২৭. মিসিসিপির তীরে

চ্যাপ্টার

সেনেনদোয়া নদী দিয়ে এগিয়ে চলছিল সুন্দর একটি মোটর বোট।
সেনেনদোয়া নদীটি উত্তর বাহী। …. পর্বতমালা থেকে বেরিয়ে গ্রেটভ্যালি হয়ে সেনেনদোয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাশ ঘেঁষে উত্তরে এগিয়ে চলেছে পটোম্যাক নদীতে।
মাঝারী স্পীডে চললেও স্রোতের বিপরীতে চলছে বলে বেশ শব্দ করে পানি কাটছে বোটটি।
বিলাসবহুল ট্যুরিস্ট বোট।
বোটের দোতলার কেবিনে ইজি চেয়ারে বসে আছে ষাটোর্ধ বয়সের প্রফেসর আরাপাহো আরিকারা। ইলিয়া রাজ্যের মিসিসিপি তীরের প্রাচীন রেড ইন্ডিয়ান নগরী ‘কাহোকিয়া’র ‘রেড ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ’ (RIHR)- এর চেয়ারম্যান তিনি। তিনি একজন সম্মানিত রেড ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী।
ছুটির সুযোগে তিনি বেড়াতে বেরিয়েছেন।
তার এক ছেলে ও এক মেয়ে দু’জনেই জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্টবিজ্ঞানের ছাত্র।
তার এই সফরে দুই ছেলেমেয়েও তার সাথী।
নৌ-পথে ভ্রমণের মজার প্ল্যান নিয়ে বেরিয়েছে তারা।
তারা ওয়াশিংটন নগরীর উপকণ্ঠ থেকে ট্যুরিস্ট মটর বোট নিয়ে যাত্রা করেছে। পটোম্যাক থেকে তারা পড়েছে সেনেনদোয়া নদীতে। এ নদী থেকে তারা উঠবে এক্সপ্রেস ওয়েতে। তারপর পশ্চিম ভার্জিনিয়ার চার্লসটন হয়ে তারা যাবে হান্টিংটনে। এখান থেকে ওহাইও নদী পথে তাদের নৌযাত্রা শুরু হবে আবার। ওহাইও হয়ে মিসিসিপি দিয়ে তারা পৌঁছবে কাহোকিয়া।
ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে প্রফেসর আরাপাহো আরিকারা চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছে।
তার ছেলে জিভারো ডেক চেয়ারে বসে মাঝে মাঝে চারদিকে দেখছিল, আবার একটা উপন্যাসে চোখ বুলাচ্ছিল এবং মেয়ে হায়েদা ওগলালা উপরে কেবিনের ছাদে, ছাদ সমান বিশাল ফোম ম্যাটে গড়াগড়ি দিচ্ছে। জিভারো এবং ওগলালা দু’জনেরই উদ্দেশ্য শরীরে কিছুক্ষণ সূর্য্যের তাপ নেয়া।
কেবিনের ছাদে বড়ো কোন আঘাত বা ভারি কিছু পড়ার শব্দ হলো। সেই সাথে ওগলালার চিৎকার।
প্রফেসর আরাপাহো আরিকারা নদী তীরের দৃশ্যের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। তার মনে পড়ছিল, এই উপত্যকা বনাঞ্চলে একদিন রেড ইন্ডিয়ানদের শক্তিশালী সাম্রাজ ছিল। যার কেন্দ্র ছিল মিসিসিপি কেন্দ্রিক সমভূমি অঞ্চল। এই বিশাল অঞ্চলে মোহক নেতা রেড ইন্ডিয়ান বীর হাইওয়াথার নেতৃত্বে ইরিকুইস ইন্ডিয়ানদের শক্তিশালী শাসন গড়ে উঠেছিল। এই রকম নদীগুলোর দু’তীরে এবং বনাঞ্চলে শিকার সন্ধানী রেড ইন্ডিয়ানদের ছিল গৌরবপূর্ণ বিচরণ। প্রফেসর আরাপাহো আরিকারা যেন দেখতে পাচ্ছে সেদিনের তাদেরকে।
মাথার উপরে প্রচণ্ড শব্দ এবং ওগলালার চিৎকারে তার সম্বিত ফিরে এল। সোজা হয়ে বসল সে। বলল হাঁক দিয়ে ছেলেকে লক্ষ্য করে, ‘কি হয়েছে জিভারো?’
বলে নিজেই বেরিয়ে এল কেবিন থেকে ডেকে।
ততক্ষণে জিভারো সিঁড়ি দিয়ে তর তর করে উঠে গেছে কেবিনের ছাদে।
প্রফেসর আরাপাহো আরিকারাও সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উপরে উঠল। বয়স তার ষাটোর্ধ হলেও দেখতে চল্লিশের বেশি মনে হয় না।
প্রফেসর আরাপাহো আরিকারা ছাদের উপর নজর পড়তেই দেখল, একজন যুবক পড়ে আছে ছাদের ফোম ম্যাটের উপর। তার কপালে ক্ষত। রক্ত বেরুচ্ছে সেখান থেকে।
ওগলালা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশেই।
জিভারো ঝুঁকে পড়ে যুবকটিকে পরীক্ষা করছিল।
প্রফেসর আরাপাহো ছাদে উঠতেই জিভারো বলল, ‘আব্বা, লোকটা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে।’
মোটর বোট তখন ব্রীজ থেকে বেশ একটু দক্ষিণে সরে এসেছে।
প্রফেসর আরাপাহো তাকাল ব্রীজের দিকে। কোন মানুষ, কোন গাড়ি কিছুই দেখতে পেল না। যুবকটি কি নিজেই নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল? না কেউ তাকে ফেলে দিয়েছিল?
এসব চিন্তা রেখে যুবকটির দিকে তাকিয়ে প্রফেসর আরাপাহো বলল, ‘যুবকটি এশিয়ান। এবং কপালের আঘাতটি তার বোটে পড়ার ফলে নয়। একে নিচে নিয়ে চল জিভারো।’
‘ঠিক বলেছেন আব্বা। ওর পেছনটা আগে পড়েছে। এখানে কপালে সে আঘাত পায়নি।’ বলল হায়েদা ওগলালা।
বলে ওগলালা একটু থামল দম নেবার মত। তারপর বলল, ‘অল্পের জন্যে আমি বেঁচে গেছি। আমার একদম মাথার কাছেই ও এসে পড়েছে।’
বাপ, বেটা, বেটি তিনজনেই ধরাধরি করে নামাল যুবকটিকে নিচে দু’তলার ডেকে।
নিচ থেকে বোটের একজন স্টাফ এসে দাঁড়িয়েছিল। প্রফেসর আরাপাহো তাকে তাড়াতাড়ি ফাস্ট এইড বক্স আনতে বলল নিচ থেকে।
ফার্স্ট এইড বক্স আনলে প্রফেসর আরাপাহো বক্স থেকে স্পিরিটের শিশি তুলে নিয়ে বলল, ‘এর সংজ্ঞা আগে ফেরানো দরকার।’
বলে সে স্পিরিটে তুলা ভিজিয়ে যুবকটির নাকে ধরে রাখল।
যুবকটি আহমদ মুসা।
প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থাতেই সে লাফিয়ে পড়েছিল ব্রীজ থেকে। আল্লাহর করুনা সে পানিতে পড়েনি, আবার বোটের নরম ম্যাট তাকে বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। কিন্তু বোটে পড়ার পর পুরোপুরি সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে।
স্পিরিটের উদ্দীপক গন্ধে তাড়াতাড়ি সংজ্ঞা ফিরে পেল আহমদ মুসা। চোখ মেলল সে।
প্রথমেই চোখ বুজে গেল আহমদ মুসার। মনে পড়লো তার, সে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার গা ভিজা নয়। তাহলে কি এই বোটের উপর পড়েছিল? এবং সে সংজ্ঞা হারিয়েছিল? কতক্ষণ সময় গেছে? হোয়াইট ঈগলের লোকেরা কোথায়? এরা কারা? চেহারায় এরা রেড ইন্ডিয়ান। কিন্তু পোশাকে ইউরোপিয়ান। তাহলে শিক্ষিত ও শহুরে রেড ইন্ডিয়ান এরা।
আবার চোখ খুলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা চোখ খুললে জিভারো আহমদ মুসার ঘাড়ের নিচে হাত দিয়ে তার মাথা উঁচু করে তুলে ধরল। আর প্রফেসর আরাপাহো এক গ্লাস ব্রান্ডি আহমদ মুসার মুখের কাছে তুলে ধরে বলল, ‘খেয়ে নাও। শরীরটা সবল হবে। ভাল লাগবে তোমার।’
‘গ্লাসে নিশ্চয় ব্রান্ডি অথবা বিয়ার? আমি মদ খাই না।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল প্রফেসর আরাপাহো এবং জিভারো ও ওগলালার চোখে-মুখে।
‘অল রাইট ইয়ংম্যান। এখন কেমন মনে করছ?’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘ভালো জনাব।’ বলে উঠে বসল আহমদ মুসা।
‘বসে থাকতে পারবে? না শুয়ে পড়বে? আহত স্থান থেকে এখনও রক্ত বেরুচ্ছে। তাড়াতাড়ি ড্রেসিং করে দিতে হবে।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
আহমদ মুসা প্রফেসর আরাপাহোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জনাব আপনি কষ্ট করবেন? একটু পর আমিই সব কিছু ঠিক করে নিতে পারব।’
‘তোমার সৌজন্য বোধের জন্যে ধন্যবাদ।’ বলে প্রফেসর আরাপাহো কাজে লেগে গেল।
ড্রেসিং করতে করতে বলল, ‘খারাপ হবে না আমার ড্রেসিং। ভাল ট্রেনিং আছে এ ব্যাপারে আমার।’
ড্রেসিং শেষে আহমদ মুসাকে নিয়ে এল কেবিনে।
আহমদ মুসা নিজেই হেঁটে এল এবং কেবিনের টয়লেটে গিয়ে তার মুখ পরিষ্কার করল। জিভারো এবং ওগলালা পাশে দাঁড়িয়েছিল। জিভারো সাহায্য করতে চাইলে আহমদ মুসা বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাদের, যেটুকু পারা যায় নিজে করাই ভাল।’
কেবিনের টেবিলে বসল সবাই। পরিবেশিত হলো গরম চা।
প্রফেসর আরাপাহো চায়ের কাপ তুলে নিতে নিতে বলল, ‘ইয়ংম্যান, অবশ্যই চাযে তোমার অভ্যেস আছে? নাও।’
‘ধন্যবাদ জনাব।’ বলে চা তুলে নিল আহমদ মুসা।
জিভারো এবং ওগলালাও চায়ে চুমুক দিল।
চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে প্রফেসর আরাপাহো বলল, ‘ইয়ংম্যান, তোমার কপালের আহত স্থানে দু’বার আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। একটা কয়েক ঘণ্টা আগের, আরেকটা তাজা। সত্যি কি তাই?’
‘জ্বি, ঠিক বলেছেন।’
‘তোমার নাম কিন্তু এখনও আমরা জানি না। তুমি কি মুসলিম?’
‘জ্বি। কি করে বুঝলেন?’
‘প্রথমত, তোমার কপালে নামাযের চিহ্ন দেখেছি। দ্বিতীয়ত, তুমি মদ খাও না।’
‘জনাব, নাম জিজ্ঞেস করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই আমি ঠিক নামটা বলতে পারি না।’
‘বুঝেছি। দেখ, আমি কাহোকিয়ার ‘রেড ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ’- এর চেয়ারম্যান। এরা আমার ছেলেমেয়ে। জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।’
আহমদ মুসা ওদের দু’জনের দিকে তাকাল। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনে মনে পড়ল সান ওয়াকার, মেরী রোজ ও শিলা সুসানের কথা। বলল ওদের লক্ষ্য করে, ‘তোমরা কি ঈগল সান ওয়াকারকে চেন?’
সান ওয়াকারের নাম শুনেই দু’জনের চোখ-মুখ যেন নতুন করে জেগে উঠল। তার সাথে কিছুটা মলিন হয়ে উঠল ওগলালার মুখ। একটা বেদনার প্রকাশ সেখানে স্পষ্ট।
ওগলালাই জিজ্ঞেস করল, ‘চিনেন আপনি তাকে?’ কণ্ঠ তার অনেকটা শুকনো।
‘চিনতাম না। তবে একই বন্দীখানায় থাকার সময় তাকে চিনেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘একই বন্দীখানায়? আমরা শুনেছি সে তো হোয়াইট ঈগলের হাতে বন্দী।’
‘আমিও বন্দী ছিলাম হোয়াইট ঈগলের হাতে।’
প্রচণ্ড এক বিস্ময় নেমে এল ওগলালা, জিভারো এবং প্রফেসর আরাপাহোর চোখে-মুখে।
কিছুক্ষণ যেন তারা কিছুই বলতে পারল না।
‘হোয়াইট ঈগল তোমাকে বন্দী করল কেন? শুধু অশ্বেতাংগ বলে নিশ্চয় নয়?’ বলল প্রফেসর আরাপাহো নীরবতা ভেঙে।
‘ঠিক বলেছেন জনাব। আমি ক্যারিবিয়ান দ্বীপাঞ্চলে অশ্বেতাংগ বিশেষ করে মুসলমানদের পক্ষ নিয়েছিলাম, এটাই আসল কারণ। আমার কারণে নাকি ক্যারিবিয়ান অঞ্চলকে শ্বেতাংগকরণের ওদের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, আমাকে বিক্রি করে ওরা বিলিয়ন ডলার উপার্জন করতে চেয়েছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
জিভারো, ওগলাল এবং প্রফেসর আরাপাহোর স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার মুখে নিবদ্ধ। তাদের চোখে বিস্ময় ও কিছুটা সমীহের ভাব।
আহমদ মুসা থামলে সংগে সংগেই প্রফেসর আরাপাহো বলে উঠল, ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড টিভি এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি ক্যারিবিয়ানে ওদের অশ্বেতাংগ বিরোধী ষড়যন্ত্রের কথা। তাহলে তুমিই এসব করিয়েছ বলছ?’
‘আমি কৃতিত্ব দাবী করছি না। ওদের সাথে আমার শত্রুতার কারণ বলেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
প্রফেসর আরাপাহো হাসল। বলল, ‘তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। আমার কথার ঐ রকম অর্থ হওয়ার জন্যে আমরা দুঃখিত।’
বলে একটু থামল প্রফেসর আরাপাহো। থেমেই আবার বলল, ‘হোয়াইট ঈগল তোমাকে বিক্রি করার অর্থ বুঝলাম না।’
‘হ্যাঁ, ওরা আমাকে ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার কাছে কয়েক বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করতে যাচ্ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
প্রফেসর আরাপাহোসহ ওদের তিনজনেরই ভ্রু কুঞ্চিত হলো টাকার অংক শুনে। বলল প্রফেসর আরাপাহো, ‘ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার লাভ?’
‘ওদের সাথে আমার পুরানো শত্রুতা। ইসরাইলে ওদের পতন নাকি আমার কারণে। ওরা প্রতিশোধ নিতে চায় এবং আমাকে হাতে রেখে কয়েকটি মুসলিম সরকারের সাথে দর কষাকষি করতে চায়।’
প্রফেসর আরাপাহোর বিস্ময় বিজড়িত মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘তুমি নিরাপত্তার কারণেই তোমার নাম বলনি। কিন্তু তুমি সাংঘাতিক একটা অস্ত্র তুলে দিলে আমাদের হাতে। ঐ লাভজনক ব্যবসায়ের উদ্যোগ হোয়াইট ঈগলের মত আমরাও নিতে পারি।’
‘আমি নিশ্চিত হবার পরই একথা বলেছি জনাব। কাহোকিয়ার রেড ইন্ডিয়ান সংস্থার কেউ এই ব্যবসা করতে যাবে না।’
‘তুমি কাহোকিয়াকে জান?’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘কিছু কিছু শুনেছি। সান ওয়াকারও কাহোকিয়া এবং আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্টের লোক।’
গম্ভীর হলো প্রফেসর আরাপাহোর মুখ। বলল, ‘তুমি আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্টের বিষয়ে জান?’
‘কিছু কিছু।’
‘ইয়ংম্যান, আমার মনে হচ্ছে তুমি যথার্থ ভাবেই নাম বলায় সতর্কতা অবলম্বন করেছ। প্রয়োজন হলে নামটা তোমার বলো। আপাতত আমি তোমাকে আহমদ মুসা বলেই ডাকব। এখন বলল, কেমন করে বন্দীখানা থেকে এই সেনেনদোয়া নদীর ব্রীজে এলে?’
প্রফেসর আরাপাহোর মুখে আহমদ মুসার নাম শুনে বিস্ময়ে ‘থ’ হয়ে গেল আহমদ মুসা। বলল, ‘আহমদ মুসাকে আপনি চেনেন?’
‘চিনি না জানি। এবং জানি শুধু নয়, আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্টের সকলেই জানে আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা তাদের জীবন্ত মডেল।’
‘ঠিক আছে ঐ নামটায় দিন। কিন্তু নামটা বাইরে দয়া করে বলবেন না। সীমাবদ্ধ রাখবেন আপনাদের তিনজনের মধ্যে।’
প্রফেসর আরাপাহো এবং ওগলালা ও জিভারো কারোরই বুঝতে বাকি রইল না যে, তাদের সামনের যুবকটিই আহমদ মুসা। তাদের তিনজনের বিস্ময় দৃষ্টি গিয়ে আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর।
নীরবতা ভাঙল প্রফেসর আরাপাহো। বলল, ‘আমি খুশী যে আমি ঠিক মানুষকে ঠিক নাম দিয়েছি। আর ঈশ্বরের প্রশংসা করছি যে, তিনি আপনাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এনেছেন এবং আপনার সাথে সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ দিয়েছেন। অধিকার বঞ্চিত রেড ইন্ডিয়ানরা খুশী হবে আপনার আগমনের এ খবরে।’
প্রফেসর আরাপাহোর মুখে এখন ‘আপনি’ সম্বোধনে বিব্রত বোধ করল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমি আপনার ছেলের বয়সের। আমাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করলেই আমি খুশী হবো।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু বয়সে ছেলের মত হলেও ওজন কিন্তু দাদার বয়সের। এ সম্মান তোমাকে না দিয়ে আমরা পারি না।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘আপনার মত মুরুব্বীদের স্নেহ আমার জন্যে বড় সম্মান।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এখন বল সেনেনদোয়া ব্রীজে তোমার আসা এবং তোমার নদীতে পড়ার কাহিনী। আর সান ওয়াকারের খবর কি?’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
আহমদ মুসা তার বন্দী হওয়া, বন্দী অবস্থায় গোল্ড ওয়াটারের ক্লোজ সার্কিট টিভি মনিটরে সান ওয়াকারকে দেখা ও তার পরিচয় পাওয়া, বন্দীখানা থেকে মুক্ত হওয়া এবং সান ওয়াকারকে মুক্ত করা, তাকে নিয়ে বন্দীখানা থেকে বের হওয়া, একটা গাড়ি হাইজ্যাক করে পলায়ন, মেরী রোজ-এর সাথে পরিচয় হওয়া, স্থল ও আকাশ পথে ঘেরাও হয়ে পড়ার পর মেরী রোজ ও সান ওয়াকারকে পালাবার সুযোগ করে দেয়ার জন্যে তাদেরকে নিরাপদ স্থানে নামিয়ে দিয়ে ওদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেবার জন্যে গাড়ি নিয়ে অগ্রসর হওয়া এবং সবশেষে চলন্ত গাড়ি থেকে ব্রীজে লাফিয়ে পড়তে গিয়ে কপালে আবার আঘাত পাওয়া এবং বাঁচার জন্যে প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া ইত্যাদি সব কথা সংক্ষেপে বর্ণনা করল তাদের কাছে।
সম্মোহিতের মত তারা শুনল সব কথা। বিস্ময় ও প্রশংসার প্রশ্রবণ তাদের চোখে মুখে।
আহমদ মুসা থামতেই ওগলালা বলল, ‘সান ওয়াকার অসুস্থ। সে পালাতে পারবে?’ ওগলালার কণ্ঠে উদ্বেগ ঝরে পড়ল।
‘পারবে। সাথে মেরী রোজ আছে। এবং আমার ধারণা শিলা সুসানও তাদের খোঁজে আসছে।’
‘তার কি ওয়াশিংটনে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে?’ ওগলালা বলল।
‘আমি মনে করি, ঠিক হবে না।’
‘কিন্তু মেরী রোজরা তাকে ওয়াশিংটনেই ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করবে?’
আহমদ মুসা ওগলালার কথার মধ্যে সান ওয়াকারের প্রতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনুরাগ এবং মেরী রোজ-এর প্রতি বিরাগ লক্ষ্য করল। এটা কি সান ওয়াকারের সাথে তার কোন বিশেষ সম্পর্কের ইংগিত দেয়? না এটা রেড ইন্ডিয়ান সান ওয়াকার, আর শ্বেতাংগ মেরী রোজ-এর প্রতি তার স্বাভাবিক মনোভারের প্রকাশ? কোনটা ঠিক বুঝতে পারল না আহমদ মুসা।
বলল আহমদ মুসা, ‘আমার মনে হয় তারা নিরাপত্তার দিকটা ভেবেই সিদ্ধান্ত নেবে।’
‘আপনি’ সেনেনদোয়ার ব্রীজে গাড়ি থামিয়ে না নেমে লাফিয়ে পড়তে গেলেন কেন?’ বলল জিভারো।
‘ওরা আমাকে তিনটি গাড়ি ও হেলিকপ্টার নিয়ে তাড়া করছিল, বুঝতে পারছিলাম, গাড়ি চালিয়ে বা গাড়ি থেমে নেমে ছুটে পালিয়ে ওদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে না। এই সময় পেয়ে গেলাম ব্রীজ। সিদ্ধান্ত নিলাম নদী দিয়ে পালাব। কিন্তু এই পালানো নিরাপদ করতে হলে ওদের বুঝতে দেয়া যাবে না যে আমি নদী দিয়ে পালিয়েছি। তা করতে হলে গাড়ি ব্রীজের উপর রাখা যাবে না, গাড়ি পাঠাতে হবে ব্রীজের ওপারে। ড্রাইভার বিহীন চলন্ত গাড়ি নিশ্চয় ওপারে গিয়ে এ্যাকসিডেন্ট করবে। ওরা বুঝবে এ্যাকসিডেন্ট করেছি, তারপর পালিয়ে গেছি। সে জন্যেই গাড়ি স্পীডে রেখে গাড়ি থেকে ব্রীজে লাফিয়ে পড়েছি। এ কৌশল কাজ দিয়েছে। সম্ভবত নদীর দিকে কেউ ওরা আসেনি। ওদের হেলিকপ্টার স্থলাঞ্চল ঘুরে বেড়াচ্ছে, নদীর উপর একবারও আসেনি।’
‘সাংঘাতিক উপস্থিত বুদ্ধি আপনার।’ বলল জিভারো।
‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি কোন রোমাঞ্চ কাহিনী পড়ছি। আপনি যদি আপনার কাহিনী লিখতেন দারুণ বিক্রি হতো।’ ওগলালা বলল।
চা’র পর নাস্তাও খেল তারা ঐ টেবিলে বসেই।
বেশ অনেকক্ষণ থেকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেনি প্রফেসর আরাপাহো। ভাবছিল সে। একসময় বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘ঈগল সান ওয়াকার রেড ইন্ডয়ানদের সমকালিন শ্রেষ্ঠ প্রতিভা। আমি ভাবছি, এ প্রতিভার কি হবে? সেতো এখন কোথাও নিরাপদ নয়।’
আহমদ মুসা মুখ খোলার আগেই ওগলালা বলে উঠল, ‘আব্বা তার এ বিপর্যয়ের কারণ মেরী রোজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই বলাবলি করছে, মেরী রোজ সান ওয়াকারের ঘনিষ্ঠ হওয়াকে বর্ণবাদীরা মেনে নেয়নি। মেরী রোজ থেকে সান ওয়াকারকে বিচ্ছিন্ন করে বিদেশে কোথাও পাঠিয়ে দেবার জন্যেই হোয়াইট ঈগল সান ওয়াকারকে কিডন্যাপ করেছে। বলাবলি হচ্ছে, সান ওয়াকার যদি মেরী রোজ-এর সাথে সম্পর্ক না রাখে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনও সময় আর ফিরে আসতে চেষ্টা না করে, তাহলে সান ওয়াকারকে তারা পৃথিবীর কোনও দেশে পাঠিয়ে দেবে।’ ওগলালা থামল। তার কণ্ঠে ক্ষোভ ও অভিমান ঝড়ে পড়ল। সেই সাথে অব্যক্ত এক আবেগে লাল হয়ে উঠেছে তার মুখ।
‘আমি সান ওয়াকারকে জানি। সে এসব শর্তের কোনটাই মানবে না। জীবনের বিনিময়েও নয়। সুতরাং তার অবস্থা বিপজ্জনক, সে কথাই আমি ভাবছি।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘বর্ণবাদীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ শ্বেতাংগীনি মেরী রোজকে সান ওয়াকারের দিকে ঠেলে দেয়, সান ওয়াকারকে দিয়ে তাকে হিপনোটাইজ করে তারা এই সর্বনাশ……..।’
কান্নায় অবরুদ্ধ উচ্ছ্বাসে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল। কথা শেষ করতে পারলো না ওগলালা।
রুমালে মুখ চাপা দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, ‘সান ওয়াকারকে সে দু’চোখে দেখতে পারতো না, কত অপমান ও লাঞ্ছনা যে সান ওয়াকারকে করেছে। তারপর হঠাৎ তার রাতারাতি পরিবর্তন হওয়া একটা ষড়যন্ত্র।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলে সে ছুটে পালাল।
মুহূর্তকাল নীরবতা।
নীরবতা ভেঙে প্রফেসর আরাপাহো বলল, ‘কিছু মনে করো না আহমদ মুসা। ও খুব ইমোশনাল এবং জেদী। কিন্তু আবার ঠান্ডা হতেও দেরী হয় না।’
‘বুঝতে পেরেছি। কিন্তু একটা জিনিস আমি বলতে পারি। সান ওয়াকারকে কিডন্যাপ যে কারণেই করুক। কিন্তু এখন তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্টে-এর কাহোকিয়া সম্মেলনে তার ভূমিকা।’
‘সে তো ছাত্র মাত্র। কোন কর্মকর্তা সে তো নয়, মুভমেন্টের!’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘সম্মেলনের দাবী-নামা নাকি তার ড্রাফটিং।’
‘হোয়াইট ঈগল এটাও জানতে পেরেছে?’ প্রফেসর আরাপাহো বলল।
‘তারা সান ওয়াকারের কাছে জানার চেষ্টা করছিল ‘এইম’ (AIM-আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট)- এর সেন্ট্রাল কমিটির নবনির্বাচিত সদস্যদের নাম।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সান ওয়াকারতো এসব বলে দেয়ার মত ছেলে নয়। প্রফেসর আরাপাহো বলল।
‘সুতরাং সান ওয়াকারের ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। ইতিমধ্যেই তার উপর দৈহিক নির্যাতন চালানো হয় অনেক। সে হয়তো বাঁচতো না ওদের হাত থেকে।’
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। তোমাকেও ধন্যবাদ। সে বেঁচে গেছে।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘হ্যাঁ, এ যাত্রা বেঁচে গেছে।’
‘ঠিক বলেছ, তার বিপদ সামনে আরও আছে। খুবই দুঃসংবাদ এটা আমাদের জন্যে।’ প্রফেসর আরাপাহো বলল।

পরদিন সকাল।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top