরা সামনে অনেক দূর ছুটে গেছে। কিন্তু নরম বালুর ওপর দিয়ে সে খুব জোরে ছুটতে পারছে না। তাছাড়া সে ভয় করেছে, বেশী ঝাঁকুনি লাগলে আহত সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসার আরও ক্ষতি হবে। সুতরাং সে ঝাঁকুনির সৃষ্টি না হয় এমন সাবধানে দ্রুত পা ফেলে সামনে এগুচ্ছে।
চরের মাঝখানে এসে গেছে নূর আবদুল্লাহ। হঠাৎ এ সময় পেছন থেকে গুলীর শব্দ ভেসে আসতে লাগল। তার সাথে গর্জন করে উঠল কামানও। বন প্রায় সামনে এসে গেছে। নূর আবদুল্লাহ তাঁর পা দুটোকে দ্রুততর করে তুলল। হঠাৎ একটি গুলী এসে নূর আবদুল্লাহর উরুতে বিদ্ধ হলো। হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল নূর আবদুল্লাহ। বালিতে মুখ গুঁজে গেছে তার। মুহূর্ত খানেক সে নিশ্চলভাবে মুখ গুঁজে পড়ে রইল। তারপর মুখ তুলল সে। ডান হাত দিয়ে মুখ চোখ থেকে বালি সরিয়ে ফেলে সামনে তাকিয়ে দেখল, হাত দুই দূরে আহমদ মুসার সংজ্ঞাহীন দেহ পড়ে আছে।
উঠতে চেষ্টা করল নূর আবদুল্লাহ, পারল না। ডান পা’টা যেন পাথর হয়ে গেছে। বৃষ্টির মত গুলী ছুটে আসছে জাহাজের দিক থেকে। নূর আবদুল্লাহ চিন্তা করল, জাহাজ থেকে বোট নামিয়ে এখানে পৌঁছতে এখনও কিছুটা দেরী আছে ওদের। এই সময়টা এভাবে ওরা গুলী বৃষ্টি করে আমাদের সরে যাবার পথ রোধ করতে চায়। আর এই সময়টুকুর সদ্ব্যবহার করে যদি আমরা আহমদ মুসাকে নিরাপদ করতে না পারি, তাহলে ওদের হাত থেকে আহমদ মুসাকে রক্ষা করা যাবে না।
নূর আবদুল্লাহ সামনে তাকিয়ে দেখল তার সাথীরা বন প্রান্তে পৌঁছে গেছে। তাদের ডাকার জন্য সে নির্দিষ্ট নিয়মে এক তীক্ষ্ণ শীষ দিয়ে উঠল। মাত্র মুহূর্তকাল, তারপরেই দেখা গেল গুলী বৃষ্টি উপেক্ষা করে পাঁচজনই ছুটে আসছে।
তারা এসে পৌঁছতেই নূর আবদুল্লাহ তাদের বলল, এক মুহূর্ত বিলম্ব নয়, তোমাদের দু’জন আহমদ মুসাকে নাও। আর তিনজন প্রাচীরের মত তাদের আড়াল করে সামনে এগিয়ে যাও। মনে রেখো, জাম্বুয়াংগো এখান থেকে বেশী দূরে নয়। একবার জংগলে ঢুকতে পারলেই নিরাপদ হওয়া যাবে। ‘পিসিডা’র ভয়ে ওরা এই রাত্রে অন্ততঃ জংগলে ঢুকবার সাহস পাবে না। যাও দেরী করো না।
পাঁচজনের একজন কাসেম নূর বলল, কিন্তু আবদুল্লাহ ভাই আপনি? নূর আবদুল্লাহ বলল, আমার কথা চিন্তা করো না, জংগল পর্যন্ত পৌঁছতে পারব আমি। তোমরা যাও আমি আসছি। আহমদ মুসাকে নিয়ে ওরা চলল। নূর আবদুল্লাহ কনুই ও বাঁ হাটুর ওপর ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলল সামনে। সামনে তখন গুলী ও গোলা-বৃষ্টি চলছে। আশেপাশে নরম বালির বুকে ওগুলো এসে বিদ্ধ হচ্ছে। মাঝে মাঝে কামানের গোলা বিস্ফোরিত হয়ে বিরাট ক্ষতের সৃষ্টি করছে নরম মাটির মসৃণ বুকে।
অরণ্যের গভীর রাত। লাখো দীপ জ্বলা কালো আকাশের নীচে রাতের কালো চাদর মুড়ি দিয়ে কালো বন যেন গভীর ঘুমে মগ্ন। সেই কালো বনের আড়ালে ততোধিক কালো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একটা মসজিদ। মসজিদের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটি অপ্রশস্ত নদী। মসজিদের প্রশস্ত আঙিনা থেকে এক বাঁধানো ঘাট নদীর পানিতে নেমে গেছে। ঘাটটি ভাঙা -কোন কালের এক পাকা ঘাটের অস্তিত্ব টিকে আছে মাত্র। ঘাটে বাঁধা আছে দু’টি স্পিড বোট। দু’টি করে চারটি কামান পাতা। ছোট নদীটি দু’পারের গাছ-গাছড়ায় প্রায় ঢেকে আছে। ওপর থেকে মনেই হয় না কোন নদীর অস্তিত্ব আছে এখানে। মসজিদ ঘিরে একটি জনবসতি পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেছে কয়েক মাইল। নদীর পূর্ব পাড়েও আর একটি অনুরূপ জনবসতি। এটিও পূর্বদিকে কয়েক মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বনের মধ্যেই মাঝে মাঝে উন্মুক্ত তৃণক্ষেত্র ও শস্যের মাঠ। এই নদী ধরে আরো উত্তরে এগুলে জাম্বুয়াংগো প্রদেশের উত্তরে দাঁড়ানো পাহাড় পর্যন্ত আরও এধরনের বেশ কয়েটি জনপদ পাওয়া যাবে। সবগুলোই মুসলিম অধ্যুষিত। ফিলিপিনো সরকারের হিসাবের খাতায় কিন্তু এদের নাম নেই। জাম্বুয়াংগো সিটি সমেত পূর্ব ও পশ্চিম জাম্বুয়াংগোর মোট লোক সংখ্যার শতকরা মাত্র ১২ জন মুসলমান। এই ভাবেই সংখ্যাগুরু মুসলমান তাদের হাতে সংখ্যালঘু জাতিতে পরিণত হচ্ছে। মিন্দানাও এর মুসলমানদের সংখ্যা যেখানে আজ ৬০ লাখেরও বেশী সেখানে আজ তারা পৃথিবীকে জানাচ্ছে মুসলমানদের সংখ্যা ১৮ লাখের বেশী নয়। খৃস্টানদের সংখ্যা বেশী করে দেখানোর জন্য কি প্রাণান্ত কৌশল তাদের।
এই জনপদের নাম মাখদুম আল-খয়েরুদ্দিন। জাম্বুয়াংগো প্রদেশের এটা অন্যতম শক্তিশালী ‘পিসিডা’ ঘাঁটি। বিখ্যাত আরবীয় ধর্ম প্রচারক দরবেশ খয়েরুদ্দিনের নাম অনুসারে এই জনপদের নাম হয়েছে। মসজিদটি মাখদুম খয়েরুদ্দিনের মসজিদ নামে পরিচিত। মাত্র কয়েক মাস আগে ফিলিপিনের কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান বাহিনী এই জনপদে হামলা চালায়। তাদের বর্বর হামলায় মসজিদও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গোটা জনপদ পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু সেদিন আজ আর নেই। আহমদ মুসার পরিকল্পনা এবং এহসান সাবরীর তৎপরতায় ‘পিসিডা’র শক্তি আজ শতগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান চক্র সবখান থেকে বিতাড়িত হয়েছে। আজ তারা গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে রাজধানী জাম্বুয়াংগোয়। পিসিডার এক শক্তিশালী ঘাঁটি হিসাবে মাখদুম খয়েরুদ্দিন জনপদ আবার আজ নতুনভাবে গড়ে উঠেছে। অর্ধ ডজনের মত বিমান বিধ্বংসী কামানও রয়েছে এখন এই জনপদে। এখান থেকে বিশ মাইল পূর্বে জাম্বুয়াংগো সিটি থেকে পাঁচ মাইল পশ্চিমে জাম্বুয়াংগো প্রদেশের প্রধান পিসিডা ঘাঁটি লেনাডেলে এহসান সবরী থাকেন।
তখন রাত কতটা কে জানে? পূর্ব দিগন্তের আদম সুরত পশ্চিম আকাশে গড়িয়ে পড়েছে। মসজিদের পশ্চিম পাশে কাঠের একটি সুন্দর বাড়ি। টিনের চালা দেয়া শক্ত সমর্থ বাড়িটির একটি দরজা খুলে গেল। একজন দীর্ঘাঙ্গ মানুষ বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। একহাতে টর্চ, আর এক হাতে পানির বদনা। টর্চ জ্বেলে বাড়ির উঠানটা একবার তিনি ভালো করে দেখে নিয়ে উঠানের এক প্রান্তে গিয়ে অজু করতে বসলেন। অজু সেরে আবার উঠে এলেন ঘরে, টর্চ জ্বেলে দেয়াল ঘড়িটা একবার দেখলেন, রাত তিনটা।
তাহাজ্জুদের নামাযে দাঁড়ালেন লুকমান রশিদ। লুকমান রশিদ পিসিডা’র পশ্চিম জাম্বুয়াংগো প্রদেশের অধিনায়ক। এই মাখদুম খয়েরুদ্দিন ঘাঁটি থেকে তিনি পশ্চিম জাম্বুয়াংগো প্রদেশের ‘পিসিডা’ (PCDA- Pacicif Crescent Defence Army) বাহিনী পরিচালনা করেন।
লুকমান রশিদের ছয় রাকাত নামায শেষ হয়েছে। আবার নামাযে দাঁড়াতে যাবেন এমন সময় তাঁর কানে কামানের গর্জন ভেসে এল। তিনি উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন, হ্যাঁ, কামান দাগার শব্দ। একাধিক কামানের গর্জন। জানালা খুলে বুঝলেন দক্ষিণ দিক থেকে কামানের শব্দ ভেসে আসছে।
লুকমান রশিদ তাড়াতাড়ি খাটিয়া থেকে নেমে মাটিতে কান রেখে শব্দ পরীক্ষা করলেন। বুঝলেন দক্ষিণ সাগরের কোণে কয়েকটি জাহাজ থেকে কামান দাগা হচ্ছে।
লুকমান রশিদ আবার এসে জায়নামাযে দাঁড়ালেন। নামায আর না বাড়িয়ে শুধু বিতরটুকু পড়ে নিয়ে নামায শেষ করলেন।
জায়নামায তুলে রেখে দেয়ালে টাঙানো সাবমেশিনগানটি কাঁধে ফেলে বেরুবার জন্য ফিরে দাঁড়ালেন। লুকমান রশিদের স্ত্রীসহ পরিবারের সবাই ততক্ষণে উঠে বারান্দায় সববেত হয়েছে। সবাই প্রস্তুত। সবার পিঠেই এম-১৬ আমেরিকান রাইফেল। এই এম-১৬ রাইফেলগুলো কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান ও ফিলিপিনো সৈন্যদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া।
লুকমান রশিদ বের হতে হতে বললেন, জাহাজ থেকে তীরের দিক লক্ষ্য করে কামান দাগা হচ্ছে। দু’তিন মিনিটের মধ্যেই সংবাদ পেয়ে যাব। তোমরা অপেক্ষা কর। বলে লুকমান রশিদ বাড়ি থেকে বের হয়ে মসজিদে আসলেন। এসে দেখলেন, মসজিদের প্রশস্ত উঠান ভরে গেছে। সবাই সারিবদ্ধভাবে এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারো হাতে চাইনিজ, কারো হাতে আমেরিকান রাইফেল। মসজিদের দক্ষিণ পাশের বিরাট লম্বা ঘর খুলে দেয়া হয়েছে। ত্রিপলে ঢাকা ১৫০ ও ১০৫ এম. এম-এর বাঘা কামান ও মেশিনগানগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নদীতে স্পিড বোট দু’টোতে ক্রুরা নির্দেশের অপেক্ষা করছে।
লুকমান রশিদ এসে পৌঁছতেই সহকারী অধিনায়ক ফারুক আলী দ্রুত তার কাছে এল। বলল, তীরে সৈন্য নামানোর কি এটা ওদের পূর্ব প্রস্তুতি জনাব?
লুকমান রশিদ মাথা নেড়ে বলল, না ফারুক, তা মনে হয় না। এ ভাবে কয়েকবার সৈন্য নামিয়ে ওরা দেখেছে, খুব কমই তারা আবার জাহাজে ফিরে যেতে পেরেছে।
তাহলে? ফারুক আলী বলল।
লুকমান রশিদ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় অয়্যারলেস রুম থেকে জামিল এসে সামনে দাঁড়াল। বলল উপকূল আউট পোস্ট থেকে তারিক ভাই জানিয়েছেন, উপকূলের চারটি জাহাজ একটি বোটকে ঘিরে ধরে। কিন্তু বোটটি অদ্ভুত কৌশলে চারটি জাহাজের বেষ্টনি থেকে বেরিয়ে আসে। বোটের কয়েকজন লোক উপকূলে উঠে এসেছে। তাদের লক্ষ্য করে গুলী বৃষ্টি ও কামান দাগা হচ্ছে।
লুকমান রশিদের ভ্রু দুটি কুঞ্চিত হলো। দ্রুত কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঠোঁট দুটি ফাঁক করেই হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন। সবাই সেই সাথে কান পাতল। এক মর্মবিদারী তীব্র তীক্ষ্ণ সুর এক অদ্ভুত ছন্দময় গতিতে ভেসে আসছে। এটা ‘পিসিডা’র নিজস্ব মহাবিপদ সাইরেন। ‘পিসিডা’র কেন্দ্রীয় কমান্ডই একমাত্র এ সাইরেন বাজাবার অধিকার রাখে।
হঠাৎ লুকমান রশিদের মনে পড়ল, বিকেলে পাওয়া এহসান সাবরীর একটি মেসেজঃ আহমদ মুসা আজ রাতে জাম্বুয়াঙ্গো আসছেন। একথা মনে পড়ার সাথে সাথে লুকমান রশিদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ফারুক আলী, জরুরী অবস্থা ঘোষণা কর। আমি চললাম, সবাইকে নিয়ে তুমি উপকূলে এস। খোদা হাফেজ।
লুকমান রশিদ চোখের পলকে পাশের আস্তাবল থেকে একটি ঘোড়া টেনে নিয়ে এক লাফে তার ওপর উঠে বসলেন। এক অস্পষ্ট সরু পথ ধরে ঘোড়া তীরের মত এগিয়ে চলল উপকূলের দিকে।
ফারুক আলীর পাশেই আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল আবিদ আলী। সুইসাইড স্কোয়াডের অধিনায়ক সে। তার দিকে চেয়ে ফারুক আলী দ্রুত কন্ঠে বলল, তোমার স্কোয়াড নিয়ে ওঁর পেছনে যাও। আমরা আসছি। বলেই সে ছুটে গিয়ে বিউগল তুলে নিয়ে মুখে ধরল। এদিকে আবিদ ছুটল উপকূলের দিকে তার ছোট্ট বাহিনী নিয়ে।
লুকমান রশিদ ঘোড়ার পিঠে বসে অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। শিক্ষিত ঘোড়া প্রভূর ইংগিত বুঝে তীরের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তবু তাঁর মনে হচ্ছে ঘোড়াটা যেন ঠিকমত ছুটছে না। কিন্তু তিনি জানেন, প্রাণীটির সাধ্য এর বেশী নেই।
বন প্রায় শেষ। আর মিনিট খানেকের রাস্তা। তারপরেই বালুময় ছোট্ট বেলাভূমি। এরপরেই সাগরের নীল পানি। মর্মবিদরী সেই সাইরেন থেমে গেছে। চারদিক নিরব নিস্তব্ধ। শুধু সামনের সাগরের দিক থেকে একাধিক ইঞ্জিনের ভারী শব্দ ভেসে আসছে। লুকমান রশিদ পিঠ থেকে বন্দুকটি নামিয়ে নিয়ে ওপরের দিকে একটি ফায়ার করলেন। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তারপর বেলাভূমির দিক থেকে একটি ফায়ারের শব্দ ভেসে এল।
তারিকরা তাহলে পৌঁছে গেছে- মনে মনে বললেন লুকমান রশিদ। দেখতে পেলেন মাত্র একশ’ গজ দূরে বালুর ওপর কয়েকজন পড়ে আছে, আর কিছু দূরে তারিক ও তাজুল মুর্তির মত দাঁড়িয়ে।
লুকমান রশিদ এক লাফে ঘোড়া থেকে নেমে দৌড়ে গেলেন বালুর ওপর পড়ে থাকা লাশগুলোর কাছে। লাগালাগি হয়ে এক সারিতে চারটি লাশ বালুর ওপর পড়ে আছে। তারা সকলেই পেছন দিক থেকে গুলীবিদ্ধ। গুলীতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে তাদের শরীর। তাদের পেছনেই পড়ে আছে আর একজন। তার হাতে ইলেক্ট্রনিক সাইরেন ধরা। ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলটি সাইরেনের ক্ষুদ্র সাদা বোতাম থেকে একটু আলগা হয়ে গেছে মাত্র। লুকমান রশিদ ব্যাকুল ভাবে তাদের সকলকেই দেখলেন। না আহমদ মুসা নেই। লুকমান রশিদ এবার অসীম জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকালেন তারিকের দিকে।
অবনত মস্তক তারিক মাথাটা কিঞ্চিৎ উঁচু করে বলল, ওরা চার পাঁচটি বোটে করে তীরে নেমেছিল। ওরাই ধরাধরি করে একজনকে বোটে তুলে নিয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ বাকস্ফুরণ হলো না লুকমান রশিদের। কয়েক মুহূর্ত মাথা নিচু করে থেকে ধীরে ধীরে চোখ তুললেন সাগরের দিকে। দূরে সাগর বক্ষ আলোকিত করে কয়েকটি হেড লাইট পূর্বে জাম্বুয়াংগোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এক দৃষ্টে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন লুকমান রশিদ। তাঁর চোখে তখন আকুলতা নয়- আগুন।
তারপর চোখ নামিয়ে ফিরে তাকালেন তিনি বালুর ওপর পড়ে থাকা রক্তাপ্লুত লাশগুলির দিকে। তিনি গভীরভাবে তাদের নিরীক্ষণ করলেন এবং প্রত্যেকের স্টেনগান এবং রিভলভরের ম্যাগাজিন পরীক্ষা করলেন। একটি গুলীও তাদের খরচ হয়নি।
লুকমান রশীদ বললেন, তারিক দেখ, আত্মরক্ষার জন্য এঁরা একটি গুলীও ছোঁড়েনি। মনে হচ্ছে সবাই মিলে এঁরা একজন কাউকে যেন আগলে বা বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাকে আগলানোর দিকেই ছিল এঁদের লক্ষ্য, আত্মরক্ষা নয়। আত্মরক্ষা করতে চাইলে এঁরা এক জায়গায় এভাবে মারা পড়তে পারেন কিভাবে?
মুহূর্ত খানেক চোখ বুঁজে চিন্তা করে লুকমান রশিদ বললেন, হয়ত আহমদ মুসা আহত ছিলেন, চলবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। তা না হলে তাঁকে আগলানো বা বহন করার প্রশ্ন উঠবে কেন?
ফারুক আলী সব দলবল নিয়ে এসে পড়ল। উঠে দাঁড়ালেন লুকমান রশিদ। ফারুক আলীকে সব বলে নির্দেশ দিলেন, সাগরের এই বেলাভূমিতেই শহীদদের কবর দেয়ার ব্যবস্থা কর। স্বাধীন মিন্দানাওয়ের জন্য এই বেলাভূমি হবে এক প্রেরণার প্রতীক। সেনাপতিকে, আন্দোলনের নেতাকে নিরাপদ করার জন্য দলের সকলের এমন নিঃশেষে প্রাণ বিসর্জনের নজীর আমার জানা নেই ফারুক!
একটু থেমে আবার তিনি বললেন, আমি চললাম। বোটটি ঘাঁটিতে পৌঁছাবার ব্যবস্থা করো। আমার মনে হয়, আজকে সন্ধ্যার মধ্যেই আমাদের জাম্বুয়াংগো সিটিতে পৌঁছতে হবে। আমি যাচ্ছি এহসান সাবরীর সাথে আলোচনার জন্য।
লুকমান রশিদের ঘোড়া আবার ফিরে চলল আগের সেই সরু পথ ধরে। ভোরের স্নিগ্ধ তারা জ্বল জ্বল করছে পূর্ব আকাশে। এক মনোমুগ্ধকর সংগীতের মত ফজরের আযান ভেসে আসছে ‘পিসিডা’র উপকূলীয় পর্যবেক্ষণ ঘাঁটি থেকে।

Top