৩০. এক নিউ ওয়ার্ল্ড

চ্যাপ্টার

সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। পটোম্যাক বে’র একটি ছোট্ট দ্বীপ। দ্বীপের পুব প্রান্তের পানি ঘেঁষে একটা সুন্দর বাংলো।
ওয়াশিংটনের বে’ এলাকায় এধরনের বাংলোগুলোর মালিক রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক ভিআইপি’রা।
বাংলোটির ঘাটে একটা সুদৃশ্য বোট এসে ভিড়ল।
বোট থেকে নামল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন। তিনি এখন রিটায়ার্ড। কদিন আগেও জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ্যাডমাস হ্যারিসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা। ইহুদীবাদীদের সাথে অন্যায় অপরাধমূলক যোগসাজসের কারণে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন একাই বোট ড্রাইভ করে এসেছে। বোট থেকে তীরে নেমে সে একবার বে’র দিকে তাকিয়ে দেখল কেউ তাকে অনুসরন করছে কি না, কাউকে সে দেখল না। নিশ্চিন্ত হয়ে পা বাড়াল বাংলোর দিকে।
বাংলোটি ‘কাউন্সিল অব আমেরিকান জুইস এসোসিয়েশনে’র চেয়ারম্যান ডেভিড উইলিয়াম জোনস এর একটি অবকাশ কেন্দ্র।
বাংলোটির চারদিকেই বাগান। বাগানের চারদিকে উঁচু প্রাচীর।
বাগানের মাজখানে টিলামত উঁচু বেদির উপর তৈরী দুতলা বাংলোটি।
বে থেকে বাংলোটিকে দেখা যায় ছবির মত সুন্দর। আবার বাংলো থেকে বে’র সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় খুব ঘনিষ্ঠভাবে।
ঘাটের উপর দাঁড়িয়েছিল একজন সুবেশধারী লোক। জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন বোট থেকে নেমে এগুতেই লোকটি এগিয়ে এল তার দিকে। সসম্মানে সম্ভাষণ বিনিময় করে বলল, ‘স্যার আমি মি. জোনস-এর সেক্রেটারী। জেনারেল শ্যারন এসেছেন। ওরা আলোচনায় বসে গেছেন।’
‘গুড। আমার একটু দেরী হলো পৌঁছাতে।’ বলল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন।
‘চলুন স্যার’
দুজনে হাঁটতে শুরু করল বাংলোর দিকে।
বাংলোতে প্রবেশ করে কয়েকটা দরজা ও কয়েকটা করিডোর পেরিয়ে অবশেষে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ডেভিড উইলিয়াম জোনস- এর সেক্রেটারী।
দরজায় নক করল মি. জোনস-এর সেক্রেটারী।
মুহূর্তকাল পরে দরজা খুলে গেল। দরজায় দেখা গেল স্বয়ং মি. জোনসকে।
মি. জোনস স্বাগত জানাল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে এবং হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল।
দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
বেশ বড়-সড় ঘর।
একা সোফায় বসে আছে শ্যারন।
উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল জেনারেল শ্যারন জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে।
ঘরে অনেকগুলো সোফার সেট বিভিন্ন ডিজাইনে সাজানো। তারা গিয়ে বসল মুখোমুখি সাজানো তিনটি সোফায়।
একটু নিরবতা।
নিরবতা ভাঙল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘মি. জেনারেল হ্যামিল্টন, আপনার যোগাযোগের কতদূর?’
‘বলল, কিন্তু তার আগে বলুন এসব কি ঘটছে, আহমদ মুসা ও ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট-এর সংযোগ আগেই ঘটেছিল, এখন দেখা যাচ্ছে হোয়াইট ইগলও আহমদ মুসার সাথে এক হয়ে গেছে। আপনারা জানালেন, মিয়ামী বন্দরের পথে আহমদ মুসা, গোল্ড ওয়াটার, বেঞ্জামিন বেকনরা গাড়ি বিস্ফোরণে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু উল্টো দেখা গেল তারাই জ্যাকসন ভীলে গিয়ে আপনাদের লোকজনদের হত্যাকরে আপনাদের মূল্যবান বন্দিনীদ্বয়কে মুক্ত করে নিয়ে গেল। তারপর ….।
জেনারেল শ্যারন আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘মি. জেনারেল হ্যামিল্টন, এটা আমাদের সাংঘাতিক একটা সেট ব্যাক। কিন্তু মি. হ্যামিল্টন আপনাকে স্মরণ রাখতে হবে, আমাদের সাথে সংঘাতে এসেছে আহমদ মুসা। যার বিবেচনা শক্তিটা অলৌকিক। মিয়ামী বিমান বন্দরের বাইরে আহমদ মুসার টিমটাকে ধ্বংস করার পরিকল্পনায় আমাদের ত্রুটি ছিল না। আহমদ মুসার টিমকে যে গাড়ি বহন করার কথা সে গাড়ি ঠিকই বিমান বন্দরে গেছে ওদের আনার জন্যে। বিমান বন্দরের টারমাকে ঢুকেছে ওদের বিমানের কাছে। তারপর শেড দেয়া কাঁচ তুলে গাড়িটি বেরিয়ে এসেছে বিমান বন্দর থেকে। তারা গাড়িতে নেই, বা উঠেনি এটা ধারণা করার কোনই অবকাশ ছিল না। গাড়িটা পরিকল্পিত স্থানেই এসে ধ্বংস হয়েছে। সুতরাং আমাদের লোকদের পরিকল্পনা ও চেষ্টার কোন ফাঁক ছিল না। কিন্তু আহমদ মুসারা কেন যে গাড়িতে উঠল না, কেন যে তারা খালি গাড়িটি ঐ ভাবে পাঠিয়েছিল সেটা একটা বিস্ময়। এমন বিস্ময়কর কান্ড ঘটাবার শক্তি আহমদ মুসার আছে এবং এটাই আমাদের বিপর্যয়ের কারণ। আর জ্যাকসন ভীলে যা ঘটেছে তা খুবই সোজা। মিয়ামীর খবর তাদের কাছে পৌছার পর তারা স্বাভাবিকভাবেই অসতর্ক ছিল। তার উপর বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমাদের পুরনো একজন পরিচারিকা।’
থামল জেনারেল শ্যারন।
সে থামতেই জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন বলে উঠল, ‘কিন্তু মি. জেনারেল, মন্টিসেলোর কি ব্যাখ্যা দেবেন। আমার মতে সর্বজনমান্য জেফারসন-পরিবারে আপনাদের এইভাবে হাত দেয়া ঠিক হয়নি। তারপর সেখানে লজ্জাজনক ব্যর্থতা, আপনাদের ডজন-দেড়ডজন লোকের লাশ সরকারের হাতে যাওয়া আমাদের জন্যে খুবই ড্যামেজিং হয়েছে। সারা জেফারসনের বিরুদ্ধে একবার নয়, দুবার নয়, আপনাদের তিনটা আক্রমণই ব্যর্থ হলো। শেষবারে আপনাদের সবাই সেখানে লাশ হয়ে পড়ে থাকল। জ্যাকসন ভীলে অসতর্ক থাকার কারণে হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে আপনাদের বিপর্যয় ঘটল। কিন্তু মন্টিসেলোতে কি ঘটল? ওখানে আপনারা ছিলেন পরিকল্পিত আক্রমণে। আর ওপক্ষে ছিল কার্যত দুজন মহিলা একজন পুরুষ।’ থামল জেনারেল হ্যামিল্টন।
জেনারেল শ্যারন বিব্রত, বিমর্ষ। ধীরে ধীরে বলল, ‘মন্ডিসেলোতে সারা জেফারসনকে হত্যার উদ্যোগ নেয়া ছাড়া আমাদের কোন উপায় ছিল না। ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে আসছে। আহমদ মুসা ও হোয়াইট ঈগলের শক্তি মূলত অস্ত্র ও বুদ্ধির লড়াইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট রাজনৈতিকভাবেও অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রভাবশালী। অথচ আমাদেরকে বাঁচাতে হলে রাজনৈতিক লড়াই-এ আমাদের জিততে হবে। সুতরাং ‘ফ্রি আমেরিকান’ মুভমেন্টকে পঙ্গু করে দেয়া এখন আমাদের প্রধান কাজ। এ জন্যেই ‘ফ্রি আমেরিকা’র নেত্রী সারা জেফারসনকে আমরা হত্যা করতে চেয়েছিলাম। আমরা জানি, ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের মূল শক্তি হলো সারা জেফারসনের নতুন আমেরিকা গড়ার স্বপ্ন। এ স্বপ্ন সারা জেফারসন আহরণ করেছে তার গ্রান্ড দাদু টমাস জেফারসন এবং আমেরিকান ফাউন্ডার ফাদারদের ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেডেন্স’ থেকে। এই স্বপ্নই আমেরিকায় আমাদের মূল শত্রু। তাদের স্বপ্ন সার্থক হলে আমেরিকা ঘিরে আমাদের যে স্বপ্ন সে স্বপ্ন ব্যর্থ হবে। সুতরাং আমাদের মূল আদর্শিক শত্রু সারা জেফারসন। তাই তাকে হত্যার একটা সর্বাত্মক আয়োজন আমরা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আহমদ মুসা সেখানে গিয়ে ঠিক সময়ে হাজির হয়েছে।’ থামল জেনালের শ্যারন।
জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই কথা বলে উঠল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। বলল, ‘মি. শ্যারন, আমাদের নতুন আমেরিকা ও নতুন বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন এবং নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার মাথায় নতুন আমেরিকাকে স্থাপন করার যে কর্মসূচি সে বিষয়ে কি জেনারেল হ্যামিল্টন অবহিত? হাসল জেনারেল শ্যারন। বলল, জেনারেল হ্যামিল্টন বিষয়টি আমাদের অনেকের চেয়ে বেশি জানেন শুধু তাই নয়, এ স্বপ্ন সফল করার ব্যাপারে আমাদের অনেকের চেয়ে তিনি অনেক বেশি একনিষ্ঠ।
বিস্ময় ফুঠে উঠল ডেভিড উইলিয়াম জোনসের চোখে মুখে। বলল, ‘অবাক করলেন জেনারেল শ্যারন। ঘটনাটা কি?
‘জেনারেল হ্যামিল্টনের মা তাকে এ তালিম দিয়ে গেছেন। তাঁর কাছ থেকেই জেনারেল হ্যামিল্টন পান আমাদের ঐতিহাসিক দলিলের একটা কপি। সুতরাং জেনারেল হ্যামিল্টন তাঁর ইহুদী মা’র কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন আমাদের নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার কর্মসূচী।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘নিঃসন্দেহে বড় একটা সুখবর এটা। আমার মনে হয়, ফরেন রিলেশন্স বিষয়ক ‘সিনেট স্ট্যান্ডিং কমিটি’র চেয়ারম্যান দানিয়েল ময়নিহান এবং ইন্টেলিজেন্স বিষয়ক ‘হাউজ সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান এ্যান্ড্রু জ্যাকবসকে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা দরকার। তাহলে তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য আরও বেশি পাওয়া যাবে। দুজনেই কিন্তু প্রকৃতির দিক দিয়ে হিটলারের মতই ওভার এ্যাম্বিশাস।’ ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলল।
সংগে সংগেই কথা বলে উঠল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন, ‘মি. জোনস ওদের সাথেই তো যোগাযোগের দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন জেনারেল শ্যারন।’
‘ব্রাভো, ব্রাভো!’ বলে চিৎকার করে উঠল ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং বলল, ‘যোগাযোগ আপনার হয়েছে?
‘হ্যাঁ, গত রাতে ওদের দুজনের সাথেই কথা বলেছি। আজ রাত এগারটায় ওদের সাথে আপনাদের নিয়ে এ্যাপয়েন্টমেন্ট।’
‘ওয়ান্ডারফুল, ওয়ান্ডারফুল মি. জেনারেল হ্যামিল্টন। এজেন্ডা ঠিক হয়েছে? ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলল।
‘হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করার জন্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন। এ এজেন্ডার কথা জেনারেল শ্যারন আগেই আমাকে বলে দিয়েছিলেন।’ বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
‘কিন্তু এজেন্ডার সাথে ‘নতুন আমেরিকা’ ও ‘নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থা’র বিষয়টিকেও রাখতে হবে। তারা উৎসাহিত হবেন।’ ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলল।
‘দেখবেন বিষয়টা আলোচনায় এমনিতেই এসে যাবে।’ বলল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন।
কথাটা শেষ করেই জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন আবার বলে উঠল, এজেন্ডা নিয়ে আপনারা যথেষ্ট ভেবেছেন তো? সাপের লেজে পা দিলে কিন্তু বিপদ। একচোটেই সাপের মাথাটা ধরে ফেলতে হবে। জনমত হবে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। এজন্যে জনবল, অর্থবল দুই-ই কিন্তু লাগবে।’
‘ভাববেন না। আমরা সবদিক দিয়েই প্রস্তুত।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘ইহুদী নয় এমন সংস্থা সংগঠনের সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়া হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে আপনারা কি ভেবেছেন? জেনারেল হ্যামিল্টন বলল।
‘আপনি জানেন, প্রটেস্ট্যান্টদের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগঠন সেফ ওয়ে সেভিয়ার’ গ্রুপ আমাদের দীর্ঘ দিনের সহযোগী। তাদের নেতা ‘জন জেরা’ টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘টাইম উইথ গড’- এর জনপ্রিয় টকার হিসাবে আমাদেরকে অমূল্য সাহায্য দিয়ে আসছেন। তবে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো, আমাদের প্রতি ভারতীয় গ্রুপের সমর্থন। তাদের একটা শীর্ষ বৈঠকে আজ আমি গিয়েছিলাম। আহমদ মুসার আমেরিকায় আগমন এবং তার প্রতি এফ বি আই ও সি আই এ প্রধান ও প্রেসিডেন্টের সমর্থনের সংবাদে তারা আমাদের চেয়ে উত্তেজিত। তারা জনবল, অর্থবল, তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি সবকিছু দিয়ে আমাদের সাহায্য করবে। সব সময়ই এই ভারতীয়রা আমাদের সহযোগী। কিন্তু এখন তাদের একটি সাহায্য পাওয়া যাবে এ বিষয়টা নিশ্চিত।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
‘থ্যাংক গড, জেনারেল শ্যারন। আজকের সময়ের জন্য খবরগুলো সত্যিই অমুল্য।’ বলল জেনারেল আলেকজান্ডার।
‘কিন্তু সমস্যা হলো, সেনাবাহিনীতে বিশেষ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও শীর্ষ অপারেশন পর্যায়ে আমাদের কোন লোক নেই।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘বিগ্রেডিয়ার স্টিভকে হারানো আপনাদের ঠিক হয়নি। সেও খুব বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। পেন্টাগন যে কতবড় সেনসেটিভ জায়গা সেটা সে মনে রাখেনি। তার ফলেই এই সেট ব্যাকটা।’ জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন বলল।
‘এখানেও সর্বনাশের হোতা আহমদ মুসাই। অনুসন্ধান থেকে আমরা জেনেছি, টেলিফোনে আঙুলের মুভমেন্ট দেখেই আহমদ মুসা ধরে ফেলে পেন্টাগনের বাইরে কোথাও সে টেলিফোন করছে। তারপর টেলিফোনে বিগ্রেডিয়ার স্টিভের কথার দুএকটা থেকেই সে সন্দেহ করে বলে’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘যাই হোক, এই ঘটনা সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। সেনাবাহিনীর ইহুদী অফিসারদের মধ্যে ইহুদীবাদী কারা তা চিহ্নিত করার জন্যে জরুরী তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। এক বিগ্রেডিয়ার স্টিভের ঘটনা সব ইহুদী অফিসারকেই আজ সন্দেহের মুখে ঠেলে দিয়েছে।’ জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন বলল।
‘আমাদের দুর্ভাগ্য জেনারেল। আহমদ মুসা আমাদের শনি হিসাবে আমেরিকায় আবির্ভূত হবে কে জানত। যাক, যা হবার হয়েছে। আর যাতে ওরা এগুতে না পারে সেটাই নিশ্চিত করতে হবে। বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আমরা যে পুরো ঘটনাকে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে দিতে চাই, এ ব্যাপারে এ্যান্ড্রু জ্যাকবস এবং দানিয়েল ময়নিহান কিছু বলেছেন? জিজ্ঞেস করল ডেভিড উইলিয়াম জোনস জেনারেল হ্যামিল্টনকে।
‘প্রসঙ্গটি এ্যান্ড্রু জ্যাকবস নিজেই তুলেছিলেন। বলেছিলেন, বিষয়টা মিডিয়াতে যাচ্ছে না কেন? আমি বলেছিলাম, এ ব্যাপারে একটা পরিকল্পনা তৈরী হয়েছে। আপনাদের সাথে বৈঠকের পরই তা মিডিয়াতে যাবে। দানিয়েল ময়নিহানও এ ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। তারও মত ছিল, ওদের বিরুদ্ধে জনমতকে যতটা বিক্ষুব্ধ করা যাবে, আমাদের কাজ তত সহজ হবে। সুতরাং মিডিয়াকেই প্রধান অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।’ থামল জেনারেল হ্যামিল্টন।
জেনারেল হ্যামিল্টন থামতেই ডেভিড উইলিয়াম জোনস সহাস্যে বলে উঠল, ‘ওদের সাথে চূড়ান্ত আলোচনারই শুধু অপেক্ষা। টিভি নেট ওয়ার্ক ও নিউজ পেপারের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন দুটি রিপোর্ট রেডি হয়ে আছে। ওদের সাথে আজ আমাদের আলোচনা সফল হলে আজকেই রিপোর্টগুলো মিডিয়াতে দিয়ে দেয়া হবে। আমাদের টিভি নেট ওয়ার্ক ও নিউজ পেপারগুলোকে এ্যালার্ট থাকার জন্যে অলরেডি ইংগিত দেয়া হয়েছে।’
জেনারেল হ্যামিল্টনের চেহারা কিছুটা প্রশ্নবোধক হয়ে উঠল। বলল, ‘আলোচনায় সফল হওয়ার প্রশ্ন উঠছে কেন? অসফলতারও কি কোন সুযোগ আছে?
হাসল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘আমাদের আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। গোটা বিষয় আমরা ওদের সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে চাই। সফলতার অর্থ হলো, যে পরিকল্পনা আমরা করেছি, তা বাস্তবায়নের জন্যে ওরা শুধু সমর্থন দেবেন ও নিজে কাজ করবেন তাই নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ওদের সর্বশক্তি কাজে লাগাতে হবে। প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে আমাদের শুভাকাঙ্খী সদস্যরা তো কাজ করবেনই, কিন্তু তাদের কাজ হবে খুবই গুরত্বপূর্ণ। আমাদের বেশি ভয় সিনেট চীফ চালর্স ডব্লিউ ওয়ারনার, হাউজ (হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ) চীফ জন জে, রিচার্ডসন, সিনেট ইনটেলিজেন্স স্পেশাল কমিটির চীফ আনা প্যাট্রেসিয়া এবং সিনেট ফরেন রিলেশনস স্ট্যান্ডিং কমিটির চীফ বব এইচ ব্রুসকে নিয়ে। স্বাধীন মতামত পোষণের ক্ষেত্রে এরা এতই বেপরোয়া যে এদের বাগে আনা মুশকিল। কিন্তু এদের পক্ষে আনতে হবে। সিনেট চীফ মি. ওয়ারনারের সাথে আমাদের মি. ডেভিড উইলিয়াম জোনস এর ভাল সম্পর্ক আছে, ব্যবসায়িক সম্পর্কও আছে, কিন্তু তিনি নিজে কিছু বললে উল্টো ফল হওয়ার ভয় আছে। অন্যদিকে দানিয়েল ময়নিহান তার এক সময়ের সহপাঠি শুধু নন, মি. ওয়ারনার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানাভাবে ময়নিহানের উপর নির্ভরশীল। অনুরুপভাবে সৌভাগ্যক্রমে জন জে রিচার্ডসন, আনা প্যাট্রোসিয়া ও এ্যান্ড্রু জ্যাকবস তিন জনই ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষ। আর বব এইচ ব্রুস এ্যান্ড্রু জ্যাকবস-এর বন্ধু। সুতরাং মি. এ্যান্ড্রু জ্যাকবস ও মি. দানিয়েল ময়নিহানকে চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’ দীর্ঘ বক্তব্য দেয়ার পর থামল জেনারেল শ্যারন।
শ্যারন থামতেই কথা বলে উঠল জেনারেল হ্যামিল্টন। বলল, ‘আপনি মি. ময়নিহান ও মি. জ্যাকবস-এর যতটা ভূমিকা প্রয়োজন বলে ভাবছেন তা না লাগতে পারে। প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে আপনাদের শুভাকাঙ্খী সদস্যদের যে বিরাট শক্তি আছে এবং প্রেসের পক্ষ থেকে যে চাপের সৃষ্টি হবে, তাতে মি. রিচার্ডসন, ওয়ারনার, ব্রুস ও মিস প্যাট্রেসিয়ারা অনেকটাই কাত হয়ে পড়বেন বলে আমার বিশ্বাস।’
‘ঠিকই বলেছেন মি. হ্যামিল্টন। মিডিয়ার সমর্থন আমরা একতরফা পেয়ে যাব। টিভি ও নিউজ পেপার এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে যে, প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন ও তার গ্যাংরা বাইরে মুখ দেখাতেই পারবে না। তবে যেটা আমাদের প্রথম টার্গেট প্রেসিডেন্টের ইমপিচমেন্ট খুব সহজ হবে না। সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন হাসিল করতে হবে।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। তাঁর কন্ঠে চিন্তার সুর।
‘কেন, সহজ হবে না কেন? প্রেসিডেন্টের দুর্নীতি, অসদাচরণ, যোগসাজস, ইত্যাদি সম্পর্কিত যে দারুন সব দলিলের কথা বলেছিলেন, সে সব তো আছে আপনাদের কাছে।’
মিষ্টি হাসল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। বলল, ‘আছে। রাজনৈতিক অফিসে তার সুন্দরী রাজনৈতিক সেক্রেটারী মিসেস শিলা জোসন এবং হোয়াইট হাউজে তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারী মিসেস উভা ব্রাউন আমার লোক। সুতরাং কি ধরনের সব ডকুমেন্ট থাকতে পারে তা চিন্তা করুন।’
‘ধন্যবাদ মি. জোনস। যেদিন কলংকের কালিমায় প্রেসিডেন্টের মুখটা কালো হয়ে যাবে এবং পরাজয়ের গ্লানিতে তার মাথাটা নুয়ে পড়বে, সেদিন আমি সবাইকে নিয়ে এমন একটা গ্র্যান্ড পার্টি করব যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
হাসল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘মি. জোনস যে দলিল দস্তাবেজের কথা বলেছেন, সে সব দলিল দস্তাবেজ বের করার প্রয়োজন হবে না। পত্র-পত্রিকায় একটা ইশারা এবং তাঁর সামনে নিয়ে কয়েকটা নমুনা তুলে ধরলেই পায়ে এসে পড়বে পদ রক্ষার জন্য। দেখবেন, কোথায় উড়ে যাবে আহমদ মুসা, জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক, আর্থার, জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন এবং সারা জেফারসনদের দল’।
‘আপনার কথা সত্য হোক মি. শ্যারন। আমরা ইতিহাসের এক মহা মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। আমরা সময়ের কাছে পরাজিত হলে মহা এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতে হতে পারে। আর সময় যদি আমাদের বিজয় এনে দেয়, তাহলে শতাব্দীর সাধনা দিয়ে আমেরিকায় ভবিষ্যতের যে বীজ বপন আমরা করেছি, তা এক নতুন পৃথিবীর মুখ আমাদের দেখাতে পারে। যা শুধু এক আমেরিকার মাধ্যমেই আমরা দেখতে পারি।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘আপনার মূল্যায়নটা একটু বেশি প্রান্তিক হয়ে গলে না? বর্তমান পরিস্থিতি কি এতটাই গুরুতর? বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
‘মি. হ্যামিল্টন, আমি পরিস্থিকে যতটা গরুত্বপূর্ণ বলেছি, পরিস্থিতি মনে করি তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। তারা যা বলছে তা যদি প্রমান করতে পারে, তাহলে জার্মানীর মতই আমেরিকা আমাদের জন্যে এক দুঃস্বপ্নের দেশে পরিণত হতে পারে। মনে হবে আমি হতাশার কথা বলছি, কিন্তু না, সর্বোচ্চ সাবধানতা, সর্বোচ্চ সক্রিয়তা অবলম্বেনের জন্যেই একথা বলছি আমি।’ বলল ডেভিড ইউলিয়াম জোনস শুকনো কন্ঠে।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের! বলল, ‘যা সত্য নয়, যা সাজানো, তা কি প্রমান করা যায়? বিশেষ করে আমেরিকায়?
উত্তরে কোন কথা বলল না ডেভিড জোনস।
জেনারেল হ্যামিল্টনের কথা শেষ হতেই জেনারেল শ্যারণ নিজের হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বলে উঠল, ‘সময় হয়ে গেছে। মনে করি আমাদের যাত্রা করা উচিত।’
জেনারেল হ্যামিল্টন ও ডেভিড জোনস দুজনেই তাদের ঘড়ির দিকে তাকাল।
জেনারেল হ্যামিল্টন বলল, ‘আরো পরেও যাত্রা করলে পারি। তবু ঠিক আছে। আমাদেরকে ঘুরা পথেই যেতে হবে। সরকারী গোয়েন্দাদের নজর এড়াবার প্রয়োজন আছে।’ বলে উঠে দাঁড়াল জেনারেল হ্যামিল্টন। উঠে দাঁড়াল সবাই।

‘এই হ্যারি এই তো এলি, তাড়াহুড়ো করে আবার এক রাতে বেরুচ্ছিস কোথায়। শোন, কথা আছে।’ বলল ন্যান্সি ময়নিহান।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top