স্ট্রাসবার্গে গিয়ে বুঝতে পারলাম কতজনকে দাস মার্কেটে বিক্রির জন্যে আনা হয়েছে। আমরা সংখ্যায় ছিলাম একশ জন। একেক কাভার্ড ভ্যানে পঁচিশজন করে। পশুর মত গাদাগাদি করে আমাদের আনা হয়েছে।
দাস বাজারে স্লেভ ট্রেডারদের এক বা একাধিক খোয়াড় ধরনের জায়গা আছে। এগলোর ছাদ আছে এবং গোলাকার চারদিকটা লোহার শিকের বেড়া দিয়ে ঘেরা। খোঁয়াড়ে প্রত্যেকের জন্যে একটা করে বেড আছে। খোঁয়াড় থেকে একেকজন করে বেরিয়ে খাবার নিয়ে আসতে হয়। খোঁয়াড়েই ঘুরে বেড়াতে হয়। রাত ছাড়া শোয়ার হুকুম নেই। পূর্ণ রাত্রি ঘুম ও পর্যাপ্ত খাবার আমাদের দেয়া হয়। দাসদের স্বাস্থ্য ভালো হওয়া বেশি দাম পাওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয়। খাওয়ার জন্যে বাইরে বের করে আনা হয় এটা দেখানোর জন্যে যে, সে শান্ত-শিষ্ট ও অনুগত। ভালো দাম পাবার জন্যে দাসকে শান্ত-শিষ্ট ও খুব অনুগত প্রমাণ করতে হয় ক্রেতার কাছে। যতদিন খদ্দের না পাওয়া যায়, তখন দাস বাজারের খোঁয়াড়েই থাকতে হয়। শীতের সময় রাতের বেলা খোঁয়াড়কে টিন শিট দিয়ে ঘেরা হয় এবং বাইরে চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে আবহাওয়া গরম রাখা হয়। আমার সংগীদের মধ্যে জনাদশেক ছাড়া সবাই আফ্রিকার খৃস্টান। অবশিষ্ট দশজনের সবাই মুসলিম। তাদের কাউকে আমি চিনি না। ওরা সবাই সৈনিক। বিভিন্ন অঞ্চল খেকে ওদের ধরে আনা হয়েছে। এদের সবাইকেই আমি মনের দিক দিয়ে ভেঙে পড়া অবস্থায় পেয়েছি। আমি ওদের সাহস দিয়েছি, আল্লাহর ওপর ভরসা করতে বলেছি। সুস্থ থাকা, শান্ত থাকা এবং যেহেতু এর বিকল্প নেই, তাই যা ঘটে তা মেনে নেয়ার মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে বলেছি। সবাইকে হারালেও, সবকিছু হারালেও আল্লাহকে না হারাবার জন্যে ওদের উপদেশ দিয়েছি। আল্লাহ রাজি থাকলে কষ্টের এ দুনিয়ার পর অনন্ত সুখের সম্ভাবনা থাকে। কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকাংশই সোহেলী অঞ্চলের। সোহেলী ভাষা আমি মোটামুটি জানি। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে প্রায় ৩০ জনের মত মুসলমান পেয়েছি। আমাদের নামাজ পড়া দেখে তারাই এসে তাদের পরিচয় দিয়েছে। এটা ঘটেছে দাস বাজারের খোঁয়াড়ে আসার পর। আমি তাদের উপদেশ দেবার সুযোগ পেয়েছি। তারা সবাই আমার ভক্তে পরিণত হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য, আমাদের এই নামাজ রাতের বেলা গোপনে পড়তাম। আমাকে তারা মুর জানত, কিন্তু সরাসরি জানত না আমি মুসলমান। আমি ইচ্ছা করেই আমার লেখা-পড়া, পেশা ও আমার ধর্ম গোপন করেছি শুরু থেকেই। খোঁয়াড়ের সবার সাথেই একটা হৃদ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম কে কোথায় বিক্রি হয় তা জানার ও গোপনে লিখে রাখার চেষ্ট করব, যাতে ভবিষ্যতে ওদের সাথে যোগাযোগের সুযোগ হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো আমাদের একশজনের লটের মধ্যে আমিই প্রথম বিক্রি হয়ে যাই।
কয়েক দিন থেকেই আমি দেখছিলাম দীর্ঘ দেহী ‘নাইট’দের ইউনিফরম পরা বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত একজন ঘোড়সওয়ার দাস বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের খোঁয়াড়ে কয়েক বার ঘুরে গেছে।
সেদিন দুপুরে আমাদের স্টল থেকে আমি খাবার আনছিলাম। হঠাৎ আমি সেই ঘোড়সওয়ারের সামনে পড়ে গেলাম। ঘোড়সওয়ারও থমকে দাঁড়াল। আমাকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলল, ‘তোমার নাম কি?’ আমি বলল, জোসেফ জ্যাকব আলগার।’
নামটি আমি আগেই ঠিক করে আমার মালিককে বলে দিয়েছিলাম। নামটি আমার মূল নাম ‘ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর’-এর খৃস্টীয়করণ। উভয় নামের অর্থ একই। ঘোড়সওয়ার লোকটি একটু ভ্রুকুঁচকে বলল, ‘দাসদের সবার নামই সংক্ষিপ্ত। তোমার এত বড় নাম? এ নামের অর্থ কি জান?’
আমি বললাম, ‘উত্তম যোদ্ধা জোসেফ জ্যাকব।’
গম্ভীর কন্ঠে বলল ঘোড়সওয়ার, ‘তুমি কি যোদ্ধা? যুদ্ধ করেছ?’
আমি বললাম, ‘যোদ্ধাও নই, যুদ্ধও করিনি। তবে যাদের নামে আমার নাম তারা সবাই এক ধরনের যোদ্ধা ছিলেন।’
‘কি ধরনের যোদ্ধা ছিলেন?’ বলল ঘোড়সওয়ার। সেই গম্ভীর কন্ঠেই।
‘শুনেছি তাঁরা মানুষ পরিবর্তনের যোদ্ধা ছিলেন।’ বললাম আমি। এবার আরও একবার ভ্রূকুঁচকে গেল ঘোড়সওয়ারের। বলল, ‘কোথায় শুনেছ তুমি?’
উত্তর আগেই চিন্তা করে রেখেছিলাম। বলল, ‘গির্জার সামনে শুনেছি।’
ঘোড়সওয়ারের চেহারায় প্রসন্নতা দেখা দিল। বলল, ‘তুমি গির্জায় যাও?’
‘যেতাম।’ আমি বললাম।
‘তুমি লেখাপড়া জান?’ জিজ্ঞেস করল ঘোড়সওয়ার।
‘কোন রকমে লেখা ও পড়ার মত অক্ষরজ্ঞান আমার আছে।’ বললাম আমি।
‘তুমি জার্মান ভাষার নাম শুনেছ?’ জিজ্ঞেস করল ঘোড়সওয়ার।
‘শুনেছি। কিছু বলতে ও বুঝতে পারি।’ আমি বললাম।
এবার বিস্ময় ঘোড়সওয়ারের চোখে-মুখে। বলল, ‘কেমন করে জান, কোথায় শিখেছ?’
‘আমার একজন জার্মান প্রতিবেশী ছিলেন। তার কাছ থেকেই দিনে দিনে কিছুটা শেখা হয়ে গেছে।’ বললাম আমি।
‘তোমাকে কোথেকে ধরেছে?’ জিজ্ঞেস করল ঘোড়সওয়ার।
‘পশ্চিম স্পেনের যুদ্ধ সংলগ্ন এক গ্রাম থেকে প্রতিপক্ষ যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধরে নিয়ে যায় এবং বর্তমান মালিকের কাছে বিক্রী করে।’ আমি বললাম। এটাই মালিক বলতে বলেছিল।দক্ষিন ফ্রান্সের শান্ত এলাকা থেকে এরা আমাকে ধরেছে, এ কথা না বলতে শাসিয়ে দিয়েছিল মালিক। আমি সেটাই বললাম।
‘দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে আমার খারাপ লাগেনি?’ জিজ্ঞেস করল মালিক।
‘এটাই মনে হয় আমার ভাগ্য।’ বললাম আমি।
‘এই ভাগ্যকে তুমি মেনে নিয়েছ?’ বলল ঘোড়সওয়ার।
‘ভাগ্য তো ভাগ্যই। একে মেনে নেয়া, না নেয়ার কোন অবকাশ নেই।’ আমি বললাম।
‘তুমি খুব বুদ্ধিমান। আমি খুশি হয়েছি।’ বলল ঘোড়সওয়ার।
‘ধন্যবাদ।’ বলে আমি চলে এলাম আমার খোঁয়াড়ে। আমার খাওয়া শেষ করে আমি হাত-মুখ পরিস্কার করতে গিয়ে দেখলাম, সেই ঘোড়সওয়ার ও আমার মালিক কথা বলছে। আমি হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে এলাম।
আমি ফিরে আসার পরপরই ফিরে এল আমার মালিক। হাসিমুখে আমার কাছে এসে বলল, ‘আমার সৌভাগ্য, তোমারও সৌভাগ্য। ক্রুসেড ফেরত একজন বিখ্যাত নাইট তোমাকে কিনে নিয়েছে। সে একজন বীর ও জ্ঞানী মানুষ। এটা তোমার সৌভাগ্য। আর আমার সৌভাগ্য হলো যে রেট চলছে, তার দ্বিগুণ দাম সে আমাকে দিয়েছে। তুমি রেডি হও। সে আধা ঘন্টার মধ্যে এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।
মনটা আমার খারাপ হয়ে গেল। আমার সাথী খোঁয়াড়ের সবাইকে আমি ভাইয়ের মত ভালোবেসে ফেলেছিলাম, বিশেষ করে মুসলিম ভাইদেরকে। আমার চলে যাওয়া মানে চিরতরে ওদের আমি হারিয়ে ফেলব।
মনটা আমার কেঁদে উঠলেও করার কিছু ছিল না। আধা ঘন্টার মধ্যেই ঘোড়সওয়ার আমার খোঁয়াড়ে গিয়ে হাজির হলেন একটা ঘোড়ায় টানা জার্মান গাড়ি নিয়ে। তার সাথে আরেকজন চব্বিশ-পঁচিশ বছরের যুবক।
মালিক স্বয়ং খোঁয়াড়ের মুখে ছিল। আমি বের হয়ে এলাম খোঁয়াড় থেকে। বের হবার সময় হাত দিয়ে একবার দেখলাম নতুন পাতলুনের পকেটে আমার সেই দু’টো মেডেল আছে কি না। নিশ্চিত হয়ে সামনে এগোলাম।
ঘোড়সওয়ার আমাকে স্বাগত জানাল। সাথের যুবকটিকে দেখিয়ে বলল, ‘এ হলো বেনেডিক্ট, আমার সেক্রেটারি। আর আমি ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক। রাইনের একজন নাইট। এখন রাইন ছেড়ে সালজওয়াডেলে চলে গেছি। তুমি সেখানেই যাবে। গাড়ির পেছনে উঠে বস।’
বলে ঘোড়সওয়ার নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক গিয়ে বসল ড্রাইভিং সিটে। তার পাশে বসল তার সেক্রেটারি বেনেডিক্ট।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
আমি বললাম, ‘ঘোড়াটার কি হবে? ঘোড়া কে নিয়ে যাবে?’
‘ধন্যবাদ আলগার, তুমি ঘোড়াটার কথা মনে করেছ। ঘোড়াটা আমার ভাড়া করা ছিল। নাইটরা ঘোড়ায় চড়তেই বেশি গৌরব বোধ করে, ঘোড়ায় টানা গাড়িতে নয়। এখানে এসে ভাড়া করেছিলাম ঘোড়াটা।’ বলল নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক।’’
এই পর্যন্ত পড়ে আহমদ মুসা সামনের আরও পাতা উল্টিয়ে দেখে নিয়ে বলল, ‘মি. আলগার, এর পরের কিছু পাতায় রয়েছে স্ট্রাসবার্গ থেকে জার্মানীর আরেক এলাকা সালজওয়াডেলে যাবার কাহিনী। এখানে পথের বর্ণনা ছাড়া তেমন কিছুই নেই। আগেও কিছু কিছু বাদ দিয়েছি, এখানে বড় একটা অংশ বাদ দিতে হবে।’ থামল আহমদ মুসা।
কোন জবাব নেই মি. আলগার কিংবা কারও তরফ থেকে। তাকাল আহমদ মুসা তাদের দিকে। দেখল, অপার বিস্ময় আর বেদনার দৃষ্টি নিয়ে আলগার তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। আদালার মায়ের চোখেও একই বিস্ময় আর বেদনা। কিন্তু আদালার চোখ অশ্রুতে ভরা। চোখ ছাপিয়ে অশ্রুর ধারা তার দুই গণ্ডেও নেমে এসেছে।’
মি. আলগারই কথা বলল। সে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, জবাব তো আমরা পেয়ে গেছি। আমরা দাস বংশোদ্ভূত কেন, কেন আমরা নন-জার্মান, আমাদের মূল কোথায়, পরিচয় আমাদের কি-সব প্রশ্নের জবাব আমরা পেয়ে গেছি। আমার দাদু আমার নাম আমাদের প্রথম পুরুষের নাম অনুসারে রেখেছিলেন। দেখা যাচ্ছে, নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক দাস হিসেবে যাকে কিনে এনেছিলেন, সেই ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর ওরফে জোসেফ জ্যাকব আলগার আমাদের প্রথম পুরুষ। তাঁর নতুন নামেই আমার নাম। আরও জানলাম, আমাদের মূলটা একটা গৌরবদীপ্ত সিভিলাইজেশন-এর সাথে। মূলে গিয়ে আমরা মুসলমান। জার্মানীতে আমার প্রথম পুরুষ মুসলমান ছিলেন। কিন্তু সব কিছুর পরেও মি. আহমদ মুসা আমরা দাস বংশোদ্ভূত আমরা নন-জার্মান, এটাই প্রতিষ্ঠিত হলো।’
থামল জোসেফ জ্যাকব আলগার। বেদনায় ভেঙে পড়া তার কন্ঠ।
পিতা জোসেফ জ্যাকব আলগার থামতেই চোখ মুছতে মুছতে আদালা হেনরিকা বলে উঠল, ‘বাবা, তোমাকে আমি ডিপ্রেসড দেখছি। তোমার কন্ঠে বেদনার সুর বাবা। আমি এর প্রতিবাদ করছি। আমি আমাদের প্রথম পুরুষ ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর ওরফে জোসেফ জ্যাকব আলগারের সীমাহীন দু:খ-বেদনা ও বিপর্যয়ে কেঁদেছি বটে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি আমি গৌরব বোধ করছি। আমার পূর্বপুরুষকে যিনি কিনেছেন, সেই নাইট একজন যোদ্ধা ছিলেন মাত্র আর আমার পূর্বপুরুষ ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর গোটা ইউরোপে যখন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরে থাক, একটা মেডিকেল স্কুলও ছিল না ইউরোপ জুড়ে, তখন ছিলেন কর্ডোভা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক প্রাপ্ত কৃতি ছাত্র এবং কর্ডোভা মেডিকেল কলেজের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত কৃতি চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং সেই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃতি অধ্যাপক। ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি হওয়া ছিল একটা ঘটনাচক্র। আর বাবা, আমার মহান সেই পূর্বপুরুষ একজন ডাক্তার হিসেবে ধর্ম, দেশ পরিচয় নির্বিশেষে সকল আহতকে সেবা দিচ্ছিলেন, প্রাণ বাঁচা্চ্ছিলেন আহতদের, তখন তার সন্তান ও স্ত্রীকে বীভৎস পাশবিকতার সাথে হত্যা করা হয়। রাজ্য হারিয়ে, সন্তান ও স্ত্রীর মৃত্যুর বীভৎস দৃশ্য দেখে তিনি সব ব্যাপারে এতটাই নিরাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, সব ত্যাগ করে পথের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন, মানে ঈশ্বরের হাতে নিজেকে তুলে দিয়েছিলেন। ঈশ্বর বা আল্লাহ তাঁকে এই জার্মানীতে আনবেন বলেই এসব ঘটেছে। তাঁর গৌরব, তাঁর মর্যাদা এতে এতটুকুও ম্লান হয়নি। আমরা তাঁর বংশধর, আমাদের মর্যাদাকে ম্লান ভাবছি কেন? তিনি যে উন্নতশিরে দাস জীবনকে গ্রহণ করেছিলেন আল্লাহর ইচ্ছা ভেবে, আমরাও তেমনি উন্নতশির হরো দাস বংশোদ্ভূত হওয়ার পরিচয় দানের ক্ষেত্রে।’ বলল আদালা হেনরিকা।
জোসেফ জ্যাকব আলগার ও তার স্ত্রী আদালার মা’র চোখ মুখ অনেকখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বলল আদালার বাবা আলগার, ‘ধন্যবাদ আদালা, আমাদের মহান প্রথম পুরুষের সর্বকনিষ্ঠ উত্তরসূরির উপযুক্ত দায়িত্ব পালন করেছ। আমরা যেটা পারিনি। পারিনি কারণ, এই দায়িত্ব নেয়ার জন্যে যে শক্তি ও প্রাণপ্রাচুর্য দরকার তা আমাদের বোধ হয় নেই। আমরা এখন শান্তি খুঁজি, স্বস্তিতে থাকতে চাই। আর শান্তি ও স্বস্তির সন্ধান মানুষকে অনেকটাই দুর্বল ও রক্ষণশীল করে তোলে। ধন্যবাদ তোমাকে আদালা। কিন্তু আমাদের মহান সেই প্রথম পুরুষ তার মুসলিম পরিচয় ও কৃতী চিকিৎসাবিজ্ঞানী হওয়ার পরিচয় সেদিন গোপন করেছিলেন কেন?’
‘বাবা, তুমি জান সে সময়টা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড উন্মাদনার সময়। এটা ফার্স্ট ক্রুসেডের পরবর্তী ঘটনা। তারপরও আরও কয়েকটি ক্রুসেড হয়েছে। সে সময় মুসলিম পরিচয় পেলে কিংবা মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীর পরিচয় পেলে ইউরোপের এই অংশের কোন দেশেই তার বাঁচার কোন সুযোগ ছিল না। আমি মনে করি, মুসলিম পরিচয় গোপন করে তিনি অন্তত প্রাণ বাঁচাতে পেরেছেন। তারপর তিনি আরও কি সুযোগ পেয়েছেন কিংবা কি’ ঘটেছে তা পরবর্তী পাঠ থেকে জানা যাবে বাবা। পড়া আমার শুরু হওয়া দরকার। আপাতত কিছু কিছু অংশ বাদ দিয়ে পড়লে সংক্ষেপে সব জানার জন্যে তা ভালো হবে। পরে পুরো পড়ার সুযোগ নেয়া যাবে, যদি স্যার আমাদের প্রতি দয়া করেন।’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘প্লিজ মি. আহমদ মুসা, আপনি যেভাবে ভালো মনে করেন পড়া শুরু করুন। আদালার সাথে আমি একমত।’
আহমদ মুসা আবার পড়া শুরু করল:
“তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় সালজওয়াডেলে পৌঁছলাম। মাঝখানে দু’রাত আমরা বিশ্রাম নিয়েছি দুই হোটেল বা পান্থশালায়। সব জায়গায় দেখেছি নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিকের ভীষণ খাতির। সবাইকে বলাবলি করতে শুনেছি, ইস্তাম্বুল অভিমুখের ষষ্ঠ ক্রুসেড পরিচালনায় তিনি বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার লোক হিসেবে আমরাও কম খাতির পাইনি।
সালজওয়াডেল নদীর ধারে বিশাল দুর্গসদৃশ বাড়ি নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিকের। পরে শুনেছি নাইট ফ্রেডারিক যখন রাইনের দুর্গ ছেড়ে সালজওয়াডেল চলে আসেন, তখন কিং চতুর্থ অটো তাকে স্বাগত জানিয়ে এই বাড়ি দান করেন এবং নদীর উপর পাহারাদারীর দায়িত্ব দেন।
বাড়িতে পৌঁছে আমার নতুন মালিক নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক তার সেক্রেটারি বেনেডিক্টকে বলল, আলগারকে আপতত বিশ্রামের একটা জায়গা দেখিয়ে দিয়ে নাস্তা করাও। তারপর তাকে সেলুনে নিয়ে গিয়ে চুল কাটাও।
দাসদের চুলকাটা মানে মাথা, মুখ সবকিছুকে নগ্ন করা। জীবনে এই প্রথম দাড়ি,গোঁফ ও চুল কেটে নেড়ে হলাম।
চুল কাটার পর মালিকের সেক্রেটারি বেনেডিক্ট আমাকে জানাল, ‘আগামীকাল সকালে তোমাকে নাইট ফ্রেডারিকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তাঁর সাথে পরিবারের অন্য কেউ থাকতে পারেন। সেই দেখা করার পর ঠিক হবে কোন কাজ তোমাকে দেয়া হবে।’ বুঝলাম সাক্ষাৎকারটা আসলে একটা ইন্টারভিউয়ের মত। মানে যে দাসকে কেনা হলো তাকে দিয়ে কোন কাজটা করানো হবে।
পরদিন নাস্তার পর আমাকে মালিকের সামনে হাজির করা হলো। মালিকের দুর্গসদৃশ বাড়ির প্রধান গেট দিয়ে ঢুকে বিরাট লন। লনের শেষ প্রান্তে বিরাট সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। বাড়িটা সত্যিই দুর্গের মত দশ বারো তলার সমান উঁচু। দোতলায় সিঁড়ির মুখে একপাশে একটা টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ারে বসেছেন আমার নতুন মালিক। তার বামপাশে তার প্রায় সমবয়স্ক এক মহিলা, নিশ্চয় তার স্ত্রী হবেন। মহিলার পাশে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের আরেকজন যুবতী, তার পাশে আট দশ বছরের একটি শিশু। তাদের পরিচয় ঠিক বুঝলাম না, তবে মনে হলো মেয়েটি মালিকের মেয়ে এবং শিশুটি মালিকের নাতি হলে মানায়। সবাইকে দেখলম প্রসন্ন, কিন্তু ডাক্তারের চোখ দিয়ে বুঝলাম, যুবতী মহিলাটি মানসিকভাবে ডিপ্রেসড। অন্য সবার মধ্যে একটা জীবন্ত আগ্রহ দেখলাম, শুধু সে ছাড়া।
তাদের টী টেবিল থেকে দশ ফুট দূরে হাতজোড় করে আমাকে দাঁড়াতে হলো। মনে কষ্ট লাগল এভাবে দাঁড়াতে, কিন্তু বেনেডিক্টের নির্দেশে এভাবে দাঁড়াতে হলো। আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে কখনও হাতজোড় করিনি। কিন্তু আজ মানুষ মনিবের কাছে তা করতে হলো। আমার সামনে ছিল উঁচু ক্ষুদ্র একটা ডেস্ক। ডেস্কের উপরে ছিল এক শিট কাগজ ও একটা কলম।
আমি দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে আমার নতুন মালিক নাইট মি. ফ্রেডারিক বলে উঠলেন, ডেস্কের উপরের কাগজটায় তুমি তোমার নাম, দেশের নাম, অঞ্চলের নাম, স্ত্রী-সন্তান আছে কি নেই, তোমার ভাষা, তোমার জানা অন্য ভাষা, তোমার অতীত পেশা, কোন ক্রাইম তোমার দ্বারা হয়ে থাকলে তা লেখ। এসব বিষয় স্লেভ ট্রেডারের হুকুমেও লিখতে হয়েছিল, সে যেমন বলেছিল সেইভাবে। তার পুনরাবৃত্তি আমি লিখে ফেললাম। স্ত্রী-সন্তান নিহত হয়েছে লিখলাম আর পেশা আগের মতই কারখানায় চাকরি লিখলাম। আমার লেখা শেষ হলে পাশে দাঁড়ানো বেনেডিক্ট কাগজ কলম নিয়ে আমার দুই হাত এবং হাতের আঙুলগুলো পরীক্ষা করল। তারপর কাগজে কিছু লিখল এবং কাগজ কলমটি রেখে এল মালিকের টেবিলে। মালিক কাগজটি হাতে তুলে নিয়ে নজর বুলিয়ে স্ত্রীর হাতে দিল। তার স্ত্রী তা দেখে তার পাশের মেয়েটির হাতে দিল। মেয়েটি দেখে নিয়ে কাগজটি তার বাবার হাতে ফেরত দিল।
ফেরত পাওয়া কাগজটি হাতে নিয়ে মালিক একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, ‘ফ্যাক্টরিতে তুমি কি কাজ করেছ?’
মিথ্যাটা আগেই সাজিয়ে রেখেছিলাম। বললাম, ‘প্যাকিং-এর কাজ করেছি।’
আবার অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল মালিক আমার দিকে। বলল, ‘দেখ, আমি একজন মুসলিম ক্রীতদাস কিনতে চেয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল, একজন মুসলিমকে ক্রীতদাস বানিয়ে আমি প্রতিশোধ নেব। ক্রুসেডে আমি যা পারিনি এভাবে আমি তারই কিছুটা পূরণ করতে চেয়েছিলাম। আমি চতুর্থ ক্রুসেডে যোগদানকারী জার্মানের একজন শ্রেষ্ঠ নাইট। পোপ তৃতীয় ইননোসেন্টের অধীনে পশ্চিম ইউরোপের সাথে আমরা জার্মানরাও সে ক্রুসেডে যোগ দিয়েছিলাম। লক্ষ্য ছিল, মুসলমানদের হাত থেকে জেরুসালেমকে আবার উদ্ধার করা। প্রথম ক্রুসেডে আমাদের পূর্বসূরিরা মুসলমানদের হাত থেকে জেরুসালেম কেড়ে নিয়েছিলেন।
জেরুসালেম শহরের সত্তর হাজার মুসলমানকে যুদ্ধোত্তর অপারেশনে হত্যা করে আমরা চেয়েছিলাম জেরুসালেমকে আমাদের হাতেই রাখব। কিন্তু তা হয়নি। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী যাকে মুসলমানরা গাজী সালা্হউদ্দিন বলে, জেরুসালেম আমাদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে। ইউরোপের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ক্রসেড পারেনি জেরুসালেমকে মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নিতে। এই জেরুসালেম উদ্ধারই ছিল আমাদের চতুর্থ ক্রসেডের লক্ষ্য। কিন্তু আমাদের এই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। হয়নি ঘরের শত্রু বিভীষণকে বধ করতে গিয়ে। পোপের অধীন ক্যাথলিক চার্চ বিশেষ করে আমাদের জার্মানদের ঘোরতর শত্রু ছিল বাইজান্টাইন অরথোডক্স চার্চ। ওরা রোমান ক্যাথলিকদের আইন-নীতি ভংগকারী, অধর্মচারী, লোভী, রক্তপায়ী, বিশৃঙ্খল বর্বর, নোংরা ইত্যাদি ধরনের গালাগালি করতো। কনস্টান্টিনোপলকে কেন্দ্র করে এই বাইজেন্টাইনরা ক্যাথলিক পোপ ও জার্মানীর তারা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই ক্রসেড যাত্রার পর আমরা গতি পরিবর্তন করে জেরুসালেম জয়ের পরিবর্তে কনস্টান্টিনোপল জয়ের যাত্রা শুরু করেছিলাম। এই যাত্রা আমাদের সফল হয়েছিল। আমরা কনস্টান্টিনোপল জয় এবং তারপর তা বিধ্বস্ত করেছিলাম। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে বা্ইজেন্টাইন অর্থোডস্ক চার্চের সমাধি রচিত হলো বটে, কিন্তু মুসলমানদের গায়ে আমরা হাত দিতে পারলাম না। এই দু:খ আমাকে পুড়িয়ে মারছে। তাই চেয়েছিলাম একজন মুসলিম ক্রীতদাস এনে তার উপর মনের ঝাল মিটিয়ে দু:খ কিছু লাঘব করবো। তাও হলো না। তোমার সাথে কথা বলে তোমাকে আমার খুব পছন্দ হলো, তাই তোমাকে নিয়ে এলাম। সেই তুমি যাত্রা শুরু করলে মিথ্যা কথা বলে। তুমি ফ্যাক্টরিতে কাজ করনি। তোমার হাতের সবটুকু নরম হওয়া তারই প্রমাণ। আর তোমার কলমের আঁচড় প্রমাণ করে তুমি ভালো লেখায় অভ্যস্ত। ইচ্ছা করেই খারাপ করে লিখেছ। এই দুই মিথ্যার পর তোমার দেয়া তোমার পরিচয়ের উপরও এখন আমার আস্থা নেই। সুতরাং তুমি ভালো আচরণ পাওয়ার উপযুক্ত নও। তুমি আমার ফার্মল্যান্ডে কাজ করবে। ফার্মল্যান্ডের কঠোর পরিবেশ এবং কাজই মিথ্যাবাদীর জন্যে উপযুক্ত জায়গা।’
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল আমার নতুন মনিব। তাঁর সাথের সবাই উঠল। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ফার্ম হাউজে। আমার মালিক ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিকের বাড়ির বিশাল এরিয়ার সীমা থেকেই তার ফার্মল্যান্ডের শুরু। সেখান থেকে প্রায় এক মাইল দূরে ফার্মল্যান্ডের মাঝখানে ফার্মহাউজ। এই ফার্মহাউজ থেকেই বিশাল ফার্মল্যান্ড পরিচালনা করা হয়।
হাসপাতালের একজন কৃতী ডাক্তার ছিলাম তা ভুলে গেলাম। ফার্মের শ্রমিক হিসেবে নতুন জীবন শুরু হলো। শ্রমিকরা বেতন পায়, কিন্তু ক্রীতদাসরা বাঁচার জন্যে শুধুই খাবার পায়। তাদের কাজের কোন সময়সীমা নেই। ক্রীতদাসদের সেই ভোরে কাজের শুরু হয়, আর ঘুমানো পর্যন্ত কাজ চলে। এভাবেই জীবন চলল।
একদিন মালিক-পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে এলেন ফার্মে। ফার্মটা দেখা ও তত্ত্বাবধান করার পর তারা ফার্মহাউজে এলেন। ফার্মহাউজে গোডাউন ছাড়াও রয়েছে শ্রমিক কর্মচারি ও দাসদের আবাস। এই সাথে ফার্মহাউজে রয়েছে দোতলা সুরম্য ভবন। ফার্মল্যান্ডে এলে মালিকরা এখানে থাকেন।
সেদিন বেলা পাঁচটায় মালিকরা এলেন সেই ভবনে। সেদিন সন্ধ্যার পর সে ভবনের দোতলায় প্রচণ্ড কান্নাকটি হৈ চৈ শুনতে পেলাম। সারাদিন পর আবাসস্থলে সবে এসে বসেছি। কান্না হৈ চৈ শুনে সবাই সেদিকে ছুটল। কৌতুহলের বলে আমিও সেদিকে গেলাম।
ফার্মহাউজের মাঝের এই বাড়িটি আসলে বাড়ির মধ্যে আর একটা বাড়ি। একট গেট পেরিয়ে প্রাচীর ঘেরা এই বাড়িতে ঢুকতে হয়। আমরা গেটের বাইরে একটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের লোকদের বলাবলিতে জানলাম, মালিকের মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। গতকাল বিকেলে হামবুর্গের রাজকীয় চিকিৎসালয়ে মাসখানেক চিকিৎসা নিয়ে ফিরেছে সে। আজই আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ভীষণ মাথাব্যথা। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আগেই শুনেছিলাম, মালিকের এই মেয়ে ক্যাথারিনার স্বামী একজন নাইট, ১২২৮ সালে শুরু হওয়া ষষ্ঠ ক্রুসেডে যোগ দিয়ে তিনি নিহত হয়েছেন। এই সময় ঘোড়ার গাড়িতে একজন ডাক্তার আসতে দেখলাম। ডাক্তার ভেতরে চলে গেল। আমি চলে এলাম। আধাঘন্টার মত পার হয়ে গেল। আমি ফার্মহাউজের পাশে ফার্মের গরুগুলো সামলা্চ্ছিলাম। আবার হৈ চৈ কানে এল, দৌড়াদৌড়ি দেখতে পেলাম। সেই সাথে মালিকের উচ্চকন্ঠ। কৌতুহলবশেই আমরা ছুটে গেলাম সেই বাড়ির দিকে। শুনলাম, ডাক্তার অপারগতা প্রকাশ করে চলে গেছেন। বলে গেছেন, রাজকীয় চিকিৎসালয়ের ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছেন, তার বাইরে কোন ওষুধ নেই। সেই ওষুধে যখন কাজ করেনি, তখন আর করার কিছু নেই। রাজকীয় চিকিৎসালয়ের ডাক্তারের দেয়া ওষুধ খেতে হবে এবং ঈশ্বরকে ডাকতে হবে।
মালিক এ সময় বাইরে বেরিয়ে আসছিলেন। বিপর্যস্ত তার চেহারা। বেদনায় নীল তার চোখ মুখ। একমাত্র সন্তান মেয়েকে খুব ভালোবাসেন তিনি। মালিক গেটে এসে গেটের পাশে দাঁড়ানো তার সেক্রেটারিকে বললেন, তুমি গাড়ি তৈরি করতে বল। ক্যাথরিনাকে আবার রাজকীয় চিকিৎসালয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার ভেতরে কি যেন হয়ে গেল। ডাক্তার ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর আমার মধ্যে যেন তীব্রভাবে জেগে উঠল। হঠাৎ কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মালিকের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘মালিক, রোগটা কি আমি দেখতে পারি?’
মালিক বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত আমার দিকে ঘুরল। তার চোখ-মুখ অপমানে কালো হয়ে গেছে। দু’চোখ দিয়ে তার আগুন ঝরছে। তীব্রকন্ঠে বলে উঠল, ‘এতবড় স্পর্ধা..!’
কিন্তু হঠাৎ করেই তার কন্ঠ থেমে গেল। তার চোখ-মুখ সহজ হয়ে এল। নিভে গেল চোখের আগুন। মাথা নিচু করল। পরক্ষণেই মাথা তুলে বলল, আমার অন্য কোন শ্রমিক-কর্মচারি-ক্রীতদাস এমন কথা বললে তার আমি শিরচ্ছেদ করতাম। কিন্তু আমি দেখে আসছি তুমি সবার চেয়ে ভিন্ন। তুমি মিথ্যা কথা বল না, কাজে ফাঁকি দাও না, খাবার যা পাও, তার বেশি কোন দাবিও তোমার নেই। সবাইকে আমি চিনি, কিন্তু তোমাকে চিনতে পারিনি। তাই তুমি বেঁচে গেলে। কিন্তু বল, কেন তুমি এই কথা বললে? নিশ্চয় জান রাজকীয় চিকিৎসকের চিকিৎসাও ব্যর্থ হয়েছে।’
‘মালিক, কোন দুই ব্যক্তির বুদ্ধি, চিন্তা, দৃষ্টিকোণ সমান নয়। আর যে ঈশ্বর রোগ দিয়েছেন, তিনি তার ওষুধও দিয়েছেন।’ বললাম আমি।
মালিক কিছুক্ষণ আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন। তিনি কি যেন আমার মধ্যে খুঁজে পেলেন। তারপর বললেন, ‘এস।’ বলেই তিনি চলতে শুরু করলেন। আমিও তার পিছু পিছু চললাম। উঠলাম দোতলায়। তাঁর এই দোতলায় ওঠা তাঁর পরিবারের বাইরের কারো জন্যে এটাই বোধ হয় প্রথম।
দোতলার একটা ঘরে তিনি ঢুকলেন। মিনিট খানেক পরে বেরিয়ে এসে আমাকে ডাকলেন। ঢুকলাম সেই ঘরে বিরাট সুসজ্জিত ঘর। দেখে কোন শাহবেগম বা শাহজাদীর ঘর বলে মনে হলো। ভাবলাম ফার্মহাউজের ঘর যদি এমন হয়, তাহলে আসল বাড়ির ঘরটা কেমন? বিধবা মেয়েকে মালিক কত ভালোবাসেন, এটা বোধ হয় তারই প্রমাণ।
মালিকের মেয়ের গোটা শরীর চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। বালিশে মুখ গুঁজে সে চিৎকার করছে, ছটফট করছে। তার মাথার পাশে বসে আছেন মালিকের স্ত্রী। তিনি যখন আমার দিকে তাকালেন, মনে হলো ডুবন্ত মানুষের মত কোন সহায় যেন তিনি হাতড়াচ্ছেন। তিনি মেয়ের মাথার যে পাশে বসে আছেন, তার বিপরীত দিকে মালিকের মেয়ে ক্যাথারিনার মাথার পাশে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম।
মেয়েটিকে মাথাগুঁজে ছটফট করতে দেখে আমি আশান্বিত হয়েছিলাম। যে সন্দেহটা আমার মনে উঁকি দিয়েছিল সেই সন্দেহটাই তাহলে ঠিক?
আমি মালিকের দিকে তাকালাম। বললাম, ‘মালিক ওকে চিৎ হয়ে শোয়াতে হবে।’
সঙ্গে সঙ্গেই মালিকের স্ত্রী তার মেয়েকে বলল মা একটু চিৎ হয়ে শুতে হবে।’ বলে নিজে তাকে চিৎ হতে সাহায্য করতে গেল।
মেয়ে ক্যাথারিনা চিৎকার করে বলল, ‘আমি আর ওষুধ খেতে পারবো না। আমার মাথার সাথে এখন পেটও জ্বলতে শুরু করেছে। আমি মরে যেতে চাই, আমাকে মরতে দাও।’
মালিক গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর স্ত্রীর পাশেই। সে এগিয়ে গেল। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, মা আমার, সোনা মা, আমরাও যে কষ্ট পাচ্ছি। একটু ঘুরে শোও। ঈশ্বরের প্রতি ভরসা রাখ মা।’
‘কত ভরসা রাখবো বাবা, যতই দিন যাচ্ছে, অসহ্য হয়ে উঠছে যন্ত্রণা। রাজবৈদ্যও তো চেষ্টার কম করলেন না। এই রোগে আমার মৃত্যুই বোধ হয় ঈশ্বরের ইচ্ছ। তার ইচ্ছাই পূরণ হোক। আমি মরতে চাই।’ বলল মালিকের মেয়ে ক্যাথারিনা। বলে বালিশে আবারও বেশি করে মুখ গুঁজল।
হঠাৎ করেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, ‘মানুষ মরণশীল। সুস্থ ও অসুস্থ দুই অবস্থাতেই মানুষ মরতে পারে। মৃত্যুর জন্যে অসুস্থতা জিইয়ে রাখার প্রয়োজন হয় না। আর ঈশ্বরের বিধান হলো, রোগ হলে চিকিৎসা করাতেই হবে।’
এক ঝটকায় মেয়েটি ঘুরে উঠে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। তীব্র কন্ঠে বলল, ‘মৃত্যুর জন্যেই কি আমি অসুস্থতা জিইয়ে রাখছি?’ আমি একটা ছোট্ট বাউ করে বললাম, ‘স্যরি ম্যাডাম। আমি তা বলিনি, আমি একটা নীতিকথা বলেছি।’
সেই তীব্র কন্ঠেই মেয়েটি বলল, ‘রাজবৈদ্য যেখানে ব্যর্থ, এই মাত্র একজন বিখ্যাত ডাক্তারও যেখানে আর কিছু করণীয় নেই বলে চলে গেল, সেখানে একজন ক্রীতদাস চিকিৎসা করতে আসা একটা স্পর্ধা নয় কি!’
‘মাফ করবেন ম্যাডাম। প্রত্যেক মানব শিশু স্বাধীন হয়েই জন্মায়, পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব তাকে নানা রূপ দিয়ে গড়ে তোলে, ক্রীতদাসও বানায়। রোগটা কি তা দেখতে চেয়েছি, এটা আমার স্পর্ধা নয়, মানুষের প্রতি একটা দায়িত্ববোধ থেকে এটা করেছি। একটা পথের শিশু হলেও আমি এটাই করতাম।’ বললাম খুব নরম, কিন্তু অনড় কন্ঠে।
মালিকের মেয়ের চোখ দু’টি বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে। তার পলকহীন চোখ আমার দিকে নিবদ্ধ হলো। অবাক হয়ে কি যেন সন্ধান করছে সে আমার মধ্যে। ধীরে ধীরে তার পলকহীন চোখ বুজে গেল। নীরব হয়ে গেল সে। বুঝা যাচ্ছে, দাঁতে দাঁত চেপে সে তার অসহ্য যন্ত্রণা চাপা দেবার চেষ্টা করছে। আমি মেয়েটির মাথার আরও কাছে এগিয়ে গেলাম। আমি ঝুঁকে পড়ে তার দু’চোখ থেকে যে ধমনীগুচ্ছ মাথার দিকে চলে গেছে, তার ভেতর থেকে দুই প্রধান ধমনী খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলাম। তার শ্বেত-শুভ্র কপাল বেদনায় আরক্ত হয়ে গেছে। দুই চোখের দুই কোণার দূরত্ব বিবেচনায় রেখে আনুমানিক হিসেব থেকে সে দুই ধমনীর অবস্থান ঠিক করলাম। তারপর মালিক-পত্নীর দিকে চেয়ে বললাম, ‘মা, আপনি আপনার দুই বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঠিক এই দুই জায়গা মাঝারি শক্তিতে চেপে ধরে রাখুন।’
মালিক-পত্নী তাকাল মালিকের দিকে। বলল, ‘আমি বোধ হয় ঐভাবে ধরতে পারব না।’
আলগার, ব্যাপারটা তুমিই ভালো বুঝবে। কাজটা তুমিই করো।আমার দিকে তাকিয়ে বলল মালিক।
আমি তার মাথার পাশে ভালোভাবে বসে দুই হাতের দুই বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বিসমিল্লাহ বলে সেই দুই ধমনী চেপে ধরলাম।
উপুড় হয়ে বালিশে তার মাথা গুঁজে থাকা, তার চোখ-মুখের রং ইত্যাদি দেখে আমার প্রাথমিক ধারণা হয়েছিল তার যন্ত্রণার উৎস মাথা নয়, চোখ। যদি তাই হয় তাহলে চোখ থেকে উপরে ওঠা প্রধান ধমনী দু’টি নির্দিষ্ট পরিমাণে চেপে ধরলে ব্যথার উপশম হবে। আল্লাহর রহমতে তাই হলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার মুখের অবস্থা সহজ হয়ে গেল। ধমনী দু’টি চেপে রেখে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। আনন্দের সাথে দেখলাম, তার মুখে প্রশান্তি ও একটা শিথিলতার ভাব নেমে এসেছে। আমি তার কপাল থেকে হাত তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মালিকের দিকে চেয়ে বললাম, ‘এর সমস্যা মাথায় নয়, চোখে। চোখের সমস্যার কারণেই তাঁর মাথার যন্ত্রণা। চোখ থেকে মাথার দিকে উঠে যাওয়া প্রধান ধমনী দু’টোকে আমি যখন চেপে রেখেছিলাম, তখন দেখেছি তার মাথার যন্ত্রণা কমে গেছে। আমি ওর চোখ দু’টি একটু দেখতে চাই।
মালিক ও মালিক-পত্নী উভয়েরই চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। মালিক এগিয়ে গেলেন মেয়ের দিকে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘মা একটু চোখ খোল। এখন কেমন মনে করছ মা?’
চোখ খুলল মেয়ে ক্যাথারিনা। তাকাল বাবার দিকে। বলল, যন্ত্রণা প্রায় ছিলই না। আঙ্গুলের চাপ তুলে নেবার পর মনে হচ্ছে একটু একটু করে বাড়ছে যন্ত্রণা।’ খুশি হলেন ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক, আমার মালিক। বললেন, ‘তাহলে তো আলগার ঠিকই বলেছে। সে চোখ দেখতে চায়, চোখটা দেখাও মা।’ বলে একটু সরে দাঁড়ালেন মালিক।
আমি এগিয়ে গেলাম। বললাম, ‘প্লিজ ম্যাডাম, খাটের এ পাশে এসে পিঠের তলায় বালিশ দিয়ে খাটে হেলান দিয়ে একটু বসুন।’
কোন কথা না বলে খাটে হেলান দিয়ে বসল সে। আমি এগিয়ে গিয়ে একটু ঝুঁকে পড়ে তার চোখ দু’টি পরীক্ষা করলাম। দুই আঙ্গুলে চোখ ফাঁক করে চোখের আইবল বিভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে পরীক্ষা করলাম। কিন্তু আমি যেট দেখতে চাই বুঝতে চাই, সেটা তেমনটা হলো না।’
আমি দাঁড়িয়ে একটু সরে এসে মালিককে বললাম, ‘হাতখানেক লম্বা কিছুটা সরু একটা লোহার বা কাঠের কিংবা বাঁশের সোজা চোঙা দরকার।’
‘চোঙা দিয়ে কি হবে?’ বললেন মালিক।
‘চোখ পরীক্ষায় চোঙার ভেতর দিয়ে যাওয়া নিয়ন্ত্রিত আলোর শক্তিশালী ফোকাস ভালো কাজ দেয়।’ আমি বললাম।
‘হ্যাঁ আছে, আনছি এখনই।’
উনুনে বা স্বর্ণকারের কয়লার আগুন উস্কে দেয়ার জন্যে যে সরু চোঙা ব্যবহার হয়, সে চোঙাই তিনি নিয়ে এলেন। খুশি হলাম আমি।
চোঙার এক মাথা আমি ক্যাথারিনার খোলা চোখের উপর রেখে অন্য মাথায় পাওয়ার ফুল লন্ঠনের আলোর শিখা সেট করলাম, যাতে আলো অন্য দিকে বিচ্ছুরিত হবার সুযোগ না পেয়ে চোঙার সুড়ঙ্গপথে চোখের উপর গিয়ে কেন্দ্রীভূত হতে পারে।
সেই আলোতে ক্যাথারিনার দুই চোখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা করলম। দু’টো জিনিস পেলাম।এক, দুই চোখেরই সূক্ষ্ণ ধমনীর গুচ্ছ আহত হয়েছে এবং রক্তের সূক্ষ্ণ জমাট বিন্দুর সৃষ্টি হয়েছে। দুই চোখেরই আইবলের রেদপেনসিভ নয় যথেষ্ট পরিমানে। আইবলের কিছু টিস্যু শুকিয়ে গিয়ে চোখের জীবন্ত সত্তাকে বাধাগ্রস্ত করারই লক্ষণ এটা। চোখের এই পরীক্ষা শেষ করে আমি বললাম মালিককে উদ্দেশ্য করে, ‘দুই চোখের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ধমনী ড্যামেজড হয়েছে এবং দুই আইবলের কিছু টিস্যু শুকিয়ে গেছে।’
মালিক ও মালিক-পত্নী অপার বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। আমার কথায় তাদের চোখে-মুখে আতংকেরও সৃষ্টি হলো। বলল মালিক, ‘তাহলে এখন উপায় আলগার?’
‘মালিক, আমার দেয়া ওষুধ যদি খাওয়ানো বা ব্যবহার ঠিক মনে করেন, তাহলে চেষ্টা করে দেখতে পারি। এই রোগের চিকিৎসা আছে মালিক।’ আমি বললাম।
মালিক ও মালিক-পত্নী দু’জনরই মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মালিকের মেয়ে ক্যাথারিনা চোখ বন্ধ করে তার কপালের সেই বিশেষ স্থান দু’টো চেপে ধরে বসেছিল। মালিক বলল, ‘আলগার তুমি রোগ ধরতে পেরেছ এবং ঠিকভাবেই ধরেছ। তাই তোমার ওষুধই চলবে।’
‘ঠিক আছে মালিক, ওষুধ যেটা দরকার, তা তৈরি করতে সময় লাগবে। বনজ কিছু ওষুধের সাথে কিছু দুর্লভ অনুপান যোগাড় করতে হবে। সেটা পরে করব। আপাতত চোখে দেয়ার মত একটা ওষুধ পাঠাচ্ছি। সেটাতে চোখের ক্ষতিপূরণ না হলেও যন্ত্রণা কমে যাবে। আমাকে একটা পরিষ্কার শিশি দিন। ওষুধটা দিনে চার পাঁচ বার এক ফোঁটা করে চোখে দিতে হবে। চোখে কোন চাপ দেয়া যাবে না, শুয়ে থাকতে হবে। ঘরে তীব্র নয়, ঠাণ্ডা আলো থাকবে।’
‘আমি শিশি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমার ওষুধ পাওয়ার পর আমরা ক্যাথারিনাকে বাড়িতে নিয়ে যাব। সকালে আমি ওষুধের অনুপান কি কি কিনতে হবে, তা তোমার কাছ থেকে জেনে নেব।’ বললেন মালিক।
‘ঠিক আছে মালিক, আমি চলি।’ বলে আমি চলে এলাম।
এসেই আমি ফার্মহাউজের বাগান থেকে ইউনানি ওষুধ বিজ্ঞানের জীবাণুনাশক, বেদনানাশক, স্নায়ু শীতলকারক এবং চক্ষুকোষের শক্তিবর্ধক একটা গাছের কিছু পাতা ও ফুল জোগাড় করে আনলাম। রস করে মালিকের পাঠানো শিশিতে করে পাঠিয়ে দিলাম। আমি তখন শুয়ে পড়েছি। আমার সাথী কয়েকজন শ্রমিক হুড়মুড় করে আমার ঘরে ঢুকে পড়ল। সমস্বরে বলে উঠল, ‘ওস্তাদ, তোমার ভাগ্য খুলেছে। তোমার প্রমোশন হয়েছে। তোমাকে আর এই ফার্মে কাজ করতে হবে না, এই ফার্মহাউজেও থাকতে হবে না। মালিকের বাড়িতে তোমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।’
কথাগুলো আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলো না। তবু জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোথায় শুনলে?’
‘শুনব আর কোথায়। খোদ মালিক যাবার সময় এ কথা তার শ্যালককে বলে গেছে, ‘কালকে সকালেই আলগারকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। ব্যাবস্থা করেছি , ওখানেই সে থাকবে।’ শুনেই মালিকের শ্যালক সাহেব প্রতিবাদ করলেন, আলগার শুধু কাজই করতো না, কাজ করাতোও সে। সে সাথে থাকলে শ্রমিকদের কাছ থেকে অনেক বেশি কাজ পাওয়া যায়। সে গেলে ফার্মহাউজের ক্ষতি হবে।’ ‘ফার্মহাউজের কাজের জন্যে নয়, এখানে তাকে পাঠিয়েছিলাম একটা শাস্তি হিসেবে। সেটা তার প্রতি অবিচার হয়েছে। জান তোমার বোন কি বলছে, আজকেই এখন থেকে তাকে আমাদের বাড়িতে ট্রান্সফার করতে হবে।’ এরপর শ্যালক সাহেব আর কথা বলেননি।’
মালিকের বাসায় আমার আরেক জীবন শুরু হলো। সেখানে আমাকে কোন কায়িক পরিশ্রম করতে হলো না। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলো, বাড়ির স্টাফদের কাজ ঠিকমত হচ্ছে কি না দেখা এবং তা করিয়ে নেয়া। কোন কিছু ঘটলে তা মালিক বা মালিক-পত্নীকে অবহিত করা। আমার থাকার জায়গা দোতলায় সিঁড়িমুখের একটা ঘরে। বাড়ির স্টাফ কর্মচারিরা সবাই থাকে নিচলতায়। মালিকের সেক্রেটারি বেনেডিক্টের কাছে শুনেছি, মালিক আমার থাকার জায়গা এক তলারই একটা ভালো ঘরে করেছিলেন। কিন্তু মালিক-পত্নী রাজি হননি। তিনি বলেছেন, ‘ছেলেটা আমার মেয়ের চিকিৎসা করছে, এটাই শুধু নয়, ছেলেটির কথা-বার্তা, কয়েক মাসের আচার-ব্যবহার থেকে মনে হচ্ছে সে শুধু শিক্ষিত ও ভদ্রই নয়, মানুষ হিসেবেও অনেক বড়। দেখনা মাত্র কয়েক মাসেই ফার্ম হাউজের সবাইকে নিজের ভক্ত বানিয়ে ফেলেছে। শুনেছি, সবাইকে ভালোবেসে, সবার পাশে দাঁড়িয়ে, সবার জন্যে কাজ করেই সে সবার ভক্তি-ভালোবাসা অর্জন করেছে। ক্রীতদাস হয়েছে বলেই তার সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। তাকে সম্মান দিলে আমরা ছোট হয়ে যাব না!’ এসব কথা বলে মালিক-পত্নী দোতলার ঐ ঘরটায় আমার থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। এসব আমার শোনা কথা। মালিক কিংবা মালিক-পত্নী নিজ মুখে আমাকে কখনও কিছু বলেননি।
শিশিতে আমি যে তরল ভেষজ-রস সে রাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, সেটা ব্যবহার শুরু করেই মালিক-তনয়া ক্যাথারিনা একমাসের মধ্যে প্রথম বারের মত শান্তিতে ঘুমাতে পেরেছে। মালিক দু’দিনের মধ্যেই দুর্লভ উপাদান ও অনুপানগুলো আমাকে এনে দিয়েছিলেন। সেসব উপাদানের সাথে কিছু বিস্ময়কর গাছ-গাছড়ার মূল, পাতা, ফুলের সমন্বয়ে ওষুধ তৈরি করে অনুপানগুলোর সাথে নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশিয়ে সময়ে সময়ে তা খাওয়ানোর ব্যবস্থাপত্র দিয়েছিলাম। কিছু দিনের মধ্যেই সে সুস্থ হয়ে যায়। মালিক ও মালিক-পত্নী একদিন ডেকে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন আমি কি চাই, তা তারা আমাকে দেবেন। আমি বলেছিলাম, ‘আমি কোন বিনিময় চাই না। আর বিনিময় চাওয়ার অধিকার ক্রীতদাসের থাকে না। আপনারা আমার জন্যে যথেষ্ট করেছেন। আমি তার জন্যে কৃতজ্ঞ।’
বলে আমি চলে আসছিলাম। দেখলাম সিঁড়ির মুখের এক পাশে একটা পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে মালিকের মেয়ে ক্যাথারিনা। তাকে দেখে আমি সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে এলাম।
সেদিনই সন্ধ্যার পর আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে নারীকন্ঠের আওয়াজ শুনলাম, ‘শুনুন।’
আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলাম সিঁড়ির মুখে মালিকের মেয়ে ক্যাথারিনা দাঁড়িয়ে। আমি এক ধাপ এগিয়ে মাথা নিচু করে বললাম, ‘আমাকে ডাকছেন?’
‘হ্যাঁ।’ বলল মালিকের মেয়ে ক্যাথারিনা।
‘কিছু আদেশ আছে, বলুন?’ আমি বললাম।
‘আদেশ নয়, অভিযোগ আছে।’ বলল ক্যাথারিনা।
‘অভিযোগ?’ আমি বললাম।
‘হ্যাঁ, অভিযোগ! আপনার বিরুদ্ধে!’ বলল ক্যাথারিনা।
‘তাহলে মালিককে বলুন। আমি কোন দোষ তো করতেই পারি।’ আমি বললাম।
‘কোন ক্রীতদাসের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ নেই। আমার অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে। তাই মালিককে বলবার প্রয়োজন নেই।’ বলল ক্যাথারিনা।
‘ক্রীতদাস এবং আমি একই সত্তা। ঠিক আছে…।’
আমার কথার মাঝখানেই সে বলে উঠল, ‘কিন্তু সেদিন আপনি বলেছিলেন ক্রীতদাস পরিস্থিতির সৃষ্টি। পরিস্থিতি যা সৃষ্টি করে তা আসল নয় এবং স্থায়ীও নয়। সুতরাং তা মানব সত্তার অংশও নয়।’ বলল ক্যাথারিনা।
‘ঠিক আছে, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটা বলতে পারেন।’ আমি বললাম।
‘সেদিন আপনাকে ক্রীতদাস বলেছিলাম। তাই আজ আপনি নিজেকে ক্রীতদাস বলে বিনিময় প্রত্যাখ্যান করে আমার উপর প্রতিশোধ নিলেন। কিন্তু আপনি জানেন না সেদিন থেকেই আমি মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছি। মাফ চাইবার সুযোগ খুঁজছি। এর মধ্যেই আপনি…।’
কথা গলায় আটকে গেল ক্যাথারিনার। গলাটা হঠাৎ তার ভারি হয়ে উঠেছিল।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘আপনার ব্যাপারটাকে এভাবে দেখা ঠিক নয়। ক্রীতদাস পরিচয় আমার সত্তার অংশ হোক বা না হোক, পরিস্থিতিগত কারণে আমি ক্রীতদাস একথা তো ঠিক? এটা তো অনস্বীকার্য বাস্তবতা? সুতরাং ক্রীতদাস বলায় আমি কিছুই মনে করিনি, মনেও রাখিনি বিষয়টা। অতএব প্রতিশোধের বিষয় হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
কিন্তু আমি তো অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করছি। আপনি আমাকে মাফ না করলে আমার এ যন্ত্রণা যাবে না।’ বলল ক্যাথারিনা।
‘না, আপনি আমার মনিব-কন্যা। আপনি এভাবে বলতে পারেন না।’ বললাম আমি।
‘আমি মনিব-কন্যা নই। আমি একজন মানুষের কন্যা ক্যাথারিনা।’ বলল ক্যাথারিনা।
‘ধন্যবাদ। কিন্তু সেদিন মানুষের কন্যা ক্যাথারিনা আমাকে ক্রীতদাস বলেননি, বলেছিলেন মনিব-কন্যা ক্যাথারিনা।’ আমি বললাম।
‘আপনি অনেক বিজ্ঞ, জ্ঞানী। কথায় কিংবা কোন দিক দিয়েই আমি আপনার সাথে পারব না।সেদিনের মনিব-কন্যাকেও আপনি মাফ করুন।’ বলল ক্যাথারিনা। কন্ঠ তার আবার ভারি হয়ে উঠেছিল।
মনিব-কন্যার সাথে এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলা আমার মানায় না। আর তার এই পরিবর্তন আমার মনে নতুন এক আশংকারও সৃষ্টি করল। বুকটা আমার কেঁপে উঠল। আমি আর কথা না বাড়াবার জন্যে বললাম, ‘ঠিক আছে ম্যাডাম। আপনার ইচ্ছা, অনুরোধ আমার কাছে আদেশ। আমি মাফ করলাম, যদিও সেদিন তা বলা আপনার জন্যে অন্যায় কিছু ছিল না। আপনার মহত্ত্বের জন্যে ধন্যবাদ।’
বলে আমি চলে যাবার জন্যে পা বাড়ালাম। পেছন থেকে মনিব-কন্যা ক্যাথারিনা বলে উঠল, ‘শুনুন, এটা আমার মহত্ত্ব নয়, একজনের মহত্ত্বের কাছে, বিরাটত্বের কাছে এক দুর্বিনীত হৃদয়ের আত্নসমর্পণ।’
মনিব-কন্যার কন্ঠ ছিল পরিষ্কার, স্থির, শান্ত কিন্তু শক্ত, তার কথাগুলো বিশ্বাসে দৃঢ়। কন্ঠের সেই ভারিভার এখানে ছিল না। এ যেন এক সিন্ধান্তের পরোয়াহীন প্রকাশ।
আমার হৃদয়টা আবার কেঁপে উঠল। পরিচিত সেই আশংকা আমার হৃদয়ে মাথা তুলল। আমি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে মনিব-কন্যার কথার প্রতিবাদে কিছু বলার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালাম। দেখলাম তিনি চলে যাচ্ছেন, আস্তে, শান্ত ও শক্ত পদক্ষেপে।
তাকে ডাকা আমার জন্যে অন্যায় মনে করলাম। আমি নেমে এলাম সিঁড়ি দিয়ে। দিন আমার এগিয়ে চলল ভিন্নতরভাবে। আমি মালিকের বাড়ির কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দেখা-শোনার কাজ করি। কিন্তু মালিক আমাকে কোন আদেশ করেন না। কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কোন বিষয় নিয়ে তাঁর কাছে গেলে তিনি আমার পরামর্শ চান অথবা বলেন তুমি যেটা ভালো মনে করো সেটাই করো। মনিব-কন্যা ক্যাথারিনার আট নয় বছরের ছেলে বেরুন বেকার প্রায়ই আমার কাছে আসে, নিষেধ সত্ত্বেও আংকেল বলে ডাকে।১৫ দিন ধরে নিয়মিত সে আমার কাছে পড়তে আসে সন্ধ্যার পর। মাসখানেক আগে সে একদিন বলে, ‘আংকেল, মা আমাকে আপনার কাছে পড়তে বলেছেন। মা বলেন, রাজার স্কুলে যা শেখানো হয় তা যথেষ্ট নয়। দেখুন, মা কি পড়াতে বলেছেন।’ বলেই সে আমার হাতে একখণ্ড কাগজ তুলে দেয়। কাগজে দেখলাম ‘যা পড়ানো হচ্ছে’ শিরোনামে তিনটি সাবজেক্টের নাম লেখা। সাবজেক্টগুলো হলো, জার্মান ও ল্যাটিন ভাষা, ক্যাথলিক থিওলজি ও চার্চের ইতিহাস। এরপর ‘যা পড়ানো দরকার’ শিরোনামেও তিনটি সাবজেক্টের নাম লেখা, সাবজেক্টগুলো হলো, অংক, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ও পৃথিবীর ইতিহাস। আমি এই সাবজেক্টগলোর নাম দেখে বিস্মিত হলাম। সবগুলোই ইউরোপের জন্যে নিষিদ্ধ সাবজেক্ট। জার্মানসহ ইউরোপের কোন দেশেই অংক-বিজ্ঞান, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ও দুনিয়ার ইতিহাস পড়ানো হয় না। আমি বেরুন বেকারকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই বিষয়গুলোর নাম কি তোমার মা লিখেছেন?’
‘হ্যাঁ, মা তো লিখেছেন। তাছাড়া কে লিখবেন?’ বলল বেরুন বেকার।
‘তোমার মা এ বিষয়গুলো পড়েন, জানেন?’ আমি বললাম বেরুনকে।
‘মা এগুলো জানেন, পড়েন কি না জানি না। তবে মা’র অনেক বই আছে। মা তো পড়েই সময় কাটান।’ বলল বেরুন বেকার।
ডাক্তারের চেতনা থেকেই বোধ হয় আমার মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে গেল, ‘চোখের অসুখ থেকে উঠেছেন, এখন তোমার মাকে কিছুদিন বই পড়া বন্ধ রাখতে হবে।’
‘তাই? তাহলে মাকে গিয়ে বলি।’ বলেই উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল বেরুন বেকার। কিছুদূর গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমাকে পড়াবেন কবে থেকে, মা জিজ্ঞাসা করলে কি বলব আংকেল?’
‘ঐ কঠিন বিষয়গুলো কি আমি পড়াতে পারি?’ বললাম আমি।
‘ঠিক আছে বলব মাকে।’ বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল বেরুন বেকার। এর কয়েকদিন পর মালিক আমাকে ডেকে বললেন, ‘আলগার, আমার নাতি বেরুনকে একটু কষ্ট হলেও পড়াও, ক্যাথারিনার অনুরোধ। তার বিশ্বাস, তুমি স্পেনের মানুষ। বেরুনকে খুব ভালভাবে তুমি পড়াতে পারবে। আমরা যাই বলি, মুসলিম স্পেন তো অংক বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ সব বিজ্ঞান , ইতিহাস, ভূগোল, ধর্মতত্ত্ব শিক্ষার বিস্ময়কর কেন্দ্র। আমরা জানি, ইউরোপে আমরা অংক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, চিকিৎসা ইত্যাদির চর্চা নিষিদ্ধ হলেও কিছু কিছু ইউরোপিয়ান ছেলে লুকিয়ে স্পেনে পড়তে গিয়েছে, যাচ্ছে। মুসলমানদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তাদের শিখিয়ে-পড়িয়ে ভর্তি করে নেবার মত উদারতা দেখিয়ে আসছে।’
পরদিন সন্ধ্যার পর বেরুন বেকারকে আমি পড়াচ্ছি। পড়াতে রাজি হয়ে নতুন বিপদে পড়ে গেলাম। ক্যাথারিনা মাঝে মাঝেই তার ছেলের হাতে বই পাঠায়। বইয়ের স্থানে স্থানে দাগ দিয়ে তার ব্যাখ্যা জানতে চায়। বইগুলোর প্রায় সবই ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক। আমি প্রথম দিকে জানি না বলে এড়িয়ে যেতাম। ক্যাথারিনা একদিন লিখে পাঠায়, ‘জনাব, একজন তৃষ্ণার্তকে পানি পান করানো কি সবচেয়ে বড় কর্তব্য, সবচেয়ে বড় ধর্ম নয়?’ এরপর আমি আর না করিনি। বইয়ে দাগ দিয়ে পাঠানো তার সব জিজ্ঞাসার জবাবই লিখে পাঠাতাম। চোখের কথা বলে তাকে এত পড়াশোনা এখন না করার জন্যে বেরুন বেকারের মাধ্যমে আবার বলে পাঠিয়েছিলাম। সে লিখে পাঠিয়েছিল, ‘মান্যবর ডক্টর, লেখা-পড়াই তো আমার সাথী। লেখা-পড়া ছেড়ে দিলে রোগ থেকে হয়তো আমি বাঁচবো, কিন্তু আমি মরে যাব।’ আমি আর তাকে কিছু বলিনি। চিঠিটা আমার অবচেতন মনের কোথায় কি যেন বিদ্ধ করে, চিঠির সাথের অদৃশ্য একটা যন্ত্রণা যেন আমার হৃদয়েও সংক্রমিত হয়। দিন এভাবেই চলতে থাকে।
একদিন সকালে আমার ঘরে আমি নাস্তা খেতে বসতে যাচ্ছি, এ সময় মালিকের খাস পরিচারিকা এসে বলে, মালিক আপনাকে স্মরণ করেছেন। তিনি আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’
নাস্তা না খেয়ে উঠতে হলো। পরিচারিকার সাথে সাথে চললাম।
পরিচারিকা যেখানে নিয়ে গিয়ে আমাকে পৌঁছালো সেটা তিন তলায় মালিকের পারিবারিক ডাইনিং কক্ষ। ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন খোদ মালিক। তার বামপাশে তার স্ত্রী আর ডানপাশে নাতি বেরুন বেকার, বেরুনের পাশে বেরুনের মা ক্যাথারিনা এবং ক্যাথারিনার মামা মালিকের শ্যালক অসরিক রেডওয়ার্ল্ড। নাস্তা তাদের সামনে প্রস্তুত, কিন্তু নাস্তায় কেউ হাত দেয়নি।
এই অবস্থায় তাদের মধ্যে হাজির হয়ে আমি বিব্রত বোধ করলাম। বললাম, ‘মালিক আমি পরে আসছি।’ বলে চলে আসার উদ্যোগ নিলাম।
‘দাঁড়াও আলগার, আমরা তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি। তুমি নাস্তার টেবিলে বসবে। কথা বলব এবং একসাথে বসেই নাস্তা করব। বস তুমি।’
মালিকের হুকুম শিরোধার্য। কিন্তু আমার দুই চোখ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত। এ কি বলছেন উনি! মালিকের খানার টেবিলে বসবে তার ক্রীতদাস! ইসলাম এটা আটশ’ বছর আগে চালু করেছে, কিন্তু ইউরোপে এটা অবিশ্বাস্য। আমি দ্বিধা করছিলাম।
মালিক-পত্নী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন। ‘এস বেটা, আমার পাশে বসবে।’
সবার দিকে তাকালাম। দেখলাম, ক্যাথারিনার মুখ নত। আর বেরুন বেকার আনন্দে চামচ দিয়ে প্লেট বাজাচ্ছে। মালিক ও মালিক-পত্নী আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি ধীরে ধীরে মালিকের স্ত্রীর পাশে বসলাম। পরিচারিকা আমার সামনে প্লেট ও কাঁটাচামচ এগিয়ে দিল।’
নাস্তা আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেল। সবাই নাস্তার সাথে পানীয় হিসেবে মদ পান করলেন। রীতি অনুসারে অন্তত আমারও মদ পান করা উচিত ছিল। কিন্তু আমি তা করলাম না। পরিচারিকা আমাকে লেমোনেড ওয়াটার দিল। আমি মদ পান করছি না দেখে সবাই অবাক হয়েছিল। বিস্ময়ে চোখ তুলে ক্যাথারিনা তাকিয়েছিল আমার দিকে। এই প্রথম সে আমার দিকে তাকাল চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর। আমি দেখলাম নাস্তা শেষে সেও মদ পান করল না। তার গ্লাসের মদ গ্লাসেই থেকে গেল। আমি মদ পান করি না দেখে মালিক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার মদ পান না করার কারণ কি? আমি বলেছিলাম মালিক অনুমতি দিলে জবাবটা পরে দিতে চাই। তিনি তা মেনে নিলেন।
নাস্তার পর চা খাওয়া শুরু হলে মালিক বললেন, ‘আলগার, দু’টি কথা বলার জন্যে তোমাকে ডেকেছি। প্রথম কথা, তোমার একটা বড় ধরনের সাহায্য প্রয়োজন। গতকাল সকালে আমি সম্রাট চতুর্থ অটো’র দরবারে গিয়েছিলাম। দরবার বসেনি। গোটা রাজপ্রাসাদ বিষাদে ঢাকা। কথায় কথায় জানলাম, সম্রাট চতুর্থ অটোর একমাত্র ছেলে যুবরাজ তৃতীয় হেনরী থিয়োলজী যুদ্ধাবিদ্যা ইত্যাদি শেখার জন্যে রোমে ছিলেন গত দু’বছর। সেখানে এক বছর যেতেই তার দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। সেখানে অনেক চিকিৎসা হয়েছে। কিন্তু কোন ফল হয়নি। সম্পূর্ণ অন্ধ অবস্থায় তিনি গত পরশু বাড়ি ফিরেছেন। এখানকার রাজবৈদ্যরা গত দু’দিন ধরে দেখে অভিমত দিয়েছে, চোখ একেবারে শুকিয়ে গেছে। দৃষ্টিশক্তি ফেরানো আর সাধ্যের মধ্যে নেই। এই খবরে সম্রাটের প্রাসাদে কান্নার রোল পড়ে গেছে। আমি সম্রাটের সাথে কথা বলেছি। তোমার কথাও আমি বলেছি তাকে। রাজবৈদ্যরা ব্যর্থ হবার পর কিভাবে তুমি ক্যাথারিনার চোখ সারিয়ে তুলেছ, সেটাও বলেছি আমি তাকে। শুনেই সম্রাট অস্থির হয়ে উঠেছেন তোমাকে তাঁর ছেলে দেখাবার জন্যে। আজই আমি তোমাকে সম্রাটের প্রাসাদে নিয়ে যেতে চাই। তোমার সম্মতি প্রয়োজন।’ থামলেন মালিক।
আমি বললাম, ‘আপনার সম্মতিই আমার সম্মতি মালিক। আমার ভিন্ন সম্মতির প্রয়োজন নেই। তবে এত বড় বড় চিকিৎসক ব্যর্থ হবার পর আমি সম্রাটের ছেলের চিকিৎসার ব্যাপারে কতদূর কি করতে পারব বুঝতে পারছি না। আপনি কি যুবরাজ তৃতীয় হেনরিকে দেখেছেন?’
‘হ্যাঁ, দেখেছি আলগার।’ বললেন মালিক।
‘তার চোখের দিকে খেয়াল করেছেন? চোখ দু’টি কি গর্তে ঢুকে গেছে, না মোটামুটি স্বাভাবিক আছে?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম মালিককে।
‘আমি তার চোখ দু’টিকে ভালো করে দেখেছি। তুমি যেটা বললে তার চোখ মোটামুটি স্বাভাবিক কি না, হ্যাঁ আমি সে রকমই দেখেছি। চোখ গর্তে ঢুকে যায়নি।’ বললেন মালিক।
‘যদি তাই হয়, তাহলে চোখের টিস্যু ও ধমনীতে এখনও রস আছে, সেগুলো এখনও সজীব রয়েছে। এটাই আমার কথা।’ আমি বললাম।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তোমাকে ধন্যবাদ। ঈশ্বর তোমার কথা সত্য করুন। গতকাল থেকে তার সম্পর্কে শুধু হতাশার কথাই শুনছি। তুমিই প্রথম আশার কথা শোনালে।’ বললেন মালিক।
‘স্রষ্টার দয়া সম্পর্কে হতাশ হতে নিষেধ করা হয়েছে। তিনি জীবিতকে মৃত করেন এবং মৃতকে জীবিত করতে পারেন। তার সব দয়া মানুষের জন্যে।’ আমি বললাম।
‘আলগার তোমাকে যতই দেখছি, ততই বিস্মিত হচ্ছি। এত জ্ঞান তুমি কোথা থেকে পাও?’ বললেন মালিক।
‘মালিক, সব জ্ঞানের উৎস স্রষ্টা। মানুষের মগজ স্রষ্টার ইচ্ছা প্রকাশের একটা মাধ্যম। এই মাধ্যমের পথ ধরেই মানুষের সকল আবিষ্কার, সকল মহৎ সৃষ্টি।’ আমি বললাম।
ক্যাথারিনা আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। বিস্ময়ভরা তার চোখে অনেক প্রশ্ন দেখলাম। মালিকই কথা বললেন, ‘সাংঘাতিক কথা বলেছ আলগার। কথাটা সাগরের চেয়েও গভীর। কারণ সাগরের তল আছে। ঈশ্বর তোমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই মালিক আবার বললেন, ‘তাহলে আজ বিকেলেই তুমি আর আমি রাজধানীতে যাত্রা করব।’ বলে থামলেন মালিক।
কেউ কোন কথা বলল না।
অস্বস্তিকর একটা নীরবতা।
নীরবতা ভাঙলেন আবার মালিক নিজেই। বললেন, ‘এবার আমার দ্বিতীয় কথা।‘
কথাটা সংগে সংগে শুরু করলেন না মালিক। আবার নীরব হলেন তিনি।
অন্য সবাই আনত দৃষ্টিতে বসে আছে। অস্বস্তিকর নীরবতায় আবার কাটল কিছুক্ষণ। পরিবেশকেও ভারি করে তুলেছে এই নীরবতা।
আবারও নীরবতা ভাঙলেন মালিকই। শান্ত, গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘আলগার, সেদিন তোমাকে কিছু চাইতে বলেছিলাম। তুমি চাওনি। বলেছ ক্রীতদাসদের কিছু বিনিময় চাইবার অধিকার নেই। চলমান ব্যবস্থায় এটা সত্য। কিন্তু আলগার, কোন ক্রীতদাস এতবড় কাজ করার পর কিছু চাইবে না তা একেবারেই স্বাভাবিক নয়, অবিশ্বাস্য। এই অবিশ্বাস্য কাজ করে তুমি প্রমাণ করেছ আমরা যা ভাবতে পারি তার চেয়েও তুমি মহৎ, বড়। এমন মহৎরা কিছু চায় না, দিতে হয় তাদের। চাইবে না বলে তাদের দিতে হবে না, এটা ঠিক নয়। আমরা সেদিন ভুল করেছিলাম। সেদিনও তোমাকে চিনতে ভুল করেছি। সে ভুল আমাদের ভেঙেছে আলগার। সেদিন যা আমাদের না চাইতেই দিয়ে দেয়া উচিত ছিল, সেটা আজ আমরা দিয়ে দিতে চাই। আজ থেকে তুমি মুক্ত আলগার। তুমি আর কারও ক্রীতদাস নও। তুমি এখন আমাদের ছেলে সন্তানের মত। আমাদের তো কোন ছেলে সন্তান নেই!’ থামলেন মালিক। শেষের দিকে তার কন্ঠ কান্নারুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আশার চেয়ে বড় কিছু ঘটলে, মানুষ যেমন বাকরুদ্ধ, বিহ্বল হয়ে যায়-আমারও সেই অবস্থা হলো। মুক্ত মানুষ থাকার যে কি স্বাদ তা ভুলেই গিয়েছিলাম, চেষ্টাও করেছি অতীতকে ভুলতে। আজ মুক্তির সংবাদ পাওয়ার পর সেই অতীত বাঁধভাঙা জোয়ারের মত আমার হৃদয়ে এসে আছড়ে পড়ল। সেই আদরের কর্ডোভা, সেই প্রিয় আমার বাড়ি, প্রিয়তমা স্ত্রী, প্রাণাধিক সন্তান, তাদের ও আমার পরিণতি, সবই এক সঙ্গে এসে আমার মনের দুয়ারে আছড়ে পড়ল। দু’চোখ থেকে দরদর করে নেমে এল অশ্রুর ধারা। ভুলে গিয়েছিলাম পারিপার্শ্বিকতা। কতক্ষণ কেঁদেছিলাম জানি না। পিঠে একটা মমতা ভরা হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। চমকে উঠে নিজেকে সামলে নিলাম। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম, মালিক-পত্নীর হাত আমার পিঠে। তার চোখে রাজ্যের মমতা।সবার উপর দিয়ে আমার চোখ ঘুরে এল। দেখলাম মালিকের চোখে প্রশান্তির উজ্জ্বলতা। আর ক্যাথারিনের দৃষ্টি আনত। তার দুই রক্তিম ঠোঁটে খেলা করছে স্বচ্ছ হাসি। তবে দু’চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুর দুটি ধারা। হাসছে ক্যাথারিনার মামা আমার দিকে চেয়ে। বেরুন বেকার একেবারেই নির্বাক।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। নতমুখে ধীর কন্ঠে বললাম, আমার মুরুব্বি, আমার গুরুজন, আমার মহৎহৃদয় মালিকের প্রতি আমার হৃদয়ের অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমি যা করেছি তা খুবই সামান্য, তিনি যা করলেন তা অনেক বড় হৃদয়ের পরিচয়। স্রষ্টা তাঁর মঙ্গল করুন। এই জগৎ ও পরজগতে স্রষ্টা অনেক বড় বিনিময় তাকেঁ দান করুন। আমার পরিবার থাকলে তারা আজ ছুটে আসত তাঁকে স্বাগত জানাতে, তাঁকে মাথায় তুলে নিতে। আমার তো কেউ নেই, সবহারা মানুষ আমি। তাই আমার একার সামান্য কয়েকটা কথা ছাড়া দেয়ার বা করার আমার কিছু নেই। এই পরিবারের সবার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তারা প্রকৃতিগতভাবেই ভালো মানুষ। তাদের কাছে আমি ভালো ব্যবহার পেয়েছি। অবস্থাগত কারণ আমিই বরং কিছু মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছি। আপনাদের সবাইকে অন্তরের অন্তরের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ। বললাম আমি।
‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আলগার। তুমি মহৎ বড়, বিজ্ঞ বলেই সবাইকে মহৎ ভাবতে পারছ। আলগার এখন একটা অনুরোধ করতে পারি?’ বললো আমার সাবেক মালিক।
আমি বললাম, ‘আপনি গুরুজন, অনুরোধ নয়, আদেশ করুন।’
‘তুমি যে মিথ্যাচারের কথা বললে, সেটা বুঝলাম না। আর আমি যে কথাটা বলতে চাচ্ছি তা হলো, তোমার পরিচয় আমরা জানি না। তুমি যেটুকু পরিচয় দিয়েছিলে তা আমার কাছে তখনই বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। তোমার আচরণ, কথা-বার্তা কোন কিছুর সাথেই তোমার পরিচয় মেলে না। জানতে পারি কি সব কথা?’ বললেন মি. ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক, আমার অভিভাবক।
একটু ভাবলাম। লুকিয়ে তো আর লাভ নেই।তবে মুসলিম পরিচয় এখন বলতে চাই না।যুবরাজের চিকিৎসা তাতে বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
পরক্ষণেই আবার ভাবলাম, আবার মিথ্যাচারের আশ্রয় নেব কেন? সত্য আমাকে যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানেই যাব।
আমার জবাব দিতে দেরি হচ্ছে দেখেই বোধ হয় আমার সাবেক মালিক ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক বলে উঠলেন, ‘থাক আলগার, অসুবিধা বা বলতে না চাইলে বলো না। এখন…।’
আমি তার কথার মাঝখানেই বললাম, ‘স্যরি। বলতে চাই না তা নয়, অসুবিধাও কিছু নেই।’
বলে একটু থেমে আমি শুরু করলাম, ‘আমার নাম ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর। আমার জন্ম স্পেনের কর্ডোভা নগরীতে। আমার বাবা কর্ডোভার সুলতানের প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। কর্ডোভা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ঐ হাসপাতালেই ডাক্তার হিসেবে ১২৩০ সালে চিকিৎসক জীবনের শুরু করি। আমি ছাত্র হিসেবে যেমন সেরা ছাত্রের গোল্ড মেডেল নিয়ে বেরিয়ে আসি তেমনি চিকিৎসক হিসেবেও সেরা চিকিৎসকের গোল্ড মেডেল পাই ১২৩৬ সালে।’ এই কথাগুলো বলে আমি সংক্ষেপে কিভাবে দেশে বিপর্যয় ঘটল, কিভাবে স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান হারালাম, কি করে আমি পথে নামলাম, পথ কিভাবে আমাকে জার্মানীতে নিয়ে এল তার কাহিনী বললাম। থামলাম আমি।
সবাই নীরব। সবার চোখ আমার দিকে নিবদ্ধ। ক্যাথারিনারও। তাদের চোখে বিস্ময় ও বেদনা দু’টোই।
আমি চোখ নামিযে নীরব রইলাম।
কথা বলে উঠলেন আমার সাবেক মালিক ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক। বললেন, ‘তোমার ও তোমার স্ত্রী সন্তানদের এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্যে আমি ও আমার পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি আলগার। তোমার এই দু:খের উপর এবং আজকের জগতের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সর্বশ্রেষ্ট কেন্দ্র স্পেনের চিকিৎসা-বিজ্ঞানের রাজধানী কর্ডোভার সেরা ডাক্তারের উপর কষ্ট ও নির্যাতনের যে বোঝা চাপিয়েছিলাম, চিকিৎসকের সোনাফলা হতে শ্রমিকের যে বেলচা, কৃষকের যে কোদাল তুলে দিয়েছিলাম, তার জন্যে আমি ও আমরা গভীর দু:খ প্রকাশ করছি। তুমি তোমার মুসলিম পরিচয় ও কর্ডোভার চিকিৎসকের পরিচয় গোপন করে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ঠিকই করেছিলে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রসেডের যে উন্মত্ততা ইউরোপ ও জার্মানীতে চলেছিল তাতে তোমার মুসলিম পরিচয় নিরাপদ ছিল না। প্রথমে তোমার এই পরিচয় পেলে বড় শিকার পেয়েছি বলে আমিও হয়তো তোমাকে হত্যা করে ফেলতাম। কিন্তু অর্ধেক বছরের ছোট্ট সময়ে আমরা তোমাকে নানা অত্যাচার করলেও তুমি তোমার কাজ, কথা, ব্যবহার দ্বারা আমাদের মন জয় করে নিয়েছ। তা না হলে যাই পরিণতি হোক, আমার মেয়েকে দেখানো বা তার চিকিৎসার জন্যে তোমাকে অ্যালাও করতাম না। তোমার প্রতি আমার অনুরোধ আলগার, তোমাকে তোমার পরিচয় ও স্পেনের ডাক্তার হওয়ার পরিচয় এখনও গোপন রাখতে হবে। আলগার, এই মুহূর্তে আমি অনুভব করছি, যে ধর্ম তোমাকে এত সুন্দর, এত মহৎ বানিয়েছে, সেই ধর্ম আমাকে, আমাদেরকেও যেন জয় করে নিচ্ছে। কিন্তু বেটা, ক্রসেডের আবেগ-উন্মত্ততার সয়লাব এখনও ইউরোপ জুড়ে চলছে। তোমার আসল পরিচয় এখনো নিরাপদ নয়। আমার পরিবারের আমরা যারা এখানে উপস্থিত আছি তারা ছাড়া আর কেউ জানবে না তোমার এই পরিচয়।’
থামলেন আমার অভিভাবক। আমি খুশি হলাম তাঁর কথায়। তিনি ঠিক পরামর্শ আমাকে দিয়েছেন। শুধু দেশ জোড়া নয়, মহাদেশ জোড়া এমন বৈরী পরিবেশে ইসলাম মেনে চলা ও প্রচারের কাজ করতে হলে একটু ভিন্ন, একটু কৌশলী হতেই হবে। আমি বললাম আমার অভিভাবককে লক্ষ্য করে, আবারও আমি আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি সঠিক পরামর্শ দানের জন্য। আপনি যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেটাই হবে। আমি থামলাম।
আমার পাশ থেকে আমার সাবেক মালিকের পত্নী, যাকে আমি মা বলে ডেকেছি, তিনি বলে উঠলেন, ‘আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন আজ। আমি বেটা আলগারকে আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে স্বাগত জানাচ্ছি। আমি আজকের দিনকে খানার এক বিশেষ আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করতে চাই। আর ক্যাথারিনার বাবা নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিককে অনুরোধ করবো, আমাদের বাড়ি ও ফার্মল্যান্ডের সকল শ্রমিক, কর্মচারি, কর্মকর্তাকে একমাস বেতনের সমপরিমাণ অর্থ উপহার হিসেবে আজ দিয়ে দেয়ার জন্য।’
আমার সাবেক মালিকের স্ত্রী থামতেই আমার অভিভাবক মি. ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক বললেন, ‘ধন্যবাদ গ্রিটা, ক্যাথারিনার মা। তোমার দুই প্রস্তাবই আমি আনন্দের সাথে গ্রহণ করলাম এবং সম্রাটের ওখানে যাওয়ার সময় আমি রাত আটটা পর্যন্ত পিছিয়ে দিচ্ছি। বলে দিচ্ছি রাত ৮টায় সম্রাটের ওখান থেকে গাড়ি আসতে।’
‘বাবা, মা তোমাদের দু’জনকেই ধন্যবাদ। বিশেষ করে বাবাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি একজন মানুষকে তার মানবিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার মহৎ সিদ্ধান্তের জন্যে। এই সিদ্ধান্ত শুধু তাঁকে মুক্ত করেনি বাবা, আমাদেরকেও মুক্ত করেছে। যে দূর্বহ কালো পাথরটা বুকের উপর চেপে ছিল, তা আজ থেকে নেমে গেল বাবা।’ বলল ক্যাথারিনা আনত মুখে। শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে সে কেঁদে ফেলল।
‘ধন্যবাদ মা ক্যাথারিনা। ঈশ্বর আমাদের সকলকে সাহায্য করেছেন।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক বললেন, ‘আমরা এখন উঠছি। গ্রিটা, তুমি আলগারকে তিন তলায় তার থাকার নতুন জায়গায় নিয়ে যাও। আর…।’
কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি। তার কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠল ক্যাথারিনার মামা অসরিক রেডওয়ার্ল্ড। বলল, ‘বৈঠক শেষ হচ্ছে দেখছি? তৃতীয় একটা কথা ছিল আমার।’
‘তোমার আবার কি কথা? বল।’ বললেন আমারা সাবেক মালিক।
‘আপা ঠিকই বলেছেন, শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর সর্বশ্রেষ্ঠ দিন আজ। এই মহান দিনের জন্যে উপযুক্ত আরেকটা বড় কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে।’ বলে থামল অসরিক রেডওয়ার্ল্ড।
‘থামলে কেন, বল সে কাজটা কি? তোমার দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলবে না তো! তোমার বউ মরে যাবার পর থেকেই কিন্তু পাত্রী খুঁজছি। এখনও পাইনি। বল, কি বলবে।’ বললেন আমার সাবেক মালিক।
‘ঠিক ধরছেন দুলাভাই। বিয়ের কথাই, তবে আমার বিয়ে নয়। আমার স্নেহের একমাত্র ভাগ্নির বিয়ে।’ বলল অসরিক রেডওয়ার্ল্ড।
‘ভাগ্নি মানে? ক্যাথারিনার বিয়ে?’ জিজ্ঞাসা করলেন আমার সাবেক মালিক। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘হ্যাঁ দুলাভাই। আমাদের সকলের প্রিয়, আমাদের শ্রমিক কর্মচারিদের প্রিয় জোসেফ জ্যাকব আলগারের সব কাহিনী আমরা জানলাম। তার স্ত্রী-পুত্র পরিজন কেউ নেই। তিনি সব হারিয়েছেন। তিনি এখন একা। আমরা তাঁকে আমাদের পরিবারের একজন হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমি তার সা্থে ক্যাথারিনার বিয়ের প্রস্তাব করছি। তারা দু’জনেই এখানে আছে। তারা একে অপরকে শুধু চেনেনই না, জানেনও। এখানে এই আলোচনা হতে পারে।’ থামল অসরিক রেডওয়ার্ল্ড।
সংগে সংগে কেউ কথা বলল না। সবাই নীরব।
আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। গোটা দেহ মনে কেমন ভাবাবেশের সৃষ্টি হলো। ইদানীং ক্যাথারিনার সামনে পড়লে, তার সাথে যখন কথা বলেছি, সে সময় মনের দুয়ারে পরিচিত যে শংকা, অস্বস্তির উদয় ঘটত, তা এখন নগ্নভাবে সামনে এসেছে। আসলে সেটা অস্বস্তি ও শংকা ছিল না, সেটা ছিল একটা আশা-সম্ভাবনার প্রকাশ চাপা দেয়ার সলজ্জ প্রয়াস। ক্যাথারিনাকে আপন করে পাওয়া বা আপন করে নেওয়ারই আশা সেটা। অলক্ষ্যে অবচেতনায় কখন থেকে যেন আমি ক্যাথারিনাকে চাইতে শুরু করেছিলাম। অসরিক রেডওয়ার্ল্ডের প্রস্তাব মনের সে চাওয়াকেই নগ্নভাবে সামনে এনে দিল। আমার মুখে কোন কথা সরল না।
ক্যাথারিনাও কোন কথা বলল না। ক্যাথারিনা কি ভাবছে, সেটাও এই মুহূর্তে আমার মনে বড় হয়ে উঠল।
কথা বললেন আমার মনিব। বললেন, ‘হ্যাঁ, অসরিক রেডওয়ার্ল্ড, তুমি প্রস্তাব করতেই পার। কিন্তু ব্যাপারটা শুধু আমার পরিবারের সিদ্ধান্তের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। দু’জনের ব্যক্তিগত মতামতটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তাদেরকে কি আমি জিজ্ঞাসা করতে পারি, তারা এখন এখানে কিছু বলবে কি না?
‘বাবা, তোমাকে ধন্যবাদ মতামত জিজ্ঞাসা করার জন্যে। কিন্তু বিয়ে পিতা-মাতারাই দেন। কোন কোন ক্ষেত্রে, ছেলে-মেয়েরা তাদের মতামত জানায় মাত্র। অতএব তোমাদের সিদ্ধান্তই এখনও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ বলল ক্যাথারিনা। নরম, সলজ্জ কন্ঠ তার।
‘ধন্যবাদ ক্যাথারিনা। অসরিক বলেছে আমরা জানি, আলগার একা, তার পরিবার নেই, পিতা মাতা নেই। আলগার তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, আমি ও গ্রিটা কি তোমার পিতা-মাতা হতে পারি না?’ বললেন আমার অভিভাবক নরম ও স্নেহের সুরে।
কথাটার মধ্যে কি জাদু ছিল জানি না। অথবা আমার হৃদয়টাই স্নেহ বুভুক্ষু হয়েছিল কি না তাও জানি না। কথাটা শোনার সাথে সাথে আমার দুই গণ্ড অশ্রুতে ভরে গেল। সংগে সংগেই আমি বললাম, ‘অবশ্যই পারেন জনাব, যদি আপনারা সবহারা একজনের পিতা মাতা হতে চান। তাহলে আমি বলছি, ক্যাথারিনার উপর আপনাদের যে অধিকার, আমার উপরও আপনাদের সেই অধিকার থাকবে।’
‘ধন্যবাদ আলগার। তুমি ও ক্যাথারিনা একই কথা বলেছ। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। তোমাদেরকে বলছি, তোমরা যদি একে-অপরের হয়ে যেতে সম্মত হও তাহলে তোমাদের বাবা-মা আমরাই সবচেয়ে খুশি হবো এবং খুশি হয়েছি তোমাদের মত পেয়ে। এটাই আমরা সিদ্ধান্ত করলাম যে, আমরা সম্রাটের ওখান থেকে এসেই বিয়ের কাজটা সারব। ইতোমধ্যে গ্রিটা ও তার ভাই বিয়ের প্রস্তাবক অসরিক রেডওয়ার্ল্ড বিয়ের আয়োজনে কাজ করতে থাকবেন। আলগার ও ক্যাথারিনা তোমাদের আর কোন কথা আছে?’ বললেন ক্যাথারিনার বাবা আমার সাবেক মালিক।
একটা কথা কিছু আগে থেকে আমার মনে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে, সেটা হলো, আমার মুসলিম পরিচয় সম্পর্কে ক্যাথারিনার মত কি? এ বিষয়ে তার মন বা মতামত জানা হলো না। তাই মনিবের কথা শেষ হতেই আমি বললাম, ‘একটা কথা বাবা, ক্যাথারিনা জোসেফ জ্যাকব আলগার সম্পর্কে জানেন কিন্তু তার মুসলিম পরিচয় সম্পর্কে ক্যাথারিনার মত জানা হয়নি।’
ক্যাথারিনার বাবা কিছু বলার আগেই ক্যাথারিনা বলে উঠল, ‘বাবা, ওকে বল, উনি যে মুসলিম এ বিষয়টা আজ উনি বলার আগেই আমি জানতাম।’
‘তুমি কিভাবে জানলে মা, আমরা তো জানতে পারিনি।’ বললেন ক্যাথারিনার বাবা।
‘বাবা, আমি বেরুন বেকারের মাধ্যমে আমার বিভিন্ন বইয়ের কিছু কিছু অংশের ব্যাপারে ওর ব্যাখ্যা জানতে চাইতাম। উনি তা লিখে পাঠাতেন। তার এসব লেখার মধ্য দিয়ে আমার বিশ্বাস নিশ্চিত হয় যে উনি মুসলিম। তার আগে আমার চিকিৎসার সময় তিনি হাতের একটা বই ফেলে রেখে এসেছিলেন আমার ঘরে।
তার মধ্যে একখণ্ড কাগজ ছিল, তাতে ওর হাতের কিছু লেখা ছিল। সেটা পড়েই আমি প্রথমে বুঝতে পারি, উনি মুসলিম হতে পারেন।’ বলল ক্যাথারিনা।
ক্যাথারিনার কথায় আমারও মনে পড়ে গেল, এ রকম ঘটেছে। খুশি হলাম এই ভেবে যে, আমি মুসলিম জেনেই সে আমার ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
ক্যাথারিনার বাবা বললেন, ‘এক সময় মুসলমানদের প্রতি আমার দারুণ বৈরীভাব ছিল। সেটা এখন আর নেই। মুসলমানরা খৃষ্টানদের মতই একত্ববাদী এবং তারা ক্যাথলিক খৃস্টানদের চেয়েও ধর্ম পালনে বেশি নিষ্ঠাবান। ক্যাথারিনা এখন কিংবা কখনো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও আমাদের আপত্তি নেই।’ ‘আমি ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করছি বাবা। জীবন্ত ধর্ম ইসলাম আমার ভালো লেগেছে।’ এ নিয়ে তোমার সাথে আলোচনা করব বাবা। বলল ক্যাথারিনা।
‘ধন্যবাদ ক্যাথারিনা।’
বলে সবার দিকে তাকিয়ে ক্যাথারিকার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক বলল, তাহলে এবার সব কাজ আমাদের শেষ হলো। সত্যি আজ সর্বশ্রেষ্ট দিন আমারও জীবনে। উঠবো এবার আমরা। অসরিক রেডওয়ার্ল্ড ধন্যবাদ তোমাকে, একটা ভালো কাজ তুমি করলে।
না দুলাভাই, প্রতিদিনই আমি ভালো কাজ করি। তুমি দেখ না। শালা হওয়াই আমার অপরাধ।
ক্যাথারিনা ও ক্যাথারিনার মা মুখ টিপে হাসছিল।
শালার চেয়ে মধুর সম্পর্ক আর আছে নাকি, অপরাধ হবে কেন? বলে উঠে দাঁড়ালেন ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক। সবাই উঠল। আমিও উঠে দাঁড়ালাম।’’ | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
৫৩. রাইন থেকে অ্যারেন্ডসী

Tags