১
সুমাইয়ার আব্বা সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘দেখ তুমি আমার ছেলের বয়সের। আমি তোমাকে তুমি বলব, কিছু মনে করো না।’
সুমাইয়ার আব্বা ষাটোর্দ্ধ বয়সের। কিন্তু দেহের গাঁথুনি ভাল আছে বলে বয়স দশ বছর কম মনে হয়। নিরেট ফরাসী চেহারা। চোখে মুখে আভিজাত্যের ছাপ।
‘জি না। আমি বরং খুশী হবো।’ আহমদ মুসা বসতে বসতে বলল।
সুমাইয়া বসল তার আব্বার পাশে।
‘সুমাইয়ার কাছে সব শুনেছি। শুনে দেখতে এসেছি। কোন মুসলিম দেশের এমন শক্তি ও সাহসের কথাতো শুনিনি!’
‘কেন, মুসলমানদের শক্তি সাহসের ইতিহাস নেই?’ মুখে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
‘সে তো ইতিহাস।’
‘কেন ফিলিস্তিন, মিন্দানাও, মধ্য এশিয়া, ককেশাস, বলকানের কাহিনী?’
‘ঠিক বলেছ। ভুলে গিয়েছিলাম ওগুলোর কথা। স্পেনের কথা বাদ দিলে কেন? সেখানে তো রক্তপাত হীন বিপ্লব ঘটে গেল। কিন্তু বৎস, তবু আমি বলব- শক্তি, সাহস ও বুদ্ধিতে মুসলমানরা অনেক পিছিয়ে।’
‘আপনার কথা ঠিক, কিন্তু সবাই পিছিয়ে একথা ঠিক নয়।’
‘হ্যাঁ, তোমার মত সম্মানজনক কিছু ব্যতিক্রম আছে।’
‘আমি ব্যর্থতাকে অসম্মানজক কিংবা অস্বাভাবিক মনে করি না।’
‘কেন?’
‘আমরা মুসলমানরা ইউরোপকে ঘুম থেকে জাগিয়ে নিজেরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সে ঘুম থেকে সবে আমরা জেগেছি।’
‘চমৎকার বলেছ বৎস। কিন্তু মুসলমানদের এ ঘুমটা বড় দীর্ঘ হয়েছিল, না?’
‘সুখের ঘুমটা একটু গাঢ়ই হয়। তখন আমরা অর্ধ পৃথিবীর মালিক। অঢেল অর্থ ছিল আমাদের পায়ের তলায়। এই সম্পদ আমাদের গৃহবিবাদের সৃষ্টি করেছিল। গৃহবিবাদ ধ্বংস করেছিল আমাদের শক্তিকে এবং ডেকে এনেছিল শত্রুকে। সুখের ঘুম পরিণত হয়েছিল পতনের ঘুমে।’
‘চমৎকার, চমৎকার। তোমার সম্পর্কে মারিয়ার কাছ থেকে যা শুনেছিলাম তার চেয়েও তুমি চমৎকার। আমি একটা কথা বলব তোমাকে।’
‘কি কথা?’
‘আমার গরীবখানা তোমাকে নিয়ে যেতে চাই। যাবে তুমি?’
‘ফ্রান্সের একটি মুসলিম পরিবারের সাথে পরিচিত হওয়াকে আমি আমার সৌভাগ্য মনে করি। কিন্তু আমার মনে খুব লেগেছে, সুমা সালাম দেয়া ভুলে গেল কেন?’
‘এটা কি আমার দোষ? সালাম পেলাম কবে? সালাম দেয়ার সুযোগ পেলাম কবে?’ অভিমান ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বলল সুমাইয়া।
সুমাইয়ার আব্বা গম্ভীর হযে উঠল। তারপর ধীর কণ্ঠে বলল, ‘শুধু সালামের কথা বলছ? মুসলিম কালচারের কি আছে আমাদের জীবনে। নামাজ জানি না, রোজা করি না। সুমা ঠিকই বলেছে, এর জন্য কি আমরা দায়ী। আমার আব্বা কুরআন শরীফ পড়া জানতেন না, আমি জানিনা, আমার সন্তান সুমাইয়াও জানে না। আমরা অবস্থার শিকার বৎস। আমরা মুসলিম নাম টিকিয়ে রেখেছি, আদম শুমারীর খাতায়। এখনও নিজেদের মুসলিম পরিচয় লিখছি, তোমাকে মুসলিম জেনে আন্তরিকভাবে আনন্দিত হয়েছি- এই যে বোধ, এটাই খুব কম?’
একটু থামল সুমাইয়ার আব্বা মোহাম্মদ দ্য গল। মুহূর্তকাল পরেই আবার বলতে শুরু করল, ‘আমার ইচ্ছা ছিল একটি মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করব। কিন্তু তা ভাগ্যে জোটেনি। বিয়ে করতে হলো এক ক্যাথলিক মেয়েকে। কিন্তু গীর্জায় গিয়ে বিয়ে করতে রাজি হইনি। অবশেষে প্যারিস গিয়ে মসজিদের ইমাম ডেকে ইসলামী মতে বিয়ে করেছি। আমার এই চেষ্টাকে কি খুব ছোট করে দেখবে বৎস?’
‘ধন্যবাদ জনাব। ধর্মের প্রতি আপনার আন্তরিকতা প্রশংসনীয়। কিন্তু জনাব এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে জাতি হিসাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যাবেনা।’
‘ঠিক বলেছ, কিন্তু উপায় কি বলো। এ নিয়ে ভাববার কথা আমাদের একথা ঠিক। কিন্তু এর সমাধান কি আমাদের দ্বারা সম্ভব? কুরআন শিক্ষার সুযোগ আমি পাইনি, আমার সন্তানকেও দিতে পারিনি। এর জন্যে আমরা দায়ী, কিন্তু আর কেউ দায়ী নয়? মুসলিম দেশগুলোর কি কোনই দায়িত্ব ছিলনা আমাদের প্রতি?’
‘অতীতে এটা হয়নি জনাব, ইনশাআল্লাহ এখন হচ্ছে, হবে। বিশ্ব মুসলিম লীগ (রাবেতা) এই সমস্যা মোকাবেলার জন্যে দুনিয়া ব্যাপী অনেক কিছু করেছে, করছে। এ ছাড়া বেশ কিছু মুসলিম দেশ এই ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসছে।’
‘খুব খুশীর খবর এটা। এখন বল, যাচ্ছ তো আমার গরীবালয়ে? বহু চেষ্টা করে একটা কোরআন শরীফ জোগাড় করেছি। আমার স্ত্রীসহ সকলের ইচ্ছা, তোমার কাছ থেকে কুরআনের পাঠ শুনবো। আমরা মক্কা, কায়রো ও ইস্তাম্বুল রেডিও’র কুরআন পাঠ শুনি। কিন্তু স্বচক্ষে আমরা কেউ কোরআন দেখিনি বা শুনিনি।’
‘অবশ্যই যাব জনাব।’
‘ধন্যবাদ বৎস। আরেকটা কথা বলব।’
‘বলুন।’
‘সুমাইয়ার ফিল্ম নাকি আটকে রেখেছে?’ হেসে বলল সুমাইয়ার আব্বা।
‘তুমি মন খারাপ করেছ সুমাইয়া। আমি আটকে রাখিনি ওগুলো। বলতে পার নিরাপত্তামূলক হেফাজতে রেখেছি। আগামী কাল দশটার মধ্যে পেয়ে যাবে।’
‘আমি তো আপত্তি করিনি। আমি আব্বাকে জানিয়েছি মাত্র।’ বলল সুমাইয়া।
‘আমারও আপত্তি নেই। তবে জানতে লোভ হচ্ছে যে, সবাই প্রচার চায়, তুমি চাওনা কেন?’ বলল সুমাইয়ার আব্বা।
‘সবই জানতে পারবেন। আগামী কাল ১০ টা পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করার জন্যে আমি আপনাদের অনুরোধ করছি।’
‘তোমার কথায় যদিও আগ্রহটা বাড়ছে, তবু ঠিক আছে। কখন যাবে আমাদের বাড়িতে। এখনি চল লাঞ্চ করে চলে আসবে।’
প্রস্তাবটি ভালো লাগল আহমদ মুসারও।
সবাই উঠল।
এখন বিকাল।
সুমাইয়ার বাড়ি থেকে আসতে অনেক দেরী হয়েছে আহমদ মুসার। ফিরতে ফিরতে প্রায় ৪টা বেজে গেছে। আহমদ মুসা হোটেল রুমে আসর নামাজ পড়ে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। যোহরের নামাজ সে পড়ে ছিল সুমাইয়াদের বাড়িতে। সাবইকে নিয়ে নামাজ পড়েছে, নামাজ শিখিয়েছে ওদের। এই প্রথম সুমাইয়াদের বাড়িতে নামাজ হলো। আহমদ মুসা অবাক হয়েছিল, আবেগ অনুভূতি দিক দিয়ে পরিবারটা শতকরা একশত ভাগ মুসলমান। এমনকি সুমাইয়ার মা ক্যাথলিক ছিল, মনের দিক দিয়ে এখন সে সম্পূর্ণ মুসলমান হয়ে গেছে। কিন্তু মুসলমানের আবেগ অনুভূতি ছাড়া পরিবারে মুসলমান হওয়ার আর কোন চিহ্ন নেই। নামাজের জন্যে প্রয়োজনীয় সুরা বা দোয়া ওরা ফরাসী ভাষায় লিখে নিয়েছে। ওরা কথা দিয়েছে ওরা নামাজ রোজা করবে। ওরা আরও কথা দিয়েছে, প্যারিসের মুসলিম দূতাবাসগুলো ফরাসী মুসলমানদের কুরআন ও হাদিস শিক্ষা দেয়ার যে ব্যবস্থা করেছে তার সুযোগ তারা গ্রহণ করবে। আহমদ মুসা ওদের কথা দিয়েছে, দক্ষিণ ফ্রান্সে অন্তত দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার জন্যে সে রাবেতা ও মুসলিম দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে উদ্যোগ নেবে। আর যোগাযোগ করতে বলেছে। ‘ইয়ুথ সোসাইটি ফর ইউরোপিয়ান রেঁনেসা’- এর সাথে যুক্ত হলে সুমাইয়া সব কিছুই জানতে পারবে।
আসার সময় সুমাইয়ার মা আহমদ মুসাকে বলেছিল, ‘সত্যি বাবা কে তুমি? ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অনেক মুসলমানের সাথে দেখা হয়েছে, তাদের চেয়ে একদমই ব্যতিক্রম তুমি। জ্ঞান যোগ্যতা এবং আচরণ সব দিক দিয়েই তুমি, আমি মনে করি একজন পূর্ণ মানুষ। কে তুমি বাবা? সুমাইয়া ও তার আব্বার কাছ থেকে শুনলাম, তুমি তোমার পরিচয় গোপন রাখতে চাও। কিন্তু মায়ের কাছে কি কিছু গোপন রাখতে আছে?’
‘আপনি এভাবে কথা বললে আমি বিপদে পড়ে যাব আম্মা। আমার সব পরিচয় তো আপনাদের সামনে, শুধু কিছু কথা বলিনি আমি অপরিহার্য প্রয়োজনেই।’
‘তুমি দীর্ঘজীবি হও বাছা। আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘজীবি করুন।’
আহমদ মুসাকে বিদায় দিতে এসে আহমদ মুসার গাড়ির দরজা বন্ধ করে জানালায় মুখ এনে সুমাইয়া বলেছিল, আপনি ভাগ্যবান। আমার রাশভারি মাকেও আপনি জয় করলেন। দীর্ঘজীবি হওয়ার জন্যে অমন দোয়া আমার মা কোনদিনই আমার জন্যে করেননি।’
‘যার মা নেই, তাকে আল্লাহ এমন ভাবেই মা জুটিয়ে দেন।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘ধন্যবাদ সুমাইয়া, এখন তোমাকে মুসলিম মেয়ের মত মনে হচ্ছে।’
নামাজের সময় সুমাইয়া গায়ে চাদর জড়িয়েছিল, সে চাদর এখনও তার মাথায় আছে।
‘দোয়া করুন, এ চাদর যেন গা- মাথা থেকে আর না নামে।’
গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল সুমাইয়া।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছিল। সুমাইয়া ছুটে গাড়ির জানালায় এসে উচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘আস্সালামু আলাইকুম।’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। ধন্যবাদ সুমা।’ হেসে বলেছিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা হোটেলের বেড়ে শুয়ে এ সব ভেবে এবং এপাশ ওপাশ করে চোখ থেকে ঘুম তাড়াচ্ছিল। মনে হচ্ছে কারও জন্যে অপেক্ষা করছে সে।
এখন বিকেল সাড়ে চারটা।
| | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »