২৩. রাজচক্র

চ্যাপ্টার

ডোনা থাকে তার পিতার সাথে তাদের রয়্যাল প্যালেসে। আহমদ মুসাকেও সেখানে থাকার অনুরোধ করেছিল ডোনার আব্বা মিঃ প্লাতিনি। কিন্তু আহমদ মুসা রাজী হয়নি। যুক্তি দিয়ে বলেছিল, আহমদ মুসাকে খুবই ব্যস্ত থাকতে হবে। তাই স্বাধীনভাবে থাকার একটা জায়গা তার দরকার। তাছাড়া সবচেয়ে গুরুত্ব যে বিষয়চির উপর দিয়েছিল, তাহলো, এবার তাকে কি ধরনের শত্রুর মুখোমুখি হতে হবে তা বলা যাচ্ছে না। ডোনাদের বাড়িটা তাদের নজরে আনা ঠিক হবে না। এই শেষ যুক্তিটায় ডোনার আব্বা রাজী হয়ে যায় আহমদ মুসার সাথে। তবে আহমদ মুসার থাকার ব্যবস্থা ডোনার আব্বাই করে দেয় তাদের সদ্য কেনা একটা বাংলোতে।
সালাম বিনিময়ের পর আহমদ মুসা ডোনাকে রক্ষ্য করে বলল,‘কি ব্যাপার ডোনা, অকস্মাত?’ আহমদ মুসার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাবার পথে উঠলাম। কেন আসতে নেই?’ বলল ডোনা।
ডোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তার শেষ পরীক্ষা দেবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। সামনেই তার পরীক্ষা।
‘তুমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেলিফোন করেছিলে। কিন্তু বলনি তো তুমি আসবে।’
‘তখন ভাবিনি, কিন্তু আসার পথে হঠাৎ মনে হলো কি করছ একটু শুনে যাই। সেই সাথে একটা সারপ্রাইজ দেয়াও হলো।’
‘কিন্তু দেখা নাও পেতে পারতে। দু’এক মিনিট পরে এলে আর দেখা পেতে না।’
‘যাক, সব সময়ই ভাগ্য আমার পক্ষে থাকে। এখন বল, তাড়াহুড়ো করে কোথায় বেরুচ্ছ?’
‘রুশ দূতাবাসে।’
গম্ভীর হলো ডোনা। বলল,‘আমি উদ্বিগ্ন। কে শত্রু কে মিত্র আমি বুঝতে পারছি না। তুমি তো চূড়ান্ত কথা বলে দিয়েছ এসব নিয়ে আমি যেন চিন্তা না করি। নাক না গলাই।কিন্তু তা কি পারা যায়? বল, ঘটনা কোন দিকে গড়াচ্ছে? কি তোমার প্ল্যান? না হলে কিন্তু তোমার পিছু নেব আমি।’
‘দোহাই আল্লাহর। তুমি তা পার। তোমার সব রকম দুঃসাহস আছে। তুমি কিন্তু তা করো না। সেদিন তো সব বলেছি। নতুন তেমন কিছু বলার নেই। আজ সকালে প্যারিস উপকণ্ঠের সেই রহস্যপূর্ণ বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাড়িটা খালি। সাইনবোর্ড টাঙানো ‘বাড়িটি সংস্কারের জন্যে নির্দিষ্ট।’ হতাশ হয়ে ফিরে এসেছি।
‘কি আশা নিয়ে গিয়েছিলে সে বাড়িটিতে?’
‘জাহরা ইভানোভার কাছ থেকে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ কিছু সাহায্য পাওয়া যেতো। তাছাড়া ঐ বাড়ির লোকদের উপর নজর রেখে ওদের নতুন কোন ঘাটির নাগাল পাওয়া যেতো।’
‘জাহরার পিতার নাম কি বলেছিলে?’
‘নিকিতা স্ট্যালিন।’
‘রুশ দূতাবাসে কি জন্যে যাচ্ছ?’
‘যাবার কোন জায়গা নেই বলে। তাছাড়া তিনি টেলিফোন করেছিলেন দেখা করার জন্যে।’
‘ঠিক আছে। ফিরে এসে আমাকে টেলিফোন করো। তোমার দেরি করে ফেললাম, আসি।’
সালাম দিয়ে ডোনা বিদায় নিল।
আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দিল রুশ দূতাবাসের উদ্দেশ্যে।
আহমদ মুসা রুশ রাষ্ট্রদূত পাভেলের ঘরে ঢুকতেই রাষ্ট্রদূত উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানিয়ে বলল,‘এস এস, তোমার অপেক্ষা করছি।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল,‘বলুন।’
‘বলব কি, আমি বড় বিপদে। প্রচন্ড চাপ আমাদের সরকারের তরফ থেকে। ক্যাথারিনকে উদ্ধার করা যায়নি, অন্যদিকে তাতিয়ানাও নিখোঁজ। অথচ আমাদের জাতীয় দিবস ঘনিয়ে আসছে। ঐ দিনই শাসনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে রাশিয়ার নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ব্যবস্থা প্রবর্তন করার সবকিছু ঠিক-ঠাক হয়ে গেছে।’ বলল রাষ্ট্রদূত পাভেল।
‘একটা কথা বলুন তো, রাশিয়ার ভীষণ অর্থনৈতিক দুর্দিন চলছে, এর মধ্যে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে একটা বড় খরচ মাথায় তুলে নিচ্ছে কেন?’
বসল পাভেল। বলল,‘রাজ পরিবারের কাছে যে অর্থ রয়েছে তা দিয়ে রাশিয়া এক যুগ চলতে পারে।’
‘কি বলছেন আপনি, ওরা তো যাযাবর। রাশিয়ায় ওদের কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। বিদেশেও তারা অধিকাংশ ভাড়া বাড়িতে থাকে।’ কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি কিছু জাননা দেখছি। বলশেভিক কম্যুনিস্টরা নিকোলাশ (দ্বিতীয়) এবং তার স্ত্রী পুত্র কন্যাদের হত্যা করেছিল বটে, কিন্তু তাদের ধনভান্ডারের এককণাও তারা পায়নি। সবই জমা রয়ে গেছে রাজ পরিবারের গুপ্ত ধনভান্ডারে।’
‘সেটা কোথায়?’
‘রাশিয়ায়।’
‘তাহলে সেটা তো আপনাদের দখলে।’
‘না। ধন ভান্ডার রাশিয়ায় বটে, কিন্তু কেউ তার সন্ধান জানে না। পৌনে একশ বছর কম্যুনিস্ট সরকার চেষ্টা করেও সে ধন ভান্ডারের সন্ধান পায়নি। আজকের রাশিয়ার জাতীয়তাবাদী সরকারও খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে। আগের রাজধানী পিটার্সবার্গে (পরে নাম হয়েছে স্ট্যালিনগ্রাদ) অথবা তার আশেপাশে কোথাও লুকানো আছে সেই শত শত বছরের সঞ্চিত বিস্ময়কর ধন ভান্ডার।’
‘সেই ধনের লোভেই কি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ব্যবস্থার প্রবর্তন?’
আবারও হাসল পাভেল। বলল, ‘রাশিয়া তার এই দুর্দিনে সেই ধন পেলে বেঁচে যায়, কিন্তু ধনের জন্যে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়। রাশিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যেই একটা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ব্যবস্থার প্রয়োজন।’
‘রাশিয়ার এই প্রয়োজন যতখানি, ততখানি কিন্তু চেষ্টা হচ্ছে না প্রিন্সেস ক্যাথারিনের উদ্ধারের জন্যে।’
‘না, তুমি ঠিক বলনি। আমাদের চেষ্টা ছাড়াও আমরা ফরাশি পুলিশ ও ইন্টারপোলের সাহায্য চেয়েছি। তবে একথা ঠিক যে, কোন কাজেই কোন ফল দেয়নি।’
‘নিকিতা স্ট্যালিন নামে কাউকে চেনেন?’
রাষ্ট্রদূত একটু চিন্তা করে বলল, ‘ঐ নামে উল্লেখযোগ্য কেউ রুশ কমিউনিটিতে নেই।’
‘কিন্তু লোকটা বিখ্যাত ধনাঢ্য ব্যক্তি। বহুদিন প্যারিসে বাস করছেন।’
‘নামটি হয় নকল, নয়তো কোন নকল নামে সে পরিচিত।’
‘জাহরা ইভানোভা নামে তার একটা তরুণী মেয়ে আছে।’
রাষ্ট্রদূত পাভেলের কপাল কুঁচকালো। চিন্তা করে বলল,‘তারও এই নাম নকল হতে পারে, অথবা নকল নামে সে সমাজে পরিচিত।’
আহমদ মুসা কখনও এদিকটা চিন্তা করেনি। সে মিঃ পাভেলের কথার যৌক্তিকতা স্বীকার করল। তবে আহমদ মুসার মনে হলো, সে আসল নামই শুনেছে। তাদের ভিন্ন অফিসিয়াল নাম থাকতে পারে। যে নামে তারা বাইরেও পরিচিত।
রাষ্ট্রদূত পাভেলের ইন্টারকম কথা বলে উঠলঃ স্যার,‘ভ্লাদিমির মায়োভস্কি এসেছেন।’
‘হ্যাঁ, পাঠিয়ে দাও।’ বলল রাষ্ট্রদূত পাভেল।
আহমদ মুসা ‘মায়োভস্কি’ নাম শুনে চমকে উঠল। কিন্তু তার সাথে ভ্লাদিমির যুক্ত থাকায় মনটা আবার ঠিক হয়ে গেল।
দরজায় দু’বার সক হলো।
‘এসো।’ বলল রাষ্ট্রদূত পাভেল।
দরজা ঠেলে প্রবেশ করল ভ্লাদিমির মায়োভস্কি।
তার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। গোটা শরীরে একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল তার।
মায়োভস্কির চোখেও মুহূর্তের জন্যে আঠার মত লেগে গিয়েছিল আহমদ মুসার মুখের উপর। সেই সাথে তার চোখ দু’টি জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু সংগে সংগেই সে সামলে নিল নিজেকে।
রাষ্ট্রদূত পাভেল মায়োভস্কিকে এসো বলেই মনোযোগ দিয়েছিল দিনের কর্মসূচীর দিকে।
চোখ সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে একবার মায়োভস্কির দিকে চেয়ে আহমদ মুসার দিকে মুখ ঘুরিয়ে মায়োভস্কিকে দেখিয়ে বলল,‘ইনি ভ্লাদিমির মায়োভস্কি। এখানে সিকিউরিটি চীফের দায়িত্ব পালন করছেন।’ তারপর মায়োভস্কিকে বলল আহমদ মুসার দিকে ইংগিত করে,‘ইনি মিঃ আবদুল্লাহ। খুব সাহসী ও পরোপকারী ছেলে। প্রিন্সেস ক্যাথারিনের পরিবারের বন্ধু। ক্যাথারিনকে উদ্ধারের ব্যাপারে তার সাহায্য আমরা পেতে পারি।’
আহমদ মুসা ও মায়োভস্কি কারো ঠোঁটেই তখন শুভেচ্ছার হাসি ফুটে ওঠেনি। তবু তারা একে অপরকে হাত তুলে স্বাগত জানাল।
রাষ্ট্রদূত পাভেল মায়োভস্কিকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই সময় তার লাল টেলিফোনটি বেজে ওঠায় বলা হলো না। টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল রাষ্ট্রদূত পাভেল। টেলিফোনে কিছু একটা শুনেই সে বলে উঠল, ‘না লাইন দেবার দরকার নেই। হোল্ড করো। আমিই আসছি ওয়্যারলেসে।’
টেলিফোন রেখে দ্রুত মায়োভস্কির দিকে চেয়ে বলল,‘তোমাকে খোঁজ করছিলাম একটা কথা বলার জন্যে। ওলগা, তার মা ও অন্যান্যরা গেছে সাঁজেলিঁজে’র সান্ধ্য মেলায়। ওলগা আবার অন্য প্রোগ্রামে যাবে। সুতরাং একা পড়বে ওরা। দিন কাল ভাল নয়। তোমার লোকদের ওদিকে খেয়াল করতে বলো।’
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল রাষ্ট্রদূত পাভেল এবং আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল,‘আমি একটা জরুরী কাজে যাচ্ছি। তোমার নাস্তা খেয়ে তারপর যাবে। আর তোমার সাথে কথা শেষ হলো না। তোমাকে আবার ডাকব।’
রাষ্ট্রদূত কথা শেষ করতেই মায়োভস্কি বলে উঠল,‘আমি আসি স্যার?’
‘এসো।’ বলল রাষ্ট্রদূত।
বেরিয়ে গেল মায়োভস্কি।
রাষ্ট্রদূত পাভেলও এগুচ্ছিল দরজার দিকে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,‘আমিও আর বসছি না জনাব।’
‘না। নাস্তা না খেয়ে গেলে মনে করব অসৌজন্যমূলকভাবে আমি চলে গেলাম বলে তুমি অসৌজন্য প্রদর্শন করলে।’ বলল মুখ ঘুরিয়ে রাষ্ট্রদূত পাভেল।
‘ঠিক আছে।’ বলে বসল আহমদ মুসা।
ভালই হলো। আহমদ মুসা নিরিবিলি চিন্তা করার একটু সময়ও চায়।
তার মাথায় তখন চিন্তার ঝড়।
মায়োভস্কি এখানকার কেজিবি (রুশ গোয়েন্দা সংস্থা) প্রধান এবং সেই প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে কিডন্যাপকারীদের একজন। রাষ্ট্রদূত কি তাদের এ ষড়যন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন! বিচ্ছিন্ন তার প্রমাণ কি? মায়োভস্কির সাথে জড়িত নেই তাও যেমন প্রমাণ করা মুস্কিল, তেমনি জড়িত আছে, সেটাও প্রমাণিত নয়। তবে একটা বিষয়, ভাবল আহমদ মুসা, রাষ্ট্রদূত মায়োভস্কিকে আহমদ মুসার সামনে ডাকা কিছুটা প্রমাণ করে রাষ্ট্রদূত ষড়যন্ত্রের সাথে নেই। ডাকলেও আহমদ মুসাকে মুক্ত অবস্থায় বাইরে আসার সুযোগ দিত না।
দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেই আহমদ মুসা নাস্তা সেরে বাইরে বেরিয়ে এল।
গাড়ির দিকে এগুতেই হঠাৎ একটা শঙ্কা ঝড়ের বেগে এসে প্রবেশ করল আহমদ মুসার মনে। তার মনে হলো, মায়োভস্কি আহমদ মুসাকে এখান থেকে মুক্ত মানুষ হয়ে যেতে দেবে তা স্বাভাবিক নয়। আহমদ মুসাকে যেতে দেয়ার অর্থ তাদের নাম-ঠিকানা ফরাসি পুলিশ ও রুশ সরকারের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়া। তাছাড়া তাদের দু’টি বড় বিপর্যয়ের প্রতিশোধের প্রশ্ন তো আছেই।
আহমদ মুসা গাড়ির দিকে এগুতে এগুতেই চারদিকে একবার তাকাল। না, সন্দেহজনক কিছু দেখতে পেল না।
আহমদ মুসা গাড়ির কাছে গিয়ে গাড়ির চারদিক ঘুরে ভেতরটা ভালো করে দেখে নিয়ে গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। প্রথমেই বিস্ফোরক ডিটেকটরের সুইচ অন করে দেখে নিল গাড়িতে কোন বিস্ফোরক পাতা নেই।
গাড়ি স্টার্ট দিল আহমদ মুসা। চলতে শুরু করল গাড়ি।
আহমদ মুসার মন থেকে খুঁত খুঁতে ভাবটা গেল না। তার মনে হচ্ছে, শত্রুর চোখের অস্বস্তিকর ছায়ায় যেন সে দাঁড়িয়ে।
রিয়ারভিউতে চোখ রেখেছিল আহমদ মুসা, কিন্তু অনেক গাড়ির ভীড়ে বুঝা যাচ্ছিল না কিছুই।
রুশ দূতাবাস থেকে দুই কিলোমিটার দূরে বিরাট একটা মোড়। বিভিন্ন দিক থেকে আসা ছয়টি রাস্তার মোহনা এটা।
মোড়ের মুখে এসে গাড়িগুলো বিভিন্ন দিকে যাবার জন্য নির্দিষ্ট লেন দিয়ে এগিয়ে বিভিন্ন ফ্লাই ওভারে ও গ্রাউন্ড ওয়েতে বিভক্ত হয়ে যায়।
ঠিক এই জায়গায় এসে আহমদ মুসা গাড়ির গতি কিঞ্চিত স্লো করে লেন চেঞ্জ করছিল।
হঠাৎ গাড়ির পাঁজরে প্রচন্ড এক আঘাত। সেই আঘাতের সাথে দেহটাও যেন তার চ্যাপ্টা হয়ে গেল, মনে হলো আহমদ মুসার। ছুটে আসা ভাঙা কাঁচের টুকরায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল তার মুখ।
এই আঘাত সামলে উঠার আগেই গাড়ির বাম পাঁজরে আরও একটা ধাক্কা এসে পড়ল। চ্যাপ্টা হয়ে গেল গাড়ি।
প্রায় সাথে সাথেই সামনের উইন্ডস্ক্রীন ভেঙে একজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল ভেতরে। প্রায় সংজ্ঞাহারা আহমদ মুসাকে টেনে বের করে নিয়ে গেল লোকটি।
এ সব কিছুই ঘটল ওলগার চোখের সামনে।
আহমদ মুসার গাড়িকে আর একটি গাড়ি যখন প্রথম আঘাত করল, তখন ওলগার গাড়ি এর সমান্তরালে বিপরীত প্রান্তের লেনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তার অনিচ্ছাতেই যেন তার গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয় গাড়িটি যখন আঘাত করল আক্রান্ত গাড়িটাকে, তখন ওলগার হঠাৎ করে মনে হলো ব্যাপারটা দুর্ঘটনা নয়। গাড়ির আরোহীর হত্যা করাই কি আক্রমণকারীদের টার্গেট? হঠাৎ মায়োভস্কিকে ছুটে এসে উইন্ড শিল্ড ভেঙে ভেতরের লোকটিকে বের করতে দেখে খুশী হলো ওলগা। ভাবল, যাক আক্রান্তের পর উদ্ধার হওয়ার একটা পথ হলো।
মায়োভস্কি যখন আহমদ মুসাকে বের করে নিয়ে আসছিল, তখন মুখটা তার দেখতে পেল ওলগা। চমকে উঠল সে। এ যে মিঃ আবদুল্লাহ! তাকে কে মেরে ফেলতে চেষ্টা করেছিল?
মায়োভস্কি আহমদ মুসাকে নিয়ে দ্রুত তার গাড়িতে তুলল এবং সংগে সংগেই গাড়ি স্টার্ট দিল।
ওলগা ভাবল মিঃ আবদুল্লাহকে মায়োভস্কি নিশ্চয় হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। ওলগাও সিদ্ধান্ত নিল হাসপাতালে যাবার। আবদুল্লাহ একদিন তার নিজের জীবন বিপন্ন করে বাঁচিয়েছিল তাকে এবং তার মাকে। তার দুর্দিনে তার পাশে দাঁড়াতে পারলে ভালই হবে।
ওলগা তার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলল মায়োভস্কির গাড়ির পেছনে। মায়োভস্কির গাড়ি অসাধারণ লাল রংয়ের। তাই অনেক পেছনে পড়েও তার পিছু নেয়া কঠিন হলো না ওলগার।
অনেক ক্লিনিক, হাসপাতাল পেরুল, কিন্তু থামার নাম নেই মায়োভস্কির গাড়ির। তাহলে আব্দুল্লাহকে কি কোন নির্দিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে? হতে পারে।
প্রায় ২০ মিনিট চলার পর মায়োভস্কির গাড়ি একটা সংকীর্ণ গলিতে ঢুকে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়েই হর্ণ দিল মায়োভস্কি। সংগে সংগেই বাড়ির সামনের গেটটি উপরে উঠে গিয়ে গাড়ি ঢুকতে পারে এই পরিমাণ উপরে উঠে স্থির হলো।
মায়োভস্কির গাড়ি দৌড় দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
ভেতরটা এক ঝলক দেখতে পেল ওলগা। বিস্মিত হলো ওলগা, ভেতরে যে কয়জন লোক তার নজরে পড়ল সবার হাতে স্টেনগান।
আরও একটা জিনিস ওলগার নজর এড়ালো না। সেটা হলো, মায়োভস্কির গাড়ি রুশ দূতাবাসের কূটনীতিকের গাড়ি নয়।
অনেক প্রশ্ন এসে ভীড় জমাল ওলগার মনে। কারা আবদুল্লাহকে হত্যার চেষ্টা করল, হঠাৎ মায়োভস্কি কোত্থেকে এল, উইন্ডশিল্ড ভেঙে তাড়াহুড়ো করে উদ্ধারের জন্যে এগুলো কেন, হাসপাতালে না নিয়ে তাকে অস্ত্রধারীদের আড্ডায় আনল কেন, কেন মায়োভস্কি কূটনীতিকের গাড়ি ব্যবহার করেনি। কোন প্রশ্নেরই সদুত্তর খুঁজে পেল না ওলগা।
বাড়িটার পাশেই কয়েকটা গাড়ির আড়ালে গাড়ি পার্ক করে ওলগা নজর রাখছিল বাড়িটার গেটের উপর।
মিনিট দশেক পরেই মায়োভস্কির গাড়ি বেরিয়ে এল। গাড়ির পিছে পিছে পকেটে হাত ঢুকানো দু’জন লোকও বেরিয়ে এসেছে। লোক দু’টি রুশ।
গেট পেরুবার পর গাড়ি রোডের উপর নেবার আগে গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে লোক দু’টিকে লক্ষ্য করে বলল,‘দেখো, সাবধান থেকো। দু’বার কিন্তু জাল কেটে পালিয়েছিল।’
বলেই তীর গতিতে গাড়ি ছাড়ল।
একটু সময় নিয়ে ওলগাও তার গাড়ি ছেড়ে দিল।
মায়োভস্কির শেষ কথাটা কানে আসার সাথে সাথে মুখ ম্লান হয়ে গেল ওলগার। শেষ ঐ কথাটা শোনার পর ওলগার বিন্দু মাত্র সন্দেহ রইল না যে, আবদুল্লাহ লোকটি বন্দী মায়োভস্কিদের হাতে। তাহলে নিশ্চয় মায়োভস্কিরাই সেই এ্যাকসিডেন্টটা ঘটিয়েছিল।
কিন্তু কেন? এই প্রশ্নটি ক্ষতবিক্ষত করল ওলগাকে। আবদুল্লাহর মত বিদেশী লোকের সাথে মায়োভস্কির কি শত্রুতা থাকতে পারে? মায়োভস্কির কথায় মনে হয় আরও দু’বার তারা আবদুল্লাহকে ধরেছিল।
বাড়িতে পৌঁছেও ওলগা আহমদ মুসার চিন্তাটা তার মাথা থেকে দূর করতে পারলো না।
একবার তার মনে হলো, ব্যাপারটা তার আব্বাকে (রাষ্ট্রদূত পাভেল) জানানো উচিত। কিন্তু তার মনে শংকা দেখা দিল, যদি ব্যাপারটার সাথে তার আব্বা অর্থাৎ দূতাবাস জড়িত না থাকে, আর যদি মায়োভস্কির কাজটা বেআইনি হয়, মায়োভস্কির ক্ষতি হবে। এই ক্ষতি ওলগা সহ্য করতে পারবে না।
ওলগা ও মায়োভস্কি পরস্পরকে ভালবাসে।
এই চিন্তা থেকেই ওলগা ব্যাপারটা তার আব্বাকে জানানো ঠিক মনে করল না। অথচ সে জানে, মায়োভস্কির এই কাজের সাথে যদি তার আব্বা অর্থাৎ দূতাবাস যদি জড়িত না থাকে, তাহলে আবদুল্লাহকে বাঁচানোর এটাই সবচেয়ে সহজ পথ।
পরিশেষে সিদ্ধান্ত নিল, ওলগা নিজে গিয়ে মায়োভস্কিকে অনুরোধ করবে আবদুল্লাহকে ছেড়ে দেবার জন্যে। যদি দেখা যায় দূতাবাস এই ঘটনার সাথে জড়িত এবং তার আব্বার অনুমতি ছাড়া মায়োভস্কি তাকে ছাড়তে পারছে না, তাহলে সে তার আব্বাকে অনুরোধ করবে।
সন্ধ্যা ৭ টায় টেলিফোনে কথা বলার পর ওলগা গিয়ে হাজির হলো মায়োভস্কির বাড়িতে।
ওলগা প্রবেশ করতেই মায়োভস্কি উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানিয়ে বলল, ‘ওলগা কিছু হয়নি তো?’ মায়োভস্কির চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘কেন বলছ একথা?’ বলল ওলগা।‘তোমাকে টেলিফোন করে আনরা যায় না, সেখানে তুমি টেলিফোন করে আসবে, সেটা কল্পনাও করতে পারছি না।’
‘এটা কি অবাক হওয়ার মত কাজ?’
‘তোমার ক্ষেত্রে অবশ্যই। অন্যদের চেয়ে তোমার নৈতিকতাটা ভিন্ন।’
‘একে খারাপ মনে কর?’
‘আমার জন্যে আনন্দের, কিন্তু কষ্টকর।’
ওলগা মায়োভস্কির পাশে বসতে বসতে বলল,‘একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।’
‘অনুরোধ নয়, আদেশ কর।’
গম্ভীর হলো ওলগা। একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল,‘আজকে একটা ঘটনা ঘটেছে না?’
‘কি ঘটনা?’
‘তোমরা একজন আহত লোককে নিয়ে গেছ না?’
চমকে উঠল মায়োভস্কি।
স্থির দৃষ্টিতে তাকাল ওলগার দিকে। বলল, ‘তুমি কি করে জান?’
‘কেন আমি দেখেছি। আমি সাঁজেলিঁজে থেকে ফিরছিলাম। আমার গাড়ি তখন ওখানে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল।’
‘কি দেখেছ তুমি?’
‘তোমরা আহত মিঃ আবদুল্লাহকে তুলে নিয়ে গেলে?’ থামল ওলগা।
‘আর কি দেখেছ?’
‘তোমরা তাকে হাসপাতালে না নিয়ে একটা বাড়িতে তুলেছ।’
মায়োভস্কির চোখে-মুখে দেখা দিল উদ্বেগ-আতংকের ছাপ। বলল, ‘তুমি সেখানে গিয়েছিলে কেন?’
‘মনে করলাম মিঃ আবদুল্লাহকে তোমরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছ, তাই তাকে দেখতে গিয়েছিলাম।’
মায়োভস্কি মুখ নিচু করেছে। তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। সেখানে ভয় ও উদ্বেগের ছাপ। কিছুক্ষণ সে নির্বাক থাকল। তারপর বলল,‘তুমি কি বলতে এসেছ?’
‘আমার মনে হচ্ছে, মিঃ আবদুল্লাহকে তোমরা আটক করেছ কোন কারণে। তাকে ছেড়ে দেবার জন্যে অনুরোধ করতে এসেছি। সে একদিন আমাদের জীবন বাঁচিয়েছিল।’
‘আব্বাকে কিছু বলিনি। ভাবলাম, তোমাকে বললে যদি কাজ হয়, আব্বাকে আর বলবো না।’
মায়োভস্বির মুখ থেকে উদ্বেগের ভাবটা একটু দূর হলো। বলল,‘ঠিক করেছ। ভিষয়টা ভিন্ন ধরনের একটা ব্যাপার। তোমার আব্বার জানা উচিত নয়।’
‘ঠিক আছে, বলব না। কিন্তু বল, আমার অনুরোধ রাখবে?’
মায়োভস্কি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল,‘তুমি কি মনে কর নিরপরাধ কোন লোককে আমরা আটকাতে পারি?’
‘না পার না।’
‘জান, লোকটি যে অপরাধ করেছে তাতে তাকে এক মুহূর্ত বাঁচিয়ে রাখা যায় না।’
‘কি অপরাধ করেছে সে?’
‘সব কিছু তোমার জানা ঠিক নয়। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না?’ মায়োভস্কি ওলগাকে কোলে টেনে নিয়ে বলল।
ওলগা এক হাতে মায়োভস্কির গলা পেঁচিয়ে ধরে বলল,‘তোমাকে বিশ্বাস না করলে দুনিয়ায় আর কাকে বিশ্বাস করব বল?’
‘তাহলে শোন, লোকটি ভয়ংকর। বাইরে ভাল মানুষী চেহারা দেখে তার কিছুই বুঝবে না। দেশ ও জাতির স্বার্থে অনেক কিছুই সবার অলক্ষ্যে করতে হয়। এ বিষয়টাও সেই রকম। বুঝেছ তুমি?’
মায়োভস্কির কোল থেকে মাথা তুলতে তুলতে ওলগা বলল,‘বুছেছি। কিন্তু………।’
‘কোন কিন্তু নয়, সে তোমাদের জীবন বাঁচিয়েছিল, সেটা তার একটা রাজনীতি ছিল।’
‘হতে পারে, কিন্তু…………।’
‘আর কোন কিন্তু নয়।’ বলে মায়োভস্কি তাকে নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিল।

শুয়ে ঘুম আসছিল না মায়োভস্কির। এপাশ ওপাশ করছিল অবিরাম।
একটা প্রচন্ড অপরাধ বোধ তাকে ক্ষত-বিক্ষত করছিল। সে ভাবছিল, ওলগার প্রতি তার ভালোবাসা গ্রেট বিয়ারের সুনির্দিষ্ট বিধান ভংগ করতে তাকে বাধ্য করেছে। গ্রেট বিয়ারের নির্দেশ হলো, গ্রেট বিয়ারের সদস্য নয় এমন কেউ গ্রেট বিয়ারের কোন লোক বা গ্রেট বিয়ারের কোন ঘাটি দেখে ফেললে তাকে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। ওলগা মায়োভস্কিকে গ্রেট বিয়ারের লোক হিসেবে চিনতে পারা শুধু নয়, গ্রেট বিয়ারের একটা গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাটি দেখে ফেলেছে। এরপরও মায়োভস্তি তাকে জীবন্ত ছেড়ে দিয়েছে। এত বড় ঘটনা আইভান দি টেরিবলের অবশ্যই অজানা থাকবে না। নিশ্চয় তার এই বাড়ি আইভানের নজরের বাইরে নয়। তার এবং ওলগার কথোপকথন কে জানে এতক্ষণ তার কাছে পৌঁছে গেছে কিনা। কেঁপে উঠল মায়োভস্কি। শয্যা তার কাছে কাঁটা বলে মনে হতে লাগলো।
তাড়াতাড়ি উঠে বসল মায়োভস্কি।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। গ্রেট বিয়ারের দাবীর কাছে তার ভালোবাসার কোন মূল্য নেই। উপায় নেই তার, কোরবানী দিতে হবে তার ভালোবাসাকে।
দ্রুত উঠে গিয়ে টিপয় থেকে মোবাইল টেলিফোন তুলে নিল। ডায়াল করে বলল,‘পেট্রভ তুমি তৈরি হয়ে এখনি এসো।’
টেলিফোন রেখে দিয়ে অস্থিরভাবে পায়চারী করতে লাগল মায়োভস্কি।
মিনিট দশেকের মধ্যে ডার্ক ছাই রংয়ের পোশাকে ঢাকা দীর্ঘদেহী একজন প্রবেশ করল মায়োভস্কির কক্ষে।
মায়োভস্কি ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। তারপর একটা কাগজ লোকটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,‘পেট্রভ বুঝতে পারো কিনা দেখ।’
পেট্রভ নামক লোকটি কাগজটির উপর চোখ বুলিয়ে বলল,‘রাষ্ট্রদূত পাভেলের বাসার ভেতরের স্কেচ। আমাকে ঢুকতে হবে মিস ওলগার কক্ষে। হাতে নিডল গান। তার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর আমাকে তার কক্ষ ছাড়তে হবে।’
মায়োভস্কির মুখের চেহারা পাথরের মত। গম্ভীর কণ্ঠে সে বলল,‘ধন্যবাদ পেট্রভ। পেট্রভ মনে রেখ তোমাকে সফল হতে হবে।’
‘বুঝেছি।’
মায়োভস্কি সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে বলল,‘যাও, তোমার ফেরা পর্যন্ত আমি এখানে বসে অপেক্ষা করবো।’
পেট্রভ বেরুবার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েও থমকে দাঁড়াল,‘স্যার, তাকে যদি কক্ষে না পাওয়া যায়?’
‘তোমার উপর দায়িত্ব তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া, যেখানে পাবে সেখানে।’ কঠোর কণ্ঠে বলল কথাগুলো মায়োভস্কি। কিন্তু বড্ড শুষ্ক শুনাল তার কণ্ঠ।
পেট্রভ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ওদিকে ওলগারও ঘুম আসছিল না। তার ভেতরে অসহ্য এক টানাপোড়েন। মায়োভস্কিকে সে ভালোবাসে। তার কথা সে বিশ্বাস করেছে। যতক্ষণ তার কাছে ওলগা ছিল, ভালই ছিল। কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে, ভেতরের এক টানাপোড়েন তাকে পীড়িত করছে। আহমদ মুসার যে ভয়ংকর রূপ মায়োভস্কি ওলগার কাছে তুলে ধরেছে, সেটা মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। ক্রিমিনালরা যতই তার অপরাধকে ভদ্র পোশাক আর ভদ্র কথার আড়ালে চাপা দিক, তার চোখ ও চেহারার আয়নায় তার যে আসল রূপ প্রকাশ পায় তা সে ঢাকতে পারে না কিছুতেই। আহমদ মুসার কোন কিছুই প্রমাণ করে না যে সে ক্রিমিনাল। আরও একটা কথাকে সে কিছুতেই মিলাতে পারছিল না। আহদ মুসা যদি রাশিয়ার শত্রু কিংবা রাশিয়ার বিবেচনায় কোন ক্রিমিনালই হবে, তাহলে রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে সে বিষয়টা গোপন রাখা হবে কেন? তাঁরই প্রথম জানার কথা। এ গোপনীয়তার অর্থ, কাজটা এমন যা রাষ্ট্রদূতের জানা ঠিক নয়, তিনি এটা পছন্দ করবেন না। এর অর্থ কাজটা বৈধ নয়।
এসব চিন্তার দ্বিমুখী টানাপোড়েনে অস্থির হয়ে উঠেছিল ওলগা। ঘুম ধরছিল না তার চোখে।
ঘর অন্ধকার।
দেয়াল বরাবর পর্দা টানা থাকায় এবং জানালায় গরাদ লাগানো থাকায় যেটুকু আলো আসতে পারতো তাও আসছে না।
হঠাৎ ধাতব ঘর্ষণের একটা অস্পষ্ট টানা শব্দ তার কানে এল। উৎকর্ণ হলো ওলগা উৎসের দিকে।
আবার শব্দ হলো তেমনি অস্পষ্ট। ওলগার বুঝতে বাকি রইল না যে, কেউ জানালার গরাদ এবং কাঁচের জানালা তুলল।
মুহূর্তেই উদ্বেগ ও আতংকের একটা ঢেউ খেলে গেল তার গোটা শরীরে।
পরক্ষণেই সতর্কতায় শক্ত হয়ে উঠল তার দেহ। বালিশের তলা থেকে রিভলবার এবং ক্ষুদ্র একটা টর্চ বের করে নিল। তার ডান হাতের রিভলবার স্থির তুলে ধরল শব্দের উৎস লক্ষ্যে। বাম হাতে তার টর্চ।
শব্দের উৎসের দিকে স্থির নিবদ্ধ তার দু’চোখ দেখল, অন্ধকার নড়ে উঠল এবং এক খন্ড সাদা আলো ফুটে উঠল অন্ধকারের বুকে।
ওলগা বুঝল, গরাদ ও কাঁচের জানালা খুলে কেউ প্রবেশ করছে তার ঘরে।
পর্দা আরও ফাঁক হলো। সেখানে আবির্ভূত হলো এক কালো ছায়ামূর্তি। ওলগা রিভলবারের ট্রিগারে তর্জনি রেখে টর্চের সুইচ অন করল ছায়ামূর্তিকে লক্ষ্য করে।
ঘটনার আকস্মিকতায়ও বিমূঢ় হলো না ছায়ামূর্তি।
টর্চের আলো জ্বলে উঠার সংগে সংগে ছায়ামূর্তি ডান হাত তুলে ধরেছিল। হাতে তার নিডল গান।
নিডল গান থেকে আলপিনের অগ্রভাগের মত এক ঝাঁক গুলী বের হয়। গুলী গুলোর অগ্রভাগ ভয়ংকর বিষাক্ত। বিষাক্ত নিডল কারও চামড়া ভেদ করে রক্ত স্পর্শ করার সাথে সাথে তার মৃত্যু ঘটে। আর এ নিডলগুলো এত শক্তি ও গতি সম্পন্ন যে, একমাত্র লোহার বর্ম ছাড়া সব রকম পোশাকই ভেদ করতে পারে।
ছায়ামূর্তি নিডল গান সমেত তার হাত তুলে স্থির হবার আগেই ওলগার রিভলবার গুলী বর্ষণ করল।
গুলীটি ছায়ামূর্তির বক্ষ ভেদ করল।
ছায়ামূর্তিটি বার কয়েক চক্কর খেয়ে আছড়ে পড়ল মেঝের উপর।
ওলগা টর্চ নিভাল, কিন্তু রিভলবার নামাল না। ছায়ামূর্তির সাথে আরও কেউ থাকতে পারে।
ওলগার রিভলবারের গুলী বর্ষিত হবার পর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রাষ্ট্রদূত পাভেল সহ বাড়ির সবাই ছুটে এল ওলগার ঘরে।
রাষ্ট্রদূত পাভেলই ঘরে আলো জ্বালল। দেখল রিভলবার হাতে ওলগাকে এবং রক্তাক্ত লাশটাকে।
রাষ্ট্রদূত ওলগার তাছে ঘটনা শোনার পর পুলিশে টেলিফোন করে ছায়ামূর্তিটির লাশের দিকে এগুতে এগুতে বলল,‘কে এই লোক?’
মূর্তিটি ভালো করে দেখে বলল,‘লোকটি রুশ কিন্তু অপরিচিত।’
তারপর লোকটির হাতে ধরে রাথা নিডল গান ভালো করে নিরীক্ষণ করে চমকে উঠল রাষ্ট্রদূত। নিডল গানটি যে শুধু রাশিয়াতেই তৈরি তা নয়, নিডল গানে রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি’র নতুন সংকেত চিহ্ন উৎকীর্ণ রয়েছে যা অন্যকেউ না বুঝলেও তিনি দেখেই বুঝলেন।
কেজিবির নিডল গান লোকটির হাতে দেখে তার চোখ-মুখ উদ্বেগে ছেয়ে গেল।
সে তাড়াতাড়ি হাতে গ্লাভস পড়ে লোকটির পকেট সার্চ করল। লোকটির বুক পকেটে প্রথমেই পেয়ে গেল একটি ছোট কাগজ। কাগজটি তার বাড়ির ইন্টরন্যাল ডায়াগ্রাম। যাতে দেখানো হয়েছে ওলগার ঘরে আসার পথ। ডায়াগ্রামের সাথে হাতের লেখার প্রতি নজর পড়তেই ভূত দেখার মত আঁৎকে উঠল রাষ্ট্রদূত পাভেল। হস্তাক্ষর দেখার সাথে সাথেই চিনতে পারলো ওটা মায়োভস্কির হাতের লেখা। তাহলে তো মায়োভস্কিই লোক পাঠিয়েছে ওলগাকে খুন করার জন্যে! কিন্তু কেন? ওলগা ও মায়োভস্কির ঘনিষ্টতা আছে বলেই তো তারা জানে। এর মধ্যে তাহলে এমন কিছু কি ঘটেছে যার জন্যে ওলগাকে তার খুন করার প্রয়োজন পড়েছে? বিষয়টা অস্বাভাবিক মনে হলো তার কাছে। আরও বড় কিছু কি আছে এর পেছনে?
ওলগা তার আব্বার ভাবান্তর দেখে বলল, ‘ও কাগজে কি কিছু পাওয়া গেছে আব্বা?’
রাষ্ট্রদূত পাভেল ওলগার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল,‘মায়োভস্কির সাথে তোমার বড় ধরনের কোন গন্ডগোল হয়েছে?’
ওলগা বিস্ময়ে চোখ দু’টো কপালে তুলে বলল,‘এ সময়ে এ প্রশ্ন কেন আব্বা?’
রাষ্ট্রদূত পাভেল তার স্ত্রী ছাড়া অন্য সবাইকে বাইরে যেতে ইংগিত করল এবং বলল ওলগাকে,‘মায়োভস্কি তোমাকে খুন করার জন্যে এই লোককে পাঠিয়েছিল।’
শুনে ওলগার চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হলো। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না ওলগা।
‘কিছু ঘটেছে তোমার সাথে তার?’ বলল ওলগার আব্বাই।
‘আমার সাথে কিছু ঘটেনি। তবে….।’
বলে একটু থামল ওলগা। তারপর বলল,‘মায়োভস্কি ও তার লোকরা মিঃ আবদুল্লাহকে আহত করে কিডন্যাপ করেছে। আমি তাকে অনুরোধ করতে গিয়েছিলাম তাকে ছেড়ে দেবার জন্যে।’
‘কেন আবদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করেছে? কেমন করে তুমি জানতে পারলে? কেন আমাকে জানাওনি?’ এইভাবে এক সাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করল রাষ্ট্রদূত পাভেল।
ওলগা সব কথা, সব বিবরণ তার আব্বাকে খুলে বলল।
ওলগার কথা শেষ হতেই রাষ্ট্রদূত উঠে দাঁড়াল। দ্রুত গিয়ে টেলিফোন তুলে নিল। নিরাপত্তা বিভাগকে নির্দেশ দিল, এখনি মায়োভস্কিকে আটক করতে এবং বলল,‘পুলিশের সাথে কথা বলে আমি আসছি।’
কিন্তু মায়োভস্কির বাড়ি শূন্য। তাকে পাওয়া গেল না।
তারপর লাষ্ট্রদূত পাভেল পুলিশকে বলে ছুটল আহমদ মুসাকে উদ্ধারের জন্যে। সেখানেও মায়োভস্কিকে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রদূত পাভেল তখনও বুঝেনি, মায়োভস্কির এই ভীমরতির কারণ কি!

ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর।
আহমদ মুসা সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে চোখ মেলল। কিছুই দেখতে পেল না। তার কি ঘটেছে মনে করার চেষ্টা করল।
তার গাড়ির এ্যাকসিডেন্টে সে আহত হয়েছিল। কিন্তু সে জ্ঞান হারায়নি। তারপর মায়োভস্কি তাকে টেনে বের করল। গাড়িতে তুলল। তারপর ক্লোরোফরম ভেজা একটা রুমাল তার নাকে চেপে ধরল। কিছু মনে নেই এরপর।
বুঝা যাচ্ছে, এ্যাকসিডেন্টটা ছিল গ্রেট বিয়ারের পরিকল্পিত। মায়োভস্কি রাষ্ট্রদূতের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার পর যে সময়টুকু পেয়েছিল তা সে এই পরিকল্পনায় ব্যয় করেছে। একটা কিছু সে করবে, রাষ্ট্রদূতের কক্ষ থেকে বেরুবার পর আহমদ মুসারও মনে হয়েছিল। কিন্তু কি করবে সেটা ভাবতে পারেনি।
তাহলে সে এখন গ্রেট বিয়ারের হাতে।
ধীরে ধীরে উঠে বসল সে। সর্বাঙ্গে ব্যথা।
এর মধ্যেও এই ভেবে খুশী হলো যে, তার হাত পা বাঁধা নেই। সম্ভবত তারা সংজ্ঞাহীন লোককে বাঁধার প্রয়োজন অনুভব করেনি।
চারদিকে হাত বুলিয়ে মেঝের কার্পেট ছাড়া আর কিছুই পেল না আহমদ মুসা।
এ সময় পায়ের শব্দ শুনতে পেল সে।
কয়েকজনের পায়ের সেই শব্দ থেমে গেল হঠাৎ।
ওরা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কি? দরজা খুলবে ওরা?
এই জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার মনে উদয় হওয়ার সংগে সংগেই যেভাবে সে মেঝের উপর কার্পেটে পড়েছিল সেইভাবে আবার শুয়ে পড়ল সংজ্ঞাহীনের মত।
খুলে গেল ঘরের দরজা। জ্বলে উঠল ঘরের আলো।
ঘরে প্রবেশ করল স্বয়ং গ্রেগরিংকো, উস্তিনভ এবং আরও দু’জন।
তাদের ঘরে ঢোকার পর পরই একটা ছোট ভ্যানে করে প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে সেখানে আনা হলো।
প্রিন্সেস ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল সংজ্ঞাহীনভাবে পড়ে থাকা রক্তাক্ত আহমদ মুসাকে। আঁৎকে উঠল সে আহমদ মুসার এই অবস্থা দেখে। একটা প্রবল যন্ত্রণা অনুভব করল সে তার হৃদয়ে। বলল সে গ্রেগরিংকোর দিকে তাকিয়ে,‘মিঃ গ্রেগরিংকো, এই লোকটি তো রাজ পরিবারের কেউ নয়, রাজ পরিবারের সাথে সম্পর্কিতও নয়। তাহলে কেন বার বার এইভাবে একে নির্যাতন করছেন?’
‘সম্মানিতা প্রিন্সেস, এ রাজ পরিবারের কেউ না হয়েও সে আমাদের পেছনে লেগেছে। সে এ পর্যন্ত আমাদের যে ক্ষতি করেছে, আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে তার কোন নজীর নেই। এর জন্যে আমাদের দু’টি মূল্যবান ঘাটি ছাড়তে হয়েছে, কয়েক ডজন লোককে হারাতে হয়েছে। একে শতবার হত্যা করলেও আমাদের প্রতিহিংসা মিটবে না। কিন্তু আমরা তাকে হত্যা করিনি। আমরা শুধু তার কাছে জানতে চাই, কেন সে আমাদের পিছু লেগেছে। তাতিয়ানা সম্পর্কে সে কি জানে?’
বলে একটু থেমেই সে উস্তিনভকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এর তো জ্ঞান এখনও ফেরেনি। তাহলে একটু পরেই আমাদের কাজ শুরু করতে হবে, কেমন?’
‘ঠিক বলেছেন।’ বলল উস্তিনভ।
গ্রেগরিংকো ভ্যানের ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল,‘সম্মানিতা প্রিন্সেসকে তাঁর ফ্লাটে নিয়ে যাও।’
সবাই কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
কক্ষ থেকে বেরুতে বেরুতে গ্রেগরিংকো উস্তিনভকে বলল, ‘একটু পর তোমরা এসে একে বেঁধে ছোট ভ্যানে করে নিয়ে যাবে। আমিও যাব প্রিন্সেসের ওখানে। শেষ নাটক ওখানেই হবে।’
কক্ষের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আবার সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার।
আহমদ মুসা আবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। মুখ মাথা ব্যথায় টন টন করছে। শরীরের হাড়গোড়ও যেন গুড়ো হয়ে গেছে।
উঠে বসতেই মাথাটা ঘুরে গেল। মাটিতে দু’হাতের হেলান দিয়ে শরীরটাকে স্থির রাখল সে। এ সময় তাকে দুর্বল হলে চলবে না। প্রবল মানসিক শক্তি দিয়ে দেহের সব শক্তিকে একত্রিত করতে চাইল সে।
ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়াল। অন্ধকার ঘরে পায়চারী করল। আহত শরীরকে চাঙ্গা করতে চেষ্টা করল। ব্যথা জ্বর জ্বর শরীরের বিভিন্ন অংশের স্টিফনেস দূর করতে গিয়ে নতুন ব্যথায় তার মুখ ফুঁড়ে আর্তনাদ বেরিয়ে এল, নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরল সে।
দরজার দিকে পা করে যেভাবে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল, সেভাবেই আবার শুয়ে পড়েছে।
শুয়ে শুয়ে আহমদ মুসা অপেক্ষা করছে আবার সেই পরিচিত পদশব্দের।
অবশেষে সে পদশব্দ শোনা গেল দরজার বাইরে।
দরজা খুলে গেল।
উস্তিনভ, চারজন স্টেনগানধারী এবং একটি ছোট ভ্যান নিয়ে একজন ড্রাইভার-এই ছয়জন প্রবেশ করল ঘরে।
আহমদ মুসাকে একইভাবে সংজ্ঞাহীনের মত পড়ে থাকতে দেখে উস্তিনভ স্টেনগানধারী একজনকে বলল,‘দেখ তো নাড়া দিয়ে, সংজ্ঞাহীন না সে ঘুমুচ্ছে।’
স্টেনগানধারী একজন এগিয়ে বাম হাতে স্টেনগান নিয়ে ডান হাতে আহমদ মুসাকে পরীক্ষা করার জন্যে ঝুকে পড়ল। তার স্টেনগান ধরা বাম হাত খানাও আহমদ মুসার বুকের প্রায় কাছাকাছি।
আহমদ মুসা এমন একটা সময়েরই অপেক্ষা করছিল।
মাটিতে নেতিয়ে পড়ে থাকা আহমদ মুসার দু’টি হাত চোখের পলকে উঠে এল। ছিনিয়ে নিল ঝুকে পড়া লোকটির বাম হাত থেকে স্টেনগান এবং শুয়ে থেকেই গুলী বৃষ্টি করল ওদের লক্ষ্য করে।
উস্তিনভরা বোঝার আগেই সব শেষ। ছয়টি রক্তাক্ত লাশ পড়ল কার্পেটের উপর।
আহমদ মুসা আরেকটি স্টেনগান কুড়িয়ে কাঁধে ফেলে হাতের স্টেনগান বাগিয়ে ধরে ছুটল দরজা পেরিয়ে করিডোর ধরে।
করিডোরের একটা বাঁক ঘুরতেই আহমদ মুসা মুখোমুখি হয়ে গেল মায়োভস্কির। মায়োভস্কির সাথে আরও চারজন। ওদের হাতে স্টেনগান, মায়োভস্কির হাতে রিভলবার।
আহমদ মুসা মুহূর্ত মাত্রও নষ্ট করেনি। মায়োভস্কিদের উপর চোখ পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসার স্টেনগান গর্জে উঠল। এক ঝাঁক গুলী গিয়ে ঘিরে ধরল ওদেরকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ল পাঁচটি লাশ করিডোরের উপর। আহমদ মুসা লাফ দিয়ে লাশগুলো ডিঙিয়ে ছুটল সামনে।
করিডোর দিয়ে ছুটতে গিয়ে উপরের তলায় উঠার সিঁড়ি পেয়ে গেল।
প্রশস্ত সিঁড়ি।
আহমদ মুসা নিঃসন্দেহ যে, প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে উপরের কোন তলায় কোথাও রাখা হয়েছে।
আহমদ মুসা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। শরীর টেনে নিয়ে উঠতে কষ্ট হচ্ছিল।
কয়েক ধাপ উঠতেই উপরের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেল।
সেদিকে চাইতেই দেখল আহমদ মুসা, তিনজন দ্রুত নামছে সিঁড়ি দিয়ে। ওদের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল।
আহমদ মুসার স্টেনগান তখন ডান হাতে ঝুলানো। তোলার সময় নেই।
আহমদ মুসা লাফিয়ে পড়ল নিচে করিডোরে। প্রচন্ড ব্যথা পেল। শরীরের হাড়-গোড় যেন ভেংগে গেল তার। কিন্তু সেদিকে মনোযোগ দেয়ার সময় নেই। করিডোরে লাফিয়ে পড়ে শোয়া অবস্থাতেই গুলী বৃষ্টি করল উপরের সিঁড়ি লক্ষ্যে। ওদিক থেকেও গুলি বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু ওরা আর নামেনি, সিঁড়ির যেখানে ছিল, সেখান থেকেই গুলী বৃষ্টি করছে। সিঁড়ির বাঁক কোন পক্ষের গুলীকেই লক্ষ্যে পৌঁছতে দিচ্ছে না।
গুলী বৃষ্টি অব্যাহত রেখেই আহমদ মুসা গড়িয়ে সরে এল দেয়ালের আড়ালে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল সামনের দিকে।
অল্প এগুতেই একটা বড় দরজা পেয়ে গেল। আর করিডোরটি বাঁক নিয়ে ডান ও বাম দু’দিকে চলে গেছে।
আহমদ মুসা খোলা দরজা পথে ঘরের বিপরীত দিকের দরজা দিয়ে লনে একটা গাড়ি দাঁড়ানো দেখতে পেল। বুঝল এটাই বাইরে বেরুবার পথ।
দরজা পথে ছুটল আহমদ মুসা গাড়ির দিকে। পেছনে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ ছুটে আসছে। কয়েকটি গুলী এসে পেছনে ফেলে আসা দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে।
আহমদ মুসা লনে একটি স্টেনগান ফেলে দিয়ে অন্যটি হাতে নিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। গাড়ির চাবি গাড়ির কি হোলে ঝুলছিল।
আহমদ মুসার গাড়ি যখন রাস্তায় নেমে ছুটতে শুরু করেছে, তখন আহমদ মুসাকে ধাওয়া করে আসা স্টেনগানধারীরা লনে এসে দাঁড়িয়েছে।
ছুটছে আহমদ মুসার গাড়ি। কোথায় ছুটছে, তার কোন চিন্তা আহমদ মুসার মাথায় নেই।
মাথাটা তার ঝিম ঝিম করছে। স্টেয়ারিং হুইলে রাখা তার হাত দু’টি শিথিল হয়ে আসছে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে তার। দেহের সব শক্তি একত্রিত করে হাত দু’টি সবল এবং চোখ দু’টি তার খোলা রাখতে চেষ্টা করছে।
আহমদ মুসার ভাগ্য ভালো যে, তখন রাতের শেষ প্রহর। রাস্তায় গাড়ি তেমন নেই বললেই চলে। তাই নিরাপদে চলতে পারলো অনেক দূর। ছোট ছোট ট্রাফিক বিধি লংঘন হলেও বড় কিছু ঘটলো না।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন চলে এসেছে শিন নদীর তীর অঞ্চলে।
হাত দু’টি আর স্টেয়ারিং হুইলে থাকছে না আহমদ মুসার। চোখের সামনে তার সবকিছু ঘুরছে। আহমদ মুসা বুঝল, আর পারবে না সে এগুতে। দেহের সব শক্তি তার নিঃশেষ। শেষ মুহূর্তে আহমদ মুসা তার পা চেপে গাড়ি দাঁড় করাতে চেষ্টা করলো। পারলো না। গাড়িটা একটা গাছের সাথে ধাক্কা খেল এবং আপনাতেই দাঁড়িয়ে পড়লো।
আহমদ মুসার দেহটা গড়িয়ে পড়ল সিটের উপর।

টেলিফোন পাশে রেখে দু’হাতে মুখ ঢাকলো ডোনা।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top