৩
ইহুদী গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শ্যারন, হোয়াইট ঈগল প্রধান গোল্ড ওয়াটার এবং এফ.বি.আই প্রধান কলিন্স গ্রীন ভ্যালির হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টারের মুখোমুখি রাস্তার ওপারে কম্যুনিটি হলের একটি কক্ষে একটা টেবিল ঘিরে বসে আলোচনায় মশগুল। হিউম্যান ডেভলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টারেই ‘আমেরিকান কাউন্সিল অব মুসলিম এসোসিয়েশনস’ (ACOMA) এর ৭দিন ব্যাপি সম্মেলন শুরু হয়েছে।
হিউম্যান ডেভলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (HDRC) আমেরিকান মুসলমানদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
জেনারেল কম্যুনিটি হলের যে কক্ষে কথা বলছিল তার জানালা দিয়ে HDRC‘র প্রধান ফটক দেখা যায়।
‘সেদিকে চোখ রেখে কথা বলছিল জেনারেল শ্যারন। তার মুখ দারুন আনন্দে উদ্ভাসিত। সে বলছিল, ‘ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ। আহমদ মুসাকে আবার নাগালের মধ্যে পাওয়া গেছে। ভাবতে কি যে আনন্দ লাগছে, সে এখন সামনের ঐ বিল্ডিংটায় রয়েছে। আমরা তার খবর জানি, কিন্তু সে আমাদের খবর জানে না’।
‘আসল আনন্দ হবে তাকে ধরার পর। তাকে ধরার কি পরিকল্পনা?’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘ওটা কোন সমস্যা নয়। তিরিশজন কমান্ডো যোগাড় হয়েছে। যে কোন সময় ওখানে ঢুকে তাকে আমরা ধরে আনতে পারি’। বলল জেনারেল শ্যারন।
‘কিন্তু তাতে রক্তপাত হবে, জানাজানি হবে, আন্তর্জাতিক নিউজ মিডিয়াতে চলে যাবে খবর, এটা করা যাবে না। আমার প্রতি এফ.বি.আই-এর নির্দেশ এটা’। বলল এফ.বি.আই এজেন্ট কলিন্স।
এফ.বি.আই প্রধান জেনারেল আব্রাহাম জনসন ও জেনারেল শ্যারনের মধ্যে আলোচনা অনুসারে এফ.বি.আই শ্যারনকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করছে, প্রত্যক্ষ সাহায্য নয়। কলিন্সকে এখানে পাঠানো হয়েছে এটা নিশ্চিত করার জন্যে যে পুলিশকে জড়িয়ে পড়তে হয় এবং খবরের কাগজে যায় এমন ঘটনা যেন না ঘটে।
‘কলিন্স ঠিকই বলেছে, এই সম্মেলনে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে, তার ষোল আনা দায় গিয়ে পড়বে মার্কিন সরকারের ঘাড়ে’।
জেনারেল শ্যারন ভাবছিল। বলল, ‘তাহলে কমপ্লেক্সের বাইরে তাকে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা কঠিন হবে না। তবে এর জন্যে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা থাকতে হবে’।
জেনারেল শ্যারন থামতেই গোল্ড ওয়াটার বলে উঠল, ‘আহমদ মুসা কি নামে সম্মেলনে যোগদান করেছে’।
‘আহমদ আবদুল্লাহ’।বলল জেনারেল শ্যারন।
‘কোন দেশী হিসেবে’। গোল্ড ওয়াটার বলল।
‘সউদি এ্যরাবিয়ান’।
‘পোশাক?’
‘পশ্চিমী, কিন্তু মুখে দাড়ি। দাড়ির স্টাইলে সে এমন বদলে গেছে যে, ফটো সামনে রেখেও তাকে চেনা কঠিন’।
‘তাহলে চোখ ও ভ্রুর পরিবর্তন ঘটিয়েছে সে?’
হতে পারে।
‘তার থাকার জায়গাটা আপনাদের হোটেলের আশে-পাশে নয়?’
‘না, সবার থাকার জায়গা ১১ তলা ভবনের টপ তিন ফ্লোরে, কিন্তু আহমদ মুসা আছেন তিন তলায়’।
‘এর কি কারণ?’
জেনারেল শ্যারন কিছু বলার আগেই কলিন্স বলল, ‘বিল্ডিংটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেই সেটা বুঝতে পারবেন’।
সবাই জানালা দিয়ে তাকাল। কিন্তু গোল্ড ওয়াটার ও জেনারেল শ্যারনের চোখে এখনও প্রশ্নবোধক দৃষ্টি।
কলিন্স বলল, ‘দেখুন তিন তলা থেকে বিল্ডিংটা সোজা উপরে উঠে গেছে। কিন্তু তিন তলা থেকে গ্রাউন্ড ফ্লোর পর্যন্ত দু’টি স্টেপ একটি দোতালায়, অন্যটি এক তলায়’।
‘সেটা তো দেখাই যাচ্ছে, তাতে কি হয়েছে?’
‘আর দেখুন বিল্ডিংটার এই স্টেপগুলো উপর থেকে তিনতলা পর্যন্ত বিল্ডিংটার চারদিকেই’।
‘হ্যাঁ ঠিক আছে’। বলল তারা দু’জনে এক সাথে।
‘এর অর্থ আহমদ মুসাকে এমন স্থানে রাখা হয়েছে, যেখান থেকে বিল্ডিংটার যে কোন দিক দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে’।
কলিন্সের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল জেনারেল শ্যারন ও গোল্ড ওয়াটার।
‘তার মানে আহমদ মুসা যে কোন পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত আছে’।
গোল্ড ওয়াটার বলল।
‘আহমদ মুসার জন্যে এটাই স্বাভাবিক’। বলল কলিন্স।
‘যতই প্রস্ত্তত থাকুক, এবার আহমদ মুসাকে ফাঁদে পড়তেই হবে। কমান্ডোরা গোটা কমপ্লেক্স ঘিরে রেখেছে’। বলল জেনারেল শ্যারন।
‘ঈশ্বর আপনার কথাকে সত্য করুন’। গোল্ড ওয়াটার বলল।
জেনারেল শ্যারনের চোখে মুখে কিছুটা উদ্বেগের ছাপ।
গোল্ড ওয়াটার থামলেও কোন কথা বলল না শ্যারন। তাকাল ঘড়ির দিকে। সত্যিই তার ভ্রু দু’টি এবার কুঞ্চিত হলো।
গোল্ড ওয়াটার ও কলিন্স উভয়েই বিষয়টি লক্ষ্য করেছে।
‘কি ব্যাপার জেনারেল?’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘কোহেন একটা প্রোগ্রাম ফেল করল কেন তাই ভাবছি’। বলল শ্যারন।
কোহেন একজন বিখ্যাত ইহুদী গোয়েন্দা এজেন্ট। নিউ মেক্সিকোর প্রতিনিধি কারসেন ঘানেম নাবালুসি’র ছদ্মবেশে এই কোহেনই কনফারেন্সে যোগ দিয়েছে। কারসেনের সাথে কোহেনের চেহারার কিছুটা মিল আছে। দু’জনই সেমিটিক-আফ্র মিশ্রণ।
‘কি প্রোগ্রাম ফেল করেছে কোহেন?’ গোল্ড ওয়াটারের চোখে বিষ্ময়।
‘সাড়ে পাঁচটায় আছর নামাজের বিরতি হবে। সে সময় কোহেন বেরিয়ে এসে কনফারেন্স বিল্ডিংটার এ প্রান্তটায় যে ওয়েস্টেজ বক্স আছে, সেখানে এক খন্ড কাগজ ফেলে রেখে যাবার কথা। কিন্তু ৬টা বেজে যাচ্ছে, এখনও সে এল না’।
‘কি কাগজ?’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘কনফারেন্স বিল্ডিংটার ফ্লোর ও আউট গেট ডিজাইন এবং আহমদ মুসার বর্তমান ছদ্মবেশসহ তার ফটো’।
‘দু’টোই তো খুব গুরুত্বপূর্ণ’। বলল এফ. বি. আই গোয়েন্দা কলিন্স।
‘নামাজের বিরতি হলেও কোন প্রোগ্রামে হয়ত আটকা পড়েছে’।
গোল্ড ওয়াটার বলল।
‘না মিঃ গোল্ড ওয়াটার। কোহেন এমন একজন গোয়েন্দা ব্যক্তিত্ব যার কর্মসূচীতে এক মিনিটও এধার ওধার কখনও হয় না। যতগুলো অসাধ্য সাধন সে করেছে, সবগুলোই নির্দিষ্ট সময়সূচীর ভেতরেই সে সম্পন্ন করেছে। এটা তাঁর রেকর্ড’।
‘তাহলে?’ বলল গোল্ড ওয়াটার চিন্তিত কণ্ঠে।
ভাবল কিছুক্ষণ জেনারেল শ্যারন।
তারপর জেগে উঠার মত দ্রুত তার ট্রাভেল কিট টেনে নিল। বের করল সিগারেট লাইটার সাইজের অয়্যারলেস রিসিভার। একটা বড় সাইজের স্পীকার বের করে তার সাথে কানেকশন জুড়ে দিল অয়্যারলেস রিসিভারের। বলল, ‘চিন্তা করে লাভ কি? কিছু ঘটলে অয়্যারলেসই তা বলে দিবে’।
বলে অয়্যারলেসের মেসেজ স্কোরের ‘কী’টা অন করে দিল।
স্পীকার সরব হয়ে উঠল।
প্রথম দিকে তেমন কিছুই পাওয়া গেল না। নানা কথা-বার্তা, আলাপ-আলোচনা-নিত্য দিনকার স্বাভাবিক ধারা বিবরণী।
নিউ মেক্সিকোর প্রতিনিধি মিঃ কারসেনের ছদ্মবেশে কনফারেন্সে যোগদানকারী ইহুদী গোয়েন্দা কোহেনের কাছে ছোট বোতাম আকৃতির যে অয়্যারলেস ট্রান্সমিটার আছে তা কোন সময় অফ করা যায় না। সব সময় অন থাকে এবং অব্যাহতভাবে শব্দ করে, যাই ঘটুক তা নিখুঁতভাবে পাঠায়।
টেবিলের উপর রাখা অয়্যারলেস স্পিকারে তখন বক্তৃতা ভেসে আসছে।
‘কনফারেন্সে বক্তৃতা যেমন চলছে, সব বক্তৃতাই এভাবে রেকর্ড হবে। বিরাট দলিল এটা। এফ.বি.আই কিনতে চাইলে আমরা বিক্রি করতে পারি’। এফ.বি.আই এজেন্ট মিঃ কলিন্সের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল জেনারেল শ্যারন।
‘এই জন্যই বুদ্ধিতে আপনারা শ্রেষ্ঠ। তবে এক্ষেত্রে ব্যবসাটা হবে না। কারণ, প্রতি সেশনের ফুল প্রসিডিংস আমরা পেয়ে যাব’। বলল কলিন্স।
‘পেয়ে যাবেন, কেমন করে?’ বিষ্মিত কন্ঠ জেনারেল শ্যারনের।
‘এ ধরনের সম্মেলন করতে দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের একটাই শর্ত ছিল। সেটা হলো সম্মেলন সেশন গুলোর ফুল প্রসিডিংস এবং সম্মেলনে দাওয়াত প্রাপ্তদের তালিকা আমাদের দিতে হবে। তালিকা তারা দিয়েছে। সম্মেলনের সেশনগুলোর ফুল রেকর্ড তারা দিচ্ছে’। কলিন্স বলল।
‘দিচ্ছে নয়, দিবে’। সংশোধন করতে চাইল শ্যারন।
‘দেবে নয়, দিতে শুরু করেছে। প্রতিটি সেশন পরেই সে সেশনের রেকর্ড তারা পাঠিয়ে দিচ্ছে’।
স্পীকারে তখন বক্তৃতা চলছিল।
হঠাৎ বক্তৃতার শব্দ তরঙ্গের মাঝে একটা কন্ঠ ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘মিঃ কারসেন, আপনি একটু আসুন। জরুরী প্রয়োজন’। সামান্য একটু নিরবতা। তারপর আরেকটি কন্ঠ উচ্চারিত হলো, ‘চলুন’।
শেষের এ কন্ঠটি ইহুদী গোয়েন্দা কোহেনের।
তারপর অবার নিরবতা। স্পীকারে বক্তৃতার শব্দ ক্ষীণ হতে হতে এক সময় থেমে গেল।
‘তার মানে ডাকতে আসা লোকটি কোহেনকে নিয়ে সেমিনার হল থেকে বেরিয়ে এসেছে’। বলল জেনারেল শ্যারন।
‘ঠিক তাই’। গোল্ড ওয়াটার বলল।
আরও কতকগুলো মুহূর্ত পার হলো।
একটা দরজা খোলার শব্দ স্পীকারে ভেসে এলো। তারপর ভেসে এলো তা বন্ধ হবার শব্দও।
‘কোহেনকে নিয়ে লোকটি একটি ঘরে প্রবেশ করেছে। বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আসুন মিঃ কারসেন। আপনাকে সালাম দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত’। নতুন একটি কন্ঠস্বর স্পীকারে শোনা গেল।
নতুন কন্ঠটি কথা শেষ করে মুহূর্ত কালের মধ্যেই আবার বলে উঠল, ‘চমকে উঠলেন কেন মিঃ কারসেন? ঘানেম নাবালুসি তো সামান্য এই কথায় চমকে উঠার কথা নয়, বলুন’।
অয়্যারলেস স্পীকারে এই কথাগুলো শেষ হতেই চমকে উঠল জেনারেল শ্যারনও। তার চোখে মুখে সন্দেহ ও অস্বস্তির একটা ছায়া।
স্পীকারে কথা বলে উঠল আবার সেই নতুন কন্ঠটিই। বলল, ‘আচ্ছা মিঃ কারসেন, আপনার ওয়াশিংটনে পৌঁছার কথা ‘এয়ার আমেরিকার ‘জিরো জিরো থ্রি’ ফ্লাইটে, আর আপনি পৌঁছলেন প্রায় ১২ ঘন্টা পর ‘জিরো সেভেনটিন’ ফ্লাইটে, কেন?’
‘এখন এসব প্রশ্নের আমি অর্থ বুঝতে পারছি না। আপনিই বা এ প্রশ্ন করছেন কেন? কনফারেন্স নেতৃবৃন্দ তো রয়েছেন’।
‘কন্ঠটা কোহেনের, জানাল জেনারেল শ্যারন শুকনো গলায়।
‘আপনি তো দেখছেন, কনফারেন্সের নেতৃবৃন্দ আমার পাশেই বসে আছেন। তাদের পক্ষ থেকেই এ প্রশ্ন আমি করছি’। বলল সেই নতুন কন্ঠ।
‘আমাকে এভাবে প্রশ্ন করার অর্থ কি? ফ্লাইট ধরতে না পারা, ফ্লাইট চেঞ্জ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার’। স্পীকারে ভেসে এল কোহেনের কন্ঠ।
‘ফ্লাইট ধরতে না পারলে, ফ্লাইট চেঞ্জ করলে মাত্র বার ঘন্টার ব্যবধানে টিকিট তো চেঞ্জ করার প্রয়োজন হয় না। আপনি টিকিট চেঞ্জ করেছেন কোন কারণে?’
নতুন কন্ঠটির স্বর উৎকর্ণ হয়ে শুনছিল জেনারেল শ্যারন। বলল সে শুকনো কন্ঠে, ‘মিঃ গোল্ড ওয়াটার চিনতে পারছেন এ কন্ঠ’।
‘না’। বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, এটা আহমদ মুসার কন্ঠ, যিনি আহমদ আবদুল্লাহ নামে সম্নেলনে যোগ দিয়েছেন’।
কিছু বলতে যাচ্ছিল গোল্ড ওয়াটার। কিন্তু তার আগেই স্পীকারে কোহেনের হাসির শব্দ শোনা গেল। বলল, ‘এসব ছোট খাট জিনিস নিয়ে আপনারা সময় নষ্ট করছেন কেন বুঝতে পারছি না। কেউ টিকিট হারিয়ে ফেললে সে নতুন টিকিট করতে পারে’।
‘মিঃ কারসেন ১২ ঘন্টা পর ভিন্ন ফ্লাইটে আসার কারণ বলেছেন ফ্লাইট ধরতে না পারা, এখন নতুন টিকিট কাটার কারণ বলছেন টিকিট হারিয়ে যাওয়া। টিকিট হারিয়ে যাওয়ার কথাটা ভিন্ন ফ্লাইটে আসার কারণ হিসেবে আগেই আসতে পারতো। তা আসেনি, কারণ কথাটা পরে বানানো। ফ্লাইট ধরতে না পারা কথাটাও বানানো নয় কি?’
স্পীকারে ভেসে আসে আহমদ আবদুল্লাহ ওরফে আহমদ মুসার কথা শুনে মুখ চুপসে গেল জেনারেল শ্যারনের। বলল, ‘সর্বনাশ গোল্ড ওয়াটার, ওরা কোহেনকে সন্দেহ করছে’।
‘ঠিক মিঃ জেনারেল, কিন্তু এটুকু প্রমাণ দিয়ে কারও সম্পর্কে ফাইনাল কথা বলা যায় না। সন্দেহ করা যায় মাত্র’।
স্পীকারে ভেসে এল কোহেনের গলা। বলল, ‘দেখুন আমি আমন্ত্রিত অতিথি। এভাবে আপনারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন না। এটা অপমান করা’।
‘আপনার দুটো কারণই বানানো, মিথ্যা –এ কথার তো কোন জবাব দিলেন না?’ আহমদ আবদুল্লাহর গলা ভেসে এল স্পীকারে।
‘অহেতুক বিষয় জবাব দেবার মত নয়’। কন্ঠ কোহেনের।
‘আচ্ছা মিঃ কারসেন এ দু’টো ডকুমেন্ট দেখুন। একটি হলো সম্মেলনে যোগদানের সম্মতিসূচক লেটার অব এ্যাকসেপট্যান্স, অন্যটি সম্মেলনে আসার পর রেজিষ্ট্রেশন ফরম। দু’টোতেই মিঃ কারসেন মানে আপনার দস্তখত আছে। দেখুন তো দুই দস্তখত কি একজনের?’ স্পীকারে আহমদ আবদুল্লাহর কন্ঠ।
স্পীকার নিরব। কোহেনের কোন উত্তর নেই।
স্পীকারে আহমদ আবদুল্লাহরই অনুচ্চ, অথচ অত্যন্ত শক্ত কন্ঠ ভেসে এল। বলছে সে, ‘না মিঃ কারসেন টেবিল থেকে হাত দু’টো যতটুকু টেনেছেন, আর টানবেন না। টানলে দু’হাতই হারাবেন, কারণ আমার গুলি লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয় না। আমি জানি, পড়ার জন্যে আপনার চশমার দরকার নেই। সম্মেলনে আসার পর লেখাপড়ার কোন কাজেই আপনি চশমা ব্যবহার করেননি। অতএব পকেট থেকে চশমা বের করবেন, এটা ঠিক নয়’।
কথায় একটু ছেদ নামল স্পীকারে। তারপরই আহমদ আবদুল্লাহ মানে আহমদ মুসার উচ্চকন্ঠ হাসি। তার কানে সাথে সাথেই ভেসে এল তার কন্ঠ, ‘আমি জানি, আপনার কোটের ভেতরের পকেটে যেখানে চশমা আছে, তার পাশেই শোল্ডার হোলস্টারে ঝুলছে নিউট্রন রিভলবার। সে রিভলবারের একটা বিষাক্ত ফায়ার কক্ষে উপস্থিত আমাদের ক’জনকে চোখের পলকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে এবং অন্তত ছ’মাসের জন্যে নিষ্ক্রিয় করে দেবে’।
মুহূর্ত কালের জন্যে নিরব হলো স্পীকার।
পরক্ষণেই আবার স্পীকারে কন্ঠ ভেসে এল আহমদ মুসার। বলছে সে কাউকে উদ্দেশ্য করে, ‘তোমরা এর পকেট থেকে নিউট্রন রিভলবারটা বের করে নাও। সার্চ করে দেখ দু’পায়ের মোজার সাথে আটকানো রিভলবার পেতে পার। সব শেষ অস্ত্র হিসেবে কোমরে বেল্টের আড়ালে একটা সুইচ নাইফ নিশ্চয় সে রেখেছে’।
নিরব হলো স্পীকার।
‘লোকটা অন্তরদ্রষ্টা নাকি। যে যে অস্ত্রের কথা আহমদ মুসা বলেছে সে সে অস্ত্র কোহেনের সেভাবেই রয়েছে’। বিষ্ময় মিশ্রিত করুণ কন্ঠে বলল জেনারেল শ্যারন।
‘কিন্তু অয়্যারলেস ট্রান্সমিটার কোহেনের কাছে আছে এটা আহমদ মুসা বলতে পারেনি’। বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘এ জন্যেই আহমদ মুসা সর্বদ্রষ্টা বা অন্তরদ্রষ্টা নয়। কিন্তু অদ্ভূত নিখুঁত অনুমান তার’। জেনারেল শ্যারন বলল।
‘এমনও হতে পারে। কোহেনকে সন্দেহ করার পর আহমদ মুসা কোহেনের অজান্তে তাকে এবং তার লাগেজ সার্চ করেছে’। বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘হতে পারে, কিন্তু এভাবে কোহনেকে সার্চ প্রায় অসম্ভব। সার্চ করলে কোহেনের কাছে অবশ্যই তা ধরা পড়তো। আর ধরা পড়লে আগেই সে সাবধান হয়ে যেত। তাহলে এই বিপদে তাকে পড়তে হতো না’। বলল জেনারেল শ্যারন।
স্পীকার কথা বলে উঠল আবার।
স্পীকারে এবার অপরিচিত গলা। বলল, ‘মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ, এদিকটা আপনি দেখুন। জরুরী টেলিফোন। আমি আসছি’।
‘ঠিক আছে,আসুন’। স্পীকারে আহমদ মুসার গলা।
স্পীকারে একটু নিরবতা।
মুহূর্ত কয়েকের মধ্যেই স্পীকারে ভেসে এল আহমদ মুসার গলা আবার। বলল, ‘দেখছেন তো অস্ত্রগুলো? একটা নিউট্রন রিভলবার, দুটো সাধারণ রিভলবার এবং একটা সুইচ নাইফ, মানে একটা যুদ্ধের অস্ত্র আপনার কাছে। মিঃ কারসেনের কাছে কি এগুলো থাকার কথা? মিঃ কারসেনের ছদ্মবেশে কে আপনি?’
স্পীকারে কোহেনের হাসির শব্দ ভেসে এল। হাসির সাথে সাথে তার কন্ঠও। বলল সে, ‘আহমদ মুসা আপনিও ছদ্মবেশ নিয়ে সম্মেলনে এসেছেন, আমিও ছদ্মবেশ নিয়ে সম্মেলনে এসেছি। আপনি জিতেছেন, আমি হেরে গেছি। এর বেশী আর কিছু জানতে পারবেন না’।
এবার স্পীকারে ভেসে এল আহমদ মুসার হাসি। বলল, ‘ভাল বলেছেন আপনি। দু’জনেরই ছদ্মবেশ। কিন্তু অনেক পার্থক্য।
সম্মেলনের উদ্যোক্তা ও অতিথি কারো কাছেই আমার ছ্দ্মবেশ নেই। সকলেই আমার পরিচয় ও নাম জানেন। কিন্তু আপনার নাম, পরিচয় আমরা কেউ জানি না। এখন আমরা সেটাই জানতে চাচ্ছি’।
স্পীকারে আহমদ মুসার কন্ঠ থেমে গেল। কিন্তু স্পীকার নিরব হওয়ার পরক্ষণেই আবা সরব হয়ে উঠল। স্পীকারে গলা পাওয়া গেল এবার টেলিফোন ধরতে যাওয়া সেই লোকটির। বলছে কন্ঠটি, ‘মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ, মিঃ কারসেনের ভাই সারাসিন ঘানেম ফোন করেছিল ‘সান্তাফে’ থেকে। কিছুক্ষণ আগে উনি কথা বলেছেন এই মিঃ কারসেনের সাথে। কথা বলেই তাদের সন্দেহ হয়েছে। উনি টেলিফোন করেছিলেন জানার জন্যে যে, কি ঘটনা, তার ভাই কোথায়। এ নিয়ে তাদের বাড়িতে সবাই উদ্বিগ্ন’।
থেমে গেল স্পীকার। কথা শেষ করেছে লোকটি।
মহূর্ত মাত্র। স্পীকারে ভেসে এলো আহমদ মুসার গলা। বলছে কন্ঠটি, ‘বলুন মিঃ ছদ্মবেশী কারসেন, আপনি কে? মিঃ কারসেনকে কোথায় রেখেছেন, না তাকে হত্যা করেছেন?’ কঠোর কন্ঠ আহমদ মুসার।
‘কোন সাহায্যই আপনাকে করব না আহমদ মুসা’। স্পীকারে শক্ত গলা মিঃ কোহেনের।
চোখে মুখে ভীষণ উদ্বেগ জেনারেল শ্যারনের। গোল্ড ওয়াটার ও কলিন্সের মুখও শুষ্ক। তাদের মুখেও কোন কথা নেই।
কোহেনের কথার পর স্পীকার থেমে গিয়েছিল মুহূর্তের জন্যে। সেটা আবার সরব হয়ে উঠল। কঠোর কন্ঠ ভেসে এল আহমদ মুসার। সে বলছে, ‘এক আদেশ আমি দু’বার দেই না। বলুন শেষ সুযোগ এটা আপনার’।
‘বলেছি তো কোন সাহায্য আমার পাবেন না আপনি’ স্পীকারে কোহেনের কন্ঠ।
স্পীকার নিরব হলো।
হঠাৎ স্পীকার মোটা স্বরে ‘দুপ’ করে উঠল। তার সাথে সাথেই একটা আর্ত চিৎকার। চিৎকার কোহেনের।
আর্তনাদ করে উঠল জেনারেল শ্যারন। বলে উঠল আর্তস্বরে, ‘শয়তানটা কি কোহেনকে হত্যা করল?’
‘না, চিৎকারের ধরন সে কথা বলে না। আহমদ মুসা নিশ্চয় সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার ব্যবহার করেছে। নিশ্চয় আহমদ মুসা কোহেনের এমন জায়গায় গুলি করেছে যাতে কষ্ট পায়। কোহেনকে কথা বলাতে চায় আহমদ মুসা’। বলল এফ.বি. আই গোয়েন্দা কলিন্স।
‘আমাদের কিছু করা দরকার। এখনও না মেরে থাকলে যে কোন সময় আহমদ মুসা তাকে মেরে ফেলবে। মিঃ কলিন্স, মিঃ গোল্ড ওয়াটার আমাকে সাহায্য করুন। এখনি আমাদের কমান্ডোদের পাঠিয়ে তাকে মুক্ত করে আনা উচিত’। উত্তেজিত কন্ঠে বলল জেনারেল শ্যারন।
‘তাতে বিরাট রক্তপাত হবে। অনেক লোক মারা যেতে পারে। এ হত্যাকান্ড জাস্টিফাই করা যাবে না। এ ঝুঁকি নেয়া যাবে না’। পরিষ্কার কন্ঠে বলল কলিন্স।
‘ওদের কাছে বে আইনি অস্ত্র আছে। বেআইনি অস্ত্র দিয়ে একজন লোককে তারা আহত করেছে, এই অভিযোগে এফ.বি.আই সম্নেলনে ঢুকে আহমদ মুসাকে গ্রেপ্তার ও কোহেনকে মুক্ত করতে পারে’। বলল জেনারেল শ্যারন।
হাসল মিঃ কলিন্স। বলল, মিঃ জেনারেল উত্তেজিত হয়ে বাস্তবতাকে আপনি ভূলে যাচ্ছেন। এখন এফ.বি.আই ভেতরে ঢুকলে বেআইনি কোন অস্ত্রও পাবে না এবং আহত মিঃ কোহেনকেও পাবেনা। আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগে দু’টোকেই তারা সরিয়ে ফেলবে। আপনি ভূলে যাচ্ছেন কেন, সেখানে আহমদ মুসা আছে। সেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে সেখানে’।
তাহল? কি করব আমরা? কিছু তো করতে হবে তাকে উদ্ধারের জন্যে’। বলল জেনারেল শ্যারন আকুল কন্ঠে।
‘মিঃ জেনারেল, অয়্যারলেস রেকর্ডে কি ঘটেছে পুরো শুনুন। তারপর করণীয় ঠিক করা যাবে। এখন তাড়াহুড়ো করে কোন লাভ নেই। যখন ঘটনা রেকর্ড হয়েছে সে সময় এবং যখন আমরা শুনছি তা এক সময় নয়। হতে পারে এ দু’ সময়ের মাঝে অনেক ব্যবধান’।
‘হ্যাঁ কলিন্স ঠিক বলেছে জেনারেল’। গোল্ড ওয়াটার বলল।
‘হ্যাঁ ঠিক বলেছেন। আমি সময়ের এই পার্থক্যের ব্যাপারটা একদমই ভূলে গিয়েছেলাম’। বলল জেনারেল চিন্তিত কন্ঠে।
স্পীকার সরব হয়ে উঠল আবার।
কন্ঠ ভেসে এল আহমদ মুসার। বলছে, ‘ডান কান উড়ে গেছে, এবার বাম কান উড়ে যাবে মিঃ ছদ্মবেশী কারসেন। আপনার পরিচয় আর আমার দরকার নেই। পরিচয় আপনার আমি পেয়ে গেছি। আপনি জেনারেল শ্যারনের লোক। একজন ইহুদী গোয়েন্দা ছাড়া আর কিছু নন। বলুন, মিঃ কারসেনকে কোথায় রেখেছেন?’
নীরব হলো স্পীকার। মুহূর্ত পরেই ভেসে এল আহমদ মুসার গলা। বলছে, ‘তিন পর্যন্ত গুনব। তিন উচ্চারিত হবার সাথে সাথে আমার গুলি ছুটবে’।
পরক্ষণেই স্পীকারে ভেসে এল আহমদ মুসার এক উচ্চারণের শব্দ।
স্পীকারে কন্ঠ শোনা গেল কোহেনের। বলছে, ‘আমি যখন ধরা পড়েই গেছি, তখন মিঃ কারসেন কোথায় তা বলতে আপত্তি নেই। তবে একটা শর্ত’।
‘কি শর্ত?’ স্পীকারে কন্ঠ আহমদ মুসার।
‘বিনিময় হতে হবে। আমাকে ছেড়ে দেবেন, তাকে আমরা ফিরিয়ে দেব’। স্পীকারে কন্ঠ মিঃ কোহেনের।
‘আপনি বলেন, কারসেন কোথায়, তাকে পাওয়ার পর আপনার মুক্তির কথা বিবেচনা করব’। কন্ঠ আহমদ মুসার।
‘এটা কিন্তু প্রতিশ্রুতি হলো না’। কন্ঠ কোহেনের।
‘যা বলেছি, তার বাইরে আর কোন কথা নেই’। স্পীকারে ভেসে আসা এই দৃঢ় কন্ঠটি আহমদ মুসার।
‘কাগজ কলম দিন, লিখে ও এঁকে দিচ্ছি’। কোহেনের কন্ঠ স্পীকারে।
নীরবতা নেমে এলো স্পীকারে বেশ কিছুক্ষণ।
‘কোহেন নিশ্চয় লিখে দিচ্ছে ঠিকানা’। গোল্ড ওয়াটার বলল।
এতক্ষণে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেছে জেনারেল শ্যারনের মুখে। বলল, ‘কোহেন ঠিক কাজ করেছে। সময় পেল সে। আমরাও সময় পেলাম। মিঃ কারসেন এখন আমাদের কাছে মূল্যবান কেউ নয়। আহমদ মুসা অবশ্যই কিছুটা রিল্যাক্সড হবেন এখন। সেটা হবে আমাদের জন্যে সুযোগ তাকে খাঁচায় বন্দী করার’।
‘ষড়যন্ত্র একটা হচ্ছে এখানে তাকে ঘিরে, এটা জেনে যাওয়ার পর আরও সাবধান হবে না?’ বলল কলিন্স।
‘তা হবে না। কিন্তু সম্মেলনের ভেতর থেকে কোন বিপদ আর নেই এটা জানার পর সে নিশ্চিন্ত হবে। আমি চাই সে সম্মেলন থেকে না পালাক। তাহলেই একটু সুযোগ আমরা পেয়ে যাব’। জেনারেল শ্যারন বলল।
জেনারেল কথা শেষ করার আগেই স্পীকার কথা বলে উঠছে। কন্ঠ এবার আহমদ মুসার। বলছে, ‘ধন্যবাদ মিঃ ইহুদী গোয়েন্দা। ইহুদীরা যে নিজেদের ব্যাপারে খুব বাস্তববাদী, আপনিও তা প্রমাণ করলেন’।
একটু নিরবতা স্পীকারে।
স্পীকারে আবার কন্ঠ ভেসে এল আহমদ মুসার। বলছে, ‘এর কানটায় ব্যান্ডেজ বেঁধে কিছু ঔষধ খাইয়ে দিন। তারপর ওর হাত পা বেঁধে ঘুম পাড়িয়ে দিন। আমি একেও নিয়ে যাব যাবার সময়। নিয়ে যেতে বলুন এঁকে’।
‘কোথায় যাবেন?’ ঘরের ভেতর থেকেই এক অপরিচিত কন্ঠ।
‘আমি যাব নিউ মেক্সিকোতে মিঃ কারসেনের সন্ধানে’। কন্ঠটি আহমদ মুসার।
‘এখনি?’ জিজ্ঞাসা সেই অপরিচিত কন্ঠটির।
‘এখনি’, কন্ঠ আহমদ মুসার।
‘ওঁকেও ওখানে নেবেন? অসুবিধা হবে না তো?’ সেই অপরিচিত কন্ঠই আবার শোনা গেল।
‘না, ওকে নিচ্ছি না। নিরাপদ একটা স্থানে ওকে রেখে যাব। সম্মেলন কেন্দ্রে ওকে আর এক মূহুর্ত রাখাও নিরাপদ নয়’।
দরজা খোলার শব্দ এল স্পীকারে। বন্ধ করারও শব্দ পাওয়া গেল।
আর শোনা গেল না আহমদ মুসার কন্ঠ।
‘কোহেনকে আহমদ মুসার লোকরা বের করে এনেছে ঘর থেকে’। জেনারেল শ্যারন বলল।
‘ঠিক’। বলল মিঃ কলিন্স।
‘মিঃ কলিন্স আর দেরী করলে কোহেনকে উদ্ধার হয়তো আর কোন দিনই করা যাবে না। কিছু করতে হবে এবং তা এই মুহূর্তেই’। জেনারেল শ্যারন বলল।
‘উদ্ধার করা যাবে না কেন? আহমদ মুসা কোন প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করেনি বটে। কিন্তু তার কথা শুনে মনে হয়েছে মিঃ কারসেনকে পাওয়ার পর তারা কোহেনকে ছেড়ে দেবে’।
‘না দেবে না। কারণ, কারসেনকে পাওয়ার আগেই আহমদ মুসা আমাদের খাঁচায় বন্দী হবে’। বলল শ্যারন।
‘কি ভাবে?’ বলল কলিন্স।
‘কোহেন আহমদ মুসাকে মিঃ কারসেনের বন্দী করে রাখার স্থান বলে দিয়ে আহমদ মুসাকে ধরার একটা ফাঁদ আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। আহমদ মুসা কারসেনকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেই আমাদের হাতে চলে আসবে। এখন যদি আহমদ মুসাকে সম্মেলন কেন্দ্র থেকে ধরা না যায়, তাহলে এই মুহূর্তেই আমাদের যাত্রা করতে হবে নিউ মেক্সিকোতে’।
‘তাহলে কোহেনকে আর উদ্ধার করতে পারছেন না’। বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘কেন?’ শ্যারন বলল।
‘কারণ, এখন কোহেন কিংবা আহমদ মুসা কেউই সম্মেলন কেন্দ্রে নেই। কোহেনকে নিরাপদ স্থানে রেখে আহমদ মুসা নিশ্চয় এখন মেক্সিকোর পথে রয়েছে’।
চমকে উঠল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘সত্যি তো। ভূলেই গিয়েছিলাম, ঘটনা ঘটার সময় এবং ঘটনার রেকর্ড শোনার সময়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য’।
বলেই উঠে দাঁড়াল জেনারেল শ্যারন। আসুন আমরা প্রস্তুত হই।
এখনি আমাদের নিউ মেক্সিকো যাত্রা করতে হবে’।
‘কিসে যাবে?’
‘আহমদ মুসা নিশ্চয় কোন এয়ার লাইন্সে নিউ মেক্সিকো যাচ্ছে। তার আগে আগে আমাদের পৌঁছতে হলে আপনার জেট বিমান ছাড়া কোন উপায় নেই। সব ধরনের খরচ আমি বহন করব। আপনি আপনার জেট প্রস্ত্তত করতে বলে দিন’।
‘ঠিক আছে মিঃ শ্যারন। কিন্তু মনে থাকে যেন আহমদ মুসাকে আমাদের কাছে থেকে কেনার চুক্তি এখনও বাতিল হয়নি’। গোল্ড ওয়াটার বলল।
‘না আমি ভূলিনি মিঃ গোল্ড ওয়াটার। আহমদ মুসাকে হাতে পেলে পয়সা আমাদের জন্যে কোন ব্যাপার নয়’।
‘কিন্তু আমাকে নিউ মেক্সিকো যেতে হলে এফ.বি.আই কর্তৃপক্ষের অনুমতি দরকার’। বলল কলিন্স।
‘না আপনাকে অবশ্যই যেতে হবে আমার সাথে। আপনি থাকলে একটা লিগ্যাল প্রটেকশন আমাদের সাথে থাকবে। ঠিক আছে আমি এখনি টেলিফোন করছি জর্জ আব্রাহাম জনসনকে’।
বলে জেনারেল শ্যারন টেলিফোন তুলে নিল হাতে।
সান্তাফে বিমান বন্দরে ল্যান্ড করল আহমদ মুসা।
খুব সাধারণ ছদ্মবেশ তার।
মুখে গোঁফ লাগানো হয়েছে, যা কোন সময়ই লাগায় না এবং মাথাভর্তি ঈষৎ কোঁকড়া চুল পরেছে।
এতেই আহমদ মুসা একদম অন্য মানুষ হয়ে গেছে।
সাথে কোন লাগেজ নেই। লাগেজ রাখবেই বা কোথায়?
যে ধরনের কাজে এসেছে তাতে সাথে লাগেজ বহনের অবকাশও নেই।
আহমদ মুসার সামনে হাঁটছিল এক বৃদ্ধ। বয়স আশি-নব্বই এর মত হবে। একটা ট্রলিতে ব্যাগ ঠেলে নিচ্ছিল সে।
কষ্ট করে ভারসাম্য রক্ষা করে হাঁটছে সে।
গ্যাংওয়ের একটা উঁচু লেয়ারে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল বৃদ্ধ।
আহমদ মুসা তাকে ধরে ফেলল।
‘ধন্যবাদ’। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল বৃদ্ধটি।
বৃদ্ধটি রেড ইন্ডিয়ান, দেখল আহমদ মুসা।
‘ওয়েলকাম। আমি যদি ট্রলিটা বহন করি, আপনি তা কি পছন্দ করবেন?’
বৃদ্ধটি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘না আমি অপছন্দ করব না’।
আহমদ মুসা ব্যাগসহ ট্রলি ঠেলে বৃদ্ধের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
লাউঞ্জ থেকে বের হবার সময় বৃদ্ধ আহমদ মুসাকে বলল, ‘তুমি অবশ্যই বিদেশী। কিন্তু একেবারে যে খালি হাত!’
‘বিদেশী হলেও চাকুরে, চাকুরীর মাধ্যমে অনেকেই এদেশী হয়ে গেছে। তাদের খালি হাতে সফর তো হতে পারে’। আহমদ মুসা বলল।
‘তোমার কি সান্তাফে’তে বাড়ি বা বাসা আছে?’ বলল বৃদ্ধ।
‘নেই’।
‘আত্মীয় স্বজন আছে?’
‘নেই’।
‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব আছে?’
‘নেই’।
‘তাহলে তো হলো না। তুমি ওয়াশিংটন থেকে আসছ নিউ মেক্সিকো। খালি হাতে খুব স্বাভাবিক নয়’।
বুড়োর বিশ্লেষণী শক্তি দেখে অবাক হলো আহমদ মুসা। মুখে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা, ‘স্বাভাবিকের একটা ব্যতিক্রম তো আছে’।
‘আছে! সেটা অস্বাভাবিক’।
‘অস্বাভাবিক ঘটনা তো ঘটতেই পারে’।
লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে এসেছে তারা।
গাড়ি বারান্দায় আসার পর আহমদ মুসা ট্রলিটা রেখে বৃদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনার জন্যে গাড়ি ঠিক করব কি? কোথায় যাবেন আপনি?’
‘ছেলের বাসা আছে এই সান্তাফে শহরেই। সেখানেই যাব, বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। তুমি কোথায় যাবে?’
‘যাবো সান্তা ফ্লারা। সেখান থেকে ক্লীফ ডোয়েলিং’।
‘তার মানে ক্লীফ ডোয়েলিং যাবে। তুমি পর্যটক বুঝি?’
‘দেশ বেড়ানো পর্যটন হলে আমি অবশ্যই পর্যটক’।
‘কিন্তু তুমি তাহলে সান্তা ফ্লারা যাবে কেন? ওখান থেকে ক্লীফ ডোয়েলিং যাবার রাস্তা সরাসরি নেই। ‘এস্পানোলা থেকে সরাসরি যোগাযোগ ক্লীফ ডোয়েলিং এর। আরও একটা সুখবর আমাদের বাড়ি এস্পানোলায়’।
‘সত্যি সুখবর। ঠিক আছে আমি এস্পানোলা হয়েই যাই। কিন্তু আপনি তো যাচ্ছেন না’।
‘হ্যাঁ যাচ্ছি। আমার বড় নাতি, আমার ছেলের বড় ছেলে খুন হয়েছে খেলার মাঠে হোয়াইটদের সাথে এক সংঘর্ষে। তুমি চল না আমার সাথে। ওদিককার অবস্থা একটু দেখে আমিও এস্পানোলা যাব, অথবা কাউকে দিয়ে তোমাকে পাঠিয়ে দেব’।
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি খুশী হতাম আপনার ছেলেদের সাথে পরিচিত হতে পারলে। কিন্তু আমার একটু তাড়া আছে’।
বলে আহমদ মুসা একটা গাড়ি ডেকে বৃদ্ধকে তুলে দিল গাড়িতে। লাগেজগুলো তুলে দিয়ে বিদায় নেবার জন্যে বৃদ্ধের কাছে যেতেই একটা টুকরো কাগজ আহমদ মুসার হাতে তুলে দিয়ে বলল, এতে এস্পানোলার যেখানে আমাদের বাড়ি তার ঠিকানা আছে। তুমি সেখানে এস। আমি কালকের মধ্যেই আশা করি বাড়ি পৌঁছব’।
‘যখন এখানে আমার কেউ নেই, তখন এ ধরনের আশ্রয়ের আহবান লোভনীয়’।
বলে গুডবাই জানিয়ে চলে যাচ্ছিল আহমদ মুসা।
বৃদ্ধ চিৎকার করে উঠল, ‘শোন শোন তোমার নামটাই বলনি’।
আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়িয়ে দু’পা সরে এসে বলল, ‘আহমদ আবদুল্লাহ’।
‘তুমি মুসলমান?’
‘কেন খারাপ মনে করছেন না তো?’
‘না হে, ভাল মনে করছি’।
‘মুসলমানদের সাথে পরিচয় আছে?’
‘বলব না, তুমি এস তখন বলব।
শুনলে তুমিও খুশী হবে’।
‘ঠিক আছে, আল্লাহর ইচ্ছা’।
বলে চলে যাবার জন্যে পা বাড়াল আহমদ মুসা আবার।
কিন্তু পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, লজ্জা বিজড়িত কন্ঠে, ‘স্যার, আপনার ঠিকানা পেলাম, সেখানে তো আপনার নাম নেই’।
হাসল বৃদ্ধ, বলল, লিখে নাও, ‘রসওয়েল পাবলো’।
আহমদ মুসা দ্রুত ‘ক্লীফ ডোয়েলিং’ পৌঁছতে চেয়েছিল। পারল না। একটা রাত এস্পানোলাতে তাকে থাকতে হলো।
থাকতে হলো খোঁজ খবর নেবার জন্যেও।
আহমদ মুসার গন্তব্য ক্লীফ ডোয়েলিং নয়। ক্লীফ ডোয়েলিং থেকে একটু দক্ষিণে ‘লস আলামোসে’র দিকে একটু এগুলে গম্বুজাকৃতি একটা সবুজ পাহাড় আছে সেটাই তার গন্তব্য। সেই সবুজ পাহাড়ের মালিক ছিলেন একজন ইহুদী বিজ্ঞানী। তিনি মৃত্যুর সময় তার বাড়ি সমেত সবুজ পাহাড়টি দিয়ে গেছেন তাদের ধর্মীয় ‘সিনাগগ’ কে। সেখানে সেই বিজ্ঞানীর স্মৃতিতে তৈরী হয়েছে এক ‘সিনাগগ’। সেই সিনাগগকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ইহুদীবাদীদের একটা গোপন আস্তানা। এই গোপন আস্তানার একটা বড় কাজ হলো ‘লস আলামোসে’র উপর গোয়েন্দাগিরি করা।
‘লাস আলামোস’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরোনো, সবচেয়ে সমৃদ্ধ পারমাণবিক গবেষণ কেন্দ্র। এই কেন্দ্রেই তৈরী হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম আণবিক বোমা। এখন এই গবেষণাগারে ‘স্ট্রাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ’ (SDI) এর নানা দিকের উপর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চলছে। সবুজ পাহাড়ের ইহুদী সিনাগগ এ গবেষণার উপরই চোখ রাখছে। প্রতিটি উন্নয়ন এবং পরিকল্পনা ও প্রস্তাব তারা মনিটর করে।
আহমদ মুসা খোঁজ নিয়ে জেনেছে ‘ক্লীফ ডোয়েলিং’ থেকে তাকে যেতে হবে সবুজ পাহাড়ের সিনাগগের দিকে। ক্লীফ ডোয়েলিং থেকে দক্ষিণ দিকে ‘লস আলামোস’ পর্যন্ত এবং তার আশপাশ এলাকায় রাতে ব্যক্তিগত ছাড়া কোন ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস চলে না। আহমদ মুসাকে যেহেতু যেতে হবে ভাড়া গাড়িতে, তাই তাকে রাতটা অপেক্ষা করতে হলো এস্পানোলাতে।
এক রাত অপেক্ষা করাটা তার জন্যে শাপে বর হলো। ওয়াশিংটনে নকল কারসেনের কাছ থেকে ক্লীফ ডোয়েলিং ও লস আলামোস এর মাঝখানের গম্বুজাকৃতি সবুজ পাহাড়ের সিনাগগের নামটাই সে শুধু পেয়েছিল। কিন্তু এক রাতের সময় হাতে পাওয়ায় খোঁজ খবর নিতে গিয়ে আরও কিছু জানতে পারল সে। বিল নামে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার তাকে বলল, ‘স্যার আমার দশ বছর ট্যাক্সি চালানোর জীবনে এই প্রথম একজন প্যাসেঞ্জার পেলাম সবুজ পাহাড় সিনাগগে যাবার’।
‘ইহুদীরা সিনাগগে যায় না?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘ওখানে কেন যাবে স্যার! ‘সান্তাফে’তেই তো সিনাগগ আছে’।
‘তাহলে ওখানে সিনাগগ করতে গেল কেন?’
‘জানি না স্যার। পর্যটকরাও ওখানে যায় না’।
‘কেন?’
‘সিনাগগের কর্তৃপক্ষরা নাকি পছন্দ করে না। বলে, এটা নতুন সিনাগগ। ঐতিহাসিক হলে দেখার কিছু থাকতো’।
বলল, ‘তুমি কোনদিন গেছ সেখানে?’
‘ক্লীফ ডোয়েলিং থেকে লস আলামোসে যাবার একটা রাস্তা সবুজ পাহাড়ের পাশ দিয়ে গেছে। একবার লস আলামোস গেছি ঐ পথ দিয়ে। ফেরার পথে লস আলামোস থেকে একজন আমার গাড়িতে উঠেছিল। সে নেমেছিল ঐ সিনাগগে। তাকে নামিয়ে দেয়ার জন্যে আমি সিনাগগের গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সাংঘাতিক ওদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্যার। গাড়ি বারান্দা পৌঁছতে আমাকে দু’বার চেক করেছে ওরা’।
‘ঐ লোকটিকে চেক করেনি?’
‘না, করেনি। বরং সে লম্বা লম্বা স্যালুট পেয়েছে’।
‘বিল তুমি বললে লস আলামোসে মাত্র একবার গেছ। কেন?’
‘লস আলামোসে যাবার আলাদা পথ আছে সান্তাফে থেকে। অন্য পথগুলো বিশেষ করে উত্তর-দক্ষিন-পশ্চিম বনাঞ্চলের প্রাইভেট পথগুলো রেস্টিকেটেড। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া এ পথগুলো ব্যবহার করা যায় না’।
‘তাহলে তুমি সেদিন গিয়েছিলে কিভাবে?’
‘যাকে নিয়ে গিয়েছিলাম, সে লস আলামোসের একজন বিজ্ঞানী’।
‘যাকে তুমি নিয়ে এসেছিলে, সেও কি তাই?’
‘তা মনে হয়নি স্যার। সে লস আলামোস অফিস থেকে আমর গাড়িতে চড়েনি। গবেষণা কেন্দ্রের বাইরে একটা ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়েছিল। আমার গাড়ি সেখানে পৌঁছতেই সে রাস্তায় ছুটে আসে। মনে হয়েছিল, সে ওঁত পেতে ছিল গাড়ির অপেক্ষায়।
‘তাহলে নিশ্চয় সে লস আলামোসের চাকুরে নয়। কারণ চাকুরেরা সবাই পারমাণবিক গবেষণাগারের সেফটি কোড অনুসারে লস আলামোসেই থাকার কথা’।
‘কিন্তু তার গায়ে লস আলামোসের ইউনিফরম ছিল। আমার গাড়িতে উঠবার পর তড়িঘড়ি তা সে খুলে ফেলে’।
‘তড়িঘড়ি বলছ কেন বিল?’
‘গাড়িতে উঠেই দ্রুত সে ইউনিফরমের বোতাম খোলা শুরু করে’।
‘আচ্ছা তোমার গাড়িতে যাওয়া বিজ্ঞানী কি ইউনিফরম পরে ছিল?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু এত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন কেন? যাবেন তো আপনি সবুজ পাহাড়ে,লস আলামোসে তো নয়’।
‘দেখ জানার প্রত্যেকটা বিষয় খুটেঁ খুটেঁ জানা আমার অভ্যাস’।
বলে আহমদ মুসা তাকে খুব সকালে গাড়ি নিয়ে হোটেলে আসতে বলে বিদায় নিয়েছিল।
পরদিন সকালে সবুজ পাহাড় সিনাগগে যাত্রা করল আহমদ মুসা।
এস্পানোলা শহরটি রেড ইন্ডিয়ান রিজার্ভ এলাকার মধ্যে। এলাকাটির সীমান্ত সা্ন্তাফে জাতীয় ফরেস্ট এলাকার সাথে মিশে আছে।
রাজধানী সান্তাফেসহ নিউ মেক্সিকোর গোটা অঞ্চলটাই পার্বত্য উচ্চভূমি।
আহমদ মুসার মনে হলো গাড়িটা যেন ক্রমেই উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। মনে পড়ল রুদ্ধ পর্বতমালার কি এক পাহাড় হবে সামনেই। ঐ পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালেই তো ক্লীফগুলো।
আরও কিছু পথ চলার পর গাড়ি একটু বাম দিকে বাঁক নিল। তার মনে হলো গাড়ি এবার নিচে নামছে।
‘স্যার আমরা গ্রান্ডি নদীর সনি লুইস উপত্যকায় নামছি। এই উপত্যকাতেই আপনার সবুজ পাহাড়। এই উপত্যকারই আদিগন্ত বনরাজিবেষ্টিত উচ্চভূমিতে লস আলামোস ল্যাবরেটরী’।
‘বিল তোমরা নিউ মেক্সিকানরা লস আলামোস নিয়ে খুব গর্বিত তাই না?’
‘হ্যাঁ, স্যার। প্রথমটাসহ প্রথম দিকের সব আণবিক বোমা তো এই গবেষণাগারেই তৈরী হয়’।
‘শুধু তো তৈরী নয়, তোমাদের এই ট্রিনিটি ভ্যালিতে আণবিক বোমার প্রথম পরীক্ষাও সংঘটিত হয়’।
‘স্যার আপনি দেখছি এই এলাকার অনেক কিছুই জানেন’।
‘কেন, এটা তো সবাই জানার কথা। লস আলামোস, ট্রিনিটি ভ্যালি তো জগত বিখ্যাত। নিউ মেক্সিকো এলে কোন মানুষ এ দু’টো জায়গা না দেখে যায় না’।
গল্পে গল্পে অনেক সময় চলে গেল।
আহমদ মুসা বলল, ‘আর কতদূর তোমার সবুজ পাহাড়?’
‘আর দু’বাঁক ঘুরলেই স্যার’।
ড্রাইভার কথা শেষ করার সাথে সাথে হার্ড ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করাল।
ঝাঁকুনি সামলে উঠে সামনে তাকাতেই আহমদ মুসা দেখল, মুখোশ পরা একজন লোক স্টেনগান তাক করে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
আপনাতেই আহমদ মুসার দৃষ্টি চারপাশ ঘুরে এল। দেখল, মুখোশ পরা আরও জনা পাঁচেক লোক স্টেনগান হাতে গাড়িটা ঘিরে ফেলেছে।
ছুটে এল দু’পাশ থেকে দু’জন গাড়ির জানালায়। একজন চিৎকার করে বলে উঠল, ‘এশিয়ান, এশিয়ান’।
পরক্ষণেই ছুটে এল বিশাল বপু আরেকজন লোক, তার হাতে একটা ফটো। সে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে, একবার হাতের ফটোগ্রাফের দিকে তাকাল। সেও বলে উঠল চিৎকার করে, ‘খুব একটা মিলছে না। কিন্তু এশিয়ান, এটাই বড় কথা। নামাও শালাকে। নিশ্চয় ছদ্মবেশে আছে’।
একজন সংগে সংগেই টান মেরে গাড়ির দরজা খুলে ফেলল। টানতে হলো না, আহমদ মুসা নিজেই নেমে এল গাড়ি থেকে। ভাবল, জেনারেল শ্যারনদেরই পাতা ফাঁদ কি? কিন্তু ওরা জানবে কি করে যে আহমদ মুসা নিউ মেক্সিকোর সবুজ পাহাড়ে আসছে! সে তো নিজ হাতে নকল কারসেন ওরফে ইহুদী কোহেনকে জর্জদের তত্বাবধানে রেখে এসেছে। সে মুক্ত হতে পেরেছে এটা বিশ্বাস হয় না। তাহলে এরা জানতে পারল কি করে? এরা যে আহমদ মুসাকেই খুঁজছে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
আহমদ মুসা নামতেই একজন তার চুল এবং আর একজন গোঁফ ধরে টান দিল। খুলে গেল দুটোই।
সেই মোটা লোকটা চিৎকার করে উঠল, ‘মিলে গেছে। একেবারে মিলে গেছে। শয়তান আহমদ মুসাকে আবার আমরা হাতে পেয়েছি’।
নেমেই সে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, ‘উঃ তোমার জন্যে আমরা গতকাল দুপুর থেকে এখানে বসে আছি। কি যে কষ্ট দিয়েছ’।
‘জানলে কি করে যে আমি আসব?’ আহমদ মুসা স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল।
মোটা লোকটি আহমদ মুসার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। বলল,
‘বাঃ তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন আমরা তোমাকে স্বাগত জানাতে এসেছি। হাফ ডজন উদ্যত স্টেনগানের সামনে কথা বলতে বুক একটু্ও কাঁপল না?’
‘কাঁপবে কেন? তোমরা আমাকে হ্ত্যা করতে পারবে না। সে ক্ষমতা তোমাদের নেই’।
লোকটির চোখ জ্বলে উঠল। সে তার স্টেনগানের বাঁট দিয়ে একটা আঘাত করল আহমদ মুসার মাথায়।
আহমদ মুসা মাথা সরিয়ে নেয়ায় আঘাতটা কান দিয়ে কাঁধে নেমে এল। কান ছিঁড়ে গেল। দর দর করে বেরিয়ে আসা রক্ত বুক, পৃষ্ঠদেশ ভাসিয়ে দিতে লাগল।
‘ক্ষমতার কথা তুলছ, ক্ষমতা দেখবে চল’। আঘাত করার সাথে সাথে কথা কয়টি বলে হুংকার ছাড়ল সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে, এর হাত পা বেঁধে নিয়ে চল একে।
দু’জন ছুটে এল আহমদ মুসার দিকে।
‘দাঁড়াও তোমরা, আমি ড্রাইভারকে ভাড়াটা দিয়ে নেই’।
বলে আহমদ মুসা পকেটে হাত দিয়ে এক গুচ্ছ নোট বের করে ড্রাইভারের সামনে তুলে ধরে বলল, ‘নাও বিল, ধন্যবাদ তোমাকে’।
ড্রাইভার উদ্বেগ, আতংকে একেবারে পান্ডুর হয়ে গেছে। আহমদ মুসাকে ভাড়া দিতে দেখে চোখ দু’টি তার ছল ছল করে উঠল। বলল, ‘থাক স্যার, আপনি…..’।
থেমে গেল, শেষ করতে পারল না। কথা আটকে গেছে তার গলায়।
আহমদ মুসা নোটগুলো ছুঁড়ে দিল ড্রাইভারের দিকে।
ওরা মহা উৎসাহে হাত পা বাঁধল আহমদ মুসার। তারপর চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল তাকে।
হঠাৎ ওদের একজন ঘুরে দাঁড়াল। চিৎকার করে উঠল ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে, ‘হারামজাদা, কি দেখছিস। এক মুহূর্ত দেরী করলে লাশ বানিয়ে দেব’।
ড্রা্ইভার তাড়াতাড়ি আহমদ মুসার দেয়া নোটগুলো কুড়িয়ে পকেটে ফেলে গাড়ি ব্যাক করে ছুটল সামনের দিকে।
শরীর কাঁপছে ড্রাইভারের। বুক তোলপাড় করছে আতংক ও বেদনায়।
তার মন বলে উঠল, যে লোক মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারের ভাড়া পরিশোধ করতে ভোলে না, সে কোন খারাপ লোক হতে পারে না। কিন্তু কেন ওরা ওঁকে ধরে নিয়ে গেল। কি দোষ তাঁর!
আবার বিষ্মিতও কম হয়নি ড্রাইভার। সে যতখানি আতংক ও উদ্বিগ্ন হয়েছে, তার কণামাত্র উদ্বেগও ঐ লোকের চোখে মুখে দেখেনি। ব্যাপারটা অলৌকিক মনে হচ্ছে তার কাছে।
দু’জন আহমদ মুসার দেহ ঘরের মেঝেতে ছুড়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘দেখতে তো খুব হালকা পাতলা, কিন্তু পাথরের মত ভারি’।
আহমদ মুসার দেহ গিয়ে পড়ল জেনারেল শ্যারনের পায়ের কাছে।
সোফায় পাশাপাশি বসে ছিল জেনারেল শ্যারন, মিঃ গোল্ড ওয়াটার ও মিঃ কলিন্স।
জেনারেল শ্যারন ডান পা দিয়ে আহমদ মুসার পাঁজরে একটা ঘা দিয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার আহমদ মুসা নিউ মেক্সিকোর সবুজ পাহাড়ে যে তুমি? লস আলামোস দেখতে এসেছিলে নাকি? কিন্তু লস আলামোসের রাস্তা তো এটা নয়’।
‘ভনিতা করবেন না জেনারেল শ্যারন। আপনি জানেন আমি কেন এসেছি’। বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আহমদ মুসা, তুমিও দেখছি বোকামী কর মাঝে মাঝে। তুমি কেমন করে নিশ্চিত হলে যে কোহেনকে আটকালে আমরা টের পাবো না এবং কোহেন আটক হওয়র পর সবুজ পাহাড়ে তুমি আসবে এটা আমরা বুঝব না?’
‘সত্যিই বলেছেন। কোহেনের কাছে অয়্যারলেস ট্রান্সমিটার চীপস আছে, এ বিষয়টা আমাদের চিন্তায় আসেনি। আর আমি বোকামী না করলে আমাকে এভাবে আটকানো তোমার পক্ষে সম্ভব হতো কি করে?’
‘সেবার আমাদের বোকা বানিয়ে তুমি সরে পড়েছিলে। এবার তোমাকে বোকা বানিয়ে আমরা তোমাকে খাঁচায় পুরলাম’। বলে হো হো করে হেসে উঠল জেনারেল শ্যারন।
‘ঠিক আছে। আমাকে তো তোমরা পেয়েছ, এবার তোমরা মিঃ কারসেনকে ছেড়ে দাও। আর তোমাদের ওয়াদা অনুসারেই ডাঃ মার্গারেট ও লায়লা জেনিফারকে ছেড়ে দিতে হবে’।
আবার জেনারেল হেসে উঠল হো হো করে। বলল, ‘কোহেনকে পাওয়ার পর আমরা ছেড়ে দেব মিঃ কারসেনকে। কিন্তু বল ডাঃ মার্গারেট ও লায়লা জেনিফারকে ছাড়ি কি করে। ইতিমধ্যেই আমাদের লোকরা তাদের প্রেমে পড়ে গেছে। তুমিই বল আমি কেমন করে বঞ্চিত করি ওদের? ওরা তো এক সাগর তৃষ্ঞা নিয়ে আমাদের দেয়া মেয়াদ পনের দিন পার হওয়ার প্রহর গুনছে। এখন কিন্তু তুমি আমাদের হাতে, পনের দিনের মেয়াদ পার হওয়ার আর কোন প্রয়োজন নেই’।
‘কিন্তু আমি এও জানি মিঃ শ্যারন, আমি বেঁচে থাকতে তাদের গায়ে তোমরা হাত দেবে না’।
‘কেন?’
‘কারণ আহমদ মুসাকে তোমরা চেন’।
‘আহমদ মুসা, তোমার এই অতি আত্মবিশ্বাস তোমাকে অতীতে বহুবার বাঁচিয়েছে জানি, কিন্তু সব বার বাঁচাবে তা ঠিক নয়। সব কিছুরই একটা শেষ আছে। সেই শেষ অবস্থায় তুমি পৌঁছে গেছ। আগামীকাল সকালে তোমাকে নিয়ে আকাশে উড়ব আমরা ইউরোপের কোন একটি দেশের উদ্দেশ্যে। আমরা মার্কিন সীমান্ত অতিক্রম করার পর ডাঃ মার্গারেট ও লায়লা জেনিফারকে ক্ষুধার্থ হায়েনারা ছিঁড়ে –ফেড়ে খাবে’।
বলে জেনারেল শ্যারন আবার হেসে উঠল হো হো করে।
‘মনে হচ্ছে মিঃ শ্যারন তোমার নিজের এবং সবার ভাগ্যটা যেন তুমিই লেখ’। বলল আহমদ মুসা।
‘ভাগ্য ঈশ্বরই লেখেন। তবে তোমাদের কবি ইকবালের একটা কথা আছে না, খুদিকে এমন বুলন্দ কর, যাতে খোদা বলেন, বল বান্দাহ তোমার ইচছা কি, আমি কি লিখব তোমার ভাগ্য। এখন ঈশ্বর তোমাদের ভাগ্য আমার হাতে দিয়ে দিয়েছেন’।
‘সৌভাগ্য আপনার মিঃ শ্যারন’।
‘আচ্ছা, মিঃ আহমদ মুসা আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আপনি এখন মুক্তির কথা ভাবছেন, না ভবিষ্যতটা অন্ধকার দেখছেন?’ বলল এফ.বি.আই এজেন্ট কলিন্স।
‘আপনি…..?’
‘আমি কলিন্স’।
‘আরেকটা পরিচয়ও আছে, আপনি এফ.বি. আই এর লোক’। বলল আহমদ মুসা।
বিষ্ময় দেখা দিল কলিন্সের চোখে মুখে। বলল, ‘আপনি কি করে জানলেন?’
‘এফ. বি. আই এজেন্টদের চোখেই তাদের পরিচয় লেখা থাকে সাধারণত’।
‘সাধারণত বললেন কেন?’
‘চেনা যায় না, এমন অসাধারণ ক্ষেত্রও বহু আছে’।
‘আমার প্রশ্নের কি জবাব দেবেন?’ বলল কলিন্স।
‘মুক্তি সম্পর্কে কোন ভাবনা আমার মাথায় এখন নেই। তাই বলে আমি সামনে অন্ধকারও দেখছি না। মৃত্যুকে যারা ‘অন্ধকার’ রূপে দেখে, তারা ভবিষ্যত অন্ধকার দেখতে পায়। কিন্তু মৃত্যু আমার কাছে আলোকিত এক সিংহ দরজা’। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা একটু থামল। পরক্ষণেই আবার বলে উঠল, ‘কিন্তু জেনারেল শ্যারন ও মিঃ গোল্ড ওয়াটারের সাথে এফ.বি.আই এর লোক কেন? মার্কিন সরকার কি জেনারেল শ্যারনকে সাহায্য করছে?’
মিঃ কলিন্সের মুখে কিছুটা বিব্রত ভাব ফুটে উঠল। বলল, ‘সরকারের কোন পলিসির প্রশ্ন এখানে জড়িত নেই। জেনারেল শ্যারন একজন গন্যমান্য লোক, আমাদের দেশে এসেছেন, তাই তাকে একটু সঙ্গ দেয়া’।
‘মেহমানকে সঙ্গ দেয়া আর লোক কিডন্যাপের অভিযানে তাকে সঙ্গ দেয়া কি এক জিনিস?’ আহমদ মুসার কন্ঠে জিজ্ঞাসা।
‘দেখুন আমি ছোট চাকুরী করি। এসব প্রশ্নের জবাব আমার দেবার কথা নয়’। বলল কলিন্স।
কলিন্স থামতেই গর্জন করে উঠল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘তুমি এদেশে বেআইনিভাবে প্রবেশকারী একজন বন্দী। এফ.বি.আইকে তোমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে? সাহস তুমি খুব বেশীই দেখাচ্ছ’।
‘আমি বেআইনী প্রবেশকারী হলে সেটা দেখার দায়িত্ব মার্কিন সরকারের, জেনারেল শ্যারনের নিশ্চয় নয়’।
‘আহমদ মুসা আমি তোমার প্রশংসা করি। কিন্তু তোমার এখন অবস্থা কি, আর তুমি আলোচনা করছ কোন বিষয়ে। তোমাকে আমরা ধরেছি, কেন ধরেছি, কিভাবে ধরেছি, সে জবাবদিহি আমরা তোমার কাছে করব না’। বলল জেনারেল শ্যারন।
‘সেটা আমি জানি। আমি কথা বলছিলাম মিঃ কলিন্সের সাথে। কারণ সে সরকারী লোক। এমনকি তার সাহায্যও আমি চাইতে পারি’।
‘তা চাইতে পার, কিন্তু তোমাকে সাহায্য করার এখন দুনিয়াতে আর কেউ নেই’। শ্যারন বলল।
‘দুনিয়ার কোন সাহায্যকারীর আমার দরকারও নেই। আমার আল্লাহ আমার জন্যে যথেষ্ট’।
‘ঠিক আছে, দেখা যাবে’।
বলে জেনারেল শ্যারন উচ্চস্বরে বলল, ‘কে আছ, এদিকে এস’।
ডাকার সঙ্গে সঙ্গে চারজন বড়ি বিল্ডার গেরিলার মত পা ফেলে এগিয়ে এল।
‘বিল্ডানীয় অন্ধকূপ আছে না, সেখানে একে রেখে দাও। হাত পা বাঁধা থাকবে’।
বলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি বোধ হয় জান না, বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের অতি পছন্দের বাড়ি এটা। যে সিনাগগ পেরিয়ে এলে সেটাও তাঁরই তৈরী। তাঁর অন্ধকূপে তুমি ভালই থাকবে। তুমি হয়তো বলবে বিজ্ঞানীর আবার অন্ধকূপ কি? বিজ্ঞানীর হবি ছিল মাঝে মাঝে কয়েকদিন ধরে কবরের নির্জনতায় বসবাস করা। তার অন্ধকূপ ঐ উদ্দেশ্যেই তৈরী। তুমি কাল সকাল পর্যন্ত ওখানে থেকে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় কর। একটা সুবিধা তোমাকে দেয়া হবে। সেটা হলো, অন্ধকার দূর করার জন্যে সেখানে তুমি আলো পাবে’। থামল জেনারেল শ্যারন।
তার থামার সাথে সাথেই ঐ চারজন এসে খেলনার মত আহমদ মুসাকে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল ঘর থেকে বাইরে বেরুবার জন্যে।
‘অন্ধকূপ থেকে বেরুবার চেষ্টা করো না। পারবে না। তাছাড়া সবুজ পাহাড়ের এই ঘাঁটি থেকে বেরুতে হলে তোমার সেনাবাহিনী দরকার’। চিৎকার করে বলল শ্যারন।
‘মিঃ কারসেনকে ছাড়ছেন কখন?’
‘দুঃখিত আহমদ মুসা, তুমি এখানে আসার আগেই মিঃ কারসেনকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তাকে আমরা ছাড়ব, তবে তার আগে আমরা কোহেনকে ফেরত পেতে চাই’।
জেনারেল শ্যারন যখন কথা শেষ করল, তখন আহমদ মুসাকে ঘরের বাইরে নেয়া হয়েছে। আহমদ মুসা আর কোন কথা বলার সুযোগ পেল না।
খুশী হলো আহমদ মুসা যে তারা কোন সময়ই আহমদ মুসার চোখ বাঁধেনি।
ছোট বড় অনেক করিডোর পেরিয়ে তাকে নিয়ে আসা হলো অনেকটা ছোট আকারের একটি কক্ষে।
দেখে মনে হল কক্ষটি স্টোর রুম। কক্ষে বহু ড্রয়ার ও তাক। তাকগুলোতে কাঁচের স্লাইডিং ডোর। তাকগুলোতে নানা সাইজের কার্টুন।
কার্টুনগুলো হিব্রু ভাষায় লেখা।
হিব্রু ইহুদীদের নিজস্ব ভাষা। ইহুদীদের বাইরে এ ভাষার প্রচলন নেই।
অধিকাংশ কার্টুনে হিব্রু ভাষায় লেখা ‘প্রজেক্ট’ শব্দের পাশে বিভিন্ন সংখ্যা।
কক্ষের দরজার বিপরীত দেয়ালে স্টীলের বড় আলমারি। রং করা, কিন্তু ময়লা ও ধূলায় রং বিকৃত হয়েছে। মনে হয় আলমারিটায় বহুদিন কেউ হাত দেয়নি।
যে দু’জন আহমদ মুসাকে বহন করছিল তারা তাকে একটা বটম শেলফের পাশে ছুঁড়ে দেয়ার মত রেখে বলল, ‘শালার শরীরটা লোহার নাকি,এত ভারী কেন?’
আহমদ মুসার তখনও হাত পা বাঁধা।
আহমদ মুসা শেলফের পাশে পড়ার সময় এর স্লাইডিং ডোরে ধাক্কা খায়। দরজা সরে যাওয়ায় সেলফের এপাশের অনেকখানি ফাঁক হয়ে যায়। ভেতর থেকে একটা কাগজে অঁকা কার্টুন গড়িয়ে পড়ে আহমদ মুসার পাশেই।
কার্টুনটা ছোট, সম্ভবত বড় একটা কার্টুনের উপর ছিল, গড়িয়ে পড়েছে।
একটু মুখ ঘুরিয়ে চোখটা বাঁকিয়ে তাকাল কার্টুনটার দিকে। কার্টুনের গায়ে হিব্রু ভাষায় একটা সিল। পড়ল আহমদ মুসা ‘ব্যবহার শেষ, ধ্বংস করুন’। সিলের নিচে একটা হিব্রু ইনিশিয়াল এবং তারিখ। তারিখটা মাত্র চারদিন আগের।
কার্টুনটার প্রতি আগ্রহী হলো আহমদ মুসা। এটা কি কাজে ব্যবহার করেছে, এখন ধ্বংস করারই বা হুকুম কেন?
আহমদ মুসা কার্টুনটার উপর শুয়ে পড়ে কার্টুনটাকে হাতের মুঠোয় নিল।
আহমদ মুসাকে রেখেই দু’জন এগুচ্ছিল আলমিরার দিকে। আর অন্য দু’জন স্টেনগান বাগিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঘরের দরজায়। আহমদ মুসার কৌশলটা তাদের নজরে পড়েনি।
আলমিরার দিকে এগিয়ে যাওয়া লোক দু’জন থমকে দাঁড়িয়েছিল। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘দেখ অসুখ-বিসুখের ভান করোনা। লাভ হবে না’।
বলেই তারা এগুলো আলমিরার দিকে।
আহমদ মুসা শুয়ে থেকেই কার্টুনটি চালান করল কোটের পকেটে।
আহমদ মুসা শুয়ে শুয়ে দেখছিল লোক দু’টিকে, যারা আলমিরার দিকে যাচ্ছে।
ওরা আলমিরার দিকে যাচ্ছে কেন? আলমিরা খুলবে নাকি। তাকে সোজা অন্ধকূপে নিয়ে যাওয়ার কথা তবে এখানে এই হল্ট কেন?
লোক দু’টি আলমিরার কাছে পৌঁছেছে। একজন হাত বাড়াল আলমিরার দরজার হাতলের দিকে। সে আলমিরার হাতলে হাত রাখতেই আলমিরা খুলে গেল।
বিষ্মিত হলো আহমদ মুসা। হাতল তাকে ঘুরাতে হলো না। তার মানে আলমিরার দরজা খোলার জন্যে হাতলে চাপ দিতে হয়। অথবা হাতলে কোন বোতাম বা সুইচ আছে।
দরজা খুলতেই ওদের একজন বলল ‘তাহলে সব ঠিক আছে। চল ব্যাটাকে নিয়ে আসি’।
ওরা এসে আহমদ মুসাকে নিয়ে গেল চ্যাংদোলা করে এবং ছুঁড়ে দিল আলমিরার ভেতর।
আলমিরাটা ফাঁকা, আলমিরার মেঝেয় ছিটকে পড়ে গেল আহমদ মুসা।
যারা আহমদ মুসাকে আলমিরার মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছিল, তাদের একজন আহমদ মুসাকে বলল, যাও তুমি এখন ঠিক অন্ধকূপে পেৌঁছে যাবে। তবে কূপটাতে অন্ধকার রাখা হয়নি, আলোকিত করা হয়েছে। তুমি নাকি খুব মূল্যবান, এজন্যে এই মর্যাদা তোমাকে দেয়া হয়েছে’।
তারা কথা শেষ করতেই আপনাতেই আলমিরার দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আর পরক্ষণেই নড়ে উঠল দরজা। নামতে শুরু করল আলমিরাটা নিচে।
নিজেকে বোকা মনে হলো আহমদ মুসার। আলমিরাটা যে লিফট সে ঘুনাক্ষরেও তা ভাবতে পারেনি।
লিফট নামছে তো নামছেই। কত নিচে অন্ধকূপটা?
আহমদ মুসার মনে হলো চারতলা পরিমাণ নেমে লিফট থেমে গেল।
ধীরে ধীরে খুলে গেল লিফটের দরজা।
খোলা দরজা পথে দেখতে পেল একটা গোলাকার মেঝে, কার্পেট মোড়ানো। মেঝের চারদিক থেকে উঠে গেছে গোল দেয়াল। দেয়ালটাও কার্পেট মোড়ানো।
এটাই তাহলে বিজ্ঞানীর সেই অন্ধকূপ। ভাবল আহমদ মুসা।
বিজ্ঞানীর অন্ধকূপের মেঝে একেবারে শূন্য। বিছানো কার্পেট ছাড়া তিল পরিমাণ জিনিসও মেঝেতে নেই। খাবার পানিটুকুও রাখা হয়নি।
চমকে উঠল আহমদ মুসা।
কিছুতেই সে লিফট থেকে অন্ধকুপে নামবে না। নিশ্চয় লিফট উঠে যাবে। তার সাথে আহমদ মুসাও উঠে যাবে। ভাবল আহমদ মুসা।
যেমন শুয়েছিল তেমনি শুয়ে থাকল আহমদ মুসা লিফটের মেঝেতে।
সময় বয়ে যায়। অনেক সময়।
কিন্তু লিফট নড়ার নাম নেই।
তাহলে কি সে লিফটে থাকা পর্যন্ত লিফট উঠবে না? ভাবল আহমদ মুসা। তাহলে কি মানুষের দেহের ওজনের সাথে লিফটের ওঠানামার সম্পর্ক আছে? যেমন সে লিফটে উঠার সাথে সাথে লিফট নেমে এলো, তেমনি তার ওজন লিফট থেকে সরে যাবার পর লিফট উঠে যাবে? ধরা যাক উঠে যাবে, কিন্তু আবার নামবে কি করে? কেউ নামিয়ে নিয়ে আসবে, না অন্ধকূপে লিফট নামিয়ে আনার ব্যবস্থা আছে?
এমন হাজারো চিন্তা মাথায় এসে ভীড় করতে লাগল আহমদ মুসার।
একটা ভাবনা আহমদ মুসাকে খুবই পীড়িত করতে লাগল। বিজ্ঞানী এই অন্ধকূপে একদিন, দু’দিন কয়েকদিন থাকতেন। তাহলে এখানে আসা, এখান থেকে বের হ্ওয়ার একটা স্বাধীন ব্যবস্থা থাকবে না কেন? এটা স্বাভাবিক নয় যে এখান থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে তিনি অন্যের মুখাপেক্ষী ছিলেন।
শেষ এই ভাবনার মধ্যে আহমদ মুসা আশার প্রদীপ দেখতে পেল। তার মনে নতুন সাহসের ও সৃষ্টি হলো।
আহমদ মুসা হাত পায়ের বাঁধন খোলার পর লিফট থেকে নামার সিদ্ধান্ত নিল।
তার হাত পায়ের বাঁধন খুব একটা জটিল ছিল না। এই বাঁধন তারা দিয়েছিল সম্ভবত আহমদ মুসার আক্রমন থেকে বাঁচার জন্যে।
আহমদ মুসা বাঁধা হাত দুটো মুখের সামনে নিয়ে দাঁত দিয়ে হাতের বাঁধন খুলে ফেলল।
বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে আহমদ মুসা লিফট থেকে বেরিয়ে বিসমিল্লাহ বলে পা রাখল অন্ধকূপের মেঝেতে।
আহমদ মুসা লিফট থেকে নামার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লিফট উঠে গেল।
লিফট উঠে যাওয়ার সাথে সাথে নিজেকে বড় একাকী মনে হলো আহমদ মুসার।
সত্যিই ভয়াবহ এক অন্ধকূপ এটা।
আহমদ মুসা উপর দিকে তাকিয়ে দেখল, গোলাকার দেয়াল উঠে গেছে উপরে। উপরের ছাদটি সে দেখতে পেল না।
মনে হয় গ্রাউন্ড ফ্লোরটাই এই অন্ধকূপের ছাদ, ভাবল আহমদ মুসা। এমন অন্ধকূপ যে কোথাও থাকতে পারে, কোনদিন ভাবেওনি সে। অভাবনীয় সেই অন্ধকূপে দাঁড়িয়ে সত্যিই কেমন একটা অজানা উদ্বেগ বোধ করল আহমদ মুসা।
পরক্ষণেই আগের সেই ভাবনাই ছুটে এল তার মনে। বিজ্ঞানী কেন এই অন্ধকূপ তৈরী করেছিলেন এই সবুজ পাহাড়ে তাঁর বাড়িতে? লোক বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জনে এখানে এসে থাকবেন, এজন্যই? এ যুক্তিটা তাঁর কাছে মোটেই শক্তিশালী মনে হলো না।
এ সময় তাঁর হঠাৎ মনে পড়ল শেলফ থেকে পাওয়া পকেটে রাখা কার্টুনের কথা।
কার্টুনটি পকেট থেকে বের করল আহমদ মুসা।
খুলল কার্টুনটি।
অনেকগুলো টুকরো কাগজ বের হলো কার্টুনটির সাথে।
প্রত্যেকটি একই সাইজের।
কয়েকটিতে হিব্রু লেখা। অন্য সবগুলোতেই জটিল অংকন ও ডিজাইন। হিব্রুগুলো হাতে লেখা এবং ডিজাইন ও অংকনগুলো কম্পিউটার প্রিন্ট।
হিব্রু কাগজগুলো সম্ভবত ড্রইং কলম দিয়ে লিখা। অক্ষরগুলো ছোট ও সুক্ষ্ণ।
পড়ল আহমদ মুসা, এস.ডি.আই ফেজ ফাইভ গাইডেড কম্পিউটার কমান্ড ডিজাইন এন্ড মিসাইল কমান্ড কোডস প্লাস ফোর্থ জেনারেশন এস.ডি.আই কমান্ড কম্পিউটার।
আহমদ মুসা পড়ে বুঝল, ডিজাইন ও অংকনগুলো স্ট্রাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভের ফিফথ ফেজের হবে। কিন্তু এগুলো এই সিনাগগে কেন? আবার ভাবল, ইহুদী বিজ্ঞানীর এই বাড়ি ও সিনাগগ, তারই কোন কাজ হবে এ অংকন ও ডিজাইনগুলো। কিন্তু পরক্ষণেই মনে প্রশ্ন জাগল, এখন তো বিজ্ঞানী নেই। কে এগুলো ব্যবহার করলো এবং এগুলো ধ্বংস করারই বা প্রয়োজন কি? এ প্রশ্নের কোন জবাব পেল না সে।
ঘটনা কি বুঝতে না পারলেও আহমদ মুসা একটা জিনিষ বুঝলো, এস.ডি.আই ডাটাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সে জানে এস.ডি.আই এর উপর যে গবেষণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চালাচ্ছে, তা এখন ফোর্থ জেনারেশনে। সুতরাং এই ফিফথ জেনারেশনের ডাটা অগ্রগামী গবেষণার ফল। অতএব এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে।
এই চিন্তা করে আহমদ মুসা ডকুমেন্ট পেপারগুলো কার্টুনে পুরে কোটের ভেতরের পকেটে রেখে দিল।
হাতের কাজটা শেষ হলে, আগের চিন্তায় ফিরে গেল আহমদ মুসার মন। ফুল কার্পেটে মোড়া এই অন্ধকূপ যদি বিজ্ঞানী কোন সময় এখানে কাটিয়ে দেবার জন্যে করে থাকেন, তাহলে এখানে বসবাসের উপকরণ কোথায়? উপকরণ রাখার জায়গাও তো নেই। এমন তো হতে পারে না। তাহলে কি ওরা মিথ্যা বলেছে? বিজ্ঞানী আসলে এখানে থাকতেন না? না থাকলে কোন প্রয়োজনে কেন কার্পেটে মোড়া প্রায় চল্লিশ ফিট গভীর এই অন্ধকূপ তৈরী করা হলো? বিজ্ঞানী এখানে আসতেন, এ কথাই ঠিক ধরে নিতে হবে।
তাহলে কিভাবে থাকতেন, এ প্রশ্নের জবাব কি?
অন্ধকারের চার দেয়ালে নজর বুলালো আহমদ মুসা।
কালো লোমশ কার্পেটে আবৃত দেয়াল। মেঝেও তাই। কার্পেটের লোমগুলো অস্বাভাবিক লম্বা।
তার দু’চোখ মেঝের উপর দিয়েও ঘুরে এল, কিন্তু দেয়াল কিংবা মেঝেতে অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না।
কি খুঁজছে তার দু’চোখ?
দেয়ালে গোপন কেবিন রাখা আধুনিক রুম ডেকোরেশনের একটা খুবই চালু পদ্ধতি। বিজ্ঞানী তা রাখতে পারেন তার গোপন খাজাঞ্চিখানা বা প্রয়োজনীয় স্টোর হিসেবে। যা তার অন্ধকূপে থাকাকালীন কাজে আসবে।
কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়ল না।
চোখ দু’টি তার ক্লান্ত হয়ে পড়ল।
শুয়ে পড়ল সে অন্ধকূপের মেঝেতে।
ফ্লোরে শুয়ে পড়ে আহমদ মুসা চোখ বুজতে যাচ্ছিল, এমন সময় সামনের দেয়ালটা যেখানে অন্ধকুপের মেঝের সাথে মিশেছে ঠিক সেখান থেকে একটা রূপালী আলোর ঝলক এসে তার চোখে লাগল। যেন কালোর অরণ্যে এক সূর্য বিন্দু।
সংগে সংগেই উঠে বসল আহমদ মুসা।
এগুলো সেই সূর্য বিন্দু লক্ষ্য করে। দেখল, সূর্য বিন্দুটা একটা পেরেকের শীর্ষভাগ। মনে হলো পেরেকটা কার্পেটকে দেয়ালের সাথে সেঁটে রাখার জন্যেই।
তাহলে এ ধরনের আরও আছে ভাবল আহমদ মুসা।
অকারণেই খুঁজতে লাগল সে পেরেকগুলো। পরে সে ভাবল, পেরেকগুলো খুলে কার্পেটের নিচের দেয়াল সে দেখতে পারে সেখানে রহস্যের কোন সমাধান পাওয়া যায় কিনা।
কিন্তু ব্যর্থ হলো আহমদ মুসা। তন্ন তন্ন করে খুজেঁও আর কোন পেরেক সে পেল না।
শোয়া অবস্থায় যেহেতু পেরেকটি চোখে পড়েছে, তাই মেঝেয় গড়িয়ে গড়িয়েও সন্ধান করল আহমদ মুসা। কিন্তু না, আর কোন পেরেক চোখে পড়ল না।
আহমদ মুসা ফিরে গেল সেই আগের পেরেকের কাছে।
পেরেকের কাছে মেঝেয় সে বসে পড়ল।
অবাক জিজ্ঞাসায় আবার দেখতে লাগল পেরেকটিকে। মাত্র একটা পেরেক দিয়ে কার্পেটটিকে তো আর আটকে রাখা যাবেনা। তাহলে? মাত্র একটা পেরেকের কি তাৎপর্য!
পেরেকের চেয়ে বেশী উজ্জ্বল মনে হচ্ছে পেরেকটিকে। আহমদ মুসা আরও খেয়াল করল, পেরেকের মাথায় যে খাঁজ কাটা থাকে এর তা নেই। তার মানে পেরেকটিকে ঘুরিয়ে নয়, পিটিয়ে লাগানো হয়েছে। কিন্তু এমনটা তো স্বাভাবিক নয়। কারণ এ ধরনের পেরেক মজবুত হয় না, সহজে তুলেও ফেলা যায়।
চিন্তাটার সংগে সংগেই আহমদ মুসা দুই আঙ্গুল দিয়ে পেরেকটি ধরে টান দিল।
সংগে সংগে হাতের সাথে উঠে এল পেরেকটি। কিন্তু পেরেক নয় বস্তুটা। নিচের দিকটা প্লেন এবং ব্ল্যাক স্টিল। যার চুম্বকত্ব আছে, তোলার সময়ই সে তা টের পেয়েছে। চুম্বকের আকর্ষণেই আরেকটা স্টিল বোতামের সাথে তা লেগে ছিল।
প্রথমটায় অবাক হয়েছিল আহমদ মুসা। পরে তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভাবল, নিশ্চয় এর মধ্যে কোন রহস্য আছে।
কিন্তু কি হতে পারে সে রহস্যটা?
রহস্যটা যাই হোক, কোন সন্দেহ নেই যে, বিজ্ঞানী তার প্রয়োজনেই সেটা করেছিলেন।
আহমদ মুসা চাপ দিল কাল বোতামটিতে।
সংগে সংগেই দেয়ালের তিন বর্গফুটের মত একটা অংশ কিঞ্চিত সরে গিয়ে দেয়ালের আড়ালে চলে গেল। বেরিয়ে পড়ল একটা সুড়ঙ্গ পথ।
সুড়ঙ্গ পথটি আলোকিত।
সুড়ঙ্গ পথের মুখ তিন বর্গফুটের মত হলেও ভেতরটা আরও প্রশস্ত। একজন মানুষ অনায়াসে হেঁটে চলাফেরা করতে পারে।
স্টিলের মজবুত সুয়ারেজ পাইপ দিয়ে সুড়ঙ্গটি তৈরী।
খুশী হলো আহমদ মুসা, সুড়ঙ্গটি নিশ্চয় বাইরে বেরুবার জন্যে। কিন্তু কেন বিজ্ঞানী শুধুমাত্র বাইরে বেরুবার জন্যে এত ব্যয়বহুল ব্যবস্থা করলেন? তাহলে তিনি কি কোন বিপদের ভয় করতেন যে, সবুজ পাহাড়ের তাঁর বাড়ি থেকে বাইরে বেরুবার পথ বন্ধ হতে পারে, তখন তিনি এই নিরাপদ সুড়ঙ্গ পথ ব্যবাহর করে বাইরে বেরুবেন? কিন্তু একজন বিজ্ঞানীর কি এমন বিপদ হতে পারে?
এ প্রশ্নের কোন উত্তর তার কাছে নেই।
এসব থাক, বের হবার একটা পথ পাওয়া গেছে, এটাই বড় কথা। ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা প্রবেশ করল সুড়ঙ্গে।
গোটা সুড়ঙ্গটাই আলোকিত।
বহুদিন এ সুড়ঙ্গে কেউ ঢোকেনি। তার অর্থ কি বিজ্ঞানীর মৃত্যুর পর আর কেউ এ সুড়ঙ্গে প্রবেশ করেনি? বলা মুশকিল। ভাবল আহমদ মুসা।
চলছে তো চলছেই। কত বড় এই সুড়ঙ্গ?
বাইরে বেরুবার জন্য এত বড় সুড়ঙ্গ কেউ কাটে?
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আহমদ মুসা ৪০ মিনিট হলো সে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করেছে।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। সবুজ পাহাড়ের বিজ্ঞানীর বাড়ি থেকে বাইরে বেরুবার সুড়ঙ্গ অবশ্যই এটা নয়।
কোথায় গেছে এ সুড়ঙ্গ? নিশ্চয় এমন কোথাও গেছে যা বাইরে বেরুবার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।
এক ঘন্টা পার হয়ে গেল।
সুড়ঙ্গের সমান্তরাল পথ একটু একটু করে উপরে উঠতে শুরু করেছে।
গন্তব্যে তাহলে এসে গেছি, বলল মনে মনে আহমদ মুসা।
কতদূর হবে সে এসেছে সবুজ পাহাড় থেকে? অবশ্যই পাঁচ ছয় মাইলের কম নয়। আহমদ মুসার অনুমান যদি ভূল না হয়ে থাকে, তাহলে সে সবুজ পাহাড় থেকে পাঁচ ছয় মাইল দক্ষিণে এখন। এ অঞ্চলের ভৌগলিক পরিচয় তার জানা নেই। তাই বলা মুশকিল সে এখন কোথায়।
সারফেস লেভেলে প্রায় উঠে এসেছে সে। সতর্ক পদক্ষেপ এখন আহমদ মুসার।
যেখানে এসে সুড়ঙ্গ শেষ হলো, সেখানে সুড়ঙ্গের মুখে একটি কংক্রিটের স্ল্যাব। স্ল্যাবটি সুড়ঙ্গের মুখে এমন ভাবে সেট করা যে, স্ল্যাবটি নিচে নামানো যাবে না।
তাহলে উপরে তুলতে হবে।
কিন্তু এ সুড়ঙ্গের মুখটি কোথায়? সেটা কি ঘর? না উঠান? কিংবা পরিত্যক্ত কোন স্থান?
ঘর কিংবা জনসমাগমের কোন স্থান হলে স্ল্যাব তুললেই সে ধরা পড়ে যাবে। জংগল বা পরিত্যক্ত কোন স্থান হলে, তবেই নিরাপদ।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। বেলা তখন ১টা।
আহমদ মুসা তায়াম্মুম করে নামাজ পড়ে নিল।
তারপর ভাবল, স্ল্যাবের অংশবিশেষ তুলে দেখা যাক, কেমন জায়গা এটা।
বিজ্ঞানী যখন এখানে উঠতেন বা এদিক দিয়ে যাতায়াত করতেন, তখন স্থানটা তাঁর নিজের অথবা তার কোন প্রতিপক্ষের কোন নিরাপদ জায়গা হবে।
কংক্রিট স্ল্যাবের একটা অংশ ধীরে ধীরে উপরে তুলতে লাগল আহমদ মুসা।
একটু তুলেই বুঝল জায়গাটায় কার্পেট বিছানো রয়েছে।
তাহলে এটা ঘর নিশ্চয়। আর ঘর হলে কোন মানুষ থাকার সম্ভাবনা থাকছেই।
বিজ্ঞানী এ পথ দিয়ে রাতে না দিনে যাতায়াত করতেন?
হঠাৎ আহমদ মুসার খেয়াল হলো এটা লাঞ্চ আওয়ার। এখন তো সব আমেরিকানদেরই অফ পিরিয়ড়। এ সময় তারা ঘরে কিংবা অফিসে থাকে না।
এই চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা অতি সন্তর্পনে কংক্রিট স্ল্যাবটা সুড়ঙ্গের মুখ থেকে সরিয়ে কার্পেটের নীচ দিয়ে মেঝের উপর ঠেলে দিল।
তারপর নিজের দেহকেও স্ল্যাবের মত করেই সুড়ঙ্গের মুখ থেকে উপরে তুলে কার্পেটের নিচ দিয়ে মেঝের উপর ঠেলে দিল। নিজেকে সুড়ঙ্গের মুখ থেকে বের করে আনার পর তার প্রথম কাজ হলো স্ল্যাবটাকে আবার সুড়ঙ্গ মুখে বসিয়ে দেয়া।
কোন দিকে কার্পেটের নিকটতম প্রান্ত? কাপের্টের তলের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে দ্রুত বেরুবার জন্যে এ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার কাছে বড় হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা দ্রুত চারদিকে হাত ও পা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল কোন দিকে কার্পেটটা ঢিলা বেশী। তার চিন্তা হলো, নিশ্চয়ই সুড়ঙ্গ মুখ কার্পেটের একটা প্রান্তে হবে এবং যে দিকে প্রান্ত হবে সে প্রান্তের কার্পেটকে অপেক্ষাকৃত ঢিলা পাওয়া যাবে।
সফল হলো আহমদ মুসা। তার হাতের ডান দিকের কার্পেট খুবই ঢিলা পাওয়া গেল।
আহমদ মুসা গড়িয়ে ঢিলা প্রান্তের দিকে এগুলো।
একটা দেয়ালে কার্পেট শেষ হয়েছে।
আহমদ মুসা কার্পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।
এক সারি দৈত্যাকার কম্পিউটারের পেছনের দেয়াল ঘেঁষে নিজেকে দেখল আহমদ মুসা।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। সুড়ঙ্গ মুখটা কম্পিউটারের আড়ালে থাকায় এখানে কি ঘটছে এ ঘরে কেউ থাকলেও তা তার নজরে পড়ার কথা নয়। বিজ্ঞানীকে মনে মনে ধন্যবাদ দিল আহমদ মুসা।
কিন্তু এটা কোন জায়গা? কোথায় এসেছে সে?
আহমদ মুসা দুই কম্পিউটারের ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরটায় উঁকি দিল, দেখল ঘরের প্রায় চারদিক দিয়েই এ ধরনের কম্পিউটারের সারি। ঘরের মাঝখানটা ফাঁকা।
আহমদ মুসা ঘরের যে প্রান্তে, তার বিপরীত প্রান্তে দরজা। ঘরে কেউ নেই। লাঞ্চে গেছে নিশ্চয়ই।
আহমদ মুসার গোটা শরীর ধুলি ধুসরিত। পকেট থেকে রুমাল বের করে মাথা ও কোট প্যান্ট যতটা পারল পরিষ্কার করল।
তারপর এক কম্পিউটারের পাশ দিয়ে ঘরের মাঝখানে প্রবেশ করল।
দ্রুত একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল কম্পিউটারের দিকে। সবগুলো কম্পিউটারই চালু অবস্থায় আছে।
প্রত্যেকটা কম্পিউটারের টপ কভারে একটা নাম পড়ে ভীষণ চমকে উঠল আহমদ মুসা। টপ কভারে পেস্টিং করা সুন্দর কাগজে সুন্দর করে লেখা ‘লস আলামোস ল্যাবরেটরী অব স্ট্রাটেজিক রিসার্চ’।
সবগুলো কম্পিউটারে এই একই শীর্ষ নাম।
তাহলে আহমদ মুসা এখন লস আলামোসের বিশ্ব বিখ্যাত স্ট্রাটেজিক রিসার্চ ল্যাবরেটরীর গ্রাউন্ড ফ্লোরে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ইহুদী বিজ্ঞানী তার সুড়ঙ্গ এই ল্যাবরেটরীতে নিয়ে এসেছে কেন? সুড়ঙ্গটি কি এ ল্যাবরেটরীতে গোয়েন্দাগিরির একটা পথ ছিল? ইহুদী বিজ্ঞানী কি এ স্ট্রাটেজিক ল্যাবরেটরীর গবেষণা চুরি করেছেন এ পথে? বহুতল বিশিষ্ট গোটা ল্যাবরেটরীর যাবতীয় গবেষণার ফল নিশ্চয়ই এই দৈত্যাকার কম্পিউটারে প্রসেস ও স্টোর হয় এবং এই কম্পিউটার কক্ষই ইহুদী বিজ্ঞানীর সুড়ঙ্গের মুখ।
কি ঘটেছে ভাবতেই শিউরে উঠল আহমদ মুসা। মাথাটা ঘুরে যেতে চাইল।
মাথাটায় একটা ঝাঁকি দিয়ে আহমদ মুসা ভাবল সব চিন্তার আগে তাকে এই অত্যন্ত স্পর্শকাতর গবেষণাগার থেকে সরে পড়তে হবে। এখানে তাকে ধরা পড়া চলবে না কোনক্রমেই।
দরজার দিকে তাকাল আহমদ মুসা। দরজা বন্ধ।
এগোলো আহমদ মুসা দরজার দিকে। খুব সন্তর্পনে দরজার নব ঘুরাল সে। লক আলগা হয়ে গেল।
ধীরে ধীরে দরজা ফাঁক করল আহমদ মুসা।
উকিঁ দিয়ে দেখল, ইউনিফরম পরা একজন দরজার বিপরীত দিকে হেঁটে যাচ্ছে। তার হাতে ঝুলছে কাল কুচকুচে এক ভয়ংকর অটোমেটিকে কারবাইন।
আহমদ মুসা দ্রুত বের হয়ে কোন শব্দ না হয় এ জন্যে আলতো করে দরজা ছেড়ে দিয়ে লোকটি দরজার যেদিকে, তার বিপরীত দিকে বিড়ালের মত নিঃশব্দে ছুটল।
কোন দিকে কি আছে, বের হবার দরজাই বা কোন দিকে কিছুই জানা নেই আহমদ মুসার। অন্ধের মত সে ছুটছে।
দরজাটা পেরিয়ে কয়েক গজ এসেই একটা করিডোর পেল। করিডোর ধরে ডানদিকে এগোলো।
করিডোরটা ধরে কয়েক গজ এগোতেই একটা করিডোর জংশনের মুখে গিয়ে পড়ল সে। সেই সাথে মুখোমুখি হলো অটোমেটিকে কারবাইনধারী এক প্রহরীর।
করিডোর জংশনটা থেকে চারদিকে চারটা করিডোর বেরিয়ে গেছে।
প্রহরীটির মুখোমুখি হয়ে আকস্মিকতার একটা ধাক্কা খেয়েছিল আহমদ মুসা। কিন্তু প্রহরীটিই আহমদ মুসাকে দেখে হতচকিত হয়েছিল বেশী।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল প্রহরীটি।
আহমদ মুসা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এক হাতে তার মুখ চেপে অন্য হাত দিয়ে তাকে জাপটে ধরে টেনে নিয়ে এল একটা দরজার দিকে।
দরজা ঠেলে প্রহরীকে ভেতরে ছুঁড়ে দিল। প্রহরীটি পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়াল। তার হাতের ঝুলন্ত কারবাইন সে উপরে তুলছিল।
আহমদ মুসার ডান হাত তার আগেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তার হাতের একটা আঘাত গিয়ে পড়ল প্রহরীর কানের নিচে ঘাড়টায়।
লোকটি সংজ্ঞা হারালে আহমদ মুসা তার কারবাইনটা নিয়ে বেরিয়ে এলো করিডোরে। কোন দিকে যাবে সে?
সব করিডোরকেই আহমদ মুসার একই রকম মনে হলো। সুতরাং প্রহরীকে আটকাবার জন্যে আহমদ মুসা যে করিডোরে ঢুকেছিল সেই করিডোর ধরে এগোবার সিদ্ধান্ত নিল।
কিছুদুর এগোবার পর আরেকটা করিডোরের মুখোমুখি হলো আহমদ মুসা। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পেল সে। তার মনে হলো, শব্দগুলো সিঁড়ি ভেঙে উপর থেকে নিচে নামছে সামনের করিডোর জংশনটার দিকে।
একটি করিডোরের শাখা এদিকে ডানে, অন্য দু’টি শাখা অন্য দু’দিকে চলে গেছে। আর সামনে সিঁড়ি। মনে হয় সিঁড়িটা দু’তলায় উঠে গেছে।
ঐ সিঁড়ি থেকেই শব্দগুলো ছুটে আসছে। ছুটে আসা লোকগুলো আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার সামনে এসে যাবে।
আহমদ মুসা আশে পাশে চাইল। দেখল, তার দু’পাশেই দু’টি দরজা। বাম দিকের দরজাটাই তার কাছে।
আহমদ মুসা ছুটে গিয়ে দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। একটা মেয়ে তার টেবিলে বসে কাজ করছিল।
কারবাইন নিয়ে আহমদ মুসাকে ঘরে ঢুকতে দেখে আতংকে উঠে দাঁড়াল মেয়েটি।
আহমদ মুসা তার কারবাইনের নল নিচে নামিয়ে তর্জনি নিজের ঠোঁটে ঠেকিয়ে মেয়েটিকে এক দিকে অভয় দিল, অন্যদিকে তাকে চুপ থাকতে বলল।
আতংকিত মেয়েটি কোন শব্দ না করে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল।
আহমদ মুসা দরজার শ্যাডো গ্লাস দিয়ে বাইরে চোখ রাখল।
দরজার ওখান থেকে আহমদ মুসা সিঁড়ির নিচের অংশটা দেখতে পাচ্ছে।
সিঁড়ি দিয়ে পাঁচজন দৌড়ে নেমে এল। আহমদ মুসার করিডোর দিয়েই তারা ছুটে গেল আহমদ মুসা যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে। ওরা টের পেয়েছে, কিন্তু কিভাবে?
কিন্তু ভাববার সময় নেই আহমদ মুসার। বলল আহমদ মুসা মেয়েটিকে লক্ষ্য করে, ‘ম্যাডাম বাইরে বেরুবার গেট কোন দিকে?’
মেয়েটি কথা বলল না।
সে সহজে কথা বলবেনা, নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা।
হাতের অটোমেটিক কারবাইনটা তুলতে চাইল। কিন্তু একজন নারীর বিরুদ্ধে তার হাত উঠল না। বলল আহমদ মুসা, ‘ধন্যবাদ ম্যাডাম’।
বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু শুনতে পেল অনেকগুলো পায়ের শব্দ ছুটে আসছে এ দিকে।
ওরা কি ফিরে আসছে?
আহমদ মুসা আর কিছু ভাববার আগেই দেখল, ওরা ছুটে আসছে এ দরজা লক্ষ্যেই।
চট করেই চিন্তাটা আহমদ মুসার মাথায় এলো যে, এ মেয়েটিই ওদের সংকেত দিয়েছে। প্রত্যেকের কাছে এবং প্রত্যেক কক্ষেই কি তাহলে সংকেতের এ ব্যবস্থা আছে?
আহমদ মুসা চাইল মেয়েটির দিকে। দেখল তার মুখ ভয়ে কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা বলল, ‘ভয় নেই, ওদের সংকেত দিয়ে আপনি চরম বিপদকালেও দেশের প্রতি অনুপম দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন’।
বলে আহমদ মুসা দ্রুত দরজার সামনের চৌকাঠের ওপাশে দেয়াল ঘেষে দাঁড়াল কারবাইনের ব্যারেল উঁচু করে, যাতে দরজা খুললেই ওরা তার সামনে এসে যায়।
ওরা দৌড়ে আসার পর দরজার কাছাকাছি এসে বিড়ালের মত সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে।
শ্যাডো কাঁচের ভেতর দিয়ে আহমদ মুসা ওদের দেখতে পাচ্ছে, ওরা কিন্তু দেখছে না আহমদ মুসাকে।
ওদের একজন আস্তে দরজার নব ঘুরাল, তারপর এক প্রচন্ড ধাক্কায় গোটা দরজাই খুলে ফেলল।
সংগে সংগেই আহমদ মুসার কারবাইন গর্জন করে উঠল। এক পশলা গুলির বৃষ্টি ছুটে গেল সামনে।
আহমদ মুসা উবু হয়ে বসে মাটির একফুট উপর দিয়ে গুলি করেছে।
সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মাটিতে। মাটিতে পড়েই কেউ কেউ কারবাইন তুলতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল।
ওদের দিকে কারবাইন তাক করে বলল, ‘আমি তোমাদের হত্যা করতে চাইনি বলেই গুলি নীচ দিয়ে করেছি। কেউ তোমরা কারবাইনে হাত দেবে না। গুলি এবার পায়ে নয় বুকে করব’।
বলে আহমদ মুসা দ্রুত কারবাইনগুলো কুড়িয়ে নিল।
কোন দিকে যাবে আহমদ মুসা?
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘সামনেই দোতলা থেকে সিঁড়ি গেটে নেমে গেছে’।
আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে চোখ ফিরাল মেয়েটির দিকে। বলল, ‘ধন্যবাদ ম্যাডাম’।
ছুটতে ছুটতেই কথাগুলো বলল আহমদ মুসা।
দ্রুত সিঁড়ি ভেংঙে উঠতে লাগল দোতলায়।
তার হাতে উদ্যত কারবাইন। একটি কারবাইন তার কাঁধে ঝুলানো। আরও চারটি কারবাইন সে ফেলে দিয়ে এসেছে সিঁড়ির গোড়ায়।
সিঁড়ি থেকে দোতলার মেঝেতে পা দিতে যাবে, এ সময় আরও চারজন সামনে থেকে ছুটে আসছে দেখল আহমদ মুসা।
দেখতে পেয়েই আহমদ মুসা দৌড়ানো অবস্থাতেই গুলি করল ওদের পা লক্ষ্য করে।
ওরা গেটের দিক থেকে বিশাল প্রশস্ত সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসছিল। সিঁড়িতেই ওরা আছড়ে পড়ল। কিন্তু সেদিকে দেখার সুযোগ নেই।
গুলি করেই আহমদ মুসা ছুটল সিঁড়ি ভেঙে নিচের দিকে।
সিঁড়ি একটা প্রশস্ত লনে গিয়ে শেষ হয়েছে। লনের পরেই বিশাল গেট। গেটের দু’পাশে দু’টি কক্ষ। সিকিউরিটি বক্স হবে নিশ্চয়ই ভাবল আহমদ মুসা।
লনের দু’পাশে দু’টি করে চারটি গাড়ি দাঁড়ানো। দু’টি কার, একটা জীপ এবং একটা সিকিউরিটি ক্যারিয়ার ধরনের গাড়ি।
গেট খোলা। দু’জন প্রহরী ছুটে আসছে খোলা গেট দিয়ে গুলি করতে করতে।
আহমদ মুসা নিজেকে ছুড়ে দিল সিঁড়ির উপর।
তারপর কারবাইন দু’টি বুকে ধরে দ্রুত গড়িয়ে নামতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে। চারপাশে গুলি এসে পড়ছে। একটা গুলি এসে বিদ্ধ করল আহমদ মুসার বাহু সন্ধিতে।
মনে হলো বাহুটা যেন কাঁধের সাথে নেই। গোটা শরীরটাই কেঁপে উঠছিল আহমদ মুসার।
কিন্তু মুহূর্তের জন্যও থামেনি সে, বরং গড়িয়ে পড়ে গতি আরও বাড়িয়ে দিল আহমদ মুসা। সিঁড়িতে তাকে টার্গেট করার যে সুবিধা নিচের লনে তা তারা পাবে না।
লনে পড়েই আহমদ মুসা ওদের গুলি বৃষ্টির মধ্যে মাথা নিচু করে গুলি করল ওদের লক্ষ্য করে।
ওরা দৌড়ে আসছিল। গুলি বৃষ্টি ওদের পা আঁকড়ে ধরেছে। আছড়ে পড়ল তারা লনের উপর।
গুলি করেই আহমদ মুসা দ্রুত গড়িয়ে চলল জীপের দিকে।
জীপের কাছে এসে শুয়ে থেকেই আহমদ মুসা নিজের দেহকে ছুঁড়ে দিল জীপের সিটে। জীপের লক হোলে চাবী ঝুলছে।
খুশী হলো আহমদ মুসা। ধন্যবাদ দিল আল্লাহকে। ভাবল এ গাড়িটাও নিশ্চয় সিকিউরিটিদের ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত ছিল। গাড়ি স্টার্ট দিল আহমদ মুসা।
দেখল, কারবাইন হাতে আরও দু’জন প্রহরী ছুটে এসেছে গেটে। গেট তখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
আহমদ মুসার জীপও গেটের মুখে এসে পড়েছে।
গেট বন্ধ করার সুযোগ হলো না।
আহমদ মুসার জীপের বেপরোয়া গতি তীব্রভাবে আঘাত করল গেটে। চলন্ত গেটের একটা অংশ বাঁকিয়ে নিয়ে বাইরে ছিটকে পড়ল গাড়ি।
আহমদ মুসার ভাগ্য ভাল যে, জীপটি প্রায় উল্টে গিয়েও আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল।
গেটে আসা প্রহরী দু’জন জীপের সামনে পড়ায় বাঁচার জন্যে দু’পাশে দু’জন ছিটকে পড়েছিল। দু’জনের হাত থেকে কারবাইন দু’টিও ছিটকে পড়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা তার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে তীব্র গতিতে ছুটল সামনে।
প্রহরী দু’জন কারবাইন দু’টি কুড়িয়ে নিয়ে গুলি করার পজিশনে আসার পর দেখল, জীপটি তাদের রেঞ্জের বাইরে। তবু তাদের কারবাইন গর্জন করে উঠল। গুলি গুলোর অপচয় ছাড়া কোনই লাভ হলো না এতে।
কারবাইন ছুড়ে ফেলে ওরা দু’জন দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মাটিতে আঘাতের পর আঘাত করার মাধ্যমে ব্যর্থতার তীব্র গ্লানি হালকা করতে চাইল।