৭. তিয়েনশানের ওপারে

চ্যাপ্টার

হাসান তারিকরা গাড়ির কাছে এসে দেখল বেবী ট্যাক্সিটি নেই, আর তাদের গাড়ির সামনের চাকা জেনারেল বোরিস গুলি করে নষ্ট করে দিয়ে গেছে। তারা ভেবে পেল না, জেনারেল বোরিস এক হাতে বেবী ট্যাক্সি চালিয়ে নিয়ে গেল কি করে! হাসান তারিক পরিস্কার দেখেছে, রিভলভারের দু’টো গুলি গিয়ে বিদ্ধ হলো তার হাতে। সে যখন উঠে দাঁড়াল, কব্জি থেকে হাতের নিচের অংশটা তখন ঝুলছিল।
হাসান তারিক তাড়াতাড়ি এক্সট্রা চাকাটি গাড়িতে লাগিয়ে নিয়ে ছুটল। তাদের টার্গেট সেই বাড়ি যেখান থেকে ওরা পাঁচজন বেবীতে উঠেছিল।
বাড়িটির কাছাকাছি একটা অন্ধকার জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে চারজন ওরা গেল সেই বাড়ির দিকে। বাড়ির সামনে গিয়ে দেখল প্রধান ফটকটি খোলা। ছ্যাঁৎ করে উঠল হাসান তারিকের মন। চিড়িয়া কি তাহলে উড়ে গেল! স্টেনগান বাগিয়ে ওরা প্রবেশ করল বাড়ির ভেতরে। এ চারটি স্টেনগান তারা যোগাড় করেছে জেনারেল বোরিসের ঐ চারজনের কাছ থেকে।
সব মিলিয়ে বাড়িতে দশটি ঘর। উপরে পাঁচটি, নিচে পাঁচটি। সবগুলি ঘর খোলা। কাপড়-চোপড় জিনিস পত্রের বিশৃংখল অবস্থা দেখে তারা বুঝল, বাড়ির লোকরা তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে গেছে। এমন কি সিগারেটের বাক্স এবং লাইটার পর্যন্ত নেবার সুযোগ পায়নি।
বিছানার তোষকের তল এবং টেবিলের ড্রয়ারগুলো তারা দেখল। কিছু নেই। সব শূন্য। হাসান তারিক জানে জেনারেল বোরিস যেখানে থাকে আট ঘাট বেধেই থাকে। কোন বাহুল্য জিনিস সে রাখে না। হঠাৎ শোবার ঘরের একটা বালিশ উল্টাতে গিয়ে একটা ছোট নোট বই পেয়ে গেল। নোট বইটি বালিশের কভারের মধ্যে লুকানো ছিল। বালিশ তুলতেই সেটা বেরিয়ে পডল। মনে হয় তাড়াহুড়ার জন্যে নোট বইয়ের মালিক এর কথা ভুলে গেছে। হাসান তারিক নোট বইটা পকেটে রাখল।
বাডি থেকে ওরা চারজন বেরিয়ে গাডির কাছে এল। ভাবছিল হাসান তারিক, জেনারেল বোরিস এখান থেকে কোথায় যেতে পারে। হঠাৎ হাসান তারিকের মনে হল সেই প্রথম বাড়িটার কথা। ওখান থেকেই ওরা স্টেনগান ভর্তি বাক্স এনে অভিযানে বেরিয়েছিল, এর অর্থ ওটাই তাদের মূল ঘাটি। একবার ওখানে গিয়ে দেখা যেতে পারে।
হসান তারিকের গাড়ি ছুটল ঐ বাড়ির উদ্দেশ্যে। গাড়িটি বড় রাস্তায় রেখে ওরা সে বাডির সামনে গিয়ে দাড়াল, দেখল এক বিরাট তালা ঝুলছে বাইরের গেটরুমের দরজায়।
হাসান তারিক একটু ভাবল। তারপর বলল, চল ঐ চোরা দরজা একবার দেখব।
দক্ষিণ রাস্তাটা ঘুরে প্রাচীরের পাশ দিয়ে তারা চারজন পশ্চিম দিকে আগ্রসর হলো। সামনে হাসান তারিক। পেছনে ওরা তিন জন। আকাশে জোৎস্না নেই, অন্ধকার । কিন্তু স্বচ্ছ আকাশের তারার আলো অন্ধকারের কাল রূপকে কিছুটা যেন ফিকে করে দিয়েছে। হাসান তারিক তার দু’চোখ সামনের কালো অন্ধকারের বুকে স্থির রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সামনের অন্ধকারে একটা অংশ নড়ে উঠল। হাসান তারিক চাপা কণ্ঠে চিৎকার দিল, শুয়ে পড়, তোমরা।
হাসান তারিক শুয়ে পডেছিল, তার সাথে সাথে ওরা তিনজনও।
ওরা শুয়ে পড়ার সাথে সাথে এক ঝাক গুলি ওদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল।
হাসান তারিক শুয়ে পড়েছিল, কিন্তু তার রিভলভারটা নড়ে ওঠা অন্ধকারটিকে তাক করেই ছিল। হাসান তারিক শুয়ে পড়েই ট্রিগার টিপেছিল ঐ অন্ধকার লক্ষ্য করে।
অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ উঠল এবং ওদিক থেকে গুলি বর্ষণও বন্ধ হয়ে গেল।
হাসান তারিক পেছনের দিকে লক্ষ্য করে বলল, তোমরা সব ঠিক তো?
-হ্যা। ইউসুফ জবাব দিল।
-ক্রলিং করে দ্রুত আমাদের এগুতে হবে। গুলির শব্দে অন্যেরা এখনি ছুটে আসবে। এ লোকটাকে নিশ্চয় ওরা পাহারায় বসিয়ে রেখেছিল।
হাসান তারিকরা দ্রুত এগিয়ে প্রাচীর যেখানে উত্তর দিকে বাঁক নিয়েছে তার কাছাকাছি গিয়ে পৌছল।
এমন সময় হাসান তারিক দেখল, একটা চলন্ত অন্ধকার এগিয়ে প্রাচীরের বাঁকের এপারে এসে চাপা কণ্ঠে ডাকল, ব্যাং কোথায় তুমি?
কোন সাড়া না পেয়ে আবার ডাকল ব্যাং।
চাপা ফিস ফিসে কণ্ঠ তার।
এরপর লোকটা এক পা দু’পা করে সামনে এগুলো। অন্ধকারেও তার উদ্যত স্টেনগানের অস্তিত্ব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
লোকটা আরও কয়েক ফুট এগিয়ে এল।
হাসান তারিক হাত দিয়ে পরীক্ষা করল তার রিভলভারের সাইলেন্সার ঠিক আছে কি না। তারপর ধীরে সুস্থে শুয়ে থেকেই একটা গুলি করল সে।
নিরব অন্ধকারে ‘দুপ’ করে একটা শব্দ উঠল। আর লোকটার মুখ থেকে বেরুল একটা ‘আ-আ’ শব্দ। পেছন দিকে উল্টে পড়ে গেল লোকটা।
হাসান তারিকরা আরেকটু এগিয়ে প্রাচীরের কোণায় গিয়ে অবস্থান নিল। এই কোণা থেকে বিশ গজ উত্তরে এগুলেই সেই চোরা দরজাটা।
হাসান তারিক দেহটাকে দক্ষিণ দেয়ালের সাথে সেঁটে রেখে একটু মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে উত্তর দিকে দেখল, চোরা দরজার সামনে মাইক্রোবাস সাইজের একটা গাড়ি কালো দৈত্যের মত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা ও গাড়ির কাছ থেকে ঠুক-ঠাক, টুং-টাং শব্দ ভেসে আসছে। মনে হয় গাডিতে কিছু উঠছে।
প্রায় এক মিনিটের মত অপেক্ষা করল হাসান তারিক। কিন্তু আর কেউ এল না। পাশেই এসে বসেছিল ইউসুফ চিয়াং। হাসান তারিক তাকে বলল, ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগছে না। একজন লোককে তারা খোঁজ নিতে পাঠাল, নিশ্চয় তার শেষ আর্তনাদটা তাদের কানে পৌছেছে। কিন্তু এর পরেও আসছে না কেন?
হঠাৎ হাসান তারিকের খেয়াল হল বইয়ে পড়া বাংলাদেশের সুন্দরবনের বাঘের চরিত্রের কথা। বাঘ চলার এক বৃত্ত রচনা করে শিকারীকে সেই বৃত্তে ফেলে পেছন থেকে তার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। তাহলে কি সামনে দিয়ে না এসে বাড়ি ঘুরে পেছন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলার ষড়যন্ত্র এঁটেছে ওরা?
হাসান তারিক তাড়াতাড়ি ইউসুফ চিয়াংকে বলল, তুমি আব্দুল্লায়েভকে নিয়ে ক্রলিং করে নিঃশব্দে পূর্ব দিকে একটু এগোও। আমার মনে হয় ওরা পেছন থেকে আসছে।
ইউসুফ চিয়াং আব্দুলায়েভকে নিয়ে দ্রুত এগোতে লাগল পূর্ব দিকে।
হাসান তারিক প্রাচীরের কোণা থেকে মুখ একটু বের করে উত্তর দিকে তার শ্যেন দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখল। যাতে অন্ধকারে সামন্য নড়া চড়াও তার দৃষ্টি এড়িয়ে না যায়।
তখন পাঁচ মিনিট পার হয়েছে। এমন সময় প্রাচীরের পূর্ব কোণ থেকে এক সাথে একাধিক স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারের শব্দ ভেসে এল। পেছন ফিরে তাকাল হাসান তারিক। আহমদ ইয়াং ফিস ফিস করে বলল, ফায়ার এদিক থেকেই করা হয়েছে মনে হল।
‘আল্লাহ্‌ সহায়’ বলল হাসান তারিক।
কথা শেষ করেই হাসান তারিক তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল আগের জায়গায়। দৃষ্টি ফিরিয়েই তার নজরে পড়ল, তিনটি ছায়ামূর্তি শরীর বাঁকিয়ে মাথা নিচু করে গুটি গুটি এগিয়ে আসছে।
আহমদ ইয়াংকে সাবধান করে হাসান তারিক স্টেনগান বাগিয়ে শুয়ে পড়ল। প্রাচীরের কোণায় তিন-চারটা ছোট ছোট গাছ ছিল। গাছগুলো ফুট খানেক করে লম্বা। এতে সুবিধা হলো হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াং এর।
ওরা তখন পঁচিশ গজ দূরে। হাসান তারিক মাথা তুলল। তাক করল স্টেনগান। তারপর ‘ফায়ার’ বলেই ট্রিগার চেপে ধরে ষ্টেনগানের মাথা ঘুরিয়ে নিল কয়েকবার। একই সাথে আহমদ ইয়াং-এর স্টেনগানও গর্জে উঠেছিল।
তিনটি ছায়ামূর্তি ঢলে পড়ল মাটিতে।
হাসান তারিক অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু ওপার থেকে কোন জবাব এলনা। এমন সময় ইউসুফ চিয়াংরা ফিরে এল। ওরা বলল, ওখানে জেনারেল বোরিসের চারজন লোক খতম হয়েছে।
অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেল ওদিক থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই।
হাসান তারিক ইউসুফ চিয়াং কে বলল, তুমি আব্দুল্লায়েভকে নিয়ে ঐ গাড়ি ঘুরে দরজায় এস। আমরা এদিক থেকে যাচ্ছি। ওরা চলে গেলে হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াং সাপের মত গড়িয়ে চলল ঐ দরজার দিকে।
দরজায় পৌছে গেল হাসান তারিকরা। ওদিকে থেকে ইউসুফরাও এল। না কোন বাধা এল না। তাহলে ওরা সবাই শেষ হয়েছে?
দরজার গোড়ায় কয়েকটা টর্চ পেল। টর্চের আলো ফেলল প্রথমে ভেতরের করিডোরে। দেখল পাঁচটি ট্রাংক পডে আছে। তালাবদ্ধ। এরপর টর্চ নিয়ে গাড়িতে উঠল। ওখানেও অনুরূপ আটটি ট্রাংক।
গুলি করে একটি ট্রাংকের তালা ভেঙ্গে ফেলল হাসান তারিক।
ট্রাংকের তালা খুলে চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেল তাদের সকলের। সোনার তালে ভর্তি ট্রাংক।
বাড়িটি সার্চ করে কয়েক বাক্স অস্ত্র-শস্ত্র ছাড়া তেমন আর কিছুই পেল না।
সোনা ও অস্ত্রের বাক্সগুলো তারা গাড়িতে তুলল। যারা মারা গেছে তাদের স্টেনগান গুলোও কুড়িয়ে আনা হলো। অস্ত্র কুড়াতে গিয়ে আরেকটা বিষয় তারা নিশ্চিত হল যে, জেনারেল বোরিস নিহতের মধ্যে নেই।
তারপর গাড়ি ছেড়ে দিল। যখন ঘাটিতে পৌছল, তখন রাত চারটা।
জিনিস পত্র সামলিয়ে যখন তারা হাত মুখ ধুয়ে বিশ্রামের জন্য বিছানায় এল, তখন উরুমচির ইবনে সাদ মসজিদে ফজরের আযান দিল।
চারজনই উঠে দাঁড়াল মসজিদে যাবার জন্যে। অন্যদেরও ডেকে দিল।
নামাজ পড়ে এসে বিছানায় গা এলিয়েই হাসান তারিকের খেয়াল হল সেই নোটবুকের কথা। তাড়াতাড়ি উঠে নোটবুক নিয়ে টেবিলে বসল। নোটবুক খুলতেই তার ভেতর থেকে বাড়ি ভাড়ার দু’টি রশিদ বের হয়ে এল। আরবী মিশ্রিত টার্কিশ ভাষায় লেখা রশিদ। পড়ে বুঝল মাত্র ছয় দিন আগে এ দু’টি বাড়ি ভাড়া নেয়া হয়েছে। রশিদ দু’টি নিয়ে ছুটল ইউসুফ চিয়াং এর কাছে।
ইউসুফ চিয়াং রশিদ দু’টো পড়ে লাফিয়ে উঠল। ওদের আরেকটা ঘাটির সন্ধান পাওয়া গেল।
উদগ্রীব হাসান তারিককে ইউসুফ চিয়াং বুঝিয়ে বলল, এ দু’টো বাড়ির একটিকে আমরা দেখে এসেছি। আরেকটা বাড়ি তুবপাস রোডে। এখান থেকে দু’মাইল হবে।
হাসান তারিক বলল, ওদের জানা জানির কোন সময় না দিয়ে আমাদের তো তাহলে এখনই বের হওয়া দরকার।
-ঠিক বলেছেন তারিক ভাই।
বলে ইউসুফ চিয়াং উঠে দাঁড়াল। বলল তারিক ভাই আপনি তৈরী হন। আমি ওদের বলে আসি তৈরী হওয়ার জন্য।
হাসান তারিক, ইউসুফ চিয়াং, আব্দুল্লায়েভ ও আহমদ ইয়াং যখন সেই বাড়িটির সামনে গিয়ে পৌছল তখন চারদিক ফর্সা হয়ে গেছে।
বাডিটি দু’তলা। আশে পাশে লাগা কোন বাড়ি নেই। বাড়িটির নিচের তলা ও দু’তলার কোন জানালা তখনও খোলেনি। বাড়ির সামনে সামান্য একটু ফাকা জায়গা পেরুলেই বাড়িতে প্রবেশের একটি মাত্র দরজা।
রাস্তা দিয়ে পায়চারি করতে করতে বাড়ির দিকে লক্ষ্য করছিল হাসান তারিকরা।
এই সময় একটা বেবী ট্যাক্সি ঐ বাড়িটার সামনে এসে দাড়াল। ট্যাক্সি থেকে একজন লোক নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির দরজার দিকে হাঁটা দিল।
হাসান তারিক ইউসুফ চিয়াং কে বলল, তুমি যাও ওর কাছে। জিজ্ঞেস করলে প্রথমে বলবে, আমরা আলেকজান্ডার বোরিসভের পরিচিত। ওর সাথে দেখা করতে এসেছি।
ইউসুফ চিয়াং ওদিকে ছুটল।
এদিকে বেবী ট্যাক্সিটি ঘুরে দাড়িয়েছিল ফিরে যাবার জন্য।
হাসান তারিক হাত তুলে বেবী ট্যাক্সিকে থামতে বলল। থামল বেবীটি। ড্রাইভারের চোখে নতুন ভাড়া পাওয়ার উৎসুক দৃষ্টি।
হাসান তারিক জিজ্ঞেস করল, কোথেকে এলে?
-এয়ারপোর্ট থেকে।
-কখন গিয়েছিলে এয়ারপোর্টে?
-চারটার পিকিং এর ফ্লাইট ধরার জন্য।
-কিছু মনে করো না, কাকে নিয়ে গিয়েছিলে?
-যে গাড়ি থেকে নামল তার সাথে হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা একজন আহত লোক ছিল। কেন সাব, কি হয়েছে?
-কিছু না। সেই লোক আমাদের পরিচিত ।তারই খোঁজে এসেছিলাম তো! ঠিক আছে তুমি যাও।
এদিকে ইউসুফ চিয়াং বাড়িটির লোহার রেলিং এর কাছে পৌঁছতেই লোকটি ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। ইউসুফ চিয়াং ডান হাত পকেটে রিভালভারের ওপর রেখে বাম হাতে নক করল দরজায়। থেমে থেমে কয়েকবার নক করার পর দরজার ওপারে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। সেই সাথে সিঁড়ি দিয়ে কাউকে নেমে আসারও শব্দ সে পেল।
দরজাটি খুলে গেল। একটি মেয়ে দরজা খুলে দিয়ে পাশে সরে গেল।
দরজার মুখেই একটা খাড়া সিঁড়ি দু’তলায় উঠে গেছে। সিঁড়ির মাঝখানে বাইরে থেকে আসা সেই লোকটি দাঁড়িয়ে। তার একটা হাত পকেটে।
ইউসুফ চিয়াং এর দু’টো হাতই জ্যাকেটের পকেটে। দরজা থেকে দু’ধাপ ভেতরে প্রায় সিঁড়ির গোড়ায় এখন সে দাঁড়িয়ে। সিঁড়ির লোকটিকে লক্ষ্য করে সে বলল, আলেকজান্ডার বরিসভ আমার পরিচিত, তার খোঁজে এসেছি।
লোকটির ঠোঁটে চিকন হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। ইউসুফ চিয়াং এর কথা শেষ হবার সাথে সাথেই সে বাঘের মত সিঁড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ল তার ওপর।
ইউসুফ চিয়াং লোকটির চোখে চোখ রেখেছিল। সে সিঁড়ির ওপর লাফ দিতেই ইউসুফ চিয়াং বিদ্যুৎ গতিতে দরজার একপাশে সরে গেল। লোকটি মুখ থুবরে পড়ে গেল দরজার ওপর। কপালের একপাশ তার থেতলে গেল। রক্ত বেরিয়ে এল সেখান থেকে।
অদ্ভুত ক্ষীপ্রগতি লোকটির। পড়ে গিয়ে ঐ অবস্থাতেই পকেট থেকে রিভলবার বের করে তাক করল ইউসুফ চিয়াং এর দিকে।
ইউসুফ চিয়াং সরে আসার সময়ই জ্যাকেটের পকেট থেকে রিভলবার সমেত হাতটা বের করে নিয়েছিল। সুতরাং লোকটির রিভলবার অগ্নিবৃষ্টির আগেই গর্জে উঠল ইউসুফ চিয়াং এর রিভলবার।
হাসান তারিকরা এসে দরজায় দাঁড়াল এ সময়।
আহমদ ইয়াং এবং আব্দুল্লায়েভ লোকটাকে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে এল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল।
ইউসুফ চিয়াং এবং হাসান তারিক রিভলবার বাগিয়ে লক্ষ্য রেখেছিল সিঁড়ি ও নিচের তলার দরজার দিকে।
সেই মেয়েটি একটু ভেতরে দাড়িয়ে কাঁপছিল। সে যেন নড়া-চড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। হান গোষ্ঠীর চীনা মেয়ে। বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে।
ইউসুফ চিয়াং তার রিভলবার মেয়েটির দিকে তুলে ধরে বলল, আর কে আছে ভেতরে?
-আমরা দশজন আছি।
-আর কেউ?
-না কোন পুরুষ নেই।
ইউসুফ চিয়াং হাসান তারিকের দিকে তাকাল। হাসান তারিক বলল, মেয়েটিকে নিয়ে তুমি ও আব্দুল্লায়েভ নিচের তলাটা দেখে এস। আমরা সিঁড়ির দিকে লক্ষ্য রাখছি।
মিনিট পাঁচেক পর ইউসুফ চিয়াং ফেরত এল। সবটা দেখেছি, নিচে কেউ নেই।
এরপর হাসান তারিকরা ওপরে উঠে এল। ওপরে সিঁড়ির মুখে বসার ঘরটায় নয়টি মেয়ে জড়-সড় হয়ে বসেছিল। তাদের চোখে-মুখে ভয়-বিহবলতা। তারা সকলেই চীনা হান। বয়স একই রকমের-চব্বিশ পঁচিশ।
আহমদ ইয়াংকে ওদের কাছে দাঁড়িয়ে রেখে ওপর তলাটাও তন্ন তন্ন করে দেখল হাসান তারিকরা। নিচের তলার মত উপরেও ছয়টি ঘর। কেউ নেই।
হাসান তারিকরা ফিরে এল সেই বসার ঘরে মেয়েগুলির কাছে।
হাসান তারিক ওদের জিজ্ঞেস করল, আলেকজান্ডার বোরিসভকে তোমরা চিন?
সামনে বসা একটি মেয়ে বলল, চিনি?
-সেই কি আজকের ফ্লাইটে পিকিং গেছে?
-হ্যাঁ।
-কেন?
-এখানকার ডাক্তার বলেছে নাকি যে আজকের মধ্যেই ওর ডান হাতটা কেটে ফেলতে হবে। তাই পিকিং অঞ্চলের কোন হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
-এ বাড়ির আর লোক কোথায়?
-দেংশিয়াং রোডের বাড়িতে থাকতে পারে।
-ওরা কতজন লোক ওখানে?
-দেংশিয়াং রোডের বাড়ি ও এ বাড়ি মিলে আলেকজান্ডার বোরিসভ সহ ওরা চৌদ্দজন থাকে।
হাসান তারিক বিস্মিত হলো, মেয়েটি মিথ্যে বলার চেষ্টাও করছে না। বলল, তোমরা কারা? এদের দলের?
মেয়েটি কেঁদে উঠল। বলল, আমরা সব হতভাগিনী। আমাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ওরা আমাদের এনে আটিকে রেখেছে। দাসিবৃত্তি ও ভোগের সামগ্রী হিসেবে ওরা আমাদের ব্যবহার করে।
সব মেয়েদেরই চোখে পানি।
হাসান তারিক বলল, আমরা মুসলমান। আমরা সব রকম জুলুম নির্যাতনের বিরোধী। এ জন্যেই এদের সাথে আমাদের বিরোধ। তোমরা কি চাও বল?
সেই মেয়েটি চোখ মুছে বলল, আমরা বাইরে বেরুলেই ওরা মেরে ফেলবে। যেখানে যাব সেখান থেকেই ওরা ধরে আনবে। কত মেয়েকে কত কষ্ট দিয়ে যে ওরা মেরেছে।
হাসান তারিক হাসল, বলল, বোনরা তোমাদের ভয় নেই। ওদের সে শক্তি আর হবে না।
ওদের সকলের চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কয়েকটা মেয়ে ছুটে এসে পা জড়িয়ে ধরল হাসান তারিকের। বলল, আমরা বড় দুঃখী, আমাদের কেউ এমন করে বোন বলে ডাকেনি। আমাদের আপনি বাঁচান।
হাসান তারিক পা টেনে নিয়ে ওদের শান্তনা দিয়ে বলল, মানুষ মানুষের পায়ে পড়ে না বোন, আল্লাহ সকল মানুষকে সমান মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে বড় ছোট থাকতে পারে না।
হাসান তারিক একটু থেমে বলল, আমরা এখন চলে যাচ্ছি। তোমরা দরজা বন্ধ করে এ বাড়িতেই থাক। আমরা পরে ফিরে আসছি। কি ব্যবস্থা করা যায়, তখন দেখা যাবে।
হাসান তারিকরা ফিরে দাঁড়াল চলে আসার জন্য। চলতে গিয়ে আবার ফিরে দাড়াল হাসান তারিক। ওদের লক্ষ্য করে বলল, আমরা গিয়ে দ’জন লোক পাঠাচ্ছি। ওরা দরজার বাইরে পাহারায় থাকবে। ওদের টুপির সামনে দেখবে লাল অর্ধচন্দ্র। আমরা না ফেরা পর্যন্ত ওরা থাকবে, তোমাদের ভয় নেই।
হাসান তারিকরা বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে। মেয়েরা খোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে থাকল ওদের দিকে। ওদের চোখে নতুন আনন্দ ও আস্থার আলো।
হাসান তারিকরা চলে গেলে ওরা দরজা বন্ধ করে ফিরে দাঁড়াল। ওরা কি মানুষ? মানুষ কি এত ভাল হয়?
আরেকজন বলল, নারে ওদের একটা বই পড়েছিলাম আমি, ওরা সত্যিই আলাদা।

রাত দু’টায় আহমদ মুসার কাছে থেকে চলে যাবার পর যা যা ঘটেছে তা খুঁটে খুঁটে সব আহমদ মুসাকে জানাল হাসান তারিক।
সব শুনে আহমদ মুসার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে সকলের পিঠ চাপড়ে দিল। বলল, তোমাদের সাফল্যের জন্যে মোবারকবাদ। আজকের রাতটা আন্দোলনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আহমদ মুসা তার চোখ ইউসুফ ও আহমদ ইয়াং এর দিকে নিবদ্ধ করে বলল, আমার তরুণ দুই ভাই, তোমরা আমাকে মুগ্ধ করেছে, তোমরা তোমাদের ঐতিহ্যের সার্থক প্রতিনিধিত্বকারী।
ইউসুফ চিয়াং ও আহমদ ইয়াং এর চোখে মুখে একরাশ লজ্জা নেমে এল।
ইউসুফ চিয়াং বলল, না মুসা ভাই, আজ রাতে আমাদের কিছু করার ছিল না, ছিল শেখার এক দুর্লভ সুযোগ। আজ রাতের ঘটনা আমাদের শুধু অমূল্য অভিজ্ঞতা দান করেনি, আত্মবিশ্বাসও জাগিয়েছে। আজ মনে হচ্ছে, অনেক কিছু করার শক্তি আমাদের আছে।
আহমদ মুসা বলল, ইউসুফ, আমার মনে হচ্ছে এখানে সবকিছুই তোমাদের হাতের মুঠোয়। মধ্যে এশিয়ায় সাইমুম থেকে ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ অনেক ভালো পরিবেশে রয়েছে। মুসলমানরা তাদের ভাষা তাদের শিক্ষা সংক্রান্ত তাদের বেশ কিছু অধিকার পিকিং এর নতুন সরকারের কাছ থেকে ফিরে পেয়েছে। আমার মনে হয়েছে, অবশিষ্ট অধিকার মুসলমানরা ফিরে পাবে।
ইউসুফ চিয়াং বলল, কিন্তু মুসা ভাই, বিরুদ্ধ শক্তির ঐ কিছুটা আপোশকামী ভূমিকা এখানকার কিছু মুসলমানের মধ্যে এমন একটা আত্মপ্রসাদ এনে দিচ্ছে যা এম্পায়ার গ্রুপের আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে।
আহমদ মুসা বলল, ঠিক বলেছ ইউসুফ, কিন্তু সমস্যা এত বেশী আছে। মুক্তির পথে এত বাধা ও জটিলতা আছে যে আত্মপ্রসাদ সৃষ্টির কোন অবকাশ নেই। এখানকার বিধ্বস্ত মুসলিম সমাজের পুনর্গঠন এবং মুসলমানদের সকলের মুখে মুক্তির হাসি ফুটানোর পথ অনেক দীর্ঘ।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা হাসান তারিকের দিকে চাইল। বলল, জেনারেল বোরিসের কাছ থেকে যে আধ টন স্বর্ণ তোমরা উদ্ধার করেছ তা এম্পায়ার গ্রুপের জন্য ইউসুফ চিয়াং এর তত্ত্বাবধানে দিয়ে দাও। এ থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটা অংশ এম্পায়ার গ্রুপ খরচ করবে ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ, মাদ্রাসার পুনর্গঠন এবং মুসলিম, এতীম, বিধবাদের পুনর্বাসনের কাজে। অবশিষ্ট সব অর্থ ব্যয় হবে এম্পায়ার গ্রুপকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করার জন্যে। আর এক লাখ ইউয়ান যে নগদ অর্থ পেয়েছ ওটা ঐ দশটি অসহায় মেয়েকে দিয়ে ওদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
হাসান তারিক উজ্জ্বল চোখে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
কথা বলে উঠল ইউসুফ চিয়াং। বলল, মুসা ভাই, আপনি যেভাবে কথা বলেছেন তাতে মনে হচ্ছে আপনারা যেন ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর কেউ নন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, বিশ্বের যেখানে যে নামেই ইসলামী আন্দোলন হোক, আন্দোলন একটাই। এম্পায়ার গ্রুপ আমার, আমি এর সাথে আছি।
ইউসুফ চিয়াং এর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, মুসা ভাই, একটা সমস্যার কথা বলি। গতকাল একটা খবর এসেছে। শিহেজি উপত্যকায় দুই একর জমি মুসলমানদের কাছ থেকে সরকারী কাজের জন্যে একোয়ার করা হয়েছিল। কিন্তু এখন সেখানে সরকারী তত্ত্বাবধানে সিংকিয়াং এর বাইরে থেকে অমুসলিম হান গোষ্ঠীর লোক এনে বসানো হচ্ছে। মুসলমানরা এতে প্রতিবাদ করতে গেলে সংঘর্ষ হয় এবং বিশজন মুসলিম যুবককে গ্রেফতার করা হয়। এখন আমাদের কি করণীয়? আমরা সম্প্রতি এ ধরনের যে কোন নতুন বসতি ভেঙ্গে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরকম বেশ কিছু পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নতুন বসতি আর পুনঃস্থাপনে তারা সাহস পায়নি। কিন্তু সমস্যা হল, আমাদের কাজের দায়দায়িত্ব স্থানীয় মুসলমানদের ওপর পড়ে এবং তারা পাইকারীভাবে নির্যাতনের শিকার হয়।
থামল ইউসুফ চিয়াং। আহমদ মুসা তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে থামলে আহমদ মুসা বলল, বর্তমান ক্ষেত্রে তোমাদের ইচ্ছা কি?
-আমরা আমাদের সিদ্ধান্তের বিকল্প দেখি না। একটা বিকল্প হলো চুপ করে থাকা। কিন্তু চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। এক দুই করে তারা পঞ্চাশ লাখ-অমুসলিম হান গোষ্ঠীর লোককে সিংকিয়াং-এ এনে ঢুকিয়েছে। তার ফলে নিজ দেশেই আমরা পরবাসী হবার উপক্রম। আমরা এ অবস্থা চলতে দিতে পারি না।
-বুঝেছি তোমরা কথা। তোমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে ওদেরকে একটা সময় দেবে না?
-না মুসা ভাই, ওটা করতে গেলে পদক্ষেপ গ্রহণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আর স্থানীয় মুসলমানদের উপর জুলুম-অত্যাচার হয়রানি এখনই শুরু হয়ে যাবে।
-বুঝলাম! ঠিক আছে, তাহলে সিদ্ধান্ত অনুসারেই কাজ করতে হবে।
একটু থেমে আহমদ মুসা বলল, বলত, তোমাদের সামনে আশু সমস্যা কি?
-সমস্যা আছে অনেক। তবে দু’টো বিষয়কে আমরা জরুরী ভিত্তিতে হাতে নিয়েছি। এর প্রথমটি হল মসজিদ-মাদরাসাকে কম্যুনিষ্ট খবরদারী থেকে মুক্ত করা। আর দ্বিতীয় হল, মুসলমানরা কম্যুনিষ্ট পার্টির সদস্য না হলে পিওন-ক্লার্কের ওপরের পদে চাকুরী না পাওয়ার যে ব্যাপার চলছে তার প্রতিরোধ করা। বাইরের অন্যায় বসতি বিস্তারের প্রতিরোধের কথা তো আগেই বলেছি। অসহায় মুসলমানদের অভিভাবকত্ব দান এবং ইসলামী চিন্তা ও জ্ঞানের প্রসার প্রচেষ্টার বাইরে এই তিনটি কাজই আমাদের মুখ্য।
আহমদ মুসার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিছু বলতে যাচ্ছিল সে। এমন সময় মা-চু এসে বলল, মেহমানদের নাস্তা দেয়া হয়েছে।
হাসান তারিক বলল, তোমরা সবাই খেতে থাক। আমি মুসা ভাইকে আরেকটা কথা বলে আসি।
মা-চু’র সাথে ওরা তিনজন চলে গেল।
ওরা চলে গেলে হাসান তারিক পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার আহমদ মুসার দিকে তাকাল। মুখটি আবার একটু নিচু করল সে।
-বলবে কিছু নিশ্চয়, বলে ফেল। আয়েশা কেমন আছে তাতো জানাওনি আমাকে? আহমদ মুসার মুখে এক টুকরো হাসি।
হঠাৎ হাসান তারিকের চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ল। দু’হাতে চোখ ঢাকল হাসান তারিক।
-তুমি কাঁদছ হাসান তারিক? তাহলে আয়েশা আলিয়েভার কিছু…….. বিস্ময় ও উদ্বেগ ঝরে পড়ল আহমদ মুসার কন্ঠে।
-না আয়েশার কিছু হয়নি। আমাদের ফারহানা আপা নেই।
-কি বলছ তুমি হাসান তারিক? বিস্ময়ের এক বজ্রপাত হল আহমদ মুসার কন্ঠে।
হ্যাঁ মুসা ভাই, তিনি নেই। জেনারেল বোরিসের লোকরা তাঁকে হত্যা করেছে।
-হত্যা করেছে? ফারহানা নিহত হয়েছে?
বেদনায় শক্ত হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার মুখ। কিছুক্ষণ তার যেন বাক স্ফুরণ হলো না। তার শক্ত এবং স্থির দৃষ্টি হাসান তারিকের দিকে।
হাসান তারিক মুখ নিচু করে আছে।
নিজেকে সামলে নিয়েছে আহমদ মুসা। ধীর গম্ভীর কন্ঠে বলল, কিভাবে এটা ঘটল হাসান তারিক?
হাসান তারিক সেদিনের সব ঘটনা খুলে বলল।
শুনে আহমদ মুসা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। তার শুন্য দৃষ্টিটা জানালা দিয়ে বাইরে নিবদ্ধ ছিল। তার চোখের দু’কোণায় দু’ফোটা অশ্রু চিকচিক করছিল।
অনেকক্ষণ পর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, যাও ভাই খেয়ে এস।
মনে হল আহমদ মুসা অনেক দূর থেকে কথা বলছে।
হাসান তারিক তার দিকে একবার তাকিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
ওরা খেয়ে ফিরে এল।
আব্দুল্লায়েভ আহমদ মুসার দিকে লক্ষ্য করেই বলে উঠল, মুসা ভাই কেমন লাগছে আপনার, খারাপ বোধ করছেন আপনি?
আব্দুল্লায়েভ তখন দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসা উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আব্দুল্লাহ, তুমি আমাকে ফারহানার কথা জানাওনি, তোমার আতিয়ার কথাও জানাওনি।
-মুসা ভাই, অনেকবার মুখে এসেছে, কিন্তু বলতে পারিনি। কথা বের হয়নি।
তার চোখে অশ্রু টলটল করে উঠল। আহমদ মুসার চোখের কোণ দু’টিও আবার ভিজে উঠল।
এই সময় মা-চু ঘরে ঢুকল। বলল, ডাক্তার সাহেব এসেছেন।
আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়িয়ে তার বিছানায় বসতে বসতে ধীর কন্ঠে বলল, তাহলে তোমরা রেস্ট নাও। বিকেলে এস, আমি তোমাদের সাথে একটু বেরুব।
আর মা-চু’র দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, নিয়ে এস ডাক্তারকে।
হাসান তারিক চলে গেল। ডাক্তার এসে প্রবেশ করল ঘরে। ডাক্তার ব্যান্ডেজ পরীক্ষা করে বলল, আর দু’দিন পরে এসে ব্যান্ডেজ পাল্টে দিয়ে যাব।
-আর কয়দিন বাণ্ডেজ রাখতে হবে?
-বাণ্ডেজ পাল্টাবার পর ধরুন আর সাত-আট দিন।
-আমি কি বাইরে টাইরে বেরুতে পারি?
-বাড়ির বাইরে?
-হ্যাঁ।
-গাড়ি করে বাইরে বেরুতে পারেন। তবে এক সাথে বেশী হাঁটা ঠিক হবে না।
হঠাৎ মেইলিগুলির কথা খেয়াল হল আহমদ মুসার। বলল, মেইলিগুলিকে কেমন দেখলেন ডাক্তার সাহেব?
-দু’ আঙুলের মাঝখানে আঘাত। জায়গাটা সেনসেটিভ। একটু সময় নেবে। তাছাড়া কবজি থেকে একটু ওপরে যে আঘাত সেটাও বড়। হাড় কাটেনি বটে, কিন্তু বেশ আহত হয়েছে। এখন আবার আসতে দেখে এলাম জ্বর উঠেছে।
-জ্বর? জ্বরের কারণ কি?
-বুঝতে পারছিনা বিকেলে আবার দেখব।
ডাক্তার বেরিয়ে গেল।
একটু গড়িয়ে নেবার জন্যে শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা। কিন্তু শুয়েই মনে পড়ল মেইলিগুলিকে দেখে আসা দরকার।
উঠে বসল আহমদ মুসা।
মা-চু’কে ডেকে বলল, তুমি মেইলিগুলিকে বল আমি আসতে চাই।
মা-চু চলে গেল। অল্পক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, চলুন।
মেইলিগুলির ঘর। খুব বড় নয়। একপাশে শোবার ডিভান। আর একপাশে পড়ার টেবিল। এপাশেই কোণায় একটি টেলিভিশন। পুরো ঘরটাই লাল কার্পেটে মোড়া।
আহমদ মুসা ঘরে ঢুকল।
মেইলিগুলি শুয়ে ছিল। আহমদ মুসা ঘরে ঢুকতেই সে উঠে বসল।
ডিভানের পাশেই একটা চেয়ার রাখা ছিল। ওখানে গিয়ে বসল আহমদ মুসা। চেয়ারে বসতেই মেইলিগুলির বালিশের পাশে ভাজ করে রাখা একটা জায়নামায আহমদ মুসার নজরে পড়ল।
মেইলিগুলির মুখ শুকনো। নীল চোখ দু’টির মধ্যে একটা ক্লান্তি। একটা বড় চাদরে মাথা ও গা ঢাকা। মেইলিগুলির জন্যে এটা নতুন একটা পরিবর্তন মনে হল আহমদ মুসার কাছে। মেইলিগুলির চুল উস্কো-খুস্কো। চাদরের প্রান্ত পেরিয়ে কিছু চুল এসে কপালে পড়েছে।
চেয়ারে বসতে বসতে আহমদ মুসা বলল, কেমন আছ?
-ভাল
-ডাক্তার বলল, গায়ে তোমার জ্বর উঠেছে। খুব জ্বর?
মেইলিগুলি চোখ তুলল। আহমদ মুসার চোখে চোখ পড়ল। চোখ নামিয়ে নিল আহমদ মুসা।
-খুব জ্বর নয় বোধ হয়।
-ডাক্তার বলল, তোমার কব্জির ওপরে আর এক স্থানেও নাকি একটা বড় আঘাত আছে?
-জ্বি আছে।
-ওটা কিসের আঘাত?
-পেছন থেকে জেনারেল বোরিস ওখানে প্রথম আঘাত করে।
-গুলি করে কখন?
-রিভলভারের বাট দিয়ে আঘাত করার পর আমার হাত থেকে রিভলভার পড়ে যায়। আমি রিভলভার কুড়িয়ে নিয়ে যখন তাকে গুলি করতে যাই, তখন সে গুলি করে।
-তুমি সেদিন জেনারেল বোরিসদের আসা কখন কিভাবে টের পেলে?
মেইলিগুলি উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে থাকল সে।
-তুমি জেনারেল বোরিসদের আসার আশংকা করেছ, একা একা রাতে পাহাড়া দিয়েছ, আমাকে জানাওনি কেন?
-আপনি এসব কার কাছে শুনলেন? দাদী?
-হ্যাঁ।
-আমি এখন বুঝতে পারছি, না বলা আমার ভুল হয়েছে অপরাধ হয়েছে।
-না এমন করে ভাবা আবার তোমার ঠিক নয়।
-কিন্তু এ রাতে যদি কিছু ঘটে যেত তাহলে অপরাধ বোধের যন্ত্রণা থেকে কোন দিনই বাঁচতে পারতাম না।
বলার সময় গলা যেন মেইলিগুলির কিছুটা কেঁপে উঠল।
-এসব ভেবে মন খারাপ করো না, আমাদের সাধ্য কতটুকু। আল্লাহই আমাদের ভরসা।
কথা বলল না মেইলিগুলি।
আহমদ মুসাও কি কথা বলবে আর ভেবে পেল না।
মেইলিগুলিই মুখ খুলল। বলল, আজ তো ডাক্তার আপনার ব্যাণ্ডেজ দেখার কথা ছিল?
-হ্যাঁ দেখেছে।
-কি বলেছে?
আরও সাত-আট দিন ব্যাণ্ডেজ রাখতে হবে। আর ডাক্তার বলেছেন, আমি বাইরে একটু করে বেরুতে পারি।
-বলেছেন ডাক্তার এটা?
-হ্যাঁ।
মেইলিগুলি মাথা নেড়ে বলল, না, হাঁটাহাঁটি করলে সেলাই-এ টান পড়বে, ক্ষতি হবে তাতে।
-গাড়ি করে বেরুনো যাবে ডাক্তার বলেছেন। বেশী হাঁটাহাঁটি তিনিও নিষেধ করেছেন।
একটু থেমে আহমদ মুসা বলল, আজ বিকেলে একটু বেরুব।
-একা?
-না, হাসান তারিকরা থাকবে।
-মেইলিগুলি চুপ করল। কথা বলল না। মনে হল আহমদ মুসার এ সিদ্ধান্ত তার মনঃপুত হয়নি। আহমদ মুসাও এটা বুঝল। বলল সে, না হাঁটাহাঁটি করব না। গাড়ি করে একটু এদিক সেদিক ঘুরে আসব মাত্র।
আহমদ মুসা থামল।
মেইলিগুলি বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
-কি কথা?
-হাসান তারিকরা রাতে বেরিয়েছিল, কোন খারাপ খবর কি তারা এনেছে?
-না তো, তোমাকে বলা হয়নি। তাদের অভিযান আশাতীত সফল হয়েছে। জেনারেল বোরিসের শেষ দু’টো ঘাটিও আমাদের দখলে এসেছে, তার সঙ্গী-সাথী সব শেষ হয়েছে। সে পিকিং চলে গেছে তার আহত হাতটি কেটে ফেলার জন্য।
মেইলিগুলির চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলল না সে। কি যেন ভাবছিল। অবশেষে বলল, কিছু মনে করবেন না, কোন দুঃসংবাদ কি আজ পেয়েছেন আপনি?
-কেন, এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছ কেন?
মেইলিগুলি বলল, প্রশ্ন করার অনুমতি আগেই চেয়ে নিয়েছি।
একটু থামল মেইলিগুলি। তারপর বলল, আপনার চেহারার মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখছি। আর মা-চু বলল, আপনার চোখে সে অশ্রু দেখেছে।
মেইলিগুলির কথার তখনই কোন উত্তর দিতে পারলো না আহমদ মুসা। চোখ বুজল সে। তার মুখ একটা বিষাদ বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
মেইলিগুলি আহমদ মুসার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আহমদ মুসার এই বেদনার্ত পরিবর্তন মেইলিগুলির দৃষ্টি এড়াল না। আহমদ মুসার এভাবে চোখ বুজাটাও তার কাছে বিস্ময়কর লাগল। তাহলে কি বড় ধরনের দু:খজনক কিছু ঘটেছে। আহমদ মুসার মত পর্বত প্রমাণ ব্যক্তিত্ব কোন ধরনের ঘটনায় এমন হতে পারে? বুঝতে পারল না, প্রশ্ন করাই তার ভুল হয়েছে কিনা!
মেইলিগুলি মুখ তুলল। তার বিষণ্ন দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলল, আমি আপনাকে ব্যথা দিয়েছি?
-না মেইলিগুলি। তুমি ঠিকই ধরেছ, আমি একটা দু:সংবাদ পেয়েছি।
-জিজ্ঞেস করতে পারি কি? সেটা কি?
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না। একটু ভাবল। তারপর বলল, ব্যাপারটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত মেইলিগুলি। আমাকে অপহরণ করে নিয়ে আসার পর যার সাথে আমার বিয়ে স্থির হয়েছিল, সে মেয়েটিকেও জেনারেল বোরিসের লোকেরা হত্যা করেছে।
এমন খবর শোনার জন্যে মেইলিগুলিও প্রস্তুত ছিল না। সে সংকুচিত হয়ে পড়ল। বেদনায় বিবর্ণ হয়ে গেল তার মুখ। বুকের কোথায় যেন একটা অস্বস্তিকর খোঁচাও অনুভূত হতে লাগল তার।
দু’জনেই নিরব।
নিরবতা ভাঙল মেইলিগুলিই প্রথম। বলল, মাফ করুন আমাকে, আমি বুঝতে পারি নি।
মেইলিগুলি আর চোখ তুলতে পারলো না।
আহমদ মুসা একটু হাসতে চেষ্টা করল। বলল, ও কিছু না মেইলিগুলি। তুমি ঠিকই ধরেছ। ভাগ করে নিলে দু:খ কমে। দু:খের সাথী থাকলে সান্ত্বনা পাওয়া যায়।
মেইলিগুলি চোখ তুলে চাইল। ওর নীল চোখে যেন এক সাগর বেদনা, আকাশের মত নিসীম এক মমতা।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, ফারহানার অশ্রু ধোয়া এমনি চোখ, বহুদিন আগে ফেলে আসা হিমালয়ের বরফ রাজ্যের বরফ গুহার মুমূর্ষ ফারহানার প্রেম-মমতা-বেদনার সাগর গভীর কালো এমনি এক চোখ।
সম্বিত ফিরে পেয়ে চোখ নামিয়ে নিল আহমদ মুসা। উঠে দাঁড়াল সে।
‘আসি মেইলিগুলি’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
দরজায় গিয়ে ডিভানের ওপর রাখা হাতের ম্যাগাজিনটা নেবার জন্যে ফিরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। কিন্তু দেখল, মেইলিগুলি বালিশে মুখ গুঁজেছে। তার দেহটা ফুলে ফুলে উঠছে। কাঁদছে সে।
আহমদ মুসা আর ঘরে না ঢুকে চলে এল।
ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল আহমদ মুসা। সব চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন বিশ্রাম নেবার জন্যে চোখ বুজল সে। কিন্তু তবু মেইলিগুলির ঐ নিশব্দ কান্নার দৃশ্য ঘুরে ফিরে তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল।

Top