৪৩. পাত্তানীর সবুজ অরণ্যে

চ্যাপ্টার

হাজী আবদুল আলী আবদুল্লাহর বিশাল ডাইনিং রুম। ডিম্বাকৃতি বিশাল টেবিলটি মেহমানদের জন্যে সুন্দর করে সাজানো। সব রেডি। মেহমানরা আসলেই খাদ্য পরিবেশন করা হবে। হাজী আবদুল আলী আবদুল্লাহ এবং তার স্ত্রী ঘুরে ঘুরে সব ঠিক-ঠাক আছে কিনা দেখছে।
ডাইনিংটি সাগরের তীর ঘেঁষে। ডাইনিং রুম লম্বালম্বি। পুব ধারটায় কাঁচের দেয়াল। কাঁচের ভিতর দিয়ে বিশাল আন্দামান সাগরের বিস্তীর্ণ অংশ দেখা যায়। কাঁচের দেয়ালের উত্তর প্রান্ত ঘেঁষেই একটা ল্যান্ডিং। সেখান থেকে একটা সিড়ি উঠে গেছে দুতলায়। ডাইনিং-এর জন্যেই সম্ভবত এই সিঁড়িটা ব্যবহার করা হয়। সিঁড়ির এই ল্যান্ডিংটার পূর্ব প্রান্তে একটা দরজা। দরজাটা খুলেই দেখা যাবে একটা পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে সাগরের পানিতে। পানির লেভেলে সিঁড়ির সাথে একটা সুন্দর বোট বাঁধা।
টেবিলের চারদিক এবং গোটা ব্যবস্থা পরিদর্শন শেষ করে হাজী আবদুল আলী আবদুল্লাহ এবং বেগম হাসনা আবদুল্লাহ দুজন এসে একটা সোফায় পাশাপাশি বসল।
বসেই হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে হাজী আবদুল্লাহ বলল, ‘আহমদ মুসা তো এতক্ষণ এসে পৌছার কথা।’
‘বাছাকে কোন টাইম ফ্রেমে বাঁধা চলে না। যে নিজে নিজের নিয়ন্ত্রক নয়, সে কোন নিয়মের মধ্যে নিজেকে বাঁধবে কি করে?’ বলল বেগম হাসনা আবদুল্লাহ।
‘আমাদের সবার জীবনই তো আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। ফল বা রেজাল্ট যা কিছু তাঁর কাছ থেকেই আসে। কিন্তু কাজ করার পরিকল্পনার অধিকার তো তিনি মানুষকে দিয়েছেন। কাজ হলে ফল তিনি মানুষকে দেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে নিজের জন্যে রুটিন তৈরি করার এক্তিয়ার মানুষের রয়েছে। এ এক্তিয়ার আল্লাহ আহমদ মুসাকে একটু বেশি দেবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।’ হাজী আবদুল্লাহ বলল।
‘ধন্যবাদ। ঠিক বলেছ।’
কথার সাথে সাথে বেগম হাসনা আবদুল্লাহ সোফায় গা এলিয়ে দিল। বলল, ‘আমার কাছে সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে। কি ছিল আন্দামান, কি হয়ে গেল। মাত্র একজন মানুষ এল, আর সব পাল্টে গেল!’
মিষ্টি হাসল হাজী আবদুল্লাহ। বলল, ‘সেই মানুষটি তো শুধুই মানুষ নয় হাসনা। সে রূপকথা ‘জিয়ন কাঠি’ এবং সবাই যার সন্ধানে পাগল সেই ‘সৌভাগ্য স্পর্শমনি’ বা ‘পরশ পাথর’ সে। তার স্পর্শে লোহা সোনা হয় না বটে, কিন্তু তার পরশে অশান্তি শান্তিতে এবং সন্ত্রাস সুস্থতায় রূপান্তরিত হয়।’
হাজী আবদুল্লাহ থামতেই কলিং বেল বেজে উঠল। বাজল তাদের ফ্যামিলি কোডে।
বেগম হাসনা আবদুল্লাহর মুখে একটা আনন্দের প্রবাহ খেলে গেল। সুইচ কনট্রোল বাক্সটা হাতে তুলে নিতে নিতে বেগম হাসনা আবদুল্লাহ বলল, দেখ, ঠিক সময়েই এসে গেছে আহমদ মুসা।’
পরে কনট্রোল বক্সের একটা সুইচ টিপে বক্সটিকে মুখের কাছে নিয়ে বলল, ‘আসসালামু আলায়কুম। বেটা আহমদ মুসা এসো।’
আহমদ মুসা এল। ড্রইং হয়ে ডাইনিং লাউঞ্জে প্রবেশ করল।
হাজী আবদুল্লাহ এবং বেগম হাজী আবদুল্লাহ উঠে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানাল।
আহমদ মুসা হাজী আবদুল্লাহর সাথে হ্যান্ডশেক করে এবং বেগম আবদুল্লাকে সালাম দিয়ে তাদের সামনের সোফায় গিয়ে বসল।
বেগম হাজী আবদুল্লাহ বসেই বলে উঠল, ‘তুমি বহুদিন বাঁচবে বেটা। তোমার কথাই বলছিলাম আমরা, তুমি এসে পড়েছ।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘খবরটা আনন্দের আম্মা। কিন্তু সমস্যা হলো, দুনিয়াতে যত বেশি সময় থাকব, হিসাবের খাতা ততই লম্বা হবে, পাকড়াও হওয়ার বিপদের ঝুঁকি ততই বাড়বে।’
‘তুমি এমন চিন্তা করলে আমাদের দশা কি হবে বাছা! পরের তরে তোমার জীবন, হিসাবের খাতায় তোমার বিরুদ্ধে তো লেখার কিছু নেই।’ বলল বেগম হাজী আবদুল্লাহ।
গাম্ভীর্য নেমেছে আহমদ মুসার মুখে। বলল, ‘আল্লাহর রসূল স.-এর সাহাবীরা যারা বেহেশতের আগাম সুসংবাদ পেয়েছিলেন, তারাও মহাহিসাবের দিনে তাদের কি হবে এ চিন্তায় অঝোর নয়নে কাঁদতেন।’
‘সুবহানাল্লাহ।’ উচ্চারিত হলো হাজী আবদুল্লাহর কণ্ঠে।
সবার চোখে-মুখেই উদ্বেগের মলিনতা।
একটা নিরবতা নামল সবাইকে ঘিরে।
নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসাই। বলল হাজী আবদুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে, ‘জনাব বিরাট সুখবর, গভর্নর বিবি মাধব স্বীকারোক্তিমূলক বিস্তারিত বক্তব্য দিয়েছে। সন্ত্রাসী দল ‘শিবাজী সন্তান সেনা’ এবং ‘মহাসংঘে’র গোটা নেটওয়ার্কের নাম-পরিচয় ধরা পড়ে গেছে। শীর্ষ নেতারাসহ প্রথম ও মাঝারী শ্রেণীর সব নেতাই ধরা পড়ে গেছে। আসার সময় কর্নেল সুরেন্দ্রের কাছে সর্বশেষ তালিকাটা দেখে এলাম।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের হিন্দুস্তান বোধ হয় বেঁচে গেল এক সর্বনাশা ষড়যন্ত্রের কবল থেকে। মহাসংঘের শীর্ষ নেতা কে? তিনিও ধরা পড়েছেন?’ হাজী আবদুল্লাহ বলল।
‘তিনি শাসক দলসহ অনেক রাজনৈতিক দলের আধ্যাত্মিক নেতা এবং নির্দলীয় সক্রিয় রাজনীতিক রাজগুরু দেশমুখ লালা রামমনোহর লেহিয়া। তাকে সর্বশেষে আজ কিছুক্ষণ আগে গ্রেফতার করা হয়েছে।’
‘সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, ঠিক লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ আনন্দ-বিস্ফোরিত চোখে বলল হাজী আবদুল্লাহ।
একটু থেমেই আবার বলল হাজী আবদুল্লাহ, ‘আন্দামানের আর নতুন কিছু ধর-পাকড় বাকী আছে?’
‘সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে থেকে আর নতুন কোন ধর-পাকড় নেই। যা হয়েছে শুরুতেই। বেশি লোক ধরা পড়েছে পুলিশ ও আমলাদের মধ্য থেকে। কর্নেল সুরেন্দ্র বললেন, যে লিষ্ট তারা পেয়েছিল গভর্নর বিবি মাধবের ফাইল থেকে, সে লিষ্ট অনুসারে উল্লেখযোগ্য সবাই ধরা পড়েছে। এখন তারা আহমদ শাহ আলমগীর ও সুষমা রাওয়ের কিডন্যাপসহ প্রতিটি ঘটনা ও হত্যাকান্ডের পৃথক পৃথক তদন্ত করছে। মামলাগুলো আদালতে উঠলে সব রহস্য, সহ কথা প্রতিটি হিন্দুস্তানীর কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিশেষ করে আহমদ শাহ আলমগীর ও সুষমা রাওয়ের কিডন্যাপ হিন্দুস্তানের সর্বকালের ইতিহাসের বড় ঘটনায় পরিণত হবে বলে কর্নেল সুরেন্দ্র মনে করেন।’ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই বেগম হাজী আবদুল্লাহ বলে উঠল, ‘সব খবরই আনন্দের। কিন্তু সুষমা রাও ও মিসেস বিবি মাধবের কথা ভেবে আমার কষ্ট হচ্ছে। পিতা ও স্বামীর সম্বন্ধটা সবার ওপরে।’
‘ঠিক বলেছেন আম্মা। এই সম্বন্ধ সবকিছুর ওপরে। সুষমা রাও এবং মিসেস বিবি মাধবও বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছেন। খবর জানার পর মা ও মেয়ে বুক ভাঙা কান্নায় ভেংগে পড়েন, অঝোর ধারায় তাদের চোখে অশ্রু নামে। তাদের সামনে বসে থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে। অপরাধী মনে হয়েছে নিজেকে। সান্তনা দেবার মত কোন কথা তাই আমার মুখে যোগায়নি। কিন্তু শীঘ্রই মিসেস মাধব নিজেকে সামলে নেন। চোখ মুছে তাড়াতাড়ি বলল, ‘স্যরি বেটা, আমাদের মাফ করো। আমাদের কান্নাকে ক্রিমিনালের প্রতি সমবেদনা মনে করো না। এ কান্না আমাদের আপন জনের বিয়োগ ব্যথার।’ তারপর একটু থেমেই আবার বলে ওঠেন, ‘আমাদের সাথে তুমিও চলো বেটা। সিবিআই যেটা চেয়েছে, তার কিডন্যাপ সম্পর্কে সেই ষ্টেটমেন্ট তো সুষমা দেবেই, আমিও তার মা হিসাবে সুষমাকে কিডন্যাপের অভিযোগে গভর্নর মাধবের বিরুদ্ধে কেস দায়ের করব। তিনি কিডন্যাপ করিয়েছেন, সেটা আমি তার মুখ থেকেই শুনেছি। সত্যিই সুষমা রাও সিবিআই ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে তার বিরুদ্ধে শক্ত জবানবন্দী রেকর্ড করিয়েছে। তার মা মিসেস মাধবও সুষমাকে কিডন্যাপের অভিযোগে শক্ত কেস দায়ের করেছে।’
‘সত্যিই বিস্ময়কর এ ঘটনা বাছা।’ বলল বেগম হাজী আবদুল্লাহ।
‘পাপের পাল্লা ভারী হলে, সহ্যের সীমা শেষ হয়ে গেলে এক সময় এরকমই হয়। আহমদ শাহ আলমগীরকে কিডন্যাপের একটা যুক্তি হয়ত তাদের দেয়ার মত আছে, কিন্তু নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ করার কারণ হিসাবে যে যুক্তিই দাঁড় করানো হোক তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই পাপই শেষে বিবি মাধবরা করেছেন। তাছাড়া সুস্মিতা বালাজীর সাথে নিজের মামা হয়ে যে আচরণ বিবি মাধব করেছেন, তা আপনারা শুনেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ মনে আছে, বিশ বছরের বনবাস জীবন, সেও এক অপরূপ রূপ কথা।’ বলল বেগম হাজী আবদুল্লাহ।
বেগম হাজী আবদুল্লাহর কথা শেষ হবার আগেই কলিংবেল বেজে উঠেছিল। কথা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বেগম হাজী আবদুল্লাহ বলল, ‘নিশ্চয় মেহমানরা কেউ এসেছে। দেখছি আমি। আহমদ মুসা তুমি বস।’
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়িয়েছিল।
বেগম হাজী আবদুল্লাহর কথার উত্তরে আহমদ মুসা বলল, ‘না আম্মা আপনি বসুন। সম্ভবত শাহবানুরা এসেছে।’
ইতিমধ্যেই হাজী আবদুল্লাহ উঠে দাঁড়িয়েছিল। হাত উঁচু করে আহমদ মুসাকে থামতে ইঙ্গিত করে বলল, ‘জনাব আহমদ মুসা, আপনি আমাদের অসীম সম্মানের দুর্লভ মেহমান। বয়সে বড় হওয়ার সুবাদে আপনার মহত্বের সুবাদে আমরা অনুচিত সুযোগ আপনার কাছে নিচ্ছি। তাই বলে আমাদের মেহমানদের দরজা খুলে দেয়ার এবং তাদের স্বাগত জানানোর দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে, এতটা বেআদব হওয়া আমাদের ঠিক নয়।’ গম্ভীর কণ্ঠ হাজী আবদুল্লাহর।
কথা শেষ না করেই উত্তরের অপেক্ষা না করে বড় বড় পা ফেলে দরজার দিকে হাঁটতে লাগল হাজী আবদুল্লাহ।
কিন্তু উত্তর আহমদ মুসা দিলই। বলল বেগম হাজী আবদুল্লাহকে লক্ষ্য করে, ‘আম্মাজী একেবারে ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’, আর সন্তানের আসন থেকে একেবারে মাথায় তুলে বসানো, এটা কি হলো?’
গম্ভীর হয়ে উঠেছে বেগম হাজী আবদুল্লাহও। বলল, ‘ঠিকই বলেছেন উনি। তোমার সহজ-সারল্য, অন্যকে বড় করে দেখার, অন্যকে সম্মান দেয়ার তোমার সার্বক্ষণিক আচরণের কারণে আমরা ভুলে যাই যে, তুমি দুর্লভ এক মানুষ, এক মহাসম্মানের মেহমান তুমি আমাদের, যার সামনে আমাদের সংযত, সপ্রতিভ ব্যবহার কাম্য। তুমি আমাদের মাফ কর আহমদ মুসা।’ আবেগে ভারী কণ্ঠ বেগম আবদুল্লাহর।
আহমদ মুসা ধপ করে বসে পড়ল তার সোফায়। তারও মুখে গাম্ভীর্য নেমে এসেছে।
হাজী আবদুল্লাহ মেহমানদের নিয়ে প্রবেশ করল ড্রইংরুমে।
এসেছে মিসেস বিবি মাধব সুষমার মা, সুষমা রাও, আহমদ শাহ আলমগীর, তার মা সাহারা বানু ও বোন শাহবানু এবং তারিক মুসা মোপলা।
আহমদ মুসা এবং বেগম আবদুল্লাহ উঠে দাঁড়াল। হাসি মুখে স্বাগত জানাল মেহমানদের।
আহমদ শাহ আলমগীর, সুষমা, শাহবানু এবং তারিক মুসা মোপলা বেগম হাজী আবদুল্লাহকে পা ছুঁয়ে সালাম করল।
বেগম আবদুল্লাহ তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে বলল, আমাকে নয় আগে সালাম করতে হতো আহমদ মুসাকে। তার সামনে আমাদেরকে আগে সম্মান দেখানো অপরাধ না হলেও অসৌজন্যমূলক।’
‘স্যরি খালাম্মা। ঠিক বলেছেন আপনি। আমরা তাকে সালাম করছি। কিন্তু উনি পা ছুঁয়ে সালাম করতে দেন না।’
বলে আহমদ শাহ আলমগীর এগোলো আহমদ মুসার দিকে।
লম্বা চুল, দাড়ি, গোঁফ কেটে আহমদ শাহ আলমগীর নতুন মানুষ হয়েছে। দেহে দূর্বলতা থাকলেও চোখে-মুখে আগের সেই ক্লান্তি আর নেই। রক্তিম সাদা চেহারায় ঔজ্জল্য ফিরে এসেছে। বাইশ-তেইশ বছরের সুদর্শন, টগবগে যুবকের চেহারা তার পুরোপুরি ফিরে এসেছে। তাকে মোগলদের একমাত্র প্রতিকৃতি হিসেবে খুবই উপযুক্ত মনে হচ্ছে।
আহমদ শাহ আলমগীরের সাথে তারিক মুসা মোপলা, সুষমা-শাহবানুরাও এগুচ্ছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা সোফায় বসে পড়ল। বলল, ‘এসো সবাই আমার পা ছুঁয়ে সালাম করো। দু’একটা ফুলও পায়ের কাছে রাখতে পার। ভগবানরা নাকি অবতার হয়ে মাঝে মাঝে দুনিয়াতে আসেন মানুষের ত্রাতা হয়ে। আমি সেরকমই একজন অবতার কিনা!’ গম্ভীর, ভারী কণ্ঠ আহমদ মুসার।
সুস্মিতা বালাজী, ড্যানিশ দেবানন্দ, সুরুপা সিংহাল এবং সাজনা সিংহালকে নিয়ে হাজী আবদুল্লাহও এসে দাঁড়িয়েছিল। তারাও শুনল কথাগুলো।
বেগম আবদুল্লাহ, সুষমার মা, সাহারা বানু সবাই উঠে দাঁড়িয়েছিল তাদের স্বাগত জানানোর জন্যে।
সুষমার মা মিসেস বিবি মাধব গিয়ে সুস্মিতা বালাজী ও সুরুপা সিংহালকে এক সাথে জড়িয়ে ধরল। সুস্মিতা বালাজী এসে সুষমা রাও শাহবানুকে জড়িয়ে ধরল এক সাথে।
আহমদ মুসার কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়েছিল আহমদ শাহ আলমগীর ও তারিক মুসা মোপলা। আহমদ মুসার এমন কণ্ঠ, এমন কথা তারা কখনও শোনেনি। তারা ভেবেছিল বেগম আবদুল্লাহর কথায় আহমদ মুসা হাসবে এবং তার পা ছুঁতে গেলে আহমদ শাহ আলমগীরদের ধমকাবে। কিন্তু তার বদলে আহমদ মুসাকে অভিমান-ক্ষুব্ধ হতে দেখে আহমদ শাহ আলমগীর অবাক হয়েছে। তারা এই অবস্থাতেই গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করল সুস্মিতা বালাজী এবং ড্যানিশ দেবানন্দকে।
সুস্মিতা বালাজী আহমদ শাহ আলমগীর ও তারিক মুসা মোপলার মাথায় হাত বুলিয়ে আহমদ মুসার দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে বলল, ‘ছোট ভাই, আমরা অবিশ্বাস করার মত এমন কথা, আমরা ভয় পাবার মত এমন ক্ষুব্ধ কণ্ঠ তো আপনার কখনো শুনিনি? কি ব্যাপার ছোট ভাই, অবতার হওয়ার প্রশ্ন উঠল কেন?’
সুস্মিতা বালাজী থামতেই সুষমার মা মিসেস বিবি মাধব বলে উঠল, ‘আরও কথা আছে সুস্মিতা। আমরা এসে কিন্তু এদের ঠোটে হাসি দেখেছি, কিন্তু চোখের দৃষ্টি ও মুখের চেহারায় কিন্তু হাসি দেখিনি। যেন বিব্রতকর কিছুর মাঝে আমরা এসে পড়েছি।’
মিসেস বিবি মাধব থামতেই শব্দ করে হেসে উঠল বেগম আবদুল্লাহ বলল, ‘না বিব্রতকর কিছু ঘটেনি। ঘটেছে মজার কিছু।’
কথা শেষ করেই বেগম আবদুল্লাহ তাকাল হাজী আবদুল্লাহর দিকে। বলল বলে দাও আহমদ মুসাকে তুমি কি বলেছিলে?’
হাজী আবদুল্লাহ তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার মুখে স্নেহসিক্ত হাসি এবং চোখে সম্ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টি। বলল, ‘তোমাকে জিজ্ঞাসা করছেন ওঁরা, তুমিই বল হাসনা।’
‘ব্যাপারটা ঘটেছে মেহমানদের স্বাগত জানানোর বিষয় নিয়ে।’ বেগম আবদুল্লাহ আহমদ মুসাকে হাজী সাহেব কি বলেছিল, আহমদ মুসা কি বলেছিল, বেগম আবদুল্লাহ কি বলেছিল সব তাদের জানিয়ে বলল, ‘আসলে আহমদ মুসা সব সময়ই ব্যক্তি আহমদ মুসাকে বড় করে তুলে ধরার ঘোর বিরোধী।’
‘এটাই আহমদ মুসা। বড়দের প্রতি, গুরুজনদের সাথে আহমদ মুসা এই ব্যবহারই করেন।’ বলল সাহারা বানু।
‘যার যে মর্যাদা সেটা তাকে দেয়া এবং যার যে সম্মান সেটা পাওয়াই তো স্বাভাবিক। গুণের স্বীকৃতি দেয়া তো অন্যায় নয় ছোট ভাই।’ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল সুস্মিতা বালাজি। সুস্মিতা বালাজীর শান্ত ও ভারী কণ্ঠস্বর।
আহমদ মুসা সোফায় সোজা হয়ে বসল।
তার ঠোঁটে হাসির অস্পষ্ট একটা ধারা ফুটে উঠল। বলল, ‘সম্মান ও মর্যাদার পেছনে থাকে কারও কোন মহৎ চিন্তা বা কাজ। এই কাজ ও আদর্শের স্বীকৃতি, অনুসরণ স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক, অসমিচীন হলো ব্যক্তিকে বড় করে তোলা। এই বড় করে তোলাটা ব্যক্তি-পুজা পর্যন্তও পৌছতে পারে। শ্রীকৃষ্ণ, রামচন্দ্রের কাজ আদর্শ আজ হারিয়ে গেছে। পূজা পায় এখন ব্যক্তি রামচন্দ্র, ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণ। ইসলাম একে সমর্থন করে না, ইসলাম এর বিরুদ্ধে। আমাদের নবী মুহাম্মদ স. ছিলেন আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ, আল্লাহর বার্তাবাহক। মানুষের জন্যে মডেল জীবন তাঁর। তিনি শ্রেষ্ঠ মানুষ। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন সকলের মত একজন মাটির মানুষ। নবী হওয়ার পরেও তিনি জীবিকার জন্যে পারিশ্রমিক নিয়ে ইহুদীকে পানি তোলার কাজ করে দিয়েছেন। সকলের সাথে পাতার বিছানায় শুয়েছেন, শুকনো রুটি খেয়েছেন। তাকে আসতে দেখে বসে থাকা কাউকে উঠে দাঁড়াতে তিনি নিষেধ করেছেন। তার জন্যে সবার চেয়ে আলাদা কোন ব্যবহারের অনুমতি ছিল না। এভাবে আমাদের নবী স্বয়ং ব্যক্তি-মানুষকে বড় করে তোলার কোন রসম-রেওয়াজ গড়ে উঠতে দেননি এবং তিনি এই ধরনের মানসিকতার মূলোচ্ছেদ করেছেন। আমার কথা এখানেই। আমাদের রসূল স. ব্যক্তি বন্দনার মূলোচ্ছেদ করেছেন। সুতরাং আমাদের উচিত তাকে অনুসরণ করা।’
থামল আহমদ মুসা।
সবাই নিরব।
নিরবতা ভাঙল সেই সুস্মিতা বালাজীই। বলল, ‘আল্লাহর রসূলের দৃষ্টান্ত দেয়ার পর আর কিছু বলার থাকে না। কিন্তু তাঁর কাজকে এত সম্মান, স্বীকৃতি দেয়া হলে ব্যক্তি এতটা নিষিদ্ধ হবে কেন? কাজ তো ব্যক্তিরই। তাছাড়া ব্যক্তি হলে, তার কাজও বড় হয়ে যেতে পারে। ব্যক্তির স্মরণ তার কাজকে সামনে আনতে পারে।’
‘কাজের স্মরণ ব্যক্তির স্মরণও সামনে এনে দেয়। এতটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু ব্যক্তির সামনে না হওয়াই ভাল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ইসলাম এই ব্যাপারে এত কঠোর কেন?’ বলল সুস্মিতা বালাজিই।
‘কঠোর এই কারণে যিশুর মত আর কাউকে যেন ঈশ্বর-পুত্র না বানানো হয়, রামচন্দ্রের মত আর যেন কেউ ভগবান না হন। ব্যক্তি-বন্দনা সংশিস্নষ্ট ব্যক্তির চরিত্র নষ্ট করে এবং তার প্রতিভার ক্ষতি করে। অন্যদিকে মানুষকেও অন্ধ ব্যক্তিকেন্দ্রীক করে দেয়। তখন মানুষ তার মূর্তি তৈরিতে যতটা অগ্রণী হয়, তার কাজ ও আদর্শের অনুসরণে ততটাই পিছিয়ে যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। সবার তরফ থেকে ধন্যবাদ তোমাকে। বুঝতে পেরেছি, আমরা। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি যে, তিনি এই বোঝার সুযোগ আমাদের করে দিয়েছেন।’ বলল হাজী আবদুল্লাহ। তার কণ্ঠ শ্রদ্ধাসিক্ত, নরম।
কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল আহমদ শাহ আলমগীর।
আহমদ মুসা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই বিষয়ে আর কোন কথা নয়। আমি একটা নতুন বিষয় এখানে উত্থাপন করতে চাই।’
বলে আহমদ মুসা থামল। হাসি মুখে তাকাল এক এক করে আহমদ শাহ আলমগীর, সুষমা রাও, শাহবানু এবং তারিক মুসা মোপলার দিকে।
হঠাৎ করে আহমদ মুসার এই দৃষ্টির কবলে পড়ে তারা চারজনই সংকুচিত হয়ে পড়ল। লাল হয়ে গেল সুষমা রাও ও শাহবানুর মুখ।
সবশেষে তাকাল আহমদ মুসা মিসেস বিবি মাধবের দিকে। বলল, ‘খালাম্মা আমি উত্থাপন করতে পারি?’
উজ্জ্বল হাসিতে ভরে উঠল সুষমার মা মিসেস বিবি মাধবের মুখ। বলল, ‘বেটা বুঝেছি আমি ইংগিত। এ অনুমতি আমার দেয়া আছে বেটা।’
‘ধন্যবাদ খালাম্মা।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মুহতারাম হাজী আবদুল্লাহ চাচাজীকে ধন্যবাদ। তার দাওয়াতে আমরা একত্রিত হবার সুযোগ পেয়েছি। এই দাওয়াতে আন্দামানের নতুন গভর্নর বিচারপতি বিশ্বনাথ রাও এবং দিল্লী থেকে সিবিআই প্রধানও আসছেন। আমি প্রস্তাব করছি, এই মহৎ অনুষ্ঠানে আহমদ শাহ আলমগীর-সুষমা এবং তারিক-শাহবানু ‘আকদ’ সম্পন্ন করা হোক।’ থামল আহমদ মুসা।
একটু নিরবতা।
আহমদ শাহ আলমগীর ও তারিক মুসা মোপলার চোখে-মুখে আকস্মিকতা সূচক বিস্ময়ভাব। সুষমা ও শাহবানুর মুখ নিচু। আর সুস্মিতা বালাজী, সুরূপা ও সাজনা সিংহালের চোখে-মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে। সাহারা বানু ও মিসেস বিবি মাধব দু’জনেই গম্ভীর, মুখে প্রসন্ন ভাব।
প্রথমে নিরবতা ভাঙল বিবি মাধব। বলল, ‘বেটা আহমদ মুসা এই প্রস্তাব উত্থাপন করবে, আমি সেটা সুষমাদের দিকে তাকানো দেখেই বুঝেছি। আমি অনুমতিও দিয়েছি। আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ যে, ভাই-বোনদের কথা সে এতটা মনে রাখে।’
মুহূর্তকালের জন্য থামল মিসেস বিবি মাধব। মুহূর্তের জন্যে মুখটা নিচু করেছিল। আবার মুখ তুলল। ভারী, গম্ভীর মুখে বলল, ‘সবাই জানেন আমার স্বামী সুষমার বাবা বালাজী বাজিরাও মাধব এখন সরকারি কাষ্টডিতে এবং দিল্লীতে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে পিতার হাজির থাকার কথা। সে সুযোগ নেই। কিন্তু বিষয়টি তাকে জানিয়ে আমি অনুমতি নিয়েছি। তাঁকে নেয়ার আগে সিবিআই আমাকে সুযোগ দিয়েছিল তাঁর সাথে একান্তে কথা বলার। আমি সে সময় আহমদ শাহ আলমগীরের সাথে সুষমার বিয়ে কথা তুলেছিলাম। তিনি অনুমতি দিয়েছেন। সুতরাং তিনি না থাকলেও তাঁর অনুমতি আমাদের সাথে আছে।’ থামল মিসেস বিবি মাধব। তার শেষের কথা কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সুষমা গিয়ে জড়িয়ে ধরল তার মাকে। কান্নায় ভেঙে পড়ল সুষমাও।
সাহারা বানু উঠে গিয়ে সুষমার মাথায় হাত বুলিয়ে মিসেস বিবি মাধবের কাঁধে হাত রাখল। বেগম আবদুল্লাহ গিয়ে মিসেস বিবি মাধবের পাশে বসল। তার একটি হাত তুলে নিল হাতে। বলল, ‘মিসেস মাধব আমরা গর্বিত। আমাদের ভারতবাসী সকলের জন্যে আপনারা একটি মহৎ দৃষ্টান্ত।’
মিসেস মাধব চোখ মুছে বলল, ‘স্যরি বেগম আবদুল্লাহ, স্যরি বোন সাহারা, স্যরি এভরিবডি।’ তারপর সুষমাকে কোলে টেনে নিল এবং আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বেটা আহমদ মুসা, তুমি ‘আকদ’ এর আয়োজন কর। সুষমার বিয়েও মুসলমানী মতেই হবে। ভালোই হবে, গভর্নর বিচারপতি রাও থাকবেন। আমরা একই বংশের।’
এরই মধ্যে গভর্নর বিচারপতি বিশ্বনাথ রাও এবং দিল্লী থেকে আসা সিবিআই চীফ ব্রিগেডিয়ার যশোবন্ত যশোরাজকে রিসিভ করার জন্য হাজী আবদুল্লাহ বাইরে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পরে মেহমানদের সাথে নিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করলেন।
ড্রইংরুমে ঢুকেই গভর্নর বিচারপতি বিশ্বনাথ রাও এগিয়ে গেল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
গভর্নর বিচারপতি বিশ্বনাথ রাও হাত বাড়িয়ে দিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘ওয়েলকাম স্যার। আবার আপনার সাথে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হবে ভাবিনি।’
‘সৌভাগ্য আমার আহমদ মুসা। আমাদের দেখা যে কেউ পেতে পারে, কিন্তু আপনার দেখা পাওয়া দুর্লভ ব্যাপার। সেদিন আপনার সাথে আলোচনা আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা।’ বলে গভর্নর বিচারপতি বিশ্বনাথ রাও পাশে এসে দাঁড়ানো সিবিআই চীফ যশোবন্ত যশোরাজকে আহমদ মুসার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
আহমদ মুসা দ্রুত হাত বাড়িয়ে বলল, ‘কনগ্রাচুলেশন স্যার, সিবিআই একটা ঐতিহাসিক কাজ করেছে। ভারতের মানুষ চিরদিন মনে রাখবে এটা।’
সিবিআই প্রধান যশোবন্ত যশোরাজ আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘না মি. আহমদ মুসা, কনগ্রাচুলেশন আপনার প্রাপ্য। আমি দিল্লী থেকে আপনাকে অভিনন্দন জানাবার জন্যই এসেছি। আপনি জানেন না, সিবিআই একবার এসে বিভ্রান্ত ও ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিল। এবার আসলে আপনি সব কাজ করেছেন, সিবিআই শেষ মুহূর্তে আপনাকে সাহায্য করেছে মাত্র।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই হাজী আবদুল্লাহ এগিয়ে এসে গভর্নর বিচারপতি রাও ও সিবিআই চীফকে একটা নির্দিষ্ট সোফা দেখিয়ে বলল, ‘স্যাররা বসুন।’
তারা গিয়ে বসল। সিবিআই চীফ আহমদ মুসাকে টেনে নিয়ে তার পাশে বসাল।
সবাই বসলে উঠে দাঁড়াল হাজী আবদুল্লাহ। সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ! আমরা দুজন সম্মানিত মেহমানের অপেক্ষা করছিলাম। গভর্নর বিচারপতি বিশ্বনাথ রাও এবং সিবিআই চীফ মি. যশোবন্ত যশোরাজ এসেছেন। আমরা মেহমানদ্বয়কে আমাদের মাঝে স্বাগত জানাচ্ছি। লাঞ্চের পর আমাদের একটা প্রোগ্রাম আছে। লাঞ্চে যাওয়ার আগে এ বিষয়ে কিছু বলবেন মিসস বিবি মাধব।’
কথা শেষ করেই মিসেস বিবি মাধবের দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করলেন তাকে বলার জন্যে।
উঠে দাঁড়াল মিসেস বিবি মাধব। বলল, ‘সম্মানিত মেহমানদ্বয় এবং ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আসন্ন লাঞ্চের পর আমার মেয়ে সুষমা রাওয়ের সাথে আহমদ শাহ আলমগীর এবং আহমদ শাহ আলমগীরের বোন শাহবানুর সাথে আন্দামানের বাসিন্দ, এখন লন্ডন প্রবাসী তারিক মুসা মোপলার ‘আকদ’ এর অনুষ্ঠান হবে। সম্মানিত মেহমানদ্বয়সহ সকলকে উক্ত অনুষ্ঠানে শরীক হবার জন্যে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’
মিসেস বিবি মাধবের কথা শেষ হতেই গভর্নর বিচারপতি বিশ্বনাথ রাও এবং সিবিআই চীফ যশোবন্ত যশোরাজ মৃদু হাততালির সাথে সাথে এক সংগে বলে উঠল, ‘শুভ সংবাদ সুস্বাগত, শুভ সংবাদ সুস্বাগত।’
তাদের সাথে সাথে সবাই হাততালি দিয়ে উঠল।
মিসেস বিবি মাধব আবার উঠে দাঁড়াল এবং সবাইকে ধন্যবাদ জানাল।
হাজী আবদুল্লাহ উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমরা এখন লাঞ্চে……।’
সিবিআই চীফ যশোবন্ত যশোরাজ হাত তুলল হাজী আবদুল্লাহর উদ্দেশ্যে। হাজী আবদুল্লাহ মাঝখানে থেমে গেল।
উঠে দাঁড়াল যশোবন্ত যশোরাজ। বলল, ‘আমি দুঃখিত মাঝখানে কথা বলার জন্যে। আমরা লাঞ্চের পর যেহেতু আরেকটা বড় অনুষ্ঠানে জড়িয়ে পড়ব, এজন্যে লাঞ্চের আগেই ভারত সরকারের একটা ঘোষণা আমরা সবাইকে জানাতে চাই। ঘোষণাটি আহমদ মুসার বিষয়ে। আজ প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অতি মূল্যবান সহযোগিতা দেয়ার জন্যে আহমদ মুসাকে ‘ভারত মহাপদ্ম’ পদক এবং পাঁচ লাখ ডলার পুরষ্কার দেয়া হয়েছে।’ আপনারা জানেন ‘ভারত মহাপদ্ম পদক’ বিদেশীদের জন্যে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা। আমি আপনাদের আনন্দের সাথে জানাতে চাই, গত কয়েকদিনে ‘ব্ল্যাক আর্মি’ বা ‘শিবাজী সন্তান সেনা’ ও ‘মহাসংঘ’ নামক সন্ত্রাসী সংগঠনের তৃতীয় পর্যায়ের নেতা সকলেই ধরা পড়েছে। এ কাজে সাবেক গভর্নর বিবি মাধব আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছেন। একটা ঘটনা তাকে সবচেয়ে বেশি বদলে দিয়েছে। সেটা হলো, কন্যা সুষমা রাওয়ের প্রতি তাঁর অবিচার। তিনি বলেছেন, যে মত বা মতাদর্শ নিজের মেয়ের ব্যাপারেও এমন অন্ধ করে দেয়, তা অবশ্যই কল্যাণের নয়, ধ্বংসের।’ থামল যশোবন্ত যশোরাজ।
আহমদ মুসা সম্পর্কিত ঘোষণা শুনেই যশোবন্ত যশোরাজের কথার মাঝখানেই সবাই হাততালি দিয়ে উঠেছিল। এবার সকলে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে মোবারকবাদ দিতে শুরু করল। আহমদ শাহ আলমগীর ও তারিক মুসা মোপলা তাকে জড়িয়ে ধরল আনন্দে।
ধন্যবাদের উত্তর দেয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘পদক মানুষকে দেয়া হয় না, তার কাজকে দেয়া হয়। আমার কাজ ছিল আন্দামানের মজলুম মানুষের জন্যে। আমি পুরুষ্কারের অর্থ পেলে আন্দামানের মজলুমদের স্মরণে এমন একটি মিনার তৈরিতে এ টাকা খরচ করব, যে মিনার আন্দামানের চারদিকের গোটা সাগর এলাকা থেকে দেখা যাবে।’ যে মিনারে আলোর অক্ষরে লেখা থাকবে বৃটিশ কারাগারে মৃত মওলানা ফজলে হোক খয়রাবাদী, মওলানা ইয়াহিয়া আলী, মৌলভী আহমাদুল্লাহ, শহীদ শেরআলীসহ সবার নাম। এতে আরও থাকবে গাজী গোলাম কাদের ওরফে গোপী কিষন, গঙ্গারামসহ এ যুগের সব শহীদের নামও। নামগুলো আলো ছড়াবে গোটা আন্দামান ও চারদিকের সাগরে। এটা হবে ভারতের সংগ্রামী নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস।’
তালি বাজানো আগেই শুরু হয়েছিল গভর্নর বিচারপতি রাও ও সিবিআই চীফ যশোবন্ত যশোরাজ। আহমদ মুসার কথা শেষ হলে গোটা হল সকলের সম্মিলিত তালির শব্দে গম গম করে উঠল।
‘আপনার এই মহৎকাজে আমাদের সকল সহযোগিতা আপনি পাবেন।’ বলল গভর্নর বিচারপতি রাও।
হাজী আবদুল্লাহ দাঁড়িয়েছিল। কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল, কিন্তু তার আগেই মিসেস বিবি মাধব বলল, একটা কৌতুহল। মহাসংঘে’র প্রধান লক্ষ্য ছিল একটা বাক্স উদ্ধার। এ রহস্যের কোন সমাধান হয়েছে?’
গভর্নর বিচারপতি রাও তাকাল সিবিআই চীফ যশোবন্ত যশোরাজের দিকে।
‘অল রাইট স্যার, আমি বলছি।’ বলে সিবিআই চীফ তাকাল মিসেস বিবি মাধবের দিকে। বলল, ‘জি ম্যাডাম, বাক্সটি বাস্তব। ঐতিহাসিক বাক্সটি বেরিয়েছে আহমদ শাহ আলমগীরের বাসা থেকেই। কিন্তু বাক্সের খবর আহমদ শাহ আলমগীর কিংবা তার পরিবারের কেউ জানতো না। আহমদ শাহ আলমগীরের পরিবারের অনুরোধে বাক্স রহস্যটির শেষ দেখার জন্যে আহমদ মুসা ও সিবিআই এর লোকরা এক সাথে বাক্সটি খুঁজতে শুরু করে। বাড়ির প্রতিটি জিনিস ও জায়গা অনুসন্ধানসহ সম্ভাব্য স্থানগুলো খুঁড়েও দেখা হয়, কিন্তু কিছুই পাওয়া যায় না। অবশেষে আহমদ মুসাই পিতলের প্লেটে আঁকা বাড়ির স্কেচে একটা ধাঁধাঁ খুঁজে পান। ধাঁধাঁটির রহস্যভেদ করেন আহমদ মুসা এবং ধাঁধাঁর সংকেত অনুসরণ করেই বাড়ির মাষ্টার বেডের প্রধান দরজার বটম চৌকাঠের তিন ফুট মাটির নিচে বাক্সটি উদ্ধার হয়।’ একটু থামল যশোবন্ত যশোরাজ।
থামতেই কয়েকজনের তরফ থেকে একই প্রশ্ন ছুটে এল, ‘কি পাওয়া গেল বাক্সতে?’
‘মহাসংঘ যা বলেছিল সেগুলোই। একটা পেপার ডকুমেন্ট, একটা নক্সা। মহাংসঘের মতে পেপার ডকুমেন্টটা জাতির উদ্দেশ্যে শিবাজীর একটা উইল। কিন্তু পেপার ডকুমেন্টে একটা শব্দও অক্ষত পাওয়া যায়নি। দলিলের একটা সীল অক্ষত পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা সীলটিকে শিবাজীর ব্যক্তিগত সীল বলে চিহ্নিত করেছেন। আর নক্সাটি মোগল সম্রাটদের গুপ্ত ধনভান্ডারের।’ বলল যশোবন্ত যশোরাজ।
‘নক্সাটি যে মোগল গুপ্ত ধনভান্ডারেরই এটা কি নিশ্চিত?’ বলল সুরূপা সিংহাল।
হাসল সিবিআই প্রধান যশোবন্ত যশোরাজ। বলল, ‘নক্সা অনুসরণে আজ গুপ্তধন উদ্ধার করা হয়েছে। আগামীকালের পত্রিকা এবং টিভি নেটওয়ার্কে খবরটা আপনারা পেয়ে যাবেন।’
গুপ্তধন উদ্ধারের খবরে গোটা হলে একটা গুঞ্জন উঠল। সাজনা সিংহাল বলে উঠল, ‘এ গুপ্ত ধনের মালিক কি সরকার, না মোগলদের বংশধর আহমদ শাহ আলমগীর?’
গাম্ভীর্য নেমে এল যশোবন্ত যশোরাজের মুখে। ‘চলমান বিধান অনুসারে সব গুপ্তধনের মালিক জাতি, মানে সরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে এই জাতীয় নীতি অনুসরণ করা হয়নি। গুপ্তধনের নক্সার সাথে শেষ মোগল সম্রাটের উইল ছিল। উইলে বলা হয়েছে, যখন গুপ্তধন উদ্ধার হবে, তখন অবস্থা যাই হোক, গুপ্তধনের দুই তৃতীয়াংশ পাবে ভারতের জনগণ অর্থাৎ দিল্লীতে প্রতিষ্ঠিত সরকার। অবশিষ্ট অংশের দুই তৃতীয়াংশ নিয়ে মুসলিম ছাত্রদের বিজ্ঞান ও ধর্মশিক্ষার জন্যে একটা ফান্ড গঠিত হবে এবং গুপ্তধনের সর্বশেষ অংশ যার কাছে গচ্ছিত অবস্থা থেকে নক্সা পাওয়া যাবে তিনি পাবেন। ভারত সরকার উইলের ইচ্ছা গ্রহণ করেছেন। তবে মোগল পরিবারের সদস্যগণ, আহমদ শাহ আলমগীর, সাহারা বানু এবং শাহবানু গুপ্তধনের অর্থ গ্রহণ না করে তা মুসলিম ছাত্রদের ধর্ম ও বিজ্ঞান শিক্ষা তহবিলের সাথে যুক্ত করতে বলেছেন। এটাও ভারত সরকার মেনে নিয়েছেন। এর পরই গুপ্ত ধনভান্ডার উদ্ধার করা হয়।’
যশোবন্ত যশোরাজের কথার মাঝখান থেকেই সমগ্র হলরুমে আনন্দ ধ্বনি শুরু হয়েছিল। যশোবন্ত যশোরাজ থামলে হাততালিতে ভরে গেল হল।
হাততালির মধ্যেই সাজনা সিংহাল প্রশ্ন করল, ‘স্যার, শিবাজীর পেপার ডুকুমেন্টে সীল ঠিক থাকলেও দলিলের লেখা অক্ষত পাওয়া গেল না কেন?’
‘এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা নেয়া হয়েছে। তারা বলেছিল, লেখার কালি যেসব উপাদান দিয়ে তৈরি হয়েছিল, দীর্ঘ সময়ে সেসবের বিক্রিয়ার ফলেই চামড়ার কাগজ নষ্ট হয়ে গেছে। আর সীলের কালি ছিল ভিন্ন। আর গুপ্তধনের নক্সা ছিল পাতলা গোল্ড প্লেটের উপর খোদাই করা।’ থামল যশোবন্ত যশোরাজ।
হাজী আবদুল্লাহ উঠে দাঁড়াল সংগে সংগেই। বলল, ‘সিবিআই প্রধানকে ধন্যবাদ। তিনি আমাদের প্রত্যাশিত জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছেন। আরও জিজ্ঞাসা থাকতে পারে, তবে আর সময় নেয়া ঠিক হবে না। আমি সকলকে লাঞ্চের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’
বলে হাজী আবদুল্লাহ গভর্নর বিচারপতি রাও এবং যশোবন্ত যশোরাজকে সাথে নিয়ে টেবিলের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। অন্যদিকে বেগম আবদুল্লাহ মেয়েদের নিয়ে চললেন।

তখন বিকেল।
রোদের রং ফিকে হয়ে এসেছে।
সূর্য ডুবতে ঘণ্টা খানেকের বেশি বাকি নেই।
হাজী আবদুল্লাহর ‘সী ভিউ ড্রইং রুম।’ ডাইনিং রুমের উত্তর পাশের এ ড্রইং রুমটি প্রাইভেট, শুধু ফ্যামেলি ব্যহারের জন্য। সাগরের দিকে এগিয়ে তৈরি এ ড্রইং রুমটি। এর তিন দিকেই সাগর। ড্রইং রুমের সোফাগুলো কাঁচের দেয়ালকে সামনে রেখে এমনভাবে সাজানো যে সবাই তার সামনে সাগর দেখতে পাবে।
এ ড্রইংরুম থেকেও একটা সিঁড়ি নেমে গেছে সাগরে। এ সিঁড়ির গোড়াতেও একটা সুন্দর বোট বেঁধে রাখা।
আহমদ মুসা কাঁচের দেয়ালের ধার ঘেঁষে একটা সোফায় বসেছিল। তার সামনে কাঁচের একটা লম্বা টি টেবিল। বাঁ দিকে কাঁচের দেয়ালে দেখা যাচ্ছে আন্দামান সাগর। আহমদ মুসার সামনে টি টেবিলের উপর রাখা আছে একটা সুন্দর দূরবীন।
আহমদ মুসার ডান দিকে টি টেবিলকে সামনে রেখে বসেছে ড্যানিশ দেবানন্দ।
ড্রইংরুমের টেবিলগুলোতে বিকেলের নাস্তা এনে সাজানো হচ্ছে। অন্যরা কেউ এখনও আসেনি।
সবাই টায়ার্ড ছিল।
বিয়ের সব অনুষ্ঠান শেষ হতে বিকেল ৩টা বেজে যায়। তারপর সবাই রেষ্টে গেছে। বিয়ে অনুষ্ঠানের পর গভর্নর বিচারপতি বিশ্বনাথ রাও এবং সিবিআই প্রধান যশোরাজ চলে গেছে। দুই নব দম্পতিসহ অন্যরা সবাই এ বাড়িতেই রেষ্ট নিচ্ছে।
‘আন্দামানের ঘটনার সুন্দর সমাধান হলো। দুই দম্পতির মিলন ঘটল। ছোট ভাই সাহেব আপনি জীবনে এমন ঘটনার মুখোমুখি বহু হয়েছেন কিন্তু আজকের ঘটনার কি কোন বিশেষ দিক আপনার হৃদয়ে রেখাপাত করেছে?’ বলল ড্যানিশ দেবানন্দ।
‘ভাই সাহেব, আজকের ঘটনার বিশেষ দিক হলো, আন্দামানের গভর্নর এবং ভারতীয় সিবিআই চীফের উপস্থিতি। এমন পূর্ণ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য এইভাবে খুব কম পেয়েছি। এজন্যে ভারত সরকারকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ।’
‘কিন্তু ভাইসাহেব, এক ‘মহাসংঘ’ শেষ হলো, আরেক ‘মহাসংঘ’ যদি গজায়?’ ড্যানিশ দেবানন্দ বলল।
‘যদি নয়, অবশ্যই গজাবে। তারও মোকাবিলা আপনারা এভাবে করবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তখন আহমদ মুসাকে কোথায় পাব?’ ড্যানিশ দেবানন্দ বলল।
ইতিমধ্যে প্রবেশ করেছে সুস্মিতা বালাজী, সিংহাল দম্পতি ও সাজনা সিংহাল। তাদের সাথে সাথেই এসে প্রবেশ করেছে সাহারা বানু ও মিসেস মাধব।
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে স্বাগত জানাল সবাইকে।
আহমদ মুসার কথা ও ড্যানিশ দেবানন্দের প্রশ্ন শুনতে পেয়েছিল সুস্মিতা বালাজীরা।
সুস্মিতা বালাজী বলল, ‘ছোট ভাই মি. দেবানন্দের প্রশ্নের জবাব শুনতে আগ্রহী। বলুন।’
‘উত্তর সোজা। আর কোন আহমদ মুসা আসবে, অথবা ভারতেও তখন অনেক আহমদ মুসা তৈরি হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার মানে আপনি আর আসবেন না!’ গম্ভীর কণ্ঠ সুস্মিতা বালাজীর।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘পৃথিবীটা ওয়ান ওয়ে চলার পথ। এ পথ শুধু চলার, ফেরার নয়।’
‘পৃথিবীর জীবন পথ এবং ব্যক্তি মানুষের জীবন পথ এক নয় স্যার। ব্যক্তি মানুষ এক পথে বার বারও ঘোরা-ফেরা করে। আপনি এ সত্যটা পাশ কাটাচ্ছেন স্যার।’ বলল সাজনা সিংহাল।
‘বা! ছোট ভাইকে তো তুমি দারুণভাবে ধরেছো। চমৎকার।’ বলল সুস্মিতা বালাজী্
‘শুধু আজ নয় আপা, ছোট ভাইয়ের সাথে তর্কে-বিতর্কে সে ইউনিক।’ সুরূপা সিংহাল বলল।
‘আলোচনা ভাল, কিন্তু তর্ক-বিতর্ক কি খুব ভালো সুরূপা?’ বলল মুরুবিবয়ানার সুরে ড্যানিশ দেবানন্দ।
‘না দুলাভাই, তার তর্ক-বিতর্ক মনগড়া নয়। জানেন, আমাদের ছোট ভাই আর তার স্যার রস দ্বীপের অপারেশনে গেলে সাজনা মন্দিরে গিয়ে পূজা দিয়েছে এবং মসজিদে গিয়ে মোমবাতি ও লোবান দিয়ে এসেছে তার নিরাপদ……..।’ সুরূপা সিংহালকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সাজনা সিংহাল তার মুখ চেপে ধরল।
কিছু বলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা। কিন্তু বেগম আবদুল্লাহ এক হাতে সুষমা রাও, অন্য হাতে শাহবানুকে ধরে ড্রইং রুমে প্রবেশ করল। সুষমার পাশে রয়েছে আহমদ শাহ আলমগীর এবং শাহবানুর পাশে রয়েছে তারিক মুসা মোপলা।
ওরা ড্রইংরুমে ঢুকে সোজা আহমদ মুসার দিকে আসছিল।
আহমদ মুসা একটু সরে বসল।
ওদের গায়ে তখনও বিয়ের পোশাক।
আহমদ মুসা হাসল। আহমদ মুসা আগে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে ওদের স্বাগত জানাল।
‘ওয়া আলাইকুম’ বলে সুষমা রাও ও আহমদ শাহ আলমগীর এবং শাহবানু ও তারিক মুসা মোপলা দুই দম্পতিই হঠাৎ আহমদ মুসার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা হাত দিয়ে আহমদ মুসার পা ছুঁয়ে সেই হাত চুম্বন করল।
তার সাথে সাথেই তারা উঠে দাঁড়াল এবং সুষমা রাও হাত জোড় করে বলল, ‘মাফ করুন ভাইয়া। আর কোন দিন সালাম করার জন্যে পায়ে হাত দেব না।’
‘আজ দেয়ার দরকার হলো কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হৃদয়ের যে সীমাহীন কৃতজ্ঞতা তা প্রকাশের জন্যে আপনার পায়ে মাথা রাখার চেয়ে উপযুক্ত কিছু পাইনি ভাইয়া।’ বলল সুষমা রাও।
আহমদ মুসা তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। তীব্র অসন্তোষ তার চোখে-মুখে। বলল, ‘সুষমা নতুন। তার অনেক কিছু শেখার বাকি। কিন্তু আহমদ শাহ আলমগীর, তারিক, শাহবানু তোমাদের কথা কি সুষমার মতই?’
ওরা তিনজন কেউ কথা বলল না। তাদের মাথা নিচু।
আহমদ মুসাই আবার বলল, ‘তোমরা কি মনে কোন মানুষ তার নিজ শক্তিতে কোন মানুষের ভাল বা মন্দ করতে পারে?’
‘স্যরি ভাইয়া……।’ কথা কথা শেষ না করেই থেমে গেল আহমদ শাহ আলমগীর।
‘স্যার, শক্তি তো মানুষের নিজেরই।’ বলল সাজনা সিংহাল।
‘মানুষের কিছুই নয়। তার যে সত্তা সেটা তার নয়। মানুষের দেহ পরষ্পর আলাদা বিলিয়ন বিলিয়ন কোষের (কণা) একত্র যোগফল। আল্লাহর আদেশের অধীন হয়ে তারা মানুষের দেহ তৈরি করেছে। কণাগুলো বিচ্ছিন্ন হলে মুহূর্তেই দেহ নামক কোন জিনিস আর চোখে পড়বে না। বল এই মানুষের নিজের কি থাকতে পারে? মানুষের ইচ্ছা, শক্তি সব কিছুই আল্লাহর তরফ থেকে অর্পিত। যদি বলতে চাও, মানুষকে অর্পণ-সূত্রে মালিক বলতে পার।’
‘ধন্যবাদ স্যার। বুঝেছি।’ বলল সাজনা সিংহাল।
‘তাহলে এটাও তোমরা বুঝবে, অর্পণ সূত্রে মালিক যে মানুষ, তাকে ধন্যবাদ দেয়া যায়, তাকে কৃতজ্ঞতা জানানো যায় এই জন্যে যে সে অর্পিত শক্তিকে মংগলের পথে ব্যায় করেছে। কিন্তু মাথা যদি নোয়াতে হয়, সিজদা যদি করতে হয়, তাহলে সেটা আল্লাহকেই করতে হবে। সুষমা তোমরা আল্লাহর যা প্রাপ্য সেটা আমাকে দিতে এসেছ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি ভাইয়া। আপনি আগেও এ সম্পর্কে বলেছেন। কিন্তু বিষয়টাকে এমন সিরিয়াসলি দেখিনি। আমরা একে নিছক একটা কালচার মনে করেছি। আর ভাইয়া আমাদের আন্দামানে গুরুজনদের পা ছুঁয়ে সালাম করাটা মুসলমানদের জীবনেরও অঙ্গ হয়ে গেছে।’ সুষমা বলল।
‘আজকের জন্যেই এটা হয়েছে, ভবিষ্যতে আর হবে না।’ বলল আহমদ শাহ আলমগীর।
আহমদ মুসা হাসল। ওদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘যাও ভাইরা, বোনরা গিয়ে বস।’
আহমদ মুসাদের টি-টেবিলটি অনেক দীর্ঘ। এর তিন দিক ঘিরে দশটা সোফা পাতা। টেবিলে আহমদ মুসা ও ড্যানিশ দেবানন্দ ছাড়াও ওপ্রান্তে বসেছে সুস্মিতা বালাজী, সুরূপা ও সাজনা সিংহাল এবং সুরূপার স্বামী। মাঝের খালি সিটগুলোতে সুষমা ও শাহবানুরা গিয়ে বসল।
আহমদ মুসার উত্তর দিকে কাঁচের দেয়ালের গা ঘেঁষে পাতা আরেকটা টেবিলে বসে মিসেস বিবি মাধব, সাহারা বানু, বেগম আবদুল্লাহ এবং হাজী আবদুল্লাহ।
সবাই বসলে আহমদ মুসা দুদিকে তাকিয়ে বলল, ‘নবীন-প্রবীণদের এই মেরুকরণ কিভাবে হলো? পরিকল্পিতভাবে, না আপনাতেই?’
‘পরিকল্পিতও না, আপনাতেও নয়। তুমিই যুব-তরুণদের ওখানে টেনে নিয়েছ বেটা।’ বলল মিসেস বিবি মাধব।
‘তাহলে আমি আপনাদের টানতে পারলাম না কেন?’ আহমদ মুসা বলল। তার মুখে হাসি।
‘তুমি টেনেছ বাছা। কিন্তু প্রবীণরাই পিছিয়ে এসেছে যুব-তরুণদের সামনে রাখার জন্যে।’ আবারও বলল মিসেস বিবি মাধবই।
নাস্তা পরিবেশিত হয়েছে।
নাস্তা খেতে খেতে আলোচনাও চলল।
নাস্তা হয়েছে, কিন্তু কথা-বার্তা এলোমেলোভাবে চলছেই।
কথার ফাঁকে আহমদ মুসা এক সময় টি-টেবিলের দূরবীনটি তুলে নিল। দূরবীনটি ড্যানিশ দেবানন্দের।
আহমদ মুসা দূরবীনটি চোখে লাগিয়েই বলে উঠল, ‘বা! সাহেব, আপনার দূরবীনটি সাংঘাতিক পাওয়ারফুল।’
আহমদ মুসার দূরবীনের চোখ ছিল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে।
‘সত্যিই চমৎকার আপনার দূরবীন। আমি আন্দামান সাগরের ওপারে থাই-মালয়েশিয়ার সীমান্তের উঁচু পাহাড়টা এবং পাত্তানীর সবুজ অরণ্য পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘টেলিস্কোপিক লেন্স-সিষ্টেমের এই দূরবীনটা সত্যিই খুব পাওয়ারফুল। দূরবীনের এটাই লেটেষ্ট জেনারেশন। ছোট ভাই দূরবীনটা আপনাকে গ্রহণ করাতে পারলে আমি খুব খুশি হবো। আমার কোন কাজে লাগে না। আপনার নানা অভিযানে নানা প্রয়োজনে দূরবীনের দরকার হয়। আপনার কাছে এর সদ্ব্যবহার হবে।’ ড্যানিশ দেবানন্দ বলল।
আহমদ মুসার চোখে তখনও দূরবীন। দূরবীনের সাহায্যে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে দেখছিল। ড্যানিশ দেবানন্দের কথায় তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘দখল করার আগে দিয়ে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ ভাই সাহেব।’
‘ওটা কথার কথা হলো ছোট ভাই। আপনি জীবনে কোন কিছুর জবর দখল করেছেন?’ ড্যানিশ দেবানন্দ বলল।
আহমদ মুসা কথা বলতে গিয়ে থেমে গেল। হঠাৎ অন্য কিছুর প্রতি মনোযোগ তার কথা থামিয়ে দিয়েছে। দেখা গেল সে লেন্স এডজাষ্টার ঘুরিয়ে ভিউ ক্লোজ করছে। দূরবীনের চোখ তার এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে।
আরও কিছুক্ষণ দেখে আহমদ মুসা বলল, ‘মজার একটা জিনিস। আপনি দেখুন তো ভাই সাহেব।’
কথা শেষ করার সাথে সাথেই আহমদ মুসা চোখ থেকে দূরবীন সরিয়ে ড্যানিশ দেবানন্দের হাতে দিতে দিতে বলল, ‘সামনেই দেখুন খেলনার মত মজার কিছু ভেসে আসছে।’
ড্যানিশ দেবানন্দ দূরবীন তার চোখে লাগাল। তার মুখে হাসি।
ইতিমধ্যে সকলের দৃষ্টিই আহমদ মুসাদের দিকে আকৃষ্ট হয়েছে।
‘কি ওটা স্যার?’ সাজনা সিংহাল প্রশ্ন করল।
‘খেলনা নৌকা। সম্ভবত পাতার, রঙিন কাগজেরও হতে পারে। তার ছোট্ট মাস্তুলে পতাকা। পতাকাটাও মজার। আরও কি সব দেখলাম।’ বলল আহমদ মুসা।
ড্যানিশ দেবানন্দের দূরবীনের চোখ এক জায়গায় স্থির। মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে। তার মুখে হাসি এখন নেই। গম্ভীর, ভারী হয়ে উঠেছে তার মুখ।
এক সময় সে চোখ থেকে দূরবীন সরাল। তার মুখ তখনও গম্ভীর। তার সাথে কিছুটা কৌতুহল ও উত্তেজনারও ছাপ। আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল সে, ‘ছোট ভাই, ওটা নৌকা কিন্তু নৌকা নয়। ওটা এক ধরনের এস ও এস (SOS)। চীনা-থাই প্রাচীন রীতি অনুসারে আল্লাহর কাছে চিঠি।’
‘আল্লাহর কাছে চিঠি?’ প্রশ্ন আহমদ মুসার। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘হ্যাঁ ছোট ভাই, নৌকায় একটা চিঠি আছে। নৌকা ‘পবিত্র পাতা’র (Divine leaves) তৈরি। চীনা-থাই ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে সে দেশে এক প্রকারের গাছ আছে যা স্বর্গ থেকে আসা। ওর পাতাগুলো পবিত্র। পাতাগুলো হিন্দু মন্দিরে পূজার উপকরণ, বৌদ্ধ মন্দিরে বৌদ্ধের মূর্তির বেদি সাজানো হয় ঐ পাতা দিয়ে এবং এই পাতাগুলো দিয়ে মসজিদের মিম্বরের বিছানা তৈরি হয়, জায়নামাযও বানানো হয়। পাতাগুলো পানিতে পচেনা, শুকালেও ভেঙে যায় না। নৌকার ছোট মাস্তুলে একটা পতাকা দেখছেন। নীল বর্ডার দেয়া সাদা পতাকা। ওটা থাইল্যান্ডের সর্বপ্রাচীন ‘সাকোথাই’ রাজবংশের পারিবারিক পতাকা। সাকোথাই রাজবংশ এখন মংকুত বা চকরী রাজবংশ নামে থাইল্যান্ডে বর্তমান রয়েছে। অবশ্য এরা এখন ঐ পতাকা বদলেছে। সেই প্রাচীন সাকোথাই…….।’
‘কিন্তু ঐ খেলনা নৌকায় ঐ পতাকা কেন?’ ড্যানিশ দেবানন্দকে থামিয়ে তার কথার মাঝখানে বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘সেই কথাই বলতে যাচ্ছি। পতাকার সাদা অংশে নিশ্চয় দেখছেন একটা লাল ছোপ। এটা একটা মেসেজ, এটাই এসওএস (SOS) । এই মেসেজে বলা হয়েছে, মানুষের শান্তির জীবনে আগুন লাগানো হয়েছে বা হচ্ছে কিংবা হবে। এই সংকট থেকে বাঁচার জন্যে সাহায্য চেয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে মেসেজ পাঠানো হয়েছে পবিত্র পাতার নৌকাকে বাহন সাজিয়ে। প্রাচীন বিশ্বাস হলো, আল্লাহ নিজ কুদরতে এই মেসেজ কারও ঘাটে বা কারো হাতে পৌছে দেবেন। তাদের আরও বিশ্বাস, নৌকাটি যিনি প্রথম দেখবেন সাগরে বা ঘাটে, তিনিই হবেন স্রষ্টার সেই মনোনীত বক্তি।’ ড্যানিশ দেবানন্দ বলল।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে বিস্ময়। রূপকথার মতই লাগলো কথাগুলো। কিন্তু পাতার নৌকাটি বাস্তব। সেখানে পতাকা বাস্তব। তাতে রক্তের ছোপটাও বাস্তব। কণ্ঠে বিস্ময় নিয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘নৌকাটি তো এখানে আমিই প্রথম দেখলাম। তার মানে মেসেজটাকে আল্লাহ আমার কাছেই পৌছাচ্ছেন?’
ড্যানিশ দেবানন্দের মুখে হাসি। বলল, ‘সাকোথাই ও তাদের বর্তমান উত্তরসূরীদের এটাই বিশ্বাস।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তার মানে বলতে চাচ্ছেন, নৌকা আমার কাছেই এসেছে।’
‘আমি বলছি না, ওদের প্রাচীন বিশ্বাস বলছে।’ বলল ড্যানিশ দেবানন্দ।
শুধু টেবিলের নয়, ঘরের সবাই শুনছিল আহমদ মুসাদের কথা। ড্যানিশ দেবানন্দ থামতেই বেগম আবদুল্লাহ বলে উঠল, ‘আমার অবাক লাগছে মি. দেবানন্দ সাকোথাই রাজবংশের এই প্রাচীন বিশ্বাসের কথা জানলেন কি করে?’
‘কারণ আমাদের জামাই দেবানন্দের মা চীনা-থাই প্রাচীন রাজবংশ ‘সাকোথাই’ এর একটি শাখার মেয়ে, যে শাখা ৭৮২ খৃষ্টাব্দে থাইল্যান্ডে নতুন চকরী রাজবংশ নাম নিয়ে তাদের সাম্রাজ্য পুনঃস্থাপন করে।’
‘ওয়েলকাম জামাই। এই বড় খবরটি আমরা জানতাম না। নতুন পরিচয়ে ওয়েলকাম জামাই।’ বলল বেগম আবদুল্লাহ।
মুহূর্তকাল নিরবতা।
সুস্মিতা বালাজী ড্যানিশ দেবানন্দের সামনে থেকে দূরবীনটা টেনে নিয়ে বলল, ‘দেখি নৌকাটা এখন কোথায় কোন দিকে যাচ্ছে।’
দূরবীন চোখে লাগাল সুস্মিতা বালাজী।
তার দূরবীনের চোখ খুঁজতে লাগল নৌকাটিকে। এক সময় প্রায় চিৎকার করে সে বলে উঠল, ‘নৌকাটি এসে গেছে আমাদের ঘাটের দিকেই আসছে।’
আহমদ মুসা সুস্মিতা বালাজীর কাছ থেকে দূরবীনটি নিয়ে চোখে লাগাল। একটু ঝুঁকে পড়ল কাঁচের দেয়ালটার উপর। দেখল, সত্যিই নৌকাটি এসে গেছে, নিচে নেমে যাওয়া সিড়ির যেখানে একটা বোট বাঁধা আছে, নৌকাটি প্রায় সেখানে পৌছে গেছে।
আহমদ মুসা দূরবীনটি টেবিলে রেখে ড্যানিশ দেবানন্দকে লক্ষ্য করে বলল, ‘চলুন ভাই সাহেব নৌকাটি নিয়ে আসি। আমরা নামতে নামতে নৌকা ঘাটে পৌছে যাবে।’
আহমদ মুসা ও ড্যানিশ দেবানন্দ দুজনেই উঠে দাঁড়াল।
‘জামাই দেবানন্দ তোমার রূপকথাকে জীবন্ত দেখলে সেটা একটা ভাগ্যের ব্যাপার হবে। গুডলাক দেবানন্দ।’ উৎসাহ দিয়ে বলল হাজী আবদুল্লাহ।
আহমদ মুসাদের সাথে অনেকেই উঠে দাঁড়িয়েছিল। কেউ কাঁচের দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়াল, আবার কেউ কেউ সিঁড়ি মুখের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসারা নেমে গেল সিঁড়ির একদম পানির কিনারায়।
তখনও কয়েক গজ দূরে নৌকাটা। কিন্তু ঠিক সিঁড়ি বরাবরই ভেসে আসছে।
নৌকাটি এসে ঠিক ষ্টিলের সিঁড়ির সাথে আটকে গেল। যেন নোঙর করল নৌকাটি।
৬ ইঞ্চির মত লম্বা নৌকাটি। ঠিকই পাতার তৈরি। কাগজের নৌকার মত ডিজাইনেই যেন তৈরি হয়েছে নৌকাটি, দুই ইঞ্চি লম্বা মাস্তুলটি ও নৌকার মাঝখানের পিরামিড আকৃতির পেটের সাথে আটকানো। পতাকাটি দেড় ইঞ্চি বর্গাকৃতির।
ড্যানিশ দেবানন্দ বলল, ‘ছোট ভাই আপনিই নৌকাটি তুলে নিন।’
‘অবশ্যই’। আহমদ মুসা বিসমিল্লাহ বলে নৌকাটি পানি থেকে তুলে নিল।
নৌকা নিয়ে আহমদ মুসারা তাদের টেবিলে ফিরে এল।
পাশের টেবিল থেকে মিসেস বিবি মাধব, বেগম আবদুল্লাহ, সাহারা বানু ও হাজী আবদুল্লাহ আহমদ মুসাদের সাথে সাথেই ছুটে এল এ টেবিলে।
সবাই গাদাগাদি করে আহমদ মুসাদের টেবিল ঘিরে বসল। সবার দৃষ্টি ৬ ইঞ্চি নৌকাটির দিকে।
‘মি. দেবানন্দ, সাকোথাই নৌকাটির পতাকায় রক্তের ছোপ দিয়ে ‘এসওএস’ সংকেত দেয়া হয়েছে বুঝলাম। এ সংকেত সাকোথাইদের কোন উত্তরসূরীদের কাছ থেকে এসেছে এটাও বুঝলাম। কিন্তু ‘এসওএস’ সংকেত কেন, কি ঘটনা, কোত্থেকে এল এই সংকেত ইত্যাদি বিষয় না জানলে এই ‘এসওএস’-এর সার্থকতা কি?’ বলল হাজী আবদুল্লাহ।
‘স্যার, যে পাতা দিয়ে এই নৌকা তৈরি হয়েছে, রীতি অনুসারে তার সাথে একটা চিঠি জড়ানো থাকার কথা। তাতেই সব বিস্তারিত লেখা থাকে।’ বলল ড্যানিশ দেবানন্দ।
‘ভাই সাহেব, তাহলে খুলুন নৌকাটা। দেখা যাক চিঠি আছে কিনা, সে রকম চিঠি থাকলে সেটা একটা বড় ঘটনা হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
ড্যানিশ দেবানন্দ নৌকাটি টেনে নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে পতাকাটি খুলে দিল নৌকা থেকে।
পাতা ভাঁজ করে তৈরি করা নৌকাটি খুলে ফেলল ড্যানিশ দেবানন্দ। পাতার সাথে এক সাথে ভাঁজ করা বেশ বড় একখন্ড কাগজও বেরিয়ে এল। নিজে না দেখেই কাগজটি ড্যানিশ দেবানন্দ তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
কাগজ খন্ডটি ৬ ইঞ্চি ও ৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য-প্রস্থের। কাগজটি ওয়াটার প্রুফ। দুপাশেই লেখা। যে কালিতে লেখা তাও ওয়াটার প্রুফ এবং অমোচনীয়।
কাগজ ও কালি সম্পর্কে এ খবর দিল ড্যানিশ দেবানন্দ। কাগজ খন্ডটি আহমদ মুসার হাতে তুলে দেবার সময় আরও জানাল, ‘আমার মা’র কাছে এই কালি সম্পর্কে শুনেছি। রাজ পরিবারের লোকরা ছাড়া এই কালি তৈরির ফর্মুলা আর কেউ জানে না। মা জানতেন তৈরি করতে, কিন্তু কোনদিন তৈরি করেননি। রাজ পরিবারের কেউ ভিন্ন পরিবারে গেলে এবং কোন জাতি বিষয়ক ডকুমেন্ট ছাড়া এ কালির ব্যবহার নিষিদ্ধ।’
আহমদ মুসা কাগজ খন্ডটি হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখে বলল, একপাশে আরবী, অন্যপাশে সাকোথাই বর্ণমালা অর্থাৎ থাইভাষায় লেখা। আমি…..।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না। তার কথার মাঝখানে সাজনা সিংহাল বলে উঠল, ‘আরবী কোত্থেকে এল স্যার? নৌকাটি আসতে পারে থাই-বার্মার দিক থেকে।’
‘দক্ষিণ থাইল্যান্ডের পাত্তানী অঞ্চলের লোকেরা তাদের থাই ভাষা লেখার ক্ষেত্রে থাই ও আরবী দুই বর্ণমালাই ব্যবহার করে থাকে।’ বলল আহমদ মুসা।
একটু থামল। মুখ তুলে সবার দিকে তাকাল। বলল, ‘আমি নিশ্চিত কাগজের দুই পাশের লেখার বিষয়বস্তু একই। আরবী ভাষা আমরা দু’একজন ছাড়া কেউ বুঝব না। সুতরাং দেবানন্দ ভাই সাহেব চিঠির থাই ভাষার দিকটা পড়ুন। সে ভাষা আমরা সবাই বুঝব।’
বলে আহমদ মুসা চিঠি তুলে দিল ড্যানিশ দেবানন্দের হাতে।
‘তথাস্তু ছোট ভাই’ বলে চিঠি হাতে তুলে নিল ড্যানিশ দেবানন্দ। পড়তে শুরু করলঃ
‘‘আমি যয়নব যোবায়দা। আমার নিকটতম একজন পূর্ব পুরুষ পাত্তানীর একজন রাজা সুলতান আবদুল কাদির কামালুদ্দিন। পূর্ববর্তী একজন পূর্ব পুরুষ পাত্তানী মুসলিম রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা সুলতাম আহমদ শাহ ওরফে চাউসির বাংগসা। চাউসির বাংগসা ছিলেন থাইল্যান্ডের ‘সাকোথাই’ রাজবংশের যুবরাজ। ১৩৫০ সালের দিকে পাত্তানী অঞ্চলে আসেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সুলতান আহমদ শাহ নাম গ্রহণ করেন। সে অঞ্চলে ১৬০০ খৃষ্টাব্দের দিকে মুসলিম রাজত্বের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সুলতান আহমদ শাহ এর উত্তরসূরীদের দ্বারা এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বংশেরই এক সুলতান হলেন, সুলতান আবদুল কাদের কামালুদ্দিন। এই সুলতান আবদুল কাদেরের সংগ্রামী পুত্র টংকু আবদুল কাদেরের নাতনি আমি। আমার ভাই জাবের বাংগসা জহীর উদ্দিন এবং আমার দাদী নিয়ে আমাদের তিনজনের পরিবার। ১৯০২ সালে পাত্তানী অঞ্চল পুরোপুরি থাই শাসনে চলে যাওয়া এবং আমাদের বংশের অন্যান্য সকল সদস্য হিজরত করে মালয়েশিয়ায় চলে যাবার পর গত শত বছরে আমাদের এই পরিবার পাত্তানী-জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। শাসন ব্যাংককের হাতে থাকলেও লাখ লাখ পাত্তানী মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব এই পরিবারের উপর এসে বর্তেছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পাত্তানীরা প্রায় স্বাধনি জীবন-যাপন করছিল এবং চীন বংশোদ্ভুত আমাদের সাকোথাই পরিবারের কারণে থাইল্যঅন্ডের চিনা বংশোদ্ভুতদের (যাদের সংখ্যা তিন চতুর্থাংশে) মধ্যে ইসলামের প্রভাব দ্রুত বাড়ছিল। এই সময় বিনামেঘে বজ্রপাত ঘটল। এক রাতে আমাদের অঞ্চলের প্রধান সেনানিবাসের উপর এক নৃশংস হামলা হলো। সংঘর্ষে বেশ কিছু থাই সৈন্য নিহত ও আহত হলো। পরদিন ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়া আক্রমণকারীদের কিছু জিনিস কুড়িয়ে পাওয়া যায়। তার মধ্যে কয়েকটি বন্দুক, টুপি, ইত্যাদি রয়েছে। বন্দুকের প্রতিটি বাঁটে খোদাই করে ‘আল্লাহ’ শব্দ লেখা। টুপিরও চারধারে এমব্রয়ডারীতে ‘আল্লাহ’ শব্দ আঁকা। গজব নাজিল হলো প্রথমই আমাদের পরিবারের উপর। আমার ভাই গ্রেফতার হলেন। পরে গ্রেফতার হলো আরো অনেক পাত্তানী যুবক। বিশেষ করে আমার ভাইয়ের গ্রেফতারে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হলো গোটা পাত্তানী অঞ্চলে। এই পরিস্থিতিতে পাত্তানীর আরও কয়েকটি থাই সেনাশিবীরে আক্রমণ হলো। পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে সেনাদের আক্রমণের শিকার হলো পাত্তানী গ্রাম। জীবন দেয়া-নেয়ার নৃশংসতায় পাত্তানীর সবুজ অরণ্য আজ রক্তাক্ত। এর ভবিষ্যৎ কি আমি জানি না। তবে আমি নিশ্চিত বলতে পারি, এসব কিছুর মধ্যে একটা ভয়াবহ ষড়যন্ত্র রয়েছে এবং সে ষড়যন্ত্রই জয়ী হতে যাচ্ছে। এই সংঘাত সৃষ্টির সাথে আমার ভাই, আমার পরিবার কিংবা পাত্তানীদের পরিচিত কোন সংস্থা-সংগঠন জড়িত নয়। একথা ঠিক আমার দাদা টংকু আবদুল কাদের এক সময় সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিলেন। কিন্তু তার জীবদ্দশাতেই সর্বসম্মতিক্রমে অস্ত্র পরিত্যাগ করে শান্তিপূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের আন্দোলন তিনি শুরু করেন। শেষ দিকে তিনি বলতেন, ‘আমাদের দেশের আদি পরিচয় ‘সাকোথাই’ (সুখের এক সুপ্রভাত) এবং ‘মোয়াং থাই’ (‘মুক্ত মানুষের মাটি’)। থাইল্যান্ডকে যদি আমরা এই আসল পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তাহলে আমরা পাত্তানীর মুসলমানরা সেখানে সব অধিকারই পেয়ে যাব। আমাদেরকে এই প্রাপ্তির আন্দোলনটাই প্রথম করতে হবে। এজন্যে প্রয়োজন প্রতিটি মানুষের মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা।’ টংকু আবদুল কাদেরের এই কথাগুলো আজ তলিয়ে যাচ্ছে। তার জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে ঘাতকের অস্ত্র। ঘাতকের এই অস্ত্র যেমন থাই সৈন্যদের প্রতি উদ্যত, তেমনি উদ্যত পাত্তানীদের সত্য কথা, সুস্থ চিন্তার বিরুদ্ধেও। অন্যদিকে এই পাত্তানীরা থাই সৈন্যদের প্রতিশোধেরও শিকার। পাত্তানীরা আজ এই দ্বিমুখী আগুনের অসহায় ইন্ধন। এই আগুনে আমরা পুড়ে শেষ হবার মুখোমুখি। প্রতিটি নতুন দিন; অবস্থার নতুন অবনতি নিয়ে আসছে। এই অবনতি রোধ করে পাত্তানী ও থাই মুসলমানদের বাঁচাবে কে? আল্লাহই পারে। তাঁর কাছেই আমার চিঠি।’’
চিঠি পড়া শেষ করল ড্যানিশ দেবানন্দ।
সবার চোখ ড্যানিশ দেবানন্দের মুখের দিকে। পিন পতন নিরবতার মধ্যে শুনছিল সবাই।
ড্যানিশ দেবানন্দ থামলেও পিনপতন নিরবতা ভাঙল না।
চিঠির কথাগুলো ভাবাচ্ছে সকলকে।
নিরবতা ভেঙে কথা বলল হাজী আবদুল্লাহ। বলল, ‘আমি দুঃখিত, আমি নৌকাটিকে খেলনা মনে করেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি, একটা জনগোষ্ঠীর তরফ থেকে মর্মান্তিক এক এসওএস।’
বলে মুহূর্তকাল থেমে আবার শুরু করল, ‘থাইল্যান্ডের পাত্তানী অঞ্চলের ঘটনা জানি। কিন্তু ভেতরের এই ভয়াবহ ঘটনা আমি জানি না। আল্লাহ তাদের রক্ষা করুন।’
‘চিঠিতে চিঠির লেখিকা যয়নব যোবায়দার যে পরিচয় দেয়া হয়েছে, সে দিক থেকে আমি মনে করি চিঠিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং চিঠির প্রতিটি কথা সত্য। আর সাকোথাইদের ইতিহাসে এমন চিঠি প্রেরণের দৃষ্টান্ত বেশি নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনের চিঠি ব্যক্তিগত বিষয়ে হয়ে থাকে। পরের জন্যে বা জাতীয় বিষয়ে এমন চিঠির ঘটনা আমি শুনিনি। আমি শুনেছি, জাতীয় বিষয়ে লেখা এ ধরনের চিঠি কখনও ব্যর্থ হয় না।’ বলল ড্যানিশ দেবানন্দ।
‘ড্যানিশকে ধন্যবাদ। সে যে তার বংশের ঢোল পেটাচ্ছে, ব্যাপারটা তা নয়। থাইদের প্রাচীন সব ইতিহাসেই এসব কথা আছে। আমি থাই রূপকথাতেও এটা পড়েছি। কিন্তু আমাদের সামনে যে চিঠিটা সেটা রূপকথা নয়।’ বলল সুস্মিতা বালাজি।
‘রূপকথার মত এই চিঠিটির গন্তব্য কি আমাদের এ বাড়ি ধরে নিতে হবে?’ হাজী আবদুল্লাহ বলল।
‘এ ধরনের চিঠির গন্তব্য বাড়ি বা স্থান হয় না, হয় ব্যক্তি এবং সে ব্যক্তি হয় ঈশ্বরের প্রতিনিধি।’ বলল ড্যানিশ দেবানন্দ।
‘বাড়ির মালিক হিসাবে চিঠির মালিক তাহলে কি আমি হব?’ হাজী আবদুল্লাহ বলল।
‘আমি বলেছি, প্রথা অনুসারে নৌকা প্রথম যার নজরে পড়ে এবং যিনি নৌকা তুলে নেন, তিনি নৌকার মালিক হন।’ বলল ড্যানিশ দেবানন্দ।
‘চিঠি তো ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে লেখা। মানুষ এ চিঠি নিয়ে বা এর মালিক হয়ে কি করবে?’ বলল সাজনা সিংহাল।
‘সাকোথাইদের বিশ্বাস, ঈশ্বরের নামে লেখা চিঠি ঈশ্বরই তার মনোনীত লোকের হাতে পৌছে দেন। সুতরাং মানুষ চিঠির মালিক হন ঈশ্বরের তরফ থেকেই।’ ড্যানিশ দেবানন্দ বলল।
‘ও গড! স্যার তাহলে নৌকা দেখেছেন ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই!’ সাজনা সিংহাল বলল।
‘শুধু এখানে নয়, গোটা আন্দামানে আল্লাহ আর কাকে মনোনীত করতে পারে বল?’ বলল বেগম হাজী আবদুল্লাহ।
জানালার ভেতর দিয়ে আন্দামান সাগরের দিকে তাকিয়েছিল আহমদ মুসা। শূন্য দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া তার দৃষ্টি। ভাবলেশহীন মুখ। চারপাশের কোন কথাই যেন তার কানে প্রবেশ করেনি।
ধীরে ধীরে এক সময় তার মুখ ঘুরে এল জানালা থেকে, আন্দামান সাগরের দিক থেকে।
বেগম হাজী আবদুল্লাহর কথা তখন শেষ হয়েছে। আহমদ মুসা বলে উঠল হাজী আবদুল্লাহকে লক্ষ্য করে, ‘জনাব, চিঠিতে উল্লেখিত নাটের গুরু তৃতীয় শক্তিটি কে কে হতে পারে?’
‘বলা মুস্কিল। তবে সেই শক্তি থাই সরকারের বন্ধু নয়, কিন্তু তারা পাত্তানী মুসলমানদের শত্রু, এ বিষয়টি চিঠি থেকে পরিষ্কার।’ বলল হাজী আবদুল্লাহ।
‘কিন্তু এ শক্তির পরিচয় কি হতে পারে?’ আহমদ মুসা বলল। তার ভ্রুকুঞ্চিত।
‘সুনির্দিষ্ট করে বলা মুস্কিল। তবে থাইল্যান্ডেরই কোন মুসলিম বিদ্বেষী গ্রুপ এরা হতে পারে।’ হাজী আবদুল্লাহ বলল।
আহমদ মুসা পকেট থেকে মোবাইল বের করল। এই সময় তার চোখ গিয়ে পড়ল হঠাৎ টিভি স্ক্রীনের উপর। টিভি’র সাউন্ড তখন খুব কম করা ছিল। লাইভ টেলিকাষ্ট হচ্ছিল একটা ফুটবল খেলা। টিভি স্ক্রীনের বটমে নিউজের হাইলাইটস দেখাচ্ছিল। তাতে ‘থাইল্যান্ডে রক্তক্ষয়ী সংঘাত’ শিরোনাম দেখল আহমদ মুসা। দেখেই ঘুরে বসল।
আহমদ মুসাকে অনুসরণ করে সবার দৃষ্টি গিয়ে নিবদ্ধ হলো টিভি স্ক্রীনের ওপর। পড়ল সবাই, ‘পাত্তানী অঞ্চলে পাত্তানী শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তরে একটা থাই সেনাশিবিরের উত্তরে একটা থাই সেনাশিবিরের উপর আকস্মিক আক্রমণে ১১ জন থাই সেনা নিহত হয়েছে। থাই সৈন্যরা পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং হামলাকারীদের অনুসরণ করে পাত্তানীদের একটা বড় গ্রামে পৌছে। সে গ্রামের মাদরাসায় তখন বার্ষিক ধর্মসভা চলছিল। থাই সৈন্যরা সে জমায়েতের উপর আক্রমণ চালায়। সংঘর্ষ বেধে যায়। সংঘর্ষে ৪৩ জন গ্রামবাসী নিহত হয়। আহতের সংখ্যা কয়েক শত।’
খবরটি পড়ার সাথে সাথে সবার মুখ বিষণ্ণতায় ভরে গেল।
কিন্তু আহমদ মুসার মুখ ভাবলেশহীন, অনেকখানি অন্যমনস্ক যেন সে। এখান থেকেও অন্যকিছু সে দেখছে, ভাবনার ক্ষেত্র যেন তার অন্য কোথাও।
বিষাদ-নিরবতটা ভাঙল হাজী আবদুল্লাহ। বলল, ‘বৎস আহমদ মুসা, টিভিতে যে কাহিনী আমরা পড়লাম, তাতে যারা থাই সেনা শিবির আক্রমণ করেছিল এবং গ্রামের জনসভার দিকে পালিয়ে গিয়ে সেনা আক্রমণ সেখানে সেখানে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, তারাই তোমার সেই তৃতীয় পক্ষ। বুঝা যাচ্ছে, এরা এক বিপজ্জনক পক্ষ। বিপজ্জনক এক ফাঁদে আটকেছে থাই মুসলিম ও থাই সরকার দুই পক্ষকেই।’
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে তাকাল হাজী আবদুল্লাহর দিকে। বলল, ‘রাইট স্যার।’ কণ্ঠ আহমদ মুসার নিস্তরঙ্গ ও নিরুত্তাপ।
বলেই আহমদ মুসা মোবাইল তুলে নিল হাতে। মোবাইলের স্ক্রীনে চোখ পড়তেই দেখল ব্যাটারীর রেড সিন্যাল, ‘রিচার্জের ম্যাক্সিমাম সময় ৬ মাস পার হয়ে গেছে। আনএবল টু এ্যাক্ট।’
আহমদ মুসা হাতের মোবাইল টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, মোবাইল বিদ্রোহ করেছে। ছয় মাস রিচার্জ করা হয়নি। ল্যান্ড টেলিফোনটা দিন আপা।’
টেবিলের ওপাশে সুস্মিতা বালাজীর কাছে একটা ল্যান্ড টেলিফোন ছিল।
সুস্মিতা বালাজী দাঁড়িয়ে টেলিফোনটা আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ছোট ভাই, আমার মোবাইলটিও আইএসডি। দেব আপনাকে?’
অন্য সবাই এক সাথে বলে উঠল, ‘কোথায় টেলিফোন করবেন? মোবাইল নিন।’
‘সউদি আরবে জোসেফাইনের কাছে টেলিফোন করব। ল্যান্ড টেলিফোনটাই আরামদায়ক হবে।’ শান্ত গলায় বলল আহমদ মুসা।
জোসেফাইনের নাম শুনতেই সকলের মুখে সম্ভ্রমপূর্ণ প্রসন্ন ভাব ফুটে উঠল।
এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেছে সাজনা সিংহালের মুখে।
চট করে উঠে দাঁড়াল। একটু ঝুঁকে পড়ে টেলিফোন সেটের স্পীকার অন করে দিল।
‘এ কি করলে সাজনা? সুষমা স্পীকার অফ করে দাও।’
সুষমা ওদিকে হাত বাড়াচ্ছিল।
আহমদ মুসা সুষমাকে নিষেধ করে বলল, ‘সাজনা তার ম্যাডামের কথা শুনতে চায়। তাকে হতাশ করার দরকার নেই।’
সাজনা সিংহাল উঠে দাঁড়াল। বলল আহমদ মুসার উদ্দেশ্যে, ‘স্যার, নাম আমার হচ্ছে। কিন্তু সকলেই উন্মুখ হয়ে আছে তাঁর কথা শোনার জন্যে। দেখুন, এক এক করে জিজ্ঞাসা করছি। কেউ না বলবে না।’
‘না জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই। তোমার পক্ষে ভোট অনেক। তোমারই জিত হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অনেক ধন্যবাদ স্যার। আমার চেয়ে অন্যেরা আরও খুশি হয়েছেন।’ বলল সাজনা সিংহাল।
টেলিফোন সেট টেনে নিয়ে ডায়াল করল আহমদ মুসা।
সেকেন্ডের মধ্যে ওপার থেকে একটা নরম নারী কণ্ঠ ভেসে এল, ‘আসসালামু আলাইকুম’ আমি জোসেফাইন।
‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম। কেমন আছ জোসেফাইন?’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠ শান্ত, সম্ভ্রমপূর্ণ।
‘আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কোত্থেকে বলছ? ভাল আছ তো? তোমার মোবাইল বন্ধ কেন?’
‘জোসেফাইন, তুমি তিনটা প্রশ্ন করলে। আমার প্রশ্নের জবাব দাওনি।’
‘স্যরি। তোমার মোবাইল হঠাৎ রেসপন্স না করায় আমি ওরিড ছিলাম। আমি ভাল আছি, আহমদ আবদুল্লাহ ভাল আছে। ওকে, এখন বল।’
‘আলহামদুলিল্লাহ, আহমদ আবদুল্লাহ ভাল আছে। কিন্তু তুমি ভাল নেই। একটা ক্লান্তি তুমি গোপন করছ। সকালেও কথা বলার সময় আমার এটা মনে হয়েছে।’
‘ঠিক ধরেছ। গত ২দিন আমার জ্বর গেছে। গত রাত থেকে আমি ভাল।’
‘জ্বরটা কেন, ডাক্তার কি বলেছেন?’
‘চিন্তা করো না এ নিয়ে। ডাক্তার আয়েশা ও ডাক্তার ফাতিমা দেখেছেন। সিজনাল ধরনের জ্বর বলেছেন।’
‘ওকে জোসেফাইন। আমার মোবাইলে চার্জ ছিল না সেজন্য পাওনি। আমি ভাল আছি। আমি এখনও বিয়ে বাড়িতেই আছি।’
‘ও নাইস। শাহবানু, সুষমারাও নিশ্চয় আছে। নতুন জীবনে ওদের ওয়েলকাম। আল্লাহ ওদের জীবন দীর্ঘ করুন, মঙ্গলময় করুন। আমার সালাম ওদের দিও। দুই বোনকে কিছু প্রেজেন্ট করেছ?’
‘স্যরি। আমি এ দিকটা তো ভাবিইনি।’
‘এটাই স্বাভাবিক। সব ভাবনা এক সাথে হয় না।’
‘এখন বল, তোমার পরমর্শ কি?’
‘দুবোনকে দুটি ‘ইউনিভার্স এ্যাটলাস’ উপহার দাও।’
‘ইউনিভার্স-এ্যাটলাস’। ওটা দিয়ে ওরা কি করবে?
‘কেন বৈচিত্রময় পৃথিবীর দেশ ও মানুষের ভূগোলকে দেখবে, রূপময় আকাশের বিশালতা ও অপরূপতাকে দেখবে এবং দেখবে এর বিজ্ঞানময় স্রষ্টাকে।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। ইউনিভার্স এ্যাটলাসের নতুন অর্থ দিলে তুমি আমাকে। তোমাকে ধন্যবাদ। এই এ্যাটলাস ওদের দেব।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। এখন তোমার কথা বল।’
‘কোন কথা?’
‘যা বলার জন্যে টেলিফোন করেছ?’
‘কি করে নিশ্চিত হলে?’
‘তোমাকে অন্যমনস্ক দেখছি। তোমার মন অন্য কোথাও নিশ্চয়। তুমি আববা-আম্মার কথা জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেছ। তুমি নিজে কয়েকদিন আগে খোঁজ নিলে ডাক্তার ফাতিমা আমেরিকা থেকে এসেছে কিনা। কিন্তু আজ তার নাম শুনেও কিছু বললে না। নিশ্চয় তোমার মন কোথাও আটকা পড়ে গেছে।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। তুমি ঠিকই ধরেছ। নতুন একটা বিষয় নিয়ে ভাবছি।’
বলে আহমদ মুসা সমুদ্র ভেংগে আসা পাতার বিস্ময়কর নৌকা, যয়নব যোবায়দার চিঠি এবং চিঠির সব কথা সংক্ষেপে বলল।
থামল আহমদ মুসা।
থামার সাথেই ওপার থেকে জোসেফাইন বলে উঠল, ‘অদৃশ্য তৃতীয় পক্ষটা কে জান? ওরা বন্ধু বেশে শত্রু অতিশয়। ইসলামী বিপ্লবীর পোশাক পরে ওরা এসেছে।’
‘এত তাড়াতাড়ি ওদের তুমি চিনলে কি করে? তুমি কিন্তু আমার ভাবনাকেই প্রকাশ করেছ জোসেফাইন। ধন্যবাদ।’
‘ওয়েলকাম। ওদের চেনার জন্যে সময়ের প্রয়োজন নেই জনাব। সেই টুইন-টাওয়ারের নাইন-ইলেভেন পর বন্ধুবেশী এ ষড়যন্ত্রকারীদের সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে।’
বলে একটা দম নিয়েই জোসেফাইন বলল, ‘তুমি থাইল্যান্ডে যাত্রা করছ কখন?’
‘আমি যাচ্ছিই, এটা কেন ধরে নিলে?’ মুখে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে জবাব এল না জোসেফাইনের কাছ থেকে। মুহূর্ত কয়েক পরে সে বলল, ‘তুমি যাচ্ছ, আমি এ কথা বলিনি। তোমার যাওয়া উচিত বলেই আমি এ কথা বলেছি। আল্লাহর কাজের কোন আবেদনের সাড়া তিনি তাঁর কোন বান্দার মাধ্যমেই দেন। বোন যয়নব যোবায়দার দরখাস্তের সাড়া আল্লাহ দেবেন তার কোন বান্দাকে পাঠিয়েই। সেই সৌভাগ্যবান মানুষ আমার স্বামী হোন এটাই তো আমি চাইব।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। অসংখ্য ধন্যবাদ আল্লাহকে, যিনি তোমাকে দিয়েছেন আমাকে জীবন সঙ্গিনী হিসাবে। থাইল্যান্ডে যাওয়ার ব্যাপারে আমার দ্বিধাগ্রস্ততা ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেল। আবারো ধন্যবাদ জোসেফাইন।’
‘এত ধন্যবাদ তখন প্রয়োজন হয়, যখন পাওয়াটা আশাতীত হয়ে থাকে। তুমি কি ভেবেছিলে জোসেফাইনের পরামর্শ অন্যরকম হতে পারে?’
‘না। আমি ভাবছিলাম অন্য বিষয়। আন্দামান থেকে ফিরে আমাদের আমেরিকা যাওয়ার প্রোগ্রাম আছে। আমেরিকায় তোমার আমন্ত্রণ যে কারণে, সে অনুষ্ঠান তো এ মাসেই। এটাই আমার ভাবনার বিষয় ছিল।’
‘ঠিকই ভেবেছ। এ ব্যাপারে আমার মত হলো, আমেরিকা যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিলও নয়, আবার যাওয়ার সিদ্ধান্তও নয়। ওটা আল্লাহর হাতে থাক। এই মুহূর্তের জন্যে যেটা করণীয়, সেটাই করতে হবে।’ বলল জোসেফাইন শান্ত, কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে।
‘আমিন। সিদ্ধান্ত তুমি দিয়ে দিলে।’ বলল আহমদ মুসা। তার মুখে সানন্দ হাসি।
‘এ সৌভাগ্য আমার উপর বর্তালে আমি খুশিই হতাম। কিন্তু সত্য হলো, আমি তোমার সিদ্ধান্ত পূর্ণ করলাম মাত্র।’
‘এটাই স্বাভাবিক জোসেফাইন। দু’জনে মিলেই তো আমরা পূর্ণাঙ্গ।’ আবেগে ভারী কণ্ঠস্বর আহমদ মুসার।
‘আলহামদুলিল্লাহ। এটাই আল্লাহর ইচ্ছা।’
একটু থেমে একটা দম নিয়েই আবার বলে উঠল জোসেফাইন, ‘আজকে তোলা আহমদ আবদুল্লাহর একটা ছবি কম্পিউটারে পাঠাচ্ছি। তুমি ওটা থাইল্যান্ডে নিয়ে যেতে পারবে।’
‘তোমার ছবিও।’
‘পাঠাব না।’
‘কেন?’
‘চোখ বুজে দেখ, ছবিটা দেখতে পাবে। ওর চেয়ে ভাল ছবি কোন ক্যামেরা দিতে পারে না।’
‘ঠিক জোসেফাইন।’
‘ধন্যবাদ।’
‘আর কিছু কথা?’
‘আমার প্রশ্নের জবাব দাওনি। কখন তুমি যাত্রা করছ থাইল্যান্ডে?’
‘আন্দামানে থাই ভিসার ব্যবস্থা আছে। যদি আজ ভিসা পেয়ে যাই, তাহলে প্লেনের সিট পেলে আজকেই চলে যাব।’
‘না, শাহবানু, সুষমা বোনদের এইমাত্র বিয়ে হলো। ওদের আনন্দের দিনে নিরানন্দ ডেকে এনো না। একদিন ওয়েট করো। তাছাড়া সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে তো কিছু সময় লাগবে।’
থামলো জোসেফাইন। কিন্তু পরক্ষণেই আবার তার কণ্ঠ শোনা গেল। বলল, ‘তোমার আর কিছু কথা না থাকলে রাখি। ডাক্তার ম্যাডাম যে কোন সময় এসে পড়তে পারেন। তৈরি হতে হবে।’
‘ঠিক আছে জোসেফাইন। আন্দামান ছাড়ার আগে তোমাকে আবার কল করব।’
‘ওয়েলকাম। শাহবানু, সুষমাদের আমার স্নেহ দিও। আর হাজী আংকেল এবং বেগম আবদুল্লাহ, সাহারাবানু ও মিসেস বিবি মাধব খালাম্মাদের আমার কৃতজ্ঞতা জানিও। ওঁরা তোমাকে যে স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়েছেন, আমি এখন থেকেও তার উষ্ণতা পাচ্ছি। আল্লাহ ওঁদের সবার মংগল করুন।’
‘ওকে জোসেফাইন। আহমদকে আমার স্নেহ, আম্মাদের আমার সালাম দিও। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। আল্লাহ হাফেজ।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা চেয়ারে হেলান দিল।
ঘরে পিনপতন নিরবতা।
নির্বাক সবাই।
সবার চোখে বিমর্ষ-বেদনার ছাপ।
আহমদ মুসাও কি দিয়ে কথা শুরু করবে তা ভেবে পেল না।
পল পল করে সময় বয়ে যাচ্ছে।
মুখ তুলল সাজনা সিংহাল। তার চোখ অশ্রুতে টল টল করছে বলল, ‘স্যার আপনি আজকেই যান। একদিন আরও থাকা মানে স্মৃতির আরও বেড়ে যাওয়া। মানুষের কষ্ট তাতে বাড়বে। আপনার মনে কিছুরই দাগ পড়ে না। কিন্তু সবার মন এমন পাথর নয়।’ থামল সাজনা সিংহাল।
তার দুগন্ড বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
সবার চোখই সিক্ত। মাথা নিচু।
চোখ মুছল সুষমা রাও। সে মুখ তুলল। বলল, ‘ভাইয়া সাজনা একদমই ছেলে মানুষ। ওর মন একেবারে সাদা। দুঃখের কোন কাল দাগ সেখানে নেই। কিন্তু ভাইয়া আমরা সবাই মনে করেছিলাম, আপনাকে কিছুদিন আমরা পাব। কিছু জানব, শিখব আমরা। এতদিন সংঘাত-সংকটের মধ্যে দিন গেছে। আপনি জানেন না ভাইয়া, আমার আম্মা আজ বাদ ফজর সুস্মিতা বালাজী আপাকে সাথে নিয়ে পোর্ট ব্লেয়ার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। আপনাকে সারপ্রাইজ দেবেন বলে কিছু বলেননি।’
এক ঝলক আনন্দে আহমদ মুসার মুখ ভরে গেল। সংগে সংগেই উঠে দাঁড়িয়ে মিসেস বিবি মাধবকে উদ্দেশ্য করে আহমদ মুসা বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ওয়েলকাম, খোশ আমদেদ খালাম্মা।’
‘আলহামদুলিস্নাহ। ধন্যবাদ বেটা। কিন্তু বেটা যে আলো তুমি এখানে জ্বেলেছ, তা একদমই ক্ষুদ্র। ভয় করছি, তুমি চলে গেলে অন্ধকারে না সব ছেয়ে যায় আবার।’ বলল সুষমার মা মিসেস বিবি মাধব।
‘ভয় নেই খালাম্মা। এ আলোর মালিক আল্লাহ। তিনিই একে আরও প্রজ্জলিত করবেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই তো শুনলাম, আল্লাহ তার ইচ্ছা তার বান্দাকে দিয়ে্ই বাস্তবায়ন করেন। তুমি এমন এক দেবদূত বেটা। তুমি এভাবে চলে যেয়ো না। সাজনা একটু বেশি বলে ফেলেছে। আকস্মিক আঘাতটা তাকে বেশি আহত করেছে বলেই হয়ত। কিন্তু আমরা সবাই তো তার মত করেই ভাবছি।’ মিসেস বিবি মাধব বলল।
সুস্মিতা বালাজী এবং ড্যানিশ দেবানন্দ পাথরের মত বসে আছে।
বিবি মাধব থামলে মুখ খুলে ধীরে ধীরে বলল, ‘নৌকাটাকে আমি মজা হিসেবে নিয়েছিলাম। কিন্তু মজা যে ছোট ভাই আহমদ মুসার জন্যে ‘সমর’ হয়ে দাঁড়াবে, কল্পনাও করতে পারিনি। যাক ছোট ভাই, বিষয়টা কিন্তু ঐ রকম ইমারজেন্সী নয় যে আপনাকে আজ কিংবা কালই চলে যেতে হবে!’
আহমদ মুসা ম্লান হাসল। বলল, ‘ভাইসাহেব, মেয়েটা লিখেছে প্রতিদিন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। টেলিভিশন নিউজেই দেখলেন এবং ১১ জন সৈনিক ও ৪৩ জন গ্রামবাসীর নিহত হবার খবর পড়লেন। এই ঘটনা নিশ্চয় আরও ঘটনার জন্ম দেবে। এটা নিশ্চয়ই ইমারজেন্সী।’ আহমদ মুসা বলল।
কিছু বলতে যাচ্ছিল আহমদ শাহ আলমগীর। তাকে থামিয়ে দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘শাহ সাহেব শোন। তুমি ও দেবানন্দ ভাই সাহেব জনাব হাজী আংকলের পরামর্শ নিয়ে গভর্নর কিংবা সিবিআই যাকে বলে পার কাল ১২ টার মধ্যে আমি থাইল্যান্ডের ভিসা চাই। আজই বা কাল বিকালের জন্যে পোর্ট ব্লেয়ার এবং কোলকাতা ব্যাংকক প্লেনের টিকিট করে রাখ।’
আহমদ শাহ আলমগীর আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল।
আবার আহমদ মুসা তাকে থামিয়ে দিল।
আহমদ শাহ আলমগীরের চোখে নতুন অশ্রুর বেগ দেখা দিল।
ফুপিয়ে কেঁদে উঠল সুষমা রাও। সে মুখ তুলল কিছু বলার জন্যে।
আহমদ মুসা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘না, সুষমা তুমি যা বলবে তা আমি জানি।’ বলে আহমদ মুসা তাকাল হাজী আবদুল্লাহর দিকে। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু তার আগেই সাজনা সিংহাল বলে উঠল, ‘স্যার, গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় আমি আপনাকে পরম গণতন্ত্রী ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখছি আপনি নির্দয়ভাবে মানুষের মুখ বন্ধ করতে পারেন।’
আহমদ মুসা মিষ্টি হাসল। বলল, ‘মানুষের নয় ভাই-বোনদের মুখ বন্ধ করতে পারি। শাসন করার জন্যে ভাই-বোন তো পাইনি। তাই এমন সুযোগ পেলে ছাড়ি না।’
‘আমি বুঝি তাহলে মানুষ?’ ম্লান কণ্ঠে বলল সাজনা সিংহাল।
শব্দ করে হেসে উঠল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমাকে মুখ বন্ধ করতে বললে করতে না। এমন ভাই-বোনও আছে যারা বড়দের উপর তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়।’
‘এ বেয়াদবদের আপনি খারাপ চোখে দেখেন তাহলে।’ সাজনা সিংহাল বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘উল্টো। ওরা বেশি অধিকার দাবী করে এবং পায়ও।’
‘ও গড’ বলে দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল সাজনা সিংহাল।
পাশ থেকে সুস্মিতা বালাজী সাজনা সিংহালের পিঠে একটা কিল দিয়ে বলল, ‘এবার খুশি তো!’
মুখ ঢেকে রাখা আঙুলের ফাঁক দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে সাজনা সিংহালের। সেদিকে নজর পড়তেই ভ্রুকুচকালো সুস্মিতা বালাজী। কিন্তু মুখ খুলল না।
আহমদ মুসার দৃষ্টি আবার ফিরে গেল হাজী আবদুল্লাহর দিকে। বলল, ‘জনাব আমি ভেবেছিলাম আন্দামানের কাজ শেষ হলে আপনাদের সবাইকে নিয়ে ওমরা করতে সউদি আরবে নিয়ে যাব। কিন্তু আমি পারছি না। আপনি দয়া করে এ দায়িত্ব নিন। আমি সউদি সরকারকে এবং দিল্লীস্থ সউদি রাষ্ট্রদূতের সাথে কথা বলেছি। দুচারদিনের মধ্যে সরকারি আমন্ত্রণ এসে যাবে। আপনারা মক্কা, মদিনা ও তায়েফ সফর করবেন।’
ঘর জুড়ে আনন্দের একটা গুঞ্জন উঠল।
গুঞ্জন ছাপিয়ে মিসেস বিবি মাধবের কণ্ঠ শ্রুত হলো। বলল, ‘এই দাওয়াত কারা পাবে?’
একটা দ্বিধায় পড়ল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসাকে কথা বলতে হলো না। হাজী আবদুল্লাহ বলে উঠল, ‘এখানে হাজির যারা তারা সবাই দাওয়াত পাবে, আহমদ মুসার কথার ধরনে এটাই আমি বুঝেছি।’
‘তাহলে তো এখানের সবাই দাওয়াত পাচ্ছে।’ হাসি মুখে বলল মিসেস বিবি মাধব।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। তাকাল এবার সুরূপা সিংহালের দিকে। পরে দৃষ্টি ফিরিয়ে বিবি মাধবের দিকে চেয়ে বলল, ‘সুরূপা বোনরাও কি……….।’
কথা শেষ করতে হলো না আহমদ মুসার। তার কথার মাঝখানেই বিবি মাধব বলল, ‘হ্যাঁ বেটা সুরূপা, সাজনারা আমার আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছে।’ সুস্মিতা আমাকে এদিকে এগিয়ে দিয়েছিল। পরে সুরূপাদের দেখেই আমি ফাইনালী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।’
আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। উঠে দাঁড়াল সে। বলল, ‘ওয়েলকাম সুরূপা বোন, দুলাভাই এবং সাজনা।’
বসল আহমদ মুসা। বসতে বসতে বলল, ‘সাজনা এত বড় কথা তুমি আমার কাছ থেকে লুকাতে পারলে?’
চোখ মুছে ফেলেছে সাজনা সিংহাল। বলল, ‘আল্লাহর ইচ্ছা এ রকমই ছিল। আপনার কাছেই শুনেছিলাম, যেদিন যা ঘটবে, সেটা আগে থেকেই সুনির্দিষ্ট।’
‘ঠিকই বলেছ। ধন্যবাদ সাজনা।’ বলল আহমদ মুসা।
মুখ খুলেছিল সাজনা কিছু বলার জন্যে। কিন্তু তার আগেই সুস্মিতা বালাজী বলল, ‘ছোট ভাই, মধুরতম একটা স্বপ্ন আপনি আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন। মক্কায় যাওয়া, আল্লাহর ঘর কাবা দর্শন খুব বড় একটা স্বপ্ন। সেখানে যাবার পরই শুধু উপলব্ধি করতে পারব এ স্বপ্নের স্বরূপ। কিন্তু মদীনায় যাব, ভাবী জোসেফাইনকে দেখতে পাব, এই আনন্দ এখনই পাগল করে তুলছে মনকে।’
সাজনা সিংহাল, সুষমা ও শাহবানু একই সাথে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ঠিকই বলেছেন আপা। মনে হচ্ছে এখনই যদি যাবার ব্যবস্থা হতো!’
‘দেখ এমনভাবে বলে তোমরা ওমরার পূণ্য নষ্ট করো না। আল্লাহ নিয়ত অনুসারে ফল দেন। আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে যদি ওমরা পালন কর তাহলে এর পূণ্য পাবে। আর যদি সৌদি আরব সফর হয় জোসেফাইনকে দেখার জন্য তাহলে আল্লাহর কাছ থেকে সেই পূণ্য মিলবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা বলে উঠল মিসেস বিবি মাধব। বলল, ‘ওদের কথা আমি বলি বেটা। আসলে নিয়ত ওদের ঠিক আছে। বৌমা জোসেফাইনকে দেখার বিষয়টা বাড়তি নিয়ত। বলতে পার এটা বোনাস আনন্দ।’
‘ধন্যবাদ খালাম্মা।’ বলে বিবি মাধবের দিকে চোখ সরিয়ে নিয়ে তাকাল হাজী আবদুল্লাহর দিকে। বলল, ‘আমি এখন উঠতে চাই চাচাজান। বেশ কিছু কাজ আছে।’
সংগে সংগেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল আহমদ শাহ আলমগীরকে লক্ষ্য করে, ‘শাহ ভাইটি এ বিশেষ দিনে তোমার আর বেরিয়ে কাজ নেই। আমি তো বেরুচ্ছিই। আমি থাই ইমিগ্রেশন হয়েই তাহলে যাই।’
তড়াক করে উঠে দাঁড়াল আহমদ শাহ আলমগীর। বলল, ‘ভাইয়া বিশেষ দিন কোন বাধা নয় এটা আপনিই সবচেয়ে ভাল জানেন। আমি কারও কোনই কাজে আসিনি ভাইয়া। আপনার এ নির্দেশটুকু পালনের সুযোগ আমাকে দিন। আপনি চলে যাবেন, নির্দেশ পালনের সুযোগ তো আর পাব না।’ কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল আহমদ শাহ আলমগীরের কণ্ঠ।
আহমদ মুসা কয়েকধাপ এগিয়ে আহমদ শাহ আলমগীরের কাঁধে হাত রেখে হাসি মুখে বলল, ‘ঠিক আছে তুমিই যাবে ভাই।’
ড্যানিশ দেবানন্দ উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘অরিজিন্যাল নির্দেশনামায় ওর সাথে আমার নামও ছিল ছোট ভাই।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমার কথা সংশোধন করছি। ঠিক আছে আপনারা যাবেন।’
তারিক মুসা মোপলা বিষন্ন মুখে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘স্যার আমি বাদ পড়েছি।’
আহমদ মুসা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার পিঠ চাপড়ে বলল, ‘তুমি আমার শিষ্য। আমার সাথে তুমি বেরুবে। আমি গাড়ির কাছে যাচ্ছি। তুমি তৈরি হয়ে এসো।’
আহমদ মুসা সবাইকে সালাম দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
হাজী আবদুল্লাহও উঠে দাঁড়াল। বলল, দেবানন্দ, শাহ আলমগীর তোমরা এসো। কাগজপত্র দেখি। তোমাদের এখনই বেরুনো উচিত। প্রয়োজন হলে গভর্নরকে বলে বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। ভিসা আজ চাই-ই। ভিসা না হলেও আহমদ মুসা কিন্তু কালকেই চলে যাবে। সে সময়সূচী ঠিক রাখে। অবস্থা অনুকূল না হলে প্রতিকূলতার মধ্যেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে।’
হাজী আবদুল্লাহর সাথে ড্যানিশ দেবানন্দ ও আহমদ শাহ আলমগীর বেরিয়ে গেল।
ঘরে তখন শুধু মেয়েরাই।
কেউ কথা বলছে না।
পাশের আন্দামান সাগরের মৌনতা যেন ঘরটাকেও এসে গ্রাস করেছে।
কারও মুখ নিচু। কারও শূন্য দৃষ্টি আন্দামান সাগরের দিকে।
সুস্মিতা বালাজী এক সময় সাগরের দিক থেকে শূন্য দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিল। চোখ বুজে ধীরে ধীরে বলল, ‘আহমদ মুসার আন্দামান জীবনের পাতা উল্টে যাচ্ছে। কেউ একে রোধ করতে পারবে না।’
‘তারপর আন্দামান কি ওর জীবন থেকে হারিয়ে যাবে? এ হয় না। এটা নিষ্ঠুরতা।’ বলল সাজনা সিংহাল। তার কথা চিৎকারের মত শুনাল।
সুস্মিতা বালাজী তার একটা হাত সাজনা সিংহালের কাঁধে রাখল সান্তনার পরশ হিসাবে। বলল আবার ধীরে ধীরে, এটাই হয় সাজনা। এটাই ওঁর জীবন। মায়ার শৃংখলে বাঁধা পড়লে তিনি তো এগোতে পারতেন না। দেখ না জোসেফাইন ভাবী তাঁকে শৃংখলে বেঁধেছেন, কিন্তু ধরে রাখেননি।’
সাজনা সিংহাল কোন উত্তর দিল না। তার একটি হাত গিয়ে জড়িয়ে ধরল সুস্মিতা বালাজীর হাতকে।
অন্যকারও মুখে কোন কথা নেই।
দেয়ালের ঘড়িতে সময়ের কাঁটা এগিয়ে চলেছে টিক টিক করে।

Top