৫. রক্তাক্ত পামির

চ্যাপ্টার

ওলগা এবং ফারহানা রেস্ট হাউজের সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল তাদের রুমে যাবার জন্য। রাতের খাওয়া হয়ে গেছে, এখন যাওয়ার জন্য গোছ গাছ করার পালা। আজ রাতের খাওয়ার আগে সমাপনী আনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। এখন যার ইচ্ছা আজ যেতে পারে, কাল সকালেও যেতে পারে। আজ গেলে তাকে নিজের ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে।
ওরা দোতালায় উঠে গেছে, এমন সময় বেয়ারা গিয়ে ওলগাকে খবর দিল, স্যার তাকে তাঁর অফিসে ডাকছেন। ফারহানা চলে গেল তার রুমে। ওলগা স্যারের সাথে দেখা করার জন্য নীচে নেমে গেল।
ফারহানা গিয়ে তার বিছানায় গা এলিয়ে ওলগার জন্য অপেক্ষা করছিল। ওলগা এলেই দুজনে মিলে গোছ-গাছে লাগবে। ওলগা পনের মিনিট পরে এল। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। ওলগার মুখ ফ্যাকাশে। চোখ দু’টিতে তার উদ্বেগ ও ভীতি।
ফারহানা তার দিকে চেয়ে বিস্মিত হলো। উদ্বিগ্ন ভাবে উঠে বসল সে। বলল, কিছু হয়েছে ওলগা তোমার?
কিছু উত্তর দিলনা ওলগা। নীরবে এসে তার পাশে বসল। ফিস ফিস করে বলল, গোয়েন্দা পুলিশ এসেছে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। বোধ হয় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করবে এবং বাড়ি সার্চ করবে।
-কেন? জিজ্ঞাসা করল ফারহানা।
-ব্যাপারটা পরিষ্কার। ঐ ওরা দু’জন আমার মা’র সেকশনে এবং পাশের চেয়ারে বসে কাজ করত। সুতরাং মা’র সাথে তাদের কোন যোগশাজস থাকতে পারে। যদি থাকে আমিও তাহলে তার সাথে যুক্ত আছি। সুতরাং ওদের সন্ধানে আমার এখানে আসা স্বাভাবিক।
আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভার জন্য উদ্বিগ্ন হল ফারহানা। ওলগার বাড়ী সার্চ হলেই তো ওরা ধরা পড়ে যাবে। এখন কি করবে সে। কিন্তু ফারহানা কিছু বলার আগেই আবার কথা বলল ওলগা। বলল, আমার বেশী সময় নেই ফারহানা, তোমাকে একটা দায়িত্ব দিতে চাই।
-কি দায়িত্ব? দ্রুত কণ্ঠে বলল ফারহানা।
-আমি আসার সময় ওদের দু’জনকে আমার খালার বাড়ীতে সরিয়ে রেখে এসেছি। আমার বাড়ী সার্চ করার পর, এরা তাঁর বাড়ীও সার্চ করবে। তারা সেখানে পৌঁছার আগেই তোমাকে গিয়ে ওদের সেখান থেকে সরাতে হবে। পারবে? ফারহানা খুশী হলো। আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভাকে নিরাপদে সরিয়ে নেবার পথ একটা আছে জেনে আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করল। ফারহানা ওলগাকে জরিয়ে ধরে বলল, চিন্তা করোনা বোন, এ দায়িত্ব আমি নিলাম।
খুশীতে ওলগার মুখটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল সে, আমার মায়ের জন্য আমি কোন দিন কিছু করতে পারব কিনা জানিনা, এদের জন্য কিছু করতে পারলেও আমি শান্তি পাব এই ভেবে যে, মায়ের দেয়া একটা দায়িত্ব পালন করেছি। তার দু’চোখে দু’ফোটা জল টল টল করে উঠল।
ফারহানা ওলগার কাঁধে একটা হাত রেখে সান্তনা দিয়ে বলল, কেঁদোনা বোন, মজলুমদেরই অবশেষে জয় হবে।
-হবে বলছ? আমার মা আবার ফিরে আসবেন?
-নিরাশ হতে আল্লাহ্ নিষেধ করেছেন। সুতরাং আমরা অবশ্যই করব।
-তোমাদের আল্লাহ্ সম্পর্কে আমি জানতে চাই ফারহানা। তোমাদের জীবন্ত ধর্ম বিশ্বাস আমার ভাল লাগে।
-বেশ তুমি জানবে।
ওলগা আর কোন কথা বলল না। তাড়াতাড়ি কাগজে খালার ঠিকানা লিখে ফারহানার হাতে দিয়ে বলল, আমার বাড়ী সার্চ করার সময়টুকু হয়তো তুমি পাবে ওদের সরিয়ে নেবার জন্য।
ফারহানা বলল, আমি সব বুজেছি ওলগা, তুমি চিন্তা করোনা। ওলগা সবে কাপড়-চোপড় গোছ-গাছে হাত দিয়েছে। দরজায় নক হলো। দরজা খুলে দিল ওলগা। দেখল, স্বয়ং স্যার দাঁড়ীয়ে। ওলগা বলল, আসছি স্যার, হয়ে গেছে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল ফারহানা। সেও স্যারকে বলল, স্যার আমিও চলে যাচ্ছি, সব ঠিক করে নিয়েছি।
মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিষয়ক অধ্যাপক নিকোলাই ষ্টেপনাভ বলল যেতে পার, আমরা তো বলেই দিয়েছি।
একটু থামল ষ্টেপনাভ। তারপর ওলগার দিকে তাকিয়ে নীচু কণ্ঠে বলল, ভয় করোনা ওলগা, ভয় করেও কোন লাভ নেই। স্রষ্টাকে ডাক। ওলগা হাতের কাজ থামিয়ে বিস্ময়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনিও ইশ্বরের কথা বলছেন?
অধ্যাপক ষ্টেপনাভ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, তোমার মা’র মত আমরা সাহসী নই, তাই উচ্চ কণ্ঠে বলতে পারিনা। কিন্তু আমরা কেউ না বললেও ঈশ্বর আছেন এবং থাকবেন।
ওলগা কিছু বলতে যাচ্ছিল। অধ্যাপক ষ্টেপনাভ বাধা দিয়ে বলল, কোন কথা নয়। তৈরী হয়ে নাও। তাড়াহুড়া করছে ওরা। এসে পড়বে হয়তো এখানেই।
ওলগা তৈরী হয়ে স্যারের সাথেই বেরিয়ে গেল। পরে ফারহানাও বেরিয়ে এল। ফারহানা নীচে এসে দেখল, একটা চকচকে গাড়ী, গাড়ী-বারান্দা থেকে বেরিয়ে গেল। গাড়ী বারান্দার এক পাশে দাঁড়ীয়ে অধ্যাপক ষ্টেপনাভ। ফারহানা বুঝল এই গাড়ীতেই ওলগা গেল। ফারহানাকে দেখে অধ্যাপক ষ্টেপনাভ বলল, কিসে যাবে?
-বিমানে সিট তো মিলবেনা, গাড়ীতেই যাব স্যার।
-একা যাচ্ছ, বিমানেই যাও। এখনই আলাপ হলো সিট একটা আছে।
খুশী হল ফারহানা। ১৫ মিনিট পর বিমান ছাড়বে। সব মিলিয়ে অন্ততঃ আধা ঘন্টা আগে মস্কো পৌছা যাবে। ফারহানা বলল স্যার আপনি একটু টেলিফোনে বলে দিন।
অধ্যাপক স্টেপানাভ বলল, তুমি যাও আমি বলে দিচ্ছি। ফারহানা গাড়ীতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে এয়ারপোর্ট চলল। বিমানে সিট পেয়ে গেল ফারহানা। পিছনের দরজার কাছাকাছি একটা সিট পেল সে।
বিমান উড়ল আকাশে। টয়লেটে যাবার সময় ফারহানা কয়েক সারি সামনে দেখতে পেল ওলগাকে। দেখে সে চমকে উঠল। তা হলে সড়ক পথে তারা যায়নি। অথচ সে মনে করেছিল ওরা গাড়ীতেই যাচ্ছে। ব্যাপারটা চিন্তা করতেই শিউরে উঠল সে। বিমানে সে সিট না পেলে কি অবস্থা দাঁড়াত। তার মিশন নির্ঘাত ফেল। কিছুতেই সে ওদের আগে অলগার খালাম্মার বাড়ীতে পৌঁছাতে পারতো না। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল ফারহানা। আল্লাহ্ যেন বিশেষ করুনায় বিমানে আসার সু্যোগ করে দিয়েছেন।
বিমান মস্কো বিমান বন্দরে এসে ল্যান্ড করল। ফারহানা ওলগাদের পিছু পিছুই নামল বিমান থেকে। বিমান বন্দর থেকে বেরুতেই একটা কার এসে তাদের সামনে দাঁড়াল। ওলগাকে ড্রাইভারের পাশে সামনের সিটে তুলে দিয়ে গোয়েন্দা অফিসার দু’জন পিছনের সিটে বসল। ওরা চলে গেলে ফারহানা ভাল চকচকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ল। ড্রাইভার একজন মাঝারী বয়সের রাশিয়ান। ফারহানা তাকে বলল, গোর্কি রোড থেকে আমার দু’জন বান্ধবীকে নিয়ে কারকোভভ রোডে যাব।
চলতে চলতে ভাবল ফারহানা, ওলগার খালাম্মা কেমন হবে? আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা তার সাথে আসতে চাইবে কি না? সময় হাতে বেশী নেই। অনুমান সত্য হলে ওলগার বাড়ী সার্চ করার পরপরই তারা ওলগার খালাম্মার বাড়ীতে যাবে। সুতরাং মিনিট পনেরর বেশী সময় নেয়া তার কিছুতেই ঠিক হবে না।
গোর্কি রোডে ওলগার খালাম্মার বাড়ীর ঠিকানা ফারহান আবার মনে মনে আওড়ালো, বই-২১/১১।
তখন রাত সাড়ে ন’টা বাজে। ফারহানা গোর্কি রোডের ২১ নম্বর ব্লকে গিয়ে পৌছাল। গাড়ী বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখে ফারহানা উপরে উঠে গেল লিফটে চড়ে। ১১নং ফ্ল্যাট ৪তলায়। ফারহানা ১১নং ফ্ল্যাটের দরজায় গিয়ে নক করলো। একবার, দু’বার, তিনবার।
-আমি ওলগার কাছ থেকে এসেছি। আপনি কি ওলগার খালাম্মা?
-হ্যাঁ। বলল মহিলাটি।
-জরুরী কথা আছে, ভেতরে আসতে চাই।
-আসুন। বলে স্বাগত জানাল মহিলাটি।
ভেতরে ঢুকেই ফারহানা বলল, আমাকে আয়েশা ও রোকাইয়েভার কাছে নিয়ে চলুন।
ওলগার খালাম্মা আরেকবার ফারহানার দিকে তাকাল। সন্ধানী দৃষ্টি তার।
আমাকে বিশ্বাস করুন, বলে খালাম্মার ঠিকানা লেখা ওলগার হস্তাক্ষর খালাম্মার হাতে দিল। সেদিকে একবার তাকিয়ে খালাম্মা ফারহানাকে নিয়ে তার বেড রুমে গেল। ডেকে আনল আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভাকে। তারা আসতেই সালাম দিয়ে বলল ফারহানা, আমি ফাতেমা ফারহানা, আমি মুসলিম তাজিক।
আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা দু’জনেই তাকে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে স্বাগত জানাল। ফারহানা খালাম্মার দিকে তাকিয়ে বলল, এই মুহুর্তে ওলগার বাড়ী সার্চ হচ্ছে, সেখান থেকে তারা এখানে আসতে পারে। আমি এদের দু’জনকে নিয়ে যেতে চাই। ওলগার মত এটাই।
সার্চ হওয়ার কথা শুনে খালাম্মার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আতংকের একটা চায়া নামল তার চোখে। সে বলল, ওলগার এটাই মত হলে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু তোমার পরিচয় কি মা, কোথায় কি ভাবে এদের নিয়ে যাবে?
ফারহানা বলল, আমি এদের বোন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
ফারহান মাথা নীচু করে খালাম্মার হাতে একটু চুমু খেয়ে বলল, চলি খালাম্মা। আর ওদিকে চেয়ে বলল, চলুন বোনেরা।
আয়েশা আলিয়েভা ফারহানাকে দেখেই তাকে বিশ্বাস করেছে। সে যাবার জন্য ঘুরে দঁড়াবার আগে খালাম্মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওলগাকে আমার ভালোবাসা দিবেন। কোন দিনই আপনাদের কথা ভুলবনা।
লিফট দিয়ে তিঞ্জনেই নেমে এল গাড়ী-বারান্দায়। ড্রাইভার গাড়ী খুলে ধরল। ওরা তিনজনেই পেছনের সিটে উঠছিল। তারা কেউই লক্ষ্য করলনা, আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভার দিকে চোখ পড়তেই ড্রাইভারের ভ্রুটা কেমন কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল।
গাড়ীর দরজা বন্ধ করে ড্রাইভার তার সিটে গিয়ে বসল। ছেড়ে দিল গাড়ী।
পিছনের সিটের মাঝখানে বসেছে আয়েশা আলিয়েভা। সামনের দুই আসনের ফাঁক দিয়ে স্পিডোমিটার, গাড়ীর গিয়ার পরিবর্তন, ষ্টিয়ারিং হুইলে রাখা ড্রাইভারের দুটি হাত সবই দেখতে পাচ্ছে সে।
স্পিডোমিটারের কাঁটা ফিফটিতে। বলা যায় আস্তেই চলছে গাড়ী। এক জায়গায় এসে সামনের গাড়ী গুলো মনে হয় কোন কারনে থেমে গেল। এ গাড়ীটাও দাঁড়িয়ে পড়ল। হর্ন দিচ্ছে বার বার ড্রাইভার। এ গাড়ীর হর্ন শুনে চমকে উঠল আয়েশা আলিয়েভা। একটা নির্দিষ্ট কোডে হর্ন বাজানো হচ্ছে, এ কোড তার কাছে পরিছিত। ‘ফ্র’ এবং কম্যুনিস্ট সরকারের গোয়েন্দারা এই কোডে হর্ন বাজায়। ট্রেনিং-এর সময় সেও এটা শিখেছে।
তা হলে এ গাড়ী কম্যুনিস্ট গোয়েন্দা অথবা ‘ফ্র’ এর। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পর শিউরে উঠল আয়েশা আলিয়েভা। সে মাথা কাৎ করে ফারহানার কানে কানে বলল, এ গাড়ী আপনার ভাড়া করা নিশ্চয়?
-হ্যাঁ। বলল ফাতিমা ফারহানা।
-কোথা থেকে ভাড়া করেছেন?
-বিমান বন্দর থেকে।
-এ গাড়ী গোয়েন্দা বিভাগের।
শুনেই ফারহানা উদ্বেগের মধ্যেও একটা সান্তনা খুঁজল, আমাদের পরিচয় ও জানবে কি করে?
আয়েশা আলিয়েভা তার রিভলভার হাতে তুলে নিয়েছে। ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। তার চোখ দু’টোকে ড্রাইভারের সিটের সমান্তরালে নিয়ে গেছে। এখন ড্রাইভারে সব কিছু সে দেখতে পাচ্ছে।
হঠাৎ সে দেখল ড্রাইভার তার পকেট থেকে একটা ছোট অয়্যারলেস সেট বের করে মুখের কাছে ধরল। সে কিছু ইনফরমেশন পাচার করবে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হোল আয়েশা আলিয়েভা। তাহলে আমাদের চিনতে পেরেছে?
চিন্তা করার সাথে সাথে আয়েশা আলিয়েভা পায়ে ভর দিয়ে একটু উঁচু হলো এবং ড্রাইভারের ঘাড়ের বিশেষ স্থান লক্ষ করে সজোরে রিভলবারের বাঁট চালাল সে। এবং সাথে সাথেই সিট টপকে ষ্টিয়ারিং হুইল হাতে নিল। গাড়িটা একটু ঝাঁকুনি খেয়ে একটু বেঁকে গিয়ে আবার ঠিক হয়ে গেল।
ঘাড়ের বাম পাশে কানের নীচে ঠিক মোক্ষম জায়গাতেই আঘাত লেগেছিল। আঘাত লাগার সাথে সাথেই দান পাশে দলে পড়েছিল ড্রাইভার। মাথাটা সিট এবং গাড়ীর দেয়ালের পাশে দুকে গিয়েছিল। দেহের মধ্যে ভাগটা সিটের উপর ছিল। আয়েশা আলিয়েভা সেটা ঠেলে নিচে নামিয়ে দিল। ড্রাইভারের দেহটা বেঁকে সিটের পাশে এমন করে ঠেসে গেছে যে, তার পক্ষে উঠা অসম্ভব।
সিটে ভাল করে বসে গড়ীর স্পীড বাড়ীয়ে দিল সে। পিছনের সিটে বসে ফাতিমা ফারহান এবং রোকাইয়েভা কাজ গুলো দেখছিল। আলিয়েভার হাতে গাড়ীর নিয়ন্ত্রন আসার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ফাতিমা ফারহানা এবং রোকাইয়েভা।
অন্যদিকে আয়েশা আলিয়েভা ভাবছিল অন্য জিনিস। গোয়েন্দা ড্রাইভার ইতিমধ্যেই কোন অথ্য পাচার করেছে কিনা? গাড়ীতে উঠার পর যত দূর মনে পড়ে গোয়েন্দা সে সুযোগ পায়নি। তার এ চিন্তা ঠিক কি না সে বিষয়ে নিশ্চিৎ হবার জন্য সে রিয়ারভিউ -এর দিকে উদ্ভিগ্ন ভাবে তাকিয়েছিল। সে গাড়ীর স্পীড বাড়ীয়ে, স্লো করে দিয়ে বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা করল। না, কেউ ফলো করছেনা। তা হলে সে খবর পাচার করতে পারেনি। সবে সে চেষ্টা করতে যাচ্ছিল বলে মনে হয়।
আশ্বস্ত হল আয়েশা আলিয়েভা। ড্রাইভার তার গড়ীর নম্বরটা এবং অবস্থানটা যদি হেড অফিসে দিয়ে দিতে পারত, তাহলে এতক্ষনে ওরা চারদিক থেকে এসে ঘিরে ফেলত। ওদের সে ট্র্যাপ থকে বেরুনো কঠিন হতো। আল্লাহ্ একটা বড় সাহায্য করেছেন।
মুখ ফিরিয়ে ফারহানাকে লক্ষ্য করে আয়েশা আলিয়েভা বলল, যে ঠিকানায় যাচ্ছি সেখানে ড্রাইভার এবং গাড়ী সামাল দেয়ার ব্যবস্থা আছে তো?
আয়েশা আলিয়েভা কি বলতে চায় তা ফাতিমা ফারহানা বুঝল। বলল, আছে, নিশ্চিত থাকুন।
কারকভ সড়ক আলিয়েভা চেনে। এখানে বড় বড় কর্তাদের বাস। অনুসরণ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হবার জন্য অনেকটা পথ ঘুরে আলিয়েভা জিজ্ঞেস করল, কত নম্বর।
-বি-৭০০। আরেকটু সামনে। বলে দিব আমি। বলল ফারহানা। বি-৭০০ কম্যুনিস্ট পার্টি সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য এবং পলিটব্যুরোর সদস্য কনষ্টাইন করিমভের বাসা। তিনি সরকারী বাড়িতে থাকেন, এখানে থাকে তাঁর বড় ছেলে ফরিদভ। তাঁর বয়স ৫০ এবং মস্কো মহানগরী কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সে। আজ পাঁচ বছর ধরে সে সাইমুমেরও সদস্য। তাঁর স্ত্রী হামিদাও সাইমুমের মহিলা ইউনিটে কাজ করে। মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের মুক্তির চাইতে তাদের বড় কামনা আর কিছুই নাই।
ফরিদভ-এর বাড়ী সাইমুম প্ল্যাটফরম হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। কারকভ রোডের অপজিটে ষ্ট্যালিন এভিনিউ। ফরিদভের বাড়ীর পেছন দিকের গোপন দরজাটা খুললে ষ্ট্যালিন এভিনিউতে দাঁড়ানো অশতিপর কূটনীতিক ফেদর বেলিকভ এর বাসায় পৌঁছানো যায়। তিনি জাতিতে রাশিয়ান, কিন্তু বিয়ে করেছিলেন তাঁর সহপাঠী এক কাজাখ মেয়েকে। দীর্ঘ কয়েক যুগ তিনি বিভিন্ন আরব দেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সময় থেকেই তিনি একদিকে স্ত্রীর প্রভাব অন্যদিকে ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারপর তিনি মধ্যপ্রাচ্য থাকতেই সাইমুমের আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি আজ মস্কোর সাইমুম ব্রাঞ্চের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি সবকিছুই ছেড়ে দিয়েছেন সাইমুমকে। তাঁর বাড়ীতেই সাইমুম মহিলা ব্রাঞ্চের অফিস। তাঁর একমাত্র নাতনী হাসনা আইরিনা মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। মহিলা ইউনিটের সে অফিস সেক্রেটারী। এই মহিলা ইউনিটের অফিসে আসার জন্য ফরিদভ এবং বেলিকভ উভয়ের বাড়ীর পথই ব্যবহার করা হয়।
ফরিদভ এর বিরাট গেট পার হয়ে আলিয়েভার গাড়ী ফরিদভের গাড়ী-বারান্দায় প্রবেশ করল। গাড়ী থামতেই ফারহানা নেমে ভিতরে গেল। কয়েক মিনিট, তারপরই ফরিদভ এবং তাঁর স্ত্রী হামিদা ফারহানার সাথে বেরিয়ে এল। গাড়ীতে চাবি দিয়ে গাড়ী থেকে নামল আয়েশা আলিয়েভা। নামল রোকাইয়েভাও। হামিদা এগিয়ে এসে প্রথমে জড়িয়ে ধরল আয়েশা আলিয়েভাকে, তারপর রোকাইয়েভাকে।
কুশল বিনিময়ের পর আয়েশা আলিয়েভা ফারহানার দিকে তাকিয়ে বলল, গাড়ী ও ড্রাইভারের বিষয় বলছেন?
ফরিদভ এগিয়ে এসে বলল, তোমরা ভিতরে যাও মা, আমি জানি গাড়ী এবং ড্রাইভার দু’টোর অস্তিত্বই আমাদের জন্য বিপজ্জনক। আয়েশা আলিয়েভার হাত থেকে চাবি নিয়ে ফরিদভ গিয়ে গাড়ীতে বসল। বেরিয়ে গেল গাড়ী।
হামিদা সবাইকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল। হামিদার বাড়ী পেরিয়ে সেই গোপন দরজা দিয়ে মহিলা সাইমুমের অফিস অর্থাৎ-ফেদর বেলিকভের বাড়ীতে গিয়ে বসল। তাদের সাথে হাসনা আইরিনা এসে যোগ দিল। তাঁর সাথে এল কিছু বিস্কুট ও গরম দুধ।
ফাতিমা ফারহানা সবার হাতে বিস্কুট তুলে দিয়ে দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে নিজে একটা গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, আমি গোয়েন্দা বইতে এতদিন যা পড়েছি, তা আজ নিজ চোখে দেখলাম। বোন আয়েশা যেভাবে পেছনের সিট থেকে গিয়ে ড্রাইভারকে কাবু করে সিট দখল করল তা এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। সবচেয়ে বড় কথা ড্রাইভারকে সরকারী গোয়েন্দা বলে চিনতে পারাটা আমার কাছে এখনও এক স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে।
ফারহানার কথা শেষ হতেই রোকাইয়েভা বলল, মস্কোভা বন্দী শিবির থেকে সরকারী গাড়ীতে করে সরকারী প্রসাদে আসার পথে বোন আয়েশা যে ভাবে একাই তিন সশস্ত্র রক্ষীকে কাবু করেন সেটা বোন ফারহানা জানলে আজকের ঘটনাকে কোন ঘটনাই বলতেন না।
রোকাইয়েভা থামতেই সবাই বলে উঠল, কি সেই ঘটনা।
গরম দুধে চুমুক দিতে দিতে গোটা কাহিনী বলল রোকাইয়েভা, তারপর আজকের কাহিনী শোনাল ফারহানা।
সবাই যখন আনন্দ-বিস্ময় নিয়ে আয়েশা আলিয়েভার প্রশংসায় মুখ খুলছে, তখন আলিয়েভা ধীর কণ্ঠে বলল, আপনাদের মত আমিও বিস্ময় বোধ করছি। যা করেছি তাঁর যোগ্যতা আমার নেই, আল্লাহই নিজ হাতে আমাদের সাহায্য করেছেন। সুতরাং প্রশংসা কিছু করতে হলে তারই করতে হবে।
আয়েশা আলিয়েভার কথায় সবাই চুপ করল।
ফারহানা মুখ খুলল প্রথম। বলল আয়েশা আপা ঠিকই বলেছেন। আমাদের প্রতি পদক্ষেপই আমরা এটা দেখেছি। হামিদা বলল, আল্লাহ্ আমাদের কবুল করেছেন, তারই প্রমান এটা।
একটু থেমে আবার হামিদাই বলল, আল্লাহ্র এ সাহায্য পাওয়ার যোগ্যতা যদি আমরা বাড়াতে পারি, তাহলে দেখব বিজয় আমাদের খুবই নিকটে। মধ্য এশিয়ার মানুষের সাথে কম্যুনিস্ট সরকারের মানসিক বিভাজন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে এবং তাঁর ফলে একটা দৈহিক ভাঙ্গনও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এটা চূড়ান্ত হওয়া একটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
হামিদা খালাম্মা থামল। কিন্তু কেউ আর কোন কথা বলল না। সবারই শূন্য দৃষ্টি সামনে। যেন সন্ধান করছে মুক্তির সেই সোনালী দিগন্ত কতদূর।
মস্কোতে ওয়ার্ড রেড ফোর্সেস- ‘ফ্র’-এর বড় বড় মাথাগুলো কয়েক দিনে ঘেমে উঠেছে। গেল কোথায় মেয়ে দুটি। বিমান বন্দর, বাস ষ্টেশন এবং রেলওয়ে ষ্টেশনগুলোকে বলতে গেলে সিল করে দেয়া হয়েছে, মস্কো থেকে তারা বেরুতেই পারেনা। মস্কোতেই তারা আছে। ড্রাইভার সমেত ট্যাক্সি লাপাত্তা, তারপর মস্কোভা নদী থেকে তাদের উদ্ধার থেকেও যে প্রমান পাওয়া গেছে তাতে এ বিশ্বাস আরও প্রবল হয়ে উঠেছে তারা মস্কোতেই আছে। কিন্তু কোথায় আছে, প্রাণপণ চেষ্টা করেও এর কোন হদিস তারা করতে পারেনি। মস্কোভা বন্দী শিবিরে যারা আছে তাদের সবার আত্মীয় স্বজনের বাড়ী সার্চ করা হয়েছে, কিন্তু কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। মস্কোভা বন্দী শিবিরেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, কিন্তু কিছুই বের করা যায়নি। এই ব্যর্থতাকে মস্কোর কম্যুনিস্ট পার্টির মহাশক্তিধর ফার্ষ্ট সেক্রেটারী, যিনি দেশের সব কিছুর ভাগ্য বিধাতা, বিষয়টাকে নিজের প্রেষ্টিজের সাথে যুক্ত করে ফেলেছেন। সরকারী প্রসাদের নিরাপত্তা প্রধানকে বরখাস্ত করা হয়েছে। মস্কোর নিরাপত্তা প্রধানকে ডেকে ধমকানো হয়েছে। সব মিলিয়ে বিষয়টা নিয়ে উপর তলা এখন আগুন। মস্কোর ঘরে ঘরে সার্চ ছাড়া মস্কোর নিরাপত্তা বিভাগ আর সব কিছুই করেছে।
এ ব্যাপারগুলোর সবই সাইমুমের নজরে আছে। আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভাকে বেশীদিন মস্কো রাখা ঠিক হবেনা, এটা চিন্তা করেই মস্কোর সাইমুম শাখা একটা প্লান তৈরি করেছে ওদের মধ্য এশিয়ায় পাঠাবার জন্য।
প্রতি ১৫দিনে একবার একটা বিশেষ ট্রেন মস্কো থেকে তাসখন্দ যায়। বিলাসবহুল এ বিশেষ ট্রেনটি মূলত ভ্রমণকারীদের জন্য, যারা বৈচিত্রময় ল্যান্ডস্কেপ দেখতে ভালবাসে। বিদেশীদের জন্য এ ট্রেনটি একটা বড় আকর্ষণ। যারা সোজা তাসখন্দ যেতে চায় এমন স্বদেশী যাত্রীও এতে ওঠে। এ ট্রেন্টির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো মাঝখানে তেল নেবার জন্য একবার দাঁড়ানো ছাড়া আর থামে না, যাত্রি উঠানামা কোথাও আর করেনা।
নিয়ম হলো, এ ট্রেনে টিকেটের জন্য ফটো সমেত দরখাস্ত করতে হয়। দরখাস্তের পর বিশেষ টিকিট কার্ড ইস্যু করা হয়। সে কার্ডে প্যাসেঞ্জারের ফটো জুড়ে দেয়া থাকে। এই টিকিট কার্ড মূলত একটা আইডেন্টিটি কার্ডই। সাইমুম ঠিক করছিল ট্রেনেই আয়েশা আলিয়েভা ও রোকাইয়েভার জন্য নিরাপদ হবে। এর সব চেয়ে ভাল যে দিকটা সাইমুম বিবেচনা করছে সেটা হলো, সামনের তারিখে এ ট্রনের ডাইরেক্টর যিনি তিনি একজন উজবেক। নাম আবু আলী সুলেমানভ। আফগানযুদ্ধে তার দুই ছেলে মারা গেছে। যুদ্ধের শুরুতে যে উজবেক ব্রিগেডকে আফগানিস্তানে পাঠানো হয়, তাতে তার দুই ছেলে শামিল ছিল। সুলেমানভ মনে করে তার ছেলেদের জোর করে যুদ্ধে পাঠিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। লাশ পর্যন্ত সে পায়নি। সেই থেকে সুলাইমানভ কম্যুনিস্ট সরকারের উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ। তারপরই সাইমুমের সাথে তার যোগাযোগ হয়। মুসলিম মধ্য এশিয়াকে কম্যুনিস্ট অক্টোপাস থেকে মুক্ত করার জন্য সুলেমানভ এখন একনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। এই সুলেমানভই আশ্বাস দিয়েছে এই ট্রেন অন্য মাধ্যমের চেয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। ট্রেনে বেশ কিছু রেলওয়ে পুলিশ থাকে। এরাই পথের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু ভয়ংকর কিছু নয়। এরা দুরনিতিবাজ, বেশীর ভাগ সময় ঘুমিয়েই কাটায় এই বিশেষ ট্রেনটির জন্য টিকিট কার্ড ইস্যু করে রেলওয়ে বিভাগ, কিন্তু OK করে নিরাপত্তা বিভাগ।
ঠিক হয়েছে আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভাদের জন্য নকল ফটো দিয়ে টিকিট কার্ড তৈরী হবে। নকল ফটোর টিকিট কার্ড যাবে নিরাপত্তা বিভাগে পাশের জন্য। সেখান থেকে পাশ হয়ে আসার পর ফটোর উপরের অংশ পাল্টে ফেলা হবে। এ কাজ রেলওয়ে দফতরে অনেক হয় পয়সার বিনিময়ে। শেষ মূহুর্তে টিকিট কার্ড বদলের ব্যাপারটা সম্ভব হয়না বলে, নতুন কাউকে এ্যাকোমোডেট করার জন্য এটা করা হয়। সেখানকার দায়িত্ব সুলেমানভ নিজেই নিয়েছে। কার্ড হয়ে গেল।
মস্কোর মহিলা ইউনিট, ছাত্রী ইউনিট সকলের কাছে বিদায় নিল আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা। গাড়ীতে করে ফাতিমা ফারহানা খাদিজায়েভা এবং হাসনা আইরিনাই তাদের পৌছে দিল দক্ষিণ মস্কোর রেল ষ্টেশনের সুলাইমানভের অফিস বারান্দায়। পৌছে দিয়ে বিদায় নিয়ে তারা ঘুরে দাঁড়াল আসার জন্য। আয়েশা আলিয়েভা ফারহানার হাত ধরে এক পাশে টেনে নিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, কিছু বলবে তাঁকে? মুখে তার দুষ্টুমির হাসি।
-কাকে? তার চোখে কিছুটা বিস্ময়।
-তাঁকে।
-কাকে?
-ইস, কাকে আবার নেতাকে।
মুখে এক ঝলক রক্তের ছোপ লাগল যেন ফারহানার। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল তার মুখ। কিন্তু নিজকে সামলে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল, এসব কথায় তার অবমাননা হয়, তিনি অনেক বড়।
আয়েশা আলিয়েভা ফারহানার হাত দুটি টেনে নিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, এটা আমার একটা নির্দোষ আবেগ মাত্র। মাফ কর বোন, আল্লাহ নিশ্চয় আমাকে ক্ষমা করবেন।
ফাতিমা ফারহানা আয়েশা আলিয়েভার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, আমরা দূর্বলতার উর্ধ্বে নই। সে জন্য সব সময় আমাদের আল্লাহর সাহায্য চাওয়া উচিত।
-এ দূর্বলতা কি সব সময় অন্যয়? বলল আয়েশা আলিয়েভা।
-মানব মনের এ এক স্বভাব অনুভূতি। শরীয়তের সীমা না ডিঙালে এটা অপরাধ নয় বলে আমি মনে করি।
এ সময় রেলওয়ের ষ্টেশন মাইকে তাসখন্দ ট্যুরিষ্ট এক্সপ্রেসে যাত্রীদের আসন নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হল।
আর কথা বলল না কেউ। আয়েশা আলিয়েভা ফারহানার একটা হাত টেনে নিয়ে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, আসি বোন, আবার দেখা হবে খোদা হাফেজ।
ফারহানাকে বিদায় দিয়ে রোকাইয়েভার হাত ধরে দু’জনে এক সাথে প্রবেশ করল সুলাইমানভের অফিসে। লংকোটে ঢাকা তাদের গোটা শরীর। মাথায় পশমের টুপি। তা কপাল এবং দু’গালের একাংশ পর্যন্ত ছাড়া গোটা দেহটাই ঢাকা।
সুলেমানভ তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। তারা ঘরে ঢুকতেই সে উঠে দাঁড়াল। কাছে এসে মুখ নিম্নমুখী রেখেই বলল, আমরা প্রাইভেট দরজা দিয়ে প্ল্যাটফরমে ঢুকব। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবে না। তবু কেউ জিজ্ঞেস করলে নতুন নাম বলবেন। আয়েশা আলিয়েভা হবেন লিলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা হবেন নিনিয়েভা। এই নামেই টিকিট কার্ড হয়েছে। ট্রেনের গোটা সময়ে আপনারা এ নামেই পরিচিত হবেন। কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়াল সুলেমানভ। তারপর ‘আসুন’ বলে চলতে শুরু করল।
খুব স্বাভাবিক ভংগিতেই হেঁটে চলছিল। দেখলে মনে হয় তিনজন রেলওয়েরই কেউ হবেন। রেলওয়ে সিকুইরিটি ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই তারা চলছিল। প্রবীন সুলেমানভকে দেখে সবাই রাস্তা ছেড়ে দিয়েছে। প্ল্যাটফরমে এসে পৌঁছল ওরা। বামদিকে প্ল্যাটফরমের গেটটি দেখতে পেল আয়েশা আলিয়েভা। সেখানে বিরাট লাইন। রেলওয়ে কর্মচারীদের সাথে সিকুইরিটির একদল লোক সবার টিকিট কার্ড পরীক্ষা করছে। কার্ডের ফটোর সাথে মিলিয়ে দেখছে বিশেষ মানুষকে। অনেকের মাথায় টুপি, হ্যাট খুলে মিলিয়ে দেখছে। বিশেষ করে মহিলা যাত্রীদের ক্ষেত্রেই এ কড়াকড়িটা বেশী দেখা যাচ্ছে।
প্ল্যাটফরমে পাশাপাশি চলতে চলতে সুলেমানভ নিম্ন স্বরে বলল, ট্রেনে উঠার পর আপনাদের দায়িত্ব আমি অবশ্যই পালন করব। তবে কোন অসুবিধা না হোক, আমি প্রার্থনা করি।
ট্রেনে দুই সিটের বেশ কিছু রিজার্ভ বার্থ আছে। স্বস্ত্রীক এবং বিলাসী পার্টি বস অথবা বিশেষ বিদেশী কোন রাষ্ট্রীয় মেহমানের জন্য এসব বার্থ রাখা হয়েছে। সুলেমানভ এ ধরনেরই একটি বার্থ যোগাড় করেছে আয়েশা আলিয়েভাদের জন্য। ইঞ্জিনের পরে কয়েকটি লাগেজ ভ্যান। তারপর প্যাসেঞ্জার কম্পার্টমেন্টের প্রথম বার্থ সেটা। সুলেমানভ বার্থটি আয়েশা আলিয়েভা ও রোকাইয়েভাকে দেখিয়ে চলে গেল।
বার্থ দেখে দু’জনে খুশী হলো। দীর্ঘ পথ আরামেই যাওয়া যাবে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লে ঝামেলা থেকেও বাঁচা যাবে। বিশেষ করে একপ্রান্তের ঘর হওয়ার কারণে নিরিবিলিই থাকা যাবে। ঠিক ন’টায় ট্রেন ছেড়ে দিল। ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলের মধ্যে এটা অত্যন্ত দ্রুতগামী ট্রেন। ঘন্টায় একশ’ মাইল চলে। মস্কো থেকে তাসখন্দ রেলপথ দু’হাজার মাইল। সময় লাগবে বিশ ঘন্টা। মাঝখানে ট্রেন একবার থামবে। ইউরোপ থেকে এশিয়ার প্রবেশ মুখে ইউরাল পর্বতমালার গোড়ায়। ইউরাল নদীর তীরে। ইউরাল শহরে তেল নেবার জন্য। সেটা সকাল ৭টায়। তারপর একেবারে গিয়ে তাসখন্দে থামবে সন্ধ্যা ৫টার দিকে।
ট্রেন এখন ফুলস্পীডে চলছে। বার্থের দরজা বন্ধ করে দু’জন শুয়ে পড়ল। ভোর পাঁচটায় তাদের ঘুম ভাঙল। উঠে ওজু করে নামাজ পড়ল। ভালই কাটল রাতটা। সামনে একটা দিন বাকী। ট্রেনে কি আর কোন চেকিং হবে? রেল পুলিশকে তেমন ভয় নেই, কিন্তু ‘ফ্র’ -এর লোক কি ট্রেনে নেই? না থাকাটাই অবিশ্বাস্য। আলিয়েভা জানে কম্যুনিষ্ট সরকারের গোয়েন্দা থাকেনা এমন কোন জায়গা নেই। বিশেষ করে পাবলিক প্লেস, গণ-সমাবেশের ক্ষেত্রগুলোতে তারা না থেকেই পারেনা। ট্রেন এমনই একটি জায়গা। এই ট্রেনে বিদেশীরা, গণ্যমান্য পার্টির বসরা থাকেন, অতএব তারা না থেকেই পারেনা।
এসব নানা কথা ভেবে আয়েশা আলিয়েভা রোকাইয়েভাকে বলল, রিভলভার কাছে রেখো, সাবধান থাকতে হবে আমাদের। দিনের আলোতে কারো নজরে পড়ে যাবার সম্ভাবনা আমাদের আছে।
এ ট্রেনে রুম সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে। সুতরাং বাইরে না বেরুলেই চলে। তারা ঠিক করল, খাওয়া-দাওয়া সেরে আরেকবার আচ্ছা করে ঘুমাবে তারা। রোকাইয়েভা বলল, ট্রেনের কোথায় কি আছে, কারা কোথায় রয়েছে, এসব একবার দেখে নিলে হতোনা?
আলিয়েভা খুশী হয়ে বলল, ঠিক আছে রোকাইয়েভা।
ওরা বেরিয়ে গোটা ট্রেনটা একবার দেখে এল। ট্রেনের ডাইরেক্টরের রুমের পাশেই রেলওয়ে পুলিশের রুম। এরপর ট্রেনে একটা ক্যানটিন আছে। এ কয়টি বাদে অন্য সবগুলো প্যাসেঞ্জারদের জন্য ট্রেনে লম্বালম্বী দীর্ঘ করিডোর রুমগুলোর সামনে দিয়ে এসেছে। এ করিডোর দিয়েই একবার ঘুরে এল আয়েশা আলিয়েভা ও রোকাইয়েভা। অধিকাংশ রুমের দরজা বন্ধ। কারো কারো সাথে দেখা হল করিডোরে। পাঁচজন পুলিশকে পুলিশ রুমের সামনেই দেখা গেল।
ঘুরে এসে তারা নাস্তা খেতে বসল। গাড়ির গতি এ সময় কমে এল, এক সময় থেমে গেল গাড়ী। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আয়েশা আলিয়েভা সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল সামনেই ব্রিজ–ইউরাল নদীর উপর। নদীটি ইউরাল পর্বতমালা থেকে বেরিয়ে কাস্পিয়ান সাগরে গিয়ে পড়েছে। ইউরালস্ক নগরীর নদী তীরের সামান্য অংশ নজরে আসছে। ঘরবাড়ী ও মানুষের আচার আচরণে এখানে ইউরোপীয় ধাঁচটাই মূখ্য। তবে এখানকার পল্লী জীবনে কাজাখদের অনেক বৈশিষ্ট্যই চোখে পড়ে। বহুদিন আগে আয়েশা আলিয়েভা মস্কো যাবার পথে এই ইউরালস্কে ক’দিন ছিল। গাড়ীর জানালা দিয়ে রোকাইয়েভাও একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল বাইরে, কিন্তু তার দৃষ্টি যেন এখানে নেই, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
রোকাইয়েভার দিকে তাকিয়ে আয়েশা আলিয়েভা বলল, কারও কথা নিশ্চয় মনে পড়ছে রোকাইয়েভা?
-পড়ছে।
-কার কথা?
-দাদীর কথা। আর কেউ নেই আমার। জানিনা কোথায় আছেন তিনি, দেখতে আর পাব কিনা?
-ভেবনা রোকাইয়েভা, সাইমুম আমার এবং তোমার খোঁজ যখন পেয়েছে, তখন তোমার দাদী তাদের নজরের বাইরে নয়।
-ঠিক বলছব। আমার দাদীকে গিয়ে দেখতে পাব?
-আমার ধারণা মিথ্যা না হলে জুবায়েরভ তার ব্যবস্তা করেছে। এতক্ষণে রোকাইয়েভার মুখে হাসি ফুটে উঠল। টিক বলেছ। জুবায়েরভ প্রতিটি বিপদ মুহূর্তে অদৃশ্য থেকেও আমাদের পাশে দাডিয়েছেন।
-দেখেছ তাকে?
-না।
ইচ্ছা হয়নি কখনও?
রোকাইয়েভা আলিয়েভার দিকে চেয়ে একটু ভ্রকুটি করে বলল তোমার প্রশ্নটা সরল নয়। জুবায়েরভ নিশ্চয় সাইমুমের ভালো কর্মী।
আয়েশা আলিয়েভা একটু মুখ টিপে হাসল। কোন জবাব দিল না। কথা বলল রোকাইয়েভাই আবার। বলল দেশে যাচ্ছি, তোমার কারও কথা মনে পড়ছেনা ?
-আমার কেউ নাই।
-কেউ নাই?
-নেই।
বুকে হাত দিয়ে বল, কেউ নেই? কারও কথাই তোমার মনে পডছেনা?
আয়েশা আলিয়েভা কথা বলল না। তার চোখটা উজ্জল, মুখটা কেমন আরক্তিম হয়ে উঠল। বলল, তোমার ইংগিত বুঝেছি রোকাইয়েভা, এমন কতই তো ভাবতে পারি।
-কত নয়, একটাই ভাবতে পার।
-কিন্তু সে ভাবাটা যদি অন্যায় হয়। তার প্রতি অবিচার হয়? গলাটা একটু ভারী আয়েশা আলিয়েভার।
-এ প্রশ্নের জবাব কি তোমার চাই আলিয়েভা?
আমি আর কোন কথা বলব না, বলে রোকাইয়েভার পিঠে একটা ছোট কিল দিয়ে উঠে গিয়ে বাথে শুয়ে পড়ল সে।
গাডী তখন নডে উঠেছে চলতে শুরু করেছে। রোকাইয়েভাও উঠে গিয়ে তার সিটে শুয়ে পড়ল।
ট্রেন চলছে তখন ইউরাল পার্বত্য ভুমির উপর দিয়ে। এ পার্বত্য অঞ্চল পেরুলেই তুরান সমভূমি কাজাখদের এলাকা।
ঘুমিয়ে পড়েছিল আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা দু’জনেই। দরজার ঠক ঠক শব্দে তাদের ঘুম ভাঙল। ঘুম থেকে উঠে দু’জনে দু’জনার মুখের দিকে তাকাল। উভয়েরই চোখে জিজ্ঞাসা, কে হতে পারে? টিকিট চেকার? নাকি পুলিশ? অথবা ডাইরেক্টর সুলেমানভ? আয়েশা আলিয়েভা উঠে দাড়াল। কাপড়-চোপড় ঠিক করে নিয়ে দরজার দিকে গিয়েও আবার ফিরে এল। এসে ওভার কোটটি গায়ে চাপাল সে।
দরজার খুলল আলিয়েভা। দরজার মাঝারী বয়সের সুঠাম স্বাস্থ্যের দু’জন লোক। তারা খোলা দরজা পথে ঘরে ঢুকল। আনুমতির অপেক্ষা করল না। আলিয়েভা তাদের পিছনে পিছনে এল ঘরে। ওরা ঘরের চারদিকে একবার নজর করে ওদের দু’জনের দিকে আরেকবার ভালো করে তাকিয়ে বলল আপনাদের টিকিট কার্ড দেখি।
দু জনে টিকিট কার্ড বের করে ওদের হাতে দিল। কার্ড দু’টির উপর নজর বুলিয়ে আয়েশা আলিয়েভার দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম?
-কার্ডই তো লিখা আছে। বলল আয়েশা আলিয়েভা।
তারপর ঐ লোকটিই রোকাইয়েভার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল আপনার নাম?
-নিনিয়েভা। বলল রোকাইয়েভা।
ওদের দু’জনের চোখে একটা সংশয়-সন্দেহ স্পষ্টই ধরা পড়ল আয়েশা আলিয়েভার কাছে।
ওরা পরিচিতি কার্ড নিয়ে ঘর থেকে বেরুবার জন্য ফিরে দাঁড়াল। তারপর বলল, আপনারা দু’জনে এখনি আসুন আমাদের সাথে। বলে তারা রুম থেকে বেরুল।
আয়েশা ওভারকোট পরেই ছিল রোকাইয়েভাও পরে নিল। তারপর ওদের পিছু পিছু বেরিয়ে এল রুম থেকে। আয়েশা আলিয়েভার দুটো হাত ওভারকোটের দুই পকেটে। পকেটের দু’টো হাত গিয়ে স্পর্শ করেছে সাইলেন্সার লাগানো দু’টো রিভলভারকে। সেই পুলিশ রুমে তারা এল। ওদের সাথে সাথে আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভাও প্রবেশ করল সে ঘরে। পুলিশ পাঁচজন ঘরে বসে ঝিমুচ্ছিল। সেই দু’জন ওদেরকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলল। বুঝা গেল পুলিশরা অনিচ্ছা সত্বেও উঠে দাঁড়াল এবং এমন করে তাকাল যাতে মনে হল কেউ বসে মজা করবে, কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে সময় গুনবে এতে তাদের ঘোর আপত্তি।
ওরা বেরিয়ে গেল। সাথে সাথে অটোমেটিক দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আয়েশা আলিয়েভা নিশ্চিত হল এরা রেলওয়ের নয় গোয়েন্দা বিভাগের লোক। আর দেখলেই বুঝা যায় লোক দু টি লম্পট চরিত্রের। গোয়েন্দা দু’জন গিয়ে পাশাপাশি চেয়ারে বসল। ধীরে সুস্থে মুখ খুলল একজন, আমরা আপনাদের সাহায্য করতে চাই। কথা বলার ধারাটাই কেমন কুৎসিত ধরনের, আয়েশা আলিয়েভা সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে জিজ্ঞেস করল কি সাহায্য ?
-আপনাদের পরিচয় আমরা জানি। দাঁত বের করে উত্তর দিল সাথের লোকটি।
-কি পরিচয় ? জিজ্ঞেস করল আয়েশা আলিয়েভা।
তাদের একজন তাড়াতাড়ি পকেটে হাত দিয়ে দু’টো ফটো বের করল। বলল এই দেখুন আপনার ছবি। আপনারা মস্কুভা বন্দি শিবির থেকে… কথা শেষ না করেই লোকটা উঠে দাঁড়াল এবং একটা কুৎসিত হাসির সাথে আলিয়েভার দিকে এগিয়ে এল। আয়েশা আলিয়েভা একটু সরে দাঁড়াল। পাশের লোকটাও উঠে দাঁড়িয়েছে। খপ করে একটা হাত ধরে ফেলেছে সে রোকাইয়েভার। রোকাইয়েভা এক ঝটকায় তার হাত খুলে নিয়েছে।
এদিকের লোকটা বলল দেখুন আপনারা আবার সেই জেলে জান তা আমরা চাইনা। যদি….
কথা শেষ না করেই লোকটা আবার এগিয়ে এল আয়েশা আলিয়েভার দিকে। ওদিকের ঐ লোকটি এক পা এক পা করে আগুচ্ছে রোকাইয়েভার দিকে। ওদের চোখে মুখে লাম্পট্যের শয়তানী নাচ।
আয়েশা আলিয়েভার দু হাত তখনও ওভার কোটের পকেটে। বিদ্যুৎ বেগে রিভলভার সমেত তার একটি হাত বেরিয়ে এল। লোকটার বুক বরাবর তাক করে বলল আর এক পা এগুলে…
মুহূর্তের জন্য লোকটির চোখ ছানাবড়া হয়ছিল। কিন্তু তার পর সে দ্রুত হাত দিল পকেটে। কিন্তু তার হাত পকেট থেকে বেরুবার আগেই আয়েশা আলিয়েভার রিভলভার অগ্নি উদগীরন করল। লোকটি ঝরে পড়ল মেঝের উপর।
গুলি করেই আলিয়েভা আপর লোকটির দিকে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল লোকটি ঝাঁপিয়ে পড়েছে রোকাইয়েভার ওপর। রোকাইয়েভার হাতেও রিভলভার। আলিয়েভা তার রিভলভারের ট্রিগার চেপে ধরল আরেকবার। সেই সাথে রোকাইয়েভার রিভলভারও অগ্নি উদ্গীরন করল। লোকটা বোটা থেকে খসে পড়া পাকা ফলের মতই ঝরে পড়ল মেঝের উপর। লাফ দেয়া অবস্থাতেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মেঝেতে।
তাড়াতাড়ি রিভলভার পকেটে ফেলে তারা দরজা খুলে বেরিয়ে এল রুম থেকে। সাইলেন্সার থাকায় গুলির কোন শব্দ হয়নি। কিন্তু দরজা খোলার সাথে সাথে বারুদের গন্ধ বেরিয়ে এল।
তাদের তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে দেখে মনে হল পুলিশরা একটু কৌতুক আনুভব করল। দু’জন পুলিশ দরজার দিকে এগিয়ে এল। ঘরের ভেতর চাইতেই তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তাদের এ অবস্থা দেখে অন্য তিনজনও এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। বিস্ময়-আতংকে হা হয়ে গেল তাদেরও মুখ।
আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা তাদের পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। তারা আবার রিভলভার হাতে তুলে নিল। আয়েশা আলিয়েভা তার দুহাতে দুটি রিভলভার উঁচিয়ে চাপা স্বরে বলল ঘরে ডুকে যাও, একটু এদিক ওদিক করলে সবার মাথা উড়ে যাবে। দু জন পিছনে ফিরে তাকাল। তারপর সুড় সুড় করে সবাই ঘরে ঢুকে গেল। ঘরে ঢুকলে আয়েশা আলিয়েভা দ্রত দরজা বন্ধ করে দিল। দেখল ঘরের চাবিটা দরজাতেই ঝুলছে। দরজায় চাবি লাগিয়ে দিল সে।
মাত্র দু তিন মিনিটের মধ্যে সাংগ হয়ে গেল এসব ঘটনা। পুলিশ রুমটি পেছনের দিকের শেষ রুমে বলে এদিকে মানুষের আনাগোনা কম। আয়েশা আলিয়েভা খুশি হল। কারো চোখেই এ ঘটনা পড়েনি।
পাশেই ডাইরেক্টর সুলেমানভের রুম। তার রুম বন্ধ। আয়েশা আলিয়েভা একবার মনে করল তাকে সব কথা বলে আসে, কিন্তু পরে বল তার কিছু না জানাই ভালো। জওয়াবদিহী করতে সুবিধা হবে তার। রোকাইয়েভা বলল চল তাহলে এখন আমাদের রুমে যাই।
আয়েশা আলিয়েভা মাথা নেড়ে বলল না, আর রুমে নয়। অবশিষ্ট কয়েকঘন্টা এখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দিয়েই কাটাতে হবে। শত্রুর শেষ হয়েছে কি না আমরা এখনও জানিনা।
ট্রেন তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে। অরল হৃদকে ডান পাশে রেখে তুরান সমভূমি ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। অরল হৃদের পূর্ব পাশে পৌঁছে আর একশ মাইল দক্ষিণ পূর্বে এগুলেই সির দরিয়া পাওয়া যাবে। তারপর সির দরিয়ার তীর ধরেই ট্রেন চলবে প্রায় সাড়ে তিন শত মাইল। তাসখন্দের দেড়শ মাইল উত্তরে পৌঁছে ইসর দরিয়া একটু পশ্চিমে সরে গিয়ে তাসখন্দের মাইল পঞ্চাশেক দক্ষিণ দিয়ে এগিয়ে তাজিকিস্তানে প্রবেশ করবে। আর ট্রেন সোজা এগিয়ে যাবে তাসখন্দে।
বাইরে থেকে মুখ ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করল আয়েশা আলিয়েভা। ট্রেনে তাদের উপর আর কোন আক্রমন হবে বলে মনে হয় না। অরল হৃদের অরলঙ্ক শহর তারা পেরিয়ে এসেছে। তাসখন্দের কাছাকাছি অরিস জংশন ছাড়া মাঝখানে কিজিল ওরস নামে একটা ছোট্ট শহর আছে। কিন্তু ট্রেন থেকে ওয়ারলেস না করলে সেখান থেকে বিপদের সম্ভাবনা নেই, কারণ ট্রেন সেখানে থামেনা। আর ওয়ারলেসতো সুলেমানভের কাছে। গোয়েন্দা দুজনের কাছেও হয়তো ওয়ারলেস ছিল, কিন্তু সেগুলো আর কোন কাজে আসছে না। এসব ভেবে খুব খুশী হলো আয়েশা আলিয়েভা।
কিন্তু এরপর কি, তার কিছুই জানে না আলিয়েভারা। শুধু এতটুকু তাদের বলা হয়েছে। ট্রেন সির দরিয়া এলাকায় পৌঁছার পর তাদের সব দায়িত্ব তাসখন্দ সাইমুমের উপর বর্তাবে। তারাই সব ব্যবস্থা করবে। বাইরের বাতাসে যেন সির দরিয়ার স্নিগ্ধ পরশ অনুভব করল আলিয়েভা। ওতে যেন নতুন জীবনের এক আশ্বাস। রোকাইয়েভা বাইরে তাকিয়েছিল। আলিয়েভাও তার দৃষ্টি মেলে ধরল বাইরে। তার চোখ দুটি খুঁজে ফিরছে সির দরিয়ার সবুজ উপত্যকা, তার রুপালী বুক।

Top