২৬. ক্যারিবিয়ানের দ্বীপদেশে

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি সাগরে যাবার সময় ঘাটে যাদের দেখেছিলে, ফিরে এসেও আবার তাদেরই দেখলে?’
‘জ্বি হ্যাঁ।’ বলল আলী ওরমা।
আলী ওরমা ওকারী গ্রামের জেলে।
আহমদ মুসা তাকে নিয়োগ করেছিল দক্ষিণের মৎস্য ঘাটের উপর নজর রাখার জন্যে।
‘তুমি কটায় নৌকা নিয়ে সাগরে নেমেছিলে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘তিনটায়।’
‘তখন ঐ দু’জনকে কি অবস্থায় দেখেছিলে?’
‘ওরা জেটিতে একটা নৌকায় বসে শশা চিবুচ্ছিল।’
‘নৌকাটা কার?’
‘আমার।’
‘তোমার নৌকায় ওরা বসেছিল?’
‘জ্বি হ্যাঁ।’
‘তারপর?’
‘আমি যখন নৌকার কাছে গেলাম। ওরা যখন বুঝল নৌকা আমার, তখন ওরা নেমে এল। বলল, সাগরে নামবেন বুঝি? ঠিক আছে। আমরা এখানে বসে একটা বোটের অপেক্ষা করছিলাম। আপনাদের বাড়ি কোথায়? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেন, নরফোকে। বলে ওদের একজন।’
নরফোক টার্কো দ্বীপের মধ্যাঞ্চলের একটি গ্রাম। উত্তর প্রান্তের টার্কো বন্দর থেকে যে সড়কটি দক্ষিণে চলে এসেছে, গ্রামটি তার পাশেই।
গ্রামটি চেনে আলী ওরমা। গ্রামের সবাই কৃষ্ণাংগ। গ্রামের অধিকাংশ লোক আফ্রিকী ধরনের স্থানীয় ধর্মের অনুসারী। অবশিষ্টদের কিছু খৃষ্টান, কিছু মুসলমান। গ্রামে শ্বেতাংগ খৃষ্টান মিশনারীরা একটি গীর্জা ও একটি ক্লিনিক তৈরি করছে।
‘ঘাটে আসা লোক দু’টি কৃষ্ণাংগ। কার বোট? কে আসবে? আমি ওদের জিজ্ঞেস করি। মাছ আসবে। আমাদের একটা আয়োজন আছে। জবাব দেয় ওদের একজন।’
‘তারপর?’ জিজ্ঞেস করল আলী ওরমাকে আহমদ মুসা।
‘আমি নৌকা নিয়ে চলে যাই সাগরে। একটু আড়ালে গিয়ে আমি নজর রাখি কোন নৌকা বা বোট ঘাটের দিকে যায় কিনা। কিন্তু সন্ধ্যার আগে আমি ফেরা পর্যন্ত কোন বোট ঘাটের দিকে আসেনি।’ থামল আলী।
‘বলে যাও।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি ঘাটে ফিরে দেখলাম লোক দু’টি নেই। ভাবলাম অপেক্ষা করে চলে গেছে। ঘাটের আশপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে চিন্তা করলাম নিকটের কোন গ্রামে মাগরিবের নামায আদায় করে আবার চলে আসব। এই উদ্দেশ্যে ঘাট থেকে উঠে অল্প কিছু দূর আসতেই দেখলাম, নরফোক গ্রামের ঐ দু’জন ঘাটের দিকে আসছে। অবাক হলাম তারা আমাকে দেখে যেন চমকে উঠল। কিছুটা বিব্রত কণ্ঠে কৈফিয়তের সুরে বলল, এদিকটা একটু ঘুরে এলাম। দেখি বোটটা এসেছে কিনা। আমি কিছু বললাম না। ওরা চলে গেল। তবে আমি একটা গাছের আড়ালে এসে একটু দাঁড়ালাম। দেখলাম, আড়াল হবার পর ওরা আর এগুলো না। রাস্তার পাশেই একটু উঁচু টিলা ছিল। তারা ওখানে উঠে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হলো। আমি আর অপেক্ষা না করে চলে এসেছি।’
আলী থামলেও আহমদ মুসা কোন কথা বলল না।
ভাবছিল আহমদ মুসা।
বলল একটু পর, ‘এ ধরনের ঘটনা আর তো ঘটেনি?’
‘জ্বি তাই।’ বলল আলী।
‘মাছের নৌকার জন্যে এত দূর আসবে, এইভাবে অপেক্ষা করবে এটাও বাস্তব নয়।’
‘জ্বি।’
‘ওদের আচরণ ও কথার মধ্যে সঙ্গতি নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমারও তাই মনে হয়েছে স্যার।’
আবার ভাবনায় ডুবে গেল আহমদ মুসা।
অল্প পরে মুখ তুলে জর্জের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চল, আমরা ক’জন সেখানে যাই। লোক দু’জন যদি এখনও থাকে, তাহলে ওদের ধরলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
মিটিং মুলতুবি করে উঠল সবাই।
জর্জ, ইসহাক আব্দুল্লাহ ও আবু বকরকে নিয়ে আহমদ মুসা এগুলো ঘাটের দিকে। পায়ে হেঁটে। সাথে থাকল আলী।
কিন্তু সেই উঁচু টিলায়, যেখানে আলী নরফোকের দু’জন লোককে দেখে গিয়েছিল, কাউকে পাওয়া গেল না।
অন্ধকারে চুপি চুপি তারা ঘাট পর্যন্ত গেল, এদিক ওদিক খুঁজল। কিন্তু কাউকে পেল না। ফিরল তারা।
সেই টিলা পার হয়ে কিছুটা পথ এসে আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। সবাউ দাঁড়াল আহমদ মুসাকে ঘিরে।
আহমদ মুসা কাছে টেনে নিল আলীকে। ফিসফিস করে তাকে বলল, ‘তোমাকে এখানে থেকে যেতে হবে। তুমি এখানে যে কোন স্থানে আত্মগোপন করে থেকে চারদিকে নজর রাখবে। সেই দু’জন কিংবা অন্য কাউকে পাও কিনা, সেটা খোঁজ করতে হবে। রাস্তা নয়, রাস্তার বাইরে দুর থেকে সব দিকে নজর রাখবে।’
বলে পকেট থেকে একটা গগলস বের করে আলীর হাতে দিল। বলল, ‘এটা বিশেষ ধরনের গগলস। এ দিয়ে অন্ধকারেও বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। সত্যিই তুমি যদি কাউকে দেখতে পাও, তাহলে তার পিছে পিছে থাকবে, চোখের বাইরে যেতে দেবে না। রাত দশটা পর্যন্ত তুমি যদি মসজিদে না ফের, তাহলে বুঝা যাবে তুমি কারো সন্ধান পেয়েছ। রাত সাড়ে দশটার দিকে আবু বকর সবাইকে খবর দিয়ে তোমার সন্ধানে আসবে। প্রশ্ন হলো তোমাকে তারা পাবে কি করে?
আহমদ মুসা একটু থেমে বলল, ‘রাত সাড়ে দশটায় আবু বকর এই গাছ তলায় গাছের আড়ালে বসবে, তোমাকেও গোপনে এখানে আসতে হবে।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসারা চলে না যাওয়া পর্যন্ত আলীকে গাছ তলার অন্ধকারে অপেক্ষা করতে বলে সবাই হাঁটা শুরু করল।
আহমদমুসাকে বাম, ডান ও পেছন থেকে বেষ্টন করে অগ্রসল হচ্ছিল অন্যরা।
পাশে হাঁটতে হাঁটতে জর্জ বলল, ‘আলীকে রেখে যাওয়ার কি দরকার ছিল?’
‘হ্যাঁ জর্জ, একবার সন্দেহের সৃষ্টি হলে তার শেষ পর্যন্ত দেখা উচিত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কাউকেই তো পাওয়া গেল না।’
‘হতে পারে ঘটনা কিছুই না। সত্যিই হয়তো মাছের নৌকার জন্যে অপেক্ষা করে তারা চলে গেছে। কিন্তু এমনও হতে পারে, তারা যায়নি। আমরা তাদের দেখতে পাইনি।’
‘কি হতে পারে ব্যাপারটা তাহলে?’ বলল জর্জ।
‘বলা মুষ্কিল। তবে এই ছোট্ট ঘাটটা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুনছো তো, অপরিচিত লোকজন গত সপ্তাহ দেড়-দুই ধরে সাউথ টার্কো দ্বীপে, বিশেষ করে এই অঞ্চলে বেশ দেখা গেছে। হতে পারে শত্রুর কেউ ওরা। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, ঐ ৩০ জন মানুষের কিভাবে কি হলো এবং কারা ঘটাল এই ঘটনা ইত্যাদি জানতে চায় তারা। এই মাছের ঘাটকে শত্রুরা আগেও ব্যবহার করেছে, আবারও করতে পারে।’
বলে আহমদ মুসা ইসহাক আব্দুল্লাহর দিকে তাকাল। বলল, আমি ও জর্জ এখন সিডি কাকেম যাচ্ছি। আবু বকর এখানে থাকল। তোমরা সাবধান থাকবে। রাত দশটার দিকে তোমরা একত্রিত হবে মসজিদ চত্বরে। তারপর আবু বকর এগুবে আলীর খোঁজে। তোমরা পেছনে থাকবে গোপনে।’
‘আমরা কতজন একত্র হবো?’ বলল ইসহাক আব্দুল্লাহ।
‘রাত দশটার মধ্যে যদি আলীর খবর না পাও, তাহলে সব শক্তি একত্র করবে। আমাকেও জানাবে টেলিফোনে।’
মসজিদ চত্বরে তখন পৌছে গেছে তারা। ওখানে একটা অটো হুইলার অপেক্ষা করছিল। সেই অটো হুইলারে উঠল আহমদ মুসা ও জর্জ। অটো হুইলার চলতে শুরু করল সিডি কাকেম গ্রামের উদ্দেশ্যে।
গাড়ি চলতে শুরু করলে আহমদ মুসার হঠাৎ যেন মনে হতে লাগল, কি কাজ যেন অসম্পূর্ণ থাকল। তার মনে হলো, আলীর সাথে দেখা হবার পর আবু বকর ও ইসহাক আব্দুল্লাহরা কি করবে সে বিষয়ে তো কিছু বলা হয়নি।
পরক্ষণেই আবার তার মনে হলো, কিছু বলারও তো ছিল না। তারপর আহমদ মুসা মনের এলোমেলো চিন্তা বিদায় করে সামনের আলো অন্ধকারে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।
চলছে অটো হুইলার।

লায়লা জেনিফার সবার হাতে চায়ের পেয়ালা তুলে দিয়ে নিজের পেয়ালা নিয়ে সোফায় তার আসনে এসে বসেছিল।
গল্প চলছিল।
সুরাইয়া মাকোনি এবং সারা উইলিয়ামও আজই এসেছে জেনিফারদের বাড়িতে। মার্গারেট এসে পৌছেছে রাত আটটার দিকে। সারা উইলিয়াম ও সুরাইয়া মাকোনি এসেছে তার এক ঘণ্টা আগে। সুরাইয়া মাকোনী চায়ের পিয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে বলল, ‘আমি ভাবতে পারছি না জেনিফার, সেই এশিয়ানটা পরিস্থিতি এমন ওলাট-পালট করে দিল কি করে? আমি তো ভেবেছিলাম, সে ওদের হাতে মারা পড়েছে।’
‘না, মাকোনি। মারা যাওয়ার কথা অমন করে মুখে এনো না।’ বলল জেনিফার ত্বড়িৎ গতিতে।
বলে একটা দম নিয়ে জেনিফার বলল, ‘আল্লাহ ওঁকে বাঁচিয়েছেন। আর বাঁচাবার জন্যে কাজ করেছেন জর্জ এবং মার্গারেট আপা। জর্জ তাঁকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়েছিল।’
লায়লা জেনিফারের কথা শেষ হতেই সারা উইলিয়াম বলল, ‘কিরে জেনিফার। এশীয় সম্পর্কে ‘মরার’ কথা শুনে অমন আঁৎকে উঠলি কেন? হৃদয় ঘটিত কোন ঘটনা সংঘটিত হয়েছে নাকি?’
এ কথার পর সারা উইলিয়াম ও সুরাইয়া মাকোনি দু’জনেই হেসে উঠল। ডাঃ মার্গারেটের মুখ একটু ম্লান হলো। আর গম্ভীর হয়ে উঠল লায়লা জেনিফারের মুখ।
কথা বলে উঠল লায়লা জেনিফার। বলল, ‘সারা তুমি ওঁকে দেখনি, ওঁকে জাননা, তাই এ কথা বলতে পারলে।’ গম্ভীর কণ্ঠ জেনিফারের।
ডাঃ মার্গারেট তাকাল জেনিফারের দিকে। তার চোখে একটা সন্ধানী দৃষ্টি। পরে ধীরে ধীরে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আমি জেনিফারের সাথে একমত। তিনি ভিন্ন এক মানুষ। যতই তাঁকে দেখা যায় আনন্দ ও বিস্ময় শুধু বাড়েই।’
‘ঠিক বলেছেন ডাঃ মার্গারেট আপা। তিনি মাত্র অল্পক্ষণ আমার সামনে কথা বলেছেন। আমার মনে হয়েছিল, আমি নতুন এক পরিবেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির মানুষের সাথে কথা বলছি। আমি যেন সাম্মোহিত হয়ে পড়েছিলাম। উনি উঠে গেলে আমি যেন বাধ্য হয়েছিলাম ওঁর সন্ধানে উঠে যেতে।’
বাইরের দরজায় নক হলো এ সময়।
‘উনি এসেছেন।’ বলে উৎকর্ণ হলো জেনিফার।
সংগে সংগে সবাই সচকিত হয়ে উঠল।
বলল সারাহ উইলিয়াম, ‘তুমি বুঝলে কি করে, জেনিফার? ওঁর গন্ধও চিনে ফেলেছ নাকি?’ হাসল সারা উইলিয়াম।
‘বলেছি, এভাবে কথা বলো না সারা। ওঁকে তুমি জান না। জান না তুমি, ওঁর সব কাজে শৃঙ্খলা আছে। দরজায় উনি নকও করেন একই নিয়মে।
বলে জেনিফার উঠে দাঁড়াল।
সবাই উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। জেনিফার বলল, ‘না উনি বৈঠকখানায় আসবেন না। সোজা উনি ওঁনার ঘরেই যাবেন।’
জেনিফার পা বাড়াল ড্রইং রুমের ভেতরের দরজার দিকে।
দরজার কাছে যেতেই দরজায় এসে দাঁড়াল পরিচারিকা। বলল, ‘স্যার তাঁর রুমে গেছেন। আরেকজন এসেছেন। ড্রইং রুমে আসতে চাচ্ছেন।’
জেনিফার ‘কে’ বলে মুখ বাড়াল দরজায়। দেখল, জর্জ দাঁড়িয়ে।
একটা রক্তিম আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল জেনিফারের মুখ। বলল, ‘এসো।’
সালাম দিয়ে ড্রইং রুমে প্রবেশ করল জর্জ। তার পেছনে পেছনে লায়লা জেনিফার।
সারা ও মাকোনি উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল জর্জকে।
ডাঃ মার্গারেট উঠেনি।
‘কেমন আছ আপা?’ ডাঃ মার্গারেটকে লক্ষ্য করে বলল জর্জ।
‘ভাল। তুমি কেমন আছ?’
‘আলহামদুলিল্লাহ!’ বলল জর্জ।
‘তোমার চিঠি পেেিয় সব জেনে আমি থাকতে পারলাম না। চলে এলাম। অসুবিধা হলো না তো জর্জ? উনি কিছু মনে করবেন না তো?’ ডাঃ মার্গারেট বলল।
‘না আপা। তোমরা সবাই এসেছ জেনে খুশীই হবেন।’ জর্জ বলল।
‘কোথায় উঠব? জেনিফারদের এখানেই উঠলাম। জেনিফার নিশ্চয় বেজার হয়নি।’ বলল ডাঃ মার্গারেট ঠোঁটে হাসি টেনে।
সলাজ হাসি ফুটে উঠেছিল জেনিফারের মুখে।
সেদিকে তাকিয়ে জর্জ হেসে বলল, ‘আপা তুমি জেনিফারকে নতুন মানুষ দেখবে।’
কৃত্রিম ক্ষোভে ফুসে উঠল লায়লা জেনিফার। বলল, ‘দেখ জর্জ, এতে তোমার কোন কৃতিত্ব নেই। তোমার ভাগ্য, আহমদ মুসার মত ব্যক্তি তোমার উকিল হয়েছেন।’
আহমদ মুসার নাম উচ্চারণ করে কথা শেষ করার পরেই জিহ্বায় কামড় দিল জেনিফার। সংগে সংগে ভয় ও অপরাধের চিহ ফুটে উঠল তার মুখে। সংকুচিত হয়ে পড়ল সে।
আহমদ মুসা নাম শুনে সবাই চমকে উঠেছিল। জর্জ তার চোখ দু’টি বিস্ফোরিত করে বলল, ‘আহমদ মুসা? কে আহমদ মুসা?’
বিমূঢ় লায়লা জেনিফার কিছুক্ষণের জন্যে পাথরের মত শক্ত হয়ে গিয়েছিল।
জর্জের সরব প্রশ্ন উত্থিত হবার পর লায়লা জেনিফার যন্ত্রচালিতের মত ড্রইং রুমের ভেতরের দরজার দিকে এগিয়ে দরজা লক করে ফিরে এল তার সোফায়।
চারদিক থেকে সবাই ছেঁকে ধরল লায়লা জেনিফারকে। বিব্রত জেনিফার।
‘জেনিফার, আহমদ আব্দুল্লাহই কি আহমদ মুসা?’ গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ডাঃ মার্গারেট।
কথা বলল না। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল জেনিফার।
ডাঃ মার্গারেট, জর্জ, মাকোনী, সারা উইলিয়াম সকলের মধ্যেই একটা স্তব্ধতা নেমে এল।
বিস্ময়, আনন্দ ও অভাবিত পাওয়ার এক প্রবল বন্যায় সকলের মধ্যেই আত্মহারা ভাব।
নীরবতা ভাঙল ডাঃ মার্গারেট। বলল, ‘তিনি আহমদ মুসা হলেই শুধু তিনি যা তার সাথে মানায়।’
‘এখন মনে হচ্ছে, তিনি আহমদ মুসা না হওয়াই অবিশ্বাস্য। কিন্তু বিশ্বাস হতে চাইছে না তিনি আমাদের মাঝে।’ বলল সারা উইলিয়াম।
‘তাঁকে প্রথম দেখেই মনে করেছিলাম তাঁর আহমদ মুসা হওয়া উচিত।’ মাকোনী বলল।
‘জেনিফার পরিচয়টা না দিলেই ভাল ছিল। এখন ভয় ও সংকোচে মনটা যে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। আর লজ্জা রাখব কোথায়, তার সাথে কত কি বেয়াদবি এ কয়দিনে হয়ে গেছে!’ বলল জর্জ।
জেনিফার উঠে দাঁড়ালো। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, ‘সত্যি আমার একটা অপরাধ হয়ে গেছে। ওঁর পরিচয় কাউকে যখন উনি বলেননি, এমনকি আম্মা ও দাদিকেও নয়, তখন আমার এভাবে বলে ফেলাটা অন্যায় হয়েছে। আমার ভয় হচ্ছে, উনি একে কি চোখে দেখবেন।’ থামল একটু।
তারপর সবার দিকে চেয়ে ফিসফিস করে আবার বলল, ‘সবাইকে অনুরোধ সকলে দয়া করে বিষয়টা গোপন রাখবেন। পরিচয় দিতে চাইলে উনিই দেবেন। আমাদের কাছ থেকে তাঁর পরিচয় আর কেউ না জানুক।’
‘ঠিক বলেছ জেনিফার। কিন্তু বল, তোমার সাথে পরিচয় হলো কি করে? উনি কি তোমাকে বলেছেন তার পরিচয়?’ বলল ডাঃ মার্গারেট।
‘না বলেননি। উনি ওকারী গ্রামে আমাকে উদ্ধার করা থেকে শুরু করে তার কাজ, কথাবার্তা, সিডি কাকেমে আসার পথে চারটি লাশ গোপন করাসহ ঘটনাবলী দেখে আমিই তাঁকে গাড়িতে বলেছিলাম তিনি আহমদ মুসা। তিনি স্বীকার করেছিলেন মাত্র।’ লায়লা জেনিফার বলল।
জেনিফার থামলে আবার নেমে এল নীরবতা।
কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভাঙল ডাঃ মার্গারেট। অনেকটা স্বগত কণ্ঠের মত বলল, ‘এখন পরিবেশ, পরিস্থিতি সবকিছুই নতুন মনে হচ্ছে। মুহূর্তেই যেন পাল্টে গেল সব। মনে হচ্ছে, আমাদের এই ক্ষুদ্র দেশটা হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’
‘এই পরিবর্তন কেন? ব্যক্তি আহমদ মুসা তো আজকের আগেও আমাদের মাঝে ছিলেন।’ বলল সারা উইলিয়াম।
‘এটা বোধ হয় তাঁর নামের সাথে আল্লাহর দেয়া একটা শক্তি।’ বলল ডাঃ মার্গারেট।
‘কিন্তু ব্যক্তির প্রভাব ও নামের শক্তি কি আলাদা হতে পারে?’
‘পারে না। নাম যে গুণগুলো বহন করে, ব্যক্তি সে কাজগুলোই করবে। কিন্তু নামের যে প্রভাব ব্যক্তি তা হঠাৎ করে সৃষ্টি করতে পারে না।’ বলল ডাঃ মার্গারেট।
থামল একটু ডাঃ মার্গারেট। পরক্ষণেই আবার শুরু করল, ‘এই কারণেই আহমদ মুসার নাম আমাদের সামনে একটা নতুন অবস্থার সৃষ্টি করেছে।’
‘ধন্যবাদ ডাঃ মার্গারেট, আমি অন্য একটা কথা বলতে চাচ্ছি। জেনিফারের কথা। জনাব আহমদ মুসা জর্জের উকিল হলো কি করে?’ বলল মাকোনী।
জেনিফারের মুখ লাল হয়ে উঠল।
ডাঃ মার্গারেট মুখ টিপে হাসল। কিছু বলতে যাচ্ছিল সে। এই সময় পাশে রাখা তার মোবাইল টেলিফোন বেজে উঠল। ডাঃ মার্গারেট টেলিফোন তুলে নিল। কথা বলল।
গ্র্যান্ড টার্কস থেকে তার বান্ধবীর টেলিফোন। কথা বলতে বলতে মুখ ম্লান হয়ে গেল মার্গারেটের। মুখে ফুটে উঠল ভয়ের চি‎হ্ণ।
টেলিফোন রেখেই সে শুকনো কণ্ঠে বলল, ‘খুব খারাপ খবর মনে হয়। হোয়াইট ঈগলের বিরাট বাহিনী নাকি এই সাউথ টার্কো দ্বীপে আসছে।’
জর্জ চমকে উঠল ডাঃ মার্গারেটের কথা শুনে। জিজ্ঞেস করল, ‘কে দিল এই খবর?’
‘মেরী।’
‘তাহলে বিষয়টা তো এখনই জনাব আহমদ মুসাকে জানাতে হয়।’
বলেই জর্জ ছুটল ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে আহমদ মুসার রুমের দিকে।
মিনিট খানেকের মধ্যে জর্জ ফিরে এল আহমদ মুসাকে নিয়ে।
আহমদ মুসা ড্রইং রুমে ঢুকতে গিয়ে দরজায় থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘স্যরি, আপনারা অনেকে দেখছি এখানে আছেন। আমি বরং….।
ডাঃ মার্গারেটসহ সবাই উঠে দাঁড়িয়েছিল। মুহূর্তে সবার মাথায় উঠে গেছে ওড়না। পোশাকের আবরণের ভেতর সবাই সবাইকে যেন সংকুচিত করে নিয়েছে। দ্রুত ড্রইং রুমের একদিকে তারা সরে এসেছে দু’টি সিংগল সোফা খালি করে।
আহমদ মুসাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে লায়লা জেনিফার বলল, ‘না ভাইয়া আপনি বসুন। অপরিচিত দু’জন অন্য কেউ নয়। মাকোনীকে তো আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছেন। আর এ আমার মামাতো বোন সারা উইলিয়াম।’ মাকোনী ও সারা উইলিয়ামকে দেখিয়ে বলল জেনিফার।
আহমদ মুসা সকলকে সালাম দিয়ে মাকোনীর দিকে চেয়ে হেসে বলল, ‘আপনি কেন সেদিন আমাকে সহযোগিতা করতে পারেননি, সেটা আমি হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পরেই বুঝেছিলাম। আরও বুঝেছিলাম, ঐভাবে খোলামেলা জিজ্ঞেস করা আমার ঠিক হয়নি।’
সংকুচিত, লজ্জিত মাকোনী বলল, ‘আমি সেদিনের ঘটনার জন্যে দুঃখিত।’
‘না বোন মাকোনী, দুঃখিত আমার হওয়া উচিত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন?’ বলল মাকোনি মুখ নিচু রেখেই।
‘সেদিন বিবেচনায় আমার বিরাট ভুল হয়েছিল। আমি এখানকার শত্রুর শক্তিকে ছোট করে দেখেছিলাম। তাই একবারও ভাবিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের উপর শত্রুরা চোখ রাখতে পারে। অন্য কারো সামনে জেনিফারের কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করা ছিল একটা ভুল সিদ্ধান্ত। এ ভুল সিদ্ধান্তের শাস্তি আমি পেয়েছি।’
‘ধন্যবাদ জনাব। এভাবে আপনি নিজেকে ছোট করতে পারে বলেই হয়তো আপনি এত বড়।’ বলল মাকোনি আবেগ জড়িত কণ্ঠে।
‘বোন মাকোনি। কখনও প্রশংসা করলে শুধু আল্লাহরই করবেন।’ গম্ভীর কণ্ঠ আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার এ কণ্ঠে সবাই তার দিকে চোখ তুলে তাকাল। একটা বিব্রত ভাব সকলের চোখে।
‘স্যরি।’ বলল মাকোনি।
‘ধন্যবাদ।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা গিয়ে সোফায় বসল।
বসল সবাই।
আহমদ মুসা বসেই বলল, ‘ডাঃ মার্গারেট আপনাকে যে খবর দিয়েছে সে কে?’ আহমদ মুসার চোখ নিচু। মুখে ভাবনার চিহ্ণ।
ডাঃ মার্গারেট পাশের সোফায় বসে ছিল। সে মুহূর্তের জন্যে চোখ তুলে একবার আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, ‘জানিয়েছে আমার এক বান্ধবী।’
‘কি করে জানতে পারল সে?’
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বিপরীত দিকে রাস্তার ওপাশে স্বাস্থ্য দফতর পরিচালিত সেন্ট্রাল মেডিকেল ষ্টোর। সে ষ্টোরেরই সেলস ম্যানেজার আমার সেই বান্ধবী। কিছুক্ষণ আগে দু’জন লোক, যার একজন সানসালভাদরের, ঐ দোকানে ঔষধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনতে গিয়েছিল। তাদের তাড়াহুড়া দেখে আমার বান্ধবী কারণ জিজ্ঞেস করেছিল। উত্তরে তারা জানায়, আমাদের খুব তাড়াতাড়ি সাউথ টার্কো দ্বীপে পৌছতে হবে। কেন সেখানে কোন দূর্ঘটনা…….? জিজ্ঞেস করেছিল আমার বান্ধবী। আমার বান্ধবীকে কথা শেষ করতে না দিয়েই তারা বলে, না দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে সুর্ঘটনা ঘটবে সেখানে। তাহলে ঔষধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের প্রয়োজন কেন? বলেছিল আমার বান্ধবী। সুলক্ষ্যের জন্যে যুদ্ধ কি সুঘটনার মধ্যে পড়ে না? বলেছিল তাদের একজন। তা পড়ে। কিন্তু তার জন্যে এত তাড়াহুড়া কেন? জিজ্ঞেস করে আমার বান্ধবী। আমরা অনেক লোক যাচ্ছি তো। প্রস্তুত হয়ে বের হতেও তো সময় লাগবে। তারা বলেছিল।
এসব কথা থেকেই আমার বান্ধবীর মনে হয়েছে সাউথ টার্কো দ্বীপে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। সাউথ টার্কো দ্বীপে আমি এসেছি এবং সাউথ টার্কোতে এ পর্যন্ত কি ঘটেছে সে জানে। সুতরাং তার মনে সন্দেহ উদয় হবার সাথে সাথে সে টেলিফোন করেছে আমার কাছে।’ বলল মার্গারেট।
আহমদ মুসা গভীরভাবে ভাবছিল। ডাঃ মার্গারেট কথা শেষ করলেও আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না।
একটু পরেই চকিতে একবার মুখ তুলে ডাঃ মার্গারেটের দিকে চেয়ে বলল, ‘তাদের তাড়াহুড়া কেন ছিল বলুন তো?’
‘অনেক কিছু অনুমান করা যায়, কিন্তু ঠিক করে বলা মুষ্কিল।’ বলল ডাঃ মার্গারেট।
‘অনুমান একটা এই হতে পারে যে, সাউথ টার্কো দ্বীপে তাদের মূল লোকেরা এসেছে সানসালভাদর থেকে। তারা চিকিৎসা সরঞ্জাম সম্ভবত সাথে আনতে পারেনি ভুলের কারণে। তাই তাড়াহুড়া করে সংগ্রহ।’
ডাঃ মার্গারেট হাসল। বলল, ‘আমার মনে হয় এই অনুমানটা সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি।’
আবার ভাবনায় ডুব দিয়েছে আহমদ মুসা।
এবার মুখ তুলে তাকাল জর্জের দিকে। বলল, ‘জর্জ, আমরা ওকারী গ্রামে মৎস বন্দরের দু’জন সন্দেহজনক লোক সম্পর্কে যা শুনে এলাম, তার সাথে ডাঃ মার্গারেটের দেয়া তথ্য মেলালে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, সাউথ টার্কো দ্বীপে একটা বড় ধরনের অভিযান আসছে এবং তা আসছে ঐ মৎস বন্দরের পথেই।’
‘বড় ধরনের অভিযান?’ শুকনো কণ্ঠে বলল জর্জ।
শুধু জর্জ নয় আহমদ মুসার শেষ কথাটা মুহূর্তেই সকলের চেহারা পাল্টে দিয়েছে। উদ্বেগ ফুটে উঠেছে সবার চোখে-মুখে।
জর্জের সভয় প্রশ্নের জবাবে আহমদ মুসা বলল, ‘হ্যাঁ অভিযানটা বড় ধরনেরই হবে। সুদূর সানসালভাদর থেকে ছোট-খাট অভিযানের জন্যে তারা আসছে না নিশ্চয়। ঔষধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ থেকে বুঝা যায়, বেপরোয়া ধরনের কোন অভিযান নিয়ে তারা আসছে।’
‘সুদূর সানসালভাদর থেকে কেন কাছে কোথাও থেকে কেন নয়? বলল জর্জ।
‘এর উত্তর জানি না। পরে খোঁজ নেয়া যাবে। আমার মনে হয় তাদের একটা বড় কেন্দ্র হতে পারে সানসালভাদর। স্থানীয় উদ্যোগ বড় ধরনের মার খাওয়ার পর ওরা আসছে যুদ্ধে জেতার জন্যে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি এখন উঠব। এখনি যেতে হবে ওকারী গ্রামে।’
জর্জসহ মেয়েদের সকলের মুখ ভয় ও উদ্বেগে আচ্ছন্ন। কিন্তু আহমদ মুসার ঠোঁটের স্বাভাবিক হাসিটি তখনও মিলায়নি।
আহমদ মুসা থামতেই লায়লা জেনিফার বলল, ‘তাহলে সাউথ টার্কো দ্বীপের উপর ভয়ানক বিপদ ঘনিয়ে আসছে?’
‘ভয়ানক কিনা জানিনা, তবে একটা বিপদ তো আসছেই।’
‘আপনি ওকারী গ্রামে চলে গেলে আমাদের এখানে কি করণীয় হবে?’ লায়লা জেনিফার বলল উদ্বিগ্ন কণ্ঠে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমি জর্জকে রেখে যাচ্ছি। সে এখানকার আলী রুফাই, ওমর লাওয়াল ও রমযান ইরোহাকে নিয়ে প্রতিরক্ষার একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে।’
বলে তাকাল আহমদ মুসা জর্জের দিকে। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে জর্জ?’
‘ঠিক আছে ভাইয়া। আপনার আদেশ সর্বশক্তি দিয়ে পালন করব।’ শুকনো, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল জর্জ।
আহমদ মুসা হেসে উঠল।
‘হাসছেন যে ভাইয়া?’ ম্লান কণ্ঠে বলল জর্জ।
‘হাসছি তোমার ভীত, উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শুনে।’
‘কিন্তু ভাইয়া, আপনার হাসি দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা কিছুই নয়। অথচ সাংঘাতিক কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’ বলল জেনিফার।
‘জর্জের পক্ষ নেবার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ জেনিফার। তুমি ঠিকই বলেছ, হয়তো সাংঘাতিক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু একে ভয় পাবার কিছু নেই।’
‘সাংঘাতিক কিছু তো অবশ্যই ভয় পাবার মত।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ভয় পেলে সাংঘাতিক বহুগুণ সাংঘাতিক হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলে যুদ্ধের আগেই পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যায়।’
‘আপনার একটুও ভয় করছে না?’ লায়লা জেনিফার বলল।
একটা গাম্ভীর্যের ছায়া নেমে এল আহমদ মুসার মুখে। তাকাল জেনিফারের দিকে। বলল, ‘ভয় কাকে করব বলত? আমি যে আল্লাহকে ভয় করি, যে আল্লাহকে আমি আমার অভিভাবক, রক্ষাকর্তা বলে মনে করি, সেই আল্লাহ তো অন্য কাউকে ভয় করতে নিষেধ করেছেন। আর ভয় আমি কেন করব বলত? সর্ব শক্তিমান আল্লাহ আমার সাথে আছেন, আমি আমাকে শত্রুর চেয়ে দুর্বল ভেবে ভীত হবো কেন?’
আহমদ মুসা কথা শেষ করলেও কেউ কোন কথা বলল না। সবার চোখে একটা বিস্ময় ও আনন্দের ঔজ্জ্বল্য।
নীরবতা ভাঙল ডাঃ মার্গারেট। বলল, ‘আমি অহেতুক ভয় করার কথা বলছি না। কিন্তু শত্রুর চেয়ে আসলেই দুর্বল হলে সে বাস্তবতা চাপা দেয়া কি ঠিক?’
‘দুর্বলতা সম্পর্কে অবহিত থাকা এবং ভয় করা, দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। দুর্বলতা সম্পর্কে অবহিত থাকলে তবেই তো মোকাবিলার উপযুক্ত ষ্ট্রাটেজি গ্রহণ করা যাবে। কিন্তু ভয় করলে মোকাবিলার আগেই অর্ধেক পরাজয় হয়ে যায়।’
‘বুঝতে পেরেছি। ধন্যবাদ।’ বলল ডাঃ মার্গারেট মুগ্ধ চোখে।
মার্গারেটের কথা শেষ হতেই সারা উইলিয়াম বলল, ‘আপনি বহুবার বন্দী হয়েছেন, বহুবার মৃত্যুর মুখে পড়েছেন, সে সময়গুলোতে আপনার কেমন মনে হতো, কি ভাবতেন আপনি?’
‘সারা?’ তীব্র কণ্ঠে বলল লায়লা জেনিফার।
সারা উইলিয়াম জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল, ‘স্যরি।’
সারা উইলিয়াম ও লায়লা জেনিফার দু’জনের দিকেই তাকাল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসাকে তাকাতে দেখে লায়লা জেনিফার লজ্জা পেল সারাকে ঐভাবে ধমকে উঠার জন্যে। বলল সেও, ‘স্যরি।’ বিব্রত চেহারা লায়লা জেনিফারের।
বুঝল আহমদ মুসা। হাসল সে। বলল, ‘বিব্রত হওয়ার কি আছে জেনিফার। যা গোপন নেই, আমার কাছে গোপন করার প্রয়োজন কি?’
‘ভাইয়া………।’ জেনিফার কথা বলতে পারলো না। কেঁদে ফেলল জেনিফার ক্ষোভে, লজ্জায়।
আহমদ মুসা গম্ভীর হলো। বলল, ‘তোমাদের কাছে আমার পরিচয় গোপন রাখার প্রয়োজন নেই। এখানকার শত্রু বা প্রতিপক্ষের কাছে আমার পরিচয় গোপন রাখা প্রয়োজন এ জন্যে যে, আমার পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়লে প্রতিপক্ষরা একদিকে সাবধান হবে, অন্যদিকে ওদেরকে সাহায্য করার জন্যে আমার পুরনো শত্রুদের অনেকেই ছুটে আসবে।’
লায়লা জেনিফার চোখ মুছে বলল, ‘তাহলে আমি অন্যায় করিনি ভাইয়া?’
‘অবশ্যই না।’ বলে আহমদ মুসা আবার ঘড়ির দিকে তাকাল।
‘আমরা সৌভাগ্যবান, আপনাকে আমার অভিনন্দন।’ বলল ডাঃ মার্গারেট আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘ডাঃ মার্গারেট, অভিনন্দনটা আগামী হয়ে গেল। দোয়া করুন।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল জর্জকে, ‘চল, দেখ গাড়িতে তেল আছে কিনা। এখনি যেতে হবে।’
জর্জ উঠে দাঁড়াল।
‘একটা কথা বলতে পারি?’ বলল ডাঃ মার্গারেট আহমদ মুসাকে।
‘আহমদ মুসা চলতে শুরু করেছিল। থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘বলুন।’
‘ওরা তো অনেক ঔষধ, অনেক চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে আসছে। আমি একজন ডাক্তার। আমি কি আপনাদের সাথী হতে পারি?’
আহমদ মুসার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ ডাঃ মার্গারেট। অবশ্যই সাথী হতে পারেন, এক সময় সাথী হতে হবে। কিন্তু আজ আপনি গেলে, জর্জকেও যেতে হবে। কিন্তু আমি চাই, জর্জ এখানে থাকুক। সুতরাং আপনিও এখানেই থাকুন।’
‘আরেকটা কথা।’ বলল ডাঃ মার্গারেট।
‘বলুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সারা উইলিয়াম একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল, তার জবাব দেননি।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এ প্রশ্নের কি জবাব দেব? এই যে আজ বেরুচ্ছি, জীবন এবং মৃত্যু দুই-ই আমার সাথে। আমি এ নিয়ে কিছুই ভাবছি না। জীবন মৃত্যুর মালিক যিনি, ভাবনা তাঁর, সিদ্ধান্তও তাঁরই।’
বলে আহমদ মুসা সালাম দিয়ে পা বাড়াল বাইরে বেরুবার জন্যে।
বেরিয়ে গেল ড্রইংরুমের থেকে। তার পিছে পিছে জর্জও।
আহমদ মুসার যাত্রাপথের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল ওরা চারজন।
আহমদ মুসা বেরিয়ে গেছে, কিন্তু ওদের চোখের পলক পড়েনি, দৃষ্টি তাদের ফিরে আসেনি।
এক সময় ঠোঁট ফুঁড়েই যেন কথা বেরুল ডাঃ মার্গারেটের। বলল, ‘জেনিফার, মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের কথা শুনেছিলাম। আজ দেখলাম এক অপরূপ মৃত্যুঞ্জয়ীকে।’ ধীর এবং ভারী কণ্ঠ ডাঃ মার্গারেটের।
মার্গারেটের কণ্ঠস্বরে ওরা তিনজন ফিরে তাকাল মার্গারেটের দিকে।
ধপ করে বসে পড়ল মার্গারেট সোফায়। বসল ওরা তিনজনও।
কথা বলল মার্গারেটই আবার। বলল, ‘কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত যে ভয় আমাকে পেয়ে বসেছিল, সে ভয় এখন আর নেই আমার।’
‘সত্য বলেছেন আপা। মনের অজানা একটা দুয়ার যেন খুলে গেছে। নিজেকে অনেক সাহসী ও শক্তিশালী মনে হচ্ছে।’ বলল লায়লা জেনিফার।
‘এ জন্যেই আহমদ মুসা অমন জগৎজয়ী আহমদ মুসা হতে পেরেছে। সে ব্যক্তি মাত্র নয়, সে যেন সাধনার সেই পরশমণি। লোহাও ওঁর সান্নিধ্যে সোনা হয়ে যায়।’
কিছু বলতে যাচ্ছিল মাকোনি। কিন্তু মুখ হা করেই থেমে গেল।
ড্রইং রুমে প্রবেশ করল জেনিফারের মা ও দাদী। বলল জেনিফারের মা, ‘কি ব্যাপার? কি ঘটেছে ওকারী গ্রামে? কয়েক টুকরো রুটি মুখে দিয়েই আমাদের আহমদ আব্দুল্লাহ (আহমদ মুসা) আবার ছুটে গেল ওকারী গ্রামে?’
‘আম্মা, আজ রাতেই শত্রুদের একটা বড় অভিযান আসছে আমাদের সাউথ টার্কো দ্বীপে।’ বলল লায়লা জেনিফার।
শুনে জেনিফারের মা ও দাদী দু’জনেই হতাশ ভাবে বসে পড়ল সোফায়। বলল জেনিফারের দাদী, ‘তাহলে কি টার্কো দ্বীপপুঞ্জ থেকেও আমাদের ভাত উঠল? এরপর কোথায় যাব আমরা? কে আমাদের জায়গা দেবে?’
উদ্বেগ, আতংকে ছেয়ে গেছে জেনিফারের মা ও দাদীর মুখ।
‘দোয়া করুন দাদী। বড় বিপদ ঠিকই। কিন্তু দাদী, বহু শতাব্দীর অব্যাহত পরাজয়ের পর আমরা প্রথমবার জিততে শুরু করেছি। এবার আমাদের বিজয়ের পালা।’ বলল জেনিফার আবেগ রুদ্ধ কণ্ঠে।
‘আল্লাহ আমাদের আহমদ আব্দুল্লাহকে সাহায্য করুন। তার হাতেই তো আমাদের বিজয় আসতে শুরু করেছে।’ বলল জেনিফারের মা।
‘আমিন।’ সকলে একযোগে বলে উঠল।

আহমদ মুসা ওকারী গ্রামের মসজিদে এসেই শুনল, আলী ওরমা রাত দশটার মধ্যে ফেরেনি। তার পরেই আবু বকর ক’জনকে নিয়ে ওদিকে চলে গেছে।
| | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top