৪৫. বসফরাসের আহ্বান

চ্যাপ্টার

চ্যাপ্টার

কিংরোডের এক জায়গায় এসে রাস্তার পূর্ব পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন। ঘুরে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার, এবার আমাদের কিংরোড ছাড়তে হবে। কাতান পাহাড়কেও। এখন পূর্ব দিকে এগোতে হবে।’
আহমদ মুসা এগোলো রাস্তার পূর্ব পাশের দিকে। পূর্ব দিকের ল্যান্ড স্পেসের দিকে তাকিয়ে দেখল আহমদ মুসা, যা চিন্তা করেছিল তাই। কিংরোডের চার-পাঁচ গজ পরেই এক খাড়া খাদ। খাদের মুখ তিরিশ-চল্লিশ গজের মতো প্রশস্ত।
‘গিরিখাদের গভীরতা কেমন আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘স্যার, থাই-মালয়েশিয়া পর্বতমালার এটাই সবচেয়ে বড় ক্যানিয়ন (গিরিখাদ)। এটা শুধু কাতান পর্বত শ্রেণী থেকে তেপাং পর্বতকেই আলাদা করেনি, কাতানকেও প্রায় বিভক্ত করে উত্তরে বহুদূর এগিয়ে গেছে। গভীরতাও স্যার দেড় হাজার ফুটের কম হবে না।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘তাহলে ক্যানিয়নটা পার হয়ে তেপাংগে পৌঁছার কোনো প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ক্যানিয়নের কোথাও আছে নিশ্চয়?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক ধরেছেন স্যার। ক্যানিয়ন বেয়ে একশ’ ফিটের মতো নামলেই অদ্ভুত একটা জায়গা পাওয়া যাবে যেখানে কাতান থেকে বেরিয়ে যাওয়া ও তেপাং থেকে বেরিয়ে আসা দু’টি বারান্দা পরস্পরের দিকে এগিয়ে একটা সেতুর সৃষ্টি করেছে। ওটা পার হয়ে ওপারের ক্যানিয়নের দেয়াল বেয়ে আবার তেপাং-এর মাথায় উঠতে হবে।’ আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বলল।
আহমদ মুসারা ক্যানিয়নের দিকে এগোলো। ক্যানিয়নের ধারে পৌঁছে নিচের দিকে উঁকি দিয়ে বলল, ‘তোমার সে বারান্দা তো দেখা যায় না। ও, এখানে ক্যানিয়নের এপার-ওপার দুই ধারকেই পরস্পরের দিকে একটু ঝুঁকে যেতে দেখা যাচ্ছে। এতেই আড়াল হয়ে গেছে বারান্দাটা।’
‘এটাও আল্লাহর একটা কুদরত স্যার। এর ফলে বারান্দাটা আড়াল হয়ে গেছে এবং আগন্তুকদের জন্যে এই ক্যানিয়নটা অনতিক্রম্য হয়ে গেছে।’ আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বলল।
‘হাবিব হাসাবাহরা জানে না?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘হাবিব হাসাবাহই শুধু জানে স্যার, দলের আর কেউ জানে না। তবে মি. হাবিব হাসাবাহও এটা দেখেনি, বর্ণনা শুনেছে মাত্র। সে এদিক দিয়ে আসা-যাওয়ায় আগ্রহী নয় সময়সাপেক্ষ ও কষ্টকর বলে। এজন্যেই সম্ভবত তার টেপাংগো ঘাঁটি থেকে এদিকে আসার একমাত্র সংকীর্ণ গিরিপথটি পাথরের দেয়াল তুলে বন্ধ করে দিয়েছে।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘আসতে চায় না এ পথে, এর চেয়ে তোমরা যাতে তোমাদের ইচ্ছেমতো পেছন দরজা দিয়ে তাদের টেপাংগো ঘাঁটিতে না যেতে পার, এটা নিশ্চিত করা ছিল তার কাছে বেশি জরুরি।’ আহমদ মুসা বলল।
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন ও সরদার জামাল উদ্দিন দু’জনেই হাঁ করে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল সরদার জামাল উদ্দিন, ‘ঠিক বলেছ ভাই। একবার এ পথ দিয়ে আমি অনাহূতভাবেই গিয়েছিলাম তাদের টেপাংগো ঘাঁটিতে। মুখে কিছু না বললেও খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন। তারপরই ঐ পথে দেয়ালটা ওঠে। তখন আমরা বুঝিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তোমার কথাই শতভাগ ঠিক।’
‘এ থেকে এটাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তারা আমাদের একটুও বিশ্বাস করে না, ব্যবহার করে মাত্র।’ আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বলল।
‘বিশ্বাসের তো প্রশ্নই ওঠে না, যাদের ধ্বংস করাই লক্ষ্য, তাদের ওরা বিশ্বাস করবে কেন? ঠিক আছে। চল, এবার ক্যানিয়নের বারান্দার দিকে নামি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে স্যার, আসুন।’ বলে আবদুল কাদের বিশেষ স্থান দিয়ে ক্যানিয়নের গা বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল।
দুই ঘণ্টা লাগল ক্যানিয়ন পার হয়ে ওপারে তেপাং পর্বতের উপরে পৌঁছতে।
আহমদ মুসা তেপাং-এ পৌঁছে সামনে তাকিয়ে দেখল, ছোট-বড় অসংখ্য চূড়ায় আকীর্ণ এবড়ো-থেবড়ো পাহাড়ের বুক। বলল আহমদ মুসা, ‘আবদুল কাদের, সামনে তো চলার মতো ট্র্যাক নেই কিংরোডের মতো?’
আবদুল কাদের কিছু বলার আগেই তার দাদা সরদার জামাল উদ্দিন বলল, ‘সামনে চেয়ে দেখ, সব চূড়ার ওপর দিয়ে প্রায় পিরামিডের মতো একটা চূড়া দেখা যাচ্ছে। ওটাই তেপাং পর্বতের প্রাণকেন্দ্র। ওটার গোড়াতেই সেই পুরানো ঘাঁটি, যেখানে এখন হাবিব হাসাবাহরা আড্ডা গেঁড়ে বসেছে। ঐ চূড়ার গোড়াতেই ঘাঁটিতে একটা সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে। পথটার বাইরের মুখ পাথরের দেয়াল তুলে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চূড়াটিকে আমাদের নাক বরাবর রেখে পথ ডিঙিয়ে টিলা এড়িয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।’
‘ধন্যবাদ দাদাজী। চূড়ার পথটা নিশ্চয় চার-পাঁচ মাইলের বেশি হবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিঞ্চিৎ বেশি হবে স্যার। আসুন চলতে শুরু করি।’
বলে হাঁটা শুরু করল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
চলতে শুরু করল সবাই। আরও দু’ঘণ্টায় তারা এসে পৌঁছল পিরামিড আকারের চূড়ার গোড়ায়।
সুড়ঙ্গ মুখের দেয়াল দেখতে পেল আহমদ মুসা। মুখের দেয়ালটা দেখা যায় না ছড়ানো ছিটানো স্তূপীকৃত পাথরের জন্যে। দেয়ালটাকে আড়াল করার জন্যেই এই ব্যবস্থা। এগোচ্ছিল দেয়ালটাকে পরখ করে দেখার জন্যে। তার পকেটের মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল ধরল আহমদ মুসা।
ওপ্রান্ত থেকে থাইল্যান্ডের সহকারী গোয়েন্দা প্রধান পুরসাত প্রজাদিপকের কণ্ঠ শুনতে পেল। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর আহমদ মুসা বলল, ‘বলুন জনাব। আমরা তেপাং পাহাড়ে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। কিন্তু নতুন মারাত্মক একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তোমার মতামত সবাই আমরা আশা করছি।’
‘বলুন জনাব। পরিস্থিতিটা কি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘খুবই উদ্বেগের আহমদ মুসা। ঘণ্টাখানেক আগে হাবিব হাসাবাহ শেষ হুমকিটা দিয়েছে। বলেছে, আগামী পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে যদি হেলিকপ্টার তার তেপাং পাহাড়ের লাল পতাকা চিহ্নিত স্থানে না পৌঁছে, তাহলে পাঁচ ঘণ্টা এক মিনিটে জাবের জহীর উদ্দিনকে হত্যা করা হবে।’
শুনে আহমদ মুসা একটুও না ভেবেই বলল, ‘জনাব, এ আল্টিমেটামের কোনো গুরুত্ব নেই। নিশ্চিত থাকুন, হাবিব হাসাবাহ পালিয়ে নিরাপদ হওয়ার আগে জাবের জহীর উদ্দিনকে হত্যা করবে না। জাবের জহীর উদ্দিন এখন তার বর্ম। নিজেকে নিরাপদ করার আগে সে বর্ম পরিত্যাগ করতে পারে না।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। কিন্তু এ আল্টিমেটামের তাহলে অর্থ কি?’ পুরসাত প্রজাদিপক বলল।
‘আমার ধারণা, সে ইতোমধ্যেই পালিয়েছে বা পালাচ্ছে। আল্টিমেটামের মাধ্যমে সে জানিয়ে দিয়েছে যে, পাঁচ ঘণ্টা সে লাল পতাকার ঐ ঘাঁটিতেই থাকবে। এটা জেনে চারদিকের পাহারা শিথিল হবে, এটাই চেয়েছে সে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝেছি আহমদ মুসা। কিন্তু ওরা হঠাৎ পালানোর ইচ্ছা প্রকাশ করার মতো দুর্বলতা প্রকাশ করল কেন?’ বলল পুরসাত প্রজাদিপক।
‘আসলে ওদের অনেক লোক মারা গেছে এবং ধরা পড়েছে। আমার মনে হয়, বেতংগে ওদের মূল বাহিনী শেষ হয়ে গেছে। আর ওদের অবস্থানের স্থানটাও ধরা পড়ে গেছে, এটা ওরা নিশ্চিত হয়েছে। সুতরাং পালানো ছাড়া পথ নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘পালাতে পারবে না। উপত্যকার সব পথ বন্ধ। হ্রদ ও পাহাড়ের মধ্যের জলপথেও শক্ত পাহারা বসানো আছে, সে তো তুমি জানই।’
হঠাৎ থেমে গেল পুরসাত প্রজাদিপক। কয়েক মুহূর্ত পরেই আবার বলে উঠল, ‘কিন্তু আহমদ মুসা, জলপথটা অনেক প্রশস্ত। পাহারা বসানো আছে শুধু উত্তর তীরে। জরুরি মুহূর্তে এই পাহারা তো গোটা জলপথ কভার করতে পারবে না।’
‘চিন্তার কিছু নেই। দক্ষিণ তীরে অবস্থান নেয়ার জন্যে দু’জনকে আমি পাঠিয়েছি। ওরা দক্ষিণ তীরে জেলেদের যে ছাউনি আছে, সেখানে জেলে বেশে বসে থাকবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আহমদ মুসা, আমাদের গোটা নির্ভরতা কিন্তু তোমার ওপর। আল্টিমেটাম দেয়ার পর এদিক থেকে ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। তোমার পরিকল্পনা কি?’ বলল পুরসাত প্রজাদিপক।
‘আমরা তেপাং পাহাড়ে পৌঁছে গেছি। সামনে কি পরিস্থিতি আমি জানি না। তবে আল্টিমেটামে যে সময় দিয়েছে, তার একাংশ সময়েই ওখানে আমরা পৌঁছে যাব ইনশাআল্লাহ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘গড ব্লেস ইউ ইয়ংম্যান। আমরা এদিকে হেলিকপ্টার সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করছি- এই কথা বলে কালক্ষেপণ করব। এর মধ্যে তোমার অপারেশন শেষ হবে আশা করছি। আর আমি যয়নব যোবায়দাদের জানিয়ে দিচ্ছি, তুমি ভালো আছ। ওরা জাবের জহীর উদ্দিনের ব্যাপারে যতটা উদ্বিগ্ন, তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন তোমার ব্যাপারে। ওরা আল্টিমেটাম দেয়ার পর যয়নব যোবায়দারা একটু বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। বার বার টেলিফোন করছে। বেশি ভেঙে পড়েছে আমার মেয়ে সিরিত থানারতা। তবে সিরিত ও যয়নব নিশ্চিত যে, তুমি জাবের জহীর উদ্দিনকে উদ্ধার করবেই। ঈশ্বর তাদের বিশ্বাসকে রক্ষা করবেন নিশ্চয়ই। আর কোনো পরামর্শ কিংবা কোনো কথা আছে আহমদ মুসা?’
‘ধন্যবাদ, তেমন কিছু থাকলে জানাব।’
‘ওকে, গুডবাই সালাম।’ বলে ওপার থেকে টেলিফোন রেখে দিল পুরসাত প্রজাদিপক।
মোবাইল পকেটে রেখে আহমদ মুসা আবদুল কাদেরদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুনলেন তো সব। এখন আমাদের দ্রুত ঘাঁটিতে পৌঁছতে হবে এবং সেটেল করতে হবে ওরা জানবে না এমন ভাবে। জাবের জহীর উদ্দিনের জীবন সত্যি ঝুঁকির মুখে।’
‘আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গটা খুব দীর্ঘ নয়। চার-পাঁচশ’ গজের বেশি হবে না। ঘাঁটি পর্যন্ত পৌঁছতে আমাদের সময় বেশি লাগবে না।’ বলল আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘শুধু সুড়ঙ্গে দেয়াল নয়, সুড়ঙ্গ পথে আরও প্রতিবন্ধকতা তারা রাখতে পারে। দেয়ালের চেয়ে সেগুলো আরও মারাত্মক হতে পারে আবদুল কাদের। সে হিসেব তোমাকে রাখতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা এগোলো সুড়ঙ্গ মুখের দিকে। লক্ষ্য, পাথরের ফাঁক দিয়ে দেয়ালের গাঁথুনি পরখ করে দেখা।
আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনও তার পিছে পিছে যাচ্ছে।
সুড়ঙ্গ মুখে পৌঁছতেই পকেটের মোবাইলটি আবার বেজে উঠল আহমদ মুসার।
মোবাইল ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে সালাম ভেসে এল থাইল্যান্ডের সহকারী গোয়েন্দা প্রধান পুরসাত প্রজাদিপকের কণ্ঠ থেকে।
সালাম নিয়ে বলল, ‘বলুন জনাব, নতুন কোনো খবর নিশ্চয়?’
‘হ্যাঁ আহমদ মুসা। তুমিও পেয়ে থাকতে পার। পঁচিশ-তিরিশ মিনিট আগের ঘটনা। তেপাং পাহাড়ের দিক থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত দ্রুতগামী বোট হ্রদের দিকে যাচ্ছিল। উত্তরের অবস্থান থেকে আমাদের লোক চ্যালেঞ্জ করলে দ্রুত দিক পরিবর্তন করে ক্যানেলের দক্ষিণ দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু দক্ষিণ দিক থেকে গর্জে ওঠে হেভি মেশিনগান। তারা গুলির দেয়াল সৃষ্টি করে। কয়েকটা গুলি নাকি বোটকেও হিট করে। বোটটি গতি পরিবর্তন করে পাহাড়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই খবর তোমাকে দেবার জন্যেই এই টেলিফোন করা।’ ওপার থেকে বলল পুরসাত প্রজাদিপক।
‘আলহামদুলিল্লাহ। সন্দেহ নেই হাবিব হাসাবাহ পালাচ্ছিল। ব্যর্থ হয়েছে তার প্রথম উদ্যোগ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তুমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলে আহমদ মুসা। আল্টিমেটামটা তার ছিল ট্র্যাপ। কিন্তু সে তো আল্টিমেটাম না দিয়েই পালাতে পারতো।’ বলল পুরসাত প্রজাদিপক।
‘সে জানে, তার পথে টাইট পাহারা বসেছে। সে চেয়েছিল পাহারাটাকে শিথিল করতে। স্বাভাবিকভাবে সবারই মনোযোগ আল্টিমেটামের সময়ের দিকে থাকবে, এটাই সে ধারণা করেছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তুমি বললে, ওটা তার প্রথম উদ্যোগ। আরও উদ্যোগ সে কোন দিকে নেবে?’ বলল পুরসাত প্রজাদিপক।
‘পাহাড়ের পথসহ সম্ভব-অসম্ভব সব উদ্যোগই সে নেবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাদের লোকরা এলার্ট আছে। সবাইকে বলে দিয়েছি। পাহাড়ের দিকে তো তোমরাই আছ।’ বলল পুরসাত প্রজাদিপক।
‘অবশ্যই। আমরা এ দিকটা দেখছি জনাব।’
‘ওকে, ধন্যবাদ। সালাম।’ বলল পুরসাত প্রজাদিপক।
মোবাইল লাইন কেটে গেল ওপার থেকে।
আহমদ মুসা মোবাইল রেখে সরদার জামাল উদ্দিনের দিকে তাকাল। বলল, ‘আমার মনে হয়, হাবিব হাসাবাহ পালাবার জন্যে অতঃপর এই পথই বেছে নেবে।’
‘কিন্তু এ পথ তো সে চেনে না।’ বলল আব্দুল কাদের কামাল উদ্দিন।
‘চেনা পথের চেয়ে তার নিরাপত্তা এখন বেশি প্রয়োজন। পথ না চিনলেও কোন দিকের কোথাও সে পৌঁছতে পারবেই।’
‘ঠিক বলেছেন স্যার। এখন তাহলে আমাদের কি করণীয়?’ আবদুল কাদের বলল।
‘সুড়ঙ্গের প্রাচীর আমরা ভাঙছি না, তাকেই ভেঙে বেরিয়ে আসতে দাও। আমরা তার জন্যে অপেক্ষা করব।’ বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই চাপা আওয়াজের একটা ‘দুপ’ শব্দ শুনতে পেল। তার সতর্ক হয়ে ওঠা দুই চোখ সংগে সংগেই দেখতে পেল, সুড়ঙ্গের দেয়ালের দিক থেকে মার্বেল আকারের একটা সাদা বল গুলির মতো বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা পরিচিত শব্দ শুনেই আঁচ করতে পেরেছিল। এবার সাদা বলটা দেখেই চিৎকার করে উঠল, ‘দূরে ছুটে পালাও তোমরা।’ বলটা কোন গ্যাস বোমা হবে, বুঝতে পেরেছিল আহমদ মুসা।
বলে আহমদ মুসা নিজেও দেয়ালের গোড়া থেকে একটা লাফ দিল যেদিকে বলটি গিয়ে পড়ল তার বিপরীত দিকে। কিন্তু দূরে যেতে পারল না। লাফ দিয়ে সে গিয়ে পড়ল একটা পাথরের প্রান্তে। পাথরটা ছিল আলগা। চাপে পাথরটা উল্টে গেলে আহমদ মুসা ছিটকে অন্য একটা পাথরের ওপর আছড়ে গিয়ে পড়ল।
ততক্ষণে গ্যাস বলটা ফেটে সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল চারদিকটা।
আহমদ মুসা ধরে নিয়েছিল, ওটা সংজ্ঞালোপকারী বোমাই হবে। হাবিব হাসাবাহ চায় আমাদের সংজ্ঞাহীন করে বিনা লড়াইয়ে হত্যা বা বন্দী করে রেখে নিজে সরে পড়বে।
আহমদ মুসা পাথরের ওপর আছড়ে পড়েই নিঃশ্বাস বন্ধ করেছিল। সে জানে, এ ধরনের বোমার কার্যকারিতা দেড়-দু’মিনিটের বেশি থাকে না।
আহমদ মুসা শ্বাস বন্ধ করার সাথে আরেকটা কাজ করল। সেটা হলো, জ্যাকেটের পকেট থেকে রিভলভার বের করে রিভলভারসমেত ডান হাত দেহের নিচে চাপা দিয়ে রাখল।
উপুড় হয়ে পড়ে আছে আহমদ মুসা। কিন্তু মুখ তার ডান দিকে কাত হয়ে আছে। কপালের বাম পাশটা ফেটে যাওয়ায় রক্ত গড়িয়ে এসেছে পাথরের ওপর। চোখ দু’টি তার বন্ধ। ডান হাত ডান পাঁজরের নিচে আটকা। আর বাম হাতটা পাশের একটা পাথরের ওপর দিয়ে ঝুলছে। নিরেট সংজ্ঞাহীন দেহের একটা অবস্থা।
আহমদ মুসা পাথরের ওপর পড়েই ভাবতে শুরু করেছে, যে ভাবেই হোক, হাবিব হাসাবাহ এখনি বেরিয়ে আসবে। সে তাদের অজ্ঞান অবস্থার সুযোগ নেবে। দেয়ালের গায়ে কোন গোপন দরজা আছে? গোপন দরজা রেখেই হয়তো দেয়াল তৈরি হয়েছে। তারপর পাথর ছড়িয়ে তাকে আরও আড়াল করে ফেলা হয়েছে। এমনটা খুবই স্বাভাবিক! আর দেয়ালের গায়ে চোখ রেখে দেখার মতো কোন ঘুলঘুলি নিশ্চয় ছিল। সেই ঘুলঘুলি দিয়েই গ্যাস বোমা ছোঁড়া হয়েছিল।
এক মিনিটও তখন পার হয় নি। দেয়ালের দিকে বোমা ফাটার একটা আওয়াজ হলো। আহমদ মুসা চোখ একটু ফাঁক করে দেখল, দেয়ালের এক প্রান্তে বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছে।
বুঝল আহমদ মুসা, তাহলে গোপন দরজা নেই। বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয়ালের গায়ে সুড়ঙ্গ সৃষ্টি করা হলো বেরিয়ে আসার জন্যে। দু’মিনি্ট হয়নি, তাই আহমদ মুসা শ্বাস তখনও বন্ধ রেখেছে।
আবার চোখ বুজল আহমদ মুসা। ওরা এখনই বেরিয়ে আসবে।

বোমা বিস্ফোরণের আগুন নিভে গেছে।
সুড়ঙ্গের দেয়ালের গায়ে প্রায় এক গজ ব্যাসের একটা গোলাকার পথ খুলে গেছে।
হাবিব হাসাবাহ তাকালো তার পাশে দাঁড়ানো জহীর উদ্দিনের দিকে।
জাবের জহীর উদ্দিনের বিধ্বস্ত চেহারা। চুল উষ্কখুষ্ক। কাপড় ময়লা। দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। পায়েও শিকল পরানো।
হাবিব হাসাবাহর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। তাদের দু’জনের হাতে স্টেনগান। দু’জনেরই পিঠে ভারি ব্যাগ।
হাবিব হাসাবাহর হাতে রিভলভার এবং কাঁধে ঝুলানো একটা ব্যাগ।
হাবিব হাসাবাহ জাবের জহীর উদ্দিনের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে পেছনের একজনকে বলল, ‘তুমি জাবেরকে নিয়ে বাইরে যাও। দেখ ওদের তিন জনের কি অবস্থা। স্টেনগানের ট্রিগারে আঙুল রেখে বাইরে যাবে। দেখ যদি কেউ জ্ঞান না হারায়, তাহলে সংগে সংগেই শেষ করে দেবে।’
লোকটা নীরবে একটা স্যালুট করে জাবের জহীর উদ্দিনকে ঠেলে নিয়ে দেয়ালের পথ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
লোকটা বাইরে বেরিয়ে দেয়ালের গোড়া পার হয়ে সুড়ঙ্গ মুখের সামনেই সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনকে পাশাপাশি পেল। দু’জনই সংজ্ঞাহীন। তারপর সে জাবের জহীর উদ্দিনকে নিয়ে এগোলো আহমদ মুসার কাছে। জাবেরকে দিয়ে পাথরের ওপর দিয়ে ঝুলন্ত তার হাত নেড়ে দেখল সংজ্ঞা নেই।
লোকটি পেছনে হটে সুড়ঙ্গ মুখের দিকে একটু এগিয়ে বলল, ‘স্যার, সবাই সংজ্ঞাহীন।’
হাবিব হাসাবাহ তার দ্বিতীয় বডিগার্ড নিয়ে বেরিয়ে এল।
হাবিব হাসাবাহর চোখ প্রথমেই পড়ল সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের ওপর। তার ঠোঁটে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল। কয়েক ধাপ এগিয়ে তাদের দু’জনের পাঁজরে দু’টি লাথি মেরে চিৎকার করে বলল, ‘এ গাদ্দার দু’জনকে শান্তিতে মরতে দেব না। জীবন্ত টুকরো টুকরো করব। এরা শুধু আহমদ মুসাকে সাহায্য করেনি, আমাদের অনেক লোকের হত্যার নিমিত্তও তারা।’
রিভলভার পকেটে রেখে একটা চুরুট ধরাল হাবিব হাসাবাহ। এগোলো এবার আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসাকে এক নজর দেখে বলল, ‘এ হারামজাদাই তাহলে আহমদ মুসা। সাধারণ একজন হয়েও অসাধারণ সবার কাছে। আজ হাবিব হাসাবাহর হাতে এর সব লীলাখেলার শেষ। আমাদের কত যে ক্ষতি করেছে, তার হিসেব দুঃসাধ্য, একে একবার নয়, লাখো বার মারলেও এর পাপ মোচন হবে না।’
হাবিব হাসাবাহ যখন কথা বলছিল, তখন জাবের জহীর উদ্দিন চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে। এই তাহলে তাদের স্বপ্নের নায়ক আহমদ মুসা! স্বপ্নপুরুষ! গোটা দেহে তার শিহরণ জাগল। তার সাথে বুকের ভেতরটা তার মোচড় দিয়ে উঠল আহত আহমদ মুসাকে সংজ্ঞাহীনভাবে পাথরের ওপর পড়ে থাকতে দেখে। আজই কি এই অবস্থায় এই মহান বিশ্বনায়কের জীবনের ইতি ঘটতে যাচ্ছে? হাহাকার করে উঠল তার মন। সে চিৎকার করে বলল, ‘হাবিব হাসাবাহ, তোমরা একে মের না। তোমরা আমার কাছে, আমাদের কাছে যা চাও তা দেব, যা করতে বলবে তা করব। আমি থাইল্যান্ডের প্রতি ঘরে ঘরে তোমাদের পক্ষে কাজ করব, তোমরা শুধু একে মের না।’ কান্নাঝরা কণ্ঠ জাবের জহীর উদ্দিনের।
হো হো করে হেসে উঠল হাবিব হাসাবাহ। বলল, ‘থাইল্যান্ডে আমাদের এখন করার কিছুই নেই। আমরা আর কিছু চাই না। তোমার এবং তোমাদের আর কোন মূল্য আমাদের কাছে নেই। সবই ফাঁস হয়ে গেছে। এখন আমাদের শুধু প্রতিশোধের পালা। তোমাকে মারব সবার শেষে। তোমাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেই আমরা দুঃসময় পাড়ি দেব। আমাদের যখন মুক্তি, তখনই তোমার ঘটবে মৃত্যু।’
বলেই হাবিব হাসাবাহ দু’জন গার্ডকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমরা গিয়ে আহমদ মুসাকে চিৎ করে শুইয়ে জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা কর। ওর জ্ঞান ফিরলে তবেই নাটক জমবে। জ্ঞান ফিরলে ওর ডান হাতটা আগে কাটবো। ঐ হাতই করেছে আমাদের বেশিরভাগ সর্বনাশ।’
গার্ড দু’জন হাবিব হাসাবাহকে নীরবে স্যালুট দিয়ে তার হুকুম পালনের জন্যে এগোলো।
ওরা পাশাপাশি হেঁটে এগোচ্ছে আহমদ মুসার দিকে। পাহাড়ের পাদদেশে পিন-পতন নীরব পরিবেশে তাদের পায়ের শব্দ খুবই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে আহমদ মুসা। তারা কতটা এগোলো, তারা কতটা এখনো দূরে তা সহজেই পরিমাপ করতে পারছে আহমদ মুসা চোখ বুজে থেকেই।
আহমদ মুসা আত্মরক্ষার জন্যে আক্রমণকেই বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। প্রথম সুযোগকেই সে কাজে লাগাবে।
ওদের পায়ের শব্দ যখন আহমদ মুসার পায়ের কাছাকাছি পৌঁছল, তখন আহমদ মুসা চোখ খুলল এবং তার রিভলভার ধরা ডান হাতও বেরিয়ে এল পাঁজরের নিচ থেকে।
আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে আসা দু’জনের দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকেই নিবদ্ধ ছিল। দেখতে পেল ওরা আহমদ মুসার চোখ এবং রিভলভার নিয়ে ডান হাত বেরিয়ে আসার দৃশ্য।
ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠে কাঁধে ঝুলানো স্টেনগানে ওরা হাত দিতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসার রিভলভার বেরিয়ে আসার পর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করেনি। আহমদ মুসার তর্জনী পর পর দু’বার ট্রিগারে চেপে বসল।
দু’জনেই কপালের মাঝ বরাবর গুলি খেয়ে নিঃশব্দে ছিটকে পড়ল মাটিতে।
দ্বিতীয় গুলির পর তৃতীয় একটা গুলিও আহমদ মুসার রিভলভার থেকে বেরিয়ে গেল প্রায় সংগে সংগেই।
আহমদ মুসা দেখতে পেয়েছিল, হতচকিত হাবিব হাসাবাহও হাতের চুরুট ফেলে দিয়ে পকেটে হাত দিয়েছিল রিভলভার বের করার জন্যে।
আহমদ মুসার তৃতীয় গুলি গিয়ে বিদ্ধ করল হাবিব হাসাবাহর রিভলভার ধরা ডান হাতকে।
তার হাত থেকে রিভলভার ছিটকে পড়ে গেল।
হাত থেকে রিভলভার ছিটকে পড়ার সাথে সাথে হাবিব হাসাবাহর বাম হাত চলে গেল বাম পকেটে। বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে এল ডিম আকৃতির একটা গোলাকার বস্তু নিয়ে।
তার দু’চোখে আগুন। গুলিতে গুঁড়িয়ে যাওয়া রক্তাক্ত ডান হাতের দিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। মরিয়াভাব তার চোখে-মুখে।
আহমদ মুসা বুঝল কি ঘটতে যাচ্ছে।
এবার চতুর্থ গুলি ছুঁড়ল আহমদ মুসা।
হাবিব হাসাবাহর হাত হাতের বস্তুটিকে ছোঁড়ার পর্যায়ে উঠে আসার আগেই আহমদ মুসার চতুর্থ বুলেটটি গিয়ে বিদ্ধ করল হাবিব হাসাবাহর বুককে।
গুলি খেয়ে তার দেহ টলে উঠলেও হাবিব হাসাবাহ ছুঁড়তে চেষ্টা করেছিল তার হাতের বস্তুটি। হাতটা তার সামনের দিকে এগিয়েও আবার ঢলে পড়ে গেল। তার সাথে সাথে সে টলে চিৎ হয়ে পড়ে গেল একটা পাথরের ওপর।
জাবের জহীর উদ্দিন বোবা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা জাবের জহীর উদ্দিনের দিকে এগোবার জন্যে পা তুলে বলল, ‘জাবের তুমি ঠিক আছ তো?’
কোন উত্তর না দিয়ে জাবের জহীর উদ্দিন পাগলের মতো ছুটে এসে আহমদ মুসার পায়ের ওপর আছড়ে পড়ল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘আপনাকে ভাই বলব, না স্যার বলব, না মহান আমীর বলব কিছু বুঝতে পারছি না। বদর যুদ্ধে মহানবী স.-এর বাহিনীর সাহায্যে আসা সেই ফেরেশতার মতো আপনি এসেছেন। কল্পনাতেও যাকে ছোঁয়া যায় না, সেই আপনাকে পাঠানোর মতো এত করুণা আল্লাহ করেছেন আমাদেরকে!’
আহমদ মুসা রিভলভার পকেটে রেখে জাবের জহীর উদ্দিনকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘তোমার ওপর দিয়ে অনেক নির্যাতন-নিপীড়ন গেছে। বদরের সাহাবীদের মতো ত্যাগ, ঈমান ও দৃঢ়তার পরিচয় তোমরা দিতে পেরেছ বলেই আল্লাহর সাহায্য তোমাদের জন্যে এসেছে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘চল জাবের, সরদার জামাল ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনদের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করি। তুমি ওদের চেন না? কোহেতান কবিলার লোক এরা।’
‘আমার আব্বার কাছ থেকে এই কবিলার গল্প শুনেছি। এরা নাকি আমাদের পরিবারের খুব অনুগত। তবে এরা পাহাড় থেকে খুব একটা বাইরে যেত না। আমার সাথে দেখা হয়নি। হাবিব হাসাবাহদেরকে এদের ব্যাপারে খুব গল্প করতে শুনেছি। প্রথম দিকে প্রশংসা শুনেছি, কিন্তু দু’দিন থেকে এদের বিশ্বাসঘাতক বলে গাল দিচ্ছে। ওদের ব্ল্যাক ঈগলের সবচেয়ে মূল্যবান লোকদের নাকি তারা আপনার সাহায্যে হত্যা করেছে।’
আহমদ মুসার পাশে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল জাবের জহীর উদ্দিন। আবদুল কাদেরদের পাশে এসে গেছে আহমদ মুসারা। আহমদ মুসা পকেট থেকে সরু ইঞ্চিখানেক লম্বা এক অ্যালুমিনিয়াম টিউব বের করে জাবের জহীর উদ্দিনের হাতে দিয়ে বলল, ‘টিউবের মুখটা ওদের নাকে ধরে দু’পাশের লাল বোতামে একসাথে দু’তিনবার চাপ দাও।’
জাবের জহীর উদ্দিন টিউবটা নিয়ে এগোলো আবদুল কাদেরের দিকে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে মোবাইল বের করে বলল, ‘জাবের, তোমার কথা যয়নব যোবায়দা ও ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনদের জানিয়ে দেই।’
একটু থেমেই আবার বলল, ‘জাবের, তোমার হবু শ্বশুর পুরসাত প্রজাদিপককেও জানিয়ে দেই। সিরিত থানারতা ওদিকে পাগলের মতো হয়ে আছে।’
থমকে দাঁড়িয়েছে জাবের জহীর উদ্দিন। ফিরে তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে। লজ্জায় রাঙা হয়ে গেছে তার মুখ। বলল সে, ‘আপনি সিরিত থানারতাকে চেনেন? স্যারকে চেনেন?’
‘শুধু চিনব কেন? ওদের বাড়িতে থাকলাম, খেলাম। সব বলব, যাও তুমি ওদের জ্ঞান ফেরাও।’ বলল আহমদ মুসা।
চলার জন্যে ফিরে দাঁড়াতে গিয়েও আবার বলল, ‘স্যার, দাদী ও যয়নবকেও এটা বলেছেন?’
মিষ্টি হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘শুধু বলেছি নয়, সিরিত থানারতার সাথে ওদের কথা বলিয়েও দিয়েছি। কি, খুশি তো! তোমার কঠিন কাজটা আমি করে দিয়েছি।’
জাবের জহীর উদ্দিন লাজনম্র একটু হাসি হাসল। বলল, ‘স্যার, আপনার সাক্ষাৎ যে পায়, তার এমন সৌভাগ্যই হয়। আমি সংগ্রামী আহমদ মুসাকেই চিনতাম স্যার এতদিন। কিন্তু এই মিনিটখানেকের পরিচয়েই আমার মনে হচ্ছে, ভাই আহমদ মুসা, মানুষ আহমদ মুসা তার চাইতে অনেক বড়।’
কথাগুলো বলতে গিয়ে জাবের জহীর উদ্দিনের কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠেছে। চোখের কোণ তার ভিজে উঠেছে।
কথা শেষ করেই জাবের জহীর উদ্দিন ঘুরে দাঁড়িয়ে আবদুল কাদেরের কাছে যাবার জন্যে পা বাড়াল।
আহমদ মুসা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল হাবিব হাসাবাহর শেষ খবরটা এবং জাবের জহীর উদ্দিনের সুস্থ থাকার কথাটা যয়নব ও পুরসাত প্রজাদিপকদের জানানোর জন্যে। কথা বলল আহমদ মুসা থাই প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও এদিকে আয়েশা আলিয়াদের সাথেও।
তারপর টেলিফোন করল আন্দামানে আহমদ শাহ আলমগীর-সুষমার কাছে, সুস্মিতা বালাজীর কাছে, স্বরূপা সিংহাল-সাজনা সিংহালের কাছে, শাহবানুদের কাছে এবং হাজী আবদুল্লাহ ও খালাম্মার কাছে।
শেষ টেলিফোনটা করল মদীনা শরীফে ডোনা জোসেফাইনের কাছে।
টেলিফোন শেষ করতে বেশ সময় লেগেছে।
মোবাইল বন্ধ করে আহমদ মুসা তাকাল আবদুল কাদেরদের দিকে। দেখল, ওদের জ্ঞান ফিরেছে। গল্পে ব্যস্ত ওরা।
আহমদ মুসার টেলিফোন শেষ হয়েছে দেখতে পেল ওরাও।
ওরা দ্রুত এগিয়ে এল আহমদ মুসার কাছে। আবদুল কাদের দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘আল্লাহর হাজার শোকর যে, আপনার কোন ক্ষতি হয়নি, শয়তানদের শেষ করেছেন। একটাই দুঃখ স্যার, যুদ্ধের শ্বাসরুদ্ধকর ফিনিশিং আমি দেখতে পেলাম না, যা শুনলাম বড় ভাই জাবের জহীর উদ্দিনের কাছে। আমরা ভেবে পাচ্ছি না স্যার, আমরা একসাথেই ছিলাম। গ্যাস বোমায় আমরা জ্ঞান হারালাম, আপনি কিভাবে বেঁচে গেলেন?’
‘তোমাদের সতর্ক করার সুযোগ আমি পাইনি। সংজ্ঞালোপকারী এ ধরনের গ্যাস বোমার কার্যকারিতা দেড়-দুই মিনিটের বেশি থাকে না। এ সময় নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে বেঁচে যাওয়া যায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সুবহানআল্লাহ! দুনিয়ায় চলতে গেলে কত যে বুদ্ধি, কত জ্ঞান যে দরকার! আজ এ বুদ্ধি যদি আপনার মাথায় না থাকতো, তাহলে ওরা লাশ না হয়ে আমরা লাশ হতাম। হাবিব হাসাবাহ নাকি ঘোষণাই করেছিল আমাদের কাকে কত টুকরা করে মারবে।’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘সরদারজী, এসব কথা এখন থাক। আপনি আসুন, আবদুল কাদের, জাবের তোমরা এস এই পাথরটায় একটু বসি। জরুরি কথা আছে।’
বলে আহমদ মুসা কয়েক ধাপ পিছিয়ে একটা সমতল বড় পাথরের এক প্রান্তে গিয়ে বসল। সবাই গিয়ে বসল তার সামনে।
‘স্বয়ং পুলিশ প্রধান, গোয়েন্দা প্রধান ও পুরসাত প্রজাদিপক আসছেন হেলিকপ্টার নিয়ে। ওরা এসে ঘাঁটি সার্চ করার পর আমরা সবাই যাব থাই রাজার প্রাসাদে। তিনি সবাইকে দাওয়াত করেছেন। আমি যে কথাটা বলতে চাই সে কথা বলার সুযোগ আর হবে না। এখনই সেটা সারতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা আবার কথা শুরু করতে যাচ্ছিল, তার আগেই আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন বলল, ‘স্যার, এদের তিনজনকে সার্চ করলে হতো না? কি নিয়ে সরে পড়েছিল দেখা যেত!’
‘না আবদুল কাদের, এসব সার্চের কাজ ওরা করবেন। আমাদের কাজ শেষ।’
বলে আহমদ মুসা মুহূর্তকাল থেমে আবার বলা শুরু করল, ‘যে গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজে পাওয়া গেছে, সে ব্যাপারেই কথা বলতে চাই। জাবের জহীর উদ্দিন ঘটনার কথা জানে না। সরদারজী, আপনি বিষয়টা জাবের জহীর উদ্দিনকে বলুন।’ শেষ বাক্যটা আহমদ মুসা সরদার জামাল উদ্দিনকে লক্ষ্য করে বলল।
সরদার জামাল উদ্দিন তেপাং পাহাড়ে আসার পথে গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজে পাওয়ার কাহিনী, গুপ্ত ধনভাণ্ডারের বিবরণ এবং গুপ্ত ধনভাণ্ডারের মালিকের কথা সংক্ষেপে জাবের জহীর উদ্দিনকে বলল।
সরদার জামাল উদ্দিন থামলে আহমদ মুসা বলল, ‘এ ধনভাণ্ডার আপনারা কিভাবে কাজে লাগাবেন, সেটাই আমি আপনাদের কাছে জানতে চাই।’
আহমদ মুসার কথা শেষ না হতেই সরদার জামাল উদ্দিন বলে উঠল, ‘আমরা কাজে লাগাব কি? এই ধনভাণ্ডার আল্লাহ তোমার হাতে তুলে দিয়েছেন। আমরা কতবার এই পথ দিয়ে যাতায়াত করেছি, ধনভাণ্ডারের সন্ধান আমরা পাইনি। ধনভাণ্ডারের পথ আল্লাহ তোমাকেই দেখিয়েছেন, এই ধনভাণ্ডার তোমার হাতেই দিয়েছেন আল্লাহ। এর দায়িত্ব তোমার।’
‘আমি এক উসিলা মাত্র। এ ধনভাণ্ডার মালয়ী, থাই মুসলমানদের এবং এ অঞ্চলবাসীর। এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আপনাদেরকেই নিতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি উসিলা, সেটা তুমি বলতে পার। কিন্তু আসলেই আল্লাহ ঐ ধনভাণ্ডার তোমার হাতেই তুলে দিয়েছেন। এটাই সত্য।’ জোর দিয়ে বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘এটা আংশিক সত্য। সত্যের অপর অংশটা হলো, ধনভাণ্ডার একা আমার হাতে তুলে দেননি। ধনভাণ্ডার যখন পাওয়া যায়, তখন আপনারা আমার সাথে ছিলেন। এর অর্থ, ধনভাণ্ডার যখন আল্লাহ আমাকে দেখালেন, তখন আল্লাহ আপনাদের আমার সাথে রেখেছেন। আর সম্পদের ওপর মালিকানার খোদায়ী একটা উসিলা হলো, যার মাটিতে, বা যে দেশের মাটিতে সম্পদ পাওয়া যাবে, সম্পদ সেই দেশের বা সেই দেশের মানুষের। যেহেতু দেশ আপনাদের, তাই এই সম্পদের মালিক আপনারা। এই সম্পদ পাওয়ার আল্লাহ আমাকে উসিলা বানিয়েছেন, এটাই সত্য।’ থামল আহমদ মুসা।
ধীর কণ্ঠে সরদার জামাল উদ্দিন বলল, ‘তোমার কথার ওপর কথা বলা আমাদের বেআদবি। কিন্তু যেহেতু তুমি আমার নাতির মতো, তাই কিছু কথা বলে রাখি। আবারও বলছি, তোমার কথা মেনে নেবার পরও তোমাকে উসিলা বানিয়েছেন আল্লাহ নিশ্চয় কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে। সেই উদ্দেশ্যটা কি? তোমাকে ছাড়াও এই ধনভাণ্ডার আল্লাহ আমাদের দিতে পারতেন, তা দেননি। তোমাকে উসিলা বানিয়েছেন কেন?’
‘হয় তো আল্লাহ চান, এ ধনভাণ্ডারের ব্যাপারে কোনো পরামর্শ চাইলে আমি তা যেন দিই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে বল, এ ধনভাণ্ডার কে রাখবে, এর ব্যবহারের ব্যবস্থাপনা কি হবে?’ সরদার জামাল উদ্দিন বলল।
‘এই ব্যাপারে আপনাদের চিন্তাটা কি বলুন, তাহলে আমার পরামর্শ দেয়া সহজ হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
সরদার জামাল উদ্দিন তাকাল জাবের জহীর উদ্দিনের দিকে। বলল, ‘জাবের জহীর উদ্দিন আমাদের নেতা। এ ব্যাপারে কথা বলা তারই হক।’
‘ধনভাণ্ডার যাদের দ্বারা আল্লাহ আবিষ্কার করিয়েছেন, আমি তাদের মধ্যে ছিলাম না। অতএব, এ ব্যাপারে কোনো মত দেবার কথা আমার নয়। তবু বলতে হলে আমি বলব, আল-কাতান বা কোহেতান পাহাড়ের ধনভাণ্ডার আপাতত কোহেতান কবিলার প্রধান জনাব সরদার জামাল উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে থাকবে। আর এ ধনভাণ্ডারের ব্যবহার ব্যবস্থাপনার বিষয়টা আমাদের সকলের সম্মানিত নেতা, থাইল্যান্ডের এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের নায়ক আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসা ঠিক করে দেবেন।’ বলল জাবের জহীর উদ্দিন।
কিছু বলতে যাচ্ছিল সরদার জামাল উদ্দিন। তার আগেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘জাবের, সর্বাবস্থায় সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যে, কোনো মানুষের এতে ভাগ বসাবার অধিকার নেই। কোনো আবেগের বশবর্তী হয়ে এটা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।’
‘স্যরি। আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। আপনি আমাকে শুধরে দিয়েছেন ভাই। আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন।’ বলল জাবের জহীর উদ্দিন। তার কণ্ঠ ভারি।
‘ধন্যবাদ জাবের। আল্লাহ আমাদের সকলকে মাফ করুন।’ জাবের থামতেই বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করে একটা দম নিয়েই আবার বলা শুরু করল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমার মত হলো, জাবের জহীর উদ্দিন এবং জনাব সরদার জামাল উদ্দিনরা যৌথ উদ্যোগে ধনভাণ্ডারটি উদ্ধার করবেন। জাবের ঠিকই বলেছে, ধনভাণ্ডার আপাতত সরদার জামাল উদ্দিন আমানত হিসেবে রাখবেন। তারপর আমি মনে করছি ধনভাণ্ডারের বণ্টনটা এভাবে হবেঃ ধনভাণ্ডার সমান চার ভাগে ভাগ হবে। এর এক ভাগকে দুই ভাগে ভাগ করে এর এক অংশ দিতে হবে থাই সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছাত্রবৃত্তি বিভাগকে। অন্য অংশ পাবে মালয়েশিয়া সরকারের অনুরূপ ছাত্রবৃত্তি তহবিল। চার ভাগের অবশিষ্ট তিন ভাগের এক ভাগ পাবে থাই সরকারের স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা মুসলিম এডুকেশন ট্রাস্ট। এর অবশিষ্ট দুই ভাগের এক ভাগ যাবে মালয়েশিয়া সরকারের ইসলামিক একাডেমি অব সায়েন্স- এর গবেষণা প্রকল্প প্রমোশন ফান্ডে। চার ভাগের শেষ ভাগের তিন-চতুর্থাংশ পাবে শাহ পরিবার তাদের দাবি-দাওয়া আন্দোলনের তহবিল হিসেবে। অবশিষ্ট এক-চতুর্থাংশ পাবে জনাব সরদার জামাল উদ্দিনের কবিলা আল-কোহেতান, যা তারা ব্যয় করবে কোহেতানের পাহাড়ী পরিবারগুলোর শিক্ষা উন্নয়নে।’ থামল আহমদ মুসা।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌।’ সরদার জামাল উদ্দিন, জাবের জহীর উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিন একসাথে বলে উঠল।
‘সবচেয়ে ভালো লাগছে, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের মুসলিম-অমুসলিম কেউ বঞ্চিত হলো না এই ফান্ড থেকে এবং এই ফান্ড ব্যয় হবে সর্বসাধারণের জাতীয় কল্যাণে। ফান্ড যেহেতু মুসলমানদের, তাই মুসলমানরা অগ্রাধিকার পেয়েছে বটে, কিন্তু অমুসলিমরাও ন্যায্য অংশ পেয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ্‌।’ জাবের জহীর উদ্দিন বলল।
‘ধনভাণ্ডারের তিন-চতুর্থাংশই ব্যয় হচ্ছে শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নে। এর পেছনে আপনার কি চিন্তা কাজ করেছে স্যার?’ জিজ্ঞাসা আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের।
‘আবদুল কাদের, ধনভাণ্ডারের সাথে রাখা ধনভাণ্ডারের মালিকের যে বক্তব্য লিখিত আছে, তার কথা মনে আছে তোমার নিশ্চয়। তার বক্তব্যে আছে, কি করে ধীরে ধীরে বিদেশীরা মালয় উপদ্বীপ দখল করে নেয়। মুসলমানদের তখন অর্থবল, জনবল, অস্ত্রবল কিছুরই অভাব ছিল না। অভাব ছিল সচেতনতার, অভাব ছিল শত্রুকে চেনা ও বোঝার মতো জ্ঞানের, অভাব ছিল জাতীয় বোধ ও ঐক্যের। এসব অভাবের মূল কারণ ছিল উপযুক্ত শিক্ষার অভাব, যে শিক্ষা নিজেকে চেনায়, জাতিকে চেনায়, দেশকে চেনায় এবং নিজেকেসহ দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করার, দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার উপযুক্ত করে তোলে। এই শিক্ষার অভাব এখনও প্রকট। উপযুক্ত শিক্ষা ও জ্ঞানের অভাবেই আমরা দেশ ও জাতির ঐক্য ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারছি না এবং ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছি। এই যে তোমরা সংকটে পড়েছিলে, এখানে তোমাদের জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব মুখ্য কারণ হিসেবে কাজ করেছে। এজন্যেই উপযুক্ত শিক্ষার উন্নতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তারের জন্যে বেশি অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। এখন বন্দুক, বোমা কোনো পরিবর্তনের অস্ত্র নয়, আসল অস্ত্র হলো উপযুক্ত জ্ঞান এবং জ্ঞানের উপযুক্ত ব্যবহার। আজ অস্ত্র ও অর্থবলের মতো হার্ড পাওয়ারের চাইতে সুপরিকল্পিতভাবে রচিত গ্রন্থাদি, সুসম্পাদিত বহুল প্রচারিত পত্র-পত্রিকা, শক্তিশালী ইলেকট্রনিক মিডিয়া আর জ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির সুপরিকল্পিত সফট পাওয়ারের শক্তি অনেক বেশি। ধনভাণ্ডারের মালিক এটাই চেয়েছিলেন যে, তার ধনভাণ্ডার উপযুক্ত হাতে পড়ুক এবং উপযুক্ত কাজে লাগুক। আমি তার এই আশা পূরণ করার চেষ্টা করেছি।’ থামল আহমদ মুসা।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌।’ বলে উঠল একসাথে তিনজনই।
কিছু বলতে গেল সরদার জামাল উদ্দিন। এ সময় হেলিকপ্টারের শব্দ তাদের কানে এল।
তিনজনের ছয়টি চোখই ছুটে গেল পূর্ব দিকে। বড় হেলিকপ্টার। সামরিক হেলিকপ্টার বলে মনে হচ্ছে।
‘আমার মনে হচ্ছে, যে হেলিকপ্টার আসছে, এই হেলিকপ্টারে করে আমরা সবাই যাব থাইরাজা আনন্দ মহিদল ভূমিবলের প্রাসাদ-অফিসে। তিনি দাওয়াত দিয়েছেন আমাদের সকলকে। সেখানে যারা যাচ্ছেন তাদের মধ্যে রয়েছে দাদী, যয়নব যোবায়দা ও ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন। তাছাড়া সেখানে যাচ্ছে সিরিত থানারতা এবং যাচ্ছে আয়েশা আলিয়া ও আবদুল জব্বার আল যোবায়েরও। আর….।’
‘সবাই মানে আয়েশা আলিয়া ও জাফর জামিল ওখানে যাচ্ছে কিভাবে?’ আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই কথা বলল সরদার জামাল উদ্দিন। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
একই ধরনের বিস্ময় জাবের জহীর উদ্দিনের চোখে-মুখে। সরদার জামাল উদ্দিন থামতেই জাবের জহীর উদ্দিন বলে উঠল, ‘মহারাজা, প্রধানমন্ত্রী আপনার সাথে দেখা করবেন, আমাদেরকেও ডাকতে পারেন, এটা ঠিক আছে। কিন্তু দাদীরা যাচ্ছেন কেন বুঝতে পারছি না।’
‘আমি টেলিফোনে সবার সাথে আলোচনা করেছি। দাদী ও যয়নবের সাথেও। আয়েশা আলিয়ার সাথেও কথা বলেছি। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, তাই সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এবং নিয়ে যাবারও ব্যবস্থা করেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন? সবাইকে প্রয়োজন কেন?’ বলল জাবের জহীর উদ্দিন।
‘দু’টি কারণে। এক. সবার সাথে আমি দেখা করতে চাই, দুই. জাবের জহীর উদ্দিন, যয়নব যোবায়দা এবং আয়েশা আলিয়ার বিয়ে আমি দেখে যেতে চাই। আমি দুঃখিত, তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করার সময় পাইনি। আমি যয়নব যোবায়দা, দাদী, আয়েশা আলিয়াদেরকে বলেছি। জাবের, সরদারজী, আপনাদের আপত্তি নেই তো? থাই রাজার প্রাসাদেই এই তিন জোড়া বিয়ের আয়োজন করা হচ্ছে।’
অপার বিস্ময় জাবের জহীর উদ্দিনের মনে। সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদেরের চোখে-মুখেও। বলল জাবের জহীর উদ্দিন, ‘আমাদের ব্যাপারে আপনার যে কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের সৌভাগ্য। কিন্তু….।’
জাবের জহীর উদ্দিনের কথার মাঝখানেই সরদার জামাল উদ্দিন বলে উঠল, ‘আমিও একে আমাদের পরম সৌভাগ্য বলে মনে করছি।’
‘কিন্তু সম্মানিত ভাই, এটা আজই কেন? এত তাড়াহুড়া করে কেন?’ বলল জাবের জহীর উদ্দিন সরদার জামাল উদ্দিনের কথা শেষ হবার সংগে সংগেই।
‘তোমাদেরকে আরেকটা কথা জানানো হয়নি। আমি আজই মদীনায় আমার বাড়িতে যাব।’
কথাটা শুনে বিদ্যুৎ-স্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল তিনজনই। হঠাৎ যেন রাতের অন্ধকার নামল তাদের চোখে-মুখে। সবাই বিস্ময়তাড়িত বোবা দৃষ্টি নিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
কিছুক্ষণ কেউ কথা বলতে পারল না।
একসময় নীরবতা ভাঙল জাবের জহীর উদ্দিন। ধীর কণ্ঠে বলল, ‘আপনার সাথে তো কিছুই কথা হলো না আমার। আপনার সম্পর্কে কত কথা শুনেছি, কত পড়েছি। এক স্বপ্ন ছিলেন আপনি আমাদের কাছে। হাবিব হাসাবাহদের মুখেই প্রথম শুনলাম যে, আপনি সম্ভবত থাইল্যান্ডে এসেছেন। ওরা নিশ্চিত তখনও জানতো না, কিন্তু বলতো যে, আহমদ মুসা ছাড়া তাদের ক্ষতি করার এমন লোক পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ নেই। তারা সন্দেহ করতো যে, আন্দামানে যখন আপনি এসেছেন, তখন থাইল্যান্ডেও আসতে পারেন। মাত্র কয়েকদিন আগে তারা নিশ্চিত হয় যে, আপনিই আহমদ মুসা। আমি এটা জানার পর কি যে খুশি হয়েছিলাম। সেদিনই প্রথম ভাবতে শুরু করলাম, আল্লাহ আমাকে মুক্ত করবেন। মুক্ত করার জন্যেই আল্লাহ আপনাকে থাইল্যান্ডে নিয়ে এসেছেন। সেদিন থেকেই কত স্বপ্ন দেখছি, আপনাকে কত কথা বলব, কত কথা জানব। আপনি কেন আন্দামানে এলেন আর কিভাবেই বা এলেন থাইল্যান্ডে? এসব নানা প্রশ্ন জমাট বেঁধে আছে আমার মধ্যে।’ বলল জাবের জহীর উদ্দিন। অশ্রুভেজা তার কণ্ঠ।
আহমদ মুসা একটা হাত জাবেরের পিঠে রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘আমরা এখনও একসাথে একবেলার মতো আছি। অনেক কথা হবে। আন্দামানের আহমদ শাহ আলমগীরের টেলিফোন নাম্বার আমি তোমাকে দিয়ে যাব। তার সাথে কথা বলে আন্দামানের সব ঘটনা জানতে পারবে। আর থাইল্যান্ডে কিভাবে এলাম, এটা যয়নব যোবায়দার কাছ থেকে জানতে পারবে। সেই আমাকে নিয়ে এসেছে থাইল্যান্ডে।’
জাবের জহীর উদ্দিন বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘যয়নব আপনাকে নিয়ে এসেছে থাইল্যান্ডে?’
‘সে এক রূপকথা জাবের। তুমি যোবায়দার কাছে শুনে নিও।’
বলেই আহমদ মুসা আকাশের দিকে তাকাল। বলল, ‘হেলিকপ্টার এসে গেছে। চল আমরা একপাশে সরে যাই। মাঝের এই এলাকাটা কিছুটা সমতল। এখানে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করাতে সুবিধা হবে।’
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
তার সাথে উঠে দাঁড়াল সবাই। একপাশে তারা সরে গেল।
একে একে দু’টি হেলিকপ্টারই ল্যান্ড করল। হেলিকপ্টারগুলো মাউন্টেইন ল্যান্ডার। সুতরাং কোনো অসুবিধাই হলো না ল্যান্ড করতে।
প্রথমে হেলিকপ্টার থেকে নামল পুলিশ প্রধান থানম কিত্তিকাচরণ। তারপর নামল সহকারী গোয়েন্দা প্রধান পুরসাত প্রজাদিপক। তারপরেই নেমে এল আরও কয়েকজন পুলিশ ও গোয়েন্দা অফিসার।
অন্য হেলিকপ্টার থেকে নামল একদল পুলিশ।
পুলিশ প্রধান অফিসারদের নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল আহমদ মুসাদের দিকে।
আহমদ মুসারাও এগোলো তাদের দিকে। মুখোমুখি হলো তারা।
আহমদ মুসা স্বাগত জানিয়ে হাত বাড়াল পুলিশ প্রধানের দিকে হ্যান্ডশেকের জন্যে।
কিন্তু পুলিশ প্রধান দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘কংগ্র্যাচুলেশন বিভেন বার্গম্যান ওরফে আহমদ মুসা। আমরা কৃতজ্ঞ আপনার কাছে। প্রথমটায় আপনার কথায় আমরা আস্থা রাখতে পারিনি বলে দুঃখিত।’
থাইল্যান্ডের সবচেয়ে সম্মানিত পুলিশ অফিসার, পুলিশ প্রধানকে জড়িয়ে ধরে আহমদ মুসা বলল, ‘কৃতজ্ঞতা আমাকেই প্রকাশ করতে হবে স্যার। আপনার বিভাগের সহযোগিতা না পেলে আমি এভাবে এগোতে পারতাম না।’
আহমদ মুসা জাবের জহীর উদ্দিনকে দেখিয়ে বলল, ‘এ হলো ঘটনার মধ্যমণি জাবের জহীর উদ্দিন।’
পুলিশ প্রধান এগোলো জাবের জহীর উদ্দিনের সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্যে।
এই ফাঁকে সহকারী গোয়েন্দা প্রধান পুরসাত প্রজাদিপক এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘ওয়েল ডান ইয়ংম্যান। তুমি সকলকে নির্বাক করে দিয়েছ।’
তারপরেই কানে কানে আহমদ মুসাকে বলল, ‘তোমার হুকুম মতো তিন জোড়া বিয়ের কাজ পুরোদমে চলছে। তোমার টিকেটও রেডি, কিন্তু সিরিত থানারতারা কি তোমাকে ছাড়বে?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘স্যার, কেউ ছাড়ে না। তবু ছাড়তেই হয়। এটাই পৃথিবীর এক নিষ্ঠুর নিয়ম।’
‘তবুও মধুর এই পৃথিবী’ বলে পুরসাত প্রজাদিপক আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল জাবের জহীর উদ্দিনকে। বলল, ‘তুমি ঠিক আছ বেটা?’ গভীর আবেগ পুরসাত প্রজাদিপকের কণ্ঠে।
আহমদ মুসা পুরসাত প্রজাদিপক ও পুলিশ প্রধানকে পরিচয় করিয়ে দিল সরদার জামাল উদ্দিন ও আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনের সাথে। বলল, ‘বেতাংগ থেকে এই টেপাংগ পাহাড় পর্যন্ত আমার অভিযানের এরা ছিলেন মধ্যমণি।’
‘না স্যার’, বলে উঠল সরদার জামাল উদ্দিন, ‘আমরা আসলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। আহমদ মুসা অদ্ভুত প্রজ্ঞার পরিচয় না দিলে ওরা তিনজন লাশ না হয়ে আমরা তিনজন লাশ হয়ে যেতাম। জাবের জহীর উদ্দিনও বাঁচত না।’
কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে একবার আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল পুলিশ প্রধান থানম কিত্তিকাচরণ।
তার আগেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘মাফ করবেন স্যার, হাবিব হাসাবাহদের সার্চ বাকি আছে, ঘাঁটিও সার্চ করা দরকার স্যার।’
মিষ্টি হাসল থানম কিত্তিকাচরণ। বলল, ‘আমি শুনেছি, তুমি প্রশংসা পছন্দ কর না। সত্যিই যদি তোমার মতো দুনিয়ার সব লোক হতো আহমদ মুসা!’
একটু থেমেই আবার আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘দেখ, অফিসাররা ভিকটিমদের ফটো নিচ্ছে, সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করছে। ওরাই সার্চ করবে ভিকটিমদের। টেররিজম প্রিভেনশন ব্যুরোর (TPB) চীফও এসেছেন। তার নেতৃত্বেই পুলিশরা ঘাঁটি সার্চ করবে, ফটো নেবে। অনেক সময় লাগবে ওদের। ওরা থাকবে, আমরা চলে যাব এখনি তোমাদের নিয়ে।’
বলেই পুরসাত প্রজাদিপকের দিকে চেয়ে নির্দেশ দিল, ‘মি. প্রজাদিপক, TPB চীফ চুলাংকরণকে সব কাজ আরেকবার বুঝিয়ে দিয়ে আসুন। আমরা এখনই স্টার্ট করব। এরা সবাই ক্লান্ত। তাছাড়া বিয়ের আয়োজনে এদের রেডি হবারও প্রশ্ন আছে।’
‘জ্বি স্যার, আমি আসছি।’ বলে অফিসারদের দিকে চলে গেল পুরসাত প্রজাদিপক।
‘আহমদ মুসা, একটা সুখবর আছে। পুরসাত প্রজাদিপক আজই থাইল্যান্ডের গোয়েন্দা প্রধানের দায়িত্ব নিচ্ছেন। আর গোয়েন্দা প্রধান আজকেই রয়্যাল কাউন্সিলের একজন সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেয়ে গেছেন।’ বলল পুলিশ প্রধান থানম কিত্তিকাচরণ।
‘খুব খুশি হলাম স্যার। আপনারা সঠিক মূল্যায়ন করছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আহমদ মুসা, তুমি এভাবে না গিয়ে আর একদিন সময় দিতে পার না আমাদের?’ পুলিশ প্রধান থানম কিত্তিকাচরণ বলল।
‘স্যার, আমার ছেলে অসুস্থ। আমার স্ত্রীকে সত্যিই একটু আপসেট মনে হলো, যদিও সে নিজেকে চেপে রাখার চেষ্টা করেছে। আমি একটু উদ্বিগ্ন।’ আহমদ মুসা বলল।
কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে এল পুরসাত প্রজাদিপক। বলল, ‘সব ঠিক-ঠাক স্যার। আমরা এখন যেতে পারি।’
‘ঠিক আছে চল।’ বলে পুলিশ প্রধান থানম কিত্তিকাচরণ আহমদ মুসার হাত ধরে পাশাপাশি হেলিকপ্টারের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
পুরসাত প্রজাদিপক জাবের জহীর উদ্দিন, সরদার জামাল উদ্দিন এবং আবদুল কাদেরকে নিয়ে পেছনে হাঁটা শুরু করল।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সবাইকে নিয়ে একটি হেলিকপ্টার আকাশে উড়ল।

থাইরাজা আনন্দ মহিদল ভূমিবলের খাস ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
ড্রইংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে রাজা আনন্দ মহিদল ভূমিবল এবং রানী মাহা সারাখান ভূমিবল বিদায় দিল আহমদ মুসাকে। বিদায়ী হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে রাজা ভূমিবল বলল, ‘আহমদ মুসা, নিজের জীবন বিপন্ন করে নিঃস্বার্থ সেবা দিয়ে থাইল্যান্ডকে আপনি অসীম কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। চিরদিন মনে রাখবে এটা থাইল্যান্ড।’
‘সিরিত থানারতা ও জাবের বাংসা জহীর উদ্দিনের বিয়ে দক্ষিণের পাত্তানীদের সাথে অবশিষ্ট থাইল্যান্ডকে আরও একাত্ম করবে এবং এরও সবটা কৃতিত্ব আপনার আহমদ মুসা।’ রাজা ভূমিবলের কথা শেষ হবার পরেই বলে উঠল রানী মাহা সারাখান ভূমিবল।
‘আপনাদের ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। যে আতিথ্য, যে আন্তরিকতা দিয়েছেন আপনারা, আমারও চিরদিন তা মনে থাকবে। আমি যা কিছুই করেছি, তার জন্যে সকল কৃতিত্ব আমার মালিকের, আমার স্রষ্টার। মহামান্য রানী, আমিও আশা করি, পাত্তানী মুসলমানদের সাথে অবশিষ্ট থাইল্যান্ড আরও একাত্ম হয়ে যাবে। ওরা বেশি কিছু চায় না, ওদের বিশ্বাস এবং বিশ্বাসভিত্তিক কাজের স্বাধীনতা ওদের জন্যে যথেষ্ট। বহুজাতিক রাষ্ট্রে জাতিগুলোর স্বায়ত্তশাসন রাষ্ট্রকে দুর্বল করে না, শক্তিশালীই করে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা, তোমার এ কথাগুলো আমাদেরও কথা। সত্যি আহমদ মুসা, সবার যদি তোমার মতো এমন পরার্থের জীবন হতো, মানুষ যদি হতো এমন ঈশ্বরকেন্দ্রিক, তাহলে দুনিয়ায় স্বর্গ নেমে আসত। তোমাকে ঈশ্বর দীর্ঘজীবী করুন।’ বলল রাজা আনন্দ মহিদল ভূমিবল।
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। গুড বাই।’
‘গুড বাই, গড ব্লেস ইউ।’ বলল রাজা ও রানী দু’জনেই।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে করিডোর ধরে চলতে শুরু করল।
করিডোরেই কিছুটা সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে প্রধানমন্ত্রী চিয়াং মাই থাকসিন।
আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে আহমদ মুসার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল। আহমদ মুসার হাতে সে একখণ্ড কাগজ তুলে দিয়ে বলল, ‘এটা ইন্টারপোলের একটা ই-মেইল বার্তার কপি। আমরা ক’মিনিট আগে পেয়েছি। আমরা হাবিব হাসাবাহর ফটো পাঠিয়েছিলাম তাদের কাছে তার পরিচয় জানার জন্যে। তারা এই ই-মেইলে জানিয়েছে, হাবিব হাসাবাহ জায়োনিস্ট গোয়েন্দা সংস্থা ইরগুন জাই লিউমির একজন শীর্ষস্থানীয় সদস্য। এর আগে সে মুসলিম পরিচয় নিয়ে লেবানন, চীনের জেন জিয়াং ও সোমালিয়াতেও কাজ করেছে। ধন্যবাদ আপনাকে আহমদ মুসা। আপনি শুরুতেই যেটা বলেছিলেন, তা শতভাগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনারা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কি আপনারা সরকারিভাবে কোনো বক্তব্য দেবেন?’ বলল আহমদ মুসা।
হাসল প্রধানমন্ত্রী চিয়াং মাই থাকসিন। বলল, ‘আমরা অফিসিয়ালী কোনো বক্তব্য দিচ্ছি না। আমরা প্রেসকে সব দিয়ে দিচ্ছি। ওরাই ষড়যন্ত্রটা ফাঁস করবে। হাবিব হাসাবাহর ফটো, এমনকি ই-মেইলের কপিও আমরা দিয়ে দিচ্ছি।’
‘এটাই যথেষ্ট হবে স্যার। ধন্যবাদ।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘গাড়ি রেডি স্যার?’
‘গাড়িতে নয়, আপনি হেলিকপ্টারে যাচ্ছেন এয়ারপোর্টে। হিজ এক্সিলেন্সি রাজা ভূমিবল তার ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার অফার করেছেন আপনাকে এয়ারপোর্টে নেবার জন্যে। বাইরের লনে হেলিকপ্টার রেডি।’ প্রধানমন্ত্রী বলল।
প্রাসাদ থেকে বাইরে এল তারা।
প্রাসাদের তিন পাশে বাগান, কিন্তু বিস্তীর্ণ লন। ডজনখানেক হেলিকপ্টার একসাথে এ লনে ল্যান্ড করতে পারে। জাতীয় দিবসে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্যারেড এখানেই অনুষ্ঠিত হয়।
সামনেই রাজকীয় হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেল আহমদ মুসা।
বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল পুলিশ প্রধান, নতুন গোয়েন্দা প্রধান পুরসাত প্রজাদিপকসহ আরও কিছু শীর্ষ আমলা ও পুলিশ অফিসার।
আরও একটু দূরে হেলিকপ্টারের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল দাদী, জাবের জহীর উদ্দিনসহ সকলকে।
আহমদ মুসারা বেরিয়ে আসতেই গোয়েন্দা প্রধান পুরসাত প্রজাদিপক এগিয়ে এল আহমদ মুসাদের দিকে। প্রধানমন্ত্রীকে স্যালুট করে সে বলল, ‘স্যার, সব রেডি।’ তারপর আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘আহমদ মুসা বিদায়-আদায় নিয়ে এসেছ সবার কাছ থেকে। কিন্তু সবাই আবার এখানে এসে গেছে। কাউকে মানানো যায়নি।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমার অসুবিধা নেই। বিয়ের অনুষ্ঠানে কম ধকল যায়নি ওদের ওপর দিয়ে। তাই কষ্ট করে আর আসতে নিষেধ করেছিলাম। এসেছে ভালোই হয়েছে। আবার সবার সাথে দেখা হবার সুযোগ হলো।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা।’ বলল গোয়েন্দা প্রধান পুরসাত প্রজাদিপক।
আহমদ মুসাকে সাথে নিয়ে চলল হেলিকপ্টারের দিকে।
দাদীর কাছাকাছি পৌঁছতেই দাদীও এগোলো আহমদ মুসার দিকে।
প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই থমকে দাঁড়াল।
আহমদ মুসাও দাদীর দিকে এগোলো। আহমদ মুসা মুখোমুখি হলো দাদীর। অন্যরাও সবাই এসে সামনে দাঁড়াল। জাবের জহীর উদ্দিন ও সিরিত থানারতা, ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন ও যয়নব যোবায়দা, জাফর জামিল ও আয়েশা আলিয়া সবাই বিয়ের পোশাক পরেই চলে এসেছে। তাদের সাথে সরদার জামাল উদ্দিন এবং আবদুল কাদের কামাল উদ্দিনও।
‘দাদী, আবার দেখা হওয়ায় খুব খুশি হলাম। কিন্তু আপনার কষ্ট হয়েছে আসতে।’
দাদীর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। সে আহমদ মুসার মাথায়-কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘দাদীকে এমন কষ্ট দেবার জন্যে আর হয়তো কোনোদিন আসবে না তুমি, এই জন্যেই ছুটে এসেছি ভাই। তুমি আল্লাহর তরফ থেকে ফেরেশতা হয়ে এসেছিলে। ফেরেশতারা আল্লাহর ইচ্ছাতে আসে, ডাকলে আসে না। সেজন্যে শেষ দেখার সুযোগ নেবার জন্যে ছুটে এসেছি।’ কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল দাদীর কণ্ঠ।
সবার চোখ দিয়েই অঝোর ধারায় নামছে অশ্রু।
আহমদ মুসার চোখও সিক্ত হয়ে উঠেছে। দাদীর কথার কি জবাব দেবে সে! এটাই তো বাস্তবতা। কত দেশের এমন কত দৃশ্য তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, এটাও তেমনি হারিয়ে যাবে, এরাও হারিয়ে যাবে সবাই। কোনোদিন এরা এভাবে আর সামনে এসে দাঁড়াবে না। স্মৃতির জগতে আবেগের ঢেউ যেন উথলে উঠতে চাইল আহমদ মুসার। আহমদ মুসা বড় দুর্বল এখানে!
আহমদ মুসা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘দাদী, এক দেশে নয় বটে, এক বিশ্বেই তো আমরা আছি। বেদনার মধ্যে এটাই আমাদের সান্ত্বনা।’
জাবের জহীর উদ্দিন, ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন, আবদুল জব্বার আল যোবায়ের একে একে সবাই এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। কান্না চাপতে গিয়ে কোনো কথাই বলতে পারল না তারা।
ওরা সরতেই সিরিত থানারতা, যয়নব যোবায়দা এবং আয়েশা আলিয়া একসাথে এসে হঠাৎ আহমদ মুসার পায়ের কাছে বসে পড়ল। কাঁদছে তারা তিনজনই।
ওরা তিনজনই বিয়ের পোশাকে সজ্জিতা। মাত্র মুখটুকু ছাড়া ওরা আপাদমস্তক বিয়ের পোশাকে মোড়া।
কি বলে আহমদ মুসা সান্ত্বনা দেবে ওদের!
একটু ভাবল। বলল, ‘একটা সুখবর দেব তোমাদের, তোমরা উঠে দাঁড়াও।’
অশ্রুভেজা মুখ তুলল সিরিত থানারতা। বলল, ‘আপনাকে বলতে হবে, আপনি আজ যাবেন না।’ কান্নায় ভেঙে পড়া তার কণ্ঠ।
‘তার চেয়েও বড় সুখবর দেব, তোমরা উঠে দাঁড়াও।’ আহমদ মুসা বলল।
মাথা নিচু করে তিনজনই উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়িয়েই যয়নব যোবায়দা বলল, ‘আপনি যে সময় থাইল্যান্ডে ছিলেন, লড়াইয়ের মধ্যে ছিলেন। ভালো খাওয়া, নিশ্চিন্ত ঘুম কিছুই আপনার কোনোদিন হয়নি। আপনার সব কথা শিরোধার্য। কিন্তু আজ আপনি যেতে পারবেন না।’ তার কণ্ঠ দৃঢ়। চোখ মুছে ফেলেছিল সে।
ম্লান হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমাদের আবেগ, তোমাদের যুক্তি সব ঠিক আছে। কিন্তু অনুরূপ একটা আবেগ এবং যুক্তিই আমাকে এখন বাড়িতে যেতে বাধ্য করছে।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। পরক্ষণেই আবার বলে উঠল, ‘তোমাদের একটা সুখবর দেব বলেছি। সেটা হলো, শীঘ্রই তোমাদের সাথে আমাদের দেখা হচ্ছে ইনশাআল্লাহ। সামনের জিলহজ্ব মাসে তোমাদের হজ্বের ব্যবস্থা হবে। হজ্বের সময় এবং হজ্ব শেষে মদীনা শরীফে তোমরা আমাদের মেহমান হবে। এটা বেশি আনন্দের হবে না?’
‘হবে, কিন্তু আমরা এটা ওটা দুটোই চাই।’ বলল আয়েশা আলিয়া। তার কণ্ঠ গম্ভীর।
আয়েশা আলিয়ার কথা শেষ হতেই দাদী বলল, ‘তোমরা জেদ করো না। হজ্ব বেশি আনন্দের, ওটাই আমরা চাই।’
বলে কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে দাদী তিনজনের গায়ে হাত বুলিয়ে আহমদ মুসার সামনে থেকে সরিয়ে নিল। বলল, ‘উনি তোমাদের বড় ভাই। কত বড় ভাই জান না। উনি যা বলেন, তার মধ্যেই কল্যাণ আছে।’
‘তাই বলে উনি আমাদের বিয়ের সাজ পরিয়েই চলে যাবেন দাদী!’ বলে সিরিত থানারতা দাদীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।
দাদী তাকে বুকে জড়িয়ে রেখে গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, ‘বিয়ের সাজ পরিয়ে নয় বোন, বিয়ে দিয়েই যাচ্ছেন।’
দাদী সিরিত থানারতার চোখ মুছে দিয়ে বলল, ‘আর দেরি নয়, হাসিমুখে বিদায় দাও বড় ভাইকে তোমরা।’
এগিয়ে এসেছে পুরসাত প্রজাদিপকসহ সবাই।
পুরসাত প্রজাদিপক বলল, ‘আহমদ মুসা, আমরা কিন্তু দাওয়াত পেলাম না।’
হাসল আহমদ মুসা। ঘুরে দাঁড়াল সবার দিকে। বলল, ‘প্রধানমন্ত্রী স্যারসহ সবাইকে আমি সৌদি আরব সফরের দাওয়াত করছি। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি সবাই বিদেশে প্রাইভেট সফরও করতে পারেন। আমি আন্তরিকভাবে সবাইকে দাওয়াত করছি। আপনারা সম্মতি দিলে আমি ব্যবস্থা করব।’
পুরসাত প্রজাদিপক তাকাল প্রধানমন্ত্রীর দিকে। প্রধানমন্ত্রী বলল, ‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আমরা খুশি সৌদি আরব সফর করতে পারলে, বিশেষ করে আপনার আতিথ্যে। আমরা জানাব আপনাকে।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি যোগাযোগ করব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা।’ বলল প্রধানমন্ত্রী। হেলিকপ্টারের প্রটোকল অফিসার এসে পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল বার বার।
আহমদ মুসা তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চল অফিসার।’
বলে আহমদ মুসা সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। জাবের, দাদীদের দিকে চেয়ে বলল, ‘দাদী এবং ভাইয়েরা, বোনেরা, আমি আসি। আল্লাহ হাফেজ।’
বলে আহমদ মুসা প্রটোকল অফিসারের সাথে হেলিকপ্টারের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
জাবেররা সবাই বলে উঠেছে, ‘ফি আমানিল্লাহ। আল্লাহ হাফেজ।’
পেছনে তাকাচ্ছে আহমদ মুসা বার বার।
হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীসহ সকলেই।

আহমদ মুসা সোফায় বসে। তার কোলে আহমদ আবদুল্লাহ।
নিচে কার্পেটে আহমদ মুসার পায়ের কাছে ডোনা জোসেফাইন। তার মাথা আহমদ মুসার উরুতে।
অনেক ঘোরাফেরা ও দুষ্টুমির পর নেতিয়ে পড়েছে আহমদ আবদুল্লাহ। এখন ঘুমাবে সে।
‘ওকে ওর বেডে রেখে আসি।’ বলল জোসেফাইন।
‘না, তোমাকে উঠতে হবে না। ও কোলেই ভালো ঘুমাবে।’
বলে একটা হাত আহমদ মুসা জোসেফাইনের মাথায় রাখল।
জোসেফাইনেরও একটা হাত ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে আহমদ মুসার হাত ধরল।
‘অসুখ কাটিয়ে উঠেছে আহমদ আবদুল্লাহ। গত দু’দিন থেকে ওর মুভমেন্টটা একদম নরমাল হয়ে গেছে।’ বলল জোসেফাইন।
‘তাহলে দেখা যাচ্ছে, অসুস্থ হবার পর দেড় মাস লাগল তার নরমাল হতে। খুব কষ্ট পেয়েছে বেচারা এবার পেটের অসুখে। আমার মনে হয়, পয়জনিংটা পানি থেকেই হয়েছিল।’
‘আমি তাই মনে করেছি। মেয়েদের যে কনফারেন্সে গিয়েছিলাম, সেখানে ছোট একটা বটলড ওয়াটার নিয়েছিলাম। পানিটার ব্র্যান্ড মনে নেই, আউটডেটেড হতে পারে পানিটা।’
‘যাক, আল্লাহ আমাদের সাহায্য করেছেন। আরও খারাপ হয়নি, এটা আল্লাহরই সাহায্য।’
‘আলহামদুলিল্লাহ, সবাই সাহায্য করেছেন। হাসপাতালের ডিজি বার বার কেবিনে এসেছেন তার খোঁজ নিতে। আমাদের মদীনার গভর্নরের স্ত্রী দু’দিন এসে দেখে গেছেন হাসপাতালে। তুমি গভর্নর সাহেবকে একটা ধন্যবাদ দিও।’
‘ঠিক আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
হঠাৎ আহমদ মুসা ডোনা জোসেফাইন যে হাত দিয়ে আহমদ মুসার হাত ধরেছিল, সে হাত টেনে নিয়ে একটা আঙুলের মাথা আস্তে স্পর্শ করে বলল, ‘আঙুলের মাথা এখনও কিছুটা ফোলা দেখছি। ওষুধ ব্যবহার করছ না?’
হাসল ডোনা জোসেফাইন। বলল, ‘থাক না পবিত্র হেরার, পবিত্র গুহার মধুর স্মৃতিটা।’
আহমদ আবদুল্লাহ সুস্থ হবার পর তাকে নিয়ে আহমদ মুসা ও জোসেফাইন ওমরাহ্‌ করতে গিয়েছিল। আহমদ আবদুল্লাহকে সাথে নিয়ে দু’জন হেরা গুহায় উঠেছিল। গোটা একটা বেলা তারা গুহায় ছিল। বের হবার সময় পাথরের ওপর একটা পা ফসকে যাওয়ায় হাত দিয়ে দেহের ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে একটা পাথরের সাথে ডান হাতের মধ্যমা জোরে লাগায় আঙুলের মাথাটা থেঁতলে যায়।
‘স্মৃতি তো মনে রাখার বিষয়, আঙুলে থাকার ব্যাপার নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক। তবে আঙুলের ব্যথা যতবার পাই, হেরার প্রশান্তির স্মৃতি তা স্মরণ করিয়ে দেয়, মন তা করে না।’
‘সত্যি জোসেফাইন, খুব সজীব ঈমান তোমার। এবার ওমরাহ্‌ করতে গিয়ে দেখেছি এক ভিন্ন রকম জোসেফাইনকে। তাওয়াফ, সা’য়ী ও নামাযে তোমার যে ধ্যানমগ্ন রূপ আমি দেখেছি, তেমন অতীতে দেখিনি।’ আহমদ মুসা বলল।
জোসেফাইন ওর হাতটা ওপরে তুলে দু’হাত দিয়ে আহমদ মুসার হাত আঁকড়ে ধরে বলল, ‘যদি তাই বল, তাহলে এটা তোমার ঈমানেরই কৃতিত্ব। তোমার ঈমান আমাকে সঞ্জীবিত করেছে, আমাকে নতুন মানুষ বানিয়েছে। আমি প্রতিদিন মসজিদে নববীতে প্রতি নামাযের পরে আমার প্রিয় রাসূল(সাঃ)-কে উসিলা করে বলি, আল্লাহ যেন তোমাকে ইহজগতে ও পরজগতে এর অফুরান জাযাহ দেন।’ ভারি কণ্ঠ জোসেফাইনের।
আহমদ মুসা জোসেফাইনের দু’হাত দু’হাতে ধরে চুম্বনে চুম্বনে ভরে দিয়ে বলল, ‘আমি ভাগ্যবান, আল্লাহর অশেষ দয়ায় তোমাকে পে….।’
ডোনা জোসেফাইন এক হাত দিয়ে আহমদ মুসার মুখ চেপে ধরে বলল, ‘আমার সম্পর্কে এভাবে বলো না, মেইলিগুলি, তাতিয়ানা আপারা অনেক অনেক বড় ছিলেন, তাদের মতো বড় জায়গায় উঠার যোগ্য আমি নই। ওরা আমার প্রেরণা, আমার আদর্শ।’
দু’চোখে অশ্রুর ধারা নেমেছিল জোসেফাইনের।
আহমদ মুসা দু’হাত দিয়ে জোসেফাইনের মুখ একটু তুলে ধরে চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে বলল, ‘বড়কে চিনতে হলে বড়ই হতে হয় জোসেফাইন। বড় হৃদয় না হলে ওদের এভাবে বড় দেখতে পেতে না।’
‘তুমি এভাবে বলো না। বড়কে চেনার মতো বড় হওয়া বড়োর সমকক্ষ হওয়া নয়।’ বলল জোসেফাইন।
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। তোমাকে এমন করে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সেই আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনকেও ধন্যবাদ।’
জোসেফাইন হাসল। বলল, ‘তুমি কথার রাজা, যুক্তির রাজা। তুমি আইনজীবী হলেও দুনিয়াজোড়া নাম করতে।’
‘আইনজীবী এখনও হতে পারি।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘পার না। ইসলামী বিশ্বের আজকের প্রয়োজনের প্রায়োরিটি তালিকা যদি করা হয়, তাহলে আইন ব্যবসায়ের স্থান হবে নিচে। আমি জানি, প্রায়োরিটিই তোমার সিলেকশন।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। তোমার চেয়ে বেশি আমাকে কে চিনবে বল?’
বলে ঠোঁটে একটা আঙুলের টোকা দিয়ে বলল, ‘তুমি এবার তায়েফ বেড়িয়ে অনেক সুন্দর হয়েছো।’
লাজ-রাঙা হাসি ফুটে উঠল জোসেফাইনের মুখে। আহমদ মুসার উরুতে মুখ গুঁজে বলল, ‘সুন্দর যদি হয়েই থাকি, সেটা তায়েফ বেড়িয়ে নয়, তোমাকে পাশে পাবার কারণে। বিয়ের পর এবারের মতো এতটা দীর্ঘ সময় এমন নিরবচ্ছিন্নভাবে তোমাকে আর কখনও পাশে পাইনি।’
সংগে সংগে কথা বলতে পারল না আহমদ মুসা। বেদনাতাড়িত এক কঠিন সত্য কথা জোসেফাইন বলেছে। আবেগে হঠাৎ করেই হয়তো হৃদয়ের একান্ত গোপন একটা কথা সে বলে ফেলেছে। সত্যি সে কষ্ট দিচ্ছে জোসেফাইনকে।
আহমদ মুসা জোসেফাইনের চুলে আঙুল চালিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, ‘দূরত্ব তোমাকে কষ্ট দেয়, আমাকেও কষ্ট দেয় জোসেফাইন। এবার আসার সময়ই ভেবেছি, এরপর যেখানে আমি যাব, তুমি আমার সাথী হবে।’
ডোনা জোসেফাইন চট করে আহমদ মুসার উরু থেকে মুখ তুলল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আমার কথা থেকে কষ্ট আবিষ্কার করলে কেন? তোমার সান্নিধ্যে আমি ভালো থাকি, এটা সত্য। তোমার কাছ থেকে দূরে থাকলে শূন্যতার একটা চাপ মনে থাকে, এটাও সত্য, কিন্তু এটা আমার জন্যে দুঃখ নয়। দুঃখ অনুভবের ব্যাপার। দুঃখ অনুভূত না হলে সেটাকে দুঃখ বলা যাবে না। তোমার সান্নিধ্যের শূন্যতা যে চাপ সৃষ্টি করে, সেটা থেকে গৌরব অনুভব করি আমি, বুক ভরা আনন্দ অনুভব করি আমি, দুঃখ নয়। এটা তুমিও জান।’
‘জানি জোসেফাইন। জানি বলেই তো দূরে আমি থাকতে পারি। তোমার গৌরব অনুভব, তোমার বুক ভরা আনন্দ অনুভব আমাকে শক্তি যোগায় জোসেফাইন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তবে ঐভাবে কথা বললে কেন? আহমদ আবদুল্লাহ বড় না হলে কোথাও বেরুতে আমি পারবো না।’ জোসেফাইন বলল।
আহমদ আবদুল্লাহকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে জোসেফাইনকে সোফায় পাশে তুলে নিয়ে বলল, ‘এ বিষয়ের আলোচনা থাক।’
ডোনা জোসেফাইন আহমদ মুসার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে বলল, ‘তাহলে বল, সিরিত থানারতা, যয়নব, আয়েশারা কবে আসছে। ওদের দেখার জন্যে মন কেমন করছে বুঝাতে পারবো না।’
‘ওরাও তোমাকে দেখার জন্যে এমনি পাগল হয়ে আছে। আমি সৌদি সরকারকে বলেছি। তারা দাওয়াতের ব্যবস্থা করছে। এ জিলহজ্বেই ওরা আসবে।’
‘তুমি ওদের বিয়ে দিয়ে এসে ভালো করেছ। না হলে ওরা এভাবে একসাথে আসতে পারতো না।’
‘শুধু আসতে পারতো না নয়, বিয়েও অনেকদিন অনিশ্চিত হয়ে থাকতো। বিশেষ করে যয়নব যোবায়দা ও ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন এবং সিরিত থানারতা ও জাবের জহীর উদ্দিনের বিয়ের ক্ষেত্রে দু’পক্ষই উন্মুখ, কিন্তু কে কথা পাড়বে, কোন পক্ষ প্রথম উদ্যোগ নেবে, এটা হচ্ছিল না।’
‘সিরিত থানারতাদের এটা হতে পারে। কিন্তু যয়নবদের ক্ষেত্রে এটা তো হবার কথা নয়। তারা একই বংশ, আবার কাছাকাছিও!’
‘ওদের ক্ষেত্রেই প্রবলেম বেশি ছিল। ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন ও যয়নব দু’জনেই চাপা, দশ বছর গেলেও তাদের ইচ্ছার কথা তারা জানাতো না। আর জাবের জহীর উদ্দিন ও দাদী এ বিষয়টা কোনোদিন ভাবেওনি। বিয়ের আগে দাদী ও জাবের দু’জনেই আমাকে বলেছিল, যে বিষয়টা আমাদের কখনও মাথায় আসেনি, সেটাই তুমি প্রায় চোখের নিমেষে করে ফেললে!’
‘তোমার অনেক পুণ্য হবে। তুমি যে কত ঘর এভাবে বেঁধেছ! কিন্তু আমাদের ঘরটা আমিই বেঁধেছি।’
আহমদ মুসা জোসেফাইনের মুখ কাঁধ থেকে সরিয়ে মুখের কাছে এনে তার গালে টোকা দিয়ে বলল, ‘ঘর বুঝি একা বাঁধা যায়!’
‘আমি উদ্যোগ নিয়েছি, তোমাকে সম্মত করেছি। তা না করলে দশ বছর কেন, বিশ বছরেও তোমার দিক থেকে কথা আসতো না।’
বলে জোসেফাইন মুখ গুঁজল আহমদ মুসার বুকে।
আহমদ মুসা দু’হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোমার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ জোসেফাইন।’
হঠাৎ ডোনা জোসেফাইন আহমদ মুসার বুক থেকে মুখ তুলে বলল, ‘গতকাল গভর্নর হাউজ থেকে একটা বড় এনভেলাপ দিয়ে গেছে। তুমি তখন বাসায় ছিলে না। তোমাকে দেখানো হয়নি। নিয়ে আসি ওটা।’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল নিজের বেডরুমের দিকে।
মিনিটের মধ্যে একটা এনভেলাপ নিয়ে ফিরে এল ডোনা জোসেফাইন। আহমদ মুসা এনভেলাপ খুলে দেখল অনেকগুলো চিঠি। চোখ বুলিয়ে দেখল চিঠির কপিগুলো।
আহমদ মুসার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘জোসেফাইন, আমেরিকায় আমি যাদের হজ্বের জন্যে দাওয়াত করে এসেছিলাম, এগুলো তাদের কাছে প্রেরিত সৌদি সরকারের দাওয়াতের আনুষ্ঠানিক চিঠির কপি।’
ডোনা জোসেফাইনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল খুশিতে। বলল, ‘দেখি চিঠিগুলো।’
চিঠিগুলো হাতে নিয়ে এক এক করে পড়তে লাগল, ‘মিসেস জেফারসন, জর্জ আব্রাহাম জনসন, মিসেস জনসন, কামাল সুলাইমান, বুমেদিন বিল্লাহ, ডঃ হাইম হাইকেল, মিসেস হাইকেল, মিঃ মরিস মরগ্যান ও মিসেস মরগ্যান।’
শেষ নামটা পড়ার পর ডোনা জোসেফাইনের মুখের আনন্দ-ঔজ্জ্বল্য হঠাৎ দপ করে নিভে গেল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘সারাহ জেফারসনের চিঠি কোথায়? সে কি আসবে না?’ ডোনা জোসেফাইনের কণ্ঠ শুকনো।
‘মনে হয়, সে আসবে না বলে দিয়েছে। তাই চিঠি যায়নি। নিয়ম হলো, যারা আসার কনসেন্ট দেয়, তাদেরকেই আনুষ্ঠানিক ইনভাইটেশন লেটার পাঠানো হয়।’ বলল আহমদ মুসা নরম কণ্ঠে সান্ত্বনা দেয়ার মতো করে।
ডোনা জোসেফাইন কোনো কথা বলল না। নীরবে এসে সোফায় আহমদ মুসার পাশে বসল। তার মুখ ভারি। কষ্টের প্রকাশ চোখে-মুখে।
আহমদ মুসা তাকাল ডোনা জোসেফাইনের মুখের দিকে। বলল, ‘তুমি ভেব না জোসেফাইন। ব্যাপারটা আসলে কি আমি খোঁজ নেব।’
‘খোঁজ নিয়ে কি করবে? দেখবে যে, সে রিগ্রেট করেছে, এজন্যেই ফরমাল চিঠি পায়নি। আসল ব্যাপার হলো, সে আসতে চায় না এবং তুমিও চাও না সে আসুক।’ ভারি কণ্ঠ ডোনা জোসেফাইনের।
আহমদ মুসা দু’হাত দিয়ে ডোনা জোসেফাইনকে জড়িয়ে কাছে টেনে নিল। বলল, ‘তুমি মন খারাপ করো না জোসেফাইন। সে আসতে চায় না, এর মধ্যেই ওর কল্যাণ আছে।’
ডোনা জোসেফাইনের ঠোঁটে একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠল। হাসিটা কান্নার চেয়ে করুণ। বলল, ‘ডোনা জোসেফাইন আহমদ মুসার কাঁধে মুখ গুঁজে আছে! এর মধ্যে তুমি কল্যাণ দেখছ, তাই না? তোমরা মেয়েদের মন জান না। আমি একজন মেয়ে। আমিই বুঝতে পারি, অনুভব করতে পারি। তুমি যাকে কল্যাণ বলছ, তা কত কষ্টের, কত মর্মান্তিক ও যাতনার!’
‘এই দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টা আমাদের ভুলে থাকা উচিত জোসেফাইন। মানুষের যেখানে কিছু করার থাকে না, সেটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিতে হয়। এর মধ্যেই শান্তি ও সান্ত্বনা আছে। তুমি ওকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দাও।’ বলল আহমদ মুসা।
ডোনা জোসেফাইন আহমদ মুসার কাঁধ থেকে মুখ তুলল। তার দু’চোখ থেকে নেমে এল নীরব অশ্রুর দু’টি ধারা। চোখে তার শূন্য দৃষ্টি। মাথাটা কাত করে আহমদ মুসার কাঁধে হেলান দিয়ে বলল, ‘তার ব্যাপারে মানুষের করণীয় সব কি শেষ হয়ে গেছে!’ ধীর স্বগতঃ কণ্ঠ জোসেফাইনের। যেন তার নিজের কাছেই নিজের জিজ্ঞাসা ওটা।
কর্ডলেস ল্যান্ড টেলিফোনটা বেজে উঠল।
টেলিফোনটা ড্রইংরুমের ওপাশে।
ডোনা জোসেফাইন উঠে চোখ মুছে দ্রুত টেলিফোন ধরতে গেল।
ওপারের কথা শুনেই ‘প্লিজ হোল্ড অন’ বলে টেলিফোন রিসিভারটা মুখের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে চাপা কণ্ঠে বলল, ‘ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল।’
‘নিয়ে এস।’ বলে আহমদ মুসা সোজা হয়ে সোফায় বসল।
ডোনা জোসেফাইন কর্ডলেস টেলিফোনের রিসিভারটা আহমদ মুসার হাতে দিল।
‘থ্যাংকস’ বলে রিসিভারটা নিল আহমদ মুসা।
টেলিফোন আহমদ মুসার হাতে দিয়ে ড্রইংরুম থেকে জোসেফাইন বের হয়ে গেল ঘুমানো আহমদ আবদুল্লাহকে কোলে তুলে নিয়ে।
চলল বেডরুমে আহমদ আবদুল্লাহকে শুইয়ে দেবার জন্যে।
দু’মিনিট পরেই জোসেফাইন ফিরে এল। দেখল, আহমদ মুসা কর্ডলেস রিসিভারটা চার্জ স্ট্যান্ডে রেখে সোফায় ফিরে যাচ্ছে।
‘শেষ হয়ে গেছে কথা?’ পেছন থেকে বলে উঠল জোসেফাইন।
পেছন ফিরে ‘হ্যাঁ’ বলে একটু দাঁড়িয়ে ডোনা জোসেফাইনের একটা হাত জড়িয়ে ধরে তাকে নিয়ে একটা সোফায় বসল। বলল, ‘ওরা আসতে চান, এখনি আসবেন কিনা এ জন্যেই টেলিফোন করেছিলেন।’
‘ওরা কারা?’ বলল জোসেফাইন।
‘ঐ তো যিনি টেলিফোন করেছিলেন, ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর এবং আরেকজন হলেন ওআইসি’র নিরাপত্তা চীফ জেনারেল তাহির তারিক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কম্বিনেশনটা সুবিধের মনে হচ্ছে না।’ বলল ডোনা জোসেফাইন। ঠোঁটে হাসি।
‘সুবিধের নয় কেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘সেক্রেটারি জেনারেল ও নিরাপত্তা চীফ যখন একসাথে আসছেন, তখন একটা খারাপ খবর নিশ্চয় তাদের সাথে আসছে।’
বলল জোসেফাইন আহমদ মুসার পাশে বসতে বসতে।
আহমদ মুসা জোসেফাইনের মাথাটা ঠেস দিয়ে শরীরটাকে সোফার ওপর লম্বা করে দিয়ে বলল, ‘তুমি রীতিমত গোয়েন্দা হয়ে গেলে দেখছি!’
জোসেফাইন হাতের আঙুল দিয়ে আহমদ মুসার মাথায় জোরে একটা টোকা দিয়ে বলল, ‘এই সহজ মন্তব্যের জন্যে গোয়েন্দা হবার দরকার হয় না জনাব। কোনো ডেলিগেশন কিংবা মিশনে ওআইসি’র মতো সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেলের সাথে যখন সংস্থার নিরাপত্তা চীফ যুক্ত হন, তখন ধরে নিতে হবে নিশ্চয় সিকিউরিটির সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে। আলোচনা যখন করবে, তখন নিশ্চয় সিকিউরিটি বিষয়ে কোন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আর সিকিউরিটি সমস্যা সব সময় কোন খারাপ মেসেজ নিয়েই আসে।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। তুমি ‘না’ বলতে গিয়ে সিচুয়েশনের চমৎকার দৃষ্টান্ত দিয়ে আরও জোরালো প্রমাণ দিলে যে, গোয়েন্দাদের মতো বিশ্লেষণী শক্তি তোমার আছে।’
‘থাক, তোমার এসব কথা রাখ। মেহমানরা এসে যাবেন। আমি উঠি।’
বলে জোসেফাইন উঠে দাঁড়াল। ড্রইংরুমের চারদিকে তাকাল। বলল, ‘সব ঠিক আছে। তুমি উঠে ঠিক হয়ে নাও।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
জোসেফাইন টেলিফোনের দিকে একটু এগিয়ে রিসিভার তুলে নিয়ে গেটে রিং করে বলল, ‘সিকিউরিটি, দু’জন মেহমান আসছেন, অ্যালার্ট থাক।’
আহমদ মুসার বাড়ির গেটে সৌদি সশস্ত্র বাহিনীর দু’জন সামরিক পুলিশ এবং দু’জন সামরিক গোয়েন্দা সব সময় পাহারায় থাকে। তারা বাড়ির চারধারেও চোখ রাখে। এছাড়া বাড়ি থেকে একটু সামনে বড় রাস্তার মুখে স্থায়ী একটি সামরিক ছাউনিও রয়েছে। আহমদ মুসার বাড়ির দিকে কোন অপরিচিত গাড়ি বা মানুষ যেতে চাইলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও সার্চ করা হয়ে থাকে। আহমদ মুসাকে সৌদি সরকার একজন ক্যাবিনেট মিনিস্টারের মর্যাদা দেয়।
জোসেফাইন সিকিউরিটির কাছে টেলিফোন করার পাঁচ মিনিটের মধ্যে দু’টি সাদা ও একটি লাল রঙের কার এল। সেনা ছাউনির প্রহরীরা আহমদ মুসার বাড়িমুখী রাস্তার মুখে গাড়ি তিনটিকে দাঁড় করাল।
গাড়ি থামতেই পেছনের লাল গাড়ি থেকে একজন নেমে সেনা প্রহরীদের কাছে নিজের গোয়েন্দা অফিসারের আইডি দেখিয়ে বলল, ‘আগের দুই গাড়িতে ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ও সিকিউরিটি প্রধান রয়েছেন।’
প্রহরী সেনা অফিসার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গোয়েন্দা অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাদের গাড়িতে ফ্ল্যাগ নেই কেন?’
নিয়ম অনুসারে দু’জনের গাড়িতেই ওআইসি ও সৌদি ফ্ল্যাগ থাকার কথা।
‘আহমদ মুসার বাড়িতে তারা যাচ্ছেন, এটা বাইরের লোকদের কাছ থেকে গোপন রাখতে চান। এজন্যে তারা ওআইসি’র নিজস্ব নাম্বারের গাড়িও নেননি।’ বলল গোয়েন্দা অফিসার।
শুনেই সেনা প্রহরী কোথাও ওয়্যারলেস করে সামনের গাড়ি দু’টির নাম্বার দিল।
মিনিটখানেক পরেই ওপ্রান্ত থেকে জবাব এল, ‘ওকে, ক্লিয়ার। গাড়ি ট্রান্সপোর্ট পুল থেকে ওআইসি’র নামে ভাড়া নেয়া হয়েছে।’
ওয়্যারলেস অফ করে সেনা প্রহরী এগোলো সামনের সাদা গাড়ি দু’টির দিকে। ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর এবং সিকিউরিটি প্রধান জেনারেল তাহির তারিক দু’জনকেই একনজর করে দেখে দু’জনের কাছেই দুঃখ প্রকাশ করল দেরি করিয়ে দেবার জন্যে।
গাড়ি তিনটি আহমদ মুসার বাড়িমুখী রাস্তায় প্রবেশ করে ছুটল তার বাড়ির দিকে। সেনা প্রহরী ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল ছাউনিতে উঠে আসার জন্যে। ওয়্যারলেসে আবার কথা বলছিল আহমদ মুসার বাড়ির গেটে পাহারায় থাকা মিলিটারি পুলিশের সাথে।
কথা শুরু করেছিল ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর।
বলছিল সে, ‘জনাব আহমদ মুসা, আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি মদীনাতুন্নাবীকে অনেক বেশি সংগ দিলেন।’
ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর মদীনায় জন্মগ্রহণকারী একজন সম্মানী ব্যক্তিত্ব। তিনি মদীনা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন অধ্যাপক ছিলেন। তিনি সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বড় বড় পদে দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষে তিনি জাতিসংঘে সৌদি আরবের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন।
আহমদ মুসা চায়ের কাপ মুখে তুলছিল। কাপটা পিরিচে নামিয়ে রাখল। তার মুখের চেহারা ঈষৎ পাল্টে আবেগঘন হয়ে উঠেছে। বলল সে, ‘না জনাব, এবার একটু বেশি প্রিয় মদীনাতুন্নাবীর সংগ লাভের সৌভাগ্য পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি। দুঃখিত, মন চাইলেও এই সুযোগ আমি সব সময় পাই না।’ আহমদ মুসার কণ্ঠ ঈষৎ ভারি।
আহমদ মুসার আবেগ সবাইকে স্পর্শ করেছে।
সবার চোখে-মুখে একটা আবেগের স্ফূরণ ঘটেছে।
‘কিন্তু আহমদ মুসা, মদীনাতুন্নাবীকে সংগ দেয়া কিংবা তার সংগ লাভের চেয়ে অনেক বড় কাজ আপনি করেন। প্রিয় নবী আল্লাহর রাসূল(সাঃ) নিশ্চয় অনেক খুশি আপনার প্রতি। রাব্বুল আ’লামীনও সন্তুষ্ট আছেন। তাঁর বিপদগ্রস্ত বান্দাহদের সাহায্যে ছুটে যাওয়ার চেয়ে বড় কোন কাজ আছে বলে আমার জানা নেই।’ বলল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর।
‘যদি রাব্বুল আ’লামীন আমার কাজ কবুল করেন, তবেই তো তাঁর সন্তুষ্টি। তাঁর সন্তুষ্টি, আর প্রিয়নবী(সাঃ)-এর খুশি ও শাফায়েতই তো আমাদের পরম পাওয়া।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, রাব্বুল আ’লামীনের সন্তুষ্টি লাভ এবং প্রিয়নবী(সাঃ)-এর খুশির কাজই আপনি করেছেন এবং করছেন।’ বলল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর।
‘অবশ্যই আমরা সবাই সাক্ষী।’ বলেই একটু থেমে জেনারেল তাহির তারিক সংগে সংগেই আবার বলে উঠল, ‘আমি আপনাকে আরেকটা বিষয়ে ধন্যবাদ জানাতে ও সেই সাথে একটা অভিযোগও করতে চাই।’
আহমদ মুসা তাকাল জেনারেল তাহির তারিকের দিকে। ঠোঁটে এক টুকরো মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল তার। বলল, ‘ওয়েলকাম জনাব।’
‘আপনাকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ যে, আপনি এবার আমাদের বাড়ির পাশ আন্দামান পর্যন্ত গিয়েছিলেন। আর অভিযোগ হলো, বাড়ির পাশে গিয়েও আমাদের বাড়িতে আপনি যাননি।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক। তারও মুখে হাসি।
জেনারেল তাহির তারিকের বাড়ি বাংলাদেশে। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল। একজন বিখ্যাত নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তিনি। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বিভাগের চীফ ছিলেন। জাতিসংঘ শান্তি মিশন বিভাগের তিনি সিকিউরিটি চীফ ছিলেন তিন বছর। সর্বশেষে তিনি বাংলাদেশের ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের প্রধান ছিলেন। এই দায়িত্বে থাকা অবস্থাতেই তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে রিটায়ার করার পরদিনই তাকে ওআইসি’র নিরাপত্তা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তার বয়স এখন পঞ্চাশ বছর। কিন্তু দেখলে মনে হয় তিনি চল্লিশ বছরও ক্রস করেননি। মেদহীন ও পেটা লোহার মতো ঋজু শরীর তার। একহারা ফর্সা চেহারায় শক্ত দুই চিবুক ও মাথার সামনের দুই-চারটা পাকা চুল তাকে আরও ব্যক্তিত্বপূর্ণ করে ফেলেছে।
জেনারেল তাহির তারিকের কথায় হেসে ফেলল আহমদ মুসা। বলল, ‘জনাবের অভিযোগ অবশ্যই ছোট নয়। সম্মানিত এক বড় ভাইয়ের বাসায় ঢুকে গেট থেকে অ্যাবাউট টার্ন করা অবশ্যই বড় অভিযোগের বিষয়।’ বলে আহমদ মুসা থামল।
মুখের হাসি সরে গিয়ে ধীরে ধীরে আহমদ মুসার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘জনাব, বাংলাদেশ আমার কাছে বিরাট আগ্রহ ও আকর্ষণের বস্তু। মুসলিম বিশ্বের মানচিত্রের দিকে চাইলেই আমার চোখ আটকে যায় বাংলাদেশের উপর। বাংলাদেশ অনাত্মীয় পরিবেশ ঘেরা এক অরক্ষিত ভাইয়ের মতো। গোটা মুসলিম দুনিয়ায় বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যার কোন মুসলিম প্রতিবেশী দেশ নেই অন্তত তার চারদিকে এক হাজার মাইলের মধ্যে। অথচ মুসলিম দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ এটি। শুধু তাই নয়, আমি যতদূর জেনেছি, এতটা সংবেদনশীল ও ধর্মভীরু মানুষের দেশ আর কোনটা নয়। এমন দেশের দরজা থেকে চলে এসেছি, সেখানে যাইনি, এটা আমার দুর্ভাগ্য।’
জেনারেল তাহির তারিকের মুখও গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘বাংলাদেশকে আপনি এতটা ঘনিষ্ঠভাবে অনুভব করেন আহমদ মুসা! সত্যি বলছি, এমন দৃষ্টিতে বাংলাদেশকে আমি দেখিনি কখনও। সত্যিই তো বাংলাদেশের এক হাজার মাইলের মধ্যে কোন মুসলিম প্রতিবেশী নেই!’
‘আমরা বাইরে থেকে যেটা বুঝি, আপনাদের ভেতর থেকে তা বোঝার কথা নয়। আপনাদের বিষয়টা স্বাভাবিক হয়ে গেছে, অস্বাভাবিকতাটা বাইরে থেকে আমরা দেখতে পাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বাংলাদেশ এমন অনাত্মীয় পরিবেশের মধ্যে আছে বলেই সেদেশের মানুষ যেমন সচেতন, সংগ্রামী, তেমনি ধর্মভীরুও। বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীও মনন ও দক্ষতার দিক থেকে মুসলিম বিশ্বের অতুলনীয় এক নিরাপত্তা বাহিনী। সেখানকার রাজনীতিকরাও ইসলামী বিশ্বের, ইসলামী স্বার্থের খুবই ঘনিষ্ঠ।’ বলল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর।
‘ধন্যবাদ জনাব আপনাদের, বাংলাদেশ সম্পর্কে এই সুধারণা প্রকাশের জন্যে।’
বলে একটু থেমে ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকরের দিকে চেয়ে বলল, ‘জনাব, আমরা এবার প্রসংগে আসতে পারি।’
‘ঠিক, জেনারেল তাহির তারিক। জনাব আহমদ মুসার বেশি সময় নষ্ট করা আমাদের ঠিক হবে না।’ বলল ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর।
‘আমার সময় নিয়ে ভাববেন না জনাব। ওয়েলকাম। আপনাদের কথা বলুন।’ আহমদ মুসা বলল হাসিমুখে।
গম্ভীর হয়ে উঠল ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকরের মুখ। সে একটু নড়ে-চড়ে উঠে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বসল। বলতে শুরু করল, ‘জনাব আহমদ মুসা আপনি জানেন, ইস্তাম্বুলে ‘ওআইসি ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড রিসার্চ এন্ড টেকনোলজি’ আছে। সংক্ষেপে সেটা ‘ওআইসি আইআরটি (OIC IRT)’ বলে পরিচিত। দৃশ্যত ওটা ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা রিসার্চ উইং। কিন্তু আসলে প্রতিষ্ঠানটি ওআইসি পরিচালিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। ওআইসি’র নিরাপত্তা কমিটি মনোনীত তিন সদস্যের একটা কমিটি এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। প্রতিষ্ঠানটি মানব কল্যাণকর মৌলিক কিছু বিষয়ে গবেষণায় রত। তার মধ্যে একটি হলো, আক্রান্ত দেশের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি হ্রাস। গণবিধ্বংসী যে সব অস্ত্র প্রচলিত আছে বা প্রচলিত হতে যাচ্ছে, সে সব অস্ত্রকে আঘাত হানার আগেই নিউট্রাল, নিষ্ক্রিয় বা নিরাপদ-ধ্বংসের উপায় বের করার মহৎ কাজে নিয়োজিত এই প্রতিষ্ঠান। তুরস্ক সরকার ইস্তাম্বুলের ‘রোমেলী হিসার’ অর্থাৎ রোমেলী দুর্গের পশ্চিম টাওয়ারের নিচে অবস্থিত গোপন আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরগুলো ছেড়ে দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের জন্যে। দুর্গে একটা সেনা গ্যারিসন থাকায় এই গবেষণাগারটি খুবই নিরাপদ। ওআইসি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে সেখানে গড়ে তুলেছে অত্যাধুনিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। কিছু অত্যন্ত প্রতিভাবান বিজ্ঞানী সেখানে কাজ করছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা বিষয়ে সেখানে গবেষণা চলছে। চাঞ্চল্যকর কিছু সফল আবিষ্কারও হয়েছে।’
থামল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর। গ্লাস তুলে নিয়ে কয়েক ঢোক পানি পান করল। তার মুখ হয়ে উঠেছে আরও গম্ভীর।
কথা বলা শুরু করল আবার, ‘গবেষণাগারে সম্প্রতি কিছু রহস্যজনক ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে বিজ্ঞানীদের ব্যবহৃত বিশেষ কিছু কম্পিউটারে অজ্ঞাত কেউ সার্চ করার কয়েকটি আলামত পাওয়া যায়। তারপর একদিন একজন সিকিউরিটি অফিসারকে দায়িত্ব পালনের এলাকায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। দৃশ্যত সে বিষক্রিয়ায় মারা গেছে বলে দেখা যায়। পরীক্ষায় প্রমাণ হয়, সে সাপের বিষের ক্রিয়ায় মারা গেছে। কিন্তু সর্প দংশনের যে চিহ্ন ছিল, তার গভীরতা, বিস্তার, প্রকৃতি দেখে বিশেষজ্ঞরা একে সন্দেহ করেছে। ওআইসি’র একজন কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এজেন্টকে সংগে সংগেই তদন্তের জন্যে কাজে লাগানো হয়। তিনি কাজ শুরু করার দু’দিন পর তার মৃতদেহ পাওয়া যায় বসফরাসের পানিতে। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট বলছে, সে ডুবে মারা গেছে। এরপর তুর্কি প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে ওআইসি’র তিনজন এবং তুরস্কের দু’জন নিরাপত্তা অফিসার নিয়ে পাঁচ সদস্যের একটা নিরাপত্তা টিম গঠন করা হয় তদন্তের জন্যে। টিম দায়িত্ব গ্রহণের একদিন পর তারা সেদিন রাত নয়টায় একসঙ্গে বের হন ঘটনাস্থল সরেজমিনে দেখার জন্যে। তারা একটা গাড়িতে করেই বের হন। তাদেরই একজন ড্রাইভ করেন গাড়ি। চরম বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। গাড়িটারও সন্ধান মেলেনি। শুধু আমরা নই, তুর্কি সরকারও ভয়ানক উদ্বিগ্ন।’
আবার থামল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ ও হতাশা। শরীরটা পেছন দিকে সোফায় এলিয়ে দিল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর। বলল, ‘আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। তুর্কি সরকারও ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে পড়েছে। সন্দেহ করছি, আমরা বড় কোন ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়েছি। কিন্তু এই সন্দেহ প্রমাণ করার মতো কোন তথ্য আমাদের হাতে নেই। তাহলে ঘটনাগুলো কি সবই কাকতালীয়? এটা হতে পারে না। আর ষড়যন্ত্র যদি ধরে নিতে হয়, তাহলে সেটা বিরাট হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সর্পদংশনের ক্যামোফ্লেজে সিকিউরিটি অফিসার হত্যা, ডুবে মরার ক্যামোফ্লেজে এক গোয়েন্দা হত্যা এবং পাঁচজন শীর্ষস্থানীয় গোয়েন্দাকে একসাথে গায়েব করে ফেলা, এসব কোন বড় ও শক্তিশালী শত্রুর কাজ বলে ধরে নিতে হবে। কে এই শত্রু? আমাদের তো কোন শত্রু নেই। এসব ব্যাপার নিয়ে আমরা দীর্ঘ আলোচনা করেছি। তুর্কি প্রধানমন্ত্রীর সাথে বসেছি। তারাও আমাদের মতোই বিমূঢ়। আমরা অনেক ভেবেছি। শেষে আমি ও তুর্কি প্রধানমন্ত্রী মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনাকে ডাকার।’
বলে মুহূর্তকাল থেমেই বলে উঠল, ‘আমরা আর কোন বিকল্প খুঁজে পাইনি। আপনাকে বিষয়টা দেখার দায়িত্ব নিতে হবে। এটা আমাদের সকলের তরফ থেকে অনুরোধ।’
থামল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর। সংগে সংগেই জেনারেল তাহির তারিক বলে উঠল, ‘আমাদের আশংকা এবং এ আশংকাকে আমি সত্য বলে মনে করি, ইস্তাম্বুলের রোমেলী দুর্গ ঘিরে বড় ঘটনা ঘটেছে। আপনার সাহায্য দরকার এবং অবিলম্বে।’
আহমদ মুসার কপাল কুঞ্চিত। ভাবছিল সে।
বলল, ‘বড় ঘটনার জন্যে বড় কারণ থাকতে হয়। কি কারণ এমন থাকতে পারে বলে আপনারা মনে করেন?’
‘কারণ জানলে তো শত্রুকে কিছুটা চেনা যেত। কিন্তু এত বড় ঘটনার কারণ হতে পারে এমন কোন কিছু খুঁজে আমরা পাচ্ছি না।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
ধীরে ধীরে আহমদ মুসা সোফা থেকে গা তুলে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘বলতে আপত্তি না থাকলে দয়া করে বলুন, কোনো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় রিসার্চ ইন্সটিটিউট সম্প্রতি কি সাফল্য লাভ করেছে?’
ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর ও জেনারেল তাহির তারিক পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। পরে ডঃ ওমর আবদুল্লাহ বলল, ‘আপনার কাছে কোন কিছুই বলতে আমাদের আপত্তি নেই। আমাদের ইন্সটিটিউটে অনেক বিষয় নিয়ে গবেষণা চলছে। অনেক বিষয়ে আমরা সাফল্য পেয়েছি। সম্প্রতি সবচেয়ে বড় সাফল্য আমাদের অর্জিত হয়েছে। সেটা হচ্ছে, আমরা গণবিধ্বংসী অস্ত্রের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর নিরাপদ প্রতিরক্ষা কৌশল আবিষ্কারে সাফল্য অর্জন করেছি। আমাদের বিজ্ঞানীরা ‘ম্যাগনেটিক কন্ট্রোল গাইডেড ইন্টিগ্রেটেড ফোটন-নেট (MCGI Foton-Net)’ আবিষ্কার করেছে। এটা কোন অস্ত্র নয়, কিন্তু উড়ে আসা সব রকম অস্ত্রকে এই ফোটন-নেট গিলে ফেলতে পারে এবং তা আকাশের নিরাপদ দূরত্বে বহন করে নিয়ে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।’
আহমদ মুসার মুখের চেহারা পাল্টে গেছে। আনন্দ-বিস্ময়ের ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে তার চোখে-মুখে। সোজা হয়ে বসেছে সে সোফায়। ডঃ ওমর আবদুল্লাহর কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘এটা কি তত্ত্বগত আবিষ্কার না এর পরীক্ষাও হয়েছে?’
‘সব রকম টেস্ট শেষ হয়েছে। এখন আমাদের ‘সোর্ড’ শতভাগ অ্যাকিউরেট।’ বলল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ।
‘‘সোর্ড’ কি? ওটা কি ‘ফোটন-নেট’ এর নাম?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘জ্বি, ‘সোর্ড’ ‘ম্যাগনেটিক কন্ট্রোল গাইডেড ইন্টিগ্রেটেড ফোটন-নেট (MCGI Foton-Net)’-এর ব্যবহারিক নাম। SOWRD (সোর্ড)-এর এলাবোরেশন হলোঃ Savior Of World Rational Domain (SOWRD)।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘ব্যবহারিক নামটাতো চমৎকার! তবে আরও সুন্দর হতো যদি Rational-এর জায়গায় ‘Human’ যোগ করা যেত। অবশ্য ডাকনামটা ‘সোর্ড’ হতো না, কিংবা কোন ভালো শব্দও হতো না।’ আহমদ মুসা বলল।
ডঃ ওমর আবদুল্লাহ সংগে সংগেই বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ জনাব আহমদ মুসা। আমাদের চিন্তা মিলে গেছে। আমরাও ‘Human’-এর কথাই চিন্তা করেছিলাম। তবে ব্যবহারিক নামের সংক্ষিপ্ত উচ্চারণে একটা তাৎপর্য আনার জন্যেই আমরা ‘Rational’ শব্দ এনেছি। তবে ‘Human’ ও ‘Rational’ ভিন্ন শব্দে হলেও একই অর্থ বুঝায়। ‘Human’ বা মানুষ হলো Rational। পশুর গুণ যেমন Animality বা পশুত্ব, তেমনি মানুষের গুণ Rationality বা মনুষ্যত্ব। Rational বলেই মানুষ প্রকৃতপক্ষে মানুষ। সুতরাং Rational Domain দ্বারা ‘Human Domain’ বুঝাচ্ছে।’
‘ধন্যবাদ, আপনাদের সিদ্ধান্ত ঠিক।’
একটু থামল আহমদ মুসা। সংগে সংগেই আবার বলে উঠল, ‘সোর্ড আবিষ্কারের বিষয় কোন পর্যায় পর্যন্ত জানাজানি হয়েছে?’
‘ওআইসি’র শীর্ষ দুই ব্যক্তি, ওআইসি নিরাপত্তা কমিটির আমরা তিনজন, তুর্কি প্রধানমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট পাঁচ জন বিজ্ঞানী ছাড়া আর কেউ জানে না এই আবিষ্কারের কথা।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ‘সোর্ড’ কি ব্যাপক ব্যবহারের উপযোগী হতে পারে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আণবিক বোমার চেয়ে অনেক কম জটিল এবং খরচও তার চেয়ে অনেক কম। ব্যবহারের দিক থেকে অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যাপক ব্যবহারের মতো এই প্রযুক্তিটি।’
কথা শেষ করে জেনারেল তাহির তারিক বলে উঠল, ‘জনাব আহমদ মুসা, আমরা বোধহয় আলোচনা থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছি।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমাদের আলোচনা ঠিক পথেই চলছে জনাব। ভবিষ্যতে নতুন কিছু সামনে আসবে কিনা আমি জানি না, তবে এই মুহূর্তে আমি নিশ্চিত, ‘সোর্ড’-এর আবিষ্কার রোমেলী দুর্গে বিপদ ডেকে এনেছে।’ থামল আহমদ মুসা।
ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ও জেনারেল তাহির তারিক দু’জনেই চমকে উঠে প্রায় একসাথে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বিস্মিত চার চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার মুখে। তাদের বিস্ময়ভরা চোখে একটা বিহ্বলতাও ফুটে উঠেছে। হঠাৎ করেই তাদের মনে দানা বেঁধে উঠতে শুরু করেছে নতুন আতংকের একটা অস্থিরতা। মুখে তাদের কোন কথা যোগাল না।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলে উঠল, ‘আমার মনে হয়, ‘সোর্ড’-এর তথ্য এমন কোন পক্ষের কাছে পৌঁছেছে, যারা এর ব্যাপারে সাংঘাতিক সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা ‘সোর্ড’-এর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানতে চায় কিংবা সব তথ্য জেনে গেছে, এখন অন্য কিছু করতে চায়।’
‘অন্য কিছু বলতে তারা কি করতে চায় ভাবছেন?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল তাহির তারিকের। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
চোখ বন্ধ করেছে আহমদ মুসা। ভাবছে সে। অন্যদিকে ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ও জেনারেল তাহির তারিক অপার আগ্রহ ও আশংকা নিয়ে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
একসময় আহমদ মুসা চোখ খুলল। সোজা হয়ে বসল সে। বলল, ‘অনেক কিছুই করতে পারে। ‘সোর্ড’-এর প্ল্যান চুরি, ফাইল চুরি এবং সোর্ড-এর ল্যাবরেটরী প্রোটোটাইপ চুরি থেকে শুরু করে বিজ্ঞানীদের হত্যা, কিডন্যাপ ইত্যাদি সব ধরনের ঘটনাই ঘটতে পারে।’ থামল আহমদ মুসা।
ডঃ ওমর আবদুল্লাহ এবং জেনারেল তাহির তারিকের মুখ-চোখের আলো যেন দপ করে নিভে গেল। আতংকের মূর্তিমান অন্ধকার নামল তাদের চোখে-মুখে। কিছুক্ষণ তারা কথা বলতেই পারল না।
ওদের নীরবতা ভাঙলে ডঃ ওমর আবদুল্লাহ বলল, ‘ঘটনা এতদূর গড়িয়েছে, সর্বনাশ! যে কোনো মুহূর্তেই একটা কিছু ঘটে যেতে পারে। জনাব আহমদ মুসা, আপনি দয়া করে তাড়াতাড়ি চলুন ইস্তাম্বুলে। আপনি শুধু শুনেই ঘটনা ধরে ফেলেছেন। ইনশাআল্লাহ, ওখানে গেলে সংকটটাও আপনি দূর করতে পারবেন।’ উদ্বেগ-আতংকে কম্পিত কণ্ঠ ডঃ ওমর আবদুল্লাহর।
‘জনাব, এখন একদিন দেরি করতেও আমাদের ভয় হচ্ছে। জনাব ওমর আবদুল্লাহ আমাদের কথা বলেছেন। আপনি আমাদের অনুরোধ রাখুন।’ বলল জেনারেক তাহির তারিক। তার কণ্ঠেও উদ্বেগ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আপনারা এখন বাঁধা দিলেও আমি ইস্তাম্বুল যাব, বসফরাসে রোমেলী দুর্গে যাব।’
ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ও জেনারেল তাহির তারিকের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠল দু’জনেই। তারা উঠে এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল ওমর আবদুল্লাহ, ‘আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘ সুস্থ জীবন দান করুন। আল্লাহ জ্ঞান, বুদ্ধি, শক্তি আপনার বাড়িয়ে দিন।’ আবেগে ভারি শোনাল ডঃ ওমর আবদুল্লাহর কণ্ঠস্বর।
দু’জনেই ফিরে গিয়ে বসল তাদের আসনে।
আহমদ মুসাও বসল।
বসেই ডঃ ওমর আবদুল্লাহ পকেট থেকে দু’টি চিঠি বের করে আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিল। বলল, ‘একটা ম্যাডাম জোসেফাইনের জন্যে। তাকে তুরস্কের ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট তার পক্ষের স্টেট গেস্ট হিসেবে তুরস্ক সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অন্য চিঠিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তার পক্ষে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আপনাকে আমন্ত্রণ করেছেন। এ আমন্ত্রণ আপনারা গ্রহণ করলে তারা সম্মানিত বোধ করবেন।’
আহমদ মুসা চিঠি দু’টি গ্রহণ করে আবার তা ডঃ ওমর আবদুল্লাহর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দুঃখিত, আমরা এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারছি না।’
অন্ধকার নামল ডঃ ওমর আবদুল্লাহর মুখে। বলল, ‘কিন্তু এই তো বললেন, আপনি যাচ্ছেন।’
‘যাব, কিন্তু রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে যাব, এ কথা আমি বলিনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘রাষ্ট্রীয় অতিথি করলে, তাতে আপনি আপত্তি করবেন কেন?’ বলল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমরা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তুরস্কে যেতে চাই না। রাষ্ট্রীয় অতিথি হলে এটাই ঘটবে।’
‘বুঝেছি জনাব আহমদ মুসা। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার সিদ্ধান্তই ঠিক।’ বলল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ। তার মুখ এবার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
‘তাহলে কিভাবে যাবেন, কখন যাবেন আমরা জানলে ব্যবস্থা নিতে পারি জনাব।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘সেটাও আমার ওপর ছেড়ে দিন। আপনাদের কোন ব্যবস্থা করতে হবে না। এখন দয়া করে যদি সম্ভব হয়, তাহলে রোমেলী দুর্গের ভেতরের এবং দুর্গের ‘ওআইসি আইআরটি’র ভেতরের একটা করে মানচিত্র, পাঁচ বিজ্ঞানীর ছবি ও তাদের বিস্তারিত বায়োডাটা আজকেই আমাকে দিন।’ বলল আহমদ মুসা।
ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল তাকাল ওআইসি’র সিকিউরিটি প্রধান জেনারেল তাহির তারিকের দিকে।
জেনারেল তাহির তারিক সংগে সংগেই বলে উঠল, ‘আল্লাহর হাজার শোকর, আপনি কাজ শুরু করেছেন। আমি নিজেই এগুলো আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাব জনাব।’
জেনারেল তাহির তারিক থামতেই ডঃ ওমর আবদুল্লাহ বলে উঠল, ‘জনাব আহমদ মুসা, আপনাদের যাওয়ার ব্যাপারে তাহলে আমাদের কিছু করণীয় আছে কিনা?’
‘জনাব, আমি যখন যেটা প্রয়োজন বোধ করব, তখনই তা জানাব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। ঠিক আছে। আমরা জেনারেল তারিককে আপনাকে সহযোগিতা করার জন্যে মনোনীত করেছি। তিনি জানালেই আমরা সব ব্যবস্থা করে দেব। তাছাড়া আমাদের তো বটেই, তুর্কি প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের দরজাও আপনার জন্যে চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকবে।’
‘ধন্যবাদ জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। আমরা এখন উঠতে চাই জনাব আহমদ মুসা। আমাদের জন্যে আপনার আর কোন কথা?’
ডঃ ওমর আবদুল্লাহ বলল।
আহমদ মুসা একটু ভেবে বলল, ‘আমি রোমেলী দুর্গে পৌঁছা পর্যন্ত বাইরের সকল লোকের আইআরটি সেন্টারে প্রবেশ বন্ধ থাকবে, বিজ্ঞানীরা আইআরটি সেন্টারের বাইরে বেরুতেঁ পারবেন না এবং আমি সেখানে যাচ্ছি কিংবা নতুন তদন্ত হচ্ছে, এমন কোন কথা সেন্টারের কাউকে জানানো যাবে না।’
‘আপনার পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে জনাব।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
বিদায় চেয়ে উঠে দাঁড়াল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ। উঠে দাঁড়াল জেনারেল তাহির তারিকও।
তাদের সাথে আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল।
বিদায়ী হ্যান্ডশেকের হাত বাড়িয়ে ডঃ ওমর আবদুল্লাহ বলল, ‘জনাব আহমদ মুসা, আপনি ওআইসি’র সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত একটা প্রজেক্টের প্রতি যে এহসান করলেন, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি এহসান আল্লাহ আপনার প্রতি, আপনার পরিবারবর্গের প্রতি করুন।’ আবেগে ভারি কণ্ঠ ডঃ ওমর আবদুল্লাহর।
‘আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোন। আমার কোন এহসান নেই, আমি কোন এহসান করিনি। আল্লাহ আমাকে যে এহসান করেছেন, তারই কিছুটা আমি বণ্টন করি মাত্র তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে।’ বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার কণ্ঠও ভারি।
ফিরে দাঁড়িয়ে চলে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিল ওরা দু’জন। আহমদ মুসা ডঃ ওমর আবদুল্লাহকে সম্বোধন করে বলল, ‘চিঠি তুর্কি প্রেসিডেন্টের দপ্তরে ফেরত যাওয়া দরকার, যাতে ঐ দপ্তর জানতে পারে যে, আমি আমন্ত্রণ গ্রহণ করিনি।’
ডঃ ওমর আবদুল্লাহ মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ জনাব আহমদ মুসা। তাই হবে। আমি সব বুঝতে পেরেছি।’
ডঃ ওমর আবদুল্লাহ থামতেই জেনারেল তাহির তারিক বলল, ‘যে আল্লাহ আপনাকে এই অসীম দূরদৃষ্টি দিয়েছেন, আমি প্রাণভরে তাঁর শুকরিয়া আদায় করছি। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘ হায়াতে কামেলা দান করুন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলল আহমদ মুসা।
ওরা দু’জন আবার ঘুরে দাঁড়াল। চলতে শুরু করল দরজার দিকে।
ওদের পিছে পিছে হাঁটছে আহমদ মুসা। গাড়ি পর্যন্ত ওদের পৌঁছে দিল।

‘আমার কোন সন্দেহ নেই, তোমার এই ইস্তাম্বুল অ্যাসাইনমেন্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি দেখতে পাচ্ছি, বসফরাসের এই আহবানের মধ্যে তোমার জন্যে এক কঠিন দায়িত্বের হাতছানি আছে। তুমি সাংঘাতিক ব্যস্ত থাকবে। আমি ও আহমদ আবদুল্লাহর উপস্থিতি কি তোমাকে অসুবিধায় ফেলবে না?’ বলল ডোনা জোসেফাইন।
আহমদ মুসা ও জোসেফাইন সোফায় পাশাপাশি বসেছিল।
আহমদ মুসা জোসেফাইনের একটা হাত হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘তোমার উপস্থিতি এক শূন্যতা থেকে আমাকে বাঁচাবে। আমার প্রেরণা, আমার শক্তি বাড়বে জোসেফাইন।’
জোসেফাইন আহমদ মুসার হাতটা দু’হাতে ধরে তুলে নিয়ে, তাতে মুখ গুঁজে বলল, ‘আমি জানি। কিন্তু ভাবছি আহমদ আবদুল্লাহর কথা। ভিন্ন আবহাওয়া ও অপরিচিত পরিবেশে সে কেমন থাকবে?’
‘ভালো থাকবে ইনশাআল্লাহ। বসফরাসের পশ্চিম তীরে, ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশে, গোল্ডেন হর্নের পূর্বকূলে যেখানে বসফরাস, গোল্ডেন হর্ন ও মর্মর সাগর একসাথে আছড়ে পড়েছে, এমন জায়গায় তুর্কি সরকারের ভিভিআইপি রাষ্ট্রীয় অতিথিদের একটা রিসোর্ট এলাকা আছে। সেখানে সবচেয়ে সুন্দর একটা কটেজ তুমি পাচ্ছ। দেখবে, খুব ভালো থাকবে আহমদ আবদুল্লাহ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি যে বর্ণনা দিলে, তাতেই বুকটা আমার তোলপাড় করে উঠেছে। বুঝতে পারছি কেমন লাগবে জায়গাটা। ধন্যবাদ তোমাকে। কিন্তু তুমি তো বললে রাষ্ট্রীয় আতিথ্য তুমি প্রত্যাখ্যান করেছো, তাহলে রাষ্ট্রীয় অতিথিদের রিসোর্ট কি করে আবার এল?’ বলল জোসেফাইন।
‘আমার ও তোমার নামে আসা রাষ্ট্রীয় আতিথ্যের চিঠি প্রত্যাখ্যান করেছি, রাষ্ট্রীয় আতিথ্য প্রত্যাখ্যান করিনি। ভিন্ন নামে ফরাসি রয়্যাল সদস্যের ভিন্ন এক পরিচয়ে তুমি রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়েছ। আর আমি যাচ্ছি ট্যুরিস্ট হিসেবে। আমি হবো অলিখিত রাষ্ট্রীয় অতিথি। আমরা যাব একই প্লেনে, কিন্তু ডিপারচার লাউঞ্জ থেকে তুমি বেরুবে ভিভিআইপি গেট দিয়ে, আর আমি বেরুবো সাধারণ বিজনেস ক্লাসের গেট দিয়ে।’ আহমদ মুসা বলল।
জোসেফাইন সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘তারপর?’
‘তারপর তুরস্কের ম্যাডাম প্রেসিডেন্টের পার্সোনাল সেক্রেটারি মিস লতিফা আরবাকান তোমাকে রাষ্ট্রীয় কায়দায় রিসিভ করে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে নিয়ে যাবে। সেখানে তুমি ম্যাডাম প্রেসিডেন্টের সাথে ডিনার করবে, বিশ্রাম নেবে। পরে তোমাকে নিয়ে যাওয়া হবে ‘গোল্ড রিসোর্ট’-এ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তুমি তখন সেখানে থাকবে না?’ বলল জোসেফাইন শুকনো কণ্ঠে।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমি তখন অনেকখানি দূরে ইস্তাম্বুলের পূর্বাংশে রোমেলী দুর্গে অথবা দুর্গসংলগ্ন কোন এক বাড়িতে বা ফ্ল্যাটে থাকব।’
জোসেফাইনের মুখে অন্ধকার নেমে এল। সে আস্তে আস্তে নিজের মাথা আহমদ মুসার কাঁধে ন্যস্ত করল। বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তুমি আছ, অথচ নেই, এটা আমি সহ্য করব কি করে? সবই যে শূন্য হয়ে যাবে?’
আহমদ মুসা জোসেফাইনকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘এ অসুবিধাটুকু তোমাকে মানিয়ে নিতে হবে। তুমি তো সেখানে একা হয়ে যাচ্ছ না। এখান থেকে আয়া ও পরিচারিকা দু’জনকে নিচ্ছ। তোমার সাথে সর্বক্ষণ ম্যাডাম প্রেসিডেন্টের পিএস মিস লতিফা আরবাকান থাকবেন। ইংরেজি, ফরাসি ও আরবিতে ভীষণ ফ্লুয়েন্ট চৌকস মেয়েটিকে দেখবে তোমার খুবই ভালো লাগবে। নিরাপত্তার বিষয়টা ঠিক রেখে আমি যতটা পারি সেখানে যাবার চেষ্টা করব।’
‘ধন্যবাদ তোমাকে।’ বলে কোল থেকে উঠে বসল জোসেফাইন। একটা হাত দিয়ে আহমদ মুসার গলা পেঁচিয়ে সোফায় গা এলিয়ে বলল, ‘আমরা কবে যাচ্ছি?’
আহমদ মুসা উত্তর দেবার জন্যে মুখ খুলেছিল। সেই সময়েই টেলিফোন বেজে উঠল। থেমে গেল আহমদ মুসা।
জোসেফাইন দ্রুত উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরল। আহমদ মুসার টেলিফোন।
কর্ডলেস রিসিভারটি এনে আহমদ মুসার হাতে দিল জোসেফাইন। ফিস ফিস করে বলল, ‘জনাব ওমর আবদুল্লাহর টেলিফোন।’
আহমদ মুসা টেলিফোন তুলে সালাম দিতেই ওপার থেকে সালাম গ্রহণ করে বলে উঠল ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর, ‘দুঃসংবাদ আহমদ মুসা, রোমেলী দুর্গের আমাদের রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার ইন্তেকাল করেছে।’
‘ইন্তেকাল?’ প্রশ্ন আহমদ মুসার।
‘ডাক্তাররা তাই বলেছেন। হার্ট ফেইলিওর।’ বলল ওমর আবদুল্লাহ ওপার থেকে।
‘বয়স কত হবে?’
‘চল্লিশ।’
‘কি দায়িত্ব ছিল তার?’
‘সে একজন লাইট মেটাল ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার। কনসেপ্ট অনুসারে যারা সোর্ড-এর বডি ডিজাইন ও নির্মাণ করেছে, তাদের একজন সে।’ বলল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ।
‘সোর্ড সম্পর্কে সে কি জানত?’
‘জানত না। কনসেপ্ট-এর দিক দিয়ে সে এতটুকু জানত যে, কণাবিজ্ঞানের অত্যন্ত তীব্র গতির কোন কণা পরীক্ষণের যন্ত্র তারা তৈরি করছে। যন্ত্রের তিনটা অংশ। প্রত্যেকটা অংশকে সে একটা যন্ত্র হিসেবে জানত। কিন্তু তিনটা মিলে যে একটা যন্ত্র সেটা জানত না। যন্ত্রের তিন অংশের একীকরণের কাজ বিজ্ঞানীরা নিজে করেছেন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল আহমদ মুসা।
‘জনাব আহমদ মুসা, তার সম্পর্কে এতকিছু জিজ্ঞেস করছেন কেন? আপনি কিছু সন্দেহ করছেন?’ বলল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ।
‘সন্দেহ করাই উচিত। তবে আরও বিস্তারিত জানার পর নিশ্চিত বলা যাবে।’
‘ভয়ংকর কথা বলেছেন আহমদ মুসা। সন্দেহ সত্য হলে তো…..।’ কথা শেষ করতে পারলো না ডঃ ওমর আবদুল্লাহ। শুকনো গলায় তার কথা যেন আটকে গেল।
‘জনাব, আপনি জেনারেল তাহির তারিককে বলুন, আজই আমি ইস্তাম্বুল যাব। ব্যবস্থা যেন করেন।’ বলল আহমদ মুসা শান্ত শক্ত কণ্ঠে।
‘ধন্যবাদ জনাব আহমদ মুসা। আপনার কাছে আমরা এটাই চাচ্ছি। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। ধরে নিন সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আপনারা প্রস্তুত হোন।’ বলল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ।
‘ধন্যবাদ জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে সব ঠিক হয়ে গেল। এখনকার মতো এতটুকুই।’
সালাম দিয়ে টেলিফোন রেখে দিল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ।
আহমদ মুসাও টেলিফোন রেখে দিল।
পাশে দাঁড়িয়েছিল জোসেফাইন।
আহমদ মুসা তাকাল জোসেফাইনের দিকে। আহমদ মুসার চোখে একটু বিব্রত দৃষ্টি। জোসেফাইনের সাথে পরামর্শ ছাড়াই ইস্তাম্বুল যাত্রার তারিখ আজ স্থির করে ফেলেছে। সব গুছিয়ে নেয়া কঠিন হবে।
আহমদ মুসার চোখের ভাষা, মুখের ভাব, মনের কথা জোসেফাইনের চেয়ে বেশি কে আর বুঝতে পারবে!
জোসেফাইন ধীরে ধীরে আহমদ মুসার আরও কাছে এগিয়ে এসে কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, ‘ভেব না তুমি, দেখবে আমি সব ঠিক করে নেব। মূল গোছ-গোছটা করাই আছে। তুমি ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছ।’
জোসেফাইন আরও ক্লোজ হলো আহমদ মুসার। কাঁধে রাখা হাতটা দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরে বলল, ‘ইন্তেকাল করেছেন যিনি, তিনি কি নিহত হয়েছেন বলে তুমি সত্যিই মনে কর?’
‘এখনও এটাই আমার বিশ্বাস।’ আহমদ মুসা বলল।
‘দেখা যাচ্ছে, রোমেলী দুর্গে এ পর্যন্ত যতগুলো মৃত্যুর ঘটনা ঘটলো, সবই অপঘাতে, কিন্তু সবগুলোই হত্যাকাণ্ড। তাহলে তো দাঁড়াচ্ছে, প্রতিপক্ষ অত্যন্ত চালাক। ধরা-ছোঁয়া, এমনকি সন্দেহের সম্পূর্ণ বাইরে থেকে সামনে এগোতে চাচ্ছে। এ হবে এক কঠিন শত্রু।’
‘ঠিক বলেছ জোসেফাইন। তবে আমার কিন্তু খুব আনন্দ লাগছে। বসফরাস আমাকে ডাকছে। ইস্তাম্বুলের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসকে জীবন্ত দেখতে পাচ্ছি আমার সামনে। অদৃশ্য শত্রু কে, কেমন জানি না। কিন্তু ইস্তাম্বুলের হয়ে লড়াইয়ে যেতে খুবই ভালো লাগছে আমার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না, তুমি ইস্তাম্বুলের হয়ে লড়াইয়ে যাচ্ছ না। তুমি ইস্তাম্বুলে লড়াইয়ে যাচ্ছ ‘সোর্ড’-এর পক্ষে—মানে মানুষের ‘Rational Domain’-এর হয়ে।’ বলল জোসেফাইন।
আহমদ মুসা জোসেফাইনকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘তুমি আমার ‘বন্ধু’ এবং ‘গাইড’। এখন ফিলোসফারও।’
‘না, এগুলো আমার উপযুক্ত পরিচয় নয়।’ বলল জোসেফাইন।
‘উপযুক্ত পরিচয় তাহলে কি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি স্ত্রী, আমি সহধর্মিণী।’ বলল জোসেফাইন।
‘সে তো আছই। তার ওপর তুমি ‘ফ্রেন্ড, ফিলোসফার এন্ড গাইড’।’ আহমদ মুসা বলল।
‘দেখ, ছোট বিশেষণ বড় বিশেষণকে বিশেষিত করতে পারে না, ছোট গুণ পরে এসে বড় গুণের মাথায় বসতে পারে না। ‘স্ত্রী’ নারীর জন্যে হিমালয়ের মতো সর্বোচ্চ এক পরিচয়। অন্য কোন ‘বিশেষণ’, অন্য কোন ‘গুণ’কে ভিন্নভাবে এনে এর পাশে দাঁড় করানো এর অমর্যাদা করা। ‘স্বামী’ ও ‘স্ত্রী’ উভয় পরিচয়ই পূর্ণাংগ। স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের জন্যে যা উচিত, যা প্রয়োজন তার সবকিছুর সমাহার এই দুই পরিচয়ে।’ বলল জোসেফাইন।
আহমদ মুসা জোসেফাইনের মুখ নিজের মুখের কাছে এগিয়ে আনতে আনতে বলল, ‘ভারি, খুব ভারি কথা বলেছ জোসেফাইন, তার ওপর এখন একটা মিষ্টি প্রলেপ প্রয়োজন।’
আহমদ মুসার মুখ এগিয়ে যাচ্ছিল জোসেফাইনের মুখের দিকে।
জোসেফাইন দুই মুখের মাঝখানে তর্জনী দাঁড় করিয়ে আহমদ মুসার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে খসিয়ে নিয়ে ছুটে পালাতে পালাতে বলল, ‘আমার এখন অনেক কাজ। তোমার লাগেজ আমি গুছিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু তোমার ইমারজেন্সী হ্যান্ডব্যাগ তোমাকেই গুছিয়ে নিতে হবে।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন।’ বলে আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল।

অফিসের টেবিলে বসে কয়েকদিনের হিসেব-নিকেশ করছিল আহমদ মুসা।
তার অফিসটা রোমেলী দুর্গের পশ্চিম টাওয়ারের আন্ডারগ্রাউন্ডে। সেখানে তিনটি গোপন ফ্লোর রয়েছে। টপ ফ্লোর, সেকেন্ড ফ্লোর এবং বটম ফ্লোর। এই তিনটি ফ্লোর নিয়েই ওআইসি’র ‘আইআরটি’ অর্থাৎ ‘ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড রিসার্চ এন্ড টেকনোলজি’র অফিস। ফ্লোরগুলো টপ থেকে বটমের দিকে ক্রমশ বড় হয়েছে। দুর্গের পশ্চিম টাওয়ারটি দুর্গ-অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের মাথায়। টাওয়ার-ফ্লোরের দশ ফিট নিচে টপ ফ্লোর। এই ফ্লোরের আয়তন সাড়ে তিন হাজার ঘন ফিটের মতো। এর নিচের সেকেন্ড ফ্লোরটির আয়তন টপ ফ্লোরের দ্বিগুণেরও বেশি অর্থাৎ প্রায় আট হাজার ঘন ফিট। কিন্তু বটম ফ্লোরটি বলা যায় একটা মাঠের মতো। আয়তন বিশ হাজার ঘন ফুট। এই তিনটি ফ্লোরের টপ ও সেকেন্ড ফ্লোর নির্মিত হয়েছে ১৪৫২ খৃস্টাব্দে। দুর্গটি নির্মিত হয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের দ্বারা। আর বিশ হাজার ঘন ফিটের বটম ফ্লোরটি নির্মাণ করেছে ওআইসি’র ইঞ্জিনিয়াররা। তিন ফ্লোরের টপ ফ্লোরে বিজ্ঞানীদের পার্সোনাল ফ্ল্যাট। সেকেন্ড ফ্লোরটি রিসার্চ সেন্টার এবং লাইব্রেরী। আর বটম ফ্লোরটি ল্যাবরেটরী ও টেস্ট সেন্টার।
বিজ্ঞানীদের সাথে আহমদ মুসার অফিসও সেকেন্ড ফ্লোরে।
ফ্লোরটির ঠিক মাঝখানে লাইব্রেরী। বৃত্তাকার লাইব্রেরীর চারদিকের বহির্দেয়ালে রয়েছে ছয়টি দরজা। এই ছয়টি দরজা ছয়টি রিসার্চ কমপ্লেক্সে ঢোকার পথ। একেকটি কমপ্লেক্সে বিজ্ঞানীরা এককভাবে বা যৌথভাবে কাজ করেন। এই ফ্লোরে ছয়টি রিসার্চ কমপ্লেক্স ছাড়াও প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা কক্ষ রয়েছে।
ওআইসি’র এই ‘আইআরটি’তে আহমদ মুসা রেসিডেন্ট ডাইরেক্টর (আরডি)-এর চাকরি নিয়ে এসেছে। জেনারেল তাহির তারিকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের যে সেল এই ইন্সটিটিউট পরিচালনা করে, তাদের কেউ এখানে থাকেন না। ডাইরেক্টর ম্যানেজমেন্ট (ডিএম) একজন আছেন। তিনি প্রশাসনিক বিষয়গুলো দেখেন। আর প্রজেক্টের প্রধান বিজ্ঞানী ‘চ্যান্সেলর অব আইআরটি’ হিসেবে সমগ্র রিসার্চ উইং পরিচালনা করেন। আহমদ মুসার নতুন চাকরিতে তার নতুন নাম হয়েছে খালেদ খাকান। তার পরিচয়, মধ্য এশিয়া অঞ্চলের বিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক।
আহমদ মুসা বিজ্ঞানীদের সাথে থাকার জন্যে টপ ফ্লোরে একটা ফ্ল্যাট পেয়েছে। অবশ্য আহমদ মুসা রোমেলী দুর্গের উত্তর পাশে আরও উঁচু একটা পাহাড়ে বাসা ভাড়া নিয়েছে। ইচ্ছেমতো দু’জায়গাতেই সে থাকে।
কাজে যোগ দেয়ার পর বেশ কয়দিন পার হয়ে গেছে আহমদ মুসার।
এই কয়েকদিনের হিসেব একসাথে তার সামনে এসেছে মালার মতো সারিবদ্ধভাবে সাজানো পুঁথির আকারে।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হয়েছে যে, বাইরের কেউ আইআরটি’র প্রশাসনিক বিভাগের কম্পিউটার নেটওয়ার্কের একটা কম্পিউটারে ‘প্রজেক্ট রেকর্ড’ ফাইলের আইডি ও পাসওয়ার্ড খুঁজেছে। কম্পিউটারের প্রসিডিংস মনিটরে দেখা গেছে, অজ্ঞাত সেই লোকটি দশ জোড়া আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেছে। কম্পিউটারের ইমেজ আইতে লোকটির ছবি আসার কথা, কিন্তু আসেনি। অতি চালাক লোকটি মুখোশ পরা ছিল। কিন্তু কম্পিউটারের ক্যারেক্টার মনিটর থেকে জানা গেছে, লোকটি তার কম্পিউটার ব্যবহারের গোটা সময়ের সত্তর ভাগ বাম হাত ব্যবহার করেছে। তার অর্থ, লোকটি বাঁ-হাতি। খুশি হয়েছে আহমদ মুসা। এসব তথ্য কম মূল্যবান নয়।
কার্যত সর্পদংশনে মারা যাওয়া লোকটির ব্যাপারেও আহমদ মুসা বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছে। আহমদ মুসা লোকটির মেডিক্যাল রিপোর্ট পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছে, তার দেহে যে বিষ পাওয়া গেছে, তা নিঃসন্দেহে সাপের বিষ। কিন্তু আহত স্থানটি সর্পদংশনের ক্ষত নয়। এটা সন্দেহ নয়, সত্য। তবে ঐ ক্ষত সৃষ্টি করেই তার মাধ্যমে রক্তে সাপের বিষ ঢুকানো হয়েছে। এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি আহমদ মুসাকে উদ্বিগ্ন করেছে, সেটা হলো তার দেহে এই ক্ষত সৃষ্টিটি কে করল? কোন অপরিচিত লোকের পক্ষে এতো ঘনিষ্ঠ হয়ে ঐ ধরনের আঘাত করার সুযোগ নেয়া সম্ভব নয়। দুর্গের সেনা-নিরাপত্তা ডিঙানোর প্রশ্ন তো আছেই। এ থেকে এটাই স্বতঃসিদ্ধ হয়ে ওঠে যে, আঘাতকারী লোকটি নিহত নিরাপত্তা গোয়েন্দার খুবই পরিচিত বা আস্থাভাজন এবং সেনা-নিরাপ ত্তা কর্মীদেরও পরিচিত কেউ। তাহলে সে কি ভেতরের না বাইরের পরিচিত কেউ?
তারপর তদন্তের জন্যে নিযুক্ত একজন নিরাপত্তা গোয়েন্দার বসফরাসে ডুবে মরার ঘটনাটিও আহমদ মুসা অনুসন্ধান করেছে। তার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখেছে আহমদ মুসা। ওতে সন্দেহের মতো কিছুই সে দেখেনি। একজন স্রেফ ডুবে মরেছে। ঐ দুই নিরাপত্তা গোয়েন্দা যে ফ্ল্যাট দু’টিতে এসে উঠেছিল, সেখানেও গেছে আহমদ মুসা। একসাথে থাকতো ওরা। আহমদ মুসা ওদের ব্যবহৃত বই-পুস্তক, কাগজপত্র, কম্পিউটার সবই পরীক্ষা করেছে। তাদের কম্পিউটারের গোপন ফাইলে আহমদ মুসা তাদের ডেইলি নোটস পেয়েছে। ডেইলি নোটসে শেষ পর্যন্ত সন্দেহ করার মতো কিছু পাচ্ছে না বলে লিখেছে। তবে ডেইলি নোটসে দু’জনেই একটা কথা লিখেছে, ‘সিক্সথ সেন্স’ এর কথা বার বারই বলেছে, আমরা সব সময় কারো নজরের মধ্যে রয়েছি। সুতরাং, আমরা হাওয়ায় ঝাণ্ডা উড়াচ্ছি না। এখন কাজ হলো, চোখের আড়ালের এই শত্রুকে চোখের সামনে নিয়ে আসা। কিন্তু সে সময় তাদের দেয়া হয়নি। আহমদ মুসা গোয়েন্দাদ্বয়ের এভাবে মরার ঘটনা অনুসন্ধান করা থেকে একটা কথাই বুঝল যে, আহমদ মুসাও কারো না কারো নজরের মধ্যে রয়েছে। আহমদ মুসা ওআইসি ও টার্কি গোয়েন্দাদের গঠিত পাঁচ সদস্যের যৌথ তদন্ত টিমের নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার ব্যাপারেও অনুসন্ধান করেছে। কিন্তু সামনে এগোবার মতো কোন ক্লু এখনো পায়নি। শেষ একটা ব্যবস্থা হিসেবে তারা তদন্ত কাজে নিযুক্ত হবার পর তাদের মোবাইল বা ল্যান্ড টেলিফোনে যে কলগুলো করেছে কিংবা যে কলগুলো তারা রিসিভ করেছে, তার একটা নির্ঘণ্ট এবং কথা-বার্তার রেকর্ড আহমদ মুসা টার্কিশ গভর্নমেন্টের কাছে চেয়েছিল। সেই রেকর্ডগুলোই এখন তার সামনে। বহুক্ষণ ধরে এই রেকর্ডগুলোই পরীক্ষা করছিল আহমদ মুসা। কিন্তু নতুন কোন ক্লু পায়নি। পাঁচ সদস্যের তদন্ত টিমের নেতা মেজর ইমাম সেদিন টেলিফোন করে অন্য চার সদস্যকে ডেকে নিয়েছিল এবং একত্রিত হয়ে কোথাও বেরিয়েছিল। তারপরেই অন্তর্ধান। ডেকে নেয়ার সময়ের কথা-বার্তা থেকে কোথাও একসাথে বের হবার আহবান ছাড়া আর কিছুই মেলেনি। কোথায় বেরিয়েছিল তারা, এ প্রশ্নের জবাব খোঁজারও চেষ্টা করেছে আহমদ মুসা। তাদের অফিসের গার্ডবয় একজন তুর্কি যুবক। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আহমদ মুসা জানতে পেরেছিল, তারা পাঁচজন একটা গাড়িতে উঠেছিল। ড্রাইভিং সিটে বসেছিল মেজর ইমাম। তিনি তুর্কি সেনা গোয়েন্দার কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের একজন তুখোড় অফিসার। পাঁচ সদস্যের টিমেরও তিনি প্রধান। তিনি গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে সাথীদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, রোমেলী দুর্গের ওপরে উত্তর পাশে ‘আলালা’ পাহাড়ের ‘সরাই’তেঁ আমরা যাব। আমাদের গোয়েন্দা সূত্র কিছু তথ্য দিয়েছে। এরপর তাদের গাড়ি স্টার্ট নিয়ে চলে যায়। এটাই তাদের শেষ যাওয়া। গার্ড যুবকের কাছে এই তথ্য জানার পর আহমদ মুসা আলালা পাহাড়ের ‘সরাই’তে গিয়েছিল। ‘সরাই’ আলালা পাহাড়ের একটি ট্যুরিস্ট ভিলা। এতে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে। ফ্ল্যাটগুলো সব ভাড়ায় চলে। আহমদ মুসা দেখেছে, ট্যুরিস্ট, নন-ট্যুরিস্ট সব ধরনের লোকই ‘সরাই’তেঁ রয়েছে। ‘সরাই’-এর বৈশিষ্ট্য হলো, এর দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশের কিছু ফ্ল্যাট থেকে রোমেলী দুর্গের প্রায় গোটাটাই দেখা যায়। আহমদ মুসা এই সরাইয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম সন্ধিস্থলের একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। এই ফ্ল্যাট থেকে দূরবীনে রোমেলী দুর্গের পশ্চিম টাওয়ারসহ দুর্গের অনেক অংশ বিশেষ করে পশ্চিম অংশ নিখুঁতভাবে দেখা যায়। আহমদ মুসা এই ফ্ল্যাটে প্রতিদিনের একটা অংশ কাটায়।
আহমদ মুসা রোমেলী দুর্গে গিয়ে পাঁচ সদস্যের গোয়েন্দা টিমের সেখানে তদন্তে যাওয়ার কোন হদিসই বের করতে পারেনি। ঐ পাঁচ সদস্যের গোয়েন্দা টিমের মেজর ইমাম কোন এক গোয়েন্দা সূত্র থেকে সরাইতে যাওয়ার ব্যাপারে একটা তথ্য পেয়েছিল। কি তথ্য পেয়েছিল, এটা জানার চেষ্টা করেছে আহমদ মুসা তুরস্কের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ থেকে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ থেকে ঐ দিন, ঐ সময় দূরে থাক, তদন্ত টিমে যোগ দেয়ার পরও কেউই সরাসরি মেজর ইমামের সাথে কথা বলেনি। কারণ, তদন্ত টিমটি তুর্কি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের অধীন নয়, এটা সরাসরি ওআইসি সিকিউরিটি চীফ জেনারেল তাহির তারিকের অধীন। এ ধরনের তদন্ত টিম যে গঠিত হয়েছে এবং তাতে মেজর ইমাম যোগ দিয়েছে, এ তথ্য তুর্কি সামরিক গোয়েন্দার শীর্ষ ব্যক্তি, তুর্কি প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট ছাড়া আর কেউ জানেই না। সুতরাং তদন্তের ব্যাপারে ঐ ধরনের টেলিফোন মেজর ইমাম পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আহমদ মুসা নিশ্চিত বুঝেছে, তদন্ত টিমকে ট্র্যাপে ফেলতে শত্রুপক্ষেরই টেলিফোন ছিল ওটা। এই চিন্তা থেকে আহমদ মুসা নিশ্চিত হয় যে, তদন্ত টিম গঠনের কথা এবং কাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে সে কথা শত্রুপক্ষ জানতে পেরেছিল এবং সেই সাথে তারা জানে তুর্কি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের চলমান ‘আইডেন্টিফিকেশন কোড’। তার মানে, তুর্কি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে কোন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের কারো সাথে তাদের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এই প্রশ্নটি আহমদ মুসার কাছে পরিষ্কার হয়নি, তারা তদন্ত টিমকে সরাই’তে ডেকেছিল কেন? এই প্রশ্নের সন্ধানেই আহমদ মুসা সরাইয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার একটা ব্যবস্থা করেছে।
ভাবনায় ডুবেছিল আহমদ মুসা। তার সামনে খোলা টেলিফোন মনিটরিং ডকুমেন্টের ফাইলটা। ফাইলটা বন্ধ করল আহমদ মুসা। নতুন একটা হিসেব তার সামনে এসে গেল।
বাইরের কে বা কয়জন কিভাবে গবেষণাগারে প্রবেশ করেছিল, কিংবা সে যদি পরিচিত কেউ বা ভেতরের কেউ হয়, তাহলে সে কে? যতটা অনুসন্ধান করতে পেরেছে, তাতে জেনেছে বাইরের কোন লোক ভেতরে প্রবেশের প্রশ্নই ওঠে না। পাঁচ জন বিজ্ঞানী, ডাইরেক্টর ম্যানেজমেন্ট এবং ভেতর ও বাইরের দু’জন সিকিউরিটি ছাড়া বাইরের কারও প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু বাইরের বা ভেতরের কেউ এটা করেছে। আচ্ছা, গোপন তদন্তে নিয়োজিত দু’টি গোয়েন্দা টিমের খবর ওরা পেয়েছিল কি করে? এটা তো কোন ঘোষিত তদন্ত ছিল না? এমনকি বিষয়টি এ প্রতিষ্ঠানেরও কাউকে জানানো হয়নি! তাহলে শত্রুপক্ষের বড় কোন সোর্স এ পক্ষের কোথাও আছে। আর দুই তদন্ত টিম টার্গেট হলো এটা ঠিক আছে, কিন্তু সিকিউরিটির লোকটি টার্গেট হলো কেন? অন্য কেউ নয় কেন? কোন কিছু জেনে ফেলার জন্যে তাকে মারা হয়েছে, না পথের বাঁধা দূর করার জন্যে তাকে মারা হয়েছে?
ফাইল বন্ধ করলেও এসব নতুন চিন্তার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল আহমদ মুসা। পায়ের শব্দে মুখ তুলল সে। দেখল, ডাইরেক্টর ম্যানেজমেন্ট (ডিএম) ডঃ আবদুল্লাহ বিন বাজ তার টেবিলের দিকে আসছে।
ডঃ শেখ আবদুল্লাহ বিন বাজ এর অফিস মানে গোটা প্রশাসনিক অফিস এই টাওয়ারের বাইরে, পাশেই। দুর্গের ভেতরেই ওটা নতুন একটা বিল্ডিং। ডঃ আবদুল্লাহ বিন বাজসহ ছোট্ট প্রশাসনিক স্টাফ সেখানেই বসেন। প্রশাসনিক স্টাফদের ভেতর ডঃ আবদুল্লাহ বিন বাজই গবেষণাগারে প্রবেশ করতে পারেন।
ডঃ শেখ বাজ এগিয়ে এসেছে আহমদ মুসার টেবিলের পাশে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে হ্যান্ডশেক করে স্বাগত জানাল তাকে। বলল, ‘ডঃ বাজ, আমি আপনাকে ডেকেছিলাম, কষ্ট দিয়েছি। প্লিজ বসুন।’
ডঃ বাজ বসতে বসতে বলল, ‘কোন কষ্ট নয় স্যার। এটা আপনার ডিউটি, আমারও ডিউটি।’
ডঃ বাজ ইংরেজিতে জবাব দিল আহমদ মুসার। সে আরবিভাষী, সৌদি। সৌদি আরবের বিখ্যাত বাজ পরিবারের ছেলে। এই বাজ পরিবার বাদশাহ ইবনে সৌদের গুরু শেখ আবদুল ওয়াহাব নজদী পরিবারেরই একটা শাখা। এই পরিবারকে সম্মান করে আহমদ মুসা। আহমদ মুসা খুশি হয়েছে যে, এই পরিবারের ছেলে এই ধরনের একটি দায়িত্ব পাওয়ারই উপযুক্ত।
কিন্তু ডঃ শেখ বাজ জানে না এখানে আহমদ মুসার মিশন সম্পর্কে। রেসিডেন্ট ডাইরেক্টর ছিল না, এখন নেয়া হয়েছে এটাই সে জানে।
‘ধন্যবাদ ডঃ শেখ বাজ। আপনাকে ডেকেছি কারণ আমি আসার পর আপনার সাথে কিছু অফিসিয়াল কথা ছাড়া আর কোন কথাই হয়নি। কেমন আছেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। ভালো স্যার। আপনি কেমন বোধ করছেন? কেমন লাগছে ইন্সটিটিউট? কেমন দেখছেন ইস্তাম্বুলকে?’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমি খুব ভালো বোধ করছি। ভালো লাগছে সবকিছু।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমরা একটা অস্বস্তিতে আছি। একজন প্রকৌশল বিজ্ঞানী ও একজন সিকিউরিটি অফিসারের পরপর মৃত্যু হলো। মৃত্যুকে সন্দেহজনক মনে করা হলেও তদন্ত এগোতে পারেনি, নিশ্চয় জানেন। এর মধ্যে বড় পদে আপনার আগমন আমাদের আশান্বিত করেছে। ইতোমধ্যেই আপনি একটা উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছেন। কি জানি, আমরা আগের চেয়ে অস্বস্তিও যেন কম অনুভব করছি।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
‘ধন্যবাদ। কিন্তু তদন্ত কেন এগোতে পারল না? আপনাদের অভিমত কি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাধারণ দৃষ্টিতে সবটাই দুর্ভাগ্য বলে মনে হয়। সবগুলো মৃত্যুই দুর্ঘটনা বা স্বাভাবিক কারণে হয়েছে। শুধু শেষ পাঁচ জনের নিখোঁজ হওয়া ছাড়া।’
‘আচ্ছা বলুন তো ডঃ শেখ বাজ, বিজ্ঞানীরা, আপনারা কয়েকজন ও সিকিউরিটি দু’জন ছাড়া ভেতরে আর কেউ কি প্রবেশ করে?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
ডঃ শেখ বাজ একটু চিন্তা করে বলল, ‘না স্যার, বাইরের অন্য কেউ ভেতরে আসতে পারে না, আসা নিষিদ্ধ।’
‘আচ্ছা, টপ ফ্লোরে রেসিডেন্সিয়াল কোয়ার্টার রয়েছে। যারা ওখানে থাকেন, তাদের কেউ এখানে আসে না?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আসার বিধান নেই। তবে বিভিন্নভাবে কেউ কেউ আসেন। যেমন, যে তারিখে আমার বাসায় ফেরার কথা, সেদিন হয়তো আমার স্ত্রী এসে আমাকে নিয়ে গেল। এ ধরনের ঘটনা অন্যদের ক্ষেত্রেও ঘটে। তবে বাইরের এমন কেউ এসে বাস করে না।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
‘এমন যারা আসেন, তারা সেকেন্ড ফ্লোর এবং বটম ফ্লোরে যান কিংবা যেতে পারেন?’
‘বটম ফ্লোরে এমন কেউ এবং অন্য কেউই যেতে পারে না। ইন্সটিটিউটের চ্যান্সেলর প্রধান বিজ্ঞানী ডঃ আমির আবদুল্লাহ আন্দালুসীই শুধু জানেন বটম ফ্লোরে প্রবেশের একমাত্র দরজার ছয়টি ডিজিটাল লকের কোনটি দিয়ে কখন কোন কোড ব্যবহার করে প্রবেশ করা যাবে। তিনিই মাত্র দরজা খোলেন এবং বিজ্ঞানীদের ভেতরে নিয়ে যান। সুতরাং তার দৃষ্টির বাইরে কারও সেখানে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তবে সেকেন্ড ফ্লোরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এমন বিধি-নিষেধ নেই। যারা এ ফ্লোরে আসেন, তারা ইচ্ছে করলে সেকেন্ড ফ্লোরে যেতে পারেন।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
আহমদ মুসা মনে মনে ভাবল, সেকেন্ড ফ্লোরে তো মাস্টার কম্পিউটারটা রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের সাথে ইন্সটিটিউটের রিসার্চ ব্লু-প্রিন্টের বিবরণসহ বিজ্ঞানীদের বায়োডাটা ও রিসার্চ স্পেসিফিকেশন রয়েছে। এই কম্পিউটারেই প্রবেশ করতে চেয়েছিল অদৃশ্য অজানা কেউ। এই অজানা কেউ কে হতে পারে? এসব চিন্তা আহমদ মুসার মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো খেলে গেল। আহমদ মুসা বলল ডঃ শেখ বাজ-এর কথা শেষ হবার পর, ‘এভাবে যারা আসেন বা এসেছেন, তাদের কোন হিসেব এন্ট্রিলগ রেজিস্টারে আছে?’
‘জ্বি স্যার। নিয়ম অনুসারে প্রত্যেকেরই নাম, পরিচয়, দস্তখত এন্ট্রিলগে রয়েছে। এছাড়া ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরা লগের ফটোও আমরা কম্পিউটারে পাব।’
‘ম্যামেরা লগে কি শুরু থেকেই সব ফটো বা দৃশ্য সংরক্ষিত আছে?’
‘অবশ্যই স্যার। শুধু ফাস্ট এন্ট্রি নয় স্যার, প্রত্যেক ফ্লোরেরই আলাদা আলাদা এন্ট্রি ক্যামেরা লগ রয়েছে কম্পিউটারে। এ লগগুলো প্রতি মাসে রুটিন চেক হয়। সম্প্রতি সন্দেহজনক একটা ঘটনা ঘটার পর সবগুলো লগ কমপ্লিট চেক করা হয়।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
‘সন্দেহজনক কি ঘটনা?’
‘মাস্টার কম্পিউটারে সন্দেহজনক সার্চের প্রমাণ পাওয়া গেছে।’
বিষয়টা আহমদ মুসা আগে থেকেই জানে। তার তদন্তের এটাও একটা ইস্যু।
বলল আহমদ মুসা, ‘লগ পরীক্ষা থেকে কিছু পাওয়া গিয়েছিল?’
‘কিছু পাওয়া যায়নি স্যার। অজানা-অপরিচিত কারও প্রবেশের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীদেরও গুরুত্বপূর্ণ অফিসিয়াল কাজের গোপনীয়তার স্বার্থে কক্ষ পর্যায়ে সিসিটিভি ক্যামেরা পাহারায় রাখা হয়নি। সেটা থাকলে গোপনে কে মাস্টার কম্পিউটারে বসেছিল, তা জানা যেত।’ ডঃ শেখ বাজ বলল।
‘ডঃ শেখ বাজ, আমাদের ইন্সটিটিউটের ভেতরে বাইরে সার্বিক নিরাপত্তার ব্যাপারে কি আপনি সন্তুষ্ট?’
‘জ্বি স্যার। বাইরের নিরাপত্তা তুর্কি নিরাপত্তা বাহিনী রক্ষা করে। দুর্গে প্রবেশ তারা নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের ক্লিয়ারেন্স ছাড়া ইন্সটিটিউট পর্যন্ত কেউ পৌঁছতে পারে না। ইন্সটিটিউটে প্রবেশের গেট নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের একজন সিকিউরিটি অফিসার। পালাক্রমে একজন সিকিউরিটি ইনস্টিটিউটের প্রধান গেট রক্ষা করে। ভেতরের জন্যে একজন সিকিউরিটি অফিসার আছেন। কিন্তু সন্দেহজনক ঘটনা ঘটার পর তাকেও বাইরের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োগ করা হয়েছে সম্প্রতি। ইনস্টিটিউটের নিরাপত্তার দিকটা আমি মনে করি এই দিক দিয়ে নিশ্চিত।’
‘ঠিক আছে, ডঃ শেখ বাজ। এনট্রান্স লগ এবং সিসিটিভি ক্যামেরা লগ আমার টেবিলে দেবেন। আমিও একটু দেখব।’
বলে আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বেলা তিনটা বাজতে যাচ্ছে।
তারপর আহমদ মুসা তাকাল ডঃ শেখ বাজের দিকে। বলল, ‘ডঃ শেখ বাজ, আমি উঠব।’
‘কোথায় যাবেন স্যার? বাসায়? আপনি তো এ সময় বের হন না।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
‘আমি পুলিশের জোনাল আর্কাইভসে যাব।’
‘আলালা পাহাড়ের আল-আলা পার্কের লাগোয়া যে বড় পুলিশ অফিস ওটায়?’ জিজ্ঞেস করল ডঃ শেখ বাজ।
‘হ্যাঁ’ বলল আহমদ মুসা।
‘আর্কাইভসে কি কাজ?’
‘তেমন কিছু না। সুলতান মুহাম্মদ মটরওয়ে থেকে যে রাস্তা আলালা পাহাড়ের ‘সরাই’ পর্যন্ত এসেছে, সে রাস্তায় গত একমাস ধরে যে সব গাড়ি চলাচল করেছে তার একটা তালিকা দরকার।’
‘সে তো অনেক বড় ব্যাপার! আপনি গোয়েন্দার মতো কথা বলছেন দেখছি! এ দিয়ে কি করবেন?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এটা ইস্তাম্বুল শহরে গাড়ি চলাচলের একটা স্যাম্পলিং। এটা আমার একটা হবি।’
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।

রোমেলী দুর্গ যে পাহাড়ে তার উত্তর-পশ্চিমে আলালা পাহাড়। অপেক্ষাকৃত অনেক উঁচু। এই পাহাড়েই ‘সরাই’ বিল্ডিং-এ আহমদ মুসা ভাড়া থাকে। এই পাহাড়ের ওপরেই সমতল বিরাট এলাকা জুড়ে একটি পার্ক। এটাই আল-আলা পার্ক। পার্কের পাশে বিরাট টিলা জুড়ে পুলিশ আর্কাইভস। পার্কের চারদিক ঘিরে রাস্তা। রাস্তার পাশ থেকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে টিলার ওপরে। এ সিঁড়ি দিয়েই উঠতে হয় পুলিশ আর্কাইভসে।
আর্কাইভসে মাগরিবের নামায পড়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় আহমদ মুসা বেরিয়ে পড়ল আর্কাইভস থেকে।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে রাস্তা অতিক্রম করে আহমদ মুসা পার্কে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা তার গন্তব্য আড়াল করার জন্যে গাড়ি পার্কের বাইরে রেখে পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে পুলিশ আর্কাইভসে গিয়েছিল।
পার্কে প্রবেশের গেটের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলেও পার্ক তখনও দিনের আলোর মতোই ঝলমলে।
প্রচুর লোক তখনও পার্কে। কেউ পায়চারি করছে, কেউ কেউ এখানে ওখানে বসে গল্প করছে।
ইস্তাম্বুল যেমন পাহাড়ের শহর, তেমনি গাছ-গাছালিরও শহর।
পার্কের ফ্লোরও উঁচু-নিচু। বিভিন্ন গাছ-গাছালিতে পরিকল্পিতভাবে সজ্জিত পার্কটি।
একটু নিরিবিলি জায়গা দেখেই এগোচ্ছিল আহমদ মুসা। একটা গাছের ছায়া পার হচ্ছিল সে।
পেছন থেকে চার জন লোক আহমদ মুসার দিকে ছুটে গেল। তাদের দু’জন জামার তলা থেকে লোহার ব্যাটন বের করে নিয়েছে। অন্য দু’জনের হাতে রিভলভার। পেছনের ব্যাটনধারী বেড়ালের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে আহমদ মুসার মাথা লক্ষ্যে আঘাত করল।
শেষ মুহূর্তে পায়ের শব্দে টের পেয়েছিল আহমদ মুসা। দ্রুত মাথাটা বাম দিকে সরিয়ে নিয়েছিল সে। কিন্তু তবু আঘাতটা এড়াতে পারল না। হাতুড়ির মতো একটা আঘাত নেমে এল মাথার ডান পাশের ওপর এবং তা নেমে গেল কান মাড়িয়ে। আরেকটা আঘাত এসে তার কাঁধ যেন গুঁড়িয়ে দিল।
আহমদ মুসা পড়ে গিয়েছিল উপুড় হয়ে। কিন্তু পড়ে গিয়েই ফলোআপ আঘাত থেকে বাঁচার জন্যে গড়িয়ে বাম দিকে সরে গেল।
দুই ব্যাটনধারী ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল নতুন করে আঘাত করার জন্যে।
আহমদ মুসা সরে গিয়েই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
দুই ব্যাটনধারী ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল তার দিকে।
আহমদ মুসা দেহ শূন্যে তুলে তার দু’পা ছুঁড়ে দিল ওদের দু’জনের ধাবমান পায়ের দিকে। অব্যর্থ আঘাত। ওরা গোড়াকাটা গাছের মতো আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার ওপর।
প্রস্তুত আহমদ মুসা। ওরা দু’জন নিজেদের সামলে নেবার আগেই দু’হাতে ওদের দু’জনের গলা সাঁড়াশির মতো প্রচণ্ডভাবে পেঁচিয়ে ধরল। তারপর ওদের গলা মুচড়ে দিয়ে ওদের হাতের ব্যাটন কেড়ে নিল।
অন্যদিকে রিভলভারধারী দু’জন ছুটে আসছিল রিভলভার বাগিয়ে।
আহমদ মুসা তখন ব্যাটন হাতে বসা অবস্থায় ছিল। উঠে দাঁড়াবার সময় নেই। নতুন ভাবনার অবকাশ নেই। তবে আহমদ মুসার এ চিন্তা ছিল যে, জানাজানি, শোরগোল এড়াবার জন্যে ওরা পারতপক্ষে গুলি চালাবে না। আহমদ মুসা দ্রুত চিন্তা করে এই মুহূর্তে তার হাতে থাকা শেষ সুযোগ হিসেবে ব্যাটন দু’টি সর্বশক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মারল ওদের রিভলভার ধরা হাতের দিকে।
প্রচণ্ড গতিতে লোহার সলিড ব্যাটন ছুটে গিয়ে ঠিক ঠিক আঘাত করল ওদের রিভলভার ধরা হাতে। ওদের হাতের রিভলভার ছিটকে পড়ে গেল। হাতও ওদের আহত হলো।
আহমদ মুসা ব্যাটন ছুঁড়েই উঠে দাঁড়াল। সেই সাথে গলার মোচড়ের আঘাত তখনও সামলে উঠতে না পারা একজনের কোমরের বেল্ট ধরে এক হ্যাঁচকা টানে মাথার উপর তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল ব্যাটনে আঘাতপ্রাপ্ত দু’জনের উপর।
এদিকে আহমদ মুসার পাশে পড়ে থাকা দ্বিতীয় জন মরিয়া হয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে পেঁচিয়ে ধরল আহমদ মুসার গলা।
আহমদ মুসা দু’হাতের কনুই দিয়ে প্রচণ্ড কয়েকটা ঘা দিল লোকটির পাঁজরে। ব্যথায় কোঁৎ কোঁৎ শব্দ বেরুলো তার মুখ থেকে। কিন্তু আহমদ মুসার গলা সে ছাড়ল না। বরং গলায় তার হাতের চাপ আরও তীব্র হলো। শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো তার। লোকটি তার গায়ের সাথে লেপটে থাকায় কনুই এর আঘাত আর কার্যকরী হচ্ছিল না। লোকটিকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করার এক কৌশল হিসেবে আহমদ মুসা পা দু’টিকে একটু ফাঁক করে, শক্ত করে সর্বশক্তিতে দেহের উপরের অংশে প্রচণ্ড এক ঝাঁকি দিয়ে বাঁকিয়ে নিয়ে মাথাটা অনেকটা লম্বভাবে নিজের পায়ের দিকে ছুঁড়ে দিল।
লোকটির পেছন দিকটা উল্টে এসে ছিটকে আহমদ মুসার সামনের দিকে চলে এল। অন্যদিকে আহমদ মুসা তার কোমর থেকে পা পর্যন্ত অবস্থানটা অনড় রাখার চেষ্টা করে তা নিচের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তার মাথাটা হাঁটুর লেভেলে পৌঁছার পর আরেকটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওপর দিকে তোলার চেষ্টা করল। মাথাটা ওপর দিকে উঠল না বটে, কিন্তু নিচের দিকে যাওয়ার গতি থেকে থেমে যাওয়ায় একটা ঝাঁকুনির সৃষ্টি হলো। এই ঝাঁকুনি ও লোকটির দেহ উল্টে গিয়ে পড়ার প্রবল চাপ- দুইয়ে মিলে আহমদ মুসার গলায় পেঁচানো লোকটির দু’হাত শিথিল হয়ে গেল।
আহমদ মুসা লোকটির হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়েই বুক ভরে এক শ্বাস নিয়ে তার পায়ের কাছে পড়ে যাওয়া লোকটির কোমরের বেল্টের নিচে হাত চালিয়ে তার দেহটা শূন্যে মাথার ওপর তুলে নিল।
ওরা তিনজন সার বেঁধে ছুটে আসছিল।
আহমদ মুসা লোকটিকে ছুঁড়ে মারল তাদের ওপর।
তিনজনই পেছনের দিকে ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা ছুটে গেল পড়ে থাকা দু’টি রিভলভারের দিকে। কুড়িয়ে নিল দু’টি রিভলভার দু’জায়গা থেকে।
রিভলভার দু’টি কুড়িয়ে নেবার পর মাথা তুলে দেখল, ওরা চারজন উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে পালাচ্ছে।
গুলি করার জন্যে রিভলভার তুলেও থেমে গেল আহমদ মুসা। শুরুতেই খুনোখুনিতে যেতে চায় না সে। রিভলভার দু’টি ফেলে দিয়ে বসে পড়ল সে। একটা প্রবল ক্লান্তি ঘিরে ধরছে যেন তার দেহকে। মাথার ডান পাশ ও কাঁধে অসহ্য একটা যন্ত্রণা। একটু জিরিয়ে নিয়ে উঠবে, ভাবল আহমদ মুসা। অবসন্নতায় মাথা ঝুঁকে পড়েছিল নিচের দিকে।
পায়ের শব্দে চমকে উঠে মুখ তুলল আহমদ মুসা। দেখল, একজন পুরুষ, একজন মহিলা তার দিকে ছুটে আসছে।
ওরা এল আহমদ মুসার কাছে। পুরুষটি আঁতকে ওঠা কণ্ঠে বলল, ‘আপনার ডান পাশটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আপনাকে এখনি হাসপাতালে নেয়া দরকার।’
‘আক্রমণের গোটা ঘটনা আমরা দাঁড়িয়ে দেখেছি, আমরা কিছু করতে পারিনি, দুঃখিত। লোকজন ডাকার কথাও মনে হয়নি। ঘটনা এত দ্রুত ঘটে গেল!’ মহিলাটি বলল।
পুরুষটির বয়স চল্লিশ প্লাস হবে। মহিলাটির বয়সও চল্লিশ হবে। দু’জনেরই পরনে বিকেলের ওয়াকিং ট্রাউজার। পুরুষটির গায়ে ফুল টি-শার্ট, আর মহিলাটির গায়ে হালকা ফুলহাতা জ্যাকেট। দু’জনের কথাবার্তায় শিষ্টাচার ও চোখে আন্তরিক সমবেদনা।
আহমদ মুসা মেয়েটির কথার উত্তরে বলল, ‘ধন্যবাদ। এ ধরনের আকস্মিক ঘটনায় বাইরে থেকে কিছু করার থাকে না।’
‘এখনি আপনাকে হাসপাতালে নিতে হবে। মাথার ডান পাশ ও বাঁ কাঁধের আঘাত সাধারণ নয়।’ বলল পুরুষটি।
‘হাস্পাতাল-ক্লিনিকে আমি যাব না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি বাসায় ফিরব। পার্কের উত্তর গেটে আমার গাড়ি আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে। একটু সামনেই আমাদের বাড়ি। আমরা দু’জনেই ডাক্তার। আপনাকে কিন্তু আমরা এ অবস্থায় কিছুতেই ছেড়ে দিতে পারি না।’ বলল পুরুষটি।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনার ইথিকসকে আমি ভাঙতে বলতে পারি না। চলুন।’
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
ডাক্তার পুরুষ ও মহিলা দু’জন হেঁটেই পার্কে এসেছিল। আহমদ মুসাকে নিয়ে তারা আহমদ মুসার গাড়িতেই উঠল।
ডাক্তার পুরুষটি ড্রাইভিং সিটে বসল। ডাক্তার মহিলাটি পেছনের সিটে আহমদ মুসার পাশে বসল।
‘আপনি ঠিক তুর্কি নন বলে মনে হয়। কোথায় থাকেন আপনি?’
‘রোমেলী দুর্গের এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি।’ বলল আহমদ মুসা।
ডাক্তারদের বাড়ি দূরে নয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেল তারা।
মাথা, কান ও কাঁধের ড্রেসিং শেষ করতে এক ঘন্টা সময় লেগে গেল। মাথার ডান পাশটা থেঁতলে অনেকটা চামড়া উঠে গিয়েছিল। কান কয়েক জায়গায় ফেটে গিয়েছিল। কাঁধের বাহুর সন্ধিস্থলের জায়গাটাও দারুণ থেঁতলে গিয়েছিল। কোন ফ্র্যাকচার হয়েছে কিনা, এক্স-রে না করলে বোঝা যাবে না।
ডাক্তার দু’জনে মিলে ড্রেসিং-এর কাজটা করল।
ড্রেসিং শেষে সবকিছু সরিয়ে দু’হাত পরিষ্কার করে ওরা দু’জন ফিরে এলে আহমদ মুসা বলল, ‘আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আমাকে নিশ্চয় এখন ছুটি দেবেন?’
কথা শেষ করেই আবার দ্রুত বলে উঠল, ‘ওহো, আপনাদের নামটাও জানা হয়নি। ডাক্তারদের নাম জেনে রাখা ভালো।’
ডাক্তার পুরুষটি বলল, ‘আমার নাম ডাঃ ইয়াসার তইফুন, আর ওর নাম ডাঃ রাসাত কাসাভা।’
বলে ডাঃ ইয়াসার আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনার নামও কিন্তু জানা হয়নি।’
‘আমার নাম খালেদ খাকান।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিকই ভেবেছি, আপনার তুর্কি অরিজিন আছে। নামটাও তুর্কি। খুশি হলাম। এবার আসুন পাশের ঘরে।’
‘কেন?’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
পাশের ঘরটা একটা বেডরুম। গেস্টরুমই হবে। একটা খাট। খাটের বিপরীত দিকে এক সেট সোফা সুন্দর করে সাজানো। আর ঘরে আছে একটা ওয়্যারড্রোব, একটা ছোট ডাইনিং টেবিল ও চেয়ার।
ঘরে ঢুকে ডাক্তার ইয়াসার বলল, ‘মিঃ খালেদ খাকান, আপনাকে ঘন্টাখানেক রেস্ট নিতে হবে। আপনার শরীর থেকে অনেক রক্তক্ষয় হয়েছে। হাসপাতালে নিলে রক্ত দেয়ার কথা উঠতো।’
‘তথাস্তু’ বলে শুয়ে পড়তে পড়তে আহমদ মুসা বলল, ‘ডাক্তারের হিসেব ও আমার হিসেব ভিন্ন। যা রক্ত গেছে, আরও ততটা রক্ত গেলেও আমি রক্ত নিতাম না।’
ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত একটু পিছিয়ে সোফায় বসল। বসতে বসতে ডাঃ ইয়াসার বলল, ‘আপনার কথা এক দিক দিয়ে ঠিক মিঃ খালেদ খাকান। আমি আপনার মতো বিস্ময়কর পেশেন্ট কোন দিন পাইনি। আপনাকে যে ধরনের ড্রেসিং করতে হয়েছে, তাতে লোকাল অ্যানেসথেসিয়া অপরিহার্য ছিল। আপনি অ্যানেসথেসিয়া নিলেন না। আমি বিস্মিত হয়েছি, ড্রেসিং-এর সময় আপনার চোখে-মুখে বেদনার সামান্য ভাঁজও পড়েনি। এ ধরনের শক্ত নার্ভ কারও থাকতে পারে, তা আমার কাছে অবিশ্বাস্য ছিল।’
এক মুহূর্ত থেমে আবার বলে উঠল ডাঃ ইয়াসার, ‘আপনার সত্যিই কোন অনুভূতি নেই?’
‘অনুভূতি তো জীবনের লক্ষণ। ওটা তো থাকতেই হবে। আসলে অনুভূতির প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায় ধৈর্য্যের দ্বারা। ধৈর্য্য নার্ভ বা অনুভূতিকে সীমাহীন শক্তি দিতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন, ধৈর্য্য নার্ভকে সীমাহীন শক্তি দিতে পারে। কিন্তু এ ধরনের ধৈর্য্য একজন অসাধারণেরই শুধু থাকতে পারে, সাধারণের নয়। আমার মনে হচ্ছে, এই অসাধারণের মধ্যে একজন আপনি। আল-আলা পার্কে আপনার ওপর হামলার সময়ও কিন্তু এটা আপনি প্রমাণ করেছেন। প্রথমেই যে পরিমাণ আহত আপনি হন, তাতে দু’জন রিভলভারধারীসহ চার জনের বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হওয়া সত্যি একজন অসাধারণের কাজ। আপনার বুদ্ধি, ক্ষিপ্রতা ও কৌশল আমাদের সত্যিই অভিভূত করেছে। আপনার প্রফেশন কি বলবেন দয়া করে?’ ডাঃ রাসাত কাসাভা বলল।
‘একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আমি একজন ব্যবস্থাপনা এক্সিকিউটিভ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি গবেষণাগার?’ জিজ্ঞাসা ডাক্তার ইয়াসারের।
‘ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান।’
‘আপনি তো দেখছি একজন প্রফেশনাল বুদ্ধিজীবী। এদিক থেকে আপনি একজন নির্বিরোধ ব্যক্তি। আপনাকে এভাবে ওরা আক্রমণ করল ক্বেন? কারা ওরা? ওদের আপনি চেনেন? কি উদ্দেশ্য ওদের?’ বলল ডাক্তার ইয়াসার।
‘আপনার কোন প্রশ্নেরই জবাব আমার কাছে নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার মনে হয়, পুলিশে আপনার খবরটা দেয়া উচিত।’ বলল ডাঃ ইয়াসার।
‘আইনের কথা তাই। কিন্তু আমি কোন ঝামেলায় জড়াতে চাই না।’
‘কিন্তু ঝামেলা তাতে আরও বাড়বে। ওরা সাহস পেয়ে যাবে। আবারও আক্রমণ করতে পারে ওরা।’ বলল ডাঃ ইয়াসার।
‘আমি অফিসে গিয়ে পরামর্শ করে দেখব। তবে আমি এসবে ভয় পাই না। যদি আল্লাহ না চান, কেউ আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর চাইলে পুলিশ কিংবা কেউ আমাকে বাঁচাতেও পারবে না।’
‘আপনি তো দেখছি একজন গোঁড়া অদৃষ্টবাদী!’ ডাঃ রাসাত কাসাভা বলল।
‘এটা বিজ্ঞান-মনস্কতাও।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বিজ্ঞান-মনস্কতা?’ বলল ডাঃ রাসাত কাসাভা। তার চোখে-মুখে কৌতুকের চিহ্ন।
‘কেন, বিজ্ঞান বলছে না মানুষের বংশ-গতি, জীবন-গতি সবকিছু মানবদেহের ‘জীন’ কণার মধ্যে ‘এনকোডেড’ রয়েছে!’
ডাঃ রাসাত ও ডাঃ ইয়াসার দু’জনেরই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
বলল ডাঃ রাসাত, ‘আপনি সত্যিই বিস্ময়কর মানুষ। সুন্দর কথা বলেন। কিন্তু বলুন তো, আপনি যদি চার জনের সাথে ফাইট না করতেন, তাহলে ‘জীন’ কি আপনাকে রক্ষা করতো?’
‘চার জনের সাথে আমি ফাইট করবো এবং জয়ী হবো, সেটা আল্লাহতায়ালা ‘জীন’-এ এনকোডেড করে রেখেছেন।’
হো হো করে হেসে উঠল ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত দু’জনেই। ডাঃ রাসাত বলল, ‘আপনার সাথে কথায় পারা যাবে না। তবে আপনি খুব হালকা কথার মধ্যে খুব ভারি কথা বলেছেন। আপনার মতো বিশ্বাস যাদের থাকে, তারাই অজেয় হন।’
‘আপনারা কি বিশ্বাসী নন? আপনাদের মধ্যে কি বিশ্বাস নেই?’ বলল আহমদ মুসা।
উত্তর দেয়ার জন্যে মুখ খুলেছিল ডাঃ ইয়াসার।
ঘরের আর একটা দরজার পর্দা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল একজন তরুণী। অপরূপা সুন্দরী তরুণী, যেন ডানাকাটা পরী।
মেয়েটি বলতে বলতে প্রবেশ করছিল, ‘বিশ্বাস আছে জনাব, কিন্তু তার অ্যাকশন নেই। আছে বিশ্বাস, কিন্তু তার জীবন নেই। বিশ্বাস আছে অবশ্যই জনাব, কিন্তু সেটা অবাঞ্ছিত গরীব আত্মীয়ের অসহ্য উপস্থিতির মতো, যাকে ফেলাও যায় না, রাখাও যায় না।’
হেসে উঠল আহমদ মুসা মেয়েটির বাচনভংগীতে। বলল, ‘আপনি অবস্থার একটা চমৎকার ডেফিনিশন দিয়েছেন।’
বলেই আহমদ মুসা ডাক্তার ইয়াসার ও ডাক্তার রাসাতের দিকে চেয়ে বলল, ‘এই ডেফিনিশন সম্পর্কে আপনাদের বক্তব্য কি?’
আহমদ মুসার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ডাঃ রাসাত মেয়েটিকে দেখিয়ে হাসিতে মুখ রাঙিয়ে বলল, ‘ও সাবাতিনি ইয়াসার। আমাদের মেয়ে। কয়েকদিন হলো ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। খুব পড়ুয়া, টকেটিভও। পাশের রুমে তার স্টাডিতে বসে পড়েছিল। কথা বলার সুযোগ পেয়ে বেরিয়ে এসেছে।’
‘ঠিক বলেছেন আম্মা। আমি পড়ার টেবিলে বসে আপনাদের ইন্টারেস্টিং আলোচনা শুনছিলাম। শেষে মিঃ খালেদ খাকান এমন প্রশ্ন আপনাদের করেছেন, যে প্রশ্নের সঠিক জবাব আপনারা দেবেন না ভেবেই আমি বেরিয়ে এসেছি সত্য জবাবটা দেয়ার জন্যে। আপনাদের ঠোঁটে ঈশ্বর আছে, কিন্তু বুকে ঈশ্বর নেই।’ বলল সাবাতিনি ইয়াসার।
‘সুন্দর ডেফিনিশন এবং স্পষ্ট কথার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু আমি কি জানতে পারি, আপনার ঈশ্বর আপনার কোথায় মানে ঠোঁটে না বুকে রয়েছে?’ আহমদ মুসা বলল।
মেয়েটির দুই ঠোঁট হাসিতে ভরে গেল। বলল, ‘জবাব আছে। তার আগে বলব, আমি বয়সে আপনার ছোট। আপনি আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করে কথা বলায় আমি অস্বস্তি বোধ করছি। এ অস্বস্তি নিয়ে আপনার সাথে আমার কোন কথা হবে না।’
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ঠিক আছে সাবাতিনি, বল তোমার উত্তরটা।’
‘জবাবটা আপনি দিয়ে রেখেছেন। ঐ যে বলেছেন মানবদেহের ‘জীন-কোষ-কণা’র বংশ-গতির কথা। সে বংশ-গতির আমিও শিকার। আমার বিশ্বাস আমার পূর্বসূরীদের মতোই তো হবে।’ বলল সাবাতিনি।
‘তোমার এই উত্তরটা কিন্তু সত্য বা সংগত হলো না সাবাতিনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন নয়? আমি তো বিজ্ঞানের কথা বলেছি, যেটা আপনিও বলেছেন।’ বলল সাবাতিনি।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সাবাতিনি, আল্লাহর দেয়া দৈহিক ব্যবস্থা ‘জীন’-এর বংশ-গতি কিন্তু মানব জীবনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে না। আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। এই ইচ্ছাশক্তিই মানুষের বিশ্বাস ও কর্মকে রূপায়িত করে পরিচালনা করে। এই কারণেই দেখ এক বিশ্বের, এক দেশের, এমনকি এক বাড়ির মানুষ বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন বিশ্বাস ও বিভিন্ন কর্মধারা অনুসরণ করে। বিভিন্ন ইচ্ছাশক্তির প্রভাবেরই এটা ফল।’
গম্ভীর হয়ে উঠেছে সাবাতিনি ইয়াসারের মুখ। বলল, ‘বিভিন্ন ইচ্ছাশক্তি, বিভিন্ন ‘জীন-কণা’ যদি মানুষের ইচ্ছাশক্তির পরিচালক হয়ে দাঁড়ায়, ইচ্ছাশক্তি তাহলে স্বাধীন থাকছে না।’
‘তুমি বলতে চাচ্ছ, একই বংশে, একই বাড়িতে বিভিন্ন জীনই বিভিন্ন ইচ্ছাশক্তির উৎস এবং তা যদি হয়, তাহলে ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন নয়। এই মত ঠিক নয় এই কারণে যে, একজন মানুষ তার জীবনে তার বিশ্বাস ও কর্মধারা একাধিক বা বহুবার চেঞ্জ করতে পারে এবং আমাদের চোখের সামনেই তা করছে। কিন্তু একজন মানুষের দেহ-কোষের ‘জীন-কণা’ তো এভাবে চেঞ্জ হতে পারে না, চেঞ্জ হয় না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ‘জীন’ চেঞ্জ হয় না, কিন্তু ইচ্ছা চেঞ্জ হয়। এর পরিষ্কার অর্থ ইচ্ছাশক্তি ‘জীন’ নির্ভর নয়, স্বাধীন।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই ডাঃ রাসাত বলে উঠল, ‘ইচ্ছা যে কোন বিশ্বাস, যে কোন কর্মধারা চয়েস করতে পারে, যেহেতু সে স্বাধীন। কিন্তু এই চয়েস তো সত্য, মিথ্যা, ন্যায়, অন্যায়, ভালো, মন্দের বিচারে চূড়ান্ত নয়। কারণ চয়েস দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন হচ্ছে, কিন্তু সত্য, ন্যায়, ভালো তো একটাই, বিভিন্ন নয়।’
‘ঠিক ধরেছেন ডাঃ রাসাত। মানুষের ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন, কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন, কিন্তু অন্ধ। ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন, কিন্তু এর নিজস্ব কোন রূপ নেই, রঙ নেই। ইচ্ছাশক্তি একটা সিদ্ধান্ত, যা ঠিক করতে, ভুলও করতে পারে বা ভালো করতে পারে, আবার মন্দও করতে পারে, যা সত্য পথে চলতে পারে, আবার ভুল পথেও চলতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘যে ইচ্ছাশক্তি মানুষের বিশ্বাস ও কর্মধারার চালিকাশক্তি, সে ইচ্ছাশক্তি এমন অন্ধ হওয়াটা তো মানুষের জন্যে বিপজ্জনক। শুধু বিপজ্জনক নয়, ধ্বংসকারীও।’ বলল ডাঃ রাসাত। গম্ভীর তার কণ্ঠ।
‘ঠিক ডাঃ রাসাত। সত্যিই সব মানুষ এক বিপজ্জনক ও ধ্বংসকরী অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আমাদের ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনে একটা ছোট্ট সূরা রয়েছে। তার নাম ‘আসর’ বা ‘কাল’। এই সূরা বা ভার্স-এ আল্লাহতায়ালা ‘কাল’-এর (যে কাল মানুষের ক্ষতি ও সফলতার সাক্ষী) শপথ করে বলেছেন, নিশ্চয় সব মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, শুধু তারা ছাড়া যারা বিশ্বাসী, যারা সৎকর্মশীল এবং যারা সত্য ও ধৈর্য্যের উপদেশ দেয়। এই ভার্স-এ একথা…….।’
‘স্যরি, আমি জানতে চাচ্ছি, ইচ্ছাশক্তি যদি অন্ধ হয় এবং তা যদি মানুষের বিশ্বাস ও কর্মধারার পরিচালক হয়, তাহলে অন্ধ ইচ্ছাশক্তির হাত থেকে বেঁচে মানুষ নিশ্চিতভাবে অবিশ্বাসী না হয়ে সুবিশ্বাসী, অসৎকর্মশীল না হয়ে সৎকর্মশীল হবে কি করে?’ বলল দ্রুতকণ্ঠে সাবাতিনি ইয়াসার।
‘বলছি সাবাতিনি। বলেছি, মানুষের ইচ্ছাশক্তি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ইচ্ছাশক্তির বিচারবোধ বা জ্ঞানচক্ষু নেই, এই অর্থেই সে অন্ধ। এই অন্ধ ইচ্ছাশক্তিকে পথ চেনাবার জন্যে আল্লাহ মানুষকে ‘অন্ধের যষ্টি’ও দিয়েছেন। এই ‘অন্ধের যষ্টি’ হলো মানুষের বিবেক ও জ্ঞান। ইচ্ছাশক্তির সাথে সাথে আল্লাহ মানুষকে এই দুই জিনিস দিয়েছেন, যাতে মানুষের ইচ্ছাশক্তি সঠিকভাবে চলার দিক নির্দেশনা পায়। ইচ্ছাশক্তির দিক নির্দেশনা স্বরূপ এই দুই জিনিসের মধ্যে ‘বিবেক’ খারাপ-ভালো, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যে সমানভাবে আছে। আর দ্বিতীয় বিষয় ‘জ্ঞান’ মানুষকে শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। জ্ঞানের আবার দু’টি উৎস রয়েছে। একটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আসা ‘ওহী’র জ্ঞান, অন্যটি জাগতিক শিক্ষা থেকে অর্জিত জগৎ বিষয়ক জ্ঞান। ওহীর জ্ঞান মানুষকে ‘বিশ্বাস’ ও ‘কর্মপদ্ধতি বা কর্মধারা’ সম্পর্কে জ্ঞান দান করে। মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে মংগলের পথে, ন্যায়ের পথে, শান্তি-স্বস্তির পথে, পরকালীন ভালোর পথে পরিচালনার জন্যে ‘ওহী’র জ্ঞান অনুসরণ অপরিহার্য। ইচ্ছাশক্তির হাতে যদি ‘অন্ধের যষ্টি’ ‘বিবেক’ ও ‘ওহী’র জ্ঞান না থাকে, তাহলে ইচ্ছাশক্তির যাত্রা হয় বিপজ্জনক, ধ্বংসকরী।’
‘‘ওহী’র জ্ঞান থাকলে ‘বিবেক’-এর কি প্রয়োজন আছে? এ দুইয়ের পার্থক্য কি, সম্পর্ক কি?’ জিজ্ঞাসা সাবাতিনির।
আহমদ মুসা বলল, ‘বিবেক হলো মানব মনের ভালো-মন্দ বাছাইয়ের একটা সহজাত শক্তি। এটা সকল মানুষের ‘জীন’-এ এনকোডেড একটা কমন বিষয়। অন্যদিকে ‘ওহী’র জ্ঞান হলো আল্লাহতায়ালা কর্তৃক তাঁর নবী-রাসূলদের মাধ্যমে পাঠানো মানুষকে মঙ্গল ও মুক্তির পথে পরিচালনার জন্যে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবন-পদ্ধতি। ‘বিবেক-জ্ঞান’ ও ‘ওহী’র জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য হলো, ‘বিবেক-জ্ঞান’ বলতে পারে কাজটি ভালো না মন্দ, গ্রহণীয় না বর্জনীয়। কিন্তু ‘বিবেক-জ্ঞান’ মানুষকে মঙ্গল ও মুক্তির পথে পরিচালনার জন্যে কোন করণীয় ও কর্মপ্রণালী তৈরি করে না। এমনকি ‘বিবেক-জ্ঞান’ একজন স্রষ্টা আছেন, এমন একটা অনির্দিষ্ট অনুভূতি দান করা ছাড়া স্রষ্টার পরিচয়, স্রষ্টার ইচ্ছা, স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্কের বিষয়ে কিছুই বলতে পারে না। বিবেকের পক্ষে পারা সম্ভব নয়, এমন সব জ্ঞানের বিশ্বাস নিয়েই নবী-রাসূলরা দুনিয়ায় এসেছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে। মানুষের জন্যে ‘ওহী’র জ্ঞান সুনির্দিষ্ট করার পর বিবেক-জ্ঞান কেন প্রয়োজন, এ প্রশ্নও উঠতে পারে। এক্ষেত্রে অনুধাবনের সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ‘ওহী’র জ্ঞান মানব মনের সহজাত প্রবণতায় সাধারণভাবে এনকোডেড কোন বিষয় নয়, এটা আয়ত্ত সাপেক্ষ, যা প্রচারের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছার কথা। কিন্তু দুনিয়ার সব জায়গার সব মানুষের কাছে এই প্রচার নাও পৌঁছতে পারে। সেক্ষেত্রে বিবেক-জ্ঞান হবে তাদের অবলম্বন, যার কাছ থেকে তাদের ইচ্ছাশক্তি পাবে দিক-নির্দেশনা। ‘ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই সাবাতিনি বলে উঠল, ‘আপনার শেষের কথায় একথা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, ‘ওহী’র জ্ঞান পৃথিবীর সব জায়গায় সব মানুষের কাছে পৌঁছা দরকার। না হলে তারা ঠকবে, একমাত্র এবং অনির্দিষ্ট বিবেক-জ্ঞান নিয়েই তাদের চলতে হবে এবং তার ফলে জীবন-পরিচালনার সঠিক নির্দেশনা থেকে তারা বঞ্চিত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু দুনিয়ার সব মানুষের কাছে ‘ওহী’র জ্ঞানের কি প্রচার হচ্ছে? না হলে তার উপায় কি? দ্বিতীয় বিষয় হলো, ‘বিবেক-জ্ঞান’ যেভাবে মানব প্রবণতার একটা সহজাত বিষয় হিসেবে ‘এনকোডেড’ হয়েছে, সেভাবে ‘ওহী’র জ্ঞান মানব-প্রবণতার সহজাত বিষয় হিসেবে এনকোডেড হলে দুনিয়ার কেউই তাহলে এই জ্ঞান থেকে বঞ্চিত থাকতো না। এ বিষয় সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সাবাতিনি, তোমার শেষ বিষয় থেকেই শুরু করি। ‘বিবেক-জ্ঞান’ অপরিবর্তনশীল। দুনিয়ার প্রথম মানুষের এই জ্ঞান যেমনি ছিল, দুনিয়ার শেষ মানুষেরও তেমনি থাকবে। এজন্যে বিবেক-জ্ঞান শুরুতেই সর্বকালের মানুষের জন্যে এনকোডেড করা গেছে। কিন্তু ওহীর জ্ঞান পরিবর্তনশীল। সময় ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে ‘ওহী’র জ্ঞানভিত্তিক জীবন-পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়ে আসছে। এই পরিবর্তনশীলতার জন্যে ‘বিবেক-জ্ঞান’-এর মতো একে ‘এনকোডেড’ করা হয়নি। আধুনিক কালে এসে পরিবর্তন প্রয়োজনের সমাপ্তি ঘটানো হয়েছে মানবজাতির জন্যে সর্বশেষ ও আগামী সর্বকালের জন্যে ‘ওহী’র জ্ঞান বা ওহীভিত্তিক জীবন-পদ্ধতি প্রেরণের মাধ্যমে। ‘ওহী’র জ্ঞান সহজাত প্রবণতার ন্যায় এনকোডেড (Encoded) না হবার আরেকটা কারণ হলো, এই জ্ঞান প্রকৃতিজাত বা সহজাত হলে একে মানুষের জন্যে পরীক্ষার বিষয় করা যেত না। অথচ কে ভালো হতে চায়, কে চায় না- এই পরীক্ষা মানব সৃষ্টির সবচেয়ে বড় বিষয়। এর মাধ্যমেই পরকালীন জীবনের জন্যে পুরষ্কার বা তিরস্কার নির্ধারিত হবে।’
‘ধন্যবাদ জনাব। আপনি ধর্মবেত্তা বা বিজ্ঞান-বেত্তা অথবা দার্শনিক হলে ভালো হতো। আমার অনার্সের সাবসিডিয়ারী বিষয়ের একটি হলো ধর্ম। আমাদের স্যাররা কিন্তু আপনার মতো এত গভীর, সেই সাথে সর্বাধুনিক দৃষ্টিভংগীর ধারে-কাছে নেই। আপনি বিরক্ত হতে পারেন। কিন্তু এসব বিষয়ে আমার আপনাকে বিরক্ত করার সম্ভাবনা আছে। যাক, আপনি একটা সাংঘাতিক কথা বলেছেন। আপনি ইসলামকে সর্বশেষ এবং আগামী সর্বকালের ধর্ম বা জীবন-পদ্ধতি হিসেবে অভিহিত করে সব ধর্মকে বাতিল করে দিয়েছেন।’ বলল সাবাতিনি ইয়াসার।
‘আমি বাতিল করিনি। স্বাধীন নিয়মেই সব বাতিল হয়ে যাবার কথা। নতুন সংবিধান চালুর অর্থ আগের সংবিধান আর নেই। এটাই স্বাভাবিক। ধর্ম এর বাইরে নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
সাবাতিনি কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে বাঁধা দিয়ে ডাঃ ইয়াসার বলে উঠল, ‘আর নয় সাবাতিনি। উনি সুস্থ নন। ওকে একটু রেস্ট নিতে দাও।’
‘স্যরি আব্বা, স্যরি জনাব। তবে আমি অপ্রয়োজনীয় কিছু বলিনি।’ বলল সাবাতিনি প্রথমে তার আব্বা, পরে আহমদ মুসার দিকে ঘুরে।
‘মিঃ খালেদ খাকান, আপনি যতক্ষণ ইচ্ছা রেস্ট নিন, তবে এক ঘন্টার কম নয়। আমরা পাশের ঘরেই আছি।’ বলল ডাঃ রাসাত।
‘ধন্যবাদ ডাক্তার।’ বলে একটু থেমেই আবার সাবাতিনিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমার একটা প্রশ্ন, আপনার বাড়ির অপজিটে রাস্তার পশ্চিম পাশে বাগান ঘেরা বড় বাড়িটা কার?’
‘কেন, বাড়িটা ভালো লেগেছে আপনার? ভালো লাগলেও লাভ নেই। ওটা ‘সিনাগগ’। শুধু সিনাগগও নয়, ওটা একটা জুইশ কমপ্লেক্স। ওকে শুধু ইস্তাম্বুল নয়, তুর্কি জুইশদের রাজধানীও বলতে পারেন।’ বলল ডাঃ রাসাত।
আহমদ মুসা মুখে বেজার ভাব এনে বলল, ‘আমি হতাশ হলাম।’
কিন্তু বাড়িটার এই পরিচয় পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছে আহমদ মুসা। আজ পুলিশ আর্কাইভসে পাঁচ গোয়েন্দা নিখোঁজ হওয়ার দিনের নির্দিষ্ট সময়ের সিসিটিভির এই রাস্তার মনিটরিং-এর ছবিগুলো পরীক্ষা করতে গিয়ে সে দেখেছে, পাঁচ গোয়েন্দাকে বহন করা গাড়িটি সর্বশেষ ঐ বাড়িতেই প্রবেশ করে। গাড়িটার বের হবার দৃশ্য পরবর্তী চার-পাঁচ ঘন্টার মনিটরিং-এর ছবি পরীক্ষা করেও আর সে পায়নি। এর অর্থ, এখান থেকেই পাঁচ গোয়েন্দা এবং তাদের গাড়িটা উধাও হয়েছে।
‘বাড়িটার কি কি সুন্দর লেগেছে আপনার কাছে?’ জিজ্ঞেস করল ডাঃ রাসাতই আবার।
‘সবই সুন্দর লেগেছে। যে টিলার ওপর বাড়িটা, তা আনকমন। এই আয়তনের কোন টিলার এত প্রশস্ত ফেস খুবই দুর্লভ। বাড়িটার বিশালত্ব এবং দুর্গ ধরনের বৈশিষ্ট্য দৃষ্টি আকর্ষণের মতো। বাড়িটা যেন চারদিক থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখে তার নিরাপত্তা ও নিরিবিলি পরিবেশকে অখণ্ড করে তুলেছে। বাড়ির মিছিলে থেকেও সে যেন একা, ভিন্নতর, স্বতন্ত্র। চারিদিকে হৈ চৈ, কিন্তু সে মৌন।’ থামল আহমদ মুসা।
হেসে উঠল ডাঃ রাসাত, ডাঃ ইয়াসার এবং সাবাতিনি একসাথে। বলল ডাঃ রাসাত, ‘বাড়িটা সব সময় আমাদের নজরে আসে কিন্তু কখনও বিশেষ বলে মনে হয়নি। অথচ আপনার বর্ণনা শুনে বাড়িটা আমার কাছে সবিশেষ হয়ে উঠেছে। আমরাও যেন ভালোবেসে ফেলছি বাড়িটাকে বর্ণনার মাধুর্যে। আপনি কি কবি না শিল্পী?’
‘দুই-ই আম্মা। কবির কথামালা, শিল্পীর তুলি যেমন সাধারণকে অসাধারণ এবং অরূপকেও অপরূপা করে, উনিও তাই করেছেন।’ বলল সাবাতিনি। তার চোখে-মুখে বিচ্ছুরিত এক বিমুগ্ধতা। তার অতল নীল চোখে নিজেকে হারিয়ে ফেলার এক আনমনা দৃষ্টি।
‘চাঁদের কলঙ্কের মতো বাড়িটার কিছু দোষও আছে। বাড়িটাতে কোন প্রাণের স্পন্দন নেই। বাড়িটার বড়, ভারি সিংহদ্বারটি আমার কাছে কারাগারের নিষ্ঠুর দরজা বলে মনে হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
আবারও হেসে উঠল ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত।
কিন্তু গম্ভীর সাবাতিনি বলে উঠল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘আপনার অনুভূতি এত স্পর্শকাতর জনাব!’ সাবাতিনির কণ্ঠে কম্পিত এক আবেগ।
‘মিঃ খালেদ খাকান, আপনার অনুভূতিটা ঠিক। বাড়িটার বিরাটত্ব, গেটে দারোয়ান না থাকা, গেট ঘন ঘন না খোলা ইত্যাদি কারণে আপনার এই অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু বাড়িটা প্রাণহীন নয়, বাড়িতে লোক আছে। গেট ভেতর থেকে নিয়ন্ত্রিত। গেটের সামনে লোক গেলেই ভেতর থেকে টিভি স্ক্রীনে তাকে দেখা যায় আর তখন দরজা খুলে দেয়া হয়। বাড়িটা পারিবারিক নয় বলে মানুষের আনাগোনা, যাতায়াত কম। যারা ওখানে আসেন, নির্দিষ্ট সময়গুলোতে আসেন।’ সাবাতিনির কথা শেষ না হতেই বলল ডাঃ রাসাত।
‘তাই হবে। কিন্তু শনিবার সিনাগগে প্রচুর ভিড় হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হতো। কিন্তু পাশেই সিজলি বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট-এ সম্প্রতি আরেকটা সিনাগগ হয়েছে। ভিড়টা ওখানে চলে গেছে। এ সিনাগগে ইস্তাম্বুলের জুইশ দায়িত্বশীলরা আসেন। ইস্তাম্বুলের বাইরে থেকেও দায়িত্বশীলরা আসেন। এখন বলা যায়, এটা বিশেষ সিনাগগ। এখানে প্রার্থনার অনুষ্ঠান দীর্ঘ হয়। কারণ, প্রার্থনার সাথে মিটিং-সিটিংও থাকে।’ বলল ডাঃ রাসাত।
আহমদ মুসা মনে মনে ধন্যবাদ দিল রাসাতকে। বাড়িটা সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পাওয়া গেল। ষড়যন্ত্রের প্রাথমিক এক রূপরেখাও অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অন্য কিছু না ঘটলে পাঁচ গোয়েন্দা এই ভবনে ঢুকেই নিখোঁজ হয়েছে। এটাই আজকের বড় পাওয়া। আনন্দিত কণ্ঠে আহমদ মুসা বলল, ‘অনেক কথা হলো। মন ভালো লাগছে আমার। আঘাতের বেদনাও যেন কমে গেছে। আমাকে রিলিজ করলে খুশি হই।’
‘রিলিজ আপনি হয়েই আছেন। আপনি যেহেতু নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করবেন, এজন্যেই বলছি, আপনি কিছু সময় রেস্ট নিন। আর এখনই যদি যেতে চান, তাহলে আপনার ড্রাইভ করা হবে না, আমরাই আপনাকে পৌঁছে দেব।’ বলল ডাঃ ইয়াসার।
‘না ডাক্তার, আপনাদের আর কষ্ট দেয়া ঠিক হবে না। রেস্ট নেয়া আমার জন্যে ভালো আর আপনাদেরও কষ্ট দেয়া থেকে বাঁচা যাবে। এই চোখ বুজলাম, ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা বালিশে মাথাটা রাখল।
‘ধন্যবাদ মিঃ খালেদ খাকান। আমরা ওপাশের ঘরটায় আছি।’
বলে ডাঃ ইয়াসার ঘর থেকে বের হবার জন্যে পা বাড়াল। তার সাথে ডাঃ রাসাতও।
‘আমিও আসছি জনাব। আমার কথা কিন্তু শেষ হয়নি।’ বলল সাবাতিনি।
‘শেষ হবার কথা নয়। একজন ছাত্রীর জন্যে এটাই স্বাভাবিক। ধন্যবাদ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ জনাব।’ বলে সাবাতিনি পাশের ঘরে ঢুকে গেল।

মোবাইলে রিং শুনে আহমদ মুসা চোখ খুলল। ডান হাত দিয়ে বালিশের পাশের মোবাইলটি অন করল আহমদ মুসা। অভ্যাসমতো ডান পাশ ঘুরে বাম হাত দিয়ে মোবাইল নিয়ে কানে তুলতে চাইল।
অন্যদিনের মতোই ডান পাশ ঘুরতে গেল আহমদ মুসা। তখন মাথা ও ডান কাঁধের ব্যথায় প্রচন্ড ঘা লাগল। মুখ থেকে ‘আহ’ শব্দ বেরিয়ে এল আপনাতেই। পাশ ফিরতে পারল না আহমদ মুসা।
বাঁ হাত ঘুরিয়ে মোবাইল নিয়ে চোখের সামনে ধরল। মোবাইল স্ক্রীনে ‘DJ’ শব্দ দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। ডোনা জোসেফাইনের টেলিফোন! নিশ্চয় সে তার বেদনাজড়িত আর্তকণ্ঠ শুনতে পেয়েছে। আহমদ মুসা তার আহত হওয়ার খবর গত রাতে ডোনা জোসেফাইনকে জানায়নি। ভেবেছিল, তেমন বড় আঘাত নয়, তাকে অহেতুক চিন্তায় ফেলার দরকার নেই। এখন জানতে পারলে তো সে কেন গোপন করেছি তা নিয়ে মন খারাপ করবে। একই শহরে কয়েক মাইলের ব্যবধানে দু’জন থাকছি, সন্ধ্যার এত বড় খবর সকাল নয়টা পর্যন্ত জানানো হয়নি, এই দায়িত্বহীনতা আড়াল করার মতো নয়। যাক, যা হবার হয়েছে। বেশি রাতের ব্যাপার, সুযোগ পায়নি টেলিফোন করতে, এটাই বলার মতো একটা কথা।
পরিকল্পনা অনুসারে একই প্লেনে একই দিনে আহমদ মুসা ও ডোনা জোসেফাইন ইস্তাম্বুল এসেছে। থাকার জায়গাও দু’জনের দু’জায়গায়। দু’জনেই ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশে থাকছে। কিন্তু ডোনা জোসেফেইনের থাকার জায়গা করা হয়েছে গোল্ডেন হর্নের দক্ষিণে আদি ইস্তাম্বুল অংশে।
ডোনা জোসেফাইনের থাকার এলাকা সিলেকশন তার নিজের। ওসমানীয় খলিফারা যেখানে বসে পাঁচশ’ বছর ধরে ইউরোপ ও এশিয়া শাসন করেছিল, গোল্ডেন হর্নের উত্তরের সেই ইস্তাম্বুলে থাকার জন্যে পছন্দ করেছিল ডোনা জোসেফাইন। কিন্তু যে স্থানে থাকতে চেয়েছিল, সেই স্থান সে পায়নি। তার পছন্দ ছিল আইয়ুব সুলতান মসজিদের আশে-পাশে কোথাও থাকা, যাতে মসজিদটিতে ইচ্ছেমতো নামায পড়ার সুযোগ হয়। কিন্তু নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে সেখানে রাখার ব্যবস্থা তুর্কি সরকার করতে পারেনি। ঐ এলাকায় প্রেসিডেন্সিয়াল কোন অতিথি ভবন নেই। পরিবর্তে ডোনা জোসেফাইনকে যেখানে রাখা হয়েছে, সেটা ধর্মীয় আবেগের দিক দিয়ে না হলেও ঐতিহ্য-আবেগের দিক দিয়ে অতুলনীয়। মর্মর সাগর, বসফরাস প্রণালী এবং গোল্ডেন হর্ন একসাথে আছড়ে পড়ছে ঈগলের ঠোঁটের মতো যে ভূ-খণ্ডের ওপর, সেখানেই ওসমানীয় খলিফাদের পাঁচশ’ বছর শাসন পরিচালনার গৌরব-দীপ্ত কেন্দ্র ‘তোপকাপি’ প্রাসাদ। এই প্রাসাদ এলাকা সংরক্ষিত এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থার অধীন। এই প্রাসাদের উত্তর-পূর্ব দিকে মর্মর সাগর, বসফরাস, গোল্ডেন হর্নের আছড়ে পড়া পানির আরও নিকটে প্রাসাদ এরিয়ার মধ্যেই রয়েছে হাই সিকিউরিটি ব্যবস্থার অধীন একটা প্রেসিডেন্সিয়াল ভবন। তোপকাপি প্রাসাদে এলে প্রেসিডেন্ট এখানে বিশ্রাম নেন। এই ভবনে প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইট ছাড়াও ভিভিআইপি প্রেসিডেন্সিয়াল অতিথিদের জন্যে আছে আরও কিছু স্যুইট। এই স্যুইটের একটা দেয়া হয়েছে ডোনা জোসেফাইনকে। তার স্যুইটের বারান্দায় বসে মর্মর সাগর, বসফরাস ও গোল্ডেন হর্নের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। আইয়ুব সুলতান মসজিদের আশেপাশে থাকার ইচ্ছে পূরণ না হলেও তোপকাপি প্রাসাদের সান্নিধ্যে কল্পনার মর্মর, বসফরাস ও গোল্ডেন হর্নকে হাতের মুঠোয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছে ডোনা জোসেফাইন। স্যুইটে উঠেই ডোনা জোসেফাইন টেলিফোন করে তার আবেগের কথা আহমদ মুসাকে জানিয়েছে।
কোন জরুরি প্রয়োজন না হলে ডোনা জোসেফাইন আহমদ মুসাকে দিনে-রাতে দু’বারের বেশি টেলিফোন করে না। দু’বার টেলিফোনের একটা রাত দশটায় আর দ্বিতীয়টা হলো সকাল নয়টায়।
মোবাইল কানের পাশে নিয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছ জোসেফাইন?’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। তুমি অসুস্থ! তোমার কি হয়েছে? তুমি তো এমন কঁকিয়ে ওঠ না সাধারণ কোন বেদনাতেই?’
‘মোবাইলটা নেয়ার জন্যে হঠাৎ পাশ ফিরেছিলাম। অজান্তেই ব্যথা পেয়েছি, অজান্তেই শব্দটা বেরিয়ে এসেছে। তোমাকে বলা হয়নি, একটা সুখবর হলো, গতকাল নতুন শত্রুদের সাক্ষাৎ মিলেছে। কিন্তু খারাপ খবর হলো, ওদের ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’-এর মতো আক্রমণে মাথার ডান পাশ ও কাঁধ আহত হয়েছে। ঐ ব্যথাতেই ডান পাশ ফিরতে পারছিলাম না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি, তুমি বিষয়টাকে খুব হালকাভাবে দেখছ। এমনটা যদি হয়, তাহলে কিন্তু আমি মর্মর, বসফরাস ও গোল্ডেন হর্ন-তীরের আরাম-আয়েশের এই অবকাশ কেন্দ্র ছেড়ে উঠব তোমার আলালা পাহাড়ের সরাইতে।’ বলল ডোনা জোসেফাইন।
‘স্যরি জোসেফাইন, আমি সাড়ে দশটায় রোমেলী দুর্গে ফিরেছি। তখন তুমি ঘুমিয়ে পড়ার কথা। তোমাকে ঘুম থেকে তুলে এই দুঃসংবাদটা দেয়া আমি ঠিক মনে করিনি। আর ভোরে নামায পড়েই আবার আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’
জোসেফাইনের জবাব সংগে সংগে এলো না। একটু সময় নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল, ‘ধন্যবাদ। মাথার ডান পাশের আঘাতটা তোমার কেমন? তুমি এখানে এস, না হলে কিন্তু আমি ওখানে যাব।’ বলল ডোনা জোসেফাইন।
‘না জোসেফাইন, তেমন বড় আঘাত নয়। যেখানে আহত হই, সেখান থেকেই দু’জন ডাক্তার দম্পতি আমাকে তাদের বাসায় নিয়েছিলেন। ওরাই চিকিৎসা করেন। আমি ওখানে দু’ঘন্টার মতো বিশ্রাম নেয়ার পর বাসায় ফিরেছি। আমিই তোমার ওখানে আসব। প্লিজ, তুমি আহমদ আবদুল্লাহকে নিয়ে ‘সরাই’তে কিংবা ‘রোমেলী’তে এস না। এ দু’জায়গা এখন ওদের নজরে।’
‘বল, তুমি আরও সাবধান হবে। তোমার এবারের শত্রু ষড়যন্ত্রকারী এবং ওরাই অফেন্সিভে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, তুমি শত্রুকে দেখছ না, এমনকি জানই না তারা কারা! অথচ তুমি সর্বক্ষণ ওদের নজরে রয়েছ। এমন লড়াই বিপজ্জনক।’ বলল ডোনা জোসেফাইন। তার কণ্ঠ ভারি।
‘অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে জোসেফাইন। ডাক্তার-দম্পতির বাড়ি থেকে একটা বড় ক্লু আমি পেয়ে গেছি। আর…….।’
‘না, এসব কথা টেলিফোনে নয়। আমি জানি, অবস্থার পরিবর্তন আল্লাহ করবেন।’ আহমদ মুসার কথায় বাঁধা দিয়ে বলল ডোনা জোসেফাইন।
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। এখন বল, তুমি এদিক-সেদিক ঘুরছ, না শুধু ঘরে থাকছ? ঠিক-ঠাক সহযোগিতা পাচ্ছ তো?’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রয়োজনের বেশি বলতে পার। আমার সেক্রেটারি লতিফা আরবাকান খুব বুদ্ধিমতী, খুব স্মার্ট, খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্না। তার ব্যবস্থাপনায় কোন ত্রুটি নেই। প্রতিদিনই বের হচ্ছি। আগে-পেছনে দুই গাড়িতে দশ জন সিকিউরিটির লোক থাকে। আমার গাড়ি সেক্রেটারি লতিফা আরবাকান নিজে চালায়। তার পাশে বসে আমার পরিচারিকা। দু’একদিন পরপরই যাচ্ছি হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (আইয়ুব সুলতান)(রাঃ)-এর মাজার সংলগ্ন মসজিদে। মসজিদে নামায পড়ি ও দোয়া করি। ওখানে অনেকটা সময় কাটিয়ে ফিরে আসি। জান, সুলতানের মাজারের সামনে যখন দাঁড়াই, তখন চোখ ফেটে পানি আসে। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি আল্লাহর পথে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে শত শত মাইল পথ পেরিয়ে এই সুদূর ইউরোপের রণক্ষেত্রে এসেছিলেন! নিজেকে তখন ছোট মনে হয় এবং হৃদয় থেকে তার জন্যে দোয়া বেরিয়ে আসে। এবার তুমি সময় নিয়ে এখানে এস। তোমাকে নিয়ে আমি তার মসজিদ ও মাজার জিয়ারতে যাব। তাঁদের সাথে তোমার মিল আছে। তোমাকে পাশে নিয়ে দোয়া করলে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অনেক বেশি পাব।’
‘তাঁদের সাথে আমাদের তুলনা করতে পার এই অর্থে যে, তাঁরা সূর্য আর আমরা পৃথিবী। আমাদের কোন আলো নেই, আমরা তাঁদের আলোতে আলোকিত হই। ঠিক জোসেফাইন, তোমাদের নিয়ে তাঁর কবর জিয়ারতে যাব। আমি ইস্তাম্বুল এসে সেদিনই তাঁর কবর জিয়ারতে গিয়েছিলাম। মন ভরে থাকতে পারিনি। তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হয়েছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাঁদের সাথে তোমার তুলনা করেছিলাম এই অর্থে যে, দেশ, বাড়ি-ঘর ছেড়ে তাঁরা যেমন আল্লাহর জন্যে মানুষের কল্যাণে ঘুরে বেড়িয়েছেন নানা দিকে, নানা দেশে, তুমিও তো তেমনি করছ।’
বলে একটু থেমেই জোসেফাইন আবার বলে উঠল, ‘আজ নয়, তুমি দু’একদিন পরে এস। রেস্ট নিলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। আহমদ আবদুল্লাহ কেমন মেজাজে আছে ওখানে? জ্বালায় না তো তোমাকে বেশি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘মহাখুশি সে! আমি তাকে পাই-ই না বেশি। সেক্রেটারির সাথে মহা থাতির হয়েছে। তার সাথে আর পরিচারিকার সাথে সে ঘুরে বেড়ায়। আর যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, সামনের ব্যালকনি বারান্দা তার প্রিয়। সে অবাক-বিস্ময়ে সারাক্ষণ চেয়ে থাকে বসফরাস, মর্মর সাগরের আদিগন্ত পানির দিকে। এ তার নতুন অভিজ্ঞতা।’ বলল জোসেফাইন।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। দরজায় নক হলো এ সময়। সংগে সংগে আহমদ মুসা প্রসংগ পাল্টিয়ে বলল, ‘জোসেফাইন, সম্ভবত কোন মেহমান দরজায় নক করছে। তোমার সাথে….।’
আহমদ মুসার কথায় বাঁধা দিয়ে ডোনা জোসেফাইন বলল, ‘আমি টেলিফোন রাখছি। পরে কথা বলব তোমার সাথে। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ধন্যবাদ। ওয়া আলাইকুমুস সালাম।’
বলে আহমদ মুসা মোবাইল অফ করে দিল। দরজার মাথার ওপরে সেট করা সিসিটিভি স্ক্রীনে আগেই দেখতে পেয়েছে দরজার বাইরে জেনারেল তাহির তারিক এসে দাঁড়িয়েছেন।
মোবাইল রেখে দিয়ে আহমদ মুসা রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপে দরজা আনলক করে দিল। সংগে সংগে দরজা পাশের দিকে সরে গিয়ে দেয়ালে ঢুকে গেল।
দরজায় দাঁড়িয়ে জেনারেল তাহির তারিক।
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে বলল, ‘আসুন জেনারেল তাহির তারিক।’
আহমদ মুসা উঠে বসেছে।
জেনারেল ঘরে ঢুকে ‘কেমন আছেন মিঃ আহমদ মুসা’ বলে সোজা আহমদ মুসার কাছে এল। মাথার ব্যান্ডেজের এরিয়া দেখে তার বাহু ও কাঁধে হাত দিয়ে ব্যান্ডেজের পজিশনটা দেখে নিয়ে বলল, ‘আল্লাহ রক্ষা করেছেন। আঘাত মাথার খুলিতে না লেগে চামড়া কেটে পিছলে নেমে গেছে। কাঁধে তো যন্ত্রণা নেই, তাই না?’
‘না জেনারেল তাহির তারিক, কাঁধে কোন যন্ত্রণা নেই, কাঁধে কোন ফ্র্যাকচার হয়নি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। আল্লাহর হাজার শোকর। আপনি ঠিক সময়ে নিজেকে সরিয়ে নিতে পেরেছিলেন।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
খাটের পাশেই সোফায় বসল জেনারেল তাহির তারিক।
বসেই বলে উঠল, ‘রাতেই আমি আসতে চেয়েছিলাম। আপনি নিষেধ করলেন। কিন্তু সারারাত আমি উদ্বেগে ঘুমাতে পারিনি। আঘাত কেমন, আপনি এত তাড়াতাড়ি টার্গেট হয়ে গেলেন, শত্রু সরাসরি আক্রমণ করতেও সাহস পেল ইত্যাদি চিন্তা সারারাত আমাকে কষ্ট দিয়েছে।’
‘কিন্তু কালকের ঘটনা আমাকে আনন্দিত করেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আনন্দ পেয়েছেন? কিভাবে?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘ইস্তাম্বুলে আসার পর বলা যায় অন্ধকারেই ঘুরছিলাম। কিন্তু কার্যকারণ সামনে রেখে সামনে এগোতে চেষ্টা করছিলাম। কালকে প্রথমবারের মতো শত্রুদের আমি সামনে পেলাম। এছাড়া আমাদের পাঁচ গোয়েন্দা যে বাড়িতে ঢোকার পর নিখোঁজ হয়ে গেছেন, সেটাও আমি গতকালের অভিযানে জানতে পেরেছি। সম্ভবত এ জানার ব্যাপারটা ঠেকানোর জন্যেই ওরা আমাকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছে তাৎক্ষণিকভাবেই। শত্রুদের পরিচয়ের একাংশও আমি জানতে পেরেছি বলে মনে হচ্ছে।’ আহমদ মুসা বলল।
জেনারেল তাহির তারিকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। ধন্যবাদ আহমদ মুসা। সত্যি আল্লাহর বিশেষ সাহায্য আপনার সাথে রয়েছে।’
‘কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না, কালকে আমি পুলিশ আর্কাইভসে গিয়েছিলাম এবং কি জন্যে গিয়েছিলাম তা শত্রুর কাছে প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল। তারা আর্কাইভসের বাইরে আমার বের হওয়ার জন্যে ওঁৎপেতে ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল জেনারেল তাহির তারিক। কয়েক মুহূর্ত আহমদ মুসার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আপনি পুলিশ আর্কাইভসে যাচ্ছেন, এটা আমদের এখানকার কেউ জানত?’
‘হ্যাঁ, আমি এ ব্যাপারে আলাপ করেছিলাম ডঃ শেখ বাজের সাথে। তিনিই শুধু জানতেন।’
মুখটা বিমর্ষ হয়ে গেল জেনারেল তাহির তারিকের। একটুক্ষণ ভেবে একটা ঢোক গিলে বলল, ‘কিন্তু ডঃ শেখ বাজ তো খুবই পরীক্ষিত মানুষ। তার বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো কিছুই আমরা পাইনি অতীতে। তাহলে সে কি কাউকে বাই দি বাই বলে ফেলেছিল?’ অনেকটা স্বগত কণ্ঠের মতো বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘আমি তার সাথে রাত্রেই কথা বলেছি জেনারেল। ডঃ শেখ বাজ বিষয়টি আর কাউকেই জানাননি। তিনি বলেছেন এবং আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি ও অফিস রেকর্ডেও পেয়েছি, ডঃ শেখ বাজ গতকাল বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অফিসে ছিলেন। সন্ধ্যা ছয়টার পর তিনি হাঁটাহাঁটি করার জন্যে বাইরে গিয়েছিলেন। বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অফিসে থাকাকালে তিনি বাইরে কোন টেলিফোনও করেননি। অফিসের মোবাইল মনিটরিং রেকর্ড থেকে এ বিষয়টা নিশ্চিত হওয়া গেছে। আমি মনে করি, কালকের ঘটনায় তিনি সন্দেহের ঊর্ধ্বে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে কিভাবে শত্রুর কাছে কথাটা পৌঁছতে পারে?’
‘সেটাই ভাবনার বিষয়। শত্রুর কাছে আমাদের গতিবিধি পৌঁছার ঘটনা ও আমার সন্দেহ যদি সত্য হয়, তাহলে অতীতে আমাদের দুই তদন্ত টিম কিভাবে ব্যর্থ ও শেষ হয়ে যায় তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
‘এখন আমাদের কি করণীয় বলুন।’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জেনারেল তাহির তারিক বলল।
‘আপাতত কিছুই করার নেই। আমাদের নিরাপত্তা-ব্যবস্থার মধ্যে কোথাও ছিদ্র আছে কিনা খুঁজে বের করতে হবে। আমি ডঃ শেখ বাজকেও বলেছি, বিষয়টা যে আমাদের নজরে এসেছে, কোন দ্বিতীয় জন যেন আর জানতে না পারে।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। একটু ভেবে নিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘আমি শুনেছি, এখানে যারা থাকেন তাদের স্ত্রীরা মাঝে মাঝে এখানে আসেন। হয়তো এসে স্বামীকে বাড়িতে বা প্রোগ্রামে নিয়ে যান কিংবা তারা এদিকে বেড়াতে এসে স্বামীর সাথে দেখা করে যান। শুনেই আমার মনে হয়েছে, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটা একটা লিকেজ হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল তাহির তারিকের চোখে উদ্বেগ ফুটে উঠল। বলল, ‘জ্বি, এটা ঘটে। দু’দশ মিনিটের জন্যে ওরা আসেন, আমরা এটাকে খুব ক্ষতিকর মনে করিনি। ব্যাপারটা স্পর্শকাতর। শুরু থেকেই এটা না হলে ভালো হতো। কিন্তু রেওয়াজ চালু হবার পর বিনা কারণে এটা বন্ধ করাও কষ্টকর ছিল। আপনার পরামর্শ বলুন, প্লীজ। কোন সৌজন্যবোধ নয়, নিরাপত্তাই আমাদের কাছে বড়।’
‘আপাতত কোন পরিবর্তন দরকার নেই। সব কিছু যেমন চলছিল, তেমন চলুক। শুধু একটা অনুরোধ করব আপনার কাছে। আপনি দয়া করে এই ইনস্টিটিউটে যারা থাকেন, তাদের স্ত্রীদের ফটো ও তাদের জন্ম পরিচয় থেকে তাদের কমপ্লিট বায়োডাটা আমাকে দেবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। আমি তার ব্যবস্থা করছি। ফটো ও বায়োডাটা সবার আছে। আমরা নিয়োগ দেয়ার সময়ই সবার স্ত্রীদের বায়োডাটাও নিয়েছি। কিন্তু আপনি যেমনটা চাচ্ছেন, তেমনটা কমপ্লিট নাও হতে পারে। যদি না হয়, তাহলে কমপ্লিট করেই আপনাকে দেব।’ জেনারেল তাহির তারিক বলল।
‘ধন্যবাদ জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আল্লাহর হাজার শুকরিয়া। আপনার চিন্তা ও কাজ সঠিক পথেই এগোচ্ছে মিঃ খালেদ খাকান। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।’ জেনারেল তাহির তারিক বলল। তার কণ্ঠে আবেগ।
ডোরবেল থেকে সংকেত এল কেউ বাইরে এসেছে। দরজার ওপরের সিসিটিভির স্ক্রীনে দেখা গেল, ডঃ শেখ বাজ দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন।
আহমদ মুসা রিমোটের সুইচ টিপে ডোরলক খুলে দিল।
আল-আলা সিনাগগের বিশাল প্রেয়ার হল। সাড়ে তিনশ’-চারশ’ লোক বসতে পারার মতো বিশাল হল ঘরটি।
অন্ধকার হল ঘরটি। শুধু প্রেয়ার পরিচালনার মঞ্চে অনেক উঁচু ছাদে একটা হলুদ বাল্ব জ্বলছে। অনুরূপ আর একটি বাল্ব জ্বলছে হলের মাঝ বরাবর ছাদে। এই দুই আলো ঘরের অন্ধকারকে ভৌতিক করে তুলেছে।
হলের চেয়ারের প্রথম রো’তে বসে আছে সাতজন মানুষ। আর প্রেয়ার হলের নিচে পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে চারজন লোক আসামীর এজলাসে দাঁড়ানো মানুষের মতো অ্যাটেনশন অবস্থায়।
চেয়ারের প্রথম রো থেকে পাঁচ-ছয় গজ সামনে থেকে শুরু হয়েছে প্রেয়ার মঞ্চ। হলের ফ্লোর থেকে প্রেয়ার মঞ্চটি এক ফুটের মতো উঁচু।
প্রেয়ার মঞ্চটি নাটকের মঞ্চের মতোই বেশ বড়। প্রেয়ার মঞ্চের পাথরের ফ্লোরটি শূন্য। কার্পেট বিছানো নেই কিংবা চেয়ারও নেই।
চেয়ারে বসা সারিবদ্ধ সাতজনের মাঝের ব্যক্তি তার হাতের রেডিয়াম ডায়ালের দিকে তাকাল। তারপর পাশের ব্যক্তির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘গ্র্যান্ড রাব্বি স্যার তো কোনদিন এক মিনিটও লেট করেন না! এখন তো বারটা চার মিনিট!’
তার কথা শেষ না হতেই মঞ্চের ঠিক মাঝখানের একটা বর্গাকৃতি অংশ কয়েক ইঞ্চি নেমে গিয়ে পাশে সরে গেল। সংগে সংগেই ফ্লোরে উঠে এল একটি চেয়ার। চেয়ারটা আলোকিত। চেয়ারে বসে গ্র্যান্ড রাব্বি আইজ্যাক বেগিন। মাথায় তার কালার টুপি, গায়ে কালো পোশাক। মুখটি খোলা।
ফ্লোরে চেয়ারটি স্থির হয়ে দাঁড়াতেই ঢোলের গমগমে ধ্বনির মতো আইজ্যাক বেগিনের কণ্ঠ বলল, ‘ঠিক বলেছেন সিনাগগ প্রধান ও আমাদের ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট’ (থ্রি জিরো) ইস্তাম্বুল শাখার প্রধান ডেভিড ইয়াহুদ। আমার চার মিনিট লেট হয়েছে। চারজন অপদার্থ লোক আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে। এই চার মিনিট তারই সিম্বল। আর হলের অন্ধকারটা ঐ চারজনের প্রতি ঘৃণার প্রতীক, যারা মিশন পরিত্যাগ করে জান বাঁচানোর জন্যে ফিরে এসেছে।’
বলে একটু থামল আইজ্যাক বেগিন।
আইজ্যাক বেগিন ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট’ বা ‘থ্রি জিরো’ সংগঠনের ইউরোপ চ্যাপ্টারের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।
কয়েক মুহূর্ত পর আইজ্যাক বেগিনের কণ্ঠ আবার ধ্বনিত হলো প্রেয়ার মঞ্চের পাশে দাঁড়ানো চারজনের উদ্দেশ্যে, ‘তোমরা জান, ডেভিড ইয়াহুদ তোমাদের কি জন্যে এনেছেন এখানে?’
চারজন হাতজোড় করে বলল, ‘বিচারের জন্যে।’
‘ধন্যবাদ। বল, তোমাদের পক্ষ থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে কি বলার আছে।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
চারজনের একজন বলল, ‘আমাদের টার্গেট খালেদ খাকান একা ছিলেন, অপ্রস্তুত ছিলেন। আমাদের মিশন সফল হওয়া সম্পর্কে ওভার সিওর ছিলাম। আমরা আক্রমণ করি। তাকে কাবু করেও ফেলা হয়। কিন্তু অবিশ্বাস্য এক দ্রুততার সাথে সে পাল্টা আক্রমণে আসে এবং আমরাই তার শিকারে পরিণত হই। এই আকস্মিকতায় এবং পাল্টা আক্রমণের কোনই পথ না দেখে এক উপায়হীন বিমূঢ অবস্থায় আমরা পালিয়ে আসি।’
‘আমাদের অভিধানে ‘পালানো’ নামক কোন শব্দ নেই। পালানো মানে খরচ হয়ে যাওয়া।’
আইজ্যাক বেগিনের কথা শেষ হবার সাথে সাথেই তার হাতের রিভলভার চারবার গর্জন করে উঠল।
প্রেয়ার মঞ্চের পাশে দাঁড়ানো চারটি দেহ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিঃশব্দে মেঝের ওপর পড়ে গেল।
সংগে সংগে হলে আলো জ্বলে উঠল। সেই সাথে প্রেয়ার মঞ্চে আইজ্যাক বেগিনের সামনে একটি টেবিল এবং টেবিলের তিন দিক ঘিরে সাতটি চেয়ার মেঝের নিচ থেকে উঠে এল।
ফ্লোরের চেয়ারে বসা সাতজন নিঃশব্দে উঠে এসে আইজ্যাক বেগিনের সামনের সাতটি চেয়ারে বসল।
শিরদাঁড়া খাঁড়া করে অ্যাটেনশন অবস্থায় বসেছিল আইজ্যাক বেগিন।
ওরা সাতজনও সেভাবেই অ্যাটেনশন হয়ে বসল।
‘মিঃ ডেভিড ইয়াহুদ, টেলিফোনে আপনার কিছু কথা শুনেছি। আপনিই শুরু করুন, ঘটনা সম্পর্কে আপনার কথা বলুন।’ প্রথমেই কথা বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘আমরা নিশ্চিত জেনেশুনেই আমাদের অপেক্ষাকৃত চৌকশ চারজনকে খালেদ খাকানকে হত্যা করার জন্যে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সে এত বড় ফাইটার তা আমরা বুঝতে পারিনি।’
‘আপনি ডঃ শেখ বাজের সাথে তার কথাবার্তার মনিটরিংটা কি ভালো করে শুনেছেন? মনে হয় শোনেননি। শুনলে বুঝতেন, এর আগে যাদের আমরা ‘ডিল’ করেছি, তাদের থেকে খালেদ খাকান কত আলাদা! উকিলদের মতো প্রশ্ন, গোয়েন্দাদের মতো বিশ্লেষণ, ডাক্তারদের মতো তার ডায়াগনোসিস থেকে আপনার বোঝার কথা ছিল, সে সাধারণ কেউ নয়।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘ঠিক স্যার, আমরা এতটা গভীরে যাইনি। আমরা নিশ্চিত ছিলাম, আমাদের বাছাই করা চারজন যে কোন একজন মানুষকে কাবু করার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের হিসেবে ভুল ছিল। আমাদের আন্দাজের বাইরেও শক্তিমান ও কুশলী মানুষ আছে।’ ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘কে এই লোক? কোত্থেকে একে আমদানি করল? এসেছে রেসিডেন্ট ডাইরেক্টর হিসেবে, কিন্তু কাজ শুরু করেছে গোয়েন্দার মতো। একে কিন্তু সময় দেয়া যাবে না। আমাদের গ্রাসে পড়লে তার বাঁচার আর অধিকার নেই। কৌশল এবং শক্তি দু’টিরই ব্যবস্থা কর। আগের মতো কৌশলে যদি কাজ হয়, তাহলে শক্তি ব্যবহারে না যাওয়াই ভালো।’
‘যথা আজ্ঞা এক্সিলেন্সি। সে আর বেঁচে নেই ধরে নিন। জীবনের খাবারটা দু’একদিন খেয়ে নিক।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘তাই হোক ডেভিড। এখন আসল কথায় আসা যাক। আমাদের মূল কাজটা কতদূর এগোলো? বিজ্ঞানী ইঞ্জিনিয়ার সহযোগিতা করেনি, বরং বাঁধার সৃষ্টি করেছিল। তাকে সরানো হয়েছে। পরে আমাদের দু’টি অপশন ছিল। এক. প্রধান বিজ্ঞানীর সাথে যোগাযোগ এবং তা সফল না হলে বিজ্ঞানীকেই কিডন্যাপ করা, দুই. এই অপশন কাজে না এলে গোটা এই পাহাড়কেই ধূলায় পরিণত করা, যার সাথে ধূলা হয়ে যাবে সকল বিজ্ঞানী, সমাধি হয়ে যাবে তাদের ভয়ংকর আবিষ্কার ‘সোর্ড’-এর। প্রথম অপশনটা কতদূর এগোলো?’
ডেভিড ইয়াহুদ তাকালো ‘থ্রি জিরো’-এর ইস্তাম্বুল প্রজেক্টের অপারেশন চীফ ইরগুন ইবানের দিকে। বলল, ‘অবস্থার বিবরণটা তুমিই দাও।’
‘ধন্যবাদ, স্যার’, বলে শুরু করল ইরগুন ইবান, ‘গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ও ‘সোর্ড’-এর জনক বিজ্ঞানী ডঃ আমির আবদুল্লাহ আন্দালুসীর সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা এখনও সফল হয়নি। যোগাযোগের জন্যে ইনস্টিটিউটে প্রবেশ সম্ভব নয়। নিশ্ছিদ্র একটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাইরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে। এরপরও গোপনে অথবা গায়ের জোরে গবেষণাগারে ঢোকা যায়, কিন্তু আমরা যে যোগাযোগ চাই, তা এর দ্বারা হবে না। এজন্যে আমরা বিজ্ঞানীর ইস্তাম্বুলস্থ বাড়ির সন্ধান করছি। তিনি সপ্তাহের কোন এক সময় দুর্গ প্রাঙ্গণ থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে তার বাড়ি যান। বাড়িতে একদিন কাটিয়ে আবার ফিরে আসেন। আমরা তার বাড়ির ঠিকানা জানার অন্যান্য চেষ্টার সাথে হেলিকপ্টারের ফ্লাইটটাকে লোকেট করার চেষ্টা করছি। তার বাড়ির সন্ধান পেলে আমরা সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ পাব। তিনি লোভ এবং ভয়েও রাজি না হলে আমরা তার পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে কিডন্যাপ করে তার ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করবো। সেটাও কাজ না করলে খোদ তাকে কিডন্যাপ করা হবে। এই গোটা অপারেশনের জন্যে আমাদের সময় প্রয়োজন। সময় বেশি লাগলেও এটাই নিশ্চিত পথ। এসব কিছুতে কাজ না হলে গবেষণাগার ধ্বংস করার অপশন তো আমাদের রয়েছেই।’
থামল ইরগুন ইবান।
সংগে সংগেই আইজ্যাক বেগিন বলে উঠল, ‘বিজ্ঞানীকে কিডন্যাপ করে খুব লাভ হবার সম্ভাবনা নেই। গবেষণা ধ্বংস করে আমরা তাদের ক্ষতি করতে পারবো, আমরাও ক্ষতি থেকে রক্ষা পাব, কিন্তু ‘সোর্ড’কে হাত করে যে লাভ করতে চাই তা হবে না। আমরা চাই ক্ষতি থেকে বাঁচতে, তার সাথে চাই ষোল আনা লাভ। সুতরাং যে কোন মূল্যে, যে কোনভাবে বিজ্ঞানী আন্দালুসীর সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
‘এর জন্যে সর্বাত্মকভাবে প্রচেষ্টা চালানো হবে। অন্যান্য বিজ্ঞানীদের ব্যাপারেও একই প্রচেষ্টা আমাদের আছে। এসব থেকেও কোন রেজাল্ট আমাদের আসতে পারে। সব চেষ্টার পরই গবেষণাগার ধ্বংস।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘আর এই প্রচেষ্টা সফল করার জন্যে প্রয়োজন খালেদ খাকানকে এই মুহূর্তে সীন থেকে সরানো। এটা এই মুহূর্তের টপ প্রায়োরিটি।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
বেগিন কথা শেষ করতেই ডেভিড ইয়াহুদের টেলিফোন বেজে উঠল।
‘এক্সকিউজ মি’ বলে টেলিফোন ধরল ডেভিড ইয়াহুদ।
ওপারের কণ্ঠস্বর শুনেই বলল, ‘বল স্মার্থা, কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছু?’
স্মার্থা ‘থ্রি জিরো’ সংগঠনের ইস্তাম্বুল শাখার একজন গোয়েন্দা কর্মী। পেশায় সে একজন শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী।
‘জ্বি স্যার। খালেদ খাকান ঘটনার পর কোথায় প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়, তার সন্ধান পেয়েছি। আমাদের সিনাগগের ঠিক বিপরীত দিকে রাস্তার ওপাশে ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাতের বাড়ি। তারা দু’জনেই পার্ক থেকে খালেদ খাকানকে বাড়িতে এনে চিকিৎসা করেন। খালেদ খাকান দুই ঘন্টা তাদের বাসায় থাকেন।’ বলল স্মার্থা।
‘ওয়ান্ডারফুল স্মার্থা। ওরা যদিও আমাদের সিনাগগের সদস্য নয়, কিন্তু একটা ধার্মিক ইহুদি পরিবার ওটা। ওরা আমাদের সাহায্য করবে। খালেদ খাকানের সাথে তাদের পরিচয়ের সুযোগ আমাদের ব্যবহার করতে হবে।’ ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘এটা সম্ভব স্যার। আমি ওদের সাথে আলোচনা করে বুঝেছি, খালেদ খাকানের সাথে ওদের একটা হৃদ্যতার সৃষ্টি হয়েছে। তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ রাখবে বলে কথা হয়েছে। খালেদ খাকান পরে টেলিফোনে তাদের সাথে যোগাযোগও করেছে।’ বলল স্মার্থা।
‘গুড। ধন্যবাদ স্মার্থা। আর কিছু কথা?’ ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘না স্যার, ধন্যবাদ।’ বলল স্মার্থা।
‘ওকে বাই।’ বলে টেলিফোন রেখে দিল ডেভিড ইয়াহুদ।
আইজ্যাক বেগিনসহ সবাই ডেভিড ইয়াহুদের কথা শুনছিল।
ডেভিড ইয়াহুদ টেলিফোন রাখতেই আইজ্যাক বেগিন বলল, ‘কার সাথে কথা বললেন? খুব খুশি মনে হল!’
‘খবর কিছুটা খুশিরই বটে। আমাদের এক গোয়েন্দা কর্মী জানাল, সেদিন ঘটনার পর মারাত্মক আহত খালেদ খাকান যেখানে যাদের কাছে চিকিৎসা নিয়েছে, তার সন্ধান পাওয়া গেছে। আমাদের এই সিনাগগের অপজিটে আমাদের কমিউনিটিরই একজন ডাক্তার দম্পতি থাকেন। তারাই আহত খালেদ খাকানকে পার্ক থেকে বাড়িতে নিয়ে চিকিৎসা করেন।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আইজ্যাক বেগিনের। বলল, ‘অবশ্যই খুশির খবর। নিশ্চয়ই ডাক্তার দম্পতির সাথে খালেদ খাকানের অন্তত কৃতজ্ঞতার একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হবার কথা।’
‘অবশ্যই তা হয়েছে। আমাদের কর্মী স্মার্থা বলল, তাদের মধ্যে একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। খালেদ খাকান তাদের সাথে যোগাযোগও রাখছে।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘জিহোভা আমাদের প্রতি সদয় আছেন। কাজ এখন অনেক সহজ হয়ে গেল। ডাক্তার দম্পতির বন্ধু সেজে খালেদ খাকানের কাছে যাবার সুযোগ নেবে অথবা ডাক্তার দম্পতিকে দিয়ে দাওয়াত করিয়ে খালেদ খাকানকে তাদের বাসায় নিয়ে এস। তারপর স্বাভাবিক পথে তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যে আমাদের বহু অস্ত্রের যে কোনটি তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করো।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘আমি ভাবছি ডাক্তার দম্পতি সরাসরি আমাদের এ ধরনের সহযোগিতা করবেন কিনা। তারা আমাদের সিনাগগের সদদ্য নয়। তারা সহায়তা করলে কাজ সহজ হবে।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘ধরে নাও, তারা সহযোগিতা করবেন না, কিন্তু সহযোগিতা আদায় করতে হবে। অনুরোধ, লোভ, ভয় সব অস্ত্রই ব্যবহার করবে। অতি শীঘ্র কাজটা হোক, আমি চাই মিঃ ডেভিড ইয়াহুদ।’ আইজ্যাক বেগিন বলল। তার কণ্ঠ শক্ত।
‘তাই হবে জনাব।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ। বিনীত তার কণ্ঠ।
উপস্থিত অন্য সকলের দিকে তাকিয়ে আইজ্যাক বেগিন বলল, ‘ইস্তাম্বুলের দায়িত্বশীল তোমাদের সকলকে এখানে ডেকেছি এই কারণে যে, তোমরাও দায়িত্ব অবহেলাকারীদের দেখ এবং সবকিছু নিজ কানে শোন। এখন সবাইকে তোমাদের জানাতে হবে, কোন কারণেই কোন ব্যর্থতা আমরা সহ্য করবো না। আমাদের সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে আমাদের সমমনা বহু রাষ্ট্রের যুদ্ধ-শক্তির ভবিষ্যৎ। আমরা ব্যর্থ হলে তাদের আক্রমণ-শক্তি জিরো হয়ে যাবে। এই কারণে তারা আমাদের ডলারের পাহাড় দিয়েছে। আমাদের ব্যর্থ হওয়া যাবে না।’ বলল আইজ্যাক বেগিন। তার কথাগুলো ছুরির মতো ধারাল। কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল আইজ্যাক বেগিন। তার সংগে সংগেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্চ থেকে নেমে গেল।
পর মুহূর্তেই চেয়ার-টেবিল অদৃশ্য হয়ে গেল মঞ্চ থেকে।
পাথুরে মেঝের শূন্য রূপ আবার ফিরে এল।

গোল্ডেন হর্নের দক্ষিণ তীরে এর দ্বিতীয় ব্রীজের একটু পশ্চিমে বিশাল জায়গা জুড়ে তুর্কি জনগণের অতি প্রিয় ‘আইউপ’ (আইয়ুব) সুলতান কমপ্লেক্স। বিশাল মসজিদ, প্রশস্ত-সুন্দর কবরগাহ, মুসাফিরদের জন্যে সরাইখানা এবং বৃহৎ একটি মার্কেট নিয়ে এই কমপ্লেক্স।
কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে ‘আইউপ সুলতান মসজিদ’-এর সুউচ্চ মিনার এবং আইউপ সুলতান কবরগাহের গম্বুজ নজরে পড়তেই একটা আবেগ এসে আহমদ মুসাকে ঘিরে ধরল। তুর্কিদের অতি প্রিয় ‘আইউপ সুলতান’ আসলে ইতিহাসের হযরত আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ)। রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-এর এক অতি প্রিয় সাহাবা ছিলেন তিনি। তিনি সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি যার বাড়িতে আল্লাহর নবী মদীনায় প্রথম প্রবেশের পর বসবাস করেছেন। এই সৌভাগ্য লাভের জন্যে মদীনার সবাই লালায়িত ছিল। কিন্তু উটে সওয়ার আল্লাহর রাসূল(সাঃ) বলেছিলেন, তার উট নিজ ইচ্ছায় যার বাড়িতে গিয়ে বসে পড়বে, তিনি সে বাড়িরই আতিথ্য গ্রহণ করবেন। আল্লাহর রাসূলের উট স্বেচ্ছায় তার বাড়িতে বসাতে আবু আইয়ুব আনসারী এবং তার পরিবার তাদের হৃদয়ের সব আবেগ উজাড় করে পরম অতিথিকে গ্রহণ করেছিলেন। রাসূল(সাঃ)-এর সাহাবী পরম সৌভাগ্যবান মদীনার সেই আবু আইয়ুব আনসারী আইউব সুলতান নাম নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন ইস্তাম্বুল নগরীর এখানে। তুর্কিরা বলে, যারা দুনিয়ার সুলতান(বাদশাহ), তাদের নামের আগে সুলতান বসে। কিন্তু আবু আইয়ুব আনসারী তাদের হৃদয়ের সুলতান বলে তার নামের পরে তারা ‘সুলতান’ বসিয়েছে।
আহমদ মুসা আহমদ আবদুল্লাহকে কোলে নিয়ে স্ত্রী জোসেফাইনের হাত ধরে এগোচ্ছিল আইউপ সুলতান মসজিদের দিকে।
জোসেফাইনের হাতে একটা চাপ দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘হাজারো মসজিদের মিনার শোভিত ইস্তাম্বুলের দৃশ্য চোখে পড়লে, ইস্তাম্বুলে এলে কোন কথা তোমার প্রথম মনে পড়ে বল তো?’
‘এই সেই ইস্তাম্বুল যা একদিন রোমানদের রাজধানী ছিল, যেখানে বসে তারা এশিয়া শাসন করেছে, এই সেই ইস্তাম্বুল যেখানে বসে মুসলমানরা ইউরোপ শাসন করেছে এবং তিন হাজার বছরের এই সেই ইস্তাম্বুল যা এখন মুসলমানদের সাথে আছে, যদিও মুসলমানরা তাদের বহু গৌরবের বহু কিছু হারিয়েছে।’ বলল জোসেফাইন। আবেগজড়িত তার কণ্ঠ।
‘তোমার কি মনে পড়ে, এই কথাই না?’ কথা শেষ করেই আবার প্রশ্ন করল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসার মুখ গম্ভীর। আবেগে তা ভারি হয়ে উঠেছে। বলল, ‘না জোসেফাইন, আমি অন্য কথা ভাবি। আমি ভাবি আবু আইয়ুব আনসারীর কথা। ইস্তাম্বুলের সবকিছু ছাপিয়ে তার নামটাই আমি সবার ওপরে জ্বলজ্বল করে উঠতে দেখি। মুসলিম-ইস্তাম্বুল নগরীর জনক বিজয়ী সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ রানা। কিন্তু এ নগরীর প্রকৃত জনক আবু আইয়ুব আনসারীই। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ ১৪৫৪ খৃস্টাব্দে ইস্তাম্বুল জয় করেন। কিন্তু সাড়ে সাতশ’ বছর আগে বিজয়ের বীজ বপন করে যান আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ)। ইস্তাম্বুল বিজয়ের সাড়ে সাতশ’ বছর আগে তার শেষ ইচ্ছায় এ নগরীতে প্রবেশের প্রধান সড়কের ওপর অন্ধকারে তাকে দাফন করা হয়। তিনি বলেছিলেন, তার কবরের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে মুসলিম বাহিনী ইস্তাম্বুল জয় করবে। তার এই ইচ্ছার সাড়ে সাতশ’ বছর পর এটাই হয়েছিল।’
আহমদ মুসার কথা শেষ না হতেই দাঁড়িয়ে গেল ডোনা জোসেফাইন। আহমদ মুসার হাত টেনে ধরল। ডোনা জোসেফাইনের চোখে-মুখে রাজ্যের কৌতুহল। দাঁড়িয়ে গেল আহমদ মুসাও।
জোসেফাইন বলল, ‘তুমি যে বিস্ময়কর ঘটনার কথা বলছ, তাতো আমি জানি না। কোথাও পড়িনি। আমি হযরত আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ)-এর জীবনী পড়েছি। তাতে তিনি যুদ্ধে গিয়ে ইস্তাম্বুলে ইন্তেকাল করেন, এর বেশি কিছু লেখা নেই। বল তুমি। মহান সাহাবীর কাহিনীটা আমি শুনতে চাই, তার পবিত্র কবরগাহের সামনে দাঁড়িয়েই শুনতে চাই।’ থামল জোসেফাইন। তার কণ্ঠ আবেগাপ্লুত।
‘বলছি। বড় কোন কাহিনী নয় জোসেফাইন। সপ্তম শতাব্দীর তখন শেষ। খলিফা মুয়াবিয়া(রাঃ)-এর শাসনকাল। তার ছেলে ইয়াজিদ সেনাপতি। রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তাম্বুল তখন ‘কনস্ট্যান্টিনোপল’। বিজয়ের জন্যে ইয়াজিদের নেতৃত্বে এক সৈন্যবাহিনী পাঠানো হয়। সে বাহিনীতে শামিল ছিলেন ছিয়াশি বছর বয়স্ক আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ)। দীর্ঘ এক বছর অবরোধ করে রেখেও ইস্তাম্বুল জয়ে ব্যর্থ হয় মুসলিম বাহিনী। এ সময় মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন বৃদ্ধ আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ)। মৃত্যু আসন্ন হয়ে উঠে তার। শুনে বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ্ ইয়াজিদ ছুটে গেলেন বুজুর্গ সাহাবী আবু আইয়ুব আনসারীর শয্যাপাশে। পরম শ্রদ্ধাভরে তার কাছে তার শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলেন। বললেন, বলুন চাচাজান, আপনি কি চান? খলিফার সাথে আলাপ করে ইনশাআল্লাহ তার ব্যবস্থা করব। আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ) বললেন, বলে লাভ কি, যা চাই তা দিতে পারবে না। ইয়াজিদ বুজুর্গ সাহাবীর শেষ ইচ্ছা জানার জন্যে নাছোড়বান্দা। বললেন, বলুন মেহেরবানী করে, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব। মুমূর্ষু মুজাহিদ বুজুর্গ সাহাবী আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, আমি চাই আমার মৃত্যুর পর আগামীকাল কনস্ট্যান্টিনোপলের প্রবেশ পথের ওপর আমাকে কবর দিয়ে আসবে। শেষ ইচ্ছা শুনে হতবাক ইয়াজিদ জানতে চাইলেন, তার এই শেষ ইচ্ছার কারণ কি! আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ) জানালেন, কনস্ট্যান্টিনোপলের বিজয় একদিন আসবেই। আমি চাই, সে বিজয়ের দিনে বিজয়ী মুসলিম সৈনিকরা যেন আমার কবরের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে রোমান রাজধানীতে প্রবেশ করে। তার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ রোমক সেনাপতিকে অনুরোধ করে রোমক সৈন্যের ব্যুহের ওপারে ইস্তাম্বুলে প্রবেশকারী সড়কের ওপর তাকে দাফন করেন। এই ঘটনার সাড়ে সাতশ’ বছর পর এই সড়কের ওপর দিয়েই ওসমানীয় খলিফা দ্বিতীয় মুহাম্মদের বিজয়ী বাহিনী ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করেছিল।’ থামল আহমদ মুসা।
জোসেফাইন আবেগ-উচ্ছ্বসিত চোখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা থামলে জোসেফাইনের চোখ ধীরে ধীরে সরে গেল আইউপ সুলতান মসজিদের ওপর, সেখান থেকে ঘুরে গিয়ে নিবদ্ধ হলো আইউপ সুলতান কবরগাহের ওপর। তারপর দু’চোখ তার আবার ফিরে এসে নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার ওপর। বলল, ‘অপরূপ কাহিনী মহান বুজুর্গ মুজাহিদ সাহাবীকে জীবন্ত করে তুলেছে। যেন দেখতে পাচ্ছি দু’পক্ষের সারি সারি সৈন্য, সেই সড়ক, সেই কবরে মহান মুজাহিদ সাহাবীকেও। তুমি সত্যিই বলেছ, ইস্তাম্বুলের সব দৃশ্য ছাপিয়ে এই দৃশ্যই বড় হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে, ১৪৫৪ খৃস্টাব্দে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের বিজয়ী বাহিনী ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করছে সে মহান মুজাহিদের ডাকে, পরিচালনায়। তুর্কিরা ঠিক নাম দিয়েছে তাকে, ‘আইউপ সুলতান’। ইস্তাম্বুলের চিরন্তন সুলতান তিনি!’
আবেগে কাঁপছে জোসেফাইনের কণ্ঠ। অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার দু’চোখের দু’কোণ থেকে।
আহমদ মুসা একটা রুমাল জোসেফাইনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঠিক, তিনি ইস্তাম্বুলের চিরন্তন সুলতান। হৃদয়ের সুলতান তো মৃত্যুর ঊর্ধ্বে। আলহামদুলিল্লাহ্‌।’
জোসেফাইন রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘চল।’
পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল আবার।
‘আইউপ সুলতান’ মসজিদে তারা দু’রাকাত করে নফল নামায পড়ল। কিছু সময় কাটাল তাসবীহ পাঠ ও ধ্যানমগ্নতায়।
জোসেফাইন নামায পড়ছিল মেয়েদের পাশে, আর আহমদ মুসা পুরুষদের এলাকায়।
আহমদ মুসা মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে দেখল, জোসেফাইন আগেই বেরিয়ে এসেছে। দাঁড়িয়ে আছে আহমদ আবদুল্লাহকে নিয়ে।
আহমদ মুসা ওদের কাছে গেল।
আহমদ আবদুল্লাহর হাতে ছোট্ট দামি একটা ইলেক্ট্রনিক খেলনা এবং চাইল্ড গ্রেড দামি একটা চকোলেটের প্যাকেট।
দেখেই আহমদ মুসা বলল, ‘এ সময় এসব এর হাতে কোত্থেকে এল জোসেফাইন?’
জোসেফাইন হাসল। বলল, ‘আমার এক আমেরিকান বান্ধবী এগুলো দিল একে। এই তো এইমাত্র চলে গেল। আমরা একসাথে নামায পড়লাম।’
‘তুমি আসবে জানত সে? কি করে সে উপহারগুলো নিয়ে এল?’ বলল আহমদ মুসা।
‘প্রায়ই সে এখানে আসে। এই সময়। আমিও এ সময়েই আসি। দেখা হয়। একসাথে নামায পড়ি, মহান বুজুর্গের কবর জিয়ারত করি। জান, আহমদ আবদুল্লাহর জন্যে সে পাগল। সাংঘাতিক ভালোবাসে। আহমদ আবদুল্লাহও তাকে পেলে আমাকে ভুলে যায়।’
‘তোমার বান্ধবী শ্বেতাংগ আমেরিকান, না কোন মাইগ্রেটেড আমেরিকান?’
‘একেবারেই খাস শ্বেতাংগ। কিন্তু শ্বেতাংগ কোন কালচার তার মধ্যে নেই। ইসলাম সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান, গভীর আগ্রহ আমার খুব ভালো লাগে। তোমার সাথে আজ তাকে পরিচয় করাতে চাইলাম। তিনি বললেন কি জান? বললেন, ‘অপ্রয়োজনে অন্য কারো স্বামীর সাথে পরিচয় করা ইসলামী কালচার নয়।’ বলেই হেসে আবার বলেছেন, ‘মসজিদে ঢোকার সময় তাকে আমি দেখেছি। আপনারা তখন দাঁড়িয়ে কোন গল্পে ডুবে গিয়েছিলেন।’ আজ তাকে খুব চঞ্চল দেখলাম। আহমদ আবদুল্লাহকে লম্বা একটা চুমু খেয়ে ছুটে চলে গেল।’
‘তোমার বান্ধবী কি করেন? কোথায় থাকেন? কোথায় তার সাথে তোমার পরিচয় হলো?’ বলল আহমদ মুসা।
‘এখানে বুজুর্গের এই কমপ্লেক্সেই তার সাথে আমার প্রথম দেখা। থাকেন, বলেছেন, তোপকাপিরই কোন এক সরকারি গেস্ট হাউসে। তোপকাপিতে নাকি অনেক এবং অনেক রকম গেস্ট হাউস আছে। এক মজার ঘটনার মাধ্যমে আমাদের বুজুর্গের মাজারে তার সাথে পরিচয় হয়। আমার সেক্রেটারি লতিফা আরবাকান গেছে অজু করতে, আমি মোনাজাত করছিলাম। এই সুযোগে আহমদ আবদুল্লাহ মাজারের ওপাশে চলে গেছে। সেখানে বসে মেয়েটি কুরআন শরীফ পড়ছিল। আহমদ আবদুল্লাহ গিয়ে তার কোলে উঠে বসেছে। মেয়েটি একটা আয়াত পর্যন্ত পড়া শেষ করে কুরআন বন্ধ করে রেখে আহমদ আবদুল্লাহকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে আমাদের খোঁজে এসেছে। ততক্ষণে আমার মোনাজাত হয়ে গিয়েছিল। লতিফা আরবাকানও এসে গিয়েছিল। আমরা আহমদ আবদুল্লাহকে খুঁজছিলাম। তাকে দেখে আমরাও তার দিকে এগিয়ে গেলাম। সে হাসতে হাসতে আমাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনি নিশ্চয় এর মা? বাচ্চার চেহারায় আপনার এক্সপ্রেশন আছে। নাম কি বাচ্চার?’
‘আহমদ আবদুল্লাহ।’
আমি নাম বলতেই তিনি বললেন, ‘চমৎকার নাম। একটা ছন্দ আছে। কিন্তু আপনার ছেলে তো আমাকে কিছুটা পটিয়ে ফেলেছে। আমি কুরআন শরীফ পড়ছিলাম। সে সোজা গিয়ে আমার কোলে উঠে বসেছে। যেন কত দাবি, কত বছরের চেনা। ‘
আমি হেসে বললাম, ‘মায়ের চেহারার সাথে আপনার চেহারার খুব একটা অমিল নেই। হয়তো মা-ই মনে করে বসেছে।’
‘সে বলল, ‘আমার কিন্তু খুব ভালো লাগছে। বাচ্চারা আমার খুব প্রিয়। দেখুন, সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। উশখুশ করছে আপনার কোলে যাবার জন্যে। কিন্তু ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। আমি আর একটু নিয়ে থাকি।’ বলে বাচ্চার দু’গালে দু’বার চুমু খেল। আবদুল্লাহরও দেখলাম আমার কাছে আসার চেষ্টা বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়েটির দিকে সে একবার চেয়ে তার বুকে মুখ গুঁজল। মেয়েটি তাকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে যেন আত্মহারা হয়ে গেল। তারপর থেকে আহমদ আবদুল্লাহর সাথে তার মহাখাতির হয়ে গেল। সেও প্রায়ই এখানে আসে। খুব ভক্ত মহান বুজুর্গের। তোমার আজকের কাহিনী শুনলে তো সে আরও পাগল হয়ে যাবে।’ বলল জোসেফাইন।
‘নাম কি তোমার বান্ধবীর? আমেরিকার কোথায় থাকেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
জিভ কেটে মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজল ডোনা জোসেফাইন। তারপর হেসে উঠল। বলল, ‘কি উত্তর দেব! সত্যি, নাম জিজ্ঞেস করার কথা মনেই হয়নি। দোষ আমার একার নয়। উনিও আমার নাম জিজ্ঞেস করেননি। উনি জিজ্ঞেস করলে আমারও মনে হতো। স্যরি।’
হাসল আহমদ মুসাও। বলল, ‘অবাক হওয়ার মতো কথা শোনালে! দু’জনের ক্ষেত্রেই একই কাণ্ড ঘটল কি করে?’
‘এর কারণ আমি মনে করি, আমরা এত দ্রুত অন্তরংগ হয়ে উঠি যে, নাম জিজ্ঞেস করার পর্যায় কখন যেন পেছেনে পড়ে যায়। আমাদের যখন দেখা হতো, যতক্ষণ আমরা একসঙ্গে থাকতাম, সবটা সময় আহমদ আবদুল্লাহকে নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকতাম। নিরিবিলি অন্তরংগ কোন আলোচনা হয়নি।’ বলল জোসেফাইন।
‘এমনটাই ঘটেছে জোসেফাইন। কিন্তু এটা মনে থাকার মতো ঘটনা। আজ নাম জানার একটা সুযোগ চলে গেল। আমার সাথে দেখা হলে, নামের প্রশ্ন হয়তো উঠতো। যাক, চল আমরা সামনে এগোই।’
‘চল। একদিন দেখা হলে নিশ্চয় আমি প্রথমেই তার নাম জেনে নেব।’ বলল জোসেফাইন।
তারা হাঁটতে লাগল আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ)-এর কবরগাহের দিকে।

বেলা বারটা।
আহমদ মুসা অফিস থেকে বেরুল। উদ্দেশ্য, আল-আলা পাহাড়ের সিনাগগ দিনের বেলায় একটু ভালো করে দেখা।
অফিস থেকে বেরুতেই দেখল, ডঃ শেখ বাজ অফিসে আসছে। দেখা হতেই বলল, ‘স্যার, এ সময়ে যে বেরুলেন?’
আহমদ মুসা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, আশে-পাশে কেউ নেই। সিকিউরিটির লোকটি বেশ একটু দূরে। বলল আহমদ মুসা, ‘আমি আল-আলা পাহাড়ের দিকে একটু যাচ্ছি। ডাঃ ইয়াসারদের সাথেও দেখা করতে পারি। আচ্ছা ডঃ শেখ বাজ, আপনি আল-আলা পাহাড়ের সিনাগগ সম্পর্কে কিছু জানেন? ওদের কেউ এখানে আসে কি? কিংবা ওদের কারো সাথে আমাদের কারো জানাশোনা আছে কিনা?’
‘আমি কিছু জানি না, তবে আমাদের ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানী যিনি মারা গেলেন, তার কাছ থেকে শুনেছি, তিনি এবং ঐ সিনাগগের যিনি প্রধান রাব্বি, ডেভিড ইয়াহুদ বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে পিএইচডি করেছেন। পিএইচডি’র পর ডেভিড ইয়াহুদ বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়েই চাকরি পেয়েছিলেন। আর তিনি দেশে ফেরার পর চাকরি নিয়ে চলে আসেন ইস্তাম্বুলে আমাদের এই ইনস্টিটিউটে। সম্প্রতি ডেভিড ইয়াহুদ ঐ সিনাগগে প্রধান রাব্বির দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
শুনে চোখ কপালে তুলল আহমদ মুসা। ‘বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রিসার্চ অধ্যাপক সিনাগগের রাব্বি হয়েছেন?’ অনেকটা স্বগতঃ কণ্ঠে আহমদ মুসা উচ্চারণ করল কথাটি। এই সাথে তার মনে জাগল অনেক কথা। ডেভিড ইয়াহুদ কি আমাদের এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং তার একটা সফল সৃষ্টি উড়ন্ত সকল ধরনের অস্ত্র-বিনাশী ‘সোর্ড’-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মিশন নিয়েই এখানে এসেছেন? তিনিই কি মূল ব্যক্তি? মনে হয় না। বরং তাকে ব্যবহারের জন্যে আনা হয়েছে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানীর সহপাঠী বলেই ডেভিড ইয়াহুদকে এখানে আনা হয়ে থাকতে পারে যাতে আমাদের ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানীর সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরে ইনস্টিটিউটের গবেষণায় ও গবেষণাগারে প্রবেশ করার সুযোগ তাদের হয়। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানীও তাদের হাতের পুতুল হতে চায়নি বলেই কি তাকে মরতে হয়েছে! এখন তাদের পরিকল্পনা কি? কোন পথে এগোচ্ছে তারা? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন, নানা কথা আহমদ মুসাকে অস্থির করে তুলেছিল। সে আনমনা হয়ে পড়েছিল কিছুটা।
ডঃ শেখ বাজই আবার কথা বলল, ‘স্যার কিছু ভাবছেন?’
আহমদ মুসা সম্বিত ফিরে পেল। বলল, ‘না ডঃ বাজ, তেমন কিছু না। আপনাকে ধন্যবাদ ডঃ বাজ একটা ভালো খবর দেয়ার জন্যে। এই তথ্যটা কি জেনারেল তাহির তারিককে জানিয়েছিলেন?’
‘না স্যার। আমার মনে পড়েনি। আপনি প্রশ্ন করার পর মনে পড়েছে আমার। আর একে আমি তেমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলে মনে করিনি।’ বলল ডঃ বাজ।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘দেখুন, আমাকে স্যার স্যার বলবেন না। আমরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে বোধহয় সহপাঠী হতাম। ভাই বলতে পারেন।’
‘না স্যার, অফিসে এটা হয় না। বাইরে অবশ্যই ভাই বলব। কিন্তু অফিস চলবে অফিসের নিয়মে।’ বলল ডঃ বাজ।
আবার হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ঠিক আছে। ‘ডাইরেক্টর ম্যানেজমেন্ট’-এর উপযুক্ত কথাই আপনি বলেছেন। ধন্যবাদ। আপনি অফিসে যান, আমি আসছি।’
‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল।
‘জেনারেল তাহির তারিক স্যার আসবেন বলেছেন। উনি যোগাযোগ করলে কি বলব?’ জিজ্ঞাসা ডঃ বাজের।
‘বলবেন, আমি ডাঃ ইয়াসারদের ওদিকে গেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ইয়েস স্যার’ বলে ডঃ বাজও যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল।
ডঃ ডেভিড ইয়াহুদ সম্পর্কে জেনে খুব খুশি হলো আহমদ মুসা। ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানীসহ সব মৃত্যু, সব নিখোঁজের কেন্দ্র এই সিনাগগ এবং হতে পারে ঐ ডঃ ডেভিড ইয়াহুদ, এই বিশ্বাস দৃঢ় হলো আহমদ মুসার। দিনের বেলা সিনাগগকে একটু ভালো করে দেখা আরও জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সাথে ডাঃ ইয়াসারদের কাছ থেকে আরও কিছু জানাও যেতে পারে।
গাড়িতে উঠে বসল আহমদ মুসা। গাড়ি চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা আল-আলা পাহাড়ে পৌঁছে গাড়ি ড্রাইভ করে সিনাগগের রাস্তার সামনে পৌঁছল।
সিনাগগটি চারদিক দিয়ে দেয়াল ঘেরা। প্রাচীরের পাশ দিয়ে পাথর বিছানো প্রাইভেট রাস্তা। এগুলো আশপাশের বাড়িতে যাবার পথ। আহমদ মুসা গাড়িতে করে পাথর বিছানো পথে বাড়ির চারদিকটা ঘুরে আসতে চাইল। কিন্তু পারল না। সিনাগগের পেছনটায় খাড়া একটা খাদ। কতটা গভীর বোঝা গেল না। ছোট-বড় নানা রকম গাছ-গাছড়ায় ভর্তি। আহমদ মুসা ফিরে এল বাড়ির সামনের বড় রাস্তায়। মোটামুটি বাড়ির বাইরেটা দেখা হয়ে গেছে তার।
গাড়িতে উঠল। গাড়ি স্টার্ট দিল। কয়েক গজ সামনেই রাস্তার ডান পাশে ডাঃ ইয়াসারদের বাড়ি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা মনে করল, আজ ডাক্তারদের বাড়ি না-ই বা গেলাম।
বিপরীত দিক থেকে আরেকটা গাড়ি আসছিল এদিকে। ডাঃ ইয়াসারের বাড়ির সামনে গিয়ে মুখোমুখি হয়ে গেল দুই গাড়ি।
পাশ কাটাবার জন্যে আহমদ মুসা গাড়ি বাঁ দিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু সামনের গাড়িটা থেমে গেল। গাড়িটা থামতেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ডাঃ ইয়াসার এবং ডাঃ রাসাত।
ওদের দেখে আহমদ মুসাও গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে।
‘কি ব্যাপার মিঃ খালেদ, আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন! গাড়ি ঘুরিয়ে নিন। আগে আপনি ঢুকুন আমাদের গেট দিয়ে, পেছনে আমরা। পালাবার পথ নেই।’ বলল ডাঃ রাসাত।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে চাইল।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগে ডাঃ ইয়াসার বলে উঠল, ‘মিঃ খালেদ খাকান, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। যেতে আপনি পারছেন না। অতএব, সময়ক্ষেপণে কোন লাভ নেই জনাব। আসুন।’
আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে নিল।
সাবাতিনিও বাড়িতে। সে বেরিয়ে এসেছে।
গাড়ি বারান্দায় নেমে এসে দাঁড়িয়েছে সে। আহমদ মুসার গাড়ি থামলে তার গাড়ির দরজা খুলে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, ‘ওয়েলকাম, আসুন স্যার।’ আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল।
ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাতও গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে।
‘আমাদের গেটেই এভাবে ধরা পড়ে যাবেন, এমনটা ভাবতেই পারেননি স্যার, তাই না মাম্মি, ড্যাডি?’ হাসতে হাসতে বলল সাবাতিনি।
‘ঠিক আছে, স্যারকে কি খাওয়াবে দেখ। আমরা সকলেই তোমার গেস্ট আজ।’ বলল ডাঃ ইয়াসার।
‘থ্যাঙ্কস ড্যাডি। মাম্মির রান্না করা খাবার দিয়ে হোস্ট হওয়া কঠিন নয়। ওয়েলকাম সকলকে। আসুন।’ বলল সাবাতিনি হাসতে হাসতে। সবাই বসল গিয়ে ড্রইংরুমে।
সাবাতিনি ভেতরে গিয়েছিল। একটু পরে বেরিয়ে এসে বলল, ‘ড্যাডি, মিঃ ইরগুন ইবান আসছেন। স্যারের সাথে নাকি তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন!’ সাবাতিনির অস্বস্তি ও অসন্তুষ্টির ভাব।
আহমদ মুসা তাকিয়েছিল ডাঃ ইয়াসারের দিকে। সাবাতিনির কথা শোনার সাথে সাথে ডাঃ ইয়াসারের মুখের আলো যেন হঠাৎ দপ করে নিভে গিয়েছিল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিল। তবে সাবাতিনির কথার উত্তরে কথা বলতে তার দেরি হলো। একটু সময় নিয়ে সে বলল, ‘তুমি তাকে কি বলেছিলে যে মিঃ খালেদ খাকান এসেছেন, না তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন?’ ডাঃ ইয়াসারের কণ্ঠে কতকটা বিব্রত হওয়ার আমেজ।
‘না ড্যাডি, আমি কিছু বলিনি। উনিও জিজ্ঞেস করেননি। মনে হলো উনি জানতেন। কারণ সোজাসুজি তিনি জানিয়েছেন যে, তিনি আসছেন।’ বলল সাবাতিনি।
পরিস্থিতি একটু বেসুরো হয়ে উঠেছিল। এটা কাটিয়ে উঠতেই এগিয়ে এলো ডাঃ রাসাত। বলল, ‘মিঃ খালেদ খাকান, মিঃ ইরগুন ইবান আমাদের প্রতিবেশী। এখানকার সিনাগগের একজন সদস্য। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন মুষ্টিযোদ্ধা। আমার মনে হয়, তার সাথে পরিচিত হয়ে আপনিও খুশি হবেন।’
‘আমারও তাই মনে হয় রাসাত। একজন মেহমান পেয়েছিলাম, দু’জন হয়ে গেল। এটা আমাদের সৌভাগ্যই।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আকস্মিকতা ভাগ্যের কাজ। মানুষের হাত এর ওপর নেই। আমার আসার কথা ছিল না এখানে। কিন্তু এসে গেছি। ইরগুনও সেভাবেই আসছেন। তাকে ওয়েলকাম।’
ইরগুন ইবানকে মুখে ওয়েলকাম জানালেও আহমদ মুসার মনে নানা চিন্তার ভিড়। তার বুঝতে বাকি নেই ইরগুন ইবান কে। সে শত্রুপক্ষের একজন, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। ডেভিড ইয়াহুদের তরফ থেকেই সে আসছে, যারা সেদিন তাকে আক্রমণ করেছিল ইরগুন ইবান তাদের গ্রুপেরই একজন, এ ব্যাপারেও সে নিশ্চিত। কিন্তু সে নিশ্চিত হতে পারছে না সে আসছে কেন? তাকে নিছক দেখার জন্যে সে অবশ্যই আসছে না। তাহলে কি জন্যে আসছে? এই শত্রুপক্ষ সম্পর্কে আহমদ মুসারা জেনেছে, তাতে পরিষ্কার এরা আক্রমণের নানা পন্থা ব্যবহার করে। তারা এখানে লোক পাঠাচ্ছে কোন কৌশল সাথে নিয়ে!
বৈঠকখানার দরজায় নক হলো। আহমদ মুসার চিন্তায় ছেদ নামল। সাবাতিনি ভেতরে চলে গিয়েছিল। সে ছুটে এসে দরজা খুলে দিল।
দরজায় একজন লোক দাঁড়িয়ে।
খোলা দরজায় সাবাতিনির মুখোমুখি হতেই লোকটি বলল, ‘আমি ইরগুন ইবান, টেলিফোন করেছিলাম।’
স্বাগত জানানোর মতো কোন কথা না বলে সাবাতিনি দরজার পাশে সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুন ভেতরে, সবাই আছে।’
ইরগুন ইবান ভেতরে প্রবেশ করল।
ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত উঠে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানাল। ডাঃ রাসাত বলল, ‘আমরা খুশি হয়েছি মিঃ ইবান আপনি আসায়।’
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়িয়েছিল।
ডাঃ রাসাতের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা ইরগুন ইবানের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমি খালেদ খাকান।’
ইরগুন ইবান হ্যান্ডশেকের জন্যে আহমদ মুসার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘খুশি হলাম খালেদ খাকান, আপনার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে।’
বলে মুখ ঘুরিয়ে ডাঃ রাসাতের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি অবশ্য না ডাকতেই এসে পড়েছি।’
‘আপনি প্রতিবেশী। আপনি যে কোন সময় আসতে পারেন। দাওয়াত বা অনুমতির প্রশ্ন এখানে নেই।’ বলল ডাঃ রাসাত।
ইরগুন ইবান হাত টেনে নিয়েছে আহমদ মুসার হাত থেকে। কিন্তু তার আগেই ইরগুন ইবানের ডান হাতের তর্জনীর একটা অস্বাভাবিক সাইজের আংটি আহমদ মুসার নজরে পড়েছে। আংটির পাথরটা পিরামিড আকৃতির। তবে পিরামিডের ওপরের শীর্ষটা সরু নয়, ফ্ল্যাট। সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো, পাথরের নিচের মেটালিক বেজটা। যেটার ওপর-নিচের প্রশস্ততা কিছুটা অস্বাভাবিক। কিছুটা অস্বাভাবিক এই আংটিটা চোখে পড়তেই তার মনে হলো, এই ধরনের আংটি এর আগে কোথায় যেন সে দেখেছে। হঠাৎ তার মনে পড়ল, ফিলিপাইনে এক মেয়ের পাল্লায় সে পড়েছিল। মেয়েটা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের গোয়েন্দা কর্মী ছিল। সে এই ধরনের আংটির পয়জন ও পিন দিয়ে আহমদ মুসাকে হত্যা করতে গিয়েছিল।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। এই আংটি যদি সেই আংটির মতো কিছু হয়ে থাকে, তাহলে ইরগুন ইবান তাকে হত্যার জন্যেই এখানে এসেছে।
‘আমি মিঃ খালেদ খাকানের পাশেই বসি। গল্প বেশি জমবে।’ বলে মিঃ ইরগুন ইবান আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে এল।
আহমদ মুসার দু’পাশের দু’টি সোফা ফাঁকা ছিল। সে এসে আহমদ মুসার বাম পাশের সোফাটায় বসল।
আহমদ মুসার বাঁ হাত ও দেহের বাম পাশটা ইরগুন ইবানের ডান হাতের আওতায় চলে এল। মনে মনে হাসল আহমদ মুসা।
গল্প জমে উঠল। ইরগুন ইবান হাত নেড়ে কথা বলছে।
আহমদ মুসার বাম হাত সোফার হাতলে।
মাঝে মাঝে কথা বলার সময় ইরগুন ইবানের চলন্ত হাত আহমদ মুসার বাম হাতের আশপাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আহমদ মুসা গল্পের মধ্যে থাকলেও ইরগুন ইবানের হাতটাকে সে ফলো করছে।
কথার মাঝখানে ইরগুন ইবান অকাল্ট সায়েন্স বা হস্তরেখা বিজ্ঞান নিয়ে কথা তুলল এবং সে বলল, জার্মানিতে এই সাবজেক্টের ওপর লেখাপড়া করেছে।
খুব ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট।
ডাঃ ইয়াসার প্রথমে হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে। তারপর ডাঃ রাসাতের হাত দেখল সে।
হস্তরেখা বিজ্ঞান সম্পর্কে সে কতটা জানে সেটা ভিন্ন কথা, তবে হস্তরেখা সম্পর্কে তার জ্ঞান কিছুটা যে আছে তা বোঝা গেল। বিজ্ঞ হস্তরেখাবিদের মতো কথা বলে ডাঃ ইয়াসার এবং ডাঃ রাসাত দু’জনকেই চমৎকৃত করে ফেলেছে।
চমৎকৃত ডাঃ ইয়াসার বলল, ‘আপনি মুষ্টিযুদ্ধ চর্চা করেছেন, কিন্তু এ চর্চা করতে গেলেন কেন?’
‘মুষ্টিযুদ্ধ শক্তি ও কৌশল নির্ভর হলেও ভাগ্যেরও একটা দিক আছে। প্রতিপক্ষের হস্তরেখা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে তার শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে জানা যেতে পারে। বিজয়ের জন্যে এর গুরুত্ব আছে।’
বলে ইরগুন ইবান ফিরল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘এবার মিঃ খালেদ খাকান, আপনার পালা। দেখি আপনার হাত।’
আহমদ মুসা হাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কারও ভবিষ্যৎ বাণীর ওপর আমি বিশ্বাস করি না। অকাল্ট সায়েন্সও এক ধরনের ভবিষ্যৎ বাণী। তবে হাতটা আপনাকে দেখতে দিচ্ছি এ কারণে যে, আপনাকে আমার হাত দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে চাই না।’
ইরগুন ইবান একবার মুখে হাসি টেনে ঠাণ্ডা চোখে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসার হাত দেখার প্রতি মনোযোগ দিল।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করল, ইরগুন ইবানের তর্জনীর সেই আংটিটি উল্টে গেছে। এ পর্যন্ত আংটির পাথর দিকটা ছিল আঙুলের পিঠে, সেটা এখন চলে গেছে আঙুলের বিপরীত পাশে।
সাবাতিনি ড্রইংয়ের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘খাবার টেবিলে সব রেডি ড্যাডি, মাম্মি।’
বলার পরেই হাত দেখার প্রতি তার নজর পড়ল। বলল, ‘বাহ, এখনো হাত দেখ চলছে নাকি!’
বলে সে এগিয়ে এসে মায়ের পাশে সোফায় বসল।
হঠাৎ আহমদ মুসার হাত থেকে মুখ তুলল ইরগুন ইবান। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ। বলল উদ্বেগ ও আতংকের সুরে, ‘মিঃ খালেদ খাকান, আপনার হাত বলছে আপনি মারা যাচ্ছেন, সেটা এখনি।’
বলেই ইরগুন ইবান আহমদ মুসার হাত ছেড়ে দিয়ে কিছুটা উঠে ডান হাত দিয়ে আহমদ মুসার বাম বাহু চেপে ধরল এবং বাম হাত দিয়ে আহমদ মুসার ডান হাত ধরতে গেল, যেন সে আহমদ মুসাকে সাহায্য করতে যাচ্ছে, তাকে বাঁচাতে চাচ্ছে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে।
কিন্তু ইরগুন ইবানের বাম হাত আহমদ মুসার ডান হাত পর্যন্ত পৌঁছার আগেই আহমদ মুসার ডান হাতের একটা প্রচন্ড ঘুষি আধা-আধি উঠে দাঁড়ানো ইরগুন ইবানের বাম কানের পেছনটায় আঘাত হানল।
ইরগুন ইবানের ডান হাত খসে গেছে আহমদ মুসার বাম বাহু থেকে। তার দেহটা টলে উঠে পড়ে গেল মেঝেতে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
মেঝেতে পড়ে গিয়েই ইরগুন ইবান কয়েকবার মাথা ঝাঁকিয়ে সেন্সটাকে সক্রিয় করে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল।
আহমদ মুসা ততক্ষণে পকেট থেকে রিভলভার বের করেছে। রিভলভার ইরগুন ইবানের দিকে তাক করে বলল, ‘একটু নড়া-চড়া করলে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব। বলেছিলেন না যে, আমি মারা যাচ্ছি। উল্টো হয়ে গেল ব্যাপারটা।’
বলে আহমদ মুসা ডাঃ ইয়াসারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ডাক্তার ইয়াসার, আপনি ইরগুন ইবানের ডান হাতের তর্জনী থেকে আংটি খুলে নিন।’
ডাঃ ইয়াসার, ডাঃ রাসাত ও সাবাতিনি মুহূর্তে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় বিস্ময়ে যেন বোবা হয়ে গেছে। পাথরের মতো বসে আছে তারা।
আহমদ মুসা ডাঃ ইয়াসারকে আহবান জানালে নড়ে উঠল সে। তাকাল সে একবার ডাঃ রাসাতের দিকে, আর একবার আহমদ মুসার দিকে। কি করবে, কি করবে না বুঝতে পারছে না সে।
ওদিকে প্রাথমিক আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠার পর ইরগুন ইবানের চেহারায় একটা মরিয়াভাব ফুটে উঠল। কঠোর কণ্ঠে বলল সে, ‘তোমাকে তোমার আচরণের জন্যে চরম মূল্য দিতে হবে খালেদ খাকান।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তোমরা কি করতে বাকি রেখেছ? সেদিন আল-আলা পার্কে তোমরা আমাকে মারতে চেষ্টা করেছিলে, আজ তোমার আংটির বিষাক্ত পিন আমার শরীরে ঢুকিয়ে আমাকে মারতে চেষ্টা করেছিলে। কি আর মূল্য দিতে হবে আমাকে! দু’বার আমাকে মারার চেষ্টা, আবারও চেষ্টা করবে, এই তো? আমি তার জন্যে প্রস্তুত আছি। কিন্তু তোমাকে এখন আমাকে হত্যা চেষ্টার অপরাধে ধরে থানায় দেব।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা না তাকিয়েই ডাঃ ইয়াসারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ডাক্তার ইয়াসার, আপনি দয়া করে এর ডান হাতের তর্জনী থেকে আংটিটা পাথরে চাপ না পড়ে এমন সাবধানে খুলে নিন। আর ডাঃ রাসাত, আপনি আপনার বাগান থেকে কোন গাছের একটা বড় পাতা নিয়ে আসুন।’
এমনিতেই বিস্ময়-বিমূঢ় ডাক্তার পরিবার, ইরগুন ইবান তারপর খালেদ খাকানের কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল। একটা বিষয় তারা পরিষ্কার বুঝল, ইরগুন ইবানরাই সেদিন খালেদ খাকানকে মারার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আজ কিভাবে ইরগুন ইবান আহমদ মুসাকে মারার চেষ্টা করেছিল, সেটা তারা বুঝল না। আংটির বিষাক্ত পিনের রহস্য তাদের কাছে এখনও পরিষ্কার হয়নি।
তবু খালেদ খাকানের আহবানে ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত দু’জনেই উঠে দাঁড়াল। ডাঃ ইয়াসার উদ্বেগ ও বিব্রতকর চেহারায় এগোলো ইরগুন ইবানের দিকে। আর ডাঃ রাসাত গাড়ি বারান্দার ওপাশের টব থেকে একটা বড় পাতা আনার জন্যে বেরিয়ে গেল।
আংটি খুলে নেয়ার জন্যে ডাঃ ইয়াসার কাছাকাছি হতেই ইরগুন ইবান তার ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে তর্জনীর আংটির পাথরের উপর চাপ দিতে গেল।
ব্যাপারটা চোখ এড়াল না আহমদ মুসার। সংগে সংগেই আহমদ মুসার পিস্তল গর্জন করে উঠল। বুলেট গিয়ে বিদ্ধ হলো হাতের কব্জির কিছু ওপরে।
চিৎকার করে উঠল ইরগুন ইবান। তার তর্জনী আংটির পাথর স্পর্শ করেই সরে এল আকস্মিক আঘাতে।
গুলি করেই আহমদ মুসা বলল, ‘তুমি যেভাবে আছ সেভাবে থাক, যে হাত যেখানে আছে, সেভাবেই থাকবে। তুমি মরতে চেষ্টা করেছিলে, মরতে তোমাকে দেয়া হবে না।’
গুলির শব্দে চমকে উঠে ডাঃ ইয়াসার পিছিয়ে গিয়েছিল। সাবাতিনিও চমকে উঠে কাঁপতে শুরু করেছে। ডাঃ রাসাত ছুটে এসে ঘরে ঢুকেছে। তার হাতে একটা বড় পাতা এবং চোখে আতংক। ঘরে ঢুকে ইরগুনের রক্তাক্ত হাতের দিকে চোখ পড়তেই ভীষণভাবে আঁৎকে উঠল সে।
‘স্যরি আমি, এসব ঘটনার জন্যে’, বলে উঠল আহমদ মুসা, ‘আসলে তার হাতে ঐ সময় গুলি করা ছাড়া তাকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচাবার আর কোন পথ ছিল না। আমি সব বলছি ডাঃ ইয়াসার, আপনি আগে তার হাতের আংটি খুলে নিন।’
এবার ডাঃ ইয়াসার এগিয়ে গিয়ে ইরগুন ইবানের আহত হাতের তর্জনী থেকে সাবধানে আংটি খুলে নিল।
‘এবার ডাক্তার ইয়াসার, আপনি ডাঃ রাসাতের হাতের পাতাটার বোঁটার মূল শিরায় আংটির পাথরের শীর্ষ অংশ চেপে ধরুন মাত্র সেকেন্ডের জন্যে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আচ্ছা’ বলে ডাঃ ইয়াসার এগোলো ডাঃ রাসাতের হাতের পাতার দিকে। ডাক্তার পরিবারের সবাই চোখ ভরা উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে পাতার দিকে। ডাক্তার দম্পতি এখন বুঝতে পারছে, পাতায় বিষক্রিয়া দেখতে চায় খালেদ খাকান।
তারা বিস্ময়ের সাথে দেখল, মাত্র তিন-চার সেকেন্ডের মধ্যে বিরাট তরতাজা পাতাটি কালো রং ধারণ করে একদম চুপসে গেল। এ যে অত্যন্ত তীব্র ও ভয়ংকর বিষের ফল!
তারা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তাদের দৃষ্টিতে ভয়, উদ্বেগ ও বিমূঢ় ভাব।
আহমদ মুসা বলল, ‘আমার হাত দেখার নাম করে আগাম মৃত্যুর খবর ঘোষণা করে ডান হাত দিয়ে সে আমার বাহু চেপে ধরেছিল ঐ বিষ আমার দেহে ঢুকিয়ে আমাকে হত্যার জন্যে। আমি মরে গেলে আপনার ধরে নিতেন আমার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এবং তাকে বাহবা দিতেন মৃত্যুর আগাম খবর নিখুঁতভাবে বলার জন্যে।’
মৃত্যুর পাণ্ডুরতা ডাক্তার দম্পতির চেহারায়।
আর অপার বিস্ময় নেমেছে সাবাতিনির চোখে-মুখে। সে কম্পিত গলায় বলল, ‘আপনি কি করে বুঝলেন যে, আংটির পাথরে ঐভাবে বিষাক্ত পিন লুকানো আছে এবং পাথরটি দেহে চেপে ধরলে বিষাক্ত পিনটি দেহে আঘাত করবে?’
‘আমরা এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে কখনও পড়িনি, এমন বিস্ময়কর সব দৃশ্য চোখে দেখব কোনদিন ভাবিনি। কিন্তু সাবাতিনির প্রশ্ন আমাদেরও।’ বলল ডাঃ রাসাত।
‘ওর সাথে হ্যান্ডশেক করার সময় তার তর্জনীর আংটির আকার দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল। দেখুন, আংটির মেটালিক বেজটা অন্যান্য আংটির চেয়ে দ্বিগুণ প্রশস্ত। আরেকটা বিষয় দেখুন, মেটালিক বেজটা আংটির পাথরকে চেপে ধরে নেই বরং দৃশ্যমানভাবেই আলগা। এ দু’টি কারণে আমি সন্দেহ করি যে, আংটিটি একটা মারণাস্ত্র। আংটির পাথর স্প্রিং-এর ওপর বসানো আছে, আর স্প্রিং থেকে একটা বিষাক্ত পিন সেট করা পাথরের ভেতর দিয়ে। চাপে পাথরটি বসে গেলেই পাথর থেকে পিনটি বেরিয়ে আসবে এবং চাপ দেয়া বস্তুকে আঘাত করবে।’ আহমদ মুসা বলল।
অপার বিস্ময় ডাক্তার পরিবারের সকলের চোখে-মুখে। ডাঃ রাসাতই আবার বলে উঠল, ‘আমরাও আংটিটি দেখেছি, কিন্তু সন্দেহ হয়নি। আংটির কোন অস্বাভাবিকতা আমাদের নজরে পড়েনি। এর অর্থ আমরা অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে ওটা দেখিনি। কিন্তু আপনি দেখেছেন। কেন?’
আহমদ মুসা গম্ভীর হলো। অন্যসব চেপে গিয়ে সাদামাটা ব্যাখ্যা হিসেবে বলল, ‘গায়ে পড়ে দাওয়াত নেয়া, বিনা কারণে আমার সাথে পরিচিত হবার তার আগ্রহে তার প্রতি আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাছাড়া সেদিন আমার ওপর আক্রমণ হওয়ার পর আমি সতর্ক ছিলাম যে, সেদিন ব্যর্থ হলেও তারা অন্য কোন কৌশলে আমার ওপর আবার আক্রমণ চালাতে চেষ্টা করবে। এই কারণে লোকটার ওপরে সন্দেহ হওয়ায় আমি তার সবকিছুই অনুসন্ধিৎসার দৃষ্টিতে দেখেছি….।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই চিৎকার করে উঠল সাবাতিনি, ‘স্যার, মিঃ ইবান তার গলার ক্রস কামড়ে ধরে দেখুন পড়ে যাচ্ছে।’
আহমদ মুসা কয়েক মুহূর্তের জন্যে ইরগুন ইবানের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকিয়েছিল ডাক্তার দম্পতির দিকে। এরই সুযোগ ইরগুন ইবান গ্রহণ করেছে।
আহমদ মুসা মুখ ফিরিয়ে দ্রুত ইরগুন ইবানের দিকে এগোলো। মুখ থেকে চেন ধরে টেনে বের করল যিশুর মূর্তি সম্বলিত ক্রসটি।
কিন্তু ইরগুন ইবানের দেহ ততক্ষণে নেতিয়ে পড়ে গেছে মেঝের ওপর। নাড়ি, চোখ পরীক্ষা করে দেখল, সে আর ইহজগতে নেই।
হতাশভাবে আহমদ মুসা ফিরল ডাক্তার দম্পতির দিকে। বলল, ‘ধরা পড়ার চেয়ে সে মৃত্যুকেই পছন্দ করেছে। আমি জীবিত রাখতে চেয়েছিলাম, পারলাম না।’
বলে আহমদ মুসা পাশের সোফায় ধপ করে বসে পড়ল। ভেতর থেকে মন তার চিৎকার করে উঠল, অদৃশ্য শত্রুদের খুব ভেতরের একজনকে একেবারে হাতের মুঠোয় পেয়েও হাতে রাখা গেল না। ওদের পরিচয় জানার জন্যে খুব দরকার ছিল একে।
ভেতরের এই অস্বস্তিকে চাপা দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘আমার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল।’
‘এতো অস্বাভাবিক মৃত্যু, এখন কি করা যাবে? পুলিশ তো ঝামেলা করবে।’ বলল ডাঃ ইয়াসার।
‘আমার সত্যি এখন ভয় করছে।’ বলল ডাঃ রাসাত।
‘আমি এসে সত্যি আপনাদের মহা ঝামেলায় ফেললাম। কিন্তু পুলিশের ভয় আপনাদের করতে হবে না।’
‘স্যরি, ঝামেলার কথা বলছি না। তাছাড়া আমরাই তো আপনাকে ডেকেছিলাম। আমরা বলছি, এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কথা।’ বলল ডাঃ রাসাত।
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর না দিয়ে মোবাইল বের করে কোথাও টেলিফোন করল।
ওপারের সংযোগ পেয়ে গেলে সে সালাম দিয়ে বলে উঠল, ‘মিঃ তাহির তারিক, আমি আল-আলা পাহাড়ে ডাঃ ইয়াসার দম্পতির বাসায়। দাওয়াত ছিল। বাইরের একজন লোক এসেছিল। সব পরে বলব। আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম। লোকটি ধরা পড়ার পর আত্মহত্যা করেছে। এখন একে সরিয়ে ফেলা দরকার, তার ব্যাপারে অনুসন্ধানও হওয়া উচিত।’
ওপারের কথা শুনে মোবাইল অফ করে ডাঃ ইয়াসারদের লক্ষ্য করে বলল, ‘এখনি পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যাবে। আমি বাদী হয়ে কেস করবো। আপনাদের কোন ঝামেলা হবে না। কালকে পত্রিকায় একটা নিউজ প্রকাশ হবে যে, আপনার বাড়িতে দাওয়াতে আমি এসেছিলাম, সেও উপস্থিত দাওয়াতে হাজির হয়েছিল। সে আমাকে হত্যার জন্যে আক্রমণ করে। এখন ইরগুন ইবানের ব্যাপারে পুলিশী তদন্ত চলছে।’
‘ধন্যবাদ। ইরগুন ইবানের লোকরা ঝামেলা করে কিনা, সেটা একটা ভাবনার বিষয়।’ বলল ডাঃ ইয়াসার।
‘তারা আপনাদের ঝামেলায় ফেলবে না, বরং তারা চেষ্টা করবে ইরগুন ইবানের কোন পরিচয় পুলিশকে যেন না বলেন। আপনারা ওদের জানিয়ে দেবেন, পুলিশকে ইরগুন ইবানের পরিচয় আপনারা দেননি। পুলিশকে বলবেন, সে আপনাদের একজন প্যাশেন্ট। কিন্তু যে ঠিকানায় সে প্যাশেন্ট হয়েছে, পুলিশ অনুসন্ধান করে সেটাকে ভুয়া পাবে।’ আহমদ মুসা বলল।
দুঃখের মধ্যেও হেসে উঠল ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত দু’জনেই। বলল, ‘ধন্যবাদ, মনে হচ্ছে সমাধান আমরা পেয়ে গেছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশের একটা গাড়ি এসে পৌঁছল। গাড়ি থেকে নামল সাদা পোশাকধারী চার-পাঁচ জন পুলিশ।
গাড়ির শব্দ শুনেই বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত।
গাড়ি থেকেই পুলিশদের একজন জিজ্ঞেস করল ডাঃ ইয়াসারকে লক্ষ্য করেই, ‘আপনি নিশ্চয় ডাঃ ইয়াসার। আমাদের ঘরটায় নিয়ে চলুন।’
ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাত পুলিশদের নিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল।
দু’জন পুলিশ পেছনে পেছনে একটা স্ট্রেচার নিয়ে প্রবেশ করেছিল।
পুলিশদের একজন একটা সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করল। অবস্থার কয়েকটা ফটোও তুলল পুলিশরা। তারপর একজন নির্দেশ দিল লাশটা গাড়িতে নিতে।
দু’জন পুলিশ স্ট্রেচারে করে লাশ নিয়ে বেরিয়ে গেল। তাদের সাথে বেরিয়ে গেল আরও দু’জন। অবশিষ্ট একজন বেরিয়ে যাবার আগে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘স্যার, আপনি বাসায় ফিরলে কাউকে আমাদের রিং দিতে বলবেন। আমরা স্টেটমেন্টটায় স্বাক্ষর করিয়ে আনব।’
বলে বেরিয়ে গেল পুলিশ অফিসারটি।
পুলিশ অফিসারটি বেরিয়ে যেতেই আহমদ মুসা বলল, ‘ডাঃ ইয়াসার, ডাঃ রাসাত, যা ঘটেছিল এখন আপনারা সব ভুলে যান। কোন পক্ষ কোন অসুবিধা করলে আমাকে জানাবেন।’
‘ধন্যবাদ।’ বলল ডাঃ ইয়াসার।
‘স্যার, কিছু মনে না করলে আমি একটা কথা বলতে চাই।’ বলল সাবাতিনি।
‘কিছু মনে করার প্রশ্ন কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাংঘাতিক যা ঘটে গেল, অবস্থার ওলট-পালট যেভাবে হলো, আমি বলতে সাহস পাচ্ছি না বিষয়টাকে আপনি কিভাবে নেবেন এই ভেবে।’ বলল সাবাতিনি।
‘আমি তো বলেছি, যা কিছু ঘটেছে তা এখন একেবারেই ভুলে যেতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ। তাহলে আমি যে ‘হোস্ট’ ছিলাম, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জানাচ্ছি, খাবার টেবিল তৈরি হয়ে আছে।’ বলল সাবাতিনি দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ঠিক সাবাতিনি, ঠিক এই সময় এই ধরনের প্রস্তাব বেসুরো হবারই কথা। কিন্তু তুমি খাবার এই আমন্ত্রণ এখন না জানালেও নিজ থেকেই আমি খেতে চাইতাম। কারণ, আমি চলে গেলে আগামী অন্তত কয়েক ঘন্টা খাবার টেবিলের দিকে কেউ যাবে না। আমি তোমাদের সকলের সাথে খেয়ে বাড়িটাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে এনে বাসায় ফিরতে চাই।’
‘আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আপনি সাইকোলজিস্টও। ঠিক বলেছেন, অন্তত আজ আমরা কেউ খাবার টেবিলে যেতে পারতাম না।’ আবেগজড়িত ভারি কণ্ঠে বলল ডাঃ রাসাত।
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘চলুন, আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে যাই। এর মধ্যে কাজের লোকরা ড্রইংরুমটা পরিষ্কার করে ফেলবে।’
কথা শেষ করেই সাবাতিনিকে ডাঃ রাসাত বলল, ‘সাবাতিনি, তোমার বাথটা মিঃ খালেদকে দেখিয়ে দাও। আর তুমি বেসিনে মুখ ধুয়ে নিয়ে খাবার টেবিল ঠিক-ঠাক করে নাও।’
সবাই গিয়ে বসল খাবার টেবিলে।
সাবাতিনি হোস্টের মতো খাবার গোটা সময় তত্ত্বাবধান কাজটা করল এবং খেলোও। তার মা ডাঃ রাসাত খাবার সময় আলোচনা শুরু করেছিল ঘটনা সম্পর্কে, কিন্তু সাবাতিনি বাঁধা দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘কথা শুরু হলে কথাই চলবে, খাওয়া হবে না। আমি খাওয়া নষ্ট করতে দেব না। খাওয়া শেষ হলে আমি নিজে কথা শুরু করে দেব।’
সত্যি খাওয়া শেষ হলে সকলকে চা পরিবেশন করে নিজে তার চায়ে চুমুক দিয়ে সাবাতিনি আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার, আপনার পুরো পরিচয় আপনি দেননি। আপনার যে পরিচয়, একটি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আকস্মিক পরিচালক, তার সাথে প্রকৃত অবস্থার মিল পাওয়া যাচ্ছে না। আপনার টেলিফোনের পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে যায়, তারা এসে কোন জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া লাশ নিয়ে যায়, আপনাকে স্যার বলে সম্বোধন করে, পুলিশরা স্টেটমেন্ট স্বাক্ষর করার জন্যে আপনার বাসায় যেতে চায়, এসবের কোনটাই আপনার কথিত পরিচয়ের সাথে মিলে না। বরং এসব থেকে মনে হয়, আপনি পুলিশ কিংবা সরকারের কোন বড় কর্তা, না তার চেয়ে আরও বড় কিছু।’
আহমদ মুসা শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা পিরিচে রেখে হেসে বলল, ‘সাবাতিনি খুব বুদ্ধিমতী, বয়সের তুলনায়।’
বলে থামল আহমদ মুসা। তার মুখ থেকে হাসির রেশ কেটে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠল জমাট এক গাম্ভীর্য। বলল, ‘তুমি ঠিকই ধরেছ সাবাতিনি। তবে আমি পুলিশ কিংবা সরকারের কেউ নই। এর বেশি আমার সম্পর্কে আর কিছু বলব না। প্রসঙ্গটা না বলা অবস্থায় থাক কোন এক ভবিষ্যতের জন্যে।’
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘আতিথেয়তার জন্যে ধন্যবাদ এবং যা কিছু অপ্রীতিকর ঘটেছে, তার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করছি।’
‘চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’ বলল সাবাতিনি।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আহমদ মুসা সাবাতিনিকে বলল, ‘কষ্ট করার দরকার কি? এখন তো একটু রেস্ট নেবে।’
‘আসল কথা হলো আমাদের রাস্তার মাথার মার্কেটটায় আমি যাব।’ বলল সাবাতিনি।
সবাইকে গুড ইভনিং জানিয়ে সাবাতিনিকে আসতে বলে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
সাবাতিনিও বেরিয়ে এল আহমদ মুসার পিছু পিছু।
আহমদ মুসা গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল।
সাবাতিনি তার পাশের সিটে উঠে বসেছে।
গম্ভীর হয়ে উঠেছে তার মুখ। আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘আমার মার্কেটে যাবার কথা মিথ্যা স্যার। দুঃখিত, আমি মিথ্যা কথা বলেছি।’
বলে থামল সাবাতিনি।
আহমদ মুসা বিস্মিত হয়ে সাবাতিনির দিকে চাইল। তার মুখ দেখে বুঝল, তার কথা শেষ হয়নি। বলল আহমদ মুসা, ‘থামলে কেন, বল।’
‘স্যার, আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই। আমার মনে হচ্ছে, আমার ড্যাডি, মাম্মি বিপদে পড়েছে। আপনি যতটা সহজভাবে বলছেন ঘটনাটা মিটে যাবে, তা বোধহয় হবে না।’
থামল সাবাতিনি। তার চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন।
‘কেন হবে না? বল।’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা সাবাতিনিকে।
‘স্যার, ইরগুন ইবান আসার মধ্যে কাহিনী আছে। ড্যাডি, মাম্মি সম্ভবত ভয়ে সেটা প্রকাশ করেননি।’ বলল সাবাতিনি।
আহমদ মুসার ঔৎসুক্য বেড়ে গেল। প্রশ্ন করল সাবাতিনিকে, ‘কাহিনীটা কি?’
‘ড্যাডি মাম্মিকে একদিন একান্তে কাহিনীটা বলছিলেন। সেটা হলো, সিনাগগের প্রধান ডেভিড ইয়াহুদ আমার আব্বাকে বলেছেন আপনাকে একদিন দাওয়াত দিয়ে আনার জন্যে। সে সময় ইরগুন ইবানকে সিনাগগ থেকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। ড্যাডির কাছে এমন প্রস্তাব কোন কারণে ভালো লাগেনি। তিনি বিষয়টা এড়াবার জন্যে বলেছিলেন যে, আপনি তেমন পরিচিত নন। এটা তিনি ভালো মনে করেছেন। তখন ডেভিড ইয়াহুদ হুমকি দিয়ে বলেছে যে, ড্যাডিকে এটা করতে হবে, দ্বিতীয়বার যেন ‘না’ শব্দ না বলা হয়। আরো বলে, ‘স্মার্থা’ নামে একটি মেয়ে আপনার ব্যাপারে ড্যাডির সাথে যোগাযোগ করবে। তিনি আরও হুমকি দেন যে, এ বিষয়টা যদি খালেদ খাকানকে আগে জানানো হয়, যদি প্ল্যানটা ব্যর্থ হয়, তাহলে এর যে ফল ড্যাডিকে ভোগ করতে হবে তা ড্যাডি কল্পনাও করতে পারবে না।’
থামল সাবাতিনি মুহূর্ত কালের জন্যে। তারপর আবার বলে উঠল, ‘আমি মনে করি, আপনার বিরুদ্ধে এটা গভীর ষড়যন্ত্র এবং আমার ড্যাডি, মাম্মিও এখন খুব বিপদে। কারণ, তাদের প্ল্যান ব্যর্থ হয়েছে। এতসব কথা মাম্মি, ড্যাডি আপনাকে বলেনি। আমি এটা বলার জন্যেই এসেছি।’
‘ধন্যবাদ সাবাতিনি। বিষয়টা উদ্বেগের, ওরা না করতে পারে এমন কিছু নেই। কিন্তু কাল পত্রিকায় দেখা যাবে, যা ঘটেছে, তাতে তোমার মাম্মি-ড্যাডির কোন হাত ছিল না এবং তারা ইরগুন ইবানের প্রকৃত পরিচয় পুলিশের কাছে গোপন করেছেন, এজন্যে আশু টার্গেট হওয়া থেকে তারা বেঁচে যাবেন। প্রধান টার্গেট এখন আমি। সুতরাং, তাদের আশু নজর আমার ওপরই পড়বে। ভয় নেই তোমাদের। একটা কথা তোমাকে আরও বলি, সিনাগগের ওপর এখন পুলিশের সার্বক্ষণিক নজর থাকবে। তোমাদের ক্ষতি করার সুযোগ তারা পাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার। আমার একটা কৌতুহল আছে।’ সাবাতিনি বলল।
‘বল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার ওপর এই আক্রমণ কেন? আপনাকে তারা হত্যা করতে চাচ্ছে কেন?’ সাবাতিনি বলল।
‘ওদের দুরভিসন্ধি কার্যকরী করার পথে ওরা আমাকে বাঁধা মনে করছে, এমন কিছু হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দুরভিসন্ধিটা কি?’ জিজ্ঞাসা সাবাতিনির।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তুমি এখনও ছোট। সব প্রশ্ন করতে নেই, সব কিছু জানতে নেই।’
‘সব প্রশ্ন করতে নেই, সব কিছু জানতে নেই, এটা ঠিক আছে। কিন্তু আমি ছোট- একথা ঠিক নয়। আমার বয়স ঊনিশ, পূর্ণ একজন নাগরিক এখন আমি। আর প্রচুর গোয়েন্দা বই আমি পড়েছি। আমি এসব বিষয় অনেক বুঝি। জানেন, সেদিন আমাদের এক প্রফেসর আমাকে বলেছে আমি গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করবো কিনা। আমি কি কাজ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, খুবই একটা সহজ কাজ। তোমার বাড়ি তো রোমেলী দুর্গের পাশেই। রোমেলী দুর্গের পশ্চিম পাশে একটা রিসার্চ ইনস্টিটিউট আছে। ঐ ইনস্টিটিউটে পাঁচজন বিজ্ঞানী আছেন, তাদের বাসা ইস্তাম্বুলের কোথায় কোথায় তা খুঁজে বের করতে হবে। এক একটি বাড়ি খুঁজে দেয়ার জন্যে এক হাজার ডলার করে পাবে। দেখুন কত বড় অফার!’ থামল সাবাতিনি।
খুব হালকা স্বরে কথা বলছিল সাবাতিনি। কিন্তু সাবাতিনির দেয়া তথ্য শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার জন্যে। তার গোটা দেহে খেলে গেল গরম চাঞ্চল্যের এক শিহরণ। ষড়যন্ত্রকারী সন্ত্রাসীরা বিজ্ঞানীদের বাড়ি সন্ধান করছে, এটা খুব বড় একটা ঘটনা, উদ্বেগজনক খবর। প্রফেসরের দেয়া অফার নিয়ে সাবাতিনি কি করল, শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কোন দিকে গড়িয়েছে- তা জানার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল সে। কিন্তু হঠাৎ থেমে যায় সাবাতিনি।
‘অফারের কি হল সাবাতিনি? তুমি গ্রহণ করেছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘টাকার অফারটা ভালো স্যার, কিন্তু কাজটা আমার পছন্দ হয়নি। কারও বাড়ি খুঁজে বের করার মধ্যে কোন থ্রিল বা কোন গোয়েন্দা যোগ্যতার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়নি। গবেষণাগারে গেলেই তো তাদের বায়োডাটা, তাদের ঠিকানা উদ্ধার করা যায়। কিংবা তাদের অনুসরণ করলেও তা জানা যেতে পারে। এসব কথা তুলে আমি বলেছিলাম, কাজটা আমার পছন্দ নয়।’ থামল সাবাতিনি।
‘তারপর?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘তারপর স্যার বললেন, পছন্দ হবে। থ্রিল আছে। ঐ গবেষণা ইনস্টিটিউটে কারও পক্ষেই ঢোকা সম্ভব নয়। তাছাড়া ওদের কোন বায়োডাটা অফিসে পাওয়া যাবে না, এটাও নিশ্চিত। আর তারা বাড়িতে যাতায়াত করেন সামরিক হেলিকপ্টারে। সপ্তাহে তারা একদিন বাড়িতে যান। কিন্তু যাওয়ার কোন দিন, ক্ষণ ঠিক নেই। অতএব, তাদের বাড়ি খুঁজে বের করার মধ্যে বিরাট থ্রিল আছে। আমি বললাম, থ্রিল আছে বুঝা গেল। তবে গবেষণা কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞানীদের ঠিকানা প্রয়োজনেই আড়াল করতে চাচ্ছেন। কিন্তু আপনারা ঠিকানা কেন চাচ্ছেন, আমি বুঝতে পারছি না। স্যার বললেন, এসব নিয়ে তোমার কাজ নেই। তোমাকে একটা দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে, সেটা তুমি করবে। আমি বললাম, মন না চাইলে সে কাজ করা যায় না স্যার। এ জন্যেই উদ্দেশ্যটা জানতে চাচ্ছিলাম। স্যার বললেন, দেখ, তোমাকে এখন সেটা বলা যাবে না। কিন্তু কাজটা মহৎ। মনে রেখ, বিজ্ঞানীরা মহাক্ষতিকর কাজেও জড়িত থাকে। সে কাজ থেকে তাদের বিরত রাখাও মানবজাতির জন্যে প্রয়োজন। স্যারের কথা আমার ভালো লাগল। বললাম, আমাকে কি করতে হবে জানালে আমি কাজটা করতেও পারি। তিনি বললেন, রোমেলী দুর্গে তোমার নিয়মিত যাওয়ার অভ্যেস করতে হবে, যেমন উইকএন্ডে অনেকেই সেখানে যায়। এভাবে ওখানকার দায়িত্বরত কিছু সেনা অফিসারের সাথে তোমার পরিচিত হতে হবে। তুমি মুসলিম নাম ‘সায়েমা সাবাতিনি’ হিসেবে তাদের কাছে পরিচিত হবে। রোমেলী দুর্গের সর্ব পশ্চিমের সর্ববৃহৎ টাওয়ারের গোড়ায় হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং করার মতো একটা জায়গায় সপ্তাহে পাঁচ দিন পাঁচটা হেলিকপ্টার ল্যান্ড করে। তোমার টার্গেট হবে হেলিকপ্টারের দশ গজের মধ্যে পৌঁছা। তোমাকে একটা পিস্তল দেয়া হবে। তাতে থাকবে রাবার বুলেট। অলক্ষ্যে তোমাকে পিস্তল থেকে রাবার বুলেট ছুঁড়তে হবে হেলিকপ্টারের গায়ে। এক সপ্তাহে সব হেলিকপ্টারে বুলেট ছুঁড়তে পারবে না। ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞানীকে বহনকারী পাঁচটা হেলিকপ্টারের জন্যে তোমাকে পাঁচ সপ্তাহ বা তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে হতে পারে। ব্যস, এটুকুই তোমার দায়িত্ব। আমি বললাম, পিস্তলের শব্দে তো বিষয়টা সবার চোখে পড়ে যাবে। স্যার বললেন, পিস্তলের একটুকুও শব্দ হবে না। কাজটা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। আমি কাজটা গ্রহণ করেছি এই জন্যে যে, কোন খারাপ কাজ হয়তো এর দ্বারা বন্ধ হবে।’ থামল সাবাতিনি।
আহমদ মুসা ভাবছিল। বলল, ‘তোমার দায়িত্ব ছিল বিজ্ঞানীদের বাড়ি খুঁজে দেয়া, হেলিকপ্টারে রাবার বুলেট ছুঁড়েই সে দায়িত্ব পালন হয় কি করে?’
হাসল সাবাতিনি। বলল, ‘আমি স্যারকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম। স্যার বলেছিলেন, রাবার বুলেট গিয়ে হেলিকপ্টারের গায়ে একটা জিনিস পেস্ট করে দেবে, ওটাই আমাদের বিজ্ঞানীদের বাড়ি দেখিয়ে দেবে।’
আহমদ মুসার চিন্তায় চলছে তোলপাড়। ওদের ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য সবকিছুই আহমদ মুসার কাছে পরিষ্কার। ওরা এবার বিজ্ঞানীদেরই সরিয়ে দিতে চায়। সাবাতিনিকে এ কাজের জন্যে কেন বাছাই করেছে, সেটাও বুঝতে পারছে সে। কিন্তু সাবাতিনি কি সেটা জানে?
‘সাবাতিনি, এ কঠিন কাজের জন্যে ওরা তোমার মতো একজন নতুনকে বাছাই করল কেন?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
হাসল সাবাতিনি। বলল, ‘স্যার, এ প্রশ্নও তাদের আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তরে প্রফেসর স্যার বলেছিলেন, তুমি ঐ এলাকার মেয়ে। তোমার চেহারা তুর্কিদের মতো, কিন্তু তোমার মতো সুন্দরী তাদের মধ্যে খুব বেশি নেই। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ছাত্র-ছাত্রীদের অবাধ গতিকে সবাই একটু মেনে নেয় এবং সর্বশেষ বিষয় হলো, তুমি আমার ইহুদি কমিউনিটির মেয়ে, সেজন্যে তোমার ওপর আস্থা রাখা যায়।’
‘উনি ঠিকই বলেছেন। তুমি কি কাজ শুরু করে দিয়েছ?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘একদিন দুর্গের ভেতরটা ঘুরে এসেছি। শুনলাম যে, দুর্গের আশে-পাশেই আপনার অফিস। আপনার সাহায্য চাইব ভাবছি। যতটা আপনাকে বুঝেছি, এটা আপনার বাঁ হাতেরও কাজ নয়।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘বলো, কোন দরকার হলে, আমি অবশ্যই সাহায্য করব। আচ্ছা, তোমার সেই প্রফেসর স্যার কোন বিভাগের, কি নাম? ভদ্রলোক বোধহয় অন্যায় কাজ, ক্ষতিকর গবেষণাও দেখতে পারেন না?’
‘তাই স্যার। তার নাম আলী আহসান বেগভিচ। তিনি বসনিয়া থেকে এসে এখানে সেটেল করেছেন।’
‘মুসলিম নাম দেখছি। তিনি তো ইহুদি।’
‘কেন, অনেক ইহুদির এমন মুসলিম নাম আছে। আমি তাকে তো মুসলমানই মনে করতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু দূরে একটা সিনাগগ আছে। সিনাগগের একটা বার্ষিক অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছিলাম। সেখানে তার সাথে আমার নতুন করে পরিচয় হলো। দেখলাম যে, তিনি ইহুদি।’
‘ধন্যবাদ সায়েমা সাবাতিনি, অনেক কথা হলো।’ বলল আহমদ মুসা।
হেসে উঠল সাবাতিনি। বলল, ‘স্যার, ও নামতো আমার ঐ দুর্গের জন্যে।’
কথা শেষ করেই আবার বলে উঠল সাবাতিনি, ‘স্যার, আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন। এসেছি যখন, মার্কেটটা ঘুরেই যাই।’
আহমদ মুসা গাড়ি থামাল।
গাড়ি থেকে নামার আগে সাবাতিনি একটা নেমকার্ড আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার, আমার নেমকার্ডটা। আমার টেলিফোন নাম্বার এতে আছে। আপনার একটা মোবাইল নাম্বার তো সেদিন আমাকে দিয়েছিলেন। আমি বিরক্ত করলে কিছু মনে করবেন না স্যার। স্যার, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার সাথের মুহূর্তগুলো অবিস্মরণীয়, ঠিক আপনার মতোই।’ বলে হাসতে হাসতে নেমে পড়ল সাবাতিনি।
‘গুড ইভনিং সাবাতিনি।’ বলল আহমদ মুসা।
সাবাতিনি নেমে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল বিদায় জানাতে।
আহমদ মুসাও তার দিকে হাত নেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।

কথা বলছিল জেনারেল তাহির তারিক, ‘…আল্লাহর হাজার শোকর। তিনি আমাদের সাহায্য করেছেন। কিন্তু আমরা উদ্বিগ্ন খালেদ খাকান, ইতোমধ্যেই খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে আপনার জীবনের ওপর দু’টি ভয়াবহ ধরনের হামলা হলো। আমি ভাবছি, আমরা যথেষ্ট সাবধান কিনা। আপনাকে উপযুক্ত সহযোগিতা আমরা দিচ্ছি কিনা। প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী দু’জনেই উদ্বিগ্ন। তারা গোটা পরিস্থিতি রিভিউ করতে বলেছেন।’
কথা হচ্ছিল ইনস্টিটিউটের অফিসে বসে।
আহমদ মুসা ছাড়াও এখানে আরও হাজির আছে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল এবং ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর।
জেনারেল তাহিরের কথা শেষ হতেই হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘জেনারেল তাহির ঠিক বলেছেন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দু’জনই উদ্বিগ্ন। অহেতুক যেন তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা না হয়, তারা বলেছেন।’
‘আমারও সেই কথা। আমাদের সতর্কতার সাথে এগোতে হবে। খালেদ খাকানের প্রতি আমাদের বিরাট দায়িত্ব আছে। তার নিরাপত্তার বিষয়টা আমাদের প্রথম বিবেচ্য।’ বলল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর।
‘আমি দুঃখিত, আমি ভেবেছিলাম এখন আমাদের কি করতে হবে এ নিয়ে আলোচনা হবে, কিন্তু আলোচনা হচ্ছে অতীত নিয়ে, কোন ব্যক্তির নিরাপত্তা নিয়ে। আমি মনে করি, এমন সব আলোচনা করার সময় এটা নয়। সাবধান হওয়া কিংবা ঝুঁকি নেয়ার কোন মাত্রা নির্দিষ্ট করা সম্ভব নয়। অতি সাবধান হওয়ার পরেও অঘটন ঘটে যায়। আর ঝুঁকি না নিয়ে কোন লড়াইয়ে নামা সম্ভব নয়। আমি মনে করি, আমাদের যতটা সাবধান হওয়া সম্ভব, ততটা সাবধান আমরা আছি।’ বিনীত কণ্ঠে, কিন্তু দৃঢ় উচ্চারণে বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন জনাব খালেদ খাকান। কিন্তু বড় দু’টি ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে, যার একটিতে আপনি মারাত্মক আহত হয়েছেন, অন্যটিতে বলা যায় মৃত্যু আপনাকে ছুঁয়ে গেছে। এ জন্যেই সবাই ভাবছেন, আরও সাবধান হওয়ার প্রয়োজন আছে।’ হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
‘আমি মনে করি, অফিসের জন্যে যে সাবধানী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট। আর আমি যেভাবে চলাফেরা করছি, সেভাবেই চলাফেরা করতে চাই। সাবধানতার নামে আমার পেছনে যদি প্রহরী দেয়া হয়, তাহলে যে লক্ষ্যে পৌঁছতে চাই, তা পারবো না…।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে কথা বলে উঠল হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল, ‘অজ্ঞাতে, অলক্ষ্যে প্রহরীরা যদি আপনাকে অনুসরণ করে আর ওদের নজরে যদি না পড়ে তাহলে ক্ষতি কি?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘প্রথমবার হয়তো ওরা বুঝতে পারবে না। কিন্তু যখন তারা দেখবে, আমার বিপদকালে পেছন থেকে, পাশ থেকে লোকজনরা যেয়ে হাজির হয়েছে, তাহলে ওদের জানা হয়ে যাবে যে, আমার আশে-পাশে, পেছনে লোক থাকে।’
‘তাহলে আপনার নিরাপত্তার দিকটা দেখার উপায় কি, যা সবাই চাচ্ছেন।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘দেখুন, ওরা যে বিষয়ের জন্যে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, সেটা আসলে আনন্দের। আমার ওপর ওদের দু’বারের আক্রমণ প্রমাণ করেছে, আমরা সঠিক পথে চলছি। ঐ হামলা আরও প্রমাণ করেছে, তাদের পরিচয় আমাদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়েছে বলে তারা ভীত হয়ে পড়েছে। তাদের ভয় যত বাড়বে, তাদের মরিয়াভাব তত বাড়বে। আমি চাই, তারা আক্রমণে আসুক। তাদের পরিচয় বেশি বেশি সামনে আসুক, তারপর সুযোগ হবে আমাদের আক্রমণের। সুতরাং উদ্বেগ নয়, এ পর্যন্ত যা ঘটেছে, তার জন্যে আমাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মিঃ খালেদ খাকান। আপনি ঠিক বলেছেন। এটাই সাফল্যের পথ। এটাও আমি মনে করি। কিন্তু এই সাথে স্বীকার করতে হবে, এটা সাংঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ। এটা নিয়েই আমরা ভাবছি।’ হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘এই ঝুঁকি নেয়ার বিকল্প নেই জনাব। দু’টি বড় ঘটনা ঘটার পর, ওদের পরিচয়-পরিকল্পনার একটা দরজা আমার সামনে খুলে গেছে। এটা আল্লাহর সাহায্য। এ সাহায্য তাদেরকেই করা হয় যারা অগ্রসর হয়, ঝুঁকি নিতে রাজি হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আপনি শুধু সাফল্যের কথা ভাবছেন, নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবছেন না।’ বলল হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ওটা ভাবার দায়িত্ব আল্লাহর। আমার ঈমান হলো, আল্লাহ যখন আমার জীবন-মৃত্যুর ফায়সালা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, তখন তার আগে মৃত্যু হবে না। অতএব, এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। কারণ, চিন্তা করে, সাবধান হয়ে মৃত্যু ঠেকানো যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া যে, আল্লাহ আপনাকে এমন সাহস ও বিশ্বাসের তৌফিক দিয়েছেন। এমন কথা বলার লোক আমাদের মধ্যে প্রচুর আছে। কিন্তু এমন কথার ওপর আপনার মতো আমল করার লোক খুব কম আছে।’ বলল ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর। আবেগরুদ্ধ তার কণ্ঠ।
‘মুহতারাম ডঃ ওমর সাহেব যা বলেছেন, তারপর আর কিছু বলার থাকে না। অনেক ধন্যবাদ খালেদ খাকান আপনাকে। একটা কথা, ওদের পরিচয়, পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা কতটুকু জেনেছি?’ বলল হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ওদের কিছু ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা গেছে কিন্তু ওদের কোন সাংগঠনিক পরিচয় এখনও জানা যায়নি। ওদের ঘাঁটির সন্ধান মিলেছে। জানা গেছে, ঐ ঘাঁটিতে পাঁচ গোয়েন্দার গাড়ি ঢোকার পরই তারা নিখোঁজ হয়ে গেছেন। আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা হলো, গোপনে এ ঘাঁটিতে প্রবেশ করা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। এ অগ্রগতি অনেক, আমরা তো একেবারেই অন্ধকারে ছিলাম। আপনাকে বোধহয় আরেকটা তথ্য এখনও জানানো হয়নি। আমরা ইরগুন ইবানের জামার ব্র্যান্ড ট্যাগে লেখা ‘One Orld O’bit’ এবং এই লেখার নিচে তিন শূন্য ‘কোডেড’ করা পেয়েছি। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এই ‘ব্র্যান্ড-নেম’ দুনিয়াতে কোন জামার নেই। আমরা এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি।’ বলল হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল। কথা শেষ করেই হাজী জেনারেল একটা কাগজখণ্ড আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ট্যাগের লেখা এখানে হুবহু লেখা আছে।’
শুনেই আহমদ মুসার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কাগজখণ্ডের লেখার ওপর চোখ বুলাল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ জেনারেল মোস্তফা কামাল। একটা রহস্যের সমাধান হয়ে গেল। ইরগুন ইবানের জামার ব্র্যান্ড-ট্যাগে লিখিত ‘One Orld O’bit’ আসলে হবে ‘One World Orbit’ ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট’। হিব্রু ভাষার লোকাল উচ্চারণে ‘World’-এর ‘ডব্লিউ’ এবং ‘Orbit’-এর ‘আর’ থাকে না। ‘One Orld O’bit’-এর তিন শব্দের প্রথম তিন ‘O’ নিয়ে হয়েছে তিন শূন্য বা ‘থ্রী জিরো’। বোঝা গেল, ইরগুন ইবানদের সংগঠনের নাম ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট’ বা ‘থ্রী জিরো’।’
‘চমৎকার। ধন্যবাদ খালেদ খাকান। তোমার এই সিদ্ধান্ত একদম ঠিক। আমার মনে পড়েছে, ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট’ নামে একটি গোপন যুদীয়-খৃস্টান গ্রুপ গোটা দুনিয়ায় কাজ করছে। কিন্তু ওটা তো কালচারাল সংগঠন।’ বলল হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘কালচারাল নামের আড়ালে রাজনৈতিক কাজ করা সুবিধাজনক জনাব। আসলে জনাব, এটা বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গঠিত একটা আমব্রেলা সংগঠন। পশ্চিমের বেশ কিছু শক্তিমান দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এর সাথে কাজ করে। ‘এক বিশ্ব গঠন’ এদের বাহ্যিক শ্লোগান। কিন্তু আসল লক্ষ্য হলো, অন্যসব জাতি, রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য ও শক্তি ধ্বংস করে সবাইকে পশ্চিমের একটি একক আধিপত্যের অধীনে নিয়ে আসা। সেটাই হবে ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড’। ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট’ এই লক্ষ্যেই কাজ করছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সর্বনাশ! এদেরই টার্গেট আমাদের গবেষণা ইনস্টিটিউট! ভয়ানক ব্যাপার তাহলে! ওদের তো অনেক ক্ষমতা!’ বলল হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ওদের অনেক ক্ষমতা, তবে আল্লাহর চেয়ে বেশি নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি, বিষয়টা যে কঠিন, জটিল এই অর্থে বলেছিলাম। ধন্যবাদ মিঃ খালেদ খাকান, আপনার মতো আত্মবিশ্বাসই প্রয়োজন। আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করুন।’ বলল হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘আমি বাইরে বেরুবো একটু। আমার জন্যে আপনাদের আর কিছু পরামর্শ?’ বলে আহমদ মুসা সবার দিকে তাকাল।
‘হ্যাঁ, মিঃ খালেদ খাকান। আমরা আপনাকে যে জন্যে চেয়েছিলাম, সেটা হয়ে গেছে। আপনার সময় আমরা নষ্ট করব না।’ ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ডঃ ওমর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর বলল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল জেনারেল তাহির তারিকও। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমি মিঃ খালেদ খাকানকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি।’
সবাইকে সালাম জানিয়ে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
সাথে জেনারেল তাহির তারিক।
আহমদ মুসা বেরিয়েই একটা চিরকুট জেনারেল তারিকের হাতে দিল। বলল, ‘মেয়েটার নাম সাবাতিনি ইয়াসার। ডাঃ ইয়াসার ও ডাঃ রাসাতের মেয়ে। এদের বাড়িতেই আমার চিকিৎসা হয়েছিল, আপনি জানেন। আবার এদের বাড়িতেই ইরগুন ইবানের সাথে ঘটনা ঘটেছে, এটাও আপনি জানেন। ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সে বুদ্ধিমতী ও অনুসন্ধিৎসু মেয়ে। জাতিতে ইহুদি, কিন্তু আমার ভক্ত। সে ‘থ্রী জিরো’দের ট্র্যাপে পড়েছে। ওদের পক্ষে কাজ করার জন্যে তাকে রোমেলী দুর্গে আসতে হবে। যেসব হেলিকপ্টার বিজ্ঞানীদের বাড়িতে চলাচল করে, তার কাছাকাছি পর্যন্ত তাকে আসতে হবে এবং একটি রাবার বুলেট ছোঁড়ার মাধ্যমে তাকে হেলিকপ্টারে ট্রান্সমিটার চিপস সেট করতে হবে। কিন্তু তার ওপর আমাদের চোখ রাখতে হবে। আর যেদিন পিস্তল দিয়ে রাবার বুলেট ছুঁড়ে ট্রান্সমিটার চিপস সেট করার চেষ্টা করবে, সেদিনই তাকে গ্রেফতার করতে হবে। কিন্তু তার সাথে কোন প্রকার দুর্ব্যবহার যেন না করা হয়। সে আমার মেহমান। তাকে গ্রেফতার করা প্রয়োজন ষড়যন্ত্র থেকে আমাদের বাঁচা এবং তাকে বাঁচানোর জন্যে। কিন্তু এটা জানানোর প্রয়োজন নেই। যা বলার আমি যথাসময়ে বলব।’ থামল আহমদ মুসা।
‘আমি বুঝেছি। কিন্তু যারা তাকে ব্যবহার করছে, তাদের সম্পর্কে কি ব্যবস্থা?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘মেয়েটি ‘থ্রী জিরো’ গ্রুপের মাত্র একজনকে চেনে, যে তাকে কাজে লাগিয়েছে। লোকটি ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তার ব্যাপারটাও আমি দেখছি। সে আমার নজরে আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। কিন্তু আপনি এখন কোথায় কোথায় বেরুবেন?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডঃ শেখ বাজ।
‘আমি আল-আলা পাহাড়ের আল-আলা সিনাগগটিতে যাব।’
বলেই আহমদ মুসা ফিরল ডঃ বাজের দিকে। বলল, ‘আজ ফিরতে একটু দেরি হতে পারে। আপনি কি থাকছেন ইনস্টিটিউটে?’
‘থাকব স্যার। কোন পরামর্শ স্যার?’ বলল ডঃ বাজ।
আহমদ মুসা একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল, ‘আমি মধ্যরাতের মধ্যে না ফিরলে আপনি জেনারেল তাহিরকে সেটা জানিয়ে দেবেন।’
‘অবশ্যই স্যার।’ বলেই চমকে উঠে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘কেন স্যার, আপনি ফিরবেন না?’
তার কথার উত্তর দেবার আগেই জেনারেল তাহির তারিক এসে আহমদ মুসার দু’হাত ধরল। বলল, ‘আপনি কি সে রকম অভিযানে…।’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল জেনারেল তাহির তারিক। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘না, মাত্র একটা অনুসন্ধানে। ভাবনার কিছু নেই।’
‘প্লিজ টেক কেয়ার অব ইউ, আমার অনুরোধ।’ বলল স্নেহের স্বরে জেনারেল তাহির তারিক। তার কণ্ঠে উদ্বেগ তখনও।
‘অবশ্যই।’ বলে সালাম দিয়ে ডঃ শেখ বাজের পিঠ চাপড়ে আহমদ মুসা পা বাড়াল তার অফিস রুমের দিকে।

আল-আলা সিনাগগের পেছনটায় ঘুটঘুটে অন্ধকার।
সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
এটা সিনাগগের পশ্চিম পাশ।
পূর্বের মূল গেট কিংবা উত্তর ও দক্ষিণের অংশ দিয়ে সিনাগগে ঢোকার চেষ্টা করা যেত। হয়তো সেটা অপেক্ষাকৃত সহজ হতো। কিন্তু সহজ বলেই সিনাগগ প্রহরীদের দৃষ্টি সেদিকে কেন্দ্রীভূত থাকবে, এটা ধরে নিয়েছে আহমদ মুসা। তাই পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবেশকেই নিরাপদ ভেবেছে আহমদ মুসা। আহমদ মুসা শুরুতেই সংঘাতে যেতে চায় না। এই যাত্রায় সিনাগগটা দেখতে চায় সে। ওখানে পাঁচ গোয়েন্দা ঢোকার পর নিখোঁজ হওয়ার কোন ক্লু সেখানে পাওয়া যায় কিনা, এটা খোঁজ করা তার একটি লক্ষ্য। তার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হলো, সদ্যোজাত ‘থ্রী জিরো’ সংগঠনের কোন পরিচয়-পরিকল্পনা সিনাগগ থেকে উদ্ধার করা যায় কিনা তা দেখা।
সিনাগগের পশ্চিম দেয়াল থেকেই খাদের খাড়া দেয়াল নেমে গেছে। খাদের দেয়াল ও সিনাগগের দেয়ালের মাঝখানে আধা-ঢালু ফুটখানেকের মতো জায়গা আছে। সেটাও আগাছায় ভরা।
আহমদ মুসা ফুটখানেক প্রশস্ত কাঁথির উপর দিয়ে এগিয়ে সিনাগগের দেয়ালের মাঝ বরাবর এসে পৌঁছল। এখান থেকে একটা মোটা পাইপ উঠে গেছে উপর দিকে। মনে হয়, স্যুয়ারেজ এবং বর্জ্য ওয়াটারের যৌথ পাইপ এটা। এই পাইপ দিয়েই উপরে উঠার সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা।
পাইপটা চেক করতে গিয়ে হঠাৎ আহমদ মুসা দেখল, পাইপের গোড়ায় একটা মোটা দড়ি বাঁধা। ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
পাইপের গোড়ায় বাঁধা দড়িটা খাদে নেমে গেছে।
আহমদ মুসা আস্তে দড়িটা টানল। উঠে আসতে লাগল দড়িটা। গজ তিনেক উঠে আসতেই দেখল, দড়িটা আসলে একটা দড়ির মই।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে এবার বিস্ময় নামল। খাদের চারদিকে তাকাল। দিনের বেলা যা দেখেছিল, তারই একটা অন্ধকার ইমেজ তার সামনে এল। খাদটা সিনাগগের বাউন্ডারি ওয়ালের। খাদের তিন দিকের উঁচু দেয়ালের কালো দেহটা স্পষ্ট তার চোখে পড়ছে। আর খাদের ভেতরটা তার চারপাশের দেয়ালের গাছ-গাছড়ায় ঢাকা বলে অপেক্ষাকৃত বেশি অন্ধকার।
আহমদ মুসা ভাবল, দড়ির মই এখানে কেন?
মই থাকার অর্থ খাদে কেউ বা কারা উঠা-নামা করে।
জংগলাকীর্ণ খাদে নামার ব্যবস্থাটা কেন? প্রশ্নটি আহমদ মুসার কাছে খুব বড় হয়ে উঠল। ভাবল সে, সিনাগগের সাথে কোন বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে এই খাদের। শুধুই পরিত্যক্ত জংগলাকীর্ণ খাদ এটা নয়। কোন রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে এখানে।
আহমদ মুসা দড়ির মই বেয়ে খাদে নামার সিদ্ধান্ত নিল।
দড়ির মইয়ে ঝুলে পড়ে কয়েক গজ নামার পর আহমদ মুসা হাতের মেশিন রিভলভারটি কাঁধে রেখে পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ হাতে নিল। খাদের দেয়াল ঘেঁষে নিচের দিকে আলো ফেলল। দেখল, নিচের দিকটা পরিষ্কার। খাদের মেঝেরও কিছুটা অংশ নজরে এল। যতটা বোঝা গেল, মেঝেটা পরিষ্কার ও সমতল।
যতই নিচে নামতে লাগল আহমদ মুসা, গাছ-গাছড়া ততই কমতে লাগল। এক জায়গায় এসে দেখল, গাছ-গাছড়া একেবারেই নেই এবং খাদের গা মসৃণ পাথরের তৈরি। বুঝল আহমদ মুসা, এটা পরিত্যক্ত কোন খাদ নয়। এটা রহস্যের কোন কেন্দ্র বা রহস্যের কোন দরজা হতে পারে।
খুশি হলো আহমদ মুসা।
মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে নিচটা দেখে নিচ্ছে আহমদ মুসা।
মেঝের চার-পাঁচ ফিট উপরে এসে থেমে গেল আহমদ মুসা।
টর্চের আলো ফেলে খাদের মেঝে ভালোভাবে দেখল এবং মেঝে সংলগ্ন খাদের চারদিকের দেয়ালটাও দেখে নিল। মেঝেটা পাথরের। মেঝের চারদিক দিয়ে খাদের দেয়ালের গোড়া বরাবর বেশ গভীর নালা। নালাটা খাদের পানি নিষ্কাশনের জন্যে, এটা মনে হলো আহমদ মুসার কাছে। সংগে সংগে তার মনে এল, তাহলে তো খাদের তলা থেকে একটা স্যুয়ারেজ আউটলেট আছে! বের হবার কোন পথও কি আছে কিংবা সিনাগগে ঢোকার কোন পথ? কি কাজে ব্যবহার হয় সুন্দর করে রাখা এই খাদটা?
এসব প্রশ্ন নিয়ে আহমদ মুসা খাদের মেঝেতে নামল।
মেঝেতে নামার পর মেঝেটা কি কাজে ব্যবহার হয় সেটা তালাশের দিকে প্রথমে মনোযোগ দিল আহমদ মুসা।
খাদের পানি নিষ্কাশনের একটা জায়গা খুঁজে পেল সে। সেখানে নালার প্রান্তে দেয়ালের গায়ে ছয় ইঞ্চি আয়তনের একটা সুড়ঙ্গ মুখ। সুড়ঙ্গ মুখে জালি লাগানো।
খাদের মেঝে ও দেয়াল সতর্কভাবে পরীক্ষা করল কিন্তু কিছুই পেল না আহমদ মুসা। খাদের মেঝে ও দেয়াল আয়তাকার, চতুষ্কোণ ইত্যাদি বিভিন্ন সাইজের পাথরে তৈরি। তবে একটা অসঙ্গতি লক্ষ্য করল আহমদ মুসা। বড়, গোলাকার এবড়ো-থেবড়ো দু’টি পাথর রয়েছে। একটি দেয়ালে, অন্যটি মেঝেতে। দু’টি পাথর গোটা মেঝে ও দেয়ালকে বেখাপ্পা করে তুলেছে। আহমদ মুসার মনে পড়ল একটা মহাজনী উক্তি, ‘সুরের মধ্যে বেসুরো কিছু ঘটলে তার পেছনে একটা কারণ কাজ করবে।’ আহমদ মুসা এই কারণ সন্ধানের জন্যে পূর্ব দেয়ালের বেঢপ আকৃতির পাথরের দিকে এগোলো।
আহমদ মুসা আবার খুঁটে খুঁটে পরীক্ষা করল দেয়ালের পাথরটিকে। কিন্তু পাথরের গা থেকে কোন ক্লু পেল না। শুধু দেখল, পাথরের চারদিকের গোলাকার প্রান্ত খুব মসৃণভাবে সেট হওয়া, অন্য পাথরগুলোর মতো এবড়ো-থেবড়ো জোড়া নয়।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সরে গিয়ে মেঝের গোলাকার পাথরটিকেও দেখল আহমদ মুসা। বিস্ময়ের সাথে দেখল, জোড়া লাগানোটা মসৃণ।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, এ পাথর দুটোই শুধু যান্ত্রিকভাবে সেট করা। অন্যগুলো হাতে করা। এর কারণ কি হতে পারে চিন্তা করতে গিয়েই সে বড় আশার আলো দেখতে পেল।
আহমদ মুসা দ্রুত এগোলো দেয়ালের গোলাকার পাথরটির দিকে।
পাথরটির মাঝখানে পা দিয়ে জোরে একটি হ্যাঁচকা চাপ দিল।
পাথরটি নড়ে উঠে কয়েক ইঞ্চি ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর তা দ্রুত সরে গেল এক পাশে।
উন্মুক্ত হলো একটা সুড়ঙ্গ পথ। আবছা আলো তাতে।
আহমদ মুসা বুঝল, সিনাগগে প্রবেশের এটা গোপন পথ।
আহমদ মুসা ঢুকতে যাবে সুড়ঙ্গ পথে, এমন সময় তার পকেটের মোবাইলে ভাইব্রেশন অনুভব করল।
মোবাইলটি হাতে নিয়ে অন করে দেখল, জোসেফাইনের কল।
‘আসসালামু আলাইকুম জোসেফাইন, আমি বাইরে। কিছু খবর?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। একটা খবর। তুমি সিনাগগে, এ খবর তারা পেয়ে গেছে।’ জোসেফাইন বলল।
শুনেই ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। বলল, ‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। আমি সিনাগগে। আর কিছু?’
‘না, আর কিছু নয়। ফি আমানিল্লাহ।’ বলল জোসেফাইন।
‘আসসালামু আলাইকুম।’ বলে মোবাইল বন্ধ করল আহমদ মুসা।
জোসেফাইনের দেয়া খবর নিয়ে মুহূর্ত কাল ভাবল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা সিনাগগে আসছে- এ খবর এরা পাওয়ার অর্থ সকলেই সতর্ক, প্রবেশের সবগুলো পথের উপর তাদের চোখ থাকবে। এই খাদ এবং এই সুড়ঙ্গ পথের উপরও কি? এ পর্যন্তকার অবস্থায় তা মনে হয়নি। তাদের এই গোপন পথ এত তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে যাবে, এতটা দুর্বল আত্মবিশ্বাস ওদের নয় নিশ্চয়। যাই হোক, তাকে সামনে এগোতে হবে।
আহমদ মুসা প্রবেশ করল সুড়ঙ্গ পথে। সুড়ঙ্গ পথের মুখ বন্ধ করার জন্যে আহমদ মুসা পেছন ফিরল।
সুড়ঙ্গ মুখ থেকে সরে যাওয়া পাথরটিকেও প্রথম দেখল আহমদ মুসা। পাথরটিকে মুভ করার কৌশল পাথরটিতেই আছে, কারণ, পাথরটির মাঝখানে চাপ দেবার ফলেই তা মুভ করে, খুলে যায়।
আহমদ মুসা পাথরের এ দিকটি ভালো করে পরীক্ষা করল। সুইচ জাতীয় কিছু পেল না। দেখল, পাথরের গোড়ার বরাবরটাই কতকগুলো চাকার উপরে এবং চাকাগুলো ইস্পাতের মজবুত রেলের উপর। রেলটা পাশের দিকে মুভেবল, বুঝল আহমদ মুসা। এ কারণেই পাথরে শক্ত চাপ পড়লে তা আগে-পেছনে মুভ করে। রেলটি ইস্পাতের পিচ্ছিল বেদীর উপর থাকায় মুভ করতে কোন অসুবিধা হয় না।
আহমদ মুসা আগের মতোই পাথরটির মাঝখানে প্রচণ্ড চাপ দিল। আগে যা ঘটেছিল, সেভাবেই পাথরটি সামনের দিকে সরে গেল এবং সংগে সংগে পাথরটি দ্রুত সরে গিয়ে সুড়ঙ্গের দরজা বন্ধ করে দিল।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করল, পাথরটি দরজায় সেট হওয়ার সাথে সাথেই পাথরের দুই প্রান্তে দু’টি হাতল ছিটকে বেরিয়ে এল। বুঝল আহমদ মুসা, ভেতর থেকে দরজার পাথরটি পেছন দিকে টানার জন্যে এই দুই হাতল ব্যবহার করতে হবে।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল।
ওদিক থেকে আসা আলোতে সুড়ঙ্গে আলো-অন্ধকার।
আহমদ মুসা সুড়ঙ্গ পথে দশ-বারো ফিট এগোনোর পর একটা আলোকোজ্জ্বল ফ্লোরে এসে দাঁড়াল।
সিনাগগের ভূ-গর্ভস্থ একটা ফ্লোর এটা।
আহমদ মুসা অনুমান করল, উপরে আরেকটা ভূ-গর্ভস্থ ফ্লোর রয়েছে। তারপরেই গ্রাউন্ড ফ্লোর।
আহমদ মুসা ভাবল, সিনাগগের গোপন ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে ‘থ্রী জিরো’ সংগঠনের পরিচয়-পরিকল্পনা সম্পর্কে কোন তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যেতে পারে।
আহমদ মুসা নজর বুলাল ফ্লোরটির চারদিকে। ফ্লোরের পশ্চিম ও উত্তর অংশ মোটামুটি ফাঁকা। এ অংশে কিছু বাক্স-পেটরা ছাড়া তেমন কিছু নেই। কিন্তু দক্ষিণ ও পূর্ব অংশে বেশ কিছু সারিবদ্ধ সুন্দর কক্ষ দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎ আহমদ মুসার নজরে পড়ল, ফ্লোরের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে মোটা রড দিয়ে তৈরি খোঁয়াড়ের মতো একটা জায়গা।
প্রশ্ন জাগল আহমদ মুসার মনে, এটা ওদের কোন বন্দীখানা নয়তো?
আহমদ মুসা এগোলো খোঁয়াড় মতো জায়গাটার দিকে।
খোঁয়াড়ের ফ্লোর ফুটখানেক উঁচু। বেশ বড় খোঁয়াড়টি। আয়তনটা আট বর্গফুটের কম হবে না। খোঁয়াড়ের একদিকে দেয়াল, তিনদিকে মোটা রডের বেড়া, ফ্লোর থেকে ছাদ পর্যন্ত উঁচু। খোঁয়াড়ের দেয়ালের দিকে নজর পড়ল আহমদ মুসার। দেখতে পেল, পরিষ্কার দেয়ালে সাদা পাথরের ওপর ফিংগার প্রিন্টের মতো কালো দাগ ইংরেজি ‘5’ অংকের আকারে সাজানো বেমানান লাগছে বলেই বিষয়টা আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আরেকটা মজার বিষয় আহমদ মুসা দেখল যে, একই সাইজের ফিংগার প্রিন্টের মতো দাগগুলোর সংখ্যাও পাঁচ। এই সংখ্যা আহমদ মুসাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করল। নিকট থেকে দেখতে চাইল দাগগুলো আসলে কি।
আহমদ মুসা খোঁয়াড়ের গ্রীল ডোরটি খোলার জন্যে ডান হাতের মেশিন রিভলভারটি বাম হাতে নিয়ে ডান হাত খালি করতে যাচ্ছিল, এমন সময় পেছন থেকে ‘হা হা’ শব্দের অট্টহাসি তার কানে এল। একই সাথে আরেকটা উচ্চকণ্ঠ, ‘হ্যাঁ খালেদ খাকান, ঠিক জায়গায় পৌঁছেছ। ঢুকে যাও খোঁয়াড়ে। তোমার আগে ওখানে পাঁচ গোয়েন্দাও….।’
কথা শেষ করতে পারল না পেছনের কণ্ঠ।
ওদিকে গুলি খেয়ে ছিটকে পড়ার মতোই আহমদ মুসার দেহ আছড়ে পড়েছিল সামনের দিকে। তার চোখের সামনে এসে গিয়েছিল পেছনটা। ট্রিগারে লাগসইভাবে সেঁটে ছিল তার তর্জনী। তার দেহ মাটি ছোঁয়ার আগেই শব্দ লক্ষ্যে তার মেশিন রিভলভার গুলি বৃষ্টি শুরু করেছিল। তার সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ‘হা হা’ অট্টহাসি এবং দ্বিতীয় কণ্ঠের বিকট উচ্চারণ।
দেহটি মাটি ছোঁবার পর পেছনটা সম্পূর্ণ নজরে এল আহমদ মুসার, দেখল, লিফটের সামনে পড়ে থাকা লাশগুলোর মধ্যে থেকে একজন উঠে দাঁড়াচ্ছে তার স্টেনগানটা হাতে নিয়ে।
আহমদ মুসার মেশিন রিভলভার তাকে টার্গেট করল। লোকটি তার স্টেনগান এদিকে ফেরানোর আগেই সে লাশ হয়ে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়িয়েই ছুটল লিফটের দিকে।
লিফট অটোমেটিকভাবে বন্ধ হবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু একটা লাশ লিফটের দরজার উপরে পড়ে থাকায় তা বন্ধ হতে পারছিল না।
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে লিফটের ভেতরে ঢুকল। ‘ওপেন’ বোতাম টিপে দরজা সরিয়ে নিল। তারপর লাশের পাটা সরিয়ে দিল লিফটের দরজা থেকে।
মোট পাঁচটি লাশ লিফটের বাইরে পড়েছিল। সবার হাতেই স্টেনগান।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। ক্ষিপ্রতার প্রতিযোগিতায় সে জিতেছে।
লিফটের কী-বোর্ডের মনিটরে দেখল আহমদ মুসা, ‘গ্রাউন্ড জিরো’ ফ্লোর থেকে অস্থিরভাবে লিফট কল করা হচ্ছে।
লিফটের ‘জিরো’ সুইচ অন করল আহমদ মুসা। তারপর তার মেশিন রিভলভার দু’হাতে বাগিয়ে ধরে দরজার পাশে লিফটের গা সেঁটে দাঁড়াল, যাতে কারও সরাসরি দৃষ্টি তার উপরে না পড়ে।
উঠতে শুরু করল লিফট।
একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে লিফট দাঁড়াল ‘গ্রাউন্ড ফ্লোর’ মানে ‘জিরো’তে। লিফট কী-বোর্ড দেখে বুঝেছে আহমদ মুসা, ‘গ্রাউন্ড টু’ হলো ভূ-গর্ভস্থ সবচেয়ে নিচের ফ্লোর। তার উপরের ফ্লোর হলো ‘গ্রাউন্ড ওয়ান’ এবং ‘গ্রাউন্ড ফ্লোর’টাই হলো ‘গ্রাউন্ড জিরো’। এটাই হলো সিনাগগের মূল ফ্লোর। এর উপরে আরও তিনটি ফ্লোর আছে, সেগুলোতে সিনাগগ সংক্রান্ত বিভিন্ন অফিস এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসস্থল। কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই ফাঁকা। সিনাগগের সাম্প্রতিক ব্যবস্থায় দু’একজন কর্মকর্তা ছাড়া কাউকেই সিনাগগে থাকতে দেয়া হয় না। সবাই বাইরে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে।
লিফট ‘জিরো’তে দাঁড়াবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লিফটের দরজা ওপেন হয়ে গেল।
লিফটের দরজা খুলতে শুরু করার সময় ওদের কথা কানে এল আহমদ মুসার। একজন বলছে, ‘না, আর গুলি-গোলার শব্দ কিন্তু নেই। তাহলে কি শয়তান খালেদ খাকান মারা পড়েছে? কিন্তু ওরা কিছু জানাচ্ছে না কেন?’
‘ওসব ভেবে লাভ নেই। চল সবাই নিচে যাই। বাইরে যারা পাহারায় আছে, তাদের আমি খাদের চারধারে পাহারায় থাকতে বলেছি।’ বলল আর একজন।
অন্য একজন বলল, ‘আমাদের রাব্বি প্রধান ডেভিড ইয়াহুদকে জানানো দরকার ছিল না কি?’
‘আমরা খবর পাওয়ার পর তাকেও খবরটা জানিয়েছি। আবার এইমাত্র টেলিফোন করেছি। তিনি বলেছেন, খালেদ খাকান যেন জীবন্ত বের হতে না পারে। হত্যাই তার একমাত্র শাস্তি। দেখামাত্রই তাকে হত্যা করতে হবে।’ বলল দ্বিতীয়জন।
লিফটের দরজা তখন পুরোপুরি খুলে গিয়েছিল।
ওরা একসাথে লিফটের দিকে এগিয়ে আসছে। ওদেরও হাতে স্টেনগান।
আর ফুট দুই-তিন এগোলেই আহমদ মুসা ওদের নজরে পড়ে যাবে পুরোপুরি।
ওরা এ সুযোগ পাওয়ার আগেই আহমদ মুসা মেশিন রিভলভারের ট্রিগার চেপে রেখে বেরিয়ে এল লিফটের দরজার আড়াল থেকে।
আহমদ মুসার মেশিন রিভলভার গুলি বৃষ্টি শুরু করেছিল দরজার ওপাশের প্রান্ত থেকে। মুহূর্তেই আহমদ মুসা দরজার মাঝ বরাবর এসে দাঁড়াবার সাথে সাথেই অর্ধ বৃত্তাকারে ঘুরে দরজার এ প্রান্তে এসে থামল।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই, পাল্টা আক্রমণের কোন চেষ্টা না করেই ওরা ছয়জন গুলি খেয়ে ঝাঁঝরা দেহ নিয়ে লাশ হয়ে পড়ে গেল।
এ গুলির শব্দ বাইরে গেলে কি প্রতিক্রিয়া হয়, দেখার জন্যে আহমদ মুসা লিফট লক করে দিয়ে বেরিয়ে অল্প দূরে লিফটমুখী একটা ঘরে প্রবেশ করল। ঘরটি অন্ধকার।
ঘিরে কেউ নেই নিশ্চয়। ঘরে কেউ থাকলে গুলির শব্দে নিশ্চয় সে বের হতো।
আহমদ মুসা দরজার একপাশে অন্ধকারে দাঁড়াল। ভাবল, এখানে দাঁড়িয়েই কয়েক মিনিট সে প্রতীক্ষা করবে গুলির শব্দে ভেতর বা বাইরে থেকে কেউ এদিকে এগোয় কিনা।
আহমদ মুসার অপেক্ষার পালা শুরু। তার ডান হাতের রিভলভারটা উদ্যত।
হঠাৎ মাথার পেছনে একটা ভারি স্পর্শ অনুভব করল আহমদ মুসা। সেই সাথে একটা কর্কশ কণ্ঠ বলে উঠল, ‘তোমার হাতের রিভলভার ফেলে…..।’
লোকটির বাক্য শেষ হলো না। তার বদলে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটা আর্তনাদ।
লোকটির কথা শেষ হবার আগেই আহমদ মুসার মেশিন রিভলভারের কয়েকটি গুলি তার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে।
মাথার পেছনে ভারি কিছুর স্পর্শ এবং তার সাথে কর্কশ কণ্ঠ শ্রুত হবার সাথে সাথেই আহমদ মুসার আত্মরক্ষার চিন্তা মুহূর্তও দেরি না করে সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছিল।
তখন আহমদ মুসার দেহ বোঁটা থেকে খসে পড়া ফলের মতোই টুপ করে দ্রুত নিচে নেমে গিয়েছিল এবং তার চেয়েও দ্রুত উপরে উঠে এসেছিল তার রিভলভার ধরা ডান হাত।
আহমদ মুসার মাথা যখন লোকটির পেট পর্যন্ত নেমে এসেছিল, তখন আহমদ মুসার ডান হাত পৌঁছে গিয়েছিল তার মাথার উপরে। তর্জনী চেপেছিল আহমদ মুসা মেশিন রিভলভারের ট্রিগারে। গুলির বৃষ্টি ছুটছিল পেছনের লোকটির বুক লক্ষ্যে।
লোকটির মনোযোগ কেন্দ্রীভূত ছিল তার কথার দিকে, তার রিভলভারের ট্রিগারে থাকা তর্জনীর দিকে নয়। যখন সে টের পেল তার রিভলভার থেকে টার্গেটের মাথা খসে গেছে, তখন কথা বন্ধ করে রিভলভারের নল রি-অ্যাডজাস্ট করার জন্যে যেটুকু সময় তার প্রয়োজন ছিল, সেটা সে পায়নি। তার আগেই গুলি বৃষ্টি আছড়ে পড়েছিল তার বুকে। এই অসতর্কতাই তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।
লোকটির লাশ পেছনে ছিটকে পড়ে গেছে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে আগের মতো পজিশন নিল সেই দরজার পাশেই। আর বেশি দেরি করতে হলো না।
দ্রুত, নিঃশব্দ পায়ে শিকারী বেড়ালের মতো ছুটে এল স্টেনগানধারী তিনজন লোক।
চারদিকে নজর রেখে তারা ছুটে এল লাশের দিকে। লাশের দিকে একবার তাকিয়েই তারা চোখ ভরা আতংক নিয়ে স্টেনগান বাগিয়ে কি যেন পরামর্শ করল তিনজনে।
আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে এল প্রশস্ত করিডোরে।
আহমদ মুসা ওদের মাথার উপর দিয়ে গুলি ছুঁড়ল। বলল, ‘তোমাদের অস্ত্র ফেলে দিয়ে হাত তুলে……।’
কথা শেষ না করেই আহমদ মুসা নিজের দেহকে বাম দিকে মেঝের উপর ছুঁড়ে দিল। এক ঝাঁক গুলি এসে সে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান দিয়ে ছুটে গেল। আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে থাকলে তার বুক, মাথা ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
আহমদ মুসা বাঁ দিকে ঝাঁপ দিলেও তার তর্জনী রিভলভারের ট্রিগার থেকে সরেনি এবং তার দু’চোখও নিবদ্ধ ছিল ওদের ওপর। ঝাঁপ দেবার পরেই সে ট্রিগার টিপে ধরেছিল মেশিন রিভলভারের। আহমদ মুসা শূন্যে থাকতেই এক ঝাঁক গুলি ওদের দিকে ছুটে গিয়েছিল। আহমদ মুসার দেহ যখন মাটিতে পড়ল, তখন মেশিন রিভলভারের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ওদের দেহও পড়ে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। মনে মনে প্রশংসা করল ওদের তিনজনের। মৃত্যুকে ওরা ভয় করেনি। প্রথম সুযোগেই ওরা শত্রুকে আঘাত হেনেছে। আহমদ মুসা ওদের মুভমেন্ট বুঝতে পেরে যদি যথাসময়ে ঝাঁপ না দিত, তাহলে ওদের আক্রমণ সফল হতো।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েই ছুটল সিনাগগের গেটের দিকে।
সিনাগগের গেটের সামনে বিশাল একটা হল ঘর। এটাই প্রধান প্রার্থনা কক্ষ। প্রার্থনা কক্ষের পূর্ব প্রান্তে একটা প্রশস্ত করিডোর প্রধান গেট পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। করিডোরের দু’পাশে কক্ষের সারি।
আহমদ মুসা যখন হল পেরিয়ে করিডোর মুখের কাছাকাছি পৌঁছেছে, তখন দেখল তিনজন স্টেনগানধারী করিডোরে প্রবেশ করেছে। ওরা দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে, আহমদ মুসাও দেখেছে ওদের।
ওদের করিডোরে দেখেই একটা পিলারের আড়ালে আশ্রয় নিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসাকে দেখেই ওরা গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছে। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তেই ওরা এগিয়ে আসছে।
আহমদ মুসা পিলারের পেছনে লুকিয়েছে, দেখেছে তা ওরা। ওরা গুলিবর্ষণ অব্যাহত রেখে এগিয়ে গেলো পিলার লক্ষ্যে। আহমদ মুসা যেন পাল্টা গুলিবর্ষণের সুযোগ না পায়, এটাই ওরা চাচ্ছে।
সত্যিই আহমদ মুসা বেকায়দায়। গুলি এসে পিলারকে এমনভাবে ছেঁকে ধরেছে যে, উঁকি মারা কিংবা গুলি করার জন্যে রিভলভার ধরা হাত বাইরে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। গুলিগুলো আসছে মাথা সমান উঁচু রেঞ্জ দিয়ে। তার উপরে গুলির লেভেল উঠছে না।
ওরা করিডোর পার হয়ে সামনে এগোতে চাচ্ছে।
আহমদ মুসা পিলারের ওপর দিকে তাকাল। দেখল, পিলারের প্রায় আট ফিটের মাথায় পিলারের ভেতর থেকে ইস্পাতের একটা বার এক ফিটের মতো বেরিয়ে এসেছে। ইস্পাত বারের প্রান্তটা উপর দিকে বাঁকানো। সম্ভবত ডেকোরেশন পিস অথবা ঝুলন্ত ফুলের বাস্কেট টাঙানোর জন্যেই সবগুলো বা কোন কোন পিলারে এ ধরনের ইস্পাত বার রাখা হয়েছে।
আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। এটা তার জন্যে এক অমূল্য সাহায্য।
আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলভারের বাঁট কামড়ে ধরে দু’হাত উপরে তুলে ইস্পাত বারটি ধরার জন্যে বিসমিল্লাহ বলে লাফ দিল।
হাতে পেয়ে গেল ইস্পাত বারটি।
ইস্পাত বারটি দু’হাতে ধরার পর বাম হাতের উপর দেহের ভার ছেড়ে দিয়ে ডান হাত মুক্ত করে মুখে কামড়ে ধরে রাখা রিভলভারটি হাতে নিল। গুলি তখনও একই লেভেলে হচ্ছে। তার মানে, আহমদ মুসা লাফ দিয়ে উপরে উঠেছে এটা তারা টের পায়নি। খুশি হলো আহমদ মুসা। উঁকি মেরে দেখল, ওরা করিডোর থেকে হলে নেমে এসেছে। আহমদ মুসা সময় নষ্ট করল না। ওরা টের পেয়ে গেলে আবার সংকটে পড়বে সে।
ওদের একজন আহমদ মুসার পিলারের উপর দিকে ইংগিত করে কি যেন বলে উঠল। সংগে সংগেই ওদের তিনজনের চোখ এদিকে নিবদ্ধ হলো, আর নড়ে উঠল ওদের স্টেনগান।
সবকিছু বুঝে গেল আহমদ মুসা। প্রস্তুত ছিল সে। তার মেশিন রিভলভারও তৈরি। তার তর্জনী চেপে বসল রিভলভারের ট্রিগারে।
লক্ষ্য একেবারে নাকের ডগায়।
ওরাও দেখতে পেয়েছিল আহমদ মুসার রিভলভার। ওদের বিস্ফারিত চোখে মরিয়াভাব। উঠে আসছিল ওদের তিনটি স্টেনগান।
কিন্তু স্টেনগানগুলো টার্গেট পয়েন্টে উঠে আসার আগেই ওরা আহমদ মুসার মেশিন রিভলভারের গুলি বৃষ্টির শিকার হয়ে গেল। পড়ে গেল হলের মেঝেতে তিনটি লাশ।
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে নামল পিলারের ইস্পাত বার থেকে।
নেমেই করিডোরের দিকে ছুটে গিয়ে দেখল, সিনাগগের প্রধান দরজাটি বন্ধ। ওরা দরজা বন্ধ করে দিয়েই ঢুকেছিল।
আহমদ মুসা পেছন ফিরে ছুটল লিফটের দিকে। লিফট দিয়ে নামল ‘গ্রাউন্ড টু’তে। ছুটল সেই খোঁয়াড়ের দিকে। খোঁয়াড়ের দেয়ালে ‘5’ আকৃতিতে সাজানো ফিংগার প্রিন্টের মতো পাঁচটি কালো দাগ তখনই পরীক্ষা করতে চেয়েছিল। আক্রান্ত হবার ফলে পারেনি। সেটাই এখন দেখতে চায় সে।
আহমদ মুসা খোঁয়াড়ে ঢুকে সেই দেয়ালে ফিংগার প্রিন্টের মতো চিহ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড়াল।
চিহ্নগুলোর উপর নজর পড়তেই আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার চোখ। পাঁচটি কালো চিহ্নের সবগুলোই সুস্পষ্ট ফিংগার প্রিন্ট।
আহমদ মুসার কোন সন্দেহ নেই যে, ঐ ফিংগার প্রিন্ট নিহত পাঁচ গোয়েন্দার। তারা তাদের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই মৃত্যুর পূর্বে শত্রুকে চিহ্নিত করার জন্যে এই ফিংগার চিহ্ন রেখে গেছে একটা দর্শনীয় পদ্ধতিতে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে কল করল জেনারেল তাহির তারিককে। জেনারেল তাহির তারিক আহমদ মুসার কণ্ঠ শুনতে পেয়েই বলে উঠল, ‘কি খবর খালেদ খাকান! আপনি ভালো আছেন? এইমাত্র গোয়েন্দা সূত্র জানাল, সিনাগগে গোলাগুলি চলছে। ওখানে পুলিশ গেছে। আমিও আসছি। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান হাজী জেনারেল মোস্তফা কামালও যাচ্ছেন।’ উদ্বেগ জেনারেল তাহিরের কণ্ঠে।
‘পাঁচ গোয়েন্দা সম্ভবত নিহত হয়েছেন। তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন রেখে গেছেন। আসুন দেখবেন। গোটা সিনাগগ তদন্তও হওয়া প্রয়োজন। আপনারা এলেই আমি বেরুব। আমাকে একটু বেরুতে হবে জরুরি কাজে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই জেনারেল তাহির তারিক বলে উঠল, ‘কিন্তু সিনাগগের কি অবস্থা, কি ঘটেছে, তা তো বললেন না। এত গুলি-গোলা…..।’
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘আমি এখানে আসছি, এ খবর এরা আগেই পেয়ে যায়। তার ফলে আমার গোপন অনুসন্ধান সম্ভব হয়নি। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। ওদের পনের জন মারা গেছে। এই মুহূর্তে সিনাগগে ওদের কোন লোক নেই।’
‘আপনি ওখানে যাচ্ছেন, এ খবর ওরা আগেই পেয়ে যায়?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘হ্যাঁ, পেয়ে যায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি তো সুস্থ আছেন?’ প্রশ্ন জেনারেল তারিকের।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। ভালো আছি।’ আহমদ মুসা বলল।

আহমদ মুসা সিনাগগ থেকে বেরিয়ে গেল তার গাড়ির কাছে। গাড়িটা সে পার্ক করে এসেছিল সিনাগগের বাইরে রাস্তার পাশে।
আহমদ মুসা গাড়ির কাছে যেতেই রাস্তার ওপ্রান্তের দিক থেকে একটা গাড়ি এসে আহমদ মুসার কাছে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল মিস লতিফা আরবাকান। বলল আহমদ মুসাকে, ‘স্যার, ও গাড়ির কোথাও ওরা বোমা বা কোন বিস্ফোরক রেখে গেছে। ও গাড়িতে এখন উঠবেন না। চলুন ঐ গাড়িতে। ম্যাডাম আছেন।’
বোমা ও বিস্ফোরকের কথা শুনে চমকে উঠল আহমদ মুসা। কিন্তু তার চেয়েও বেশি চমকে উঠল ম্যাডাম মানে জোসেফাইন এখানে আসার সংবাদে।
‘আপনারা এখানে, এ সময়ে?’ দু’চোখ কপালে তুলে বলল আহমদ মুসা।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই আহমদ মুসা এগোলো গাড়ির দিকে।
আহমদ মুসা গাড়ির কাছে পৌঁছতেই গাড়ির পেছন সিটের দরজার কাঁচ নেমে গেল। জানালা দিয়ে শোনা গেল জোসেফাইনের কণ্ঠ, ‘আসসালামু আলাইকুম, আসুন।’
গাড়ির দরজাও খুলে গেল সেই সাথে।
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে বসতেই জোসেফাইন আবার বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌, তিনি সুস্থ রেখেছেন তোমাকে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। তোমরা এখানে জোসেফাইন! আমার কাছে তো স্বপ্নের মতো লাগছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমিও ভাবিনি আসব, কিন্তু এসে গেছি। পরে কথা হবে, এবার চলি আমরা।’
বলে জোসেফাইন হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকল তার পারসোনাল সেক্রেটারি মিস লতিফা আরবাকানকে।
লতিফা আরবাকান এসে ড্রাইভিং সিটে উঠছিল।
‘আমিই ড্রাইভ করব। এই রাতে মিস লতিফার ড্রাইভ না করাই ভালো।’ বলে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামতে যাচ্ছিল।
জোসেফাইন আহমদ মুসার হাত ধরে আটকে ফেলে বলল, ‘মিস লতিফা খুবই এক্সপার্ট ড্রাইভার। উইম্যান কার রেসিং-এ মিস লতিফা ইস্তাম্বুলের চ্যাম্পিয়ন। ওকে, গাড়ি ছাড়ুন মিস লতিফা।’
গাড়ি স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা আবারও বলল, ‘জোসেফাইন, তোমরা এই রাতে এই বিপদের মধ্যে এখানে এসেছ! আমি যে বিশ্বাস করতে পারছি না।’
‘পরে সব বলব। তুমি নিশ্চিন্ত থাক। আমার কাছে তোমার দেয়া মেশিন রিভলভার আছে, জেফি জিনার কাছেও রিভলভার ছিল, লতিফা আরবাকানের কাছেও রিভলভার আছে। তুমি জান না, আমাদের মিস লতিফা আরবাকান বয়সে কম হলেও সেনাবাহিনী থেকে জেদ করে রিটায়ারমেন্ট নেয়া একজন ব্রিলিয়ান্ট সেনা অফিসার অর্থাৎ ক্যাপ্টেন। আর টুয়েন্টি ফাইভ এজ গ্রুপে মিস লতিফা সেনাবাহিনীতে পরপর তিনবার র‍্যানডম পিস্তল শুটিং-এ চ্যাম্পিয়ন ছিল। সে দক্ষতা তার আরও বেড়েছে।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘মিস লতিফা আরবাকানকে ধন্যবাদ। আমি খুব খুশি যে, তুমি তাকে পিএস হিসেবে পেয়েছ। কিন্তু একটা বিষয় তুমি জান না জোসেফাইন, মিস লতিফা আরবাকান সেনাবাহিনী থেকে রিটায়ারমেন্ট নিলেও তুর্কি সেনাবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবী মহিলা গোয়েন্দা ইউনিটের একজন বড় অফিসার এখন সে।’
বিস্ময় নামল জোসেফাইনের চোখে-মুখে, তার সাথে আনন্দও।
আর মিস লতিফা আরবাকান চমকে উঠে মুহূর্তের জন্যে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু আমি যতদূর জানি, এই বিষয়টাতো স্যার, আপনার জানার কথা নয়।’
‘আমার জানার কথা নয়, এ কথা ঠিক। আমাকে কেউ জানায়নি। কিন্তু আপনাকে প্রথম দিন দেখেই জেনে ফেলেছি যে, আপনি তুর্কি সেনাবাহিনীর ‘ভি ডব্লিউ সি এস’ ইউনিটের (Voluntary Women Counter-spionage Unit) সদস্য।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু কিভাবে সেটা জানলেন?’ মিস লতিফা আরবাকানের চোখে-মুখে বিস্ময়।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আপনার বাঁ হাতের অনামিকায় একটা গোল্ড রিং আছে। যে গোল্ড রিং-এ ‘VWCS’ অক্ষরগুলো উৎকীর্ণ আছে। আমি জানি, ‘VWCS’-এর সকল সদস্যের বাঁ হাতের অনামিকায় এই রিং থাকে। এটা তাদের প্রাথমিক আইডেন্টিফিকেশন।’
মিস লতিফা আরবাকানের চোখে-মুখে নামল এবার অপার বিস্ময়। বলল, ‘এই ছোট বিষয়টাও আপনার নজর এড়ায়নি স্যার! আপনি অসাধারণ, অনন্য অসাধারণ স্যার আপনি।’
‘আপনিও কম অসাধারণ নন মিস লতিফা। আমি খুব খুশি আপনাকে সাথী পেয়ে।’
বলেই জোসেফাইন প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, ‘সিনাগগে কি ঘটল, এটা কিন্তু আমাদের জানা হয়নি।’
‘সেটা বলব, কিন্তু তার আগে বল, জেফি জিনা কে যার নাম তুমি বললে।’ আহমদ মুসা বলল।
হাসি ফুটে উঠল জোসেফাইনের মুখে। বলল, ‘ও হো, তোমাকে তো বলা হয়নি। ওটা আমার সেই বান্ধবীর নাম, হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর মাজারে যার সাথে আমার দেখা। তুমি এটা জান।’
‘তাহলে ‘জেফি জিনা’ তার নাম। কিন্তু তিনি তোমার সাথে এই সময়ে এলেন কি করে? এবং তিনি এখন কোথায়?’
‘সে অনেক কথা। এতক্ষণ ছিলেন। পুলিশ সিনাগগে ঢোকার পর উনি চলে গেছেন। হঠাৎ অসুস্থ বোধ করছিলেন।’ বলল জোসেফাইন।
‘ছাড়লে কেন? এত রাতে উনি কিভাবে গেলেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘অসুবিধা হবে না। উনি নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। তার সাথে তার পিএ মহিলাও রয়েছেন।’ বলল জোসেফাইন।
‘কিন্তু তিনি তোমার সাথে এলেন, তাকে এই রাতে পেলে কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সেটাই তো আসল কথা। তার কাছ থেকেই জানতে পারি, তুমি সিনাগগে যাচ্ছ এবং শত্রুরা তোমার যাওয়ার খবর আগাম পেয়ে গেছে। আমি….।’
জোসেফাইনের কথার মাঝখানে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘তিনি তোমাকে জানান?’ আহমদ মুসার চোখ ভরা বিস্ময়।
‘হ্যাঁ, তিনি আমাকে জানান।’
‘উনি কিভাবে জানলেন? ক’টায় তিনি জানান?’
‘উনি রাত দশটা থেকে আমাকে টেলিফোন করছিলেন। আমার মোবাইল বন্ধ ছিল, আমি গিয়েছিলাম তোপকাপি প্রাসাদের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। রাত এগারটা পর্যন্ত আমি ছিলাম সেখানে। উনি আমাকে টেলিফোনে না পেয়ে সোজা আমার বাসায় চলে এসে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। আমি ফিরে এসে তার কাছ থেকে সবকিছু শুনি এবং সংগে সংগেই তোমাকে টেলিফোন করি।’
‘এই খবর দেবার জন্যে তিনি ঐ রাতে তোমার ওখানে এসেছিলেন!’ বলল আহমদ মুসা। তার চোখে বিস্ময়।
‘খুব ভালো বন্ধু তিনি আমার। খবরটা তাকে খুবই উদ্বিগ্ন করেছিল। আমি তার সাথে যখন কথা বলেছি, তখন তাকে দারুণ উদ্বিগ্ন দেখেছি।’ জোসেফাইন বলল।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে তখনও দারুণ বিস্ময়। বলল, ‘কিন্তু তিনি এই গুরুতর খবরটা জানলেন কি করে?’
‘এ বিষয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, সেদিন রাত নয়টায় ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স ক্লাবে গিয়েছিলেন তার একজন আমেরিকান অধ্যাপিকা বান্ধবীর সাথে দেখা করতে। বান্ধবীর কক্ষে যাবার সময় একটা কক্ষের পাশ দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন। রুমটার একটা দরজা খোলা ছিল। ভেতরে কেউ একজন টেলিফোনে কথা বলছিলেন। কথার মধ্যে তোমার নাম ‘খালেদ খাকান’ শুনে সে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। ভেতরের লোকটি টেলিফোনে বলছিল, বুঝলাম। কিন্তু খালেদ খাকান লোকটা আল-আলা সিনাগগে আজ রাতে যাচ্ছে, এটা নিশ্চিত হওয়া গেল কি করে? তার কথা শেষ হওয়ার কিছু পর আবার কণ্ঠ শোনা যায়। তিনি বলেন, কখন যাচ্ছে, কতজন যাচ্ছে- এটা কি জানা গেছে? তার কথা শেষ হওয়ার পর আবার নীরবতা। কিছুপর তার কণ্ঠ শোনা যায় আবার, খবরের জন্যে ধন্যবাদ। দু’বার খালেদ খাকান আমাদের হাত থেকে বেঁচে গেছে, সেদিন খালেদ খাকান আমাদের একজন লোককে হত্যা করেছে, তার আজ শেষ দিন। সিনাগগ থেকে সে জীবন্ত বের হতে পারবে না। তার মৃত্যুদণ্ড আগেই ঘোষিত হয়েছে, আজ তা বাস্তবায়নের রাত। তার কথা বন্ধ হয়ে যায়। আর কোন কথা হয়নি। এই টেলিফোনের কথা শুনে সে সংগে সংগেই আমাকে টেলিফোন করে। বার বার আমাকে পাওয়ার চেষ্টা করে টেলিফোনে। না পেয়ে সে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। বান্ধবীর সাথে কথা বলার প্রোগ্রাম বাতিল করে সে ছুটে আসে আমার বাসায়। প্রায় পৌনে দু’ঘন্টা অপেক্ষা করে আমাকে পায়। আমি এজন্যে দুঃখপ্রকাশ করেছিলাম। উত্তরে সে কি বলেছিল জান? বলেছিল, আরও দু’ঘন্টা অপেক্ষা করতে হলেও করতাম।’
থামল জোসেফাইন।
‘তোমার বান্ধবী আসলেই তোমার সত্যিকার একজন বান্ধবী। তাকে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা দিও। আচ্ছা বল, তুমি তো আমাকে খবর জানালেই, আবার এলে কেন? তিনিই বা এলেন কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘এখানেই জেফি জিনার ভূমিকা আছে। সে আমাকে বলে, এই খবর দেয়াই যথেষ্ট নয়, বিষয়টা পুলিশকে জানানো উচিত। তার কথার উত্তরে সত্য গোপন করে বললাম, তার কোন ব্যাপারে পুলিশকে জানানোর অনুমতি নেই। তখন সে বলে, এ রকম হতে পারে, তাহলে কিছু একটা করা দরকার। এত বড় খবর পাওয়ার পর ঘরে বসে থাকা সম্ভব কি করে? আমি বলি, আমারও মন এটাই বলছিল। কিন্তু আমরা কি করতে পারি? সে বলে, আমাদের একটা কাজই করার আছে, সেটা হলো সংকটের জায়গায় আমরা উপস্থিত হতে পারি। আমরা কোন সাহায্যে আসতে পারবো কিনা সেটা আল্লাহই বলতে পারেন। কিন্তু না গেলে আল্লাহ যে কিছু করবেন, তারও সুযোগ থাকে না। তার এ কথার পর আমরা সিনাগগে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।’ থামল জোসেফাইন।
‘তোমার বান্ধবী তো আমার বিস্ময় বাড়িয়েই তুলছে। আশ্চর্য, এমন বান্ধবী এখনো দুনিয়াতে মিলে?’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। বলল আবার, ‘তোমার বান্ধবী জেফি জিনা কি ঐ অধ্যাপকের নাম বলেছিলেন?’
‘আমি জিজ্ঞেস করিনি, তিনিও বলেছেন বলে মনে পড়ছে না।’ বলল জোসেফাইন।
‘নামটা জানতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জানা যাবে। সকালেই জেনে নেব।’ বলল জোসেফাইন।
‘নামটা না জানালেও চলবে জোসেফাইন। রুমটার নাম্বার কিংবা আইডেন্টিফিকেশন পেলেও চলবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওটা তো পাওয়া যাবেই।’ বলল জোসেফাইন।
গাড়ি তখন গোল্ডেন হর্নের দ্বিতীয় ব্রীজ অতিক্রম করছিল।
বাইরে দৃষ্টি ছিল জোসেফাইনের। বলল, ‘রাতের গোল্ডেন হর্ন, মর্মর সাগর, বসফরাসের পটভূমিতে ইস্তাম্বুলকে অপরূপ লাগে। সত্যিই ইস্তাম্বুল ভূমধ্যসাগরের তীরে সবুজ জনপদের গলায় বিমুগ্ধকরী সৌন্দর্যের এক মুক্তা।’
আহমদ মুসাও দৃষ্টি ফিরিয়েছিল বাইরে। বলল, ‘আমার মনে কি হয় জানো জোসেফাইন? পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবির সর্বশ্রেষ্ঠ এক কবিতা হচ্ছে ইস্তাম্বুল।’
‘ধন্যবাদ। আমিও কি কিছু বলতে পারি?’ বলল মিস লতিফা আরবাকান।
‘বলুন, মিস লতিফা।’ জোসেফাইন বলল।
‘ইস্তাম্বুলের মানুষগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন।’
‘বুঝেছি মিস লতিফা, আপনি কি বলতে চান। ইস্তাম্বুলের মতোই ইস্তাম্বুলের ইতিহাসও ইতিহাসের পাতায় বিশেষ করে, মুসলিম ইতিহাসের পাতায় প্রোজ্জ্বল এক মুক্তার মতো। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ এবং সোলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টরা ইস্তাম্বুলের মুক্তার মতোই মানুষ। ওরা ইস্তাম্বুলের শুধু নয়, শুধু তুরস্কের নয়, গোটা ইসলামী দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সন্তান।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমরা এসে গেছি।’ বলল মিস লতিফা আরবাকান।
মর্মর সাগরের তীরে তোপকাপি প্রাসাদের দ্বিতীয় গেট দিয়ে প্রবেশ করল গাড়ি।

রোমেলী দুর্গে আহমদ মুসার অফিস কক্ষ।
চেয়ারে বসে আছে আহমদ মুসা।
তার সামনে একটা ফাইল খোলা। ফটোসহ বায়োডাটা টাইপের কাগজপত্র সে ফাইলে।
ফাইলের দিকে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসা। কিন্তু দৃষ্টি তার ফাইলে নেই। মন-মনোযোগটা হারিয়ে গেছে অন্য কোথাও।
ভেতরে তার এক প্রবল অস্বস্তি এবং তোলপাড়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার, কিন্তু ঘুরে-ফিরে তার সন্দেহের দৃষ্টি সেদিকেই পড়ছে কেন?
আহমদ মুসার অফিস কক্ষে হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করল জেনারেল তাহির তারিক এবং তার সাথে ডঃ শেখ আবদুল্লাহ বিন বাজ।
তাদের দু’জনের পায়ের শব্দেও আহমদ মুসার হারিয়ে যাওয়া ভাব কাটল না। মুখ তুলল না আহমদ মুসা। নিশ্চল, নিস্পন্দ সে। যেন ফাইলের দিকে তাকিয়ে পাথর হয়ে গেছে সে।
জেনারেল তাহির তারিকরা যতটা দ্রুত আহমদ মুসার অফিস কক্ষে ঢুকেছিল, ততটাই থমকে গেল তারা আহমদ মুসার নিজেকে হারিয়ে ফেলা তন্ময় ভাব দেখে।
তারা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়াল। বুঝল তারা যে, আহমদ মুসা গভীর চিন্তায় নিমগ্ন।
জেনারেল তাহির তারিক তাকাল ডঃ শেখ বাজের দিকে।
ডঃ শেখ বাজ একটু সচল হলো। আর দু’একধাপ এগিয়ে টেবিলের ধারে গিয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার।’
চমকে উঠে মুখ তুলল আহমদ মুসা।
সামনে জেনারেল তাহির তারিক এবং ডঃ শেখ বাজকে দেখে উঠে দাঁড়াল। হেসে বলল, ‘স্যরি, আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন। আমি একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। প্লিজ, বসুন আপনারা।’
বসল জেনারেল তাহির তারিক ও ডঃ শেখ বাজ।
আহমদ মুসাও বসল।
‘আপনার এমন আপনহারা চেহারা আমি আর কখনও দেখিনি। গত রাতে আপনার উপর দিয়ে যে ধকল গেছে, তাতে আপনি আজ অফিসে না আসলেও পারতেন। আপনার যথেষ্ট বিশ্রাম হচ্ছে না বলে আমি মনে করি।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘না, সেরকম কিছু নয়। আমি কোন ক্লান্তি অনুভব করছি না। আমি আমাদের সমস্যাগুলো নিয়েই ভাবছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘যার মন ক্লান্ত হয় না, তার দেহ ক্লান্ত হওয়ারও সুযোগ পায় না। আপনার মন কখনও ক্লান্ত হবার নয়, আমি জানি খালেদ খাকান। তবু কাজ ও বিশ্রামের একটা অংক আছে, সে অংক মানতে হয় আমাদের। যাক, মিঃ খালেদ খাকান। আমি এখানে আসার আগে টেলিফোন পেলাম হাজী জেনারেল মোস্তফা কামালের। তিনি সাংঘাতিক খুশি। তিনি জানালেন, আপনার অনুমান শতভাগ ঠিক। ঐ পাঁচটি ফিংগার প্রিন্ট আমাদের পাঁচজন গোয়েন্দার। তাদের গলিত দেহাবশেষও পাওয়া গেছে। আর….।’
জেনারেল তাহিরের কথার মাঝখানে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘কোথায় পাওয়া গেছে তাদের দেহাবশেষ?’
‘খাদের ফ্লোরে যে পাথরটা দেখিয়ে এসেছিলেন। বলেছিলেন যে, পাথরটা কোন সুড়ঙ্গ বা সিঁড়ি পথের মুখ হতে পারে। ঠিকই পাথরটা সরিয়ে একটা সিঁড়িপথ পাওয়া গেছে। সিঁড়িটা সিনাগগ থেকে বেরুবার একটা গোপন পথ। ঐ সিঁড়ি দিয়ে একটা স্যুয়ারেজ পথও পাওয়া গেছে। সেখানেই পাঁচটি লাশ পাওয়া গেছে।’
একটু থামল জেনারেল তাহির তারিক। বলে উঠল সংগে সংগেই আবার, ‘যা বলছিলাম, সিনাগগ সার্চ করে কিছু মূল্যবান ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। সবাই মনে করছে, আপনার দেখা দরকার ওগুলো।’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমি দেখব ওগুলো। আচ্ছা, সিনাগগে যারা মারা গেছে, তাদের পরিচয় পাওয়া গেছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘সে চেষ্টা হচ্ছে। তবে লাশের মধ্যে আপনি যার কথা বলেছিলেন, সেই ডঃ ডেভিড ইয়াহুদের লাশ নেই।’
‘ওদের কথা-বার্তায় শুনেছিলাম যে উনি সিনাগগের বাইরে আছেন, তবে এসেছেন কিংবা এসে পৌঁছেছিল কিনা এটা নিশ্চিত হবার জন্যেই লাশের মধ্যে তাকে সন্ধান করার কথা বলেছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জনাব খালেদ খাকান, রাতেই প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী আপনার সিনাগগ অপারেশনের রেজাল্টের কথা শুনেছেন। ভোর রাতেই তারা আমাকে টেলিফোন করে তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা আপনাকে জানাতে বলেছেন। আপনি তাদের কল করলে তারা খুশি হবেন। ভোর রাতে টেলিফোন করে আপনাকে কষ্ট দিতে তারা চাননি।’
‘ঠিক আছে, আমি তাদের টেলিফোন করব। কিন্তু আমরা আসলে খুব একটা এগোইনি। ওদের খবর দেবার মতো তেমন কিছু নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বলছেন কি আপনি! আমরা গত কয়েক মাসে এক ইঞ্চি এগোতে পারিনি। আপনি মাত্র কয়েক দিনে শুধু ষড়যন্ত্রটাকেই সামনে এনে ফেলা নয়, তাদের উপর আপনি শক্ত আঘাতও করেছেন।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘কিছুটা আমরা এগিয়েছি বটে। কিন্তু তাদের দিকে এগোবার দরজা আমরা পেয়েছিলাম। সেটা আল-আলা সিনাগগ। কিন্তু গত রাতের পর সে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি বন্ধ করতে চেয়েছিলাম না, মাত্র একটা গোপন অনুসন্ধানে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার যাওয়াটা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় বড় ঘটনা ঘটে গেল এবং সে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। এখন আমাদের সামনে দু’টি দুর্বল অবলম্বন অবশিষ্ট আছে, সে দু’টা হলো ….।’
বলে হঠাৎ থেমে গেল আহমদ মুসা। তার মনে হলো, সিনাগগে যাবার বিষয়টা এভাবে বলেই জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। সেদিনও তার সিনাগগে যাবার খবরটা জেনারেল তাহির তারিক ও ডঃ শেখ বাজের কাছে আহমদ মুসা বলেছিল। সেভাবে আর কোন কথা বলা যাবে না।
আহমদ মুসাকে হঠাৎ থেমে যেতে দেখে জেনারেল তাহির ও শেখ বাজ উৎসুক হয়ে উঠল। আহমদ মুসাকে খুব চিন্তিত দেখে এ বিষয়ে কিছু না বলে জেনারেল তাহির তারিক জিজ্ঞেস করল, ‘জানা-জানির বিষয়টা কিভাবে ঘটল? ওদের কাছে খবরটা কিভাবে পৌঁছল? আমার কাছে বিষয়টা খুব সাংঘাতিক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমাদের নিরাপত্তায় কোন ফুটো আছে। এ ফুটো বন্ধ না করলে তো আমরা সামনে এগোতে পারবো না।’
গম্ভীর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ, ‘আমি এ বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যেই আপনাদের ডেকেছি।’
বলে নড়ে-চড়ে বসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এ পর্যন্ত আমার মনে হয়, খবর পাচার বা লীক-আউট হওয়ার তিনটি ঘটনা ঘটেছে। আমি আল-আলা পাহাড়ের পুলিশ আর্কাইভসে কি উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম, সেটা শত্রুরা জেনে ফেলে। পরে আমি ডাঃ ইয়াসারের বাসায় যাওয়ার খবরও পাচার হয়ে যায়। তৃতীয় ঘটনা গত রাতে। আমি যে সিনাগগে যাচ্ছি, সেটাও শত্রুদের আগাম জানা হয়ে যায়। এর অর্থ আমাদের অফিসে কোন লিকেজ রয়েছে এবং বাইরের কারো সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে।’ থামল আহমদ মুসা।
চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল জেনারেল তাহির তারিক ও ডঃ শেখ বাজ দু’জনেরই।
‘সাংঘাতিক কথা! তাহলে তো আমাদের সব তথ্যই শত্রুরা পেয়ে যাচ্ছে! এমন কি এই কথা-বার্তাও হয় তো!’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
‘শেখ বাজ, তোমার শেষ কথাটা আতংকজনক। এতটা সন্দেহ করার কি আছে?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘আমার একথা বলার কারণ হলো, খালেদ খাকান স্যার তথ্য পাচারের যে তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন, সেখানে স্যারের যাওয়ার বিষয়ে আমাদের সাথেই আলাপ হয়েছে। অফিসের আর কেউ এসব বিষয় জানার প্রশ্নই ওঠে না।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
‘বিষয়টা তাহলে তো গুরুতর অবস্থার দিকে টার্ন নিচ্ছে। আমাদেরকে সামনে রেখেই তাহলে সন্দেহের যাত্রা শুরু করতে হবে।’ জেনারেল তাহির তারিক বলল।
‘জেনারেল তাহির তারিক দুইয়ে দুইয়ে চার হওয়ার মতো অংকের কথা বলেছেন। কিন্তু অংক ও ষড়যন্ত্র এক জিনিস নয়। ষড়যন্ত্রের অন্ধকার গলি অংকের নিয়মে চলে না। এখানে যা দৃশ্যমান হয়, বাস্তবতা তার চেয়ে ভিন্ন হয়ে থাকে। আপনাদের দু’জনের সাক্ষাতে যে কথা হয়, তা পাচার হওয়ার উৎস অনেক কিছুই হতে পারে। আমাদের দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ হওয়া দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে করণীয় বলুন মিঃ খালেদ খাকান।’ জেনারেল তাহির তারিক বলল।
আহমদ মুসা তার ফাইলের তলা থেকে একখণ্ড কাগজ বের করে জেনারেল তাহিরের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘এই কাজটা এখনি এই মুহূর্তে সম্পন্ন করতে হবে। সেনাবাহিনীর এ বিষয়ক একজন এক্সপার্ট এসেছেন। তিনিই কাজটা করবেন। তার অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউ কোন কথা আর বলব না।’
জেনারেল তাহির তারিক আহমদ মুসার দেয়া কাগজখণ্ড তার চোখের সামনে তুলে ধরল। পড়ল, ‘আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ফ্লোরে সবগুলো প্রশাসনিক কক্ষের প্রতিটি ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা, অফিসের জিনিসপত্র সবকিছু ট্রান্সমিশন-সেনসেটিভ স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করে প্রমাণ করতে হবে, অফিসের কোথাও কোন গোপন ট্রান্সমিটার নেই। অনুসন্ধানের এই সময়টা অফিসের সবাইকে তাদের স্ব স্ব জায়গায় ডিউটিরত অবস্থায় থাকতে হবে। এ বিষয়টা লিখে দিলাম এই কারণে যে, শত্রুদের কাছে এ তথ্য যাতে না যায়, আমরা আমাদের অফিসে ট্রান্সমিটার থাকার বিষয় সন্দেহ করেছি এবং তার সন্ধান করছি।’
পড়ে জেনারেল তাহিরের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ মিঃ খালেদ খাকান। এ বিষয়টি যে আপনার মাথায় এসেছে, এজন্যে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘কাজটা শেষ হবার আগে আমরা কেউ কথা বলব না জেনারেল তাহির তারিক।’
চমকে উঠল জেনারেল তাহির। বলল, ‘স্যরি, উৎসাহের বশে ভুলে গিয়েছিলাম। সত্যিই স্যরি।’
বলে জেনারেল তাহির তারিক কাগজখণ্ড তুলে দিল ডঃ শেখ বাজের হাতে। শেখ বাজও পড়ল কাগজখণ্ড। তার মুখও আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌, স্যার ঠিক পথে এগোচ্ছেন।’
‘আবার কথা!’ বলল জেনারেল তাহির তারিক ডঃ শেখ বাজকে লক্ষ্য করে।
ডঃ শেখ বাজ জিভ কাটল।
সবাই যে যার টেবিলে চলে গেল।
দু’ঘন্টা ধরে চলল ট্রান্সমিশন-সেনসেটিভ স্ক্যানার (TSS)-এর অনুসন্ধান। TSS যন্ত্রটি ট্রান্সমিশন-সেনসেটিভ ডিটেক্টরের (TSD) উন্নততর সংস্করণ। এই যন্ত্রটি দুই বর্গফুট এরিয়ার মধ্যে আলপিনের আগার চেয়েও সূক্ষ্ম ট্রান্সমিটার যে কোন কভারের মধ্যেই থাক, তা বের করে ফেলতে পারে।
দুই ঘন্টার অনুসন্ধান শেষে অনুসন্ধান টিমের প্রধান কর্নেল জামালী ওনাল আহমদ মুসার কাছে এসে তার হাতে একটা এনভেলাপ তুলে দিয়ে বলল, ‘স্যার, অত্যন্ত পাওয়ারফুল একটা ট্রান্সমিটারের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমার রিপোর্টে তার সব বিবরণ রয়েছে।’
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা এনভেলাপটি নিয়ে বলল, ‘প্লিজ কর্নেল, একটু বসুন।’
বসল কর্নেল জামালী ওনাল।
আহমদ মুসা এনভেলাপ খুলে রিপোর্টের উপর চোখ বুলাতে গিয়ে মুখ মলিন হয়ে গেল তার। ডঃ শেখ আবদুল্লাহ বিন বাজের কোট-পিনে ট্রান্সমিটার। তার সন্দেহ তাহলে সত্য প্রমাণ হলো! কিন্তু এই সত্য হওয়াটা খুবই বেদনাদায়ক। ঘরের পরিবেশ বৈরি হলে তার চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কিছু নেই। আহমদ মুসা বলল, ‘কর্নেল, এই ট্রান্সমিটারের মেসেজ কতদূর পৌঁছতে পারে এবং এই মেসেজ একাধিক জন রিসিভ করতে পারে কিনা?’
‘শহরাঞ্চলে এর রেঞ্জ দশ বর্গমাইলের বেশি নয়। কিন্তু শহরের বাইরে এর রেঞ্জ চার গুণ বেশি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এর মেসেজ ট্রান্সমিটটা টার্গেটেড। এর মেসেজ রিসিভ করার জন্যে এর গোপন কোডের ফ্রিকোয়েন্সি জানা থাকা দরকার।’
‘ধন্যবাদ কর্নেল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার।’ বলে উঠে দাঁড়াল কর্নেল জামালী ওনাল।
কর্নেল উঠে যেতেই আহমদ মুসা কর্নেলের দেয়া এনভেলাপ নিয়ে ছুটল জেনারেল তাহির তারিকের কক্ষে।
আহমদ মুসা জেনারেল তাহিরের কক্ষে গিয়ে তাকে এনভেলাপ দিয়ে সবকিছু বলল। সব শুনে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল জেনারেল তাহির তারিকের। বলল ভারি, ভাঙা কণ্ঠে, ‘শেষ পর্যন্ত ডঃ শেখ বাজ এই বিশ্বাসঘাতকতা করল!’
‘না মিঃ জেনারেল তারিক, ডঃ শেখ বাজ নিরপরাধ। ওর ‘কোট-পিন’ যে একটি ট্রান্সমিটার, তা উনি জানেন না, আমি নিশ্চিত।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল তাহির তারিকের।
‘বলছি। তার আগে ডঃ শেখ বাজকে এখানে ডাকুন।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলল, ‘তাকে বলুন, আসার আগে তার কোটটা যেন তিনি খুলে রেখে আসেন।’
‘কেন মিঃ খালেদ খাকান?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘তার কোটে ‘কোট-পিন’ আছে। সেটা থাকলে কোন কথা বলা যাবে না।’
‘বুঝেছি, ধন্যবাদ।’ বলে জেনারেল তাহির ডঃ শেখ বাজকে তার নিজের কক্ষে আসতে বলল এবং বলে দিল, আসার সময় যেন সে তার কোট কক্ষে খুলে রেখে আসে।
মিনিটখানেকের মধ্যেই ডঃ শেখ বাজ জেনারেল তাহিরের কক্ষে এল।
ডঃ শেখ বাজ বসলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এক মিনিট, আমি আসছি।’
আহমদ মুসা ঘরের বাইরে এসে সোজা গিয়ে ঢুকল শেখ বাজের কক্ষে। দেখল, ডঃ শেখ বাজের কোট তার হ্যাংগারে টাঙানো এবং কোট-পিনটা জ্বলজ্বল করছে তার কোটে। খুশি হলো আহমদ মুসা।
ফিরে এল সে জেনারেল তাহিরের কক্ষে।
ডঃ শেখ বাজ কোট-পিনটা পকেটে নিয়ে এসেছে কিনা, সেটা নিশ্চিত হবার জন্যেই আহমদ মুসা ডঃ বাজের কক্ষে গিয়েছিল। এটা নিশ্চিত হবার তার প্রয়োজন ছিল দুই কারণে—এক. ডঃ শেখ বাজের নির্দোষিতা সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হওয়া, দুই. আরও সাবধানতা অবলম্বন করা যে, কোট-পিনটা তার সাথে ভুলক্রমেও আসেনি।
আহমদ মুসা এলে জেনারেল তাহির তারিক বলল, ‘মিঃ খালেদ খাকান, শুরু করুন।’
‘মিঃ শেখ বাজ, কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলে তো কিছু মনে করবেন না?’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, ব্যক্তিগত কিংবা যে কোন প্রশ্ন করার অধিকার আপনার আছে।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
‘ধন্যবাদ ডঃ শেখ বাজ।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর শুরু করল, ‘বিয়ের আগে আপনার স্ত্রীর সাথে প্রথম দেখা আপনার কোথায় হয়?’
‘প্রথম দেখা হয় লেবাননের আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে এক আন্তর্জাতিক ছাত্র-সেমিনারে। তারপর জার্মানিতে আমরা একসাথে পিএইচডি করি।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
‘আপনার স্ত্রীর জন্মস্থান লেবাননের বেকাতে। কখনও আপনি সেখানে গেছেন?’
‘না, যাইনি। এমন কি বিয়ের পর লেবাননেও আর যাওয়া হয়নি।’ ডঃ শেখ বাজ বলল।
‘আপনি কি আপনার স্ত্রীর একাডেমিক রেকর্ডগুলো দেখেছেন?’
‘একসাথে পিএইচডি করার সময় গ্র্যাজুয়েশন সার্টিফিকেট, মার্কসশীট দেখেছি। অন্যকিছু দেখার কখনও প্রয়োজন হয়নি।’ বলল ডঃ শেখ বাজ।
‘বৈরুতে হায়ার স্কুলে ঢোকার সময় আপনার স্ত্রী শুধু নাম নয়, গোটা একাডেমিক রেকর্ড বদলে ফেলেন, এটা কি আপনি জানেন?’
বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে ডঃ শেখ বাজ তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল প্রতিবাদী কণ্ঠে, ‘এটা কি ঠিক স্যার?’
‘দুঃখিত ডঃ শেখ বাজ। আমি যা বলেছি, তা সম্পূর্ণ সত্য। শুধু তাই নয়, আপনার স্ত্রী বেকাতে এক লেবাননী ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক স্কুল তিনি শেষ করেন ইসরাইলে। তারপর ফিরে আসেন লেবাননে। তখন তার নাম ছিল আলিশা দানিয়েল। লেবাননে তিনি ফেরার পর ‘আয়েশা আজিমা’ নামে একজন প্রাথমিক স্কুল পাস ছাত্রী রহস্যজনকভাবে খুন হয়। অন্যদিকে এই ছাত্রীর গোটা পরিবারের সবাই এক বিস্ফোরণে নিহত হয়। আয়েশা আজিমা খুন হওয়ার পর আলিশা দানিয়েল হয়ে যান আয়েশা আজিমা। এই নাম ও আয়েশা আজিমার একাডেমিক রেকর্ড নিয়ে তিনি ভর্তি হন বৈরুতের হায়ার স্কুলে। ফিলিস্তিনের গোয়েন্দা বিভাগের অনুরোধে লেবাননের গোয়েন্দা বিভাগ অনুসন্ধান করে এ তথ্য জানিয়েছে। আমি ফিলিস্তিন সরকারকে অনুরোধ করেছিলাম এ তথ্য জানার জন্যে।’ থামল আহমদ মুসা।
ডঃ শেখ বাজ নির্বাক, নিস্তব্ধ। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে-মুখে অসীম বিস্ময়। এক অসহায় ভাব ফুটে উঠেছে তার চেহারায়।
আহমদ মুসা তার একটি হাত ডঃ শেখ বাজের কাঁধে রাখল। সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘মন শক্ত করুন ডঃ শেখ বাজ। আপনার স্ত্রী গুরুতর কাজে আপনার অজান্তে আপনাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন।’
আহমদ মুসা একটু থামল। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘আপনি আপনার ‘কোট-পিন’টা কোথায় পেয়েছিলেন ডঃ বাজ?’
‘আমার স্ত্রী সংগ্রহ করেন। তিনিই আমাকে এটা ব্যবহারের জন্যে দেন।’ বলল শুকনো কণ্ঠে ডঃ শেখ বাজ।
‘আপনি জানেন না শেখ বাজ, আপনার কোট-পিনটা একটা ট্রান্সমিটার। অফিসে আপনি যত কথা বলতেন, যত কথা আপনাকে বলা হতো, ঐ ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সব চলে যেত আপনার স্ত্রীর কাছে রক্ষিত গ্রাহক যন্ত্রে। আপনার স্ত্রী সেগুলো সংগে সংগেই জানিয়ে দিতেন ষড়যন্ত্রকারী……।’
আহমদ মুসার কথায় বাঁধা দিয়ে আর্তকণ্ঠে বলে উঠল ডঃ শেখ বিন বাজ, ‘আর বলবেন না স্যার। আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে। আমি সব বুঝতে পারছি। কেন সে কোট-পিনটার প্রতি এত লক্ষ্য রাখত, কেন সে প্রতিদিন কোটে আমার কোট-পিনটাকে ঠিকঠাক করে দিত। আমি ভাবতাম, কোট-পিনে যেহেতু ‘কাবা’ শরীফের প্রতিকৃতি আছে, তাই এর প্রতি তার এই যত্ন।’
থেমে গেল ডঃ শেখ বাজ। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল তার কণ্ঠ।
সান্ত্বনা দেবার জন্যে ডঃ শেখ বাজের কাঁধে হাত রাখল আহমদ মুসা।
এই সান্ত্বনায় সে আরও ভেঙে পড়ল। তার দু’চোখ থেকে নেমে এল অশ্রুর বন্যা। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে।
জেনারেল তাহির তারিক তার চেয়ার থেকে উঠে এল এবং ডঃ শেখ বাজের পাশে বসল। কয়েকখণ্ড টিস্যু পেপার তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘চোখ মোছ ডঃ শেখ বাজ। তুমি কি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই তুখোড় ছাত্রনেতা নও, যে জাতির কাছে নিজের জীবন উৎসর্গ করার শপথ নিয়েছিল! তুমি কি সেই ডঃ শেখ বাজ নও, যে এই গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাকরিকে যুদ্ধ হিসেবে নিয়েছিল! তুমি বরং এখন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর যে, তোমার প্রতি, তোমার জাতির প্রতি, মানবতার প্রতি তোমার স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতা আল্লাহ যথাসময়ে ধরিয়ে দিয়েছেন আরও কোন বড় ক্ষতি হবার আগেই।’
ডঃ শেখ বাজ চোখ মুছল। বলল, ‘আমার কষ্ট অন্য জায়গায় স্যার। আয়েশা আজিমা আমার এত কাছের হয়েও এত দূর হতে পারল কি করে! সে তো মানুষ।। হৃদয় ছাড়া তো কোন মানুষ নেই! সেই হৃদয়কে পদদলিত করে কোন স্বার্থে সে আমার সাথে, আমার পরিবারের সাথে এই বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারল!’ বলে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।
‘তোমার এই কষ্ট স্বাভাবিক ডঃ বাজ। কিন্তু সে তার হৃদয়বৃত্তি, প্রেম-ভালোবাসা এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্বের চাইতে তার জাতিগত পরিচয় ও দায়িত্বকেই বড় করে দেখেছে। তোমাকেও শক্ত হতে হবে শেখ বাজ। ন্যায়ের প্রতি তোমার দায়িত্বকেও সবার উপরে স্থান দিতে হবে তোমাকে। তোমার ক্ষেত্রে যা ঘটল, ষড়যন্ত্রের রঙ্গমঞ্চে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে।’ বলল আহমদ মুসা।
চোখ মুছে সোজা হয়ে বসল ডঃ শেখ বাজ। সে বলল জেনারেল তাহিরকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার, আয়েশা আজিমা এখন বাড়িতে আছে। তিনটায় যাবে সে আমার মেয়েকে আমার বোনের বাড়ি থেকে আনতে। তার আগেই তাকে আপনারা গ্রেফতার করুন।’
থামল। একটা দম নিল। তারপর সে হাতজোড় করে বলল, ‘আমি আপনাদের সাথে যেতে পারবো না। আপনারাই তাকে গ্রেফতার করে আনুন। আমি তার দিকে চাইতে পারবো না। আমি সহ্য করতে পারবো না অসহ্য সেই দৃশ্যটাকে। আমার এই দুর্বলতাকে আপনারা ক্ষমা করুন।’ আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল ডঃ শেখ বাজ।
আহমদ মুসা ও জেনারেল তাহির তারিক দু’জনেই দু’দিক থেকে ডঃ শেখ বাজের পিঠে সান্ত্বনার হাত রাখল। জেনারেল তাহির তারিক বলল, ‘ঠিক আছে ডঃ বাজ, তুমি যেভাবে চাচ্ছ, সেভাবেই হবে। তবে আমরা তোমার বাসায় যাব আরও ঘণ্টা দুয়েক পর। এ দুই ঘণ্টা আমাদের ব্যস্ত থাকতে হবে। আজ টেস্ট ল্যাবে আমাদের একটা আবিষ্কারের ল্যাব-প্রদর্শনী হবে। সেখানে ওআইসি চেয়ারম্যান, সেক্রেটারি জেনারেল, তুর্কি প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী আসছেন।’
থামল জেনারেল তারিক।
‘কিন্তু তাকে ধরাটাই আপনাদের এই মুহূর্তের প্রথম প্রায়োরিটি হওয়া উচিত। তাকে ধরলে ষড়যন্ত্রটাকেও আপনারা ধরতে পারবেন। আমি জানি না, আমাদের এই চিন্তা-ভাবনা সে জানতে পারছে কিনা। কিন্তু তাকে কোনভাবেই পালাবার সুযোগ দেয়া উচিত নয়।’ বলল ডঃ শেখ বাজ শুকনো, ভাংগা কণ্ঠে।
শুনেই জেনারেল তাহির তারিক একবার আহমদ মুসার দিকে চেয়ে মোবাইল তুলে একটা কল করল। কল পেয়ে সালাম বিনিময়ের পর বলল, ‘স্যার, ল্যাব-প্রদর্শনীটা দু’ঘণ্টা পিছিয়ে দিতে হবে। একটা ইমারজেন্সি কাজ দেখা দিয়েছে। মিঃ খালেদ খাকানকে এখনি বেরুতে হবে। আমি তার সাথে যেতে পারি। মাননীয় প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এই ডিসপ্লেতে খালেদ খাকানের উপস্থিত থাকা খুব জরুরি। আপনি যদি যোগাযোগ করে একটা সিদ্ধান্ত নেন ভালো হয়।’
বলে ওপারের কথা শুনে টেলিফোন রেখে দিল জেনারেল তাহির তারিক। বলল, ‘ডক্টর বিজ্ঞানী আমির আবদুল্লাহ আন্দালুসী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হাউজের সাথে যোগাযোগ করে এখনি জানাবেন।’
‘প্রদর্শনীতে আজ কোন বিষয়টা দেখানো হবে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমাদের ‘সোর্ড’-এর ফোটন-নেট যে কোন উড়ন্ত বস্তুকে আটকে আরো উপরে সরিয়ে নিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। আমাদের বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেছিল এই বিস্ফোরণটা পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলের বাইরে নিয়ে গিয়ে করার। সে ক্ষেত্রে আমরা সফল হয়েছি। আজ সেটাই ল্যাব-ডিসপ্লেতে দেখানো হবে।’ বলল জেনারেল তাহির।
‘শুরু থেকেই আমার একটা জিজ্ঞাসা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘এসডিআই’ এবং আমাদের ‘সোর্ড’-এ দু’য়ের পার্থক্য কি? দু’টিই তো উড়ে আসা অস্ত্র ধ্বংস করে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘দু’য়ের মধ্যে যোজন যোজন পার্থক্য। মার্কিন ‘এসডিআই’ হলো কাউন্টার ক্ষেপণাস্ত্র যা আক্রমণকারী ক্ষেপণাস্ত্রকে পূর্বাহ্নে আঘাত করে ধ্বংস করে। আর আমাদের ‘সোর্ড’ কোন অস্ত্র নয়। এটা উড়ন্ত সকল বস্তুকে গ্রেফতার করার একটা ব্যবস্থা। ‘সোর্ড’-এর ফোটন-নেট উড়ন্ত বস্তুকে বন্দী করে মানুষের পৃথিবী, পৃথিবীর আবহাওয়া থেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে ফোটন-চুম্বক ডেটোনেটরের মাধ্যমে উড়ন্ত অস্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিস্ফোরণ ঘটায়। ‘সোর্ড’-এর এই কীর্তিটা আজ নিজ চোখে দেখবেন ‘সোর্ড’-এর ল্যাব-ডিসপ্লের সময়।’
টেলিফোন বেজে উঠল জেনারেল তাহির তারিকের।
‘নিশ্চয় ডক্টর আন্দালুসী টেলিফোন করেছেন’ বলে টেলিফোন ধরল জেনারেল তাহির তারিক।
টেলিফোনে কথা বলার পর রিসিভার রাখতে রাখতে বলল, ‘হ্যাঁ, ল্যাব-ডিসপ্লে দু’ঘণ্টা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বলেছেন, খালেদ খাকান চাইলে দু’ঘণ্টা কেন, দু’দিন পেছাতেও আমাদের আপত্তি নেই। তাহলে তো হয়ে গেল। এখন মিঃ খালেদ খাকান, বলুন কি করতে হবে আমাদের? আমরা ডক্টর শেখ বাজের কোট-পিনটা এখন নিয়ে নেব এভিডেন্স হিসেবে?’
‘এখন নয়। এখন পিন ট্রান্সমিশন বন্ধ রাখা যাবে না। ‘কোট-পিন’ ধরা পড়েছে সন্দেহ হলে ঘটনা ভিন্ন দিকে যেতে পারে। ডঃ শেখ বাজ এখন কোট-পিন সমেত কোট পরে স্বাভাবিকভাবে অফিস করবেন। আমার মনে হয় ডঃ বাজ, আপনি আইটি ইঞ্জিনিয়ার ইসমত কামালকে সাথে নিয়ে গত মাসের ডোরভিউ-এর মনিটরিং রিপোর্ট তৈরি করে ফেলুন।’ বলে আহমদ মুসা ইন্টারকমে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল ইসমত কামালকে এবং নির্দেশ দিল এখনি ডঃ শেখ বাজের কক্ষে আসতে।
‘ধন্যবাদ’ বলে উঠে দাঁড়াল ডঃ শেখ বাজ। বলল, ‘স্যার, ওদিকে দেখছি। আই উইশ ইউ অল গুডলাক, স্যার।’ ভারি কণ্ঠ ডঃ বাজের। বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।
‘খুব ভালো ছেলে। অসহনীয় এক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ল। কাজ যাই হোক, ওকে সাথে নিয়ে ব্যস্ত রাখার ব্যবস্থা করে গেলাম।’ বলল আহমদ মুসা। উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
উঠে দাঁড়াল জেনারেল তাহির তারিকও।
‘জেনারেল, আপনি হাজী মোস্তফা কামালকে বলুন আমাদের পুলিশী সাহায্য দরকার। কিন্তু পুলিশ যেন আমরা পৌঁছার পরে পৌঁছে।’
মনে মনে বলল আহমদ মুসা, এখন আয়েশা আজিমাই আমাদের প্রধান দরজা লক্ষ্যে পৌঁছার। তাকে হাতছাড়া হতে দেয়া যাবে না। ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও দরজা হতে পারেন, আয়েশা আজিমার পরেই তার পালা আসবে। ‘থ্রী জিরো’র কাছে পৌঁছার জন্যে তার বাড়তি হাতিয়ার সাবাতিনি ইয়াসার। কিন্তু তাকে নিয়ে বেশি দূর যাওয়া যাবে না।
‘কিছু ভাবছেন আহমদ মুসা?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘ভাবছি থ্রী জিরো’র ষড়যন্ত্রের কথা। হিসেব কষলে খুব একটা এগোতে পারিনি আমরা। কতগুলো বিকল্প নিয়ে তারা এগোচ্ছে, বিস্তারিত না জানলে প্রতিরোধ দাঁড় করানো যাবে কোন পথে? চলুন, আয়েশা আজিমাকে হাতে পাওয়ার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।’
‘চলুন।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।

সাইমুম সিরিজের পরবর্তী বই
‘রোমেলী দুর্গে’

Top