২০. অন্ধকার আফ্রিকায়

চ্যাপ্টার

ইয়াউন্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন।
ছোট, কিন্তু সুন্দর বাগানটি।
গোটা বাগান জুড়ে মাকড়সার জালের মত লাল সুড়কির রাস্তা। মাঝে মাঝে বেঞ্চ পাতা।
একটা বেঞ্চিতে বসে রোসেলিন, লায়লা ইয়েসুগো এবং ডোনা।
আজ বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে। রোসেলিন ডোনাকে নিয়ে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তিনজন গল্প করছে।
ডোনা চোখ কপালে তুলে বলছিল, ‘বেনু নদীর তীরের গারুয়া শহর? সে তো আফ্রিকার বুকের গভীরে, চাদ হ্রদের তীরে প্রায়।’
‘প্রায় নয়, ‘লেক চাদ’-এর পশ্চিম তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ইয়েসুগো রাজবংশের রাজত্ব।’ বলল লায়লা ইয়েসুগো।
‘কিন্তু আফ্রিকার এত গভীরে একটি মুসলিম রাজত্বের প্রতিষ্ঠা কিভাবে হলো?’ বলল ডোনা।
‘লেক চাদ-এর তীরে ইসলামকে দেখে বিস্মিত হচ্ছেন? আমাদের ক্যামেরুনের দক্ষিণে, গ্যাবনের পুবে কাম্পুর উত্তরাংশ যেখানে সভ্যতার কোন আলোই এখনও পড়েনি, সেই ‘এনডোকি’ এলাকাতে গেলেও ‘আল্লাহ’ এবং ‘মুহাম্মাদ (সঃ)’-এর নাম (যদিও ভাঙা উচ্চারণে) আপনি শুনতে পাবেন। আমাদের গারুয়া উপত্যকা তো ভাগ্যবান। নাইজেরিয়ার ‘লাগোস’ এবং ‘বেনু’ নদীর পথে এবং উত্তর নাইজেরিয়ার ঐতিহাসিক মুসলিম মহানগরী ‘কানো’ থেকে নদী ও সড়ক পথে ইসলাম এখানে পৌঁছেছে।’
‘যাই বলুন। যতই ভাবছি, ততই বিস্মিত হচ্ছি, কিভাবে আফ্রিকার এই গভীরে, অকল্পনীয় দুর্গম অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশ করল। আমি জানি আফ্রিকার এই অঞ্চলে ইসলামের বড় ধরনের কোন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাহলে ইসলাম কিভাবে, কিসের জোরে পাহাড়-জংগল-নদীর দুর্গম গভীরে পথ করে নিল?’
‘আমাদের এই আফ্রিকা অঞ্চলে কোন সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা তো নয়ই, এমনকি কোন মিশনারী সংগঠন বা পেশাদার মিশনারীদের দ্বারাও ইসলাম প্রচার হয়নি। স্ট্যানলি লেনপুলের বইতে আমি পড়েছি। ‘The Preaching of Islam’ বইতে তিনি বলেন, ‘ইসলাম প্রচারের জন্যে গঠিত কোন সংস্থা বা এই উদ্দেশ্যে তৈরী কোন প্রচারবিদের দ্বারা ইসলামের প্রচার কাজ পরিচালিত হয়নি। মুসলমানদের প্রত্যেকেই ছিলেন একজন করে সক্রিয় মিশনারী।’ বলল লায়লা ইয়েসুগো।
‘বিস্ময়টা আমার এই জন্যেই বেশী। এই অবস্থায় ইসলাম কি করে আফ্রিকার এই অঞ্চলে প্রবেশ করল।’ বলল ডোনা।
‘সেই কাহিনী লিখলে আমার মনে হয় পৃথিবীর বৃহত্তম মহাকাব্য রচিত হতো।’
বলে একটু দম নিল লায়লা। তারপর শুরু করল, ‘আরবী অশ্বারোহী সৈনিকের বিজয়ী পদক্ষেপ মরক্কো-মৌরতানিয়ায় এসে থেমে গিয়েছিল। আরও দক্ষিণে সেনেগালের বিজন জংগলে তারা প্রবেশ করেনি। পরবর্তীকালে সেনেগালের উপকূল ধরে ইসলামের যাত্রা শুরু হয় মুসলমানদের ব্যক্তিগত উদ্যোগের আকারে। সুদান ও লিবিয়ার মরুভূমি পাড়ি দিয়ে বাণিজ্য-কাফেলার পথ ধরে যেভাবে স্থলপথে ইসলামের দক্ষিণ মুখী যাত্রা শুরু হয়, সেভাবে সেনেগাল থেকে উপকূলের পথ ধরে ইসলাম দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত হতে থাকে। সেনেগাল থেকে গাম্বিয়া, গাম্বিয়া থেকে গিনি বিসাউ, গিনি, তারপর সিয়েরা লিওন- এভাবে ধীরে ও নিরবে ইসলাম অগ্রসর হয়েছে এক জনপদ থেকে আরেক জনপদে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে।’
একটু থামল লায়লা ইয়েসুগো। একটু নড়ে বসল। তারপর বলল, ‘ব্যক্তি উদ্যোগে ইসলামের এই প্রচার কত যে অমর ঘটনা, কত যে অপরূপ কাহিনী এবং অশ্রু ভেজা কত যে গাঁথা সৃষ্টি করে। কিন্তু সবই হারিয়ে গেছে, তার সাথে হারিয়ে গেছে সংখ্যাহীন ত্যাগী মানুষের উজ্জ্বল জীবনচিত্র। আপনার মত আমারও ইচ্ছা করত এসব জানবার। অনেক বই ঘাটাঘাটি করেছি আমাদের ঐ মহান অতীতকে জানার জন্যে। যা পেয়েছি তা সামান্য ইংগিতমাত্র।’
‘সেটা কেমন?’ বলল ডোনা।
‘মুসলমানরা যখনই এ অঞ্চলে কোন নতুন ভূখন্ডে এসেছে ব্যবসার উদ্দেশ্যে কিংবা বসবাসের জন্যে, তারা প্রথমেই গেছে স্থানীয় গোত্র সরদারের কাছে। আবেদন করেছে তাদের প্রার্থনা গৃহ (মসজিদ) তৈরীর অনুমতি দানের। এইভাবে তারা মসজিদ গড়েছে, স্কুল তৈরী করেছে। শীঘ্রই তাদের সততা ও নিষ্ঠা এবং উন্নত সাংস্কৃতিক আচার-ব্যবহার স্থানীয় বিধর্মী নিগ্রোদের অভিভুত করেছে।’ এই কথাগুলো লিখেছেন, ‘Islam and Mission’ বইতে একজন ইউরোপীয় ঐতিহাসিক। আর ‘Rise of British West Africa’ বইতে জর্জ ক্লাউডে যে বিবরণ দিয়েছেন তা হলোঃ ‘মুসলমানদের স্কুলগুলো ছিল স্থানীয় আফ্রিকানদের জন্যে বিস্ময়কর। স্কুলে যে সব বিষয় ও আচার-ব্যবহার শিক্ষা দেয়া হতো, তা মুগ্ধ ও অভিভুত করত তাদেরকে। আফ্রিকান ছাত্ররা এই শিক্ষা ও আচার-ব্যবহার ছড়িয়ে দিত, এখান থেকে সেখানে, এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায়। ইসলামের মেসেজ ছড়িয়ে পড়ে তার সাথে। ইসলামের আরও দু’টি বিষয় আফ্রিকার নিগ্রোদের সম্মোহিত করে। তার একটি হলো দাস ব্যবসার প্রতি মুসলমানদের বিরোধিতা। অন্যটি হলো আইন-শৃংখলার প্রতি মুসলমানদের গুরুত্ব দান। সে সময় উপকূল জুড়ে ছিল প্রচন্ড নৈরাজ্য। যার কারণে আফ্রিকান নিগ্রোরা তাদের উপকূল থেকে সব সময় দূরে থাকতে চেষ্টা করতো। মুসলমানরা যেখানেই গেছে এবং কিছুটা শক্তি অর্জন করতে পেরেছে, সেখানেই তারা শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে এবং মানুষের নিরাপত্তা বিধান করেছে। এর ফলে নিগ্রো মানুষেরা ছুটে এসেছে শান্তি ও স্বস্তির সন্ধান পেয়ে। এভাবে মুসলমানদের ইমেজ বিধর্মী নিগ্রোদের মধ্যে এতটাই বেড়ে যায় যে গোত্র সর্দাররা মুসলমান না হয়েও মুসলিম নাম গ্রহণ করতে গৌরব বোধ করত। নাম গ্রহণ করার সাথে সাথে তারা ইসলামও গ্রহণ করে বসতো। আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের শ্রেষ্ঠ নিগ্রো গোত্রগুলো যেমন ‘ফুলবি’, ‘ম্যানডিংগো’, ‘হাউসা’ এবং ‘ফুলানি’ ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেয় এইভাবে।’
থামল লায়লা ইয়েসুগো।
‘চমৎকার। বিস্ময়কর ইতিহাস।’ বলল ডোনা।
‘পশ্চিমা ঐতিহাসিক ‘ব্লাডেন’ এবং ‘ওয়াস্টারম্যান’ কি বলেছেন জানেন? বলেছেন, সেনেগাল এবং নাইজেরিয়ার উপকূল পর্যন্ত দু’হাজার মাইল উপকূল রেখায় এমন কোন শহর দেখা যেত না যা মসজিদের গম্বুজে শোভিত ছিল না। এই বিপ্লব সংঘটিত হয় উনিশ ও বিশ শতকে এবং গিজ গিজ করা খৃস্টান মিশনারীদের চোখের সামনেই।’
‘কি সর্বনাশা, এই বিপ্লব উনিশ-বিশ শতকের? পশ্চিমা আধিপত্যের কালে?’
‘অবশ্যই। আপনি শুনে বিস্মিত হবেন, উনিশ ও বিশ শতকের মাঝা-মাঝি সময় পর্যন্ত, মুসলমানদের রাজনৈতিক সৌভাগ্য সূর্য যখন অস্তমিত, যখন অধিকাংশ মুসলিম দেশ দুর্ভাগ্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত, ঠিক তখনই আফ্রিকার এই অঞ্চলে কালো মানুষদের জীবনে সৌভাগ্য সূর্য দীপ্ত হয়ে উঠে। ইসলাম এই সময় কত দ্রুত বিস্তার লাভ করে তার একটা হিসেব দিচ্ছিঃ

দেশের নাম — উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম জনসংখ্যার হার — বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুসলিম জনসংখ্যার হার
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top