৫৪. আবার আমেরিকায়

চ্যাপ্টার

কোলে ঘুমিয়ে পড়া আহমদ আব্দুল্লাহকে অত্যন্ত আদরের সাথে তুলে নিয়ে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিল সারা জেফারসন।

সারা জেফারসনের বেডে তার বালিশের পাশেই ছোট একটা বালিশ আহমদ আব্দুল্লাহর জন্যে। মারিয়া জোসেফাইন ও সারা জেফারসনের ঘরের মাঝখানের ঘরটি আহমদ আব্দুল্লাহর। সেখানেই তার বেড। কিন্তু সারা জেফারসনকে ছাড়া সে শুতে চায় না। ঘুমানোর পর তাকে তার বেডে রেখে এলেও ঘুম ভাঙলে সে ছুটে চলে আসে। মারিয়া জোসেফাইন শেষে অনুমতি দিয়েছে, ‘ঠিক আছে আহমদ আবদুল্লাহ সারা জেফারসনের কাছে ঘুমাবে। অনেক দিন পর সারা জেফারসনকে সে দেখছে তো তাই কাছে কাছেই থাকতে চাচ্ছে আবার পালিয়ে না যায় সেই ভয়ে।’ বলে মুখ টিপে হেসেছে মারিয়া জোসেফাইন। সারা জেফারসন হেসে প্রতিবাদ করে বলেছে, ‘আমি পালাইনি। আমি আহমদ আব্দুল্লাহকে বলেই এসেছিলাম তুমি বুঝতে পারনি।’ কিন্তু আমার কাছ থেকে পালিয়েছিলে।’ বলেছিল মারিয়া জোসেফাইন। সলজ্জ হেসে সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, ‘প্লিজ আপা, সে অতীতের কথা তুল না। মাফ কর প্লিজ।’ মাফ তোমাকে তখনি করেছি আমি। আমি তোমার মতোই তো মেয়ে, তোমাকে বুঝব না। কিন্তু ভীষণ কষ্ট লেগেছিল। শুধু আমি নই, উনি মানে আহমদ আব্দুল্লাহর আব্বা, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেনি জান, নিজেকে নিজের মধ্যে কোথায় হারিয়ে ফেলেছিল।’ বলেছে মারিয়া জোসেফাইন। মারিয়া জোসেফাইনের এই কথার পর সারা জেফারসন কোন কথা বলতে পারেনি। আকস্মিক এক বেদনার ঝলকে শক্ত হয়ে উঠে তার মুখ। একটা অজুহাত তুলে সে পালিয়ে বাঁচে।

আহমদ আবদুল্লাহকে শুইয়ে দিয়ে কপালে একটা আদরের চুমু খেয়ে উঠে বসল সারা জেফারসন। কিন্তু চোখ সরাতে পারল না আহমদ আবদুল্লাহর মুখ থেকে। কপাল ও চোখ ঠিক আহমদ মুসার মতো। গাল, ঠোঁট ও মুখের আদল একদম মায়ের, আবার দাঁত ও হাসি একেবারে আহমদ মুসার। দু’জনের অপরূপ প্রতিচ্ছবি ঘুমন্ত আহমদ আবদুল্লাহর দিকে চেয়ে থাকতে গিয়ে এক সময় মিষ্টি হাসিতে ভরে গেল সারা জেফারসনের মুখ। মনে পড়ল আহমদ আবদুল্লাহর আমেরিকা আসার প্রথম দিনের কথা। সে ও তার মা জিনা জেফারসন এয়ারপোর্টে গিয়েছিল ওদের রিসিভ করতে। সারা জেফারসনকে দেখেই আহমদ আবদুল্লাহ ছুটে এসেছিল। সারার হাতে ছিল ফুলের তোড়া। ফুল দিতে গিয়েছিল সে আহমদ আবদুল্লাহকে। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ তার ছিল না। সোজা ছুটে এসে সে জড়িয়ে ধরেছিল সারা জেফারসনকে। ‘মাম্মি মাম্মি’ বলে মিষ্টি চিৎকার দিয়ে উঠেছিল। কিছুটা বিব্রত হলেও সারা জেফারসন নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। হাতের ফুলের তোড়া মেঝের উপর ছেড়ে দিয়ে তুলে নিয়েছিল আহমদ আবদুল্লাহকে। বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে কয়েকটা চুমু খেয়ে ফিস ফিস করে বলেছিল, ‘মাম্মি নয় বেটা; আন্টি বলতে হয়।’ কিন্তু সংগে সংগেই আহমদ আবদুল্লাহ প্রতিবাদ করে বলে, ‘না, আমি মাম্মি বলব। আম্মিকে তো আমি আম্মি বলি।’ সারা জেফারসন আর কোন যুক্তি না দিয়ে আহমদ আবদুল্লাহকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছিল। তারপর থেকে আহমদ আবদুল্লাহ সারা জেফারসনকে মাম্মি বলেই ডাকে। মারিয়া জোসেফাইন বলেছে, ‘আমি আন্টি বলতে বলাতে সে একই যুক্তি দিয়েছে, আপনাকে আম্মি বললে ঐ মাম্মিকে মাম্মি বলব না কেন।’ সারার মা জিনা জেফারসন বলেছে, ‘বাচ্চারা বেহেশতের ফুল। যা ভালো লাগে বলুক। তোমরা তাকে কিছু বলো না।’ বলবে কি সারা তাকে! ওর কচি কণ্ঠের সুন্দর মাম্মি ডাক তার প্রাণ ভরে দেয়। প্রতি ডাকেই ইচ্ছা করে বুকে জড়িয়ে ধরতে।

আহমদ আবদুল্লাহর গায়ে কম্বলটা একটু ভালো করে তুলে দেয়ার সময় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সারা জেফারসনের বুক থেকে। অবুঝ শিশু আহমদ আবদুল্লাহ তাকে যতটা বিব্রত করেছে, তার চেয়ে বড় বিব্রতকর বিষয় তুলেছে মারিয়া জোসেফাইন আপা। জোসেফাইন আপারা আসার কয়েকদিন পর সেদিন অনেক রাতে অনেক গল্পের পর এই বেডেই সারা জেফারসনের মাথা কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিল, ‘সারা, তোমাকে তো আমি নিতে এসেছি।’ আমি কথাটা বুঝিনি। বলেছিলাম, ‘কোথায় নিতে এসেছ?’ জোসেফাইন আপা বলেছিল, ‘আমার করে নিতে এসেছি।’ আমি হেসে বলেছিলাম, ‘আমি তো তোমার আছিই। না হলে সাত সাগর পাড়ি দিয়ে আমার কাছে এলে কেমন করে! ধন্যবাদ তোমাকে।’ জোসেফাইন আপা বলেছিল, ‘আমি তোমাকে চিরদিনের করে নিতে এসেছি। আমরা পাশাপাশি থাকব। আমরা দুই স্রোত এক মোহনায় গিয়ে সাগরে মিশব। সে সাগর হবে আমার তোমার ভালবাসার ধন আহমদ মুসা।’ জোসেফাইন আপার কণ্ঠ শেষে এসে আবেগে ভেঙে পড়েছিল। জোসেফাইন আপার কথায় আমার সমগ্র সত্তা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকিত হয়ে উঠেছিল। আমি উঠে বসতে গিয়েছিলাম। জোসেফাইন আপা আমাকে উঠতে দেয়নি। শক্ত করে আমাকে ধরে রেখেছিল। তার বাহুবন্ধনে আটকে থেকে বিস্ময়ে কাঠ হয়ে আমি তার দিকে হা করে তাকিয়েছিলাম আমার মুখে কোন কথা সরেনি। আমার ভাবনার অতীত এমন একটা বিষয়কে সে কিভাবে আমার কাছে পাড়তে পারল। জোসেফাইন আপাও আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অনেকক্ষণ পর আপাই নীরবতা ভেঙে বলেছিল, ‘মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মত অবস্থা দেখছি তোমার! ভাবছ এ প্রস্তাব কেমন করে তোমাকে দিলাম ফরাসি মেয়ে হিসাবে এমন প্রস্তাবের মুখে তোমর মতোই আমার অবস্থা হতো। কিন্তু দেখ, আমি সেই ফরাসি মেয়েই এক সময়ের অকল্পনীয় একটা বিষয় তোমাকে বলেছি! বলতে পারছি কারণ, বাস্তব ধর্ম ইসলাম, জীবনের ধর্ম ইসলাম আমাকে বাস্তববাদী বানিয়েছে; জীবনবাদী বানিয়েছে।’ অসম্ভব নরম কণ্ঠে কথাগুলো বলেছিল জোসেফাইন আপা। অন্তরের কথা অন্তর স্পর্শ করে। আমারও তাই হয়েছিল। আমি আর পাল্টা কিছু না বলে কেঁদে ফেলে বলেছিলাম, ‘আমিও মুসলিম আপা, আমি এ ব্যাপারে পড়েছি। যেহেতু আল্লাহ একে অপরিহার্য করেননি, তাই একে আমি সম্পূর্ণভাবেই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করি।’ জোসেফাইন আপা আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল, ‘আমিও একে অপ্রয়োজনীয়, অবাঞ্চিত, অনাকাঙ্খিত বলে মনে করি। আমার ও তোমার মতো প্রতিটি মেয়েই এ কথা বলবে। আমাদের মনে এ কথা কি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জানেন না, জানতেন না? জানতেন। তা না হলে এই ব্যবস্থা তিনি রাখলেন কেন? এ নিয়ে তুমি নিশ্চয় ভাবনি, আমি অনেক ভেবেছি। ভাবতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে এই ব্যবস্থা না রাখলে মানুষের প্রতি অবিচার করা হতো, ইসলাম স্বাভাবিক ও মানবিক ধর্ম হতোনা।’ বলে জোসেফাইন আপা আমাকে আরও কোলে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলেছিল, ‘তোমার কথা ভাবতে গিয়ে আল্লাহর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নুয়ে এসেছিল। আর সেই সাথে আমার হৃদয়টা আতংকে কেঁপে উঠেছিল, আল্লাহ এই ব্যবস্থা না রাখলে কি করতাম! আমার তখন কি মনে হয়েছিল জান? মনে হয়েছিল, সৃষ্টির আগেই আল্লাহ যেন তোমার এ কথা জানতেন!’ অসীম মমতায় ভরা জোসেফাইন আপার নরম কথাগুলো আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। পাল্টা কিছু বলতে না পেরে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম, ‘আমি কিছু ভাবতে পারছি না আপা। জীবনের সবকিছুই আমার গুলিয়ে যাচ্ছে।’ জোসেফাইন আপা আমার চোখ মুছে দিয়ে বলেছিল, ‘তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না, বলতেও হবে না। মনে রেখে, প্রেম স্বর্গীয়। যারা এর পবিত্রতা বজায় রাখে, আল্লাহ তাদের পুরষ্কৃত করেন। তোমার পবিত্র প্রেম, তোমার অতুলনীয় ত্যাগ আমরা কেন, আল্লাহ স্বয়ং বৃথা যেতে দেবেন না। আমি আজ তোমাকে যা বলছি, তা আল্লাহরই ইচ্ছা বোন!’ জোসেফাইন আপার এই কথার পর আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলাম। অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছিল আমার মুখ। বলেছিলাম, ‘আর বলো না আপা। আমি ক্লান্ত, আমি দুর্বল, আমার বুক এত ভার সইতে পারছে না। একটা অসম্ভবকে ধারণ করার শক্তি আমার নেই।’ জোসেফাইন আপা ‘থাক, আর নয়’ বলে আমাকে শুইয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘ঘুমাও। আমি একটু মাথায় হাত বুলাই।’ সত্যিই তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, পরদিন সকালে উঠে নামাজ পড়েই আমি তার ঘরে ছুটে গিয়ে তার বিছানায় তাকে ধরেছিলাম। বলেছিলাম, ‘স্যরি আপা, কাল কতক্ষণ ছিলে জানি না। আমি তোমাকে ‍ভুগিয়েছি। স্যরি।’ জোসেফাইন আপা মিষ্টি হেসে বলেছিল, ‘স্যরি আমাকেই তো বলতে হবে। তোমাকে অনেক কাঁদিয়েছি।’ মনে পড়ল রাতের কথা। রাজ্যের লজ্জা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করেছিলাম, ‘গোটাটাকেই রাতের প্রথম প্রহরের একটা স্বপ্ন বলে মনে কর।’ বলে আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু জোসেফাইন আপা একটু ঝুঁকে খপ করে আমার একটা হাত ধরে আমাকে কাছে টানার চেষ্টা করে বলেছিল, ‘দুষ্টু, আমার অত কথা সব স্বপ্ন হয়ে যাবে। তা হচ্ছে না….।’ তার কথার মধ্যেই আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে পালাতে পালাতে বলেছিলাম, ‘আমি আহমদকে নিয়ে বাগানে বেড়াতে যাচ্ছি।’

আহমদ আবদুল্লাহর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সারা জেফারসনের চোখ এক সময় অশ্রুতে ভরে উঠেছিল। শেষে তা আবার দুষ্টুমির আনন্দে ভরে যায়- সে দিনের সে পালানোর কথা মনে পড়ায়। আহমদ আবদুল্লাহর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মনে মনে বলল, সত্যি জোসেফাইন আপার কোন তুলনা হয় না, চুম্বকের মতো মানুষকে কাছে টানতে পারে, আপন করে নিতে পারে। তার সামনে দাঁড়ালে আমি যেন এক বালিকার মতো ছোট হয়ে যাই। মনে হয়, আমাকে আদেশ দেয়া, বকা, শাসন করা সবই তার অধিকার। আবার কোলে টেনে যখন আদর করে তখন মনে হয় এটা বড় বোনের কাছে ছোট বোনের অধিকার এবং এটা আমার প্রাপ্য।

দরজায় নক করার শব্দে সারা জেফারসন ফিরে তাকাল দরজার দিকে। দেখল দরজায় দাড়িয়ে মারিয়া জোসেফাইন।

‘আহমদ আবদুল্লাহ নিশ্চয় ঘুমিয়েছে? আসতে পারি ম্যাডাম।’ দরজায় দাঁড়িয়ে হেসে বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘না, ম্যাডাম অনুমতি দেবে না। সারা অনুমতি দিতে পারে।’ সারা জেফারসনও বলল হেসে।

‘আমি আমার বোন সারার কাছে অনুমতি চাচ্ছি।’ মারিয়া জোসেফাইনও হেসে বলল।

‘না হলো না, বল আমার প্রিয় বোন সারার কাছে।’ বলল সারা দুষ্টুমি ভরা হাসি হেসে।

হাসল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘আমার প্রিয় বোন, আমার প্রিয়তম বোন, আমার সোনা বোন, সারার কাছে অনুমতি চাচ্ছি।’

‘যদিও এক বিশেষণের জায়গায় তিন বিশেষণ এসেছে, যা চাওয়ার খেলাফ, তবুও অনুমতি মঞ্জুর।’ বলল সারা জেফারসন যাত্রা দলের অভিনয়ের মতো করে।

হেসে মারিয়া জোসেফাইন প্রবেশ করল ঘরে।

উঠে দাঁড়িয়েছিল সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে স্বাগত জানানোর জন্যে।

জোসেফাইন গিয়ে সারা জেফারসনকে ধরে নিয়ে বেডে বসে পড়ল। সারার মাথা কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, ঘুম নষ্ট করতে এলাম। ঘুমাতে যাচ্ছিলে তুমি।’

‘আবার ম্যাডাম?’ শাসনের স্বরে বলল সারা জেফারসন।

‘তুমি ম্যাডামের চেয়ে বড়। আহমদ মুসার কাছ থেকে সব শুনেছি। তুমি একটা মহান আন্দোলনের নেত্রী। তুমি আমেরিকার নতুন প্রজন্মের মুখপাত্র।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

সারা জেফারসন হেসে বলল, ‘নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছি। প্রয়োজনও আর নেই। উনি আমেরিকাকে রাহুমুক্ত করার পর নতুন আমেরিকার জন্ম হয়েছে।ৎ

‘কিন্তু উনি বলেন সারা, রাহুমুক্ত করার চাইতে রাহুমুক্ত দেশ গড়ার কাজ অনেক কঠিন। তোমাদের কাজ আরও বেড়েছে।’

‘উনি যতদূর দেখতে পান, আমি মানে আমরা তা পাই না।’ হেসে বলল সারা জেফারসন।

মারিয়া জোসেফাইন মুখ টিপে হেসে সারা জেফারসনের কাঁধের উপর একটা মৃদু চাপ দিয়ে বলল, ‘দেখতে না পেলে স্বপ্ন দেখ কি করে, তোমার দাদুদের নতুন আমেরিকা গড়ার স্বপ্ন?’

চমকে উঠে সারা জেফারসন তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের চোখের দিকে। ভাবল একটু। তারপর বলল, ‘উনি বোধ হয় তোমাকে সব বলেন?’

সারা জেফারসনকে আরও নিবিড়ভাবে কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘উনি যা করেন, যা বলেন, যা শোনেন, সবই আমাকে বলেন। আমিও বলি। আমাদের মাঝে ব্যক্তিগত বলে কোন বিষয় নেই।’

‘সবটুকু দিয়ে তুমি তাকে ভালোবাস, তাই না?’ বলল সারা জেফারসন।

‘হ্যা, অবশ্যই।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘সবটুকু দিয়ে তিনি তোমাকে ভালোবাসেন, তাই না?’ জিজ্ঞাসা সারা জেফারসনের।

‘হ্যা, অবশ্যই সারা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

গম্ভীর হলো সারা জেফারসন। বলল, ‘আমিও এটা জানি আপা। তিনি ও তুমি এই দুই ভালো মানুষের জন্যে এটাই স্বাভাবিক। তোমাদের মধ্যে কোন ‘তৃতীয়’-এর উপস্থিতি অসম্ভব আপা, এমন আশা তুমি করতে পার না!’

‘ও তুমি আমার অস্ত্রে আমাকে আক্রমণ করেছ! ভুলে গিয়েছিলাম তুমি পলিটিশিয়ান।’ হেসে কথাগুলো বলে গম্ভীর হলো মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘পারি আমি সারা জেফারসন। কারণ আমি তাঁকে ভালোবাসি, ওঁর প্রতি আমার ভালোবাসাকে আমি চিনি। সে ভালোবাসা একান্ত আমারই ভালোবাসা, ‘কোন তৃতীয়’-এর ভালোবাসা এবং তার স্থানেও এটা নয় সারা।’ মারিয়া জোসেফাইনের গম্ভীর কণ্ঠ সীমাহীন এক আবেগে ভেঙে পড়ল।

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপা, দু’টোকে এক করো না। তোমার এই ভালোবাসার কোন দ্বিতীয় নেই।’

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তোমার ভালোবাসাকে তুমিই জান না সারা। তোমাকে দেখার আগে তোমার স্বপ্নের কথা আমি শুনেছি। একে তুমি তোমার ভবিতব্য মনে কর, সেটা আমি জেনেছি। তোমার চিঠিটাও আমি পড়েছি। তোমার এই ত্যাগ কত বড় তুমি জান না। তার ইস্তাম্বুল মিশনে তুমি অলক্ষে তার পাশে দাঁড়িয়েছ। নিজের নিরাপত্তার চিন্তা বিসর্জন দিয়ে তার নিরাপত্তার কথা ভেবেছ। সব শেষে অলক্ষেই তুমি ইস্তাম্বুল ছেড়েছ। এই ত্যাগ অমূল্য সারা। ভালোবাসা সাগরের মতো অতল, আর আকাশের মতো অসীম না হলে নীরবে এই ত্যাগ কেউ করতে পারে না সারা। তোমার পবিত্র এই প্রেম তোমার সাথে আমাকে একাত্ম করেছে সারা। তাতিয়ানা, মেইলিগুলি, ফারহানা, মেরীদের কেউ নেই। ওদের হারিয়েছি, দেখারও সৌভাগ্য হয়নি ওদের। তোমাকে পেয়ে হারাতে পারবো না। তাই ছুটে এসেছি আমি তোমার কাছে। তোমাকে না নিয়ে আমি ফিরব না।’

‘আপা, তোমার কোন কথাই আমি অস্বীকার করবো না। কিন্তু আপা, তুমি অসম্ভব এক দাবি নিয়ে এসেছ। সারাজীবন আমি কুমারী থাকার চেয়েও ওটা কঠিন। সব ভালোবাসাই সফল হয় না, ভালোবাসার স্মৃতি নিয়েও জীবন কাটানো ….।’

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের মুখ চেপে ধরল। বলল, ‘এসব কথা বলতে হবে না। একটা হালালকে হারাম করতে চেয়ো না।’

‘এটা হারাম করা নয়, একটা হালালকে গ্রহণ করতে না পারা।’ বলল সারা জেফারসন।

‘হ্যা, একটা হালালকে গ্রহণ না করার অধিকার আছে। কিন্তু সবক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। যখন কোন হালাল বর্জন করা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়, তখন বর্জন করা বৈধ হয় না।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘কিভাবে ক্ষতি করছি বা আমার সিদ্ধান্তে কিভাবে ক্ষতি হচ্ছে?’ বলল সারা জেফারসন।

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের গালে একটা চিমটি কেটে আদর করে বলল, ‘ক্ষতি দেখতে পাচ্ছ না, ন? এক. তোমার জীবনের সীমাহীন ক্ষতি, দুই. আহমদ মুসার কষ্ট।’

চকিতে মুখ তুলে তাকাল সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনের দিকে। চোখে তার বিস্ময় ! বলল, ‘আমার যে বিষয়টাকে ক্ষতি বলছ, তা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তাঁর কষ্ট কিভাবে?’

হাসল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘সারা, তোমার কষ্ট অনেকটাই সবাক। সবাই দেখবে, অনেকেই বুঝবে। কিন্তু উনি কোন্ কষ্টের শিকার ! তুমি যে চিঠি ওঁর কাছেঁ লিখেছিলে, তাতে ওঁর অশ্রুর অনেকগুলো ফোঁটার চিহ্ন রয়েছে। আর….।’

সারা জেফারসন হাত দিয়ে মারিয়া জোসেফাইনের মুখ চেপে ধরে বলল, ‘আর বলো না আপা। আমি শুনতে পারবো না। আমি ভেবেছিলাম ….।’ ভেঙে পড়া কণ্ঠ তার থেমে গেল।

‘কি ভেবেছিলে?’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ভেবেছিলাম তাঁর মতো অসম্ভব ব্যস্ত মানুষ, জটিল সব মিশন নিয়ে যার কাজ, দুঃখী, বিপদগ্রস্ত মানুষের চিন্তা যার মাথায় সব সময়, তিনি কি করে আমেরিকার একটা মেয়েকে নিয়ে ভাববেন! তার কষ্টের কথা তো আমি চিন্তাই করিনি।’ বলল কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে জেফারসন।

‘না সারা, তুমি তার প্রতি অবিচার করেছ। তিনি শুধু নিজের বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষায় এত বড় বড় ও জটিল মিশন নিয়ে কাজ করেন আর সেটা এ জন্যই করেন যে, তিনি মানুষকে ভালোবাসেন। যারা মানুষকে এভাবে ভালোবাসে তাদের হৃদয়-মন হয় অসম্ভব সংবেদনশীল। তার এই সংবেদনশীল মন এক বোবা যন্ত্রনার সব সময় বিপর্যস্ত হয়েছে। তুমি….।’

সারা জেফারসন হাত দিয়ে মারিয়া জোসেফাইনের মুখ চেপে ধরে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, ‘তুমি এভাবে বলো না আপা। তাঁকে সত্যিই আমি বুঝিনি। আমি মনে করেছিলাম, পাথরের মতো কঠিন চরিত্র ওঁর। এসব ব্যাপার ওঁর জন্যে কোন সমস্যা নয়, আমি আমাকেই শুধু সমস্যা মনে করেছি। আমি আমাকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম আপা। আরও মনে করেছি আপা, ইসলামের যে কঠোর নৈতিকতা অনুসরণ করেন তিনি, আমার অন্যায় ও অনৈতিক চিন্তা তাঁর কাছে আমলই পাবে না।’

‘কোনটাকে অনৈতিক, অন্যায় চিন্তা বলছ? তোমার চিঠি কিংবা তোমাকে নিয়ে যা ঘটেছে সেটা? এমন ভাবনা, এমন চিন্তা অবৈধ নয়, অনৈতিক নয়। কেউ যদি কারও সম্পর্কে ভাবে আর সে ভাবনা যদি পবিত্রতা ও আইনের সীমা লংঘন না করে, তাহলে সে ভাবনা দোষের নয়, বরং মানবিক। এমন যদি ঘটে তাহলে অন্য পক্ষেরও ভাববার প্রয়োজন। এ অধিকার আল্লাহ দিয়েছেন। না হলে এই সমস্যার সমাধান হবে কি করে? আল্লাহ মানুষকে রোবট বা যন্ত্র করে সৃষ্টি করেননি। মানুষকে তিনি আবেগ-অনুভূতিপ্রবণ মন দিয়েছেন। অনেক কিছুই এই মানব মনে আবেগের ঢেউ তুলবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কোন চিন্তা, কোন আবেগ সক্রিয়তায় পৌছে সীমা লংঘন না করা পর্যন্ত তা পাপ নয়। তুমি এ সীমা লংঘন করনি।’

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনের এসব কথার কোন জবাব দিল না। সে মারিয়া জোসেফাইনের কোলে মুখ গুজে চুপ করে রইল।

মারিয়া জোসেফাইন সারার মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আর কি বলব তোমাকে সারা?’

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনের দু’হাত টেনে নিয়ে তাতে মুখ গুঁজে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, ‘আর কিছু বলো না আপা। ভেতরটায় যে ঝড় বইছে, তা আর সইতে পারছি না।’ কথার সাথে সাথে সারা জেফারসনের দু’গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল।

মারিয়া জোসেফাইন বলল, ‘ঠিক, আর কোন কথা নয়। তুমি ঘুমাও সারা। তবে একটা কথা বলি, তোমার ভাগ্যের নিয়ন্তা তুমি সাজতে চেয়ো না, তা চাইলে ঝড় আরও বাড়বে। আল্লাহকে তোমার ভাগ্যের নিয়ন্তা স্বীকার কর।’

‘আমি জানি না, ভেতরে এত ঝড় কেন? আল্লাহর ইচ্ছা আমি বুঝতে পারছিঁ না।’ বলল সারা জেফারসন।

‘অন্তরের বেদনা অশ্রু হয়ে তোমার চোখ দিয়ে নামছে, সেই অন্তরে বেদনার কেন্দ্রে খুঁজে দেখো আল্লাহর ইচ্ছা তুমি দেখতে পাবে।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘আপা বুঝতে পারছ না, ঐ খুঁজে দেখতেই ভয় আমার। বুক কাঁপছে।’ বলল সারা জেফারসন অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে।

‘সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি শান্ত হও বোন। এস শুয়ে পড়।’ বলে মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনকে শুইয়ে দিল। তার গায়ে কম্বলটা তুলে দিয়ে বলল, ‘আমি যাই বোন সারা !’

উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার বসল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘আর একটা কথা। আমি মা’র সাথে কথা বলতে চাই। বলতে পারি সারা?’

সারা জেফারসন তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের দিকে। একটু ভাবল। একটু ম্লান হাসল। বলল, ‘এটা বুঝি জিজ্ঞাসা করতে হয় আপা। তিনি তোমারও মা। তোমার যা ইচ্ছা সবই বলতে পার।’

‘ধন্যবাদ সারা। আসসালামু আলাইকুম।’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল মারিয়া জোসেফাইন।

সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসনও ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত সাড়ে ৯টা। শোবার আগে আরও আধ-ঘণ্টা সময় তার হাতে আছে। সোফার পাশের ছোট্ট বুকস্ট্যান্ড থেকৈ একটা ম্যাগাজিন টেনে নিয়ে সোফায় বসল জিনা জেফারসন।

দরজায় নক হলো।

‘এস।’ জিনা জেফারসন বলল।

ঘরে প্রবেশ করল মারিয়া জোসেফাইন।

উঠে দাঁড়াল জিনা জেফারসন। বলল, ‘এস মা।’

‘আপনি বসুন মা। আমি বসছি।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

জিনা জেফারসন বসল।

মারিয়া জোসেফাইন গিয়ে জিনা জেফারসনের পায়ের কাছে কার্পেটের উপর বসল।

জিনা জেফারসন তাকে সংগে সংগেই টেনে তুলতে তুলতে বলল, ‘করছ কি মা। তুমি আমার মেয়ের মতো বটে, কিন্তু তুমি ফ্রান্সের বুরবন রাজকুমারী। ইউরোপের একটা শ্রেষ্ঠ রাজবংশের রাজরক্ত তোমার দেহে।’

জিনা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে পাশে বসাল।

‘মা, সব মানুষেরই রক্তের রং লাল, সবার একই রক্ত। এর বাইরে যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা অদৃশ্য। সৃতরাং মানুষকে বড়-ছোট আমরা করতে পারি না। রাজ্য একটা মানুষকে রাজা করে আর রাজ্য না থাকলে সে সাধারণ মানুষ।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘সাধারণভাবে একথা সত্য, আইনের ব্যবহারের দৃষ্টিকোণ থেকেও এ কথা সত্য। ইসলামের এসব বিষয় পড়ে জানলাম, মানুষকে বড়-ছোট করা চলে না। কিন্তু মা, আল্লাহর রসূলও বংশকে একটা গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন কোরাইশ বংশ জ্ঞান, মান-মর্যাদায় আরবের শীর্ষে ছিল।’ বলল, জিনা জেফারসন।

‘আপনার কথা ঠিক মা। তবে এখন আমি তো আর রাজকুমারী নই।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘ঠিক আছে মা, কিন্তু মানুষ রাজকুমারী বললে আটকাবে কে। অতএব চুপ থাকা ভালো।’ বলল জিনা জেফারসন।

‘আচ্ছা মেনে নিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে ‘মেয়েরে মতো’ বলেছেন। আমি কি আপনার মেয়ে নই?’ অনেকটা অভিমানক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল মারিয়া জোসেফাইন।

জিনা জেফারসন হেসে এক হাত দিয়ে মারিয়া জোসেফাইনকে কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘কে বলল তুমি আমার মেয়ে নও। তুমি সারার চেয়েও আমার ভালো মেয়ে।’

‘কি বলছেন মা, সারার চেয়ে মা-ভক্ত মানুষ আমি কম দেখেছি। সে খুব ভালো।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘ভালো, কিন্তু অনেক কথাই আমার শোনে না।’ বলল জিনা জেফারসন।

অনেক কি কথা শোনে না জিজ্ঞাসা করতে ভয় হলো মরিয়া জোসেফাইনের। যদি তার অন্যত্র বিয়ের কথা বলে? তাহলে একটু অসুবিধায় পড়বে মারিয়া জোসেফাইন। মারিয়া জোসেফাইন বলল, ‘মা’ বলেই মেয়েরা অনেক আবদার করার সুযোগ পায়। অনেক কথা না মানারও অধিকার ভোগ করে মা।’

‘জীবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে তো গুরুজনদের কিছু কথা শুনতে হয় মা।’ বলল জিনা জোফারসন গম্ভীর কণ্ঠে।

চমকে উঠল মারিয়া জোসেফাইন, কথা উনি তো ওদিকেই নিচ্ছেন। ভাবল মারিয়া জোসেফাইন। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ।

‘মা, একটা কথা বলতে চাই।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘অবশ্যই মা, বল।’ সারা জেফারসনের মা জিনা জেফাসরন বলল।

‘একটা জিনিস চাইব মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

জিনা জেফারসন তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের দিকে। হাসল। বলল, তুমি চাইবে, তা আবার বলতে হয়! চেয়ে ফেল।’

হাসল মারিয়া জোসেফাইনও। বলল, ‘না বলবেন না তো মা?’

‘মেয়ে মায়ের কাছে সাধ্যের বাইরের কিছু চায় না। তাই না দেয়ার কোন প্রশ্ন নেই মা।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘মা আমি সারাকে চাই আমার পাশে চিরদিনের জন্য।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

সারার মা জিনা জেফারসন চোখ তুলে তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের দিকে। চোখ তার জিজ্ঞাসা আছে, কিন্তু বিস্ময় নেই। বিস্ময় নেই কারণ প্রথম দিন দেখার সাথে সাথে আহমদ আবদুল্লাহ যে ভাবে ‘মাম্মি’ বলে জড়েয়ে ধরেছিল সারাকে, তাতেই তার মনে ভাবনাটার হঠাৎ উদয় হয়েছিল: ইসলামে তো একাধিক বিয়ের অনুমতি আছে। সে রকম কিছূ কি ঘটতে পারে? ঘটা উচিত? পরের দিনগুলোতে মারিয়া জোসেফাইনের ব্যবহারে সে মুগ্ধ হয়েছে। মনে হয়েছে, মারিয়া জোসেফাইনও বোধ হয় তারই মত চিন্তা করে। আজ সে কথাটাই মারিয়া বলল। কিন্তু এর পরেও তার মনে জিজ্ঞাসা আমেরিকান সমাজে এটা কতদূর গ্রহণযোগ্য হবে!

সারার মতো সচেতন ও শীষ মর্যাদার আমেরিকানের পক্ষে এ ধরনের জীবন মেনে নেয়া কি সম্ভব!

এসব ভাবতে গিয়ে মারিয়া জোসেফাইনের কথার জবাব দিতে দেরি হয়ে গেল।

‘কি ভাবছেন মা?’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ভাবছি তোমার চাওয়া খুব বড় নয়। কিন্তু এক কথায় দুই কথায় এর জবাব নেই।’ বলল জিনা জেফারসন।

‘ঠিক বলেছেন মা। কিছু কথা বলুন আপনি।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘দেখ মা, আহমদ মুসা আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। ইসলাম দিয়েছে আমাদের নতুন জীবন। কিন্তু এর পরও আমরা আমেরিকান সমাজের একজন। এ সমাজে এমনকি মুসলিমরাও একাধিক স্ত্রীর কথা চিন্তা করে না। এ সবই ভাবার কথা।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘মা, আপনি মায়ের মতোই বাস্তব চিন্তার কথা বলেছেন। কিন্তু ইসলামে একাধিক স্ত্রীর বিষয়টি সাধারণ নয়, সবার জন্যে নয়, ব্যতিক্রমধর্মী একটা অনুমতি। মানুষের স্বাভাবিক জীবন রক্ষা, অসহনীয় এক জীবন-জটিলতার মানবিক সমাধানের জন্যেই এই ব্যতিক্রমী বিধান করেছেন মানুষের স্রষ্টা মানুষের জন্যে। যে সমাজ এটা ভালো চোখে দেখে না, সেটা সর্বাঙ্গীণ সুস্থ সমাজ নয় মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ঠিক বলেছ মা। সারার বিষয়টা নিয়েই আমি ভেবেছি। সব প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় না। অন্যত্র বিয়ে হবার পর সুখের সংসারও তারা করতে পারে। কিন্তু দুনিয়াতে এর ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রয়েছে। সারার ঘটনা তার একটি। সারার মতো মেয়েরা যা একবার গ্রহণ করে, তা বর্জন করতে পারে না। এ ধরনের ক্ষেত্রের জন্যেই স্রষ্টা ঐ ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা রেখেছেন এবং এটাই বাস্তব ও স্বাভাবিক। আমি একমত মা।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘তাহলে মা, আমাকে আপনি সাহায্য করুন। আমি আপনার সাহায্য চাই মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘আমার সারা তার গ্রান্ড দাদু টিজে মানে টমাস জেফারসনের চরিত্র পেয়েছে। নীতির ব্যাপারে সে অনড়। তাকে নিয়ে আমার খুব ভয়। দেখ মা, আহমদ মুসাকে সেই যে চিঠি লিখে তার সামনে থেকে সরে গেল, এখনও তার সামনে আসেনি। ইস্তাম্বুলে সারা দু’বছর ছিল। শেষ দিকে এক মিশনে আহমদ মুসাও সেখানে যায়। তোমার কাছ থেকেই শুনেছি সারা গোপনে তাকে সাহায্য করেছে এই বিষয়টি গোপন রেখেই ইস্তাম্বুল থেকে চলে আসে। এই সারাকে দিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করানো যাবে সেটা বলা মুশকিল। বুঝতে পারছি না, আমি তোমাকে কি সাহায্য করতে পারবো।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘মা, আহমদ মুসার সাথে সে দেখা করেনি, এটা ঠিক, কিন্তু আহমদ মুসাকে সে তার সমগ্র সত্তা দিয়ে ভালোবাসে মা। এত ভালোবাসে বলেই সারা দূরে থাকছে, দূরে থাকতে পারছে সে।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘আমি জানি মা। সে পাগলের মতো ভালোবাসে ছেলেটাকে। আমার কাছে সে সব ঢেকে রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমি তো মা! সন্তানের মন আমি বুঝব না। সেও অনেক সময় নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। মনে পড়ে একদিনের কথা। সারা ছুটিতে বাড়িতে এসেছিল। পুরনো কাপড় বাছতে গিয়ে আহমদ মুসার একটা শার্ট পেলাম। আমি ভাবছিলাম পুরনো কাপড়ের সাথে এটাও বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলব কিনা। আমার কথা শুনে সে আঁতকে উঠেছিল। বলেছিল, ‘না মা, ওঁর শার্ট পুরনো হলেও ওটা ওঁরই শার্ট। ওটা ফেলে দেয়া যাবে না।’ আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে মা তুমি রেখে দাও।’ সারা বলেছিল, ‘তুমিও রাখ মা, ওঁ কোন দিন এলে দিয়ে দিও।’ আমি রেখে দিলাম। সেদিনই রাত দু’টো, আমার ঘুম হঠাৎ ভেঙে যায়। ঘরের ডিম লাইটে দেখলাম আমার ক্লথ হ্যাংগার খুলে আহমদ মুসার শার্ট নিয়ে গেল সারা। দেখলাম, সে এখনও ঘুমায়নি। সে তো এমন অনিয়ম করে না! আমার কৌতুহল হলো, আমি তার পিছু পিছু গেলাম। তার ঘরের দরজা খোলা। সে ভেতরে ঢুকে গেছে। আমি খোলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলাম। দেখলাম, বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে সারা। বালিশে আহমদ মুসার শার্টের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। ‍বুঝা গেল শার্টের উপরই মুখ গুঁজে পড়ে আছে সে। কাঁদছে সে। অবরুদ্ধ কান্নার চাপে তার দেহ ফুলে ফুলে উঠছে। কোন শব্দ নেই, নীরব কান্না, ঠিক রাতের নীরব প্রহরের মতো। মন বলল, গিয়ে মেয়েকে বুকে নিয়ে সান্ত্বনা দেই। কিন্তু আবার মনে হলো, নীরবে কাঁদছে সে, কাঁদুক, কাঁদা তার দরকার। আমি ফিরে এলাম আমার ঘরে। আর ঘুমাতে পারলাম না। সারার এই কান্নার শেষ কোথায়? কোন উত্তর আমার জানা নেই। আমারও ‍দুই গণ্ড বেয়ে নেমে এল অশ্রুর ঢল। জানি না মা জোসেফাইন, আমার সারা এভাবে কত কেঁদেছে।’ জিনা জোসেফাইন থামল। তার কণ্ঠ কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে।

মারিয়া জোসেফাইনেরও দুই চোখ অশ্রুতে সিক্ত হয়েছে। বলল, ‘এই সারাকে আমিও চিনি মা। এ জন্যেই তো আমি ছুটে এসেছি। আমি তাকে নতুন জীবন দিতে চাই মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘তুমি খুব ভালো মা। তোমার মতো মেয়ে আছে, গল্পে শুনলে বিশ্বাস করতাম না। তুমি গল্প-রূকপথার চেয়েও বিস্ময়কর। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা কত নিশ্ছিদ্র, কত গভীর এবং পারস্পরিক আস্থার বিষয়টা কত দৃঢ়, কত অভঙ্গুর হলে একজন স্ত্রী আরেকজন মেয়েকে নিজের স্বামীর অধিকারে ভাগ বসাতে দিতে পারে! এমন ভালোবাসা, এমন আস্থা বিশ্বাসের কথা পাশ্চাত্যের স্বামী-স্ত্রীরা ভুলে গেছে। তোমাকে ধন্যবাদ মা।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘না মা, পাশ্চাত্যেও এই ভালোবাসা ও বিশ্বাস আছে। সারা তো পাশ্চাত্যের মেয়ে, তার ভালোবাসা নিশ্ছিদ্র, নিখাদ, নিবিড়তায় বেনজীর। আমি যাকে ভালোবাসি আমার সবকিছু দিয়ে, তার প্রতি সারার এই নিঃস্বার্থ, নির্লোভ ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে, আমাকে গৌরবান্বিতও করেছে মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘বিধাতা কিভাবে তোমাদের দু’জনকে এভাবে এক করলেন! তুমি সারার ভালাবাসাকে নিঃস্বার্থ, নির্লোভ বলছ, কিন্তু তোমার স্বামীকে তার সামনে হাজির করে তুমি তোমার স্বার্থের যে কুরবানী দিলে, তা সারার ত্যাগের চেয়ে অনেক বড়, অসীম, অতল।’ জিনা জেফারসন বলল। তার কণ্ঠ ভারি।

‘একজন মুসলিম নারীর জন্যে এটা বড় নয় মা। আল্লাহ যখন এটাকে হালাল করেছেন, তখন এর মধ্যে মানুষের জন্যে কল্যাণই রয়েছে। আমার জন্যে, সারার জন্যে আমি সে কল্যাণই চাচ্ছি।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘কিন্তু সব মুসলিম মেয়ে কি এটা বুঝে মা? এ নিয়ে কত অশান্তি, কত মামলা-মোকদ্দমার কথাও শুনেছি।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘ঠিক মা। কিন্তু বাড়তি বিয়ের ক্ষেত্রে অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণ এবং দেহগত কামনার পরিতৃপ্তি এক জিনিস তো নয়। মানুষ যখন আল্লাহর দেয়া একটা ব্যতিক্রমী সুযোগকে দেহগত কামনা পূরণের জন্যে অপব্যবহার করে, তখনই সৃষ্টি হয় তাদের জীবনে অশান্তি। এর আরেকটা কারণ দেহগত কামনা যার উপর বিজয়ী হয়, সে স্ত্রীদের সাথে সুব্যবহার, সমব্যবহার করতে পারে না। এর স্বাভাবিক পরিণতি অশান্তি, ঝগড়া-ফাসাদ এবং মামলা-মোকদ্দমা। আহমদ মুসা, সারা জেফারসন অর্থাৎ আমাদের কেসটা এদের থেকে একেবারেই ভিন্ন।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ধন্যবাদ মা জোসেফাইন।’ বলে জিনা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘দ্বিতীয় মেয়ে তুমি আমার।’

‘প্রথম মেয়ে নয় কেন? আমি সারার চেয়ে বড়।’ বরল মারিয়া জোসেফাইন। তার মুখে হাসি।

‘ঠিক আছে মা, তুমি দ্বিতীয় নও, আমার প্রথম মেয়ে তুমিই।’ হেসে বলল জিনা জেফারসন।

মারিয়া জোসেফাইন জিনা জেফারসনের কোল থেকে মাথা তুলল। হাসিমাখা মুখ তার একটু গম্ভীর হলো। বলল, ‘সামনে এগোবার পথ কি মা, সারা তো এখনও ইয়েস বলেনি।’

‘আমিও সেটা ভেবেছি জোসেফাইন। বলেছি, সারার ব্যক্তিত্ব তার টিজে দাদুর মতো। এই কারণে তাকে আমি ভয়ও করি। আমেরিকায় আহমদ মুসার সবচেয়ে বড় অভিভাবক, আমাদের পরিবারেরও বন্ধু এবং সারার গুরুজন এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম আমার এখানে এসেছিলেন সারার সাথে আহমদ ‍মুসার বিয়ের ব্যাপার নিয়ে। তিনি আমার কাছে সব কথা শুনে সারাকে আর বলতে সাহস পাননি। আমরা একমত হয়েছিলাম সারাকে সময় দেয়া তার মনের স্থিতিশীলতার জন্যে। আমি মনে করি সারাকে কোন বিষয়ে রাজী করানোর ক্ষেত্রে তুমি সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। সারা যেমন তোমাকে ভালোবাসে, তেমনি সম্মানও করে তোমাকে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, তুমি আহমদ মুসার স্ত্রী। পারলে একমাত্র তুমি পারবে সারাকে রাজী করাতে।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘এ বিশ্বাস আমারও ছিল মা। কিন্তু সে বিশ্বাস আমার এখন নেই। আমার সব যুক্তি শেষ। আমার যুক্তি সে অস্বীকার করছে না, শুধু কাঁদছে এবং বলছে সে এ নিয়ে ভাবতে পারছে না।’ বলল জোসেফাইন।

উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল জিনা জেফারসন। এ সময় সারা জেফারসন ঘরে প্রবেশ করল। বলল, ‘আপা তুমি এখানে, আমি ওদিকে খুঁজে হয়রান।’

‘আহমদ আবদুল্লাহ ঘুমিয়েছে সারা?’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘হ্যা, ঘুমিয়েছে আপা।’ বলল সারা

‘কম্পিউটার থেকে তুলে নিয়ে এত তাড়াতাড়ি তাকে তুমি ঘুম পাড়িয়ে দিলে কি করে? তোমার হাতে জাদু আছে সারা।’

বলেই উঠে দাঁড়াল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘এখন চলি মা।গুড নাইট।’

‘হ্যা, এস মা। ঘুমাতে দেরি করো না যেন।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘ঠিক আছে মা। চল সারা।’ বলে হাঁটতে শুরু করল মারিয়া জোসেফাইন।

তারা দু’জন বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

সারার শোবার ঘরে যাবার পথে একটা বড় ফ্যামিলি লাউঞ্জ ক্রস করছিল। হঠাৎ মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনকে টেনে নিয়ে লাউঞ্জের একটা সোফায় বসে পড়ল। বসেই জড়িয়ে ধরে থাকল সারা জেফারসনকে। বলল, ‘উনি তো আসছেন সারা। আমি কিন্তু এগোচ্ছি।’

সারার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেই আবার দপ করে নিভে গেল। সে জোসেফাইনের কোলে মুখ গুঁজে বলল, ‘আপা আমি ওঁর আছি, আমৃত্যু আমি ওঁরই থাকব। কিন্তু আমি ওঁকে আমার করতে পারবো না। ও তোমার, শুধুই তোমার।’ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল সারা জেফারসনের গলা।

‘তার মানে সারা, আহমদ মুসা আমার বলেই তাকে তুমি প্রত্যাখ্যান করছ?’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘না, না আপা। আমি ওঁকে প্রত্যাখ্যান করছি না। প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। মাত্র ওঁকে আমার করতে পারছি না।’ সারা জেফারসন বলল কান্না জড়িত কণ্ঠে।

‘ও আমার এ জন্যেই তো?’ বরল মারিয়া জোসেফাইন ভারি কণ্ঠে।

‘না আপা, ওজন্যে নয়। আমি তোমাকে ভালোবাসি আপা। তোমার কোন কষ্ট, তোমার ক্ষতি আমি বরদাস্ত করতে পারি না, পারবো না।’ সারা জেফারসন বলল।

‘দুঃখিত সারা, আমার আনন্দ, আমার খুশিকে-আমার কষ্ট, আমার ক্ষতি বলছ। তুমি আমাকে এতটুকুই বুঝেছ বোন!’ বলল আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে মারিয়া জোসেফাইন।

সারা জেফারসন জড়িয়ে ধরল মারিয়া জোসেফাইনকে। বলল, ‘আমাকে মাফ কর, ভুল বুঝোনা আমাকে আপা। আমি মনে করি, স্বামী মেয়েদের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা। এই জায়গাকে সব মেয়েই তার সবকিছু দিয়ে আগলে রাখতে চায়। আমি এই অর্থে কথাটা বলেছি আপা।’ ভারি, কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর তার।

সারাকে আরও কোলে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ। ওটা মেয়েদের সবচেয়ে স্পর্শকতার জায়গা। আমারও। আমি দশ বছর ধরে ওঁকে আমার সবকিছু দিয়ে আগলে রেখেছি। উনি তো উড়ন্ত পাখি। এবার আমরা দু’জনে মিলে ওঁকে সামলাব। আজ ‘কবুল’ না বললে তোমাকে ছাড়ছি না।’

‘তুমিও দেখছি ‘কবুল’ শব্দ বলছ। মুসলিম মতে বিয়ের যে বিবরণ পড়েছি। তাতেও স্বীকারোক্তির ক্ষেত্রে ‘কবুল’ শব্দটা দেখেছি।’ বলে হেসে ফেলল সারা জেফারসন।

‘হ্যা সারা, ওটা একটা পরিভাষাগত শব্দ। থাক এ কথা। তুমি ঘুরিয়ে কথা অন্যদিকে নিও না। বল সারা, আমি শুনতে চাই।’

গম্ভীর হলো সারা। বলল, ‘আপা, তোমার এসব কথা কি উনি জানেন?’

‘না সারা। জানেন না। আমি তাঁকে বলিনি। তবে উনি আমাকে এখানে আসার অনুমতি দিয়েছেন।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘কেন বলনি?’ বলল সারা জেফারসন।

‘তোমাকে নিয়েই আমার ভয় বেশি। তোমাকে পেলে আমি ওঁকেও পাব। তাই তোমাকেই প্রথম রাজী করাতে চাই।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘ওঁকে নিয়ে তোমার ভয় নেই আপা? ওঁ বরফের মতো ঠাণ্ডা, আর পাথরের মতো কঠিন। আমি কত দুর্বলতা দেখিয়েছি, ওঁর সামান্য দুর্বলতাও কখনও প্রকাশ পায়নি। চিঠিতে তুমি পড়েছ আমি দুর্বত্তদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ওকে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরেছিলাম। কিন্ত ‍এই পরিস্থিতিতেও তিনি সৌজন্যের সীমার মধ্যে থেকেছেন। এই মানুষকে ভয় না করে আমার মতো দুর্বলকে ভয় করছ আপা!’ বলল সারা জেফারসন।

‘তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি তাঁর আরও দিক জানি। আবেগের ক্ষেত্রে বরফের মতো ঠাণ্ডা, আর নৈতিকতায় উনি পাথরের মতো শক্ত বটে, কিন্তু তিনি যুক্তির কাছে ‍দুর্বল, মানুষের কষ্টের কাছে আরও দুর্বল। সবচেয়ে দুর্বল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির কাছে। সুতরাং তোমাকে যদি পাশে পাই, তাঁকে রাজী করানো আমার জন্যে কঠিন নয়।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনের কোল থেকে উঠে বসল। মারিয়া জোসেফাইনের দু’হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপা, আমি তোমার পাশে আছি। এর বেশি কিছু প্লিজ আমার কাছ থেকে আদায় করতে চেষ্টা করো না। তুমি তো জানই আপা, আমি ওঁর ইচ্ছার বাইরে যেতে পারি না।’

মারিয়া জোসেফাইন হেসে সারা জেফারসনের কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘বুঝেছি, তুমি ওঁর মতটা আগে জানতে চাও তো! কিন্তু উনি তোমার মতোই যদি তোমার মত কি তা জানতে চান? কি বলব আমি?’

লজ্জায় লাল হয়ে উঠল সারা জেফারসনের মুখ। সে মারিয়া জোসেফাইনের বুকে মুখ গুঁজে বলল, ‘বলেছি, আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করো না আপা। তোমাদের ইচ্ছার বাইরে যাবার সাধ্য কি আমার আছে?’

হাসল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘সারা জেফারসন এক সুপারম্যান এবং আহমদ মুসা আর এক সুপারম্যান। দুই সুপারম্যানের মাঝখানে সাধারণ এক মারিয়া জোসেফাইনের অবস্থা দেখছি ত্রিশংকু!’

সারা জেফারসন পাশ থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে মারিয়া জোসেফাইনের পিঠে একটা কিল দিয়ে বলল, ‘দুই সুপারম্যানকে যে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরায় সে বুঝি সাধারণ!’

বলে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে পালাতে পালাতে বলল, ‘আমি শুতে গেলাম। গুড নাইট। আসসালাম।’

সেদিকে তাকিয়ে হাসিভরা মুখ নিয়ে মারিয়া জোসেফাইনও উঠে দাঁড়াল। চলতে শুরু করল সে তার ঘরের দিকে।

যে দিন সে আমেরিকায় পা রাখে, সেদিনও তার মনে অনিশ্চয়তার যে গুরুভার ছিল তা এখন নেই। আবার প্রাণ খুলে হাসারও পরিবেশ হয়নি। আহমদ মুসার সাথে কোন আলোচনাই হয় নি। অন্যদিকে সারা জেফারসন একটা ‘কিন্তু’ রেখেই দিয়েছে।

আপাতত সব চিন্তা মত থেকে ঝেড়ে ফেলে শোবার বিছানার দিকে এগোলো মারিয়া জোসেফাইন।

Top