৪৬. রোমেলি দুর্গে

চ্যাপ্টার

অল্পক্ষণ হলো মিটিং শুরু হয়েছে। একটা বড় টেবিল ঘিরে চারজন মানুষ।
প্রধান বা সভাপতির আসনে বসেছে ‘থ্রি জিরো’র ইউরোপীয় প্রধান আইজ্যাক বেগিন। তার পাশেই ইসরাইলী রাস্ট্রদূত বসেছে। তাদের সামনে টেবিলের ওপ্রান্তে বসেছে ‘থ্রি জিরো’র ইস্তাম্বুল প্রজেক্টের প্রধান প্রফেসর ডক্টর ডেভিড ইয়াহুদ। তার পাশেই ‘স্মার্থা’। স্মার্থা ইস্তাম্বুল প্রজেক্টের নতুন অপারেশন চীফ। ইরগুন ইবান নিহত হবার পর তার দায়িত্ব এসে পড়েছে স্মার্থার উপর।
প্রফেসর ডক্টর ইয়াহুদ তাদের ইস্তাম্বুল প্রজেক্ট সম্প্রতি মারাত্মক যে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, তার উপর পূর্ণাঙ্গ ব্রিফিং শেষ করল।
‘থ্রি জিরো’র ইউরোপীয় প্রধান আইজ্যাক বেগিনের মুখ আষাঢ়ে মেঘের মত ভারি।
মাথা নিচু করে সে ডক্টর ডেভিড ইয়াহুদের কথা শুনছিল।
ডক্টর ইয়াহুদের কথা শেষ হলে ধীরে ধীরে মুখ তুলল আইজ্যাক বেগিন। চোখে-মুখে তার অনেক প্রশ্ন। মুখ ফাঁক করেছে প্রশ্ন করার জন্যে।
এই সময় ইন্টারকমে কথা বলে উঠল আইজ্যাক বেগিনের পিএস।
‘বল রবিন। জরুরি কিছু?’ জিজ্ঞাসা আইজ্যাক বেগিনের।
‘স্যার, বেঞ্জামিন এসেছে। ভেতরে পাঠাব?’ বলল রবিন।
‘বেঞ্জামিন? লরেন্স কোথায়? আমি তো লরেন্সের টেলিফোনের অপেক্ষা করছি। পাঠাও তাকে।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘লরেন্স তো এভাবে আমাদের দূতাবাসে আসার কথা নয়। তার উপর পুলিশের নজর আছে বলে আমরা জানি।’ বলল তুরস্কে কার্যরত ইসরাইলি রাষ্টদূত।
‘আমি সে কথাই ভাবছি। টেলিফোনে মেসেজ আসবে লরেন্সের কাছ থেকে। কিন্তু সেই মেসেজের বদলে বেঞ্জামিন আসছে কেন? লরেন্সের মোবাইল ঘন্টা খানেক আগে থেকে বন্ধ।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘লরেন্সের সাথে গোয়েন্দা হেডকোয়ার্টারেই যেহেতু ডিউটি ছিল, তাই জরুরি কোন কথা তার থাকতে পারে।’ বলল ড.ইয়াহুদ।
দরজায় নক হলো।
‘এস রবিন।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
রবিন লরেন্সকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
রবিন লরেন্সকে ভেতরে ঢুকিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল।
নির্দেশ মত স্মার্থার পাশে একটা খালি চেয়ারে বসল বেঞ্জামিন।
বেঞ্জামিন পুলিশের গোয়েন্দা হেডকোয়ার্টারে একজন সিভিলিয়ান কেমিষ্ট অফিসার।
সবার চোখ বেঞ্জামিনের দিকে নিবদ্ধ।
মুখ খুলল বেঞ্জামিন। একবার ড. ইয়াহুদের দিকে তাকিয়ে চোখ নিবদ্ধ করল আইজ্যাক বেগিনের দিকে। তার চোখ-মুখ ভীত ও ফ্যাকাসে। বলল, ‘স্যার, লরেন্স নিহত হয়েছেন।’
‘কখন, কিভাবে? সে তার কাজ করতে পারেনি?’ জিজ্ঞাসা আইজ্যাক বেগিনের।
‘সে বেয়ারার ছদ্মবেশে নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। জেনারেল মোস্তফা তখন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খালেদ খাকান তাকে গুলী করে মেরেছে।’
‘খালেদ খাকান কি করে তাকে সন্দেহ করল? লরেন্স অত্যন্ত চালাক লোক। একাধিক অপশন দেয়া হয়েছিল। যে কোন মূল্যে আজকেই ভিসিডি উদ্ধার করতে হবে। সুযোগ পেলে চায়ে বিষ মিশিয়ে ওদের হত্যা করে ভিসিডির কাছে পৌঁছতে হবে। এ সুযোগ না পেলে ঘরে বিষাক্ত গ্যাস ছুঁড়ে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এই দুই ক্ষেত্রে সন্দেহ হবার আগেই তো কাজ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সে খালেদ খাকানের সন্দেহের শিকার হলো কি করে? জেনারেল মোস্তফা সন্দেহ করলে একটা কথা ছিল যে, সে লরেন্সকে চিনতে পেরেছে।’
বেঞ্জামিন বলল, ‘আমি বলাবলি করতে শুনেছি যে, লরেন্স ঘরে প্রবেশ করার আগেই জেনারেল মোস্তফা বেরিয়ে এসেছিল এবং তাঁর নির্দেশেই লরেন্স নাস্তা নিয়ে যান ঐ ঘরে। তিনি জেনারেল মোস্তফার বরাত দিয়ে ভিসিডিটি কম্পিউটার থেকে নিয়ে আসার চেষ্টাও করেন। সেই সময় খালেদ খাকান বাধা দিলে লরেন্স তাকে গুলী করেন। কাঁধে গুলীবিদ্ধ হয়েও খালেদ খাকান গুলী করে হত্যা করে লরেন্সকে।’
‘তাই হবে। ওতো খালেদ খাকান নয়, আমাদের চিরশত্রু, আমাদের সীমাহীন সর্বনাশের হোতা সেই আহমদ মুসা। নিখুঁত মেকআপে তার চেহারা অনেক খানি পরিবর্তন করেছিল। দেরি হয়েছে তাকে চিনতে। সব ব্যাপার আমরা জেনেছি। তার নাম পাল্টিয়ে তুর্কি সরকার ও ওআইসি তাকে নিয়ে এসেছে তাদের আইআরটি রক্ষার জন্যে।’ থামল আইজ্যাক বেগিন।
ড. ডেভিড ইয়াহুদ, স্মার্থা সকালের চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত। অবচেতন মনে শিউরেও উঠেছে তারা। তারা সবাই জানে, সব যুদ্ধেই অবশেষে তারা আহমদ মুসার কাছে হেরেছে। সাধারণ ঐ লোকটি একেবারেই অসাধারণ। যেমন সে ক্ষীপ্র, তেমনি ধুর্ত, তার সাহসেরও পরিমাপ নেই।
তাদের মুখে কোন কথা নেই।
কথা বলে উঠল আইজ্যাক বেগিন। বলল বেঞ্জামিনকে লক্ষ্য করে, ‘তুমি এবার এস।’
‘ইয়েস স্যার।’ বলে বেঞ্জামিন উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বেঞ্জামিন বেরিয়ে যেতেই আইজ্যাক বেগিন বলল, ‘এখন দুই টার্গেট, ‘সোর্ড’-এর ফর্মুলা হাত করা এবং আহমদ মুসাকে হত্যা করা। দেখামাত্র তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত আমাদের আগে থেকেই আছে। সেটাই কার্যকারী করতেই হবে।’
‘সে সাংঘাতিক ধড়িবাজ। তার ফাইল আমি মোসাদ-এর ওয়েবসাইটে পড়লাম। তাকে ধরার জন্যে, তাকে শেষ করার জন্যে হাজারো ফাঁদ পাতা হয়েছে, হাজারো সুযোগ আমাদের হাতে এসেছে, কিন্তু সবই আমাদের ব্যর্থ হয়েছে। ইস্তাম্বুলে আমাদের যে অভিজ্ঞতা, তাও এ কথাই বলছে যে, তার সাথে লড়াই নয় ধ্বংস করতে হবে তাকে। আমি মনে করি স্যার, আইআরটি সমেত তাকে ও বিজ্ঞানীদের ধ্বংস করা হোক। তাতে আহমদ মুসাসহ ওদের সোর্ড ও গবেষণা কার্যক্রম শেষ হয়ে যাবে।’ বলল স্মার্থা।
গম্ভীর হলো আইজ্যাক বেগিন এবং ড. ডেভিড ইয়াহুদের মুখ। ড. ইয়াহুদ তাকাল আইজ্যাক বেগিনের দিকে।
আইজ্যাক বেগিন সোজা হয়ে বসল চেয়ারে। বলল, ‘স্মার্থা, তুমি আমাদের অপারেশন স্কোয়াডের একটি কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। তোমার জানা দরকার যে, সোর্ড, সোর্ডের বিজ্ঞানী বা আইআরটি ধ্বংস করা আমাদের মিশন নয়। আমরা ‘সোর্ড’-এর ফর্মুলা চাই, আমরা চাই সোর্ডের ডিজাইন।’
‘কিন্তু স্যার, আমি বুঝতে পারছি না, ‘সোর্ড’ এবং এর ডিজাইনে এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে কেন? আমি জানি, মার্কিন ইহুদী কণাবিজ্ঞানী ইলাম ইমামুয়েল আলোক কণা ফোটন নিয়ে ‘সোর্ড’-এর অনুরূপ গবেষণায় সফল হয়েছেন। এর অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সোর্ড’ জাতীয় ডিফেনসিভ শিল্ডের মালিক হওয়ার সাথে সাথে গোপনে ইসরাইলও এর মালিক হয়ে গেছে। অতএব সোর্ড কিংবা সোর্ডের ফর্মূলার দরকার ইসরাইলের নেই। এরপরও স্যার, আইআরটির সোর্ড ও সোর্ডের ফর্মূলা পাওয়ার জন্যে অহেতুক আমরা এত ক্ষতি স্বীকার করছি কেন? সব সমতে আইআরটি ধ্বংস করলেই তো আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায়। সোর্ড ওদের হাতে না থাকলেই আমরা বেঁচে যাই।’ বলল স্মার্থা।
‘তুমি যে তথ্য দিয়েছ তা ঠিক। কিন্তু সব তথ্য তুমি দিতে পারনি। আমাদের কণাবিজ্ঞানী ইলাম ইমামুয়েল আলোক-কণার ‘ফোটন’- শিল্ড আবিষ্কার করেছেন, যার ফাংশন ডিফেন্সিভ অস্ত্র হিসেবে ওদের সোর্ড এর মতই। কিন্তু ওদের ‘সোর্ড’- এর ভয়াবহ অফেনসিভ ক্যারেক্টার রয়েছে, যা আমাদের ফোটন শিল্ডে নেই।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘বুঝলাম না, স্যার?’ স্মার্থা বলল।
‘বলছি শোন, ইস্তাম্বুলের ‘আইআরটি’ গবেষণাগার ‘সোর্ড’ নামের যে ‘ফোটন-শিল্ড তৈরি করেছে তা যেমন ডিফেনসিভ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তেমনি অফেনসিভ অন্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। আইআরটির প্রধান বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বহু আগের লেখা ‘টেকনোলজিক্যাল ইউজ অব ফোটনস’ নামের একটা নিবন্ধ তার গোপন ওয়েব সাইট থেকে আমাদের বিজ্ঞানীরা উদ্ধার করেছেন। তাতে অন্যান্য বিষয়ের সাথে তিনি গামা-ফোটনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম নতুন উপাদান ‘আল-সালাম’- এর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন এই ‘আল-সালাম’- এর প্রযুক্তিগত ব্যবহার ফোটন-নেটকে ভয়ংকর মারণাস্ত্রে রূপ দিতে পারে, যা পাল্টে দিতে পারে দুনিয়াকে। তার মতে ‘আল-সালাম’- এর প্রযুক্তি রূপকে যদি ফোটন-নেটের সাথে যুক্ত করা হয়, তাহলে এমন একটা অস্ত্র তৈরি হবে যা আলোর গতিতে দুনিয়ার যে কোন প্রান্তে পৌছে যে কোন দুর্ভেদ্য সাইলোতে ঢুকে পড়ে মেটালিক-ননমেটালিক সব অস্ত্রকে সম্পূর্ণ হাওয়া করে দিতে পারে। আজ আইআরটিতে বসে ড. আন্দালুসি যে ‘সোর্ড’ তৈরি করেছেন, তাতে এই অফেনসিভ ক্যারেক্টার যুক্ত রয়েছে। ‘সোর্ড’- এর যে অর্থ তার মধ্যেও এর ইংগিত আছে। ‘সোর্ড’ -কে সেভিয়ার অব ওয়ার্ল্ড র‌্যাশনাল ডোমেইন বলা যায়। সংক্ষেপে এর অর্থ ‘মানব-ধর্মের ত্রাতা’। মানব ধর্ম বলতে ওরা বুঝাচ্ছে ‘শান্তি’ (rational domain)। আর বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি ফোটনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম- এর নতুন উপাদানের নাম রেখেছেন ‘আল-সালাম’ মানে শান্তি। এর অর্থ তারা বুঝাচ্ছেন, আমরা মনে করছি, দুনিয়ার সব অস্ত্রকে তার নিজ নিজ সাইলোতে ধ্বংস করে দিয়ে তারা দুনিয়াতে যুদ্ধহীন শান্তি নিয়ে আসবেন। এটাই আমাদের আতংকের বিষয়। আমরা চাই আমাদের সাইলোগুলোতে আমাদের অন্ত্র অটুট রেখে দুনিয়ার সব অস্ত্র ধ্বংস করতে। এজন্যেই আমরা মরিয়া ওদের ‘সোর্ড’ এবং তার ফর্মুলা হাত করতে।’
থামল আইজ্যাক বেগিন।
স্মার্থার ঠোঁট শুকনো। তার চোখে অসহায় দৃষ্টি।
তার ঠোঁট নড়ল, কিন্তু কথা বেরুলো না। কথা যেন গলায় আটকে গেছে।
স্মার্থা সামনের গ্লাসের ঢাকনা সরিয়ে এক গ্লাস পানি সবটাই খেয়ে নিল।
গ্লাসটা টেবিলে রেখে সে বলল, ‘স্যার আমাদের বিজ্ঞানী গামাফোটনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম-এর আল-সালাম উপাদান খোঁজার চেষ্টা করছে না?’
চেয়ারে গা এলিয়ে দিল আইজ্যাক বেগিন। তার চোখে-মুখে দারুণ হতাশার ছাপ। বলল, ইউরোপ-আমেরিকার কার্যরত আমাদের সকল কণাবিজ্ঞানী অবিরাম চেষ্টা করেও এই ব্যাপারে এক ধাপ এগোতে পারেনি। এমনকি কোন সম্ভাবনাও তারা সৃষ্টি করতে পারেনি।’
স্মার্থারও চোখে-মুখে ভীতি-মিশ্রিত হতাশার সুর। বলল, ‘দক্ষিণ স্পেনের প্রায় পরিত্যক্ত শহর গ্রানাডার দরিদ্র মরিসকো পরিবারের সন্তান ড. আমির আবদুল্লাহ আন্দালুসি যা পারলো, আমাদের হাজারো বিজ্ঞানীরা তা পারল না?’
‘তিনি দরিদ্র মরিসকো ঘরের সন্তান বটে, কিন্তু তার বাল্য-কৈশোরের গোটা সময় কেটেছে মালাগা, গ্রানাডা, কার্ডোভার ভাঙা লাইব্রেরীগুলোতে। সে যেন কোন হারানো জিনিস অবিরাম খুঁজে ফিরেছে। কিছু পেয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু অনুসন্ধিতসু কিশোর মাদ্রিদের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কণা-পদার্থ বিজ্ঞানে সর্বকালের সর্বোচ্চ নাম্বার নিয়ে পাস করেছে। আর বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ‘ক্যারেক্টার’ অব ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজমের যে গবেষণাপত্র তিনি তৈরি করেন, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মান লাভ করে। সুতরাং তিনি সামান্য থেকে উঠে আসা হলেও একজন অসামান্য মানুষ। তাকে ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাগারগুলো যে কোন মূল্যে কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি নামমাত্র বেতনে সৌদি আরবের মদিনা বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখান থেকেই তিনি এসেছেন ওআইসির আইআরটি প্রজেক্টে।’
থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
কথা বলে উঠল আইজ্যাক বেগিন। বলল, ‘ড. আন্দালুসি যা পেরেছেন, তা আমাদের বিজ্ঞানীরা না পারাটা বিস্ময়ের নয়। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নিউটন আবিষ্কার করেন, আর কোন বিজ্ঞানী পারেননি। আইনস্টাইন আবিষ্কার করেন, আপেক্ষিক তত্ব। অন্য কোন বিজ্ঞানীর পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানের জগতে এটাই ঘটে।’
‘স্যার, এখন তাহলে আমাদের করনীয়? আমার মনে হচ্ছে, আমাদের দুনিয়ার এখন প্রথম এবং একমাত্র কাজই হবে, যে কোন মূল্যে সোর্ডের ফর্মুলা হস্তগত করা এবং বিজ্ঞানীদের সমেত আইআরটিকে ধ্বংস করা।’ বলল স্মার্থা।
‘সেটাই তো আমরা চাচ্ছি। কিন্তু হচ্ছে কই। আমাদের চলার পথ তো ধীরে ধীরে সংকুচিতই হয়ে পড়ছে। স্মার্থা, তুমি যা বলেছ আমরা সেটাই চিন্তু করছি। যে কোন মূলেই আমরা সোর্ডের ফর্মুলা হাত করব এবং আইআরটিকে অবশ্যই আমরা চলতে দেব না।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘আমাদের অনেক ক্ষতি হলেও আমরা একটা বড় সাফল্য পেয়েছি। প্রফেসর বেগভিচের আত্মা শান্তি পাক। তার চেষ্টাতেই আমরা আইআরটির প্রধান বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাসার সন্ধান পেয়েছি। এখন আমরা কার্যকরী কিছু ভালো পদক্ষেপের দিকে এগোতে পারব।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘সেই পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে কি চিন্তা করেছেন? আমাদের কিন্তু দ্রুত এগোতে হবে। অনেক সময় আমাদের নষ্ট হয়েছে ইতিমধ্যেই।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘ড. আন্দালুসিকে ভয় দেখিয়ে আমরা কাজ আদায় করব। সেটা ব্যর্থ হলে আমরা তাকে কিডন্যাপ করে ফর্মুলা আদায়ের ব্যবস্থা করব। কিন্তু অনেক বিবেচনার পর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, তাকে ভয় দেখিয়ে কিংবা কিডন্যাপ, নির্যাতন করে কিংবা হত্যার ভয় দেখিয়েও তার কাছ থেকে কিছু আদায় করা যাবে না। তিনি তার জীবনের চেয়ে আইআরটি’র স্বার্থ, জাতির স্বার্থকে অনেক বড় বলে মনে করেন। সুতরাং আমরা ভাবছি যে, তিনি তার জীবনের চেয়ে যাকে বেশি ভালোবাসেন, যার ক্ষতি তিনি সহ্য করতে পারবেন না, এমন কিছুর উপর আমাদের হাত দিতে হবে। এই লক্ষ্যে আমরা তার পারিবারিক তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছি। শীঘ্রই আমরা এ বিষয়ে একটা কমপ্লিট চিত্র পেয়ে যাব। আমরা এখন তারই অপেক্ষা করছি।
‘ধন্যবাদ ড. ডেভিড ইয়াহুদ। আপনারা ঠিক পথে এগোচ্ছেন। ড. আন্দালুসির মত আদর্শনিষ্ঠ ও জাতিগত- প্রাণ লোকদের শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে বা ক্ষতি করে দূর্বল করা যায় না। আঘাত দিতে হয় এদের মনে। এরা নীতিনিষ্ঠ, আদর্শবাদী বলে তাদের মনটা স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। তাই তাদের মনে উপযুক্ত আঘাত পড়লে তাদের আদর্শিক ও মানসিক প্রতিরোধ ধ্বসে পড়ে। সুতরাং ড. আন্দালুসির ব্যাপারে আপনারা সঠিক পথ বেছে নিয়েছেন।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘কিন্তু আহমদ মুসাকে পথ থেকে সরাতে না পারলে এই কাজ নিরাপদ হবে না বলে আমি মনে করি। এই ইস্তাম্বুলেই সে আমাদের অনেকগুলো উদ্যোগ র্ব্যথ করে দিয়েছে।’ ইসরাইলী রাষ্ট্রদূত বলল।
‘আহমদ মুসা ও সোর্ড- এর ফর্মূলা দু’টিই আমাদের নাম্বার ওয়ান প্রায়োরিটি। এ ব্যাপারে উপর থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আহমদ মুসার একদিন বেঁচে থাকা মানে আমাদের হায়াত একদিন কমে যাওয়া। আমাদের দুর্ভাগ্য বসফরাস ব্রীজ থেকে পড়েও সে বেঁচে গেল। বারবার গুলীর মুখ থেকে বেঁচে গেছে। তার আমরা কোন ক্ষতি করতে পারিনে, তার হাতে আমাদের ক্ষতি আকাশ স্পর্শ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল আমাদের জন্যে স্বর্গভূমি, সেখান থেকে আমরা উৎখাত হয়েছি। আমাদের কিছু বিজ্ঞানী ও আমলা নাম ভাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টিকে আছে বলেই কিছু সুবিধা আমরা পাচ্ছি। যেখানেই আমাদের প্রজেষ্ট সেখানেই আহমদ মুসা। এই আহমদ মুসা তুরস্কেও এসেছে। একথা ঠিক, সে থাকবে আর আমরা সফল হবো, এটা অসম্ভব। বিজ্ঞানী ও আহমদ মুসাকে এক সাথেই ধরতে হবে।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘আহমদ মুসা এক জায়গায় থাকে না, সর্বশেষ তথ্য হলো সে এখন হেলিকপ্টার ব্যবহার করে।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আইজ্যাক বেগিনের। বলল, ‘আহমদ মুসাকে তুর্কি সরকার এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে!’
‘ওআইসি নিশ্চয় এর পেছনে রয়েছে। কারন আইআরটি তো ওআইসির একটি প্রতিষ্ঠান। ওআইসি গুরুত্ব দিলে তুর্কি সরকার অবশ্যই গুরুত্ব দিতে বাধ্য। তাছাড়া আমি শুনেছি, খালেদ খাকান ওরফে আহমদ মুসা খোদ তুর্কি প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মেহমান হিসেবে এখানে এসেছে।’ ইসরাইলী রাষ্ট্রদূত বলল হতাশ কন্ঠে।
‘স্বাভাবিক। স্বপ্ন তারা দেখতেই পারে। অটোম্যানদেরই উত্তরসূরী তো তারা! কিন্তু স্বপ্নটা তারা বেশি দেখে ফেলেছে। এই স্বপ্ন শীঘ্রই মুখ থুবড়ে পড়বে। অটোম্যানদের সেই দিন আর ফিরে…।’
কথায় ছেদ পড়ল আইজ্যাক বেগিনের।
পকেটের মোবাইল বেজে উঠেছে তার।
কথা বন্ধ করে মোবাইল তুলল আইজ্যাক বেগিন।
মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে একনজর তাকিয়েই মুখের কাছে নিয়ে বলল, ‘বল অ্যালিয়াস, কোন-খবর?’
অ্যালিয়াস সিজলি এলাকায় বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির নতুন বাড়ির আশে-পাশে মোতায়েন ‘থ্রি জিরো’র লোকদের একজন।
‘স্যার, বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি চলে যাচ্ছেন। তিনি হেলিকপ্টারে উঠছেন। তার বাড়ির লনেই হেলিকপ্টারটা রয়েছে।’ বলল অ্যালিয়াস।
‘যেতে পারেন। হয়তো ইনস্টিটিউট থেকে ডাক পড়েছে। উইকএন্ডটা গোটা দিন বাসায় থাকতে পারলেন না। তুমি হেলিকপ্টারের পাশে মানে বিজ্ঞানীকে বিদায় দিতে আসা কাউকে দেখছ?’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘দেখছি স্যার। একজন সুবেশধারী মহিলাকে দেখছি। তার পেছনে পরিচারিকা ধরনের আরও দু’জন মহিলা এবং আরও দুতিন জন লোক। পেছনের এরা সবাই কাজের মানুষ বলে মনে হচ্ছে।’ বলল অ্যালিয়াস।
‘সুবেশধারী তাঁর স্ত্রী হতে পারেন। বয়স কত মনে হচ্ছে?’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘স্যার তিরিশের মত বয়স হবে।’ বলল অ্যালিয়াস।
‘বয়সের পার্থক্য ঠিক আছে। মুসলমানদের আইডিয়েল পরিবারগুলোতে ৫ থেকে ১০ বছরের পার্থক্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে থাকে। নিশ্চিত উনি ম্যাডাম আন্দালুসি।’
থামল আইজ্যাক বেগিন।
‘কোন নির্দেশ স্যার?’
‘হ্যাঁ, বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি চলে যাচ্ছেন। তোমাদের কাজ বেড়ে যাচ্ছে। তোমরা বিজ্ঞানীর পরিবার সম্পর্কে আরও খোঁজ খবর নাও। বাড়িতে কে কখন আসা-যাওয়া করে তার তালিকা রাখ। অন্যান্য খোঁজ আমরা নিচ্ছি। আবার কোন দিন বিজ্ঞানী আসছেন সে খোঁজ নাও। বিজ্ঞানীর সাথে আমরা একবার কথা বলব, তারপর যা করার তা আমরা করব। বাড়ির চাকর-বাকর, লোকেরা যারা বাইরে বের হয়, তাদের সাথে সম্পর্ক কর এবং বাড়ির নিয়ম-কানুন, রুটিন সম্পর্কে জান। কিন্তু সাবধান, কোনোভাবেই ওদের মনে যেন তোমাদের সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক না হয়।’
‘আপনাদের এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন হবে স্যার।’
‘ধন্যবাদ অ্যালিয়াস।’
মোবাইল রেখে দিল আইজ্যাক বেগিন। তাকাল ড. ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘ড. ইয়াহুদ, বিজ্ঞানীর বাড়িটার একটা নক্সা আপনার কাছে দেখেছি, সেটা রুম-অ্যারেঞ্জমেন্টর ডিজাইন। আমাদের প্রয়োজন ডিটেইল লে-আউট।’
‘আমরা সেটার সন্ধান করেছি। বাড়িটার নির্মাতা ইস্তাম্বুলের পূর্ব বিভাগ। পূর্ব বিভাগে বাড়ির লে-আউট থাকার কথা। কিন্তু সেখানে পাওয়া যায়নি।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘ড. ইয়াহুদ, আপনি সুইচ দূতাবাসে যোগাযোগ করুন। ওখানে জোসেফ জাকারিয়া আছে ডাইরেক্টর এ্যাডমিনিস্ট্রেশন হিসেবে। তার কাছে সাহায্য পাবেন। ওরা ভাড়া নেবার সময় বাড়ির লে-আউট নিশ্চয় নিয়েছিল, কিংবা তারা একটা লে-আউট তৈরি করেছিল। যা হোক, আমরা যা চাই, ওদের কাছ থেকে তা পাওয়া যাবে।’
ড.ডেভিড ইয়াহুদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা দিক আপনি সামনে নিয়ে এসেছেন। বিষয়টা আমার মনেই হয়নি। ধন্যবাদ মি. বেগিন। আমরা অবশ্যই…।’
ডেভিড ইয়াহুদের কথা শেষ না হতেই উঠে দাঁড়াল আইজ্যাক বেগিন। বলল, ‘ধন্যবাদ ডেভিড ইয়াহুদ। আমি উঠছি। জরুরি কাজ আছে।’
ড. ডেভিড ইয়াহুদও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চলুন আমিও বেরুবো।’ বেরিয়ে এল তারা সবাই ঘর থেকে।
ড. ডেভিড ইয়াহুদ তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জেমস জোসেফ, তোমার হাতে মাত্র এক ঘন্টা সময় আছে। তোমার এ্যাপয়েনমেন্টা রাত ঠিক আটটায়। রেড়ি হয়ে নাও।’
জেমস জোসেফও ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘ঠিক আছে স্যার। আমি যাচ্ছি’
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে জেমস জোসেফ ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
জেমস জোসেফ বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়িতে অভিযানের নতুন সদস্য। সে ইস্তাম্বুলের ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির মেকানিক্যাল স্পেস সাইন্সের ছাত্র। সেই সাথে সে জায়নবাদী আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার সক্রিয় কর্মী।
জেমস জোসেফ বেরিয়ে যেতেই বাইরে গাড়ি দাঁড়াবার শব্দ হলো। কয়েক মুহূর্ত পরে ঘরে ঢুকল আইজ্যাক বেগিন।
ঘরে ঢুকেই বলল, জেমস জোসেফকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম। সব রেডি তো। ওরা তো বেরুচ্ছে ঠিক সময়ে?’
‘হ্যাঁ, ঠিক সময়ে বেরুচ্ছে। স্মার্থা এবার নেতৃত্বে আছে। আপনি সব ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ডেলিগেশনের সাথে স্মার্থা বেমানান।
‘স্মার্থা শিক্ষকতা করলেও সে ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে কণাবিজ্ঞানের একটা বিষয়ের উপর পিএইচডি করছে। সুতরাং বেমানান হওয়ার কথা নয়।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘ধন্যবাদ ডক্টর। আমি খুব উদ্বিগ্ন। ক’দিন আমি ছিলাম না। এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। বিস্তারিত একটু বলুন ডক্টর।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘সত্যিই অনেক কিছু ঘটে গেছে।’
বলে একটু থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
সোজা হয়ে বসল চেয়ারে। বলল, ‘বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়ি আমরা যতটা প্রটেকটেড মনে করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক সুরক্ষিত বাড়িটা। আমরা নিশ্চিত হয়েছি, বিজ্ঞানীর বাড়ির কাজের লোকগুলো অবশ্যই পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগের লোক। মোতায়েনকৃত আমাদের লোকেরা তাদের কাছ থেকে কথা আদায় করতে গিয়ে বিপদে পড়ার মুখোমুখি হয়েছে। প্রয়োজনীয় কোন কথা আদায় করতে পারেনি। যে কথাগুলো তারা আদায় করতে পেরেছে তা উল্টা-পাল্টা বা ফাঁদ জাতীয় বলেই আমাদের মনে হয়েছে।’
‘পরীক্ষামূলকভাবে হকার-ফেরিওয়ালা পাঠাবার যে কথা হয়েছিল, সেটার কিছু করা গেছে?’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘ও পরীক্ষাও হয়ে গেছে। ফেরিওয়ালা, নিউজপেপার হকার ও হোম সার্ভিসের লোকদের পাঠিয়েছিলাম। ওরা গেট পর্যন্তও পৌঁছতে পারেনি। তার আগেই তাদের ধরে ফেলা হয়েছে। অবশ্য পরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ওরা আমাদের লোক, কিন্তু সেই সাথে ওরা প্রকৌশলীও। সুতরাং কোন অসুবিধা হয়নি। তবে পরিষ্কার হয়েছে, বিনা বাধায় বিজ্ঞানীর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারা যাবে না। জোর করে যাওয়ার চেষ্টা করলে লড়াই করতে হবে নিঃসন্দেহে।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘জেমস জোসেফদের দ্বারা যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন, সেটার ব্যাপারে আপনি কতটা নিশ্চিত?’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘হ্যাঁ। অনেক চিন্তা করে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ছেলেরা যদি বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির সাথে দেখা করার একটা অফিসিয়াল উদ্যোগ নেয় তাহলে তারা সে অনুমতি পেতে পারে। এমন ভাবনা থেকেই জেমস জোসেফকে দিয়ে ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির এক গ্রুপ ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রকে উৎসাহিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রদের রিসার্চ ফোরাম আছে। তারা বিজ্ঞান-টেকনোলজির অত্যাধুনিক টপিক্সের উপর মাঝে মাঝেই সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল ও গ্রুপ জিসকাশনের আয়োজন করে। বড় বড় বিজ্ঞানী ও শিক্ষকদের এসব অনুষ্ঠানে আনা এবং তাদের সাথে গ্রুপ করে দেখা করা তাদের নিয়মিত প্রোগ্রামের অংশ। তাদের এসব প্রোগ্রাম ও পরিচয়ের নানারকম পেপারস-ব্রসিয়ারস আছে। জেমস জোসেফ এই ফোরামের একজন সদস্য, অবশ্য মূল বডিতে সে নেই। তবে তার প্রস্তাবকে তারা গ্রহণ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আইআরটির টেলিফোন নাম্বার যোগাড় করে ফোরামের প্রেসিডেন্ট বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে টেলিফোন করে। ফোরামের একটা গ্রুপ তার সাথে দেখা করতে চাইলে বিজ্ঞানী তার অপরাগতার কথা প্রকাশ করেন। এই অবস্থায় ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির কণাবিজ্ঞান বিভাগের ডীন ড. ফাতিমা বাদরুমা ফোরামকে পরামর্শ দেন তাদের ‘হিস্ট্রি এন্ড মেথডলজি অব স্ট্রাটেজিক রির্সাচ’ বিষয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ড. সারার সাহায্য নিতে। তিনি জানান, কিছুদিন আগে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সায়েন্স এন্ড ইমান বিল গায়ে’-এর উপর সাড়া জাগানো যে আন্তর্জাতিক সেমিনার হয়, তাতে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি ও ড. সারা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। আমি তখন দেখেছি মার্কিন স্ট্রাটেজিক রিসার্চেও ড. সারাকে ড. আন্দালুসি খুব রেসপেক্ট করেন। তিনি যদি ফোরামের পক্ষে ড. আন্দালুসিকে অনুরোধ করেন, তাহলে ড. আন্দালুসি নিশ্চত রাজি হবেন। ড. ফাতিমা বাদরুমার পরামর্শ অনুসারে ফোরাম প্রতিনিধিরা ড. সারার সাথে দেখা করে তাঁকে অনুরোধ করেন। প্রতিনিধি দলে জেমস জোসেফও ছিল। সেই ফোরামের পক্ষ থেকে একটা ফোল্ডার তৈরি করে ড. সারাকে দেয়া হয়। ড. সারা অনেক আলোচনা ও জিজ্ঞাসাবাদের পর ফোরামের পক্ষে ড. আন্দালুসিকে অনুরোধ করতে রাজি হন। তার অনুরোধেই ড. আন্দালুসি রাজি হন ফোরামকে সাক্ষাৎকার দিতে। আমরা চেয়েছিলাম ড. আন্দালুসি যেন তাঁর বাড়িতে সাক্ষাৎ দিতে রাজি হন। এ জন্যেই সিজলি এলাকায় তার বাড়ির কাছের ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ফোরামকে আমরা ব্যবহার করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। সাক্ষাৎ দিতে রাজি হওয়ার পর ড. আন্দালুসি বলেন, অফিসে আমি কাউকে সাক্ষাৎ দেই না। তার উপর আগামী শুক্রবার সিজলিতে আমার বাসাতেই থাকব। বিশ্ববিদ্যালয়ও ঐ এলাকাতেই। সুতরাং সাক্ষাৎটা আমার বাসাতেই হবে।’ থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
খুশিতে উঠে দাঁড়িয়েছে আইজ্যাক বেগিন। সে হাত বাড়িয়ে ড. ইয়াহুদের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ইশ্বর আমাদের সাহায্য করছেন। না হলে এতবড় সুযোগ আমরা এভাবে পেয়ে যাই! এখন বলুন, অপারেশন টিমটা আপনার কেমন হয়েছে। তারা পরিকল্পনা অনুসারে ড. আন্দালুসিকে তার স্ত্রী সমেত ওখান থেকে বের করতে পারবে তো?’
‘অবশ্যই বিজ্ঞানীর বাসার মূল অপারেশনে নেতৃত্ব দেবে স্মার্থা। তার সাতে আমাদের আটজন চৌকশ কমান্ডো। জেমস জোসেফ এদের সাথে থাকবে। কারণ যেখানে ওদের আটকে রাখা হবে, সেটা জেমস জোসেফেরই জানা। অন্যদিকে বিজ্ঞানীর বাসায় যাওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রতিনিধিদলকে কিডন্যাপ করবে অন্য একটা কমান্ডো দল। এরও নিরাপদ পরিকল্পনা করা হয়েছে। আটকে রাখার জায়াগাও ঠিক করা আছে। আমাদের লোকদের প্রত্যেকের ডুপ্লিকেট আইডি কার্ড তৈরি করা হয়েছে। এই আই ডি কার্ডগুলো নিয়ে ছাত্র সেজে আমাদের স্মার্থা বাহিনী বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়িতে প্রবেশ করবে। ছাত্র প্রতিনিধি দলের যে নাম পরিচয় বিজ্ঞানীকে আগেই সরবরাহ করা হয়েছে, তাতে কারও ছবি নেই, ছবি তারা চায়ওনি। সুতরাং কোন দিক দিয়ে কোন অসুবিধা হবে না।’
খুশিতে আইজ্যাক বেগিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘আপনি বললেন, বিজ্ঞানীর বাড়িতে চাকর-বাকর যারা আছে, তারা হয় পুলিশের না হয় গোয়েন্দা বিভাগের লোক। বাড়িতে তাদের সংখ্যা কত হতে পারি এ ব্যাপারে কিছু জেনেছেন?’
‘বিজ্ঞানীর বাড়ির উপর আমাদের যারা চোখে রেখেছে, তাদের মতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে যারা বাইরে এসেছে, তাদের সংখ্যা পাঁচ-ছয় জনের বেশি নয়।’
‘তার মানে বিজ্ঞানীর বাড়িতে ঐ ধরনের লোক সাত আটজনের বেশি হবে না। আর তোমার স্মার্থা বাহিনীতে থাকছে ১০ জন। তুমি কি মনে করছ? সাফল্যের ব্যাপারে কিন্তু কোন ঝুঁকি থাকা চলবে না।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘কোন চিন্তু নেই। আমার লোকরা প্রস্তুত অবস্থায় প্রথম আঘাত করবে। ওরা থাকবে অপ্রস্তুত। স্মার্থার পরিকল্পনা হলো, প্রথম আঘাতেই ওদের অধিকাংশ লোককে টার্গেটে নিয়ে আসা। এজন্যে কথা হয়েছে, সাক্ষাতের এক পর্যায়ে আমাদের লোকরা চোখের পলকে গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়বে এবং একযোগে আক্রমণ করবে। ওদেরকে প্রস্তুতির কোন সুযোগ দেয়া যাবে না। শুধু বিজ্ঞানী ও তার স্ত্রীকে কোন আঘাত করতে নিষেধ করা হয়েছে। ওদের ধরে নিয়ে যেতে হবে।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘কেন, বিজ্ঞানীর বাচ্চাদের বাদ দিচ্ছেন কেন? ওদের ধরে নিয়ে যেতে হবে। স্ত্রীর সাথে ওরাও হবে বিজ্ঞানীকে কথা বলাবার অব্যর্থ টোপ।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘না, বিজ্ঞানীর ছেলে-মেয়েরা এখন এখানে নেই। এই তথ্য আমরা নিশ্চিতই জানতে পেরেছি।’
বলেই দ্রুত ঘড়ির দিকে তাকাল ড. ডেভিড ইয়াহুদ। বলল, ‘এখন ১০টা বিশ মিনিট। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেলিগেটদের কিডন্যাপের অপারেশন এখন নিশ্চয় শেষ হয়েছে। স্মার্থা বাহিনী যাচ্ছে এখন বিজ্ঞানীর বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ডেলিগেশনের ছদ্মবেশে। কিন্তু এতক্ষনেও টেলিফোন আসছে না কেন? প্রথম অপারেশনের পরেই তার খবর জানানোর কথা ছিল।’
থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
তাকাল আবার ঘড়ির দিকে।
সংগে সংগেই বেজে উঠল তার মোবাইল।
দ্রুত মোবাইল মুখের কাছে তুলে ধরল ড. ডেভিড ইয়াহুদ। ওপারের কন্ঠ শুনেই বলল, ‘বল জেমস জোসেফ, সুখবর?’
‘জি স্যার। অপারেশন সাকসেসফুল। দু’টি ক্লোরোফরম টাইম বোমার স্বয়ংক্রিয় বিস্ফোরণে দুই গাড়ির সবাই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। পরে আমাদের ড্রাইভার গাড়ি দু’টিকে ড্রাইভ করে সিজলি পাহাড়ে নিয়ে যায়। একটা ঝোঁপে তাদের সংজ্ঞাহীন দেহ লুকিয়ে রেখে গাড়ি নিয়ে চলে আসে। ম্যাডাম স্মার্থার নেতৃত্বে আমরা নতুন ছাত্র ডেলিগেটরা এখন যাচ্ছি বিজ্ঞানীর বাড়ির দিকে।’
‘ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাদের। টেলিফোনটা স্মার্থাকে দাও।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা।
ওপার থেকে স্মার্থার গলা পেতেই ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল, ‘এখন আর কোন কথা নয়। গড ব্লেস ইউ স্মার্থা। এটাই আমাদের সর্বোচ্চ সুযোগ। লক্ষ্য অর্জনের জন্য আশা করি সব কিছুই করবে। গড ব্লেস ইউ। গুড বাই।’
মোবাইল রেখে দিল ড. ডেভিড ইয়াহুদ। বলল আইজ্যাক বেগিনের দিকে তাকিয়ে, ‘ওরা বিজ্ঞানীর বাড়িতে যাত্রা করেছে মি. আইজ্যাক বেগিন। ঈশ্বরকে ডাকুন।’
‘গড হেলপ আস।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘সামনে আধ ঘন্টা সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসুন আমরা সুখবরের জন্য অপেক্ষা করি।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘ঠিক আছে। কিন্তু সুড়ঙ্গ পথ সম্পর্কে ওদের সুস্পষ্ট ধারণা আছে তো। ঠিকভাবে বুঝতে না পারলে বিজ্ঞানী ও তার স্ত্রীকে নিয়ে পালানোর সব আয়োজন পন্ড হয়ে যাবে।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘সে রকম কোন অসুবিধা হবে না। অপারেশন টীমে যারা আছে, তারা প্রত্যেককেই বাড়ির নকশা, ঘরগুলোর নকশা, সুড়ঙ্গের মুখ এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়া হয়েছে।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
আইজ্যাক বেগিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ।’
বলে সোফায় গা এলিয়ে দিল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে বলল, ‘মাফ করবেন ড. ইয়াহুদ, একটা জরুরি টেলিফোন সেরে নেই।’
‘অবশ্যই।’ বলল ড. ইয়াহুদ।

আইআরটি-তে রোববারের সকাল।
ফরমাল অফিস নেই। তবু নাস্তার পর ড. শেখ আবদুল্লাহ বিন বাজ এবং আইটি ইঞ্জিনিয়ার ইসমত কামাল বেশ অনেকক্ষণ আগে অফিসে এসেছে।
অফিসের লাউঞ্জে বসে আহমদ মুসা তাদের সাথে আলাপ করছিল।
বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির দক্ষিণহস্ত তরুণ আলোক বিজ্ঞানী ড. ইবনুল আব্বাস আবদুল্লাহ সেসুসি লাউঞ্জে ঢুকল।
সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে এক জনের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখন দশটা বিশ মি. খালেদ খাকান। মাত্র বিশ মিনিট লেট। ছুটির দিনে এই লেট নিশ্চয় কাউন্টেবল নয়।’ ড. সেসুসির মুখে হাসি।
সকাল ৯টায় আহমদ মুসা অফিসে এসেছে। সকাল সাড়ে ৮ টায় ড. সেসুসি টেলিফোন করেছিল আহমদ মুসাকে। বলেছিল, আপনি যখন এসেছেন, তখন আমিও ১০টার দিকে লাউঞ্জে আসছি।
‘ওয়েলকাম ড. সেসুসি। ছুটির দিন না হলেও বিজ্ঞানীদের লেট দোষনীয় নয়। বিজ্ঞানীরা অংকে একেবারে অ্যাকুরেট বলেই ব্যক্তি জীবনের কাজ-কর্মে অনেক খানি বেহিসেবী। সুতরাং বিশ মিনিট লেট আমরা সানন্দে গ্রহন করলাম।’ হাসতে হাসতে বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। তবে মি. খালেদ খাকান বিজ্ঞানীদের এই বেহিসেবী হবার কথা তাদের পরিবারের কাছে না বলা উচিত। তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’ বলল ড. সেসুসি মুখ টিপে হেসে।
‘পরিস্থিতি আরও খারাপ না করার কথা বলছেন। তার মানে পরিস্থিতি এখন খারাপ। তাই কি ড. সেসুসি?’ বলল ড. আবদুল্লাহ বাজ। তার ঠোঁটে হাসি।
হাসল ড. সেসুসি। বলল, ‘সবে তো আমাদের সাথে আসলেন। আমাকে এখনো বুঝে সারেননি হয়তো। কিন্তু গত তিন মাসে আমাদের চার বিজ্ঞানীর বাড়িতে কয়েকবার গেছি। সেখানে ভাবীদের কাছে মজার মজার কথা শুনেছি। আল্লাহ নাকি বিজ্ঞানীদের মাথায় বস্তুবিজ্ঞানের জ্ঞান ও তার প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং সেই সাথে মগজ থেকে সংসার বুদ্ধির জ্ঞান কেটে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। আন্দালুসি ভাবীর কাছে এ অভিযোগ শুনেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘বিয়ের পর গত ২৫ বছরে তোমার স্যার একদিনের জন্যেও কোন অবকাশ সফরে নিয়ে যাবার সময় পাননি। আমার স্ত্রীর সামনে এ কথা বলায় আমি বিপদেই পড়েছিলাম।’
হেসে উঠল আহমদ মুসা ও ড. বাজ দু’জনেই। ড. বাজ বলল, ‘বিপদে পড়েছিলেন কেন, আপনার তো শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়েছে।’
‘ঠিক বলেছেন। পরের উইক এন্ডেই আমি উইক এন্ডের সাথে আরও দু’দিন যোগ করে স্ত্রীকে নিয়ে ‘লেক ভ্যান’-এ গিয়েছিলাম তিনদিনের অবকাশ যাপনে। নূহ আ.- এর কিস্তির মাউন্ট আরারা দেখা আমার স্ত্রীর একটা বড় শখ ছিল।’ বলল ড. সেসুসি। তার মুখে হাসি।
‘তাহলে আল্লাহ নিশ্চয় বিশেষ আনুকুল্য দেখিয়ে আপনার মগজের সংসার-বুদ্ধির সবটুকু অংশ কেটে রাখেননি।’ বলল আহমদ মুসা মিষ্টি হেসে।
‘আল হামদুলিল্লাহ। দোয়া করুন, দয়া করে আর যেন না কাটেন। ঘরের বিপদের মত বড় বিপদ আর নেই। গত উইক এন্ডেও ড. আন্দালুসি বাসায় যাননি। এ উইক এন্ডেও যেতে পারলেন না।’ ড. সেসুসি বলল। তার মুখেও মিষ্টি হাসি।
আহমদ মুসা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘তা ঠিক। কিন্তু ড. আন্দালুসি মিসেস আন্দালুসির অনুমতি নিয়েছেন। মিসেস আন্দালুসি শুধু অনমুতিই দেননি, বলেছেন, ‘দেশ, ধর্ম, জাতি, সর্বোপরি মানুষের প্রয়োজনে ড. আন্দালুসি যা করেন তার সাথে তিনি আছেন।’
গম্ভীর হয়ে উঠল ড. সেসুসির মুখও। বলল, ‘ম্যাডাম রসিকতা করে অনেক সময় অনেক কথা বলেন। কিন্তু তিনি একজন মডেল বিজ্ঞানীর মডেল স্ত্রী। তিনি একদিন হাসতে হাসতে আমাকে বলেছেন, ‘বেটা! বিজ্ঞানীদের স্ত্রীরা কিন্তু স্বভাবগতভাবে বিজ্ঞানের সতীন। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের ও তাদের স্ত্রীদের কিন্তু সচেতন থাকা দরকার। স্ত্রীরা অবশ্যই ত্যাগ স্বীকার করবে, কিন্তু স্বামীদের তার স্বীকৃতি দেয়া উচিত, ঠিক যেমন তোমার স্যার দিয়ে থাকেন।’
ড. সেসুসি কথা শেষ করে একটু থেমে আবার বলে উঠল, ‘ম্যাডামের কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে।’
ড. সেসুসি কথা শেষ করতেই আহমদ মুসার মোবাইল বেজে উঠল।
আহমদ মুসা মোবাইল বের করে স্ক্রীনের দিকে চেয়ে জোসেফাইনের নাম দেখেই বলল, ‘মাফ করবেন, আমি কলটা রিসিভ করছি।’
বলে আহমদ মুসা সোফা থেকে উঠে ঘরের একটা প্রান্তে সরে গেল।
‘হ্যালো, জোসেফাইন। আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। আমরা ভাল আছি। এইমাত্র আমার সেই বান্ধবী জেফি জিনা একটা খবর দিল। মনে হয় খবরটা খুব খারাপ।’ বলল জোসেফাইন।
‘খবরটা খুব খারাপ?’ দ্রুত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘আজ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির একটা ছাত্র প্রতিনিধিদলের সাথে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির সাক্ষাতকার ছিল বিজ্ঞানীর সিজলির বাড়িতে। এই উপলক্ষে জেফি জিনাকেও চায়ের আমন্ত্রণের কথা বলেছিলেন বিজ্ঞানী। জেফি জিনা……….।’
জোসেফাইনের কথায় বাধা দিয়ে আহমদ মুসা মাঝখানেই বলে উঠল, ‘সেখানে কিছু ঘটেছে?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘সেখানে কিছু ঘটার কথা নয়, একটা সন্দেহজনক ঘটনার খবর দিয়েছে জেফি জিনা।’
মুহূর্তের জন্যে থামল জোসেফাইন, তারপর বলে উঠল, ‘জেফি জিনা বিজ্ঞানীর বাড়ি যাচ্ছিলেন তার গাড়িতে করে। তিনি ছাত্র প্রতিনিধি দলের দু’টি মাইক্রো দেখেছিলেন তার সামনে। তিনি দেখেন, মাইক্রো দু’টি ডানদিকে শেষ একজিট রোড পার হয়ে বিজ্ঞানীর বাড়ির দিকে কয়েক গজ এগিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। থামাটা এত আকস্মিক ছিল যে, পেছনের মাইক্রোটা সামনের মাইক্রোকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। পরক্ষণেই রাস্তার পাশ থেকে দু’জন লোক হঠাৎ বেরিয়ে এসে দুই মাইক্রোর ড্রাইভিং সিটে উঠে যায়। তার পরেই মাইক্রো দু’টি দ্রুত ঘুরে সেই ডানের একজিট রোড ধরে ডান দিকে চলে যায়। জেফি জিনা ততক্ষণে ডানর একজিট রোডটার কাছে এসে পড়েছিল। যখন মাইক্রো দু’টি ঘুরে দাঁড়িয়ে ডানের রোড ধরে চলছিল, তখন জেফি জিনা সেই দু’জন ড্রাইভারের পাশে বসা একজনকে দেখেন যাকে ছাত্র বলে তিনি চিনতে পারেন। সে ছাড়া মাত্র প্রতিনিধিদলের কাউকে গাড়ির সিটে বসা দেখতে পাননি। বিস্মিত হন জেফি জিনা। তিনি রাস্তা থেকে একটু সরে গাড়িটা দাঁড় করান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেলিফোন করে ছাত্র প্রতিনিধিদলের যে কারও টেলিফোন যোগাড়ের চেষ্টা করেন। টেলিফোন নাম্বার পেতে দেরি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কণাবিজ্ঞান বিভাগের ডীনের অফিস থেকে প্রতিনিধিদলের নেতা ছাত্রটির টেলিফোন নাম্বার পেয়ে যান। কিন্তু তিনি টেলিফোন করার চেষ্টা করাকালেই মাইক্রো দু’টিকে দ্রুত ফিরে আসতে দেখেন। তিনি মোবাইল রেখে ড্যাশ বোর্ড থেকে তার দুরবিনটা নিয়ে তাকান মাইক্রোর দিকে। পরে দুই মাইক্রোতে ওঠা দু’জন লোককেই ড্রাইভ করতে দেখেন। কিন্তু সিটগুলোতে বসা যাদের দেখলেন, তাদেরকে তার ছাত্র বলে মনে হয়নি। জেফি জিনার বিস্ময় সন্দেহে পরিণত হয়। তিনি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া প্রতিনিধি দলের নেতা ঐ ছাত্রের নাম্বারে টেলিফোন করেন। কিন্তু বারবার টেলিফোন করেও কোন উত্তর পাননি তিনি। বারবারই নো-রিপ্লাই হয়। ততক্ষণে মাইক্রো দু’টি চলে গেছে। বিজ্ঞানীর বাড়ি সেখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু প্রবল দ্বিধায় পড়েন তিনি। তার নিশ্চিত মনে হয়, ঐ দুই মাইক্রোতে যারা গেছে তারা ছাত্র-প্রতিনিধি দল নয়। প্রবল ……..।’
‘ইন্নালিল্লাহ…। স্যরি জোসেফাইন, তুমি একটু হোল্ড কর। তোমার সাথে আরও কথা বলতে হবে। আমি একটা টেলিফোন করে নেই।’
বলেই কল হোল্ড করে আহমদ মুসা দ্রুত ওয়ান টাস ডায়ালে জেনারেল মোস্তফা কামালকে টেলিফোন করল। ওপার থেকে তার কণ্ঠ পেতেই সালাম দিয়ে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘জেনারেল, এখনি আপনি সিজলি এলাকার পুলিশ ষ্টেশনগুলোকে দ্রুত বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়িতে পৌছার জন্যে মুভ করতে বলুন। আর আপনি বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে টেলিফোন করুন। জরুরি।’
‘বুঝতে পারছি কিছু ঘটেছে। কি ঘটেছে? বাড়িতে তো আমাদের শক্তিশালী গোয়েন্দা টিম রয়েছে।’ দ্রুত, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ছাত্র-প্রতিনিধিদলের সাথে ড. আন্দালুসির একটা সাক্ষাতকার ছিল আজ সকালে। যা খবর পেলাম, তাতে মনে হচ্ছে ছাত্র প্রতিনিধিদলকে কিডন্যাপ করে শত্রু পক্ষের কেউ সেখানে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ও গড! বুঝেছি। আমি পুলিশ ষ্টেশনগুলোতে টেলিফোন করছি। আমরা যাচ্ছি সেখানে, আপনি প্লিজ আসুন মি. খালেদ খাকান।’
বলেই ‘আসসালাম’ কথাটি কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করে কল লাইন কেটে দিল।
আহমদ মুসা জোসেফাইনের হোল্ড লাইনটা অন করে বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘মনে হয় সাংঘাতিক কিছু ঘটে গেছে সেখানে। তোমার বান্ধবী জেফি জিনা শেষ পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?’
‘প্রবল দ্বিধা নিয়ে অবশেষে তিনি বিজ্ঞানীর বাড়ির দিকেই এগোন। কিন্তু বিজ্ঞানীর বাড়ির রাস্তায় যাবার আগেই দু’জন লোক এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। বলে, বিজ্ঞানী স্যারের বাড়ি যেতে হলে পাশ লাগবে। পাশ আছে কিনা। তখন জেফি জিনা জানান, তার দাওয়াত আছে সেখানে। কিন্তু সেই লোক দুজন বলে, ছাত্র প্রতিনিধি দলের পাশ ছিল, তাঁরা গেছে। পাশ না থাকলে আপনাকে যেতে দিতে পারি না। তখন জেফি জিনা তাদেরকে বলে, তোমরা যদি সরকারি কিংবা সিকিউরিটির লোক হও, তাহলে এখনি পুলিশকে খবর দিয়ে বিজ্ঞানী স্যারের বাড়িতে যাও। তার বিপদের আশংকা করছি আমি। সেই দু’জন লোক জানায়। ভয় নেই, বাড়িতে তাঁর নিরাপত্তার জন্যে ব্যবস্থা আছে। তার পরেই জেফি জিনা আমাকে টেলিফোন করে তোমাকে সব জানাবার অনুরোধ করে তিনি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেছেন।’
থামল জোসেফাইন।
‘তোমার বান্ধবীকে ধন্যবাদ জোসেফাইন। দোয়া করো, বিজ্ঞানী স্যারের যেন কোন বিপদ না হয়। যে উদ্দেশ্যে আমি এখানে এসেছিলাম জোসেফাইন, তা সম্পাদনে বোধ হয় ব্যর্থ হলাম। রাখি। দেখি ওদিকে কি অবস্থা।’ গম্ভীর অথচ ভাঙা কণ্ঠস্বর আহমদ মুসার।
‘তুমি তো ভেঙে পড়ার জন্যে নও। আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করবেন। ইনশাআল্লাহ তুমি সফল হবে। আমি রাখছি, আসসালামু আলাইকুম।’ গভীর মমতা মাখানো কণ্ঠ জোসেফাইনের।
আহমদ মুসা মোবাইল রাখল পকেটে।
ড. বাজ ও ড. সেসুসি চোখ-মুখ ভরা উদ্বেগ নিয়ে আহমদ মুসার দিকে অপলক দৃষ্টি রেখে পাথরের মত স্থির হয়ে বসে আছে।
আহমদ মুসা তাকাল তাদের দিকে। বলল, ‘শুনেছেন তো সব। খবর সত্য হলে, ধরেই নিতে হবে ড. আন্দালুসি বিপদে পড়েছেন।’ গম্ভীর ও শান্ত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘আমি কয়েকবার স্যারের মোবাইলে টেলিফোন করলাম। রিং হচ্ছে, কিন্তু কেউ এ্যাটেন্ড করছে না। এই মোবাইল সব সময় তিনি কাছে রাখেন।’ বলল ড. সেসুসি। কান্না ভেজা তার কণ্ঠ।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল ড. বাজ। আহমদ মুসা দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল তার আগেই, ‘আমি সিজলিতে যাচ্ছি। আপনারা অফিসে থাকুন।’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
ড. বাজ ও ড. সেসুসি উঠে দাঁড়াল।
‘স্যার, আমাদের জন্যে আর কোন নির্দেশ?’ বলল ড. বাজ।
‘আপনাদেরকেও সাবধান থাকতে হবে। ওরা ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হয়ে গেছে। আসি। আসসালামু আলাইকুম।’
সালাম নিয়ে ড. বাজ সংগে সংগেই বলে উঠল, ‘স্যার, আপনার নিরাপত্তা আমাদের জন্যে বেশি প্রয়োজনীয়। হেলিকপ্টার ওয়ার্কশপে, আসতে বলি?’
‘না ড. বাজ। তাতে আরও দেরি হয়ে যাবে। আমাকে এখনই বেরুতে হবে। আর সিজলি তো বেশি দূরে নয়।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল।

সিজলিতে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়ির সামনে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করতেই জেনারেল মোস্তফা হেলিকপ্টার থেকে লাফ দিয়ে নেমে ছুটল ড. আন্দালুসির বাড়ির দিকে। পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের টেলিফোনে আগেই জেনেছেন ড. আন্দালুসির বাড়িতে ৭টি লাশ ছাড়া কিছু নেই। পুলিশ প্রধানের হেলিকপ্টারটিকেও একটু দূরে দাঁড়ানো দেখল।
সিকিউরিটি কর্মীদের স্যালুটের মধ্যে দিয়ে জেনারেল মোস্তফা কামাল বিজ্ঞানী আন্দালুসির বাড়িতে ঢুকে গেল।
পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন জেনারেল মোস্তফা কামালকে স্বাগত জানাল। বলল, ‘বেজমেন্টসহ গোটা বাড়ি সার্চ করা হয়ে গেছে স্যার। যে সাতটি লাশ পাওয়া গেছে, তার সবই আমাদের গোয়েন্দাদের।’
‘ওদের লাশ পড়লেও তা তারা রেখে যায়নি নিশ্চয়?’ গম্ভীর কণ্ঠ জেনারেল মোস্তফা কামালের।
‘অবশ্যই।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘চলুন, আমি একটু দেখতে চাই, বাড়িটাই আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দাদের যারা বাইরে পাহারায় ছিল, তাদের বক্তব্য কি?’
‘কোন গোলা-গুলীর শব্দ তারা পায়নি। মনে করা হচ্ছে, তাদের রিভলবার, ষ্টেনগান সবকিছুতেই সাইলেন্সার লাগানো ছিল।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘কিন্তু আমাদের লোকরা তাদের চলে যেতে দেখলো না কেন? তারা কিভাবে হাওয়া হয়ে গেল বুঝতে পারছেন কিছু?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘মাইক্রো দু’টি বাইরে পড়ে আছে। আমাদের লোকেরা তাদের কাউকে বাড়ি থেকে বের হতেই দেখেনি। এটা ঠিক হলে দু’টি বিকল্প থাকে, এক. তারা বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে আছে এবং দুই. তারা বাড়ি থেকে কোন বিকল্প পথে পালিয়েছে।’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘বিকল্প পথটা কি?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘সুড়ঙ্গ পথ হতে পারে। কিন্তু আমরা বাড়ির একতলা ও বেজমেন্ট ইঞ্চি ইঞ্চি করে খতিয়ে দেখেছি। সুড়ঙ্গের কোন অস্তিত্ব আমরা পাইনি। আরেকটা কথা, আমরা এমনভাবে খুঁজেও কোন সুড়ঙ্গ পেলাম না, কিন্তু বাইরের লোকরা এসে তাড়াহুড়োর মধ্যে তা পেয়ে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। সুতরাং তাদের অন্তর্ধান একটা বড় রহস্য!’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘আসুন, আরেকবার আমরা দেখি বাড়িটা।’
বলে পা বাড়াল জেনারেল মোস্তফা কামাল। তার পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনসহ আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসার।
আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরসহ সব ফ্লোর ও ঘর দেখে জেনারেল মোস্তফা পুলিশ প্রধানসহ আবার ফিরে এল ড্রইংরুমে।
বসল দু’জনেই সোফায়। দু’জনের চোখে-মুখে উদ্বেগ।
পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন সোফায় সোজা হয়ে বসে মনে হয় কিছু শোনার জন্যে অপেক্ষা করল। তারপর বলল, ‘স্যার, কোন সুড়ঙ্গ পথ যদি না থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে পেছনের দরজা দিয়েই তারা পালিয়েছে। পেছনের পনের গজ দূরে বাউন্ডারি ওয়াল। ওয়ালের বাইরে একটা প্রাইভেট রোড আছে। সেখানে গাড়ি রেখে এসে থাকলে এ দিক দিয়ে পালিয়ে যাবার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়।’
সোফায় মাথা রেখে দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বসেছিল জেনারেল মোস্তফা কামাল। সেও সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘দু’জন লোককে কিডন্যাপ করে ডজন খানেক লোক পেছনের বাউন্ডারি ওয়াল ডিঙিয়ে চলে যাবে, বাইরে মোতায়েন করা আমাদের কোন লোকের নজরে পড়বে না, এটা স্বাভাবিক নয় মি. নাজিম এরকেন।’
‘এ যুক্তিও ঠিক স্যার, কিন্তু বাড়ির তিনদিকে বাগান থাকলেও বাড়ির পেছনে গাছ-গাছড়াটা একটু বেশি। এছাড়া আমাদের লোকদের নজর কিন্ত বাড়ির সামনের গেট ও বাড়ির এ্যাপ্রোস রোডের উপর বেশি ছিল। বাড়ির ঠিক পেছনে সরাসরি কোন পাহারা ছিল না। ওয়ালের বাইরে প্রাইভেট রোডটার উপর চোখ রাখার ব্যবস্থা ছিল। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তাদের চোখ ছিল রাস্তাটির দু’প্রান্তের মুখে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া বিস্তারিত কিছু বলা যাবে না।’
পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের কথা শেষ হতেই ঘরে ঢুকল একজন পুলিশ অফিসার। বলল, ‘জনাব খালেদ খাকান সাহেব এসেছেন।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন দু’জনেই চমক ভাঙার মত নড়ে-চড়ে বসল। যেন প্রাণ পেল তারা!
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিয়ে এস। আমরা ওনার জন্য অপেক্ষা করছি।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে।
পুলিশ অফিসার চলে গেল।
কয়েক মুহূর্ত পরেই আহমদ মুসা ঘরে ঢুকল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন দু’জনই উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল আহমদ মুসাকে। হাসি নয়, তার মুখে বেদনা যেন উথলে উঠছে! জেনারেল মোস্তফা জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘আমরা বিস্মিত, বিপর্যস্ত মি. খালেদ খাকান। আপনার জন্যে আমরা অপেক্ষা করছি।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল আহমদ মুসাকে ধরে নিয়ে পাশের সোফায় বসাল। তারপর নিজের আসনে ফিরে গিয়ে বসতে বসতে বলল, ‘ভূতুড়ে ঘটনা ঘটেছে মি. খালেদ খাকান! বাড়ির চারদিকে পুলিশ পাহারায় ছিল। তাছাড়া বাড়ির ভেতরে কাজের লোক ও পরিবারের সদস্যের ছদ্মবেশে ছয়জন মহিলা ও দু’জন পুরুষ গোয়েন্দা অফিসারসহ সর্বমোট আটজন গোয়েন্দা কর্মী পাহারায় ছিল, অথচ দশজনের একটা দল বাড়িতে প্রাবেশ করে সাতজন গোয়েন্দা কর্মীকে খুন করে বিজ্ঞানী ও একজন গোয়েন্দা মহিলা কর্মীকে কিডন্যাপ করে হাওয়া হয়ে গেল। তারা কিভাবে পালাল তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘মহিলা গোয়েন্দা অফিসারকেও হয়তো তারা বিজ্ঞানীর সাথে গ্রেফতার করেছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাই মনে হচ্ছে। কারণ তার লাশও নেই, পালাতেও পারেনি। কিন্তু অন্যদের খুন করে তাকে নিয়ে যাবে কেন?’ বলল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তাকে ভুল করে নিয়ে গেছে।’
‘ভুল করে কিভাবে?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফা কামালের।
‘মহিলা গোয়েন্দা অফিসারকে ওরা বিজ্ঞানীর স্ত্রী মনে করেছে এবং খুশি হয়ে তাকে তাদের প্রয়োজনের বড় অস্ত্র হিসেবে সাথে করে নিয়ে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
বেদনার সাথে সাথে বিস্ময় নামল জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন দু’জনের চোখে-মুখেই। দ্রুত কথা বলে উঠল জেনারেল মোস্তফা কামাল। বলল, ‘বুঝেছি, স্ত্রী মনে করে নিয়ে গেছে। কারণ, বিজ্ঞানী কথা না বললে, কথা মত কাজ না করলে স্ত্রীকে লাঞ্জিত করে, তার উপর নির্যাতন চালিয়ে বিজ্ঞানীকে ওদের কথা মতো চলতে বাধ্য করবে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় মি. খালেদ খাকান।’
‘অবশ্যই উদ্বেগের খবর জনাব! কিন্তু এর মধ্যেও আনন্দের বিষয় হলো, মহিলাটি আমাদের বিজ্ঞানীর স্ত্রী নন।’
‘খবরটা আনন্দের কেন? স্ত্রী না হলেও মেয়েটিকে লাঞ্জিত করতে পারে, সে নির্যাতিতা হতে পারে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘আনন্দের এই কারণে যে, বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি মেয়েটি তার স্ত্রী নয় বলার পর মেয়েটিকে গিনিপিগ বানাতে পারবে না। অন্যদিকে বিজ্ঞানীকে তাদের ইচ্ছামত কাজ করাতে ও কথা বলাতে বাড়তি কোন সুযোগ তারা পাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন দু’জনের মুখেই কিছু উজ্জ্বলতা ফিরে এল। বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল, ‘ধন্যবাদ খালেদ খাকান। এখন চলুন, ঘটনার সব জায়গা আপনিও একটু দেখুন। কোন দিক দিয়ে পালাল সেটা উদ্ধার হলে আমাদেরও সামনে এগোবার একটা পথ হয়।’
‘চলুন দেখি’ বলে উঠে আহমদ মুসা পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনকে জিজ্ঞেস করল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কি যোগাযোগ হয়েছে, আটকে রাখা ছাত্র প্রতিনিধিদলের সদস্যরা মুক্ত হয়েছে, তদন্তে ওরা আমাদের কিছু সাহায্য করতে পারে?’
‘পুলিশ ছাত্র প্রতিনিধিদলকে সিজলি পাহাড় এলাকা থেকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করেছে। ওরা এখন হাসপাতালে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। তারাও তদন্ত শুরু করেছে। সব রকম সহযোগিতা তারা আমাদের করবে।’ বলল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
আহমদ মুসা একবার জেফি জিনার কথা বলতে চাইল যে, সে মূল্যবান সাহায্য করতে পারে। কিন্তু আহমদ মুসা বলল না, চেপে গেল। কারণ আহমদ মুসা ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছে। বাইদিবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে জেফি জিনা নামে কোন শিক্ষিকা বা গবেষক আছেন কিনা জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু এ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ নেই বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে জানান। বিষয়টা আহমদ মুসার কাছে কিছুটা জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির সাথে তিনি পরিচিত হলেন কি করে? আর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি কেউ না হলে তিনি ছাত্রদের সাথে চায়ের দাওয়াত পেলেন কি করে? সুতরাং বিষয়টার কূল কিনারা করতে না পেরে আহমদ মুসা জেফি জিনা সম্পর্কে পুলিশ প্রধানকে কিছু বলল না। শুধু বলল, ‘মি. নাজিম এরকেন ছাত্র প্রতিনিধি দলের ছদ্মবেশে শত্রুদের যারা বিজ্ঞানীর বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করেছিল, তাদের মধ্যে সাইন্স এন্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রও ছিল।’
উজ্জ্বল হয়ে উঠল পুলিশ প্রধানের চোখ দু’টি। বলল, ‘স্যার, এটা তো অতি মূল্যবান ও সুনির্দিষ্ট ইনফরমেশন। তার নামটা জানা যাবে স্যার?’
‘এখনও জানা যায়নি। আমি চেষ্টা করব জানার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার পুলিশ বাহিনী, আপনার গোয়েন্দা বিভাগ নেই। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় তথ্য আপনার কাছেই আসছে। আমরা কৃতজ্ঞ।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘একটা প্রবাদ আছে, ঝড়ে বক পড়ে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে। ব্যাপারটা এই রকমই। অকল্পনীয় সব সোর্স থেকে তথ্য আসে। এটা মনে করি আল্লাহর খাস সাহায্য। আমার কোন কেরামতি নেই।’
হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলছিল আহমদ মুসা।
আগে আগে হাঁটছিল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
চলছিল উপর তলায় উঠার সিঁড়ির দিকে।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘নিহত সব লাশ এক তলায়।’ তাহলে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্যে নিচে ড্রইংরুমে নেমেছিলেন নিশ্চয়! সুতরাং সবাই নিচে ছিলেন। সব ঘটনা এক তলায় ঘটেছে, উপর তলায় নয়। তারা পালিয়েছে হয় একতলা হয়ে না হয় আন্ডার গ্রাউন্ড কোন পথ দিয়ে। সুতরাং নিচের তলা ও আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরটাই শুধু দেখতে চাই।’
একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘চলুন, পেছনের দরজা পর্যন্ত যাওয়া যাক।’
চলল সবাই। এবার আহমদ মুসা সকলের আগে।
ওপরে ওঠার সিঁড়ির ডান পাশ ঘেঁষে একটা করিডোর সামনে চলে গেছে। এ করিডোরটাই কয়েকটা বাঁক নেবার পর পেছনের দরজায় গিয়ে ঠেকেছে।
হাঁটছে আহমদ মুসা।
তার দৃষ্টি দু’পাশের দেয়াল ও মাটির দিকে। তার বিশ্বাস এ পক্ষের ৭ জন লোক নিহত। এরা একেবারেই অপ্রস্তুত ছিল, সুতরাং প্রস্তুত ও পরিকল্পিত অবস্থায় আক্রমণের সুযোগ তারা পেয়েছে। কিন্তু তাই বলে ওপক্ষ আহত-নিহত হওয়ার কোন ব্যাপার ঘটবেই না, এটা স্বাভাবিক নয়। আর যেহেতু দু’জনকে বন্দী করে তাড়াহুড়ো করে পালাতে হয়েছে, তাই তারা কিছু চিহ্ন রেখে যাবেই। তার মধ্যে রক্তের দাগ একটি।
কিন্তু আহমদ মুসা পেছনের দরজা পর্যন্ত হেঁটেও কোন চিহ্ন বা অস্বাভাবিক কিছু পেল না। দরজা খুলে বাগানটাও দেখল। কিছুই পেল না।
ফিরে এল আবার সিঁড়ির গোড়ায়।
সিঁড়ির বাম পাশ ঘেঁষে আর একটা করিডোর সামনে চলে গেছে। এ করিডোরের ডান পাশ দিয়ে বরাবর একটা দেয়াল। আর বাম পাশ দিয়ে যে দেয়াল তার মাঝ বরাবর বড় একটা দরজা।
ঐ দরজার দিকে ইংগিত করে জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘ওটাই আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামার দরজা মি. খালেদ খাকান।’
করিডোরের মেঝে ও দু’ধারের দেয়ালও পাথরের। বর্গাকৃতি পাথরের জোড়াগুলোও ধবধবে সাদা।
করিডোর ও দুই দেয়ালের উপর সূঁচ খোঁজার মত তীক্ষ দৃষ্টি ফেলে এগিয়ে চলছে আহমদ মুসা। দরজা পর্যন্ত যেতে বার দুয়েক দাঁড়াল।
দরজার সামনে এসে আবার দাঁড়াল আহমদ মুসা।
দরজা কালো রং করা ষ্টিলের স্লাইডিং ডোর। ডিজিটাল, ম্যানুয়াল দু’ভাবেই খোলা যায়। তবে ম্যানুয়াল সিষ্টেম অফ করে ডিজিটাল সিষ্টেম চালু করতে হয়। আবার ডিজিটাল সিষ্টেম অফ করে ম্যানুয়াল সিষ্টেম চালু করা যায়।
পুলিশ প্রধান এগিয়ে এসে দরজাটা খুলে দিল। সরে গেল ষ্টিলের স্লাইডিং ডোরটা দেয়ালের ভেতরে।
দরজার পরেই সিঁড়ির কাছে বড় একটা ষ্ট্যান্ডিং। ষ্ট্যান্ডিং-এর ডান ও বাম পাশ দিয়ে দু’পাশের দেয়াল ঘেঁষে দু’টি প্রশস্ত সিঁড়ি দু’দিকে নেমে গেছে।
ষ্ট্যান্ডিং-এর সামনেটা রেলিং ঘেরা। রেলিং ষ্ট্যান্ডিং-এর সামনেটা ঘুরে এসে দু’পাশে সিঁড়ির সাইড রেলিং হয়ে নিচের ফ্লোর পর্যন্ত নেমে গেছে। সিঁড়ি ও রেলিং দু’টোই ব্ল্যাক ষ্টিলের।
আহমদ মুসারা ষ্ট্যান্ডিং-এ এসে দাঁড়াল।
নীচে বড় একটা হলঘর।
সিঁড়ি বরাবর অংশটুকু ছাড়া গোটা হলঘর লাল কার্পেটে ঢাকা। চারদিক ঘিরে সোফার সারি। মাঝখানটা ফাঁকা।
গোটা হলঘরটা উজ্জ্বল আলোয় প্লাবিত। ষ্ট্যান্ডিং এর উপরে দেয়ালে দু’পাশে দু’টি লাইট। সে আলোতে কালো সিঁড়িতে সাদা প্রতিফলনের সৃষ্টি করেছে।
আহমদ মুসা সিঁড়ি দু’টোকে একবার তীক্ষ দৃষ্টিতে দেখল। ডানদিকে সিঁড়ির দ্বিতীয় ষ্টেপের রেলিং সংলগ্ন একটা জায়গায় একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘আসুন, আমরা ডান পাশের এ সিঁড়ি দিয়ে নামি।’
সবাই নেমে এল নিচে।
সিঁড়ি থেকে নেমে হলঘরে ঢোকার মত প্রশস্ত একটা জায়গা দু’প্রান্তে বাদ রেখে সোফা সাজানো। সিঁড়ি প্রান্তের সোফার সারিটা সিঁড়ি যতটা প্রশস্ত তার চেয়ে কিছু বেশি জায়গা রেখে সাজানো হয়েছে।
‘শত্রুরা বিজ্ঞানীকে কিডন্যাপ করে আন্ডার গ্রাউন্ড এই ঘরে নেমে এসেছিল। নিশ্চয়ই এই ঘর বা এই আন্ডার ফ্লোরের কোন স্থান দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ আছে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা তাকাল জেনারেল মোস্তফার দিকে। বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা ও জেনারেল তাহির তারিককে এই বাড়ির ইন্টারনাল, এক্সটারনাল ডিজাইন, লে-আউট, নকশা যোগাড় করতে বলেছিলাম। সেটা পেলে সহজেই বের হতো সিঁড়ি পথটা কোথায়।’
‘জেনারেল তাহির আমাকে বলেছিলেন, সেসব যোগাড় হয়েছে। আমার অফিসে এই বাড়ি সংক্রান্ত ফাইলে সব আছে। বলব কি সে ফাইল আনতে?’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘ঠিক আছে। আমরা আর একটু দেখি। না হলে ফাইলের সাহায্য নেয়া যাবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মি. খালেদ খাকান, আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন কিডন্যাপটা এই আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে এসে তারপর হয়েছে?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘কিডন্যাপারদের এক বা একাধিক লোক আহত হয়েছে। কিডন্যাপ করে পালাবার সময় পথে আহতদের থেকে রক্তের ফোটা পড়েছে। কেউ যাতে তাদের অনুসরণ করার সুযোগ না পায়, এজন্যে তারা রক্তের দাগ মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। এর পরও করিডোরে দুই জায়গায় এবং সিঁড়িতে এক জায়গায় সামান্য পরিমাণে হলেও শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ আমি দেখেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এবার নিয়ে তিনবার এ পথে এলাম, আমার কিন্তু তা চোখে পড়েনি। ধন্যবাদ আপনার চোখের দৃষ্টিকে।’ বলল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
‘চোখের খুব বেশি কৃতিত্ব নেই। আমি আগেই ধরে নিয়েছিলাম এ পক্ষের ৭ জনকে হত্যা করতে ওদের কাউকে না কাউকে নিশ্চয় অন্তত আহত হতেই হবে। আহতদের নিয়ে তাড়াহুড়ো করে পালাবার সময় পথে তাদের পালানোর চিহ্ন হিসেবে রক্তের দাগ ফেলে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। এই ক্লুটা খোঁজার চেষ্টার ফলেই তা পেয়ে গেছি।’
‘ধন্যবাদ খালেদ খাকান। আপনি ঠিক চিন্তা করেছেন। দুর্ঘটনার সাইক্লোনের মধ্যেও আপনার মাথা ঠান্ডা থাকে। আপনি একটা দৃষ্টান্ত।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
আহমদ মুসার নজর তখন সিঁড়ির গোড়ার দিকে। জেনারেল মোস্তফার কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘জেনারেল দেখুন দু’পাশের সিঁড়ির লেভেল থেকে সোফায় সারির দূরত্ব একটু বেশি মনে হচ্ছে না?’
‘হ্যাঁ, এতটা দূরত্ব না রাখলেও হতো। সিঁড়ি থেকে নেমে হলরুমে প্রবেশের জন্যে যথেষ্ট জায়গা রাখার পরও এতটা জায়গা শূন্য রেখে দেয়া ‘অডলুকিং’ মনে হচ্ছে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘অডলুকিং লাগছে আরও এই কারণে যে এই ফাঁকা জায়গা কার্পেটে ঢেকে না দেয়ার মধ্যে কোন যুক্তি নেই। ঘরের সৌন্দর্য নষ্ট করে এটা কেন করা হয়েছে সেটা একটা বড় প্রশ্ন।’ পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন বলল।
‘এই সৌন্দর্যহানির কারণ আছে। আমার সন্দেহ সত্য হলে আন্ডার গ্রাউন্ড স্পেসটা এখানেই আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
চমকে উঠল জেনারেল মোস্তফা, পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনসহ উপস্থিত পুলিশ অফিসাররাও। চোখ বড় বড় করে জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন এক সাথেই দু’জনে বলে উঠল, ‘এখানে সুড়ঙ্গ রয়েছে?’
‘হ্যাঁ, এখানেই রয়েছে এবং আমরা এই যে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি, আমি মনে করছি এখানেই রয়েছে সুড়ঙ্গের মুখ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মি. খালেদ খাকান আপনি – ভবিষ্যত বক্তার মত কথা বলছেন। এখানে সুড়ঙ্গের মুখ আছে, কোনো চিহ্ন দেখে নিশ্চয় এ কথা বলছেন, সেটা কি?’
‘আমি নিশ্চিত নই, তবে বিভিন্ন অসঙ্গতি, অস্বাভাবিকতা ও নানা কার্যকরণ থেকে এ ধারণা করছি। আপনারা দেখুন ওপাশের সিঁড়ির গোড়ায় শেষ পিলার একটাই, কিন্তু এ পাশের প্রান্তে জোড়া পিলার। মূল পিলারের সাথে আরেকটা পিলার। দ্বিতীয় পিলারটার মাথা হাতল আকারের এবং সাইড রেলিং-এর টপ বরাবর আসা ষ্টিল বার থেকে বিচ্ছিন্ন। দ্বিতীয় পিলারটার গোড়া দেখুন গাড়ির গিয়ারের মত রাবারের কভার। এ থেকে এ সিদ্ধান্ত স্বতঃসিদ্ধ হয়ে উঠে যে এর একটা ফাংশন আছে। কি সেই ফাংশন? এ প্রশ্নের উত্তরেই আমার সিদ্ধান্ত, গোপন সুড়ঙ্গের মুখ এখানেই।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা দুই ধাপ এগিয়ে গিয়ে শেষ দ্বিতীয় পিলারের শীর্ষ হাতল দু’হাতে ধরে জোরের সংগে নিচের দিকে টানল।
সংগে সংগে সিঁড়ির গোড়া থেকে পাশের মেঝের সোফার সারির পাশ ঘেঁষে একটা আয়তাকার অংশ সরে গেল। বেরিয়ে পড়ল আলোকজ্জল একটা সিঁড়ি মুখ।
‘ও গড! আলহামদুলিল্লাহ।’ জেনারেল মোস্তফা কামাল ও নাজিম এরকেন এক সাথেই বলে উঠল।
‘আসুন, নামি।’
বলে সুড়ঙ্গের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল আহমদ মুসা।
‘গ্যাস মাস্ক তো লাগবে না আহমদ মুসা?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘না মি. জেনারেল। আমার মনে হয় সুড়ঙ্গ স্বল্প দীর্ঘই হবে এবং সুড়ঙ্গে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা নিশ্চয় আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘চলুন মি. খালেদ খাকান।’
বলে তাকাল জেনারেল মোস্তফা পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের দিকে।
পুলিশ প্রধান তার পাশেই দাঁড়ানো সিজলি এলাকার পুলিশ কমিশনারকে তাদের সাথে যেতে বলল। আর সবাইকে সব ফরমালিটি শেষ করে লাশগুলো নিয়ে যেতে বলল। আর কয়েকজন পুলিশকে থাকতে হবে এই বাড়ির পাহারায় এ নির্দেশও দিল।
পুলিশ কমিশনার পাশের পুলিশ অফিসারদের সব নির্দেশ দিয়ে সুড়ঙ্গে নামার জন্যে সবার সাথে পা বাড়াল।
সিঁড়ি দিয়ে প্রায় পনের ফিট নামার পর একটা প্রশস্ত ল্যান্ডিং পাওয়া গেল যেখানে চার পাঁচ জন লোক এক সাথে দাঁড়ানো যায়। এখান থেকে সুড়ঙ্গের শুরু। সিঁড়িটা অন্ধকার। ল্যান্ডিং দেয়ালে রয়েছে একটা সুইচ বোর্ড। তাতে চারটি সুইচ। প্রথম সুইচের নিচে দু’টি এ্যারো চিহ্ন মুখোমুখি আর দ্বিতীয় সুইচের নিচে দু’টি এ্যারো চিহ্ন বিপরীতমুখী। তৃতীয় সুইচের নিচে একটা মশালের ছবি আর চতুর্থ সুইচের নিচে আঁকা একটা ছোট্ট হাতপাখা। জেনারেল মোস্তফারাও দেখছিল সুইচ বোর্ড।
জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘এ্যারো চিহ্নিত সুইচ দু’টি সুড়ঙ্গের সিঁড়ির মূখ বন্ধ করা ও খোলার জন্য, মশাল চিহ্নিত সুইচটা চেপে সুড়ঙ্গে আলো জ্বালাতে হবে, আর বাতাসের জন্যে চাপতে হবে পাখার সুইচ।’
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘সুইচ চাপুন জনাব।’
জেনারেল মোস্তফা একে একে তিনটি সুইচই চাপল। কিন্তু সিঁড়ির মুখ যেমন বন্ধ হলো না, তেমনি সুড়ঙ্গে আলো জ্বললো না, বাতাসও এল না।
জেনারেল মোস্তফা কামাল তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘সুইচগুলো ওয়ার্ক করছে না মি. খালেদ খাকান।’
‘সুইচগুলোর মধ্যে নির্মাতারা একটা ধাঁধাঁ তৈরি করে রেখেছে জেনারেল মোস্তফা। এবার আপনি বিপরীত এ্যারো চিহ্নিত সুইচ টিপুন এবং মশাল ও পাখা চিহ্নিত সুইচ এক সাথে চাপুন এবং মশাল ও পাখার সুইচ আগে চাপতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
তাই করল জেনারেল মোস্তফা।
এবার সুড়ঙ্গে আলো জ্বললো, বাতাস এল এবং সিঁড়ি মুখ বন্ধ হয়ে গেল।
বিস্মিত জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, আপনি এই ধাঁধাঁটি কি করে ধরলেন?’
‘সুইচ বোর্ডটার সবটা বিষয় আপনি ভালোভাবে দেখে বুঝার চেষ্টা করলে আপনিও ধরতে পারতেন। দেখুন, এ্যারো আঁকা সুইচ দু’টোর উপরে দু’টো সুইচের স্থান কভার করে লম্বা দু’টো এ্যারো আঁকা। বোর্ডের মত একই কালারের হওয়ার কারণে এ তীর দু’টো খুব তাড়াতাড়ি চোখে পড়ছে না। এর অর্থ, এই তীর দু’টির একটির শুরু প্রথম সুইচ থেকে, কিন্তু মাথাটা দ্বিতীয় সুইচে, আর দ্বিতীয় তীরটির শুরু দ্বিতীয় সুইচ থেকে, মাথাটা প্রথম সুইচে। এর অর্থ হলো, প্রথম সুইচটির কাজ পাওয়া যাবে দ্বিতীয় সুইচ থেকে। মশাল ও পাখা আঁকা সুইচের মাথার উপরে দেখুন বোর্ডের মত একই কালারে দু’টি সমান্তরাল সরল রেখা সুইচ দু’টোকে যুক্ত করেছে। এটার ইংগিত হলো, এ সুইচ দু’টির ফাংশন এক সাথে, সুতরাং এদের অফ, অন একই সময়ে করতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মশাল ও পাখার সুইচ দু’টি কেন আগে চাপতে হবে, সে কথা কিন্তু বলেননি।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘মশাল ও পাখার সুইচ আগে অন না করে সিঁড়ি বন্ধের সুইচ অফ করলে সিঁড়ি মুখের দরজা বন্ধ হতো না। নির্মাতারা এটাই চেয়েছেন। কারণ সিঁড়ি মুখের দরজা আগে বন্ধ হলে সিঁড়ি মুখ থেকে আসা আলো-বাতাস বন্ধ হয়ে যেত। তাতে সুড়ঙ্গ অন্ধকারে ডুবে যেত, বাতাসও বন্ধ হতো। এই সংকট যাতে না হয়, এ জন্যে মশাল ও পাখার সুইচ দু’টি আগে অন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা কামাল একদিকে কথা শুনছিল, অন্যদিকে তার চোখ দু’টি আঠার মত লেগেছিল সুইচ বোর্ডের উপর। আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই জেনারেল মোস্তফা বলে উঠল, ‘পেয়েছি মি. খালেদ খাকান, আগে-পরের ক্লুটা পেয়ে গেছি। এই দেখুন, মশাল ও পাখার দুই সুইচের পাশেই বোর্ডের কালো অংশে ‘২’ লেখা ও এ্যারো চিহ্নিত দুই সুইচের পাশে একইভাবে ‘১’ লেখা।
‘ধন্যবাদ জেনারেল মোস্তফা। এবার আসুন, আমরা সামনে অগ্রসর হই।’
বলে আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করল।
সবাই হাঁটতে শুরু করল আহমদ মুসার পেছনে পেছনে।
হাঁটা শুরু করে জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, আপনি গোয়েন্দা ট্রেনিং-এর অদ্বিতীয় এক শিক্ষক হতে পারেন।’
আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফার কথার দিকে কান না দিয়ে বলল, ‘জেনারেল, ওদের পালানোর পথ তো পেয়ে গেলাম, ওদের ধরার পথ এখন আমাদের দরকার। আইআরটি কিংবা বিজ্ঞানী কারও কোন ক্ষতি হতে দিতে আমরা পারি না। এজন্যে ওদের কোন সময় দেয়া যাবে না।’
‘ঠিক মি. খালেদ খাকান। ওরা সময় পেয়ে আমাদের দারুণ ক্ষতি হবে। কিন্তু সামনে আমি অন্ধকার দেখছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ না কেউ এই গ্যাং মানে ‘থ্রি জিরো’র সাথে জড়িত। আমি মনে করি এদের খুঁজে বের করাকে আমাদের প্রথম গুরুত্ব দিতে হবে। সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘এ পর্যন্ত আমি যা জানতে পেরেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছেলে তাদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছে। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে পালানোর সময়ও ছেলেটি তাদের সাথে ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এটা তো স্পেসেফিক ইনফরমেশন। তাকে লোকেট করতে পারলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবো।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘তবে তার নামটা আমি এখনও জানতে পারিনি। চেষ্টা করছি।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা বলতে বলতে হাঁটছে তারা।
একশ’ গজও তখন পার হয়নি তারা। সুড়ঙ্গ শেষ হয়ে গেল, তারা একটা সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ এসে হাজির হলো।
আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘আমার অনুমান ভুল না হলে আমরা বাড়ির উত্তর প্রান্তের সীমানা দেয়ালের কাছে এসে গেছি। এ দেয়ালের বাইরে রয়েছে ওয়াটার সাপ্লাই প্ল্যান্ট, তার সাথে বেশ ফাঁকা জায়গাও রয়েছে।’
‘তার মানে ওরা এখানে পালাবার জন্যে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করেছিল। চলুন উপরে ওঠা যাক।’
‘সিঁড়ির গোড়ায় ল্যান্ডিং এর দেয়ালে আগের মত সুইচ বোর্ড এবং সুইচ বোর্ডের চারটি সুইচ পাওয়া গেল। এখানেও ধাঁধাঁ সেই একই রকমের।
আহমদ মুসারা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
সিঁড়ি মুখ যেখানে শেষ হয়েছে, সেটা ভাঙা, পরিত্যক্ত সামগ্রী ফেলার একটা ঘর। সুড়ঙ্গ মুখ জুড়ে রয়েছে এই ঘরটির মেঝেরই একাংশ।
আর ঘরটির উত্তর দেয়ালটাই আসলে সীমান্ত দেয়াল।
আহমদ মুসা ঘরে উঠে চারদিকে একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলতেই দেখতে পেল, ঘরের উত্তর দিকের অর্থাৎ সীমান্ত দেয়ালের গায়ে দেয়াল রংয়ের একটা ষ্টিলের দরজা। এখানেও দেখল দরজার গায়ে দু’টি দেয়াল রংয়ের বোতাম। দুই বোতামের নিচে আঁকা এ্যারো চিহ্নের সেই ধাঁধাঁ।
আহমদ মুসারা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। বাইরে গাড়ির চাকার দাগও তাদের খুব সহজেই চোখে পড়ল।
‘আমাদের দুর্ভাগ্য, কিডন্যাপারদের এই সাফল্যের কারণ তাদের সফল পরিকল্পনা। তারা বাড়ির নকশা হাত করতে সফল হয়েছে। জেনারেল মোস্তফা, আপনারা দেখুন বাড়ির নকশা কারা বের করল, কিভাবে বের করল।’
‘অবশ্যই দেখছি। কিন্তু বলুন আমরা এগোবো কোন পথে? তাড়াতাড়ি কিছু করতে না পারলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। তুরষ্কও বেকায়দায় পড়েছে ওআইসি’র অন্যান্য সদস্যের কাছে।
গম্ভীর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। বলল, ‘এই বিপর্যয়ের ভার আমার উপরই বর্তায় বেশি।’
‘না মি. খালেদ খাকান। আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। আপনি যদি বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে এখানে আনার ব্যবস্থা না করতেন, বাড়িতেই যদি তাঁকে রাখা হতো, তাহলে তার স্ত্রী ও বাচ্চারাও আজ তার সাথে বন্দী হতো। সেটা হতো অত্যন্ত ভয়াবহ। তাতে বিজ্ঞানী তাদের সব কথা মানতে বাধ্য হয়ে তাদের হাতের পুতুলে পরিণত হতে পারতেন। সবকিছু আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেত। বিজ্ঞানী কিডন্যাপ হলেও এই মহাদুর্যোগ থেকে আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছেন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে তখন গভীর চিন্তার ছাপ। যেন কোন গভীর ভাবনায় ডুবে গেছে আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা থামলেও আহমদ মুসা কোন কথা বলেনি।
জেনারেল মোস্তফাই আবার কথা বলল, ‘কি ভাবছেন মি. খালেদ খাকান?’
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে মুখ তুলে জেনারেল মোস্তফার দিকে তাকাল। বলল, ‘আমাকে এখুনি যেতে হবে। চলুন ফিরে যাই, গাড়ি তো ওখানে।’
‘চলুন। কিন্তু আপনি পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কি ভাবছেন, আমাদের আপনার কিছু বলার আছে কিনা? সময় নষ্ট করা যাবে না কিছুতেই।’
সীমানা ওয়ালের দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে সবাই হাঁটা শুরু করেছে গাড়ির কাছে আসতে।
হাঁটতে হাঁটতে বলল আহমদ মুসা, ‘জেনারেল মোস্তফা, জনাব নাজিম এরকেন, আপনারা একটু চেষ্টা করুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জ্ঞান ফিরে এলে তাদের কাছ থেকে জানুন কিডন্যাপকারীদের কাউকে তারা চেনে কিনা। নিশ্চয় তাদের সাথেরই কেউ কিডন্যাপারদের একজন বা কিডন্যাপারদের লোক। বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করলে কোন ক্লু পাওয়া যাবেই। বাড়ির নকশা কারা পূর্ত দফতর থেকে যোগাড় করেছে, তাদের চিহ্নিত করতে পারলেও কিডন্যাপারদের কাছে পৌছা সম্ভব হবে। তাদের গাড়ি দু’টির ষ্টিয়ারিং হুইলে দু’জন ড্রাইভারের ফিংগার প্রিন্ট পাওয়া যাবে, তাও সাহায্যে আসতে পারে। আর আমিও একটা ক্লু সামনে রেখে বেরুচ্ছি। কিন্তু আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কিছুই করতে পারবো না।’
‘নিশ্চয় আল্লাহ সাহায্য করবেন। আমরা ভয়ংকর এক বিপদের মধ্যে আছি। আল্লাহ আমাদের একমাত্র ভরসা।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘অবশ্যই।’ বলল আহমদ মুসা।
তারা পৌছে গেছে গাড়ির সামনে।
আহমদ মুসা এগোল গাড়ির দিকে।
জেনারেল মোস্তফা ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে। বলল, ‘আপনি হেলিকপ্টারে যেতে পারেন মি. খালেদ খাকান।’
‘দরকার নেই জেনারেল। আমার নামে বরাদ্দ হেলিকপ্টার তো অফিসে আছে। দরকার হলে নিয়ে নেব। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার পায়ের তলায় মাটি দরকার।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেনও হেসে ফেলেছে। জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘দুঃখের মধ্যেও আপনি হাসতে পারেন, হাসাতেও পারেন মি. খালেদ খাকান। আমরা এখন হেলিকপ্টারে উঠব বটে, কিন্তু আমাদের পায়ের তলাতেও মাটি দরকার।’
‘পায়ের তলায় মাটি না থাকলে হেলিকপ্টার আকাশে উড়বে কি করে! হেলিকপ্টার আকাশে উড়ার জন্যে যেমন মাটি দরকার, তেমনি ল্যান্ড করার জন্যেও মাটি প্রয়োজন।’ হেসেই বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ মি. খালেদ খাকান। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।’
‘ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম।’ বলে আহমদ মুসা গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো।
‘ওয়া আলাইকুম সালাম।’ বলল জেনারেল মোস্তফা। সেও ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করেছে।

Top