৪৩. পাত্তানীর সবুজ অরণ্যে

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসা কর্নেল সুরেন্দ্রের কাছে টেলিফোন সেরে মোবাইলটি জ্যাকেটের পকেটে রেখে গুহার গায়ে হেলান দিল। মনে মনে ভাবল, ১৫ মিনিট পরে সে যাত্রা করবে। তাহলে কর্নেল সুরেন্দ্ররা এবং সে একই সময়ে ‘মহাসংঘ’র আন্ডার গ্রাউন্ড ঘাঁটির মুখে প্রত্নতত্ব অফিস এলাকায় পৌছে যাবে। এদিকে তার ১৫ মিনিটের একটা বিশ্রামও হয়ে যাবে।
আহমদ মুসা তার গোটা শরীর ঢিলা করে চোখ বুঝল।
শুধু তার কানটাই সক্রিয় রইল। তার দুই কানে লাগানো ছিল ‘সাউন্ড মনিটরিং’-এর দুই রিসিভার। কি যেন ভেবে পনের মিনিটের জন্যে মনিটরিং-এর রিসিভার কান থেকে নামিয়ে নেবার জন্যে ওদিকে হাত বাড়াতেই হালকা শব্দে একটা কোরাস ভেসে এল তার কানে।
হাত সরিয়ে নিল আহমদ মুসা। রিসিভার থামাল না।
সোজা হয়ে বসে শব্দের কোরাস বুঝার চেষ্টা করল।
কিছুটা শোনার পর তার মনে হলো অনেকগুলো লোকের এক সঙ্গে চলার জমাট শব্দ এটা। শব্দগুলো ক্রমেই স্পষ্টতর হচ্ছে। তার মানে একদল লোক এদিকে এগিয়ে আসছে।
কথাটা মনে আসতেই তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। কারা আসছে? মহাসংঘ’র লোকরা নিশ্চয়। কিন্তু দল বেঁধে এদিকে আসছে কেন? ওদের একটা অংশ কি এখান থেকে চলে যাচ্ছে? বোট দুটো কি এজন্যেই প্রস্তুত রাখা হয়েছে? এটা কি ওদের রুটিন যাতায়াত? ওরা এক নম্বর নেভি ডকে সিবিআই-এর লোকদের আসা টের পায়নি তো?
আহমদ মুসা গুহা থেকে বেরিয়ে দ্রুত গাছ-পালা ও আগাছার আড়াল নিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠতে লাগল।
সামনের এলাকা নজরে আসে এমন জায়গায় উঠে একটা গাছের আড়ালে বসল। পাহাড়ের গা গাছ-গাছড়া ও নানারকম আগাছায় ঢাকা। আহমদ মুসা বসলে ঢেকে গেলো তার দেহ। ব্যাগ থেকে দূরবীণ বের করে চোখে লাগাল সে।
সামনের এলাকাটা এবড়ো-থেবড়ো পাথুরে জমি। ঘাস-আগাছায় ঢাকা। মাঝে মাঝে বড় গাছ আছে, কিন্তু তার সংখ্যা খুব বেশি নয়। সুতরাং সামনে বহুদূর দেখা যায়। দৃষ্টি সার্কেলের প্রান্ত পর্যন্ত।
দূরবীনের চোখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নেবার সময় হঠাৎ দূরবীনের চোখে ভেসে উঠল মানুষের সারি। যুদ্ধক্ষেত্রের ব্যুহের মত সারি বেঁধে এগিয়ে আসছে দশ বারোজন লোক। প্রত্যেকের হাতে কিছু লাগেজ এবং অস্ত্র। তার মধ্যে বেশ কয়েকজনের কাঁধে বড় বড় ব্যাগ। আর দুজন বহন করছে কফিনাকৃতির লম্বা একটি কাঠের বাক্স।
দূরবীনের চোখ এই গোটা দলের ওপর ঘুরে আসার আগেই স্নায়ু তন্ত্রীতে একটা শক ওয়েভ খেলে গেল। জেগে উঠল গোটা শরীর, শক্ত হয়ে উঠল গোটা দেহ।
হঠাৎ তার মনে জাগল, এই ঘাঁটি থেকে মহাসংঘের ওরা পালাচ্ছে শাহ আলমগীরকে নিয়ে। ওরা তাহলে অবশ্যই জেনেছে যে, নৌবাহিনীর ১নং ডকে সিবিআই-এর একটা দল নেমেছে, কিন্তু তারা বুঝতেও পেরেছে যে, সিবিআই-এর টার্গেট তাদের এই ঘাঁটি। এটা বুঝেই তারা পেছনের এই দরজা দিয়ে পালাবার জন্যে ছুটে আসছে।
আহমদ মুসা দূরবীন থেকে চোখ সরিয়ে নিল।
আনন্দের একটা অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করল। সে নিশ্চিত এই দলের মধ্যে রয়েছে আন্দামানের গভর্নর বালাজী বাজি রাও মাধব এবং আহমদ শাহ আলমগীর। কফিনের মত লম্বা কাঠের বাক্সটায় যে আহমদ শাহ আলমগীরকে বহন করা হচ্ছে, সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই।
আহমদ মুসার ভাবনা দ্রুত হলো।
প্রথমেই ভাবল ব্যাপারটা কর্নেল সুরেন্দ্রকে জানানো দরকার।
পকেট থেকে মোবাইল তুলে নিল হাতে। মোবাইল করল সিবিআই-এর কর্নেল সুরেন্দ্রকে।
সব শুনে কর্নেল সুরেন্দ্র বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার, আমরা ৫ মিনিটের মধ্যে যাত্রা করছি। কিন্তু স্যার, গাড়ি চলবে না। যতটা পারি আমরা দৌড়ে এগুবো। এতেও তো সময় লেগে যাবে। ওরা ততক্ষণে…………।’ দ্রুত, উত্তেজিত কণ্ঠ কর্নেল সুরেন্দ্রের।
আহমদ মুসা তার কথার মাঝখানেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘চিন্তা নেই কর্নেল। আমি ওদের আটকে রাখব। ওদের হত্যা নয়, সারেন্ডার করাবার চেষ্টা করতে হবে। এজন্যই আপনাদের তাড়াতাড়ি এখানে পৌছা প্রয়োজন।’
‘ওকে স্যার আমরা আসছি যতটা পারি দ্রুত।’ বলল কর্নেল সুরেন্দ্র।
‘ঈশ্বর সাহায্য করুন। বাই।’
মোবাইল পকেটে রেখে দিল আহমদ মুসা।
আবার চোখে দূরবীন লাগাল। দেখল ওরা আরও অনেকখানি পথ এগিয়ে এসেছে। ওরাও দ্রুত হাঁটছে।
দূরবীন চোখ থেকে নামাল আহমদ মুসা।
ওদের ঠেকানোর বিষয়টি মাথায় এসেছে।
ভাবছে সে। তার দরকার ফায়ারিং গান। কিন্তু তার ব্যাগে যে সাবমেশিনগান আছে, তা ছোট ম্যাগাজিনের এবং হালকা।
বোটে দেখা বাক্সগুলোর কথা মনে পড়ল আহমদ মুসার। ওগুলোর কয়েকটিতে হেভি মেশিনগান ও হেভি সাব-মেশিনগান রয়েছে। কিন্তু বোটে যাওয়া, আসা এবং অস্ত্রগুলো সংযোজন করার জন্যে যে সময় দরকার তা তার নেই।
হঠাৎ আহমদ মুসার মাথায় এল, সে বোট দুটোর নোঙর তুলে লেকের মাঝামাঝি কিংবা ওপারে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারে। বোট দখল তাদের জন্য অসম্ভব হবে। তখন তারা ফিরে যাবার চিন্তা করবে। ভাববে যে, দ্বীপের জংগলে আত্মগোপন করে সুযোগ মত পালাবে। কয়েকটা গোপন ঘাটে তাদের বোটও রাখা আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু তারা ফেরার পথে গিরিপথ পার হবার আগেই কর্নেল সুরেন্দ্ররা এসে পড়বে।
খুশি হলো আহমদ মুসা। ওদের ফাঁদে ফেলার এটাই সবচেয়ে ভাল উপায় হবে।
আহমদ মুসা পাহাড় থেকে নেমে এল।
গিরিপথ ধরে ফিরে চলল লেকের দিকে বোটের উদ্দেশ্যে।
গিরিপথ বড়, ছোট নানা সাইজের পাথরে ভরা। যাবার সময় ধীরে-সুস্থে গেছে খুব অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এখন তাড়াহুড়া করতে গিয়ে পথ চলাটা খুব কষ্টকর মনে হচ্ছে।
লেকের কিনারায় পৌছে আহমদ মুসা বোট দুটির নোঙর খুলে একটি আরেকটির পেছনে বাঁধল। বোট চালিয়ে নিয়ে গেলো লেকের মাঝখানে।
লেকের পানি যেমন শান্ত, নিস্তরংগ, তেমনি লেকের আবহাওয়াও একেবারে মৌন। লেকের তিন দিক জুড়ে পাহাড়। একদিক দক্ষিণ পাশটা মাত্র খোলা, তাও ঘন বনে ঢাকা। সুতরাং দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের দেয়াল না থাকলেও দাঁড়িয়ে আছে জংগলের প্রাচীর। এই জংগলের প্রাচীরকে দুভাগ করে একটা খাড়ি বেরিয়ে সাগরে গিয়ে মিশেছে। চার দিক এভাবে ঘেরা বলেই বাতাসের প্রবাহহীন স্থির, শান্ত লেকটা।
বোটগুলোও স্থির, শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
আহমদ মুসা বোটের কেবিনে ঢুকে বাক্সগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। সবগুলো বাক্সেই দেখল অস্ত্র। আহমদ মুসা বিশেষ ধলনের অটো রিভলবার রাইফেল বের করে নিল। এ রাইফেলে একবার ট্রিগার টিপলেই এক এক করে বারটি গুলী বেরিয়ে যায় যদি না অটো ষ্টপ ফাংশন অন করা থাকে। রাইফেলটির রেঞ্জও সাধারণ রাইফেল থেকে বেশি।
আহমদ মুসা রাইফেলটা নিয়ে কেবিনের দরজার পাশে বসল। এখান থেকে গিরিপথসহ লেকের উত্তর উপকূলের প্রায় গোটাটাই দেখা যাচ্ছে।
মোবাইলটা বেজে উঠল আহমদ মুসার।
মোবাইল কানের সামনে নিয়ে আসতেই কণ্ঠ শুনতে পেল সিবিআই কর্মকর্তা কর্নেল সুরেন্দ্রের।
‘হ্যালো কর্নেল, কোন খবর?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না মি. বার্গম্যান, খবর তেমন নয়। আমরা পুরাতত্ব অফিস মানে ওদের পরিত্যক্ত ঘাঁটি পর্যন্ত এসেছি। ওদের খবর কি?’ কর্নেল সুরেন্দ্র বলল।
‘আমি এখন লেকে। ওদের পালিয়ে যাবার বোট দুটি দখল করে লেকের মাঝ বরাবর নিয়ে এসে বসে আছি। মিনিট পনের ওদের খবর জানি না। তবে ওরা যে গতিতে আসছিল, তাতে আর পনের মিনিটের মধ্যে লেকের ধারে পৌছে যাবে। ওরা নিশ্চয় এখন গিরিপথের কাছাকাছি পৌছে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মি. বার্গম্যান, আপনি এনকাউন্টার নিয়ে কি ভাবছেন?’ কর্নেল সুরেন্দ্র বলল।
‘আমার ধারণা ওরা যখন লেকের ধারে পৌছবে, তখন আপনারা গিরিপথের মুখে পৌছে যাবেন। তখন ওরা বোট হাতের নাগালে না পেয়ে কি করে, সেটা দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। ভাল হয় যদি আপনি গিরিপথের মুখে এসে আমাকে একটা কল দেন।’
‘ওকে মি. বার্গম্যান। আমরা আরও দ্রুত গিরিপথের মুখে পৌছার চেষ্টা করছি।’
‘ওকে। বাই’ বলে আহমদ মুসা কল অফ করে দিল।
আহমদ মুসা মোবাইল পকেটে রেখে দুপা সামনের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বাক্সের স্তুপে ঠেস দিয়ে বসল।
দেহটাকে শিথিল করে দিল সে।
চোখ তার গিরিপথের দিকে নিবদ্ধ। কিন্তু তাতে শূন্য দৃষ্টি।
ভাবছে আহমদ মুসা।
ভাবছে সামনের এনকাউন্টার নিয়ে। কতটা সহজে আহমদ শাহ আলমগীরকে উদ্ধার এবং আন্দামানের গভর্নর বিবি মাধবসহ অন্যদের বন্দী করা যায়, এই চিন্তা এসে পেয়ে বসল আহমদ মুসাকে।
মনে মনে অনেক অংক কষার পর আহমদ মুসা এক নজরে বোঝার জন্য একটা ছক আঁকল। মনটা তার প্রসন্ন হয়ে উঠল। বিবি মাধবরা গিরিপথের এপ্রান্তে পৌছলেই কর্নেল সুরেন্দ্রকে এ একশন প্ল্যান সে জানিয়ে দেবে।

বিবি মাধবরা বারো জনের একটা দল।
মহামুনি শিবদাস সংঘমিত্র’র ছদ্মবেশে বিবি মাধব সবার সামনে।
মুখে তার লম্বা, গোঁফ, দাড়ি। গৈরিক রং করা। মাথায় গৈরিক পাগড়ী। গায়েও গৈরিক বসন। গলায় এক গুচ্ছ রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে চন্দনের তিলক।
ভাব-গাম্ভীর্য বজায় রেখে দ্রুতই হাঁটছে বলা যায়। দীর্ঘদেহী বিবি মাধবের দ্রুত হাঁটা অনেকের জন্যে ডবল মার্চের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মহামুনি শিবদাস সংঘমিত্র ওরফে গভর্নর বিবি মাধবের পাশাপাশি হাঁটছিল সাবেক জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি।
জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি আন্দামানে মহাসংঘের দ্বিতীয় ব্যক্তি এবং রস দ্বীপের ‘মহাসংঘ’ ঘাঁটির প্রধান। সে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আগাম অবসর দেয়া একজন মেজর। তার চরমপন্থী মতামতের জন্য তাকে আগাম অবসর দেয়া হয়। অবসর দেয়ার পরদিনই সে ‘শিবাজী সন্তান সেনা’য় যোগ দেয়। সেই সূত্রে এখন ‘মহাসংঘ’-এর প্রথম সারির নেতাদের একজন সে।
‘মহামুনি প্রভু, সিবিআই আমাদের এই ঘাঁটি তো দূরে থাক কোন ঘাঁটির খবরই জানতো না। আজ একেবারে আমাদের এই ঘাঁটিতে এসে হাজির! কিভাবে?’ বলল জেনারেল (অব) কৃষ্ণমূর্তি মহামুনি শিবদাস সংঘমিত্রকে লক্ষ্য করে।
‘এটা বিস্ময়ের নয়, এর চেয়ে বড় বিস্ময়ের হলো সিবিআই একবার এসে চলে গেল, আবার ফিরে এল কেন? আসলে সবকিছুর মূলে রয়েছে আমেরিকান নাগরিক ছদ্মবেশে আসা বিভেন বার্গম্যান। সেই নয়া দিল্লীস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও তাদের সরকারকে ম্যানেজ করে আমাদের সরকারকে কোনভাবে বুঝিয়ে সর্বনাশটা করেছে।’ বলল মহামুনি শিবদাস সংঘমিত্র ওরফে গভর্নর বিবি মাধব।
‘প্রভু আমাদেরও তো লোক আছে। তারা কি করল?’ জেনারেল (অব) কৃষ্ণমূর্তি বলল।
‘সিবিআই’-এর এই অপারেশন প্রধানমন্ত্রী নিজেই তদারক করছেন। কারুরই কিছু করার সুযোগ নেই।’ বলল বিবি মাধব।
‘বিপদ এভাবেই বোধহয় আরেকটি বিপদ ডেকে আনে। প্রভু, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি? আমার তো মনে হচ্ছে, আমাদের কোন ঘাঁটির সন্ধানই ওদের অজানা নেই।’
জেনারেল কৃষ্ণমূর্তির কথা শেষ হতেই থমকে দাঁড়াল বিবি মাধব। তাকাল সে জেনারেল কৃষ্ণমূর্তির দিকে। তার চোখ থেকে আগুন ছিটকে বেরুল। বলল, ‘আজ মাফ করে দিলাম। এই ধরনের হতাশার কোন কথা দ্বিতীয়বার শুনলে শুধু আমাদের সাথে চলার নয়, বেঁচে থাকারও অধিকার হারাবে।’
‘মাফ করুন গুরুজী।’ সঙ্গে সঙ্গেই কাঁচু-মাচু মুখে ভয় জড়িত কণ্ঠে বলল জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি।
কথা শেষ করেই জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি বলল, ‘গুরুজী আমরা গিরিপথটার মুখে এসে গেছি।’
‘অলরাইট। সবাই আমাকে ফলো করো। আমার পেছনেই আহমদ শাহ আলমগীরের বাস্কেটের সাথে তুমি থাকবে। সবাইকে দ্রুত আসতে হবে। ওরা যদি ঘাঁটির উপর চোখ রেখে থাকে, তাহলে আমাদের চলে আসা ওদের কাছে সংগে সংগেই ধরা পড়ে গেছে। তাহলে বুঝতে হবে অনেক আগেই ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে।’ গভর্নর বিবি মাধব বলল।
সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে সকলেই ছুটল।
লেকের ধারে প্রথমেই পৌছল বিবি মাধব।
লেকের দিকে চোখ পড়তেই এক রাশ বিস্ময় এসে তাকে গ্রাস করল। দেখল যে, এই ঘাটে নোঙর করা তাদের দুটি বোট লেকের মাঝখানে ভাসছে।
‘জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি, তুমি বোট দুটিকে ঠিকমত নোঙর করেছিলে? বোটগুলো ভেসে গেল কি করে?’ চিৎকার করে বলল বিবি মাধব।
জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি ছুটে এসে বিবি মাধবের পেছনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বলল, ‘প্রভু আমি বোট দুটো ভালভাবে নোঙর করেছিলাম। নোঙর আটকানো ছাড়াও চেন দিয়ে বেঁধেছিলাম পাথরের সাথে’
মহামুনিরূপী গভর্নর বিবি মাধব কোন জবাব দিল না। সে তাকিয়েছিল ভাসমান দুবোটের দিকে। ভাবছিল সে।
বোটের দিকে চোখ রেখেই হাতের ষ্টেনগানটা ফেলে দিয়ে ডান হাতটা পেছনে প্রসারিত করে বলল, ‘অটো রাইফেলটা দাও।’
জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি তার পিঠে ঝুলন্ত অটো রাইফেলটা বিবি মাধবের হাতে তুলে দিল।
রাইফেলটা হাতে নিয়ে বিবি মাধব দুটি বোট লক্ষে অবিরাম গুলী চালাল। বারটা গুলীর গোটা ম্যাগাজিন শেষ করল সে।
তারপরও কিছুক্ষণ চোখ রাখল সে বোট দুটির উপর। তারপর চোখ ফেরাল সে জেনারেল কৃষ্ণমূর্তির দিকে। বলল, ‘নিশ্চিত হলাম বোট খালি কিনা। লোক থাকলে গুলী বৃষ্টির জবাব আসত কিংবা লোকদের নড়াচড়ায় বোট দুলত অথবা বোট সরিয়ে নেবার উদ্যোগ নিত। কোন কিছুই হয়নি। আর লোক থাকলে তারা বোট নিয়ে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন! সুতরাং বোটে কেউ নেই।’
কথা শেষ করে মুহূর্তকাল থেমেই জেনারেল কৃষ্ণমূর্তিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি কয়েকজনকে পাঠিয়ে দাও। ওরা গিয়ে বোট দুটি নিয়ে আসুক।’
জেনারেল কৃষ্ণমূর্তির পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকা দুজন লোকের দিকে চোখ ফিরিয়ে সে বলল, ‘তোমরা যাও, কুইক। দুজন দুটো বোট চালিয়ে নিয়ে এসো।’
ওরা দুজন আহমদ শাহ আলমগীরকে রাখা কাঠের লম্বা বাক্সটি বহন করে এনেছিল। লেকের কিনারায় পৌছে ওরা বাক্সটি নামিয়ে রাখলো।
হুকুম পেয়েই ওরা তৈরি হলো।
ওরা লেকের পানিতে নামতে যাচ্ছিল। এই সময় মেশিনগানের অব্যাহত গুলীর শব্দ এল গিরিপথের উত্তর প্রান্তের দিক থেকে।
চমকে উঠল বিবি মাধব।
জেনারেল কৃষ্ণমূর্তির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওরা এসে গেছে। গিরিপথে ঢুকে গেছে। আক্রমণ করেছে ওরা আমাদের লোকদের।’
থামল বিবি মাধব। তার চোখ-মুখে সীমাহীন উদ্বেগ ও ভীতির চিহ্ন।
‘হ্যাঁ, গুরুজী ওরা এসে গেছে। বোটও কাছে নেই আমরা সরে পড়তে পারছি না। এখন আমাদের ওদের প্রতিরোধ করতে হবে।’ বলল জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি। তারও মুখে বিমূঢ় ভাব।
‘বোট আনা ও প্রতিরোধ দুই-ই আমাদের করতে হবে।’ গভর্ণর বিবি মাধব।
‘অতদূর থেকে বোট তীরে আনা পর্যন্ত নিরাপদ সময় আমরা পাব কিনা?’ বলল জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি।
‘ঠিক বলেছ জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি। তাহলে কি করা যায়?’ বিবি মাধব বলল।
‘গুরুজী আপনার নিরাপত্তার বিষয়টিই এখানে সবচেয়ে বড়। চলুন আমরা এ দুজনের সাথে বোটে চলে যাই। আপনি একটা বোটে অপেক্ষা করবেন, আমি আরেকটা বোট নিয়ে এসে এদের তুলে নিয়ে যাব।’ বলল জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি।
জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি যখন কথা বলছিল, তখন তাদের কয়েকজন লোক তীরে এসে পৌছল। এই সময় গিরিপথের উত্তর প্রান্তের দিক থেকে বোম ফাটারও শব্দ এল।
‘আমাদের লোকদের হাতে তো বোম নেই। তাহলে বোম ওরাই ফেলছে নাকি?’ উদ্বিগ্ন ও দ্রুত কণ্ঠে বলল বিবি মাধব।
‘ঠিক গুরুজী।’ বলল জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি।
‘তাহলে তো ওরা আরও দ্রুত এসে পড়বে।!’
‘হ্যাঁ প্রভু। আর দেরি করা ঠিক হবে না। আপনি পানিতে নেমে পড়ুন। আমি এদের কিছু নির্দেশ দিয়ে আসছি।’
জেনারেল কৃষ্ণমূতির কথা শেষ হবার সাথে সাথে বিবি মাধব গায়ের আলখেল্লা ও পায়ের জুতা খুলে ফেলে এবং গলায় ঝুলানো চাদর কোমরে বেঁধে পানিতে নেমে পড়ল।
ওরা চারজন সাঁতরে আসছে বোটের দিকে। বিবি মাধব সবার আগে। তারপর জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি। তাদের পেছনে মহাসংঘের সৈনিক দুজন এক সাথে সাঁতরাচ্ছে।
দেখা গেল বিবি মাধব ও জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি ভাল সাঁতরাতে পারে। ওরা পেছনের দুজনকে প্রায় আট-দশ হাত পেছনে ফেলে বোটের কাছে পৌছে গেল।
বোটে প্রথমে উঠল মহামুনি শিবদাস সংঘমিত্র’ ওরফে গভর্নর বিবি মাধব। তার পরেই জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি।
তারা উঠে বসে একটু রেষ্ট নিচ্ছিল আর দেখছিল তীরের পরিস্থিতি।
আহমদ মুসা কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেছে। তার দুহাতে দুটি রিভলবার।
আহমদ মুসা কেবিন থেকে বেরিয়ে দুতিন ধাপ আসতেই সম্ভবত বোট দুলে উঠা দেখেই বিবি মাধব ও জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি দুজনেই এক সাথে পেছনে তাকাল। তাদের দিকে তাক করা রিভলবার হাতে আহমদ মুসাকে দেখে তারা ভূত দেখার মত আঁতকে উঠল। তাদের আতংকিত বোবা দৃষ্টি যেন আটকে গেল আহমদ মুসার মুখে।
‘স্রষ্টাকে ধন্যবাদ। আপনাকেই নৌকায় চেয়েছিলাম বিবি মাধব। আপনার খেলা শেষ। এবার দুজনেই ডেকের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন।’ আহমদ মুসার কণ্ঠ এবার কঠোর।
মহামুনি শিবদাস সংঘমিত্রকে গভর্নর বিবি মাধব নামে সম্বোধন করায় জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি চোখ ছানাবড়া করে তাকাল তাদের নেতা মহামুনি শিবদাস সংঘমিত্রের দিকে। তার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। সে আহমদ মুসার দিকেও তাকাল। চোখে তার একরাশ প্রশ্ন, অবিশ্বাসও কিছুটা।
আহমদ মুসা তার কথাটা শেষ করেই জেনারেল কৃষ্ণমূর্তিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তাহলে তোমরা জাননা তোমাদের মহামুনি শিবদাস সংঘমিত্রই গভর্নর বিবি মাধব। তিনি আইনের লোক হয়ে ছদ্মবেশে তোমাদের নিয়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছেন।’
জেনারেল কৃষ্ণমূর্তির বিস্ময়ে বোবা হয়ে যাওয়া দৃষ্টি আবার ঘুরে গেল বিবি মাধবের দিকে।
গভর্নর বিবি মাধব কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে ঘুরে দাঁড়াবার ক্রুব্ধ ভাব নিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা রিভলবার নেড়ে ধমকে উঠে বলল, ‘কোন কথা নয়, আগে দুজনে উপুড় হয়ে ডেকের উপর শুয়ে পড়ুন।’
কিন্তু তারা ডেকে শুয়ে পড়তে ইতস্তত করছিল।
আহমদ মুসার বাম হাতে ধরা রিভলবারটা একটু নড়ে উঠল। গর্জন করে ওঠা রিভলবার থেকে একটা গুলী বেরিয়ে বিবি মাধবের কানটা প্রায় স্পর্শ করে ছুটে গেল।
সংগে সংগেই বিবি মাধব এবং জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি দুজনই শুয়ে পড়ল উপুড় হয়ে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে কয়েক খন্ড রশি বের করে জেনারেল কৃষ্ণমূর্তির দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘গভর্নর বিবি মাধবকে পা’সহ পিছ মোড়া করে বেঁধে ফেল।’
জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি ভয়ের সাথে তাকাল বিবি মাধবের দিকে। নির্দেশ পালনের কথা যেন সে ভুলে গেল।
নড়ে ওঠল এবার আহমদ মুসার ডান হাতের রিভলবার। গর্জে ওঠল আবার। একটা গুলী গিয়ে জেনারেল কৃষ্ণমূর্তির কানের একটা অংশ ছিড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি চিৎকার করে উঠে বসে রশি কুড়িয়ে নিয়ে গভর্নর বিবি মাধবের পা দুটি ও পরে পিছ মোড়া করে হাত দুটি বাঁধল।
‘বিভেন বার্গম্যান ওরফে আহমদ মুসা’, গর্জে উঠল গভর্নর বিবি মাধব, ‘মনে রেখ আমি শুধু আন্দামানের গভর্নর নই, আমি ভারতে একজন রাজনীতিক। তোমাকে এই আচরণের জন্যে চরম মূল্য দিতে হবে।’
‘আমার কথা পরে, আপনি নিজের কথা আগে ভাবুন বিবি মাধব। ভারতে সংবিধান এবং ভারতের জনগনের বিরুদ্ধে আপনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। অন্যান্য সব প্রমাণ যোগড় হয়েছে। আজ আপনাকে হাতে-নাতে ধরায় সবচেয়ে বড় প্রমাণ যোগাড় হয়ে গেল।’
আহমদ মুসা এ কথাগুলো বলছিল আর বাঁধছিল জেনারেল কৃষ্ণমূর্তিকে। বাঁধা হয়ে গেলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
তাকাল আহমদ মুসা সাঁতরে আসা বাকি দুই জনের দিকে। ওরা কূলের দিকে পালাচ্ছিল। আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তোমরা তীরেই যাও, বোটে জায়গা হবে না।’
আহমদ মুসা রিভলবার পকেটে রেখে মোবাইল বের করল। কল করার জন্য মোবাইল মুখের কাছে তুলে নিল। ওপার থেকে কর্নেল সুরেন্দ্রের কণ্ঠ পেয়ে বলল, ‘গুড নিউজ কর্ণেল মি. সুরেন্দ্র। পরিকল্পনা কাজ দিয়েছে। মহামুনি শিবনাথ সংঘমিত্র ওরফে গভর্নর বিবি মাধব একজন সংগীকে নিয়ে বোটে এসেছেন সাঁতরে। তাঁকে বন্দী করা হয়েছে। ওপার থেকে আপনার ভয় দেখানো খুব কাজ দিয়েছে।’
‘স্যার, এটা তো ছিল আপনারই পরিকল্পনা। ধন্যবাদ স্যার। এখন কি করণীয় বলুন। গুলী করতে করতে তীর পর্যন্ত কি আমরা এডভান্স করব?’ ওপার থেকে বলল সিবিআই-এর কর্নেল সুরেন্দ্র।
‘তাতে রক্তপাত হবে মি. সুরেন্দ্র। অনেক লোক মারা যেতে পারে। আমি অন্য চিন্তা করছি। বোটে মাইক্রোফোন আছে। আর ওরা প্রায় সবাই তীরে এসে দাঁড়িয়েছে এবং দুএকজন গিরিপথের এদিকের মুখ পর্যন্ত পৌছে গেছে। মাইক্রোফোনে আমি ওদেরকে আত্মসমর্পণের জন্যে আহবান জানাতে চাই। তাদের নেতা ধরা পড়ে গেছে। তারাও ধরা পড়ার অবস্থায়। তারা আত্মসমর্পণ করবে বলে মনে করি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি শান্তিপূর্ণ সমাধানের চিন্তা করছেন। ধন্যবাদ স্যার। আপনার আশা ব্যর্থ হলে তারপর আমরা অপারেশন শুরু করব।’ কর্নেল সুরেন্দ্র বলল।
‘মি. সুরেন্দ্র, এখন থেকে মিনিট খানেক পর আপনি আকাশের দিকে ফাঁকা গুলী ছুঁড়ে এদিকে এগুতে থাকবেন। ইতিমধ্যে ওদেরকে আত্মসমর্পনের আহবান জানানো আমার শেষ হয়ে যাবে। ফাঁকা গোলাগুলী ছুঁড়ে ঐভাবে আপনার অগ্রসর হওয়া অব্যাহত রাখবেন যতক্ষণ না আমি মোবাইল করি।
ধন্যবাদ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওকে স্যার।’ কর্নেল সুরেন্দ্র বলল।
মোবাইল পকেটে রেখে আহমদ মুসা জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি ওরফে ভাস্করের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘তোমার পরিচয় জানা হয়নি। তুমি কে? তোমার নাম কি?’
জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি এবার জবাব দিতে দেরি করল না। বলল, ‘আমার নাম জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সাবেক জেনারেল আমি। ‘মহাসংঘ’ এর রস দ্বীপের ঘাঁটির প্রধান।’
‘গুড।’ খুশি হলো আহমদ মুসা এই ভেবে যে, সর্বোচ্চ নেতা এবং এখানকার স্থানীয় নেতা দুজনেই ধরা পড়েছে। এতে ওদের আত্মসমর্পণ করানো সহজ হবে।
আহমদ মুসা বোটের পজিশন ঠিক-ঠাক করে নিয়ে হর্নটাকে তীরের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে মাউথ পীস মুখের সামনে ধরে উচ্চ কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘মহাসংঘের কর্মীবৃন্দ, আপনাদের শীর্ষ নেতা মহামুনি শিবদাস সংঘমিত্র এবং রস দ্বীপের ঘাঁটি প্রধান জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি ধরা পড়েছেন। তারা আমাদের হাতে বন্দী। আপনারও ঘেরাওয়ের মধ্যে আছেন। পেছন থেকে সিবিআই-এর সৈন্যরা আপনাদের ঘিরে ফেলেছে। সামনে লেক। পালাবার পথ নেই। অতএব আত্মসমর্পণই বুদ্ধিমানের কাজ। না হলে সবাই মারা পড়বেন। আমি আপনাদের আত্মসমর্পণের আহবান জানাচ্ছি, চিন্তা করার জন্যে পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। রাজি হলে সবাই গিয়ে সব অস্ত্র লেক-তীরের কাঠে বাক্সটার উপর রেখে হাত তুলে দাঁড়াবেন।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হওয়ার সংগে সংগেই গিরিপথের উত্তর প্রান্ত থেকে বন্দুক ও মেশিনগানের গর্জন ভেসে আসতে লাগল। আহমদ মুসা বুঝল কর্নেল সুরেন্দ্ররা ফাঁকাগুলী করতে করতে অগ্রসর হওয়া শুরু করেছে।
মিনিট তিনেক পার হলো।
এর পরেই দেখা গেল মহাসংঘের অস্ত্রধারী কর্মীরা এক এক করে গিয়ে কাঠের বাক্সটার উপর অস্ত্রপাতি রেখে সার বেঁধে হাত তুলে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা গুনে দেখল ওরা দশজন।
আহমদ মুসা জেনারেল কৃষ্ণমূর্তিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জেনারেল তোমরা মোট কজন এসেছ?’
‘আমাদেরসহ মোট বারজন।’ বলল জেনারেল কৃষ্ণমূর্তি।
‘ধন্যবাদ জেনারেল।’ বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে মোবাইল বের করল। কল করল কর্নেল সুরেন্দ্রের নাম্বারে।
ওপার থেকে কর্নেল সুরেন্দ্রের কণ্ঠ পেতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘কর্নেল মি. সুরেন্দ্র, ওরা আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছে। ওরা নির্দিষ্ট করে দেয়া জায়গায় অস্ত্র জমা দিয়ে এসে সবাই হাত তুলে দাঁড়িয়েছে। এবার দ্রুত আপনারা চলে আসুন।’
‘ধন্যবাদ স্যার, আপনার প্ল্যান কামিয়াব হয়েছে। আমরা আসছি।

আত্মসমর্পণকারী দশ জনকে সিবিআই জওয়ানরা পিছমোড়া করে বাঁধছিল, আহমদ মুসা দুই বোট তীরে এনে নোঙর করল।
বোট তীরে ভিড়তেই কর্নেল সুরেন্দ্র বোটে উঠল। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার মি. বিভেন, আমি ওদের বিশেষ করে গভর্নর স্যারের একটা ফটো নিতে চাই তিনি যে অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছেন, সে অবস্থায়।’
‘হ্যাঁ সেটা তো আপনার একটা আইনি প্রয়োজন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ইয়েস মি. বিভেন স্যার।’ বলেই কর্নেল সুরেন্দ্র তীরে দাড়ানো ক্যামেরাধারী একজনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমার ওদিকের ফটো নেয়া শেষ তো! এখন বোটে এসো, এদের ফটো নিতে হবে।’
নির্দেশ পেয়েই লোকটি বোটে উঠে এল।
গভর্নর বিবি মাধব এবং জেনারেল কৃষ্ণমূর্তিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘একসিলেন্সি মি. গভর্নর এবং জেনারেল স্যার আমার দায়িত্বের অংশ হিসেবে আমি আপনাদের ফটো নেব।’
ফটোগ্রাফার ক্যামেরা তাক করল গভর্নরের দিকে।
‘দাঁড়াও কর্নেল সুরেন্দ্র, তো…….।’ চিৎকার করে কথা বলতে যাচ্ছিল বিবি মাধব।
কর্নেল সুরেন্দ্র তাকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘একসিলেন্সি, দয়া করে আমাকে সরকারি কাজে বাধা দেবেন না। আপনি কথা বলুন, তাতে আমার আপত্তি নেই।
কর্নেল সুরেন্দ্র যখন কথা বলছিল, তখন সিবিআই ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা একের পর এক ক্লিক করে চলছিল।
‘আমি আন্দামানের গভর্নর। আমাকে এভাবে গ্রেফতার করতে পার না প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়ার অনুমতি ছাড়া।’ বলল বিবি মাধব ক্রুব্ধ কণ্ঠে।
‘প্রমাণ পেলে আন্দামানের যে কাউকে আমি গ্রেফতার করতে পারব, এ অথরিটি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাকে আন্দামানে পাঠিয়েছেন। তার উপর এই দশ মিনিট আগে প্রধানমন্ত্রীকে আমি সব কথা জানিয়েছি। তিনি প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে তার অনুমতি নিয়ে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আপনাকে গ্রেফতার করার জন্যে। তিনি আমাকে আরও জানিয়েছেন, ‘আন্দামান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে তাৎক্ষণিকভাবে আন্দামানের গভর্নরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’ কর্নেল সুরেন্দ্র বলল।
এ কথা শোনার সংগে সংগে গভর্নর বিবি মাধবের মুখ মলিন হয়ে গেল। তার চোখে-মুখে নামল উদ্বেগের গভীর ছায়া। বলল, ‘কর্নেল সুরেন্দ্র তোমার মোবাইলটা আমাকে দাও। আমি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলব। প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। এই বিভেন বার্গম্যান আমেরিকান পরিচয় দিয়ে সব কলকাঠি নেড়েছে। কিন্তু বিভেন বার্গম্যানকে তো প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং তোমরাও জান না।’
‘আমি জানতাম না একথা ঠিক একসিলেন্সি। কিন্তু এক মিনিট আগে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার সময় তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে, বিভেন বার্গম্যান আসলে আহমদ মুসা।’ বলল কর্নেল সুরেন্দ্র।
‘জানার পরেও প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা শুনেছেন? তোমরাও তাকে সহযোগিতা করছ?’ উচ্চকণ্ঠে বলল বিবি মাধব। তার কণ্ঠে হতাশার সুর।
‘একসিলেন্সি, আমরা তাকে সহযোগিতা করছি না, তিনিই দয়া করে আমাদের সহযোগিতা করছেন। আর প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা শুনবেন কেন? আন্দামানের প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে তারা সঠিক পদক্ষিপ নিয়েছেন। তিনি যদি এ ব্যাপারেও কোন সহযোগিতা করে থাকনে, সেটা তার শুভেচ্ছা।’ কর্নেল সুরেন্দ্র বলল।
‘তুমি ঠিক বলছ না। সে তার সম্প্রদায় মুসলমানদের স্বার্থে সব কিছু করেছে। আর……।’ বিবি মাধব কথা শেষ করতে পারল না। মাঝপথেই থেমে যেতে হলো।
কর্নেল সুরেন্দ্র বিবি মাধবের কথার মাঝখানেই বলে উঠল, ‘ব্যাপারটাকে ঐভাবে না দেখে বলুন যে, একদল মজলুম মানুষের স্বার্থে তিনি কাজ করছেন।’
‘তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ, আমরা জালেম?’ ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল বিবি মাধব।
‘আমি কিছুই বলছি না একসিলেন্সি। সে কথা আইন বলবে, বিচার বলবে।’ কর্নেল সুরেন্দ্র বলল।
‘বিচার কি বলবে? আমরা জাতির স্বার্থে কাজ করেছি। ব্যক্তি স্বার্থে কিছু করিনি আমরা।’
কর্নেল সুরেন্দ্রের ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘একসিলেন্সি আপনারা আমাদের অগ্রজ। একটা কথা বলি, একজনের সর্বনাশ করে আরেকজনের ‘পৌষ মাস’ আনা ভাল কাজ নয়, সব আইনেই এটা অপরাধ।’
কথা শেষ করেই কর্নেল সুরেন্দ্র আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘চলুন স্যার, আহমদ শাহ আলমগীরকে বাক্স থেকে উদ্ধার করতে হবে।’
আহমদ মুসা মনে মনে আহমদ শাহ আলমগীরের কথা ভেবে অধীর হয়ে উঠেছিল। কর্নেল সুরেন্দ্র নিজের থেকেই একথা মনে করায় খুশি হলো আহমদ মুসা। দুজনে বোট থেকে নেমে চলল বাক্সটার দিকে।
বাক্সের পাশে দাঁড়াতেই বুকটা দুরু দুরু করে উঠল আহমদ মুসার। কি অবস্থায় দেখবে সে আহমদ শাহ আলমগীরকে!
বাক্সের উপরের ঢাকনায় অনেকগুলো বড় বড় ফুটো। বাক্সের দুপাশে দেয়াল এবং পা ও মাথার দিকেও কয়েকটা করে বড় ফুটো। বুঝল আহমদ মুসা, আহমদ শাহ আলমগীরের বাঁচার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা না হয় এজন্যে বাক্সে ভালো ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাক্সটির দুপ্রান্ত প্লাষ্টিক দড়ি দিয়ে বাঁধা।
আহমদ শাহ আলমগীর সংজ্ঞাহীন, না সজ্ঞানে রয়েছে? ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ঝুঁকে পড়ল বাক্সটির উপর।
ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে প্রথমে জোরে একটি টোকা দিল। মুহূর্তকাল থেমে একই সাথে জোরে আরো একটি টোকা দিল।
এই টোকার ধরন আহমদ শাহ আলমগীরের কাছে পরিচিত। তাদের পরিবারে আঙুল বা কলিংবেল যাই হোক নক করার ক্ষেত্রে এই সংকেত ব্যবহার করা হয়। টোকার এই সংকেতের মাধ্যমে আহমদ মুসা আহমদ শাহ আলমগীরকে এই মেসেজ দিতে চাইল যে, সে এখন আপন পরিবেশে, শত্রুদের হাতে নয়।
আহমদ মুসা নক করার কয়েক মুহূর্ত পরেই ভেতর থেকে বাক্সের ঢাকনায় ঠিক আহমদ মুসার নিয়মেই তিনবার নক হলো।
অপার খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। কর্নেল সুরেন্দ্রও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিল। সে খুশি হয়ে আহমদ মুসাকে বলল,‘গুড নিউজ স্যার। আহমদ শাহ আলমগীর সজ্ঞানে এবং সচল অবস্থায় আছে। আপনার সংকেতের জবাব দিয়েছে সে। কিন্তু আপনার সাথে এ সহযোগিতা করল কেন সে? শত্রুর সংকেতে সে তো রেসপন্স করার কথা নয়।’
‘আমি তার ফ্যামেলী কোডে সংকেত দিয়েছি কর্নেল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝেছি।’ প্রসন্ন মুখে কথাটা বলেই কর্নেল সুরেন্দ্র কোমরের বেল্টে ঝুলানো খাপ থেকে ছুরি বের করে দু’প্রান্তের বাঁধন কেটে দিল।
আহমদ মুসা দুহাত দিয়ে বাক্সের উপরের ঢাকনা তুলে বন্ধনের এক প্রতীক অর্গলটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
আহমদ মুসার চোখ দুটি গিয়ে স্থির হলো অপার প্রত্যাশিত আহমদ শাহ আলমগীরের মুখের উপর। অনিয়ন্ত্রিত, অগোছালো লম্বা দাড়ি-গোফ এবং মাথা থেকে নেমে আসা বিশৃঙ্খল লম্বা চুলে মুখ প্রায় ঢেকে গেছে। কালোর মধ্যে মুখের সাদা দীপ্তি এবং উজ্জ্বল চোখ দেখতে পেল আহমদ মুসা। শবাসনে থাকার মত চিৎ হয়ে সে শুয়ে ছিল। তার প্রলম্বিত হাত দুটি লম্বাভাবে দেহের উপর রাখা ছিল।
আহমদ শাহ আলমগীরের চোখ চার দিকে ঘুরে এসে আহমদ মুসার মুখের উপর স্থির হলো। ধীরে ধীরে তার চোখে ফুটে উঠল সাত রাজারধন কুড়িয়ে পাওয়ার এক আনন্দ।
আর আহমদ মুসার চোখে অবশেষে আহমদ শাহ আলমগীরকে ঘিরে পাওয়ার অশ্রুঘন এক আবেগ।
শোয়া থেকে তাকে তুলে আনার জন্যে আহমদ মুসা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
আহমদ শাহ আলমগীরের ডান হাত উঠে এল। কাঁপছিল তার হাত। অপুষ্টিতে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার হাতের চামড়া। হাতের আঙুলগুলো অনেকটাই শিথিল।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে ফেলল। আহমদ শাহ আলমগীরের বাম হাত উঠে এল এবং আঁকড়ে ধরল আহমদ মুসার হাত।
আহমদ মুসা তাকে টেনে তুলল এবং জড়িয়ে ধরল। আহমদ শাহ আলমগীরও আহমদ মুসাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
‘তুমি ঠিক আছ আহমদ শাহ আলমগীর?’ নরম কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘আমার সব দুঃখ, সব বেদনা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। আমি আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরতে পেরেছি। তিনি আমাকে উদ্ধার করতে এসেছেন, উদ্ধার করেছেন।’ অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল আহমদ শাহ আলমগীর। তার শেষ কথাগুলো কান্নায় ভেঙে পড়ল।
আহমদ মুসা নরমভাবে আহমদ শাহ আলমগীরকে পিঠ চাপড়ে সান্তনা দিল। বলল, ‘আমি আহমদ মুসা তুমি কি করে জানলে?’
‘আপনি বিভেন বার্গম্যান, ওরফে আহমদ মুসা। আপনার সব কথাই ওরা গল্প করতো এবং বলতো, ‘আহমদ মুসা আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে সত্য, তবে আহমদ মুসা কেন তার বাবাও পারবে না তোকে উদ্ধার করতে। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম।’
আহমদ মুসা আহমদ শাহ আলমগীরকে একটু উঁচু করে বাক্সের বাইরে নিয়ে এল। বলল, ‘তোমার কাছ থেকে অনেক কথা শোনার আছে। চলো আগে বোটে, হাঁটতে পারবে?’
আহমদ শাহ আলমগীর কিছু বলার আগেই পাশ থেকে সিবিআই কর্নেল বলল আহমদ মুসাকে, ‘স্যার শাহ সাহেবের বাক্সে শোয়া অবস্থায় একটা ফটো নেয়া হয়েছে, বাক্সের পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় একটা ছবি নিতে চাই স্যার।’
‘অবশ্যই, আপনার আইনের জন্যে যা যা প্রয়োজন, তা অবশ্যই করবেন।’
বলে আহমদ মুসা আহমদ শাহ আলমগীরকে বাক্সের পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে সরে এল।
কিন্তু আহমদ শাহ আলমগীর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। টলে উঠল তার দেহ।
সিবিআই-এর ক্যামেরা ক্লিক করে উঠল।
বাক্সের পাশে টলায়মান আহমদ শাহ আলমগীরের দেহটাই ক্যামেরাবন্দী হয়ে গেল।
আহমদ মুসা এবং কর্নেল সুরেন্দ্র দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলল আহমদ শাহ আলমগীরকে। পড়ে যাওয়া থেকে বেঁচে গেল সে।
‘স্যার এঁর দেহের কাঠামোটা শুধু ঠিক আছে, দীর্ঘ নির্যাতন তাঁর দেহের আর কিছু বাকি রাখেনি। দেখুন দুই হাতের কব্জিই ক্ষত-বিক্ষত। মনে হয় ভেতরে ঘা এখনও কাঁচা আছে। বাহুতেও দেখুন অনেক কালচে দাগ। কাপড়ের নিচে দেহের অবস্থা যে কি ঈশ্বর জানেন।’ বলল কর্নেল সুরেন্দ্র।
‘আল্লাহর অশেষ প্রশংসা কর্নেল। তাদের এতসব নির্যাতন ব্যর্থ হয়েছে। নির্যাতনের ভয়াবহ শক্তিকে পরাজিত করতে পেরেছে আহমদ শাহ আলমগীর। ওরা যা চেয়েছিল তার কাছ থেকে তা পায়নি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কারণ সম্ভবত এই যে, তার দেহের শক্তি যত কমেছে, মনের শক্তি তত বেড়েছে।’
কথা শেষ করেই কর্নেল সুরেন্দ্র বলল, ‘স্যার চলুন একে তাড়াতাড়ি বোটে নিয়ে যাই। কিছু খাওয়াতে হবে। আমাদের কাছে চা, জুস ও শুকনো খাবার আছে।’
‘হ্যাঁ চলুন। সত্যই ওকে খাওয়ানো প্রয়োজন। কখন খেয়েছে কে জানে? আর তাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাবার তাকে দেয়া হয়নি।’ আহমদ মুসা বলল।
দু’জনে দুদিক থেকে ধরে আহমদ শহা আলমগীরকে বোটে তুলল।
বোটের কেবিনে বিছানা পাতাই ছিল।
আহমদ শাহ আলমগীরকে অজু করিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল আহমদ মুসা।
একজন সৈনিককে নিয়ে প্রবেশ করল কর্নেল সুরেন্দ্র। কর্নেল সুরেন্দ্রের হাতে পানির একটি বোতল, জুসের ক্যান এবং সৈনিকের হাতে পেপার প্লেটে শুকনো খাবার ও চা।
আহমদ শাহ আলমগীরকে খাবার দিয়ে কর্নেল সুরেন্দ্র আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার ওদিকের একটা ব্যবস্থা করতে হয়। কে কিভাবে আমরা যাব ঠিক করে ফেলতে হয়।’
‘দিল্লী কি বলছে?’
‘দিল্লী থেকে সিবিআই এর একটা টীম পোর্ট ব্লেয়ারে আসছে, তারা গভর্নর বিবি মাধবকে দিল্লী নিয়ে যাবে। আর অন্য সব বন্দীরা এখানে থাকবে। তাদের জিজ্ঞাসাবাবদ করে মহাসংঘের সব তথ্য জানতে হবে। ‘মহাসংঘে’র সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
‘নাইস। বন্দীদের নিয়ে সবাই এক সাথে যেতে পারলে ভাল হয়। আমাদের দুটি বোট আছে। তৃতীয় একটি বোট ডোবানো আছে, এ বোটেই আমি এসেছিলাম। তিনটি হলেও এক সাথে আমরা যেতে পারছি না। এই……….।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই কর্নেল সুরেন্দ্র বলে উঠল, ‘স্যরি স্যার মাঝখানে কথা বলার জন্যে। এক সাথে আমরা যাচ্ছি না। আমার সহকারী মেজর বীরবল সৈনিকদের নিয়ে এখানে থাকছে। আমরা মাত্র জনাছয়েক সৈনিক ও বন্দীদের নিয়ে এখন পোর্ট ব্লেয়ারে যাব। মেজর বীরবলরা মহাসংঘের রস দ্বীপের ঘাঁটি সার্চ করে তথ্য প্রমাণাদি যা পায় তা নিয়ে পরে পোর্ট ব্লেয়ারে যাবে। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে পুলিশ আসার জন্যেও তাদের কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। ঘাঁটির দায়িত্ব পুলিশের হাতে ন্যাস্ত করার আগে তারা যেতে পারবে না।’
‘ওকে কর্নেল, সঠিক সিদ্ধান্ত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার। তাহলে ওদিকটা দেখি। সব ব্যবস্থা করে ফেলি।’ কর্নেল সুরেন্দ্র বলল।
‘ওকে কর্নেল।’
কর্নেল সুরেন্দ্র উঠে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
খাওয়া শেষ করেছে আহমদ শাহ আলমগীর।
খাবারের অবশিষ্ট নিয়ে বেরিয়ে গেল সৈনিকটি।
সৈনিকটি বেরিয়ে যেতেই আহমদ শাহ আলমগীর পশ্চিম দিকে ঘুরে সিজদায় পড়ে গেল। দীর্ঘক্ষণ সিজদায় থাকল।
সিজদা থেকে উঠে সালাম ফিরিয়ে ঘুরে বসল আহমদ মুসার দিকে।
তার চোখে অশ্রু। বলল সে, ‘আপনার আন্দামানে আগমন অকল্পনীয় এক ব্যাপার। আল্লাহর অসীম দয়া। আমার এবং আমাদের সাহায্যের জন্যেই আপনাকে তিনি এখানে এনেছেন। যাদের কেউ থাকে না, আল্লাহ বোধ হয় এভাবেই তাদের সাহায্য করেন।’ কান্না জড়ানো কণ্ঠ আহমদ শাহ আলমগীরের।
‘অবশ্যই।’ বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে মোবাইল বের করল। বলল, ‘তোমার আম্মা, শাহবানু, সুষমার সাথে কথা বলো। ওঁরা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আছে।’
‘আমার মা-বোন এবং পরে সুষমাকে কিডন্যাপ করেছে আমাকে কথা বলতে বাধ্য করার অস্ত্র হিসাবে এটা আমি ওদের কাছেই শুনেছি। আবার ওঁরা তাদের হাতছাড়া হয়েছে, সে কথা বলেও তারা আমাকে নির্যাতন করেছে। আমি তখনই বুঝেছি, আপনিই তাদের উদ্ধার করেছেন।’ বলল আহমদ শাহ আলমগীর।
আহমদ মুসা মোবাইল কল করতে করতে বলল, ‘ধর তাদের যদি তোমার সামনে নিত আর তাদের নির্যাতন করতো, তাহলে কি ওদের প্রার্থীত তথ্য দিয়ে দিতে ওদেরকে?’
‘আমার বলার কিছু ছিল না। ওরা যা জানতে চায় আমিতা জানি না।’ আহমদ শাহ আলমগীর বলল।
‘শোন আহমদ শাহ আলমগীর, ঐ বিষয়টা কি? তা জানার খুব ইচ্ছা আমারও। কোন তথ্য বা কি তোমার কাছে ওরা জানতে চাচ্ছিল?’ বলল আহমদ মুসা দ্রুতকণ্ঠে এবং আগ্রহের সাথে।
‘জি, সেটা এক বাক্সের কথা।’ বলতে শুরু করল আহমদ শাহ আলমগীর, ‘বাক্সটিতে না কি আছে…………।’
আহমদ মুসা হাত তুলে ইশারা করে থামতে বলায় থেমে গেল আহমদ শাহ আলমগীর।
আহমদ মুসা মোবাইলে কল পেয়ে গিয়েছিল। কথা বলতে শুরু করেছিল।
…………..আমি ভাল আছি, আহমদ শাহ আলমগীর ভাল আছে। খালাম্মাকে ডাক। আহমদ শাহ আলমগীরের সাথে কথা বল।’
আহমদ মুসা মুখ থেকে মোবাইল সরিয়ে আহমদ শাহ আলমগীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘শাহবানুর সাথে কথা বল। খালাম্মা আসছে। এঁদের সাথে কথা শেষ কর, তারপর সুসমার সাথেও লাগিয়ে দেব।’
আহমদ শাহ আলমগীরের চোখ-মুখ মুহূর্তেই আনন্দ-আবেগে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে দ্রুত হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিল।
আহমদ মুসা তার হাতে মোবাইল তুলে দিয়ে বলল, ‘তুমি কথা বল, আমি এখুনি আসছি।’
বলে আহমদ মুসা বোটের কেবিন থেকে বেরিয়ে এল। আহমদ মুসা চাইল, আহমদ শাহ আলমগীর সংকোচহীন পরিবেশে প্রাণখুলে কথা বলুক। সুষমার সাথে আহমদ শাহ আলমগীরের কথা বলার অবস্থা কেমন হবে, সেটাও ভাবনায় এল আহমদ মুসার। কান্না ও বাঁধভাঙ্গা আবেগের বন্যা নিশ্চয় দুজনের কণ্ঠই রুদ্ধ করে দেবে। এই না বলার মধ্যেই তাদের সব বলা হয়ে যাবে।

Top