৫৯. বিপন্ন রত্নদ্বীপ

চ্যাপ্টার

দাদী,

আমার সালাম নিও। তোমার মেসেজ আমি পেয়েছি। আমার জন্যে যে তুমি কতটা উদ্বিগ্ন থাক, আমি বুঝতে পারি। আল্লাহর উপর ভরসা করা ছাড়া কোনো উপায় আছে কি দাদী? নেই। শুধু আল্লাহর উপর ভরসা কর দেখবে উদ্বেগ কমে যাবে, প্রশান্তি আসবে মনে।

জানতে চেয়েছ আমি কিছুটা এগিয়েছি কিনা। না দাদী, পারিনি। চেষ্টার ত্রুটি নেই। ডায়েরির তথ্যসূত্র যেন কয়েকশ বছরে রত্নদ্বীপ থেকে মুছে গেছে। গত এক বছরে দাদী সাধ্যের মধ্যে আছে রত্নদ্বীপের এমন কোনো জায়গা আমার অনুসন্ধানের বাইরে নেই। কিন্তু ডায়েরির তথ্য, চিত্র, চিহ্ন কোথাও আমি পাইনি। পাইনি বলে নেই, তা নয়। আমি খুঁজছি, খুঁজব। একই সাথে আমি তাঁরও সন্ধান করছি দাদী। সম্প্রতি আমার আশা বেড়েছে দাদী। রত্নদ্বীপে পংখীরাজ ঘোড়ায় চড়ে তোমার সেই সহজ সরল সুন্দর একজন রাজকুমার অবশেষে এসেছেন। যিনি শত রাজকুমারের সমান। আবার আমার রাজকুমার বলে আনন্দে তুমি লাফিয়ে উঠো না। আমাকে তুমি শাহজাদী বল তো তাই বললাম। কিন্তু তুমি জান না দাদী, আমার মতো উত্তরাধিকারের শত শাহজাদীও তাকে আঁচলে বাঁধতে পারে না। আসলে তিনি সবার স্বপ্নের রাজকুমার। নাম শুনলে আমার কথা তুমি মেনে নেবে। কিন্তু নাম এখন বলব না দাদী।

আমি এখন আমার মিশনের ব্যাপারে আশাবাদী দাদী। আমার মিশনের কথা আমাদের বংশের বাইরে শুধু তাকেই বলা যায়। তিনি আরেক ধারার নতুন এক তারিক বিন জিয়াদ। অনেকে বলেন তিনি এক নতুন হাতেম তাঈ। তাঁকে আমি ডেকেছি আজ। তিনি আমার কথা শুনতে চান। দোয়া করো দাদী, আমাদের শাহমাতার ধনভাণ্ডার যেন উদ্ধার হয়। তার মহৎ স্বপ্ন যেন সফল হয়। আজ এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।

তোমার শাহজাদী

জাহরা তার ল্যাপটপে মেসেজটি টাইপ করে সেন্ড বাটনে ক্লিক করে তার দাদীর নাম্বারে পাঠিয়ে দিল। ল্যাপটপটিকে জাহরা একটু সামনে ঠেলে দিল। চেয়ারে গা এলিয়ে দিল জাহরা।

চোখ দুটিও বন্ধ করল।

মেসেজটি পাঠিয়ে খুব ভালো লাগছে জাহরার। আগে কখনো এমনভাবে দাদীকে তার আশার কথা শোনাতে পারেনি জাহরা। এই আশা কি সত্যিই ফল নিয়ে আসবে? ছয়শত বছরের বন্ধ দরজা কি খুলবে? পেছনে ছুটে গেল তার মন। একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার। বুক থেকে।

কিন্তু আবার তার মুখে ফুটে উঠল হাসি। ছয়শত বছরের অন্ধকার দূর করতে পারেনি সে, কিন্তু জমাট অন্ধকারের বুকে সে একটা ক্যান্ডল জ্বালতে পেরেছে। তার আগে তো রত্নদ্বীপে কেউ আসেনি তার বংশ থেকে।

ভেবে চলে জাহরা, নিঃসীম অন্ধকারে আমি একখণ্ড আলো জ্বেলেছি বটে, কিন্তু অন্ধকারকে আলোকিত করার সাধ্য আমার নেই। দাদী বলেছিলেন, তার স্বপ্নের শাহজাদা শুধু স্বপ্নের নয়, বাস্তবেও তুমি দেখো। সে আসবে। সে ইতিহাসকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসবে। যারাজুনুব পাহাড়ে যখন আমার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছিল, তখন আহমদ মুসা আমাকে বিস্ময়করভাবে বাঁচালেন, তখনই আমার মনে হয়েছিল তিনিই দাদীর সেই স্বপ্নের শাহজাদা যিনি আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় শাহমাতার স্বপ্ন সফল করবেন। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নেই সব তাঁকে বলব।

আলহামদুলিল্লাহ, তিনি আসছেন।

মনের কথা মন থেকে মিলিয়ে যাবার আগে দরজায় নক হলো।

জাহরা তাকাল তার হাতঘড়ির দিকে। দেখল দুপুর ১২ টা। মন তার খুশি হয়ে উঠল, নিশ্চয় দাদীর শাহজাদা আহমদ মুসা এসেছেন।

জাহরা দ্রুত স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং-এর ভেতর দিয়ে গিয়ে দরজা খুলল।

আসোলামু আলায়কুম। দরজা খুলে আহমদ মুসাকে সালাম দিল জাহরা।

সালাম নিল আহমদ মুসা। ভেতরে ঢুকল। চারদিকে তাকাল। বলল, এটা দেখছি তোমার ডাইনিং কিচেন। আর ওটা?

ওটা স্যার আমার স্টাডিরুম। তার পাশে বড় রুমটা আমার বেডরুম। বলল জাহরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হোস্টেল কিন্তু অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের মতো মনে হচ্ছে না। আহমদ মুসা বলল।

ঠিক স্যার। রত্নদ্বীপ স্টেট ইউনিভার্সিটির হোস্টেল দুই রকমের আছে। ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান রুম- এই ব্যবস্থার হোস্টেল সাধারণভাবে সকল ছাত্রের জন্যে। বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে কিছু ডরমিটরি আছে বিদেশি ও ভিআইপি কিছু ছাত্রের জন্যে। আমার ডরমিটরিটা সেগুলোরই একটা। এর সুবিধা হলো, নিজের খানা নিজেই রান্না করে খাওয়া যায়। একদম নিরিবিলি পরিবেশ, পড়াশুনার জন্য খুবই ভালো। বলল জাহরা।

একটু থেমেই আবার সে বলে উঠল, আসুন স্যার বসি।

কোথায়? বলল আহমদ মুসা।

ড্রয়িং রুম তো নেই। স্টাডি রুমে একটা মাত্র চেয়ার। বেড রুমেই মাত্র তিনটা সোফা ও একটা সেন্টার টেবিল আছে। ওটা আমার ড্রয়িং রুমও। ওখানেই আমরা বসব। জাহরা বলল।

আচ্ছা জাহরা, তোমার ডরমিটরিতে ঢোকার সময় তোমার ডরমিটরির সাথে অ্যাটাস্ট ছোট একটা এনক্লোজার দেখলাম। দুটি সোফাও দেখলাম সেখানে। ওটা….?

আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই জাহরা বলল, ওটা আমার বাইরে বসার একটা জায়গা। বান্ধবীরা ছাড়া কেউ দেখা করতে এলে ওখানে বসেই তাদের সাথে কথা বলি।

সুন্দর ব্যবস্থা জাহরা। আমরা ওখানেই বসব। বলল আহমদ মুসা।

জাহরা হাসল। বলল, ঐ বসার জায়গাটা অনাত্মীয় ও বাইরের লোকদের জন্যে। আপনার জন্যে নয়।

তোমার বান্ধবীরা ও পরিবার ছাড়া সবার জন্যে ওটাই বসার জায়গা। বলল আহমদ মুসা।

আপনি আত্মীয়-বন্ধুর চেয়ে অনেক বড়। জাহরা বলল।

আমরা সেজন্যেই বন্ধ ডরমিটরিতে বসতে পারি না। আল্লাহর রাসুল স.-এর তাৎপর্যপূর্ণ একটা হাদিস আছে। হাদিসটা এই রকম- উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা রা. ও তাঁর পিতা আবু বকর রা. একটা ঘরে নিরিবিলি বসে কথা বলছিলেন। সেই সময় আল্লাহর রাসুল স. সেখানে আসেন। আল্লাহর রাসুল স. নিরিবিলি একটা ঘরে বসে বাবা-মেয়ের এই আলাপ পছন্দ করেননি। তিনি বলেছিলেন যে, তোমাদের দুজনের মাঝে তৃতীয় একজন ছিল। সে হলো শয়তান। এই শয়তান এখনও আছে জাহরা। আর ঈমানের দিক দিয়ে তাঁদের চেয়ে আমরা অনেক বেশি দুর্বল। বলল আহমদ মুসা।

আল্লাহু আকবর! বলে দুহাতে মুখ ঢাকল জাহরা। কয়েক মুহূর্ত পরে মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল, স্যরি স্যার, ইসলাম ও বাস্তবতা- দুটি থেকেই আমরা আজ বহু দূরে। জাহরার দুই চোখে লজ্জা ও অশ্রুর অপরূপ মিশ্রণ।

চলুন স্যার বাইরে গিয়ে বসি। জাহরা বলল।

দুজনে গিয়ে বসল বাইরের এনক্লোজারটায়।

জায়গাটা এক প্রশস্ত বারান্দার মতো। বারান্দাকেই ছোট ও সুন্দর একটা এনক্লোজারের মতো করা হয়েছে।

বসেই আহমদ মুসা বলল, কথা শুরু কর জাহরা।

মুখে গাম্ভীর্য নেমে আসল জাহরার। মুখ নিচু করল। ভাবল। খুলল তার হাতের ব্যাগ। বের করল ভাঁজ করা কাগজ।

তার হাতের ভাঁজ করা কাগজ আহমদ মুসাকে দেখিয়ে বলল, এগুলো একটা ডায়েরির অংশ স্যার।

ডায়েরির অংশটা হাত বাড়িয়ে আহমদ মুসার দিকে দিতে দিতে বলল, প্রথমে ডায়েরির অংশটা পড়ুন স্যার। পরে কথা হবে।

আহমদ মুসা কাগজ হাতে নিল।

কাগজের ভাঁজ খুলে দেখল, ডায়েরির কয়েকটা পাতা। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা। লেখাটা ফটোকপি।

আহমদ মুসা তাকাল জাহরার দিকে। বলল, ডায়েরির স্টাইলেই লেখা দেখছি। কার ডায়েরি?

জাহরার গম্ভীর মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। বলল, প্লিজ স্যার পড়ন। আমি জানি উত্তরটা আপনিই খুঁজে পাবেন।

কিছু না বলে আহমদ মুসা ডায়েরির পাতার দিকে তাকাল। স্পষ্ট ও সুন্দর হাতের লেখা। পড়তে কোনোই কষ্ট হবার কথা নয়। পড়তে শুরু করল আহমদ মুসা–

খবর পেলাম, আমার ছেলে আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ আল-সানি আশারা বন্দীত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সিংহাসনে ফিরে আসার জন্যে কাস্টেলিয়ানদের সাথে চুক্তি করেছে। আমার এই দুর্ভাগা ছেলে ১৪৮২ সালে গ্রানাডার সিংহাসনে বসার পরই আমার উপদেশ উপেক্ষা করে ১৪৮৩ সালে কাস্টেলিয়ানদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং পরাজিত ও বন্দী হয়। সেই বন্দীত্ব থেকে মুক্তি ও সিংহাসনে ফিরে আসার জন্যে কাস্টেলিয়ানদের সাথে চুক্তি করেছে খুবই অপমানজনক শর্তে। গুপ্তচরের কাছে চুক্তির যে কপি পেলাম তাতে দেখা যাচ্ছে, গ্রানাডা রাজ্য করদ রাজ্যে পরিণত হবে কাস্ট্রেলিয়ান ক্যাথলিক খৃস্টান রাজার অধীনে। দ্বিতীয়ত স্পেনের উপকূলীয় দুর্গনগরী মালাগায় ক্যাথলিক খৃস্টান রাজার যে অবরোধ চলছে, তাতে গ্রানাডা হস্তক্ষেপ করবে না। আমি দাঁড়িয়ে খবরটা পড়ছিলাম। এটুকু পড়ার পর দাঁড়িয়ে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব হলো না। ইশারা পেয়ে পরিচারিকা গুপ্তচরকে বাইরে নিয়ে গেল। কয়েক ধাপ পেছনে হটে আমি এলাম কুরসির কাছে। আমার দেহটা খসে পড়ল কুয়সির উপর। আমার মনে তখন গ্রানাডা রাজ্যের নতজানু এক সুলতানের অপমান নয়, মহান এক পরিবারের অপমান নয়, স্পেনীয় মুসলমানদের শেষ আশা ও ঐতিহ্যের অপমান নয়, আমার চোখে ভেসে উঠেছে স্পেনে মুসলমানদের মহান শাসন ও সভ্যতার সমাধিস্থ হওয়ার দৃশ্য। ইসলামের মহান সেনাধ্যক্ষ তারিক বিন যিয়াদ স্পেনের মাটিতে পা রাখার ৭৭৬ বছর পর আমি দেখছি ইসলামের অর্ধচন্দ্র পতাকা ভূলণ্ঠিত হলো স্পেনের মাটিতে এবং সেটা আমার ছেলের হাতে। চেষ্টা করেও চোখের অশ্রুর প্রস্রবণ আমি রোধ করতে পারলাম না। কুরসিতে পড়ে কতক্ষণ কেঁদেছিলাম জানি না। সম্মোহিত অবস্থা থেকে যখন জাগলাম, মন অনেক শান্ত, স্থির। মনের স্থির কণ্ঠ শুনতে পেলাম, নিশ্চিতভাবে এই ১৪৮৭-তেই মালাগা মুসলমানদের হাতছাড়া হচ্ছে। তারপর একে একে যাবে গ্রানাডা রাজ্যের খুঁটিগুলো বাযা, আলমুনেকার, সোলেব্রেফিয়া এবং আলমেরিয়া। এর পরেই গ্রানাডার গলা টিপে ধরা হবে। এই চিন্তার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হলো গুরুত্বপূর্ণ কিছু করার আছে আমার। গ্রানাডার পতন ঘটলে করদ রাজ্যের রাজা হিসেবে তার পক্ষে যা নেয়া সম্ভব সে সম্পদ তাকে নিয়ে যেতে দেয়া হবে। তা হবে আমার ছেলের ব্যক্তিগত সম্পদ। বংশের শেষ শাহমাতা হিসেবে আমার কাছে যে সম্পদ জমা আছে, তা না আমার ছেলের হাতে পড়তে দেব, না দখলদারদের হাতে যেতে দেব। কর্ডোভার পতনের আগে সেখানকার শেষ সুলতান তৃতীয় হিশামের মাতা তার কাছে সঞ্চিত সম্পদ আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহারের জন্যে। সেই বিশাল সম্পদেরও দায়িত্ব আমার উপর। এই সম্পদের সংরক্ষণ আমাকে করতে হবে। এই সম্পদ স্পেনের বাইরে নিতে হবে নিরাপদ করার জন্যে। কিন্তু কিভাবে? এই চিন্তা করতে গিয়েই আমি ডাকলাম আমার খালাত ভাই নৌ কমান্ডার তারিক ফতেহ আলীকে। ডাকলাম আমার প্রাসাদ মসজিদের দ্বিতীয় ইমাম আবু আমর আবদুল্লাহকে। নৌ কমান্ডার তারিক ফতেহ আলীকে এজন্যে ডাকলাম যে, নৌ-পথকেই আমি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে করি এবং তারিক ফতেহ আলী মালাগাভিত্তিক একটা ফ্লিটের কমান্ডার ছিলেন। সে ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ ও পাহাড় বিশারদ। আর ইমাম আবু আমর। আবদুল্লাহ ছিলেন আমার স্বামী সুলতান আবু হাসান আলীর একটা বিশেষ কমান্ডো বাহিনীর নেতা। একজন সৎ ও খোদাভীরু মানুষ সে। আমি তাদের ডেকে আমার পরিকল্পনার কথা বললাম। জানালাম যে, গোল্ড কয়েন ও স্বর্ণালংকারের বিপুল এই ভাণ্ডার আমি একটা অসিয়তসহ ভবিষ্যত এক জেনারেশনের জন্যে রেখে যেতে চাই। আমার পরিকল্পনা শোনার পর আমার নৌকমান্ডার ভাই বলল, মুহতারামা শাহমাতা, আপনার কথা শোনার সাথে সাথে একটা নির্জন দ্বীপের কথা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যাওয়া-আসার পথে দুবার আমি দ্বীপটিতে উঠেছি মিঠা পানি ও ফল-মুলের সন্ধানে। পাহাড়ের দেয়াল ঘেরা ও পার্বত্য টিলার পূর্ণ দ্বীপটি খুবই দুর্গম, সাধারণভাবে জনবসতির উপযুক্ত নয়। চারপাশে সাড়ে চারশ-পাঁচশ মাইলের মধ্যে কোনো দ্বীপ বা দেশ নেই। আল্লাহর উপর ভরসা করে এমন একটা দ্বীপের কথা আমরা চিন্তা করতে পারি। শুনেই আমি বললাম, আলহামদুলিল্লাহ। এই দ্বীপ আমি পছন্দ করলাম। আমি আবু আমর আবদুল্লাহকে বললাম, আমার ডাকে সাড়া দেবার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। আমি চাচ্ছি, কমান্ডার ফতেহ আলীর নেতৃত্বে আপনি এই মিশনে অংশ নেবেন এবং জাহাজের নিরাপত্তার জন্যে একটা টিম গড়ে নেবেন। প্রয়োজনীয় সব আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো, পরবর্তী ছয়মাসের মধ্যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে। আরেকটি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলো এই দুইজন ছাড়া দ্বীপটির নাম ও লোকেশন সম্পর্কে কেউ কিছু জানবে না। কোনো সেফ কাস্টোডির বাইরে সাধারণভাবে কোনো ঘড়ি, ক্যালেন্ডার ও কম্পাস জাহাজে থাকবে না, এ বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।

ডায়েরির একটা অংশ পড়া শেষ হলো। এর সাথে ডায়েরির আরেকটি অংশ আছে ছয় মাস পরের। তারিখটা ১৪৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন। ডায়েরির সে অংশে লেখা হয়েছে–

আল হামদুলিল্লাহ, ছয় মাসের মধ্যেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ। সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিপটির সবচেয়ে নিরাপদ, দুর্গম ও সুচিহ্নিত একটি স্থানে। স্বর্ণভাণ্ডার লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। আজ পথ ও পাহাড়ের স্কেস ও সাংকেতিক চিহ্ন সংবলিত ডকুমেন্ট আমি তারিক ফতেহ আলীর কাছ থেকে পেলাম। আল্লাহর হাজার শোকর। তিনি যেমন এই সম্পদ নিরাপদে সংরক্ষণের সুযোগ দিয়েছেন, তেমনি এই সম্পদ যাতে অসিয়ত অনুসারে আল্লাহর মনোনীত বান্দাদের কাজে লাগতে পারে তারও ব্যবস্থা। যেন মহান আল্লাহ দয়া করে করেন।

ডায়েরির দ্বিতীয় অংশ পড়া শেষ হবার পর তৃতীয় আরেকটা অংশ পেলাম। ডায়েরির তারিখ ১৫১১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি। ডায়েরিতে এ দিনের পাতায় লেখা

আমার বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসছে। গ্রানাডার প্রাসাদ ছেড়ে মরক্কো রাজ্যের আশ্রিত হিসাবে ফেজ-এর এই বাড়িটাতে ১৯ বছর বাস করছি। বুঝতে পারছি এই পরিবারের জন্যে ক্রমশ খারাপ দিন আসছে। খুবই দুঃখ বোধ হচ্ছে, সে খারাপ দিনগুলো দেখার জন্যে আমি বেঁচে থাকবো না। সুদিনের চেয়ে দুর্দিনে দৃঢ়তা ও ধৈর্য বেশি দরকার হয়। আমার ছেলের সেটা নেই। সুদিনে দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না থেকে দুঃখে ভেঙে পড়াই তার চরিত্র। যাক, যিনি সবার কথা ভাবেন, যিনি সবাইকে পালন করেন, যিনি দুঃখের তিমিরেও সুখের সোবহে সাদেকের আয়োজন রাখেন, সেই সর্বশক্তিমান আল্লাই আমার পরিবারকেও দেখবেন। আগে আমার অনেকবার অসুখ হয়েছে, কিন্তু বর্তমান অসুস্থতা আমাকে বলছে প্রভুর সান্নিধ্যে ফেরার সময় আমার হয়েছে। আমার সামনে খুব বড় সমস্যা ছিল সেই দ্বীপে লুকিয়ে রাখা ধন-ভাণ্ডারের ডকুমেন্ট হেফাজতের দায়িত্ব কার হাতে রেখে যাব। সে সমস্যারও সমাধান আমি করেছি। আমার ছেলে ক্ষমতাচ্যুত সুলতান আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ আল সানি আশারার তিন সন্তান আহমাদ, আয়েশা এবং ইউসুফ। আয়েশার নাম ওর বাবা আমার নাম অনুসারে রেখেছে। ভাই বোনদের মধ্যে সবচেয়ে দৃঢ়চেতা সে। ছোটবেলা থেকেই আমি তাকে চোখে চোখে রাখছি। কোরআন শরিফ ও ইতিহাস আমিই তাকে পড়িয়েছি। আমার আশা, স্পেনের নাসেরাইদ রাজপরিবারের যোগ্য এক শাহজাদী হবে সে। ভবিষ্যতে কি করবে সে আমি জানি না। আমি দোয়া করি সর্বহারা এই বংশের দুঃখের দিনে আল্লাহ তাকে এক কাণ্ডারী হওয়ার তৌফিক দিন। আমি আয়েশা বিনতে আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদকেই আমার গুপ্তধনভাণ্ডারের ডকুমেন্ট হেফাজত করার দায়িত্ব দেয়ার বিষয় চূড়ান্ত করলাম। দুই ইঞ্চি পুরু চার ইঞ্চি প্রস্থের একটা আয়তাকার রূপার কাসকেটে ধনভাণ্ডারের ডকুমেন্ট আমি রেখেছি। কাসকেটের লক খোলার জন্যে পাশাপাশি পাঁচটি বোতাম রয়েছে। বোতামগুলোর পাশে একটা করে ছবি ও বোতামের উপর এক অংকের একটা করে নাম্বার। ছবি দেখে সঠিক বোতাম চিহ্নিত করতে হবে। সে বোতামে পুশ করলেই কাসকেট খুলে যাবে। যদি ভুল পুশ হয়, তাহলে কোনো বোতাম পুশ করলেও আর কাসকেট খুলবে না। সেক্ষেত্রে আর একটা মাত্র বিকল্প অবশিষ্ট থাকবে, সেটা হলো, কাসকেটের উপর কোরআন শরিফের একটা আয়াত লেখা রয়েছে। আয়াতে তিন শব্দের একটা করে গুচ্ছ আছে। প্রতিটি গুচ্ছের রয়েছে এক অংকের একটি করে নাম্বার। গুচ্ছগুলোর নাম্বার বোতামেও আছে। গুচ্ছগুলোর সঠিক নাম্বার সিলেকশন করতে পারলে, সে নাম্বারেই কাসকেট খুলবে। কাসকেট খোলার ব্যবস্থা একটু জটিল করেছি এজন্যেই যে, যাতে করে যে কেউ যেন কাসকেট খুলে ডকুমেন্ট লোপাট বা নষ্ট করতে না পারে। যে ব্যবস্থা আমি করেছি তাতে, ইসলামকে যে তার সঠিক রূপে জেনেছে, সেই কাসকেটের ধাঁধা বুঝতে পারবে। আজ ফজরের নামাজ শেষে প্রতিদিনের কোরআন পাঠের পর আয়েশাকে ডেকে আল্লাহর উপর ভরসা করে কাসকেট তার হাতে দিলাম। বললাম, আমার দেয়া এই ডকুমেন্টকে আল্লাহর আমানত মনে করবে। আমার মতো তোমারও দিন শেষ হয়ে যাবে একদিন। সে দিনটি আসার আগেই আল্লাহর আমানত বংশের এমন একজন মেয়ে বা ছেলের হাতে তুলে দেবে যে নামাজ পড়ে, মিথ্যা কথা বলে না এবং ইতিহাসের উপর জ্ঞান রাখে। কাসকেট খোলার অধিকার তারই যে লকের ধাঁধা বুঝতে পারবে। কাসকেট যে পাবে, আমার ডায়েরিটাও সে পেয়ে যাবে। ডায়েরিতে গুপ্তধনভাণ্ডারের সংকেত আছে। কাসকেট কোনো কারণে যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে ধনভাণ্ডার উদ্ধারের বিস্তারিত সংকেত ও স্কেচ হারিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে এই সংকেত কাজে লাগাতে হবে?

দক্ষিণের মধ্য ভূমধ্যসাগরে এক দ্বীপ, বেনগাজীর উত্তর-পশ্চিম, ত্রিপলীর উত্তর-পূর্ব ক্রীটের দক্ষিণ-পশ্চিম মাল্টার পূর্ব দক্ষিণের এক মিলনগ্রন্থি, এই তার নিরিখ।

এবং
পাহাড়ের কোলে পাহাড়
তার কোলে সন্তান
দেয়াল করবে খান খান।

আমার ডায়েরির এখানেই সমাপ্তি। আল্লাহ রাব্বল আলামিনের কাছে আমারা প্রার্থনা- মানবীয় সাধ্যের মধ্যে যা সম্ভব আমি তা করেছি, ধনভাণ্ডারের সংরক্ষণ ও কাজে লাগাবার জন্যে। ফল দেয়ার মালিক শুধু তুমিই প্রভু। তোমার উপর, শুধু তোমারই উপর ভরসা করছি। দয়াময় হাফেজ তুমি সর্বাবস্থায়।

ডায়েরির পাতাগুলো পড়া শেষ করে আহমদ মুসা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। তার চোখ ডায়েরির পাতার দিকেই।

আহমদ মুসা ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল জাহরার দিকে। বলল, শাহজাদী জায়নেব জাহরা, বুঝলাম ডায়েরিটা গ্রানাডার শেষ সুলতান আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ-এর মা শাহমাতা আয়েশার, যাকে ইউরোপের ইতিহাস অদম্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা বলে অভিহিত করেছে। আমি আরও বুঝতে পারছি, তুমি এই শাহমাতার বংশেরই এক অধস্তন। শাহজাদী। কিন্তু মাঝখানে কেটে গেছে সাতশ বছর। এই সময়টা অন্ধকার একটা কাল। তোমার পরিচয়, তোমাদের অতীত সম্পর্কে কিছু বল।

বলছি। কিন্তু তার আগে বলুন আমি শাহজাদী জায়নেব জাহরা এটা কি করে জানলেন? ডায়েরির ঐ পাতাগুলোতে এ সম্পর্কে কিছুই থাকার কথা নয়। বলল জাহরা।

গতকাল তোমার গাড়ির সিটে তোমার হাতব্যাগের সবকিছু পড়ে ছিল। ব্যাগে সেসব তুলতে গিয়ে একটা গ্রুপ ফটো পেয়েছিলাম। অভ্যাসবশতই ফটোটা দেখি। সেখানেই তোমার ছবি দেখি এবং নামটাও পড়ি। আহমদ মুসা বলল।

বুঝেছি স্যার।

বলে একটু থামল জাহরা। বলতে শুরু করল আবার, আমি শাহমাতা। আয়েশার নবম উত্তরসূরি। গ্রানাডা থেকে এসে আমাদের পরিবার মরক্কোর ফেজ নগরীতে বসতি স্থাপন করে। যোড়শ শতক পর্যন্ত আমাদের অবস্থা ভালোই গেছে বলে আমরা জানতে পারি। শাহমাতা যাকে ডায়েরি ও ডকুমেন্টের উত্তরাধিকার দিয়েছিলেন সেই আয়েশা বিনতে আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ বেঁচে থাকা পর্যন্ত সংসার খুবই ভালো চলেছে। ১৫৬০ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে সংসারে বিপর্যয় নামতে শুরু করে। বংশীয় আভিজাত্য ব্যবসায় ও চাকরি থেকে পরিবারের সদস্যদের বিরত রাখে। যাকাতনির্ভর হয়ে পড়ে আমাদের পরিবারটি। পরিবারের উত্তরাধিকারিত্ব আমার দাদী বেগম আয়েশা আবদুল্লাহ নাসিরী-এর হাতে আসার পর তিনি অতীতের সব নিয়ম ভেঙে ফেলেন। আধুনিক উচ্চ শিক্ষা ও ব্যবসায় ও চাকরির দরজা খুলে দেন। পরিবার আত্মনির্ভরশীলতা, সেই সাথে সমাজের মূল স্রোতে শামিল হয়ে মানুষের কাজে লাগতেও সমর্থ হয়। আমি রাবাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছি। দাদীর বয়স এখন বিরানব্বই। তিনি আমাকে উত্তরাধিকারিত্ব অর্পণ করেছেন। থামল জাহরা।

কিন্তু তুমি রত্নদ্বীপে কেন? সেই রুপোর কাসকেটে ধাঁধা কি তুমি সমাধান করেছ? রত্নদ্বীপের সন্ধান তুমি পেলে কি করে? এলে কেমন করে রত্নদ্বীপে? বলল আহমদ মুসা।

না, রুপোর কাসকেটের ধাঁধা আমি ভাঙতে পারিনি। রত্নদ্বীপের সন্ধান পাওয়া এখন আর কোনো কঠিন কাজ নয়। শাহমাতার ডায়েরিতে দ্বীপের যে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সে নির্দেশনা সামনে রেখে স্যাটেলাইট ম্যাপ দেখে দ্বীপটা বের করেছি। এই দ্বীপের চারশ সাড়ে চারশ কিলোমিটারের মধ্যে আর কোনো দ্বীপ নেই। সুতরাং এ দ্বীপই। শাহমাতার দ্বীপ। জাহরা বলল।

কিন্তু জাহরা, ডায়েরি অনুসারে কাসকেটের ধাঁধা ভেঙে ভেতরের ডকুমেন্ট থেকে নির্দেশনা নিয়ে এবং শাহমাতার অসিয়ত অনুসারে ধনভাণ্ডার ব্যবহারের নিয়ত নিয়ে রত্নদ্বীপে আসার কথা। ডকুমেন্টের কাসকেট না খুলে রত্নদ্বীপে এলে কেন? ডায়েরি অনুসারে কাসকেটটি হাতছাড়া হলেই শুধু ডায়েরির কোড ব্যবহার করার কথা। বলল আহমদ মুসা।

স্যার ঠিক বলেছেন। ডায়েরির নির্দেশ ব্যবহার করে কাসকেট নিয়ে আমার রত্নদ্বীপে আসার পেছনে একটা কাহিনী আছে। কাহিনীটা শুনলেই সব বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে। জাহরা বলল।

কাহিনীটা কি? বল। বলল আহমদ মুসা।

জাহরা সোজা হয়ে বসল।

মাথার কাপড়টা কপালের উপর আর একটু টেনে নিল। বলল, স্যার আমার দাদী বেগম আয়েশা আবু আবদুল্লাহ নাসিরী খুবই ধর্মভীরু মানুষ। সুখে-দুঃখে আল্লাহর প্রশংসা করেন, আল্লাহর উপরই ভরসা করেন। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সব সংকটে আমি তাঁকে স্থির ও শান্ত দেখেছি, কোনো মিথ্যা কথা বলতে তাকে শুনিনি। একদিন ভোরে নামাজের পর। জায়নামাজে বসেই তিনি আমাকে ডাকলেন। ছোটবেলা থেকেই দাদীর পাশের ঘরে আমার শোবার ব্যবস্থা। দুই ঘরের মধ্যে একটা কানেকটিং দরজা আছে। আগে দাদী ছোট্ট আমার উপর নজর রাখতেন, এখন বৃদ্ধা দাদীর উপর আমি নজর রাখি।

হঠাৎ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল জাহরার গলা। থেমে গেল সে। মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে শামলে নিল জাহরা। বলল, স্যরি স্যার, হঠাৎ মনটা বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল। দাদীকে আমার অসুস্থ মা কতটা দেখাশুনা করতে পারছেন, সেটাই সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমার বড় ভাই মরক্কোর নৌবাহিনীতে এবং বাবা রাবাতে এক সরকারি চাকরি করেন। মাকে ফজর নামাজ পড়ে কিছুটা ঘুমাতে হয়। দাদী হয়তো অভ্যাসবশত আমাকেই বার বার ডাকেন, কিন্তু পান না। থামল জাহরা। তার কণ্ঠ ভেজা।

ভেব না জাহরা। অবস্থা যখন মানুষের আয়ত্তের বাইরে যায়, তখন স্বয়ং আল্লাহ তার দায়িত্ব নেন। সান্ত্বনার সুরে বলল আহমদ মুসা।

হাসবুনাল্লাহ! বলে একটু থামল জাহরা। বলতে শুরু করল আবার, দাদীর ডাক পেয়ে আমি আমার জায়নামাজ থেকে উঠে দাদীর ঘরে গেলাম। দাদী বললেন, বস বোন শাহজাদী। আমি দাদীর জায়নামাজের পাশে কার্পেটের উপর বসলাম। দাদী একটু সরে বসে জায়নামাজে জায়গা বের করে বললেন, শাহজাদী মাটিতে বসবে কেন? জায়নামাজে বস। আমি দাদীর নির্দেশ মতো জায়নামাজে বসে বললাম, দাদী ছোটবেলায় আমাকে শাহজাদী বলেছ ঠিক আছে, এখনও আমাকে শাহজাদী বল কেন? আমার লজ্জা লাগে। আমি তো শাহজাদী নই। দাদী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন না। একটু গম্ভীর হয়ে উঠলেন তিনি। পরে ধীরকণ্ঠে বললেন, ছোটবেলায় তোমাকে শাহজাদী বলেছি আদর করে, কিন্তু এখন বলি তোমার অতীত, তোমাদের ক্ষমার অযোগ্য ব্যর্থতা এবং তোমার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যে। দিন কারো সমান যায় না, একথা ঠিক। কোনো সাম্রাজ্য চিরদিন টিকে থাকে না, এটাও সত্য। কিন্তু স্পেনে তোমার পূর্বসূরিরা নিছক ক্ষমতা লিপ্সার কারণে ভাইয়ে ভাইয়ে যে নিষ্ঠুর লড়াই করেছে, তা আল্লাহ মাফ করেননি। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে দীপ্ত, ইউরোপের শিক্ষা হিসাবে বরিত, গৌরবপূর্ণ ও উদার শাসনের মুসলিম স্পেন তাই মুসলমানদের গোরস্তানে পরিণত হয়েছিল। আটশত বছর সেখানে বাস করেও, মাতৃভূমি হিসাবে আঁকড়ে ধরেও নিরাপদে বাস করার একখণ্ড ভূমিও সেখানে পাইনি। থামলেন দাদী। তার কণ্ঠে যেন অশ্রু ঝরে পড়ল। কিন্তু তার চোখ দেখলাম শুষ্ক। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। জানি জিজ্ঞাসা করলেই তিনি বলবেন, চোখের পানি শেষ হয়ে গেছে। আমি আমার ডান হাত দাদীর কাঁধে রেখে অনেকটা সান্ত্বনার স্বরে বললাম, ঠিক আছে দাদী তুমি আমাকে শাহজাদীই বলো। আঘাতটুকু তো আমার জন্যে প্রাপ্যই। দাদী কিছু বললেন না। একদম নীরব হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর মুখ তুললেন। বললেন, তোমাকে ডেকেছি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্যে শাহজাদী। আমি বললাম, বলুন দাদী। দেখলাম দাদীর চোখ দুটি জানালা দিয়ে বাইরে। বাইরের আকাশ তখন সফেদ হয়ে উঠেছে। না দিন, না রাত। অপার্থিব এক প্রশান্তি ও স্নিগ্ধতা চারদিকে। দাদী বললেন, শাহজাদী, গত তিন দিন ধরে নামাজে উঠার আগে আমি একই স্বপ্ন দেখে আসছি।… দাদীর কথার মাঝখানেই আমি বলে উঠলাম, তিন দিন ধরে একই স্বপ্ন দাদী! দারুণ মজার ব্যাপার! দাদী বললেন, মজার ব্যাপার বলে একে হালকা করে ফেলো না শাহজাদী। আমার কাছে এটা একটা পবিত্র ঘটনা। বললাম আমি, স্যরি, বল দাদী। দাদী বলতে শুরু করলেন, চারদিকে অথৈ সাগর। তার মাঝে ছোট্ট সোনালি একটা দ্বীপ। চারদিকে সোবহে সাদেকের পবিত্রতা। আপাদমস্তক শুভ্র পোষাকে সজ্জিত নেকাবে ঢাকা মুখ শাহমাতা এলেন। আমার কাছ থেকে তোমাকে টেনে নিলেন। নামিয়ে দিলেন তোমাকে সেই সুন্দর সোনালি ছোট দ্বীপটিতে। তোমার হাতে তাঁর সেই ডায়েরি এবং কাসকেট। দ্বীপের কোনো এক প্রান্ত থেকে সাদা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে একজন এলেন সহজ, সরল সুন্দর চেহারার, কিন্তু ইস্পাতের মতো দৃঢ় ও ঋজু। তিনি রাজকুমার নন, কিন্তু মনে হলো শত রাজকুমারের সমান তিনি। তুমি তার হাতে তুলে দিলে শাহমাতার ডায়েরি এবং কাসকেট। আমার স্বপ্ন এতটুকুই। এই স্বপ্নই আমি পরপর তিনদিন দেখলাম। এরপরেই দাদী আমাকে পাঠিয়ে দিলেন এই রত্নদ্বীপে। দ্বীপে আসার পর অনেক দিন ধরে আমি অবিরাম খুঁজছি সহজ, সরল, সুন্দর শত রাজকুমারের সমান মানুষটিকে। কিন্তু পেলাম না কোথাও। আমি হতাশ হয়ে পড়ায় খোঁজার আগ্রহ ধীরে ধীরে কমে গেল। প্রায় ভুলেই গেলাম তাঁকে। ডায়েরির নির্দেশনা অনুসারে আমি নিজেই খুঁজতে লাগলাম শাহমাতার ধনভাণ্ডার। এই সময়ই দেখা পেলাম আপনার। প্রথম, দ্বিতীয় দেখায় আমি বুঝতে পারিনি, মনের দরজাও খোলেনি। কিন্তু গতকাল রাতে যখন আপনি জীবন ও সম্মান শেষ হওয়া থেকে আমাকে বাঁচালেন, তখন হঠাৎ করেই আমার মনের দরজা খুলে গেল। আপনাকে চেনা আমার সম্পূর্ণ হলো। এখন দাদীর স্বপ্নের শেষ অংশের বাস্তবায়ন শুধু ফাঁকি স্যার।

গম্ভীর আহমদ মুসার মুখ। বলল, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের স্বপ্ন আল্লাহর ইচ্ছায় সত্য হয়ে থাকে। যার হাতে ডায়েরি ও কাসকেট তুলে দেয়া হয়েছিল, স্বপ্নের সেই ব্যক্তি যে আমি তা নিশ্চিত হওয়া গেল কি করে?

আপনি ছাড়া মানুষ চেনে-জানে এমন একজন দ্বিতীয় হাতেম তায়ীর নাম আপনি করুন। পারবেন না। আর আপনি রত্নদ্বীপে এসেছেন, ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। এমন হাজারো সংকট আপনি সমাধান করেছেন। সুতরাং সবদিকের বিচারে আপনি সেই ব্যক্তি, এতে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই স্যার। সবচেয়ে বড় কথা স্যার, শাহমাতা যার মাধ্যমে ডায়েরি ও কাসকেট রত্নদ্বীপে আপনার জন্যে পাঠিয়েছেন। সেই আমার মন বলছে আমি যাকে খুঁজছিলাম তাকে পেয়ে গেছি। এরপর আর কোনো কথা চলতে পারে না। বলল জাহরা। তার মুখে হাসি।

কিন্তু আহমদ মুসার মুখে হাসি নেই। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ঠিক আছে জাহরা, তুমি আমাকে কাসকেটটা দেখাও।

ধন্যবাদ স্যার। এখানে আনব? বলল জাহরা।

আহমদ মুসা দেয়াল ও উপরের দিকে তাকাল। বলল। এখানে সিসি ক্যামেরা নেই তো?

আছে স্যার। প্রত্যেক ডরমিটরির প্রবেশ পথে সিসি ক্যামেরা আছে। বলল জাহরা।

তাহলে তো এখানে কাসকেটটি দেখা নিরাপদ নয়। তাহলে চল তোমাদের বাগানে গিয়ে বসি। আহমদ মুসা বলল।

ঠিক আছে স্যার। আমি কাসকেটটা নিয়ে আসি।

জাহরা দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল এবং কাসকেট নিয়ে ফিরে এল।

আহমদ মুসা আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিল।

জাহরা এলেই তারা নিচে নামতে শুরু করল।

 

 

ডরমিটরি বিল্ডিংটা চারদিকে ঘুরানো। বের হবার মাত্র একটা গেট। গেটে ভারি গ্রীলের দরজা। দরজার নিচের অংশ আইনশীট দিয়ে ব্লাইন্ড করে দেয়া, দারোয়ানদের লুকিং হোল ছাড়া। ডরমিটরি বিল্ডিং-এর মাঝখানে বিশাল ফাঁকা জায়গাটায় পাশাপাশি একটা খেলার মাঠ এবং একটি বাগান। বাগানের এখানে সেখানে স্টিলের বেঞ্চ, স্টিলের টেবিল এবং উপরে স্টিলের রঙিন ছাতা।

আহমদ মুসা ও জাহরা দুজন ডরমিটরি থেকে নেমে বাগানের দিকে চলল। পেছন দিক থেকে গাড়ি ছুটে আসার মতো একটা শব্দ শুনতে পেল। আহমদ মুসার গোটা স্নায়ুতন্ত্রী একসাথে যেন সাইরেন দিয়ে উঠল।

চোখের পলকে আহমদ মুসা জাহরাকে ডান দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সে বাম দিকে জাম্প দিল। তার সাথে সাথে শোল্ডার হোলস্টার থেকে বের করে নিল এম-১৬ মেশিন রিভলবার। পেছন দিকে তাকিয়ে দেখল একটা। মাইক্রো ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে। চিন্তাটাও ঝড়ের বেগে মাথায় এলো আহমদ মুসার। শুরুতেই গুলি করলো মাইক্রোর পেছনের টায়ারে।

দশ পনের গজ গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মাইক্রো।

মাইক্রো থেকে নামল ছয় সাতজন স্টেনগানধারী। তাদের সকলের দৃষ্টি পেছন দিকে। তাদের স্টেনগান আহমদ মুসা লক্ষ্যে উঠে আসছে।

আহমদ মুসার এম-১৬ মেশিন রিভলবার প্রস্তুত ছিল। ট্রিগার টিপে ধরল শুধু।

মাইক্রোর বাম পাশে দুটি দরজা এবং তা পাশাপাশি। তারা একসাথেই গাড়ি থেকে নেমেছিল এবং একসাথেই গুলির শিকার হলো।

আহমদ মুসা উঠে বসল। তাকাল জাহরার দিকে। সে মাটির সাথে লেপটে পড়ে আছে।

তুমি ঠিক আছ জাহরা? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।

মাথা তুলে তাকাল জাহরা। ভয়-আতংকে কুকড়ে যাওয়া তার মুখ। দেহের কাঁপুনি তার থামেনি এখনও। মৃত্যু থেকে তার ব্যবধান ছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ডের। স্যার ধাক্কাটা না দিলে মাইক্রোর তলায় সে পিষ্ট হয়ে যেত।

উঠে বসল জাহরা। বলল, স্যার আমি বেঁচে আছি, ভালো আছি। স্যার।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।

গেটের দিকে একটা শব্দ পেয়ে আহমদ মুসা ফিরে তাকাল। চমকে উঠল ফিরে তাকিয়েই। একজন লোক ছুটে আসছে। তার গায়ে ডরমিটরির সিকিউরিটি স্টাফদের পোষাক। দৌড়ের মধ্যেই তার এক হাত উপরে উঠেছে আহমদ মুসার লক্ষ্যে। সেই সাথে দেখতে পেল একটা কার গেট ঠেলে দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করছে। সম্ভবত নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ি। এক পলকের দৃষ্টিতে আহমদ মুসার নজরে পড়ল এসব।

দৃষ্টির চেয়ে দ্রুত কাজ করল আহমদ মুসার চিন্তা। লোকটিকে চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা মাথা নিচু করে জাম্প দিল এবং দেহকে গুটিয়ে বলের মতো করে ছুটল লোকটির দিকে।

লোকটি বোমা ছুঁড়েছে।

বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটার প্রায় সাথে সাথেই আহমদ মুসার গড়ানো দেহ গিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করল লোকটির দুপাসহ হাঁটুর নিচটায়। লোকটি পড়ে গেল। আহমদ মুসা স্পিং-এর মতো উঠে দাঁড়াল।

আহমদ মুসা লোকটির দিকে রিভলবার তাক করে বলল, যেমন আছ ঠিক তেমন থাক। হাত-পা নাড়াচাড়া করতে…।

কিন্তু আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই লোকটি বেপরোয়া ভংগিতে তার ডান হাতের অনামিকা কামড়ে ধরেছে।

আহমদ মুসা কথা শেষ না করেই ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটির হাত লক্ষ্যে। টেনে বের করল তার অনামিকা। কিন্তু আঙুলের রিংটা তার মুখেই রয়ে গেছে।

হতাশভাবে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।

আহমদ মুসাদের পাশেই নিরাপত্তা বাহিনীর একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে।

গাড়ি থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সহকারী প্রধান মেজর পাভেল।

আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে সামনে মেজর পাভেলকে দেখতে পেয়ে বলল, একেও জীবন্ত ধরা গেল না মেজর পাভেল।

একদম বেপরোয়া এদের আচরণ। অবাক ব্যাপার! এদের একই রকম দেখছি।

বলে মেজর পাভেল একটু থামল। বলল আবার, স্যার এরা এই ডরমিটরির ৮জনকে হত্যা করে তাদের পোষাক ও গাড়ি নিয়ে ডরমিটরিতে আপনার উপর হামলা করতে আসে। মিনিট বিশেক আগে আমরা টেলিফোন পাই একজন পেট্রোল-নিরাপত্তা কর্মীর কাছ থেকে। সে জানায়, রাস্তার ধারে একটা টিলার আড়ালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিমেল ডরমিটরির নিরাপত্তা প্রহরীর লাশ পড়ে আছে। তাদের একজনের গায়েই শুধু ইউনিফরম ছিল। অন্যদের খালি গা। আপনি এই ডরমিটরিতে এসেছেন, এ তথ্য আমাদের কাছে ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা নিশ্চিত হই, ডরমিটরি নিরাপত্তাকর্মীদের পোষাক ও গাড়ি নিয়ে ওরা আপনার সন্ধানেই ডরমিটরিতে গেছে। তার পরেই আমরা ছুটে এসেছি।

থামল মেজর পাভেল। তার চেহারা উদ্বেগ-আতংকে বিধ্বস্ত।

জাহরা ডায়েরি ও কাসকেট রাখা ব্যাগটা কুড়িয়ে আহমদ মুসাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

ডরমিটরির মেয়েরা অনেকেই গোটা দৃশ্য দেখেছে। তারা সবাই নিচে নেমে এসেছে অভূতপূর্ব ঘটনা এবং এর কারণ কি ও কেন তা জানার জন্যে।

তারা এসে জমা হয়েছে আহমদ মুসা, জাহরা, মেজর পাভেলদের ঘিরে। দৃষ্টি তাদের জাহরা ও আহমদ মুসার দিকে। তাদের জাহরাকে নিয়ে কি ঘটল? জাহরার সাথে লোকটি কে? একদম ফিল্মের মতো ঘটনা ঘটাল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, ৮টা লাশ পড়ে গেল?

মেজর পাভেলের দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, ধন্যবাদ মেজর। মেজর পাভেল একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, আমি এখানে এসেছি এটা শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস ও কর্নেল জেনারেল রিদা জানেন। এত তাড়াতাড়ি ওরা জেনে গেল কি করে?

স্যার, মনে হয় ওরা প্রেসিডেন্ট হাউজে আপনাকে ফলো করেছে, তারপর ডরমিটরিতেও আপনাকে ফলো করে এসেছে।

তার মানে ওরা সব সময় আমাকে ফলো করছে। বলল আহমদ মুসা।

স্যার, আমাদের তো তাই মনে হচ্ছে। মেজর পাভের বলল।

মেজর পাভেল, আপনি এই লাশগুলোর ব্যবস্থা করুন এবং ডরমিটরির নিরাপত্তা আরও জোরদার করার ব্যবস্থা করতে হবে।

বলেই আহমদ মুসা তাকাল জাহরার দিকে। বলল, দেখ ডরমিটরির মেয়েরা নেমে এসেছে। তারা জানতে চায়, শুনতে চায়। যা ঘটেছে তা বল সবাইকে।

আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই চারদিক থেকে ডরমিটরির মেয়েরা আহমদ মুসাদের আশেপাশে দাঁড়িয়ে গেল। তাদের সকলের মুখেই উদ্বেগ-আতংক।

আহমদ মুসা এবার তাকাল মেজর পাভেলের দিকে। বলল, মনে করেছিলাম জাহরা বললেই হবে। কিন্তু সে তাদেরই একজন। তার কথা সবার কাছে সমান গুরুত্ববহ হবে না। পাভেল, তুমিই বিষয়টা সবার কাছে পরিষ্কার করে দাও।

পাভেল মেয়েদের দিকে এগিয়ে গেল। তার আগেই জাহরা মেয়েদের কাছে চলে গিয়েছিল। উত্সক ও আতংকগ্রস্ত মেয়েরা তাকে এসে ঘিরে ধরেছিল বিষয়টা কি তা জানার জন্যে। মেয়েদের পেছনে অনেক ছাত্রকেও দেখা গেল। খোলা গেট দিয়ে তারা এসেছে। তাদের সংখ্যা বাড়ছে।

মেজর পাভেল সামনে গিয়ে দুই হাত তুলে বলল, ছেলেমেয়েরা শোন, এখন আর উদ্বেগের কিছু নেই। সন্ত্রাসীরা যারা ভেতরে ঢুকেছিল, সবাই মারা পড়েছে। সন্ত্রাসীদের আমরা চিনতে পেরেছি। দেশের কয়েক জায়গায় সন্ত্রাস করতে গিয়ে যারা মারা পড়েছে, এরা তাদের গ্রুপেরই। আমাদের একজন সম্মানিত ভাই সন্ত্রাস দমনে যিনি আমাদের সহযোগিতা করছেন, তাঁকে টার্গেট করেই সন্ত্রাসীদের এই অভিযান ছিল। আল্লাহ তাদের সন্ত্রাসী অভিযান ব্যর্থ করে দিয়েছেন। সবাই আপনারা প্রার্থনা করুন গোটা দ্বীপ থেকেই সন্ত্রাসীরা যেন উৎখাত হয়ে যায়। থামল মেজর পাভেল।

সঙ্গে সঙ্গেই একটি মেয়ে বলে উঠল, সম্মানিত ভাইটি কে? আমরা যা দেখলাম, যেভাবে তিনি বাঁচলেন, বাঁচালেন এবং মারলেন সবাইকে, তা অবিশ্বাস্য। তিনি রত্নদ্বীপের নিশ্চয় নন।

আহমদ মুসা রত্নদ্বীপের নয়, বেড়াতে আসা এক মেহমান তিনি। এই পরিচয় দিয়ে মেজর পাভেল বলল, এর বেশি তার পরিচয় সম্পর্কে আমরা বলতে পারবো না। নানা কারণে বিষয়টা গোপন রাখা হয়েছে। প্লিজ, এ বিষয়ে কেউ আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।

মেজর পাভেল থামতেই আরেকজন উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠল, আপনাদের সম্মানিত ভাই আমাদের সম্মানিত স্যার। তাঁর কাছে। দুএকটা কথা আমরা শুনতে চাই। অবশ্যই বলবেন তিনি আমরা আশা করি।

মেজর পাভেল তাকাল আহমদ মুসার দিকে।

ঠিক আছে ওরা চাইছে বলব আমি।

বলে আহমদ মুসা সামনে এগোলো।

সবাইকে লক্ষ্য করে সালাম দিয়ে বলল, তোমরা আমার কাছে কি কথা শুনতে চাও আমি জানি না। কিন্তু আমি কিছু বলতে চাই তোমাদেরকে। এই ঘটনায় তোমাদের সবার মুখে আমি উদ্বেগ দেখছি। রত্নদ্বীপের নতুন প্রজন্মের এই চেহারা আমার ভালো লাগেনি। সন্ত্রাস, বিপদ ইত্যাদি সামনে এলে ভয়, উদ্বেগের বদলে তোমাদের মুখ প্রতিবাদ প্রতিরোধে দৃঢ় হওয়া উচিত। আজ রত্নদ্বীপে সন্ত্রাসীরা যে বিপদ নিয়ে এসেছে, সেটা আমি মনে করি রত্নদ্বীপ, রত্নদ্বীপের মানুষের ক্ষতি নয়, উপকারে আসবে। রত্নদ্বীপের সংবিধান, তার ফল হিসাবে রত্নদ্বীপের শান্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দৃষ্টান্তযোগ্য একটা মডেল। আমি অভিবাদন জানাই রত্নদ্বীপের মানুষকে ও তাদের নেতাকে। রত্নদ্বীপের এই প্রশংসার সাথে সাথে আমি রত্নদ্বীপের একটা বিচ্যুতির কথা বলতে চাই। রত্নদ্বীপের মানুষ দেশে শান্তি এনেছে, শান্তি এনেছে তাদের। জীবনে, কিন্তু এই শান্তি রক্ষার জন্যে, শান্তিকে বাইরের সন্ত্রাস, ষড়যন্ত্র, আগ্রাসন থেকে রক্ষার জন্যে যে শক্তি প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করেনি। স্বাধীনতা ও শক্তি সমার্থক। এক থেকে অন্যকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। শক্তিহীন স্বাধীনতা হলো পরনির্ভরতা, অন্য কথায় পরাধীনতা। রত্নদ্বীপকে তার এই ভুল শোধরাতে হবে। রত্নদ্বীপকে পরিণত হতে হবে এক অজেয় শক্তিকে। ছোট দেশ হলেই তার শক্তি ছোট হবে তা ঠিক নয়। ছোট দ্বীপকে বরং পরিণত হতে হবে বড় শক্তিতে। রত্নদ্বীপ নিয়মিত-অনিয়মিত মিলে এক লাখ সৈন্যের একটা বাহিনী গড়ে তুলতে পারে। আধুনিক অস্ত্রভাণ্ডার ব্যবহার করলে এই বাহিনী অজেয় এক বাহিনীতে পরিণত করা সম্ভব। রত্নদ্বীপ একটা প্রাকৃতিক দুর্গ। প্রাকৃতিক এই সুযোগও তার প্রতিরক্ষার একটা বড় শক্তি। রত্নদ্বীপের নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতা ও শক্তির মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। বর্তমান সংকটে রত্নদ্বীপের নতুন প্রজন্মের প্রত্যেক সদস্যকে এ কথা বুঝতে হবে এবং তাদের চারপাশে শান্তি রক্ষা করে চলতে হবে, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। জনগণের সরকার ও সংবিধান যাতে দুর্বল না হয়ে পড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে। আমি একজন বিদেশি। আমার এই কথাগুলো রত্নদ্বীপের প্রতি, রত্নদ্বীপের জনগণের প্রতি আমার ভালোবাসা।

সবাইকে সালাম নিয়ে আহমদ মুসা তার কথা শেষ করল।

আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই গোটা মাঠ হাততালিতে যেন ফেটে পড়ল।

মাঠ ভরে গেছে ছাত্র-ছাত্রীতে। ছাত্রী ডরমিটরির বিশাল হোস্টেল। ডরমিটরির ঘটনা তাদের কানে পৌঁছেছে। তারা সবাই ছুটে এসেছে। ডরমিটরিতে।

ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্য থেকে একজন সামনে এগিয়ে এল। দেখেই আহমদ মুসা চিনল তাকে। প্রেসিডেন্টের ছেলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হামযা আনাস আমিন। সে সকল ছাত্র-ছাত্রীর তরফ থেকে আহমদ, মুসাকে সালাম দিয়ে বলল, আপনি নিজেকে বিদেশি বলে পরিচয় দিয়েছেন। কোনো বিদেশি এমন আপনজন হয় না। আপনি নতুন এক রত্নদ্বীপকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। এই দিকটা আমরা রত্নদ্বীপবাসীরা কখনো কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। আমরা আশা করি, শান্তি ও শক্তিতে সজ্জিত যে রত্নদ্বীপের কথা আপনি বলেছেন, সেটাই হবে ভবিষ্যতের রত্নদ্বীপ। রত্নদ্বীপের নতুন প্রজন্ম আমরা চাই নতুন রত্নদ্বীপ গড়ার সংগ্রামে আপনি রত্নদ্বীপের সাথী হোন। স্বপ্ন যিনি দেখান, স্বপ্নের বাস্তবায়ন থেকে বিচ্ছিন্ন তিনি থাকেন না। রত্নদ্বীপের তরুণ প্রজন্মের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। নতুন রত্নদ্বীপের সৈনিক আমরা নতুন প্রজন্মের সকলেই, এই নিশ্চয়তা আমরা দিতে চাই আপনাকে।

আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে কথা শেষ করল হামযা আনাস আমিন।

আহমদ মুসা ধন্যবাদ জানাল সকলকে।

আহমদ মুসা কথা শেষ করে মেজর পাভেলের দিকে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল–এ সময় ছাত্র-ছাত্রীদের সারি থেকে একটা মেয়ে ও একটা ছেলে ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে।

তাদেরকে ছুটে আসতে দেখে আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল।

মেয়ে ও ছেলেটা এসে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। মেয়েটা বিশ একুশ বছরের। ছেলেটা দুএক বছরের ছোট হবে। তাদের চোখে-মুখে গ্রিক ও স্প্যানিশ চেহারার মিশ্রণ। তবে শহুরে নয়, বন্য-লাবন্য তাদের সুষমায়। খুব ঋজু, খুব সরল তাদের ভঙ্গিমা।

মেয়েটি বলল, আমি লরা সোফিয়া, আর আমার সাথে আমার ছোট ভাই লরেঞ্জো। দ্বীপের পূর্বাঞ্চলে গোয়দিয়া পাহাড় অঞ্চলে থাকি। সেখান। থেকেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি। আজ জরুরি একটা কাজে আমরা। এদিকে এসেছিলাম। ভাগ্যবলেই আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল।

একটু থামল মেয়েটি। একটু ভাবল বা নিজেকে মনে হয় একটু গুছিয়ে নিল। বলল, স্যার, আপনাকে একটা ইনফরমেশন দিতে চাই। আর কিছু না হোক, বিপদ থেকে বাঁচার জন্যে এটা আমাদের প্রয়োজন।

ইনফরমেশন? এখানেই বলবে, কোথাও বসতে চাও? বলল আহমদ মুসা।

আপনার ইচ্ছা স্যার। বলল লরা সোফিয়া।

একটু অপেক্ষা করতে পারবে তোমরা? বলল আহমদ মুসা।

অসুবিধা নেই স্যার, আমাদের কোনো তাড়া নেই। আমরা অপেক্ষা করব। লরা সোফিয়া বলল।

তাহলে তোমরা একটু দাঁড়াও।

বলে আহমদ মুসা তাকাল মেজর পাভেলের দিকে। বলল, লাশগুলো নেয়ার ব্যবস্থা কর। তার আগে চল লাশগুলোকে সার্চ করি। ডরমিটরির নিরাপত্তার জন্যে শুধু এর প্রহরীরা যথেষ্ট নয়। তাদের সাথে কয়েকজন করে নিরাপত্তা সৈনিকও রাখতে হবে।

আহমদ মুসা কথা শেষ করেই লাশের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

মেজর পাভেল আহমদ মুসার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ডরমিটরি, মেয়েদের ও ছেলেদের হলের গেটে নিরাপত্তা সৈনিক। মোতায়েনের ব্যবস্থা করা হয়েছে স্যার।

ধন্যবাদ মেজর। আসুন। বলল আহমদ মুসা।

জাহরা ছুটে এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। বলল, স্যার ডায়েরি এবং কাসকেট আমার হাতে।

হ্যাঁ জাহরা, ওগুলো তোমার হাতে রাখ। ডরমিটরি থেকে বেরোবার আগে তোমার সাথে আমার সাক্ষাত হবে। বলল আহমদ মুসা।

ধন্যবাদ স্যার। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। জাহরা বলল।

ওয়েলকাম। বলে আহমদ মুসা আবার হাঁটতে শুরু করল।

হঠাৎ ঝড়ের বেগে একটা কথা আহমদ মুসার মনে এলো। লরাদের বিপদের কথা না শুনা ভুল হয়েছে। কি বিপদ না জেনে তাদের অপেক্ষা করতে বলাটা আল্লাহর ইচ্ছার খেলাফ হতে পারে। আল্লাহর ইচ্ছাতেই তো ওরা এসেছিল আমার কাছে।

কথাটা মনে হওয়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসা লরারা কোথায় তা দেখার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল। পেছন ফিরেই দেখতে পেল, লরা সোফিয়া ও লরেঞ্জো তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। গল্প করছে তারা।

সেই সাথেই স্টার্ট নিয়ে উঠা মটর সাইকেলের দিকে তার দুই চোখ ছুটে গেল। দেখল মোটর সাইকেলে তিনজন আরোহী। তাদের পেছনের দুইজনের হাতের রিভলবার এদিকে উঠে আসছে। দেখার সাথে সাথেই আহমদ মুসা বুঝল, লরা সোফিয়া ও লরেঞ্জো ওদের টার্গেট।

ওটা দেখার সাথে সাথেই আহমদ মুসার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে। আহমদ মুসার হাত জ্যাকেটের পকেট থেকে বেরিয়ে এল রিভলবারের ট্রিগারে তর্জনি রেখে। নতুন করে টার্গেটের সময় নেই, জ্যাকেটের পকেট থেকে হাত বের হবার সাথে সাথেই ট্রিগারে চেপে বসল তার আঙুল। বেরিয়ে এলো দুটি গুলি পরপর।

আহমদ মুসার অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতাই জিতে গেল। মোটর সাইকেলের পেছনের দুইজন রিভলবারধারী গুলিবিদ্ধ হলো। তাদের তর্জনিও ট্রিগার টিপেছিল। কিন্তু গুলি খাওয়ার ঝাঁকুনি তাদের টার্গেট থেকে সরিয়ে দিল। রিভলবারের নল নড়ে গিয়ে অনেকখানি নিচে ও পাশে সরে গিয়েছিল। গুলি দুটি অল্প দূরে দাঁড়ানো দুটি ছেলের একজনের উরু, অন্যজনের হাঁটুর নিচের পেশিটাকে বিদ্ধ করল। ছেলে দুটি যন্ত্রণায় চিৎকার করে বসে পড়েছিল। আর মোটর সাইকেলের রিভলবারধারী দুজন গুলি খেয়ে মোটর সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েছিল।

মোটর সাইকেলের তৃতীয়জন ছুটে পালাচ্ছিল।

ঘটনার সাক্ষী হিসাবে তাকে পালাতে দিতে চাইল না আহমদ মুসা।

আপনাতেই তার রিভলবার টার্গেটে উঠে গিয়েছিল। আহমদ মুসা তর্জনি চাপল ট্রিগারে। বুলেট ছুটল মোটর সাইকেলে ছুটে চলা লোকটির পেছনে। চার পাঁচ গজও এগোতে পারল না লোকটা। গুলি খেয়ে পড়ে গেল।

বিস্ময় আতংকে অভিভূত মাঠভর্তি ছাত্র-ছাত্রীরা দেখছিল তাদের মাঝে সংঘটিত এই ঘটনা।

লরা সোফিয়া ও লরেঞ্জোরা শুরুতে বুঝতেই পারেনি যে, তারা। টার্গেট। পরে বুঝতে পেরে বাকহীন পাথরের মতো হয়ে গিয়েছিল তারা।

অন্য সবাই প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি বিষয়টা। ডরমিটরির সিকিউরিটির পোষাক পরা মোটর সাইকেলের রিভলবারধারী আরোহীকে দেখে তাদের কিছু মনে হয়নি। কিন্তু রিভলবারধারীরা যখন দুজন ছাত্র ছাত্রীর দিকে রিভলবার তুলল এবং আহমদ মুসা যখন ওদের গুলি করল, তখনই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল সবার কাছে। আতংক, বিস্ময় ফুটে উঠে তাদের চোখে-মুখে। তাদের সবার চোখ আহমদ মুসার দিকে। সিকিউরিটির লোকরা ছুটে এসে গুলিবিদ্ধদের ঘিরে ফেলেছে।

আহমদ মুসা মেজর পাভেলকে বলল আহত দুজন ছাত্রকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করতে।

আহমদ মুসা এগোলো লরা সোফিয়া ও লরেঞ্জোর দিকে।

আহমদ মুসাকে সামনে দেখেই লরা বলল, স্যার, আপনি আমাদের দুজনের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আমরা আমৃত্যু কৃতজ্ঞ থাকবো। ভীত, ভারি কণ্ঠস্বর লরা সোফিয়ার।

আহমদ মুসা লরা সোফিয়ার কথার কোনো উত্তর দিল না। প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলল, ওরা তোমাদের টার্গেট করেছিল কেন? ওদের চেন? কারা ওরা জান?

জানি না স্যার। তবে আমার মনে হচ্ছে, যারা আমাদের বিপদ ঘটিয়েছে, যাদের কথা আমরা আপনাকে বলতে চাচ্ছিলাম, এরা তাদের কেউ হতে পারে। তারা না হলে আমাদের চিনল কি করে? লরা সোফিয়া বলল।

কিন্তু ওরা তোমাদের মারতে চাচ্ছিল কেন? বলল আহমদ মুসা।

তাদের কোনো কথা কাউকে বলার ক্ষেত্রে নিষেধ আছে আমাদের পরিবারের সকলের উপর। এমন কি যা ঘটেছে, সে সম্পর্কেও কাউকে কিছু বলা যাবে না। আপনার সাথে আমরা কথা বলায় তারা হয়তো সন্দেহ করেছে যে, আমরা আপনাকে কিছু বলতে যাচ্ছি। লরা সোফিয়া বলল।

তাহলে কি তারা তোমাদের ফলো করে? তোমরা কাদের সাথে কি কথা বলছ, তা কি তারা মনিটর করে? বলল আহমদ মুসা।

আমরা এটা খেয়াল করিনি। এটা তারা করতে পারে স্যার। তারা। সাংঘাতিক তৎপর, নাছোড়বান্দা স্যার। লরা সোফিয়া বলল।

তোমাদের ঘটনা কি, এখনি জানতে হচ্ছে লরা সোফিয়া। শুন, তোমরা জাহরার সাথে তার ডরমিটরিতে যাও। আমি আসছি।

বলেই পাশে দাঁড়ানো জাহরাকে বলল, তুমি এদের নিয়ে যাও।

যাচ্ছি স্যার। জাহরা বলল।

তাকাল জাহরা লরা সোফিয়ার দিকে। বলল, আসুন আমরা চলি।

তারা তিনজন এগোলো জাহরার ঘরের দিকে।

আহমদ মুসা মোবাইল বের করল পকেট থেকে।

কল করল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোসকে।

মোবাইলের ওপ্রান্ত থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গলা পেয়েই বলল আহমদ মুসা, মি. কনস্টানটিনোস, আপনি নিশ্চয় এ দিকের খবর পেয়েছেন।

হ্যাঁ মি. আহমদ মুসা, সব খবর পেয়েছি। আবার আপনাকে আমাদের হৃদয়পূর্ণ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ডরমিটরির ভেতরে তাদের দু দুটি ভয়াবহ অভিযান আপনি ব্যর্থ করে দিয়েছেন। সাক্ষী হবার মতোও কেউ বাঁচেনি! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল।

মি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আসুন আমরা অতীত নয়, ভবিষ্যতের কথা ভাবি। আমরা যে সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করছি, তারা খুবই দুঃসাহসী, বেপরোয়া এবং প্রাণ থাকা পর্যন্ত পিছু হটে না। ওদের অনেক ক্ষতি হয়েছে কিন্তু তা তারা বুঝতে দিচ্ছে না আক্রমণ অব্যাহত রেখে। পথের কাঁটা দূর করার কোনো সুযোগই তারা মিস করছে না। বলল আহমদ মুসা।

এটাই তো আমাদের সবার জন্যে উদ্বেগের মি. আহমদ মুসা। এখন বলুন আমাদের কি করণীয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল।

গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত পাহারার ব্যবস্থা করুন। স্টেট সিকিউরিটি ফোর্সসহ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যে ফটোসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দস্তখত সংবলিত নতুন আইডি কার্ডের ব্যবস্থা করুন। সিকিউরিটি ফোর্সসহ সকলের জন্যে আইডি কার্ড শো করা। বাধ্যতামূলক করতে হবে। আপনাদের প্রত্যেক নাগরিকের যে ন্যাশনাল আইডি কার্ড রয়েছে তার দ্রুত নবায়নের ব্যবস্থা করুন। অঞ্চলভিত্তিকভাবে বসে পরিচয় নিশ্চিত করে কার্ড নবায়ন করতে হবে। কার্ড ও পাসপোর্ট-ভিসাবিহীন কোনো লোক পেলে তাকে গ্রেফতার করতে হবে। আমার মনে হয় এই কাজগুলো সম্পন্ন হলে সন্ত্রাসীদের অবাধ চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং তারা অনেকটাই চাপে পড়বে। আরও কিছু বিষয় আছে, ওগুলো নিয়ে পরে চিন্তা করা যাবে। বলল আহমদ মুসা।

আহমদ মুসা মোবাইল অফ করে পাভেলদের কাজের দিকে একবার তাকিয়ে হাঁটা দিল জাহরার ডরমিটরির দিকে।

Top