জেনারেল শ্যারনকে কথা শেষ করতে না দিয়েই এস এস সেন বলে উঠল, ‘জেনারেল এত বিনয়ী হওয়ার দরকার নেই। এ সাহায্যের পেছনে আমাদেরও স্বার্থ আছে। আহমদ মুসারা যেমন আপনাদের জানের শত্রু, তেমনি তারা আমাদের প্রানের শত্রু। আমাদের ভারতকে কম জ্বালায়নি ওরা। এখনও কম জ্বালাচ্ছে না। আমাদের মাতৃসম ভারতকে তিন টুকরো করেছে। সেই জ্বালায় আমরা তড়পাচ্ছি। আমাদের অসহনীয় জ্বালা থামবে না যতদিন না ঐ দুটো রাষ্ট্রকে আমরা হজম করতে পারছি। আহমদ মুসারা আমাদের লক্ষ্য অর্ঝনের পথে প্রধান বাধা। আমরা চাচ্ছি আধুনিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আবরনে ঐ দুই রাষ্ট্র থেকে মুসলমানদের মুসলিম পরিচয় ভুলিয়ে দিতে। আর আহমদ মুসারা এই মুসলিম পরিচয়কে আরও শাণিত করছে। তার উপর আহমদ মুসারা এসেছে আমেরিকায়। এরা এখানে সুবিধা পাওয়ার অর্থ আমাদের সর্বনাশ হওয়া। সুতরাং আপনাদের মত আমরাও আহমদ মুসাদের বিনাশ চাই।’
এস এস সেন এর পুরো নাম। শিব সংকর সেন। তার বাপ ছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর একজন ডাকসাইটে অফিসার। শিব সংকর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কম্পিউটার পড়তে এসে এখানেই থেকে যায়। সে একজন প্রতিভাবান কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। দেশ প্রেমিক শঙকর চায়নি আমিরিকায় সেটলড হতে। কিন্তু তার বাবা শিব দাশ সেন তাকে বুঝিয়েছে, হিন্দুস্তানের স্বার্থেই তার স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বাস করা প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগামী দিনের এক বিশ্ব। এ বিশ্বে আমরা ভাগ বসাতে চাই, এ বিশ্বকে আমাদের হিন্দুস্তানের স্বার্থে পেতে চাই। তা পেতে হলে মিভ শংকরদের মত হিন্দুস্তানগত প্রাণ ছেলেদের আমেরিকায় থেকে যাওয়া প্রয়োজন। পিতার এই কথায় সে সানন্দেই রাজী হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর সে চাকরী নেয় বিখ্যাত আই বি এম কোম্পানীতে। এখন সে নিজেই বড় একটি কোম্পানীর মালিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট সফটওয়্যার বিজনেসের প্রায় ২০ ভাগ তার পকেটে আসে। আমেরিকার অর্থনৈতিক ভাগ্যের চাকা যাদের হাতে তার মধ্যে সেও একজন। সে মনে করে তার বিত্ত-বৈভব তার হিন্দুস্তানের জন্যে।
তার সবচেয়ে বড় তৃপ্তি হলো, আমেরিকান সফটওয়্যার টেকনলজি সে পাচার করতে পেরেছে তার হিন্দুস্তানে। হিন্দুস্তানের হায়দারাবাদ সফটওয়্যার টেকনলজিতে এখন এক মিনি আমেরিকা।
শিব সংকরের এই বাড়িটি পেন্টাগনের ঠিক অপজিটে পটোম্যাক নদীর উত্তর তীরে। চার বিঘা জমির উপর বিশাল বাড়ি। বাড়ির চারদিকটা কৃত্রিম লেক আর বাগানে সজ্জিত।
বাড়িটা চারতলা। মাটির নিচে আরও দুটি ফ্লোর। পারমানবিক যুদ্ধের আশংকা সামনে রেখেই এ ফ্লোর দুটি তৈরী। মাটির তলায় সর্বশেষ ফ্লোর থেকে পটোম্যাক নদীতে বের হওয়ার একটা আধুনিক সুড়ঙ্গ পথও রয়েছে। যুদ্ধ শুরু হলে মাটির মাটির সারফেসের পথ কোন কারনে বন্ধ হয়ে গেলে সুড়ঙ্গটি পালাবার বিকল্প পথ।
পরিবার নিয়ে শিব শংকর এ বাড়িতেই বাস করে। আহমদ মুসা এই বাড়িরই ভূগর্ভস্থ শেষ তলার বাম পাশের একটি ঘরে বন্দী।
শিব শংকরের কথা শুনে জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড জোনসের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘আপনাকে ধন্যবাদ মিঃ সেন। আমাদের একেবারে নিশ্চিন্ত করলেন। দেখা যাচ্ছে আমরা ও আপনারা একই লক্ষ্যে আমেরিকায় কাজ করছি। আপনাদের লক্ষ্য হিন্দুস্তান, আর আমাদের লক্ষ্য প্রোমিজড ল্যান্ড ইসরাইল। আর আমাদের সাধারন শত্রুও এক। আসুন আমরা এই শত্রুর বিরুদ্ধে এক সাথে লড়াই করি।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। আবেগে ভারী ছিল তার কন্ঠ।
‘লড়াই তো শুরু করেছি মিঃ জোনস। কিন্তু এটাতো লুজিং ব্যাটল। লস আলামোসের সুড়ঙ্গটা যে গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ, তদন্ত টীমের সদস্যদের হত্যার জন্যে লস আলামোসের পথে আপনারাই যে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিলেন এবং একই লক্ষ্যে এফ বি আই বিমানে বোমা পেতে তা ধ্বংস করেছেন, তা তো প্রমাণ হয়েই গেছে।’ বলল শিব শংকর সেন।
‘হ্যাঁ। এগুলো সব শয়তান আহমদ মুসার কাজ।’
‘কিন্তু আজকের নিউজ আরও মারাত্মক। জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের হত্যাকারী হিসাবে আপনাদের দুজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। মিঃ হ্যামিল্টনের পকেটে পাওয়া একটা টেপ থেকে হত্যাকান্ডের গোটা বিবরণ নাকি তারা পেয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত সিনেটর ময়নিহানের ছেলে হ্যারিকে কিডন্যাপের কিডন্যাপ নাকি আপনারাই করেছিলেন। হ্যারি এবং আপনাদের যারা ধরা পড়েছে, তাদের জবানবন্দী ছেপেছে পত্রিকাগুলো।’ বলল আবার শিব শংকর সেন।
‘ভাগ্য আমাদের বিরুদ্ধে গেছে মিঃ সেন। এক আহমদ মুসা এসে আমেরিকায় আমাদের সাজানো সংসারকে লন্ড-ভন্ড করে দিল।’ ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলল।
‘আহমদ মুসাকে ধরে রেখে কি পেতে চান আপনারা? যা করার তার সবকিছুই সে করে ফেলেছে। কি লাভ হয়েছে এখন তাকে ধরে?’ বলল এস এস সেন।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন। তাকে ধরে আমেরিকায় কোন লাভ আমরা করতে পারবো না। কিন্তু আমরা একটা প্রতিশোধ তো নিতে পারলাম! আমরা দুর্বল হয়ে পড়িনি তাও বোঝানো গেল।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘কিন্তু এর মূল্যটা অনেক বড় দিতে হবে। তাকে ধরে মার্কিন সরকারকেই একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ অবশ্যই মার্কিন সরকার গ্রহন করবে। তার ফলে আপনাদের মুভমেন্ট এবং আহমদ মুসাকে বাইরে কোথাও সরিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
‘কিন্তু যে কোন মূল্যের চেয়ে আহমদ মুসা আমাদের কাছে মূল্যবান। তাকে নিয়ে আমেরিকার হয়তো দর কষাকষির কিছু নেই বটে, কিন্তু এশিয়ায় আছে। তাকে হত্যা করলে আমাদের জাতি যেন একটা স্থায়ী বিপদ থেকে মুক্ত হতে পারে, তেমনি তাকে হত্যা না করার শর্তে এশিয়া ও আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর কাছ থেকে বড় বড় স্বার্থ আদায় হতে পারে। এমনকি ফিলিস্তিন উপকূলে ‘গুড হোপ’ দ্বীপে ইসরাইল রাষ্ট্রের নতুন যে প্রতিষ্ঠা হয়েছে তার প্রতিও স্বীকৃতি আমরা আদায় করতে পারি। তা পারা সম্ভব হলে ফিলিস্তিনের উপরও গিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্রের পরোক্ষ অধিকার বর্তাবে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘কিন্তু সেটা করতে হলে তো আহমদ মুসাকে আমেরিকার বাইরে নেয়া চাই।’ বলল এস এস সেন।
‘আহমদ মুসাকে যদি কোন রকমে ইসরাইল দুতাবাসে নেয়া যায়, তাহলে সহজেই বাইরে পাচার করা যাবে।’ ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলে উঠল।
‘খবরদার, এখন তাকে ইসরাইল দুতাবাসে নেয়ার নামও করবেন না। যে জায়গাগুলোতে সরকার এখন সার্বক্ষনিক চোখ রেখেছে, তার মধ্যে অবশ্যই শীর্ষে আছে ইসরাইল দুতাবাস। তাদের নজর এড়িয়ে এখন সেখানে একটা সুঁচও পাচার করতে পারবেন না।’ বলল এস এস সেন।
‘ধন্যবাদ। আমরা সেটা আঁচ করেছি বলেই সেদিকে না গিয়ে আপনার আশ্রয়ে এসেছি।’
‘আপনাদের সেবা করার এটুকু সুযোগ দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ।’
বলে একটু থেমে একটু চিন্তা করে এস এস সেন পুনরায় বলে উঠল, অবশ্য আমি অনেকটা একক সিদ্ধান্তেই এটা করেছি। আমাদের কম্যুনিটি ফোরামে একটা ফরমাল সিদ্ধান্ত এ ব্যাপারে হওয়া দরকার।’
‘কেউ কি আপত্তি করতে পারে বলে মনে করেন?’ জিজ্ঞেস করল উইলিয়াম জোনস।
‘সে রকম সম্ভাবনা নেই। আপনাদের সাথে আমাদের ভারতের সম্পর্কতো আজকের নয়, সেই আদিকালের। ভারত নানা ভাবে কৃতজ্ঞ আপনাদের কাছে। ভারতের আজকের যে পারমানবিক শক্তি, কনভেশনাল অস্ত্র তৈরীতে যে উন্নতি, তার ভিত্তিতো আপনারাই গড়ে দিয়েছেন। আপনাদের সহযোগিতা না পেলে বহু আগেই আমাদের কাশ্মীর থেকে পাততাড়ি গুটাতে হতো। আমাদের কম্যুনিটির কেউই এসব কথা তুলতে পারে না। তাছাড়া ইতিমধ্যেই আমি অনেকের সাথে আলোচনা করেছি। তারা সকলেই সোৎসাহে এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। সুতরাং চিন্তার কিছু নেই।’
‘ধন্যবাদ মিঃ সেন।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘আরেকটা কথা মিঃ জোনস, আপনারা আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করেছেন, এটা কি আপনারা কাউকে বলেছেন বা এ সম্পর্কে কোন ঘোষনা দিয়েছেন?’ জিজ্ঞেস করল এস এস সেন।
‘মাথা খারাপ! আমরা স্বীকার করতে যাব কেন? বরং আমরা আমাদের মিডিয়াকে বলে দিয়েছি, আমরা আমাদের সন্দেহ করার প্রতিবাদ করছি, এটা যেন তারা জানিয়ে দেয়। তাছাড়া তারা যেন এ রকম স্টোরী করে যে, আহমদ মুসা ইহুদী বিরোধী তার স্বার্থ হাসিল করারা পর নিজের ইচ্ছাতেই আত্মগোপন করেছে। এটা তার পুরনো অভ্যাস। যে জায়গাতেই তার মিশন শেষ হয়ে যায়, সেখান থেকে সে এভাবেই সরে পড়ে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘ব্রাভো! ব্রাভো! অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। তারা বিশ্বাস করবে না একথা ঠিক। কিন্তু আপনাদেরও নির্দোষ দাবী করার একটা পথ হলো এর ফলে। জনগনের অন্তত একটা অংশকে বুঝ দেয়ার মত একটা কথা পাওয়া গেল।’ এস এস সেন বলল।
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে এস এস সেন বলল, ‘এখনকার মত উঠি।’
‘অবশ্যই। অনেক সময় দিয়েছেন। অশেষ ধন্যবাদ।’
বাইরের ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে গেল এস এস সেন।
লিফটটি বেজমেন্ট লাইব্রেরীর প্রায় দরজায় এসে দাঁড়ায়।
শশাংক সেন ও সাগরিকা সেন লিফট থেকে লাইব্রেরীর দরজায় নামল।
শশাংক সেন শিব শংকর সেনের একমাত্র ছেলে এবং সাগরিকা সেন তার একমাত্র মেয়ে।
দুই ভাইবোনের মধ্যে সাগরিকা সেন বড় এবং শশাংক সেন বয়সে ছোট।
দুজনেই ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র। একজন ইতিহাস ও একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র।
সাগরিকা সেন ইতিহাস এবং শশাংক সেন কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ে।
মাঝে মাঝেই বেজমেন্টের লাইব্রেরীতে তাদের আসতে হয়।
বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড দুটি ফ্লোর বাড়ির উপরের অংশের একদম বিকল্প হিসাবে গড়ে তোলা হয়। বোমায় যদি বাড়ির উপরের অংশ সম্পুর্ন উড়ে যায় তাহলেও প্রাত্যহিক জীবন পরিচালনার সবকিছু সহ আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোর দুটি অবশিষ্ট থাকবে।
আন্ডার গ্রাউন্ড দুটি ফ্লোরের উপরেরটি স্টোর, কিচেন, অফিস ইত্যাদি। আর নিচের ফ্লোরটি শয়ন, লাইব্রেরী, ড্রইং এবং পারমানবিক ধ্বংসযজ্ঞ সময়ের জন্যে বিশেষভাবে তৈরী আশ্রয় কেন্দ্র নিয়ে গঠিত।
দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য ধরনের বই পুস্তক, ডকুমেন্ট রাখা হয়েছে আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাইব্রেরীতে। এসব বই ও ডকুমেন্টের খোঁজেই তার প্রায়ই আসতে হয় আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাইব্রেরীতে।
সাগরিকা সেন ও শশাংক সেন দুই ভাই বোন আজ দুষ্প্রাপ্য সেই বইয়ের খোঁজেই আন্ডার গ্রাউন্ড লাইব্রেরীতে এসেছে।
লাইব্রেরীর দরজা খুলতে খুলতে সাগরিকা সেন বলল, ‘মনটা আজ ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে মাথায় যেন অশ্বস্তিকর বোঝারএকটা চাপ। বাবা কেন বাড়তি বোঝা মাথা পেতে নেন।’
‘তুমি কিসের কথা বলছ দিদি, বুঝলাম না আমি?’ বলল শশাংক সেন।
‘ভুলে গেলে কেমন করে এরই মধ্যে। বাবা একজন বন্দীকে এন রেখেছেন না বেজমেন্টের এই ফ্লোরে!’ সাগরিকা বলল।
‘না ভুলিনি। এখন বুঝতে পেরেছি।’
বলে একটু থেমেই আবার বলল শশাংক সেন, ‘সত্যিই বলেছ দিদি, আমার মনে হচ্ছে কি জান? মনে হচ্ছে এই ফ্লোরটা যেন এখন আর আমাদের নয়। কেমন একটা পর পর লাগছে।’
‘ঠিক বলেছ শশাংক, এই অনুভূতিটা আমারও।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘আসলে ঘটনাটা কি দিদি? কে এই বন্দী? কেন বন্দী? এবং আমাদের এখানে কেন?’
‘মা বলতে চাচ্ছেন না। তবে মার সাথে বাবার কথা বার্তা আড়াল থেকে যতটুকু শুনেছি এবং মা দু একটা কথা যা বলেছেন, তাতে বুঝেছি বন্দীটি ডেভিড জোনস আংকেলদের। ওদের অসুবিধার কারনে বাবা সাময়িক আশ্রয় দিয়েছেন মাত্র।’
‘ডেভিড জোনস আংকেল মানে এ বন্দী তাহলে ইহুদীদের।’ বিস্ময় জড়িত কন্ঠে বলল শশাংক সেন।
একটু থেমে ঢোক গিলে আবার কথা বলে উঠল শশাংক সেন। বলল, ‘তুমি গত কয়েকদিনের নিউজ লক্ষ্য করেছ দিদি?’
‘কোন নিউজের কথা বলছ?’ বলল সাগরিকা সেন।
‘ঐ যে আহমদ মুসার উপর ষড়যন্ত্রের ব্লেম দিয়ে খবর বেরুল। খবরটা যদিও ছিল পত্রিকাগুলোর এক্সক্লুসিভ আইটেম, তবুও বোঝা গেছে খবরটার সরবরাহকারী ছিল ইহুদীরা। একদিন পর এই খবরের প্রতিবাদ বের হলো। দারুন চাঞ্চল্যকর। তাতে লস আলামোসের গোয়েন্দা সুড়ঙ্গসহ সবুকছুর জন্যে দায়ী করা হলো ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার ষড়যন্ত্রকে। খবরটা সাংঘাতিক হৈ চৈ এর সৃষ্টি করেছে।’
‘আরও তো দারুন খবর বের হয়েছে কাল।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘কোন খবরটার কথা বলছ দিদি?’ জিজ্ঞেস করল শশাংক সেন।
‘কেন জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন খুন হওয়ার কথা।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘ও পড়েছি, পড়েছি। ও খুনের জন্যেও তো সরাসরি দায়ী করা হয়েছে ডেভিড জোনস আংকেল ও জেনারেল শ্যারন নামে ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার একজনকে।’ শশাংক সেন বলল।
‘তাহলে তো দেখা যাচ্ছে, ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থা মানে ইহুদীরা অনেকগুলো ষড়যন্ত্রের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ল। আচ্ছা শশাংক, বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের ব্যাপারটা কি? তুমি দ্বিতীয় দিনে প্রতিবাদমূলক যে নিউজের কথা বললে তাতে তো হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ তৈরী করেছে ইহুদী বিজ্ঞানী জন জ্যাকব এবং তিনি লস আলামোস থেকে গবেষণা তথ্য অব্যাহতভাবে পাচারও করেছেন ঐ গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ দিয়ে। এ ঘটনা সত্য হলে তো তা বিড়াট ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘বিরাট ব্যাপারই তো! বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের মত লোক যদি ইহুদী স্বার্থের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করে থাকে, তাহলে কোন ইহুদীকে আর বিশ্বাস করা যাবে? এ প্রশ্ন কোন আমেরিকানই এড়িয়ে যেতে পারবে না।’ শশাংক সেন বলল।
লাইব্রেরীর একটা ডেস্কের চেয়ারে বসতে বসতে সাগরিকা সেন বলল, ‘নিউজে যেসব প্রমাণের কথা তুলে ধরেছে তা অকাট্য। আমি বুঝতে পারছি না হঠাৎ করে এমন সেনসিটিভ নিউজ এভাবে পত্রিকায় এল কেন? তাও আবার সরকারী সুত্রে নয়। ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগলে’র মত সংগঠন এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, সরকার নয় কেন?’
‘দিদি, প্রথম দিনের নিউজে মনে হয় এর উত্তর আছে। প্রথম দিনের নিউজে ইহুদীদেরকে ব্লেম দেয়া, ইহুদীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করারা জন্যে আহমদ মুসার সাথে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’কে দায়ী করা হয়েছিল। এমনকি বলা হয়েছিল, আহমদ মুসার অর্থের লোভে এ দুই সংগঠন আহমদ মুসার দিকে চলে গেছে। আরও বলা হয়েছিল, মৌলবাদী আহমদ মুসা সরকারের উপরও ভর করেছে। এতেই সম্ভবত ক্ষিপ্ত হয়ে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’ একবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে।’ বলল শশাংক সেন।
শশাংক ও সাগরিকা মুখোমুখি বসেছে।
‘ফ্রি আমেরিকা’ খুব পপুলার সংগঠন। সবাই জানে, প্যাট্রিওটদের এ সংগঠনটি দেশের স্বার্থ ছাড়া অন্য কোন স্বার্থে কাজ করে না। ‘হোয়াইট ঈগল’ও আগে বর্ণবাদী সংগঠন ছিল, এখন তা আর নেই। এদের ছোবল দেয়া ইহুদীদের ঠিক হয়নি।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘ঠিকই হয়েছে দিদি। সত্য প্রকাশের একটা পথ হয়েছে। ওদের ছোবল না দিলে ইহুদীদের এ ষড়যন্ত্রের কথা এভাবে জনসমক্ষে আসতো না।’ শশাংক সেন বলল।
‘এভাবে ‘ইহুদীদের’ বলে সব ইহুদীদের এক সাথে শামিল করা ঠিক নয়।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘ঠিক দিদি। দেশের মেজরিটি ইহুদী এ ষড়যন্ত্রে সাথে নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো বদনামটা তাদেরকেও স্পর্শ করবে। নির্দোষ হয়েও অনেকে দুর্ভাগ্যের শিকার হবে।’
‘অন্যের কথা না ভেবে, আমাদের নিজেদের কথাটাই ভাব না শশাংক। খুনের দায়ে অভিযুক্ত সেই মিঃ ডেভিড জোনসই আামাদের বাড়িতে এন্ট্রান্স পেয়ে গেল।’
‘না সে তো পায়নি।’
‘একই কথা। তার বন্দীকে আশ্রয় দেয়ার অর্থ কি? অর্থ কি এটা নয় যে আমরা মিঃ ডেভিড জোনসের পক্ষ নিলাম?’
‘ঠিক বলেছ দিদি। ড্যাডি এটা কোন বিবেচনায় করলেন বুঝতে পারছি না। তিনি তো এসব ব্যাপারে খুবই সতর্ক।’
‘সতর্ক বটে, কিন্তু তুমি তো জান, আমাদের পিতৃভূমি ভারতের সাথে ইসরাইল রাষ্ট্র ও ইহুদীদের সম্পর্ক খুবই গভীর এবং পুরোনো। অনুকূল, প্রতিকূল কোন অবস্থাতেই এই সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। আমেরিকাতেও ইহুদীরা ভারতীয়দের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ভারতীয়রা যে আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায়-বানিজ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসতে পেরেছে তার পেছনেও ইহুদীদের আন্তরিক সহযোগিতা রয়েছে।’
‘কিন্তু তাই বলে জলজ্যান্ত ক্রাইমের সাথে তো আপোস করা যায় না। তাও সাধারন ক্রাইম নয়, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। যা পরিস্কার রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে।’
‘ড্যাডি ওদের একজন বন্দীকে আশ্রয় দিয়েছেন, এর বেশী তো আর কিছু করা হয়নি। সম্ভবত বন্দীকে রাখার মত ওদের কোন জায়গায়ই আজ আর নিরাপদ নয়। এই অবস্থায় ওদের একটা অনুরোধ আমাদের রক্ষা করতে হয়েছে। এমন ক্ষেত্রে তো ‘না’ বলা যায় না।’
‘বন্দী লোকটা কে? কেন বন্দী সে?’ প্রশ্ন করল শশাংক সেন।
‘কথা প্রসঙ্গে মাকে একবার বলতে শুনেছি যে, বন্দীকে নাকি কোন শূল্য দিয়ে মাপা যাবে না, এমন অমূল্য সে। ইহুদীদের সকল দুর্ভাগ্যের কারনও নাকি এই লোকটাই।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘তুমি যে বর্ণনা দিলে দিদি, তাতে তো লোকটিকে দেখতে ইচ্ছা করছে। অমূল্য বন্দীটি দেখতে তাহলে কেমন!’
‘ঠিক বলেছ শশাংক। মা’র মুখ থেকে শোনার পর আমার মধ্যেও এই কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে। একজন মানুষ এমন অমূল্য হতে পারে কেমন করে! আর একজন মাত্র একটা জাতির সকল দুর্ভাগ্যের কারণ হতে পারে কিভাবে! কিন্তু দেখার সুযোগ কিভাবে হতে পারে বলত?’
চিন্তা করছিল শশাংক সেন।
একটু পর হাসল। বিজয়ীর হাসি। বলল, ‘উপায় পেয়েছি দিদি।’
‘উপায়টা কি?’
‘উপায় হলো ভেন্টিলেটর। আমাদের পারমানবিক শেল্টারগুলোরই কোন একটাতে তাকে রাখঅ হয়েছে। আর আমাদের পারমাণবিক শেল্টারের প্রত্যেকটা মূল কক্ষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত। তার মানে চার দিকের যে কোন দিক দিয়ে ঘরে যাওয়া যায়। ঞরের চার দেয়ালের তিন দেয়ালেরই প্রায় ছাদ সমান উঁচু জায়গায় তিনটি ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু অন্য সময় ভেন্টিলেটর খোলা থাকার কথা। নিচে আমাদের অটো ল্যাডার আছে। সেটা দিয়ে উপরে উঠে ভেন্টিলেটর দিয়ে সহজেই আমরা ঘরের ভেতর দেখতে পারি।’
সাগরিকা সেনেরও মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ শশাংক। খুঁজে পেতে তুমি একটা ভাল পথ বের করেছ। চল ওঠ, এখনি যাব।’
সোৎসাহে সংগে সংগেই উঠে দাঁড়াল শশাংক। সাগরিকাও উঠল।
অটো ল্যাডারটি তারা দুজনে শেল্টারের পেছনের দেয়ালে নিয়ে এল।
পরপর পাঁচটি ঘর। অথবা বলা যায় একটা বড় কক্ষকে পাঁচটি কক্ষে বিভক্ত করা হয়েছে।
একদম শেষের ঘর থেকে বন্দী অনুসন্ধান শুরু করার সিদ্ধান্ত নিল তারা দুজন।
অটো ল্যাডারে একসাথে দুজন উঠা যায়। ল্যাডারে অটোমেটিক কন্ট্রোল প্যানেল রয়েছে। ল্যাডারে বসেই তারা অটো কন্ট্রোল প্যানেলের একটা কি’তে চাপ দিল এবং ল্যাডার বক্সকে পেছনের দেয়ালের এমন জায়গায় সেট করল যেখান থেকে দাঁড়িয়ে ভেন্টিলেটর দিয়ে ঘরের ভেতরটা পুরোপুরি দেখার সুযোগ নেয়া যায়।
তাদের প্রথম উদ্যোগই সাফল্যের মুখ দেখল। ভেন্টিলেটরে দুজন চোখ লাগাতেই বন্দীকে ঘরের মেঝেতে একটা খাটিয়ায় শোয়া অবস্থায় দেখতে পেল।
বন্দীর মাথাটা বিপরীত দিকে থাকায় তারা বন্দীর মুখসহ গোটা চেহারাটাই দেখতে পেল। বন্দীকে দেখে তারা দুজনেই হতাশ হলো।
বিশল দেহের, বিকট চেহারার কাউকে দেখবে এ রকমই তারা আশা করেছিল। তারা আরও আশা করেছিল, বন্দীকে ক্রুদ্ধ চেহারা বা হতাশ বদন নিয়ে বসে থাকতে দেখবে। তার বদলে তারা দেখল একজন ভদ্রলোককে, যাকে এই বন্দীখানার চেয়ে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশে তাদের পাশে মানায় বেশী। ক্রুদ্ধ বা হতাশার বদলে প্রসন্ন মুখ নিয়ে শুয়ে আছে। তার চেহারার প্রসন্নতা ও নিরুদ্বিগ্নতা দেখে মনে হচ্ছে সে যেন তার নিজের ঘরে নিজের বেডে শুয়ে একটু রেস্ট নিচ্ছে।
‘এমন ভদ্র একজন ছেলে সাংঘাতিক বিপজ্জনক বন্দী কি করে হয়?’ বলল শশাংক সেন।
‘আমাদের ভুল হচ্ছে না তো? বন্দী হয়তো অন্য কোথাও আছে, যাকে দেখছি সে মনে হয় বন্দী নয়।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘হতে পারে। তাহলে অন্য ঘরগুলো কি দেখব?’ বলল শশাংক সেন।
‘না এখন নয়, পরে আসব। এর মধ্যে জানার সুযোগ হতে পারে যে, বন্দী ছাড়া আরও কেউ আছে কি না।’
‘ঠিক আছে। তাহলে চল দিদি। খবর নিয়ে পরেই আসা যাবে।’
ল্যাডার বক্স চালিয়ে দুজনে নেমে এল নিচে।
ফিরে এল তারা লাইব্রেরীতে। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »