১. অপারেশন তেলআবিব-১

এমিলিয়াদের গেট পেরিয়ে ফুটপাতে দাঁড়াতেই কালো রং এর একটি ‘মরিস করোনা’ এসে মাহমুদের সামনে দাঁড়াল। ভিতর থেকে মুখ বাড়াল আফজল পাশা। জাফা বন্দর থেকে সারাটা পথ আফজল পাশা মাহমুদের অনুসরণ করে এসেছে। এই নির্দেশই ছিল তার প্রতি। জাফা বন্দরের যে আস্তানায় আমরা ইতিপূর্বে মাহমুদ ও আফজলকে দেখেছি সেটা আপতত বন্ধ থাকবে।

মাহমুদ গাড়ীতে উঠে বসলে গাড়ী ছুটে চলল প্রশস্ত আলকেনান রোড ধরে দক্ষিণ দিকে। গাড়ীতে বসেই মাহমুদ পোশাক পাল্টে নিল। প্রথমেই কথা বলল মাহমুদ। বলল, শেখা জামালকে জানিয়েছ?

শেখ জামাল তেলআবিবের ৩ নং আস্তানার পরিচালক। এ আস্তানাটি দক্ষিণ তেলআবিবের বাজার সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। এ আস্তানাতেই মাহমুদ এখন যাচ্ছে।

গাড়ী এবার ডেভিড পার্ক ঘুরে স্যামুয়েল রোড ধরে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলল। তিন মিনিট চলার পর গাড়ী দক্ষিণ দিকে মোড় নিয়ে সেন্ট সলোমন রোড ধরে ছুটে চলল দক্ষিন দিকে। সেন্ট সলোমন রোড যেখানে এসে খাড়া পূর্ব দিকে মোড় নিয়েছে সেই মোড়ের উপর রাস্তার দক্ষিণ পাশে শেখ জামালের আস্তানা। দোতলা বাড়ী। নিচের তলায় ফলের দোকান। উপর তলায় থাকে জামাল। আরও দু’টি ঘর পশ্চিম দিকে রয়েছে। এর একটি দৃশ্যত রান্নাঘর আরটি ষ্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার হয়। কিন্তু রান্নাঘরটি ভ্রাম্যমান সাইমুম কর্মীদের একোমোডেশন এবং নিচের তলার ষ্টোর রুমটি অস্ত্রাগার ও ট্রেনিং কক্ষ। স্থানীয় সাইমুম ক্যাডেটদের মধ্যে অস্ত্র বিতরণ করার পর অস্ত্রাগারটির অবশিষ্ট সবকিছু তেলআবিবের মূল ঘাঁটিতে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ইসরাইলে কর্মরত সাইমুম ইউনিট গুলোকে স্বয়ং সম্পূর্ণ করার পর সর্বক্ষেত্রে একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ এবং জরুরী মুহূর্তে নির্দেশ গ্রহণের জন্য যোগাযোগ রক্ষা করা ছাড়া আর আস্তানার সাথে স্বয়ং সম্পূণ সাইমুম ইউনিটগুলোর কোন রকমের সম্পর্ক নেই। ইসরাইলের বাসিন্দা আরব মুসলমানদের ৯৭ হাজার পুরুষ এবং ৮২ হাজার মহিলা সাইমুমের ‘জয় নয়, মৃত্যু’ মন্ত্রে দীক্ষিত। এদের নিয়েই গঠিত হয়েছে সাইমুমের হাজার হাজার ইউনিট। বিভিন্ন ঘাটি থেকে আস্তানাসমূহের মাধ্যমে এ ইউনিটগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। ইসরাইলের এসব আরব বাসিন্দারা ইসরাইলীদের সাথে মিলে মিশে শান্তিপূর্ণ ও নিরীহ জীবন যাপন করছে আর সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের সেই দিনটির জন্য অতন্দ্র চোখে অপেক্ষা করছে। সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির পূর্বে কোন অপারেশনে ইসরাইলের আরব বাসিন্দাদের ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমন কি ইসরাইলে কর্মরত সাইমুমের ১০ হাজার কর্মীর প্রতি এ নির্দেশ রয়েছে যে, বিপদ মুহূর্তেও তারা কোন আরব মুসলমানের সাহায্য কিংবা আশ্রয় প্রার্থনা করবে না। সংরক্ষিত এবং গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ইসরাইলের আরব মুসলমানদেরকে সকল সন্দেহের উর্ধ্বে রাখাই সাইমুম প্রধান আহমদ মুসার লক্ষ্য।

সেন্ট সলোমন রোড চলে গেছে সরল রেখার মত দক্ষিণ দিকে। সামনেই মোড় দেখা যাচ্ছে। আস্তানার দু’তলা গৃহটিও চোখে পড়ছে। আস্তানার দ্বিতলের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল মাহমুদ। আফজল পাশাকে তৎক্ষণাৎ গাড়ী থামতে ইংগিত করল সে। আস্তানার দ্বিতলের ঘরটিতে নীকষ বেগুনি রং এর আলো জ্বলছে। সাইমুমের কোড অনুসারে এই আলো বিপদের সংকেত। শেখ জামালের কিছু হয়েছে, নয়তো সে অস্বাভাবিক কিছু সন্দেহ করেছে।

মাহমুদ গাড়ী থেকে নেমে পাশের গলিতে আফজলকে অপেক্ষা করতে বলে ডান পাশের ফুটপাত ধরে এগোল। গাছের ছায়ায় ঈষৎ আলো আঁধারের সৃষ্টি করেছে। মাহমুদের কাছে এটা আর্শিবাদ হয়ে দেখা দিল। সেন্ট সলোমন রোড যেখানে পূর্বদিকে মোড় নিয়েছে, সেখান থেকে আর একটি লেন পশ্চিম দিকে চলে গেছে। গলিটির মুখে এক ধারে প্রকান্ড একটি গাছ। নিচে বেশ অন্ধকার। পাতার ফাঁক দিয়ে কোথাও কোথাও চাঁদের আলো নেমে এসেছে অন্ধকারের বুক চিরে। তারই একটি আলোক রেখায় একটি গাড়ীর উইন্ড শিন্ড মাহমুদের চোখে পড়ল। সে ভাল করে তাকিয়ে দেখতে গেল, অন্ধকারের মধ্যে একটি গাড়ী দাঁড় করানো রয়েছে মাহমুদ হামাগুড়ি দিয়ে গাড়ীর দিকে এগুলো। পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ বের করে নাম্বার প্লেটে দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল সে। এ যে ইসরাইলেল সিকুইরিটি ব্রাঞ্চ ‘সিনবেথ’ এর তেলআবিব শাখার প্রধান মিঃ চেচিনের গাড়ী। শিকারি বিড়ালের মতো ধীরে ধীরে মাহমুদ গাড়ীর সামনের দিকে এগুলো। গাড়ীতে কেউ নেই। ওরা কি তাহলে আস্তানার ভিতরে ঢুকেছে? পেন্সিলটর্চটি আর একবার জ্বেলে মাহমুদ গাড়ীটি পরীক্ষা করল। সামনের সীটের উপর সে নোট বুক পেল। তাড়াতাড়ি সে নোট বুকখানা পকেটে পুরে সরে এল গাড়ীর কাছ থেকে। তারপর কি মনে করে সে আবার ফিরে গেল গাড়ীর কাছে। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে বের করল ডিম্বাকৃতি একটি বস্তু – টাইম বম। ধীরে ধীরে সেফটিপিন খুলে নিয়ে তা রেখে দিল সামনের সীটের নীচে। তারপর সরে এল সেখান থেকে।

মাহমুদ আফজলের কাছে ফিরে এল। বলল, সিনবেথ এর লোক এসেছে। তাদের সংখ্যা এক থেকে চার এর বেশী হবে না। গোপনে আস্তানা পরীক্ষা করা ওদের লক্ষ হতে পারে। তা যাই হোক শেখ জামালের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি তারা। সে একাই যথেষ্ট হবে। শেখ জামালের কেশাগ্রও তারা স্পর্শ করতে পারবে না। সব চিহ্ন মুছে ফেলে সে একক্ষণে সরে পড়েছে।

উপর তলার ঘরে রাখা আলমারির মধ্যে দিয়ে নীচের তলায় ফলের দোকানে নামবার সিঁড়ি আছে। ফলের দোকানের বসবার বেদিটি একটি সুড়ঙ্গের মুখে রয়েছে। সে সুড়ঙ্গ দিয়ে আস্তানার গ্যারেজে পৌঁছা যায় এবং সেখান থেকে গাড়ী নিয়ে অথবা পিছনের দরজা দিয়ে যে কোন মুহূর্তে সরে পড়া সম্ভব। সুড়ঙ্গে নামবার পর বসবার বেদিটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। সুতরাং ‘সিনবেথ’ এর পক্ষে তা খুঁজে পাওয়া খুব সহজ হবে না।

গাড়ীতে উঠে বসতে বসতে মাহমুদ বলল, ‘সিনবেথ’ এর মিঃ চেচিন সাহেবের জন্য ফাঁদ পেতে রেখে গেলাম। খোদা করেন শিকার ধরা পড়বে। বলে আফজলের দিকে চেয়ে মাহমুদ বলল, এবার ঘরে ফিরে যাই চল। শেখ জামালকে হয়তো ওখানে পাব আমরা।

ইসরাইলের প্রতিটি শহরে ও উল্লেখযোগ্য স্থানে সাইমুমের একটি করে মূল ঘাঁটি রয়েছে। এখানে ‘ঘর’ বলতে মাহমুদ তেলআবিবের মূল ঘাঁটিকেই ইংগিত করেছে। ঘাঁটি ছাড়াও ঐ সমস্ত স্থানে রয়েছে কয়েকটি করে আস্তানা। এই আস্তানা গুলির ভূমিকা এ্যাকোমোডেশন ও তথ্য সরবরাহের মধ্যে সীমাবদ্ধ। গাড়ী সেন্ট সলোমন রোড ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে চলল। মাহমুদ গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত। ওসেয়ান কিং জাহাজের ঘটনা সিনবেথবে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত করে তুলেছে, কিন্তু মাহমুদ ভেবে পাচ্ছে না, সিনবেথ তাদের এ আস্তানার সন্ধান পেল কি করে?

তেলআবিবের শহরতলী এলাকা। তাই বলে ঘিঞ্জি বস্তি এলাকা নয়। অভিজাত আবাসিক এলাকা। পারিল্পনা করে সাজানো ইসরাইলের অনেক মাথাওয়ালা এবং বৈদেশিক মিশনের বাড়ীগুলি এ অঞ্চলেই। মাহমুদের গাড়ী এসে এক বিরাট অট্টালিকার সামনে দাঁড়াল। কাল পাথরে তৈরী বাড়ীর সামনে সাদা মার্বেল পাথরে খোদাই করা। বাড়ীটির নাম ‘গ্রীণলজ’। বাড়ীটির সামনে বিরাট একটি সাইন বোর্ড ‘দানিয়েল এন্ড কোং’। বাড়ীটিকে ঘন ছায়াদার নানা গাছ যেন চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। মাহমুদ স্থানটি পার হতেই ভিতরে নীল আলো জ্বলে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা।

গ্রীণলজের একটি ইতিহাস আছে। ফিলিস্তিন বিভক্ত হবার পূর্বে অর্থাৎ ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হবার আগে আহমদ শরিফ নামে একজন আরব মুসলমান এই গ্রীণলজের এবং সংলগ্ন বিস্কুট ফ্যাক্টরীর ছিল। ১৯৪৪ সালে উলম্যান নামে একজন ইহুদী তার অধীনে বিস্কুট ফ্যাক্টরীতে চাকরি নেয়। বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতার গুণে সে আহমদ শরিফের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয় এবং ফ্যাক্টরীর সহকারী কর্মাধ্যক্ষ পদে উন্নীত হয়। তারপর এল ১৯৪৮ সালের ঝড়ো দিনগুলো। ইহুদীরা ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করল এবং আরব মুসলমানদেরকে উচ্ছেদের অবাধ অধিকার লাভ করল সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে। বৃদ্ধ আহমদ শরিফ নিহত হলেন। তাঁর ছয় ছেলে এবং আত্মীয় স্বজন রাতের অন্ধকারে জর্দান উপত্যকার দিকে পালিয়ে গেল। কিন্তু আহমদ শরিফের নয় বছরের ছেলে মাহমুদ ছিল সেদিন রোগশয্যায় মুমূর্ষ অবস্থায়। উলম্যান বহু কষ্টে আহমদ শরিফের এই ছেলেটিকে স্বজাতির হিংস্র গ্রাস থেকে রক্ষা করে। ১৯৪৮ সালের পর উলম্যান গ্রীণলজ এবং সন্নিহিত ফ্যাক্টরীর মালিক হয়ে যায়। কিন্তু উলম্যান তার মৃত প্রভুর প্রতি বিশ্বসঘাতকতা করতে পারেননি। সে মাহমুদের ইহুদী নাম দেয় ‘দানিয়েল’ এবং তার নামেই ফ্যাক্টরীর নামকরণ হয় এবং বাড়ীটির মালিকানা সত্ত্বও তার নামেই লিখিত হয়। মাহমুদ সবার কাছে উলম্যানের পুত্র বলে পরিচিত হলেও প্রকৃত ইতিহাস মাহমুদ জানত। তাঁর পিতার রক্তাক্ত জামা-কাপড় এখনও তার বাক্সে সযত্নে রক্ষিত। মৃত্যু পর্যন্ত উলম্যান কখনও মাহমুদকে প্রভাবিত কিংবা তার জীবনকে কোন দিক থেকে নিয়ন্ত্রিত করতে চায়নি। মাহমুদ ছোটবেলায় ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কর্মী তোফায়েল বিন আবদুল্লাহর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে। কৈশোরে সে মুসলিম যুব আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। তারপর মজলুম মানুষের মুক্তি আন্দোলন সাইমুমে সে যোগদান করে। ‘দানিয়েল এন্ড কোং’ এর ভার এখন সে একজন ম্যানেজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে সংগঠনের কাজে ঘুরে বেড়ায়। সবাই ধারণা করে, ধনী ইহুদীর একমাত্র সন্তান এমন একটু ছন্নছাড়া হতে পারে বৈকি। মাহমুদের বাড়ীই এখন তেলআবিবস্থ সাইমুমের মূল ঘাঁটি। এখানে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন রেডিও রিসিভার ও ট্রান্সমিটার রয়েছে। বাড়ীর পিছনে উঁচু দেয়াল ঘেরা বাগানে রয়েছে তেল, আবিব ও সন্নিহিত অঞ্চলের অস্ত্রাগার। অবিবাহিত মাহমুদের বাড়ীতে রয়েছে ৮ জন মানুষ। এর মধ্যে তিনজন রেডিও ইঞ্জিনিয়ার, চারজন প্রহরী। এদেরই একজন বাজার ও রান্না বান্নার কাজ করে থাকে। এরা সকলেই সাইমুমের অভিজ্ঞ কর্মী।

রাত ১ টা মাহমুদ শোবার জন্য শয্যায় উঠে বসেছে। হঠাৎ তার খেয়াল হল মিঃ চেচিনের গাড়ী থেকে পাওয়া ডাইরীর কথা। উঠে গিয়ে পকেট থেকে ডাইরিটা নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসল। ডাইরীটা খুলতেই একটি ভাজ করা কাগজ বেরিয়ে এল। কাগজটি তুলে নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল। ফটোষ্ট্যাট করা একটি চিঠিঃ

প্রেরকঃ – চেয়ারম্যান, সংযুক্ত ফিলিস্তিন জনফ্রন্ট ও ফিলিস্তিন গণতন্ত্রী জনফ্রন্ট, আম্মান, জর্দান।

প্রাপকঃ পরিচালক, মোসাদ জেরুজালেম, ইসরাইল।

নিম্ন স্বাক্ষরকারী আপনার অবগতি ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংযুক্ত ফিলিস্তিন জনফ্রন্ট ও ফিলিস্তিন গণতন্ত্রী একবিংশ কংগ্রেসের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের অনুলিপি আপনার সমীপে পাঠাইতেছে।

সিদ্ধান্ত

১। যেহেতু সংযুক্ত ফিলিস্তিন জনফ্রন্ট ও ফিলিস্তিন গণতন্ত্রী জনফ্রন্ট কার্ল মার্কস নির্দেশিত সমাজবাদে বিশ্বাসী, সেইহেতু এই ফ্রন্ট ইসরাইল রাষ্ট্রের সাথে ধর্ম সাম্প্রদায়ভিত্তিক শত্রুতামূলক সকল আচরণ পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছে।

২। এই সংযুক্ত ফ্রন্ট জর্দান, সিরিয়া, ইরাক, মিসর প্রভৃতি দেশের প্রতিক্রিয়াশীল জনগোষ্ঠী ও সরকারকে প্রধান শত্রু বলিয়া মনে করে এবং এদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকেই এই ফ্রন্ট আশু কর্তব্য বলিয়া মনে করিতেছে।

৩। এই ফ্রন্ট তাদের সংগ্রামে ইসারাইল রাষ্ট্রের সাহায্য কামনা করিতেছে বিনিময়ে এই ফ্রন্ট প্রতিশ্রুতি দান করিতেছে যে, এই ফ্রন্ট ইসরাইল বিরোধী সরকার ও সাইমুমের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সবরকম তথ্য পরিবেশন করিবে।

৪। ইসরাইল সরকারের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য এই ফ্রন্টের প্রধান জর্জ বাহাশকে ক্ষমতা প্রধান করিতেছে।

জর্জ বাহাশ

চেয়ারম্যান

সংযুক্ত ফিলিস্তিন জনফ্রন্ট

ও ফিলিস্তিন গণতন্ত্রী জনফ্রন্ট

রুদ্ধ নিঃশ্বাসে চিঠি পড়া শেষ করল মাহমুদ। তার দেহের প্রতি অণু পরমাণুতে যেন এক প্রচন্ড লাভাস্রোত বয়ে গেল। লৌহ হৃদয়ও তার কেঁপে উঠল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল তার। কি নিদারুণ বিশ্বাসঘাতকতা! দেশ ও জাতির বুকে কি নিষ্ঠুর ছুরিকাঘাত। ও! ওরা ‘মার্কস এর অনুসারী অন্যজাত, ইহুদীদের পয়সার দালাল। চোখের কোণ ভিজে উঠতে চাইল মাহমুদের। জর্জ বাহাশদের সুপরিকল্পিত শয়তানীর কবলে পরে তাদেরই অসংখ্য ভাই তাহলে আত্মঘাতি পথে পা বাড়ালো?

সাইমুমের তেলআবিবস্থ ৩ নং আস্তানার পতন তাহলে ওদের এই বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতি? ওরাই তাহলে মোসাদের মাধ্যমে সিনবেথদের লেলিয়ে দিয়েছে। কথাটা মনে হতেই বিদ্যুৎ স্পর্শের মত চমকে উঠল মাহমুদ। তাহলে তেলআবিবের মতই সাইমুমের ৫০০ টি আস্তনা তো বিপদের সম্মুখীন? বিভিন্ন শহরে অবস্থিত সাইমুমের মূল ঘাঁটিগুলোর সন্ধান জনফ্রন্ট জানে না বটে, কিন্তু প্রতিটি শহরের ১ টি করে আস্তানার ঠিকানা ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার মধ্যে সম্পাদিত পারস্পরিক চুক্তি মোতবেক জনফ্রন্টকে জানান আছে। মাহমুদ তাড়াতাড়ি ডাইরীটা বন্ধ করে চিঠি হাতে করে ছুটলো রেডিও রুমের দিকে।

ব্যস্ত সমস্ত হয়ে মাহমুদকে ট্রান্সমিশন রুমে ঢুকতে দেখে রেডিও অপারেটর ইবনে রায়হান বলল, জরুরী কোন কিছু জনাব?

-হ্যাঁ। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে মাহমুদ বলল, সব ঠিক আছে তো?

-হ্যাঁ। উত্তর দিল রায়হান।

আর কোন কথা না বলে মাহমুদ নিজেই ট্রান্সমিশন যন্ত্রের পাশে বসে গেল। রায়হান পাশে সহযোগিতা করতে লাগল তার। ট্রান্সমিটারের কাঁটা ঘুরিয়ে সুইচ টিপে জেরুজালেমের মূল ঘাঁটির সাথে সংযোগ করল মাহমুদ।

-০০১। মারুফ আল কামাল?

-হাঁ, বলছি।

-জরুরী – জরুরী- জরুরী ‘আমাদের সহযোগী জ, ফ, প্রতিষ্ঠান আমাদের প্রতিযোগী কোম্পানীর সাথে হাত মিলিয়েছে। জ, ফ, কোম্পানীর সাথে সম্পর্কিত আমাদের খুচরা বিক্রির দোকানটি বন্ধ করে দিয়ে মালপত্র গোডাউনে ফেরত আনো।

-আচ্ছা আর কিছু?

-না, বলে মাহমুদ কট করে লাইন বন্ধ করে দিয়ে বিভিন্ন এ্যাংগেলে ট্রান্সমিটারের কাঁটা ঘুরিয়ে সুইচ টিপে ঐ একই ধরনের মেসেজে মাসাদা, খান ইউনুস, বীরশিন, হাইফা, আমাদোদ, ইম কাফে, শারম আল শেখ, ইলাত, গাজা, নাবলুস প্রভৃতি শহরের ঘাঁটিগুলোতে প্রেরন করল। তারপর পশ্চিম সিনাই এর রাফা, আল আরিস, কোয়ানতারা, মিতলা গিরিপথ, বীর লাহফান, ববেল লিবনি, আবু আখিলা পিতসানা, বীর গিফ গাফা প্রভৃতি মধ্য সিনাই এর খান জামিল, বীর আলনাফে, বীর আমন, বীর কাছেম, বীর সালেম প্রভৃতি, পূর্ব সিনাই ও সিনাই পর্বত মালার ওয়াদি গালাফা, আবু দোজানা, জেবেল উল ফজল, জেবেল কহর প্রভৃতি, জেরেুজালেম অঞ্চলের বীর আসির, তেলবায়ত, রামাত রাহেল, আলাতের উত্তর অঞ্চলীয় নেগিভের আউত, সিরটি, আলখারগা, আতসান জেজারিল ভ্যালির আল ফাসের, আর ওবেদি, হারার হুলেহ ভ্যালির আল-খাজাল, আল-আলামিন এবং গোলান হাইটের আল কুইনিত্রা ও আল বেনিয়াস ঘাঁটিতে সে মেসেজের প্রথম অংশ পাঠিয়ে দিল। জনবিরল এইসব অঞ্চলের ঘাঁটি কিংবা আস্তানার সন্ধান জনফ্রন্টকে জানানো হয় নাই, কারণ এসব অঞ্চলের কোন ঘাঁটি বা আস্তানার পতন ঘটলে নতুন করে তা প্রতিষ্ঠা করা এসব অঞ্চলে খুবই কঠিন।

ঘেমে উঠেছে মাহমুদ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে তার। রাত তখন সাড়ে তিনটা। ইসরাইলের সব ঘাঁটিতে সংবাদ পাঠান শেষ করে ট্রান্সমিটারের কাঁটা ঘুরিয়ে আম্মানস্থ হেড কোয়াটেরের সাথে সংযোগ করল মাহমুদ।

-১০০০?

-হাঁ কে আপনি?

-০১১, মাহমুদ! আপনি?

-আবদুল্লাহ আমিন।

মেসেজ রেকোর্ড করুন, বলে মাহমুদ মিঃ চেচিনের ডাইরীতে প্রাপ্ত সমস্ত চিঠিটা সাইমুমের বিশেষ কোডে পাঠিয়ে দিল।

কপালের ঘাম মুছে মাহমুদ উঠে দাঁড়াল। রায়হানের দিকে চেয়ে হেসে বলল মাহমুদ বিস্মিত হয়েছো রায়হান? ভুলে যাচ্ছে কেন, আবদুল্লাহ বিন ওবাই এর জন্মতো যুগে যুগে হবে। বলে মাহমুদ বের হয়ে এল ট্রান্সমিশন রুম থেকে।

তখন রাত ৩টা ৪৫ মিঃ। মাহমুদ তার ঘরে ফিরে গিয়ে টেবিলে বসল, মিঃ চেচিনের ডাইরীটা আবার মেলে ধরল চোখের সমনে। গভীর রাতের নিঝুম প্রহর। মাহমুদ হাত ঘড়ি থেকে ক্ষীণ কম্পন জাগছে বাতাসে -টিক, টিক, টিক -বয়ে চলেছে সময়।