৮. সিংকিয়াং থেকে ককেশাস

চ্যাপ্টার

যুবায়েরভ এবং আবুল ওয়াফা আহমদ মুসা এবং হাসান তারিককে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। তারপর সামনে এগিয়ে দুজন দুজনকে পাগলের মত জড়িয়ে ধরল।
যুবায়েরভ মুসলিম মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান কর্নেল কুতাইবার এবং আবুল ওয়াফা ফিলিস্তিন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান কর্নেল মাহমুদের প্রতিনিধি হিসেবে এখানে এসেছে। আবুল ওয়াফার সাথে আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের কয়েক বছর পর দেখা। আর যুবায়েরভের সাথে এই সেদিন বিপ্লব পর্যন্ত এক সাথে করেছে তারা। আনন্দে ও আবেগে যুবায়েরভ ও আবুল ওয়াফার দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।
আলিঙ্গন শেষে দুজনের একসাথে প্রশ্ন আপনারা তো ভাল ছিলেন? ভাল আছেন?
হ্যাঁ আমরা ভাল আছি। বললেন আহমদ মুসা।
মুসা ভাইকে কোথায় পেয়েছিলেন, কীভাবে পেয়েছিলেন?
যুবায়েরভ হাসান তারিকের দিকে এক সাথে প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দিল।
সব শুনবেন, মুসা ভাই-ই সব বলবেন। তার আগে ওদিকে সবাই কেমন আছে?
কেমন থাকবে, সবার অবস্থা পাগলের মত। সবাই সব কাজ করে কিন্তু যেন প্রান নেই কারও। কুতাইবা ভাইকে দেখলে চিনতে পারবেন না। একদম অর্ধেক হয়ে গেছে। আহমদ মুসা আলাপ করছিলেন আবুল ওয়াফার সাথে। যুবায়েরভের এ কথা তার কানে যেতেই তিনি বলে উঠলেন, কেন কি হয়েছে তার, কোন অসুখ-বিসুখ?
না কোন অসুখ নয় মুসা ভাই। আপনাকে হারাবার পর থেকেই উনি যেন কেমন হয়ে গেছেন। একদম নিরব। সারাদিন নীরবে কাজ করে যান। আর রাতের সাথী জায়নামায। রাতে চোখের পানি তার বোধ হয় শুকায় না।
ওখানে কি সবাই পাগল হয়ে গেছে? কোন কিছুর অভাবে বা কোন ব্যাথায় মুষড়ে পড়া তো ইসলামী চরিত্র নয়।
অনেকেই তাকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু তিনি বলেন, আমি তো মুষড়ে পড়িনি, আমি তো গাফলতি করছি না কোন কাজে? তার বার বার একটাই কথা, আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি মুসা ভাইয়ের প্রতি।
পাগল, পাগল। আল্লাহর যে কি পরিকল্পনা এতে ছিল তা তো সে ভেবে দেখেনি।
একটু থামলেন আহমদ মুসা। তারপর হাসান তারিকের দিকে ফিরে বললেন, তুমি আয়েশার খবর নিয়েছ? হাসান তারিকের মুখ লাল হয়ে উঠল। মাথা নিচু করল। বলল, ঠিক আছে, নেব পরে।
যুবায়েরভ এই কথা শুনেই উঠে দাড়াল। বলল, ওরা সবাই ভাল আছেন মুসা ভাই। আয়েশা ভাবী একটা চিঠি দিয়েছিল। এনে দিচ্ছি।
সুটকেস থেকে চিঠি এনে যুবায়েরভ হাসান তারিকের হাতে দিল। হাসান তারিক চিঠিটা নিয়ে পকেটে রেখে দিল। তা দেখে আহমদ মুসা বললেন, তারিক যাও পাশের ঘরে, চিঠিটা পড়ে এস। জরুরী খবর থাকতে পারে।
হাসান তারিক একটু দ্বিধা করল। তারপর নির্দেশ মেনে চলে গেল পাশের ঘরে।
আহমদ মুসা বললেন, দেখ কি ভুল। আমাদের এ ভাইয়ের সাথে তোমাদের পরিচয় করে দেয়া হয়নি।
আহমদ ইয়াং পাশে একটা চেয়ারে বসে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপের মত অপলক কোছে এই মিলন দৃশ্য দেখছিল।
আহমদ মুসা তাকে দেখিয়ে বললেন, এ আহমদ ইয়াং। এখানকার ইসলামী আন্দোলন অর্থাৎ ‘টার্কিক এম্পায়ার গ্রুপের’ একজন সিপাহসালার ও আমার একজন অতি প্রিয় সাথী।
যুবায়েরভ ও আবুল ওয়াফা এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ ইয়াংকে।
আলাপ পরিচয় শেষে সবাই স্হির হয়ে বসল। হাসান তারিক ফিরে এল পাশের রুম থেকে।
কোন ম্যাসেজ যুবায়েরভ? বললেন আহমদ মুসা।
আপনার জন্য একটা চিঠি আছে। একটা চিঠি গভর্নর লি ইউয়ানকে আমরা দিয়েছি। আমাদের প্রথম দায়িত্ব ছিল সিংকিয়াং প্রশাসনের সহযোগিতায় আপনাদের খুজে বের করা।
কুতাইবা – মাহমুদরা কিভাবে নিশ্চিত হল যে, লি ইউয়ানের সাহায্য তারা পাবে।
পিকিংস্হ দুতাবাসের মাধ্যমে তার সাথে এ ব্যাপারে প্রাথমিক আলাপ হয়েছিল। বিস্তারিত না জানিয়ে শুধু বলা হয়েছিল ‘ফ্র’ এর লোকেরা আমাদের একজন লোককে কিডন্যাপ করে এনেছে। গভর্নর এতে সহযোগিতা করতে রাজি হন। তারপরই বিস্তারিত প্রস্তাব নিয়ে আমরা তার কাছে এসেছি। মিন্দানাও প্রজাতন্ত্রের সরকারও পিকিং- এর উপর চাপ দিচ্ছে। তারাও দেখা করেছে গভর্নর লি ইঊয়ানের সাথে সিংকিয়াং-এর মুসলমানদের ব্যাপারে।
থামল যুবায়েরভ। তারপর সুটকেসটা টেনে একটা সিল করা বড় ইনভেলপ তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা উল্টে-পাল্টে খামটার উপর নজর বুলালেন। মুসলিম মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের নামাংকিত সরকারী ইনভেলপ।
খামটার উপর চোখ বুলাতে বুলাতে চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। অনেকটা স্বগতঃই উচ্চারণ করলেন, কত ত্যাগ, কত সাধনা, কত লড়াই এর ফসল এই স্বাধীনতা। তিনি প্রশ্ন করলেন যুবায়েরভকে, সংস্কার-কাজ, মানুষের দুঃখ-মোচনের কাজ কেমন চলছে যুবায়েরভ?
শিক্ষা, মটিভেশন এবং তার সাথে সংস্কারের কাজ পাশাপাশি চলছে। প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার মত মৌলিক অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
খুশি হলেন আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বললেন, ঠিক করছ তোমরা। শুধু নাম বদল, পতাকা, মানুষ বদল ইত্যাদিতে কোন লাভ নেই যদি না আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যা চান তার ব্যবস্থা না করা যায়।
আহমদ মুসা ইনভেলপের একটা প্রান্ত ছিড়ে ফেললেন। বের করলেন বড় ধরনের একটা চিঠি। সুন্দর কাগজে লেখা। কাগজটা রুশ আমলের। লেটার হেডে ছাপা সোভিয়েত কম্যুনিস্ট প্রজাতন্ত্রের নাম কেটে তার পাশে মুসলিম মধ্য এশিয়ার নাম উৎকীর্ণ করা হয়েছে।
কাগজগুলো নষ্ট না করে এই ভাবে ব্যবহারের ব্যবস্থা করে তোমরা ঠিক করেছ যুবায়েরভ। শিশু রাষ্ট্রের সৌখিনতার চেয়ে অস্তিত্ব বহুগুণ বড়। বললেন আহমদ মুসা।
চিঠিটা তার চোখের সামনে মেলে ধরলেন আহমদ মুসা। দীর্ঘ চিঠি পড়তে শুরু করলেন তিনি।

আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ভাই,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আপনাকে এই সালাম পাঠাতে গিয়ে বেদনায় মনটা মুষড়ে পড়ছে। আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন আমরা জানি না। আমাদের সালাম আপনার কাছে কবে পৌছবে, আদৌ পৌছবে কিনা তাও জানি না। এই না জানার বেদনা আমাদে ক্ষত বিক্ষত করে চলছে। জেনারেল বোরিসের পেছনেই গেছে হাসান তারিক এবং আব্দুল্লায়েভ। তাদেরও কোন খোঁজ আমরা পাইনি। পিকিং সরকার এবং সিং কিয়াং এর প্রাদেশিক সরকারের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা শুরু করেছি। ফিলিস্তিন ও মিন্দানাও সরকারও চেষ্টা করছে। সৌদি সরকারকেও অনুরোধ করা হয়েছে। তারা চেষ্টা করছে। মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে আমাদের আকুল প্রার্থনা, আল্লাহ আপনাকে নিরাপদে রাখুন, সুস্থ রাখুন।
এই চিঠি আপনার কাছে পৌঁছবে কিনা নিশ্চিত নই, তবু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এক বিষয়ে আপনাকে লিখছি যদি চিঠিটা আপনার কাছে পৌঁছে এই আশায়।
ককেশাস অঞ্চল নিয়ে ভয়ানক এবং জঘন্য এক ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠেছে। আপনি জানেন, পামির থেকে কাস্পিয়ানের উত্তর তীর এবং আফগান সীমান্ত থেকে কাজাখস্থানের শেষ প্রান্ত ইউরাল পর্বতমালা পর্যন্ত এলাকা নিয়ে মুসলিম মধ্য এশিয়া সাধারণতন্ত্র গঠিত হয়েছে। আর নতুন রাশিয়ার রিপাবলিকের একটা সীমানা মধ্য এশিয়া মুসলিম সাধারণতন্ত্র, ক্রিমিয়া এবং তাতারিয়া স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের উত্তর বরাবর এসে শেষ হবার কথা। এখান থেকে ইরান ও তুরস্কের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ক্রিমিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান এবং তাতারিয়া এক কালের এই চার অঞ্চল নিয়ে গঠিত মুসলিম অধ্যুষিত ককেশাস অঞ্চল আজ মারাত্মক ষড়যন্ত্র ও সংঘাতের শিকার। সেখানে চেষ্টা হচ্ছে একটা খালেস খৃষ্টান রাষ্ট্র কায়েমের। কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধবর্তি এশিয়া ও ইউরোপকে সংযোগকারী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এই অঞ্চলে তারা চাচ্ছে পশ্চিমী স্বার্থের আজ্ঞাবহ একটা খৃষ্টান রাষ্ট্র কায়েম করতে। এ রাষ্ট্রের দুপাশে থাকবে দুই সাগর, পশ্চিম পাশে তুরস্ক, দক্ষিনে ইরান এবং উত্তর সীমান্ত গঠিত হবে ককেশাস পর্বত মালা দিয়ে। রাষ্ট্রটা হবে অবস্থান ও সমৃদ্ধির দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। এখান থেকে শুধু দুই সাগর নিয়ন্ত্রন নয়, চারপাশের গুরুত্বপূর্ন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর উপরও খবরদারীর একটা পথ হবে। ওরা চেয়েছিল লেবাননকে দিয়ে এশিয়ায় একটি খৃষ্টান রাষ্ট্রের অভাব পূরণ করতে। কিন্তু সে আশা পূরন হয়নি। এখন ককেশাসকে দিয়ে সে সাধ পূরণ করতে চাচ্ছে। উত্তরের রাশিয়ান রিপাবলিক, যা মূলত খৃষ্টান জনঅধ্যুষিত, এতে তাদের লাভই দেখছে। তারা মনে করছে ককেশাসের ঐ অংশ যদি খৃষ্টানদের হাতে চলে যায়, তাহলে তাতারিয়া ও ক্রিমিয়াকে স্বাধীনতা না দিয়ে সে বাঁচতে পারে। এতে করে রাশিয়ান রিপাবলিকের সীমানা একদিকে ককেশাস পর্বতমালা পর্যন্ত পৌঁছবে, অন্যদিকে কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরে নামার পথ পাবে যা তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। অতএব রাশিয়ান রিপাবলিক এবং পশ্চিমা কয়েকটি খৃষ্টান দেশ আজ এক জোট হয়ে ককেশাসের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে। ১৯১৭ সালে লেনিনের পাঠানো কম্যুনিষ্ট রেড আর্মি আর্মেনিয় খৃষ্টান শামিউনের নেতৃত্বে ককেশাসের মুসলমানদের উপর গনহত্যা চালিয়ে অঞ্চলটিকে যেভাবে তাদের দখলে নিয়েছিল, সেভাবেই তারা এখন এগুচ্ছে। মুসলিম এলাকায় খৃষ্টান ও কম্যুনিষ্টদের মদদপুষ্ট গেরিলা সন্ত্রাস শুরু হয়েছে এবং মুসলিম নেতৃবৃন্দের অপহরণ ও হত্যার কাজও শুরু হয়ে গেছে। সুযোগ পেয়ে সন্ত্রাসী ‘ফ্র’রাও জুটেছে এখানে এসে। ইরান ও তুরস্ক নানা কারনেই এ ব্যাপারে মাথা ঘামাতে নারাজ। হয়তো সে সুযোগ ও সামর্থ্যও তাদের নেই। এ অবস্থায় আমরা চোখে অন্ধকার দেখছি। সেখানকার মুসলমানরা চরম আতংক ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। অবিলম্বে যদি তাদের ব্যাপারে কিছু না করা হয়, তাহলে ১৯১৭ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটবে আবার।
এই বিপদ আমরা বুঝতে পারছি, কিন্তু আমরা কিভাবে কি করণীয় তা বুঝতে পারছি না। ফিলিস্তিনের মাহমুদ ভাইয়েরও এই কথা। আমরা আপনার পরামর্শ ও পরিচালনা চাই।
সবশেষে আল্লাহর কাছে আমাদের আকুল প্রাথর্না এই চিঠি যেন অতি সত্ত্বর আপনার হাতে পৌছে।
ওয়াসসালাম-
আপনার স্নেহ ধন্য কুতাইবা।

চিঠি পড়া শেষ করে আহমদ মুসা নীরবে তা তুলে দিলেন হাসান তারিকের হাতে।
একটি কথাও বললেন না তিনি। তার শূন্য দৃষ্টিটা সামনে দেয়ালে নিবদ্ধ। ওখানে একটা বড় ল্যান্ডস্কেপ। ল্যান্ডস্কেপের দিগন্ত পেরিয়ে হারিয়ে গেছে তার দৃষ্টি। কপাল তার কুঞ্চিত। মুখে বেদনার কালো ছায়া।
সবাই নীরব। পল পল করে বয়ে যাচ্ছে সময়।
এক সময় আহমদ মুসার চোখ ধীরে ধীরে নীচু হল। যেন জেগে উঠলেন তিনি। একটু নড়ে বসলেন চেয়ারে। যুবায়েরভের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন তোমাদের কেউ গিয়েছিল ওখানে?
গিয়েছিল। একটা তথ্যানুসন্ধান দল পাঠনো হয়েছিল। আর ককেশাস থেকে কয়েকটা প্রতিনিধি দল এসেছে। কোন উত্তর এলোনা আহমদ মুসার কাছ থেকে। তাঁর দৃষ্টি আবার ফিরে গেছে সেই দেয়ালে। দৃষ্টিটা আবার কোথায় যেন হারিয়ে গেছে তাঁর।
হাসান তারিক চিঠি পড়া শেষ করে ভাঁজ করতে করতে বলল, আরেক ফিলিস্তিন, আরেক মিন্দানাও মুসা ভাই।
আহমদ মুসা মখটা ঘুরিয়ে হাসান তারিককে বললেন, মিন্দানাও ও ফিলিস্তিনে খৃষ্টান ও কম্যুনিষ্ট স্বার্থের এমন সম্মেলন ঘটেনি তারিক।
ঠিক বলেছেন মুসা ভাই।
আহমদ মুসা কোন কথা বললেন না। হাসান তারিকই আবার বলা শুরু করল। বলল, এটা ঠিক ইহুদী–ইসরাইলের মত খৃস্টানরাও এশিয়ায় একটি খৃষ্টান-ইসরাইল চায়। ককেশাস তাদের একটি সুচিন্তিত সিলেকশন।
এতে বিস্ময়ের কিছু আছে হাসান তারিক? উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও বিজ্ঞানের উন্নতি দিয়ে খৃষ্টানরা বহুদুর এগিয়েছে। শুধু ককেশাস কেন প্রতিটি দেশেই তাদের অবস্থান নিয়ে তারা ভাবছে। আর এটা শুধু ভাবা নয়। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিটি দেশ, গোটা বিশ্বকেই তারা একটি প্রতিষ্ঠানিক আওতার মধ্যে নিয়ে আসছে। ধীর কন্ঠে বললেন আহমদ মুসা।
কিন্তু কম্যুনিষ্ট ও খৃষ্টান স্বার্থের এই সম্মেলনের তা‍‌‌‌‍ৎপর্য কি? যোবায়েরভ প্রশ্ন তুলল।
ধর্মকে বাদ দিয়ে স্থায়ী কোন জাতি গঠন হয় না, সোভিয়েত জাতি গঠনের ব্যর্থতা কম্যুনিষ্টদের তা পরিষ্কার করে দিয়েছ। তাই এখন রাশিয়ান রিপাবলিক যদি কোন ধর্মের আশ্রয় নিতে আগ্রহী হয় তাহলে বিস্ময়ের কি আছে। আর রাশিয়ার জন্যে স্বাভাবিক ভাবেই সে ধর্ম হবে খৃষ্টান ধর্ম।
আবার নীরবতা।
আহমদ মুসা একবার ঘড়ির দিকে চেয়ে বললেন, অনেক রাত। বাইরে সরকারী লোকরা কষ্ট পাচ্ছে। যুবায়েরভের দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বললেন, তোমরা থাক এখানে। এখনকার মত উঠি। কাল দেখা যাবে।
কোথায় যাবেন? যুবায়েরভের কন্ঠে যেন উদ্বেগ।
এক শুভাকাঙ্ক্ষীর বাসায়। চলবার শক্তিহীন আহত অবস্থায় আমি যখন একটা রাস্তায় পড়েছিলাম তখন ওরাই আমাকে নিয়ে আসে।
জানে আপনাকে?
জানে। ওখানে হাসান তারিক ও আহমদ ইয়াং ও আমার সাথে থাকবে। আবদুল্লায়েভ আমাদের ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর হেড কোয়ার্টার্সে থাকে। কোন চিন্তা নেই।
কিন্তু আপনাকে ছাড়তে মন চাইছে না। হয় আপনি এখানে থাকুন না হয় আমাদের নিয়ে চলুন।
আহমদ মুসা হেসে ফেলে বললেন, পাগল। তোমাদের নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু তোমরা যার মেহমান তার অনুমতি না হলে পারি না। বলে আহমদ মুসা উঠে দাড়ালেন। তার সাথে হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াংও।
মুখ ভার করে যুবায়েরভ বলল, আপনার কিছুই আমরা শুনতে পারলাম না।
যুবায়েরভের পিঠ চাপড়ে আহমদ মুসা বললেন, হবে, কালকে সব শুনবে। আসি। তোমরা ঘুমাও।
বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। তার পিছনে হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াং। মা-চু গাড়িতে বসেছিল। মা-চুকে আহমদ মুসাদের সাথে আসতে বলা হলে বলেছিল, বড় ধরনের কোন কথা আমি কিছু বুঝি না। তার চেয়ে আমি গাড়ি পাহারা দিই।
আহমদ মুসা বুঝেছিল, মা-চু তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। গাড়িতে থাকাই তার জন্য বেশি প্রয়োজন। তবু আহমদ মুসা হেসে বলেছিলেন, তোমার আপামনি না তোমাকে আমার পাশে পাশে থাকতে বলেছেন।
মা-চু তৎক্ষণাৎ জবাব দিয়েছিল, তা বলেছেন। কিন্তু আপনি তো এখন লড়াই-এ যাচ্ছেন না।
মা-চুর জবাবে আহমদ মুসা হেসে উঠেছিলেন। মনে মনে বুঝেছিল মা-চুকে বোকা মনে হলেও খুব চালাক সে।
বাইরে করিডোরে একটা চেয়ারে বসেছিল সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। আহমদ মুসারা বেরুতেই সে উঠে দাড়িয়ে স্যালুট দিল।
আহমদ মুসা বললেন, খুব কষ্ট দিয়েছি আপনাদের। এখন আসুন। আমরা চলে যাচ্ছি।
সেনা অফিসারটি বলল, স্যার আপনাকে বাসায় পৌছে দিতে চায়।
এই-ই কি হুকুম?
গভর্নর সাহেবের এটা নির্দেশ।
ঠিক আছে। বলে আহমদ মুসা অতিথি ভবন থেকে বেরিয়ে তাদের জীপে এসে উঠলেন।
তাদের জীপের পেছনে পেছনে বেরিয়ে এল সেনাবাহিনীর একটি জীপ।

আহমদ মুসার জীপটি মেইলিগুলিদের গেটের মুখোমুখি হতেই বিস্ময়ে আঁতকে উঠলেন আহমদ মুসা। দেখলেন গেটটা হা হয়ে আছে। আরো দেখলেন একটা মাইক্রোবাস দ্রুত বেরিয়ে আসছে।
ছ্যাৎ করে উঠল আহমদ মুসার মনটা। নেইজেনকে উদ্ধার করতে গিয়ে আজ কিছুক্ষণ আগে ‘ফ্র’র ঘাঁটিতে দেখা আলামতের কথা তার মনে পড়ল। ঘাঁটির ঘরগুলো দেখতে গিয়ে একটা ঘরে হ্যাঙ্গারে একটা স্যুট সে দেখেছে। স্যুটটা জেনারেল বোরিসের। চীনে আসার সময় জেনারেল বোরিসের পরিধানে এই স্যুটটাই ছিল। কিন্তু বিশ্বাস হয়নি তার, জেনারেল বোরিস তার হাতটা সুস্থ না করেই ফিরে আসবে? কিন্তু এখন মেইলিগুলির বাড়ি থেকে এই মধ্যরাতে গাড়ি বেরুতে দেখে সেই আশংকা তার কাছে বাস্তবরূপ নিয়ে সামনে এল।
আহমদ মুসার জীপটি গেট থেকে রাস্তায় বেরুবার যে প্যাসেজে একদম গেটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল। আর মাইক্রোবাসটি তখনো গেট থেকে পাঁচ-ছয় গজ ভিতরে।
মুহুর্তের জন্য বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন আহমদ মুসা। কিন্তু মাইক্রোবাস থেকে স্টেনগান হাতে একজনকে লাফিয়ে পড়তে দেখেই আহমদ মুসা বললেন, ‘সাবধান তোমরা’ কথাটা বলতে বলতেই গাড়ি থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলেন আহমদ মুসা।
ব্যাপারটা আহমদ ইয়াং ও হাসান তারিকের নজরে পড়েছিল। আর তার প্রায় সাথে সাথেই বৃষ্টির মত এক পশলা গুলী এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল জীপটার উপর। গুলী বন্ধ হলো না। পাগলের মত কে যেন স্টেনগান চালাচ্ছে।
সেনা অফিসারটির জীপ ও গেট বরাবর রাস্তার উপর এসে দাঁড়িয়েছিল। ফলে এ জীপও গুলীর মুখে পড়ল। অপ্রস্তুত ড্রাইভার সৈনিকটি গুলী বিদ্ধ হয়ে তার সিটেই ঢলে পড়ল। সেনা অফিসারটি তার আগেই লাফিয়ে পড়েছিল নিচে। পেছনের সিটে বসা দুজন লেফটেন্যান্ট পেছনের দরজা দিয়ে নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।
আহমদ মুসার জীপের চেহারার একদম পাল্টে গেছে। উইন্ড স্ক্রিনের কোন চিহ্ন নেই। জীপের সামনের দিকটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। দুটো হেড লাইটও গুড়ো হয়ে গেছে।
আহমদ ইয়াং এবং দুজন লেফটেন্যান্টের স্টেনগানও উঁচু হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আহমদ মুসা হাত তুলে তাদের নিষেধ করেছে। ওরা নিশ্চিন্তে বেরিয়ে আসুক।
কর্ণেল সেনা অফিসারও আহমদ মুসার সাথে একমত হয়েছে। বলেছে, আমরা এবার আক্রমণের পজিশনে, ওদের বিভ্রান্ত করা এবং একটু আশ্বস্ত করে বন্দুকের নলের সামনে বের করে আনাই আমাদের প্রধান কাজ।
কর্ণেল, আপনারা এই কাজটি করুন। আর আহমদ ইয়াং, এদের সাথে এখানে দাঁড়িয়ে গেট থেকে কেউ যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করা তোমার দায়িত্ব। বলে আহমদ মুসা হাসান তারিককে বললেন, চল আমরা পেছন দিক দিয়ে বাড়িতে ঢুকব। পালাবার ওদিকের পথও বন্ধ করতে হবে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই আহমদ ইয়াং উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, মা-চু কোথায় মুসা ভাই? সে তো গাড়ি থেকে নামেনি।
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, চিন্তা করো না ইয়াং, আত্মরক্ষা ও আক্রমণ দুটি কৌশলই মা-চুর জানা আছে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক প্রাচীর ঘুরে দ্রুত চলে এলেন বাড়ির পেছনে।
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। করিডোরের ও বাড়ির পেছনের যে আলোটা সব সময়ই থাকে তাও নেই। আহমদ মুসার মনে পড়লো গেটের শেডেও কোন আলো দেখা যায়নি। তাহলে কি বিদ্যুত লাইন ওরা কেটে দিয়েছে? টেলিফোন লাইনও? এত বড় আয়োজন! বিস্ময় বোধ করলেন আহমদ মুসা। হঠাৎ মনে পড়লো, জেনারেল বোরিস তো কোন ছোট্ট মিশনে আসেনি। আহমদ মুসাসহ সবাইকে ধরার মত আঁট-সাট বেঁধেই সে এসেছে। ভাবতে গিয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো আহমদ মুসার। আল্লাহই জানেন, মেইলিগুলির কি হয়েছে! দেহের স্নায়ুতন্ত্র জুড়ে একটা জ্বালা ছড়িয়ে পড়ল তার। প্রাচীরের পেছনে অপেক্ষাকৃত একটি অন্ধকার জায়গায় এসে তারা দাঁড়ালেন।
পেছনের দিকে প্রাচীরটা আট ফিট উঁচু। আহমদ মুসা হাসান তারিককে বললেন, তুমি আমার কাঁধে পা টা রেখে প্রাচীরে উঠে যাও। হাসান তারিক একটু ইতস্তত করে বলল, আপনি কিভাবে উঠবেন?
এখন নষ্ট করার মত সময় নেই হাসান তারিক। যা বলছি কর। প্রায় ধমকে উঠলেন আহমদ মুসা। হাসান তারিক প্রাচীরে উঠে গেল। নেমে গেল ওপারে।
আর আহমদ মুসা প্রাচীরের প্রায় দশ গজ দূর থেকে তীব্র গতিতে ছুটে এসে অদ্ভূত দক্ষতার সাথে প্রাচীরের অর্ধেকটা দৌড়ে উঠে গেলেন এবং ওই অবস্থায় দুই হাত দিয়ে প্রাচীরের মাথাটা ধরে প্রাচীরে উঠে পার হয়ে গেলেন ওপারে।
প্রাচীর টপকে তারা বাড়ির পেছনের বাগানে এসে দাঁড়ালেন। এই বাগানটাই ঘুরে বাড়ির সামনে চলে গেছে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে বের করে ইনফ্রারেড গগলসটি চোখে পরে নিলেন। তারপর বিল্ডিংয়ের পাশ ঘেঁষে সামনে এগুলেন। তাঁর পেছনে হাসান তারিক। হাতে তাদের এম-১০ মেশিন রিভলভার। তাদের লক্ষ্য বাগান ঘুরে সেই মাইক্রোবাসটির পেছনে গিয়ে পৌঁছা।
বিল্ডিং এর দক্ষিণপাশ ঘুরে উত্তরমূখী হয়ে চলতে শুরু করেছেন এমন সময় আবার গুলি শুরু হল। গুলি শুরু হয়েছে এ পাশ থেকে।
বিল্ডিংটা উত্তর দক্ষিণ লম্বা। মাঝখানে গাড়ি বারান্দা। গাড়ি বারান্দারও প্রায় দশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে মাই্ক্রোবাসটি।
বিড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে দ্রুত আহমদ মুসা ও হাসান তারিক গাড়ি বারান্দায় উঠে দুই থামের আড়ালে দুজন বসে পড়লেন। এখান থেকে মাইক্রোবাসের পূব পাশ দিয়ে গেটের পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। দেখলেন, স্টেনগানধারী ছয়জন লোক গুলি করতে করতে সামনে এগুচ্ছে। গেটের গজ দুয়েক ভেতরে থাকতেই বিকট শব্দে একটা হাত বোমা এসে বিস্ফোরিত হল তাদের উপর। তার ইনফ্রারেড গগলসে তিনি বিস্ময়ের সাথে দেখলেন, বোমাটি ছুটে এল আহমদ মুসার সেই বিধ্বস্ত জীপ থেকে। তাহলে মা-চু এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল।
চারজন লোক ঢলে পড়লো ওখানেই। অন্য দুজন দুপাশে ছিটকে পড়েছিল। হামাগুড়ি দিয়ে ওরা সরে আসতে চেষ্টা করল এ দিকে।
এই সুযোগে গুলি করতে করতে গেট দিয়ে ছুটে এল আহমদ ইয়াং এবং অন্যরা।
মাইক্রোবাসের ড্রাইভিং সিট থেকে লাফ দিয়ে একজন নেমে এল এ সময়। টেনে নামাল সে আরেকজনকে। তারপর সেই লোক চিৎকার করে উঠল, আহমদ মুসা তোমরা আর এক পা এগুলে এবং গুলি করা বন্ধ না করলে মেইলিগুলির মাথা গুড়ো হয়ে যাবে।
দেখা গেল সেই লোকটা গাড়ি থেকে যাকে টেনে নামাল তাকে সামনে রেখে তার গা ঘেঁষে পেছনে দাঁড়িয়ে। আহমদ মুসা বুঝলেন সামনের জনই তাহলে মেইলিগুলি। তাকে বোরিস এখন ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।
জেনারেল বোরিসের কণ্ঠ ধ্বনিত হবার সাথে সাথে আহমদ ইয়াংরা থমকে দাঁড়াল, গুলিও বন্ধ হয়ে গেল তাদের।
জেনারেল বোরিস হো হো করে হেসে উঠল। বলল, আহমদ মুসা, জেনারেল বোরিসের হারাবার কিছূ নেই। আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। কিন্তু আজ তোমার প্রিয়তমা আগে মরবে তারপর আমি মরব।
একটু দম নিল জেনারেল বোরিস, তারপর আবার চিৎকার করে উঠল, তোমরা স্টেনগান ফেলে দিয়ে গেটের পূবপাশে গিয়ে দাড়াও। এক মুহূর্ত দেরি করলে মেইলিগুলির মাথা গুড়ো করে দেব।
আহমদ ইয়াংরা মুহূর্ত দ্বিধা করল, তারপর স্টেনগান ফেলে দিয়ে গেটের বাঁ পাশে চলে গেল।
আহমদ মুসা ততক্ষণে বিড়ালের মত নিঃশব্দে জেনারেল বোরিসের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। শেষ মুহূর্তে টের পেল জেনারেল বোরিস। চমকে সে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল।
কিন্তু ব্যাপারটা বুঝে উঠার আগেই আহমদ মুসা রিভলবারের বাট দিয়ে তার কানের ঠিক উপরটায় প্রচন্ড একটা আঘাত করলেন। ঘুরে পড়ে গেল জেনারেল বোরিস একপাশে ।
হঠাৎ আহমদ মুসার নজর পড়ল মেইলিগুলির উপর। মেইলিগুলি টলছে। ঠিক পড়ে যাবার মুহূর্তে তাকে গিয়ে ধরলেন আহমদ মুসা। বললেন, কি হয়েছে মেইলিগুলি? অসুস্থ বোধ করছো? আহমদ মুসার কাঁধের উপর ঢলে পড়ল মেইলিগুলি। বলল, একটা গুলি লেগেছে।
গুলি লেগেছে? কোথায়?
পাঁজরে।
আহমদ মুসা তাকে পাঁজাকোলা করে হাতে তুলে নিলেন। ডাকলেন হাসান তারিককে।
আমি এখানে। পাশ থেকে বলে উঠল হাসান তারিক। এই সমায় আহমদ ইয়াং, মা-চু, সেনা অফিসারসহ সৈনিকরা সেখানে এসে দাঁড়াল।
মেইলিগুলিকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। রাস্তা থেকে জীপটা সরিয়ে ফেল। এই মাইক্রোবাসটা নিয়েই যেতে হবে।
বলে আহমদ মুসা মেইলিগুলিকে নিয়ে মাইক্রোবাসের দিকে এগুলেন। মাইক্রোবাসে উঠে সিটের উপর তাকে শুইয়ে দিলেন।
মেইলিগুলি ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আমার দাদী, আমার দাদীকেও ওরা গুলি ….. কান্না এসে কথা তার রুদ্ধ করে দিল।
দাদীকেও। বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হলো আহমদ মুসার চোখ। আহমদ ইয়াং ও অন্যরা চলে গিয়েছিল গেটের সামনে থেকে জীপটি সরিয়ে দিতে। হাসান তারিক ও মা-চু মাইক্রোবাসের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। মা-চু বাকরুদ্ধ প্রায়।
আহমদ মুসা ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, হাসান তারিক তুমি ও মা-চু ওপরে যাও। দাদী কি অবস্থায় দেখ। ওঁকেও হাসপাতালে নিয়ে এস সৈনিকদের ওই জীপে করে। আহমদ ইয়াং ও মা-চু এখানেই থাকবে।
লেফটেন্যান্ট দুজনকে হাসান তারিকের সাথে জীপে আসার জন্য রেখে আহমদ মুসা মেইলিগুলিকে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালের দিকে। ড্রাইভিং সিটে বসে সেই সেনা কর্ণেল অফিসারটি।
আহমদ মুসা সিটের সামনে গাড়ির ফ্লোরে বসে মেইলিগুলির দেহকে ধরে রেখেছিলেন সিটের সাথে। আহমদ মুসার সামনের দিকটা রক্তে ভিজে গেছে।
শংকিত হয়ে উঠলেন আহমদ মুসা। কখন থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে মেইলিগুলির?
মেইলিগুলি নিঃসাড়ভাবে শুয়ে আছে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেনি তো? আহমদ মুসা আস্তে ডাকলেন, আমিনা?
জ্বি। একটু সময় নিয়ে দুর্বল কণ্ঠে উত্তর দিল মেইলিগুলি।
কখন গুলি লেগেছে তোমার আমিনা?
আমি স্টেনগান দিয়ে ওদের ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। একটা গুলি এসে লাগলে আমার হাত থেকে স্টেনগান পড়ে যায়।
ধীরে ধীরে বহু কষ্টে উচ্চারণ করল মেইলিগুলি। ক্রমেই সে দুর্বল হয়ে পড়ছে।
আহমদ মুসা মাথাটা খাড়া করে বললেন, হাসপাতাল আর কতদূর কর্ণেল?
আর দুমিনিট স্যার, বলল কর্ণেল। আবার নীরবতা।
মেইলিগুলি কি জ্ঞান হারিয়ে ফেলল? উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন আহমদ মুসা। আবার ডাকলেন, আমিনা?
জ্বি। অস্ফুট একটা জবাব এল বেশ দেরীতে।
কেমন বোধ করছ?
কোন জবাব দিল না মেইলিগুলি। মেইলিগুলিকে ধরে রাখা আহমদ মুসার একটা হাতের উপর অতি ধীরে উঠে এল মেইলিগুলির একটি হাত। চমকে উঠলেন আহমদ মুসা। অপরিচিত অস্বস্তির একটা ঢেউ যেন খেলে গেল তার গোটা দেহে। মেইলিুগলির দুর্বল হাত কাঁপছিল।
এই সময় হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ঢুকে গেল মাইক্রোবাসটি।
কর্ণেলের ইঙ্গিতে দ্রুত ছুটে এল ইমার্জেন্সির লোকরা রোলিং স্ট্রেচার নিয়ে। কর্ণেলের হাঁক ডাকে পাশের রুম ইনচার্জ ডাক্তারও বেরিয়ে এসেছিল। কর্ণেল তাকে কানে কানে কি যেন বলল।
ডাক্তারও ছুটে এল মাইক্রোবাসের গেটের দিকে স্ট্রেচারের কাছে। আহমদ মুসাকে হাত তুলে একটা স্যালুট দিয়ে বলল, কোন অসুবিধা হবে না স্যার।
বলেই সে পেশেন্টকে সোজা অপারেশন কক্ষে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়ে ছুটল ইমার্জেন্সি কক্ষের দিকে।

অপারেশন কক্ষের বাইরে উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষা করছিলেন আহমদ মুসা ও হাসান তারিক। কর্ণেল চলে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা ঘড়ি দেখলেন। রাত আড়াইটা। হাসপাতালে আসার পর প্রায় দেড় ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। আরও পনের মিনিট পরে অপারেশন কক্ষের দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এলো সিংকিয়াং এর শ্রেষ্ঠ অস্ত্রোপচারবিদ ডাক্তার চ্যাং। তার মুখ গঙ্ভীর। বলল, অপারেশন সফল, কিন্তু কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। ইনটেনসিভ কেয়ারে আছে। আগামী বার ঘন্টা খুবই গুরুত্বপূর্ন।
আর দাদী, মানে বৃদ্ধা মহিলাটির খবর? বললেন আহমদ মুসা।
স্যরি। মাথা নিচু করে বলল ডাক্তার।
সঙ্গে সঙ্গেই একটা অন্ধকার নেমে এল আহমদ মুসার মুখে। বেদনায় নীল হয়ে এল তার মুখটা। কয়েক মুহুর্ত কথা বলতে পারলেন না তিনি।
অপারেশন কক্ষের দরজা আবার বন্ধ হয়েছে। ডাক্তার চলে গেছে।
আহমদ মুসা হাসান তারিককে কিছু বলার জন্য মুখ তুললেন, এমন সময় করিডোর দিয়ে একজন হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটে এল। বলল, আহমদ মুসা কে?
আমি। বললেন আহমদ মুসা।
শীগ্রি আসুন, গভর্ণর সাহেবের টেলিফোন।
আহমদ মুসা টেলিফোন ধরতেই ওপার থেকে লি ইউয়ান বলল, আমি সব শুনেছি মি. আহমদ মুসা। ডাক্তারের কাছ থেকে মেইলিগুলির কথাও শুনলাম। চিন্তার কিছু নাই। আমি নির্দেশ দিয়েছি, এই কেস টপমোস্ট প্রাইওরিটি পাবে।
শুকরিয়া মি. গভর্নর।
আমি মেইলিগুলির বাড়িতে পাহারা বসাবার নির্দেশ দিয়েছি। আর মেইলিগুলির আব্বা-আম্মা সরকারী সফরে এখন জেনেভায়। সেখানেও খবর পৌছাচ্ছি।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জনাব।
আমি কাল নেইজেনকে নিয়ে একবার মেইগুলিকে দেখতে যাব। একটু থেমে গভর্ণর আবার বলল, আপনি বাসায় চলে আসুন। বিশ্রাম প্রয়োজন আপনার। হাসপাতালের জন্য কোন চিন্তা নেই।
টেলিফোনে কথা শেষ করে আহমদ মুসা বললেন, এখানে আর কোন কাজ নেই হাসান তারিক। চল বাসায় ফিরি। ‘ফ্র’র যে দু’জন লোক ধরা পড়েছে তাদের নিয়ে আহমদ ইয়াং কি করছে চল দেখি।
সেই মাইক্রোবাসে আহমদ মুসারা মেইলিগুলির বাসায় ফিরে এল।
গেট বন্ধ করে দিয়ে আহমদ ইয়াং ও মা-চু গাড়ি বারান্দাতেই বসেছিল। তাদের সামনে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে বোমার স্প্লিন্টারে আহত ‘ফ্র’র দুজন লোক।
প্রাথমিক অনুসন্ধানের কাজ আহমদ ইয়াং মোটামোটি সেরেই ফেলেছে। মা-চু কাটা বিদ্যুত সংযোগে জোড়া লাগিয়েছে। আলোয় ঝলমল করছে এখন বাড়ি।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক আসতেই উৎসুকভাবে মুখ তুলল আহমদ ইয়াং এবং মা-চু দুজনেই।
আহমদ মুসা গঙ্ভীর কন্ঠে বললেন, খবর ভাল নয় মা-চু। দাদী নেই, মেইলগুলি এখন ইনটেনসিভ কেয়ারে আছে।
শুনে মা-চু মাথা নিচু করল। দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল সে।
কিছুক্ষন কেউ কিছু বলতে পারল না। অবশেষে মুখ খুললেন আহমদ মুসা। বললেন, এ দিকের খবর কি ইয়াং?
কিছু খবর নিয়েছি। এখানে এবং নেইজেনকে অপহরণ করার অভিযান এক জায়গা থেকেই হয়েছে।
হ্যাঁ, সেটা আগেই বুঝতে পেরেছি।
এই অভিযান ছিল ‘ফ্র’ এবং ‘রেড ড্রাগনের’ সম্মিলিত। নেইজেনকে কিডন্যাপ করে গভর্ণরকে শিহেজী উপত্যকায় হান বসতির পক্ষে ওরা বাধ্য করতে চেয়েছিল।
হ্যাঁ, ওটা তো গভর্ণরও বলেছেন।
আর এখানে জেনারেল বোরিসের অভিযানের লক্ষ্য ছিল আপনাকে অপহরণ করা। আপনাকে না পেয়ে প্রতিশোধ স্পৃহায় অন্ধ বোরিস বাড়িতে যাকেই পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছ। মেইলিগুলিকে নিয়ে যাচ্ছিল জিম্মি হিসাবে আপনাকে ধরার জন্য।
জেনারেল বোরিস পিকিং থেকে কবে ফিরেছে?
আজ সকালে। সব প্ল্যান ঠিক করে পিকিং থেকে প্রস্তুত হয়েই সে ফেরে।
একটু থেমে আহমদ ইয়াং বলল, জেনারেল বোরিসের ফেলে যাওয়া মানিব্যাগে একটা টেলেক্স পেয়েছি। টেলেক্সটি এসেছে আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভেন থেকে। পাঠিয়েছে জনৈক মাইকেল পিটার। বলেছে, চুড়ান্ত প্রস্তুতি এগুচ্ছে। জেনারেল বোরিসকেও সেখানে প্রয়োজন। স্ট্যালিনের জন্মভূমি জর্জিয়া এবং তার সাথে আর্মিনিয়া তাকে স্বাগত জানাবে।
থামল আহমদ ইয়াং।
কি যেন চিন্তা করছিলেন আহমদ মুসা। একটু পরে বললেন, মনে হয় চীনে জেনারেল বোরিসের এটাই শেষ অভিযান ছিল। আহমদ মুসার ওপর প্রতিশোধ নেয়া শেষ করে সে নতুন ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র ককেশাসে পাড়ি জমাতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর চেয়ে তো বড় পরিকল্পনাকারী আর কেউ নেই। জেনারেল বোরিসের যেখানে ককেশাসে যাবার কথা সেখানে যাচ্ছে আহমদ মুসা।
শেষের কথা ছিল ধীর স্বগত কন্ঠের…….
কি মুসা ভাই, আপনি কোথায় যাবেন? চমকে উঠেই যেন বলল আহমদ ইয়াং।
আহমদ মুসা হাসলেন। কোন জবাব দিলেন না। তার দৃষ্টি বাইরে অন্ধকারের বুকে নিবন্ধ কোন ভাবনায় যেন ডুব দিয়েছে আবার আহমদ মুসা।

Top