৫৫. ডেথ ভ্যালি

চ্যাপ্টার

মারিয়া জোসেফাইন ও সারা জেফারসন পাশাপাশি সোফায় বসে। দু’জনেরই মুখ গম্ভীর।
বাম দিকের আরেকটা সোফায় বসেছিল সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন। তার চোখ-মুখ উদ্বেগে ঠাসা।
গতকালের স্টোরিটাই এতক্ষণ বিস্তারিত বলছিল সারা জেফারসন।
বলা শেষ করেছে সে। তার পরেই নেমে এসেছে গাম্ভীর্য ও উদ্বেগের এক পরিবেশ।
মারিয়া জোসেফাইনের গাম্ভীর্যের আড়ালে অশ্রুর এক বন্যা নেমেছে তার হৃদয় জুড়ে। ধৈর্যের অনড় বাঁধ ভেঙে চোখ পর্যন্ত গড়াতে পারছে না। বুক ফাটলেও মুখ ফোটে না এমনই এক ধৈর্যের প্রতিমূর্তি মারিয়া জোসেফাইন। কিন্তু হৃদয়ের প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস রোধ করে কথা বলতে পারছে নাসে।
নীরবতা ভাঙল জিনা জেফারসন, সারা জেফারসনের মা। বলল, ‘সারা, তুমি সব কথাই বললে। কিন্তু আমাদের ছেলে মানে আহমদ মুসা কোথায় আছে, কেমন আছে, সেটাই তো জানা গেল না।’
‘সেটা জানা যায়নি মা। তবে সবাই আশা করছেন মা, তিনি ভালো আছেন।’ বলল সারা।
‘তাহলে তুমি সারারাত ঘুমাতে পারনি কেন? কেন লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছ। কেন জোসেফাইন মা, তুমি কথা বললে, হাসার চেষ্টা করলেও তা কান্নার মত হয়ে উঠছে? কেন মনে হচ্ছে অশ্রুর সাগর ডিঙিয়ে তোমার সব কথা বেরিয়ে আসছে?’ জিনা জেফারসন বলল।
‘মা, আমাদের মন দুর্বল বলে আমাদের কাছে আশংকার দিকটাই প্রধান হয়ে উঠে। আমারও তাই হয়েছে মা। স্যরি। এর চেয়েও ভয়াবহ বিপদে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন। নিশ্চয় এবারও করবেন। সারা ঠিকই বলেছে। আমারও মন বলছে তিনি ভালো আছেন।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।
‘আমিন। তোমার মনের কথাই আল্লাহ যেন সত্য করেন, মা।’
এ সময় ইন্টারকমের প্যানেল বোর্ডে নীল আলো সংকেত দিতে লাগল।
‘নিশ্চয় আমাদের গেট থেকে। আমি দেখছি।’
বলে দ্রুত উঠে গিয়ে সারা জেফারসন ইন্টারকম অ্যাটেন্ড করল।
‘ম্যাডাম, আলাইয়া অ্যানজেলা নামে এক ম্যাডাম…।’
ওপারের কথা শেষ হতে না দিয়েই সারা জেফারসন কথার মাঝখানেই বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, ওর আসার কথা আছে, পাঠিয়ে দাও।’
‘ঠিক আছে।’ বলে ওপার থেকে কল অফ করল।
‘আপা, ওঁকে আমি নিয়ে আসছি।’ মারিয়া জোসেফাইনকে লক্ষ্য করে এই কথা বলেই সারা ছুটল।
মিনিটখানেকের মধ্যেই আলাইয়া অ্যানজেলাকে নিয়ে এল সারা জেফারসন।
আলাইয়া অ্যানজেলাকে সারা জেফারসন জোসেফাইনের সামনে নিয়ে এল। উঠে দাঁড়াল জোসেফাইনও।
‘ইনি মারিয়া জোসেফাইন, ফরাসি রাজকন্যা, আহমদ মুসার স্ত্রী।’
সারা জেফারসন বলল।
অ্যানজেলার মুখে একটা চমকানো ভাব ফুটে উঠল। ফরাসি রীতিতে একটা বাউ করল অ্যানজেলা। সংগে সংগেই বলে উঠল, ‘এখানে এসে আহমদ মুসার স্ত্রীকে দেখতে পাব, তা কল্পনাও করিনি। আজকের যুগের এক প্রবাদ পুরুষের স্ত্রীকে দেখে খুশি হলাম। তার উপর তিনি ফরাসি রাজকন্যা। অভিনন্দন ম্যাডাম।’
‘রাজকন্যা-টাজকন্যা কিছু নই। সারা আমাকে খুব ভালোবাসেতো, তাই আমার নামের আগে সব সময় বিশেষণ লাগায়। আমি মানুষ, আহমদ মুসার স্ত্রী, তাতেই আমি খুশি।’ বলল জোসেফাইন।
‘না অ্যানজেলা। আমি অহেতুক বিশেষণ লাগাইনি। আমার আপা মারিয়া জোসেফাইন ফ্রান্সের বিখ্যাত বুরবন রাজবংশের সরাসরি সব শেষ বংশধর, তাহলে তো রাজকন্যাই হয়।’ সারা জেফারসন বলল।
‘এসব কথা থাক। আসুন সবাই আমরা বসি।’
বলে সারা জেফারসন অ্যানজেলাকে সামনের সোফাটায় বসিয়ে ফিরে এসে জোসেফাইনের পাশে বসল।
‘আমি সারার কাছে সব শুনেছি মিস অ্যানজেলা, আপনি আহমদ মুসার জন্যে অনেক কিছু করেছেন। আপনাদের সাহায্যেই উনি ওদের হাতের বাইরে যেতে পেরেছেন। কৃতজ্ঞ আমি মিস অ্যানজেলা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।
অ্যানজেলা উঠে দাঁড়াল। মারিয়া জোসেফাইনকে একটা ছোট্ট বাউ করে বলল, ‘ম্যাডাম আহমদ মুসা, স্যরি, আমাকে কৃতজ্ঞতা কেন? বরং আমি আমরা আপনাকে এবং আহমদ মুসাকে কৃতজ্ঞতা জানাব। আহমদ মুসা আমেরিকানদের জন্যে যে অবর্ণনীয় কষ্টের বোঝা মাথায় তুলে নিয়েছেন, তা আমরা কোন কিছু দিয়েই শোধ করতে পারব না। আমি ও শ্যালন যে তাঁকে সামান্য সহযোগিতা করতে পেরেছি, তার জন্যে আমরা গর্ব বোধ করছি। চিরদিন কথাটা আমরা সবার কাছে বলতে পারব। আমরা ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি এ সুযোগ আমাদের দিয়েছিলেন।’
সিটে আবার বসে পড়ল অ্যানজেলা। বসেই বলল, ম্যাডাম আহমদ মুসা, ‘উপরে ও সব পাশ থেকে ঘেরাও হওয়ার সেই কঠিন অবস্থায় তিনি আমেরিকার সিকিউরিটির বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং যে কোন মূল্যে ওদের হাতে ধরা পড়া যাবে না, চিন্তা করেছেন। এজন্যেই তিনি গাড়িসহ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সেই দৃশ্যের কথা মনে হলে এখনও আমার বুক কাঁপে। এমন পরার্থে জীবন যাঁর, তার প্রতি প্রতিটি আমেরিকান কৃতজ্ঞ থাকবে।’
‘মিস অ্যানজেলা, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা, প্রশংসা নয়, তার জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। আল্লাহ যেন তাঁকে সুস্থ রাখেন, সফল করেন।’ বলল জোসেফাইন।
‘আমিন।’ বলল অ্যানজেলা।
‘আমিন।’ সারা জেফারসনও বলল।
‘জর্জ আব্রাহাম আংকেল তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। ফল কিছু হয়েছে?’ জিজ্ঞাসা করল অ্যানজেলাকে সারা জেফারসন।
অ্যানজেলা সংগে সংগে উত্তর দিল না।
তার মুখটা মলিন হয়ে গিয়েছিল। সাথে সাথে মুখ নিচুও হয়ে গিয়েছিল তার।
মুখ তুলে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বলল, ‘এফবিআই আমাদের বাসা থেকে পরীক্ষার জন্যে কিছু জিনিস নিয়ে এসেছেন, যেমন, সিসিটিভির মনিটরডিস্ক, টেলিফোন টকের রেকোর্ড, আব্বার কয়েকটি কনফিডেনশিয়াল ফাইল, আব্বার পার্সোনাল কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক।’
অ্যানজেলা তার বাবার ডাইরি যে এফবিআই প্রধানকে দিয়েছেন, তার কোন উল্লেখ সে করল না।
‘ঘটনা কি অ্যানজেলা? চাচাজান মানে তোমার আব্বা ওদের সহযোগিতা করেছিল কেন?’ বলল সারা জেফারসন।
অ্যানজেলা কথা বলার জন্যে মুখ খুলেছিল।
এ সময় সারাদের ইন্টারকম কথা বলে উঠল আবার, ‘ম্যাডাম, জর্জ আব্রাহাম জনসন এসেছেন।’
‘হ্যাঁ, তাঁর আসার কথা আছে। আমি আসছি।’ বলে উঠে দাঁড়াল সারা জেফারসন। সাথে সাথে অ্যানজেলাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘অ্যানজেলা, জর্জ আব্রাহাম আংকেল এসেছেন। আগেই জানিয়েছিলেন। তুমি বস, আমি তাঁকে নিয়ে আসি।’
‘ম্যাডাম, আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ আর কথা তো হয়েই গেছে। আমি এখন উঠি।’ অ্যানজেলা বলল।
‘ঠিক আছে, উনি এলে দেখা করে যাও। আর আমার প্রশ্নটার জবাব দাওনি তুমি। একটু বস, আসছি।’
বলে সারা জেফারসন দ্রুত বেরিয়ে গেল। এক-দেড় মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল জর্জ আব্রাহাম জনসনকে নিয়ে।
অ্যানজেলা ও মারিয়া জোসেফাইন উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে স্বাগত জানাল।
জর্জ আব্রাহাম জনসন বসতে বসতে বলল, ‘মা জোসেফাইন, মা অ্যানজেলা, তোমরা কেমন আছ?’
‘জি আংকেল, আমরা ভালো আছি।’ দু’জনে প্রায় একসাথেই বলে উঠল।
‘তোমার মা কেমন আছেন?’ অ্যানজেলাকে জিজ্ঞাসা জর্জ আব্রাহামের।
‘খুব খারাপ নয় আংকেল।’ অ্যানজেলা বলল।
‘স্যরি অ্যানজেলা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘না আংকেল, আপনারা যা করছেন তা দেশের জন্যে করছেন।
আমরাও আপনাদের সাথে আছি। সত্য যতই বেদনাদায়ক হোক, সত্য সত্যই।’ অ্যানজেলা বলল।
‘ধন্যবাদ অ্যানজেলা। তোমাদের দেশপ্রেম আমাদের গর্বের বিষয়।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘ধন্যবাদ আংকেল। আংকেল আমি এখন উঠব। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই দেখা করতে এসেছিলাম।’
বলে তাকাল সারা জেফারসনের দিকে তার কাছে বিদায় নেবার জন্যে।
‘ঠিক আছে। কিন্তু তুমি কিছু বলতে চেয়েছিলে।’ বলল সারা জেফারসন।
হাসল অ্যানজেলা। বলল, ‘আচ্ছা, বলব ম্যাডাম।’
অ্যানজেলা তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। তারপর সারা জেফারসনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আমার আব্বা ওদের সহযোগিতা করলেন কেন? এর জবাবটাই শুনতে চাচ্ছেন তো?’
‘ওটা তো আমারও জানার বিষয়, অ্যানজেলা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
মাথা নিচু করে একটুক্ষণ চুপ করে থাকল অ্যানজেলা। তারপর শুরু করল, ‘আমার বাবা সম্পর্কে আমিও জানার চেষ্টা করছি। আমি অনেকটাই বিস্ময়ের মধ্যে রয়েছি। আমার বিস্ময়ের শুরু আমি পাস করে বেরোবার আগের সময় থেকে। পাস করার আগেই বাবা আমাকে বলেছিলেন, তোমার গবেষণার বিষয় আমাদের কোম্পানির কাজে লাগবে। পাস করার পর আমাদের কোম্পানিতে যোগ দেবে। পাস করার পর কয়েকবার বলেছেন তার প্রস্তাবের কথা। আমি সব সময় বলেছি, বাবা, তোমার কোম্পানির কাজ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না, কাজের বিষয়টা কি তাও জানি না, আমি কি করে সিদ্ধান্ত নেব? বাবা স্পষ্ট করে কখনই কিছু বলেননি। সর্বশেষ এই ঘটনার দিন সকালে বাবা আমাকে ডেকেছিলেন। বলেছিলেন, সেদিনের মধ্যেই তাঁকে আমার মত দিতে হবে। সেদিন তিনি আমাকে তাঁর কোম্পানির নাম বলেছিলেন, এইচ কিউব বা এইচথ্রি আর কাজ সম্পর্কে বলেছিলেন কৌশলগত অস্ত্রের গবেষণা। আমি এই কোম্পানির নাম আগে শুনিনি বলে কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলাম। আপনাদের কোম্পানি রেজিস্টার্ড কি না? আর এ ধরনের কোম্পানির তালিকায় আপনাদের এ কোম্পানির কোন নাম আমি দেখিনি। সরকার এই অস্ত্র গবেষণার বিষয় অবহিত কি না? কারণ অস্ত্র বিক্রি-ব্যবসায়ে সরকারের অনুমোদন দরকার হয়। কোম্পানির লোকেশনটা কোন্ শহরে, কোন এলাকায়? প্রশ্নগুলোর উত্তরে বাবা শুধুই বলেছেন, কাজে যোগ দাও, সবই জানতে পারবে। তিনি আরও একটি কথা বলেছিলেন, কম্যুনিটির জন্যে দায়িত্ব পালন খুবই মূল্যবান, আমাদের জন্যে এটা সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। বাবার এসব কথা থেকে আমার মনে হয়েছে বাবা এইচ থ্রি কোম্পানির একজন মূল ব্যক্তি। এ কথা ভাবতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমার যে বাবাকে নিয়ে আমি অরাজনৈতিক নিঃস্বার্থ সমাজসেবী হিসেবে গর্ব করি, আমার সেই বাবা মনে এমন ধারণা পোষণ করেন এবং আইনের চোখে অবৈধ ব্যবসায়কেও তিনি অন্যায় মনে করেন না!’ অ্যানজেলা বলল। তার কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠেছিল।
‘ধন্যবাদ মা অ্যানজেলা। তুমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছ। তুমি সেদিন জিজ্ঞাসা করেছিলে তোমার বাবা ও তাদের ব্যবসায় সম্পর্কে আমরা আর কি জানতে পেরেছি। সাংঘাতিক, বিপজ্জনক তথ্য আমরা জানতে পেরেছি। ঘাঁটি থেকে পাওয়া দলিল-পত্র থেকে আমরা যেটা জানতে পেরেছি তা হলো, দুনিয়াতে কারো হাতে নেই, এমন ভয়ংকর অস্ত্র তারা তৈরি করেছে। কিন্তু কেন করেছে, এই বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জানসন।
‘বিস্ময়, আতংক ফুটে উঠেছে অ্যানজেলার চোখে-মুখে। তার মনে পড়ল, তার আব্বা বলেন তার কম্যুনিটি মানে জায়োনিস্ট স্বার্থের কথা। এটাই তার অগ্রাধিকার, আমেরিকার স্বার্থ তার কাছে বড় নয়। তাহলে এ অস্ত্রগুলো কি জায়োনিস্ট স্বার্থের জন্যে? বুক কেঁপে উঠল অ্যানজেলার। ধীর কণ্ঠে বলল, ‘সত্য কি আমি জানি না স্যার, কিন্তু আমার মনে হয়, এই অস্ত্রগুলো জায়োনিস্টদের স্বার্থে তৈরি হয়েছে।’
ভ্রু-কুঞ্চিত হলো জর্জ আব্রাহাম জনসনের। ‘জায়োনিস্টদের স্বার্থ কি?’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘হতে পারে বারগেনিং, ব্ল‍্যাক মেইলিং আর এর মাধ্যমে তাদের দাবি আদায়।’ অ্যানজেলা বলল।
‘কি দাবি? আমাদের ইহুদি নাগরিকদের আলাদা বা বিশেষ দাবি আছে বলে আমি জানি না।’ বলল আব্রাহাম জনসন।
‘ইহুদিরা তো জায়োনিস্ট নয়। তারা ধর্মভীরু ও দেশপ্রেমিক নাগরিক। যারা ইসরাইলের স্রষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক, যারা আমার বাবার মত এক স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের নাগরিক হয়েও স্বদেশ ও স্বদেশের নাগরিকদের বাদ দিয়ে জায়োনিস্টদের স্বার্থ পূরণকে অগ্রাধিকার দেয়, এরা তারা।’ অ্যানজেলা বলল।
‘তোমার মতে তারা কোন স্বার্থ দাবি করতে পারে বারগেনিং বা ব্ল‍্যাক মেইলিং-এর মাধ্যমে?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘আংকেল, সব বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার নয়। বাবার কথায় আমি যা বুঝেছি, আমি সেটা বললাম।’ অ্যানজেলা বলল।
‘অ্যানজেলা। তুমি তো ইহুদি ঘরের মেয়ে। তুমি তো জায়োনিস্ট নও। ওরা জায়োনিস্ট হলো কি করে?’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘আংকেল, আমি ইহুদি। আমি নিয়মিত সিনাগণে যাই। আমাদের ধর্মের জন্ম প্রফেট মুসা থেকে। কিন্তু জায়োনিস্টদের সৃষ্টি ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে। ওদের ধর্ম, ওদের সিনাগগ সবই ইসরাইল রাষ্ট্র। ওরা যে জাতি স্বার্থের বা কম্যুনিটি স্বার্থের কথা বলে, সেটা আসলে ইসরাইলের স্বার্থ, ইহুদিদের স্বার্থ নয়।’
‘ধন্যবাদ মা। তোমরা নিউ জেনারেশন আমাদের ভরসা। তোমরা খৃস্টান, মুসলিম, ইহুদি ও অন্যান্য সবাই মিলে সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতির নতুন আমেরিকা গড়ে তুলবে।’
বলে একটু থেমে আবার শুরু করল, ‘বিষয়টা নিয়ে আমরা খুব চিন্তিত মা। তোমার কথায় চিন্তা আরও বাড়ল। তুমি ওদের যে ধরনের জাতীয় সাম্প্রদায়িকতার কথা বললে তা অত্যন্ত ভয়াবহ। ধর্মের নীতি থাকে, ভৌগোলিক জাতীয়তা বোধেরও একটা নীতি থাকে, কিন্তু যারা ধর্মকে এক্সপ্লয়েট করে, তারা সব নীতি আদর্শকে এক্সপ্লয়েট করে থাকে। এমন লোকরা যখন ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র যোগাড় করে, তখন তা উদ্বেগ-আতংকের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।’
‘গড সেভ আস।’ অ্যানজেলা বলল।
একটু থেমেই আবার বলল, ‘স্যার, শেষ পর্যন্ত আহমদ মুসা সম্পর্কে কি জানা গেল?’
‘অনুসন্ধান চলছে, এটাই এখন আমাদের টপ প্রায়োরিটি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
জোসেফাইন ও সারা জেফারসন দু’জনেই হতাশ চোখে তাকাল আব্রাহাম জনসনের দিকে।
‘স্যার, এখন আমি উঠতে চাই।’
বলে অ্যানজেলা তাকাল জোসেফাইন ও সারা জেফারসনের দিকে।
‘আচ্ছা মা, ঠিক আছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
অ্যানজেলা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘স্যার, যখন দরকার হবে বলবেন, ডাকবেন। দেশ ও জনগণ আমার কাছে বড় স্যার।’
‘ধন্যবাদ অ্যানজেলা। খুব খুশি হলাম।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন। অ্যানজেলার সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়েছিল জোসেফাইন ও সারা জেফারসন।
তারা তিনজনই একসাথে হাঁটতে হাঁটতে এগুলো। জোসেফাইন দরজা থেকে ফিরে এল। আর সারা জেফারসন অ্যানজেলাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ফিরে এল।
সারা জেফারসন জোসেফাইনের পাশে বসতে বসতে বলল, ‘আংকেল, আপনি কষ্ট করে এসেছেন। আমাদের ডাকলে আমরা যেতে পারতাম। ওয়েলকাম আংকেল।’
‘ধন্যবাদ সারা। প্রেসিডেন্টের সাথে আমাদের বৈঠক শেষ হয়েছে অনেক রাতে। অত রাত না হলে রাতেই আসতাম। সকালেই এসেছি। কথাগুলো টেলিফোনে বলার মত নয়।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জোসেফাইন ও সারা জেফারসনের চোখে মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল। বলল জোসেফাইন, ‘খারাপ কিছু নয় তো আংকেল?’
সারা কিছু বলতে গিয়েও পারল না। কথা যেন গলায় আটকে গেল।
কি এমন খবর যে, খোদ আব্রাহাম জনসনকে আসতে হলো আমাদের বাড়িতে। কথাটা জিজ্ঞেস করতেও ভয় পাচ্ছিল সারা জেফারসন।
‘না মা জোসেফাইন, ভালো খবর। গত কাল রাতে আমি আহমদ মুসার সাথে কথা বলেছি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
কথাটা বলার সাথে সাথে জোসেফাইন ও সারা জেফারসনের বিস্ময়-আনন্দ মিশ্রিত বিস্ফারিত দৃষ্টি গিয়ে আছড়ে পড়ল জর্জ আব্রাহামের উপর। বাকরুদ্ধ অনেকটাই তারা।
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা।
নীরবতা ভাঙল সারা জেফারসন। বলল, ‘উনি কোত্থেকে টেলিফোন করেছিলেন?’
‘বিশেষ কারণে সেটা উনি বলেননি। প্রেসিডেন্টের সাথে আমাদের মিটিং চলাকালে তিনি অপরিচিত অয়্যারলেস ওয়েভ ব্যবহার করে আমাকে অয়‍্যারলেস কল করেছিলেন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘তিনি কবে আসছেন? কিছু বলেছেন?’ জিজ্ঞাসা সারা জেফারসনের।
মুহূর্ত কয় চুপ করে থাকল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘তিনি আসতে পারছেন না মা? এমনকি মনিটরিং হবার ভয়ে তার পক্ষে মোবাইল বা কোন টেলিফোনে যোগাযোগ করাও সম্ভব নয়।
আবারও বিস্ময় ফুটে উঠল জোসেফাইন ও সারা জেফারসনের চোখে-মুখে। বলল জোসেফাইন, ‘তিনি বন্দী নন তো?’
হাসল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘উনি সম্পূর্ণ মুক্ত, মা।’
‘তাহলে আসতে পারবেন না কেন? যোগাযোগ করতে পারবেন না কেন?’ জিজ্ঞাসা জোসেফাইনের।
জর্জ আব্রাহাম জনসন একটু চুপ করে থাকল। পরে বলল, ‘দেশ খুব সংকটে, মা। উনি গতরাতে উদ্বেগজনক খবর দিয়েছেন।’
বলে একটু থেমে আবার শুরু করল, ‘দেখ, বিষয়টা মাত্র আমি এবং প্রেসিডেন্ট জানি। আর কাউকে জানানো হয়নি। অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। তোমাদের এ বিষয়টা না বললে আহমদ মুসার ব্যাপারটা তোমরা বুঝবে না।’ বলে আবার একটু থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আবার বিস্ময় ও উদ্বেগে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে জোসেফাইন ও সারা জেফারসেনের মুখ। কি এমন ভয়ানক গোপনীয় খবর যা মাত্র প্রেসিডেন্ট ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জর্জ আব্রাহাম জনসন জানেন? কি বিষয় সেটা!
আবার কথা শুরু করল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘আমাদের সন্ত্রাসী শত্রুপক্ষ ভয়ংকর দু’টি অস্ত্র তৈরি করেছে, যাকে প্রতিরোধ করার কোন ব্যবস্থা আমাদের নেই। প্রথমটি তারা সম্পূর্ণ করেছে। দ্বিতীয়টি এখনো সম্পূর্ণ করতে পারেনি। আর এই অস্ত্র তৈরি সম্পূর্ণ করার জন্যেই তারা আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করেছিল। তারা চেয়েছিল আহমদ মুসার মগজ ধোলাই করে রোবটে পরিণত করবে। আর ঐ অস্ত্রটি সম্পূর্ণ করার জন্যে তারা আহমদ মুসার মাধ্যমে পেন্টাগন থেকে একটি যন্ত্রাংশ চুরি করার ব্যবস্থা করবে। পেন্টাগন আহমদ মুসাকে চেনে ও বিশ্বাস করে, সেজন্য অন্য কারো চেয়ে পেন্টাগনে ঢোকা আহমদ মুসার জন্যে সহজ। কিন্তু পরিকল্পনা কার্যকর করার আগেই আহমদ মুসা তাদের ভূগর্ভস্থ বন্দীখানা থেকে পালিয়ে আসে। আহমদ মুসা পালিয়ে আসায় ওরা আতংকিত হয়ে পড়েছে। তার কাছ থেকে আমেরিকান সরকার সব তথ্য জেনে ফেলবে, এই তাদের ভয়। এটা যদি ঘটে তাহলে আমেরিকান সরকার অ্যাকশনে যাবার আগে তারাই অ্যাকশনে যাবে। তারা যদি আগে অ্যাকশনে যায়, তাহলে আমাদের কৌশলগত ও কনভেনশনাল অস্ত্র ভাণ্ডার তারা তাদের হেড কোয়ার্টারে বসেই ধ্বংস করে ফেলতে পারবে। এরপর যা ঘটবে তা কল্পনাই করা যায় না। এটা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো, তারা যেন বুঝতে পারে যে, আহমদ মুসা আমেরিকান সরকারকে তথ্য দিতে পারেনি, আমেরিকান সরকারের সাথে সে দেখা করেনি, আহমদ মুসাকে সরকার খুঁজে বেড়াচ্ছে, এ সম্পর্কে শত্রুদের নিশ্চিত থাকা দরকার। আহমদ মুসা তার গোপন অবস্থান থেকে এই জন্যেই আসতে পারছে না, এই বিষয়টাই সে গতকাল অয়‍্যারলেসে আমাদের জানিয়েছে। তার সাথে এই যোগাযোগ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলেই সম্পূর্ণ নতুন এক ওয়েভ লেংথে সে কথা বলেছে।’
উদ্বেগ-আতংকে ছেয়ে গেছে জোসেফাইন ও সারা জেফারসনের মুখ। ভয়ংকর একটা সংকটে আমেরিকা এবং আহমদ মুসাও। আহমদ মুসা বেঁচে আছে, এ কথা প্রকাশ হওয়াও বিপজ্জনক। কিন্তু এ সংকটের সমাধান কিসে! এই প্রশ্নই করল সারা জেফারজন জর্জ আব্রাহাম জনসনকে। বলল, ‘আংকেল, এই সংকটে আপনারা কি করবেন ভাবছেন? কেমন করে এ ভয়ংকর সংকটের সমাধান হবে?”সেই পথটাও আমাদের আহমদ মুসাই দেখিয়ে দিয়েছেন।
বলেছেন, তিনি পরিকল্পনা করছেন ওদের অপারেশন ঘাঁটিতে ঢোকার। তিনি মনে করছেন ওদের অপারেশন ঘাঁটি তিনি চিহ্নিত করতে পেরেছেন।’ বলল আব্রাহাম জনসন।
‘তিনি একা, এত বড় সাংঘাতিক মিশন…?’ মারিয়া জোসেফাইন বলল অনেকটা আতংকের সুরে।
‘হ্যাঁ মা, তিনি একা। আমরা বলেছিলাম আরও লোক নিয়ে অভিযানের কথা। কিন্তু তিনি বলেছেন, ওদের আক্রমণের শক্তি অচল করে দেবার একটাই পথ, সেটা হলো ওদের সংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্রের উপর আঘাত হানা, তাকে অচল করে দেয়া। এই অভিযান অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ওরা সামান্য পরিমাণেও যদি সন্দেহ করে যে তাদের অপারেশন ঘাঁটি চিহ্নিত হয়েছে এবং তা আক্রান্ত হতে পারে, তাহলে সেই মুহূর্তেই তারা আক্রমণে যেতে পারে। সুতরাং অভিযান অত্যন্ত গোপনে এবং সেই কারণে একক ধরনের হওয়াই উচিত হবে। তাঁর যুক্তি আমরা মেনে নিয়েছি, মা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘আমরাও মেনে নিচ্ছি, আংকেল। তাঁর চিন্তায় সবচেয়ে ভালো যেটা, সবচেয়ে কল্যাণ যা, সেটাই গ্রহণ করেছেন। বাকি আল্লাহ ভরসা।’ জোসেফাইন বলল।
‘ধন্যবাদ মা, তুমি ঠিকই বলেছ।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘আংকেল, ওর প্রয়োজন জানা, তাকে সাহায্য করার কাজটা তো হওয়া উচিত।’ সারা জেফারসন বলল।
‘সেটা আমরাও চিন্তা করেছি। প্রেসিডেন্ট এই নির্দেশই দিয়েছেন।
কিন্তু তার সাথে যোগাযোগের পথ তো আমাদের হাতে নেই। তিনি যোগাযোগ করলেই শুধু আমরা কিছু করতে পারি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন। কথা শেষ করেই জর্জ আব্রাহাম আবার বলল, ‘এস আমরা সকলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। তিনি যেন আহমদ মুসাকে সফল করেন এবং আমেরিকাকে অকল্পনীয় এক বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।’
বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘আমিন।’ বলল জোসেফাইন ও সারা জেফারসন দু’জনেই।
‘আংকেল, আমার মা কিন্তু টেবিলে চা দিয়েছেন। আপনি এগোলে আমরাও তাড়াতাড়ি খেতে পারি।’ সারা জেফারসন বলল।
‘অবশ্যই এগোব মা, চল। আমি এমনটাই আশা করছিলাম।’
বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল।

খাবার টেবিলে সবাই বসে। দেরিতে টেবিলে এল দাউদ ইব্রাহিম। বুঝাই যাচ্ছে সে মাত্র গোসল করেছে।
‘ভাইয়ার একটু দেরি হয়েছে, তুমি কিছু মনে করো না, বাবা। সে পাহাড় থেকে নেমেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
‘কিন্তু জনাব আহমদ মুসা এবং সে একসাথেই তো পাহাড় থেকে নেমেছিল!’ বলল নূর ইউসুফ।
‘তা নেমেছিল। কিন্তু আমাদের অতিথি স্যার এসেই ঝর্নায় গিয়েছিলেন গোসল করতে। আর ভাইয়া ঘুমিয়ে পড়েছিল।
বসেই আবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল দাউদ ইব্রাহিম। আহমদ মুসার সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছোট বাউ করে তার পিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা, পাহাড়ে উঠতে গিয়ে বুঝলাম আমাদের অতিথি স্যার স্টিলের মানুষ এবং আমি নিছকই মাটির মানুষ।’ থামল দাউদ ইব্রাহিম।
‘তোমাদের পাহাড়-অভিযানের গল্প শোনার জন্যে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। কিন্তু তোমার এ কথার অর্থ কি?’ বলল নূর ইউসুফ।
‘বাবা, আমার ছোট বেলা থেকেই পাহাড়ে উঠা আর বেড়ানোর অভ্যেস আছে। কিন্তু আমাদের পাশের পাহাড়ে আমি কখনো উঠিনি।
ক্লাইম্বারদের জন্যে এটি বিপজ্জনক পাহাড়। বাবা, পাহাড়ের গা মসৃণ এবং পাথর অত্যন্ত শক্ত। পাহাড়ের গা থেকে কতবার যে পিছলে পড়েছি, শুধু গাছের সাহায্যে বেঁচে গেছি! কিন্তু স্যার ক্লাইম্বিং, গাছে উঠা, গাছ ও পাহাড়ের মাঝে রোপওয়ে তৈরি করা ও ব্যবহারে অসম্ভব দক্ষ।
আমার মনে হয়েছে তিনি প্রফেশনাল ক্লাইম্বার। দশ ঘন্টার ক্লাইম্বিং-এর পরও তার মধ্যে কোন ক্লান্তি নেই। এসেই উনি গোসলে গেলেন আর রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে আমাকে ঘুমাতে হলো।’ বলল দাউদ ইব্রাহিম।
নূর ইউসুফ ও মরিয়ম মারুফা দুজনেই তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
‘জনাব আহমদ মুসা, আপনার সম্পর্কে যতটা জানি, মাউন্টেনেয়ারিং-এর ধারেকাছেও আপনি নন। কিন্তু দাউদ ইব্রাহিম যা বলল, সেটা তো সত্য। সেটা কিভাবে সম্ভব?’ বলল নূর ইউসুফ।
‘পাহাড়ে উঠা, পাহাড়ে হাঁটা ছোট বেলা থেকেই করেছি। কিন্তু মাউন্টেনিয়ারিং শেখা যাকে বলে, সেটা আমি শিখিনি। আমার বিশ্বাস, আল্লাহর দেয়া জ্ঞান-বুদ্ধি ও কমনসেন্স কাজে লাগিয়ে সম্ভব সবকিছুই করা যায়। আমি সেটাই করেছি জনাব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক। তবে সবার জন্যে এটা নয়। যা আহমদ মুসার পক্ষে খুবই সম্ভব।’
বলে মুহূর্তকাল নূর ইউসুফ চুপ থেকে আবার বলে উঠল, ‘কিন্তু এত কষ্ট করে পাহাড়ে উঠে কি পেলেন?’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না আহমদ মুসা। ভাবছিল সে।
‘আমার প্রথম দেখার বিষয় ছিল, এই পাহাড়ের পথে ডেথ ভ্যালিতে যাওয়া যায় কি না। আর…।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই নূর ইউসুফ বলল, ‘কি দেখলেন জনাব আহমদ মুসা? আর আপনি কি নিশ্চিত, ওখানে গিয়ে কাজ হবে?’
‘যখন জানার সব পথ বন্ধ হয়, তখন মানুষের মন কথা বলে উঠে। আর মন বা আত্মা যখন পরিপূর্ণভাবে আল্লাহমুখী হয়ে দাঁড়ায়, তখন মনের কথা হয় আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিধ্বনি। জনাব, আমি আমার মনের কথাকে মেনে নিয়েছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ জনাব আহমদ মুসা। আলহামদুলিল্লাহ, আপনার কাছে বহু বিষয় শেখার আছে। সত্যই মন কথা বলে। তবে আমাদের মত লোকদের মনের কথায় শয়তানি কথার ভেজাল থাকতেও পারে।’ নূর ইউসুফ বলল।
‘না জনাব, আসলেই যা মন বা আত্মার কথা, সেখানে শয়তান ঢুকতে পারে না। ওটা আল্লাহর ইচ্ছার জন্যে বরাদ্দ। সেজন্যে দেখা যাবে, চোর যখন চুরি করে, তখনও সে ভাবে সে ভালো কাজ করছে না। কিন্তু জাগতিক নানা যুক্তি তাকে চুরির দিকে ঠেলে দেয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ জনাব আহমদ মুসা। ঠিক বলেছেন। সব অপরাধীই অপরাধকে খারাপ মনে করে। মানুষের বিবেক বা আত্মা কোন মন্দ, অন্যায় নির্দেশ দেয় না। মেনে নিলাম শয়তান এখানে ঢুকতে পারে না।’ নূর ইউসুফ বলল।
‘ধন্যবাদ জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়েলকাম জনাব আহমদ মুসা। ডেথ ভ্যালিতে যাওয়ার কি ঠিক করলেন?’ নূর ইউসুফ বলল।
‘যেতে চাই। কিন্তু এ পাহাড়ের পথে যাওয়া অসম্ভব।’
‘আপনার কাছেও অসম্ভব কিছু আছে স্যার?’ মরিয়ম মারুফা বলল।
গাম্ভীর্য নেমে এল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, ‘আমরা যারা মানুষ, তাদের সামর্থ্যের সীমা আছে, আল্লাহই শুধু অসীম। আমাদের ‘চিন্তা-কর্ম, জ্ঞান-বুদ্ধি সবই সসীমতার ঘেরা টোপে আটকানো।’
বলে একটা দম নিয়েই আবার বলল, ‘এমন বিপজ্জনক পাহাড় আমি এর আগে কোথাও দেখিনি। পাহাড়ের এ পাশটা কিছুটা স্লোপিং, গাছ-গাছড়াও যথেষ্ট আছে। কিন্তু ও পাশটা একদম খাড়া। গাছ-পালা কিছুই নেই। পাহাড়ের গা বেয়ে নামার কোন উপায় নেই। পাহাড়ের মাথা থেকে দড়ি নামিয়ে দিয়ে সেটাকে অবলম্বন করে নিচে নামা সম্ভব। কিন্তু এভাবে নামা নিরাপদ নয়। ডেথ ভ্যালিতে ওদের ঘাঁটি থাকার সন্দেহ যদি সত্যি হয়, তাহলে ওরা সবাই দেখে ফেলতে পারে। তাহলে কিছু করার আগেই ধরা পড়ে যেতে হবে।’
‘তাহলে এখন কি ভাবছেন? ডেথ ভ্যালিতে যাবার উপায় সম্পর্কে কি চিন্তা করছেন?’ মরিয়ম মারুফা বলল।
‘এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ডেথ ভ্যালির চারিদিকটা দেখেছি। তাতে আপনাদের কাছ থেকে যেটা শুনেছি, সেটাই ঠিক। ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশের একমাত্র গিরিপথ বন্ধ হবার পর এখানে প্রবেশের সত্যিই আর কোন পথ নেই। তবে আগে আমি ইন্টারনেটে দেখেছি, ডেথ ভ্যালির উত্তর সীমানার পাহাড়টা উঠে এসেছে গভীর একটা ক্রিক থেকে। গোড়ার প্রান্তটা ক্রিকের পানিতে নেমে গেছে। ও প্রান্তে যাওয়ার জন্যে ক্রিকের জলপথ দিয়ে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ঐ দিকের পাহাড়ের উচ্চতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। পাহাড়ের পথে ঐ প্রান্তে যাওয়ার পথ পেলেও সেটা ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশের কোন বিকল্প নয়। উত্তর প্রান্তের স্লোপিংটা উপরের দিকে খাড়া হলেও নিচের জংগলাকীর্ণ দিকটা কম খাড়া। ডেথ ভ্যালির ঐ প্রান্তের ভেতরের পাশটা কিছুটা কম খাড়া হলেও উঠা-নামার জন্যে অনুকূল নয়, তবে মন্দের ভালো হিসাবে এ পাশটাকে ধরা যায় ইতিবাচক। সব মিলিয়ে ডেথ ভ্যালির অবশিষ্ট সব দিক ভালো করে দেখতে চাই, তবে উত্তর দিটকা আমার বেশি পছন্দ হয়েছে।’ থামল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ জনাব। চারদিকের পাহাড়ের যা বিবরণ দিলেন, তা আমাদের কাছে একেবারেই নতুন। বহু বছর ধরে এখানে আমরা বাস করছি বটে, কিন্তু আমাদের গণ্ডির বাইরে কোথাও যাইনি। যাওয়া কোন সময় সম্ভব নয় বলে আমরা মনে করে আসছি। আপনি পাহাড়ের অবস্থানকে যেভাবে পর্যালোচনা করলেন, তাতে এখন নিশ্চিত যে আপনি ডেথ ভ্যালিতে ঢুকতে চান। কিন্তু এখান থেকে কিভাবে সামনে এগোবেন?’ বলল নূর ইউসুফ।
‘হ্যাঁ জনাব, পাহাড়ে উঠেছিলাম চার দিকের পাহাড় সম্পর্কে একটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্যে। আজকেই বিকেলে আমি ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশের জন্যে কাজ শুরু করব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিভাবে? আপনি যে বর্ণনা দিলেন, তাতেই তো পরিষ্কার ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশের কোন পথই খোলা নেই।’ বলল নূর ইউসুফ।
‘পথ বের করতে হবে। ডেথ ভ্যালি সম্পর্কে আমার সন্দেহ যদি সত্য হয়, তাহলে একটা পথ অবশ্যই আছে। না থাকলে অন্যরা গেল কি করে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সন্দেহ সত্যি নাও তো হতে পারে স্যার?’ বলল মরিয়ম মারুফা।
‘চেষ্টার পর কোন পথ যদি বের না হয়, তাহলে নিশ্চিত হবো আমার সন্দেহ ঠিক নয়। আর সন্দেহ যদি ঠিক হয়, আল্লাহ আমাকে সাহায্য করবেন। আমি পথ পেয়ে যাব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনার বিশ্বাসের এ দৃঢ়তা আছে বলে আপনি নিশ্চিন্তে সামনে অগ্রসর হতে পারেন। আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন, তাকে তিনি এই দুর্লভ শক্তি দেন।’ বলল নূর ইউসুফ।
“এই শক্তি দুর্লভ নয়। আল্লাহ সবার জন্যে এর অর্জনকে উন্মুক্ত রেখেছেন। আল্লাহকে ভালোবাসলে আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু স্যার, এমন ভালোবাসা কঠিন। তাই তাঁর ভালোবাসা পাওয়াও কঠিন।’ বলল মরিয়ম মারুফা।
‘এটা ভুল ধারণা মারুফা। তাকে ভালোবাসা কঠিন হবে কেন? তিনি তো কিছু চান না? আল্লাহ স্রষ্টা, প্রতিপালক, মালিক, সবকিছুর নিয়ন্তা-এটা মানা কি কঠিন? শেষ রাসূলকে রাসূল হিসাবে মানা কি কঠিন? নামাজ পড়া, রোজা রাখা, জাকাত দেয়া কঠিন কোন্ দিক দিয়ে? মন্দ পরিহার করা, ভালোকে গ্রহণ করা কতটা কঠিন? এসব যতটা কঠিন, আল্লাহকে ভালোবাসা মাত্র ততটাই কঠিন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, এ কাজ সহজও নয়, আবার কঠিনও নয়। আমি পড়েছি স্যার, ঈমানদারদের জন্যে এসব কাজ খুবই সহজ, অন্যদের জন্যে কঠিন।’ বলল মরিয়ম মারুফা।
‘ঠিক বলেছ মারুফা। এই ঈমান বা বিশ্বাসই ভালোবাসার আসল শক্তি। যাক এ প্রসংগ। আমি এখনই একটু বেরুতে চাই।’
খাওয়া শেষে হাত পরিষ্কার করতে করতে বলল আহমদ মুসা।
সবাই খাওয়া শেষ করে বসল কম্যুনিকেশন রুমটায়।
‘কোথায় বেরুবেন বললেন?’ দাউদ ইব্রাহিম বলল।
‘দক্ষিণ পাশের সংকীর্ণ বিলম্বিত স্থানটায় প্রবেশ করব।’ বলল আহমদ মুসা।
নূর ইউসুফসহ সবাই তাকাল আহমদ মুসার দিকে। সবারই চোখে-মুখে প্রশ্ন। সবাই মুখ খুলেছিল। কিন্তু সবার আগে কথা বলল মরিয়ম মারুফা। বলল, ‘স্যার, ওখানে কি আছে? পাথর, টিলা, জংগলে ভরা একটা সংকীর্ণ প্যাসেজ। কিছু দূর এগিয়েই তো পাহাড়ের খাড়া উঁচু দেয়াল।’
‘আমি ওদিকে যাইনি। কিন্তু পাহাড়ে উঠে ওদিকটা দেখেছি। ঐ প্যাসেজটা জুড়ে বড় গাছ একটাও নেই। পাথরের উপর যে ধুলা-বালি জমেছে, তাতেই জন্মেছে লতা-গুল্মের জংগল। কোন পাথুরে পথের সাধারণ চরিত্র কিন্তু এটাই। তাই অন্য কিছু ভাববার আগে জায়গাটা দেখতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
নূর ইউসুফ হাসল। বলল, ‘জনাব আহমদ মুসা, আল্লাহ বুদ্ধি-জ্ঞান সব আপনাকে ঢেলে দিয়েছেন। আপানি এক দিন একবার সেদিকে তাকিয়ে যা বুঝলেন, আমি প্রায় সারাজীবন ওদিকে ঘুরাঘুরি করেও তা বুঝিনি। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, সত্যি জায়গাটা একটু বেশি রকম পাথুরে।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই মরিয়ম মারুফা বলল, ‘কখন যাচ্ছেন আপনি সেখানে?’
‘একটু রেস্ট নিয়েই আমি যাব।’
বলেই তাকাল আহমদ মুসা দাউদ ইব্রাহিমের দিকে। বলল, ‘আমার একটা টর্চ দরকার হবে, আছে?’
‘অবশ্যই স্যার, আমাদের সবারই টর্চ আছে।’ বলল দাউদ ইব্রাহিম।
‘প্রস্তুত থেকো, তুমিও আমার সাথে যাবে। আপত্তি নেই তো?’
আহমদ মুসা বলল।
‘আপত্তি থাকবে কেন স্যার? আপনার সাথী হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ কেউ পায়ে ঠেলে?’ দাউদ ইব্রাহিম বলল। আনন্দ উপচে পড়ছে তার চোখে-মুখে।
‘জনাব এই সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত থাকব?’ বলল নূর ইউসুফ।
‘আমার আপত্তি নেই জনাব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আর আমি?’ বলল মরিয়ম মারুফা।
‘তুমি একা বাড়ি থাকবে কেন? আর কিছু না হোক বেড়ানোর কাজটা তো আমাদের হবে।’ নূর ইউসুফ বলল।
বিকেল সাড়ে তিনটায় বেরুল আহমদ মুসারা।
সবার সামনে আহমদ মুসা। তার পেছনে দাউদ ইব্রাহিম, মরিয়ম মারুফা। সবার পেছনে নূর ইউসুফ।
আহমদ মুসা যে জায়গাটায় যেতে চায় সেটা নূর ইউসুফরা যেখানে থাকে তার পাশেই। রক ক্রিক নদী থেকে যে ছড়াটা পশ্চিম দিকে ঢুকেছে, তার শেষ মাথার ডান পাশে মানে উত্তর পাশে থাকে নূর ইউসুফরা। আহমদ মুসা যে জায়গটা দেখতে চায় সেটা নূর ইউসুফদের বাসস্থান থেকে শুরু হয়ে ছড়াটার মাথা হয়ে দক্ষিণ দিকে একশো গজের মত এগিয়ে পাহাড়ের দেয়ালে গিয়ে শেষ হয়েছে। ছড়ার দক্ষিণ ধার ঘেষে মাথা পর্যন্ত এসে পাহাড়ের দেয়ালটা দক্ষিণ দিকে বেঁকে গিয়ে অর্ধবৃত্তাকার প্রায় সমতল একটা পকেট সৃষ্টি করেছে। ছড়ার মাথার সামনে দিয়ে যাওয়া প্যাসেজটা এই কারণেই একশো গজের মত দীর্ঘ হতে পেরেছে। প্যাসেজটার দক্ষিণ মাথাটা ঢুকে গেছে পাহাড়ের ঐ পকেটে।’ এই পকেটের শেষ মাথাটা পর্যন্ত দেখতে চায় আহমদ মুসা।
ছোটখাটো আগাছা, লতা-গুল্ম মাড়িয়ে চলছে আহমদ মুসারা। পায়ের নিচে শক্ত পাথরের উপরে মাটির পাতলা লেয়ার। পুরু লেয়ার সম্ভবত গড়ে উঠতে পারেনি বৃষ্টির কারণে। বৃষ্টির পানিতে অব্যাহত ভাবেই কিছু কিছু করে মাটি ধুয়ে নিচের ছড়ায় নেমে যায়। মাটির পাতলা লেয়ারেই জন্মেছে ঘাস, গুল্ম জাতীয় আগাছা। পাথরের জোড়াগুলোতে মাটির লেয়ার পুরু। এসব জায়গাতেই জন্মেছে ছোট ছোট গাছ, লতা-পাতার ঝোপ। এসব মাড়িয়ে, কখনও পাশ কাটিয়ে সামনে এগোতে হচ্ছে আহমদ মুসাদের।
সামনে এগোবার এ প্যাসেজটা আড়াই থেকে তিন গজের মত প্রশস্ত
। পশ্চিম পাশ বরাবর খাড়া পাহাড়ের দেয়াল। পাহাড়ের গা একেবারেই নগ্ন। খাড়া বলেই গায়ে ধুলা-বালি জমতে পারে না, তার উপর রয়েছে বৃষ্টির আঘাত। আর পুব পাশেও পাহাড়ের খাড়া দেয়াল নেমে গেছে নিচের গভীর খাড়িতে। ভীতিকর এক দৃশ্য। সে দৃশ্য এড়াতেই যেন সবাই হাঁটছে প্যাসেজের পশ্চিম পাশের পাহাড়ের গা ঘেষে।
আহমদ মুসার সন্ধানী দৃষ্টি পায়ের তলার রাস্তার গঠন, পাশের পাহাড়ের গা, পাথরের রকম ইত্যাদি সব বিষয়েই চোখ বুলাচ্ছিল।
পাহাড়ের সামনের দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছল তারা।
প্যাসেজের মাথা যেখানে শেষ হয়েছে সে দেয়ালটাও খুঁটে খুঁটে দেখল আহমদ মুসা। আনন্দিত হবার মত কিছুই পেল না।
পেছন ফিরে চারদিকে তাকাল আহমদ মুসা। তার মন বলছে, দিব্য দৃষ্টিতে যেন সে দেখতেও পাচ্ছে, এ যেন চলাচলের একটা পথ।
‘স্যার, আপনি যেন কিছু খুঁজছেন।’ বলল মরিয়ম মারুফা।
‘হ্যাঁ মারুফা, খুঁজতেই তো এসেছি। কিন্তু পাচ্ছি না কিছু।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি খুঁজতে এসেছেন স্যার?’ বলল দাউদ ইব্রাহিম।
‘কি খুঁজছি আমি নিজেও জানি না। কিন্তু কেন জানি আমার মনে হচ্ছে, এটা চলাচলের একটা পথের মত।’ আহমদ মুসা বলল।
সবাই আহমদ মুসার দিকে তাকাল। সবার চোখেই বিস্ময় দৃষ্টি।
বলল নূর ইউসুফ, ‘একে আপনার চলাচলের পথ মনে হলো কেন? আমরা ছাড়া তো এখানে কেউ বাস করে না। আর সামনেও দেখুন পাহাড়ের দেয়ালে, ঐ দিকের পথটা যে একেবারেই বন্ধ সেটা আপনিও দেখেছেন। এটা চলাচলের পথ হতে পারে কেমন করে?’
আহমদ মুসা পশ্চিম পাশের পাহাড়ের দেয়ালের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। ঐভাবে থেকেই বলল, ‘এর উত্তর আমিও জানি না। আমার মনে হয়েছে তাই বললাম।’
আহমদ মুসার দু’চোখের দৃষ্টি হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। আহমদ মুসা এগিয়ে গেল পশ্চিম পাশের পাহাড়ের দেয়ালের দিকে। দাঁড়াল তুলনামূলকভাবে মসৃণ একটা পাথরের সামনে। আরও ভালোভাবে তার চোখে পড়ল, পাথরের গায়ের সমান্তরালে কিছু জায়গা জুড়ে আঁকা-বাঁকা রেখায় পাথরের গায়ে ধুলা-মাটি যেন বেশি জমেছে। আহমদ মুসা পকেট থেকে চাকু বের করে চাকুর আগা দিয়ে আঁকা-বাঁকা গোটা রেখা থেকে ধুলা-মাটি সরিয়ে দিল।
সবাই আহমদ মুসার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই দেখছে আহমদ মুসার কাজ।
ধুলা-মাটি সরানোর পর রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল।
রেখাগুলোর ঢেউ খেলানো রূপ দেখে ভ্রু-কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। চোখ তার উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
পেছন ফিরে সবার দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘রেখাগুলো দেখে আপনাদের কি মনে হচ্ছে বলুন তো?’
সবাই ভালো করে তাকাল।
‘আপনি কি মনে করছেন রেখাগুলো প্রাকৃতিক নয়, মানুষের তৈরি?’ বলল নূর ইউসুফ।
‘আমার তাই মনে হচ্ছে, আপনাদের মত জানতে চাচ্ছি।’ আহমদ মুসা বলল।
নূর ইউসুফদের সবার চোখে-মুখে বিস্ময়! দ্রুত কথা বলে উঠল মরিয়ম মারুফা, ‘মানুষের তৈরি? মানুষ আসবে কোথেকে এখানে? কেনই বা পাথরে আঁকবে ওসব?’
‘কেন আঁকবে এটাই তো খোঁজার বিষয়। তার আগে কি এঁকেছে, এটা জানার বিষয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু রেখাগুলোর কোন অর্থ আছে বলে মনে হচ্ছে না।’ বলল দাউদ ইব্রাহিম।
‘দাউদ ইব্রাহিম, মরিয়ম মারুফা, তোমরা ছোটবেলায় এ রকম কিছু এঁকেছ কি না, স্মরণ কর।’ আহমদ মুসা বলল।
দু’জনের চোখে-মুখে ভাবনার চিহ্ন ফুটে উঠেছে। ভাবছে দু’জনেই।
মরিয়ম মারুফাই প্রথম আনন্দে চিৎকার করে উঠল। বলল, মেঘের ছবি আমরা এভাবে আঁকতাম।’
‘ঠিক মারুফা।’ দাউদ ইব্রাহিম বলল।
‘হ্যাঁ, তোমরা ঠিকই বলেছ, এটা মেঘের সিম্বলিক ছবি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু’ কে আঁকবে? কেন আঁকবে?’ নূর ইউসুফ বলল।
‘কেন এঁকেছে, আমি বোধ হয় বুঝেছি জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এঁকেছে? সেটা কি?’ বলল নূর ইউসুফই।
আহমদ মুসা শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চাইল। ভাবল একটু। তাকাল আবার সেই আঁকা-বাঁকা রেখাগুলোর দিকে। চোখ নামিয়ে আরও একটু নিচে তাকাল গরুর দুই শিং দিয়ে তৈরি অস্পষ্ট একটা সার্কেলের দিকে। বলল, ‘মেঘের সিম্বল এঁকে উপরের দিকে ইংগিত করা হয়েছে। আর এটা এঁকেছে এই এলাকার পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ান ট্রাইব।’
‘পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ান ট্রাইব?’ নূর ইউসুফরা প্রায় একসাথেই বলে উঠল।
‘হ্যাঁ, পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ান ট্রাইব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সে তো অনেক আগের কথা। ওরা এখানে আসবে কেন? কেনইবা আঁকবে এই মেঘের সিম্বল? আর এটা বুঝা গেল কি করে যে, ওটা পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ানদের কাজ?’ বলল নূর ইউসুফ।
আহমদ মুসা রেখাগুলোর নিচে গরুর দুই শিং-এর সার্কেলের দিকে ইংগিত করে বলল, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য পূর্ব উপকূলের রেড ইন্ডিয়ান, বিশেষ করে পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ানরা এই সিম্বল ব্যবহার করে থাকে।’
মুহূর্তের জন্যে থেমেই আবার শুরু করল আহমদ মুসা, ‘পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ান পটোম্যাক নদীর তীরসহ রক ক্রিক নদীর এই এলাকাতেই বাস করতো। পিসকাটাওয়ে একটা গ্রামের নাম ছিল। পিসকাটাওয়ে থেকেই পটোম্যাক নদীর নাম হয়েছে। পটোম্যাককে এক সময় বলা হতো পাটাওমেক, সেখান থেকেই পটোম্যাক। পটোম্যাক থেকে এই রক ক্রিক হয়ে পশ্চিম-উত্তরে ওয়াশিংটন ডিসি ও মেরিল্যান্ডের ওকোমা পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ান ট্রাইবের বাস ছিল। তারা প্রধানত বাস করত নদীর তীর এলাকায়। এই রক ক্রিক নদীর তীর এলাকাতেও। আমার নিশ্চিতই মনে হচ্ছে এই সংকীর্ণ প্যাসেজটা এক সময় সংকীর্ণ ছিল না। চলাচলের একটা প্রশস্ত পথ ছিল। পাহাড়ের দেয়ালে পাথরের গায়ে তাদের সিম্বল ও মেঘের ড্রইং এটাই প্রমাণ করছে।’
‘কিন্তু পথ কোথায়? পাহাড়ের দেয়ালে প্যাসেজটা তো থেমে গেছে?’ বলল নূর ইউসুফ।
মরিয়ম মারুফাদের চোখে বিস্ময় দৃষ্টি! নূর ইউসুফ থামতেই মরিয়ম মারুফা বলে উঠল, ‘স্যার, আমাদের এলাকা ও এলাকার ইতিহাস সম্পর্কে আপনি যা বললেন তার কিছুই আমরা জানি না। পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ানরা ওয়াশিংটন ডিসি এলাকায় বাস করত,
এটুকুই মাত্র জানি।’
‘জানার সময় শেষ হয়ে যায়নি মারুফা। আর মানুষের আবাল্য পরিচয়ের জায়গা সম্পর্কে জানার আগ্রহ কম থাকাটাই স্বাভাবিক।’ আহমদ মুসা থামল।
আহমদ মুসা থামার সাথে সাথেই নূর ইউসুফ বলল, ‘আসল কথাই বলেননি মি. আহমদ মুসা। মেঘের সিম্বল দিয়ে উপর দিকে ইংগিত করবার তাৎপার্যটা কি?’
‘আমি জানি না জনাব। জানার জন্যে আমি উপরে উঠতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘জানার সত্যিই কি কিছু আছে? কি থাকতে পারে?’ বলল মরিয়ম মারুফা।
‘তা আমি জানি না মারুফা। প্যাসেজের ক্লোজিং পয়েন্টে এসে পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ানরা কেন উপরের দিকে ইংগিত করল
সেটা দেখতে চাই।’ বলে উপরের দিকে তাকাল আহমদ মুসা।
তার সাথে সাথে তাকাল সবাই।
প্রায় ১০ ফিট উপরে নিচের লেভেল থেকে পাহাড়ের দেয়াল ভেতরের দিকে সরে গেছে। ঠিক ভাঁজের স্থানে বাইরের দিকে পাথর বেরিয়ে এসেছে। ঠিক যেন কার্নিশ।
পাহাড়ের কার্নিশ বা ভাঁজটা সামনে মানে দক্ষিণে এগিয়ে গেছে, যেখানে পাহাড়ের দেয়াল পূর্ব দিকে টার্ন নিয়েছে সে পর্যন্ত। ভাঁজটা উত্তর দিকেও কিছুটা এগিয়ে এক সময় পাহাড়ের গায়ে মিশে গেছে। পাহাড়ের গায়ে এই ভাঁজের ফলে জিগজ্যাগ, এবড়োথেবড়ো সংকীর্ণ একটা বারান্দার সৃষ্টি হয়েছে।
আহমদ মুসা তাকাল দাউদ ইব্রাহিমের দিকে। বলল, ‘তোমার ব্যাগ থেকে দড়ির মইটা বের কর। উপরে উঠতে হবে।’
‘কাজে তাহলে লাগলই স্যার। আমি ভেবেছিলাম, এবার আপনার এই আগাম প্রস্তুতি কাজে লাগবে না।’ হাসতে হাসতে বলল দাউদ ইব্রাহিম।
‘কাজে এখনও লাগেনি দাউদ ইব্রাহিম, ব্যবহার করছি মাত্র।’ বলল আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে।
দড়ির মই হাতে নিল আহমদ মুসা।
প্রথমবারের ছোড়াতেই নাইলন-দড়ির ফাঁসটা বেঁধে গেল কার্নিশের বেরিয়ে থাকা পাথরটায়।
দড়ির মইটা কয়েকবার টেনে দেখে পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘আমি ওপরটা একটু দেখে আসি।’
‘আমিও উঠতে চাই।’ দাউদ ইব্রাহিম বলল।
‘আমিও উঠব।’ বলল মরিয়ম মারুফা।
‘অযথা কষ্ট হবে, এর কি প্রয়োজন আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ক্ষতি তো নেই। আমরাও উপরটা দেখলাম।’ বলল নূর ইউসুফ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘অপ্রয়োজনে কষ্টের প্রয়োজন নেই মনে করেছিলাম। ঠিক আছে, চলুন উঠি সবাই।’
প্রথমে উঠল আহমদ মুসা। একে একে সবাই।
উপরে উঠে হতাশ হলো। পাহাড়ের এবড়োথোবড়ো গা বারান্দার মত এগিয়ে গেছে সামনে, দক্ষিণে পাহাড়ের দেয়াল পর্যন্ত। বারান্দা হয়ে বারান্দার ক্লোজিং পয়েন্টের দেয়াল পর্যন্ত বার দুই যাতায়াত করল। তার সতর্ক দৃষ্টি পাথরের গায়ে সংকেত চিহ্নের সন্ধান করল। কিন্তু পেল না কিছুই। মনে মনে রেড ইন্ডিয়ানদের ব্যবহৃত কোন প্যাসেজের সন্ধান পাওয়ার সে যে আশা করছিল, তা নিরাশায় পরিণত হলো। কিন্তু মন মানছে না, উপরের দিকে উঠার যে সংকেত নিচে পাহাড়ের গায়ে পেয়েছে, তা নিরর্থক অবশ্যই নয়। সবাইকে উদ্দেশ্য করে আহমদ মুসা বলল, ‘আসুন, সবাই আমরা একটু বিশ্রাম নেই। একটু ভাববারও সময় পার। পরে আর এক দফা খোঁজ করা যাবে।’ সবাই বসে পড়ল।
আহমদ মুসারা তখন বারান্দা টাইপ পথটার দক্ষিণ প্রান্তে।
মরিয়ম মারুফা বসে পড়েছিল পথ রোধ করে দাঁড়ানো পাহাড়ের দেয়ালে ঠেস দিয়ে। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করল মরিয়ম মারুফা পানি পানের জন্য। পানি পানের আগে মুখ পরিষ্কারের জন্যে মুখ বাড়িয়ে পাহাড়ের দেয়ালের গোড়ায় কুলি ফেলল। কুলির সাথে সাথে তার চোখও গিয়ে পড়ল কুলি পড়ার স্থানে, পাহাড়ের গায়ে। চোখ পড়তেই সে চমকে উঠল পাথরের গায়ে আংশিক একটা রেখা দেখে। রেখা ধুলা-ময়লায় ভর্তি হলেও ভিজে যাওয়ার পর তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিস্মিত মরিয়ম মারুফা ঝুঁকে পড়ে বোতল থেকে পানি ছুঁড়ে পাথরের অনেকখানি জায়গা ধুয়ে দিল। এবার কিছুটা আয়তাকার একটা ক্ষেত্র বেষ্টনকারী ঘুরানো রেখা সুন্দরভাবে ফুটে উঠল। মনে পড়ল তার নিচের পাথরে দেখা মেঘের রেখাচিত্রের কথা।
বিস্মিত, উত্তেজিত মারুফা চিৎকার করে উঠল, ‘স্যার, দেখুন আয়তাকার ক্ষেত্রের মত একটা কিছু?’
সবাই তাকাল মারুফার দিকে।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে এগোলো মারুফার দিকে।
মারুফা দেখাল আহমদ মুসাকে পাথরের গায়ের আয়তাকার রেখাচিত্র।
আহমদ মুসা বসল পাথরের সামনে।
নূর ইউসুফ ও দাউদ ইব্রাহিমও আহমদ মুসার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসা ছোট পাথর খণ্ডের তীক্ষ্ণ প্রান্ত দিয়ে আয়তাকার ক্ষেত্রের চারদিকের রেখা পরিষ্কার করে বলে উঠল, ‘এটা একটা পায়ের রেখাচিত্র।’
সবাই ভালো করে দেখল। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়! বলল নূর ইউসুফ, ‘তাহলে মানুষ এখানে এসেছে?’ স্বগত কণ্ঠ তার।
‘নিচে পাহাড়ের দেয়ালে দেখা গেল মেঘ। তার একটা অর্থ পাওয়া গেছে। পায়ের রেখাচিত্র দিয়ে নিশ্চয় কিছু বুঝানো হয়েছে। সেটা কি?’ বলল মরিয়ম মারুফা।
ভাবছিল আহমদ মুসা। বলল, ‘এর একটা অর্থ হতে পারে, এটা পায়ে চলার পথ। আরেকটা অর্থ হতে পারে, এই পাথরের গায়ে লাথি দিতে হবে। দুই অর্থ একে অন্যের পরিপূরক মনে হচ্ছে। এটা একটা পায়ে চলার রাস্তা। পথের বাধা দূর করতে হলে আমাদের সামনের এই পাথরটা সরাতে হবে। কিভাবে, তার ইংগিত এই পদরেখা। পাথরের গায়ে ধরার মত কিছু নেই, তাই পা দিয়ে পুশ করে পাথর সরাতে হবে। পদচারি রেড ইন্ডিয়ানদের হাতের চেয়ে পা চলত বেশি।’
‘তার মানে এই পাহাড়ের দেয়াল পেরিয়ে ওপারে মানে সাউথে যাওয়া যাবে!’ বলল মরিয়ম মারুফা।
‘আমি ঠিক জানি না। তবে এটা ওপারে পৌঁছার পথ হওয়াই স্বাভাবিক।’
বলেই আহমদ মুসা পাথরের গায়ের ফুটপ্রিন্টের উপর পা সেট করে জোরে চাপ দিল। কিন্তু পাথরটা চুল পরিমাণও নড়ল না।
আরও কয়েকবার চেষ্টা করল। কোনই ফল হলো না।
অনেকটাই হতাশ হয়ে আহমদ মুসা বসে পড়ল পাথরের গোড়ায়। সে নিশ্চিত, ফুটপ্রিন্টের ইংগিতের মধ্যে কোন ভুল নেই।
তাহলে? তাদের কি কিছু ভুল হচ্ছে?
পাথরটির উপর চোখ বুলাতে লাগল আহমদ মুসা। পাথরের নিচের অংশে সমতলের কাছাকাছির দিকটা অপেক্ষাকৃত বেশি ধুলি-ধূসরিত।
ধুলো-বালি মোছার জন্যে আহমদ মুসা নিচু হবার সময় হঠাৎ নজরে পড়ল পাথরটির বাম প্রান্তে তীরের অস্পষ্ট ফলা।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়াল।
ধুলো-বালি মুছে ফেললে তীরের ফলাটা আরও স্পষ্ট হলো।
তীরের ফলা সামনে দিকনির্দেশ করছে। আবার রেড ইন্ডিয়ানদের পায়ের চিহ্নও সেটাই নির্দেশ করে। তাহলে? পাশাপাশি দুটি নির্দেশ কেন? পায়ের চিহ্ন পাথরের মধ্যখানে আর তীরের ফলা পাথরের এই প্রান্তে কেন?
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হঠাৎ তার মনে হলো, পাথরের মাঝখানের পায়ের চিহ্নটি নিশ্চয় স্থানটির একটি সাধারণ নির্দেশনা আর তীরের ফলাটি কার্যকরী একটি নির্দেশ। নিশ্চয় পাথরের বাম প্রান্তটাকে সামনে পুশ করতে হবে।
‘কি ভাবছেন স্যার, সমাধান কিছু পেলেন?’ বলল মরিয়ম মারুফা।
‘পেয়েছি বলব না, তবে মনে হচ্ছে পেয়েছি।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা পাথরটির বাম প্রান্ত বরাবর সরে গিয়ে বাম প্রান্তের উপর পা সেট করে প্রচণ্ড শক্তিতে পাথরকে পেছন দিকে পুশ করল। সংগে সংগেই পাথরের বাম প্রান্তটি পেছনে সরে গেল এবং ডান প্রান্তটি বাম দিকে ঘুরে এল। গড়িয়ে পড়ে গেল পাথরটি।
একটা ল্যান্ডিং-এর উপর দাঁড়িয়েছিল পাথরটি। ল্যান্ডিংটির পেছনে মাঝ বরাবর পর্যন্ত ডান দিক থেকে পাথরের দেয়াল রয়েছে। বামে অর্ধেক ফাঁকা, গবাক্ষ ধরনের একটা প্যাসেজের মুখ এটা।
প্যাসেজটির ফ্লোর এবড়োথেবড়ো, উঁচু-নিচু। তবে কিছুটা নিচু ল্যান্ডিং-এর তুলনায়। পাথরটি প্যাসেজটির উপরই পড়ে গেছে। ল্যান্ডিং গবাক্ষ ও প্যাসেজটাকে প্রাকৃতিক এবং ল্যান্ডিং বা গবাক্ষ মুখের পাথরটার আকার প্রাকৃতিক মনে হলো না আহমদ মুসার কাছে। গবাক্ষ মুখ বন্ধ রাখার জন্যে এটা তৈরি করা হয়েছে।
আহমদ মুসা পেছন ফিরে নূর ইউসুফদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমি ওপারে যেতে চাই। আপনারা যাবেন?’
‘হ্যাঁ, ওপাশটা আমরা দেখতে চাই। খুব আনন্দের কথা যে, যোগাযোগের একটা বিকল্প পথ পাওয়া গেল। বলল নূর ইউসুফ।
‘আসুন।’ বলে আহমদ মুসা গবাক্ষ পথে ভেতরে ঢুকে গেল।
সবাই ঢুকে গেল ভেতরে।
গবাক্ষ-সুড়ঙ্গটা খুবই স্বল্প দৈর্ঘ্য। সুড়ঙ্গের বাইরের দিকটা ক্রমশই
প্রশস্ত।
আহমদ মুসা গবাক্ষ-সুড়ঙ্গের ওপাশের মুখে গিয়ে ফিরে দাঁড়াল।
তার দৃষ্টি একটা কঙ্কালের দিকে।
নূর ইউসুফরা আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়াল।
‘এ তো মানুষের কঙ্কাল!’ বলল নূর ইউসুফ।
‘হ্যাঁ জনাব! বেশ অনেক বছরের পুরানো।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা দেখছিল কঙ্কালটিকে খুঁটে খুঁটে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ও। কঙ্কালের পরনের কাপড় টুকরো টুকরো হয়ে শেষ হয়ে গেছে। কংকালটি সুড়ঙ্গের পশ্চিম দেয়ালে গুহার মত জায়গায় বসা অবস্থায় রয়েছে।
কত বছরের পুরানো হবে কংকালটা? নিজেই নিজের মনকে প্রশ্ন করল আহমদ মুসা। সময়টা আহমদ মুসা আন্দাজ করতে পারল না।
‘কংকালের বয়স নিশ্চয় অনেক হবে। কিন্তু এখানে সে আসল কেন? আবার একা কেন? আর তার খোঁজই বা কেউ করল না কেন? তার কেউ থাকলে নিশ্চয় লাশ এখানে এভাবে কংকাল হতো না।’
বলল নূর ইউসুফ।
দাউদ ইব্রাহিম ও মরিয়ম দু’জনেরই চোখে-মুখে বিস্ময়!
‘আপনি ঠিক বলেছেন জনাব। সে এখানে এল কেন? তার সাথে কেউ এল না, তাকে কেউ খোঁজ করল না কেন? সত্যি ভাববার বিষয়।’ বলে আহমদ মুসা থামল। তার চোখে-মুখে ভাবনার চিহ্ন।
একটু পর সে মুখ খুলল। বলল, ‘আমার মনে হয় সে একক উদ্যোগে এসেছে। তার স্বজন-সাথীরা কেউ তার এখানে আসার ব্যাপারটা জানত না।’
‘কিন্তু সে ফিরে গেল না কেন? মারা গেল কিভাবে?’ প্রশ্ন মরিয়ম মারুফার।
‘হ্যাঁ, এ দু’টিও বড় প্রশ্ন।’ বলে আহমদ মুসা নিজের ব্যাগ থেকে পেন্সিল আকৃতির টর্চ বের করল। এগিয়ে গেল কংকালের দিকে। সুড়ঙ্গের চেয়ে গুহা মত জায়গাটা অন্ধকার।
টর্চ জ্বেলে কংকালের মাথা থেকে পা পর্যন্ত আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। এক জায়গায় টর্চের আলো পড়তেই কিছুটা ঝিলিক দিয়ে উঠল। যে বস্তুর উপর টর্চের আলো পড়ে প্রতিবিম্বিত হলো, আহমদ মুসা ঝুঁকে পড়ে তা তুলে নিল। দেখল বস্তুটা একটা ব্যবহৃত বুলেট।
চমকে উঠে আহমদ মুসা তাকাল কংকালের মাথা ও বুকের দিকে। বুক দেখে কিছু বুঝল না। কিন্তু মাথার দিকে তাকাতেই কপালের মাঝে বেশ বড় একটা ফুটা দেখতে পেল।
‘কংকালের লোকটি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘লোকটা গুলিতে মরেছে? তাহলে বিবদমান দুই পক্ষ এখানে এসেছিল?’ নূর ইউসুফ বলল।
‘তাই হবে। কিন্তু কারা এরা? শ্বেতাংগ, রেড ইন্ডিয়ান, না কোন উপজাতি?’ বলল আহমদ মুসা।
কথা বললেও আহমদ মুসা কংকালের উপর থেকে চোখ সরায়নি। হঠাৎ কংকালের দাঁতের ফাঁক দিয়ে মুখের ভেতর কিছু একটা দেখতে পেল।
আর একটু এগিয়ে টর্চ দিয়ে ভালো করে দেখল ভেতরে কি দেখা যাচ্ছে। বুঝতে পারল না। অবশেষে আহমদ মুসা কংকালের গলার দিকে হাত ঢুকিয়ে দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা জিনিসটি বের করে আনল। সরে এল কংকালের কাছ থেকে।
হাতের জিনিসটার দিকে নজর বুলাল আহমদ মুসা। নরম চামড়া জাতীয় কিছু ভাঁজ করা। ভাঁজ খুলে ফেলল আহমদ মুসা। বর্গাকৃতির একটা পাতলা চামড়া। চামড়ার কাগজও বলা যায়। রেড ইন্ডিয়ানদের সময়ে এভাবে চামড়ার ব্যাপক প্রচলন ছিল। নানা কাজে এর ব্যবহার হতো। কিন্তু এটা কি? কংকালের মুখে কেন এটা? যখন তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়, তখন এটা তার মুখে ছিল। কেন?
প্রথম দৃষ্টিতে চামড়ার অমসৃণ, খসখসে কাগজটিতে কিছুই দেখতে পেল না। কিন্তু পেনসিল টর্চের আলো ফেলতেই দেখতে পেল, কালচে চামড়ার কাগজটার বাম অংশে হালকা কালো রঙের কালিতে বর্গাকৃতি স্থানের উপর আঁকা-বাঁকা আঁচড়। একটু মনোযোগ দিয়েই বুঝল ওগুলো পাহাড়ের সিম্বল। এই সাথে আরেকটা জিনিস দেখতে পেল আহমদ মুসা। বৃত্তাকার পাহাড়ের সিম্বলের ডান পাশ দিয়ে একটা ডট রেখা সামনে এগিয়ে গেছে। ডটগুলো পিরামিড আকৃতির। পিরামিডের শীর্ষদিকটা সামনের দিকে।
আহমদ মুসা কাগজ থেকে মুখ তুলে বলল, ‘আসুন, আমরা সুড়ঙ্গটার বাইরে যাই, কাগজটা ভালো করে দেখতে পাব। মনে হচ্ছে কাগজটা গুরুত্বপূর্ণও কিছু হতে পারে।’
বলে আহমদ মুসা সুড়ঙ্গের বাইরে যাবার জন্যে পা বাড়াল। সবাই তাকে অনুসরণ করল। সুড়ঙ্গের বাইরেটা পাথুরে, জংগলাকীর্ণ।
আহমদ মুসা একটা পাথরে বসল। সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা চোখ বুলাচ্ছিল চামড়ার সেই কাগজটার উপরই। সে দেখল, বর্গাকৃতি পাহাড়ের যে সিম্বল, তার পূর্ব পাশ দিয়ে পিরামিড-ডটগুলো উত্তরে চলে গেছে। আহমদ মুসারা সুড়ঙ্গপথে যে পাহাড় পেরিয়ে এল, সে পাহাড়ের দেয়ালে ডটগুলো থেমে গেছে। কিন্তু পাহাড়ের ওপার থেকে আবার সে ডটগুলো সামনে এগিয়েছে। অবশেষে তা গিয়ে শেষ হয়েছে নূর ইউসুফরা যেখানে থাকে সেখানে। ওখানে গিয়ে পিরামিডের উত্তরমুখী শীর্ষদেশটা পশ্চিম দিকে ঘুরে পাহাড়ের মুখোমুখি হয়েছে। সেখানে পাহাড়ের গায়ে দরজা আকৃতির একটা থলে টাঙানো।
অবাক হলো আহমদ মুসা। বুঝল সে, পিরামিড আকৃতির ডটগুলো অবশ্যই রাস্তা নির্দেশক একটা সংকেত। কিন্তু কেন? পাহাড়ের যেখানে গিয়ে সংকেত শেষ হয়েছে, সেটা নূর ইউসুফদের জায়গা। এর আশ-পাশেই ওরা থাকে। কিন্তু সংকেতের লক্ষ ওখানে কেন? কি বুঝাতে চাচ্ছে সংকেত?
আহমদ মুসা মুখ তুলে তাকাল নূর ইউসুফের দিকে। কাগজটা তাকে দেখিয়ে বলল, ‘দেখুন এই রাস্তার সংকেত আপনাদের ওখানে গিয়ে শেষ হয়েছে। একটা কথা জনাব, আপনারা পাহাড়ের যে গুহা-ঘরগুলোতে বাস করছেন, সেগুলো নিশ্চয় আপনাদের তৈরি নয়?’
‘না। আস্ত গুহা-ঘর আমরা পেয়েছি। প্রয়োজনীয় যে জিনিসপত্র সেগুলোই শুধু আমাদের। কিন্তু এ প্রশ্ন কেন?’ বলল নূর ইউসুফ।
প্রশ্নটি বোধ হয় আহমদ মুসার কানে পৌঁছেনি। কাগজটির দিকেই তার মনোযোগ আবার নিবিষ্ট হয়েছে। তার ভ্রু-কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে।
সংকেতের রাস্তাটা পাহাড়ের গায়ে এসে যেখানে শেষ হয়েছে, যেখানে থলের আকারে দরজার চিহ্ন অংকিত ছিল। সেটার প্রতিই আহমদ মুসার গভীর মনোযোগ নিবদ্ধ। আহমদ মুসার মনে হল, থলের আকারে দরজার যে চিহ্ন তা একটা কিছুর ইংগিত বহন করে। থলে সব সময়ই সম্পদের প্রতীক। থলে দ্বারা এটাই বুঝানো হয়েছে! তাহলে তো এর অর্থ দাঁড়ায় থলেটি কোন গুপ্তধন ভাণ্ডারকে ইংগিত করছে।
কথাটা মনে হওয়ার সংগে সংগে আহমদ মুসার ভাবনায় এল নূর ইউসুফের কোন ঘরে ধনভাণ্ডার ছিল, না ধনভাণ্ডারটি পাশে কোথাও। তাহলে নূর ইউসুফদের গুহা-ঘরগুলো কি, কেন? তাহলে গুপ্তধনের সাথে বা পাহারায় লোক এখানে থাকত? না আরও গুপ্তধন রাখার জন্যেই এ ঘরগুলোও নির্দিষ্ট ছিল।
আহমদ মুসাকে এভাবে হঠাৎ ভাবনায় ডুবে যেতে দেখে বিস্মিত নূর ইউসুফ বলল, ‘নতুন কিছু ঘটেছে জনাব আহমদ মুসা?’
আহমদ মুসা নূর ইউসুফের কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘জনাব আপনাদের কোন ঘরে কি গুপ্তধন পেয়েছেন?’
‘গুপ্তধন!’ অনেকটা স্বগতোক্তির মত বেরিয়ে এল নূর ইউসুফের মুখ থেকে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়!
গুপ্তধনের কথা শুনে বিস্মিত হয়েছে দাউদ ইব্রাহিম এবং মারুফাও।
‘আমাদের ঘরে গুপ্তধন? বুঝলাম না আমি জনাব।’ বলল বিস্মিত নূর ইউসুফ।
আহমদ মুসা নকশার সাংকেতিক রাস্তা আবার দেখিয়ে বলল, সাংকেতিক পথের শেষে থলে আকৃতির সংকেতটার অর্থ হলো, এখানে গুপ্তধন রয়েছে।
‘কোথায়? আমাদের ঘরে?’ বলল নূর ইউসুফ।
‘আপনাদের ঘরে না থাকলেও পাশে কোথাও আছে বলে আমার বিশ্বাস। আপনারা যখন আপনাদের ঘরগুলোতে ঢোকেন, তখন সেখানে কি দেখেছিলেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঘরটা শূন্যই ছিল। আরশোলা, বিভিন্ন কীট-পতঙ্গের বাসা, দীর্ঘ দিন পরিত্যাক্ত থাকলে যেমনটা হয়।’ বলল নূর ইউসুফ।
‘ঘরগুলোকে কিভাবে খুঁজে পেয়েছিলেন? আশেপাশে কি ওরকম ঘর আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সেটা অনেকটাই একটা অ্যাকসিডেন্ট। আমরা পাহাড়ের গা’কে পেছনের দেয়াল হিসাবে ধরে থাকার মত ঘর তৈরি করছিলাম গাছকে খুঁটি এবং গাছের ডাল-পাতার বেড়া দিয়ে। একদিন গাছের একটা লম্বা খুঁটি বসাতে গিয়ে পাহাড়ের গায়ের এক স্থানে আঘাত করার সংগে সংগেই একাংশ সরে যায় এবং একটা দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়। এভাবে দরজা খুলে যাবার পর এর সংলগ্ন পাহাড়ের গায়ে খোঁজ করাতে আরও দুটি কক্ষ আমরা পেয়ে যাই। আগেই বলেছি কক্ষগুলো শূন্য ছিল।’
বলল নূর ইউসুফ।
‘আশেপাশে তো আর খোঁজ করেননি ঐ ধরনের কক্ষ আরও আছে কিন?’ আহমদ, মুসা বলল।
‘আমরা খোঁজ করিনি। আপনি তো দেখেছেন, আমাদের তিনটি কক্ষের দু’পাশেই পাহাড়ের দেয়াল খুবই এবড়োথেবড়ো। ঐ রকম জায়গায় কক্ষ থাকার প্রশ্নই উঠে না। তবে আমাদের তিন কক্ষের উত্তর পাশে এবড়োথেবড়ো জায়গাটার পাশে পাহাড়ের মসৃণ দেয়াল আছে। তবে আমরা ওদিকে খোঁজ করিনি, প্রয়োজনও ছিল না।’ বলল নূর ইউসুফ।
আহমদ মুসা তার হাতের নকশার কাগজের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলে উঠল, ‘চিহ্নিত জায়গাটার যে লোকেশন সেটা আমার মনে হচ্ছে আপনাদের কক্ষের উত্তর দিকেই।’
‘আপনি কি মনে করছেন, আমাদের কক্ষের উত্তর দিকে আরও কক্ষ আছে এবং যেখানে ধনভাণ্ডার আছে!’ বলল নূর ইউসুফ।
‘আমি নিশ্চিত নই। তবে নকশার নির্দেশনা বলছে, গুপ্তধনভাণ্ডার ঐ রকম স্থানেই থাকতে পারে। আবার ধনভাণ্ডার আপনাদের কক্ষগুলোতে কোথাও থাকতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা মুহূর্তকাল থেমে আবার বলল, ‘আপনারা বাসায় ফিরে, আমার অনুরোধ, একটু খোঁজ করে দেখবেন। আরও কক্ষ সেখানে আছে কি না, কিংবা আপনাদের কক্ষেরই কোথাও ধনভাণ্ডার আছে কি না।’
নূর ইউসুফদের বিস্ময়জড়িত চোখে এবার নতুন চাঞ্চল্যেরও সৃষ্টি হলো।
‘আমরা বাসায় ফিরব, আপনি ফিরবেন না?’ বলল মারুফা।
‘হ্যাঁ, তাই তো। সবাই মিলে আমরা খুঁজব গুপ্ত ধনভাণ্ডারের আলাদা কোন কক্ষ আছে কি না।’ দাউদ ইব্রাহিম বলল।
‘না, দাউদ ইব্রাহিম। সময় খুব কম। ডেথ ভ্যালির চারদিকটা তাড়াতাড়ি দেখে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি এখনই যাব ওদিকে।’
বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল দাউদ ইব্রাহিমকে লক্ষ্য করে, ‘দাউদ ইব্রাহিম, তোমাকে শহরে যেতে হবে।’
‘কোথায়?’ বলল দাউদ ইব্রাহিম। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘এফবিআই হেড কোয়ার্টারে যেতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এফবিআই হেড কোয়ার্টারে? কেন?’ বলল দাউদ ইব্রাহিম।
‘আমি চিঠি দেব। সেটা এফবিআই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসনকে পৌঁছে দিতে হবে। তিনি যা বলেন তাই করবে।’ বলে আবার থামল আহমদ মুসা। বলল পরক্ষণেই, ‘তুমি হবে তাঁর এবং আমার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী। এ ক্ষেত্রে কোন টেলিফোন-মোবাইল ব্যবহার করা যাবে না। সব কাজ তোমাকে অত্যন্ত গোপনে করতে হবে। মনে রেখ, সাবধান না হলে জীবনের উপর ঝুঁকিও আসতে পারে। অবশ্য সিদ্ধান্ত তোমার, তুমি এই অবস্থায় আমাদের সহযোগিতা করবে কি না?’
দাউদ ইব্রাহিম আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল। তার চোখে-মুখে একটা গৌরব ও খুশির ভাব ফুটে উঠেছিল। কিন্তু আহমদ মুসার শেষ কথায় তার খুশির ভাব উবে গেল, বেদনার ছায়া নামল তার চোখে-মুখে। বলল, ‘এটা আপনাদের কাজ, আমাদের নয়? আমরা কি আমেরিকার নাগরিক নই? এই কাজের জন্যে মাত্র ঝুঁকি কেন, জীবন বিসর্জন দিতে পারি, জনাব।’
‘ধন্যবাদ দাউদ ইব্রাহিম। তোমার কাছে আমি এটাই আশা করেছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জরুরি ও তাৎক্ষণিক যোগাযোগ ও সিদ্ধান্তের জন্যে বিশেষ অয়‍্যারলেস ব্যবহার করা যায় না?’ বলল মরিয়ম মারুফা।
‘না মারুফা। যে কোন ধরনের ইলেকট্রনিক মেসেজ মনিটর করার ব্যবস্থা ডেথ ভ্যালির শত্রুদের থাকতে পারে। যারা রিমোট কনট্রোলে সব রকম সমরাস্ত্র ধ্বংসের ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে পারে। তাদের এমন মেসেজ মনিটর ব্যবস্থা থাকতেই পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাদের অয়‍্যারলেস সেট ব্যবহার করা যায়। ওটার ট্রান্সমিশন তো ধরা পড়ে না।’ বলল মারুফা।
‘সেটা ঠিক। কিন্তু সেই ট্রান্সমিশন যেখানে রিসিভ করা হবে, সেখানে এটা নানা অফিসিয়াল মনিটরে ধরা পড়তে পারে। সেটা হতে দেয়া যাবে না। আমি বেঁচে আছি কি না, আমার সাথে আমেরিকা-সরকারের যোগাযোগ আছে কি না, তা জানার জন্যে হোয়াইট হাউজসহ সব গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানে চোখ ও কান রাখা হয়েছে। সুতরাং সবদিক দিয়েই ইলেকট্রনিক যোগাযোগ বন্ধ রাখতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
বলে আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে থামল। একটু সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘আর সময় নষ্ট করা যায় না। আপনারা বাসায় ফিরে যান। আমি ডেথ ভ্যালির চারদিকটা একটু ঘুরে দেখব।’
আহমদ মুসা থামতেই দাউদ ইব্রাহিম বলল, ‘আমি কি আপনার সাথে যেতে পারি না?’
‘না, দাউদ ইব্রাহিম। এসব একক কাজ। যত নীরবে করা যায় ততই মঙ্গল। শোন, এখান থেকে দেড়-দু’কিলোমিটার দূরে ডেথ ভ্যালির দক্ষিণ প্রান্তের মাঝামাঝি জায়গায় পাহাড়ের গোড়ায় একটা টিলা আছে। ঠিক টিলার মাথায় একটা স্কারলেট ওক গাছ আছে। চারদিকে সবগুলোই হোয়াইট ওক, মাত্র এই একটাই স্কারলেট ওক গাছ। সেই গাছের তলায় তুমি শহর থেকে ফেরার পর প্রতিদিন একবার করে যাবে। আমার কোন নির্দেশ থাকলে সেখানেই পাবে। গাছের তলায় ওক গাছের পশ্চিম পাশে কোন এক পাথরের তলায় একটা চিরকুটে সেটা লেখা থাকবে। পাথরটা অবশ্যই একটু অসাধারণ হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি কি ওক গাছের ওখানে গেছেন স্যার?’ জিজ্ঞাসা মারুফার।
তার চোখে-মুখে বিস্ময়!
‘না যাইনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘যাননি? তাহলে গাছের এমন প্রত্যক্ষদর্শীয় বর্ণনা কিভাবে দিলেন?’ বলল মারুফা।
‘ওটা আমার কৃতিত্ব নয়, গুগলে এসব সম্পর্কে আমি আগে দেখেছি।’
আহমদ মুসা বলল।
মারুফা কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই দাউদ ইব্রাহিম বলল, ‘শহরে আমাকে কখন যেতে হবে জনাব?’
‘হ্যাঁ, এখনি আমি একটা চিরকুট লিখে দিচ্ছি। তুমি বরং এখান থেকেই চলে যাও। এদিক হয়ে নতুন পথটা তোমার চেনাও দরকার।’
বলে আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে কাগজ ও কলম নিয়ে লিখতে বসল। আর দাউদ ইব্রাহিমরা সুড়ঙ্গ পথে ঢুকে সবকিছু আর একবার দেখা শুরু করল। দাউদ ইব্রাহিম বলল, ‘বাবা, আমাকে এখন তো এ পথেই যাতায়াত করতে হবে।’
লেখা হলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
সুড়ঙ্গ থেকে দাউদ ইব্রাহিমরাও ফিরে এসেছে।
আহমদ মুসা চিরকুটটা দাউদ ইব্রাহিমের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘খুব সাবধান! এই চিঠি এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন ছাড়া তার অফিসের আর কাউকে দেয়া যাবে না। অফিসে তার সাথে দেখা করা বিপজ্জনক হতে পারে। তার বাসায় তার সাথে দেখা করাই ভালো। চিরকুটের সাথে অন্য একটা কাগজে তার বাড়িতে যাওয়ার পথ এঁকে দিয়েছি। পারবে যেতে? জর্জ আব্রাহাম জনসন লাঞ্চের জন্যে উঠেন বেলা সাড়ে এগারোটায়। বাড়ির গেটে পৌছেন সোয়া বারোটায়। তুমি তার আগেই সেখানে পৌছবে। গার্ডরা ঢুকতে দেবে না। তুমি বলবে, আমি স্যারের সাথে কথা বলতে চাই। আমি যে কোন শর্ত মেনে তার সাথে দেখা করতে রাজী আছি। যাহোক, তোমাকে যেভাবেই হোক দেখা তার সাথে করতেই হবে।’
একটু থামল আহমদ মুসা। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘আগামী কাল বেলা দশটায় অথবা তিনটায় স্কারলেট ওক গাছের তলায় যাবে। তারপর ওখানকার সব সংবাদ লিখে পাথর চাপা দিয়ে রাখবে। প্রতিদিন এ সময় তোমাকে ঐ ওক গাছতলায় যেতে হবে। তখন আমার সাথে দেখাও হবে ইনশাআল্লাহ। যদি কখনো তুমি দেখ যে, তোমার রাখা কাগজ আমি পাথরের তলা থেকে নেইনি, তাহলে বুঝবে আমি কিছুতে ব্যস্ত আছি অথবা আমি কোন বিপদে পড়েছি। সে ক্ষেত্রে তুমি প্রতিদিন অন্তত একবার ঠিক সময়ে গাছের তলায় আসবে।’
একটু থামল আহমদ মুসা। পরমুহূর্তেই আবার বলল, ‘তোমাকে এখানে আসা-যাওয়ার কাজটা মেষপালকের ছদ্মবেশে করতে হবে। ছোট-খাটো একটা মেষের পাল তো তোমাদের রয়েছেই।’ থামল আহমদ মুসা।
‘আপনার কি ধরনের বিপদ হতে পারে? সেক্ষেত্রে আমাদের উপর নির্দেশ কি?’ আহমদ মুসা থামতেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল মরিয়ম মারুফা।
‘হ্যাঁ জনাব, আমিও এই কথাটাই বলব ভাবছিলাম।’ নূর ইউসুফ বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘কিছুই করতে হবে না দোয়া ছাড়া। একটা কাজ, দাউদ ইব্রাহিম প্রতিদিন ঐ গাছতলায় একবার যেন যায়।’
‘অবশ্যই তা হবে জনাব। কিন্তু একটা কথা, যদি তেমন কিছু ঘটে, তাহলে আমরা খোঁজ করতে যেতে পারব না?’ বলল দাউদ ইব্রাহিম।
‘গিয়ে কিছু লাভ হবে না। শত্রুপক্ষ এতটাই শক্তিশালী যে, তোমাদের বিপদ বাড়ানো ছাড়া আর কোন লাভ হবে না।’
‘এমন শত্রুর মোকাবিলায় আপনি একা যাবেন কেন তাহলে?’ বলল মরিয়ম মারুফা।
‘আমি এ শত্রুদের চিনি। তাই তাদের মোকাবিলা করার পথ আমার কিছুটা হলেও জানা আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমার সন্ধানে কেউ বেরিয়েছে এটা জানতে পারলে ওরা এর ভিন্ন অর্থ করতে পারে। তারা ধরে নেবে মার্কিন সরকারের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে এবং তোমরা তাদেরই লোক। সেক্ষেত্রে তারা ভীত হয়ে তাদের ভয়ানক অস্ত্র ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভ, মার্কিন অস্ত্রভাণ্ডার ধ্বংসের জন্যে ব্যবহার করে বসতে পারে। এটা আমরা তাদের করতে দিতে পারি না।’
‘ঠিক আছে স্যার, তাই হবে। আমরা বুঝতে পারছি।’ বলল নূর ইউসুফ, দাউদ ইব্রাহিমের মত তারও চোখে-মুখে উদ্বেগের ছাপ।
‘ধন্যবাদ সকলকে। আমি যাত্রা শুরু করতে চাই।’ বলে ছোট ব্যাগটা পিঠের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আর একটা কথা, সুড়ঙ্গ পথের মুখের পাথরটা খোলাই থাকবে। কারণ ওপার থেকে পাথরটা বন্ধ করা যায় না। আসলে ওপারে পাহাড় খোদাই করে ঘরগুলো তৈরি হয়েছিল ধনভাণ্ডার সংরক্ষণের জন্যে। ওখানে মানুষ থাকত না। যখন ধন-সম্পদ দেখার জন্যে কিংবা রাখার প্রয়োজন হতো তখন একাধিক লোক সেখানে যেত। তাদের কেউ যখন ধনভাণ্ডারে যেত, তখন অন্য কেউ সুড়ঙ্গ মুখ বন্ধ করে এপাশে আড়ালে কোথাও অপেক্ষা করত। এখন দু’পাশে লোক রাখা যাচ্ছে না বলে সুড়ঙ্গ মুখ বন্ধ করার দরকার নেই।’
একটু থেমে আহমদ মুসা নূর ইউসুফদের লক্ষ্য করে বলল, ‘সবাই সাবধান থাকবেন। আমি আসি, আস্সালামু আলাইকুম।’
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল।
নূর ইউসুফদের সবার দৃষ্টি আহমদ মুসার যাত্রাপথের দিকে। সবাই বাকহীন, নীরব।
এক সময় নীরবতা ভেঙে দাউদ ইব্রাহিম বলল, ‘বাবা, আমিও এখন যাত্রা করতে চাই।’
‘হ্যাঁ, আব্রাহাম জনসনের সাথে দেখা করাটা খুবই জরুরি। যাও তুমি। একটা কথা, গুপ্তধনের ব্যাপারটা আমাকে চিন্তিত করছে।’
‘কেন?’ বলল দাউদ ইব্রাহিম।
‘যেভাবেই হোক, ওখানে থাকার সুবাদে আমরা গুপ্তধনের পাহারাদার হয়েছি।’ নূর ইউসুফ বলল।
‘চিন্তার কিছু নেই বাবা। এ সম্পদের আর কোন ক্ষতির আশংকা নেই। আহমদ মুসা এলে তিনিই বিষয়টা দেখবেন এবং ব্যবস্থাও নেবেন।’ বলল দাউদ ইব্রাহিম।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমিও তাই চাই।’ নূর ইউসুফ বলল।
‘তাহলে আমি আসি বাবা। তোমরা সাবধানে থেকো। আস্সালামু আলাইকুম।’
বলে দাউদ ইব্রাহিম ঘুরে দাঁড়িয়ে বিসমিল্লাহ বলে সামনের দিকে পা বাড়াল।

Top