১
‘আমার মনে হয় জোসেফাইন, তুমি আবেগ নিয়ে বিষয়টাকে দেখছ। কিন্তু বিষয়টা আবেগের নয়। আমার জীবন, তোমার জীবন, সারার জীবন, এমনকি আমাদের আহমদ আব্দুল্লাহর জীবনও এর সাথে জড়িত। সুতরাং বিষয়টা নিয়ে তোমাকে ধীরস্থিরভাবে ভাবতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা শুয়েছিল।
জোসেফাইন বসেছিল আহমদ মুসার মাথার কাছে।
জোসেফাইনের ডান হাতটা আহমদ মুসার মুঠোর মধ্যে। আহমদ মুসার দিকে জোসেফাইন তাকিয়েছিল পলকহীন চোখে।
আহমদ মুসার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে উঠল জোসেফাইনের মুখ। সে হাত ছাড়িয়ে নিল আহমদ মুসার হাত থেকে। বলল, ‘তুমি আমার চিন্তা, আমার কথাকে আবেগ বলছ? বরং আমার মনে হয়, তুমিই আবেগ থেকে কথা বলছ। আমার চিন্তা হঠাৎ আবেগপ্রসূত নয়। আমি দীর্ঘ দিন ভেবেছি এ বিষয়টা নিয়ে। মনে আছে তোমার, আমি ইস্তাম্বুলে তোপকাপি প্রাসাদে অবস্থানকালে তোমাকে বলেছিলাম আমাকে আমেরিকা সফরের অনুমতি দেয়ার জন্যে। তারও আগে থেকে আমার এই চিন্তার শুরু। আমি একজন মেয়ের মন নিয়ে, তোমার স্ত্রীর মন নিয়ে, সারাকে নিয়ে অনেক ভেবেছি। অনেক ভাবনার ফল আমার এই সিদ্ধান্ত। একে তুমি আবেগপ্রসূত বলে আমার প্রতি অবিচার করতে পার না।’
আহমদ মুসার মুখও গম্ভীর হয়ে উঠেছে। জোসেফাইনের হাত আবার হাতে নিয়ে বলল, ‘আমার আবেগপ্রসূত বলার অর্থ এই নয় যে, তুমি কথাটা হঠাৎ বলছ কিংবা চিন্তা না করে বলছ। আবেগপ্রসূত বলেছি কারণ, গোটা বিষয়টা তোমার জন্যে আবেগের। একজন বান্ধবীর সাথে তোমার সম্পর্কের বা সে রকম একজন মেয়ের সাথে আমার সম্পর্কের বিষয়টা আবেগেরই হওয়ার কথা। এমন ক্ষেত্রে আবেগপ্রবণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তোমার, আমার এটা কোন দোষ নয়। কিন্তু তুমি যে চিন্তা করছ, যে কথা তুমি বলছ, তা অপ্রয়োজনীয়, অন্যায় ও অস্বাভাবিক জোসেফাইন।’
‘অপ্রয়োজনীয়? অন্যায়? অস্বাভাবিক? এটা কি চিন্তা করে বলছ? তুমি আহমদ মুসা, এ কথা তুমি কি করে বলতে পার? অন্যায়ের প্রতিকারের জন্যে যে বিপদের সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যে মানুষের অশ্রু মোছানোর জন্যে নিজের দুঃখ-কষ্টের কথা সামান্যও ভাবে না, সেই আহমদ মুসা এটা কিভাবে বলতে পারে? তুমি সারা দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কথা ভাব, সারার কথা কোন দিন ভেবেছ তুমি?’ বলল জোসেফাইন। জোসেফাইনের কণ্ঠ ভারি।
‘স্যরি জোসেফাইন। পৃথিবীর দুঃখী মানুষের কাতারে তুমি জেফারসন পরিবারের সন্তান সারাকে রাখছ কি করে?’ বলল আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না জোসেফাইন। তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে স্তম্ভিত দৃষ্টি। জোসেফাইন হাত দিয়ে আহমদ মুসার মুখ একটু তুলে ধরল। আহমদ মুসার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘তুমি এ কথা বলতে পারলে? এত নিষ্ঠুর হতে পারলে সারা জেফারসনের প্রতি?’
তুলনাটা করে আহমদ মুসাও একটু বিব্রত হয়েছিল। এভাবে তুলনা করা ঠিক হয়নি, আহমদ মুসাও এটা উপলব্ধি করল। জোসেফাইনের চিন্তার প্রতি কঠোর হতে গিয়েই আহমদ মুসা এটা বলেছে।
আহমদ মুসা যখন এসব ভাবছিল, তখন নীরবতা ভেঙে জোসেফাইনই কথা বলল, ‘শান্তি ও সুখ এক জিনিস নয় আহমদ মুসা। যেমন এক নয় অশান্তি ও কষ্ট। সারার মতো প্রথম শ্রেণীর নাগরিকরা শান্তিতে থাকতে পারে, কিন্তু এই শান্তি তাদের সুখ নিশ্চিত করে না। তুমি সারার শান্তি দেখেছ, তার কষ্টটা দেখনি, তার কান্না দেখনি।’ জোসেফাইনের কণ্ঠ অশ্রুরুদ্ধ। ঝর ঝর করে তার দু’চোখ থেকে নেমে এসেছে অশ্রু।
‘স্যরি জোসেফাইন, এভাবে বলো না। তুলনাটা হঠাৎ হয়ে গেছে। আমি সেটা মিন করিনি।’ বলল আহমদ মুসা। তার নরম কণ্ঠ। গলা ভারি।
জোসেফাইন চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘তুমি সারাকে আমার চেয়ে বেশি চেন। সারার মতো মেয়েরা নীরব কান্না, বিদীর্ণ অন্তর নিয়ে শেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু এরা মুখ খোলে না। সেই যে তোমাকে দেখা না দিয়ে পালিয়ে যাবার আগে চিঠি লিখেছিল, তারপর কি সে তোমার সামনে এসেছে? আসেনি। সে শেষ হয়ে যাচ্ছে, যাবে, কিন্তু তোমাকে কিংবা কাউকে কিছুই জানতে দেবে না। তার প্রতি কোন অবিচার, আমি বলছি, আল্লাহ সইবে না।’
উত্তরে আহমদ মুসা কিছুই বলল না।
জোসেফাইনের একটা হাত হাতে নিয়ে শূন্যে তাকিয়ে চুপ করে রইল।
এক সময় সে চোখ ফিরিয়ে তাকাল জোসেফাইনের দিকে। বলল ধীরে ধীরে, ‘হ্যাঁ জোসেফাইন, সারাকে আমি চিনি। তাকে নিয়ে আমার কোন কথা নেই। আমার কথা তোমার অস্বাভাবিক চিন্তা নিয়ে।’
‘আমার চিন্তাকে অস্বাভাবিক বলছ কেন? স্বয়ং আল্লাহ যা হালাল করেছেন, তা অস্বাভাবিক হয় কি করে?’ জোসেফাইন বলল।
‘হালাল করেছেন, কর্তব্য বলেননি। বিষয়টা বান্দাদের এখতিয়ারে ছেড়ে দিয়েছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে, বান্দার এখতিয়ারে ছেড়ে দিয়েছেন, কর্তব্য বলে অভিহিত করেননি। কিন্তু হালাল করেছেন কেন?’ জোসেফাইন বলল।
‘এর প্রয়োজন দেখা দিতে পারে, এজন্যে হালাল করেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার যে চিন্তাকে অস্বাভাবিক বলছ, তা কি প্রয়োজন থেকে উদ্ভুত নয়?’ জোসেফাইন বলল।
‘প্রয়োজন সম্পর্কে ধারণা সবার এক রকম হয় না। এটা রিলেটিভ। ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিছু প্রয়োজন আছে সার্বজনীন। তা ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করে না, রিলেটিভ নয়। যে প্রয়োজন থেকে আমার চিন্তাটা এসেছে, তা সার্বজনীন একটা বিষয়। সব মানুষের ক্ষেত্রে তা একই রকম।’ জোসেফাইন বলল।
উত্তরে আহমদ মুসা কিছু বলল না। চোখ নামিয়ে নিল সে জোসেফাইনের চোখ থেকে। আহমদ মুসার চোখে-মুখে বিব্রত ভাব।
কথা বলল জোসেফাইন, ‘দেখ তোমাকে বুঝ দেবার ক্ষমতা আমার নেই, কোন বিষয়েই সঠিক বুঝের তোমার অভাব নেই অবশ্যই। শুধু কোন বিষয় আমি তোমার কাছে তুলে ধরতে পারি। আমি সেটাই করেছি।’ জোসেফাইনের কান্নাভেজা কণ্ঠ।
আহমদ মুসা জোসেফাইনের দুই হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘তুমি এভাবে কথা বলছ কেন জোসেফাইন? আমরা তো একে অন্যের অভিভাবক, পরিপূরক। আমি ভুল করলে তা শুধরাবার, কিছু না জানলে তা জানাবার, না বুঝলে তা বুঝাবার শুধু অধিকার নয়, দায়িত্বও তোমার।’
‘ধন্যবাদ।’
বলে জোসেফাইন একটু ক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘তুমি কি সারার জীবন নিয়ে ভেবেছ কোন সময়?’
‘স্যরি, ভাবিনি জোসেফাইন। এ ধরনের ভাবনা আমার কাছে অন্যায় মনে হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাবা অন্যায় হবে কেন? একজন মানুষ তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছে, তার বিষয়ে ভাবা অন্যায় হবে কেন?’ জোসেফাইন বলল।
‘বিষয়টা নিয়ে এমন ঘনিষ্ঠভাবে আমি ভাবিনি। ভাববার প্রয়োজনও মনে হয়নি। কারও প্রতি দুর্বল হয়ে পড়া, কাউকে ভালোবাসা সব সমাজেরই একটা সাধারণ দৃশ্য। আবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজের দুর্বলতা, ভালোবাসা থেকে সরে আসার ঘটনা কোন সমাজেই দুর্লভ নয়। এজন্যেই আমি তার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছি, সেও আমার থেকে দূরে সরে থেকেছে। আমি নিশ্চিত ভেবেছি, এভাবেই সে সব ভুলে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘একটা সম্ভাব্য রেজাল্ট তুমি ধরে নিয়ে বসে আছ। এদিকে কি ঘটেছে জান না। সে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সরে যাবার জন্যে, সব ভুলে যাবার জন্যে। কিন্তু সে পারেনি। পারেনি, একথা সে কাউকে জানতে দেয়নি, দিচ্ছেও না। এমনকি তার মা’কেও না। দেখতে সে নীরব, শান্ত। কিন্তু ভেতরে তার অগ্নিগিরির জ্বালা। দেশে থাকতে আমি এতটা ভাবিনি। এখানে এসে তার সাথে মিশেও তা বুঝিনি। সে পাথরের মতো শক্ত ও শান্ত। ধীরে ধীরে নানা কথায় নানাভাবে তার মায়ের মুখ খুলতে পেরেছি। সারার অলক্ষ্যে সারার কিছু বিষয় তিনি দেখেছেন। সে সব কাহিনী বলতে গিয়ে তিনিও কেঁদেছেন, আমিও কেঁদেছি। আর তুমি ভালো করেই জান, দূরে সরে যেতে, ভুলে যেতে অনেক মেয়েই পারে, সব মেয়ে পারে না। সারার মতো মেয়েরা তো পারেই না। সুতরাং তুমি যে আশা করেছিলে, তা তার ক্ষেত্রে সফল হয়নি, সফল হবারও নয়।’ জোসেফাইন লল।
‘জোসেফাইন, সারার যে বিষয় তুমি তুলে ধরলে তা তোমাকে কত কষ্ট দিয়েছে জানি না, কিন্তু আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে। খুব ভালো মেয়ে সারা। তার এ অবস্থার জন্য আমি দায়ী। কিন্তু আমি কি করব তার জন্যে? তুমি এমন জীবনের কথা বললে, তেমন জীবনের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। আমি অমন জীবনের জন্যে প্রস্তুত নই জোসেফাইন।’ বলল আহমদ মুসা।
তার কণ্ঠ নরম, ভেজা। যেন অশ্রু সাগর পেরিয়ে এসেছে।
‘তাহলে সারার কি হবে? সে কি এভাবে তিল তিল করে শেষ হয়ে যাবে? একটা জীবনকে বাঁচানোর চাইতে বড় প্রয়োজন আর কি আছে? এমন প্রয়োজন সামনে রেখেই তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন একাধিক বিয়ে হালাল করেছেন। এই প্রয়োজনের দাবি তুমি অস্বীকার করবে কেন?’ বলল জোসেফাইন।
‘আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না জোসেফাইন। কোন জবাব আমার কাছে নেই।’
থামল আহমদ মুসা। একটু ভাবল। বলল, ‘জোসেফাইন, সারার মাকে তুমি কিছু বলেছ?’
‘হ্যাঁ বলেছি।’ জোসেফাইন বলল।
‘কি বলেছ?’
জোসেফাইন আহমদ মুসার চোখে চোখ রাখল। বলল, ‘অভয় দাও তো বলতে পারি।’
‘কি অভয়?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি বকবে না তো আমাকে?’ জোসেফাইন বলল।
‘তোমাকে কখনও বকেছি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না, বকনি। কিন্তু এবার বকুনি খাবার কাজ করেছি।’জোসেফাইন বলল।
‘বকুনি খাবার মতো কাজ করলে কেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তোমার উপর আমার আস্থা আছে।’ জোসেফাইন বলল।
‘তাহলে বকুনির ভয় কেন, বল?’ বলল আহমদ মুসা।
জোসেফাইন একটু ভাবল। কথা বোধ হয় গুছিয়ে নিল। বলল, ‘আমি তাঁকে সুযোগ মতো সরাসরি বলেছি, আমি সারাকে নিয়ে যেতে এসেছি। তিনি শুনে অনেকক্ষণ চুপ থেকেছেন। তারপর কেঁদেছেন? সারার কথা বলতে গিয়ে আরও কেঁদেছেন। বলেছেন, ইসলাম ধর্মে একাধিক বিয়ে আছে। মুসলিম সমাজে তা প্রচলিতও আছে। কিন্তু সারা ভিন্ন প্রকৃতির মেয়ে। সে ভাঙে কিন্তু মচকায় না। তিনি জানালেন, প্রেসিডেন্টের পরামর্শে জর্জ আব্রাহাম জনসন একবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এই বিয়ের ব্যাপারে সারাকে বলতে। কিন্তু অবশেষে তিনি সাহস পাননি। মা আমার কেঁদে কেঁদেই শেষ হয়ে যাবে, কাউকে জানতেও দেবে না, বলবেও না কিছু। কেঁদে কেঁদে এসব কথা বলেছিলেন সারার মা। এসবই কথায় কথায় হয়েছিল সারার মায়ের সাথে।’ জোসেফাইন বলল।
‘সারাকে এসব কথা তুমি নিশ্চয় বলেছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি এত সব আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন? তোমার জবাব জানতে চেয়েছি, সেটা তো বলছ না?’ জোসেফাইন বলল।
‘কারণ তুমি আমার স্ত্রী। তুমি কত দূর এগিয়েছ, সেটা আমার জানা দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সারার মাকে যা বলেছি, সারাকে আমি সরাসরি সেটাই বলেছি। বলেছি যে, আমি তাকে চিরদিনের জন্যে নিতে এসেছি।’ জোসেফাইন বলল।
‘ইন্না লিল্লাহ…। কথাটা আমার পক্ষ থেকে বলনি তো? মানে প্রস্তাবটা আমার পক্ষ থেকে হয়ে যায়নি তো?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি তা বলিনি, সে তা মনেও করেনি।’ জোসেফাইন বলল।
আহমদ মুসা কিছু বলল না।
‘জিজ্ঞাসা করলে না, সারা কি বলেছে?’ জোসেফাইন বলল।
‘সারার মায়ের কথা থেকে বুঝা যায় সারা কি বলতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না জনাব, সারার মা’র কথা থেকে তা বুঝা যায় না। বরং তোমার কথার সাথে সারার কথার মিল আছে। তুমি আমার চিন্তাকে বলেছ, ‘অস্বাভাবিক’ আর সে বলেছে, ‘অসম্ভব’। আর তোমার সাথে তার পার্থক্য হলো, একথা তোলায় সে কেঁদেছে বেশি, কথা বলেছে কম। আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, সারার ভবিষ্যত কি, সারার কি হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে সারা বলেছে, আমি জানি না। আর তুমি বলেছ, এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। দু’জনের একই উত্তর। এর অর্থ তোমরা দু’জনের কেউই সিদ্ধান্ত নেবার পর্যায়ে নেই। সিদ্ধান্ত তোমাদের বাইরে থেকে আসতে হবে।’
জোসেফাইন, যে বিবরণ তুমি দিলে তার অর্থ এও হতে পারে যে, আমি ও সারা দু’জনেই সময়ের বাস্তবতাকে মানতে চাচ্ছি। তুমি যে চিন্তা করছ, তা আমরা কেউ করছি না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তোমার কথা বলছি না। সারার কথা বলতে পারি, সে ভাবছে না তা নয়। না ভাবলে এত কাঁদছে কেন? কষ্ট নিয়েই তো কাঁদছে, তার জীবন নিয়েই তো কাঁদছে। ‘অসম্ভব’ বলে যে কথা বলেছে তা নেতিবাচক অর্থে নয়, অবাঞ্ছিত, অসহনীয় চলমান সামাজিক মানসিকতার অর্থে। এই মানসিকতার সে অসহায় শিকার।’ জোসেফাইন বলল।
‘অসম্ভব’ বলতে কি সারা এটুকুই বুঝিয়েছে জোসেফাইন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি ঠিকই ধরেছ। শুধু এটুকুই নয়, তার আরও কথা আছে। তোমার পারসোনাল ও প্রাইভেট লাইফে বিপর্যয় নামাতে সে চায় না। তুমি শুধুই আমার। আমার এই এক্সকুসিভ অধিকারে অন্যথা ঘটাতে সে রাজী নয়।’ বলল জোসেফাইন।
‘তার কোন্ কথাকে তুমি অস্বীকার কর জোসেফাইন?’ বলল আহমদ মুসা। গম্ভীর কণ্ঠ তার।
‘আমি সব কথাকেই অস্বীকার করেছি। একজনের পারসোনাল ও প্রাইভেট লাইফে বিপর্যয় আসে, যদি অবাঞ্ছিত কিছু ঘটে যায়। এটা অবাঞ্ছিত কিছু ঘটে যাওয়া নয়, বরং এটা একজনের জীবনকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা, একজনের জীবনকে সম্মান করা। আমাদের রাসুল (সা.) এর পরবর্তী বিয়েগুলো সব এই ধরনের। এর পর থাকে তোমার উপর আমার এক্সক্লুসিভ অধিকারে অন্যথা ঘটানোর প্রশ্ন। আমি তাকে বলেছি, অনেক নদী এক সাগরে গিয়ে পড়ে। কারই আশ্রয়ের অভাব হয় না। আহমদ মুসার হৃদয়টা সাগরের মতোই বড়। সেখানে আমাদের দু’জনের স্বাধীন অবস্থানের জন্যে জায়গার কোন অভাব হবে না। তোমাকে ভালোবাসার জন্যে আমার জন্যে তার যে ভালোবাসা তা থেকে কিছু কাটতে হবে না। তা কাটতে হয় না। আল্লাহ মানুষের মনকে এভাবেই তৈরি করেছেন। না হলে একাধিক বিয়ের অনুমতি আল্লাহ দিতেন না।’
জোসেফাইন বলল।
‘তুমি ঠিক বলেছ জোসেফাইন। আল্লাহ এভাবে মানুষের মন তৈরি করেছেন। যারা মন এভাবে রাখতে পারবে না, মানে যে একাধিক স্ত্রীকে সমানভাবে দেখতে পারবে না, তাদের একাধিক বিয়েতে নিষেধ করা হয়েছে। আমার মনেও এ আশঙ্কা আছে জোসেফাইন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি তর্কের খাতিরে, তর্কের জন্যেই একথা বলছ। তাই তোমার এ কথার জবাব আমি দেব না। শুধু তোমাকে তোমার মনকে জিজ্ঞাসা করতে বলব, সেখানে জোসেফাইনের পাশে সারার বসার জন্যে স্থানের অভাব ঘটবে কি না?’ জোসেফাইন বলল। আবেগে তার কণ্ঠ রুদ্ধ।
আহমদ মুসা কোন উত্তর দিল না। তার গম্ভীর মুখ আরও গম্ভীর হয়ে উঠল।
জোসেফাইনই আবার মুখ খুলেছিল কথা বলার জন্যে।
এ সময় দরজায় কয়েকটা দ্রুত নক হলো। সাধারণত এমন ‘নক’ হয় না। বিস্মিত জোসেফাইন দ্রুত এগোলো দরজার দিকে। দরজা খুলল।
দরজায় জিনা জেফারসন। সারার মা দাঁড়িয়ে।
জোসেফাইনকে দেখেই সে ভাঙা গলায় দ্রুত বলে উঠল, ‘মা জোসেফাইন, আমার সারা মা অ্যাকসিডেন্ট করেছে।’
‘অ্যাকসিডেন্ট করেছে? সারা? কোথায় সে এখন? কেমন আছে?’ আতংকের সুরে বলে উঠল জোসেফাইন। উদ্বেগে আচ্ছন্ন তার মুখ।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে এসে জোসেফাইনের পাশে দাঁড়াল। বলল, ‘কে জানাল? কোথায় সে মা?’
‘পেন্টাগন মিলিটারি হাসপাতাল থেকে কে একজন টেলিফোন করে জানাল।’ বলল সারার মা জিনা জেফারসন।
‘অ্যাকসিডেন্টের খবরের সাথে আর কিছু বলেনি?’ জোসেফাইন বলল।
জিনা জেফারসন কিছু বলার আগেই তার হাতের মোবাইল আবার বেজে উঠল।
কলটা ধরল জিনা জেফারসন।
কলটা ধরেই ওপারের কথা শুনে বলল। ‘হ্যাঁ, আহমদ মুসা আছে। আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।’
ওপারের কথা শুনে এবং কথা শেষ করেই মোবাইলটি আহমদ মুসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘জর্জ আব্রাহাম জনসন।’
আহমদ মুসা কল ধরে সালাম বিনিময়ের পর ওপারের কথা শুনল। মাঝে মধ্যে দু’একটা কথাও বলল। কল শেষ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা জিনা জেফারসন ও জোসেফাইনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘সারা জেফারসনের মাথার সামনে আঘাত লেগেছে। তার ডান হাত ও ডান কাঁধেও আঘাত’ লেগেছে। কিছুক্ষণের জন্যে সে সংজ্ঞা হারিয়েছিল। হাসপাতালে নেয়ার পর তার জ্ঞান ফিরেছে। ভার্জিনিয়া থেকে আসার সময় ওয়াশিংটনে ঢোকার পথে একটা গাড়ি তার গাড়িকে ধাক্কা দেয়। কমান্ডোদের গাড়ি তার পেছনে ছিল। তারাই তাকে হাসপাতালে নেয়। জর্জ আব্রাহাম জনসন হাসপাতালে যাচ্ছেন। আমাদের জন্যে সিকিউরিটি ফোর্সের গাড়ি আসছে।’
‘সারার তো বড় কোন ক্ষতি হয়নি?’ জোসেফাইন বলল। তার কম্পিত কণ্ঠস্বর।
‘পরীক্ষা নীরিক্ষা চলছে। ওর সংজ্ঞা ফিরেছে, বড় ধরনের কোন আশংকা নেই। এস আমরা প্রার্থনা করি, সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমিন।’ বলল জোসেফাইন ও জিনা জেফারসন একই সাথে।
‘আল হামদুলিল্লাহ। সারা তোমাকে আজ অনেক ফ্রেশ লাগছে। তোমার উপর দিয়ে বিরাট ধকল গেল।’ বলল জোসেফাইন।
সারা জেফারসনের মাথার কাছে চেয়ারে বসে আছে জোসেফাইন। তার একটা হাত সারা জেফারসনের মাথায়।
সারা জেফারসনের হাতে তখনও ব্যান্ডেজ। মাথার ব্যান্ডেজ খুলে ফেলা হয়েছে। তবে কপালের উপরের ক্ষতটার চিহ্ন এখনও তাজা। ক্ষতস্থানে একটা পেস্টিং ব্যান্ডেজ লাগানো আছে। কাঁধের আঘাতটায় ফ্র্যাকচার ছিল না। তা অনেকটাই সেরে উঠেছে। তবে ওপাশ ফিরে শোবার মতো এখনও হয়নি।
সারা জেফারসনকে মিলিটারি হাসপাতালে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তাকেও হাসপাতালের একটা স্যুটে রাখা হয়েছে। স্যুটে রোগীর কক্ষ ছাড়াও একটা অ্যাটেনড্যান্ট কক্ষ, একটা গেস্ট রুম, একটা ড্রইং রুম, ডাইনিং রুম ও ওয়াশ রুম রয়েছে।
সারার মা জিনা জেফারসন প্রতিদিনই হাসপাতালে একবার করে আসেন। কিন্তু জোসেফাইন সেই যে এসেছে আর ফিরে যায়নি। আহমদ মুসাকেও যেতে দেয়নি। আহমদ আব্দুল্লাহ তো রয়েছেই।
জোসেফাইনের কথা শুনে সারা জেফারসন তাকাল জোসেফাইনের দিকে। মাথা থেকে জোসেফাইনের হাত সে নিজের হাতে তুলে নিল। বলল, ‘ধকলটা আমার চেয়ে তোমার উপর দিয়েই বেশি গেল। আমি তো শুয়ে থেকেই খালাস। তুমি তো সবকিছুই দেখছ, সবকিছুতেই আছ। তোমাকে কি বলে প্রশংসা করব। কিছুই বলার আমার নেই।’
থামল সারা জেফারসন। তার দু’চোখের কোনায় অশ্রু এসে গেছে।
জোসেফাইন সারা জেফারসনের অশ্রু মুছে দিয়ে হেসে বলল, ‘আরেকজনের কথা বলছ না কেন? সেও তো আমার সাথে তোমার পাশেই সারাক্ষণ আছে?’
সারার মুখ লাল হয়ে উঠল।
একটু হাসল। বলল, ‘তুমি আছ বলেই তো উনি আছেন। সুতরাং কৃতিত্ব, প্রশংসা সব তোমার প্রাপ্য।’
জোসেফাইন সারার গাল টিপে দিয়ে বলল, ‘ওরে দুষ্টু। তবু ধরা দেবে না। আমি থাকলেই কি উনি থাকেন? জান, তোমার মাথার আঘাত নিয়ে উনি কি ভীষণ উদ্বেগে ছিলেন?’
‘আপা উনি তো সকলের, সব মানুষের। সব দুর্গত মানুষের পাশেই উনি ছুটে যান।’ সারা জেফারসন বলল।
জোসেফাইন সারা জেফারসনের চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। বলল সে ধীর কণ্ঠে, ‘সারা, এই তুলনা কি তোমার ঠিক হলো? আর দশ জায়গায় যাওয়ার সাথে এখানে তাঁর আসাকে এক করে দেখলে?’
সারা জেফারসন কিছু বলল না। চোখ বুজল। মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে।
জোসেফাইন হাসল। সারা জেফারসনের মুখ ঘুরিয়ে নিল সে নিজের দিকে। বলল, ‘তাকাও আমার দিকে সারা।’
সারা জেফারসন চোখ খুলল।
সারা জেফারসনের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু খসে পড়ল, গড়িয়ে এল গণ্ড বেয়ে। বলল, ‘আপা, এত দিন ওঁকে রেখেছেন। ওঁকে কষ্ট দিচ্ছেন কেন? ওঁর সময় কত মূল্যবান? আমার ভাবতেও খারাপ লাগছে, আমার কারণে তিনি এভাবে আছেন।’ কথাগুলো বলল সারা চোখ নামিয়ে রেখে।
জোসেফাইন সারা জেফারসনের মুখ উপরে তুলে নিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘এসব পোশাকি কথা বলেবে না সারা। তোমাকে আমি জানি। বল, এখনি যদি আহমদ মুসাকে আমি বলি, চলে যাও! তুমি খুশি হবে?’
আবার চোখ বুজল সারা জেফারসন। চোখ ভরে গেছে তার অশ্রুতে। বন্ধ চোখের বাধা ডিঙিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তার অশ্রু। বালিশ থেকে মাথা একটু সামনে ঝুঁকিয়ে এনে জোসেফাইনের হাত জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘এসব প্রশ্ন আমাকে করো না আপা। জান তুমি, এসব প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব না, জিজ্ঞাসা আমাকে করো না আমার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত আপা। অ্যাকসিডেন্টও আমাকে বাঁচিয়ে রেখে গেল, মরতে পারলে বোধ হয় ভালো হতো। কি করব আমি!’
জোসেফাইন চেয়ার থেকে উঠে সারা জেফারসনের মাথার কাছে বসল। মাথাটা কোলে টেনে নিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বলল, ‘সারা, তুমি তোমার আত্মার আহ্বানকে বহিরাগত চিন্তা দিয়ে দমিয়ে রাখতে চাইছ।
তা করো না সারা। আত্মার আহ্বানকে তুমি শোন।’
উত্তরে সারা কিছু বলল না। সে জোসেফাইনের হাত আরও জোরে চেপে ধরল।
‘তোমার ওর সাথে কথা বলা উচিত।’ সারার কানে কানে বলল জোসেফাইন।
‘আমাকে বিপদে ফেলো না আপা।’ সারা জেফারসন বলল।
‘এমন সরাসারি আলোচনায় দোষ নেই সারা। তোমাদের মধ্যে একবার অন্তত এভাবে কথা হওয়া উচিত।’ বলল জোসেফাইন।
জোসেফাইনের কথা শেষ হতেই দরজায় নক হলো।
‘উনি এসেছেন।’ বলে জোসেফাইন তাড়াতাড়ি সারার গায়ে চাদর টেনে দিল। মাথার উড়নাটাও কপাল পর্যন্ত নিয়ে এল। নিজের মাথাতেও চাদর টেনে নিল জোসেফাইন।
‘এস।’ বলল জোসেফাইন।
আহমদ মুসা কক্ষে প্রবেশ করল এবং সালাম দিল।
‘তোমার অপেক্ষা করছি।’ বলল জোসেফাইন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘কেন? কোন জরুরি কিছু? সারা ভালো আছে?’ এক নিশ্বাসে এতগুলো প্রশ্ন করে চুপ করল আহমদ মুসা।
হাসল জোসেফাইন। বলল, ‘এতো উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই।’
একটু থামল জোসেফাইন। তারপর আবার বলল, ‘আহমদ আব্দুল্লাহ কোথায়? গোসল ও খাওয়ার সময় ওর পার হয়ে যাচ্ছে।’
জবাব দেবার প্রয়োজন হলো না আহমদ মুসার।
আহমদ আব্দুল্লাহ দৌড়ে এসে প্রবেশ করল কক্ষে।
‘কোথায় গিয়েছিলে আহমদ আব্দুল্লাহ?’ জোসেফইন বলল।
‘ঐ তো আম্মা, চিলড্রেন কর্নারে।’ বলল আহমদ আব্দুল্লাহ।
‘ঠিক আছে বেটা। বলে গেলে ভালো হতো।’ জোসেফাইন বলল।
‘বলে গেছি তো, মাম্মিকে।’ বলল আহমদ আব্দুল্লাহ।
‘ঠিক, আমাকে বলে গেছে আপা, ভুলে গেছি তোমাকে বলতে।’
জোসেফাইন আহমদ আব্দুল্লাহকে কাছে টেনে নিয়ে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ বেটা। এখন চল গোসল করতে হবে, খেতে হবে।’
‘চলুন আম্মি। আমি মাম্মিকে একটা কথা বলে আসি।’ বলল আহমদ
আব্দুল্লাহ।
‘আচ্ছা!’ বলে হেসে উঠে দাঁড়াল জোসেফাইন।
আহমদ আব্দুল্লাহ চেয়ারে পা দিয়ে সারা জেফারসনের বেডে উঠে তার মাথার কাছে বসল। পকেট থেকে চকলেটবার বের করে ফিসফিস করে সারা জেফারসনকে বলল, ‘মাম্মি, এই চকলেটবারটি তুমি রাখ। ডাক্তার যেন না দেখে। ওরা তোমাকে তো চকলেট দেয় না। তুমি চুপে চুপে এটা খেয়ে নিও।’
হেসে উঠল সারা জেফারসন। আহমদ আব্দুল্লাহকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘খেয়ে নেব বাবা। তুমি দিলে না খেয়ে আমি পারি।’
আহমদ মুসা ও জোসেফাইন মুখ টিপে হাসছে।
আহমদ মুসা বলল, ‘বেটা আহমদ আব্দুল্লাহ, চকলেটবার আমাদের জন্যে নেই?’
‘মাম্মি অসুস্থ। তোমরা তো অসুস্থ নও বাবা। মাম্মি চকলেট পছন্দ করে। অনেক দিন হলো কেউ তাকে দেয়নি।’ বলল আহমদ আব্দুল্লাহ।
‘তোমাকে বলেছে বুঝি?’ জোসেফাইন বলল
‘আজই তো বলেছে।’ বলল আহমদ আব্দুল্লাহ।
সারা জেফারসনের চোখে-মুখে বিব্রতভাব ফুটে উঠেছে। সে চাদর টেনে নিল মুখের উপর।
হেসে উঠল আহমদ মুসা ও জোসেফাইন। বলল জোসেফাইন হাসতে হাসতে, ‘আহমদ আব্দুল্লাহ তোমার মাম্মির সিক্রেট ফাঁস করে দিলে? আমার তো চোখে পড়েনি তার চকলেট প্রীতির কথা? তুমি জানলে কি করে?’
‘কেন, মাম্মি তো সব সময় আমাকে সাথে নিয়ে চকলেট খায়।’ বলল আহমদ আব্দুল্লাহ।
সারা মুখ থেকে চাদর সরিয়ে নিয়ে ‘আহমদ আব্দুল্লাহ!’ বলে ধরতে গেল তাকে।
আহমদ আব্দুল্লাহ ‘না’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে লাফ দিল বেড থেকে।
মেঝেতে পড়েই আহমদ আব্দুল্লাহ ‘আহ!’ বলে কঁকিয়ে উঠল।
‘আহমদ আব্দুল্লাহ!’ বলে চিৎকার করে উঠে সারা জেফারসন মাথা তুলে ঝুঁকে পড়তে গেল বেডের পাশে। পারল না অতদূর মাথা নিতে। তার আগেই ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল সারা জেফারসন। তার মাথাটা বালিশের উপর পড়ে গেল।
আহমদ আব্দুল্লাহর দিকে ছুটে গিয়েছিল জোসেফাইন।
আহমদ মুসাও ছুটে এল জেফারসনকে ধরতে।
জোসেফাইন পাঁজাকোলা করে আহমদ আব্দুল্লাহকে কোলে তুলে নিয়েছে। দেখতে লাগল ব্যথা কোথায় লেগেছে।
আহমদ আব্দুল্লাহ থেমে গেছে। সে বলছে, ‘পায়ে লেগেছিল, এখন আর ব্যথা নেই।’
ওদিকে আহমদ মুসা সারা জেফারসনের ডান কাঁধ ও মাথা ধরে আস্তে করে বালিশের উপর শুইয়ে দিল। আলগা হয়ে পড়া গায়ের চাদর ঠিক করে দিল।
সারা চোখ বুজে ছিল।
আহমদ মুসা বলল, ‘মিস সারা, কাঁধের যন্ত্রণাটা বাড়ছে, না কমছে? হাতের আঘাতটায় কোন চাপ লাগেনি তো?’
‘ধন্যবাদ! হঠাৎ ওঠায় ব্যথা লেগেছিল। এখন কমে যাচ্ছে। হাত ঠিক আছে।’.
বলেই চোখ খুলে তাকাল সারা জেফারসন জোসেফাইনের দিকে। বলল, ‘স্যরি আপা, ওভাবে ওকে ধরতে যাওয়া ঠিক হয়নি। দুষ্টু যে এখান থেকে লাফ দিতে পারে, বুঝতে পারিনি।’
‘তুমি এ নিয়ে ভেবো না সারা। ওর কিছু হয়নি। পা’টা একটু বাঁকা হয়ে পড়ায় একটু ব্যথা পেয়েছে। তা সঙ্গে সঙ্গেই সেরে গেছে। তবে তোমার ওভাবে উঠে পড়া ঠিক হয়নি।’ জোসেফাইন বলল।
‘কখন যে এভাবে উঠেছি, বুঝতে পারিনি আপা।’ সারা জেফারসন বলল। তার মুখে ম্লান হাসি।
জোসেফাইন আহমদ আব্দুল্লাহকে কোল থেকে নামিয়ে বলল, ‘চল এখন গোসলে যেতে হবে।’
জোসেফাইন সারার কাছে গিয়ে তার মাথার স্কার্ফ ঠিক করে দিয়ে ওড়নাও ভালো করে মাথায় টেনে দিল। বলল, ‘কম্বলটাও কি আরেকটু টেনে দেব গায়ে?’
‘দাও আপা।’ সারা জেফারসন বলল।
কম্বল সারার কোমর পর্যন্ত টেনে দিল। জোসেফাইন গেল আহমদ মুসার কাছে। বলল, ‘আমি আহমদ আব্দুল্লাহকে গোসল করিয়ে খাইয়ে আসছি। তুমি একটু বস এখানে। নার্সও পাশেই তার কেবিনে আছে।’
‘আচ্ছা এস।’ বলল আহমদ মুসা।
যাবার জন্যে পা বাড়িয়েও ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘টেবিলে সারার মোবাইলটা আছে। ওদিকেও একটু দেখো। মাঝে মাঝে টেলিফোন আসে।’
‘টেলিফোন এলে কি স্যরি বলব, না মিস সারাকে দিতে হবে?’ বলল আহমদ মুসা।
হাসল জোসেফাইন। বলল, ‘সারার কাছে কোন অপ্রয়োজনীয় টেলিফোন আসে না। স্যরি বলবে কেন?’
‘কি নিয়ম তোমাদের, আমি কি টেলিফোন ধরে মিস সারাকে দেব, না রিং অবস্থায় দেব।’ বলল আহমদ মুসা নিচু কণ্ঠে।
হাসল জোসেফাইন। বলল, ‘আমাকে দেরি করানোর চেষ্টা করছ।’
একটু থামল জোসেফাইন। বলল, ‘পারসোনাল সেক্রেটারি বলে কাকে জান তো? এখন সেই সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করতে হবে তোমাকে।’
‘তথাস্তু!’ বলল আহমদ মুসা।
জোসেফাইন আহমদ আব্দুল্লাহর হাত ধরে চলে গেল।
আহমদ মুসা গিয়ে সোফায় বসল।
সেন্টার টেবিলের নিচের তাক থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিল।
এমন সময় দরজায় নক হলো।
আহমদ মুসা উঠে দরজায় গেল। দেখল মেজর ম্যাক আর্থার দাঁড়িয়ে।
তার সাথে মেজর নেলসন ও আরেকজন এশীয়।
মেজর নেলসন আহমদ মুসাকে স্যালুট দিয়ে বলল, ‘স্যার, ইনি সৌদি দূতাবাস থেকে এসেছেন। আপনার জন্য একটা মেসেজ আছে।’
মেজর নেলসন সারা জেফারসনের এই হসপিটাল স্যুটের নিরাপত্তার দায়িত্বে।
মেজর নেলসনের কথা শেষ হতেই সৌদি দূতাবাসের লোকটি বলল, ‘আস্সালামু আলায়কুম। স্যর, আমি ব্রিগেডিয়ার আমর আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ। ওআইসি’র নিরাপত্তা কমিটির চেয়ারম্যান এবং রাবেতা আলম আল ইসলামীর সংখ্যালঘু কমিটির সভাপতির একটা যৌথ বার্তা নিয়ে এসেছি।’
ব্রিগেডিয়ার আমর বার্তাটি তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা বার্তাটি হাতে নিয়ে ইনভেলাপের উপরের লেখাটা পড়ল। তাতে লেখা রয়েছে ‘ব্রাদার আহমদ মুসা, প্রযত্নে: সারা জেফারসন, জেফারসন ভিলা, ওয়াশিংটন।’
ব্রিগেডিয়ার আমরই আবার কথা বলল। বলল, ‘স্যার, অনুমতি দিলে আমি আসতে পারি।’
‘কিন্তু ব্রিগেডিয়ার, মেহমানদারীর কি হবে?’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি হাসপাতালে এসেছি। এটা মেহমানদারীর জায়গা নয় স্যার।’ বলল ব্রিগেডিয়ার আমর।
‘আচ্ছা ব্রিগেডিয়ার আবার দেখা হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
সালাম দিয়ে ব্রিগেডিয়ার আমর মেজর নেলসনের সাথে চলে গেল।
সারা জেফারসনের কক্ষে ফিরে এল আহমদ মুসা।
সোফায় বসল এসে।
‘মনে হলো কেউ এসেছিলেন। না বসেই চলে গেলেন?’ জিজ্ঞাসা করল সারা জেফারসন আহমদ মুসার দিকে না তাকিয়েই।
‘হ্যাঁ মিস সারা, সৌদি আরব দূতাবাস থেকে ব্রিগেডিয়ার আমর এসেছিলেন ওআইসি ও রাবেতার একটা বার্তা নিয়ে। চলে গেছেন তিনি।’
বলল আহমদ মুসা।
‘বার্তা? কি বার্তা?’ বলল সারা জেফারসন। তার কণ্ঠে একটা চমকে ওঠার ভাব।
‘বার্তাটা বন্ধ ইনভেলাপে এখনও খুলি নাই।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা ইনভেলাপ তুলে নিয়ে খুলতে গেল।
বেজে উঠল টেবিলের উপর রাখা সারা জেফারসনের টেলিফোন।
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে মোবাইল তুলে নিয়ে কল অন করে সারা জেফারসনের কাছে নিয়ে গেল।
মোবাইল বেজে উঠলে সারা জেফারসন এদিকে তাকিয়ে ছিল। যে তার ডান হাত বাড়িয়ে আহমদ মুসার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নিল। বলল, ‘ধন্যবাদ।’
‘ভালো। আপনি খুব ফরমাল হয়ে গেছেন।’ মোবাইল সারা জেফারসনের হাতে দিয়ে বলল আহমদ মুসা।
মুহূর্তের জন্যে সারা জেফারসন একটু থমকে গিয়েছিল। কিছু বলল না। মোবাইলে অনুচ্চস্বরে কিছু কথা বলল। কথা শেষ করে মোবাইলটা টেবিলে ফেরত দেয়ার জন্যে মোবাইলসহ হাত বাড়িয়ে বলল, ‘প্লিজ…।’
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে সারা জেফারসনের হাত থেকে মোবাইলটা নিল। আহমদ মুসা ফিরছিল সোফায়।
‘আমি বেশি ফরমাল হয়ে গেছি। তার সাথে সাথে আমি ‘আপনি’ এবং ‘মিস’ও তো হয়েছি।’
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘ও এই কথা! অনেক দিন পর দেখা তো। অনেক কিছু ভুলে গেছি।’
সারা জেফারসন আহমদ মুসার এ কথার জবাব দিতে গিয়েছিল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। বলল, ‘একটা কথা বলতে পারি?’ গম্ভীর কণ্ঠ সারা জেফারসনের।
‘অবশ্যই। বল।’ বলল আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গেই কথা বলল না সারা জেফারসন। একটা বিব্রত অবস্থা তার চোখে-মুখে। প্রবল একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ছায়া তার চেহারায়। নীরবতা ভেঙে সে বলল অবশেষে, ‘জোসেফাইন আপার অসম্ভব চিন্তার বিষয়টা আপনি জানেন?’ সারা জেফারসনের কথাগুলো বাধো বাধো ও কিছুটা ভাঙা কণ্ঠ।
প্রশ্ন শুনে আহমদ মুসার চোখে-মুখেও গাম্ভীর্য নেমে এল। সঙ্গে সঙ্গেই এর উত্তর তার কাছ থেকে এল না। একটু ভেবে বলল, ‘হ্যাঁ সারা জেফারসন, আমি হাসপাতাল থেকে ফেরার পর জোসেফাইন তার চিন্তার কথা আমাকে বলেছে।’
একটু থামল আহমদ মুসা। শুরু করল আবার, ‘জোসেফাইনের চিন্তাকে ‘অসম্ভব’ বলেছো সারা। জোসেফাইন যখন আমাকেও তার এই চিন্তাটার কথা বলেছিল তখন আমিও তার চিন্তাকে অস্বাভাবিক, অন্যায় ও অপ্রয়োজনীয় বলেছিলাম। কিন্তু এখন তা মনে করছি না।’
‘কেন?’ সারা জেফারসন বলল।
‘আমি যেটা শুনেছি, দেখেছি এবং আজ যা দেখলাম, তাতে এটা নিশ্চিত আহমদ আব্দুল্লাহর মাম্মি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেছেন। আহমদ আব্দুল্লাহ তার মাম্মিকে ছাড়তে পারবে না এবং তার মাম্মিও আহমদ আব্দুল্লাহকে কষ্ট দিতে পারবেন না। সুতরাং জোসেফাইনের চিন্তা আর অসম্ভব, অস্বাভাবিক নেই।’ বলল আহমদ মুসা। তার গম্ভীর কণ্ঠ।
সারা জেফারসনও উত্তর দিতে দেরি করল। বলল ধীর কণ্ঠে, ‘আহমদ আব্দুল্লাহ অবুঝ ছেলে। তার কথা, তার কাজ আর অন্যের সিদ্ধান্ত এক হতে পারে না। সে পরিবারের অংশ, কেন্দ্র নয়।’ সারা জেফারসন বলল।
‘পরিবারের কেন্দ্রই এটা বলছে সারা জেফারসন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এই বলাটা একটা অবুঝ শিশুর মন-নির্ভর, তার ভালো লাগা নির্ভর।’ সারা জেফারসন বলল।
‘না সারা। এই বলাটা ঐ শিশুর মাম্মির মন-নির্ভর, তার মাম্মির ভালো লাগা নির্ভর, তার মাম্মির জীবন-নির্ভরও।’ বলল আহমদ মুসা।
সারা জেফারসনের মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। অশ্রুতে ভারি হয়ে উঠেছে তার দুই চোখ। আহমদ মুসার কথার কোন জবাব দিতে পারল না সারা জেফারসন। একথা সে বলতে পারছে না আহমদ মুসার ঐ বলাটা মন-নির্ভর নয়, ভালো লাগা নির্ভর নয়, তাঁর জীবন-নির্ভর নয়। বলবে কি করে এর চেয়ে বড় সত্য তার জীবনে কি আছে?
ঘরে প্রবেশ করল জোসেফাইন।
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা, ধন্যবাদ সারা। আমি তোমাদের শেষের দিকের সব কথা শুনেছি।’ বলতে বলতে এগিয়ে এল জোসেফাইন। বসল সে এসে আহমদ মুসার সামনে কার্পেটের উপর। আহমদ মুসার দুই হাত টেনে নিয়ে চুমু খেয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ আহমদ মুসা। একজন লাভিং স্বামী হিসাবে, অন্যায়ের প্রতিরোধ ও সত্যের সংগ্রামের একজন দা’য়ী হিসাবে এবং একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসাবে যা এই মুহূর্তে করা দরকার তা তুমি করেছ।’ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল জোসেফাইনের কণ্ঠ।
বলেই জোসেফাইন উঠে দাঁড়াল। ছুটে গেল সারা জেফারসনের কাছে। তার মাথার কাছে বসে তার হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আল্লাহর ইচ্ছা যে কি সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে সারা। না হলে সাত সাগর তের নদী পার হয়ে আমি ছুটে আসব কেন তোমার কাছে। আর ওঁর মতো লোককে বুঝাবার ক্ষমতা কি আমাদের আছে? তিনি আমার চিন্তা শোনার পরে যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাতে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। দেখ, সেই তিনিও যুক্তির কাছে, বাস্তবতার কাছে ‘এবং নিশ্চয় আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। এটা আল্লাহর রহমত। সারা, তুমি ওঁর শেষ কথাটার জবাব দাওনি? তোমার কথাটা বল সারা।’
সারার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল। বলল অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে, ‘আল্লাহর কি ইচ্ছা আমি বুঝতে পারছি না। হয়তো তুমি যা বলছ সেটাই। কিন্তু তোমাকে বলেছি আপা, তুমি যা বলবে আর উনি যা বলবেন, তার বাইরে আমি যেতে পারি না, পারব না।’
জোসেফাইন সারার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ সারা। তুমি আমাদের ইচ্ছার সাথে একমত হয়েছ। কিন্তু তোমার মত কি তা জানা গেল না?’
‘আমাকে আর কিছু বলতে বলো না আপা। সারার কোন্ কথাটা তোমার অজানা আছে?’ বলল সারা খুব নিচু গলায়, প্রায় ফিসফিস করে।
‘ধন্যবাদ সারা। আমার বুক থেকে পাথর নেমে গেল। আল হামদুলিল্লাহ।’
বলে মুখ ফিরাল জোসেফাইন আহমদ মুসাকে কিছু বলার জন্যে।
দেখল আহমদ মুসা নেই, কোন্ ফাঁকে চলে গেছে। হাসল জোসেফাইন। মনে মনে বলল, আমি খুব খুশি আহমদ মুসা। তুমি আমার অনুরোধ `রেখেছ। তুমি সারাকে এভাবে না বললে, সারার মনে কোথাও একটা অন্ধকার, অস্পষ্টতা থেকেই যেত। সারার যেটুকু জানার বিষয় ছিল, জেনে গেছে। সে এখন দ্বিধাহীন। আল হামদুলিল্লাহ।
‘আহমদ মুসা সরে পড়েছে সারা।’ বলল জোসেফাইন হাসতে হাসতে।
জোসেফাইন উঠতে যাচ্ছিল। সারা জেফারসন তার হাত ধরে টেনে রাখল।
জোসেফাইন ফিরে বসল। বলল, ‘কি হলো সারা?’
‘তুমি একটু বস আপা। আমার খুব খারাপ লাগছে। উনি বললেন বটে আমি তোমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেছি। কিন্তু আমার শুধুই মনে হচ্ছে, একটা সুন্দর সাজানো পরিবেশ যেন লণ্ডভণ্ড করে দিলাম আমি। মনে হচ্ছে সবাই যেন অবাক-বিস্ময় নিয়ে আমাকে দেখছে। একটা অন্যায় বোধ আমাকে কুঁকড়ে দিচ্ছে।’ সারা জেফারসন বলল। তার কণ্ঠ ভারি।
জোসেফাইন সারা জেফারসনের আরও ক্লোজ হয়ে বসে সারার মাথায় হাত রাখল। বলল, ‘তোমার এই বোধটা শুধুই তোমার নয়, আমেরিকার একটি সংস্কার। শুধু আমেরিকার নয়, গোটা দুনিয়া জুড়ে নারী অধিকার ও নারী আন্দোলন সামনে আসা এবং বহুবিবাহের বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রচারের পর একটা কুসংস্কার মানুষের মনে দানা বেঁধে বসেছে। সেই কুসংস্কারই অন্যায় বোধ-এর রূপ নিয়ে তোমাকে পীড়া দিচ্ছে।’
‘আপা তুমি এই বোধকে একদম কুসংস্কারই বলে ফেললে?’ সারা জেফারসন বলল।
A ‘যা স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে, যা মানবিকতার বিরুদ্ধে, সুস্থ জীবনধারার বিরুদ্ধে তা অবশ্যই কুসংস্কার।’ বলল জোসেফাইন।
‘তুমি অনেক ভারি কথা বলেছ আপা। সে ভারি কথাটা আবার চলমান বিশ্বাস-ব্যবস্থার বিপরীত। একাধিক বিয়ের ব্যবস্থাকে তুমি বলছ স্বাভাবিক, মানবিক ও সুস্থ জীবনধারার অংশ। অথচ আজকের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস ও সিদ্ধান্ত হলো একাধিক বিয়েই বরং নারীর মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী এবং সেহেতু মানবাধিকারেরও বিরোধী একটা স্বেচ্ছাচার।’ সারা জেফারসন বলল।
হাসল জোসেফাইন। বলল, ‘একাধিক বিয়ে ব্যবস্থা সম্পর্কে ওদের প্রথম ভুল হলো এটাকে সার্বিক সাধারণ সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে দেখা। অথচ এটা তা নয়, এটা সাধারণ সামাজিক বিয়ে ব্যবস্থার একটি ব্যতিক্রমী বিধান। এই বিধান দেয়া হয়েছে মূলত সামাজিক সমস্যা মোকাবিলার জন্যে। ইয়াতিমের মতো অসহায় মেয়েদের সমস্যা সমাধান উপলক্ষেই এই বিধান দেয়া হয়েছে। তুমি কুরআন শরিফের সূরা নিসা’র ৩ নাম্বার আয়াতে দেখ আছে, ‘তোমরা যদি আশংকা কর যে, ইয়াতিম মেয়েদের প্রতি সুবিচার (শ্লীলতা, পবিত্রতা রক্ষা) করতে পারবে না, তাহলে তাদের মধ্যে যাদের পছন্দ তাদের বিয়ে কর দুই, তিন অথবা চার। আর যদি আশংকা কর যে সুবিচার (সমান ব্যবহার) করতে পারবে না, তাহলে একজনকে অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে। এতে পক্ষপাতিত্ব না করার অধিকতর সম্ভাবনা।’ সূরা নিসার আরও সামনে এগুলে তুমি ১২৯ ও ১৩০ নাম্বার আয়াতে দেখতে পাবে, আল্লাহ বলছেন, ‘আর তোমরা যতই ইচ্ছা কর না কেন তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সমান ব্যবহার করতে কখনই পারবে না। তবে তোমরা কোন একজনের দিকে সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়ো না এবং অপরকে ঝুলানো অবস্থায় রেখ না। যদি তোমরা নিজেদের সংশোধন কর ও সাবধান হও তবে আল্লাহ নিশ্চয় ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। যদি তারা পৃথক হয়ে যায়, তবে আল্লাহ তাদের প্রাচুর্য দ্বারা তাদের প্রত্যেককে অভাবমুক্ত করবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও প্রজ্ঞাময়।’ সূরা নিসার এই তিন আয়াতের তুমি যদি সারাংশ কর তাহলে দেখবে- এক. সমস্যা মোকাবিলা, ব্যভিচার ও অবৈধ-অসামাজিক সম্পর্ক রোধ করার জন্যে পছন্দের নারীদের চারজন পর্যন্ত বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। দুই. স্ত্রীদের প্রতি সুবিচার ও সমান ব্যবহার যদি করতে না পারে, তাহলে এই চারজন পর্যন্ত বিয়ের অধিকার কেড়ে নিয়ে ‘এক’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রে মাত্র ক্রীতদাসীদের বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। বিয়ে না করলেও ক্রীতদাসীরা মালিকের সম্পত্তি হিসেবে মালিকের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। এটা বন্ধ করা ও ক্রীতদাসীদের সম্মান দেয়ার জন্যেই তাদের বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এর আরও কারণ হলো, এতে নতুন কোন পক্ষপাতিত্বের ভয় নেই। তিন. একাধিক স্ত্রীর প্রতি সমান ব্যবহার সম্ভব নয় এ ঘোষণা করে একাধিক বিয়ের পথ কার্যত বন্ধ করা হয়েছে এবং যদি বিয়ে হয়েও যায়, তাহলে অবিচার না করে, ঝুলিয়ে না রেখে পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন হবার অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে আল্লাহ উভয়ের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন ও সাহায্য করবেন। আমি যে তিনটি পয়েন্ট তুলে ধরলাম, যা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, তার সারমর্ম হলো, মানবিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা পবিত্রতার লক্ষ্যে চার পর্যন্ত বিয়ের পথ খুলে রাখা হয়েছে, কিন্তু এই অনুমতিকে সাংঘাতিকভাবে শর্তসাপেক্ষ করে একাধিক বিয়ের পথ কার্যত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যারা একাধিক বিয়েকে খারাপ চোখে দেখেন এবং একাধিক বিয়ের অনুমতি দেয়ায় ইসলামের সমালোচনা করেন, তারা ইসলামী বিধানের বাস্তবতা অনুধাবন করলে তারা তাদের সমালোচনার জন্যে লজ্জিত হবেন এবং এই বিধানকে গ্রহণ করবেন সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা মোকাবিলার জন্যে। দেখ সারা, প্রত্যেকটা আইন বা কঠোর আইনের এক বা একাধিক একসেপশন বা ব্যতিক্রম থাকে। বিয়ের ক্ষেত্রেও ইসলাম একটা ব্যতিক্রম রেখেছে। এটাই মানবিক এবং সামাজিক।’ থামল জোসেফাইন।
সারা জেফারসনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘ধন্যবাদ আপা। আমার কি মনে হচ্ছে জান, আমাদের আমেরিকান খৃস্টান সমাজে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে ও বাড়ছে তাকে উদাহরণ হিসাবে সামনে এনে ইসলামের এই বিধানের উপকারিতা তুলে ধরে আমি দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে। পারবো। সূরা নিসা আমি পড়েছি আপা, কিন্তু এই কথাগুলো এভাবে আমার মাথায় আসেনি। ধন্যবাদ তোমাকে।’
*একটু থেমেই জেফারসন আবার বলল, ‘আমাদের আমেরিকান সমাজ কি এই বাস্তবতা কোন দিন বুঝবে আপা?’
‘যত দিন না বুঝবে তত দিন তাকে অনেক পারিবারিক, সামাজিক সমস্যায় ভুগতে হবে। বুঝলে এই শর্তযুক্ত ব্যতিক্রমকে মানুষ একটা বড় কল্যাণ হিসেবেই গ্রহণ করবে।’ বলল জোসেফাইন।
‘শর্তের কথা উনি নিশ্চয় জানেন। আল্লাহ যেখানে নিজে বলছেন, সমান ব্যবহার তোমরা কিছুতেই করতে পারবে না। সেই সমান ব্যবহার উনি কিভাবে করবেন?’ সারা জেফারসন বলল। তার ঠোঁটে হাসি।
‘বিয়ের পর তুমিই জিজ্ঞেস করো তাকে। তবে ওর প্রতি আমার আস্থা আছে। তিনি কোন অন্যায় করতে পারেন না। আর আমি-তুমি, আমরা তো কোন প্রতিযোগী নই সারা।’ বলল জোসেফাইন।
সারা জেফারসনের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘প্রতিযোগিতা কেন আপা। আমি তো তোমার পাশে বসার ভয় নিয়েই মরছি। মনকে বুঝাতে পারছি না, যা তোমার, একান্তই তোমার, তাতে আমি হাত লাগাব কেন? আমি তোমাকে ভালোবাসি আপা?’
বলতে বলতে কান্নারুদ্ধ হয়ে গেল সারা জেফারসনের কণ্ঠ। চোখ থেকে ঝরঝর করে নেমে এল অশ্রু।
আবেগে ভারি হয়ে উঠেছে জোসেফাইনের চেহারা। সে সারা জেফারসনের কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি সারা। তোমার সেই চিঠি পড়েই আমার এই ভালোবাসার শুরু। তারপর যখন তোমার সাথে দেখা হলো, তখন দেখলাম চিঠির সারার চেয়ে বাস্তবের সারা আরও বেশি সুন্দর, আরও বেশি মিষ্টি, আরও বড় হৃদয়ের।’ জোসেফাইনেরও দু’চোখ ভরে উঠল আবেগের অশ্রুতে। সারা জেফারসন জোসেফাইনের গলা জড়িয়ে ধরে আরও কাছে টেনে নিল। জোসেফাইনও জড়িয়ে ধরল সারা জেফারসনকে। দুই দেহের মতো দু’জনের অশ্রুও এক হয়ে গেল।