থাকতে হলো খোঁজ খবর নেবার জন্যেও।
আহমদ মুসার গন্তব্য ক্লীফ ডোয়েলিং নয়। ক্লীফ ডোয়েলিং থেকে একটু দক্ষিণে ‘লস আলামোসে’র দিকে একটু এগুলে গম্বুজাকৃতি একটা সবুজ পাহাড় আছে সেটাই তার গন্তব্য। সেই সবুজ পাহাড়ের মালিক ছিলেন একজন ইহুদী বিজ্ঞানী। তিনি মৃত্যুর সময় তার বাড়ি সমেত সবুজ পাহাড়টি দিয়ে গেছেন তাদের ধর্মীয় ‘সিনাগগ’ কে। সেখানে সেই বিজ্ঞানীর স্মৃতিতে তৈরী হয়েছে এক ‘সিনাগগ’। সেই সিনাগগকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ইহুদীবাদীদের একটা গোপন আস্তানা। এই গোপন আস্তানার একটা বড় কাজ হলো ‘লস আলামোসে’র উপর গোয়েন্দাগিরি করা।
‘লাস আলামোস’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরোনো, সবচেয়ে সমৃদ্ধ পারমাণবিক গবেষণ কেন্দ্র। এই কেন্দ্রেই তৈরী হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম আণবিক বোমা। এখন এই গবেষণাগারে ‘স্ট্রাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ’ (SDI) এর নানা দিকের উপর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চলছে। সবুজ পাহাড়ের ইহুদী সিনাগগ এ গবেষণার উপরই চোখ রাখছে। প্রতিটি উন্নয়ন এবং পরিকল্পনা ও প্রস্তাব তারা মনিটর করে।
আহমদ মুসা খোঁজ নিয়ে জেনেছে ‘ক্লীফ ডোয়েলিং’ থেকে তাকে যেতে হবে সবুজ পাহাড়ের সিনাগগের দিকে। ক্লীফ ডোয়েলিং থেকে দক্ষিণ দিকে ‘লস আলামোস’ পর্যন্ত এবং তার আশপাশ এলাকায় রাতে ব্যক্তিগত ছাড়া কোন ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস চলে না। আহমদ মুসাকে যেহেতু যেতে হবে ভাড়া গাড়িতে, তাই তাকে রাতটা অপেক্ষা করতে হলো এস্পানোলাতে।
এক রাত অপেক্ষা করাটা তার জন্যে শাপে বর হলো। ওয়াশিংটনে নকল কারসেনের কাছ থেকে ক্লীফ ডোয়েলিং ও লস আলামোস এর মাঝখানের গম্বুজাকৃতি সবুজ পাহাড়ের সিনাগগের নামটাই সে শুধু পেয়েছিল। কিন্তু এক রাতের সময় হাতে পাওয়ায় খোঁজ খবর নিতে গিয়ে আরও কিছু জানতে পারল সে। বিল নামে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার তাকে বলল, ‘স্যার আমার দশ বছর ট্যাক্সি চালানোর জীবনে এই প্রথম একজন প্যাসেঞ্জার পেলাম সবুজ পাহাড় সিনাগগে যাবার’।
‘ইহুদীরা সিনাগগে যায় না?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘ওখানে কেন যাবে স্যার! ‘সান্তাফে’তেই তো সিনাগগ আছে’।
‘তাহলে ওখানে সিনাগগ করতে গেল কেন?’
‘জানি না স্যার। পর্যটকরাও ওখানে যায় না’।
‘কেন?’
‘সিনাগগের কর্তৃপক্ষরা নাকি পছন্দ করে না। বলে, এটা নতুন সিনাগগ। ঐতিহাসিক হলে দেখার কিছু থাকতো’।
বলল, ‘তুমি কোনদিন গেছ সেখানে?’
‘ক্লীফ ডোয়েলিং থেকে লস আলামোসে যাবার একটা রাস্তা সবুজ পাহাড়ের পাশ দিয়ে গেছে। একবার লস আলামোস গেছি ঐ পথ দিয়ে। ফেরার পথে লস আলামোস থেকে একজন আমার গাড়িতে উঠেছিল। সে নেমেছিল ঐ সিনাগগে। তাকে নামিয়ে দেয়ার জন্যে আমি সিনাগগের গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সাংঘাতিক ওদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্যার। গাড়ি বারান্দা পৌঁছতে আমাকে দু’বার চেক করেছে ওরা’।
‘ঐ লোকটিকে চেক করেনি?’
‘না, করেনি। বরং সে লম্বা লম্বা স্যালুট পেয়েছে’।
‘বিল তুমি বললে লস আলামোসে মাত্র একবার গেছ। কেন?’
‘লস আলামোসে যাবার আলাদা পথ আছে সান্তাফে থেকে। অন্য পথগুলো বিশেষ করে উত্তর-দক্ষিন-পশ্চিম বনাঞ্চলের প্রাইভেট পথগুলো রেস্টিকেটেড। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া এ পথগুলো ব্যবহার করা যায় না’।
‘তাহলে তুমি সেদিন গিয়েছিলে কিভাবে?’
‘যাকে নিয়ে গিয়েছিলাম, সে লস আলামোসের একজন বিজ্ঞানী’।
‘যাকে তুমি নিয়ে এসেছিলে, সেও কি তাই?’
‘তা মনে হয়নি স্যার। সে লস আলামোস অফিস থেকে আমর গাড়িতে চড়েনি। গবেষণা কেন্দ্রের বাইরে একটা ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়েছিল। আমার গাড়ি সেখানে পৌঁছতেই সে রাস্তায় ছুটে আসে। মনে হয়েছিল, সে ওঁত পেতে ছিল গাড়ির অপেক্ষায়।
‘তাহলে নিশ্চয় সে লস আলামোসের চাকুরে নয়। কারণ চাকুরেরা সবাই পারমাণবিক গবেষণাগারের সেফটি কোড অনুসারে লস আলামোসেই থাকার কথা’।
‘কিন্তু তার গায়ে লস আলামোসের ইউনিফরম ছিল। আমার গাড়িতে উঠবার পর তড়িঘড়ি তা সে খুলে ফেলে’।
‘তড়িঘড়ি বলছ কেন বিল?’
‘গাড়িতে উঠেই দ্রুত সে ইউনিফরমের বোতাম খোলা শুরু করে’।
‘আচ্ছা তোমার গাড়িতে যাওয়া বিজ্ঞানী কি ইউনিফরম পরে ছিল?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু এত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন কেন? যাবেন তো আপনি সবুজ পাহাড়ে,লস আলামোসে তো নয়’।
‘দেখ জানার প্রত্যেকটা বিষয় খুটেঁ খুটেঁ জানা আমার অভ্যাস’।
বলে আহমদ মুসা তাকে খুব সকালে গাড়ি নিয়ে হোটেলে আসতে বলে বিদায় নিয়েছিল।
পরদিন সকালে সবুজ পাহাড় সিনাগগে যাত্রা করল আহমদ মুসা।
এস্পানোলা শহরটি রেড ইন্ডিয়ান রিজার্ভ এলাকার মধ্যে। এলাকাটির সীমান্ত সা্ন্তাফে জাতীয় ফরেস্ট এলাকার সাথে মিশে আছে।
রাজধানী সান্তাফেসহ নিউ মেক্সিকোর গোটা অঞ্চলটাই পার্বত্য উচ্চভূমি।
আহমদ মুসার মনে হলো গাড়িটা যেন ক্রমেই উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। মনে পড়ল রুদ্ধ পর্বতমালার কি এক পাহাড় হবে সামনেই। ঐ পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালেই তো ক্লীফগুলো।
আরও কিছু পথ চলার পর গাড়ি একটু বাম দিকে বাঁক নিল। তার মনে হলো গাড়ি এবার নিচে নামছে।
‘স্যার আমরা গ্রান্ডি নদীর সনি লুইস উপত্যকায় নামছি। এই উপত্যকাতেই আপনার সবুজ পাহাড়। এই উপত্যকারই আদিগন্ত বনরাজিবেষ্টিত উচ্চভূমিতে লস আলামোস ল্যাবরেটরী’।
‘বিল তোমরা নিউ মেক্সিকানরা লস আলামোস নিয়ে খুব গর্বিত তাই না?’
‘হ্যাঁ, স্যার। প্রথমটাসহ প্রথম দিকের সব আণবিক বোমা তো এই গবেষণাগারেই তৈরী হয়’।
‘শুধু তো তৈরী নয়, তোমাদের এই ট্রিনিটি ভ্যালিতে আণবিক বোমার প্রথম পরীক্ষাও সংঘটিত হয়’।
‘স্যার আপনি দেখছি এই এলাকার অনেক কিছুই জানেন’।
‘কেন, এটা তো সবাই জানার কথা। লস আলামোস, ট্রিনিটি ভ্যালি তো জগত বিখ্যাত। নিউ মেক্সিকো এলে কোন মানুষ এ দু’টো জায়গা না দেখে যায় না’।
গল্পে গল্পে অনেক সময় চলে গেল।
আহমদ মুসা বলল, ‘আর কতদূর তোমার সবুজ পাহাড়?’
‘আর দু’বাঁক ঘুরলেই স্যার’।
ড্রাইভার কথা শেষ করার সাথে সাথে হার্ড ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করাল।
ঝাঁকুনি সামলে উঠে সামনে তাকাতেই আহমদ মুসা দেখল, মুখোশ পরা একজন লোক স্টেনগান তাক করে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
আপনাতেই আহমদ মুসার দৃষ্টি চারপাশ ঘুরে এল। দেখল, মুখোশ পরা আরও জনা পাঁচেক লোক স্টেনগান হাতে গাড়িটা ঘিরে ফেলেছে।
ছুটে এল দু’পাশ থেকে দু’জন গাড়ির জানালায়। একজন চিৎকার করে বলে উঠল, ‘এশিয়ান, এশিয়ান’।
পরক্ষণেই ছুটে এল বিশাল বপু আরেকজন লোক, তার হাতে একটা ফটো। সে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে, একবার হাতের ফটোগ্রাফের দিকে তাকাল। সেও বলে উঠল চিৎকার করে, ‘খুব একটা মিলছে না। কিন্তু এশিয়ান, এটাই বড় কথা। নামাও শালাকে। নিশ্চয় ছদ্মবেশে আছে’।
একজন সংগে সংগেই টান মেরে গাড়ির দরজা খুলে ফেলল। টানতে হলো না, আহমদ মুসা নিজেই নেমে এল গাড়ি থেকে। ভাবল, জেনারেল শ্যারনদেরই পাতা ফাঁদ কি? কিন্তু ওরা জানবে কি করে যে আহমদ মুসা নিউ মেক্সিকোর সবুজ পাহাড়ে আসছে! সে তো নিজ হাতে নকল কারসেন ওরফে ইহুদী কোহেনকে জর্জদের তত্বাবধানে রেখে এসেছে। সে মুক্ত হতে পেরেছে এটা বিশ্বাস হয় না। তাহলে এরা জানতে পারল কি করে? এরা যে আহমদ মুসাকেই খুঁজছে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
আহমদ মুসা নামতেই একজন তার চুল এবং আর একজন গোঁফ ধরে টান দিল। খুলে গেল দুটোই।
সেই মোটা লোকটা চিৎকার করে উঠল, ‘মিলে গেছে। একেবারে মিলে গেছে। শয়তান আহমদ মুসাকে আবার আমরা হাতে পেয়েছি’।
নেমেই সে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, ‘উঃ তোমার জন্যে আমরা গতকাল দুপুর থেকে এখানে বসে আছি। কি যে কষ্ট দিয়েছ’।
‘জানলে কি করে যে আমি আসব?’ আহমদ মুসা স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল।
মোটা লোকটি আহমদ মুসার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। বলল,
‘বাঃ তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন আমরা তোমাকে স্বাগত জানাতে এসেছি। হাফ ডজন উদ্যত স্টেনগানের সামনে কথা বলতে বুক একটু্ও কাঁপল না?’
‘কাঁপবে কেন? তোমরা আমাকে হ্ত্যা করতে পারবে না। সে ক্ষমতা তোমাদের নেই’।
লোকটির চোখ জ্বলে উঠল। সে তার স্টেনগানের বাঁট দিয়ে একটা আঘাত করল আহমদ মুসার মাথায়।
আহমদ মুসা মাথা সরিয়ে নেয়ায় আঘাতটা কান দিয়ে কাঁধে নেমে এল। কান ছিঁড়ে গেল। দর দর করে বেরিয়ে আসা রক্ত বুক, পৃষ্ঠদেশ ভাসিয়ে দিতে লাগল।
‘ক্ষমতার কথা তুলছ, ক্ষমতা দেখবে চল’। আঘাত করার সাথে সাথে কথা কয়টি বলে হুংকার ছাড়ল সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে, এর হাত পা বেঁধে নিয়ে চল একে।
দু’জন ছুটে এল আহমদ মুসার দিকে।
‘দাঁড়াও তোমরা, আমি ড্রাইভারকে ভাড়াটা দিয়ে নেই’।
বলে আহমদ মুসা পকেটে হাত দিয়ে এক গুচ্ছ নোট বের করে ড্রাইভারের সামনে তুলে ধরে বলল, ‘নাও বিল, ধন্যবাদ তোমাকে’।
ড্রাইভার উদ্বেগ, আতংকে একেবারে পান্ডুর হয়ে গেছে। আহমদ মুসাকে ভাড়া দিতে দেখে চোখ দু’টি তার ছল ছল করে উঠল। বলল, ‘থাক স্যার, আপনি…..’।
থেমে গেল, শেষ করতে পারল না। কথা আটকে গেছে তার গলায়।
আহমদ মুসা নোটগুলো ছুঁড়ে দিল ড্রাইভারের দিকে।
ওরা মহা উৎসাহে হাত পা বাঁধল আহমদ মুসার। তারপর চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল তাকে।
হঠাৎ ওদের একজন ঘুরে দাঁড়াল। চিৎকার করে উঠল ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে, ‘হারামজাদা, কি দেখছিস। এক মুহূর্ত দেরী করলে লাশ বানিয়ে দেব’।
ড্রা্ইভার তাড়াতাড়ি আহমদ মুসার দেয়া নোটগুলো কুড়িয়ে পকেটে ফেলে গাড়ি ব্যাক করে ছুটল সামনের দিকে।
শরীর কাঁপছে ড্রাইভারের। বুক তোলপাড় করছে আতংক ও বেদনায়।
তার মন বলে উঠল, যে লোক মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারের ভাড়া পরিশোধ করতে ভোলে না, সে কোন খারাপ লোক হতে পারে না। কিন্তু কেন ওরা ওঁকে ধরে নিয়ে গেল। কি দোষ তাঁর!
আবার বিষ্মিতও কম হয়নি ড্রাইভার। সে যতখানি আতংক ও উদ্বিগ্ন হয়েছে, তার কণামাত্র উদ্বেগও ঐ লোকের চোখে মুখে দেখেনি। ব্যাপারটা অলৌকিক মনে হচ্ছে তার কাছে।
দু’জন আহমদ মুসার দেহ ঘরের মেঝেতে ছুড়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘দেখতে তো খুব হালকা পাতলা, কিন্তু পাথরের মত ভারি’।
আহমদ মুসার দেহ গিয়ে পড়ল জেনারেল শ্যারনের পায়ের কাছে।
সোফায় পাশাপাশি বসে ছিল জেনারেল শ্যারন, মিঃ গোল্ড ওয়াটার ও মিঃ কলিন্স।
জেনারেল শ্যারন ডান পা দিয়ে আহমদ মুসার পাঁজরে একটা ঘা দিয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার আহমদ মুসা নিউ মেক্সিকোর সবুজ পাহাড়ে যে তুমি? লস আলামোস দেখতে এসেছিলে নাকি? কিন্তু লস আলামোসের রাস্তা তো এটা নয়’।
‘ভনিতা করবেন না জেনারেল শ্যারন। আপনি জানেন আমি কেন এসেছি’। বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আহমদ মুসা, তুমিও দেখছি বোকামী কর মাঝে মাঝে। তুমি কেমন করে নিশ্চিত হলে যে কোহেনকে আটকালে আমরা টের পাবো না এবং কোহেন আটক হওয়র পর সবুজ পাহাড়ে তুমি আসবে এটা আমরা বুঝব না?’
‘সত্যিই বলেছেন। কোহেনের কাছে অয়্যারলেস ট্রান্সমিটার চীপস আছে, এ বিষয়টা আমাদের চিন্তায় আসেনি। আর আমি বোকামী না করলে আমাকে এভাবে আটকানো তোমার পক্ষে সম্ভব হতো কি করে?’
‘সেবার আমাদের বোকা বানিয়ে তুমি সরে পড়েছিলে। এবার তোমাকে বোকা বানিয়ে আমরা তোমাকে খাঁচায় পুরলাম’। বলে হো হো করে হেসে উঠল জেনারেল শ্যারন।
‘ঠিক আছে। আমাকে তো তোমরা পেয়েছ, এবার তোমরা মিঃ কারসেনকে ছেড়ে দাও। আর তোমাদের ওয়াদা অনুসারেই ডাঃ মার্গারেট ও লায়লা জেনিফারকে ছেড়ে দিতে হবে’।
আবার জেনারেল হেসে উঠল হো হো করে। বলল, ‘কোহেনকে পাওয়ার পর আমরা ছেড়ে দেব মিঃ কারসেনকে। কিন্তু বল ডাঃ মার্গারেট ও লায়লা জেনিফারকে ছাড়ি কি করে। ইতিমধ্যেই আমাদের লোকরা তাদের প্রেমে পড়ে গেছে। তুমিই বল আমি কেমন করে বঞ্চিত করি ওদের? ওরা তো এক সাগর তৃষ্ঞা নিয়ে আমাদের দেয়া মেয়াদ পনের দিন পার হওয়ার প্রহর গুনছে। এখন কিন্তু তুমি আমাদের হাতে, পনের দিনের মেয়াদ পার হওয়ার আর কোন প্রয়োজন নেই’।
‘কিন্তু আমি এও জানি মিঃ শ্যারন, আমি বেঁচে থাকতে তাদের গায়ে তোমরা হাত দেবে না’।
‘কেন?’
‘কারণ আহমদ মুসাকে তোমরা চেন’।
‘আহমদ মুসা, তোমার এই অতি আত্মবিশ্বাস তোমাকে অতীতে বহুবার বাঁচিয়েছে জানি, কিন্তু সব বার বাঁচাবে তা ঠিক নয়। সব কিছুরই একটা শেষ আছে। সেই শেষ অবস্থায় তুমি পৌঁছে গেছ। আগামীকাল সকালে তোমাকে নিয়ে আকাশে উড়ব আমরা ইউরোপের কোন একটি দেশের উদ্দেশ্যে। আমরা মার্কিন সীমান্ত অতিক্রম করার পর ডাঃ মার্গারেট ও লায়লা জেনিফারকে ক্ষুধার্থ হায়েনারা ছিঁড়ে –ফেড়ে খাবে’।
বলে জেনারেল শ্যারন আবার হেসে উঠল হো হো করে।
‘মনে হচ্ছে মিঃ শ্যারন তোমার নিজের এবং সবার ভাগ্যটা যেন তুমিই লেখ’। বলল আহমদ মুসা।
‘ভাগ্য ঈশ্বরই লেখেন। তবে তোমাদের কবি ইকবালের একটা কথা আছে না, খুদিকে এমন বুলন্দ কর, যাতে খোদা বলেন, বল বান্দাহ তোমার ইচছা কি, আমি কি লিখব তোমার ভাগ্য। এখন ঈশ্বর তোমাদের ভাগ্য আমার হাতে দিয়ে দিয়েছেন’।
‘সৌভাগ্য আপনার মিঃ শ্যারন’।
‘আচ্ছা, মিঃ আহমদ মুসা আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আপনি এখন মুক্তির কথা ভাবছেন, না ভবিষ্যতটা অন্ধকার দেখছেন?’ বলল এফ.বি.আই এজেন্ট কলিন্স।
‘আপনি…..?’
‘আমি কলিন্স’।
‘আরেকটা পরিচয়ও আছে, আপনি এফ.বি. আই এর লোক’। বলল আহমদ মুসা।
বিষ্ময় দেখা দিল কলিন্সের চোখে মুখে। বলল, ‘আপনি কি করে জানলেন?’
‘এফ. বি. আই এজেন্টদের চোখেই তাদের পরিচয় লেখা থাকে সাধারণত’।
‘সাধারণত বললেন কেন?’
‘চেনা যায় না, এমন অসাধারণ ক্ষেত্রও বহু আছে’।
‘আমার প্রশ্নের কি জবাব দেবেন?’ বলল কলিন্স।
‘মুক্তি সম্পর্কে কোন ভাবনা আমার মাথায় এখন নেই। তাই বলে আমি সামনে অন্ধকারও দেখছি না। মৃত্যুকে যারা ‘অন্ধকার’ রূপে দেখে, তারা ভবিষ্যত অন্ধকার দেখতে পায়। কিন্তু মৃত্যু আমার কাছে আলোকিত এক সিংহ দরজা’। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা একটু থামল। পরক্ষণেই আবার বলে উঠল, ‘কিন্তু জেনারেল শ্যারন ও মিঃ গোল্ড ওয়াটারের সাথে এফ.বি.আই এর লোক কেন? মার্কিন সরকার কি জেনারেল শ্যারনকে সাহায্য করছে?’
মিঃ কলিন্সের মুখে কিছুটা বিব্রত ভাব ফুটে উঠল। বলল, ‘সরকারের কোন পলিসির প্রশ্ন এখানে জড়িত নেই। জেনারেল শ্যারন একজন গন্যমান্য লোক, আমাদের দেশে এসেছেন, তাই তাকে একটু সঙ্গ দেয়া’।
‘মেহমানকে সঙ্গ দেয়া আর লোক কিডন্যাপের অভিযানে তাকে সঙ্গ দেয়া কি এক জিনিস?’ আহমদ মুসার কন্ঠে জিজ্ঞাসা।
‘দেখুন আমি ছোট চাকুরী করি। এসব প্রশ্নের জবাব আমার দেবার কথা নয়’। বলল কলিন্স।
কলিন্স থামতেই গর্জন করে উঠল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘তুমি এদেশে বেআইনিভাবে প্রবেশকারী একজন বন্দী। এফ.বি.আইকে তোমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে? সাহস তুমি খুব বেশীই দেখাচ্ছ’।
‘আমি বেআইনী প্রবেশকারী হলে সেটা দেখার দায়িত্ব মার্কিন সরকারের, জেনারেল শ্যারনের নিশ্চয় নয়’।
‘আহমদ মুসা আমি তোমার প্রশংসা করি। কিন্তু তোমার এখন অবস্থা কি, আর তুমি আলোচনা করছ কোন বিষয়ে। তোমাকে আমরা ধরেছি, কেন ধরেছি, কিভাবে ধরেছি, সে জবাবদিহি আমরা তোমার কাছে করব না’। বলল জেনারেল শ্যারন।
‘সেটা আমি জানি। আমি কথা বলছিলাম মিঃ কলিন্সের সাথে। কারণ সে সরকারী লোক। এমনকি তার সাহায্যও আমি চাইতে পারি’।
‘তা চাইতে পার, কিন্তু তোমাকে সাহায্য করার এখন দুনিয়াতে আর কেউ নেই’। শ্যারন বলল।
‘দুনিয়ার কোন সাহায্যকারীর আমার দরকারও নেই। আমার আল্লাহ আমার জন্যে যথেষ্ট’।
‘ঠিক আছে, দেখা যাবে’।
বলে জেনারেল শ্যারন উচ্চস্বরে বলল, ‘কে আছ, এদিকে এস’।
ডাকার সঙ্গে সঙ্গে চারজন বড়ি বিল্ডার গেরিলার মত পা ফেলে এগিয়ে এল।
‘বিল্ডানীয় অন্ধকূপ আছে না, সেখানে একে রেখে দাও। হাত পা বাঁধা থাকবে’।
বলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি বোধ হয় জান না, বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের অতি পছন্দের বাড়ি এটা। যে সিনাগগ পেরিয়ে এলে সেটাও তাঁরই তৈরী। তাঁর অন্ধকূপে তুমি ভালই থাকবে। তুমি হয়তো বলবে বিজ্ঞানীর আবার অন্ধকূপ কি? বিজ্ঞানীর হবি ছিল মাঝে মাঝে কয়েকদিন ধরে কবরের নির্জনতায় বসবাস করা। তার অন্ধকূপ ঐ উদ্দেশ্যেই তৈরী। তুমি কাল সকাল পর্যন্ত ওখানে থেকে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় কর। একটা সুবিধা তোমাকে দেয়া হবে। সেটা হলো, অন্ধকার দূর করার জন্যে সেখানে তুমি আলো পাবে’। থামল জেনারেল শ্যারন।
তার থামার সাথে সাথেই ঐ চারজন এসে খেলনার মত আহমদ মুসাকে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল ঘর থেকে বাইরে বেরুবার জন্যে।
‘অন্ধকূপ থেকে বেরুবার চেষ্টা করো না। পারবে না। তাছাড়া সবুজ পাহাড়ের এই ঘাঁটি থেকে বেরুতে হলে তোমার সেনাবাহিনী দরকার’। চিৎকার করে বলল শ্যারন।
‘মিঃ কারসেনকে ছাড়ছেন কখন?’
‘দুঃখিত আহমদ মুসা, তুমি এখানে আসার আগেই মিঃ কারসেনকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তাকে আমরা ছাড়ব, তবে তার আগে আমরা কোহেনকে ফেরত পেতে চাই’।
জেনারেল শ্যারন যখন কথা শেষ করল, তখন আহমদ মুসাকে ঘরের বাইরে নেয়া হয়েছে। আহমদ মুসা আর কোন কথা বলার সুযোগ পেল না।
খুশী হলো আহমদ মুসা যে তারা কোন সময়ই আহমদ মুসার চোখ বাঁধেনি।
ছোট বড় অনেক করিডোর পেরিয়ে তাকে নিয়ে আসা হলো অনেকটা ছোট আকারের একটি কক্ষে।
দেখে মনে হল কক্ষটি স্টোর রুম। কক্ষে বহু ড্রয়ার ও তাক। তাকগুলোতে কাঁচের স্লাইডিং ডোর। তাকগুলোতে নানা সাইজের কার্টুন।
কার্টুনগুলো হিব্রু ভাষায় লেখা।
হিব্রু ইহুদীদের নিজস্ব ভাষা। ইহুদীদের বাইরে এ ভাষার প্রচলন নেই।
অধিকাংশ কার্টুনে হিব্রু ভাষায় লেখা ‘প্রজেক্ট’ শব্দের পাশে বিভিন্ন সংখ্যা।
কক্ষের দরজার বিপরীত দেয়ালে স্টীলের বড় আলমারি। রং করা, কিন্তু ময়লা ও ধূলায় রং বিকৃত হয়েছে। মনে হয় আলমারিটায় বহুদিন কেউ হাত দেয়নি।
যে দু’জন আহমদ মুসাকে বহন করছিল তারা তাকে একটা বটম শেলফের পাশে ছুঁড়ে দেয়ার মত রেখে বলল, ‘শালার শরীরটা লোহার নাকি,এত ভারী কেন?’
আহমদ মুসার তখনও হাত পা বাঁধা।
আহমদ মুসা শেলফের পাশে পড়ার সময় এর স্লাইডিং ডোরে ধাক্কা খায়। দরজা সরে যাওয়ায় সেলফের এপাশের অনেকখানি ফাঁক হয়ে যায়। ভেতর থেকে একটা কাগজে অঁকা কার্টুন গড়িয়ে পড়ে আহমদ মুসার পাশেই।
কার্টুনটা ছোট, সম্ভবত বড় একটা কার্টুনের উপর ছিল, গড়িয়ে পড়েছে।
একটু মুখ ঘুরিয়ে চোখটা বাঁকিয়ে তাকাল কার্টুনটার দিকে। কার্টুনের গায়ে হিব্রু ভাষায় একটা সিল। পড়ল আহমদ মুসা ‘ব্যবহার শেষ, ধ্বংস করুন’। সিলের নিচে একটা হিব্রু ইনিশিয়াল এবং তারিখ। তারিখটা মাত্র চারদিন আগের।
কার্টুনটার প্রতি আগ্রহী হলো আহমদ মুসা। এটা কি কাজে ব্যবহার করেছে, এখন ধ্বংস করারই বা হুকুম কেন?
আহমদ মুসা কার্টুনটার উপর শুয়ে পড়ে কার্টুনটাকে হাতের মুঠোয় নিল।
আহমদ মুসাকে রেখেই দু’জন এগুচ্ছিল আলমিরার দিকে। আর অন্য দু’জন স্টেনগান বাগিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঘরের দরজায়। আহমদ মুসার কৌশলটা তাদের নজরে পড়েনি।
আলমিরার দিকে এগিয়ে যাওয়া লোক দু’জন থমকে দাঁড়িয়েছিল। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘দেখ অসুখ-বিসুখের ভান করোনা। লাভ হবে না’।
বলেই তারা এগুলো আলমিরার দিকে।
আহমদ মুসা শুয়ে থেকেই কার্টুনটি চালান করল কোটের পকেটে।
আহমদ মুসা শুয়ে শুয়ে দেখছিল লোক দু’টিকে, যারা আলমিরার দিকে যাচ্ছে।
ওরা আলমিরার দিকে যাচ্ছে কেন? আলমিরা খুলবে নাকি। তাকে সোজা অন্ধকূপে নিয়ে যাওয়ার কথা তবে এখানে এই হল্ট কেন?
লোক দু’টি আলমিরার কাছে পৌঁছেছে। একজন হাত বাড়াল আলমিরার দরজার হাতলের দিকে। সে আলমিরার হাতলে হাত রাখতেই আলমিরা খুলে গেল।
বিষ্মিত হলো আহমদ মুসা। হাতল তাকে ঘুরাতে হলো না। তার মানে আলমিরার দরজা খোলার জন্যে হাতলে চাপ দিতে হয়। অথবা হাতলে কোন বোতাম বা সুইচ আছে।
দরজা খুলতেই ওদের একজন বলল ‘তাহলে সব ঠিক আছে। চল ব্যাটাকে নিয়ে আসি’।
ওরা এসে আহমদ মুসাকে নিয়ে গেল চ্যাংদোলা করে এবং ছুঁড়ে দিল আলমিরার ভেতর।
আলমিরাটা ফাঁকা, আলমিরার মেঝেয় ছিটকে পড়ে গেল আহমদ মুসা।
যারা আহমদ মুসাকে আলমিরার মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছিল, তাদের একজন আহমদ মুসাকে বলল, যাও তুমি এখন ঠিক অন্ধকূপে পেৌঁছে যাবে। তবে কূপটাতে অন্ধকার রাখা হয়নি, আলোকিত করা হয়েছে। তুমি নাকি খুব মূল্যবান, এজন্যে এই মর্যাদা তোমাকে দেয়া হয়েছে’।
তারা কথা শেষ করতেই আপনাতেই আলমিরার দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আর পরক্ষণেই নড়ে উঠল দরজা। নামতে শুরু করল আলমিরাটা নিচে।
নিজেকে বোকা মনে হলো আহমদ মুসার। আলমিরাটা যে লিফট সে ঘুনাক্ষরেও তা ভাবতে পারেনি।
লিফট নামছে তো নামছেই। কত নিচে অন্ধকূপটা?
আহমদ মুসার মনে হলো চারতলা পরিমাণ নেমে লিফট থেমে গেল।
ধীরে ধীরে খুলে গেল লিফটের দরজা।
খোলা দরজা পথে দেখতে পেল একটা গোলাকার মেঝে, কার্পেট মোড়ানো। মেঝের চারদিক থেকে উঠে গেছে গোল দেয়াল। দেয়ালটাও কার্পেট মোড়ানো।
এটাই তাহলে বিজ্ঞানীর সেই অন্ধকূপ। ভাবল আহমদ মুসা।
বিজ্ঞানীর অন্ধকূপের মেঝে একেবারে শূন্য। বিছানো কার্পেট ছাড়া তিল পরিমাণ জিনিসও মেঝেতে নেই। খাবার পানিটুকুও রাখা হয়নি।
চমকে উঠল আহমদ মুসা।
কিছুতেই সে লিফট থেকে অন্ধকুপে নামবে না। নিশ্চয় লিফট উঠে যাবে। তার সাথে আহমদ মুসাও উঠে যাবে। ভাবল আহমদ মুসা।
যেমন শুয়েছিল তেমনি শুয়ে থাকল আহমদ মুসা লিফটের মেঝেতে।
সময় বয়ে যায়। অনেক সময়।
কিন্তু লিফট নড়ার নাম নেই।
তাহলে কি সে লিফটে থাকা পর্যন্ত লিফট উঠবে না? ভাবল আহমদ মুসা। তাহলে কি মানুষের দেহের ওজনের সাথে লিফটের ওঠানামার সম্পর্ক আছে? যেমন সে লিফটে উঠার সাথে সাথে লিফট নেমে এলো, তেমনি তার ওজন লিফট থেকে সরে যাবার পর লিফট উঠে যাবে? ধরা যাক উঠে যাবে, কিন্তু আবার নামবে কি করে? কেউ নামিয়ে নিয়ে আসবে, না অন্ধকূপে লিফট নামিয়ে আনার ব্যবস্থা আছে?
এমন হাজারো চিন্তা মাথায় এসে ভীড় করতে লাগল আহমদ মুসার।
একটা ভাবনা আহমদ মুসাকে খুবই পীড়িত করতে লাগল। বিজ্ঞানী এই অন্ধকূপে একদিন, দু’দিন কয়েকদিন থাকতেন। তাহলে এখানে আসা, এখান থেকে বের হ্ওয়ার একটা স্বাধীন ব্যবস্থা থাকবে না কেন? এটা স্বাভাবিক নয় যে এখান থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে তিনি অন্যের মুখাপেক্ষী ছিলেন।
শেষ এই ভাবনার মধ্যে আহমদ মুসা আশার প্রদীপ দেখতে পেল। তার মনে নতুন সাহসের ও সৃষ্টি হলো।
আহমদ মুসা হাত পায়ের বাঁধন খোলার পর লিফট থেকে নামার সিদ্ধান্ত নিল।
তার হাত পায়ের বাঁধন খুব একটা জটিল ছিল না। এই বাঁধন তারা দিয়েছিল সম্ভবত আহমদ মুসার আক্রমন থেকে বাঁচার জন্যে।
আহমদ মুসা বাঁধা হাত দুটো মুখের সামনে নিয়ে দাঁত দিয়ে হাতের বাঁধন খুলে ফেলল।
বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে আহমদ মুসা লিফট থেকে বেরিয়ে বিসমিল্লাহ বলে পা রাখল অন্ধকূপের মেঝেতে।
আহমদ মুসা লিফট থেকে নামার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লিফট উঠে গেল।
লিফট উঠে যাওয়ার সাথে সাথে নিজেকে বড় একাকী মনে হলো আহমদ মুসার।
সত্যিই ভয়াবহ এক অন্ধকূপ এটা।
আহমদ মুসা উপর দিকে তাকিয়ে দেখল, গোলাকার দেয়াল উঠে গেছে উপরে। উপরের ছাদটি সে দেখতে পেল না।
মনে হয় গ্রাউন্ড ফ্লোরটাই এই অন্ধকূপের ছাদ, ভাবল আহমদ মুসা। এমন অন্ধকূপ যে কোথাও থাকতে পারে, কোনদিন ভাবেওনি সে। অভাবনীয় সেই অন্ধকূপে দাঁড়িয়ে সত্যিই কেমন একটা অজানা উদ্বেগ বোধ করল আহমদ মুসা।
পরক্ষণেই আগের সেই ভাবনাই ছুটে এল তার মনে। বিজ্ঞানী কেন এই অন্ধকূপ তৈরী করেছিলেন এই সবুজ পাহাড়ে তাঁর বাড়িতে? লোক বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জনে এখানে এসে থাকবেন, এজন্যই? এ যুক্তিটা তাঁর কাছে মোটেই শক্তিশালী মনে হলো না।
এ সময় তাঁর হঠাৎ মনে পড়ল শেলফ থেকে পাওয়া পকেটে রাখা কার্টুনের কথা।
কার্টুনটি পকেট থেকে বের করল আহমদ মুসা।
খুলল কার্টুনটি।
অনেকগুলো টুকরো কাগজ বের হলো কার্টুনটির সাথে।
প্রত্যেকটি একই সাইজের।
কয়েকটিতে হিব্রু লেখা। অন্য সবগুলোতেই জটিল অংকন ও ডিজাইন। হিব্রুগুলো হাতে লেখা এবং ডিজাইন ও অংকনগুলো কম্পিউটার প্রিন্ট।
হিব্রু কাগজগুলো সম্ভবত ড্রইং কলম দিয়ে লিখা। অক্ষরগুলো ছোট ও সুক্ষ্ণ।
পড়ল আহমদ মুসা, এস.ডি.আই ফেজ ফাইভ গাইডেড কম্পিউটার কমান্ড ডিজাইন এন্ড মিসাইল কমান্ড কোডস প্লাস ফোর্থ জেনারেশন এস.ডি.আই কমান্ড কম্পিউটার।
আহমদ মুসা পড়ে বুঝল, ডিজাইন ও অংকনগুলো স্ট্রাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভের ফিফথ ফেজের হবে। কিন্তু এগুলো এই সিনাগগে কেন? আবার ভাবল, ইহুদী বিজ্ঞানীর এই বাড়ি ও সিনাগগ, তারই কোন কাজ হবে এ অংকন ও ডিজাইনগুলো। কিন্তু পরক্ষণেই মনে প্রশ্ন জাগল, এখন তো বিজ্ঞানী নেই। কে এগুলো ব্যবহার করলো এবং এগুলো ধ্বংস করারই বা প্রয়োজন কি? এ প্রশ্নের কোন জবাব পেল না সে।
ঘটনা কি বুঝতে না পারলেও আহমদ মুসা একটা জিনিষ বুঝলো, এস.ডি.আই ডাটাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সে জানে এস.ডি.আই এর উপর যে গবেষণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চালাচ্ছে, তা এখন ফোর্থ জেনারেশনে। সুতরাং এই ফিফথ জেনারেশনের ডাটা অগ্রগামী গবেষণার ফল। অতএব এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে।
এই চিন্তা করে আহমদ মুসা ডকুমেন্ট পেপারগুলো কার্টুনে পুরে কোটের ভেতরের পকেটে রেখে দিল।
হাতের কাজটা শেষ হলে, আগের চিন্তায় ফিরে গেল আহমদ মুসার মন। ফুল কার্পেটে মোড়া এই অন্ধকূপ যদি বিজ্ঞানী কোন সময় এখানে কাটিয়ে দেবার জন্যে করে থাকেন, তাহলে এখানে বসবাসের উপকরণ কোথায়? উপকরণ রাখার জায়গাও তো নেই। এমন তো হতে পারে না। তাহলে কি ওরা মিথ্যা বলেছে? বিজ্ঞানী আসলে এখানে থাকতেন না? না থাকলে কোন প্রয়োজনে কেন কার্পেটে মোড়া প্রায় চল্লিশ ফিট গভীর এই অন্ধকূপ তৈরী করা হলো? বিজ্ঞানী এখানে আসতেন, এ কথাই ঠিক ধরে নিতে হবে।
তাহলে কিভাবে থাকতেন, এ প্রশ্নের জবাব কি?
অন্ধকারের চার দেয়ালে নজর বুলালো আহমদ মুসা।
কালো লোমশ কার্পেটে আবৃত দেয়াল। মেঝেও তাই। কার্পেটের লোমগুলো অস্বাভাবিক লম্বা।
তার দু’চোখ মেঝের উপর দিয়েও ঘুরে এল, কিন্তু দেয়াল কিংবা মেঝেতে অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না।
কি খুঁজছে তার দু’চোখ?
দেয়ালে গোপন কেবিন রাখা আধুনিক রুম ডেকোরেশনের একটা খুবই চালু পদ্ধতি। বিজ্ঞানী তা রাখতে পারেন তার গোপন খাজাঞ্চিখানা বা প্রয়োজনীয় স্টোর হিসেবে। যা তার অন্ধকূপে থাকাকালীন কাজে আসবে।
কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়ল না।
চোখ দু’টি তার ক্লান্ত হয়ে পড়ল।
শুয়ে পড়ল সে অন্ধকূপের মেঝেতে।
ফ্লোরে শুয়ে পড়ে আহমদ মুসা চোখ বুজতে যাচ্ছিল, এমন সময় সামনের দেয়ালটা যেখানে অন্ধকুপের মেঝের সাথে মিশেছে ঠিক সেখান থেকে একটা রূপালী আলোর ঝলক এসে তার চোখে লাগল। যেন কালোর অরণ্যে এক সূর্য বিন্দু।
সংগে সংগেই উঠে বসল আহমদ মুসা।
এগুলো সেই সূর্য বিন্দু লক্ষ্য করে। দেখল, সূর্য বিন্দুটা একটা পেরেকের শীর্ষভাগ। মনে হলো পেরেকটা কার্পেটকে দেয়ালের সাথে সেঁটে রাখার জন্যেই।
তাহলে এ ধরনের আরও আছে ভাবল আহমদ মুসা।
অকারণেই খুঁজতে লাগল সে পেরেকগুলো। পরে সে ভাবল, পেরেকগুলো খুলে কার্পেটের নিচের দেয়াল সে দেখতে পারে সেখানে রহস্যের কোন সমাধান পাওয়া যায় কিনা।
কিন্তু ব্যর্থ হলো আহমদ মুসা। তন্ন তন্ন করে খুজেঁও আর কোন পেরেক সে পেল না।
শোয়া অবস্থায় যেহেতু পেরেকটি চোখে পড়েছে, তাই মেঝেয় গড়িয়ে গড়িয়েও সন্ধান করল আহমদ মুসা। কিন্তু না, আর কোন পেরেক চোখে পড়ল না।
আহমদ মুসা ফিরে গেল সেই আগের পেরেকের কাছে।
পেরেকের কাছে মেঝেয় সে বসে পড়ল।
অবাক জিজ্ঞাসায় আবার দেখতে লাগল পেরেকটিকে। মাত্র একটা পেরেক দিয়ে কার্পেটটিকে তো আর আটকে রাখা যাবেনা। তাহলে? মাত্র একটা পেরেকের কি তাৎপর্য!
পেরেকের চেয়ে বেশী উজ্জ্বল মনে হচ্ছে পেরেকটিকে। আহমদ মুসা আরও খেয়াল করল, পেরেকের মাথায় যে খাঁজ কাটা থাকে এর তা নেই। তার মানে পেরেকটিকে ঘুরিয়ে নয়, পিটিয়ে লাগানো হয়েছে। কিন্তু এমনটা তো স্বাভাবিক নয়। কারণ এ ধরনের পেরেক মজবুত হয় না, সহজে তুলেও ফেলা যায়।
চিন্তাটার সংগে সংগেই আহমদ মুসা দুই আঙ্গুল দিয়ে পেরেকটি ধরে টান দিল।
সংগে সংগে হাতের সাথে উঠে এল পেরেকটি। কিন্তু পেরেক নয় বস্তুটা। নিচের দিকটা প্লেন এবং ব্ল্যাক স্টিল। যার চুম্বকত্ব আছে, তোলার সময়ই সে তা টের পেয়েছে। চুম্বকের আকর্ষণেই আরেকটা স্টিল বোতামের সাথে তা লেগে ছিল।
প্রথমটায় অবাক হয়েছিল আহমদ মুসা। পরে তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভাবল, নিশ্চয় এর মধ্যে কোন রহস্য আছে।
কিন্তু কি হতে পারে সে রহস্যটা?
রহস্যটা যাই হোক, কোন সন্দেহ নেই যে, বিজ্ঞানী তার প্রয়োজনেই সেটা করেছিলেন।
আহমদ মুসা চাপ দিল কাল বোতামটিতে।
সংগে সংগেই দেয়ালের তিন বর্গফুটের মত একটা অংশ কিঞ্চিত সরে গিয়ে দেয়ালের আড়ালে চলে গেল। বেরিয়ে পড়ল একটা সুড়ঙ্গ পথ।
সুড়ঙ্গ পথটি আলোকিত।
সুড়ঙ্গ পথের মুখ তিন বর্গফুটের মত হলেও ভেতরটা আরও প্রশস্ত। একজন মানুষ অনায়াসে হেঁটে চলাফেরা করতে পারে।
স্টিলের মজবুত সুয়ারেজ পাইপ দিয়ে সুড়ঙ্গটি তৈরী।
খুশী হলো আহমদ মুসা, সুড়ঙ্গটি নিশ্চয় বাইরে বেরুবার জন্যে। কিন্তু কেন বিজ্ঞানী শুধুমাত্র বাইরে বেরুবার জন্যে এত ব্যয়বহুল ব্যবস্থা করলেন? তাহলে তিনি কি কোন বিপদের ভয় করতেন যে, সবুজ পাহাড়ের তাঁর বাড়ি থেকে বাইরে বেরুবার পথ বন্ধ হতে পারে, তখন তিনি এই নিরাপদ সুড়ঙ্গ পথ ব্যবাহর করে বাইরে বেরুবেন? কিন্তু একজন বিজ্ঞানীর কি এমন বিপদ হতে পারে?
এ প্রশ্নের কোন উত্তর তার কাছে নেই।
এসব থাক, বের হবার একটা পথ পাওয়া গেছে, এটাই বড় কথা। ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা প্রবেশ করল সুড়ঙ্গে।
গোটা সুড়ঙ্গটাই আলোকিত।
বহুদিন এ সুড়ঙ্গে কেউ ঢোকেনি। তার অর্থ কি বিজ্ঞানীর মৃত্যুর পর আর কেউ এ সুড়ঙ্গে প্রবেশ করেনি? বলা মুশকিল। ভাবল আহমদ মুসা।
চলছে তো চলছেই। কত বড় এই সুড়ঙ্গ?
বাইরে বেরুবার জন্য এত বড় সুড়ঙ্গ কেউ কাটে?
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আহমদ মুসা ৪০ মিনিট হলো সে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করেছে।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। সবুজ পাহাড়ের বিজ্ঞানীর বাড়ি থেকে বাইরে বেরুবার সুড়ঙ্গ অবশ্যই এটা নয়।
কোথায় গেছে এ সুড়ঙ্গ? নিশ্চয় এমন কোথাও গেছে যা বাইরে বেরুবার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।
এক ঘন্টা পার হয়ে গেল।
সুড়ঙ্গের সমান্তরাল পথ একটু একটু করে উপরে উঠতে শুরু করেছে।
গন্তব্যে তাহলে এসে গেছি, বলল মনে মনে আহমদ মুসা।
কতদূর হবে সে এসেছে সবুজ পাহাড় থেকে? অবশ্যই পাঁচ ছয় মাইলের কম নয়। আহমদ মুসার অনুমান যদি ভূল না হয়ে থাকে, তাহলে সে সবুজ পাহাড় থেকে পাঁচ ছয় মাইল দক্ষিণে এখন। এ অঞ্চলের ভৌগলিক পরিচয় তার জানা নেই। তাই বলা মুশকিল সে এখন কোথায়।
সারফেস লেভেলে প্রায় উঠে এসেছে সে। সতর্ক পদক্ষেপ এখন আহমদ মুসার।
যেখানে এসে সুড়ঙ্গ শেষ হলো, সেখানে সুড়ঙ্গের মুখে একটি কংক্রিটের স্ল্যাব। স্ল্যাবটি সুড়ঙ্গের মুখে এমন ভাবে সেট করা যে, স্ল্যাবটি নিচে নামানো যাবে না।
তাহলে উপরে তুলতে হবে।
কিন্তু এ সুড়ঙ্গের মুখটি কোথায়? সেটা কি ঘর? না উঠান? কিংবা পরিত্যক্ত কোন স্থান?
ঘর কিংবা জনসমাগমের কোন স্থান হলে স্ল্যাব তুললেই সে ধরা পড়ে যাবে। জংগল বা পরিত্যক্ত কোন স্থান হলে, তবেই নিরাপদ।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। বেলা তখন ১টা।
আহমদ মুসা তায়াম্মুম করে নামাজ পড়ে নিল।
তারপর ভাবল, স্ল্যাবের অংশবিশেষ তুলে দেখা যাক, কেমন জায়গা এটা।
বিজ্ঞানী যখন এখানে উঠতেন বা এদিক দিয়ে যাতায়াত করতেন, তখন স্থানটা তাঁর নিজের অথবা তার কোন প্রতিপক্ষের কোন নিরাপদ জায়গা হবে।
কংক্রিট স্ল্যাবের একটা অংশ ধীরে ধীরে উপরে তুলতে লাগল আহমদ মুসা।
একটু তুলেই বুঝল জায়গাটায় কার্পেট বিছানো রয়েছে।
তাহলে এটা ঘর নিশ্চয়। আর ঘর হলে কোন মানুষ থাকার সম্ভাবনা থাকছেই।
বিজ্ঞানী এ পথ দিয়ে রাতে না দিনে যাতায়াত করতেন?
হঠাৎ আহমদ মুসার খেয়াল হলো এটা লাঞ্চ আওয়ার। এখন তো সব আমেরিকানদেরই অফ পিরিয়ড়। এ সময় তারা ঘরে কিংবা অফিসে থাকে না।
এই চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা অতি সন্তর্পনে কংক্রিট স্ল্যাবটা সুড়ঙ্গের মুখ থেকে সরিয়ে কার্পেটের নীচ দিয়ে মেঝের উপর ঠেলে দিল।
তারপর নিজের দেহকেও স্ল্যাবের মত করেই সুড়ঙ্গের মুখ থেকে উপরে তুলে কার্পেটের নিচ দিয়ে মেঝের উপর ঠেলে দিল। নিজেকে সুড়ঙ্গের মুখ থেকে বের করে আনার পর তার প্রথম কাজ হলো স্ল্যাবটাকে আবার সুড়ঙ্গ মুখে বসিয়ে দেয়া।
কোন দিকে কার্পেটের নিকটতম প্রান্ত? কাপের্টের তলের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে দ্রুত বেরুবার জন্যে এ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার কাছে বড় হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা দ্রুত চারদিকে হাত ও পা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল কোন দিকে কার্পেটটা ঢিলা বেশী। তার চিন্তা হলো, নিশ্চয়ই সুড়ঙ্গ মুখ কার্পেটের একটা প্রান্তে হবে এবং যে দিকে প্রান্ত হবে সে প্রান্তের কার্পেটকে অপেক্ষাকৃত ঢিলা পাওয়া যাবে।
সফল হলো আহমদ মুসা। তার হাতের ডান দিকের কার্পেট খুবই ঢিলা পাওয়া গেল।
আহমদ মুসা গড়িয়ে ঢিলা প্রান্তের দিকে এগুলো।
একটা দেয়ালে কার্পেট শেষ হয়েছে।
আহমদ মুসা কার্পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।
এক সারি দৈত্যাকার কম্পিউটারের পেছনের দেয়াল ঘেঁষে নিজেকে দেখল আহমদ মুসা।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। সুড়ঙ্গ মুখটা কম্পিউটারের আড়ালে থাকায় এখানে কি ঘটছে এ ঘরে কেউ থাকলেও তা তার নজরে পড়ার কথা নয়। বিজ্ঞানীকে মনে মনে ধন্যবাদ দিল আহমদ মুসা।
কিন্তু এটা কোন জায়গা? কোথায় এসেছে সে?
আহমদ মুসা দুই কম্পিউটারের ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরটায় উঁকি দিল, দেখল ঘরের প্রায় চারদিক দিয়েই এ ধরনের কম্পিউটারের সারি। ঘরের মাঝখানটা ফাঁকা।
আহমদ মুসা ঘরের যে প্রান্তে, তার বিপরীত প্রান্তে দরজা। ঘরে কেউ নেই। লাঞ্চে গেছে নিশ্চয়ই।
আহমদ মুসার গোটা শরীর ধুলি ধুসরিত। পকেট থেকে রুমাল বের করে মাথা ও কোট প্যান্ট যতটা পারল পরিষ্কার করল।
তারপর এক কম্পিউটারের পাশ দিয়ে ঘরের মাঝখানে প্রবেশ করল।
দ্রুত একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল কম্পিউটারের দিকে। সবগুলো কম্পিউটারই চালু অবস্থায় আছে।
প্রত্যেকটা কম্পিউটারের টপ কভারে একটা নাম পড়ে ভীষণ চমকে উঠল আহমদ মুসা। টপ কভারে পেস্টিং করা সুন্দর কাগজে সুন্দর করে লেখা ‘লস আলামোস ল্যাবরেটরী অব স্ট্রাটেজিক রিসার্চ’।
সবগুলো কম্পিউটারে এই একই শীর্ষ নাম।
তাহলে আহমদ মুসা এখন লস আলামোসের বিশ্ব বিখ্যাত স্ট্রাটেজিক রিসার্চ ল্যাবরেটরীর গ্রাউন্ড ফ্লোরে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ইহুদী বিজ্ঞানী তার সুড়ঙ্গ এই ল্যাবরেটরীতে নিয়ে এসেছে কেন? সুড়ঙ্গটি কি এ ল্যাবরেটরীতে গোয়েন্দাগিরির একটা পথ ছিল? ইহুদী বিজ্ঞানী কি এ স্ট্রাটেজিক ল্যাবরেটরীর গবেষণা চুরি করেছেন এ পথে? বহুতল বিশিষ্ট গোটা ল্যাবরেটরীর যাবতীয় গবেষণার ফল নিশ্চয়ই এই দৈত্যাকার কম্পিউটারে প্রসেস ও স্টোর হয় এবং এই কম্পিউটার কক্ষই ইহুদী বিজ্ঞানীর সুড়ঙ্গের মুখ।
কি ঘটেছে ভাবতেই শিউরে উঠল আহমদ মুসা। মাথাটা ঘুরে যেতে চাইল।
মাথাটায় একটা ঝাঁকি দিয়ে আহমদ মুসা ভাবল সব চিন্তার আগে তাকে এই অত্যন্ত স্পর্শকাতর গবেষণাগার থেকে সরে পড়তে হবে। এখানে তাকে ধরা পড়া চলবে না কোনক্রমেই।
দরজার দিকে তাকাল আহমদ মুসা। দরজা বন্ধ।
এগোলো আহমদ মুসা দরজার দিকে। খুব সন্তর্পনে দরজার নব ঘুরাল সে। লক আলগা হয়ে গেল।
ধীরে ধীরে দরজা ফাঁক করল আহমদ মুসা।
উকিঁ দিয়ে দেখল, ইউনিফরম পরা একজন দরজার বিপরীত দিকে হেঁটে যাচ্ছে। তার হাতে ঝুলছে কাল কুচকুচে এক ভয়ংকর অটোমেটিকে কারবাইন।
আহমদ মুসা দ্রুত বের হয়ে কোন শব্দ না হয় এ জন্যে আলতো করে দরজা ছেড়ে দিয়ে লোকটি দরজার যেদিকে, তার বিপরীত দিকে বিড়ালের মত নিঃশব্দে ছুটল।
কোন দিকে কি আছে, বের হবার দরজাই বা কোন দিকে কিছুই জানা নেই আহমদ মুসার। অন্ধের মত সে ছুটছে।
দরজাটা পেরিয়ে কয়েক গজ এসেই একটা করিডোর পেল। করিডোর ধরে ডানদিকে এগোলো।
করিডোরটা ধরে কয়েক গজ এগোতেই একটা করিডোর জংশনের মুখে গিয়ে পড়ল সে। সেই সাথে মুখোমুখি হলো অটোমেটিকে কারবাইনধারী এক প্রহরীর।
করিডোর জংশনটা থেকে চারদিকে চারটা করিডোর বেরিয়ে গেছে।
প্রহরীটির মুখোমুখি হয়ে আকস্মিকতার একটা ধাক্কা খেয়েছিল আহমদ মুসা। কিন্তু প্রহরীটিই আহমদ মুসাকে দেখে হতচকিত হয়েছিল বেশী।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল প্রহরীটি।
আহমদ মুসা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এক হাতে তার মুখ চেপে অন্য হাত দিয়ে তাকে জাপটে ধরে টেনে নিয়ে এল একটা দরজার দিকে।
দরজা ঠেলে প্রহরীকে ভেতরে ছুঁড়ে দিল। প্রহরীটি পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়াল। তার হাতের ঝুলন্ত কারবাইন সে উপরে তুলছিল।
আহমদ মুসার ডান হাত তার আগেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তার হাতের একটা আঘাত গিয়ে পড়ল প্রহরীর কানের নিচে ঘাড়টায়।
লোকটি সংজ্ঞা হারালে আহমদ মুসা তার কারবাইনটা নিয়ে বেরিয়ে এলো করিডোরে। কোন দিকে যাবে সে?
সব করিডোরকেই আহমদ মুসার একই রকম মনে হলো। সুতরাং প্রহরীকে আটকাবার জন্যে আহমদ মুসা যে করিডোরে ঢুকেছিল সেই করিডোর ধরে এগোবার সিদ্ধান্ত নিল।
কিছুদুর এগোবার পর আরেকটা করিডোরের মুখোমুখি হলো আহমদ মুসা। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পেল সে। তার মনে হলো, শব্দগুলো সিঁড়ি ভেঙে উপর থেকে নিচে নামছে সামনের করিডোর জংশনটার দিকে।
একটি করিডোরের শাখা এদিকে ডানে, অন্য দু’টি শাখা অন্য দু’দিকে চলে গেছে। আর সামনে সিঁড়ি। মনে হয় সিঁড়িটা দু’তলায় উঠে গেছে।
ঐ সিঁড়ি থেকেই শব্দগুলো ছুটে আসছে। ছুটে আসা লোকগুলো আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার সামনে এসে যাবে।
আহমদ মুসা আশে পাশে চাইল। দেখল, তার দু’পাশেই দু’টি দরজা। বাম দিকের দরজাটাই তার কাছে।
আহমদ মুসা ছুটে গিয়ে দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। একটা মেয়ে তার টেবিলে বসে কাজ করছিল।
কারবাইন নিয়ে আহমদ মুসাকে ঘরে ঢুকতে দেখে আতংকে উঠে দাঁড়াল মেয়েটি।
আহমদ মুসা তার কারবাইনের নল নিচে নামিয়ে তর্জনি নিজের ঠোঁটে ঠেকিয়ে মেয়েটিকে এক দিকে অভয় দিল, অন্যদিকে তাকে চুপ থাকতে বলল।
আতংকিত মেয়েটি কোন শব্দ না করে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল।
আহমদ মুসা দরজার শ্যাডো গ্লাস দিয়ে বাইরে চোখ রাখল।
দরজার ওখান থেকে আহমদ মুসা সিঁড়ির নিচের অংশটা দেখতে পাচ্ছে।
সিঁড়ি দিয়ে পাঁচজন দৌড়ে নেমে এল। আহমদ মুসার করিডোর দিয়েই তারা ছুটে গেল আহমদ মুসা যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে। ওরা টের পেয়েছে, কিন্তু কিভাবে?
কিন্তু ভাববার সময় নেই আহমদ মুসার। বলল আহমদ মুসা মেয়েটিকে লক্ষ্য করে, ‘ম্যাডাম বাইরে বেরুবার গেট কোন দিকে?’
মেয়েটি কথা বলল না।
সে সহজে কথা বলবেনা, নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা।
হাতের অটোমেটিক কারবাইনটা তুলতে চাইল। কিন্তু একজন নারীর বিরুদ্ধে তার হাত উঠল না। বলল আহমদ মুসা, ‘ধন্যবাদ ম্যাডাম’।
বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু শুনতে পেল অনেকগুলো পায়ের শব্দ ছুটে আসছে এ দিকে।
ওরা কি ফিরে আসছে?
আহমদ মুসা আর কিছু ভাববার আগেই দেখল, ওরা ছুটে আসছে এ দরজা লক্ষ্যেই।
চট করেই চিন্তাটা আহমদ মুসার মাথায় এলো যে, এ মেয়েটিই ওদের সংকেত দিয়েছে। প্রত্যেকের কাছে এবং প্রত্যেক কক্ষেই কি তাহলে সংকেতের এ ব্যবস্থা আছে?
আহমদ মুসা চাইল মেয়েটির দিকে। দেখল তার মুখ ভয়ে কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা বলল, ‘ভয় নেই, ওদের সংকেত দিয়ে আপনি চরম বিপদকালেও দেশের প্রতি অনুপম দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন’।
বলে আহমদ মুসা দ্রুত দরজার সামনের চৌকাঠের ওপাশে দেয়াল ঘেষে দাঁড়াল কারবাইনের ব্যারেল উঁচু করে, যাতে দরজা খুললেই ওরা তার সামনে এসে যায়।
ওরা দৌড়ে আসার পর দরজার কাছাকাছি এসে বিড়ালের মত সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে।
শ্যাডো কাঁচের ভেতর দিয়ে আহমদ মুসা ওদের দেখতে পাচ্ছে, ওরা কিন্তু দেখছে না আহমদ মুসাকে।
ওদের একজন আস্তে দরজার নব ঘুরাল, তারপর এক প্রচন্ড ধাক্কায় গোটা দরজাই খুলে ফেলল।
সংগে সংগেই আহমদ মুসার কারবাইন গর্জন করে উঠল। এক পশলা গুলির বৃষ্টি ছুটে গেল সামনে।
আহমদ মুসা উবু হয়ে বসে মাটির একফুট উপর দিয়ে গুলি করেছে।
সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মাটিতে। মাটিতে পড়েই কেউ কেউ কারবাইন তুলতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল।
ওদের দিকে কারবাইন তাক করে বলল, ‘আমি তোমাদের হত্যা করতে চাইনি বলেই গুলি নীচ দিয়ে করেছি। কেউ তোমরা কারবাইনে হাত দেবে না। গুলি এবার পায়ে নয় বুকে করব’।
বলে আহমদ মুসা দ্রুত কারবাইনগুলো কুড়িয়ে নিল।
কোন দিকে যাবে আহমদ মুসা?
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘সামনেই দোতলা থেকে সিঁড়ি গেটে নেমে গেছে’।
আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে চোখ ফিরাল মেয়েটির দিকে। বলল, ‘ধন্যবাদ ম্যাডাম’।
ছুটতে ছুটতেই কথাগুলো বলল আহমদ মুসা।
দ্রুত সিঁড়ি ভেংঙে উঠতে লাগল দোতলায়।
তার হাতে উদ্যত কারবাইন। একটি কারবাইন তার কাঁধে ঝুলানো। আরও চারটি কারবাইন সে ফেলে দিয়ে এসেছে সিঁড়ির গোড়ায়।
সিঁড়ি থেকে দোতলার মেঝেতে পা দিতে যাবে, এ সময় আরও চারজন সামনে থেকে ছুটে আসছে দেখল আহমদ মুসা।
দেখতে পেয়েই আহমদ মুসা দৌড়ানো অবস্থাতেই গুলি করল ওদের পা লক্ষ্য করে।
ওরা গেটের দিক থেকে বিশাল প্রশস্ত সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসছিল। সিঁড়িতেই ওরা আছড়ে পড়ল। কিন্তু সেদিকে দেখার সুযোগ নেই।
গুলি করেই আহমদ মুসা ছুটল সিঁড়ি ভেঙে নিচের দিকে।
সিঁড়ি একটা প্রশস্ত লনে গিয়ে শেষ হয়েছে। লনের পরেই বিশাল গেট। গেটের দু’পাশে দু’টি কক্ষ। সিকিউরিটি বক্স হবে নিশ্চয়ই ভাবল আহমদ মুসা।
লনের দু’পাশে দু’টি করে চারটি গাড়ি দাঁড়ানো। দু’টি কার, একটা জীপ এবং একটা সিকিউরিটি ক্যারিয়ার ধরনের গাড়ি।
গেট খোলা। দু’জন প্রহরী ছুটে আসছে খোলা গেট দিয়ে গুলি করতে করতে।
আহমদ মুসা নিজেকে ছুড়ে দিল সিঁড়ির উপর।
তারপর কারবাইন দু’টি বুকে ধরে দ্রুত গড়িয়ে নামতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে। চারপাশে গুলি এসে পড়ছে। একটা গুলি এসে বিদ্ধ করল আহমদ মুসার বাহু সন্ধিতে।
মনে হলো বাহুটা যেন কাঁধের সাথে নেই। গোটা শরীরটাই কেঁপে উঠছিল আহমদ মুসার।
কিন্তু মুহূর্তের জন্যও থামেনি সে, বরং গড়িয়ে পড়ে গতি আরও বাড়িয়ে দিল আহমদ মুসা। সিঁড়িতে তাকে টার্গেট করার যে সুবিধা নিচের লনে তা তারা পাবে না।
লনে পড়েই আহমদ মুসা ওদের গুলি বৃষ্টির মধ্যে মাথা নিচু করে গুলি করল ওদের লক্ষ্য করে।
ওরা দৌড়ে আসছিল। গুলি বৃষ্টি ওদের পা আঁকড়ে ধরেছে। আছড়ে পড়ল তারা লনের উপর।
গুলি করেই আহমদ মুসা দ্রুত গড়িয়ে চলল জীপের দিকে।
জীপের কাছে এসে শুয়ে থেকেই আহমদ মুসা নিজের দেহকে ছুঁড়ে দিল জীপের সিটে। জীপের লক হোলে চাবী ঝুলছে।
খুশী হলো আহমদ মুসা। ধন্যবাদ দিল আল্লাহকে। ভাবল এ গাড়িটাও নিশ্চয় সিকিউরিটিদের ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত ছিল। গাড়ি স্টার্ট দিল আহমদ মুসা।
দেখল, কারবাইন হাতে আরও দু’জন প্রহরী ছুটে এসেছে গেটে। গেট তখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
আহমদ মুসার জীপও গেটের মুখে এসে পড়েছে।
গেট বন্ধ করার সুযোগ হলো না।
আহমদ মুসার জীপের বেপরোয়া গতি তীব্রভাবে আঘাত করল গেটে। চলন্ত গেটের একটা অংশ বাঁকিয়ে নিয়ে বাইরে ছিটকে পড়ল গাড়ি।
আহমদ মুসার ভাগ্য ভাল যে, জীপটি প্রায় উল্টে গিয়েও আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল।
গেটে আসা প্রহরী দু’জন জীপের সামনে পড়ায় বাঁচার জন্যে দু’পাশে দু’জন ছিটকে পড়েছিল। দু’জনের হাত থেকে কারবাইন দু’টিও ছিটকে পড়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা তার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে তীব্র গতিতে ছুটল সামনে।
প্রহরী দু’জন কারবাইন দু’টি কুড়িয়ে নিয়ে গুলি করার পজিশনে আসার পর দেখল, জীপটি তাদের রেঞ্জের বাইরে। তবু তাদের কারবাইন গর্জন করে উঠল। গুলি গুলোর অপচয় ছাড়া কোনই লাভ হলো না এতে।
কারবাইন ছুড়ে ফেলে ওরা দু’জন দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মাটিতে আঘাতের পর আঘাত করার মাধ্যমে ব্যর্থতার তীব্র গ্লানি হালকা করতে চাইল। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
২৮. আমেরিকার এক অন্ধকারে

Tags