৪০. কালাপানির আন্দামানে

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসাকে স্বাগত জানাল হোয়াইট হাউজের চীফ অব প্রোটোকল এ্যালান শেফার্ড।
আহমদ মুসাকে নিয়ে বসাল হোয়াইট হাউজের বৈদেশিক উইং-এর ভিভিআইপি কক্ষে। এ কক্ষেই প্রেসিডেন্ট বিদেশী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীদের সাক্ষাত দেন।
আহমদ মুসা বসলে এ্যালান শেফার্ড বলল, ‘মাফ করবেন স্যার, এক মিনিট, আমি আসছি।’
কিন্তু তার কথা শেষ না হতেই তার হাতের অয়্যারলেস টেলিফোন বেজে উঠল।
ধরল টেলিফোন এ্যালান শেফার্ড। টেলিফোন ধরে শুধু ‘ইয়েস স্যার’, ‘ইয়েস স্যার’, বলতে থাকল। সব শেষে বলল, ‘আমি ওঁকে নিয়ে যাচ্ছি স্যার।’
কথা শেষ করে কল অফ করে দিল এ্যালান শেফার্ড। তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে। তার মুখে কিছু বিব্রত ভাব। বলল সে আহমদ মুসাকে, ‘স্যরি স্যার। আপনাকে আর একটু কষ্ট করতে হবে। আসুন আমার সাথে।’
বলে সে ঘুরে দাঁড়াল ঘর থেকে বের হবার জন্যে।
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল। চলল এ্যালান শেফার্ডের সাথে।
এ্যালান শেফার্ড আহমদ মুসাকে নিয়ে এল হোয়াইট হাউজের ডোমেষ্টিক উইং-এ। বসাল তাকে ভিভিআইপি কক্ষে। এ কক্ষেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট মার্কিন ভিভিআইপি’দের সাক্ষাত দেন।
আহমদ মুসা বসল। বলল হাসতে হাসতে, ‘কোন তৃতীয় স্থানে তো আর যেতে হবে না?’
এ্যালান শেফার্ডের বিব্রত অবস্থা বাড়ল। বলল, ‘স্যরি স্যঅর। ভুলটা আমারই হয়েছিল।’
‘কিন্তু বুঝতে পারলাম না। ‘বিদেশ’ থেকে ‘স্বদেশ’-এ আসলাম কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, এটাই তো হবে। আমার মত আপনিও ভুল করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো আপনার স্বদেশ। আপনি তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও নাগরিক। আপনি তো ডোমেষ্টিক উইংয়েই আসবেন।’ বলল এ্যালান শেফার্ড।
‘ও এই কথা। এমন নাগরিক আমি তো প্রতিটি মুসলিম দেশের।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, অন্য অনেক দেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনা হয় না। মার্কিন নাগরিকরা যে অধিকার ভোগ করে, তা দুনিয়ার অধিকাংশ দেশেই নেই।’ এ্যালান শেফার্ড বলল।
আবার অয়্যারলেস বিপ বিপ করা শুরু করল এ্যালান শেফার্ডের।
কথা বলল সে অয়্যারলেসে। কথা শেষ করেই সে ঘুরে তার পেছনের দেয়ালের দিকে এগুলো। দেয়ালের একটা ছবির সামনে দাঁড়াল। ছবিটি দেয়ালে সেঁটে আছে। ছবির বটমে সাপোর্টিং একটা কাঠের প্যানেল। প্যানেলে প্রায় অদৃশ্য কয়েকটা বোতাম। একটা বোতাম টিপল। সংগে সংগে আহমদ মুসার সামনের দেয়ালের একটা অংশ টেলিভিশন স্ক্রীনে রূপান্তরিত হলো। টিভি স্ক্রীনে ফুটে উঠেছে একটা বিশাল ঘরের দৃশ্য। ঘর ভর্তি মানুষ। একটি চেয়ারও খালি নেই। প্রতিটি চেয়ারের সামনে ডেষ্ক। ডেষ্কে প্রত্যেকের নোটশীট, কলম, রেকর্ডার রেডি। ঘরে ষ্টিল ও টিভি ক্যামেরার বন্যা।
এ্যালান শেফার্ড বলল, ‘স্যার আপনার একটু কষ্ট হবে। প্রেসিডেন্টের ‘meet the press’ অনুষ্ঠান শেষ মুহূর্তে এক ঘণ্টা পিছিয়ে যায়। আর দু’এক মিনিটের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট প্রেসের সামনে আসছেন। দুঃখিত স্যার, আপনাকে এক ঘণ্টা বসতে হবে।’
‘দুঃখ নয় মি. শেফার্ড, এটা খুশির বিষয় হলো। প্রোগ্রামটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে যাওয়ায় প্রেসিডেন্টের প্রেস ব্রিফিং এখন সরাসরি দেখার আমার সৌভাগ্য হলো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার। প্রেসিডেন্টের ‘meet the press’ অনুষ্ঠান আপনাকে আনন্দ দিলে আমরা খুব খুশি হবো।’
কথা শেষ করেই ‘এক মিনিট স্যার’ বলে সে বেরিয়ে গেল।
ঠিক এক মিনিটের মধ্যেই সে একটা ট্রেতে দুই মগ কফি এবং দুই হাফপ্লেট ভর্তি ক্র্যাকার নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
এ্যালান শেফার্ড আহমদ মুসাকে কফি ও ক্র্যাকার এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘জর্জ জনসন স্যার বলেছিলেন, এই সময় আপনি কফি পছন্দ করেন।’
‘কারণ বেশির ভাগ ক্ষেতে এই সময় আমি তার মেহমান হয়েছি।’ আহমদ মুসা বলল হাসতে হাসতে।
‘স্যার প্রেসিডেন্ট আসছেন। শুরু হচ্ছে প্রেস ব্রিফিং।’ আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই বলে উঠল এ্যালান শেফার্ড।
আহমদ মুসা টিভি স্ক্রীনের দিকে চোখ ফেরাল। দেখল, প্রেসিডেন্ট হ্যারিসন মঞ্চে তার নির্ধারিত আসনে এসে বসেছেন। মঞ্চে তিনি একাই। মঞ্চের নিচে ডান পাশে তাঁর ক্যাবিনেটের কয়েকজন সদস্য ও তাঁর কয়েকজন পার্সোনাল ষ্টাফ বসেছে।
প্রেসিডেন্ট বসে সকলকে গুড ইভিনিং জানিয়ে কিছুক্ষণ সিনিয়র কয়েকজন সাংবাদিকদের সাথে হালকা মুডে ইনফরমাল কিছু আলাপ করল। এই আলাপেরই এক পর্যায়ে তিনি হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলে উঠল, ‘মাই ডিয়ার ফ্রেন্ডস ইন মিডিয়া, এখন কাজ আমরা শুরু করতে পারি।’
বলে থামল একটু প্রেসিডেন্ট। সামনের ফাইলটার উপর একবার নজর বুলাল। তারপর মাথা তুলল। গম্ভীর মুখ। কিন্তু কোন বিষণ্ণতা তাতে নেই। আছে স্থির আস্থা ও অনড় দায়িত্বশীলতার স্ফুরণ। বলতে শুরু করল প্রেসিডেন্টঃ
“মাইডিয়ার ফ্রেন্ডস, বিশ বছর আগে টুইনটাওয়ারের ধ্বংস যেমন নিমিষেই বদলে দিয়েছিল পৃথিবী, তেমনি আজ সকাল হতে শুরু হওয়া সংবাদ-ভূমিকম্প পাল্টে দিয়েছে গতকাল থেকে আজকের অবস্থাকে। কিন্তু মার্কিন সরকারের কাছে এটা কোন অভাবিত বিষয় আকারে আসেনি। বিষয়টি সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত হয়েছি। মিডিয়ায় বিষয়টি না এলে আমরা অচিরেই আমাদের জনগণ ও বিশ্ববাসীর কাছে এ নিয়ে কথা বলার জন্যে হাজির হতাম। এই অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মিডিয়ায় আসার ফলে আমাদের দেশসহ সবদেশে সবখানে প্রবল জিজ্ঞাসার জন্ম হয়েছে। জিজ্ঞাসাগুলো আমরা অনুধাবন করতে পারছি। এই জিজ্ঞাসার দাবী পূরণ করতেই আপনাদের কাছে ত্বরিত হাজির হওয়ার প্রয়োজন হবে তা আমরা অনুভব করেছি। আমাদের বক্তব্য হবে আপাতত খুবই সংক্ষিপ্ত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত একটি গণতান্ত্রিক দেশের সরকার জনগণের পক্ষে সব দায়িত্ব পালন করা এবং জনস্বার্থে সব দিকে নজর রাখার জন্যে দায়িত্বশীল। কিন্তু এই সরকার সবজান্তা নয় এবং তা হওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া এই সরকার জনগণের হলেও বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তিপ্রবণতা অনেক সময়ই সিদ্ধান্তকারী হয়ে উঠতে পারে। এই ব্যক্তিপ্রবণতা যখন আইন-বিধান লংঘন করে, জাতির স্বার্থ বিঘিœত করে এবং জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করে, তখন তা হয়ে দাঁড়ায় বিপর্যয় সৃষ্টিকারী অপরাধ। সুতরাং সরকার গণতান্ত্রিক হলেও সে সরকারের কাজ ও সিদ্ধান্তে ব্যত্যয় ও বিপর্যয় ঘটতে পারে, সবজান্তা না হওয়া এবং ব্যক্তির স্বার্থদুষ্ট প্রবণতা- এ দুয়ের যে কোন কারণে। বিশ বছর আগের মর্মান্তিক ঘটনার ক্ষেত্রে আমাদের তদানিন্তন সরকারের এদুটো কারণের কোনটি ক্রিয়াশীল ছিল মার্কিন-জীবনের স্বচ্ছতার জন্যেই তা দিনের আলোতে আসা প্রয়োজন। এ কারণেই আমার সরকার আমাদের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আমরা আশা করছি, এই তদন্তের মাধ্যমে সব প্রশ্নেরই জবাব পাওয়া যাবে, সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে। এই তদন্ত সাপেক্ষে আমাদের ইতিমধ্যেকার অনুসন্ধান থেকে কিছু কথা আমরা বলতে পারি। টুইনটাওয়ার ধ্বংসের পেছনে যে ষড়যন্ত্র ছিল, তার সাথে মার্কিন সরকার কোন ভাবেই যুক্ত ছিল না। ড. হাইম হাইকেল-এর কনফেশন ও তাঁর কনফেশনের ভিত্তিতে ১৪ জন আরবের কংকাল আবিষ্কারসহ যে তথ্য প্রকাশ পেয়েছে এবং তার মাধ্যমেই ‘ডিমোলিশন বিস্ফোরক’ দিয়ে টুইনটাওয়ার ধ্বংসের যে তথ্য জানা গেছে, তার সাথে মার্কিন সরকারকে কোনও ভাবেই যুক্ত দেখা যাচ্ছে না। অনুরূপভাবে ‘সেফ এয়ার সার্ভিস’-এর সাবেক কর্মকর্তা মি. মরিস মরগ্যান-এর সাক্ষ্য থেকেও প্রমাণ হচ্ছে দুটি সিভিল প্লেন হাইজ্যাক ও টুইনটাওয়ারে আঘাত করার জন্যে আমাদের ‘এ্যান্টি-হাইজ্যাক’ প্লেন ‘গ্লোবাল হক’ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমাদের সরকারের কোন ভূমিকা নেই। এই প্লেনকে একটা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটা চক্র ব্যবহার করেছিল।
তবে এই ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের তদানিন্তন সরকারের কেউ বা অনেকেই জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে যুক্ত থাকতে পারেন। এটা অনুসন্ধান সাপেক্ষ বিষয়। এটা অনুসন্ধানের জন্যেই আমরা উপচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি।
টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আমাদের আরেকটি বড় বিবেচ্য বিষয়। যেহেতু এই ষড়যন্ত্র আমাদের মাটিতে হয়েছে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত টুইনটাওয়ার আমাদের সম্পদ ছিল তাই অপরাধীদের শাস্তি বিধানও আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ইতিমধ্যেই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত দুজন শীর্ষ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে তদন্ত কাজ শুরু করেছি। এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন এই তদন্তে নেতৃত্ব দেবেন। অপরাধীদের মধ্যে যারা জীবিত আছে তাদের অবশ্যই আমরা পাকড়াও করব। উপযুক্ত শাস্তি থেকে কেউই রেহাই পাবে না।
সবশেষে আমি টুইনটাওয়ার ধ্বংসের ষড়যন্ত্র উদঘাটনকারী ইউরোপ-বেজড ‘স্পুটনিক’ গোয়েন্দা সংস্থাকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি। সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি ‘স্পুটনিক’-এর হয়ে কাজ করে যিনি গোটা ষড়যন্ত্রকে দিনের আলোতে নিয়ে এসেছেন, সেই আহমদ মুসাকে। তিনি বিশ বছর ধরে জেঁকে বসে থাকা মিথ্যার দূর্গকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত করেছেন সত্যকে। এতে ব্যক্তি হিসাবে তাঁর কোন উপকার হয়নি। কিন্তু দেশ হিসাবে, জাতি হিসাবে উপকৃত হয়েছি আমরা মার্কিনীরা। আমাদের জাতির পক্ষ থেকে আমি তাকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি।
শেষ করার আগে বলতে চাই, আমরা মার্কিনীরা আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসদের প্রতিষ্ঠিত আদর্শের প্রতি অনড়ভাবে আস্থাশীল। আমরা ভুল করতে পারি, কিন্তু ভুল শোধরানোর সাহস আমাদের আছে। এই সাহসই আমাদের মার্কিনী জাতির শক্তি। সকলকে ধন্যবাদ।”
প্রেসিডেন্ট কথা শেষ করতেই কয়েকজন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল প্রশ্ন করার জন্য। প্রেসিডেন্ট তাদের বসতে বলে গ্লাস থেকে এক ঢোক পানি খেয়ে বলল সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে, ‘আমার বক্তব্যে আমি কোন প্রশ্ন করার অবকাশ রাখিনি। তবু সাংবাদিকরা থাকবেন, কিন্তু কোন প্রশ্ন থাকবে না, এটা স্বাভাবিক নয়। তাই ঠিক করেছি আমি তিনটি প্রশ্নের জবাব দেব। এখন আপনারা ঠিক করুন প্রশ্ন তিনটি কি হবে। পাঁচ মিনিট পরে আমি আসছি।’
বলে প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে।
তার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল উপস্থিত মন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের পার্সোনাল ষ্টাফরা।
ঠিক পাঁচ মিনিট-এর মধ্যেই প্রেসিডেন্ট সংবাদ কক্ষে প্রবেশ করল এবং তাঁর আসনে ফিরে এল।
প্রেসিডেন্ট তাঁর আসনে বসতেই সাংবাদিকদের প্রথম সারি থেকে ওয়াশিংটন পোষ্টের হোম এ্যাফেয়ার্স এডিটর প্রবীণ সাংবাদিক জ্যাকব জোনস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, আমরা তিনটি প্রশ্ন আপনার সামনে রেখেছি।’
‘ধন্যবাদ মি. জোনস।’ মুখে হাসি টেনে বলল প্রেসিডেন্ট।
টেবিল থেকে নিয়ে প্রশ্নগুলোর উপর নজর বুলাল প্রেসিডেন্ট।
হাসি ফুটে উঠল প্রেসিডেন্টের মুখে। মুখ তুলে তাকাল প্রেসিডেন্ট সকলের দিকে। বলল, ‘উপস্থিত বন্ধুরা, আপনাদের প্রথম প্রশ্ন হলো, ‘টুইনটাওয়ার ধ্বংসের রহস্য উদঘাটন সম্পর্কিত মূল রিপোর্ট করেছে ফ্রান্সের দৈনিক ‘লা-মন্ডে’ এবং ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড টেলিভিশন’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার কি এই রিপোর্ট কনফার্ম করছে?’
‘বন্ধুগণ, আমার উত্তর হলো, টুইনটাওয়ার ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বিষয়ে মার্কিন সরকারের হাতে যে তথ্য রয়েছে তার ভিত্তিতে লা-মন্ডে ও FWTV -এর রিপোর্টের মূল বিষয়কে আমরা কনফার্ম করেছি। মাউন্ট মার্সি’র গণকবর থেকে উঠানো ১৪টি কংকালের পরিচয়মূলক ফরেনসিক রিপোর্ট এবং ধ্বংস টুইনটাওয়ারের ডাষ্ট পরিক্ষার রিপোর্ট আমাদের কাছে রয়েছে। গ্লোবাল হক-এর সেদিনের লগ এবং উড্ডয়ন রুট ও এর তৎপরতার এরিয়েল ফটোগ্রাফও আমরা পেয়েছি। এসব প্রমাণের সবগুলোই মিডিয়া রিপোর্টের মূল বিষয়কে কনফার্ম করছে।
আপনাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন: টুইনটাওয়ার ষড়যন্ত্র উদঘাটন করতে পারল ইউরোপ থেকে একটা প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থা। বিশ বছরেও আমাদের এসব গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই কাজটা করতে পারল না কেন?
আমি আমার উত্তরে এই প্রশ্নটিকে খুবই সংগত বলে অভিহিত করতে চাই। কিন্তু প্রশ্ন সংগত হলেও টুইনটাওয়ার ধ্বংসের ষড়যন্ত্র উদঘাটনের তদন্ত আমাদের গোয়েন্দা বিভাগগুলোর জন্যে স্বাভাবিক ছিল না। তদন্ত অনুষ্ঠানের প্রথম শর্ত হলো, সন্দেহ করা। টুইনটাওয়ার ধ্বংসের পেছনে যে ষড়যন্ত্র আছে, এই সন্দেহ বিশ বছর আগে আমাদের কারও মনেই জাগেনি। রাজনীতিকদের মধ্যেও নয়। সাংবাদিকরা কিছু লিখলে সেটা আমাদের জন্যে চোখ খোলার একটা অবলম্বন হতো। তাও হয়নি। অন্যদিকে স্পুটনিক হলো কিছু মুসলিম ব্যক্তির পরিচালিত একটা গোয়েন্দা সংস্থা। আর মুসলমানরা ছিল টুইনটাওয়ার ধ্বংসের প্রতিপক্ষ। সুতরাং টুইনটাওয়ার ধ্বংসের পেছনে ষড়যন্ত্র আছে এটা তারা শুরু থেকেই মনে করেছে। এই সন্দেহ থেকেই স্পুটনিক সংস্থাটি সত্য উদ্ধারের জন্যে তদন্ত শুরু করে। বলা যায় ঘটনাক্রমেই তারা ড. হাইম হাইকেলের সন্ধান পেয়ে যায় এবং অবশেষে তারা ষড়যন্ত্র উদঘাটন করতে সমর্থ হয়। এই সুযোগগুলো আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ পায়নি এবং সন্দেহ করেনি বলে সত্য সন্ধানের চেষ্টাও তারা করেনি। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে প্রশাসন ও সরকারের কেউ কেউ ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিল। এ ব্যাপারটা আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ধরতে পারেনি কেন? সরকার ও প্রশাসনের কোন পর্যায় এই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিল, তা জানতে পারলেই এই জটিল প্রশ্নের জবাব দেয়া যাবে। হতে পারে বিষয়টি চাপা দেবার মত শক্তি তাদের ছিল। এই কারণেই হয়তো টুইনটাওয়ার ধ্বংসের আগাম কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও সরকার ও প্রশাসন প্রতিরোধ করার জন্রে সামনে এগুতে পারেনি। এই বিষয়গুলো দেখার জন্যেই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অপেক্ষা করুন, সব প্রশ্নেরই জবাব মিলবে।’
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর শেষ করে একটু থামল প্রেসিডেন্ট হ্যারিসন। তাকাল হাতের কাগজের দিকে তৃতীয় প্রশ্নের জন্যে।
হাসি ফুটে উঠল প্রেসিডেন্টের মুখে। বলল, ‘আপনাদের তৃতীয় প্রশ্ন হলো, অবস্থা ও পরিস্থিতি যাই হোক এটা কি সত্য নয় যে, মার্কিন সরকার ইহুদী বিদ্বেষী আহমদ মুসার সাথে যুক্ত হয়ে ইহুদী বিদ্বেষী অবস্থান নিতে যাচ্ছে?’
বন্ধুগণ আমার উত্তর হলো, ‘প্রশ্নটিতে পক্ষ-বিপক্ষের নির্বিচার মেরুকরণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্নকর্তার ইতিমধ্যেই জেনে ফেলার কথা টুইনটাওয়ার ধ্বংসের ষড়যন্ত্র উদঘাটনে আহমদ মুসার প্রধান সাহায্যকারী একজন ইহুদী, এবং তিনি ড. হাইম হাইকেল। ড. হাইকেল শুধুই একজন ইহুদী নন, তিনি আমেরিকার শীর্ষ ও সম্মানিত ইহুদী পরিবারের একজন শীর্ষ ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। শুধু তিনি নন অনেক সম্মানিত ইহুদী ব্যক্তিত্ব এবার অপূরণীয় ক্ষতি স্বীকার করেও আহমদ মুসাকে সাহায্য করেছে। ইতিপূর্বে বর্তমানে আটক ইহুদী নেতা জেনারেল শ্যারনের ষড়যন্ত্র বানচাল করার ক্ষেত্রেও আহমদ মুসা অনেক সম্মানিত ইহুদী ব্যক্তিত্বের সাহায্য পেয়েছেন। সুতরাং বলা যায় আহমদ মুসা ইহুদী বিদ্বেষী নয় এবং ইহুদীরাও আহমদ মুসা বিদ্বেষী নন। ঘটনাক্রমে কিছু ইহুদীর ষড়যন্ত্রের মোকাবিল আহমদ মুসাকে করতে হয়েছে। বর্তমান ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। এজন্যেই আহমদ মুসা ইহুদীদের সহযোগিতা পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন। আর আমাদের ইহুদী বিরোধী অবস্থান নেবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। কিছু ক্রিমিনাল ছাড়া দেশের ইহুদী নাগরিকরা আমাদের সাথে আছেন। জেনারেল শ্যারনের বিরুদ্ধে আমাদের খৃষ্টান নাগরিকদের চেয়ে ইহুদী নাগরিকদেরই বেশি সোচ্চার দেখা গেছে। বর্তমান ক্ষেত্রেও এটাই ঘটবে।’
প্রেসিডেন্ট একটু থামল। সকলের দিকে চাইল। বলল আবার, ‘বন্ধুগণ, মার্কিন সরকার মার্কিন জনগণের সরকার। তারা ইহুদীদেরও সরকার, মুসলমানদেরও সরকার। আইন মান্যকারী নাগরিকদের যেমন সরকার ভালবাসবে, তেমনি আইন ভংগকারীদের দেবে শাস্তি। অন্যদিকে সরকারও ভুলের উর্ধ্বে নয়। বিশ বছর আগে টুইনটাওয়ার ধ্বংসের ঘটনার পরে একটা ভুল বা অন্যায় করা হয়েছিল। তার ফলে মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আমরা দ্বিধাহীন ভাবেই এই ভুল বা অন্যায়ের দায়িত্ব স্বীকার করছি। ধন্যবাদ সকলকে। ধন্যবাদ আমাদের ডাকে হাজির হয়ে আমাদের সহযোগিতা করার জন্যে।’
কথা শেষ করেই প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল।
সংগে সংগেই আহমদ মুসাদের সামনে দেয়ালের টিভি স্ক্রিনটি অফ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা স্ক্রিনের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে এ্যালান শেফার্ডকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, এ সময় এ্যালান শেফার্ডের অয়্যারলেস বেজে উঠল।
আহমদ মুসা থেমে গেল।
এ্যালান শেফার্ড মুখের কাছে তুলে নিল অয়্যারলেস।
ওপারের কথা সে শুনল। শুধু ‘স্যার’ ‘স্যার’ বলা ছাড়া কোন কথা সে বলল না। কথা বলা শেষ হলো।
অয়্যারলেস কল অফ করে দিয়ে সে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, মি. প্রেসিডেন্ট সরাসরি এখানে আসছেন। মাফ করবেন স্যার, আমি একটু বাইরেটা দেখি সব ঠিক আছে কিনা।’
বলে এ্যালান শেফার্ড দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
দুমিনিটের মধ্যেই এ্যালান শেফার্ড ঘরে ফিরে এল। বলল, ‘মি. প্রেসিডেন্ট এসে পড়েছেন।’
তার কথা শেষ হওয়ার সংগে সংগেই প্রেসিডেন্টের পারসোনাল সিকিউরিটি এবং পারসোনাল সেক্রেটারী ঘরে প্রবেশ করল।
তারা আহমদ মুসাকে শুভেচ্ছা জানাল।
পি,এস প্রেসিডেন্টের বসার চেয়ার ঠিকঠাক করে টেবিলের উপর নোটশীট ও কয়েকটি ইনভেলাপ এবং একটি কলম রাখল।
আর সিকিউরিটি অফিসার হাতে একটা ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র নিয়ে গোটা ঘরটা একবার চেক করে প্রেসিডেন্টের চেয়ারের অনেকখানি পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।
প্রেসিডেন্ট হ্যারিসন প্রবেশ করল ঘরে।
প্রবেশ করে নিজের চেয়ারের দিকে না গিয়ে ‘হ্যালো ইয়ংম্যান, হিরো অফ দি টাইম’ বলে আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে এল।
আহমদ মুসা আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিল।
প্রেসিডেন্ট সামনে চলে এলে আহমদ মুসা হাত বাড়াল হ্যান্ড শেকের জন্যে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট দু’হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল এবং ডান হাত দিয়ে পিঠ চাপড়ে বলল, ‘কনগ্রাচুলেশন আহমদ মুসা। ঈশ্বর নিশ্চয় তোমাকে বিশেষ বিশেষ কিছু কাজের জন্যে বেছে নিয়েছেন। আমার আমেরিকার পক্ষ থেকে তোমাকে ধন্যবাদ।’
‘আমাকে আপনার সাথে সাক্ষাতের এই সুযোগ দেয়া এবং আমাকে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্যে আপনাকে এবং আমেরিকাকে ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট।’ বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে পরে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল।
প্রেসিডেন্ট চেয়ারে বসার পর প্রেসিডেন্টের পার্সোনাল সেক্রেটারী ও সিকিউরিটি অফিসার ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট চেয়ারে বসেই বলল, ‘আমেরিকা তোমাকে সাহায্য করল কখন?’
‘মি. প্রেসিডেন্ট, ড. হাইম হাইকেল আমেরিকান, মরিস মরগ্যান আমেরিকান, প্রফেসর আরাপাহো আমেরিকান, সান ওয়াকার আমেরিকান, মাউন্ট মার্সিতে যারা আমাদের সাহায্য করেছেন, মিলিটারি হিষ্ট্রি মিউজিয়ামে যিনি আমাদের জীবন বাঁচিয়েছেন, তারা সবাই আমেরিকান। সর্বোপরি যার আশ্রয়, প্রশ্রয় ও সাহায্য না পেলে এগুনোই সম্ভব হতো না সেই সম্মানিত ব্যক্তি জর্জ আব্রাহাম জনসনও আমেরিকান। সুতরাং আল্লাহর সাহায্য বাদ রাখলে আমার যে সাফল্য তা এই মহান আমেরিকানরাই এনে দিয়েছেন।’
গাম্ভীর্য নামল প্রেসিডেন্টের মুখে। বলল, ‘এই আমেরিকানদের জন্যে আমিও গর্বিত আহমদ মুসা।’
তারপর ঠোঁটে এক টুকরো মুচকি হাসি টেনে বলল, ‘তবে জর্জ জনসন তোমাকে আমেরিকান হিসাবে সাহায্য করেননি, তিনি সাহায্য করেছেন তাঁর এক পুত্রকে।’
‘সত্যি মি. প্রেসিডেন্ট, তিনি আমাকে তার পুত্রের মত ভালবাসেন। আমি ভাগ্যবান যে, আমি তার এ ভালবাসা পেয়েছি।’ বলল আহমদ মুসা আবেগ জড়িত গম্ভীর কণ্ঠে।
‘শুধু তিনি নন আহমদ মুসা। মিসেস জনসন যে বিশেষ খাবার তৈরি করে, কেক তৈরি করে নিউইয়র্কে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন, এটা আমি জানি।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘অবশ্য তিনি তা পাঠাবেন। তিনি তো আমার মা।’ মিষ্টি হেসে আহমদ মুসা বলল।
হাসল প্রেসিডেন্ট। বলল, ‘শুধু মা হিসাবে তাঁকে দখল করনি। মা ও তার পরিবারের বিশ্বাসও তো তুমি পাল্টে দিয়েছ।’
‘ধর্ম বিশ্বাস?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিভাবে?’
‘কেন তুমি জান না, তারা গোটা পরিবার ইসলাম গ্রহণ করেছে?’
‘না মি. প্রেসিডেন্ট, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। তারা তো কিছুই বলেননি আমাকে?’
‘আশ্চর্য! তুমি জান না এত বড় ঘটনা? তুমি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তাদেরকে কোন সময় কিছু বলনি?’ বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে দু’চারটা কথা কখনও কখনও বলেছি। এর বেশি কিছু নয়। আমি তাঁদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে কোন সময়ই কিছু বলিনি।’
প্রেসিডেন্ট হাসল। বলল, ‘আহমদ মুসা, কোন আদর্শের দিকে আহ্বান দুভাবে হতে পারে। একটা হলো, মুখে বা লিখিতভাবে বলা, আরেকটার মাধ্যম দৃষ্টান্ত উপস্থাপন। তুমি মুখে তাদেরকে ইসলামের পরিচয় বলনি, কিন্তু তোমার মধ্যে তারা জীবন্ত ইসলামকে দেখেছে। সেই ইসলামই তাদের আকৃষ্ট করেছে, যেমন আকৃষ্ট করেছে ড. আয়াজ ইয়াহুদ, ড. হাইম হাইকেল, মরিস মরগ্যান, প্রফেসর আরাপাহোদের পরিবারসহ সান ওয়াকারদের মত তোমার সান্নিধ্যে আসা বহু পরিবারকে।’
বিস্ময় ফুটে উঠেছে আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, আমি শুধুমাত্র সান ওয়াকাররা ছাড়া আর কারো বিষয়ে কিছুই জানি না। তাদের সবার ব্যাপারে নতুন কিছু জানেন?’
হাসল আবার প্রেসিডেন্ট। বলল, ‘আহমদ মুসা, তোমার দৃষ্টি সামনে। তুমি যে পথ মাড়িয়ে যাও, সেদিকে আর ফিরে তাকাও না তুমি। কিন্তু আমি দেশের প্রেসিডেন্ট। সব জানতে হয় আমাকে।’
‘ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট। আমার একটা কৌতুহল, জানার একটা ফল আছে, ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেটাই হোক। আপনার মধ্যে এই জানার ফলটা কি ধরনের?’
হো হো করে হেসে উঠল প্রেসিডেন্ট। বলল, ‘তুমি আমাকে ফাঁদে ফেলতে চাও আহমদ মুসা। ওটা বলব না। প্রেসিডেন্সিয়াল সিক্রেট ওটা। তবে এটুকু বলতে পারি, তুমি সত্যিই একটা বিস্ময়। ধর্ম-নিরপেক্ষ-মানবতা ও ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিকতার এই জয়-জয়কারের যুগে তুমি একটা ধর্মকে সংগ্রাম, সুবিচার ও মানবিকতার অচ্ছেদ্য এক দ্রবণ হিসাবে তুলে ধরেছ। আমি বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছি আহমদ মুসা।’
কথা শেষ করেই প্রেসিডেন্ট আবার বলে উঠল, ‘এই বিষয়টা এখন থাক আহমদ মুসা। এস, আমরা অন্য কথায় যাই।’
একটু থামল প্রেসিডেন্ট। তারপর বলল, ‘আমার প্রেস ব্রিফিং-এ বলা দরকার ছিল, এমন কিছু বাদ পড়েছে কিনা?’
‘না জনাব। তেমন কিছুই বাদ পড়েনি। সব দিকের সব কথা সুন্দরভাবে এসেছে। প্রেস ষ্টেটমেন্টের সাথে তিনটি প্রশ্নের উত্তর কোন প্রশ্নেরই অবকাশ রাখেনি। মুসলমান ও আমার অবস্থানটা সুন্দরভাবে তুলে ধরায় আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি তোমাদের কোন ফেভার করিনি যে, ধন্যবাদ দিতে হবে। আমি একটা সত্যকে সত্য হিসাবে তুলে ধরেছি মাত্র।’
‘ধন্যবাদটা আপনাকে এই জন্যেই মি. প্রেসিডেন্ট।’
‘এশিয়া, আফ্রিকায় আমার প্রেস ব্রিফিং-এর প্রতিক্রিয়া কি হবে বলে মনে কর?’
‘আমেরিকাকে তারা আসল রূপে ফিরে পাবে মি. প্রেসিডেন্ট। এতে আমেরিকা তাদের মাথা থেকে পড়ে গেলেও তাদের হৃদয়ে স্থান পাবে। ভুল বা অন্যায়ের দায়িত্ব স্বীকারমূলক যে উক্তি আপনি করেছেন, তা আমেরিকাকে দুর্বল নয়, আরও শক্তিশালী করেছে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। তোমার কথা সত্য হোক। আমরা আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসদের দেখানো পথেই চলতে চাই।’
বলে প্রেসিডেন্ট একটু থামল। তারপর আহমদ মুসার উপর সরাসরি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল, ‘তোমার সাথে সাক্ষাত করার ইচ্ছা ছাড়াও আরও দুটি প্রয়োজনে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি।’
‘বলুন মি. প্রেসিডেন্ট।’ আহমদ মুসা বলল।
প্রেসিডেন্ট টেবিল থেকে একটা ইনভেলাপ তুলে নিয়ে আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এতে জুনিয়র আহমদ মুসা মানে আহমদ আবদুল্লাহর মার্কিন পাসপোর্ট আছে। আমাদের সরকার তাকে অভিনন্দন জানাবার সাথে সাথে তাকে মার্কিন নাগরিকত্ব দিয়ে ধন্য হতে চায়।’
আহমদ মুসা ইনভেলাপ থেকে পাসপোর্ট বের করে পাসপোর্ট খুলে তাতে আহমদ আবদুল্লাহর ছবি দেখে ছবিতে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘এই সময়ের মধ্যে আপনারা কি করে এঁর ছবি পেলেন মি. প্রেসিডেন্ট?’
‘আমরা সৌদি সরকারকে অনুরোধ করেছিলাম। আমাদের অনুরোধের এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা ছবি পেয়ে গেছি।’
‘ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট, পৃথিবীর এক সদ্যজাত অতিথিকে এই মর্যাদা দেয়ার জন্যে। আল্লাহ তার জন্যে এটা কল্যাণকর করুন।’ আবেগে ভারী আহমদ মুসার কণ্ঠ।
‘ওয়েলকাম আহমদ মুসা’ বলে প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয় একটি ইনভেলাপ তুলে ধরল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘এটা তোমাকে ও তোমার পরিবারকে আমাদের মেহমান হিসাবে আমেরিকা সফরের আমন্ত্রণ। তোমরা মার্কিন নাগরিক হিসাবে যে কোন সময় আমেরিকা সফর করতে পার। কিন্তু এটা বিশেষ আমন্ত্রণ। আগামী মাসে ওয়াশিংটনে ‘এডাম এন্ড ইভ’ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সম্মেলনের শ্লোগান হবে ‘এক পরিবারের সন্তান আমরা ভালবাসি সবাই সবাইকে।’ এই সম্মেলনে তোমাদের দাওয়াত। শুধু আহমদ মুসার স্ত্রী হিসাবে নয়, ফরাসী রাজকুমারী হিসাবে ম্যাডাম আহমদ মুসা একটা নারী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন। এই দাওয়াত তোমরা গ্রহণ করলে বাধিত হবো।’
আহমদ মুসা একটু ম্লান হাসল। বলল, ‘আমেরিকা সফরের দাওয়াত আমরা গ্রহণ করলাম। কিন্তু দুঃখিত যে, আগামী মাসে আমরা আসতে পারবো না। আমি তখন থাকব আন্দামানে। এখান থেকে আমি সৌদিআরব যাচ্ছি। তারপর সেখান থেকে যাবো আন্দামানে।’
‘আন্দামানে কেন? আরও পরে সেখানে যাও।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘না জনাব। বিষয়টা জরুরী। ওখানকার কাজ সেরে আমেরিকা আসবো, এটা হতে পারে।’
‘তুমি যে বিষয়টাকে জরুরী ভাবছো, তা অবশ্যই জরুরী এবং এই প্রোগ্রাম তোমার বাতিল করা ঠিক হবে না এটাও আমি জানি। কিন্তু আহমদ মুসা, তোমার তো নিশ্চিত একটা রেষ্ট দরকার।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘কাজ ও রেষ্টের ব্যবস্থা আল্লাহ এক সাথেই করেছেন। দিনে কাজ, রাতে রেষ্ট-এটা আল্লাহর দেয়া অবকাশ যাপনের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা। এর বাইরে মানুষের রেষ্টের আসলেই কোন প্রয়োজন নেই।’
হাসল প্রেসিডেন্ট। বলল, ‘ঠিক আহমদ মুসা, তোমার এই কথা ভেবে দেখার মত?’
‘একটা অনুরোধ করতে পারি প্রেসিডেন্ট?’
‘বল। এই প্রথম তোমার কাছ থেকে একটা অনুরোধ পেলাম।’
‘মার্কিন নাগরিক হিসাবে আন্দামান-এর জন্যে আমার একটা পাসপোর্ট প্রয়োজন।’
‘জানি, আন্দামান ভারতের নানা বিধি-নিষেধের আওতাধীন একটা এলাকা। এ জন্যেই হয়তো তুমি এই অনুরোধটা করেছ। আমি আনন্দিত যে তোমার একটা অনুরোধ পেয়েছি। মনে কর ভিসা তুমি পেয়ে গেছ। আজ পাসপোর্ট দিয়ে যাও। কালকে ভিসা করে পাসপোর্ট তোমাকে পৌছে দেব।’
‘ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার একটা কৌতুহল হচ্ছে আহমদ মুসা।’
‘বলুন মি. প্রেসিডেন্ট।’
‘আন্দামানে নিশ্চয় বড় কোন কাজ। কাজটা কি জানতে কৌতুহল হচ্ছে, যদি তাতে তোমার কোন ক্ষতি না হয়।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘ক্ষতির কোন প্রশ্ন নেই মি. প্রেসিডেন্ট। আমি মক্কার রাবেতায়ে আলম আল-ইসলামী থেকে ই-মেইল পেয়েছি। ই-মেইলে আন্দামান নিকোবর দ্বীপে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির বিবরণ দেয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে আন্দামানের একটা দ্বীপ থেকে রাবেতার অফিস রাতারাতি ভৌতিকভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে অল্প দূরে একটা ছোট সবুজ দ্বীপ রাবেতা ভাড়া নিয়েছিল। সেখানে গড়ে তুলেছিল কাঠের তৈরি একটা অফিস কমপ্লেক্স। তার সাথে একটা মসজিদ এবং আবাসিক ইসলামী স্কুল। এমন ভাবেই উচ্ছেদ করা হয়েছে রাবেতার অফিস যে সেখানে কোনদিন কিছু ছিল তার প্রমাণ নেই। গাছগাছালি লাগিয়ে ও অনেক চারাগাছের সমাবেশ ঘটিয়ে জায়গাটাকে নার্সারিতে পরিণত করা হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সরকারী ফাইল ও রেকর্ড থেকে রাবেতা যে দ্বীপটা ভাড়া নিয়েছিল তার কাগজপত্র ও প্রমাণ সব উধাও হয়ে গেছে। রাবেতার লোকদের কিছু সংখ্যক মুখোশধারী সেই রাতেই একটা জাহাজে তুলে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে। এই ঘটনায় আন্দামানের গভর্নর জেনারেলের অফিস ও পুলিশ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে। পুলিশ তদন্ত হাতে নিয়েছিল। কিন্তু তদন্ত আগায়নি। পুলিশ ভয় পাচ্ছে এগুতে। ঘটনা এটুকুতেই থেমে নেই। সবুজ দ্বীপের ঐ ঘটনার আগে ও পরে মিলে কয়েক ডজন মুসলিম ব্যক্তিত্ব আন্দামানে মারা গেছে। আন্দামানের এ ঘটনাগুলোকে আগে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। স্বাভাবিক ও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করা হয়েছে। কিন্তু সবুজ দ্বীপের ঘটনার পর পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে এবং মুসলিম ব্যক্তিত্বদের বিচিত্রভাবে মারা যাবার ঘটনা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। অধিকাংশই ডুবে মারা যাচ্ছে। প্রচার করা হচ্ছে, এরা সবাই ‘আরাম চৌগলা’ ও ‘জরুডান্ডা’ নামক অপদেবতার রোষে পড়ে মারা যাচ্ছে। আন্দামানের প্রাচীন বিশ্বাস অনুসারে যারা হঠাৎ মাটিতে মারা যায় তারা ডাঙার অপদেবতা ‘জরুডান্ডা’ এবং যারা হঠাৎ পানিতে মারা যায় তারা পানির অপদেবতা ‘আরাম চৌগলা’ কর্তৃক নিহত হয়। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে ‘শাহজাদা আহমদ শাহ আলমগীর’ নামের অত্যন্ত জনপ্রিয় এক মুসলিম তরুণের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে। এই শাহজাদা আহমদ শাহ আলমগীরের দাদা মোগল শাহজাদা ফিরোজ শাহ ছিলেন ১৮৫৭ সালের প্রথম আজাদী সংগ্রামের একজন সংগঠক। দেশীয় রাজা ও জমিদারদেরকে বৃটিশের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ করার জন্যে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এরপর বিচারে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়ে আন্দামানে নির্বাসন করা হয়। সংগ্রামী এই মোঘল শাহজাদার নাতি হিসাবে শুধু নয়, শাহজাদা আলমগীরের যোগ্যতা ও ব্যবহারের জন্যেই সে ধর্ম মত নির্বিশেষে সকল আন্দামানবাসীর প্রিয় হয়ে উঠেছিল। দ্বীপের গভর্নর বালাজী বাজী রাও মাধবের মেয়ে সুষমা রাও-এর সাথে তার খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। উভয়ে ভারতের মেইন ল্যান্ডের দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। শাহজাদা আলমগীর নিখোঁজ হবার পর সুষমা রাওকেও জনসমক্ষে দেখা যাচ্ছে না। ভারত থেকে CBI এর লোকরা গোটা বিষয়ের তদন্তের জন্যে আন্দামানে এসে দুদিন থেকেই অজ্ঞাত কারণে ফেরত চলে গেছে। এই অবস্থায় দ্বীপের মুসলমানদের জীবনে উদ্বেগ ও আতংকের অন্ধকার নেমে এসেছে। তাদের পাশে দাঁড়াবার আজ কেউ নেই।’
দীর্ঘ এই বক্তব্য দেয়ার পর একটু থামল আহমদ মুসা। শেষ কথাগুলো বলার সময় আবেগে তার কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠেছিল। একটু থামার পর আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, ‘আমি কি করতে পারব তা আমি জানি না। কিন্তু সব দেখার জন্যে, বোঝার জন্যে এবং সম্ভব হলে কিছু করার জন্যে আমি সেখানে যেতে চাই।’
‘সত্যি আহমদ মুসা সেখানে তোমার যাওয়া উচিত। ভারতের গণতান্ত্রিক সরকার অনেক দিক দিয়েই দক্ষ, কিন্তু সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রশ্ন আসলে সরকারের আইন সেখানে অকার্যকর হয়ে পড়ে। আমার মনে হয় ভারতের শিবাজী সেনার মত রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ভয়ংকর কোন গ্রুপ সেখানে তৎপর রয়েছে। বাইরে বা ভেতর থেকে প্রতিবাদ বা প্রতিকার দাবী করে কোন লাভ হবে না। তোমার মত কেউ সেখানে যাওয়া দরকার।’
থামল প্রেসিডেন্ট। একটু ভাবল। তারপর আবার বলল, ‘একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না। আমি জানতাম ভারতের মধ্যে সবচেয়ে সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির এলাকা হলো আন্দামান। হঠাৎ সেখানে এই উৎপাত শুরু হলো কেন? আহমদ মুসা, তুমি সেখানে যাচ্ছ। দেখ, কোন প্রকার সাহায্যের দরকার হলে আমাকে বলবে। কোন মুসলিম দেশের পক্ষে সেখানে সাহায্য করা কঠিন। কিন্তু আমেরিকা পারবে। তার উপর তুমি যাচ্ছ আমাদের নাগরিক পরিচয়ে।’
‘ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট।’
‘ওয়েলকাম আহমদ মুসা। তাহলে এখনকার মত আমি উঠছি।’ বলে প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল।
প্রেসিডেন্ট হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়াল আহমদ মুসার দিকে। বলল সেই সাথে, ‘তুমি পাসপোর্টটা এখনি জর্জ জনসনকে দিয়ে দেবে। আর মনে থাকে যেন, আন্দামান থেকে ফিরে সপরিবারে আসছ আমেরিকায়।’
‘ইনশাআল্লাহ।’ বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসার হাত ছাড়ল না। হাত ধরে রেখেই কথা বলতে বলতে এগুলো ঘরের দরজার দিকে।
তার আগেই প্রেসিডেন্টের পার্সোনাল ও সিকিউরিটি ষ্টাফরা ঘরে প্রবেশ করেছে।

জেফারসন হাউজ।
আহমদ মুসা তার ঘরে ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছিল।
ঘরে ঢুকল একসাথে হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউন। দুজনেই সালাম দিল আহমদ মুসাকে। বারবারা ব্রাউনের পরনে প্যান্ট, কোর্ট কিন্তু মাথা ও গলায় রুমাল জড়ানো।
আহমদ মুসা সালাম নিয়ে ব্যাগ রেখে গিয়ে জড়িয়ে ধরল বেঞ্জামিনকে। স্বাগত জানাল বারবারা ব্রাউনকে।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল বারবারা ব্রাউনকে। কথা আটকে গেল। ঘরে প্রবেশ করল বেঞ্জামিনের আব্বা ড. হাইম হাইকেল এবং বেঞ্জামিনের দাদী ম্যাডাম হাইম। তাদের পেছনে পেছনে কামাল সুলাইমান।
আহমদ মুসা বেঞ্জামিনকে ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে গেল ম্যাডাম হাইমের দিকে। তার আগেই ড. হাইম হাইকেল ও ম্যাডাম হাইম সালাম দিয়েছে আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে অভিনন্দন জানাল ম্যাডাম হাইমকে। বলল, ‘দাদী, আপনি কষ্ট করে এসেছেন কেন? আমি তো যাবার পথে আপনার সাথে দেখা করে যাব ঠিক করেছি।’
‘তুমি তো আমার কাছে গেছ ভাই। আমি তো আসিনি। তাই সুযোগ নিলাম। আমার এটা সৌভাগ্য।’ বলল ম্যাডাম হাইম। ভারী কণ্ঠ তার।
‘দাদী এভাবে বলে না। আমি আপনার নাতীর মত।’
‘সেটা বয়সে। কিন্তু ওজনে তুমি তো হিমালয়ের মত। তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি ভাই।’
‘কেন কৃতজ্ঞতা, কিসের কৃতজ্ঞতা দাদী?’
‘তুমি আমার পরিবারকে বাঁচিয়েছ শুধু নয়, আমাদেরকে অবিশ্বাসের অন্ধকার থেকে বিশ্বাসের আলোতে নিয়ে এসেছ।’
আহমদ মুসা ম্যাডাম হাইমের দুহাত চেপে ধরে বলল, ‘দাদী কথাটা ঠিক হলো না, আলোর পথে নিয়ে আসার মালিক আল্লাহ। তার একটা দয়ার প্রকাশ এটা।’
‘ঠিক ভাই। কিন্তু তুমি না হলে তাঁকে তো আমরা পেতাম না। তুমি সোনার ছেলে ভাই।’ বলে চুমু খেল আহমদ মুসার কপালে।
আহমদ মুসাকে ছেড়ে ম্যাডাম হাইম তাকাল বারবারা ব্রাউনের দিকে। বলল, ‘ব্রাউন বোন, ওটা ভাইকে দাও।’
বারবারা ব্রাউন তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে ছোট একটা মোড়ক বের করে আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাই সাহেব, এটা নতুন অতিথি আমাদের ভাতিজার জন্যে আমাদের দাদীর পক্ষ থেকে।’
‘ধন্যবাদ’ বলে মোড়কটি নিয়ে বলল, ‘আমি খুলে দেখতে পারি তো।’
সবাই হেসে উঠল।
খুলল আহমদ মুসা মোড়কটি। মোড়ক থেকে বেরিয়ে এল একটা ক্রেষ্ট। সোনার তৈরি মিনার সিম্বলের উপর একটি সোনার অর্ধচন্দ্র। অর্ধচন্দ্রের ভেতরে তারকার আদলে সোনার তার দিয়ে লেখা ‘আহমদ আব্দুল্লাহ’ নাম।
‘চমৎকার’ উচ্ছসিত কণ্ঠে বলে উঠল আহমদ মুসা। বিস্ময়-বিমুগ্ধ আহমদ মুসা। বলল ডক্টর হাইম হাইকেলের দিকে তাকিয়ে, ‘জনাব, চমৎকার এ আইডিয়া। ইসলামের ইতিহাসের অনেক কথাকে এর মধ্যে বেঁধে ফেলা হয়েছে। ধন্যবাদ দাদী, ধন্যবাদ সকলকে।’ বলল আহমদ মুসা।
হাইম পরিবারের সকলের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ড. হাইম হাইকেল।
এ সময় কুরআন শরীফের একটা আয়াত আবৃত্তি করতে করতে ঘরে প্রবেশ করল বুমেদীন বিল্লাহ।
থেমে গেল হঠাৎ হাইম হাইকেল।
ঘরে প্রবেশ করে ড. হাইম পরিবারকে দেখে হোঁচট খাওয়ার মত থেমে গেল সে। সালাম দিল সকলের উদ্দেশ্যে। বলল, ড. হাইম হাইকেলকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার কেমন আছেন। খুব খুশি হলাম আপনাদের সবাইকে দেখে।’
‘ধন্যবাদ। আমরা ভাল। কিন্তু বিল্লাহ তোমার মুখে আগে থেকে উপছে পড়া খুশি দেখছিলাম। তার কারণ কি? আহমদ মুসার সাথে মক্কা-মদিনায় যাওয়ার সৌভাগ্য হচ্ছে সেই জন্যে?’ বলল ড. হাইম হাইকেল হাসতে হাসতে।
‘না স্যার। তার চেয়ে বড় একটা আনন্দ সংবাদ পেয়েছি।’ বুমেদীন বিল্লাহ।
‘এর চেয়েও বড় আনন্দ? কি সেটা?’ জিজ্ঞাসা ড. হাইম হাইকেলের।
ড. হাইকেলের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘তুমি তো সৌদি রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করে আসছ না? ঐ ব্যাপারেই বোধ হয় তিনি কিছু জানিয়েছেন?’
হাসল বুমেদীন বিল্লাহ। বলল, ‘হ্যাঁ ভাইয়া, আমি কনসোলার অফিস থেকে আসছি। সৌদি রাষ্ট্রদূত আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। আপনার চিঠি তাকে দিতেই হয়নি। তার আগেই তিনি বললেন, আহমদ মুসার জন্যে সুখবর আছে। তিনি যে প্রস্তাব করেছিলেন, সৌদি সরকার আনন্দের সাথে সবটাই গ্রহণ করেছেন।’
বলে হাসল বুমেদীন বিল্লাহ। তারপর পকেট থেকে একটা চিঠি বের করল। বলল, ‘এ দাওয়াতপত্র ড. হাইম হাইকেলের পরিবারের জন্যে। অন্যদের দাওয়াত পৌছে যাচ্ছে বা পৌছে গেছে।’
‘বলতো অন্যদের মধ্যে কারা আছেন? দেখি সবাই তার মধ্যে আছেন কিনা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ইউরোপ থেকে স্পুটনিকের ছয় গোয়েন্দা এবং তাদের সব পরিবারকেই দাওয়াত করা হয়েছে। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের গনজালো, পলা জোনস ও সোফিয়া সুসান পরিবার, টার্কস দ্বীপের লায়লা জেনিফারের পরিবার, বাহামা’র শিলা সুসানের পরিবার, সান ওয়াকার-মেরী রোজদের পরিবার, নিউইয়র্কের ড. আয়াজ ইয়াহুদের পরিবার, প্রফেসর আরাপাহোর পরিবার, মরিস মরগ্যানের পরিবার, ড. হাইম হাইকেলের পরিবার, ভার্জিনিয়ার জেফারসন পরিবার এবং জর্জ আব্রাহাম জনসনসহ প্রস্তাবিত সব লোক সৌদি আরব সফর ও ওমরার দাওয়াত পেয়েছেন। আর আমি ও জনাব সুলাইমান ও তার পরিবার তো আপনার সাথে আজ মদিনায় যাচ্ছি। বুমেদীন বিল্লাহ কথা শেষ করল।
‘এবং এদের সফর ও ওমরার দাওয়াত তো এ মাসেই? এটাই আমি বলেছিলাম।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ ভাইয়া।’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
‘আল-হামদুলিল্লাহ। আমি ওদিকে ফিলিস্তিন, মধ্যএশিয়া, সিংকিয়াং, মিন্দানাও, ইত্যাদি থেকেও বন্ধুদের দাওয়াত করেছি এ সময় সৌদি আরব সফর ও ওমরায় আসার জন্যে। বিরাট একটা সম্মেলন হবে। এটাই হবে নতুন অতিথি আহমদ আবদুল্লাহর আকিকা উৎসব।’
চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ঘরে উপস্থিত ড. হাইম হাইকেল, সুলাইমান ও বুমেদীন বিল্লাহ সকলের। বলল ড. হাইম হাইকেল বুমেদীন বিল্লাহকে লক্ষ্য করে, ‘আমার তর সইছে না। আমার সৌভাগ্যের দাওয়াতপত্রটা দাও দেখি।’
বুমেদীন বিল্লাহ হেসে তার হাতে দিল চিঠিটা।
পড়ল সে চিঠিটা।
পড়তে পড়তে তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। তার চোখের দু’কোণায় অশ্রু এসে জমল। চিঠিতে একটা চুমু খেয়ে চিঠি বন্ধ করে স্বগত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আল্লাহর রসূলের কবর জিয়ারত করার এবং কাবা তাওয়াফের সুযোগ হবে এত তাড়াতাড়ি, আল্লাহ এর ব্যবস্থা এত তাড়াতাড়ি করে দেবেন, স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি! ধন্যবাদ সৌদি সরকারকে। ধন্যবাদ আহমদ মুসা তোমাকে।’ কান্না ও আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল ড. হাইম হাইকেলের কথা।
টেলিফোন বেজে উঠল আহমদ মুসার।
ড. হাইম হাইকেল চোখ মুছে বিল্লাহ ও সুলাইমানকে লক্ষ্য করে বলল, ‘চল আমরা বাইরে গিয়ে বসি। উনি টেলিফোন সেরে নিন।’
বলে ড. হাইম হাইকেল বাইরে বেরুবার জন্যে হাঁটা শুরু করল।
তার সাথে সুলাইমান, বুমেদীন বিল্লাহ, হাইম বেঞ্জামিন, ম্যাডাম হাইম ও বারবারা ব্রাউন সকলে।
মোবাইলটা মুখের সামনে তুলতেই দেখল কলটা এসেছে মিসেস জর্জ জনসনের কাছ থেকে। খুশি হয়ে আহমদ মুসা মোবাইল মুখের কাছে নিয়ে সালাম দিল। বলল, ‘আম্মা, কেমন আছেন?’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম, বেটা। আমরা সকলে ভাল আছি। তোমার আংকেল এবং আমাদের পরিবারের সকলের তরফ থেকে শুকরিয়া জানানোর জন্যে এই টেলিফোন করছি। আমরা সৌদি সরকারের কাছ থেকে সৌদি আবর সফর ও ওমরার দাওয়াত পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছি। কিন্তু বেটা, সেদিন তোমার সাথে কত কথা হলো, কিন্তু তুমি এত বড় খবর সম্পর্কে তো কোন ইংগিত দাওনি!’
‘আম্মা, দাওয়াত সৌদি সরকারের তরফ থেকে। সেজন্যে আমি আগাম কিছু বলতে চাইনি। আম্মা, এখন জানিয়ে দিচ্ছি আরো একটা খবর, আমি মদিনায় ফেরার পর আমাদের তরফ থেকেও একটা দাওয়াত আপনাদের কাছে আসবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিসের দাওয়াত বেটা?’
‘আপনার নাতি আহমদ আবদুল্লাহর আকিকা অনুষ্ঠান হবে। সেখানে আমি গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমার বন্ধু-বান্ধব ও গুরুজনদের আমন্ত্রণ জানাব। সেখানে আপনারা অবশ্যই থাকবেন।’
‘ও বেটা! ধন্যবাদ। সেটা তো হবে এক মহাব্যাপার! আর সেটা আমাদের জন্যে সৌভাগ্যের। তোমার দাওয়াত আসার আগেই গ্রহণ করলাম।’
বলে একটু থামল মিসেস জনসন। তারপর বলল, ‘বেটা, তোমার আংকেল ওমরার প্রস্তুতির ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন। কোন অভিজ্ঞতা তো এ ব্যাপারে আমাদের কারো নেই।’
‘কোন চিন্তা নেই আম্মা। আপনারা প্রথমে মদিনা যাচ্ছেন। সুতরাং এ ব্যাপারে আগাম কোন চিন্তার প্রয়োজন নেই। আমি সব ব্যবস্থা মদিনায় করে রাখব। মদিনা থেকে মক্কায় যাবেন ওমরা করতে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ বেটা। তুমি বেরুচ্ছ কখন?’
‘এই তো কাপড় গোছ-গাছ করছি। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরুবো।’
‘তোমাকে তাহলে আর আটকাব না। তোমার সফরকে আল্লাহ সুন্দর ও নিরাপদ করুন। আমি রাখছি। আস্সালাম। বাই।’
‘ওয়াস্সালাম। দেখা হবে মদিনায়। বাই আম্মা।’
আহমদ মুসা কলটি অফ করে দিয়েই টেলিফোন করলো কামাল সুলাইমানকে। বলল, ‘শোন সুলাইমান, আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান ও আজোরস-এর যারা সৌদি আরব সফর ও ওমরার দাওয়াত পেয়েছে, তাদের সকলকে টেলিফোন করে আমার সালাম দাও। দাওয়াতের চিঠি পেয়েছে কিনা দেখ। তারপর ওদের জানাও, তাদের প্রথমে মদিনায় নেয়া হবে। সেখান থেকে তাঁরা ওমরা করতে মক্কায় যাবেন। তাদের কোন চিন্তা করতে হবে না। ওমরার সব প্রস্তুতি মদিনায় থাকবে। ঠিক আছে, বলে দাও এখনি। বিল্লাহর কাছে টেলিফোন নাম্বার আছে। তাকেও বল কিছু টেলিফোন করতে।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করে মোবাইল রাখতে যাচ্ছিল। আবার বেজে উঠল টেলিফোন। মোবাইলটি সামনে এনে দেখল সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসনের টেলিফোন। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা, মিসেস জিনা জেফারসন তার এই গোপন টেলিফোন নাম্বার পেলেন কিভাবে!’
দ্রুত টেলিফোনটা মুখের কাছে তুলল আহমদ মুসা। বলল, ‘আস্সালামু আলাইকুম। খালাম্মা, কেমন আছেন আপনি? সব ভাল তো?’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। আমি ভাল আছি, মাই সান। কতদিন পর তোমার ডাক শুনলাম বলত? খালাম্মার উপর রাগ করেছ বুঝি! মায়েরা সব সময় সন্তানদের ভাল চায় বেটা।’
‘জানি খালাম্মা। আমি দুঃখিত, এবার এসে খুব ব্যস্ত অবস্থায় আছি। কিন্তু সব সময় আপনাকে মনে করি খালাম্মা।’
‘জানি বাছা। তোমাকে অনেক দিন দেখি না। কিন্তু মনে হয় তুমি আমার চোখের সামনেই আছ। অন্তরে তোমার স্পর্শ পাই। তোমার মত ছেলে চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল হবার মত নয়।’
‘এমন ¯েœহ পাওয়া সৌভাগ্যের খালাম্মা।’
বলে আহমদ মুসা একটু থেমে আবার বলে উঠল, ‘খালাম্মা, আপনি কি সৌদি সরকারের একটা দাওয়াত পেয়েছেন সৌদি আরব সফর ও ওমরা করার জন্যে?’
‘হ্যাঁ বেটা। এ জন্যেই তো তোমাকে টেলিফোন করেছি। সারা আমাকে তোমার সাথে আলোচনা করতে বলেছে। আমি দাওয়াত পত্রটা পাওয়ার পরেই সারাকে টেলিফোন করেছিলাম। সারা কি একটা সর্ট কোর্স করছে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে যেতে পারবে না।’
‘সে ভাল আছে খালাম্মা?’
‘সে সব অবস্থায় বলে, ভাল আছি। নিজের অসুবিধার কথা সে কোন সময়ই জানায় না। এই অভ্যেস তার এখন আরও বেড়েছে। তাই তাকে নিয়ে আমার খুব ভয় বেটা।’
‘ভাববেন না খালাম্মা। আল্লাহ সাহায্য করবেন।’ বলে একটু থামল তারপর আবার বলল, ‘আপনি আসুন খালাম্মা। শুধু সৌদি সরকার নয় আমরা খুশি হবো আপনাকে পেলে। আমি মদিনায় ফিরে আপনাকে চিঠি লিখব। তাতে আমি আপনার সফরের সব ব্যবস্থার কথা জানাব।’
‘ধন্যবাদ বেটা। আমি কি ওখান থেকে পরে সারার কাছে যেতে পারব? আরও তো প্রায় আড়াই মাস সে তুরষ্কে থাকছে। আমি ওদিক হয়ে তাকে দেখে আসতে চাই।’ বলল জিনা জেফারসন, সারা জেফারসনের মা।
‘কোন অসুবিধা হবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। তাছাড়া মদিনায় আমাদের অনুষ্ঠানে তুরষ্ক থেকেও আমার বন্ধু-মুরুব্বীরা আসবেন।’
‘তাহলে খুবই ভাল হবে বাছা। ঠিক আছে, রাখি। তুমি ভাল থাক বেটা। আসসালামু আলাইকুম। বাই।’
সালাম নিয়ে আহমদ মুসা ফোন রেখে দিল।
আহমদ মুসা মোবাইল রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দৌড়ে কামাল সুলাইমান প্রবেশ করল আহমদ মুসার ঘরে। তার হাতে মোবাইল। বলল সে দ্রুত কণ্ঠে, ‘ভাইয়া টেলিফোন নিন, ভাবী লাইনে আছে।’
বলে আহমদ মুসার হাতে তার মোবাইলটি তুলে দিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল দরজাটা বন্ধ করে।
টেলিফোন মুখের কাছে তুলে নিয়েই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছ জোসেফাইন?’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। ভাল আছি। তুমি?’
‘খুব ভাল।’
‘ভাল’র আগে ‘খুব’ লাগালে কেন?’
‘দেখ, এশিয়ানরা সাধারণত ঘরমুখো। সুতরাং ঘরে ফেরার সময় তারা বাড়তি আনন্দে থাকে।’
‘তুমি বলতে চাচ্ছ নন-এশিয়ানরা বাহির-মুখো। না?’
‘স্যরি, কথা তুলে নিচ্ছি। তুমি যে ইউরোপীয়ান ভুলে গিয়েছিলাম। তবে……………।’
‘আর কথা নয়। বল, টেলিফোন কি এতক্ষণ কেউ এনগেজ রাখে? আমি কখন থেকে চেষ্টা করছি।’
‘স্যরি। আমি কাপড়-চোপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরছিলাম। এই সময় কয়েকটা টেলিফোন এল। কথাটা একটু দীর্ঘ হয়ে গেছে।’
‘সবে ব্যাগেজ গোছাতে শুরু করেছ? ও! না! তুমি তো ওখানে নয় ঘণ্টা পেছনে। আর কতক্ষণে তুমি যাত্রা করছ?’
‘এই ধরো দশ মিনিট। ওরা সবাই লাগেজ নিয়ে নিচে নেমে গেছে। আমি হাত ব্যাগটা গুছাচ্ছি। আমিও এখনি বেরুব।’
‘জান, তুমি আসার এখন আয়োজন করছ এটা ভেবেই আমার পালস বীট আজ সকাল থেকে বেড়ে গেছে। তুমি আসলে কি হবে তাই ভাবছি।’
‘দেখ, তোমার শরীর দূর্বল। তুমি বেশি টেনশন করো না। ক্ষতি হবে।’
‘তুমি বোকা। এটা টেনশন নয়। এ অস্থিরতা আনন্দের, আনন্দের হৃদ-কম্পন এটা। এতে ক্ষতি হয় না, শক্তি ও সুস্থতা আরও বাড়ে।’
‘তাহলে ঠিক আছে। ধন্যবাদ। তোমার পালস বীট আরও বাড়………….’ কথা শেষ করতে পারল না আহমদ মুসা।
তাকে বাধা দিয়ে ডোনা জোসেফাইন বলে উঠল, ‘বাজে কথা আর বাড়িয়ো না। তোমার সময় কম। শোন, তোমাকে দুটো অনুরোধ করব বলে এ টেলিফোন করেছি।’
‘বল।’
‘বলছি। তার আগে শোন, আজ সকালে আমি আহমদ আবদুল্লাহকে নিয়ে মেইলিগুলো আপার কবরে গিয়েছিলাম। আহমদের কচি হাতে একটা ফুল ধরিয়ে ওঁর কবরে রেখে এসেছি। আমি আহমদকে বলেছি, এ তোমার বড় মায়ের কবর। যে মা তোমার জন্মের আগেই তোমাকে ভালবেসেছেন, অজ¯্র টাকার একটা গিফট তোমার জন্যে ব্যাংকে রেখে গেছেন। মনে হয় আমার কথা সে বুঝেছে। হেসে হাত-পা নেড়ে আনন্দ প্রকাশ করেছে সে।’ বলল ডোনা জোসেফাইন।
‘ভাল করেছো জোসেফাইন। ধন্যবাদ। ওঁর আত্মা খুশি হবে। একটি স্বপ্ন পূরণ করেছ তুমি তাঁর।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, ‘নির্দেশটা এবার বল।’
‘নির্দেশ নয়, অনুরোধ।’
‘ঠিক আছে বল।’
দুটি অনুরোধ। একটি হলো, ‘তুমি আন্দামান যাওয়ার আগে আমরা দু’জনে সুইজারল্যান্ডে তাতিয়ানার কবর জেয়ারতে যাব। খুব ইচ্ছা হচ্ছে, তাতিয়ানার বোন রুশ সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরীনকে আমাদের অনুষ্ঠানে দাওয়াত করার। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। আমার দ্বিতীয় অনুরোধ হলো, ‘তুমি সারা জেফারসনকে অনুরোধ করবে আমাদের অনুষ্ঠানে আসার জন্যে। আমি তাকে টেলিফোন করেছিলাম। সে বলেছে, তার একটা শর্ট কোর্স চলছে। কিছুতেই তার পক্ষে সময় বের করা সম্ভব হবে না। তুমি যদি তাকে অনুরোধ কর, তাহলে আমাদের দুজনের অনুরোধ সে ফেলতে পারবে না।’
‘তোমাকে আবারও ধন্যবাদ জোসেফাইন। তাতিয়ানার কবর জেয়ারতে এ সময় আমাদের যাওয়া উচিত। তুমি স্মরণ করিয়ে ভাল করেছ। আমরা যাব। আর রুশ সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরীনকে আমরা দাওয়াত করতেই পারি। তিনি আসতে পারবেন না সেটা ভিন্ন কথা। অন্তত এ অনুষ্ঠান সম্পর্কে তাঁর জানার অধিকারটা তো পূরণ হবে! তোমার দ্বিতীয় অনুরোধ আমি রাখতে পারছি না জোসেফাইন। সারাকে তার মত করে চলতে দেয়ার মধ্যেই তার কল্যাণ আছে। কোন কিছুতেই আমাদের তাকে বাধ্য করা ঠিক নয়। সে অত্যন্ত সচেতন ও বুদ্ধিমান। সে নিজের জন্যে যেটাকে ঠিক মনে করেছে, তার বাইরে তাকে টানাকে আমি উচিত মনে করছি না।’
‘তোমার কথার মধ্যে যুক্তি আছে। হয় তো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তোমার এ কথা ঠিক নয় যে, সারা জেফারসন যা করছে এটাই তার জন্যে ঠিক। আমি এটা মেনে নেব না।’
‘জোসেফাইন, তুমি যেটা বলছ, সেটাও একটা দিক। কিন্তু অলটারনেটিভগুলোর মধ্যে যেটা স্বাভাবিক সেটাই গ্রহণ করতে হবে।’
‘আমি আগেই বলেছি যে, হয়তো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার দ্বিমত আছে। তবে এ নিয়ে আমি কথা বাড়াতে চাই না। তোমাকে কি এটুকু অনুরোধ করতে পারি যে, তুমি শুধু একবার তাকে বল, তুমি ও আমি তাকে ওয়েলকাম করছি আমাদের এ অনুষ্ঠানে। তাহলেও আমি মনে একটু শান্তি পাব। তা না হলে সবাই আসবে, আর একা সারাই বাইরে থাকবে, এটা আমি সহ্য করতে পারবো না।’ বলতে গিয়ে জোসেফাইনের শেষ কথাগুলো আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা সংগে সংগেই জবাব দিল না। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘জোসেফাইন, তোমার কষ্ট তো আমাকেও কষ্ট দেবে। ঠিক আছে তুমি যেভাবে যা বলতে বলেছ আমি তা সারাকে বলব। খুশি?’
‘খুশি। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। এস তুমি। রাখি এখন?’
‘ঠিক আছে জোসেফাইন। ভাল থেক। আল্লাহ হাফেজ। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম’ বলে ওপার থেকে জোসফোইন টেলিফোন রেখে দিল।
আহমদ মুসা কল অফ করে দিয়ে মোবাইল রেখে আবার ব্যাগ গুছিয়ে নেয়ায় মনোযোগ দিল।

আহমদ মুসারা গ্যাংওয়ের দিকে এগুচ্ছিল।
তার সাথে হাঁটছে কামাল সুলাইমান, মিসেস সুলাইমান, বুমেদীন বিল্লাহ ছাড়াও তাদেরকে ‘সি অফ’ করতে আসা ড. ইয়াহুদ, ম্যাডাম ইয়াহুদ, নুমা ইয়াহুদ, নিউইয়র্কের মুসলিম কম্যুনিটির নেতৃবৃন্দ এবং নিউইয়র্কের এফ.বি.আই চীফ ও নিউইয়র্ক ষ্টেটের প্রধান প্রটোকল অফিসার।
গ্যাংওয়েতে ঢোকার আগে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে সবার সাথে বিদায়ী হ্যান্ডশেক করল।
একপাশে দাঁড়িয়ে নুমা ইয়াহুদ ও বুমেদীন বিল্লাহ একান্তে আলাপ করছিল। আহমদ মুসার হ্যান্ডশেক শেষ হতেই নুমা ইয়াহুদ ও বুমেদীন বিল্লাহ একসাথে এগিয়ে এল আহমদ মুসার কাছে।
আহমদ মুসা একটু হেসে বলল, ‘কি দুজনের তরফ থেকে কোন সুখবর আছে?’
নুমা ইয়াহুদের মুখ লাল হয়ে উঠল লজ্জায়। আহমদ মুসাকে সালাম দিয়ে আহমদ মুসার হাতে একটা ছোট্ট ইনভেলাপ তুলে দিয়ে ছুটে পালাল।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটা শুরু করল। তার সাথে কামাল সুলাইমানরা।
এফ.বি.আই অফিসার আহমদ মুসার পিছনে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘স্যার, আমার উপর হুকুম প্লেনে উঠা পর্যন্ত আপনার সাথে থাকার এবং প্লেন ‘টেক অফ’ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করার।
‘ধন্যবাদ জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
প্লেনে উঠল আহমদ মুসা। সৌদি আরবের আল-মদিনা এয়ার লাইন্সের বিশেষ ফ্লাইট এটা। বিমানটি নন-ষ্টপ উড়ে একেবারে গিয়ে ল্যান্ড করবে মদিনা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে।
প্লেনের দরজায় আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে জড়িয়ে ধরল ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন। তার ক্রুরা সহাস্যে পরমাত্মীয়ের মত স্বাগত জানাল আহমদ মুসাকে। ক্যাপ্টেন বলল, ‘আমাদের সৌভাগ্য, এই ফ্লাইটের সৌভাগ্য যে, আপনার মত এক মহান ভাইকে আতিথ্য দেবার ভাগ্য আমাদের হয়েছে।’
সবাইকে মোবারকবাদ দিয়ে আহমদ মুসা বসল গিয়ে তার সিটে।
প্লেন উড়তে শুরু করলে আহমদ মুসা নুমা ইয়াহুদের দেয়া চিঠি বের করল। ইনভেলাপ থেকে একটা ছোট্ট ই-মেইল বের হলো। দেখল, ই-মেইলটি সারা জেফারসনের। পড়ল:
‘আসসালামু আলাইকুম। টেলিফোনে তাৎক্ষণিকভাবে উত্তরটা দিতে পারিনি বলে দুঃখিত। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, শর্ট কোর্সটিতে কয়েক দিনের ব্রেক হলে কোর্সটাই অর্থহীন হয়ে যাবে। তাই আপনাদের আমন্ত্রণে ‘না’ বলারই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দূরে থাকলেও আমাদের নতুন ‘সোনামণি’র জন্যে থাকবে আমার এক বুক ভালবাসা ও দোয়া। ওয়াস্সালাম। -সারা।’
ই-মেইল পড়া শেষ করে আহমদ মুসা তা আবার ইনভেলাপে পুরে ইনভেলাপটি পকেটে রাখল। মনে মনে বলল, ‘ই-মেইলটি জোসেফাইনের পড়া দরকার। কারণ তার অনুরোধেই সে সারাকে টেলিফোন করেছিল।’
আরও কিছু চিন্তা ও আরও কিছু কথা চারদিক থেকে ছুটে আসছিল মাথায়। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি মাথাটা সিটে এলিয়ে দিয়ে মাথাটাকে শূন্য করার উদ্যোগ নিল। বুজল সে তার চোখ।
অন্য সবাইও নীরব।
নীরবতা নেমেছে প্লেনের প্রথম শ্রেণীর এ কক্ষটিতে।
প্লেনের বাতাস কেটে সাঁতরে চলার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ কোথাও নেই।
ছুটে চলছে প্লেন মদিনার উদ্দেশ্যে।