৩
ইয়াউন্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন।
ছোট, কিন্তু সুন্দর বাগানটি।
গোটা বাগান জুড়ে মাকড়সার জালের মত লাল সুড়কির রাস্তা। মাঝে মাঝে বেঞ্চ পাতা।
একটা বেঞ্চিতে বসে রোসেলিন, লায়লা ইয়েসুগো এবং ডোনা।
আজ বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে। রোসেলিন ডোনাকে নিয়ে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তিনজন গল্প করছে।
ডোনা চোখ কপালে তুলে বলছিল, ‘বেনু নদীর তীরের গারুয়া শহর? সে তো আফ্রিকার বুকের গভীরে, চাদ হ্রদের তীরে প্রায়।’
‘প্রায় নয়, ‘লেক চাদ’-এর পশ্চিম তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ইয়েসুগো রাজবংশের রাজত্ব।’ বলল লায়লা ইয়েসুগো।
‘কিন্তু আফ্রিকার এত গভীরে একটি মুসলিম রাজত্বের প্রতিষ্ঠা কিভাবে হলো?’ বলল ডোনা।
‘লেক চাদ-এর তীরে ইসলামকে দেখে বিস্মিত হচ্ছেন? আমাদের ক্যামেরুনের দক্ষিণে, গ্যাবনের পুবে কাম্পুর উত্তরাংশ যেখানে সভ্যতার কোন আলোই এখনও পড়েনি, সেই ‘এনডোকি’ এলাকাতে গেলেও ‘আল্লাহ’ এবং ‘মুহাম্মাদ (সঃ)’-এর নাম (যদিও ভাঙা উচ্চারণে) আপনি শুনতে পাবেন। আমাদের গারুয়া উপত্যকা তো ভাগ্যবান। নাইজেরিয়ার ‘লাগোস’ এবং ‘বেনু’ নদীর পথে এবং উত্তর নাইজেরিয়ার ঐতিহাসিক মুসলিম মহানগরী ‘কানো’ থেকে নদী ও সড়ক পথে ইসলাম এখানে পৌঁছেছে।’
‘যাই বলুন। যতই ভাবছি, ততই বিস্মিত হচ্ছি, কিভাবে আফ্রিকার এই গভীরে, অকল্পনীয় দুর্গম অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশ করল। আমি জানি আফ্রিকার এই অঞ্চলে ইসলামের বড় ধরনের কোন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাহলে ইসলাম কিভাবে, কিসের জোরে পাহাড়-জংগল-নদীর দুর্গম গভীরে পথ করে নিল?’
‘আমাদের এই আফ্রিকা অঞ্চলে কোন সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা তো নয়ই, এমনকি কোন মিশনারী সংগঠন বা পেশাদার মিশনারীদের দ্বারাও ইসলাম প্রচার হয়নি। স্ট্যানলি লেনপুলের বইতে আমি পড়েছি। ‘The Preaching of Islam’ বইতে তিনি বলেন, ‘ইসলাম প্রচারের জন্যে গঠিত কোন সংস্থা বা এই উদ্দেশ্যে তৈরী কোন প্রচারবিদের দ্বারা ইসলামের প্রচার কাজ পরিচালিত হয়নি। মুসলমানদের প্রত্যেকেই ছিলেন একজন করে সক্রিয় মিশনারী।’ বলল লায়লা ইয়েসুগো।
‘বিস্ময়টা আমার এই জন্যেই বেশী। এই অবস্থায় ইসলাম কি করে আফ্রিকার এই অঞ্চলে প্রবেশ করল।’ বলল ডোনা।
‘সেই কাহিনী লিখলে আমার মনে হয় পৃথিবীর বৃহত্তম মহাকাব্য রচিত হতো।’
বলে একটু দম নিল লায়লা। তারপর শুরু করল, ‘আরবী অশ্বারোহী সৈনিকের বিজয়ী পদক্ষেপ মরক্কো-মৌরতানিয়ায় এসে থেমে গিয়েছিল। আরও দক্ষিণে সেনেগালের বিজন জংগলে তারা প্রবেশ করেনি। পরবর্তীকালে সেনেগালের উপকূল ধরে ইসলামের যাত্রা শুরু হয় মুসলমানদের ব্যক্তিগত উদ্যোগের আকারে। সুদান ও লিবিয়ার মরুভূমি পাড়ি দিয়ে বাণিজ্য-কাফেলার পথ ধরে যেভাবে স্থলপথে ইসলামের দক্ষিণ মুখী যাত্রা শুরু হয়, সেভাবে সেনেগাল থেকে উপকূলের পথ ধরে ইসলাম দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত হতে থাকে। সেনেগাল থেকে গাম্বিয়া, গাম্বিয়া থেকে গিনি বিসাউ, গিনি, তারপর সিয়েরা লিওন- এভাবে ধীরে ও নিরবে ইসলাম অগ্রসর হয়েছে এক জনপদ থেকে আরেক জনপদে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে।’
একটু থামল লায়লা ইয়েসুগো। একটু নড়ে বসল। তারপর বলল, ‘ব্যক্তি উদ্যোগে ইসলামের এই প্রচার কত যে অমর ঘটনা, কত যে অপরূপ কাহিনী এবং অশ্রু ভেজা কত যে গাঁথা সৃষ্টি করে। কিন্তু সবই হারিয়ে গেছে, তার সাথে হারিয়ে গেছে সংখ্যাহীন ত্যাগী মানুষের উজ্জ্বল জীবনচিত্র। আপনার মত আমারও ইচ্ছা করত এসব জানবার। অনেক বই ঘাটাঘাটি করেছি আমাদের ঐ মহান অতীতকে জানার জন্যে। যা পেয়েছি তা সামান্য ইংগিতমাত্র।’
‘সেটা কেমন?’ বলল ডোনা।
‘মুসলমানরা যখনই এ অঞ্চলে কোন নতুন ভূখন্ডে এসেছে ব্যবসার উদ্দেশ্যে কিংবা বসবাসের জন্যে, তারা প্রথমেই গেছে স্থানীয় গোত্র সরদারের কাছে। আবেদন করেছে তাদের প্রার্থনা গৃহ (মসজিদ) তৈরীর অনুমতি দানের। এইভাবে তারা মসজিদ গড়েছে, স্কুল তৈরী করেছে। শীঘ্রই তাদের সততা ও নিষ্ঠা এবং উন্নত সাংস্কৃতিক আচার-ব্যবহার স্থানীয় বিধর্মী নিগ্রোদের অভিভুত করেছে।’ এই কথাগুলো লিখেছেন, ‘Islam and Mission’ বইতে একজন ইউরোপীয় ঐতিহাসিক। আর ‘Rise of British West Africa’ বইতে জর্জ ক্লাউডে যে বিবরণ দিয়েছেন তা হলোঃ ‘মুসলমানদের স্কুলগুলো ছিল স্থানীয় আফ্রিকানদের জন্যে বিস্ময়কর। স্কুলে যে সব বিষয় ও আচার-ব্যবহার শিক্ষা দেয়া হতো, তা মুগ্ধ ও অভিভুত করত তাদেরকে। আফ্রিকান ছাত্ররা এই শিক্ষা ও আচার-ব্যবহার ছড়িয়ে দিত, এখান থেকে সেখানে, এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায়। ইসলামের মেসেজ ছড়িয়ে পড়ে তার সাথে। ইসলামের আরও দু’টি বিষয় আফ্রিকার নিগ্রোদের সম্মোহিত করে। তার একটি হলো দাস ব্যবসার প্রতি মুসলমানদের বিরোধিতা। অন্যটি হলো আইন-শৃংখলার প্রতি মুসলমানদের গুরুত্ব দান। সে সময় উপকূল জুড়ে ছিল প্রচন্ড নৈরাজ্য। যার কারণে আফ্রিকান নিগ্রোরা তাদের উপকূল থেকে সব সময় দূরে থাকতে চেষ্টা করতো। মুসলমানরা যেখানেই গেছে এবং কিছুটা শক্তি অর্জন করতে পেরেছে, সেখানেই তারা শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে এবং মানুষের নিরাপত্তা বিধান করেছে। এর ফলে নিগ্রো মানুষেরা ছুটে এসেছে শান্তি ও স্বস্তির সন্ধান পেয়ে। এভাবে মুসলমানদের ইমেজ বিধর্মী নিগ্রোদের মধ্যে এতটাই বেড়ে যায় যে গোত্র সর্দাররা মুসলমান না হয়েও মুসলিম নাম গ্রহণ করতে গৌরব বোধ করত। নাম গ্রহণ করার সাথে সাথে তারা ইসলামও গ্রহণ করে বসতো। আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের শ্রেষ্ঠ নিগ্রো গোত্রগুলো যেমন ‘ফুলবি’, ‘ম্যানডিংগো’, ‘হাউসা’ এবং ‘ফুলানি’ ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেয় এইভাবে।’
থামল লায়লা ইয়েসুগো।
‘চমৎকার। বিস্ময়কর ইতিহাস।’ বলল ডোনা।
‘পশ্চিমা ঐতিহাসিক ‘ব্লাডেন’ এবং ‘ওয়াস্টারম্যান’ কি বলেছেন জানেন? বলেছেন, সেনেগাল এবং নাইজেরিয়ার উপকূল পর্যন্ত দু’হাজার মাইল উপকূল রেখায় এমন কোন শহর দেখা যেত না যা মসজিদের গম্বুজে শোভিত ছিল না। এই বিপ্লব সংঘটিত হয় উনিশ ও বিশ শতকে এবং গিজ গিজ করা খৃস্টান মিশনারীদের চোখের সামনেই।’
‘কি সর্বনাশা, এই বিপ্লব উনিশ-বিশ শতকের? পশ্চিমা আধিপত্যের কালে?’
‘অবশ্যই। আপনি শুনে বিস্মিত হবেন, উনিশ ও বিশ শতকের মাঝা-মাঝি সময় পর্যন্ত, মুসলমানদের রাজনৈতিক সৌভাগ্য সূর্য যখন অস্তমিত, যখন অধিকাংশ মুসলিম দেশ দুর্ভাগ্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত, ঠিক তখনই আফ্রিকার এই অঞ্চলে কালো মানুষদের জীবনে সৌভাগ্য সূর্য দীপ্ত হয়ে উঠে। ইসলাম এই সময় কত দ্রুত বিস্তার লাভ করে তার একটা হিসেব দিচ্ছিঃ
দেশের নাম — উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম জনসংখ্যার হার — বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুসলিম জনসংখ্যার হার
সেনেগাল — ৪০% — ৯৫%
গিনি বিসাউ — ৩০% — ৮০%
গিনি — ১৫% — ৬৫%
সিয়েরা লিওন — ১০% — ৮০%
লাইবেরিয়া — ৫% — ৪৫%
আইভরি কোস্ট — ৫% — ৫৫%
ঘানা — ২% — ৪৫%
টোগো — ৩% — ৫৫%
বেনিন — ০% — ১১%
নাইজেরিয়া — ৩০% — ৬৫%
ক্যামেরুন — ১% — ৫৫%
এই হিসেবে দেখা যাবে, উনিশ ও বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সেনেগানল থেকে ক্যামরুন উপকূল পর্যন্ত একটা বিপ্লব ঘটে গেছে।’
‘কিন্তু কেন, কিভাবে?’ বলল ডোনা।
লায়লা ইয়েসুগো মুখ খোলার আগেই কথা বলে উঠল রোসেলিন। বলল, ‘আমার মনে হয় এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো, পশ্চিমীরা এ সময় নিগ্রোদেরকে পশুতে পরিণত করেছিল দাস ব্যবসায়ের মাধ্যমে আর ইসলাম এসেছিল তাদেরকে মানুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে। আরেকটা কারণ হলো, যেটা লায়লা বলল, মুসলমানদের চরিত্র মাধুর্য এবং শান্তিপ্রিয়তা।’
‘কি রোসেলিন, তুমি খৃষ্টানদের বদনাম করছ আর মুসলমানদের প্রশংসা করছ তোমার মুখে?’ মুখ টিপে হেসে বলল ডোনা।
‘করবে না? রাশিদি ইয়েসুগো মুসলমান না?’ বলল লায়লা দুষ্টুমি হেসে।
‘তোমার মুহাম্মদ ইয়েকিনির কথা কেউ জানে না বুঝি?’
‘ঠিক আছে। সবাই জানুক। আমি তো অস্বীকার করছি না।’ বলল লায়লা।
‘মুহাম্মদ ইয়েকিনি কে রোসেলিন?’ বলল ডোনা।
‘ইয়াউন্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কুন্তে কুম্বায় বাড়ি।’
এ সময় ওরা তাদের পেছন থেকে কাশির আওয়াজ পেল।
ফিরে তাকাল তিনজনেই।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে রাশিদি ইয়েসুগো।
রাশিদি ইয়েসুগোর দিকে ইংগিত করে লায়লা ডোনাকে বলল, ‘আমার ভাই রাশিদি ইয়েসুগো।’
বলেই লায়লা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘তোমরা একটু বস। আমি আসছি।’
লায়লা ছুটলো রাশিদির দিকে। সেখানে পৌছে বলল, ‘কিছু বলবে ভাইয়া?’
‘রোসেলিনকে একটু দরকার। কিন্তু নতুন মেয়েটা কে? এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কেউ নাকি?’ কিন্তু মাথায় ওড়না কেন?’
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ না ভাইয়া। ও ফ্রান্সের মেয়ে। কিন্তু মুসলমান। নাম মারিয়া। এখানকার ফরাসি রাষ্ট্রদূতের মেহমান। ওঁর আব্বাসহ বেড়াতে এসেছেন।’
‘মুসলমান জেনে খুশী হলাম। কিন্তু শোন, আহমদ মুসা সম্পর্কে একটি কথাও ওঁকে কিংবা রোসেলিনকে এক কথায় বাইরের কাউকেই বলবে না।’
‘এটা আমি জানি।’
বলে একটু থেমেই আবার বলল, ‘চল ওঁর সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেই।’
‘না উনি কিছু মনে করতে পারেন। পর্দা করেন মনে হচ্ছে।’
‘ঠিক আছে। একটু দাঁড়াও। রোসেলিনকে পাঠাচ্ছি।’ বলে এক দৌড়ে ফিরে গেল।
লায়লা রোসেলিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘রোসেলিন, যাও ভাইয়ার হুকুম।’
‘কি হুকুম? কোথায় যাব?’ বলল রোসেলিন।
‘ভাইয়া তোমাকে ডাকছেন।’
‘আমি কেন যাব। উনি তো আসতে পারেন।’
‘আসবেন না। আমি মারিয়া আপার কথা ভাইয়াকে বলেছি। আমি পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে আসতে বললে তিনি বললেন, মারিয়া নিশ্চয় এটা ভালোভাবে নিবেন না।’
‘কেন?’ বলল রোসেলিন।
‘কারণ, মারিয়া আপার গায়ে আমার মত চাদর দেখেই ভাইয়া বুঝেছেন মারিয়া পর্দা করেন।’
‘বুঝেছি।’ বলে উঠে দাঁড়াল রোসেলিন।
ধীরে ধীরে সে গিয়ে দাঁড়াল রাশিদি ইয়েসুগোর সামনে। বলল, ‘বল তোমার এত জরুরী বিষয়টা কি?’
‘আমি দুঃখিত রোসেলিন, তোমাদের জমজমাট গল্পের আসরে ছেদ টানার জন্যে। কিন্তু আমি কি জরুরী বিষয় ছাড়া তোমাকে ডাকতে পারি না।’
‘কোন দিন ডাক না। তুমি আমাকে এড়িয়ে চলতেই ভালবাস। ভাই বলছিলাম।’
‘এড়িয়ে চলি কথাটা ঠিক নয় রোসেলিন। কারণ এর মধ্যে উপেক্ষার ভাব আছে। তুমি কি বলতে পার আমি তোমাকে উপেক্ষা করি?’
‘না সেটা অবশ্যই নয়। কিন্তু তোমার আলগা চলার হেতু কি? সেদিন দেখ ডিপার্টমেন্টাল পিকনিকে সবাই কিভাবে সময় কাটাল, আর আমি-তুমি কিভাবে সময় কাটালাম। প্রায় সকলেই যখন জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়িয়েছে, তখন তুমি তাঁবুর পাশে গাছতলায় বসে বই পড়ে সময় কাটিয়েছ, আর আমি একটু দূরে একটা ঝোপের পাশে বসে তোমার দিকে তাকিয়ে সময় কাটিয়েছি। আমার কান্না পাচ্ছিল। কেন তুমি এমন নিষ্ঠুরতা কর?’ আবেগে কাঁপল রোসেলিনের গলা।
রাশিদি ইয়েসুগো একটু হাসার চেষ্টা করল। বলল, ‘তুমি ব্যথা পেয়েছ। আমি দুঃখিত রোসেলিন। তোমার কোন কষ্ট আমাকেও কষ্ট দেয়।’
রাশিদি ইয়েসুগো একটু থামল। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘কিন্তু সমস্যা হলো রোসেলিন, আমাদের ধর্ম ইসলাম বিবাহ-পূর্ব এ ধরনের অবাধ মেলামেশার সুযোগ দেয় না এবং এই না দেয়াটা সবদিক থেকে যুক্তিসংগত।’
‘আমি জানি রাশিদি। আমার ভালো লাগে তোমাদের এই কালচার। কিন্তু ভুলে যাই, যখন হৃদয়ের এক সাগর অবুঝ তৃষ্ণা উন্মুখ হয়ে ওঠে।’
একটু থামল রোসেলিন। তারপর মুখে এক টুকরো হাসি টেনে বলল, ‘বল, কি বলতে ডেকেছ?’
রাশিদি ইয়েসুগো হেসে বলল, ‘তেমন কিছু না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ গেল। কেমন ছিলে তাই জানতে চাচ্ছিলাম।’
‘ভালই ছিলাম। তবে আমার বাইরে বেরুনোর ব্যাপার নিয়ে মনে হচ্ছে আব্বা খুব চিন্তিত।’
‘কেন? তিনি কিছু বলেছেন?’
‘আমাকে একটু সাবধানে থাকতে বলেছেন। একা একা আমাকে বাইরে বেরুতে বলা যায় নিষেধ করেছেন। দেখ না আজ আমার নতুন বান্ধবী মারিয়াকে নিয়ে এসেছি!’
‘কারণ কি?’
‘আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তরে বলেছেন, সময় ভালো যাচ্ছে না তো তাই।’
‘কিন্তু তেমন খারাপ কিছু তো দেখা যাচ্ছে না। তোমাদের পারিবারিক কিংবা কোর্টের কোন ঘটনার কারণে কোনো অসুবিধা নেই তো?’
‘না, পারিবারিক কোন সমস্যা নেই। তবে আব্বা কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে এ কথাও বলেছিলেন যে, তাকে কত রকম বিচারের সাথে জড়িত থাকতে হয়, বিচারে কত মানুষের কত স্বার্থের হানি ঘটে।’
রোসেলিনের শেষ কথায় রাশিদির মনকে চঞ্চল করে তুলল। সে ভাবল, পিয়েরে পল কিংবা তার লোকেরা চীফ জাস্টিসের সাথে তাহলে অবশ্যই যোগাযোগ করেছে। চীফ জাস্টিসের মত কি, প্রতিক্রিয়া কি তা জানার জন্যে তার মন আকুলি-বিকুলি করে উঠল। কিন্তু জানার উপায় নেই। বুঝা যাচ্ছে, রোসেলিনও কিছু জানে না। অবশ্য জানার কথাও নয়। চীফ জাস্টিস তার মেয়ের সাথে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন তা স্বাভাবিক নয়। যাক তবু এটুকু জানা গেল যে, পিয়েরে পলরা চীফ জাস্টিসের সাথে যোগাযোগ করেছে। এ খবরটা আহমদ মুসাকে এখনই জানানো দরকার। খুশী হলো রাশিদি ইয়েসুগো, আহমদ মুসার প্রথম এ্যাসাইনমেন্ট পুরো না হলেও কিছুটা সমাধা করতে পেরেছে।
রোসেলিনই আবার কথা বলল, ‘মনে হচ্ছে তুমি কিছু ভাবছ?’
‘হ্যাঁ। তুমি তো একটা খারাপ খবর শোনালে।’
‘এ নিয়ে তুমি ভেব না। আমিও ভাবছি না।’
‘কিন্তু তোমার সাবধান থাকা দরকার।’
‘না থাকলে তোমার কোন ক্ষতি হবে?’ মুখ টিপে হেসে বলল রোসেলিন।
‘না, কিছু ক্ষতি হবে না।’ রাশিদিও হেসে জবাব দিল।
‘জান, কেউ আমাকে নিয়ে ভাবলে আমার খুব ভালো লাগে।’
‘এই ‘কেউ’ একজন না বহুজন?’
‘বলব না।’ হাসি চাপতে চাপতে বলল রোসেলিন।
কথা শেষ করেই ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসি। ওদিকে লায়লা দুষ্টটা কত গল্প ফাঁদছে কে জানে।’
বলে দৌড় দিলে রোসেলিন।
আহমদ মুসা, রাশিদি ইয়েসুগো এবং মুহাম্মদ ইয়েকিনি যখন সুপ্রীম কোর্ট ভবনে পৌঁছল, তখন বেলা ১১ টা।
কোর্ট ভবনে নেমে আহমদ মুসা চীফ জাস্টিসের এজলাসের দিকে এগুলো। উদ্দেশ্য চীফ জাস্টিসকে একনজর দেখা। তবে তাদের লক্ষ্য চীফ জাস্টিসের রেজিস্টার অফিসে গিয়ে খোঁজ-খবর নেয়া।
রাশিদি ইয়েসুগোর কাছে রোসেলিনের কথা শুনেই আহমদ মুসা নিশ্চিত হয়েছিল পিয়েরে পলরা চীফ জাস্টিসের সাথে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু এই যোগাযোগের ফলাফলটা যে কি তা রোসেলিনের কথায় বুঝা যায়নি, তবে চীফ জাস্টিস তার মেয়ের চলাচলে সাবধানতা অবলম্বন করায় বুঝা গেছে তিনি পিয়েরে পলদেরকে ভয় করছেন। কিন্তু ভয়টা পিয়েরে পলদের প্রস্তাব প্রত্যাখান করা জনিত, না এটা কোন বাড়তি সাবধানতা তা পরিস্কার হয়নি। তবে আহমদ মুসা খুশী রোসেলিন রাশিদিদের পরিচিত হওয়ায়। প্রয়োজনে চীফ জাস্টিসের সাথে যোগাযোগের একটা মাধ্যম সে হতে পারে। আহমদ মুসার মনে প্রশ্ন জাগল, রোসেলিন ও রাশিদি ইয়েসুগোর মধ্যে প্রেম আছে এটা চীফ জাস্টিস জানেন কিনা? তিনি যদি মেয়ের এ সম্পর্ককে গ্রহণ করতেন, তাহলে বড় একটা লাভ হতো। চীফ জাস্টিস মুসলমানদের ভালবাসতেন।
আহমদ মুসা, রাশিদি ইয়েসুগো এবং মুহাম্মদ ইয়েকিনি পাশাপাশি হাঁটছিল। আহমদ মুসা রাশিদি ইয়েসুগোর দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, রাশিদি তোমার রোসেলিনের সম্পর্কের ব্যাপারটা চীফ জাস্টিস সাহেব জানেন?
প্রশ্ন শুনে রাশিদির চোখে-মুখে লজ্জার একটা আবরণ নেমে এল। রাশিদির ঠোঁটে এক টুকরো লজ্জা-পীড়িত হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘না উনি জানেন না।’
‘জানলে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে তুমি অনুমান করতে পার?’
‘রোসেলিন বলে, ইয়েসুগো রাজ-পরিবার সম্পর্কে চীফ জাস্টিসের খুব সুধারণা আছে। এ ব্যাপারটা আমিও জানি। ‘ইয়েসুগো রাজ পরিবার বনাম রাষ্ট্র’ শীর্ষক একটা বড় মামলায় রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট বছর পাঁচেক আগে। রায়টা এসেছিল ইয়েসুগো রাজ পরিবারের পক্ষে। এই রায়ের ফলে গারুয়া উপত্যকায় বেনু নদী তীরের বিশাল এলাকা ইয়েসুগো রাজ পরিবার ফিরে পেয়েছে। হাইকোর্টের যে বেঞ্চ এই রায় দিয়েছিল, সে বেঞ্চের চেয়ারম্যান ছিলেন বর্তমান চীফ জাস্টিস। তবে রোসেলিন বলেছে, একটা মুসলিম পরিবারে নিজের মেয়েকে বিয়ে দেয়ার ব্যাপারটা চীফ জাস্টিস হয়তো সহজভাবে নেবেন না।’
‘এটা স্বাভাবিক।’
চীফ জাস্টিসের এজলাসের দরজায় পৌঁছে গিয়েছিল আহমদ মুসা।
চীফ জাস্টিস তাঁর বেঞ্চসহ এজলাসে।
ক্যামেরুনে সুপ্রীম কোর্টে ‘ওয়ানম্যান বেঞ্চ’ বেঞ্চে বসে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়েই শুধু ফুল বেঞ্চ গঠিত হয়। আজ ফুল বেঞ্চ বসেছে। শাসনতান্ত্রিক একটা বিষয়ে তাদের রায় দিতে হবে।
প্রধান বিচারপতিকে চিনিয়ে দিল রাশিদি ইয়েসুগো। রঙে খাস আফ্রিকান নিগ্রো, চেহারায় নয়।
‘ওঁর স্ত্রী বোধ হয় ইউরোপীয়?’
‘হ্যাঁ, ওঁর স্ত্রী ফরাসী। কেন বলছেন এ কথা?’ জিজ্ঞেস করল রাশিদি।
‘রোসেলিনের যে বিবরণ তোমার কাছে শুনেছি, তাতে তার মা অবশ্যই শ্বেতাংগ বা নন-আফ্রিকান হবেন।’
কথা শেষ করেই আবার আহমদ মুসা বলল, চল রেজিস্ট্রার অফিসে যাওয়া যাক।
বেরিয়ে এল তারা চীফ জাস্টিসের কোর্ট রুম থেকে।
রেজিস্ট্রার অফিসে প্রবেশ করল তারা।
ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসল।
বসেই রাশিদি ইয়েসুগো আহমদ মুসাকে ফিস ফিস করে বললো, ‘ভাইয়া রিট সেকশনে ‘ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট’-এর একজন ভাই আছেন। একজন সেকশন অফিসার সে। আমরা তার সাহায্য নিতে পারি না?’
‘অবশ্যই পার।’
‘তাহলে তার সাথে গিয়ে আলোচনা করি। তার সময় হলে তাকে নিয়ে আসি?’
‘হ্যাঁ, যাও।’
‘তাহলে আমি ও ইয়েকিনি একটু ঘুরে আসি। আপনি একটু বসুন।’ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল রাশিদি।
বেরিয়ে গেল ওরা দু’জন ওয়েটিং রুম থেকে।
ওয়েটিং রুমে বসেছিল আরও দু’জন। আহমদ মুসার পাশের সোফাতেই।
সামনে লম্বা একটা টিপয়।
টিপয়ের উপর কয়েকটা ম্যাগাজিন।
আহমদ মুসার পাশের দু’জন কৃষ্ণাংগ। বয়সে যুবক। একজন আহমদ মুসার কিছু বড় হবে, আরেকজন সমান সমান। আহমদ মুসার পাশে বসা লোকটির হাতে একটা কলম। সে কলমটা দিয়ে একটা ম্যাগাজিনের মলাটে লিখছিল, আঁচড় কাটছিল। দেখলেই বুঝা যায় সে উদ্দেশ্যহীন ভাবে এটা করছে। যেন সময় কাটাচ্ছে সে।
আহম্মদ মুসারও করার কিছু ছিল না। গল্প করার মত দু’জন ছিল, তাও চলে গেল।
আহমদ মুসা পাশের লোক দু’জনের দিকে তাকাল। তাদের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিতে পারল না আহমদ মুসা। হাতের পেশি, ঘাড়ের গঠন, মুখের চোয়াল, আর ঋজু শরীর দেখে মনে হলো যেন স্টিলের তৈরী কোন রোবট।
আহমদ মুসার মুগ্ধ দৃষ্টি একসময় পাশের লোকটির হাত বেয়ে নেমে গেল তার লেখার উপর।
তার লেখাগুলোয় চোখ বুলাতে গিয়ে একটা স্কেচের উপর নজর পড়তেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল আহমদ মুসা। কলমের কালি দিয়ে তৈরী মানুষের একটা স্কেচ। কালো কালি দিয়ে তৈরী কালো একটা মনুষ্য মূর্তি। মূর্তিটির বাম হাতে কালো কালির ক্রস। খুব সাধারণ একটা স্কেচ।
কিন্তু স্কেচটার উপর নজর পড়তেই আহমদ মুসার মনে পড়ল ‘ওকুয়া’র প্রতীক চিহ্নের কথা। একজন সৈনিকের ছবি, হাতে তার একটি ক্রস।
আহমদ মুসা দেখল, লোকটির কলম সৈনিকের সেই স্কেচটির উপর আবার উঠে এল। কালো কালির গভীর আঁচড়ে শীঘ্রই সৈনিকের স্কেচটি কালো সৈনিকে রূপ নিল। হাতে তার কালো ক্রস।
আহমদ মুসার কোন সন্দেহ রইল না, ওকুয়ার প্রতীক চিহ্ন এটা।
আহমদ মুসার বিস্মিত দৃষ্টি উঠে এল লোকটির মুখের উপর। লোকটি ওকুয়ার কেউ?
এ সময় তাদের দু’জনের ওপাশের জন উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘পাওল তুই বস। কাজটা কতদূর একটু খোঁজ নিয়ে আসি।’
বলে লোকটি রেজিস্ট্রার অফিসের ভেতরে ঢুকে গেল।
আহমদ মুসা ভাবল, লোকটি নিশ্চয় ‘ওকুয়া’র কেউ। আনমনে কাগজে আঁচড়াতে গিয়ে প্রিয় প্রতীক চিহ্ন সে এঁকে ফেলেছে। লোকটির চেহারাও বলে ওকুয়ার মত সংগঠনের সাথেই তাকে মানায়।
ওকুয়ার এই লোকরা নিশ্চয় ওমর বায়ার কেসের ব্যাপারে এসেছে! ওর সাথের লোকটা কি এই কাজেই ভেতরে গেছে?
ঠিক এ সময় সেই লোকটা বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসার পাশের লোকটাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘পাওল, রেজিস্ট্রার সাহেব দুইদিন পরে একবার খোঁজ নিতে বললেন। আমাদের ব্যাপারটা চীফ জাস্টিসের আগামী পরশুদিনের কর্মসূচীতে উঠেছে। পরদিন এলেই ডেট জানা যাবে। চল।’
আহমদ মুসার পাশের লোকটিও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চল।’
ওরা কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
মন চঞ্চল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। এখন কি করবে সে? ‘ওকুয়া’র লোককে তো ছাড়া যায় না। মোক্ষম একটা সুযোগ। ওদের ফলো করে নিশ্চয় ওকুয়া’র কোন এক ঠিকানায় পৌঁছা যাবে। তার ফলে ওমর বায়া ও ডঃ ডিফরজিসের সন্ধান পাওয়া অথবা উদ্ধার করার একটা সুযোগ পাওয়া যাবে।
কিন্তু রাশিদিরা দু’জন নেই, ভাবল আহমদ মুসা।
লোক দু’জন কক্ষের বাইরে চলে গেছে।
আর চিন্তা করতে পারলো না আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে দাঁড়াল।
বেরিয়ে এল কক্ষ থেকে। দেখল, ওকুয়ার ওরা দু’জন পাশা-পাশি হেঁটে এগোচ্ছে সিঁড়ির দিকে।
আহমদ মুসা পিছু নিল ওদের।
ওদের অনুসরণ করে আহমদ মুসা নিচে লনে নেমে এল।
সুপ্রীম কোর্টের গাড়ি বারান্দা থেকে বেরুলেই হাতের বাম দিকে বিশাল পার্কিং প্লেস।
অনেকগুলো গাড়ি পার্ক করা আছে।
ওকুয়া’র ওরা দু’জন গাড়িগুলোর দিকে এগুচ্ছে। আহমদ মুসা বুঝল, ওরা নিজস্ব গাড়ি নিয়ে এসেছে।
আহমদ মুসার হাতে রাশিদির গাড়ির চাবি। সেদিকে একবার তাকিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। গাড়ি না থাকলে ওদের পিছু নেয়া মুস্কিল হতো। রাশিদির গাড়ি আহমদ মুসা ড্রাইভ করেছিল বলে চাবিটা তার হাতেই রয়ে গিয়েছিল।
ওরা তাদের গাড়ির কাছে গিয়ে থামলে আহমদ মুসা চাবির রিংটা আঙুলে নাচাতে নাচাতে আনমনাভাবে গুণ গুণ করে গাড়ির দিকে এগুলো।
ওদের গাড়ি লন পেরিয়ে যখন গেটের কাছাকাছি পৌঁছল, তখন আহমদ মুসার গাড়ি স্টার্ট নিল।
ওদের পিছু পিছু বেরিয়ে এসে রাস্তায় পড়ল আহমদ মুসার গাড়ি।
সুপ্রীম কোর্ট লন থেকে বেরিইয়ে ওদের গাড়ি ‘ইয়াউন্ডি সার্কুলার’ ধরে দক্ষিণে এগিয়ে চলল।
‘ইয়াউন্ডি সার্কুলার’কে রাজধানী ইয়াউন্ডির ‘মাদার রোড’ বলা হয়। রোডটি ইয়াউন্ডিকে চারটি বৃত্তে ভাগ করেছে। চারটি বৃত্ত শহরের কেন্দ্রে এসে মিলিত হয়েছে। এই কেন্দ্রেই সুপ্রীম কোর্ট। বৃত্তগুলো থেকে দু’পাশে ডজন ডজন রোড বেরিয়ে রাজধানী শহরকে মাকড়শার জালের মত ভাগ করেছে। বৃত্ত চারটিকে এ, বি, সি, ডি- এই চার নামে চিহিৃত করা হয়েছে। বৃত্ত থেকে বের হওয়া বাইরোডগুলোকে এক, দুই, তিন- এইভাবে নামকরন করা হয়েছে।
আহমদ মুসা রাস্তার রোড সাইন দেখে বুঝল তারা ‘ইয়াউন্ডি সার্কুলার সি’ ধরে এগিয়া চলছে। ‘ওকুয়া’র গাড়িটি তার দু’শ গজ সামনে।
প্রায় পনের মিনিট চলার পর ওকুয়ার গাড়ি বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে একটা বাইরোডে প্রবেশ করল। রোড সাইনে দেখল ‘সি-৭’, অর্থাৎ সি নম্বর বৃত্তের সাত নম্বর বাইরোড।
মিনিট পাঁচেক চলার পর সামনের গাড়িটি হঠাৎ দাড়িয়ে পড়ল।
বিপদে পড়ল আহমদ মুসা। তারা কি তার গাড়িকে সন্দেহ করছে? নাকি কোন প্রয়োজনে তারা দাঁড়িয়েছে। যেখানে সামনের গাড়িটি দাঁড়িয়েছে, সেটা একটা রাস্তার মুখ, সি-৭ থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে চলে গেছে।
সে কি দাঁড়াবে, ভাবল আহমদ মুসা। দাঁড়ানো ঠিক মনে করল না। তারা যদি সন্দেহ করেই থাকে, তাহলে দাঁড়ানোর অর্থ তাদের সন্দেহ পাকাপোক্ত করা।
সুতরাং আহমদ মুসা না দাঁড়িয়ে একি গতিতে গাড়ি চালিয়ে ‘ওকুয়া’র গাড়ি পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়া দু’শ গজের মত গিয়ে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পড়ল।
দাঁড়িয়েই পেছনে ফিরে তাকাল। ‘ওকুয়া’র গাড়িটি তখনও দাঁড়িয়ে।
আধা মিনিটও গেল না। ‘ওকুয়া’র গাড়িটি দক্ষিন গামী সেই রাস্তায় ঢুকে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসা তার গাড়িটি ঘুরিয়ে নিয়ে ছুটল সেই রাস্তার দিকে।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করল না, তার গাড়িটি দাঁড়াবার পর পরই আরেকটা নীল রঙের গাড়ি তার গাড়িকে পাশ কাটিয়ে দু’শ-আড়াইশ গজ দূরে একটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। গাড়িতে দু’জন আরোহী। তারা চোখ রাখছিল আহমদ মুসার উপর। আহমদ মুসা যখন তার গাড়ী নিয়ে ছুটল ‘ওকুয়া’র গাড়ী যে রাস্তার ঢুকেছে সে রাস্তার দিকে, তখন দু’জনের মুখেই একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল। একজন বলল, ভাব দেখেই বুঝা গিয়েছিল বেটা ফেউ হবে। এখন আর সন্দেহ রইল না। ও ঐ গাড়িকেই ফলো করছে। আহমদ মুসার গাড়ি চলতে শুরু করার পর তারা আহমদ মুসার গাড়ির পিছু নিল।
ওকুয়ার গাড়িটি বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছিল। আগের চেয়ে গতিটা এখন অনেক বেশি।
প্রায় দশ মিনিট চলার পর বেশ প্রশস্ত রাস্তায় উঠে এল গাড়ি। রাস্তাটি ইয়াউন্ডি সার্কুলার সি-র অপর একটি অংশ।
ওকুয়া’র গাড়ি ‘ইয়াউন্ডি সার্কুলার সি’-কে পাশ বরাবর ক্রস করে আরেকটি বাইরোডে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসার গাড়িও সেই বাইরোডে প্রবেশ করল। রোড় সাইন দেখে আহমদ মুসা বুঝল বাই রোডটি ‘সি-৪১’। আহমদ মুসা লক্ষ্য করল না সেই নীল গাড়িটিও বিড়ালের মত তার পিছু পিছু প্রবেশ করছে ‘সি-৪১’ বাইরোডে।
আরও দশ মিনিট চলল গাড়ি।
একটানা একই গতিতে এগিয়ে চলছিল ওকুয়ার গাড়ি। এই রাস্তায় গাড়িও কম। আহমদ মুসা নিশ্চিন্তে অনুসরন করছিল ওকুয়ার গাড়িটার। এই নিশ্চিন্ততায় আনমনা হয়ে পড়েছিল সে।
সামনের গাড়িটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আনমনা ভাবটি মুহুর্তে কেটে গেল। হার্ড ব্রেক কষল আহমদ মুসা। তবু তার গাড়িটা গিয়ে ‘ওকুয়া’র গাড়ির ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।
দ্রুত আহমদ মুসা নজর বুলালো সামনে-ডাইনে-বামে।
রাস্তার দু’পাশে জংগল। চারপাশের পরিবেশটা কোন পরিত্যক্ত এলাকার মত বিশৃংখল। শহরের কোন মসৃণতা নেই।
ভ্রু কুঞ্চিত হল আহমদ মুসার। ওকুয়ার গাড়িটা এখানে এল কেন? এতো লোকালয়হীন পরিত্যক্ত এক শহরতলী!
ঠিক এই সময়ই পেছনের নীল গাড়িটি আহমদ মুসার গাড়ির পেছনে এসে দাঁড়াল। আহমদ মুসা সেই গাড়িটাকে দেখল।
হঠাৎ করেই প্রচন্ড এক চিন্তার ঝলক নামল আহমদ মুসার দেহে।
সে কি ট্র্যাপে পড়েছে? তাকে কি পরিকল্পনা করে এই নির্জন শহরতলী এলাকায় নিয়ে আসা হয়েছে?
মূহুর্তেই শক্ত হয়ে উঠল আহমদ মুসার দেহ। অজান্তেই তার হাতটা ছুটে গেল পকেটে রাখা পিস্তলের বাটে। কিন্তু বিস্ময়ের সাথে সে সময় সে দেখল পেছনের নীল গাড়ীর দু’পাশের দু’দরজা দিয়ে দু’জন নেমে ছুটে আসছে তার গাড়ীর দিকে।
দ্রুত আহমদ মুসার হাত রিভলবার সমেত পকেট থেকে বেরিয়ে এল।
গাড়ী থেকে বেরুবার জন্য আহমদ মুসা মুখ ফিরাতেই দেখল, তার গাড়ীর দু’পাশের দুই দরজায় দু’জন তার দিকে রিভলবার তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই ওদের চিনতে পারল আহমদ মুসা সুপ্রীম কোর্ট থেকে এ দু’জন লোককে অনুসরন করেই সে আসছে।
ডান হাতে রিভলবার ধরে রেখে ওদের একজন একটানে গাড়ীর দরজা খুলে ফেলল। হেসে উঠল হো হো করে। বলল, ‘ও! তোমাকেই তো বসে থাকতে দেখেছিলাম সুপ্রীম কোর্টে আমাদের পাশে। তুমিই ফলো করছ তাহলে আমাদের!’
‘পাওল চেন একে?’ পেছনের নীল গাড়ী থেকে আসা দুজনের একজন বলল।
‘না, চিনি না, আজ একবার দেখেছি। সুপ্রীম কোর্টের রেজিস্ট্রার অফিসে আমাদের পাশে বসেছিল।’
চারটি রিভলবারই আহমদ মুসার দিকে তাক করা। নীল গাড়ী থেকে নেমে আসা পুর্বের সেই লোকটিই আবার বলল, ‘তাহলে ব্যাটা টিকটিকি নাকি? আমরা যদি পেছনে পাহারায় না থাকতাম, ধরাই হয়তো পড়তনা ব্যাটা। ফাদারকে ধন্যবাদ যে, তিনি বুদ্ধিটা করেছিলেন। পিছনে নজর রাখতে হবে এমন কথা আমাদের চিন্তাও আসেনি।’
নীল গাড়ীর সেই লোকটি পকেট থেকে ওয়াকিটকি বের করল। বলল, ‘তোমরা একটু দাঁড়াও, ফাদারের সঙ্গে কথা বলে নেই।’
বলে লোকটি ওয়াকিটকির বোতাম টিপে মুখের কাছে তুলে ধরল।
ওয়াকিটকি থেকে কন্ঠ ভেসে এল ‘আমি পল’।
‘গুড ইভেনিং স্যার। আমি ‘অপারেশন সুপ্রীম’-এর রজার।
ফাদারকে চাচ্ছিলাম।’
‘ফ্রান্সিস বাইক ইদেজা গেছেন। আমাকে বল। আমি তোমাদের কলের অপেক্ষা করছি।’
‘ধন্যবাদ স্যার, কোর্ট থেকে আমাদের ফলো করে আসছিল একজন, আমরা তাকে ধরেছি।’
‘ধরেছ? ব্রাভো! ব্রাভো! টিকটিকি নাকি?’
‘তাই মনে হচ্ছে স্যার’
‘সর্বনাশ তাহলে চীপ জাস্টিস উসাম বাইক আমাদের পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে।’
‘তাই মনে হচ্ছে, চীপ জাস্টিসেরই টিকটিকি এ। কোট রুম থেকে আমাদের ফলো করছে।’
‘ঠিক আছে। চীপ জাস্টিসের কপাল মন্দ। আমাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে। আমরা এর প্রতিশোধ নেব।’
‘হ্যাঁ, প্রতিশোধ নিতে হবে স্যার। আমরা এখন কি করব স্যার?’
‘তোমরা ওকে আটকে রাখ। কাল সকালে ফ্রান্সিস বাইক ফিরবে। দু’জন একসাথে টিকটিকির পেটটাকে একবার সাফ করব। কি কথা আছে ওর পেটে দেখব। তারপর…’
‘তাহলে কাল সকালে ফাদার ফ্রান্সিস বাইক ফেরা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে স্যার।’
‘হ্যাঁ’, বলে একটু থেমে গুড ইভেনিং বলে লাইন কেটে দিল ওপাশ থেকে।
এই আকস্মিক কথা বন্ধে রজার লোকটা আহত হল মনে হয়। হঠাৎ তার কপালটা কুঞ্চিত হল। অস্ফুটে তার মুখে উচ্চারিত, ‘ব্যাটা শ্বেতাংগের বাচ্চা, গুড ইভেনিংটাও দিতে দিল না।’
বলে এন্টেনা গুটিয়ে রেখে ওয়াকিটকি পকেটে রাখল।
উদ্যত রিভলবারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা ওয়াকিটকিতে কথা বলা শুনতে পেল। খুব লো ভয়েসে কথা বলছিল না তারা।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো যে, তাকে ওরা টিকটিকি অর্থাৎ সরকারী গোয়েন্দা মনে করছে।
আহমদ মুসা চিন্তা ভেঙে পড়ল কথার শব্দে।
ওয়াকিটকিওয়ালা বলছিল, ‘পাওল টিকটিকি ব্যাটার পকেট সার্চ করে ওর হাত-পা বেঁধে গাড়িতে তোল।’
ওয়াকিটকিওয়ালা ওয়াকিটকি পকেটে রেখে রিভলবার হাতে তুলে নিল।
‘পাওল’ নামের লোকটি তার ডান হাতের রিভলবার আহরদ মুসার পিঠে ঠেকিয়ে তার বাম হাত দিয়ে আহমদ মুসার পকেট সার্চ করল। একটা রিভলবার ছাড়া আর কিছুই পেল না আহমদ মুসার পকেটে।
তারপর আহমদ মুসাকে বেঁধে আহমদ মুসার গাড়িতে তুলল।
আহমদ মুসার পাশে ‘পাওল’ নামের লোকটি বসল হাতে রিভলবার নিয়ে। আর এ গাড়ির সিটে বসল ওয়াকিটকি ওয়ালা ‘রজার’ নামের লোকটি।
গাড়ি স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করল।
তিনটি গাড়িই একসাথে চলল।
ভাবছিল আহমেদ মুসা। ‘ওকুয়া’র বুদ্ধিমত্তা ও সতর্কতার ব্যাপারে আহমেদ মুসার নিম্নমানের ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক মিনিটের ঘটনাগুলো থেকে আহমেদ মুসার পুর্বের ধারণা পাল্টে গেল। ওরা যথেষ্ট সতর্ক ও বুদ্ধিমান। তাকে ঘিরে ফেলা থেকে শুরু করে বেঁধে গাড়িতে তোলা পর্যন্ত কোন ভুল বা অসতর্কতা ছিল না।
কো্থায় নিয়ে যাচ্ছে আহমেদ মুসাকে ওরা? এই বিপদের মাঝেও আহমেদ মুসার মনে আনন্দ। এভাবে সে নিশ্চয় ‘ওকুয়া’র কোন ঘাটিতে পৌছতে পারবে। ওদের কাছে পৌছা খুব প্রয়োজন।
‘টিকটিকি মহাশয় আপনার নাম কি?’ আহমদ মুসাকে পাশের লোকটা প্রশ্ন করল।
‘টিকটিকি।’ নির্বিকার কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ‘পাওল’ নামের লোকটি গভীর দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘সাহস তো খুব দেখছি। আমাদের যতটা ভদ্র দেখাচ্ছে, তার এক ভাগ ভদ্রও আমরা নই। কিন্তু কি করব, ফাদার বাইকের শিকারে তো আর আমরা হাত দিতে পারি না।’
‘পাওল টিকটিকিকে বলে দে, কোন টিকটিকি আমাদের পিছু নিলে তার একটাই শাস্তি- মৃত্যুদন্ড।’ ড্রাইভিং সিট থেকে বলল রজার।
‘কিন্তু এক টিকটিকি মরলে আরেক টিকটিকি আসবে। টিকটিকি মেরে শেষ করা যায় না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি বোধ হয় নতুন রিক্রুট। তাই জাননা যে তোমাদের বস’রা আমাদের নেতাদের ড্রইংরুমে একটু বসতে পারলে কৃতার্থ হন। তোমরা মত দশটা মরলেও তারা রা করবে না।’
‘বস’রা শেষ কথা নয়, সরকারও আছে।’
হো হো করে হেসে উঠল পাওল ও রজার দু’জনেই। পাওল বলল, ‘টিকটিকি সব খবর রাখ, এ খবর রাখ না যে, আমাদের এনজিওগুলোর আশীর্বাদ ও অর্থ না হলে সরকার সরকার হতে পারবে না, সরকার সরকার থাকবে না।’
শহরের পূর্ব প্রান্তে শহরতলীর একটা পুরনো বাড়ির সামনে গিয়ে তিনটা গাড়ি দাঁড়াল।
প্রাচীর ঘেরা বিশাল এলাকার মধ্যে দু’তলা একটা বাড়ি। বেশ বড়।
বাড়িতে প্রবেশের একটা মাত্র গেট।
সিংহ দুয়ারের মত বিশাল। বন্ধ।
সামনের গাড়ি যে ড্রাইভ করছিল সে নেমে দরজা খুলে দিল। এর অর্থ এ বাড়িতে গেটের দরজা খুলে দেবার কেউ নেই।
গেট দিয়ে প্রবেশ করল তিনটি গাড়ি।
ভেতরটা আরও বেশী অপরিষ্কার।
এক সময়ের পাথর বিছানো রাস্তাটা ধুলা-ময়লায় একদম ঢেকে গেছে।
তিনটি গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল বাড়িটির সামনে। একটা সিংহ দরজার মুখে।
‘আপনাদের বস ফাদার বাইক এই পোড়ো বাড়িতে থাকে?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
হো হো করে হেসে উঠল ‘পাওল’ নামের পাশের লোকটা। বলল, ‘টিকটিকি মশায়, এটা কোর্ট ও বন্দীখানা। এখানে বিচার হয় এবং শাস্তি বাস্তবায়ন হয়।’
‘বন্দীখানা, কিন্তু লোক তো দেখছি না। পাহারাদার কোথায়? এত ময়লা-আবর্জনা কেন?’
‘যখন প্রয়োজন পাহারাদার থাকে। প্রদর্শনীর জন্যে কোন পাহারাদার রাখা হয় না।’
পায়ের বাঁধন খুলে আহমদ মুসাকে ওরা গাড়ি থেকে নামাল।
আহমদ মুসা যতই বাড়িটা দেখছে স্তম্ভিত হচ্ছে। চুন-কাম, প্লাষ্টার খসে পড়েছে বাড়িটির, ইটও অনেক জায়গা থেকে খসে গেছে। কিন্তু বাড়িটার নির্মাণ শৈলী অপরূপ। মনে হচ্ছে সে যেন স্পেনের কোন ভাঙা প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে।
দেয়ালের ইট দেখে আহমদ মুসার মনে হলো এক বা একাধিক শতাব্দীর বেশী বয়স হবে বাড়িটার।
অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে সিংহ দরজার সামনে প্রশস্ত উঠানে গিয়ে দাঁড়ালো তারা। সিঁড়ি দেখে আহমদ মুসা বুঝল দামী পাথর লাগানো ছিল সিঁড়ির ধাপগুলোতে। খুলে নেয়া হয়েছে সেগুলো। সিংহ দরজা ও দেয়ালের চেহারা দেখেও আহমদ মুসা বুঝল এক সময় সেগুলোতেও দামী পাথর লাগানো ছিল।
দরজায় নক করল রজার।
কয়েক বার একরাশ ভয়ংকর গর্জন শোনা গেল। তারপরই দরজা খুলে গেল।
দরজায় দেখা গেল নেড়ে মাথা পর্বতাকৃতি একজনকে। কয়লার মত কালো গায়ের রং। তিনটি ভীষণাকৃতির ব্লাক-হাউন্ড তার সাথে। কুকুরগুলো চেন দিয়ে বাঁধা। চেনগুলো গরিলা-লোকটির হাতে।
তিনটি ব্লাক-হাউন্ডের চোখই আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। চোখে আগুন তাদের। আহমদ মুসার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মত পোঁজ তাদের।
কুকুরগুলো টেনে নিয়ে প্রশস্ত করিডোরের এক পাশে সরে দাঁড়াল গরিলা লোকটা।
গরিলা লোকটি মাথা ঝুকিয়ে অভিবাদনের জবাবে রজার বলেছিল ‘ব্ল্যাক-বুল তোমার আরেকটা শিকার নিয়ে এলাম। তবে বিচার এখনো হয়নি, কাল ফাদার আসবেন।’
বলে ভেতরে প্রবেশ করল ওরা আহমদ মুসাকে নিয়ে।
বাইরের থেকে বাড়ির ভেতরের অবস্থা ভাল। পাথর তুলে নেয়ায় দেয়ালের গা ক্ষতবিক্ষত, কিন্তু অধিকাংশ জায়গায় প্লাস্টার টিকে আছে।
করিডোর আরেকটা বড় দরজার সামনে নিয়ে গেল। দরজার দিকে তাকাতে গিয়ে দরজার অনেকখানি উপরে ভেন্টিলেটরে আটকে গেল আহমদ মুসার চোখ। ভেন্টিলেটরটায় লতা-পাতার সুন্দর জ্যামিতিক ডিজাইন। ডিজাইনের কেন্দ্রে একটা অর্ধচন্দ্র। অর্ধচন্দ্রের পেটে একটা ভাঙা ডিজাইন। যাকে একটা গম্বুজের অর্ধাংশ বলে মনে হচ্ছে।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। ক্রিসেন্ট এল কোথেকে এখানে?
আনমনা হয়ে পড়ায় চলার গতি কমে গিয়েছিল আহমদ মুসার।
পেছন থেকে পাওলের রিভলবারের বাঁট আহমদ মুসার মাথা সামনের দিকে ঠেলে দিল।
সম্বিত ফিরে পেয়ে আবার চলতে শুরু করল সে।
দরজাটা পেরুলেই দেখা গেল ডিম্বাকৃতির একটা বিরাট হলঘর। ডিম্বাকৃতি হলঘরের দৈর্ঘ্যের একটা প্রান্ত শুরু হয়েছে এই দরজা থেকে। দরজায় দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে নাক বরাবর সোজা আরেক প্রান্তে একটা বড় সিংহাসন। আর সিংহাসনের সামনে হল ঘরের দুই প্রান্ত দিয়ে ধনুকের মত সারিবদ্ধ গদী আঁটা আসন। কিন্তু সিংহাসন কিংবা এসব আসনের সবগুলোই ক্ষত-বিক্ষত, কংকাল মাত্র।
হল ঘরটিকে আহমদ মুসার একটা দরজার কক্ষ বলে মনে হলো। সিংহাসনের উপর নজর বুলাতে গিয়ে আহমদ মুসা আবার সেই বিস্ময়ের মুখোমুখি হলো। সিংহাসনের শীর্ষে সে একটা অর্ধচন্দ্র খোদিত দেখল।
আগে আগে হাঁটছিল আহমদ মুসা। পেছনে রজার, পাওল এবং তাদের সাথী দু’জন ও ব্ল্যাক বুল নামের লোকটি তার পিছনে তিনটি কুকুর হাতে।
আহমদ মুসা হলঘরের মাঝামাঝি পৌঁছতেই পেছন থেকে রজার বলল, ‘বাঁয়ের বড় দরজা দিয়ে।’
আহমদ মুসা বাঁয়ে ঘুরে দরজার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াল। দরজায় চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। দরজাটি একটা সিঁড়ির মুখে। সিঁড়িটা নেমে গেছে নিচের দিকে, ভূগর্ভে।
আহমদ মুসা দাঁড়ালো সিঁড়ি মুখে।
পেছন থেকে রজার বলে উঠল, ‘ব্ল্যাক বুল টিকটিকির হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে রেখে এসো নিচে।’
এগিয়ে এল ব্ল্যাক বুল। প্রথমে সে লোহার বেড়ি পরিয়ে দিল আহমদ মুসার পায়ে। তারপর হাতের বাঁধন খুলে হাতে লোহার বেড়ি পরিয়ে দিল।
আহমদ মুসা বিস্মিত। হাত-পায়ের বেড়িগুলোর প্রাচীন ডিজাইন, কিন্তু তাতে মডার্ন তালা সিস্টেম।
হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে ব্ল্যাক বুল লোকটি খেলনার মতই আহমদ মুসাকে কাঁধে তুলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামল নিচে।
সিঁড়ির দু’টি বাঁক ঘুরে ব্ল্যাক বুল মেঝেয় নামল, লক্ষ্য করল আহমদ মুসা। তার মনে হলো তারা পনের ফুট নিচে নেমেছে।
মেঝেতে নেমেই ব্ল্যাক বুল কাঁধ থেকে আহমদ মুসাকে ছুঁড়ে দিল মেঝেতে।
আহমদ মুসা এর জন্যে প্রস্তুত ছিল না। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় শক্ত মেঝের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষারও কোন উপায় ছিল না।
কাত হয়ে আঁছড়ে পড়েছিল শক্ত মেঝের উপর। শেষ মুহূর্তে শ্বাস বন্ধ করে আঘাত সামলে নেবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তবু ঘাড় ও পাঁজরটা তার যেন থেঁতলে গেল। আঘাতের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠল।
ধীরে ধীরে মাথাটা সে মেঝের উপর রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আঘাতটা হজম করার চেষ্টা করলো।
‘তুই বিদেশী কি করে টিকটিকি হলি?’ ভাঙা ফরাসীতে বলল ব্ল্যাক বুল।
আহমদ মুসা কোন জবাব দিল না। চোখ বুজে ছিল সে।
ব্ল্যাক বুল তার থামের মত পা দিয়ে আহমদ মুসার শরীরটাকে বলের মত গড়িয়ে বলল, ‘রেষ্ট নে, কাল তো যমের বাড়ি যেতে হবে!’
আহমদ মুসা হতাশ হয়ে পড়েছিল। তার আশা বন্দী হবার পর ওকুয়ার কোন ঘাটিতে যাবার সুযোগ হবে এবং ওমর বায়াদের মুক্ত করার একটা পথ সে পাবে। কিন্তু এটা ওকুয়া’র কোন ঘাটি নয়। মনে হচ্ছে এ পোড়ো বাড়িটা ওদের নিকৃষ্ট ধরনের কোন বন্দী খানা এবং এ ধরনের বন্দীখানায় ওমর বায়া এবং ডঃ ডিফারজিসকে তারা রাখবে না। ব্ল্যাক বুল-এর কথা আহমদ মুসার চিন্তায় নাড়া দিল। ব্ল্যাক বুলের মত মোটা বুদ্ধির লোকের কাছ থেকে কিছু কথা বের করা যেতে পারে।
এসব চিন্তা করে আহমদ মুসা ব্ল্যাক বুলের কথার জবাবে বলল, ‘যম বুঝি তোমাদের বলে গেছে?’
‘এই অন্ধ কুঠরিতে ঢোকার পর কেউ এখান থেকে বের হয়নি। এখান থেকে গেছে সোজা যমালয়ে।’
‘মনে হচ্ছে মিছিল করে মানুষ এখানে আসে যমালয়ে যাবার জন্যে!’
‘এই অন্ধ কুঠরিতে কংকাল ও নরমুন্ডের মিছিল দেখলেই সেটা বুঝতে পারবে।’
আহমদ মুসা চারদিকে তাকাল।
অন্ধ কুঠরিটি বিশাল। দু’প্রান্তের শেষটা বেঁকে গেছে বলে দেখা যাচ্ছে না।
মেঝের এখানে-সেখানে ছড়িয়ে আছে নরকংকাল এবং মানুষের মাথার খুলি।
অন্ধ কুঠরির বাতাস নাকে লাগতেই একটা তীব্র গন্ধ পেয়েছিল আহমদ মুসা। এখন সে বুঝতে পারল গন্ধের উৎস কি।
আহমদ মুসার কাছে পরিষ্কার হলো, খুনে ‘ওকুয়া’ এই পুরানো বাড়িটাকে অতীতে রাজা-বাদশাহদের মতো বধ্যভুমি হিসাবে ব্যবহার করছে। যাকে তারা হত্যা করবে তাকে এখানেই নিয়ে আসে। জিজ্ঞাসাবাদ বা নির্যাতেনর পর তাদের হত্যা করা হয় বা তিলে তিলে তাদের মৃত্যুবরণ করতে হয়।
‘এত লোককে তোমরা হত্যা করেছ?’ ব্ল্যাক বুলের কথার জবাবে বলল আহমদ মুসা।
‘এ আর কত! বড় ও বিপজ্জনক শিকার ছাড়া এখানে কাউকে আমরা আনি না।’
‘বড় ও বিপজ্জনক বন্দী এখন তাহলে তোমাদের নেই দেখছি, আমি একা এখানে!’
‘নেই কেন? আছে অন্য জায়গায়।’
‘আরও জায়গা তোমাদের আছে?’
‘অবশ্যই আছে।’
‘এই ইয়াউন্ডিতেই?’
‘এত প্রশ্ন করছ কেন? ও, তুমি তো টিকটিকি। আচ্ছা কত বেতন পাও যে, এভাবে মরতে এসেছ? সরকারের বেশীর ভাগ লোকই তো ‘ওকুয়া’কে ঘাটায় না। তোমার ভীমরতি হলো কেন?’
‘মনে কর কি যে, তোমরা ঠিক কাজ করছ?’
‘অবশ্যই। আমরা খৃষ্টের সৈনিক।’
‘কিন্তু তোমরা একজন বিখ্যাত ফরাসী লোককে পণবন্দী করে রেখেছো। অথচ সে নির্দোষ-নিরপরাধ। এটা কি খৃষ্টের সৈনিকের কাজ?’
‘এটা নেতাদের ব্যাপার। তাঁরা যা করেন খৃষ্টের জন্যেই করেন।’
‘ফরাসি ঐ ভদ্রলোককে তোমরা নিশ্চয় আমার মত করে রাখনি।’
‘তুমি তো দেখি সাংঘাতিক লোক, যমের বাড়ির দুয়ারে দাঁড়িয়ে অন্যকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ।’
‘কেন তুমিও কি মানুষ নও? তোমার মন নেই? মানুষের দুঃখ তোমার মনকে নাড়া দেয় না?’
‘দেখ ওসব কিছু আমরা বুঝি না। চৌদ্দ পুরুষ ধরে আমাদের পেশা খুন করা।’
‘বাপের মত ছেলে হয় না। চৌদ্দ পুরুষের কথা বলছ কেন?’
হো হো করে হেসে উঠল ব্ল্যাক বুল। বলল, ‘আমাদের ক্ষেত্রে ওসব নীতিকথা খাটে না। খুন আমাদের বিজনেস। তাই আমরা সব সময় শক্তিমানের হাতে থাকি। একটা গল্প বলি শোন। এই বাড়ির যিনি নির্মাতা ও মালিক, তিনি আমার দাদাকে নিয়েছিলেন বডি গার্ড হিসেবে। ফরাসীরা এলে তারাই শাসনের মালিক হয়। আমার দাদা তাদের একটা মিশনারী পক্ষের সাথে যোগ দিয়ে এই বাড়ি লুট করায় এবং বাড়ির বৃদ্ধ মালিক ও তার স্ত্রীকে হত্যা করে। এই ঘর তাদের ছিল ধন ভান্ডার। পরে ফরাসী দেশীয় মিশনারী ঐ সংস্থা দাদাকে দিয়ে ঐ বৃদ্ধ ও তার স্ত্রীকে খুন করায়। সেই থেকে আমরা ঐ মিশনারী পক্ষের পেশাদার খুনি।’
‘তোমার এ মিশনারী পক্ষের নাম কি?’
‘তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি এখানে আসিনি। তুমি মর, আমি চললাম।’ বলে ব্ল্যাক বুল ঘুরে দাঁড়াল চলে যাওয়ার জন্যে।
আহমদ মুসা বলল, ‘মিঃ ব্ল্যাক বুল প্রশ্নের উত্তর দিও না ঠিক আছে। কিন্তু তুমি তোমার দাদা ও আব্বার মত নও। হলে দাদার ঐ গল্প তুমি করতে না।’
ব্ল্যাক বুল ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল।
তার চোখ দু’টি নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার দিকে।
চোখ দু’টি শান্ত। কয়লার মত কালো মুখে পাপের কুৎসিত আবরণ ভেদ করে নিষ্পাপ বিষ্ময়ের একটা আভা ফুটে উঠল।
একইভাবে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে।
অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে ধীর কন্ঠে বলল, ‘তুমি টিকটিকি নও, তুমি কে?’
‘কেন? এ প্রশ্ন কেন?’
‘টিকটিকিদের আমি চিনি। ওরা তোমার মত করে কথা বলে না। তোমার কথায় সংষ্কারকের কন্ঠ, তোমার চোখে সংস্কারকের দৃষ্টি। বল তুমি কে?’
‘তার আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।’
হো হো করে হেসে উঠল ব্ল্যাক বুল। কিন্তু তার শুকনো হাসিকে একটা জমাট বিদ্রুপ বলে মনে হলো। বলল সে, ‘দাদা ও আব্বা মিলে যত খুন করেছে, আমি তার দ্বিগুণ খুন করেছি। সুতরাং বুঝতেই পারছ তোমার কথা সত্য নয়।’
‘পেশা এবং মন আলাদা হতে পারে মিঃ ব্ল্যাক বুল।’
‘রক্তের সাগর সে মনকে রাখেনি, চাপা দিয়েছে। যাক। তোমার জন্যে দুঃখ হচ্ছে। তুমি কে?’
‘আমি টিকটিকি নই। আমি বাইরে থেকে এসেছি দু’জন লোককে বন্দীদশা থেকে উদ্ধারের জন্যে।’
‘কিন্তু এদের পিছু নিয়েছিলে কেন?’
‘এদের হাতেই ওঁরা দু’জন বন্দী আছেন।’
‘আমার মনে হচ্ছে, তুমি একজন ভাল মানুষ। কিন্তু তোমার ভাগ্য খারাপ। তোমাকে হত্যা করতে আমার কষ্ট হবে।’
‘তাহলে আমার কথাই ঠিক। তোমার পেশা এবং মন আলাদা।’
ব্ল্যাক বুল বসে পড়ল। তার চোখে শুন্য দৃষ্টি। বলল, ‘সত্যি বলছ আমার মন নামক কিছু আছে?’ তার কথা খুব ভেজা শোনাল।
‘কেন মন তোমার নেই মনে কর?’
‘না নেই। আমার দাদার ছিল না, আব্বার ছিল না, আমারও নেই।’
‘আবার তুমি পেশা এবং মনকে এক করে দেখছ।’
‘তুমি সব জান না। লোভ, বিশ্বাসঘাতকতা, নেমকহারামি ইত্যাদি পেশা হতে পারে না। তাহলে শোন।’
বলে একটু থামল ব্ল্যাক বুল। তারপর শুরু করল, ‘আমার পিতৃপুরুষের বাসভূমি ছিল মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের ‘সলো’ শহরে। সংঘ নদীর তীরে ছিল আমাদের বাড়ি। আমার দাদু ‘কমন্ড কাল্লা’ তখন নব্য যুবক। কুস্তিগীর হিসেবে বিখ্যাত। সংঘ নদী তখন দাস ব্যবসায়ীদের আনাগোনায় বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। এক ভোরে আমাদের নদী তীরের বাড়ি আক্রান্ত হলো দাস ব্যবসায়ীদের দ্বারা। ওদের বন্দুকের কাছে আমাদের তীর এবং বর্ষার প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টিকল না। দাদুর আব্বা-আম্মা নিহত হলো। আর বন্দী হলেন দাদু। হাত-পা বেঁধে দাদুকে আরও অনেকের সাথে নৌকার খোলে ফেলে রাখা হলো। সংঘ নদী বেয়ে তাদের আনা হলো কংগোর ‘ওয়েসু’ শহরে। দাস-ব্যবসায়ীদের বড় কেন্দ্র ছিল এটা।
নিয়ম ছিল, দাস ব্যবসায়ের জন্যে বন্দীদের না খাইয়ে রেখে দুর্বল করে ফেলা হতো।
দাদুরা যখন ‘ওয়েসু’তে পৌঁছলেন, তখন তারা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় জর্জরিত। মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের ‘সলো’ থেকে ‘ওয়েসু’ পর্যন্ত এক সপ্তাহের পথ এসেছে। সাত দিনের মধ্যে মাত্র একদিন একবেলা খেতে দিয়েছে। পানি খেতে দিয়েছে প্রতিদিন একবার।
দাদুরা যখন ‘ওয়েসু’তে পৌঁছল, তখন তারা শয্যাশায়ী।
ওয়েসু’তে আসার পর দাস ব্যবসায়ীরা মনে হয় কিছু সদয় হলো বন্দীদের প্রতি। ওদের খেতে দেয়া হলো এবং খোলের বাইরে মুক্ত বাতাসে নিয়ে আসা হলো তাদেরকে। পায়ের বেড়ি খুলে দেয়া হলো খোলের উপর হাঁটাহাঁটি করার জন্যে।
নৌকার দুই প্রান্তে দুইজন রাইফেলধারী তাদের পাহারা দিচ্ছিল।
দাদু মুক্তির জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। এইটুকু সুযোগও তিনি নষ্ট করলেন না। নৌকা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি পানিতে।
দাদু সাঁতরে নদীর উত্তর পাড়ে ওঠার জন্যে ছুটেছিলেন। ওদের দু’জনও পানিতে ঝাঁপিয়ে দাদুর পিছু নিলেন। পরে একটা ছোট বোটও দাদুকে ধরার জন্যে ছুটল।
অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাঁতারু ছিলেন দাদু। সুতরাং সাঁতারে ওরা পারল না দাদুর সাথে।
তীরে উঠার পর দৌঁড়েও তারা পারল না দাদুর সাথে। নদীর তীর ধরে পশ্চিম দিকে পাগলের মত ছুটছিলেন দাদু।
দৌঁড়ে ওরা যখন দাদুর সাথে পেরে উঠল না, তখন গুলী করল। গুলী গিয়ে বিদ্ধ হলো দাদুর পায়ে।
সামনেই একটা মোটর বোট বাঁধা ছিল ঘাটে। দাদু গুলীবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেলেন নৌকার সামনের তীরটায়।
ওরা ছুটে গিয়ে গুলী বিদ্ধ যন্ত্রণা কাতর দাদুকে ঘিরে দাঁড়াল।
এই সময় বোট থেকে নেমে এলেন মধ্য বয়সী একজন ভদ্রলোক। ভদ্রলোকটি কৃষ্ণাংগ, কিন্তু ঠিক নিগ্রো নয়। নাক খাড়া, চুল সরল, মুখে এশিয়ান বা ইউরোপীয় চেহারা।
ভদ্রলোক বোট থেকে নেমে চারজন শ্বেতাংগকে একজন গুলী বিদ্ধ কৃষ্ণাংগকে ঘিরে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন এবং পরিষ্কার ফরাসী ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার? কি ঘটেছে?’
দাস ব্যবসায়ী শ্বেতাংগরা তার কথার দিকে কর্ণপাত না করে দাদুকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল।
ভদ্রলোক ছুটে এসে ওদের পথ রোধ করে দাঁড়ালেন।
ওদের একজন বলল, ‘পথ ছেড়ে দিন। এ আমাদের ক্রীতদাস।’
‘আমি ওকে জিজ্ঞেস করব, ও ক্রীতদাস কিনা। তোমরা ওকে কোথা থেকে কিনেছ, ও বলুক।’
দাদু চিৎকার করে উঠল, ‘ওরা ধরে এনেছে আমাকে আমার আব্বা-আম্মাকে হত্যা করে।’
সঙ্গে সঙ্গে ওরা পিস্তল তুলল ভদ্রলোককে লক্ষ্য করে। ভদ্রলোকের হাতে ছিল ষ্টেনগান। বিদ্যুত গতিতে তা উঠে এসে গুলী বৃষ্টি করল।
এ রকমটা ওরা ভাবেনি। কোন কৃষ্ণাংগ শ্বেতাংগকে এইভাবে গুলী ছুড়তে সাহস পাবে তা তারা চিন্তা করেনি। সম্ভবত পিস্তল তুলেছিল ভয় দেখাবার জন্যে। গুলীতে ওদের চারজনের দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেল।
ভদ্রলোক দাদুকে পাঁজাকোলা করে তুলে বোটে নিয়ে এল এবং সঙ্গে সঙ্গেই ষ্টার্ট দিল বোট। বলল, ‘খবর পাবার পর ‘ওয়েসু’ থেকে দাস ব্যবসায়ী শয়তানরা এক জোট হয়ে ছুটে আসবে।’
‘কিন্তু কোথায় পালাবেন। নদী পথে কি ওদের হাত থেকে বাঁচা যাবে?’ জিজ্ঞেস করেছিল ক্রু।
‘আমি সংঘ নদী দিয়ে যাব না। আমি ক্যামেরুনের দিজা নদীতে ঢুকব। দিজার মত ছোট ও দুর্গম নদীতে ওরা ঢুকবে না’।
এই ভাবেই দাদু ভদ্রলোকটির আশ্রয় লাভ করলো। ভদ্রলোক দীর্ঘ পনের দিন এ নদী সে নদী বেয়ে ইয়াউন্ডিতে এসে হাজির হলেন। যেদিন তিনি ইয়াউন্ডিতে পৌঁছিলেন, সেদিনই পনের ষোল বছরের তাঁর একমাত্র ছেলে মারা গেল।
ছেলেটির কবর দেয়া হলো ইয়াউন্ডিতে। কবর দেয়ার সময় আমার দাদু বুঝলেন ভদ্রলোকটি মুসলমান।
ভদ্রলোকের গন্তব্য ছিল নাইজেরিয়ার লাগোস অথবা ‘কানো’ শহর এবং সেখান থেকে হজ্জে চলে যাওয়া এবং হজ্জ শেষে মদিনায় স্থায়ী হওয়া।
কিন্তু ছেলে মারা যাওয়ার পর একেবারে ভেঙে পড়লেন ভদ্রলোক। নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ঠিক করলেন, ছেলের কবরের পাশেই গড়ে তুলবেন স্থায়ী নিবাস। দাদুকে বললেন, তুমি সম্পূর্ণ মুক্ত। বাড়িতে ফিরে যাও। কিংবা তোমার যেখানে ভালো লাগে যেতে পার।
দাদু বললেন, বাড়িতে আমার কেউ নেই। আপনি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। আপনার ধর্মও আমার ভালো লেগেছে। আমি ইসলাম গ্রহণ করে আপনার পায়ের কাছেই থাকতে চাই।
ভদ্রলোক দাদুকে সন্তান হিসেবে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। এবং একমাত্র মেয়ে আয়েশাকে বিয়ে দিয়েছিলেন দাদুর সাথে।’
থামল ব্ল্যাক বুল।
‘কিন্তু তোমার এ কাহিনীতে কি বুঝা গেল?’ বলল আহমদ মুসা।
‘শেষ করতে দাও।’ বলে আবার শুরু করল ব্ল্যাক বুল, ‘আসল কাহিনী শুরুই হয়নি। ভদ্রলোক ছিলেন মহৎ হৃদয় এক রাজপুত্র। তার নাম ছিল যায়দ রাশিদি। উত্তর ক্যামেরুনের মারুয়া উপত্যাকায় এদের রাজত্ব ছিল। পার্শ্ববর্তী চাদ ও নাইজেরিয়ারও কিছু এলাকা ছিল এই রাজত্বের অধীন। পিতার মৃত্যুর পর যায়দ রাশিদি রাজ্যের সুলতান হন। কিন্তু রাজত্বের অভিলাসী ছোট ভাইয়ের ষড়যন্ত্রে অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে ছোট ভাইকে সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে পরিবার সমেত নিরুদ্দেশ হন। প্রথমে যান চাদে, তারপর মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের দুর্গম অঞ্চল ‘বোমাসায়’ বসবাস করতে থাকেন। সংঘ নদী তীরবর্তী ‘বোমাসা’ বন্দরটি ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ও কংগোর সংগম স্থলে। দীর্ঘ ২০ বছর এখানে বসবাস করার পর হজ্জের উদ্দেশ্যে ‘বোমাসা’ ত্যাগ করেন। তারপর ‘ওয়েসু’তে অবস্থান কালে দাদুর সাথে তার সাক্ষাত হয়।’
থামল ব্ল্যাক বুল।
‘থামলে কেন। চমৎকার তোমার কাহিনী। কিন্তু তুমি কি বলতে চাও এখনো বুঝিনি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বলছি। এর পরের কাহিনী আমার দাদুর বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী। যায়দ রাশিদি ইয়াউন্ডির বিশাল এলাকা কিনে অল্পদিনেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন এবং ব্যবহার ও বদান্যতার গুণে তিনি স্থাণীয় লোকদের হৃদয় জয় করেছিলেন। কিন্তু তার এই জনপ্রিয়তা তার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ায়। ক্যামেরুনে পশ্চিমী শাসকদের সাথে খৃষ্টান মিশনারী সংগঠন সমূহেরও আগমন ঘটে। যায়দ রাশিদি তাদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায়। আমার দাদু খৃষ্টান মিশনারীদের প্রলোভনের শিকার হয়ে পড়েন। অর্থ বিশেষ করে নারী দিয়ে ফাঁদে ফেলে তাকে সম্পূর্ণ বশীভূত করা হয়। খৃষ্টান মিশনারীদের টার্গেট ছিল যায়দ রাশিদির ধর্ম প্রচার বন্ধ করা এবং তাঁর অর্থ ও সম্পত্তি আত্মসাত করা। দাদুকে দিয়ে অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে এ কাজটি আঞ্জাম দেয়া হয়।
একদিন ভোরে প্রার্থনারত অবস্থায় যায়দ রাশিদি ও তার স্ত্রীকে হত্যা করেন দাদু ছুরি দিয়ে নিজ হাতে।
চিৎকার শুনে পাশের রুম থেকে প্রার্থনারত দাদী প্রার্থনা ছেড়ে ছুটে আসেন। পিতা-মাতার রক্তে ভাসমান দেহ এবং দু’হাতে ছুরি নিয়ে দাদুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান।
যায়দ রাশিদি ও তার স্ত্রীর হত্যার পর বাড়ি ও সমগ্র সম্পত্তি দখল করে খৃষ্টান মিশনারীরা। এবং দাদীকে বন্দী করে রাখা হয় এই অন্ধ কুঠরীতে। তার উপর নির্যাতন চলে দিনের পর দিন।
যায়দ রাশিদির সব সম্পদ-সম্পত্তিই খৃষ্টান মিশনারীরা পেয়ে যায়, কিন্তু যায়দের স্বর্ণ মুদ্রার বিশাল বাক্সটি কোথাও পাওয়া যায় না। ঐ বাক্সটির সন্ধানে সবগুলো ঘরের মেঝে এবং দেয়ালের সন্দেহজনক সব জায়গা খুড়ে ও ভেঙ্গে দেখা হয়। এই অন্ধ কুঠরীর মেঝে কয়েকবার খুঁড়ে দেখা হয়। কিন্তু কোথাও সেই বাক্স খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই বাক্সের সন্ধানেই দাদীর উপর নির্যাতন চলে।
দাদী সেই যে জ্ঞান হারিয়েছিলেন, তারপর তিনি যেন একদম বোবা হয়ে গিয়েছিলেন। কথা বলতেন না। তাঁর উপর নির্যাতন চলার প্রথম দিকে একদিন একটি মাত্র বাক্য দাদুর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি গলায় ক্রস পরেছ, ঐ অর্থ ক্রিসেন্টের জন্য, ক্রসের জন্যে নয়।’
এই কথাটুকুর পর দাদী আবার বোবা হয়ে গিয়েছিলেন। তার উপর নির্যাতন চালাত দাদু এবং দাদুর সাথী ফ্লোরেন্স নামের মিশনারীদের একটি মেয়ে। শত নির্যাতনেও দাদী আর মুখ খোলেননি। শুধু আব্বাকে দেখলে ডুকরে কেঁদে উঠতেন। আব্বা তখন সাত-আট বছরের ছেলে। আব্বাকে দাদীর কাছে আনা হতো টোপ হিসেবে, যাতে তিনি কথা বলেন। দাদী কাঁদতেন, কিন্তু কথা বলতেন না। একদিন ফ্লোরেন্স মেয়েটি কথা বলতে দাদীকে বাধ্য করার জন্যে আব্বার গলায় ছুরি ধরেছিল। দাদী চিৎকার করে চোখ বুজেছিলেন, কিন্তু মুখ খোলেননি।
নির্যাতন, রোগ-শোক এবং অনাহারে দাদী এই অন্ধ কুঠরিতেই একদিন প্রাণ ত্যাগ করেন।
দাদুও পরবর্তীকালে সুস্থ ছিলেন না। দাদীর মৃত্যুর পর ফ্লোরেন্স ও মিশনারীদের কাছে দাদুর প্রয়োজন আর থাকে না। দাদু পরিণত হন তাদের চাকরে। ধীরে ধীরে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
এই বাড়ি ও এই অন্ধ কুঠরি পরিণত হয় খৃষ্টান মিশনারীদের বধ্যভূমিতে। আর দাদু পরিণত হন তাদের অসহায় এক জল্লাদে।
জল্লাদি করে আব্বাও প্রায়শ্চিত্ত করে গেছেন দাদুর পাপের। আমিও করছি। এ পাপ আমাদের ঘাড় থেকে কখনই নামবে না। পেশা এবং পাপক্লিষ্ট মন আমাদের এক হয়ে গেছে। তুমি পেশা ও মনকে আলাদা করছ, আমাদের ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়।’
একটু থামল ব্ল্যাক বুল। শেষ দিকে তার মুখে ফুটে উঠেছিল কান্নার মত হাসি।
পরে গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘জানো, আমি আমার পেশা নিয়ে খুশি আছি। কারণ এই বাড়ি ছাড়তে চাই না। যায়দ রাশিদির এই বাড়ি আমার কাছে স্বর্ণের টুকরার চেয়েও মূল্যবান। আর এই অন্ধ কুঠরী ঘর আমার সবচেয়ে বেশী প্রিয়। এখানে এলে আমি দাদীর গন্ধ পাই, কথা শুনি।’
বলে উঠে দাঁড়াল ব্ল্যাক বুল।
আহমদ মুসা কাহিনী শুনে নিজেই যেন বোবা হয়ে গিয়েছিল। হৃদয়ের গভীরে একটা ব্যথা চিন চিন করে উঠেছিল তার। যায়দ রাশিদির সেই অতীত তার কাছে ভেসে উঠতে চাচ্ছিল।
ব্ল্যাক বুলের উঠে দাঁড়ানো দেখে সম্বিত ফিরে পেল আহমদ মুসা।
একটু নড়ে বসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার এই কাহিনী বলা, এই বাড়ি এবং এই অন্ধ কুঠরীকে তোমার ভালোবাসা প্রমাণ করে, তোমার কাছে তোমার পেশার চেয়ে তোমার মন বড়। যাক সে কথা। তোমার মত করে এই বাড়ি এবং এই অন্ধ কুঠরীকে যে আমিও ভালোবেসে ফেললাম!’
‘কেন? বিদ্রুপ করছ?’ বলল ব্ল্যাক বুল।
‘না, বিদ্রুপ করিনি। তোমার হতভাগ্য যায়দ রাশিদি এবং তোমার হতভাগ্য দাদী তো আমার ভাই-বোন!’
‘কি বলছ তুমি?’
‘হ্যাঁ। এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। সেই হিসেবে তারা আমার ভাই-বোন।’
‘তুমি মুসলমান?’ চোখে একরাশ বিষ্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল ব্ল্যাক বুল।
মুহূর্তকাল থামল। তারপর সেই বিষ্ময় নিয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি মুসলিম, তুমি টিকটিকি নও। তাহলে তুমি আমাদের লোকদের পিছু নিয়েছিলে কেন?’
জবাব দিতে মুহূর্তকাল দেরী করল আহমদ মুসা। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘তোমার সংগঠন ‘ওকুয়া’ আমার এক মুসলিম ভাই এবং নিরপরাধ এক ফরাসী ভদ্রলোককে বন্দী করে রেখেছে। তাদের মুক্ত করার জন্যে ‘ওকুয়া’র ঘাটির সন্ধানে আমি ওদের পিছু নিয়েছিলাম।’
‘কেন ওদের বন্দী করেছে?’
‘যায়দ রাশিদির মতই ওমর বায়াকে ওরা বন্দী করেছে তার দশ হাজার একর সম্পত্তি আত্মসাত করার জন্যে।’
‘এটা ওদের খুব সাধারণ একটা কৌশল। কিন্তু ওদের বাধা দিয়ে কেউ কোনদিন সফল হতে পারেনি। যারা বেশী বেয়াড়া, তাদের এই অন্ধ কুঠরীতে আনা হতো। আর তাদের জীবন যেত আমার হাতে। কিন্তু কোন বুদ্ধিতে তুমি একা এদের বিরুদ্ধে লড়তে এসেছ?’
‘একা নই। সাথে আল্লাহ আছেন। এবং আরও অনেকে আছেন। যাক একথা। তুমি কি বলতে পার ওদের কোথায় আটকে রাখা হয়েছে?’
‘আমি এই বাড়িটা ছাড়া ওদের কিছুই চিনি না, কিছুই জানি না।’
বলেই উঠে দাঁড়াল ব্ল্যাক বুল। বলল, ‘এই প্রথম কোন বন্দীর জন্যে আমার দুঃখ হচ্ছে। মনে হচ্ছে জীবন দিয়ে হলেও তোমাকে সাহায্য করি। কিন্তু জীবন দিয়েও এখান থেকে তোমাকে মুক্ত করতে পারবো না। ওরা চারজন পাহারায় আছে। কাল দুই সাহেব আসার পর তোমার বিচার করবে। আমাকে দিয়ে তোমাকে খুন করাবে। তারপর যাবে।’
‘আমার জন্যে তুমি ভেবনা। একটা কথা বল, যায়দ রাশিদির এই বাড়ি এবং তার সকল সম্পত্তির বৈধ মালিক যে তুমি, একথা তোমার মনে জাগে না?’
‘জাগে। আরও জাগে, আমার দেহে মুসলিম রক্ত আছে। কিন্তু পাপের জগদ্দল পাথর ঠেলে তা বেরিয়ে আসতে পারে না। আমি একজন পাপিষ্ঠ।’
‘পাপ যেমন হয়, পাপ তেমনি মোচনও হয়।’
‘কিন্তু আমার পাপ?’
‘সব পাপই মোচন হয়।’
‘আমি মানুষের মধ্যে গণ্য হতে পারব বলে তুমি মনে কর?’
‘তোমার চেয়ে বড় পাপী শুধু মানুষ হওয়া নয়, মহামানুষও হতে পারে।’
‘সত্যি পারব?’
বলে ব্ল্যাক বুল এগিয়ে এল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘এখন আমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব।’
ব্ল্যাক বুল তার পকেট থেকে চাবী বের করে আহমদ মুসার হাত ও পায়ের বেড়ি খুলে দিল।
ঠিক এই সময়েই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল।
আহমদ মুসা এবং ব্ল্যাক বুল দু’জনেই সেদিকে চোখ ফিরাল। দেখল, ব্ল্যাক ক্রসের সেই চারজনের দু’জন উদ্যত রিভলবার হাতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। তাদের চোখে আগুনের ফুলকি।
ব্ল্যাক বুল ওদের দিকে তাকিয়ে যেন পাথর হয়ে গেছে। আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়িয়েছে। তারও স্থির দৃষ্টি ওদের দিকে।
ওরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। দাঁড়াল আহমদ মুসা ও ব্ল্যাক বুলের মাঝখানে।
ওদের একজনের রিভলবার ব্ল্যাক বুলের দিকে এবং আরেকজনের আহমদ মুসার দিকে।
ব্ল্যাক বুলের দিক হয়ে দাঁড়ানো লোকটি চিৎকার করে উঠল, ‘জান বিশ্বাসঘাতকতার কি শাস্তি এখানে? দেখা মাত্র হত্যা করা। ঈশ্বরের নাম নাও। তিন গোণা পর্যন্ত সময় পাবে।’
বলে সে এক….. দুই….. করে গোণা শুরু করল।
আহমদ মুসা বুঝতে পারছিল ওরা ফাঁকা ভয় দেখাচ্ছে না। আফ্রিকার গোত্রীয় ঐতিহ্য সে জানে, বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি তাদের সর্বোচ্চ এবং তাৎক্ষণিক। ওরা ব্ল্যাক বুলকে হত্যা করবে।
আহমদ মুসার মনে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তার স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল তার দিকে রিভলবার উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির দিকে।
ব্ল্যাক বুলের দিকে বন্দুক উঁচানো লোকটি যখন এক….. দুই…. গুনছিল, তখন আহমদ মুসার সামনের লোকটি সম্ভবত অপ্রতিরোধ্য কৌতূহল বশতই ব্ল্যাক বুলের অবস্থা দেখার জন্যে মুখ ঘুরিয়েছিল মুহূর্তের জন্যে।
এমন একটি সুযোগের জন্যেই অপেক্ষা করছিল আহমদ মুসা।
লোকটি তার মুখ ঘুরিয়ে নেবার সাথে সাথেই আহমদ মুসা তার হাত থেকে রিভলবার কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘রিভলবার ফেলে দাও, হাত তুলে দাঁড়াও।’
আহমদ মুসার হুকুম তামিল হলো না।
যার রিভলবার আহমদ মুসা কেড়ে নিয়েছিল, সে তার মুখ ঘুরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল আহমদ মুসার উপর। আহমদ মুসার লক্ষ্য তখন ব্ল্যাক বুলের সামনের রিভলবারধারী লোকটি। এই সময় রিভলবারধারী লোকটিও রিভলবার ফেলে না দিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল।
আহমদ মুসাও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল।
তার হাতের রিভলবার চোখের পলকে দু’বার অগ্নিবৃষ্টি করল। যে লোকটি আহমদ মুসার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল, সে গুলী খেয়ে উল্টে পড়ে গেল। আর ব্ল্যাক বুলের কাছের যে লোকটি আহমদ মুসার দিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছিল তার রিভলবার, সে মাথায় গুলী খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ব্ল্যাক বুলের পায়ের কাছে।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় কঠোর একটি কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, ‘হাত থেকে রিভলবার……..।’
প্রথম শব্দ শোনার সাথে সাথেই আহমদ মুসা বিদ্যুৎ গতিতে মাথা তুলেছিল। দেখল, স্টেনগান হাতে সেই চারজনের অবশিষ্ট দু’জন রজার এবং পাওল সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে। সামনে আছে রজার তার স্টেনগানটি আহমদ মুসার দিকে উদ্যত।
আহমদ মুসার চোখ ওদের উপর পড়ার সংগে সংগেই উঠে এসেছিল তার রিভলবার। রজারের কথা শেষ হবার আগেই আহমদ মুসা দু’বার ট্রিগার টিপল তার রিভলবারের। দু’টি গুলী পর পর গিয়ে বিদ্ধ করল রজার ও পাওলকে। দু’জনের দেহই গড়িয়ে পড়ল সিঁড়ি দিয়ে নিচে।
‘ব্ল্যাক বুল চল আমরা যাই।’ বলল আহমদ মুসা।
ব্ল্যাক বুল তখন রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। মনে হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বিস্ময়কর বস্তুর সামনে সে যেন দাঁড়িয়ে। ধীরে ধীরে সে বলল, ‘থ্রি মাসকেটিয়ারের গল্প আমি শুনেছি, আমেরিকার বিখ্যাত পিস্তলবাজদের গল্পও আমি জানি। কিন্তু মনে হচ্ছে তোমার মানে আপনার কাছে তারা শিশু। এত দ্রুত রিভলবার তুলে লক্ষ্যভেদ করা যায়, না দেখলে আমার বিশ্বাস হতো না। এখন স্বীকার করছি, ‘ওকুয়া’ এর সাথে আপনি লড়তে পারবেন।’
‘থাক এসব কথা। চল আমরা যাই।’
‘কোথায়?’
‘আমি যেখানে যাব।’
‘কিন্তু এই বাড়ি তো আমি ছাড়ব না।’
‘ওকুয়া, কোকদের তুমি আমার চেয়ে ভাল চেন। এখানে আর এক মুহূর্ত তুমি নিরাপদ নও।’
‘তা জানি। কিন্তু…..’
‘কিন্তুটা বুঝেছি। বাপ, দাদা, দাদীদের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি তুমি ছাড়তে চাও না।’
‘এই বাড়িতে টিকে থাকা হৃদয়হীন পেশাটা গ্রহণের একটা বড় কারণ।’
‘আমরা এ বাড়িটা ছাড়ছি না। আবার ফিরে আসব। ইয়াউন্ডিতে এটাই আমার মনে হয় প্রথম মুসলিম বসতি। সুতরাং এ বাড়িটার ঐতিহাসিক মূল্যও আছে। সেই অতীত সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানতে চাই।’
বলে আহমদ মুসা সামনে পা বাড়িয়ে বলল, ‘এসো।’
‘জানতে চান? তাহলে তার কিছু বইপত্র আছে দেখতে পারেন।’ বলল ব্ল্যাক বুল।
‘কোথায়?’
‘এই সিঁড়ির নিচে একটা ট্রাংকে ঢুকিয়ে রেখেছি। চলুন দেখবেন।’
ট্রাংক খুলে বই বের করতে করতে বলল, ‘সব বই ওরা পুড়িয়ে ফেলেছে। একটা সুযোগ পেয়ে এ কয়টা আমি সরিয়ে রেখেছি।’
আহমদ মুসা এক এক করে সবগুলো বই দেখল। অধিকাংশই আরবী ভাষায়। অবশিষ্ট কয়েকটি ফরাসী ভাষায় লেখা। আর দু’টি সুহাইলী ভাষায় লেখা। বইগুলো ইতিহাস, কোরআন, হাদীস, ভ্রমণ কাহিনী ইত্যাদি বিষয়ক। ডাইরীর মত একটা নোট বুক দ্রুত তুলে নিল আহমদ মুসা।
পাতা উল্টিয়ে দেখল, প্রথম পাতায় আরবী ভাষায় লেখা নাম: যায়দ রাশিদি। তার নিচে লেখা: মারুয়া খিলাফত।
তারপর আরও পাতা উল্টাল আহমদ মুসা। দেখল, স্মৃতি কথা ধরনের একটা দিনপঞ্জী। আরবী ও সুহাইলী এই দুই মিশ্র ভাষায় লেখা।
আগ্রহ হলো আহমদ মুসার নোট বুকটি পড়ার। আফ্রিকার এ অঞ্চলের অনেক কছুই জানা যেতে পারে একজন মুসলিমের লেখা এই দিনপঞ্জী থেকে।
শেষ পাতাটিতে নজর বুলাতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। চমকে উঠার কারণ লেখার একটি শিরোনাম। যার অর্থ হলোঃ ‘যিনি এই ডায়েরিটি পড়বেন তার প্রতি।’
শিরোনামের নিচের লেখাও পড়ল আহমদ মুসা। ছোট একটা অনুচ্ছেদে লেখাঃ
“বুক ভরা অভিমান নিয়ে মারুয়া খিলাফত থেকে চলে আসার সময় আমার ন্যায্য পাওনা কিছু স্বর্ণমুদ্রা সাথে নিয়ে এসেছিলাম। যা আমার কোন প্রয়োজনে খরচ করিনি। আমার সাধ ছিল, আমার স্বর্ণ মুদ্রা আল্লাহর ঘর কাবা এবং নবীর মসজিদের রং ও রূপ বৃদ্ধিতে কাজে লাগাব। কিন্তু তা হলো না। তারপর ভেবেছিলাম, এ দেশীয় দুঃখী মুসলমানদের স্বার্থে এ স্বর্ণমুদ্রা কাজে লাগাব। তারও সুযোগ পেলাম না। নাসারা মিশনারীরা যেভাবে এগুচ্ছে তাতে আমি এবং আমার অর্থ সবই গিয়ে তাদের গ্রাসে পড়বে আশংকা করছি। এই আশংকায় আমার অর্থগুলো হেফাজতের একটা চেষ্টা করে গেলাম। আমার একান্ত আশা, যিনি ডাইরির এই অংশ পাঠ করবেন তিনি একজন দায়িত্বশীল মুসলিম হবেন। তিনি নিম্নলিখিত নক্শা অবলম্বনে মাটির তলা থেকে ৩ বর্গ ঘনফুট আয়তনের স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি বাক্সটি উদ্ধার করবেন। স্বর্ণমুদ্রার মালিক তিনি হবেন এবং তার বিবেকের রায় অনুসারে স্বাধীনভাবে খরচ করবেন।”
অনুচ্ছেদটির নিচে একটা বৃত্ত আঁকা। তার মাঝখানে একটা পাখির বাসা। সে পাখির বাসার ডানে অল্প দূরে একটা বর্গক্ষেত্র। তার মাঝখানে পাখির প্রাণহীন একটা ছানা। পাখির ছানাটির ঠোঁটের কাছে একটা গোলাপ ফুল। মনে হচ্ছে যেন ফুলটি ছানাটির ঠোঁটে ছিল, পড়ে গেছে।
কথিত নক্শা এটুকুই।
নক্শাটির উপর একবার নজর বুলিয়েই মুখে হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার। ভাবল, যায়দ রাশিদি এত সহজ ধাঁ ধাঁ’র চাবী দিয়ে তার অর্থ লুকিয়ে রেখেছেন।
আহমদ মুসা নোট বুক বন্ধ করল। বলল ব্ল্যাক বুলের দিকে তাকিয়ে, ‘এটা তোমার দাদীর আব্বার ডাইরী। আমরা সাথে নিতে পারি?’
‘ডাইরি কেন সব বই-ই নিতে পারেন।’
‘সবই নেব। আবার যখন ফিরে আসব তখন।’
‘সত্যিই তাহলে ফিরে আসবেন?’
‘অবশ্যই ফিরে আসতে হবে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। বলল , ‘চল।’
আহমদ মুসার গাড়ি অন্য দু’টি গাড়ির সাথে বাইরেই ছিল। গাড়িতে উঠল তারা দু’জন।
ওরা দু’জন বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে।
বেরিয়ে আসার আগে ব্ল্যাক বুল তিনটি কুকুরের গলা থেকে চেন খুলে নিয়ে ওদের গা নেড়ে আদর করে বলল, ‘তোরা স্বাধীন চলে যা।’
কিন্তু কুকুর তিনটি চলে না গিয়ে অবাক হয়ে তাকাল ব্ল্যাক বুলের দিকে। যেন চেন খুলে নিয়ে স্বাধীনতা দেয়ার তারা বিস্মিত হয়েছে।
ককুর তিনটিকে আবার আদর করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে।
বাড়ির ভাঙ্গা গেট দিয়ে বেরুবার সময় পেছনে তাকাল ব্ল্যাক বুল। তাকিয়ে বিস্মিত হলো, কুকুর তিনটি তাদের স্ব স্ব চেন মুখ দিয়ে ধরে গাড়ির পিছু পিছু আসছে।
ব্ল্যাক বুল আহমদ মুসাকে ডাক দিল।
আহমদ মুসাও তাকিয়ে দৃশ্যটা দেখে বিস্মিত হলো। বলল, ‘ব্ল্যাক বুল তুমি ওদের ছাড়তে চাইলও ওরা তোমাকে ছাড়তে চাইছে না। দেখ, ওরা চেন নিয়ে এসেছে। চেয়ে দেখ ওদের চোখের নির্বাক ভাষা বলছে, চেন দিয়ে বেঁধে আমাদের সাথে নিয়ে চল, স্বাধীনতা আমরা চাই না।’
‘সেই ছোট থেকে ওদের মানুষ করেছি, ট্রেইনিং দিয়েছি।’ ব্ল্যাক বুলের কণ্ঠ ভারী শোনাল।
কুকুর তিনটিকে গড়িতে তুলে নিল ব্ল্যাক বুল।
তাপর বাড়িটা পেছনে রেখে ছুটে বলল গাড়ি।