২৮. আমেরিকার এক অন্ধকারে

চ্যাপ্টার

অবিরাম কেঁদে চলছে লায়লা জেনিফার।
ডাঃ মার্গারেট বলল, ‘এভাবে কাঁদলে মরার আগেই মরে যাবে জেনিফার। মৃত্যু অবধারিত একটি বিষয়। সুতরাং ভয় কিসের? কাঁদবে কেন?’
‘আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না আপা। ইতোমধ্যে যদি ওরা আমাকে মেরে ফেলত, তাহলে খুশী হতাম’।
‘তাহলে আর ভয় কিসের? এত কাঁদছ কেন?’
লায়লা জেনিফার মুখ খুলতে যাচ্ছিল কিছু বলার জন্যে। দরজায় শব্দ শুনে থেমে গেল সে। দরজা খোলার শব্দ হলো।
ভয়ে মরার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেল জেনিফারের মুখ। সে ডাঃ মার্গারেটের পা ঘেঁষে বসল।
ডাঃ মার্গারেট জেনিফারের পিঠে সান্ত্বনাসূচক একটা হাত রাখল।
দরজা খুলে গেল। খাবারের ট্রলি ঠেলে প্রবেশ করল একজন। তার পেছনে আরেকজন। তার কোমরে রিভলবার ঝুলানো। হাতে একটা ওয়াকিটকি। সুবেশধারী লোকটি।
লোকটি চকচকে চোখে লায়লা জেনিফার ও ডাঃ মার্গারেটের দিকে তাকাল। লায়লা জেনিফারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘বিনা কারণে কাঁদলে, কারণের সময় কাঁদার জন্যে চোখে পানি পাবেন কোথায়?’
ডাঃ মার্গারেট ও লায়লা জেনিফার কোনো কথা বলল না। মুখও তুলল না তারা। তাদের, বিশেষ করে লায়লা জেনিফারের অবস্থা আড়ষ্ট।
বলল লোকটাই আবার, ‘খুব তো ভয় দেখছি। আহমদ মুসার সংস্পর্শে যারা আসে, তাদের তো এমন ভয় থাকার কথা নয়। ভয়ংকর আহমদ মুসার পাল্লায় পড়েছিলেন আপনারা কেমন করে?’
ডাঃ মার্গারেট চকিতের জন্যে একবার মুখ তুলল। কিন্তু দু’জনের কেউই কোন উত্তর দিল না। কি বলবে তারা? আহমদ মুসা তো ভয়ংকর নয়, আল্লাহ তো তাকে ত্রাণকর্তা হিসেবে পাঠিয়েছেন। কিন্তু একথা তো বলা যাবে না। সুতরাং কিছু না বলাই ভালো।
ক্রোধে লোকটির মুখ লাল হয়ে উঠল। বলল সে চিৎকার করে, ‘কথা বলতে হবে। যাক না পনেরটা দিন। বসের নির্দেশ পনের দিন গায়ে হাত দেয়া যাবেনা। পনের দিনের মধ্যে যদি আহমদ মুসা আত্মসমর্পন না করে, তাহলে তোমরা আমাদের। তোমাদেরকে আমাদের হাতে তুলে দেবেন বস গণ-উৎসব করার জন্যে’।
ট্রলি ঠেলে নিয়ে আসা লোকটি খাবার নামিয়ে রেখেছে মেঝেতে। ট্রলি ঠেলে সে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে।
লোকটি কথা শেষ করেই ঘুরে দাঁড়াল ঘর থেকে বেরুবার জন্যে। যাবার জন্যে পা তুলে একটু মুখ ঘুরিয়ে লোভাতুর দৃষ্টি ডাঃ মার্গারেট ও লায়লা জেনিফারের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘কয়দিন খেয়ে-দেয়ে তৈরী হয়ে নাও ডার্লিং’।
বেরিয়ে গেল লোকটি। দরজা বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই।
লোকটি কি বলছে বুঝতে বাকি ছিল না কারোরই। কাঁপছিল লায়লা জেনিফার।
ডাঃ মার্গারেটের চোখেও আতংকের ছায়া। তবু লায়লা জেনিফারের দিকে চেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, ‘যারা অসহায়, তাদের আল্লাহ আছেন’।
‘আলহামদুলিল্লাহ’। চোখ মুছে বলল লায়লা জেনিফার।
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘পনের দিনের মধ্যে আত্মসমর্পনের কথা নিশ্চয় ওরা আহমদ মুসাকে বলেছে’।
‘অবশ্যই’।
‘আহমদ মুসা কি করবেন বলে মনে করেন?’ শুকনো কন্ঠে বলল লায়লা জেনিফার।
মুখ ম্লান হয়ে গেল ডাঃ মার্গারেটের। তার মনেও এই প্রশ্নটাই বড় হয়ে উঠল। আহমদ মুসার মুখটি ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। হৃদয়ের কোথাও চিন চিন করে উঠল পরিচিত সেই বেদনা। আবার আগের মতই চমকে উঠল সে। এই অন্যায় চিন্তাকে সে ভয় করে এবং মনের আড়ালে রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু সুযোগ পেলে চিন্তাটা মাথা তোলে এবং তাকে বিব্রত করে। আহমদ মুসা হিমালয়ের মত উঁচু এক ব্যক্তিত্বই শুধু নন, ডোনা জোসেফাইনের আহমদ মুসাকে নিয়ে তার ভাববার অধিকার কোথায়? চোখ দুটি ভারি হয়ে উঠল ডাঃ মার্গারেটের।
বলল মার্গারেট ধীরে ধীরে, ‘যিনি নিজের চেয়ে পরের কথা বেশী ভাবেন, তিনি কি করতে পারেন তা বলা খুব সহজ নয় কি?’
‘তার মানে তিনি আত্মসমর্পণ করবেন?’
‘তা জানি না। এটুকু আমরা বলতে পারি যে, তিনি আসবেন’। বলল ডাঃ মার্গারেট।
আসার অর্থ দুটোই হতে পারে। আমাদের উদ্ধারের জন্যে তিনি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়বেন অথবা ওদের দাবী অনুসারে নিজেকে তিনি ওদের হাতে তুলে দেবেন’। বলল লায়লা জেনিফার।
‘ঠিক’।
বলে একটু থেমে আবার শুরু করল মার্গারেট, ‘একটা জিনিস আমার কাছে খুব স্পষ্ট নয়। আহমদ মুসাকে ধরার জন্যে আমাদের পোর্ট বানানো কেন?’ আমরা তাঁকে চিনি, জানি। কিন্তু গোল্ড ওয়াটাররা কেমন করে ধরে নিল যে, আমাদের আটকালেই আহমদ মুসাকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করা যাবে?’
‘কেন, আহমদ মুসাই তো আপনাকে দুঃসাহসিক ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার করেছিলেন’।
বলে একটু থামল লায়লা জেনিফার। তার বেদনা পীড়িত ঠোঁটে এক টুকরো মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘শোনেননি, এরা কি বলে? ওদের ধারণা আপনাদের মধ্যে গভীর একটা সম্পর্ক আছে যা আহমদ মুসাকে এদিকে টেনে আনবেই’।
ডাঃ মার্গারেটের হৃদয়টা কেঁপে উঠল। তার মুখের উপর দিয়ে লজ্জার লাল আভা খেলে গেল। সেই সাথে বিব্রত একটা ভাবও ফুটে উঠল তার চোখে মুখে।
কিন্তু মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে প্রসঙ্গটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেবার জন্যে বলল, ‘আসলে ভূল আমাদের। তোমার বাইরে না বেরুবার এবং আমার হাসপাতালের চাকরিতে যোগ না দেবার জন্য তাঁর কঠোর নির্দেশ ছিল। তাঁর আদেশ উপেক্ষা করে আমরা বিপদে পড়েছি। তাঁকেও বিপদগ্রস্ত করেছি’।
‘ভূল বটে, তবে সেখানকার অবস্থা তো স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। ঐ অবস্থায় ঘরে আবদ্ধ থাকার কি যুক্তি ছিল?’ বলল লায়লা জেনিফার।
‘যুক্তি যে ছিল তা এই বিপদ ঘটার পর তো প্রমাণিত হলো। আমি ভাবছি, জর্জও না আবার কোন বিপদে পড়ে’। ডাঃ মার্গারেট বলল।
ডাঃ মার্গারেট জর্জের নাম উচ্চারণ করতেই মুহূর্তে লায়লা জেনিফারের মুখ আঁধারে মেঘের মত হয়ে গেল। বেদনায় নীল দেখালো ওর চেহারা। ধীরে ধীরে বলল, ‘ওর কথা ভুলে থাকতে চাই আপা। মনে হলে বুক কাঁপে। বুদ্ধির চেয়ে শক্তির উপর সে নির্ভর করতে চায় বেশী। জানি না সে কি করছে’। বলে কান্না রোধের চেষ্টায় দু’হাতে মুখ ঢাকলো লায়লা জেনিফার।
নরম কন্ঠে সান্ত্বনার সুরে ডাঃ মার্গারেট বলল, ‘আল্লাহর উপর ভরসা করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। জর্জের জন্যে তুমি ভেব না। আহমদ মুসার সাথে যোগাযোগ না করে সে কিছু করবে না’।
‘আমাদের এই আচরণে আহমদ মুসা ভাই নিশ্চয় খুব বিরক্ত হবেন। তার এই বিরক্তির চেয়ে আমাদের মৃত্যুই ভাল ছিল। আহমদ মুসা ভাইকে এর মধ্যে না জড়িয়ে ওরা যদি আমাদের মেরে ফেলত সেই ভাল ছিল’। বলল লায়লা জেনিফার।
‘ঠিক আমিও এটাই ভাবছি। কিন্তু শয়তানদের মতলব ভিন্ন। ওরা তো আমাদের মারবেই, আহমদ মুসাকেও ফাঁদে আটকাবে’।
‘এটা নিশ্চয়ই আহমদ মুসা ভাই জানেন। তাহলে তিনি শুধু শুধু ফাঁদে পড়তে আসবেন কেন?’
‘নিশ্চয়ই ওদের ফাঁদে পড়তে নয়, আমাদের উদ্ধার করতে আসবেন’।
লায়লা জেনিফারের চোখে মুখে আরও একরাশ বেদনা এসে ছড়িয়ে পড়ল। বলল আর্তস্বরে, ‘আমাদের উদ্ধার করার জন্যে এই বিপদে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়বেন, এই কথা মনে হতেই বুক ফেটে যায়। কে আমরা? সামান্য দু’জন নারী। আমাদের মত হাজার জন মারা গেলেও পৃথিবীর কোন ক্ষতি হবে না’। থামল লায়লা জেনিফার।
একটা করুণ হাসি ফুটে উঠল ডাঃ মার্গারেটের মুখে। বলল ভেজা গলায়,’লায়লা তুমি ঠিক বলেছ। কিন্তু এ কথা বুঝাবে কে তাঁকে!’
‘অজানা অচেনা লায়লা জেনিফারের একটা চিঠি যাঁকে সুদূর মধ্যপ্রাচ্য থেকে টেনে আনতে পারে এই আমেরিকায়, তাঁকে এ কথা বুঝানো লাগে কি?’
‘এত কিছু ঘটবে তা কি জানতাম। জানলে তাঁকে কি ডাকতাম!’ লায়লা জেনিফার বলল।
‘তুমি ডাকনি, আল্লাহ ডেকেছিল। তুমি একটা উপলক্ষ মাত্র। আল্লাহ তাঁকে দিয়ে আমেরিকায় কিছু করতে চান। ভেবে দেখ আমাদের টার্কস দ্বীপপুঞ্জের কথা। এখানকার দুর্বল মুসলমানরা তাদের অস্তিত্ব বিলোপকামী ভয়াবহ ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা পাবে, জাতি গোষ্ঠীসহ সারা দুনিয়া এদের নিরাপত্তা বিধানে ছুটে আসবে। এটা কি কল্পনাও করতে পেরেছ? যা কল্পনা করনি, তাই ঘটেছে। তাঁর বুদ্ধি ও দূরদর্শিতা দিয়ে এটা তিনি ঘটিয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে দিয়ে আরও কিছু ঘটাবেন আমেরিকায়’।
‘আপনার কথা সত্য হোক। এ বিপদ থেকে আল্লাহ তাঁকে উদ্ধার করুন’। জেনিফার বলল।
‘আমিন’। বলল মার্গারেট।

কথা বলছিল ইহুদী গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল আইজ্যাক শ্যারন এবং শুনছিল মার্কিন ফেডারেল ব্যুরো এবং ইন্টেলিজেন্সের প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন।
দীর্ঘ বক্তব্য শেষ করে থামল জেনারেল আইজ্যাক শ্যারন।
ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেছে জর্জ আব্রাহাম জনসনের। বলল, ‘আপনি যা বললেন, তার দু’একটা বিচ্ছিন্ন চিত্র আমাদের কাছেও এসেছে। তার মধ্যে রয়েছে কয়েকটা হত্যাকান্ডের ঘটনা। ওসবের সাথে গোল্ড ওয়াটারের সংশ্লিষ্ট থাকার বিষয়টা আঁচ করা গেছে। গোল্ড ওয়াটারের সাথে আপনাকেও দেখা গেছে। কিন্তু আপনি এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট আছেন, এটা আমাদের কাছে নতুন’।
‘স্যরি। আহমদ মুসাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছি, এই টেনশনে এত ব্যস্ত ছিলাম যে সৌজন্যমূলক একটু ‘হ্যালো’ বলব তারও সুযোগ পাইনি’। বলল জেনারেল শ্যারন।
‘তা আমি বুঝেছি। আহমদ মুসা এখন আপনাদের কাছে সাত রাজার ধন। কিন্তু বলুন তো, এক ব্যক্তির উপর এতটা ক্ষ্যাপা, একটু বেশী বেমানান নয় কি?’
‘যে আপরাধে আপনারা একটা ভিন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নরিয়েগাকে ধরে এনে সারা জীবনের জন্যে জেলে ঢুকিয়ে দিলেন, তার চেয়ে হাজারগুণ, লক্ষগুণ বেশী অপরাধ করেছে সে আমাদের কাছে। আমাদের রাষ্ট্র ইসরাইল সে ধ্বংস করেছে এবং কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাত থেকে। তারপরও কত ঘটনায়, কত লোক আমাদের শেষ হয়েছে ওর জন্যে, তার হিসেব কষলে আতংকিত হতে হয়। তাকে একবার নয় শতবার হত্যা করলেও তার অপরাধ শেষ হবে না। কিন্তু আমরা তাকে হত্যা করব না। তাকে পণবন্দী করে যতটা পারা যায় আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থ আমরা হাত করতে চাই আরবদের কাছ থেকে’।
‘আমাদের আপত্তি নেই। এখন বলুন কি সাহায্য আপনি চান এফ. বি. আই (FBI) এর কাছে থেকে? বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘আহমদ মুসাকে খোঁজা এবং তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য আপনাদের সাহায্য চাই’।
একটু চিন্তা করল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘কোন বড় অনুরোধ এটা নয়। কিন্তু গ্রেপ্তারের পেছনে এফবিআই এর লিগ্যাল গ্রাউন্ডটা কি হবে। তার বিরুদ্ধে আমাদের কাছে কোন অভিযোগ নেই’।
‘চমৎকার এক অভিযোগ আছে। বিনা ভিসায় তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ। তাকে গ্রেপ্তারের জন্যে এটাই যথেষ্ট’।
হাসল আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘আপনি কি মনে করেন এর মধ্যে সে ভিসা জোগাড় করেনি?’
একটু বিব্রত হলো জেনারেল শ্যারন। সঙ্গে সঙ্গে কোন জবাব দিল না।
জর্জ আব্রাহাম জনসনই আবার মুখ খুলল। বলল, ‘আমরা আহমদ মুসাকে যতটা জানি, তার চিন্তা চলে সময়ের অনেক আগে। আমি নিশ্চিত তার পাসপোর্টে ক্যারিবিয়ান স্টেটগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা অবশ্যই আছে’।
‘আমিও আপনার সাথে একমত হচ্ছি মিঃ জনসন। কিন্তু অবস্থা তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে?’
‘সেটাই তো কথা। তার বিরুদ্ধে কি ধরনের অভিযোগ দাঁড় করানো যাবে?’
‘খুব সহজ পথ আছে। সে টেররিস্ট গ্রুপের নেতা। সন্ত্রাস ও সংঘাত সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে’।
‘দুনিয়া কি বিশ্বাস করবে আহমদ মুসা টেররিস্ট গ্রুপের সদস্য? সকলেই তো জানে এ পর্যন্ত কি কি কাজ সে করেছে। তাকে আর যাই হোক সন্ত্রাসী বলে চালানো যাবেনা’। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘কেন যাবে না? সে যে খুন জখমে জড়িত হয়ে পড়েছে কাহোকিয়ার কয়েকটা ঘটনা দিয়ে তা প্রমাণ করা যাবে। এ থেকে সহজেই অভিযোগ আনা যাবে যে, আমেরিকার মুসলমানদের সন্ত্রাসী তৎপরতায় সাহায্য করার জন্যে আহমদ মুসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে’।
হাসল জর্জ আব্রাহম জনসন। বলল, ‘কাহোকিয়ার পুলিশ কি রিপোর্ট দিয়েছে জানেন? বলেছে, শ্বেতাংগ সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ হোয়াইট ঈগল কাহোকিয়ার হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত। একটা রেড ইন্ডিয়ান দৈনিক পত্রিকায় এ রিপোর্ট প্রকাশিত ও হয়েছে। সুতরাং কাহোকিয়া হত্যাকান্ডের দায় তার উপর চাপানো যাবে না’।
‘এফ বি. আই-এর অফিসিয়ালী তাকে ধরার দরকার নেই। আনঅফিসিয়ালী এফ.বি.আই. আহমদ মুসাকে ধরে দিতে আমাকে সাহায্য করুক। এর জন্যে যে খরচ হবে, সেটা আমি দেব’। বলল জেনারেল শ্যারন।
আবার হাসল জনসন। তারপর গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘ঠিক আছে জেনারেল শ্যারন, খরচ তো আপনি দেবেনই’।
বলে একটু থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন। একটু নড়েচড়ে বসল। বলল, ‘আহমদ মুসা মার্কিন রাজনীতির বন্ধু নয়। সুযোগ এলে আমরা তাকে ছাড়ব না। কিন্তু তার আগে তার গায়ে হাত দেয়া বিপদজনক হবে। মুসলিম দেশগুলোর প্রতিক্রিয়াকে অবশ্যই আমাদের হিসেব করতে হবে। তবে আনঅফিসিয়ালি আপনাকে সাহায্য আমরা করব। কিন্তু আহমদ মুসা আমেরিকায় আছে এটা গোপন থাকা প্রয়োজন। এতে কাজের সুবিধা হবে, আমাদের ঘাড়ে কোন প্রকার দায় চাপানোর ভয় থাকবে না’।
জেনারেল আইজ্যাক শ্যারন খুশী হয়ে একগাল হেসে বলল, ‘তার আসার ব্যাপারটা গোপনই আছে। সে, আমরা এবং আপনারা কেউই চাই না এটা প্রকাশ হোক। সুতরাং প্রকাশ হবে না’।
কি যেন বলতে যাচ্ছিল জর্জ আব্রাহাম জনসন। হঠাৎ কি মনে হওয়ায় সে থেমে গেল। চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে জর্জ জনসনের। বলল, ‘জেনারেল শ্যারন, বিরাট একটা সুযোগ সামনে। আপনার ভাগ্য ভাল হলে খুব সহজেই আপনার কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে’।
‘কি সে সুযোগ?’ দ্রুত কন্ঠে বলল সে। সোজা হয়ে বসল।
ওয়াশিংটন ডিসির গ্রীন ভ্যালিতে আমেরিকান মুসলিম সমিতি ও সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে সাত দিনব্যাপি একটা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এখানে আহমদ মুসা নিশ্চয়ই সবচেয়ে সম্মানিত একজন অতিথি হবেন। খোঁজার কষ্ট না করে ওখান থেকেই তাকে ধরতে পারেন’। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জেনারেল শ্যারনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে একটা মহা সুযোগের সন্ধান আপনি দিয়েছেন। ওখানে আহমদ মুসা না এসেই পারেনা’।
ভাবছিল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘আপনার জন্যে মহা সুযোগ বটে। তবে একটা সমস্যা আছে। আহমদ মুসার সন্ধান বা তাকে ধরতে গিয়ে সেখানে যদি হতাহতের ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে মার্কিন সরকার বিপদে পড়তে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মুসলিম প্রেসও সেখানে থাকবে’।
‘আপনারা যদি সহযোগিতা করেন, কোন হতাহতের ঘটনা ঘটার প্রশ্নই আসেনা’।
‘না, ওখানে এফ.বি.আই পরিচয় দিয়ে আমাদের কোন লোক ধরপাকড়ে যেতে পারবে না। আগেই তো বলেছি, আহমদ মুসাকে এই মুহূর্তে এফ.বি.আই-এর সরাসরি গ্রেপ্তার করার বৈধ কারণ নেই, আর কারণ ছাড়া গ্রেপ্তার ও করা যাবেনা। বিশেষ করে এই সম্মেলন থেকে সুপরিচিত কোন মুসলিম নেতাকে’।
‘তাহলে?’
‘কাজ আপনাদের লোক দিয়েই করতে হবে। তথ্যাদি দিয়ে কিছু সাহায্য আমরা করতে পারি’।
সঙ্গে সঙ্গে কোন উত্তর দিল না জেনারেল শ্যারন। ভাবছিল সে। এক সময় বলল, ‘সম্মেলনটা কবে?’
‘আর সাতদিন পরে’।
‘সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথিদের একটা তালিকা আমাকে যোগাড় করে দিতে পারেন?’
‘ওটা দিয়ে কি হবে? আহমদ মুসা নিশ্চয় স্বনামে সেখানে আসছে না’।
‘আমার জানা দরকার আমেরিকা থেকে কারা সম্মেলনে আসছে। নিরাপদে কাজ উদ্ধারের একটা পথ তো বের করতেই হবে’।
‘ঠিক। লিস্ট আমাদের কাছে আছে। দিয়ে দেব আপনাকে’।
‘ধন্যবাদ’।
বলে একটু থেমে অবার শুরু করল জেনারেল শ্যারন, ‘ভবিষ্যত প্রশ্নে একটা কথা আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, মুসলমানদের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহনের ক্ষেত্রে পদে পদে আইন দেখার সত্যিই কি কোন প্রয়োজন আছে? আপনারা যদি সাবধান না হন তাহলে ইসলাম কিন্তু আমেরিকাকে গিলে ফেলবে। ইসলামী আদর্শের সাথে পেট্রোডলার যোগ হবার পর ইসলাম কিন্তু অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়াবে’।
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, সাম্প্রদায়িকতা কোন প্রকারে আমাদের কাছে ঘেঁসতে পারবেনা। কিন্তু মানুষের ইসলাম গ্রহন আমরা ঠেকাবো কি করে? মানবিক অধিকারে তো আমরা হস্তক্ষেপ করতে পারিনা’।
‘যদি না পারেন, তাহলে ঠেকাবার দায়িত্বটা হোয়াইট ঈগলের হাতে ছেড়ে দিন’।
কথা শুনে হাসল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে উঠল জর্জ জনসনের মুখ। বলল, ‘আমরা হোয়াইট ঈগলের কোন কাজে বাধা দেই না। কাহোকিয়ার ঘটনা নিয়ে হোয়াইট ঈগলের কোন লোককে আমরা সামান্য জিজ্ঞাসাবাদও করিনি। কিন্তু তারা বোকার মত যে সব কাজ করছে, তাতে তারাও ডুববে, আমাদেরকেও বিপদে ফেলবে। দেখুন, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে কি কাজটাই না করল তারা। করতে কিছু পারেনি, মাঝখান থেকে মুসলিম দেশগুলোসহ গোটা দুনিয়া এলার্ট হয়ে গেল। বলা যায়, গোটা ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ফসকে গেল হোয়াইট ঈগলের হাত থেকে’।
‘তবু আমি মনে করি জনাব, হোয়াইট ঈগলই আপনাদের ভবিষ্যত। নতুন পরিকল্পনা নিয়ে হোয়াইট ঈগল আবার যাতে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে বসতে পারে, সে সাহায্য আপনাদেরকেই করতে হবে’। বলল জেনারেল শ্যারন।
আবার হাসল জর্জ জনসন। বলল, ‘মনে হচ্ছে হোয়াইট ঈগলের চেয়ে আপনার আগ্রহই বেশী?’
‘কারণ আছে। আপনারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে না নামলে, আমরা তাদের সাথে এঁটে উঠতে পারছি না। এক আহমদ মুসাই তো আমাদের ডুবিয়েছে’। জেনারেল শ্যারন বলল।
‘আপনার সাথে আমি একমত। ব্যক্তিগত কারণে আমি আরও বেশী একমত। কিন্তু……’
জেনারেল শ্যারণ জর্জ জনসনকে বাধা দিয়ে বলল, ‘আপনার ব্যক্তিগত কারণ বুঝলাম না’।
হাসল জনসন। বলল, ‘আমার মা ইহুদী ছিলেন। আমার মাতুল পরিবার ইসরাইলে ছিলেন। ফিলিস্তিন বিপ্লবের পর তাদেরকে ফিলিস্তিন ছাড়তে হয়েছে, কারণ তারা ১৯৪৮ সালের পর ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করেছিলেন’।
আনন্দে চিৎকার করে উঠল জেনারেল শ্যারণ। বলল, ‘তাহলে তো আমাদের লোক আপনি। আমাদের দুঃখ আপনাকে বুঝাবার কোন প্রয়োজন নেই। এখন বলুন কি করতে পারেন আমাদের জন্যে’।
‘কি করতে পারব বলছি’।
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘আপনার কথা যদি সত্য হয়, আহমদ মুসা যদি এসেই থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, আর আপনারা যদি তাকে কিছু করতেই চান, তাহলে মনে হয় একটা সংকটের সৃষ্টি হবে আমাদের জন্যে। বলছি, মুসলিম বিশ্বের সাথে আমাদের সম্পর্কের কারণে আহমদ মুসার মত ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কিছুই করতে পারবেন না। আপনারা যদি গোপনে তাকে ধরে নিয়ে যেতে পারেন, তাহলে ভাল। কিন্তু যদি হত্যার মত কিছু ঘটে যায়, তাহলে আমরা অসুবিধায় পড়তে পারি’।
‘কেমন করে? কাউকে তো আমরা জানাচ্ছি না’।
হাসল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘আপনাদের কারো দ্বারা প্রকাশ হতে পারে, আবার এফ.বি.আই এর কারো দ্বারাও প্রকাশ হতে পারে। আহমদ মুসাদের সাথীদের দ্বারা তো প্রকাশ হতে পারেই’।
‘তাতেই বা কি হবে? আহমদ মুসা অঘোষিতভাবে আমেরিকায় এসেছে। সুতরাং তার কোন দায়-দায়িত্ব মার্কিন সরকারের নেই। তার তো শত্রু কম নেই। কার দ্বারা কোথায় সে নিহত হলো তার দায় নিশ্চয় আপনাদের উপর বর্তাবে না’।
‘তাত্ত্বিকভাবে আপনার কথা ঠিক। যুক্তি হয়তো আমাদের পক্ষে থাকবে। কিন্তু মুসলিম দেশগুলো বিশেষ করে কয়েকটি মুসলিম দেশ আমাদের মাফ করবে না’।
‘মুসলিম দেশগুলোর কথা এত বলছেন কেন? ওদের কি আছে? ভয় কি ওদের?’
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না জর্জ আব্রাহাম জনসন। একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘ভয় নয়, ভাব রাখতে চাই, সাহায্য সহযোগিতা দেয়ার পরিবেশ রাখতে চাই। বলবেন, কেন? কারণ, আমরা যা চাই, তা যদি তাদের দিয়ে করাতে হয়, তাহলে ভাব রাখতে হবে, সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের মাঝে ঢোকার সুযোগও নিতে হবে’।
‘হাসালেন আপনি। যারা নিজের পায়ে হাঁটতে পারে না, যারা নিজের হাতে খেতে পারে না, তাদের দিয়ে কি করাবেন?’ বলল জেনারেল শ্যারন মুখে হাসি টেনে।
‘দেখুন, নেকড়ে মহিষকে একা পেলে মুহূর্তেই কাবু করতে পারে, কিন্তু দশটি মহিষ এক হলে সিংহও সে বুহ্যে ঢুকতে পারে না। মুসলিম দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে ঐ দুর্বলরই মহা বলবান হয়ে যাবে। আমরা তা হতে দিতে পারি না। তাই আমাদের নাক কেটে হলেও ওদের যাত্রা ভঙ্গের ব্যবস্থা করছি’।
‘নাক কাটতে গিয়ে মাথাটাই আবার কেটে না ফেলেন’। হেসে বলল জেনারেল শ্যারন।
‘এর উত্তর দিতে হলে অনেক আলোচনায় যেতে হবে। আজ থাক এ প্রসংগ। বলুন, আর কোন কথা আছে?’ হাতঘড়ির দিকে চকিতে একবার চোখ বুলিয়ে বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘তেমন নেই। শেষ কথাটা তাহলে কি দাঁড়াল?’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আপনি কাজ শুরু করুন। অবস্থা কি দাঁড়ায় দেখুন। তথ্যাদি দিয়ে আমরা সাহায্য করব। একান্ত দরকার হলে এফ.বি.আই এর শীর্ষ অপারেটরদের একটা সশস্ত্র গ্রুপ আছে, তাদের কাজে লাগাব। তবু এফ. বি. আইকে সাধারণভাবে ব্যবহার করতে পারবো না। যেহেতু জানাজানি এড়াতে চাই’।
‘ধন্যবাদ, আজকের মত এ পর্যন্তই’। বলে উঠে দাঁড়াল জেনারেল শ্যারন।