৩১. ফ্রি আমেরিকা

চ্যাপ্টার

বাল্টিমোর থেকে ছুটে আসছে তিনটি গাড়ি ওয়াশিংটনের দিকে। তিনটি গাড়ির দুটি এফ বি আই-এর। অন্য গাড়িটি সারা জেফারসনের।
গাড়ি তিনটির সামনেরটিতে আছে এফ বি আই প্রধান জর্জ আব্রাহান জনসন। আব্রাহাম জনসনের গাড়ি ড্রাইভ করছে এফ বি আই-এর একজন ড্রাইভার। জর্জ আব্রাহাম জনসন বসে আছে পেছনের সিটে। তার সিটের পেছনে ধাঁধা এফ বি আই ডগ স্কোয়াডের শ্রেষ্ঠ কুকুর ‘সোর্জ’।
রিচার্ড সোর্জ ছিলেন সফল গোয়েন্দা এজেন্ট, যে দিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধের গতি পাল্টে দিয়েছিল এবং ফ্যাসিবাদের পতনের কারণ হয়েছিল।
‘সোর্জ’ সুপার সেনসেটিভ শিকারী কুকুর। এক বর্গমাইলের মধ্যে টার্গেট থাকলে গন্ধ থেকে তাকে টার্গেট করতে পারে সোর্জ।
দ্বিতীয় গাড়িতে সারা জেফারসন ও তার প্রাইভেট সেক্রেটারী ক্লারা কার্টার। তৃতীয় গাড়িতে ভর্তি এফ বি আই পুলিশ।
এফ বি আই-এর কোন গাড়িতেই এফ বি আই-এর চিহ্ন নেই। এফ বি আই পুলিশরাও সারা পোশাকে।
গাড়ি তিনটি সারিবদ্ধভাবে এগুচ্ছে।
সারা জেফারসনের গাড়ি মাঝে।
বাল্টিমোর ওয়াশিংটন রোড ও আনাপোলিষ ওয়াশিংটন রোড যেখানে মিলিত হয়েছে, সে সন্ধিতে পৌঁছতে যাচ্ছে গাড়ি।
ঠিক সেই সন্ধিতে আনাপোলিশ রোডে বাল্টিমোর রোডের মোহনায় একটা বিশাল এলাকা জুড়ে ‘সেন সফটঅয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ (প্রাঃ) লিমিটেড’ অবস্থিত।
কারখানাটির পশ্চিম প্রান্ত জুড়ে বাল্টিমোর রোড এবং দক্ষিন প্রান্ত জুড়ে আনাপোলিশ রোড।
জর্জ আব্রাহাম জনসনের গাড়ি যখন সেন সফটঅয়্যার কারখানার পাশে বাল্টিমোর রোডের উপর পৌঁছল, তখন জর্জ আব্রাহামের পেছনে বাঁধা শিকারী কুকুর সোর্জ শেকল ছেঁড়ার জন্যে ভয়ানক বিদ্রোহ শুরু করে দিল।
পেছনে তাকাল জর্জ আব্রাহাম। দেখল কুকুরটির দৃষ্টি পাশের কারখানাটির উপর নিবদ্ধ। ছুটতে চাচ্ছে সেদিকেই।
ভ্রুকুঁচকালো জর্জ আব্রাহাম জনসন।
গাড়ি সংগে সংগেই দাঁড় করাল জর্জ আব্রাহাম।
পেছনের দুটি গাড়িও দাঁড়িয়ে পড়েছে।
গাড়ি থেকে নেমেছে আব্রাহাম জনসন। তাকাল সে ফ্যাক্টরীর দিকে আবার।
বিশাল ফ্যাক্টরী। সামনের দিকে ফ্যাক্টরী, পেছনের অংশে গোডাউন। গোডাউনটাও বিশাল।
গাড়ি থেকে নামল সারা জেফারসন এবং পুলিশরাও। একজন পুলিশ অফিসার ও সারা জেফারসন গিয়ে দাঁড়িয়েছে জর্জ আব্রাহামের পাশে। কুকুরের বিদ্রোহের বিষয়টি তারাও গাড়ি থেকে নামার আগেই টের পেয়েছে।
‘ঘটনা কি? ওদিকে কি দেখছেন জনাব?’ ফ্যাক্টরীর দিকে ইংগিত করে জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন।
‘কুকুর এ ফ্যাক্টরীকে সন্দেহ করেছে।’
‘সন্দেহটা কি আহমদ মুসার ব্যাপারে?’ প্রশ্ন করতে গিয়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল সারা জেফারসনের। আহমদ মুসার কথা মনে হলেই তার গোটা দেহে অসহনীয় এক জ্বালা ছড়িয়ে পড়ে। শয়তানদের হাতে পড়ে আহমদ মুসা কেমন আছে, এই চিন্তা মনে এলেই গোটা দেহ মন ঢুকরে কেঁদে উঠতে চায় সারা জেফারসনের ।
‘আমার তাই মনে হচ্ছে। কুকুরের মাথায় তো এখন আহমদ মুসা ছাড়া অন্য কিছু নেই।’
‘তাহলে এখন?’ বলল সারা জেফারসন।
সারা জেফারনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জর্জ আব্রাহাম তার অধঃস্তন অফিসারকে নির্দেশ দিল, ‘সোর্জকে নামিয়ে আনুন মিঃ নোভাক।’
সংগে সংগেই আদেশ পালন করল নোভাক।
কুকুর সোর্জকে নামিয়ে আনতেই সে ছুটে যেতে লাগল ফ্যাক্টরীর দিকে। অফিসার নোভাক শক্ত হাতে চেন ধরে আটকাল সোর্জকে। সামনে ছোটার গতি বন্ধ হলে সোর্জের গতি আকাশমুখী হলো। লাফিয়ে উঠতে লাগল আকাশের দিকে।
কুকুর সোর্জকে নামিয়ে পর্যবেক্ষন করার পর কুকুরের চেনটি হাতে নিল জর্জ আব্রাহাম। নির্দেশ দিল অফিসার নোভাককে, ‘তোমার হাতে এখন ছয়জন পুলিশ রয়েছে। এই ছয়জনের পাঁচজনকে বল পেছনের গোডাউন ও এই ফ্যাক্টরী ঘিরে ফেলতে। অবশিষ্ট একজন আমাদের সাথে থাকবে।’
অফিসার নোভাক নির্দেশ পেয়ে ছুটল তার গাড়ির দিকে।
নির্দেশ পেয়ে পাঁচজন এফ বি আই এজেন্ট প্রত্যেকেই স্টেনগান হাতে নিয়ে ছুটল ফ্যাক্টরী ঘিরে ফেলার জন্যে।
অবশিষ্ট একজন এল অফিসার নোভাকের সাথে জর্জ আব্রাহামের কাছে।
নোভাক ফিরে এলে তাকে উদ্দেশ্য করে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘এই এফ বি আই কর্মীকে সাথে নিয়ে যাও ফ্যাক্টরী অফিসে। যেই অফিসে থাক নিজের পরিচয় দিয়ে তাকে তুমি বল আমরা এই মুহূর্তে গোটা এলাকা সার্চ করব। তারপর তাকে সাথে নিয়ে চলে এস।’
নোভাক চলে গেল।
মিনিট তিনেকের মধ্যেই ফিরে এল একজনকে সাথে নিয়ে। তারা কাছে এলে সাথে আনা লোকটাকে লক্ষ্য করে জর্জ আব্রাহাম বলল,’আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে আমরা দুঃখিত। আমরা নিখোঁজ হওয়া একজন লোককে খুঁজছি। আমাদের গোয়েন্দা কুকুর এই এলাকাকে সন্দেহ করে বসেছে। তাই এলাকা সার্চ করতে হচ্ছে আমাদের। আমি আপনাদের মালিক শিব শংকর সেনকে চিনি। তিনি খুব ভাল লোক। তিনিও আমাকে জানেন। তিনি এই ঘটনাকে ওয়েলকামই করবেন।’
সাথে আসা লোকটি বলল, ‘আমাদের কোন আপত্তি নেই স্যার। তবে গোডাউন এলাকায় যাওয়ার মনে হয় দরকার হবে না। ওদিকে কোন লোক থাকে না।
‘গোডাউন, ফ্যাক্টরী বলে কোন কথা নেই। কুকুর যেখানে যাবে, আমরা সেখানে যাব।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
বলেই জর্জ আব্রাহাম কুকুরের চেনটি এফ বি আই অফিসার নোভাকের হাতে তুলে দিল। বলল, ‘স্টার্ট কর।’
নোভাক কুকুরের পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে চেন লুজ করে দিল।
কুকুর চলতে শুরু করল।
চেন এক হাতে ধরে রেখে তার পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করল এফ বি আই অফিসার নোভাক।
নোভাকের পেছনে জর্জ আব্রাহাম জনসন। আব্রাহাম জনসনের পাশে সারা জেফারসন। তার পাশে সারা জেফারসনের সেক্রেটারী ক্লারা কার্টার। সবার পেছনে এফ বি আই-এর পুলিশ কর্মী। তার সাথে ফ্যাক্টরীর লোকটি।
বুক কাঁপছে সারা জেফারসনের। বলল জর্জ আব্রাহামকে লক্ষ্য করে, ‘কুকুরের সন্দেহ নিয়ে কি ভাবছেন জনাব?’
‘কুকুর ভুল করেনি।’
‘এর অর্থ ক্রমেই তার কাছাকাছি হচ্ছি? এত সহজেই কি উদ্ধার সম্ভব? কিছু ঘটতে পারে সেখানে?’ বলল সারা জেফারসন।
‘আমরা তার জন্যে প্রস্তুত আছি। আপনারা প্রস্তুত থাকুন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘অবশ্যই জনাব। কিছু না পারলে জান দিতে তো পারব।’
কুকুর কিছুক্ষন চলার পর ফ্যাক্টরীকে পাশে রেখে গোডাউন লক্ষ্যে চলতে শুরু করেছে।
নোভাক বলে ইঠল, ‘আমরা ফ্যাক্টরী নয়, গোডাউনে যাচ্ছি স্যার।’
‘কিন্তু গোডাউনগুলোর চাবি তো আমার কাছে নেই। তাছাড়া গোডাউন খোলার ক্ষমতাও আমার নেই।’ বলল সাথে আসা ফ্যাক্টরীর লোকটি।
‘চাবি থাকলে ভল হতো, না থাকলেও চলবে। তালা ভাঙার জন্যে আমাদের কাছে রিভলবার আছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘তাহলে স্যার আপনারা যান, আমি মালিকের কাছে গিয়ে টেলিফোন করি। তিনি এসে পড়তে পারেন।’ কাঁপা কন্ঠে বলল লোকটি।
‘না, কোথাও আপনি যেতে পারবেন না। আমাদের সাথে থাকবেন। টেলিফোনের দরকার হলে আরও লোক আছে তারা করবে।’ বলল শক্ত আদেশের সুরে জর্জ আব্রাহাম জনসন।
কুকুর গোডাউনের দিকে যাত্রা শুরু করার পর সারা জেফারসন ও ক্লারা কার্টার দুজনের মন খুশী হয়ে উঠেছে। গোডাউনের মত জায়গায় আহমদ মুসা বন্দী থাকতে অবশ্যই পারে।
কিন্তু ফ্যাক্টরীর কথা মনে হতেই সারা জেফারসনের মনে প্রশ্ন জাগল, ফ্যাক্টরীর মালিকের নাম শুনে মনে হলো, উনি একজন ভারতীয় বংশোদ্ভুত শিল্পপতি। তার এখানে আহমদ মুসা বন্ধী থাকবে কেন? আমেরিকান ভারতীয়রা ইহুদীদের ভাগ্যের সাথে তাদের ভাগ্য জড়াবে কেন? এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। মনের এই অবস্থায় প্রশ্ন করল সারা জেফারসন, ‘জনাব আমেরিকান ভারতীয়দের এখানে আহমদ মুসা আসবে কি করে?’
‘এটা তোমার একটা সংগত প্রশ্ন। কিন্তু তুমি তো জান না, এই ফ্যাক্টরীর মালিক শিব শংকর সেন সহ আমেরিকান ভারতীয় কমুঃনিটির লিডাররা কয়েকদিন আগে প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করেছে জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনসের পক্ষে তৎবির বরার জন্যে। এটা সত্যি হলে আমেরিকান ভারতীয়দের কাছে আহমদ মুসা বন্দী থাকতে পারবে না কেন?’ বলল আব্রাহাম জনসন।
‘সর্বনাশ। কথঅটা সত্যি হলে এটা হবে এটা হবে আমেরিকার জন্যে একটা অতি বড় ঘটনা। আমেরিকায় ভারতীয় কম্যুনিটি এবং ইহুদী কম্যুনিটি দুপক্ষই আমেরিকানদের মাথায় হাত বুলিয়ে অর্থ-বিত্ত ও সুযোগ সুবিধা অর্জনের ক্ষেত্রে সবার চেয়ে অর্থাৎ আমেরিকানদের চেয়েও এগিয়ে গেছে। অবস্থান ও সুযোগ সুবিধা লাভের এ সাদৃশ্যই কি দুই কম্যুনিটিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে? তাহলে তো আমাদের লড়াই-এর ফ্রন্ট আরো একটা বাড়ল।’ বলল সারা জফারসন উদ্বিগ্ন কন্ঠে।
‘কিন্তু এই সাথে আহমদ মুসারে উদ্ধার আগের চেয়ে আরও জটিল হয়ে গেল।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘আপনি এ কথা বলবেন না। বরং বলুন ঈশ্বর আজ যে সুযোগ আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, সেই সুযোগেই আহমদ মুসা উদ্ধার হয়ে যাবে।’ প্রায় আর্ত কন্ঠে বলে উঠল সারা জেফারসন।
‘আমি ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনাই করছি মিস জেফারসন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন।’ বলল সারা জেফারসন।
গোডাউনের এ ব্লক সে ব্লক পেরিয়ে একটা দরজা খোলা গোডাউনের দরজায় ছুটে গেল শিকারী কুকুর সোর্জ।
বুকটা তোলপাড় করে উঠল সারা জেফারসনের। এখানেই কি আহমদ মুসা বন্দী? কিন্তু ঘরের দরজা খোলা কেন?
কুকুরের ফেছনে পেছনে সবাই গোডাউনের দরজায় গেল।
দরজার বাইরের অংশটার উপর ভল করে নজর পড়তেই আঁৎকে উঠল সবাই।
দরজার বাইরে দু’জায়গায় চাপ চাপ রক্ত। রক্তের উপরটা শুকিয়ে গেছে।
কিন্তু কুকুর রক্তগুলো লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে দরজায় গিয়ে পৌছল। দরজার চৌকাঠের কাছে কুকুর সোর্জ মুখ নিচু করে লেজ নাড়তে লাগল।
সকলে দরজায় গিয়ে পৌছল।
গোডাউনের ভেতর আলো জ্বলছে।
দরজাও আলোকিত।
দরজার ওপাশেও দেখা গেল কিছু রক্ত। সেই রক্তই শুকছে কুকুর সোর্জ।
কারোরই বুঝতে বাকি রইল না দরজার পাশের রক্ত আহমদ মুসার। আহমদ মুসার বলেই কুকুর সোর্জ তা শুকছে ও লেজ নাড়ছে।
গোডাউন শূন্য।
বুকটা হাহাকার করে উঠল সারা জেফারসনের।
যে আশায় এতক্ষন সে বুক বেঁধে ছিল, সে আশা ঘরের শূন্যতার মধ্যে দিয়ে উবে যাওয়ায় বুকটা একদম দুমড়ে মুচড়ে গেল। তার উপর আহমদ মুসার রক্ত দেখে আশংকা ও আতঙ্কে দম বন্ধ হওয়ার যোগাড় হলো সারা জেফারসনের।
ক্লারা কার্টার তা বুঝতে পেরেছিল। ক্লারা কার্টার তাকাল সারা জেফারসনের দিকে।
ক্লারা কার্টার তার দিকে এগিয়ে এসে প্রথমে কাঁধে হাত রেখে তাকে সচেতন করল। তারপর তাকে নিজের দেহের সাথে জড়িয়ে রাখল।
কুকুর সোর্জ দরজা থেকে ছুটল গোডাউনের মাঝখানে।
সেখানে মেঝের উপর একটা কার্পেট। কার্পেটের উপর পড়ে আছে কম্বল। এটা হলো একটা বিছনা। বিছানার উপর পড়ে আছে সিল্কের সরু কর্ডের অনেকগুলো খন্ড।
সোর্জ সেই বিছানায় উঠে কার্পেট ও কম্বল শুকতে লাকল আর নাড়তে লাগল তার লেজ।
সবাই এগুলো বিছানার দিকে।
‘বুঝা যাচ্ছে, এই বিছানাতেই আহমদ মুসাকে রাখা হয়েছিল।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘কর্ডের এই খন্ডগুলো কেন?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন। কন্ঠ তার শুকনো, কম্পিত।
‘আমার মনে হচ্ছে, আহমদ মুসা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ছিল। পরে সে কোনভাবে বাঁধনগুলো কেটে মুক্ত হয়। খন্ড-বিখন্ড হওয়া কর্ডগুলো তারই প্রমাণ।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
কুকুর সোর্জকে নিয়ে জর্জ আব্রাহাম বেরিয়ে এল।
সবাই বেরিয়ে এল গোডাউন থেকে।
বাইরে বেরিয়ে কুকুর সোর্জ মাটি শুকতে শুকতে দক্ষিণ দিকে চলতে লাগল।
‘আহমদ মুসা সম্ভবত এ পথ দিয়েই বেরিয়ে গেছে। সোর্জ নিশ্চয় সে পথই অনুসরণ করছে। চল সবাই সোর্জকে অনুসরণ করি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
সবাই কুকুর সোর্জের পেছনে পেছনে চলতে লাগল।
হঠাৎ সারা জেফারসন আর্তকন্ঠে বলে উঠল, ‘মিঃ জর্জ আব্রাহাম! ঘাসের উপর দেখুন রক্তের ফোঁটা।’
সবাই দেখল ঘাসের উপর ফোঁটা ফোঁটা রক্তের একটা ধারা সামনে এগিয়ে গেছে।
‘সোর্জ রক্তের এই ধারাই অনুসরণ করছে মিস জেফারসন। নিশ্চিত, আহমদ মুসা এ পথ ধরেই এগিয়ে গেছে।’
সারা জেফারসনের চোখে-মুখে আষাঢ়ে মেঘের ঘনঘটা।
সবাই নিরবে কুকুরকে অনুসরণ করে এগুলো।
কুকুর সোর্জ ঘাসের কাছাকাছি পর্যন্ত মুখ নিচু করে এক গতিতে সামনে এগুচ্ছে।
আনাপোলিশ সড়কে উঠে গেল সোর্জ।
সড়কে উঠে একজায়গায় এসে সোর্জ থমকে দাঁড়াল। মুখ উপরে তুলে চারদিকে তাকাল।
জর্জ আব্রাহাম, সারা জেফারসনসহ সবাই ওখানে পৌঁছল দেখল, সেখানে রাস্তার একপ্রান্তে কুকুর সোর্জ এর সামনে বেশ কিছূ পরিমান রক্ত জমা হয়ে আছে।
রক্তের দাগ আর সামনে এগুয়নি।
‘এই সড়কে উঠার পর আহমদ মুসা এখানে বসে বা শুয়ে ছিল। এই রক্ত জমা হয়েছে তার ফলেই। তারপর কেউ বা কোন গাড়ি তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘কারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে, অনুমান করা যায়?’ বলল সারা জেফাসন। তার কন্ঠ ভেজা।
‘বলা মুস্কল। এটুকু বলা যায় কোন গাড়ি যদি তাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তারা শত্রু নাও হতে পারে। আর যাদের কারণে সে আহত হয়েছে তারা যদি তাকে ফলো করে এসে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তিনি আবার শতুর হাতেই পড়েছেন।’
শেষ বাক্যটা শুনে সারা জেফারসনের মুখে একটা পান্ডুর ছায়া নেমে এল। তার ঠোঁট কেঁপে উঠল থর থর করে। পেছন দিকে মুখ একটু ঘুরিয়ে নিল সারা জেফারসন।
কথা বলেই জর্জ আব্রাহাম মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে তাদের সাথে আসা ফ্যাক্টরীর লোকটির দিকে। বলল, ‘আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন।’
‘আমি ঘন্টা তিনেক হলো অফিসে এসেছি। আমি কিছূই দেখিনি, কিছুই শুনিনি।’ বলল লোকটি।
‘কিন্তু গোডাউনে রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছে, তা এক ঘন্টার বেশী আগে নয়। আপনি কোন গোলা-গুলীর শব্দ শুনেননি?’
‘না, সেরকম কোন শব্দ শুনুন।’ বলল সেই লোকটি।
‘ঠিক আছে, আপনি একটা স্টেটমেন্ট লিখে দেবেন।’ বলে জর্জ আব্রাহাম এফ বি আই অফিসার নোভাকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি এর সাথে এর অফিসে যাও। উনি আমাদের সাথে থেকে যা যা দেখেছেন, তার উপর একটা স্টেটমেন্ট লিখে দেবেন।’
কথা শেষ করেই আবার তাকাল ফ্যাক্টরীর লোকটির দিকে। বলল, ‘ঠিক আছে?’
‘জ্বি স্যার। আমি লিখে দিচ্ছি।’
ওরা দু’জন চলে গেল।
জর্জ আব্রাহাম ঘুরে দাঁড়াল সারা জেফারসনের দিকে। বলল, ‘স্যরি সারা জেফারসন, মাত্র এক ঘন্টার ব্যবধান আমাদেরকে আহমদ মুসার সাক্ষাৎ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করল।’
‘দুর্ভগ্য আমাদের, এক ঘন্টা আগে আসতে পারলে আহমদ মুসাকে আহত ওয়া থেকেও বোধহয় আমরা বাঁচাতে পারতাম।’ বলল সারা জেফারসন।
একটু থামল সারা জেফারসন। থেমেই আবার শুরু করল, ‘গোটা বিষয় পর্যবেক্ষন করে আপনার কি মনে হচ্ছে?’
‘কি ঘটেছে, সেই ব্যাপারটা?’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘হ্যাঁ।’ বলল সারা জেফারসন।
‘ঘটনা খুবই সরল। হাত পা বেঁধে আহমদ মুসাকে ওরা বন্দী করে রেখেছিল। আজকে কোনওভাবে আহমদ মুসা হাত পায়ের বাঁধন কাটতে সমর্থ হয়। বাঁধন মুক্ত হয়ে আহমদ মুসা সম্ভবত দরজার সামনে শত্রুর আগমদনের অপেক্ষা করছিল। দরজা খোলার পর তাদের সাথে ধ্বস্তা ধ্বস্তি হয়। শত্রুরা সম্ভবত ছিল দু’জন। ওদের একজনের রিভলবার আহমদ মুসা কেড়ে নিয়ে ওদের গুলী করে। ওদের দু’জনের একজন অথবা দু’জনই আহত বা নিহত হয়। কিন্তু তাদের একজন আহমদ মুসাকে আঘাত করতে সমর্থ হয়। সে আঘাত আহমদ মুসার পা, বুক, মাথা ছাড়া অন্য কোথাও লাগে। এর ফলে আহমদ মুসা গুরুতর আহত হলেও রাস্তা পর্যন্ত হাঁটতে সমর্থ হয়। রাস্তায় পৌঁছার পর রাস্তার এক জায়গায় বসে গাড়ির অপেক্ষা করেছে সে। তারপর সে শত্রুর হাতে পড়ল, না কোন গাড়ি তাকে নিয়ে গেল, তা অনুমান করা মুস্কিল। তবে আহমদ মুসা যে গাড়ির জন্যে বসেছিল, একজায়গায় ঐ পরিমান জমাট রক্ত তারই প্রমাণ।’
‘আহমদ মুসা বন্দী হলে তাকে তো আবার বন্দীখানাতেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথঅ। তাতো তারা তকরেনি।’ সারা জেফারসন বলল।
‘হ্যাঁ। সেটাই হবার কথা। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। চিকিৎসা ও নিরাপত্তার জন্য তাকে অন্যত্র সরিয়েও নিতে পারে। তবে সব দেখে-শুনে আমার এখন মনে হচ্ছে, আহমদ মুসাকে অন্য কেউ তুলে নিয়ে গেছে।, এ দিকটাই প্রবল।’
থামল জর্জ আব্রাহাম।
‘ঈশ্বর করুন, এই শেষ কথাটাই যেন সত্য হয়।’ বলল সারা জেফারসন।
পাশ থেকে সারা জেফারসনের পিএ ক্লারা কার্টার বলে উঠল, ‘আমেন।’
‘চল আমার গাড়ির দিকে হাঁটি।’
বলে ওপারের বাল্টিমোর রোডের দিকে গাড়ির জন্যে হাঁটতে শুরু করল জর্জ আব্রাহাম।
সারা জেফারসনরাও হাঁটা শুরু করল।
সারা জেফারসন ও ক্লারা কার্টার পাশাপাশি হাঁটছে।
গোটা রাস্তায় একটা কথাও বলল না সারা জেফারসন। উদ্বিগ্ন ক্লারা কার্টারও। এ ধরনের নিরবতা সারা জেফারসনের স্বভাব বিরুদ্ধ।
গাড়িতে বসেও ঐ একই অবস্থা।
গাড়ির সিটে গা এলিয়ে চোখ বুজেছে সারা জেফারসন।
পাশেই বসেছে ক্লারা কার্টার। কিন্তু ঘাঁটাতে সাহস করছে না সারা জেফারসনকে। তার মন খারাপ সেটা তো ক্লারা কার্টার জানে। কিন্তু ভয় হচ্ছে তার অসুখ-বিসুখ করল কিনা। এই তো মাত্র ক’দিন আগে সে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে।
পরীক্ষা করার জন্যে ক্লারা কার্টার তার হাত সারা জেফারসনের কপালে রাখল।
ধীরে ধীরে চোখ খুলল সারা জেফারসন।
বলল, ‘না ক্লারা আমি অসুস্থ হয়ে পড়িনি। ভাল আছি।’
‘কে বলল ভাল আছেন? গায়ের উত্তাপ অন্তত ডিগ্রি খানেক বেড়েছে।’
‘অবস্থার পার্থক্যে অমন ফ্লাকচুয়েশণ হয়েই থাকে।’
‘আসলে আপনার আসা ঠিক হয়নি। আন্টি ঠিকই বাধা দিয়েছিলেন।’
‘ওকথা বলো না ক্লারা। না এল কেমন করে দেখতাম আহমদ মুসা মেঝেতে একটা কার্পেটের ওপর একটা কম্বল গায়ে দিয়ে কি সুখে বন্দী জীবন কাটিয়েছে! না এলে কেমন করে দেখা হতো তার দেহের জমাট রক্ত! কেমন করে দেখতাম আহমদ মুসা মুক্ত হবার প্রানান্ত চেষ্টা করেও….।’
কান্নায় জড়িয়ে গেল সারা জেফারসনের শেষের কথাগুলো। দু’হাতে মুখ ঢাকল সে। ক্লারা তার একটা হাত সারা জেফারসনের কাঁধে রেখে বলল, ‘বৃথাই ভাবছেন। দেখবেন, উনি ঠিক মুক্ত হয়েছেন। আংকেল জর্জ আব্রাহাম ঠিকই বলেছেন, তার মুক্ত হবার সম্ভাবনার দিকটাই প্রবল।’
‘সবাই আমরা এটাই কামনা করছি। কিন্তু আমরা যা চাচ্ছি সেটাই ঘটেছে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছি না। কষ্টটা এখানেই।’
সরা জেফারসন থামলেও ক্লারা কার্টার সংগে সংগে কোন জবাব দিল না। একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘একটা কথা বলি মিস জেফারসন।’
‘বল।’ বলল সারা জেফারসন।
‘আহমদ মুসা সম্পর্কিত আপনার সিদ্ধান্তকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তারপরও বলতে চাই, আহমদ মুসা একটা বুনো পাখি। পোষ মানবার মত নয়।’ ক্লারা কার্টার বলল।
সারা জেফারসনও সংগে সংগে জবাব দিল না। বলল ধীরে ধীরে একটু সময় নিয়ে, ‘আমি তো তাকে পোষ মানাতে চাইনি ক্লারা। কিংবা আমি তাকে আমার বানাতেও চাইনি। আমি শুধু চেয়েছি তার হতে।’
‘ঐ একই কথা হলো। আপনি তার হতে গেলে তিনি আপনার হতে হবে।’ বলল ক্লারা কার্টার।
‘না, একই কথা নয়। নদী যখন সাগরে মিশে যায়, তখন নদী সাগরের হয় কিন্তু সাগর নদীর হয় না।’
‘সাগরের ঘর-সংসার নেই। কিন্তু আপনার সংসার চাই, তারও সংসার চাই।’
‘আমি এতকিছু ভাবিনি, ভাববার সময়ও পাইনি। তাকে দেখার আগে আমি তাকে স্বপ্নে পেয়েছি। এটা আমার নিয়তি ক্লারা। ঈশ্বর যা করেন, তার উপর তো হাত নেই কারও।’
‘তাকে আপনার জানার দরকার ছিল।’
‘কি দরকার ক্লারা। না জেনেই তো ভালবেসেছি। জানার কি প্রয়োজন আর।
‘তিনি আপনাকে কিছু বলেন নি?’
‘সেদিন অভিযান থেকে ফিরে আমাকে ‘মিস সারা জেফারসন’ বলায় আমি কেঁদে ফেলেছিলাস। তিনি গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। পরে একসময় তিনি আমাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি টেলিফোন ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় এবং তারপর আব্বা এসে পড়ায় তার বলা আর হয়নি।’
‘তার সম্পর্কে কি ধরনের কথা তিনি বলতে শুরু করেছিলেন?’
‘সবে তিনি বলতে শুরু করেছিলেন, ‘স্যরি মিস সারা, মাত্র আমার নামটি ছাড়া আর কিছুই আপনাকে জানানো হয়নি।’ একথা শেষ করেই তিনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। এই সময় আমার টেলিফোন আসে।’
‘বোঝা যাচ্ছে তার কিছু বলার আছে। অথচ আপনি কিছুই শোনেননি, জানেননি।’
‘আমি তার সাথে কোন লেন-দেন করতে চাইনি যে, আমি হিসেব-নিকেশ করব। যা ঘটেছে তা একান্তই আমার, এতে তারও কোন শরিকানা নেই।
কথা শেষ করতেই সারা জেফারসন দেখল জর্জ আব্রাহাম তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
সারা জেফারসন গাড়ি থেকে নামল।
জর্জ আব্রাহাম একটু নিকটবর্তী হলে সারা জেফারসন বলল, ‘মিঃ নোভাক ফিরেছে। এখন করনীয়?’
‘এখন ফেরা ছাড়া আর কি করার আছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘আপনি আপনার লোকদের আনাপোলিশসহ আশে-পাশের এবং ওয়াশিংটনের সকল হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চোখ রাখতে বলুন। আমার বিশ্বাস, অন্য কেউ আহত আহমদ মুসাকে নিশ্চয় কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিয়ে যেতে পারে।’ বলল সারা জেফারসন।
খুশী হয়ে উঠল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘বর্তমান নিয়ে বেশী ব্যস্ত থাকায় ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবতেই ভুলে গেছি। ধন্যবাদ মিস সারা জেফারসন।’
বলেই পা বাড়াল নোভাকের গাড়ির দিকে। বলল, ‘যাই নোভাককে বলি এখনই মেসেজটা সব জায়গায় জানিয়ে দেবার জন্যে।’
জর্জ আব্রাহাম চলে গেল।
‘মোবাইলটা দাও ক্লারা।’
মোবাইলটা সারা জেফারসনের হাতে দিতে দিতে ক্লারা বলল, ‘বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতক্ষনে মেসেজটা সবাই জেনে গেলে ভাল হতো।’
‘আমারও এইমাত্র মনে পড়ল।’
বলে সারা জেফারসন ‘ফ্রি আমেরিকা’র ওয়াশিংটন অফিসে জানিয়ে দিল মেসেজটা।
এসময় জর্জ আব্রাহাম সারা জেফারসনের গাড়ির পাশ দিয়ে ফেরার সময় বলল, ‘প্রস্তুত মিস সারা। আমরা এখনি স্টার্ট করব।’
অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে সামনে জর্জ আব্রাহামের গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ পাওয়া গেল।
স্টার্ট নিল সারা জেফারসনদের গাড়িও।
তিনটি গাড়ি আবার চলতে শুরু করল ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে।

নোয়ান নাবিলা গাড়ি ড্রাইভ করছিল। তার পাশে বসেছিল সাগরিকা সেন।
ইহুদী মেয়ে নোয়ান নাবিলা ও সাগরিকা সেন দু’জন ঘনিষ্ঠ বান্ধবী।
নোয়ান নাবিলারা আনাপোলিশের স্থায়ী বাসিন্দা। তাদের বাড়ি থেকে অল্পদূরে একেবারে সমুদ্র তীরে একটি টিলার উপর সাগরিকা সেনদের গ্রীষ্মাবাস।
সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ নোয়ান নাবিলাই প্রথম দেখতে পেয়েছিল মাটিতে পড়ে থাকা লোকটিকে।
‘সাগরিকা দেখ একজন লোক পড়ে আছে রাস্তার পাশে।’ বলে উঠল নোয়ান নাবিলা।
তার বলা শেষ হতে না হতেই গাড়ি লোকটির সমান্তরালে চলে এল।
নোয়ান নাবিলার মত সাগরিকা সেনও তাকিয়ে ছিল লোকটির দিকে।
লোকটির কুকড়ানো দেহ পড়েছিল মাটির উপর। তার মুখ রাস্তার দিকে। রক্তাক্ত দেহের একটা অংশ।
লোকটির মুখের উপর চোখ পড়তেই ভীষণ চমকে উঠল সাগরিকা সেন। অন্তরের গভীর থেকে উচ্চারিত হলো, ‘এ যে আহমদ মুসা!’
অন্তরের গভীর থেকে এ কথা উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই সাগরিকা সেন এল উঠল চিৎকার করে, ‘গাড়ি দাঁড় করাও নাবিলা।’
গাড়ি ডেড স্টপ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘লোকটিকে কি সাহায্য করবে? বেঁচে আছে কি লোকটি?’ জিজ্ঞাসা উচ্চারিত হলো নাবিলার কন্ঠে।
কোন উত্তর না দিয়ে লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে সাগরিকা সেন।
সে ছুটে গেল আহমদ মুসার কাছে।
প্রথমে তার একটা আঙুল দিল আহমদ মুসার নাকে।
বেঁচে আছে আহমদ মুসা, খুশী হলো সাগরিকা সেন।
এসময় আহমদ মুসা চোখ খুলল আচ্ছন্নের মত।
সাগরিকা সেন উঠে দাঁড়াল। বলল নাবিলাকে লক্ষ্য করে, ‘একে গাড়িতে নিতে হবে নাবিলা।’
‘তোমার পরিচিত নাকি?’
গাড়ি থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করল নাবিলা।
‘হ্যাঁ।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল সাগরিকা সেন।
‘তাহলে গাড়িতে নিয়ে কাজ কি? এই তো তোমাদের ফ্যাক্টরী। কাউকে ডাক দিয়ে বল। তারা এসে ব্যবস্থা করবে। তোমাকে কিছুই ভাবতে হবে না।’ বলল নাবিলা।
‘না। এ শুধু পরিচিত নয়, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একে আমি এদের হাতে দিতে পারি না। একে আমি গাড়িতে নেব।’
‘তথাস্তু মিস সেন।’ বলে নোয়ান নাবিলা সাগরিকা সেনের পাশে এসে দাঁড়াল।
তারপর দুজনে ধরাধরি করে আহমদ মুসাকে গাড়ির পেছনের সিটে তুলল।
গাড়িতে তুলে শুইয়ে দিতে দিতে নাবিলা বলল, ‘আমি প্রথমে মেন করেছিরাম গাড়ির এ্যাকসিডেন্ট। কিন্তু এখন দেখছি তা নয়। হয় গুরী, না হয় সাংঘাতিক ধরনের ছুরিকাহতের ঘটনা। ভীষণ ব্লিডিং হচ্ছে। প্রথমেই রক্ত বন্ধ হওয়া দরকার।’
‘ঠিক বলেছ নাবিলা। তুমি ড্রাইভিং সিটে যাও। গাড়ি স্টার্ট দাও। আর ফাষ্ট এইড বক্স থেকে তুলার বান্ডিল এবং ব্যান্ডেজ টেপটা আমাকে দাও।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘তুমি পারবে কিছু করতে?’ তুলার বান্ডিল এবং ব্যান্ডেজ টেপ নিয়ে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল নোয়ান নাবিলা।
‘অভ্যেস নেই, কিন্তু কমন সেন্স তো আছে।’
ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল নোয়ন নাবিলা।
‘কোথায় গাড়ি নেবো সাগরিকা, কোন ক্লিনিকে?’ বলল নোয়ান নাবিলা।
‘সোজা আনাপোলিশ চল।’
‘আনাপোলিশের কোন ক্লিনিকে নেবে?’
‘পরে বলছি।’
আহমদ মুসা চোখ খুলেছিল। কিছু বলতে যাচ্ছিল।
সাগরিকা সেন ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে কথা বলতে নিষেধ করল এবং সাথে সাথে অন্য দিকে তাকাল।
সাগরিকা সেন একদলা তুলা নিয়ে মূল ক্ষতস্থানের রক্ত মুছেই আবার সেখানে প্রকান্ড একদলা তুলা লাগিয়ে চেপে ধরল এবং চেপে ধরেই থাকল।
সাগরিকা সেন এতটুকু অন্তত জানে এভাবে কিছুক্ষন ধরে রাখলে সারফেসের রক্ত জমাট বাধলে ভেতর থেকে রক্ত বেরিয়ে আসা বন্ধ হবে। তাই হয় কিনা সেটাই দেখতে চায় সে।
আহমদ মুসা চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। সাগরিকা সেন যেমন বিস্মিত হয়েছে আহমদ মুসাকে দেখে, আহমদ মুসাও তেমনি বিস্মিত হয়েছে সাগরিকা সেনকে দেখে। প্রথমে তার চিন্তা হয়েছিল যে, সাগরিকা সেন তাকে নিয়ে কি করে ঠিক নেই। সে নিশ্চিক হলো তখন, যখন সে দেখল এখানকার লোকদের হাতে তাকে ছেড়ে দিল না এবং এখানকার কোন ক্লিনিকেও তাকে নিল না। আহমদ মুসা বুঝল, তার বিপদ সাগরিকা সেন বুঝেছে। সম্ভবত সে আহমদ মুসাকে বিপদ থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। অথচ তারই পিতার গোডাউনের অমানবিক পরিবেশে বন্দী ছিল আহমদ মুসা। বুকের উপরে কাঁধের একটু নিচের ছুরিকাঘাতটা খুবই মারাত্মক নিঃসন্দেহে, কিন্তু এই আঘাত তাকে এত কাবু করতে পারতো না, যদি পেটে খাবার থাকতো। দু’একদিন পর পর আহমদ মুসাকে তারা যে খাবার দিয়েছে তা না দেবার মতই। দেহটা তার দুর্বল হয়ে পড়েছে এ কারনেই। তারা আহমদ মুসার সমস্ত শক্তি কেড়ে নিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল। যাতে মুক্ত হবার শক্তি তার না থাকে। সাগরিকা সেনের সাথের মেয়েটির কথা মনে পড়ল আহমদ মুসার। আহমদ মুসাকে তার সামনে কথা বলতে নিষেধ করল কেন সাগরিকা সেন? অবাঞ্চিত কোন কথা বলে ফেলি কিনা এজন্যে? আর সাগরিকা সেন মেয়েটিকে আহমদ মুসার মিথ্যা পরিচয় দিয়েছে। আহমদ মুসা তো সাগরিকা সেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয়। সব মিলিয়ে আহমদ মুসার পরিচয় সে গোপন করে গেছে।
যখন আহমদ মুসা এসব ভাবছিল, তখন সাগরিকাও আহমদ মুসার শিয়রে বসে চিন্তা করছিল। ভাবছিল আহমদ মুসার কথাই। সেদিন আহমদ মুসা তাদের দুভাই-বোনকে নিজের পরিচয় দেয়নি। পরের দিনই তারা তাদের মায়ের কাছ থেকে আহমদ মুসার পরিচয় জানতে পেরেছিল। জানতে পেরেছিল তাদের ভূগর্ভস্থ কক্ষে যিনি বন্দী ছিলেন তিনি বিশ্বখ্যাত বিপ্লবী আহমদ মুসা। নাম শুনে শিহরিত হয়েছিল সাগরিকা সেন। পত্র-পত্রিকা পড়ে সাগরিকা সেনের ধারনা হয়েছিল আহমদ মুসা হবে ভীম সদৃশ রুক্ষ চরিত্রের, যে হবে শুধু ভয়েরই পাত্র। কিন্তু যে আহমদ মুসাকে তারা দেখল, সে একেবারেই ভিন্ন। সরল, সুদর্শন এক ভদ্রলোক সে। যে কয়েক মিনিটের দেখায় একেবারে কাছে এসে গিয়েছিল, সমর্থন ও সহানুভূতি আদায় করে নিয়েছিল। এমন লোককে শুধু বন্ধুই ভাবা যায়, শত্রু নয়। বিস্মিত হয়েছিল সাগরিকা সেন। এমন একজন লোক বিশ্ব বিপ্লবী হয়েছে কিসের জোরে। শক্তি ও সন্ত্রাসের জোরে অবশ্যই নয়। শক্তি ও সন্ত্রাস তার অবলম্বন হলে সেদিন দু’জন প্রহরীকে সে হত্যা করত এবং তাদের উপরও নির্যাতন হতো, কিন্তু তা সে করেনি। তাদের দুই ভাই বোনকে আটকে রেখে গিয়েছিল তাদেরই ভালোর জন্যে তা পরে প্রমাণিত হয়েছে। তারা মুক্ত থাকলে তাদেরকে অনেক রকম প্রশ্নের শিকার হতে হতো। তারা তাদের পিতার কাছে তেকেই শুনেছিল আহমদ মুসা পালাতে পারেনি, ধরা পড়েছে। কিভাবে ধরা পড়েছে তাও তাদের বলেছে। ধরা পড়ার খবর শুনে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল সাগরিকা সেন ও তার ভাই শশাংক সেন দুজনেরই। এ নিয়ে দু’ভাই-বোন অনেক আলোচনা করেছে। ভেবেছে তারা, তারা যদি আহমদ মুসাকে মুক্ত করার জন্যে কিছু করতে পারতো। আজ সাগরিকা সেন সেই সুযোগই পেয়েছে।
সাগরিকা সেন মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। চোখবন্ধ করে আছে আহমদ মুসা। নতুন করে আহমদ মুসার দিকে তাকাতে গিয়ে শিউরে উঠল সাগরিকা সেন। কিন্তু এমন সাধারন লোক এতবড় অসাধারন হয় কেমন করে! যে মুক সে দেখছে সেমুখে কোন মলিনতা, কোন আবিলতা, কোন পাপের স্পর্শ নেই। শিশুর মত নিষ্কলুষ এক মুখ। এই মুখ ও মুখের আড়ালে যে মন-এই তো সাধু-সন্তত্ব এবং শক্তি দু’য়েরই সম্মিলন ঘটেছে। এ কারনেই কি সাধারন হয়েও অসাধারন! শ্রদ্ধায় যেন নুয়ে পড়তে চাইল সাগরিকা সেনের মন।
আহমদ মুসার মুখ দেখে বিস্মিত হলো সাগিরকা সেন আরেকটা কারণেও। সেটা হলো, আহমদ মুসার দেহে যে বিপর্যয় ঘটে গেছে তার কোন প্রকাশ তার মুখে নেই। নিশ্চয় আহমদ মুসা এখন চেতন আছে। কিন্তু তার দেহ এখন যন্ত্রনায় যে জর্জরিত হচ্ছে, তার কোন প্রকাশ তার মুখে দেখা যাচ্ছে না। হয় তার নার্ভ পাথরের মত শক্ত, নয়তো এই যন্ত্রণা হজম করার মত মানসিক শক্তি তার আছে। অথবা সাধু-সন্ত বিপ্লবী হিসাবে তার দুটিই আছে।
সাগরিকা সেনের ভাবনার এই ভেলা আর কতদূর বয়ে চলত কে জানে। কিন্তু সামনের ড্রাইভিং সিট থেকে নোয়ান নাবিলা কথা বলে উঠল, ‘আনাপোলিশ তো এসে গেলাম। বল কোথায় যাব। কোন হাসপাতালে? কোন ক্লিনিকে?’
‘না কোথাও না।’
‘তাহলে কোথায়? তোমার বাড়িতে?’
‘না।’
‘তাহলে?’
‘নাবিলা তুমি তো আনাপোলিশের মেয়ে। তোমার কি এমন কোন ডাক্তারের কথা জানা আছে যিনি বাড়িতে চিকিৎসা করেন, বাড়িতে তার চিকিৎসার ফ্যাসিলিটি আছে, যেখানে একে চিকিৎসার জন্যে নিয়ে যেতে পারি।’
‘কিন্তু হাসপাতালে, ক্লিনিকে অসুবিধা কি? সেখানে আরও বেটার হবে।’
‘এর শত্রু আছে। খুব শক্তিশালী শত্রু । তারা হাসপাতালে-ক্লিনিকে নিশ্চয় খুঁজবে।’
‘সে রকম ভয় থাকলে পুলিশের সাহায্য নাও না।’
‘নিরাপদ নয়। বড় বড় পুলিশ অফিসার শত্রুর পক্ষে কাজ করতে অনেক সময় বাধ্য হয়।’
‘তোমার বন্ধু কি এতবড় কেউ?’
‘তার শত্রু বড়।’ বলেই সাগরিকা সেন তার আগের প্রশ্নে ফিরে গেল। বলল, ‘যা বললাম, তোমার পরিচিত তেমন কোন ডাক্তার আছে?
‘আছেন একজন রাব্বী ডাক্তার। তিনি ভাল ডাক্তার, ভাল সার্জন। বাড়িতে চিকিৎসা করেন। জরুরী রোগী তার বাড়িতে রাখার ব্যবস্থাও আছে। তবে নার্স ভাড়া করতে হয়। আর ডাক্তারের ফি’টা একটু বেশী।’
‘তা হোক। যত টাকা চান দেব। নার্স ভাড়া করব ক্ষতি নেই।
ধন্যবাদ তোমাকে নাবিলা। এখন তাহলে সেই ডাক্তারের ওখানেই চল।’
‘অল রাইট।’ বলে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, ‘শশাংক আজ কখন আসছে সাগরিকা?’
নাবিলা ও শশাংক সেন দু’জনে বন্ধু। শুধু বন্ধুই নয়, দু’জন দু’জনকে গভীরভাবে ভালবাসে। শশাংকের মাধ্যমেই এক পার্টিতে নোয়ান নাবিলার সাথে সাগরিকা সেনের পরিচয়।
‘হয়তো এতক্ষনে এসেই গেছে। ভেব না নাবিলঅ। দেখি তাকে টেলিফোন করছি। এর কথা যদি ওকে বলি, দেখবে আমরা ডাক্তারের কাছে পৌঁছার আগেই সে পৌঁছে গেছে।’
‘এত ভালবাসে?’
‘ভালবাসে মানে একেবারে ভক্ত।’
‘কিন্তু ইনি দেখছি এশিয়ান, আর তোমরা আমেরিকান। বন্ধুত্বটা কিভাবে?’
‘এটা আবার কোন বাধা হলো নাকি? এক দেখাতেই অনেক সময় শতবার দেখার কাজ হয়ে যায়।’
‘সে রকম কাজ তোমার হয়েছে নাকি?’
‘বলতে পার।’
‘আরও কিছু বলতে পারি না?’ নোয়ান নাবিলার চোখে দুষ্টুমীর হাসি।
‘দেখ ভিন্ন অর্থ খোঁজার কোন অবকাশ নেই। আর তার সময়ও এটা নয়।’ কৃত্রিম গম্ভীর হবার চেষ্টা করে বলল সাগরিকা সেন।
‘ঠিক আচে, সময়েই বলব।’
বলে স্লো হয়ে পড়া গাড়ির গতি আবার বাড়িয়ে দিল।
ছুটে চলল গাড়ি আনাপোলিশের দিকে।

‘সাগরিকা মামনি কেবিনে যাচ্ছ?’ বলল ডাঃ বেগিন বারাক।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top