৮. সিংকিয়াং থেকে ককেশাস

চ্যাপ্টার

কাস্পিয়ান সাগরের কালো পানি কেটে চারদিকের ঘুটঘুটে অন্ধকার ঠেলে পোর্ট আনোয়ার থেকে একটি পেট্রোল বোট এগিয়ে চলেছে পশ্চিম দিকে।
পোর্ট আনোয়ার কাস্পিয়ান সাগর তীরস্থ মুসলিম মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের একটি বন্দর। রুশ শাসন আমলে এ বন্দরের নাম ছিল ক্রাজনোভস্ক। কাস্পিয়ান সাগরের পূর্ব তীরে মুসলিম মধ্য এশিয়ার এটাই একমাত্র বন্দর। মধ্য এশিয়া স্বাধীন হবার পর মুসলিম সরকার এই বন্দরের নাম রেখেছে পোর্ট আনোয়ার -শহীদ আনোয়ার পাশার নাম অনুসারে।
শহীদ আনোয়ার পাশা মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে কম্যুনিষ্ট লালফেৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হয়। কম্যুনিস্ট চাপের মুখে মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের যখন ঘোর দুর্দিন, তখন সেনাধ্যক্ষ আনোয়ার পাশা কাস্পিয়ান সাগরের পথে ছুটে আসে মধ্য এশিয়ায়। এই বন্দরেই সে বোট থেকে নামে। একজন মহান শহীদের সে স্মৃতি ধরে রাখার জন্যে মুসলিম মধ্য এশিয়ার স্বাধীন সরকার তার নামে বন্দরের এই নাম রেখেছে।
বোটে মাত্র ছয়জন আরোহী। ড্রাইভিং সীটে মুসলিম মধ্য এশিয়ার নৌবাহিনীর তরুণ অফিসার আলী নকীর। তার পেছনে সোফায় আহমদ মূসা। সারফেস টু এয়ার কামান রয়েছে। সারফেস টু সারফেস কামানের পাল্লা পঞ্চাশ মাইলেরও বেশী।
বোটের স্বল্প পাল্লার হেডলাইটের আলোটি ছাড়া সব আলো নিভানো। বোটটি একটা জমাট অন্ধকারের মত এগিয়ে চলেছে পশ্চিমে। লক্ষ্য তার ককেশাসের বাফু ও সীমান্ত নগরী আশতারার মধ্যবর্তী উপকূলের একটি স্থান।
ঘন্টায় পঞ্চাশ মাইল বেগে চলেছে বোটটি। পোর্ট আনোয়ার থেকে বাকু দু’শ মাইল। আহমদ মূসা তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত এগারটা। এই গতিতে গেলে পথে কোন ঝামেলা না হলে তিনটার দিকে তিনি ককেশাস উপকূলে পেৌঁছতে পারবেন।
বহু চিন্তা করে আহমদ মুসা ককেশাস যাবার এই কাস্পিয়ানের পথটাকে বেছে নিয়েছেন। মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের কাজাখিস্তান হয়ে ককেশাস প্রবেশ করা যেত, কিন্তু পথটায় বিপদ বেশি। কাজাখ বর্ডার থেকে ককেশাস বর্ডারের মধ্যবর্তী গোটা তাতারিয়া অঞ্চলে রুশরা সর্বক্ষণ চোখ আর কান খাড়া করে আছে যাতে একটা পিঁপড়াও মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্র থেকে সেদিকে প্রবেশ করতে না পারে। অন্যদিকে পারস্যের পথটা আহমদ মূসার জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অবশেষে কাস্পিয়ানের সংক্ষিপ্ত পথটাকেই সবচেয়ে অনুকূল মনে করেছে। কিন্তু এখানে বিপদ নেই তা নয়। মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের পানিসীমা পার হবার পর আজারবাইজানের প্রায় উপকূল পর্যন্ত দেড়শ’ মাইল পথটি রুশদের কড়া পাহারায় রয়েছে। কাজাখ অঞ্চল থেকে তাতারিয়া অঞ্চলে সে যেমন একটা পিঁপড়া ঢুকতে দিতেও নারাজ, তেমনি কাস্পিয়ান সাগরের পথটাও সে পাহারা দিচ্ছে যাতে মধ্য এশিয়া থেকে ককেশাসে আসা যাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব না হয়। এই পাহারা দেয়ার কাজে সাবমেরিন এবং একটি শক্তিশালী নেৌ-গোয়েন্দা ইউনিটসহ অনেক যুদ্ধ জাহাজ ও পেট্রোল বোট রয়েছে। চব্বিশ ঘন্টা তাদের এই পাহারা কাজ চলছে। এতদসত্ত্বেও আহমদ মূসা মনে করেছেন, স্থল পথের চেয়ে পানি পথে শত্রুকে ফাঁকি দেয়া সহজ হবে।
এই বিপদ সংকুল পথে আহমদ মুসাকে এইভাবে একাকি ছেড়ে দিতে কেউ রাজী হয়নি। কিন্তু আহমদ মুসা কাউকেই সাথে নিতে চাননি। শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত হাসান তারিক জেদ করেছে। আহমদ মুসা বলেছেন, এ ধরনের অভিযানে যত কম লোক জড়িত হয়ে পারা যায় তাই করা উচিত। আর হাসান তারিককে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, তার কিছুদিন বিশ্রাম প্রয়োজন। তার দেশ ফিলিস্তিন থেকে সে বহুদিন বাইরে। এমন কি, স্বাধীন ফিলিস্তিনকে সে এখনও দেখেইনি। বাড়িতে মা-বোনের সাথে বহুদিন থেকে বিচ্ছিন্ন। সুতরাং আয়েশা আলিয়েভকে নিয়ে একবার তার দেশে যাওয়া দরকার। প্রয়োজন হলেই তাকে ডেকে নেবে আহমদ মুসা। তাছাড়া আহমদ মুসা মনে করেন, নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মাহমুদ ফিলিস্তিনে একাকিত্ব অনুভব করছে। হাসান তারিকের মত দক্ষ নেতৃত্ব তার পাশে থাকলে ইসলামী ফিলিস্তিন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
একটু মাথা ঝুঁকিয়ে আহমদ মুসা ‘ডিস্টেন্স রেকর্ড’ প্যানেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, নকীর, পঞ্চাশ মাইল পেরিয়ে আসছো, এবার বোধ হয় তোমাকে হেডলাইটের আলোটুকুও নিভিয়ে ফেলতে হবে।
কাস্পিয়ান সাগরের ক্ষেত্রে উপকূল পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত জাতীয় অর্থনৈতিক এলাকা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই অর্থনৈতিক এলাকা পর্যন্ত স্বাধীনভাবে বিচরণ করা যায়।
পেট্রোল বোটটি একান্নতম মাইলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হেড লাইটের আলো নিভিয়ে দিল।
চার দিক থেকে জমাট অন্ধকারের এক পাহাড় এসে বোটটিকে ঘিরে ধরল। বোটটিকে মনে হল চলন্ত এক খন্ড জমাট অন্ধকার।
চোখ বন্ধ করে এগিয়ে চলার অবস্থা। কম্পাস ও সামনে মেলে রাখা মানচিত্রই আলী নকীরের ভরসা। মাঝে মাঝে সে তাকাচ্ছে কঠিন বস্তু নিরীক্ষণ স্ক্রীনের দিকে। বোটের দশ মাইলের মধ্যে কোন কঠিন বস্তু এসে পড়লেই সাদা পর্দায় কাল স্পট জেগে উঠবে। স্ক্রীনটি অসংখ্য বর্গক্ষেত্রে ভাগ করা। বর্গক্ষেত্রে কাল অবস্থান থেকে বুঝা যাবে বস্তুটি কোনদিকে কতদূরে।
আরও চল্লিশ মাইল চলার পর প্রায় একই সময়ে উত্তর ও দক্ষিণ দিগন্তে দুটি আলোক রেখা ফুটে উঠল। বোঝা গেল বড় যুদ্ধ জাহাজই হবে। জাহাজ দুটির প্রত্যেকটিতেই কয়েকটি করে সার্চ লাইট।
আলোগুলোকে ঘুরতে দেখা গেল। এই সময় পশ্চিম দিগন্তেও আরেকটা আলো দেখা গেল। তিনটি আলোই দ্রুত এগিয়ে আসছে।
আহমদ মুসা সেদিকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর বললেন, আলী নকীর, জাহাজগুলো খুব দ্রুতগামী এবং তাদের সার্চ লাইটগুলি খুব পাওয়ারফুল। তাছাড়া তিনটি জাহাজ একা নয়। ভালো করে দেখ, বিড়ালের চোখের মত আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলো দেখা যাচ্ছে। এর অর্থ পেট্রোল বোটের সারিও এগিয়ে আসছে।
এই সময় রিয়ারভিউ স্ক্রীণের দিকে চোখ পড়তেই আঁৎকে উঠল আলী নকীর। বলল, জনাব, পেছন থেকেও একটা জাহাজ ছুটে আসছে।
মুহূর্তকাল স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন আহমদ মুসা। বললেন, আলী নকীর, চারদিক থেকে জাল ফেলে ওদের এই এগিয়ে আসা কোন রুটিন প্রেট্রোল নয়। একটা সচেতন পরিকল্পনা নিয়ে ওরা এগিয়ে আসছে। আমার মনে হয় আমাদের এই যাত্রা শত্রুদের কাছে গোপন নেই।
একটু থামলেন আহমদ মূসা। চারদিকটায় একবার নজর বুলালেন। তারপর বললেন, ভয় নেই আলী নকীর, আমরা ওদের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছি। ওরা আমাদের অবস্থান দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু ওদের অবস্থান আমরা দেখতে পাচ্ছি।
আহমদ মূসা উঠে গিয়ে আলী নকীরের পাশে বসলেন। বললেন, আমরা আর সামনে এগুব না। তুমি বোটের মাথা বাম দিকে ঘুরিয়ে নাও। দক্ষিণ দিক থেকে ও পূবদিক থেকে ছুটে আসা জাহাজ আরও ক্লোজ হবার আগে আমরা এ দুয়ের ফাঁক গলিয়ে দক্ষিণ দিকে বেরিয়ে যাব। তারপর ওদের এই বেষ্টনির বাইরে গিয়ে প্রয়োজন হলে পারস্য জল সীমার কাছাকাছি দিয়ে ঘুরে গিয়ে আজার বাইজান জলসীমায় প্রবেশ করব। অনেকটা পথ আমাদের ঘুরতে হবে। তুমি স্পীড বাড়িয়ে দাও। আমি ‘হার্ড অবজেক্ট ভিশন’ প্যানেলের দিকে নজর রাখছি। কারও সাথে ধাক্কা লাগবে এ চিন্তা কর না। বলে আহমদ মূসা ম্যাপটাকে নিজের সামনে টেনে নিলেন।
আহমদ মূসার কথা শেষ হবার আগেই বোটের মাথা দক্ষিণ দিকে ঘুরে গেল।
আহমদ মূসা বললেন, বোটের মাথা আরও পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী ইস্টে সরিয়ে নাও।
বোটের মাথা আরও পূর্ব দিকে ঘুরে গেল। ছুটে আসা জাহাজগুলোর শক্তিশালী সার্চ লাইট সাগরের বিস্তৃত অঞ্চলকে আলোকিত করেছে। চারটি জাহাজ আরও কাছাকাছি এগিয়ে এলে মধ্যবর্তী সাগরের গোটাই আলোকিত হয়ে উঠবে। আহমদ মুসার বোটকে ওরা এই আলোর ফাঁকেই বন্দি করতে চাইছে।
জাহাজ ও পেট্রোল বোটের বেস্টনি গড়ে নিশ্চিন্ত মনেই ওরা এগিয়ে আসছে। ওরা জানে আহমদ মুসার বোট পশ্চিম দিকের কোন ফাঁক-ফোঁকড় দিয়েই কেটে পড়তে চাইবে। তাই সে ফাঁক-ফোকড় বন্ধের জন্য ওরা পেট্রোল বোটের পাহারা সাথে নিয়ে আসছে।
আহমদ মুসা হাসলেন। এত বড় সাগরের সব দরজা ওরা বন্ধ করবে, এটা ওদের দুরাশা।
আহমদ মুসা তাকিয়ে দেখলেন, দক্ষিণ ও পূর্বদিক থেকে যে জাহাজ দুটো এগিয়ে আসছে ওদের সার্চলাইট ক্রমেই নিকটতর হয়ে উঠছে। এক সময় ওরা মিশে যাবে, তার আগেই তাকে এ বেষ্টনি পার হতে হবে।
জাহাজ দুটোর কৌণিক অবস্থান বিবেচনা করে ছোট্ট একটা অংক কষে আহমদ মূসা বললেন, আলী নকীর, পনের মিনিটে আমরা যদি পঁচিশ মাইল পথ পার হতে পারি তাহলে ওদের সার্চলাইট আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না।
আলী নকীর মাথা দুলিয়ে বলল, আমরা এখন ঘন্টায় নব্বই মাইল চলছি। গতিবেগটা আমি একশ’ মাইলে তুলে দিচ্ছি। আমরা পনের মিনিটের আগেই পঁচিশ মাইল পেরিয়ে যাব।
পেট্রোল বোটের স্পিডোমিটারের কাঁটা লাফ দিয়ে নব্বই থেকে একশ মাইলে দিয়ে স্থির হলো। আহমদ মুসার বোট যখন পঁচিশ মাইলের পনের মাইল পার হয়েছে, তখন ‘হার্ড অবজেক্ট ভিশন’ অর্থাৎ ‘শক্ত বস্তু নিরীক্ষণ’ স্ক্রীনে একটা কাল বিন্দু জেগে উঠল।
ভ্রু কুঁচকালেন আহমদ মূসা। কাল বিন্দুটির অবস্থান ঠিক আহমদ মূসার বোটের নাক বরাবর।
আহমদ মুসা বললেন. আলী নকীর, তোমার ঠিক নাক বরাবর দশ মাইল দূরেএকটা পেট্রোল বোট এগিয়ে আসছে।
একটু থেমে আহমদ মুসা বললেন, দুটো জাহাজের সার্চলাইট এবং পেট্রোল বোটটির সার্চলাইট একসাথে মিশে যেতে পারে, এমন জায়গায় যদি ওদের নজরে পড়ি তাহলে বিনা সংঘাতে আমরা বেরিয়ে যেতে পারবনা। আর সংঘাত করে বেরিয়ে গেলেও ওরা পিছু ছাড়বেনা আমাদের বার মাইলের জলসীমা পর্যন্ত। আমরা তাহলে ককেশাসে যেতে পারবনা। তুমি তোমার গতি একশ বিশ মাইলে তোল নকীর।
পেট্রোল বোটের সর্বোচ্চ গতিই হলো একশ তিরিশ মাইল। যে লোড বোটে আছে তাতে গতি একশ বিশে তোলা ঝুঁকিপূর্ণ।
কিন্তু দক্ষ নৌ-অফিসার আলী নকীর বলল, বুঝেছি জনাব, আমরা বার মিনিটেই নির্ধারিত দূরত্ব পার হয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।
আহমদ মুসার পেট্রোল বোট প্রচণ্ড বেগে লাফিয়ে লাফিয়ে সামনে এগিয়ে চলল। স্পিডোমিটারের কাঁটা একশ’ বিশে দাঁড়িয়ে থর থর কাঁপছে। কাঁপছে গোটা বোট প্রচণ্ডভাবে। মনে হচ্ছে বড় বড় পাথর ডিঙিয়ে কখনও আছড়ে পড়ে, কখনও লাফিয়ে উঠে দৌড়ে চলেছে একটা জীপ।
আহমদ মুসা ‘হার্ড অবজেক্ট ভিশন’ প্যানেলের দিকে তার চোখ স্থির রেখেছিলেন। এগিয়ে আসা পেট্রোল বোটটা তখন তিন মাইল দূরে।
আহমদ মুসা এ সময় তার সামনের স্পীকার সুইচ অন করে বললেন, আবদুল্লাহ আমাদের সামনেই একটা শত্রু পেট্রোল বোট। তার সার্চ লাইটটা তোমরা দেখতে পাচ্ছ। মনে রেখ কোন প্রকার সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে আমরা এদের বেষ্টনি থেকে বেরিয়ে যেতে চাই। আক্রান্ত হলেও আমরা গুলি ছুড়বনা, আত্মরক্ষার শেষ মুহূর্ত ছাড়া। সে নির্দেশ আমিই দেব। এখন তোমরা কামানের সবগুলো ব্যারেল নামিয়ে নাও।
আবদুল্লাহ পেট্রোল বোটের চার সদস্য বিশিষ্ট গোলন্দাজ ইউনিটের প্রধান।
নির্দেশের সাথে সাথে কামানের সবগুলো ব্যারেল নিচে নেমে এল।
দক্ষিণ ও পূর্বের দুই জাহাজের সার্চ লাইটের মধ্যে ব্যবধান তখনও অনেক। প্রায় তিন মাইলের মত। শত্রুর পেট্রোল বোটের সার্চ লাইটের হিসেবটা বিয়োগ করলে এক মাইল বিস্তৃত দুটো অন্ধকার লেন সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে শত্রু বোটের দুপাশে।
শত্রু বোট থেকে আহমদ মুসার বোটের দূরত্ব তখন দেড় মাইল, তখন আহমদ মুসা আলী নকীরকে বোটের মাথা ত্রিশ ডিগ্রী ডান দিকে ঘুরিয়ে নিতে বললেন।
বোঝা গেল শত্রু বোটও তখন সামনে কিছুর অস্তিত্ব নিয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। সার্চ লাইট ছারাও হেড লাইটের আলো সে সামনে ফেলেছে।
শত্রু বোটের সাথে মুখোমুখী অবস্থা থেকে ত্রিশ ডিগ্রি টার্ন নিয়ে তীর বেগে ছুটে চলল আহমদ মুসার বোট।
আহমদ মুসার বোটের এই গতি পরিবর্তন শত্রু বোটও টের পেল। তার সার্চ লাইট আরও চঞ্চল হয়ে উঠল হেড লাইটের আলোও এদিকে বেঁকে এল।
আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন দক্ষিণের জাহাজটির সার্চ লাইটও এদিকে এসে স্থির হল।
কিন্তু শত্রু বোট এ শত্রু জাহাজের সার্চ লাইটের মাঝের ব্যবধান প্রায় এক মাইল। এই অন্ধকার লেন দিয়েই আহমদ মুসার বোট বেরিয়ে যেতে চায়।
আহমদ মুসা বললেন, শত্রু জাহাজ ও শত্রু বোটের মধ্যে সংবাদ বিনিময় হয়েছে। ওদের মনে কিছুটা সন্দেহও হয়েছে। সার্চ লাইট ফেলে অনুসন্ধানের চেষ্টা তারই প্রমাণ। কিন্তু স্বস্তির সাথে লক্ষ্য করলেন শত্রু বোট বা শত্রু জাহাজের গতি পরিবর্তন হয়নি।
আহমদ মুসার বোট যখন শত্রু বোটের সমান্তরালে অর্থাৎ সবচেয়ে কম দূরত্বে এল, ঠিক তখনই শত্রু বোট থেকে কামানের গর্জন শোনা গেল। কয়েকটা গোলা আহমদ মুসার বোটের পাশে ও পেছনে এসে পড়ল।
কামানের গর্জনের সংগে সংগে আলী নকীর বোটটি আরেকটু ডান পাশে সরিয়ে নিয়েছিল। আহমদ মুসার বোট তখন চলছিল ঘন্টায় একশ বিশ মাইল বেগে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুই বোটের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে গেল। ওদিকে কামানের গর্জনও থেমে গেল।
আহমদ মুসা হেসে বললেন, সম্ভবত কোন উত্তর না পেয়ে ওরা ভেবেছে, নিরীহ কোন মাছ ধরা বোট ভয়ে পালাচ্ছে। তারা ধারনা করেনি যে, আহমদ মুসার ককেশাসমুখী বোট এবাউট টার্ন করতে পারে। আহমদ মুসা সম্পর্কে শত্রুর এই উচ্চ ধারণা আহমদ মুসাকে বহুবারই সাহায্য করেছে। শত্রুর মনে এই অনূভূতি সৃষ্টি আল্লাহরই অসীম রহমত। আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।
ওদের বেষ্টনী পেরিয়ে মাইল দশেক আসার পর আহমদ মুসা বোটের মুখ সোজা দক্ষিণ দিকে ঘুরিয়ে নিতে বললেন। দক্ষিণ দিকে পঞ্চাশ মাইল চলার পর আহমদ মুসা বললেন, ওদের কোন জাহাজের আলো আর দেখা যাচ্ছেনা। মনে হচ্ছে সবই উত্তর দিকে চলে গেছে। কিন্তু আবার ফিরে আসবে। তার আগেই মধ্য-কাষ্পিয়ানে আমাদের পাড়ি দিতে হবে। তুমি বোট পয়তাল্লিশ ডিগ্রী পশ্চিমে ঘুরিয়ে নাও। তারপর ত্রিশ মাইল চলার পর বোট সোজা পশ্চিম দিকে চলবে। তাহলে আমরা পারস্যের পানি সীমা ঘেঁসে আজার বাইজানের সীমান্ত শহর আশতারা উপকূলে পৌঁছতে পারব। এ এলাকায় রুশদের পাহারা একটু কম থাকবে।
আহমদ মুসা উঠে পেছনে সোফায় গিয়ে বসলেন। সোফায় হেলান দিয়ে গা এলিয়ে দিলেন।
ঘন্টায় একশ মাইল বেগে চলছে বোট। গতির তীব্রতায় বোট থর থর করে কাঁপছে।
বোট ইঞ্জিনের গুম গুম আওয়াজ এবং পানি কেটে চলার তীক্ষ্ণজলজ শব্দ ছাড়া চারদিকটা নীরব-নিথর। মাটির গাঢ় অন্ধকারটা যেন আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। সেই আকাশ-অন্ধকারে জ্বলছে তারার প্রদীপ।
আহমদ মুসার চোখ ছিল সেই তারার জগতে নিবদ্ধ। বড় ভাল লাগে তাঁর এই তারার জগত। খোদায়ী প্রভূত্বের বিশালতা এবং মহিমাময়তা তাঁর কাছে মূর্ত হয়ে ওঠে এদিকে চাইলে। আমরা বলদর্পী মানুষ- বিশাল পৃথিবীর তুলনায় দৃষ্টি গোচরের অযোগ্য এক দূর্বল অস্তিত্ব আমাদের। বিশাল পৃথিবী ঐ মিট মিট তারার তুলনায় একটা বিন্দু বই আর কিছুই নয়। কিন্তু বিশাল বপু এই তারা আবারন আমাদের ছায়াপথ নামক গ্যালাক্সির গায়ে ক্ষুদ্র এক তিল মাত্র। তাই বলে ‘ছায়াপথ’ গ্যালাক্সির গর্বের কিছু নেই। অন্তহীন আকাশ জগতে লক্ষ-কোটি গ্যালাক্সির মাঝে আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সি অনুজ্জ্বল এক আলোক বিন্দু ছাড়া আর কিছুই নয়। অসীম বিশালত্বের বিস্ময়ে বিমূঢ় আহমদ মুসার মন ভেবে পায় না, বৃহত্তরের পথে ঊর্ধ্বমুখী এই যাত্রার শেষটা কোথায় যেখানে গিয়ে শেষ সেটাই কি ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’ অথবা প্রথম আকাশ! তারও তো অনেক ওপরে সবকিছু সৃষ্টি জুড়ে সর্বশক্তিমান, সর্ব প্রশংসার অধিকারী আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আরশুল আজিম। মানুষের অসহায় ক্ষুদ্রত্বের কথা বিবেচনা করে এবং মানুষের প্রতি আল্লাহর অসীম দয়ার কথা স্মরণ করে সব সময়ের মত আহমদ মুসার দুচোখ কৃতজ্ঞতার অশ্রুতে ভরে ওঠে।
তারার জগতে একবার পৌঁছুলে আহমদ মুসা নিজেকে হারিয়ে ফেলে। অসীমের উদার স্পর্শ তাকে আকুল করে তোলে। আজও তাই হয়েছিল। কতক্ষণ তিনি এই ভাবে ছিলেন জানেন না। গভীর প্রশান্তিতে তাঁর চোখ দুটোও এক সময় ধরে এসেছিল।
হঠাৎ বোটের গতি কমে যাবার চাপ আহমদ মুসার তন্দ্রা ভেঙে দিল।
চোখ খুলেই আহমদ মুসা ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালের দিকে নজর বুলালেন। রাত আড়াইটা।
আহমদ মুসা মুখ তুলে হঠাৎ বোটের গতিটা এভাবে কমে গেল কেন জিজ্ঞেস করতে যাবেন, এই আলী নকীর পেছন দিকে তাকিয়ে বলল, জনাব, মাইল চারেক সামনে একটা পেট্রোল বোট। অয়্যারলেসে আমাদের পরিচয় জানতে চাচ্ছে। আমি বোটটাকে পাশ কাটাবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের বোটটা লক্ষ্য করেই ঐ বোটটা এগিয়ে আসছে।
আলী নকীরের কথার জবাব না দিয়ে আহমদ মুসা বললেন, আমরা কোথায় আলী নকীর?
এই মাত্র আমরা আজারবাইজানের জলসীমায় প্রবেশ করেছি। আমরা এখন পারস্য ও আজারবাইজানের জলসীমার মাঝখান দিয়ে আসতারার দিকে চলছি।
বোটটা এখন কার পানি সীমায় আছে?
আজারবাইজানের।
কতদূর বললে?
চার মাইল।
আলো নিভানো?
হ্যাঁ সব আলো নিভানো।
তাহলে ওটা শত্রুদের পেট্রোল বোট। আন্তর্জাতিক পানি সীমায় আমাদের খুঁজে না পেয়ে আজারবাইজানের পানি সীমায় ওরা প্রবেশ করেছে।
আমিও তাই মনে করছি।
তোমার ‘হার্ড অবজেক্ট ভিশন’-এ কারও সন্ধান পাচ্ছ?
না।
তাহলে বোঝা গেল দশ বর্গমাইলের মধ্যে আর কোন শত্রু বোট নেই ।
জি হ্যাঁ।
আমাদের পরিচয় জানতে চাচ্ছে?
জি।
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করলেন। তারপর বললেন ঠিক আছে, আমি ওদের সাথে কথা বলছি।
বলে আহমদ মুসা উঠে এসে আলী নকিরের পাশে ওয়ারলেসের সামনে বসলেন।
সুইচ অন করার আগে আহমদ মুসা আলী নকির কে বললেন, তুমি বোটের মাথা ত্রিশ ডিগ্রি পরিমান পারস্যের দিকে ঘুরিয়ে ফুল স্পীডে চালিয়ে যাও।
ওয়ারলেসের সুইচ অন করে আহমদ মুসা আর্মেনীয় ভাষায় বললেন, আমাদের ভয় করছে, আপনাদের পরিচয় আগে বলুন।
কিসের ভয়। ওপার থেকে বলল।
এ উপকূলে দস্যুদের উপদ্রুব বেড়েছে। আপনাদের বোটে বাতি নেই।
আপনাদের নেই কেন?
বললাম তো আমাদের ভয় আছে। পুলিশ, জলদস্যু উভয়কেই আমাদের ভয়।
কি ব্যাপার, আপনারা ওদিকে পালাচ্ছেন কেন?
আপনাদের পরিচয় বললেন না, বাতি নেই কেন তা বললেন না।
হাঃ হাঃ হাঃ ভয় নেই তোমাদের। কি মাল আছে বোটে?
অনেক জিনিস।
তোমরা কি পূর্ব থেকে মানে ওপার থেকে কোন বড় পেট্রোল বোট আসতে দেখেছ?
না।
ততক্ষণে আহমদ মুসার বোট পারস্যের তাব্রিজ উপকূলে কয়েক মাইল ভিতরে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু দেখা গেল শত্রু বোটটি তার মাথা ঘুরায়নি। বরং ওদের শেষ প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বলার পর ওরা পূর্ব-উত্তর দিকে বোটের মুখ ঘুরিয়ে চলতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসা হাসতে হাসতে বললেন, ওরা আমাদের চোরাচালানই মনে করে খুব মজা করল।
আহমদ মুসা চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে বললেন, বোটের স্পীড এবার কমিয়ে দাও। আশতারাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চল।
সীমান্ত নগরী আশতারার চার মাইল দূর দিয়ে এগিয়ে চলল আহমদ মুসার বোট। রাত সাড়ে তিনটার সময় তারা কুরা নদীর মোহনায় এসে পৌঁছালেন। ককেশাসের আরাকাস ও কুরা নদী সম্মিলিতভাবে এখানে এসে কাস্পিয়ান সাগরে পড়েছে।
মোহনা পাড় হবার পর আহমদ মুসা আলী নকিরকে বোট উপকূলের আরও কাছে নিতে বললেন।
বোট উপকূলের আরও সিকি মাইলের কাছাকাছি এসে পৌছাল। আহমদ মুসা এবার আলী নকিরকে বোটের আলো জ্বেলে দিতে বললেন।
উপকূলের ধার দিয়ে বোট ধীরে ধীরে বাকুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আহমদ মুসা মানচিত্র থেকে মুখ তুলে বললেন, এবার সিগন্যাল দিতে শুরু কর আলী নকির।
আহমদ মুসার বোটের হেড লাইট এবার সাইমুমের কোডে সিগন্যাল দিতে শুরু করল।
মাত্র মিনিট খানেক পরে পাশের উপকূলে নীল আলো জ্বলে উঠল। নীল আলোটিও সাইমুমের কোডে সংকেত দিয়ে চলল।
আহমদ মুসা সেদিকে একবার তাকিয়ে বললেন, আলী নকীর এবার বোট তীরে নাও। ওটা আলী আজিমভের সংকেত।
কাস্পিয়ানের তীরে কুরা নদীর স্বাগত জানাবার মোহনায় এই ‘কুদতলি’ ককেশাস ক্রিসেন্টের একটা প্রধান ঘাটি।
আজ বাকুর ককেশাস ক্রিসেন্টের নেতা মুহাম্মদ বিন মুসা এবং এখানকার সাইমুম ইউনিট এর প্রধান আলী আজিমভ এসেছে আহমদ মুসা কে স্বাগত জানাবার জন্য। পরিকল্পনা অনুসারে স্বাগত জানাবার জন্য আসার কথা ছিল আল্লামা ইব্রাহীম এদতিনার। তাঁর শাহাদাতের পর ঠিক হয় আজ এখানে আসবে সালমান শামিল। কিন্তু সালমান শামিলও গত পরশু কিডন্যাপ হবার পর স্থানীয়ভাবে আলি আজিমভের সাথে মুহাম্মদ বিন মুসা এসেছে।
আহমদ মুসার বোট ধীরে ধীরে নোঙর করল অস্থায়ীভাবে তৈরি একটি কাঠের জেটিতে। জেটিতে দাঁড়িয়েছিল আলী আজিমভ এবং মুহাম্মদ বিন মুসা। তাদের পিছনে সাইমুম এবং ককেশাস ক্রিসেন্টের একদল মুজাহিদ। তাদের চোখে –মুখে আশা আনন্দের এক দীপ্তি। যেন অমূল্য এক সম্পদ তাদের হাতে এসে পৌঁছেছে।
বোট থেকে নামান হল এলুমিনিয়ামের এক সিঁড়ি।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন আহমদ মুসা। বিসমিল্লাহ্‌ বলে তিনি পা রাখলেন ককেশাসের মাটিতে।

ককেশাস ক্রিসেন্টের বাকুর প্রধান মুহাম্মদ বিন মুসার কাছ থেকে ককেশাস পরিস্থিতির দীর্ঘ রিপোর্ট নিয়েছেন আহমদ মুসা।
অবস্থা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। ককেশাস ক্রিসেন্টের এবং মুসলিম সমাজের যারা মাথা ছিল তারা সবাই হারিয়ে গেছে। একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সবার মধ্যে। সবাই মনে করছে ‘হোয়াইট উলফ’ অপ্রতিরোধ্য। আজারবাইজান সরকারও আতংক বোধ করছে, কিন্তু কিছু করতে নারাজ। তার ভয় হল, রাশিয়া ও পশ্চিমা খৃষ্টান দেশগুলোর মদদ-পুষ্ট ‘হোয়াইট উলফ’ কে ক্ষ্যাপালে তার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। আর ক্ষ্যাপাবার স্কোপ ও তার নেই। রাশিয়া এবং পশ্চিমা দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা পরিস্কার বলেছে, ‘হোয়াইট উলফ’ এর ব্যাপারে যেন আজারবাইজান সরকার কোন প্রকার নাক না গলায়। ‘হোয়াইট উলফ’ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির উৎখাতের জন্য কাজ করছে, আজারবাইজান সরকারের সাথে তাদের কোন বিরোধ নেই। ‘হোয়াইট উলফ’ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির উৎখাতে সফল হলে তাতে আজারবাইজান সরকারের ও লাভ। তার এক প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত থেকে বাঁচবে। আজারবাইজান সরকার বাধ্য হয়ে এই পরামর্শ গলধঃকরন করেছে, কিন্তু এই কথা গুলো তারা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেনা। রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশসমূহের মদদ-পুষ্ট ‘হোয়াইট উলফ’ কি তা আজারবাইজান সরকার ভাল করেই জানে। যাদেরকে তারা মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িক বলছে তারাই জাতির মৌল শক্তি। এ মৌল শক্তির বিনাশ করতে পারলে মূল্যহীন আজারবাইজান সরকারকে কুপোকাত করা কোন সময়ের ব্যাপার নয়। এই বিষয়টা পরিষ্কার বুঝার পরেও আজারবাইজান সরকারের আজ করার কিছুই নেই। ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’ কে গোপনে সাহায্য করতেও সে ভয় পায়। সে মনে করে ‘হোয়াইট উলফ’-এর সর্বদর্শী চোখ থেকে সে কিছুই লুকাতে পারবেনা। মোট কথা একদম মুষড়ে পরা অবস্থা ককেশাসের মুসলমানদের। আল্লামা ইব্রাহীম এদতিনা হারিয়ে যাবার পর সকলের অনেকখানি ভরসা ছিল ইমাম শামিলের বংশধর প্রতিভাবান তরুন সালমান শামিলের বুদ্ধিমত্তার ওপর। কিন্তু সে কিডন্যাপ হবার পর সকলের চোখে অন্ধকার নেমেছে।
ককেশাসের এই পরিস্থিতি আহমদ মুসার কাছে স্বাভাবিক বলেই মনে হল। সত্যই হোয়াইট উলফ এই পর্যন্ত যা করেছে তাতে কোন খুঁত নেই। ছাব্বিশজন মুসলিম নেতার অপহরনের কেস তিনি বিশদভাবে পর্যালোচনা করেছেন। ‘হোয়াইট উলফ’ কে এবং কারা তার চেনার কোন চিহ্নই তারা পেছনে রেখে যায়নি। এমন কি ঘটনার কোন সাক্ষীও নয়।
যেখানেই ‘হোয়াইট উলফ’ অপারেশনে গেছে সেখানকার কাউকেই সে বাঁচিয়ে রাখেনি। তাই জানা যায় না, অপহরণের কাজ কাদের দ্বারা, কিভাবে ঘটল। এমন কি এ সংক্রান্ত কোন খবরও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। ‘হোয়াইট উলফ’-এর হুমকিতে সব পত্রিকাই নীরব হয়ে গেছে।
শুধু ব্যতিক্রম সালমান শামিলের ব্যাপারটা। তাকে অপহরণের প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হবার খবরও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পরে তার কিডন্যাপের খবর বিস্তারিতই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। খবর বলে, কিভাবে সালমান শামিল একটা জীপ নিয়ে ইনস্টিটিউটের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসে, কিভাবে একটা ট্রাক এসে তার জীপকে ধাক্কা দেয়, কিভাবে ছিটকে পড়ার পর উঠে বসতে চেষ্টা করে এবং কিভাবে একটা মাইক্রোবাস এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তার সাথে বলে-দেশে ইদানিং সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধির কথা।
আহমদ মুসা ভেবে পেলনা, এই খবর প্রকাশ কিভাবে সম্ভব হল? নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ইনস্টিটিউটের সালমান শামিল। ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ কি তাহলে এই ঘটনা প্রকাশের ব্যাপারে চেষ্টা করেছে বা চাপ দিয়েছে?
আহমদ মুসার চিন্তা স্রোতে বাধা পড়ল। হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল মুহাম্মদ বিন মুসা। বলল, জনাব আমাদের একজন লোককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কোত্থেকে হারিয়েছে?
কুদতলি থেকে।
সে কি আমাকে দেখেছে কিংবা আমি আসার খবর জানে?
জানে, সে তখন উপকূলে হাজির ছিল।
খবর আপনি কখন পেয়েছেন।
এই মাত্র।
কে আপনাকে খবর দিয়েছে?
কুদতলি ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’- এর একজন কর্মী এসেছে।
কুদতলি থেকে কখন বেরিয়েছে সে?
বিকেলে।
এত দেরি কেন? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন আহমদ মুসা।
রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া প্রথমে সে ‘কুমুখী’তে যায়, তারপর এখানে আসে।
আহমদ মুসা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। বললেন তারপর, আমার অনুমান মিথ্যা না হলে আমি বলব আমাদের কুদতলি ঘাঁটি এতক্ষণে আক্রান্ত হয়েছে।
মুহাম্মদ বিন মুসা কোন কথা না বলেই সোফায় বসে পড়ল। তার মুখ শুকনো। চোখে-মুখে উদ্বেগ।
রাত তখন দশটা। আহমদ মুসা ভাবছিলেন চোখ বুজে। এক সময় চোখ খুলে মুহাম্মদ বিন মুসার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাকুতে কতদিন ধরে আপনারা এই ঘাটিতে আছেন?
এক বছর।
আমার আশংকা হচ্ছে আজ রাতে এখানেও আক্রমণ হতে পারে।
কেমন করে বুঝলেন?
যে কর্মীকে ধরে নিয়ে গেছে তার কাছ থেকে নিশ্চিতভাবে আমার আসার খবর পাবে এবং সে খবর পাবার পর কোন সময় না দিয়ে সম্ভাব্য সকল স্থানে ওরা আঘাত হানবে।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই টেলিফোন বেজে উঠল। মুহাম্মদ বিন মুসা গিয়ে টেলিফোন ধরল।
টেলিফোন ধরে কথা শুনতে শুনতে মুহাম্মদ বিন মুসার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল।
তারপর টেলিফোন রেখে আতর্নাদ করে উঠল, মুসা ভাই আমাদের কুদতলি ঘাঁটি শেষ করে দিয়েছে। কেউ বাঁচেনি।
কখন আক্রমণ হয়েছে?
সন্ধ্যার পর পরই।
কে টেলিফোন করেছে?
কুদতলির পাঁচ মাইল পশ্চিমের একটি ছোট শহর থেকে আমাদের এক কর্মী।
আহমদ মুসা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, মুহাম্মদ বিন মুসা, এখনই কয়েকজন কর্মীকে কুদতলিতে পাঠাও সব বিষয় সরেজমিনে জানার জন্যে।
একটু থেমে আবার বললেন, ‘কুমুখী’ তে খবর পাঠাও এখনি যাতে সকলে ঘাঁটি ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র সরে যায়। আর এ ঘাঁটি থেকেও সবকিছু এবং সবাইকে এখনই সরিয়ে দাও। এ ঘাঁটিতে আজ শুধু তুমি, আজিমভ এবং আমি থাকব। বলে আহমদ মুসা চোখ বুজে সোফাতে গা এলিয়ে দিলেন।
তার মানস চোখে কুদতলি ঘাঁটির দৃশ্য। সারিবদ্ধ লাশ সেখানে। এদের মা, বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে সবাই আছে। তাদের বুক ফাটা কান্নায় কোন সান্ত্বনা দেয়া যাবে? চোখের কোণ ভারী হয়ে উঠল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা চোখ খুলে দেখল , মুহাম্মদ বিন মুসা নেই। সম্ভবত তার নির্দেশ পালন করতে বেরিয়ে গেছে।
সেদিন গভীর রাত। বাকুর ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’-এর ঘাঁটিটার দক্ষিণ পাশ দিয়ে একটা বড় এ্যাভিনিউ। আর পূর্ব পাশ দিয়ে ছোট একটা রাস্তা। ছোট রাস্তাটা ঐ এ্যাভিনিউ থেকে বেরিয়েছে। বাড়ির পূর্ব ও উত্তর দিকটা বাগান ঘেরা।
রাত এগারোটায় আহমদ মুসা, আলীআজিমভ ও মুহাম্মদ বিন মুসা গ্যাস মাস্ক হাতে নিয়ে বাড়ির পেছন দিকের সুইপার প্যাসেজ দিয়ে বেরিয়ে এলেন। আহমদ মুসা মুহাম্মদ বিন মুসার দিকে চেয়ে বললেন, তুমি পূব দিকে বাগানে লুকিয়ে দক্ষিণ ও পূর্বের প্রাচীরে দিকে লক্ষ্য রাখ। আর আলী আজিমভ উত্তর দিকের প্রাচীরে। আমি পশ্চিম দিকে থাকছি। আমার ধারণা ওরা এলে বারটার আগে আসবে না। ওরা এলে আমি যেভাবে বলেছি কাজ করবে।
এক এক করে বারটা বাজার শব্দ উঠল বাকু মিউজিয়ামের পেটা ঘড়িতে।
ধীরে ধীরে রাস্তায় গাড়ির শব্দ, হর্ণের আওয়াজ কমে এল। নিস্তব্ধতা নেমে এল রাতের বাকুতে।
আহমদ মুসা নিশ্চিত ‘হোয়াইট ওলফ’-এর কেউ যদি ককেশাস ক্রিসেন্টের এ ঘাঁটিতে ঢুকতে চায় তাহলে ফল বাগানের দিকটাই ব্যবহার করবে।
আহমদ মুসার অনুমান সত্য হল। রাত সাড়ে বারটার দিকে নিঃশব্দে একটা ছায়ামুর্তি উঠে এল প্রাচীরে ওপর। তারপর আরও দুজন।
প্রাচীরের এই অংশটা গাছের ছায়ায় অন্ধকার। কিন্তু আহমদ মুসার ইনফ্রারেড গগলস-এ সবছিু স্পষ্টভাবে ধরা পড়ল।
ওরা তিনশন নিঃশব্দে প্রাচীর থেকে নামল। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর বিড়ালের মত নিঃশব্দে এগিয়ে চলল। ককেশাস ক্রিসেন্টের বাড়ির দিকে।
আহমদ মুসা মুখে তার গ্যাস মাস্ক ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে তাদের পিছু নিলেন। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই পেছনে একটা শব্দ পেয়ে পেছনে ফিরে তাকালেন। দুজন লোক লাফিয়ে পড়েছে প্রাচীর থেকে ।তাদের হাতে লম্বা ব্যারেলের রিভলবার।
ওদিকে এক নিমেষ তাকিয়েই আহমদ মুসা চকিতে পাশের মোটা গাছটার আড়ালে সরে গেলেন।
পর মুহূর্তেই একটা নিউট্রন বুলেট এসে বিস্ফোরিত হল গাছটির পাশে, আহমদ মুসার থেকে এক হাতের মধ্যে। ভয়াবহ নিউট্রন বুলেটটির এত সান্নিধ্যে শিউরে উঠল আহমদ মুসার দেহ।
আহমদ মুসা বুঝতে পেরেছিলেন তার সামনে পেছনে দুদিকেই শত্রু। তাদের সময় দেয়া যাবে না। যে মুহূর্তে নিউট্রন বুলেট বিস্ফোরিত হল, সে মুহূর্তেই গাছের আড়াল থেকে আহমদ মুসার এম-১০ মেশিন রিভলবার গুলী বৃষ্টি করল পেছনের ঐ ছায়ামুর্তি লক্ষ্য করে।
সাইলেন্সর লাগানো এম-১০ থেকে চাপা শিষের মত একটা আওয়াজ বেরুল শুধু।
নিউট্রন বুলেট ছোঁড়ার পর ওরা উঠে দাড়িয়েছিল এগিয়ে আসার জন্যে। কিন্তু এম-১০ এর এক ঝাঁক বুলেটে ঝাঝঁরা হয়ে যেখানে দাড়িয়েছিল সেখানেই পড়ে গেল।
আহমদ মুসা গুলী ছোড়ার পর ফিরে দাড়িয়ে দেখলেন, সামনের চলমান তিনটি ছায়ামুর্তি থমকে দাড়িয়েছে।
আহমদ মুসা বুঝলেন পেছনের সাথীদের কি হয়েছে, কি ঘটেছে তা না দেখে ওরা আর সামনে এগুবে না।
ওদের থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্যে আহমদ মুসা সন্তর্পণে গাছের পশ্চিম পাশে চলে এলেন।
তারপর গাছের আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখলেন, তিনটি ছায়ামুর্তি নিশ্চলভাবে দাড়িয়েই আছে। বোধ হয় ঘটনা বুঝতে চেষ্টা করছে।
আরও কিছুক্ষণ পর ঝি-ঝি পোকার মত এক ধরণের শব্দ করে উঠল তাদের একজন।
ওটা ওদের সংকেত । কোন উত্তর ওরা পেল না।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ওরা তিনটি ছায়ামুর্তি হামাগুড়ি দিয়ে সর্ন্তর্পণে এগিয়ে আসতে লাগল।
আহমদ মুসা একহাতে টর্চ, অন্য হাতে এম-১০ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল । ইচ্ছা করলে আহমদ মুসা খুব সহজেই তাদের হত্যা করতে পারেন। কিন্তু আহমদ মুসা ‘হোয়াইট উলফ’কে জীবন্ত ধরতে চান। জানতে চান ওদেরকে।
ওরা গাছের সমান্তরালে আসতেই আহমদ মুসা টর্চের আলো ওদের ওপর ফেলে কঠোর কণ্ঠে বললেন, উঠে হাত তুলে দাড়াও। না হলে এম-১০ এর গুলী ঝাঁক এখনই তোমাদের ঝাঁঝরা করে দেবে।
টর্চের আলোর দিকে স্থির দৃষ্টি রেখেই তারা উঠে দাড়াচ্ছিল। দুচোখে থেকে তাদের হিংস্রতা ঝরে পড়ছিল। উঠতে গিয়ে তাদের একজন অকস্মাৎ ঝাপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার ওপর।
আহমদ মুসা তাদের উপর স্থির দৃষ্টি রেখেছিলেন। মতলব বুঝতে পেরেই আহমদ মুসা লোকটি ঝাঁপিয়ে পড়ার সাথে সাথেই নিজেকে ডানপাশে একটু সরিয়ে নেন।
এইভাবে সরতে গিয়ে বামহাতের টর্চ নিভে যায়, কিন্তু এম-১০ এর ট্রিগার তার তর্জনি চেপে বসল। বেরিয়ে যায় এক ঝাঁক গুলী। সামনের দুজন অস্ফুট আর্তনাদ করে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় মাটিতে। যে লোকটি আহমদ মুসার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে আহমদ মুসার পাশেই উপুড় হয়ে পড়ে যায়। আহমদ মুসা তাকে আর ওঠার সুয়োগ দেননি। এম-১০ ও টর্চ ফেলে দিয়ে তার ওপর ঝাপিয়ে পড়েন।
কিন্তু লোকটির কাছ থেকে কোন প্রতিরোধ আসে না। বরং তার শরীরে এক অস্বাভাবিক কম্পন অনুভব করেন আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা উঠে দাড়ান। টর্চ কুড়িয়ে নিয়ে তার ওপর টর্চের আলো ফেলে দেখে, লোকটি তার ডান হাতের আংটিটি কামড়ে ধরে আছে।
আহমদ মুসার আর বুঝতে বাকি থাকে না, আংঠিতে লুকানো ভয়ানক বিষ খেয়ে লোকটি আত্মহত্যা করছে।ধরা পড়া অবধারিত জেনেই সে এটা করেছে ‘হোয়াইট উলফ’-এর এটাই বোধ হয় নির্দেশ যে, কারো জীবন্ত ধরা পড়া চলবে না।
আহমদ মুসা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একটা শিস দিলেন।
সংকেত পেয়ে অল্পক্ষনের মধ্যেই আলী আজিমভ এবং মুহাম্মদ বিন মুসা এসে হাজির হল সেখানে।
আহমদ মুসা ওদেরকে সংক্ষেপে সব কথা বলে লাশগুলো বাগান থেকে টেনে নিয়ে এলেন আলোতে। দেখলেন, সবাই আর্মেনিয়।
তাদের পকেট হাতড়ে কিছুই পাওয়া গেল না। অস্রশস্র আর কিছুই নেই তাদের সাথে।
পরদিন সকাল। ককেশাস ক্রিসেন্টের বাকু পার্টির ড্রইংরুম।
আহমদ মুসা মহাম্মাদ বিন মুসাকে বললেন, লাশগুলোর ব্যবস্থা করেছ?
জি হ্যাঁ।
আজ তোমাদের প্রধান কাজ হল ককেশাস ক্রিসেন্টকে তার সব ঘাঁটি খালি করতে বলা। তুমি তোমার পক্ষ থেকে সবাইকে জানিয়ে দাও সবাইকে, পুরাতন ঘাঁটি ছেড়ে আজই নতুন ঘাটি যেন খুঁজে নেয়।
আজ মুহাম্মদ বিন মুসাকে খুব খুশি দেখাচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত তরি মধ্যে যে ভয় আর হতাশার চিহ্ন ছিল আজ তা নেই। এই প্রথমবারের মত তারা ‘হোয়াইট উলফ’-এর পাঁচজনকে হত্যা করতে পেরেছে, তাদের একটা মিশন তারা ব্যর্থ করতে পেরেছে। সে খুব খুশি যে, সাফল্য দিয়েই আহমদ মুসার যাত্রা শুরু হয়েছে। ঐসময় আহমদ মুসার ঐ নির্দেশকে তার ভাল লাগল না। বলল, কেন জনাব? আমাদের জন্যে কি এটা এখন খুব জরুরি?
হ্যাঁ, আমরা ওদের আক্রমণের অসহায় শিকার হতে পারি না।
কিন্তু আক্রান্ত না হলে তো আজকের এই সাফল্য আসতো না।
এইধরনের সাফল্যের জন্যে যে প্রস্তুতি আমাদের প্রয়োজন তা আমাদের নেই।
কিন্তু এই সরে পড়া ‘আমরা ভীত’ প্রমাণ করবে না?
তা করুক। শত্রু একটা আত্মপ্রসাদ লাভ করুক। কিন্তু আমাদের এটা কৌশল।
শত্রুকে আমাদের ব্যাপারে অন্ধকারে ফেলে দেয়া। আমরা যেমন ওদের ঠিকানা জানি না তেমনি আমাদের ঠিকানাও ওদের কাছ থেকে মুছে ফেললাম।
ঠিক বলেছেন জনাব। খুশি হয়ে বলল, মুহাম্মদ বিন মুসা।
আমার আরও একটা নির্দেশ সবাইকে জানিয়ে দাও। সেটা হল আমাদের পরিচিত ও নেতৃস্থানীয় সব লোককে আজ থেকে আত্মগোপন করতে হবে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কাউকে জনসমক্ষে আসা চলবে না।
এটা কেন জনাব? সম্ভব হবে কি এটা?
সম্ভব হতে হবে।
আমাদের লোকক্ষয় এড়াবার জন্যে এটা প্রয়োজন। তাছাড়া আমাদের পরিচিত ও নেতৃস্থানীয় লোকজন যদি জনসমক্ষে থাকে, তাহলে আমাদের নতুন ঘাঁটির সন্ধান ‘হোয়াইট উলফ’ দু’এক দিনেই বের করে ফেলবে।
আমি এখন বুঝতে পেরেছি জনাব। হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করে বলল মুহাম্মদ বিন মুসা।
হাসিমুখেই মুহাম্মদ বিন মুসা আহমদ মুসার নির্দেশ পালনের জন্য বেরিয়ে গেল।
হোয়াইট উলফের পাঁচজনকে মারতে পেরে মুহাম্মদ বিন মুসার খুশি ধরছে না। বলল আলী আজিমভ।
কিন্তু ওদের মৃত্যু আমাদের ক্ষতি করেছে, ওদের এই মৃত্যু আমি চাইনি। এঘটনা শত্রুকে আরও সাবধান ও সতর্ক করে দিয়ে গেল। বেঁচে থাকলে ওদের কাছ থেকে শত্রুর একটা সন্ধান আমরা পেতামই।
আলী আজিমভ কোন কথা বলল না, আহমদ মুসাও না।
আহমদ মুসা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। তাঁর কপাল কুঞ্চিত। ভাবছেন তিনি।
কোন পথে এগুনো যায়? পথ কোথায় সামনে এগুবার? অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াই করা যায়?
মনে পড়ল আহমদ মুসার সালমান শামিলের কথা। সালমান শামিলের কিডন্যাপের মধ্যেই শুধু একটা আলোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু যারা কিডন্যাপ দেখেছে, যারা ঝুঁকি নিয়ে নিউজটা সংবাদপত্রে দিয়েছে, তারা কি আহমদ মুসার সাথে কথা বলতে রাজি হবে? আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভেনের ঐ সম্মানিত ইনস্টিটিউটের কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই খৃস্টান হবে। তাদের কোন প্রকার সহযোগিতা মুল্যবান হতে পারে।
আহমদ মুসার বিশ্বাস, ‘হোয়াইট উলফ’-এর মেরুদন্ড যেহেতু খৃস্টান আর্মেনিয়া, তাই হোয়াইট উলফের মূল ঠিকানা ঐ ইয়েরেভেনেই হবে। যাই হোক অবিলম্বে তাঁর ইয়েরেভেনেই যাওয়া দরকার।
এই সময় মুহাম্মদ বিন মুসা ড্রইং রুমে প্রবেশ করল উসমান এফেন্দীকে নিয়ে কথা বলতে বলতে।
চিন্তায় বাধা পড়ল আহমদ মুসার। চোখ মেলে তাকালেন তিনি।
মুহাম্মদ বিন মুসা বলল, জনাব ইনি উসমান এফেন্দী। ইয়েরেভেন থেকে এসেছেন। আমাদের ইয়েরেভেন যুব শাখার কর্মী।
সালাম বিনিময়ের পর আহমদ মুসা তাকে বসতে বলে বললেন, ভালই হল আমি ইয়েরেভেন যেতে চাচ্ছি।
সত্যি? আপনার যাওয়া প্রয়োজন। চোখ উজ্জ্বল করে বলল উসমান এফেন্দী।
কেন প্রয়োজন মনে কর? প্রশ্ন করলেন আহমদ মুসা।
সালমান শামিলের অনুসন্ধানের জন্যে।
সন্ধানের কোন সুত্র পাওয়া যাবে সেখানে?
বলতে পারব না, তবে এটুকু শুনেছি- সালমান শামিল ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর ডঃ জনসনের খুব প্রিয় ছাত্র ছিল। দারোয়ানের কাছ থেকে আমি শুনেছি সালমান সেদিন সোজা গিয়ে ডঃ পল জনসনের কাছেই উঠেছিল। দেড় ঘন্টা ছিল সেখানে। সেখান থেকে বেরিয়ে ফেরার পথেই সে কিডন্যাপ হয়।
ঠিক বলেছ উসমান, আমরা তার সাহায্য চাইতে পারি সালমান শামিলের অনুসন্ধানের জন্যে।
সালমান শামিল তার প্রথম কিডন্যাপ প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে পালিয়ে উসমান এফেন্দীর ওখানেই উঠেছিল। আবার যেদিন সে কিডন্যাপ হয় সেদিন উসমান এফেন্দীর ওখান থেকেই যায়। বলল মুহাম্মদ বিন মুসা।
ঠিক আছে উসমান তুমি একটু বিশ্রাম নাও। পরে তোমার কাছ থেকে সব শুনব। আজই আমরা ইয়েরেভেনে রওয়ানা হতে চাই। বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালেন। প্রবেশ করলেন তাঁর বিশ্রাম কক্ষে।

সেদিনই বাদ আসর।
একটা জীপ দাঁড়িয়েছিল বাকু ককেশাস ক্রিসেন্টের নতুন ঘাঁটির সামনে। জীপের ড্রাইভিং সিটে স্টিয়ারিং ধরে বসেছিল উসমান এফেন্দী। পাশের সিটে আলী আজিমভ।
পেছনের সিটে গিয়ে উঠলেন আহমদ মুসা। লাগেজ এর আগেই উঠেছে। সকলেরই পরনে আর্মেনিয় পোশাক।
মাথায় খৃস্টানদের মত শোলার ক্যাপ।
জীপে উঠে আহমদ মুসা বললেন, উসমান তুমি রেডি?
জি হ্যাঁ। উত্তর দিল উসমান এফেন্দী।
মুহাম্মদ বিন মুসা ও ‘কুমুখী’র ককেশাস ক্রিসেন্টের প্রধান লতিফ করিমভ জীপের দরজায় আহমদ মুসার সামনে দাঁড়িয়ে।
আহমদ মুসা তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা সাবধানে থেকো। পরিকল্পনার বাইরে যেও না। মনে রেখ ইতিমধ্যেই যথেষ্ঠ ক্ষতি আমাদের হয়েছে। অহেতুক ক্ষতি অর্থাৎ তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে আমরা যেন ক্ষতির শিকার না হই সে চেষ্টা আমাদের করতে হবে।
তারপর উসমানের দিকে ফিরে বললেন, বিসমিল্লাহ বলে স্টার্ট দাও উসমান।
উসমান এফেন্দী চাবি ঘুরাতেই গর্জে উঠল ইঞ্জিন।
জীপের দরজায় দাঁড়ানো মুহাম্মদ বিন মুসা ও লতিফ করিমভ বলল, আপনার সব নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে জনাব।
আল্লাহ সহায় হোন। বললেন আহমদ মুসা।
সচল হল গাড়ি। ছুটে চলল তারপর ইয়েরেভেনের দিকে।
আহমদ মুসার দৃষ্টি সামনের দিকে প্রসারিত। ভাবছেন তিনি, ইয়েরেভেন শুধু আর্মেনিয় রাজধানী নয়, ‘হোয়াইট উলফ’-এরও রাজধানী। কম্যুনিষ্ট ও খৃস্টান শক্তির মানস সন্তান ‘হোয়াইট উলফ’ -রহস্যময় রাজধানী কি তাকে দরজা খুলে দেবে? আল্লাহ তাকে তাওফিক দেবেন রক্ষা করতে ককেশাসকে, ককেশাসের মজলুম মুসলমানদেরকে? ভেবে চলেছেন আহমদ মুসা।
জীপ তখন ছুটে চলেছে ফুল স্পীডে বাকু-নাগারনো কারাবাখ সড়ক হয়ে ইয়েরেভেনের দিকে।

পরবর্তী বই
ককেশাসের পাহাড়ে

Top