৪৯. বিপদে আনাতোলিয়া

চ্যাপ্টার

মিসেস গাজেনের বাড়িটা সুন্দর একটা ডুপ্লেক্স। নিচের তলাতে থাকে আয়া ও পরিচারিকা। রান্না-বান্না, ষ্টোর সব নিচ তলাতেই। সব মিলিয়ে নিচ তলায় ৫টি ঘর।
নিচ তলা থেকে সার্চ শুরু করেছিল আহমদ মুসা।
কাজে লাগতে পারে এমন কিছুই পেল না সে নিচ তলায়।
নিচ তলায় সিঁড়ির গোড়ায় বড় একটা লাউঞ্জর মত জায়গা। নিচ তলার কেন্দ্র এটাই। এখান থেকে রান্নাঘর, স্টোর, ড্রয়িং, শোবার ঘর সবই দেখা যায়। এখানে দোল খাওয়া একটা ইজি চেয়ার।
আহমদ মুসা আয়াকে জিজ্ঞেস করল, ‘এ ইজি চেয়ারটা কার?’
সার্চের সময় আয়া ও পরিচারিকাকে আহমদ মুসা সাথেই রেখেছিল।
‘এখানে ম্যাডাম বসতেন। ছুটির দিন কিংবা অফিস থেকে আসার পর বিকেলে এখানে বসতেন। আমরা কাজ তরতাম, আর তিনি বসে বসে দেখতেন এবং গল্প করতেন।’ আহমদ মুসার প্রশ্নের উত্তরে বলল আয়া।
পরিচারিকা ও আয়া দু’জনেই মধ্যম বয়সের। পরিচারিকা গোবেচারা চেহারার, কিন্তু আয়ার চোখ-মুখ খুব শার্প। আর্মেনীয়, না তুর্কি বুঝা মুশকিল। তবে কথায় আর্মেনীয় টানটা একটু খেয়াল করলেই বুঝা যায়।
‘মিসেস গাজেন ছুটি ও অবসর আর কিভাবে কাটাতেন আয়া?’ জিজ্ঞাসা আহমেদ মুসার।
‘লিখে-পড়ে তিনি সময় কাটাতেন,’ বলল আয়া।
‘কি লিখতেন?’ জিজ্ঞাসি আহমদ মুসার।
‘‘দৈনিক ভ্যানের নিকল’-এ নিয়মিত তিনি ছদ্মনামে কলাম লিখতেন।’ আয়া বলল।
‘তাঁর সে কলামের কি কোন কালেকশন আছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আছে অবশ্যই। তার স্টাডিতে পাওয়া যেতে পারে।’ আয়া বলল।
‘নিচের কাজ শেষ। চলুন উপরটা দেখব।’
বলে আহমদ মুসা ইজি চেয়ার ক্রস করে সিঁড়ির দিকে যাবার সময় ইজি চেয়ারের পেছনের ‘সেফারস প্লেট’ তার নজরে পড়ল। প্রস্তুতকারী প্রতাষ্ঠানের নামটাই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। টার্কিস হরফে ‘আডিরা ফার্নিচারস’। ‘আডিরা’ হিব্রু শব্দ। অর্থ- ‘শক্ত’, ‘শক্তিশালী’। সেফারস প্লেটে একটা মনোগ্রাম। বহুকোণ বিশিষ্ট তারার মধ্যে আর্টিস্টিক কায়দায় হিব্রু অক্ষরে আডিরা লেখা।
হঠাৎ আহমেদ মুসার কি মনে পড়ল। একটু ঘুরে সামনে গিয়ে ইজি চেয়ারের একটা হাতলের উপর চোখ ফেলল। তার সন্দেহ ঠিক। এগুলোও হিব্রু অক্ষর। এগুলোও হিব্রু অক্ষর। উপর থেকে নিচে একটি করে অক্ষর বেশ স্পেস দিয়ে লেখা হয়েছে। মোট চারটি অক্ষর। চারটি অক্ষরকে একত্রিত করলে একটা শব্দ হয়ে যায়। সেটা হলো হিব্রু ‘বাটিয়া’ শব্দ যার অর্থ ‘ঈশ্বরের কন্যা’।
এগুলো নিশ্চয় মিসেস গাজেনের হাতের লেখা, তাহলে হিব্রু তিনি জানতেন, ভাবল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
আপনাতেই আহমদ মুসা বলল, ‘একটা কিছু লেখা দেখলাম। কিন্তু বুঝলাম না।’ বলেই আহমদ মুসা সিঁড়ির দিকে চলল।
উপরে উঠে এল আহমদ মুসা আয়াকে সাথে নিয়ে।
উপরে চারটি রুম। একটা ড্রইং, একটা মাস্টার বেড, একটি অতিথি কক্ষ এবং একটি স্টাডি রুম। মাস্টার বেড রুমের সাথে আরেকটা ছোট কক্ষ আছে। ওটা ড্রেসিং রুম।
মাস্টার বেডে ঢুকেই আহমেদ মুসা দেয়ালে দেখল একটা ছবি টাঙানো। নবযৌবনা এক মহিলা।
‘মিসেস গাজেনের ছবি, না?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা আয়াকে।
‘জি হ্যাঁ, অনেক আগের ছবি তাঁর।’ বলল আয়া।
‘তোমার ম্যাডাম তো খুবই সুন্দরী, বিয়ে করেননি কেন? মিসেসই বা হলেন কেমন করে?’ ছবির দিকে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
একটুক্ষণ চুপ করে থাকল আয়া। তারপর বলল, ‘স্যার, এটা তার পার্সোনাল ব্যাপার। তিনি কোন দিন বলেননি, আমিও জিজ্ঞেস করিনি। তবে আমি শুনেছি, তিনি প্রথম যৌবনে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন। কিন্তু এসব নিয়ে তার কোন দুঃখবোধ ছিল না। তিনি নিজেকে ‘ডটার অব গড’ ভাবতেন। যতদূর জানি, তাঁর মিসেস লেখার কারণ মানুষের কৌতুহল থেকে নিজেকে রক্ষা করা।’
‘উনি কোন ধর্ম অনুসরণ করতেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আমি তাঁকে কোনদিন কোন ধর্মশালায় যেতে দেখিনি। বাড়িতে কোন ধর্মগ্রন্হও আমার চোখে পড়েনি।’
আয়াকে ধন্যবাদ দিয়ে আহমদ মুসা আয়ার সহযোগিতায় শোবার ঘরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কাগজ-পত্র, খাতা-ডাইরি এসবই তার লক্ষ্য ছিল। আলমারি, ড্রয়ার, সবই দেখা হয়ে গেল। কিছুই পাওয়া গেল না।
স্টাডি রুমটাও দেখা গেল ফাঁকা। কিছু বই কিছু ফাইল ছাড়া কিছুই নেই। বইয়ের অধিকাংশই ইতিহাস বিষয়ক। প্রত্নতত্বের উপর কিছু বই আছে। চরিত্রের দিক দিয়ে বইগুলো সবই একাডেমিক ও প্রফেশনাল। ফাইলগুলো দুই ধরনের। তাঁর লেখার কালেকশান, অন্যদিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিষয়ক অন্য লেখকদের লেখা একটি কালেকশন। মিসেস গাজেনের লেখার কিছু শিরোনাম দেখে বুঝল তার লেখার মূল বিষয় হলো, সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে জাতিগত বিভেদের বিলোপ সাধন। মনে মনে হাসল আহমদ মুসা। মিসেস গাজেনের নাম খ্রীস্টান ধর্মযাযিকার হলেও তিনি লেখেন ইহুদি স্বার্থের পক্ষে। ইহুদিদের তথাকথিত মানবতাবাদের রাজনীতিকরা চাচ্ছে, দুনিয়ার সব ধর্ম ও সব জাতির বিলয় ঘটু। শুধু টিকে থাকুক বনি ইস্রাইল জাতি ও তাদের ইহুদি ধর্ম।
অবশ্য আহমদ মুসা স্বীকার করল তুরস্কের পূর্ব আনাতোলিয়া অঞ্চলের রাজনীতিতে মিসেস গাজেনের ভূমিকা খৃস্টানদের পক্ষে গেছে। কারণ এ অঞ্চলে তুর্কি স্বতন্ত্রের বিলুপ্তির পর হবে তুর্কি শাসনের বিলুপ্তি। মাউন্ট আরারাতকেন্দ্রিক পূর্ব আনাতোলিয়া অঞ্চল নিয়ে আর্মেনিয়ার যে নীল-নকশা তার বাস্তবায়নের জন্যে এমন একটা পরিস্থিতিই দরকার।
কিছু বই, বইয়ের র‍্যাক, টেবিল, টেবিলের ড্রয়ার ও একটা কম্পিউটার ছাড়া স্টাডিতে আর কিছু নেই।
আহমদ মুসা কম্পিউটার চেক করল। কম্পিউটারে মাত্র কয়েকটি ফাইল আছে। ফাইল সবই লেখা এবং লেখা সংক্রান্ত তথ্যবিষয়ক। কোন গোপন ফাইল কম্পিউটারে নেই।
ড্রইংরুম ও গেস্টরুমও দেখা হয়ে গেছে। সেদু’টি রুম আরও ফাঁকা।
কোথাও কোন কিছু না পাওয়াই প্রমাণ করেছে, বিষয়টা অস্বাভাবিক। মিইজিয়ামে রক্তাক্ত অভিযানে জড়িতদের সাথে মিসেস গাজেনের যোগসাজশ, তার হিব্রু জানা, জিউইশ ব্যাকগ্রাউন্ডর ভ্যান-ক্রনিকল পত্রিকায় লেখা, তার নাম, তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে বড় কোন বিষয়ের সে একটা গ্রন্হি। যদি তাই হয়, তাহলে এর পরিচয় কোথাও না কোথাও সে রাখবে। সে ‘কোথাও’ টা কোথায়?
এ সম্পর্কে জানার হাতের কাছে একমাত্র মাধ্যম হলো আয়া মেয়েটা। এই বুদ্ধিমতি, চালাক মেয়েটা কিছুই জানে না, তা হতে পারে না।
আহমদ মুসা আয়া মেয়েটাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মিসেস গাজেনকে না জানলে, হত্যাকারীদের মোটিভ বুঝা যাবে না। হত্যার মটিভ না জানলে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা মুষ্কিল। কিন্তু মিসেস গাজেনের পরিচয়মূলক কিছুই তো পেলাম না।’
মেয়েটার চোখে-মুখে চাঞ্চল্যের প্রকাশ ঘটল। বলল, ‘স্যার একটা জায়গা অবশিষ্ট আছে, কিন্তু…।’
‘কিন্তু কি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘স্যার, বিষয়টা আমি পরিষ্কারভাবে জানি না। শোবার ঘরের আলমারির নিচ থেকে একটা কিছু বের করতে দেখেছি। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।’
‘কি ধরনের জিনিস বের করতে দেখেছেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ছোট আয়তাকার বাক্সের মত।’ বলল আয়া মেয়েটা।
‘চলুন তো দেখি।’ বলেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
দু’জনে মাস্টার বেডে ঢুকে আলমারির গোড়ায় গিয়ে বসল।
আহমদ মুসা নিজেই একটা স্টিক দিয়ে আলমারির নিচের জায়গাটা এদিক-ওদিক দেখল। কাঠিতে কিছুই বাঁধলো না।
এবার আহমদ মুসা আলমারির নিচটা হাত দিয়ে হাতড়াল। আলমারির তলা ও মাটির মধ্যবর্তী স্থান গোটাই ফাঁকা।
আরেকটা জিনিস দেখে বিস্মিত হলো। সেটা আলমারির বটমে দু’পাশ থেকে দূরত্বের ঠিক মাঝখানে আলমারির ‘মেকারস প্লেট’ লাগানো। আহমদ মুসার কাছে এটা স্বাভাবিক মনে হলো না। এ প্লেট সাধারণত আলমারির মাথায় লাগানো তাকে, যাতে সহজে মানুষের চোখে পড়ে। আরেকটা জিনিসও বিদঘুটে ঠেকল। মেকারস প্লেটটা অবস্থানগত ভারসাম্যের দিক দিয়ে যেখানে লাগানো দরকার ঠিক তার দুই তিন ইঞ্চি উপরে লাগানো। অন্য একটি বিষয় হলো, আলমারির দরজার নিচের কাঠামোটা যার সাথে আলমারির খুরা রয়েছে, সেটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চওড়া।
এ সবের সাথে কি আলমারির নিচ থেকে আয়তাকার বাক্স বের করার কোন সম্পর্ক আছে?
মেকার্স প্লেট নেড়েচেড়ে দেখার সময় দু’আঙুল দিয়ে দুই প্রান্তে চাপ দিল। সংগে সংগে প্লেটটি খসে পড়ে গেল। প্লেটটি চুম্বকে আটকে ছিল, বুঝল আহমদ মুসা।
মেকার্স প্লেট সরে গেলে সেখানে প্লেটটির আকার থেকে কিছুটা ছোট আয়তাকার একটা উইনডো বেরিয়ে এল। সেই উইনডো পথে সবুজ রংয়ের আংটার মাথা দেখা গেল।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নিশ্চিত হলো সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।
আংটা ধরে টান দিতেই ইঞ্চি খানেক বেরিয়ে এল। সংগে সংগেই কিছু একটা পড়ার শব্দ হলো আলমারির তলায়।
আহমদ মুসা আলমারির তলায় হাত দিয়ে স্টিলের আয়তাকার একটা বাক্স বের করে আনল।
আয়া মেয়েটি আনন্দে বলে উঠল, ‘স্যার, এই বাক্সই আমি ম্যাডামের হাতে দেখেছি।’
আহমদ মুসা ঢাকনা খুলে দেখর বাক্সে একটা ডাইরি রয়েছে।
আহমদ মুসা আয়াকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘বাক্সে একটা ডাইরি দেখে যতটা খুশি হয়েছি, বাক্স ভর্তি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হীরা পেলেও এত খুশি হতাম না। আপনি সাহায্য করেছেন। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।’
‘ধন্যবাদ নয় স্যার, ম্যাডামের হত্যাকারীরা শাস্তি পেলেই আমি খুশি হবো।’ বলল আয়া মেয়েটা।
‘অবশ্যই ওরা শাস্তি পাবে।’ বলে উঠে দাঁড়ার আহমদ মুসা।
‘আমরা কী করব স্যার, আমাদের কী হবে?’ বলল আয়া।
‘আপনারা যেভাবে আছেন, সেভাবেই থাকবেন। আপনাদের কোন ভয় নেই। আপাতঃত পুলিশ পাহারা তো থাকছেই।’ আহমদ মুসা বলল।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য হাঁটা শুরু করল আহমদ মুসা।
একটা প্রাইভেট বাড়িকে আহমদ মুসা তার অফিস বানিয়েছে। ডিজিপি মাহির হারুন ও অন্যদিকে ড. আজদা, সাবিহা সাবিত, ড. সাহাব নূরী, ড. মোহাম্মাদ বারজেনজো ছাড়া এই বাড়ির নতুন পরিচয়ের খবর আর কেউ জানে না।
ড. মোহাম্মদ বারজেনজো সেই রাতের ঘটনার পর জরুরী প্রয়োজনে ইস্তাম্বুল গিয়েছিলেন।
সেই প্রাইভেট হাউস মানে আহমদ মুসার অফিসে তার বিশ্রাম কক্ষে আহমদ মুসা সেই ডাইরী নিয়ে বসেছে।
ডাইরির পাতা উল্টাচ্ছে আহমদ মুসা। ঠিক ডাইনী নয় এটা। বিচ্ছিন্ন স্মৃতিচারণ।
স্মৃতিচারণের বিষয় দেখে দেখে পড়তে লাগল আহমদ মুসা। শুরুতেই সে লিখেছে:
‘প্রথম যেদিন নিজের সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে জানলাম, দেখলাম জীবনটাই কৃত্রিমতায় সাজানো। যে পিতাকে মুসলিম পিতা হিসাবে জেনেছি, জানলাম তিনি একজন ইহুদি আর্মেনীয়। আর জানতাম আমার মুসলিম পিতা বিয়ে করেছেন কনভার্টেড সুন্দরী আর্মেনীয়কে, যার হাজারো দৃষ্টান্ত আছে তুরস্কে, আর্মেনিয়ায়। পরে জানলাম মায়ের এ পরিচয় ঠিক নয়। তিনিও আর্মেনীয় ইহুদি। মুসলিম ও আর্মেনীয় শব্দ মিলিয়ে আমার নাম হলো অ্যানোশ আব্দুল্লাহ্ গাজেন। আমি মুসলিম পরিচয় নিয়ে বড় হলাম। কিন্তু আমার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত হলো ইয়েরেভিনের একটি হিব্রু স্কুলে। তারপর আমরা একদিন রাতের অন্ধকারে মাইগ্রেট করে তুরস্কের পূর্ব আনাতোলিয়ার সবচেয়ে বড় শহর ভ্যানে চলে এলাম আর্মেনিয়া থেকে পালিয়ে আসা এক মুসলিম পরিবার হিসেবে। ভ্যানে আমাদের জন্যে বাড়ি, ব্যবসা, নাগরিক কাগজপত্র সবই প্রস্তুত ছিল। কিভাবে ছিল তা তখন বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝেছি। এসবই জগতজোড়া ইহুদি আণ্ডারওয়ার্ল্ডের কাজ।’
‘এ বিষয়গুলো আমি জানতে পারি, যখন আমার আঠারো বছর বয়স। তখন আমি ভ্যানের এক সুন্দরী কলেজ ছাত্রী। আমি মুষড়ে পড়ি আমার নতুন পরিচয়ে। কিন্তু আমার এই মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটে যখন আমি ভ্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, যখন আমি আর্মেনীয় বংশজাত একজন ইহুদি তরুণকে ভালোবেসে ফেলেছি। অতীতকে ভুলে গিয়ে আমি আমার প্রতিভাবান প্রেমিককে ঘিরে নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠি। তখন আমার সুখস্বপ্ন ষোলকলায় পূর্ণ হয় যখন আমি পূর্ব আনাতোলিয়ান সুন্দরী প্রতিযোগীতায় প্রথম হই এবং প্রেমিককে বিয়ে করার কথা প্রকাশ করে দিন-তারিখের জন্য পিতামাতাকে বলি।’
‘আমার স্বপ্নের ষোলকলা যখন পূর্ণ ভাবছি, তখনই আমার জীবনের অন্ধকার পথে যাত্রা শুরু। একদিন গভীর রাতে আমাদের বাড়িতে আমার পিতা-মাতার সামনে তিনজন আগন্তুক আমাদের কম্যুনিটি লিডারের পরিচয় দিয়ে বলল, আংকারা সামরিক স্কুল থেকে অলরাউন্ডার, ব্রিলিয়ান্ট রেকর্ড নিয়ে পাস করে আসা ভ্যান সামরিক গ্যারিসনে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত একজন অমিত সম্ভবনাময় সামরিক অফিসারকে ভালোবাসতে হবে। তাকে বিয়ে করতে হবে। আমি এ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। উত্তরে সাপের মত ঠাণ্ডা গলায় ওরা জানায় যে, আমার জীবন, আমার বাপ-মায়ের জীবন, আমাদের বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই তাদের। তাদের কথার অন্যথা করার উপায় আমাদের নেই। তাদের কথা না মানলে পরের দিনই আমার প্রেমিকের লাশ আমি দেখতে পাব। তারপর আমার পিতামাতা, তার…। আমি তাদের কথায় রাজি হয়ে যাই। আমি হয়ে যাই তাদের হাতের পুতুল। সেই সামরিক অফিসারের সাথে তারাই আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রথম দৃষ্টিতেই সে আমাকে পছন্দ করে, তারপর ভালোবাসা, তারপর…। সে পাগল হয়ে উঠে। আমি বুঝতে পারি, সে অলক্ষ্যেই আমাদের স্বার্থের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে। সে স্বার্থ কি আমি জানি না, জানে আমাদের কম্যুনিটির গুরুরা, যারা আমাদের ব্যবহার করে। সে গোপনে আমাকে বিয়ে করে। এই কথা সে প্রকাশ করতে পারেনি পারিবারিক ও আইনি কারণে। কারণ স্ত্রী আছে। আজও আমি তাঁর গোপন স্ত্রী। আজও আমার গোপন স্বামী আমাদের কম্যুনিটির স্বর্থে কাজ করছেন। সে স্বার্থটা কি আমি জানি না। জীবনটা যদি আমার এটুকুর মধ্যে শেষ হতো, তাহলেও ভালো ছিল।’
‘কিন্তু তা হয়নি। আমার সৌন্দর্য্য, আমার যৌবনকে এটুকু মূল্যে বিক্রি করে আমার কম্যুনিটি সন্তুষ্ট হতে চায়নি। তখন আমি আমার পিতা-মাতা থেকে আলাদা হয়ে এক গোপন বাড়িতে থাকি। এ গোপন বাড়িটি আমার গোপন স্বামীই ঠিক করে দিয়েছেন। আমার স্বামীর পোস্টিং তখন আংকারার হেডকোয়ার্টারের সেন্ট্রাল কমান্ডে। প্রতি উইক-এন্ডে আসেন। সেই সময় একদিন রাতে আমাদের কম্যুনিটির দু’জন এলেন। তারা দু’জন সামরিক অফিসারের ফটো দেখিয়ে তাদের পরিচয় বললেন। একজন ভ্যান-এর ব্রিগেড কমান্ডার। এরা এখন থেকে সপ্তাহের দুইদিন ভিন্ন দিনে আসবেন সময় কাটাবার জন্যে। আমাকে তাদের সংগ দিতে হবে। তারা নাকি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে দেখেছেন এবং তারা নাকি আমার সাথে সাক্ষাতের জন্যে উদ্গ্রীব। উল্লেখ্য, যে ধরনের অনুষ্ঠানে তারা আমাকে দেখেছেন, সে সব অনুষ্ঠানের আয়োজক আমাদের কম্যুনিটির লোকেরা। শান্তি, সম্প্রীতির প্রসারমূলক ও বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালনমূলক এসব অনুষ্ঠানে সম্ভাবনাময়, প্রতিভাবান সামরিক অফিসারদেরও ডাকা হয় গণসংযোগের কথা বলে। যথারীতি আমি এ প্রস্তাব অস্বীকার করে বলি, গোপন হলেও সে আমার স্বামী। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আমি করতে পারবো না। তখন আবারও আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়, তাদের কথার অমান্য করার সুযোগ আমার নেই। আমার জীবন তাদের, আমার নয়। এর সাথে ভয় দেখানোর পালা। তারাই জয়ী হয়। আমার জীবন আরও অন্ধকারে ডুবে যায়। এ ভাবেই চলছে আমার জীবন।’
‘মিউজিয়ামে চাকুরীর ব্যবস্থাটা আমার কম্যুনিটির লোকরাই করে দিয়েছে। আমার গোপন স্বামীর অনুমতিও এতে ছিল। চাকুরীর সুবাদে নতুন ডুপ্লেক্স বাড়িটাতে আছি আমি। এটা একদিকে সামরিক গ্যারিসন, অন্যদিকে মিউজিয়াম দু’টোরই কাছে। এ ডুপ্লেক্স বাড়ির ভালো দিক হলো, উপর তলাটা নির্জন, আমার অন্ধকার জীবনের জন্যে সুবিধাজনক।’
‘আমাকে ওরা সন্দেহ করছে কি? ডিজিপি মাহির হারুন সেদিন আমার সাথে যেভাবে কথা বলল, তাতে সেটাই মনে হয়। সেদিন আমার সাথে যেভাবে কথা বলল, তাতে সেটাই মনে হয়। সেদিন আমার কম্যুনিটির লোকেরা এসে আমাকে বলে গেছে, সবই ঠিক-ঠাক চলছিল, কিন্তু কি যেন আবু আহমদ নামের ঘোড়েল একজন লোক এসেছে ভ্যান-এ। আমি যেন কথা-বার্তায় সাবধান থাকি। বিশেষ করে সামরিক অফিসারদের পরিচয়ের ব্যপারটা খুবই স্পর্শকাতর। এটা কোনও ভাবেই প্রকাশ হতে দেয়া যাবে না।’
‘সেদিন এক অনুষ্ঠানে দেখলাম, প্রথম যৌবনে আমি যেমন ছিলাম, সে ধরনেরই কিছু মেয়ের আনাগোনা। বুঝলাম, আমাদের কম্যুনিটির লোকেরাই তাদের আমদানি করেছে। আমার অফিসারদের সাথেও দেখি তাদের পরিচয় করানো হচ্ছে। বুঝতে বাকি রইল না, তারা আমার মতই কোন হতভাগি। আমার মত এই হতভাগিদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের কম্যুনিটির লোকেরা যে ব্যবসায় করছে, সে ব্যবসায়ের স্বার্থ কি, লক্ষ্য কি?’
ডাইরিটা এ পর্যন্ত পড়েই আহমদ মুসা পড়া বন্ধ করল। আগে-পিছের পাতা উল্টাতে লাগল সেই সামরিক অফিসারদের নাম কোথাও আছে কিনা, কোনওভাবে নাম কোথাও পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু না, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নাম কোথাও পেল না। আশ্চর্য, অনাহুত বিশ্বাসঘাতকতা ও ব্ল্যাকমেইলের শিকার একজন মহিলা তার কম্যুনিটির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। সব কথাই সে বলেছে, কিন্তু নামগুলো উল্লেখ করেনি। কম্যুনিটির স্বার্থ কি জানতো না, তবু কম্যুনিটির স্বার্থ সে রক্ষা করতে চেয়েছে, স্বার্থ রক্ষা করেছে তার সাথে সম্পর্কিত সামরিক উচ্চপদে আসিন। তাদের নাম-পরিচয় জানা একন এই মুহুর্তের জন্য সবচেয়ে বড় কাজ।
আহমদ মুসা টেলিফোন করল মিসেস গাজেনের আয়া সোমিকে।
ওপার থেকে সোমির কণ্ঠ পেতেই আহমদ মুসা বলল, ‘আমি মিসেস গাজেনের খবর নিতে চাই। আমার কয়েকটা কথা জানার আছে।’
‘ওয়েলকাম স্যার, বলুন।’ বলল গাজেনের আয়া।
‘মিসেস গাজেনের কি এক বা একাধিক বন্ধু ছিল যাদের সাথে তিনি অন্তরঙ্গভাবে মিশতেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
ওপার থেকে কোন জবাব এল না। নিরব সোমি, মিসেস গাজিনের আয়া।
সোমাকে নিরব দেখে আহমদ মুসাই আবার বলল, ‘দেখুন সোমি, মিসেস গাজেনের হত্যাকারীদের পাকড়াও করতে আপনার সাহায্য আমরা চাই। ওদের পাকড়াও করতে যে প্রশ্ন আমি করেছি, তার উত্তর জানা খুবই জরুরী।’
‘স্যরি স্যার। ম্যাডামের পার্সোনাল বিষয় নিয়ে কথা বলতে বিব্রত লাগছে স্যার।’ সোমি ওপার থেকে বলল।
‘তিনি এখন নেই। এখন তাঁর পার্সোনাল বিষয় নিয়ে কথা বলতে বিব্রত লাগছে স্যার।’ সোমি ওপার থেকে বলল।
‘তিনি এখন নেই। এখন তাঁর পার্সোনাল ব্যপার আর পার্সোনাল নেই। তার হত্যাকারীদের ধরার জন্যে সব কথা আমাদের জানা দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি বলব বুঝতে পারছি না।’ প্রতি উইক এন্ডে নিয়মিত একজন আসতেন। শনিবার রাতে আসতেন। রোববার রাতে চলে যেতেন। ঘর থেকে তিনি বেরুতেন না। আমরা উপরে যেতাম না। খানা পরিবেশন ম্যাডামই করতেন। ম্যাডাম তার সম্পর্কে কিছু বলেননি। তবে আচার-ব্যবহারে তাঁকে স্বামীস্থানীয় বলেই আমাদের মনে হয়েছে। পরের উইকে মঙ্গল ও বৃহঃস্পতিবার রাতেও তিনি বা কেউ আসতেন। সব আসাটাই রাত দশটার পর। রাত দশটার পর আমরা শুয়ে পড়তাম।’ আয়া সোমি বলল।
‘আপনারা তাঁকে বা তাদেরকে দেখেছেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘মঙ্গল ও বৃহঃস্পতিবার রাতে যারা আসতেন, তাদের দেখার প্রশ্নই ওঠে না। রাতেই তারা চলে যেতেন। উইক এন্ডে যিনি আসতেন, তিনি দু’একবার পলকের জন্য আমার চোখে পড়েছেন মাত্র।’ বলল সোমি।
‘তার মুখের বা শরীরের কোন বৈশিষ্ট্য বা চিহ্ন আপনার মনে পড়ে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘কপাল চওড়া, হাসি মাখা মুখ। এটুকুই আমার নজরে পড়েছে।’ বলল সোমি।
‘ওদের কোন জিনিসপত্র, ফেলে যাওয়া কোন চিহ্ন?’ আহমদ মুসার আবার জিজ্ঞাসা।
‘স্যার, এ রকম কিছু মনে পড়ছে না।’ বলল সোমি।
‘কত দিন পর্যন্ত ওরা এসেছেন। মনে ওদের আসাটা অনাহুত ছিল কিনা, ওরা এখনও আসে কিনা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কোন আসাটাই এখন আগের মত নিয়মিত নয় স্যার। তবে আসা বন্ধ হয়নি।’ বলল সোমি।
‘তোমার ম্যাডামের বয়স কত ছিল?’ জিজ্ঞেস করলো আহমদ মুসা।
‘স্যার, চল্লিশ হবে। তবে স্যার, তিনি বয়সের চেয়ে ছোট ছিলেন। অদ্ভুত ছিল তার দেহগঠন। মেকআপ না করলেও তাঁকে তিরিশের বেশি মনে হতো না।’ বলল সোমি।
‘তাই হবে। ওরা কম্যুনাটির শ্রেষ্ঠ মেয়েদেরকেই বাছাই করে তাদের স্বার্থক যুপকাষ্ঠে বলি দেয়ার জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা সোমিকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘দরকার হলে আপনাকে আবার বিরক্ত করব ম্যাডাম সোমি।’
কর অফ করে দিয়ে আহমদ মুসাও সোফায় গা এলিয়ে দিল।
মাথা খালি করে একটু বিশ্রাম নিতে চেয়েছিল। কিন্তু রাজ্যের চিন্তা এসে ঘিরে ধরল।

ওয়েটার কফি দিয়ে সরে যেতেই সোহা’র (Son of Holy Ararat) প্রেসিডেন্ট মিহরান মুসেগ মিসিস বলল, ‘মি. জেনারেল, তাড়াতাড়ি আমাদের আসল কথাটা দরকার।’
‘বলুন।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
জেনারেল মেডিন মেসুদ তুর্কি সেনাবাহিনীর শীর্ষ জেনারেলদের একজন। তিনি স্টাফ অফিসের প্রধান। অফিসারদের ট্রান্সফারের প্রধান ব্যক্তি সে।
মিহরান মুসেগ মাসিস তাকাল হোলি আরারাত গ্রুপের অন্যতম ভারদান বুরাগের দিকে।
ভারদান বুরাগ নড়ে-চড়ে বসে বলল, ‘দেখুন, গত কয়েকদিনে পূর্ব আনাতোলিয়ায় আমাদের আরারাত অঞ্চলে আমাদের প্রায় অর্ধশত নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছে। অথচ মাদকের বিস্তারের মত সামাজিক অপরাধ দমনে আমাদের লোকরাই সেখানে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। আমাদের লোকদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন ও হত্যার জন্যে দায়ী শুধু পুলিশ, ঐ অঞ্চলের সেনা অফিসাররাও দারুন উৎসাহী।’
বলে ভারদান বুরাগ পকেট থেকে ভ্যান, অগ্রি, ইজদির ও কারস প্রদেশের সামরিক অফিসারদের তালিকা জেনারেল মেডিন মেসুদের সামনে রেখে বলল, ‘এই অফিসারদের সরিয়ে দিয়ে তাদের নামের বিপরীতে লিখা অফিসারদের এনে বসাতে হবে।’
ভারদান বুরাগের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মিরহান মুসেগ মাসিস বলল, ‘এটা করতেই হবে, না করলে আমাদের ধ্বংস করে ছাড়বে।’
‘কিন্তু এত স্টাফ এইভাবে বদল হয় না, করা যায় না।’ ক্ষোভ ঝরে পড়ল জেনারেল মেডিন মেসুদের কণ্ঠে।
তার চোখে-মুখে বিরক্তিরও চিহ্ন।
‘সবই সম্ভব। আপনারা ইচ্ছা করলে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। অনেক সাহায্য করেছেন আপনি। এ সাহায্যও করতে হবে।’
‘তাহলে গোটা দেশের সেনা অফিসারকেই বদলি করুন। তাহলে অন্যকিছু ধারণা করার সুযোগ হবে না।’ ভারদান বুরাগই বলল।
দুই চোখ ছানাবড়া করে তাকাল জেনারেল মেডিন মেসুদ ভারদান বুরাগদের দিকে। বলল, ‘দেখুন, রসিকতা করার ব্যপার নয় এটা।’
‘আমরা রসিকতা করছি না। সত্যিই বলছি, শুধু চারটি প্রদেশে সেনা অফিসারদের ট্রান্সফার নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারে কেউ। সুতরাং সারা দেশের সেনা অফিসারদের ট্রান্সফার করার কথা আমরা সিরিয়াসলি বলছি।’ বলল ভারদান বুরাগ।
‘এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। কোন যুক্তি নেই এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের।’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল। বিরক্তি ও অসন্তোষের ভাব ফুটে উঠল ভারদান বুরাগ ও মিহরান মুসেগের চোখে-মুখে। ভারদান বুরাগ বলল, আপনার কোন যুক্তি আমরা শুনতে চাই না। বলুন, আমরা যা বলেছি, তা করবেন কিনা। আপনি যদি অস্বীকার করেন, তাহলে কি ঘটতে পারে আপনি জানেন। আপনার মান-সম্মান শুধু নয়, চাকরিই শুধু নয়, কোট মার্শাল হবে আপনার।’
মুহুর্তেই মুষড়ে পড়ল জেনারেল মেডিন মেসুদ। নিচু হয়ে গেল তার মাথা। বলল, ‘আমি করব না বলছি না।’
একটু থেমেই আবার বলল, ‘এক সাথে করায় অসুবিধা আছে, আপনাদের প্রায়োরিটি বলুন।’
সংগে সংগে উত্তর না দিয়ে ভারদান বুরাগ ও মিহরাম মুসেগ পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল এবং ভারদান বুরাগ বলল, ‘ঠিক আছে, আগ্রি ও ইজদির প্রদেশের সেনা অফিসারদের আগে ট্রান্সফার করুন।’
ইজদির প্রদেশেই মাউন্ট আরারাত অবস্থিত।
আর আগ্রি এই প্রদেশের পশ্চাৎভুমি। ভ্যান প্রদেশ আগ্রির পেছনে। আর কারস ইজদির প্রদেশের উত্তরে।
‘ওকে, তাই হবে। তবে এমাসে নয়, বিভিন্ন সময়ে।’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল।
‘ধন্যবাদ। কিন্তু বাকি দুই প্রদেশের ট্রান্সফার করতে হবে, একটু পরে হলেও।’ বলল ভারদান বুরাগ।
‘ঠিক আছে। কিন্তু এই ট্রান্সফার দিয়ে আপনারা কী করতে চান?’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল।
হাসল ভারদান বুরাগ। বলল, ‘অন্য কিছু নয়, লক্ষ্য আমাদের লোকদের বাঁচানো।’
‘কিন্তু শুধু সেনা অফিসারদের বদলি করলেই কি এলক্ষ্য অর্জন হবে? এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকাই তো বড়।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
‘ওটা আগে থেকেই আমাদের বিবেচনায় আছে।’ বলল মিহরান মুসেগ মাসিস।
কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ, ‘ওকে, আপনারা সফল হোন। কিন্তু আপনারা আমার প্রতি অবিচার করেছেন।’
‘কিন্তু আমরা আপনার জন্যে তো কম করিনি। আপনি যত দ্রুত এতদূর এসেছেন, তার পেছনে আমাদের অবদান অনেকখানি। আপনি তুরস্কের সবচেয়ে ধনী জেনারেলদের একজন সেটাও কি আমাদের কাজ নয়? আর আমরা তো অবিচার করিনি, আমরা উপকার চাচ্ছি আপনার কাছে। এটা কি চাইতে পারি না?’
‘চাইতে পারেনা। কিন্তু চাওয়াটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সীমাছাড়া।’ বলল জেনারেল মেডিন মেসুদ।
হাসল ভারদান বুরাগ। বলল, ‘কিন্তু আমাদের চাওয়াটা আমাদের কাছে এক ইঞ্চিও বেশি নয়। সুতরাং গাছাড়া চাওয়া এটা নয়।’
‘একথা ঠিক, প্রয়োজন থেকেই চাওয়ার সৃষ্টি হয়, কিন্তু সব চাওয়া পূরণ হবার মত নয়। কিন্তু আপনারা সেটাই করতে চাচ্ছেন।’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল।
‘কি করব, এটাই আমাদের নীতি।’
‘আমাদের চাওয়া পূরণ হতেই হবে এবং আপনাকে তা করতেই হবে।’ ভারদান বুরাগ।
‘হ্যাঁ, আমি পণবন্দী।’ জেনারেল মেডিন মেসুদ বলল। তার মুখে অসহায় ভাব।
‘যদি এটাই ভাবেন, তাহলে…।’
বলেই উঠে দাঁড়াল ভারদান বুরাগ। বলল আবার জেনারেল মেডিনকে লক্ষ্য করে, ‘আমাদের সময় দেয়া, আমাদের সাহায্য করার জন্যে ধন্যবাদ।’
মিহরান মুসেগ মাসিসও উঠে দাঁড়িয়েছে।
উঠে দাঁড়াল জেনারেল। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল ভারদান বুরাগ ও মিহরান মুসেগের সাথে। অতিকষ্টে মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করেছিল জেনারেল। বেরিয়ে এল তারা রেস্টুরেন্ট থেকে।
মিহরান মুসেগ ও ভারদান বুরাগ রেস্টুরেন্টের সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল। আর জেনারেল মেডিন মেসুদ ভিন্ন আর একটি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
গাড়িতে উঠল মিহরান মুসেগ ও ভারদান বুরাগ। ড্রাইভিং সীটে বসল মিহরান মুসেগ। গাড়িটা তারই। তার পাশের সীটে ভারদান বুরাগ। ভারদান বুরাগের মুখে হাসি।
কিন্তু ভাবছিল মিহরান মুসেগ মাসিস। বলল সে, ‘আজ জেনারেলকে আনউইলিং হর্স মনে হলো। আমি তার পিঠে চড়ে বসে আছি সেটা পছন্দ করছেন না।’
সেটাই স্বাভাবিক। তার উপর মুসলমানের বাচ্চা। বিশ্বাসঘাতকতা করলেও ঈমান ওদের সরে যায় না। সুযোগ পেলেই মাথা তোলে। কিন্তু জেনারেল মাথা তুলে কোন ফল পাবে না। আমাদের কিছু ভিডিও অডিওর মধ্যে তার প্রাণ বাধা আছে। সুতরাং প্রাণ রক্ষা করতে চাইলে আমাদের পুতুল তাকে হতেই হবে।’ বলল ভারদান বুরাগ হাসতে হাসতেই।
‘তার ভাবান্তর ঘটেছে বেশ আগে থেকেই। গাজেনের গোপন স্বামী হওয়া সত্বেও অনেক আগে থেকেই তিনি মিসেস গাজেনের খোঁজ খবর নেওয়াও ছেড়ে দিয়েছিলেন।’ মিহরান মুসেগ বলল।
ওটা বড় কথা নয়। কারণ তার জন্যে নতুন সারপ্রাইজ ছিল। যাদের প্রতি তার আকর্ষণ মিসেস গাজেনের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং দেশপ্রেম তার মনে উঁকি-ঝুঁকি মরলেও সে সাধু হয়ে যায় নি। অতএব, ভয়ের কিছু নেই তার তরফ থেকে।’ বলল ভারদান বুরাগ।
‘কিন্তু ধরুন দু’টো প্রদেশ থেকে আমাদের বাঞ্ছিত সেনা অফিসারদের বসাল অন্যদের সরিয়ে দিয়ে, তাতেই কি আমাদের কাজ হয়ে যাবে? একাই একশ আবু আহমদ তো আছেই, কার সাথে এসে জুটেছে দেশভক্ত পুলিশ অফিসাররাও। তাদের ম্যানেজ করা না গেলে আমরা এগোবো কিভাবে?’ মিহরান মুসেগ মাসিস বলল।
‘ভাববেন না মি. মুসেগ। সেনাবাহিনী হাতে থাকলে খুব বেশি চিন্তা আর আমাদের থাকে না। আর আমরা তো দু’টো কাজ করব। এক, মাউন্ট আরারাতের স্বর্ণভান্ডার হস্তগত করার চেষ্টা, দ্বিতীয় হলো, আমাদের লোক দিয়ে গণবিদ্রোহ শুরুর মাধ্যমে গণহত্যা ঘটিয়ে এই অঞ্চলকে তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এই দুই বিষয়ে পুলিশের করণীয় কিছু নেই। মাউন্ট আরারাত পাহারা দেয় সেনাবাহিনীর লোকেরা, সুতরাং সেখানে পুলিশ থাকছে না। অন্যদিকে সরকার ও পুলিশের গণহত্যা ইস্যু করে যে বিদ্রোহ হবে সেখানে কিছু করার শক্তি পুলিশের থাকবে না। ডাকা হবে সেনাবাহিনী যারা থাকবে আমাদের অনুগত। অতএব, চিন্তার কিছু নেই মি. মিহরান মুসেগ।’ বলল ভারদান বুরাগ।
‘এ দু’টো কাজই তো লং টার্মের। এখন আমরা কি করব?’ বলল মিহরান মুসেগ।
‘কি করব মানে? আমাদের মাউন্ট আরারাতের স্বর্ণভান্ডার অভিযানের গ্রাউন্ডওয়ার্ক তো চলছেই, চলবে। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে, এমন বাছাই করা লোকদের মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে জেলে পাঠানোর কাজও যেমন চলছে, তেমনি চলবে।’ ভারদান বুরাগ বলল।
‘কিন্তু এই কাজগুলো তো বন্ধ হওয়ার পথে। কমপক্ষে দশ জায়গায় আমাদের লোকেরা হাতে-নাতে ধরা পড়েছে। আর প্রাণহানির ঘটনা তো এলার্মিং। আমাদের বেস্ট জনশক্তির একটা অংশ শেষ হয়ে গেছে। পুলিশ ও গোয়েন্দারা আমাদের কৌশল বুঝে ফেলেছে। এই পথে আমরা আর এগোতে পারবো বলে মনে হয় না। সব নষ্টের মূল আবু আহমদ। সেই আমাদের সব লোককে খুন করেছে। তার ব্যাপারে তো আমরা কিছুই করতে পারলাম না। তাকে এভাবে মাঠে রেখে কি আমরা এগোতে পারব? শোনা যাচ্ছে, মিউজিয়ামে হানা দেয়া ও হত্যাকান্ডের ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব সরকার নজীরবিহীনভাবে তাকেই দিয়েছে। ক্ষমতাহীনভাবে সে যতটা ভয়ংকর, ক্ষমতা পেয় সে কতটা ভয়ংকর হবে কে জানে।’ বলল মিহরান মুসেগ।
ভারদান বুরাগের চোখে মুখেও বিমর্ষতা নেমে এল। বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, ঐ লোকটা আমাদের ব্যর্থতার জীবন্ত নজীর। কিন্তু আমরা কি করব। চেষ্টার তো আমরা ত্রুটি করিনি। লোকটা যাদু জানে, কিংবা আগের-পরের সবকিছুই সে দেখতে পায়। তাকে কোন ফাঁদেই আটকানো গেল না। এ ক্ষেত্রে যুদ্ধের কৌশল হলো, সামনের বাধা এড়িয়ে এগোবার নতুন পথ সৃষ্টি করা। আমরা তাই করেছি। আমাদের দু’টি লক্ষ্যই এধরনের। এখানে আবু আহমদ বাধা হয়ে দাঁড়ানোর আর কোন স্কোপ নেই। এ অর্থ তাকে আমরা রেহাই দিচ্ছি না। সামনে এগোবার বিজয় রথ থেকে ঠিক সময়েই মোক্ষম অস্ত্রটি মারা হবে।’
‘ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন।’ বলে স্লো হয়ে আসা গাড়ির গতিতে ব্রেক কষল মিহরান মুসেগ। পৌঁছে গেছে তারা হোটেলে।

Top