১
সুমাইয়ার আব্বা সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘দেখ তুমি আমার ছেলের বয়সের। আমি তোমাকে তুমি বলব, কিছু মনে করো না।’
সুমাইয়ার আব্বা ষাটোর্দ্ধ বয়সের। কিন্তু দেহের গাঁথুনি ভাল আছে বলে বয়স দশ বছর কম মনে হয়। নিরেট ফরাসী চেহারা। চোখে মুখে আভিজাত্যের ছাপ।
‘জি না। আমি বরং খুশী হবো।’ আহমদ মুসা বসতে বসতে বলল।
সুমাইয়া বসল তার আব্বার পাশে।
‘সুমাইয়ার কাছে সব শুনেছি। শুনে দেখতে এসেছি। কোন মুসলিম দেশের এমন শক্তি ও সাহসের কথাতো শুনিনি!’
‘কেন, মুসলমানদের শক্তি সাহসের ইতিহাস নেই?’ মুখে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
‘সে তো ইতিহাস।’
‘কেন ফিলিস্তিন, মিন্দানাও, মধ্য এশিয়া, ককেশাস, বলকানের কাহিনী?’
‘ঠিক বলেছ। ভুলে গিয়েছিলাম ওগুলোর কথা। স্পেনের কথা বাদ দিলে কেন? সেখানে তো রক্তপাত হীন বিপ্লব ঘটে গেল। কিন্তু বৎস, তবু আমি বলব- শক্তি, সাহস ও বুদ্ধিতে মুসলমানরা অনেক পিছিয়ে।’
‘আপনার কথা ঠিক, কিন্তু সবাই পিছিয়ে একথা ঠিক নয়।’
‘হ্যাঁ, তোমার মত সম্মানজনক কিছু ব্যতিক্রম আছে।’
‘আমি ব্যর্থতাকে অসম্মানজক কিংবা অস্বাভাবিক মনে করি না।’
‘কেন?’
‘আমরা মুসলমানরা ইউরোপকে ঘুম থেকে জাগিয়ে নিজেরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সে ঘুম থেকে সবে আমরা জেগেছি।’
‘চমৎকার বলেছ বৎস। কিন্তু মুসলমানদের এ ঘুমটা বড় দীর্ঘ হয়েছিল, না?’
‘সুখের ঘুমটা একটু গাঢ়ই হয়। তখন আমরা অর্ধ পৃথিবীর মালিক। অঢেল অর্থ ছিল আমাদের পায়ের তলায়। এই সম্পদ আমাদের গৃহবিবাদের সৃষ্টি করেছিল। গৃহবিবাদ ধ্বংস করেছিল আমাদের শক্তিকে এবং ডেকে এনেছিল শত্রুকে। সুখের ঘুম পরিণত হয়েছিল পতনের ঘুমে।’
‘চমৎকার, চমৎকার। তোমার সম্পর্কে মারিয়ার কাছ থেকে যা শুনেছিলাম তার চেয়েও তুমি চমৎকার। আমি একটা কথা বলব তোমাকে।’
‘কি কথা?’
‘আমার গরীবখানা তোমাকে নিয়ে যেতে চাই। যাবে তুমি?’
‘ফ্রান্সের একটি মুসলিম পরিবারের সাথে পরিচিত হওয়াকে আমি আমার সৌভাগ্য মনে করি। কিন্তু আমার মনে খুব লেগেছে, সুমা সালাম দেয়া ভুলে গেল কেন?’
‘এটা কি আমার দোষ? সালাম পেলাম কবে? সালাম দেয়ার সুযোগ পেলাম কবে?’ অভিমান ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বলল সুমাইয়া।
সুমাইয়ার আব্বা গম্ভীর হযে উঠল। তারপর ধীর কণ্ঠে বলল, ‘শুধু সালামের কথা বলছ? মুসলিম কালচারের কি আছে আমাদের জীবনে। নামাজ জানি না, রোজা করি না। সুমা ঠিকই বলেছে, এর জন্য কি আমরা দায়ী। আমার আব্বা কুরআন শরীফ পড়া জানতেন না, আমি জানিনা, আমার সন্তান সুমাইয়াও জানে না। আমরা অবস্থার শিকার বৎস। আমরা মুসলিম নাম টিকিয়ে রেখেছি, আদম শুমারীর খাতায়। এখনও নিজেদের মুসলিম পরিচয় লিখছি, তোমাকে মুসলিম জেনে আন্তরিকভাবে আনন্দিত হয়েছি- এই যে বোধ, এটাই খুব কম?’
একটু থামল সুমাইয়ার আব্বা মোহাম্মদ দ্য গল। মুহূর্তকাল পরেই আবার বলতে শুরু করল, ‘আমার ইচ্ছা ছিল একটি মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করব। কিন্তু তা ভাগ্যে জোটেনি। বিয়ে করতে হলো এক ক্যাথলিক মেয়েকে। কিন্তু গীর্জায় গিয়ে বিয়ে করতে রাজি হইনি। অবশেষে প্যারিস গিয়ে মসজিদের ইমাম ডেকে ইসলামী মতে বিয়ে করেছি। আমার এই চেষ্টাকে কি খুব ছোট করে দেখবে বৎস?’
‘ধন্যবাদ জনাব। ধর্মের প্রতি আপনার আন্তরিকতা প্রশংসনীয়। কিন্তু জনাব এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে জাতি হিসাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যাবেনা।’
‘ঠিক বলেছ, কিন্তু উপায় কি বলো। এ নিয়ে ভাববার কথা আমাদের একথা ঠিক। কিন্তু এর সমাধান কি আমাদের দ্বারা সম্ভব? কুরআন শিক্ষার সুযোগ আমি পাইনি, আমার সন্তানকেও দিতে পারিনি। এর জন্যে আমরা দায়ী, কিন্তু আর কেউ দায়ী নয়? মুসলিম দেশগুলোর কি কোনই দায়িত্ব ছিলনা আমাদের প্রতি?’
‘অতীতে এটা হয়নি জনাব, ইনশাআল্লাহ এখন হচ্ছে, হবে। বিশ্ব মুসলিম লীগ (রাবেতা) এই সমস্যা মোকাবেলার জন্যে দুনিয়া ব্যাপী অনেক কিছু করেছে, করছে। এ ছাড়া বেশ কিছু মুসলিম দেশ এই ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসছে।’
‘খুব খুশীর খবর এটা। এখন বল, যাচ্ছ তো আমার গরীবালয়ে? বহু চেষ্টা করে একটা কোরআন শরীফ জোগাড় করেছি। আমার স্ত্রীসহ সকলের ইচ্ছা, তোমার কাছ থেকে কুরআনের পাঠ শুনবো। আমরা মক্কা, কায়রো ও ইস্তাম্বুল রেডিও’র কুরআন পাঠ শুনি। কিন্তু স্বচক্ষে আমরা কেউ কোরআন দেখিনি বা শুনিনি।’
‘অবশ্যই যাব জনাব।’
‘ধন্যবাদ বৎস। আরেকটা কথা বলব।’
‘বলুন।’
‘সুমাইয়ার ফিল্ম নাকি আটকে রেখেছে?’ হেসে বলল সুমাইয়ার আব্বা।
‘তুমি মন খারাপ করেছ সুমাইয়া। আমি আটকে রাখিনি ওগুলো। বলতে পার নিরাপত্তামূলক হেফাজতে রেখেছি। আগামী কাল দশটার মধ্যে পেয়ে যাবে।’
‘আমি তো আপত্তি করিনি। আমি আব্বাকে জানিয়েছি মাত্র।’ বলল সুমাইয়া।
‘আমারও আপত্তি নেই। তবে জানতে লোভ হচ্ছে যে, সবাই প্রচার চায়, তুমি চাওনা কেন?’ বলল সুমাইয়ার আব্বা।
‘সবই জানতে পারবেন। আগামী কাল ১০ টা পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করার জন্যে আমি আপনাদের অনুরোধ করছি।’
‘তোমার কথায় যদিও আগ্রহটা বাড়ছে, তবু ঠিক আছে। কখন যাবে আমাদের বাড়িতে। এখনি চল লাঞ্চ করে চলে আসবে।’
প্রস্তাবটি ভালো লাগল আহমদ মুসারও।
সবাই উঠল।
এখন বিকাল।
সুমাইয়ার বাড়ি থেকে আসতে অনেক দেরী হয়েছে আহমদ মুসার। ফিরতে ফিরতে প্রায় ৪টা বেজে গেছে। আহমদ মুসা হোটেল রুমে আসর নামাজ পড়ে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। যোহরের নামাজ সে পড়ে ছিল সুমাইয়াদের বাড়িতে। সাবইকে নিয়ে নামাজ পড়েছে, নামাজ শিখিয়েছে ওদের। এই প্রথম সুমাইয়াদের বাড়িতে নামাজ হলো। আহমদ মুসা অবাক হয়েছিল, আবেগ অনুভূতি দিক দিয়ে পরিবারটা শতকরা একশত ভাগ মুসলমান। এমনকি সুমাইয়ার মা ক্যাথলিক ছিল, মনের দিক দিয়ে এখন সে সম্পূর্ণ মুসলমান হয়ে গেছে। কিন্তু মুসলমানের আবেগ অনুভূতি ছাড়া পরিবারে মুসলমান হওয়ার আর কোন চিহ্ন নেই। নামাজের জন্যে প্রয়োজনীয় সুরা বা দোয়া ওরা ফরাসী ভাষায় লিখে নিয়েছে। ওরা কথা দিয়েছে ওরা নামাজ রোজা করবে। ওরা আরও কথা দিয়েছে, প্যারিসের মুসলিম দূতাবাসগুলো ফরাসী মুসলমানদের কুরআন ও হাদিস শিক্ষা দেয়ার যে ব্যবস্থা করেছে তার সুযোগ তারা গ্রহণ করবে। আহমদ মুসা ওদের কথা দিয়েছে, দক্ষিণ ফ্রান্সে অন্তত দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার জন্যে সে রাবেতা ও মুসলিম দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে উদ্যোগ নেবে। আর যোগাযোগ করতে বলেছে। ‘ইয়ুথ সোসাইটি ফর ইউরোপিয়ান রেঁনেসা’- এর সাথে যুক্ত হলে সুমাইয়া সব কিছুই জানতে পারবে।
আসার সময় সুমাইয়ার মা আহমদ মুসাকে বলেছিল, ‘সত্যি বাবা কে তুমি? ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অনেক মুসলমানের সাথে দেখা হয়েছে, তাদের চেয়ে একদমই ব্যতিক্রম তুমি। জ্ঞান যোগ্যতা এবং আচরণ সব দিক দিয়েই তুমি, আমি মনে করি একজন পূর্ণ মানুষ। কে তুমি বাবা? সুমাইয়া ও তার আব্বার কাছ থেকে শুনলাম, তুমি তোমার পরিচয় গোপন রাখতে চাও। কিন্তু মায়ের কাছে কি কিছু গোপন রাখতে আছে?’
‘আপনি এভাবে কথা বললে আমি বিপদে পড়ে যাব আম্মা। আমার সব পরিচয় তো আপনাদের সামনে, শুধু কিছু কথা বলিনি আমি অপরিহার্য প্রয়োজনেই।’
‘তুমি দীর্ঘজীবি হও বাছা। আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘজীবি করুন।’
আহমদ মুসাকে বিদায় দিতে এসে আহমদ মুসার গাড়ির দরজা বন্ধ করে জানালায় মুখ এনে সুমাইয়া বলেছিল, আপনি ভাগ্যবান। আমার রাশভারি মাকেও আপনি জয় করলেন। দীর্ঘজীবি হওয়ার জন্যে অমন দোয়া আমার মা কোনদিনই আমার জন্যে করেননি।’
‘যার মা নেই, তাকে আল্লাহ এমন ভাবেই মা জুটিয়ে দেন।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘ধন্যবাদ সুমাইয়া, এখন তোমাকে মুসলিম মেয়ের মত মনে হচ্ছে।’
নামাজের সময় সুমাইয়া গায়ে চাদর জড়িয়েছিল, সে চাদর এখনও তার মাথায় আছে।
‘দোয়া করুন, এ চাদর যেন গা- মাথা থেকে আর না নামে।’
গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল সুমাইয়া।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছিল। সুমাইয়া ছুটে গাড়ির জানালায় এসে উচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘আস্সালামু আলাইকুম।’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। ধন্যবাদ সুমা।’ হেসে বলেছিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা হোটেলের বেড়ে শুয়ে এ সব ভেবে এবং এপাশ ওপাশ করে চোখ থেকে ঘুম তাড়াচ্ছিল। মনে হচ্ছে কারও জন্যে অপেক্ষা করছে সে।
এখন বিকেল সাড়ে চারটা।
আহমদ মুসার দরজায় নক হলো।
তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে আহমদ মুসা দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘আস্সালামু আলাইকুম। এস ওমর বায়া।’
সালামের জবাব দেবার পর এক মুখ সংকোচ নিয়ে ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করল সেদিন হোটেলের ডাইনিং রুমে মার খাওয়া সেই কৃষ্ণাংগ যুবক।
ওমর বায়াকে একটা চেয়ারে বসিয়ে আরেকটা চেয়ার টেনে নিয়ে তার মুখোমুখি বসল আহমদ মুসা।
ওমর বায়ার ঠোটটা তখনও ফোলা।
‘বল ওমর তোমার কথা। সে দিন যে দু’জন লোক তোমাকে আক্রমণ করল তুমি চেন তাদের?’ আহমদ মুসাই শুরু করল।
‘না চিনি না। ওরা ভাড়াটিয়া। আমাকে কিডন্যাপ করার জন্যে ওদের নিয়োগ করা হয়েছিল।’
‘কারা নিয়োগ করেছিল?’
‘একটা আর্ন্তজাতিক খৃষ্টান মিশনারী সংগঠন।’
‘ওদের সাথে তোমাদের কি বিরোধ? কেন তোমাকে ওরা কিডন্যাপ করতে চায়?’
‘আমার সমস্ত সম্পত্তি ওদের নামে লিখে দিতে বাধ্য করবে, রাজী না হলে খুন করবে।’
‘ঘটনা কি বলত।’
‘ঘটনা অনেক বড়,কাহিনী অনেক দীর্ঘ।’
আহমদ মুসা নড়ে চড়ে বসল।
‘আমার বাড়ি’, শুরু করল ওমর বায়া, ‘ক্যামেরুনের একদম দক্ষিণ সীমান্তে আটলান্টিকের উপকূল ঘেঁষে দাঁড়ানো নতেম নদী দ্বারা প্রায় চারদিক থেকে ঘেরা কাম্পু উপত্যকায়। এই উপত্যকা ছিল দক্ষিণ ক্যামেরুনে মুসলমানদের সর্বশেষ বসতি। এর আগে দক্ষিণ ক্যামেরুনের আম্বা, সালাস, মলুন্ডু, দুম প্রভৃতি অঞ্চলে অনেক মুসলিম বসতি ছিল। কিন্তু নিরক্ষীয় গিনী, গ্যাবন ও কংগোর সাহায্যপুষ্ট ক্যামেরুনের খৃষ্টান মিশনারীদের দ্বারা পরিচালিত খৃষ্টান সপ্ম্রসারণের বন্যা সে সবকে কোথায় তলিয়ে দিয়েছে, তার কোন চিহ্নও এখন নেই। এরপর ওদের হাত এসে পড়ল আমাদের কাম্পু উপত্যকায়। আমাদের কাম্পু উপত্যকা ছিল সব দিক থেকেই অগ্রসর ও সমৃদ্ধ। এখানে স্কুল,কলেজ,হাসপাতাল সবই আছে। আমার আব্বা আবুবকর বায়ার অক্লান্ত চেষ্টার ফল ছিল এগুলো।
খৃষ্টান মিশনারীরা এখানে স্কুল, হাসপাতাল ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নামে জমি কেনা শুরু করল। আমার আব্বা যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন ওরা এটা পারেনি। কিন্তু আব্বা হঠাৎ একদিন খুন হলেন। আমি তখন ছোট। এই খুনকে কেন্দ্র করে যাদেরকে ধরা হলো তারা মুসলিম সম্প্রদায়ের বড় বড় প্রভাবশালী লোক। খৃষ্টান মিশনারীরা প্রশাসনের ওপর প্রভাব খাটিয়ে এটা করল। শুরু হলো ষড়যন্ত্রের যাত্রা আমাদের উপত্যকায়। নানা ভাবে মানুষকে মামলায় জড়িয়ে, বিপদে ফেলে তাদেরকে খৃষ্টানদের কাছে জমি বিক্রিতে বাধ্য করতে লাগল। ধীরে ধীরে ওদের ষড়যন্ত্র গ্রাস করল আমাদের গোটা কাম্পু উপত্যকা। মুসলমানরা জায়গা-জমি হারিয়ে, মারামারি, খুন ইত্যাদি মামলার শিকার হয়ে উপত্যকা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো। সর্বশেষে হাত পড়ল আমাদের ওপর। কাম্পু উপত্যকায় আমাদের মোট দশ হাজার একর জমি আছে। এই জমির উপর এসে পড়ল ওদের চোখ। এ জমিটুকু তারা দখল করতে পারলে গোটা দক্ষিণ ক্যামেরুন মুসলিম শূণ্য হয়ে যায়। আমি তখন কলেজে উঠেছি। ওরা এসে সরাসরি আমাকে প্রস্তাব করলো, জমিটা বিক্রি করে দিতে। ওরা স্পষ্ট জানাল যে, আমরা চেষ্টা করলেও এই উপত্যকায় আর বাস করতে পারবো না।
আমি জমি বিক্রি করতে সম্মত হলাম না। ওদের তরফ থেকে হুমকি আসতে লাগল। বলাবলি হতে লাগল, হয় আমি আমার আব্বার মত খুন হবো, নয়তো ওরা কিডন্যাপ করে জোর করে জমি লিখিয়ে নেবে, যেমন অনেকের নিয়েছে। আম্মাকে নিয়ে আমি পালালাম। কাম্পু থেকে চলে এলাম উত্তর ক্যামেরুনের কুম্বা উপত্যকায় আমার দুর সম্পর্কের এক স্বজনের কাছে। ওরা আমার সব জমি-জিরাত ও ঘর-বাড়ী দখল করে নিল। আমি মামলা করলাম। এই মামলা আমার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়াল। ওদের ষড়যন্ত্র কুম্বাতেও এসে পৌঁছাল। শুরু হলো আমাকে কিডন্যাপ অথবা হত্যা করার চেষ্টা। একদিন রাতে আমার বাড়ী আক্রান্ত হলো। আমি প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছিলাম, কিন্তু আমার মাকে ওরা খুন করে যায়। আমি কোর্টে নিরাপত্তার জন্য আপিল করলাম। কিন্তু পরে কোর্টে যাওয়াই আমার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াল। উপায়ান্তর না দেখে আমাকে ক্যামেরুন ছাড়তে হলো। চলে এলাম ফ্রান্সে। এখানে একটি ল’ কর্মীকে আমি আমার মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ করলাম। ওরা জানতে পারলো সব। ছুটে এল ওরা ফ্রান্সে। খুঁজে বের করলো ওরা আমাকে। শুরু হয়ে গেল সেই খুন করা অথবে কিডন্যাপ করার পুরানো প্রচেষ্টা। কিডন্যাপের একটা প্রচেষ্টা আপনি নিজ চোখেই দেখেছেন এবং আমাকে বাঁচিয়েছেন।
থামল ওমর বায়া।
আহমদ মুসা গোগ্রাসে গিলছিল ওমর বায়ার কাহিনী। তার মন বেদনায় ভরে গেল। তার চোখে ভেসে উঠল কাম্পু উপত্যকার দৃশ্য। যেন কানে শুনতে পেল সে ভিটে মাটি ছেড়ে পালানো এবং খুন হয়ে যাওয়া হাজারো মানুষের হাহাকার আর হাহাশ্বাস। এই দুর্ভাগারা কারোরই সাহায্য পায়নি। মার খেয়ে খেয়ে নিরবে অজানার অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। ওমর বায়া তার কথা শেষ করলেও আহমদ মুসা অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারল না। বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ওমর বায়ার দিকে।
বহুক্ষণ পর একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আহমদ মুসা বলল, ‘তুমি ফ্রান্সে এলে, কিন্তু প্রতিবেশী মুসলিম দেশ নাইজেরিয়ায় তুমি যেতে পারতে।’
‘যেতে পারতাম, কিন্তু সেখানে নিরাপত্তার ভরসা পাইনি। ওখানকার প্রশাসন ও পুলিশে খৃষ্টানরা প্রভাবশালী। ওরা আমাকে নিরাপত্তা দেয়া দুরে থাক, সুযোগ পেলে ক্যামেরুনের সেই ষড়যন্ত্রকারীদের হাতেই তুলে দিত।’ বলল ওমর বায়া।
‘ক্যামেরুনের সেই গ্রুপটির নাম কি যারা তোমার জমি দখল করেছে এবং তোমার বিরুদ্ধে এই ভাবে লেগেছে?’
‘যারা আমাদের জমি দখল করেছে তারা ‘কিংডোম অব ক্রাইম’ নামের একটি সংগঠন। আর যারা ওদের পক্ষে আমাদের পেছনে লেগেছে তারা হলো ‘আর্মি অব ক্রাইম অব ওয়েষ্ট আফ্রিকা’ (AOCOWA)। সংক্ষেপে ওদেরকে ‘ওকুয়া’ বলে ডাকা হয়। এটা খৃষ্টান মিশনারীদের একটা গোপন সন্ত্রাসী সংগঠন। এরা অত্যন্ত শক্তিশালী। এদের চোখ সর্বত্র। অর্থ ও অস্ত্রের এদের অভাব নাই।’
‘এদের হেডকোয়ার্টার কোথায়?’
‘গোপন সংগঠন এটা, কিছুই আমরা জানি না।’
‘আচ্ছা মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের কোন বিহিত ক্যামেরুন সরকার করেন না?’
‘খৃষ্টান প্রভাবিত ক্যামেরুন সরকারের সে ক্ষমতা নেই। আর তাছাড়া যে অন্যায়, অবিচার করা হচ্ছে, তা গোপনে এবং আইনের লেবেল এঁটে করা হচ্ছে। মুসলমানদেরকে ঘর-বাড়ি ত্যাগ এবং জমি বিক্রিতে বাধ্য করে হচ্ছে, এটা কিন্তু বাইরের নজরে আসছে না। সবাই দেখছে মুসলমানরা জমি বিক্রি করছে।’
‘এটা চলতে থাকলে তো ক্যামেরুনে অল্পদিনেই মুসলিম শূণ্য হয়ে যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘প্রতিবেশী নিরক্ষীয় গিনি ও গ্যাবনের আদম শুমারীতে মুসলমানদের চিহ্ন নেই। এই ষড়যন্ত্র এখন ক্যামেরুনকেও গ্রাস করতে আসছে। ক্যামেরুনে খৃষ্টানদের সংখ্যা ইতিমধ্যেই শতকরা ৩৩ ভাগে উন্নীত হয়েছে, মুসলমানদের সংখ্যা দেখানো হচ্ছে শতকরা ১৬ ভাগ। এই ১৬ ভাগকে শূন্যে নামানোর চেষ্টা হচ্ছে।’
‘এখানে যারা তোমাকে কিডন্যাপ অথবা হত্যা করার চেষ্টা করছে, তারা এটা সামনেও চালাবে। তোমার পরিকল্পনা কি?’
‘ওদের ভয়ে প্যারিস থেকে পালিয়ে এসেছি পাউ-এ। এরপর আমি কি করব জানি না। আর কত পালাব, পালিয়েই বা লাভ কি?’
‘কোন মুসলিম সংস্থা-সংগঠনের সাহায্য তুমি চাওনি?’
‘প্যারিসে এসে এ ধরনের কোন সংগঠন পাইনি। এসোসিয়েশন জাতীয় যা আছে তারা এ ধরনের ঝুঁকি নিতে চায় না। আমি প্যারিসের UMA (Union of Muslim Association) কে বলেছিলাম। তারা আমাকে কিছু দিনের জন্যে আত্মগোপন করতে বলেছিলেন। তাদের পরামর্শেই আমি পাউ-এ এসেছিলাম।
আহমদ মুসা কথা বলল না। ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘দেখ জরুরী প্রয়োজনে আমাকে চলে যেতে হচ্ছে আগামীকাল। না হলে আমি তোমার সাথে ক্যামেরুনে যেতাম। যাওয়ার চিন্তা আমি বাদ দিচ্ছি না। শুধু ক্যামেরুন নয় ওমর, সাহারার দক্ষিণ প্রান্তের অন্ধকার আফ্রিকা আমাকে ডাকছে। আমি তার কান্না শুনতে পাচ্ছি। আমি সে কান্নার উৎসভূমি গুলোতে যাব। কি করতে পারব আমি জানি না, অন্তত তাদের কান্নার সাথী হতে পারবো তো!’
একটু থামল। ঢোক গিলল আহমদ মুসা।
ওমর বায়া বিস্ময়বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে।
‘আমার কথা তুমি যদি রাখ, তাহলে তোমাকে আমি বলব তুমি ফ্রান্স থেকে ফিলিস্তিন চলে যাও। আপাতত ক্যামেরুনে তোমার ব্যাপারটার কিনারা না হওয়া পর্যন্ত ওখানে থাক।’
‘আমার কেসের ব্যাপারটা কি হবে। আমি এখান থেকে কেসের তদবীরও করছিলাম।’
‘সেটার অসুবিধা হবে না। প্যারিসের ফিলিস্তিন দুতাবাস কারও মাধ্যমে এ কাজ করবে।’
‘তারা কেন করবে? আর আমি ফিলিস্তিনে যাব কি করে? কারা আমাকে আশ্রয় দেবে?’
‘সে চিন্তা তোমার নয়। তুমি আজ রাতেই ফিলিস্তিন দূতাবাসে আশ্রয় নেবার জন্য তৈরি হও। কয়টায় যেতে পারবে তুমি?’
‘একটু সময় লাগবে। রাত দশটা।’
‘ঠিক আছে, আজ রাত দশটায় হোটেলের গাড়ি বারান্দায় ফিলিস্তিন দূতাবাসের গাড়ি তোমার জন্যে অপেক্ষা করবে।’
ওমর বায়ার চোখে তখন রাজ্যের বিস্ময়। তার মনে চিন্তার ঝড়।
কে এই লোক। এমন ভাবে কথা বলছে যেন ফিলিস্তিন দূতাবাস, ফিলিস্তিন সবই তার অধীন।
আমি একটি প্রশ্ন করতে পারি ? চিন্তা করে ধির কন্ঠে বলল ওমর বায়া।
‘অবশ্যই’।
‘আপনি সেদিন যেভাবে আমাকে বাঁচালেন এবং যেভাবে এ কথাগুলো বললেন, তাতে আমি নিশ্চিত আপনি সাধারণ কেউ নন। আমার কথা দ্বায়িত্বশীল অনেক মুসলিম শক্তি কাছে বলেছি কিন্তু তারা এবং আপনি আকাশ পাতাল তফাৎ। আপনি কে আমি কি তা জানতে পারি?
‘ঠিক আছে একটু ধৈর্য ধর। ফিলিস্তিন দূতাবাসে গিয়ে ওদের তুমি জিজ্ঞাসা করো। মুখে এক টুকরো স্নেহের হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
তারপর আহমদ মুসা বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘তাহলে ওমর বায়া তুমি যাও তৈরী হওগে। ঠিক রাত দশটায় অথবা তার দু’চার মিনিট আগে হোটেলের পার্কিং প্লেসে আসবে।
‘শুকরিয়া জনাব’ বলে ওমর বায়া উঠে দাঁড়াল এবং সালাম দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসা আবার এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
পর দিন খুব ভোরে ব্রেক ফার্ষ্ট সেরেই প্রথমে এয়ার লাইন অফিসে টেলিফোন করে টিকিট কনফার্ম করল। তারপর টেলিফোন করল মন্টেজুতে ডোনার কাছে, ডোনা, জেন ও জোয়ানের কাছে বিদায় নেবার জন্যে।
টেলিফোন করতে গিয়ে ভাবল আহমদ মুসা, ডোনা যে জেদী মেয়ে কি বলে বসে কে জানে! সে তো জানিয়েই দিয়েছিল, আহমদ মুসা মন্টেজুতে না গেলে সে জেন ও জোয়ান কে ছাড়বেনা।
আহমদ মুসা যেতে পারত মন্টেজুতে। কিন্তু তার মন চায়নি যেতে। ইসলামকে ডোনা অনেক খানিই বুঝেছে, কিন্ত পর্দার কোন বিধি-নিষেধকে সে বিন্দুমাত্রও পাত্তা দেয়নি, এটা আহমদ মুসার জন্যে খুবই অস্বস্তিকর।
‘টেলিফোন ধরল ডোনাই। আহমদ মুসার গলা পেয়েই সে চিৎকার করে উঠল, আমরা এ দিকে ভেবে সারা। কখন পৌছেছেন ফ্রান্সে? কখন পৌছবেন মন্টেজুতে ? জেন ও জোয়ান ভাল আছে। ওদের হানিমুনে পাঠিয়েছিলাম সুইজারল্যান্ডে, গত রাতে ফিরে এসেছে।
এতগুলো কথা বলে দম নিল ডোনা।
আহমদ মুসা অত্যন্ত নরম ভাষায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ডোনাকে জানাল যে সে আজ দশটার মধ্যে এশিয়া চলে যাচ্ছে, মন্টেজুতে যেতে সে পারছে না।
শুনেই ডোনা না না করে উঠল। বলল, আমি কোন কথাই শুনব না।
উত্তরে আহমদ মুসা তার অপারগতার জন্যে ডোনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করল।
ওপার থেকে ডোনার আর কোন কথা শোনা গেল না। আহমদ মুসা এপার থেকে হ্যালো হ্যালো করে চলল।
বেশ কিছুকক্ষণ পর ওপার থেকে জেনের গলা পাওয়া গেল। সে সালাম দিয়ে বলল আপনি কোথা থেকে ভাইয়া? ডোনার কি হয়েছে? ওর চোখে পানি, জলভরা মেঘের মত মুখ?
আহমদ মুসা জেনকে সব কথা জানিয়ে বলল, তোমার সাথেও দেখা করতে পারলাম না।
কেন?
আজ দশটার প্লেনে না গেলে আবার কয়েক দিন দেরী হয়ে যাবে। কিন্তু এতটা দেরী আমি করতে পারছি না।
কিন্তু ডোনা তো আমাদের আটকে রেখেছে, আপনি না এলে কিছুতেই ছাড়বে না আমাদের।
‘ডোনা ছেলে মানুষ। পিতা-মাথার একমাত্র সন্তান। জেদী খুব। কিন্তু ভাল মেয়ে। ওকে দাও, বুঝিয়ে বলি ওকে।
জেন রিসিভার থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে ডাকতে লাগল ডোনাকে। আহমদ মুসা শুনতে পাচ্ছিল ডাক। এরপর জেন রিসিভার রেখে চলে গেল ডোনাকে আনতে।
বেশ কিছুকক্ষণ পর জেনের কন্ঠ শুনা গেল টেলিফোনে। স্যরি ভাইয়া ডোনা কিছুতেই এলোনা টেলিফোনে। ভীষন রাগ করেছে।
‘দুঃখিত জেন। আমার অবস্থার কথা ডোনা জানে না। জানলে সে রাগ করতো না আমি নিশ্চিত। এটাই আমার শান্ত্বনা। শুন জেন, আমি ট্রিয়েষ্টে টেলিফোন করেছিলাম। তোমাদেরকে দু’চার দিনের মধ্যেই পৌছতে হবে ট্রিয়েষ্টে। খুব খোলামেলা না হয়ে সতর্কতার সাথে তোমাদের ট্রিয়েষ্টে পৌছতে হবে। আর সেখানে তোমাদের চাকুরীর নাম ভিন্ন হবে। ওখানে গেলেই তা জানতে পারবে। আর সে ভিন্ন নামের সিটিজেনশীপ হবে ফিলিস্তিনের। নতুন পাসপোর্ট পাবে ওখানে গেলেই। খবরদার স্পেনের পাসপোর্ট নষ্ট করবে না।
‘ধন্যবাদ মুসা ভাই’ আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন, ভাই-বোনদের এভাবে ধন্য করার জন্যে। কিন্তু ভাইয়া আমরা কিছুই করতে পারলামনা আপনার জন্যে।
‘এভাবে কথা বল না, জাতির জন্যে যা করার সেটাই আমার জন্যে করা হবে। জোয়ান কোথায়? কথা হলোনা, তাকেও সালাম দিও।
‘তাহলে এখানেই শেষ? আবার কবে দেখা হবে ভাইয়া ?
‘এটা তুমিও যেমন বলতে পার না, আমিও বলতে পারি না।’ বলে সালাম দিয়ে টেলিফোন রেখে দিল আহমদ মুসা।
তখন সকাল ৮টা পার হয়ে গেছে।
আহমদ মুসার ব্যাগ গোছানো শেষ।
চেক আউট করার জন্যে বেল বয়কে ডেকে পাঠিয়েছে। নিচে গিয়ে হোটেলের বিল পরিশোধ করেই চলে যাবে।
আহমদ মুসা বসে আছে এক চেয়ারে। সামনের সোফায় বসে আছে সুমাইয়া এবং তার আব্বা। ওরা এসেছে বেশ আগে ‘সি অফ’ করার জন্যে।
সবাই বসে অপেক্ষা করছে বেল বয়ের।
রুমের কলিং বেল বেজে উঠল।
আহমদ মুসা বুঝলো বেল বয় এসেছে। বলল, এস খোলা আছে।
দরজা ঠেলে প্রবেশ করল বেল বয় নয়, জেন, জোয়ান এবং ডোনা।
ভূত দেখার মতো আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। তার ঠোঁট দু’টি ঠেলেই যেন শব্দ বেরিয়ে এল, জেন, জোয়ান, ডোনা তোমরা।
বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে যেন আহমদ মুসার মুখ।
জেনের পরনে লম্বা স্কার্ট, গায়ে কোট। মাথায় ও গলায় পেছানো রুমাল। শুধু মুখ ও হাতটুকুই খোলা। ডোনার পরনে ফুল প্যান্ট, গাঁয়ে শার্ট (মাথা খোলা)।
জেন ও জোয়ানের মুখ ম্লান, অপ্রস্তুতভাব। কিন্তু ডোনার থমথমে মুখে একটা বেপরোয়া ভাব।
‘মুসা ভাই, ডোনা আসছে দেখে তার গাড়ীতে আমরা চড়ে বসেছি।’ আহমদ মুসার বিস্মিত উক্তির জবাবে বলল জেন।
জোয়ানের মুখ শুকনো, বিব্রতভাব। ভাবছে সে এভাবে আসা ঠিক হয় নি।
আহমদ মুসার মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। বলল, ভালই করেছ তোমরা, দেখা হলো। দেখা না করে যেতে খারাপই লাগছিল।
ডোনা নির্বাক। থমথমে মুখ তার। স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার মুখে।
আহমদ মুসা ডোনার দিকে ফিরে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, ‘খুব রাগ করেছ ডোনা ?
‘আপনি মন্টেজু চলুন। টিকিট থাক। আমি টিকিট করে দেব। আবেগ-প্রকম্পিত কন্ঠে বলল ডোনা।
আহমদ মুসার মুখে স্বচ্ছ এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। সে ব্যাগের পকেট থেকে চার ভাঁজ করা একটা চিঠি বের করে ডোনার হাতে তুলে দিল।
ডোনা প্রকম্পিত হাতে চিঠি নিয়ে পড়তে লাগল।
পড়ে চোখ বন্ধ করল ডোনা।
বন্ধ চোখ থেকে চোখের পাতার বাঁধন ভেঙে নেমে এলো অশ্রুর ধারা।
আহমদ মুসা জেন এবং জোয়ানকে লক্ষ্য করে বলল, জোয়ান সিংকিয়াং-এ বিপর্যয় ঘটে গেছে। সব লন্ড ভন্ড হয়ে গেছে ওখানে। তোমাদের ভাবীর আব্বা-আম্মা নিহত, তোমাদের ভাবী নিখোঁজ।
কথা শোনার সাথে সাথে জোয়ান ও জেনের মুখের আলো দপ করে নিভে গেল। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি তাদের আহমদ মুসার ওপর নিবন্ধ। মুখে কোন কথা নেই তাদের। যেন বোবা হয়ে গেছে।
অবাক বিস্ময়ে এ দৃশ্য দেখছে সুমাইয়া এবং তার আব্বা। সুমাইয়া পরিষ্কারই বুঝল, আগন্তুকরা সকলেই এ বিস্ময়কর লোকটির অত্যন্ত ঘনিষ্ট। কিন্তু এরা কারা। বিশেষ করে ডোনার কথা ভাবছে সুমাইয়া। মেয়েটি কে? তার সাথে কি সম্পর্ক? মেয়েটির মুখ, তার চোখের জল সুমাইয়ার হৃদয়ের কোথায় যেন একটা বেদনার সৃষ্টি করেছে। সে বেদনার সাথে ঈর্ষার তীক্ষন একটা সুরও বাজছে। চমকে উঠল সুমাইয়া।
রুমের কলিং বেল আবার বাজল।
বেল বয় প্রবেশ করল ঘরে।
সবাই বেরিয়ে এল কক্ষ থেকে।
ডোনা চোখের পানি মুছে ফেলেছে। মুখটা তার শান্ত কিন্তু থমথমে।
আহমদ মুসা লাউঞ্জে নেমে বিল কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াল। আহমদ মুসার সাথে জেন, জোয়ান, ডোনা, সুমাইয়া সকলেই।
আহমদ মুসা দাঁড়াতেই কম্পিউটারের সামনে বসা লোকটি গুডমর্নিং জানিয়ে বলল, ‘সব রেডি স্যার।’ বলে একটা বোতাম টিপে একটা লম্বা একাউন্টস স্লিপ বের করে আনল। তারপর ওটা তুলে ধরল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা হাত বাড়িয়ে কাগজটি ধরে ফেলার আগেই ডোনা ছোঁ মেরে কাগজটি নিয়ে নিল। তারপর কাগজের দিকে নজর বুলিয়েই পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল। গুনতে লাগল টাকা।
‘কি করছ ডোনা?’ বলে আহমদ মুসা এক ছোঁ মেরে মানিব্যাগটি কেড়ে নিল ডোনার হাত থেকে।
ডোনা একবার মুখ ফিরিয়ে তাকাল। কিছু বলল না। তার মুখ গম্ভীর। তারপর সে হিপ পকেট থেকে আরও কতগুলো নোট বের করল এবং গুণে ৭ হাজার ফ্রাঙ্ক তুলে দিল বিল-ক্লার্কের হাতে।
এবার আহমদ মুসা কোন বাধা দিলনা। জেদী মেয়েটি আবার কোন কাণ্ড করে বসে কে জানে। আহমদ মুসা খুবই বিব্রত বোধ করছে ডোনাকে নিয়ে।
লাউঞ্জ থেকে কারপার্কে এল ওরা সকলে। গাড়ী রয়েছে সুমাইয়ার ও ডোনার। ভাড়া গাড়ী আর ডাকতে হলোনা।
কারপার্কে এসেই আহমদ মুসা বলল, ‘ওহো, তোমাদের তো পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়নি।’ বলে আহমদ মুসা জেন, জোয়ান ও ডোনার সাথে সুমাইয়া ও সুমাইয়ার আব্বাকে পরিচয় করিয়ে দিল।
পরিচয় শেষে সুমাইয়ার সাথে সুমাইয়ার গাড়িতে উঠল জেন ও ডোনা। আর ডোনার গাড়িতে উঠল আহমদ মুসা, জোয়ান এবং সুমাইয়ার আব্বা। এই ভাবে ভাগটা আহমদ মুসাই করে দিয়েছিল।
ভাগটা পছন্দ হয়নি ডোনার, তবু সে খুশী যে, আহমদ মুসা তার গাড়ি ড্রাইভ করছে।
বিমান বন্দরে যখন আহমদ মুসারা নামল, তখন বেলা ৯ টা। সময় নেই। বিমান বন্দরে অনেক ফর্মালিটিজ বাকী।
গাড়ি থেকে নেমেই আহমদ মুসা পকেট থেকে ফিল্মে র একটি রীল বের করে সুমাইয়ার দিকে তুলে ধরে বলল, ‘নাও সুমাইয়া, তোমার ফিল্ম আটকে রেখেছিলাম কয়দিন। মাফ করে দিও।’
ফিল্ম টি হাতে নিয়ে সুমাইয়া বিস্ময় ভরা চোখে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি আহমদ মুসা’ এ পরিচয় জানালে কি ক্ষতি হতো বলুনতো? খুবই বেদনা লাগছে আপনি আমাদের বিশ্বাস করেন নি।
অভিমান ফুটে উঠল সুমাইয়ার কণ্ঠে।
‘অবিশ্বাস নয় সুমাইয়া, এটা সতর্কতা। ভেবে দেখলে বুঝবে এর প্রয়োজন ছিল’ আহমদ মুসা হাসতে হাসতে বলল।
সুমাইয়ার কথা শোনার পর বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টিতে সুমাইয়ার আব্বা তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। হতবাক সে, কোন কথা সরছে না তার কণ্ঠ থেকে। দু’চোখ গোগ্রাসে যেন গিলছে আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা জেন ও জোয়ানের দিকে ফিরে বলল, ‘যা বলেছি তোমরা মনে রেখ, সেই ভাবে কাজ করবে।’
‘আপনার সাথে আর দেখা হবে না, যোগাযোগ করতে পারবো না?’ কাঁদো কাঁদো কণ্ঠ জোয়ানের।
‘জোয়ান, তুমি বিজ্ঞানী। সৃষ্টিতে বন্ধনের মধ্যেও বিচ্ছিন্নতা আছে।’
বিষণ্ণ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘এই দেখা, এত ঘটনা না হলেই ভাল হতো।’ বলল জেন স্লান কণ্ঠে।
‘যে জীবন নাট্যের আমরা নট, তার প্রণেতা-পরিচালক তো আমরা নই।’
বলে আহমদ মুসা ডোনার দিকে ঘুরল।
পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ডোনা। যেন অনুভুতি তার ভোতা হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে ডোনার মানিব্যাগ বের করে ডোনার দিকে তুলে ধরে বলল, ‘তোমাদের কাছে অনেক ঋণী আমি ডোনা। অনেক করেছ তোমরা আমাদের জন্যে। দুঃখিত আমি, যাবার সময় তোমার আব্বার সাথে দেখা হলো না।’
মানিব্যাগ নেবার জন্যে হাত না বাড়িয়ে বলল ডোনা, ‘ যদি আমি বলি ওটা আপনার কাছে থাক।’ অত্যন্ত ভেজা কণ্ঠে বলল ডোনা।
‘আমি কপর্দকহীন ডোনা।’ নিজের বলতে দুনিয়ায় আমার কিছু নেই। তাই বলেই হয়তো গোটা ইসলামী দুনিয়ার সম্পদ আমার সম্পদ। সত্যিই টাকার কোন প্রয়োজন আমার নেই।
‘আমি ইসলামী দুনিয়ার মধ্যে পড়ি না। তবু আমার এ মানিব্যাগ কি আপনার হতে পারে না? খুব ছোট জিনিস। কিন্তু তাছাড়া তো দেবার কিছু নেই, নেবারও কিছু নেই।’
‘ঋণ বাড়াতে চাও বুঝি?’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘বাড়াতে চাই এই আশায়, ঋণ গ্রহিতা যদি আসেন ঋণ পরিশোধের জন্যে।’
বলেই ডোনা দু’হাতে মুখ ঢেকে দৌড় দিল গাড়ির দিকে।
আহমদ মুসা ডোনার মানিব্যাগ থেকে টাকা গুলো বের করে জোয়ানের হাতে তুলে দিল এবং মানিব্যাগটা নিজের পকেটে রাখল। বলল, ‘ডোনাকে বলো না যে, টাকা গুলো তোমাদের দিয়ে গেলাম।’
আহমদ মুসা তারপর জেন, জোয়ান, সুমাইয়া ও সুমাইয়ার আব্বার কাছে বিদায় নিয়ে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বিমান বন্দরের লাউঞ্জের দিকে এগুলো। দরজায় গিয়েও একবার পেছনে তাকালো না সে। ঢুকে গেল লাউঞ্জে।
‘জগতের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী, কিন্তু মনটা মোমের মত নরম। পেছনে ফিরে তাকাতে পারলো না একবারও।’ অনেকটা স্বাগত কণ্ঠে বলল সুমাইয়ার আব্বা।
জেন, জোয়ান ও সুমাইয়া তাকালো সুমাইয়ার আব্বার দিকে। পানি ঝরছিল জেন ও জোয়ানের চোখ দিয়ে। সুমাইয়ার চোখও ভেজা।
‘জনাব, আহমদ মুসা কখনই পেছনে ফিরে তাকান না, থামবার তাঁর অবসর নেই।’ ধীর কণ্ঠে বলল জোয়ান।
‘ঠিক, কিন্তু পেছনের স্মৃতিকে তিনি ভয়ও করেন। ভয়টা তার নিজে ভেঙ্গে পড়ার ভয়।’
‘হবে হয়তো। মাঝে মাঝে বিপ্লবী আহমদ মুসার চেয়ে মায়া মমতায় জড়ানো গৃহাঙ্গনের আহমদ মুসাকে মহত্তর বলে মনে হয়।’ হাসল জোয়ান।
সবাই তারা পা বাড়াল গাড়ীর দিকে।
ডোনার গাড়ীর কাছে এসে তারা দেখতে পেল, ডোনা তার গাড়ির সিটে মুখ গুজে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে ডোনার দেহ। কাঁদছে সে।