২
‘আমাদের সতর্কতা কি একটু বেশি পরিমাণে হয়ে যাচ্ছে না?’ বলল বেগিন লিকুড। তার কণ্ঠে বিরক্তির প্রকাশ।
বেগিন লিকুড আমেরিকান জুইস পিপলস লীগের যুব বিভাগের একজন বেপরোয়া গোছের নেতা। ফ্লোরিডা অঞ্চলের যুব গ্রুপের দায়িত্বে সে।
বেগিন লিকুড যাকে লক্ষ্য করে কথা বলল সে হল হাইম শামির। সে জ্যাকসন ভিল সিনাগগের প্রধান এবং আমেরিকান জুইস পিপলস লীগের ফ্লোরিডা অঞ্চলের সভাপতি।
বেগিন লিকুডের কথা শুনে হাইম শামির একটু ম্লান হাসল। বলল, ‘কোন সতর্কতার কথা বলছ? ডা. মার্গারেট ও লায়লা জেনিফারকে সরিয়ে রাখার কথা?’
‘হ্যাঁ।’ বলল বেগিন লিকুড।
‘যে কারণে মিয়ামী থেকে সরিয়ে তাদের এ সিনাগগে আনা হয়েছিল, সে ধরনের কারনেই আবার পাশের আমাদের মিত্র ভারতীয়ের বাসায় তাদের সরিয়ে রাখা হলো।’ বলল হাইম শামির।
‘মিয়ামীর ঘাটি ওদের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখানকার সন্ধান তো ওরা জানে না।’ উত্তরে বলল বেগিন লিকুড।
‘জানে না, একথা বলা যাবে না। আমাকে জেনারেল শ্যারন জানিয়েছেন, সিনাগগ, ক্লাব বা সমিতি জাতীয় ইহুদী কোন স্থান বা স্থাপনাই আজ নিরাপদ নয়। জেনারেল শ্যারনের কাছ থেকে এই সংকেত পাওয়ার পর এবং যখন শুনতে পেলাম যে, আহমদ মুসা ও গোল্ড ওয়াটার মিলিত হয়েছে এবং তারা অন্যান্যদের নিয়ে মায়ামীতে ল্যান্ড করেছে, তখন ওদের সিনাগগে রাখার আর সাহস পাইনি। বলল হাইম শামির।
‘এই সতকর্ততার কি প্রয়োজন এবং তাদের জামাই আদরে রাখার কি দরকার? আহমদ মুসা ধরা দেবে, আমেরিকা ত্যাগ করবে? এসব অবাস্তব কল্পনা। আমাদের হাতে ছেড়ে দিন ও দুজনকে! আমরা ওদের উপর প্রতিশোধ তুলব ইহুদীদের প্রতি ফোটা রক্তের, যা আহমদ মুসা ঝরিয়েছে। তারপর ছবিগুলি এক এক করে পাঠিয়ে দিতে থাকব আহমদ মুসার কাছে। তাহলেই না সে পাগল হবে, পাগল হলেই সে ভুল করবে। সেই ভুলের সুযোগ আমরা নিয়ে তাকে শেষ করতে পারব। বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল বেগিন লিকুড।
‘শোন, আমাদের চেয়ে জেনারেল শ্যারন আহমদ মুসাকে অনেক বেশি চেনে। তিনি আহমদ মুসাকে হাতে পেতে চান, অথবা চান আমেরিকা থেকে সে চলে যাক, তাকে ক্ষেপাতে চান না।’ বলল হাইম শামির শান্ত কণ্ঠে।
‘দেখুন, জেনারেল শ্যারনকে আমরা শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি। কিন্তু তাঁর সতর্কতা তাকে জেতায়নি কোন সময়। আমেরিকাতেও তিনি হারছেন আহমদ মুসার কাছে। সুতরাং সতর্কতা নামের দুর্বলতা নয়, আমরা সোজা আঘাত করতে চাই আহমদ মুসাকে। মার্গারেট ও জেনিফার হবে আমাদের প্রথম শিকার। ওদের শতধা লাঞ্ছিতা ও ধর্ষিতা লাশ আমরা আহমদ মুসাকে উপহার দিতে চাই। যন্ত্রণার আগুনে আমরা আহমদ মুসার দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণুকে পোড়াতে চাই, ব্যর্থতার আগুনে জ্বালিয়ে ওকে আমরা উন্মাদ করে তুলতে চাই। দিন এখনি ওদের আমাদের হাতে তুলে দিন।’ বলল বেগিন লিকুড।
‘তোমরা তো পাচ্ছই। আর দুদিন। তিন দিনের সময় দেয়া হয়েছে আহমদ মুসাকে আমেরিকা ছাড়ার।’ হাইম শামির বলল।
‘তাকে বলা হয়েছিল আমেরিকা ছেড়ে যেতে, আর সে অভিযানে আসছে ফ্লোরিডায় আমাদের বিরুদ্ধে। আর আমরা আরও দুদিন তার আমেরিকা ছাড়ার অপেক্ষায় থাকব। ঠিক আছে আপনারা অপেক্ষায় থাকুন, আমাদের কাজ আমাদের করতে দিন। আমরা যাচ্ছি ভারতীয়ের বাসায় ওদের তুলে নিয়ে আসতে।’
এই সময়ে ঝড়ের মত ঘরে প্রবেশ করল শিমন। শিমন ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মী, ফ্লোরিডায় জেনারেল শ্যারনের একজন প্রতিনিধি।
প্রবেশ করেই চিৎকার করে উঠল, ‘হিপ হিপ, হুররে।’
‘কি ব্যাপার শিমন? মিয়ামীর কি খবর?’ বলল হাইম শামির।
‘সব খতম, আনন্দ কর, সব খতম।’ দুই হাত তুলে নাচতে নাচতে আবার চিৎকার করল শিমন।
‘কে খতম, কারা খতম? আহমদ মুসারা কি………?’
কথা শেষ না করেই থেমে গেল বেগিন লিকুড। কি উচ্ছ্বাসে কথা তার গলায় আটকে গেল।
শিমন চেয়ারে বসে টেবিলে মুষ্ঠাঘাত করতে করতে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আহমদ মুসা, গোল্ড ওয়াটারসহ তাদের টিমের সবাই খতম হয়ে গেছে।’
শিমনের কথাটা ঘরে বজ্রপাতের মতই শক ওয়েভের সৃষ্টি করল। হাইম শামির, বেগিন লিকুড সবাই কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না।
নিরবতা ভাঙল প্রথমে হাইম শামির। বলল, ‘তুমি যা বলছ বুঝে বলছ? সত্য বলছ? আবার বলত কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না।
শিমন আনন্দে হাত দিয়ে টেবিল বাজাতে বাজাতে বলল, ‘যে গাড়ি নিয়ে আহমদ মুসা ও গোল্ড ওয়াটারদেরকে বিমান বন্দর থেকে আনতে যাবার কথা ছিল, সে গাড়িতে ভয়ংকর দূর নিয়ন্ত্রিত গাড়ি বোমা পেতে রেখেছিলাম। সেই বোমার বিস্ফোরণে তাদের নিয়ে গাড়িটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল হাইম শামির ও বেগিন লিকুডের। বলল বেগিন লিকুড, ‘ঘটনা বিস্তারিত বলল দুকানকে সার্থক করি। তাদের লাশ-টাশ দেখে এসেছ?’
‘তাদের লাশ পাবে কোথায়? সাথে সাথে পুড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পানিতে। কিছু টুকরো পড়ে থাকতে দেখেছি ব্রীজের উপর।’
বলে একটা দম নিয়ে আবার শুরু করল শিমন, ‘আমরা হোয়াইট ঈগলের মিয়ামী অফিসের গ্যারেজেই বোমা পাতার কাজ সেরেছিলাম। তারপর ব্রীজের কিছু দূরে নদীতে একটা বোটে বসে ওদের অপেক্ষা করছিলাম। আমাদের চোখের সামনে দিয়েই ব্রীজ পার হয়ে ওরা বিমান বন্দরে গেল। বিমান বন্দর থেকে ফেরার পথে গাড়িটা ব্রীজে উঠল। দেখলাম গাড়ির শ্যাডো কাঁচ তুলে দেয়া। আমরা খুশি হলাম, আহমদ মুসাদের মানুষের চোখ থেকে আড়ালে রাখার জন্যেই শ্যাডো কাঁচ তুলে রাখা হয়েছে। গাড়িটা যখন ঠিক ব্রীজের মাঝ বরাবর পৌছল, তখন কনট্রোল সিস্টেমের লাল বোতামে আমরা চাপ দিলাম। সংগে সংগেই ঘটে গেল কিয়ামত কান্ড। শালারা কেউ বাঁচেনি।’
‘গাড়িতে ওরা ছিল তোমরা নিশ্চিত?’ বলল হাইম শামির।
‘এয়ারপোর্টের বাইরে যে লোক আমাদের পাহারায় সেও আমাদের মোবাইলে জানায়, টারমাকে যাওয়া গাড়ি ওদের নিয়ে বেরিয়ে এল এবং চলে যাচ্ছে।’ বলল শিমন।
‘যদি তাই হয়, তাহলে তুমি যে পুরস্কার পাবে তা কল্পনাও করতে পার না। জান, আজকের জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে এটা, পুরস্কারও তেমনি বড় হবে।’ বলল হাইম শামির।
‘ওসব বাকি পুরস্কার বাকিতেই থাক। নগদ পুরস্কার এখনই চাই।’ বলল শিমন।
‘কি সেটা?’
‘ডা. মার্গারেট ও লায়লা জেনিফার। সেই শুরুর দিন থেকে শালিদের পেছনে আছি। গায়ে ওদের হাত দিতে পারলাম না। বস আহমদ মুসার ভয় দেখিয়ে আর আশা দিয়ে আমাদের থামিয়ে রেখেছে। আর নয়। শালিদের মুসলমানিত্বের দেমাগ বের করে দিতে চাই। আহমদ মুসা শান্তিতে মরে গেছে। এদের উপর প্রতিশোধ নেব আহমদ মুসার সব জ্বালাতনের।’
হাসল হাইম শামির। বলল, ‘বেগিন লিকুডরাও এ দাবী নিয়ে বসে আছে। ঠিক আছে। পুরস্কার পরে। আপতত এই বোনাস তোমরা নিয়ে যাও। আজকের আনন্দে এই বোনাস তোমাদের যোগ্য প্রাপ্য। তবে তোমরা একটু বস, আমি মায়ামী ও হোয়াইট ঈগলের অফিসে টেলিফোন করে ঘটনার শেষটা জেনে নেই।’
বলে হাইম শামির মোবাইলটা হাতে তুলে নিল।
হাইম শামির তার কথা শেষ করার আগেই বেগিন লিকুড ও শিমনরা উঠে দাঁড়িয়ে আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে নাচতে শুরু করেছে। বলছে আশ্রাব্য সব কথা ডা. মার্গারেট ও জেনিফারের উদ্দেশ্যে।
এই হৈচৈ এর মধ্যেই টেলিফোনে কথা বলতে শুরু করেছে হাইম শামির।
ঘরের তালা খোলার শব্দ হলো।
ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল ডা. মার্গারেট ও লায়লা জেনিফার দুজনের মুখেই।
উঠে বসল দুজনেই।
দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করল ভ্যানিসা নেল।
ভ্যানিসা হাইম শামিরের সিনাগগের একজন পরিচারিকা। বয়স হবে পঞ্চাশের কাছাকাছি।
মার্গারেটরা তাদের গোটা বন্দী জীবনে একজন মাত্র মানুষের সন্ধান পেয়েছে, সে হলো এই ভ্যানিসা। আন্তরিক ব্যবহার, সহানুভুতির কথা শুধু তার কাছ থেকেই শুনেছে।
ভ্যানিসাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে খুশি হলো, আবার উদ্বিগ্নও হলো দুজনে। বলল, ‘কি ব্যাপার ভ্যানিসা আন্টি?’
‘তোমাদের পালাতে হবে, না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল ভ্যানিসা নেল।
‘ওরা আসছে। তোমাদের দুজনকে নিয়ে যাবে। আড়াল থেকে সব শুনেছি। ওরা আজ মহোৎসব করবে তোমাদের নিয়ে।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল ভ্যানিসা নেল।
মার্গারেটের চোখে-মুখে আতংক দেখা দিল। ভয়ে চুপসে গেল তাদের মুখ। তাদের মনে হলো, হঠাৎ যেন তাদের চারদিকের পৃথিবীটা সংকীর্ণ হয়ে গেল। শ্বাসরুদ্ধকর একটা অন্ধকার যেন তাদের দিকে ধেয়ে এল।
কোন কথা তাদের মুখে যোগাল না। বোবা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইল ভ্যানিসার দিকে।
‘দেখ সময় নষ্ট করো না। চল তোমাদের বাইরে বের করে দেব।’ বলল ভ্যানিসা।
‘কিভাবে? কেউ নেই এদিকে?’ বলল মার্গারেট।
‘আছে। তবে ওরা মনে করেছে আমাকে ওরা পাঠিয়েছে। তাই ওরা আপাতত অপেক্ষা করবে। আর এটাই সুযোগ।’ বলল ভ্যানিসা নেল।
ভয় ও উদ্বেগে আড়ষ্ট ডা. মার্গারেট ও লায়লা জেনিফার পুতুলের মত উঠে দাঁড়াল।
দ্রুত বের হলো তারা ঘর থেকে ভ্যানিসার সাথে।
ঘর থেকে বের হবার সময় ভ্যানিসা একটা রিভলবার তুলে দিল ডা. মার্গারেটের হাতে। বল, ‘লুকিয়ে রাখ, যদি দরকার হয় তাহলে……।’
ভ্যানিসা আগে, পেছনে ওরা দুজন।
ভ্যানিসা হঠাৎ মুখোমুখি হলো রবিন সেনে’র সাথে। সে সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল।
রবিন সেন একজন ভারতীয়। আমেরিকায় এসেছে তিরিশ বছর আগে। এখন আমেরিকান। কম্যুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার রবিন সেন একটি আমেরিকান এয়ার লাইনসের অর্ধেকেরও বেশি শেয়ারের মালিক এবং সেই সাথে ব্যবস্থাপনা পরিচালকও। ইহুদী পুঁজিপতিদের সাথে তার গভীর সম্পর্ক। শুধু অর্থনৈতিভাবে নয়, তারা পরস্পর রাজনৈতিক মিত্রও। ব্যবসায়ের একটা রাজনৈতিক বিনিয়োগ আছে। সেই বিনিয়োগ রবিন সেন ইহুদী বন্ধুদের মাধ্যমেই সমাধান করে থাকে।
এসব বহুদর্শী ভ্যানিসা জানে। জানে বলেই স্বয়ং রবিন সেনের সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথে সে আড়ষ্ট হয়ে পড়ল। তুব মনের সমস্ত জোর একত্রিত করে ভ্যানিসা বলল, ‘গুড ইভনিং স্যার। ভালো আছেন?’
‘গুড ইভনিং। কিন্তু তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? এ সাপের বাচ্চাদের নিয়ে কোথায় দৌড়াচ্ছো? কোন বিপদ হয়নি তো?’ বলল রসিন সেন। তার চোখে-মুখে কিছুটা উদ্বেগের ছায়া।
‘ওদের সিনাগগে নিয়ে যাচ্ছি স্যার। খুব তাড়া ওদিক থেকে।’ বলল ভ্যানিসা।
‘আচ্ছা।’ বলে রবিন সেন সিঁড়ি দিয়ে আবার উপরে উঠা শুরু করল।
আর ভ্যানিসারাও তখন আবার ছুটতে শুরু করল।
সিঁড়ি মুখের পরেই প্রশস্ত লাউঞ্জ। নানা আকারের সোফায় সাজানো। লাউঞ্জের তিনটি ধাপ পেরিয়ে উপরে উঠলে আবার একটা করিডোর। এ প্রশস্ত করিডোরের শেষ প্রান্তে বিরাট দরজা। দরজার পর আবার প্রশস্ত বারান্দা। এ বারান্দা থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে বাইরের লনে। তারপর প্রাইভেট রাস্তা। রাস্তার ওপাশে ঠিক এ বাড়ির বিপরীতেই সিনাগগটি। তবে সিনাগগের গেট আরও একটু সামনে। রাস্তাটা দিয়ে সামনে এগুলে সিনাগগের গেটের পাশ দিয়ে সরকারী রাস্তায় পড়া যায়।
লাউঞ্জ পেরিয়ে করিডোর হয়ে ভ্যানিসারা বাইরের বারান্দায় বেরুবার দরজায় গিয়ে পৌছতেই ভ্যানিসা দেখল লন থেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে হাইম শামির, বেগিন লিকুড, মিশন ও আরও দুজন। তারা সিঁড়ি দিয়ে দরজার দিকে উঠে আসছে।
ওদের দেখে আতংকিত ভ্যানিসারা দরজায় দাঁড়িয়ে গেল।
হাইম শামিররাও দেখতে পেয়েছে ভ্যানিসাদেরকে। তারাও প্রথমে চমকে উঠেছে। তারপরেই তারা ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছে। সংগে সংগেই চিৎকার করে উঠল হাইম শামির। বলে উঠল, ‘তুমি শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করলেই ভ্যানিসা………।’
হাইম শামিরের কথা শেষ হতে না হতেই ছুটল বেগিন লিকুড ও শিমন ভ্যানিসাদের দিকে। টার্গেট ডা. মার্গারেট ও লায়লা জেনিফার।
কিন্তু সিঁড়ি থেকে তারা বারান্দায় পা রাখা পর্যন্তই। আর সামনে তারা এগুতে পারলো না। ভ্যানিসার রিভলবার তাদের দিকে উদ্যত হয়ে উঠেছে।
ভ্যানিসার দেখাদেখি ডা. মার্গারেটও তার রিভলবার বের করে তাক করল ওদের দিকে। ডা. মার্গারেট তার কম্পিত দেহটাকে ঠেস দিয়ে রেখেছে দরজার ডান দিকের চৌকাঠে। আর ভ্যানিসা বাম হাতে আঁকড়ে ধরে আছে দরজার ওপাশের চৌকাঠ। তার ডান হাতে রিভলবার।
হাইম শামিমের কথায় ভ্যানিসা চিৎকার করে উঠল, ‘বিশ্বাসের কথা বলছ শামির! আমার সংসার বিরান করেছ, আমার জীবন বিরান করেছ তোমরা। ক্রীতদাসী হয়ে আছি তোমাদের। জীবনের নিস্ফলতাকে মেনে নিয়ে বেঁচে আছি আমি। কিন্তু এই ঈশ্বর ভক্ত দুই মেয়েকে আমার ভাগ্য বরণ করতে আমি কিছুতেই দেব না।’
‘তোমার ভাগ্য বরণের কথা বলছ কেন? ওদেরকে আমরা অন্য জায়গায় নিয়ে যাব। তোমার ভয় মিথ্যা। দেখ না ওদের গায়ে কেউ হাত দেয়নি।’ বলল নরম কণ্ঠে শামির।
‘মিথ্যা বলো না শামির। আমি সব কথা মোতাদের শুনেছি। তুমি ওদেরকে এই কুকুরদের হাতে তুলে দেবার আয়োজন করেছো। সব হারালেও আমি মেয়েই আছি। সুন্দর জীবনের দুই মেয়ের সর্বনাশ আমি হতে দেব না।’ বলল ভ্যানিসা চিৎকার করে।
ভ্যানিসার কথা শেষ হতেই ক্রোধে উম্মত্ত বেগিন লিকুড চিৎকার করে বলল, ‘বুড়ি হারামজাদী, তোর রিভলবারের ভয় আমরা করি না। শয়তান আহমদ মুসাকে আজ আমরা শেষ করেছি, বিশ্বাসঘাতক গোল্ড ওয়াটারকেও। তুই আমাদের কি করছি?’
বলে বেগিন লিকুড দ্রুত পকেট থেকে রিভলবার বের করতে গেল।
সংগে সংগে গর্জে উঠেছিল ভ্যানিসার রিভলবার।
বুক চেপে ধরে বেগিন লিকুড আছড়ে পড়ল সিঁড়ির উপর।
পরক্ষণেই বাড়ির ভেতর দিক থেকে দুটি গুলীর শব্দ হলো।
ভ্যানিসা ও ডা. মার্গারেট উভয়ের আহত হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেল। দুজনেই তাদের আহত হাত অন্য হাত দিয়ে চেপে ধরে কঁকিয়ে উঠল।
ভীত লায়লা জেনিফার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল দুই হাতে দুই রিভলবার নিয়ে করিডোরের মুখে দাঁড়িয়ে আছে রবিন সেন। তার দুই রিভলবারের নলে তখনও ধোঁয়া।
লায়লা জেনিফার যখন পেছন ফিরে তাকিয়েছে, তখন আহত হাত চেপে যন্ত্রণাকাতর ডা. মার্গারেট সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল গুলীবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাওয়া লোকের পাশের লোকটি রিভলবার তুলে তাক করেছে ভ্যানিসাকে।
সঙ্গে সঙ্গেই ডা. মার্গারেট ছুটে গিয়ে নিজেদের দেহ দিয়ে ভ্যানিসাকে আড়া করে দাঁড়াল।
ভ্যানিসাকে লক্ষ্য করে নিক্ষিপ্ত শিমনের গুলীটা গিয়ে বিদ্ধ করল ডা. মার্গারেটের বুক।
একটা আর্তনাদ উঠল মার্গারেটের কন্ঠে। তার সাথে সাথেই লুটিয়ে পড়ল তার দেহ দরজার উপর।
লায়লা জেনিফার চিৎকার করে উঠে ছুটে গিয়ে আছাড়ে পড়ল ডা. মার্গারেটের উপর।
আর ঠিক সে সময়েই লনের দিক থেকে গুলী বৃষ্টির শব্দ ভেসে এল।
লায়লা জেনিফার চোখ বন্ধ করে ডা. মার্গারেটের দেহ আঁকড়ে ধরে অপেক্ষা করছিল। তার দেহও ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছিল সে আন্তরিকভাবেই। কারণ এটাই তার এখন একমাত্র পথ।
কিন্তু গুলী এল না।
তার বদলে ভেসে এল মমতা জড়ানো এক ডাক ‘লায়লা জেনিফার।’
এযে আহমদ মুসার কণ্ঠ!
বিস্ময়ে চোখ খুলল লায়লা জেনিফার। দেখল তার সামনে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা ও তার স্বামী জর্জ।
আবার চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠল, ‘হে আল্লাহ, আমি কি স্বপ্ন দেখছি!’
‘না স্বপ্ন নয়, উঠ বোন। মার্গারেটেকে নিতে হবে। সে আহত।’
জেনিফার উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরল জর্জকে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, ‘আমার মার্গারেট আপা…..।’
কথা শেষ করতে পারল না কান্নার উচ্ছ্বাসে।
আহমদ মুসা তুলে নিল মার্গারেটের দেহ গাড়িতে নেয়ার জন্যে। এসময় পরপর দুটি গুলীর শব্দ হলো।
বেকন গুলী করেছে করিডোরে দাঁড়ানো একজন অশ্বেতাংগ এশীয়কে।
‘মি. আহমদ মুসা, ওর দুই রিভলবার টার্গেট করেছিল আপনাকে ও ভ্যানিসাকে। তাকে হত্যা না করে উপায় ছিল না।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
আহমদ মুসা বেঞ্জামিনের কথার দিকে কান না দিয়ে বলল, ‘মি. বেঞ্জামিন এদের একটা গাড়িতে আপনি গোল্ড ওয়াটারদের নিয়ে উঠে বসুন। আমি এদের নিয়ে বাইরে দাঁড়ানো গাড়িতে উঠছি।’
বলে আহমদ মুসা ড. মার্গারেটকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে ছুটল লনের ওপাশের রাস্তায় রাখা তাদের গাড়ির দিকে।
দুটি গাড়িই স্টার্ট নিল।
গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে গোল্ড ওয়াটার বলল, ‘মন্দ হলো না মি. আহমদ মুসা, পুলি এসে দেখবে বাড়িওয়ালার সাথে সিনাগগের লড়াই? না কিভাবে ব্যাখ্যা করবে তারা ঘটনার?’
‘পত্রিকায় একটা নিউজ করিয়ে দিন, তাহলে পুলিশ তদন্তের লাইন খুঁজে পাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার বন্ধুর কন্যা মার্গারেট কেমন আছে? তাকে কোথায় নিচ্ছি আমরা?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল গোল্ড ওয়াটার।
পাশ থেকে ভ্যানিসা বলে উঠল, ‘চলুন আমি ক্লিনিক দেখিয়ে দেব।’
আহমদ মুসা ও তার কথাটা জানাল গোল্ড ওয়াটারকে।
ভ্যানিসা বসে আছে আহমদ মুসার পাশের সিটে। আর পেছনের সিটে ডা. মার্গারেটকে শুইয়ে তিয়ে তার পাশে গাড়ির মেঝেতে বসেছিল জেনিফার ও জর্জ।
ডা. মার্গারেট জ্ঞান হারায়নি।
গোল্ড ওয়াটারকে লক্ষ্য করে বলা আহমদ মুসার কণ্ঠ থামলেই জেনিফার আহমদ মুসাকে বলে উঠল আর্ত কন্ঠে, ‘ভাইয়া মার্গারেট আপা আপনার সাথে কথা বলতে চান। এখনি।’
গাড়ি তখন এগিয়ে চলছিল সেন্টজন নদীর তীর বরাবরের ব্যস্ত হাইওয়ে ধরে।
জ্যাকসন ভিল সিনাগগটি নদীর তীর ঘেঁষেই। মাঝাখানে শুধু হাইওয়েটা।
আহমদ মুসা গাড়ি দাঁড় করবার জন্যে একটা জায়গা খোঁজ করতে লাগল।
ভ্যানিসা বলে উঠল, ‘এই সামনেই রাস্তার পাশে নদীর উপর একটা ‘হেলথ রিজোর্ট’ আছে। ওখানে দাঁড়ানো যায়।’
আহমদ মুসা গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে দিল। বলল, ‘জেনিফার তাড়াতাড়ি কোন ক্লিনিকে পৌছা দরকার। সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।’
বলতে বলতেই সামনে দেখতে পেল একটা এক্সিট লেন। সংগে সংগে আহমদ মুসা গাড়ি এক্সিট লেনে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করাল।
তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘জর্জ তুমি ড্রাইভিং সিটে এস। আমি ওদিকে দেখছি।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে দ্রুত নামল।
জর্জও নেমে এল।
আহমদ মুসা পেছনের সিটে উঠে রক্তে ভাসা ডা. মার্গারেটের মাথার কাছে গাড়ির মেঝেতে বসল।
ওদিকে জর্জ ড্রাইভিং সিটে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল।
নিঃশব্দ ঝড়ের গতিতে গাড়ি চলতে শুরু করল আবার।
চোখ বুজে ছিল ডা. মার্গারেট।
লায়লা জেনিফার সিটের নিচে বসে বাম হাত দিয়ে ডা. মার্গারেটকে জড়িয়ে ধরেছিল। আর তার ডান হাত চেপে ধরেছিল ডা. মার্গারেটের রক্তক্ষরণরত বুকের বাম পাশটা।
আহমদ মুসা বসলে সে ধীরে ধীরে চোখ খুলল। চাইল আহমদ মুসার দিকে। বলল ক্ষীণ কন্ঠে, ‘ওরা বলেছিল আপনাকে ও গোল্ড ওয়াটারসহ সবাইকে নাকি আজ ওরা শেষ করে দিয়েছে। ভেবেছিলাম, আর দেখা হলো না আপনার সাথে। আল্লাহর হাজার শুকরিয়া, আপনার দেখা পেলাম। বন্দী হবার পর সব সময় মৃত্যুর জন্যে তৈরী ছিলাম। কিন্তু একটা প্রার্থনা করেই চলেছিলাম আল্লাহর কাছে, মৃত্যুর আগে যেন একবার আপনার দেখা পাই। আল্লাহ আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। একটা……….।’
আহমদ মুসা ডা. মার্গারেটের কথার মাঝখানেই বলে উঠল, ‘মার্গারেট এসব কথা এখন নয়। তুমি ভাল হয়ে যাবে। আমরা ক্লিনিকে যাচ্ছি। কথা বলো না এখন, ক্ষতি হবে।’
ডা. মার্গারেটের দুই চোখ আহমদ মুসার দুই চোখ থেকে সরেনি। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল ম্লান হাসির রেখা। বলল, ‘কথা বলার আর সময় আমি পাবো না। জনাব, আমি ডাক্তার। আমি জানি একটুও সময় নেই আমার হাতে।’
একটু থামল ডা. মার্গারেট। তার চোখের দুই কোনায় দুই ফোটা অশ্রু এসে জমেছে।
বোধ হয় অশ্রু রোধ করার জন্যেই ডা. মার্গারেট চোখ বুজল। কিন্তু তাতে অশ্রু রোধ হলো না। অশ্রু তার গড়িয়ে পড়ল দুই গন্ড দিয়ে। ডান হাতটি তুলতে চেষ্টা করল ডা. মার্গারেট, বোধ হয় চোখ মোছার জন্যেই। কিন্তু হাত তুলতে পারল না।
অশ্রু সিক্ত দুচোখ আবার তুলল ডা. মার্গারেট আহমদ মুসার দিকে। ঠোঁট দুটি তার ফাঁক হয়েছিল কিছু বলার জন্যে, কিন্তু পরক্ষণেই প্রবল যন্ত্রণায় মুখ আড়ষ্ট হয়ে গেল তার। হাত কাঁপছে, গোটা শরীর কাঁপছে ডা. মার্গারেটের। সে আবার চোখ বুজেছে। তার মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে, দাঁতে দাঁত চেপেছে সে। বুঝা যাচ্ছে, লড়াই করছে নিজেকে ধরে রাখার জন্য।
কেঁদে উঠল লায়লা জেনিফার।
আহমদ মুসা চেপে ধরল ডা. মার্গারেটের কম্পমান দুই হাত ডাকল, ‘মিস মার্গারেট।’
চোখ খুলল মার্গারেট। তাকাল আহমদ মুসার চোখে।
ঠোঁট দুটি কাঁপছে মার্গারেটের।
চেষ্টা করছে কিছু বলার।
ফিস ফিসে কণ্ঠ আবার শোনা গেল মার্গারেটের। বলল, ‘একটা প্রশ্ন, মুসলমান হিসাবে আমার তো কোনই সঞ্চয় নেই। জান্নাত কি আমার হবে? দেখা কি পাব সেখানে আপনার? খুব জানতে ইচ্ছা করছে আমার।’
ক্ষীণ থেকে ক্ষীনতর কণ্ঠ থেমে গেল ডা. মার্গারেটের।
আহমদ মুসা একটু ঝুঁকে পড়ল ডা. মার্গারেটের মুখের দিকে। ‘মার্গারেট’ ‘মার্গারেট’ বলে ডাকল দুবার। বলল কানের কাছে মুখ নিয়ে, ‘মার্গারেট, তোমার এ মৃত্যু শহীদের মৃত্যু। আল্লাহ নিশ্চয় তোমাকে জান্নাত মঞ্জুর করবেন।’ আহমদ মুসার কণ্ঠ অশ্রু সিক্ত, ভারী।
চোখ খুলল না আর ডা. মার্গারেট।
কিন্তু তার ঠোঁটে ফুটে উঠল ফুলের মত নিষ্পাপ এক টুকরো হাসির রেখা।
পরক্ষণেই তার মাথাটা এক পাশে কাত হয়ে পড়ল। কিন্তু ঠোঁটে থেকেই গেল ফুলের মত সুন্দর সেই এক টুকরো হাসি। ডুকরে কেঁদে উঠল লায়লা জেনিফার। আছড়ে পড়ল সে মার্গারেটের বুকে। ড্রাইভিং সিট থেকে জর্জ মুহূর্তের জন্যে পেছন ফিরে তার আপা মার্গারেটের স্পন্দনহীন দেহের উপর চোখ বুলাল। তারপর কান্নার প্রবল উচ্ছ্বাস রোধের জন্যে ঠোঁট কামড়ে ধরে সামনে দৃষ্টি প্রসারিত করল সে। পাশ থেকে ভ্যানিসা নেল পেছন দিকে একবার তাকিয়ে বুকে ক্রস এঁকে প্রার্থনা করে উঠল, ‘ঈশ্বর! আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি জীবন দিলেন। তাঁর মঙ্গল করুন ঈশ্বর।’
আর আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘ইন্নালিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন’ আমরা সকলে আল্লাহর জন্যে এবং আল্লাহর দিকেই আমাদের প্রত্যাবর্তন।’
পরদিন ‘ফ্লোরিডা হোরাইজন’- এর একটি খবর গতকাল সেন্টজন নদী তীরে অভিজাত ‘রিভার ভিউ’ এলাকায় এক মর্মান্তিক হত্যাকান্ড ৬ জন লোক নিহত হয়েছে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে লাভজনক এয়ারলাইন্স ‘ব্লু বার্ড’ -এর বড় অংশীদার রবিন সেনও রয়েছে। তার লাশ তার বাসভবনে নিচের তলায় লাউঞ্জে পাওয়া গেছে। অবশিষ্ট ৫ জন পার্শ্ববর্তী সিনাগগের সদস্য বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই ৫ জনের মধ্যে সিনাগগের পরিচালক হাইম শামিরও রয়েছে। এদের লাশ রবিন সেনের বাসভবনের উক্তর লাউঞ্জের সিঁড়িতে পাওয়া গেছে। এই হত্যাকান্ডের জন্যে কাউকে সন্দেহ করা যায়নি, কেউ গ্রেফতারও হয়নি।
অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে নিহত রবিন সেনের উক্ত বাড়িটি তার একটি অবকাশ ভিলা। এ ভিলায় চাকর-বাকর ছাড়া পরিবারের কোন সদস্য স্থায়ীভাবে থাকেন না। ঘটনার দিন রবিন সেন ছাড়া ঐ বাড়িতে তার পরিবারের কোন সদস্য ছিলেন না।
বাড়ির চাকর-বাকরদের জিজ্ঞাসাবাদ থেকে ঘটনার মূলে নারীঘটিত কোন ব্যাপার রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। চাকর-বাকরদের সূত্রে প্রকাশ, ঘটনার দিন সকালে পার্শ্ববর্তী সিনাগগের পরিচালক হাইম শামির ও তার কয়েকজন সঙ্গী দুজন মেয়েকে ধরে এনে রবিন সেনের ভিলার একটি ঘরে বন্দী করে রাখে। বিকেলে মেয়ে দুটিকে সিনাগগের লোকেরা কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় মেয়ে দুটিকে উদ্ধার করতে আসা জনাপাঁচেক লোকের সাথে তাদের সংঘর্ষ বাধে। এই সংঘর্ষেই রবিন সেন ও সিনাগগের লোকেরা নিহত হয়েছে।
মনে করা হচ্ছে ভারতীয় বংশোদ্ভুত রবিন সেনের সাথে সিনাগগের অবৈধ সহযোগিতার কোন সম্পর্ক ছিল। অভিজ্ঞ-মহল এই হত্যাকান্ডের চেয়ে এর উৎস হিসেবে এই অবৈধ সহযোগিতার সম্পর্ককেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
খবরটি পড়ে আহমদ মুসা তাকাল বেঞ্জামিন বেকনের দিকে। বলল, ‘মনে হচ্ছে এ আপনার কীর্তি।’
‘কীর্তি নয়, একটা চেষ্টার ফল মাত্র।’ বলল বেঞ্জামিন।
‘ফেম মানে ‘ফ্রি আমেরিকা’র কোন লোক আছে নাকি ঐ পত্রিকায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আছে। তবে দেখুন একটা শব্দও কিন্তু মিথ্যা লেখেনি।’
‘ও শেষ বাক্যটার কথা বলছেন? হ্যাঁ, ওটা কমেন্ট বটে, আবার ইনফরমেশনও। এই ইনফরমেশন দিয়ে একটি অশুভ সহযোগিতার প্রতি পুলিশ ও সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট করা হয়েছে।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘ধন্যবাদ বেঞ্জামিন বেকন। এই ঘটনায় আমিও অবাক হয়েছি। ভারতীয় একজন ইঞ্জিনিয়ার। অত বড় ব্যবসায় ও পদের মালিক হয়েও সিনাগগের একটা জঘন্য কাজের সাথী হলো কেমন করে।’ বলল আহমদ মুসা বিস্ময়ের সুরে।
উত্তরে বেঞ্জামিন বেকন কিছু বলতে যাচ্ছিল । কিন্তু বলা হলো না। তার টেলিফোন বেজে উঠল।
বেঞ্জামিন বেকন তার মোবাইল হাতে তুলে নিল।
টেলিফোন কানে ধরেই বেঞ্জামিন বেকন সচকিত কন্ঠে বলে উঠল, ‘ম্যাডাম ক্লারা? গুড মর্নিং।’
ওপার থেকে ক্লারার কথা শুনতে গিয়ে মুখ মলিন হয়ে গেল বেঞ্জামিন বেকনের। একবার তাকাল সে আহমদ মুসার দিকেও। চোখে মুখে তার উদ্বেগের চিহ্ন। বলল সে, ‘কোথায় উনি?’
আহমদ মুসার সন্দেহ হলো, কোন খারাপ খবর আসছে নিশ্চয়, কোত্থেকে? কে এই ম্যাডাম ক্লারা।
‘নির্দেশ না দিলেও জানাতাম।’ ইয়েস ম্যাডাম, অবশ্যই জানাব’ বলে টেলিফোন রাখল বেঞ্জামিন বেকন।
‘কি ব্যাপার? কার টেলিফোন? মনে হয় খারাপ খবর আছে!’ বলল আহমদ মুসা।
‘মিস ক্লারা কার্টারের টেলিফোন। খুব খারাপ খবর।’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ বেঞ্জামিন বেকনের।
‘মিস ক্লারা কার্টার কে?’
‘উনি ম্যাডাম সারা জেফারসনের পার্সোনাল সেক্রেটারী।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘খারাপ কোন খবর আছে কি মিস সারা জেফারসনের?’ আহমদ মুসার কণ্ঠেও উদ্বেগ।
‘হ্যাঁ। গত সন্ধ্যায় ম্যাডাম সারা জেফারসন মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়েন। উনি শার্লট ভিল থেকে মন্টিসেলোতে যাচ্ছিলেন। তার দুই গাড়ির সামনেরটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটা গভীর খাদে পড়ে তাতে আগুন ধরে যায়। আর পেছনের গাড়িটা সেই অবস্থায় হার্ড ব্রেক কষতে গিয়ে কাত হয়ে পড়ে যায়। ম্যাডাম কপালে আঘাত পেয়েছেন। আর সামনের গাড়ির কেউ বাঁচেনি।’
‘ঐ গাড়িতে কে ছিল?’
‘ম্যাডাম কে রিসিভ করতে আসা দুজন হাউজ স্টাফ ছিলেন। ম্যাডামের মন্টিসেলোর বাড়িতে তার মা থাকেন, আর তিনি। বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্ব হাউজ স্টাফের।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘আচ্ছা বলতে পারেন, এমন ঘটনা ঐ অঞ্চলে আরও কি ঘটেছে?’ প্রশ্ন আহমদ মুসার।
‘সম্ভবত ঘটেনি। কারণ মিস ক্লারা প্রথমেই একে বেনজির দুর্ঘটনা বলেছেন।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘কেন? আমেরিকায় তো প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে। ওখানে ঘটবে না কেন?’ আহমদ মুসা প্রশ্ন করল।
‘আমি গ্রেট ভ্যালির ঐ এলাকায় গেছি। এ ধরনের এলাকায় গাড়ির স্পীড কম হয় এবং ড্রাইভারও বেশি সতর্ক থাকে। আর গাড়ির সংখ্যাও কম হয়। এসব কারণেই এমন এলাকাগুলোতে দুর্ঘটনা খুবই কম।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘উনি এখন কোথায়?’
‘মন্টিসেলোতে। শার্লট ভিলে চিকিৎসা নেয়ার পর তিনি মন্টিসেলোতে ফিরে গেছেন।
বলে একটু থেমেই বেঞ্জামিন বেকন বলল আহমদ মুসাকে, ‘ম্যাডাম সারা জেফারসন বলেছেন এ বিষয়টা আপনাকে জানাবার জন্যে। এবং এজন্যেই মিস ক্লারা আমাকে টেলিফোন করেছিলেন।’
ভাবছিল আহমদ মুসা। বেঞ্জামিনের কথায় বলে উঠল, ‘মি. বেঞ্জামিন, আমার কি মনে হচ্ছে জানেন। মনে হচ্ছে, বেনজির দুর্ঘটনাটা আমি একটু দেখে আসি।’
খুশি হলো বেঞ্জামিন বেকন। বলল, ‘আমার ধারণা ম্যাডামও এটা চাচ্ছেন। আপনাকে জানাতে বলার মধ্যে দিয়ে তার এ চাওয়ারই প্রকাশ ঘটেছে।
‘প্রসঙ্গক্রমে বলছি মি. বেঞ্জামিন, আপনাদের নেতাকে এমন অরক্ষিত রেখেছেন কেন আপনারা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘এ প্রশ্ন আমারও মি. আহমদ মুসা। কিন্তু তাকে এ কথা বুঝাবে কে? তিনি টমাস জেফারসনের সাক্ষাত প্রতিবিম্ব। কোন বাড়তি আয়োজনই তিনি বরদাশত করেন না। চাকুরী না করলেও উনি পারেন। কিন্তু তার যুক্তি হলো, জাতিকে প্রত্যক্ষভাবে তার কিছু দেয়া দরকার। বেঞ্জামিন বেকন বলল।
‘ধন্যবাদ আপনাদের নেতাকে। একজন অনুকরণযোগ্য দেশপ্রেমিক তিনি। বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে আপনি যাচ্ছেন? ব্যবস্থা করব?’
‘আপনি যাবেন না?’
‘তাঁর সেরকম নির্দেশ নেই। তাছাড়া আমার এখন ওয়াশিংটনে থাকা প্রয়োজন। নিশ্চয় শ্যারনরা বড় কিছু করছেন। এদিকে নজর রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।’
বলেই উঠে দাঁড়াল বেঞ্জামিন বেকন। বলল, ‘আপনি তৈরী হোন। আমি প্লেনের টিকিটের ব্যবস্থা করছি। ওয়াশিংটন থেকে ভার্জিনিয়ার শার্লট ভিল পৌনে দু’শ কিলোমিটারের বেশি হবে না। শার্লট ভিল থেকে মন্টিসেলো ২০ কিলোমিটারের মত। ঐ পথটুকু গাড়িতে যাবেন।’
‘মিস ক্লারা কার্টারকে কি আপনি জানাচ্ছেন, আমি যাচ্ছি সেখানে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘অবশ্যই।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।
‘আমার মনে হয় জানানোর দরকার নেই।
‘ম্যাডাম সারা জেফারসন যদি হঠাৎ কোন প্রোগ্রামের অন্য কোথাও যান।’
‘ক্ষতি নেই, আমি তো যাচ্ছি এ্যাকসিডেন্ট দেখতে। তারপর একান্তই ওঁকে দরকার হলে আমি খুঁজে নেব।’
‘না জানালে ম্যাডাম যদি আমাকে এজন্যে দায়ী করেন?’ আপত্তি জানিয়ে বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘বলবেন জানাতে আমি রাজী হইনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু না জানানোর যুক্তি আমি বুঝতে পারছি না।’
‘কোন যুক্তি নেই। আমি নিজের সিদ্ধান্তে যাচ্ছি, কি দরকার জানিয়ে। জানিয়ে গেলে অতিথি সাজতে হবে।’
‘মনে আছে, আপনি বলেছিলেন ম্যাডাম আপনাকে মন্টিসেলোতে দাওয়াত দিয়ে রেখেছেন।
‘না জানিয়ে গেলে কি সেখানে হাজির হয়ে তার দাওয়াত নিতে পারবো না?
‘তথাস্তু, আপনার সিদ্ধান্তই বহাল।’ হেসে উঠে বলল বেঞ্জামিন বেকন। তারপর বেরিয়ে গেল।