৪৭. বসফরাসে বিস্ফোরণ

চ্যাপ্টার

বিদ্যুৎ বিভাগের লাইন চেকিং কাজের লক্কড় মার্কা একটা গাড়ি ড্রাইভ করে আহমদ মুসা বার্বারোস বুলেভার্ড থেকে ১০১ নম্বর বাড়ির সংযোগ রাস্তায় প্রবেশ করল।
আহমদ মুসার পরনেও বিদ্যুৎ বিভাগের লাইনম্যানদের পোশাক। মাথার চুল অগোছালো। চেহারায় রোদ পোড়া, ক্লান্ত ভাব। পায়ে পুরানো ময়লা বুট।
বিদ্যুৎ বিভাগের গাড়িটি ১০১ নম্বর বাড়ির সংযোগ রাস্তায় ঢুকতেই দু’জন লোক এসে হাত তুলে গাড়ির সামনে দাঁড়াল।
গাড়ি দাঁড় করাল আহমদ মুসা।
‘কোথায় যাও?’ বলল একজন।
‘একশ’ এক নম্বর বাসা থেকে টেলিফোন করেছে। জরুরি।’ স্থানীয় টার্কিস ভাষায় বলল আহমদ মুসা। এ ধরণের প্রয়োজনীয় কয়েকটি বাক্য সে গত আধা ঘন্টা ধরে মুখস্থ করেছে।
উত্তর শুনে লোক দু’জন একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। একজন আরেকজনকে বলল, ‘নিশ্চয় লাইনে কোন সমস্যা দেখা দিয়েছে, জরুরি টেলিফোন করেছে।’
অবশেষে তারা সামনে থেকে সরে গেল। হাত দিয়ে ইশারা করে যেতে বলল।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল আহমদ মুসা। ওদের দু’জনের পকেটে রিভলবার আছে, তাদের পকেটের ওজন দেখেই তা বুঝতে পেরেছে আহমদ মুসা। সেই সাথে আরও বুঝতে পারল, বাড়িটাকে তারা কড়া পাহারায় রেখেছে।
আহমদ মুসার লক্কড় মার্কা পিকআপ গাড়িটা গিয়ে বাড়ির গাড়ি বারান্দায় থামল।
হাতে প্লাস্টিকের ছোট্ট থলে নিয়ে লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা।
গাড়ি বারান্দার পরেই তিন ধাপের সিঁড়ি পেরিয়ে ওপরে উঠলেই মূল বারান্দা। মূল বারান্দাতেই বড় দরজা। এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করা যায় বাড়ির ড্রইং রুমে।
কিন্তু আহমদ মুসা এ দরজার দিকে না এগিয়ে বারান্দাটির পাশ দিয়ে বাড়িটিতে প্রবেশের আরেকটি বড় দরজার দিকে এগোলো।
বাড়িতে প্রবেশের এটাই প্রধান দরজা।
দরজায় দ্রুত নক করল আহমদ মুসা, কাজের তাড়া থাকলে যেমনটা হয়।
দরজা খুলে গেল।
দরজায় দাঁড়িয়ে গুন্ডাকৃতির একজন মানুষ। কঠোর মুখে ভীষণ বিরক্তি প্রকাশ করল আহমদ মুসাকে দেখে।
কিছু বলতে যাচ্ছিল লোকটি। তার আগেই আহমদ মুসা ‘আমি ইলেকট্রিসিয়ান, ভেতর থেকে জরুরি কল করেছে’ বলে অনুমতি না নিয়েই ভেতরে ঢুকে গেল।
লোকটি এমনটা আশা করেনি। সে দু’ধাপ পিছিয়ে গিয়ে দু’হাত প্রসারিত করে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও, যেতে পারবে না এখন। আমি জিজ্ঞেস করে দেখি, তোমাকে কেউ ডেকেছে কিনা?’
‘যাও, জিজ্ঞেস করে এসো।’ বলল আহমদ মুসা।
লোকটির দু’দিকে প্রসারিত হাত নেমে এলো নিচে।
‘তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি ভেতরের লোকের সাথে কথা বলছি।’ বলে লোকটি পকেট থেকে মোবাইল বের করে পেছন ফিরে দাঁড়াল কথা বলার জন্যে।
আহমদ মুসার বাম হাতে ঝুলছিল একটা টুলস ব্যাগ, ডান হাত খালি ছিল।
লোকটি ঘুরে দাঁড়াতেই আহমদ মুসার ডান হাত দ্রুত তার ডাক পকেটে চলে গেল, আর বাম হাতের টুলস ব্যাগ বাম কাঁধে তুলে নিয়ে হাতটি মুক্ত করল।
আহমদ মুসার ডান হাত বেরিয়ে এলো একটা ভাঁজ করা ছোট্ট রুমাল নিয়ে।
লোকটা তখন সবে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়িয়েছে মাত্র।
আহমদ মুসা দু’ধাপ সামনে এগিয়ে গেল দ্রুত, বিড়ালের মতো নিঃশব্দে। সংগে সংগেই তার বাম হাত চোখের পলকে পেঁচিয়ে ধরল লোকটির গলা সাঁড়াশির মতো। সেই সাথে তার ডান হতের রুমাল এসে চেপে বসল লোকটির নাকে।
লোকটি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে প্রাণপণ চেষ্টা করল কয়েক মুহূর্ত। কিন্তু পারল না। কয়েক মুহূর্তেই সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
আহমদ মুসা তার সংজ্ঞাহীন দেহ ডিঙিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল।
ভেতরটায় একটা লাউঞ্জ।
লাউঞ্জের চারদিকেই ঘর। পশ্চিম-উত্তর কোণে একটা সিঁড়ি ওপর দিকে উঠে গেছে। সিঁড়ির গোড়া দিয়ে লাউঞ্জ থেকে একটা করিডোর চলে গেছে পশ্চিম দিকে।
আহমদ মুসাদের পাওয়া তথ্য সত্য হলে এই বাড়িতেই এনে তোলা হয়েছে কিডন্যাপড হওয়া অসুস্থ বিচারপতিকে। বাড়ির ভেতর-বাইরের পাহারাও এটাই প্রমাণ করেছে।
কিন্তু এখন কোন্ দিকে অগ্রসর হবে বুঝতে পারলো না আহমদ মুসা। লাউঞ্জের বাম দিকের ঘরগুলোর সব দরজাই বন্ধ। ভাবল আহমদ মুসা, এক তলার কোন ঘরে অবশ্যই তিনি নেই। এসব ঘরে সাধারণত প্রহরী ও বাড়ির কর্মচারীরাই থাকে। হয় তাকে আন্ডারগ্রাউন্ড কোন ফ্লোরে রাখা হয়েছে, না হয় ওপর তলার কোথাও। বাড়িটি তিন তলা।
সিঁড়ি দিয়ে ওপর তলায় ওঠা যায়, কিন্তু পশ্চিম দিকের করিডোরটি কোথায় গেছে?
আহমদ মুসা এগোলো সিঁড়ির গোড়ার দিকে।
সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছেই আহমদ মুসা দেখতে পেল, সিঁড়ির গোড়া থেকে করিডোরের যে দেয়াল শুরু হয়েছে, সিঁড়ির গোড়ার পরেই এর সংলগ্ন দেয়ালে লিফটের দরজা। লিফটের দরজার ফ্লোর ইনডিকেটরে গ্রাউন্ড প্রথম ও দ্বিতীয় ফ্লোরের আগে আরও দু’টি ফ্লোর ইনডিকেটর, ইউজি ওয়ান ও ইউজি টু রয়েছে। এর অর্থ আন্ডারগ্রাউন্ডে দুটি ফ্লোর আছে এবং এই লিফট দিয়েই সেখানে যাওয়া যাবে।
আহমদ মুসা পা তুলল লিফটের দিকে যাওয়ার জন্যে।
এই সময় তার মনে হলো তার পেছনে মানুষ।
পকেটের হাতটা রিভলবারের বাঁটটা চেপে ধরল। মাথা ঘোরাতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই দু’পাশ থেকে দু’টি শক্ত বস্তু এসে তার মাথায় চেপে বসল। স্পর্শ থেকেই বুঝল দু’টিই রিভলবারের নল।
আহমদ মুসা পকেট থেকে হাত বের না করে ওদেরকে কথায় জড়িয়ে সময় নিতে চাইল। বলল সে, ‘তোমরা কে, কি চাও?’
কথার সাথে সাথেই দু’জন তার সামনে এসে দাঁড়াল। তাদেরও হাতে রিভলবার।
আহমদ মুসার মাথা থেকে রিভলবারের নল এক তিলও সরেনি।
তার সামনের গিয়ে দাঁড়ানো একজন বলল, ‘আমরা কে, কি চাই, তা নয়। তুমি কে, কি জন্যে এখানে ঢুকেছ, সেটা বলো।’
‘তোমরা আমাকে এ প্রশ্ন করছ কেন, তোমরা জান আমি কে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন প্রশ্ন করছি জান না? গেটের আমাদের প্রহরীকে তুমি সংজ্ঞাহীন করে ভেতরে ঢুকেছ। তুমি বিদ্যুৎ বিভাগের লোক নও, কে তুমি?’ বলল সেই আগের লোকটিই।
কথা বলার জন্যে আহমদ মুসা মুখ তুলেছিল লোকটির দিকে। তাকাতে গিয়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়ানো একটা মেয়ের ওপর চোখ পড়ল। হাতে তার বই, পরনে ক্রিম রংয়ের প্যান্টের ওপর ক্রিম রংয়ের বিশেষ কাটিং-এর কোট। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল এটা ‘বসফরাস কলেজ অব টেকনোলজি’র ছাত্রীদের ইউনিফরম। মেয়েটি বিস্ময় বিস্ফোরিত চোখে এদিকে তাকিয়েছিল। আহমদ মুসার চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি কয়েক ধাপ ওপরে উঠে আড়ালে সরে গেল।
উত্তর না দিয়ে আহমদ মুসাকে এদিক-ওদিক তাকাতে দেখে ধমক দিয়ে সেই লোকটি তার রিভলবার আহমদ মুসার দিকে তাক করে বলল, ‘চালাকি করার চেষ্টা করো না, চারদিকে গুলীতে মাথার খুলি গুঁড়ো হয়ে যাবে।’
‘কি জানতে চাও তোমরা?’ বলল আহমদ মুসা শান্ত কণ্ঠে।
ক্রোধে ফেটে পড়ল সামনে লোকটি। আহমদ মুসার কপালে রিভলবার ঠেকিয়ে বলল, ‘তুমি এখানে এসেছ কেন?’
‘তোমরা জান যে, প্রধান বিচারপতিকে উদ্ধার করতে এসেছি আমি এখানে। তাকে তোমরা কিডন্যাপ করে এখানে নিয়ে এসেছ।’ লোকটির মতোই উচ্চ স্বরে দৃঢ় কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
সামনের লোকটি আহমদ মুসার কপাল থেকে রিভলবার সরিয়ে আহমদ মুসার হাঁটুতে একটা লাথি মারল এবং দু’ধাপ পেছনে সরে গিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘এবার তুই মর্।’
তার হাতের রিভলবারটা আবার উঠে আসতে লাগল আহমদ মুসার লক্ষ্যে।
লাথিটা খুব জোরেই মেরেছিল। আহমদ মুসা তার পা’টা একটু শিথিল করে না নিলে হাঁটুটা ভেঙেই যেত।
এভাবে আকস্মিক লাথি খেলে পড়ে যাবার কথা। আহমদ মুসাও পড়ে গিয়েছিল। এমন একটা সুযোগই চাইছিল সে। পড়ে যাওয়ায় সে পেছন থেকে টার্গেট-করা দুই রিভলবারের আওতার বাইরে চলে এসেছে।
পড়ে যাওয়ার সময় আহমদ মুসার দেহ মেঝে স্পর্শ করার আগেই তার ডান হাত পকেট থেকে বের হয়ে এসেছে রিভলবার নিয়ে।
আহমদ মুসা চিৎ হয়ে পড়ে গিয়েছিল বলে তাকে লাথি মারা লোকটি তার সামনেই ছিল।
‘এবার তুই মর্’ বলে লোকটি তার রিভলবারের ট্রিগার টেপার আগেই আহমদ মুসা তার ট্রিগার টিপে দিয়েছিল।
আহমদ মুসার রিভলবারের গুলী ৪০ ডিগ্রী এ্যাংগেলে গিয়ে লোকটির বাম বক্ষ বিদ্ধ করেছে। গুলী খেয়ে তার দেহ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলেও তার তর্জনিটা রিভলবারের ট্রিগারে ঠিকই চেপে বসেছিল। কিন্তু টার্গেটটা দেহের কম্পনের সাথে কেঁপে গিয়েছিল। গুলীটা আহমদ মুসার মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে পেছনে দাঁড়ানো একজন রিভলবারধারীর হাঁটুতে গিয়ে বিদ্ধ করল।
লোকটির হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেল। সে দু’হাত দিয়ে হাঁটু চেপে ধরে বসে পড়ল।
আহমদ মুসা প্রথম গুলী করেই দ্বিতীয় গুলীটি করল সামনে দাঁড়ানো দ্বিতীয় লোকটিকে লক্ষ্য করে।
আহমদ মুসা তখনও পড়ে আছে চিৎ হয়ে।
দ্বিতীয় গুলী করেই চোখ ফিরিয়ে দেখল পেছনে দাঁড়ানো অন্য লোকটি তার ডান পাশে। লোকটির রিভলবার উঠে এসেছে আহমদ মুসার লক্ষ্যে। আহমদ মুসা তার রিভলবার ঘুরিয়ে নিয়েছে, কিন্তু টার্গেটকে তাক করার সময় নেই।
আহমদ মুসার এই চিন্তা যত দ্রুত চলেছে, তার চেয়ে দ্রুত সচল হয়ে উঠেছে তার শরীর।
উদ্ধত রিভলবারের ওপর চোখ পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসার দেহ মিডল ব্যাটে পেটানো ফুলটস ক্রিকেট বলের মতো গড়িয়ে গেল লোকটির দু’পায়ের দিকে।
লোকটি গুলী করেছিল। গুলীটি আহমদ মুসার গড়ানো দেহের প্রান্ত থেকে মাত্র ছয় সাত ইঞ্চি দূরে মেঝেকে গিয়ে বিদ্ধ করেছে। যথাসময়ে তার দেহ না গড়ালে গুলীটি তার বাম বুককে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিত।
রিভলবারের টার্গেট সরিয়ে নিয়ে লোকটি দ্বিতীয় গুলীর জন্যে ট্রিগারে তর্জনি চাপছিল। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসার গড়ানো দেহ প্রচন্ডভাবে আঘাত করল তার দু’পায়ে।
লোকটি হুমড়ি খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা উঠে বসেছে।
লোকটিও পড়ে গিয়েই এক মোচড়ে দেহটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে উঠে বসেছে। রিভলবার সে ছাড়েনি। তার রিভলবারও ঘুরে আসছে আহমদ মুসার দিকে। লোকটির চোখে-মুখে বেপরোয়া ভাব।
আহমদ মুসার হাতের রিভলবারও উদ্ধত ছিল। বেপরোয়া লোকটিকে সময় দেয়া যাবে না ভেবেই আহমদ মুসা তর্জনি চাপল তার রিভলবারের ট্রিগারে।
রিভলবার থেকে বেরিয়ে গেল একটা গুলী। আর তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়িয়ে স্থির হবার আগেই তার দেহটা ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উফল। একটা গুলী তার উরুতে এসে বিদ্ধ হয়েছে। গুলীটা বাম উরুর বাম পাশের একটা অংশকে আগ্রাসি এক কামড় দিয়ে কিছু অংশ তুলে নিল।
আহমদ মুসার দেহ কেঁপেছে, কিন্তু তার রিভলবার ধরা ডান হাত ও দু’চোখ এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করেনি। দু’চোখ ও রিভলবার এক সংগেই ঘুরে গেল শব্দ লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা দেখল, হাঁটুতে গুলী খাওয়া লোকটিই রিভলবার তুলে নিয়ে তাকে গুলী করেছে।
তার দিকে চোখ পড়ার সংগে সংগেই আহমদ মুসা গুলী করল লোকটিকে তাকে দ্বিতীয় গুলী করার সুযোগ না দিয়ে।
বসে থাকা লোকটির মাথা গুঁড়ো হয়ে গেল। নিঃশব্দে সে ঢলে পড়ল মেঝেতে।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল সিঁড়ির গোড়ার দিকে। তাকে হয় আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরে নামতে হবে, নয়তো ওপরে যেতে হবে। সে নিশ্চিত এই বাড়িতেই প্রধান বিচারপতি বন্দী আছেন।
ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে সিঁড়ির দিকেও চোখ গেল আহমদ মুসার। দেখল সিঁড়ির মাথায় সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে সৌম্য দর্শন একজন বৃদ্ধ। লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ানো। তার বাম হাত সিঁড়ির রেলিংয়ে রাখা। লোকটির মাথার চাঁদিতে ছোট্ট একটা টুপি।
তার মানে বৃদ্ধটি ইহুদি, মেয়েটি নিশ্চয় বৃদ্ধটিরই কেউ। তাহলে সেও তো ইহুদি! তারা কি এই কিডন্যাপারদের অংশ? কিন্তু ওরা তো এ্যাকশনে নেই। একই দলের হলে ওরা নির্বিকার দর্শক হবে কেন? একই দলের হলে হয় এ্যাকশনে আসার কথা, নয়তো পালানোর কথা, অথচ তাদের দেখে মনে হচ্ছে শংকিত, বিস্মিত দর্শকের ভূমিকায়। একই বাড়িতে তাহলে এরা কারা?
আহমদ মুসার চোখে-মুখে যখন এসব প্রশ্ন, তখন শংকিত, বিস্মিত বৃদ্ধটি বলে উঠল, ‘এসব এখানে কি ঘটছে, কেন ঘটছে, ওরা কারা? আপনি কে?’
এক নিঃশ্বাসে অনেক প্রশ্ন করে থামল বৃদ্ধটি। কণ্ঠে তার শংকা ও উদ্বেগ ঝরে পড়ল।
‘আপনি এই লোকটিকে চেনেন না? এরা তো এই বাড়িরই লোক মনে হচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না, এদের আমি চিনি না। আমি ওপর তলায় থাকি। নিচ তলাটা আমি ভাড়া দিয়েছি ডেভিড ইয়াহুদ নামে একজন ভদ্রলোককে অফিস করার জন্য। তারা কয়েকদিন হলো এখানে বসছেন।’ বলল বৃদ্ধটি।
‘ডেভিড ইয়াহুদকে আপনি কতদিন ধরে চেনেন?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘জার্মানিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমি পড়ি, তখন সে ছাত্র ছিল সেখানে।’ বৃদ্ধটি বলল।
বৃদ্ধ থামতেই মেয়েটি ফিস ফিস করে তাকে কিছু বলল।
শুনেই চমকে উঠল বৃদ্ধটি। বিস্ফোরিত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল বৃদ্ধটি চিৎকার করে, ‘প্রধান বিচারপতিকে ওরা কিডন্যাপ করে এখানে এনেছে, এটা নাকি আপনি বলেছেন? কি ঘটনা?’
‘জি, ওরা আজ প্রধান বিচারপতিকে কিডন্যাপ করে এখানে এনেছে। আমরা নিশ্চিত জেনেই তাকে উদ্ধারের জন্যে এসেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাঁর মানে প্রধান বিচারপতি এখন আমার এই বাড়িতে বন্দী আছেন!’ কম্পিত কণ্ঠে বলল বৃদ্ধটি।
‘আমি তাই মনে করি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওপরের তলায় নেই, আমি ওপরে থাকি বলে নিশ্চিত করে বলতে পারি। তাহলে নিচ তলায় আছেন। চলুন দেখি।’ বলল বৃদ্ধটি।
‘বাবা, কিন্তু উনি তো আহত। ঊরুতে গুলী লেগেছে ওনার।’ বলল মেয়েটি।
মেয়েটির হাতে তখনও কয়েকটি বই।
‘ঠিক তো। যাও, তুমি গিয়ে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে এসো। আমি নিচে নামছি।’ বলল বৃদ্ধটি।
‘না, এসব এখন নয়। আসুন, আগে প্রধান বিচারপতির সন্ধান করি। ওটাই বেশি জরুরি।’
‘জরুরি অবশ্যই। সাধারণ ব্যান্ডেজে সময় বেশি লাগবে না।’ বলল মেয়েটি।
‘আমার হাঁটুতে ক্রেপ গার্ডার আছে। আমি ওটা টেনে ওপরে তুলে নিয়েছি। অন্তত রক্ত বন্ধ হয়ে যাবে এতে।’ বলল আহমদ মুসা।
বৃদ্ধটি এক হাতে সিঁড়ির রেলিং ধরে অন্য হাতে লাঠিতে ভর দিয়ে নিচে নেমে এলো।
তার সাথে মেয়েটি নেমে এলো।
আহমদ মুসাও সিঁড়ির গোড়ায় চলে এসেছে।
বৃদ্ধ ও মেয়েটি এসে তার সামনে দাঁড়াল।
বৃদ্ধটি বলল, ‘আমি ডেভিড হারজেল। বসফরাস কলেজ অব টেকনোলজি থেকে আমি রিটায়ার করেছি। ফিজিক্স পড়াতাম। তবে অধ্যাপনা নয়, ব্যবসায় ছিল মূল নেশা। এখন ব্যবসাটা কর্মচারীরা দেখে।’ আর বৃদ্ধ মেয়েটিকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলল, ‘আমার মেয়ে হান্নাহ হাগেরা, বসফরাস কলেজ অব টেকনোলজি ছাত্রী। কলেজ-হোস্টেলেই সে থাকে।’
‘আপনি বোধ হয় কলেজেই ফিরে যাচ্ছিলেন?’ আহমদ মুসা বলল মেয়েটিকে লক্ষ্য করে।
‘কি করে বুঝলেন?’ বলল মেয়েটি। তার বিস্ময় ভরা দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
‘কয়েকটি বই হাতে নিয়ে আপনি নামছিলেন।’ আহমদ মুসা বলল।
মেয়েটি হাতের বইগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘ভুলেই গিয়েছিলাম বইগুলোর কথা। এই জরুরি বইগুলো নেয়ার জন্যে আধ-ঘন্টা আগে বাসায় এসেছিলাম। ফিরতে গিয়েই এই সাংঘাতিক ঘটনার মুখে পড়লাম।’
‘সাংঘাতিক ঘটনা না ঘটিয়ে উপায় ছিল না। চলুন, আমরা দেখি।’
বলে আহমদ মুসা চলতে শুরু করল লিফটের দিকে।
তার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল হান্নাহ হাগেরা ও বৃদ্ধ ডেভিড হারজেল।
আহমদ মুসা গিয়ে দাঁড়াল লিফটের সামনে। নিচে নামার জন্যে ডাউন বাটনে চাপ দিল, কিন্তু লাইট ইনডিকেটর জ্বলল না।
লিফটের দরজার চারদিকটা একবার দেখল আহমদ মুসা। তারপর টপে ফ্লোর ইন্ডিকেটরের ডান পাশে প্রায় অদৃশ্য একটা বোতামের ওপর চাপ দিল। সংগে সংগেই ডাউন মুভিং ইন্ডিকেটরে আলো জ্বলে উঠল।
বৃদ্ধ ডেভিড হারজেল নিরবে আহমদ মুসার কাজ দেখছিল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়! লিফটের মুভিং ইন্ডিকেটর যে বিদ্যুৎ কানেকশনের অভাবে কাজ করছে না, তা বুঝল কেমন করে? প্রায় অদৃশ্য বাটন সে খুঁজে পেল কেমন করে এত দ্রুত? আর টপ ফ্লোর ইন্ডিকেটরের দু’পাশেই অনুরূপ বাটন আছে, কিন্তু ডান দিকের বাটনটাই চাপল কেন?
এসব প্রশ্ন ও একরাশ বিস্ময় নিয়ে বৃদ্ধ ডেভিড হারজেল বলল, ‘ফ্লোর ইন্ডিকেটরের দু’পাশেই অনুরূপ বাটন আছে। আপনি কি করে বুঝলেন ডান পাশের বাটন টিপলেন লিফট বিদ্যুৎ কানেকশন পাবে?’
‘এ ব্যবস্থা আপনারাই করে রেখেছেন। বাম বাটনের সারপেসের দিকটি দুই অর্ধবৃত্তে বিভক্ত এবং ডানেরটি বিভক্ত নয়। এতেই বামেরটি ডিসকানেক্ট, আর কানেক্ট করার বাটন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অসাধারণ আইকিউ আপনার! এ পর্যন্ত কেউই না বলে দিলে এই গোলকধাঁধাঁ ভাঙতে পারেনি। আপনার কাছেই প্রথম এই গোলকধাঁধাঁ পরাজিত হলো।’ বলল বৃদ্ধ।
‘শুধু আই কিউ নয়, লড়াইতেও অসাধারণ! উনি যে অবস্থায় পড়েছিলেন, তাঁর বাঁচা অবিশ্বাস্য ছিল। কিন্তু উনি শুধু বাঁচেননি, যাদের পরাজয় অকল্পনীয় ছিল, তারা সবাই মরেছে ওনার হাতে।’ মেয়েটি বলল।
‘আসুন’ বলে লিফটে প্রবেশ করল আহমদ মুসা মেয়েটির কথা শেষ হবার আগেই।
ডেভিড হারজেল ও হান্নাহ হাগেরা লিফটে প্রবেশ করল।
প্রথমে তারা সার্চ করল আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোর ওয়ান।
লিফট ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোর ওয়ান’- এ পৌঁছলে আহমদ মুসা বৃদ্ধ ও মেয়েটিকে লিফট থেকে নামতে অনুরোধ করে লিফট লক করে পরে নিজে নামল।
‘লিফট লক করার দরকার হলো কেন?’ জিজ্ঞাসা ছিল বৃদ্ধ ডেভিড হারজেলের।
‘যাতে অন্য কোন ফ্লোর থেকে কেউ লিফট ব্যবহারের সুযোগ না পায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝেছি, আর ইতোমধ্যে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোর-টু’ থেকে কেউ পালাতে না পারে, এজন্যেই এ ব্যবস্থা। আপনি অনেক দূরের ভবিষ্যতকেও দেখেন।’ বলল হান্নাহ হাগেরা।
‘এটা ভবিষ্যত দর্শন নয়। ভবিষ্যত স্রষ্টা ছাড়া আর কেউ জানেন না। আমি যেটা করেছি সেটা কমনসেন্সের ব্যাপার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোর ওয়ান’ কতকগুলো প্রায় ফাঁকা কক্ষের সমষ্টি। সব কক্ষেই অনুসন্ধান হলো, কিন্তু কিছুই মিলল না। অফিস ঘরের টেবিলে একটা নোট-শিট পেল। আজকের তারিখ দেয়া ওপরের শিটটাতেই শুধু বিক্ষিপ্ত কিছু লেখা। শিটটা ছিঁড়ে আহমদ মুসা পকেটে পুরল। বলল মেয়েটি ও বৃদ্ধকে লক্ষ্য করে, ‘এ ফ্লোরটি বন্দী কাউকে রাখার উপযুক্ত নয়। চলুন, নিচের ফ্লোরটি দেখি।’
বলে আহমদ মুসা লিফটের দিকে পা বাড়াল।
সবাইকে নিয়ে লিফট নেমে এলো ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোর-টু’ মানে আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের সবচেয়ে নিচের তলায়।
লিফট থেকে ডেভিড হারজেল ও হান্নাহ হাগেরা নেমে গেলে আহমদ মুসা লিফট লক করে বেরিয়ে এলো।
নিচের ফ্লোরটির অর্ধেকটাই ফাঁকা। বাকি অংশের তিন দিকে সারিবদ্ধ কেবিন। এর পরেই মাঝখানে রয়েছে প্রশস্ত অনেকখানি জায়গা।
‘এখানে অল্পক্ষণ আগেও লোক ছিল, এখন নিশ্চয় নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
ডেভিড হারজেল হাঁটতে হাঁটতেই তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে-মুখে প্রশ্ন। বলল, ‘কেন বলছেন এ কথা?’
আহমদ মুসা কেবিনগেুলোর দরজা খুলে দেখছিল।
সব কেবিনের দরজা বন্ধ, কিন্তু লক করা নয়। এক প্রান্তের একটা কেবিনের দরজাই শুধু খোলা।
আহমদ মুসা সে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। বলল ডেভিড হারজেলের প্রশ্নের জবাবে, ‘খেয়াল করে দেখুন, পাতলা একটা সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এই ফরাসি মৃগনাভির সুগন্ধ আমি আপনাদের গেটে এর চেয়ে বেশি পরিমাণে পেয়েছি। আমার বিশ্বাস এখানকার সুগন্ধের উৎস আগের, গেটেরটা পরের। তুরস্কের প্রধান বিচারপতি এই সুগন্ধ ব্যবহার করেন, এটা আমি তার লাইফ-ডসিয়ার থেকে জানি। ইন্টারনেটে এই লাইফ-ডসিয়ার আছে।’
‘আপনার এই অনুমান প্রশংসনীয়, কিন্তু এতটুকুতেই কি বলা যায় প্রধান বিচারপতিকে এখানে আটকে রাখা হয়েছিল? ফরাসি ঐ মৃগনাভি অনেকেই ব্যবহার করেন, এটাই স্বাভাবিক।’ বলল হান্নাহ হাগেরা।
‘আপনার কথাও ঠিক।’ বলে আহমদ মুসা খোলা দরজা দিয়ে কেবিনে প্রবেশ করল।
ডেভিড হারজেল ও হান্নাহ হাগেরাও কেবিনের দরজায় এসে পড়েছে।
কেবিনটির খাটের এদিকের পায়ার পাশে পড়ে থাকা একটা চকচকে ছোট্ট জিনিসের দিকে আহমদ মুসার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে।
আহমদ মুসা গিয়ে ওটা তুলে নিল।
জিনিসটার ওপর চোখ বুলিয়েই আহমদ মুসা একটু উচ্চ স্বরে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, মি. ডেভিড হারজেল, প্রধান বিচারপতি এখানে ছিলেন। তার চিহ্ন তিনি এখানে ফেলে রেখে গেছেন।’
ডেভিড হারজেল ও হান্নাহ হাগেরা দু’জনেই জিনিসটা তুলে নেয়াকে উৎসুকের দৃষ্টিতে দেখছিল। বলল হান্নাহ হাগেরা দ্রুত কণ্ঠে, ‘কি ওটা পেলেন?’
আহমদ মুসা জিনিসটা তাদের দিকে তুলে ধরে বলল, ‘বিচারপতির মনোগ্রামের কোটপিন। বিচারপতিরা এটা পরেন।’
ডেভিড হারজেল ওটা দেখে বলল, ‘ঠিক বলেছেন। এটা বিচারপতিদের কোটপিন।’
বলার সাথে সাথে বৃদ্ধ ডেভিড হারজেলের মুখটা কঠোর হয়ে উঠল। বলল, ‘ওরা আমার বাড়িকে সন্ত্রাসের আড্ডা বানিয়েছিল! ডেভিড ইয়াহুদকে আমি প্রতিভাবান একজন ভালো মানুষ মনে করতাম।’
মুহূর্তের জন্যে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘কিন্তু তাঁকে নিয়ে এসেই আবার সরিয়ে নিল কেন?’
‘ওরা বুঝতে পেরেছিল, তাদের এই আড্ডার ঠিকানা আমরা পেয়ে গেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনারা কে? আপনার পরিচয় কিন্তু জানা হয়নি।’ জিজ্ঞাসা ডেভিড হারজেলের।
‘আমি খালেদ খাকান। আমি আপনাদের পুলিশকে সাহায্য করছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার নাম বললেন, পরিচয় কিন্তু বললেন না। আপনি পুলিশ এটুকু মাত্র বোঝা গেছে।’ বলল হান্নাহ হাগেরা।
‘প্লিজ এসব কথা পরে হবে। এখন উদ্বেগজনক হলো অসুস্থ প্রধান বিচারপতি কোথায় কিভাবে আছেন! তাকে অবিলম্বে উদ্ধার করতে না পারলে তার ক্ষতি হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল। আহমদ মুসার গম্ভীর কণ্ঠে উদ্বেগ ঝরে পড়ল।
ডেভিড হারজেল ও হাগেরার চোখে-মুখে উদ্বেগের ছায়া খেলে গেল। বলল ডেভিড হারজেল, ‘কিন্তু তারা প্রধান বিচারপতিকে কিডন্যাপ করেছে কেন? তাকে নিয়ে তারা কি করবে? আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘এর উত্তর দিতে হলে অনেক কথা বলতে হবে। শুধু এটুকু জেনে রাখুন, ওরা বিদেশের স্বার্থে গোপনে কাজ করেন। রোমেলী দুর্গের ল্যাবরেটরী অব টেকনোলজিকে ওরা ধ্বংস করতে চায়। ওরা ল্যাবরেটরীর প্রধান বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে কিডন্যাপ করেছিল। তাকে উদ্ধার করা হলে ওরা সুযোগ পেয়ে চীফ জাস্টিসকে কিডন্যাপ করেছে। সম্ভবত পণবন্দী হিসেবে কিংবা প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে ওরা প্রধান বিচারপতিকে হত্যাও করতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাংঘাতিক ঘটনা! কিন্তু প্রধান বিচারপতিকে ওরা সরিয়ে নিয়েছে। কোথায় পাওয়া যাবে ওদের?’ উদ্বেগে ডেভিড হারজেলের কণ্ঠ কাঁপছিল।
ভাবছিল আহমদ মুসা। বলল, ‘ওরা বেশিক্ষণ আগে যায়নি প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে। ওরা চারজনকে পেছনে রেখে গিয়েছিল, তাদের উদ্দেশ্য পেছনটা নিরাপদ রাখা এবং তাদের এ ঘাঁটির সন্ধান সত্যিই কেউ পেয়েছে কিনা, কেউ আসে কিনা, সেটা দেখার জন্যে। আমার ধারণা তাদের এখান থেকে পালানোর সময় আধা ঘন্টার বেশি হবে না।’
ভ্রু কুঞ্ছিত হয়ে উঠেছিল হান্নাহ হাগেরার। আধা ঘন্টা আগে বাড়িতে আসার সময় ঠিকই সে দেখেছিল দু’টি গাড়িকে তাদের বাড়ি থেকে চলে যেতে। সামনে একটা মাইক্রোবাস ছিল, পেছনে একটা জীপে ছিলেন ডেভিড ইয়াহুদ আংকেল। তাহলে কি প্রধান বিচারপতিকে নিয়েই তারা পালাচ্ছিলেন ঐ সময়! বুকটা কেঁপে উঠল হান্নাহ হাগেরার। বলল সে, ‘হ্যা, আধা ঘন্টা আগে আমি বাড়িতে আসার সময় দু’টি গাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে যেতে দেখেছি। একটা মাইক্রো, অন্যটা জীপ। জীপ চলাচ্ছিলেন ডেভিড ইয়াহুদ আংকেল নিজে।’
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘সন্দেহ নেই ঐ মাইক্রোবাসেই অসুস্থ প্রধান বিচারপতি ছিলেন। আপনি ঠিক কোন্‌ জায়গায় ওদের দেখেছিলেন, কোন্‌ দিকে যাচ্ছিলেন?’
‘গাড়ি দু’টি প্রধান রাস্তায় উঠতে যাচ্ছিল, সে সময় আমি ওদের ক্রস করি। আমি অটো রিকশায় আসছিলাম। ডেভিড ইয়াহুদ আংকেল আমাকে দেখেননি, আমি তাকে দেখেছি। পরে আমি পেছনে ফিরে তাকাইনি। ওরা রাস্তায় উঠে কোন্‌ দিকে গেছে দেখিনি। তবে…।’
বলে থেমে গেল হান্নাহ হাগেরা।
‘তবে কি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমি যখন ডেভিড ইয়াহুদ আংকেলকে ক্রস করে এসেছি, সে সময় তার কণ্ঠ থেকে দু’টি শব্দ আমার কানে এলো। একদম অচেনা দু’টি শব্দ, আমি বুঝলাম না। পেছন দিকে তাকালাম। দেখলাম একজন জীপের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম তাকে লক্ষ্য করেই শব্দ দু’টি বলা হয়েছে। এই লোকটি চারজনের একজন যারা আপনার সাথে সংঘর্ষে এই মাত্র মারা গেল।’
একটু থামল হান্নাহ হাগেরা।
আহমদ মুসা উন্মুখ হয়ে উঠেছে। বলল, ‘শব্দ দু’টি কি মিস হান্নাহ হাগেরা?’
‘শব্দ দু’টি এই রকম: ডেকেল কারমেল।’
শব্দ দু’টি শুনে একটু ভাবল। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। বলল দ্রুত কণ্ঠে, ইস্তাম্বুলে ‘পাম ট্রি গার্ডেন’ নামে কোন বাগান বা ‘পাম ট্রি গার্ডেন’ নামে কোন এলাকা আছে?’
ডেভিড হারজেল ও হান্নাহ হাগেরা কথা বলল না তৎক্ষণাত। ভাবছিল তারা। একটু পর বলল, ‘না, এ নামের কোন বাগান বা স্থানের নাম আমরা শুনিনি।’
আহমদ মুসা পকেট থেকে মোবাইল বের করে দ্রুত একটা কল করল।
ওপারের সাড়া পেয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘আমি খালেদ খাকান, জেনারেল মি. মোস্তফা, ইস্তাম্বুলে ‘পাম ট্রি গার্ডেন’ বা ‘পাম গার্ডেন’ এলাকা বলে কিছু আছে?’
‘না, মি. খালেদ, এমন নামের স্থান বা গার্ডেন ইস্তাম্বুলে নেই। আপনি কোথায়?’
‘আমি ঐ ঠিকানা থেকে কথা বলছি। এখান থেকে ওরা পালিয়েছে। আমার মনে হয় ‘পাম গার্ডেন’ নামের কোথাও পালিয়েছে। আপনি কোথায়?’
‘এখনও হাসপাতালে। পুলিশপ্রধান নাজিম এরকেন তোমার ওখানে রওয়ানা দিয়েছে।’ বলল ওপার থেকে জেনারেল মোস্তফা।
‘এখন আর ওঁদের আসার প্রয়োজন ছিল না। যাক, শুনুন, আপনার পাশে কি কম্পিউটার আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, আছে। কেন বলছেন? কি করতে হবে?’ বলল জেনারেল মোস্তফা ওপার থেকে।
‘আপনি দয়া করে ইন্টারনেটে ইস্তাম্বুল ফাইলে ‘পাম ট্রি গার্ডেন’ অথবা ‘ডেকেল কারমেল’ নামে কিছু পান কিনা দেখুন। আমি আপনার উত্তরের অপেক্ষা করছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝেছি খালেদ খাকান। দেখছি আমি। ধন্যবাদ। সালাম।’
ওপার থেকে মোবাইল অফ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা হাত নিচে নামাল। কিন্তু মোবাইলটা হাতেই রাখল।
ডেভিড হারজেল ও হান্নাহ হাগেরা আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল। তাদের চোখে-মুখে প্রশ্ন। মোবাইলে কথা দু’একটা তাদেরও কানে গেছে। বলল ডেভিড হারজেল আহমদ মুসা তাদের দিকে ঘুরে তাকাতেই, ‘তাহলে ডেকেল কারমেল অর্থ কি পাম ট্রি গার্ডেন?’
‘হ্যাঁ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এটা তো হিব্রু শব্দ!’ জিজ্ঞাসা ডেভিড হারজেলের।
‘হ্যাঁ, হিব্রু শব্দ!’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু এর অর্থ আমি ইহুদি হয়েও জানি না। আপনি জানলেন কি করে?’ বলল ডেভিড হারজেল।
‘ইসরাইল একটা মৃত ভাষাকে জীবিত করছে তো, তাই এর প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহ আছে আমার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জেনারেল মোস্তফা কে, মি. খালেদ খাকান?’ বলল হান্নাহ হাগেরা। তার চোখে-মুখে বিস্ময়!
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘উনি তুরস্কের নিরাপত্তা-গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হাজী জেনারেল মোস্তফা কামাল।’
‘তাহলে তো মনে হয়, আপনি তার চেয়ে বড়। তুরস্কের নিরাপত্তা গোয়েন্দাপ্রধানকে যিনি নির্দেশ দিতে পারেন তিনি তো নিশ্চয় অসম্ভব বড় হবেন। আপনি যেটুকু পরিচয় দিয়েছেন, তার সাথে আপনার কাজ মেলে না।’ হান্নাহ হাগেরা বলল।
‘বড় হবার প্রয়োজন হয় না। বন্ধুস্থানীয় যারা, তাদের নির্দেশ দেয়া যায়, এমনকি অবস্থা বিশেষে যে কেউ যে কাউকে নির্দেশ দিতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ডেভিড হারজেল। তখন মোবাইল বেজে উঠল আহমদ মুসার।
থেমে গেল ডেভিড হারজেল।
আহমদ মুসা মোবাইল উঠিয়ে নিয়ে সালাম দিতেই ওপার থেকে জেনারেল মোস্তফা বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, মি. খালেদ খাকান। আপনার চেষ্টা সফল। ‘পাম ট্রি গার্ডেন’- এর সন্ধান পাওয়া গেছে। ওটা একটা বাসা-কাম-ল্যাবরেটরি।’
‘কার বাসা?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘ইস্তাম্বুলের ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির স্কুল অব এ্যাডভান্স ফিজিক্স-এর রিটায়ার্ড প্রফেসর আবু আবদুর রহমান আরিয়েহর বাড়ি। তার ব্যক্তিগত ল্যাবরেটরি রয়েছে ঐ বাড়িতে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘তার পরিচয় সম্পর্কে আপনি কত দূর জানেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তিনি পার্টিকেল ফিজিক্সের একজন প্রতিভাবান প্রফেসর। লেবাননে জন্ম। লেখাপড়া শেষে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে এসে তুরস্কেই থেকে গেছেন। রিটায়ার করার পর অধিকাংশ সময়ই ইউরোপে কাটান। ক’দিন আগে তিনি জার্মানিতে গিয়েছিলেন। ফিরেও এসেছেন সম্ভবত।’
বলে একটু থামল জেনারেল মোস্তফা। তারপর বলল, ‘তার সম্পর্কে এত কথা কেন? পাম গার্ডেনেরই বা খোঁজ করছেন কেন?’
‘সব বলব। আপনি অবিলম্বে সাদা পোশাকের পুলিশ দিয়ে বাড়ির গোটা কমপ্লেক্স ঘিরে ফেলার ব্যবস্থা করুন। বাড়ি থেকে কেউ বেরুলে তাকে গোপনে আটকে রাখার ব্যবস্থা করুন। আমি ওখানে যাচ্ছি। বাড়িটার ঠিকানা বলুন।’ আহমদ মুসা বলল।
বাড়ির নম্বর ও লোকেশন আহমদ মুসাকে জানিয়ে জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘পুলিশপ্রধান নাজিম এরকেনকেও আমি জানাচ্ছি। আমিও যাচ্ছি ওখানে। আমার অনুমান মিথ্যা না হলে আপনি সন্দেহ করছেন প্রধান বিচারপতিকে সরিয়ে নিয়ে ওখানেই রাখা হয়েছে। একটা কথা মি. খালে খাকান, আপনাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে। আপনি ঠিক আছেন তো?’
‘কেমন করে মনে হলো আমি অসুস্থ?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আপনি নিশ্চয় একটা কথা জানেন না, আমি একজন সাউন্ড এ্যানালিস্টও। আপনার কথার প্রতিটা শব্দের মধ্যে সূক্ষ্ণ একটা কম্পন আছে। এই ধরণের কম্পন কোন দৈহিক আঘাত থেকে আসে। আমি ঠিক বলেছি কিনা বলুন।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘হ্যাঁ, জেনারেল মোস্তফা, আমার হাঁটুর একটু ওপরে একটা গুলী আঘাত করেছে। খুব বড় আঘাত নয়। একটা পাশ ঘেঁষে গুলীটা বেরিয়ে গেছে। আমি ভালো আছি, মি. জেনারেল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘গুলী লেগেছে? তাহলে আপনি চলে আসুন, না আমি আসব? আপনার চিকিৎসার পর আমরা ওদিকে এগোবো। আমি বলে দিচ্ছি বাড়িটা ঘিরে রাখবে।’ প্রায় এক নিঃশ্বাসে দ্রুত কণ্ঠে বলল কথাগুলো জেনারেল মোস্তফা।
‘এই তো আপনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এজন্যেই কথাটা গোপন করেছিলাম। আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না। চিকিৎসার যদি কিছু থাকে করেই আমি ওখানে যাচ্ছি। আপনি আসুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘না, মি. খালেদ খাকান, এ ব্যাপারে আপনার ওপর আমার আস্থা নেই। আপনি আপনার নিজের ওপর অবিচার করেন অথচ সুবিচারের শুরু নিজের হক থেকেই। আল্লাহ এটা চান।’ বলল গম্ভীর কণ্ঠে জেনারেল মোস্তফা।
‘আমি এটা মানি। অবস্থার কারণে ব্যতিক্রম কখনও হতেই পারে। এক্ষেত্রে কনসেশন আল্লাহ দিয়েছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আজ ঐ ধরণের কনসেশন আল্লাহ দেবেন না। আমি রাখছি। আপনি কথা রাখবেন, তারপর ওখানে যাবেন। আমি যাচ্ছি।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসাও মোবাইল অফ করে দিল।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই ডেভিড হারজেল বলল, ‘পাম গার্ডেন পেয়েছেন? কোথায়? ওখানে যাবেন, এখনি?’
‘সন্ধান পেয়েছেন ওনারা। পূর্ব ইস্তাম্বুলের পাহাড় এলাকায়। হ্যাঁ, জনাব, যেতে হবে আমাকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে, যাবেন। আগে চলুন, আপনার আঘাতের শুশ্রূষা দরকার। তারপর যাবেন। দরকার হলে আমিই আপনাকে পৌঁছে দেব।’ বলল হান্নাহ হাগেরা।
‘ঠিক আছে চলুন।’ আহমদ মুসা বলল।
সবাই বেরিয়ে এলো বেসমেন্ট থেকে। সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি ওপরে উঠছিল আহমদ মুসা ও হান্নাহ হাগেরা। সামনে ডেভিড হারজেল।
‘আপনার কি ক্রেপ ব্যান্ডেজ আছে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা মেয়েটিকে।
‘আপনি ইস্তাম্বুলে খুব বেশি দিন আগে আসেননি তাহলে?’ বলল হান্নাহ হাগেরা।
‘কেন বলছেন এই কথা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কারণ ইস্তাম্বুলে এটা আইন যে, কলেজ লেভেলের প্রত্যেক মেয়েকে সিভিল ডিফেন্স ও নার্সিং ট্রেনিং এবং হাসপাতালে তিন মাস কাজ এবং এই লেভেলের ছেলেদেরকে তিন মাস সামরিক ট্রেনিং ও তিন মাস সামরিক ক্যাম্পে থাকা বাধ্যতামূলক। এই সাথে প্রতিটি বাড়িতে একটি মিনি মেডিকেল কাউন্টার থাকতে হবে।’ বলল হান্নাহ হাগেরা হাসি মুখে।
উঠে এসেছে তারা দু’তলায়।
ওপরে ওঠার পরেই লাউঞ্জের মতো প্রশস্ত একটা জায়গায় গুচ্ছাকারে সোফা সাজানো।
হান্নাহ হাগেরা আহমদ মুসাকে সোফায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলল, ‘মেডিকেল জিনিসপত্র সব ঠিকঠাক করে আমি আসছি।’
আহমদ মুসা বসল।
পাশে বসল ডেভিড হারজেলও। ডেভিড হারজেল বসেই আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি বিস্মিত হচ্ছি, মি. খালেদ খাকান। ডেভিড ইয়াহুদের সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয়েও আমি তাকে চিনতে পারিনি। আমি বুঝতে পারছি না তার এসব করার পেছনে লক্ষ্য কি, স্বার্থ কি?’
‘ওরা সম্ভবত একটা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কর্ম চুরি করতে চায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি বিষয়ের গবেষণা কর্ম?’ জিজ্ঞাসা ডেভিড হারজেলের।
‘সম্ভবত পারটিকেল ফিজিক্সের কোন বিষয়ে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘পারটিকেল ফিজিক্সের বিখ্যাত গবেষক প্রফেসর আরিয়েহের তো ড. ডেভিড ইয়াহুদের সাথে সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। সে আবার পারটিকেল ফিজিক্সের কোন্ গবেষণা কর্ম নিয়ে এমন হন্যে হলো? ফিজিক্সের মতো কোন গবেষণা কর্ম নিয়ে তার তো আগ্রহী হওয়ার কথা নয়!’ বলল ডেভিড হারজেল।
আহমদ মুসা বিস্মিত হলো প্রফেসর আরিয়েহের নাম শুনে। এই প্রফেসর আরিয়েহ নিশ্চয় প্রফেসর আবু আবদুর রহমান আরিয়েহ। উনিও তো পারটিকেল ফিজিক্সের প্রফেসর। বলল আহমদ মুসা, ‘মি. ডেভিড হারজেল, আপনি কি প্রফেসর আরিয়েহকে চেনেন?’
‘আগে প্রায়ই দেখা হতো। এখনও সিনাগগে মাঝে মাঝে দেখা হয়। লোকটা খুব গুণী লোক। বিজ্ঞানের জগত ছাড়া তাঁর আর কোন জগত নেই।’ বলল ডেভিড হারজেল।
‘উনি থাকেন কোথায়?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আগে বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে থাকতেন, এখন কোথায় থাকে জানি না।’ ডেভিড হারজেল বলল।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো ডেভিড হারজেল সব কথাই সত্য বলেছেন। আবু আবদুর রহমান আরিয়েহ কোথায় থাকেন জানলে তিনি পাম গার্ডেনও চিনতে পারতেন। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল আবু আবদুর রহমান আরিয়েহ সিনাগগে যান কেন? তাহলে কি…? মনে সন্দেহটি উঁকি দিতেই আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল, ‘মি. ডেভিড হারজেল, বিজ্ঞানী আবু আবদুর রহমান আরিয়েহ সিনাগগে যান কেন?’
হাসল ডেভিড হারজেল। বলল, ‘আপনি কি তাকে মুসলিম মনে করেছেন? সে একজন সক্রিয় ইহুদি।’
‘তাহলে নামটা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘এমন নাম আপনি প্রচুর দেখবেন। অনেক রকম সুবিধা লাভের জন্যে স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় অনেক ইহুদিই, বিশেষ করে রাজনৈতিক চিন্তায় নাম পাল্টায়। তাঁর নামও ঐভাবে পাল্টানো হয়েছে।’ বলল ডেভিড হারজেল।
‘ডেভিড ইয়াহুদের মতো কোন গোপন সংগঠনের সাথে কি তিনি জড়িত?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘তা আমি জানি না। তিনি নিরেট একজন গবেষক। তবে আমাদের ইহুদিদের মধ্যে যারা চরমপন্থী তাদের সাথেই তার ওঠাবসা।’ বলল ডেভিড হারজেল।
‘এ চরমপন্থীরা কারা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘এ ব্যাপারে আমার স্বচ্ছ ধারণা নেই। তবে আমি যেটা বুঝেছি তাতে ইহুদিবাদকে আধিপত্যের এক অস্ত্র হিসেবে যারা দেখতে চায়, প্রফেসর আরিয়েহ তাদের সাথে একমত।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। ঠিক এ সময় হান্নাহ হাগেরা এসে দাঁড়িয়েছিল। বলল, ‘সব ঠিক ঠাক, আসুন, মি. খালেদ খাকান।’
বলেই হান্নাহ হাগেরা চলতে শুরু ককরল। আহমদ মুসাও তার পিছু পিছু চলল।
লাউঞ্জ থেকে এক করিডোর ধরে সামনে এগিয়ে শেষ প্রান্তের একটা রুম বাড়ির মেডিকেল কর্নার।
মোটামুটি বড়-সড় ঘর। দু’টি বেড। বসার জন্যে কয়েকটি সোফা ও চেয়ার। একটা উঁচু লম্বা টেবিল, ঠিক অপারেশন টেবিলের মতো। স্টিলের ফ্রেমে একটা কাচের আলমারি। তাতে ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জাম।
ঘরটিতে আয়োডিনের গন্ধ হাসপাতালের মতোই।
আহমদ মুসা দেখল, ছোটখাট অপারেশনের মতোই ব্যান্ডেজ ও অন্যান্য সরঞ্জাম একটা ছোট টেবিলে সাজানো। অনুরূপ আরেকটা টেবিলে পানির গামলা। ঘরের অন্য পাশে রয়েছে একটা পানির বেসিন।
সব দেখে আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে হান্নাহ হাগেরার দিকে চাইতেই সে বলল, ‘আপনি টেবিলে উঠে শুয়ে পড়ুন। আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
আহমদ মুসার মুখে বিব্রত ভাব ফুটে উঠল। নিজের উরুর ব্যান্ডেজ সে নিজেই করতে চায়। বলল সে, ‘ধন্যবাদ, মিস হান্নাহ হাগেরা, ছোট শুশ্রুষা ও ব্যান্ডেজের কাজটা আমিই করে নিতে পারব।’
হান্নাহ হাগেরা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে বিস্ময়! বলল, ‘আপনি একা কিভাবে করবেন? কেন করবেন? বলেছি তো এর ওপর আমার ট্রেনিং আছে।’
‘স্যরি, নিজের যে কাজটা নিজে করতে পারা যায়, সে কাজটা আপনিও নিশ্চয় অন্য কাউকে দেবেন না করতে।’ বলে হাসল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার দিকে একবার গভীর দৃষ্টিতে চাইল হান্নাহ হাগেরা। ঠোঁটে ফুলে উঠল এক টুকরো হাসি। বলল, ‘নিজে করার মতো কাজ এটা নয়, বিশেষ করে সাহায্যকারী যখন থাকে। আমি বুঝেছি, আপনি একটু গোঁড়া মুসলমান। তাই…।’
‘না, আমি গোঁড়া মুসলমান নই। ‘মুসলিম’ শব্দের আগে গোঁড়া, অগোঁড়া বিশেষণ লাগানো যথার্থ নয়।’ বলল আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি।
‘কেন, যারা ধর্মীয় অণুশাসন মানার নামে বাড়াবাড়ি করে, তাদেরই তো গোঁড়া বলা হয়?’ বলল হান্নাহ হাগেরা।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ধর্মীয় অনুশাসন মানার নামে যদি কেউ বাড়াবাড়ি করে, তাহলে সেটা ধর্মীয় আদর্শ ও অনুশাসনের পরিপন্থী কাজ। এটাকে গোঁড়ামি বলা যায় না। গোঁড়ামি অর্থে সাধারণত যারা ধর্মীয় আদর্শ ও অনুশাসন পুরোপুরি মানতে চেষ্টা করে তাদেরকে বুঝানো হয়। কিন্তু ‘গোঁড়ামি’ শব্দের ব্যবহার এক্ষেত্রে যথার্থ নয়। এখানে ‘গোঁড়ামি’র বদলে ‘একনিষ্ঠ’ বা ‘নিষ্ঠাবান’ শব্দের ব্যবহার যথোপযুক্ত। কারণ ধর্মীয় আদর্শ ও অনুশাসন পুরোপুরি মেনে চলতে চেষ্টা করা ভালো জিনিস, কিন্তু ‘গোঁড়ামি’ শব্দ থেকে এই ভালো অর্থ বুঝায় না।’
‘তার মানে আপনি ধর্মের নিষ্ঠাবান অনুসারি। ধন্যবাদ আপনাকে।’
বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছনের ওয়াল হ্যাংগারে এক সেট পোশাক দেখিয়ে বলল, ‘ব্যান্ডেজ শেষে আপনি এ পোশাক পরে নেবেন। পরনের জামা-কাপড় আপনার নষ্ট হয়ে গেছে। আর হ্যাঁ, বিদ্যুৎ অপারেটরের চেহারাটাও এই সুযোগে পাল্টে নেবেন।’ হান্নাহ হাগেরার মুখে হাসি।
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো হান্নাহ হাগেরা।
হান্নাহ হাগেরাকে দেখেই ডেভিড হারজেল বলল, ‘কি ব্যাপার, তুমি চলে এলে?’
‘বাবা, উনি একাই নিজের ট্রিটমেন্ট করবেন।’ বলল হান্নাহ হাগেরা। তার ঠোঁটে হাসি।
‘উনি তাই বললেন? আশ্চর্য মানুষ!’ ডেভিড হারজেল বলল।
‘সব দিক দিয়েই আশ্চর্য মানুষ বাবা তিনি! তবে গত আধা ঘন্টায় তাঁর যে পরিচয় মিলেছে তাতে ‘আশ্চর্য’ বিশেষণ তাঁর জন্যে যথেষ্ট নয়। যিনি তুরস্কের সিকউরিটি চীফ জেনারেল মোস্তফাকে ডিকটেট করতে পারেন তাঁর পরিচয় কি হতে পারে বাবা ভেবে দেখ।’ বলল হান্নাহ হাগেরা।
‘হ্যাঁ, দেখছি ডেভিড ইয়াহুদরা তো কম নয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যে নামবে সে তো ওদের থেকে বড়ই হবে।’ ডেভিড হারজেল বলল।
‘কিন্তু বাবা, বুঝতে পারছি না, ডেভিড ইয়াহুদ আংকেলরা কাজটা কি করছেন? বিজ্ঞানীকে ধরে রাখতে পারেননি, বাগে পেয়ে অসুস্থ বিচারপতিকেই পণবন্দী বানিয়েছেন। এতটা মরিয়া কেন ওরা? কি কারণে?’
ভাবনায় কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল ডেভিড হারজেলের। ধীরে ধীরে বলল, ‘সব কথা আমি খালেদ খাকানকে বলিনি। ডেভিড ইয়াহুদের সন্ত্রাসী কাজ-কর্মের দিকটা আমি একেবারেই জানি না, কিন্তু তাদের ধ্বংসকারী গবেষণা কর্মের দিকটা আমি কিছু জানি। একদিন সিনাগগে নিরিবিলি আলাপকালে বিজ্ঞানী আবু আবদুর রহমান আরিয়েহ বলেছিলেন, ‘দুনিয়াটা হাতের মুঠোয় আসতে দেরি নেই। মানুষ পরমাণুকে নিজের ইচ্ছার অধীন করে বিধ্বংসী মারণাস্ত্র বানিয়েছে, তেমনি আলোর পরমাণু ফোটন পারটিকেলকে দাস বানিয়ে দুনিয়ার সব শক্তির সব সমরস্ত্রকে অদৃশ্য এক অস্ত্র দ্বারা নিরব ধ্বংসের শিকারে পরিণত করব।’ আমি বিস্মিত কণ্ঠে বলেছিলাম, ‘এমন অস্ত্রের কল্পনা কি বাস্তব?’ উত্তরে তিনি বলেছিন, ‘বলতে পারেন সাফল্য থেকে মাত্র আমরা এক গজ দূরে।’
বলে একটু থামল ডেভিড হারজেল। পর মুহূর্তেই আবার বলে উঠল, ‘কিন্তু বুঝতে পারছি না, তাদের কথা সত্য হলে তারা তো ভয়ংকর অস্ত্র আবিষ্কার করছে, তাহলে তারা অন্য একজন বিজ্ঞানীর গবেষণা নিয়ে এমন মরিয়া হয়ে উঠল কেন?’
‘বাবা, বিজ্ঞানী বিজ্ঞানীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়। এও হয়তো তেমনি একটা ব্যাপার। কিন্তু বাবা, আমি ভাবছি অন্য কথা, ডেভিড ইয়াহুদ আংকেল এমন ভয়ংকর অস্ত্র তৈরী করছেন কেন, কার স্বার্থে? কোন রাষ্ট্রের তারা কেউ নন, মালিকও তারা কোন রাষ্ট্রের নন, তাহলে দুনিয়ার সব অস্ত্রাগার ধ্বংস করে তারা কি করবেন?’ বলল হান্নাহ হাগেরা। তার কণ্ঠে বিস্ময়!
‘এর উত্তর আমিও জানি না, মা। ডেভিড ইয়াহুদ ও আবু আবদুর রহমান আরিয়েহ দু’জনেই তুরস্কের নাগরিক। কিন্তু তুরস্কের পক্ষে তারা কাজ করছে না, এ কথা পরিস্কার। আবু আবদুর রহমান আরিয়েহের কথাবার্তায় যে ইংগিত পেয়েছি, তাতে বুঝা যায় তারা জায়নবাদী কোন চক্রান্ত বা পশ্চিমী কোন পাওয়ার সিন্ডিকেটের পক্ষে কাজ করছে। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে তা হবে সাংঘাতিক বিপজ্জনক।’ বলল ডেভিড হারজেল। তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার কালো ছাপ।
হান্নাহ হাগেরার চোখে-মুখেও আশংকার ছাপ। বলল, ‘ব্যাপারটা আমার কাছে সিরিয়াস মনে হয়নি। কিন্তু এখন আপনার শেষ কথাগুলো শুনে আমি আতংকিত বোধ করছি। এতো পৃথিবীর বিরুদ্ধে, পৃথিবীর মানুষের বিরুদ্ধে একটা ভয়াবহ ষড়যন্ত্র। আমি ভেবে পাচ্ছি না আমাদের তুরস্ক এই ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের স্থান হয়ে দাঁড়াল কেমন করে?’
দু’জনই সোফায় বসে আলোচনায় তন্ময় হয়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা পেছনে এসে গিয়েছিল।
হান্নাহ হাগেরার কথার জবাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল ডেভিড হারজেল। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা বলল, ‘স্যরি মিস হান্নাহ, তুরস্ক কেন ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের স্থান হয়ে দাঁড়াল?’
হান্নাহ হাগেরা বসে থেকেই পেছন ফিরে তাকাল। দেখল, আহমদ মুসা একদম তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার পরনে নতুন প্যান্ট ও শার্ট। আগের জ্যাকেটটাও তার গায়ে আছে।
হান্নাহ হাগেরা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বসুন, বলছি আপনার উত্তর।’
আহমদ মুসা বসতে বসতে বলল, ‘আমাকে এখনি ছুটতে হবে।’
‘হ্যাঁ, যে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করছিলেন। কি সব ভয়ংকর অস্ত্র নাকি আবিষ্কৃত হয়েছে! ফোটন পারটিকেল ব্যবহার করে নাকি দুনিয়ার সব মারণাস্ত্র তার অস্ত্রাগারেই নিরবে ও পলকের মধ্যে ধ্বংস করার অস্ত্র আবিষ্কার করেছে এক ব্যক্তি বা একটি সংঘ এবং এই আবিষ্কারের গবেষণা নাকি তুরস্কেই হয়েছে! এই ভয়ংকর খবরের কথাই বলছিলাম।’
চমকে উঠল না আহমদ মুসা। কিন্তু বিস্মিত হলো এই ভেবে যে, তাহলে ডেভিড ইয়াহুদরা আমাদের আইআরটি ফোটনের গামা পারটিকেল থেকে সোর্ড (SOWRD-Saviour of world Rational Domain) আবিষ্কার করেছে, সে খবর এঁদের কানে পর্যন্তও পৌঁছে গেছে! তবু স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা হিসেবেই বলল, ‘এমন সাংঘাতিক খবর আপনারা কোথা থেকে পেলেন?’
হান্নাহ হাগেরা তার পিতার দিকে চাইল।
ডেভিড হারজেল একটু নড়ে বসল। একটা অস্পষ্ট চিন্তার রেখা তার মুখে ছায়া ফেলেছিল। বলল, ‘ডেভিড ইয়াহুদ বলেছিল, তারা নাকি এ ধরণের ভয়ংকর গবেষণা করছে। সাফল্য থেকে তারা নাকি মাত্র এক গজ দূরে! এই গল্পটাই আমি হান্নাহর কাছে করছিলাম।’
হাসল আহমদ মুসা। মনে মনেই বলল, তারা তো গবেষণা করছে না, গবেষণার ফল তারা হাইজ্যাক করতে চাচ্ছে। কিন্তু তা মারণাস্ত্র নয়, মারণাস্ত্র থেকে রক্ষার অস্ত্র। তবে এসব মনের কথা না বলে আহমদ মুসা বলল, ‘মারাত্মক খবর! কিন্তু তারা কি ঐ ভয়ংকর অস্ত্র পাওয়া থেকে এক গজ দূরে! না গবেষণার সাফল্য থেকে এক গজ দূরে!’
‘হ্যাঁ, গবেষণার সাফল্য থেকে তারা মাত্র এক গজ দূরে, এই কথাই তারা বলছেন।’ বলল ডেভিড হারজেল।
আহমদ মুসা এবার একটু বিস্মিতই হলো! ডেভিড ইয়াহুদরা তো আমাদের আইআরটি থেকে সফল অস্ত্র ‘সোর্ড’ হাইজ্যাক করতে চাচ্ছে! তাছাড়া এটা তো মারণাস্ত্র নয়, মারণাস্ত্রকে অচল করার অস্ত্র। আর এ অস্ত্র তো কোন অস্ত্রাগারে গিয়ে তা ধ্বংস করবে না। তাহলে অমন কথা ডেভিড ইয়াহুদ বলল কেন? এসব কথা আহমদ মুসার মনে নতুন করে জাগল। কিন্তু কোন সমাধান পেল না।
আহমদ মুসার চিন্তা আবার ঘুরে গেল বন্দী, অসুস্থ প্রধান বিচারপতির দিকে। আহমদ মুসার দেহটা সোজা হয়ে এ্যাটেনশনের রূপ নিল। বৃদ্ধ ডেভিড হারজেলকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমি এখন উঠতে চাই স্যার, অনেক ধন্যবাদ।’
কথা শেষ করেই চাইল আহমদ মুসা হান্নাহ হাগেরার দিকে। তার রক্তাক্ত কাপড়ের প্যাকেটটা পাশ থেকে হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘এটা আমি বাইরের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে যাব। নতুন এক প্রস্থ কাপড়ের জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কাপড়গুলো ফেরত পাঠানো শোভন হবে না। আপনি এমন অবস্থায় পড়লে কি করতেন বলুন তো?’
হাসল হান্নাহ হাগেরা। বলল, ‘আমি বলতে পারি যদি আপনি আমাকে কপি না করার প্রতিশ্রুতি দেন।’
‘এভাবে কপি সাধারণত আমি করি না। সুতরাং আপনি বলুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি নতুন আর এক প্রস্থ কাপড় তার জন্যে পাঠিয়ে ঋণটা শোধ করতাম।’ বলে হাসতে লাগল হান্নাহ হাগেরা।
‘আমার মনের কথাই আপনি…?’
আহমদ মুসাকে কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠল হান্নাহ হাগেরা, ‘আপনি আপনার মনের কথার দোহাই দিয়ে এখন প্রতিশ্রুতি উল্টালে চলবে না। আপনি আমাকে কপি করবেন না স্বীকার করে নিয়েছেন।’
‘আপনার মতো আমারও তো ঋণ শোধ করা দরকার, সেটা কিভাবে হবে?’
‘দুনিয়াতে মহাজন-খাতক, দাতা-গ্রহীতার সম্পর্কের বাইরে কোন সম্পর্ক নেই?’ জিজ্ঞাসা হান্নাহ হাগেরার। তার কণ্ঠ গম্ভীর।
‘অবশ্যই আছে এবং সে মানবিক সম্পর্কটাই প্রধান।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে তো কথা থাকে না।’ হান্নাহ হাগেরা বলল। তার মুখে হাসি।
‘ধন্যবাদ মিস হান্নাহ। আমি…’
আহমদ মুসাকে আবার বাধা দিয়ে হান্নাহ হাগেরা বলে উঠল, ‘এ ধরণের ‘ধন্যবাদ’ সাধারণত সম্পর্কের ইতি ঘটানোর সমার্থক। কিন্তু গত ১ ঘন্টায় এমন এক মহাঘটনার সাথে আমাদের জড়িয়েছেন, যা ইচ্ছা করলেই আমরা ভুলে যেতে পারবো না। এ ব্যাপারে আপনার কাছ থেকে আমরা কিছু আশা করি।’
আহমদ মুসার মুখে ভাবনার একটা ছায়া নামল। বলল, ‘সব ধন্যবাদ বিদায়ের নয়, মিস হান্নাহ। ঘটনার ব্যাপারে মিস হান্নাহ যে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, সেটা আমার জন্যে আরও আনন্দের। আপনারা আমাকে সহযোগিতা করেছেন, আরও সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। ওয়েল মিস হান্নাহ, আমি আপনাদের সাহায্য চাই।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল মিস হান্নাহ ও ডেভিড হারজেলও। ডেভিড হারজেল বলল, ‘অবশ্যই, ইয়ংম্যান! সাহায্য করার যদি কিছু থাকে, অবশ্যই পাবে।’
‘ধন্যবাদ আপনাদের, আমি চলি।’ বলল আহমদ মুসা।
হান্নাহ হাগেরা আহমদ মুসা দিকে এগিয়ে এল। আহমদ মুসার হাত থেকে রক্তাক্ত জামা-কাপড়ের প্যাকেট নিয়ে বলল, ‘ট্রাসে আমিও ফেলে দিতে পারব। চলুন, আপনাকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিই।’
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠলে হান্নাহ হাগেরা বলল, ‘আমরা তুরস্কের কোন কাজে লাগলে খুশি হবো। সত্যি, আপনার সাথের এক ঘন্টা আমার কাছে এক হাজার বছরের মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছে!’
আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দিয়েছিল। ‘আসি, মিস হান্নাহ, প্রার্থনা করুন বিপদটা তাড়াতাড়ি যেন কেটে যায়! ওকে, বাই!’ বলল আহমদ মুসা।
হান্নাহ হাগেরা বলতে চাইল, ‘বিপদ তাড়াতাড়ি শেষ হলে তো আপনি হাওয়া হয়ে যাবেন!’ কিন্তু বলল সে, ‘ঈশ্বর আমাদের ওপর সদয় হোন! আসুন স্যার। বাই!’
হান্নাহ হাগেরা ফিরে এলো তার পিতার কাছে। পিতার পাশে বসেই বলল, ‘বাবা, বিজ্ঞানী আবু আবদুর রহমান আরিয়েহই যে তোমাকে ঐ আবিষ্কারের কথা বলেছেন, সেটা গোপন করলে কেন? তিনিই তো আবিষ্কারের কথা বলেছিলেন! তাঁর নাম না বলে ড. ইয়াহুদের নাম বললে কেন?’
বৃদ্ধ ডেভিড হারজেল একটু গভীর দৃষ্টিতে তাকাল হান্নাহ হাগেরার দিকে। ধীর কণ্ঠে বলল, ‘সব সময় সব কথা বলতে নেই। আমি তাদের সাথে একমত নই বটে, কিন্তু আমি বিজ্ঞানী আবু আবদুর রহমানকে ঝামেলায় জড়াতে চাইনি। তিনি একজন গুণী, নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ।’
‘কিন্তু বাবা, তিনি তো ঝঞ্ঝাট বাঁধানোর অস্ত্র তৈরী করছেন।’ বলল হান্নাহ হাগেরা।
‘তা করছেন। কিন্তু আমি মনে করি, তিনি কোন বিশেষ গরজে এটা নাও করতে পারেন। বিজ্ঞানীরা কোন সিংহাসনে বসতে চান না। যারা বসতে চান, তারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের ব্যবহার করেন।’ ডেভিড হারজেল বলল।
‘কিন্তু বাবা, তুমি যা বলেছ, তাতেই তো দেখা যাচ্ছে যে, তিনিই দুনিয়াকে দাস বানানোর কথা বলছেন। তার মানে তিনি অস্ত্রের জোরে দুনিয়াকে দাস বানাতে চান।’ বলল হান্নাহ হাগেরা।
‘তিনি চান, একথা ঠিক নয়। তিনি হয়তো জায়নবাদীদের কোন রাজনৈতিক অভিলাষের শিকার হয়েছেন।’ ডেভিড হারজেল বলল।
‘এই জায়নবাদীরা কারা, বাবা? শুনেছি, জার্মানিতে নিরীহ ইহুদিরা যে মার খেল তার পেছনে ছিল এই জায়নবাদীদের হাত। তারা কারা? এখন তারা কি চাচ্ছে?’ বলল হান্নাহ হাগেরা।
‘এসব বিষয় নিয়ে তুমি মাথা ঘামিয়ো না হান্নাহ। ওরা বিপজ্জনক। শুধু সেদিন জার্মানিতো নয়, এখনও দুনিয়া জুড়ে নিরীহ ইহুদিরা তাদের হাতে মার খাচ্ছে। এরা ওদের চাঁদা দিয়ে চলার অসহায় গর্দভ মাত্র। কিছু বলে লাভ নেই।’ বলল ডেভিড হারজেল। তার চোখে-মুখে বেদনার প্রকাশ।
‘তাহলে কি ওদের ভয়ে তুমি বিজ্ঞানী আবু আবদুর রহমানের নাম খালেদ খাকানের কাছে বলনি?’ জিজ্ঞাসা হান্নাহ হাগেরার।
‘না, মা। ভয়ে নয়, সমবেদনায়। বিজ্ঞানী লোকটাকে আমার কাছে নিরীহ বলে মনে হয়। ভয় করলে ডেভিড ইয়াহুদের নাম বলতাম না।’ বলল ডেভিড হারজেল।
‘তাহলে আমাকে ভয় করতে বলছ কেন? জিজ্ঞাসা আবারো হান্নাহ হাগেরার।’
‘ভয় না করলেও আমার কিছু করার ক্ষমতা, সময় কোনটাই নেই। কিন্তু তুমি ভয় করলে অনেক কিছু করার সময় ও সুযোগ তোমার আছে। আমি চাই না এ পথ তুমি মাড়াও। এই পথকে ভয়ের চোখে দেখাই নিরাপদ।’ ডেভিড হারজেল বলল। গম্ভীর হয়ে উঠেছিল কণ্ঠ তার।
সংগে সংগেই কোন উত্তর দিল না হান্নাহ হাগেরা। গাঢ় একটা ভাবনার ছায়া তার চোখে-মুখেও। এক সময় বলল হান্নাহ হাগেরা অনেকটা স্বগত কণ্ঠেই, ‘ঠিক আছে, বাবা, কিন্তু এ অব্যাহত ষড়যন্ত্রের প্রতিরোধ করবে কে?’
‘আমি জানি না, মা। হয়তো খালেদ খাকানরাই।’ বলেই উঠে দাঁড়াল ডেভিড হারজেল।
হান্নাহ হাগেরার ভাবনা-কাতর চোখে-মুখে এক টুকরো প্রশান্তির আলো জ্বলে উঠলো খালেদ খাকানের নাম শুনে।
সোফায় গা এলিয়ে দিল হান্নাহ হাগেরা।