৫. রক্তাক্ত পামির

চ্যাপ্টার

কুতাইবাকে যখন ওরা গ্রেপ্তার করে তখন তাকে সাধারণ একটা কেউকেটা তারা মনে করেছিল। কিন্তু বখশ শহরের ‘ফ্র’ দপ্তরে দু’ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা বুঝতে পারল কুতাইবা সাধারণের তালিকায় পড়েনা। জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পাহাড়ের মত স্থির এবং পাথরের মত শক্ত সে।
তদন্তকারী অফিসার কর্ণেল সোভার্দনেজ যখন ভাবছিল কোন পথে এগুবে, তখন স্পেশাল অফিসার সরকারী একটা ফাইল এনে তার কাছে রাখল। ফাইল খুলতেই তাতে রাখা একমাত্র শিটটির দিকে তার নজর পড়ল। এইমাত্র তাসখন্দ থেকে পাঠানো কুতাইবার ফাইলের ব্রিফ সামারি। ওতে আছে কর্ণেল গানজভ নাজিমভ ওরফে কুতাইভার সামরিক ও পারিবারিক জীবনের কথা। কর্ণেল সোভার্দনেজ বিম্মিত হলো, তাসখন্দের গভর্ণরের ছেলে এবং কম্যুনিষ্ট সেনাবাহিনীর অনেক গৌরবপূর্ণ রেকর্ডের অধিকারী অফিসার অবশেষে ট্রাকবহরে শ্রমিকের কাজে গেল! ভাবল সে, মানুষ কোন নীতি ও আদর্শের প্রশ্ন ছাড়া ত্যাগ স্বীকার করতে পারেনা। সুতরাং তার মনে হল কুতাইবা সাধারণ নয়, অসাধারণ তালিকার একজন মানুষ।
কর্ণেল সোভার্দনেজ উঠে ধীরে ধীরে গিয়ে কুতাইবার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, গানজভ অহেতুক আপনি কষ্ট দিচ্ছেন আমাদের। আপনার সব পরিচয় আমাদের জানা হয়েছে। তাসখন্দের গভর্ণরের ছেলে এবং কম্যুনিষ্ট সেনাবাহিনীর একজন কৃতি কর্ণেল নিশ্চয় কোন ছোট মিশনে ট্রাক বহর পরিচালনার কাজ নেয়নি। সুতরাং অযথা সময় নষ্ট না করে বলুন, আহমদ মুসা কোথায়? আপনার সাথীরা কোথায়?
কুতাইবা মেঝেয় পড়ে ছিল। তার পা ফেটে গেছে চাবুকের ঘায়ে। চোরের মত গরু পেটা করে তার কাছ থেকে কথা আদায় করতে চেয়েছিল ওরা। চোখ বন্ধ করে পড়ে ছিল কুতাইবা।
মেজর সোভার্দনেজের কথায় কুতাইবা চোখ দুটি খুলল। বলল, আমি আবার বলছি কর্নেল, কোন সহযোগিতাই আমি আপনাদের করতে পারছি না।
কর্নেল সোভার্দনেজ ফিস ফিস করে নরম সুরে বলল, কর্নেল গানজভ, আমি ক্রিমিয়ার মানুষ। আপনাদের ব্যাথা আমি বুঝি, কিন্তু আপনার বাঁচার পথ একটাই, আমরা যা জানতে চাই সেটা বলা।
কুতাইবা হাসল। স্লান হাসি। বলল, নিছক সন্দেহের বসে যাদের পাখির মত লোক হত্যা করতে বাধে না, তাদের সম্পর্কে এসব কথা বাজারে খাটবেনা কর্নেল। তাছাড়া আমি এদের কোন সহযোগিতাই করবোনা। এমন আশা করাও সংগত নয়। আমি তাদের প্রতিপক্ষ।
একটু থামল কুতাইবা। তারপর আবার বলল, আপনাকে ধন্যবাদ কর্নেল। ক্রিমিয়দের স্বাধীন চেতনা ও সংগ্রামকে আমি শ্রদ্ধা করি।
কর্নেল সোভার্দনজের চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এসময় প্রবেশ করল কর্নেল জুকভ, বলল, কর্নেল এ পথে আর মুখ খুলবেনা। আসনে বসাতে হবে। বলে দুটি তালি বাজাল জুকভ। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করল দুজন লোক। ওদের উদ্দেশ্য করে জুকভ বলল, একে অপারেশন রুমে নিয়ে চল।
অপারেশন রুমটা পাশেই। বিরাট হলঘর। মানুষের উপর নির্যাতন চালাবার বিচিত্র সব কলাকৌশল সেখানে। কুতাইবাকে নিয়ে একটা তক্তপোষে রাখল। পায়ের কাছে বিদ্যুৎ সুইচ। আর তক্তপোষের চার ধার দিয়ে প্রায় ডজন খানেক ইস্পাতের রিং। পাশেই পড়ে আছে প্লাস্টিক কর্ড। রিং-এ দড়ি পেঁচিয়ে কুতাইবাকে ভালো করে বেঁধে ফেলা হলো।
কুতাইবা তক্তপোষের চেহারা আর চারিদিকটা দেখেই বুঝতে পেরেছিল ইলেকট্রিক শক দেয়ে নির্যাতনের আসন এটা। শক্ত করে বাঁধতে দেখে খুশিই হলো কুতাইবা। শরীরকে বাগমানানোর কিছু দায়িত্ব দড়িও নিল।
কর্নেল সোভার্দনেজ সেখানে ছিল না। কর্নেল জুকভই সব দেখা শুনা করছিল। বাঁধা হয়ে গেলে কুতাইবার পিছনটায় সুইচের কাছে গিয়ে দাঁড়াল জুকভ। সুইচে হাত রেখে বলল, মিঃ গানজভ অহেতুক আমরা কষ্ট দেয়া পছন্দ করিনা, তুমি আমদের সহযোগিতা কর। তুমি যা কল্পনা করনা, সেই সম্মান ও মর্যাদা তোমাকে দেয়া হবে।
কুতাইবা চোখ বন্ধ করেছিল। জুকভের কথা শুনে চোখ খুলে অত্যন্ত শান্ত ও গম্ভীর কণ্ঠে বলল, মিঃ জুকভ, আপনি এমন অবস্থায় আপনার জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে রাজি হবেন?
-‘না’ বলল কর্নেল জুকভ।
একটু থেমে আবার বলল, কিন্তু গানজভ আমরা তো আপনাকে জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বলছি না, বরং জাতিকে সহযোগিতা করতে বলছি।
-আপনি যে জাতির কথা বলছেন, সে জাতি আমার জাতি নয়।
-কারা আপনার জাতি?
-মধ্য এশিয়ার, কম্যুনিস্ট কবলিত এই দেশের নির্যাতিত মুসলমানদের আমি একজন। আমি আমার এই নির্যাতিত মুসলিম জাতির মুক্তির জন্য কাজ করছি।
কর্নেল জুকভ হাসল। বলল, আপনার সাহসের প্রশংসা করি মিঃ গানজভ। বিদ্যুৎ আসনে শুয়ে এমনভাবে কথা বলতে আমি আর কাউকে দেখিনি। কিন্তু এ সাহস দিয়ে আপনি নিজেকেই ধংস করতে পারবেন, কোন লাভ হবে না।
-ধংস আর লাভের সংজ্ঞাও আপনাদের থেকে আমদের আলাদা। যাকে আপনারা ধংসের কাজ বলছেন, সেকাজই আমাদের কাছে সৃষ্টির। আর লাভের কথা বলছেন? নিজের জাতি, নিজের আদর্শ ও বিশ্বাসের জন্য জীবন দেয়ার চেয়ে বড় লাভের কিছু নেই আমাদের কাছে। এই লাভের প্রত্যাশাই আমরা বেঁচে থাকি। সুতরাং এই জীবন দেয়া আমাদের প্রত্যাশার মৃত্যু। কথা শেষ করে থামল কুতাইবা।
কর্নেল জুকভ যখন কথা শুরু করে, তখনই ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল ‘ফ্র’ এর নিরাপত্তা দপ্তরের ডাইরেক্টর ব্রিগেডিয়ার পুসকভ। তিনি নিরবে দাঁড়িয়ে গোটা কথোপকথনটাই শুনলেন।
কুতাইবা কথা শেষ করলে কর্নেল জুকভ বলল, মিঃ গানজভ আপনার মাথা ঠিক নেই। আমার দুঃখ হচ্ছে আপনার জন্য।
একটু থামল। ঢোক গিলল একটা। তারপর ইলেকট্রিক কানেকশন ঠিক করার জন্য মনোযোগ দিল। ব্রিগেডিয়ার পুসকভ দরজা থেকে কথা বলে উঠল এ সময়। বলল, জুকভ শুনলেই তো এদের দেহটাকে মেরে ফেলে লাভ নেই। এদের আঘাত করতে হবে অন্য জায়গায়। শুন আমার কাছে।
কর্নেল জুকভ উঠে দাঁড়িয়ে একটা স্যালুট ঠুকে সামনে এসে দাঁড়াল পুসকভের। পুসকভ একটু মুখ বাড়িয়ে জুকভের কানে কানে কিছু বলল। পুসকভের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বেরিয়ে গেল জুকভ। পুসকভ এগিয়ে এল কুতাইবার দিকে। তার কাছে এসে জোরে একবার পা ঠুকল মাটিতে। কুতাইবা চোখ মেলে তাকালে পুসকভ বলল, খুব শক্ত না তুমি?
কোন জবাব দিলনা কুতাইবা। পুসকভ আবার বলল, মোল্লা আমির সোলাইমানকে চিন?
-ভালো করে চিনি।
-তার মেয়ে শিরিন শবনমকে তাহলে ভাল করে চিন?
-তার কি হয়েছে?
-কেন তার কিছু হলে খারাপ লাগবে নাকি?
কোন জবাব দিলনা কুতাইবা। বুঝল রসিকতা করতে চাইছে।
পুসকভ আবার বলল, যদি বলি শিরিন শবনম এখানে, তাহলে বিশ্বাস হবে তোমার?
-তোমরা জালেমের ভূমিকায় আছ, তাকে তোমরা ধরে আনবে অসম্ভব কি? কিন্তু হিসার দুর্গের তোমরা কি করেছ?
-চিরদিনের জন্য মাতির সাথে মিশিয়ে দিয়েছি।
-সেখানকার জনপদ, মসজিদ, মাদ্রাসা, সুফী আব্দুর রহমানের কবরগাহ?
-দেখার জন্য যদি তুমি বেঁচে থাক, তাহলে তোমাদের সেই সাধের হিসার দুর্গের আর কোন চিহ্নই আর দেখতে পাবে না।
চোখ বুজল কুতাইবা। ভেসে উঠল তার সামনে হিসার দুর্গের জনপদ। কয়েক হাজার মুস্লিমের এক ঐতিহ্যবাহী জনপদ। ভাসতে লাগল তার চোখের সামনে অনেক শিশু, নারী, বৃদ্ধের অসহায় মুখ। তার সমগ্র সত্তায় একটা যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল। অক্ষম এক বেদনায় চোখের কোণ দু’টি তার ভিজে উঠল।
পুসকভ আবার বলল, দেখবে চল শিরীন শবনমকে।
দরজায় এসে দাঁড়ানো দু’জনকে ইশারা করল পুসকভ। তারা এসে বাঁধন খুলে দিল কুতাইবার। তারপর দু’টি হাত পিছামোড়া করে বেঁধে নিয়ে চলল। পিছনে পিছনে চলল পুসকভ। ছাদ ঢাকা উন্মুক্ত জায়গায় কুতাইবাকে নিয়ে আসা হলো। এর চারপাশে ঘিরে অনেকগুলো ঘর। কুতাইবা বুঝতে পারল, ওগুলো সবই টর্চার চেম্বার। নিকটের জাল ঘেরা ঘরটিতে কয়েকটি সাপকে ঘুরে বেড়াতে দেখল কুতাইবা। শিউরে উঠল কুতাইবা। এ সাপ দিয়ে এরা কি করে।
কুকুরের প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ শব্দে চোখ ফিরিয়ে দেখল ডান পাশের সেলটিতে বিরাট এক কুকুর। জিহবা বের করে ঘেউ ঘেউ করছে। তার চোখের হিংস্রতা যেন ঠিক্রে পড়ছে। হিংস্র ব্লাড হাউন্ডের কথা শুনেছে কুতাইবা। একি সেই।
উন্মুক্তে এসে দাড়িয়েই হাততালি দিল পুসকভ। সেই সাথে বলল, মিঃ গানজভ তুমি বলবেনা আহমদ মুসা কোথায়, তোমার সাথীরা কোথায়?
-আমি আমার কথা বলেছি। সংক্ষিপ্ত জবাবে বলল কুতাইবা।
-ঠিক আছে তোমাকে কথা বলাতে আমরা জানি।
এই সময় শিরীন শবনমকে সেখনে নিয়ে প্রবেশ করল জুকভ।
তাকে দেখিয়ে পুসকভ কুতাইবাকে বলল, চিন তো, এ তোমাদের পুজনীয় মোল্লা আমির সুলাইমানের আদরের নাতনী শিরিন শবনম।
শবনমের গায়ে সাদা (তুর্কি) গাউন। মাথায় তাজিক কায়দায় রুমাল জড়ানো। আঠার বছরের শবনম শুভ্র এক খন্ড ফুলের মত। কিন্তু তার মুখে আজ সেই শুভ্র হাসি নেই। তার বদলে সেখানে নীল বেদনার এক ছায়া। কুতাইবা মোল্লা আমীর সুলাইমানের বাড়ি হিসার দুর্গে বহুবার গেছে। শিরীন শবনমকে না দেখলেও তার নাম কুতাইবার কাছে পরিচিত। কুতাইবা জানে মোল্লা আমীর সুলাইমানের হৃদয়ের টুকরা এই শবনম। কুতাইবা চোখ তুলল তার দিকে। শিরীন শবনমও মুখ তুলেছিল এ সময়। চোখাচোখি হল। নীল চোখে, গভীর দৃষ্টি। তাতে ভয়ার্ত হরিণীর এক অসহায় রূপ। চোখ নামিয়ে নিল কুতাইবা।
তারপর পুসকভের দিকে ফিরে কুতাইবা বলল, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো পূজা করিনা। মোল্লা আমীর সুলাইমান আমাদের পূজনীয় নন, সম্মানিত মুরব্বী। একটু থেমে আবার কুতাইবা বলল, এই নিরপরাধ মেয়েটিকে তোমরা ধরে এনেছ কেন?
হাসল পুসকভ। বলল, ভালো লেগেছে আমাদের মেয়েটিকে। বলে হাস্তে লাগলো। হাসতে হাসতেই বলল, তবে মেয়েটিকে আমরা প্রথমে তোমাকে কথা বলানোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাই।
পুসকভের ইংগিত অস্পষ্ট হলেও একটা আশংকা উঁকি দিল কুতাইবার মনে। এরা জানোয়ারের মত জঘন্য। এরা কি শবনমের শ্লীলতাকে কুতাইবার কথা বলানোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। হৃদয়টা কেঁদে উঠল কুতাইবার। পুসকভই আবার কথা বলে উঠল। বলল, মিঃ গানজভ চেয়ে দেখ তো কুকুরটির দিকে। থামল পুসকভ। কুতাইবা মুখ ঘুরিয়ে প্রথমে কুকুরটি, তারপর পুসকভের উপর চোখ নিবদ্ধ করল। তার মনে চিন্তার তোল্পাড় , কি বলতে চায় পুসকভ।
পুসকভ মুখ খুলল, শিরীন শবনমের সুন্দর দেহটিকে যদি ঐ হিংস্র ব্লাড হাউন্ডের সেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তাহলে কেমন হয় মিঃ গানজভ।
পুসকভের পরিকল্পনা এতক্ষণে স্পষ্ট হলো কুতাইবার কাছে। কেঁপে উঠল তার হৃদয়। যন্ত্রণার এক উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল তার গোটা দেহে।
পুসকভ আবার শুরু করল। বলল, কি ভাবছ মিঃ গানজভ। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, এক মিনিট সময় দিচ্ছি চিন্তার। এর মধ্যে মন স্থির করে যদি আহমদ মুসা ও তোমার সাথীদের খবর আমাদের জানাও তাহলে অতীতের কথা চিন্তা করে, তোমাকে আমরা মুক্তি দিব, পুরস্কৃত করব এবং বাড়তি ইনাম হিসেবে এই অপরূপ মেয়েটিকেও তোমার হাতে তুলে দিব আর যদি মুখ না খোল, তাহলে এক মিনিট পরেই দেখবে ঐ হিংস্র কুকুরের ধারাল দাঁত ও নখের আঘাতে শবনমের সুন্দর দেহটি কিভাবে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে।
থামল পুসকভ। মুখে ক্রুর হাসি। চিন্তার এক মিনিট সময় দিলাম মিঃ গানজভ , এক মিনিট পরেই আমরা ফিরে আসছি , বলে সে এবং জুকভ বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।
কুতাইবার বুকে তখন ঝড়। তার চোখ দু’টি বন্ধ। সমগ্র সত্তা জুড়ে তার এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। যে কোন কষ্ট, যে কোন পরিনতির জন্য সে তৈরী, কিন্তু তাদের বুজুর্গ পীর সুফী আব্দুর রহমানের বংশধর তাদের পরম সম্মানিত মুরুব্বী মোল্লা সুলাইমানের নাতনী একটি ব্লাড হাউন্ডের বন্য হিংস্রতায় ক্ষতবিক্ষত হবে তার চোখের সামনে এটা সহ্য করবে কেমন করে? আর তাকে রক্ষার যে বিনিময় তারা চায়, সেটা সে দিবে কমন করে? মধ্য এশিয়ার মজলুম মুসলমানের মুক্তির জন্য যে সংগঠন গড়ে উঠেছে তার মূল্য সে নিজের জীবনের চেয়ে লক্ষ গুন বেশী মনে কএ। এই সংগঠনের জন্য সে লক্ষবার জীবন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু তার সমাজের অতি সম্মানিত পরিবারের একটি অসহায় নারীর উপর বন্য হিংস্রতা কিভাবে সে চোখের সামনে সহ্য করবে?
উদ্বেগ উত্তেজনার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে কুতাইবার কপালে। ধীরে ধীরে চোখ খুলল সে। চোখচোখি হয়ে গেল শিরীন শবনমের সাথে। কিন্তু তাতে হরিণীর ভয়ার্ত রূপ আর নেই। নিঃসংশয় স্থির দৃষ্টি। রক্তের মত লাল ওষ্ঠাধর শুকনো , কিন্তু ভয়ের কোন কম্পন নেই তাতে। চোখ নামিয়ে নিল কুতাইবা।
কথা বলল শবনম। বলল, আপনি ভাববেন না। একটি জীবনের চেয়ে আমাদের সংগঠনের স্বার্থ, মধ্য এশিয়ার মজলুম মুসল্মান্দের স্বার্থ অনেক বড়। যারা জীবন দিয়ে জাতির জন্য পথ রচনা করেছে, আমাকে তাদের চেয়ে আপনি পিছনে দেখবেন না।
থামল শবনম। চোখ নামিয়ে নিয়েছে সে, চোখ তুলল কুতাইবা। তার চোখে আনন্দ এবং বিস্ময়। আনন্দ-আবেগ-বেদনার এক সমন্বয় তরল রূপ নিয়ে বেড়িয়ে এল তার চোখ দিয়ে। চোখ তুলেছে শবনমও।
-আপনার চোখে অশ্রু? শবনমের চোখে জিজ্ঞাসা উত্তাল হয়ে উঠল।
-এ অশ্রু আনন্দের, অহংকারের শবনম।
কিছু বলতে গিয়েছিল শবনম। কিন্তু পুসকভ ও জুকভ এসে সেখানে প্রবেশ করল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, এক মিনিট দশ সেকেন্ড হয়েছে। বল এখন তোমার কি মত।
-আমার কিছুই বলার নেই। আমরা তোমাদের জুলুম থেকে আল্লাহর সাহায্য কামনা করছি। ধীর কন্ঠে বলল, কুতাইবা। হা হা করে হেসে উঠল পুসকভ। বলল, তোমাদের আল্লাহ এতদিনও তো ছিলেন।
-জালেমকে তিনি একটা সময় দেন। সে সময় তোমাদের শেষ হয়ে আসছে পুসকভ। স্থির কন্ঠে জবাব দিল কুতাইবা।
কুতাইবার কথাটা পুসকভের দেহে আগুণ ধরিয়ে দিল। ক্রোধে জ্বলে উঠল সে। খাপ থেকে পিস্তল বের করে তার বাট দিয়ে উন্মত্তের মত আঘাত করল সে কুতাইবার মাথায়।
চকিতে মাথাটা পিছন দিকে সরিয়ে নিয়েছিল কুতাইবা। তবু, আঘাতটা কপালের একপাশ ছুয়ে গেল। ছিড়ে গেল কপালের একপাশের কিছুটা অংশ। তীর বেগে বেরিয়ে এল রক্ত। সে রক্তে ভিজে গেল তার মুখমন্ডল। গড়িয়ে পড়ল বুকে।
দাঁতে দাঁত চেপে দাড়িয়ে আছে শবনম। চোখে মুখে তার রুখে দাড়াবার ভংগী, কিন্তু চোখ দিয়ে তার গড়িয়ে এল অশ্রু। পুসকভ পিস্তলটি খাপে ভরতে ভরতে বলল, জুকভ ঐ কাল নাগিনীকে ভরে দাও ব্লাড হাউন্ডের সেলে। দেখছি বড় বড় কথা কোথায় যায়।
জুকভ পকেট থেকে একহাতে চাবি বের করে অন্যহাতে ব্লাড হাউন্ডের সেলের তালা টেনে নিল। চাবি প্রবেশ করাল তালায়। ব্লাড হাউন্ড উম্মত্তের মত ঘেউ ঘেউ করছে। যেন পাগল হয়ে উঠেছে মানুষের গন্ধে। জুকভের পাশেই দাড়িয়ে আছে শবনম। চোখ মুখ পাথরের মত শক্ত। বিশ্বের কোন কিছুকেই সে যেন পরোয়া করে না।
বখশ নদীর সমান্তরালে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ‘ফ্র’ এর এই নিরাপত্তা অফিস। হাইড্রোলেক্ট্রিক প্রকল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই বখশ শহরটি ছোট হলেও ‘ফ্র’ এর অফিসটি মোটেই ছোট নয়। গোটা দক্ষিণ পুর্ব ও পুর্ব তাজিকিস্তানে কম্যুনিস্ট স্বার্থের তদারকি এবং মুসলিম উত্থানকে ধ্বংস করার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে এই অফিস।
একেবারে নদীর ধার ঘেষে অফিসটি। বখশ নদীর সমান্তরালে উত্তর দক্ষিণ যে হাইওয়ে তা থেকে লাল ইটের ছোট রাস্তা বেরিয়ে প্রথমে পুর্বদিকে তারপর উত্তর দিকে বাক নিয়ে ‘ফ্র’ এর অফিসের প্রধান ফটকে গিয়ে থেমেছে।
জেলখানার মত উচু প্রাচীরে ঘেরা অফিসটি। ইস্পাতের তৈরী মজবুত ফটক। ফটকের পাশেই গার্ডরুম। গার্ডরুমের ভিতরে গেটের সুইচ। সুইচ টিপলে গেট খুলে যায়। গেট এবং প্রাচীর সারারাত আলোর বন্যায় ভেসে থাকে। তার উপর বিদ্যুতবাহী তারের বেড়াজাল দিয়ে প্রাচীর ও ফটককে দুর্ভেদ্য করে রাখা হয়েছে। অফিসটির নিজস্ব বিদ্যুৎ জেনারেটর রয়েছে এবং সেটা অফিসের ভিতরে। হাইওয়ে থেকে লাল ইটের রাস্তায় ঢোকার মুখে একটা সাধারণ গেট। ক্রেনের মত একটা স্পাতের ডিভাইডার সবসময় রাস্তার উপর পড়ে থাকে। কেউ এলে প্রথমে তাকে রাস্তার পাশের গার্ডবক্সে গিয়ে পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। তারপর বিদ্যুৎ পরিচালিত ডিভাইডারটি উঠে যায়। সবদিক দিয়ে ‘ফ্র’ এর এই কেন্দ্রটিকে দুর্ভেদ্য করে তোলা হয়েছে। আহমদ মুসা ও আলী ইব্রাহীম এলাকাটা একবার ঘুরে দেখার পর তাদেরও এটাই মনে হলো। তাদের সাথে ছিল বখশ শহরের সাইমুমের প্রধান আলী ইমামভ।
তারা তিনজনই হাইওয়ের পাশের একটি টিলার আড়ালে বসে রাত ৯ টা থেকে লাল রাস্তাটার উপর নজর রেখেছিল। ওখান থেকে হাইওয়ের মুখে লাল রাস্তার ফটক এবং প্রধান ফটক দুই-ই দেখা যাচ্ছিল। আহমদ মুসা অতি যত্নের সাথে যে গাড়ীগুলো ‘ফ্র’ এর অফিসের ভিতর ঢুকেছে সেগুলোর প্রতিটির গতিবিধি, সামনের এবং পিছনের লাইট ওয়ার্ক এবং হর্ণ ওয়ার্ক অনুসরণ করছিল। শুরু থেকেই আহমদ মুসা লক্ষ্য করল হাইওয়ের মুখের প্রথম ফটকে সবাই নেমে গিয়ে গার্ডকে সম্ভবতঃ আইডেন্টিটি কার্ড দেখাচ্ছে। কিন্তু, মূল গেটে গিয়ে কেউই গাড়ি থেকে নামছে না। ফটকের সম্মুখে দাঁড়াবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গেটের ভারী ইস্পাতের দরজা সরে যাচ্ছে এবং গাড়ীগুলো ঢুকে যাচ্ছে ভিতরে। আহমদ মুসার বুঝতে কষ্ট হয়নি, এটা আলো সংকেত বা হর্ণ সংকেত কিংবা দুইয়েরই ফল। তারপর থেকে আহমদ মুসা গভীর মনযোগের সাথে গাড়ীগুলোর হর্ণ ওয়ার্ক ও লাইট ওয়ার্কগুলো মুখস্ত করছে। সে দেখছে, প্রত্যেকটা গাড়ীই প্রথম ফটক পার হয়ে উত্তর দিকে টার্ণ নেবার সাথে সাথে ডানদিকের হেড লাইটটা একদমই বন্ধ করে দিচ্ছে এবং গেটের সামনে পৌছা পর্যন্ত গুচ্ছাকারে ২৭ বার হর্ণ বাজাচ্ছে। প্রতিটা গুচ্ছে থাকছে তিনটি করে হর্ন। প্রতিটি গাড়ীই গেটের সামনের রাস্তার পাশে যে লাইট পোষ্ট আছে তার বরাবর গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে দু’টি হেডলাইটের ডিস্ট্যান্ট ফ্লাশ একসাথে জ্বলে উঠে গোট ফটকটাকে আলোয় ধাঁধিয়ে দিয়ে একসাথে নিভে যাচ্ছে। তারপর হর্ণ বেজে উঠছে হারমোনিয়ামের মত একটা ছন্দময় গতিতে। এই শব্দ সংকেত বিশেষজ্ঞ আহমদ মুসার কাছে পরিচিত। শব্দ-সংকেতের কম্যুনিস্ট কোড অনুসারে এর অর্থ, আমি হাজির।
পর্যবেক্ষণ শেষ করে আহমদ মুসা বলল, আলী ইব্রাহীম, আলী ইমামভ, এস আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি। মনে হয় ‘ফ্র’ এর এই দুর্গে ঢোকার চাবিকাঠি আমি হাত করে ফেলেছি। এখন শুধু দরকার শুধু ওদের একটা গাড়ী হাত করা।
তারপর আহমদ মুসা ‘ফ্র’ এর এই অফিস বিল্ডিং এর নক্সা নিয়ে বসল। উল্লেখ্য, গুরুত্বপূর্ণ এই নক্সাটি বখশ শহরের সাইমুম ঘাটিতে আগে থেকেই জোগাড় করা ছিল।
নক্সা দেখা শেষ করে আহমদ মুসা আলী ইব্রাহীম ও আলী ইমামভের সাথে পরামর্শ করল, কিছু নির্দেশ দিল। তারপর তিনজন বেরিয়ে এল টিলার আড়াল থেকে। উঠে এল তারা হাইওয়েতে। তাদের তিনজনের পরনেই তাজিক পুলিশ অফিসারের পোশাক। উল্লেখ্য, সাইমুমের সেই উপত্যকা ঘাটি থেকে আসার পথে তাজিক পুলিশের গাড়ী এবং পোশাক দখল করেই তারা বখশ শহরে পৌঁছেছে।
হাইওয়ে পেরিয়ে তারা তিনজন লাল রাস্তাটার মুখে এসে দাড়াল। আলী ইমামভকে রাস্তার মুখে দাঁড় করিয়ে রেখে আহমদ মুসা আলী ইব্রাহিমকে নিয়ে গার্ড বক্সে এল। গার্ড বক্সে তখন দু’জন দুটি চেয়ারে একটি ছোট টেবিল সামনে রেখে বসে ছিল। আহমদ মুসা গার্ড রুমের দরজায় গিয়ে দাড়াল। একজন রুটিন মাফিক পরিচয় পত্রের জন্য হাত বাড়াল। আহমদ মুসা পকেটে হাত দিল। কিন্তু, পরিচিতি কার্ডের বদলে হাতে বেরিয়ে এল এম-১০ রিভলভার। চোখ দু’টি বড় বড় হয়ে গেল দুজন গার্ডের। আহমদ মুসা ওদের পিছন ফিরে দাঁড়াতে বলল। তারা সুবোধ বালকের মত হুকুম পালন করল।
আহমদ মুসা আলী ইব্রাহীমকে বলল, এ গরীব বেচারারা বেঁচে থাক, এদের তুমি ঘুম পাড়িয়ে দাও আলী ইব্রাহীম।
ক্লোরফরম ভেজা রুমাল দিয়ে ওদের ঘুম পাড়িয়ে দিল আলী ইব্রাহিম। তারপর ওদের বেঁধে দুজনে ধরে পাশের টিলার আড়ালে একটি খাদে ফেলে রেখে এল।
তিনজন গার্ড বক্স এ বসে অপেক্ষা করতে লাগল গাড়ির। মাত্র দশ মিনিট। একটা কার এসে রোড ডিভাইডার এর সামনে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নেমে এলো একজন সুঠাম দেহী মানুষ। এলো গার্ড রুমের দরজায়। পরিচিতি কার্ড তার হাতেই ছিল। কিন্তু আহমদ মুসাদের দিকে চেয়ে মনে হয় সে চমকে উঠল। সম্ভবত গার্ড এর পোশাকের বদলে পুলিশ পোশাকের এবং সংখ্যায় দুজনের বদলে তিন জন হওয়াই এর কারন। কিন্তু চিন্তা করার আর সে সুযোগ পেল না। আহমদ মুসার সাইলেন্সার লাগান এম-১০ পিস্তল নিরবে অগ্নি বর্ষণ করল। দরজার উপরে লুটিয়ে পড়ল লোকটি। লোকটিকে টেনে গার্ড বক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে তিনজনে বেরিয়ে এলো গার্ড রুম থেকে। আহমদ মুসা গিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসল। পাশে আলী ইব্রাহিম। পেছনের সিটে আলী ইমামভ।
সিটে বসে আহমদ মুসা ঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে পিছন সিটের দিকে তাকিয়ে বলল, আলী ইমামভ এখন রাত ১১ টা। তোমার লোকেরা কয়টায় এখানে পৌঁছাবে?
-আমাদের স্পিড বোট গুলো এতক্ষণে এসে গেছে। স্থল ইউনিট ঠিক রাত সাড়ে ১১ টায় এই শহর এলাকায় পোঁছাবে। ঠিক আছে বলে আহমদ মুসা গাড়িতে স্টার্ট দিল। গেট আগেই খুলে রেখেছিল। তীর বেগে এগিয়ে চলল গাড়ি। আহমদ মুসা মুখস্ত অংকের ফরমুলার মত গাড়ির হর্ন-ওয়ার্ক ও লাইট-ওয়ার্ক করে এগিয়ে চলল গেটের দিকে।
গেটের সামনে সেই লাইট সেই লাইট পোষ্টের সমান্তরালে মুখস্ত করা একই নিয়মে গিয়ে দাঁড়াল। দুটা হেডলাইটের ডিস্ট্যান্ট ফ্লাশ আলোয় ধাঁধিয়ে দিল গেটটিকে। তারপর হারমনিয়ামের মত ছন্দময় গতিতে হর্ন বাজাল ‘আমি হাজির’।
সঙ্কেতে সে কোন ভুল করেনি। তবু ও আহমদ মুসার মন কি হয় না হয় সন্দেহের দোলায় দুলছে। প্রায় শ্বাসরুদ্ধ ভাবে সে তাকিয়ে আছে ইস্পাত এর দরজার দিকে। মনের আকুল আকুতি, ইস্পাতের দরজাটা দুলে উঠুক, সরে যাক দরজাটা।
হ্যাঁ ইস্পাতের দরজাটা দুলে উঠল। মুহূর্তে হারিয়ে গেল প্রাচীর এর গেটে। দরজা সরে গেলে গেটের ওপাশে প্রশস্ত চত্বর এবং বিশাল এক গাড়ি বারান্দা আহমদ মুসার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা যে স্পীডে এসে ছিল, সেই স্পিডেই গাড়ি চালিয়ে দিল। গাড়ি তীর বেগে ছুটে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল। দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসা মুখ ফিরিয়ে পেছন সিটের দিকে তাকিয়ে বলল, বোমা পাতার কাজ তোমার শেষ? আলী ইমামভ সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল। তারপর গাড়ি থেকে নেমে এলো তারা তিনজন। কোমরে খাপের মধ্যে ঝুলানো তাদের এম-১০ পিস্তল। পিস্তলের বাঁটে হাত রেখে আহমদ মুসা দ্রুত উঠে এলো। তার পিছনে আলী ইব্রাহিম এবং আলী ইমামভ।
ছোট সিঁড়ির পর অভ্যর্থনা রুমের দরজা। T আকারের তিন ব্লকে বিভক্ত চারতলা এই বিল্ডিং – এর অভ্যর্থনা কক্ষটি গ্রন্থির মত। এর দক্ষিন অংশে দক্ষিণ ব্লকের সিঁড়ি, উত্তর অংশে উত্তর ব্লকের সিঁড়ি। আর ঘরের মেঝে পেরুলে ঠিক নাক বরাবর যে সিঁড়ি উঠে গেছে তা দিয়ে মাঝের মূল ব্লকে যাওয়া যায়। এ সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠে গেলে দেখা যাবে আরেকটা সিঁড়ি নিচে একতলায় নেমে গেছে। এই এক তলাতেই ‘ফ্র’ এর কয়েদ খানা ও টর্চার চেম্বার। এই একতলা ছাড়া গোটাটাই ‘ফ্র’ এর নিরাপত্তা অফিস।
অভ্যর্থনা কক্ষের দরজার বাইরে স্টেনগান হাতে একজন রক্ষী দাঁড়িয়ে ছিল। তিনজন পুলিশ অফিসারকে আসতে দেখে সে মুহূর্তকাল দ্বিধা করল। কিন্তু অবশেষে সে খুলে দিল দরজা। তারা তিনজন প্রবেশ করলে দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
অভ্যর্থনা কক্ষ শূন্য। আহমদ মুসা খাপ থেকে রিভলভার বের করে নিল। তারপর ছুটল মাঝখানে সিঁড়ির দিকে। হাতে পিস্তল বাগিয়ে আলী ইব্রাহিম এবং আলী ইমামভ আহমদ মুসার পিছে পিছে ছুটল।
দোতালায় উঠে একতলায় নামার সিঁড়ি খুঁজে নিল আহমদ মুসা। কিন্তু দেখল একতলায় সিঁড়ির দরজা বন্ধ। দরজা ভাল করে পরীক্ষা করে বুঝল বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত এই দরজা।
হতাশভাবে চারিদিকে নজর বুলাল আহমদ মুসা। না, কোথাও কোন সুইচ নেই। দরজার গা, দরজার চৌকাঠ আহমদ মুসা ভালো করে পরীক্ষা করল। না, কোথাও গোপন বোতামের অস্তিত্ব নেই। এই দিকে সময় বয়ে যাচ্ছে। অস্থির হয়ে উঠল আহমদ মুসা। না, দরজা ভাংতে হবেই। সে পকেটে হাত দিল লেজার ছুরি বের করার জন্য। কিন্তু হঠাৎ নড়ে উঠল দরজা। নীচ থেকে কেউ কি বেরিয়ে আসছে?
আহমদ মুসা রিভলভার বাগিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিল।
দরজা খুলে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে মাঝারি উচ্চতার একজন সুঠাম দেহী মানুষ। আহমদ মুসার রিভলভার এর নল তার বুকে। আহমদ মুসা তাকে নির্দেশ দিল, পেছনে ফিরে নিচে নামুন।
লোকটি প্রথমে বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পরক্ষনেই যেন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেল। নির্দেশ পালন করল সে। সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে সবশেষে নেমে এলো আলি ইমামভ। সিঁড়ি যেখানে এসে শেষ হয়েছে সেখান থেকে পূর্ব দিকে এগিয়ে যাবার গোড়ায় দাড়িয়ে সেই লোকটিকে আহমদ মুসা বলল, কুতাইবা এবং শবনম কোথায়?
-কুতাইবা? আমি জানিনা। বলল লোকটি।
আলী ইব্রাহিম বলল, মিঃ গানজভ এবং শবনম কোথায়?
লোকটির মুখে যেন এক টুকরা হাসি খেলে গেল। বলল, সাহায্য আমি কেন করব?
আহমদ মুসা রিভলভার নাচিয়ে বলল, জীবনের বিনিময়ে।
-জীবনের বিনিময়ে কি এ ধরনের তথ্য দিতে আপনারা রাজি হবেন?
আহমদ মুসা বুঝল , লোকটি সময় নিতে চায় , মতলব খারাপ। আহমদ মুসার কঠোর কণ্ঠে বলল, আমরা রসালাপ করতে আসিনি, আপনাকে আমরা সময় দেবনা।
আহমদ মুসার শাহাদাৎ আঙ্গুল রিভলভারের ট্রিগারে। ট্রিগারের এর উপর আঙ্গুলের চাপ ক্রমশঃ বাড়ছে। লোকটি গম্ভীর হল। বলল, বলছি তবে জীবনের ভয়ে নয়, আমি আপনার সাহায্য করতে চাই, মিঃ গানজভ এবং শবনমের মুক্তি আমিও কামনা করি। তারপর লোকটি বলল, এই করিডোর যেখানে শেষ হয়েছে সেটা একটা হলঘর। ওখানেই তাদের পাবেন।
আহমদ মুসা বলল, চলুন আপনি আগে আগে। তার দিকে আহমদ মুসার রিভলভার তখনও তাক করা। লোকটির চোখ বলছে সে সত্য কথাই বলছে, কিন্তু এই মুহূর্তে বিশ্বাস করে আহমদ মুসা ঠকতে চায় না, সত্যের মত করে ও অনেকে মিথ্যা বলতে পারে।
করিডোর দীর্ঘ। মাঝে মাঝে অপেক্ষাকৃত সরু উত্তর-দক্ষিণ মুখী করিডোর একে ক্রস করেছে।
আগে আগে চলছে লোকটি, তার ঠিক পেছনে আহমদ মুসা। তাদের একটু পেছনে আলী ইব্রাহিম ও আলী ইমামভ। একটা ক্রস করিডোর পার হয়ে তারা গজ দশেক এগিয়েছে। এমন সময় আলী ইমামভ চাপা কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, মুসা ভাই বসে পড়ুন। বাজের মত ক্ষিপ্র আহমদ মুসা ইমামভের কথা শেষ হবার আগেই বসে পড়েছে। তার বসে পড়ার সাথে সাথেই একটা বুলেট শাঁ করে ছুটে গিয়ে আগের সেই লোকটিকে বিদ্ধ করল।
আহমদ মুসা বসেই বিদ্যুতবেগে শরীরটাকে ঘুরিয়ে নিয়েছিল। দেখল, কয়েক গজ পেছনে ফেলে আশা ক্রসিং পয়েন্টে উদ্দত পিস্তল হাতে একজন দাঁড়িয়ে। আহমদ মুসার আঙ্গুল ট্রিগারেই ছিল। শুধু হাতটি উপরে উঠাতে যা দেরি। আহমদ মুসার এম-১০ পিস্তল থেকে এক পশলা বুলেট ছুটে গেল। লুটিয়ে পড়ল লোকটার দেহ।
আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়িয়ে দেখল, আগের সেই লোকটি মুখ থুবড়ে পড়েছে তার পায়ের কাছেই। গুলি বামে পাজর ভেদ করে চলে গেছে। কি যেন বলতে গেল সে। আহমদ মুসা একটু ঝুঁকে পড়ল। কথা আসছেনা লোকটির মুখে। তবু সে বলতে চায় কথা। অনেক কষ্টে একটা হ্মীন কণ্ঠ তার শোনা গেলো। আমি কর্নেল সোভার্দনজ, আমি রুশ নই, ক্রিমিয়। আমি আপনার মতই স্বাধীনতাকে ভালবাসি।
সর্ব শক্তি একত্র করে যেন কথা কটি বলল সোভার্দনজ। কথা শেষ হবার সাথে সাথে নিরব নিথর হয়ে গেলো তার দেহ।
স্বাধীনতার আকুল পিয়াসি এই মানুষটির মুখের দিকে চেয়ে মুহূর্তের জন্য আনমনা হয়ে পড়ছিল আহমদ মুসা।
তারপর এই আবার উঠে করিডোর ধরে পূর্ব দিকে ছুটল আহমদ মুসা। তার সাথে আলী ইব্রাহিম এবং আলী ইমামভ।
জুকভ চাবি ঘুরিয়ে তালা খুলে ফেলেছিল, কিন্তু তালাটা হুক থেকে তখনও খুলতে পারেনি। পুশকভ দাঁড়িয়ে মজা দেখার জন্য তৈরি হচ্ছিলো।
বোধ হয় ভাবছিল, ব্লাড-হাউন্ডটা যখন শবনমের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, তখন চেহারাটা কেমন হবে কুতাইবার। এমন সময় করিডোরের দিক থেকে গুলির শব্দ এল। চমকে উঠল পুশকভ। চমকে উঠে একবার জুকভের দিকে চাইল। তারপর খাপ থেকে রিভলভারটা হাতে তুলে নিয়ে করিডোর ও হলরুম সংযোগকারী দরজায় মুহুর্তকাল দাঁড়াল। বোধ হয় বুঝতে চেষ্টা করল উৎকীর্ণ হয়ে। দরজার খুব কাছে পায়ের শব্দ শুনে সে দরজার এক পাশে দাঁড়াল।
এই সময় দরজা প্রচন্ড এক ধাক্কায় খুলে গেল। একটা পাল্লা গিয়ে দরজার পাশে দাড়ানো পুসকভের মাথায় বেশ জোরেই ঠোকা দিল। আর দরজা প্রায় তাকে ঢেকে দিল। কুতাইবা, জুকভ, শবনম সবাই তাদের চোখের আড়ালে চলে গেল। উদ্যত রিভলভার হাতে দরজায় এসে দাড়িয়েছে আহমদ মুসা। করিডোরে গুলির শব্দ শুনেই তালা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়েছিল জুকভ। দরজায় আহমদ মুসাকে দেখেই পিস্তলের বাটে হাত দিলে সে। কিন্তু দেরী হয়ে দেছে। আহমদ মুসার রিভলভার থেকে এক পশলা গুলি গিয়ে ঝাঝরা করে দিল জুকভের বুক।
কুতাইবা দরজার দিকে ইংগিত করে বলে উঠল, মুসা ভাই এই দরজার আড়ালে আরেকজন।
কুতাইবার কথা তখনও শেষ হয়নি। আহমদ মুসা প্রচন্ড বেগে ঠেলে দিল দরজাটা দেয়ালের দিকে।
‘আ’ করে একটা শব্দ হলো। সেই সাথে একটা ভারি কিছু খসে পড়ল মাটিতে। আহমদ মুসা দরজা টেনে নিয়ে দেখল, দেয়াল ও ইস্পাতের দরজার প্রচন্ড চাপে পিষে গেছে পুসকভের দেহ। মাথা ফেটে গেছে। এই অবস্থাতেই হাত থেকে ছুটে যাওয়া পিস্তল হাতড়াচ্ছিল পুসকভ। আহমদ মুসার রিভলভার আবার গুলি বৃষ্টি করল। নিশ্চল হয়ে গেল পুসকভের দেহ।
আলী ইব্রাহিম ও আলী ইমামভ ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। দাহাতে মুখ ঢেকে ব্লাড হাউন্ডের সেলের সামনেই বসে পড়েছে শিরীন শবনম। দুহাত ছাপিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার। অশ্রু কষ্টের নয়, এ অশ্রু আনন্দের, এ অশ্রু মুক্তির।
আলী ইমামভ গিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা কুতাইবার হাতের বাঁধন কেটে দিল। কুতাইবা জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। কুতাইবার চোখেও তখন অশ্রু। সে অশ্রু কপাল থেকে নেমে আসা রক্তের ধারাকে আরো যেন বেগবান করে দিল।
কুতাইবার কপালের ক্ষত থেকে তখনও বেশ রক্ত ঝরছিল। আহমদ মুসা ক্ষতটা বেঁধে ফেলার জন্য চারদিকে চাইল কিছু পাওয়া যায় কিনা। সেদিকে তাকিয়েছিল শবনম। সে বুঝতে পাল আহমদ মুসার ইচ্ছা। শবনম তাড়াতাড়ি মাথার রুমালটি খুলে আহমদ মুসার হাতে দিল।
‘শুকরিয়া বোন’ বলে রুমালটি হাতে নিল আহমদ মুসা।
কুতাইবার ক্ষতস্থানটি বেঁধে দিয়ে সে সবাইকে বলল, তোমরা সবাই ঘরের উত্তর কোণে গিয়ে দাঁড়াও। করিডোরের সাথে সংযোগকারী খোলা দরজার দিকে একবার তাকাল আহমদ মুসা। দরজাটিকেও সে বন্ধ করে দিল।
তারপর সে বলল, আর দুমিনিটের মধ্যে আমাদের গাড়ী বোমার বিস্ফোরণ ঘটবে। আমাদের এর মধ্যেই এখান থেকে সরতে হবে। আমরা পূবের এই দেয়ালের বাধা ভাঙতে পারলেই বখশ নদীতে দাঁড়ানো আমাদের বোটে গিয়ে উঠতে পারবো।
আহমদ মুসা কাঁধ থেকে বগলের নিচে ঝুলানো থলে থেকে একটা ডিম্বাকৃতি জিনিস বের করল। ওটা এ্যান্টি ওয়াল গ্রেনেড। সীমিত পরিসরে প্রচন্ড আঘাত হেনে এই গ্রেনেড যে কোন দেয়ালে একটা চার ফিট বাই ছয় ফিট গবাক্ষ সৃষ্টি করতে পারে।
আহমদ মুসা অতি সন্তর্পনে গ্রেনেড থেকে পিন আলগা করে নিয়ে ঘরের উত্তর কোণের দিকে তাকিয়ে বলল, বোন শবনম, কানে আঙ্গুল দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বস। তারপর দেয়ালের দক্ষিণ প্রান্তে মেঝে থেকে পাঁচ ফিট উপরে ছোট ঘুলঘুলিটির নিচে দেয়ালে গ্রেনেডটি ছুড়ে মারল আহমদ মুসা। বিকট শব্দ, প্রচন্ড কাঁপুনি। ধোঁয়ায় ভরে গেছে গোটা ঘর। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। বাইরের ঠান্ডা বাতাসে ঘর ভরে গেল, সেই সাথে কমলো ধোঁয়াও। দেখা গেল মেঝে থেকে পাঁচ ফিট উপরে বিরাট একটা গবাক্ষ। আকাশের তারা দেখা যাচ্ছে সে গবাক্ষ দিয়ে।
আহমদ মুসা বলল, কুতাইবা, তুমি প্রথম বেরিয়ে যাও। বোট ঠিক কের রাখ। শবনমকে তুলে নেবার ব্যবস্থা করবে বোটে। বলে আহমদ মুসা গবাক্ষের নিচে মেঝেতে বসে পড়ল। বলল, আমার কাঁধে উঠে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাও। ইতস্তত করছিল কুতাইবা। আহমদ মুসা তাকে একটা মিষ্টি ধমক দিল।
কুতাইবা গবাক্ষে উঠে দেখল, একদম বরাবর নয় দশ ফুট নিচেই নদীর পানি। দেয়ালের পাথরের ভিত্তি পানি থেকেই উঠে এসেছে। একটু দুরেই দুটি বোট দেখতে পেল সে। মনে হচ্ছে এগুলো এগিয়ে আসছে। কুতাইবা ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে।
কুতাইবার পর শবনম। শবনম কুতাইবার মতই ইতস্তত করছিল। বলল, আমি পারবো না কাঁধে পা দিতে। আহমদ মুসা বলল, এটা নির্দেশ শবনম।
শবনম আর কোন কথা বলল না। কাঁধে উঠে গবাক্ষে উঠে বসল। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। একে একে সবাই বেরিয়ে গেলে নিজে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা যখন ঝাঁপিয়ে পড়ছিল পানিতে, তখনই এক প্রচন্ড বিস্ফোরণে উলট পালট হয়ে গেল ‘ফ্র’ এর অফিস বিল্ডিং। সেই সাথে প্রচন্ড গোলাগুলিরও আওয়াজ এল চতুর্দিক থেকে। বোটে উঠতে উঠতে আহমদ মুসা বলল, সাইমুমের ছেলেরা ঠিক সময়েই এসেছে। আলী ইমামভ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু মুসা ভাই, গাড়ী বোমার বিস্ফোরণ ৪০ সেকেন্ড আগে ঘটল কেন?
-হতে পারে সময় নির্ধারণে আমাদের ভুল হয়েছে অথবা হতে পারে আল্লাহর কোন মঙ্গল ইচ্ছা এর মধ্যে আছে। এই বিস্ফোরণের ফলে বলা যায় আমাদের এদিকে নজর দিতে ৪০ সেকেন্ড সময় তারা কম পেল। বলল আহমদ মুসা। গোটা বখশ শহর তখন অন্ধকার। সাইমুম কর্মীরা শহরের ভেতর ও বাইরে থেকে শহরের গোটা প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে দিয়েছে। সাইমুম কর্মীরা এখন শহরের অস্ত্র এবং অস্ত্রাগার হাত করার কাজে ব্যস্ত।
অন্ধকারের মধ্যে নদী বেয়ে ৫টি বোট এগিয়ে চলেছে শহরের বাইরের সাইমুম ঘাঁটির দিকে। ক্লান্তিতে আহমদ মুসা গাটা এলিয়ে দিয়েছে বোটের পাটাতনে। মাথাটা ব্যথায় ঢিপ ঢিপ করছে তার। সেই পুরানো আঘাতের ব্যথাটা এখনও সারেনি।
ভেজার পর কুতাইবার কপালের ব্যান্ডেজটা আবার লাল হয়ে উঠেছে রক্তে। রক্তের একটা সোদা গন্ধ, সেই থেকে একটা অপরিচিত সুগন্ধ নাকে আসছে তার। বুঝল, সুগন্ধটা শবনমের রুমালের। ভেজার পর রুমালের একটা অংশ নাকের গোড়া পর্যন্ত নেমে এসেছে। একটু দুরেই বসে আছে শবনম। চোখটা যেন জোর করেই ওদিকে চলে গেল কুতাইবার। মনে হল শবনম এদিকেই তাকিয়ে ছিল। কুতাইবা চাইতেই সে চোখ মাটিতে নামিয়ে নিল। কুতাইবার চোখ ঘুরে চলে গেল দুর আকাশের ঐ আদম সুরতের দিকে।
হঠাৎ তার নিজ বাড়ীর সুন্দর চিত্রটা ভেসে উঠল কুতাইবার চোখে। ভাবতে ভালো লাগল তার গৃহের অমন একটা সুন্দর শান্তিময় আশ্রয়ের।
কেঁপে উঠল কুতাইবা। সে তো গানজভ নাজিমভ নয়। কুতাইবা সে। মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের লাখো লাখো ঘরের মিছিলে ঘর বাঁধবার সুযোগ কুতাইবার কোথায়?

Top