৫১. প্যাসেফিকের ভয়ংকর দ্বীপে

চ্যাপ্টার

ইয়াংম্যান, তুমি যা বলেছ তার সরল অর্থ হলো কোন অ্যাটল দ্বীপে বাইরে থেকে সহজে দেখা যায় না এমন কোন স্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব কি না? এর সরল উত্তর হলো, সম্ভব নয়। কারণটা দেখ, একটা অ্যাটলে কি থাকে? চারদিকের সংকীর্ণ অথবা কিছুটা প্রশস্ত ভূমি সীমানা, এই ভূমি সীমানার মাঝখানে থাকে লেগুন।লেগুনের নিচে থাকে কোরাল লাইমস্টোনের সলিড বেজ। এই বেজটা ধীরে ধীরে এখানে উঠে এসেছে সাগরের ফ্লোর থেকে। পানির নিচে অ্যাটলের এই সলিড বেজের চারিদিকের দেয়াল নানা রকমের হতে পারে। মসৃণ হতে পারে, এবড়ো-থেবড়ো হতে পারে, সূচালো অথবা ভোঁতা কোরালের ঝাড়ে পূর্ণও হতে পারে। এসব নিয়েই একটা অ্যাটল দ্বীপ। এর মধ্যে ইনডিভিজুয়াল স্থাপনা গড়ে উঠার সুযোগ কোথায়?
কথাগুলো বলছিল ইজিচেয়ারে শোয়া শুভ্র কেশ, শুভ্র ভ্রূর একজন বৃদ্ধ। মুখের চামড়াও তার অনেক কুঁচকানো। উজ্জ্বল সোনালী চেহারায় তার চোখ দু’টি খুবই সজীব ও তীক্ষ্ণ।
বৃদ্ধের নাম অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি।
তাহিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওসেনিক ল্যান্ড-সাইন্সের সাবেক অধ্যাপক। গোটা প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় এই বিষয়ে সে অদ্বিতীয় বিশেষজ্ঞ। দুনিয়াজোড়া নাম তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার সাথে সাথে সে প্যাসিফিক আইল্যান্ড ইন্সটিটিউটের প্রধাণও ছিল।
অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি মারেভার বাবার শিক্ষক ছিল। আবার তার পারিবারিক বাড়ি “আরু”তে। এই কারণে মারেভাদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্ক আছে অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতির পরিবারের সাথে।
মারেভাই আহমদ মুসাকে নিয়ে এসেছে অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতির কাছে। অ্যাটল দ্বীপগুলোর কম্পোজিশন সম্পর্কে আহমদ মুসা জানতে চায়। আর জনতে চায় অ্যাটলগুলোতে কোন গোপন স্থাপনা কিভাবে গড়ে উঠতে পারে।
আহমদ মুসা তার মাল্টিওয়েভ মনিটরে পাওয়া এসএমএস মতুতুংগা দ্বীপ থেকেই এসেছে এটা নিশ্চিত হবার পর ভেবে কুল-কিনারা পাচ্চে না। ছোট এই দ্বীপের কোথা থেকে তার কাছে এসওএস বার্তা এল!চারদিকে ঘুরে সে মতুতুংগা দ্বীপটাকে দেখেছে। তাছাড়া কম্পিউটারে দ্বীপটির স্যাটেলাইট ইমেজ সে পরিক্ষা করেছে। এতে উপরের সারফেস ছাড়াও দ্বীপটির পানির তলের বেজটাকেও সে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। এই অবস্থায় মারেভা তাঁকে নিয়ে এসেছে অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতির কাছে।
অধ্যাপক তাতিহিতি “আরু”তে তার পৈত্রিক বাড়িতে অবসর জীবনযাপন করছে। সারা জীবন ধরে সমৃদ্ধ করে তোলা পৈত্রিক পাঠাগারে পড়াশুনা, বাড়ির চারদিকের বাগানের টুকিটাকি পরিচর্যা ও বাগানে ঘুরে বেড়িয়েই তার সময় কেটে যায়। আজ খুশি হয়েছে সে আহমদ মুসাদের পেয়ে।
অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতির কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, কিন্তু স্যার, আমি নিশ্চিত একটি অ্যাটলে গোপন স্থাপনা আছে এবং সেখানে মানুষও আছে। যদি এটা সত্য হয়, তাহলে গোপন স্থাপনা কিভাবে গড়ে উঠল?
তুমি ‘যদি’ শব্দ ব্যবহার করেছ। কিন্তু এই ‘যদি’টাকে সত্য বলে নিশ্চিত হচ্ছো কেমন করে, ইয়ংম্যান? বলল অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি।
স্যার, আমি ঐ দ্বীপের এক স্থান থেকে একটি এসওএস বার্তা পেয়েছি। আহমদ মুসা বলল।
তুমি কি করে নিশ্চিত হচ্ছো, এসওএস বার্তাটা ঐ অ্যাটল থেকেই এসেছে? বলল অধ্যাপক তাতিহিতি।
আহমদ মুসা তার অংকের বিবরণ দিয়ে বলল, আমার হিসাবে কোন ভুল হয়নি স্যার।
অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি মাথা নেড়ে বলল, ইয়াংম্যান, অংক তোমার ঠিক আছে।কিন্তু অ্যাটলে গোপন স্থাপনা কোত্থেকে আসবে, সে অংক তো মিলছে না!
আহমদ মুসা ভাবছিল। বলল, স্যার, অ্যাটলের কোরাল স্টোন বেজ যা সাগরের ফ্লোর থেকে উঠে এসেছে, তা কি সব সময় সলিড হতে বাধ্য? দেয়ালঘেরা ঘরের মত ফাঁপা হয়ে উঠতে পারে না তা? এভাবে তা কি লেগুনের ফ্লোরের নিচে কোন স্থাপনা গড়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে না?
আহমদ মুসার প্রশ্ন শুনে অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিল।সংগে সংগে উত্তর দিল না। তার চোখ বুজে গিয়েছিল। ভাবছিল সে।
এক সময় চোখ খুলল অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি। সোজা হয়ে বসল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ইয়ংম্যান, তুমি কি বলতে চাচ্ছ আমি বুঝেছি। স্রষ্টার সৃষ্টি বড় বিচিত্র।এর কতটুকু আমরা জানি। এখানে সম্ভব-অসম্ভবের সীমারেখাও টানা যায় না। অতএব, তুমি য বলছ থাকতে পারে, আবার নাও পারে। বিজ্ঞানের কথা যদি বল তাহলে বলব কোরাল স্তরের বৈচিত্রময় গঠনের ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক মাপ-জোক থেকে পাওয়া যাবে না। এগুলো মহান স্রষ্টার ইচ্ছার সৃষ্টি।তুমি অ্যাটলের বেজে কোরাল স্টোন ওয়ালকে যেমন ফাঁপা হওয়ার কথা বলছ, তা স্রষ্টার ইচ্ছার আওতার বাইরে নয়।
বলে থামল অধ্যাপক তাতিহাতি। হঠাৎ তার মুখে ভাবনার একটা ছাপ ফুটে উঠল। তার সাথে সাথে তার ঠোঁটে দেখা গেল এক টুকরো হাসিও। তাকাল সে মারেভা মাইমিতির দিকে। বলল, মারেভা, তোমার নিশ্চয় মনে আছে জগতেশ্বরী ও প্রথম মানবী হিনা, প্রিন্স হেসানা হোসানা ও সাগর-রূপা জলকন্যা ভাইমিতি শাবানুর কাহিনী। এই কাহিনীতেই আছে প্রিন্স হেসানা হোসানার প্রতি সদয় জগতেশ্বরী হিনা পাগল প্রেমিক প্রিন্সকে তার প্রেমিকা ভাইমিতি শাবানুর সাথে দেখা করিয়েছিল পানির তলে অ্যাটলের এক প্রাসাদে। অ্যাটলের পানির তলে মানে অ্যাটলের বেজ এলাকায় যে প্রাসাদ থাকতে পারে, তাহিতি এলাকার এই কাহিনীতে তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায়।
অধ্যাপক তাতিহিতি থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, কাহিনীটা কি স্যার?
রূপকথা যেমন হয়, এ তেমনি এক কাহিনী। এটা পমারে রাজবংশের এক রাজপুত্রের কাহিনী।
বলে একটু থামে অধ্যাপক তাতিহিতি তাকাল মারেভা মাইমিতির দিকে। বলল, মারেভা, তুমি জানলে কাহিনীটা, বল।
মারেভার মুখ লাল হয়ে উঠল। এক ছোপ লজ্জা এসে ঢেকে দিল তার চোখ-মুখ। সে মুখ নিচু করল।
হাসল অধ্যাপক তাতিহিতি। বলল, ঠিক আছে, আমিই বলছি।বলে শুরু করল অধ্যাপক তাতিহিতিঃ অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপিয়দের আগমন শুরু হয় প্রশান্ত মহশাগরীয় অঞ্চলে। কিন্তু তার আগে কয়েক শতাব্দী ধরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে অনেক রাজবংশের উত্থান ঘটে। তাহিতিতেও এমন একটি রাজবংশ কয়েক শতাব্দী ধরে রাজত্ব করেছে। তাহিতির পমাতে রাজবংশ এদেরই উত্তরসূরি। ঐ রাজবংশের নামও এখন জানা নেই।সেই অজানা বংশের এক রাজপুত্র ছিল হেসানা হোসানা, যার অর্থ সুন্দর ও শক্তির রাজমুকুট। এই সুন্দর রাজপুত্রের শখ ছিল সাগরে ঘুরে বেড়ানো। মাঝে মাঝেই তার নিরুদ্দেশ যাত্রা হতো সাগরে। দিন, রাত, সপ্তাহ গড়িয়ে যেত সে বাড়িতে ফিরতো না। এ দ্বীপ থেকে সে দ্বীপে, এ অ্যাটল থেকে সে অ্যাটলে ঘুরে বেড়াত। তার পালতোলা সাগরজ্বয়ী সুদৃশ্য রাজকীয় বোটে একাই ঘুরে বেড়াত সে। একদিন এক জ্যোৎস্না-গলানো সুন্দর রাতে তার বোট নোঙর করা ছিল এক অ্যাটলের তীরে। বোটের ডেগে বসে সে তন্ময় হয়ে উপভোগ করছিল জ্যোৎস্নাপ্লাবিত সাগরের নিরব-নিঝুম সৌন্দর্য। এই সময় পুব সাগরের বুক থেকে উঠে আসে এক খন্ড কালচে রক্তিম মেঘ। শুরু হয় প্রবল ঘুর্ণি। সে ঘুর্ণিতে তলিয়ে যায় তার বোট। সেও ছিটকে পড়ে যেন কোথাও! নিজেকে হারিয়ে ফেলে সে। নিজেকে আবার ফিরে পেয়ে যখন সে চোখ খুলে, তখন সে দেখে সুসজ্জিত ঘরের অসম্ভব সুন্দর এক নরম বিছানায়। চোখ ঘুরাতে গিয়ে তার চোখ পড়ে পাশেই সুন্দর আসনে বসা নীল বসনা, নীল নয়না এক অপরূপ সুন্দরীর উপর। তার সাগর-নীল রাজকীয় পোষাকের উপর তার সাগর নীল দোপাট্রা মাথা থেকে কপাল পর্জন্ত নেমে এসেছে। চাঁদের মতো মুখটিই শুধু তার খোলা। চাঁদে কলংক আছে, কিন্তু তার দুধ-আলতা মুখে কোন কলংক নেই। রাজপুত্রের চোখ যেন বাঁধা পড়ে গেল তার মুখে! চোখ সরাতে পারল না রাজপূত্র। পল পল করে সময় বয়ে গেল। দৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তবু পলক পড়ে না চোখে। নিল-নয়না সুন্দরী তার চোখ সরিয়ে নিল ঠোঁটে এক টুকরো হাসি টেনে। বলল শাহজাদা আপনি এখন সুস্থ। আপনার বোটও ঠিক হয়ে গেছে। সেটাও তৈরি। আপনি ইচ্ছা করলে এখনই উঠতে পারেন।
রাজপুত্র তখনও তার চোখ সরাতে পারেনি। সুন্দরীর কথাগুলো তার কানে যেন অমৃত ঢেলে দিল! তাহিতি ভাষায় এমন শুদ্ধ, মিষ্টি উচ্চারণ আগে সে শোনেনি।
সুন্দরীর চোখ ঘুরে এল আবার রাজপুত্র হেসানা হোসানার মুখের উপর। আবার আটকা পড়ে গেল দুই জোড়া চোখ।
সুন্দরীর চোখে-মুখে ফুটে উঠল সলাজ হাসি। সে মুখ নিচু করল। বলল, তাহলে শাহজাদা, আরও একটু বিশ্রাম করুন।
উঠতে যাচ্ছিল সুন্দরী।রাজপুত্র হেসানা হোসানা বলল, আমি কোথায় রাজকন্যা?
সুন্দরী মিষ্টি হাসল। বলল, আমি রাজকন্যা নই। আমি বলতে পারেন, সাগরকন্যা। আপনি অ্যাটল রাজ্যের এক প্রাসাদে, মানে অ্যাটলের এক নিবাসে।
যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল সুন্দরী। রাজপুত্র হেসানা হোসানা বিছানায় উঠে বসল। বলল, আপনার নাম কি?
সুন্দরী তার নিচু মুখ না তুলেই বলল, আমি ভাইমিতি শাবানু। বলেই সুন্দরী ভাইমিতি শাবানু পা তুলল যাবার জন্যে।
রাজপুত্র নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে মরিয়া হয়েই বলল, আমি যদি না যেতে চাই? আমি যাব না।
পেছনে না তাকিয়েই ভাইমিতি শাবানু সেই মিষ্টি হেসে বলল, অতিথিশালা তো কারো বাড়ি হয় না! এখানে অতিথিরা আসেন চলে যাবার জন্যেই। আপনিও যাবেন।
বলে চলে গিয়েছিল ভাইমিতি শাবানু।
চলেই আসতে হয় রাজপুত্র হেসানা হোসানাকে। দ্বিতীয়বার এসে ভাইমিতি শাবানু যখন রাজপুত্রের চোখে চোখ রেখে বলল, আসুন শাহজাদা। তখন কি এক অমোঘ টানেই রাজপুত্র উঠে দাঁড়াল, যেন এমন মিষ্টি ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য তার নেই।
রাজপুত্র হেসানা হোসানা যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালে ভাইমিতি শাবানু বলল, শাহজাদা, এবার আপনি দুই চোখ বন্ধ করবেন। আমি আপানকে হাত ধরে নিয়ে যাব।
রেশমের নরম গলার এই মিষ্টি আদেশও রাজপুত্র সংগে সংগেই পালন করল।চোখ বন্ধ করল সে।
ধন্যবাদ! বলে ভাইমিতি শাবানু তার হাত ধরে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলল।
ভাইমিতি শাভানুর স্পর্শে রাজপুত্র হেসানা হোসানার দেহের প্রতিটি পরমাণু যেন জেগে উঠল, শিহরিত হলো! কারও স্পর্শ যে এত মিষ্টি, এত মধুর হতে পারে, তা রাজপুত্রের কল্পনারও বাইরে ছিল।
রাজপুত্র হেসানা হোসানাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কিভাবে নিয়ে যাচ্ছে, সেসব নিয়ে রাজপুত্রের কোন মাথা ব্যথা ছিল না। অন্য কিছু ভেবেই স্পর্শের অনুভূতি সে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছিল না। তবে সে ক্রমশ উপরে উঠছিল সেটা তার পা-ই বলে দিচ্ছিল।
উপরে উঠা এক সময় শেষ হলো। তারপর আরো একটু পথ চলা।
আবার থমকে দাঁড়ানো।
ভাইমিতি শাবানুর নরম মিষ্টি গলা শুনতে পেল রাজপুত্র। বলল, একটু দাঁড়াতে হবে শাহজাদা। বিশ, ত্রিশ সেকেন্ড পরে একটা শব্দ হবে, তারপর আপনি চোখ খুলবেন।
বলে ভাইমিতি শাবানু রাজপুত্র হেসানা হোসানার হাত ছেড়ে দিল। মেয়েটি হাত ছেড়ে দেবার সাথে সাথে রাজপুত্রের মনে হলো তার দেহ জুড়ে জ্বলে থাকা উজ্জ্বল বাতি যেন নিভে গেল। সব শক্তি কেউ শুষে নেয়ার মত দেহটা তার দুর্বল হয়ে পড়ল। একটা শব্দ হলো। মিষ্টি একটা শিসের শব্দ।
চোখ খুলল। দ্রুত চোখ বুলাল চারিদেকে। মেয়েটি নেই।কেউ কোথাও নেই। চারিদিকে পানি। সে এক অ্যাটলের সরু তীরে দাঁড়িয়ে আছে। তার একপাশে সাগর, অন্য পাশে অ্যাটলের লেগুন। পাশে দক্ষিনে আর একটা অ্যাটল আছে, সেটা প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে। তার বোটটি হালকা দোল খাচ্ছে সাগরের পানিতে। বোটটি আগের মতোই বাঁধা অ্যাটলের তীরে। কিন্তু মেয়েটি গেল কোথায়? মাত্র বিশ-ত্রিশ সেকেন্ডের ব্যবধান, কোথায় গেল মেয়েটি? রাজপুত্রের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! সব হারানোর হৃদয়-ভাঙ্গা অনুভূতি নিয়ে সে বসে পড়ল অ্যাটলের তীরে।
মিনিট যায়, ঘন্টা যায়, দিন যায়, রাজপুত্র সে অ্যাটলের তীর থেকে ওঠেনি। তার মুখে একটাই কথা বারবার, কোথায় গেল আমার ভাইমিতি শাবানু?
কয়েকদিন পর রাজার একটি সন্ধানী দল গিয়ে তাঁকে অ্যাটলের তীর থেকে মুমূর্ষ অবস্থায় তুলে আনে। তাকে নিয়ে আসে রাজধানী আরুতে। সে সুস্থ হয়, কিন্তু ভাইমিতি শাবানুর নাম তার মুখ থেকে যায় না। ডাক্তার-কবিরাজ ও ভূত-প্রেতের তান্ত্রিকরাও তাঁকে দেখে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। তাঁকে বুঝানো হয় ভাইমিতি অদৃশ্য জগতের সাগরকন্যা, শাবানু হতে পারে তার নাম। সে অদৃশ্য জগতের বাসিন্দা, অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাঁকে রাজপুত্রের মতো মানুষ পাবে কি করে? কিন্তু কোন বুঝই সে নেয়নি। তার সাগরে ঘুরাঘুরি আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। রাত-বিরাত, বৃষ্টি-খরা, কোন কিছুরই তোয়াক্কা নেই, তার বোট ঘুরে বেড়ায় সাগরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, সবখানে। চারিদিকের নিঝুম নিরবতার মাঝে ধ্বনিত তার একটি মাত্র নামের উচ্চারণ-ভাইমিতি শাবানু, আমার ভাইমিতি শাবানু!
জগতেশ্বরী ‘হিনা’ অবশেষে সদয় হন পাগল প্রেমিক রাজপুত্রের প্রতি। আগের মতোই জ্যোৎস্না-গলা এক চাঁদনী রাতে রজপুত্র হেসানা হোসানার বোট নোঙর করা ছিল সেই অ্যাটলের তীরে।জগতেশ্বরী ‘হিনা’ নেমে আসে।আসে সে অ্যাটলের তীরে। ঘুমন্ত রাজপুত্রকে তুলে নিয়ে নেমে যায় অ্যাটলের তীর থেকে। অ্যাটল-তীরের মাটি ফুঁড়ে ঢুকে যায় ভেতরে। চলে যায় অ্যাটলের সেই রাজপ্রাসাদে। তাঁকে শুইয়ে দেয় দুগ্ধ ফেনায়িত মনোহরা নরম সেই বিছানায়। ঘুম থেকে জেগে উঠলে সেখানেই আবার দেখা হয় ভাইমিতি শাবানুর সাথে।মিলন হয় দুই হৃদয়ের। রাজপুত্র তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, সবাই বলে তুমি অদৃশ্যের সাগরকন্যা, হারিয়ে যাবে না তো আবার। অদৃশ্য থেকে হাসেন জগতেশ্বরী’হিনা’। রাজপুত্রের উদ্দেশ্যে তার কন্ঠ ধ্বনিত হয়ঃ না রাজপুত্র, ভাইমিতি শাবানু মায়া নয়, মানবী, তাইতো তোমাদের মিলন হলো। আমি আনন্দিত, নিমজ্জিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত মহাদেশ ‘মু’-এর এক মহাগুণী, মহাজ্ঞানী বংশধরের সাথে নতুন প্যাসিফিক কন্টিনেন্টের এই প্রথম মিলন। কাহিনীর এখানেই শেষ। তবে আরও কথা প্রচলিত আছে, রাজপুত্র নাকি এরপর গোপনে আসতো রাজধানীতে, ঘুরে বেড়াতো সাগরেও ভাইমিতি শাবানুকে নিয়ে কাহিনীর শেষ অংশ নাকি সেই জানিয়ে গেছে সবাইকে।
থামল অধ্যাপক তাতিহিতি দীর্ঘ কাহিনী বলা শেষ করার পর।
অত্যন্ত মনোযোগের সাথে আহমদ মুসা অধ্যাপক তাতিহিতির কথা শুনছিল। রূপকথা হিসাবেই সে শুনছিল কিন্তু শুনতে গিয়ে মাঝে মাঝেই তার চোখে-মুখে যে বিস্ময়ের সৃষ্টি হচ্ছিল, তা অবশ্যই রূপকথা শুনে হয় না।
অধ্যাপক তাতিহিতি থামতেই আহমদ মুসা বলল, স্যার, আপনার কাহিনী রুপকথা হলেও বাস্তবতার কিছু উপাদান তার মধ্যে আছে! যা আমার কাছে সত্যিই বিস্ময়কর লাগছে।
যেমন? বলল অধ্যাপক তাতিহিতি।
যেমন এক.যে অ্যাটলের অবস্থানরত অবস্থায় রাজপুত্র ঝড়ের কবলে পড়ে সংজ্ঞা হারিয়ে অ্যাটলের প্রাসাদে গিয়েছিল, সেই অ্যাটল থেকেই আবার তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় সেই অ্যাটল প্রসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই.অ্যাটলের প্রাসাদ থেকে রাজপুত্র ভাইমিতি শাবানুর হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিল ক্রমঊর্ধ্বমুখী এক পথে বা সিঁড়িপথে। তিন. সংজ্ঞা হারিয়ে যে অ্যাটলের যেখান থেকে অ্যাটলের প্রসাদে নীত হয়েছিল, সে অ্যাটলের সেখানেই সে ওঠে। চার. ভাইমিতি শাবানু রাজপুত্রকে অ্যাটলের তীরে পৌঁছে দিয়ে ফেরার জন্য বিশ-ত্রিশ সেকেন্ড সময় নিয়েছিল, সে সময় রাজপুত্রকে তার চোখ বন্ধ রাখতে হয়েছিল, পাঁচ. জগতেশ্বরী ‘হিনা’ ভাইমিতি শাবানুকে ‘মানবী’ বলেছে এবং ছয়. কাহিনীতে রাজপুত্রের নাম ‘হোসানা’ শব্দ এবং কথিত সাগরকন্যার নামের সাথে ‘শাবানু’ শব্দটি বিস্ময়কর এক বাস্তবতার ইংগিতবহ। বলল আহমদ মুসা।
অধ্যাপক তাতিহিতি ভ্রূ কুঞ্চিত করে খুব অভিনিবেশ সহকারে আহমদ মুসার কথা শুনছিল। আহমদ মুসার কথা শেষ হবার পরও ভাবল। বলল, বৎস, তুমি বলতে চাচ্ছ, কাহিনীটা রূপকথা হলেও বাস্তবতার এই উপাদানগুলো তার মধ্যে আছে। এই উপাদান মানে এই বিষয়গুলোর তুমি কি অর্থ করছ তা একটু বুঝিয়ে বলতে হবে ইয়ংম্যান।
অবশ্যই স্যার। প্রথমে একই স্থান থেকে প্রথমবার ও দ্বিতীয়বার অ্যাটল থেকে রাজপুত্রকে নেয়ার কথা বলি। স্থান-কাল-পাত্র সবই রূপকথা হলে এমনটা নাও হতে পারতো। জগতেশ্বরী ‘হিনা’ যে কোন স্থান থেকে রাজপুত্রকে অন্য যে কোন স্থানে সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারতো। তা করা হয়নি। একই স্থান থেকে একই অ্যাটল প্রাসাদে নিয়ে গেছে। এর অর্থ আমি এটা করতে পারি, সেই অ্যাটল প্রাসাদটি সেই অ্যাটলে বা পাশের কোন অ্যাটলেই হবে। দ্বিতীয় বিষয়টির যে অর্থ আমি করতে চাই, তা হলো, কাহিনীটা শুধু রুপকথা হলে ভাইমিতি শাবানু রাজপুত্রকে ঊর্ধ্বমুখী হাঁটার কষ্ট দিয়ে অ্যাটলের প্রাসাদ থেকে বাইরে নিয়ে আসতো না। উড়াল দিয়ে বা শাঁ করে মাটি ভেদ করে উপরে তুলে আনতো। রূপকথায় এটাই হয়। দ্বিতীয়ত ক্রমঊর্ধ্বমুখী পথ বা সিড়িপথ দিয়ে রাজপুত্র ভাইমিতি শাবানুর হাত ধরে উপরে উঠে এসেছিল। আন্ডারগ্রাউন্ড কোন স্থান থেকে এমন পথ ধরে উপরে উঠে আসাটাই বাস্থবতা। এর অর্থ এই হতে পারে, অ্যাটলের প্রাসাদ বা নিবাস বাস্তবেই অস্তিত্বমান। মানে এর অস্তিত্ব রয়েছে। তৃতীয় বিষয় অর্থাৎ অ্যাটলের যেখান থেকে ভাইমিতি শাবানু সংজ্ঞাহীন রাজপুত্রকে নিয়ে গিয়েছিল, ঠিক সেই স্থানেই তাকে ফিরিয়ে আনা প্রমান করে ক্রমঊর্ধ্বমুখী বা ক্রমনিম্নমুখী ঐ পথেই ভাইমিতি শাবানু তাকে নিয়ে গিয়েছিল, আবার ঐ পথেই তাকে ফিরিয়ে আনতে হয় রাজপুত্রকে এবং সেটা স্বাভাবিকভাবে একই স্থানে হয়।রূপকথার এমন বাস্তবতার নিয়মে বন্দী থাকে না। এক নিমেষে পাতাল থেকে আকাশে ওঠা রূপকথার চরিত্র। আপনার রূপকথায় এটা হয়নি। এখানে রূপকথার নায়িকা ভাইমিতি শাবানুকে উপরে উঠার জন্যে ক্রমঊর্ধ্বমুখী পথ এবং পা ব্যবহার করতে হয়েছে। আমি মনে করছি, অ্যাটল থেকে উপরে ওঠার পথ ও অ্যাটলের প্রাসাদ দু’য়েরই অস্তিত্ব রয়েছে। চতুর্থ বিষয়টি এ অস্তিত্বের আরও বড় প্রমাণ। ভাইমিতি শাবানু রাজপুত্রকে প্রাসাদ থেকে অ্যাটলে তীরে পৌঁছিয়ে দিয়ে বলেছিল বিশ-ত্রিশ সেকেন্ড চোখ বন্ধ রাখতে। বলেছিল একটা শব্দ শোনার পর চোখ খুলতে। কেন বলেছিল এটা ভাইমিতি শাবানু? বলেছিল ভাইমিতি তার চলে যাবার সুযোগ সৃষ্টির জন্যে। এই সময়ের মধ্যে চলেও গিয়েছিল সে। ভাইমিতি শাবানু অশরীরী কোন সাগরকন্যা হলে তার চলে যাবার জন্যে বিশ-তিরিশ সেকেন্ডের প্রয়োজন ছিল না, এক মুহুর্তই যথেষ্ট ছিল।সে অশরীরী কেউ ছিল না বলেই তার সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। অশরীরী কেউ না হলে সে মানবীই হবে বলে আমি মনে করি। দ্বিতীয়ত ভাইমিতি শাবানু তার চলে যাবার জন্যে বিশ-তিরিশ সেকেন্ড সময় নেয়ার অর্থ এই যে, যে পথ দিয়ে অ্যাটলে ঢুকে যাবে, সে পথ সেখান থেকে বিশ-তিরিশ সেকেন্ডের পথ। আরও স্পষ্ট কথা, ভাইমিতি শাবানু ও রাজপুত্র যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে বিশ-তিরিশ সেকেন্ড দূরত্বে অ্যাটলের প্রাসাদে নামার পথ ছিল। পঞ্চম বিষয় হলো, জগতেশ্বরী কাহিনীর নায়িকা ভাইমিতি শাবানুকে ‘মানবী’ বলা। আমি বলতে চাচ্ছি, জগতেশ্বরীর এই সাক্ষ্য থেকেও প্রমানিত হয় ভাইমিতি শাবানু মানবী। ষষ্ট বিষয়, ভাইমিতির নামের ‘শাবানু’ শব্দ ও রাজপুত্রের নামের ‘হোসানা’ শব্দ।এ ‘শব্দ’ দু’টি তাহিতিয়ান নয়, পলিনেশীয়ানও নয়। শব্দ দু’টির ‘হোসানা’ আরবি শব্দ ও ‘শাবানু’ আরবি-ফারসি মেশানো শব্দ। দু’টিই মুসলিম নামের খন্ডিত রূপ। ‘হোসানা’ আসলে হাসান এবং ‘শাবানু’ হলো ‘শাহবানু’। আপনার কাহিনীর এই ভাষাগত ও নামগত উপাদান থেকে মনে করছি, কাহিনীকে শুধু এক নতুন বাস্তবতা নয়, নতুন এক ইতিহাসের দিকেও ঠেলে দিচ্ছে। সে ইতিহাস নিশ্চয় তাহিতির ইতিহাস, পলিনেশীয়ার ইতিহাস, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলেরও ইতিহাস। থামল আহমদ মুসা।
বিস্ময়ে প্রায় ছানাবড়া অধ্যাপক তাতিহিতির দু’চোখ! বিহবল চেহারা মারেভা মাইমিতির। তার অবাক দৃষ্টি আহমদ মুসার মুখের ওপর নিবদ্ধ।
ইতিমধ্যে তামাহি মাহিন এসে পড়েছিল। সেও শুনেছে আহমদ মুসার কথা। তারও চোখ-মুখ বিস্ময়ে ভরা!
অধ্যাপক তাতিহিতি তার ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বলল আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে, অদ্ভুত! অদ্ভুত! তুমি তুমি কি নতুন কোন শার্লক হোমস, না কুশাগ্র বুদ্ধির ব্যারিস্টার! তুমি কাহিনীর যে অদ্ভুত বিশ্লেষণ করেছ, তা আমার কাছে অবিশ্বাস্য। এসব বিষয় কোন সময় আমাদের ভাবনাতেও আসেনি। কিন্তু বৎস, তুমি রূপকথা থেকে যে বাস্তবতা বের করেছ, তা যে রূপকথার চেয়েও বিস্ময়কর! রূপকথাও বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু তোমার বাস্তবতাকে আমরা কিভাবে বিশ্বাস করবো,কি করে বিশ্বাস করবো অ্যাটলের তলায় রাজপ্রাসাদ আছে, সেখানে ঢোকার ও বের হবার রাস্তা আছে! বিশ্বাস করব কি করে, ভাইমিতি শাবানু মানবী!
স্যার, বিশ্বাস করা, না করা ভিন্ন জিনিস। কিন্তু আমি বলছি, আপনাদের কাহিনীটা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমার কথাও সত্য। স্যার, আপনি সাগরের ভূমি গঠন, দ্বীপমালা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ, কিন্তু আপনি কি এর সবটা জানেন? অজানার তুলনায় আমাদের জানা জগতটা তো খুবই নগণ্য! আমরা জানি না বলেই অজানাটা মিথ্যে হয়ে যাবে? বলল আহমদ মুসা।
অধ্যাপক তাতিহিতির মুখে হাসি ফুটে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে সে হাসি মিলিয়ে গিয়ে নেমে এল এক গাম্ভীর্য। বলল ধীরে ধীরে, তুমি কে জানি না, কিন্তু তোমার কথা আর দশজনের মতো নয়, চিন্তার ধারাও একদম ভিন্ন। তুমি যে যুক্তি তুলে ধরেছ, তা সত্যই অকাট্য। বিশ্বাস করা না গেলেও এনিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। তুমি ঠিকই বলেছ, আমরা সৃষ্টি সম্পর্কে খুব অল্পই জানি, আমাদের অজানাই তো সব! চিন্তা-ভাবনা জ্ঞান-গবেষণার মাধ্যমেই অনেক অজানা বিষয় জানার পরিমন্ডলে আসছে। তোমার চিন্তার নিয়েও ভাবতে হবে। বল, তুমি নিজে এ নিয়ে কি ভাবছ?
স্যার, আমি যা বলেছি সেটাই সত্য তা বলছি না। কিন্তু কাহিনীর যে ঘটনা পরম্পরা তাতে আমার মনে হচ্ছে, কোন কোন অ্যাটলে সে প্রাসাদ, যাকে ভাইমিতি শাবানু নিবাস বলেছে, তাতে প্রবেশ ও বের হবার পথও আছে! সে অ্যাটলের চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ দূরে আরেকটা অ্যাটলও আছে! বলল আহমদ মুসা।
কোন অ্যাটলে তুমি এ ধরনের কোন স্থাপনা খুঁজছ। সে চিন্তা থেকেই কাহিনীর প্রাসাদের মধ্যে তুমি তোমার বাঞ্চিত স্থাপনা দেখতে চাচ্ছ, এ কথা আমি বলতে পারতাম। কিন্তু বলতে পারছি না এ কারণে, যুক্তি দিয়েই তুমি তোমার কথা প্রমাণ করেছ। এখন আমি মনে করি, অনুসন্ধান করে দেখা দরকার সে ধরনের অ্যাটল কোনটা হতে পারে। সে অ্যাটল যদি পাওয়া যায় তাহলে পরের কাজগুলো সহজ হয়ে যাবে। আর এ ধরনের কিছু যদি পাওয়া যায়, তাহলে কাহিনীটা ভিন্ন রূপ নিয়ে আমাদের কাছে আসবে। তুমি যা বলেছ, তাহিতি নয় শুধু, পলিনেশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপাঞ্চলের ইতিহাস পাল্টে যেতে পারে। আচ্ছা বৎস, তুমি যে দু’টো শব্দের কথা বললে, সেটা কিন্তু ঠিক। এ দু’টো পলিনেশিয় কোন শব্দ নয়। কিন্তু তুমি জানলে কি করে, এ দু’টো আরবি ও ফারসি শব্দ? বলল অধ্যাপক তাতিহিতি।
আমি আরবি, ফারসি ও এ ভাষার নামের সাথে পরিচিত স্যার। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু কাহিনীর চরিত্রে আরবি, ফারসি ভাষার নাম এল কি করে? তাহলে পলিনেশীয়া মানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলের ইতিহাসের সাথে মুসলমানদের কোন সম্পর্ক আছে। এখানকার অতীত জন-জীবনের সাথে মুসলমানরা কোনওভাবে জড়িত? তুমি যেটা বলেছ, এটা সত্যি নতুন ইতিহাসের ইংগিত?
বলে একটু থামল বৃদ্ধ অধ্যাপক তাতিহিতি। ইজি চেয়ারে আবার তার দুর্বল দেহটা এলিয়ে দিল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, এই জিজ্ঞাসার জবাবের জন্য অনুসন্ধান দরকার। চলমান ইতিহাসে এর কোন জবাব মিলবে না।পলিনেশিয়ানে ছড়িয়ে আছে ‘মিথ’ আকারে অসংখ্য ‘পুটাটুপুনা’ (putatupuna) অ্যানসেস্ট্রাল স্টোরিজ (Ancestral stories)। সে সবের মধ্যেই খুঁজতে হবে ইতিহাসকে। প্রিয় ইয়ংম্যান, তোমার মধ্যে যে অদ্ভুত বিশ্লেষণ শক্তি দেখছি, তাতে তুমি পারবে এ ইতিহাসের সন্ধান করতে। আমি আশীর্বাদ করছি বৎস।
থামল অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি। কথা শেষ হবার সাথে সাথে তার চোখ দু’টিও বুজে গেল। চোখে-মুখে তার ক্লান্তি।
স্যরি স্যার, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। আমি বলতে চাচ্ছি স্যার, অ্যানসেন্ট্রাল স্টোরি বা পূর্বপুরুষ-কাহিনীর মধ্যে ইতিহাস সন্ধান করা যত সহজ, পূর্বপুরুষের কাহিনী সন্ধান করা ততটা সহজ নয়। আহমদ মুসা বলল।
চোখ খুলল অধ্যাপক তাতিহিতি। বলল, ঠিক বলেছ তুমি। তবে একজন লোক আছে। তাকে মারেভা ও মাহিন দু’জনেই চেনে। তার নাম মাহকোহ মিনালী মিনার। তিনি প্রাচীন পমেরী রাজবংশের বেঁচে থাকা একমাত্র প্রধানতম মানুষ। ইউরিপীয়রা আসার আগে এই রাজবংশ বিভিন্নভাবে শত শত বছর রাজত্ব করেছে তাহিতিসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে। তিনি এই ‘আরু’তেই সেই প্রাচীন রাজবংশের ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজপ্রাসাদের এক কোণে অতীতের সাক্ষী হয়ে অবস্থান করছেন। ‘Putatupuna’ অর্থাৎ অ্যানসেস্ট্রাল স্টোরিজের (পূর্বপুরুষ কাহিনীর) বিশাল ভান্ডার আছে তার কাছে। তিনিই তোমাকে সাহায্য করতে পারেন।
ধন্যবাদ স্যার। বলল আহমদ মুসা।
ওয়েলকাম বৎস। অধ্যাপক তাতিহিতি বলল। চোখ দু’টি তার বুজে গেল আবার।
আমরা তাহলে উঠতে পারি স্যার। আপনি বিশ্রাম নিন। বলল মারেভা মাইমিতি।
এস বোন, কিন্তু তোমার মাহকোহ’র কাছে যেও। আমারও খুব আগ্রহ এ কাহিনী জানার। অধ্যাপক তাতিহিতি বলল।
অধ্যাপক তাতিহিতির কাছ থেক বিদায় নিয়ে আহমদ মুসারা বেরিয়ে এল।
বেরিয়েই তামাহি মাহিন বলল, স্যার, আপনি কি ফাদার মাহকোহ’র ওখানে যাবেন?
ফাদার কেন, উনি কি খৃস্টান? আহমদ মুসা বলল।
না স্যার, উনি খৃস্টান নন। আমরা প্রধান শিক্ষক ও ধর্মনেতাদের ফাদারও বলি। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মনেতাদের ‘ফাদার’ বলে। তার অনুসরণেই আমরা এটা বলি আত্মরক্ষার কৌশল হিসাবে। কারণ খৃস্ট ধর্ম ছাড়া এখানে অন্য সব ধর্ম-বিশ্বাস ও গীর্জা ছাড়া অন্য সব উপাসনালয় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সুতরাং খৃস্ট ধর্মের নাম পরিচয়ের আড়ালেই অনেক তাহিতিয়ান নিজেদের ধর্ম পালন করে থাকে। আরু’তেও তাই হয়। বলল মারেভা।
উনি কি ধর্মনেতা? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
ধর্মনেতা। কিন্তু প্রচলিত কোন ইশ্বরের উনি পূজা করেন না। উনি ধ্যান করেন, আ-ভুমি মাথা নোয়ান কোন অদৃশ্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে। বলল তামাহি মাহিন।
তিনি কি করতেন, কি করেন? আহমদ মুসা বলল।
তিনি নিজেকে রাজকীয় শিক্ষা একাডেমি, লাইব্রেরী ও উপাসনালয়ের পরিচালক বলে মনে করেন। এসবের ধ্বংসাবশেষের একটা বাড়িতে তিনি থাকেন। তিনি কোথাও যান না। বলল মারেভা।
তিনি যেখানে থাকেন, সেটা ‘আরু’র কোথায়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
স্যার, আমরা এসেছি ‘আরু’র সাগর তীরবর্তী পুননির্মিত অংশে। এই অংশের দক্ষিণে একটা বিশাল বিরান অঞ্চল পাওয়া যাবে। দক্ষিণ থেকে উত্তরে সাগর পর্যন্ত বিলম্বিত তিনটি দীর্ঘ উপত্যকা ও তিনটি বিলম্বিত পাহাড় নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত।এটাই প্রাচীন রাজধানী ‘আরু’র মূল অংশ।এই এলাকার শীর্ষ স্থানে ছিল প্রাসাদ। এই প্রসাদেরই একাংশে ছিল শিক্ষা একাডেমী, লাইব্রেরী ও উপাসনালয়ের স্থান। সেখানেই ফাদার মাহকোহ এখনও বাস করেন। বলল মারেভা।
আর কেউ থাকে না ওখানে? প্রশ্ন আহমদ মুসার।
আরও দু’চারটা বসতি আছে। এদের কেউ রাজপরিবারের অধস্তন, কেউ রাজপরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। এছাড়াও আশেপাশে কিছু পরিবার আছে যারা পশু পালন করে জীবন নির্বাহ করে। বলল তামাহি মাহিন।
চল মাহিন মারেভা, ফাদার মাহকোহ’র সাথে দেখা করেই আমরা ফিরব। আমাদের সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্যে অ্যাটলের প্রাসাদ রহস্য এবং ভাইমিতি শাবনুর কাহিনী সম্পর্কে আরও জানা প্রয়োজন। আহমদ মুসা বলল।
ভালই হলো, আজ আমার ও মারেভার মা এসেছেন ‘আরু’তে মাহকোহ’র মন্দিরে উপাসনার জন্যে। তাদের সাথেও দেখা হবে। আমরা একসাথে ফিরতে পারবো। বলল তামাহি মাহিন।
তারা প্রার্থনা করতে এখানে আসেন? আহমদ মুসা বলল।
প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবারে তারা আসেন। আজ মাসের প্রথম শুক্রবার। বলল তামাহি মাহিন।
ফাদার ‘মাহকোহ’র মন্দিরে শুক্রবারে প্রার্থনা হয়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
জি স্যার, সপ্তাহের শুক্রবারে এখানে প্রার্থনা হয়। বলল তামাহি মাহিন।
শুক্রবার কেন? আহমদ মুসা বলল।
জানি না স্যার, এটাই ঐতিহ্য। বলল তামাহি মাহিন।
কি প্রার্থনা হয় সেখানে? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
হাঁটু গেড়ে বসে ধ্যান ও প্রার্থনা। মারেভা বলল।
সবাই উঠে বসেছে গাড়িতে। চলতে শুরু করল গাড়ি।
ড্রাইভার তেপাও-এর পাশের সিটে মারেভা। পেছনে আহমদ মুসা ও তামাহি মাহিন। পেছনের সিটে মারেভার পাশে আহমদ মুসা যেমন বসে না, তেমনি তামাহি মাহিনের বসাও সে এলাউ করে না।
পাহড়ী পথে আস্তে আস্তে চলছে গাড়ি।

অধ্যাপক তাতিহিতির সাথে যে সব কথা হয়েছিল এবং আহমদ মুসা যা জানতে চায়, এক এক করে সব বলল ফাদার মাহকোহ মিলানী মিনারকে।
সামনেই ফরাসে হাঁটু মুড়ে বসে ছিল ফাদার মাহকোহ। তার সামনে ফরাসে বসে কথা বলছিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার পেছনে আছে মারেভা ও মাহিন। পাশেই একটু তফাতে বসেছিল মারেভা ও মাহিনের মা পাশাপাশি।
এটাই ফাদার মাহকোহ’র অফিস ঘর।
ঘরের বাইরের দেয়াল এবড়ো-থেবড়ো ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের হলেও ভেতরটা অনেকটা ভাল।
ফাদার মাহকোহ’র এই অফিস ঘরের পাশেই উপাসনালয় মানে মন্দির। উপাসনালয়টি নতুন-পুরাতনের মিশ্রণ। আগের কাঠামোর উপর উপাসনালয়টি পুননির্মিত।
আহমদ মুসার এসে যখন উপাসনালয়ে ঢুকেছিল তখন উপাসনা চলছিল উপাসনালয়ে।
বিরাট ঘর। সবাই ফরাসের উপর লাইন করে পশ্চিমমুখী হয়ে হাঁটু মুড়ে বসে। সবাই ধ্যানস্থ। ধ্যানের সময় শেষ হলে সবাই এক সাথে প্রার্থনা করল।
উপাসনালয়ের পশ্চিম দেয়ালে একটা বড় অর্ধ চন্দ্র।পরে আহমদ মুসা জিজ্ঞাসা করে জেনেছিল, অর্ধ চন্দ্র, মানে চন্দ্র হলো জগতেশ্বরী ‘হিনা’-এর প্রতীক। পলিনেশীয় বিশ্বাসমতে জগতেশ্বরী ‘হিনা’ চন্দ্ররুপে প্রকাশিত।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও ফাদার মাহকোহ যেমন ছিল, তেমনি বসে রইল। তার মাথা ঈষৎ নোয়ানো। তার চোখ দু’টি দু’জনের মাঝখানে মাটির মেঝের উপর নিবদ্ধ। মাথায় কাপড়ের একটা গোল বন্ধনী, পাগড়ির একটা বেড়ের মত। প্রাচীন রাজবংশের রাজশিরস্ত্রাণের প্রতীক সেটা করা। সে প্রতীকের মাঝখানে অর্ধ চন্দ্র শোভা পাচ্ছে। ফাদার মাহকোহ’র পরনে লম্বা জামা। মুখে সুন্দর শুভ্র দাড়ি। ফাদারের বয়স শুনেছিল একশ’ বছরের বেশি, তার দেহের কাঠামো শিথিল হয়েছে অবশ্যই, কিন্তু মুখে-চোখে তারুণ্যের দ্যুতি।
একসময় মুখ তুলল ফাদার মাহকোহ। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। চোখে তার শান্ত-গভীর দৃষ্টি। বলল, বুঝতে পারছি তুমি একটা মিশন নিয়ে এসেছ। মিশনটা মনে হচ্ছে কোন এক অ্যাটলের তলদেশের স্থাপনার সন্ধান করা। কিন্তু এর বাইরে তুমি এদেশের না হয়েও এদেশের অতীত নিয়ে, ইতিহাস নিয়ে, জন-কাহিনী নিয়ে যে আগ্রহ প্রকাশ করছ, তার জন্যে আমি মোবারকবাদ দিচ্ছি তোমাকে। আজকের মানুষ, বিশেষ করে আমাদের মত অনুন্নত দেশের মানুষ সভ্যতার ভোগবাদী মোহে পড়ে বর্তমানের সমৃদ্ধি ও ভবিষ্যত গোছানো নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, নিজেদের অতীত নিয়ে ভাববার সময় এদের নেই আবার অনেক ক্ষেত্রে তারা আমাদের রাজা মাকোয়া তাকাও-এর মত নিজেদের ইতিহাসের সব উপাদান নিজের হাতেই ধ্বংস করছে। তুমি তার ব্যতিক্রম, ধন্যবাদ তোমাকে।
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, তুমি অনেক বিষয় সামনে এনেছ।কিন্তু বিষয়গুলোর সারাংশ করলে দু’টি বিষয় মুখ্য হয়ে ওঠে ! এক. কাহিনীর ভাইমিতি’র নামের ‘শাবানু’ ও প্রিন্স হেসানা’র নামের ‘হুসানা’ অংশ আরবি-ফারসি শব্দের অপভ্রংশ। তাদের নামের সাথে আরবি ও ফারসি ভাষার নাম কোত্থেকে এল। এবং দুই. কাহিনীটিতে অ্যাটল-প্রাসাদের যে কথা বলা হয়েছে, তার বাস্তবতা। থামল ফাদার মাহকোহ।
চোখ বন্ধ করে একটু ভাবল। বলল, এই মাত্র আমি বললাম, আমাদের রাজা মাকোয়া তাকাও তাহিতি ও পলীনেশীয় দ্বীপাঞ্চলের শত শত বছর ধরে জমিয়ে তোলা পূর্বপুরুষদের কাহিনী সব ধ্বংস করে দিয়েছে। এর সাথে অনেক ইতিহাসই মুছে গেছে। এটা যে…।
এটা তাহলে সত্যি ঘটনা? আহমদ মুসা বলল।
দুর্ভাগ্যজনক এক সত্য জনাব আহমদ। পলিনেশীয় সভ্যতার একটা বড় বৈশিষ্ট হলো পারিবারিক ইতিহাস স্মৃতিতে ধরে রাখা। এভাবে হাজার বছরের ইতিহাস ছিল তাদের স্মৃতির স্তরে। কিন্তু ইউরিপীয়রা আসার পর তাদের নতুন সভ্যতা বিপর্যয় ঘটায়। স্মৃতির ইতিহাসকে লিখে রাখার বা এর লেখ্য রূপ তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। এরপর ইতিহাসকে একমুখী করার প্রবনতারও সৃষ্টি হয়। এই প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের হাতের পুতুল নতুন রাজাদের মধ্যে। ১৭৫৭ সালের জুনে আসে বৃটিশ ক্যাপ্টেন ওয়ালিস বন্দুক-কামান নিয়ে। নির্দয় পন্থায় দখল হয়ে যায় রাজধানী ‘আরু’সহ তাহিতি এবং পলিনেশীয় দ্বীপাঞ্চল। আর ১৭৬৮ সালে আসে ফারাসিরা আরও বড় শক্তি নিয়ে এবং তারা বৃটিশদের তাড়িয়ে দখল করে নেয় গোটা এলাকা। স্থানীয় রাজারা প্রতিরোধ চালিয়ে যায় অনেক দিন। অবশেষে উচ্ছেদ হয় ঐতিহ্যবাহী পমারী রাজবংশ ও স্থানীয় রাজারা। ১৮১৫ সালে ফরাসিদের পুতুল রাজা দ্বিতীয় পমপাই একমাত্র রাজা হিসাবে ঘোষিত হয়। ধ্বংস হয় রজধানী আরু। ধ্বংস হয় অতীতের সমাজ-সভ্যতা নির্দয়ভাবে। আর সব কিছুর উপর চেপে বসে খৃস্টান রাজা। গীর্জা ছাড়া সব ধরনের উপাসনালয় ধ্বংস করা হয়। এরই ধারাবাহিকতাতেই ১৮৯০-এর দশকে রাজা মাকিয়া তাকাও লিখিত সব পারিবারিক ইতিহাস ধ্বংস করে ফেলে, একমাত্র তার সময়ের ইতিহাস ছাড়া। তার ফলে মাকিয়া তাকাওদের কাহিনী পলিনেশীয়ার একমাত্র ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায়। শুধু পলিনেশীয়াতে নয়, প্রশান্ত মহাসাগরীয় সব দ্বীপাঞ্চলেই এই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের উদ্যোগে একক ইতিহাস তৈরির নামে। ধ্বংসের এই ঝড়ে অগণ্য সত্য কাহিনী, ইতিহাসের ঘটনা, ইতিহাসের উপাদান চিরতরে হারিয়ে গেছে। থামল ফাদার মাহকোহ।
বিস্ময়ের বেদনা নিয়ে আহমদ মুসা তাকিয়ে ছিল ফাদার মাহকোহ’র দিকে। ফাদার মাহকোহ থামতেই আহমদ মুসা বলল, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা এই কাজ বহু দেশে করেছে। কিন্তু সবখানে তারা ষোল আনা সফল হয়নি, আপনাদের পলিনেশীয়াতে কি অবস্থা স্যার?
আমাদের পলিনেশীয়তে অন্য সব লিখিত ইতিহাস শুধু ধ্বংস করা হয়েছে তাই নয়, অন্য ইতিহাসের পাঠ, সংরক্ষণ ও নিষিদ্ধ করা হয়। তার ফলে এখানে সেখানে কিছু কাহিনী, কথা, ইতিহাস ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচতে পারলেও সংরক্ষণ ও চর্চার অভাবে সে সব বেশি দিন বাঁচতে পারেনি। বলল ফাদার মাহকোহ।
স্যার, আপনি তো তা বাঁচাতে পেরেছেন! আহমদ মুসা বলল।
কিছু কিছু, এমনকি আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের সবটা সংগ্রহ করতে পারিনি। আমাদের রাজধানী ‘আরু’ ধ্বংসের সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় আমাদের রজকীয় সংগ্রহশালা ও লাইব্রেরী। আমি ব্যাপক ঘুরে বেড়িয়েছি ইতিহাসের কাহিনীর সন্ধানে। কিছু মানুষের স্মৃতি থেকে, কিছু গোপনে সংরক্ষিত লেখা থেকে আমি সংগ্রহ করেছি। বলল ফাদার মাহকোহ।
ধন্যবাদ স্যার। আপনার সংগ্রহ কতদূর অতীত পর্যন্ত যেতে পেরেছে স্যার? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
পেছনের ইতিহাস কত দূর পেছনে গেছে তা আমি জানি না। এ ব্যাপারে এখনও ঐকমত্য হয়নি। আমার কাছে ইতিহাসের যে উপাদান আছে, তাতে অনেক ফাঁক-ফোকর থাকলেও এক নজরে আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। বলল ফাদার মাহকোহ।
ধন্যবাদ স্যার। আমাকে আপনি কিভাবে সাহায্য করতে পারেন? আহমদ মুসা বলল।
তুমি ‘হাসানা’ ও ‘শাবানু’ এই দুই আরবি, ফারসি নামের উৎস খুঁজছ, কিন্তু শুধু এ দু’টি নামই তো নয়, আরও অনেক নামের উৎস তোমাকে খুঁজতে হবে। পলিনেশীয় সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে পুরাতন দ্বীপ ‘তাহিতি’ নাম নিয়ে কি তুমি ভেবেছ? তাহিতিকে বিশ্বের সুন্দরতম দ্বীপ যদি নাও বলি, তাহিতিবিশ্বের সুন্দরতম দ্বীপের একটি অবশ্যই। ইউরপীয়রা এই দ্বীপকে দেখেই বলে উঠেছিল ‘আইল্যান্ড অব লাভ’ ভালবাসার দ্বীপ। ফরাসি বোগেনভিল বলেছিলেন ‘ মিথ অব প্যারাডাইস’ স্বর্গের কল্পলোক। আরেকজন রোশো বলেছিলেন ‘ মহত্তম অসভ্য’। কিন্তু তাদের অনেক আগে তাহিতি তার নামের মাঝে তার পরিচয়কে, রূপকে ধারণ করেছে। ৮৫০ খৃস্টাব্দের দিকে প্রথম মানব যারা তাহিতিতে বসতি গড়তে আসে, তারা তাহিতিকে ‘আমার শ্রদ্ধা’ ‘আমার সালাম’ বলে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। ভাই আহমদ, হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা অধ্যয়ন করার কিছু সুযোগ আমার হয়েছিল। ‘তাহিতি’ নিজেই আরবি শব্দ, আরবি মুল ‘তাহিয়াত’ থেকে এসেছে। তাহিতির অর্থ ‘ আমার শ্রদ্ধা’, ‘আমার অভিনন্দন’, ‘আমার সালাম’। প্রথম মানব যারা তাহিতিতে আসেন, তারা শ্রাদ্ধার, ভালবাসার, শান্তি-আকাঙ্ক্ষার মহত্তম নাম দিয়েই দ্বীপটিকে বরণ করেন। কিন্তু এই লোকগুলো কারা, কোত্থেকে কিভাবে এল, এটাই এখানকার প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর পেলে পলিনেশীয় কাহিনীতে মূল আরবি-ফারসি ‘হাসান’ ও ‘সাহবানু’ নাম কোত্থেকে এল তাও পরিষ্কার হয়ে যাবে। ‘তাহিতি’র মত অনেক আরবি শব্দ আমরা তাহিতি ও পলিনেশীয়ায় পাব। হয়তো এমনি ভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় সব দ্বীপাঞ্চলেই পাওয়া যাবে। ইউরোপীয়রা আসার আগে যারা রাজার অধীনে বা স্বাধীনভাবে তাহিতির বিভিন্ন অঞ্চল শাসন করতো, তাদের ‘আরাই’ (Ari’i) বলা হতো। তারা জনগণের ‘প্রদর্শঙ্কারী’ হিসাবে এই উপাধি ব্যবহার করতো। এটা আরবি শব্দ। তাহিতির রজধানী ধ্বংস করে ফেলা আমাদের এ প্রিয় শহরের ‘আরু’ নামটিও আরবি ‘আরাই’-এর অপভ্রংশ। আবারও প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় আঞ্চলিক শাসকদের এই ‘আরাই’ নাম এবং স্বাধীন তাহিতি ও পলিনেশীয়ার গৌরবান্বিত রাজধানীর ‘আরু’ নাম কোত্থেকে এল, কারা রাখল, কেন রাখল? এ প্রশ্নগুলো আহমদ তোমার প্রশ্নের মতই। এই প্রশ্নগুলোর জবাব পেলে তোমার প্রশ্নেরও জবাব হয়ে যাবে। অতীত ইতিহাসের মধ্যেই এর জবাব পাওয়া যাবে।
দীর্ঘ এক বক্তব্য দিয়ে থামল ফাদার মাহকোহ।
কিন্তু স্যার, ইতিহাস তো ধ্বংস করেছে! আহমদ মুসা বলল।
এরপরও এখানে-সেখানে কিছু রক্ষা পেয়ে গেছে। তার কিছুটা আমিও সংগ্রহ করতে পেরেছি। আমাদের নিজেদের পারিবারিক ইতিহাস তো আছেই ! বলল ফাদার মাহকোহ।
এই ইতিহাসের গুড়াটা কত দূর পর্যন্ত গেছে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
এ রকম ইতিহাসের কোন সময় নির্ণয় করা মুস্কিল।
তারপর?
তারপরও এভাবেই কাহিনী বর্ণিত ও লিখিত হয়েছে! তাও আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ্যালেগেরিক্যাল প্রতীকের আবরণ দেয়া। রূপকথায় পাত্র-পাত্রীর যেমন হঠাৎ আগমন ঘটে, আগ-পিছের পরিচয় ও যুক্তি-প্রমাণের কোন বালাই থাকে না, কতকটা সেই রকমই অনেক ক্ষেত্রে। যেমন আমাদের বংশ-ইতিহাসের শুরু আমাদের বংশ বা গোত্রপতির মৃত্যুর ঘটনা দিয়ে। সারাংশ এই রকমঃ বংশের সর্দার তাহেনা (শক্তি) ঈশ্বর হিনার কাছে চলে গেছে। তার দেহটাও পাঠাবার ব্যবস্থা চলছে। সারা রাত তার দেহ পাহাড় শীর্ষে রাখা হয়েছিল। ঈশ্বরের কাছে তার দেহ যায়নি। এবার ছোট ভেলায় করে তার দেহ ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে সাগরে ভাসাবার ব্যবস্থা করা হয়। বংশের তান্ত্রিক ‘রানুই’ (পবিত্র পুরুষ) ভীষণ ব্যস্ত এই প্রস্তুতি নিয়ে। হঠাৎ দেখা গেল পশ্চিমে মুরিয়ার দিক থেকে একটা জাহাজ আসছে উপকূলের দিকে। এতবড় ও এমন জাহাজ আমরা কখনও দেখিনি। জাহাজ অনেক কাছে এসে গেল। জাহাজের সব কিছুই দেখা যাচ্ছে। পাল আগেই নামিয়ে ফেলা হয়েছে। জাহাজের পাল টাঙানো উঁচু মাস্তুলে একটা বড় সবুজ পতাকা। বাতাসের অভাবে উড়ছে না। জাহাজের ডেকে আপাদমস্তক সাদা পোষাকের অনেক মানুষ। উপকূলে আমাদের লোকদের মধ্যে ভয় ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। জাহাজটি আরও কাছে আসে। মৃতের সৎকারের কাজ বাদ দিয়ে আমাদের লোকেরা তীর-ধনুক, বর্শা ও গুলতি নিয়ে তৈরি হয়ে যায়। জাহাজের লোকজনও ডেকে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু ওদের হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। আমাদের লোকদের এ অভিজ্ঞতা আছে, জলদস্যুরা বিভিন্ন রূপ ধরে আসে, শান্তিবাদী ও ভালো মানুষের ছদ্মবেশও তারা নেয়। সুতরাং আমদের লোকেরা ওদের গতিরোধের জন্যে তীর ও বর্শা নিক্ষেপ করে আক্রমণ শুরু করল। তীরগুলো মারাত্মক সূচালো পাথরের, বর্শাগুলো ও তাই। জাহাজের কয়েকজন আহত হয়ে পড়ে গেল। কিন্তু ওরা আক্রমণ করলো না। প্রায় সবাই আড়ালে সরে গেল। মাত্র দু’জন নতুন কাপড়ের বান্ডিল ও বস্তা থেকে খাদ্যশস্য আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করলো, আমরা আক্রমণ বা দখলের জন্যে নয়, ব্যবসায়ের জন্যে এসেছি। সরদারের ছেলে নতুন মনোনীত সরদার সবকিছু পর্যবেক্ষন করছিল।সে আমাদের লোকদের ওদের উপর আক্রমণ বন্ধের নির্দেশ দিল। আক্রমণ বন্ধ হলে জাহাজ এসে তীরে ভিড়ল। জাহাজের ওরা সবাই তীরে নামল। লোকেরা সবাই দীর্ঘদেহী, ফর্সা শ্মশ্রুমণ্ডিত। সকলেই প্রশান্ত চেহারার। চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ, তাতে কোন হিংসা-কুটিলতার ছায়া নেই। দেখলে মনে ভয় জাগে না, বরং বন্ধু বলে মনে হয়।
সবাই ওরা নিরস্ত্র। তীরে নেমে সবাই ওরা এক সাথে হাত তুলে প্রার্থনা করল। তারপর ওরা উঠে এসে আমাদের সবার সাথে হাত মেলাল। দু’চারটি তাহিতিয়ান শব্দ, দু’চারটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অন্যান্য ভাষা মেশানো ভাষায় তারা বুঝালো তাহিতিয়ার কেউ তাদের শত্রু নয়, তারাও কারও শত্রু নয়। তারা ব্যবসায়-বানিজ্য করে এবং সাধ্যমত মানুষের উপকার করে। আমাদের লোকেরা তাদের জাহাজে চড়ল। দেখল, জাহাজে কোন অস্ত্র নেই। আছে কাপড়, খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কিছু ব্যবসায়ের পণ্য। আমাদের লোকেরা তাদের বিশ্বাস করল। অস্ত্র ছাড়া কেউ আসতে পারে, আত্মরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া কেউ আসতে পারে, এমনটা আমাদের লোকেরা অতীতে দেখেনি। আমাদের আক্রমণে ওদের কয়েকজন আহত হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন মারা গেল। আহতদের তারা চিকিৎসা করল। তাদের চিকিৎসার ধরন উন্নত। আহত স্থান ওষুধ মেশানো পানি দিয়ে পরিষ্কার করা, ওষুধ লাগানো, কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা, এসব বিষয় আমাদের লোকেরা এই প্রথম দেখল। তারা তাদের মৃত লোককে কূলে নামিয়ে তার সৎকার করার অনুমতি চাইল। আমাদের নতুন সরদার পো মিরি (poe Miri) তাদের অনুমতি দিল। জাহাজ থেকে লাশ তারা উপকূলে নামিয়ে লাশকে গোসল করাল এবং সাদা কাপড় কেটে কয়েক টুকরো করে লাশকে পরিয়ে দিল। গোটা লাশকে সাদা কাপড়ে তারা মুড়ে ফেলল। সেই কাপড়ে মোড়া লাশ তারা সামনে রেখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে দু’হাত বুকে বেঁধে কি সব পড়ল! তারপর আয়তাকার সুন্দর একটা গর্ত বানাল। সেই গর্তের ফ্লোরে কাপড়ে মোড়া লাশকে যত্নের সাথে রেখে দিল এবং গর্তের আয়তাকার মুখ তারা সাইজমত কাটা কাঠ, ডাল, লাকড়ি দিয়ে বন্ধ করে দিল। তার উপর বড় আকারের পাতা সাজিয়ে ঢেকে দিয়ে তাতে মাটি চাপা দিল। গর্তের উপরের এই মাটিকেও তারা সমান ও পরিপাটি করে রাখল। সবশেষে তারা সেই গর্তের চারদিকে দাঁড়িয়ে এক সাথে প্রার্থনা করল। এই গোটা বিষয়টি আমাদের লোকেরা বিস্ময়ের সাথে দেখল এবং খুবই ভাল লাগল তাদের এই লাশের সৎকার করা, বিশেষ করে আমাদের সরদার পো মিরি ও আমাদের তান্ত্রিক রানুই খুবই মুগ্ধ হলো মৃতের প্রতি সম্মান, যত্ন, তাকে ঘিরে প্রার্থনা ও লাশ রাখার পদ্ধতি দেখে। আমাদের সর্দার আমাদের তান্ত্রিক ও লোকদের বলল, আমাদের মৃত সর্দারকে আমরা এভাবে রাখতে পারি। এতে সুবিধা হবে আমার মৃত পিতা কোথায় আছেন তা আমি দেখতে পাবো, তার সাথে কথা বলতে পারবো। তান্ত্রিক ও আমাদের লোকেরা এতে খুব খুশি হলো। তান্ত্রিক বলল, পাহাড়ে রেখে লাশ পশু-পাখির পেটে দেয়া কিংবা লাশ সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে হারিয়ে ফেলার চাইতে এটা অনেক ভাল। এসব দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, আমাদের সর্দারের লাশ ফুল-পাতা দিয়ে ঢেকে না রেখে আগন্তুকদের লাশ যেভাবে জাহাজ থেকে নামিয়ে আদবের সাথে সৎকার করা হলো, সর্দারের লাশ সেভাবেই সৎকার করা হবে। আগন্তুকরাও এভাবে সৎকারের কথা বলল। আগন্তুকরা আনন্দের সাথে রাজি হলো এবং কাজে লেগে গেল। তারা খুব যত্ন ও সম্মানের সাথে মৃত সর্দারকে গোসল করিয়ে, নতুন কাপড় পরিয়ে, কাপড়ে মুড়ে আমাদের লোকজনদের সাথে নিয়ে আয়তাকার সেই গর্তে সুন্দর করে রাখল। সবশেষে গর্তের উপর পাটি সাজানোর কাজ সম্পন্ন করার পর আমাদের লোকদের সাথে নিয়ে মৃতের মঙ্গলের জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল। এমন সুন্দর ও নতুন ব্যবস্থায় আমাদের সর্দার পো মিরি ভীষণ খুশি এবং আমাদের লোকেরাও। এসব কাজে দুপুর হয়ে গেল। সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিমে একটু হেলে পড়েছে। আগন্তুকদের একজন এসে আমাদের সর্দারকে বুঝালো, তাদের প্রার্থনার সময় হয়েছে, তারা তাদের প্রার্থনার অনুমতি চায়। সর্দার সোৎসাহে অনুমতি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কার কাছে তারা প্রার্থনা করবে? অনুমতি নিতে আসা সেই লোক বলল, এই বিশ্ব-জাহান যিনি সৃস্টি করেছেন, যিনি এই বিশ্ব-জাহানসহ আমাদের সকলকে পালন করেন তার কাছে আমরা প্রার্থনা করব।আমাদের সর্দার খুশি হয়ে বলল, খুব ভাল। আমরাও পার্থনা করি ঈশ্বর হিনার। আপনাদের প্রার্থনা দেখি। আগন্তুকদের কয়েকজন পাহাড়ের ঝর্না থেকে পানি এনেছে। দেখা গেল সেই পানি দিয়ে তারা সকলে একই নিয়মে মুখ, হাত, পা ধুয়ে নিল। একজন একটু উঁচুতে দাঁড়িয়ে দুই কানে দুই হাত চাপা দিয়ে উচ্চ স্বরে কয়েকটি বাক্য উচ্চারণ করল। তারপর তারা সকলেই ভিন্ন ভিন্নভাবে দাঁড়িয়ে, কোমর বাকিয়ে হাঁটুর উপর হাত রেখে মাটির উপর মাথা রেখে প্রার্থনা করল। পরে তাদের প্রবীণ একজনকে সামনে রেখে তারা সকলে পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে ব্যক্তিগতভাবে যা যা করেছিল সামস্টিকভাবেও তাই করল। সামনে দাঁড়ানো প্রবীণ ব্যক্তিটি যা করছে, সকলে তাই করছে অদ্ভুত শৃঙ্খলার সাথে! তাদের প্রার্থনা শেষ হলে সর্দার ও তান্ত্রিক তাদের ডেকে জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের প্রার্থনা দেখলাম, খুব সুন্দর। কিন্তু শুরুতে একজন কানে হাত দিয়ে উচ্চ স্বরে কি বলল, কেন বলল বুঝলাম না। আগন্তুকদের একজন বুঝিয়ে বলল, ওটা প্রার্থনার জন্যে সকলকে আহ্বান। নিয়ম হলো, সকলকে প্রার্থনার জন্যে ডেকে এক সঙ্গে প্রার্থনা করতে হয়। সর্দার ও তান্ত্রিক উভয়েই বলল, সুন্দর নিয়ম। সকলের অংশগ্রহনে সংঘবদ্ধভাবে এমন প্রার্থনার প্রদ্ধতি আমাদের নেই। আমরাও তো এভাবে প্রার্থনা করতে পারি! প্রার্থনার নেতৃত্ব দানকারী প্রধান ব্যক্তি বলল, অবশ্যই পারেন। আমাদের সর্দার আবার জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু প্রার্থনার সময় আপনাদেরকে তো অনেক কিছু পড়তে দেখছি! কোন মন্ত্র এগুলো? আমরা তো তা জানি না। প্রধান ব্যক্তিটি বলল, অনেক কিছু পড়তে হয় প্রার্থনায়। আপনারা চাইলে আপনাদেরও শিখিয়ে দেব। কিন্তু সবার আগে একটা বিষয় আপনাদের জানতে হবে। সেটা হলো, এই বিশ্ব-জাহানের একজন স্রষ্টা আছেন। তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদের যা প্রয়োজন, সবই আমাদের দিয়েছেন। মৃত্যুর পর আমরা তার কাছে ফিরে যাব। সেখানে তিনি আমাদের পুরস্কার দেবেন অথবা শাস্তি দেবেন। দুনিয়ায় আমরা ভাল কাজ করলে সেখানে পুরস্কার পাব মানে সুখের জীবন পাব, যা হবে চিরন্তন, আর দুনিয়ায় খারাপ কাজ করে গেলে সেখানে আমরা শাস্তি মানে অসীম যন্ত্রনা-যাতনার এক জীবন পাব, যাও হবে চিরন্তন। স্রষ্টা আমাদের ভালবাসেন। তিনি চান আমরা দুনিয়ায় ভাল কআজ করে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে পুরস্কার হিসাবে সুখের জীবন পাই। আল্লাহ বা স্রষ্টার এই ইচ্ছা মানুষকে জানাবার জন্যে এবং ভালো কাজের পথ কোনটা এবং মন্দ কাজের পথ কোনটা তা মানুষকে দেখাবার জন্যে কিছু কাল পরপর আল্লাহ বিশেষ লোকদের তার দূত হিসাবে পাঠান। এ ধরনের একজন সর্বশেষ মহান ব্যক্তি এসেছিলেন, তার কাছ থেকেই আমরা আমাদের প্রার্থনার ও জীবনের অন্য সব বিষয় জেনেছি। এই বিশ্বাসকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করলে প্রার্থনার সব বিষয় আপনাদের কাছে সহজ হয়ে যাবে। এই সব কথা বলতে গিয়ে প্রধান আগন্তুকের চোখ-মুখও যেমন উজ্জ্বল উঠেছিল, তেমনি শুনতে শুনতে আমাদের সর্দার ও তান্ত্রিকের চোখ-মুখও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। প্রধান আগন্তুক থামতেই তারা দুজনেই বলে উঠল, আপনি যা বলেছেন সব কথাই ভালো, সব কথাই আমরা বিশ্বাস করি। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আগন্তুক প্রবীণের মুখ। বলল, দিনে পাঁচবার আমরা প্রার্থনা করি। সবই আপনাদের জানাব, শেখাব। দীর্ঘ কথা বলার পর থেমে গেল ফাদার মাহকোহ।
আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে শুধু শুনছিল তাই নয়, গোগ্রাসে যেন গিলছিল। ফাদার মাহকোহ’র থামাটায় বিরাট এক ছন্দ পতনের মত ধাক্কা খেল আহমদ মুসা। তাই ফাদার মাহকোহ থামার সংগে সংগেই আহমদ মুসা বলল, তারপর কি স্যার?
তারপর কি আমিও জানি না। হাতে লেখা একশত পৃষ্ঠার একটা পুড়ে যাওয়া বইয়ের প্রথম বিশ পৃষ্ঠার কাহিনী আমি বললাম। এর পরের পাতা গুলো পুড়ে গেছে, মাঝের চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মানে এই দশ পৃষ্ঠা আবার অক্ষত পাওয়া গেছে। পরের পৃষ্ঠাগুলো পাওয়া যায়নি। নিশ্চয় পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। বলল ফাদার মাহকোজ।
মাঝের দশ পৃষ্ঠায় কি আছে স্যার? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
বলব, বলছি। বলল ফাদার মাহকোহ।
একটু থামল তারপর নড়ে-চড়ে বসে আর একটু সরাসরি আহমদ মুসাদের মুখোমুখি হলো অধ্যাপক মাহকোহ। মুখ খুলল। বলতে শুরু করল আবার, এই দশ পাতায় তাহিতি এলাকার ও তাহিতর জন-জীবনের কিছু পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। সারাংশটা এই রকমঃ আগন্তুকরা যে জাহাজ নিয়ে এসেছিল, তাতে লোহার ব্যবহার ছিল মুখ্য। কাঠগুলো ছিল লোহার পেরেকে আটকানো, আবার লোহার পাতে মোড়া। জাহজের রেলিং ও সিঁড়ির কাঠামো ছিল লোহার। আগন্তুকরা লোহার ব্যবহার নিয়ে এল তাহিতি এলাকায়। তীর, বর্শার মতো আত্মরক্ষার অস্ত্র তৈরি, ছুরি-কাটারির মত নিত্য ব্যবিহার্য উপকরণ তৈরি হলো লোহা দিয়ে। তৈজসপত্রের মধ্যে লোহার ব্যবহার ঢুকে গেল। হাঁড়ি, বাটি, কড়াইয়ের মতো জিনিষ তৈরি হলো লোহা দিয়ে। ভীষণ খুশি তাহিতির মানুষ। সবচেয়ে বড় খুশির বিষয় ছিল তাহিতি এলাকায় কৃষ্টির প্রচলন, কাপড়ের ব্যাপক আমদানি ও কাগজের ব্যবহার শুরু হওয়ার বিষয়। আগন্তুকদের সাথে ছিল গম, যব ছাড়াও কয়েক ধরনের সবজির বীজ। উপকূলে সমভূমি ও উপত্যকাগুলোতে আগন্তুকারা নিজেরা জংগল কেটে, ঘাস সরিয়ে চাষের কাজে লেগে গেল, হাতে-কলমে ভুমি চাষ শেখাল তাহিতিবাসিদের। মাটিতে গম-যবের গাছ উঠল, তা থেকে গম, যব প্রভৃতি খাদ্যশস্য মানুষ পেল। উপকূল ও উপত্যকার নরম মাটিতে তৈরি হলো নানা সবজির সমারোহ।বিস্ময়কর পরিবর্তন এল তাহিতি অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে। কাপড়ের সরবরাহ এল, তার সাথে এল পোশাকের নতুন ধরন। নগ্নতা নিষিদ্ধ হয়ে গেল। মেয়েদের মাথা, গা ও পা পর্যন্ত ঢেকে পোশাক পরার রীতি হয়ে গেল। আর ছেলেরা কমপক্ষে নাভি থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঢাকা পোশাক পরতে লাগল। আগন্তুকদের নিয়ে আসা কাগজ তাহিতিতে নিয়ে এল লেখাপড়া। আগন্তুকরা সামস্টিক প্রার্থনার জন্যে সবাইকে নিয়ে যে প্রার্থনা গৃহ তৈরি করল, তাতে পড়াশুনার আয়োজন করা হলো সকাল ও সন্ধ্যায়। আগন্তুকরা তাহিতি ভাষা শিখল, আর তাহিতিয়ানদের তারা শেখাল তাদের ধর্মগ্রন্থ পড়ার ভাষা। দুই শিক্ষাই একসাথে প্রার্থনা গৃহে হতো। প্রার্থনা গৃহ ছিল পশ্চিম মুখী। পাতার মাদুর ফেলে মেঝেতে সম্মিলিতভাবে পশ্চিমমুখী হয়ে প্রার্থনা হতো। আগন্তুরাই প্রার্থনা শিক্ষা দিয়েছিল এবং মানুষ তা সানন্দে গ্রহণ করেছিল।তাদের ঈশ্বর হিনা তাদের কাছে আল্লাহ হয়ে গেল অথবা আগন্তুকদের ঈশ্বর আল্লাহ তাহিতিদের কাছে ঈশ্বর হিনা’র রূপ নিয়ে এল। তবে ‘হিনা’র প্রতিকৃতি তৈরি বন্ধ হয়ে গেল। বলা হলো, যিনি অদৃশ্য, নিরাকার তাকে আকার দেওয়া ঠিক নয়। তার আকার দিলে তাঁর সম্পর্কে ধারনা ও বিশ্বাস ধীরে ধীরে বিকৃত ও পরিবর্তিত হতে পারে। তাহিতিয়ানদের জীবনে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন এল সেটা সামাজিক ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। আগে ছিল পারিবারিক বা বংশীয় সর্দার বা হেডম্যান হওয়ার সিস্টেম। আগন্তুকরা তৈরি করল বহু বংশ মিলে আঞ্চলিক বা ভুখন্ডগত বা সমাজভিত্তিক পরিচালক বা শাসক হওয়ার সিস্টেম। ঠিক হলো, সবচেয়ে বয়স্ক, জ্ঞান ও চরিত্রে সর্বজনমান্য এমন ব্যক্তিই শাসক বা পরিচালক হবে। তিনি অপারগ হলে প্রবীণরা বসে অন্তত বেশীর ভাগ প্রবীণ একমত হয়ে যোগ্য কাউকে পরিচালক বা শাসক বানাবেন। আবার বেশির ভাগ প্রবীণ তাঁর সাথে একমত না হলে শাসক তাঁর পথ থেকে সরেও যাবে। কিন্তু এই ব্যবস্থা পরবর্তী কালে চলতে পারেনি। স্থিতিশীলতা আনয়ন ও বহুধাবিভক্তি নিরসন করার জন্যে বংশীয় শাসন এসে যায়। এভাবেই আমাদের পামরী রাজবংশ ক্ষমতায় আসে।আমাদের পামরী বংশ শুরু থেকেই আগন্তুকদের সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। আগন্তুদের প্রায় সবাই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে পামরীদের আরু এলাকায়। আগন্তুকদের কিছু শিক্ষক হিসাবে, ধর্মনেতা হিসাবে, বিশেষজ্ঞ ও উপদেষ্টা হিসাবে গোটা তাহিতি, মুরিয়া ও অন্যান্য দ্বীপে ছড়িয়ে পরেছিল। তারা সেসব অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। আগন্তুকদের সাথে পামরীদের ব্যাপক বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল। পামরী রাজবংশের প্রথম রাজা আরি আবদালাহ আরিন্যু ছিল আগন্তুকদের প্রথম জাহাজের নেতা ও বিজ্ঞ আধ্যাত্মিক পুরুষ। আবদালাহ বানজাদ’র মেয়ের ঘরের প্রিয় নাতি। আগন্তুকরাই তাহিতির প্রথম আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। মাঝে মাঝেই জাহাজ এসে নোঙর করত আমাদের আরুতে। জাহাজ থেকে বিভিন্ন পন্য নামত, তাহিতির কিছু ফলমূলও তারা নিয়ে যেত। বুঝা যেত তারা আগন্তুকদের পরিচিত বা তাদের সমজেরই কেউ। জাহাজে আসা কেউ কেউ থেকে যেত, আবার তাহিতি থেকেও কেউ কেউ চলে যেত। আমাদের আগন্তুকরা ও জাহাজের লোকরা ছিল একই ধর্মের।প্রার্থনার সময় জাহাজ থেকেও প্রার্থনার আহবান আসত। শোনা যেত জাহাজগুলো আসছে সুমাত্রা, জাম্বোয়াংগ, ফিজি হয়ে, আবার চলে যেত কোনটি পেরু, কোনটি মেক্সিকো, গোয়াতেমালা, পানামার দিকে। এসব দেশসহ বিভিন্ন দেশের কাহিনীও শোনা যেত আমাদের আগন্তুকসহ তাদের কাছে। এভাবে তাহিতিয়ানরা প্রথম জানল পৃথিবীতে বহু উন্নত মানুষ, উন্নত দেশ আছে, রাজ্য আছে, রাজা আছে। তাহিতির সাথে এসব দেশের লেনদেনও শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাহিতির কি দরকার, কি চাই, জানাতে হতো, পরের জাহাজে সেসব পাওয়া যেত। বলা যায়, এভাবে সব দিক থেকে এক সময়ের অন্ধকার তাহিতি আলোময় হয়ে উঠেছিল।
থামল ফাদার মাহকোহ। থেকেই আবার বলে উঠল, অবশিষ্ট দশ পৃষ্ঠার সারাংশ মোটামুটি এটাই।
স্যার, আপনার সংগ্রহে তো আরও কাহিনী আছে! সে সবে নতুন কিছু নিশ্চয় আছে? আহমদ মুসা বলল।
প্রথমে আমি আমার বংশীয় কাহিনী ১০০ পাতার গ্রন্থগুলো শোনানোর চেষ্টা করেছি। কাঠামোগত একটা গ্যাপ পূরণ হয়েছে। কিন্তু কাহিনীর গ্যাপ রয়েই গেছে। সুতরাং এ থেকে তোমার কোন লাভ হবে না। অধ্যাপক মাহকোহ বলল।
অন্য আরও বংশের তো কাহিনী আছে! সে সবও কি আপনি সংগ্রহ করছেন? বলল আহমদ মুসা।
সে সবের অনেক আমি সংগ্রহ করেছি। সেগুলো সবই শ্রুতি ও স্মৃতি থেকে। লিখিত কাহিনীর পরবর্তী পর্যায় এগুলো। পরিবর্তন ও বিকৃতির অনেক হাওয়া বয়ে গেছে এ সবের দিয়ে। তুমি যার সন্ধান করছ তা তুমি পাবে না ওসব থেকে। ফাদার মাহকোহ বলল।
তাহলে তাহিতির ইতিহাস এভাবে হারিয়ে গেল? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
শুধু তাহিতি নয়, গোটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ইতিহাসও এভাবে হারিয়ে গেছে। এখন বলা হচ্ছে, ইতিহাসের শুরু হয়েছে ইউরিপীয়দের আগমনের আশপাশ থেকে। আমি জানি না, কিভাবে এই ইতিহাসের উদ্ধার সম্ভব এবং কারা এই দায়িত্ব নেবে। বলল ফাদার মাহকোহ একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে।
ইতিহাস কি এভাবে সবটাই মুছে ফেলা যায়? আহমদ মুসা বলল।
এখন যায় না, কিন্তু তখন যেত। তখন এখানকার মত নানাজনে নানাভাবে ইতিহাস লিখত না। ইতিহাসের লিখিত রূপও ছিল না, ইতিহাস থাকতো স্মৃতিতে। পরে ইতিহাস লেখা শুরু হলেও তা ছিল সীমিত। তাহিতি অঞ্চলের দুর্ভাগ্য হল, লিখিত হবার পর তাহিতি অঞ্চলের ইতিহাস নষ্ট হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে লিখিত ইতিহাসগুলো ছিনিয়ে এনে একসাথে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে পরবর্তীকালে নিরপেক্ষ লোকদের গবেষণা ও অনুসন্ধানে অন্ধকার অতীত মাঝে মাঝে কিছুটা ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। যেমন বৃটিশ সমুদ্রচারী ক্যাপ্টেন কুক যিনি তাহিতি এসেছিলেন ১৭৬৯ সালে। তাঁর সহঅভিযাত্রী বিতানী জোসেফ ব্যাংকস বলেছেন পলিনেশীয় ভাষায় উৎপত্তি দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া থেকে। তিনি বিভিন্ন তাহিতিয়ান শব্দের উৎস খোঁজ করতে গিয়ে বিলেছেন, তাহিতিয়ান এ ভাষার শেকড় শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, আরও পশ্চিমে ভারত মহাসাগর, আরব সাগর এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। ক্যাপ্টেন কুক ‘তুপাইয়া’ নামে এক তাহিতিয়ান নাবিকের কথা বলেছিলেন। এই নাবিকের সাথে আলোচনা করে তিনি দেখেন এই নাবিক উত্তর-পূর্বে মারকুইজ দ্বীপপুঞ্জ, পুবে তুয়ামতু অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিনে অস্ট্রালী দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত জানে কিন্তু পশ্চিম দিকে তার জ্ঞান দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ান গোত্রভূক্ত প্রমানিত হয়েছে। এভাবে তাহিতিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস সবই দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া ও আরও পশ্চিমের সাথে যুক্ত। জনসংখ্যার বিস্তার যেমন ঐদিক থেকে এসেছে, তেমনি ভাষা, সংস্কৃতি সব ঐদিক থেকেই এসেছে। আর অষ্টক শতক থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত মুসলিম আরব বনিক, নাবিক ও মিশনারীরাই আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরের মত প্রশান্ত মহাসাগরও চষে ফিরেছে। তারাই তাহিতির মত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপমালার ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের জনক। সমুদ্র, সমুদ্রপথ ও দিক নির্ণয় সম্পর্কে তাহিতিয়ান নাবিকদের যে বিস্ময়কর জ্ঞান ছিল, তা মুসলিম সভ্যতার সমুদ্রচারী আরব নাবিকদের কাছ থেকেই পাওয়া। কিন্তু সে ইতিহাস মুছে গেছে। একজন ইউরোপীয় বিজ্ঞানী বলেছেন, যেদিন নাবিক তুপাইয়াদের সমুদ্রজ্ঞানের উৎস সম্পর্কে জানা যাবে, সেদিনই পরিস্কার হবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের ইতিহাস। এই ইতিহাসের সন্ধান যদি আমরা চাই, তাহলে আমাদের যেতে হবে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে, এভাবে আমাদের যেতে হবে এশিয়ার অভ্যন্তর পর্যন্ত। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এই কথা বলা হয়েছিল নাবিক তুপাইয়াদের কথার আলোকে। সেই সময়ের অবস্থা এখন নেই। অনেক ঝড় বয়ে গেছে তারপর। সে ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে সে সময় পর্যন্ত ইতিহাসের সব উপকরণ। ফাদার মাহকোহ দীর্ঘ বক্তব্যের পর থামল।
কথা শেষ করে ফাদার মাহকোহ তার হাঁটু মুড়ে বসা অবস্থাটা একটু শিতিল করল। হিপটা মেঝের উপর রেখে দু’পা একটু সরিয়ে নল।
গভীর একটা আনন্দের ছায়া আহমদ মুসার চোখে-মুখে। সব মনোযোগ ঢেলে দিয়ে যেন শুনছিল আহমদ মুসা ফাদার মাহকোহ’র কথাগুলো। তার পেছনে বসা মারেভা ও মাহিন এবং পাশে একটু তফাতে বসা মারেভা ও মাহিনের মা। তাদের সবার চোখে দুনিয়ার বিস্ময় ! এসব কোন কথাই তাহিতির কোন ইতিহাস গ্রন্থে লেখা নেই।
ফাদার মাহকোহ থামলে আহমদ মুসা বলল, স্যার, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। তবু স্যার বলছি, আমার প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব মেলেনি।
তোমার প্রশ্নের জবাবের জন্যেই তো এত কথা বললাম। এর মধ্যে তোমার প্রশ্নের জবাব এসে গেছে। তাহিতিতে প্রথম জাহাজ ও পরবর্তী জাহাজগুলো মুসলমানদের। এই মুসলমানদের অনেকেই তাহিতিতে বসতি স্থাপন করে এবং তারাই অন্ধকার তাহিতিকে আলোতে নিয়ে আসে। তারাই নতুন তাহিতির নির্মাতা। তাহিতির পমেরী রাজবংশের প্রথম রাজা আরি আবাদাল্লাহ আরিন্যু’র মায়ের বংশ ও পিতার বংশ তাহিতিয়ান। তার নাম অপভ্রংশ হিসাবে আমাদের কাছে এসেছে। তার নামের আসল উচ্চারণ আর আব্দুল্লাহ আরিন্যু। তাহিতিয়ান ‘আরি’ মুলত আরবি শব্দ। অর্থ পরিচালক, তত্ত্বাবদায়ক, প্রিন্স, সর্দার ইত্যাদি। আরিন্যু তাহিতিয়ান শব্দের অর্থ সমুদ্র তরঙ্গ। আর সমুদ্র তরঙ্গ মানে সাগর-তরঙ্গ অর্থাৎ সর্দার আব্দুল্লাহ। প্রথম রাজার নামের সাথে ‘আরবি’ শব্দ থাকলে সেই বংশের একজন প্রিন্সের নামের সাথে ‘হাসানা’ বা ‘হেসানা’ শব্দ থাকবে না কেন এবং কেন রূপকথার নায়িকা ভাইমিতির সাথে ‘শাবানু’ অর্থাৎ ‘শাহবানু’ থাকবে না ? বলল ফাদার মাহকহ।
তাহলে রাজা, রাজপুত্ররা কি মুসলমান ছিলেন? জিজ্ঞাসা মারেভা মাইমিতির। তার চোখে-মুখে ঠিকরে পড়া বিস্ময়।
আমি জানি না। এর কোন দলিল পাইনি। যা পেয়েছি তা বললাম। তোমরা তরুণ-তরুণীরা এটা অনুসন্ধান করতে পার। তবে এই যে প্রার্থনাগৃহে আমরা প্রার্থনা করি, এটাও তো মুসলমানদের মসজিদের মতই। যেটুকু পার্থক্য রয়েছে, সেটা সময়ের ব্যবধানে সৃষ্টি হয়েছে বলা যায়। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে রাজধানী আরুর আংশিক ধ্বংসের সাথে এই প্রার্থনা ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।তারপর এটা আবার পুননির্মিত হয় বেশ পরে। নতুন নির্মানের সময় আগের অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সেটাই স্বাভাবিক। দেখ, আমার নামটাও বিদঘুটে। আমার নামের মাহকোহ, মিনালী, মিনারী এই তিন শব্দই আরবি শব্দের অপভ্রংশ। এর অর্থ আমার জানা নেই। আমার পিতার সময়েরও অনেক আগে এই আরবি শব্দগুলো বিকৃত হয়ে গেছে, কিন্তু বিকৃত হলেও আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে আমাদের পরিবার কর্তৃক তা অনুসৃত হয়ে এসেছে। এই দেখ,আমাদের প্রার্থনাকক্ষের সামনের দেয়ালে অর্ধ চন্দ্র আঁকা। একে তাহিতিয়ানদের একজন ঈশ্বর ‘হিনা’র সিম্বল বলে মনে করা হয়। আসলে এটাও বিকৃতি। আসলে এই চাঁদ মুসলমানদের বিখ্যাত অর্ধ চন্দ্র (cresent)। মুসলমানদের মসজিদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাবে এই অর্ধচন্দ্রের ব্যবহার হতো। আমাদের প্রার্থনা ঘরের অর্ধচন্দ্র আমি গভিরভাবে দেখেছি। আমি নিশ্চিত এটা মুসলমানদের অর্ধ চন্দ্রই। বলল ফাদার মাহকোহ।
তার, মানে স্যার, মূলত এই প্রার্থনাগৃহ মুসলিম প্রার্থনাগৃহ মানে মসজিদই ছিল। আহমদ মুসা বলল।
আমার তাই মনে হয়। বলল ফাদার মাহকোহ।
তাহলে স্যার, এসব জানার পরেও আপনি কেন এই প্রার্থনা গৃহকে তার মূল পরিচয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছেন না, কেন এই ঘরের প্রার্থনা মুসলমানদের নামাজ হয়ে উঠছে না? আহমদ মুসা বলল।
এসব যেমন রূপান্তরিত হয়েছে, ইতিহাস যেমন রূপান্তরিত হয়েছে, তেমনি মানুষও রূপান্তরিত হয়েছে। আমিও এই রূপান্তরের ফসল। আমার জানা এবং আমি এক নই। এক হতে চাইলেও আমি পারবো না। পরিবর্তনের স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নেবে। স্রোতের টান উপেক্ষা করে মাটিতে শিকড় গাড়ার সাধ্য আমার নেই। বলল ফাদার মাহকোহ।
ঠিক স্যার, প্রয়োজন স্রোতের গতি পাল্টায়। মারেভা মাইমিতি বলল।
হ্যাঁ, প্রয়োজন স্রোতের গতি পাল্টায়। এটা আমার কাজ নয়, মারেভা-মাহিন এ কাজ তোমাদের। বলল ফাদার মাহকোহ।
ধন্যবাদ স্যার, মারেভা-মাহিনরা এটা পারবে ইনশাআল্লাহ ! আর একবার মূল আলোচনায় আসতে চাই স্যার। তাহিতির ইতিহাসের রূপান্তর, মানুষের রূপান্তর ও এই প্রার্থনা গৃহের রূপান্তরের মত রাজপুত্র হেসানা হোসানা ও ভাইমিতি শাবানুদের কাহিনীর রূপান্তর কতটুকু ? বলল আহমদ মুসা।
এটা বলা মুস্কিল। তবে আমি মনে করি কাহিনীতে ঈশ্বরী হিসাবে ‘হিনা’র ভুমিকা বাদ দিলে কাহিনীর যা থাকে, তার তার প্রায় সবটুকুই সত্য। কিন্তু কেন এ বিষয়টা জিজ্ঞেস করছ? ফাদার মাহকোহ বলল।
এ কাহিনী সত্য হলে অ্যাটলের কাহিনীও সত্য হবে। আমি সেই অ্যাটলকেই খুঁজছি। স্যার, আপনি কাহিনী থেকে ঈশ্বরী ‘হিনা’র ভুমিকা মাইনাস করছেন। কিন্তু তাহলে অ্যাটলের অভ্যন্তরে রাজপুত্র হেসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানু গেলেন কিভাবে? বলল আহমদ মুসা।
এক কথায় এর উত্তর দেয়া যাবে না। প্রশান্ত মহাসাগর নিয়ে কাহিনী চালু আছে। সবটুকুই ‘মিথ’ বলা হয়। যেমন বিজ্ঞানের মাথায় যা ধরে না, তাকেই বিজ্ঞান অবিশ্বাস করে বসে। এটা ঠিক নয়। বিজ্ঞানের বস্তুজগতের বাইরে যে অদৃশ্য জগত সক্রিয় আছে তা বস্তুজগতের চেয়ে অনেক অনেক বড়। তেমনি আটলান্টিক সম্পর্কিত সব কাহিনীকে ‘মিথ’ বা কল্পকথা বলে অস্বীকার করা যাবে না। প্রশান্ত মহাসাগরের নিমজ্জিত মহাদেশ ‘মু’ এর কথাই ধরা যাক। প্রশান্ত মহাসাগরে একটা মহাদেশ ছিল, প্রাকৃতিক কারণে তা নিমজ্জিত হয়ে গেছে, একে ‘মিথ’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। আমি এই উড়িয়ে দেয়াকে সমর্থন করি না । কাহিনীর সবটুকু সত্য কিনা আমি বলতে পারবো না। কিন্তু সত্য অবশ্যই আছে। প্রশান্ত মহাসাগরের সাগর তলের ভূ-গঠন এটাই প্রমাণ করে। প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-দক্ষিণ মাঝামাঝি বরাবর পশ্চিম অংশের ভু-গঠন ও এর পুর্বাংশের ভু-গঠন একেবারেই আলাদা। পূর্বাংশের মধ্যে আবার দক্ষিণ-পূর্ব অংশ গভীর খাঁদের মত। এর মাথায় অ্যাটল অধ্যুষিত পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ। প্রশান্ত মহাসাগরেরে এই অংশে একটা কিছু প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছিল। পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে সেই বিপর্যয়ের একটা কিছু ধ্বংসাবশেষ থাকা বিচিত্র নয়! হতে পারে সমুদ্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ সমুদ্রচারী রাজপুত্র হেসানা হোসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর নিমজ্জিত এমন শেল্টার ও তার প্রবেশ পথ সম্পর্কে কোনওভাবে জানতেন। দুই প্রেমিক সেখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন সম্ভবত। বলল ফাদার মাহকোহ।
ধন্যবাদ স্যার, আমি এমন একটি সম্ভাবনা সম্পর্কেই জানতে চাচ্ছিলাম। স্যার, আমিও মনে করি রাজপুত্রের এ বিষয়টা কোন কল্পকথা নয়, বাস্তবতা আছে এর মধ্যে। ধন্যবাদ স্যার।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা তাকাল মাহিন মারেভার দিকে। বলল, আমরা স্যারকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। এবার বোধহয় আমরা উঠতে পারি।
মারেভারা কিছু বলার আগেই ফাদার মাহকোহ বলল, আর একটু কষ্ট আমাদের দিয়ে যেতে হবে। প্রার্থনা গৃহে যারা আসেন দুপুরের আগ পর্যন্ত তাদের নিয়ে আমরা দুপুরে এক সাথে খাই। অতএব, আরও কিছু কষ্ট না দিয়ে যেতে পারছেন না। ফাদার মাহকোহ’র মুখে স্পষ্ট হাসি।
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল ফাদার মাহকোহ। বলল, ইতিহাস তো কিছু শুনলে, চল এবার ভাঙ্গা রাজধানী ‘আরু’টা একবার দেখ। ইতিহাস এখানে তোমাদের সাথে কথা বলবে। আহমদ মুসারাও উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল মারেভা-মহিনের মায়েরা ও।
মারেভার মা আহমদ মুসাকে বলল, চল বেটা, ভাঙ্গা রাজধানী দেখার সময় আমাদের বাড়িও দেখতে পাবে। আমাদের ও মাহিনদের বাড়ি এক রাস্তাতেই, মাত্র রাস্তার এপার-ওপার।
ধন্যবাদ মা। খুব খুশি হবো দেখলে। কেউ থাকেন না এখানে আপনাদের? আহমদ মুসা বলল।
না, তোমাদের ফাদার মাহকোহ আমাদের চাচাজী। তিনিই আমাদের অভিভাবক। তার লোকরাই সব দেখাশুনা করে। আচ্ছা চল, উনি বেরিয়ে গেছেন। বলল মাহিনের মা।আহমদ মুসা ওদের সঙ্গে চলতে শুরু করে মারেভা ও মাহিনের মাকে লক্ষ্য করে বলল, মা, আমি মারেভা ও মাহিনের সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলতে চাই।
এখনি? বলল মাহিনের মা।
এখনি নয়, তবে বিষয়টা জরুরী। বলল আহমদ মুসা।
জরুরী? কেমন বিষয় বেটা, খারাপ কিছু নয় তো ? বলল মারেভার মা। কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে।
খারাপ নয়, সেটা শুভ একটা বিষয়। বলল আহমদ মুসা।
মারেভা ও মাহিন দু’জনেই পরস্পরের দিকে তাকাল, তারপর তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তাদের মুখ কিছুটা রাঙা হয়ে উঠেছে। ‘শুভ কাজ’ বলতে তাদের স্যার কি বুঝিয়েছেন, সেটা তারা দু’জনেই বুঝতে পেরেছে। ইদানিং মাঝে মাঝেই তাদের স্যার বলছেন, তোমরা একসাথে যেভাবে চলাচল করছ তা ঠিক নয়, বিশেষ করে আমাদের সাথে থাকতে হলে তোমরা বিচ্ছিন্ন থাকলে চলবে না। তাদের স্যার যথাসম্ভব শীঘ্র তাদের বিয়ের পক্ষপাতি। কিন্তু মারেভাও মাহিন সলজ্জভাবে সযতনে বিষয়টাকে এড়িয়ে গেছে। এবার সেই বিষয়টা তাদের স্যার তাদের মায়ের কাছে পাড়তে যাচ্ছে। তবে ‘এখনি নয়’ বলে বিষয়টাকে আপাততঃ চাপা দেয়ায় তারা লজ্জার হাত থেকে বাঁচল, স্বস্তি পেল।
তারা সবাই বেরিয়ে এল প্রার্থনা গৃহ থেকে। সকলে হাঁটছে ফাদার মাহকোহ’র পেছনে পেছনে।

Top