৮. সিংকিয়াং থেকে ককেশাস

চ্যাপ্টার

উংফু এভেনিউ-এর দিকে আবার ছুটে চলেছে আহমদ মুসার জীপ।
ড্রাইভিং সিটে এবার হাসান তারিক। তার পাশের সিটে আহমদ মুসা পেছনের সিটে প্রথমে মা-চু, তারপর আহমদ ইয়াং, সবশেষে মেয়েটা, নেইজেন।
‘নেইজেন’- এর পরিচয় ওরা জেনে নিয়েছে। গভর্নর লিউয়ানের মেয়ে। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-বিজ্ঞানের শেষ বর্ষের ছাত্রী নেইজেন। উংফু এভেনিউ-এর ‘শেনচিং’ শপিং সেন্টারে ঢোকার পথে তাকে কিডন্যাপ করেছে।
নেইজেন-এর পরিচয় পেয়ে আহমদ মুসা খুশি। নেইজেনের প্রপিতামহ যে কাজাখ ছিল সে কথাও আহমদ মুসারা জেনে নিয়েছেন নেইজেনের কাছ থেকে। জেনে আহমদ মুসা খুশি হয়েছেন। আবার ব্যাথা পেয়েছেন এই ভেবে যে এই ভাবে মুসলিম পরিবারের কত সন্তান যে মুসলমান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেও অবস্থার কারণে মুসলিম সমাজ থেকে ছিটকে পড়ে গেছে।
আহমদ মুসার জীপ চ্যাংচিং রোড থেকে বেরিয়ে উত্তর দিকের আরেকটা রোড ধরে লিউ শাও চি স্কোয়ারের দিকে ছুটে চলেছে।
সবাই নীরব। একক্ষণ নেইজেন একটানা প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেছে আহমদ মুসার।
সামনে চোখ মেলে সিটে হেলান দিয়ে বসে ছিল নেইজেন। তার মনেও নানা প্রশ্ন। এরা কারা? কেন তাকে উদ্ধান করতে ছুটে গিয়েছিল? লোকগুলো সবাই যে মুসলমান তা সে নাম থেকেই বুঝেছে। এ কারণেই তার প্রপিতামহও যে কাজাখ মুসলমান ছিল তা জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ঐ প্রশ্ন তার মনে খচ খচ করে বিঁধছে। নেইজেন পাশের আহমদ ইয়াং- এর দিকে তাকাল। তার চোখ দুটি সোজা। বুঝাই যাচেছ গাড়ির ঝাঁকুনিতে একটু তন্দ্রার ভাব এসেছে তার চোখে। তন্দ্রাচ্ছাদিত আলো আাঁধারে ঘেরা আহমদ ইয়াং- এর মুখের দিকে চেয়ে নেইজেনের মনে হল পবিত্র সুন্দর এক যুবক। কিছুক্ষণ আগের সবগুলো কথা তার এক এক করে মনে পড়ল। কিন্তু এই যুবকটির আচরণ, কথা এবং চোখের দৃষ্টিতে বাড়তি কোন আগ্রহ তার নজরে পড়েনি। গাড়িতে বসে একটি কথাও সে বলেনি, তাকায়নি সে একবারও নেইজেনের দিকে। মুসলিম নৈতিকতার কথা নেইজেন ইতিহাসে পড়েছে, চোখে দেখেনি। আজ যেন সশরীরে তা দেখছে।
এই সময় জীপ একটি টার্ণ নিতে গিয়ে বড় একটা ঝাঁকুনি খেল।
চোখ খুলল আহমদ ইয়াং। একটু নড়ে চড়ে বসল, দৃষ্টি তার নিচের দিকে।
আপনার বোধ হয় ঘুম পাচ্ছে? বলল নেইজেন।
না ঠিক তা নয়। কিভাবে যেন চোখটা একটু ধরে এসেছিলো। চোখ নিচু রেখেই জবাব দিলো আহমদ ইয়াং। আবার নীরবতা। নীরবতা ভেঙে নেইজেনই আবার প্রশ্ন করলো, আমার নাম জানলেন কি করে?
আপনার আইডেনটিটি কার্ড থেকে।
বলে আহমদ ইয়াং পকেট থেকে নেইজেন – এর কার্ড এবং মা-চুর কাছ থেকে সেই ব্যাগটা নিয়ে নেইজেনকে দিয়ে দিল। বলল, ব্যাগটা ওদের গাড়ী থেকে আমরা পেয়েছিলাম।
কেন, কিভাবে আপনারা আমাকে উদ্ধার করতে গেলেন ?
আমরা একটা গাড়ী থেকে ‘বাঁচাও’ চিৎকার শুনতে পাই। সংগে সংগে আহমদ মুসা ভাই এর নির্দেশে আমাদের গাড়ি ঐ গাড়িটিকে ফলো করে।
একটা ছোট্ট ‘বাঁচাও’ চিৎকার শুনেই আপনারা এতটুকু করলেন ?
আহমদ মুসা ভাই তখন বলেছিলেন এই ‘বাঁচাও’ চিৎকার ছোট কিন্তু এর আবেদন ছোট নয়। আর আল্লাহর মজলুম বান্দাদের পাশে দাঁড়ানোই তো মুসলমানদের কাজ।
সে যদি অমুসলমান হয় ?
‘মজলুম’ -এর একটাই পরিচয় সে মজলুম। আর আল্লাহর মনোনীত শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে মুসলমানরা সকল জুলুমের বিরুদ্ধে, সকল মজলুমের পক্ষে।
‘নেইজেন’-এর চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, আমিও অনেক মুসলমান দেখেছি, সবাইকে তো এমন দেখিনি?
অবস্থা, পরিবেশ, অজ্ঞতা মুসলমানদের তাদের স্থান থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
আপনারা কারা? কি পরিচয় আপনাদের?
এ প্রশ্ন আপনি মুসা ভাইকে করবেন। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, আমরা মুসলমানদেরকে তাদের বর্তমান অবস্থা ও অজ্ঞতা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছি।
গভর্নর লিইউয়ানের মেয়ে নেইজেন বুদ্বিমতি, সচেতন। আহমদ ইয়াং-এর কথায় তার দৃষ্টিটা মুহূর্তের জন্যে তীক্ষ্ম হয়ে উঠল। সে এটুকু বুঝল, এরা সাধারণের মধ্যে অসাধারণ।
একটুক্ষণ নীরব থেকে নেইজেন বলল, আমাকে আপনি প্রথম ‘তুমি’ বলেছেন, এখন ‘আপনি’ বলছেন কেন?
সেই অবস্থায় ভুল হতে পারে।
না ভুল নয় সেটাই ঠিক ছিল। আমাকে ‘তুমিই’ বলবেন। আহমদ মুসা সাহেব আমাকে বোন…………..
‘নেইজেন’- এর কথা শেষ হলো না একটা কড়া ব্রেক কষে জীপ দাঁড়িয়ে পড়ল পুলিশের সিগন্যাল পেয়ে।
লিও শাও চি স্কোয়ারে গাড়ি এসে পড়েছে। স্কোয়ারের প্রতিটি রোডের মুখে একেকটি করে পুলিশের গাড়ি। যাতায়াতকারী প্রতিটি গাড়ী তারা সার্চ করছে, জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
আহমদ মুসা বুঝলেন, নেইজেন-এর সন্ধানেই পুলিশের এই তৎপরতা। সম্ভবত গোটা শহরের প্রতিটি মোড় ও গলিমুখেই পুলিশ এই প্রহরা বসিয়েছে।
হাসান তারিক, ওরা বোধ হয় নেইজেনকেই খুঁজছে। বললেন আহমদ মুসা।
পুলিশকে পেয়ে আহমদ মুসা খুশিই হলেন। নেইজেনকে কোন দায়িত্বশীল পুলিশের হাওলায় দিয়ে তারা তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারবেন। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত আট টা বাজে। সময় যদিও অনেক নষ্ট হয়েছে। তবু ফুল স্পীডে গেলে পৌনে নটার মধ্যে তারা আল-খলিল উপত্যকায় পৌছতে পারবেন। আহমদ মুসা চিন্তা করলেন। পুলিশ গাড়ি সার্চ করলে অসুবিধা সুতরাং ওদেরকে সার্চ করার সুযোগ দয়া যাবে না।
আহমদ মুসা জানালা দিয়ে হাত বের করে ইশারায় একজন পুলিশ অফিসারকে ডাকলেন। পুলিশ অফিসারটি এলে আহমদ মুসা বললেন, আপনারা কি গভর্নর লি ইউয়ানের মেয়ে ‘নেইজেন’কে খোঁজ করছেন?
হ্যাঁ, কেন?
আহমদ মুসার হাসি মাখা মুখের দিকে চেয়ে উদগ্র্রীব কন্ঠে বলল পুলিশ অফিসারটি।
অপহরণকারীদের হাত থেকে আমরা তাকে উদ্ধার করেছি।
কোথায় সে, কোনখানে? বলে পুলিশ অফিসারটি উত্তরের অপেক্ষা না করে দুই হাত তুলে তার বস অফিসারকে ডাকল। এ অফিসারের ব্যস্ত ডাকার ঢং দেখে বস অফিসারটিও ছুটে এল। ডি এস পি ইনসিগনিয়া তার কলার ব্যান্ডে। সে থামতেই এ পুলিশ অফিসারটি আহমদ মুসাকে দেখিয়ে বললেন, ইনি বলছেন ‘নেইজেন’কে এঁরা উদ্ধার করেছেন অপহরণকারীদের হাত থেকে।
ডি এস পি কিছু বলার আগে আহমদ মুসা বললেন, হ্যাঁ আমরা নেইজেনকে উদ্ধার করেছি। সে আমাদের গাড়িতে আছে।
ডি এস পি বিস্ফোরিত চোখে গাড়ির ভেতরে উঁকি দিল। নেইজেনকে দেখতে পেয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে একটা স্যালুট ঠুকে সোজা হয়ে দাঁড়াল পুলিশ অফিসার। তাঁর কাঁধে ঝুলে থাকা বাঁশীতে একটা হুইসেল বাজালো।
সংগে সংগে সমস্ত পুলিশ, পুলিশের গাড়ি ছুটে এল এদিকে। তারা আহমদ মুসার জীপটিকে ঘিরে দাঁড়াল। তাদের চোখ-মুখ ও ব্যস্ততা দেখে মনে হচ্ছে, অপহরণকারীদের তারা ধরে ফেলেছে।
আপনারা নেইজেন এর দায়িত্ব নিয়ে নিন, আমাদের এক্ষুনি যেতে হবে। পুলিশ অফিসার ডি এস পি কে উদ্দেশ্য করে বললেন আহমদ মুসা। নেইজেনকে আমরা তুলে নিচ্ছি, কিন্তু হেড কোয়ার্টার্সের নির্দেশ না পেলে আমরা আপনাদের ছাড়তে পারি না।
বলে পুলিশ আফিসারটি অয়্যারলেসে যোগাযোগ করল হেডকোয়ার্টার্সের সাথে। বলল সব কথা। আলাপ শেষ করে অয়্যারলেসটা মুখের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে বলল, আপনাদের হেডকোয়ার্টার্সে যেতে হবে। যা করার উনারাই করবেন।
বলেই পুলিশ অফিসারটি আর কোন কথা শোনার অপেক্ষা না করে গাড়ির সামনের দিকটা ঘুরে নেইজেন- এর দিকে গেল।
পুলিশ অফিসারের কথা শুনে চোখটা মুহূর্তের জন্যে জ্বলে উঠেছিল আহমদ মুসার। চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর। সেদিকে তাকিয়ে হাসান তারিক বলল, মুসা ভাই, নির্দেশ দিন। গাড়ি চালিয়ে দিই। ওরা আটকাতে পারবেনা আমাদের।
ততক্ষণে শান্ত হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসা। বললেন, ওরা বোধ আমাদের সন্দেহ করছে কিছুটা বাজিয়ে দেখতে চায় সম্ভবত। কি আছে, দেখি আল্লাহ আমাদের কোথায়………..
আহমদ মুসাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই নেইজেন বলল, না জনাব এটা হতে দেবনা। আমি সব জানি আমি বলছি ওদের।
বলে নেইজেন তার পাশে এসে দাড়ানো ডিএসপিকে বলল, এরা আমাকে উদ্ধার করেছেন। এদের কি আপনারা সন্দেহ করছেন?
সন্দেহ নয়, হেড কোয়ার্টার্সের নির্দেশ যা তাই করছি।
তাহলে হেড কোয়ার্টার্সে নয়, গভর্নর ভবনে নিয়ে চলুন।
ম্যাডাম, তাহলে খবরটা আমি হেড কোয়ার্টার্সে জানিয়ে দেই।
ডি এস পি অয়্যারলেসে হেড কোয়ার্টার্সের সাথে কথা বলল। কথা শেষ করে বলল, ঠিক আছে ম্যাডাম, আমরা গভর্নর ভবনেই যাচ্ছি। আপনি আমাদের গাড়িতে উঠুন।
বলে সে গাড়ির দরজা খুলে নেমে আসার অনুরোধ করল নেইজেনকে।
না, আমি এ গাড়িতেই যাব। বলে সে টেনে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিল। ডি এস পি মুখটা লাল করে গিয়ে তার গাড়িতে উঠল।
নেইজেন ও গাড়িতে গেলেই পারতে। বেচারার মুখের ওপর এভাবে দরজা বন্ধ করা ঠিক হয়নি। নরম কন্ঠে বললেন আহমদ মুসা।
সে আপনাকে অপমান করেছে।
না, জেন, তার দোষ নেই। ও তার দায়িত্ব পালন করেছে।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। মাঝখানে জীপ। তাকে ঘিরে পুলিশের গাড়ি সার বেঁধে এগিয়ে চলছে। আহমদ মুসা হাসলেন। বললেন , বেচারাদের ভীষণ সতর্কতা।
এ সতর্কতা কাজের বেলায় নেই, অকাজে। বলল নেইজেন। তার কথায় এখনও ক্ষোভ।
কিছুক্ষণ নীরবতা ভাঙল নেইজেন। আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলল, জনাব, আপনাদের কি পরিচয় আব্বাকে দেব?
পরিচয় দিয়ে আর কি করবে, পারলে তোমার আব্বার সাথে আমাদের দেখা করিয়ে দাও সত্ত্বর। রাত নটার মধ্যে আমাদের একশ মাইল দূরে এক জায়গায় পৌছতে হবে। বেশ দেরি করে ফেলেছি আমরা।
কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকল নেইজেন। তারপর বলল, নিশ্চয়ই আব্বার সাথে দেখা করিয়ে দেব।
একটু ঢোক গিলল নেইজেন। তাই বলে পরিচয় জানতে পারবনা? আপনারা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন।
শেষের কথাগুলো নেইজেনের ভারী হয়ে উঠল।
দু:খ পেলে বোন? আসলে অনেক পরিচয় আছে যা দুএক কথায় বুঝানো যায় না।
কিন্তু আমি এক কথায় আপনাদের পরিচয় বলতে পারি।
বল তো?
আপনারা মুসলমানদের একটা আদর্শ বিপ্লবী দল। নাম জানি না।
কি করে বুঝলে?
একদিকে মুসলমানদেরকে বর্তমান অবস্থা ও অজ্ঞতা থেকে আপনারা মুক্ত করতে চান, অন্যদিকে স্রষ্টার সৃষ্টি হিসেবে সব মানুষকে আপনারা ভালবাসেন। যার জন্যে একজন অসহায় নারীকে বাঁচানোর জন্যে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ছুটে গিয়েছিলেন। সবশেষে মুখোমুখি লড়াইয়ে যে অপুর্ব দক্ষতা আপনাদের আমি দেখেছি। সব মিলিয়েই আমি ওটা বলেছি।
তুমি কেমন করে জানলে মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা ও অজ্ঞতা থেকে আমরা তাদের মুক্ত করতে চাচ্ছি?
আহমদ ইয়াং বলেছে আমাকে। একটু দ্বিধা করে বলল নেইজেন।
আমাদের পরিচয়্টা তাকে জিজ্ঞেস করনি? হাসিমুখে বলল আহমদ মুসা।
জিজ্ঞেস করেছি। উনি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে বলেছেন।
আহমদ ইয়াং এর মুখটা লাল হয়ে উঠছিল। বিব্রত বোধ করছিল সে। মুহূর্ত কয়েক নিরব রইলেন আহমদ মুসা। তারপর বললেন, তুমি খুব চালাক নেইজেন। তুমি সাইমুমের নাম শুনেছ?
কোন সাইমুম? মুসলিম মধ্য এশিয়ার সাইমুম?
হ্যাঁ।
তারা সেখানে ও ফিলিস্তিনে যে ইতিহাস সৃষ্টি করল যার আলোচনা পত্রপত্রিকায় এখনো হচ্ছে তার নাম জানবনা?
আমরা সেই সাইমুমের লোক।
আপনারা সাইমুমের লোক? আপনি আহমদ মুসা কি সেই আহমদ মুসা? বিষ্ময়ে বিস্ফোরিত হয়ে গেল নেইজেনের চোখ।
কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলনা নেইজেন। তারপর বলল, আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করি?
কর।
সিংকিয়াং-এর ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর সাথে আপনাদের সম্পর্ক আছে?
তুমি কি মনে কর?
সাইমুম সিংকিয়াং-এ এসেছে আর ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর সাথে তার সম্পর্ক থাকবেনা তা হয়না।
তাহলে আছে মনে কর। আহমদ মুসার মুখে হাসি। নেইজেন আবার কিছুক্ষণ কথা বললনা। তার বিষ্ময়ের ঘোর কাটেনি। সে বিশ্বাস করতে পারছেনা, পৃথিবীব্যাপী বহুল আলোচিত সাইমুম এর সাথে সে বসে আছে এবং কিংবদন্তির নায়ক আহমদ মুসা তার সামনে। তার মনের কোন গভীরে যেন কোন একটা অপরিচিত আনন্দ মাথা তুলছে। তার প্রপিতামহ যে কাযাখ ছিল, মুসলমান ছিল, সেজন্য মনটা যেন গর্ব করতে চাইছে। আনন্দ অছে এই ভেবে যে, তার দেহেও মুসলিম রক্ত আছে। পাশে আহমদ ইয়াং মূর্তির মত বসে আছে। সে মা-চুর গায়ের সাথে সেঁটে আছে। নেইজেনের কোন স্পর্শ যেন না লাগে এ জন্যে সব সময় নিজেকে আড়ষ্ট করে রেখেছে। সে একবারও ফিরে তাকায়নি। কথা বলার সময়ও না। হাসি পাচ্ছিল নেইজেনের তার অবস্থায়। তার মনে পড়ল সাইমুম এর বিপ্লবী ও আদর্শ চরিত্রের এটাও একটা দিক।
আহমদ মুসা আরবী ভাষায় হাসান তারিকের সাথে কথা বলছিলেন। তিনি একবার থামলে সেই ফাঁকে নেইজেন বলল, আপনাদের পরিচয় সম্পর্কে যা শুনলাম আব্বাকে তার কিছুই জানাবনা।
জানি আমি।
কেমন করে জানেন?
অনেক সময় মনে এমন সব কথা উদয় হয়, কিন্তু কেমন করে হল তা জানা যায়না।
ঠিক বলেছেন।
গাড়ির গতি ধীর হয়ে গেল। নেইজেন সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, এসে গেছি আমরা।
সামনে ঐ যে লন, তারপরে ঐ তো গভর্ণর ভবনের গেট।
গেটের কয়েক গজ সামনের জীপ দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে একদল পুলিশ অফিসার এসে জীপ ঘিরে দাঁড়াল। একজন অফিসার এসে জীপের দরজা খুলে ধরে একটা স্যালুট ঠুকে নেইজেনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ম্যাডাম, নেমে আসুন।
নেইজেন তার ডান পাটা নিচে নামিয়ে দিল। মুখটা আহমদ মুসার দিকে ফিরিয়ে বলল, জনাব আমি আব্বার সাথে দেখা করে আসছি। আপনারা গাড়িতেই বসুন।
গাড়ি থেকে নেমে দরজা বন্ধ করে সামনেই পেল সিংকিয়াং-এর পুলিশ প্রধান চ্যাং ইউকে। নেইজেন নামতেই চ্যাং ইউ শশব্যস্তে বলল, কেমন আছ মা? ব্যন্ডেজের দিকে তাকিয়ে বলল আঘাতটা কিসের? বড় নয়তো?
না চাচাজান, আমি ভাল আছি। এঁরা ভাল করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন।
একটু থেমে আবার বলল, আব্বার সাথে দেখা করে না ফেরা পর্যন্ত এঁরা এ গাড়ীতেই থাকবেন। বলে গেটের দিকে এগুলো নেইজেন। তার পেছনে কয়েকজন পুলিশ অফিসার।
গেটের দুপাশে সৈনিকরা উদ্ধত স্টেনগান হাতে পাহারায়। গেটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গভর্ণর লি ইউয়ান ও তার স্ত্রী ইউজিনা।
নেইজেনের মা খাস হান মেয়ে। উরুমচি আর্টস কলেজের সে ইতিহাসের অধ্যাপিকা।
নেইজেন গেটে পৌঁছুতেই বাপ-মা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল নেইজেনকে। ফুপিয়ে কেঁদে উঠল মা ইউজিনা।
নেইজেনের ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতের দিকে আগেই নজর পড়েছিল লি ইউয়ানের। সে মেয়েকে মায়ের হাওলা করে পাশে দাঁড়ানো মিলিটারী সেক্রটারীকে বলল, ওয়াং, গাড়ী বের করতে বল। মাকে এখনই হাসপাতালে নিতে হবে।
মাকে ছেড়ে নেইজেন পিতার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল। ব্যস্ত হবেন না। ওটা সিরিয়াস কিছু নয়।
একটু থেমে একটা ঢোক গিলে সে আবার বলল, আব্বা যারা আমাকে অপহরণকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন তারা আপনার সাথে দেখা করতে চান এখনি। আপনি অনুগ্রহ করে সময় দিন।
গভর্ণর লি ইউয়ান একটু থমকে দাঁড়াল। চিন্তা করল। পরে বলল, তা অবশ্যি উচিত কিন্তু এখনি?
হাঁ, আব্বা ওরা অনেক দূর যাবেন।
তুমি পরিচয় জেনেছ তাদের?
পরিচয়ের কি প্রয়োজন। আপনি তাদের ধন্যবাদ জানাবেন।
তা তো অবশ্যই, ঠিক আছে।
মিলিটারী সেক্রেটারীর দিকে ঘুরে লি ইউয়ান বলল, আমি অফিসে বসছি, তুমি ওদের নিয়ে এস।
স্যার এত রাত্রে এই অবস্থায় সবকিছু না জেনে কয়েকজন অপরিচিতের সাথে দেখা করাটা . . . . . আপত্তি জানাতে চেষ্টা করল ওয়াং।
ওরা আমার মেয়েকে বাঁচিয়েছে, তাদেরকে ধন্যবাদ জানানো আমার দায়িত্ব। তুমি যাও।
আব্বা আমিও যাচ্ছি। বলল নেইজেন।
না জেন ওরাই নিয়ে আসবে। তুমি চল আমার সাথে, তুমি ক্লান্ত, আহত তুমি।
বলে মেয়ের হাত ধরে হাঁটা শুরু করল লি ইউয়ান গভর্ণর ভবনে তার প্রাইভেট অফিসের দিকে।

গভর্ণর লি ইউয়ানের বাস ভবনে তার প্রাইভেট অফিস। বাইরে অফিসটা প্রায় ঘিরে রেখেছে সৈনিকরা। অফিসের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মিলিটারী সেক্রেটারী। দরজা বন্ধ।
আহমদ মুসা কথা বলছিলেন লি ইউয়ানের সাথে। তার পাশের সোফায় আহমদ ইয়াং। আহমদ মুসা হাসান তারিকের আরব চেহারা এবং অন্যান্য দিক চিন্তা করে হাসান তারিক এবং মা-চু কে গাড়ীতে রেখে এসেছেন।
পিতার পাশেই সোফায় বসেছিল নেইজেন। সোডিয়াম লাইটের সুন্দর আলোতে নেইজেনকে অপরূপ এক কাজাখ মেয়ে মনে হচ্ছে। তার দেহে চীনা কোন চিহ্নই নেই।
চোখ নিচু করে বসেছিল আহমদ ইয়াং। দেখে মনে হচ্ছে অতি শান্ত, ভদ্র যুবক। শিশুর সারল্য তার চোখে মুখে। নেইজেন-এর বিষ্ময়ভরা মুগ্ধ দৃষ্টি বার বারই ওর দিকে ছুটে যাচ্ছিল।
তখন কথা বলছিল গভর্ণর লি ইউয়ান। বলছিল, অশেষ ঋণে বেঁধে ফেলেছেন আপনারা আমাকে। আমি আপনাদের জন্য কি করতে পারি বলুন? জেনের কাছ থেকে শুনলাম, নটার মধ্যেই নাকি একশ মাইল দূরে কোথাও আপনাদের পৌঁছতে হবে?
জি হ্যাঁ। খুবই জরুরী।
কিন্তু এখনতো সাড়ে আটটা। জীপ নিয়ে কি পৌঁছতে পারবেন?
আমরা চেষ্টা করব।
গভর্ণর লি ইউয়ান কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল। একবার সে চোরা দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে চাইল। তার চোখ দুটো কেমন যেন উজ্জ্বল, সেখানে যেন অনেক কথা।
আমি আপনাদের জন্য একটা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে পারি। কিন্তু জানতে পারি কি সেখানে কি ধরনের প্রয়োজন আপনাদের? লি ইউয়ানের ঠোঁটে যেন একটা হাসির রেখা। আহমদ মুসা পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে লি ইউয়ানের দিকে তাকালেন। তার চোখে চোখ রাখলেন কয়েক মুহূর্ত। তাঁরও চোখে যেন একটা নতুন চিন্তা।
যা বলতে চান বলুন। চোখে চোখ রেখেই বলল লি ইউয়ান।
জি বলতে চাই।
অনেকটা স্বগত ধরনের এই কথাটা। আহমদ মুসার হৃদয়ের কোন গভীর থেকে যেন বেরিয়ে এল। একটা আবেগ, একটা ভাবালুতা এসে তাঁর চেহারাটাকেই যেন পালটে দিয়েছে। তিনি যেন একটা অন্য মানুষ। নেইজেনের দৃষ্টি এড়ায়নি। বিষ্ময় দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু লি ইউয়ানের কোন ভাবান্তর নেই। তার ঠোটে তখনও সেই হাসি।
মুখ খুললেন আহমদ মুসা। বললেন, শানসি এলাকার হান সর্দার ওয়াং হুয়া শিহেজী উপত্যকার মুসলিম স্বার্থ গলাটিপে মারার জন্যে দশ হাজার নতুন বসতি নিয়ে ছুটে আসছে। ভোরের মধ্যেই ওরা গিয়ে শিহেজীর নতুন কলোনীতে জেঁকে বসতে চায়। আমরা ওদের বাধা দেব।
আপনার এই চার জন?
চেষ্টা করব।
কেন ওদের বাধা দিতে চান, সরকার তো ওদের অনুমতি দিয়েছে?
এ অন্যায় অনুমতি।
কেমন করে?
মুসলমানদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করে হানদের সেখানে আনা হচ্ছে।
আপনাদের এটা কি অসম্ভব মিশন নয়?
আমরা সফল হব কিনা জানি না, কিন্তু দুনিয়াতে অসম্ভব কিছু নেই। যিনি সব কিছুর স্রষ্টা, সেই আল্লাহর কাছে সব কিছুই সম্ভব। আমরা তাঁরই সাহায্য প্রার্থী।
আপনারা ওয়াংকে কি আল-খলিলে গিয়ে বাধা দিতে চান?
জি।
বাধা দিতে চান, মানে তাকে ওখানে আটকে দেবেন এই তো! আর ওদিকে উদ্বাস্তু মুসলমানরা যারা এসে শিহেজীতে জমা হয়েছে তারা গিয়ে সেই কলোনী দখল করবে এই তো?
আহমদ মুসা বিস্ময় বোধ করলেন বললেন, আপনি তো সব কিছুই জানেন, জানার কথা।
কয়েক মুহূর্ত কথা বলল না লি ইউয়ান। তার ঠোঁটে সেই হাসি।
আপনাদের একটু সুখবর দিই?
বলুন। আগ্রহের সাথে বললেন আহমদ মুসা। তার চোখে কি যেন একটা আলো।
আমি আজ বিকেলেই ওয়াংকে শিহেজীর পথ থেকে ফিরিয়ে দিয়েছি। কেন্দ্রীয় সরকারকে ব্যাপারটা আমি জানিয়েছিলাম। পিকিঙ আজই নির্দেশ পাঠিয়েছে হানদের যেন শিহেজীতে আর না বসানো হয়। নতুন কলোনীয় মুসলমানরাই পাবে।
আহমদ মুসার চোখ দুটি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে তিনি বললেন, জনাব কি যে খুশি হয়েছি আমি বুঝাতে পারবো না। মনে হয় এত বড় উপকার আমি জীবনে পাইনি।
আরেকটা খুশির খবর আছে মহান যুবক। হাসি মুখে বলল লি ইউয়ান।
আহমদ মুসা শুধু মুখ তুলে চাইলেন। কিছু বললেন না। লি ইউয়ানই আবার মুখ খুলল। বলল, সেই সাথে পিকিং সরকার নির্দেশ দিয়েছে, সিংকিয়াং-এর কোন এলাকাতেই হানদের এনে বসানো হবে না আর আগের মত। এ অঞ্চলের মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা ও দাবী পূরণের জন্যেই এই ব্যবস্থা।
আমি জানি, পিকিং-এর নতুন সরকার অনেক উদার অনেক বাস্তববাদী হয়েছে। কিন্তু তারা এতটা এগুবে তা আমি ধারণা করিনি। বিস্ময়ের সাথে বললেন আহমদ মুসা।
সৌদি আরব সরকারের সাথে পিকিং-এর সম্পর্ক-উন্নয়ন এবং মক্কা ভিত্তিক রাবেতায়ে আলম আল-ইসলামীর চেষ্টা গভর্নমেন্টকে এই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে। সম্ভবত আরও অনেক পরিবর্তন আসছে।
কিন্তু এসব কি স্থায়ী হবে মনে করেন? সরকারের যদি পরিবর্তন আসে?
তা আসতে পারে। কিন্তু বাস্তবতাকে কে অস্বীকার করবে?
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই লি ইউয়ান পুনরায় কথা বলে উঠল, ইয়াংম্যান, এবার আপনার পরিচয়টা বলুন।
লি ইউয়ানের মুখে সেই হাসি।
আমার পরিচয় আমি মুসলিম সমাজের একজন কর্মী।
আমি বলি পরিচয়?
আহমদ মুসা একবার সন্ধানী চোখ তুলে তাকালেন লি ইউয়ানের দিকে, তারপর নেইজেনের দিকেও । বললেন, বলুন।
লি ইউয়ান সোফা থেকে উঠে তার টেবিলের পেছনের ছোট্ট ফাইল ক্যাবিনেটটার সামনে দাঁড়াল। ফাইল ক্যাবিনেট খুলে একটা ফাইল বের করে ফিরে এল। ফাইল খুলে এগিয়ে দিল আহমদ মুসার সামনে।
আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে দেখলেন তার একটা ফটো, তার সাথে তার একটা পূর্ণ বায়োডাটা। সেই সাথে রয়েছে ফিলিস্তিন, মিন্দানাও ও মধ্য এশিয়ায় তার তৎপরতার পূর্ণ বিবরণ।
বিস্ময়ের বশে নেইজেনও আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেও দেখছে।
ফাইল বন্ধ করে মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে রইলেন আহমদ মুসা।
ইয়াংম্যান, আপনাকে অভিনন্দন। আপনাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছি।
আহমদ মুসা তখনও নীরব। সম্ভবত ঘটনার আকস্মিকতা থেকে তখনো তিনি মুক্ত হননি।
লি ইউয়ানই আবার কথা বলল। বলল, আমি খুশি হয়েছি আহমদ মুসা। বলতে পারেন আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। আমি কোনদিনই ভাবিনি এভাবে আপনার মুখোমুখি হব।
একটু থেমেই সে আবার শুরু করল, সবচেয়ে আনন্দ লাগছে ‘ফ্র’ ও ‘রেড ড্রাগন’দের হাত থেকে আমার মাকে উদ্ধার করার জন্যে আল্লাহ আপনাকেই পাঠিয়েছেন।
লি ইউয়ানের শেষের কথাগুলো যেন একটু ভারী শোনাল।
আল্লাহকে আপনি এখনও মনে রেখেছেন জনাব?
তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিলনা লি ইউয়ান। শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। পরে ধীরে ধীরে বলর, আমার সব কথাই আপনি জানবেন এটাই স্বাভাবিক।
আবার মুহূর্তের জন্যে থামল সে। শুরু করল আবার ধীরে ধীরে, আমার দাদার কুরআন শরীফ আর জায়নামায আমি সযত্নে রেখেছি। মনে করি ওগুলো আমার পরিচয়ের প্রতীক। মুসলমান সমাজের সাথেও আমার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়েছে আমার অজ্ঞাতে রক্তের সাথেই যেন আল্লাহ নামটা মিশে আছে। আমি সরকারী কাজে একবার তুরস্ক গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম নীল গম্বুজ মসজিদ দেখতে। সেদিন ছিল শুক্রবার। জামায়াতে নামাজ হচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখ পানিতে ভরে গিয়েছিল। অতীতটা আমার সামনে এসে গিয়েছিল। মনে পড়ে গিয়েছিল দাদাকে। মনে হয়েছিল আমি যেন আমার পরিচয়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছি।
থামল লি ইউয়ান। এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল নেইজেন পিতার দিকে। পিতাকে যেন সে নতুন করে দেখছে। তার চোখে বিস্ময় এবং একটা নতুনকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দ। আহমদ মুসা ও আহমদ ইয়াংও গোগ্রাসে গিলছিল লি ইউয়ানের হৃদয় থেকে নিঃসারিত কথাগুলো।
আবার কথা বলে উঠল লি ইউয়ান। নরম কণ্ঠ তার, আপনি একটা শক্ত প্রশ্ন করেছেন। এ প্রশ্ন আমি কোনদিন আমার নিজকে করিনি। কিন্তু একটা জিনিস, ফিলিস্তিন বা মিন্দানাওয়ের মুসলমানরা মুক্তি পেল, বিজয়ী হল, তখন আমার খুব ভাল লেগেছে। বলে বুঝাতে পারব না, মধ্য এশিয়ায় যেদিন আপনাদের বিপ্লব সফল হল সেদিন শুধু আনন্দিত হওয়া নয়, একটা তীব্র আবেগ যেন আমাকে অভিভূত করছিল। এখানকার ‘এম্পায়ার গ্রুপ’কে আমি সমর্থন করতে পারি না, কিন্তু ওদের কোন ক্ষতির খবর যখনই পাই, বুকের কোথায় যেন বেদনা বোধ হয়। শিহেজী উপত্যকাসহ অন্যান্য এলাকায় হান বসতি নিয়ে যা ঘটেছে তাকে কোন সময় আমার ভাল মনে হয়নি। সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত আমাকেই খুশি কেরেছে সবচেয়ে বেশি। তাই বাস্তবায়ন করতে আমি এক মুহূর্তও বিলম্ব করিনি। ‘ফ্র’ এবং ‘রেড ড্রাগন’রা এটা জানে বলেই ওরা আমার মাকে কিডন্যাপ করেছিল। জেনকে আটকে রেখে ওরা শিহেজী উপত্যকার বসতি নিয়ে আমার সাথে দর কষাকষি করতে চেয়েছিল।
থামল লি ইউয়ান। একটা আবেগ ও বেদনায় আচ্ছন্ন লি ইউয়ানকে এখন একজন নতুন মানুষ বলে মনে হচ্ছে। তার পাশে নেইজেন পুতুলের মত নির্বাকভাবে বসে আছে। তার চোখে একটা কিছু খুঁজে পাওয়ার আলো।
আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি জনাব। শান্ত-গম্ভীর কণ্ঠে বললো আহমদ মুসা।
কি পেয়েছেন?
আপনার আল্লাহ বিশ্বাস, জাতি প্রেম এবং আপনার ঐতিহ্য আপনার সচেতন স্বত্তার গোটাটাই দখল করে আছে। প্রকাশের সুযোগ পায় না।
সামান্য সুযোগ পেলেই সচেতন স্বত্তার সাথে সংঘাত বাধে অবচেতন স্বত্তার।
কিন্তু প্রায় দুই পুরুষ ধরে অতীতের সাথে আমার বিচ্ছিন্নতা। বিচ্ছিন্নতা শুধু নয়, বিরোধিতা। বিশ্বাস বাঁচতে পারে কি করে?
বিশ্বাস মানুষের মনের নিজস্ব একটা প্রকৃতি। বাইরের ঘটনা- দুর্ঘটনার ঝড়ো হাওয়া এবং পরিবর্তন একে খুব কমই স্পর্শ করতে পারে। এ কারণেইতো সোভিয়েত ইউনিয়ন যুগ যুগ ধরে চেষ্টা সত্ত্বেও মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে মেরে ফেলতে পারেনি। আজ বিশ্বাসকে তারা স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হচ্ছে।
থামলেন আহমদ মুসা। লি ইউয়ানও কথা বলল না। নীরবতা কয়েক মুহূর্তের। ভাবনার গভীরে ডুবে আছে লি ইউয়ান। কয়েক মুহূর্ত পরে একটু নড়ে-চড়ে বসল সে। যেন জেগে উঠল এমন কণ্ঠে সে বলল, আপনার জন্যে আরেকটা সুখের খবর আছে আহমদ মুসা। কি? নতুন আগ্রহ ঝরে পড়ল আহমদ মুসার কণ্ঠে।
আজ সন্ধ্যার আগে মুসলিম মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্র ও ফিলিস্তিন সরকারের দুজন প্রতিনিধি এসেছে। তাদের সরকারের চিঠি নিয়ে এসেছে তারা। ঐ চিঠিতে জানতে পারলাম, আপনি এখন সিংকিয়াং-এ।
তারা কোথায়? তারা আর কি বলেছে?
চিঠিতে দুসরকারই বলেছে, আপনার সন্ধানে সাহায্য করার জন্যে। দূতাবাসের মাধ্যমে পিকিংকেও তারা এ অনুরোধ করেছে। আমাকে তারা বাড়তি অনুরোধ জানিয়েছে আন-অফিসিয়ালি। তারা আমাদের অতিথি ভবনে আছে।
আপনি কিছু মনে না করলে আমি এখুনি তাদের সাথে দেখা করতে চাই।
নিশ্চয়ই দেখা করবেন। এই প্রাসাদেরই উত্তর ভবনে অতিথি ভবন। উংফু এভিনিউ ঘুরে এদিক দিয়ে গেছে।
আপনি ব্যবস্থা করলে আমরা এখনই উঠতে পারি।
ঠিক আছে, বলে লি ইউয়ান কলিংবেলে হাত দিতে যাচ্ছিল। নেইজেন পিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু কথা বলল। লি ইউয়ানের মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, বেশ তো যাও, নিয়ে এস।
হাসি ভরা মুখ নিয়ে নেইজেন ভেতরে চলে গেল। লি ইউয়ান আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, আমার মা আপনাকে তার নিজস্ব রিভলবারটা উপহার দিতে চায়।
খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে জেন। কিছু না জেনেও শুধু ঘটনা বিশ্লেষণ করেই আমাদের পরিচয় প্রায় সে বলেই ফেলেছিল।
কি বলেছিল? আগ্রহের সাথে জানতে চাইল লি ইউয়ান।
জেন বলেছিল, আমরা একটা মুসলিম আদর্শবাদী বিপ্লবী দল।
লি ইউয়ান কিছু বলতে যাচ্ছিল, এই সময় নেইজেন ঘরে ঢুকল। তার হাতে সাদা চামড়ার কেসে ভরা রিভলবার।
নেইজেন কেস থেকে রিভলবার বের করল। রিভলবারটাও সাদা ধপধবে। দেখেই বুঝা যায় একটা দুর্লভ সংগ্রহ।
লি ইউয়ান বলল, আমি জেনকে এ রিভলবার জার্মানী থেকে অনেক খুঁজে এনে দিয়েছিলাম।
নেইজেন পিতার হাতে রিভলবার দিয়ে বলল, আব্বা, আমার পক্ষ থেকে তুমি ওনাকে দিয়ে দাও।
কেন তুমিই দাও মা, উপহার নিজ হাতেই দিতে হয়। হেসে বলল লি ইউয়ান।
নেইজনের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। পিতার হাত থেকে রিভলবারটা নিয়ে নিল সে। এগুলো সে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালেন। লি ইউয়ানও উঠে এল। নেইজেন কম্পিত হাতে রিভলবারটা আহমদ মুসার হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, এ রিভলবারটা বহুদিন আমার কাছে লুকিয়ে আছে। জাতির সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তিকে আমি এটা উপহার দিলাম।
কথাগুলো তার কাঁপল অব্যক্ত এক আবেগে।
আহমদ মুসা রিভলবারটি নিয়ে একটু চুমু খেলেন তাতে। তারপর কেসে ভরতে ভরতে বললেন, আমার বোনের কাছ থেকে পাওয়া শক্তি ও সংগ্রামের এ প্রতীক উপহার আমার চিরদিন মনে থকবে।
মাথা নিচু করল নেইজেন। আনন্দ-আবেগে তার মুখটা লাল হয়ে গেছে। মুহূর্তকাল পরে মুখ তুলে নেইজেন পিতার দিকে চেয়ে বলল, আব্বা ওঁরা তো যাচ্ছেন, বোনের বাড়িতে ওঁদের দাওয়াত দাও না!
লি ইউয়ান হেসে উঠল। নিশ্চয়ই মা, ওঁদের ছাড়ছি না। নিশ্চয় আসবেন। একবার নয়, অনেক বার।
আহমদ ইয়াং আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল একটা শান্ত সুবোধ বালকের মত। তার মধ্যে কেমন একটা সংকোচ ও জড়তার ভাব। লি ইউয়ান তার দিকে চেয়ে বলল, মাই বয়, তুমি তো কিছু বলছ না?
জি মুসা ভাই বলছেন…..
তখন তোমার দরকার কি, বলার এই তো? হেসে বলল লি ইউয়ান।
আহমদ মুসা আহমদ ইয়াং-এর পিঠ চাপড়ে বললেন, আপনি একে চিনবেন হয়তো। কানশুর পিয়ং লিয়াং-এর হুই নেতা মা পেন চাই বংশের ছেলে।
কোন মা পেন চাই? ইস্পাত বাহিনীর?
জি। এ হুই নেতা ওয়াং চিং-এর ছেলে আহমদ ইয়াং।
লি ইউয়ান এগিয়ে এসে আহমদ ইয়াং-এর ঘাড়ে হাত রেখে বলল, তোমার আব্বা তিয়েনশান ভ্যালিতে না?
জি। বলল আহমদ ইয়াং।
লি ইউয়ান আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, এদের চিনব না! মা পেন চাই তো চীনের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। আর ওয়াং চিং চাই এবং তাঁর পিতা স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের জন্য যে সংগ্রাম করেছে এবং পরাধীনতার সুখের চাইতে সর্বস্ব ত্যাগ করে স্বাধীনচিত্ততার যে নজীর স্থাপন করেছে তাও কোন দিন ভুলার নয়। ওরা আসলেই গর্বের বস্তু। আহমদ ইয়াং-এর দিকে ফিরে তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ইয়াং, খুশি হলাম তোমার সাথে পরিচিত হয়ে। তোমার পিতার সাক্ষাৎ পেলে আমি খুশি হতাম।
কথা শেষ করে লি ইউয়ান দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আসুন আমি বলে দিচ্ছি। ওরা অতিথি খানায় পৌঁছে দেবে আপনাদের।
চারজনেই লি ইউয়ানের প্রাইভেট অফিস থেকে বেরিয়ে এল। কড়া স্যালুট করল বাইরে দাঁড়ানো মিলিটারি সেক্রেটারী ও সৈনিকরা।
লি ইউয়ান মিলিটারী সেক্রেটারীকে বলল, এদের সবাইকে পৌঁছে দাও আজ মধ্য এশিয়া থেকে যে মেহমানরা এসেছে তাদের কাছে।
চারজনই অফিসের সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। নেইজেন আহমদ ইয়াং-এর পাশাপাশি চলছিল। তার হাতে একটা লাল গোলাপ। গোলাপটি আহমদ ইয়াং-এর হাতে গুঁজে দিল। সিঁড়ির নিচে গাড়িতে উঠতে গিয়ে বিদায় নেবার সময় আহমদ ইয়াং জেনকে কিছু বলল না, জেনও কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে গাড়ির জানালা দিয়ে এক পলক দেখে সরে দাঁড়াল জেন।
গেটের বাইরে দাঁড়ানো জীপে এসে উঠলেন আহমদ মুসা ও আহমদ ইয়াং। সামনে একটা আর্মির জীপ। তাকে অনুসরণ করে আহমদ মুসার জীপ ছুটে চলল অতিথি ভবনের দিকে।
এবার জীপের পেছনের সিটে বসেছিলেন আহমদ মুসা ও আহমদ ইয়াং।
আহমদ ইয়াং-এর হাতে ধরা সেই গোলাপ। গোলাপটি নাকের কাছে তুলে নিতে গিয়ে চমকে উঠল আহমদ ইয়াং। এ গোলাপ যেন গোলাপ নয়। এ যেন নেইজেনের সেই চোখ এবং কথা বলতে না পারা নেইজেনের সেই লাজ নম্র মুখ।
অদ্ভুত সুন্দর সুগন্ধ গোলাপটির। উরুমচির গোলাপে সুগন্ধ একটু বেশি নাকি? হতে পারে, আহমদ ইয়াং ভাবল।
পাশেই বসেছিলেন আহমদ মুসা। এক সময় বললেন, গোলাপটার খুব সুন্দর সুগন্ধ তো আহমদ ইয়াং।
আহমদ ইয়াং হাত বাড়িয়ে গোলাপটি দিতে গেল আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা একটু হেসে বললেন, না ইয়াং, এ গোলাপ তোমার জন্যই। আহমদ ইয়াং কিছু বলতে পারল না। লাল হয়ে উঠল সে লজ্জায়!