৫
বারবার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল ওরান্তি ওরারতু। তার চোখে-মুখে অধৈর্য ভাব। স্বাভাবিকভাবে কথা বলে গেলেও তার অস্থিরতা কারুরই নজর এড়াবার কথা নয়।
বিষয়টা লক্ষ্য করে মুখে হাসি টেনে মিহরান মুসেগ মাসিস নিজের হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল, ‘মি. ওরান্তি ওরারতু, এখন মাত্র ভোর পৌনে পাঁচটা। ওরা ভ্যান থেকে যাত্রা করেছে ৪টায়। রাস্তায় কয়েক জায়গায় চেকিং আছে। ওদের ইজডির এসে পৌঁছতে সোয়া ঘণ্টা লাগবেই। চিন্তিত হবার কোন কারণ নেই।’
ইজডির শহরটি আর্মেনিয়ার লাগোয়া তুর্কি প্রদেশ ইজডির-এর রাজধানী। মাউন্ট আরারাত পর্বতটি এ প্রদেশেই অবস্থিত। ইজডির শহরটি মাউন্ট আরারাত থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। এখান থেকে আর্মেনিয়া সীমান্ত মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে।
মিহরান মুসেগ মাসিসের কথা শেষ হতেই ওরান্তি ওরারতু বলল, ‘ওরা কখন আসবে এ নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই। উদ্বিগ্ন আমি মাউন্ট আরারাতের ডকুমেন্ট নিয়ে। ডকুমেন্টটি কখন আমাদের হাতে পৌঁছবে, এ নিয়েই আমার অস্থিরতা। আপনি জানেন মি. মিহরান মাসিস, দুর্লভ এই মানচিত্রটি হাতে পাওয়া আমার কত বছরের সাধনা।’
ওরান্তি ওরারতু ‘লাভার অব নোহা’স হোলি আর্ক’ গ্রুপের প্রেসিডেন্ট। এই গ্রুপকে সংক্ষেপে ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’ বলা হয়। সাধারণ মানুষের কাছে এরা পয়গম্বর নুহ-এর স্মৃতিধন্য মাউন্ট আরারাতের ভক্ত বলে পরিচিত। এদের কাছে ‘মাউন্ট আরারাত’ দেবতা, এই মাউন্ট আরারাতের প্রতি এদের এত ভক্তির আধিক্য, এটাই মানুষ জানে। এই জানার আড়ালে এই গ্রুপ আসলে একটি ভয়ংকর লোভী চক্র। লোভ থেকেই এই গ্রুপের জন্ম। একটা লোক-বিশ্বাসের এর উত্তরসূরী। শত শত বছর ধরে বংশ-পরম্পরায় এক শ্রেণীর বিশেষ করে আরারাত আর্মেনীয় খৃস্টানদের মধ্যে এ বিশ্বাস চলে আসছে যে, হযরত নুহ আ.-এর নৌকায় টন টন স্বর্ণ ছিল। নুহ আ. –এর একজন ভক্ত অতি পুরাতন ধর্মালয়ের একজন সেবক এই টন টন স্বর্ণ নৌকায় তুলেছিল হাতির পিঠে করে। প্লাবন শেষ হবার পর সেই আবার স্বর্ণ নামিয়ে নিয়ে পাহাড়ের বড় গুহায় রেখেছিল সাময়িকভাবে। বোধহয় ভেবেছিল, সব ঠিক-ঠাক করে স্বর্ণের ভাণ্ডারকে আবার ঐ ধর্মশালায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু প্লাবনে ধর্মশালাটি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হওয়ায় সে স্বর্ণভাণ্ডারকে গুহা থেকে আর নিয়ে যায়নি। সে ভেবেছিল, স্বর্ণভাণ্ডার পবিত্র পর্বতের গুহায় থাকবে, এটাই বোধহয় আল্লাহর ইচ্ছা। সেই থেকে স্বর্ণের সেই অতুল ভাণ্ডার পর্বতের সেই গুহাতেই আছে। ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’ সেই স্বর্ণেরই তালাশ করছে বহু বছর ধরে। কিন্তু গুহাটির সন্ধান তারা পায়নি। মাউন্ট আরারাতের দুই শৃঙ্গের মাঝখানে যেখানে নুহ আ.-এর নৌকা প্লাবনের পর ল্যান্ড করেছিল, তারই আশেপাশে কোন বড় গুহায় স্বর্ণভাণ্ডার রয়েছে। কিন্তু মাউন্ট আরারাতের বরফ প্রায় তিনশ’ ফুটের মত গভীর হওয়ায় গুহা চিহ্নিত করা যেমন কঠিন, গুহাগুলোর ভেতরটা তালাশ করা আরও কঠিন। সবচেয়ে বড় যে মুশকিলে তারা পড়েছে সেটা হলো, ১৮৪০ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে পাহাড়ে বিরাট পরিবর্তন আসে এবং অনেক গুহা বন্ধ হয়ে যায়। স্বর্ণভাণ্ডারের গুহা অনুসন্ধানও কঠিন হয়ে যায়। প্রয়োজন পড়ে ভূমিকম্প-পূর্ব সময়ে পর্বতের গুহাগুলোর অবস্থান জানা। এই তথ্য লাভের জন্য ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’ হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ায়। অন্যদিকে মিহরান মুসেগ মাসিস ‘সান অব হোলি আরারাত’ (Son of Holy Ararat- SOHA) সম্প্রদায়ের প্রেসিডেন্ট। খুব প্রাচীন এই সম্প্রদায়। সময়ের পরিবর্তনে সম্প্রদায়ের নামটি অভিন্ন থাকলেও সম্প্রদায়টির প্রকৃতি পাল্টে গেছে। প্রাচীনকালে সম্প্রদায়টি ধর্মভীরু মানুষের প্রতিষ্ঠান ছিল। সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ ও বৈষম্য চিন্তার বাইরে ছিল। মধ্যযুগে সোহা (SOHA) সম্প্রদায় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। তারা দাবি তুললো, মাউন্ট আরারাত আর্মেনিয়ার এবং আর্মেনিয়া মাউন্ট আরারাতের। তাদের কাছে মাউন্ট আরারাত দেবতা, সে দেবতার সৃষ্টি আর্মেনিয়া। তারা বলল, সৌভাগ্য দেবতা মাউন্ট আরারাতকে বাদ দিয়ে আর্মেনিয়ার অস্তিত্ব কল্পনাই করা যায় না। এই সব কথা ও দাবি সামনে এনে ‘সোহা’ সম্প্রদায় হিংসাত্মক এক সন্ত্রাসী আন্দোলন শুরু করল, নুহ ও জেসাসের হোলি ল্যান্ড আর্মেনিয়া ও হোলি মাউন্ট আরারাতের জন্যে হত্যা-লুণ্ঠনকে তারা পুণ্য বলে মনে করল। তাদের এই হত্যা ও সন্ত্রাসের শিকার হলো তুর্কি মুসলিম জনসাধারণ। এরই অংশ হিসেবে ‘সোহা’রা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তুরস্কের বিরুদ্ধে রাশিয়াকে সাহায্য-সহযোগিতা করার ষড়যন্ত্র করে। এরই জবাবে তুরস্ক ‘সোহা’ নামের আর্মেনীয় তুর্কি নাগরিকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। একেই আর্মেনিয়া ও পশ্চিমী মিত্ররা আর্মেনীয় গণহত্যা নাম দিয়েছে। পরে আর্মেনীয় সরকার সোহাদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়। এইভাবে ‘সোহা’দের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে শেষ পর্যন্ত অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু আধুনিককালে এসে ‘হোলি আর্ক গ্রুপ’-এর উস্কানি এবং অঢেল অর্থ-সাহায্যে ‘সোহা’রা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। উভয়ের স্বার্থ উদ্ধারে দুই গ্রুপের মধ্যে একটা আন-হোলি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সোহারা চায়, তুরস্কের ইজডির, কারস, অ্যাগ্রি ও ভ্যান প্রদেশসহ মাউন্ট আরারাতকে আর্মেনিয়ার সাথে এক করে ফেলতে। এতে মাউন্ট আরারাত আর্মেনিয়ার এবং আর্মেনিয়া মাউন্ট আরারাতের এই আবহমান লক্ষ্য তাদের হাসিল হবে। অন্যদিকে হোলি আর্ক গ্রুপ চাচ্ছে, নিরপদ্রবে, কোন বাঁধা-বিপত্তি, নজরদারি ছাড়া মাউন্ট আরারাতে স্বর্ণভাণ্ডারের সন্ধান করতে। গোটা এলাকা বিশেষ করে মাউন্ট আরারাত তুর্কি সৈন্যের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকায় স্বর্ণভাণ্ডারের সন্ধান করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মাউন্ট আরারাত আর্মেনিয়ার অংশ হলে এই অসুবিধা থাকবে না। তখন মাউন্ট আরারাতকে বৈঠকখানার মত ব্যবহার করা যাবে এবং মাউন্ট আরারাতের স্বর্ণভাণ্ডার হাতের মুঠোয় এসে যাবে।
‘মাউন্ট আরারাতের হাজারো মানচিত্র আছে। খুব বিস্তারিত, খুব সূক্ষ্ম মানচিত্রও রয়েছে। কিন্তু সব বাদ দিয়ে ঐ বিশেষ মানচিত্রটা কেন এত জরুরি মি. ওরান্তি ওরারতু?’ বলল মিহরান মুসেগ মাসিস ওরান্তি ওরারতুর কথা শেষ হতেই।
‘আসলে ঐ মানচিত্রটা অদ্বিতীয় মি. মিহরান মাসিস। এক দুর্লভ মানচিত্র ওটা। বলা যায়, এক উলঙ্গ মানচিত্র ওটা মাউন্ট আরারাতের। খৃস্টপূর্ব ৫শ’ অব্দের এক দুর্লভ গ্রীষ্মকাল এসেছিল। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় খরাপীড়িত গ্রীষ্মকাল ছিল এটা। মাউন্ট আরারাতের ১৪০০০ ফুট-লেভেল থেকে ১৭০০০ ফুট পর্যন্ত সব সময় বরফে ঢাকা থাকে। কিন্তু সেই গ্রীষ্মকালে মাউন্ট আরারাতের বরফের লেভেল ১৬০০০ ফিট পর্যন্ত উঠে যায়। ইতিহাসে প্রথমবারের মত মাউন্ট আরারাতের ২০০০ ফুট এলাকার বরফ গলে নগ্ন হয়ে পড়ে। এরই সুযোগ নেন ওরান্তি রাজবংশের তৎকালীন রাজসভার শিল্প ও ভূ-তত্ত্ববিদ সভাসদ নাইরো নারিজিয়ান। ইতিহাসে প্রথমবারের মত নগ্ন হয়ে পড়া মাউন্ট আরারাতের ঐ অংশের (১৪০০০ থেকে ১৬০০০ ফিট) বিস্তারিত মানচিত্র আঁকেন তিনি। যাতে পর্বতের প্রতি ভাঁজ ও প্রতি গুহা শুধু নয়, বড় বড় পাথরের অবস্থানও সে মানচিত্রে চিহ্নিত হয়। আর আপনি জানেন, আমাদের পিতা নুহের নৌকা প্লাবন শেষে মাউন্ট আরারাতের ১৫ হাজার ৫শ’ ফিট উচ্চতায় এক গিরিভাঁজে ল্যান্ড করেছিল। এখানেই নৌকাটি এখনও আছে কোন গুহায় অথবা পাহাড়ের কোন ধ্বংসস্তুপের আড়ালে। ৫শ’ খৃস্টপূর্ব অব্দে কিন্তু সব গুহা ও পর্বতের ভাঁজ সবই অক্ষত ছিল। সুতরাং নারিজিয়ানের ঐ মানচিত্রে নুহের নৌকা এবং আশেপাশের সব গুহাসহ সব গুহার অবস্থান জানা যাবে। আর এটা নিশ্চিত, নৌকার আশেপাশের কোন নিরাপদ গুহাতেই স্বর্ণভাণ্ডার সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। মানচিত্রটি পেলে এই সব গুহার লোকেশন হিসেব-নিকেশ করে বের করে নেয়া যাবে। এখানেই মানচিত্রটির গুরুত্ব মি. মিহরান মাসিস।’
দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল ওরান্তি ওরারতু।
‘আপনার কথাগুলো রূপকথার মত মনে হচ্ছে।’ বলল মিহরান মাসিস।
‘বাস্তবতা অনেক সময় রূপকথাকেও ছাড়িয়ে যায়।’ ওরান্তি ওরারতু বলল।
‘তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু এই বিস্ময়কর মানচিত্রের সন্ধান কি করে পেলেন? জানলেন কি করে যে, মানচিত্রটি ভ্যান মিউজিয়ামের মাউন্ট আরারাত সেকশনে আছে? আমি তো বহুবার মিউজিয়ামের আরারাত সেকশনে গেছি, কিন্তু মানচিত্রটি তো দেখিনি!’ বলল মিহরান মাসিস।
‘সে আর এক কাহিনী মি. মিহরান মাসিস। বেশ কিছুদিন আগে ইয়েরেভেনের সেন্ট মেরী মনস্টারিতে কয়েকদিন ছিলাম। মনস্টারির জ্যেষ্ঠতম ফাদার পিটার জনকে আপনি চেনেন। বয়স তার ১০৯ বছর। জীবন্ত এক মিউজিয়াম তিনি। মাউন্ট আরারাতকে যিশুর জন্মস্থান বেথেলহেমের মতই ভক্তি করেন তিনি। আর মাউন্ট আরারাত সম্পর্কে তার চেয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি আর্মেনিয়া ও তুরস্কে আর কেউ নেই। মাউন্ট আরারাত বিষয়ে তার সাথে কয়েকদিন ধরে আলাপ করেছি। কথায় কথায় আমি মাউন্ট আরারাতের স্বর্ণভাণ্ডারের কল্পকাহিনী সম্পর্কে বলেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, এটা কল্পকাহিনী নয়, পিতা নুহার নৌকার মতই বাস্তবতা ওটা। তবে মা মেরীর ঐ সম্পদ মা মেরী মানুষের চোখ থেকে আড়াল করে ফেলেছেন। পিতা নুহার নৌকা ল্যান্ড করার জায়গায় যেদিকে নৌকার সামনের দিকটা ছিল, তার সামনের এক গুহায় স্বর্ণভাণ্ডার সংরক্ষিত করা হয়েছিল। কিন্তু ১৮৪০ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের মাধ্যমে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তাহলে আমাদের পবিত্র পর্বতের আদিরূপ আর নেই। এটা ভক্তদের জন্যে এক বিরাট ক্ষতি নয় কি?’ তিনি বলেছিলেন, ‘এটা ঈশ্বরের ইচ্ছায় হয়েছে বৎস। এ নিয়ে কথা তোলো না। তবে পবিত্র পর্বতের আদিরূপ দেখতে চাইলে, তারও একটা সুযোগ ঈশ্বর রেখেছেন।’ বলে থেমে গিয়েছিলেন তিনি। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আমি উদগ্রীব হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কি সেই সুযোগ, কোথায় সেই সুযোগ?’ তিনি আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিলেন। স্থির দৃষ্টিতে দেখেছিলেন আমাকে। পরে বলেছিলেন, ‘কি বলছিলে, তুমি ‘লাভার অব হোলি আরারাত’-এর নেতা? হ্যাঁ, তোমার এটা জানার রাইট আছে।’ বলে একটু চুপ থেকে তিনি শুরু করেছিলেন, ‘অন্তত একটা মানচিত্রে পবিত্র মাউন্ট আরারাতের আদিরূপ সংরক্ষিত আছে। এই মানচিত্রটি তৈরি হয়েছিল খৃস্টপূর্ব ৫শ’ অব্দের কোন এক সময়। সময়টি ছিল এক মাহেন্দ্রক্ষণ। যখন পবিত্র মাউন্ট আরারাত মাথায়-টুপির মত আস্তরণ ছাড়া সমগ্র গা থেকে বরফের পোশাক ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিল, যেমনটা ছিল ঠিক প্লাবন ও প্লাবন-উত্তর কিছু সময়ে। সেই সময় ওরান্তি রাজবংশের বিজ্ঞানী সভাসদ ঈশ্বরভক্ত নাইরো নারিজিয়ান এই মানচিত্র তৈরি করেন।’ বলে আবার থেমে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ পিটার জন। ইজিচেয়ারে গা’টা এলিয়ে আবার চোখ বুজেছিলেন। মানচিত্রের কথা শুনে বুকটা আমার তোলপাড় করে উঠেছিল। মানচিত্রটা কোথায় পাওয়া যাবে, তা জানার জন্যে আমি মরিয়া। আমি বললাম, ‘ঐ মানচিত্রেই পবিত্র মাউন্ট আরারাতের আদি রূপ জানা যাবে। কিন্তু মানচিত্রটি পাওয়া যাবে কোথায়?’ বৃদ্ধ ফাদার আবার চোখ খুলল। তাকাল আমার দিকে। চোখে সেই সন্ধানী দৃষ্টি। বলল, ‘‘লাভার অব হোলি মাউন্ট আরারাত’ সংগঠনের তুমি প্রধান না! হ্যাঁ, তোমাকে বলা যায়। মানচিত্রটি ওরান্তি রাজবংশের প্রপার্টি ছিল। অনেক রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মানচিত্রটির স্থান হয় লেক-ভ্যানতীরস্থ ঐ অঞ্চলের প্রাচীনতম মনস্টারি তিলকিটেপী ধর্মালয়ে। এই যুগের এক খনন কাজের মাধ্যমে তিলকিটেপী ধর্মমঠ আবিষ্কৃত হলে অন্যান্য সব প্রত্নতাত্ত্বিক দ্রব্যের সাথে পোড়া চোয়াং রক্ষিত মানচিত্রটিও ভ্যান ক্যালিস প্রাসাদ মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি তখন ভ্যানে ছিলাম। আমার মত প্রবীণ ধরনের কয়েকজন গীর্জার প্রতিনিধি ও প্রত্নতত্ত্ববিদকে ডাকা হয় মানচিত্রটাকে ক্ল্যাসিফাই করার ক্ষেত্রে মতামত দেয়ার জন্যে। আমরা মানচিত্রটিকে মাউন্ট আরারাতের প্রাচীনতম মানচিত্র হিসেবে অভিহিত করি। এরপরই অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে ভ্যান ক্যালিস মিউজিয়ামের মাউন্ট আরারাত সেকশনে ওটা রাখা আছে। আমি আনন্দিত, মাউন্ট আরারাতের আদিরূপের নিদর্শন ঈশ্বর এভাবে সংরক্ষিত করলেন।’ বৃদ্ধ ফাদার পিটার জনের এই কাহিনী আমার হাতে আকাশের চাঁদ তুলে দেয়। হাতে চাঁদ পাওয়ার মতই খুশি হই। সেই মানচিত্র নিয়েই ওরা এখন ভ্যান থেকে আসছে। আমার মন অস্থির হবে না কেন বলুন?’
‘আপনার কথা ঠিক ওরান্তি ওরারতু! সত্যিই মানচিত্রটি মহামূল্যবান। আর এ মানচিত্রের সন্ধান পাওয়ার কাহিনী রূপকথাকে হার মানায়। আমি মনে করছি, আমাদের মিশন সফল হবে, দুর্লভ মানচিত্রের এই সন্ধান পাওয়াটা তারই লক্ষণ।’ বলল মিহরান মাসিস।
‘ঈশ্বর আপনার কথাকে সত্যে পরিণত করুন।’ বলে আবার হাতঘড়ির দিকে তাকাল ওরান্তি ওরারতু। বলল, ‘দেরি নেই, অল্পক্ষণের মধ্যেই ওরা এসে যাবে।’
ওরান্তি ওরারতুর কথা শেষ হতেই বাইরের লনে গাড়ির শব্দ পেল।
কান খাড়া ওরান্তি ওরারতু এবং মিহরান মাসিস দু’জনেরই।
গাড়ির শব্দ তাদের বাড়ির গাড়ি বারান্দায় এসে থেমে গেল।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ওরান্তি ওরারতু ও মিহরান মাসিস দু’জনেই।
দু’জনেই ছুটল বাইরে বেরুবার জন্যে।
মানচিত্রটি বার বার খুঁটে খুঁটে দেখার পর মুখ তুলল মিহরান মাসিস ও ওরান্তি ওরারতু দু’জনেই।
তাকাল তারা পরস্পরের দিকে। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময় ও আনন্দ।
প্রথমেই মুখ তুলল মিহরান মাসিস। বলল, ‘আমার অবাক লাগছে, সে সময়ের শিল্পীরাও এমন থ্রি-ডাইমেনশনাল নকশা আঁকতে পারতো! পবিত্র মাউন্ট আরারাতের অদ্ভুত এই থ্রি-ডাইমেনশনাল নকশা। ছবির মতই দেখা যাচ্ছে সব কিছু।’
‘ছবি কয়টি ডাইমেনশনালে তা নিয়ে আমার কাজ নেই মি. মিহরান মাসিস, আমার আগ্রহ আরারাতের সাড়ে পনের হাজার ফিট থেকে ষোল হাজার ফিটের বরফমুক্ত এলাকা, বিশেষ করে মাউন্ট আরারাতের পশ্চিম ঢালের উত্তর-পশ্চিম কোণটা। পনের হাজার পাঁচশ’ ফিট ওপরের এই স্থানেই প্লাবন শেষে মহান পিতা নুহের নৌকা ল্যান্ড করেছিল। নকশার এই স্থানে নজর করে দেখুন, পাহাড়ের এক গভীর ভাঁজে শিল্পী নৌকার মত একটা স্থাপনার ওপরের অংশ এঁকেছেন। নৌকার ডেকটা দেখা না গেলেও দেখুন, ডেকের ওপরের বিশাল দুই-আকৃতির একটা স্থাপনাকে শিল্পী স্পষ্ট করে তুলেছেন। এই স্থাপনার সামনের প্রান্ত থেকে কিছুটা জায়গা বাদ দিয়ে আরও সামনে তীরের মত কৌণিক একটা জিনিসকে মাথা উঁচু করে থাকতে দেখা যাচ্ছে! নিশ্চয় সামনের গুহাই হবে। এর চারপাশে পর্বতের গায়ে এবং পর্বতের খাঁজ ও ভাঁজের মেঝেতে দেখুন, নানা আকারের গুহাকে শিল্পী খুব স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন। এই গুহাগুলোই আমাদের সব আগ্রহ ও আকর্ষণের কেন্দ্র। আকুলভাবে এই গুহাগুলোর অবস্থা ও দর্শনই আমরা চেয়েছি। ঈশ্বর সেটা আজ আমাদের দিলেন। শিল্পীকে ধন্যবাদ যে, পবিত্র পর্বতের নকশা আঁকার ক্ষেত্রে এই এলাকার নকশাতেই যেন নজর দিয়েছেন বেশি, এই এলাকার নকশাকেই তিনি সবচেয়ে বিস্তারিত ও নিখুঁত করতে চেয়েছেন। দেখুন পর্বতের ঢাল, খাঁজ ও ভাঁজে পাথরগুলোর অবস্থানকেও তিনি স্পষ্ট করে তুলেছেন। ধন্যবাদ শিল্পীকে। ধন্যবাদ ঈশ্বরকে। পবিত্র স্বর্ণভাণ্ডারের প্রতি আমাদের যে আকর্ষণ, তাকেও অনুমোদন দিয়েছেন নিশ্চয়।’
দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল ওরান্তি ওরারতু। তার কণ্ঠে উত্তেজনা এবং চোখে-মুখে লোভের আগুন যেন জ্বল জ্বল করে উঠেছে।
‘সত্যিই ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করেছেন। না হলে এই দুর্লভ ডকুমেন্ট আমরা হাতে পেতাম না। কিন্তু আসল কাজই আমাদের বাকি। পনের হাজার পাঁচশ’ ফিট লেভেলের গুহাগুলোর সন্ধান আমরা পেলাম, লোকেশনও জানলাম, কিন্তু খুঁজে বের করব কি করে? তুর্কি সৈন্যরা তো কাউকে পাহাড়ে দু’দণ্ডও দাঁড়াতে দেয় না।’ বলল মিহরান মাসিস।
‘সেটাই তো সমস্যা। তবে এই সমস্যা দূর করার কাজও তো আমরা শুরু করে দিয়েছি। এবং সে কাজ খুব ভালোভাবেই এগোচ্ছে। এই অঞ্চলের টার্গেট পরিবারগুলোকে ড্রাগ-ব্যবসায়ের ফাঁদে ফেলার আমাদের কৌশল খুবই কাজ দিচ্ছে। আমাদের দেয়া তথ্য ঠিক ঠিক পাওয়ায় পুলিশও খুব উৎসাহিত হয়ে উঠেছে। পুলিশের অধিকাংশকেই আমরা কিনতে পেরেছি। শুধু ইজডির এলাকারই আড়াই হাজার পরিবারের তিন হাজার মানুষকে আমরা জেলে ঢোকাতে পেরেছি। ইতোমধ্যেই এখান থেকে বারশ’ পরিবার উচ্ছেদ হয়ে গেছে। এই বারশ’ পরিবারের জায়গায় আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে নতুন বারশ’ পরিবারকে বসাতে পেরেছি, যাদের মোট জনসংখ্যা পাঁচ হাজার হবে। যে হারে আমাদের কাজের অগ্রগতি হচ্ছে, তাতে বছরখানেকের মধ্যে ইজডির, কারস, অ্যাগ্রি ও ভ্যান প্রদেশ এলাকায় টার্গেটেড পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ এবং তাদের স্থানে আমাদের লোকদের পুনর্বাসন সম্ভব হবে।’ ওরান্তি ওরারতু বলল।
‘আমিও তাই মনে করছি। আমরা যতটা চাচ্ছি তার চেয়েও কাজ দ্রুত হচ্ছে। কিন্তু আমি ভয় করছি, পুরাতন পরিবারের উচ্ছেদ আর নতুন পরিবারের পুনর্বাসন সরকারের চোখে না পড়ে যায়।’ বলল মিহরান মাসিস।
‘নতুন পরিবারের পুর্নবাসন হচ্ছে এ কথা কেন বলছেন? আপনিই না সবকিছু করেছেন। ইস্তাম্বুল, আংকারাসহ উত্তরের শহরগুলোতে যে আর্মেনীয় পরিবারগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তাদের মধ্যে যারা বেশি রাজনীতি সচেতন, তাদেরকে গত দশ-পনের বছর ধরে দক্ষিণ-পূর্ব ইজডির, কারস, অ্যাগ্রি ও ভ্যানের মত প্রদেশগুলোতে ভোটার বানানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে সুনির্দিষ্ট সব ঠিকানায়। কেউ বুঝতে পারলেও প্রমাণ করতে পারবে না যে, অন্য অঞ্চল থেকে এরা এসেছে। গত তিনটি নির্বাচন কিংবা তারও বেশি সময়ের ভোটার তালিকায় তাদের নাম আছে, মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স পরিশোধ আছে। অতএব ভয়ের কিছু নেই মি. মিহরান মাসিস।’
হাসলো মিহরান মাসিস। বলল, ‘ধন্যবাদ মি. ওরান্তি ওরারতু। কাগজে-কলমে আমরা ঠিক আছি। কিন্তু আসলেই তো তারা হবে নতুন। এ বিষয়টা প্রশাসনসহ সচেতনদের চোখে পড়ে যেতে পারে। আমি এই ভয়টাই করছি।’
হাসল ওরান্তি ওরারতুও। বলল, ‘যাদের আপনি সচেতন বলছেন, যারা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে পারে, তারা হয় জেলে থাকবে, নয়তো উচ্ছেদ হবে টাকা-পয়সা নিয়ে। সুতরাং প্রতিক্রিয়া প্রকাশের কেউ থাকবে না মি. মিহরান মাসিস।’
‘এটাই ভরসা মি. ওরান্তি ওরারতু যে, যারা উচ্ছেদ হচ্ছে, তারা ঠিক উচ্ছেদ নয়। তারা জমি ও সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ পেয়ে নিজেরা সরে যাচ্ছে। সুতরাং তাদের কোন অভিযোগ থাকছে না, প্রতিক্রিয়া প্রকাশেরও সুযোগ তাই হবে না। টাকা-পয়সা প্রচুর খরচ হলেও অবাঞ্ছিত পপুলেশনকে এইভাবে সরিয়ে দেয়ার আমাদের কৌশল খুবই ভালো হয়েছে।’ বলল মিহরান মাসিস।
‘এজন্যে ধন্যবাদ দিতে হয় ‘আমরা মানুষ’ নামের ইহুদি এনজিওকে। বুদ্ধিটা ওরাই দিয়েছে। ‘আমরা মানুষ’-এর প্রেসিডেন্ট মোশে অ্যাসেনাথ বলেছিলেন, ‘এই ধরনের তৃণমূল পরিবর্তনের কাজ কখনও গায়ের জোরে করবে না, বুদ্ধি দিয়ে করবে। বুদ্ধির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো টাকা। কৌশলে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি কর, নিরাপত্তাহীনতার আতংক ছড়াও, তারপর টাকা দাও নিরাপদ স্থানে সরে পড়ার জন্যে। দেখবে, ওরা তোমার শত্রু হয়ে নয়, তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে সরে যাচ্ছে, তুমি যেমনটি চাও।’ টার্গেটেড পরিবার ও লোকদেরকে ড্রাগ-ব্যবসায়ের ফাঁদে ফেলার বুদ্ধিও ‘আমরা মানুষ’ নামের ঐ ইহুদি এনজিওর কাছ থেকেই আমরা পেয়েছি। ধন্যবাদ তাদেরকে। তাদের এই বুদ্ধি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে কাজ দিচ্ছে।’ ওরান্তি ওরারতু বলল।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। কিন্তু মি. ওরান্তি ওরারতু, একটা বড় গণ্ডগোল তো বেঁধে গেছে। আরিয়াসের বারজানি পরিবারকে কেন্দ্র করে আমাদের পরিকল্পনা সাংঘাতিকভাবে মার খেয়েছে। আপনি জানেন, ঐ পরিবারের সবচেয়ে সক্রিয় সদস্য যুবক আতা সালাহ উদ্দিন বারজানিকে ড্রাগ-ব্যবসায়ের ফাঁদে ফেলে জেলে পুরেছি। তার পিতা-মাতা আছেন মস্কোতে। তাদের তরফ থেকে এখনও ভয়ের কিছু ঘটেনি। কিন্তু আতা সালাহ উদ্দিনের বোন ড. আজদা আয়েশা এসেছে জার্মানি থেকে। সেই এসে ঝামেলা পাকিয়েছে। তাকে ড্রাগের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। ড্রাগ-ফাঁদ পাতার জন্য আমাদের বালক-বালিকা বাহিনীর একজন বালককে পাঠানোও হয়েছিল ড. আজদার ঘরে ড্রাগ রাখার জন্যে। কিন্তু ড. আজদা তাকে ধরে ফেলে। গোপনীয়তা যাতে বালকটি ফাঁস করতে না পারে সেজন্যে থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে আমাদের লোকরা বালকটিকে হত্যা করে।’
বলে মিহরান মাসিস থামল এবং টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নিল।
‘চমৎকার কাজ করেছে আমাদের লোকরা। এরপর আমাদের কিছু লোক সেখানে মারা গেছে, এই তো! এটা আমি ভ্যান থেকেই শুনেছি।’ বলল ওরান্তি ওরারতু।
মিহরান মাসিস পুরো গ্লাসের পানি ঢক ঢক করে গিলে নিয়ে বলল, ‘শুধু লোক মারা যাওয়া নয়, সেই লোকেরা কি অবস্থায় কিভাবে মারা গেল, তা অ্যালার্মিং। আমাদের একজন মূল্যবান বালক হারাবার শোধ নেয়ার জন্যে সেদিনই সন্ধ্যা রাতে ড. আজদাকে কিডন্যাপ করতে গিয়েছিল আমাদের কিছু লোক। ঠিক সেসময় পুলিশ সেখানে হাজির হয় এবং কিডন্যাপ করে ফেরার পথে আমাদের চারজনই পুলিশের গুলিতে মারা যায়, অথচ পরিচয় জানার পর পুলিশ তাদের মারার কথা নয়। আমাদের নীতি অনুসারে সেদিন রাতেই ড. আজদাকে তার বাড়ি থেকে ধরে আনার জন্যে দুর্ধর্ষ কয়েকজনকে পাঠানো হয়েছিল। তারা সকলেই মারা পড়ে। এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে শত্রুকে সময় না দেয়ার আমাদের যে নীতি, সেই অনুসারে হোম সার্ভিসের গাড়ি করে হোম সার্ভিসের ছদ্মবেশে আমাদের ৭জন কমান্ডো যায় সেখানে। ৭ জন কমান্ডোই মারা পড়েছে। পরবর্তী এই দু’ঘটনায় পুলিশের সাহায্য আমরা পাইনি।’
বিস্ময় ফুটে উঠেছিল ওরান্তি ওরারতুর চোখে-মুখে। মিহরান মাসিস থামতেই সে বলে উঠল, ‘কে হত্যা করল তাদের? ঐ পুঁচকে মেয়েটা? তা কি করে সম্ভব?’
‘মেয়েটা নয়, তাদের বাড়িতে আসা একজন মেহমান। সম্ভবত ড. আজদার কোন আত্মীয়।’ মিহরান মাসিস বলল।
‘বারজানি পরিবার ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের সবাই তো আমাদের নখদর্পণে। তাদের মধ্যে কেউ এই অসাধ্য সাধন করেছে বলে তো মনে হয় না।’ বলল ওরান্তি ওরারতু।
‘আমিও বুঝতে পারছি না কি ঘটনা। ইজডির পুলিশের ডিওপি খাল্লিকান যে মেসেজ আমাদের দিয়েছেন, সেটাও উদ্বেগজনক। বলেছেন তিনি, ড. আজদাদের মেহমান লোকটি সাধারণ নয়। রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের সাথে তার যোগাযোগ থাকতে পারে।’ মিহরান মাসিস বলল।
‘রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের সাথে তার যোগাযোগ থাকতে পারে? তাহলে সে সে?’ বলল ওরান্তি ওরারতু। উদ্বেগ তার কণ্ঠে।
তার কথা শেষ হতেই মিহরান মাসিসের পিএস মিহরান মাসিসকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার, আরিয়াস থেকে মি. ভারদান এসেছেন।’
‘হ্যাঁ, আমরা তাকেই আশা করছিলাম। নিয়ে এস তাকে।’
ভারদান বুরাগ আরিয়াস অঞ্চলের ‘সোহা’ প্রধান।
মিনিটখানেকের মধ্যেই ভারদান বুরাগ ঘরে প্রবেশ করল। মিহরান মাসিস ও ওরান্তি ওরারতু দু’জনেই স্বাগত জানাল তাকে।
ভারদান বুরাগ গিয়ে মিহরান মাসিসের সামনের সোফায় বসল।
‘সোজা আরিয়াস থেকে এলেন?’ জিজ্ঞেস করল মিহরান মাসিস ভারদান বুরাগকে।
‘স্যার, আরিয়াস থেকে ভ্যান হয়ে এখানে আসছি স্যার।’
‘বল কি খবর?’ জিজ্ঞাসা মিহরান মাসিসের।
‘ভালো নয় স্যার। লোকটি এসে সবকিছুই লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে।’ বলল ভারদান বুরাগ।
‘কোন লোক? ড. আজদার অতিথি?’ মিহরান মাসিস বলল।
‘ঠিক বলেছেন স্যার! ঐ লোকটিই।’ ভারদান বুরাগ বলল।
‘লণ্ডভণ্ড কি করছে? দু’ঘটনায় আমাদের তেরজন লোক মেরেছে, সেটাই কি?’ বলল মিহরান মাসিস।
‘শুধু এটাই নয় স্যার। লোকটি যে যাদুকর। এসেই যেন সব জেনে ফেলছে। এসেই নাকি সে পুলিশকে জানিয়েছে, ইজডিরসহ দক্ষিণ-পূর্বের কয়েকটি প্রদেশ থেকে লোক উচ্ছেদ করে বাইরের লোক এনে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। সর্বশেষে আমরা জানতে পেরেছি, সে লোক লাগিয়েছে বাড়ি বাড়ি ঘুরে একটা রিপোর্ট তৈরি করতে তাদের অভিযোগ সত্য প্রমাণের জন্য।’ ভারদান বুরাগ বলল।
ভারদান বুরাগের কথা শুনে মিহরান মাসিস ও ওরান্তি ওরারতু দু’জনের মুখ কালো হয়ে গেছে। ওরান্তি ওরারতুর মুখ ফেটেই যেন চিৎকার বেরুল, ‘বলছ কি ভারদান বুরাগ? এসেই লোকটা এসব জানতে পেরেছে?’
‘সেটাই তো আশ্চর্যের। তারা থানায় যে কেস করেছে, তাতেও তাদের এসব কথা আছে। পুলিশ আমাদের এটা জানিয়েছে।’ বলল ভারদান বুরাগ।
‘লোকটি কে তোমরা জেনেছ?’ জিজ্ঞাসা মিহরান মাসিসের।
‘জানা যায়নি। তবে সে যে বারজানি পরিবারের আত্মীয় নয়, এটা নিশ্চিত। পুলিশের কাছ থেকেও এ ব্যাপারে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। পুলিশ সদস্য রশিদ দারাগ চিকিৎসা নিচ্ছেন ভ্যানে। আর ডিওপি খাল্লিকান খাচিপ তেমন কিছু তথ্য দিতে পারেননি।’ ভারদান বুরাগ বলল।
‘কোথায় এখন লোকটি?’ বলল ওরান্তি ওরারতু।
‘গতকাল ভ্যানে এসেছে। এসে এখানেও গণ্ডগোল পাকিয়েছে।’ ভারদান বুরাগ বলল।
‘কি গণ্ডগোল?’ মিহরান মাসিস বলল।
‘গণ্ডগোল মানে এখানেও আমাদের কাজে বাগড়া দেবে বলে মনে হচ্ছে। আমি এখানে রওয়ানা দেয়ার আগে পুলিশ সূত্রে জানতে পারলাম, ভ্যান ক্যালিস প্রাসাদ মিউজিয়ামের এই রাতের রক্তাক্ত অভিযানের ঘটনাকে সে মাউন্ট আরারাতের উল্কিধারী মানে আমাদের কাণ্ড বলে পুলিশকে জানিয়েছে। আরও মজার…।’
ভারদান বুরাগের কথার মাঝখানেই ওরান্তি ওরারতু উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠল, ‘উল্কিধারীর কথা সে বলেছে? জানল কি করে আমাদের মাউন্ট আরারাতের সদস্যরা উল্কি ধারণ করে! অসম্ভব ব্যাপার!’
‘সে জন্যেই তো লোকটা যাদুকর। আরও একটা বড় ব্যাপার হলো, ভ্যানের পুলিশ সূ্ত্রেই আমি জানলাম, মিউজিয়ামে রক্তাক্ত এ ঘটনার দায়ে মিউজিয়ামের প্রধান গ্রেফতার হওয়া অবধারিত ছিল। ডিজিপি পুলিশ নিয়ে স্বয়ং গিয়েছিলেন ড. মাহজুন মাজহারকে গ্রেফতারের জন্যে। কিন্তু সেখানেও হাজির ঐ যাদুকর লোকটি ড. আজদা ও ড. সাহাব নুরীকে নিয়ে। লোকটি তার যুক্তি দিয়ে ঘটনার মোড় একেবারে পাল্টে দেন এবং ড. মাহজুন মাজহার নির্দোষ হয়ে যান এবং মিউজিয়ামের হামলাকারীরা কিভাবে, কোন কৌশলে মিউজিয়ামে প্রবেশ করেছে, তারও সম্ভাব্য তথ্য সে পুলিশকে দিয়েছে। পুলিশ সে অনুসারে তদন্তও শুরু করে দিয়েছে।’
‘অসম্ভব সব কথা বলছেন মি. ভারদান। কিভাবে একজন লোক এভাবে সবজান্তা হতে পারে? পুলিশকে দেখছি এভাবে সে হাতের মুঠোয় নিয়ে ফেলেছে। কল্পনারও অতীত ঘটনা এসব।’ বলল মিহরান মাসিস।
‘ভ্যানে কোথায় উঠেছে লোকটা?’ বলল ওরান্তি ওরারতু।
‘ভ্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ড. আজদার মামা ড. সাহাব নুরীর বাড়িতে।’ ভারদান বুরাগ বলল।
ওরান্তি ওরারতু তাকাল মিহরান মাসিসের দিকে। বলল, ‘এসব শুনে আর লাভ নেই মি. মিহরান মাসিস। এখন বলুন কি করা যায়? ঐ লোকটিকে এক মুহূর্তও বাঁচিয়ে রাখা যায় না।’
‘এখন সব কাজ ছেড়ে ঐ লোকটিকেই দেখতে হবে। সত্যিই বলেছেন, ওকে বাঁচিয়ে রেখে আমাদের সামনে এগোনো সম্ভব নয়।’ বলল মিহরান মাসিস।
‘একজনের জন্যে সব কাজ বন্ধ থাকবে না। আমাদের সব কাজই চলবে, চলতে হবে আরও দ্বিগুণ বেগে। এর পাশাপাশি আমরা লোকটিকেও দেখবো। আমাদের বাছাই করা কমান্ডোদেরকে আজই পাঠাতে হবে ভ্যানে। দরকার হলে আমিও সেখানে যাবো। ভ্যানে এই মুহূর্ত থেকেই তার ওপর চোখ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।’ ওরান্তি ওরারতু বলল।
‘তার ওপর সার্বক্ষণিক চোখ রাখার ব্যবস্থা আমরা করেছি। সে আরিয়াস থেকে ভ্যানে এলে আমাদের দু’জন তাকে অনুসরণ করে ভ্যানে এসেছে এবং তার ওপর সার্বক্ষণিকভাবে চোখ রাখছে।’ বলল ভারদান বুরাগ।
ওরান্তি ওরারতুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ মি. ভারদান বুরাগ। আমি আনন্দিত যে, আপনারা সময়ের সাথে এগোচ্ছেন।’
ভারদান বুরাগের কথা শেষ হতেই মিহরান মাসিস বলল, ‘তাহলে এখন উঠা যাক। আজকেই ভ্যানে লোক পাঠাতে হবে। কাদের পাঠানো যায়, আপনিও ভাবুন। আমিও দেখছি। সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলোর এ পর্যন্তকার বিশ্লেষণে বুঝেছি, লোকটি বিপজ্জনক। সাবধানে এগোতে হবে। তাকে কাবু করতে, বাগে আনতে আরও কি করা যায়, সেসব বিকল্প নিয়েও ভাবতে হবে।’
‘ঠিক মি. মিহরান মাসিস। আপনি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, সেসব নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।’
বলে উঠে দাঁড়াল ওরান্তি ওরারতু।
উঠে দাঁড়াল মিহরান মাসিস।
ভারদান বুরাগও।