১
ইভা নারিনকে ও.টি-তে নেবার আগেই তার বাবা পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিক, তার মা মেরী মার্গারিটা এবং ছোট বোন আন্না এলিনা এসে পৌঁছিল পুলিশ হাসপাতালে। হেলিকপ্টার থেকে নেমেই তারা ছুটল প্রি ও.টি. সেকশনের দিকে।
ইভা নারিনকে দেখতে পেয়েই ছুটে গিয়ে ইভা নারিনের মুখের উপর মুখ রেখে কেঁদে উঠল তার মা মেরী মার্গারিটা। বাবা এবং অতি আদরের ছোট বোনও তার পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়েছিল ডাক্তারদের পাশে নির্বাক বেদনা নিয়ে।
আহমদ মুসা ডাক্তারকে ফিসফিসে কণ্ঠে বলল, ম্যাডাম নারিনকে শীঘ্রই ও.টি-তে নেয়া দরকার।
ও.টির প্রধান ডাক্তার আরেভিক আভেডিস বলল, স্যার, সবে এসে বসলেন মেয়ের পাশে। কি করে বলি। আপনি আমাদের সাহায্য করুন।
আহমদ মুসা আস্তে আস্তে গিয়ে অ্যারাম আভ্রানিকের পাশে দাঁড়াল। ধীরকণ্ঠে বলল, স্যার, দেরি হয়ে যাচ্ছে। ইভা নারিনকে ও.টি-তে নেয়া দরকার।
মাথা ঘুরিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। উঠে দাঁড়াল সংগে সংগেই। জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, কনগ্রাচুলেশন আহমদ মুসা। তুমি অসাধ্য সাধন করেছ। কিন্তু ইভা মার একি হল?
দুঃখিত স্যার, যে গুলিটা আমাকে বিদ্ধ করত, সেই গুলি সে নিজের বুক পেতে নিয়েছে। বলল আহমদ মুসা অশ্রুভেজা কণ্ঠে।
বাবা, উনি দুঃখিত, কিন্তু আমি গর্বিত। জীবনে একটা বড় কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, সে কাজ আমি করেছি বাবা! কণ্ঠ টেনে সর্বশক্তি দিয়ে যেন কথাগুলো বলল ইভা নারিন।
স্যার, ওকে ও.টি-তে নিতে আর দেরি করা ঠিক হবে না। বলল আহমদ মুসা ইভা নারিনের বাবাকে।
ঠিক।
বলে অ্যারাম আড্রানিক তাকাল ডাক্তারদের দিকে। বলল, ডাক্তার, এবার আপনারা কাজ শুরু করুন।
স্যার, আমরা আপনার নির্দেশের অপেক্ষা করছি। বলল ডাক্তার আরেভিক আভেড়িস।
ডাক্তাররা চললো ইভা নারিনের দিকে। ইভা নারিনের মা ও বোন উঠে ইভা নারিনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
ডাক্তাররা ইভা নারিনকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হলো।
ডাক্তার আংকেল, আমি ডাক্তার নই, কিন্তু আমার আঘাত আমি অনুভব করছি। কোনো অপারেশনই তা নিরাময় করার জন্যে যথেষ্ট হবে না। আংকেল, আমি সত্যি বলছি কি না? বলল ইভা নারিন।
ডাক্তার আরেভিক আভেডিস মাথা নিচু করল। মুহূর্তকাল পরে বলল, মা, আমরা শুধু চেষ্টাই করতে পারি।
বাবা, শুনলে ডাক্তার আংকেলের কথা। বাবা, আমাকে অপারেশন থিয়েটারে মেরো না বাবা। আমার জীবন আজ ধন্য হয়ে গেছে বাবা। দুনিয়াতে আমার আর পাওয়ার কিছু নেই। আমি যতক্ষণ দুনিয়াতে আছি তোমাদের পাশে থাকতে চাই। বলল নারিন বাধো বাধো ক্ষীণ কণ্ঠে।
না আপা, তুমি বাঁচবে। তুমি মরতে পার না। আমাকে ছেড়ে তুমি যেতে পার না। কাঁদতে কাঁদতে বলল আন্না এলিনা, তার ছোট বোন।
ইভা নারিনের যন্ত্রণাকাতর মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। বলল, তোমার স্যারকে জিজ্ঞেস কর, উনিও জানেন অপারেশন প্রথাগত দায়িত্ব পালনের জন্যে।
ইভা নারিনের মৃত্যুর সময় আল্লাহ নির্দিষ্ট রেখেছেন, যা আমরা কেউ জানি না। সেজন্যে তাকে বাঁচানো বা তার বাঁচার জন্যে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করতে হয়। তোমার ঐ ধরনের একটা শেষ মুহূর্তের চেষ্টায় আমি বেঁচে গেছি। সেই শেষ চেষ্টাটা আমাদেরকে করতে দাও তুমি। শাত, নরম কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
দুচোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ইভা নারিনের। বলল, আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। কিন্তু আমার মন বলছে আমার সময় শেষ। তবু আপনি চাইলে, করুন শেষ চেষ্টা।
কথা শেষ করার পর পরই দেহটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল ইভা নারিনের। কি এক প্রবল কষ্টে ধুঁকতে লাগল ইভা নারিন। কেঁদে উঠল ইভা নারিনের মা, বোন।
ডাক্তার তাকে ঘিরে ধরল। মুখে অক্সিজেন মাস্ক বসাতে গেল।
মুখ নেড়ে নিষেধ করল ইভা নারিন।
বলল, মা-বাবা, আমাকে মুসলিম ম-তে কবর দিও। এলিনার স্যার যেন আ-মা-র জা-না-যা প-ড়া-ন। কথাগুলো কষ্ট করে টেনে টেনে বলল ইভা নারিন। গভীর অবসাদ যেন তার চোখ বুজিয়ে দিল। ধীরে ধীরে এক বার চোখ খুলল ইভা নারিন। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, এলিনার স্যার কোথায়? আমার একটা হাত ধরুন।
আহমদ মুসা পাশে বসল। আলতোভাবে নিজের হাতটা ইভা নারিনের হাতে রাখল। ইভা নারিনের দুর্বল হাত আহমদ মুসার হাত ধরার চেষ্টা করেও পারল না। বলল, কিছু মনে করবেন না। এটুকু অপরাধ আল্লাহ মাফ করে দেবেন। বলুন, বেহেশতে সবাই কি সবার দেখা পাবে?
সেটা মানুষের চাওয়া ও আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভর। বলল আহমদ মুসা।
আল্লাহ এক, মুহাম্মদ স, তাঁর রাসূল। আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। গলগল করে তার দুই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সাথে সাথে একদিকে গড়িয়ে পড়ল তার মাথা।
আহমদ মুসা ইন্নালিল্লাহ বলে উঠে দাঁড়াল। কেঁদে উঠল ইভা নারিনের মা, বোন। মাথা নিচু করল ইভা নারিনের বাবা। অশ্রু গড়াচ্ছিল তার দুগণ্ড বেয়ে।
চারদিকে দাঁড়ানো পুলিশরা তাদের মাথার হ্যাট নামিয়ে নিল।
দিভিনের পুলিশ প্রধান ভাহান ভাবান হন্তদন্ত হয়ে সেখানে এল। খবর শুনে মাথার হ্যাট নামিয়ে বলল পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিককে লক্ষ্য করে, স্যরি স্যার। সে শুধু আপনার ভালো মেয়েই নয়, দেশের সফল একজন গোয়েন্দা অফিসার ছিলেন। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলাম স্যার।
সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা ভাবদান। ওদিকের কি খবর? বলল পুলিশ প্রধান।
খারাপ খবর স্যার। সেন্ট সেমভেল পটাশিয়াম সাইনাইড খেয়েছেন। আমরা গাড়িতেই মৃত অবস্থায় পেয়েছি। বলল ভাহান ভাবদান।
দিভিনের পুলিশ প্রধানকে কথা বলতে দেখে আহমদ মুসাও পাশে এসে
দাঁড়িয়েছিল। বলল, তার মানে তিনি জীবন্ত ধরা দিলেন না।
দেখছি, ওরা এক বিপজ্জনক দল স্যার। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি এদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেছেন। ভাহান ভাবান বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
এখানে আসার পথে আমি প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন পেয়েছি। তিনি আহমদ মুসাকে মোবারকবাদ জানিয়েছেন। তিনি আহমদ মুসার সাথে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছেন। বলল পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিক।
ধন্যবাদ স্যার, তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারলে আমি খুশি হবো। বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল পুলিশ প্রধান ইভা নারিনের আব্বাকে, স্যার, সবাই কাঁদছে। ওদিকে দেখুন।
ইভা নারিনের বাবা চললো তার স্ত্রী ও মেয়ের দিকে। পুলিশকে নির্দেশ দিল তাদের ফর্মালিটি সম্পূর্ণ করার জন্যে।
পুলিশরা তৎপর হয়ে উঠল।
সবার অনুরোধের চাপে আহমদ মুসা সেন্ট সেমভেলের সেন্ট গ্রেগরি চার্চে তার অভিযানের কাহিনী বলছিল। কাহিনী শেষ করে উপসংহারে বলল, ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার-এর সবাই ধরা পড়েছে। সেদিন চার্চ কমপ্লেক্সেই ওদের তিরিশ জন ধরা পড়েছিল, নিহত হয়েছিল প্রায় বিশজন। যারা না জেনে বা নিছক আবেগবশত ওদের দলে যোগ দিয়েছিল, তারা ওদের সন্ত্রাসী ঘটনা জানার পর অনুতপ্ত হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ দিভিন উপত্যকার অধিবাসীরা এখন নিরাপদ। থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামার সাথে সাথেই দিভিনের সরদার আসতি আওয়াত বলল, ম্যাডাম ইভা নারিনের ঘটনা আমাদের খুব আহত করেছে, দুঃখিত করেছে। আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা সকলেই তার জন্যে দোয়া করছি। তার নিহত হওয়া সম্পর্কে আপনি বেশি কিছু বলেননি।
আজই ঘন্টা দেড়েক আগে দিভিন উপত্যকায় এসেছে দিভিনের লোকরা। তারা আহমদ মুসার জন্যে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল। আহমদ মুসা আসার খবরে দিভিনের লোকেরা ঢলের মতো ছুটে এসেছিল সরদার আসতি আওয়াতের বাড়িতে। আহমদ মুসাকে তাদের উদ্দেশ্যে কথা বলতে হয়েছে। এরপর আহমদ মুসা সবাইকে দশটার মধ্যে জমায়েত হতে বলেছে। সেখানে আরও কথা হবে। আশ্বস্ত হয়ে সবাই মসজিদের দিকে চলে গেছে। কিন্তু সরদার আসতি আওয়াত, শেপল, এরদেলান, আহমদ নেবেজ, সিন সেনগাররা আহমদ মুসাকে ধরেছে তার অসাধ্য সাধনের কাহিনী বলার জন্যে, যা খবরের কাগজে বের হয়নি। খবরের কাগজে আহমদ মুসার কাহিনী কিছুই বলা হয়নি। বলা হয়েছে পুলিশের কৃতিত্বের কথা। আহমদ মুসার অনুরোধেই আর্মেনীয় সরকার এটা করেছে।
আজ সকাল দশটায় আর্মেনীয় সরকারের তরফ থেকে দিভিন। উপত্যকার অধিবাসীদের তাদের বড় মসজিদে সমবেত হতে আহবান জানিয়েছে। সেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও পুলিশ প্রধান আসবেন।
আহমদ মুসা আগেই দিভিন চলে এসেছে। সকাল ৭টার মধ্যেই সে দিভিন এসে পৌঁছেছে। আসতি আওয়াতের প্রশ্নের উত্তরে আহমদ মুসা বলল, প্রাচীন শহর দিভিনে সেন্ট সেমভেলকে ধরার অভিযানে আমি ইচ্ছা। করেই ইভা নারিনকে শামিল করিনি। ক্রিমিনালদের সাথে সংঘাতে পুরুষরা বিকল্প থাকতে মেয়েদের শামিল করা আমি উচিত মনে করি না। কিন্তু সে নিজের ইচ্ছাতেই গোপনে (পরে শুনেছি সে তার বাবার অনুমতি নিয়ে) আমার অনুসরণ করে। চার্চ গ্রেগরিতে অভিযানের আগে দিভিন শহরেরই অন্যত্র এক স্থানে মারাত্মক সংঘাতকালে সে আমার জীবন বাঁচায়। আমি সেদিন চার্চ গ্রেগরিতে ঢোকার পর সে এক সময় আমাকে সাহায্যের জন্যে চার্চ গ্রেগরিতে ঢুকে পড়ে। অভিযানের শেষ দিকে আমি যখন আহত ও পলায়নরত সেন্ট সেমভেলের দিকে ছুটছি, সে সময় সে পেছন থেকে আমার দিকে ছুটে আসতে থাকে। আমি তখন সামনের সেন্ট সেমভেল ও তার চারজন সহযোদ্ধা স্টেনগানধারীকে সামলাতে ব্যস্ত, সে সময় সেন্ট সেমভেলের গোয়েন্দা প্রধান সোনা সোনা পাশের এক আড়াল থেকে আমাকে গুলি করে। ইভা নারিন তখন আমার পেছনে পৌঁছে গেছে। আমাকে পাশের আড়াল থেকে গুলি করার বিষয়টা সে শেষ মুহূর্তে দেখতে পায়। তখন তার পক্ষে পাল্টা কিছু করার ছিল না। আমাকে রক্ষার জন্যে আমার দেহকে আড়াল করে গুলির সামনে এসে সে দাঁড়ায়। তার জীবনের বিনিময়ে আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেন। বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা থামল।
কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই নীরব। গভীর বেদনার ছায়া সকলের চোখে-মুখে।
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়েছেন। আপনার জন্যে জীবন দেয়ার মাধ্যমে ইভা নারিন আপা তার হৃদয়ের এক চাওয়াকে মহী য়ান করে গেলেন। আল্লাহ তাকে জাযাহ দিন। বলল শেপল। তার কণ্ঠ ভারি।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, সময় কিন্তু বেশি নেই। মেহমানরা আসার আগেই আমাদের সেখানে পৌঁছা দরকার। ব্যবস্থাপনা দেখা দরকার, যদিও সরকারিভাবে সব হচ্ছে। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল আহমদ মুসা।
সবার অবস্থা স্বপ্লেখিতের মতো হলো। শোকের আবহ কেটে গেল। জেগে উঠল সবাই। সবাই উঠে দাঁড়াল। সরদার আসতি আওয়াত সবাইকে দুতিন মিনিটের মধ্যে তৈরি হতে বলল।
সবাই দ্রুত চলে যাচ্ছিল।
সিন সেনগার আস্তে আস্তে এসে আহমদ মুসার পাশের চেয়ারে বসল।
ওড়নার ঘোমটার মধ্যে তাকে চেনাই কষ্ট হচ্ছিল।
কেমন আছ বোন? বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা যেন সে শুনতেই পায়নি। আপন মনেই অনেকটা স্বগতকণ্ঠে বলল, ভাইয়া এভাবেই কি আপনি মৃত্যুকে সাথে নিয়ে চলেন?
হাসল আহমদ মুসা। বলল, আমি একা কেন, সব মানুষই তো মৃত্যু সাথে নিয়ে পথ চলে।
কিন্তু আপনার সাথে মৃত্যুর সাক্ষাৎ বারবার হয়, আমার বা অন্যদের তা হয় না ভাইয়া। বলল সিন সেনগার।
আমার সাথে মৃত্যুর সাক্ষাৎ হয়, আমি বাঁচিও তা থেকে। অনেকের কাছে সাক্ষাৎ ছাড়া আসে বলে তা থেকে বাঁচারও সৌভাগ্য হয় না। সেদিক থেকে আল্লাহ আমাকে সৌভাগ্যবান করেছেন সিন সেনগার। আহমদ মুসা বলল।
আপনার সাথে যুক্তিতে আমি পারব কেন? আশ্চর্যের বিষয় এবং আমার সৌভাগ্য যে ভাবীকে আপনার সম্পর্কে বলতে শুনলাম। বলল সিন সেনগার।
তোমার ভাবীর সাথে কবে কথা বললে? আহমদ মুসা বলল।
ঘটনার পরদিন টেলিফোন করেছিলেন। দেখলাম, আপনি সব কথাই তাকে জানিয়েছেন। তিনি আমাদের সকলের খোঁজ-খবর নিলেন এবং খুবই দুঃখ করলেন ইভা নারিন ম্যাডামের জন্যে। ভাইয়া, আপনার পরিবারও মডেল পরিবার। বলল সিন সেনগার।
মডেল পরিবার নয়, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানার চেষ্টাকারী একটি পরিবার মাত্র। রাসুল স.-এর পরিবারই একমাত্র মডেল পরিবার। আহমদ মুসা বলল।
স্যরি ভাইয়া। আর ভুল হবে না। ভাইয়া, আপনি নাকি আজ রাতেই চলে যাচ্ছেন? বলল সিন সেনগার।
হ্যাঁ, যেতে হবে বোন।
জানি ভাইয়া। এটাই তো শেষ যাওয়া। আর কি আসবেন আপনি? বলল সিন সেনগার। অশ্রুভেজা তার কণ্ঠ।
আল্লাহ ছাড়া এটা কেউ জানে না বোন। আর শুধু আমি আসব কেন? তোমরাও যেতে পার। মদিনায় এস তোমরা। আহমদ মুসা বলল।
মদিনায় গেলেই তো আপনার দেখা মিলবে না। বলল সিন সেনগার।
কেন ভাবীদের পাবে। আর মদিনায় গেলে যাকে পেলে মানুষ সবাইকে ভুলে যায় সেই রাহমাতুল্লিল আলামিনকে পাবে। তার সামনে গেলে দুনিয়ার আর কোনো চাওয়ার কথাই মনে থাকবে না। আহমদ মুসা বলল। আবেগ ঝরা তার কণ্ঠ।
ধন্যবাদ, সে নসিব যেন হয় ভাইয়া। বলল সিন সেনগার।
ভেতর থেকে তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলো সরদার আসতি আওয়াত, এরদেলান, শেপল ও আহমদ নেবেজ।
ভাই-বোনে কি আলোচনা হচ্ছে? স্নেহভরা কণ্ঠে বলল সরদার আসতি আওয়াত সিন সেনগারকে লক্ষ্য করে।
বাবা, ভাইয়া চলে যাচ্ছেন, সেটা নিয়েই কথা বলছি।বলল সিন সেনগার।
কে যাবেন? তোমার ভাইয়া, মানে জনাব আহমদ মুসা? সরদার আসতি আওয়াত বলল।
হ্যাঁ বাবা, ভাইয়া আজ রাতেই চলে যাচ্ছেন। বলল সিন সেনগার।
সরদার আসতি আওয়াত তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, এ কি শুনছি জনাব আহমদ মুসা? আপনি সবে তো এলেন দিভিন উপত্যকায়। এখনই আমরা আপনাকে ছাড়তে পারি না।
শেপল, এরদেলান, সিন সেনগার, আহমদ নেবেজ সকলের চোখে-মুখে বেদনার কালো ছায়া।
আহমদ মুসা গম্ভীর। বলল, আমি আপনাদের সাথে আরও কয়েকদিন থাকতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। আজ রাতে মদিনা শরিফে যাব। কাল জরুরি কিছু কাজ আছে। পরদিন সকালেই আমার ফ্লাইট ভূমধ্যসাগরের রত্ন দ্বীপে যাবার জন্যে তৈরি থাকবে। আমেরিকা থেকে আমার পরিবার মদিনা যাবার পথে পরশু ঐ দ্বীপে আসছে মাত্র দুদিনের জন্যে। আমার এখানকার কাজ আপাতত শেষ হয়ে গেছে এটা জানার পর এই প্রোগ্রাম তারা করেছে। সুতরাং জনাব আমার কিছু করার নেই। আপনারা আমাকে মাফ করবেন।
জানি জনাব আহমদ মুসা, আমাদের ডাকে নয়, হঠাৎ করেই আপনি এখানে এসেছিলেন আবার হঠাৎ করেই চলে যাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন বিনা নোটিশে যাবেন তা আমরা ভাবিনি।
একটু থামল সরদার আসতি আওয়াত। থেমেই আবার শুরু করল, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো কিন্তু আমরা সকলেই জানি, সাধারণত যা ঘটে, তা আহমদ মুসার কাছে আশা করা ঠিক নয়। বিয়ের মেহেদির রং শুকানোর আগেই জীবন-মরণ সগ্রামের অভিযানে তিনি এসেছিলেন অনেকের মন ভেঙে দিয়ে, আজ যেমন আমাদের মন ভেঙে যাচ্ছে। এইভাবে মন ভাঙতে গিয়ে এই মহান মানুষটির মনও যে রক্তাক্ত হয়, সে খবর আমরা কিন্তু কেউ রাখি না। আল্লাহ তাকে দীর্ঘজীবী করুন, আমাদের মতো মজলুম মানুষদের পাশে দাঁড়াবার তৌফিক আল্লাহ তাকে আরও বেশি বেশি দিন।
একটু থেমেই আবার সে বলল, চলুন জনাব আহমদ মুসা, সময় বেশি নেই।
তারপর অন্য সবার দিকে তাকিয়ে সরদার আসতি আওয়াত বলল, চল সবাই।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
মন ভাঙার বেদনায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন স্যার, কিন্তু আমাদের মন ভাঙা তো নতুন, তাই বেশি খারাপ লাগছে আমাদের। বলল আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে শেপল।
সবাই হাঁটতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসা হাসল। হেসে সে পরিস্থিতি হালকা করতে চাইল। বলল, শেপল। মন না থাকলে মন ভাঙবে কি করে, এমনটা ভাব না কেন?
বরং আপনার মনটাই সবচেয়ে সজীব, সবচেয়ে স্পর্শকাতর। তা না হলে, আমরা ভাবার আগেই ইয়াতিম, সহায় হয়ে পড়া সিন সেনগারকে আপনি বোন বানিয়ে নিলেন কি করে? শেপলই বলল। তার কণ্ঠ ভারি, ভাঙা ভাঙা।
সবাইকে ধন্যবাদ। এস আমরা সামনের প্রোগ্রাম নিয়ে ভাবি। এই আয়োজনটা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর অফিস। তিনিই কথা বলবেন। আর দিভিনের পক্ষ থেকে কথা বলবেন সরদার সাহেব। বলল আহমদ মুসা।
জনাব আহমদ মুসা আপনাকেও কথা বলতে হবে। আর আমি কি কথা বলব। প্রধানমন্ত্রীর সামনে আমি আগে তো কোনো দিন কথা বলিনি। সরদার আনতি আওয়াত বলল।
প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনলেই বলার বিষয় খুঁজে পাবেন। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন দক্ষিণ আর্মেনিয়া প্রদেশের কমিশনার। তার পরেই কথা বলবেন প্রধানমন্ত্রী। তার পরে বক্তব্য রাখবেন আপনি। এখানে আসার জন্যে প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানাবেন। ধন্যবাদ জানাবেন দিভিবাসীদের জন্যে কথা বলা ও কাজ করার জন্যে। বলল আহমদ মুসা।
প্রধানমন্ত্রী কি বলবেন, কিছু জানেন জনাব আপনি? সরদার আসতি আওয়াত বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার সাক্ষাতের সময় আমি কিছু কথা বলেছিলাম। তিনিও বলেছিলেন। এখন তিনি এখানে কতটুকু কি বলবেন আমি ঠিক জানি না। চলুন, সময় তো প্রায় হয়ে গেছে।
চত্বরসহ দিভিনের বিশাল মসজিদ। চত্বর ও চত্বরের তিন পাশ জুড়ে দিভিনের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার বিশাল সমাবেশ।
প্রধানমন্ত্রীর ডানপাশে বসেছে আহমদ মুসা, আহমদ মুসার পাশে বসেছে দিভিনের সরদার আসতি আওয়াত। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর বামপাশে বসেছে আর্মেনিয়ার দক্ষিণ প্রদেশের কমিশনার এবং তার পাশে বসেছে। আর্মেনিয়ার পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিক। তাদের পেছনে বসেছে। সরকারি অফিসিয়াল, সিকিউরিটি ও পুলিশের লোকরা। সামনে, ডাইনে, বামে বসেছে দিভিনের হাজার হাজার লোক।
উদ্বোধনী ও স্বাগত বক্তব্য শেষ হয়েছে মাত্র। এখন প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেবেন। চারদিকে প্রবল আবেগ ও উত্তেজনা।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্য শুরু করে প্রথমেই দিভিনবাসীদের বিরাট সংখ্যার যে প্রাণহানি ঘটেছে, ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, তাদের উপর যে জুলুম অত্যাচার হয়েছে তার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করল। তবে বলল, হত্যা, গুম, জুলুম অত্যাচার বন্ধে সরকারের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। অবশেষে সাফল্য। এসেছে। এ সাফল্য যার হাত দিয়ে এসেছে, যাদের হাত দিয়ে এসেছে, তার। এবং তাদের প্রতি আমি আমার সরকার ও আর্মেনীয় জনগণ কৃতজ্ঞ। আর্মেনিয়া একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে খ্রিস্টান, মুসলমান, ইহুদিসহ সব ধর্মের লোকের সমান অধিকার। এটা আমাদের রাষ্ট্রের নীতি। এই নীতি আমাদের জনগণ সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করবে। আমি আজ এখানে দ্ব্যর্থহীন। ভাষায় ঘোষণা করছি, দিভিনের বাসিন্দারা মহান সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর বংশধর! এটা সমগ্র আর্মেনিয়ার জন্যে একটা গর্বের বিষয়। এটা জেনে আমি ও আমরা আর্মেনীয়রা গর্ববোধ করছি। আরও গর্ববোধ করছি। এটা জেনে যে, মহান সুলতান সালাহ উদ্দিনের পূর্বপুরুষরা আর্মেনিয়ার। দিভিন নগরীর বাসিন্দা ছিলেন। এখন থেকে দিভিনবাসীরা স্ব পরিচয়েই আর্মেনিয়ায় থাকবেন আর্মেনীয় জনগণের আবহমান অংশ হিসাবে। দিভিবাসীদের উপর যে অবিচার হয়েছে, তাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুরণ করা অসম্ভব। তবে তাদের অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি হিসাবে দিভিন নগরীতে তাদের যে বসতি ছিল, তা তাদের ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তারা দিভিন উপত্যকা ও দিভিন নগরী দুজায়গাতেই থাকতে পারবেন। দিভিন নগরীতে যেখানে তাদের বসতি ছিল, সেখানেই তাদের নতুন বসতি গড়ে দেয়া হবে। গত কয়েক বছরে দিভিন উপত্যকার যে ক্ষতি হয়েছে, তার কিছুটা পূরণ করে দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে। যারা দিভিবাসীদের ক্ষতি করেছে তারা আর্মেনিয়ারই ক্ষতি করেছে। তাদের পরিচয় যাই হোক, আর্মেনীয় জনগণ। তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে। এদের সাথে সীমান্ত পারের এক শ্রেণির লোকেরও যোগসাজস ছিল। তাদেরও খুঁজে বের করা হচ্ছে।
বক্তব্য শেষ করার আগে প্রধানমন্ত্রী বলল, ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে আর্মেনীয় জনগণের যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, সে বিজয় এনেছেন আর্মেনীয় জনগণের এমন একজন বন্ধু যিনি, আমি মনে করি, তিনি পৃথিবীর সব মানুষের গর্ব। তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি। যিনি নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জন্যে এভাবেই নীরবে-নিভৃতে থেকে কাজ করে যাবেন। তার নাম না জানলেও প্রত্যেক আর্মেনিয়ান ভালোবাসা দিয়ে তাকে সিক্ত করবে। তাকে আমার প্রাণঢালা অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা। সেই সাথে আমি আমাদের পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিকের কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি এই মহৎ মানুষটিকে সাধ্যমত সহযোগিতা করেছেন। সবচেয়ে বেশি আমি স্মরণ করছি, আমাদের পুলিশ প্রধানের বড় মেয়ে আমাদের গোয়েন্দা অফিসার ইভা নারিনকে। তিনি শুরু থেকেই ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে অভিযানে আর্মেনিয়ার। বন্ধু মহান ব্যক্তিটিকে সঙ্গ দিয়েছেন, সাহায্য দিয়েছেন এবং শত্রুর বুলেটে জীবন দিয়ে তাকে বিজয়ী করে গেছেন। আমার দেশ, আমাদের পুলিশ বাহিনী সব সময় ইভা নারিনকে গর্ব ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। তার পিতা-মাতা এবং পরিবারের প্রতি আমি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আমি দিভিবাসীদের নতুন জীবনে স্বাগত জানিয়ে আমার কথা শেষ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ। কথা শেষ করল প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ঘোষণা করা হলো সরদার আসতি আওয়াতের নাম।
সরদার আসতি আওয়াত শুরুতেই দিনিবাসীদের পক্ষ থেকে। প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানাল দিভিনে আসার জন্যে এবং আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল দিভিনবাসীদের প্রতি তার শুভেচ্ছার জন্যে। ইভা নারিনকেও স্মরণ করল এবং তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করল। সবশেষে বলল, আর্মেনিয়া তাদের মাতৃভূমি। আমরা নিজেদের যতটা ভালোবাসি, আর্মেনিয়াকে আমরা ততটাই ভালোবাসি। আমাদের ধর্ম ইসলামেরও শিক্ষা এটাই। আমাদের উপর অতীতে যা ঘটেছে, তার জন্যে দায়ী কিছু ক্রিমিনাল। আমাদের দুঃসময়ে জনগণ ও জনগণের সরকার আমাদের সাথে। ছিল। আমরা কৃতজ্ঞ তার কাছে, যে মহান ভাইয়ের সাহায্যে আমাদের দুঃসময়ের অবসান ঘটল, আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করতে চাই না। প্রার্থনা করব, আল্লাহ যেন এই জগতে এবং পরজগতে এর উপযুক্ত জাযাহ তাকে দেন। তাকে দীর্ঘজীবী করুন এবং দুনিয়ার সব মজলুম মানুষের পাশে দাঁড়াতে আল্লাহ যেন তাকে তৌফিক দান করেন।
সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং সবশেষে মহান আল্লাহর শোকর আদায় করে সরদার আসক্তি আওয়াত তার কথা শেষ করল। সম্মেলন শেষ হলো।
আনন্দে আপুত দিভিনবাসীরা ধীরে ধীরে চলে যেতে শুরু করলো।
প্রধানমন্ত্রী সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠল। তার সিকিউরিটি টিম ও সংগীরা প্রস্তুত হলো।
পুলিশ প্রধান প্রধানমন্ত্রীকে জানালো সে একটু পরে যাবে। প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিয়ে বলল, ঠিক আছে, আপনি ওদের সাথে কথা বলে আসুন। আপনি আহমদ মুসার সাথে এয়ারপোর্টে যাচ্ছেন তো?
জি স্যার, আমার গোটা পরিবারই যাবে। বলল পুলিশ প্রধান।
সেটাই ভালো। তাকে বিদায় দেয়াটা সরকারি না হয়ে পারিবারিক হোক, আহমদ মুসা এটাই চায়। প্রধানমন্ত্রী বলল।
বিদায়ের সময় আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, বিদায় বলব না, আসুন বলব। আর আমি যে কথাটা বলেছি, মার্কিন প্রেসিডেন্টকে কথাটা সুযোগ বুঝে বললে আমি বাধিত হবো।
অবশ্যই বলব মি, প্রধানমন্ত্রী। ধন্যবাদ। বলে আহমদ মুসা বিদায় জানাল প্রধানমন্ত্রীকে।
চলে গেল প্রধানমন্ত্রী দল-বল নিয়ে। পুলিশ প্রধানকে নিয়ে আহমদ মুসা, আসতি আওয়াত ও অন্যরা যা করল সরদার আসতি আওয়াতের বাড়ির দিকে।
ডিনার সেরে নিজের ঘরে এসে বসল আহমদ মুসা।
ঘড়ির দিকে তাকাল। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। মাত্র ঘন্টা দেড়েক আগে আহমদ মুসা দিভিন উপত্যকা থেকে ইভা নারিনদের বাসায় এসে পৌঁছেছে। দেরি হয়ে গেছে ওখান থেকে বেরুতেই। দিভিন থেকে বিদায় নয়া তার জন্য কষ্টকর হয়েছে। এরদেলান, আহমদ নেবেজ, শেপল, সিন সেনগারসহ দিভিনের নতুন প্রজন্মের অশ্রু মাড়িয়ে আসতে হয়েছে তাকে। ওরা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছে, এ কয়েকটা দিন তো আর স্বপ্ন ছিল না যে, আমরা এত সহজেই সবকিছু ভুলে যাব, ভুলে যেতে পারব? উত্তরে আহমদ মুসা সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, এটাই জীবন। আল্লাহ মানুষের জীবনকে হাসি-কান্না দিয়ে এভাবেই সাজিয়েছেন। আমরা আনন্দঘন মিলনকে এনজয় করব, বিচ্ছেদে ধৈর্য ধারণ করব, এটাই মহান আল্লাহ চান। আহমদ মুসার এ কথাগুলো ওদের কান্না আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল, থামায়নি মোটেও। সিন। সেনগার বলেছিল, এ কান্না থামবে না ভাইয়া, এ কান্না দুঃখের নয়, বিচ্ছেদের নয়, ভালোবাসার। কান্নার সব প্রস্রবণ পেছনে ফেলেই আহমদ মুসাকে আসতে হয়েছে।
আহমদ মুসা তার ব্যাগ গুছিয়ে নিল। এয়ার লাইন্স টিকিট এখানেই দিয়ে যাওয়ার কথা। টিকিট ও বিদায় নেয়ার জন্যে তাকে আসতে হয়েছে। অ্যারাম আড্রানিক, আন্না এলিনা, সবার কাছেই।
আবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু গড়িয়ে নেবার জন্যে শুতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা। কিন্তু পারল না।
বাইরে পায়ের শব্দ পেল। সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা।
দরজায় নক হলো।
এসো আন্না এলিনা। বলল আহমদ মুসা।
ঘরে প্রবেশ করল আন্না এলিনা, তার বাবা পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিক ও মা মেরী মার্গারিটা।
স্যার, দরজা বন্ধ ছিল। কেমন করে বুঝলেন আমি নক করেছি। আন্না এলিনা বলল।
তুমি সব সময় তর্জনি ও বুড়ো আঙুল একসংগে করে নক কর। শব্দটা মোটা ও ফাপা ধরনের হয়। বলল আহমদ মুসা।
বাবা, তুমি প্রত্যেকটা বিষয়কে এত সূক্ষ্মভাবে দেখ! সত্যিই একটা বিস্ময় তুমি বাবা! আমার ইভা মা দিভিন যাবার সময় আমি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলে সে বলেছিল, উদ্বিগ্ন হয়ো না মা, আহমদ মুসার ছায়ায় কাজ করে মৃত্যুতেও আনন্দ আছে। তিনি মানুষের জন্যে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন। ইভা নারিন ও আন্না এলিনার মা ও পুলিশ প্রধানের স্ত্রী মেরী মার্গারিটা। বলল।
সেও নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জন্যে জীবন দিয়েছে মা। আমাদের বিশ্বাস মতে সে শহীদের মর্যাদা পাবে, যাদের জন্যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে। বলল আহমদ মুসা।
এটাই আমাদের জন্যে সান্ত্বনা বাবা। মা আমার কাজের মধ্যে ডুবে থেকে যেন কোনো এক শূন্যতা ঢেকে রাখতে চাইত। কিন্তু মৃত্যুকালে তার চোখে-মুখে সেই শূন্যতা আমি দেখিনি, দেখেছি পরিতৃপ্তি। সে মৃত্যুকে স্বাগত জানাতে পেরেছে বাবা। এটাও আরেক সান্ত্বনা আমাদের। মেরী মার্গারিটা বলল।
স্যারের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পর আপা একদমই বদলে গিয়েছিলেন। একদিন আপা বললেন, এলিনা, অবশেষে আমি আলোর দেখা পেলাম। আমার জীবনে কোনো অন্ধকার এখন আর নেই। বলে একটু থেমেছিলেন। আপা। আবার বলে উঠেছিলেন, সে আলো আমার নয় এলিনা, কিন্তু সে আলো আমাকে পথ দেখিয়েছে, আমার জীবনকে পূর্ণ করেছে। মৃত্যুকালেও আপা একথাই বলে গেছেন। বলল আন্না এলিনা, ইভা নারিনের বোন।
মায়ের আত্মা শান্তি পাক, তার বেহেশত নসীব হোক, এই প্রার্থনাই আমরা করতে থাকব।
মুহূর্তকাল থেমেই পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিক আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, শেষ পর্যন্ত তোমার টিকিট আহমদ মুসা টার্কিস এয়ার লাইন্সেই হয়েছে। টার্কিস যে প্লেনটা আজারবাইজানের বাকু থেকে আসছে, সেটা ইয়েরেভেনে রাত ৯টায় ল্যান্ড করবে এবং সাড়ে ৯টায় বাগদাদ, রিয়াদ হয়ে মদিনা শরিফ যাবে। সুতরাং তোমার সময়টা আধা ঘন্টা এগিয়ে এসেছে।
তাহলে তো সময় বেশি নেই। বেরুতে হবে আমাকে। আমি প্রস্তুত জনাব। বলল আহমদ মুসা।
এলিনা আরও কি যেন দেবার জন্যে এনেছে। অ্যারাম আভ্রানিক, এলিনার বাবা বলল।
আবার কি আছে এলিনার কাছে। তার ও আপনাদের গিফটে বড় ব্যাগটা তো ভরে দিয়েছেন। বলল আহমদ মুসা।
এটা গিফট নয়, আর আমারও নয়। আপা একদিন এই প্যাকেট আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, এগুলো কাজে লাগাবার সুযোগ আমার আসেই না। তোমার স্যারের এগুলো খুব কাজে লাগবে। তুমি রাখ এবং যখন মনে করবে তখন তাকে এটা দিয়ে দিয়ো।বলে আন্না এলিনা প্যাকেটটা আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরল।
হাত বাড়িয়ে নিল আহমদ মুসা। বলল, প্যাকেটে কি আছে এলিনা, জান?
না, জানিনা স্যার। আমি পৌঁছে দেয়ার বাহক মাত্র। আন্না এলিনা বলল।
আহমদ মুসা খুলে ফেলল প্যাকেটটা। দেখল, ভেতরে আরও দুটো কার্টুন প্যাকেট এবং সেই সাথে ভেলভেট কাপড়ে মোড়া ক্ষুদ্র সাদা একটা রিভলবার।
জিনিসগুলোর দিকে চোখ পড়তেই পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিক বলে উঠল, আহমদ মুসা তুমি নিশ্চয় চিনতে পারছ জিনিসগুলো। অতি কাজের এই দুর্লভ জিনিসগুলো আমিই এনে দিয়েছিলাম ইভা নারিনকে।
হ্যাঁ, একটা দেখছি স্কিন স্পাই সেট, আরেকটা ক্লথ স্পাই সেট এবং রিভলবারটি নিশ্চয় পিনের মতো পাতলা ও পয়জনস বুলেট স্প্রে করে। এ রিভলবার আমি ব্যবহার করিনি, তবে এ সম্পর্কে আমি জানি। কিন্তু স্কিন স্পাই সেট ও ক্লথ স্পাই সেটের নাম শুনেছি, বিস্তারিত কিছু জানি না। বলল আহমদ মুসা।
স্কিন স্পাই সেট ও ক্লথ স্পাই সেটের স্পাই অস্ত্রগুলো প্রায় একই ধরনের, ফাংশনও একই রকমের। পার্থক্য হলো একগুলো স্কীনে পেস্ট হয় আর অন্যগুলো কাপড়ে পেস্ট হয়। স্কিনের পেস্টটা পেস্ট করার সংগে সংগেই তা চামড়ার রং ধারণ করে, আর কাপড়েরটা স্কিনে পেস্ট করার পরে তা কাপড়ের রং নেয়। স্পাই সেটের ক্ষুদ্র অস্ত্রগুলো বিভিন্ন কাজের। এর মধ্যে সাউন্ড মনিটর, রিসিভার, রিমিটার আছে, বিস্ফোরক চীপস আছে যা দিয়ে যেকোনো কংক্রিটের দেয়ালও ১ বর্গগজের মতো ফুটো করা যায়। ল্যাসার কাটার আছে, সাময়িক অন্ধত্ব সৃষ্টিকারী গ্যাস চীপসও আছে, আছে অ্যান্টিগ্যাস চীপস- যা যেকোনো গ্যাস আক্রমণ এক ঘন্টা ঠেকিয়ে রাখতে পারে এবং আছে ভিটামিন চীপস যা খেয়ে কয়েকদিন মানুষ সুস্থ ও সবল থাকতে পারে। অ্যারাম আড্রানিকু বলল।
দারুণ দরকারী জিনিসগুলো তো! এসব তো মার্কেটে পাওয়া যায় না! বলল আহমদ মুসা।
না, এগুলো মার্কেটে পাওয়া যায় না। খুবই গোপন অস্ত্র এগুলো। আমি এগুলো মার্কিন স্পাই নেটওয়ার্ক থেকে যোগাড় করেছি। মা ইভা নারিন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি খুশি হবো আমার মায়ের গিফটগুলো গ্রহণ করলে। অ্যারাম আড্রানিক বলল।
আল্লাহ ইভা নারিনকে এর উপযুক্ত জাযাহ দিন। আমি কৃতজ্ঞ এলিনা ও আপনার কাছেও। আমি আপনাদের কাছ থেকে শুধু নিয়েই গেলাম! বলল আহমদ মুসা।
তোমার সৌজন্যবোধও অনুকরণীয় আহমদ মুসা। কিন্তু তুমি শুধু নিয়ে গেলে, এটা ঠিক নয়। তুমি আর্মেনিয়ায় পা দেবার পর থেকেই যা করেছ, সবই আর্মেনিয়ার জন্যে, আর্মেনিয়ার জনগণের জন্যে করেছ। ইভা নারিনের মৃত্যু তোমাকে আহত করেছে, কিন্তু সেও তো জীবন দিয়েছে আর্মেনিয়ার জন্যে। তোমাকে বাঁচাতে না পারলে সেন্ট সেমভেলকে ধরা যেত না। আর তাকে ধরা না গেলে গোটা পরিস্থিতি পাল্টে যেত। পরে পুলিশকেই আসামী হতে হতো। সেরকম একটা আয়োজনের জন্যে একটা চক্র মুখিয়ে ছিল। আমার ইভা মা তোমাকে বাঁচিয়ে আর্মেনিয়াকেই বাঁচিয়েছে এক প্রবল সন্ত্রাসী চক্রের হাত থেকে। সুতরাং আমরা এবং আর্মেনিয়াবাসী তোমার কাছে। অনেক ঋণি আহমদ মুসা। এই পরিবারেরও তুমি অশেষ উপকার করেছ। ইভা মার কথা ধরো না। অনেক সময় বেঁচে থাকার চেয়ে মরণ আনন্দের হয়। ইভা মাকে দেখে আমার তাই মনে হয়েছে।
একটু থামল অ্যারাম আভ্রানিক। সংগে সংগেই আবার বলল, এবার উঠতে হয় আহমদ মুসা।
হ্যাঁ, চলুন।
বলে আহমদ মুসা অ্যারাম আভ্রানিকের সাথে উঠে দাঁড়াল। তার হাতে তার ছোট ব্যাগটা।
বেয়ারা এসে আহমদ মুসার বড় ব্যাগটা নিয়ে গেল।
আগে হাঁটছিল আড্রানিক। তার পাশে আহমদ মুসা। তাদের পেছনে মেরী মার্গারিটা ও আন্না এলিনা। তাদের দুজনেরই মাথা ও গায়ে ওড়না। জড়ানো। ঢিলা ট্রাউজারের উপর গায়ে ফুলহাতা শার্ট।
অশ্রুতে আন্না এলিনার চোখ ভেজা।
স্যার, আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে, আপনার কষ্ট হচ্ছে না এভাবে চিরদিনের মতো ছেড়ে যেতে! বলল আন্না এলিনা। কান্নায় ভেঙে পড়ল এলিনার শেষ কথাগুলো।
এই কান্নাকে ভয় করে আহমদ মুসা। অথচ এই কান্নার মুখোমুখি হতে হয় তাকে অবিরামভাবে।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। বলল নরম কণ্ঠে, বোন এলিনা, মানুষ হিসেবে তোমার এ ভাইয়ের মনও তোমার মনের মতোই নরম। কিন্তু মনের চাওয়া এবং জীবনের গতি সব সময় মেলে না। যখন মেলে না তখন জীবনের গতিকেই প্রাধান্য দিতে হয়। আর চিরদিনের কথা বলছ কেন? আমরা তো সবাই সবার টেলিফোন নাম্বার জানি। আর আমাদের বাড়ির দূরত্ব এয়ারে তিন ঘন্টারও কম। কষ্ট পেয়ো না বোন, আমি তোমাদের পাশেই আছি মনে করো।
আন্না এলিনা চোখ মুছে বলল, বোন বলেছেন আমাকে! খুশিতে আরও কাঁদতে ইচ্ছা করছে আমার। কিন্তু বকবেন, তাই কাঁদবো না। কিন্তু বোনের দাবি অনেক, ভাইয়ের দায়িত্বও অনেক, কথাটা মনে রাখবেন। আর আমার আবদার কিন্তু বেশি। ভাই ছিল না। ভাই পেয়ে আবদার আরও বাড়বে।
বলতে বলতে আবার কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল তার কণ্ঠ।
শুনব আবদার। কিন্তু আর কান্নাকাটি নয়। বলল আহমদ মুসা।
এলিনার ভাই হয়ে তো আমাদের ছেলে হয়ে গেছ আহদ মুসা। আমরা আবদার নয়, আদেশ করতে পারি। এলিনার মা মে মার্গারিটা বলল।
মা, আমি তো ছেলে হয়েই আছি। মায়ের আদেশকে ছেলেরা ভয় করে।। মমতাময়ী মায়েরা ছেলের সামর্থ্য দেখেই আদেশ করেন। বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। চলতে শুরু করল আবার।
