২২. অদৃশ্য আতঙ্ক

চ্যাপ্টার

তেষট্টি লিভিংস্টোন রোড।
আহমদ মুসা বাইবেল সোসাইটির সামনে দাঁড়িয়ে সামনের অংশটার উপর নজর বুলাল।
গেট পার হলেই প্রশস্ত একটা কম্পাউন্ড। তারপরে কম্পাউন্ডের উত্তর প্রান্ত বরাবর দীর্ঘ বারান্দা। চার ধাপের সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠতে হয়। লম্বা বারান্দার মাঝখানে একটা বড় দরজা। বড় দরজার দু’পাশে বারান্দায় আরও কয়েকটা দরজা আছে। বিল্ডিং-এর মাথায় একটা সাইনবোর্ড। লেখা আছে, বাইবেল সোসাইটি স্কুল।
বাইবেল সোসাইটি স্কুলের পুব পাশে একটা গীর্জা। গীর্জা এবং স্কুল একই বাউন্ডারী প্রাচীরের ভেতরে। আহমদ মুসা বেলাল ম্যাকাকোর কাছ থেকে বাইবেল সোসাইটির যে বিবরণ পেয়েছে, তাতে এখানে বাইবেল স্কুল ও গীর্জা ছাড়াও একটা আবাসিক এলাকা ও গোডাউন এলাকা রয়েছে। সব নিয়েই বাইবেল সোসাইটি কমপ্লেক্স।
আহমদ মুসা বাইবেল সোসাইটির সামনে দিয়ে লিভিংস্টোন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, গোডাউন ও আবাসিক এলাকা তাহলে গীর্জা ও স্কুলের পেছনে হবে।
আহমদ মুসা দেখেছে, স্কুল ও গীর্জার মাঝে উভয়কে বিভক্তকারী একটা প্রাচীর আছে।
সকালের আমেজ কেটে যাচ্ছে। রাস্তায় লোক চলাচল দু’একজন করে শুরু হয়েছে। কিন্তু গেটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়েও বাইবেল সোসাইটির ভেতরে কাউকে আনাগোনা করতে দেখা পেল না আহমদ মুসা। হয় সকলে ঘুমচ্ছে অথবা স্কুল ও গীর্জার কাজ শুরু হয়নি বলে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আহমদ মুসা মনে করল, ভেতরে ঢুকার এটাই সময়।
কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, স্কুল ও গীর্জার অফিস খুললে ভেতর ও বাইরের লোকের আনাগোনা বাড়বে, সেই সুযোগে প্রবেশ করাটা সবচেয়ে সুবিধাজনক। সে আরও ভাবল, ভেতরে ঢোকার আগে চারদিকটা একবার ভাল করে দেখা দরকার। এতে ভেতরে ঢুকে জরুরী মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়া তাঁর পক্ষে অনেক সহজ হবে।
ঠিক করল আহমদ মুসা, স্কুল ও গীর্জা খুলুক, ততক্ষণে সে বাইবেল সোসাইটি কমপ্লেক্সের চারদিকটা ঘুরে আসবে।
সোসাইটি কমপ্লেক্সের পুব দিক দিয়ে গীর্জার পাশ বরাবর বেশ ফাঁকা। তারপরে সীমানা প্রাচীর। প্রাচীরের পাশ দিয়ে পায়ে চলার মত রাস্তা।
আহমদ মুসা এগুলো সেই রাস্তা ধরে। পায়ে চলা রাস্তাটা উত্তর দিকে নদীর ধার পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে।
আহমদ মুসা নদীর ধারে বাইবেল সোসাইটির সীমানা প্রাচীরের পূর্ব-উত্তর কোণ ঘেঁষে দাঁড়াল।
সেখান থেকে নদীর ধারটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীতে।
আহমদ মুসা বাইবেল সোসাইটির দিকে নজর ফেরাল। দেখল, হাত কয়েক দূরে উত্তর দিকের সীমানা প্রাচীরের গায়ে একটা বড় গেট। গেট থেকে একটা পাকা ঘাট নেমে গেছে নদীতে। গেটটা বন্ধ।
আহমদ মুসা বুঝল, নদী পথে এদের যোগাযোগ এ ঘাট পথেই। মুসলিম নেতৃবৃন্দকে কিডন্যাপ করে সম্ভবত এ ঘাট পথেই বাইবেল সোসাইটিতে ঢুকিয়েছে।
উত্তর সীমানার পশ্চিমে বেশ কিছুদূর এগিয়ে নদীর দিকে বেড়ে আসা বিল্ডিং এর মূল দেয়ালের সাথে মিশে গেছে। অর্থাৎ বিল্ডিং-এর পশ্চিম অংশের উত্তর প্রান্তটা, বলা যায়, পানির উপর দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা স্মরণ করল, বিল্ডিং-এর এই অংশটা বেলাল ম্যাকাকোর বিবরণ অনুসারে গোডাউন হিসেবে ব্যবহার হয়।
আহমদ মুসা ভাবল, পণবন্দি মুসলিম নেতৃবৃন্দকে নিশ্চয় গীর্জা ও স্কুল অংশে রাখা হয় নি। কারন ১২ জনের একটা বিরাট দলকে গীর্জা ও স্কুলের মত জনসমাবেশের স্থানে রাখা সম্ভব নয়। তাহলে নিশ্চয় রাখা হয়েছে আবাসিক অথবা গোডাউন এলাকায়। এ দু’য়ের মধ্যে কোথায় তাদের রাখা হতে পারে? মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ ও সম্মানিত নেতাদের আরামদায়ক আবাসিক এলাকায় রাখাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যাদের জীবনের সীমা পনের দিনে সীমিত করা হয়েছে, তাদের সুখ-সুবিধার কথা নিশ্চয় ওদের বিবেচনার কথা নয়।
কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না আহমদ মুসা।
ভেতরে ঢুকেই সন্ধান করতে হবে, ভাবল আহমদ মুসা। তবে দিনের বেলা এই সন্ধান করা খুবই বিপজ্জনক। কিন্তু সামনে একটা রাত মাত্র তার হাতে আছে। তারপরেই ১৫তম দিন। কে জানে পনের তারিখের সূর্যোদয়কেই যদি ওরা বন্দীদের শেষ সময় ধরে থাকে। সুতরাং শেষ রাতের ঝুঁকি সে নিতে পারে না। তাই সকালেই সে ছুটে এসেছে।
কিন্তু দিনের এই ঝুঁকিপূর্ণ মিশন তার কেমন হবে? বন্দী নেতৃবৃন্দকে খুঁজে পাবার আগে সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেলে ওদের কাছে ঠিক সময়ে পৌঁছা এবং যথাসময়ে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অতীতে কখনই সময় তার কাছে এত মুল্যবান মনে হয় নি। শত্রুর এমন ‘ডেডলাইন’- এর মোকাবিলাও তাকে করতে হয়নি কখনও।
আহমদ মুসার দু’চোখ নিবদ্ধ ছিল বাইবেল সোসাইটির উত্তর প্রান্ত বরাবর নদী তীরের উপর। সংঘ নদীর স্বচ্ছ পানি ঢেউয়ে সোয়ার হয়ে এসে আছড়ে পড়ছে পাথর বাধানো তীরে। সেই ঢেউয়ে নাচছিল মাঝারি সাইজের একটা মটর বোট। মটর বোটটি আহমদ মুসার আগেই নজরে পড়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই এবার মটর বোটটির অবস্থান আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বোটটি ঘাট থেকে অতদূরে কেন?
ঘাট থেকে পশ্চিমমুখী প্রাচীরটা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে আট দশ ফিট পশ্চিমে তীর থেকে বেশ একটু দূরে বোটটি পানিতে ভাসছে।
আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করল, বোট থেকে একটা শিকল পানিতে নেমে গেছে। বোট নড়ার কারনে যখন শিকলে টান পড়ছে, দেখা যাচ্ছে পানির সমান্তরালে শিকলটি তীরের পাথরের মধ্যে ঢুকে গেছে। ওখানে তীরের পাথরের ফরমেশনটা অপেক্ষাকৃত খাড়া।
ভ্রু কুচকাল আহমদ মুসা। বোট ওখানে কেন? ঐভাবে কেন?
বেলাল ম্যাকাকোর বিবরণ অনুসারে বাইবেল সোসাইটি কমপ্লেক্সের ঐ অঞ্চলটা গোডাউন এলাকা। ওখানে কোন ঘাট নেই, কিন্তু বোট তাহলে কেন? এ ঘাট থেকে বোটটাকে কি ওখানে সরিয়ে রাখা হয়েছে? কিন্তু কেন? কি করে? পানিতে না নেমে বোটের কাছে পৌঁছা সম্ভব নয়। সুতরাং ঘাটের বোট ওখানে রাখা স্বাভাবিক নয়।
আহমদ মুসাকে সবচেয়ে বিস্মিত করল পানির সমান্তরালে বা পানির দু’এক ইঞ্চি নিচ দিয়ে বোটের শিকল তীরের পাথরের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার ব্যাপারটা।
পাশেই একটা শব্দ হলো। শব্দটা এসেছে সেই দরজার দিক থেকে। দরজায় কেউ এলো নাকি?
আহমদ মুসা দ্রুত করে প্রাচীরের আড়ালে দাঁড়াল। উঁকি দিয়ে দেখল, দরজা খুলে গেছে। পায়ের শব্দ পেল আহমদ মুসা। মাথাটা প্রাচীরের আড়ালে নিয়ে পকেটে হাত দিয়ে রিভলবার স্পর্শ করল আহমদ মুসা।
দরজা দিয়ে দু’জন মহিলা পরপর বেরিয়ে এসে দরজার বাইরের ল্যান্ডিং-এ দাঁড়াল।
দু’জনেরই পরনে ট্রাক স্যুট।
স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, ওরা ব্যায়াম করে বেরিয়ে এসেছে।
ল্যান্ডিং-এ বসল ওরা।
ট্রাক স্যুটের চেন ওরা খুলে ফেলল।
ওরা হাওয়া খেতে চায়।
দু’জনেরই বয়স তিরিশের কাছাকাছি হবে।
হাত-পা ছড়িয়ে বসে ওদের একজন বলল, ‘জেনি, যে দু’টো বোট ব্রাভাজিল গেছে, কবে ফিরবে?’
‘জানিনা, মনে হয় দু’একদিনের মধ্যেই।’ বলল জেনি নামের মেয়েটা।
‘এ সময় ঐ বোটটা ঘাটে এনে রাখা যায় না? এমন সময় কাজে না লাগলে কখন আর কাজে আসবে?’
‘রেন, তুমি দেখি কিছুই জাননা। ঐ বোটটা ওখানকার জন্যই।’
‘কেন?’
‘ইমারজেন্সী প্যাসেজের জন্যে রাখা হয়েছে।’
চমকে উঠল আহমদ মুসা। ইমারজেন্সী প্যাসেজ! এর অর্থ কি?
জরুরী মুহূর্তের বাহন হিসেবে বোটটাকে রিজার্ভ রাখা হয়েছে?না ইমারজেন্সী প্যাসেজেই বোটটাকে বেঁধে রাখা হয়েছে? ওখানে কি ইমারজেন্সী প্যাসেজ আছে?
ইত্যাদি প্রশ্ন এসে আহমদ মুসার মনে ভীড় জমাল। সে বুঝতে চেষ্টা করল। শেষের দু’টি প্রশ্নকেই সে ইতিবাচক মনে করল। অর্থাৎ মনে হলো, বোটটা যেখানে নোঙর করা, সেখানেই কোথাও গোপন প্যাসেজ রয়েছে।
খুশীই হল আহমদ মুসা। বোটের ওখানে গিয়ে যদি গোপন প্যাসেজটা বের করা যায়, তাহলে তার অভিযান অনেক নিরাপদ হতে পারে।
‘কে তুমি, এখানে কি করছ?’- পেছন থেকে আসা আকস্মিক এই শব্দে আহমদ মুসা লাফ দিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, মারমুখো এক শ্বেতাঙ্গ।
মারমুখো হবারই কথা। আহমদ মুসা যেভাবে গুটি গুটি মেরে প্রাচীরের আড়ালে বসে ছিল তাতে তাকে চোর-বাটপার কিংবা তার চেয়ে বড় কিছু ভাবা খুবই স্বাভাবিক।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতেই লোকটার বাম হাত তড়াক করে এসে আহমদ মুসার জ্যাকেটের কলার চেপে ধরল। আর ডান হাতের এক প্রচণ্ড ঘুষি ছুটে এল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে তার ঘুষিটা ঠেকিয়ে বাম হাত দিয়ে লোকটির বাম বাহুর সন্ধিতে আঘাত করল।
লোকটির বাঁ হাত খসে গেল আহমদ মুসার কলার থেকে।
আহমদ মুসার এই আকস্মিক প্রতিরোধ সে আশা করেনি। মুহূর্তের জন্যে সে থমকে গিয়েছিল। তার চোখে ফুটে উঠেছিল বিস্ময়।
তার এই নিষ্ক্রিয় অবস্থার সুযোগ গ্রহন করল আহমদ মুসা। ডান হাতের কারাত চালাল সে লোকটির বাঁ কানের ঠিক নিচটায়।
টলতে লাগল লোকটির দেহ। কয়েক মুহূর্ত। পড়ে গেল লোকটি গোড়া কাটা গাছের মত।
আহমদ মুসা বাইবেল সোসাইটির সামনে ফিরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে তাকাল সামনের রাস্তার দিকে।
তাকিয়েই চোখ দু’টি চঞ্চল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। দেখল, দু’জন লোক মার মুখো হয়ে ছুটে আসছে। ওদের হাতে রিভলবার।
আহমদ মুসা চকিতে পেছনে নদীর দিকে একবার তাকাল। দেখল, যে মেয়ে দু’টিকে সে দরজার ল্যান্ডিং-এ বসে গল্প করতে দেখেছিল, ওরা নদীতে গোসল করতে নেমেছে।
আহমদ মুসার মাথায় একটা নতুন চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল। সংগে সংগে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে।
লাফ দিয়ে আহমদ মুসা প্রাচীরের কোলে নদীর তীরে গিয়ে পড়ল। তারপর উত্তরের প্রাচীরের পাশ দিয়ে দৌড়ে দরজার ল্যান্ডিং-এ গিয়ে উঠল।
ল্যান্ডিং-এ মেয়ে দু’টির খুলে রেখে যাওয়া কাপড়।
নদীতে সাঁতাররত মেয়ে দু’টি দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে।
‘কে, কে তুমি, কি চাও’ বলে চিৎকার করে উঠল তারা।
সেদিকে খেয়াল করার সময় নেই আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা দ্রুত দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
কয়েক মুহূর্ত পরে রিভলবারধারী দু’জন ছুটে এসে প্রাচীরের সেই কোনায় নদী তীরে দাঁড়াল। তাকাল নদীর দিকে। তাদের ধারণা তাড়া খেয়ে তাদের শিকার নিশ্চয় নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে পালাবার চেষ্টা করছে।
নদীর দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল মেয়ে দু’টিকে।
মেয়ে দু’টির উপর চোখ পড়তেই সম্ভ্রম ফুটে উঠল লোক দু’টির চোখে-মুখে।
মেয়ে দু’টির একজন মোবাসা বাইবেল সোসাইটি কমপ্লেক্সের প্রধান পরিচালকের স্ত্রী, অন্যজন গীর্জার অধ্যক্ষের স্ত্রী।
লোক দু’টির একজন দ্রুত সম্ভ্রমের সাথে জিজ্ঞেস করল, ‘শয়তানটা এখানে ঘাপটি মেরে আপনাদের উপর চোখ রাখছিল। পালাবার জন্যে নদীতে লাফ দিয়েছে নিশ্চয়! কোন দিকে গেছে?’
মেয়ে দু’টির চোখ তখনও ছানাবড়া। তীরের দিকে অনেকখানি উঠে এসেছে তারা। ওদের একজন বলল, ‘না নদীতে লাফ দেয়নি! ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।’
লোক দু’টি এক সংগে দরজার দিকে তাকাল। দেখল, দরজা বন্ধ। তাদের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। তাদের একজন স্বগত কণ্ঠে বলল, ‘বিপদ দেখে লোকটির নিশ্চয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তা না হলে নিজের পায়ে হেঁটে এসে কেউ খাঁচায় ঢোকে!’
বলে দু’জনেই দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিল, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়া।
হাসল আগের সেই কথা বলা লোকটি। বলল, ‘ফাঁদে ফেলে যেমন ইঁদুর ধরে, সেভাবেই লোকটিকে ধরা হবে।’
বলে একটু থেমেই তার সাথীকে বলল, ‘তুমি এ দরজা পাহারা দাও যাতে পালাতে না পারে দরজা খুলে। আমি গিয়ে সামনে দিয়ে ঢুকছি।’
যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়ে তীরে উঠে আসা সেই মেয়ে দু’টিকে বলল, ‘দুঃখিত ম্যাডাম, ব্যাটা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। একটু কষ্ট করে সামনে দিয়ে ঢুকতে হবে। ব্যাটা নিশ্চয় কোন ছিঁচকে চোর বা মাথা খারাপ কেউ। এখনি ধরা পড়বে।’
বলে লোকটি রিভলবার পকেটে রেখে হাঁটা শুরু করল বাইবেল সোসাইটি কমপ্লেক্সের সামনে যাবার জন্যে।
ওদিকে আহমদ মুসা দরজা বন্ধ করেই পেছনে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল সে একটি কংক্রিটের রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তাটি অল্প এগিয়ে একটা বাংলোতে উঠেছে। বাংলোটির পাশ দিয়ে রাস্তাটির আরও দুটি শাখা, একটি দক্ষিণে, অন্যটি উত্তরে চলে গেছে। রাস্তা থেকে আরেকটি শাখা তার ঠিক সামনে দিয়েই তার ডান পাশে পশ্চিম দিকে চলে গেছে। রাস্তার মাঝের স্থানগুলোতে মাঝে মাঝে ফুলের গাছ।
আহমদ মুসা সামনের বাংলোর দিকে যাবার জন্যর পা বাড়িয়েছিল। হঠাৎ দেখতে পেল সাম্নের বাংলোটির দরজা দিয়ে একজন লোক বেরিয়ে আসছে। আহমদ মুসা ভাবল, সে ডানের রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে সরে পড়বে। কিন্তু পা বাড়াতে গিয়ে দেখল, লোকটি আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েছে। এই অবস্থায় সরে পড়তে চেষ্টা করে কোন লাভ নেই।
সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল।
‘আমি আপনার সাহায্য পেতে পারি, মশায়।’ লোকটির দিকে চেয়ে একটু উচ্চ স্বরে বলল আহমদ মুসা।
লোকটির পরনে হাফপ্যান্ট এবং গায়ে গেঞ্জি।
আহমদ মুসাকে দেখে লোকটির মধ্যে কোন ভাবান্তর সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আহমদ মুসা যখন সাহায্য চাইল, বিস্ময় ফুটে উঠল লোকটির চোখে-মুখে।
বিস্মিত লোকটি এগিয়ে এল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আপনার কি সমস্যা? নতুন কি আপনি এখানে?’
লোকটি নিশ্চয় আহমদ মুসাকে তাদের কোন মেহমান মনে করেছে।
‘আমি বন্দীদের এ্যাটেনডেন্ট, সকালে বাইরে বেরিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি।’ এ সস্তা মিথ্যে কথাটা লোকটাকে বিশ্বাস করানো যাবে না সন্দেহ নিয়েই কথাটা বলল আহমদ মুসা। কারন মুসলিম বন্দীরা কোথায় আছে তা জানাই তার এখন প্রধান কাজ।
আহমদ মুসার কথা শুনে কপালটা কুঞ্চিত হলো লোকটির। বিস্ময়টা তার আরও যেন গাঢ় হলো। বলল, ‘বন্দীরা তো গোডাউন সেকশনে, আপনি এতদুর এলেন কেন?’
আহমদ মুসা কে উত্তর দিতে হল না। পেছনের দরজায় ধাক্কা পড়তে লাগল। একজন চিৎকার করল, ‘কে কথা বলছেন, দরজা খুলুন।’
‘ও তো টুর্গোর গলা। ওপারে কেন?’ দরজার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো উচ্চারন করে লোকটি আহমদ মুসা কে বলল, ‘মাফ করুন। আমি দরজাটা খুলে দিয়ে আসি।’
বলে সে দরজার দিকে পা বাড়াল।
আহমদ মুসা জানে। লোকটি দরজা খুলে দেয়া মানে আহমদ মুসার সংকট বাড়া।
সুতরাং তাকে দরজা খুলতে দেয়া যায় না।
লোকটি যখন আহমদ মুসাকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল, তখন আহমদ মুসা ডান হাতের একটা কারাত চালাল লোকটির মাথা ও ঘাড়ের মধ্যবর্তী নরম জায়গাটায়।
লোকটি মুখ দিয়ে শব্দও করতে পারল না। একটা পাক খেয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে রাস্তায় পড়ে গেল।
আহমদ মুসা দ্রুত তাকে টেনে একটা ফুলের গাছের আড়ালে রাখল।
তারপর আহমদ মুসা ডান পাশের যে রাস্তাটা প্রাচীরের সমান্তরালে পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেছে, সে রাস্তা দিয়ে শান্তভাবে দ্রুত অগ্রসর হলো।
আহমদ মুসা জানে গোডাউন সেকশন বাইবেল সোসাইটি কমপ্লেক্সের উত্তর-পশ্চিম অংশে। সুতরাং নদীর সমান্তরালে পশ্চিম দিকে এগুলেই ওই সেকশনে পৌঁছাতে পারে। আহমদ মুসা নিজেকে এখন অনেকখানি হালকা অনুভব করছে। সে নিশ্চিত মুসলিম নেতৃবৃন্দকে গোডাউন সেকশনেই বন্দী করে রাখা হয়েছে।
একটু সামনেই বামপাশে একটা বাংলো পেল। লনে দুটি বালক একটা বল নিয়ে খেলার মহড়া দিচ্ছে।
লনের পাশ দিয়েই রাস্তা।
আহমদ মুসার দিকে চোখ পড়তেই ওরা খেলা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ওদের বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বুঝল, সে যে নতুন আগন্তুক এ কথা বালকরাও বুঝতে পেরেছে। এ আবাসিক এলাকায় নিশ্চয় এমন কোন আগন্তুক আসে না।
আরেকটু সামনে এগিয়ে আহমদ মুসা দেখল, দুই জোড়া পুরুষ মহিলা টেনিস খেলছে। ওদের পোশাক দেখলেই বোঝা যায় সকালের ব্যায়াম করছে ওরা।
আহমদ মুসা দ্রুত হাঁটছিল।
টেনিস কোর্টের সীমানায় গিয়ে থমকে দাঁড়াল।
তার সামনেই এ পাশের দু’জনের একজন, পুরুষ লোকটি, সার্ভ করতে যাচ্ছিল। তার বাম হাতে বল এবং ডান হাতে উদ্যত র‍্যাকেট।
‘মাফ করবেন, আমি এখানে নতুন। ওদিকটায় যাব। কোন পথে যেতে হবে?
লোকটির সার্ভ করা আর হল না। তার বল ও ব্যাকেট ধরা হাত দু’টি নিচু হয়ে ঝুলে পড়ল। তার চোখে একটু অবাক হওয়ার ভাব। বলল, ‘কে তুমি, কি কাজ ওদিকে?’
‘মুসলিম বন্দীরা আছে। ওখানে যাব।’
‘কি কাজ তোমার ওখানে? কে তুমি?’
লোকটির পার্টনার মহিলাটি এসে লোকটির পাশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে কোর্টের ওপাশ থেকে র‍্যাকেট নাচাতে নাচাতে বিরক্তির সাথে মহিলা একজন বলে উঠল, ‘সময় নেই, কি করছ তোমরা?’
ঠিক এই সময়েই পুব ও দক্ষিণ দিক থেকে চার পাঁচজন লোক ‘চোর’ ‘চোর’ বলতে বলতে ছুটে এল।
ঘিরে ফেলল ওরা আহমদ মুসাকে।
একজনের হাতে পিস্তল।
পিস্তলধারীকেই সে বাইরে দেখেছিল তার দিকে ছুটে আসতে।
‘বাছাধন, আমাদের একজন লোককে কুপোকাত করে ভেবেছিলে পার পেয়ে যাবে। তুমি কেমন অন্ধ চোর হে যে বাঘের খাঁচায় ঢুকেছ?’ বলে রিভলবারধারী লোকটি তার রিভলবারের নল দিয়ে খোঁচা দিল আহমদ মুসার মাথায়।
‘চোর মানে? লোকটি চোর নাকি?’ টেনিস খেলোয়াড় যার সাথে আহমদ মুসা কথা বলছিল, তার চোখে বিস্ময়।
‘চোর তো চোর। সাংঘাতিক লোক। ওপারে আমাদের একজন লোককে মেরে অচেতন করে ফেলেছে।’ বলেই রিভলবারধারী তার রিভলবারের বাঁট তুলল আহমদ মুসার মাথা লক্ষ্যে। ছুটে আসছিল তার ডান হাতে ধরা রিভলবারের বাঁটটি।
আহমদ মুসা শেষ মুহূর্তে মাথাটা একদিকে সরিয়ে বাঁ হাত দিয়ে তার ছুটে আসা হাতটা ঠেকিয়ে ডান হাত দিয়ে তার হাত থেকে রিভলবার কেড়ে নিয়ে লোকটির বুকে রিভলবারের নল চেপে চাপা কণ্ঠে কঠোর নির্দেশ দিল, ‘তোমার সাথীরা যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে হাত তুলে বসে পড়তে…’
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই তার ডান পাশে দাঁড়ানো লোকটির টেনিস র‍্যাকেট এসে আঘাত করল আহমদ মুসার ডান হাতে।
আহমদ মুসার হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গেই সামনে দাঁড়ানো লোকটি, যার বুকে পিস্তল ধরেছিল আহমদ মুসা, জাপটে ধরার জন্যে ঝাপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর।
আহমদ মুসা বুঝল বেকায়দায় সে পড়ে গেছে। এদের ঘেরাও থেকে মুক্ত হওয়াই এখন প্রথম কাজ।
সামনের লোকটি ঝাপিয়ে পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসা বসে পড়েছিল। ঝাপিয়ে পড়া লোকটি ভারসম্য হারিয়ে আহমদ মুসার পেছনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
বেষ্টনীর সামনেটা ফাঁকা হয়ে গেল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে এক লাফে বেরিয়ে এল বেষ্টনী থেকে।
পকেট থেকে বের করে নিয়েছে রিভলবার।
কিন্তু সে সিদ্ধান্তই নিয়েছে, এই মুহূর্তে সে রিভলবার ব্যবহার করবে না। যুদ্ধের আগে যুদ্ধ করে তার আসল লক্ষ্য সে পণ্ড করতে চায় না। যতটা সম্ভব গোপনে প্রথমে তার বন্দীদের কাছে পৌঁছা দরকার।
আহমদ মুসার হাতে রিভলবার দেখে ওরা থমকে দাঁড়িয়েছিল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়া লোকটি পাশ থেকে রিভলবার কুড়িয়ে নিয়েই উঠে দাঁড়িয়েছিল।
‘কোথায় তোমরা মাইকেল?’ -এই শব্দটি এ সময় দক্ষিন থেকে ভেসে এল।
ওদিকে এক পলক চেয়েই আহমদ মুসা বাম হাত তার পকেটে ঢুকিয়ে টেবিল টেনিস বলের মত গোলাকৃতি একটা বস্তু বের করল। ভাবল, আর সময় নেয়া যাবেনা, এদের খোঁজে আরও লোক এসে পড়তে পারে।
গোল বস্তুটি একটা ক্লোরোফরম বল। দ্রুত প্রসারমান এর অদৃশ্য ধোয়া মানুষের নাকে প্রবেশ মাত্র সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
আহমদ মুসা বাম হাতেই বলটা ছুড়ে মারল। পড়ল গিয়ে ওদের মাঝখানে।
ছোট্ট একটা শব্দ হল। তারপর কয়েক মুহূর্ত। লোকগুলো প্রায় একসাথে গোড়া কাটা গাছের মত লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
আহমদ মুসা পা বাড়াতে যাবে, এমন সময় দক্ষিনের রাস্তা দিয়ে ছুটে আসা একজন লোক আহমদ মুসার মুখোমুখি হয়ে গেল।
আহমদ মুসা বুঝল, এইমাত্র এই লোকটিই কোন এক ‘মাইকেলের’ নাম ধরে ডেকেছিল। যারা জ্ঞান হারিয়েছে তাদেরই একজন হয়তো সে হবে।
লোকটি আহমদ মুসার মুখোমুখি হয়ে প্রথমে বিস্মিত হয়ে পড়েছিল। পরে সামনেই তাদের লোকগুলোকে মাটির উপর নেতিয়ে পড়ে থাকতে দেখে আতংক ফুটে উঠল তার চোখে।
আহমদ মুসার ডান হাতে রিভলবার ছিলই।
আহমদ মুসা লোকটির দিকে রিভলবার তুলে ধরে বলল, ‘রিভলবারের কি কাজ তুমি জান। মরতে না চাইলে বল, ওধারে গোডাউনের অংশে পৌঁছার কাছাকাছি পথ কোনটা?’
লোকটার চেহারা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। টার ঠোঁট কাঁপল, কিন্তু কোন কথা বেরুল না। যেন বাক রোধ হয়ে গেছে তার।
আহমদ মুসা তার রিভলবার তার মাথা বরাবর তুলে ধরল। তার তর্জনী ট্রিগারে চেপে বসতে লাগল।
লোকটি সবই দেখতে পাচ্ছিল।
তার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। মৃত্যুভয় ফুটে উঠল তার চোখে। বলল কাঁপা গলায়, ‘কাছে কোথাও গেট নেই। একটাই গেট, মেইন গেট।’
‘এস, চল। প্রাচীরের দিকে চল।’ বলল কঠোর কণ্ঠে আহমদ মুসা।
লোকটি আগে আগে চলল। রিভলবার সমেত হাতটা পকেটে রেখেছে আহমদ মুসা।
প্রাচীরের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল লোকটা।
আহমদ মুসা গিয়ে দাঁড়াল তার পেছনে।
এই এলাকায় প্রচুর গাছ-গাছড়া। বড় গাছও আছে।
খুশী হল আহমদ মুসা। শত্রুর নজরে পড়া থেকে কিছুটা বাঁচা যাবে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে রিভলবার সমেত হাতটা বের করল। রিভলবারের নল লোকটির পাঁজরে ঠেকিয়ে বলল, ‘এক প্রশ্ন আমি দু’বার করব না। বল ওপারে গোডাউন এলাকার কোথায় মুসলিম বন্দীদের আটক করে রাখা হয়েছে?’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই পেছন থেকে ছোট্ট একটা শব্দ শুনতে পেল। যেন কোন কিছুতে জড়িয়ে একটা লতা কিংবা কোন কচি গাছ ছিঁড়ে গেল।
বিদ্যুৎ বেগে পেছন দিকে তাকিয়েই আহমদ মুসা দেহটাকে ছুড়ে দিয়েছিল মাটির দিকে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গুলীর শব্দ। আহমদ মুসার সামনে যে লোকটি দাঁড়িয়েছিল তার মাথায় গিয়ে বিদ্ধ হল একটা বুলেট।
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে দেখতে পেয়েছিল, মাত্র সাত-আট গজ দূরে একজন শ্বেতাঙ্গ দাঁড়িয়ে। তার হাতের রিভলবার উঠে এসেছে তাকে লক্ষ্য করে। আর মুহূর্ত বিলম্ব হলে ঐ বুলেট গুড়ো করত আহমদ মুসার মাথাকেই।
রিভলবারধারী লোকটি তার গুলীতে তাদের নিজের লোক গুলী বিদ্ধ হয়ে ঢলে পড়তে দেখে কিছুটা বিমুঢ় হয়ে পড়েছিল।
এরই সুযোগ গ্রহন করেছিল আহমদ মুসা।
মাটিতে পড়ে গুলী করেছিল সে।
গুলীটি কপাল গুড়ো করে দিল রিভলবারধারীর।
ছিটকে পড়ে গেল লোকটির দেহ মাটিতে।
আহমদ মুসা গুলী করেই উঠে দাঁড়াল। ভাবল, পরপর দু’টি গুলীর শব্দ হয়েছে। নিশ্চয় সবার কানে পৌঁছে গেছে। এখনই সবাই ছুটে আসবে এদিকে। তাদের আসার আগেই ওপারে তাকে পৌছতে হবে।
তাকাল আহমদ মুসা প্রাচীরের দিকে।
প্রাচীরটা বেশ উঁচু, আট ফুটের মত হবে। এ প্রাচীর ডিঙানো তার জন্যে কঠিন নয়। কিন্তু সমস্যা হল ওপারে প্রাচীর ঘেঁষে উঁচু দেয়াল উথেছে, দু’তলা বিল্ডিং এর দেয়াল।
হতাশ হল আহমদ মুসা। দক্ষিন দিকটা বিপদজনক। ওদিকে এগুলে সহজেই লোকদের নজরে পড়ে যাবে।
তাকাল আহমদ মুসা উত্তর দিকে। দেখল, উঁচু বিল্ডিংটা প্রাচীর শেষ হবার ছয় সাত ফিট দক্ষিন থেকে পশ্চিম দিকে বেঁকে গেছে।
পেছন দিক থেকে পায়ের শব্দ ও মানুষের কণ্ঠ আহমদ মুসার কানে এল। পেছনে তাকিয়ে দেখল, কয়েকজন ছুটে আসছে এদিকে।
আর চিন্তা করার কোন অবকাশ নেই।
আহমদ মুসা উত্তর দিকে ছুটছিল।
তার লক্ষ্য প্রাচীরের ফাঁকা জায়গাটুকু, যেখানে প্রাচীর ঘেঁষে ওপারে কোন দেয়াল নেই। ওখান দিয়ে ওপারে লাফিয়ে পড়া যাবে।
আহমদ মুসা ছুটা অবস্থাতেই দাত দিয়ে রিভলবার কামড়ে ধরে প্রাচীর বেয়ে প্রাচীরের মাথায় উঠে বসল। পেছনে তাকাল। দেখল, চার পাঁচজন এদিকে ধেয়ে আসছে।
আহমদ মুসা সামনে তাকাল। দেখল, নদীর তীর ঘেঁষে উত্তর প্রান্ত বরাবর প্রাচীর। আর তার সমান্তরালে একটু দক্ষিন পশ্চিম দিকে চলে যাওয়া বিল্ডিং-এর দেয়াল। এ দু’য়ের মাঝখানে দীর্ঘ একটা চত্বর সবুজ ঘাসে ঢাকা। চত্বরটা তেমন কোন কাজে ব্যাবহার হয় বলে মনে হল না। খুশী হল আহমদ মুসা।প্রথমেই কোন বাধা আসার সম্ভাবনা এখানে কম থাকবে।
আহমদ মুসা প্রাচীরের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ল নিচের চত্বরে। পরেই দাঁত থেকে রিভলবার হাতে তুলে নিয়ে চারদিকে তাকাল। না কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তার বাম পাশে বিল্ডিং-এর দেয়ালে কোন জানালা দরজা নেই। তবে একটু পশ্চিমে কয়েকটা জানালা দেখা যাচ্ছে।
পেছনে প্রাচীরের ওপাশে ওরা এসে গেছে। চোর চোর বলে চিৎকার করছে ওরা তারস্বরে।
আহমদ মুসা মনে মনে হাসল। তাকে যতক্ষণ ওরা চোর ভাবে ততক্ষণ তার সুবিধা।
ঘাসে ঢাকা মাটির উপর দিয়ে আহমদ মুসা সামনে এগুলো।
হঠাৎ পেছনের চিৎকারটা খুব কাছে মনে হল আহমদ মুসার।
মাথ ঘুরিয়ে দেখল, দু’জন প্রাচীরের মাথায় উঠে এসেছে।
আহমদ মুসা মুহূর্ত দেরি করল না। রিভলবার তুলে পরপর দু’বার গুলী করল। গুলীবিদ্ধ দু’জন লোক গড়িয়ে পড়ে গেল প্রাচীরের ওপারে।
আমদ মুসা মনে কিছুটা স্বস্তি পেল। ভাবল, এই মুহূর্তে অন্তত প্রাচীর ডিঙাতে কেউ চেষ্টা করবে না। সুতরাং নিরাপদ সে অনেকটা।
কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। দেখল, সামনে যেখানে সে জানালা দেখেছিল, সেখানে এখন একটা দরজা। দরজায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘদেহী একজন শ্বেতাঙ্গ। তার হাতে রিভলবার। আহমদ মুসার দিকে তাক করা।
আহমদ মুসার সাথে চোখাচোখি হতেই সে বলল, ‘তুমি তো বড় সেয়ানা চোর হে। কিন্তু চুরি করার আর জায়গা পেলে না। রিভলবার এদিকে ফেলে দাও।’
আহমদ মুসার ডান হাতে ছিল রিভলবার।
রিভলবার ধরা তার ঝুলন্ত ডান হাতটা নড়ে উঠল। উঠতে লাগল একটু উপরের দিকে। মনে হল যেন নির্দেশ পালনের জন্যে সে রিভলবার সামনের দিকে ছুড়ে ফেলছে।
কিন্তু তার রিভলবার ধরা ডান হাতটা চোখের পলকে দরজায় দাঁড়ানো লোকটির সমান্তরালে উঠে এল এবং সঙ্গে সঙ্গেই গুলী বেরিয়ে এল একটি।
দরজায় দাঁড়ানো রিভলবারধারী লোকটি কতকটা রিলাক্সড মুডে ছিল। ভাবখানা একজন চোরের সাথে আর কি লড়াই হবে। তার চোখের সামনে যখন ঘটনাটা ঘটে গেল, তখনও যেন সে কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। বুকে গুলী খেয়ে লোকটির দেহটা বার কয়েক এদিক-ওদিক দোল খেয়ে পড়ে গেল দরজার সামনে।
আহমদ মুসা চারদিকে তাকিয়ে জায়গাটার লোকেশনটা একবার বুঝে নিয়ে ছুটল দরজার দিকে।
লাশ ডিঙিয়ে দরজায় প্রবেশ করে আহমদ মুসা দরজা বন্ধ করে দিল।
আহমদ মুসা যেখানে প্রবেশ করল তা ঘর নয় একটা করিডোর।
আহমদ মুসা দেখল, অল্প একটু দুরেই পশ্চিম দিকে যাওয়া করিডোর থেকে আরেকটা শাখা দক্ষিণে বেরিয়ে গেছে।
আহমদ মুসা সেদিকে এগুলো। সবে এক ধাপ এগিয়েছে সে।
দক্ষিণ দিক থেক আসা করিডোর থেকে দু’জন স্টেনগানধারী এসে প্রবেশ করল এ করিডোরে। তাদের স্টেনগান উদ্যত।
আহমদ মুসা একদম মুখোমুখি হয়ে গেল তাদের। তাদের বাগিয়ে ধরা স্টেনগান স্থির হয়ে হয়েছে আহমদ মুসার বুক লক্ষ্যে।
আহমদ মুসার রিভলবার তার ডান হাতে ঝুলছিল।
‘রিভলবার ফেলে দাও।’ চিৎকার করে বলল তাদের একজন।
ওরা দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল।
ওদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। হাত থেকে ছেড়ে দিল সে রিভলবার। পড়ে গেল তার পায়ের কাছেই।
রিভলবার পড়ে যেতেই ওদের একজন ছুটে এল। রিভলবার হাতে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিল।
লোকটি আহমদ মুসা এবং একটু দূরে দাঁড়ানো দ্বিতীয় স্টেনগানধারীর মধ্যে একটা দেয়াল সৃষ্টি করেছিল।
আহমদ মুসা সুযোগ গ্রহণ করলো।
আহমদ মুসার ডান হাত বিদ্যুৎ গতিতে লোকটির গলা পেঁচিয়ে তাকে চেপে ধরেই বাম হাত দিয়ে তার কাছ থেকে রিভলবার কেড়ে নিল এবং সঙ্গে সঙ্গেই গুলী করল দূরে দাঁড়ানো স্টেনগানধারীকে লক্ষ্য করে।
লোকটি মুহূর্তের জন্যে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার আগেই গুলী খেয়ে আছড়ে পড়ল।
আহমদ মুসার বাহুর সাড়াশির বাঁধনে আটকে পড়া লোকটি অসহায় ভাবে হাত-পা ছুড়ছিল।
আহমদ মুসা এবার রিভলবারের নলটা তার মাথায় চেপে ধরে বলল, ‘মুসলিম বন্দীদের কোথায় রেখেছ বল? তিন গুনার মধ্যে না বললে মাথা গুড়ো করে দেব।’
লোকটি মুহূর্ত দেরী করল না। সামনে করিডোরের দক্ষিন পাশের ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘ঐ ঘরে রয়েছে।’
‘কোন দিকে দরজা?’
‘ঘরের দক্ষিন দেয়ালে’ বলল লোকটি।
‘চল কোন দিকে?’ বলে ঐভাবে তাকে ধরে রেখেই চলতে শুরু করল।
দরজায় দাঁড়িয়ে দুজন প্রহরী। তারা আহমদ মুসাদের দেখেই তাঁদের স্টেনগান বাগিয়ে ধরল।
হেসে উঠল আহমদ মুসা। বলল, ‘ওদের দরজা খুলে দিতে বল।’
‘ওরা আমার নির্দেশের অধীন নয়। আমার নির্দেশ ওরা মানবে না।’ বলল লোকটি।
ক্রোধের চিহ্ন ফুটে উঠল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। এসব কথা শুনে সময় নষ্ট করার সময় তার নেই।
আহমদ মুসা গার্ড দু’জনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘দরজা খুলে দাও।’
গার্ড দু’জন যেমন দাঁড়িয়েছিল, তেমনি দাঁড়িয়ে থাকল। কোন ভাবান্তর দেখা গেল না তাদের চোখে-মুখে।
আহমদ মুসার রিভলবার তাদের লক্ষ্যে স্থির হলো। পরপর দুটি গুলী উদ্গীরন করল। গার্ড দু’জন দরজার উপরই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে।
আহমদ মুসা লোকটিকে ঐভাবে ধরে রেখেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। যাবার পথে পড়ে থাকা স্টেনগান দু’টি তুলে নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখল।
লোকটিকে একটা ধাক্কা দিয়ে সামনে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘খুলে দাও দরজা।’
লোকটি আর অন্যথা করল না। খুলে দিল দরজা।
দরজা খুলে গেল।
ঘরের মাঝখানে ওরা বারোজন দাঁড়িয়েছিল। দরজার দিকে মুখ। তাদের চোখে-মুখে উদ্বেগ।
আহমদ মুসা এগিয়ে গেল দরজার কাছে।
ওদের লক্ষ্য করে সালাম দিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা কে সামনে দেখে অপার বিস্ময়ের একটা স্রোত খেলে গিয়েছিল তাদের মুখের উপর দিয়ে। পরমুহূর্তেই সেখানে নেমে এল আনন্দের প্রস্রবণ। আহমদ মুসার সালাম নিতে তারা ভুলে গেল। চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল ত্তুরস্কের কামাল ইনুনু।
আহমদ মুসা ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে কথা বলতে নিষেধ করে বলল, ‘আপনারা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসুন।’
বেরিয়ে এল ওরা ঘর থেকে দ্রুত।
আহমদ মুসা আবার ওদের সালাম দিয়ে বলল, ‘আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি যে, আপনারা সুস্থ আছেন। এখনই আমাদের বেরুবার পথ করতে হবে। ওরা এখনি এসে পড়বে।’
বলে আহমদ মুসা সেই লোকটির মাথায় রিভলবারের নল চেপে ধরে বলল, ‘বেরুবার গোপন পথ কোনদিকে বল?’
‘গোপন পথ?’ অজ্ঞতার ভান করল লোকটি।
‘আর এক মুহূর্ত দেরী করলে মাথা গুড়ো করে দেব তোমার।’ বলল আহমদ মুসা চাপা কঠোর কণ্ঠে।
পশ্চিম দিকের একটা করিডোর দেখিয়ে বলল, ‘ওদিকে।’
আহমদ মুসা লোকটিকে ধাক্কিয়ে নিয়ে সেদিকে চলল। ওরা ১২জন তাদের পেছনে পেছনে চলল।
একটা চতুষ্কোণ ফাঁকা জায়গা তারা পার হচ্ছিল, এসময় বিপরীত দিক থেকে অনেকগুলো দ্রুত পদশব্দ এবং অনেকের উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে এল।
করিডোরের মুখ ঘেঁষেই একটা দরজা।
আহমদ মুসা লোকটিকে ঠেলে দ্রুত দরজার কাছে পৌঁছল। দরজার নব ঘুরাতেই দরজা খুলে গেল।
আহমদ মুসা পেছনে মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত বলল, ‘আপনারা দ্রুত ভেতরে ঢুকে পড়ুন।’
সঙ্গে সঙ্গেই ওরা ১২জন ভেতরে ঢুকে গেল। আহমদ মুসা সেই আটকে রাখা লোককে ঠেলে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
ঘরে ঢুকেই আহমদ মুসা দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনেকগুলো লোক এসে প্রবেশ করল আহমদ মুসাদের পেরিয়ে আসা ফাঁকা জায়গাটায়। তাদের উত্তেজিত কথাবার্তা ও চিৎকার শোনা গেল। সম্ভবত বন্দীদের পালানোর ব্যাপারটা তারা টের পেয়েছে।
তাদের চিৎকারের মধ্যে একটু দূর থেকে একটা উচ্চ কণ্ঠ সব কণ্ঠকে ছাপিয়ে উঠল। সে বলছে, ‘পুলিশ, পুলিশ অনেক পুলিশ। বাড়ির তিন দিক তারা ঘিরে ফেলেছে।’
অনেক কণ্ঠের চিৎকার ও চেঁচামেচি এক মুহূর্তেই থেমে গেল।
‘কি চায় পুলিশ, কি বলছে তারা?’ একটা ভারী কণ্ঠ ধ্বনিত হলো।
‘তারা ভেতরে প্রবেশ করতে চায়।’ বলল সম্ভবত খবর নিয়ে আসা লোকটি।
‘ঠিক আছে, তোমরা কয়েকজন চারদিকটা দেখ বন্দীরা কোথায়, অন্যরা আমার সাথে এসো। দেখি পুলিশ এখানে নাক গলাতে এল কেন?’ বলল সেই ভরাট গলার লোকটা।
আহমদ মুসাসহ ঘরের সবাই এইসব কথা-বার্তা শুনছিল।
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে ভেতরের দিকে মনোযোগ দিতেই ওয়ার্ল্ড এ্যাসেম্বলী অব মুসলিম ইয়ুথের নেতা কামাল ইনুনু বলল, ‘ওদের কেউ নিশ্চয় এদিকে খুজতে আসবে।’
বলেই একটু থেমে সে ঘরের এক পাশের মেঝেতে নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়ির দিকে অঙ্গুলি সংকেত করে বলল, ‘আমার মনে পড়ছে এই সিঁড়ি দিয়েই আমরা উঠেছিলাম।’
‘কেন আপনারা কি আগে ভু-গর্ভের কোন কক্ষে বন্দী ছিলেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না, এ পথেই আমরা বন্দীখানায় উঠেছিলাম। নদী থেকে এক সুড়ঙ্গ পথে আমাদের আণ্ডারগ্রাউন্ড কক্ষে আনা হয়েছিল।’
আহমদ মুসার মনে পড়ে গেল নদীর কুল ঘেঁষে দাঁড়ানো মোটর বোটের কথা। তার চোখে ভেসে উঠল মোটর বোটের নোঙরের রশি ঠিক পানির সমান্তরালে উপকূলের কংক্রিটের ভেতরে ঢুকে যাবার দৃশ্য।
আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। সুড়ঙ্গ পথের মুখে নিশ্চয় মোটর বোটটি দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা কামাল ইনুনুকে কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল এ সময় দরজায় ধাক্কা পড়তে লাগল।
আহমদ মুসা দরজার দিকে একবার তাকিয়ে কামাল ইনুনুকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনি এঁদের নিয়ে দ্রুত নিচে নেমে যান। নিচের ফ্লোরে নেমে উত্তর দিকে এগিয়ে যাবেন। ফ্লোর লেভেলেই নদীতে বেরুবার দরজাটা পেয়ে যাবেন। আমার যতদুর মনে হয় উত্তর দেওয়ালের কোথাও সুইচ পেয়ে যাবেন। ঠিক সুইচটা চাপলেই দেয়াল সরে যাবে। সামনেই দেখবেন একটা মোটর বোট দাঁড়িয়ে। আমার যতদুর মনে হয় লাল সুইচ কিংবা নৌকা বা মাস্তুলের ছবি ওয়ালা কোন সুইচ থাকলে সেটাই টিপবেন। খোদা হাফেয।’
কামাল ইনুনু সিঁড়ির দিকে পা বাড়ানোর জন্যে নড়ে উঠলেও বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ মাদানী নড়ল না। বলল, ‘মনে হচ্ছে তুমি যাচ্ছ না। তুমিও চল।’
আহমদ মুসা তার দিকে চোখ তুলে দ্রুত বলল, ‘আমি নিশ্চয়ই আসব। কিন্তু এদের আটকাতে হবে এখানে।’
‘কেন দরজা শক্তভাবে বন্ধ আছে, ভাঙার আগেই আমরা চলে যেতে পারব।’
‘জনাব ওদের দরজা ভাঙতে দেরী হলে কিংবা দরজা ভাঙতে না পারলে ওরা নদীর দিকে ছুটে যাবে। সেখানে আমাদের আটকাতে চেষ্টা করবে। সুতরাং দরজা খুলেই ওদের এখানে ব্যস্ত রাখতে হবে। ইতিমধ্যে আপনাদের নিরাপদ দুরত্বে সরে পড়তে হবে।’ বলল দ্রুত কণ্ঠে আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি বাবা তোমার কথা। তুমি একা এদের সাথে লড়াই করবে, আর আমরা পালাব?’ বলল ভারী কণ্ঠে শেখ মাদানী।
আহমদ মুসা হাত জোড় করে বলল, ‘আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। লড়াই থেকে একা একা সরে পড়া কঠিন নয়, কিন্তু সবাইকে নিয়ে সরে যাওয়া কঠিন। আপনারা দয়া করে যান।’
শেখ মাদানী আর পাল্টা কথা আর বলল না। ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে পা বাড়াল সিঁড়ির দিকে। সেই সাথে তার সাথী এগারোজন সকলেই।
দরজায় ধাক্কা বাড়ছিল।
আহমদ মুসা রিভলবার পকেটে রাখল। কাঁধ থেকে হাতে তুলে নিল স্টেনগান। ধরে রাখা সেই লোকটিকে বলল, ‘দরজা খুলে দাও আর বল, ‘এদিকে কেউ আসেনি। তাড়া খেয়ে তুমিই দরজা বন্ধ করেছিলে।’
বলে আহমদ মুসা দরজার বিপরীত দিকে সিঁড়ির পাশে দেয়াল বরাবর রাখা একটা ভাঙা টেবিলের আড়ালে গিয়ে বসল।
লোকটি টেবিলের নিচ দিয়ে হা করে থাকা স্টেনগানের কালো ব্যারেলের দিকে একবার তাকিয়ে দরজা খুলে দিল।
দরজা খোলার সাথে সাথে দরজা ঠেলে চার পাঁচজন ঘরে প্রবেশ করল উদ্যত স্টেনগান হাতে।
দরজা খুলে দেয়া সেই লোকটি দ্রুত তাদের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল এবং দরজার বিপরীত দিকে সিঁড়ির মুখের পাশে রাখা টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘প্রথমে ওকে দেখ, তারপর…।’
তার কথা শেষ হতে পারল না।
আহমদ মুসার স্টেনগান থেকে এক ঝাক গুলী এসে ওদের সবাইকে ঘিরে ধরল। পর মুহূর্তেই ৬টি মানুষ লাশ হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।
আহমদ মুসা নড়ল না টেবিলের আড়াল থেকে। তার স্টেনগানের কাল নল হা করে তাকিয়ে থাকল দরজার দিকে শিকারের অপেক্ষায়।
এদিকে স্টেনগানের গুলীর শব্দ শুনেই সম্ভবত বিভিন্ন দিক থেকে আরও তিনজন এগিয়ে এল।
তারা দরজার সামনে এসে তিনজনেই তাদের স্টেনগান থেকে গুলী ছুঁড়ল। তাদের গুলী দরজা দিয়ে ঢুকে সিঁড়ির মাথার উপর দিয়ে দেয়ালকে গিয়ে বিদ্ধ করল। আহমদ মুসাকে আড়াল করা টেবিলটা দরজার বিপরীত দেকে হলেও একটা কৌণিক ব্যবধানে তার অবস্থান ছিল। সুতরাং বৃষ্টির মত আসা গুলীর হাত থেকে বেঁচে গেল সে।
গুলী বর্ষনের কোন পাল্টা উত্তর না পেয়ে ওরা গুলী বন্ধ করে স্টেনগান বাগিয়ে পা পা করে দরজার কাছাকাছি হলো।
আহমদ মুসার স্টেনগানের নল ওদিকেই তাকিয়ে ছিল। গুলী বর্ষণ করল এক পশলা।
দরজার সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সেই এগিয়ে আসা তিনটি মানুষ।
আহমদ মুসা উঠল না তার জায়গা থেকে। স্টেনগানটা সেইভাবেই দরজার দিকে তাক করে রাখল। মুসলিম নেতৃবৃন্দ এখান থেকে বেরিয়ে বোটে না ওঠা পর্যন্ত ওদের মনোযোগ ভেতর দিকেই আটকে রাখতে হবে। ওদের বুঝাতে হবে ভেতরেই সংঘাত হচ্ছে, বন্দীরা ভেতরেই আছে।
আরও কিছু সময় গেল। কেউ আসছে না। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালো।
বাইরে একটু দূর থেকে ভেসে আসা কথা শুনতে পেল আহমদ মুসা।
দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, এদিকে আসছে পুলিশ এবং সেই সাথে কিছু লোক।
আহমদ মুসা দ্রুত দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটল।
আণ্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে ছুটল উত্তর দিকে। উত্তরে দেয়ালে সে দরজা খোলাই দেখতে পেল।
আহমদ মুসা দরজায় এসে স্তম্ভিত হয়ে দেখল, মোটর বোটে মুসলিম নেতৃবৃন্দ সবাই উঠেছে, কিন্তু বোটটি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা কে দেখেই ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্টের’ প্রধান তারিক আল-মাহদী বলল, ‘লোহার বিশেষ চেন দিয়ে বোট আটকানো সম্ভবত ভেতর থেকে। কোন ক্রমেই খোলা যায়নি।’
আহমদ মুসা ঘুরে সুইচ বোর্ডের কাছে গেল। নজর বুলাল প্যানেলের সুইচগুলোর উপর। আহমদ মুসা নিশ্চিত, চেন খুলে দেবার জন্যে এখানেই একটা সুইচ আছে।
সাদা সুইচের উপর সাদা চেন আঁকা একটা সুইচ পেয়ে এগিয়ে গেল আহমদ মুসা। অফ করে দিল সুইচটা। সামনের দেয়ালের কোথাও থেকে ক্লিক করে একটা শব্দ উঠল।
‘খুলে গেছে চেন’ বুঝল আহমদ মুসা।
ছুটে ফিরে গেল দরজায় আহমদ মুসা। বলল, অনুচ্চ স্বরে, ‘চেন খুলে গেছে স্টার্ট দিন বোটে।’
ঠিক এই সময়েই পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা।
স্টেনগান বাগিয়ে চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। ট্রিগার টানতে যাচ্ছিল সে স্টেনগানের। কিন্তু দেখতে পেল পুলিশকে আর দেখতে পেল পুলিশের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ব্ল্যাক বুল এবং মিঃ ম্যাকাকো।
বিস্মিত হল আহমদ মুসা। তার স্টেনগানের ব্যারেল নিচে নেমে গেল।
মোটর বোট স্টার্ট নেয়ার শব্দ পেল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘স্টার্ট বন্ধ করে দিন।‘
ব্ল্যাক বুল ও মিঃ ম্যাকাকো এগিয়ে এল। তার পেছনে পুলিশ অফিসাররা।
ব্ল্যাক বুল এসে আনন্দের অতিশয্যে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে।
মিঃ ম্যাকাকোও বিস্ময় ও আনন্দের সাথে আহমদ মুসাকে মোবারকবাদ জানিয়ে বলল, ‘একক’ একজন যে এমন একটা যুদ্ধে জিততে পারে, সেই অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধক্ষেত্র আজ দেখলাম।’
মিঃ ম্যাকাকো নামতেই ব্ল্যাক বুল একজন পুলিশ অফিসারের দিকে অংগুলি সংকেত করে বলল, ‘ইনি ‘সলো’ বন্দরের পুলিশ প্রধান, আমার ভাই। আরেকজনকে দেখিয়ে বলল, ইনি মিঃ উপাংগো। বোমাসার পুলিশ প্রধান, আমার ভাইয়ের বন্ধু।’
পুলিশ অফিসার দু’জন আহমদ মুসার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমাদের জীবন ধন্য হলো, আমাদের চোখ সার্থক হলো আপনাকে দেখে।’
আহমদ মুসাও হাত বাড়িয়ে দিল তাদের দিকে।
মুসলিম নেতৃবৃন্দ নেমে এল বোট থেকে।

ব্ল্যাক ক্রস-এর প্যারিস হেড কোয়ার্টার।
বিশাল টেবিল সামনে নিয়ে রিভলবিং চেয়ারে দুলছিল ব্ল্যাক ক্রস-এর নতুন প্রধান সাইরাস শিরাক। চোখে তার শুন্য দৃষ্টি। যেন এই জগতে সে নাই। মাথার চুল উস্কো-খুস্কো। চোখ লাল।
তখন রাত ৮টা। সেই বিকেল ১টা থেকে এই চেয়ারেই বসে আছে সাইরাস শিরাক। মদ গিলছে পেগের পর পেগ।
ফ্রী ওয়ার্ল্ড টেলিভিশনের বিকেল ১টার নিউজ বুলেটিন সাইরাস শিরাকের মাথায় ভয়ানক বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। FWTV বলেছে, “মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের বারবারেতির ভয়ানক অগ্নিকান্ডে নিহত বলে কথিত ১২জন মুসলিম বিশ্বনেতাকে ইউরোপ ভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন ব্ল্যাক ক্রস কিডন্যাপ করে কঙ্গোর বোমাসা সীমান্ত শহরের বাইবেল সোসাইটিতে বন্দী করে রেখেছিল। ‘সলো’-এর পুলিশ প্রধান মিঃ জাগুয়াস ম্যাকা একটি গোপন সুত্রের খবরের ভিত্তিতে বোমাসার পুলিশ প্রধান মিঃ উপাংগোর সাহায্যে বন্দী মুসলিম নেতৃবৃন্দকে আজ সকালে মুক্ত করেন। প্রকাশ, ১২জন মুসলিম বিশ্ব নেতাকে কিডন্যাপ করার ঘটনা আড়াল করার জন্যেই ব্ল্যাক ক্রস বারবারেতির ইসলামী সম্মেলনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কয়েক কুড়ি মানুষের হত্যাযজ্ঞের সৃষ্টি করে। মুসলিম বিশ্ব নেতাদের কেন কিডন্যাপ করা হয়েছিল, পুলিশ এ সম্পর্কে এখনও কিছু জানতে পারেনি।”
নিউজ শেষে FWTV ঘোষণা দেয়, ‘সচিত্র ও বিস্তারিত নিউজের জন্যে FWTV সকলকে বিকেল ৩টার বুলেটিনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।’
FWTV-এর নিউজ ব্ল্যাক ক্রস প্রধান সাইরাস শিরাকের বুকে শেলবিদ্ধ করে। বাকরুদ্ধ হয়ে যায় তার। মুসলিম বন্দীদের উদ্ধার কিভাবে সম্ভব? গোটা দুনিয়া যাদের মৃত জানে, তাদের খুঁজতে গেল কেন দু’জন পেটি পুলিশ অফিসার? আর খুজে পেলইবা কি করে?
কোন প্রশ্নেরই উত্তর সাইরাস শিরাকের কাছে ছিল না।
সবচেয়ে দুর্বহ মনে হচ্ছে তার কাছে ব্ল্যাক ক্রস-এর বদনাম। ব্ল্যাক ক্রস আজ গোটা দুনিয়ায় সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচিত হবে।
চেয়ার থেকে উঠতে পারল না সাইরাস শিরাক। বেলা তিনটার FWTV-এর নিউজ বুলেটিন তাকে দেখতে হবে। সচিত্র বিবরণে কি তারা দেখায়, টা দেখার পরে অনেক কিছু তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
কিছুতেই বুঝতে পারছে না সাইরাস শিরাক বোমাসা, সলো অথবা বারবারেতি থেকে কেউ কিছু জানাচ্ছে না কেন? তাহলে কি বোমাসা থেকে খবর দেবার মত কেউ বেঁচে নেই? শিউরে উঠল সাইরাস শিরাক। ক্যামেরুনে যা ঘটেছে তারই কি পুনরাবৃত্তি ঘটল বোমাসায়? সলো বন্দরে এশিয়ানকে আটক করা হয়েছিল, সে কে ছিল? সে ঘটনার পর যে অবস্থায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং যেভাবে সে পালিয়েছে, তা প্রমান করে সে অসাধারন কেউ। কে সে? আহমদ মুসা?
ঐভাবে চেয়ারে বসেই মিঃ সাইরাস শিরাক FWTV-এর ৩টার নিউজ বুলেটিন দেখে। বোমাসার বাইবেল সোসাইটির ভেতর-বাহির সবটাই দেখানো হয়। প্রায় ১৫-১৬টি লাশ তাঁর চোখে পড়ে। সবগুলোই ব্ল্যাক ক্রস-এর লোকদের। শত্রুপক্ষের একটা লাশও তার চোখে পড়ে না। ছবিতে ১২জন বিশ্ব নেতাকে দেখানো হয়। গর্বিত দু’জন পুলিশ অফিসারকেও দেখা যায় তাদের সাথে। তাদের সাক্ষাৎকারও প্রচার হয়। তারা বলে বড় বড় সুবিধা ও স্বার্থ আদায়ের গোপন দরকষাকষির অস্ত্র হিসেবে তাদের কিডন্যাপ করা হয়েছিল। তবে তারা তাদের গোপন দাবী আদায় করত, কিন্তু বন্দীদের তারা ছেড়ে দিত না। তাদের স্লো পয়জনিং করা হচ্ছিল।’
FWTV তাদের খবরে প্রাথমিক রক্ত পরীক্ষার বরাত দিয়ে বলে, মুসলিম বিশ্ব নেতাদের স্লো পয়জন করা পয়জনটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। মনে হচ্ছে প্রথম বারের মত কোন মানুষের উপর এটা টেস্ট করা হয়েছে।
রাগে-দুঃখে মাথার চুল ছেঁড়ে সাইরাস শিরাক।
চেয়ার থেকে আর উঠতে পারেনি সে। স্রোতের মত টেলিফোন এসেছে। তাকেও টেলিফোন করতে হয়েছে অনেক।
ছয়টার মধ্যেই পৃথিবীর সকল রেডিও-টিভি নেটওয়ার্ক বোমাসার মুসলিম বন্দী উদ্ধারের ঘটনাকে তাদের প্রথম ও প্রধান ঘটনা হিসেবে প্রচার করে। FWTV-এর প্রচারিত ফটোগ্রাফ ব্যাবহার করে তারা।
মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সাইরাস শিরাকের সামনে পুরো পৃথিবীর মানচিত্রটা যেন পাল্টে গেল। তার সামনের উজ্জ্বল দিগন্তটা কালো হয়ে গেল। তার মনে হচ্ছে, ব্ল্যাক ক্রস-এর চেয়ে ব্যর্থ সংগঠন দুনিয়াতে আর নেই। কিন্তু কার জন্যে?
সন্ধ্যা ৭টায় বৈঠক বসল ব্ল্যাক ক্রস নির্বাহী কমিটির।
জলন্ত অঙ্গারের মত সবার মুখমণ্ডল।
কিন্তু কারো মুখে কথা নেই।
কথা বলল সাইরাস শিরাকই প্রথমে।
বলল, ‘সবার চোখে আমি আগুন দেখছি। কিন্তু আগুনে পোড়াবে কাকে?’
কেঊ উত্তর দিল না। সবারই চোখে যেন একই জিজ্ঞাসা।
সাইরাস শিরাকই কথা বলল, ‘আহমদ মুসা সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছে, অপূরণীয় ক্ষতি করেছে আমাদের। কিন্তু শেষ এই ঘটনায় তাকে আমরা দেখছি না।’
‘আমরা কি করব, আমাদের বোমাসার এত বড় বিপর্যয়ের জন্যে কাকে আমরা দায়ী করব?’ বলল একজন।
‘সেটা পরে খোঁজ নেয়া যাবে। সকলের আগে এখন আমাদের এক বড় শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। যে শত্রুকে সরাতে না পারলে পদে পদে আমাদের হোঁচট খেতে হবে।’
‘কে এই শত্রু?’ একসাথে বলে উঠল কয়েকজন।
‘সময়ে জানতে পারবেন। তবে সে শত্রু কোন মানুষ নয়।’
‘মানুষ নয়?’
‘মানুষের চেয়েও পাওয়ারফুল। সেনসিটিভ।’
‘কে সে? কি তার নাম?’
‘বললাম তো সময়ে জানা যাবে।’ বলে একটু থেমে আবার বলল সাইরাস শিরাক, ‘অপারেশন চীফ মিঃ রেনেন, আপনার নতুন অস্ত্র প্রস্তুত তো? নতুন করে পরীক্ষা করেছেন আবার?’
‘প্রস্তুত। পরেও পরীক্ষা করেছি। সফল।’
‘ধন্যবাদ। সকলকে ধন্যবাদ’ বলে সাইরাস শিরাক চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।