৪
জেনের আব্বা জেমেনিজ যে সিসনারোসা ঘরে ঢুকল তার মুখে অস্বস্তির চিহ্ন।
প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকেছিল। সকালে টেলিফোন করে জেমেনিজকে আনুরোধ করেছিল। প্রেসিডেন্ট এবং তিনি জেমেনিজের সাথে অত্যন্ত জরুরী কিছু কথা বলতে চান। জেমেনিজ কষ্ট করে গেলে তারা বাধিত হবেন। জেমেনিজ দেখতে পাচ্ছিল দেশ এক সঙ্কটজনক অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছে। জেনের চুরি করা ডকুমেন্ট দুনিয়াময় প্রচার হওয়ার পর স্পেনীয় কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের সর্বনাশ তো হয়েছেই স্পেন সরকারও ভীষণ চাপের মধ্যে পডেছে। যার ফলাফল সে নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ পাওয়ার পর জেমেনিজ বিস্মিত হয়ছিল প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দেশের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করবেন কু–ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের সম্পর্কেও তাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে? এ সব চিন্তা করে জেমেনিজেরও মনে হয়েছিল আলোচনা নিশ্চয় খুব জরুরী। তাই জেমেনিজ টেলিফোন পাওয়ার পর আর দেরি করেনি।
জেমেনিজ যখন ঘরে ঢুকল জেনের আম্মা তখন শুয়ে। অত্যন্ত মলিন চেহারা। দেহের সব রস শুকিয়ে তার দেহটা যেন চুপসে গেছে। জেন চলে যাওয়ার পর জেনের আম্মা শয্যা নিয়েছে। জেন তাদের একমাত্র সন্তান। একমাত্র সন্তান গুলিবিদ্ধ হওয়া এবং তার কোন খোঁজ না পেয়ে জেনের আম্মা খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে যখন সে শুনেছিল মাদ্রিদের কোন হাসপাতালে, ক্লিনিক, ডাক্তার খানায় জেনকে পাওয়া যায়নি, পুলিশ গোয়েন্দা বিভাগ ও কু–ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান মিলে চেষ্টা করেও জেনকে বের করা যায়নি জেনের মা তখন জ্ঞান হারিয়েছিল। তারপর যেদিন সে দেখল জেনের নিয়ে যাওয়া ডকুমেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর খবর হিসাবে প্রকাশ পেয়েছে বিশ্বের সংবাদ সমুহে সেদিন জেনের মা আশা ফিরে পেয়েছে যে জেন বেঁচে আছে এবং যারা এতবড় কাজ করেছে তাদের কাছে জেন ও জোয়ান ভালই থাকবে। তাছাডা এ বিষয়টাও জেনের মাকে আশ্বস্ত করেছে যে আহমদ মুসা শুধু অসাধারণ কুশলী একজন বিপ্লবীই নন খাটি মুসলিম চরিত্র আছে তার। আর একজন খাটি মুসলমান পরিচয় নির্বিশেষে সব মানুষকে ভালোবাসে, বিপদগ্রস্ত সকলকে সাহায্য করে। এসব চিন্তা জেনের মা’র মনকে কিছুটা সুস্থ করে তুলেছে। খাওয়া দাওয়া কিছু শুরু করেছে।
দরজার দিকে মুখ করেই শুয়েছিল জেনের আম্মা। জেনের আব্বার মুখের অস্বস্তির কালো ছায়াটা দেখতে পেল।
জেমেনিজ কাপড় ছেড়ে ফিরে এল ঘরে।
জেনের আম্মা উঠে বসল।
জেমেনিজ এসে বসল তার পাশে। বলল, ‘কেমন লাগছে আজ?’
‘ভালো। দেখা হলো ওদের সাথে?’
‘হয়েছে।’
‘কথার ফলাফল বোধ হয় খুব ভাল হয়নি।’
‘একথা বলছ কেন?’
‘তোমার মুখে একটা অস্বস্তির ছায়া দেখছি।’
‘অস্বস্তির কথাই তো, দেশ এখন খুব অসুবিধায়।’
‘কি শুনলে?’
‘অনেক কথা।’
‘খারাপ কিছু?’
‘অবশ্যই। মাদ্রিদের শাহ ফয়সাল মসজিদ সহ মুসলিম ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল পুতে রাখার অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এবং ইউনেস্কোর যৌথ কমিটি সবগুলো ঐতিহাসিক স্থানের মাটি পরীক্ষা করেছে। সব জায়গাতেই তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া গেছে একটা।’
‘তা হলে ঐ সব স্থানের সবগুলো বিল্ডিং কি এখন ধসে যাবে?’
‘না তেজস্ক্রিতার সবে প্রাথমিক অবস্থা। আরও বছর খানেক বিকিরণ চললে সে অবস্থার সৃষ্টি হতো।’
একটু থামল জেমেনিজ। তারপর আবার শুরু করল, ‘যে কথাটা বলেছিলাম। এই তেজস্ক্রিয়তা প্রয়োগকে একটা জাতির অস্তিত্ব ও ঐতিহ্য ধ্বংসের একটা জঘন্য ষড়যন্ত্র এবং মানবতার বিরুদ্ধে এক অপরাধ হিসাবে দেখছে জাতিসংঘের একটা মহল এবং বিশ্বের অনেকে মনে করছে স্পেন সরকারও এর সাথে জড়িত আছে। স্পেন সরকারকে বলা হয়েছে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুলগুলো তুলে ফেলা হবে। তবে এর সমূদয় খরচ বহন করতে হবে স্পেন সরকারকে। স্পেন সরকারকে বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিতে হয়েছে যদিও এটা অপমানকর। সবচেয়ে….’
‘অপমানকর কি করে? কথার মাঝ খানে বলে উঠল জেনের মা।’
‘স্পেন সরকার বলেছিল তারা নিজেরাই তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল তুলে নেবে। কিন্তু স্পেন সরকারকে বিশ্বাস করা হয়নি। এখন তারা কাজ করবে খরচ দিতে হবে স্পেনকে এটা অপমানকর নয়?’
কথা শেষ করে আগের কথায় আবার ফিরে গেল জেমেনিজ। বলল, ‘সবচেয়ে অপমানকর হলো মুসলিম ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো এখন মুসলিম কম্যুনিটির হাতে ছেড়ে দিতে হবে। জাতিসংঘের সমাজিক সংস্থা বিপুল ভোটাধিক্যে এ সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে।’
‘বল কি? এতবড় সিদ্ধান্ত নিল কি করে? নিতে পারল কি করে?’ বলল জেনের আম্মা বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে।
বিশ্বের ৫৫টি মুসলিম দেশ এবং তাদের সংগঠন ও আই সি এই ব্যাপারে গোটা দুনিয়া জুড়ে লবীং করেছে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে গোটা থার্ডওয়ার্ল্ড লবী। তারাই জাতিসংঘের এখন সামাজিক সংস্থার মত সংগঠনে তো বটেই। সুতরাং মুসলমানদের অনুকুলে সিদ্ধান্ত পাশ করাতে বেগ পেতে হয়নি। আমাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে যুক্তিটা কাজ করেছে, সেটা হলো আমরা ঐতিহাসিক স্থানগুলোর প্রতি বৈরী মনোভাবাপন্ন কারন ওগুলো সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থাই আমরা করিনি।’ বলল জেমেনিজ।
‘জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে তো করডোভা, গ্রানাডা, সেভিল, মালাগা, টলেডো শুধু নয়, সারাগোসা, লিস্তন, জাহিন ও স্যালমনিকার মত শহরের বৃহত্তর অংশ ওদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।’
‘হ্যাঁ তা যাবে।’
‘স্পেন সরকার কি মেনে নেবে?’
‘না মেনে উপায় কি?’
‘স্পেনের জন্য এটা একটা বিরাট ব্যাপার হবে।’
‘এর চেয়েও বড় ঘটনা আছে।’
‘সেটা কি?’ বিস্মিত কণ্ঠ জেনের আম্মার।
‘তুমিও তো খবর পড়েছ যে করডোভা, গ্রানাডা, মালাগা, টলেডো, সেভিল প্রভৃতি শহর ছাড়া খোদ মাদ্রিদেও মরিস্করা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে, মিছিল করেছে। তারা দাবী করেছিল মুসলিম হিসাবে তাদের সংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে সংখ্যালঘু জাতি গোষ্ঠী হিসাবে তাদের ন্যায্য অধিকার দান সহ তাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে হবে। তাদের এসব দাবীর পক্ষে মুসলিম দেশগুলোর এবং ও আই সি র কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে গোটা তৃতীয় বিশ্ব ও বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থা গুলো সোচ্চার হয়েছে। গত পরশু জাতিসংঘের সামাজিক কমিশন আরেক প্রস্তাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, মরিস্কদেরকে সংখ্যালঘু হিসাবে সংবিধানিক ভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং মুসলমানদেরকে সংখ্যালঘু হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদেরকে সকল নাগরিক অধিকার দিতে হবে। তাদের সম্পত্তি ও বাড়ি ঘর ফিরিয়ে দিতে হবে।’
থামল জেমেনিজ।
জেমেনিজ থামলেও জেনের মা কোন কথা বলতে পারলোনা। বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে তার মুখ। অনেক্ষন পর বলল, ‘এতবড় ঘটনা ঘটল কি করে? জানি তুমি বলবে মুসলিম দেশ গুলো লবীং করে জাতিসংঘকে দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বলত রাজধানী মাদ্রিদসহ এতগুলো শহরে মরিস্করা বিক্ষোভ প্রদর্শন করল কি করে? যারা ভয়ে নাম প্রকাশ করে না, পরিচয় দেয়না, তারা এ ভাবে সংঘবদ্ধ হলো কি করে, এ সাহস পেল কোথায়?’
‘এক কথায় তোমার প্রশ্নের উত্তরঃ আহমদ মুসা। এ সবকিছুর মূলে রয়েছে তার পরিকল্পনা ও প্রয়াস।’
‘কিন্তু আহমদ মুসা তো একজন মানুষ।’
‘অর্গানাইজ করতে একজন মানুষই লাগে। আহমদ মুসার নেতৃত্বে কাজ করেছে ‘নিউ ফ্যালকন অব স্পেন’ বলে পরিচিত গ্রানাডা অঞ্চলের যিয়াদ বিন তারিক এবং বাস্ক গেরিলা নেতা ফিদেল ফিলিপের দলে কার্যরত মুসলমানদের একটা শক্তিশালী গ্রুপ। প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তাতে বুঝেছি, যিয়াদ বিন তারিকের দল ও বাস্কের মুসলমানরা স্পেনের শহরে শহরে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে মরিস্কদের সংঘবদ্ধ করে ঐ সব শহরে জড়ো করে বিক্ষোভ মিছিলের ব্যবস্থা করেছে।’
‘কেন তাদের ধরা যায়নি?’
‘সরকার সার্বক্ষনিক শ্যেন দৃষ্টি রেখেছিল আহমদ মুসা ও জোয়ানের উপর। কিন্তু সরকারের রিপোর্ট মতে তারা মাদ্রিদ থেকে বের হয়নি। মাদ্রিদে বসে আহমদ মুসা কলকাঠি নেড়েছে। যিয়াদ বিন তারিক এবং বাস্কদের কোন মুসলমান নেতাকে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ চেনে না। তাই ওদের বাধা দেয়া যায় নি, ধরা যায়নি।’
থামল জেমেনিজ। থেমে পা দু’টো খাটের উপর তুলে ভালো করে বসল, জেনের আম্মার মুখোমুখি। তারপর শুরু করল, ‘দেখ, সরকার আহমদ মুসাকেই মনে করছে সব নষ্টের মূল। তারা মনে করে জোয়ানকে হাত করে জোয়ানের মাধ্যমে জেনকে ফুসলিয়ে সে রাজী করিয়েছে ঐ ডকুমেন্ট চুরি করার জন্যে। জেন বন্ধু জোয়ানকে সাহায্য করেছে মাত্র। আর ডকুমেন্ট গুলোকে জেন সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে করেনি। সরকার জেনকে কোন দোষ দিচ্ছে না। জেনকে উদ্ধারের জন্যে সরকার আগের চেয়ে অনেক বেশী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু কিছুতেই তার সন্ধান করা যাচ্ছে না।’
থামল একটু জেমেনিজ। একটা ঢোক গিলল। তারপর বলল, ‘সরকার একটা পরামর্শ দিয়েছে।’
‘পরামর্শ! কি পরামর্শ?’ জেনের আম্মার চোখে কৌতুহল।
‘তুমি খুবই অসুস্থ, এমন খবর দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে। তাদের বলতে হবে তুমি একটি বারের জন্যে জেনকে দেখতে চাও।’
‘জেন আসবে?’ জেনের আম্মার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘আমার এবং সবার ধারনা সে আসবে। সে আমাদের একমাত্র সন্তান। সে একটা কাজ করেছে বটে, কিন্তু তোমার অসুস্থতার কথা শুনলে সে স্থির থাকতে পারবে না।’
‘সে তো ভয় করতে পারে।’
‘ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে ভয় করার ছিল, কিন্তু ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান তো এখন নেই। ভাসকুয়েজ দেশ ত্যাগ করেছে। উর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা যারা ঘটনা কিছু কিছু জানত তারা গ্রেফতার হয়েছে। সুতরাং তার তো ভয় করার কিছু নেই।’
‘কেন সরকারকে ভয় করবে না?’
‘তার বিষয়টা তো সরকারের জানার কথা নয়। আমরা জানি, আর খুব বেশী হলে ‘ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান জানবে, এটাই সে জানে।’
‘আমিও তো এটাই জানি, কিন্তু বল তো সরকার জেনের ব্যাপারে জানলো কি করে?’ চিন্তিত কন্ঠে বলল জেনের আম্মা।
‘ভাসকুয়েজই গোয়েন্দা বিভাগকে জানিয়ে গেছে।’
জেমেনিজ কথা শেষ করলেও জেনের আম্মা কথা বলল না। ভাবছিল সে। কিছুক্ষন পর বলল, সরকার এখন তো জানে, সরকার আহমদ মুসা ও জোয়ানের উপর খুব ক্ষ্যাপা। জেনকে আবার সরকার আটকাবে নাতো?’ চিন্তিত কন্ঠ জেনের আম্মার।
‘না জেনকে তারা আটকাবে কেন? হয়তো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। তার বেশী কিছু নয়।’
‘একটা কথা বলব?
‘কি কথা?’
‘মেয়ের সিদ্ধান্তের সাথে আমাদের কোন দ্বিমত করা ঠিক হবে না।’
‘কোন সিদ্ধান্তের কথা বলছ?’
‘জেন জোয়ানকে পছন্দ করে।’
‘সেটা বুঝেছি, আগে হলে বিরোধিতা করতাম। এখন তার কোন যৌক্তিকতা দেখিনা।’
‘ঠিক বলেছ।’
‘কিন্তু তুমি আমি কি সত্যিই সুখী হতে পারব? তুমি নিশ্চয় জান, কার্ডিনাল পরিবারের জন্যে এটা কত বড় আঘাত। যে কার্ডিনাল পরিবার মরিস্কদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতা, সেই কার্ডিনাল পরিবারের নয়নের মনি যাবে পরিস্ক পরিবারে।’
‘জেন তো জানতো না জোয়ান মরিস্ক।’
‘পরে তো জেনেছে।’
‘তা জেনেছে, কিন্তু তুমি বল জোয়ান অন্য সব দিক দিয়েই উপযুক্ত কি না।’
‘কিন্তু মানুষটি কে, তার রক্ত কি, এই বিবেচনাই সবচেয়ে বড় নয়কি?’
‘তুমি অন্যভাবে নিওনা, মরিস্কদের মানে মুসলমানদের রক্ত তুমি ছোট মনে কর?’
‘ছোট-এর সংজ্ঞা তো অনেক আছে।’
‘যে সংজ্ঞাই ধর, ওরা রাজার জাতি, নেতৃত্বের গুণ ওদের রক্তের সাথে মিশে আছে, ওদের স্বাধীন সত্ত্বা কেউ ধ্বংস করতে পারে না, স্পেন শত শত বছরেও পারেনি।
‘বুঝেছি মেয়ে তোমাকে ভাল ভাবেই দলে টেনেছে।’
‘ওকথা বলোনা, মেয়েটা যে কার টান বেশী টানে, কাকে দু’দন্ড না দেখলে যে হাঁপিয়ে ওঠে, সে কথা আর বলিয়ে নিও না।’
জেনের আম্মার মুখের কথা শেষ করার আগেই জেমেনিজের চেহারার রং পাল্টে গেল। তার চোখ মুখ ভারী হয়ে উঠল। মুখ নিচু করল জেমেনিজ। ধীরে ধীরে তার চোখ ভিজে উঠল অশ্রুতে।
তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলল, ‘জানি না, মা আমার কোথায় আছে, কেমন আছে। জানিনা, মা আমাকে মাফ করেছে কি না। গুলিবিদ্ধ জেনের চিৎকার এখনও আমার কানে বাজে, আমাকে পাগল করে তুলে।’
জেমেনিজের শেষ কথাগুলো রুদ্ধ হয়ে গেল কান্নায়।
জেনের আম্মার চোখও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। বলল, ‘কোন খারাপ চিন্তা তুমি করোনা, জেন নিশ্চয় ভাল আছে।’
‘জেনের মা বিজ্ঞাপনটা তোমার নামে দেই, আমার নামে দিলে যদি না আসে? আমাকে মাফ করতে পেরেছে কিনা জানি না।’
‘এসব বাজে চিন্তা করোনা, তুমি জেনকে চিনতে পারলে গুলি করতে পারতে না, একথা জেন জানে।’
‘জানে বলছ?’
‘অবশ্যই জানে।’
‘কেমন করে তুমি বলছ?’
‘চেনার পরেও জেনকে বাধা দেবার জন্যে যদি গুলি করতে, তাহলে জেনকে পালাতে দিতে না। তাকে আরেকটা গুলি করতে পারতে। কিংবা গাড়ির চাকা ফুটো করে দিতে পারতে, তাহলেই জেন আটকে যেত। কিন্তু তুমি তা করো নি, জেনের চিৎকার শোনার পর তুমি থেমে গিয়েছিলে। এটাই প্রমাণ করে জেনকে আগে চিনতে পারনি। চিনতে পারার পর স্মিয় বেদনায় হতভম্ব হয়ে পড়েছিলে, তোমর থেমে যাওয়ার কারণ ছিল এটাই।’
‘এসব কথা জানে জেন? সত্যিই ্লছ জানে?’
‘দেখ, জেন তোমার আমার চেয়ে অনেক বুদ্ধিমতি।’
‘তোমার কথা সত্য হোক জেনের মা। আজ আমার মনটা খুব হালকা লাগছে। একটা দুঃখের কাল পাথর চেপে ছিল আমার মনে।’
‘তুমি সুস্থ মাথায় ছিলে না, তাই বুঝনি। চল উঠি।’
বলে জেনের মা দু’টি পা নিচে নামাল।
‘তাহলে আজই বিজ্ঞাপনটি দিয়ে দেই?’
‘দাও।’
বিছানা থেকে নামল জেনের মা। জেনের আব্বা জেমেনিজও উঠে দাঁড়াল।
জেনের আম্মার পেছনে পেছনে ঘর থেকে বেরিয়ে এল জেনের আব্বা জেমেনিজ।
যখন সাতদিন পেরিয়ে গেল জেনের তরফ থেকে কোন যোগাযোগ হলোনা, তখন জোয়ান উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল, আহমদ মুসাও।
কথা ছিল, জেন গিয়ে টেলিফোন করবে না, কারন সে বাড়িতে ফেরার পর তাদের টেলিফোন টেপ হতে পারে। কিন্তু অন্য কোনভাবে তার খবরাখবর জোয়ানদের জানাবে। ফিলিপের মায়ের কাছে সে চিঠি লিখতে পারে। তবে চিঠি সে নিজে পোস্ট করবে না, বাড়ীর কাউকে দিয়েও না। কিন্তু সাতদিন পার হয়ে গেলেও জেন কিছুই জানাল না।
অবশেষে উদ্বিগ্ন জোয়ান আহমদ মুসার সাথে পরামর্শ করে আবদুর রহমানকে আজ পাঠিয়েছে হান্নার কাছে। একমাত্র হান্নার কাছ থেকেই জেনের সব খবর নিরাপদে পাওয়া যেতে পারে। আবদুর রহমানকে সরাসরি জেনের বাড়ীতে পাঠানো হয়নি, কারণ সেখানে গিয়ে অপরিচিত কেউ জেনের কথা জিজ্ঞাসা করা উচিত হবে না।
নাস্তার পর আটটার দিকে আবদুর রহমান গেছে হান্নার বাড়ীতে। জোয়ানের চিঠি নিয়ে গেছে সে।
সেই থেকে জোয়ান ফিলিপের ড্রইং রুমে বসে আবদুর রহমানের অপেক্ষা করছে।
জোয়ান ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল বেলা ১১টা। অল্প ক্ষণের মধ্যেই আবদুর রহমান এসে পড়বে। সে কি দেখা পেয়েছে হান্নার? কি খবর আনবে সে? জেন এ পর্যন্ত কোন খবর দিল না কেন? অসুখ বিসুখ করলো নাতো? এসব প্রশ্ন তোলপাড় করছে জোয়ানের মনকে।
বাইরে থেকে এসে আহমদ মুসা প্রবেশ করল ড্রইং রুমে। জোয়ানের পাশে বসতে বসতে বলল, ‘আবদুর রহমান তো এখনো আসেনি দেখছি।’
‘হ্যাঁ, বেশ দেরী করছে, বোধহয় দেখা পায়নি হান্নার।’ বলল জোয়ান।
ঠিক এই সময়ই ড্রইংরুমে এসে প্রবেশ করল আবদুর রহমান। তার মুখটা ভাবলেশহীন।
‘তুমি বহুদিন বাঁচবে আবদুর রহমান, এইমাত্র তোমার নাম করলাম আমরা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দোয়া করুন মুসা ভাই, আমার নবী যতদিন দুনিয়ায় ছিলেন তার বেশী যেন থাকতে না হয়।’ বলল আবদুর রহমান।
‘কি খবর ভাই, হান্নাকে পেয়েছিলেন?’ বলল জোয়ান।
‘প্রথমবার গিয়ে পাইনি, বাড়ী ছিল না। ঘুরেফিরে আবার গিয়েছিলাম, পেয়েছি।’
‘খবর কি?’ বলল জোয়ান।
‘জেন যেদিন গিয়েছিল, সেদিনই হান্নাকে টেলিফোন করেছিল। তারপর আর কোন কথা হয়নি। পরদিন হান্না জেনদের বাসায় যায়, কিন্তু বাসাটা জনশূণ্য এবং তালাবদ্ধ। গেটে দারোয়ানও নেই।’
থামল আবদুর রহমান।
কারো মুখে কোন কথা নেই।
জোয়ানের মুখ মলিন।
আহমদ মুসা গম্ভীর।
আহমদ মুসাই প্রথম কথা বলল, ‘কোথায় গেছে তারা, কোন আত্মীয় বাড়ী, অথবা মাদ্রিদের বাইরে এসব বিষয়ে কোন খবর নিতে পারেনি হান্না?’
‘হান্না বলেছে, তার ধারণা জেনরা কোন আত্মীয় বাড়ী, অথবা মাদ্রিদের বাইরে কোথাও বেড়াতে যায়নি। এমনটা ঘটলে বাড়ীর গেটে দারোয়ান থাকতো।’ বলল আবদুর রহমান।
‘হান্না ঠিক বলেছে। আমার মনে হয় জেনকে নিয়ে তার আব্বা আম্মারা আত্মগোপন করেছে। এ বিষয়টা যাতে জানাজানি না হয়, তাদের নতুন ঠিকানা যাতে প্রকাশ না হয়ে পড়ে, এজন্যেই দারোয়ানকে সরানো হয়েছে। যাতে যোগাযোগের কোন প্রকার ক্লু কেও না পায়। এখন প্রশ্ন হলো, জেনের কি অবস্থা, সে বন্দী না মুক্ত?’ বলল আহমদ মুসা।
‘প্রথমদিন টেলিফোনের পর আর কোন যোগাযোগ করেনি জেন হান্নার সাথে। হান্নার ধারণা, এ ধরনের যোগাযোগের সুযোগ জেনের নেই, তাকে হয়তো এ সুযোগ দেয়া হচ্ছে না।’ বলল আবদুর রহমান।
‘এটাই ঠিক। আসলে জেনের যাওয়া ঠিক হয়নি, যেতে দেয়া ঠিক হয়নি। জেন যে কাজ করেছে তাতে তাকে আটকানোই স্বাভাবিক।’ বলল জোয়ান।
‘ওর মার অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর আমরা তো তাকে বাধা দিতে পারি না। অসুস্থ মায়ের সাথে দেখা করার জন্যে জেনো আগ্রহী হওয়া স্বাভাবিক ছিল। বিজ্ঞাপনটা যে ফাঁদ ছিল জেনও তা মনে করেনি, আমরাও মনে করিনি। ভুলটা এখানেই হয়েছে আমাদের।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বিজ্ঞাপনটা ফাদ ছিল মনে করেন মুসা ভাই?’ বলল জোয়ান।
‘ফাঁদ না হলে এরকমটা ঘটতো না। প্রস্তুতি ছিল বলেই জেন যাওয়ার পর দিনই তারা স্থানান্তর হতে পেরেছে। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছিনা, জেনকে সরালেই তারা পারতো। সবাই সরে গেছে কেন? এর তো কোন প্রয়োজন ছিল না।’
‘মুসা ভাই এমনকি হতে পারে না যে, ওরা বাধ্য হয়েছে সরে যেতে।’ বলল জোয়ান।
‘কার দ্বারা বাধ্য হবে? কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানতো নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
থেমেই আহমদ মুসা আবার শুরু করল, ‘জেন এতবড় ঘটনা ঘটিয়েছে এটা কি স্পেন সরকার জানতে পেরেছে মনে কর জোয়ান?’
‘কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান জানে যখন, সরকারের কানে সেটা যাওয়া সেটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এদিকটা আপনি ভাবছেন কেন মুসা ভাই?’ বলল জোয়ান।
‘সরকারের ভূমিকা একদম বাদ দিয়ে চিন্তা করা আমাদের ঠিক নয়। স্পেন সরকার যে কারণে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ওপর ক্ষেপেছে, সেই একই কারণে জেনের ওপর ক্ষেপতে পারে। কারণ এতবড় বিপর্যয়ের ঘটনা জেনের ডকুমেন্ট পাচারের ফলেই ঘটেছে। সুতরাং কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের চেয়ে জেনকে তারা দায়ী করবে এই ঘটনার জন্যে। তাছাড়া জেন আমাকে, তোমাকে সাহায্য করেছে, আমাদের আশ্রয়ে ছিল এটাও তার অপরাধ।’
‘ঠিক বলেছেন মুসা ভাই। স্পেন সরকার এখন সবচেয়ে বেশী ক্ষ্যাপা আপনার ওপর, আমার ওপর।’ বলল জোয়ান।
‘হান্নাও তাই বলল। সে জানাল, জোয়ানকে খুব সাবধানে থাকতে বলবেন, পারলে মাদ্রিদ কিংবা স্পেনের বাইরে যেন চলে যায়। সরকার জোয়ানকে এবং আহমদ মুসাকে হন্যে হয়ে খুজছে। তাদের মতে এ পর্যন্ত যা ঘটেছে তা আহমদ মুসার পরিকল্পনার ফল।’ বলল আবদুর রহমান।
‘হ্যাঁ বুঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা। তাহলে এখন করনীয় কি আমাদের?’ বলল জোয়ান।
‘প্রথম কাজ জেন কোথায় জানা, দ্বিতীয় কাজ তাকে মুক্ত করা। অন্য কোন কাজ এখন আর আমাদের নেই। স্পেনের মরিস্করা জেগে উঠেছে, সাহস ফিরে পেয়েছে। মুসলিম বিশ্বও তাদের পক্ষে স্পেন সরকারকে চাপ দেবার উপযুক্ত হাতিয়ার পেয়ে গেছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সমাজও স্পেনের মুসলমানদের পক্ষে এগিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে স্পেনের মুসলমানদের নতুন এক শক্তিশালী জাতিতে রূপান্তরিত হবার সুযোগ এনে দিয়েছে। আল হামদুলিল্লাহ! এ সুযোগ কাজে লাগাবার জন্যে যিয়াদ বিন তারিক ও ফিলিপের লোকেরা নিরলসভাবে কাজ করছে। এখন এতবড় কাজ যার সাহায্যে আমরা করলাম, সেই জেনকে উদ্ধার করা আমাদের এক নম্বর দায়িত্ব।’ বলল আহমদ মুসা।
জোয়ানের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে আবদুর রহমানের দিকে চোখ তুলে চাইল। বলল, ‘হান্নার মধ্যে আপনি সহযোগিতার ভাব কেমন দেখেছেন?’
‘খুবই আন্তরিক মনে হয়েছে। দেখলাম, জেনকে সে খুব ভালবাসে, তোমার প্রতিও খুব সহানুভূতিশীল। সে নিজ থেকেই বলেছে জেনকে খুজে বের করার চেষ্টা সে করছে।’ বলল আবদুর রহমান।
‘মুসা ভাই, আমরা যদি হান্নাকে অনুরোধ করি, তাহলে সে এই কাজে আরও তৎপর হতে পারে।’
‘তা আমরা করব। কিন্তু আরও পথ আমাদের বের করতে হবে।’
থামল আহমদ মুসা। তার কপাল কুঞ্চিত, চিন্তা করছে সে। এক সময় বলল, ‘জোয়ান বলতে পার মিঃ জেমেনিজ নিয়মিত যান এমন কোন ক্লাব বা প্রতিষ্ঠান আছে?’
‘নিয়মিত যান বলতে পারবোনা। তবে MEC ক্লাবের সদস্য তিনি এবং সেখানে তিনি যান।’ বলল জোয়ান।
‘MEC এর পুরা নামটা বল।’
‘মাদ্রিদ এলডার্স ক্লাব।’
‘তোমাকে ধন্যবাদ জোয়ান, নামটা প্রমাণ করছে তিনি সেখানে যাবেন, যান। নিশ্চয় ক্লাবটা এলিট মানে উচু তলার লোকদের জন্যে?’
‘ঠিক বলেছেন, টপ পলিটিসিয়ান, টপ আমলা, টপ ব্যবসায়ীদের আড্ডা এটা।’
‘কোথায় এ ক্লাবটা?’
‘স্প্রিং লেকের উত্তর তীরে।’
‘তুমি চেন আবদুর রহমান?’ আবদুর রহমানের দিকে চেয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘ক্লাবে কোন দিন যাইনি, তবে লোকেশনটা জানি।’
‘চল আবদুর রহমান ক্লাবটা থেকে ঘুরে আসি।’
‘এখন তো কাউকে পাবেন না। বিকেল ৫টা থেকে সেখানে অতিথি আসা শুরু হয়।’ বলল জোয়ান।
‘কেন অফিস পাব না? এমন ক্লাবগুলোর অফিস বিভাগটা দিনে সক্রিয় থাকে।’
‘তা পাবেন।’ বলল জোয়ান।
‘না, আবদুর রহমান, তুমি এই মাত্র ঘরে এলে। তুমি রেস্ট নাও, ক্লাবের লোকেশানটা আমি বুঝেছি। আমি বের করে নেব।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
‘না মুসা ভাই, আমি মোটেই ক্লান্ত নই। রেস্ট নেয়ার কোন দরকারই আমার নেই।’ আবদুর রহমান আহমদ মুসার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাল।
জোয়ানও সমর্থন করল আবদুর রহমানকে।
‘ঠিক আছে, আমার আপত্তি নেই।’ বলে আহমদ মুসা তার ঘরের দিকে চলল তৈরী হবার জন্যে।
আবদুর রহমানও উঠে গেল তার ঘরের দিকে।
আহমদ মুসা যখন বেরিয়ে এল দেখা গেল তার মুখে গোঁফ এবং ভ্রু দুটিকে আরোও গভীর করা হয়েছে। এতটুকু ছদ্মবেশেই আহমদ মুসাকে একদম ভিন্ন মানুষ মনে হচ্ছে।
জোয়ান হৈ হৈ করে উঠে বলল, আমিও না জানলে চমকে উঠতাম দেখে।
‘ধন্যবাদ জোয়ান, তাহলে এটুকু ছদ্মবেশে কাজ কিছুটা চলতে পারে, কি বল?’
‘চলবে মানে বেশ চলবে।’
আবদুর রহমান ড্রইং রুমে এলে দুজনে বেরিয়ে এল।
মাদ্রিদ এলডার্স ক্লাবের সামনে গিয়ে যখন আহমদ মুসা ও আবদুর রহমান পৌছল, তখন বেলা ১২টা।
মাদ্রিদ এল্ডার্স ক্লাব ক্লাসিক ডিজাইনের প্রাসাদের মত এক বিশাল বাড়ীতে অবস্থিত। সামনে প্রকাণ্ড ফটক।
ফটক খোলা। মুর্তির মত দুপাশে দুজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে।
ভেতরে প্রবেশের অনুমতি শুধু সদস্যদের জন্যেই।
গাড়ী থেকে নেমে গট গট করে গেটের দিকে চলল আহমদ মুসা। তার পেছনে আবদুর রহমান।
কি পরিচয় দেব আমরা, ঢুকতে দেবে তো? বলল আবদুর রহমান।
আমরা সত্য কথাই বলব। বলল আহমদ মুসা।
গেটে পৌছতেই একজন দারোয়ান এগিয়ে এল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বলল, ‘আমরা জেমেনিজ ডে সিসনারোসার কাছে এসেছি। আমরা তার বন্ধু।’
‘তিনি তো নেই এখন।’ বলল দারোয়ান।
‘আসবেন তিনি। কেন এ সময় তিনি আসেন না?’
‘সাধারণতঃ আসেন না।
‘গতকাল তিনি ক’টায় এসেছিলেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘গতকাল নয়, পরশু এসেছিলেন ৭টায়। তাও কয়েকদিন পর।’
‘কেন নিয়মিত আসেন না?’
‘আসেন। তবে সপ্তাহ খানেক থেকে নিয়মিত নয়।’
‘দারোয়ানদ্বয় গেট থেকে সরে দাঁড়াল।
আহমদ মুসারা প্রবেশ করল ভেতরে।
প্রবেশের পর প্রথমেই বিলাশ রিসেপশন রুম। মূল্যবান সোফায় সাজানো। ঘরের একপাশে রিসেপশন কাউন্টার। কেতাদুরস্ত একজন মহিলা বসে।
সদস্যদের সাথে কেউ দেখা করতে এলে তারা এই রিসেপশনে অপেক্ষা করেন।
আহমদ মুসা রিসেপশনে প্রবেশ করে সোজা চলে গেল কাউন্টারে। বলল, ‘ম্যাডাম আমরা জেমেনিজ ডে সিসনারোসার জন্যে অপেক্ষা করতে চাই, তাঁর আসার কথা আছে।’
আহমদ মুসা এই অভিনয়টা একটা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। আহমদ মুসার টার্গেট জেমেনিজের নতুন ঠিকানা, কমপক্ষে টেলিফোন যোগাড় করা। জেমেনিজের জন্যে বেশ সময় অপেক্ষা করার পর যখন তিনি আসবেন না, তখন কাউন্টারে গিয়ে সাহায্য চাইবে; তাঁর সাথে অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজন, দেখা না করলেই নয়, ঠিকানাটা অথবা টেলিফোন নাম্বারটা দিন অথবা দয়া করে এখনই যোগাযোগ করে দিন। এ ধরণের অনুরোধে রিসেপশনের কাছ থেকে অবশ্যই সহযোগিতা পাওয়া যাবে। যদি নাই পাওয়া যায়, তাহলে রিসেপশনিষ্টের হাতের কাছ সযতনে রাখা ‘মেম্বারস গাইড’ বইটা সে ছিনতাই করবে।
রিসিপশনিষ্ট সসম্ভ্রমে নরম সুরে বলল, ‘আপনারা দয়া করে বসুন। খুব বেশী হলে আধ ঘন্টা আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে। সাড়ে বারটায় অর্থ কমিটির মিটিং আছে। তার আগেই তিনি এসে যাবেন।’
আহমদ মুসা ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এসে বসল সোফায়।
ধন্যবাদ জানাল বটে হাসিমুখে, কিন্তু ভেতরে চাঞ্চল্য অনুভব করল আহমদ মুসা। এযে চাওয়ার চেয়ে বেশী পাওয়া। এই পাওয়াটা কি ভাল হবে? তারা তো জেমেনিজের সাথে দেখা করতে আসেনি, এসেছে তার ঠিকানা যোগাড় করতে।
আবদুর রহমানের চোখে আশংকার ছাপ। চুপ করে থাকতে পারলনা। বলল, ‘যদি এসে পড়েন, তাহলে কি হবে। আমাদের মিথ্যা কথা ধরা পড়ে যাবে? আর কি পরিচয় দেব আমরা?’
‘তুমি নিশ্চিন্তে বস আবদুর রহমান। আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে তো আমরা যেতে পারবো না। ভেবনা, অনেক সময় আল্লাহ তার বান্দাকে চাওয়ার চেয়ে বেশী দিয়ে ফেলেন।’ হাসি মুখে বলল আহমদ মুসা। তার নিশ্চিত মুখ। প্রথমটায় যে একটা চাঞ্চল্য এসেছিল তা কেটে গেছে।
আহমদ মুসার নিশ্চিত মুখ দেখে আবদুর রহমান আশ্ব্স্ত হলো। কিন্তু তার মনে খোঁচার মত বিধেই চলল কথাটা যে, জেমেনিজের কাছে তারা তাদের কি পরিচয় দেবে আর কি কথাই বা তারা বলবে তাঁকে।
আহমদ মুসা ও আবদুর রহমান দু’জনই ষ্ট্যান্ড থেকে ম্যাগাজিন নিয়ে তাতে চোখ বুলাচ্ছিল।
সময়টা যেন খুব তাড়াতাড়িই চলে গেল।
তখন ঠিক ১২টা ২০ মিনিটি।
একজন দীর্ঘদেহী প্রৌঢ় ব্যক্তি প্রবেশ করল রিসেপশন রুমে। সুন্দর-সুগঠিত দেহ। সাদা লালে মেশানো সুন্দর চেহারা।
সে প্রবেশ করতেই রিসেপমনিষ্ট উঠে দাঁড়াল।
রিসেপশনের পাশ দিয়ে ভদ্র লোক চলে যাচ্ছিল। রিসেপশনিষ্ট তাকে কিছু বলল।
ভদ্রলোক ফিরে তাকাল আহমদ মুসাদের দিকে। তার চোখে একটা তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফুঠে উঠল। তারপর সে রিসেপশনিষ্টের দিকে ফিরে কি বলে ভেতরে চলে গেল।
রিসেপশনিষ্ট আহমদ মুসাদের কাছে এল। বলল, ‘চলুন স্যার। তাঁর রুমে যেতে বলেছেন।’
আহমদ মুসারা উঠল।
‘রিসেপশনিষ্ট একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, এই ঘর, যান আপনারা।’ বলে চলে গেল রিসেপশনিষ্ট।
বন্ধ দরজার নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে প্রবেশ করল আহমদ মুসারা।
একটা ফাইলের ওপর ঝুঁকে পড়ে ছিল জেমেনিজ ডে সিসনারোসা, আমার সাথে কথা বলতে চান আপনারা?
‘জি হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি কি আপনাদের চিনি?’
‘আমরা জোয়ানের বন্ধু, জেনের শুভাকাঙ্খী।’
জেমেনিজ আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে ছিল। আহমদ মুসার মুখ থেকে কথা বেরুবার সংগে সংগে জেমেনিজের মুখের ওপর দিয়ে একটা পরিবর্তনের স্রোত বয়ে গেল। তার চোখে মুখে কঠোরতার চেয়ে বিষ্ময়ের ভাবটাই এখন বেশী। কিছক্ষণ এভাবে চেয়ে থাকার পর বলল, ‘তোমরা জোয়ানের বন্ধু, তোমরা এখানে! তোমরা জাননা কিছু?’
‘জানি, কিন্তু খুব জরুরী প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি প্রয়োজন?’
‘জেনের কোন সংবাদ জোয়ান পাচ্ছে না।’
‘আমার মেয়ে আমার কাছে ফিরে এসেছে। আর কি সংবাদ তার চাই?’
‘কিন্তু আমরা মনে করছি জেনকে আটক করা হয়েছে।’
‘চোখে মুখে একটা বিমর্ষের ছায়া নামল জেমেনিজের। অল্পক্ষণ একদৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আটক হলে সেটাই কি স্বাভাবিক হবে না?
‘আপনাদের দিক থেকে স্বাভাবিক।’
‘তোমাদের দিক থেকে?’
‘অন্যায়।’
‘আচ্ছা সে কথা যাক, এসেছ কেন?’
‘জেনের খবরটা জানতে।’
‘বেশ জেনে গেছ।’
‘একটু বাকি আছে, আপনার ঠিকানাটা।’
‘ঠিকানা কেন দরকার?’
‘জেনের সাথে আমরা দেখা করব।’
‘এত সাহস তোমাদের? জান সেখানে পুলিশ পাহারা আছে?
‘জানি।’
‘জানার পরও তার সাথে দেখা করতে যেতে চাচ্ছ?’
‘আমাদের আর তো কোন বিকল্প পথ নেই।’
‘কেন আমার সাহায্য তো চাইলেনা? সোজা চাইলে আমার বাড়ীর ঠিকানা।’
‘কোন সাহায্য আপনি করতে পারবেন না। আপনার মেয়ে আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বন্দী আছে।’
‘অপার বিষ্ময় ফুটে উঠল জেমেনিজের চোখে মুখে। বলল, ‘জানলে কি করে?’
‘আপনার সাথে এতক্ষণ ‘আলোচনার মাধ্যমে।’ আপনার হাতে আপনার মেয়ে বন্দী থাকলে আপনার গোটা আচরণ ভিন্ন রকম হতো।’
‘বিষ্ময় ভরা চোখে জেমেনিজ বলল, ‘আমার কথা শুনে, আমাকে দেখে তোমাদের আর কি মনে হচ্ছে?’
‘আপনি অসহায় অবস্থায় আছেন, আপনি কারো সাহায্য চান।’
‘বিষ্ময়ে বিষ্ফোরিত হয়ে গেল জেমেনিজের চোখ। বলল, ‘এটা বুঝলে তোমরা কেমন করে?’
‘বিনা জিজ্ঞাসাবাদে অপরিচিত দু’জন লোকের সাথে এই ধরণের সাক্ষাতে আপনার রাজী হওয়া থেকে।’
‘আমাকে তুমি হতবাক করেছ বৎস। কে তুমি! জোয়ানের বন্ধু মহলে এমন অসাধারণ কেউ আছে বলে তো জানি না। তোমার নাম কি বৎস্য?’
আমি আহমদ মুসা। আর এ আবদুর রহমান।
‘কি বললে তোমার মানে, আপনার নাম আহমদ মুসা!’ বিষ্ময়াভিভূত কণ্ঠে কাঁপা গলায় বলল জেমেনিজ।
বলে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ঠিক, এই দুঃসাহস, এই অসাধারণ বুদ্ধি আহমদ মুসারই হবে। কিন্তু এ আপনার ঠিক হয়নি। আপনি যান। আমার সাথে গোয়েন্দা এসেছে। গেটের সামনে তারা দাড়িয়ে আছে, কেমন করে যাবেন? আপনি জানেন না গোটা মাদ্রিদে, গোটা ষ্পেনে সেনা, পুলিশ, গোয়েন্দা মাছির মত ছড়িয়ে পড়েছে আপনাকে খুঁজে বের করার জন্যে। আপনি যান। অস্থির কণ্ঠ জেমেনিজের।
‘আমরা যাচ্ছি। আমাদের জন্যে আপনার কোন ক্ষতি হোক তা আমরা চাই না। কেউ জানতেই পারবে না আমরা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। কিন্তু ঠিকানাটা?’
‘জেমেনিজ খস খস করে একটা কাগজে লিখে আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বরল, ‘ঠিকানা দিলাম। কিন্তু জেনের সাথে দেখা করতে আপনারা পারবেন না, সে বন্দী আছে। আমরাও আপনাদের কোন সাহায্য করতে পারবো না তাও আপনারা জানেন।’
‘দয়া করে একটা কথা জেনকে বলবেন, তার কোন চিন্তা নেই। জোয়ান ভাল আছে। বলল আহমদ মুসা।
‘সত্যি জেনের চিন্তার কিছু নেই।’ চোখ উজ্জ্বল করে বলল জেনেনিজ।
‘হ্যাঁ জনাব।’
‘কিন্তু আপনারা ভাবছেন কি জেন জোয়ানের কি হবে? গোটা দেশ তাদের বিরুদ্ধে।’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ জেমেনিজের।
‘আমি এটুকু বলতে পারি, আল্লাহর চেয়ে বড় কোন শক্তি নেই’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার কথায় আমার আস্থা আছে বৎস।’
‘তাহলে চলি জনাব।’
বলে আহমদ মুসা ও আবদুর রহমান পা বাড়াল বেরুবার জন্যে জেমেনিজের কক্ষ থেকে।
‘কিন্তু আপনারা যাবেন কি করে? গেটে তো গোয়েন্দা পুলিশ।’ ব্যাকুল কন্ঠ জেমেনিজের।
‘কোন অসুবিধা নেই, আমরা ওদের বলব মিঃ জেমেনিজ বাড়ী বদলেছেন। আমাদের কিছু লেন দেন ছিল তার সাথে। আমরা ব্যবসায়ী।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
ঘর থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসারা। হাঁটতে হাঁটতে বলল আহমদ মুসা, ‘মেয়েকে আটকে রাখায় তার আত্মসম্মানে যেমন ঘা লেগেছে, তেমন মনের দিক থেকেও খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন মিঃ জেমেনিজ। এ ধরণের পরিস্থিতি তার জন্যে একেবারেই নতুন।’
‘জেনকে আটক করল কেন?’ বলল আবদুর রহমান।
‘তার মুখ থেকে কথা বের করার জন্যে। জেন তো আমাদের অনেক কিছুই জানে। তাছাড়া তারা মনে করছে, তাকে আটকে রাখলে জোয়ানকে, তার সাথে আহমদ মুসাকেও হয়তো হাজির করতে পারবে।’
‘এ পরিবারটি স্পেনে অত্যন্ত পপুলার, তাদের এ খবর প্রচার হলে সরকারের অসুবিধা হবে।’
‘অসুবিধা নেই। তারা বলবে পরিবারটির নিরাপত্তার জন্যেই এটা করেছে। শুধু মেয়েটিকেই তারা বেরুতে দিচ্ছে না, অন্য কারো উপর নিয়ন্ত্রণ নেই।’
ফটক দিয়ে বেরিয়ে আহমদ মুসা দেখল, ফটকের ডানপাশে দুজন লোকের সাথে দারোয়ান কথা বলছে। আহমদ মুসা বুঝল, এরা সেই দুই টিকটিকি।
গেটের বামপাশে ছিল আহমদ মুসাদের গাড়ী। ফটক থেকে বেরিয়ে আহমদ মুসা গাড়ীর দিকে চলল।
গাড়ীতে উঠে বসল, এমন সময় টিকটিকি দু’জন গাড়ীর জানালায় দাড়াল। একজন আহমদ মুসা কে লক্ষ্য করে বলল, মাফ করবেন, আপনাদের পরিচয়টা দয়া করে বলবেন?’
‘আমরা ব্যবসায়ী। জেমেনিজের সাথে একটা লেনদেন ছিল। হঠাৎ সে বাড়ী বদল করেছে। নতুন বাড়ী আমরা চিনিনা। এখানেই উনি আসতে বলেছিলেন।’
কথা বলতে বলতেই গাড়ী স্টার্ট দিয়েছিল আহমদ মুসা। কথা শেষ হবার সাথে সাথে সাঁ করে বেরিয়ে গেল গাড়ী।
টিকটিকি দু’জন বাধা দিল না। বোধ হয় উত্তর তারা পেয়ে গিয়েছিল।
গাড়ীটা সদর রাস্তায় পড়লে স্পিডটা আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আবদুর রহমান এখন কি করা যায় বল, ঠিকানাটা তো পাওয়া গেল।’
‘মুসা ভাই ব্যাপারটা আমার কাছে এখনও স্বপ্নের মতই মনে হচ্ছে। কার্ডিনাল পরিবারের বিখ্যাত জেমেনিজ ডে সিসনারোসা আমাদেরকে এই ভাবে সাহায্য করলেন?’
‘বললাম তো তোমাকে, মেয়ে গৃহবন্দী হওয়ায় ক্রুদ্ধ হয়েছে জেমেনিজ। কারডিনাল পরিবার বলেই তাদের বংশীয় অহমিকা আকাশস্পর্শী। জেনকে গৃহবন্দী করায় সে অহমিকা বোধে ঘা লেগেছে। মনে হয় বাড়ী পরিবর্তনও জেমেনিজের মতানুসারে হয়নি। তার ওপর জেন তাদের একমাত্র মেয়ে। একমাত্র মেয়ের পছন্দে বাধ সেধে তাকে কষ্ট দিতে চায় না। গুলিবিদ্ধ হয়ে জেন যখন ডকুমেন্ট চুরি করে চলে আসে, মনে হয় তখনি তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, জেন যখন ফিরবেনা, তখন জোয়ানের সাথেই তার বিয়ে হোক। এসব কারণ একত্রিত হয়ে জেমেনিজকে মেয়ের পক্ষ নিতে বাধ্য করেছে।’
‘আপনার কি মনে হয় মুসা ভাই, কথা আদায়ের জন্যে জেনকে কি তারা কোন কষ্ট দিচ্ছে?’
‘আমার মনে হয়না। সেরকম হলে মিঃ জেমেনিজ সেটা আমাদের বলতেন, এমনকি সাহায্যও চাইতেন।’
একটু থেমে আহমদ মুসাই আবার বলল, ‘ঠিকানা আমরা পেয়েছি, এখন কি করা যায় বলত? এদিকে ফিলিপ যিয়াদরা মাদ্রিদে নেই।’
‘কখন কি ঘটে যায়। আমি মনে করি, সময় ক্ষেপন ঠিক নয়, জেনকে মুক্ত করার কাজে আমরা এগুতে পারি।’
‘তোমার কথা ঠিক। তবে আমরা এগুবার আগে ঠিকানা সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ খবর নেবার মত সময় আমাদের নেয়া প্রয়োজন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এটুকু সময় আমাদের অবশ্যই নেয়া প্রয়োজন।’ বলল আবদুর রহমান।
আহমদ মুসা কোন কথা বললনা। তার দৃষ্টি তখন সামনে প্রসারিত।
ছুটে চলছে গাড়ী তীর বেগে।
রাত দশটা।
পার্ল স্ট্রিটের বাইলেনের মুখে একটা জীপ এবং একটা কার এসে থামল।
গাড়ীদুটো থামতেই জীপ থেকে লাফ দিয়ে নামল যিয়াদ, ফিলিপ এবং আরও দুজন। ড্রাইভার গাড়ীতেই থাকল। যিয়াদ ও ফিলিপ এসে কারের সামনে জানালার কাছে দাঁড়ালো।
কারের ড্রাইভিং সিটে আবদুর রহমান। তার পাশের সিটে আহমদ মুসা। পেছনের সিটে জোয়ান।
যিয়াদ ও ফিলিপ জানালার কাছে দাঁড়াতেই আহমদ মুসা মুখ বের করে বলল তোমরা চলে যাও। ঠিক ১০ মিনিট পর আমি সামনের গেট দিয়ে ঢুকব।
পার্ল স্ট্রিটের এ বাইলেন দিয়ে ১৫ গজ ভেতরে গেলে হাতের ডান পাশে একটা গেট। এই বাড়ীতেই এনে রাখা হয়েছে জেমেনিজদের। আগে এটা জনৈক মন্ত্রীর বাড়ী ছিল। তাকে আরেকটা বাড়ীতে পার করে জেমেনিজকে দেয়া হয়েছে এ বাড়ী।
পার্ল স্ট্রিট মন্ত্রীদের পাড়া। রাস্তার দু’পাশে প্রধানত মন্ত্রীদের বাড়ী। প্রাইভেট বাড়ী আছে, ফ্ল্যাট বাড়ীও আছে। তবে তাদের সংখ্যা কম। এলাকাটা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বলেই জেমেনিজকে এখানে এনে রাখা হয়েছে। সরকারের ভয়, জেনকে আটকাবার পর জেমেনিজ এবং কার্ডিনাল পরিবার আহমদ মুসার রোষদৃষ্টিতে পড়বে।
আহমদ মুসারা গত তিনদিন ধরে জেমেনিজের বাড়ীর উপর চোখ রাখছে। রাতে বাড়ীর এলাকায় ঢুকে নিরাপত্তা ব্যবস্থার খোঁজ নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বিশাল এলাকা নিয়ে বাড়ী। চারদিক দিয়ে প্রাচীর ঘেরা। প্রাচীরের ভেতরে বাগানের মত প্রচুর গাছ। ঠিক মাঝখানে বাড়ী। বাড়ীটি দ্বিতল।
বাড়ীর গেটে স্টেনগানধারী দু’জন প্রহরী। স্টেনগানধারী আরও দু’জন প্রহরী টর্চ নিয়ে বাড়ীর চারদিকের বাগানে ঘুরে বেড়ায়। বাড়ীর গ্রাউন্ড ফ্লোরের রিসেপশন রুমে আরও ছয়জন পুলিশ সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকে। যাতে সংকেত পেলেই যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে ছুটে যেতে পারে।
আহমদ মুসা ভেতরের প্রহরীদের দায়িত্ব দিয়েছে যিয়াদ, ফিলিপ ও তাদের দলকে। প্রাচীর টপকে বাড়ীর ভেতর প্রবেশ করে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবে। তারা ভেতরে ঢোকার ১০ মিনিট পর আহমদ মুসা প্রধান গেট দিয়ে বাড়ীতে ঢুকবে। গেটে দু’জন পুলিশের দায়িত্ব তার।
যিয়াদ ও ফিলিপরা চলে যাবার ঠিক ১০ মিনিট পর আহমদ মুসা আবদুর রহমানকে ইশারা করলেন ঢোকার জন্যে। জীপের ড্রাইভারকে বলল আরও কিছু পরে গেটে আসতে।
লেনের বাপ পাশ দিয়ে দীর্ঘ প্রাচীর। একটা বাড়ীর পেছন দিক এটা। তাই এ প্রাচীরে কোন গেট নেই।ডান পাশ দিয়েও প্রাচীর। এ প্রাচীর জেমেনিজের বাড়ীর। এ লেন দিয়ে গজ পনের এগুলেই এই প্রাচীরের সাথেই জেমেনিজের বাড়ীর গেট।
গেটের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছল আহমদ মুসার গাড়ী। দেখা গেল, গেটের দু’জন পুলিশ গেটের দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গেট খোলা।
আহমদ মুসা আবদুর রহমানকে গাড়ী ঠিক গেটের উপর নিয়ে দাঁড় করাতে বলল।
গাড়ী গিয়ে দাঁড়াল ঠিক গেটের ওপরই।
গাড়ী দাঁড়াতেই দু’দিক থেকে দু’জন পুলিশ ছুটে এল। দু’জনেই এল জানালার কাছে। একটু বাঁকা হয়ে জানালা দিয়ে ভেতরে চোখ ফেলতে চেষ্টা করল ভেতরের মানুষকে দেখার জন্যে। তাদের দু’জনের হাতেই স্টেনগান বাগিয়ে ধরা।
গাড়ী গেটে দাঁড়াবার সংগে সংগেই আহমদ মুসা ও আবদুর রহমান গাড়ীর দরজা খুলে শক্ত হাতে দরজার হুক ধরে বসেছিল। দু’জন পুলিশ যেই বাঁকা হয়ে জানালা দিয়ে ভেতরে চোখ বুলাতে গেছে, অমনি আহমদ মুসা ও আবদুর রহমান একই সাথে প্রচন্ড বেগে দরজা সামনে ঠেলে দিল। ছিটকে পড়ে গেল পুলিশ দু’জন।
আহমদ মুসা ও আবদুর রহমান বেরিয়ে এল দ্রুত গাড়ী থেকে। পুলিশ দু’জন উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল। ওদের হাতে স্টেনগান নেই, ছিটকে পড়ে গেছে।
ওদের উঠে দাঁড়াতে দিল না আহমদ মুসা ও আবদুর রহমান। কারাতের মারাত্মক ছোবল তাদের ঘুম পাড়িয়ে দিল।
ঠিক এই সময়েই বড় রাস্তার দিক থেকে দু’টি মটর সাইকেলের আওয়াজ পাওয়া গেল।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি জোয়ানকে গাড়িটা গাড়ি বারান্দায় নিতে ইশারা করে সংজ্ঞাহীন একজন পুলিশকে টেনে গেটের পাশে একটু আড়ালে নিয়ে গেল।
কিন্তু আবদুর রহমান সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করে ফেলেছিল। জোয়ান গাড়ী নিয়ে চলে যাবার পর আবদুর রহমান যখন দেখল আহমদ মুসা সংজ্ঞাহীন পুলিশটিকে সরিয়ে ফেলেছে, তখন আবদুর রহমানও অপর পুলিশটিকে সরাতে গেল। কিন্তু দেরী হয়ে গেছে তখন। ছুটে আসা মটর সাইকেল একেবারে কাছে এসে পড়েছে। ফলে সে যে একজন সংজ্ঞাহীন পুলিশকে সরিয়ে ফেলছে তা ধরা পড়ে গেল।
আবদুর রহমান সংজ্ঞাহীন পুলিশকে ছেড়ে দিয়ে তার রিভলবার বের করতে গেল। কিন্তু মটর সাইকেল আরোহীদের চারটা রিভলবার তখন তার দিকে তাক করা। মটর সাইকেল আরোহীদের থেকে একজন ভারী কন্ঠে বলল, পকেট থেকে খালি হাত বের করে নাও। না হলে মাথা গুড়ো হয়ে যাবে।
আবদুর রহমান পকেট থেকে হাত বের করে নিল।
গেটে এসে চারজন মটর সাইকেল থেকে নামল। মনে হল চারজনই পুলিশের অফিসার র্যাংকের লোক। নেমেই একজন বলল, গেটের আরেকজন পুলিশ কোথায়?’
সম্ভবত আরেকজন পুলিশকে খোঁজার জন্য দু’জন এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। আর দু’জন এগুলো আবদুর রহমানের দিকে।
আহমদ মুসা দেখল, যারা দ্বিতীয়জন পুলিশকে খুঁজছে, তাদের দৃষ্টি গেটের এদিকে। ওরা এক্ষুনি এদিকে আসবে।
আহমদ মুসা আর দেরী করা সমীচিন মনে করল না। তার হাতে তখন দ্বিতীয় পুলিশটির স্টেনগান।
স্টেনগান বাগিয়ে বেরিয়ে এল সে আড়াল থেকে। যে দু’জন পুলিশ অফিসার এদিকে আসার জন্যে ফিরে দাঁড়িয়েছিল, তারা ভূত দেখার মত চমকে উঠল।
আহমদ মুসা গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘রিভলবার ফেলে দাও।’
আহমদ মুসার কন্ঠে যারা আবদুর রহমান দিকে এগুচ্ছিল তারা চমকে ফিরে তাকাল।
আর সেই সুযোগে আবদুর রহমান বের করে নিল তার রিভলবার।
দু’জন পুলিশ অফিসার তাদের পিস্তল আগেই ফেলে দিয়েছিল। আবদুর রহমান অবশিষ্ট দু’জনের হাত থেকে কেড়ে নিল রিভলবার।
‘আবদুর রহমান ওদের মটর সাইকেলের ইমারজেন্সী কীট থেকে হ্যান্ডকাফ গুলো বের করে পিছমোড়া করে ওদের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দাও।’ নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
আবদুর রহমান এগিয়ে গেল হ্যান্ডকাফ আনার জন্যে।
এই সময় যিয়াদ ছুটে এল সেখানে।
‘ওদিকের কাজ শেষ?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘জি হ্যাঁ।’ বলল যিয়াদ।
‘যে টুকু বাকি আছে, বড় ভাই (ফিলিপ) তা সারছেন। এদিকে এই দৃশ্য দেখে আমি ছুঠে এলাম।’ কথা শেষ করল যিয়াদ।
আবদুর রহমান ও জোয়ান দু’জনে মিলে চার পুলিশ অফিসারকে পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিল। তারপর তাদের পা বেধে, মুখে রুমাল গুজে গেটের পাশে গাছপালার আড়ালে ঠেলে দিল।
গেটের ব্যবস্থাটা শেষ করে চলে এল আহমদ মুসা গ্রাউন্ড ফ্লোরের রিসেপশনে। দেখল ওখানকার ৬ জন পুলিশকে হাত-পা বেধে ফেলে রাখা হয়েছে।
‘বাগানের দু’জন প্রহরীকেও হাত-পা-মুখ বেধে ফেলে রেখে এসেছি।’ বলল ফিলিপ।
‘ফিলিপ তুমি ও যিয়াদ অন্য ভাইদের নিয়ে থাক। আমি, আবদুর রহমান ও জোয়ান ওপরে দেখছি।’ বলে আহমদ মুসা দোতালা ওঠার সিড়িঁর দিকে এগুলো। তার পেছনে আবদুর রহমান এবং জোয়ান।
দুতালার সিঁড়ি গিয়ে শেষ হয়েছে দুতালার ড্রইং রম্নমে।
দুতালার ড্রইংরুমে পা দিতেই সামনে পড়ল একজন পরিচারিকা।
রিভলবার হাতে আহমদ মুসাদের দেখে ভয়ে পাথর হয়ে গেল পরিচারিকাটি। তার হাতে একটা চায়ের কাপ ছিল, পড়ে গেল।
‘জেন কোথায়, কোন ঘরে?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
পরিচারিকার মুখে কথা সরলনা। আঙুল দিয়ে একদিকে ইংগিত করল।
‘চল দেখিয়ে দাও।’ বলে পরিচারিকাকে চলার ইংগিত করল আহমদ মুসা।
আগে আগে চলল পরিচারিকা। সে কাপঁছে। তার পেছনে আহমদ মুসা ও অন্যান্যরা।
‘ভয় করছ কেন, আমরা জেনের ভাই।’ একটু থেমেই আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘জেনের আব্বা আম্মা কোথায়?’
‘জেনকে একজন পুলিশ অফিসার জিজ্ঞাসাবাদ করছে, তারা সেখানেই বসে আছেন।’
পরিচারিকার কথা শেষ না হতেই সামনের একটা দরজা দিয়ে একজন পুলিশ অফিসারকে বেরুতে দেখল। কিন্তু রিভলভার হাতে আহমদ মুসাদের ওপর চোখ পড়তেই ঝট্ করে সে আবার ভেতরে ঢুকে গেল।
কিন্তু ঘরের ভেতরে ঢুকে সামনের দিকে তাকাতেই আহমদ মুসাকে থমকে দাঁড়াতে হলো। দেখল, পুলিশ অফিসারটি জেনের পেছনে দাঁড়িয়ে তার মাথায় পিস্তল ঠেসে ধরে আছে।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াতেই পুলিশ অফিসারটি বলল, ‘তোমরা দরজা ছেড়ে দিয়ে এই মুহূর্তে সরে যাও, না হলে জেনকে হত্যা করব আমি।’
আহমদ মুসার পা আর নড়ল না। তার রিভলবারের নল পুলিশ অফিসারের দিক তাক করা, কিন্তু জেনের পেছনে পুলিশ অফিসার।
জেনের আব্বা-আম্মা বসেছিল। তারা উঠে দাঁড়িয়েছে। তাদের মুখ ফ্যাকাসে। কাঁপছে তারা।
‘তিন পর্যন্ত গুনব এর মধ্যে যদি তোমরা সবাই ঘরে ঢুকে দরজা ছেড়ে না দাও তাহলে জেনকে হত্যা করব আমি।’ চিৎকার করে বলল পুলিশ অফিসারটি।
আহমদ মুসারা ঘরের এক পাশে সরে গেল দরজা থেকে।
পুলিশ অফিসারটি জেনকে সামনে নিয়ে দেয়ালের ধার ঘেঁষে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। তার সাথে বেরিয়ে গেল আহমদ মুসাও।
জেনকে সামনে রেখে তার আড়ালে দাঁড়িয়ে এক পা এক পা করে পিছু হটছিল পুলিশ অফিসার।
সিঁড়ির মুখে গিয়ে পুলিশ অফিসার আবার চিৎকার করে বলল, ‘তোমরা আর এক পাও এগুতে পারবে না, যদি বাঁচিয়ে রাখতে চাও জেনকে।’
পুলিশ অফিসারের এই চিৎকারে খুশী হলো আহমদ মুসা। সিঁড়ি গোড়ায় বসে আছে যিয়াদ ও ফিলিপরা। নিশ্চয় তারা শুনতে পেয়েছে পুলিশ অফিসারের এ বাজখাই কন্ঠ।
তাই হল।
অপরিচিত একটা বাজখাই কন্ঠ নিচে ফিলিপদের কানে যাওয়ার সাথে সাথে তারা উৎকর্ণ হয়ে উঠে দাঁড়াল। তাদের চোখে মুখে কিছুটা উদ্বেগ নেমে এল। কিছু একটা বিপত্তি ঘটেছে ওপরে।
‘যিয়াদ তুমি বস আমি ওপরে দেখি।’ বলে ফিলিপ রিভলবার বাগিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বিড়ালের মত নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। সিঁড়ির দ্বিতীয় বাঁকে গিয়ে ওপরে চোখ ফেলতেই গোটা ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, সেই সাথে সে শিউরে উঠল। সেও যদি ঐ শয়তানের কাছে ধরা পড়ে যায়, তাহলে তাকে রিভলবার ফেলে দিতে হবে, জেনকে বাঁচাবার জন্যে। সুতরাং শয়তানটার চোখে পড়ার আগেই তাকে কাজ সারতে হবে।
চিন্তার সংগে সংগেই ফিলিপ তার রিভলবারটি তুলে নিল।
পুলিশ অফিসারটি তখন সিঁড়ির দু’ধাপ নেমে এসেছে।
ফিলিপ ধীরে সুস্থে ঠিক মাথার পেছনটা লক্ষ্য করে রিভলবারের ট্রিগার টিপল।
কোন শব্দও বেরুলনা পুলিশ অফিসারের কন্ঠ থেকে। গড়িয়ে পড়ল সিঁড়ি দিয়ে।
আহমদ মুসা তার রিভলবার পকেটে পুরল। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল আবদুর রহমান। আর পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল জেনের আব্বা-আম্মা এবং তাদের সাথে জোয়ান।
পুলিশ অফিসার গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাবার সংগে সংগেই জেন ছুটে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরল।
সিঁড়ির বাঁকে এসে আটকে যাওয়া পুলিশ অফিসারের লাশের দিকে একবার চেয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠে এল ফিলিপ।
‘ধন্যবাদ ফিলিপ, তুমি সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করনি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কোন অসুবিধা হয়নি তো মুসা ভাই?’
‘ঐ টুকুই, আর কিছু নয়।’ বলে আহমদ মুসা পেছন ফিরে জেনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জেন তুমি নিচে যাও, জোয়ান তুমিও যাও।’
জেন তার আম্মাকে জড়িয়ে ধরে ছিল। আম্মাকে ছেড়ে দিয়ে জেন সোজা হয়ে দাঁড়াল। একবার আহমদ মুসা, আরেক বার তার আম্মা-আব্বার দিকে তাকাল। বিমূঢ় সে।
‘জেন আমরা কিন্তু সময় বেশী পাব না।’
‘যাচ্ছি ভাইয়া। আব্বা-আম্মার কি হবে?’
‘ওঁদেরকে একটা ষ্টোরে আটকে রেখে যাব, যাতে আমরা চলে যাবার আগে ওঁরা পুলিশকে খবর দেয়ার সুযোগ না পান।’
বলেই আহমদ মুসা তার রিভলবার উঁচিয়ে জেমেনিজকে বলল, ‘আপনাদের স্টোর রুমে নিশ্চয় টেলিফোন নেই, ওখানেই আপনাদের আটকে রাখতে চাই।’
বলে আহমদ মুসা তিন জন পরিচারিকা সহ জেমেনিজকে নির্দেশ দিল ষ্টোর রুমের দিকে হাঁটার জন্যে।
জেমেনিজ ও জেনের মা একবার আহমদ মুসার কঠোর মুখের দিকে, আরেকবার জেনের দিকে দিকে চেয়ে ভয় ও অপমান পীড়িত চেহারা দিয়ে ষ্টোরের দিকে হাঁটতে লাগল।
জেন, জোয়ান, আবদুর রহমান এবং ফিলিপ সকলেরই বিব্রতকর চেহারা। তাদের সকলের মুখেই বিমূঢ় ভাব।
আহমদ মুসা জেনের আব্বা-আম্মা ও তিনজন পরিচারিকাকে ষ্টোর রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনি তুলে দিল।
ফিরে এল আহমদ মুসা ড্রইং রুমে। বলল, ‘চল।’
তখনও সকলের চোখে-মুখে বিমূঢ় ভাব। জেনের আব্বা-আম্মার সাথে আহমদ মুসার এই রূঢ় আচরণের কোন ব্যাখ্যা তারা খুঁজে পাচ্ছে না। জিজ্ঞাসা করারও সাহস নেই।
জেন প্রথমে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। তারপর জোয়ান।
সকলেই নেমে এল গাড়ী বারান্দায়।
কারের পাশে জীপও এসে দাঁড়িয়েছিল।
কারের ড্রাইভিং সিটে বসল আবদুর রহমান। সামনের সিটে আহমদ মুসা। তার পাশে জোয়ান। পেছনের সিটে জেন একা।
অবশিষ্টরা সবাই জীপে।
গাড়ী দু’টো বেরিয়ে এল পার্ল ষ্ট্রীটে।
ফিলিপের বাড়ীর গাড়ী বারান্দায় যখন তারা সবাই নামল গাড়ী থেকে, তখন রাত ১২টা।
গাড়ী থেকে নেমে সবাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাড়ীতে প্রবেশের জন্যে।
আহমদ মুসার পাশেই ছিল ফিলিপ। আহমদ মুসা সামনে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘মাফ করবেন মুসা ভাই, আমার আর তর সইছেনা। আমার একটা প্রশ্ন, আমার কেন সবারই প্রশ্ন জেনের আব্বা-আম্মার সাথে এই আচারণ না করলে কি হতো না, তাদেরকে স্টোর রুমে আটকে না আসলে হতো না ?’
‘কি করতে হতো তোমাদের মতে?’ একটু হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘তাদেরকে আটকে রাখার দরকার ছিল না। ওদের সাথে ভাল করে কথা বলে আসতে পারতাম।’
‘মন্দ হতো না, আগামী কালই ওরা গ্রেফতার হতেন। ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হতো, আমাদের সাথে গোপনে যোগাযোগ করে ওরা জেনকে পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং একজন পুলিশ অফিসারকে হত্যা করিয়েছেন। এটাই কি ভাল হতো?’
‘ওদের সাথে আমাদের এই ব্যবহার ওরা জানত কি করে?’
‘একজন পুলিশ কে আমরা মারলাম, অন্যদের মেরে সংজ্ঞাহীন করলাম, কাউকে বেঁধে রাখলাম, আর ওদের কিছুই হল না, ওদের গায়ে আঁচড় ও লাগল না একে স্বাভাবিক বলে ওরা মেনে নিত না।’
‘ঠিক আছে, ওদের আটকেই রেখে আসতাম, কিন্তু ভাল করে কথা বলে আসা যেত না? শত্রুর সাথে যে আচরণ, সেই আচরণ আমরা ওদের সাথে করে এসেছি।’ বলল ফিলিপ।
‘তোমাদের এই ভাল আচরণ এবং আলাপ, কথা বার্তা পুলিশ এবং সরকারের কাছে গোপন থাকতো না।’
‘কি করে? কেউ তো দেখতে পেতনা। পুলিশ যারা সজ্ঞানে ছিল তারা তো সবাই নিচে।’
‘নিশ্চয় জেনে রেখ, এই ঘটনা নিয়ে ঐ তিনজন পরিচারেকা কে পুলিশ অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করবে। পরিচারিকাদের কাছে থেকেই সব কিছু বেরিয়ে যেত।’
ফিলিপ কোন কথা বলল না। তার মুখে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জেন, জোয়ান সকলের মুখেই তখন হাসি।
‘ভাইয়া আমাকে মাফ করবেন, এতক্ষন মনে যেমন কষ্ট পেয়েছি, তেমনি আপনার উপর হয়ে উঠেছিলাম ক্ষুব্ধ, এখন বুঝতে পারছি, আপনি আমার আব্বা আম্মাকে বাঁচিয়েছেন, মান – মর্যাদা সহ তাদের বেঁচে থাকারও ব্যবস্থা করেছেন।’
‘কার্ডিনাল পরিবার এক ভয়ানক বিপদ থেকে রক্ষা পেল।’ বলতে বলতে জেনের চোখ ছল ছল করে উঠল কৃতজ্ঞতার অশ্রুতে।
একটু থেমেই জেন আবার বলল, ‘আমার আব্বা বিপদগ্রশ্থ হবেন এই আশংকা করেই আমি সেখানে বলেছিলাম, ‘ভাইয়া আমার আব্বা-আম্মার কি হবে।’ আপনি এত নিখুঁতভাবে আমার উদ্বেগের সমাধান করে দিয়েছেন, তা তখন বুঝিনি। না বুঝে কষ্ট পেয়েছিলাম।’
‘কিন্তু জেন তোমার আব্বা আম্মা আমাকে এখন কি ভাববেন, বলত?’ মুখে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা এখন যেটা বুঝলাম তারাও এটা পরে বুঝবেন। যখন বুঝবেন তখন তারা আমাদের চেয়েও বেশী খুশী হবেন। আপনি আমাদের পরিবারের কত বড় উপকার করলেন তা আপনি বুঝবেন না মুসা ভাই।’ বলল জেন।
‘মুসা ভাই, ঐ উত্তেজনার মুহূর্তে অতদুরে চিন্তা আপনি কি করে করতে পারলেন?’ বলল যিয়াদ।
‘এ জিজ্ঞাসার জবাব কি আমি দিতে পারি যিয়াদ? এ জ্ঞান যিনি দিয়েছেন, সে আল্লাহ তো সব জানেন, সব করেন, সব পারেন। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের এ ভাবেই সাহায্য করেন।’
বলে আহমদ মুসা পা বাড়াল বাড়ির ভেতরে প্রবেশের জন্য।
তাঁর পেছনে সবাই হাঁটতে শুরু করল।
সবার পেছনে জোয়ান আর জেন।
‘আম্মার সাথে দেখা করতে গিয়ে তোমাদের খুব ভোগালাম তাই না?’ জেন বলল জোয়ানকে।
‘শুধু ভোগালে, ভোগও তো করলে।’
‘শুনিনি তো, জানলে কি করে?’
‘জানার জন্য সব সময় কি শোনার দরকার হয়?’
‘তোমরা আর দেরী করলে কি হতো জানি না। জান আজ ওরা ‘মিথ্যা ধরা’ যন্ত্র এনেছিল। পুলিশ অফিসার নিচে থেকে ঐ যন্ত্রই আনতে যাচ্ছিল, এই সময় তোমরা গেছ।’
‘তোমার কাছ থেকে ওরা কি জানতে চেষ্টা করেছে?’
‘বেশীর ভাগ প্রশ্ন তোমার, মুসা ভাই আর ফিলিপ-এর ঠিকানা নিয়ে। এছাড়া তোমাদের কি পরিকল্পনা রয়েছে, কোন কোন দেশ সাহায্য করেছে, স্পেনে আর কারা সাহায্য করেছে, ইত্যাদি প্রশ্নই বার বার ওরা করেছে।’
‘মুক্তি সম্পর্কে কি ভাবতে?’
‘আমি নিশ্চিত ছিলাম, আহমদ মুসা ভাই আমাকে মুক্ত করবেনই। তারপর আব্বার কাছ থেকে মুসা ভাই আমাদের ঠিকানা নেওয়ার খবর যখন শুনলাম, তখন থেকে প্রতিদিনই তোমাদের অপেক্ষা করেছি।’
‘তোমার আব্বা আম্মা?’
‘আমার খুব ভয় ছিল আব্বা আম্মা আমার সিদ্ধান্তকে কিভাবে গ্রহন করেন। কিন্তু দেখলাম তারা মেনে নিয়েছেন। তারা মেয়ের সিদ্ধান্তকে গ্রহন করেছেন আন্তরিকভাবে।’
‘কোন সিদ্ধান্ত?’
‘জানিনা কোন সিদ্ধান্ত’ বলে জেন দ্রুত পা চালিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। তাঁর মুখ রাঙা হয়ে উঠেছে।