৪৪. ব্লাক ঈগলের সন্ত্রাস

চ্যাপ্টার

সংকট এল তিন দিন পরেই।
আহমদ মুসা শুয়েছিল তার কক্ষে তার বেডে। ধীরে ধীরে এসে ফরহাদ আহমদ মুসার বিছানায় তার পাশে বসল।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি উঠে বসল। তুমি কষ্ট করে এলে কেন? ডাকলে আমি যেতাম।
তিন দিনেই আহমদ মুসা প্রায় সেরে উঠেছে, কিন্তু ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের জ্বরই এখনও সারেনি।
ডাক্তার খালাম্মা ঘরে ঢুকে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনকে দেখে বলল, ফরহাদ তোমার বিছানা থেকে উঠা ঠিক হয়নি। দাঁড়ালেও আহত স্থানগুলোর উপর চাপ পড়বে, তাতে জ্বর বাড়বে এবং নিরাময় বিলম্বিত হবে। শুয়ে পড়, এখানেই তোমাকে দেখব।’
সুবোধ বালকের মত সংগে সংগেই শুয়ে পড়ল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
‘ফরহাদ আমাদের খুব ভালো ছেলে। বড়দের কথা মান্য করতে একটু দেরি করে না।’ বলল দাদী প্রসন্ন মুখে।
মুখ টিপে হাসল যয়নব যোবায়দা। বলল, ‘বুঝার আগে কাজ করলে তার ফল সব সময় ভালো হয় না।’
‘ভালো একটা নীতি কথা বলেছ বেটি’ বলে ডাক্তার খালাম্মা আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি একটা মিরাকল বিভেন বার্গম্যান। তিন সপ্তাহের নিরাময় তোমার ক্ষেত্রে তিন দিনে হয়ে গেছে। আজ আমি আমাদের ডাক্তারদের বৈঠকে তোমার কথা বললে সবার চোখ ছানাবড়া হয়েছে। একজন তো সব শুনে এতটা অভিভূত হয়েছে যে তোমাকে দেখার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে। আমি তাকে ওয়েলকাম করেছি। সে আসছে। সে একজন চর্ম বিশেষজ্ঞ হওয়া ছাড়াও একজন প্লাষ্টিক সার্জন। তার কাছ থেকে ভালো পরামর্শও পাবে।’
থামল ডাক্তার খালাম্মা।
ডাক্তার খালাম্মার শেষের কয়েকটি বাক্য শুনে মুখের সব আলো দপ করে নিভে গেল আহমদ মুসার। তার মিরাকল নিরাময়ের কথা শুনেই একজন শীর্ষ স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সংগে সংগে তাকে দেখতে চলে আসতে, এটা একেবারেই স্বাভাবিক নয়। আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল ডাক্তার খালাম্মাকে, ‘তারা কি আমার নাম জেনেছে?’
‘হ্যাঁ তারা জিজ্ঞেস করেছে। আমি বলেছি তোমার নাম। বিদেশী তাও বলেছি।’ বলল ডাক্তার খালাম্মা।
‘কে জিজ্ঞেস করেছে?’
‘কেন, ঐ স্কিন স্পেশালিষ্ট ও প্লাষ্টিক সার্জন। তাঁরই তো উৎসাহ বেশি।’
‘কি নাম তার ডাক্তার খালাম্মা?’
‘ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো জুদাহ।’
নাম শুনেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। তার নামের প্রথম অংশকে না ধরলেই শেষ অংশটা পরিষ্কার ইহুদী। বলে ‘ডাক্তার খালাম্মা, ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো আমাকে দেখার জন্য আসবেন এ কথা কখন আপনাকে বলেন? সংগে সংগেই?’
ডাক্তার খালাম্মা পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ভাবনার একটা ছায়া ফুটে উঠল তার চোখে মুখে। আহমদ মুসার প্রশ্নের উত্তরে সংগে সংগেই সে কিছু বলল না। একটু ভেবে বলল, ‘মনে পড়ছে সে মাঝখানে উঠে টয়লেটে গিয়েছিল। টয়লেট থেকে আসার পর সে আলোচনায় আবার যোগ দেয় এবং বলে ঐ কথা। কেন প্রশ্ন করছ এসব, অন্য কিছু ভাবছ?’
‘বলছি খালাম্মা। বললেন উনি আসছেন। উনারা কি আলাদাভাবে আসছেন? বাসা চিনবেন কি করে ওরা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘এক সাথেই আশার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ সে বলল, ওদিকে আমার এক বন্ধুরও যাওয়ার কথা। আমরা এক সাথেই যাবো। ক’মিনিট দেরী হবে। আপনার পেছনেই আমি আসছি। আমি বাসার ঠিকানা লিখে দিয়ে চলে এসেছি।’ ডাক্তার খালাম্মা বলল।
আহমদ মুসা নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘আপনারা এসেছেন সাত মিনিট। আর চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওরা এসে পড়বে নিশ্চয়।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা তাকাল দাদী ও যয়নব যোবায়দার দিকে। বলল, ‘ভবিষ্যত জানেন একমাত্র আল্লাহ। কিন্তু আমি আশংকা করছি চার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। বাড়ির সামনের দিকে ছাড়া অন্য কোন পথ কি আছে যেখান দিয়ে আপনাদের বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হতে পারে?’
সবার মুখ শুকিয়ে গেছে। প্রবল উদ্বেগ ফুটে উঠেছে তাদের চোখে মুখে। বলল ডাক্তার খালাম্মা চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে, ‘তুমি কি আশঙ্কা করছ ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো কোন বিপদের………।
ডাক্তার খালাম্মার কথা শেষ হলো না। কলিং বেল বেজে উঠল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ডাক্তার খালাম্মা ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর ডান তর্জনি কি ডিফেক্টিভ?’
বিস্ময় বিমূঢ় চোখে তাকাল খালাম্মা আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি জানলে কি করে?’
‘পরে বলব, ওরা এসে গেছে। আপনারা সবাই দু’তলায় জান। ফরহাদ তুমিও যাও। দয়া করে আমি না ডাকা পর্যন্ত কেউ নিচে নামবেন না। যান আপনারা, আমি গিয়ে দরজা খুলে দিচ্ছি।’
বলে আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি বালিশের নিচ থেকে রিভলবার বের করে মাথার পেছনে জ্যাকেটের গোপন পকেটে ঢুকিয়ে নিল।
‘খারাপ কিছুর আশংকা আছে?’ দ্রুত কম্পিত কণ্ঠে বলল যয়নব যোবায়দা।
‘প্রস্তুত থাকা ভালো।’ হাসি মুখে শান্ত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘প্লিজ আপনারা দোতলায় যান।’
কথা বলতে বলতেই আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে ছুটল বাইরের ঘরের দিকে।
আহমদ মুসা চলে যাবার পর ডাক্তার খালাম্মা যোবায়দাকে বলল, ‘তোমরা যাও, আমি দেখি ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো সত্যি এলেন কিনা।’
‘প্লিজ খালাম্মা, উনি যা বলেছেন তার মধ্যেই কল্যাণ আছে। সব ঠিক ঠাক থাকলে তো উনি আমাদের ডাকবেনই।’ অনুরোধ করল যয়নব যোবায়দা ডাক্তার খালাম্মাকে।
ওরা সবাই দোতলায় উঠে গেল।
আহমদ মুসা ছুটে এসে ড্রইংরুমের বাইরের দরজার ডোর ভিউতে চোখ রাখল। দেখতে পেল দরজার সামনেই আছেন দীর্ঘদেহী পঞ্জাশের মত বয়সের একজন ভদ্রলোক। তার গায়ে তখনও ডাক্তারের এ্যাপ্রোন। তার পেছনে বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন পুলিশ।
পুলিশ দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর সাথে তো আসার কথা ব্ল্যাক ঈগলের লোকরা। পুলিশ কেন তার সাথে?
একটা সন্দেহ উঁকি দিল আহমদ মুসার মনে। পুলিশের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দৃষ্টি বুলাল আহমদ মুসা। না পুলিশী ক্যাপ, ইউনিফরম, বুট সব ঠিক আছে। কোন খুত নেই। কিন্তু আহমদ মুসার চোখ আটকে গেল পুলিশদের চুলের উপর। থাই পুলিশদের চুল মাথার ক্যাপ ছাপিয়ে এমন বেঢপ ভাবে বেরিয়ে আসে না। দ্বিতীয় আরেকটি জিনিস তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেটা হলো, এই পুলিশদের বুটের কালো ফিতার প্রান্তের মেটাল মোড়কের সবটাই সাদা। কিন্তু থাই পুলিশের তা নয়। তাদের ফিতার মোড়কের অগ্রভাগের এক তৃতীয়াংশ কালো।
ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর চালাকি বুঝতে পারল আহমদ মুসা। ঝামেলা এড়াবার জন্যে ব্ল্যাক ঈগলের লোকদের সে পুলিশ সাজিয়ে নিয়ে এসেছে।
হাসল আহমদ মুসা।
ডোর ভিউ থেকে সরে এসে দরজার পাশের ছোট ‘কী’ বোর্ড থেকে চাবি হাতে নিল।
দরজাটির তালায় ভেতর বাহির দু’দিক থেকেই চাবি দেবার ব্যবস্থা আছে। খুশি হলো আহমদ মুসা। সে যে পরিকল্পনার কথা ভাবছে, তাতে এর প্রয়োজন আছে।
এ সময় কলিংবেল আবার বেজে উঠল। এবার পর পর দু’বার। আহমদ মুসা বুঝতে পারল ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন।
আহমদ মুসা দরজার লক আন-লক করে চাবিটা লকের ভেতরেই রেখে দিল।
দরজাটি দ্রুত খুলে বলল, ‘স্যরি স্যার দেরি হয়ে গেল। আমি ভেতরে রোগীর ঘরে ছিলাম। স্যার আপনি তো ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো, ম্যাডাম ডাক্তার খালাম্মা আপনার কথা বলেছেন।’
তারপর লোকটিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলল, ‘পুলিশ কেন স্যার, কি চায়?’
‘হ্যাঁ, আমি ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো। এই পুলিশদের সাথে আমার রাস্তায় দেখা। ওরাও এখানে আসছে জেনে এক সাথেই এলাম। কি জন্যে ওরা এসেছে আমি জিজ্ঞেস করিনি।’
আহমদ মুসা কয়েক ধাপ এগিয়ে বারান্দার প্রান্ত পর্যন্ত পৌছে পুলিশদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনারা এ বাড়িতে এসেছেন? কেন এসেছেন?’
বাড়ির উঠানে সদ্য আসা তিনটি গাড়ি। একটা ছোট কার অন্য দু’টি অটো-টেম্পো। পুলিশের সংখ্যা মোট এগার জন। তাদের সবার হাতেই খাটো ব্যারেলের হ্যান্ড মেশিনগান। আহমদ মুসা থাই পুলিশের হাতে এ ধরনের সাব-মেশিনগান দেখেনি।
কাঁধে সাবমেশিনগান ঝুলানো ও হাতে ব্যাটনধারী একজন পুলিশ একটু সামনে এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনি কে?’
‘আমি আলী আবদুল্লাহ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বিভেন বার্গম্যান কি ভেতরে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমরা তার সাথে কথা বলব।’ পুলিশ লোকটি।
‘আপনারা কোন থানা থেকে এসেছেন।’
একটু থতমত খেয়ে পুলিশ অফিসারটি একটা ঢোক গিলে বলল, ‘না, আমরা পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে এসেছি।’
‘ওয়েলকাম আপনাদের। আপনারা সকলে আসুন।’
বলে আহমদ মুসা দরজার একপাশে দাঁড়াল।
ভেতরে ঢুকল প্রথমে ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো। বলল, ‘আমিও তাকে দেখতে এসেছি।’
পুলিশরা সবাই এক এক করে ভেতরে ঢুকল।
সবশেষে আহমদ মুসা ঢুকল। ঢুকেই দু’হাত পেছনে নিয়ে দরজা ঠেলে বন্ধ করে দিল এবং একই সাথে লকে লাগানো চাবি ঘুরিয়ে লক বন্ধ করে ঘরের মাঝখানে এসে বলল, ‘আপনারা একটু বসুন। আমি ওঁকে নিয়ে আসছি।’ বলে আহমদ মুসা ড্রইংরুম থেকে ভেতরে যাওয়ার দরজায় এসে বলল, ‘৮ জনের সোফায় ১২জন বসতে একটু অসুবিধা হবে স্যার।’
একটা চেয়ার ঘরের এদিকের দেয়ালের সাথে আলগা করে রাখা ছিল। চেয়ারটি একটু টেনে আহমদ মুসা একজন পুলিশকে ডেকে বলল, ‘আপনার ওখানে অসুবিধা হচ্ছে। এখানে বসুন।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ব্যাটনধারী পুলিশ অফিসারটি বলল, ‘মি. আবদুল্লাহ, বসার দরকার নেই। দু’জন আপনার সাথে যাচ্ছে। তারা বিভেন বার্গম্যানকে আনতে আপনাকে সাহায্য করবে।’
মনে মনে হাসল আহমদ মুসা। তার প্ল্যানটা একটু পাল্টে গেল। তাতে বরং তার লাভই হবে। দু’জন কম হলো এ রুমের থেকে।
‘ঠিক আছে। আসুন, ওয়েলকাম।’
বলে আহমদ মুসা নব ঘুরিয়ে ভেতরে যাবার দরজা খুলে ফেলল। এবং দরজার এক পাশে দাঁড়াল। পুলিশ দু’জন এলে তাদেরকে ভেতরে যাবার জন্যে আহবান জানাল। দু’জন পুলিশেরই হ্যান্ডমেশিনগান কাঁধে ঝুলানো।
পুলিশ দু’জন ভেতরে ঢুকে গেল এক এক করে। তাদের পেছনে ঢুকল আহমদ মুসাও।
আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকে গেল এক এক করে। তাদের পেছনে ঢুকল আহমদ মুসাও।
আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকে দরজার পাল্লা আস্তে করে ঠেলে দিল এবং লকটাও টিপে দিয়েছে সাথে সাতে। অটো ক্লোজ হওয়ার মতই দরজাটা সামান্য শব্দ তুলে ক্লোজ হয়ে গেল।
দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে দু’জন পুলিশ এক সাথেই পেছন ফিরে তাকাল। তাদের চোখে সন্দেহযুক্ত প্রশ্ন। কিন্তু তারা প্রশ্ন করার আগেই আহমদ মুসা চোখের পলকে মাথার পেছনে জ্যাকেটের পকেট থেকে রিভলবার বের করে তাদের দিকে তাক করে বলল, ‘তোমরা কাঁধ থেকে মেশিনগান নামিয়ে নেবার সুযোগ পাবে না। তার আগেই আমার রিভলবারের দুই গুলী তোমাদের মাথা গুঁড়ো করে দেবে। আমার এই রিভলারে কোন শব্দ হয় না। নিঃশব্দে দুই গুলী তোমাদের মেরে ফেলবে। তোমাদের সঙ্গীরা কেউ জানতে পারবে না। যদি বাঁচার ইচ্ছা থাকে অস্ত্র ফেলে দাও।’
পুলিশ দু’জন একটু দ্বিধা করল, কিন্তু পরক্ষণেই কাঁধের হ্যান্ড মেশিনগান নিচে মেঝেয় ছেড়ে দিল।
দু’জনের দিকে রিভলবার নাচিয়ে বলল, ‘তোমরা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়। মনে রেখ, এক আদেশ কিন্তু দুবার করব না। দ্বিতীয় বার চলবে গুলী।’
উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল দু’জনেই।
আহমদ মুসা ঘরের এদিক-ওদিক তাকাল বাঁধার কিছু একটার খোঁজে।
ঘরটি নিচ তলার ডাইনিং রুম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ঘরের পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি উঠে গেছে। সিঁড়ির নিচ দিয়ে ওপাশে কিচেনে যাবার দরজা। ঘরের অন্য দু’দিকে দু’টি কক্ষ। এ দু’টিই বাড়ির গেষ্ট রুম। এরই একটিতে আহমদ মুসা, অন্যটিতে থাকে ফরহাদ উদ্দিন।
খুঁজতে গিয়ে আহমদ মুসা অ্যাডহীসীভ টেপ পেয়ে গেল। এ টেপ তাদের ব্যান্ডেজ বাঁধার কাজের জন্যেই আনা হয়েছিল।
এই টেপ দিয়ে দ্রুত দুই পুলিশের হাত-পা ছাড়াও মুখ আটকে দিল যাতে চিৎকার করতে না পারে।
এরপর আহমদ মুসা মোবাইলে একটা টেলিফোন করল পাত্তানী শহরের এসপিকে। থাই গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী প্রধান পুরসাত প্রজাদিপক পাত্তানী সিটির এসপিকে আহমদ মুসা সম্পর্কে আগেই বলে রেখেছে। আহমদ মুসাও তার সাথে কথা বলেছে বিভেন বার্গম্যান পরিচয়ে।
সিটি পুলিশ ধরলেই আহমদ মুসা এ বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বলল, ‘ব্ল্যাক ঈগলের লোকরা পুলিশের ছদ্মবেশ নিয়ে আমাদের ধরতে এসেছে। এখানে যয়নব যোবায়দাও আছে আপনি জানেন।’
‘এখন কি অবস্থা?’ সিটি পুলিশ সুপার জিজ্ঞেস করল।
‘আমি ওদের আটকে রেখেছি। কতক্ষণ পারব জানি না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মি. বার্গম্যান মিনিট দশেক ওদের সামলান। ঐ এলাকায় পুলিশ ইন্সপেক্টর থাচিনের নেতৃত্বে একটা ভ্রাম্যমান টীম আছে। ওরা যাচ্ছে ওখানে। আমি একটি পুলিশ টীম নিয়ে নিজেই আসছি।’ বলল পাত্তানী সিটি পুলিশ সুপার।
‘ধন্যবাদ স্যার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওয়েলকাম মি. বার্গম্যান।’ বলে পুলিশ সুপার টেলিফোন রেখে দিল।
আহমদ মুসা মোবাইল পকেটে রেখে দু’জন পুলিশের হ্যান্ডমেশিনগান তুলে নিয়ে একটি কাঁধে ঝুলাল, অন্যটি হাতে রাখল।
ডান দিক থেকে পেছনে ঘুরতে গিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে নজর গেল আহমদ মুসার। দেখল, ‘সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে যয়নব যোবায়দা। তার দু’চোখে বিস্ময়, আতংক।
আহমদ মুসা দ্রুত কয়েক ধাপ এগিয়ে বলল, ‘আপনারা কেউ এদিকে থাকবেন, কাউকে আমার দরকার হতে পারে।’
যয়নব যোবায়দার পেছনে এসে দাঁড়াল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন এবং ডাক্তার খালাম্মা। উদ্বেগ-আতংকে সবার মুখই শুকনো।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। যয়নব যোবায়দা শুকনো কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার।’
আহমদ মুসা কোন কথা না বলে ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে চুপ থাকার ইশারা করে ঘুরে দাঁড়িয়ে চলল ড্রইং রুমের দরজার দিকে।
ড্রইংরুমের দরজায় গিয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়াল। তারপর হ্যান্ড মেশিনগানের ট্রিগারে আঙুল রেখে বাম হাতে দরজার নব ঘুরিয়ে আস্তে স্বাভাবিকভাবে খুলতে লাগল। প্রথমেই তার নজরে পড়ল, দরজা সোজা চেয়ারটা যেখানে একজন পুলিশকে বসতে বলেছিল, সেটা খালি। খুশি হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ডান হাতের হ্যান্ডমেশিনগানটা একটু আড়াল করে বাম হাত দিয়ে দরজাটা পরিপূর্ণ খুলে দেয়ালের সাথে সেঁটে দিল। ইলাষ্টিক হুকে আটকে গেল দরজা।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা হ্যান্ডমেশিনগানটা বাগিয়ে ধরে লাফ দিয়ে দরজা ডিক্সিয়ে ড্রইং রুমের মেঝেয় গিয়ে দাঁড়াল এবং নিচু গলায় কঠোর কণ্ঠে বলল, ‘একজনও অস্ত্র তোলার চেষ্টা করলে সবাইকে এক সাথে গুলী করে মারব।’
আহমদ মুসাকে অস্ত্র হাতে লাফ দিয়ে পড়তে দেখেই কয়েকজন উঠে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আকস্মিকতা কাটিয়ে তারা অস্ত্র তোলার আগেই আহমদ মুসার মেশিনগান তাদের দিকে উদ্যত হলো এবং ধ্বনিত হলো তার কঠোর কণ্ঠ।
আহমদ মুসার হাতের হ্যান্ডমেশিনগানের হাঁ করা ব্যারেল দেখে এবং তার চোখের দিকে তাকিয়ে কেউই আর অস্ত্রে হাত দিতে সাহস করল না। বসে দাঁড়িয়ে যে যেভাবে ছিল সেভাবেই থাকল।
সেই ব্যাটনধারী পুলিশ অফিসার লোকটি উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার হাতেও ছিল রিভলবার। সে বলল, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে তুমি বন্দুক উঁচিয়েছ। এর পরিণতি জান? আমাদের দু’জন পুলিশ কোথায়? কি করেছ তাদের?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমার পরিণতির কথা পরে। কারণ আমার হাতে এখন বন্দুক। তোমার পরিণতির কথা ভাব।’
আহমদ মুসা যখন কথা বলছিল, তখন একে সুযোগ হিসাবে নিয়ে পুলিশ অফিসারটি তার রিভলবার তুলেছিল আহমদ মুসার লক্ষে।
কিন্তু আহমদ মুসা মুখে কথা বললেও হ্যান্ডমেশিনগানে আটকানো তার তর্জনি একটুও অসতর্ক হয়নি। পুলিশ অফিসারবেশী লোকটির রিভলবার থেকে গুলী বেরুবার আগেই আহমদ মুসার হ্যান্ডমেশিনগানের কয়েকটি গুলী ছুটে গেল তার দিকে। একটি গুলী বিদ্ধ করল তার রিভলবার ধরা হাতকে। আরও দু’টি গুলী তার বাহু ও উরুতে গিয়ে বিদ্ধ হলো।
সে আর্তনাদ করে বসে পড়ল সোফায়।
হ্যান্ডমেশিনগানের ব্যারেল সবার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল আহমদ মুসা, ‘ওর বুকে গুলি করিনি প্রথম কেস বলে। কিন্তু এরপর কেউ অস্ত্রে হাত দিলে এবার গুলী যাবে সরাসরি তার বুকে। সবাই অস্ত্র মেঝের মাঝখানে ফেলে দাও।’
সংগে সংগেই সবার অস্ত্র মেঝের মাঝখানে এসে জমা হলো।
সোজা হয়ে বসল ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো। বলল ভীত কণ্ঠে, ‘আমি এসবের মধ্যে থাকতে চাই না। কিছু বুঝতে পারছি না আমি। আমি চলে যাই। বিভেন বার্গম্যানের সাথে আমি পরে দেখা করব।’
ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো উঠে দাঁড়াল।
‘না, ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো আপনি বসুন। আমার আশঙ্কা, এই ভুয়া পুলিশদের পাঠিয়েছে যারা, তাদের আপনি খবর দেবেন এখান থেকে বেরিয়েই। সুতরাং পুলিশ আসা পর্যন্ত থাকুন। আপনাকে কি করবে তারাই সিদ্ধান্ত নেবে।’
‘আমাদের ভুয়া পুলিশ বলছ। তোমার কাছে কি প্রমাণ আছে?’ বলল আহত পুলিশবেশী অফিসার লোকটি।
প্রতিবাদ করলেও পুলিশবেশী সকলের মুখে ভীতির পর এবার মুষড়ে পড়া ভাব সৃষ্টি হয়েছে।
‘প্রমাণ করা আমার দায়িত্ব নয়। পুলিশ আসছে, খোদ এসপি সাহেবও আসছেন। তাঁরাই প্রমাণ করবেন।’
ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোও মুষড়ে পড়েছে। সে বলল, ‘আমি পুলিশের অপেক্ষা করব কেন? এদের সাথে কিংবা তাদের সাথে আমার কি সম্পর্ক? আমি আপনাদের ডাক্তার খালাম্মার সাথে যোগাযোগ করে এসেছি। তাঁকে ডেকে দিন।’
পাশের ঘরে যয়নব যোবায়দা, ডাক্তার খালাম্মা ও ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন সবাই দাঁড়িয়েছিল। তাদের সাথে আহমদ মুসার কথোপকথন সবই তারা শুনেছে। ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর শেষ কথাটা শুনে ডাক্তার খালাম্মা ড্রইং রুমে আসতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা দেখতে পেয়ে তাকে ইশারা করে ফিরিয়ে দিল। বলল সে ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর কথার উত্তরে, ‘মি. ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো, এখন ডাক্তার খালাম্মাকে ডাকার সময় নয়। আপনি যা বলার পুলিশকে বলবেন।’
হঠাৎ ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো তার এ্যাপ্রনের পকেটে থাকা দুই হাতের ডান হাত রিভলবারসহ বের করে গুলী করল আহমদ মুসাকে। ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর চেহারায় পুটে উঠেছিল উৎকট বেপরোয়া ভাব।
একটু অসতর্ক ছিল আহমদ মুসা। আর ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর রিভলবারসহ হাতটা এত দ্রুত তার লক্ষে উঠে এসেছিল যে, পাল্টা আক্রমণের সময় তখন ছিল না। আত্মরক্ষার জন্যে দ্রুত বসে পড়েছিল আহমদ মুসা। ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর গুলীটা তার গলদেশের বাম গোড়ায় কাঁধের পেশি উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। বসতে সে তিল পরিমাণ দেরি করলে গুলীটা তার হৃদপিন্ড ভেদ করে চলে যেত।
আহমদ মুসা বসে পড়ার জন্য যে সময় পেল সেই সময়ের মধ্যে তার হ্যান্ডমেশিনগানের লক্ষ্য ঠিক করে নিয়ে ট্রিগার টেপে তার হ্যান্ডমেশিনগানের। হাত, পাঁজরসহ কয়েক জায়গায় গুলী খেয়ে ঢলে পড়ে ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো সোফার উপর।
ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোকে গুলী করেই আহমদ মুসা তার হ্যান্ডমেশিনগানের ব্যারেল অন্যদের উপর একবার ঘুরিয়ে নিল। বলল, ‘দেখ ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর ডাক্তার পরিচয়কেই বড় করে দেখেছিলাম। তাই তিনি আমাকে ফাঁকি দিতে পেরেছেন। কিন্তু তোমাদের ব্যাপারে আমার কোন বিভ্রান্তি নেই। অতএব যে যেমন আছ, ঠিক সে ভাবেই থাক।’
আহমদ মুসাকে গুলী লাগতে দেখে আর্তনাদ করে উঠেছিল যয়নব যোবায়দা এবং ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন দু’জনেই।
‘ও গড, বিভেন বার্গম্যান তো আগের আহত জায়গার পাশেই আবার গুলী খেয়েছে।’
ডাক্তার খালাম্মা কয়েক মুহূর্ত থেমে আবার আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, ‘ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো বার্গম্যানকে গুলী করে আহত করল, আবার বার্গম্যান ব্রাশ ফায়ার করল ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোকে। উনি হয়তো মরেই গেলেন! এসব কি হচ্ছে?’
এ সময় কলিং বেল বেজে উঠল।
আহমদ মুসা পুলিশদের উপর থেকে চোখ না সরিয়েই বলে উঠল, ‘ফরহাদ তুমি এস।’
ফরহাদ তাকাল যয়নব যোবায়দার দিকে।
‘দেরি করো না। উনি আহত, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। যা বলছেন কর।’ উদ্বেগ-আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল যয়নব যোবায়দা।
অসুস্থ ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন সব ভুলে দৌড়ে পৌছল ড্রইং রুমে।
‘ফরহাদ, ডোর ভিউ দিয়ে দেখ বাইরে পুলিশ কিনা। পুলিশ হলে দরজা খুলে দাও।’ বলে আহমদ মুসা একটা চাবি তার হাতে দিল।
ইতিমধ্যে কলিংবেল আবারো বেজে উঠল।
ফরহাদ দ্রুত এগিয়ে ডোর ভিউতে একবার চোখ রেখেই দ্রুত দরজা খুলে দিল।
ঘরের বড় পুলিশ অফিসার তার পাশের পুলিশ অফিসারকে বলল, ‘ইন্সপেক্টর থাচিন, অস্ত্রগুলো নিয়ে নাও আর ওদের গ্রেফতার করতে বল।’ বলে বড় পুলিশ অফিসারটি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আমি সিটি এসপি উদয় থানি। আপনি তো মিঃ বিভেন বার্গম্যান স্যার। আপনি গুলীবিদ্ধ হয়েছেন দেখছি। তবু আপনি এদের আটকে রেখেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘ধন্যবাদ মিঃ উদয় থানি। আমাকে গুলীবিদ্ধ করেছেন ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো। এর আগে আমাকে গুলী করেছেন পুলিশ অফিসারবেশী ঐ আহত ভদ্রলোক। দু’জনকে নিরস্ত্র করার জন্যে আমাকে গুলী করতে হয়েছে। আমার হাতের হ্যান্ডমেশিনগানটিও ওদের।’ বলে আহমদ মুসা হ্যান্ডমেশিনগানটি উদয় থানিকে দিয়ে দিল।
পাত্তানী সিটি এসপি উদয় থানি হ্যান্ডমেশিনগানটি আহমদ মুসার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা রাখুন স্যার, আপনার কাজে লাগবে।’
একটু থেমেই আবার বলল, ‘ইতিমধ্যে সহকারী গোয়েন্দা প্রধান পুরসাত প্রজাদীপক স্যারের সাথে আমার কথা হয়েছে। আপনি অসম্ভব বড় একটা কাজ করেছেন স্যার। কথিত ‘ব্ল্যাক ঈগল’ এর কাউকেই এখনও জীবন্ত হাতে পাওয়া যায়নি। এবার এক সঙ্গে দশজনকে অস্ত্রসহ এ্যাকশনকালে হাতে-নাতে ধরা গেছে। এটা….।’
সিটি এসপি উদয় থানির কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘ওরা দশজন নয়, বার জন। আরও দু’জনকে পাশের ঘরে বেঁধে রেখেছি।’
‘স্যার চলুন দেখি।’ বলে সিটি এসপি উদয় থানি পাশের ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল। আহমদ মুসাও চলল।
সিটি এসপি উদয় থানি ঘরে ঢুকে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দু’জন পুলিশবেশী লোককে দেখতে পেল। দেখতে পেল যয়নব যোবায়দা, দাদী এবং ডাক্তার খালাম্মাকেও।
দাদী ইতোমধ্যে নিচে এসে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা উদয় থানিকে ওদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘জাবের জহীর উদ্দিনের বোন যয়নব যোবায়দা ওদের টার্গেট। জাবেরের মত যয়নব যোবায়দাকেও ওরা হাতের মুঠোয় পেতে চায়।’
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এই চেষ্টা তারা করেছে বলেই তাদেরকে আজ এভাবে হাতে-নাতে ধরা গেল। অবশ্য সব কৃতিত্ব স্যার আপনার। তবে এর চেয়ে বড় কৃতিত্বের কাজ আপনি থাইল্যান্ডের জন্য করেছেন, যার জন্যে শুধু থাই পুলিশ নয়, থাই সরকারও আপনার কাছে কৃতজ্ঞ স্যার।’
কথা শেষ করেই উদয় থানি তাকাল যয়নব যোবায়দার দিকে। বলল, ‘শাহজাদী ম্যাডাম যোবায়দা, আমরা দুঃখিত আপনাদের সম্মানিত পরিবার এক ভয়ানক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। তবে ম্যাডাম মেঘ কেটে যাচ্ছে আশা করি। মি. বিভেন বার্গম্যান স্যার বলা যায় অসাধ্য সাধন করেছেন। এটা শুধু আপনার পরিবারের প্রতি নয়, থাইল্যান্ডের প্রতি ঈশ্বরের একটা বিশেষ সাহায্য।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমাদের পুলিশ বাহিনী ও সরকারের প্রতি সব সময়ই আমরা আস্থাশীল। আমাদের সংকট মোচনে তারা সফল হবেন। আমার অনুরোধ ভাইয়াকে তাড়াতাড়ি উদ্ধার করুন। আর ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের মত যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাদের দয়া করে আপনারা অভয় দিন।’ বলল যয়নব যোবায়দা।
‘শাহজাদী ম্যাডাম, এ নিয়েও উর্ধ্বতন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। আজকের পর তাদের আর হয়রানি করা হবে না।’ সিটি এসপি উদয় থানি বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার।’
‘ওয়েলকাম ম্যাডাম’ বলে উদয় থানি তাকাল ডাক্তার খালাম্মার দিকে। ‘ডাক্তার ফাতেমা জহুরা ম্যাডাম আপনি এখানে, আবার ডাক্তার এ্যাঞ্জেলো ভুয়া পুলিশের সাথে দেখছি। কি ব্যাপার?’
ডাক্তার খালাম্মা সংক্ষেপে ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর এখানে আসার ব্যাকগ্রাউন্ডটা বর্ণনা করে বলল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তিনি ভুয়া পুলিশের সাথে আসবেন, তিনি ভুয়া পুলিশের সাথে আসবেন, তিনি মি. বার্গম্যানকে গুলী করবেন, এসব কি করে হয়?’
‘ডাক্তার খালাম্মা, উনি ভুয়া পুলিশের সাথে আসেননি। তিনিই ভুয়া পুলিশকে নিয়ে এসেছে আমাকে, ফরহাদকে এবং ম্যাডাম যয়নবকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ডাক্তার ফাতেমা জহুরা ম্যাডাম এ দুনিয়ায় কিছুই অসম্ভব নয়। এই গ্রুপের লোককে প্রথম আমরা হাতে পেয়েছি। বহু কিছুই এখন বেরিয়ে আসবে।’
একটু থামল সিটি এসপি উদয় থানি। কিছুক্ষণ পর আবার বলে উঠল যয়নব যোবায়দাকে লক্ষ্য করে, ‘শাহজাদী ম্যাডাম, ফরহাদ সাহেবকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন, সে একটা এফআইআর লিখে দিয়ে আসবে।’
‘ওকে স্যার সে যাচ্ছে আপনাদের সাথে।’ বলে যয়নব যোবায়দা তাকাল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের দিকে।
‘ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।’ বলল ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন।
‘অসুস্থ তুমি, পারবে তো যেতে?’ আহমদ মুসা বলল দরদ ভরা কণ্ঠে।
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন চোখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। তার দু’চোখ অশ্রুতে ভরে উঠেছে। বলল, ‘স্যার আপনি গুলীবিদ্ধ, রক্ত ঝরছে সেখান থেকে প্রবলভাবে। কিন্তু মনে হচ্ছে আপনার কিছুই হয়নি। এই শিক্ষা কেন আমরা নিতে পারবো না স্যার!’ আবেগরুদ্ধ কণ্ঠ ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের।
ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের কথার সাথে সাথে ব্যস্ত হয়ে উঠল সিটি এসপি উদয় থানি। দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘আমরা তো ওদের নিয়ে যাচ্ছি। বিভেন বার্গম্যান স্যারকে এখনি হাসপাতাল বা কোন ক্লিনিকে নেয়া দরকার। অপারেশন দরকার হতে পারে। রক্তও অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার।’
কথা শেষ করেই সিটি এসপি উদয় থানি, ‘সবাইকে ধন্যবাদ, আমরা চলি’ বলে ঘুরে দাঁড়াল। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়িয়েও থমকে দাঁড়াল উদয় থানি। আবার ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘তিনজন পুলিশের একটা টীম বাড়ির সামনে পাহারায় থাকবে। একটি ভ্রাম্যমান পুলিশ বক্সসহ তারা আসছে। সেখানেই তারা থাকবে। এটা উপরের হুকুম। আপনাদের কোন অসুবিধা হবে না।’
বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে লাগল উদয় থানি।
ওদের সাথে আহমদ মুসাও ড্রইংরুমে গেল।
সবাই বেরিয়ে যেতেই যয়নব যোবায়দা তাকাল ডাক্তার খালাম্মার দিকে।
এ দৃষ্টির অর্থ বুঝল ডাক্তার খালাম্মা ফাতেমা জহুরা। বলল, ‘বেটি ওকে হাসপাতালে নেয়ার দরকার নেই। ডাক্তার এ্যাঞ্জেলোর এই ঘটনা দেখার পর আমি হাসপাতালকে বিশ্বাস করতে পারছি না। অপারেশন লাগলে এখানেই সেটা হবে।’
‘ওকে ভালো করে দেখুন ডাক্তার খালাম্মা। উনি মানুষ নয় খালাম্মা, আল্লাহর ফেরেশতা উনি! অন্যের কথাই শুধু ভাবেন, নিজের দিকে তাকান না। আপনি তো দেখলেন খালাম্মা, যে গুলীটা তার কাঁধে লেগেছে, ত্বরিত বসে না পড়লে সে গুলীটা তার বক্ষ ভেদ করে যেত। তাহলে কি হতো ভাবতেও ভয় লাগে খালাম্মা। কিন্তু দেখুন, তাঁর মধ্যে এর সামান্য অনুভূতি, উদ্বেগও নেই।’ আবেগ রুদ্ধ কণ্ঠে তার আপনাতেই থেমে গেল। চোখ দু’টিও তার অশ্রু সজল হয়ে উঠেছে।
‘ঠিক বলেছ বেটি। তবে তিনি ফেরেশতা নন, ফেরেশতার চেয়ে বড়। ফেরেশতা যে মানুষকে সিজদা করেছে, তিনি সে ধরনের মানুষ। আমি ভাগ্যবান যে তাকে চিকিৎসা করার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু তার পরিচয় কি বেটি? তার সাথে বিভেন বার্গম্যান নাম মানায় না। বলল ডাক্তার খালাম্মা।
আহমদ মুসা ড্রইংরুমে থেকে এ ঘরে প্রবেশ করল।
‘আপনাকে বলব খালাম্মা পরে।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল যয়নব যোবায়দা।
দাদী এগুলো আহমদ মুসার দিকে। রাজ্যের মমতা নিয়ে তাকাল তার দিকে। বলল, ‘ভাই, আমাদের জন্যে তোমার যুদ্ধ তো এখনকার মত শেষ। এবার নিজের দিকে নজর দাও। আমার এই ডাক্তার বেটির হাতে নিজেকে ছেড়ে দাও ভাই।’ ডাক্তার ফাতেমা জহুরার দিকে ইংগিত করল দাদী।
‘হ্যাঁ বেটা, টেবিল তো রেডিই আছে। অন্য সবকিছুও প্রস্তুত আছে। চল টেবিলের দিকে।’ দাদীর কথা শেষ হতেই বলল ডাক্তার ফাতেমা জহুরা।
‘হাসপাতালে নিতে চাননি এজন্যে ধন্যবাদ ডাক্তার খালাম্মা। আমি রেডি চলুন।’ হাসি মুখে বলল আহমদ মুসা।
‘বেটা তুমি কি পাথরের? বুলেট বিদ্ধ হয়েও স্বাভাবিক থাকতে পার, হাসতে পার?’ আহমদ মুসার ডান হাত ধরে টেবিলের দিকে টেনে নিতে নিতে বলল ডাক্তার ফাতেমা জহুরা।
‘মানুষ পাথর নয় ডাক্তার খালাম্মা। কষ্ট ও যন্ত্রণাবোধ সব মানুষের প্রায় একই রকম। তবে বড় কষ্টের কথা ভাবলে ছোট কষ্ট ভুলে থাকা যায় খালাম্মা, বড় বিপদ প্রতিরোধের বিষয় বড় হয়ে দেখা দিলে উপস্থিত কষ্টের কথা মানুষের মনে থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা ডাক্তার খালাম্মা, ঈশ্বরের জন্যে সব ব্যাথা-বেদনা মানুষ হজম করতে পারে।’
‘ঠিক বলেছ বেটা, যুক্তি এবং বিজ্ঞানও এই কথা বলে। কিন্তু যে মানুষ একে বাস্তবে রূপ দিতে পারে, সেই মানুষ কিন্তু দেখা যায় না। তোমাকে ব্যতিক্রম হিসাবে দেখছি। তুমি কে বেটা, আমি এখনও কিন্তু জানি না।’ বলল ডাক্তার ফাতিমা জহুরা।
টেবিলে পৌছে গিয়েছিল আহমদ মুসা।
ডাইনিং টেবিলে একটা তোষক তার উপর রেক্সিন আর চাদর বিছানোই ছিল। একজন পরিচারিকা বিছানা ঝেড়ে-মুছে দিচ্ছিল। তারও কাজ হয়ে গেল।
বিছানায় শোবার সময় বলল, ‘পরিচয় যেটুকু বাকি আছে, সেটুকও হয়ে যাবে ডাক্তার খালাম্মা।’
ডাক্তার ফাতেমা জহুরা তার ব্যাগ খুলে ষ্টেরিলাইজড অপারেশন কীটস নিয়ে আহমদ মুসার মাথার কাছে গেল।
কীটসটা খুলে বিছানায় রেখে গস্নাভস পরতে পরতে বলল ডাক্তার ফাতেমা জহুরা, ‘কারও একজনের সাহায্য প্রয়োজন।’
যয়নব যোবায়দা বলল, ‘আমি আপনার পাশে আছি ডাক্তার খালাম্মা।’ বলে ডাক্তার ফাতেমা জহুরার পাশে এসে দাঁড়াল সে।
পরিচারিকরা দু’জন ড্রইংরুম পরিষ্কার করছিল, সেখানেই আবার ফিরে গেল।
অপারেশন শুরু করে দিল ডাক্তার ফাতেমা জহুরা। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
Top